অপূর্ব সংসদ
অধ্যাপক আহমদ শরীফের নানান লেখা ও চিঠিতে শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুল আজিজ বাগমার, আল মুজাহিদী প্রমুখ ছাত্রলীগ নেতার উল্লেখ থাকলেও সিরাজুল আলম খানের প্রসঙ্গ নেই। বরং আহমদ শরীফের লেখা থেকে জানা যায়, ঢাকা জেলা ছাত্রলীগের একসময়ের সভাপতি আবদুল আজিজ বাগমার স্বাধীন বাংলাদেশের কথা ভাবতেন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে বাগমার স্বাধীনতার তিনটি ইশতেহার প্রকাশ করেছিলেন। তৈরি করেছিলেন ‘অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার। সংক্ষেপে ‘অপূর্ব সংসদ’। এর জন্মকাহিনি বেশ চমকপ্রদ।
পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা ‘যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আইয়ুব খান তার ক্ষমতা গ্রহণের দুই মাসের মধ্যেই একটি বড় কাজে হাত দেন। সরকারের শিক্ষাসচিব এস এম শরিফের নেতৃত্বে কমিশন অন ন্যাশনাল এডুকেশন নিয়োগ দেওয়া হলো ৩০ ডিসেম্বর ১৯৫৮। দেশের সেরা শিক্ষাবিদদের অনেকেই কমিশনের সদস্য হলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন। রাজিউদ্দিন সিদ্দিকী (সদস্য, পাকিস্তান পরমাণু শক্তি কমিশন), কর্নেল এম কে আফ্রিদি (উপাচার্য, পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়), বি এ হাশমি (উপাচার্য, করাচি বিশ্ববিদ্যালয়), মমতাজ উদ্দিন আহমদ (উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়), এ এফ এম আবদুল হক (চেয়ারম্যান, পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড), এ এফ এ হুসেন (অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), এ রশিদ (অধ্যক্ষ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ঢাকা), আর এম ইউয়িং (ফোরম্যান, ক্রিশ্চিয়ান কলেজ, লাহোর), কর্নেল মোহাম্মদ খান (পরিচালক, আর্মি এডুকেশন কোর) এবং ব্রিগেডিয়ার এস হামিদ শাহ (ডাইরেক্টর অব অর্গানাইজেশন, সেনাসদর)। এটিই পরে শরিফ কমিশন নামে পরিচিতি পায়। [১]
শরিফ কমিশনের খসড়া প্রতিবেদন প্রেসিডেন্টের দপ্তরে জমা পড়ে ২৬ আগস্ট ১৯৫৯। প্রায় সাড়ে তিন শ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবগুলোর মধ্যে ছিল বিএ পাস কোর্স দুই বছরের পরিবর্তে তিন বছর করা, কোনো একটি বিষয়ে ন্যূনতম ৪০ শতাংশ এবং সব বিষয় মিলিয়ে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ নম্বর পেলে পরীক্ষায় পাস হওয়া, প্রাথমিক শিক্ষা হবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত, কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া ইত্যাদি।
শরিফ কমিশনের প্রতিবেদন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। ১৯৬২ সালের ১ মার্চ দেশ থেকে সামরিক শাসন তুলে নেওয়া হয়। শুরু হয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন। রাজনৈতিক দলগুলো তখন অনেকটাই হতোদ্যম এবং নিষ্ক্রিয়। অনেকেই মামলা এড়াতে স্বেচ্ছানির্বাসনে গেছেন। আন্দোলনের নেতৃত্বে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্ররা। অনুঘটকের ভূমিকায় ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। তাদের যৌথ নেতৃত্বেই পরিচালিত হচ্ছিল শিক্ষা আন্দোলন’।
শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে বিভিন্ন কলেজের ছাত্রনেতাদের নিয়ে ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৈরি হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফোরাম। ঢাকার জগন্নাথ কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি আবদুল্লাহ ওয়ারেস ইমাম এবং নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজের ছাত্রনেতা আবদুল আজিজ বাগমার ছিলেন যথাক্রমে এর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। ১৯৬২ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। নারায়ণগঞ্জের একটি ছাত্রসভায় সমবেত সবাই শপথ নেন যে বিজয় ছাড়া কেউ নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যাবেন না। তারা আরও শপথ নেন যে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করতে হবে। ছাত্রদের মধ্যে এ ধরনের উচ্চারণ এর আগে শোনা যায়নি। আবদুল আজিজ বাগমারের ভাষ্যমতে :
১৯৬২ সালে এ ধ্বনিটি বা স্লোগানটি আমিই উচ্চারণ করেছিলাম। আমি ছিলাম সভার শেষ বক্তা। সবাই উচ্চ কণ্ঠে স্বাধীনতার পক্ষে ধ্বনি প্রদান করে।
তখনকার পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের মৌলিক গণতন্ত্রী চিফ হুইপ এম এ জাহের তাদের নেতাদের সঙ্গে আট দিন সলাপরামর্শ করে আবিষ্কার করল, আবদুল আজিজ বাগমার দেশদ্রোহের ধ্বনি উচ্চারণ করেছে।…অতএব ঘটনার ৯ দিন পর দৈনিক আজাদ পত্রিকায় আমার বিরুদ্ধে জঘন্য অভিযোগ উত্থাপন করল–বাগমার বন্দে মাতরমধ্বনি দিয়েছে, আল্লাহু আকবর দেয়নি। আমি তার প্রতিবাদ করলাম। দৈনিক ইত্তেফাক আমার বক্তব্য
সম্পূর্ণটা ছেপেছিল ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৬২ সালে। [৩]
শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে ১৭ সেপ্টেম্বর (১৯৬২) প্রদেশব্যাপী হরতাল ডাকা হয়। ওই সময় দেশবাসীর প্রতি ছাত্রসমাজের ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে পল্টনের জনসভায় ভাষণ দিচ্ছেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। পেছনে প্রথম সারিতে আবুল হাসনাত ও কাজী জাফর আহমদ, দ্বিতীয় সারিতে সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, পেছনে দাঁড়ানো সিরাজুল আলম খান ‘আহ্বান’ শিরোনামে ‘পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামী ছাত্রসমাজ’-এর নামে একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয়। [৪]
আন্দোলনের পক্ষে কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানিয়ে এক বিবৃতিতে সই দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাধারণ সম্পাদক এনায়েতুর রহমান, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফোরামের সভাপতি ও জগন্নাথ কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি আবদুল্লাহ ওয়ারেস ইমাম, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এবং তোলারাম কলেজের সংসদপ্রধান আবদুল আজিজ বাগমার, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফোরামের সহসম্পাদক ও ইডেন কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমা রহমান, কায়েদে আজম কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক এম এ সাত্তার, পি সি কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক এস এম এ সবুর, কারমাইকেল কলেজের আনিসুর রহমান, ভিক্টোরিয়া কলেজের মো. রফিকুল ইসলাম, ঢাকা সিটি নাইট কলেজের সাখাওয়াত হোসেন, কুষ্টিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার আমিনুল হক, পাবনা কলেজের কাজী আবদুস শহীদ, মহিউদ্দিন আহমদ প্রমুখ। [৫]
বাষট্টির আন্দোলন শেষ হওয়ার পর ছাত্র ফোরামের নেতারা ইডেন কলেজের নাজমা রহমানের বাবার বাসায় এক গোপন বৈঠকে জাতীয় প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের বিষয়ে আলোচনা করেন ও সিদ্ধান্ত নেন। ‘কেউ কেউ শপথনামায় রক্তস্বাক্ষর প্রদান করেন। একজন শুধু ওয়াকআউট করেন। তিনি মতিয়া চৌধুরী।’ এভাবেই জন্ম হলো নতুন সংগঠন–’অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার’, সংক্ষেপে ‘অপূর্ব সংসদ’। দিনটি ছিল ১ অক্টোবর ১৯৬২। তাঁদের লেখা বিভিন্ন ইশতেহার ও পুস্তিকায় সংগঠনের নাম হিসেবে সংক্ষেপে লেখা হতো ‘অপু’। তারা একটি সরকারকাঠামোও ঠিক করেছিলেন, যেমন :
রাষ্ট্রপতি : বেগম সুফিয়া কামাল
প্রধানমন্ত্রী : আবদুল আজিজ বাগমার
উপদেষ্টা : অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই
অধ্যাপক শওকত ওসমান
অধ্যাপক আহমদ শরীফ
অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী [৬]
অপূর্ব সংসদের মনোগ্রাম এঁকে দিয়েছিলেন শিল্পী প্রাণেশ কুমার মন্ডল। বাগমারের দাবি, বিষয়টি যারা জানতেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ও অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। এ ছাড়া রাজনীতিবিদদের মধ্যে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ বিষয়টি জানতেন। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলগাড়িতে ইন্টার ক্লাসে স্বাধীনতার প্রচারকাজে অংশ নিতেন হাবিবুর রহমান, বাবু সারওয়ার, এ কে এম এ রফিক, নজরুল ইসলাম (মিনা), ফরিদা আক্তার, মনিরুল ইসলাম, আবদুল আউয়াল, লাল মিয়া, শহীদ, মেঘনাদ চন্দ, শান্তিনারায়ণ ঘোষ, কমরউদ্দিন (মন্টু), কামালউদ্দিন আহমদ, আখতারুজ্জামান (মনু), খাজা মহিউদ্দিন, এম এ খালেক, মুক্তা, মতি, মো. আলী, কুতুবউদ্দিন আকসির প্রমুখ। [৭]
বাগমার ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। তার রুমমেট ছিলেন শেখ রিয়াজউদ্দিন, রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ ও খন্দকার মোশারফ হোসেন। এ ছাড়া সিরাজুল আলম খান, আল মুজাহিদী, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুস সোবহান এবং রকিবউদ্দিন আহমদ মাঝেমধ্যে ওই কামরায় আসতেন এবং থাকতেন। তাঁরা সবাই বাগমারের গোপন কার্যকলাপের ব্যাপারে অবহিত ছিলেন বলে বাগমারের ভাষ্যে জানা যায়। এ সময় বাগমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ও অপূর্ব সংসদের উপদেষ্টা মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকারের জন্য স্বাধীনতার পক্ষে কিছু লিখে দেওয়ার অনুরোধ করলে তিনি বাঙালী কি চায়? স্বাধীনতা’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখে দেন। লেখাটি ‘অপু-১’ ইশতেহার হিসেবে ২১ ডিসেম্বর ১৯৬৩ প্রচার করা হয়। এই লেখার একটি অংশ ছিল এ রকম :
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য, সর্বনাশা প্যারিটি, স্থানান্তরিত রাজধানী ঢাকায় না হওয়ায় তীব্র ক্ষোভ, ক্ষমতার সকল উৎস পিন্ডিতে কেন্দ্রীভূত করা, সরকারি চাকরি ও সামরিক বাহিনীতে বাঙালিকে দাসের মর্যাদা প্রদান প্রভৃতি কারণে বাঙালি স্বাধীনতা দাবি করবে এটাই যুক্তিসঙ্গত। [৮]
বাঙালি চায় স্বাধীনতা। ১৯৬৪ সালের ১ জানুয়ারি বাগমার অপূর্ব সংসদের মনোগ্রাম নিজেই লেখেন অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকারের।
দ্বিতীয় ইশতেহার, ‘অপু-২’। শিরোনাম দেন ‘শকুন-শৃগালের আবার বাংলা আক্রমণ’। ছদ্মনামে এটি প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক আহমদ শরীফ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপূর্ব সংসদের অন্যতম সমন্বয়কারী শান্তিনারায়ণ ঘোষ। ঢাকার ৫৫ পাতলা খান লেনে অবস্থিত কাজী হারুন-অর-রশিদের মালিকানাধীন মোনালিসা প্রেসে এটি ছাপানো হয়। ইশতেহারের শুরুতে বলা হয় :
বাংলার ওপর অত্যাচার করে সবাই আনন্দ পায়। কারণ এতে তাদের সম্পদ বৃদ্ধি পায়। শক, হুন, মোগল, পাঠান, পাল, সেন এবং ইংরেজ শতাব্দীর পর শতাব্দী বাংলার ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। বাংলাকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস পেয়েছে। কিন্তু পারেনি। বাংলা নিজেকে বিসর্জন দিয়ে দানের আনন্দ পেয়েছে বারবার। কিন্তু আর কত দিন? [৯]
অপূর্ব সংসদের তৃতীয় ও শেষ ইশতেহারটি ১ অক্টোবর ১৯৬৫ প্রকাশ করা হয়। এটি লিখে দিয়েছিলেন অধ্যাপক আহমদ শরীফ। বাগমার এর প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন এভাবে :
ড. আহমদ শরীফ সাহেবের নিকট নিয়মিত অনুরোধ করতে থাকি। অতঃপর মে মাসে ‘অপু-৩ ইতিহাসের ধারায় বাঙালী’ স্বাধীনতার তৃতীয় ও চূড়ান্ত ইশতেহারের মূল কপি আমার নিকট হস্তান্তর করেন। তিনি নির্দেশ প্রদান করেন, দ্রুত কপি করে মূল কপি ফেরত দেওয়ার জন্য।…
ড. আহমদ শরীফ ওই দুঃসময়ে শতভাগ বিশ্বাস করেছিলেন। এর সকল কৃতিত্ব কেবল তাঁর। তবে ওই বিশ্বাসে কখনো ফাটল ধরেনি। অটুট ছিল।
সুলতানা কামালকে দিয়ে দ্রুত কপি করালাম। অন্যদের দেখতে দিলাম 1…ইতিমধ্যে উপদেষ্টামণ্ডলী দেখা সম্পন্ন করলেন।
মুদ্রণের জন্য একজন বিশ্বস্ত প্রেস মালিককে দেওয়া হলো। নাম কাজী হারুন-অর-রশিদ। মোনালিসা ফাইন আর্ট অ্যান্ড প্রিন্টিং প্রেস, ৫৫ পাতলা খান লেন, ঢাকা।…
অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার (অপূর্ব সংসদ) আর বিলম্ব করেনি। ১ অক্টোবর ১৯৬৫ সাল আমাদের অপু-৩ ইতিহাসের ধারায় বাঙালী বাংলাদেশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা প্রকাশিত হলো। রাষ্ট্রপতি কবি বেগম সুফিয়া কামাল ও প্রধানমন্ত্রী আবদুল আজিজ বাগমারের সংক্ষিপ্ত নামে স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণাপত্র প্রকাশিত হয়।
দ্রুত প্রেসক্লাবের নিচের তলায় উত্তর-পূর্ব কক্ষে যেখানে সকল পত্রিকার ফাইল পড়ার জন্য ছিল, তাতে বেশ কিছু কপি রাত ১১টায় রেখে আসা হলো। ওখানে তখন কেউ ছিল না। ইত্তেফাক এর প্রধান সাংবাদিকদের কপি দেওয়া হলো। হাইকোর্ট বারে পৌঁছানো হলো।…ঢাকাস্থ আদমজী কোর্টে অবস্থিত মার্কিন কনস্যুলেট অফিসে কপি দেওয়া হলো। তবে দুই ঘণ্টার মধ্যে পাক গোয়েন্দারা এই কপি পেয়ে যায়। এমনটা হতে পারে, এ আশঙ্কা আমাদের ছিল।
দেওয়া হলো সেগুনবাগিচায় অবস্থিত ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনে। সম্ভবত ক্ষিতীশ সেন বা সেন বলে একজন ছিলেন। চীনসহ অন্যদের কপি দেওয়া হলো। [১০]
অপু-৩ ইশতেহারটি ছিল পাঁচ পর্বে বিভক্ত। সূচনাপর্বে আহমদ শরীফ লিখলেন, “আমরা এ দেশেরই জলবায়ু ও মাটির সন্তান। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই এ দেশের মাটির পোষণে, প্রকৃতির লালনে এবং মানুষের ঐতিহ্যধারায় আমাদের দেহ-মন গঠিত ও পুষ্ট। আমরা আর্য নই, আরবি, ইরানি কিংবা তুর্কিস্তানিও আমরা নই। আমরা এ দেশেরই অষ্ট্রিক গোষ্ঠীর বংশধর। আমাদের জাত আলাদা, আমাদের মনন স্বতন্ত্র, আমাদের ঐতিহ্য ভিন্ন, আমাদের সংস্কৃতি অনন্য। আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ। ভাষার নাম বাংলা। তাই আমরা বাঙালী।’ ইশতেহারটি শেষ করা হয়েছিল জাতীয় সংগীত কী হবে, তার ইঙ্গিত দিয়ে। শেষ অনুচ্ছেদটি ছিল এ রকম :
অতএব যে অর্থনৈতিক কারণে হিন্দুবিদ্বেষ জেগেছিল এবং ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতিগত স্বাতন্ত্রের জিগির তুলে আর্থিক সুবিধার জন্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত, আজ আবার সেই অর্থনৈতিক কারণে অর্থাৎ শোষণের ফলেই বাঙালী স্থানিক, ভাষিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্রের ভিত্তিতে স্বাধীনতা দাবি করবে এ-ই তো স্বাভাবিক। অন্তত ইতিহাস তো তাই বলে।
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস,
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।
মন পদার্থটি মিলনের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে, আর বিরোধের স্পর্শে জেগে ওঠে। [১১]
‘ইতিহাসের ধারায় বাঙালী’ নিবন্ধটি ১৯৭০ সালে আহমদ শরীফ। সংকলিত স্বদেশ অন্বেষা গ্রন্থে ছাপা হয়েছিল। ২০১৩ সালে বাঙলা বাঙালী বাঙলাদেশ গ্রন্থে এটি সংকলিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের একটি সারসংক্ষেপ পাওয়া যায় আহমদ শরীফের লেখা ‘বিশ শতকে বাঙালী নামক আরেকটি প্রবন্ধে। এখানে তিনি লেখেন :
উঠতি শিক্ষিত বাঙালী আশাভঙ্গে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল ১৯৫৭-৫৮ সনেই; কোনো কোনো সাংসদ রাজনীতিক স্বায়ত্তশাসন দাবির স্বপ্নও দেখেছিলেন। ভাষার দাবিতে প্রগতিশীলদের আন্দোলন ও ক্ষোভ ক্রোধ ক্রমেই শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে তাল রেখে তীব্র হতে থাকল। এ সময় ১৯৬৫ সনে আবদুল আজিজ বাগমার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এক ছাত্র স্বাধীনতার স্বপ্ন ও সাধ। বাস্তবায়নের জন্যে ছাত্র ও নেতা হিসেবে পন্থা আবিষ্কারে ও উপায় উদ্ভাবনে সক্রিয়ভাবে গোপনে কাজ শুরু করলেন। ঢাকার কিছু শিক্ষককে করলেন উপদেষ্টা। পরে ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতি হয়েই শেখ মুজিবুর রহমান দাবি জানালেন অভীকচিত্তে ছয় দফা পূরণের। এর কিছু পরে মোয়াজ্জেম হোসেন প্রমুখ কিছু সামরিক বিভাগের বাঙালী সেনানী আগরতলা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কিংবা অন্যভাবে স্বাধীনতা অর্জনে প্রয়াসী হলেন। [১২]
.
২
ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (১৯৬১-৬৩) শেখ ফজলুল হক মনি অপু-৩ ইতিহাসের ধারায় বাঙালীর ভাষ্য নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন। ওই নিবন্ধে দুজন নেতার সমালোচনা ছিল। যে নাম দুটি নিয়ে শেখ মনির আপত্তি ছিল, তারা হলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরেবাংলা ফজলুল হক। এর একটি অংশ ছিল এ রকম, বাঙালীর থেকে সংখ্যাসাম্য নীতির স্বীকৃতি আদায় করে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে একক প্রদেশ গঠন করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাঙালীর যে ক্ষতি করেছেন তার তুলনা বিরল।’ অন্য অংশটি ছিল : রাজনীতি ক্ষেত্রে ফজলুল হকের সুবিধাবাদ নীতি বাঙালী রাজনৈতিক কর্মীদের করেছে আদর্শভ্রষ্ট ও চরিত্রহীন। স্বার্থান্বেষী জনপ্রতিনিধিরা আজ এ দলে, কাল ও দলে থেকে দেশের গণমানুষের ও গণচরিত্রের যে ক্ষতিসাধন। করেছেন, তা আমাদের উত্তরপুরুষের কালেও পূরণ হবে কি না সন্দেহ।১৩
পরে ইশতেহার থেকে ওই দুটি অংশ বাদ দেওয়া হয়। অধ্যাপক আহমদ শরীফও এটা মেনে নেন। তিনি শেখ মনির আপত্তি সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন, যদিও পুরো লেখাটিই পরে তাঁর স্বদেশ অন্বেষা এবং বাঙলা বাঙালী বাঙলাদেশ বইয়ে সংকলিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, বাগমারের মতো মনিও। সরাসরি তার ছাত্র ছিলেন। মনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকাকালে আহমদ শরীফকে একাধিক চিঠি পাঠিয়েছিলেন এবং এগুলোর জবাবও পেয়েছিলেন। চিঠির ভাষা পড়লে বোঝা যায়, তাঁদের মধ্যকার সম্পর্ক কত গভীর ছিল। এখানে একটি চিঠি উদ্ধৃত করা হলো :
শ্রদ্ধাস্পদেমু
আমার সালাম জানবেন। আপনার ২১.৪.৬৭ তারিখে লেখা চিঠিখানা পেয়েছিলাম। ইচ্ছে করেই আর লিখিনি। এবার পরীক্ষা দিয়েছিলাম আইনের। উত্তীর্ণ হয়েছি। আশীর্বাদ করবেন। এখানে কোনো কিছুরই অভাব বোধ করি না। জীবনটা সহনীয় হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে কিছু বই খাতার অভাবই বিপদে ফেলে দেয়। কারও কাছেই চাইতে ইচ্ছে। করে না। ভয় হয়, যদি অস্বীকার করে বসে। তাই আপনার কাছে লিখলাম। পছন্দমতো কয়েকখানা বই পাঠাবেন।
ইতি
স্নেহধন্য মনি
পুনশ্চ : ডাকযোগে পাঠালেই আমি পাব।[১৪]
শেখ ফজলুল হক মনি
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার
২১.৪.১৯৬৮
অপু-৩ ইশতেহারে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাদেশ’ নামকরণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। অধ্যাপক আহমদ শরীফকে এর কৃতিত্ব দিতেই হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে উল্লেখ করার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে একটি দূরবর্তী রূপকল্পের আভাস পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান (সাবেক প্রধান বিচারপতি) বলেন :
পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত সম্পর্কে ড. আহমদ শরীফ অপুর তৃতীয় ইশতেহার ‘ইতিহাসের ধারায় বাঙালী’তে বলেন, জাতীয় সংগীত হচ্ছে বল, বীর্য, প্রেরণা ও আদর্শের উৎস। আমাদের সেই জাতীয় সংগীত রচিত হয়েছে জনগণের অবোধ্য ফারসী ভাষায়। অধিকাংশ পাকিস্তানিদের প্রাণের যোগ নেই যে-কওমী সংগীতের সঙ্গে।’ ইশতেহারের শেষাংশ ছিল ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।’ অপূর্ব সংসদের প্রচেষ্টায় গানটির প্রচারে ব্যাপ্তি ঘটে। [১৫]
অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাগমারের ভর্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বাগমার ২ নভেম্বর ১৯৬৭ লন্ডনের পথে ঢাকা ছাড়েন। আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা ও সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে। তাঁকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়ানো হয়। লন্ডনে বাঙালি ছাত্ররা ‘শেখ মুজিব ডিফেন্স ফান্ড’ তৈরি করেন। বাগমার এর সঙ্গে যুক্ত হন। এর উদ্যোক্তা ছিলেন জাকারিয়া খান চৌধুরী ও সুলতান মোহাম্মদ শরীফ। ৭ এপ্রিল ১৯৬৯ লন্ডনের দ্য টাইমস-এর প্রথম পাতায় তাদের একটি মিছিলের ছবি ছাপা হয়েছিল। মিছিলে বাগমারের হাতে ছিল একটি সচিত্র পোস্টার। তাতে লেখা ছিল, ‘ইস্ট পাকিস্তান ফর ইস্ট পাকিস্তানিজ’।
১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব কারামুক্ত হন। অক্টোবরে তিনি লন্ডন গিয়েছিলেন। বাগমারকে টেলিগ্রাম করে তিনি তাঁর সফরসূচি জানিয়েছিলেন। টেলিগ্রামে লেখা ছিল :
ABDUL AZIZ BAGMAR, EAST PAKISTAN HOUSE
91 HIGHBURY HILL LONDON N5
REACHING LONDON SUNDAY TWENTY SIXTH BY
PK 719 INFORM OTHER FRIENDS
SHEIKH MUJIBUR RAHMANG [১৬]
শেখ মুজিব লন্ডন পৌঁছান ২৬ অক্টোবর ১৯৬৯। তার সঙ্গে ছিলেন মেয়ে শেখ হাসিনা ও জামাতা ড. ওয়াজেদ মিয়া। বিমানবন্দরে তাঁদের অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত ছিলেন সুলতান মোহাম্মদ শরীফ, জাকারিয়া চৌধুরী, আবদুল আজিজ বাগমার ও তার হবু স্ত্রী আতিয়া।
বাগমার লন্ডনেই ছিলেন বেশ কিছুদিন। তিনি আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য কমিটিতে যুক্ত হন। পরে সস্ত্রীক ঢাকায় ফিরে আসেন। তাঁরা তাজউদ্দীন আহমদের ধানমন্ডির বাসার দোতলা ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকতেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে ৯ মাস কারাগারে ছিলেন। বাংলাদেশ মুক্ত হওয়ার পর তিনি আবার লন্ডনে চলে যান।১৭ পরে দেশে ফিরে এসেছিলেন। ২০১১ সালের ১৭ এপ্রিল তিনি প্রয়াত হয়েছেন।
.
৩
আবদুল আজিজ বাগমার ছিলেন অধ্যাপক আহমদ শরীফের স্নেহধন্য। আহমদ শরীফকে তার মেন্টর বা গুরু বলা যায়। লন্ডন চলে যাওয়ার পরও চিঠিপত্রের মাধ্যমে গুরু-শিষ্যের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। চিঠির মাধ্যমে আহমদ শরীফ তাকে নানান পরামর্শ দিতেন।
১৯৬৭ সালের নভেম্বরে লন্ডনে যাওয়ার পর বাগমার আহমদ শরীফকে দুটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিগুলোর প্রাপ্তি স্বীকার করে আহমদ শরীফ তাঁর ফুলার রোডের বাসা থেকে ২৩ নভেম্বর বাগমারকে একটি চিঠি পাঠান। চিঠিতে তিনি বলেন, “তুমি ওদেশের লোকের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছ, টিলা ও নদী দেখতে অভ্যস্ত মানুষ যখন পর্বত ও সমুদ্র দেখে, তখন তার বিস্ময় না জেগে পারে না। আমাদের দেশি লোকের রুচি, সংস্কৃতি ও চরিত্র টিলা ও নদীর মতোই সীমিত। চিন্তা ও মননের বিকাশেই মানুষ বড় হয়। ওরা মানুষ হিসেবে জ্ঞানে, কর্মে ও চিন্তায় বড় হয়েছিল, তাই জাতি হিসেবেও বিশ্ববন্দ্য ও জগজ্জয়ী হয়েছিল। তাদের যেসব মানস-ঐশ্বর্যের কিছু আজও আছে–আমাদের মধ্যে আজও যা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা পুরোপুরি জাগেনি। [১৮]
কয়েক দিনের মধ্যে বাগমার তার প্রিয় শিক্ষককে আরেকটি চিঠি লেখেন। চিঠির ভাষ্য ছিল এ রকম:
২৯.১১.১৯৬৭
শ্রদ্ধেয় স্যার
আমার সালাম নেবেন। গতকাল আপনার প্রীতি ও শুভেচ্ছা’র প্রতীক আদর এবং স্নেহে সমৃদ্ধ লিপিখানা পেয়েছি। এবং গতকালই আমি নতুন বাড়িতে উঠেছি। তাই আর লিখতে পারিনি। এত দিন আমার এক শিক্ষক মহাশয়ের নিকট ছিলুম। গ্রেট বা নোবেলম্যান সর্বদাই, সব কালেই ছোটদের বা তরুণদের প্রেরণা এবং উৎসাহ দিয়ে থাকেন। আপনার পত্রেও তাই আছে। আশা করি ভবিষ্যতেও এমন পাওনা থেকে বঞ্চিত হব না। আপনার উপমা শুধু আমাকে নয়, সব কালের অধিবাসীকেই মুগ্ধ করবে।
আপনার বাণী চিত্ত ও মননের বিকাশেই মানুষ বড় হয়।’ ‘সেয়িংস অব গ্রেটম্যান’ হয়েই বেঁচে থাকবেন। আপনার টিলা ও নদী’ একদিকে আমাদের দেশের দৈন্যতার চিত্র উজ্জ্বল করেছে, অন্যদিকে তেমনি মানস-ঐশ্বর্য অর্জনের আকাঙ্ক্ষাকে প্রবলভাবে প্রেরণা যোগাচ্ছে। আশীর্বাদ করুন আমাদের দেশি লোকের রুচি, সংস্কৃতি ও চরিত্র টিলা ও নদীর মধ্যে সীমিত না থেকে পর্বত ও সমুদ্রের মতো হয়ে যেন বিশ্ববন্দ্য ও জগজ্জয়ী হয়। আপনার এবং আমাদের জীবৎকালে কি সেই সোনার বাংলা দেখতে পাব? আপনার সহানুভূতি কামনা করছি।…
আমরা এখানে বেশ ভালোভাবে ২১শে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপন করব (লন্ডনে)। বাঙালি’ কেন স্বায়ত্তশাসন চায়–এর উপর আপনার একখানা ছোট প্রবন্ধ হলে খুব ভালো হয়। আপনার ইচ্ছে অনুসারে প্রবন্ধটা আপনার নামে অথবা বেনামে পঠিত হবে। ওপারের বাঙালি ছেলেরাও থাকবে। প্রবন্ধখানা অবনী কুমার বর্মনকে দিয়ে কপি করিয়ে নেওয়া যাবে।…
আপনার স্নেহের
আজিজ [১৯]
আহমদ শরীফের কথাবার্তা এবং লেখাজোকায় বোঝা যায়, ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের প্রতি তাঁর আস্থা ছিল না। তিনি চাইতেন বাংলার স্বাধীনতা। একই সঙ্গে তিনি কমিউনিস্ট মতাদর্শের দিকে ঝুঁকেছিলেন। বাগমারের চিঠির জবাবে ৮ ডিসেম্বর ১৯৬৭ তারিখে তিনি লেখেন
‘আমার পক্ষে প্রবন্ধ লেখা সম্ভব হবে না। তুমি EPSU (পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন)-এর কোনো কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করো। তারা সেদিন যে সেমিনার করেছে তাতে এবং তাদের আয়োজিত প্রদর্শনীতে বৈষম্যের নানা তত্ত্ব ও তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। এ বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরলেই তোমার বক্তব্য স্পষ্ট ও সুপ্রমাণ হবে।’
কমিউনিজমের প্রতি আস্থা এবং এ ব্যাপারে বাগমারকে প্রণোদনা দিয়ে তিনি একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন মাস ছয়েক পর। চিঠিটি এখানে উদ্ধৃত করা হলো :
১৮ সি, ফুলার রোড
২.৬.৬৮
প্রিয়বরেষু,
তোমার পত্র পেলাম সুদীর্ঘ বিরতির পর। তোমার ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছিলাম বলে তোমার পাশের খবর তোমাকে জানাতে পারিনি। তোমার এ পত্র বহু তথ্য সমন্বিত। পড়ে খুশি হলাম।
আজকের পৃথিবী বিক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী। যুগের চাহিদা মিটাতে অর্থাৎ মানুষের অন্ন ও আনন্দের ভারসাম্য রক্ষা করতে যেসব রাষ্ট্র পারছে না বা পারবে না, সেসব রাষ্ট্রের জনগণ টাইম বম্ব বা আগ্নেয়গিরির মতো হয়ে আছে। যোগ্য নেতৃত্বে সামান্য কারণে আগুন জ্বলে উঠবে। যেমন দেখছ আজকের ফ্রান্সকে। ইংল্যান্ডেও বছর দু বছরের মধ্যে লাগবে রেস-রায়ট। যদি আর্থিক অবস্থা আজকের মতোই থাকে অথবা আরো অবনতি ঘটে—সব বহিরাগতকে তাড়াবে, যেতে না চাইলে মেরে-কেটে ইংলিশ চ্যানেলে ফেলবে। সমাজতন্ত্র ছাড়া কোনো গরীব দেশেই আজকের দিনে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব নয়। যদিও কমিউনিজম কোনোমতেই স্থায়ী সমাধান নয়, কেবল কালের ধারায় বিবর্তনের একটি স্তর মাত্র। সেজন্যেই গরীব দেশে কমিউনিজম ইজ আ মাস্ট।
যোগাযোগের ব্যাপারে অধ্যাপক আহমদ শরীফ সুবিবেচনার সঙ্গে এগোতে হবে। ফ্রান্সেও এর হাত আছে বলে মনে করি। ঢাকায় তুমি কাজে সফল হওনি। ওখানেও কোনো সুবিধে হবে বলে মনে করিনে, কেননা সর্বত্রই রীতি-নীতি দ্রুত বদলাচ্ছে। তবু চেষ্টা করে দেখতে পার। এ ব্যাপারে সেখানকার কারো পরামর্শ নিতে পার কিনা দেখ।
আমার প্রবন্ধের বই বিচিত চিন্তা বেরিয়েছে। খুব বিক্রি হচ্ছে–এটা আমি আশা করবার সাহসও পাইনি। অনেকেই তারিফ। করেছেন-নিন্দাও করবেন অনেকে।…
শুভার্থী
শরীফ
জনাব আবদুল আজিজ বাগমার প্রিয়বরেষু [২০]
বাগমারের ব্যাপারে অধ্যাপক আহমদ শরীফের স্নেহ ও আন্তরিকতার। সবচেয়ে বড় নিদর্শন হলো বিশ শতকে বাঙালিবইটি তার নামে উৎসর্গ করা। উৎসর্গলিপিতে তিনি লেখেন, ‘স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রয়াসে পথিকৃৎ আবদুল আজিজ বাগমার প্রিয়বরেষু।’ বাগমারকে তিনি সম্বোধন করেছেন ‘স্বাধীনতার স্বাপ্নিক’ বলে।[২১]
.
৪
রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ (পরে সাংবাদিক) একসময় নরসিংদী কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি ছিলেন। তিনি ছাত্রলীগ করতেন। তখন থেকেই তিনি বাগমারকে জানতেন। বাগমার তখন নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজের ছাত্রনেতা। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে তাঁরা এক কামরায় থাকতেন। স্মৃতির ঝাঁপি খুলে রিয়াজ উদ্দিন ওই সময়ের একটি বিবরণ দিয়েছেন :
আমি নরসিংদী কলেজে ভর্তি হলাম ১৯৬১ সালে। তখন ছাত্রলীগ ছাত্র ইউনিয়ন, এগুলি কিছুই হয় নাই। মার্শাল লর পর সব বিলুপ্ত। কলেজে মাঝেমধ্যে মিছিল হতো। বাষট্টিতে মার্শাল লর বিরুদ্ধে আন্দোলন। নরসিংদী তখন নারায়ণগঞ্জ মহকুমার একটা থানা। নারায়ণগঞ্জে তখন বাগমারের নেতৃত্বে একটা মিছিল হয়। সে তখন নারায়ণগঞ্জে ওয়েল এস্টাবলিশড। জোহা সাহেব, শামীম ওসমানের বাবা–উনি ছিলেন নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা। জোহা সাহেবকে কেন্দ্র করেই বাগমার পলিটিকস শুরু করে। তার সঙ্গে ছিল হাবিবুর রহমান, বাবু সারওয়ার। এদেরকে নিয়ে বাগমার নারায়ণগঞ্জে একটা মিটিং ডাকে। শিক্ষা আন্দোলনের সময় আমরা একসঙ্গে বসি, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে যাই।
বাষট্টি সনের শেষ দিকে হাতিরদিয়ায় একটা মিটিং দিল। রাজিউদ্দিন ভূঁইয়া, ওইখানকার জমিদার, মুসলিম লীগের নেতা। সেখানে যাবে সবুর খান, ওয়াহিদুজ্জামান, বশিরউদ্দিন মাজমাদার আর নারায়ণগঞ্জের এসডিও ড. সাত্তার। ওরা নরসিংদী আসার সাথে সাথে আমরা কালো পতাকা দেখিয়ে, ইট-পাটকেল, মারামারি শুরু হয়ে গেল। মুসলিম লীগের লোকেরা আমাদের লোকজনকে দিল এমন পিটুনি! ওরা হাতিরদিয়া চলে গেল।
আপেল মাহমুদ তখন নরসিংদী কলেজে পড়ে। ওর বাড়ি কুমিল্লা। কিন্তু ওর মা চাকরি করতেন নরসিংদীতে, ওখানেই সেটেল করেন। ওর ভাই শাহ আলম নরসিংদী কলেজে পড়ান। আমি আর আপেল নরসিংদী থেকে পালিয়ে বাবুরহাটের কাছে এসে মমিন কোম্পানির লাস্ট বাসে ঢাকায় গেলাম। ইত্তেফাক-এর সিরাজুদ্দীন হোসেনের সামনে বসলাম। আমাদের কাছ থেকে সারা দিনের ঘটনার বিবরণ নিল। আমাদেরকে চিঠি লিখে দিল, তোমরা ঢাকা হলে চলে যাও। ওখানে গিয়ে দেখি শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, শেখ ফজলুল হক। মনি, সিরাজুল আলম খান, ওবায়দুর রহমান–মানে ছাত্রলীগের টপ লিডারশিপ, পুরোটাই। ঢাকা হলে আসমত আলী সিকদার ছিল ভিপি। উনি আবার নরসিংদী কলেজের পার্টটাইম লেকচারার। আমরা ছাত্রলীগের মধ্যে ঢুকে গেলাম। আদর্শ-টাদর্শ না। আইসা গেছি, নেতা পেয়ে গেছি, আর কি।
তখন আমরা বাগমারের সঙ্গে ইন্টিগ্রেটেড হয়ে গেলাম। বাগমার বোধ হয় নারায়ণগঞ্জ ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট হয়েছিল। পরে তো আমরা ইউনিভার্সিটিতে চলে আসি। আমি আর বাগমার এস এম হলে থাকতাম। ওইখানে বাগমার পরে কেন যেন আর অ্যাকটিভ থাকল না। একদিন শুনলাম সে ব্যারিস্টারি পড়তে লন্ডন চলে গেছে। ছাত্ররাজনীতি থেকে তার ডিসট্যান্স হয়ে গেল। পরে। সে রাজনীতিতে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে অ্যাকটিভ হলো। তখনই সে মার্জিনালাইজড হয়ে গেল। মাঝে মাঝে দেখা হতো।২২ আবদুল আজিজ বাগমার সুধীজনের স্নেহ, ভালোবাসা ও সাহচর্য পেয়েছেন। তারা সমাজে অতি পরিচিত এবং দেশের চিন্তা ও মননের জগতে পুরোধা ব্যক্তিত্ব। বাগমারকে লেখা তাঁদের কয়েকজনের চিঠি ও নিবন্ধ থেকে এখানে উদ্ধৃত করা হলো :
মুহম্মদ আবদুল হাই, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
একালের ছেলেরা যদি ভবিষ্যতের নেতৃত্বদান করার মতো যোগ্যতা অর্জন না করে তা হলে আমাদের সমগ্র দেশের এবং বিশেষভাবে পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। তুমি বিলেত গিয়েছ ভালোই করেছ। এইটুকু মনে রেখো, এটা তোমার জীবনের ভবিষ্যৎ গতিপথের প্রস্তুতির কাল। এ ক’বছরে নিজেকে যেমনভাবে গড়ে তুলতে পারবে, তার ওপর নির্ভর করছে তোমার নিজের ভবিষ্যৎ এবং কিয়দংশে আমাদেরও ভবিষ্যৎ।
আল মুজাহিদী, কবি-সাংবাদিক
আমরা ভালোবাসি এই মাটি, মর্ত্য, মৃত্তিকা। আমরা আগুনের ভাষা দিয়ে লিখেছিলাম আগুনের ইস্তেহার। আমাদের শব্দপুঞ্জে উত্তীর্ণ হয়েছিল প্রথম রক্তিম পতাকাটি–স্বাধীনতার। আমার সুহৃদতম স্বাধীনতার সাগ্নিক পুরুষ আবদুল আজিজ বাগমার প্রকাশ করেছিলেন বাঙালির স্বাধীনতার অস্তিত্বের রসকীর্ণ পাণ্ডুলিপি। বাগমার আত্মগোপন করে থাকলেন, কারাবরণ করলেন দীর্ঘ সময়। কালের ধারায় কি এসব হারিয়ে যাবে? ইতিহাস পত্রে কি কোনো চিহ্ন থাকবে না? ডামাডোলে শুধু কেটে পড়বে কৃত্রিম, ভঙ্গুর, ঠুনকো, পলকা উপসর্গগুলো? না, ইতিহাস তো কেবল সত্যের মুখোমুখিই করে। নিজেকে।
খন্দকার বজলুল হক, অধ্যাপক
বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান
আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। থাকতাম সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। হলজীবনের শুরুতে বাস করতাম পশ্চিম ভবনের ৮৯ নম্বর কক্ষে। আমার রুমমেট ছিল তুখোড় ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ এবং খান আবদুস সোবহান। হলজীবনে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত লক্ষ করেছি বাগমারের সদাব্যস্ত জীবন। বাগমারের নিয়মিত কাজের মধ্যে অন্যতম ছিল সেসব বরেণ্য রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও বন্ধু সহযোদ্ধাদের সাথে দেখা করা এবং পরামর্শ গ্রহণ করা যারা তাকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছিল, যারা তাকে সেই লক্ষ্য অর্জনে কাজ করার জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যারা তাকে সেই লক্ষ্যে কাজ করতে সাহায্য আর সাহস যোগাত। সম্ভবত তার সেই লক্ষ্য অর্জনের দুঃসাহসী অভিযানে নতুন অভিযাত্রীর সন্ধান লাভ করাও ছিল তার নিরন্তর প্রচেষ্টার অংশ।
প্রাণেশ কুমার মন্ডল, শিল্পী
আমার শৈশব কেটেছে নারায়ণগঞ্জ শহরে। তখন থেকেই আবদুল আজিজ বাগমারের সঙ্গে পরিচয়। পরে ১৯৬৫ সালের শেষের দিকে বাগমারের সাথে পুনরায় কচি-কাঁচার সদস্য হওয়ার সুবাদে সাক্ষাৎ হয়। ওই সময়েই বাগমার তাদের পরিকল্পিত একটি প্রতীক নকশা ভালোভাবে এঁকে দেওয়ার জন্যে বললে তখন আমার অপরিণত হাতে একটি প্রতীক নকশা করে দিই। যার নকশাটি করেছিলাম তার নাম ছিল অপূর্ব সংসদ।
শান্তিনারায়ণ ঘোষ, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দিন তারিখ আমার এখন মনে নেই। তবে বাগমার সাহেবের বিশ্লেষণ এখনো আমার মনে পড়ে। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত অপূর্ব সংসদ পর পর তিনটি রিলিজ বের করে। প্রথম রিলিজ অনুযায়ী বাঙালি চায় স্বাধীনতা।’ প্রশ্ন ছিল এটা কীভাবে আসবে। জনগণকেই এ সংগ্রামে। সম্পৃক্ত করতে হবে। তার জন্য আস্তে আস্তে অগ্রসর হতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথেও যোগাযোগ রাখতে হবে। ১৯৬৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ব বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও’, ১৯৬৫তে অরক্ষিত পূর্ব বাংলা, ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দাবি, সব মিলে পূর্ব বাংলার জনসাধারণের মাঝে এক নতুন আশার সঞ্চার হলো। এ আশাকে আরেক ধাপ এগিয়ে নেওয়ার জন্য অপূর্ব সংসদ কিছু পদক্ষেপ নেয়। এর মাঝে ছিল বিদেশি দূতাবাসগুলোর সাথে যোগাযোগ করে পূর্ব বাংলার দাবির পক্ষে সমর্থন আদায় করা। এ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতি বছর কিছু ছাত্রছাত্রী পাকিস্তানে বেড়াতে আসত। অপূর্ব সংসদ এসব ছাত্রছাত্রীদের কাছে সংসদের দাবি-দাওয়া বিশ্লেষণ করত। এ রকম দুটো সভায় আমি উপস্থিত ছিলাম। বনগ্রাম লেনের এক বাড়িতে গোপনে এ বৈঠক হতো।
রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ষাটের দশকের সেই অন্ধকার দিনগুলিতে যেসব অকুতোভয় নিরস্ত্র ছাত্র সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, আমার স্নেহভাজন ছাত্র আবদুল আজিজ বাগমার তাদের অন্যতম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ শিক্ষকরূপে ষাটের দশকজুড়ে দলমত নির্বিশেষে পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে যেসব ছাত্র বা ছাত্রনেতা প্রকাশ্যে বা গোপনে, প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় ছিলেন, তাদের প্রায় সকলকেই ব্যক্তিগতভাবে জানার ও তাদের কার্যক্রম লক্ষ করার সুযোগ আমার হয়েছে। যারা প্রথম আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, স্বাধীনতার কথা ভেবেছিলেন, তাদের অনেকেই ঝরে গেছেন, অনেকের কথাই আমরা ভুলে গেছি।
বেগম সুফিয়া কামাল
স্বাধীনতার প্রচারের কাজ আমরা শুরু করেছিলাম। অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকারের (অপূর্ব সংসদ) অপু-৩ ইতিহাসের ধারায় বাঙালি স্বাধীনতার ৩য় ইস্তেহার আমার সংক্ষিপ্ত নামে প্রচার করেছিল ১৯৬৫ সালের ১লা অক্টোবর। এ কাজে ছেলেদের কঠিন ত্যাগ, কষ্ট স্বীকার আমাকে আনন্দ দিয়েছে। ওদের সঙ্গে কাজের প্রয়োজনে দেশের অনেক স্থানে সভা করেছি।[২৩]
.
৫
অপূর্ব সংসদের কার্যক্রম চলাকালে ছাত্রদের মধ্যে একটি সমান্তরাল চক্রের কথা জানা যায়। এটি হলো সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ আহমদের নেতৃত্বে একটি গোপন তৎপরতা, যাকে তাঁরা পরে ‘নিউক্লিয়াস’ নাম দিয়েছিলেন। প্রশ্ন হলো, দুটি প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিল কি না এবং তারা একে অপরের কাজ সম্পর্কে জানতেন কি না। আবদুল আজিজ বাগমারের ভাষ্যে জানা যায়, শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ ছাত্রনেতারা এ ব্যাপারে অবহিত ছিলেন। অপু-৩ ইস্তেহারটি শেখ মনির পরামর্শে পরিমার্জন করা হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে আমি সিরাজুল আলম খানের মুখোমুখি হয়েছিলাম। বাগমারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সিরাজুল আলম খানকে জিজ্ঞেস করায় তিনি আমাকে বলেন :
শুনেছি পরে। সে তো আমারে ধরায়া দিছে। এসবির এজেন্ট ছিল। রাজ্জাককেও সে ধরিয়ে দিয়েছিল। আই ওয়াজ দ্য লাস্ট ম্যান টু বি অ্যারেস্টেড ইন নাইনটিন সিক্সটি থ্রি। একসঙ্গে নিয়ে গেল হলে। ইঞ্জিনিয়ারিং হলে। ইঞ্জিনিয়ারিং হলগুলো তখন আন্ডার কনস্ট্রাকশন। সেখানে তার পরিচিত এক রুমে থাকলাম। অন ফোর্থ ডে…বুঝলাম সে কাজটা করিয়েছে। ভুল বোঝার কোনো কারণ নাই–করিয়েছে। আবার ভুলও হতে পারে। অন্য কোনোভাবে সে হয়তো, কেউ হয়তো তাকে ফলো করেছে। তারপর এখানে এসে আমাকে ধরল। এটা হতে পারে। এমনি খারাপ ছিল না। খুব সোশ্যাল, অ্যাকটিভ ছিল। [২৪]
অপূর্ব সংসদের ব্যাপারে সিরাজুল আলম খান পরে শুনেছেন বলে জানিয়েছেন। অপূর্ব সংসদের তিনটি ইশতেহার বেরিয়েছিল ২১ ডিসেম্বর ১৯৬৩ থেকে ১ অক্টোবর ১৯৬৫। এ সময়টির বেশির ভাগ অংশজুড়ে সিরাজুল আলম খান ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। সিরাজুল আলম খানদের গোপন উদ্যোগের কথা যেমন এই উদ্যোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বাইরে কেউ জানতেন না, তেমনি বাগমারের উদ্যোগের ব্যাপারেও এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কহীন লোকদের জানার কথা নয়। অপূর্ব সংসদ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সিরাজুল আলম খান বিরক্তি ও ক্ষোভ জানিয়েই ক্ষান্ত হননি, তিনি বাগমারের বিরুদ্ধে তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ এনেছেন। বিষয়টিকে হালকা করে দেখা যায় না। আবার তিনি এ-ও বলেছেন যে, এটা একটি সম্ভাবনা, হতে পারে। এটি এমন একটি মনস্তত্ত্ব, যা বাইরে থেকে বোঝা কিংবা ব্যাখ্যা করা কঠিন, যদি না অভিযোগকারী সুনিশ্চিত প্রমাণ উপস্থাপন করেন। অনুমানের ওপর নির্ভর করে একজনের ওপর এ ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য ওই ব্যক্তিকে জনসমক্ষে হেয়, এমনকি ধ্বংস করে দিতে পারে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেক অধ্যাপক এবং বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় অধ্যাপকদের অন্যতম আবদুর রাজ্জাক ভাষাশহীদ আবুল বরকত সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছিলেন, তা উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁর সহকর্মী শিক্ষক সরদার ফজলুল করিমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, আবুল বরকত পুলিশের চর (ইনফর্মার) ছিলেন। তিনি অবশ্য সরদার ফজলুল করিমকে এটি ছাপাতে নিষেধ করেছিলেন। নিষেধ না মেনে সরদার এটি সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ছেপে দেন। এ নিয়ে বেশ টানাপোড়েন তৈরি হয়েছিল। সাক্ষাৎকারটি যখন পরে গ্রন্থাকারে বের হয়, তখন এ তথ্যটি বাদ দেওয়া হয়েছিল। প্রশ্ন হলো, অধ্যাপক রাজ্জাকের দেওয়া এই তথ্যের কোনো বাস্তব ভিত্তি ছিল কি না। সাক্ষাৎকারে তিনি এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ হাজির করেননি এবং সরদারও। এ বিষয়ে জানতে চাননি। অধ্যাপক রাজ্জাকও একটি মিথ, এটি অনেকেই মনে করেন। এ বিষয়ে খোলাখুলি লিখেছেন অধ্যাপক আহমদ শরীফ। যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, অধ্যাপক রাজ্জাক যা বলবেন, তা-ই সত্য বলে মেনে নিতে হবে কি না। এ দেশে যে গুরুমুখী বা গুরুবাদী জ্ঞানচর্চা হয়, সেখানে গুরুর বচন শিষ্যরা বিনা প্রশ্নে মেনে নেন।
সিরাজুল আলম খানের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে বাগমারের নিজস্ব একটি ব্যাখ্যা আছে। যত দূর জানা যায়, ১৯৭১ সালের আগে সিরাজ শুধু একবারই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে। বাগমারও ওই সময় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। বাগমার অবশ্য একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আটক ছিলেন।
সিরাজুল আলম খানের গ্রেপ্তার সম্পর্কে বাগমার বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন। ওই সময় তিনি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলী সাইদুর রহমানের বাসায় থাকতেন। তখন তিনি এবং আরও অনেকেই পলাতক জীবন যাপন করতেন। সবার নামেই হুলিয়া। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলার মাঠে রাতের অন্ধকারে গোপন সভা করতেন। বাগমার গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে বলেন :
এই অবস্থায় সিরাজুল আলম খান আমার গোপন আস্তানায় আসার সংকেত পাঠালেন। তিনি আবু হেনা ভাইকে সাথে নিয়ে নিশীথে এসে উপস্থিত।
আমরা তখন ঘুমুচ্ছি। পাশের রাস্তায় ঠেলাগাড়ির স্ট্যান্ড ছিল। ঠেলাগাড়িওয়ালারা ঝগড়া করছে। হঠাৎ করে সব শান্ত হয়ে গেল। কোনো সাড়াশব্দ নেই। ভাবলাম এবার ঘুমুতে পারব।
বাংলার স্বাধীনতার প্রশ্নে যখন কোনো আলাপ-আলোচনা হতো, লক্ষ করে দেখেছি সিরাজুল আলম খানের স্পষ্ট মৌন সমর্থন উপস্থিত। এই দুর্বলতা ছিল আবদুর রাজ্জাকেরও।
ভোর রাতের কিছু পূর্বে হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করে। ফ্ল্যাটের দরজা ছিল একটি। আমরা সবচেয়ে উপরের তলায়। রান্নার একটি ছেলে ছিল। সে দরজা খুলে দিল। সামনে পুলিশ। ছেলে হতভম্ব। সে কোনো কথা বলছে না। পুলিশ জিজ্ঞেস করল, সাহেব কোথায়? কাজের ছেলেটি জবাব দিল, নাই’। ঘরে কে আছেন? ‘মেহমান’। তোমার মেহমানের সঙ্গে আমরা দেখা করব–বলেই পুলিশ দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করল। আমার ও সিরাজুল আলম খানের। ঘরে নক করতে থাকে। বিরামহীন নক। উভয়ে দরজা খুলে দিলাম। একাধিক পুলিশের লোক ঘরে প্রবেশ করল। একজন বললেন, এবার আমাদের মেহমান, চলুন। অনেক কষ্ট পেয়েছি। সবাইকে মেহমান বানিয়েছি। কেবল আপনারা দূরে ছিলেন। অগত্যা নিচে এসে দেখি সে কী কাণ্ড! পুরো এলাকা ঘেরাও দেওয়া। শত শত পুলিশ, সর্বত্র পুলিশ।
আমাদের দুজনকে আলাদা গাড়িতে উঠিয়ে রওয়ানা হলো। সকাল হওয়ার পূর্বেই গোয়েন্দা দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। আলাদা কক্ষে আমাদের অবস্থান নির্দিষ্ট করে দিন তিনেক জিজ্ঞাসাবাদ চলে। আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি প্রসঙ্গে প্রশ্ন। সব প্রশ্নের জবাব এমনভাবে দিয়েছি যে আসলে কিছুই জানি না। অগত্যা জিজ্ঞেস করল, পল্টন ময়দানে (আউটার স্টেডিয়াম) শেখ মুজিব কেবল বাংলা বাংলা বলে কেন?’ বললাম, এই প্রদেশের আদি ও আসল নাম ছিল বাংলা। তাই হয়তো উনি ওই নামে ডাকেন। পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট হবার। পর নাম পরিবর্তন হয় পূর্ব পাকিস্তান। আমাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন করেনি। তবে শরীরের ওপর ধকল ছিল অসহনীয়। তিন দিন ঘুমাতে দেয়নি। শুতে দেয়নি। একটি চেয়ার। পঁড়িতে থাকতে হয়েছে। বেশির ভাগ সময় চেয়ার বাইরে সরিয়ে রাখা হতো। এক পাতা করে ইংরেজি ও বাংলা হাতের লেখা আদায় করে। ছোট ও বড় হাতের লেখা। হাজারো প্রশ্ন।
অতঃপর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ২ নং খাতায় ভর্তি হলাম। নিরাপত্তা বন্দী। জনগণের নাম রাজবন্দী। এক দিন পর অসুস্থ হয়ে জেল হাসপাতালে স্থানান্তরিত হলাম। ওখানে সাক্ষাৎ হলো শেখ ফজলুল হক মনি, মোশারফ হোসেন, হাবিবুর রহমান, কাজী জাফর আহমদের সঙ্গে।…
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের (১ জানুয়ারি ১৯৬৫) সাত দিন পূর্বে আমাকে ও আসমত আলী সিকদারকে মুক্তি দেওয়া হলো। কিন্তু মামলা থাকায় এবং জামিন না থাকায় ওল্ড ২০ সেলে পাঠানো হলো। এটা ছিল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অন্যতম আটককেন্দ্র। সেলে একা থাকার বিড়ম্বনা। জেলে থাকা সত্ত্বেও জামিন বাতিল করা দুঃখজনক পদ্ধতি।
দু’ নম্বরে আমাদের সঙ্গে যারা বন্দী ছিলেন এবং যাদের কথা স্মরণে আছে তারা হচ্ছেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, শেখ ফজলুল হক মনি, ওবায়দুর রহমান, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, শহীদুল হক মুন্সী, সওগাতুল আলম সগির, এনায়েতুর রহমান, আল মুজাহিদী, ফেরদৌস আহমদ কোরেশী, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, এম এ রেজা, আসমত আলী সিকদার, কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, বদরুল হক, আইয়ুব রেজা চৌধুরী, রেজা আলী, আলী হায়দার, বদিউজ্জামান বড় লস্কর, আবদুর রহিম আজাদ, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, গিয়াস কামাল চৌধুরী প্রমুখ। [২৫]
বাগমারের ব্যাপারে সিরাজুল আলম খান যে অভিযোগ করেছেন, তার পেছনে কি কোনো সত্যতা আছে, নাকি তা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব বা ঈর্ষার প্রতিফলন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। সিরাজুল আলম খান আমাকে বলেছিলেন, আবদুর রাজ্জাকের গ্রেপ্তারের পেছনেও বাগমারের হাত আছে।
১৯৬৪-৬৫ সালের কোনো এক ঈদের দিনে রাজ্জাক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বাগমারকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। চিঠিতে কোনো তারিখ ছিল না। বোঝা যায়, চিঠিটি জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাঠানো হয়নি। চিঠির বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে বাগমারের প্রতি রাজ্জাকের বিশ্বাস ছিল অটুট।
আজিজ,
শুভেচ্ছা রইল–সেই তথাকথিত আনন্দের দিনের। কয়েক দিন আগে তোর চিঠি পেয়েছি। এমনি দু’একখানা চিঠি পেলে যে কতটুকু আনন্দ পাই তা ভুক্তভোগীদের নিকট ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করি না। তুই এখান থেকে যাওয়ার পর অনেক কিছুই ঘটেছে–সাক্ষাতে বলব।
তোর প্রতি যে আমার কতটুকু বিশ্বাস আছে তা তোকে অনেক আগেই বলেছি। কারও কথায় কিছু মনে না করে কাজ করে গেলে সুখী হব। নিজের দায়িত্ব পালন করাই বুদ্ধিমানের কাজ। আর একটা কথা সব সময় মনে করি, সবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে যে কাজ চালিয়ে যায় সে সত্যিকারের মানুষ।
তোর আব্বা ও আম্মার অসুখের খবর শুনে আমরা উদ্বিগ্ন আছি। আশা খোদার ইচ্ছায় শীঘ্রই আরোগ্য লাভ করবে। ওনাদের সুস্থতার। খবর জানাস।
আমরা কেউ মানসিক দিকে ভাল নাই। অবশ্য শারীরিক দিক দিয়ে কেউ কেউ ভাল। তোর বন্ধুবান্ধবদের জন্য আমার ঈদ মোবারক,কুশলান্তে
ইতি
রাজ্জাক ভাই [২৬]
.
৬
অপূর্ব সংসদ সম্পর্কে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার ব্যাপারে এটি ছিল একটি উদ্যোগ। প্রক্রিয়াটি গোপন হলেও অনেকেই এর সঙ্গে জড়িত হয়েছিলেন এবং এ সম্পর্কে জানতেন। তল্কালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের ভেতরেই এ উদ্যোগ গড়ে উঠেছিল। এর কেন্দ্রে ছিলেন আবদুল আজিজ বাগমার। তিনি বিদ্বজ্জনের সঙ্গে একটি সাংগঠনিক ও আদর্শিক যোগাযোগ তৈরি করতে পেরেছিলেন।
সমসাময়িক রাজনীতিতে খোলাখুলিভাবে স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারে ঝুঁকি ছিল অনেক। তারপরও তিনি অনেকের সমর্থন, বিশেষ করে তার শিক্ষকদের সহানুভূতি ও আশীর্বাদ পেয়েছিলেন। তিনি কখনোই দাবি করেননি যে তিনি একাই সবকিছু করেছেন। অনেক বিদ্বজ্জন এ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। অপু-৩ ইশতেহারে নতুন দেশের নাম বাংলাদেশ’ এবং জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি নির্বাচন করার বিষয়টি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ছয় বছরের ব্যবধানে এটি বাস্তবে পরিণত হয়েছিল।
বাগমার ছাত্রলীগের মধ্যে কোনো উপদল তৈরির চেষ্টা করেননি। ফলে এটিকে কেন্দ্র করে দীর্ঘমেয়াদি কোনো চক্র গড়ে ওঠেনি। তারুণ্যের উচ্ছ্বাস কিংবা রোমান্টিকতার সারল্যে মাখা ছিল এ উদ্যোগ। বড় পরিসরে এটি সাড়া জাগাতে না পারলেও এ উদ্যোগের তথ্যমূল্য অস্বীকার করা যায় না।
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবির মাধ্যমে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের পথ ধরে স্বাধীনতার একটি আগাম পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। বাগমার এর সঙ্গে নিজেকে বিলীন করে দেন। তখনই বাগমারের উদ্যোগটি চাপা পড়ে যায়। বিষয়টি হয়তো কখনোই জনসমক্ষে আসত না, যদি না ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে তিনি স্বাধীনতার স্বপ্ন: উন্মেষ ও অর্জন নামে একটি বই লিখে প্রকাশ করতেন। বইটির মুখবন্ধে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান চমৎকার একটি মন্তব্য করেছিলেন—’স্বাধীনতা শব্দটি কীভাবে আমাদের। হলো তা জানতে হলে এ বইটি পড়তে হবে।’ বইটি প্রকাশিত হওয়ার সময়। ‘অপূর্ব সংসদের’ অনেকেই জীবিত ছিলেন। মৃত ব্যক্তিদের ঢালাওভাবে উদ্ধৃত করে যা খুশি লিখে দেওয়ার প্রবণতা তিনি সযত্নে এড়িয়ে যেতে পেরেছেন।
.
তথ্যসূত্র
১. Commission on National Education, Government of Pakistan Press, Karachi, 1959
২. fbid.
৩. বাগমার, আবদুল আজিজ (২০০৬), স্বাধীনতার স্বপ্ন : উন্মেষ ও অর্জন, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, পৃ. ৩০-৩১
৪. ওই, পৃ. ৩২-৩৩
৫. ওই, পৃ. ৩৪-৩৫
৬. ওই
৭. ওই, পৃ. ৩৭
৮. ওই, পৃ. ৫৬
৯. ওই, পৃ. ৬৩-৬৪
১০. ওই, পৃ. ৭২-৭৩
১১. শরীফ, আহমদ (১৯৭০), স্বদেশ অন্বেষা, খান ব্রাদার্স, ঢাকা; শরীফ, আহমদ (২০১৩), বাঙলা বাঙালী বাঙলাদেশ, সংকলক : নেহাল করিম, মহাকাল, ঢাকা, পৃ. ১১৬, ১২৪; বাগমার, পৃ. ৮৪-৮৫
১২. ওই
১৩. শরীফ (২০১৩), পৃ. ১২২-১২৩।
১৪. আহমদ শরীফকে লেখা নির্বাচিত পত্রাবলি-১, প্রথম খণ্ড ১৯৩৯-১৯৭৯ (২০১৭), সংকলন ও সম্পাদনা : নেহাল করিম, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, পৃ. ১৫৪
১৫. মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, অপূর্ব সংসদ-এর কথা, প্রথম আলো, ৪ ফেব্রুয়ারি। ২০০০
১৬. বাগমার, পৃ. ১১৩-১৩৯
১৭. ওই
১৮. ওই, পৃ. ৩৯৪
১৯, আহমদ শরীফকে লেখা নির্বাচিত পত্রাবলি-১, পৃ. ১৫২
২০. বাগমার, পৃ. ৩৯৫-৩৯৬
২১. শরীফ, আহমদ (১৯৯৮), বিশ শতকে বাঙালী, ঈক্ষণ, ঢাকা; নবজাতক (কলকাতা), ১৯৯৯; মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০০১
২২. রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ।
২৩. বাগমার, পৃ. ৩১৭-৩১৮
২৪. সিরাজুল আলম খান।
২৫. বাগমার, পৃ. ৬৮-৭০ ২৬. ওই, পৃ. ৪০০