৩.৩ বিভক্তি

বিভক্তি

একসময় দলের মধ্যে সিরাজুল আলম খানের প্রতি সবার আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। তার কথাই ছিল চূড়ান্ত। ১৯৭৪-৭৫ সালের পর দল সংকটে পড়ে। অনেকেই গ্রেপ্তার হয়ে বছরের পর বছর জেলে থাকেন। অন্যরা গ্রেপ্তার এড়িয়ে আত্মগোপনে চলে যান। অনেকের মধ্যেই নতুন চিন্তা ও উপলব্ধি দেখা যায়।

১৯৭৮ সালে সরকারের সঙ্গে একটা সমঝোতার পর অনেকেই জেল থেকে ছাড়া পেতে থাকেন। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাসদ অংশ নেয়। তারপর সামরিক শাসন উঠে যায়। অন্য কারাবন্দীরাও ছাড়া পান। জাসদের মূল শক্তি তখনো তার ছাত্রসংগঠন। ১৯৭৯ সালে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে জাসদ-সমর্থিত ছাত্রলীগের মান্না আখতার প্যানেল জয়ী হয়। ১৯৮০ সালের শুরুতে তৈরি হয় সরকারবিরোধী ১০-দলীয় জোট। জোটে আওয়ামী লীগ এবং জাসদও ছিল।

তারা অতীতের কাজকর্মের মূল্যায়ন করতে থাকেন। প্রকাশ্যেই তারা সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। এটি একসময় অচিন্তনীয় ছিল। সিরাজুল আলম খান এ ধরনের রাজনৈতিক বিতর্কে অভ্যস্ত নন। ভিন্নমতকে তিনি বিদ্রোহ’ হিসেবে দেখলেন এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের ডানা হেঁটে দিতে চাইলেন। তাঁর প্রথম কোপটা গিয়ে পড়ল বিপুল ভোটে জেতা ডাকসুর সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্না ও আখতারউজ্জামানের ওপর। তাঁরা ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত হলেন। এর জের ধরে জাসদেও কিছুটা ধস নামল। জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাতজন নেতা বহিষ্কৃত হলেন। এঁরা হলেন সহসভাপতি আবদুল্লাহ সরকার, সহসম্পাদক একরামুল হক, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া, আইন সম্পাদক আসাফউদ্দৌলা, মহিলা সম্পাদক মমতাজ বেগম, সদস্য আ ফ ম মাহবুবুল হক ও হাবিবুল্লাহ চৌধুরী।

দলের ভেতরে রাজনৈতিক বিতর্কের মূল বিষয়গুলো ছিল সরকারবিরোধী ঐক্যজোটে আওয়ামী লীগের সঙ্গী হিসেবে জাসদের যাওয়া, না যাওয়া। জাসদের দেওয়া ১৮ দফা কর্মসূচি নিয়ে সিরাজুল আলম খান যে নীতি ও কৌশল পাল্টাচ্ছেন, এটা কারও কারও কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। একসময় বিদ্রোহীদের প্রতিভূ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেলেন মান্না-আখতার। ১৯৮০ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ছাপা হওয়া এক সাক্ষাৎকারে মান্নার দেওয়া ভাষ্যটি ছিল এ রকম :

…কিছুদিন আগে জেল থেকে সিরাজ ভাই আন্দোলন, সংগঠন সম্পর্কে একটা চিঠি লিখেছিলেন। তাতে তিনি গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, এ জিনিসটা অবশ্যম্ভাবী এবং তিনটা ধাপে হবে। প্রথম ধাপে সরকারে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে বুর্জোয়া নেতৃত্ব, তারপর বুর্জোয়া-প্রলেতারিয়েত শক্তির ভারসাম্য করতে হবে এবং তারপরে প্রলেতারিয়েতের নেতৃত্বে বুর্জোয়ারা থাকবে। এখানেও আমাদের একটা প্রশ্ন, বুর্জোয়া নেতৃত্বে যদি সরকারে যোগ দেওয়া অবশ্যম্ভাবী হয়, তাহলে সিপিবির বাকশালে যোগ দেওয়া বা জিয়ার ফ্রন্টে যেসব বামপন্থী বলে কথিত দলগুলো যোগ দিল, তারা কি ভুল করল? আমরা যখন বলছি বিপ্লবের পর্যায় চলছে, তখন এ ধরনের বক্তব্য কখনোই রণনীতির সঙ্গে খাপ খায় না। এটা একটা বিতর্কের দিক।…

সিরাজ ভাই যখন জেলে ছিলেন, তখন তিনি লিখেছিলেন (কাগজগুলো আমাদের কাছে আছে) ১৮ দফা কর্মসূচি একটা ছেলেমানুষি ব্যাপার। এটি রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়, বড়জোর একটা দলের ম্যানিফেস্টো হতে পারে। তিনিই বেরিয়ে এসে বললেন, এই ১৮ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি বিবৃতি দিয়েছেন, আমরা ১৮ দফা মানি না বলে আমাদের বহিষ্কার করা হয়েছে।

আমি এগুলোর বিরোধিতা করছিলাম সংগঠনের ভেতর থেকে। কোনো রাজনৈতিক প্রোগ্রাম ছাড়া বাকশালের সঙ্গে ঐক্য গঠনের ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবেই ব্যাপকতর ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সাংঘাতিক বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। এ ব্যাপারে ছাত্রলীগের দুটো বর্ধিত সভা হয়। একটাতে তারা প্রত্যক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করেন। ছাত্রলীগের বর্ধিত সভায় ১৮ দফার পক্ষে প্রস্তাব পাস হয়নি। বর্ধিত সভায় প্রস্তাব আসলেও জাসদ তো এখনো সাংগঠনিকভাবে তেমন শক্তিশালী নয়। শক্তিটা মূলত ছাত্রসংগঠনের। এই ছাত্রসংগঠন যখন বিরোধিতা করল, তখন তাঁরা সাংঘাতিক বিব্রত বোধ করলেন। এরপরে কোনো কারণ ছাড়াই, কোনো সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ছাড়াই ছাত্রলীগ কর্মীদের বহিষ্কার করা হলো। কিন্তু পাস হলো না। এরপর সভা মুলতবি হলো। রাত ১০টা পর্যন্ত আমি খবর জানলাম, সভা বসেনি। কিন্তু সকালে কাগজে দেখলাম আমরা দুজন বহিষ্কৃত। [১]

মান্নার ভাষ্য থেকে বোঝা যায়, সিরাজুল আলম খান তার আগের অবস্থান বদলেছেন। পরিস্থিতি যে আমূল পাল্টে গেছে, এটা তিনি উপলব্ধি করেছেন। জিয়াউর রহমানের বিএনপি সরকারকে সবাই বলছেন ফ্যাসিবাদী। এর বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক জোট হলে সেখানে স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগ থাকবে। সেখানে জাসদের যোগ দেওয়াটা তিনি সমস্যা মনে করেন না। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেছে অন্য জায়গায়। কয়েক বছর ধরে একটি বিপ্লবী পার্টি’ গড়ার প্রক্রিয়া থেকে তরুণদের মনোজগতে যে পরিবর্তন এসেছে, হঠাৎ করে তাতে ছেদ ঘটানো সম্ভব নয়। আওয়ামী বাকশালী’ আমলের নির্যাতনের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকেই। আওয়ামী লীগের সঙ্গে এক ছাতার তলায় যাওয়ার বিষয়টি তাদের মনঃপূত হয়নি। তখন ছাত্রলীগের অন্যতম প্রধান স্লোগান ছিল, রুখো বাকশাল হটাও জিয়া, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া’। তরুণেরা অনেকেই দলের এই নতুন রণনীতি মেনে নিতে পারেননি। বিপ্লব’ নিয়ে অনেকের মনে একধরনের ভাববিলাস ছিল। সেটা কাটতে বেশি দিন সময় নেয়নি। মান্না-আখতার দুজনই পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন।

আমাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মান্না এই সংকটের পূর্বাপর তুলে ধরেন। দলের মধ্যকার বিতর্কের পুরো বিবরণ পার্টি দলিলে থাকে না। মান্নার সঙ্গে আলাপচারিতায় বেরিয়ে এসেছে জানা-অজানা কিছু তথ্য।

মাহমুদুর রহমান মান্না : জেলে বসে বদিউল আলম আর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম সিরাজ ভাইকে চিঠি লিখব। আমাদের ধারণাগুলো জানাব। বদিউল বলল, আমাদের বক্তব্য অন্য জায়গাগুলোতেও পাঠাই। সব জায়গায় পাঠালাম। সিরাজ ভাই এ সম্পর্কে কোনো কমেন্ট করলেন না। পরে আখলাক ভাইয়ের সঙ্গে যখন দেখা হয়েছে, বলেছেন, পড়েছি তো? উনি তো সিরিয়াস আলোচনা কখনো করেন না। সব সময় একটা জোক করার টেনডেন্সি। বেশির ভাগ জায়গা থেকেই আমাদের বক্তব্য সমর্থন করা হয়েছিল। শাজাহান সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে তো জেলে একসঙ্গে ছিলাম। উনি আমার সঙ্গে পুরো একমত। এটা নিয়ে পরে লিখলাম ‘শুধুমাত্র সদস্যদের জন্য’। ৩২ পৃষ্ঠার বই। আমার দুর্ভাগ্য, বইটা নাই। কোথাও আর পাইনি।

মহি : এসব থাক। আপনাকে ছাত্রলীগ থেকে এক্সপেল করা হলো কেন? আবুল হাসিব খান আমাকে বলেছে। তাকে দিয়েই বোধ হয় প্রস্তাবটা পাস করানো হয়।

মান্না : প্রস্তাবটা তুলেছিল নাজমুল হক প্রধান। সে কিছুদিন আগে পঞ্চগড় থেকে এসেছে। সে ছিল কেন্দ্রীয় কমিটির জুনিয়রমোস্ট মেম্বার। ঢাকার পলিটিকস কিছুই জানে না। সম্ভবত মার্শাল মনি তাকে ইনফ্লুয়েন্স করেছিল। পুরো কমিটিই ছিল আমার এক্সপালশনের বিপক্ষে। এটা করিয়েছে সিরাজ ভাই। হাসিব খুব হেজিট্যান্ট ছিল। আরও অনেকেই হয়তো দ্বিধায় ছিল। আসলে। আমাকে তো এক্সপেল করা যায় না। আমি তো ছাত্রলীগের কেউ নই। প্রাক্তন সভাপতি হিসেবে আমি পদাধিকারবলে সদস্য। তখন আমি ডাকসুর ভিপি। কনস্টিটিউশনালি করতে পারে না। সিরাজ ভাই তখন নাকি একটা ডায়ালগ দিয়েছিলেন,’কেটে ফেলে দিতে। হবে, আজ রাতের মধ্যেই এটা আমি চাই।’

মহি : বডিতে টিউমার হলে কেটে ফেলে দিতে হবে।

মান্না : এ রকমই বলেছিল, রাতের মধ্যেই করতে হবে। তো ওই রাতের মধ্যেই ওরা এটা করেছিল। এর আগের ঘটনা হলো, জেল থেকে বের হওয়ার পর–আমি একটু স্টুপিড টাইপের ছিলাম। পার্টি যে রকম বলত, আমি সে রকম বিশ্বাস করতাম। থিওরেটিক্যাল স্ট্রাগল করা উচিত, এ রকম আমিও বলেছি।

মহি: জেল থেকে বেরোলেন কবে?

মান্না : ‘৭৮ সালের এপ্রিলে। বেরোনোর পর আমি এটা বলতে শুরু করলাম। সিরাজ ভাই জেল থেকে বেরিয়ে এসে নতুন একটা তত্ত্ব বের করলেন–গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার, ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল গভমেন্ট (ডিএনজি)। তত্ত্বটা হয়তো ঠিক ছিল। কিন্তু। আমি এটা অ্যাকসেপ্ট করি নাই। কারণ, তখন আমি বুঝি নাই। আমি মনে করেছি এটা হবে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাওয়া। আগে ছিল। পুরো লেফট, এখন পুরা রাইটে চলে আসল। এখন আমি মনে করি, স্বাধীনতার পর থেকেই ডিএনজির (ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল গভমেন্ট) তত্ত্ব গ্রহণ করা উচিত ছিল। তখন আমি এটাকে আক্রমণ করেছিলাম। এই আক্রমণে ছাত্রলীগ তো সম্পূর্ণ আমার সাথে। আমাকে এক্সপেল করার পর মুনীর-হাসিব তো ছাত্রলীগ অফিসে যেতেও সাহস পায়নি। ইউনিভার্সিটিতে তো তাদের কেউ নেই। আমি ছাত্রলীগ অফিসে গিয়ে কোনো ঝামেলা করিনি। কারণ, ওরা হলো অফিশিয়াল লিডারশিপ। আমি ছাত্রলীগ অফিস ছেড়ে দিয়ে অন্য জায়গায় গেছি।

এই থিওরেটিক্যাল স্ট্রাগলটা যখন চলছে, আমি বক্তৃতা করছি, লিখছি, আলোচনা করছি। অনেস্টলি বলি সিরাজ ভাই, জলিল ভাই, রব ভাই তখন আমার সামনে দাঁড়ায় নাই। দাঁড়াতে পারে নাই। ছাত্রদের মধ্যে তো ব্যক্তিগত সম্পর্ক, আবেগ ইত্যাদি বেশি কাজ করে। আমি তখন ছাত্রদের মধ্যে যথেষ্ট পপুলার। সবাই যখন আমার পক্ষে এসে যাচ্ছে এবং তারা হেরে যাচ্ছে, তখন তারা একদিন আমাকে আর আখতারকে ডাকল। জলিল ভাইয়ের বাসা তখন রাজারবাগের ওখানে। সেখানে সিরাজ ভাই, জলিল ভাই, রব ভাই, মোহাম্মদ শাহজাহান, জিকু ভাই, মুনীর-হাসিব ছিল। আর কে ছিল মনে নাই।

কিছুক্ষণ দমটম নিয়ে মোহাম্মদ শাহজাহান বলল, তোমাদের মধ্যে যা-ই হচ্ছে, এগুলো বন্ধ করতে হবে। মান্না-আখতার আর মুনীর-হাসিব এই দ্বন্দ্ব আমরা চাই না। তোমাদের অঙ্গীকার করতে। হবে এটা এখন থেকে আর হবে না।

শাহজাহান ভাই, যে কথাটা আপনি বললেন, মুনীর-হাসিবের সঙ্গে তো আমার বা আমাদের কোনো দ্বন্দ নাই। ওদের জিজ্ঞেস করে দেখুন। এ নিয়ে আপনাদের কাছে অঙ্গীকারনামা দেওয়া, এটা আবার কী সিস্টেম? কী নিয়ে আমাদের বিতর্ক? যা নিয়ে আমরা ঝগড়া বা বিতর্ক করব না, তা যদি চিহ্নিত না হয়, তাহলে–এটা কী কথা?

তাহলে এটা অ্যাগ্রি করছ না?

এটা শাহজাহান ভাই অথবা সিরাজ ভাই, কে বলেছিলেন মনে নেই। আমি বললাম, সিরাজ ভাই, একটা কথা বলি। আমি তো চট্টগ্রামে ছিলাম। ভেবেছিলাম, পড়াশোনা শেষ হয়ে গেলে রাজনীতির পথে থাকব–এটাও ঠিক করিনি। আজ রাজনীতিতে আমার যেটুকু অবস্থান, সবই আপনাদের জন্য। জেএসডি ইজ মাই ফার্স্ট লাভ। আই ওয়ান্ট দ্যাট ইট উইল বি মাই লাস্ট লাভ। আপনাদের যদি মনে হয় আমার কোনো কাজ সংগঠনবিরোধী হচ্ছে, সংগঠনের ক্ষতি করছে, তাহলে বলেন, চুপচাপ বসে যাব। বলেন, কত দিন? এক বছর? দুই বছর? কিন্তু আমি মনে করি, যে লাইনে আপনারা যাচ্ছেন, আপনারা ধ্বংস হয়ে যাবেন। এর কোনো ফিউচার নাই। আমাকে যদি পলিটিকস করতে দেন, আই উইল বি ফাইটিং অ্যাগেইনস্ট দিস।

তখন সিরাজ ভাই অন্যদের শুনিয়ে বললেন, ‘ওরা তো মানছে না।’ মুনীর-হাসিব কোনো কথা বলে নাই। মিটিংটা এভাবেই শেষ হয়ে গেল। বেরিয়ে চলে এসেছি। তার কত দিন পরে এক্সপেলড হয়েছি মনে নাই।

মহি : মেজর জলিল জেল থেকে ছাড়া পেলেন ‘৮০ সালের ২৪ মার্চ, সিরাজ ভাই ছাড়া পেলেন পয়লা মে। আর জাসদ ভেঙে বাসদ হলো ‘৮০ সালের নভেম্বরে। এটা মে মাস বা তার পরপরই হবে, হয়তোবা। হাসিবের কাছেই আমি প্রথম শুনি যে সিরাজ ভাই ফোর্স করে তাকে দিয়ে এটা করিয়েছে। কিন্তু ওরা এটা অ্যাগ্রি করল কেন?

মান্না : আমি দেখেছি অনেকেই বড় বড় কথা বলে। জোরে কথা বলে, কিন্তু ভেতরে ওই রকম দৃঢ়তা নেই। চাপের মুখে এরা বলতে পারে না–সিরাজ ভাই, এটা করতে পারব না। কী হতো? আমি তো বলেছি কোনো অঙ্গীকারনামায় সই করব না। হাসিবরা আমার এক্সপালশনে সই করেছে-হাউ ক্যান ইট হ্যাঁপেন? এরপরও তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে। কিন্তু অনেক জায়গায় এ সম্পর্ক থাকে না। এটা যদি তারা না করত, তাহলে জাসদ হয়তো একভাবে রক্ষা। পেত। বলতে পারত, আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে, কিন্তু এ জন্য এক্সপেল করব না।

মহি: আপনি বলেছেন ‘গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার স্বাধীনতার পরপরই পারসু করা দরকার ছিল।

মান্না: এর কোনো ডিটেইলস করা হয়নি। গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার বলতে যা বোঝায়, আমরা মনে করি, স্বাধীনতার পরপরই এটা নিয়ে এগোনো উচিত ছিল।

মহি: আমি একটা লিটারেচার দেখলাম–কেন গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার। তারিখ লেখা আছে জুন ১৯৭৬।

মান্না : প্রশ্নই আসে না।

মহি: পরে শুনেছি, সিরাজ ভাই এটা জেল থেকে পাঠিয়েছে।

মান্না : হতে পারে। আমি জেল থেকে বেরোনোর পরেই এ বিতর্ক। সিরাজ ভাইয়ের মনে থাকতে পারে। উনি যদি ‘৬২ সালেই নিউক্লিয়াস করতে পারেন, তাহলে এটাও করতে পারেন। এটা অসম্ভব না।

বদিউল আলমের একটা কথা বলি। সে তখন কুমিল্লায় কমান্ডার বা ডেপুটি কমান্ডার। ওখানে তার এক্সপেরিয়েন্সটা ভালো হচ্ছে না। সিরাজ ভাই জিজ্ঞেস করলেন, কী হচ্ছে?’ বদিউল বলেছে, ‘ভাই, এই লোকই পরে আমার সামনে বলছে–যাও, এই এই করো। মানে অ্যাকশন করবা।’

মহি : আমরা তো চান্দিনাতে একটা মিটিং করে বদিউলকে কুমিল্লা জেলা গণবাহিনীর কমান্ডার বানালাম। মিটিংয়ে আমি ছিলাম। হাবিবুল্লাহ চৌধুরীকে করা হলো পলিটিক্যাল কমিসার। গণবাহিনীর কোনো অ্যাকটিভিটি কিন্তু কুমিল্লায় নাই, কুমিল্লা-চিটাগাং-সিলেট বেল্টে ছিল না। আমি তো চাঁদপুর থেকে সুনামগঞ্জ পুরো অঞ্চলটাই দেখেছি।

মান্না : সিরাজ ভাইকে যখন জেলে নিচ্ছে, উনি নাকি খালি কাঁদতেন। তাহের ভাইয়ের বড় ভাই ইউসুফ ভাই খুবই বিরক্ত। বলতেন, আপনাদের লিডার কান্দে।’ কান্না কিসের? সবার সঙ্গে যোগাযোগ করবে, কথাবার্তা বলবে, তাই না? আমরা কথাবার্তা বলছি না? সিরাজ ভাই কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতেন না। খালি কাঁদতেন।

স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগঠনে তাকে আমি এক নম্বর মনে করি। উনি যে টিমটা তৈরি করেছিলেন, এটা অসাধারণ। পরবর্তী সময়ে লিড করতে পারলে বাংলাদেশের চেহারা বদলে দিতে পারতেন। পরে কেন পারলেন না, এটা ওনার লিমিটেশন। এত বড় মানুষের এত ছোট ছোট বা বড় বড় মিথ্যাচার আমার কাছে বিস্ময়কর লাগে।

যেদিন আমাকে ছাত্রলীগ থেকে এক্সপেল করা হলো, তখনো তো জানি না। জাসদ অফিসে গেছি। তখন রাত আটটা হবে। রব ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। বললেন, “আরে, কী খবর, বঙ্গশার্দুল, চট্টশার্দূল!’ বললাম, আপনার সঙ্গে কথা আছে। দুজন একান্তে কথা বললাম। আমি বললাম, আমার বিরুদ্ধে তো এই সব হচ্ছে। রব ভাই বললেন, আরে, কিছু হবে না!

আপনিই তো আমাকে চিটাগাং থেকে ঢাকায় এনেছেন, ছাত্রলীগের সেক্রেটারি বানিয়েছেন। কিন্তু আমারও তো কিছু কাজ আছে। আমার বিরুদ্ধে কিছু করা হলে আমি তো চুপচাপ বসে থাকব না। আমি তো রাজনীতি করব। এটা তো জাসদের জন্য ভালো হবে না।

আরে, এসব কিছু হবে না। বাসায় গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাও।

আমি তখন রাজারবাগের কাছে একটা বাসায় থাকি। আখতারের সঙ্গে কথা হলো। বললাম, রব ভাই বলেছেন, চিন্তার কোনো কারণ নাই।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে। দরজা খুলে দেখি আমার মেজ ভাই দাঁড়িয়ে। হাতে একটা পত্রিকা। বললেন, ‘দেখো, খবর বেরিয়েছে, মান্না-আখতারকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সব কাগজেই এই সংবাদ, একটু পরে আখতার ফোন করে বলল, মান্না ভাই, আপনার কথা শুনে রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাইতে। গেলাম, এখন এ কী শুনছি।’ আমি তখন লা-জবাব। রব ভাই আমাকে এ রকম একটা ব্লাফ দিল? [২]

দলের মধ্যে সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রবকে সিরাজুল আলম খানের শীর্ষ মুখপাত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তারা একে অপরকে চেনেন এবং একসঙ্গে রাজনীতি করেছেন প্রায় দুই দশক ধরে। দলে ভাঙন পর্বের একটি ব্যাখ্যা তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যায় ১৯৮০ সালে বিচিত্রায় ছাপা হওয়া এক সাক্ষাৎকারে। এখানে তা উদ্ধৃত করা হলো :

প্রশ্ন : প্রত্যেকটা সংগঠনেই ভিন্নমত থাকে। ভিন্নমতের ফলে দ্বন্দ্ব আসে, দ্বন্দ্বের ফলে বিকাশ হয়। কিন্তু এখনকার জাসদের যে দ্বন্দ্ব। তা ভাঙন সৃষ্টি করল কেন?

উত্তর : কিছু লোক কোনো সংগঠন থেকে চলে গেলে বা দ্বিমত পোষণ করে আলাপ কর্মসূচি করলেই তাকে ভাঙন বলা যায় না। তারা আমাদের রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে।

প্রশ্ন : এই বিরোধ যদি কেবলমাত্র ডাকসু-ছাত্রলীগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে আমরা তা বিশ্বাস করতাম। কিন্তু এখন তো ভাঙন দেখা গেল কেন্দ্রীয় কমিটিতেও।

উত্তর : আমাদের চারটি সহযোগী সংগঠনের মূল লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। কাজেই বিরোধ এক জায়গায় দেখা দিলে স্বাভাবিকভাবেই তা অন্য ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।

প্রশ্ন : যে দলিল জোর করে ওদের ওপর চাপিয়ে দেবার অভিযোগ তারা আপনাদের বিরুদ্ধে এনেছে, সে সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?

উত্তর : বাকশালের সঙ্গে ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু জাসদ বা তার কোনো সংগঠন আজ পর্যন্ত বলেনি যে আমরা বাকশালের সঙ্গে ঐক্য করতে চাই। বাকশালের কনসেপ্টের সঙ্গে আমাদের কোনো ঐক্য হতে পারে না। অথচ এই প্রশ্নটি নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে চমকপ্রদ স্লোগান দিয়ে আমাদের নিপীড়িত কর্মী বাহিনীর মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।

প্রশ্ন : তাহলে আপনি বলতে চান যে এই মতবিরোধ বা ভিন্নমত সংগঠনের মধ্যে আগে থেকেই ছিল?

উত্তর : মার্ক্সবাদী চিন্তাধারা নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনের মধ্যে মতবিরোধ থাকবেই। যারা চিন্তা করে তাদের মতপার্থক্য হওয়া ভালো। কিন্তু আমাদের দেশে সংগঠনগুলোতে মতপার্থক্যের নামে অন্য কিছু হচ্ছে। আমরা মতপার্থক্য করি মতৈক্যে পৌঁছবার জন্য। কিন্তু মতপার্থক্যকে যদি নোংরামি দিয়ে সাজানো হয়, তাহলে তা সংগঠনের বৃহৎ স্বার্থে আঘাত হানে।

প্রশ্ন : তাদের বিরুদ্ধে আপনার সুস্পষ্ট অভিযোগ কী?

উত্তর : এরা আমাদের বর্তমান কর্মসূচির বিরোধিতা করেছে। সেটাই হলো আসল কারণ। আর অন্য যেগুলোর কথা বলা হচ্ছে সেগুলো সবই ধূম্রজাল। এ মুহূর্তে ঐক্যই আমাদের কাছে বড় নয়। আন্দোলনই বড়। অথচ ঐক্যের প্রশ্নটাকে বড় করে তুলে চমক সৃষ্টি করা হচ্ছে।

প্রশ্ন : তারা যদি ভুল স্বীকার করে আপনারা কি তাদের গ্রহণ করবেন?

উত্তর : আমরা ইতিমধ্যেই এ ধরনের বিবৃতি দিয়েছি। তারা যদি ভুল স্বীকার করে এবং যে শর্ত দিয়েছি তা মেনে নিতে তৈরি থাকে, তাহলে অবশ্যই তাদের গ্রহণ করা হবে।

প্রশ্ন : চূড়ান্তভাবে বিবৃতি দিয়ে আপনারা একতরফাভাবে তাদের বহিষ্কার করলেন কেন?

উত্তর : আমার মনে হয় এটা সঠিক নয়। কারণ, আমাদের সংগঠন দেশের অন্য সংগঠনগুলোর চাইতে একটু আলাদা। এ রকম করলে আমরা সবাই যখন একসঙ্গে জেলে ছিলাম, তখন সংগঠন টিকে থাকত না। [৩]

বিপ্লবী পার্টি তৈরির পরিক্রমাটি বন্ধ করে দেওয়ায় যে শূন্যতা তৈরি হলো, তা কীভাবে পূরণ হবে, এ প্রশ্ন উঠল। ভিন্নমতাবলম্বীরা পরে মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর তাত্ত্বিক নেতৃত্বে একজোট হয়েছিলেন। তাঁদের চিন্তা থেকেই পরে জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। তাঁদের বক্তব্য ছিল, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি (সিওসি) ভেঙে দেওয়ার পর কোনো প্রকার পার্টি প্রক্রিয়া বা পার্টি বিবেচনায় কোনো সাংগঠনিক কাঠামো রাখা হয়নি। ফলে থেকে গেল শুধু গণসংগঠনগুলো, যার মাধ্যমে বিপ্লবী রাজনীতি গড়ে তোলার নামে প্রকারান্তরে ‘বিলোপবাদী স্বতঃস্ফূর্ততা’র হাতে কর্মী বাহিনীকে ছেড়ে দেওয়া হলো এবং এভাবে। পার্টির অগ্রণী ভূমিকাকে অস্বীকার করা হলো। [৪]

.

পয়লা মে ১৯৮০ ময়মনসিংহ জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সিরাজুল আলম খান ঢাকায় আসেন। কয়েক দিন হাসপাতালে ছিলেন। গণকণ্ঠ পত্রিকা আবার বের করার উদ্যোগ নিলেন তিনি। পুরোনো সাংবাদিক-কর্মীদের অনেককেই জড়ো করলেন। এদের মধ্যে ছিলেন মোস্তাফা জব্বার, আতিয়ার রহমান, আবু করিম, আহমদ ছফা, মাশুক চৌধুরী। দলের ভেতরের এবং বাইরের অনেকেই এ সময় গণকণ্ঠএ যোগ দেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন বদিউল আলম, মোরশেদ শফিউল হাসান ও সোহরাব হাসান। সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেন বাহাউদ্দিন চৌধুরী। তিনি একসময় সরকারের ভারপ্রাপ্ত তথ্যসচিব ছিলেন। বাহাউদ্দিন চৌধুরী তাঁর বন্ধু ওয়াহিদুল হককে নিয়ে এলেন সম্পাদকীয় বিভাগটি দেখভাল করার জন্য। ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে চুক্তি ছিল অনানুষ্ঠানিক।

সিরাজুল আলম খান টিপু সুলতান রোডের গণকণ্ঠ অফিসে একটা কামরায় নিয়মিত বসতেন। পত্রিকার মান দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছিল। পত্রিকা চালাতে অনেক টাকা লাগে, বিজ্ঞাপন পাওয়া যায় না। বেশির ভাগ দিন গণকণ্ঠ বেরোত ছয় পাতার। রোববারে আট পাতা। ওই সময় মাস তিনেক আমি সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করেছি। সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় লেখা ছাড়াও আমাকে অর্থনীতি’র একটা সাপ্তাহিক পাতা বের করতে হতো। কয়েক বছর জেলে থেকেও জাসদের নেতাদের রাজনীতিতে চেতনাগত পরিবর্তন যে হয়নি, তার একটি প্রমাণ পেলাম খুব শিগগির। এ নিয়ে একটি মজার ঘটনা হয়েছিল।

একদিন বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনের চত্বরে জাসদের এক জনসভায় আ স ম আবদুর রব বক্তৃতা দিলেন। তখন জিয়াউর রহমানের সরকার। জাসদের ভাষায় ফ্যাসিবাদী সরকার। কিন্তু রবের বক্তৃতায় আগাগোড়া ছিল আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আক্রমণ। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, এ নিয়ে একটি উপসম্পাদকীয় লিখব।

রবের বক্তৃতার সারমর্ম ছিল–আমরা স্বাধীনতার আগে শেখ মুজিবকে সমর্থন করেছি। তখন তিনি ভালো ছিলেন। পরে তিনি খারাপ হয়ে গেছেন। এ জন্য আমরা তার বিরোধিতা করি। আমি এই যুক্তিটাকেই খণ্ডন করার চেষ্টা করলাম। লেখাটা বেশ বড় ছিল, পৃষ্ঠাজুড়ে চার কলাম। তার শেষ অনুচ্ছেদটা এ রকম :

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সোভিয়েত-ভারত জোটের প্রভাবের কারণে হোক। বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার কারণে হোক অথবা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের একটা বিরোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের মোড়ল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। আওয়ামী লীগ সরকারকে খুব একটা সুনজরে দেখেনি এবং এ বিরোধ চাপা ছিল না। একপর্যায়ে শেখ মুজিবকে প্রাণ দিয়ে এ বিরোধের মীমাংসা করতে হয়েছিল। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর এই ভূমিকা কি ইতিবাচক ছিল না? তাঁর রাজনীতি যদি একান্তই দুই পর্যায়ে ভাগ করে দেখতে হয়, তাহলে আমরা কোন পর্যায়ের রাজনীতিটাকে তুলনামূলকভাবে প্রগতিশীল বলব? [৫]

লেখাটা দেখালাম ওয়াহিদুল হককে। শিরোনাম ছিল ‘শেখ মুজিবের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আমার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু এটা ছাপানো যাবে না। তবে আমি চাই এটা ছাপা হোক। আমি দেখলাম, এ লেখা জাসদের নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় এবং জাসদের মালিকানাধীন পত্রিকায়। এটা ছাপানো কঠিন। যাহোক, ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে একটু ষড়যন্ত্র করলাম। উনি রোববার অফিসে আসেন না। আমি রোববারে লেখাটা প্রেসে দিয়ে দিলাম। যিনি কম্পোজের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি আমাকে চেনেন বাহাত্তর সাল থেকে। তিনি এটা রেখে দিলেন। যথারীতি দুদিন পর এটা একমাত্র উপসম্পাদকীয় হিসেবে মঙ্গলবার (৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮০) ছাপা হলো। ওয়াহিদুল হকের জন্য প্রতিরক্ষাব্যবস্থা করা হলো। তিনি বলতে পারবেন, তিনি ওই দিন অফিসে ছিলেন না। অর্থাৎ তার হাত দিয়ে এটা প্রেসে যায়নি।

মঙ্গলবার সকালে অফিসে গিয়ে বুঝলাম, রীতিমতো একটা বোমা ফেটেছে। এ লেখা কীভাবে ছাপা হলো? সিরাজুল আলম খান খোঁজ নেন বাহাউদ্দিন চৌধুরীর কাছে। বাহাউদ্দিন চৌধুরী জিজ্ঞেস করেন ওয়াহিদুল হককে। বেলা ১১টার দিকে আমাকে ডেকে নিলেন সিরাজুল আলম খান। অনেক কথাবার্তা হলো। তিনি ঘুণাক্ষরেও আমার লেখার প্রসঙ্গ তুললেন না। আমাকে প্রায় দেড়-দুই ঘণ্টা আটকে রাখলেন। সম্পাদকীয় রুমে ফিরে এসে দেখি আহমদ ছফা কী যেন লিখছেন। পরদিন আহমদ ছফার লেখা ‘শেখ মুজিব প্রসঙ্গে’ ছাপা হলো সম্পাদকীয় পাতায়। আমার লেখায় যা। বলতে চেয়েছি, তিনি লিখলেন তার উল্টো, একটু ইনিয়ে-বিনিয়ে। বুঝতে পারলাম, ছফাঁকে দিয়ে এটা লিখিয়েছেন সিরাজুল আলম খান। ছফা তল্পিবাহকের মতো কাজটি করলেন। একসময় আখলাকুর রহমান ছিলেন জাসদ ঘরানার প্রধান বুদ্ধিজীবী। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। আহমদ ছফা তখন জাসদের প্রধান বুদ্ধিজীবী হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন। এ জন্য তার দরকার সিরাজুল আলম খানের পৃষ্ঠপোষকতা!

.

১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোরবেলায় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার অতর্কিত হামলায় নিহত হন। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার। ওই বছর ১৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি পদে নতুন নির্বাচন হয়।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সিরাজুল আলম খান চেয়েছিলেন আতাউল গনি ওসমানীকে ১০-দলীয় জোটের প্রার্থী করতে। জোটের বড় শরিক আওয়ামী লীগ রাজি হয়নি। তারা চেয়েছিল তাদের নিজস্ব লোক ড. কামাল হোসেন জোটের প্রার্থী হবেন। এ প্রশ্নে জোটের শরিকেরা একমত হয়নি। কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থী হন। ওসমানীকে নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে প্রার্থী করা হয়। এ সময় জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি এবং শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দল মিলে একটি ত্রিদলীয় জোট হয়। এই জোটের প্রার্থী হন মেজর জলিল। নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন ৮৩ জন। শেষ পর্যন্ত ২২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ মোট ৩৩ জন নির্বাচনী দৌড়ে টিকে থাকেন। বেশির ভাগই ছিলেন ‘ডামি’ প্রার্থী।

নির্বাচনে শতকরা ৬৬ ভাগ ভোট পেয়ে বিচারপতি সাত্তার জয়ী হন। কামাল হোসেন পেয়েছিলেন শতকরা ২৬ ভাগ ভোট। জলিলের স্থান ছিল ৫ নম্বরে। তিনি আড়াই লাখের মতো (১.১৫%) ভোট পান। [৬]

এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ২৪ মার্চ ভোরবেলায় রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে হটিয়ে ক্ষমতা নেন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮২ এরশাদ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খান জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়া প্রকাশ করেন। এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

১৯৮২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর একযোগে শিক্ষা দিবস পালন করার জন্য ১৪টি ছাত্রসংগঠন তৈরি করে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’। পরে আরও পাঁচটি ছাত্রসংগঠন যোগ দিলে এটি হয় ১৯ দলের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এতে আওয়ামী লীগ, জাসদ, বাসদসহ অনেক দলের সহযোগী ছাত্রসংগঠন ছিল। তারা একটা ১০ দফা দাবিও দেয়। বিএনপিপন্থী জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এই জোটে যোগ দেয়নি। তত দিনে আওয়ামী লীগকে কেন্দ্র করে ১৫-দলীয় জোট তৈরি হয়ে গেছে। এর পাল্টাপাল্টি বিএনপিকে কেন্দ্র করে সমমনা দলগুলোর একটি ৭-দলীয় জোট তৈরি হয়।

১৯৮৩ সালের ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। কমপক্ষে পাঁচজন ছাত্র নিহত ও শতাধিক আহত হয়। নিহত ছাত্রদের মধ্যে ছিল জয়নাল, কাঞ্চন, মোজাম্মেল, জাফর ও দিপালী সাহা। এই আন্দোলনে জাসদ-সমর্থিত ছাত্রলীগের সক্রিয় ভূমিকা ছিল।

সিরাজুল আলম খান তত দিনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, পুরোনো ধারার জাসদীয় রাজনীতিতে ছেদ ঘটাবেন। ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি ঘটে যাওয়া সহিংসতাকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। তার তত্ত্বাবধানে প্রকাশকের নামধাম ছাড়া ম্যাগাজিন সাইজের একটা বুলেটিন বের হতো। নামও ছিল বুলেটিন। এর ফেব্রুয়ারি-মার্চ ১৯৮৩ সংখ্যায় ষড়যন্ত্র সন্ত্রাস ও হঠকারিতা মোকাবেলা করে আন্দোলনের শক্তিকে সংহত করুন’ শিরোনামে মূল। প্রতিবেদনে মহল বিশেষের উসকানিতে ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে ব্যত্যয় ঘটল’ বলে মন্তব্য করা হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয় :

ছাত্ররা কেন শান্তিপূর্ণভাবে তাদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি পালন করতে পারলেন না? ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মূল পরিকল্পনার পরিপন্থী। ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা কেন ঘটল? জাতীয় নেতৃত্ব কর্তৃক পরিকল্পিত আন্দোলনের কর্মসূচির পরিপূরক ও সম্পূরক কর্মসূচি ছাত্ররা কেন রক্ষা করতে পারল না? ছাত্র আন্দোলন কেন এ অনভিপ্রেত সংঘর্ষ ও আঘাতের সম্মুখীন হলো? আচমকা জাতীয় নেতৃবৃন্দসহ আন্দোলনের শক্তি কেন আপাতভাবে হলেও বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত হলো? এ জন্য সরকারের দমননীতি, গণবিরোধী ও হঠকারী পদক্ষেপ যেমন দায়ী, তেমনি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মূল পরিকল্পনার পরিপন্থী ব্যতিক্রমধর্মী কার্যক্রমও কম দায়ী নয়।

আন্দোলনকারীদের এই আত্মোপলব্ধি অবশ্যই অর্জন করতে হবে। ১৯৮৩ সালের ছাত্র আন্দোলন নিয়ে জাসদে দুই মত ছিল। মধ্য ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর সিরাজুল আলম খান এখান থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। আন্দোলন অবশ্য বেশি দিন জারি থাকেনি। আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা ছিল জাসদ-সমর্থিত মুনীর-হাসিবের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগ এবং বাকশাল-সমর্থিত ফজলু-চুনুর নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগ। ওই সময় জেনারেল এরশাদ টাকাপয়সা দিয়ে দুই দলের দুই নেতাকে ম্যানেজ করেন বলে জানা যায়। এ প্রসঙ্গে বাকশালের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এবং সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা এস এম ইউসুফ চাঞ্চল্যকর বিবরণ দিয়েছেন :

জিল্লুর রহিম দুলাল বাকশালের প্রেসিডেন্ট মহিউদ্দিন আহমেদের মেয়ের জামাই, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ১৫ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর দুলাল একজনকে নিয়ে আমার বাসায় এল। পরিচয় হলো, মেজর মুন্না (মুনীরুল ইসলাম চৌধুরী), তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ের জামাই। সে জেনারেল চিশতির দালাল। বলল, পনেরোটা দিনের জন্য ইউনিভার্সিটি ঠান্ডা করেন। মুনীর-হাসিব, ফজলু-চুনু এদের ইউনিভার্সিটি এলাকা থেকে অ্যাবসেন্ট করে দেন।’ বললাম, মুনীর হাসিব তো আমার কমান্ডে না। তারা হাসানুল হক ইনুর কমান্ডে। সে বলল, আপনার কমান্ডে ফজলু-চুন্নু, তাদেরকে বের করে দেন। আপনার জন্য পনেরো লাখ টাকা নিয়ে এসেছি।’ মুন্না একটু বেয়াদব টাইপের, অ্যাগ্রেসিভ। ব্রিফকেস খুলে দেখাল, নোটের বান্ডিল। বললাম, এইটা আমার পক্ষে সম্ভব না। তারা রাজ্জাক ভাইয়ের কমান্ডে। দুলাল বলল, আমি জানি আপনিই কমান্ড করেন। রাজ্জাক ভাই তো নেতা আছেনই। আপনি চাইলেই এটা হয়ে যায়। ওদেরকে কিছু টাকা দিয়া দেন, ঢাকার বাইরে চলে যাক।’ মুন্না বলল, টাকা কি কম হইছে? আপনি বললে আরও পাঁচ লাখ নিয়া আসতে পারি। আমি দেখলাম মিলিটারির লোক, কখন ধরে নিয়ে যায়, মেরে ফেলবে। বললাম, দেখি ভাই, একটু চিন্তা করি। সিগারেট আনার কথা বলে ভেতরের ঘরে গিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে লাফ দিয়ে একটা রিকশায় উঠে চলে গেলাম পিন্টুর বাসায়।

১০-১৫ দিন পরে যখন নরমাল হইছি, দুলালের বাসায় গেলাম। দুলাল বলল, ইউসুফ ভাই, আপনি নিজে তো লস করলেন, আমারেও লস করাইলেন। চাইলেই ২০ লাখ টাকা পাইতেন। আমিও কিছু পাইতাম। কোনোটাই হইতে দিলেন না। আপনি করেন নাই। আমরা তো করায় আনছি। তিন লাখ বাঁচছে। ছাত্রনেতাদের উস্তাদদের একজনকে দিলাম সাত লাখ, আরেকজন নিল পাঁচ লাখ। কোথায় পেমেন্ট হইল? এসবির ডিআইজি মোরশেদের বাড়িতে। এরশাদের খুব কনফিডেন্সের লোক। তার বাড়িতে পলিটিশিয়ানদের গোপন বৈঠক-টৈঠক হইত। [৮]

এ ধরনের সহিংস ছাত্রবিক্ষোভে সিরাজুল আলম খানের আপত্তি ছিল। তখন তিনি ১৫-দলীয় জোটকে আরও সংহত ও শক্তিশালী করার কথা ভাবছেন। একই সঙ্গে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে এগোনোর চেষ্টা করছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি একটি বিবৃতি দেন, যা তার স্বাক্ষরসহ বুলেটিন এ ছাপা হয়েছিল। বিবৃতিটি ছিল এ রকম :

বর্তমান পরিস্থিতিতে সিরাজুল আলম খানের বক্তব্য :

বিরাজমান সামাজিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও রাজনৈতিক স্থবিরতা দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। স্বাধীনতা লাভের পর হইতে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা শূন্যতা বিরাজ করিতেছে, তাহার ফলে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সর্বোপরি বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে অবক্ষয় দেখা দিয়াছে। যার পরিণতিতে আজ স্বাধীনতাসংগ্রামের সকল আশা-আকাঙ্ক্ষা নস্যাৎ হওয়ার পথে এবং জাতি ও জনগণ চরমভাবে হতাশার শিকার।

এই সংকটজনক অবস্থা হইতে উত্তরণের একমাত্র পথ সমাজজীবনের সকল মহল ও অংশের যৌথ উদ্যোগ। তাহার জন্য প্রয়োজন পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, সহযোগিতা ও সহনশীলতার মনোভাব। ইহা সম্ভব একমাত্র গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। জাতীয় ও সমাজজীবনে আপেক্ষিক স্থিতিশীল পরিস্থিতি সুস্থ রাজনীতির জন্য অপরিহার্য। ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাহিরের সকল মহলের জন্য এই কথা সমভাবে প্রযোজ্য।

গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে সামনে রাখিয়া গড়িয়া উঠিয়াছে প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক ১৫টি দলের ঐক্য। অভ্যন্তরীণ ও বাহিরের কোনো বিভ্রান্তিকর কার্যকলাপ যেন এই ঐক্যকে দুর্বল ও বিনষ্ট করিতে না পারে, তাহার প্রতি সজাগ থাকিতে হইবে। কারণ, গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও আন্দোলনের অনুপস্থিতিতে হঠকারী ও নৈরাজ্যবাদীরাই উপকৃত হইবে এবং উহা ডাকিয়া আনিবে দেশ ও জাতির জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি।

গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও রাজনৈতিক কর্মতৎপরতার প্রয়োজনীয়তা ক্ষমতাসীন সরকার বাস্তবে মানিয়া লইলে জাতীয় জীবনের বহু সংকট নিরসন সহজতর হইবে।

এই প্রেক্ষিতে পরিস্থিতির উন্নতিকল্পে যেকোনো রাজনৈতিক উদ্যোগকে অর্থবহ করিতে হইলে সরকারকে একটি উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করিতে হইবে। এই জন্য প্রয়োজন ছাত্রসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি, মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার, ১৪ ও ১৫ই ফেব্রুয়ারির ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত, প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি প্রত্যাহার এবং রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মের সুযোগ প্রদান।

স্বাক্ষর
সিরাজুল আলম খান
১৮/৩/৮৩৯ [৯]

.

ছাত্রলীগ-জাসদের অনেক কর্মী তখন ভবঘুরের মতো জীবন যাপন করছে। আবার কারও কারও মনে রয়ে গেছে বিপ্লবের স্বপ্ন। ওই সময় কর্মীদের দেশের বাইরে পাঠানোর উদ্যোগ নেন মেজর জলিল। আহমেদ আবদুর রাজ্জাক ছিলেন ঢাকায় প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) আবাসিক প্রতিনিধি। তাঁর সঙ্গে মেজর জলিলের সখ্য ছিল। জলিল তার মাধ্যমে ১৯৮১ সালে ফিলিস্তিনে কিছু স্বেচ্ছাসেবক পাঠান। এদের জন্য কিছু মাসোহারার ব্যবস্থা ছিল। তারা ভেবেছিলেন, সেখানে গিয়ে তাঁরা প্রয়োজনে যুদ্ধ করবেন। বেশ কয়েক মাস সেখানে থেকে অনেকেই কপর্দকশূন্য অবস্থায় হতাশ হয়ে ফিরে আসেন।

জলিল লিবিয়ার সঙ্গেও যোগাযোগ গড়ে তোলেন। লিবিয়ার শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে লিবিয়ার ত্রিপোলিতে একটি আন্তর্জাতিক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গাদ্দাফি। ১৯৮১ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে তিনি সেখানে একটি সংহতি সম্মেলন ডাকেন। জলিলকে তিনি ওই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানান। আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মালেক উকিলও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। জলিল সেখানে প্রায় দুই সপ্তাহ ছিলেন।

ঢাকায় জলিলের বিশ্বস্ত সহচর হলেন বিমানবাহিনীর সাবেক করপোরাল মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। জলিলের অধীনে তিনি মুক্তিযুদ্ধে নবম সেক্টরে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে জলিল যাদের নিয়ে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন, মজিদ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। ত্রিপোলি থেকে জলিল তাঁকে একটি চিঠি পাঠান।

৩/৯/৮১
ত্রিপোলি
মজিদ,

শুভাশীষ নিস। আশা করি কুশলেই আছিস। আসার দিন অনেক বিলম্ব হয়েছে। বম্বেতে ৩ ঘন্টা এবং দুবাই এয়ারপোর্টে ৬ ঘণ্টা বিলম্ব করে যার ফলে ২৬ তারিখ সকাল ৭টায় এসে পৌঁছতে হয়।

ভূমধ্যসাগরের তীরে ত্রিপোলি শহর ভালোই লাগছে সবকিছু। কনফারেন্স ২৮/৮ থেকেই শুরু হয়েছে। গাদ্দাফি ২৮/৮ তারিখে উদ্বোধনী ভাষণ দিয়েছে; আমি ৩১/৮ তারিখ রাত ৮-৩০ মিনিটে ভাষণ দিয়েছি। এখানকার রেডিও টেলিভিশন ভালো Coverage দিয়েছে।

লিবিয়ায় থাকাকালে গাদ্দাফির সঙ্গে জলিলের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পঁচাত্তরের আগস্ট অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িতদের কয়েকজন তখন লিবিয়ায় ছিলেন। তাঁদের অন্যতম খন্দকার আবদুর রশিদ, সৈয়দ ফারুক রহমান ও বজলুল হুদা গাদ্দাফির পৃষ্ঠপোষকতায় সেখানে একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। নাম দেন ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্প। সেখানে বাংলাদেশ থেকে আসা তরুণদের সামরিক ও রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক উচ্চাশা থেকেই তারা এই প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছিলেন। জলিল ত্রিপোলিতে ছিলেন প্রায় দুই সপ্তাহ। ফেরার আগে তিনি মজিদকে আরেকটি চিঠি দেন।

৮/৯
মজিদ

আমি আগামীকাল কুয়েত এয়ারলাইনসে বৈরুতের পথে রওনা হচ্ছি। এখান থেকে কোনো লাইন পাওয়া কঠিন। মালেক ভাই যাচ্ছেন। রবের জন্য তার কাছে চিঠি পাঠালাম। আমার একটা Box unaccompanied luggage হিসেবে পাঠালাম। এখানকার বড় সাহেবের সাথে আমার দেখা হয়েছে। আজ আবার হবে।

লেবাননে গিয়ে যোগাযোগ করব। বাসার সবাই কেমন আছে। সবাইকে শুভেচ্ছা। আমি মোটামুটি ভালোই আছি। আনোয়ার, বেলাল ও ইউসুফ ভাইকে শুভেচ্ছা দিস। খোদা হাফেজ।

জলিল ভাই।

ত্রিপোলি থাকাকালে ফারুক-রশিদদের সঙ্গে জলিলের কথাবার্তা হয়। তাঁদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পে কিছু তরুণকে পাঠানোর ব্যাপারে জলিলের সঙ্গে তাঁদের সমঝোতা হয়। ত্রিপোলিতে পাঠানোর জন্য ঢাকায় লোকজন বাছাইয়ের কাজে কর্নেল তাহেরের ভাইয়েরা যুক্ত ছিলেন। তাদের কেউ কেউ ফারুকের বনানী ডিওএইচএসের বাসায় গিয়ে সলাপরামর্শ করতেন। ফারুক ঢাকা-ত্রিপোলি আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিলেন।

১৯৮২ সালে বেশ কিছু লোককে লিবিয়ায় পাঠানো হয়। রিক্রুটমেন্টের দায়িত্বে ছিলেন তাহেরের বড় ভাই সার্জেন্ট (অব.) আবু ইউসুফ। কয়েকটি ব্যাচে জাসদের কয়েক শ তরুণকে লিবিয়ায় পাঠানো হয়। তাদের বলা হয়, সেখানে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এসবের পাশাপাশি চলত রাজনৈতিক ক্লাস। লিবিয়ার নেতা কর্নেল গাদ্দাফির গ্রিন বুক পড়ানো হতো তাদের। লিবিয়া থেকে ফিরে এসে পরে তাঁদের কেউ কেউ ফারুক-রশিদের তৈরি ‘ফ্রিডম পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। [১০]

মেজর জলিলের সঙ্গে অন্য জাসদ নেতাদের বিরোধ শুরু হয়। সিরাজুল আলম খান, আ স ম আবদুর রব, কাজী আরেফ আহমদ, হাসানুল হক ইনু, শাজাহান সিরাজ, শরীফ নুরুল আম্বিয়াসহ প্রায় সব নেতাই তখন জলিলের বিরুদ্ধে এককাট্টা। ১৯৮৩ সালের প্রায় পুরোটাই এ নিয়ে জাসদে তোলপাড় চলে।

মেজর জলিলের বিরুদ্ধে পিএলও ও লিবিয়ায় লোক পাঠিয়ে চাঁদা আদায় ও ‘আদম ব্যবসা’ করার অভিযোগ উঠলে জলিল নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, তিনি যা কিছু করেছেন, দলের স্বার্থেই করেছেন। জাসদের জাতীয় কমিটির সদস্যদের উদ্দেশে লিখিত এক বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘দলীয় কার্যাবলি পরিচালনা, বড় বড় জনসভা অনুষ্ঠান, গণকণ্ঠ পত্রিকার জন্য টাকা ইত্যাদির প্রয়োজনে আমার ওপর অর্থ সংগ্রহের চাপ আসে।…যখন যা পেরেছি, তা গণকণ্ঠ পত্রিকার জন্য সিরাজ ভাই বা রাজা ভাই (মির্জা সুলতান রাজা), দলীয় কার্যক্রমের জন্য শাজাহান সিরাজ এবং জনসভার জন্য জিকু ভাইয়ের (নূর আলম জিকু) হাতে তুলে দিয়েছি।’ লিবিয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাসদ ‘সবকিছু বিবেচনা করে লিবিয়ার সাথে একটা ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রয়াস গ্রহণ করে। এ উদ্যোগের সূচনা করি আমি, রব ও শাজাহান সিরাজ।…এ নিয়েও আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু আপনারাই তো ধারাবাহিকভাবে দলীয়ভাবে পরিচালিত গণকণ্ঠ পত্রিকায় গাদ্দাফির গ্রিন কে পর্যন্ত ছাপিয়েছেন। [১১]

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে লেখক আহমদ ছফাঁকে কায় লিবীয়। দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন জলিল ছফা তখন গণকণ্ঠ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করতেন। পরে জলিলকে এড়িয়ে ছফা নিজেই লিবীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন। বাংলায় গ্রিন বুক অনুবাদ করার জন্য তিনি লিবীয় দূতাবাস থেকে আর্থিক অনুদান পেয়েছিলেন। তিনি কয়েকজনকে লিবিয়ায় পাঠিয়েছিলেন। তাঁদের একজন। ছিলেন ঢাকা নগর গণবাহিনীর পলিটিক্যাল কমিসার রফিকুল ইসলাম।

একটা পর্যায়ে এসে জাসদের কয়েকজন শীর্ষ নেতা মেজর জলিলকে দল থেকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। বিষয়টির একটি সম্মানজনক নিষ্পত্তি হতে পারত। কিন্তু জাসদ নেতারা ওই পথে গেলেন না। তাঁরা জলিলের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনলেন, তাতে তার চরিত্রহনন হলো। জলিলও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। দলের জাতীয় কমিটির সদস্যদের প্রতি এক খোলা চিঠিতে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দেন। একই সঙ্গে তিনি তার বিরোধিতাকারীদের প্রচণ্ড সমালোচনা করেন। তাঁর কথায় কোনো রাখঢাক ছিল না। ফলে যা ছিল এত দিন কানাঘুষা, তা একেবারে উদোম হয়ে পড়ল। জলিলের বক্তব্যের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো :

আমরা কে কীভাবে চলি, তার খোঁজ সংগঠন রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না বা রাখে না। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা একদল তরুণকে মাঝপথে এসে নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছি। দৈনন্দিন বেঁচে থাকার সংগ্রামে আজও তারা কী করে টিকে আছে, সেটাই একটা তাজ্জব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ আমরা দিব্যি সুখে আছি। কেন এই সংগঠনের কর্মীদের অবস্থা দিন দিন মানবেতর পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। আর আমরা, নেতাদের অবস্থা খোদার ষাঁড়ের মতো বাড়ছে। আমরা কি কর্মীদের রক্ত জল করা পরিশ্রমের ফসলকে নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের কাজে লাগাচ্ছি না?…

এরপর আপনারা আমার বিরুদ্ধে দলীয় অর্থ আত্মসাৎ ও সরকারি আনুকূল্যের অভিযোগ আনতে পারেন। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলুন, দলের চাঁদা তুলে আমি গ্রহণ করেছি না তা আপনারা করেন। আর সরকার থেকে আর্থিক সহযোগিতা কখনো কি আমার হাত দিয়ে এসেছে, না আপনারাই এনেছেন এবং খরচও করেছেন। হয়তো বলবেন, আপনার নির্দেশে করা হয়েছে। তাহলে আমি কি জেলে থেকেও ‘৭৯ সংসদ নির্বাচনের সময় সরকারের অর্থ আনতে নির্দেশ দিয়েছিলাম? একের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাবার চেষ্টা থেকে বিরত থাকুন। আসুন দলের স্বার্থে আমরা এখনো সংযত হই।

আমার বিরুদ্ধে জনশক্তি রপ্তানির সাথে জড়িত থাকার মিথ্যা অপবাদ এনে বলা হচ্ছে আমাদের রাজনীতি এটা অনুমোদন করে কি না। অবশ্যই আমাদের রাজনীতি প্রতারণামূলক কাজকে অনুমোদন করে না। মাননীয় বিচারকমণ্ডলী, আজ আপনাদের রায় দিতে হবে, আমাদের রাজনীতি বিদেশের ব্যাংকে টাকা রাখা অনুমোদন করে কি না? বহু নারীর সাথে রাত্রিযাপন করার স্বপক্ষে বিপ্লবী রাজনীতির কোনো অভিধানে লেখা আছে কি না? আন্দোলনের সময় শত্রুপক্ষের কাছে আশ্রয়গ্রহণ অনুমোদন করে কি না? স্ত্রীর কাছ থেকে এক দিনের জন্য বাইরে গেলে অন্যের বাসার কাজের মেয়েকে ধর্ষণ অনুমোদন করে কি না? আমাদের রাজনীতি সমকামিতা সমর্থন করে কি না? এমনকি অবৈধ সম্পর্কের মাধ্যমে কোনো মহিলাকে অন্তঃসত্ত্বা বানানো অনুমোদন করে কি না? আমাদের রাজনীতি যখন-তখন বিদেশে যাওয়া, বিশেষত ভারতে যাওয়া অনুমোদন করে কি না? চাঁদা তোলা অর্থ দিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন সমর্থন করে কি না? শুনতে বিষয়গুলো অত্যন্ত কদর্য ঠেকলেও আজ প্রয়োজন এসেছে এগুলোর উপরও সিদ্ধান্ত নেওয়ার এবং আপনাদের সুচিন্তিত অভিমত প্রদান করার। [১২]

.

জাসদ নেতারা রাজনীতির খেলায় থাকলেও ক্ষমতার রসায়নটি বুঝতে তাঁদের দেরি হয়েছিল। একসময় তাদের উপলব্ধি হলো, সেনাবাহিনী নতুন শক্তি হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। সুতরাং উদীয়মান এই শক্তির সঙ্গে সমঝোতায় এসে কিংবা দর-কষাকষি করে যতটুকু এগোনো যায়, সেই চেষ্টা করা দরকার। তাদের এই চেষ্টায় নাটকীয়তা যেমন ছিল, তেমনি ছিল দলের মধ্যে সুবিধাবাদ এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব। এ সময় তাঁদের কেউ কেউ এমন সব পদক্ষেপ নেন, যার মধ্যে যথেষ্ট ঝুঁকি ছিল। এটা ছিল অনেকটা জুয়া খেলার মতো। পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয় খুবই গোপনে। জাসদের ওপর দিকের কয়েকজন। ছাড়া অন্যরা এসবের বিন্দুবিসর্গও জানতেন না। তাদের চোখে নেতারা সবাই ফেরেশতাতুল্য।

করপোরাল মোহাম্মদ আবদুল মজিদ জাসদ রাজনীতির ক্ষমতার কাঠামোর মধ্যে ছিলেন না। এই প্রক্রিয়ায় তিনি আসেন মেজর জলিলের হাত ধরে। মুক্তিযুদ্ধে ৯ নম্বর সেক্টরে থাকাকালে জলিলের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর তিনি গ্রেপ্তার হন এবং জলিল। ও অন্যদের সঙ্গে কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯৮০ সালের মার্চে জলিল জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর থেকে তিনি তার ছায়াসঙ্গী। এক সাক্ষাৎকারে তিনি অনেক লুকানো তথ্য উন্মোচন করেছেন। আমার সঙ্গে তাঁর কথোপকথন ছিল এ রকম :

মহিউদ্দিন আহমদ : জাসদের অনেকেই লিবিয়া গিয়েছিল?

আবদুল মজিদ: হ্যাঁ, গেছে তো। ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পে।

মহি: আপনাদের সঙ্গে তো কর্নেল ফারুকদের ভালো সম্পর্ক ছিল? ক্যাম্পটা হয়েছিল কী জন্য?

মজিদ : টু ট্রেইন আপ বাংলাদেশি বয়েজ, পলিটিক্যাল মোটিভেশন।

মহি : ফর?

মজিদ: পলিটিকস।

মহি: মানে, তারা ফিরে এসে একটা পার্টি করবে। এ জন্য?

মজিদ : পার্টি তো অলরেডি করছে?

মহি: ফ্রিডম পার্টি?

মজিদ: হ্যাঁ। ওইটারই মোটিভেশন।

 মহি : ওখানে জাসদের তো অনেকেই ট্রেনিং নিয়েছে?

মজিদ: প্রায় দেড় শ থেকে দুই শ।

মহি: আহমদ ছফা কি লিবিয়া গিয়েছিল?

মজিদ : তাকে লিবিয়ান এমবাসিতে আমিই নিয়া গেছিলাম।

মহি : ঢাকা এমবাসিতে?

মজিদ : হ্যাঁ। পরিচয় করাইছি–আমাদের পার্টির ইন্টেলেকচুয়াল। জলিল ভাই খুব অ্যাপ্রিশিয়েট করছে।

মহি: মেজর জলিল আপনাকে দিয়ে পাঠিয়েছে? নিজে যায়নি?

মজিদ: আমি নিয়া গেছি। তারপর সে গাদ্দাফির ওপর বইটই লিখল। এমবাসিতে একটা সম্পর্ক হইল। তারপর সে মেজর জলিলকে বাইপাস কইরা…কিছু ছেলেপিলেকে সে নিজেই লিবিয়া পাঠাইল।

মহি: তাদের কি ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পে পাঠিয়েছিল?

মজিদ : কোথায় পাঠাইছে আই ডোন্ট নো। লিবিয়ায় পাঠাইছে।

মহি: কয়জনকে পাঠিয়েছে?

মজিদ : নাম্বার জানি না।

মহি : এলসি (লিটল কমরেড–রফিকুল ইসলাম) তো আমাকে বলেছে, সে গিয়েছিল।

মজিদ : হ্যাঁ, আহমদ ছফার মাধ্যমে।

মহি: আহমদ ছফা কি এ জন্য টাকাপয়সা পেয়েছে? লোক পাঠিয়ে?

মজিদ : লোক পাঠায়া না, টাকা পাইছে বই লেইখা।

মহি : বই আর কী লিখেছে? গ্রিন বুক ট্রানস্লেট করেছে।

মজিদ: গ্রিন বুক ট্রানস্লেট করছে, আর গাদ্দাফির ওপর একটা বই লিখছে।

মহি: আর কে গিয়েছিল?

মজিদ : বেলাল লেড দ্য টিম।

মহি: কর্নেল তাহেরের ভাই ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল?

মজিদ : হ্যাঁ।

মহি: সে কয়জনকে নিয়ে গিয়েছিল?

মজিদ : সঠিক নাম্বারটা জানি না। মহি: তারপর বলেন।

মজিদ : মেইনলি আবু ইউসুফ খান। কর্নেল তাহেরের বড় ভাই। জলিল ভাই আবু ইউসুফ খানের সঙ্গে আলাপ করছে। আবু ইউসুফ খান রিক্রুট করছে বেলালের মাধ্যমে। সাঈদ ভাই (কর্নেল তাহেরের আরেক ছোট ভাই) আমাকে বলল, ইনফরমেশন পাইলাম যে সামবডি ইজ টেকিং সাম বাকস্। যাদের রিক্রুট করা হইতেছে, তাদের কাছ থেকে। কিন্তু তারা তো যাবে ফ্রি? এভরিথিং ফ্রি। তারা টাকা নিতেছে। তখন আমি জলিল ভাইকে বললাম, এই যে ছেলেগুলা যাবে, আপনি তাদের ব্রিফ করবেন। কী কারণে যাচ্ছে, এখানে টাকার কোনো প্রবলেম নাই, ভলান্টারিলি যাচ্ছে, ওখানে বেতনও নাই। হয়তো একটা পকেট খরচ পাবে। এইভাবে ব্রিফ করবেন। এর আগে আপনি প্যালেস্টাইনে লোক পাঠাইছেন বিভিন্নজনের মাধ্যমে। আপনার কিন্তু অনেক প্রবলেম হইছে। অনেকে অনেক কোশ্চেন করছে।

তো সে আবু ইউসুফ খানকে বলছে। আবু ইউসুফ খান বলছে, ঠিক আছে জলিল ভাই। পরে ইউসুফ ভাইকে মোটিভেট করা হয়েছে–এই ছেলেগুলোর সামনে মেজর জলিলকে ফেস করাবেন না। ফেস করাইলে টাকাপয়সার কথা তো এক্সপোজ হইয়া যাবে।

ইউসুফ ভাই জলিল ভাইকে বলল, এইটা তো একটা ইন্টারন্যাশনাল পলিটিকস। এইটা নিয়া তো কেইস হবে। কেইস হইলে–এই ছেলেগুলা তো আপনাকে চেনে। তারা ডাইরেক্ট আপনাকে আইডেন্টিফাই করবে। আপনি লিডার। আপনি পিছনে থাকেন। এদেরকে ফেস কইরেন না।

আমি বললাম, জলিল ভাই, আপনি এইটা বিশ্বাস কইরা চইলা আসলেন?

কয়, দ্যাখ, আবু ইউসুফ খানকে যদি বিশ্বাস করতে না পারি, তাইলে কারে বিশ্বাস করব? কেমনে পার্টি করব? এই সব সিরিয়াস কাজ কেমনে করব?

আমি তো আর বেশি কথা তাঁকে বলতে পারি না।

পরে লিবিয়ায় ক্যাম্পে গন্ডগোল লাগছে। টাকা নিছে, চাকরি দেওয়ার কথা বলছে। কারও কাছ থেকে ২০ হাজার, কারও কাছ থেকে ৩০ হাজার, কারও কাছ থেকে ১০-১৫, এই রকম। ক্যাম্পে ট্রেনিংয়ের সময় এই গন্ডগোল লাগছে।

পরে ওইটার একটা চিঠি আসছে সাঈদ ভাইয়ের কাছে। আপনাকে বলছিলাম, মজিদ। দ্যাখেন এই। জলিল ভাইকে দেখাইলাম।

মহি : চিঠিটা কার?

মজিদ : ওই ছেলেদের। কেউ হয়তো সাঈদ ভাইয়ের পরিচিত, তাকে লেখছে।

ওইখানে একটা স্পেশাল টিম যাবে ১০ জনের। গাদ্দাফির গেস্ট হিসেবে। আমাকে যেতে ইনসিস্ট করা হচ্ছে। আমি বলছি, নো। হোয়াই শুড আই গো দেয়ার? জলিল ভাইকে বললাম, আপনাকে তো আগে বলছি। আপনি শোনেন নাই। এখন প্রবলেম হইছে। কী করবেন?

জলিল ভাই লেখছে–সে এক চিঠি! ব্রিফলি, হোয়াট হ্যাঁপেন্ড। তখন তাদেরকে রশিদ জিজ্ঞেস করেছে, হোয়াই ডিড ইউ টেক মানি? কয়, হাইকমান্ডের নির্দেশে। হাইকমান্ড মানে জলিল ভাই।

জলিল ভাই রশিদকে একটা চিঠি লেইখা আমাকে বলল, ইউ। আর টু টেক দিস লেটার অ্যান্ড গিভ ইট টু রশিদ। হি শুড বি। ক্লিয়ার।

মহি : চিঠিটা আপনাকে দিল?

মজিদ: হ্যাঁ। জলিল ভাই বলল, দ্যাটস হোয়াই ইউ আর টু গো। তোমার আর কোনো কাজ নাই।

লিবিয়া যাওয়ার পর আমাদের একটা গেস্টহাউসে রাখল। ওখানে আমরাই ছিলাম। আর কেউ না।

রশিদ আসল। কথাটথা হইল। তারপর আমাদের ক্যাম্প দেখাইতে নিয়া গেল, ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্প। আমরা গেলাম। আসার সময় অন্যরা ক্যাম্পে রয়ে গেল। তারা আমাকে বলল, ‘আপনিও থাকেন।’ বললাম, না, আমি গেস্টহাউসে যাব।

রশিদ গাড়ি ড্রাইভ কইরা আসতেছে। আমি পাশের সিটে বসা, তাকে চিঠিটা দিলাম। তারপর ১০ দিন ওই গেস্টহাউসে ডিসকাস হইছে। অন্যরা এইটা জানে না। গাদ্দাফির সেকেন্ডম্যান, ক্যাপ্টেন সালেম, সে আসছে। ইন্টারন্যাশনাল লিংকে যারা কাজ করে, তারা আসে, ফারুকের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ হইছে। সকাল ১০টায় আসত। বেলা দুইটায় যাইত।

একদিন রশিদ আমারে ডাইকা বলে, দেখেন, এখন কী করা যায়? ওরে (বেলাল) দিয়া কাজ করানো যাবে কি না?

আমি বলি, হি ইজ ভেরি ইফেকটিভ। যদি সে কাজ করতে চায়, আর আপনার কাছে যদি কনফেস করে। ইউ হ্যাভ গট অল দ্য ইনফরমেশন। তার লিংক আছে, হি ক্যান ওয়ার্ক।

এই পর্যন্ত কথা হইছে ডাইরেক্ট রশিদের সঙ্গে।

ইমরান, তাদের থার্ড ম্যান হবে হয়তো। বেলাল আমাকে বলছে, ‘ওকে বইলেন, আমি এই গ্রুপের লিডার, আমি কাজকর্ম করতে পারব। ওকে এইটা বলে রিকোয়েস্ট কইরেন।

মহি: লিবিয়ান?

মজিদ: লিবিয়ান।

পরে আমি জানতে পারি মহব্বতজান চৌধুরীর কাছ থিকা ক্লিয়ারেন্স নিয়া বেলাল এই কাজগুলো করছে। মহব্বতজান তখন ডিজিএফআইয়ের চিফ। তার সঙ্গে একটা ভালো সম্পর্ক। লিবিয়া থেকে ফিরে আসার পর সে কী করছে জানেন? সে ওই ছেলেদের নিয়া একটা গেটটুগেদার করছে।

মহি: কোথায় করেছে?

মজিদ : মগবাজারে। সেখানে ডিজিএফআইয়ের লোকও ছিল। মোটামুটি আইডেন্টিফাই করা হইছে যে এরা লিবিয়ায় গেছে। এই কম্মটা সে করছে। সে যে কী জিনিস!

মহি: সে লিবিয়ায় কত দিন ছিল?

মজিদ : ওই গেছে। ট্রেনিং নেয় নাই সে। আমরা যখন আসি, আমাদের সঙ্গে চইলা আসছে।

মহি: আপনি কয় দিন ছিলেন?

মজিদ: ১০-১২ দিন। ওই গেস্টহাউসেই ছিলাম। ঘুরায়া ঘুরায়া সাইট দেখাইছে। গ্রিনহাউস, গ্রিন স্কয়ার।

মহি: আপনাকে একটা প্রশ্ন করি, আমার বোঝার জন্য। তারা ওখানে ট্রেনিং নিয়ে একটা পার্টি করবে?

মজিদ: হ্যাঁ, পার্টিই তো। মোটিভেটেড পার্টি।

মহি: মেজর জলিল জাসদের প্রেসিডেন্ট হয়ে জাসদের বাইরে আরেকটা পার্টি করার জন্য লোকদের কেন ট্রেনিংয়ে পাঠাবে?

মজিদ: সে তো উইদিন পার্টি, তাদের সঙ্গে লিংকআপ হওয়ার জন্য। লিবিয়ার সঙ্গে তো জাসদের সম্পর্ক আছে।

মহি: সম্পর্কটা কি জলিলের ব্যক্তিগত?

মজিদ : না, পার্টির।

মহি: পার্টির? পার্টির কে কে জানে?

মজিদ: জানে শাজাহান সিরাজ, ইনু সাহেব–এরা সবাই। লিবিয়ার টাকায় গণকণ্ঠ বের হইছে। ওখানে গ্রিন বুকও ছাপা হইছে। রাজা ভাই (মির্জা সুলতান রাজা) তখন চার্জে ছিল। ভূইয়া ভাই (রুহুল আমিন ভূঁইয়া) চার্জে ছিল।

মহি: সিরাজুল আলম খান জানে এটা?

মজিদ: না জানার তো কথা না? এখন ডিনাই করবে।

মহি: মেজর জলিল অবশ্য তাঁর খোলা চিঠির মধ্যে এটা লিখেছে যে লিবিয়ার টাকায় গণকণ্ঠচলত। আপনি যখন ১০-১২ দিনের জন্য গেলেন, ওই টিমে আর কে কে ছিল?

মজিদ : বেলাল ছিল। শাজাহান ছিল, তেজগাঁওতে শ্রমিক জোট করত, কেইস শাজাহান বলত। এনাম ছিল। তারপর রায়েরবাজারের আনোয়ার। অনেক দিন আগের কথা তো। নাম ভুলে গেছি। আরেকজন ছিল, হোমিওপ্যাথিক কলেজ থেকে পাস করা।

মহি : যে নামগুলো বললেন, এরা ট্রেনিং নিয়ে দেশে এসে একটা কিছু করে ফেলবে–এমন মনে হয়?

মজিদ : এ রকমই তো হয়। রশিদ আর ফারুকের সঙ্গে কনফ্লিক্ট যদি না হইত, এ রকমই তো হইত। এ লোকগুলো তো ওয়ার্কার। দে আর নট লিডার। রশিদ-ফারুকের সঙ্গে সবার লিংক ছিল। সবাই গেছে তাদের কাছে।

মহি : আর কে কে গেছে?

মজিদ: রশিদ ছিল না, ছাত্রলীগের, এম এ রশিদ, সে তো তাদের লোক।

মহি: কী রকম?

মজিদ : তাদের লোক, হার্ডকোরের লোক।

মহি: আর?

মজিদ : চৌধুরী ফারুক, মিল্লাত পত্রিকা বাইর করত। বিভিন্ন গ্রুপে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে তারা তোক রিক্রুট করত। যেমন আমাদের ছফা ভাইয়ের মাধ্যমে করছে, চৌধুরী ফারুকের মাধ্যমে করছে, এম এ রশিদের মাধ্যমে করছে। এ রকম বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ডিস্ট্রিক্টে ডিস্ট্রিক্টে…

মহি : এম এ রশিদ যে তাদের লোক, এটা আপনি সিওর হলেন কীভাবে?

মজিদ : আমি জানি।

মহি : কীভাবে জানেন?

মজিদ : সিওরের কিছু না। আমি জানি এইটা।

মহি : আপনি তাদের লোক না?

মজিদ : না। আমি মেজর জলিলের লোক।

মহি: মেজর জলিলের সঙ্গে কি তাদের একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছিল?

মজিদ: হুম।

মহি : এই আন্ডারস্ট্যান্ডিং কি ১৫ আগস্টের আগে থেকেই?

মজিদ: না। এটা ‘৮০ সালের পরে।

মহি: জলিল জেল থেকে রিলিজ হওয়ার পরে?

মজিদ: জেল থিকা আইসা লিবিয়া যাওয়ার পরে ওইখানে গাদ্দাফির সঙ্গে কথাটথা হওয়ার পরে।

শোনেন, ঘটনা আরও আছে। জলিল ভাই যখন গণকণ্ঠ-র জন্য টাকা আইনা দেয়, তারা মনে করতেছে, বুঝি কোটি কোটি টাকা আনতেছে। তখন তারা বলতেছে, ‘এই টাকায় চলবে না, আরও টাকা লাগবে, তাদের সঙ্গে আমাদের একটু…’।

জলিল ভাই বলছে, তারা যা দেয়, তা-ই দেই তোমাদের। তোমরা এ রকম করলে…লেট আস ফেস ইট। তোমরা চলো তাদের কাছে। শাজাহান সিরাজ আর ইনু সাহেব লিবিয়ার…তখন তো অ্যাম্বাসাডর না, সেক্রেটারি। তার সঙ্গে মিটিং করছে।

মহি: তাদের অফিসে গিয়ে?

মজিদ : তাদের এমবাসিতে গিয়া।

মহি: শাজাহান সিরাজ আর হাসানুল হক ইনু?

মজিদ : ইয়েস।

মহি: আপনি ছিলেন ওই সময়?

মজিদ: নো।

মহি : মেজর জলিল নিয়ে গেছে তাদের?

মজিদ: হ্যাঁ, নিয়া গেছে। মিটিং-টিটিং…ফাইন। চা-কফি খাওয়া-টাওয়া হইছে। পরে ওই সেক্রেটারি মেজর জলিলকে বলছে, ‘মেজর জলিল, উই বিলিভ ইউ। আওয়ার লিডার ইজ গাদ্দাফি অ্যান্ড উই হ্যাভ ফেইথ অন ইউ, হিয়ার। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু ডিসকাস উইথ দিস পিপল। সো, ক্লোজ দিস চ্যাপ্টার।

মহি: তারপর কি সহযোগিতা বন্ধ?

মজিদ : হ্যাঁ।

মহি : এটা ইন্টারেস্টিং। আমি একটা বড় ক্যানভাসে চিন্তা করছি।

মজিদ: এরশাদের সঙ্গে জলিল ভাইয়ের একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল। গোলাম মোস্তফাঁকে তো সে মুক্ত করছে। এটা কেউ জানে না।

মহি : ঝিনাইদহের মোস্তফা?

মজিদ: হ্যাঁ। এরশাদ যখন পাওয়ারে গেছে, এরশাদ সিরিয়াসলি ওয়ান্টেড মেজর জলিল, তার সঙ্গে…। তাকে পাইলে জাসদকে পাবে। জাসদের এই গ্রুপটা। এই যে চার কুতুব আছে, তারা। প্লাস ছাত্রলীগ।

মহি: চার কুতুব মানে আরেফ, মার্শাল, ইনু, আম্বিয়া?

মজিদ : ইয়েস, অ্যান্ড এ বি এম শাহজাহান। দে হ্যাড আ মিটিং উইথ চিশতি, লতিফ, মান্নান সিদ্দিকী–এদের সঙ্গে তাদের মিটিং হইছে। আই ওয়াজ দেয়ার।

মহি: চিশতি?

মজিদ : ওই সময় মার্শাল লর যারা টপ নট ছিল, সবাই।

মহি : এই পাঁচ কুতুবের মিটিং? আপনি সেখানে ছিলেন?

মজিদ : আমি মিটিংয়ে পার্টিসিপেট করি নাই। আই টুক দেম দেয়ার।

মহি : মেজর জলিল পাঠিয়েছে আপনাকে? তো কী আলাপ হলো?

মজিদ : বলছে যে এরশাদ আমাদের নেতা। এখন আপনাদের। নেতাকে কোন জায়গায় রাখবেন, রাখেন।

মহি : এটা কে বলছে?

মজিদ: ওরাই, জেনারেলরা। যারা ওই সময় সরকার চালাইত। মাহমুদুল হাসান ছিল মেজর জলিলের কোর্সমেট– ডিজিএফআইয়ের। উপজেলা কনসেপ্ট কিন্তু মাহমুদুল হাসানের। সে। বলছে, ‘তোমাদের পার্টির তো সব জায়গায় লোক আছে–নেটওয়ার্ক আছে, আই নো। প্রত্যেক থানায়-উপজেলায় চেয়ারম্যান হিসাবে যারা কাজ করতে পারবে, তাদের লিস্ট দাও।’ তারা লিস্ট সাবমিট করছে। কথা ছিল, লিস্ট অনুযায়ী তাদেরকে বসায়া দিবে। এক-দেড় বছর তারা কাজ করবে। পরে ইলেকশন হবে। দে উইল বি ইলেক্টেড।

মহি : তারপর?

মজিদ : তারপর তো…সিরাজুল আলম খান আর আ স ম আবদুর রব বাগড়া দিয়া…দেখল যে সাবসাইড হইয়া যাচ্ছে, বলল–জাসদ। যাবে না। গ্রুপিং তো এইখান থিকা শুরু।

মহি : তখন ওই পাঁচ কুতুব কী করল?

মজিদ: তাদের কাছ থেকে সরে গেল।

মহি : পরে তো সিরাজুল আলম খান আর আ স ম রবই গেল ওই দিকে?

মজিদ : রাইট।

মহি: এইটা কীভাবে হলো?

মজিদ : ছাত্রলীগের হাসিব খান অ্যান্ড মুনীরউদ্দিন হ্যাড আ মিটিং উইথ মাহমুদুল হাসান। ছাত্রলীগ ভাঙার আগে যে কনফারেন্স হইছিল, তার আগে তো মিটিং হইছে তাদের সঙ্গে। সেকেন্ড মিটিংয়ের পর কর্নেল শামস টেলিফোন করছে, ‘স্যার, আপনার ফলোয়াররা তো আসছিল। ওরা মিটিংয়ের রেজাল্ট কী বলল? আর দে স্যাটিসফায়েড?’

মহি : কাকে ফোন করেছে?

মজিদ : মেজর জলিলকে।

মহি : তারপর?

মজিদ : মেজর জলিল ডাজ নট নো!

মহি : না জানিয়ে গেছে?

মজিদ: হ্যাঁ, উনি বলছে, ইট ইজ ফাইন। উনি তো বলতে পারেন না যে ‘আমি জানি না।’

মহি: তারপর কী হলো? মেজর জলিল কি ওদের এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করেছে?

মজিদ : না। সে বুঝে গেছে যে এদের সঙ্গে আর কাজ করা যাবে না। সো হি ডিসাইডেড হিস কোর্স।

মহি : ইন্টারেস্টিং! আমার কাছে তো এটা থ্রিলার মনে হচ্ছে!

মজিদ: তারা উপজেলা চেয়ারম্যানের জন্য লিস্ট দিছে। সেই লিস্ট ভেরিফাই করা হইছে।

মহি : লিস্ট বানাল কে?

মজিদ: এই চারজন-পাঁচজন মিলে।

মহি : আরেফ, ইনু, মার্শাল, আম্বিয়া, এ বি এম শাহজাহান?

মজিদ: হ্যাঁ।

মহি: শাজাহান সিরাজ এর মধ্যে ছিল না?

মজিদ : হি ওয়াজ নোহয়ার। সে রব সাহেবদের সঙ্গেও ছিল না।

মহি : জাসদের যে ভাঙাভাঙিটা, লোকে যেভাবে জানে, এটা তো তা না?

মজিদ: প্রেসিডেন্ট ইলেকশনের সময় সিরাজুল আলম খান যখন আতাউল গনি ওসমানীকে ক্যান্ডিডেট করতে পারল না–পার্টি ডিসাইড করল আমাদের পার্টির প্রেসিডেন্ট ক্যান্ডিডেট হবে। সে যদি না হয়, শাজাহান সিরাজ হবে। সে যদি না হয়, মেনন হবে। মেনন না হলে নির্মল সেন হবে।

মহি : হ্যাঁ, তিন পার্টি মিলে তো একটা অ্যালায়ান্স হয়েছিল।

মজিদ : হ্যাঁ। যাহোক, ক্যান্ডিডেট হিসেবে মেজর জলিল অ্যাকসেপ্ট হইয়া গেছে। ইলেকশনের সময় সিরাজুল আলম খান চইলা গেল বাহিরে। বইলা গেল–এক্সপোজ মেজর জলিল অ্যান্ড আউট হিম।

মহি: উনি কোথায় গেল?

মজিদ: বাইরে কোথাও গেছে।

মহি: জলিলকে আউট করার সিদ্ধান্ত নিল?

মজিদ: হুম। ওরা জিজ্ঞেস করল–হোয়াই? বলল, দেয়ার ইজ নো হোয়াই। সে তো দেখতে পারছে কানেকশনগুলো সব মেজর জলিলের। সে কিছু না–নোবডি। লিবিয়ার কানেকশন, ইরাকের কানেকশন, ইন্ডিয়ান কানেকশন। সিরাজুল আলম খানের ইন্ডিয়ান কানেকশন চিত্তরঞ্জন সুতারের মাধ্যমে। আর দিল্লি থেকে ডাইরেক্ট মেজর জলিলের কাছে চলে আসে।

মহি : দিল্লিতে কানেকশন কার সঙ্গে?

মজিদ : মেজর জলিলের কানেকশন কংগ্রেসের সঙ্গে।

মহি: আপনি যেভাবে বলেছেন, ইট এক্সপোজেস দ্য হিস্ট্রি। আমি মনে করি, পিপল শুড নো হোয়াট হ্যাঁজ বিন হ্যাঁপেনিং। এখন আপনি যদি বলেন, ৪০ বছর পরও এগুলো বলা যাবে না…?

মজিদ : না না না, বলা যাবে না, আমাকে তো মাইরা ফেলবে।

মহি: কে মারবে?

মজিদ : আপনি দেখেন নাই, মাহবুবের বইতে?

মহি : নায়েব সুবেদার মাহবুব?

মজিদ : সে লেখছে এই কথা।

মহি : খেয়াল নাই কী লিখেছে।

মজিদ: এই কথা লেখছে যে হি ক্যান কিল।

মহি: কাউকে মারাইছে এভাবে?

মজিদ: তা জানি না। তবে যারা মরে গেছে, তাদের কারও জন্য তাদের ফিলিংস ছিল না। আমার তো ধারণা, দলের নেতারাই তাদের লোকদের মৃত্যুর কারণ।

মার্শাল মনি, কাজী আরেফ, ইনু ওয়াজ নট দ্যাট ইম্পর্ট্যান্ট অ্যাট দ্যাট টাইম। একটা গ্রুপ মেনটেইন করত মার্শাল মনি–ভাওয়ালের ওহাব, আলী হোসেন–এরা ছিল তার ফলোয়ার। কাজী আরেফের ফলোয়ার ছিল ইমদুতারে দিয়া কৃষক লীগ করাইত। থানার কনফারেন্স করছিল গরু জবাই দিয়া। এরা গণবাহিনীর মাধ্যমে টাকা। কালেকশন কইরা তাদের কাছে ফান্ড প্লেস করত।

মহি: আলী হোসেনকে পরে ইমদু মারল না?

মজিদ: হ্যাঁ। আর ইমদুকে মারার চেষ্টা করছিল আজম, ঢাকা ইউনিভার্সিটির ওখানে। মানে মধুর ক্যানটিনে।

মহি : আজম তাকে মারতে চাইল কেন?

মজিদ: গ্রুপের ইন্ধনে?

মহি : আপনি তো বেশ আছেন?

মজিদ : বেঁচে আছি, এইটা অ্যাকসিডেন্ট। আমাকে ওই কেইসে ফাঁসি দেয় নাই–নেতাদের সঙ্গে বাইধা গেছে, আমি চুনোপুঁটি ২ অক্টোবরের (১৯৭৭) ঘটনায় আমাকে কুত্তার মতো খুঁজছে।

.

১৯৮৩ সালের শেষ দিকে জলিল জাসদের সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন। ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ নামে নতুন একটা দল তৈরির ঘোষণা দেন তিনি। পরে হাফেজ্জী হুজুরের নেতৃত্বে ১১টি ইসলামি দলের একটি জোট তৈরি হলে তিনি ওই জোটে যোগ দেন। রাজনীতিতে যে নাটকীয়ভাবে জলিলের উত্থান হয়েছিল, মাত্র এক দশকেই তার বিয়োগান্ত পরিণতি হলো।

.

১৯৮৪ সালে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাসদ আবার ভাঙে। সিরাজুল আলম খান উপজেলা নির্বাচনের পক্ষে মত দেন। সঙ্গে পান নূর আলম জিকু ও আ স ম আবদুর রবকে। কাজী আরেফ আহমদ, মির্জা সুলতান রাজা, শাজাহান সিরাজ, মনিরুল ইসলাম, হাসানুল হক ইনু, শরীফ নুরুল আম্বিয়া প্রমুখ নির্বাচন বর্জনের প্রস্তাব দেন। দলের একটি অংশ নিয়ে সিরাজুল আলম খান, রব, জিকু বেরিয়ে আসেন। আ স ম আবদুর রব ও নূর আলম জিকুকে দিয়ে জাসদের নতুন কমিটি বানান সিরাজুল আলম খান। বড় অংশটি রয়ে যায় এর বাইরে। এটাই ছিল জাসদে সিরাজুল আলম খানের শেষ অস্ত্রোপচার।

রাজনীতিতে হাসানুল হক ইনুর উত্থান সিরাজুল আলম খানের হাত ধরে। একসময় তিনি ঢাকার ফুটবল লিগে একটি ক্লাবের হয়ে খেলতেন গোলকিপার হিসেবে। ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। জাসদ নেতাদের বেশির ভাগই ‘হ্যান্ড-পিকড’। ইনু তাদের অন্যতম। ১৯৭২ সালে তাকে প্রথমে জাতীয় কৃষক লীগের সাধারণ। সম্পাদক বানানো হয়। তখন থেকেই দলের নেতৃত্বে দ্রুতগতিতে তার উত্থান। ঘটে। একপর্যায়ে এসে ১৯৮৪ সালে সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে তার রাজনৈতিক বিচ্ছেদ ঘটে। একদা গুরু সম্পর্কে তাঁর চাঁছাছোলা মন্তব্য উঠে এসেছে সমীক্ষণকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে।

প্রশ্ন : সিরাজুল আলম খান সম্পর্কে আপনার এ মুহূর্তের মূল্যায়ন কী?

উত্তর : জাসদের রাজনীতিতে তার কোনো স্থান নেই। উনি পদত্যাগ করেছেন এবং অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে স্বৈরাচারী এরশাদকে সমর্থন করেছেন।

প্রশ্ন : জাসদীয় ঐক্যের ব্যাপারে তার কি কোনো ভূমিকা আছে? কোনো যোগাযোগ হয়েছে?

উত্তর : তাঁর সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দলের যোগাযোগ করার প্রয়োজন নেই, উচিতও না।

প্রশ্ন : উনি তো আপনাদের রাজনীতিরও স্রষ্টা?

উত্তর : ছিলেন, এখন উনি বুদ্ধিজীবী হয়েছেন, আইজি এখন ওসি হয়েছেন–ওসির সঙ্গে কী কথা বলব? রাজনৈতিক নেতা ছিলেন উনি, সে দায়িত্ব ছেড়ে এখন উনি বুদ্ধিজীবী হয়েছেন।

প্রশ্ন : এগুলো তো অভিমানের কথা?

উত্তর : অভিমানের কোনো ব্যাপার নাই। উনি একটা প্রকাশ্য বিবৃতির মাধ্যমে কেবল দল ত্যাগই করেননি, যখন বাংলাদেশের রাজপথে ছাত্রদের রক্ত ঝরছে, তখন উনি প্রকাশ্য বিবৃতির মাধ্যমে রক্তের অবমাননাই শুধু করেননি–স্বৈরাচারের পক্ষাবলম্বন করেছেন। আপনি যে আদর্শেই বিশ্বাস করেন না কেন, মানবিক মূল্যবোধ তো থাকতে হবে।[১৪]

.

সিরাজুল আলম খান নতুন একটা পত্রিকা বের করলেন, পাক্ষিক মশাল। প্রকাশক-সম্পাদক ছিলেন আবুল হাসনাত (বাচ্চু)। তবে সবকিছু দেখতেন সিরাজুল আলম খান। তিনি মশাল অফিসেই বসতেন। পত্রিকাটি বের হতো দিলকুশার একটি অফিস থেকে। এটি একসময় একটি উর্দু পত্রিকার অফিস ছিল। স্বাধীনতার পর ভবনটি পরিত্যক্ত সম্পত্তি ঘোষণা করা হয়। এটি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) দিয়ে দেওয়া হয়। ভবনটি বাসসের প্রধান কার্যালয় হবে, এ রকম একটা চিন্তা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। বাসস ওটা ভাড়া দিয়ে দেয়। এখানেই ছিল মশাল অফিস। কয়েক বছর ভাড়া বাকি পড়েছিল। ১৯৯০ সালের গোড়ার দিকে বাসসের প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে যোগ দেন আমানউল্লাহ। তিনি বকেয়া ভাড়া আদায় করতে তৎপর হলেন। নোটিশ পাঠালেন। আমানউল্লাহর ভাষ্যে জানা যায় :

সিরাজুল আলম খান একদিন এলেন আমার অফিসে। আমি তাঁকে ভালো করেই চিনি। তিনি আমাকে যথেষ্ট রিগার্ডর্স দিলেন। চা-টা খেলেন। বললাম, পুরো ভাড়া না দিতে পারলেও অল্প কিছু দেন। কিছু না বলে উনি চলে গেলেন। মাঝরাতে হঠাৎ টেলিফোন। আমি তখন ঘুমানোর আয়োজন করছি। ফোন ধরলাম। অপর প্রান্তে প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ। বাড়িভাড়ার প্রসঙ্গ উঠল। উনি বললেন, এটা তো আমার কাগজ।’ বললাম, তাহলে তো আমাকে আরও সিরিয়াসলি টাকাটা আদায় করতে হবে। উনি তখন তথ্য মন্ত্রণালয়েরও দেখভাল করতেন। বললেন, এটা আর পারসু করার দরকার নাই। সবই বুঝলাম। সিরাজুল আলম খান আমাকে সরাসরি না বলে কাজী জাফরকে দিয়ে বলিয়েছেন। [১৫]

ওই সময় সিরাজুল আলম খান বেশ কয়েকটি চটি বই বের করেন। তাঁর মূল বিষয়বস্তু হলো, ৫০০ আসনের একটা পার্লামেন্ট হতে হবে, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। নিম্নকক্ষ হবে ৩০০ আসনের, যেখানে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা থাকবেন। ২০০ আসনের একটা উচ্চকক্ষ হবে পেশাজীবীদের প্রতিনিধিদের নিয়ে। তাঁর মতে, এ রকম একটা পার্লামেন্ট হলেই দেশের তাবৎ সমস্যার সমাধানের পথ খুলে যাবে। এটাকে তিনি বলছেন শ্রমজীবী-পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা। কীভাবে এটা হবে? সিরাজুল আলম খান ব্যাখ্যা করলেন তাঁর চিন্তাভাবনার কথা। এটাই হলো তার সাম্প্রতিকতম দর্শন :

আমরা যদি একটা রাজনৈতিক লাইন–পলিটিক্যাল থিসিস দাঁড় করাই–আমরা তো বলতামই, এটা একটা সোশ্যালিস্ট রেভলুশন হবে। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব না। বুর্জোয়াদের থেকে ক্ষমতাটা নিতে হবে। তবে অনেক ডেমোক্রেটিক আসপেক্ট কভার করতে হবে। ইফ উই আর নট ইন দ্য পাওয়ার, তাহলে গ্রু পলিটিক্যাল প্রোগ্রাম। এখন। পলিটিক্যাল প্রোগ্রামের মধ্য দিয়ে সেই ডেমোক্রেটিক কাজগুলোই। কিন্তু করছি। ওই যে, শ্রমজীবী-পেশাজীবীদের কর্তৃত্বমূলক আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি হয়। সোশ্যালিস্ট টেকওভার না হওয়া পর্যন্ত আমরা কী করব? যদি ৪০ বছর লাগে, কী করব এই ৪০ বছর? ২০ বছর। পরে কী করব? আমাকে তো বিয়ে করতে হবে, জমিজমা কিনতে হবে, আমার তো ফ্ল্যাট লাগবে, আমার ছেলেমেয়েকে তো লেখাপড়া। শেখাতে হবে, আমার তো ব্যাংক ব্যালান্স লাগবে। আমি চাই সোশ্যালিস্ট টেকওভার, এখন হচ্ছে না। তাই বলে এগুলো আমি করব না? এগুলো লাগবে তো? এই হলো আমার চিন্তা। সোশ্যালিস্ট টেকওভার, কিন্তু ইন দ্য প্রসেস, ডেমোক্রেটিক আর্জ এবং ডেমোক্রেটিক আসপেক্টস অব দ্য পিপল লেফট আনকেয়ার্ড, আনঅ্যাড্রেসড। সেগুলো অ্যাড্রেস করতে হবে প্রু পলিটিক্যাল প্রোগ্রাম। এর মধ্য দিয়ে ফোর্সেস অব সোশ্যালিস্ট রেভলুশন উইল ইমার্জ। সেখানে আমাকে আর সশস্ত্র ধারায় যেতে হবে না। আর্মড রেভল্যুশন লাগবে না। লিবারাল বুর্জোয়া সিস্টেমের মধ্য দিয়ে, লিবারাল ডেমোক্রেটিক সিস্টেমের মধ্য দিয়ে এটা গ্রো করে ফেলবে।

মার্ক্স সব সময় সোশ্যালিস্ট রেভলুশনের কথা বলতেন। ১৮৭১ সালে উনি প্যারি কমিউনকে সোশ্যালিস্ট রেভলুশন করতে বলেছিলেন। যদি না করতে পারেন, তখন কী করবেন? বা ১৮৪৮ সালে পর সব টেকওভার কি সোশ্যালিস্ট রেভলুশন হবে? উত্তর হলো, না। তাহলে সেগুলো কী? সেগুলোর যে ডেমোক্রেটিক আসপেক্টস ডাইরেক্টেড টুওয়ার্ডস সোশ্যালিস্ট রেভলুশন–এখন তার ক্রিটিকরা এগুলো বলতে চান যে এগুলো উনি নেগলেক্ট করেছেন। অ্যাড্রেস করেননি। তাঁরাই আবার বলছেন, ইন দ্যাট কেস, এঙ্গেলস ওয়াজ শারপার দ্যান মার্ক্স। এঙ্গেলস কিন্তু বলছেন ডেমোক্রেটিক আসপেক্টস অ্যাড্রেস করতে হবে আনটিল সোশ্যালিস্ট রেভলুশন টেকস ওভার।

তখনকার যুগে মধ্যস্বত্বভোগীরা, বিটুইন ওয়ার্কার্স অ্যান্ড বুর্জোয়া ভেরি লিটল। আর আজকের যুগে, দ্যাট ইজ রুলিং দ্য হোল ওয়ার্ল্ড। এই মধ্যবিত্তরা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের মধ্য দিয়ে, শৌর্য-বীর্যের মধ্য দিয়ে, উৎপাদন-বণ্টনের মধ্য দিয়ে, ইন এভরিথিং, এরাই কিন্তু মেইন ইকোনমিক মাইট হিসেবে কাজ করছে। বুদ্ধিবৃত্তিক দিকটাও। তাদের সঙ্গে না রেখে তুমি শুধু শ্রমিকদের দিয়ে সোশ্যালিস্ট টেকওভারের কথা বলবা, তাহলে এরা কোন দিকে যাবে? তারা তো সংখ্যার দিক। থেকেও বেশি, বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকেও বেশি। এমনিতে তারা তো থাকবে বুর্জোয়ার সঙ্গে। তাহলে তো এক হাজার বছরের মধ্যেও ওয়ার্কাররা বুর্জোয়াদের সরাতে পারবে না। বুর্জোয়াদের হলো বিত্তের দিকটা, আর মধ্যবিত্তের হলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিকটা, বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা। ওয়ার্কাররা কিছু হতে পারবে না। যদি এমন একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা হয়, যেখানে মধ্যবিত্ত-পেশাজীবীরা ও শ্রমজীবীরা যুক্তভাবে যদি রাজনৈতিক ক্ষমতা নেয়। এদের রোল যদি তুমি ঠিকমতো পিনপয়েন্ট না করো, তাহলে কম্বোডিয়ার মতো অবস্থা হয়ে যাবে। পলপট সৃষ্টি হবে। সে ১৫ লাখ মধ্যবিত্তকে গ্রামে পাঠিয়ে দিল–ওয়ার্কার হয়ে যাও। অল ওয়ার অ্যানিহিলেটেড।

আমার এখানে এত ডাক্তার, এত ইঞ্জিনিয়ার, এত শিল্পী সাহিত্যিক, এত বুদ্ধিজীবী, গুণীজ্ঞানীজন, শিক্ষা-সংস্কৃতির এত লোক–এদের কী করব আমি? তারা কি ওয়ার্কারদের আন্ডারে থাকবে? উইদাউট অ্যানি পলিটিক্যাল ফরমুলেশন? হোয়াট ইজ দ্য পলিটিক্যাল ফরমুলেশন? এখানে একটা পলিটিক্যাল টেকনোলজি ওয়ার্ক আউট করতে হবে।

সোশ্যালিস্ট রেভলুশনে এরা কোথায় অবস্থান করে? ১ লাখ ৫০ হাজার চিকিৎসক, ১ লাখ প্রকৌশলী, সাড়ে ৩ লাখ ডিপ্লোমা, ১০ লাখ শিক্ষক, সাংবাদিক ১৮ হাজার, সংস্কৃতিসেবী সোয়া ২ লাখ, কৃষিবিদ ১ লাখ ৬০ হাজার, ব্যাংক কর্মকর্তা ২ লাখ, আইনজীবী ২ লাখ, ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ১ লাখ, সরকারি কর্মচারী ১৪-১৫ লাখ, এনজিওরা ১ কোটি, দোকানমালিক, বিশেষজ্ঞ, প্রতিরক্ষা বাহিনী, কোথায় রাখবা তাদের? তুমি তাদের বলবা… শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে আসেন! এটা একটা কথা হলো? এটা হয়? এখন তো বাস্তবতা সম্পূর্ণ আলাদা।

বাট থিয়োটি স্ট্যান্ডস। ইভেন রিলিজিয়নকে নালিফাই করে তুমি সোশ্যালিস্ট টেকওভারে যেতে পারবে না। মানুষের মধ্যে যেটা আছে। এবং থাকবে, সেটাকে তুমি তো ইগনোর করতে পারো না। যেটা হওয়া উচিত না, সেটা হয়ে গেছে। সেটাকে তুমি অস্বীকার করতে পারো না। [১৬]

এই তত্ত্ব নিয়ে সিরাজুল আলম খান হলেন নিঃসঙ্গ পথের যাত্রী। অফিস নেই, দল নেই। মাঝেমধ্যে আ স ম আবদুর রবকে নিয়ে কিছু করার চেষ্টা করেন। সেটা হালে পানি পায় না। এর মধ্যে তিনি কথা বলার একটা জায়গা খুঁজে পেলেন, হোটেল শেরাটনের (ইন্টারকন্টিনেন্টাল) লবি। বিকেলে সেখানে যান। নানা ধরনের লোকজন আসে তার কাছে। টেবিল ঘুরে ঘুরে তিনি সবার সঙ্গে কথা বলেন। ওখানে চা-টা খাওয়া হয়। ভক্তরা দাম চুকিয়ে দেন। বাইরে অনেকেই কানাঘুষা করেন, গুজব ছড়ান, বাব্বা! শেরাটনে বসে রোজ মিটিং করে! কত না টাকা ওড়ায়! কোত্থেকে আসে এত টাকা?

এভাবেই চলছিল কয়েক বছর, বেগম খালেদা জিয়া তখন প্রধানমন্ত্রী। শেরাটনের যে কর্মচারী ইউনিয়ন, তাঁদের অনেকেই ছিলেন সিরাজুল আলম খানের ভক্ত। একদিন তারা ‘না’ করে দিলেন, এখানে আর বসা যাবে না, অসুবিধা আছে। বোঝা গেল, সরকারের লোকজন এটা পছন্দ করছে না। শেরাটনের আড্ডা বন্ধ হয়ে গেল।

সিরাজুল আলম খানের জীবনযাত্রা পাল্টে গেল। তিনি এখন শুধু লেখালেখি করেন। নিজে লেখেন না। ডিকটেশন দেন। বইপত্র ঘাঁটেন। বাঙালিদের মধ্যে নীরদ সি চৌধুরী তার প্রিয় লেখক। ধানমন্ডির ২৭ নম্বর সড়কে অক্সফোর্ড স্কুলে সন্ধ্যার পর বসেন। ওখানে লোকজন আসে, কথাবার্তা হয়। প্রতিবছর কয়েক মাসের জন্য বিদেশে চলে যান। বিশেষ করে নিউইয়র্কে। খুব শীত পড়লে ফিরে আসেন। এটা এখন তার রুটিন।

.

তথ্যসূত্র

১. উল্লাহ, মাহফুজ (২০১৬), পাঠকের চোখে জাসদ, মধ্যমা, ঢাকা, পৃ. ১৩১

২. মাহমুদুর রহমান মান্না

৩. উল্লাহ (২০১৬), পৃ. ১২২-১২৪

৪. বাসদ, সর্বহারা শ্রেণীর দল গঠনের সমস্যা প্রসঙ্গে, ২০১১, পৃ. ৪

৫. ‘শেখ মুজিবের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে, মহিউদ্দিন আহমদ, গণকণ্ঠ, ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮০

৬. আহমদ, মহিউদ্দিন (২০১৬), বিএনপি: সময়-অসময়, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, পৃ. ১৭৯-৮১

৭. বুলেটিন, ফেব্রুয়ারি-মার্চ ১৯৮৩, পৃ. ৬

৮. এস এম ইউসুফ

৯. বুলেটিন, পৃ. ১৪

১০. আহমদ (২০১৪), পৃ. ২৫২-২৫৪

১১. জলিল, মেজর এম এ (১৯৮৩), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের জাতীয় কমিটির সদস্যদের প্রতি, পৃ. ৮-১৩

১২. ওই, পৃ. ২৫-২৬

১৩. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

১৪. সমীক্ষণ, ১৯৯১

১৫. আমানউল্লাহ

১৬. সিরাজুল আলম খান

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *