৩.০৯ উত্তরার্চিক — নবম অধ্যায়

উত্তরার্চিক — নবম অধ্যায়

এই অধ্যায়ের মন্ত্রগুলির দেবতা (সূক্তানুসারে)– ১৮, ১১।১২, ১৫-১৭ পবমান সোম; ৯। ১৮ অগ্নি; ১০।১৩।১৪।১৯।২০ ইন্দ্র।
ছন্দ–- ১৯ ত্রিষ্ঠুভ; ২-৮।১০।১১।১৫।১৮ গায়ত্রী; ১২ জগতী; ১৩।১৪ প্রগাথ; ১৬।২০ অনুষ্ঠুভ; ১৭ দ্বিপদা বিরাট; ১৯ উষ্ণিক।
 ঋষি–
১ প্রতর্দন দৈবোদাসি; ২-৪ অসিত কাশ্যপ বা দেবল; ৫, ১১ উতথ্য আঙ্গিরস; ৬।৭ অমহীয়ু আঙ্গিরস; ৮।১৫ নিধ্রুবি কাশ্যপ; ৯ বসিষ্ঠ মৈত্রাবরুণি; ১০ সুকক্ষ আঙ্গিরস; ১২ কবি ভার্গব; ১৩ দেবাতিথি কাণ্ব; ১৪ ভর্গ প্রাগাথ; ১৬ অম্বরীষ বার্ষগির, ঋজিশ্বা ভারদ্বাজ; ১৭ অগ্নিধিষ্ণ্য ঈশ্বর; ১৮ ঊশনা কাব্য; ১৯ নৃমেধ আঙ্গিরস; ২০ জেতা মাধুছন্দস৷

প্রথম খণ্ড  

সূক্ত ১– শিশুং জজ্ঞানাং হর্ষতং মৃজন্তি শুম্ভন্তি বিপ্রং মরুততা গণেন। কবির্গীভিষ্কাব্যেনা কবিঃ সন্তুসোমঃ পবিত্রমতেতি রেভ৷৷৷৷৷ ঋষিমনা য ঋষিকৃৎ স্বর্ষাঃ সহস্রনীথঃ পদবীঃ কবীনাম্। তৃতীয়ং ধাম মহিষঃ সিষাসন্তুসোমো বিরাজমনু রাজতি ষ্টুপ৷২৷৷ চমূষচ্ছেনঃ শকুনো বিভৃত্বা গোবিন্দুদ্রপস আয়ুধানি বিভ্রৎ। অপামূর্মিং সচমানঃ সমুদ্রং তুরীয়ং ধাম মহিষো বিবক্তি৷৩৷

সূক্ত ২– এতে সোমা অভিপ্রিয়মিন্দ্রস্য কামমক্ষর। বধন্তো অস্য বীর্য৷৷৷৷৷ পুনানাসাশ্চমূষদো গচ্ছন্তো বায়ুমশিনা। তে নো ধত্ত সুবীর্য৷৷২৷৷ ইন্দ্রস্য সোম রাধসে পুনানো হার্দি চোদ্দয়। দেবানাং যোনিমাসদম৷৷৩৷৷ মৃজন্তি জ্বা দশ ক্ষিপো হিন্বন্তি সপ্ত ধীতয়ঃ। অনু বি অমাদিষুঃ ॥৪৷ দেবেভ্য জ্বা মদায় কং সৃজানমতি মেষ্যঃ। .. সং গোভিবাসয়ামসি৷৫৷৷ পুনানঃ কলশে বস্ত্রাণ্যরুষো হরিঃ। পরিগব্যান্যব্যত ৷৷৬৷৷ মঘোন আ পবস্ব নো জহি বিশ্বা অপ দ্বিষঃ। ইন্দ্রো সখায়মাবিশ৷৷৭৷৷ নৃচক্ষসং ত্বাং বয়মিন্দ্রপীতং স্বর্বিদম্। ভক্ষীমহি প্ৰজামিষম৷৮৷৷ বৃষ্টিং দিবঃ পরিস্রব দ্যুম্নং পৃথিব্যা অধি। সহো নঃ সোম পৃৎসুধাঃ ॥৯৷৷

 মন্ত্ৰাৰ্থ— ১সূক্ত/১সাম– প্রশংসনীয় সাধকদের হৃদয়ে উৎপদ্যমান সকলের প্রার্থনীয় (অথবা পাপহারক) শুদ্ধসত্ত্বকে সকল দেবভাবের সাথে বিবেকরূপী দেবগণ বিশুদ্ধ করেন এবং প্রাজ্ঞ সেই শুদ্ধসত্ত্বকে পবিত্র করেন; শুদ্ধসত্ত্ব সর্বজ্ঞ হন; স্তুতির দ্বারা প্রীত হয়ে জ্ঞানের সাথে নেই সর্বজ্ঞ শুদ্ধসত্ত্ব জ্ঞান প্রদান করে সাধকদের পবিত্র হৃদয়কে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, বিবেকজ্ঞান উৎপন্ন হলে সত্ত্বভাব বিশুদ্ধ হয়; এবং সাধকগণ শুদ্ধসত্ত্ব প্রাপ্ত হন)। [শুদ্ধসত্ত্ব সাধকের হৃদয়ে উৎপন্ন হয়; সত্ত্বভাব সকলের মধ্যে বর্তমান থাকলেও, তাকে মোক্ষপথের সহায় করতে হলে, তার সাথে দেবভাবের মিলন হওয়া প্রয়োজন। এই মিলনকর্ম সাধন-সাপেক্ষ। বিবেকরূপী দেবগণ (মরুতঃ) সত্ত্বভাবকে বিশুদ্ধ করেন?– তার তাৎপর্য এই যে, যখন বিবেকশক্তি মানুষের জীবনে আধিপত্য বিস্তার করে, তখন তার সমস্ত জীবনই বিশুদ্ধ হয়, পবিত্র হয়। মানুষের মধ্যে বিবেকরূপে ভাগবতী শক্তি মঙ্গল সাধন করে। উচ্চভাব ও উচ্চ চিন্তা মানুষের মনকে অধিকার করে। মোট কথা, ভগবৎ-শক্তির প্রভাবে মানুষের সমস্ত জীবন শুদ্ধসত্ত্বময় হয়। বিবেকের ইঙ্গিত অনুসারে চললে মানুষ কখনও ভ্রান্তপথে যেতে পারে না বা যাওয়া সবপর হয় না। গোভিঃ পদে ভাষ্যকার পূর্বে গরু গন্তা ইত্যাদি অর্থ গ্রহণ করলেও এখানে স্তুতিভিঃ অর্থ গ্রহণ করেছেন। আমরা পূর্বাপরই ঐ পদে জ্ঞান অর্থ গ্রহণ করেছি]।

১/২– যে শুদ্ধসত্ত্ব সর্বদর্শনশীল সর্বজ্ঞ সকলের জ্ঞানপ্রদাতা, সকলের মঙ্গলসাধক, সকলের কর্তৃক আরাধনীয়, সাধকদের (বিপদ হতে) ত্রাণকর্তা অর্থাৎ বিপথগামী জনগণকে সৎপথে প্রতিষ্ঠাতা, স্বলোকপ্রাপক মহান্ জ্যোর্তিময় সেই শুদ্ধসত্ত্ব আরাধিত অর্থাৎ প্ৰদ্দীপিত হয়ে সাধকদের হৃদয়ে দিব্যজ্যোতিঃ প্রকাশ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক। ভাব এই যে, সাধকেরা সর্বলোকের আরাধনায় স্বর্গপ্রাপক পরমমঙ্গলসাধক শুদ্ধসত্ত্ব প্রাপ্ত হন)। [মন্ত্রটির একটি প্রচলিত ব্যাখ্যা প্রদত্ত এ হলো। তা থেকে প্রচলিত অর্থ সম্বন্ধে একটা আভাষ পাওয়া যাবে। অনুবাদটি এই– সোমের মন, ঋষি অর্থ সকলি দেখতে পায়; সোম (সোমরস) সকলে দেখেন, সহস্র প্রকার তার স্তব; কবিদের পদস্থলিত হলেই তিনি বলে দেন। তিনি প্রকাণ্ড; তিনি তৃতীয় লোক অর্থাৎ স্বর্গধামে যেতে উদ্যত এ হয়ে বিরাট অর্থাৎ অতি দীপ্তশালী ইন্দ্রের সঙ্গে দীপ্তি পাচ্ছেন, তাঁকে সকলে স্তব করছে। — আমরা সোম পদে পূর্বাপর শুদ্ধসত্ত্ব অর্থই গ্রহণ করেছি]।

১/৩– হৃদয়স্থিত ঊর্ধ্বগতিপ্রাপক, হৃদয়ে বিচরণশীল জ্ঞানদায়ক অমৃতময় রক্ষাস্ত্রযুক্ত অমৃতের প্রবাহ-প্রদায়ক মহান্ পূজ্য সেই দেবতা পরমানন্দদায়ক স্থান অমৃত-সমুদ্র সাধকদের প্রাপ্ত করান। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — অমৃতস্বরূপ ভগবান্ কৃপাপূর্বক সাধকদের অমৃত প্রদান করেন)। [মানুষ কোথা থেকে এসেছে, কোথায় যাবে– জানে না। কিন্তু তার সহজাত সংস্কার, অমৃতের প্রেরণা তার মনকে উতলা করে তোলে। সে যে অনন্ত পথের যাত্রী, অনন্তের পথে যে তাকে যেতে হবেই। আজ হোক, কাল হোক। অমৃতময় ঈশ্বরের সন্তান মানুষকে যে তার আদি বাসস্থানে ফিরে যেতে হবে– এ প্রবাসের বাসা যে ভাঙতে হবে, এ ধারণা তো তার মনে চিরবর্তমান আছে। কিন্তু এখানে কোথায় সেই অমৃতময় তিনি? হ্যাঁ, তিনি মানুষের হৃদয়েই বর্তমান আছে, তিনি প্রত্যেক হৃদয়ে বিহার করেন– এই আশ্বাস এই মন্ত্রের মূল]। [এই সূক্তের তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত ছটি গেয়গানের নাম পার্থম, মহাবামদেব্যম, হাউউঁহুবায়িবাসিষ্ঠম, উঁহুবায়িবাসি, উদ্বদ্ভাগব, বৈশ্বজ্যোতিরাদ্যম]।

২/১– সাধকের আত্মশক্তি-বর্ধনকারী প্রসিদ্ধ শুদ্ধসত্ত্ব সকলের প্রার্থনীয়, ভগবানর প্রীতিকর, সৎকর্ম-সাধনের সামর্থ্য আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত সৎকর্মের সাধন-সামর্থ্য প্রাপ্ত হই)। [অস্য বীর্যং বর্ধন্তঃ পদ তিনটি সোমাঃ পদের বিশেষণরূপ ব্যবহৃত হয়েছে। ভাব এই যে, — যে সত্ত্বভাব সাধকদের আত্মশক্তি বর্ধন করেন, সেই সত্ত্বভাবই আমরা কামনা করছি। আমরা সাধক নই; সাধনার শক্তি আমাদের নেই। সাধকেরা তাদের কঠোর সাধনার বলে সেই শক্তি লাভ করেন; কিন্তু আমরা সাধন-ভজন-হীন, আমরা কিভাবে তা লাভ করব? আমাদেরও যে এই পরম বস্তু না হলে চলে না। একমাত্র ভরসা– ভগবানের কৃপা। তাই প্রার্থনা– সাধকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমরাও ভগবানের পরমধন যেন লাভ করতে পারি]।

২/২– হে শুদ্ধসত্ত্ব! পবিত্রকারক, হৃদয়ে অধিষ্ঠিত (অথবা সাধকের হৃদয়ে উৎপদ্যমানা, আশুমুক্তিদায়ক দেবতাকে এবং আধিব্যাধিনাশক দেবতাদ্বয়কে প্রাপ্তিকারক আপনারা আমাদের শোভনবীর্য আত্মশক্তি প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে আত্মশক্তি লাভ করি)। [একটি প্রচলিত ব্যাখ্যা– সেই সোম অভিযুত হচ্ছেন, চমস মধ্যে আহ্বান করছেন, এবং বায়ু ও অশ্বিদ্বয়ের নিকট গমন করছেন। এটি আমাদের সুবীর্য দান করুন। সায়ণভাষ্যের সাথে এই ব্যাখ্যার ঐক্য না থাকলেও উভয়েই সোমরসের প্রসঙ্গ এনেছেন। সোমরস মাদক-দ্রব্যকে কেন্দ্র করেই ব্যাখ্যার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। এখানে কিন্তু সঙ্গতভাবেই সোম-অর্থে শুদ্ধসত্ত্ব গৃহীত হয়েছে এবং শুদ্ধসত্ত্বকেই সম্বোধন করা হয়েছে। বায়ু– ভগবানের আশুমুক্তিদায়ক বিভূতি। অশ্বিনাঅশ্বিনীকুমার যুগল– ভগবানের আধিব্যাধিনাশকারী বিভূতি। সুবীর্যং– শোভনবীর্য, আত্মশক্তি ইত্যাদি]।

২/৩– হে শুদ্ধসত্ত্ব! পবিত্রকারক আপনি ভগবানের আরাধনার জন্য আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত এ হোন; দেবভাব-প্রাপ্তির জন্য আমাদের হৃদয়ে আগমন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবানের আরাধনার জন্য আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করি)। সাংসারিক অবস্থার ঘূর্ণবর্তে পড়ে মানুষ পতিত হয়, অপবিত্রভাবে হীনতার মধ্যে বাস করে। হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বের আবির্ভাব হলে হৃদয় পবিত্র হয়, পাপকার্যে মতি নিরস্ত হয়। তাই শুদ্ধসত্ত্বকে পুনানঃ বলা হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ ভগবানে ফিরে যাওয়াই মানবজীবনের চরম লক্ষ্য, সেই লক্ষ্য সাধিত হতে পারে-ভগবানের আরাধনার দ্বারা। অহর্নিশ তার ধ্যান করায় (গুণাবলীর অনুধ্যান, গুণকীর্তন ইত্যাদির মাধ্যমে) ভগবৎশক্তি সাধকের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। ক্রমশঃ সেই শক্তি বিকাশ লাভ করলে ভগবানের সান্নিধ্য প্রাপ্ত হওয়া যায়। অবশেষে তাতেই সাধক বিলীন হয়ে যান। এটাই ভগবৎ প্রাপ্তিস্বরূপাবস্থা-প্রাপ্তি। তাই মানুষের জীবনের চরম উদ্দেশ্য-সাধনের জন্য হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বসঞ্চয়ের– শুদ্ধসত্ত্বের বিকাশ সাধনের প্রয়োজন। সেই জন্যই মন্ত্রে শুদ্ধসত্ত্বপ্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। মন্ত্রের অন্তর্গত ইস্য রাধসে পদ দুটিতে এই উদ্দেশ্যই বিধৃত]

 ২/৪– হে শুদ্ধসত্ত্ব! সৎকৰ্ম-সাধনের দ্বারা সাধকগণ আপনাকে হৃদয়ে উৎপাদন করেন এবং পরাজ্ঞান আপনাকে উৎপাদন করে। সাধকগণ আপনাকে পেয়ে পরমানন্দ লাভ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সৎকর্মসাধনের দ্বারা এবং পরাজ্ঞানের দ্বারা সাধকগণ শুদ্ধসত্ত্ব হৃদয়ে উৎপাদন করেন)।

২/৫– সরল হৃদয় ব্যক্তিগণ দেবভাব-প্রাপ্তির জন্য এবং পরমানন্দ লাভের জন্য সুখভূত তোমাকে তাদের হৃদয়ে সম্যকরূপে উৎপাদন করেন; আমরা যেন তোমাকে জ্ঞানের সাথে হৃদয়ে সংস্থাপন করতে পারি। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — সরল-অন্তঃকরণ ব্যক্তিগণ পরমানন্দ লাভ করেন; আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করি)। [যাঁদের হৃদয় সরল তাঁদের মধ্যে ভগবৎ শক্তি অতি সহজেই স্ফুর্তি লাভ করে। শিশুদের হৃদয়ে যেমন পাপচিন্তা, হীন কামনা-বাসনা থাকে না। তাদের হৃদয়ে যেমন সংসারের দুর্নীতি কুটিলতা প্রবেশ করে হৃদয়কে মলিন অপবিত্র করতে পারে না, ঠিক তেমনই শিশুদের মতো সরল-হৃদয় ব্যক্তিদের মনেও কোন কুটিলতা পাপচিন্তা প্রবেশ করতে পারে না। সব কিছুতে পরম বিশ্বাসী শিশুদের মতোই সরলহৃদয় মানুষের মধ্যে ভক্তি-বিশ্বাস অত্যন্ত প্রবল এবং তারা অতি সহজেই জীবন-সংগ্রামে জয়লাভ করে পরাশান্তি প্রাপ্ত হন]।

২/৬– হৃদয়ে নিহিত জ্যোর্তিময়, পাপহারক, পবিত্রকারক শুদ্ধসত্ত্ব জ্ঞানযুক্ত পাপ-অবরোধক ভক্তি-ইত্যাদিকে সর্বতোভাবে সাধকদের প্রাপ্ত করায়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে সাধকগণ পাপনাশক পরাভক্তি লাভ করেন)।

২/৭– হে শুদ্ধসত্ত্ব! পরমধনপ্রাপক আপনি (সাধকের) সকল শত্রুকে বিনাশ করেন; আমাদের সম্যকরূপে আপনার ধন প্রদান করুন এবং আপনার সখিত্ব কামনাকারী আমাকে প্রাপ্ত হোন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে সাধকগণ রিপুজয়ী হন; তার অনুগ্রহে আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করি)।

২/৮– হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমরা যেন সৎকর্মসাধকদের পরিচালক, সর্বজ্ঞ, ভগবানের দ্বারা গৃহীত অর্থাৎ ভগবানের প্রীতিসাধক আপনাকে এবং আত্মশক্তি ও সিদ্ধি লাভ করতে পারি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — শুদ্ধসত্ত্ব এবং আত্মশক্তি লাভ করি)। [শুদ্ধসত্ত্ব নৃচক্ষসংঅর্থাৎ সৎকর্মসাধকদের পরিচালক। শুদ্ধসত্ত্ব ভগবৎশক্তি। তা মানুষের হৃদয়ে সম্যক্ স্ফুর্তিলাভ করলে, মানুষের হৃদয়ে বিবেক-জ্ঞানের– ভাগবতী-শক্তির সাথে একত্রীভূত হয়ে যায়। সত্ত্বভাব– — ইন্দ্রপীতং– ভগবান্ এই সত্ত্বভাবকে পান করেন, গ্রহণ করেন]।

২/৯– হে শুদ্ধসত্ত্ব! দ্যুলোক হতে অমৃতধারা সম্যকরূপে বর্ষণ করো; পৃথিবীর উপরে অর্থাৎ পৃথিবীর সকল ব্যক্তির হৃদয়ে দিব্যজ্যোতিঃ অথবা পরমধন প্রদান করো; রিপুসংগ্রামে আমাদের আত্মশক্তি প্রদান করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে দিব্যজ্ঞানজ্যোতিঃ লাভ করি এবং রিপুজয়ী হই)। (এই মন্ত্রের একটি প্রচলিত ব্যাখ্যা-হে সোম! তুমি দ্যুলোক হতে পৃথিবীর উপর বৃষ্টিবর্ষণ করো; (ধন) উৎপাদন করো; সংগ্রামে আমাদের বল দান করো। সোম অর্থাৎ সোমরস নামক মদ্য কিভাবে দ্যুলোক থেকে পৃথিবীর উপরে বৃষ্টি বর্ষণ করবে বোঝা সাধ্যাতীত। তাছাড়া সোমরসের বৃষ্টিবর্ষণের ক্ষমতা এলো কোথা থেকে? অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিলে তা বাষ্পকারে মেঘে পরিণত হয়, এবং মেঘ থেকে বরং বৃষ্টি হয়; সেই বৃষ্টি থেকে অন্ন, অন্ন থেকে প্রজা উৎপন্ন হয় বা বেঁচে থাকে। তাহলে সোমের বৃষ্টি-প্রদান আবার কেমনতর? সোম-কে মাদক ধরেই যত মাদকতা। সোম-এর এমন কতকগুলি বিশেষণ বেদমন্ত্রে দেখতে পাওয়া যায় যে, তা দেখে হঠাৎ মনে হয়– বুঝি বা সোমের মাদকতা শক্তি আছে; সোমরস পান করে বুঝি বা মানুষ মাতাল হয়। কথাটা কিছু পরিমাণে সত্য। সোমরস পানে মানুষ মাতাল হয় সত্য; কিন্তু মদখোর-মাতাল নয়। বেদের অন্যত্র সোমরস ও মদ্যের পার্থক্য বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং সোম যে সোমরস বা মদ নয়, সে সম্বন্ধে বেদমন্ত্রই প্রমাণ। আগেও বলা হয়েছে, এখনও উল্লেখ করা যেতে পারে, সোম সাধারণ মদ্য নয়, তবে তা পান করে যোগী ঋষিগণ মাতাল হতেন, পরমানন্দে বিভোর হতেন। এই পরম বস্তু, যা মানুষকে চিদানন্দরসে বিভোর করে দেয়, তা ভগবৎশক্তি– ভগবানের চরণামৃত। পার্থিব কোন সামগ্রী নয়, সোম সাধক-হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব– বিশুদ্ধা ভক্তি]।

.

দ্বিতীয় খণ্ড

সূক্ত ৩– সোমঃ পুনানো অতি সহস্রধাররা অত্যবিঃ। বায়োরিন্দ্রস্য নিষ্কৃত৷৷৷৷৷ পবমানমবস্যবো বিপ্রমভি প্র গায়ত। সুম্বাণং দেববীতয়ে॥২॥ পবন্তে বাজসাতয়ে সোমাঃ সহপাজসঃ৷৷ ঘূর্ণনা দেববীতয়ে ৷৩৷৷ উত নো বাজসাতয়ে পবস্ব বৃহতীরিষঃ ৷৷ দুমদিন্দো সুবীর্য৷৷৷৷ অত্যা হিয়ানা নহেতৃভিরং বাজসাতয়ে। বিবারমব্যমাশবঃ ॥৫৷৷ তে নঃ সহষিণং রয়িং পবামা সুবীর্য। স্বানা দেবস ইন্দবঃ ॥৬৷৷ বাশ্ৰা অষীন্তবোহভি বৎসং ন মাতরঃ। দধন্বিরে গৃভস্ত্যোঃ ॥৭৷৷ জুষ্ট ইন্দ্রায় মৎসরঃ পবমান কনিক্ৰদৎ। বিশ্বা অপ দ্বিষো জহি৷৮৷৷ অপঘুন্তো অরাণঃ পবমানাঃ স্বদৃশঃ। যোনাবৃতস্য সীদত৷৯৷৷

মন্ত্রাৰ্থ— ৩সূক্ত/১সাম– পবিত্রকারক প্রভূতশক্তিসম্পন্ন পরাজ্ঞানযুত শুদ্ধসত্ত্ব আশুমুক্তিদায়ক দেবতার এবং বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতার সংস্কৃত-স্থান অর্থাৎ তাদের সান্নিধ্য প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — শুদ্ধসত্ত্ব সাধককে ভগবানের সামীপ্য প্রাপ্ত করান)। [মূল মর্ম এই যে, — যাঁরা হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব সঞ্চয় করেছেন, তারা সেই শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে ভগবৎ-সামীপ্য লাভ করেন। কারণ পবিত্র বস্তু পবিত্রতার প্রতাঁকের দিকেই গমন করে। বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব ভগবানের দিকেই মানুষকে পরিচালিত করে। বায়ুভগবানের আশুমুক্তিদায়ক বিভূতিধারী দেবতা। ইন্দ্র– বলৈশ্বর্যাধিপতিরূপ ঈশ্বরীয় বিভূতিধারী দেবতা। সোম– শুদ্ধসত্ত্ব]।

৩/২– পরিত্রাণপ্রার্থী হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! দেবভাব প্রাপ্তির জন্য পবিত্রকারক জ্ঞানস্বরূপ পবিত্র পরমদেবের অভিমুখে প্রকৃষ্টরূপে স্তুতি করো, অর্থাৎ ভগবানকে আরাধনা করো। (মন্ত্রটি আত্ম উদ্বোধনমূলক। আমরা যেন ভগবৎ-পরায়ণ হই)। [ভাষ্যকার দেববীতয়ে পদের অর্থ করেছেন– দেবপানায়। বিবরণকার অর্থ করেছেন, — দেবানাং ভক্ষণায়, অর্থাৎ দেবতাদের ভক্ষণের জন্য। কিন্তু আমরা মনে করি এখানে দেবতাদের পানের বা ভক্ষণের কোন কথাই নেই। বীতয়ে পদের অর্থ গ্রহণীয়, তাই দেববীতয়ে পদের অর্থ– দেবত্বপ্রাপ্তির জন্য অথবা দেবভাবপ্রাপ্তির নিমিত্ত। দেবভাব-প্রাপ্তির জন্য সাধক ভগবানের আরাধনা করছেন]।

৩/৩– সাধকদের আত্মশক্তিপ্রদাতা পরম-আকাঙ্ক্ষণীয় শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের দেবভাবপ্রাপ্তি এবং আত্মশক্তিলাভের জন্য আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন দেবভাবপ্রাপক আত্মশক্তিদায়ক শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করতে পারি)। [এখানে দেববীতয়ে পদে ভাষ্যকার অর্থ করেছেন যজ্ঞার্থং; অথচ এর আগের মন্ত্রেই এই পদে তিনি দেবপানায় অর্থ করেছিলেন]।

৩/৪– হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের জ্যোর্তিময় আত্মশক্তি প্রদান করুন; অপিচ, আত্মশক্তিলাভের জন্য মহতী সিদ্ধি প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে আমরা যেন জ্যোতির্ময়ী আত্মশক্তি লাভ করতে পারি)।

৩/৫– আশুমুক্তিদায়ক দেবতার মতে, সাধকগণ কর্তৃক উৎপাদিত শুদ্ধসত্ত্ব, সাধকদের আত্মশক্তি লাভের জন্য নিত্যজ্ঞানপ্রবাহ বিশেষভাবে সৃজন করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সাধকেরা শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে পরাজ্ঞান লাভ করেন)। [প্রচলিত একটি অনুবাদ– সংগ্রামে প্রেরিত অশ্বের ন্যায় প্রেরকগণ কর্তৃক প্রেরিত হয়ে শীঘ্রগামী সোম অন্নলাভের জন্য দশাপবিত্র অতিক্রম করে চলে যাচ্ছেন। প্রচলিত মত অনুসারে সোমরস প্রস্তুতের একটি বর্ণনা এই মন্ত্রে বিস্তৃত। সোমরস স্রোতের বেগে যাচ্ছে, তাই তাকে যুদ্ধের ঘোড়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। ভাষ্যকার অবশ্য আশবঃ পদের অর্থ করেছেন-শীঘ্রগামিনঃ সোমাঃ। যুদ্ধাশ্ব প্রভৃতি অনুবাদকের কল্পনা। ভাষ্য ইত্যাদিতে সোমকেই অন্ন বলা হয়েছে। এখানে আবার দেখা যাচ্ছে– সোম অন্নলাভের জন্য যাচ্ছেন। সোমই যদি অন্ন হয় তবে তার আবার অন্নলাভ কি হতে পারে, বোঝা অসাধ্য]।

৩/৬– পবিত্রকারক দেবত্বপ্রাপক প্রসিদ্ধ সেই শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের প্রভূত পরিমাণ আত্মশক্তিদায়ক পরমধন সম্যকরূপে প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, হে ভগবন! আমাদের শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত পরমধন প্রদান করুন)।

৩/৭– বৎস যেমন মাতৃক্রোড়কে আশ্রয় করে, অথবা মাতৃভূতা গাভী যেমন সস্নেহে বৎসকে আপন অঙ্কে ধারণ করে, তেমনই সৎ-ভাব ইত্যাদি সাধক-হৃদয়কে আশ্রয় করে। সাধকও জ্ঞান এবং ভক্তি রূপ হস্ত দুটির দ্বারা সেই শুদ্ধসত্ত্বকে ধারণ করে থাকেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। সাধকের হৃদয়ই সৎ-ভাবের আধার। সেখানে শুদ্ধসত্ত্ব আপনা হতেই সঞ্চারিত হয়)।

৩/৮– ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য পর্যাপ্ত অর্থাৎ ভগবৎপ্রাপক পরমানন্দদায়ক শুদ্ধসত্ত্ব সাধকদের পরাজ্ঞান প্রদান করেন; হে দেব! আমাদের সকল শত্রু বিনাশ করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — শুদ্ধসত্ত্ব সাধকদের পরাজ্ঞান প্রদান করেন; আমরা যেন রিপুজয়ী হই)।

৩/৯– সৎ-বৃত্তির রোধক রিপুদের বিনাশকারী পবিত্রকারক হে পরাজ্ঞানসমূহ! আপনার সত্যের (অথবা সৎকর্মের) উৎপত্তিস্থান হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আমরা যেন রিপুনাশক পরাজ্ঞান লাভ করি)। [একটি প্রচলিত ব্যাখ্যা– হে পবমান, (অদাতাগণের) হিংসক সর্বদর্শী সোমরস! তোমরা যজ্ঞস্থানে উপবেশন করো। — মন্ত্রের মধ্যে সোমরসের কোনও প্রসঙ্গ নেই। ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে সোমরসকে জোর করে টেনে আনা হয়েছে। মন্ত্রের প্রত্যেকটি পদই জ্ঞানকে লক্ষ্য করে। কিন্তু মন্ত্রের সঙ্গতি নষ্ট হলেও প্রচলিত ব্যাখ্যাকারবৃন্দ সোমরসকে অধ্যাহার করেছেন-মন্ত্রের একটি পদ অরাণঃ এবং তার সাথে সংযুক্ত অন্য পদ অপঘন্তোঃ। এই দুটি পদের ভাষ্যার্থ– যে সকল যজমান (অবশ্য পুরোহিত বা ঋত্বিককে) দান করেন না, তাদের বিনাশকারী। এই পদের এই প্রচলিত ব্যাখ্যা থেকে প্রাচীন ভারতের একটি চিত্র অঙ্কিত করবার চেষ্টা দেখা যায়। এই চিত্রাঙ্কণকারী ব্যক্তিরা বলেন– যজ্ঞ ইত্যাদি কার্যে জীবিকা নির্বাহকারী পুরোহিতশ্রেণীর তুষ্টি-বিধানের জন্য ধনী যজমানগণ সদা তৎপর থাকতেন। যজমানেরা তাদের ভয়ে তটস্থ থাকতেন। কিন্তু তথাপি এমন অনেক লোক ছিল, যারা দারিদ্র্যবশতঃ অথবা অন্য কোন কারণে পুরোহিতকে অর্থ ইত্যাদি দ্বারা সন্তুষ্ট করতে পারত না। তাদের শাসন অথবা ভয় প্রদর্শন করবার জন্যই নাকি এই দুই পদের সৃষ্টি। সাধারণ ভয় প্রদর্শন অপেক্ষা মন্ত্রের মধ্য দিয়ে এই ভয় প্রদর্শন অনেক বেশী কার্যকরী হবার কথা। তাই নাকি মন্ত্রে বলা হয়েছে অরাঃ অপঘন্তো?– অদাতা যজমানকে বিনাশকারী। একটি বিষয় কিন্তু লক্ষণীয় যে, — মূলে মাত্র আছে অরাণঃ অর্থাৎ হিংসক। তা থেকেই ব্যাখ্যাকারবৃন্দ একেবারে যজমানকে টেনে এনে কি পরিমাণ অনর্থের সৃষ্টি না করেছেন তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। — ঋত শব্দে সত্য ও সৎকর্ম বোঝায়]।

.

তৃতীয় খণ্ড

সূক্ত ৪– সোমা অগ্রমিন্দবঃ সুতা ঋতস্য ধারয়া। ইন্দ্রায় মধুমত্তমাঃ ॥১॥ অভি বিপ্রা অনূষত গাবো বৎসং ন ধেনবঃ। ইং সোমস্য পীতয়ে৷৷২৷৷ মদ্যুৎক্ষেতি সাদনে সিন্ধোরূৰ্মা বিপশ্চিৎ। সোমো গৌরী অধিশ্রিতঃ ॥৩৷৷ দিবো নাভা বিচক্ষণোহব্যা বারে মহীয়তে। সোমমা যঃ সুক্ৰতুঃ কবিঃ ॥৪৷৷ যঃ সোমঃ কলশে অন্তঃ পবিত্র আহিতঃ। তমিন্দুঃ পরি ষস্বজে। ৫৷৷ প্র বাচমিন্দুরিষ্যতি সমুদ্রস্যাধি বিষ্টপি। জিম্বন্ কোশং মধুশ্রুত৷৬৷৷ নিত্যস্তোত্রো বনম্পতিৰ্ধেনামন্তঃ সবর্দুৰ্ঘা। হিন্বনো মানুষ যুজা। ৭৷৷ আ পবমান ধারয়া রয়িং সহস্রবর্ডসম। অম্মে ইন্দো স্বাভুম্ ৷৷৷৷ অভি প্রিয়া দিবঃ কবিৰ্বিপ্ৰঃ স ধারয়া সুতঃ। সোমো হিন্ধে পরাবতি। ৯।

মন্ত্ৰাৰ্থ— ৪সূক্ত/১সাম– পবিত্র অমৃতময় বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব আমাদের ভগবৎ-প্রাপ্তির জন্য সত্যজ্ঞানের ধারারূপে আমাদের হৃদয়ে প্রবাহিত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানের কৃপায় শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করি)। [প্রচলিত ব্যাখার মর্ম এই যে, — যজ্ঞের জন্য যজ্ঞগৃহে। সোমরস প্রস্তুত হচ্ছে। কার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে? ব্যাখ্যাকার বলছেন– ইন্দ্রায়; ইন্দ্রের জন্য। ইন্দ্র উপভোগ করবেন বলে। — আমরা ইন্দ্রায় পদের অর্থ করেছি ভগবৎপ্রাপ্তিয়ে। ভগবানকে প্রাপ্তির জন্য হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব সঞ্চয়ের অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজন, তা না হলে অমৃতত্বলাভ আদৌ সম্ভব হতে পারে না– এটাই মন্ত্রের মূল ভাব]। এ ৪/২– স্নেহপরায়ণা ধেনুগণ যেমন প্রেমের সাথে তাদের বৎসের প্রতি শব্দ করে, তেমনভাবে এ জ্ঞানী সাধকগণ শুদ্ধসত্ত্ব লাভের জন্য ভগবানকে প্রার্থনা করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — জ্ঞানী সাধকবৃন্দ ভগবৎ-প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা করেন)। [ভূমানন্দের স্বাভাবিক, আকাঙ্ক্ষা সৎ-মানুষের মনে সর্বদাই ক্রিয়া করছে। কিন্তু কোথায় এবং কেমনভাবে সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে, তা জানতে না পেরে অশান্তি ভোগ করে। যখন সে সেই চিরবাঞ্ছিত বস্তুর সন্ধান পায়, তখন তার আর দিগবিদিগ জ্ঞান থাকে না; আকুল হয়ে সে সেই বস্তু লাভ করবার জন্য ছোটে;– নিজের হৃদয়ের ও মনের সমগ্র শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করে তার দিকে প্রেরণ করে। হৃদয়ের এই ব্যাকুলতার ভাব প্রকাশিত হয়েছে একটি উপমায়। সেটি এই– ধেনবঃ ন বৎসং]।

৪/৩– পরমানন্দদায়ক ভক্তিরসের স্রাবয়িতা শুদ্ধসত্ত্ব সৎকর্মে অধিষ্ঠিত থাকে। অপিচ, ঊর্মিমালা যেমন সিন্ধুহৃদয়ে আশ্রিত থাকে; তেমনই সর্বজ্ঞ অর্থাৎ সকলের প্রজ্ঞাপক সেই শুদ্ধসত্ত্ব গিরির ন্যায় স্থির অবিচলিত অথবা জ্ঞান-প্রদীপ্ত হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হয় অথবা সেই হৃদয়কে আশ্রয় করে বিদ্যমান থাকে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সৎকর্মের দ্বারা শুদ্ধসত্ত্ব সঞ্জাত হয়; এবং স্থির অবিচলিত ভক্তের হৃদয়ই শুদ্ধসত্ত্বের আধারস্বরূপ)। [সিন্ধোঃ উমঃ উপমায় এক উচ্চভাবের দ্যোতনা করে। ঊর্মিমালা অর্থাৎ ঢেউ যেমন সমুদ্রের বক্ষে উত্থিত হয়ে সিন্ধুতেই লয়প্রাপ্ত হয়; আবার ঊর্মি যেমন সিন্ধুরই অংশীভূত, তেমনই শুদ্ধসত্ত্ব সৎ-ভাব-সমন্বিত হৃদয়েই উথিত হয়; এবং সেই হৃদয়েই আশ্রয় গ্রহণ করে। অপিচ, শুদ্ধসত্ত্ব সেই সৎ-ভাবপূর্ণ হৃদয়েই অংশীভূত। গৌরীপদের ভাষ্যানুযায়ী অর্থ– মাধ্যমিকায় বাঁচি। আমরা গিরি শব্দ থেকে অপত্যর্থে গৌরী পদ নিষ্পন্ন করি। আবার গৌরী পদে জ্ঞানদীপ্তিও বোঝাতে পারে। এমনভাবেই গৌরী পদের জ্ঞানপ্রদীপ্তে হৃদয়ে– এই দ্বিতীয় ভাবটি পাওয়া যায়]।

৪/৪– বুদ্ধিমান সৎকর্মসাধক জ্ঞানী যে সাধক তাঁর (অর্থাৎ সেই সাধকের) দ্বারা দ্যুলোকের মূলীভূত, নিত্যজ্ঞানপ্রবাহে অবস্থিত, অর্থাৎ পরাজ্ঞানযুত শুদ্ধসত্ত্ব পূজিত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সৎকর্মের সাধক জ্ঞানী পরাজ্ঞানযুত শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করেন)। [ভাষ্যের অনুসরণে ব্যাখ্যাকার বলছেন– সোমরস (মদ্য) সুকর্মা, কবি ও বিচক্ষণ; তিনি অন্তরীক্ষের নাভিস্বরূপ মেষলোমে পূজিত হন। মাদকদ্রব্যের এতসব গুণ! — অধিক মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

৪/৫– যে সত্ত্বভাব সর্বলোকের হৃদয়ে বর্তমান আছে, সেই সত্ত্বভাব বিশুদ্ধীকৃত হয়ে পবিত্র হৃদয় মধ্যে অধিষ্ঠিত হয়; ভগবান্ সেই পবিত্র হৃদয়কে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ শুদ্ধসত্ত্ব সমন্বিত পবিত্র সাধক-হৃদয়কে প্রাপ্ত হন)।

৪/৬– শুদ্ধসত্ত্ব ভগবানের স্থানে অর্থাৎ ভগবৎসমীপে প্রার্থনা প্রেরণ করে; সেই শুদ্ধসত্ত্ব অমৃতকামী হৃদয়কে পূর্ণ করে। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে এবং ভগবানের আরাধনার দ্বারা সাধকেরা অমৃতত্ব লাভ করেন)। [প্রচলিত একটি অদ্ভুত ব্যাখ্যা– সোম মদাবী মেঘকে প্রীত করে অন্তরীক্ষের স্তম্ভনকর স্থানে বাক্য উচ্চারণ করেন। ভাষ্যকার ইন্দুঃ পদে ধাতু-অর্থের অনুসরণে ক্লেদনবান্ অর্থ গ্রহণ করেছেন। অথচ ঠিক এর পূর্ববর্তী মন্ত্রে এই পদে অর্থ করা হয়েছে সোমদেব বা চন্দ্র। সেখানে সোম ও ইন্দুঃআবার দুই পৃথক সত্তা। অন্যত্র আবার ইন্দুঃ পদের সোম অর্থ গ্রহণ করেছেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, -ইন্দুঃ পদের অর্থ সম্বন্ধে তার মনেও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে; তাই তিনি বিভিন্নস্থলে বিভিন্নরকম অর্থ অধ্যাহার করেছেন]।

৪/৭– নিত্যকাল আরাধিত পরম-জ্যোতির্ময় পরম-দেব অমৃতদায়ক জ্ঞান প্রদান করে মানুষের ও দ্বারা আরাধিত হয়ে তাদের মধ্যে হৃদয়ে আবির্ভূত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব– সাধকেরা ঐকান্তিক আরাধনার দ্বারা ভগবানের কৃপা লাভ করেন)। [বনস্পতি পদের অর্থ বনানাং পতি। বন শব্দ-জ্যোতিঃ বাচক। জ্যোতিঃর অধিপতি সেই পরমদেবতাকেই বনস্পতি পদে লক্ষ্য করে। তিনিই নিত্য আরাধিত। ভাষ্যকার অর্থ করেছেন– সোম। কিন্তু মন্ত্রটি বিশেষভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এখানে ভগবানেরই মহিমা পরিকীর্তিত হয়েছে]।

৪/৮– পবিত্রকারক হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি আমাদের পরম-জ্যোতির্ময় পরম-আশ্রয়দায়ক পরম ধন সম্যকরূপে প্রদান করুন। (প্রার্থনামূলক এই মন্ত্রটির ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত মোক্ষদায়ক পরমধন লাভ করি)। [সাধক জানেন, এই পার্থিব যা কিছু, তা একদিন ছাড়তেই হবে, মানুষকে একদিন সেই চরম-আশ্রয়ের সন্ধানে বাহির হতেই হবে। যে স্থান থেকে কখনও ভ্রষ্ট হতে হবে না, যে আশ্রয় থেকে পতনের সম্ভাবনা নেই, সেই পরম-আশ্রয়ের সন্ধানেই সাধক আত্মনিয়োগ করেন। মানুষ অতৃপ্ত; তার অতৃপ্তির কারণ– অপূর্ণতা। এই অপূর্ণতার ধারণাই মানুষকে পূর্ণত্ব সম্বন্ধেও সজাগ করে তোলে। এই ধারণাই সাধকের মনে পার্থিব সম্পদের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মিয়ে দেয়। সব অসার অস্থায়ীর পরিবর্তে, তাই তিনি স্থায়ী নিত্য বাসস্থানের (পরম-আশ্রয়ের) জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছেন]।

৪/৯– সৎকর্মসাধন-শাক্তদাতা জ্ঞানী পবিত্র প্রসিদ্ধ শুদ্ধসত্ত্ব দ্যুলোকে অবস্থিত হয়ে প্রভূত পরিমাণে দুলোকের প্রিয়ধন অর্থাৎ পরমধন সাধককে লক্ষ্য করে প্রেরণ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — শুদ্ধসত্ত্ব সাধকদের পরমধন প্রদান করেন)। [প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ– কবি সোম দ্যুলোক হতে প্রেরিত হয়ে ধারারূপে মেধাবীগণের প্রিয়স্থানে গমন করেন। ভাষ্যানুসারী এই বঙ্গানুবাদটি অনেকটা আমাদেরই মতকে সমর্থন করছে। সোমরস মাদক-দ্রব্য হলেও তা দ্যুলোকবাসী অর্থাৎ স্বর্গ থেকে তা প্রেরিত হচ্ছে। সুতরাং মাদকদ্রব্য হলে তা কেমন করে স্বর্গীয় বস্তু হতে পারে? সুতরাং এইবারে ব্যাখ্যাকারের মত অনুসরণ করেই আমরা মোটামুটিভাবে এই সিদ্ধান্তের সমর্থন পাই যে, সোম নামে বেদমন্ত্রের মধ্যে আমরা যার পরিচয় পাই, বেদে যার বহুরকম মহিমা প্রখ্যাপিত হয়েছে, তা ভাগবতী-শক্তি-শুদ্ধসত্ত্ব ব্যতীত আর কিছুই নয়]।

.

চতুর্থ খণ্ড

সূক্ত ৫– উৎ তে শুস ঈরতে সিন্ধোরূমেরিব স্বনঃ। বাণস্য চোদ্দয়া পবিম৷৷৷৷৷ প্রসবে ত উদীরতে তিম্রো বাচো মখসুবঃ। যদব্য এষি সানবি৷২৷৷ অব্যা বারৈঃ পরি প্রিয়ং হরিং হিন্বন্ত্যাদ্রিভিঃ, পবমানং মধুশ্রুত৷৩৷ আ পবস্ব মদিন্তম পবিত্রং ধারয়া কবে। অর্কস্য যোনিমাসদম্॥৪ স পবস্ব মদিম গোভিরঞ্জানো অভিঃ। এন্দ্রস্য জঠরং বিশ৷৫৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ৫সূক্ত/১সাম– হে দেব! সমুদ্র-তরঙ্গের শব্দের ন্যায় অর্থাৎ সমুদ্রের তরঙ্গ হতে শব্দ যেমন অহর্নিশ উদ্গত হয় তেমন ভাবে, আপনার আশুমুক্তিদায়ক জ্ঞান নিত্যকাল সাধক-হৃদয়ে প্রবাহিত হয়;হে দেব! বীণাতন্ত্রের শব্দতুল্য মধুর শব্দ অর্থাৎ পরাজ্ঞান আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — সাধকেরা নিত্যকাল পরাজ্ঞান লাভ করেন; আমরা যেন পরাজ্ঞান লাভ করতে পারি)। [মন্ত্রটি একটু জটিলভাবাপন্ন। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতেও মন্ত্রের ভাব পরিষ্কার হয়নি, বরং দুএক স্থলে মূল ভাবের বিপর্যয় ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ একটি বঙ্গানুবাদ– হে সোম! সমুদ্রের তরঙ্গের বেগের মতো তোমার ধারা বহমান হচ্ছে। যেমন: ধনুগুণ। থেকে বিক্ষিপ্ত বাণ শব্দ করে, তুমি তেমন শব্দ ছাড়তে থাকে। এই ব্যাখ্যার মধ্যে সোম প্রস্তুত প্রণালীর একটা আভাষ পাওয়া যায়। কিন্তু মন্ত্রের অন্তর্গত পদগুলির প্রতি দৃষ্টিপাত করলে এই ধারণা নষ্ট হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, মূলে আছে– স্বনঃ, তার অর্থ ধ্বনি শব্দ। ভাষ্যকারও ঐ অর্থ গ্রহণ করেছেন। সুতরাং সিন্ধোর ঊর্মে স্বনঃ ইব পদগুলির অর্থ হয়, — সমুদ্রতরঙ্গের শব্দের ন্যায়। কিন্তু প্রচলিত বঙ্গানুবাদে স্পষ্টতঃ স্বনঃ পদের অর্থ করা হয়েছেবেগ। তোমার ধারা ব্যাখ্যার মধ্যে কোথা থেকে এল, মোটেই বোঝা যায় না। ধারাদ্যোতক কোন শব্দই মন্ত্রের মধ্যে নেই। বাণস্য পদের অর্থ ধনুর্বাণ কেন, বীণাযন্ত্রও তো হতে পারে। বরং বীণাঅর্থ গ্রহণ করলে ঐ উপমার দ্বারা পরাজ্ঞানের স্বরূপ প্রকটিত হয়। সঙ্গীত মানুষের অতি প্রিয় জিনিষ। শুধু মানুষ কেন, পশু-পক্ষীগণ ও ভীষণ হিংস্র জন্তু পর্যন্ত এই সঙ্গীতের প্রভাবে মুগ্ধ হয়ে তাদের হিংস্রভাব পরিত্যাগ করে। যন্ত্রসঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ উপকরণ বীণা। পরাজ্ঞানকে সেই বীণা-শব্দের মতো মধুর বলা হয়েছে। জ্ঞান যে কেবলমাত্র মোক্ষসাধক তা নয়, এটি আনন্দদায়কও বটে; মন্ত্রে তা-ই প্রখ্যাপিত হয়েছে]।

৫/২– হে শুদ্ধসত্ত্ব! যখন বিশুদ্ধ নিত্য-জ্ঞানপ্রবাহে আপনি মিলিত হন, তখন আপনার জন্ম হলে সৎকর্মসাধকগণের বেদ-অনুসারিণী প্রার্থনা উচ্চারিত হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব উৎপন্ন হলে সাধকেরা ভগবৎপরায়ণ হন)। [যখন জ্ঞানের সাথে শুদ্ধসত্ত্ব মিলিত হয়, তখন মানুষের জীবনে খুব বড় রকমের একটা পরিবর্তন আসে। জ্ঞান ও সত্ত্বভাবের মিলনে যে অপূর্ব বস্তু প্রস্তুত হয়, যে নূতন শক্তি জন্মলাভ করে– সেই শক্তিই এই পরিবর্তনের মূলে আছে। প্রসবে পদে এই নূতন শক্তির জন্মবার্তাই ঘোষিত হচ্ছে। এই মিলনে মানুষ অপূর্ব দেবভাবে বিভোর হয়ে ভগবানের আরাধনায় রত হয়]।

৫/৩– সাধকগণ পাষাণ কঠোর সাধনের দ্বারা নিত্যজ্ঞান-প্রবাহের সাথে দেবতাদের প্রীতিজনক, পাপহারক, অমৃতপ্রাপক, পবিত্রকারক শুদ্ধসত্ত্বকে তাদের হৃদয়ে উৎপাদিত করেন। (মন্ত্রটি  নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, সাধকেরা কঠোর সাধনের দ্বারা অমৃতপ্রাপক শুদ্ধসত্ত্বকে লাভ না করেন)। [প্রচলিত ব্যাখ্যায় মন্ত্রটি সোমরস প্রস্তুত প্রণালীর একটি বর্ণনামাত্রে খ্যাপিত হয়েছে। কিন্তু এ এ মূলমন্ত্রে সোমরসের কোনও উল্লেখ নেই]।

৫/৪– পরমানন্দদায়ক জ্ঞানদায়ক হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের হৃদয়কে পবিত্র করে ধারারূপে আমাদের হৃদয়ে সমুদ্ভুত হোন; এবং জ্যোতির উৎপত্তিনিলয়কে– পরাজ্ঞানকে প্রাপ্ত হোন অর্থাৎ পরাজ্ঞানের সাথে মিলিত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন পরাজ্ঞানযুত শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করতে পারি)। [প্রচলিত একাধিক ব্যাখ্যায় অবাঞ্ছিতভাবে বহু কল্পিত শব্দ টেনে এনে এই মন্ত্রকে সোম-দ্যোতক করে তোলা হয়েছে]।

৫/৫– পরমানন্দদায়ক হে শুদ্ধসত্ত্ব! জ্যোতিঃদায়ক জ্ঞানকিরণযুক্ত আপনি আমাদের হৃদয়ে সমুদ্ভুত হোন; তারপর ভগবানের সামীপ্য প্রাপ্ত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করে তার প্রভাবে ভগবানকে প্রাপ্ত হই)। [এই মন্ত্রটির দুএকটি পদের বিভিন্ন পাঠ দৃষ্ট হয়। যথা এস্য জঠরং বিশ এবং ইন্দ্র ইন্দ্রায় পীতয়ে। প্রথম পাঠভেদে তো সোমরসকে সোজাসোজি ইন্দ্রদেবের উদরে প্রবেশ করবার জন্য বলা হয়েছে, দ্বিতীয় পাঠেও প্রায় তা-ই। যাঁরা বেদে সোমরস নামক মাদকের উল্লেখ আছে বলে মত প্রকাশ করেন, তারা তো বলবেন—ঐ তো বেদে একেবারে উদরে প্রবেশ করবার জন্য সোমরসকে বলা হচ্ছে। সুতরাং ইন্দ্রদেব যে সোমরস পান করতেন সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। প্রচলিত ব্যাখ্যাতে যেন সোমরস নামক মদ্য-প্রস্তুতের প্রণালীই বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু অভিঃ  পদে জ্যোতিদায়কৈঃ; গোভিঃ পদে গোর্বিকারৈঃ ক্ষীরাদিভিঃ অর্থাৎ গো শব্দের অর্থ গো থেকে উৎপন্ন দুগ্ধ ক্ষীর প্রভৃতির পরিবর্তে (গো– জ্ঞানকিরণ) জ্যোতিঃদায়ক জ্ঞানকিরণের সাথে– ইত্যাদি অর্থ ধরলে মন্ত্রব্যাখ্যা সুসংগত হয়]।

.

পঞ্চম খণ্ড

সূক্ত ৬– অয়া বীতী পরিস্রব যস্ত ইন্দো মদেম্বা অবাহন্নবতীর্নব৷১৷ পুরঃ সদ্য ইথাধিয়ে দিবোদাসায় শম্বর। অধ ত্যং তুর্বশং যদুম্৷৷২৷৷ পরি নো অশ্বমশ্ববিদ গোমদিন্দো হিরণ্যবৎ। ক্ষরা সহষিণীরিষঃ ॥৩৷৷

সূক্ত ৭– অপঘ্নন পবতে মৃধোপ সোমো অরাণঃ। গচ্ছন্নিস্য নিষ্কৃত৷৷৷৷৷ মহো নো রায় আ ভর পবমান জহী মৃধঃ রাস্বেন্দো বীরবদ যশঃ ॥২৷৷ ন ত্বা শতং চন হতো রাধো দিসন্তমা মিন। যৎপুনানো মখস্যসে৷৷৷৷

সূক্ত ৮– অযা পবস্ব ধারয়া যয়া সূর্যমরোচয়ঃ। হিন্বনো মানুষীরপঃ ॥১॥ অযুক্ত সুর এতশং পবমানো মনাবধি। অন্তরিক্ষেণ যাতবে৷২৷৷ উত ত্যা হরিততা রথে সূরো অযুক্ত যাবে। ইন্দুরিন্দ্র ইতি ব্রুবন্৷৷৩৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ৬সূক্ত/১সাম– হে শুদ্ধসত্ত্ব! তোমার যে দীপ্তি পরমানন্দের জন্য (অথবা রিপুসংগ্রামে) অসংখ্য রিপু বিনাশ করে, সেই দীপ্তির সাথে আমাদের প্রাপ্ত হও অর্থাৎ আমাদের হৃদয়ে প্রকৃষ্টরূপে আবির্ভূত হও। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, আমরা যেন দীপ্তিমান সত্ত্বভাব লাভ করি)। [এই মন্ত্রের অন্তর্গত নবতীর্নব পদের ব্যাখ্যায় ভাষ্যকার শম্বরপুরীর উল্লেখ করেছেন। অন্য এক ব্যাখ্যাকার এই পদের মেঘ, উদক, বল অর্থ করেছেন। কেউ আবার ঐতিহাসিকদের মত অনুসারে শম্বর নামে দৈত্য-বিশেষের উল্লেখও করেছেন। কিন্তু এই মন্ত্রের ব্যাখ্যায় শম্বরশব্দকে টেনে আনবার কোনই সার্থকতা নেই। নিবতীর্নবপদে সংখ্যার বহুত্ব প্রকাশ করে মাত্র। নবতীর্নব অবাহন পদদুটিতে অসংখ্য শত্রুর বিনাশ বোঝায়। চারিদিকে অংসংখ্য শত্ৰু মানুষকে মোক্ষপথ থেকে নিবৃত্ত করবার জন্য চেষ্টা করে। সেই রিপুদের জয় করে মোক্ষপথে অগ্রসর হতে হয়। হৃদয়ে সত্ত্বভাবের সঞ্চার হলে এইসব রিপুই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এখানে সত্ত্বভাবের সেই শক্তি এবং মানুষের এই অসংখ্য রিপুর কথাই বিবৃত হয়েছে– কোন দৈত্য বা অসুরের কথা বলা হয়নি]। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৫অ-৩দ ৯সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

৬/২– হে ভগবন! আপনি সত্যকর্মা ভগবৎ-আরাধনাপরায়ণ ব্যক্তির জন্য অর্থাৎ তার মুক্তিলাভের জন্য, প্রসিদ্ধ প্রবল রিপু এবং জ্ঞানভক্তি-বিনাশক রিপুসমূহকে মুহূর্তমধ্যে (সর্বদা) বিনাশ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক সাধকদের রিপুনাশ করেন)। [যে কোন কারণেই মানুষ ভগবানের আরাধনায় নিযুক্ত হোক না কেন, তা মঙ্গলপ্রদ হবেই। সৎকার্যের সাধনে মঙ্গল, কল্যাণলাভ হবেই। কখনও তার অন্যথা হয় না। ভগবান্ নিজে তার ভক্তকে রক্ষা করে থাকেন, নিজে তাকে হাতে ধরে ক্রোড়ে তুলে নেন। এই সত্যটিই বর্তমান মন্ত্রের মধ্যে বিধৃত হয়েছে]।

৬/৩– হে শুদ্ধসত্ত্ব! ব্যাপক জ্ঞানদায়ক আপনি আমাদের জ্ঞানযুত, প্রভূতপরিমাণ, পরমধনযুক্ত । — পরাজ্ঞান এবং সিদ্ধি প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — সেই ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত পরাজ্ঞান-যুত পরমধন প্রদান করুন)। [অশ্ববিৎ– ব্যাপকজ্ঞানদায়ক। গোম– জ্ঞানযুত। সহস্ৰিণঃ– প্রভূতপরিমাণ। হিরণ্যবৎ হিরণ্যযুত, পরমধনযুত। অশ্বং ব্যাপকজ্ঞান, পরাজ্ঞান। ইষঃ সিদ্ধি। ইন্দো– হে শুদ্ধসত্ত্ব]।

৭/১– হিংসক শত্রুদের বিনাশ করে, লোভ-মোহ ইত্যাদি অপসরণ করে সত্ত্বভাব সাধকদের হৃদয়ে উপজিত হয়; সত্ত্বভাবপ্রাপ্ত সেই ব্যক্তি ভগবৎ-সান্নিধ্য প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক। ভাব এই যে, -সত্ত্বভাব লাভের দ্বারা মানুষ রিপুজয়ী হয় এবং ভগবৎ-পদ প্রাপ্ত হয়)। [অপঘন্ পদের অর্থে লোভমোহ ইত্যাদি রিপু গৃহীত]। [ছন্দ আর্চিকেও (৫অ-৪দ-১৪সা) মন্ত্রটি দ্রষ্টব্য]।

৭/২– পবিত্রকারক হে শুদ্ধসত্ত্ব! আমাদের মহান্ পরমধন প্রদান করুন। আমাদের রিপুদের বিনাশ করুন; এবং আমাদের আত্মশক্তিযুক্ত সৎকর্ম-সাধনশক্তি প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। এটির ভাব এই যে, আমরা যেন ভগবানের কৃপায় রিপুজয়ী হয়ে আত্মশক্তিযুত পরমধন লাভ করি)। [প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে যে ভাব গৃহীত হয়েছে তা একটি অনুবাদ থেকে উপলব্ধ হবে। অনুবাদটি– এই, — হে ক্ষরৎ সোম! প্রচুর ধন আমাদের দাও; হিংসকদের ধ্বংস করো; আমাদের ধন, জন এবং যশ বিতরণ করো। অথচ সঙ্গত অর্থের বিচারে মন্ত্রের প্রথম অংশ নি মহঃ রায়ঃ আভরঃ– আমাদের মহৎ পরমধন প্রদান করুন; দ্বিতীয় অংশ মৃধঃ জহী– আমাদের রিপুদের বিনাশ করুন; তৃতীয় অংশ বীরবৎ যশঃ রাস্ব– আত্মশক্তিযুত সৎকর্ম সাধনের শক্তি প্রদান করুন]।

৭/৩– হে দেব! যখন পবিত্রকারক আপনি সাধকদের পরমধন দান করতে ইচ্ছা করেন, তখন পরমধনদানেচ্ছুক আপনাকে বহুরিপুও বারণ করতে সমর্থ হয় না। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, পরম শক্তিমান্ ভগবান্ সকল রিপুকে বারণ করে সাধকদের পরমধন প্রদান করেন)। [ভগবান্ যখন মানুষের প্রতি কৃপা-পরায়ণ হন, তখন কোন বিরুদ্ধশক্তিই মানুষকে মোক্ষমার্গ থেকে প্রতিনিবৃত্ত করতে পারে না। ভগবৎশক্তির কাছে সকলের সকল শক্তিই প্রতিহত হয়। সাধক অনায়াসেই ভগবানের কৃপায় আপন জীবনের চরম সার্থকতা লাভ করতে সমর্থ হন]।

৮/১– হে শুদ্ধসত্ত্ব! পবিত্রকারক তুমি মনুষ্যবর্গের হিতজনক অমৃতসম্বন্ধি যে প্রবাহের দ্বারা জ্ঞানরশ্মি প্রকাশিত করো, সেই প্রবাহের সাথে আমাদের হৃদয়ে উপজিত হও। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, — অমৃতস্বরূপ জ্ঞান আমাদের হৃদয়ে উপজিত হোক)। [মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৫অ ৩দ-৭সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

৮/২– মোক্ষমার্গে গমন করবার জন্য পবিত্রকারক দেব জ্ঞানদেবের ভগবৎ-সামীপ্যপ্রাপক, মোক্ষপ্রাপক পরাজ্ঞানকে মানুষের হৃদয়ে সংযোজিত করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবানের কৃপায় সাধকেরা মোক্ষদায়ক পরাজ্ঞান লাভ করেন)। [সূরঃঅর্থে সূর্যের বা জ্ঞানদেবের]।

৮/৩– শুদ্ধসত্ত্ব ভগবানের মাহাত্ম্য প্রখ্যাপিত করেন; অপিচ, সাধকদের উধ্বগমনের জন্য প্রসিদ্ধ পাপহারর্ক সৎবৃত্তিনিবহকে জ্ঞানযুত সৎকর্মে সংযোজিত করেন। (নিত্যসত্যমূলক এই মন্ত্রের ভাব এই যে, — শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে সাধকবর্গ পরাজ্ঞানযুত সৎকর্ম-সাধন-শক্তি লাভ করেন)। [প্রচলিত এক বঙ্গানুবাদ– অপিচ, সোম ইন্দ্রের নাম উচ্চারণপূর্বক দশদিকে গতিবিধির জন্য সূর্যের অশ্ব যোজনা করছেন। ব্যাখ্যা, মন্ত্রের ভাবও প্রকাশ করছে না, এবং ভাষ্যের অর্থের সাথেও সামঞ্জস্য রক্ষিত হয়নি]।

.

ষষ্ঠ খণ্ড

সূক্ত ৯– অগ্নিং বো দেবমগ্নিভিঃ সজোষা যজিষ্ঠং দূতমধ্বরে কৃণুধ্বম্। যো মর্তে্যু নিবিঋতাবা তপূমূর্ধা ঘৃতান্নঃ পাবকঃ॥১॥ প্রাথদশ্বে ন যবসেহবিষ্য যদা মহঃ সংবরণাদ ব্যস্থা। আদস্য বাতো অনুবাতি শোচির স্ম তে ব্রজনং কৃষ্ণমস্তি॥২॥ উদ্যস্য তে নবজাতস্য বৃষ্ণোইগ্নে চর্যজরা ইধানাঃ অচ্ছা। দ্যামুরুষো ধূম এষি সং দূতো অগ্ন ঈয়সে হি দেবা৷৩৷৷

সূক্ত ১০– তমিং বাজয়ামসি মহে বৃত্রায় হবে। স বৃষা বৃষভো ভুবৎ। ১। ইন্দ্রঃ স দামনে কৃত ওজিষ্ঠঃ স বলং হিতঃ। দ্যুমী শ্লোকী স সোম্যঃ ॥২॥ গিরা বজ্রো ন সতঃ স বলল অনুপচ্যুতঃ। ববক্ষ উগ্রো অস্তৃতঃ ৷৩৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ৯সূক্ত/১সাম– হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা জ্ঞানতেজের সাথে মিলিত হও; যে জ্ঞানদেব মানুষের মধ্যে ধ্রুবতারারূপে বর্তমান আছেন, যিনি সত্যপ্ৰাপক, পরম ভেজঃসম্পন্ন, অমৃতময়-শক্তিযুক্ত, পবিত্ৰকারক, সেই আরাধনীয় জ্ঞানদেবকে সৎকর্মের সাধনে দূত করো। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধন-মূলক। ভাব এই যে, আমরা যেন সৎকর্মের সাধনে জ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত হই)। [মন্ত্রে জ্ঞানের মাহাত্ম্যও প্রখ্যাপিত হয়েছে। সকল কর্মে জ্ঞানের সাহায্য গ্রহণের জন্য আত্ম-উদ্বেধনা রয়েছে। জ্ঞান কেমন? তিনি ঋতাবা– সত্যপ্ৰাপক। জ্ঞানের সাহায্যে মানুষ সত্যলাভ করতে পারে। সত্য কি?, ভগবান্। তিনি সত্যস্বরূপ-সত্যং জ্ঞানং অনন্তং। জ্ঞান তপূর্ধ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ পাপনাশক, পরম তেজঃসম্পন্ন। জ্ঞান হৃদয়ে এলে হৃদয় থেকে পাপ-অন্ধকার তিরোহিত হয়, জ্ঞানাগ্নিতে পাপের আবর্জনা দগ্ধ হয়ে যায়। সেই জ্ঞান মানুষের হৃদয়ে ধ্রুবতারারূপে বিরাজিত থেকে তাকে ধ্রুব লক্ষ্যের প্রতি চালনা করে। তাই অধ্বরে দূতং কৃণুধ্বং-জীবনের প্রত্যেক সৎকর্মে জ্ঞানকে দূতরূপে গ্রহণ করো]।

৯/২– যখন পরমদেব ঘনকৃষ্ণ বিপর্যস্ত অজ্ঞান-আবরণ হতে অশ্বের ন্যায় শীঘ্রবেগে আশু জ্ঞান ও এ প্রদান করে সাধককে রক্ষা করেন, তখন সাধকের অন্ধকারময় মার্গ ভগবানের অনুক্রমে পরিচালিত হয়; হে দেব! আপনার জ্যোতিঃ অধঃপতিত জনের উপরেও বর্তমান আছে। (নিত্যসত্যমূলক এই মন্ত্রের ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক জ্ঞান দান করে সাধককে মোক্ষের পথে পরিচালিত করেন)। [মন্ত্রের শেষাংশ ভগবানকে সাক্ষাৎ সম্বোধন করে উক্ত হয়েছে। তাতে ভগবানের মহিমাই ব্যাখ্যাত হয়েছে। তিনি অধঃপতিত জনেরও পরম বন্ধু। তার হৃদয় হীনপতিত জনের দুঃখে বিগলিত হয়। তার যে দিব্যজ্যোতিঃ, তা কেবলমাত্র উচ্চশ্রেণীর জন্যই নয়, পাপী-তাপী দুর্বল হীন পতিত সবই তাতে একদিন না একদিন পতিত হবে। তার অপার করুণা সর্বত্রই বর্তমান আছে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হতে পারে– যদি তিনি পাপীর প্রতিও সমান স্নেহশীল তবে পাপীর শাস্তি বিধান করেন কেন? উত্তর এই যে, শাস্তিও তার আশীর্বাদ, তার করুণার দান। তিনি শাস্তি বিধান করেন বলেই পাপী পাপপথ পরিত্যাগ করে; পুণ্যের পথে, সৎকর্মের পথে প্রত্যাবর্তন করে। আর তখন সেই হীন পাপীও সাধনসিদ্ধের মতো ঈশ্বরের দিব্যজ্ঞানের জ্যোতিঃ লাভ করে।

৯/৩– হে জ্ঞানদেব! সাধকের হৃদয়ে নব প্রাদুর্ভূত অভীষ্টবর্ষক যে আপনার নিত্য, ঐকান্তিক প্রার্থনা ভগবানের সামীপ্য প্রাপ্ত হয়, অজ্ঞানতার নাশক সৎকর্মে দূতস্বরূপ জ্যোতির্ময় সেই আপনি দ্যুলোকের প্রতি সম্যকরূপে গমন করেন; হে জ্ঞানদেব! আপনিই দেবভাবগুলিকে প্রাপ্ত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, জ্ঞানীরা ভগবৎপরায়ণ হন; জ্ঞানের দ্বারা লোক ভগবানের সামীপ্য প্রাপ্ত হয়)। [মন্ত্রের নবজাতস্য পদটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জ্ঞানকে এখানে নবজাত বলা হয়েছে। জ্ঞান তো চিরপুরাতন, অনন্ত, তবে তা নবজাত হলো কিভাবে? হয়। পৃথিবী তো পুরাতন, তার সবকিছুই তো পুরাতন, তবু আজ যে নতুন অতিথি পৃথিবীতে এল, তার কাছে তো সবই নতুন। এসবের কোন কিছুরই সাথে তো তার পরিচয় নেই। নতুন কোন দেশে কেউ ভ্রমণ করতে গেলে, সেখানকার সব পুরাতনই তো তার চোখে নতুন বলে মনে হবে। ঠিক তেমনভাবেই জ্ঞান নিত্য, প্রাচীন হলেও ব্যক্তিবিশেষের কাছে (অর্থাৎ যে সাধকের হৃদয়ে এই প্রথম জ্ঞানের উন্মেষ হলো– তাঁর কাছে) তো তা নতুন]।

 ১০/১– হে আমার মন! আত্ম-উদ্বোধন-রূপ এই মহান্ যজ্ঞে তোমার অজ্ঞানতারূপ শত্রুকেবলিদানের জন্য পরমৈশ্বর্যশালী সেই ভগবান্ তোমার অভীষ্ট-পূরক হোন। (ভাব এই যে, অজ্ঞাননাশক সেই ভগবান্ আমাদের পূজায় পরিতৃপ্ত হয়ে আমাদের অভীষ্ট পূরণ করুন)। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (২অ-১দ-৫সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১০/২– প্রসিদ্ধ সেই বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতা সাধকদের পরমধন দান করবার জন্য আরাধনীয় হন; সর্বশক্তিমান্ সেই দেবতা সাধকদের আত্মশক্তিতে বর্তমান থাকেন; জ্যোতির্ময়, প্রার্থনীয়, সেই দেবতা শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা আরাধনীয় হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ সাধকদের পরমধন প্রদান করেন; জ্যোর্তিময় সেই দেবতা শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা আরাধনীয় হন)।

১০/৩– বজ্রতুল্য অর্থাৎকঠোর-রিপুনাশক রক্ষাস্ত্ৰতুল্য পরমশক্তিশালী, অপরাজেয়, মহাতেজস্বী, অজাতশত্রু সেই পরমদেবতা প্রার্থনার দ্বারা স্তুত হয়ে আমাদের পরমধন দান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, পরমশক্তিমান্ ভগবান্ আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। [মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক হলেও এর মধ্যে ভগবানের মাহাত্ম্যও বর্ণিত আছে। তিনি সবলঃঅর্থাৎ পরমবলশালী। বজ্রঃ ন উপমার লক্ষ্যস্থল সবলঃ পদ। সুতরাং পূর্ণ উপমা হলো– রিপুনাশক রক্ষাস্ত্ৰতুল্য পরমশক্তিশালী। এই উপমার দ্বারা ভগবানের রিপুনাসিকা শক্তির প্রতিও ইঙ্গিত আছে। তিনি অনপচুতঃ– অপরাজেয়। শুধু অপরাজেয় নন– তিনি অজাতশত্রুও বটেন। তার নিজের শত্রু না  থাকলেও, বিশ্ববাসীর মোক্ষপথের অন্তরায় দূর করতে হলে তাকে রক্ষাস্ত্র ধারণ করতেই হয়। তাই, তাকে বর্জীরক্ষাস্ত্রধারী বলা হয়]।

.

সপ্তম খণ্ড

সূক্ত ১১– অধ্বৰ্যো অদ্রিভিঃ সুতং সোমং পবিত্র আ নয়। পুনাহীন্দ্রায় পাতবে৷১৷৷ তব ত্য ইন্দো অন্ধসো দেবা মধোৰ্যাশত। পবমানস্য মরুতঃ ॥২॥ দিবঃ পীযুষমুত্তমং সোমমিল্লায় বত্রিণে। সুনোতা মধুমত্তম৷৷

সূক্ত ১২– ধর্তাঃ দিবঃ পবতে কৃষ্যো রসোদক্ষো দেবানামনুমাদ্যো নৃভিঃ। হরিঃ সৃজানো অতো ন সত্বভিবৃথা পাজাংসি কৃণুষে নদী॥১॥ শূরো ন ধ আয়ুধা গভস্ত্যোঃ স্বঃ সিষাসন্ রথিরো গবিষ্টিযু। ইন্দ্রস্য শুম্মমীরয়নুপস্যুভিরিন্দুৰ্হিানো অজ্যতে মনীষীভিঃ ॥২৷৷ ইন্দ্রস্য সোম পবমান ঊর্মিণ তবিষ্যমাণ্যে জঠরে বা বিণ। প্র নঃ পিন্ব বিদ্যুদবে রোদসী ধিয়া নো বাজাঁ উপ মাহি শশ্বতঃ৷৩৷

সূক্ত ১৩– যদিন্দ্র প্রাগপাগুদ ন্যগ বা হ্য়সে নৃভিঃ। সিমা পুরু নৃসূতো অস্যানবেহসি প্রশর্ধ তুর্বশে৷১। যদ বা রুমে রুশমে শ্যাবকে কৃপ ইন্দ্র মাদয়সে সচা। কাঘাসত্ত্বা স্তোমেমিব্রহ্মবাহস ইন্দ্রা যচ্ছত্যা গঞ্জি৷৷২।

 সূক্ত ১৪– উভয়ং শৃণবচ্চ ন ইন্দ্রো অর্বাগিদং বচঃ। সত্ৰাচ্যা মঘবাৎসোমপীতয়ে ধিয়া শবিষ্ঠ আ গমৎ৷৷৷৷৷ তং হি স্বরাজং বৃষভং তমোজ ধিষণে নিষ্টভক্ষতুঃ। উতোপমানাং প্রথমো নি যীদসি সোদকামং হি তে মনঃ॥২৷৷

মন্ত্ৰার্থ— ১১সূক্ত/১সাম– সকর্মে নিয়োজিত হে আমার মন! তুমি কঠোর কৃচ্ছসাধনের দ্বারা পবিত্ৰীকৃত শুদ্ধসত্ত্বকে হৃদয়-রূপ যজ্ঞাগারে প্রতিষ্ঠিত করো; তারপর সেই শুদ্ধসত্ত্বকে পরমৈশ্বর্যশালী ভগবানের গ্রহণের জন্য পবিত্র (অর্থাৎ উৎকর্ষ সাধন) করো। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। এখানে সত্ত্বভাবের প্রভাবে ভগবানকে প্রাপ্তির জন্য যাজ্ঞিক আত্মাকে উদ্বোধিত করছেন। মন্ত্রের ভাব এই যে, সৎ-ভাবের প্রভাবে সৎকর্মের দ্বারা আমরা যেন ভগবানকে প্রাপ্ত হই)। অথবা-সৎকৰ্ম-সাধন-সমর্থ হে আমার মন! কঠোর সৎকর্ম-সাধনের দ্বারা হৃদয় পবিত্র করে বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব প্রাপ্ত হও; বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবের গ্রহণের জন্য সত্ত্বভাবকে পবিত্র করো। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। ভাব এই যে, — শুদ্ধসত্ত্বলাভের জন্য আমরা যেন কঠোর তপঃ-পরায়ণ হই)। [মনই কর্মের নিয়ামক। মন ইন্দ্রিয়সমূহের রাজা। আমরা ইন্দ্রিয়গুলির দ্বারা সমস্ত কার্য নির্বাহ করি বটে; কিন্তু ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রিত করে– মন। তাই দুরকম অন্বয়েই অধ্বর্যো পদে সৎকর্মসাধনসমর্থ হে মনঃ! অর্থ গৃহীত হয়েছে। ; কারণ মনই সৎকর্মের বা অসৎকর্মের সম্পাদক। সৎকর্মসাধনের পথে বহু বাধাবিঘ্ন বর্তমান। সেই সকল বাধা অতিক্রম করে সৎপথে অগ্রসর হওয়া অতিশয় কঠোর বা কষ্টকর। বজ্রের চেয়েও কঠোর হৃদয় নিয়ে কর্মক্ষেত্রে অগ্রসর না হলে এই সব বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করা যায় না। তাই অদ্রিভিঃ পদে কঠোরসৎকর্মসাধনৈঃ অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে)। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৫অ-৪দ-৩সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১১/২– হে শুদ্ধসত্ত্ব! বিবেকরূপী দেবগণ (মরুতঃ) এবং সকল দেবতা (ত্যে দেবাঃ) আত্মশক্তিধারক পবিত্রকারক আপনার অমৃত গ্রহণ করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্বের অমৃতের সাথে সকল দেবভাব মিলিত হয়)। [প্রচলিত ব্যাখ্যা থেকে যেন একটা নিমন্ত্রণ ভোজের চিত্র পাওয়া যায়। সোমরসকে পানের উপযোগী করে প্রস্তুত করা হয়েছে; এবং তার সাথে অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যও আছে। সকল দেবতাকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। তারা এসে সোমরস ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের চারদিকে ঘিরে রয়েছেন। এটাই হলো প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদির প্রতিপাদ্য বিষয়। এই ব্যাখ্যার সমর্থনে অতীত ভারতের চিত্রাঙ্কনকারী ব্যক্তিগণ মত প্রকাশ করেছেন যে, বাস্তবিকপক্ষে দেবতাগণ এসে সোম পান করতেন না। এটি মন্ত্র রচয়িতাদের নিজেদের চিত্র মাত্র। তখন ভারতে সোমরসের অত্যন্ত জনপ্রিয়তা ছিল, তাই যজ্ঞ ইত্যাদি কর্মে অঢেল সোমপান করা হতো এবং প্রিয়বস্তু হিসাবে দেবতাদেরও তা নিবেদন করা হতো। পশুবলি ইত্যাদিও এমনই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঘটনা। — সোম অর্থে সোমরস নামক মাদকদ্রব্য ধরেই এইসব ব্যাখ্যা ও ইতিবৃত্তিকা। সোম-কে সঙ্গত অর্থে শুদ্ধসত্ত্ব ধরলে বোঝা যায়– মানুষের হৃদয়ে যখন শুদ্ধসত্ত্ব উপজিত হয়, তখন তার অন্তরস্থিত সুপ্ত দেবভাবসমূহ জাগরিত হয়ে ওঠে, তার ফলে সাধক দেবত্ব প্রাপ্ত হন। বিবেক জাগরিত হয়, মানুষ বিবেকের নির্দেশ অনুযায়ী নিজের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে। বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবের সাথে দেবভাব মিলিত হয়ে সাধককে ভগবানের সমীপে নিয়ে যায়– এটাই বর্তমান মন্ত্রের মর্মার্থ। দেবগণ শুদ্ধসত্ত্বের অমৃত ভক্ষণ করেন, গ্রহণ করেন, তার অর্থ এই যে, তারা মানুষের হৃদয়স্থিত শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারাই প্রীতিলাভ করেন, এটাই ভগবৎ-আরাধনার সর্বশ্রেষ্ঠ উপকরণ। কর্মণি ষষ্ঠী এই নিয়ম অনুসারে মধো পদের দ্বিতীয়ান্ত অমৃতং অর্থ গৃহীত হয়েছে]।

 ১১/৩– হে আমার চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা রক্ষাস্ত্রধারী ভগবানকে প্রাপ্তির জন্য দ্যুলোকের শ্রেষ্ঠ, এ মাধুর্যোপেত, অমৃতস্বরূপ, আমাদের হৃদয়স্থিত সত্ত্বভাবকে বিশুদ্ধ করো। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। ভাব এই যে, আমরা ভগবানকে প্রাপ্তির জন্য যেন আমাদের হৃদয়স্থিত সত্ত্বভাবকে বিশুদ্ধ ভগবানের আরাধনার যোগ্য করে তুলতে পারি)। [একটি প্রচলিত বঙ্গানুবাদ– হে পুরোহিতগণ! এই সোম চমৎকার রসযুক্ত, স্বর্গবাসের সর্বশ্রেষ্ঠ পানীয়; বজ্রধারী ইন্দ্রের উদ্দেশে এই সোমের নিপীড়ন করো। এতে যে মন্ত্রের ভাব-বিপর্যয় ঘটেছে, তাতে কোন সন্দেহই নেই। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত নটি গেয়গান আছে। সেগুলির নাম– বৈরূপম, আশুভার্গবনম, সৌমিত্রম, মার্গীয়বম্, ঐটতম, ধুরাসাকমশ্বম্, বিলম্বসৌপর্ণম, সৌপবর্ণম এবং রোহিতকুলীয়োত্তরম]।

১২/১– সকলের ধারণকর্তা, স্বর্গজাত, অমৃতময়, বিশুদ্ধ, দেবভাবসম্পন্নদের শক্তিদায়ক, সাধকদের দ্বারা স্তবনীয় অর্থাৎ সাধকদের প্রার্থনীয় সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ে সমুদ্ভূত. হোন; (ভাব এই যে, আমরা যেন পরমমঙ্গলদায়ক সত্ত্বভাব লাভ করি); সৎকর্ম যেমন শক্তিপ্রদান করে, তেমনই মনুষ্যগণের হৃদয়ে উৎপন্ন হয়ে পাপহারক সত্ত্বভাবই আপনা-আপনিই হৃদয়ে বল প্রদান করেন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — সত্ত্বভাব পাপনাশক এবং আত্মশক্তিদায়ক হন)। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৫অ-৯দ-৫সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১২/২– বীর ব্যক্তি যেমন শত্রুনাশের জন্য অস্ত্র-শস্ত্র ইত্যাদি ধারণ করেন, তেমনই স্বৰ্গকামনাকারী মোক্ষপ্রাপক, সৎকর্মসাধকের জ্ঞানে বর্তমান, শুদ্ধসত্ত্ব হস্তদ্বয়ের দ্বারা রক্ষাস্ত্র ধারণ করেন; ভগবানের শক্তি কামনাকারী, অমৃতকামী সৎকর্মর্সাধকের দ্বারা উৎপদ্যমান শুদ্ধসত্ত্ব জ্ঞানে সম্মিলিত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, -শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে সাধকেরা রিপুজয়ী হন, তারা পরাজ্ঞান লাভ করেন)। [প্রচলিত একটি বঙ্গানুবাদ– ইনি (সোমরস) বীরপুরুষের ন্যায় দুই হস্তে অস্ত্রধারণ করেন; ইনি স্বর্গলাভের উপায়স্বরূপ; ইনি গাভী উপার্জনব্যাপারের সময় রথীর ন্যায় কার্য করেন; ইনি ইন্দ্রের বলবৃদ্ধি করে তাকে পাঠিয়ে দেন। বুদ্ধিমান ঋত্বিকেরা চালনা করলে, ইনি দুগ্ধ ও ক্ষীরের সাথে মিলিত হন। — মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

১২/৩– আমাদের হৃদয়স্থিত, পবিত্রকারক হে শুদ্ধসত্ত্ব! আরাধনীয় আপনি প্রভূত-পরিমাণে ভগবানের সামীপ্য প্রাপ্ত হোন; বিদ্যুৎ যেমন মেঘ হতে দীপ্তি আহরণ করে, তেমনই আপনি আমাদের জন্য দ্যুলোক ও ভূলোক হতে অমৃত আহরণ করুন; অনুগ্রহ বুদ্ধির দ্বারা আমাদের প্রভূতপরিমাণ আত্মশক্তি প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে যেন অমৃত প্রাপ্ত হই-ভগবানের সামীপ্য প্রাপ্ত হই]। [সর্বশক্তির শ্রেষ্ঠ আত্মশক্তি। আত্মশক্তি মানুষের হৃদয়েরই সামগ্ৰী, তা হৃদয়েই উপজিত হয়। তবে এই আত্মশক্তি অন্যের কাছ থেকে (শুদ্ধসত্ত্বের কাছ থেকে) চাওয়া হচ্ছে কেন? একটু বিবেচনা করে দেখলে বোঝা যায় যে, আত্মশক্তি বাহির থেকে প্রদান করবার জন্য কারও কাছে প্রার্থনা করা হয়নি। নিজের অন্তরে যে শুদ্ধসত্ত্ব আছে, উদ্বুদ্ধ সেই শুদ্ধসত্ত্বের কাছে অর্থাৎ অন্তরস্থায়ী ভগবৎশক্তির কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে। সেই প্রার্থনার মর্ম হলো এই যে, আমরা যেন আত্মশক্তি লাভ করতে পারি, ভগবান্ আমাদের মধ্যে যে শক্তিবীজ দিয়েছেন, তাকে যেন বিকশিত করে আমরা পূর্ণত্বের পথে অগ্রসর হতে পারি। তার দেওয়া শক্তিবলে যেন তারই চরণে উপনীত হতে পারি। তিনি তো আমাদের সমস্তই দিয়েছেন, কেবল তার সৎব্যবহার করা চাই, সৎ ব্যবহার করতে জানা চাই]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত ছটি গেয়গান আছে। এ, সেগুলির নাম– উদ্বদ্ভার্গবম, কাবম, যজ্ঞাযজ্ঞীয়ম্, শাক্করর, বাসিষ্ঠম এবং বারোরভিক্রন্দন]।

১৩/১– বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! যদ্যপি আপনি সর্বত্র নেতা মানুষ্যগণ কর্তৃক পূজিত হন; তথাপি ঐকান্তিকতার সাথে সৎকর্মের দ্বারা সাধকগণ কর্তৃক আরাধিত হলে, আপনি সাধকের হৃদয়ে রিপুগণের প্রাধান্য আবরকরূপে প্রাদুর্ভূত হন; এবং সৎকর্মের প্রভাবে ভগবানে আশ্রয়প্রাপ্ত জনের হৃদয়ে রিপুরিমদকরূপে প্রাদুর্ভূত হয়ে থাকেন। (ভাব এই যে, যদিও বহুজন কর্তৃক আরাধিত হন, তথাপি ভগবান্ সঙ্কর্মান্বিত সাধককে শীঘ্র রিপুর কবল থেকে উদ্ধার করেন)। অথবা-বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! সর্বত্র আপনি নেতৃস্থানীয় লোকগণ কর্তৃক পূজিত হন; কিন্তু যখন ঐকান্তিকতার সাথে সাধকগণ কর্তৃক আরাধিত হন, তখন রিপুবশকারক হে দেব! সৎকর্মের প্রভাবে ভগবানে আশ্রয়প্রাপ্ত জনের হিতের নিমিত্ত আপনি তার রিপুবিমর্দক হয়ে থাকেন। (ভাব এই যে, — বহুজন কর্তৃক আরাধিত হলেও ভগবান্ সৎকর্মে অন্বিত সাধককে শীঘ্র রিপুর কবল থেকে উদ্ধার করেন)। ভিগবান্ সমদর্শী, তার দানে পক্ষপাতিত্ব নেই। তবে সকলেই তাঁর দান গ্রহণের উপযুক্ত হতে পারে না। সৎকর্ম সাধনের দ্বারা হৃদয় নির্মল ও প্রশস্ত হলে ভগবানের করুণা ধারণ করবার শক্তি জন্মায়। আমরা অসৎকর্মে অসৎ-চিন্তায় নিজের শক্তি ক্ষয় করি, আর তার ফলভোগ করবার সময় দোষ দিয়ে থাকি.ভগবানের। নিজের দোষ, নিজের খনন করা গর্তে পড়ি, আর নিজের পাপের মাত্রা বৃদ্ধি করবার জন্যই যেন বলি– দোষ ভগবানের। তত্ত্বদর্শী ঋষি সত্য দর্শন করেন, তাই ভগানের মহিমা– তার নিরপেক্ষতা জগৎকে জ্ঞাপন করেন– ভুল করো না মানুষ, ভগবানের করুণী অজস্র ধারায় বর্ষিত হলেও স্বকর্মফলভুক পুমান্ বাক্যটি ভুলো না। সৎকর্মে সৎ-চিন্তায় আত্মনিয়োগ করো। তুমিও ভগবানের কৃপা আত্মায় উপলব্ধি করতে পারবে]। [এই মন্ত্রটি ছন্দর্চিকেও (৩অ-৫দ-৭সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১৩/২– বলৈশ্বর্যাধিপতি হে দেব! যদিও প্রার্থনাপরায়ণ জ্যোতির্ময় ঊর্ধ্বগমনকারী ভগবনকৃপাপ্রার্থিজনে আপনি আনন্দলাভ করেন– তৃপ্ত হন, তথাপি হে ভগবন! মোক্ষার্থী ক্ষুদ্রশক্তি জন প্রার্থনার দ্বারা আপনাকে আহ্বান করছে; কৃপাপূর্বক আপনি তাদের হৃদয়ে আগমন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপা করে ক্ষুদ্রশক্তি আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন)। [প্রচলিত একটি অনুবাদ– হে ইন্দ্র! যদিও তুমি রুম, রুমশ, শ্যাবক ও কৃপের সাথে হৃষ্ট হয়ে থাকো; স্তোত্রবাহক কথগণ তোমাকে স্তোত্রপ্রদান করছে, তুমি আগমন করো। অনুবাদকার ভাষ্যকারের অনুকরণে রুমে প্রভৃতি পদে কয়েকজন বিশিষ্ট লোকের নাম উল্লেখ করেছেন, অর্থাৎ রুম প্রভৃতি নামধারী কয়েকজন তোক যেন ইন্দ্রকে আরাধনা করেন এবং ইন্দ্রও প্রীত হয়ে থাকেন। কিন্তু একটু বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায়, রুমে প্রভৃতি পদে কোন ব্যক্তিকে বোঝাচ্ছে না, এই পদগুলি সাধকের গুণাবলী প্রকাশ করছে মাত্র। যেমন, রুম শব্দ রবকরার্থক কৃ-ধাতু নিষ্পন্ন। তা থেকে ভাব আসে, যে শব্দ করে, ভগবানকে ডাকে, প্রার্থনা করে অর্থাৎ প্রার্থনাপরায়ণ। রুশমে পদে দীপ্তি অর্থ প্রকাশ পায়। অর্থাৎ যিনি দীপ্তিমান জ্যোতির্ময়। সাধনার প্রভাবে সাধক যে জ্যোতিঃ তেজঃ লাভ করেন এখানে সেই জ্যোতিঃর উল্লেখ আছে। তাই ঐ পদে দীপ্তিমতি, জ্যোতির্ময়ে অর্থ গৃহীত হয়েছে। শ্যাবক শব্দ গমনার্থক শ্যৈ-ধাতু নিষ্পন্ন, অর্থাৎ যিনি ঊর্ধ্বগমন করেন, ঊর্ধ্বগমনকারী। তাই সপ্তমান্ত ঐ পদে ঊর্ধ্বগমনকারিনি অর্থই সঙ্গত হয়েছে। কৃপেপদের অর্থ-কৃপাপ্রার্থিজনে, যিনি ভগবানের কৃপা প্রার্থনা করেন তাতে। সুতরাং ঐ পদগুলিতে একই ব্যক্তিকে, সাধককে, নির্দেশ করেছে। আর যদি ঐ। এ পদগুলিতে বিভিন্ন ব্যক্তিকে বোঝাত, তাহলে বহুবচন ব্যবহৃত হতো। কিন্তু ঐগুলিতে এক ব্যক্তিকে বোঝাচ্ছে বলেই একবচনই ব্যবহৃত হয়েছে। [এই সূক্তান্তর্গত দুটি মন্ত্রের গেয়গানের নাম, নৈপাতিথম]।

১৪/১– বলৈশ্বর্যাধিপতি দেবতা, আমাদের অভিমুখী হয়ে, আমাদের কর্মক্যাত্ম এই প্রার্থনা শ্রবণ করুন; এবং সর্বশক্তিমান্ শ্রেষ্ঠধনসম্পন্ন দেবতা আমাদের সৎকর্মসাধক করে আমাদের সত্ত্বভাব প্রদান করবার জন্য আগমন করুন। (ভাব এই যে, আমাদের সৎকর্ম-সহযুত প্রার্থনা শ্রবণ করে আমাদের সৎকর্ম-সাধন-সামর্থ্য এবং শুদ্ধসত্ত্বভাব প্রদান করুন)। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৩অ-৬দ-৮সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১৪/২– বিশ্ববাসী জনসমূহ অর্থাৎ সকল লোক সেই স্বতন্ত্র, অভীষ্টবর্ষক, প্রসিদ্ধ পরম দেবতাকেই প্রাপ্ত হোক; অপিচ, হে দেব! শ্রেষ্ঠদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ আপনি আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন; হে দেব! আপনার অন্তঃকরণ সাধকদের শুদ্ধসত্ত্বগ্রহণেচ্ছু অর্থাৎ আপনি মুক্তিদাতা। (মন্ত্রটি ভগবানের মাহাত্ম্যখ্যাপক ও প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — হে ভগবন! মুক্তিদাতা আপনি আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন; সকল লোক আপনার কৃপায় মোক্ষপ্রাপ্ত হোক)। [তিনভাগে বিভক্তব্য এই মন্ত্রের প্রথম দুঅংশে প্রার্থনা ও তৃতীয় অংশে নিত্যসত্য প্রখ্যাপন আছে। মন্ত্রের প্রার্থনার মধ্যে যে একটা বিশ্বজনীনতার ভাব ফুটে উঠেছে, তা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এই বিশ্বপ্রেমের মূলে আছে দার্শনিক– জ্ঞান, বিশ্বের একত্বের ধারণা। বিশ্ব ভগবান্ থেকে এসেছে, এটি তাতে সূত্রে মণিগণা ইববিধৃত আছে। এর এক অংশকে পশ্চাতে ফেলে অন্য অংশের অগ্রসর হবার উপায় নেই। পশ্চাতের অংশ অন্য অংশকে পশ্চাতেই টানবে। শুধু তাই নয়, বিশ্বে যদি সত্যের, জ্ঞানের আধিপত্য স্থাপিত না হয়, বিশ্ববাসীসকল যদি পবিত্র না হয়, তাহলে উন্নত অংশও পারিপার্শ্বিকতার চাপে অবনত হয়ে পড়তে বাধ্য হবে। সুতরাং মোক্ষলাভ করতে হলে পারিপার্শ্বিক অবস্থাও সেই অবস্থা লাভের উপযোগী হওয়া চাই। আর্য ঋষিগণ এই সত্যের সাক্ষাৎকার লাভ করেছিলেন সৃষ্টির সেই আদিমতম মুহূর্তেই এবং তাদের অদ্ভুত শিক্ষা প্রণালীর গুণে সমাজের সর্বস্তরেই এই জ্ঞান বিস্তৃত লাভ করেছিল]। [এই সূক্তের অন্তর্গত মন্ত্র দুটির একত্র গ্রথিত গেয়গানের নাম– বৈয়শ্বম ও বাশম]।

 .

অষ্টম খণ্ড

সূক্ত ১৫– পবস্ব দেব আয়ুষগিং গচ্ছতু তে মদঃ। বায়ুমা বোহ ধর্মণ ॥১॥পবমান নি তোশসে রয়িং সোম শ্ৰবাষ্য। ইন্দো সমুদ্রমা বিশ৷৷২৷৷ অপঘ্ন পবসে মৃধঃ ক্রতুবিৎ সোম মৎসরঃ। নুদস্যাদেবয়ুং জনম্ ৷৷৩৷ অভী নো বাজসাতমং রয়িম শতশৃহম্। ইন্দো সহস্ৰভর্ণর্সং তুবিদ্যুম্নং বিভাসহ৷৷৷৷৷ বয়ং তে অস্য রাধসো বসোর্বসসা পুরুস্পৃহঃ। নি নেদিষ্ঠতমা ইষঃ স্যাম সুমে তে অব্রিগো॥২॥ পরি স্য স্বানো অক্ষরদিন্দুরব্যে মদচ্যুতঃ। ধারা য উর্ধো অধ্বরে ভ্রাজান যাতি গব্যয়ুঃ ॥৩৷৷

সূক্ত ১৭– পবস্ব সোম মহাসমুদ্রঃ পিতা দেবানাং বিশ্বাভিধাম৷৷৷৷৷ শুক্রঃ পবস্ব দেবভ্যঃ সোম দিবে পৃথিব্যৈ শং চ প্রজাভ্যঃ ॥২॥ দিবো ধর্তাসি শুক্রঃ পিযূষঃ সত্যে বিধর্ম বাজী পবস্ব৷৩৷৷

মন্ত্রার্থ— ১৫সূক্ত/১সাম– হে শুদ্ধসত্ত্ব! দ্যুতিমান্ তুমি আমাদের হৃদয়ে উদ্ভূত হও; অপিচ, তোমার সম্বন্ধি পরমানন্দ আনন্দয়ময় ভগবানকে প্রাপ্ত হোক; এবং তুমি বায়ুর ন্যায় ক্ষিপ্রগতিতে আমাদের প্রাপ্ত হও। (ভাব এই যে, — আমরা সত্ত্বভাব লাভ করে তার সাহায্যে যেন ভগবানকে লাভ করতে পারি)। [প্রচলিত ব্যাখ্যাতে সোমের উল্লেখ আছে]।

১৫/২– পবিত্রকারক হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি আকাঙ্ক্ষণীয় পরমধন সম্যভাবে আমাদের প্রদান ধরুন। হে আমাদের হৃদয়স্থিত সত্ত্বভাব! আনি অমৃতের সমুদ্রকে প্রাপ্ত হোন অর্থাৎ অমৃতের সমুদ্রে সম্মিলিত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন আমাদের পরমধন অমৃত প্রদান করুন)। [প্রচলিত ব্যাখ্যায় প্রার্থনার মধ্যে শত্রুর বিপুল ধন নাশের কথা আছে। সোমরসকে সম্বোধন করে এই প্রার্থনা উক্ত হয়েছে। সোমরস শত্রুর ধন নাশ করবে কেমন করে? শত্রুকে মাতাল করে? তাতে প্রার্থনাকারীর ভাগ্যেও ঘটতে পারে। যাই হোক, একথা সহজেই অনুমেয় যে, ভাষ্য ইত্যাদিতে মন্ত্রের মূল ভাব রক্ষিত হয়নি]।

১৫/৩– হে শুদ্ধসত্ত্ব! শত্রুদের বিনাশ করে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! রিপুজয়ী করে আমাদের শুদ্ধসত্ত্ব প্রদান করুন)। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত পাঁচটি গেয়গানের নাম– সুরূপাদ্যম, ভাম, কাক্ষীবন্তিমি., গায়ত্ৰালাসিতম, ঐড়সৈন্ধুক্ষিতম]।

১৬/১– হে ভগবন! আমাদের পরমধন প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ কৃপাপূর্বক আমাদের পরমধন প্রদান করুন)। [ভাল জিনিষ সকলেই পেতে চায়। যার দ্বারা মানুষ উপকার পায়, — যা মানুষকে শক্তি দিতে পারে, তা-ই মানুষ আগ্রহের সাথে কামনা করে। সত্ত্বভাব মানুষকে তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাম্যবস্তু দিতে পারে; কাজেই সকলে তা-ই পাবার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। সেইজন্যই বাজসাতমং অর্থাৎ পরমধন পাবার প্রার্থনার করা হয়েছে]।

১৬/২– পরমাশ্রয় (অথবা পরমধনদাতা) হে দেব! প্রার্থনাকারী আমরা যেন সকলের আরাধনীয় এ আশ্রয়দাতা অথবা পরমধনদাতা প্রসিদ্ধ আপনার পরমধনের অত্যন্ত সমীপবর্তী হই। (ভাব এই যে, আমরা যেন আপনার পরমধন লাভ করি)। ঊর্ধ্বগতিপ্রাপক হে দেব! আপনার পরমানন্দের জন্য আমরা যেন সিদ্ধি নিঃশেষে প্রাপ্ত হই। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! আমরা যেন আপনার পরমানন্দ এবং পরমধন প্রাপ্ত হই)। (মন্ত্রের প্রথমাংশে সাধক যেন পরমধনের অতিশয় নিকটবর্তী হতে অর্থাৎ পরমধন লাভ করতে প্রার্থনা করছেন। দ্বিতীয়াংশে চাইছেন– পরাসিদ্ধি সাধনায় সিদ্ধিলাভ]।

১৬/৩– পরাজ্ঞানলাভেচ্ছুক ব্যক্তি যেমন দিব্যজ্যোতিঃর সাহায্যে সৎকর্মে প্রবৃত্ত হন, তেমনই যিনি ঊর্ধ্বগতিপ্রাপক পরমানন্দদায়ক, বিশুদ্ধকারক, সেই প্রসিদ্ধ শুদ্ধসত্ত্ব ধারারূপে নিত্যজ্ঞানে সম্মিলিত হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভাব এই যে, — মোক্ষদায়ক পরমানন্দদায়ক শুদ্ধসত্ত্ব পরাজ্ঞানের সাথে মিলিত হয়)। [প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে মন্ত্রটি জটিল করে তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে– মাদকতা-শক্তিধারী সোম নিপীড়িত হয়ে মেষলোমের চতুর্দিকে ক্ষরিত হলেন। তার ধারা যজ্ঞস্থলে ঊর্ধ্বে যাচ্ছে; তিনি দীপ্তিশালী হয়ে দুগ্ধের সাথে মিশ্রিত হবার নিমিত্ত আসছেন। এইভাবে পদে পদে সোমরসের কল্পনা বৈদিক ঐতিহ্যকে আঘাত করেছে। অথচ একটু সতর্কতার সাথে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, — এই মন্ত্রেও সোমরসের কোন উল্লেখ নেই। ভ্রাজান উপমার অর্থ দিব্যজ্যোতিষা সহ। এই উপমা গবায়ুঃ পদের সাথে অন্বিত। তাতে অর্থ দাঁড়িয়েছে এই, পরাজ্ঞানলাভেচ্ছুক ব্যক্তি যেমন দিব্যজ্যোতির সাহায্যে সৎকর্মে প্রবৃত্ত হন। — ইত্যাদি]। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের চৌদ্দটি গেয়গান আছে। যথা;- গৌরীবিতম, ঐডকৌৎসম্, শুদ্ধাশুদ্ধিয়াদ্যম, ক্রৌঞ্চাদ্যম ইত্যাদি]।

১৭/১– হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি মহত্ত্ব ইত্যাদি সম্পন্ন, তুমি সমুদ্রতুল্য অসীম ও অভিক্ষরণশীল; তুমি দেবভাবসমূহের উৎপাদক; তুমি সকল স্থান অভিলক্ষ্য করে অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বে ক্ষরিত হও। (ভাব, এই যে, সমগ্র বিশ্ব সত্ত্বভাবে পূর্ণ হোক)। [সত্ত্বভাব বিশ্বব্যাপী। ভগবান্ শুদ্ধসত্ত্বময়। এই বিশ্ব তাঁর, বহিঃপ্রকাশমাত্র। তাই সত্ত্বভাবই সমগ্র বিশ্বে নিগূঢ়ভাবে অনুচ্যুত হয়ে রয়েছে। ভগবানের গুণ অনন্ত; বিশুদ্ধ সত্ত্বও অনন্ত। জগতের পাপমোহ অপসৃত হলেই সেই সত্ত্বভাব প্রকাশিত হয়। তাই পরোক্ষভাবে জগতের পাপ অজ্ঞানতা প্রভৃতি নাশের জন্য প্রার্থনা এই মন্ত্রে দেখতে পাওয়া যায়]। [এই মন্ত্রটি ছন্দ আর্চিকেও (৪অ-৯দ-৩সা) পরিদৃষ্ট হয়]।

১৭/২– হে শুদ্ধসত্ত্ব! জ্যোতির্ময় আপনি দেবভাব লাভের জন্য আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন; অপিচ; দ্যুলোক-ভূলোকের এবং সকল লোকের সুখকর হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে দেবভাব লাভ করি; বিশ্বাবাসী সকল জীব পরমসুখ লাভ করুক)। [দিবে পৃথিব্যৈ ও প্রজাভ্যঃ পদ তিনটিতে কেবলমাত্র পৃথিবীর অধিবাসী জীববৃন্দের জন্য নয়, বিশ্ববাসী সকলের মুক্তির জন্য, মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে]।

১৭/৩– হে দেব! জ্যোতির্ময় অমৃতস্বরূপ আপনি দ্যুলোকের ধারণকর্তা হন; সর্বশক্তিমান্ আপনি কৃপাপূর্বক সত্যপ্ৰাপক সৎকর্মসাধনে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রখ্যাপক এবং প্রার্থনামূলক। এর ভাব এই যে, ভগবান্ বিশ্বের ধারক ও রক্ষক হন; সৎকর্মের সাধনে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন)। [তার আবির্ভাব না হলে মানুষ জ্ঞানালোক লাভ করতে পারে না। তার কৃপাতেই মানুষ জ্ঞান লাভ করতে পারে– আবার সেই জ্ঞানবলেই তাকে জানতে পারে। সূর্য যেমন জগতে আলোক প্রদান করে সেই আলোকের কেন্দ্রস্বরূপরূপে জ্ঞাত হন, ঠিক সেইভাবে জ্ঞানস্বরূপ ভগবানও নিজের দেওয়া জ্ঞান-জ্যোতিঃর দ্বারা জ্ঞাত হন]। [এই সূক্তের তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত দুটি গেয়গান আছে। সে দুটির নাম– ধর্মম ও আন্ধীগবম]।

.

নবম খণ্ড

সূক্ত ১৮– প্রেষ্ঠং বো অতিথিং স্তুষে মিত্রমিব প্রিয়। অগ্নে রথং ন বেদ্য৷৷৷৷৷ কবিমিব প্রশংস্যং যং দেবাস ইতি দ্বিতা। নি মর্ত্যেস্বাদধূঃ ॥২৷৷ ত্বং যবিষ্ঠ দাশুষো, পাহি শৃণুহী গিরঃ। রক্ষা তোকমুত অনা৷৷৩৷৷

সূক্ত ১৯– এন্দ্র নো গধি প্রিয় সত্রাজিদগোহ। গিরির্ন বিশ্বতঃ পৃথুঃ পতির্দিবঃ ॥১৷৷অভি হি সত্য সোমপা উভে বভথ বরাদসী। ইন্দ্রাসি সুন্বততা বৃধঃ পতিদিবঃ ॥২৷৷ ত্বং হি শশ্বতীনামিন্দ্র ধর্তা পুরামসি। হন্তা দস্যোৰ্মনো বৃধঃ পতির্দিবঃ ॥৩॥

সূক্ত ২০– পুরাং ভিযুব কবিরমিতৌজা অজায়ত। ইন্দ্রো বিশ্বস্য কর্মণো ধর্তা বর্জী পুরুষ্টুতঃ ॥১৷৷ ত্বং বলস্য গোমতোহপাবরবিবা বিলম্। ত্বং দেবা অবিভষস্তুজমানাস আবিষ্ণুঃ ॥২॥ ইন্দ্ৰমীশানমোজসাভি স্তোমৈরনুষত। সহস্রং যস্য রাতয় উত বা সন্তি ভূয়সীঃ ৷৩৷৷

মন্ত্ৰাৰ্থ— ১৮সূক্ত/১সাম– হে জ্ঞানদেব (অগ্নে)! এক হয়েও বহু হই (বঃ)– যাঁর কর্তৃক উক্ত হয়েছে, সেই আপনাকে বিশ্বের ন্যায় প্রীতিহেতুভূত এবং মোক্ষলাভপক্ষে রথস্বরূপ জেনে, স্তব করছি। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেব! আপনি সর্বদেবময় চতুর্বর্গফলপ্রদ সুহৃদের মতো হন; আপনাকে রথস্বরূপ জেনে, পরিত্রাণলাভের জন্য অর্চনা করছি)। [এই মন্ত্রার্থের সম্পূর্ণ বিপরীত-ভাবমূলক অন্য অর্থ এ যাবৎ প্রচলিত রয়েছে। একটি বঙ্গানুবাদ– প্রিয়তম অতিথি ও মিত্রের ন্যায় প্রিয় এবং রথের ন্যায় ধনবাহক অগ্নিকে তোমাদের জন্য স্তব করছি। প্রখ্যাত এক বেদজ্ঞ পণ্ডিতের ব্যাখ্যার মর্মার্থ এই যে, এ উশনা ঋষি অসুরদের পুরোহিত ছিলেন। দেবতাদের পক্ষ হয়ে অগ্নি ঋষি অসুরদের শিবিরে দূতরূপে গমন করেন। অসুরেরা অগ্নি ঋষিকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। ঋষি উশনা সেই উপলক্ষে অসুর ও সৈন্যদের নিরস্ত করবার প্রয়াস পান। তিনি বলেন, — অগ্নি ঋষি দূতরূপে আগমন করেছেন। সুতরাং তিনি প্রেষ্ঠং প্রিয়তম। তিনি তোমাদের অতিথিং। সুতরাং মিত্রের ন্যায় প্রিয়। তাকে স্তব করাই বিধেয়। তাকে রথের অর্থাৎবাহকের ন্যায় জানবে। কেননা, তিনি অপর পক্ষের বার্তা বহন করে এনেছেন মাত্র। বার্তাবহ বলেই দূত অবধ্য।  এইভাবে বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন কৌতূহলপ্রদ অর্থ প্রকাশ পেয়ে আসছে]।

১৮/২– দেবগণ, প্রজ্ঞানস্বরূপ আরাধনীয় প্রসিদ্ধ যে জ্ঞানদেবকে মানবহৃদয়ে পরা এবং অপরা এই দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন, সেই জ্ঞানদেবকে আমরা প্রার্থনা করছি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমরা যেন পূর্ণজ্ঞান লাভ করি)। অথবা– দেবগণ অথবা দেবভাবসমূহ জ্ঞানস্বরূপ আরাধনীয় প্রসিদ্ধ যে পরমদেবতাকে মানবজ্ঞানের মধ্যে প্রকৃতি তথা পুরুষ এই দুই ভাগে নিহিত করেছেন, সেই পরমদেবতাকে যেন আমরা আরাধনা করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, — প্রকৃতি পুরুষরূপে দ্বিধাবিভক্ত ভগবানকে আমরা যেন আরাধনা করি)। [প্রথম অন্বয়ে যংপদে জ্ঞানদেবতাকে লক্ষ্য করা হয়েছে। জ্ঞানকে দুভাগে বিভক্ত করা হয়, — পরাজ্ঞান ও অপরাজ্ঞান। অপরাজ্ঞান বলতে জাগতিক বস্তুর ব্যবহারিক জ্ঞান বোঝায়, যেমন ঘটি-বাটি পভৃতির জ্ঞান। এই জ্ঞান মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য প্রয়োজন। এই সাংসারিক বা অপসজ্ঞানের মধ্য দিয়ে মানুষকে পরাজ্ঞান স্বরূপজ্ঞানে পৌঁছাতে হয়। অর্থাৎ জাগতিক বস্তুর অস্তিত্ব ও সৃষ্টি সম্পর্কে ঔৎসুক্যের ফলে অনুসন্ধানে প্রবৃত্তি আসে। যেমন, সেই বস্তুর নির্মাণকারী কে, সে এই নির্মাণকৌশল কেমনভাবে শিক্ষা করল, তার অন্তরে সেই জ্ঞানশক্তি কোথা থেকে এল, এই জ্ঞানের মূল উৎস কোথায়– ইত্যাদি। এইভাবে একটি জাগতিক বস্তুর সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞান লাভ করতে গিয়ে মানুষ জগতের সম্বন্ধেজগতের মূলকারণ সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করতে পারে– অর্থাৎ অপরাজ্ঞান থেকে পরাজ্ঞানে পৌঁছায়। এই প্রণালীকে আরোহণ-প্রণালী বলৈ। মানুষ মোক্ষলাভ করে– পরাজ্ঞানের, স্বরূপজ্ঞানের দ্বারা। সেই পরাজ্ঞানই মানুষের আকাঙ্ক্ষার বস্তু। দ্বিতীয় অন্বয়ে যং পদে সেই পরমপুরুষকে লক্ষ্য করছে; যিনি নিজেকে প্রকৃতি ও পুরুষরূপে দ্বিধাবিভক্ত করেছেন। তিনিই প্রকৃতি, তিনিই পুরুষ। তিনিই এক হয়ে সৃষ্টিকর্মের জন্য দুই হয়েছে। প্রকৃতি জগতের উপাদান কারণ রূপে পরিবর্ণিত, আর পুরুষ চৈতন্য সত্তা অথবা বিশ্বচৈতন্য। স্থূলকথায় বলা যায়– জড় ও চৈতন্য একই সত্তার বিভিন্ন দিক মাত্র। সেই দ্বিধাবিভক্ত একমেব অদ্বিতীয়ং পরমপুরুষের কাছেই প্রার্থনা করা হয়েছে। — প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে কিভাবে মন্ত্রটি গৃহীত হয়েছে, তা দেখা যেতে পারে। একটি বঙ্গানুবাদ– দেবগণ, যে অগ্নিকে প্রকৃষ্ট-জ্ঞানবিশিষ্ট পুরুষের ন্যায় মনুষ্যগণের মধ্যে দুরকমে স্থাপিত করলেন। — মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।

১৮/৩– নিত্যতরুণ হে দেব! আপনি প্রার্থনাকারী আমাদের রক্ষা করুন, আমাদের প্রার্থনা শ্রবণ করুন অর্থাৎ আরাধনা গ্রহণ করুন;অপিচ, আপনশক্তিতে পুত্ররূপ আমাদের রিপুকবল হতে পরিত্রাণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন! কৃপাপূর্বক আপনি আমাদের সর্ববিপদ থেকে রক্ষা করুন এবং আমাদের পূজা গ্রহণ করুন)। [যবিষ্ঠ পদের ভাষ্যার্থ-যুবতম, অনুবাদার্থ সর্বকনিষ্ঠ, এই যবিষ্ঠপদে কি ভাব দ্যোতনা করে?তাকে যুবতমবলার অর্থ কি? ভগবান্ নিত্যতরুণ; তিনি কখনও পুরাতন হন না, তিনি অবিনাশী, অবিনশ্বর। তাঁর জন্ম নেই; মৃত্যু নেই, হ্রাস নেই– তিনি অপরিবর্তনীয়। তাকে বৃদ্ধাদপি বৃদ্ধও বলা যায়;আবার যবিষ্ঠ-ও তার যোগ্য বিশেষণ। তিনি ভক্তের ও কাছে অতি বড় বৃদ্ধ বলেই প্রতিভাত। সমস্তই তাতে সম্ভবে, তিনি সর্ববিরোধের মীমাংসাভূমি। রিপুর কবল থেকে উদ্ধার পাবার জন্য সেই নিত্যতরুণ দেবতার কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে। এখানে যবিষ্ঠ বা নিত্যতরুণ বলার আরও একটি নিগূঢ় ভাব লক্ষ্য করা যায়। তরুণত্বের মধ্যে জীবনের যে সাড়া পাওয়া যায়, প্রাণের যে স্পন্দন পাওয়া যায়, অন্যত্র তা দুর্লভ। রিপুদমন করতে হলে সজীব প্রাণের বিপুল শক্তির প্রয়োজন। জীবনসংগ্রামে জয়লাভ করবার জন্য, নবজীবনের নূতন কর্মপ্রেরণা, অদম্য শক্তির খেলা মানুষকে চঞ্চল অধীর করে তোলে। রিপুসংগ্রামে জয় প্রদান করবার জন্য, রিপুর কবল থেকে উদ্ধার করবার জন্য যে শক্তির প্রয়োজন, তা এই যবিষ্ঠংপদের মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে)। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একত্রগ্রথিত গেয়গানটির নাম– গায়ত্র্যৈৗশম]।

১৯/১– সকলের প্রিয়তম, রিপুজয়কারী, অপরাজেয়, পরমৈশ্বর্যশালিন্ হে ভগবন! আপনি পর্বতের ন্যায় স্থির অটল; অপিচ, বিশ্বব্যাপী এবং সর্বলোকের অধিপতি হন। আপনি আমাদের হৃদয়ে আগমন করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, -হে ভগবন! কৃপা করে আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হোন)। [সাধক ভগবানকে বন্ধুরূপে আহ্বান করছেন। দূরে থেকে আর তৃপ্তি লাভ করতে পারছেন না। নিকটে, আরও নিকটে, হৃদয়ের নিভৃত স্থানে তাকে পাওয়া চাই। কিন্তু তিনি কেবল ব্যক্তিবিশেষের বা জাতিবিশেষের প্রিয় নন, তিনি বিশ্ববন্ধু, বিশ্বের সকলের প্রিয়তম। সাধক সেই জগৎবন্ধু ভগবানকে নিজের হৃদয়ে উপলব্ধি করবার জন্য তারই কাছে প্রার্থনা করছেন]। [এই মন্ত্রটি ছদ আর্চিকেও (৪অ-৫দ-৩সা) পাওয়া যায়]।

১৯/২– সত্যস্বরূপ শুদ্ধসত্ত্বদাতা বলাধিপতি হে দেব! আপনিই দ্যুলোক-ভূলোককে অভিভূত করেন, অর্থাৎ দ্যুলোক-ভূলোকের স্বামী হন; পবিত্ৰজনের– সাধকের মোক্ষদায়ক এবং স্বর্গের প্রভু হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভগবানই বিশ্বলোকের স্বামী এবং সকল লোকের মোক্ষদায়ক হন)।

১৯/৩– বলাধিপতি হে দেব! আপনিই বহু শত্রুনগরীর নাশয়িতা হন; আপনি অসুরের– পাপের নাশক, সাধকের বর্ধক অর্থাৎ মোক্ষদায়ক এবং দ্যুলোকের স্বামী হন। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যমূলক। ভগবানই সকলের সকল রিপুর বিনাশকারী এবং লোকবর্গের মোক্ষদায়ক হন)। [তিনি দস্যোঃ হন্তাঅসুরের, পাপের নাশকারী। দস্যু যেমন মানুষের-সাংসারিক ধনরত্ন হরণ করে নেয়, পাপ তেমনই মানুষের অধ্যাত্ম-জীবনের সম্বল, পুণ্যও হরণ করে। জাগতিক সামান্য ধনরত্ন নাশ হলে মানুষের অতি অল্পই ক্ষতি হয়; কিন্তু পুণ্যজীবন বিনষ্ট হলে তা ফিরে পাওয়া খুবই শক্ত। ভগবান কৃপাপরবশ হয়ে যাঁকে এই রিপুদের, পাপের হাত থেকে উদ্ধার করেন, তিনিই অনায়াসে মোক্ষমার্গে অগ্রসর হতে পারেন, মোক্ষলাভে সমর্থ হন। তাই ভগবানকে মনোঃ বৃধঃ মানুষের, সাধকের বর্ধক বলা হয়েছে। [এই সূক্তের অন্তর্গত তিনটি মন্ত্রের একটি গেয়গান আছে। সেটির নাম– সাম্বর্তম]।

২০/১– সেই ইন্দ্রদেব রিপু-শত্রুগণের দুর্ভেদ্য দুর্গ-ভেদকারী, চিরনবীন, মেধাবী, প্রভূতবলশালী, বিশ্বের সকল সৎকর্মের পরিপোষক, অনুগত জনের রক্ষার জন্য সর্বদা বজ্রধারী, সর্বজন কর্তৃক স্তুত এবং সৎকর্মের সাথে প্রকাশমান। (ভাব এই যে, — ভগবানের বলৈশ্বর্যের বিভূতিধারী ইন্দ্রদেব বহুকর্মশালী বহুগুণেপেত; কর্মের জন্য স্তুত হয়ে কর্মের দ্বারাই তিনি প্রকাশিত হন; তার অর্চনার দ্বারাই মানুষ তার মতো গুণযুত হয়)। [এই মন্ত্রের অন্তর্গত পুরাং ভিন্দুঃ শব্দ দুটি উপলক্ষে নানারকম অর্থ কল্পনা করা হয়। কারও কারও মত এই যে, ভারতবর্ষে আগমনকালে আর্যদের নেতৃস্থানীয় ইন্দ্রদেব অসুরদের দুর্গ ইত্যাদি উদ্ভিন্ন করেছিলেন, মন্ত্রে তেমন ভাবই প্রকাশমান্ আছে। আবার, দেবাসুরের সংগ্রামে অসুর পক্ষের দুর্গ ধ্বংসের বিষয়ও এই প্রসঙ্গে উল্লিখিত হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে মন্ত্রের সাথে পুরাবৃত্তের বা পুরাণকথিত উপাখ্যানের সম্বন্ধ-সূচনা পরবর্তী কালের কল্পনা-মাত্র। নচেৎ, মন্ত্রের মধ্যে তেমন কোনও না এ সম্বন্ধ-সংশ্রবের প্রমাণ আদৌ পাওয়া যায় না। — রিপুশত্রুপরিবৃত অজ্ঞানান্ধকারাচ্ছন্ন হৃদয়, এর চেয়ে শত্রুর দুর্ভেদ্য দুর্গ আর কি হতে পারে? ভগবানের দয়ায় জ্ঞানরশ্মি প্রবিষ্ট হলে, সে দুর্গ ভঙ্গ হয়। পুরাং ভিন্দুঃ পদ দুটি সেই ভাবই ব্যক্ত করছে। তিনি বিশ্বস্য কর্মণো ধর্তা। এই বাক্যে সকল সৎকর্মের তিনি সহায়– এই ভাবই উপলব্ধ হয়। সাধু-সজ্জনের রক্ষার জন্য, তাদের শত্রুভয় দূর করবার জন্য, তিনি সর্বদা বজ্র ধারণ করে আছেন। এই জন্যই তাকে বজ্ৰী বলা হয়েছে]।

২০/২– শত্রুগণের প্রতি অদ্রির ন্যায় কঠোর হে ভগবন! আপনি যখন আমাদের রিপুশত্রুগণের গুহাকে অর্থাৎ পাপকর্মের কেন্দ্রস্থানকে (অর্থাৎ অন্তরকে) ভেদ করে জ্ঞানকিরণান্বিত রক্ষণ-উপায়কে আমাদের হৃদয়-দেশে প্রতিষ্ঠিত করেন, তখন রিপুশত্রুগণের নাশক (পাপ-বিমদক) দেবভাব-নিবহ শত্রুর ভয়ে অভিভূত না হয়ে আপনাকে প্রাপ্ত হয়। (ভাব এই যে, ভগবানের কৃপাতেই অজ্ঞানান্ধকার নাশ পায়, দিব্যজ্ঞানসমূহ হৃদয়-দেশ অধিকার করে, শত্রুভয় দূরে যায়; তখন ভগবানকে পেয়ে মানুষ পরাগতি প্রাপ্ত হয়)। [এই মন্ত্রে অন্তর্গত বলস্য বিলং শব্দ দুটি নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। বলনামক অসুর দেবতাদের গাভী চুরি করে পর্বতের গুহায় লুকিয়ে রেখেছিল। ইন্দ্রদেব সেই গাভীর উদ্ধার সাধন করেন। পৌরাণিক এই এক উপাখ্যান– এই মন্ত্রের ভিত্তি বলে কেউ কেউ কল্পনা করে থাকেন। সায়ণাচার্যও এই মতের সমর্থক। আরও কতরকম মত যে প্রচলিত, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু এ সব অর্থ যে পরবর্তী কালে কল্পিত এবং দূর-অন্বয়-মূলক, তাতে কোনও সন্দেহই নেই। -কেন বল অসুরকে টেনে আনব? কেন গরু-চুরির উপাখ্যান কল্পনা করব? যখন দেখছি, আমার হৃদয় অসুরে আক্রমণ করে আছে; যখন দেখছি, অজ্ঞানতার সূচীভেদ্য অন্ধকার রূপ প্রাচীর-বেষ্টনে তারা দৃঢ় দুর্গ রচনা করে বসেছে; আর যখন দেখছি, তাদের দুর্ভেদ্য ব্যুহ আমার জ্ঞানকে সর্বদা প্রতিহত করছে; তখন, আমি অন্যত্র আবার কোন্ গো-চোরের খোঁজে ফিরব? অন্তরের মধ্যে চোর; হৃদয়ের অভ্যন্তরে চোরের রাজত্ব। মন্ত্র তাই বলেছেন, হৃদয় পরিষ্কার করো; ভগবানের ভগবানের শরণাপন্ন হও। তবেই তো তোমার শত্রু বিমর্দিত হবে। তবেই তো ভগবান্ তোমার রিপুশত্রুকে দমন করে তোমার হৃদয়ের অন্ধকার দূর করবেন। তবেই তো শত্রুর অধিকৃত দুর্ভেদ্য দুর্গ-দ্বার বিমুক্ত হবে। তবেই তো তোমার হৃদয়ে দিব্যজ্ঞান প্রবেশ করবে। এর চেয়ে এই মন্ত্রের সঙ্গত অর্থ হয় না]।

২০/৩– যে ভগবান্ ইন্দ্রদেবের, ধনদান কর্মসমূহ সহস্র সহস্র রকমে অথবা অশেষ প্রকারে বিহিত হয়, জগতের নিয়ন্তা সেই ইন্দ্রদেবকে স্তোতৃগণ নিজেদের সাধনশক্তির প্রভাবে প্রাপ্ত হন। (ভাব এই যে, ভগবানের বলৈশ্বর্যের প্রতীক বা বিভূতিধারী ইন্দ্রদেব অশেষ দানশীল; স্তোতৃগণ সাধনশক্তির প্রভাবে সেই দান লাভ করেন)। [দানের পরিমাণ, দানের রকমভেদ, তাই সহস্র-সহস্রের বেশী। তুমি কি চাও? কত চাও? তাঁর অফুরন্ত সম্পদের ভাণ্ডারের দ্বার উন্মুক্ত করে তিনি বসে আছেন। যা আকাঙ্ক্ষা করো, তাই পাবে। বিশ্বাস হলো না? ফিরে এস, কর্মফল ভোগ করো। করুণা-দানের জন্য করুণাময় মুক্তহস্ত হলেও, সে করুণা সকলের ভাগ্যে ঘটে কি? ভগবানের বাক্যে অবিশ্বাসী জন স্বেচ্ছায় অন্ধত্ব বরণকারী মানুষের দশা পায়। এ মন্ত্র সেই সত্য ঘোষণা করছেন। তুমি অন্ধ সেজে চক্ষু বুজে চলে যাচ্ছ। সুতরাং তোমার ভাগ্যে যে ফল লাভ আছে, সে গতি রুখবে কে? তোমার প্রাক্তন– তোমার দুর্বুদ্ধিই তো তোমায় বাধা দিচ্ছে। তোমার অতীত কর্ম, তোমার পারিপার্শ্বিকশত্রুগণ, তোমার বর্তমান শ্রেয়ঃসাধনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। উপায় অবশ্যই আছে। কর্মের দ্বারা প্রাক্তন পরিবর্তন করতে হবে। সৎকর্মের দ্বারা অপকর্মের গতিকে প্রতিহত করতে হবে। তাঁর শরণাপন্ন হও]। [এই সূক্তের একত্রগ্রথিত দুটি এ গেয়গানের নাম– মারুত্তম এবং মহাবৈশ্বমিত্রম্]।

নবম অধ্যায় সমাপ্ত —

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *