০৬.
কিন্তু শশাঙ্কর অবস্থা আর এমন কি? কতটুকুই বা জব্দ হল সে?
ঝিঁঝি পোকা আর শেয়ালডাকা গ্রামের ধারে অন্ধকার আকাশের নীচে অচল গাড়ির মধ্যে বিমূঢ় সোনালী এই কথাই ভাবল, ওর আর কতটুকু কি হল? কি আর এমন জব্দ হল ও? সোনালী নিজেই যে–
আচ্ছা, এইভাবে সারাটা রাত কাটিয়ে দেওয়া কি খুব শক্ত? কি আর হবে চারিদিকে কাঁচ তুলে নিঃশব্দে বসে থাকলে? সকাল হলে যা হয় একটা ব্যবস্থা হবেই।
তাছাড়া উপায়ই বা কি? নিজেকে ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়ে বসে থাকাই যাক।
কিন্তু এ কল্পনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না।
চারিদিক থেকে শেয়ালের ঐক্যতান শরীরের সমস্ত রক্ত ঝিমঝিমিয়ে তুলল।
হৃৎপিণ্ডের মধ্যে যেন একটা হিমপ্রবাহ বইতে সুরু করেছে, অথচ হাত পা কপাল উঠেছে ঘেমে।
জগতের সমস্ত বাঘ, সমস্ত সাপ, আর সমস্ত চোর-ডাকাত খুনেগুণ্ডা বুঝি সোনালীর গাড়িখানা ঘিরে তাণ্ডবনৃত্য করছে, শুধু একবার ঝাঁপিয়ে পড়বার ওয়াস্তা।
যা থাকে কপালে বলে আর বসে থাকা অসম্ভব! সহসা একটা কাজ করল সোনালী। গাড়ির হেলাইটটা ফের জ্বালিয়ে তীব্র শব্দে হর্ণটা বাজাতে শুরু করল। মুহুর্মুহু নয়, অনবরত।
অবিচ্ছেদ্য সেই তীক্ষ্ণ তীব্র চীৎকারটা যেন খণ্ড বিখণ্ড করতে চাইছে গ্রামের নিশ্চিন্ত শান্তি।
কিন্তু সোনালীরও যেন নেশা লেগেছে। যেন বাজিয়ে যাবেই শেষ পর্যন্ত, যতক্ষণ ওই যন্ত্রটার ক্ষমতা থাকবে আর্তনাদ করবার। অথবা ওই শব্দটার মধ্যেই বুঝি ভরসা খুঁজছে সে।
সামনের পথটা গাড়ির আলোয় চোখধাঁধানো, কিন্তু পাশের অন্ধকার অনাহত।
.
হঠাৎ যেন বিদীর্ণ হল সেই নিচ্ছিদ্র প্রাচীর। সরু একটি আলোকরেখা কোথায় যেন চিকচিকিয়ে উঠল।
সত্যি? না কল্পনা?
কিসের ওই আলোকরেখা, দুলছে কাঁপছে, মাঝে মাঝে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, মাঝে মাঝে মিলিয়ে যাচ্ছে? কিসের আলো ওটা?
চিরশহরবাসিনী সোনালী গল্পে কাহিনীতে পড়া ধারণাটাকে ছুটিয়ে দেয় কল্পনার ঘোড়ায় চড়িয়ে।
ওই বোধহয় আলেয়া।
ওই যে মাঝে মাঝে স্পষ্ট হচ্ছে, মাঝে মাঝে মিলিয়ে যাচ্ছে। ওই আলেয়াটাই কি সোনালীকে পথভ্রান্ত করে দেবে?
কিন্তু কি করে? সোনালী তো গা থেকে নামছে না। ওর পিছনে ছুটতেও যাচ্ছে না।
কিন্তু কিসের পিছনে ছুটে এতদূর এল সে?
আর যদিই বা উগ্ৰ অভিমানের বশে এসে থাকে, প্রধান রাস্তাটা ছেড়ে এমন অজানা অন্ধকার কাঁচা রাস্তায় চলে এল কেন?
যশোর রোড দিয়ে অনবরত মালবাহী লরি আসা যাওয়া করে। সোনালীর অচল গাড়িখানা সেখানে পথ জুড়ে পড়ে থাকলে নিশ্চয় তাদের দৃষ্টিতে পড়ত, এবং এতক্ষণে নীপার বাড়ি বসে সমারোহ করে নিজের খামখেয়ালের অ্যাডভেঞ্চারের গল্প করতে পারত সোনালী।
কিন্তু তা হল না। পাকা রাস্তা ছেড়ে কাঁচা রাস্তায় চলে এসেছে সোনালী।
হয়তো বা শুধু এইটুকু চলে আসার জন্যেই জীবনের পাকা রাস্তাটাকে হারালো সোনালী। চিরকালের মত কাঁচা রাস্তায় পড়ল।
না, ওটা আলেয়া নয়, লণ্ঠনের আলো। কেউ বুঝি এগিয়ে আসছে আলোটা হাতে ঝুলিয়ে।
ছেলেবেলায় শোনা যত সব ডাকাতের গল্প মনে জেগে উঠছে। আলো হাতে করে কাছে আসে তারা, কড়া গলায় বলে, গায়ে কী গহনা আছে খুলে দাও চটপট।
কিন্তু শুধু গহনা পেলেই কি সন্তুষ্ট হয়ে চলে যাবে?
তাই কি যায়? যদি আরও কিছু উপরি পাওনার আশা থাকে? হায় হায়, কেন এ বোকামী করতে গেল সোনালী? কেন শব্দের সঙ্কেত দিয়ে অনিশ্চিত বিপদকে নিশ্চিত করে তুলল? কেন আলোর নিশানা দিয়ে জানিয়ে দিল কোনখানটায় পড়ে আছে সে অরক্ষিত একটা গাড়ির মধ্যে?
আলোটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে।
আর বোঝা না বোঝার দ্বন্দ্ব নেই। দুটো লোক আসছে গাড়ির দিকে। একজনের হাতে একটা হ্যারিকেন লণ্ঠন। মেঠো লোক, গায়ে জামার বালাই নেই, কেঁচার খুঁটটা একটু গায়ে দেওয়া।
দুজন এসেছে, অর্থাৎ গুছিয়েই এসেছে। কে জানে হাতের ফাঁকে লুকোনো আছে কিনা কোনও ধারালো অস্ত্র।
বাইরে থেকে ভরসার যখন আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না, ভয় বস্তুটা একটা ক্ষুধার্ত হিংস্র জন্তুর মত দন্ত মেলে উদ্যত হয়ে ওঠে, তখনই বুঝি অন্তর্জগতে একটা ওলটপালট ঘটে যায়। চিরদিনের ভীতু মানুষটা সহসা সাহসী হয়ে ওঠে, চিরদিনের দুর্বল মানুষটা পায় অমিত বল। মন যেন তার আঁকড়ে ধরে থাকা কোনোখানে লুকিয়ে রাখা শেষ ব্রহ্মাস্ত্রখানা প্রয়োজন বুঝে বার করে।
.
ওরা গাড়ির কাছে এসে পড়েছে।
হাতের কাছে কোনও ভারী জিনিস থাকলে, ঈশ্বর জানেন সেইটা ছুঁড়ে মেরে বসত কিনা সোনালী। কিন্তু কিছুই নেই। একখানা ভারী বই পর্যন্ত না।
অতএব চীৎকার নয়, অদৃশ্য কারও কাছে সাহায্য প্রার্থনা নয়, শুধু সমস্ত মানসিকশক্তি একত্র করে বসে বসে প্রতিক্ষা করা মৃত্যুর জন্যে, ধ্বংসের জন্যে।
.
কিন্তু কই, ওরা তো এসেই গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে বসল না। জানালার কাঁচগুলো শাবলের ধাক্কায় ভেঙে সাতটুকরো করল না! ওরা শুধু হাতের আলোটা তুলে ধরে কিছু একটা প্রশ্ন করল।
কাঁচের ওপিঠ থেকে গলার আওয়াজ ঠিক বোঝা গেল না, তবে ভঙ্গীটা বোঝা গেল– প্রশ্নের ভঙ্গী।
আশ্চর্য, একটা ভদ্রলোক জুটল না সোনালীর ভাগ্যে?
তবু দরজাটা খুলল সোনালী।
আর তীব্র তীক্ষ্ণকণ্ঠে এমনভাবে প্রশ্ন করল যেন ওরা কাঠগড়ার আসামী, আর নিজে সে অপর পক্ষের উকিল।
জায়গাটার নাম কি?
হ্যারিকেনধারী চুপচাপ সেটা উঁচু করে তুলেই রইল। অপর ব্যক্তি মৃদুস্বরে উত্তর দিল, এই পাড়াটাকে জামতলা বলা হয়। টাউন বনগাঁ।
বনগাঁ! কী সর্বনাশ! বনগাঁ পর্যন্ত চলে এসেছে সোনালী? কিন্তু আসা তো নয়, এ যে এসে পড়া!
কে জানে এই এসে পড়তে কতক্ষণ লেগেছে?
কিন্তু না, এদের সামনে বিচলিত ভাব দেখালে চলবে না, ভুরু দুটো আরও কুঁচকে বলে ওঠে, বেজেছে কটা?
এই খালি-গা চাষা দুটোকে আপনি বলতেও ইচ্ছে করছে না, আবার ঠিক তুমিটাও মুখে আসছে না। একটা লোক যেন ঠিক চাষার মতও নয়। যদিও বেশভূষায় উভয়েই প্রায় অভিন্ন, তবু কোথায় যেন মস্ত একটা পার্থক্য রয়েছে চোখে, চুলে, মুখের রেখায়। হ্যারিকেনের আলোটা ওর মুখেই বারেবারে আলোছায়ার আলপনা কাটছে।
কিন্তু ও উত্তর দেবার আগেই আলোধারী বলে ওঠে, ঘড়ি তো আজ্ঞে আপনার হাতেই বাঁধা রয়েছে দিদিমণি!
অপর ব্যক্তি সঙ্গে সঙ্গেই তেমনি মৃদুস্বরে বলে, তুই থাম ফণী।
কিন্তু এ বিনয় নরম করতে পারে না সোনালীকে। যেন সমস্ত ঘটনাটার জন্যে এরাই দায়ী এই ভাবে রুক্ষস্বরে বলে, সেটা আমার জানা আছে। ঘড়ি বন্ধ হয়েছে বলেই জিজ্ঞেস করা হচ্ছে।
ফণী অবশ্য আর কথা কয় না, অপর জন বলে, পৌনে নটা মতন হবে।
পৌনে নটা! মাত্র পৌনে নটা।
সোনালীর যে মনে হচ্ছিল অনন্তকাল এইভাবে বসে আছে সে!
সোনালীর এই বিস্ময় প্রকাশে লোকটা মৃদু হাসে, পাড়াগাঁয়ের ব্যাপার তো! সন্ধ্যেবেলাই শেয়াল ডাকে। কিন্তু কি হয়েছে বলুন তো? গাড়ি বিগড়েছে?
লোকটার কথা বলার ধরনটা নেহাৎ চাষাড়ে নয় বটে, কিন্তু ওই দিদিমণি বলা লোকটার সঙ্গী বই তো নয়, ওকে আপনি বলে হাস্যাস্পদ হতে পারবে না সোনালী। তাই সবলে দ্বিধা দূর করে বেশ মনের জোরের সঙ্গে বলে, তাই মনে হচ্ছে। কাছাকাছি কোনো মোটর মেকানিকের সন্ধান জানা আছে তোমার?
আলোধারী যেন একটু চমকে উঠল। তুমি শুনেই কি?
কিন্তু অপর জন অবিচলিত মুখে বলল, কাছাকাছির মধ্যে কই? আছে টাউনে।
তবে তো সবই হল, সোনালীর স্বরে অসহিষ্ণুতা, সেটা এখান থেকে কত দূর?
মাইল তিনেক হবে।
ডেকে নিয়ে আসতে পারবে না? বখশিশ পাবে।
আলোধারীর কণ্ঠ থেকে একটা অস্ফুট আওয়াজ উঠল। আর অবিচলিত ব্যক্তির মুখে ফুটে উঠল একটা মৃদু হাসি।
আমি যেতে পারলেও সে আসতে রাজী হবে না।
হবে না মানে? চালাকি নাকি? একজন ভদ্রমহিলা এইরকম বিপদে পড়েছেন জেনেও আসতে রাজী হবে না?
মুশকিল কি জানেন, আবার হাসে সে, ওসব লোক এ সময় যে অবস্থায় থাকে, সে অবস্থায় স্বয়ং বৈকুণ্ঠের নারায়ণ এসে আবেদন জানালেও তাকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হবে।
এবার সোনালী যেন থতমত খায়, হোঁচট খায়, তার মানে?
মানে নেশায় আচ্ছন্ন। তায় আবার শনিবার, লরিওয়ালারা আলাদা বখশিশ দেয়।
চমৎকার! রেল স্টেশন এখান থেকে কত দূর?
ওই তো বললাম মাইল তিনেক। স্টেশনের ওপারেই বাজার, সেখানেই যত লরির আচ্ছা। মোটর মেকানিকও–
তোমাদের এখানে ট্যাক্সি মিলবে?
এখানে? পাগল হয়েছেন! দস্তুরমত হেসে ওঠে লোকটা।
উঃ, আচ্ছা বিপদেই পড়া গেছে। বলি আর কোনও যানবাহন, মানে আর কিছু গাড়ি-টাড়ি আছে?
আছে কয়েকখানা সাইকেল রিকশা, কিন্তু সন্ধ্যার পর বেরোয় না।
সন্ধ্যার পর বেরোয় না! অপূর্ব! ডবল মজুরি দিতে চাইলেও না?
সেটা ঠিক বলতে পারি না, কারণ আমার অন্তত জানা নেই কেউ কোনো দিন ওদের ডবল মজুরী দিতে চেয়েছে কিনা!
সোনালী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আর একবার লোকটার আপাদমস্তক দেখে নেয়।
মনে হচ্ছে যেন সোনালীকে ব্যঙ্গ করছে। সোনালীর বিপদগ্রস্ত অবস্থায় মজা পেয়েছে যেন। নিশ্চয় কু-মতলবী বদলোক। এইভাবে সোনালীকে আটকে ফেলতে চাইছে।
মোটে রাত্তির পৌনে নটা, এক্ষুনি অমনি গাড়ি ঘোড়া সব ঘুমিয়ে পড়ল, আর মেকানিক নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে রইল!
সব মিথ্যে কথা! খুব সম্ভব দলের আরও লোকজনের আসার অপেক্ষায় কথা কয়ে সময় ক্ষেপণ করছে।
হায় ভগবান, গাড়ি বিগড়ে দেবার আর সময় পেলে না তুমি
আর কিছু না, এ হচ্ছে শশাঙ্কের শাপের ফল। নির্ঘাৎ সোনালী যখন চলে এসেছে, অভিশাপ দিয়েছে সে!
কিন্তু এখন কি করা যায়! মুখের জোর হারালে চলবে না। হাত পা ঠাণ্ডাই হয়ে আসুক আর বুকের মধ্যে সমুদ্রকল্লোলই উঠুক, মুখের জোর বজায় রাখতেই হবে।
কোথায় থাকে রিকশাওয়ালারা? নিয়ে এসো দিকি একজনকে।
তারা তো সবই গ্রামের মধ্যে। কিন্তু চেষ্টা করে তাদের কাউকে ডেকে এনে রাজী করিয়ে রওনা দিলেও ফল কিছুই হবে বলে মনে হয় না, ততক্ষণে লাস্ট ট্রেন চলে যাবে।
লাস্ট ট্রেন চলে যাবে? সোনালীর তীক্ষ্ণস্বর আরও তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, লাস্ট ট্রেন কটায়?
সাড়ে দশটা।
ওঃ, সে তো অনেক দেরি। সাইকেল রিকশায় এই তিন মাইল রাস্তা যেতে এতক্ষণ লাগবে?
ওদের বাড়িতে গিয়ে রাজী করিয়ে ডেকে নিয়ে আসার সময়টাও যোগ করুন ওর সঙ্গে।
আবার সেই প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ।
আপাদমস্তক জ্বলে ওঠে সোনালীর। ছেলেবেলায় শোনা ওর মার একটা কথা মনে পড়ে যায়, হাতী যখন হাবড়ে পড়ে, ব্যাঙে ধরে লাথি মারে।
এ যে প্রায় তাই।
নইলে কোথায় সোনালী, আর কোথায় ওই খালি গা, খাটো কাপড়-পরা গাঁইয়া ভূতটা, ওর সাহস হয় সোনালীকে ব্যঙ্গ করতে!
এবার রক্তমূর্তি হওয়া দরকার।
তাই গলা চড়িয়ে বলে ওঠে সোনালী, আমার মনে হচ্ছে তোমার সমস্ত কথাই মিথ্যে। নিশ্চয় তোমার মতলব খারাপ। ভালো চাও তো হয় একটা মোটর মেকানিক, নয় একটা রিকশাওলা ডেকে আনো বলছি।
দাদাবাবু! ফণী সহসা হাতের আলোটা ঠক করে মাটিতে বসিয়ে বলে ওঠে, আপনি ফিরবেন?
আঃ, দাঁড়া না!
না দাদাবাবু, ফণীর আর দাঁড়াবার ক্ষ্যামতা নেই।
কেন রে, কি আবার হল তোর?
ও কথা শুধোবার আর দরকার নেই দাদাবাবু। আপনি দেবতা হতে পারো, ফণী রক্তমাংসর মানুষ! উঃ, ধন্যি বলি আপনাকে দিদিমণি! সাধে কি আর শহুরে মানুষদের দূরে থেকে গড় করি আমরা। বলি আপনি যে এই একা মেয়েছেলে শখ করে রাতদুপুরে গাড়ি চালিয়ে এসে, মাঠের মাঝখানে গাড়ি ভেঙে বেপোটে পড়েছ, এ দোষ কি আমাদের দাদাবাবুর?
ফণী! বিরক্ত গম্ভীর কণ্ঠ ভৎর্সনা করে ওঠে, তুমি যদি চুপ করে না থাকতে পারো আলোটা রেখে চলে যাও।
তা জানি। আপনার কাছে তো নেয্য কথা কইবার জো নেই।
ফণীর দাদাবাবু সম্বোধনটা সোনালীকে একটু যে নার্ভাস করে না আনে তা নয়। বোঝা যাচ্ছে আর যাই হোক, এ লোকটা ফণীর পর্যায়ভুক্ত নয়। কিন্তু এখন আর কি-ই বা করা যায়। বড় জোর সুরটা একটু নরম করা। কিন্তু তাতেও তো মানের হানি। ও যা হচ্ছে তোক।
অতএব সুরের গরমটা একটু কমলো কি না কমলো, নরম আদৌ নয়।
আচ্ছা মানছি, আমারই সব দোষ। কিন্তু কি করে জানব যে পৃথিবীতে এখনও এ রকম হতচ্ছাড়া জায়গা আছে।
পৃথিবীতে যে এখনও আরও কত হতচ্ছাড়া জায়গা আছে সে আপনাদের কল্পনার শুধু বাইরেই নয়, তার থেকে সমুদ্রপ্রমাণ দূরে।
.
০৭.
গম্ভীর মৃদু ক্ষুব্ধ এই স্বরটা যেন শুধু সোনালীকেই নয়, সমস্ত সভ্যতাকেই ধিক্কার দিয়ে উঠল।
সোনালী যদি আজকের বিকেল থেকে এই রাত অবধি সমস্ত ঘটনাটা জীবন থেকে মুছে ফেলতে পারত!
আবার দেখা দিচ্ছে আপনি তুমির দ্বন্দ্ব। লোকটার কথাবার্তা বারে বারেই ধাক্কা দিচ্ছে সোনালীকে।
বিমূঢ়র মত কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে সোনালী বলে, তাহলে কথা দাঁড়াচ্ছে–এখন আমার সারারাত এই অবস্থায় বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করবার নেই! বাঘেই খাক আর ডাকাতেই ধরুক।
অত দূর পর্যন্ত নয়! একটু কষ্ট করে খানিকটা হেঁটে গ্রামের মধ্যে চলুন, আপনাকে বসিয়ে যা হোক একটা ব্যবস্থা করা যাবে।
গ্রামের মধ্যে কোথায় আমি বসতে যাব? উদ্বিগ্ন স্বর সোনালীর।
এই হতচ্ছাড়া গ্রামের কোনও এক হতভাগ্যের ঘরে।
তারপর? ব্যবস্থাটা কি হবে?
দেখি যদি স্টেশন থেকে ফোন–ফোন আছে অবশ্যই আপনার বাড়িতে?
ফোন! সোনালী যেন অথৈ সমুদ্রের কূল পায়। কী আশ্চর্য, এতক্ষণ এই সহজ কথাটা মনে আসছিল না কেন তার?
ফোন আছে বইকি! এখানে ফোন আছে কারুর বাড়ি?
এখানে? লোকটা কেবলই বুঝি হাসির খোরাক পাচ্ছে, এখানে নয়। স্টেশন থেকেই যদি সম্ভব হয়। তাও নিশ্চয় করে বলতে পারছি না। তবে চেষ্টা দেখতে হবে তো। বাড়িতে অবশ্যই সবাই ভাবছেন।
আমার জন্যে ভাববার কেউ নেই। সহসা বলে ওঠে সোনালী।
লোকটার কি একটু বিস্ময় বোধ হয় না? একটু বা কৌতূহল?
মনে হয় না ভদ্রমহিলা কি রাগ করে বাড়ি থেকে পালাচ্ছিলেন না কি?
কিন্তু কৌতূহল প্রকাশটা অশোভন। তাই একেবারে প্রসঙ্গান্তরে চলে যায় সে, তাহলে নেমে এসে হাঁটুন একটু কষ্ট করে। ফণী, তুই আলোটা নিয়ে আগে আগে চল্।
নেমে পড়বার ইচ্ছে অনেকক্ষণ থেকেই করছিল সোনালীর, কিন্তু ঠিক সাহস পাচ্ছিল না। গাড়ির মধ্যে আছে তবু নিজের কোটে আছে।
আহা, গাড়িটা যদি সহসা বিশ্বাসঘাতকতা পরিহার করে! যদি স্টার্ট দিতেই স্টার্ট নিয়ে ছুটতে শুরু করে। তাহলে ওদের নাকের সামনে দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায় সোনালী ধুলোর ঝড় উড়িয়ে।
কিন্তু যেত কি?
সত্যি বলতে কি, খুব ভয়ঙ্কর ভয় আর করছে না!
আর এই মুহূর্তে সমস্ত নাটকটার উপর যবনিকাপাত করে ঠিক যে চলেই যেতে ইচ্ছে করছে তাও নয়।
নিজেকে সাংঘাতিক বিপদগ্রস্ত আর মনে হচ্ছে না, বরং অনেকটা যেন উপন্যাসের নায়িকার মত মনে হচ্ছে নিজেকে।
এই জায়গাটাকে কি যেন বললে?
জামতলা।
এইখানে থাকো তোমরা?
হ্যাঁ।
কেন, টাউনে থাকতে পারো না? এখানে এত অসুবিধে
ফণী হেসে ওঠে, গাঁয়ের মানুষদের অসুবিধেয় অত কাতর হলে চলে না। হয়ও না।
খাও কি? এখানে নিশ্চয়ই বাজার নেই!
সবই আছে।
কথা কইবার জন্যেই কথা কইছে সোনালী। নিঃশব্দে নিয়তির নির্দেশে এগিয়ে চলার মত লোক দুটোর পিছন পিছন এগিয়ে যেতে ভালো লাগছে না।
কথা কওয়া ভালো, কথার মধ্যে আশ্রয় আছে। তবু গেল খানিকক্ষণ।
ফণীর হাতের আলোর রেখাটুকু ধরে নীরবে এগিয়ে চলেছে দুটো মানুষ।
প্রথমজন সোনালী, দ্বিতীয়জন এখনও অজ্ঞাতনামা।
তা সোনালীর নামটাই কি ও জেনেছে?
.
আর কতক্ষণ হাঁটতে হবে সেই কোনো একজন যেন হতভাগ্যের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছোবার জন্যে?
এ লোকটার সঙ্গে নেহাৎ ফণীর মত করে কথা না বললেও চলবে এটুকু বোঝা গেছে এতক্ষণে।
উদ্দিষ্টব্যক্তি হেসে ওঠে।
এই যে প্রায় এসে গেছি।
তোমারই বাড়ি বোধহয়? নাকি তোমার মনিববাড়ি?
নাঃ, ফণীর সহ্যের উপর বড্ড বেশি চাপ দেওয়া হচ্ছে, আর পারছে না সে। দাদাবাবুর এই অতাত ভাবে গা জ্বলে যাচ্ছে তার।
কোথা থেকে এক উড়ো আপদ এসে জুটে কী গেরো করছে।
বেশ বাবা, একা মেয়েছেলে বেরিয়ে পড়ে পথে বিপদে পড়েছিস, মায়া দয়া করা মানুষের কাজ। আর দাদাবাবুর তো ওই পেশা, লোকের উপকার করে বেড়ানো, লোককে মায়া দয়া করে।
করো ভালো কথা, কিন্তু ওই বেসহবৎ মেয়েটা যে তোমায় চাকরবাকরের মত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে, এটা বরদাস্ত করবার দরকার কি?
অথচ এটা ফণীর বিলক্ষণ জানা, ফণী যদি মেয়েটাকে দাদাবাবুর মহিমা সমঝে দিতে যায়, জন্মে আর ফণীর মুখ দেখবে না দাদাবাবু।
রাগের চোখে শুধু হাতের আলোটাকে সজোরে আন্দোলিত করতে থাকে সে চলতে চলতে।
ফণী, আলোটা নিভে যাবে, আস্তে। …হ্যাঁ কি বললেন, বাড়িটা আমার মনিববাড়ি কিনা? তা প্রায় ঠিকই ধরেছেন। ওটাই আমার কর্মস্থল।
হুঁ।
কোনো এক রহস্য আবিষ্কারের আশায় মন চঞ্চল হয়ে ওঠে সোনালীর।
কি কাজ করতে হয়?
যখন যা পড়ে। যখন যা এসে যায়। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত।
আর এই ফণী?
ও? ও আমার সহকারী।
বাড়িতে আছে কে?
আজ্ঞে গেলেই দেখতে পাবেন।
আর মুখ বন্ধ করে থাকতে পারে না ফণী, বলে ওঠে, এই তো এসে গেলাম।
এসে গেলাম বলে যে বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে–আলোটা উঁচু করে তুলে ধরে ফণী, সে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে যায় সোনালী।
অন্ধকারে সম্যক ধারণা না হলেও বাড়িটা যে অনেকখানি জমি জুড়ে আর অনেকটা উঁচুতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তা বোঝা গেল। এই ঝোঁপজঙ্গলের মাঝখানে হঠাৎ এতবড় একটা বাড়ি দেখতে পাবে সে কল্পনাই করে নি। মনের মধ্যে বারে বারে কল্পনার ছায়া ফেলেছিল একখানি মাটির ঘর। একটু বা গোবর লেপা উঠোন। একটা তুলসীমঞ্চ।
প্রকাণ্ড বাড়ি।
তবে আর একবার ভালো করে চেয়ে দেখে টের পায় সোনালী, নেহাৎই ভগ্নদশাগ্রস্ত। একদিকের খানিকটা ভেঙে পড়ে স্কুপের সৃষ্টি করেছে। দেখে গা ছমছম করে।
মাকে খবর দিয়ে আয় তো ফণী! বললো অন্য ব্যক্তি।
মা!
শব্দটা যেন কানে মধুবর্ষণ করল সোনালীর।
আশা হচ্ছে তাহলে কোনো একটি নারীচরিত্রের আবির্ভাব ঘটবে।
কিন্তু মা বলতে কি বোঝায়? সত্যিকার মা, না মনিবগিন্নী?
তাই সম্ভব। তবে এ লোকটা যে নেহাৎ চাকর বাকর শ্রেণীর নয়, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। কিছু কিঞ্চিৎ লেখাপড়াও জানে সন্দেহ নেই। খুব সম্ভব ধনী বিধবার বিষয়আশয়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতীয়। তার চাইতে উঁচুদরের হলে গায়ে একটা জামা অন্তত থাকত।
কিন্তু কথাবার্তায় ভব্যতা আছে। কথায় একটা আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারে।
.
০৮.
আলোটা নামিয়ে রেখে বাড়ির মধ্যে ঢুকে মুহূর্তে অন্ধকারের মধ্যে মিশিয়ে গেল ফণী।
সোনালী ওর সেই পরিত্যক্ত আলোটা তুলে ধরে দেখতে থাকলবাড়ির আকৃতি আয়তন।
বাড়ির মালিক বাড়ি সারান না কেন?
মালিক বলে ঠিক কেউ নেই।
তার মানে? থাকে কে?
দুএকজন কর্মচারী।
মা বললে কাকে?
তিনি? তিনি এখানের অধিষ্ঠিত দেবী। এ অঞ্চলটারই।
নাঃ, আর একবার না ধমকে পারে না সোনালী!
আচ্ছা গোলমেলে কথা তো তোমার! এ সব কথার অর্থ কি? এ কোথায় এনে তুলেছ আমায়?
কী আশ্চর্য! এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন?
হব না? বলো কি তুমি! কী মতলবে এই একটা ভাঙা বাড়িতে ডেকে নিয়ে এলে আমাকে? আমি ঢুকব না এ বাড়িতে।
না ঢোকেন জোর নেই। অভিযুক্ত আসামী মৃদুহাস্যে বলে, তবে বাইরে সাপখোপ
ওঃ, আবার ভয় দেখানো হচ্ছে- সোনালীর আস্ফালনের মধ্যেও উৎকণ্ঠার স্বর গোপন থাকে না, এ সময় সাপ বেরোয়?
বেরোবেই এমন কথা বলছি না, তবে বেরোনো অসম্ভব নয়।
এই ভাঙা বাড়ির খাঁজে-খোপেই যে সাপ নেই তার প্রমাণ?
প্রমাণ দেওয়া শক্ত। প্রমাণের মধ্যে আমরা–যারা এখানে বাস করি, তারা এখনও দিব্যি টিকে আছি, এই।
হু! তোমরা কে কে থাকো?
স্থিরতা কিছু নেই, কখনো তিনজন, কখনো বিশজন।
সোনালীর বুকটা ক্রমশ যেন হিম হয়ে আসছে। বেশ বুঝতে পারছে লোকটা গোলমেলে, জায়গাটা গোলমেলে, আর মতলব ওর খারাপ নিশ্চয়ই।
একটা আস্তানায় কখনো তিনজন, কখনো বিশজন, এর মানে? ডাকাতের আচ্ছা নাকি!
না এর গহ্বরে কিছুতেই ঢুকবে না সোনালী, বরং খোলা মাঠ ভালো। সাপে খায় খাক।
সহসা রুখে দাঁড়িয়ে বলে, আমি ভেতরে ঢুকব না।
বেশ!
বেশ বলে এভাবে চুপ করে রইলে যে? আমাকে আমার গাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসো।
চলুন।
তুমি কি ভেবেছ কি? তীক্ষ্ণ চীৎকারে অন্ধকার পরিবেশটাকে যেন খান খান করে ফেলে সোনালী, যেন মজা দেখছ এই ভাবে কথা বলছ! ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা কইতে জানো না?
আসামী হেসে ফেলে বলে, আপনি বড্ড বেশি নার্ভাস হয়ে পড়েছেন, এখন আপনাকে কোনো কিছু বোঝাতে যাওয়া বৃথা।
তাই নাকি? তুমি তো দেখছি অনেক রকম কথা জানো। কিন্তু মনে জেনো আমার সঙ্গে কোনো রকম দুর্ব্যবহার করতে এলে সহজে রেহাই পাবে না তুমি। তোমার দলসুষ্ঠু সবাইকে পুলিশে
সহসা অন্ধকারের গুহা থেকে বেরিয়ে আসে ফণী। পিছনে খানিকটা ধপধপে সাদা।
সেই শ্বেতবস্ত্রাবৃতার কণ্ঠ থেকে কোমল মধুর একটি ঝঙ্কার ওঠে, ছিঃ মা, ও কথা কি মনে করতে আছে? দুর্ব্যবহার করবে কেন? কত ভাগ্য যে এই ভাঙা বাড়িতে আজ তোমার মত অতিথির পায়ের ধুলো পড়ল!
থতমত খেয়ে যায় সোনালী। ঠিক এ রকমটা আশা করে নি সে।
কিন্তু আজ সন্ধ্যা থেকে কোনটাই বা তার আশানুরূপ ঘটছে?
এসো। আলোটা তুলে ধরেন মহিলাটি।
তুলে এগোতে থাকেন, আর মন্ত্রমুগ্ধ সাপের মত সোনালী তার পিছন পিছন এগোয়।
বাইরেটা যেমন ভূতুড়ে ভিতরটা তেমন নয়। ভিতরে চলনপথ পার হয়ে দালানে পা দিতেই স্পষ্ট পরিষ্কার আলোর আশীর্বাদ।
সীলিং থেকে দুপাশে দুটো গোল চিমনি ঢাকা বড় বড় কেরোসিন আলো ঝুলছে। সেই আলোয় সমস্ত দৃশ্যটার ওপর চোখ বুলিয়ে নিল সোনালী।
দালানের একপাশে একহারা একটা চৌকীতে পরিষ্কার চাদর ঢাকা সরু একটি বিছানা। তার মাথার কাছে বয়সে কিছুটা বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ছোট্ট একটি পাথরের ত্রিপদী। তার উপর দুএকখানা বই, একখানা চশমার খাপ, একটা চকচকে তামার ঘটিতে কয়েকটি ফুল। দেওয়ালের ধারে ধারে সারিগাঁথা বুক-সেলফ।
জিনিসগুলো পুরনো সন্দেহ নেই, পালিশ খসে যাওয়া রংজ্বলা কিন্তু মজবুত সন্দেহ নেই।
পুরনো আমলের ফার্ণিচার। কিন্তু আগাগোড়া বইয়ে ঠাসা।
এ কি। এত গ্রন্থ-সংগ্রহ।
এ কোথায় এসে পড়েছে সোনালী? কোনো রাজনৈতিক দলের গুপ্ত আড্ডায়?
এ বইয়ের মালিক কে?
কে পড়ে এত বই? ওই মহিলাটি?
ওই লোকটা নয় তো? ছদ্মবেশী কোনো দলনেতা হতে পারে,–বিশ্বাস কি?
বোসো মা।
মহিলাটির কণ্ঠস্বরে দালানের এ পাশটায় লক্ষ্য পড়লো। এ পাশে দেয়াল জুড়ে সরু টানা একটা চৌকী, আশেপাশে কয়েকটি বেতের মোড়া। এই দিকে সোনালীকে বসতে অনুরোধ করছে মহিলাটি।
চৌকীতে বসল সোনালী।
দেখলো তার ওপর বিছানো চাদরটা ছাপা খদ্দরের। সামনের বিছানার চাদরটাও বোধকরি তাই। এতক্ষণে নজর পড়ল মহিলাটি এবং পুরুষ দুটি তিনজনেই খদ্দরমণ্ডিত।
ওঃ, বোঝা গেছে।
এতক্ষণে যেন কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হয় সোনালী। রাজনৈতিক দল হতে পারে। কিন্তু ভয়ঙ্কর কোনো দল নয়।
মহিলাটি যে রীতিমত অভিজাত ঘরের তাতে আর সন্দেহ নেই, চলনে বলনে ধরনে চেহারায় বনেদী আভিজাত্যের ছাপ।
আর এই লোকটা?
স্পষ্ট আলোয় ধরা পড়ছে এবার মহিলাটির সঙ্গে একান্ত সাদৃশ্য। তার মানে লোকটা ওঁর আপন কেউ। অর্থাৎ ভদ্রলোক।
কিন্তু কী ভয়ঙ্কর লোক! এ ভাবে ছোটলোকের ছদ্মবেশে
নিরু, তুই তাহলে চেষ্টা দেখ এঁর জন্যে কি করতে পারিস। অভিজাতের মসৃণ কণ্ঠ ধ্বনিত হয়ে ওঠে, আমি ততক্ষণ এঁকে-হাতমুখ ধোবে মা?
সোনালী বিচলিত ভাবে বলে, না না, ওসব কিছু দরকার নেই।
মহিলাটি তাকিয়ে দেখেন।
তা সত্যি, দরকার নেই সত্যিই। এনামেলমণ্ডিত উগ্র আধুনিক সাজের এনামেলটা এত উদ্বেগ উৎকণ্ঠা, এত ঘাম গরম সব কিছুর মধ্যেও যথেষ্ট বজায় রয়েছে। অতিরঞ্জিত ঠোঁটটাই যা আপাতত ঈষৎ ম্লান।
তাহলে থাক। কিন্তু খেতে তো হবে একটু।
না না, আমার কিছু খাবার ইচ্ছে নেই এখন।
তা বললে কি ছাড়ব মা, এখন ছাড়া তোমাকে আর পাচ্ছি কোথায়? সকাল হলে আর কি তুমি আমার ঘরে
সকাল হলে! সোনালী চমকে বলে, রাত্তিরে এখানেই থাকতে হবে নাকি?
মহিলাটি ওর চমকানিতে হেসে ফেললেন, তা এই রাতে আর এই ঝোপজঙ্গলের পথে কোথায় যাবে মা? কি করেই বা যাবে?
কেন, আপনি যে বললেন উনি কি যেন ব্যবস্থা করবেন।
নিরু নামক ব্যক্তিটিকে এবার উনি সম্বোধনে সম্ভ্রম দেখায় সোনালী।
ভেবেচিন্তে নয়, অজ্ঞাতসারে।
মহিলাটি নিরুর দিকে একবার তাকিয়ে আর একটু হেসে বলেন, এই রাতে তোমার ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা আর কি করে হবে মা? কলকাতা থেকে কত দূরে এসে পড়েছ। এখন কলকাতা থেকে গাড়ি আনিয়ে আবার সেখানে ফিরে যেতেও তো রাত ভোরই হয়ে যাবে। ব্যবস্থা করতে বলছি–তোমার বাড়িতে খবর দেবার। বাড়িতে সবাই ভাবছেন তো
সবাই ভাবছেন তো, এইটুকু বলেই থেমে গেলেন ভদ্রমহিলা।
সোনালী কোথায় যাচ্ছিল, কেন যাচ্ছিল এতদূর পথে রাতে অমন একবস্ত্রে, একলাই বা যাচ্ছিল কেন, এ সব অশিষ্ট প্রশ্নের দিক দিয়েও গেলেন না।
এমন কি নারীর সহজাত কৌতূহল দৃষ্টি নিয়ে দেখলেন না খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।
এই যে সোনালী বললে হাত মুখ ধোবার দরকার নেই, তৎক্ষণাৎ সেই অপ্রয়োজনের ইচ্ছাটাকেই মেনে নিলেন, তার ওপর জোর করলেন না অনুরোধে ভেঙে পড়ে।
সোনালী যদি খেতে না চায়, যদি বলে দরকার নেই, নিশ্চয় মেনে নেবেন সে কথা। খাও খাও করে পীড়ন করবেন না।
আতিশয্য কিছুতেই নেই।
এমন কি চাকরটা পর্যন্ত এত শিক্ষিত যে, মনের বিরক্তি স্পষ্ট প্রকাশ করে নি। তবে চটেছে যে বিলক্ষণ তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। শুধু মনিবের মান রেখে চলতে চুপ করে আছে।
নাঃ, এদের প্রতি কৃতজ্ঞতার ভাষা নেই সোনালীর।
যথেষ্ট কৃতজ্ঞ হয় সোনালী।
না, সত্যিই ভদ্র রুচির মানুষ।
মা, আমি বেরুচ্ছি তাহলে– বলে নিরু (খুব সম্ভব নিরঞ্জন) দালানের মধ্যেকার একটা দরজা দিয়ে কোন ভিতরে চলে যায় এবং মিনিট খানেক পরেই গায়ে একটা মোটা পাঞ্জাবি চড়িয়ে বেরিয়ে আসে।
একটু সোনালীর দিকে তাকিয়ে বলে, জানি না আমার অভিযান সফল হবে কিনা, না হবার আশঙ্কাই পনেরো আনা, বাকী এক আনার উপর নির্ভর। তবু চেষ্টা করব। দয়া করে আপনার ফোন নাম্বারটা—
.
০৯.
ফোন নাম্বার!
মুহূর্তে সোনালী অনেকগুলো মাইল অতিক্রম করে পৌঁছে যায় একটা পরিচিত বাড়ির দোতলার একটা ঘরে।
যেখানে টেবিলল্যাম্পের সামনে টেবিলের উপর ঝুঁকে বসে এক জ্ঞানতপস্বী।
সেই টেবিলের ধারে উঁচু টুলের উপর বসানো আছে টেলিফোন রিসিভারটা।
টেলিফোনের কল লোকটার সমাধির মধ্যে সহজে সাড়া জাগাতে পারে না। বার বার চেঁচাতে চেঁচাতে তবে সমর্থ হয় তার ধ্যানভঙ্গ করতে।
সোনালী দেখতে পায় অলস হাতে রিসিভারটা তুলে নিয়েছে সে। তারপর এ পক্ষের বক্তব্য শুনে অবাক-অবাক গলায় বলছে, তাই নাকি? এতক্ষণ ফেরেন নি উনি? জানতাম না তো! আচ্ছা ঠিক আছে, আছেন তো কোথাও এক জায়গায়।…কী বললেন? ব্যাপারটা হয়েছে গাড়ি বিগড়ে? ওঃ। আচ্ছা কাল সকালে যা হয় হবে। ধন্যবাদ, ছাড়লাম।
এ ছাড়া আবার কি! আর কিছু নয়।
এই এরা, এরা মনে মনে কত হাসবে! ভাববে, ওঃ মহিলাটির তো এ দিকে এত অহংকার, অথচ দেখছি ঘরে ওঁর কোনো মূল্যই নেই।
হঠাৎ অকারণ একটা রাগে সমস্ত শরীর জ্বলে ওঠে সোনালীর। থাক দরকার নেই খবর দেবার। কী কাজ, যার উদ্বেগ নেই তার উদ্বেগ মোচনের চেষ্টায়।
চেয়ে দেখে সামনের ব্যক্তিটির দিকে।
পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে চেহারায় এসে গেছে ভদ্র ছাপ। সন্দেহ নেই ও এতক্ষণ ধরে প্রতারণা করেছে সোনালীর সঙ্গে।
ওই ফণীটার সঙ্গে এক শ্রেণীভুক্ত করে ওকে তুমি বলেছে সোনালী, বকেছে ধমকেছে, কোনো প্রতিবাদ করে নি ও।
ওর ওপরেও রাগে আপাদমস্তক জ্বলে যায় সোনালীর।
আর ঠিক এই মুহূর্তেই বিধবা মহিলাটি আর একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলেন, আচ্ছা মা, তুমি একটু বোসো, আসছি আমি।.ফণী, তুই আর একটা আলো নিয়ে যা দাদাবাবুর সঙ্গে।
অর্থাৎ তিনি যাচ্ছেন অতিথি সৎকারের চেষ্টায়।
ফণী বোধকরি এই বেহায়া মেয়েটার সংস্পর্শ যতটা পরিহার করা যায় এই ভেবে নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গেই আলোটা হাতে তুলে ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়ায় দাদাবাবুর বেরোবার আশায়।
.
নিরু পকেট থেকে একটা ছোট্ট নোটবুক বার করে বলে, কই বলুন!
বলব! কী বলব?
আপনার ফোন নাম্বারটা। টুকে নিয়ে যাওয়াই ভালো। স্মৃতিশক্তির ওপর বেশি চাপ না পড়ানোই উচিত।
ফোন নাম্বার নেবার দরকার নেই।
দরকার নেই! দরকার নেই কথাটা এত সহজে উচ্চারণ করে ফেলছেন কেন? দুনিয়াটা এমনই জায়গা, একবার যদি উচ্চারণ করেন দরকার নেই, তো আর সে দেবে না।
দুনিয়ার কাছে আমার কিছু চাইবার নেই।
এই সেরেছে। আপনি যে দেখছি মহাপুরুষের পর্যায়ে গিয়ে পড়ছেন।..কিন্তু বাড়ির লোকের উদ্বেগের কথা চিন্তা করুন একবার!..
আমার বাড়ির কথা আমি ভাবব, নিতান্ত রূঢ়স্বরে বলে ওঠে সোনালী, আপনাকে আর ভাবতে হবে না।
কি হল, আবার আপনি কেন? বেশ তত সহজ ডাকটি ধরেছিলেন।
.
আপনি–আপনি বলে সম্বোধন করে ফেলেছে বুঝি সোনালী! তাই ফেলেছে বোধহয়। অজ্ঞাতসারেই।
কিন্তু অপ্রতিভ সে হবে না। তাই বলে ওঠে, ভেবেছিলাম মানুষটাও সরল।
সে ধারণা ভঙ্গ হবার হঠাৎ কি হল?
জানি না। আমার যখন যা খুশি, তাই বলব।
আশ্চর্য, কিছুতেই আহত হয় না লোকটা। এই অকারণ ঔদ্ধত্যেও নয়।
তাই বলবেন। তুই বললেও আপত্তি নেই। শুধু নাম্বারটা–অন্তত বাড়ির ঠিকানাটা
না না না। বলছি আমার বাড়িতে খবর দেবার দরকার নেই!
কী আশ্চর্য, এতক্ষণ তাহলে ব্যস্ত হচ্ছিলেন কেন? নিরু হতাশভাবে প্রশ্ন করে।
সোনালী সমান উদ্ধতভাবেই বলে, ব্যস্ত হচ্ছিলাম ফিরে যাবার জন্যে। বলেছি তো আমার জন্যে কেউ ভাববার নেই।
খুব মৃদু একটি হাসির রেখা ফুটে ওঠে নিরুর মুখে, যেখানে আপনার অনুপস্থিতিতে উদ্বেগের আশঙ্কা নেই, সেখানে ফিরে যাবার জন্যে এত অস্থিরতা কেন? যাবেন কাল ধীরে সুস্থে গাড়ি ঠিক করে। এসেই যখন পড়েছেন, না হয় একটু দেখে যাবেন আমাদের গ্রামটা।
সোনালী অবজ্ঞার সুরে বলে, দেখবার কিছু আছে নাকি?
আছে বইকি। নিরঞ্জন গম্ভীর হয়ে যায়, মানুষ কত হতভাগা আর তার পরিবেশ কত হতচ্ছাড়া হতে পারে সেটাও তো দেখবার জিনিস!
দেখে কি হবে? কিছু প্রতিকার করতে পারব?
অন্তত গ্রামের জন্যে কিছু ভাবতেও তো পারবেন।
তার জন্যে তো আপনারাই রয়েছেন। খুব সম্ভব গ্রামোন্নয়ন নিয়েই পড়ে আছেন এখানে?
এটা আমার দেশ, এখানেই বড় হয়েছি, দুদশ বছর ছাড়া বরাবরই এখানে আছি, পড়ে থাকা মনে হয় না।
দুদশ বছর ছাড়া কেন? পড়াশোনার জন্যে?
ওই যা হয় কিছু।
হু। এ বাড়িতে যদি বাস করেন, এমন পোড়ো বাড়ি করে রেখেছেন কেন?
এত বড় বাড়ি সারাই অত পয়সা কোথায়?
চমৎকার। বাড়ির ছাতটা মাথায় নেমে আসুক তাও ভালো, কেমন? এই আমাদের দেশ! হতচ্ছাড়া কি অমনি হয়? কেন, এত বড় বাড়ি রাখারই বা দরকার কি? বেচে দিন না।
কিনবে কে? যারা আছে সবাই যে হতভাগা। তা ছাড়া
কি? কি তা ছাড়া?
এই পোড়ো বাড়িটায় কিছু পোড় ছেলের জটলা হয় দুপুরবেলা।
ও, ইস্কুল! খুব সম্ভব অবৈতনিক? আর সেটা আপনিই পড়ান? বিদ্রুপে ভুরুটা কুঁচকে আসে সোনালীর!
আশ্চর্য অনুমানশক্তি তো আপনার! আমি কিন্তু আপনার সম্বন্ধে কিছুতেই কিছু অনুমান করতে পারছি না!
আপ্রাণ চেষ্টা করছেন নিশ্চয়?
আপ্রাণ না হলেও, করছি।
আপনার মার কিন্তু এত কৌতূহল নেই।
বাঃ, উনি আমার মা একথা তো বলি নি আপনাকে?
ভগবান কাউকে কাউকে সহজাত কিছু ক্ষমতা দেন যাতে সে অনেক কিছুই নিজে বুঝে নিতে পারে।
নিরু হেসে উঠে বলে, সব সময় পারে না।
ও-সেটা অপরের ছদ্মবেশের মহিমা।
ছদ্মবেশ!
তাছাড়া আবার কি?
বিশ্বাস করুন, ওইটাই আমার সত্যিকারের বেশ, সচরাচরের বেশ!
কেন? কৃচ্ছ্বসাধন?
ওসব বড়সড় কিছু না, প্রয়োজনের অতিরিক্তে আমার অস্বস্তি।
অথচ একজন ভদ্রমহিলার সামনে খালিগায়ে দাঁড়াতে আপনার অস্বস্তি নেই। কথাটা বলেই সোনালী স্তব্ধ হয়ে যায়।
এ কী! এ কথা কেন বলল সে? এ ধরনের রূঢ় কথা বলবার ইচ্ছে তো তার ছিল না!
কিন্তু বেশি অবাক হবার কিছু নেই। ইচ্ছের বাইরেও অনেক কিছু করে মানুষ। গভীর স্তরের কোনও অদৃশ্য ইচ্ছে গোপনে বসে ধাক্কা মারে, সেই ধাক্কায় বাইরের ইচ্ছের কাঠামোটা ভেঙেচুরে বদলে যায়।
ধৈর্য হারাব না ভাবলেও ধৈর্য বশ মানে না। রূঢ় হব না ভাবলেও আত্মস্থতার অভাব ঘটে। নিরাসক্ত নিস্পৃহের ভূমিকা নেব ভাবলেও নেওয়া হয় না।
.
১০.
নিরঞ্জন কিন্তু এবার অপ্রতিভ হয়।
কুণ্ঠিতস্বরে বলে, দেখুন বিশ্বাস করুন, ইচ্ছে করে এটা করি নি। খালি-খালি হর্ন শুনে মনে হল নিশ্চয় কেউ কোনো রকম অসুবিধেয় পড়েছে, তাই যেমন ছিলাম তেমনিই ছুটে চলে গেছি। ধারণাই করতে পারি নি, আপনার মত একজন ভদ্রমহিলাকে ওখানে এভাবে–।
হুঁ থাক। কই, এত যে পরোপকারের শখ, তা জিজ্ঞেস করলেন না তো যাচ্ছিলাম কোথায়।
সাহস হয় নি। হেসে ওঠে নিরঞ্জন, যাচ্ছিলেন কোথাও অবশ্যই। অন্তত এই হতচ্ছাড়া দেশের কোনো এক হতভাগার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরোন নি সেটা তো ঠিক!
সোনালী সহসা ওর চোখের উপর অদ্ভুত একটা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে মৃদুকণ্ঠে বলে, কে বলতে পারে সেটাই ঠিক?
অসম্ভব কথা কেউ বলে না!
মাথা নীচু করে বলে নিরঞ্জন ওই চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নেয়।
সামান্য ক্ষণ গভীর একটা স্তব্ধতা!
.
দাদাবাবু!
ফণীর অসহিষ্ণু কণ্ঠ এসে ধাক্কা মারে এই স্তব্ধতার উপর, আসবেন, না আসবেন না?
দেখুন আমি যাই, একবার ঘুরে আসি। চেষ্টা করতে দোষ কি?
দোষ আছে। আমার দিক থেকে। আমার জন্যে আমি আপনাকে অনর্থক এত খাটাতে রাজী নই।
অনর্থক বলছেন কেন, আর আমার জন্যে ভেবেই বা কুণ্ঠিত হচ্ছেন কেন? যে কেউ এভাবে অসুবিধেয় পড়লেই
তার জন্যে এ উপকার করতেন আপনি, এই তো?তীব্র অসহিষ্ণু স্বরে বলে ওঠে সোনালী, কিন্তু আমার জন্যে করতে দেব না।
রূঢ়তা রুক্ষতা তীব্রতা আর অসহিষ্ণুতা সোনালীর একেবারে মজ্জাগত হয়ে গেছে বলেই হয়তো মুহূর্তে মুহূর্তে কারণে অকারণে সেটা প্রকট হয়ে উঠছে।
কিন্তু এ-পক্ষের বুঝি মৃদুতাই মজ্জাগত, তাই সে মৃদু হেসে বলে ফেলে, আপনার মেজাজ দেখে মনে হচ্ছে বাড়ি থেকে রাগ করে বেরিয়ে পড়েছেন আপনি। কিন্তু ছেলেমানুষী করবেন না, দিন দয়া করে আপনার ফোন নাম্বারটা।
বিদ্যুতের মত একটা দুষ্টুমির হাসি খেলে যায় সোনালীর মুখে। তাই তো, এতেই তো ওকে বেশ জব্দ করা যায়। ছেলেমানুষের মতোই মাথা নেড়ে বলে, উঁহু, কিছুতেই না। দেখি, আপনি কিন্তু পরোপকার করেন।
নাঃ, হার মানছি। কিন্তু আপনি টাই চালিয়ে যাচ্ছেন দেখছি। শুনে মনে হচ্ছে, কি যেন একটা লোকসান হচ্ছে আমার।
কি বলত সোনালী কে জানে, ঠিক এই সময় আবার মা এলেন হাতে একটা ছোট রেকাবী নিয়ে। আর সেটা যথাস্থানে দিতে ভুলে অবাক হয়ে বলেন, একি, তুই যাস নি?
কই আর গেলাম! ইনি যে আসল জিনিসটাই দিতে চাইছেন না।
আসল জিনিসটা! আবার অবাক হন মা।
ওঁর ফোন নাম্বারটা।
দিচ্ছেন না? ফোন আছে বাড়িতে?
আছে তো বলেছেন।
তবে? সোনালীর দিকেই তাকান এবার তিনি।
দ্বিধা ত্যাগ করে মুখ তোলে সোনালী, দেখুন, ভেবে দেখলাম পনেরো আনাই যখন অনিশ্চিত তখন বাকী এক আনার ওপর ভরসা করে বৃথা এত চেষ্টা করাটা অর্থহীন। স্টেশন তো শুনছি এখান থেকে অনেক দূর। তাছাড়া ওই জঙ্গল অন্ধকার
মহিলা হাসেন, জঙ্গল অন্ধকার, এখানের লোকের অভ্যাস আছে মা।
তা হোক, সোনালী দৃঢ়কণ্ঠে বলে, একজনের দোষে আর একজন কষ্ট পাবে কেন? আমি এতক্ষণ ধরে নিষেধ করছিলাম ওঁকে।
দোষ আর কি। দৈবের কথা। গাড়ি-ঘোড়ায় এমন বিপদ তো ঘটেই। শুধু ভগবান রক্ষে করেছেন যে কোনো অ্যাকসিডেন্ট কি ওই রকম কিছু হয় নি। কিন্তু বাড়িতে তো সবাই নিশ্চয় সেই আশঙ্কায় অস্থির হচ্ছেন, যদি কোনো রকমে খবরটা–।
থাক না, হেসে ওঠে সোনালী, হোক না অস্থির, দাম বাড়ক আমার।
তোমার মতো এমন একটি মেয়ের কি আর দাম বাড়বার অপেক্ষা বাছা? মা হেসে ওঠেন, সেরা দামের জিনিস।
নিরু হেসে বলে, আমার সন্দেহ হচ্ছে মা উনি রাগ করে বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছিলেন।
রাখ তোর সন্দেহ। যাক, যদি স্টেশনে না যাবি তো খাওয়া দাওয়া কর। তুমি মা কিন্তু কী ভুল দ্যাখো, তোমার নামটা যে এখনো জিজ্ঞেস করি নি। ভুলটা শোধরাই। বলল শুনি।
নাম! আমার নাম সোনালী।
সোনালী!
হ্যাঁ, সোনালী সেন।
চমৎকার নামটি। উপযুক্ত নাম। আমার এই বাউণ্ডুলে ছেলেটার নাম হচ্ছে নিরঞ্জন। তবে নিরু নামেই বিখ্যাত। কিন্তু ফণী কোথায় গেল? সে কি একাই বাইরের দিকে তাকান তিনি।
আজ্ঞে বড়মা, ফণী ঘরের মধ্যে এসে উঁকি মারে, একা চলে যাবার হুকুম পেলে এতক্ষণ পৌঁছে যেতাম।
আচ্ছা থাক, যেতে আর হবে না তোকে, আয় দিকি, আমায় একটু সাহায্য করে দিবি।
আর যাই হোক, অতিথির প্রতি মন প্রসন্ন নেই ফণীর, তাই ভারী মুখে বলে, আবার এখন রান্না চাপাবে তো?
চাপাব। বড়মা ধমকে ওঠেন তাকে, এখন দুসের চালের ভাত চাপাব। আমার জন্যে ভেবে সারা একেবারে।
সোনালী ক্ষুব্ধস্বরে বলে, দেখুন দিকি আমার জন্যে কী অসুবিধেয় পড়া আপনার। ছি ছি। কিন্তু শুনুন, বৃথা আমার জন্যে কোনো আয়োজন করবেন না, খাবার মত অবস্থা নেই আমার।
কিছু করব না, নির্ভয়ে থাকো তুমি বাছা। এখন এই মিষ্টিটুকু খাও দিকি বলে রেকাবীটা এগিয়ে দিলেন তিনি।
মিষ্টি বললে মিষ্টি। একটু টাটকা ছানা আর চিনি।
সোনালী আর একবার আপত্তি প্রকাশ করে, না, সত্যি না।
তবে থাক-বলে চলে যান ভদ্রমহিলা।
নিরঞ্জন বলে, খেলে পারতেন। বাড়ির গরুর দুধের! খুব সম্ভব এইমাত্র কাটানো হয়েছে।
কি আর করা, জীবনের অনেক জিনিসই মিস করতে হয়, এটাও না হয় করলাম। এই বইয়ের কালেকশান কার? উঠে গিয়ে দেখতে দেখতে বলে সোনালী।
কিছু আমার, কিছু আমার বাবার।
ও। সুনেত্রা দেবী কার নাম?
আমার মার।
মার? আপনার মার নাম? আশ্চর্য তো
কেন, আশ্চর্যের কি আছে? খুব প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড চোখ না থাকলে বুঝি আর তাকে সুনেত্রা বলা চলে না?
ধেৎ, কি যে বলেন! নামটা বেশ আধুনিক-আধুনিক তাই বলছি। বই একটু দেখতে পারি?
নিশ্চয়। আপনিও কি যে বলেন!
সেলফের মাঝখান থেকে এক একখানা বই টানে সোনালী, উল্টোয় আবার রেখে দেয়।
তারপর বসে পড়ে হেসে বলে, পড়তে খুব ইচ্ছে করছে, কিন্তু বিদ্যুতের আলোয় ঝলসানো চোখ অক্ষমতা প্রকাশ করছে!
অভ্যাসের দোষ।
সোনালী আবার ফিরে এসে বসে পড়ে বলে, আপনি আমাকে যে তখন কি ভাবলেন! মনে করে ভীষণ লজ্জা করছে।
লজ্জার কি আছে? চাষাভূষোর মত চেহারা নিয়ে দাঁড়ালে লোকে আর কি ভাববে তাকে? আমার তো মজাই লাগছিল।
মজা! আমি হলে কিন্তু রেগে আগুন হতাম।
সেটা অনুমান করছি।
অনুমান করছেন? কি করে?
সব বিষয়ে অগ্নিশিখার সাদৃশ্য দেখে।
চমকে মুখ তুলে তাকায় সোনালী, তারপর তীক্ষ্ণস্বরে বলে, এ ভাবে প্রশস্তি গাওয়াটা বুঝি আপনার অভ্যস্ত বিদ্যা?
না, কোনো দিন না। নিরঞ্জন গাঢ়স্বরে বলে, এইমাত্র দেখছি বিদ্যাটা আপনিই এসে যাচ্ছে।
কেন?
কি জানি। খুব বেশি অভাবনীয় একটা কিছু ঘটল বলে বোধ হয়। সত্যি স্বপ্নের মধ্যেও এতটা অভাবনীয়তা কল্পনা করা যায় না। আপনার আজকের এই দুর্বিপাক আমার কাছে
কি আপনার কাছে?
কিছু না এমনি।
সহসা দুজনেই কেমন স্তব্ধ হয়ে যায়।
কে জানে কতক্ষণ ছিল দুজনে পরস্পরের দিকে না তাকিয়ে, অথচ কাছাকাছি বসে।
ফণী এসে ডাক দিল, দাদাবাবু, দিদিমণি, মা ডাকছেন।
চলুন।
চলুন!
সহসা অনুভব করে সোনালী, খিদেও পেয়েছে বটে।
ভিতর বাড়িতে নিয়ে যায় ফণী আলো ধরে ধরে।
দেয়াল ভাঙা ভাঙা, কিন্তু মেজেটা পরিষ্কার। নিকানো মাজা মাজা উঠোন, ধারে ধারে ফুলগাছের সারি, ঝিরঝিরে বাতাস, জানা-অজানা নানা ফুলের গন্ধে সে বাতাস অলস আবেশময়।
এই বাতাসে সমস্ত চপলতা স্তব্ধ হয়ে যায়, সমস্ত বাঁচালতা মূক হয়ে যায়। বাড়িটা নতুন চকচকে হলেই বুঝি এই ছন্দে ছন্দপতন হতো।
.
কোথায় যেন চলে এসেছে সোনালী। কোনো পূর্বজন্মের অতীতে। কি যেন এক হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি ধরা-অধরার লুকোচুরি খেলায় উতলা করে তুলছে তাকে। সোনালী কি কিছু হারিয়ে ফেলেছে? সোনালী কি হঠাৎ কিছু পেয়েছে?