১১.
খাওয়ার পর সুনেত্রা দেবী নিয়ে এলেন সোনালীকে শোবার ঘরে।
দালানের সংলগ্ন ছোট্ট একটি ঘর, দালানের যেদিকে সুনেত্রার নিজের চৌকী পাতা সেদিকে। হাত বাড়ালে দরজায় হাত ঠেকে।
বলতে গেলে একই ঘর, বললেন সুনেত্রা, নির্ভয়ে শোও তুমি, এই পর্দাটা টানা রইল, ইচ্ছে করলে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিতে পারো। ওদিকে আর একটা দরজা আছে, সেদিকটা ভাঙা–সে দরজা খোলা যায় না। এই পাখা রইল, এই খাবার জল, শুয়ে পড়ো।
.
সুনেত্রা চলে আসতেই দরজাটা সোনালী বন্ধ করেই দিল। নিভিয়ে দিল টেবিলে বসানো বাতিদানের জ্বলন্ত বাতিটা। খুলে দিল সমস্ত জানলা।
ছোট্ট ঘর হলে হবে কিসব দেওয়ালে দেওয়ালজোড়া জানলা, সবগুলো খুলে দিতেই জ্যোৎস্নায় ভরে গেল ঘরখানা।
এখানেও একহারা একখানা চৌকীতে পরিপাটি একটি বিছানা। মাথার কাছে টেবিল। টেবিলে বাতিদান, ফুলদানী।
পোড়ামাটির গায়েয় ছাঁচের কাজ করা সুন্দর ফুলদানী। তাতে কয়েকটি চাঁপা ফুল।
রুচি আছে এদের। মনে মনে বলল সোনালী।
বলল কেমন যেন আবিষ্টের মত ভোলা জানলার দিকে তাকিয়ে বসে।
আজ সন্ধ্যা থেকে যা কিছু ঘটছে তা পর্যালোচনা করতে পারলে হয় তো সোনালী মনস্তত্ত্বের নতুন কোন তত্ত্ব আবিষ্কার করতে পারত।
সব কেমন ঝাপসা লাগছে।
এ সব কি সত্য? এই ঘর, এই বিছানা, ওই জানলা আর জানলার বাইরের ঝিঁঝি ডাকা অন্ধকার, এ সব কি বাস্তব, না স্বপ্ন?
আর সোনালী নিজে?
সব কেমন ঝাপসা লাগছে।
এমন অদ্ভুত পরিস্থিতি কবে কজনের ভাগ্যে ঘটে?
এই একটু আগে সেই ফুলের গন্ধে উতলা বাতাসে ভোলা বোয়াকে পিঁড়ি পেতে বসে খেয়ে এল যে মানুষটা, সে কে?
যখন খেয়েছিল তখন কি প্রকৃতিস্থ ছিল? ছিল আত্মস্থ?
তবে কেন কিছুই মনে পড়ছে না। মনে পড়ছে না কি খেয়েছিল, কি বা কথা বলেছিল।
অথচ এটা মনে পড়ছে বলেছিল কথা, হয়তো খেয়েও ছিল সবই, যা কিছু পরিবেশন করেছিলেন সুনেত্রা।
নেশাচ্ছন্নের মত সমস্ত চৈতন্য যেন কুয়াসাটাকা। অথচ ঘুমও আসছে না। পরের বাড়িতে অচেনা বিছানায় ঘুম কি আসে?
এ ঘরটা কার শোবার ঘর?
চারিদিক তাকিয়ে দেখল সোনালী মোমবাতির মৃদু আলোয়। বিছানা আর টেবিল বাদে আর বিশেষ কিছুই নেই। কেমন যেন রিক্ত রিক্ত চেহারা। কোনো মানুষের স্থায়ী উপস্থিতির চিহ্ন বহন করছে না।
বোধকরি এ ঘর কারুরই শোবার ঘর নয়। অতিথির জন্যে প্রস্তুত থাকে। থাকে সরু খাটে বিছানা পাতা।
.
কৃষ্ণপক্ষের রাত।
যত রাত গম্ভীর হচ্ছে চাঁদ ততই উজ্জ্বল হচ্ছে। জানলার বাইরের ঝোঁপজঙ্গলগুলো এখন আর জমাট অন্ধকারের চাপ বলে মনে হচ্ছে না। ছাড়া ছাড়া ভাবে দেখা যাচ্ছে।
জানলার ধারে এসে দাঁড়াল সোনালী।
ঠাণ্ডা একটা বাতাসের শিহরণ।
কিন্তু ও কি?
ঠাণ্ডা বাতাসের শিহরণের চাইতে অনেক তীব্র বিদ্যুতের মত একটা শিহরণ খেলে গেল সর্বাঙ্গে।
ওখানে, ওই মাঠের মাঝখানে এত রাত্রে ঘুরে বেড়াচ্ছে কে?
কী দরকার ওর এমন করে ঘুরে বেড়াবার খালিগায়ে জ্যোৎস্নার প্রলেপ মেখে!
বিশ্বাস করুন, ছদ্মবেশ নয়, ওটাই আমার স্বাভাবিক বেশ, সচরাচরের বেশ।
হ্যাঁ, বিশ্বাস করেছে সোনালী।
বিশ্বাস করে মুগ্ধ হয়ে বলেছে, এমন বলিষ্ঠ পুরুষদেহের এই বেশই স্বাভাবিক হওয়া উচিত।
কিন্তু ও জেগে কেন?
ও ঘর ছেড়ে বাইরে কেন?
.
আস্তে আস্তে তখনকার কিছু কিছু কথা মনে পড়ছে।
সুনেত্রা তার ছেলের গুণের কথা গল্প করছিলেন তখন।
একরাশ পাশ করে, দেশ-বিদেশ থেকে বিদ্যে আহরণ করে ছেলে ওঁর এখন গ্রাম সেবা নিয়ে মেতে আছে, এই কথাটাই বোঝাচ্ছিলেন তিনি।
বলেছিলেন, তাই কি গভর্নমেন্টের সাহায্য নেবে?
নেবে না।
নিজের চেষ্টায় আর গ্রামের লোকের সহযোগিতায় যা পারবে করবে।
বাপ-ঠাকুরদার ভিটেটা ছিল তাই চলছে অনেক কিছু। স্কুল, তাঁতশালা, পোলট্রি।
গোড়ায় কি কম বেগ পেতে হয়েছিল? গ্রামের লোক বিশ্বাসই করতে চায় না। তাছাড়া শ্রমদানের মূল্য তো দূরের কথা, মানেই বোঝে না কেউ।
ছাড়া ছাড়া ছিটে ছিটে ভাবে মনে পড়ছে কথাগুলো।
.
খাওয়ার পর আবার সেই দালানে এসে বসেছিল খানিকক্ষণ। দেখছিল সুনেত্রার টেবিলের বই দুখানা উল্টে। না, গীতা নয়, ভাগবত নয়, যোগবাশিষ্ট রামায়ণও নয়, আধুনিক দুজন লেখকের দুখানা অতি আধুনিক উপন্যাস।
.
দেখে একটা সুস্থ হাওয়ায় হাঁপ ফেলে বেঁচেছিল সোনালী।
মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ানো লোকটার কি প্রাণে সাপের ভয়ও নেই?
ওই বিশ্রী জায়গায় সাপ বেরোতে পারে না রাত্রে?
এত বেপরোয়া কেন!
আশ্চর্য, কেউ তো ওকে বারণও করছে না।
কিন্তু কে করবে?
মা? মা কি সারাদিনের কর্মক্লান্ত শরীর নিয়ে জেগে থাকতে পারেন?
আচ্ছা, সোনালী তো দেখছে। সোনালীর কি উচিত নয় ওকে সাবধান করে দেওয়া?
অনেকক্ষণ ধরে উচিত অনুচিতের দ্বন্দ্ব চলল, তারপর তাকিয়ে দেখল দরজার দিকে। ও দরজাটায় নিষেধ, এ দরজাটা সুনেত্রার মাথার কাছে।
কোনটাই সহজ নয়।
কিন্তু সহজ হলেই কি সহজ হত?
অতএব এই জানলাই রইল শেষকথা। জানলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল সোনালী।
কোনো এক সময় যেন নিশাচর মানুষটা কাঁটাবন ডিঙিয়ে জানলার কাছবরাবর এল, দাঁড়াল, চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ, আবার চলে গেল।
জানলার নীচে দিয়ে চলে গেল। কথা বললে বলা অসম্ভব ছিল না, কিন্তু সাপের ভয়ের জন্যে সাবধান করা হল না।
অথচ যেত। একটু চেঁচিয়ে বললে অনায়াসেই শুনতে পেত লোকটা।
আরও কতক্ষণ চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকল সোনালী।
তারপর কখন ঘুমে শরীর ভেঙে এল। কখন যেন শুয়ে পড়ল।
পরের বাড়িতে অচেনা জায়গায় ঘুম?
তা আসে বইকি। শ্বাসপ্রশ্বাসের গভীর শব্দ জানিয়ে দিচ্ছে সোনালী ঘুমিয়ে পড়েছে।
.
১২.
ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়।
সুনেত্রার ডাকে। চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে মৃদু ডাক দিচ্ছেন তিনি।
কী আশ্চর্য, আপনি! না না, ছি ছি, আমায় একটু আগে ডেকে দিলেন না কেন? আমি তৈরি করতাম চা।
সুনেত্রা হেসে উঠলেন, আমাদের চা-টা কোরো তৈরি, এখন খেয়ে নাও। তোমরা বাছা শহরের মানুষ, নিশ্চয় বেড-টি খাওয়া অভ্যেস।
না না, ওসব কিছু না। লজ্জিতভাবে বলে সোনালী।
তা আজ একদিনই নয় খাও। সুনেত্রা সামনে একটা টুলে বসে বলেন, এ শহুরে অভ্যেসটুকু আমারও আগে ছিল, কিন্তু গ্রামে বাস করতে করতে কখন যে সে অভ্যেস ঝরে পড়ল টেরও পেলাম না। কত অভ্যেসই এমন ঝরলো।
আগে বুঝি কলকাতায় থাকতেন? সোৎসুকে প্রশ্ন করে সোনালী।
না কলকাতায় নয়, ওদিকে। সুনেত্রা বুঝি একটা নিঃশ্বাস চেপে নিয়ে বলেন, নিরুর বাবার কাজ ছিল দিল্লী সিমলে, মানমর্যাদা বজায় রাখবার জন্যে ক্লেশ কত! হাসলেন সুনেত্রা, নিজের হাতে নিজের সংসারের কাজকর্ম করব তার জো নেই। হামেহাল নাকের সামনে চাকর খাড়া। কি আর করবে তারা, বারকতক চা-ই খাওয়াতো সেধে সেধে ডেকে ডেকে।
স্তব্ধ হয়ে যায় সোনালী। এই সহজ কথাটুকুর মধ্যেকার প্রচ্ছন্ন ইতিহাসখানি অনুভব করে।
আর যখন চেতনা হয়, তখন সমস্ত অন্তরাত্মা আর একবার ছি-ছি করে ওঠে নিজের গত সন্ধ্যার আচরণ স্মরণ করে।
আপনাদের চা খাওয়া হয় নি?
বোধকরি নীরবতা ভঙ্গ করতেই এই বাহুল্য প্রশ্ন।
না, নিরু তো সেই কোন ভোরে বেরিয়ে গেছে। ফণীও গোয়ালের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, নিরু আসুক।
কোথায় গেছেন?
যেন কোনো ঔৎসুক্য নেই, নেই কোনো আগ্রহ, শুধু একটু সাধারণ কথা।
সুনেত্রা বলেন, ওই যে সেই মোটর মেকানিকের সন্ধানে। সাড়ে সাতটা থেকে যত সব বাস লরি ছাড়তে থাকবে, মিস্ত্রিগুলো তখন কাজে আটকা পড়ে যায়, তার আগেই যাতে–
আমার জন্যে আপনাদের কত বিব্রত হতে হল!
এর আবার বিব্রত কি মা? সুনেত্রা প্রসন্নমুখে বলেন, আমার ক্ষ্যাপা ছেলে এটুকুতে বিব্রত বোধ করে না। ওই করতেই তো আছে। কারুর একটু কাজে লাগতে পারলে–তা ছাড়া যদি বিব্রতই বলল, হাসেন সুনেত্রা, তার বদলে কতখানি লাভ হল আমাদের বলো তো?
লাভ!
লাভ বইকি! তোমার মত এমন একটি মেয়ে পাওয়া কি কম লাভ মা?
হয়তো জীবনে আর আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে না।
যেমন গভীর স্বরে জীবনে কোনো দিন বলে নি সোনালী, হয়তো যে গভীরতর স্তরের সন্ধানও জানত না কোনো দিন, সেই গভীর স্বরে কথা বলে সোনালী। সেই গভীরতর স্তর থেকে উঠে আসে একটি ভারী নিঃশ্বাস।
সুনেত্রা বৃথা হইহই করেন না, না না সে কি, আবার দেখা হবে বইকি, বলে স্তোক না দিয়ে শুধু তিনিও গভীর স্বরে বলেন, হয়তো হবে না। তবু এই পাওয়ার জমাটুকু তো রইল। আমার ঘরে এমন মেয়ে তো জীবনে কখনো আসবে না।
এই আক্ষেপটুকুর মধ্যে রইল অনেকটা কথা। অনুক্তর মধ্যে উক্ত হল বাংলা মাতৃমনের আশা আর হতাশা।
আদর্শবাদী সন্তানের মা হওয়া গৌরবের নিশ্চয়, কিন্তু গৌরবের মধ্যে তো লুকিয়ে থাকে দুঃখ।
সাধারণ হতে না পারার দুঃখ, সহজ হতে না পারার দুঃখ।
.
সকালের আলোয় সুনেত্রার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখল সোনালী-সুনেত্রার ক্ষেতখামার, ফুলবাগান, নিরঞ্জনের স্কুল, তাঁতশালা।
তারপর এল নিরঞ্জন।
ঠিক হয়ে গেছে আপনার গাড়ি।
ঠিক হয়ে গেছে! কথাটা হাতুড়ির ঘায়ের মত বুকের মধ্যে এমন করে বাজতে থাকে কেন?
সোনালী কি আশা করছিল ঠিক হবে না! এত সহজে ঠিক হবে না!
থেকে যেতে পারে সোনালী আরও কিছুক্ষণ। গ্রাম্য প্রকৃতি কি তার সরল সৌন্দর্যের ডালি হাতে নিয়ে দুর্নিবার আকর্ষণে টানছে সোনালীকে?
ঠিক হয়ে গেছে?
হ্যাঁ।
এত শীগগির?
বিশেষ কিছুই হয় নি। তবে তেলটা ফুরিয়েছিল।
আবার আশায় স্পন্দিত হয় বুক।
তবে? এখানে তেল জোগাড় করা তো খুব যেন চিন্তায় পড়েছে সোনালী।
না, ওটা একেবারে সংগ্রহ করেই আনলাম।
সংগ্রহ করেই আনলাম!
তার মানে যত শীগগির সম্ভব সোনালীকে বিতাড়ন করা!
হঠাৎ ভয়ানক একটা রাগ হয় সোনালীর। তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে, এ সবের জন্যে টাকা বলে একটা জিনিসের তো দরকার হয়, যাবার সময় বলে গেলে পারতেন!
সুনেত্রা একটু অবাক হয়ে তাকান। এতক্ষণের সেই উজ্জ্বল উচ্ছল প্রাণচঞ্চল মেয়ের সহসা এমন রুদ্ররূপ কেন? ওই মুখের দিকে একবার তাকান সুনেত্রা দেবী, একবার নিজের ছেলের মুখের দিকে।
একটু স্তব্ধ হয়ে যান, তারপর আস্তে আস্তে বেরিয়ে যান ঘর থেকে।
কিন্তু ওই নিঃশব্দ প্রস্থান বুঝি এদের নজরে পড়ে না। ওরা শুধু পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েকটি মুহূর্ত।
তারপর নিরঞ্জন বলে, টাকা নেব বৈকি, শুধু টাকা কেন, আনা পাই সবই নিখুঁত হিসেব করে নিয়ে নেব।
তা তো নেবেনই। পাছে আর একটা বেলা আপনাদের অতিথি হতে চাই, তাই তাড়াবার জন্যে ব্যস্ততার সীমা নেই। মানুষ তো অতিথিকে একবার অফারও করে,–এ বেলাটা থেকে যান, এক মুঠো ভাত খেয়ে যান।
হয়তো করে। যে অতিথি সহজপ্রাপ্য, তাকে হয়তো করে। দুর্লভ অতিথির জন্যে কি সাধারণ ব্যবস্থা চলে?
ছাই দুর্লভ। কাল থেকে খালি জ্বালাতন করলাম।
দোহাই আপনার, ওই সাধারণ কথাগুলো থাক।
তবে কি বলব বলুন? সোনালী যেন হতাশ সুরে বলে, অসাধারণ কথার স্টক কোথায়?
নাই বা কথা হল। কথা সকলের মুখে মানায় না। নীরবতা অনেক বেশি অর্থবহ। কি কাজ কতকগুলো অর্থহীন কথায়, কি বলেন?
হেসে ওঠে নিরঞ্জন, চলুন। উঠবেন চলুন আপনার রথে। তারপর এই হতচ্ছাড়া দেশের হতভাগাদের চোখে ধুলো উড়িয়ে এগিয়ে যান তাদের নাকের ওপর দিয়ে।
সোনালী অদ্ভুত এক রকম হেসে বলে, ধরুন যদি না যাই?
আহা। অপূর্ব!
ঠাট্টা করছেন? কিন্তু আপনাদের গ্রাম দেখে ইচ্ছে হচ্ছে থেকে যাই।
ওটা শহরবাসীদের প্রচলিত কথা। আবার স্বস্থানে ফিরে গেলেই মনে হবে, ই, অমন হতচ্ছাড়া দেশে মানুষ থাকে কি করে!
ওঃ, ওই কথাটা আর ভুলতে পারছেন না দেখছি।
নিরঞ্জনও বুঝি সোনালীর দেখাদেখি অদ্ভুত হাসি হাসতে শিখেছে। তাই সে হাসির সঙ্গে একটি বদ্ধ গভীর দৃষ্টি ফেলে বলে, সব কথা কি ভোলা যায়?
.
১৩.
না, সব কথা ভোলা যায় না।
সোনালী কি জীবনে কখনো ভুলতে পারবে এই জামতলা গ্রামকে?
শূন্য রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে উড়িয়ে ছুটে চলেছে সোনালী নতুন মেরামত করা নতুন তেল ভরা গাড়ি করে। গাড়িটার গতিতে উদ্দাম প্রাণের আবেগ।
যন্ত্র জিনিসটা সহসা বিকল হয়ে থেমে গেলেও ভয় নেই, আবার মেরামত করা যায়। আবার চালানো যায় তাকে সহজ পথে, নির্ভুল পথে।
সেই নির্ভুল পথ ধরে চলেছে সোনালী। যে পথে কাল সন্ধ্যায় যাবার কথা ছিল।
শুধু যে জিনিসটাকে সহজ পথে নির্ভুল পথে চালান নিজের হাতের বাইরে, সে চলেছে আপন খেয়ালে।
তাই বান্ধবী নীপার বাড়ি যাবার পথে সোনালীর আর মনে হচ্ছে না উপহারের জিনিস নেই তার হাতে।
একশো টাকার সেই নোটখানা ভাঙিয়ে গাড়ির তেলের দাম দিয়েছে সোনালী, দিয়েছে। মোটর মেকানিকের মজুরি, বাকী ফেরতটা নিয়েছে হাত পেতে নির্ভুল হিসেবে, তবু বারে বারে হিসেবের গরমিল হয়ে যাচ্ছে যেন।
আচ্ছা, আসার সময় সুনেত্রার কাছে কি তেমন করে বিদায় নেওয়া হয়েছিল? নাকি ত্রুটি থেকে গেল?
একটুখানি ব্যঙ্গহাসি ফুটে উঠবে না তো তার মুখে মেয়েটা কি অকৃতজ্ঞ ভেবে?
আর নিরঞ্জন? সুনেত্রার নেত্রের নিধি?
সে কী ভাবল সোনালীকে? বাঁচাল? বেহায়া? বেশি গায়ে-পড়া?
সোনালী বলেছিল, চলুন না আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবেন। কত ট্রেন আছে ফেরবার।
কই আর কথা রাখল সে!
মৃদু হেসে বলল, কেন, এই তো বেশ দৃষ্টিপথ আচ্ছন্ন করে ধুলো উড়িয়ে চলে যাওয়া।
.
না, কেউ বলে নি আবার আসবেন। বলে নি যাবেন ওখানে।
নীপা মিনিটখানেক স্তব্ধ থেকে ওর আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে গম্ভীরভাবে বলে, তুমি না তোমার প্রেতাত্মা?
যা বলিস।
চেহারাটি তো দেখছি একেবারে তাজা ঝকঝকে। চুলে একটু বিশৃঙ্খলা নেই, শাড়িতে নেই একবিন্দু ধুলো, মনে হচ্ছে সকালবেলা সাবান ঘষে মানও করে এসেছিস।
ধারণা ভুল নয়।
ভুল নয়?
না।
গিয়েছিলি কোথায়?
কোথাও না।
ন্যাকামি রাখ! অ্যাকসিডেন্ট যে ঘটে নি তা তো দেখা যাচ্ছে, গাড়ি আস্ত, তুই আস্ত, ব্যাপারটা কি?
ব্যাপার কিছুই না। কাল তোর নেমন্তন্নে এসে উঠতে পারি নি, আজ বাসি খেতে এলাম।
কোথায় গিয়েছিলি বলবি না?
কোথাও তো যাই নি, তা বলব কি?
আমার সঙ্গেও এ রকম চালাকি খেলবি? বেশ। কিন্তু গৃহকলহ যদি হয়েই থাকে, আমার সঙ্গে কি? আমার কাছে এলি না কেন?
গৃহকলহ? এ কথা কে বলল?
ভয় নেই, গৃহস্বামী নয়। আহা, বেচারার কি অবস্থা কাল থেকে! বোস, সব কথা শুনব পরে, আগে ওনাকে একটা খবর দিয়ে দিই। স্বর্গ মর্ত্য পাতাল এক করে বেড়াচ্ছেন ভদ্রলোক।
বড্ড বেশি অত্যুক্তি হয়ে যাচ্ছে না নীপা?
অত্যুক্তি?
তা ছাড়া আর কি? যার যা অসাধ্য, সে তা—
অসাধ্যসাধন করিয়ে ছেড়েছ তুমি বলে টেলিফোন তুলে নেয় নীপা।
কে? ও তুমি। বাবু বাড়ি নেই?…কতক্ষণ বেরিয়েছেন?…ভোরবেলা? আচ্ছা, এলেই বলে দিও মা এসেছেন…হা হা, এখানেই আছেন।…হা ভালো আছেন।..ও সে কথা পরে শুনো। বাবুকে বলবে বাড়ি ফিরেই যেন সোজা এখানে চলে আসেন। হা হা, আমার এখানে। বুঝতে পেরেছ তো আমি কে? পেরেছ? ঠিক আছে। তোমাদের বাবু আজ এখানেই খাবেন বলে দিও সে কথা। এসেই চলে আসেন যেন।
সরে এসে বলে নীপা, এত করে অনুরোধ করবার কথা নয়, হারানিধি পাওয়া গিয়েছে শুনে উন্মত্ত হয়ে ছুটে আসবার কথা, কিন্তু যা উদোমাদা মানুষ হয়তো ভাববেন, যাক, এসেছে, ভালো আছে, আর চিন্তার কি!
তা সত্যিই তো–আর চিন্তার কি?
বটে! প্রাণ থেকে বলছিস?
প্রাণ মন আত্মা সব থেকে বলছি।
তবে বৃথাই লোকটা কাল থেকে অস্থির হয়ে বেড়াল?
একেবারে বৃথা।
দেখ সোনালী, তোর রকম-সকম রীতিমত সন্দেহজনক, বল পোড়ারমুখি কোথায় গিয়েছিলি?
এ জোর নীপা করতে পারে বটে। নীপা সোনালীর আবাল্যের সখী। নীপার কাছে কোনও দিন কোনও কথা গোপন করে নি সোনালী। এমন কি শশাঙ্কর ঔদাসীন্য অবহেলার কথাও।
নীপা অবশ্য বলে, অবহেলা নয়, ওকে বলে অন্যমনস্কতা, কিন্তু সোনালী তা বলে না।
কই, বললি না?
সোনালী ওর উগ্র কৌতূহলেভরা উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে হেসে বলে, পৃথিবীর বাইরে।
ভুরু কুঁচকে ওঠে নীপার।
তুই ভেবেছিস কি? কাল থেকে কি ঘোড়দৌড়টা করিয়েছিস আমাদের, তার ধারণা আছে? নিশ্চিন্ত ভেবে বসে আছি কোন চুলোয় কোন খানাখন্দরের ধারে হাত পা ভেঙে পড়ে আছিস, চোরে গায়ের গহনাগুলো খুলে নিয়ে গেছে
আহাহা, বলে যা বলে যা। শেয়ালে কুকুরে চোখনাকগুলো খুবলে খাচ্ছে! সত্যি, এত ভালবাসিস আমাকে যে কিছুতেই ভাবতে ইচ্ছে হল না, আমি বেশ আছি, খাসা আছি, নরম বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছি, কেমন? ভালবাসার দাপটে আমার হাতভাঙা রক্তাক্ত কলেবর ছাড়া আর কিছুই তোর চোখে ভাসল না!
কথা দিয়ে কথা ঢাকিসনে সোনালী, এবার সত্যিই ভাবনা হচ্ছে আমার, কোথায় কী একটা করে এসেছিস তুই!
আমার ওপর তো তোর অগাধ আস্থা দেখছি।
আস্থা ছিল, সত্যিই ছিল। কিন্তু আর থাকছে না। মনে হচ্ছে পোড়ারমুখী তুই নিশ্চয় শশাঙ্কবাবুকে বোকা বুঝিয়ে নেমন্তন্নে যাচ্ছি বলে বেড়িয়ে অভিসারে গিয়েছিলি।
যাক এতক্ষণে রহস্য উদঘাটন করলি তাহলে?
আচ্ছা, এ রকম করছিস কেন বল তো? নীপা করুণ সুরে বলে, আমাকে না বলে পারবি তুই?
দেখি না চেষ্টা করে পারি কিনা।
কিন্তু তাতে তোর লাভ? বলতে বাধা কি? চেহারাখানি দেখে তো মনে হচ্ছে না বাপু অসহায়া রমণী কোনো দুৰ্বত্তের কবলে পড়েছিল, অথবা ডাকাতের কবলে। সাপ বাঘ নেকড়ে শেয়াল ধারে কাছেও আসে নি, অ্যাকসিডেন্ট তো নয়ই, তবে এই আঙুল গুনে সময় হিসেব করে বলে নীপা, আঠারোটি ঘণ্টা ছিলে কোথায়, করলে কি, তার হিসেব দিতে হবে না?
দিতেই হবে? সোনালী একটি দুর্ভেদ্য হাসি হেসে বলে, এত বড় এই জীবনটা থেকে মাত্র আঠারো ঘণ্টা সময় চুরি করে সরিয়ে রাখা যায় না?
নীপা এবার গম্ভীর হয়ে যায়, সোনালীর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলে, নাঃ এতক্ষণে বুঝতে পারছি কেস সিরিয়াস! অভিসারটা আর ঠাট্টার কথায় থাকছে না। কিন্তু আমার অগোচরে তলে তলে কবে কি করলি?
ভাবো বসে বসে। নিষ্কর্মা মাথা তবু খানিক কাজ পাবে।
উচ্ছন্নে যাও তুমি, গোল্লায় যাও। বলে রাগ করে উঠে যায় নীপা। যায় রান্নার তদারকে।
শুধু সোনালী নয়, আপ্যায়িত করতে হবে শশাঙ্ককেও। সহজে যাকে ধরে এনে খাওয়ানো দাওয়ানো যায় না। আজ বড় প্যাঁচে পড়েছেন বাছাধন, নীপা ভাবে, গিন্নিটিকে আটকেছি, ছুটে আসতেই হবে।
.
১৪.
কিন্তু আশ্চর্য, কিছুতেই কেন কোনো কথা বলছে না সোনালী! রহস্যকে জইয়ে রাখবারও তো একটা সীমা আছে। তবে কি শশাঙ্ককেই প্রথম বলতে চায়? নিশ্চয় এই নেমন্তন্নে আসা নিয়ে শশাঙ্কর সঙ্গে কিছু একটা ঘটেছিল, তাই রাগ করে কোথাও গিয়ে বসেছিল।
কিন্তু কোথায়?
সম্ভব অসম্ভব কোনো আত্মীয়-বন্ধুর বাড়িই তো কাল থেকে খবর নেওয়া বাকী থাকে নি। আর নীপা বা শশাঙ্কর অজ্ঞাত কোথায় এমন আত্মীয় বন্ধু
.
চিন্তায় ছেদ পড়ল নীপার।
ফোন এসেছে।
করছে শশাঙ্ক। সবিনয়ে জানাচ্ছে মধ্যাহ্নভোেজনের নেমন্তন্ন নেবার সময় নেই তার। কিছু যেন মনে করে না সে আর সোনালী। ওই নেমন্তন্ন জিনিসটা ধাতে সয়ও না তার। সোনালী এসেছে, ভালো আছে, কোনো রকম বিপদ আপদ হয় নি, এটা যখন জেনেই যাওয়া গেল তখন আর শশাঙ্কর ব্যস্ততা কি? দুই সখী সারাদিন প্রেমালাপ চলুক। সন্ধ্যায় তো আসছে সোনালী নিজের বাড়ি।
নীপা বসে পড়ে। রেগে বলে, এই লোককে খোঁড়াই কেয়ার করে অভিসারেই যাওয়া উচিত তোর! ছি ছি, একটু ইয়ে নেই? কাল তো একেবারে মুখ-চোখ বসে শুকনো আমসি হয়ে উঠেছিল। আর যেই শুনলেন নিরাপদে ফিরেছে, হয়ে গেল সব উদ্বেগ ঠাণ্ডা? এই মুহূর্তে ছুটে আসতে ইচ্ছে হল না দেখবার জন্যে?
সোনালী শান্ত হাসি হেসে বলে, অবাক হবার কি আছে? ও তো ওই রকমই।
জানি না বাবা, রাগে ঝলসে ওঠে নীপা, এত সব রাঁধতে দিলাম ঘটা করে—
ভালোই তো। আমরা বেশি করে খাব।
হেসে ওঠে সোনালী।
রাগ হচ্ছে না তোর?
সোনালী তেমনি শান্ত হাসি হেসে বলে, কই, টের পাচ্ছি না তো?
.
না, সত্যিই টের পাচ্ছে না সোনালী।
অনুভব করতে পারছে না কোথাও কোনোখানে কোনো ক্ষোভ আছে কিনা তার। বুঝতে পারছে না কোথায় হারিয়ে গেল তার সেই সদাবিক্ষুব্ধ হৃদয়ের উত্তাল অভিযোগ, যে উত্তাল অভিযোগের উত্তাপ গতকালও তাকে রাগে অন্ধ করে তুলেছে, ছুটিয়ে নিয়ে গেছে দিশাহীন বেপরোয়া পথে।
কোন মন্ত্রে সহসা বদলে গেল মনের সেই অন্ধকার রং? সহসা সমগ্র পৃথিবীটা সোনালীর করায়ত্ত হয়ে গেল কি করে?
তাই সোনালীর আর অভাব নেই অভিযোগ নেই ক্ষোভ নেই। তাই কিছুই এসে যাবে না তার আগ্রহে কি ওদাসীন্যে।
যে জিনিসটা প্রতিমুহূর্তে যন্ত্রণা দিয়েছে সোনালীকে, করে তুলেছে উগ্ৰ অসহিষ্ণু হিংস্র, সে জিনিসটা সহসা এত তুচ্ছ এত মূল্যহীন হয়ে গেল কি করে ভেবে পায় না সোনালী।
অথচ ভাবেও না! শুধু অপূর্ব এক পূর্ণতার প্রশান্তিতে ভরে থাকে মন, যেন বাকী সমস্তটা জীবনে রয়ে যাবে এই পূর্ণতার স্পর্শ। অবোধ শশাঙ্কর কোনও ত্রুটিই সেখানে বিদারণরেখা আঁকতে পারবে না।