২. অমিয় বেরিয়ে যাওয়ার পর

সকালে অমিয় বেরিয়ে যাওয়ার পরই হাসি গোছগাছ করতে বসেছে। থাকে থাকে শায়া, ব্লাউজ, ব্রেসিয়ার জমে গেছে। এতসব পরার সময় হয়নি। ট্রাঙ্ক ভর্তি রয়েছে শাড়ি, র‍্যাকে নানারকমের জুতো, ড্রেসিং টেবিলে সাজগোজের অসংখ্য টুকিটাকি। এসব কিছুই নেবে না সে। দু-চারটে মাত্র নেবে–যা নাহলে নয়।

নীচের থাক নাড়া দিতেই হাসি দেখতে পায় ইঁদুরের কাটার চিহ্ন। তার শায়া, ব্লাউজ, ব্রেসিয়ারের এখানে-সেখানে ফুটো। গরম জামার থাক ভরতি জামাকাপড় কেটে রেখেছে। কত কি কেটেছে দেখার জন্য হাসি সব জামাকাপড় নামিয়ে মেঝেতে স্তূপ করে। একটা পুরোনো ফুলহাতা সোয়েটারে জড়ানো দু-বাণ্ডিল চিঠি। চিঠির বাণ্ডিল তুলতেই ঝুরঝুর করে কাগজের টুকরো ঝরে পড়ে। অমিয় দু-দফায় দিল্লি আর কানপুর গিয়েছিল। প্রথমবার দু-মাস, দ্বিতীয়বার মাসখানেকের জন্য। আর দুবার বাপের বাড়িতে গিয়ে কিছুদিন করে ছিল হাসি। সেইসব সময়ে অমিয় লিখেছিল এইসব চিঠি। ইঁদুর নষ্ট করে গেছে। সবচেয়ে ওপরের চিঠিটা খুলে কয়েক পলক দেখে হাসি। ছিদ্রময় প্রেমপত্র। প্রিয়তমাসু… হাসি পড়তে থাকে

-তোমার জন্য ভীষণ (ফুটো) হয়ে আছি। কবে আসছ? তোমার জন্য এমন (ফুটো) লাগছে যে কি বলব। আমার (ফুটো) ভিতরটা তো তুমি (ফুটো) পাও না… রানি আমার, আমার (ফুটো), কবে (ফুটো)? তোমার জন্য আমি সব (ফুটো) পারি। তাড়াতাড়ি চলে (ফুটো)…

হাসি একটু হাসে। চিঠি দেখে নয়। প্রেমপত্র লিখতে অমিয় জানে না। দু-চারটে দুর্দান্ত এলোমেলো আবেগের লাইন লিখেই তার সব কথা ফুরিয়ে যায়। কোনো ইনল্যাণ্ডের একটার বেশি ফ্ল্যাপ (ফুটো) ভরতি করতে পারেনি সে।

ছিদ্রময় এই চিঠিগুলো নিয়ে কী করবে তা ঠিক করতে পারে না সে। নিয়ে যাবে? নাকি পুড়িয়ে ফেলবে? ভাবতে ভাবতেই আবার পুরোনো পুলওভারে চিঠিগুলো জড়িয়ে ওয়ার্ডরোবে আগের জায়গায় রেখে দেয়। থাকগে। থাকতে থাকতে একদিন পুরোনো হয়ে হয়ে ধুলো হয়ে যাবে আপনা থেকে।

মধুকে ডেকে হাসি ন্যাপথলিন আনতে বলে, আর ইঁদুর মারা বিষ। তারপর একে একে ট্রাঙ্ক, বাক্স, স্টিলের আলমারি–সবই খুলে ফেলে সে। জামাকাপড় নামায়, ছিদ্র খুঁজে দেখে। সব জায়গাতেই হয়েছে ইঁদুরের দাঁতের দাগ। ভিতরে ভিতরে সব ফোঁপরা করে দিয়ে গেছে। আবার সব গোছ করে তুলতে বেলা গড়িয়ে যায়। সঙ্গে নেওয়ার জন্য সাদামাটা কয়েকটা জামাকাপড় আলাদা করে রাখে হাসি। দু একটা প্রসাধন। কিছু টাকা। কবে যাওয়া হবে তার কিছু ঠিক নেই। দার্জিলিং মেলে এখন সামার-রাশ। জামাইবাবুকে রিজার্ভেশন করতে বলা আছে।

ঘর-দোর আবার ঝাঁট দেয় হাসি, আটার গুলিতে বিষ মিশিয়ে রাখে ওয়ার্ডরোবে, খাটের তলায়, রান্নাঘরে। স্নান করে খেয়ে উঠতে বেলা দুটো বাজে।

মেঝেয় শতরঞ্জি পেতে একটু গড়িয়ে নেয় হাসি। মেঝে থেকে শীতভাব উঠে আসে শরীরে। বাইরে রোদের মুখে ছায়া পড়েছে। মেঘ করল নাকি! বুকের ওপর সিলিং ফ্যানটার ঝকঝকে ইস্পাতের রঙের ব্লেডগুলো একটা প্রকান্ড স্থির বৃত্ত তৈরি করেছে। ঘূর্ণিঝড়ের মতো। বাতাস নেমে এসে মেঝেতে চেপে ধরে হাসিকে! মধু রান্নাঘর ধোলাই করছে। কলঘরে জলের শব্দ। দূরে মেঘ ডাকছে। জানালা-দরজায় সব পর্দা ফেলা। ঘরে একটা সবুজ আভা। হাসি একটু চেয়ে থাকে, কিন্তু কিছুই দেখে না। দেখার জন্য সে চেয়েও নেই। দুই ঘরের এই যে ছোট্ট বাসা, এই কি সংসার? খাট, আলমারি, খাওয়ার টেবিল, ড্রেসিং টেবিলের আয়না–দৃশ্যমান যা কিছু আছে, যা ধরা-ছোঁয়া যায় তার কোনোটাই কি একটা মানুষের সঙ্গে আর একটা মানুষকে আটকে রাখতে পারে? ঘরে দরজা দিয়ে দাও, শরীরে শরীর মিশিয়ে ফেলো, সারাবেলা বললো ভালোবাসার কথা, পোষা পাখীর মতো, ওয়ার্ডরোবে জমে উঠুক প্রেমপত্র–তবু কিছুই প্রমাণ হয় না। সরকারি দপ্তরে হাসি আর অমিয়র বিয়ের দলিল নব্বই কী এক-শো বছর ধরে জমা থাকবে–অতদিন ধরে তাতে লেখা থাকবে যে তারা আইনগত ভাবে স্বামী-স্ত্রী। তবু কিছু প্রমাণ হয় না। হাসি পাশ ফিরে শোয়।

খামের ওপর সাঁটা একটা ডাকটিকিট জলে ভিজিয়ে খুব সাবধানে তুলে নিচ্ছে হাসি। খামের ওপর টিকিটের চৌকো চিহ্ন একটা থেকে যাবে-থাকগে। নাকি কোনোদিনই টিকিটটা ঠিকমতো সাঁটা ছিল না খামের গায়ে? দুটো শরীর কেবল পরস্পরকে ডাকাডাকি করেছে এতকাল? মন নয়, বিশ্বাস নয়, নির্ভরতা নয়।

ছেলেবেলা থেকেই তার মন বলত-কলকাতা কলকাতা!

গরিব ঘরেই জন্ম হয়েছে হাসির। তার বাবা কাছাড়ের এক ছোট্ট চা-বাগানের কেরানি। তারা ছয় ভাই-বোন। হাসি চতুর্থ। লেখাপড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। শিলচরে থাকত এক মাসি, তার ছেলেমেয়ে নেই। সেই মাসিই নিয়ে গেল হাসিকে, পালত পুষত। শিলচর কলেজ থেকেই সে বি-এ পাশ করে, শিলচরেই শেখে মণিপুরি নাচ। লেখা পড়া, নাচ, গানবাজনা– এ সবই হাসি শিখত প্রাণ দিয়ে। এই সব লোকে শেখে কত কারণে। হাসির কারণ ছিল ভিন্ন। হাস্যকর সে কারণ, তবু কত সত্য।

ছেলেবেলা থেকেই তার মন বলত-কলকাতা, কলকাতা! চা বাগানে তার ছেলেবেলা কেটেছে। চারদিকে ঘন গাছের বেড়া জাল, বৃষ্টি পড়ত খুব, আবার রোদ উঠলে চা-পাতার মাতলা গন্ধে ম-ম করত বাতাস। রাতে ফেউ ডাকত, শেয়াল কাঁদত, তাদের বাড়ির আনাচে কানাচে এঁটোকাঁটা খেতে আসত শুয়োরের মতো মুখওয়ালা বাগডাশা। ঝিঁঝির ডাক রাতে অরণ্যকে গভীর করে তুলত। শীতকালে পড়ত অসহ্য শীত, মাটির ভাপ কুয়াশার মতো হয়ে বর্ষাকালে চরাচর আড়াল করত। পাহাড়ি পথ হঠাৎ বাঁক ঘুরে রহস্যে হারিয়ে যেত। তারা ভাইবোনেরা উৎরাই ভেঙে দৌড়ে দৌড়ে খেলত ছোঁয়াছুঁয়ির খেলা। দীনদরিদ্র ছিল তাদের পোশাক, আসবাব। তাদের ছোট্ট বাড়িটিতে তাদের অতজনের ঠিক আটত না। সেই বাগানে তাঁর ছেলেবেলার প্রথম বাবার কাছে কলকাতার গল্প শোনে। বেশিরভাগই কলকাতার দৃশ্যের গল্প, গাড়িঘোড়া, আলো, দোকান আর লোকজনের গল্প। বাবা গল্প বলতেন সুন্দর, আস্তে আস্তে, সময় নিয়ে প্রতিটি দৃশ্য যেন নিজেও প্রত্যক্ষ করতেন। সেই সব গল্পে তাঁর যৌবনকালে কলকাতার ছাত্রজীবনের নানা দীর্ঘশ্বাস মিশে থাকত। আর থাকত কলকাতা ছেড়ে আসবার বিরহ-যন্ত্রণা। হাসির মনে সেই প্রথম কলকাতার নাম বীজের মতো ঢুকে যায়। সে বাবাকে বলত–চলো না বাবা, কলকাতা যাই। বাবা স্থির থেকে বলত–দূর! আর যাওয়া হবে না। সেখানে আমাদের আত্মীয়স্বজন কেউ নেই, কোনো কাজও নেই সেখানে, খামোখা টাকা-পয়সা খরচ করে চারদিনের রাস্তার ধকল সয়ে কার কাছে যাব? হাসির মন বলত–কেন, কলকাতার কাছে।

শিলচর ছিল সুন্দর ছিমছাম শহর। লোকজন বেশি না, গাড়িঘোড়া বেশি না, চারদিকে জঙ্গল ঘেরা ছোট্ট শহর। সেখানে মাসির বাড়িতে এসে সে প্রথম শহরের স্বাদ পায়। সুন্দর সেই স্বাদ। তখন তার মনে কলকাতার বীজটি ফেটে অঙ্কুর দেখা দিয়েছে। সে বুঝতে পারে–শহর-শহরের মতো জায়গা নেই। সাতবছর সে শিলচরে কলকাতার আরও বিচিত্র গল্প শোনে বন্ধুবান্ধবীর কাছে। মাসিদের আত্মীয় হারুকাকার ক্যান্সার হয়েছিল, সে গেল চিকিৎসার জন্য কলকাতায়। শচীন নামে কলেজের একটি ছেলে বেশ কবিতা লিখত, সে গেল কলকাতায় বড়ো কবি হওয়ার জন্য। অনুরাধা ক্লাসিকাল গাইত গৌহাটি রেডিয়ো থেকে। সে প্রায়ই বলত–মফস্বলে কিছু হয় না, শিখতে হলে যেতে হবে কলকাতা। হাসির মন বলতে থাকে–কলকাতা, কলকাতা। তুমি গান গাও? নাচো? কবিতা লেখো? তুমি চাকরি চাও? উন্নতি চাও? তোমার মরণাপন্ন অসুখ! তবে কলকাতা যাও। যাও কলকাতায়। একবার কলকাতা থেকে ঘুরে এসো। মানুষকে কলকাতা সব দিতে পারে। খ্যাতি, টাকা, প্রাণ পর্যন্ত। কলকাতা থেকে যারা শিলচরে ফিরে যায় সেই সব বন্ধুদের কাছ ঘেঁসে কলেজে বসত হাসি। দেখত—ঠিক। ওদের মুখে-চোখে আলাদা দীপ্তি, ঝলমলে আনন্দিত ওদের পোশাক, গায়ে কলকাতার মিষ্টি গন্ধ। মাসিকে বলত–মেসোকে বলত–কী গো তোমরা! ভারী ঘরকুনো, চলো একবার কলকাতা যাই। মাসি মেসো সমস্বরে বলত–সে ভারি দুরের রাস্তা, পথের কষ্ট খুব, একগাদা টাকা খরচ, তা সেখানে গিয়েই বা হবে কী? যা ভিড়, গন্ডগোল, মারপিট আমাদের মতো সুন্দর নিরিবিলি শহর নাকি সেটা? চোর পকেটমার, রকবাজ ছেলে, রাজনীতি –দূর দূর।

যাওয়া হত না। হত না বলেই হাসির কল্পনায় কলকাতা ক্রমে ক্রমে এক বিশাল ব্যাপক রাজত্ব স্থাপন করে। কলকাতায় যেন বা আলাদা সূর্য ওঠে, আলাদা চাঁদ, কলকাতা শূন্যে ভাসমান বুঝি বা। কলকাতাকে ঘিরে যেসব কল্পনা হাসির–সেসব কল্পনা কলকাতার দিগ্বিজয়ী সৈন্যদলের মতো তার ভিতরটা তছনছ করে দিয়ে যেত। কলকাতা কল্পনা-লতা তার ওপর দু-চোখের পল্লবের ছায়া ফেলেছিল। কলকাতা বলে বোধ হয় কিছু নেই তবে। লোকে কেউ কখনো যায় নি। সবাই মিলে যোগাযোগ করে বানিয়েছে গল্প। যারা কলকাতার কথা জানে তারা নিজেদের মধ্যে চোখ টেপাটেপি করে, কানাকানি করে, যুক্তি করে, হাসিকে এক কাল্পনিক শহরের কথা শোনায়। কলকাতার খন্ডিত ছবি সে অনেক দেখেছে ভূগোলের বইতে, খবরের কাগজে, ক্যালেণ্ডারে। কখনো জি-পি-ওর ঘড়ি, হাওড়া ব্রিজ, ভিক্টোরিয়া, মনুমেন্ট, তা থেকে কিছু বোঝা যায় না। ক্রমে সে বুঝতে পারে, কলকাতার দৃশ্য নয়, রাস্তা ঘাট আলো নয়; নয় তার দোকানপাট কিংবা বিচিত্র পসরা–এসবের অতীত, কিংবা এসব মিলিয়ে কলকাতা এক মন্ত্রের মতো। কিংবা কলকাতা কি জ্বলন্ত পুরুষ, তার বুকে রহস্যের শেষ নেই, সীমাহীন তার নিষ্ঠুর উদাসীনতা, চুম্বকের মতো তার আকর্ষণ! দূরদূরান্ত থেকে প্রেমিকারা চলেছে কলকাতার দিকে! কেবলই চলেছে!

কলকাতা এক প্রেমিকেরই নাম। জ্বলন্ত দুর্বার এক প্রেমিক পুরুষ। কলকাতায় একবার গেলে আমি আর ফিরব না, ভাবত হাসি।

হাসি লেখাপড়া শিখত কলকাতায় যাবে বলে। গান শিখত, নাচ শিখত–কলকাতায় যেতে হলে কোনটা যে দরকার হবে, কোনটার সূত্রে কলকাতায় যাওয়া হবে তা বুঝতে পারত না। কিন্তু হাস্যকর হলেও একথা খুবই সত্য যে তার সব কিছুর পিছনেই ছিল কলকাতা, কলকাতা। বিয়ের সম্বন্ধ মাসিই খুঁজছিল। হাসি একদিন খুব লজ্জার সঙ্গে তাকে বলে–যদি বিয়ে দাও তো কলকাতায় দিও। মাসি অরাজি ছিল না। কিন্তু অত দূরের পাল্লায় ঠিকমত যোগাযোগ কে করে!

সেই সময়ে ডিগবয়ের তেল কোম্পানির এক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে চমৎকার সম্বন্ধ এসে গেল হাসির। বিলেত-ফেরত ছেলে, বেশ স্মার্ট চেহারা, দেড়-দুই হাজার মাইনে। হাসিকে পাত্রপক্ষ পছন্দও করে গেল। মণিপুরি নাচে, রবীন্দ্র-সংগীতে শিলচরে তখন হাসির বেশ নাম। রং চাপা হলেও বড়ো সুশ্রী ছিল হাসি। সবাই জানত হাসির ভালোই বিয়ে হবে। হয়েও যাচ্ছিল। পাত্রের ঠাকুমা মারা গিয়েছিল মাস আষ্টেক আগে, চারমাস পর কালাশৌচ কাটবে। তখন অস্থি বিসর্জন দিয়ে বিয়ে হবে–ঠিক হয়েছিল। হয়ে গেল পাটিপত্র, এমনকী আশীর্বাদের ব্যাপারে কালাশৌচ ওঁরা মানেননি। হাতে তখন চারমাস সময়। মাসির অ্যালবামে পাত্রের ফোটো সাঁটা হয়ে গেছে, পাশে হাসির ফোটো। মাসি মাঝে মাঝে হাসিকে অ্যালবামের সেই পাতাটা খুলে দেখাত–দ্যাখ হাসি।

হাসির মন বলত–কলকাতা, কলকাতা। বহু দূরে এক বিশাল পর্বতের মতো বহ্নিমান পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। চতুর্দিককে কেন্দ্রাভিগ আকর্ষণে টানছে চুম্বক পাহাড়ের মতো। সেখানে গেলে ফিরত না হাসি। যাওয়া হবে নাকি!

কাছাড়ের এক লোকনাট্য দল সেবার কলকাতায় যাচ্ছে। তারা হাসিকে দলে নিতে রাজি। হাসি মাসিকে গিয়ে ধরল–এখনও চারমাস বাকি। একবার ঘুরে আসি মাসি। মাত্র তো পনেরোটা দিন।

–বিয়ের আগে কলকাতায় গিয়ে নাচবি গাইবি, সেটা কি ভালো দেখাবে? পাত্রপক্ষ যদি কিছু মনে করে।

হাসি হাসে–কলকাতার জলে রং ফর্সা হয়, জান না?

অনেক বলা-কওয়ার মাসি রাজী হল।

কলকাতা কীরকম দেখতে তা আজও হাসি সঠিক জানে না। প্রথম দিনের মতোই। বহুদূর থেকে একটা যৌবনকালের প্রতীক্ষা নিয়ে সে যখন কলকাতায় নামল তখন আর রাস্তার কষ্টের কথা মনেও ছিল না, খুব পিপাসা পেয়েছিল, বিবেকানন্দ ব্রিজ পেরিয়ে আসার সময়ে যে গুম গুম আওয়াজ করেছিল রেলগাড়ি, সেই আওয়াজ শিয়ালদা পর্যন্ত তার বুকের ভেতরে কলকাতার শব্দ তরঙ্গ তুলেছিল। শিয়ালদার ঘিঞ্জি কলকাতা সে তো চোখে দেখেনি। শুভদৃষ্টির সময়ে কেউ কী বরের মুখ ঠিকঠাক দেখতে পায়, নির্লজ্জ ছাড়া? সে গাড়ি থেকে প্ল্যাটফর্মে পা দিতেই এক দুরন্ত পুরুষের প্রকান্ড উষ্ণ বুকের মধ্যে চলে এল। গর্জমান এক কামুক পুরুষ যার শিরা-উপশিরায় প্রাণস্রোত, যার আদরে অবহেলায় সর্বক্ষণ জীবন বয়ে যাচ্ছে। সেই প্রথম পুরুষটির আদরে লজ্জায় চোখ বুজেছিল বুঝি হাসি। চোখ আর খোলা হল না। কলকাতা তার চারদিকে সর্বক্ষণ এক শিশু বয়সের বিস্মৃত রঙিন মেলার মতো কাল্পনিক হয়ে রইল।

জ্যাঠতুতো দিদির বাড়িতে উঠেছিল হাসি, চিৎপুরের এক ফ্ল্যাটবাড়িতে। বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে সে একদিন লোকনৃত্যের অনুষ্ঠানও করল। কিন্তু সারাক্ষণ সে কেবলই তার শিরায় শিরায় উল্লসিত রক্তের স্পন্দনে কলকাতার শব্দ শুনল। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে থেকে টের পেল তার যুবতী বুক কলকাতার পাথুরে বুকের সঙ্গে মিশে আছে। একের হৃৎস্পন্দন মিশে যাচ্ছে আর একজনের। সঙ্গে আমি তোমাকে ছেড়ে কী করে আবার ফিরে যাব–মনে মনে বলত হাসি।

পাশের ফ্ল্যাটে এক দম্পতি ছিলেন, আর ছিল অমিয়। দম্পতি অমিয়রই দিদি জামাইবাবু। এ ফ্ল্যাটে হাসিরও দিদি জামাইবাবু। দুই পরিবারে যাতায়াত ছিল। সামনের বারান্দাটা কমন। সেইখানে দাঁড়িয়ে কলকাতা দেখতে দেখতে হাসি কতদিন দেখেছে পাশের ফ্ল্যাট থেকে সুন্দর পোশাক পরে অমিয় বেরোচ্ছে, নীচে রাস্তায় রাখা তার স্কুটার। স্কুটারে চলে যেত ছেলেটা, যাওয়ার আগে তাকে লক্ষ করত। কিন্তু অমিয়কে কেন লক্ষ করবে হাসি? কলকাতার প্রেমিকা কেন গ্রাহ্য করবে অন্য পুরুষকে?

দুই পক্ষের দিদি জামাইবাবুরা প্রায় রাতেই খাওয়ার পর কিছুক্ষণ ফিস খেলার আসর বসাতেন। হাসি থাকত, অমিয়ও। দুপক্ষের কথাবার্তা মাঝে মাঝে হাসি আর অমিয়কে ঘেঁষে যেত। সে সব ঠাট্টার গুরুত্ব ছিল না। হাসির দিদি জামাইবাবু জানতেন হাসির বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।

হাসি অমিয়কে তেমন করে লক্ষ করত না ঠিকই, কিন্তু তার মন বলত-কলকাতা, কলকাতা।

অমিয় খুব বেশিমাত্রায় লক্ষ করেছিল হাসিকে। কতটা তা হাসি টের পায় নি। কিন্তু একদিন অমিয় খুব দুঃসাহসের সঙ্গে প্রস্তাব করেছিল–চলুন, আমার স্কুটারে আপনাকে কলকাতা দেখিয়ে আনি। প্রথমদিন হাসি রাজি হয় নি। কিন্তু কয়েকদিন পরে হয়েছিল। কলকাতার মেয়াদ তখন শেষ হয়ে এসেছে। কয়েকদিন পরই হাসি চলে যাবে।

মসৃণ, সুন্দর ক্যাথিড্রাল রোড হয়ে ময়দানের দিকে স্কুটার ছুটিয়ে অমিয় প্রস্তাব দিয়েছিল–যদি কিছু মনে না করেন–

কলকাতা–কেবলমাত্র কলকাতার জন্য হাসি থেকে গেল। কয়েকটা কাগজপত্রে সই করে বিয়ে, বাড়িতে চিঠি লিখে ব্যাপারটা জানানো, তারপরই ঢাকুরিয়ার ফ্ল্যাট।

হাসির মন বলত–কলকাতা, কলকাতা!

হাসির জীবনে অমিয় কোথাও ছিল না। যৌবনকালে একশো ছেলে ভালোবেসেছে হাসিকে। শিলচর জুড়ে ছিল তার প্রেমিকেরা। তাদের মধ্যে ছিল আমাদের রঞ্জি ট্রফির ক্রিকেট খেলোয়াড়, কবি, অধ্যাপক, ছাত্রনেতা, ভবঘুরে। তাদের অনেকের সঙ্গে হাসির দীর্ঘকালের সম্পর্ক। কোথায় ছিল অমিয়! পাত্র হিসেবেও অমিয় তো কিছুই না। সদ্য ব্যবসা শুরু করেছে। কয়েকটা অর্ডারে লাভ পেয়ে কিনেছে স্কুটার, দু-হাতে টাকা ওড়ায়, পোশাক কেনে। সেই অমিয় হাসির জীবনে এসে গেল! এসে গেল, আবার এলও না। সারাদিন টাটা বিড়লা হওয়ার আশায় সারা কলকাতা দৌড়-ঝাঁপ করে যখন অমিয় ফিরত, তখন সদর খুলে অমিয়কে দেখে একটু অবাক হয়ে এক পলকের জন্য হাসি ভাবত–আরে এ লোকটা কে? স্বামীঃ তার মনে পড়ত, সারাদিন সে অমিয়র কথা ভাবেই নি!

শরীরে শরীরে কথা হত ঠিকই। অমিয়র প্রথম দিকের ভালোবাসা ছিল তীব্র, শরীরময়, আক্রমণাত্মক। হাসি সেই খেলায় আগ্রহভরে অংশ নিয়েছে। কিন্তু সে কতটুকু সময়ের ভালোবাসা? শরীর জুড়োলেই তা ফুরোয়। তারপর আর আগ্রহ থাকে না অচেনা পুরুষটির প্রতি। হাসি তখন থেকে নিষ্ঠুর।

চিৎপুরের দিদি-জামাইবাবু এসে বলতেন–হাসি, তোমার বাবা-মা আমাদের দোষ দিয়ে চিঠি লিখেছেন, আমরা কী লিখব ওদের?

–দোষ! আপনাদের দোষ কী?

–দোষ নেই ঠিকই, তুমি ভালোবেসে বিয়ে করেছ, কিন্তু আমাদের বাসার থেকেই তো ব্যাপারটা ঘটল।

ভালোবাসা! হাসি ভারি অবাক হত। ভালোবাসা কীসের! কাকে! অমিয়কে? অমিয়কে তো সে কোনোকালে ভালোবাসেনি। সে ভালোবেসেছিল কলকাতাকে। বিশাল কলকাতার কতটুকু প্রতিদ্বন্দ্বী অমিয়? অমিয়কে জানালায় এসে বসা চড়াইপাখির মতো তুচ্ছ মনে হত তার। যার সঙ্গে হাসির বিয়ে ঠিক হয়েছিল বা তার শিলচরের অন্য প্রেমিকেরা তাদের তুলনাতেও অমিয় কিছুই না। কিছুই না। অমিয় কেবল কলকাতায় হাসিকে আশ্রয় দিয়েছে।

বিয়ের ছ-মাস পরে মাসি আর মেসোমশাই এসেছিলেন।

–এটা কী করলি হাসি? সেই ডিগবয়ের ছেলেটা বিয়েই করল না। হাসি উত্তর দেয়, আমি যা চেয়েছিলাম, পেয়েছি।

–কী চেয়েছিলি?

 হাসি মুখে কিছু বলল না। মনে মনে বলল–কলকাতা।

তিন বছরে ডাকটিকিটটা ভিজে ভিজে আলগা হয়ে এসেছে। খামের গা থেকে এবার সাবধানে তুলে নেবে হাসি, একটা চৌকো দাগ থেকে যাবে কী? থাক। শরীর বহতা নদীর মতো, শরীরে কোনো চিহ্ন থাকে না। অমিয়কে শরীরের বেশি দেয়নি হাসি।

সিলিং ফ্যানের ঝকঝকে ইস্পাতের রঙের ঘূর্ণী বৃত্তটা দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল হাসি। উঠে দেখল রোদের মুখে বসেছে কালো মেঘ। গুড় গুড় শব্দ হচ্ছে। পুবের বাতাসে পর্দা উড়ে আসছে। উদ্ভিদহীন কলকাতায় প্রকৃতির বন্য গন্ধ নিয়ে আসে বৃষ্টি।

পাশ ফিরতেই খুব অবাক হয়ে হাসি দেখে, শতরঞ্চির একধারে তার মাথার কাছেই একটা ছোট্ট লালচে ইঁদুর মরে পড়ে আছে। শিশু শরীর ইঁদুরটার, উদোম ন্যাংটো, মুখে নির্দোষ একখানা ভাব, চুপ করে মরে গেছে কখন। আহা রে! এত দূর এসেছিলি কেন? কিছু বলতে চেয়েছিলি আমাকে? লাল টুকটুকে হাত-পা, সুন্দর সতেজ লেজ রেশমের মতো রোমরাজি, ঠোঁটে গোঁফের নরম সাদাটে চুল। আস্তে আস্তে উঠে বসে হাসি। তার একটু কষ্ট হয়। বিষ সে নিজে মিশিয়েছিল।

উঠে মধুকে ডাকে হাসি-ঘরগুলো খুঁজে দেখো মধু, ইঁদুরগুলো কোথায় কোথায় মরে পড়ে আছে। পচে গন্ধ বেরোবে।

চারটে বেজে গেছে। জামাইবাবুকে একটা ফোন করা দরকার। রিজার্ভেশনটা যদি পাওয়া যায়।

জলে কলকাতার ভঙ্গুর প্রতিবিম্ব পড়েছে, ভেঙে যাচ্ছে। জল হলে এক কলকাতা অনেক কলকাতা হয়ে যায়। ঢাকুরিয়া থেকে বাস ধরে হাসি গড়িয়াহাটায় এসে পেট্রোল পাম্প থেকে জামাইবাবুর অফিসে টেলিফোন করে।

–জামাইবাবু, আমি হাসি।

–বলো।

–আমার রিজার্ভেশনের কী হল?

 –হয়নি। দার্জিলিং মেলে ভীষণ ভীড় হচ্ছে। এখন সামার-রাশ।

রেলে যে কে আপনার বন্ধু আছে চেকার?

 –থাকলেই বা, সিটি বুকিংগুলো দেখে এসো না। তিনদিন ধরে লাইন দিয়ে বসে আছে। লোক–কোথায় কত টিকিটের কোটা আছে সব তাদের মুখস্থ, একটা টিকিট কম পড়লে আস্ত রাখবে?

-এত লোক যাচ্ছে কোথায়?

-কলকাতা থেকে পালাচ্ছে; আবার কলকাতার পালিয়ে আসবে বলে।

–আমার মনে হয়, আপনি গা করছেন না।

–তা তো করছিই না।

–কেন?

-তুমি সুখের পাখি উড়ে যাবে, আর আমরা পড়ে থাকব হাঁফিয়ে ওঠা ভ্যাপসা কলকাতায়–তা কী হয়!

–আমার যে যাওয়াটা দরকার।

-কেন?

যাব না কেন?

ওপাশে জামাইবাবু একটা শ্বাস ফেলে।

-হাসি, গতকাল অমিয় আমার কাছে এসেছিল।

হাসি তীক্ষ্ণ গলায় বলে–কেন?

–ভয় পেও না। সে তোমার চলে যাওয়া আটকানোর ষড়যন্ত্র করতে আসেনি।

হাসি চুপ করে থাকে।

-ও এসেছিল একটা স্টিমারঘাটের কথা বলতে।

–স্টিমারঘাট!

–স্টিমারঘাট। ও আজকাল মাঝে মাঝে একটা স্টিমারঘাট দেখতে পায়।

তার মানে?

তার মানে তোমাকেই আমরা জিজ্ঞেস করব ভাবছিলাম।

স্টিমারঘাটের কথা আমি কী জানি। কোথাকার স্টিমারঘাট।

তার আগে বলো, ওর ব্যবসার অবস্থা কী?

হাসি একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে–বোধহয় ভালো না। বাজারে অনেক ধার জমে গেছে।

–আর এ সময়ে তুমি সুখের পাখি উড়ে যাচ্ছ?

–আমি কী করব জামাইবাবু?

ওপাশে জামাইবাবু আবার চুপ।

–আমার রিজার্ভেশনের কী করবেন বলুন? কাছে-পিঠের রাস্তা হলে আমি রিজার্ভেশন ছাড়াই চলে যেতাম। কিন্তু চারদিন ধরে যাওয়া তো সেভাবে সম্ভব না।

-দেখছি।

–আমার কিন্তু সময় নেই। আর পনেরো দিনের মাথার খুশির বিয়ে। তারপর ফিরে এসে স্কুলে জয়েন করব। বুঝলেন?

-বুঝেছি। কিন্তু অমিয়র স্টিমারঘাটের কী হবে?

–আমি কী জানি।

–হাসি, অমিয়র ওজন কত?

হাসি হেসে ফেলে। বলে–আমি কি দাঁড়িপাল্লা?

-না। কিন্তু বউরা তো স্বামীর ওজন জানে। জানা উচিত।

-ফোন রেখে দেব কিন্তু।

–আমি ইয়ার্কি করছি না। অমিয়কে দেখে মনে হয় অন্তত কুড়ি কে.জি. ওজন কমে গেছে।

হাসি একটা শ্বাস ফেলে। অমিয় বোধহয় তাকে ভালোবেসেছিল। কিন্তু তাতে হাসির কিছু যায় আসে না।

জামাইবাবু, আমি ওর সঙ্গে ঝগড়া করি না। আমাদের মধ্যে কোনো ভুল-বোঝাবুঝি নেই।

-তোমার দিদির সঙ্গে আমার রোজ চারবার করে ঝগড়া হয়, আর ভুল বোঝাবুঝি? আমার জীবনে কেউ কাউকে বুঝব না। কিন্তু গত চারমাসেও আমার ওজন দু-কে.জি বেড়েছে।

–ওজনের কথা বলছি না।

–আমি ওজনের পয়েন্টেই স্টিক করতে চাই। হাসি, অমিয়র ওজন কমে যাচ্ছে কেন?

 –আমার রিজার্ভেশনের কথাটা মনে রাখবেন। ছেড়ে দিচ্ছি

— –ছেড়ো না। শোনো, স্টিমারঘাটের কথা ও তোমাকে কখনো বলেনি?

–না।

-আশ্চর্য!

–আশ্চর্যের কী? ও আমাকে অনেক কথাই বলে না।

 –কিন্তু স্টিমারঘাটের ব্যাপারটা বলা উচিত ছিল।

—কেন?

–স্টিমারঘাটটা ও খুব স্পষ্ট দেখতে পায়, আর এমনভাবে বলে যে আমিও যেন সেটা দেখতে পাই। শুনতে শুনতে কেমন যেন অদ্ভুত লাগছিল।

-কীরকম স্টিমারঘাট সেটা?

–খুব উঁচু একটা বালিয়াড়ি বহুদূর গড়িয়ে নেমে গেছে…কিন্তু ফোনে অত সব বলা যায় না। তুমি ওর কাছে শুনো।

–আমি শুনব কেন জামাইবাবু? আমার কৌতূহল নেই।

–তুমি আসাম থেকে কবে ফিরবে হাসি?

–বললাম তো, খুশির বিয়ে হয়ে গেলেই। ফিরে এসে স্কুলে জয়েন করব।

–সেটা তো ফেরা নয়। স্কুলে মানে বাগনানের কাছে যাবে, গ্রামে। কিন্তু তুমি অমিয়র কাছে কবে ফিরবে হাসি?

হাসি উত্তর দেয় না। ফোনটা খুব আস্তে ক্র্যাডলে নামিয়ে রাখে।

আজ কলকাতা বৃষ্টির পর বড়ো সুন্দর সেজেছে। সূর্যের শেষ আলো সিঁদুর-গোলা রং ঢেলেছে রাস্তায় রাস্তায়। গড়িয়াহাটার বাড়িগুলোর গায়ে সেই অপার্থিব রং জলে ছায়াছবি। রাস্তাগুলো ভেজা, রাস্তার নীচু অংশে পাতলা জলের স্তর জমে আছে। সেই জল থেকে আলোর অজস্র প্রতিবিম্ব উঠে আসে। একা একা হাঁটতে বড়ো ভালো লাগছে হাসির। মোড়ের দোকানগুলোর শো-কেশে সে সুন্দর শাড়িগুলো ঘুরে ঘুরে দেখল একটু। পায়ে পায়ে হাঁটতে লাগল। কী ভিড় চারদিকে! তবু এ ভিড় বড়ো রঙিন। বাগনান থেকে হয়তো প্রায়ই আসা হবে না, কিন্তু পুরোনো ভালোবাসার টানে ছুটি-ছাটায় ঠিক চলে আসবে হাসি, উঠবে চিৎপুরে দিদি জামাইবাবুর কাছে। একা একা ঘুরবে কলকাতায় যেমন সে গত তিনবছর ধরে ঘুরেছে এবং ক্লান্ত হয়নি। কলকাতার রূপ কখনো ফুরোয় না।

একটা মরা বেড়াল পড়ে আছে বৃষ্টিতে কাদায় মাখামাখি হয়ে। ফুটপাথ থেকে রাস্তায় নামতে বেড়ালটাকে ডিঙিয়ে গেল হাসি। পচা গন্ধ, কাছেই বসে কোনো নেমন্তন্ন-বাড়ির এঁটো-কাঁটার রাশ খবরের কাগজে জড়ো করে বসেছে এক ভিখিরি মেয়ে তার বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে। হাসি ট্রাম লাইন পেরিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। তার মন বলে, আজও বলে– কলকাতা, কলকাতা।

চলে যাবে বলে উঠে দাঁড়িয়েছিল অমিয়, ঠিক সে-সময়ে নিঃশব্দ পায়ে কালীচরণ এল। সিঁড়িতে ওর পায়ের শব্দ হয়নি। অমিয় একটু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।

-চলে যাচ্ছিলেন? কালীচরণ জিজ্ঞেস করে। তার মুখে ঘাম, উৎকণ্ঠা।

 –হুঁ।

–আমি আপনার কাছেই এসেছিলাম।

অমিয় চুপ করে থাকে।

–গত দুমাস কিছু চাইনি। জানতাম আপনি অসুবিধেয় আছেন। কিন্তু এখন আমার বড়ো ঠেকা। পেমেন্টের একটা তারিখ দিন এবার।

অমিয় জিজ্ঞেস করে–সিঁড়িতে তোমার পায়ের শব্দ হয়নি কেন কালীচরণ?

কালীচরণ একটু থমকে যায়। চেয়ে থাকে। অমিয় হাত বাড়িয়ে ওর ঘেমো হাতখানা ছুঁয়ে বলে–কাঠের সিঁড়িটা বড়ো পুরোনো হয়েছে, বেড়াল বাইলেও শব্দ হয়। তুমি কী করে শব্দ না করে উঠলে? তুমি বেঁচে আছ তো! ভূত হয়ে আসনি তো কালীচরণ? কিংবা পাখায় ভর করে?

কালচীরণ একটু হেসে একটা ময়লা রুমালে মুখ মোছে। তার গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। হার্ডওয়ার বাজার যদিও কালীচরণের পায়ের তলায়, কিন্তু তবু বাইরের চেহারায় সে ভদ্রলোক থাকেনি। ময়লা মোটা ধুতি, গায়ে লংক্লথের হাফ-হাতা জামা, পায়ে টায়ারের চটি।

–বাগচীবাবু, আমার মেয়ের বিয়ে। তিনহাজার যদি আপনার কাছে আটকে থাকে তো আমি গরিব, কী দিয়ে কী করব?

অমিয় একটু চুপ করে থাকে। তারপর হঠাৎ বলে–দুটো সরকারি অর্ডার আছে কালীচরণ, পনেরো হাজার টাকার। করবে?

-আপনি পেয়েছেন?

আমিয় মাথা নাড়ে–আমারই। কিন্তু আমি করব না। তুমি করো তো তোমাকেই ছেড়ে দিই।

কালীচরণ সতর্ক গলায় জিজ্ঞেস করে–আপনি কত পারসেন্ট নেবেন?

 –এক পয়সাও না। শুধু পেমেন্টের জন্য আমাকে একটু সময় দাও।

–অর্ডার দেখি–বলে কালীচরণ হাত বাড়ায়।

অমিয় অর্ডারের কাগজপত্র বার করে দেয়।

–কালীচরণ কয়েক পলক অর্ডারের কাগজপত্র দেখে বলে–মাত্র আট পারসেন্ট উঁচু দর দিয়েছেন! তাও হচ্ছে একমাস দেড়মাস আগেকার দর। গত একমাসে মেশিন পার্টস, কয়েল আর স্প্রিংয়ের দর দশ থেকে কুড়ি পারসেন্ট বেড়েছে। পনেরো হাজার টাকার অর্ডার, অফিসার আর বিল ডিপার্টমেন্টকে খাইয়ে হাজার খানেকও ঘরে তোলা যাবে না। পরিশ্রম পোষায়?

–তুমি করবে না?

কালীচরণ একটু হাসে-–করব না কেন? ব্যবসা চালু রাখতে হলে কাজ ধরতেই হবে, লোকসান হলেও।

গায়ের জামা খুলে স্যাণ্ডো গেঞ্জি গায়ে রজত টেবিলের ওপর শুয়ে ছিল। তার রায়চৌধুরি এখনও আসেনি। শুয়ে থেকেই মুখ ফিরিয়ে বলল–কালীচরণ, বাগচীর জায়গায় আমি হলে অর্ডার দুটো কেড়ে নিয়ে তোমাকে ঘাড়-ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতাম।

-কেন?

–সরকারি অর্ডারের জন্য হাজারটা লোক হন্যে হয়ে ঘুরছে। তুমি ভদ্রলোক হলে লোকসানের কথা বলতে না। পনেরো হাজারে তোমার অন্তত ছ-হাজার মার্জিন থাকবে।

কালীচরণ বিড় বিড় করে বলে–দেনা পাওনার কথা উঠলেই সব জায়গায় খিচাং।

রজত ধমক দিয়ে বলে-দেনা-পাওনা আবার কী? বাগচীর তিন হাজার ওই অর্ডারে শোধ হয়ে গেল। আর এসো না।

তার মানে? তিন হাজার টাকা আমি এখনো পাই

–না পাও না। তোমাকে সেনগুপ্ত এনেছিল, তার আমলে তুমি সাপ্লায়ার ছিলে। পারো তো তাকে খুঁজে বের করো।

তাকে পাব কোথায়?

–বাগচী তার কী জানে কালীচরণ? ছোটো কোম্পানি, আট-দশ হাজার টাকা ক্যাপিটাল তুলে নিয়ে গেল, আর লায়বিলিটি সব রেখে গেল–এটা কী মগের মুল্লুক?

–আমি তার কী জানি?

-তোমাদের সঙ্গে সেনগুপ্তর ষাট আছে, আমি জানি! সে-ই তোমাদের পাঠাচ্ছে তাগাদায়। যাতে বাগচী বিপদে পড়ে। বাগচী ভালো লোক কালীচরণ, দেনা সে সব মেনে নিচ্ছে, সরকারি অর্ডার বিলিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু মনে রেখো গড়বড় করলে ঝামেলা হবে।

কালীচরণ চুপ করে থাকে।

রজত হাই তুলে বলে–সকলের দিন সমান যায় না। বাগচী তোমাদের অনেক বিজনেস দিয়েছে। এখন বেরোও

কেউ তার হয়ে বোঝাপড়া করুক, কিংবা তাকে করুণা করুক, এটা আজও পছন্দ করে না অমিয়। সেইটুকু অহঙ্কার তার এখনও আছে। তবু সে কিছুই বলে না। চেয়ে থাকে।

দুর্বল চোখে একটু চেয়ে থেকে কালীচরণ উঠে পড়ে।

 শ্লথ ভঙ্গীতে টেবিল থেকে রজত তার চেয়ারে নেমে বসে। অলস ভঙ্গিতে বুশ-শার্টটা চেয়ারের পিঠ থেকে খুলে নিয়ে গায়ে দিতে দিতে অমিয়র দিকে তাকায়। চোখে ভর্ৎসনা।

কেমন লজ্জা করে অমিয়র। চোখ সরিয়ে নেয়। অর্ডার দুটো রাখবার জন্য তাকে অনেকবার কল্যাণ বলেছিল। তিন-চার মাস কোনো অর্ডার পায়নি অমিয়, এই দুটো পাওয়াতে দিন সাতেক আগে তারা তিনজন অফিসঘরে একটা ছোট্ট উৎসব করেছিল। সবীর থেকে রেজালা আর তন্দুরী রুটি এসেছিল, আর কে-সি দাসের সন্দেশ। কল্যাণ মুখার্জি, রজত সেন আর অমিয় বাগচী–তারা কেউ কারো বন্ধু নয়। একটা ঘরে তিনটে টেবিলে তাদের তিনটে আলাদা কোম্পানি। যে যার ব্যবসার ধান্দায় ঘোরে। রোজ দেখাও হয় না। কিংবা খুব কম সময়ের জন্য দেখা হয়। তবু কী করে যেন তাদের মধ্যে বুনো মোষের মতো পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ততা এসে গেছে। তারা কেউ কখনো তিনটে কোম্পানিকে এক করার কথা বলেনি। তারা বন্ধুও নয়, তাহলে কী? তা ঠিক ব্যাখ্যা করা যায় না। কিন্তু বাগচীর কিছু হলে আপনা থেকেই রুখে দাঁড়ায় মুখার্জি আর সেন, যেমন সেনের কিছু হলে রুখে ওঠে বাগচী আর মুখার্জি। বোধহয় এই ঘরটাই তাদের এই সম্পর্ক তৈরি করে দিয়েছে।

সেনের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে অমিয় মাথা নীচু করে ছিল।

রজত ইণ্ডিয়া কিংসের প্যাকেটটা ছুঁড়ে দেয় অমিয়র টেবিলে। বলে–আপনার ঠোঁটে সন্দেশের গুঁড়ো লেগে আছে বাগচী, মুছে নিন।

অমিয় একটু হাসে। সহজ হতে চেষ্টা করে। বলে–আমার দ্বারা সাপ্লাইটা হত না সেন।

রজত ভ্রূ কুঁচকে একটু তাকিয়ে থেকে বলে–গত তিন মাস আপনি বিজনেস পাননি বাগচী। এই অর্ডারটা ছাড়তে আপনাকে আমরা বারণ করেছিলাম।

–আমি পারতাম না।

–আমরা চালিয়ে দিতাম। আফটার অল উই আর কমরেডস।

 রজত ওঠে। তার ডেস্ক, আলমারি বন্ধ করতে করতে হঠাৎ একটু হেসে বলে–-জার্মানি থেকে আপনাকে কী পাঠাব বলুন তো! ঘড়ি? শেভার? নাকি কলম? তার চেয়ে জব ভাউচার একটা পাঠিয়ে দেব বরং–কী বলেন?

রজত নিজেই হাসে–কিন্তু মিসেসকে রেখে আপনি তো যাবেন না। গিয়েও শান্তি পাবেন না। ম্যারেডদের ওই এক বিপদ।

সে-কথার উত্তর না দিয়ে অমিয় তার গভীর অন্যমনস্ক মুখ তুলে বলে–সেন, লক্ষ করেছেন কালীচরণের পায়ের কোনো শব্দ হয় না।

-কী বলছেন? রজত ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে।

–বলছি, যাদের পায়ের শব্দ হয় না তারা খুব ডেঞ্জারাস। সেনগুপ্তরও হত না।

 সেনগুপ্তর উল্লেখে রজতের মুখটা ঝুলে পড়ে। চাপা গলায় সে বলে–বাস্টার্ড। আপনাকে কী সেনগুপ্ত হিপনোটাইজ করেছিল বাগচী? কী করে তবে সে জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের টাকা তুলে নিল, আদায় করে নিল চার চারটে বিল-পেমেন্ট, সমস্ত লায়েবিলিটি কী করে আপনার ঘাড়ে ফেলে গেল?

অমিয় একবার হাত উলটে তার অসহায়তা প্রকাশ করে মাত্র। কথা বলে না। হতাশ গলায় রজত বলে–ব্যবসা আপনার কর্ম নয় বাগচী। আপনি ভীতু হয়ে যাচ্ছেন, লোককে দাবড়াতে পারেন না।

সেনগুপ্তর পায়ের কোনো শব্দ হত না–এই সত্যটা আবিষ্কার করে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে অমিয়। কালো ছিপছিপে সুপুরুষ এবং হিংস্র সেনগুপ্ত ছিল বার্ড কোম্পানির চাকরে। চাকরি নামে মাত্র, সে ছিল কোম্পানির টিমের নামকরা গোলকিপার। খেলার জন্যই চাকরি পেয়েছিল। পোস্ট থেকে পোস্টে উড়ে শট আটকাত, বহুবার পেনালটি ধরেছে। অবধারিত একটা লিফট পেত, কিন্তু সেবার হাঁটুর মালাইচাকি ভেঙে পড়ে রইল ছ-মাস। উন্নতির আর আশা নেই দেখে চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করতে এল অমিয়র সঙ্গে।

তখন অমিয় মারাত্মক পোশাক পরত, দারুণ হাসত, পিচের রাস্তার মতো গড়গড়ে ইংরেজি বলত। সাপের মতো সাবলীল ছিল তার নড়াচড়া, ক্রুর চোখ, ঘন ভ্রূ। সেনগুপ্ত তার দিকে সম্মোহিতের মতো চেয়ে থাকত। একটা সময় ছিল যখন সেনগুপ্তর মতো বিপজ্জনক ছেলেকে নিপুণভাবে চালাত অমিয়। তখন সাপ্লায়ারেরা সাবধানে মাল দিত, ছ-মাস ন-মাস তাগাদা করত না। অর্ডার আসত ঝাঁকে ঝাঁকে। চোখা, চালাক, সাহসী অমিয় হিংস্র, মারকুট্টা সেনগুপ্তকে ব্যবহার করত ব্যবসার ডেকর হিসেবে, কখনো তাকে বানাত দেহরক্ষী, কখনো তাকে আউটডোরে ঘুরিয়ে আনত সেলসম্যান হিসেবে! সেনগুপ্তকে তৈরি করেছিল সে-ই। তারপর কবে থেকে–কবে থেকে যেন–বহু দূরের এক অচেনা নির্জন ফেরিঘাট জাহাজের মতো ধীরে অমিয়ের কাছাকাছি চলে আসতে থাকে। তখন থেকেই সে মাঝে মাঝে সেনগুপ্তর দিকে চেয়ে ভয় পেয়ে চমকে উঠত। সে দেখতে পেত–তার সামনে স্বাভাবিক পোশাক পরা সেনগুপ্ত নয়-সেনগুপ্তর পরনে কালো শর্টস, লাল টুকটুকে গেঞ্জি, দস্তানা পরা দুটো হাত থাবার মতো উদ্যত হয়ে আছে, মাথায় টুপি, টুপির ছায়ায় দুটো আলপিনের মতো চোখ, ফণা তুলে দুলছে এক হিংস্র গোলকিপার, অমিয়র সব রাস্তা বন্ধ করে সে দাঁড়িয়ে।

মানুষের পতনের কোনো শব্দ হয় না। তবু আশপাশের কিছু লোক ঠিক কেমন করে টের পায়, এ লোকটার দিন শেষ হয়ে এসেছে। কোনোদিন দীর্ঘ টেণ্ডার টাইপ করতে করতে হঠাৎ চোখ তুলে সেনগুপ্ত হয়তো দেখেছিল, অমিয় ভীত চোখে তার দিকে চেয়ে আছে। কিংবা হয়তো কোনোদিন অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে দু-জনে বেরোনোর সময় অন্ধকার সিঁড়িতে সেনগুপ্তর আগে আগে নামতে দ্বিধা করেছে। কিংবা এরকমই কোনো তুচ্ছ কিছু লক্ষণ দেখেছিল সেনগুপ্ত। বুঝেছিল ব্যবসাতে অমিয়র দিন শেষ, তার শুরু। বুঝেছিল সাপ্লায়াররা, পারচেজাররা। বুঝেছিল আরও অনেকে। সবার শেষে বুঝেছে অমিয়। স্পষ্টই নিজের ভেতরে সে এখন এক দিনাবসান টের পায়, প্রত্যক্ষ করে সূর্যাস্ত। বহু দূর থেকে নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে এক নির্জন ফেরিঘাট, তার জেটি, তার অতলান্ত জল…অমিয় মুখ তোলে–কিছু বলছেন সেন?

-একটা মেয়েকে কী করে রিফিউজ করতে হয় বাগচী? আমি কোনো ল্যাংগুয়েজ খুঁজে পাচ্ছি না। নাকি জার্মানিতে গিয়ে চিঠি দেব?

অমিয় একটু হাসে–ল্যাংগুয়েজের দরকার হয় না সেন। রিফিউজাল মনে থাকলেও লোকে ঠিক বুঝে নেয়। ডোন্ট বদার।

–মাইরি! তাহলে বেঁচে যাই।

অমিয় হাসে।

–চলি বাগচী। সিগারেটের প্যাকেটটা আপনি রেখে দিন। যদি রায়চৌধুরি আমার মোটর পার্টস নিয়ে আসে তবে আমার হয়ে ওর পাছায় তিনটে লাথি কষবেন–তিনটে–ভুলবেন না।

অমিয় অনেকক্ষণ বসে থাকে। অফিসঘরটা অন্ধকার হয়ে আসে। অমিয় আলো জ্বালে না। রাস্তার নানা আলোর ছায়াছবি এসে সিলিংয়ে কাঁপতে থাকে, দেয়ালে চমকায়। কাকের পাখার মতো অবসাদ নেমে আসে অমিয়র শরীর জুড়ে।

বাড়ির দেয়ালের কোনো গোপন কোণে হঠাৎ উঁকি দেয় এক অশ্বত্থ চারা। কেউ লক্ষ করে না। কলতলায় শ্যাওলা জমে, দেয়ালের চাপড়া খসে পড়ে। কেউ লক্ষ করে না। কিন্তু ওই ভাবেই অলক্ষিতে শুরু হয় একটা বাড়ির ক্ষয়। অমিয় নিজের ভিতরে সেই অশ্বত্থের গোপন চারাটিকে খুঁজছে। অনুসন্ধান করছে। শ্যাওলা জমল কোথায়, কোথায়ই বা খসে পড়ছে চাপড়া। খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু এ তো ঠিকই যে সে সেনগুপ্তকে ভয় পেতে শুরু করেছিল একদিন। অথচ ভয়ের তেমন কারণ ছিল না। গোলকিপারের পোশাক বহুকাল আগেই ছেড়ে ফেলেছিল সেনগুপ্ত, খুলে রেখেছিল দস্তানা, ক্রমে হয়ে আসছিল অমিয়র বশংবদ। সাপুড়ে কবে আবার তার ঝাঁপির সাপকে ভয় পেয়েছে?

কিন্তু এর জন্য তো সেনগুপ্ত দায়ী নয়।

সারা কলকাতা দৌড়-ঝাঁপ করত অমিয়, আর তার স্কুটার। সন্ধ্যে বেলা বাড়ির সামনে থেমে, ভারী স্কুটারটা অবলীলায় টেনে তুলত সিঁড়ির তলায়, শিস দিয়ে সিঁড়ি ভাঙত অমিয়। ভাবত দরজা বন্ধ করেই সে এক সুন্দর জগতে চলে যাবে। কিন্তু প্রায়দিনই সে অর্গলহীন দরজা ঠেলে এক আবছা অন্ধকার ঘরে ঢুকত। পরিত্যক্ত বাড়ির মতো ঘর। দেখত, হাসি তার জন্য প্রস্তুত হয়ে নেই। হয়তো শুয়ে আছে, কিংবা দাঁড়িয়ে আছে ব্যালকনিতে। মুখোমুখি হতে হাসির চোখে সে বিস্ময় দেখতে পেত। কোনোদিন বা দেখত, হাসি ঘরে নেই।

পরস্পর আশ্লিষ্ট রতিক্রিয়ার সময়ে সে কি দেহসংলগ্ন হাসির শীৎকার শোনেনি? অনুভব করেনি তার শিহরন, বুকের ভিতরে হৎপিন্ডের উত্তেজনা? লক্ষ করেনি মুখমন্ডলে মুক্তোর মতো স্বেদবিন্দু? করেছিল। হাসির শরীরে অর্গলহীন দরজা খুলে ফেলে অমিয় দেখেছে, সেখানেও এক আবছা অন্ধকার ঘর–পরিত্যক্ত ঘরের মতো নিরিবিলি–সেখানে হাসি সাজেগোজে, চুল বাঁধে, আয়নায় দেখে মুখ, প্রতীক্ষা করে–অমিয় সেই ঘরে ঢুকলে হাসি যেন অবাক মুখ তুলে নীরব প্রশ্ন করে তুমি কে?

মারাত্মক ঘটনা ঘটেছিল একদিন। গতবারে। জ্যাঠামশাইয়ের মেয়ে অনুর বিয়েতে যাবে তারা। সে আর হাসি। ধুতি-পাঞ্জাবিতে কোনোদিন অমিয়কে দেখেনি হাসি। বিয়েতে যাওয়ার সময়ে অমিয় সেদিন ওয়ার্ডরোব খুঁজে হাঁটকে বের করেছিল পাঞ্জাবি আর ধুতি। বহু যত্নে, পরিশ্রমে ধুতির কোঁচা কুঁচিয়েছিল সে। অন্য ঘরে তখন হাসি সাজগোজ শেষ করে সবশেষে তার বেনারসী পরছে। হাসি বেরিয়ে এসে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা অমিয়কে দেখে ভ্রূ ওপরে তুলে হেসে ফেলবে, বলবে–ওমা, তোমাকে যে চেনা যাচ্ছে না। এরকমই হবে বলে ভেবেছিল অমিয়। ধুতি-পাঞ্জাবি পরে সে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়েছিল এ ঘরে, ও ঘরের দরজার দিকে মুখ, মুখে অপ্রতিভ হাসি। হাসি বেরিয়ে এসেছিল ঠিকই, কিন্তু একটুও অবাক হয়নি। ঘড়ি দেখে কেবল বলেছিল–বড়ো দেরি হয়ে গেল, বর এসে গেছে বোধহয়–তোমার হল? একসঙ্গে তারা বেরোলো, ট্যাক্সিতে উঠল, গেল বিয়ে-বাড়ি। সেখানে অমিয়কে পরিবেশন করতে হয়েছিল, বরযাত্রীদের তদারকও। দৌড়-ঝাঁপে পাঞ্জাবির ভাঁজ গেল নষ্ট হয়ে, ধুতি গেল দুমড়ে-মুচড়ে, ঝোল-তেলের দাগ ধরল তাতে। ফেরার সময়ে আবার ট্যাক্সিতে পাশাপাশি বসে আসছিল তারা। অমিয়র মুখে বিকেলের প্রথম ধুতি-পাঞ্জাবি পরে হাসির সামনে দাঁড়ানোর সেই অপ্রতিভ হাসিটি কখন বিষণ্ণ ক্লান্তিতে ডুবে গেছে। শরীরের ঘামে, ঝোলে, তেলে ন্যাকড়া হয়ে গেছে তার পোশাক। হাসি তবু লক্ষ করেনি। ট্যাক্সিতে হাসির খোঁপা থেকে বেলফুলের মালার গন্ধ আসছিল, আর প্রসাধনের সুবাস, গয়নার টুং-টাং শব্দ। অভিজাত মহিলাকে ভিখিরি যেমন দেখে, তেমনই হাসির দিকে ভয়ে ভয়ে একবার চেয়েছিল অমিয়। বলেছিল–হাসি, আমি আজ অন্য পোশাক পরেছিলাম। তুমি দেখনি।

হাসি চমকে বলল–কই?

অমিয় হাসল– দেখছ না?

হাসি ভ্রূ কুঁচকে বলল–নতুন পোশাক কোথায়, এ তো ধুতি আর পাঞ্জাবি, তুমি তো প্রায়ই পর।

-পরি! কবে পরেছি?

পরনি? হাসি একটু ভেবে-টেবে বলে–গতবার মিঠুর কাকার শ্রাদ্ধের সময়ে পরেছিলে?

-না। অফিস থেকে এসেই তো তোমাকে নিয়ে বেরোলাম, পোশাক পালটানোর সময় ছিল না।

–তাহলে বোধহয় জামাইবাবুদের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিতে।

–না।

–তবে নিশ্চয়ই দীপালি-র বিয়ের সময়ে

–তাও নয় হাসি।

–কী জানি! আমার তো মনে হচ্ছে তুমি পরেছ, আমি দেখেছি।

–না হাসি, তুমি দেখনি।

হাসি একটু হাসল, তারপর বলল–দেখি, কেমন দেখাচ্ছে। বা: বেশ তো, একদম নতুন মানুষ! তোমাকে চেনাই যাচ্ছে না!

শুনে কেমন একটু ভয় এসে ধরেছিল অমিয়কে।

 এই সব তুচ্ছ ঘটনা থেকেই কি মানুষের ভয় জন্ম নেয়! মূল্যহীন হয়ে যাওয়ার ভয়! গুরুত্ব না পাওয়ার ভয়!

গির অরণ্যে একবার সিংহ দেখতে গিয়েছিল অমিয়। বহুকাল আগে। দেখেছিল পিঙ্গল জটার মাঝখানে রাজকীয় গম্ভীর মুখ সিংহ বসে আছে, তার চারদিকে কয়েকটা সিংহী ঘুর ঘুর করে কাছে আসছে, গা শুঁকছে, গড়গড় শব্দ করে জানাচ্ছে তাদের প্রেম। পিঙ্গল জটার সিংহ গ্রাহ্যই করছে না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে সেই অপরূপ, উদাসী, নির্মম সিংহকে দেখেছিল অমিয়, দেখেছিল তার ভয়ঙ্কর পিঙ্গল কেশর, পঞ্জরসার দেহটিতে স্তম্ভিত বিদ্যুৎ, নিষ্ঠুরতা। বারে বারে তার পায়ের কাছে মাথা নত করে দিচ্ছে প্রেমিকারা, সে ফিরেও দেখছে না।

সেই সিংহটির কথা ভাবলে নিজের তুচ্ছতাকে বুঝতে পারে অমিয়, আজ। সে স্কুটারের পিছনে হাসিকে বসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ক্যাথিড্রাল রোডে, উপযুক্ত পরিবেশ খুঁজে বের করেছিল, মিষ্টি মোলায়েম কয়েকটা কথা মনে মনে তৈরি করেছিল আগে থেকে। বিয়ের পর সে কত খুশি করতে চেয়েছে হাসিকে, নিজেকে বার বার নানা পোশাকে সাজিয়ে ডামির মতো দাঁড়িয়েছে হাসির সামনে। হাসি তাকে ভালোবাসেনি।

গির-এর প্রায়ান্ধকার অরণ্যে একটা সিংহকে প্রায়ই ভাবে অমিয়। সেই সিংহকে কেউ নারীপ্রেম শেখায়নি। প্রকৃতিদত্ত পুরুষকার বলে সে উদাসী, নির্মম! মানুষেরাও কি নয় সেই সিংহের মতো! পঞ্জরসার দেহে স্তম্ভিত বিদ্যুৎ, পিঙ্গল কেশর ঘেরা মুখে বৈরাগ্য, চোখে দূরের প্রসার–পুরুষ এরকমই ছিল বহুকাল থেকে। কে তাকে শেখাল নারীপ্রেম, হাঁটু গেড়ে প্রেমভিক্ষা, মোলায়েম ভালোবাসার কথা!

বলতে গেলে তখন থেকেই অমিয়র পতনের শুরু, যখন সে হাসির কাছে ক্যাথিড্রাল রোডে, ময়দানের সুন্দর বাতাসে স্কুটারে ভেসে যেতে যেতে ভিক্ষা চেয়েছিল হাসিকে। তখনই তার পতনের, ক্ষয়ের প্রথম অশ্বত্থাচারাটি উঁকি দিয়েছিল অলক্ষে।

সেই পতনের প্রথম চিহ্ন ছিল এই, সে সারাদিন হাসির কথা ভাবত। নির্বিকার হাসির কথা, তার নিষ্ঠুরতা, উপেক্ষা–ভাবতে ভাবতে তার ঘুম হত না। ডিগবয়ের তেল কোম্পানির বিলেতফেরত ইঞ্জিনিয়ারটির কথা বলত হাসি, বলত তার শিলচরের প্রেমিকদের কথা, তার মণিপুরি নাচের কথা। শুনতে শুনতে ভেতরে ভেতরে উন্মাদ হয়ে যেত অমিয়। কিনে আনত পোশাক, প্রসাধন-হাসি মনের মতো সাজত, হাসিকে খুশি করার জন্য সুন্দর কথা ভেবে রাখত সারাদিন, অন্যমনস্ক হাসির কাছে অনর্গল বলত–সে একদিন বড়ো হবে, খুব বড়ো ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, বিজনেস ম্যাগনেট। সে হাসির জন্য শাড়ি কিনেছিল, গয়না, চমৎকার সব আসবাব, একটা ফ্রিজও। হাসি কিছুই তেমন আদর করে নেয়নি। অমিয়কেও না। রাতে শরীরে শরীর মিশিয়ে দিত অমিয়, মিশিয়ে ভাবত–পেয়েছি, পেয়েছি তোমাকে! তারপর মুখের স্বেদবিন্দু মুছে তৃপ্ত হাসি যখন পাশ ফিরে ঘুমোত, তখন উত্তপ্ত মাথায় সারা রাত ছিল অমিয়র জেগে থাকা। নিজের সেই পতন তখনও টের পায়নি অমিয়, তখনো গির অরণ্যে দেখা পঞ্জরসার দেহে স্তম্ভিত-বিদ্যুৎ সেই সিংহের ছায়া তার চোখে পড়ত না। সে আধঘুম থেকে চমকে জেগে উঠে দীর্ঘশ্বাস ফেলত তখন, খুব জোরে স্কুটার চালাতে ভয় পেত, তখন থেকেই তার নিজের ভবিষ্যৎ এবং কর্মক্ষমতার ওপর সন্দেহ জন্মাতে থাকে। আর জন্ম নেয় ভয়।

ব্যবসা হচ্ছে তারের ওপর হাঁটা। সবাই লক্ষ রাখে, মানুষ কখন টলছে, পড়ো-পড়ো হচ্ছে, কখন পা ফেলছে না ঠিক জায়গায়। লক্ষ রেখেছিল তার সাপ্লায়াররা, পারচেজাররা, প্রতিদ্বন্দ্বীরা আর সেনগুপ্ত। সি.এম.ডি.এ-র একটা বিল পেমেন্ট গোপনে আদায় করেছিল সেনগুপ্ত, চেক ক্যাশ করেছিল। অমিয় টের পেয়েছিল দেরিতে। দুর্দান্ত সেনগুপ্তর সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেল খুব। সেনগুপ্ত তার ক্যাপিট্যাল তুলে নিয়ে গেল। আর অন্যমনস্ক, দুঃখিত অমিয়র চোখের আড়ালে আদায় করে নিয়ে গেল আরও তিনটে বিল-পেমেন্ট। সেগুলো টের পেতে আরও অনেক দেরি হয়েছিল তার। কলকাতার রাস্তার ভীড়ে আজও সেনগুপ্তকে খুঁজে বেড়ায় অমিয়। কিন্তু দেখা হলে কী করবে তা বুঝতে পারে না। চোখ বুজলেই সে দেখতে পায়, কালো শর্ট, লাল টুকটুকে গেঞ্জি, দস্তানা পরা দু-টি উদ্যত হাত, টুপির ছায়ায় আলপিনের মতো দু-টি হিংস্র চোখ–সেনগুপ্ত ফনা তুলে দুলছে। পোস্টে পোস্টে উড়ে যাচ্ছে সেনগুপ্ত, পেনালটি আটকাচ্ছে বেতের মতো শরীর বেঁকিয়ে। আশ্চর্য! সেনগুপ্তর খেলা কোনোদিনই দেখেনি অমিয়, তবু চোখ বুজলেই ওই কাল্পনিক ভয়ঙ্কর দৃশ্যটিই সে দেখতে পায়।

বাইরের লড়াইয়ে সে হারতে থাকে, সে তত ভেতরে ঢুকে কল্পনার দৃশ্য দেখে। কল্পনায় প্রতিশোধ নেয়; কল্পনায় ভয় পায়। হাসির জন্যই কি? কে জানে!

অমিয় আলো জ্বালল না। অন্ধকারেই উঠল। দু-একটা কাগজ গুছিয়ে রাখল, বন্ধ করল ডেস্ক, চাবি কুড়িয়ে নিল। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ওপর থেকেই বৃষ্টির গন্ধ পায় অমিয়। ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে এসে লাগে।

গাড়ি-বারান্দার তলায়, এক ভীড় লোক বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতে দাঁড়িয়ে আছে। স্কুটারটা ফুটপাথে তুলে রেখেছে আহমদ। স্কুটারটা ছুঁয়ে বাইরের ঝিরঝিরে বৃষ্টি একটুক্ষণ দেখে অমিয়। তারপর স্কুটারটা টেনে বৃষ্টিতে রাস্তায় নেমে পড়ে। বৃষ্টির ঝরোখার ভেতর দিয়ে তার প্রিয় স্কুটার চলে লঞ্চের মতো জল ভেঙে। অমিয় ভিজতে থাকে। কপালের ঘামের নোনা স্বাদ জলে ভিজে গড়িয়ে এসে স্পর্শ করে তার জিভ। একটা সুন্দর কাচের বাসন ভেঙে ছড়িয়ে পড়লে যেমন দেখায়, বৃষ্টির ভেতর তেমনি শতধা বিদীর্ণ কলকাতার প্রতিবিম্ব দেখা যায়। চারদিকের কাচের টুকরোর মতো ধারালো, রঙিন, ভঙ্গুর কলকাতা ছড়িয়ে পড়ে আছে।

গড়িয়াহাটা পর্যন্ত একটানা চলে এল সে। তারপর খাড়াই ভেঙে স্কুটার উঠতে থাকে। গড়িয়াহাটা ব্রিজের ওপর, ধনুকের পিঠের মতো সম্মুখ আড়াল করে উঠে গেছে রাস্তা। স্কুটারের মেশিন গোঙাতে থাকে ভয়ঙ্কর। বরাবর এইটুকু উঠতে ভালো লাগে তার। ঝড় তুলে স্কুটার উঠতে থাকে। ব্রিজের সবচেয়ে উঁচু বিন্দুতে উঠে এলে হঠাৎ দিগদিগন্তের বাতাস ঝাপটা মারে এসে, চারিদিকে বহু দূরের বিস্তার ডানা মেলে দেয়। সামনে স্বচ্ছন্দ উৎরাইরের শেষে তার বাসা। বাসায় হাসি।

প্রবল বৃষ্টির ফোঁটা বর্শাফলকের মতো ঝকঝকে হয়ে ছুটে আসে। মুখের চামড়া ফেটে যায়। ব্রিজের সবচেয়ে উঁচু বিন্দুটিতে বাতাস লাগল। বৃষ্টির ফোঁটা খরশান। স্কুটার টাল খায়। এখানে ডানদিকে একটা অন্ধকার মাঠে বিস্ফোরকের মতো বিদ্যুৎ ফেটে পড়ে। এমন বাদলার দিন–এই দিনে হাসির কাছে ফিরে গিয়ে কী হবে অমিয়র?

অমিয় উৎরাই ভেঙে নেমে আসে। বড়ো রাস্তার ওপর ওই দেখা যায় অমিয়র বাসা। দোতলায় আলো জ্বলছে, উড়ছে সবুজ পর্দা। বাইরের দিকে একটা ঝুলবারান্দা। অমিয় একপলক তাকায়। তারপর অচেনা বাড়ির দিকে চেয়ে যেমন চলে যায় রাস্তার লোক, তেমনিই না থেমে চলতে থাকে অমিয়। স্কুটার ভেসে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *