৩. সোজা চলে স্কুটার

বহুদূর পর্যন্ত সোজা চলে তার স্কুটার। তারপর বাঁক নেয়। রাস্তার আলো এখানে ক্ষীণ, বহু দূরে দূরে। দু-ধারে গাছ-গাছালি, ব্যাঙের ডাক শোনা যায়, রাস্তায় লোকজন বিরল। এক আধটা দোকান খদ্দেরহীন, আলো জ্বেলে বসে আছে দোকানি। এই সব রাস্তা পার হয়ে অমিয়র স্কুটারের আলো পড়ে একটা লেভেল ক্রসিংয়ের সাদা লোহার গেটে। এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় লাফায় হাল্কা স্কুটার, ভেঙে পড়তে চায়। অমিয় দাঁতে দাঁত চেপে হাতল সোজা রাখে। লেভেল ক্রসিংয়ে লাইনের মাঝখানে গভীর খন্দ, তাতে জল জমে আছে। ঝাঁকুনিতে ঘাড়ের রগ ছিঁড়ে পড়তে চায়। গর্তে পড়ে জলে ঢেউ তোলে স্কুটার। অমিয়র জুতো-মোজা ভিজে যায়। লেভেল-ক্রসিং পার হয়ে অন্ধকার কাঁচা রাস্তা। রাস্তার দু-ধারে ফাঁকা জমিতে দু-একটা ঘুমন্ত বাড়ি চোখে পড়ে। স্কুটার গোঙায়, তবু এগোয় ঠিক। বহুকাল আসা হয় না এদিকে। রাস্তাটা একটু গোলমেলে লাগে, স্কুটার থামিয়ে হেডলাইটটা বার কয়েক চারধারে ফেলে অমিয় স্কুটার ছাড়ে। এগোয়। অনেকটা গিয়ে ডানধারে ইটখোলাটা দেখতে পায় অমিয়। নাবাল মাঠে জল জমে গেছে। কী গম্ভীর ব্যাঙের ডাক। মনে হয় রাত নিশুতি হয়ে গেছে। ইটখোলার গা বেয়ে একটা গুঁড়ি পথ। দুধারে এই বর্ষায় আগাছা জন্মেছে খুব। পিছল হয়েছে রাস্তা, ক্ষয়ে গেছে। সেই রাস্তায় স্কুটার এগোয় না। এঁটেল মাটিতে চাকা পড়ে একই জায়গায় ঘুরতে থাকে। অমিয় টেনে তোলে। আবার এগোয়।

একটা নিমগাছ ছিল এখানে, আর কলার ঝাড়। সামনে উঠোন। মনে করতে চেষ্টা করে অমিয়। স্কুটার অনিচ্ছায় বহন করে তাকে। অনেকটা ভেতরে ঢুকে যায় সে। চারদিকে বাড়িঘর নেই। আলো নেই। কোনো মানুষ চোখে পড়ে না। অমিয় এগুতে থাকে। আঁকা বাঁকা পথে স্কুটার ঘোরে। কাদা ছিটকে আসে, ব্যাঙ লাফায়, জলের কলকল শব্দ হতে থাকে। বিদ্যুৎ চমকায় জলে-স্থলে। অমিয় প্রাণপণে চেয়ে দেখে, চিনতে চেষ্টা করে জায়গাটা। বহুকাল আসা হয়নি। বহুকাল।

স্কুটার লাফিয়ে উঠে একটা কলার ঝাড়ে আলো ফেলে এক মুহূর্তের জন্য। আভাসে একটা নিমগাছ দেখা যায় অবশেষে। উঠোন জলে ভাসছে। একটা অন্ধকার বেড়ার ঘর, টিনের চালে অবিরল বৃষ্টির শব্দ উঠছে। অমিয় স্কুটার থেকে নেমে উঠোনের আগল ঠেলে গোড়ালি ডুব জলে পা দেয়। ডাক দেয়–খুড়িমা! ও খুড়িমা!

দরজা খুলতেই একটা হ্যারিকেনের ম্লান, হলুদ আলো দেখা যায়।

–কে?

 অমিয় বারান্দায় উঠে আসে। একটা স্যাণ্ডো গেঞ্জি গায়ে বোকা চেহারার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। শোভনাদির ছেলে ভাসান। অমিয় চিনতে পারে।

–ভাসান, আমি অমিয়মামা। খুড়িমা কেমন আছে?

ছেলেটা ঠিক চিনতে পারে না প্রথমে, বিশ্বাস করতে পারে না। বোকা চোখে চেয়ে থেকে একটু সময় নেয় বুঝতে। তারপর বলে–অমিয়মামা? তুমি এই রাতে? কী হয়েছে?

অমিয়র হঠাৎ লজ্জা করতে থাকে। কী বলবে সে! এত রাতে মানুষ বড়োজোর বাড়ি ফেরে। কোথাও যায় না।

ভেতর থেকে ঘুম ভাঙা বুড়ি-গলায় কে জিজ্ঞেস করে–কে রে? কে এল রে ভাসান?

–অমিয়মামা।

–কে অমিয়?

ভাসান আলোটা সরিয়ে দরজা ছেড়ে বলে–ভেতরে এসো অমিয়মামা। দিদিমা ভালো নেই। হার্ট খুব খারাপ।

অমিয় তার ভেজা জুতো ছাড়ে। জামা-প্যান্ট থেকে যতদূর সম্ভব জল ঝেড়ে ফেলবার চেষ্টা করে। ঘরে ঢুকতেই ম্লান আলোয় বহুদিন আগেকার সেই ঘরখানা দেখে। হ্যারিকেনের গন্ধে ঘর ভরা, বিছানায় মশারি ফেলা! মশারির ভেতর হাতপাখা নাড়ার শব্দ। খুড়িমার কাছে মা মরার পর বহুদিন শুয়েছিল অমিয়। ঘুমের মধ্যেও খুড়িমার পাখা নড়ত নির্ভুলভাবে।

-কে এলি রে? মশারির ভিতর থেকে প্রশ্ন আসে।

–আমি খুড়িমা, আমি অমিয়।

 একটা অস্ফুট শব্দ করে খুড়িমা, গোঁজা মশারির এক দিক তুলে বুড়ো মুখখানা বের করে। চোখে আলো লাগতে মিট মিট করে তাকিয়ে বলে–অমিয় মানে মেজোঠাকুরের ছেলে?

ভাসান ধমক দেয়–তো আর কে অমিয় আছে?

–হ্যারিকেনটা তোল তো ভাসান, দেখি। অমিয়, কাছে আয়। দেখি তোর গা। ঠিক তুই তো?

ভাসান বলে–-শার্টটা ছেড়ে ফেল অমিয়মামা। ইস! তুমি খুব ভিজে গেছ।

অমিয় বিছানার ওপর ঝুঁকে পড়ে বলে–খুড়িমা, তুমি এত বুড়ো হলে কবে? এত বুড়িয়ে যাওয়ার কথা তো ছিল না তোমার।

–তুই কি এই বৃষ্টিতে এলি? কী হয়েছে তোর? খারাপ খবর আছে কিছু? কাছে আয়, দূরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

-তুমি কাকার থেকে চোদ্দো বছরের ছোটো ছিলে, তবে বুড়ো হলে কী করে?

মশারি তুলে খুড়িমা উঠে বসে। গা উদোম। কাপড় খসে গেছে। কোমরের কাপড় ঠিক করতে করতে বলে–তোর কাকা গেছে বিশ বছর আগে, তখনই আমার পঞ্চাশ পুরে গেছে। বয়সের হিসেব তুই কি জানবি? মেজোঠাকুরের বুড়োবয়সের সন্তান তুই। তোর জন্মের সময়ে মেজোঠাকুরের বয়স পঞ্চাশ-বাহান্ন, তোর মার চল্লিশ। তোর এখন বয়স কত?

–পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ।

-তবে? বয়সের হিসেব ঠিক রাখতে পারিস না তোরা। কাছে আয় তো দেখি, কীরকম ভিজেছিস!

খুড়িমা হাত বাড়িয়ে অমিয়কে ধরে কাছে টেনে নেয়। সমস্ত শরীরে মরা হাতখানা দিয়ে সেঁক দেওয়ার মতো চেপে চেপে ধরে তার শরীর দেখে।

–তুই কী পাগল? এমন কাক-ভেজা কেউ ভেজে? ভাসান, জামাকাপড় দে এক্ষুণি, তার আগে গামছা দে। রাখুকে বল এক পাতিল আগুন করতে, সেঁক না দিলে ও মরে যাবে।

-খুড়িমা, তুমি কেমন আছ?

-কী জানি! ডাক্তার বলেছে, ভালো না। কাপড়ে-চোপড়ে হেগে-মুতে ফেলি, আর বুকে একটা চাপ ব্যথা হয়। কতকাল আসিস না।

–আজ তো এলাম।

–এটা কীরকম আসা। তোর মাকে আমি রোজ স্বপ্নে দেখি। আমার ভরসায় তোকে ছেড়ে গিয়েছিল, তাই রোজ এসে খবর নিয়ে যায়। বাইরের নিমগাছতলায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে, ডাকে। বহু কালের পুরোনো ঝগড়া শত্রুতা তার সঙ্গে। ক-দিন পর আমিও তো তার কাছে যাব, এখন যদি তোর কিছু হয় তো সে আমাকে আস্ত রাখবে? এই বৃষ্টিতে ভিজে এলি, তুই কেমন পাগল? ও ভাসান–

–দিই।

 –তাড়াতাড়ি দে।

–খুড়িমা, আমি তোমাকে দেখতে এসেছি, চলে যাব। এখন আর জামাকাপড় ছেড়ে কী হবে?

-তোর বর্ষাতি নেই? ছাতা কিনিসনি? ওরে তোরা ওঠ, ও ভাসান, পাখিকে বল চা করবে, রাখুকে ঠেলে তুলে দে, পাতিলের আগুনটা করে দিক, আমি ওকে সেঁক দেব। অমিয়, কেন এসেছিস? অমিয়র বলতে ইচ্ছা করে, এই জন্যই। কিন্তু তা বলে না অমিয়, বলতে নেই। চুপ করে থেকে তার বুকে পিঠে মাথায় কঙ্কালসার হাতখানা অনুভব করে সে। এইটুকুর জন্য এত রাতে, দীর্ঘ পথ জল কাদা ঝোড়ো বাতাস ভেদ করে এসেছে সে।

–কেন এসেছিস? আমাকে দেখতে? আমি মরে গেলাম কিনা দেখতে এসেছিস? বলতে বলতে খুড়িমা একটু কাঁদে। বলে–সত্যিই খুড়িমাকে ভালোবাসিস অমিয়? তোর বউ বাপের বাড়িতে গেছে নাকি? বাচ্চা-কাচ্চা হবে না তো?

-না।

–তোর বাচ্চা হয় না কেন রে? অ্যাঁ! কী করিস তোরা? আঁট-বাঁধ দিয়ে রেখেছিস নাকি? বুড়োবয়সে হলে মানুষ করার সময় পাবি না। এখন হইয়ে ফেল।

-চুপ করো খুড়িমা।

–আমার তো ছেলে নেই। ভাসানকে বলি তোর খবর আনতে। তা সে তোর দোরগড়ায় গিয়ে গিয়ে ফিরে আসে, ভিতরে ঢোকে না, এসে বলে–মামা বাড়িতে থাকে না, মামিকে চিনি না, লজ্জা করে। আমি অবাক হই। মামিকে আবার চেনার কী আছে। গিয়ে কোলে বসে পড়বি, আবদার করবি, জ্বালাবি–তাতেই চিনবে।

-চুপ করো, তুমি চুপ করো।

–চুপ করব কেন? অমিয়, কেন এসেছিস?

–তোমাকে দেখতে।

ঘুম ভেঙে উঠে এসেছে রাখি আর পাখি। কেটলিতে জল ফোটে। পাতিলে কাঠকয়লার আগুন জ্বালে রাখি। অমিয় খালি গায়ে, ধুতি পেঁচিয়ে বসে। তাকে ঘিরে হ্যারিকেনের আলোয় একটা ছোটো উৎসব শুরু হয়।

-আমার কেউ নেই অমিয়। শোভনা তার তিন ছেলে-মেয়ে রেখেছে আমার কাছে, রক্ষা। ভেবেছিলাম, শোভনা আমার মেয়ে আর তুই ছেলে। তুই কেমন ছেলে?

পাতিলের আগুনের ওপর দুই হাত মেলে ধরে খুড়িমা। গরম হাত দু-খানা এনে তার গায়ে চেপে চেপে ধরে। কতকালের পুরোনো এক রক্তস্রোত আর এক রক্তস্রোতের খবর নিতে থাকে।

রাখু, ভাত চড়াসনি?

–না তো! মামা কী খেয়ে যাবে?

 –খেয়ে যাবে না তো কী? কোথায় খাবে?

–আমি খাব না খুড়িমা।

–কেন খাবি না? বউ রেঁধে রেখেছে বলে? গেরস্তর ঘরে কখনো ভাত নষ্ট হয় না। খেয়ে যা। আপিস থেকে এলি তো?

–হ্যাঁ।

–পাখি, তুই একটু হাত গরম করে সেঁক দে। আমি একটু শুই, বুকটা কেমন করে।

কথা বোলো না।

–বলব না! কেন? কাছে এসে বোস আরও। তোর বউকে বিয়েতে আমি গয়না দিইনি, না? কী দিয়েছিলাম যেন?

পাখি মুখ তুলে বলে–দিয়েছিলে। নাকছাবি।

-ওঃ। নাকছাবি আবার গয়না! অমিয়, তোর ছেলে-মেয়ে হলে একছড়া গোঠ দেব। তিন ভরি সোনা। তুই কোথায় থাকিস যেন?

–ঢাকুরিয়া।

–সে কী অনেক দূর? যদি দূর না হয় তো তোর বউ, কী-নাম যেন, তাকে নিয়ে আসিস। ভাসান, পাখি, তোরা ওর সঙ্গে কথা বলছিস না কেন? কথা বল।

–তুমি অত তাড়া দিলে কথা বলবে কখন? চা করছে, গা সেঁকছে, ভাত রাঁধছে, ওদের তো বসতেই দিচ্ছ না।

-তাড়া কী সাধে দিই! তোর মাকেই আমার ভয়। তার মুখের বড়ো ধার ছিল। এখনও এ বাড়ির আনাচে-কানাচে ঘুরে জিভ শানাচ্ছে, আমি গেলেই ধরবে আমাকে। হ্যাঁ রে, পরের মেয়ে বউ হয়ে এসে আপনজন হয়ে যায়, আর পরের মা কিছুতেই কী মা হতে পারে না? কেন এসেছিস অমিয়?

-খুড়িমা, তুমি আমাকে গল্প বলো।

–কীসের গল্প শুনবি?

 –আমার গল্প বললো। আমি কেমন ছিলাম?

–তুই? তুই আবার আলাদা কী ছিলি! আর পাঁচজনের মতোই ছিলি তুই। শিশুকালে সবাই এক থাকে, বড়ো হয়ে আলাদা রকমের হয়।

-তবু বলো।

–খুব দুষ্টু ছিলি। ভীষণ। মা ছিল না বলে তোর আদর ছিল সবচেয়ে বেশি। আশকারা পেয়ে মাথায় উঠেছিলি। তোর দিদি নানি সেই তুলনায় ঠাণ্ডা ছিল। পুরুলিয়ার বাড়িতে একটা মস্ত দিঘি ছিল–তার এপার-ওপার দেখা যায় না, তার কালো জল খুব গভীর, বড়ো বড়ো মাছ ছিল। দিঘির পারে একটা ডিঙিনৌকো বাঁধা থাকত–তাতে চড়ে মাঝ-দিঘিতে শ্বশুরমশাই মাছ ধরতে যেতেন। সেই…ডিঙিনৌকোয় চড়ে এক দুপুরে তুই আর নানি চুপি চুপি দিঘির মাঝখানে চলে গিয়েছিলি। চীৎকার শুনে আমরা দিঘির পাড়ে গিয়ে দেখি, নানি উঠে দাঁড়িয়ে বৈঠা তুলে চেঁচাচ্ছে, তুই নৌকোর এক ধারে ঝুঁকে আছিস। কেতরে নৌকোটা ভেসে আছে। সে যে কতদূর চলে গিয়েছিলি তোরা–এই টুকু টুকু দেখাচ্ছিল তোদের। চারদিক থেকে লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে কিন্তু তোরা এতদূরে যে পৌঁছোতে পারছিল না। নৌকোটা কেবলই কাত হচ্ছিল তখন, তুই ঝুলে ছিলি, পড়ে যাচ্ছিলি। কী ভয় আমাদের!

–তুমি কী করেছিলে?

–আমি! আমি কী করব? বোধহয় খুব চেঁচিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। তোরা মা-মরা দুটো ভাই-বোন কেন যে ওই বিদঘুঁটে খেলা করতে গিয়েছিলি! লোকে বলাবলি করেছিল যে তোদের ভূতে পেয়েছে। কেন গিয়েছিলি অমিয়?

-আমরা কী করে ফিরে এলাম আবার?

–কেউ ধরার আগেই তুই ঝাঁপ দিয়েছিলি জলে। তোকে কেউ ধরতে পারেনি। একা সাঁতরে এলি পাড়ে। খুব রোখ ছিল তোর।

–খুড়িমা, আমি একটা জলের স্বপ্ন খুব দেখি।

–কীরকম জল?

–অনেক জল, অথৈ জল। একটা খুব বড়ো নদী, তার ওপার দেখা যায় না। তার একধারে একটা বিরাট বালিয়াড়ি, আর একটা স্টিমার বাঁধার জেটি। সেখানে কেউ নেই। বালির ওপর একটা কেবল সাপের খোলস পড়ে আছে।

খুড়িমা হঠাৎ রোগা, মরা হাত বাড়িয়ে অমিয়র হাত ধরে। বলে–অমিয় কী বলছিস?

–একটা স্টিমারঘাটের কথা। একটা বালিয়াড়ির কথা।

 খুড়িমা একটু চুপ করে থাকে।

–খুড়িমা তুমি এই স্টিমারঘাটের কথা কিছু জান?

খুড়িমা, আস্তে আস্তে একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়। বলে–না তো! স্টিমারঘাটের কথা কী জানব! তুই কবে থেকে এটা দেখিস?

অমিয় একটু ভাবে। তারপর বলে–অনেকদিন থেকে। এক দিন ঘুমের মধ্যে ওই স্বপ্ন দেখে জেগে উঠি। তারপর আবার ঘুমোই, আবার সেই স্বপ্ন। তিনবার করে স্বপ্নটা দেখে আর ঘুম হল না। একা একা শুয়ে খুব ভয় করতে লাগল। মনে হল, কেউ পাশে থাকলে খুব ভালো হত।

বউয়ের সঙ্গে কি তোর ঝগড়া অমিয়?

–কেন, ওকথা জিজ্ঞেস করছ কেন?

-এই যে বললি–তুই একা শুস। একা শুবি কেন অমিয়? বউ বিছানায় নেয় না? আলাদা শোয়? তা তার এত গুমোর কীসের? ওই জন্যই তোদের বাচ্চা হয় না

-খুড়িমা স্টিমারঘাটের কথাটা আগে শোনো।

–কী শুনব! স্টিমারঘাটের কথা আমি কিছু জানি না। রাখু ভাতটা টিপে দ্যাখ, হাঁ করে গল্প শুনছিস, ভাত গলে যাবে। একটু ডাঁটো থাকতে নামাস, অমিয় ঝরঝরে ভাত ভালোবাসে। ভাসান, কত রাত হল রে?

-নটা।

–অমিয় যাওয়ার সময় টর্চ জ্বেলে বড়োরাস্তা পর্যন্ত ওকে এগিয়ে দিস। আমি একটু চোখ বুজে থাকি। আমার মনটা ভালো লাগছে না।

–কেন খুড়িমা?

–তুই কেন স্টিমারঘাটের কথা বললি? ওসব অলক্ষুণে কথা, মন বড়ো খারাপ হয়ে যায়। খুড়িমা মশারির মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে নেয়, হাতপাখার মৃদু শব্দ হতে থাকে। রাখু এসে বলে–মামা, রান্না হয়ে গেছে। বসবেন না?

অন্যমনস্ক অমিয় ওঠে।

খেয়ে উঠে পোশাক পরছিল অমিয়। খুড়িমা ঘুমচোখে বলে-ভেজা পোশাক আবার পরছিস অমিয় ঠাণ্ডা লাগবে না? ওগুলো ছেড়ে রেখে যা

রাখু বলে–উনুনে ধরে শুকিয়ে দিয়েছি দিদিমা।

-ওতে কি শুকোয়? সেলাইয়ে জল থেকে যায়। স্টিমারঘাটের কথা যেন কী বলছিলি অমিয়?

-তুমি তো শুনতেই চাইলে না।

-খুড়িমা একটু অস্ফুট শব্দ করে। তারপর বলে–ছেলেবেলা থেকে তুই বড়ো একা। সেই জন্যে তোর দুঃখ নেই তো অমিয়? তোর মা-বাপ নেই–সে বড়ো দুঃখ। আমি তোর মা হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু চাইলেই কি হওয়া যায়। নিজের মেয়েটা, এই যে সব নাতি নাতনি-এ-সব থেকেও তো কেমন একা লাগে। রাত-বিরোতে ঘুম ভাঙলে কারো নাম মনে পড়ে না। ডাকতে গিয়ে দেখি, মাথা অন্ধকার লাগে। মনে হয় কেউ নেই আমার। সে বড়ো কষ্ট। ভাবি, মানুষের আপনজন কে-ই বা আছে! তুই কেন এসেছিলি যেন অমিয়?

–তোমাকে দেখতে।

একটা শ্বাসের শব্দ হল। খুড়িমা বিছানায় পাশ ফিরে শোয়। তারপর বলে–স্টিমারঘাটের কথা কেন বললি? কী জানি কেন, আমিও ঠিক একটা ধু ধু বালির চর দেখতে পাই এখন, অনেক দূরে একটা ঘাট, তারপর অথৈ জল… সাবধানে যাস অমিয়, উঠোনটা পিছল, রাস্তা ভালো না, অনেক রাত হয়েছে!

-খুড়িমা, তুমি ঘুমোও।

–ঘুম কী আসে। ভাসান, টর্চটা ধর। অমিয়, তোর বউয়ের নাম যেন কী?

–হাসি।

–হাসি! হাসির কেন বাচ্চা হয় না রে? আঁট-বাঁধ দিয়ে রেখেছিস নাকি?

–অমিয় চুপ করে থাকে।

–বাচ্চা না হলে বউ আপন হয় না। আঁটকুড়ি নয় তো? ডাক্তার দেখাস। তোর কেউ নেই অমিয়, বাচ্চা-কাচ্চা হলে একটু বাঁধা পড়বি। কিন্তু বয়স হলে আবার সেই

-কী?

–সেই যে কী যেন বললি! সেই স্টিমারঘাট–অথৈ জল…অমিয় সাবধানে যাস।

মেঘ কেটে ভয়ঙ্কর জ্যোৎস্না পড়েছে। অমিয় নির্জন রাস্তায় তার স্কুটার চালায়। বাতাস লাগে, জল-মাটির গন্ধ পায় সে। চলতে থাকে। হাসি এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। অমিয়র ঘুম হয় না আজকাল।

দূরে সিংহের ডাকের মতো মেঘগর্জন শোনা যায়। গির-অরণ্যে দেখা এক সিংহের অবয়বের ছায়া পড়ে অমিয়র চোখে। সে চলতে থাকে!

স্কুটারের শব্দ ঠিকই শুনতে পেল হাসি। আধো ঘুমের মধ্যেও। যেন এতক্ষণ সে এই শব্দের অপেক্ষায় ছিল। উঠে ঘড়ি দেখল সে। রাত এগারোটা বেজে গেছে। অমিয়র জন্য তার কোনো কৌতূহল নেই। সে শুধু আধো জেগে ছিল বলে মাঝে মাঝে রাস্তায় চলমান স্কুটারগুলির শব্দ শুনে উঠে একবার ঘড়ি দেখেছে। কোনো স্কুটারের শব্দই এতক্ষণ থামেনি।

হাসি শুনতে পেল, অমিয় স্কুটার টেনে সিঁড়ির নীচে উঠিয়ে রাখছে। আবার বিছানায় এসে শুয়ে থাকল হাসি। আগে আগে অমিয় এলে অন্তত খাওয়ার টেবিলে গিয়ে বসত সে। মুখোমুখি দু-চারটে কথা হত। খাওয়ার পর ছিল তাদের বাঁধা রতিক্রিয়া। এখন আর হাসি খাওয়ার টেবিলে যায় না।

সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসে অমিয়র পায়ের শব্দ, ভেজানো দরজা টেলে ও-ঘরে ঢোকে। জামাকাপড় ছাড়ে। বাথরুমে যায়।

ও-ঘর থেকে একটা চৌকো আলো এসে এ ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকে অনেকক্ষণ। অমিয়র রাত্রে ভালো ঘুম হয় না।–হাসি জানে। অনেক রাত জেগে ও বই পড়ে। সিগারেট ধরানোর শব্দ হয় রাতে, পায়চারীর শব্দ হয়, কাশির।

চৌকো আলোটাতে একটা মানুষের ছায়া পড়ে। বাঁকা ছায়াটা, একটা কাঁধ উঁচু দেখায়, মাথাটা বেঁকে পড়ে আছে।

হাসি চেয়ে থাকে।

দরজার কাছ থেকে অমিয় বলে–কেউ এসেছিল?

 হাসি মৃদুগলায় বলে–টেলিফোনের লোক। কাল তোমার টেলিফোন দিয়ে যাবে।

টেলিফোন! একটু অবাক হয় অমিয়।

-বলল, তুমি তিনবছর আগে অ্যাপ্লাই করেছিলে, এতদিনে মঞ্জুর হয়েছে।

–টেলিফোন দিয়ে আমি এখন কী করব?

হাসি একটু হাসে। বলে–লোকের সঙ্গে কথা বলবে। কত কথা আছে মানুষের, শোনার লোকেরও অভাব নেই।

–আমার কোনো কথা নেই।

–কে বলল নেই! শুনতে পাই, তুমি লোককে একটা স্টিমারঘাটের কথা বল।

–সে-কথা থাক হাসি। আর কে এসেছিল?

–এক বুড়োমতো ভদ্রলোক; তোমার পিসেমশাই। তাঁর মেয়ের বিয়ের চিঠি রেখে গেছেন।

–চিঠি দেখেছি। তিনি কিছু বলেননি?

-বলেছেন। পরশু বিয়ে, আমি যেন অবশ্যই তোমাকে নিয়ে বিয়েতে যাই। অনেক বার বললেন। আমি বলেছি–যাব। চা করে খাইয়েছি। অনেকক্ষণ বসেছিলেন তোমার জন্য।

-আর কিছু বলেননি?

 –না। বোধ হয় কিছু বলার ছিল, তোমাকে বলতেন। আমাকে কিছু বলেননি।

-বলেছিলাম, রেখার বিয়েতে এক হাজার টাকা দেব। এত তাড়াতাড়ি বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে ভাবিনি।

–দেবে যখন বলেছিলে তখন তো দেওয়াই উচিত। তাঁর পোশাক দেখেই মনে হয় অবস্থা ভালো না।

–কোথা থেকে দেব?

-তুমি আমাকে যেসব গয়না দিয়েছিলে সব স্টিলের আলমারিতে আছে। দরকার হলে নিতে পার, আমি তো নিচ্ছি না।

–আমাদের বংশের কেউ কখনো ঘরের জিনিস বেচেনি।

–তা হলে কী করবে?

–বুঝতে পারছি না।

হাসি লক্ষ করে একটা ধুতি জড়িয়ে অমিয় দাঁড়িয়ে আছে। কোমরের ওপর ওর খালি গা। পেছন থেকে আলো এসে পড়েছে ওর গায়ে। মাথাটা বোধহয় ভেজা, পাটকরা চুল থেকে আলো পিছলে আসছে। লম্বাটে হাড়সার দেহ অমিয়র। অমিয় রোগা হয়ে গেছে কিনা তা ঠিক বুঝতে পারে না হাসি। এসব বোঝা খুব মুশকিল। ওই দেহটির স্বাদ সে বহুবার পেয়েছে। তার দুই হাতে, নগ্ন শরীরের আনাচে-কানাচে আজও ছড়িয়ে আছে সেই স্বাদ। কতবার সে বেষ্টন করেছে ওই শরীর, মথিত হয়েছে। তবু ওই শরীরের সব খবর তার জানা নেই।

অমিয়র ঠোঁটে একটা সিগারেট একটু জ্বলে উঠল। সেই আগুনটাই বোধহয় একটা আশ্লেষ তৈরি করে হাসির শরীরে। সে শরীরের ভঙ্গি বদলায়। হঠাৎ প্রশ্ন করে–তোমার ওজন কত?

অমিয় একটু থমকে থাকে। প্রশ্নটা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে–কী বলছ?

–তোমার ওজন কত?

–কেন?

–এমনিই জিজ্ঞেস করছি। জামাইবাবু বলছিল, তুমি নাকি রোগা হয়ে গেছ। তোমার কি ওজন কমে গেছে?

–কী জানি।

–তুমি ওজন নাও না?

–না।

হাসি একটু শ্বাস ফেলে বলে–আমার রিজার্ভেশন পাওয়া যায়নি। কলকাতায় আমাকে আরও কয়েকদিন থাকতে হবে।

-থাকবে। তাতে কী?

–আমি দিদি-জামাইবাবুর কাছে চলে যেতে পারতাম এ ক-দিনের জন্য। কিন্তু সেখানে পাশের ফ্ল্যাটে তোমার দিদি-জামাইবাবু থাকেন। গেলে ওঁরা নানারকম সন্দেহ করতে পারেন বলে যাইনি।

–যেমন তোমার ইচ্ছে।

–খুশির বিয়ের তারিখ এসে গেল! রিজার্ভেশন পাওয়া যাচ্ছে না। কী যে করব!

–প্লেনে চলে যাও।

–তুমি ভাড়া দেবে? অনেক ভাড়া কিন্তু।

–দেব।

–তুমি আমাকে অনেক দিয়েছ।

–প্লেনের ভাড়া কত?

 –দু-তিন-শো হবে বোধহয়। আমি ঠিক জানি না। তোমার ব্যবসার অবস্থা কী?

-ভালো নয়।

খুব খারাপ?

—হুঁ।

–কীরকম খারাপ?

–উঠে যাওয়ার মতো।

–কেন?

–হাসি, আমি প্লেনের ভাড়া ঠিক দেব।

–হাসির ঘুম পায়। সে হাই তুলে বলে-দরজার পর্দাটা টেনে দেবে? চোখে আলো লাগছে।

পরদিন দুপুর বেলা জামাইবাবুকে ফোন করে হাসি।

–জামাইবাবু, রিজার্ভেশন যদি না পাওয়া যায় তো আমি প্লেনে যাব।

–তার দরকার নেই, তেরো তারিখের একটা স্লিপার বার্থ পাওয়া গেছে।

পাওয়া গেছে? সত্যি?

–সত্যি। সুখের পাখি এবার উড়ে যাও।

হাসি চুপ করে থাকে।

–ফোন কি ছেড়ে দিয়েছ হাসি?

না।

–কাল ছেড়ে দিয়েছিলে। একটা প্রশ্নের জবাব দাওনি।

-জামাইবাবু, আমাদের মধ্যে কোনো ঝগড়াঝাঁটি হয়নি। কথাবার্তা বন্ধ হয়নি। কাল রাতেও অনেকক্ষণ আড্ডা মেরেছি। আমরা সম্পূর্ণ নরমাল। এমনকী কোর্ট-কাছারির কথাও ভাবছি না।

–তবে কি ফিরে আসার কথাও ভাবছ?

-না।

–তুমি কোথা থেকে ফোন করছ হাসি?

—কেন?

–ফ্রিলি কথা বলতে পারবে?

–আমি বাসা থেকে ফোন করছি।

–বাসা থেকে! বাসায় কবে ফোন এল?

–আজ। বছর তিনেক আগে অ্যাপ্লাই করেছিল, আজ কানেকশান দিয়ে গেছে।

–ফোন কেন নিতে গিয়েছিল অমিয়? দুপুরে অফিস থেকে তোমার সঙ্গে প্রেম করার জন্য?

—হবে হয়তো।

–ফোন কোম্পানির মতো বেরসিক দেখিনি। যখন পাখি উড়ে যাচ্ছে তখনই এল ফোন! এখন দুপুরে কার সঙ্গে কথা বলবে অমিয়? বেচারা!

-কী বলছিলেন বলুন।

–ডিগবয়ের তেল কোম্পানির সেই ইঞ্জিনিয়ার, যে এখনও বিয়ে করেনি শুনেছি। সত্যি? –

-সত্যি।

–সে কখনো তোমার সঙ্গে দেখা করেছিল হাসি?

হাসি একটু দ্বিধা করে বলে-না না।

–তবে কী করেছিল?

একটা দীর্ঘ চিঠি দিয়েছিল। তাতে বার বার একটা প্রশ্ন করেছিল–আমার কী দোষ? আমাদের অপরাধ কী? আপনি কেন এমন করলেন? আরও লিখেছিল, যদি কখনো নিজের ভুল বুঝতে পারি তবে যেন তাকে জানাই, সে সারাজীবন অপেক্ষা করবে, নিঃশর্তে গ্রহণ করবে আমাকে…জামাইবাবু আপনি কি শুনছেন? আপনার শ্বাস-প্রশ্বাসও যে শোনা যাচ্ছে না।

-শুনছি। বলো।

–সে এই কথা লিখেছিল। আরও লিখেছিল, তাদের কালাশৌচের মধ্যেই যে তারা আমাকে আশীর্বাদ করে রেখেছিল, সেটাও তারই আগ্রহে। তার ভয় ছিল, আশীর্বাদ করে না রাখলে ওই সময়ের মধ্যে আর কেউ এসে আমাকে বিয়ে করে ফেলবে। তখন শিলচরে আমার স্যুটার অনেক, ঝাঁকে ঝাঁকে চিঠি পেতুম…শুনছেন?

–শুনছি।

-কালো হলেও তো আমি সুন্দরী-ই। তার ওপর দারুণ নাচতাম, গাইতাম। আমার পায়ে পুরুষদের মাথা নূপুরের মতো বাজত।

ও-পাশে জামাইবাবু বহুক্ষণ শ্বাস ধরে রেখে আবার অনেকক্ষণ ধরে শ্বাস ছাড়ে। হাসি হাসে।

–কিছু বুঝলেন জামাইবাবু?

–বুঝলাম।

–কী?

তুমি আর ফিরবে না হাসি।

ও-পাশে জামাইবাবু একটুক্ষণ চুপ করে থাকে। হাসি অপেক্ষা করে।

–হাসি, স্টিমারঘাটটা সাবধানে পার হোয়ো। ও জায়গাটা ডেঞ্জারাস।

 হাসি চমকে উঠে বলে।– স্টিমারঘাট! কোন স্টিমারঘাট?

–বা:, ফারাক্কায় তোমাকে ঘাট পেরোতে হবে না?

–ওঃ। বলে স্তব্ধ হয়ে থাকে হাসি।

 –একা যাচ্ছ, আমরা চিন্তায় থাকব। ওপারে বঙ্গাইগাঁও এক্সপ্রেসে তোমার রিজার্ভেশন আছে, ভুল করে দার্জিলিং মেলে উঠো না।

–ভুল ট্রেনে ওঠাই কি আমার স্বভাব জামাইবাবু?

জামাইবাবু একটু চুপ করে থেকে বলে–ভুল ট্রেনের কথা বলছ হাসি! কিছু ইঙ্গিত করছ কি? তবে বলি, আমাদের আমলে ভুল ট্রেনে উঠলেও শেষ পর্যন্ত যেতে হত। হয়তো ভুল জায়গায় গিয়ে পৌঁছোতাম। কিন্তু তবু যেতে হত। তোমাদের আমল আলাদা। তোমরা ভুল ট্রেন বুঝতে পারলেই চেন টেনে নেমে পড়তে পার।

-আমরা ভাগ্যবান।

–দেখা যাক। আমি আরও কিছু দিন বাঁচব হাসি।

হাসি হাসে।

–এখনও সাত-আট দিন সময় আছে, এ ক-দিন কী করবে হাসি?

–কী করব! ঘুরব, ঘুরে বেড়াব।

–কোথায় যাবে?

–কোথাও না। কলকাতা–কেবল কলকাতায় ঘুরব–ইচ্ছেমতো।

কলকাতায় আর কোথায় ঘুরবে, কী আছে কলকাতায়?

–কী আছে? কী জানি! আমি তো বিশেষ কোথাও যাব না। আমি ঘুরে বেড়াব রাস্তায় রাস্তায়। রঙিন দোকান দেখব, আলো দেখব, পার্কে বসে থাকব, কলকাতা পুরোনো হয় না।

-কলকাতায় তুমি কী পেয়েছ হাসি?

কী পেয়েছি! হাসি তা ভেবে পায় না। সে চোখ বুজে থাকে মনে মনে বলে–কলকাতা। কলকাতা আমার প্রেমিক। জ্বলন্ত এক পুরুষ কলকাতা। সে আমাকে সব সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত করে টেনে এনেছিল, সুখি হতে দেয়নি। সে আমাকে নিয়ে আরও কত খেলা খেলবে, তোমরা দেখো।

–হাসি, ফোন কী ছেড়ে দিয়েছ?

–না তো।

-তোমার শ্বাস-প্রশ্বাসও যে শোনা যাচ্ছে না।

-শুনছি। বলুন।

–এ কয়দিন অমিয়কে সঙ্গে নিয়ে ঘুরো।

-ও-মা! ওকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরব না কেন? এইতো ওর পিসতুতো বোনের বিয়েতে যাচ্ছি একসঙ্গে। ওর স্কুটারে বহুদিন চড়িনি। ভাবছি ওর স্কুটারের পিছনে বসে একদিন ঘুরে বেড়াব। অফিসপাড়া, কলেজ স্ট্রিট, পার্কস্ট্রিটের রেস্টুরেন্ট দেখে বেড়াব দু-জনে। জামাইবাবু আপনি কী ভাবছেন আমার প্রেজুডিস আছে? একদম নেই। আমরা দুজনে কথা বলি, হাসি ঠাট্টা করি, কখনো ঝগড়া করি না। এমনকী মাঝে মাঝে এক বিছানায়…জামাইবাবু শুনছেন?

–কী ভয়ঙ্কর।

–কী?

–তোমার নিষ্ঠুরতা।

মাথা আস্তে আস্তে পেছনে হেলিয়ে দিচ্ছিল হাসি। ক্রমে পিঠ বেঁকে গেল পিছনে, মাথা প্রায় স্পর্শ করল পিঠ। কত উঁচু বাড়ি। উঠে গেছে তো উঠেই গেছে। কী বিশাল বাড়িটার বুক, কী পাথুরে গড়ন! দেখতে দেখতে নেশা ধরে যায়। হ্যারিংটন স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়িয়ে বাড়িটার ঠিক পায়ের তলা থেকে চূড়া দেখার চেষ্টা করল হাসি, তার মুখে ঘাম জমে গেল বেদনায়।

–বাব্বাঃ! আপনমনে বলল সে। হেসে আঁচলে একবার মুখ মুছে নিল। কলকাতার প্রোথিত ইমারত চারদিকে, তার মাঝখানে নিজেকে ধূলিকণার মতো লাগে তার। কান পাতলে –পাতালের খরস্রোতা নদীর গর্জনের মতো উতরোল কলকাতার গম্ভীর শব্দ শোনা যায়। কী রোমাঞ্চ জাগে শরীরে! কলকাতা–তার চারদিকে উষ্ণ কল্লোলিত কলকাতা!

হাসি পায়ে পায়ে পার হয় রাস্তা। ময়দানের দিকে ট্রামলাইন পেরোলে দেখা যায় সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এলোমেলো পড়ে আছে–যেন বা যে খুশি নিয়ে যেতে পারে। ঘনপত্র গাছের ছায়া। পাতা ঝরে পড়ছে। পাখিরা ফেলে দিচ্ছে কুটোকাটা। নিবিড় ছায়া এখানে। পায়ের নীচে ঘাস, পাতা, নির্জনতা। হাসি পায়ে পায়ে উদ্দেশ্যহীন হাঁটে। কিছুই দেখে না, অথচ সব কিছু অনুভব করে তার সর্বগ্রাসী মন।

সামনেই একটা কালো হেরাল্ড গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। নতুন চকচকে গাড়ি। গাড়ির বনেটে হাত রেখে একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে। ফর্সা, মজবুত চেহারা, লম্বা জুলপি, ঘন বড়ো চুল, চৌকো মুখ। রঙিন চৌখুপওলা শার্ট তার পরনে, আর জলপাই-রঙা সরু চাপা প্যান্ট, পায়ে চোখা জুতো, কোমরের চওড়া বেল্টের বকলসে একটা ইস্পাত রঙের ইংরিজি ডি অক্ষর ঝলসে ওঠে। কবজির ঘড়িতে মোটা সোনারঙের চেন। মানুষটা হাসিকে দূর থেকেই লক্ষ করে। অন্যমনে একটা ঘাসের ডাঁটি তুলে আলস্যভরে চিবোয়। হাসি এগিয়ে যায় ধীরে ধীরে। সেই হাঁটা দেখে লোকটা দেখে তার পোশাক, মুখশ্রী, তার বুক, চোখ। চোখই বেশি লক্ষ করে। চেয়ে থাকে। একটা লক্ষণ খুঁজে দেখে। বোধহয় লক্ষণটা মিলে যায়। মিলিয়ে লোকটা হাসে। একটু বড়ো এবং মসৃণ দাঁত তার। ধারালো। হাসির একটুও ভয় করে না। সে এগোতে থাকে। লোকটা হাসে। হাসি এগোয়। হেরাল্ড গাড়িটার গায়ের পালিশে হাসির ছায়া পড়ে। লোকটা বনেট থেকে হাতের ভর তুলে নেয়। ঝুলে পড়া শার্ট, কোমরে গুঁজে এক পা এগিয়ে আসে। আর এক পা। আর এক পা এগুলেই হাসির পথ আটকাতে পারে, ছুঁয়ে ফেলতে পারে হাসিকে। ডাক দেয়–মিস-ও মিস

হাসি ছেলেটার দিকে মুখ ফিরিয়ে একটু হাসে। প্রশ্রয়ের হাসি। ছেলেটা লক লক করে ওঠে লোভে। দাঁতাল হাসি হাসে। বেল্টের ডি অক্ষরটা ঝলসায়। ভাঙা গলায় ডেকে বলে –আই হ্যাভ এ কার মিস

হাসি বড়ো বড়ো চোখে ছেলেটাকে দেখে। ছেলেটা টেরও পায় না, ঠিক তার পিছনেই উদ্যত আঠারো তলা উঁচু এক হিংস্র ইমারত। সেই ইমারতের সামনে তাকে কত তুচ্ছ, এইটুকু পতঙ্গের মতো দেখায়। হাসি সেই ইমারতের ফ্রেমে ছেলেটার ক্ষুদ্রতা মাত্র একপলক অবাক হয়ে দেখে। ছেলেটা ঝুঁকে ফিস ফিস করে কী যেন বলে। অমনি ময়দান থেকে মার মার করে ছুটে আসে বাতাস, তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে যায়। হাসির করুণা হয়। তার প্রেমিক কলকাতা চারদিকে জেগে আছে সহস্র চোখে। উদাসী, নির্মম, আবার ঈর্ষায় কাতর। যদি ইঙ্গিত করে হাসি তবে অমনি তার প্রেমিক কলকাতা পিছনের ওই আঠারোতলা বাড়িটার চূড়া হয়ে মড় মড় করে ভেঙে পড়বে ছেলেটার মাথায়। গুড়ো করে মিশিয়ে দেবে মাটিতে। কিন্তু ইঙ্গিত করে না হাসি। শুধু মুখটা ফিরিয়ে নেয় অবহেলায়। একা একা ঘোরে বলে এরকম কত মানুষ কতবার তার পিছু নিয়েছে, ডাকাডাকি করেছে ইঙ্গিতে, কীটপতঙ্গের মতো সব ছোটো মাপের জীব কলকাতার গায়ে উড়ে এসে বসে, আবার উড়ে যায়।

হাসি হাঁটতে থাকে। কত দূর দূর হেঁটে যায় হাসি। কখনো ট্রামে ওঠে। কিছুদূর যায় আবার নেমে পড়ে। ধ্বংসাবশেষ দূর্গের শেষ একটিমাত্র স্তম্ভের মতো মনুমেন্ট দাঁড়িয়ে আছে, দেখে। দেখে, গঙ্গার কোল জুড়ে শুয়ে আছে হাওড়ার পোল। তার চোখের পাশ দিয়ে ভেসে যায় ভাঙা টুকরো সব দৃশ্যাবলি, ছায়া পড়ে, ভেঙে যায়। চকিতে মানুষের চোখ ঝলসে ওঠে। কানাগলির মুখ সরে যায়। গভীর গভীর অগাধ কলকাতার ভেতর হারিয়ে যায় হাসি। ভোগবতীর গম্ভীর নিনাদের মতো কলকাতার কত শব্দ হয়।

জাহাজঘাট! হাসি থমকে দাঁড়ায়। মাস্তুল। জল। না এখানে নয়। এ তো কলকাতা থেকে বিদায়ের বন্দর। এর অর্থ তো ছেড়ে যাওয়া। মাস্তুল অদৃশ্য রুমাল উড়িয়ে বিদায় জানায়। জাহাজ ভেসে যাবে দূর সমুদ্রে। হাসি ফিরে দাঁড়ায়। এখানে নয়, এখানে নয়। এখানে কলকাতার শেষ। জীবনের শেষ, এখানে অচেনার শুরু। হাসি ফিরে আসে।

সেনগুপ্ত নিয়ে গেছে অনেক। হিসেব করলে কত দাঁড়াবে তা ভেবে দেখেনি অমিয়। হিসেব করা সে প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। ক্যাপিটাল শেয়ার আর সেই সঙ্গে লভ্যাংশ মিলে একটা বেশ বড় অঙ্কের টাকা। অমিয় আটকাতে পারেনি। কিন্তু তবু সেটা কিছু নয়। সেনগুপ্ত বা তার টাকা কোনোটার অভাবেই ব্যবসা আটকাত না। যদি অমিয় খাড়া থাকত। তরতরে তাজা জোয়ান বয়সের মানুষের কাছে এ আবার একটা সমস্যা ছিল নাকি। ছিল না–অমিয় তা জানে, কিন্তু সে কেমনধারা মেঘলা মানুষ হয়ে গেল। দিন না ফুরোতেই আলো মরে গিয়ে ঘনিয়ে এল দিনশেষ।

দুপুরে অমিয় আজকাল কিছুই খায় না। লাঞ্চ সে প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। কল্যাণ বা রজত সবাই এ সময়টায় বাইরে থাকে, পাঞ্জাবি হোটেল বা গাঙ্গুরামে টিফিন সারে। ডিউক রেস্টুরেন্টে নতুন একটা আড্ডা হয়েছে কল্যাণের। সেখানে সারাটা দুপুর কাটায় কখনো কখনো। অমিয় একসময়ে যেত। এখন টিফিনের সময়টায় বসে থাকে চুপচাপ। রাজেন এক কাপ চা রেখে যায় না বলতে। আজ চায়ের সঙ্গে একটা শালপাতার ঠোঙায় কয়েকটা দেওঘরের প্যাঁড়া রেখে গেছে। কোনো ভাই যেন এনেছে দেশ থেকে।

চা-টা খেল অমিয়, প্যাঁড়া ছুঁতে ইচ্ছে করল না। পেটে খিদে মরে একটা গুলিয়ে ওঠা ভাব। সবাই তাকে লক্ষ করে আজকাল। সে যে খায়নি, সে যে বিপাকে পড়েছে। ভাবতে চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসে। রাত্তিরে অফিস বাড়িটা ফাঁকা থাকে। তখন রাজ্যের দেশওয়ালি মুটে-মজুর, রিক্সা বা ঠেলাওয়ালাকে এখানে এনে তোলে রাজেন। এক রাত্রির বসবাসের জন্য মাথাপিছু দু-চার আনা করে নেয়। তারা দিব্যি ফ্যানের হাওয়া খায়। অনেক রাত অবধি বাতি জ্বেলে গল্পসল্প করে। মাসের শেষে মস্ত অঙ্কের ইলেকট্রিক বিল আসে। তাই রাজেনকে তার সাইড বিজনেসের জন্য বিস্তর বকাবকি করেছে অমিয়, কল্যাণ আর রজত। সেই খারাপ ব্যবহারটুকুর জন্য এখন প্যাঁড়াগুলির দিকে চেয়ে একটু বুকটা টনটন করে। রাজেন আজকাল না বলতেই টিফিনের সময় কোনো কোনোদিন একঠোঙা মুড়ি বাদাম হাতের কাছে রেখে যায় নিঃশব্দে। এ সবই সহৃদয়তার নিদর্শন। কিন্তু অমিয়র ভেতরটা জ্বালা করে।

দুপুরের দিকে পিসেমশাই ফোন করলেন।

–অমিয়, আমি সেদিন তোর বাসায় গিয়েছিলাম। রেখার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে রে!

–শুনেছি পিসেমশাই, পাত্র কেমন?

–খুব ভালো। টাটার ইঞ্জিনিয়ার, তবে দাবিদাওয়া অনেক।

অমিয় একটা শ্বাস ছাড়ল। পিসেমশাই আবার বললেন–মেয়েটার সুন্দর মুখ দেখে পছন্দ করেছে, নইলে গরিব ঘরের সঙ্গে সম্বন্ধ করার মতো পাত্র তো নয়।

–পিসেমশাই আপনার কত দরকার?

পিসেমশাই লজ্জিত হন বোধহয়। একটু নীরব থাকেন। তারপর আস্তে করে বলেন, দরকারের কী শেষ আছে অমিয়! প্রভিডেণ্ড ফাণ্ডের টাকা যা অবশিষ্ট ছিল সবই প্রায় তুলেছি। কিছু ধার কর্জ করেছি। এখনো দু-তিন হাজার কম পড়বে। আলমারিটা এখনও কেনা হয়নি, সোনার দোকানেও যা আন্দাজ করেছিলাম তার বেশি পড়ে গেল।

–ঠিক আছে, আমি হাজার খানেক দেব।

–দিতে তোর কষ্ট হবে না তো?

–কষ্ট কী পিসেমশাই? রেখার বিয়েতে আমার তো দেওয়ার কথাই ছিল।

 পিসেমশাই হাসলেন ফোনে। বললেন–কথা দিয়েছিস বলেই আবার কষ্ট করে দিস না।

অমিয় একটু আহত হল। সে দিতে পারবে না–এমন যদি কেউ ধরে নেয় তবে তার আহত হওয়ারই কথা।

সে একটু নীচু স্বরে বলল–পিসিমা বেঁচে থাকতে, সেই কবে ছেলেবেলায় আমি পিসিমাকে প্রায় সময়েই বলতাম, রেখার বিয়ে আমি দেব, সে-কথা তো রাখতে পারলাম না পিসেমশাই।

পিসিমার উল্লেখে পিসেমশাই নীরব হয়ে গেলেন। অনেকটা পরে যখন কথা বললেন তখন টেলিফোনেও বোঝা গেল, গলাটা ধরে গেছে।

বললেন–তা হোক, ছেলেবেলায় মানুষ কত কী বলে। যা দিতে পারিস দিস।

–আচ্ছা পিসেমশাই।

-শোন, বউমাকে বিয়ের দু-একদিন আগে আমাদের এখানে পাঠাতে পারবি না? বিয়ের কাজকর্ম মেয়েছেলে ছাড়া কে বুঝবে!

হাসিকে বললে হাসি রাজি হবে কিনা তা কে জানে। তাই অমিয় উত্তরটা ঘুরিয়ে দিল– সেদিন যখন গিয়েছিলেন তখন নিজেই তো বউমাকে বলে আসতে পারতেন।

-লজ্জা করল। বউমা তো আমাকে খুব ভালো চেনেন না, দু-এক বার মাত্র দেখেছেন, তুইও সাহেবি কায়দায় বিয়ে করলি, সামাজিক অনুষ্ঠান হল না!

অমিয় লজ্জা পায়। বলে-তাতে কী?

–সামাজিক বিয়ে হলে সেই অনুষ্ঠানে সব আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে নতুন বউয়ের চেনাচিনি হয়ে যায়। তোর বেলায় তো সেরকম হয়নি, তাই একটু দূরের মানুষ হয়ে আছি আমরা। তবে তোকে বলি অমিয়, বউমা ভারি ভালো হয়েছে। পরিচয় দিতে কত যত্ন-আত্তি করল। আজকালকার মেয়েদের মতো নয়।

অমিয় উত্তর দিল না।

–অমিয়।

–বলুন পিসেমশাই।

–পারিস তো বিয়ের আগে হাসিকে পাঠিয়ে দিস।

 –দেখি।

–দেখি-টেখি নয়, এয়োর কাজ করার লোক নেই।

-আচ্ছা।

ছাড়ছি, বলে পিসেমশাই ফোন রাখলেন।

ফোনটা রেখে অমিয় তিন বুড়োর দিকে তাকাল, তিনজনই পাথর হয়ে বসে আছে। একেই কি স্থবিরতা বলে! তান্ত্রিক লোকটা একবার চোখ তুলে অমিয়র দিকে তাকায়, মাথায় জটা, কপালে মস্ত লাল একটা ফোঁটা, চোখ দুটোয় বেশ তীব্র চাউনি। হেসে এবং তাকিয়ে হঠাৎ শ্বাস ছেড়ে বলল–টাকা!

অমিয় হাসে। উলটো দিকের দুই বুড়ো খুব আগ্রহের সঙ্গে তান্ত্রিকের দিকে ঝুঁকে বসল, বাবা যদি এবার কিছু বাণী দেন।

অমিয় মাথা নেড়ে বলল–টাকা।

তান্ত্রিক তার দুই ভক্তের দিকে চেয়ে আস্তে করে বললে–টাকা।

ভক্ত দু-জন কী বুঝল কে জানে। জুল জুল করে চেয়ে থাকে।

অফিসঘরে এসে অমিয় ফাঁকা ঘরটার চারদিকে চাইল। কেউ নেই। কাগজপত্র হাওয়ায় নড়ে শব্দ করছে। পুরোনো ফ্যান থেকে একটা ঘট ঘটাং শব্দ উঠছে।

কিছুক্ষণ বসে থাকল অমিয়। রেখার বিয়ে, এক হাজার টাকা দিতে হবে।

অমিয় বেরিয়ে এল।

 স্কুটারটা এখনও তার আছে। বেশিদিন থাকবে না। কল্যাণকে সে দিয়ে দিয়েছে, যতদিন ও না নেয় ততদিন তার। আহমদ একটা মফস্সলের লোককে জাঙিয়া গছানোর চেষ্টা করছে। অমিয়কে দেখে নীচু গলায় বলল–সাহা ব্রাদার্স থেকে লোক এসেছিল তাগাদায়, হটিয়ে দিয়েছি। আবার তিনটের পর আসবে।

অমিয় উত্তর না দিয়ে গিয়ে স্কুটার চালু করে।

যে ব্যাংকে অমিয়র অ্যাকাউন্ট আছে তা অনেকটা তার ঘরবাড়ির মতো হয়ে গেছে, বহুকাল ধরে একই ব্যাংক-এ সে টাকা রাখছে, তুলছে, চেক বা ড্রাফট ভাঙাচ্ছে। সবাই মুখ চেনা হয়ে গেছে। কেউ কেউ একটু বেশি চেনা এবং একজনের সঙ্গে পরিচয় আরও একটু গভীর।

ব্যাংকের বাইরে স্কুটার রেখে অমিয় ভেতরে আসে! সোনাদার ব্যাংক যেমন বড়ো, আর হালফ্যাশানের এই ব্যাংকটা তেমন নয়। প্রাইভেট আমল থেকেই এর মলিন দশা, কাউন্টারের পুরোনো কাঠে গাঢ় খয়েরি রং ধরেছে, দেয়ালের রং বিবর্ণ, কাঠের পার্টিশনগুলো নড়বড় করে।

কারেন্ট অ্যাকাউন্টটা অমিয় বহুদিন হল বন্ধ করে দিয়েছে! সেভিংসে কিছু টাকা থাকা সম্ভব, পাশবইটা বহুকাল এন্ট্রি করানো হয়নি। কত টাকা আছে কে জানে!

টোকেন ইসু করার কাউন্টারে একসময়ে নীপা চক্রবর্তী বসত। ভেতরের দিককার একটা ঘরে বসে আপন মনে কাজ করে। পাবলিকের সামনে আর থাকে না।

কাউন্টারের মেয়েটি ফোর ওয়ান নাইন নাইন অ্যাকাউন্ট লেজার খুলে দেখে বলল–না, হাজার টাকা তো নেই। দু-শো পঁয়ত্রিশ টাকা আছে।

অমিয় যন্ত্রের মতো শব্দ করে–ও।

আরও দুটো ব্যাংক-এ অ্যাকাউন্ট আছে অমিয়র। কিন্তু সেখানে আর যাওয়ার আগ্রহ হয় না। খুব বেশি নেই। যা আছে তাতে হাত দেওয়া যায় না। হাসি চলে যাবে। অনেক পেমেন্ট বাকি। একটা হতাশা ভর করে তাকে। মুখটা বিস্বাদ। খালি পেটে সম্ভবত পিত্ত পড়েছে। মাথার মধ্যে একটা রিমঝিম। চোখের সামনে একটু অন্ধকার, অন্ধকারে উজ্জ্বল কয়েকটি তারা খেলা করে মিলিয়ে গেল। দুর্বলতা থেকে এরকম হয়।

দুটো বাজতে আর খুব বেশি দেরি নেই। বেলা দুটোয় সব জায়গায় টাকা পয়সার ওপর ঝাঁপ পড়ে যায়।

ভেতরের দিকে একটা করিডোর গেছে। ওদিকে একটা বাইরে যাওয়ার দরজা আছে। ব্যাংক-এর সামনের দরজা বন্ধ হয়ে গেলে ওদিক দিয়ে যাতায়াত করে লোক। ব্যাংক আওয়ারের পরে এসেও বহুদিন ওই দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকেছে অমিয়, চেক ক্যাশ করে নিয়ে গেছে। নীপা চক্রবর্তী ওইটুকু ভালোবাসা দেখাত।

দু-শো পঁয়ত্রিশ টাকায় হাত দিল না অমিয়। থাকগে। সে করিডোর ধরে ভেতরের পার্টিশানের কাছে এসে দাঁড়ায়। কাঠের পার্টিশনে কাচ লাগিয়ে বাহার করার চেষ্টা হয়েছে। ময়লা ঘোলা কাচের ভেতর দিয়ে দেখা যায় লম্বা লম্বা টেবিলের ওপর ঝুঁকে কয়েকজন কাজ করছে। তৃতীয় জন নীপা। শ্যামলা রং রোগা শরীরে ইদানিং একটু মাংস লেগেছে। মুখখানা নোয়ানো বলে ভালো দেখা যায় না। কিন্তু অমিয় জানে মুখখানা ভালোই নীপার। টসটসে মুখ বলতে যা বোঝায় তাই। বড়ো বড়ো দুখানা চোখ ভরে একটা নরম সৌন্দর্য ছড়িয়ে থাকে। চোখে কাজল দেয় নীপা, কপালে টিপ পরে, সাদা খোলের শাড়ি পরে বেশিরভাগ সময়ে। রঙিন পরলে হালকারঙা। গায়ের রং চাপা বলে চড়া সাজ কখনো করে না। তাতে ও ফুটে ওঠে বেশি।

অমিয়র সঙ্গে নীপার এমনিতে কোনো সম্পর্ক ছিল না।

চেক জমা দিয়ে টোকেন নেওয়ার সময়ে বা অ্যাকাউন্টের টাকার অঙ্ক জানতে এসে, মুখোমুখি একটু বেশিক্ষণ কি দাঁড়াত অমিয়?

চোখে চোখ পড়লে সহজে চোখ সরাত না বোধহয়? মাঝে মাঝে একটু-আধটু হাসত কি? সে যাই হোক, তাদের চেনাজানা ছিল খুব সহৃদয়তায় ভরা। অনুভূতিশীল। ব্যাঙ্ক আওয়ার্সের পরে এসে অমিয় বলত–একটু জ্বালাতে এলাম।

নীপা মৃদু অহংকারী হাসি হেসে বলেছে–কে না জ্বালায়! জ্বলে যাচ্ছি। দিন কী আছে…বলে হাত বাড়িয়ে চেক নিত।

রোগা মেয়ে পছন্দ করত অমিয়। মোটা বা বেশি স্বাস্থ্যবতী তার পছন্দের নয়। নীপা রোগা ছিল, আবার রুগ্নও নয়। বুকের স্নিগ্ধ ফল দু-টি মুখ তুলে চেয়ে থেকেছে পুরুষের দিকে। কনুই বা কব্জির হাড় তেকোণা হয়ে চামড়া ফুঁড়ে উঠে থাকত না। শরীরের চেয়ে অনেক আকর্ষক ছিল গলার স্বরে নম্রতা। অমিয় ছাড়া আর কাউকে কখনো নীপা ঠাট্টা করে কথার উত্তর দিয়েছে এমনটা অমিয় দেখেনি। খুব সিরিয়াসভাবে কাজ করত। মেয়েরা অফিসের কর্মচারি হিসেবে বেশির ভাগই ভালো হয় না। যেখানে তিন-চারটে মেয়ে জোটে সেখানে কাজ হওয়া আরও মুস্কিল! কিন্তু নীপা ছিল অন্যরকম। শনিবার যখন প্রচন্ড রাশ হয়, কিংবা কোনো ছুটির আগে যখন টাকা তোলার ধূম পড়ে যায় তখনো নীপাকে বরাবর নীচু গলায় লোকের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছে অমিয়, দেখেছে মুখে স্নিগ্ধ হাসি, অবিরল ব্যস্ততার মধ্যেও নানা লোকের অপ্রয়োজনীয় বোকা-প্রশ্নর উত্তর দিতে। একদিন দু-জন অল্পবয়সী ছোকরা স্রেফ ইয়ার্কি দিতে ব্যাংক-এ ঢুকে পড়েছিল। তারা উইথড্রয়াল স্লিপ নিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা লিখে জমা দিয়ে টোকেন নিল। ব্যাপারটা ধরতে দু মিনিটের বেশি লাগেনি নীপার। লেজার বইটা খুলে অ্যাকাউন্ট দেখে যখন তার উচিত ছিল দারোয়ান ডেকে ছোঁড়া দুটোকে বের করে দেওয়া, তখনও সে বিনীতভাবে তাদের ডেকে বলেছিল–সইয়ে যে নাম লিখেছেন তার সঙ্গে অ্যাকাউন্টের নাম মিলছে না। ছেলে দুটো সাহস পেয়ে আরও কিছু ইয়ার্কি দেয়, একজন বলে–তাহলে অ্যাকাডন্ট খুলব। ফর্ম দিন। নীপা আশ্চর্য, ধৈর্য ধরে রেখে ওদের ফর্মও দিয়েছিল যেটা ওরা কিছুক্ষণ কাটাকাটি করে ছিঁড়ে ফেলে চলে যায়। দৃশ্যটা অমিয়র চোখের সামনে ঘটে। নীপা স্বাভাবিক হাসি হেসে বলেছিল তাকে–এরকম প্রায়ই হয়। আমরা কিছু মনে করি না।

তখনো হাসির সঙ্গে দেখা হয়নি। এ হচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক ঘটনা। তখন অমিয় মাঝে মাঝে নীপার কথা ভাবত বিরলে। মনেপড়া শুরু হয়েছিল, ভাবতে ভালো লাগত। ঘন ঘন তখন ব্যাংক-এ যাওয়ার দরকার পড়ত তার। রাজেন বা সেনগুপ্তকে পাঠালেও যখন কাজ চলে তখনও সে নিজেই যেত। নীপা যেদিন আসত না সেদিন ক্ষুণ্ণ হত সে। পরদিন এলে অনুযোগ করত–কাল আসেননি কেন? কাল আমার পেমেন্ট পেতে অনেক দেরি হয়েছে।

নীপা সে অনুযোগের সহৃদয় উত্তর দিত। বলত–রোজ তো আসি। এক-আধদিন না এলে বুঝি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়। যন্ত্র তো নই।

এ ধরনের কথা নীপা একমাত্র তার সঙ্গেই বলত এবং তখন চোখে চোখে মানুষের গভীর হৃদয় গোপন বার্তা পাঠাত না কি?

ব্যাংক-এর বাইরে দেখা হয়েছিল মোটে একদিন। গ্রান্ট স্ট্রিটের একটা দোকানে নীপা পুজোর জামাকাপড় কিনতে ঢুকেছিল। অফিসের পাড়া। অমিয় ডাব খাচ্ছিল পাশের পানের দোকানটায়। নীপা দেখেনি। অমিয় ভেতরে ঢুকে নীপাকে ধরল–এই যে!

নীপার সঙ্গে অফিসের আরও দুটি মেয়ে ছিল। তারা একটু ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে দেখল অমিয়কে। নীপারই ভ্রূ সহজ ছিল। মুখে হাসি ফুটল সেই সহৃদয়তার। অনেক কিছু এড়িয়ে যাওয়ার কথা বলতে পারত। কিন্তু খুব আন্তরিক লাজুক গলায় একটা ঘন নীল পাছা পেড়ে শাড়ি তুলে দেখিয়ে বলল–দেখুন তো, এটা অদিতিকে মানাবে না? অদিতি সঙ্গি মেয়েদের একজন। ফর্সা। অমিয় হেসে বলে–নীল শাড়ি সবাইকে মানায়।

যতক্ষণ শাড়ি কিনেছিল ওরা ততক্ষণ নীপা চোখের শাসনে আটকে রাখল অমিয়কে। অমিয় যতবার বলে–এবার যাই, কাজ আছে। ততবার নীপা বলে–দাঁড়ান। মেয়েরা ঠিক ঠিক শাড়ি পছন্দ করতে পারে না। পুরুষেরা অনেক পারে। আমাদের শাড়ি পছন্দ করা হয়ে গেলে যাবেন।

শাড়ি কেনা হলে সঙ্গিনীরা চলে গেল। বোধহয় একটা ষড়যন্ত্র করেই। নীপা একা হয়ে বলল–এবার আমাকে সাউথের বাসে তুলে দিন তো।

অমিয় তার স্কুটার দেখিয়ে বলে–বাসের দরকার কী! যদি সাহস থাকে তো উঠে পড়ুন। পৌঁছে দিয়ে আসি!

-ও বাবা! স্কুটার! পড়ে টড়ে যাব, কখনো চড়িনি।

অবশেষে উঠেছিল নীপা স্কুটারেই। মাঝপথে একটা রেস্টুরেন্টে চা খেয়ে নিয়েছিল তারা। অনেক কথাও হয়েছিল। এলোমেলো কথা। আর কথার মাঝখানে লজ্জার সঙ্কোচের এবং আকর্ষণের ঝাপটা এসে লাগছিল। মাঝে মাঝে কথা বন্ধ হয়ে যায়। নীরবতা নৈকট্যকে অদ্ভুত ভাবে টের পায় তারা।

শেষ পর্যন্ত কিছুই বলা হয়নি। টালিগঞ্জের খাল পাড় পর্যন্ত নীপাকে পৌঁছে দিল অমিয়। তারপর সিগারেট জ্বেলে থেমে থাকা স্কুটারে বসে দেখল নীপা নড়বড়ে সাঁকো পেরিয়ে ওপারে চলে যাচ্ছে। যাওয়ার সময়ে অনেকবার পিছু ফিরে চেয়ে দেখল তাকে। মুখটায় স্মিত গভীর একটা বিশ্বস্ততা।

না, কিছু হয়নি শেষ পর্যন্ত। হয়তো হতে পারত। মাঝপথে হাসি এসে সব তছনছ করে দিল। তুলে নিল তাকে। নিল, আবার নিলও না। বড়োঘরের মেয়েরা যেমন নিত্যনূতন জিনিস কিনে সেসব জিনিসের কথা ভুলে যায় দু-দিন পর। অবহেলায় ফেলে রেখে দেয়। তেমনি অমিয়কে কবে ভুলে গেছে হাসি।

ঘোলা ময়লা কাচের ভেতর দিয়ে কয়েক পলক চেয়ে থাকে অমিয়। নীপা টের পায়। মুখ তোলে।

অমিয় একটু হাসে। নীপাও একটু হাসে। ওর সিঁথিতে সিদূর। হাসিটা তেমনি সহৃদয়তায় ভরা। দেখে ভেতরে একরকম ছুঁচ ফোঁটার যন্ত্রণা হয়। ঘোলা ময়লা কাচের ভেতর দিয়ে প্রায়ান্ধকার করিডোরে দাঁড়ানো অমিয়কে চিনতে পেরেছে নীপা। চেয়ারটা ঠেলে সরিয়ে উঠে এল।

–কী খবর? আবার বুঝি জ্বালাতে এসেছেন? নীপা করিডোরে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে।

অমিয় মাথা নাড়ল। বলল–না। কোনোদিন আপনাকে কাজ ছাড়া দেখি না। আজও দাঁড়িয়ে দেখছিলাম।

কাজের জায়গায় দেখা হলে কাজ-ছাড়া কী করে দেখবেন?

 অমিয়র এখন আর সাহসের অভাব হয় না। সে বলে–অকাজের জায়গায় কেমন দেখাবে কে জানে!

আশেপাশে ব্যস্তসমস্ত লোকেরা যাচ্ছে আসছে। নীপা বলে-বলুন না বাবা কী কাজ আছে। কোনো চেকের ক্লিয়ারেন্স আসেনি না কি!

-ওসব নয়। অ্যাকাউন্টে টাকাই নেই। চেক জমা দিই না অনেকদিন।

–সে তো জানি।

–কী করে জানলেন?

–আপনার অ্যাকাউন্টটা দেখি মাঝে মাঝে। আজকাল কেবল উইথড্রয়াল হচ্ছে, জমা পড়ে না। কী ব্যাপার?

অমিয় একটা শ্বাস ফেলে। মাথা নেড়ে বলে–আপনি আমাকে মনে রেখেছেন।

-মনে রাখব না! ব্যাংক-এর সব ক্লায়েন্টকে আমার মনে থাকে।

বানানো কথা। মিথ্যে।

অমিয় একটা বিষ বোলতার কামড় খায় এই কথায়। বলে–কোনো পক্ষপাত নেই, না?

নীপার মুখে একটু দুঃখের ছায়া খোঁজে অমিয়। পায় না। হাসিকে বিয়ে করার পর মাস দুই বাদে নীপার বিয়ে হয়। কেউ কাউকে নিমন্ত্রণ করেনি। জানায়ওনি। কিন্তু জানাবার দরকার হয় না। অমিয় তখন বিয়ের পর দেদার টাকা ওড়াত। হাসিকে স্কুটারের পেছনে বসিয়ে নিয়ে আসত ব্যাংক-এ। টাকা তুলত আর টোকেন নিয়ে অপেক্ষা করার সময়ে কলকলাত দু-জনে। সেসব কি দেখেনি নীপা? তেমনি আবার দু-মাস বাদে নীপার সিঁথিতে সিঁদূর দেখেছে অমিয়। কেউ কাউকে প্রশ্ন করেনি। জেনে গেছে।

নীপার মুখে তাই কোনো দুঃখের ছায়া নেই। কিন্তু তবু সে কেন অমিয়র অ্যাকাউন্টের খবর রাখে?

অমিয় বলে–আপনার টিফিনের সময় হয়নি?

হয়ে গেছে। কেন?

হতাশ অমিয় বলে–হয়ে গেছে! আমি ভাবছিলাম আজ আপনাকে খাওয়াব।

–তাই বা কেন! কোনো খাওয়া কি পাওনা হয়েছে! নীপা দাঁতে ঠোঁট কামড়ে হাসল। অমিয় মাথা নেড়ে বলল-খাওয়ার জন্য নয়।

-তাহলে?

অমিয় বুঝল, নীপার সঙ্গে আসলে তার কোনো বোঝাবুঝি তৈরি হয়নি। এমন অধিকার তার নেই যে সে ইংগিতে ডেকে নিয়ে যেতে পারে বিশ্বস্ত নীপাকে। এখন তার উচিত হবে ভদ্রতাসূচক দু একটা কথা বলে চলে যাওয়া।

কিন্তু চলে যেতে পারে না অমিয়। আস্তে করে বলে–আপনি মিস চক্রবর্তী ছিলেন, এখন কী হয়েছেন?

নীপা একটু তাকিয়ে থাকে তার দিকে। বোধ হয় মনে মনে বলে–আর যাই হই, বাগচী হইনি। তাকিয়ে থেকে নীপা মৃদুস্বরে বলে–আমার বুঝি কাজ নেই! কী দরকার বললেই তো হয়।

–আমার জানা দরকার, আপনি চক্রবর্তী ছেড়ে কী হয়েছেন।

নীপা মৃদু হাসল বটে, কিন্তু ভ্রূ কুঁচকে গেল একটু। বলল চক্রবর্তীদের অনেক গোত্র হয় জানেন তো! আমি চক্রবর্তী থেকে চক্রবর্তীই হয়েছি। গোত্রটা আলাদা। জেনে হবে কী!

-এমনি, কৌতূহল।

–আপনার চেহারাটা খারাপ হয়ে গেছে। আনঅফিসিয়াল কথাটা বলে ফেলেই বোধহয় লজ্জা পায় নীপা। মুখ ফিরিয়ে বলে–চলি।

অমিয় মাথা নাড়ল, তারপর করিডোর ধরে হাঁটতে থাকে ধীরে ধীরে। দরজাটার কাছ বরাবর এসে ফিরে তাকায়। নীপা দাঁড়িয়ে আছে।

অন্য মেয়ে হলে এই অবস্থায় চোখে চোখ পড়তেই পালিয়ে যেত। নীপা পালাল না হাতটা তুলে তাকে থামতে ইংগীত করল। তারপর ঢুকে গেল ভেতরে।

অমিয় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। অপেক্ষা করে, একটু বাদেই নীপা আসে। হাতে ব্যাগ, ছোটো ছাতা, মুখখানায় একটু রক্তাভা। কাছে এসে বলে–আজ ছুটি নিয়ে এলাম। বাড়ি যাব।

অমিয় অবাক হয়। বলে–বাড়ি যাবেন?

–হ্যাঁ।

–তাহলে আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখলেন যে!

নীপা উত্তর দিল না।

রাস্তায় এসে তারা ঝিরঝিরে একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়ায়। অদূরে অমিয়র স্কুটার। অমিয় স্কুটারটা দেখিয়ে বলে–আজ আপনাকে পৌঁছে দিতে পারি। যাবেন?

মুখ নীচু করে নীপা মাথা নেড়ে বলে–না। রাধাবাজারে আমার স্বামীর ঘড়ির দোকান আছে। কাছেই। এখন ওখানে যাব। সেখানে আমাদের গাড়ি আছে। তাতে ফিরব। এখন আমি নর্থ-এ থাকি। পাইকপাড়ায়।

–ও। অমিয় বুঝতে একটু সময় নেয়। নীপাকে ছাড়া নীপার আর কিছুই জানত না অমিয়। এখনও জানে না। শুধু ঘড়ির দোকান, স্বামী, গাড়ি আর পাইকপাড়া শব্দগুলো তার ভেতরে খুচরো পয়সার মতো হাত খসে পড়ে গিয়ে গড়াতে থাকে।

আপনি কী যেন বলতে চেয়েছিলেন। বললেন না।

অমিয় কষ্টে হাসে। ঘড়ির দোকানে স্বামী। স্বামীর গাড়ি। আর গাড়িতে পাইকপাড়া–এ সবই খুব রহস্যময় লাগে তার কাছে। নীপার কেন স্বামী থাকবে। সে কেন স্বামীর গাড়িতে পাইকপাড়া যাবে। কেন সে আজও অমিয়র নিজস্ব জিনিস নয়–তা ভেবে এক ধরনের ক্রোধ আর হতাশা মিশে যায় তার ভেতরে।

সে বলল-শুনুন।

-কী?

–আপনার সম্পর্কে কিছুই কোনোদিন জেনে নেওয়া হয়নি।

নীপা মৃদু হেসে বলে–জানাটা কী দরকার ছিল?

-আমার সম্পর্কেও আপনি কিছু জানেন না।

–না। তবে আপনার বউকে দেখেছি। খুব সুন্দর বউ।

 অমিয় স্থির চোখে নীপাকে চেয়ে দেখে। ঠিক। হাসি নীপার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দরী। হাসিও কালো। নীপার মতোই। তবু হাসির মুখ, চোখ, শরীরের গঠন অনেক উঁচু জাতের। নীপার হিংসে হতে পারে।

অমিয় মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে বলে–আমরা কেউ কারো সম্পর্কে জানলাম না। কেন?

নীপা এ কথার উত্তর দিল না। কারণ, এ বড়ো বিপজ্জনক কথা। উত্তর হয় না।

অমিয় বলল–স্কুটার থাক, চলুন আপনাকে রাধাবাজারের দিকে একটু এগিয়ে দিই। পথে বরং এক কাপ চা খেয়ে নেব।

তারা হাঁটতে থাকে। নীপা মাথা নত রাখে। অমিয়কে সে যে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দিচ্ছে সে বিষয়ে সচেতন। দূরত্ব বজায় রাখছে। বোধহয় ভয়ও পাচ্ছে মনে মনে। আবার বোধহয় চাইছেও, অমিয় তাকে কিছু বলুক।

–আজ এমন করছেন, কী হয়েছে আপনার? নীপা তার মস্ত চোখ তুলে হঠাৎ বলে।

 আশপাশ দিয়ে কলকাতার দৃশ্যাবলি মিলিয়ে যাচ্ছে ডাইলিউশনে। রেলগাড়ির মতো দ্রুত বয়ে যাচ্ছে কলকাতা। সেই গতিশীলতার মধ্যে তারা ধীরে হাঁটে। অমিয় বলে–আমার ব্যাংক-এর অ্যাকাউন্ট কী বলছে।

নীপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে–ও!

আবার হাঁটতে থাকে তারা। ওল্ড কোর্টহাউস স্ট্রিট পার হতে হতে অমিয় বলে–আমি ভালো নেই নীপা।

নিজের নাম শুনে একটু চমকে ওঠে নীপা। চমকটা ঢাকা দিয়ে মৃদুস্বরে বলে–কেন? ব্যাংক-এর অ্যাকাউন্টের কথা ভেবে?

না। অমিয় বলে–আমি তোমাকে ভালোবাসতাম। কিন্তু সে-কথা কখনো বলা হয়নি, এই অপরাধে।

নীপা ঠোঁট কামড়ায়, মাথা নত করে।

কলকাতার প্রকাশ্য রাজপথ। চারদিকে মানুষ আর মানুষের মধ্যে প্রবল গাড়ির আওয়াজের মধ্যে এক নিস্তব্ধতার ঘেরাটোপ নেমে আসে।

অমিয় হঠাৎ দাঁড়ায়। ভেতরে বিষবাষ্প জমে উঠেছে আজ।

 নীপা তার দিকে মুখ তুলে তাকায়। দুটি চোখ বা’য়। কিছু বলতে চায়।

অমিয় আস্তে করে বলে–দেখা হবে। আবার।

–কোথায়?

অমিয় তেমনি আস্তে টরে-টক্কার মতো মৃদু লয়ে বলে–একটা স্টিমারঘাট আছে। সেইখানে সকলের দেখা হয়।

–কোথায়? নীপার কপালে ভাঁজ পড়ে।

–ধু-ধু গড়ানে বালিয়াড়ি বহুদূর নেমে গেছে। তারপর কালো গভীর জল। একটা ফাঁকা শূন্য জেটি। অথৈ জল। ওপরে একটা কালো আকাশ ঝুঁকে আছে। বালির ওপরে পড়ে আছে। একটা সাপের খোলস। হাহাকার করে বাতাস বয়ে যাচ্ছে সেখানে।

অবাক চোখে চেয়ে আছে মেয়েটা।

অমিয় বলে, দেখা হবে।

তারপর হেঁটে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল অমিয়।

নীপা খুব ধীরে ধীরে হাঁটে। ভাবে। মুখে কয়েকটা দুশ্চিন্তার রেখা খেলা করে যায়। তারপর কখন যেন চোখ ভরে জল আসে। জলভরা চোখে চেয়ে দেখে। কলকাতা শহরটা কেমন ভেঙেচুরে গেছে। আবছা, অষ্পষ্ট আর অলীক হয়ে গেল চারধার। অর্থহীন হয়ে গেল জীবন। বেলুনের মতো ফেটে গেল বাস্তবটা।

চোখের জল মুছে নেয় নীপা। ভুল রাস্তায় চলে যাচ্ছিল। সতর্ক হয়ে ফিরে এল সঠিক রাস্তায়। মানুষটা কেমন! খুব অদ্ভুত, না? ফের জল আসে চোখে। ওর অ্যাকাউন্টে মোটে দু শো পঁয়ত্রিশ টাকা আছে, নীপা জানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *