৩. তুষার কাপড় বদলাচ্ছিল

১১.

আশাদির ঘরে তুষার কাপড় বদলাচ্ছিল। বাইরের দরজা ভেজানো, ঘরের ভেতর দিকের দরজা খোলা। আশাদি স্নানের ঘরে স্নান করছে, জলের শব্দ ভেসে আসছিল। খোলা জানলার পরদা দিয়ে মধ্যাহ্নের উজ্জ্বল রোদ অনুভব করা যায়। বাইরে একটা ঘুঘু অনবরত ডেকে যাচ্ছে। এই ঘর নিস্তব্ধ। তুষার আঁচলটা গায়ে টেনে নিয়ে বেতের মোড়া টেনে বসল, চুল ঠিক করে নেবে। চিরুনি হাতে উঠিয়ে, আশাদির ছোট আয়নায় নিজের মুখ দেখে তুষার একটুক্ষণ চেয়ে থাকল। তার চোখের সাদা জমির কোণে যেন লালের ছিট লেগেছে। বেশি জল ঘাঁটার জন্যে, নাকি সাবানের ফেনায়, অথবা রোদ লেগে এই লালটুকু হয়েছে, তুষার বুঝতে পারল না। আজ সে খুব জল ঘেঁটেছে, অনেকক্ষণ ধরে স্নান করেছে। মাথাটা কেমন ভাব ধরা-ধরা হয়েছিল সকাল থেকেই, রাত্রে ভাল ঘুম হয়নি। যেন ঘুমের মোটা সর কোনও কারণে দুধের সরের মতন ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছিল। সকালে বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছিল না, বাসের হর্ন শুনে উঠেছে। আজ তার তৈরি হয়ে বেরোতে বেশ দেরি হয়ে গেছে।

চিরুনি বসিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে তুষার অনুভব করল, তার চুল মাথা এখন খুব ঠাণ্ডা। ভাত খাবার পর সমস্ত গা ঘুমের আলস্যে জড়িয়ে ধরবে। ঘুম পাবে খুব।

খাওয়া-দাওয়ার পর ছেলেমেয়েগুলোর খানিকক্ষণ শুয়ে থাকার কথা। যা দস্যি সব, শোয় না, ঘুমোয় না–চুপ করেও থাকে না। কেউ লুডো খেলে, কেউ স্নেক ল্যাডার; নয়তো মাঠে ছুটবে, টেনিস বল নিয়ে ফুটবল খেলবে। আজ ওদের শান্ত করতে পারলে তুষার নিজের ছোট ফালি-ঘরে গিয়ে ইজিচেয়ারে শুয়ে ঘুমিয়ে নেবে একটু।

টেনে টেনে চুল আঁচড়াচ্ছিল তুষার। এলো চুলই থাকবে। একটা গিট দিয়ে নেবে দুপাশের দুগুচ্ছ চুল এনে। রোজই তাই করে। সারা দুপুর বিকেলে চুল শুকোয়, বাড়ি ফিরে তবে বিনুনি বা খোঁপা বেঁধে নেয়।

পুজোর ছুটির জন্যে আজ সকাল থেকেই তুষার কেমন ছেলেমানুষদের মতন কাতর হচ্ছিল, আনমনা হয়ে যাচ্ছিল। পুজো খুব কাছে। আর বুঝি বিশ বাইশটা দিন। এখানে আকাশ যেন অপরাজিতা ফুলের পাপড়ির আগার মতন বেগুনেনীল; কী নির্মল নয়ন জোড়ানো, হালকা তুলোর মেঘ কোথাও কোথাও রোদে গা ভাসিয়ে শুয়ে আছে, রোদের রং সোনার মতন, বর্ষার শেষে গাছপালা মাঠ সবুজ, সবুজে রোদ পড়ে সর্বত্র একটি আভা ঠিকরে উঠেছে। আর এই বাতাস বার বার শরতের সেই সুগন্ধ এনে দিচ্ছে।

তুষার আজ শিশুতীর্থ আসার পথে বাইরে প্রকৃতি দেখতে দেখতে অনুভব করল, তার মন এখন সব দায় দায়িত্ব ভুলে গিয়ে নিভৃত বিরাম চাইছে। প্রত্যহের এই পুনরাবৃত্তি থেকে কিঞ্চিত বিরাম।

আশাদি বারান্দায়, তার গলার আওয়াজ শোনা গেল। মনে মনে কথা বলে আশাদি, অথচ সে কথা উচ্চস্বর হয়ে ওঠে। তুষার শুনল শুনল না,তার কানে ভাসা ভাসা ভাব একটা কথা গেল শুধু, মলিনা…।

সামান্য পরেই আশাদি ঘরে এল। আলগা অগুছালো শাড়িতে আশাদিকে বউ বউ দেখাচ্ছে। আয়নার এক পাশে চোখ করে তুষার আশাদিকে দেখল। তার হাসি পাচ্ছিল, মজা লাগছিল দেখতে।

তোর চুল আঁচড়ানো হল? আশাদি বললেন।

হ্যাঁ। হয়েছে। বলে তুষার আয়না থেকে মুখ সরিয়ে ঘাড় ফেরাল।

গা থেকে শাড়ির আঁচল আলগা করে আশাদি সেমিজের ওপর জামা পরছিল।

আশাদি?

বল।

তুমি রঙিন শাড়ি পরে বাইরে যাও না কেন? তুষার শুধোল।

 হাত গলিয়ে জামা গায়ে পরে নিয়ে আশাদি তুষারের দিকে না তাকিয়ে বলল, সেফটিপিন দে তো৷।

তুষার উঠে নিজের বেতের টুকরি থেকে চাবির গোছা বের করল। চাবির রিঙে দু একটা সেফটিপিন থাকে।

আশাদির হাতে সেফটিপিন দিয়ে তুষার আবার বলল, রঙিন শাড়িতে তোমায় বেশ দেখায়, আশাদি।

জামায় সেফটিপিন আটকে আশাদি মুখ তুলে তুষারকে দু পলক দেখল। চোখের তলায় সকৌতুক হাসি সামান্য। আয়নার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, আমাদের কি রঙিন শাড়ি পরার বয়েস আছে রে! বুড়ি হয়ে গেলাম। নিজের চিরুনি খুঁজে নিয়ে আশাদি চুল আঁচড়াতে বসল।

তার চিরুনিটা পরিষ্কার করে জানলা দিয়ে ওঠা-চুলের গুচ্ছটা ফেলে দিচ্ছিল তুষার। আদিত্যকে দেখতে পেল। রান্নাঘরের দিকে গাছতলায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে মলিনার সঙ্গে। যেমন করে মানুষ রেল স্টেশনের গাড়ি দেখে, সরল কৌতূহলে, তুষার সেই ভাবে আদিত্যদের দেখল। দেখে জানলা থেকে সরে এল।

তোমার যা কথা– তুষার আশাদির বিছানার পায়ের কাছে বসল, সত্যি তুমি রঙিন শাড়ি মাঝে মাঝে পরো, আশাদি। বেশ দেখায়।

কেমন দেখায় শুনি।

আ-হা। কেমন আর? ভাল। তুষার হাসল। বাড়িতে যেমন বউদি-টউদিদের দেখায়।

খুব। আশাদি মোড়া ঘুরিয়ে তুষারের মুখোমুখি বসল, চুল আঁচড়াতে লাগল, তোর দেখি খুব। সাধ।

ওমা, সাধ কীসের। তুষার বোধ হয় সামান্য অপ্রস্তুত, দেখতে ভাল লাগে তাই বললাম।

চুলের প্রান্ত বুকের কাছে এনে জটের বাধা ছাড়াতে ছাড়াতে আশাদি বলল, ভাল লাগলেই কি সব করা যায়! বলে দু মুহূর্ত থামল, আবার বলল, রঙিন পরতে আমার বড় লজ্জা করে রে। পরি না তো। এই ঘরে কাপড়-চোপড় ছাড়তে বা বিকেলে পরতে হয়। ঘরে চলে। বাইরে নয়।

তুষার বুঝে পাচ্ছিল না, ঘরে যদি পরা যায় বাইরে নয় কেন? কীসের বাধা?

আশাদি কী ভেবে বলল, এই শাড়িটাও কি সাধে পরেছি। …কাল বিকেলে মলিনা একটা শাড়ি চাইল। দিলাম বাক্স খুলে। তখনই এটায় চোখ পড়ল। কবেকার কেনা জানিস, দু বছর আগে। বাংলা দেশ ছাড়া এশাড়ি তুই পাবি না। পরতে ইচ্ছে হল খুব। হাজার হোক মেয়েমানুষ তো রে…আশাদি হেসে উঠল, শাড়ির লোভ বড় লোভ। কাল সন্ধেবেলায় পরেছিলাম।

তুষার শুনছিল। মলিনার কথায় আবার তার আদিত্যের কথা মনে পড়ল। এখনও কি ওরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে গাছতলায়? তুষারের ইচ্ছে হল, একবার উঠে গিয়ে দেখে। দেখল না।

চুল আঁচড়ানো শেষ করে আশাদি মুখ মুছে নিল। এখন খেতে যেতে হবে। শাড়িটা বদলে নিলেও চলত, কিন্তু তুষারের জন্যেই যেন, বদলাল না আশাদি; খেয়ে এসে বদলালেই চলবে।

তুষার?

বলো।

একটা কথা বলি তোকে। আশাদি এলো-আঁচলের প্রান্ত কাঁধে উঠিয়ে নিল। জ্যোতিবাবুর আস্কারায় মলিনা যা করছে আজকাল; চোখে লাগে বাপু আমাদের।

কী করছে মলিনা? তুষার তাকাল, তাকিয়ে থাকল অপলকে।

কাল সন্ধের গোড়ায় মলিনা ওই আদিত্যের সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়ে গেল–ফিরল যখন তখন আমরা খেতে বসেছি। কী বিচ্ছিরি লাগে দেখতে বল তো! আশাদি অনুযোগের গলায় বলল।

তুষার যেন কেমন হতবুদ্ধি,হল। কথাটা বুঝেও না-বোঝার মতন করে বসে থাকল। এখানে এসব ছিল না। …আমি বলছি না এতে কিছু মন্দ আছে, তুষার। কিন্তু মানুষের চোখ বলে একটা জিনিস আছে। দৃষ্টিকটু লাগে। লাগত না, যদি ওরা এখানে আশেপাশে কোথাও ঘুরে বেড়াত অত রাত না করত। আশাদি যে বেশ অসন্তুষ্ট, ব্যাপারটা পছন্দ করেনি বোঝা যাচ্ছিল।

খুবই আচমকা তুষার কেমন বিরক্তি অনুভব করল, রাগ হয়তো। বলল, এতে জ্যোতিবাবুর দোষ কোথায়?

দোষ দিচ্ছি না আমি, বলছি। জ্যোতিবাবু মলিনাকে প্রশ্রয় দেন যথেষ্ট। নয়তো এরকম সাহস মলিনার হত না।

মলিনার নিজেরই বোঝা উচিত। তুষার বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বলল।

 কে বুঝবে! কোনও জ্ঞান-গম্যি আছে তার। আশাদি এবার রাগের গলায় বলল, এখানে ওকে দিয়ে কাজ চলে না। সে স্বভাব মন ওর নয়। জ্যোতিবাবু ভাবেন, ওকে তৈরি করে নেবেন। তৈরি হবার মতন মেয়ে ও নয়। সে যোগ্যতা মলিনার নেই। আশাদিও উঠে পড়ল।

চল খেয়ে আসি। বাইরে বেরিয়ে দরজাটা টেনে ভেজিয়ে দিতে দিতে নিচু গলায় আশাদি বলল, আর ওই এক এসে জুড়ে বসেছে। যাবার নাম করে না। …তুই জানিস তুষার, একটা ঘোড়া কোথা থেকে এনে সাহেবদাদুর পুরনো গাড়িটায় জুড়ে গাড়ি হাঁকাবার চেষ্টা করছে। কাল ওই করতে গিয়ে মরত। যত বিদঘুঁটে কাণ্ড!

তুষার নীরব। আশাদির বাড়ির সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে মলিনার ঘরের দিকে তাকাল একবার, দরজা বন্ধ। মলিনা সকালেই স্নান করে নেয়, দুপুরে সে বড় একটা ঘরে আসে না। প্রয়োজন হয় না তার।

বাড়ির নীচে দু পাঁচ পা এগিয়ে একটা গাছ। বেশ বড়, লম্বা লম্বা পাতা। ওরা কেউ নাম জানে না গাছটার। বুনো কোনও বৃক্ষ। …ঘুঘুটা তখনও ডাকছিল। তুষার খাবার ঘরের দিকে তাকাল। ছেলেমেয়েরা খেয়ে-দেয়ে চলে গেছে–ঝি এঁটো ফেলছে। এক খণ্ড দুধের মতন সাদা মেঘ চোখে পড়ল তুষারের। তার এখন আর কিছু ভাল লাগছিল না। অল্প আগে এই শরতের স্পর্শ মনকে হালকা আলস্য লোভী করেছিল। এখন সব বিরস লাগছে। ভাল লাগছে না। রোদের তাত মুখে লাগার মতন গাল কপাল তপ্ত লাগছে। তুষার খাবার ঘরের দিকে হেঁটে চলল।

.

খাবার ঘরে একপাশে মেয়েরা–আশাদি তুষার মলিনা; অন্য দিকে জ্যোতিবাবু প্রফুল্ল আর আদিত্য। মাটিতে বসে খেতে হয়। হাট থেকে কিনে আনা শালপাতার অভাব পড়ে না, পড়ে এনামেলের থালা বাটির। বাচ্চাদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শালপাতা পেতে দিলে তারা খুব খুশি হয়। তুষারদের অবশ্য কাঁসার থালা কিন্তু বাটি গ্লাস এনামেলের।

ওরা পুরুষরা একদিকে মেয়েরা অন্যদিকে বসে খাচ্ছিল। খাবার ঘরের জানলাগুলো হাট করে খোলা, ডালিম গাছটা চোখে পড়ে। সিমেন্ট করা মেঝেতে রোদের আভা আর নেই, ছায়া ছড়িয়ে আছে। ঘরটা নিরিবিলি; একটা কালো ভ্রমর এসে সমস্ত ঘরে গুঞ্জন তুলেছে; কখনও কখনও বাইরে থেকে দাসদাসীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে।

খাবার সময় সচরাচর মেয়েদের তরফে বড় একটা কথা হয় না; বা হলেও কোন খাবারটা কেমন হয়েছে তার জন্যে আশাদিকে হয়তো পুরুষপক্ষ থেকে কিছু বলা হয়। পুরুষদের দিকে মোটামুটি একটা কথাবার্তা থেকে যায়। মেয়েরা হয়তো খেতে খেতে সে কথায় কান দেয় কখনও, কখনও বা দেয় না।

আজ পুরুষদের দিকে আদিত্য অন্য দিনের চেয়েও বেশি কথা বলছিল। তার বলার বিষয়ের অভাব নেই, এবং ঈশ্বর তাকে লজ্জা সঙ্কোচ দেননি। খেতে খেতে আদিত্য ঘোড়ার কথা বলছিল। বলছিল, এ দেশে ঘোড়ার আদর ছিল রাজপুতদের কাছে, মিডাইভাল যুগে। কারণ, সমস্ত রাজপুতনা আর তার আশেপাশেও যে প্রকৃতি–সে-প্রকৃতি রুক্ষ নির্মম। সে মানুষকে বিশ্বাস করেনি, মানুষকে তার মাটিতে বসাতে চায়নি। চিরকাল সে বিমুখ ছিল–বিমুখতাই তার স্বভাব…।

কথাগুলো জোরে জোরে বলছিল আদিত্য, বলতে বলতে তুষারের দিকে তাকাচ্ছিল। আদিত্যর কথা শুনতে ভাল লাগে। তার কথায় সব সময় হৃদয়ের আবেগ থাকে, সে ভাষায় অলঙ্কার দিয়ে কথা বলে, কিন্তু একথা মনে হয় না, এসব বেখাপ্পা, এসব নাটুকে। ফলে আদিত্যের কথা সবাই শোনে। আজও শুনছিল।

রাজপুতরা কেমন করে তাদের প্রতি বিমুখ প্রকৃতিকে জয় করার জন্যে ঘোড়ার ভক্ত হয়েছিল, ঘোড়াকে খাতির যত্ন করতে শিখেছিল, আদিত্য তার এক বিবরণ দিল। বিবরণ দেওয়া শেষ হলে সে রাজপুত রাণাদের ইতিহাস প্রসিদ্ধ ঘোড়ার নামগুলো একে একে বলে গেল। তারপর থামল, থেমে হাসল হাহা করে বলল, আমি এখানকার সব বিমুখতাকে জয় করব। বুঝলেন, জ্যোতি-স্যার, সেই জন্যে একটা ঘোড়া আনিয়েছি।

জ্যোতি-স্যার কথাটা ঠাট্টা করে বলা। এই রকম ঠাট্টা আদিত্য করে থাকে। জ্যোতিবাবু রাগ করে কি? তুষার জানে না। মনে হয় না রাগ করে, রাগ করার মানুষই নয়।

আদিত্যর কথায় প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল বোধ হয়। ইঙ্গিত বলে মনে হওয়ার আরও কারণ, আদিত্য কথা বলতে বলতে প্রায়ই চোখ তুলে তুষারকে দেখছিল। তুষার লক্ষ করেছে।

খাওয়ার পর্ব তাড়াতাড়ি সারতে চাইছিল তুষার। তার ভাল লাগছিল না। আশাদির সঙ্গে কয়েকবার চোখাচুখি হল। মনে হল আশাদি বলছেন, বড্ড কথা বলে ভদ্রলোক; এত বাজে কথা মানুষ বলতেও পারে! তুষার মলিনাকে দেখল নজর করে, মলিনা যেন মুগ্ধ চিত্তে আদিত্যর বক্তৃতা শুনছে। কী বিশ্রী!

আদিত্য ঘোড়ার গল্প শেষ করে বলল, জ্যোতি-স্যার কি কখনও ঘোড়দৌড়ের মাঠে গেছেন?

 জ্যোতি মাথা নাড়ল। না।

রেস-এ বাজি ধরেন কখনও?

না। জ্যোতি হাসি মুখে বলল।

দ্যাটস অ্যান এনজয়মেন্ট! ..খুব থ্রিলিং। আদিত্য বলল, আমি বার দুই তিন গিয়েছি। একবার প্রায় টাকা চল্লিশেক জিতেছিলাম।

চল্লিশ টাকা। মেয়েদের দিক থেকে মলিনা বলল। এমন আচমকা বলল যে, পুরুষরা সকলেই তাকাল। আশাদি এবং তুষার পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। তুষারের মনে হল, মলিনা যেন তাদের এই তরফের আভিজাত্য সম্মান রুচি সব নষ্ট করে দিল।

চল্লিশ টাকা জেতা কিছু নয়… আদিত্য ও-তরফ থেকে বলল, যার লাক ফেবার করে সে চার হাজারও একদিনে জিততে পারে চোখের পলকে। ইট ইজ এ কোশ্চেন অফ লাক!

জুয়া খেলা ভাল না–প্রফুল্ল মিনমিনে গলায় বলল, মানুষে শুনেছি হারে বেশি, জেতে কম।

আদিত্য হেসে উঠল। উচ্চস্বর সেই হাসির কোনও মাথা মুণ্ডু খুঁজে পেল না তুষার। খাবার ঘরটা কি জুয়ার গল্পের আড্ডা হয়ে উঠল! বিরক্ত হয়ে তুষার হাত গুটিয়ে নিল। আশাদিও অসন্তুষ্ট।

মলিনাকেই যা উৎসাহিত দেখা গেল, এই সব গল্প যেন তার খুব ভালই লাগছে।

হাসি থামলে আদিত্য প্রফুল্লকে উপলক্ষ করে সকলকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, আপনি মশাই শিশুশিক্ষার বই-টই লিখুন, বেণীর গল্প গোপালের গল্প-টল্প, বিদ্যাসাগর মশাই মার খেয়ে যাবেন। …যা বললেন একটা কথা, জুয়া খেলা ভাল না, মানুষ হারে বেশি–জেতে কম! …আরে মশাই, সব খেলাতেই হারের আশংকা বেশি, আপনার কথাটাই ভেবে দেখুন না–উইন করছেন নাকি, বেধড়ক হেরে যাচ্ছেন। তবু তো পড়ে আছেন মাটি কামড়ে। জীবনে জেতাটাও ভাগ্য! লেট আস হোপ ফর দি বেস্ট–বলতে বলতে আদিত্য চোখ তুলে তুষারের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকল।

তুষার মাথা তুলতেই সেই চোখ দেখতে পেল। তার অস্বস্তি হল, ঘৃণা হল। কী করে একটা লোক বার বার এভাবে মেয়েদের দিকে তাকায়! তুষার এবার স্পষ্ট গলায় আশাদিকে বলল, আমি উঠছি, আশাদি। অপেক্ষা করল না আর তুষার, এঁটো কুড়িয়ে নিয়ে উঠল পড়ল। জ্যোতিবাবু যে তার দিকে তাকাল, তুষার দাঁড়িয়ে ওঠার পর তা লক্ষ করল।

.

দুপুরের আলস্য গভীর করে জড়িয়ে ধরেছে তুষারকে। নিজের ক্লাস-ঘরের কুঠরিতে ক্যাম্বিসের চেয়ারে সে শুয়ে আছে। সামনে ফালি জানলা। শরতকালের এই দুপুর এখানে কী জারকে যেন জরে যাচ্ছে। সামনের মাঠটুকুতে ছায়ার কাপড় যেন শুকোতে দেওয়া হয়েছে, এক ছায়া থেকে অন্য ছায়ার মধ্যে রোদ, দুপুরের রোদ বলেই প্রখর, মৃদুমন্দ বাতাস বইছে, আর সম্মিলিত পক্ষীকুলের বিচিত্র শব্দ কখনওঁ নিকটে কখনও দুরান্ত থেকে ভেসে আসছে। পড়ার ঘরে ছেলেমেয়েগুলো খেলছে হয়তো, খেলা শেষ হলে আজ পাঁচটা ধাঁধাঁ করবে। ধাঁধাঁগুলো তুষার ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে দিয়ে এসেছে। এই ধাঁধার মধ্যে একটা বানান সংক্রান্ত, একটা মহাভারতের, একটা ভূগোলের, আর বাকি দুটো অঙ্কের। ছেলেমেয়েরা খুব ভালবাসে এই ধাঁধা। তুষার জানে ধাঁধার খেলা নিয়ে এক দেড় ঘণ্টা ওরা অনায়াসে কাটিয়ে দেবে। গোলমাল করবে না, বাইরে পালিয়ে যাবে না।

ক্যাম্বিসের চেয়ারে শুয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তুষার চোখের পাতা ক্রমে ছোট করে আনছিল, যেন কপালের কোথাও আলস্যজাত ঘুমের কাজল আছে, চোখের পাতায় ছুঁইয়ে নিতে পারলেই চোখ জুড়ে যাবে। ভাল লাগছিল ওর, শরীরের প্রতি অণু এই মধ্যদিনের পুঞ্জিত বিশ্রামের মধ্যে শিথিল হয়ে আসছিল।

তুষার ছুটির কথা ভাবছিল। পুজোর ছুটি যেন এখন থেকেই নেশার মতন টানছে। যত তাড়াতাড়ি ছুটি হয়, ততই ভাল। তুষার জানে না, সেই ছুটি কেন তার এত কাম্য। তবু মনে হচ্ছে ছুটিটায় সে বিশ্রাম নেবে, এই প্রাত্যহিক কর্ম থেকে বিরতি, একটানা কাজ থেকে খানিক ছুটি।

নিজেকে তুষার বাস্তবিক আজ কদিন ক্লান্ত অনুভব করছে। তার এমন চিন্তা–এই ক্লান্তি অনুভব আগে কখনও আসেনি। শরীর হয়তো ক্লান্ত লেগেছে, সে ক্লান্তি পরিশ্রমের, আসা যাওয়ার, দায় দায়িত্ব পালনের। আজকাল যে ক্লান্তি অনুভব করছে তুষার–তা শরীরের, ঠিক শরীরজাত নয়, পরিশ্রমের জন্যেও নয়। মনের কোথাও যেন একটা ভাল না লাগার ভাব। উদাস ও অবসন্ন হওয়ার শূন্যতা বোধ করছে। কেন? এরকম কেন লাগছে তুষারের? তার শরীর কি ভাল যাচ্ছে না!

তন্দ্রায় চোখ জড়িয়ে তুষার ঘুমিয়ে পড়ছিল। আচমকা গলা শুনে চোখ খুলল তুষার। তার জড়তার মধ্যে আদিত্যকে দেখল। দেখেও যেন মনে করতে পারল না, ওই লোকটা সামনে দাঁড়িয়ে আছে, ঘুমের চোখে তাকাল, আবার পাতা বুজল।

বাঃ, দিব্যি ঘুমোচ্চন তো! আদিত্য বলল।

তুষার ঘুমের বোজা চোখে ঠোঁটে যেন হাসল, ফিক করে। সে দেখছিল না।

 মেয়েরা দুপুর বেলায় খানিক গা গড়িয়ে নেয় তা হলে–সে যেই হোন। আবার বলল আদিত্য।

চোখ মেলল তুষার। ফালি জানলার ওপাশে আদিত্য দাঁড়িয়ে আছে। ডান হাতের আঙুলে চোখের পাতা বুলিয়ে তুষার আবার দেখল। আদিত্য। তা হলে তন্দ্রায় বা ঘুমের জড়তায় নয়, সত্যিই আদিত্যকে সামনে দেখছে তুষার। সঙ্গে সঙ্গে গায়ের কাপড় ঠিক করে ক্যাম্বিসের চেয়ারের ওপর সোজা হয়ে, পিঠ উঁচু করে নিয়ে বসল তুষার। পায়ের দিকের কাপড় গুছিয়ে টেনে নিল। চোখের দৃষ্টিতে বিরক্তি ফুটল।

আপনি! তুষার গলা তুলতে পারল না।

 দেখতে এলাম আপনাকে। আদিত্য বলল, মুখে সেই হাসি, তুষার যে-হাসি অপছন্দ করে।

 কথাটা কানে কটু শোনাল তুষারের। অভদ্র!

আপনি কী মনে করেন? তুষার খুব অপ্রসন্ন হলেও রাগ যথাসম্ভব সংযত করে বলল। বলে তিরস্কারের চোখে চেয়ে থাকল।

আদিত্য জানলার কাছে আরও সরে এল দু পা-খাঁচায় বন্দি কোনও প্রাণীকে কৌতূহলে সকৌতুকে দেখছে–এমন চোখ করে দেখল সামান্য সময়। বলল, আমি কিছুই মনে করতে পারছি না। আপনি বড় অদ্ভুত পদার্থ!

অদ্ভুত!

রাগ করে খাওয়ার ঘর থেকে উঠে এলেন কেন? আদিত্য স্পষ্ট গলায় জানতে চায়।

তুষার দু মুহূর্ত দেখল আদিত্যকে, চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, রাগ! কীসের রাগ?

কী করে জানব। তবে আপনার মুখ দেখে মনে হল না আমার ওপর যথেষ্ট অনুরাগ দেখিয়ে উঠে এলেন।

তুষারের কানে শব্দটা ভাল শোনাল না। মনের মধ্যে যেন কাঁকর পড়েছে–অনুরাগ শব্দটা সেই ভাবে অস্বস্তি জাগাল। বিরক্তস্বরে ও বলল, আমার খাওয়া হয়ে গিয়েছিল।

বাজে কথা বলছেন কেন!

বাজে কথা!

আমার ওপর আপনার এত বিতৃষ্ণা কেন বলুন তো তুষার দিদিমণি–আদিত্য হাস্যকর গলা করে বলল, যেন সত্যিই সে একটা কথা সরাসরি জানতে চাইছে।

তুষার জানলা দিয়ে তাকাল। আদিত্য প্রায় সবটুকু জানলাই জুড়ে নিয়েছে। ওপাশের মাঠ বা গাছ আর দেখা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে না জ্যোতিবাবুর ঘরের বাইরের অংশ। কে কোথায় রয়েছে এখন, কে দেখছে, যদি তুষারের ঘরের সামনে আদিত্যকে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কী ভাববে ইত্যাদি চিন্তায় তুষার অস্বস্তি বোধ করল, বিব্রত হল।

বিতৃষ্ণা সতৃষ্ণার কথা নয়–তুষার চোখ নামিয়ে বলল, এখন বিশ্রামের সময়, আমি বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। আপনি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন না দয়া করে…, এটা–তুষার কথা শেষ করতে পারল না।

আদিত্য গ্রাহ্য করল না। বরং আরও যেন দৃষ্টিকটু কাণ্ড করল, জানলার কাণা ধরে দাঁড়াল। সদা সত্য কথা বলিবে। কাহাকেও প্রবঞ্চনা করিবে না। …আপনি সাদামাটা সত্যি কথাটা বলে ফেলুন না, ঝঞ্ঝাট চুকে যায়।

কী বিরক্তিকর! মানুষটা কি কানে তুলো গুঁজে গায়ে গণ্ডারের চামড়া দিয়ে থাকে। কেন তুষারকে ও বার বার এমন করে অপ্রসন্ন বিরক্ত করে তুলতে চায়। ভাল লাগে না তুষারের সহ্য হয় না। বিশ্রী লাগে তুষারের, গায়ে যেন জ্বালা করে, মনে ঘৃণা আসে। তুষারকে কি ও তার পরিহাসের পাত্রী পেয়েছে?

আপনি এখান থেকে যান। তুষার শক্ত গলায় বলল। এটা গল্পগাছা করার জায়গা নয়।

 কেউ দেখবে এই ভয় বোধ হয় আপনার!

 দেখতে পারে।

দেখলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?

আমি পছন্দ করি না।

 আমায় যে কেন আপনার এত অপছন্দ আমি বুঝে উঠতে পারি না। আমি আপনার কোনও ক্ষতি করিনি। …হোয়াই শুড ইউ হেট মি? হোয়াই? অ্যাম আই এ লোফার? …কী, ব্যাপারটা কী? সরাসরি মন খুলে বলে দিন।

আদিত্য এমন ভাবে জানলার মধ্যে ঝুঁকে পড়ল যে, তুষারের মনে হল ও বোধ হয় গলে আসবে ফোকর দিয়ে। আসা কিছু অসম্ভব নয়, জানলাটায় গরাদ নেই, দু পাট খড়খড়ি শুধু। আর আদিত্যর পক্ষে সব সম্ভব। তুষার আরও বুঝল আদিত্য সত্যিই আহত হয়েছে, রেগেছে।

কী বলবে ভেবে পেল না তুষার। মাথায় কোনও আপাতবুদ্ধি আসছিল না। সঙ্কুচিত আড়ষ্ট ভাব নিয়ে তুষার শরীরটাকে চেয়ারের পিছু দিকে টেনে নিল। বলল, ছেলেমানুষি করবেন না। …আমায় এবার উঠতে হবে।

উঠেই দেখুন, একটা কেলেঙ্কারি করব।

মানে?

চেঁচাব।

 চেঁচাবেন–

চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সুর করে কবিতা আওড়াব। আপনার ঘরের সব ছেলেমেয়েকে যদি বাইরে বের করে আনতে না পারি তো কি! জাস্ট লাইক দি পাইপপাইপার অফ হ্যাঁমেলিন। আমি বাঁশি বাজাতে বাজাতে যাব, আপনার ছেলেমেয়েরা নেংটি ইঁদুরের মতন নাচতে নাচতে আমার সঙ্গে যাবে। …দেখতে চান? আমি পারি।

আদিত্য এমন ভাবে তাকিয়ে থাকল যেন সে তুষারের সঙ্গে এই নিয়ে একটা বাজি ধরতে চাইছে। তাকে খুব নিঃসন্দেহ দেখাচ্ছিল।

না, থাক। তুষার বিশ্বাস করল না এই পাগলকে। হয়তো পারবে না, হয়তো পারবে। পারুক না পারুক একটা দৃষ্টিকটু ব্যাপার ঘটবে যে তাতে তুষার নিঃসন্দেহ।

আদিত্য বিজয়ীর মতো হাসল। বলল, তবে বসুন। এমন কিছু দেরি হয়ে যায় নি। এখন মাত্র দেড়টা। হাতের ঘড়ি দেখল আদিত্য, দেখাল।

তুষার ভিজে চুলের গোছাটা পিঠে সরিয়ে দিল। কী বিপদেই পড়া গেল! এ মানুষ কেমন, তাড়ালে যায় না, বিরক্তি দেখালে গ্রাহ্য করে না, অপমান করলে মাখে না। আচ্ছা, ওকে কি সত্যি রূঢ়ভাবে অপমান করে দেখবে একবার তুষার, কী হয়! ও গায়ে মাখে কি মাখে না। তুষার চোখ তুলল, দেখল আদিত্যকে, কিছু বলতে পারল না। বলতে ইচ্ছে করল না।

দেখুন দিদিমণি আদিত্য পরিহাস করে বলল, আমি স্ট্রেট ব্যাপারটা পছন্দ করি। যা করব পরিষ্কার। লুকোচুরি, মুখ আড়াল করে কথা বলা, আই হেট ইট। …সরাসরি বলে ফেলুন তো, আপনার চক্ষুশূল হবার মতন কারণটা কী ঘটিয়েছি?

তুষার এই বিপদ থেকে আপাতত মুক্তি পেতে চায়। চায় বলেই কথা বাড়াবে না, মানুষটাকে শাসাবে, বরং কেমন যেন আপোস করার ভাবই ভাল দেখাবে। তুষার অপ্রসন্নতা মুছে নেবার চেষ্টা করে বলল, কী যা তা বলছেন আপনি! কীসের চক্ষুশূল!

তবে?

কী তবে!

 আমার সঙ্গে এরকম দুর্ব্যবহার কেন?

আমি কোনও দুর্ব্যব্যহার করিনি। কেনই বা করব! ..এখানে আপনিও যা আমিও তাই।

পাগল। আদিত্য ঘোরতর প্রতিবাদের ভান করল, আমি আউটসাইডার। আপনি ভেতরের লোক। আমার কাজ ভাঙার, লণ্ডভণ্ড করার আপনার কাজ…কী বলে যেন…আপনার কাজ রক্ষণের, লালনের পালনের-আদিত্য টেনে টেনে বলল, পরিহাসের গলায়।

আপনি কি নিজেকে কালাপাহাড় ভেবে খুশি হন। তুষারের গলার স্বর তার অজান্তে নরম কোমল ও সরস হয়ে এসেছিল।

না। আমি নিজেকে কালাপাহাড় ভাবতে চাই না। লোকে আমায় ভেবে নেয়।

অন্যায় করে?

বোধ হয়। আদিত্য অন্য দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক গলায় বলল। চুপ করে থাকল দু মুহূর্ত, আবার বলল, আমার চরিত্রে অনেক দোষ আছে, না কি বলুন?

তুষার আবার অস্বস্তি বোধ করল! হ্যাঁ, আছে। কিন্তু তুষার কি তাই বলবে না কি! পাগল! কেউ কি বলে তা! কথাটা এড়িয়ে যাবার জন্যে তুষার বলল, ওসব কথা থাক। এখানে–

বলা যায় না বলছেন? বেশ তা হলে বাড়িতে যাব।

 বাড়ি! তুষার অস্ফুট গলায় বলে ফেলল।

 বারণ করছেন যেতে?

 না, না। সে কী…! তুষার তীর ছাত্রীদের মতন বিপর্যস্ত বোধ করে ঢোঁক গিলল।

তা হলে কাল যাব। …আদিত্যর গলা সরল, আজ একবার ঘোড়াটাকে গাড়িতে জুতে ট্রায়াল দিতে হবে। সাংঘাতিক বদমাস ঘোড়া! বাট, আই উইল মেক দ্যাট অ্যানিমাল বিহেভ প্রপারলি।

বলতে বলতে আদিত্য বোধ হয় ঘোড়ার চিন্তায় অন্যমনস্ক হয়ে জানলা থেকে সরে গেল। চলে গেল লম্বা লম্বা পা ফেলে।

জানলাটা এতক্ষণ আদিত্যর শরীরে আড়াল হয়ে ছিল। ও চলে গেলে আবার মাঠ ঘাস গাছ দেখা গেল। দ্বিপ্রহরের রৌদ্র চোখে পড়ল। চোখে পড়ল একটা হরিয়াল পাখিও।

তুষার জানলা দিয়ে তাকিয়ে অনুভব করল, সে অনেকক্ষণ যেন নিশ্বাস বন্ধ করে ছিল। বুক ভারী লাগছে। দীর্ঘ করে নিশ্বাস ফেলল।

.

১২.

বাড়ির বারান্দার কাছাকাছি আসতেই চমকে উঠল তুষার। আতাগাছটার পাশে সাইকেল। হেলান দিয়ে রাখা সাইকেলটার দিকে তাকিয়ে তুষার আর পা বাড়াতে পারল না। আদিত্য তা হলে এখনও অপেক্ষা করছে।

ভয় হল তুষারের। বাড়ির বাগানটা ছোট, গাছপালা প্রচুর নয়; চারদিকে সতর্ক চোখে তাকিয়ে আদিত্যকে খোঁজার চেষ্টা করল। তার ভয় হচ্ছিল; মনে হচ্ছিল, কোনও গাছপালার আড়াল থেকে আচমকা বেরিয়ে এসে আদিত্য তার সামনে দাঁড়াবে, বলবে–এই রকম অভদ্রতা কেন, আমায় আসতে বলে বাড়ি থেকে পালানো?

বাগানে কোথাও নেই আদিত্য, বারান্দাতেও নেই। তবে কোথায় গেল? চলে গেছে! চলে যাবে যদি তবে সাইকেল পড়ে থাকবে কেন? তা হলে কি তুষারকে না পেয়ে সাইকেল রেখে অন্য কোথাও ঘুরে আসতে গেছে? বোধ হয় তাই। আবার আসবে আদিত্য।

সামান্য সময় লেবুগাছের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে তুষার পা পা করে বারান্দার দিকে এগিয়ে চলল। আদিত্য আসবে জেনেও সে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। তুষার আশা করেছিল, বাড়ি এসে তাকে না পেয়ে আদিত্য ফিরে যাবে। ক্ষুণ্ণ হবে, রাগ করবে। তা হোক ক্ষুণ্ণ, তুষারের কিছু আসে যায় না। পরে দেখা হলে বলবে, আমায় একটা জরুরি কাজে বাইরে যেতে হয়েছিল, কিছু মনে করবেন না।

প্রকৃতপক্ষে তুষার চায়নি, আদিত্য তার বাড়ি এসে আবার জ্বালাতন করুক। ওর উৎপাত সহ্য করা উচিত না; প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে। এই ধরনের মানুষকে একটু প্রশ্রয় দিলেই তারা মাথায় ওঠে। বাস্তবিক, আদিত্যকে ছেলেমানুষ বা পাগল ভেবে নিতান্ত ভদ্রতা করে যেটুকু সহানুভূতি দেখিয়েছে তুষার তার পরিণাম এখন বিশ্রী হয়ে উঠেছে! সামলাতে পারছে না তুষার। আদিত্য যেন পেয়ে বসেছে।

ইচ্ছে করে, জোর করে, আদিত্যকে দূরে সরাবার মতন কারণ তৈরি করার অন্যতম উপায় হিসাবে আজ তুষার বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সে জানত, আসব যখন বলেছে তখন আদিত্য আসবেই আর এলে সহজে মুক্তি দেবে না, লক্ষটা কথা বলবে জ্ঞানহীনের মতন। এমন অদ্ভুত কোনও অনুরোধ করে বসবে যা করা অশোভন, অযথা অনর্থক তুষারকে ক্রমাগত বিরক্তিকর অবস্থার মধ্যে টেনে নিয়ে যাবে। …

যারা অন্যের সহ্য অসহ্য বোঝে না বুঝতে চায় না, যারা জানে না অন্যেরও ভালমন্দ লাগা আছে, ছোঁয়া পেলে আঠার মতন জড়িয়ে থাকতে চায়, ফুটে যাওয়া কাঁটার মতন যন্ত্রণা দেয় তাদের কাছ থেকে রেহাই পেতে হলে এ ছাড়া আর কী পথ আছে ওই এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া, দূরে দূরে সরে থাকা বই?

কিন্তু, মানুষটা গেল কোথায়? তুষার বারান্দার সিঁড়িতে গিয়ে দাঁড়াল। চারপাশে তাকাল আবার, ভাল করে দেখল।

এমন তো নয়, তুষার ভাবল, আদিত্য চলেই গেছে, শুধু তুষারকে বিব্রত করতে ভয় দেখাতে সাইকেলটা রেখে গেছে? হতে পারে; কিছুই আশ্চর্য নয়। বরং, তুষারের মনে হল, বরং আদিত্যর যা স্বভাব তাতে এই রকম বিশ্রী কিছু করাই তাকে মানায়। সে তোমায় উদ্বেগে রাখবে, দুশ্চিন্তা যাতে জিইয়ে থাকে তার চেষ্টা করবে, তোমায় ভীত ব্যস্ত পীডিত করবে, ওতেই ওর আনন্দ।

কয়েক দিন আগে সেই রাত্রে আসব বলে শাসিয়ে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে ভাবতে তুষার দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘরের মধ্যে পা বাড়াল।

ঘর থেকে বারান্দা। রান্নাঘরে বাতি জ্বলছে। গঙ্গা রান্না নিয়ে ব্যস্ত। বারান্দার একপাশে মিটমিটে বাতি। অন্ধকারে ডুবোনো দাওয়ায় দড়ির ওপর তুষারের ভিজে শাড়ি বাতাসে দুলছে। তুষার দু মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল, উঁচু মুখে আকাশ দেখল, তারার প্রশ্ন চিহ্নটা একেবারে চোখের সামনা সামনি।

গঙ্গাকে ডাকবে ভেবেছিল তুষার। না ডেকে শিশিরের ঘরের দিকে পা বাড়াল। শিশির বলতে পারবে, ওই মানুষটা কখন এসে ছিল? বাইরে থেকে চিৎকার করে কিছু বলে গেছে কিনা!

শিশিরের ঘরে পা দিয়ে তুষার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। না এগুতে না পিছিয়ে আসতে পারল। চোখের পাতা স্থির, অপরিসীম এক বিস্ময় তাকে বিমূঢ় করেছে। শিশিরের বিছানার ওপর দাবার ছক বিছানো, লণ্ঠনটা জানলার ওপর, দুজনে, গালে হাত দিয়ে দাবার চাল ভাবছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভুলে। আদিত্যর পিঠ দরজার দিকে।

তুষার এতটা প্রত্যাশা করেনি, কল্পনাও করেনি। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় শিশিরকে তার পালাবার কারণ পর্যন্ত না, বলেছিল আমি সুষমা বউদিদের বাড়ি যাচ্ছি রে, দরকার আছে! ফিরতে দেরি হবে।

দেরি হওয়ার কথাটা বলেছিল এই জন্যে যে, যদি আদিত্য খোঁজ নেয়, জানতে পারবে তুষারের ফেরার দেরি আছে, অপেক্ষা করবে না। অথচ তুষারের সমস্ত অভিসন্ধি আদিত্য ব্যর্থ করল।

এই বা কী রকম? আলাপ পরিচয় নেই শিশিরের সঙ্গে, তবু একটা বাইরের লোক সদর থেকে অন্দরে ঢুকে দিব্যি দাবা খেলছে বসে বসে। কোনও গা নেই, গ্রাহ্য নেই, সঙ্কোচ নেই। শিশিরই বা ওকে কেন ঘরে আসতে দিল!

তুষার একবার ভাবল, যেমন নিঃশব্দে সে এসেছে তেমনি নিঃশব্দে সে চলে যায়। আবার বাইরে, বাড়ি ছেড়ে কাছাকাছি কারও বাড়ি গিয়ে বসে থাকে। যদি রাত দশটা বাজে বাজুক, এগারোটা বেজে যায় তাতেও ক্ষতি নেই, আদিত্যকে দেখা না দিয়ে সে ফিরিয়ে দেবে। কতক্ষণ বসে থাকবে আদিত্য, কত সময় সে অপেক্ষা করতে পারবে।

এখন কটা? আটটা বেজে গেছে বোধ হয়। তুষারের মনে হল, সে নিজেই বোকামি করেছে। তার আরও বেশিক্ষণ বাইরে থাকা উচিত ছিল। অথচ, বাইরে কেমন যেন সময় দীর্ঘ ও গত মনে হল, মনে হল রাত হয়ে গেছে, বাড়ি ফেরার ইচ্ছে ক্রমাগত তাকে অন্যমনস্ক করতে লাগল, সে ফিরে এল।

তুষার দুপা এগিয়ে এল। পালিয়ে গিয়ে লাভ নেই। আদিত্য, বলা যায় না সারারাতই বসে থাকতে পারে।

গলায় শব্দ করল তুষার। শিশির নৌকো চালতে ব্যস্ত, চোখ তুলল। দিদি। বলল ওই যা, আবার চাল দিতে চোখ নামাল।

আদিত্য যেমন বসেছিল তেমনি, মুখ ঘাড় ফেরাল না। তুষার অবাক হল।

তুষারের আবির্ভাব ওদের দুজনকে বিচলিত বা অব্যবস্থচিত্ত করতে পেরেছে এমন লক্ষ্মণ কোথাও দেখা গেল না। পায়ের মাপ আরও একটু বাড়াল তুষার, জানলার পাশে চায়ের কাপ পড়ে আছে, বোঝ দায়-দাবা–দাবা খেলার শুরুতে বা মধ্যে শিশির অতিথি আপ্যায়ন করেছে। তবে কি শিশিরই অতিথি বৎসল হয়ে আদিত্যকে ডাকিয়ে এনে ঘরে বসিয়েছে? শিশিরের ওপর রাগ হচ্ছিল তুষারের। সে যাকে এড়িয়ে যেতে চায় শিশির তাকে আদর করে ঘরে ঢোকায়। বাঁদর কোথাকার! কী বিশ্রী কাণ্ডটা বাঁধাল শিশির!

আদিত্য বিড় বিড় করে কী বলল আপন মনে, একটা চাল দিল, দিয়ে মাথা চুলকোল। এবং পরের চাল ভাববার জন্যেই সিগারেট ধরাল।

রাগ হচ্ছিল তুষারের। কেন হচ্ছিল সে জানে না। দাবা খেলার জন্যে, নাকি তার দিকে কারও ক্ষেপ নেই দেখে! আদিত্য কি এখনও খেয়াল করতে পারছে না, তুষার ঘরে এসেছে?

ইচ্ছে করেই, যেন আদিত্যকে তার দাবার নেশা থেকে অন্যমনস্ক করে দেবার জন্যেই তুষার বিছানার মাথার দিকে–শিশিরের পাশে এগিয়ে গেল। কখন এলেন?

আদিত্য ঘাড় ফিরিয়ে দেখল তুষারকে। এই যে! এসেছেন তা হলে!

তুষার এমন ভাবে তাকাল, যার অর্থ সে বলতে চাইছে, মানে–তা হলে এসেছেন মানে কী?

শিশির আদিত্যর রাজা বেঁধে ফেলেছে। বলল, এবার সামলান।

আদিত্য দাবার ছকের দিকে তাকাল। তাকিয়ে থাকল কয়েক দণ্ড। বলল, হেরে গেলাম, ভাই। বলে হাত বাড়িয়ে শিশিরের হাতে চাপ দিল।

হাসল শিশির। বলল, আপনার দুটো চাল আমার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। অনেক কষ্টে সামলেছি।

আমি সেই কবে খেলেছি, চাল-ফাল ভুলে গেছি। তা ছাড়া ওই কনসেনট্রেসন–ওটা আর হয় না।

 তা হলেও পাকা খেলোয়াড়ের মতন খেলেছেন।

আদিত্য অট্টহাস্যে হাসল।

 শিশির দিদিকে বসতে দিচ্ছে এমন ভাব করে সামান্য সরে গেল। তুষার বসল না।

আদিত্য এবার তুষারকে ভাল করে দেখল। তারপর হাতঘড়ি দেখে বলল, সাড়ে ছটায় এসেছি, এখন আটটা কুড়ি৷ খুব লোক আপনি।

তুষার চোখে চোখে তাকাল আদিত্যর, লহমার জন্যে চোখ ফিরিয়ে শিশিরের দিকে রাখল। এক জায়গায় যেতে হল, দরকারি কাজ ছিল একটা। …বলে তুষার সামান্য থামল, শিশিরের সামনে সমস্ত ব্যাপারটাকে সে শালীন স্বাভাবিক করতে চাইল, অনেকক্ষণ বসে আছেন তা হলে–অপরাধ মার্জনা করুন গোছের ফিকে একটু হাসি টানল মুখে। সময় ভালই কাটছিল দেখলাম!

ভালই। আদিত্য জবাব দিল। আমায় কখনও বড় একটা জলে পড়তে হয় না। কথা শেষ করে আদিত্য চোখের তারা এবং পাতায় যে ভাব দেখাল তাতে মনে হল, আদিত্য যেন বলছে, আমি এসব গ্রাহ্য করি না।

হয়তো আদিত্য তার ইচ্ছাকৃত অনুপস্থিতি বুঝতে পেরেছে, তুষার ভাবল। ভাবল, যদি বুঝে থাকে তবে বসে ছিল কেন? কেন ও ক্ষুব্ধ হচ্ছে না? অপমান বোধ করছে না?

আপনার ভাইয়ের সঙ্গে অনেক গল্প হল। আদিত্য বলল, শিশিরের দিকে সস্নেহের চোখে তাকাল, আমায় গান গাইতে বলছিল।

গান! অস্ফুটে বলল তুষার, প্রথমে আদিত্য পরে শিশিরের দিকে তাকাল।

সেই যে– শিশির হেসে দিদিকে সেদিনের কথা মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করল, আমি পথ ভোলা এক পথিক… আমি বলছিলাম, আপনার গান শুনেছি সেদিন, আপনাকে দেখিনি; আজ দেখলাম। বললাম একটা গান করুন, গলা ছেড়ে; গাইলেন না। শিশির হাসছিল।

তুষার এই হাসি, এই জলের মতো সাধাসিধে অন্তরঙ্গতা পছন্দ করছিল না। শিশিরের কাণ্ডজ্ঞান বড় কম। আদিত্যর কোনও কাণ্ডজ্ঞানই নেই। কী ভেবেছে লোকটা? শিশুতীর্থ থেকে বাড়ি, বাড়ি থেকে অন্দরমহল, ও কি ভেবেছে পা বাড়ালেই সব দরজা খুলে যাবে! না। দরজা খুলবে না।

মনে মনে ছটফট করলেও কিছু বলতে পারছিল না তুষার। শিশিরের কাছে দৃষ্টিকটু হয় এমন কিছু করা, শ্রুতিকটু হয়–এমন কিছু বলা যায় না। বিছানার মাথার দিকে অকারণে ঝুঁকে চাদরটা ঠিক করে হাতে হাতে ঝেড়ে দিল।

একদিন তোমায় একটা ইংরিজি গান শোনাব। আদিত্য হেসে বলল শিশিরকে লক্ষ করে।

ইংরিজি?

খুব ভাল গান। …আই ওয়াক অ্যালোন…অ্যালোন, মাই ওয়ে ইজ…কথাটা শেষ না করেই আদিত্য তুষারের দিকে তাকিয়ে বলল, ও হো, আপনাকে বলিনি খবরটা। কাল ঘোড়া জুতে গাড়িটা চালিয়েছি।

কার গাড়ি! শিশির অবাক হয়ে শুধোল।

ওঁদের সাহেবদাদুর। ভাঙা জঙ্গলের মধ্যে পড়েছিল, গাড়িটা ঠিক করলাম ঘোড়া জোগাড় করলাম–তারপর কাল ট্রায়েল দিলাম। …এখনও বেশ রাফ রয়েছে ঘোড়াটা, আরও°ট্রেইন করতে হবে। …এক দিন তোমায় বেড়াতে নিয়ে যাব। টমটমে চড়ে বেড়ানো একটা প্লেজার। আদিত্য উঠল। শিশিরের হাতে হাত দিয়ে বলল, চলি ভাই। আবার দেখা হবে।

আদিত্য আগে পিছু পিছু তুষার ঘরে ছেড়ে চেলে গেল।

বাইরে এসে আদিত্য বলল, আমার ভয়ে আপনি পালিয়ে গিয়ে বসেছিলেন।

তুষার বারান্দার সিঁড়িতে, আদিত্য শেষ ধাপে নেমে দাঁড়িয়েছে। দেখল না তুষার, চোখ মুখ তুলে তাকাতে তার অস্বস্তি হচ্ছিল। নিচু গলায় বলতে গিয়ে কথাটা ঠিক মুখে আনতে পারল না।

আদিত্য বাগানে নামল। তার পায়ের চাপে কাঁকরে শব্দ উঠিল। এ ধরনের লুকোচুরি খেলা আমার ভাল লাগে না।

লুকোচুরি! তুষারের স্বর অস্পষ্ট।

আমাকে আপনি সহ্য করতে পারেন না।

কই, না! তুষার এমন একটা অবস্থার মধ্যে পড়বে জানলে বাড়ি ফিরত না, আরও রাত করত; অনেক রাত।

ন্যাকামি করছেন কেন! আদিত্য ক্ষুব্ধ, সামান্য উত্তেজিত। তুষার বুঝতে পারছিল। আদিত্যর সন্দেহ নেই, তুষার আর পাঁচটা মেয়ের মতন ন্যাকামি করছে। তুষারের দিকে তাকিয়ে তিক্ত গলায় আদিত্য বলল, আপনার অত ভয় কীসের! সত্যি কথা বলতে আটকাচ্ছে কেন?

তুষার অসন্তুষ্ট। তার রাগ হচ্ছিল। এই মানুষটা কী ভাবে তাকে? ভদ্রতাকে সে ভয় ভাবে, শিষ্টতাকে ন্যাকামি? তুমি কে, কী তোমার ব্যক্তিত্ব যে তুষার তোমায় ভয় পাবে!

আজ একটা পরিষ্কার বোঝাপড়া হয়ে যাওয়া ভাল। রোজ ওর গায়ে পড়া ঘনিষ্ঠতা তুষারের ভাল লাগে না, ভাল লাগে না জোর জবরদস্তি, ইচ্ছাকৃত অবিবেচনা।

মানুষকে বিরক্ত করা, উত্যক্ত করা আপনার স্বভাব। তুষার চাপা রাগে বলল।

আপনাকে আমি উত্যক্ত করি?

করেন কি না করেন আপনি জানেন।

না। আমি জানি, আপনাকে আমার ভাল লাগে।

 রাগে তুষারের কপালের শিরা টাটিয়ে উঠল। কেমন করে কথা বলছে ও? তুষার কি তার…

আমাকে, আপনি সহ্য করতে পারেন না, কিন্তু আপনাকে আমার খুব ভাল লাগে। আদিত্য আবার বলল। কোনও সংকোচ নেই, স্বরে একটু সুরও নেই।

কী লাগে না লাগে আমার শুনে লাভ নই। আপনি যদি ঠিক মতন কথা বলতে না পারেন কথা বলবেন না। তুষারের গলায় যেন কেউ শান দিয়ে মরচে তুলে ক্রমশ ধার ফুটিয়ে আনছে।

আপনি অত অসহিষ্ণু কেন?

সহিষ্ণু হবার কোনও দরকার নেই আমার।

তা হলে এবার স্পষ্ট করেই বললেন–আদিত্য মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তুষারের দিকে তাকাল। ইউ হেট মি…ঘেন্না করেন!

তুষার নীরব। তার ইচ্ছে হচ্ছিল, সোজা ঘরে চলে যায়। যাচ্ছিল না, যদি এখানে আজ একটা নিষ্পত্তি ঘটে যায়–যাক। প্রত্যহ এই পীড়ন তার ভাল লাগে না।

সামান্য অপেক্ষা করে আদিত্য দু পা এগিয়ে এল। সিঁড়ির প্রথম ধাপে তার একটা পা রাখল। আমাকে আপনি কী ভাবেন? বাঁদর না হনুমান?

তুষার নীরব। কথা বলতেও ইচ্ছে করছিল না।

আপনাকে উত্ত্যক্ত করা আমার চাকরি নয়। …ভাল লাগত বলে আসতাম। দু মুহূর্ত থেকে আদিত্য হাত দুলিয়ে কেমন এমন একটা ভঙ্গি করল, বলল, ন্যাকাবোকা ছেলেদের মতন আমি মেয়েদের কাছে আসতে শিখিনি। …দূরে দূরে থাকলে, আপনার ছায়ার দিকে তাকিয়ে হু হা করলে আপনি ভাবতেন আহা, বড় ভালবাসে আমায় ও। আদিত্য পাগলের মতন বলছিল, বলার সময় ওর গলার স্বর প্রচণ্ড লাগছিল এবং মনে হচ্ছিল সে এক একটা শব্দকে বিকৃত করে ঠাট্টা করে আরও হাস্যকর করে তুলছে। আমি ওই ধরনের সাবুবার্লি খাওয়া প্রেম করতে দেখেছি। আই হেট ইট…। আমার কিছু আসে যায় না। হ্যাঁ, আপনার মতন আমারও কিছু যায় আসে না। …আপনি ভাবছেন, আমায় খুব ঠোক্কর দিলেন! খুব শিক্ষা দিলেন আমায়! আমি গ্রাহ্য করি না। পরোয়া করি না। বুঝলেন তুষারদিদিমণি, আমার চরিত্র আলাদা। ভালবাসা না পেলে আমি মরে যাই না৷বলতে বলতে আদিত্য সিঁড়ির ওপর তুষারের গায়ের কাছে এসে পড়ল। এবং পরক্ষণেই হাত ধরে ফেলল, তুষার বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে, আদিত্য বলল, আমার ভালবাসা ওয়েল ড্রেসড নয়, সিভিলাইজড নয়, কিন্তু সেটা বাঁদর হনুমানের মতনও নয়। আপনি যেমন দেখলে আহ্লাদিত হতেন–বিহ্বল হয়ে পড়তেন তেমন করে আসতে পারিনি। …কিন্তু বিশ্বাস করুন, আপনাকে আমার ভাল লাগে।

তুষার জোর করে হাত টেনে নিল। সর্বাঙ্গ তার জ্বালা করছে। রাগ ক্ষোভ লজ্জা ঘৃণায় তুষারের মনে হচ্ছিল, লোকটার গালে ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দিয়ে বলে, চলে যান এখান থেকে। অভদ্র ইতর কোথাকার!

আদিত্যর কী হয়েছিল কে জানে, তুষার হাত টেনে নিলে সে হাসল, হো হো করে হাসতে লাগল, অপ্রকৃতিস্থের মতন। হাসি থামলে দেখল তুষার দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ বলল বাড়ির ভেতর চিরকাল থাকতে পারবেন না দিদিমণি, একদিন বাইরে আসতে হবে। তখন দেখবেন আমি নেই।

তুষার কথাগুলো শুনল কি শুনল না–বোঝা গেল না। ঘরে চলে গেল। দরজা বন্ধ করল।

আদিত্য দাঁড়িয়ে থাকল অল্পক্ষণ। সিঁড়ি থেকে নামল, ওপাশে আতাগাছের কাছে গিয়ে সাইকেলটা নিল। তারপর সাইকেল ঠেলে বাগান পেরিয়ে যেতে যেতে তার দীর্ঘশ্বাস সে নিজের কানে শুনল। দাঁড়াল। আবার দীর্ঘ করে শ্বাস ফেলল। আবার কান পেতে শুনল। আপন মনে বলল, সো সিলি এ হার্ট, নেভার নোজ লাভ, লাভ দ্যাট ইজ অ্যান আর্ট।

.

১৩.

আদিত্যর স্বভাব দেখে তুষার কয়েক দিন পরে আবার মনে মনে হাসল। নিতান্ত অবোধ হলে কি এই রকম হয়! যখন রাগল তখন সে রাগ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল, কোনও মাত্রা মানল না, এলোমেলো বাতাস পাওয়া শিখা ওঠা আগুনের হলকার মতন তার ক্রোধের হলকা চারপাশে যা পারল তার গায়ে ছোবল দিল, তারপর কখন সব আবার শান্ত হয়ে গেল। আঁচ বা আগুন আছে তাও মনে হবে না। অবোধে এই ভাবে রাগ করে, দপ করে জ্বলে ওঠে, খানিক পরেই আবারই নিভে যায়।

ছেলেমানুষের। রাগ। তার জ্বলতে যতক্ষণ নিবতেও ততক্ষণ। তুষার ভেবেছিল, আদিত্যর শিক্ষা হয়ে গেছে, মানুষটা আহত ক্ষুব্ধ অপমানিত হয়ে আক্রোশে রাগে যা বলার সব বলেছে, এবার নিজেকে সরিয়ে ফেলবে, তুষারকে আর উত্ত্যক্ত করতে আসবে না।

দু তিনটে দিন ওই রকম হয়েছিল। শিশুতীর্থে ওরা সামনাসামনি পড়ে গেছে, প্রায়ই, খাবার ঘরে নিয়মিত মুখোমুখি বসে দু দলকেই খেতে হয়েছে, আদিত্য কোনও রকম অশোভনতা করেনি। বরং তুষার লক্ষ করেছে, তার মনে চাপা রাগও যে আছে আদিত্য তাও প্রকাশ করত না। মুখ বুজে থাকার পাত্র আদিত্য নয়, মুখ বুজে থাকেনি, তবু তার অতিরিক্ত চঞ্চলতাও যেন এ কদিন কোনও অসুখে ভুগছিল, তেমন করে প্রকট হত না।

এরই মধ্যে তুষার কখনও দেখেছে আদিত্য আর মলিনা গল্প করছে গাছতলায় দাঁড়িয়ে, কখনও দেখেছে জ্যোতিবাবু একা কোথাও বসে আছেন, কখনও বা তুষার কান পেতে শুনে নিয়েছে, মলিনা আদিত্যর কাছ থেকে গান শিখে দুপুরে স্নান করতে এসে নিজের ঘরে চুল খুলতে খুলতে সেই গান গাইছে। মলিনার ওই গানের গলায় আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি,–শুনে তুষারের হাসি পেয়েছে। ভেবেছে, যেমন মাস্টার তেমনি ছাত্রী। কিন্তু এও ঠিক, তুষার আদিত্যর গলায় আচমকা যতটুকু শুনেছিল গানটা, তাতে মনে হয়নি আদিত্যর গলার সুর খারাপ। মলিনার গলায় কিন্তু সত্যিই বিশ্রী শুনিয়েছিল, অত্যন্ত বিশ্রী।

এমনি করে কয়েকটা দিন কাটল। শরতের যাওয়া পথে মেঘ আবার দল জুটিয়ে দুটো দিন তুমুল বর্ষা নামাল। শিশুতীর্থ বন্ধ থাকল, নুটুর গাড়ি পাঁচ মাইল পথ এই আসা যাওয়ার ধকল সইতে পারল না। তারপর আবার রোদ উঠল, মেঘের সমস্ত ময়লা যেন কেউ আকাশ থেকে ঝাঁট দিয়ে নিয়ে গেছে, তকতকে পরিষ্কার আকাশটা আর নীল, রোদের আভায় অপরূপ উজ্জ্বল।

পরশু মহালয়া। শিশুতীর্থ এখন শিশু-স্বর্গ। ছেলেমেয়েগুলো বই খাতা পত্র আর ছোঁবে না, ঘরেও ঢুকবে না। সমস্ত মাঠ ভরে শুধু তাদের কলরব আর ছোটাছুটি, খেলা আর চাঞ্চল্য।

প্রতিবার মহালয়ার দিন এই বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কাছাকাছি একটা জায়গায় গিয়ে চড়ুইভাতি করতে হয়। এখন একটা আর শীতে আর একটা।

জ্যোতিবাবু আর আশাদি চড়ুইভাতির ব্যবস্থা করতে মত্ত। সাহেবদাদুর শরীর আজ কদিন সামান্য ভাল যাচ্ছে বলে তিনি ইতির হাত ধরে বাড়ির সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ছেলেমেয়েদের ডেকে নিজেই এক একটা অবাক খেলার নিয়ম শিখিয়ে দিচ্ছেন, ওপাশেই যেন বাচ্চাকাচ্চাদের ভিড় বেশি, প্রফুল্ল নুটুর গাড়ি নিয়ে বাজার হাট করতে ছুটছে শহরে, আর মলিনা আদিত্যর ছায়ায় ছায়ায় ঘুরছে।

তুষারের কিছু অন্য কাজ ছিল। একাজ খানিকটা অফিসের কাজও। মাসখানেকেরও বেশি বন্ধ থাকবে শিশুতীর্থ। এই বন্ধের মধ্যে ক্লাস ঘরগুলোর তদারকির ব্যবস্থা, জিনিসপত্র রাখার ব্যবস্থা টাকা পত্র দেওয়া থোওয়া, কয়েকটা ছোটখাটো হিসেব–এই রকম আরও কিছু।

কাগজপত্র নিয়ে কাজ করতে বসে তুষার দেখল, আদিত্য তার দু মাসের পাওয়া সরকারি মাইনের প্রায় সবটাই এখানে জমা রেখে দিয়েছে। টাকাটা তার আজকালের মধ্যে নিয়ে নেওয়া উচিত, মহালয়ার পরও অবশ্য দু-চার দিনের মধ্যে নিতে পারে, না নিলে এই হিসেবপত্রের খাতা বন্ধ হয়ে যাবে, ছুটির মধ্যে কে আবার হাঙ্গামা করবে!

তুষার আরও দেখল, জ্যোতিবাবুর সই করা চিট-এ মলিনা তার মাইনের অতিরিক্ত শ দেড়েক টাকা আগাম নিয়েছে। দেখল, আদিত্যর নামে-আসা একটা চিঠি, তার জবাবও। আদিত্য পুজোর ছুটির আগে চলে যাচ্ছে, তার এখানের কাজ শেষ।

একটানা ঘন্টা দুই কাজ করে তুষার উঠে পড়ল। বেলা হয়েছে। এগারোটা বাজে প্রায়।

সাহেবদাদু বারান্দায় বসে বিশ্রাম করছেন। স্নান করতে যাবেন। ইতি কাঠের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার বুঝি স্নান সারা হয়ে গেছে, মাথার চুল এলো। ঘন বেগুনি রঙের শাড়ি পরেছে ইতি। কেমন বড় বড় লাগছিল দেখতে। তুষার আসতে গিয়ে কী ভেবে সাহেবদাদুর দিকে এগিয়ে গেল।

বারান্দায় উঠতে গিয়ে ইতির সঙ্গে চোখাচুখি। তুষার হাসল। কী রে! তোকে বড্ড বড় দেখাচ্ছে।

ইতি লজ্জায় হাসল। রংটা ভাল, না তুষারদি?

খুব সুন্দর।

তোমার মতন ফরসা রং হলে আরও মানাত।

তুই কি কালো নাকি?

শাড়িটা আমায় আশাদি কিনে দিয়েছে। ইতি বলল, পুজোর জন্যে।

তুষারের খেয়াল হল, ইতির জন্য তাকেও একটা শাড়ি কিনতে হবে। আগে আগে তুষার জামা করে দিত, আজকাল ইতি বেশির ভাগ শাড়ি পরে, শাড়িই কিনতে হবে এবার।

ইতিকে ওরা সবাই দেয়, জ্যোতিবাবু, আশাদি, তুষার, প্রফুল্ল। মলিনা নয়। মলিনাটা যেন কী! কাণ্ডজ্ঞান নেই।

বারান্দায় উঠে সাহেবদাদুর মুখোমুখি দাঁড়াল তুষার।

কী খবর? কাজ হল? সাহেবদাদু প্রশান্ত মুখে তাকালেন।

হ্যাঁ, অনেকটা। তুষার সাহেবদাদুর চোখে চোখে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। দু মুহূর্ত নীরব থাকল, সাহেবদাদুর কপালে ঘাম ফুটে আছে, তুষার বিনীত গলায় বলল, ওই টাকাটার কী হবে?

কোন টাকা?

 আদিত্যবাবুর! উনি তুলে না নিলে হিসেব গোলমাল হবে।

নেয়নি টাকাটা? আমি তো আগেও বলেছি ওকে। সাহেবদাদু যেন সামান্য চিন্তিত হলেন, কী ভাবলেন অল্প সময়, বললেন, টাকাটা সরাসরি ওকে পাঠালেই পারে, আমাদের হাত দিয়ে ঘুরে যাবার যে কী দরকার আমি জানি না। …টাকাটা ওকে ডেকে দিয়ে দাও।

তুষার ঘাড় কাত করল। দিয়ে দেবে।

তুষার

আজ্ঞে

 আমার চিঠিপত্রের মধ্যে একটা ড্রাফট পাবে। ব্যাঙ্ক ড্রাফট। জ্যোতিকে বলো ছুটির আগেই যাতে ভাঙিয়ে আনে। তোমাদের হাতে এখন কিছু না দিলে আমার খারাপ লাগবে।

মলিন করে হাসল তুষার। আমায় দিতে হবে না।

কেন? তোমার কি জমিদারি আছে? সাহেবদাদু তাকিয়ে থাকলেন।

আমার দরকার হলে আমি নিই।

 এবারে না হয় এমনিই নাও। …সবাই মিলে তোমরা নাও, ওই ছেলেটিকেও দিয়ো। …

তুষার কোনও কথা বলল না। বলার প্রয়োজন ছিল না। সাহেবদাদু এমনি মানুষ। পুজোর আগে সবাইকে কিছু কিছু টাকা দিতে না পারলে তাঁর শান্তি নেই। এই টাকা হয়তো কর্জ করে এনেছেন, হয়তো তাঁর কোনও পুরনো সম্পত্তি বেচেছেন কী করেছেন কেউ কোনওদিন জানতে পারবে না। তবু তিনি দেবেন, না দিয়ে স্বস্তি পাবেন না।

তুষার চলে আসার জন্যে ফিরে দাঁড়াল। ইতি নেমে রোদে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সাহেবদাদু আচমকা বললেন, তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করব, তুষার। কদিনই ভাবছি। তুষার দাঁড়াল।

ইশারায় তুষারকে আরও একটু কাছে ডাকলেন সাহেবদাদু, তুষার পাশে এসে দাঁড়াল। খানিকটা সময় পরিপূর্ণ নীরব থাকলেন সাহেবদাদু, খুব যেন আত্মমগ্ন। শেষে মৃদুস্বরে বললেন, আমার আয়ু আর বেশি দিন নয়; আজকাল প্রায়ই রাত্রের দিকে বুকের মধ্যে কেমন করে। এমনিতেও বুঝতে পারছি, যাওয়ার দিন এল।

এমন শারদ দিনে, এই পুঞ্জিত রৌদ্র আর উদ্ভাসিত পূর্ব মধ্যাহ্নে সাহেবদাদুর শান্ত অথচ বিষণ্ণ আলাপ তুষারের ভাল লাগছিল না। তুষার বিষণ্ণ বোধ করল। সাহেবদাদুর চোখের দিকে তাকাতে পারল না। মনে হল, হয়তো সেই আসন্ন দুঃখকে সাহেবদাদুর মুখে ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাবে।

অস্বস্তি বোধ করে তুষার বলল, আপনি যত অমঙ্গল ভাবেন।

 অমঙ্গল ভাবি! যা সত্যি তাই ভাবা কি অমঙ্গল? সুন্দর একটু হাসি সাহেবদাদুর ঠোঁটে, যেন এই হাসি তুষারকে বলছে, ওরে এমনি করেই তো যেতে হয়।

তুষার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাক টানল, গায়ের আঁচল অকারণে নাড়ল, তারপর কয়েক পলকের জন্যে সাহেবদাদুর মুখ দেখল।

আমার ভাবনা ইতিকে নিয়ে। সাহেবদাদু বললেন নিশ্বাস ফেলে, ও আর ওর মাসির কাছে যাবে না। এই শিশুতীর্থর বাইরে ওকে পাঠানো মুশকিল। আমি বড় দুশ্চিন্তায় পড়েছি, তুষার। ওর একটা ব্যবস্থা করে যেতে পারলে শান্তি পেতাম।

আর একটু বড় হোক, আমাদের সঙ্গে কাজ করবে। তুষার সহজ সাধারণভাবে বলল, সরল পথ দেখিয়ে দিল।

তোমরা কি চিরটা কাল এখানে কাটাবে, তুষার–! সাহেবদাদু চোখ স্থির রেখে তাকিয়ে থাকলেন, মুহূর্ত কয় পরে বললেন, আমি তোমাদের জীবনের সব নিতে পারি না। জ্যোতি হয়তো পারবে, আশাও পারতে পারে কিন্তু তোমরা পারবে না। …তোমাদের নিজেদেরও একটা জীবন আছে, শুধু শিশুতীর্থে পড়ে থাকলে চলবে কেন!

আমরা তো ভালই আছি। তুষার আড়ষ্ট গলায় বলল। সাহেবদাদুর কথা সে বুঝতে পেরেছে।

মেয়েদের ভাল সব দিক তাকিয়ে ভাবতে হয়–সাহেবদাদু বললেন, জ্যোতির কথা ধরো; সে পুরুষমানুষ। এই শিশুতীর্থর দায় নিয়ে তার আজীবন কেটে যেতে পারে। তার যদি সংসার করতে ইচ্ছে হয়, আটকাবে না কোথাও; কাজের সঙ্গে সংসারের বিরোধ হবে না। কিন্তু মেয়ে হলে কি পারত?

আশাদির কথা তুষারের মনে হল। ইচ্ছে হল জিজ্ঞেস করে আশাদি তো মেয়ে, সেও কি পারবে না! কথাটা তুষার বলল না; সাহেবদাদু আশাদিকে বোধ হয় সংসারের সাধারণ পথ থেকে পাশে সরিয়ে রেখেছেন। কেন? আশাদির একটু বয়স হয়ে গেছে বলে! বয়স হয়ে গেলে কি মেয়েরা বিধবার মতন হয়ে যায়। মেয়েদের বয়সও কি এক ধরনের বৈধব্য। তুষারের চোখে আশাদির রঙিন শাড়ি পরা সেদিনের চেহারাটা ভাসছিল। দুঃখ হচ্ছিল তুষারের। দুঃখ হচ্ছিল, আশাদি নিজেকে বুড়ি সাজিয়ে রেখেছে বলে।

সাহেবদাদু বললেন, ইতির জন্যে আমার বড় ভাবনা, তুষার। তোমাদের ভরসা ছাড়া ওকে আর কোথায় বা রাখব অথচ তোমাদের ঘাড়ে এই দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে যেতেও ইচ্ছে করে না।

তুষার নীরব থাকল। সাহেবদাদুর দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা সে অগ্রাহ্য করতে পারল না। সাহেবদাদুর অবর্তমানে ইতির দায় দায়িত্ব কে নেবে? জ্যোতিবাবু? জ্যোতিবাবু কি পারবেন? আশাদিও কি ওই মেয়ের সব ভালমন্দের ভার আজীবন বইতে পারবে? …তুষারের কেমন আচমকা মনে হল, মেয়েদের দায় বয়ে নিয়ে যাওয়া বড় কঠিন। অকূল নদীতে যাত্রী চাপিয়ে নৌকা বয়ে যাওয়ার মতন। কোনও স্থিরতা নেই, নির্দিষ্ট চিহ্ন নেই যে ততটুকু পৌঁছে দেবে। এই সমস্যা তুষারকে এখন কেমন বিহ্বল করল।

একটি অল্পবয়সী ভাল ছেলে পেলে আমি ইতির বিয়ে দিয়ে দিতাম। সাহেবদাদু বললেন হঠাৎ।

তুষার চমকে উঠল। এত অল্প বয়সে!

ষোলো বছর। খুব কম আর কোথায়! সাহেবদাদু চিন্তিত মুখে বললেন, পারলে এটাই ভাল হত, তুষার। …যাক তোমায় বলা থাকল। তেমন কোনও খবর পেলে আমায় একটু জানিয়ে।

বেলা বাড়ছে। তুষার অল্প সময় দাঁড়িয়ে থেকে মাঠে নামল। ইতি তখনও রোদে। মাথার চুল শুকিয়ে নিচ্ছে। তুষার দাঁড়িয়ে ভাল করে আরও একবার দেখল ইতিকে। বেশ বাড়ন্ত দেখায়। তবু মুখের আদলে সেই কচি ভাবটা রয়ে গেছে ইতির। ওকে বিয়ে দিলে কেমন দেখাবে, ভাবতে তুষারের সকৌতুক হাসি পেল।

তুষারদি–ইতি কাছে এসে দাঁড়াল তুষারকে দেখতে পেয়ে।

তুষার স্নেহের চোখে দেখছিল। ইতির গায়ের রং যেমনই হোক, মুখ বড় মিষ্টি। নাক লম্বা পাতলা, ভুরু সরু, ঠোঁট পাতলা। এক মাথা চুল। তুষারের বড় ভাল লাগছিল দেখতে।

আজ তুমি যখন বাড়ি যাবে আমি একটু কাপড় দিয়ে দেব। ইতি বলল।

কীসের কাপড়?

জামার। তুমি কেটে এনে দিয়ো, আমি সেলাই করে নেব।

আমি সেলাই করতে পারি না? তুষার হাসিমুখে বলল।

তুমি তো কত ভাল পার! ..না, অত কাজের মধ্যে আর সেলাই করে দিতে হবে না তোমায়। আমি হাতে সেলাই করে নেব।

কাপড়টা তা হলে যাবার সময় দিয়ে দিস।

মাথা নাড়ল ইতি, দিয়ে দেবে কাপড়টা।

তুষার আশাদির বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল।

সাহেবদাদুর কথা ভাবছিল তুষার। ভেবে অবাক হচ্ছিল যে-লোক পাণ্ডব বর্জিত জায়গায় এসে, কোন পাহাড়ের কোলে, বুড়ো বয়সে একটা স্কুল খুলে বসতে সাহস পেলেন, তিনি আজ একফোঁটা মেয়ের জন্যে কোনও ভরসা খুঁজে পাচ্ছেন না। ইতির বিয়ে দেওয়ার জন্যে সাহেবদাদুর এত দুশ্চিন্তা কেন! শিশুতীর্থ যতকাল আছে ততদিন ইতির আশ্রয় আছে, ভালমন্দ দেখার লোকও আছে। তবু সাহেবদাদু কেন এত ভাবছেন?

শিশুগাছের ছায়ায় তুষার একটু দাঁড়াল। অনেকটা দূরে আদিত্য। তুষার আদিত্যর টাকাটার কথা ভাবল। আজ আদিত্যকে বলতে হবে, টাকাটা আপনি তুলে নিন, আমার হিসেব রাখতে গোলমাল হচ্ছে।

আঁচলের আগায় গলা কপাল আলতো করে মুছে তুষার হাঁটতে লাগল।

ইতির জন্য সাহেবদাদুর ভাবনা যেন বেশি বেশি। এই বয়সে একটা বিয়ে দিয়ে দিলেই কি সব সমস্যা ঘুচে যাবে। সাহেবদাদুর মনের অন্য দিকের জানালাগুলো যতই খোলা থাক–এ দিকে, তুষারের মনে হল, এদিকের জানলাটা কিন্তু বন্ধ। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়াকেই তিনি নিরাপদ বলে ভেবে নিয়েছেন। একটি পুরুষের হাতে একটি মেয়েকে সমর্পণ করলেই কি মেয়ের জীবনের সব সমস্যা মিটে যায়! তুষার স্বীকার করল, এতে মেয়েদের একটা আশ্রয় জোটে, বল-ভরসাও, কিন্তু সংসারে কি ইতির মাত্র সেইটুকুই প্রয়োজন? যদি তাই হয়, তবে ইতির আশ্রয়ের অভাব তো শিশুতীর্থে নেই, ইতির সুখ দুঃখের ভাবনা ভাববার লোক তো রয়েছে শিশুতীর্থে–জ্যোতিবাবু, আশাদি, তুষার নিজেই। …তবে?

এসব ভাঙা যুক্তি, সাধারণ কথাবার্তা তুষারের পছন্দ হল না। সাহেবদাদু অত সামান্য বুদ্ধির মানুষ নন। ইতির মাথায় যে ছাদ থাকবে, ইতির দেখাশোনা করার লোক যে আছে–তিনি নিশ্চয় জানেন। তবু বিয়ের কথা ভাবেন যে, তার কারণ আছে। কারণটা তুষার অস্পষ্টভাবে অনুমান করতে পারছিল।

তুষার ভাবছিল, যাকে সোজা কথায় আশ্রয় বলা হয়–যাকে দায় দায়িত্ব ভার বলা হয়, তেমন আশ্রয় বা দায় দায়িত্ব বয়ে বেড়ানোর লোক মেয়েদের জীবনে অন্য ভাবেও জুটতে পারে; কিন্তু কোনও মেয়ের জীবন হয়তো এতে সম্পূর্ণভাবে আশ্রিত বা নিরাপদ, নিশ্চিন্ত অথবা নিরুদ্বিগ্ন থাকে না। ঘরবাড়ি খাওয়া পরার ভাবনা আপদ বিপদে দেখার লোক–এসব সাংসারিক প্রয়োজনের পরও নিশ্চয় মেয়েদের জীবনে অন্য প্রয়োজনও আছে। সেটা কী?

সেটা কী, তুষার ভাল করে ভাবতে পারছিল না। তবে অনুভব করতে পারছিল, ইতির যদি আজ বিয়ে হয়ে যায়, ইতি শুধু তার স্বামীর বাড়িতে থাকার, স্বামীর ছায়ায় নিশ্চিন্ত হবার, আহার বিহারের সুযোগ পাবে না–তার বেশি–অনেক কিছু বেশি হয়তো সেই জিনিসই পাবে, যাকে আমরা নিজের সুখ বলি। বা, তুষার ভাবল, হয়তো এই পাওয়াতে মেয়েদের এমন কোনও প্রাপ্তি আছে যা গভীর, যা পূর্ণ। হয়তো ইতিকে সাহেবদাদু এমন কোনও মানুষের হাতে দিয়ে যেতে চান–যার চেয়ে ঘনিষ্ঠ, যার চেয়ে অধিক আত্মীয়, যার চেয়ে ইতির সমস্ত মন প্রাণ সুখ দুঃখ, আশা আকাঙ্ক্ষার বেশি অন্য কেউ হতে পারবে না। সমস্ত জীবনের মতন ইতি তাকে পাবে, পাবে মৃত্যু পর্যন্ত।

ভাবনাটা তুষারের অনুভূতিকে কেমন রোমাঞ্চিত করল। যেন এই ভাবনার অজ্ঞেয় তাপ হৃদয়কে উষ্ণ ও কামনার্ত করল।

তুষার থমকে দাঁড়াল। সামনে আদিত্য। চোখ তুলে আদিত্যকে দেখল তুষার। এ কদিন তুষার আদিত্যর পাশ কাটিয়েছে। আদিত্যও তাকে উত্ত্যক্ত করতে আসেনি। আজ তুষার কী মনে করে সৌজন্যোচিত হাসি আনল মুখে।

আদিত্য হাসল না। তাকিয়ে থাকল।

আপনার টাকাটা নিয়ে নেবেন আজ। তুষার বলল।

টাকা! কীসের টাকা?

খেয়ালও নেই আপনার! তুষার চোখ ভরে আদিত্যকে দেখল, আপনার মাইনের টাকা। আমাদের কাছে পড়ে আছে।

কত টাকা?

আপনার হিসেব নেই?

না। কিছু টাকা আমি নিয়েছিলাম।

 চারশো প্রায়।

শ খানেক আমায় দিয়ে দেবেন। মানে!

 তুষার বিস্মিত হয়ে চোখ তুলল। সবটাই তো আপনার টাকা। জানি।

আমার শ খানেক হলেই চলবে। পুজোর পর রাঁচির দিকে একটা স্কুলে যাব। মিশনারি স্কুল। কোনও খরচা নেই। আদিত্য ধাঁধার মতন বলছিল, আমায় একশোটা টাকা দিয়ে দেবেন।

তুষার কিছু বুঝতে পারছিল না। মানুষটা পাগলামি করছে! বাকি টাকা কি ওর জন্যে জমা করে নিয়ে বসে থাকবে তুষার। বাকি টাকা? তুষার প্রশ্ন করল।

দান করে দিলাম। অবহেলার গলায় বলল আদিত্য।

 দান!

ডোনেশান। …দু তিনটে গোরু কিনে নেবেন টাকাটায়।

গোরু! তুষার বিস্মিত।

গোরু ভাল জিনিস। একটা গোয়ালঘর করে রেখে দেবেন। দুধ-টুধ হবে বাচ্চাদের খাওয়াবেন। আদিত্য ঠাট্টা করছিল না, নাকি বিদ্রূপ, অথবা সত্যিই সে গরু কেনার প্রস্তাব দিচ্ছিল, তুষার কিছু বুঝতে পারল না। আদিত্য আবার বলল, মিলক ইজ গুড ফর হেলথ। বলে হাসতে লাগল।

তুষার বুঝতে পারল সমস্তটাই বিদ্রূপ। রাগ হল তুষারের। বলল, এখানে কী ব্যবস্থা করা হবে তার ভাবনা আমরা ভাবব।

আদিত্য কথাটা শুনল, গ্রাহ্য করল না। বলল, টাকাটা সত্যিই আমি আপনাদের ফান্ডে দিলাম। আমার এখন প্রয়োজন নেই। …গোর না কিনতে চান কিনবেন না, যা খুশি করবেন।

আদিত্য দু হাত মাথার ওপর তুলে আলস্য ভাঙল। হাই তুলল। কাল একেবারে ঘুম হয়নি। আজ দুপুরে একটু ঘুমোতে হবে। চলি।

চলে গেল আদিত্য। তুষার দাঁড়িয়ে থাকল। লোকটা কি সত্যিই তিনশো টাকা দান করে দিল। খেয়াল নাকি? তোক দেখানো দম্ভ। দম্ভ হলে এতদিন কেন টাকাটা দেয়নি!

তুষার আবার আশাদির বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে মনে হল, মানুষটা বোধ হয় কিছুটা ছেলেমানুষ, কিছুটা খেয়ালি। না, ওর কোনও দম্ভ নেই। অথচ দম্ভ দেখালে বেমানান হত না। যতই তুমি অপছন্দ করো, তবু একথা স্বীকার না করে উপায় নেই, ও বিদেশ ঘুরেছে এই শিক্ষাপদ্ধতি দেখে বেড়াতে, ও না জানে এমন বিষয় বোধ হয় শিশুশিক্ষার মধ্যে নেই। লোকটাকে অশিক্ষিত বলা চলে না।

কয়েক পা এগিয়ে এসে তুষারের হঠাৎ মনে হল আচ্ছা–আদিত্য, সাহেবদাদু যদি আদিত্যের সঙ্গে ইতির বিয়ে দেন, কেমন হয়! বয়সে একটু বেমানান, কিন্তু স্বভাবে কি খুব বেমানান হবে! দুজনেই ছেলেমানুষ।

কথাটা ভাবতে তুষারের কেমন ভীষণ হাসি পেল। আদিত্য ইতির স্বামী, ইতি আদিত্যের স্ত্রী। আর তখন, আদিত্য শিশুতীর্থ-য় সর্বেসর্বা। তার ধমকে তার কথা মতন তুষারদের চলতে হবে।

আদিত্য তখন নিশ্চয় তুষারকে আর কাজ করতে দেবে না। তাড়িয়ে দেবে। তুষারের ওপর গায়ের জ্বালা কি তখন না মিটিয়ে পারবে আদিত্য।

এই কাল্পনিক অকারণ চিন্তা তুষারকে কেমন ম্রিয়মাণ করল। তার ভাল লাগল না ভাবতে। আদিত্যকে ইতির স্বামী হিসেবে যেন তুষার পছন্দ করতে পারল না।

.

১৪.

শিশুতীর্থ বন্ধ হয়েছে। পুজোর ছুটির বন্ধ। জ্যোতিবাবু আর আশাদির এখনও ছুটি হয়নি। যে ছেলেগুলো শিশুতীর্থর মধ্যে থাকে তাদের বাড়ি পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করেছে ওরা। কাছাকাছি। জায়গার ছেলে ওরা–বিশ পঁচিশ মাইলের মধ্যে বাড়ি; এক একটা দল করে ট্রেনে বোডবাসে পৌঁছে দিতে হচ্ছে কচিগুলোকে। দুতিনদিনের মধ্যে শিশুতীর্থ খালি হয়ে যাবে, থাকার মধ্যে সাহেবদাদু, ইতি, আশাদি আর দু একজন ঝি চাকর আর নুটু।

ছুটি শুরু হবার পর চারটে দিন দেখতে দেখতে কেটে গেল। এবার আশ্বিন শেষ করে পুজো। অর্থাৎ এই পুজো কেটে গেলেই কার্তিকের গোড়ায় হেমন্তকাল শীতের ছোঁয়া দিতে আসবে।

তুষার কটা দিন ঘরবাড়ি পরিষ্কার করল। পুজোর আগে প্রতিবার তার এই এক খাটুনি। সমস্ত বাড়ি, প্রতিটি জিনিস নিজের হাতে পরিচ্ছন্ন করবে। শিশির বলছিল বলে, এই ঘরদোর ধোওয়া মোছর সঙ্গে অন্য খাটুনিও জুটল চুনকাম করানোর হাঙ্গামা।

বাড়ি ঘর তকতকে করিয়ে তুষার যখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, তখন বোধনের বাজানা বেজে উঠেছে।

সকালে চা খেতে খেতে শিশির বলল, তুই না তোদের শিশুতীর্থতে যাবি বলছিলি একবার।

হ্যাঁ রে, একবার যেতে হবে। আজ ষষ্ঠী হয়ে গেল। ইতিকে কাপড়টা দিয়ে আসতে হবে পুজোর।

 যাবি কী করে? শিশির শুধোল।

 তাই তো ভাবছি।

কালও নুটু এসেছিল, ওর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিলেই পারতিস।

নুটু এত দিন তার গাড়ি নিয়ে রোজই এসেছে। জ্যোতিবাবু আর আশাদি ছেলেদের পৌঁছতে যাচ্ছে, ফিরছে; নুটুর গাড়িও তাই যাচ্ছে আসছে। কাল শেষবারের মতন এসে গেছে নুটুর গাড়ি; আজ আসবে কি না কে জানে। তুষারের খেয়াল ছিল কালকেও, কিন্তু নুটুর হাত দিয়ে ইতিকে পুজোর শাড়ি পাঠাতে তার মন চায়নি। তা ছাড়া তুষার সাহেবদাদুর জন্যে একজোড়া কার্পেটের চটি বুনেছে অনেকদিন থেকে, ইচ্ছে ছিল এবারে নিজে গিয়ে সাহেবদাদুকে দিয়ে আসবে।

নুটুর গাড়ি অবশ্য শহরে আবার আসবে। ইতিকে আশাদিকে নুটু শহরের ঠাকুর দেখাতে নিয়ে আসবে। কিন্তু সে কি আর আজ আসবে? এলেও তখন ইতিকে কিছু দেওয়া ভাল দেখাবে না।

কবে কিনেছি–তুষার আপন মনে বলল, নিয়ে যাব যাব করে ভুলে গেলাম।

শিশির হাসল। বলল, তোর দেওয়ার ইচ্ছে নেই বলেই অত ভুল।

বাজে কথা বলিস না।

বাজে কথা কেন! শাড়ি তোরও খুব পছন্দ ছিল রে। শিশির হাসছিল।

 তাতে কি, পছন্দ হতেই পারে। তা বলে ইতির নাম করে কিনে আমি নিজে নেব।

 আমি তার কী জানি! তুই-ই বলেছিলি।

হ্যাঁ বলছিলাম। তোর মুণ্ডু।

কথাটা খুব অসত্য নয়। মেতিপাতা বাটলে যেমন রং হয়, তেমনই লাল রঙের লম্বা ডুরে দেওয়া একটা শাড়ি ইতির জন্যে কিনেছিল তুষার। কিন্তু শাড়িটা তার নিজেরই পছন্দ ছিল। শিশিরকে দেখাবার সময় বলেছিল, শাড়িটা আমায় কেমন মানাবে বল তো! শিশির রং দেখে মুগ্ধ হয়েছিল, দিদির গায়ের রঙের সঙ্গে যে চমৎকার মানাবে তাতে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না; শিশির বলেছিল, তোকে ওয়ান্ডারফুল মানাবে।

তুষারের মন দীন নয়, তবু আশ্চর্য যে, তুষার সহসা যেন এই সুন্দর শাড়িটা নিজের জন্য রাখার লোভ করেছিল। বলেছিল, ইতির জন্যে তবে অন্য একটা আনতে হয়।

মনে মনে তুষার কি এই দ্বিধাবশত শাড়িটা ইতির জন্যে নিয়ে যেতে ভুলে যাচ্ছিল! তুষার কি অকস্মাৎ কোনও কারণে নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে পড়েছে? না। তুষার পরে মাথা নেড়েছে, এবং তার এই ছেলেমানুষি লোভ ও চিত্ত দীনতাকে শাসন করে নিয়েছে।

একটা উপায় বল তো তুষার ভাইয়ের কাছে পরামর্শ চাইল।

শিশির ভাবল। বলল, তুই না ছেলেবেলায় একবার সাইকেল চড়া শিখেছিলি।

 ইয়ার্কি করিস না–তুষার রাগ করে বলল।

তবে হেঁটে যা।

 খুব বললি!

 শিশির নীরব হল। তার মাথায় এমন কোনও বুদ্ধি এল না, যাতে দিদিকে নিশ্চিত করতে পারে।

 তুষার ভাইয়ের ঘাড়ে যেন সব দোষটা চাপাবার চেষ্টা করে বলল, তোর জন্যেই এরকম হল।

 আমার জন্যে!

না তো কী! এ কদিন শুধু ঘর দোর পরিষ্কার, চুনকাম করানো–এসব দেখতে গিয়ে আর সময় পেলাম কই। নয়তো নুটুর সঙ্গে গিয়ে কাজটা সেরে আসতাম। তুষার কিছুটা ক্ষুণ্ণ যেন।

শিশির বলল, দেখ দিদি, তুই এক কাজ কর। পোস্ট অফিসের কাছে যতীনের বাড়ি। যতীনকে গিয়ে বল, ব্যবস্থা করে দেবে।

তুষার যতীনকে চেনে। শিশিরের বন্ধু যতীন। কাঠগোলার মালিকের ছেলে। মাঝে মাঝে তাদের জিপগাড়ি বন জঙ্গলে যায় কাঠ কাটা তদারক করতে। তুষার বললে যতীন যে একটা ব্যবস্থা করে দেবে তাতে সন্দেহ নেই। সামান্য নিশ্চিন্ত হল তুষার।

.

আরও একটু বেলায় তুষার যতীনদের কাঠগোলায় গেল। যতীন নেই কাজে বেরিয়েছে, ফিরতে দুপুর হবে। তুষার ফিরে এল।

নুটুর গাড়ি আজ আসবে না। যদি আসার হত সকালেই আসত। বিকেলে কি আর আসবে। জ্যোতিবাবু বাড়ি আসবেন আজ বিকেলেই হয়তো, কিন্তু তিনি সাইকেল নিয়ে আসবেন, গাড়ি নিয়ে নিশ্চয় নয়। তুষার ভেবে দেখল, তার পক্ষে অপেক্ষা করা ছাড়া পথ নেই। যদি কোনও কাজে কর্মে নুটু এসে পড়ে গাড়িটা নিয়ে ভাল, নয়তো কাল যখন ইতি আর আশাদিকে নিয়ে নুটু ঠাকুর দেখাতে আসবে তখনই যাবে তুষার। উপায় কী!

আজ দুপুরটা অজস্র সময় আর কর্মহীন অবসর নিয়ে এসেছিল। তুষার অনুভব করল তার চারপাশে অফুরন্ত আলস্য দীঘির মতন বিরাজ করছে। এখানে শরৎ কাল বাংলা দেশের মতন নয়, কিন্তু এই শরৎ আরও শুষ্ক, যেন শীতের মিশেল দেওয়া। রোদ ঠিকরে আছে, আকাশ সুনীল, বাতাস মৃদু ও শীতল। বাগানে কয়েকটা প্রজাপতি আপন মনে উড়ছে।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানলা দিয়ে অনেকক্ষণ তুষার এই দুপুরকে অনুভব করল। আজ অনেকটা বেলায় সে মাথা ঘষেছে, চুলগুলো এখনও সামান্য ভিজে। রোদে দাঁড়িয়ে তুষার চুল শুকিয়েছে যতটা পেরেছে, তারপর আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি, রোদটা কপালে লাগছিল। তা ছাড়া, আরও কিছু যেন লাগছিল।

তুষার দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে নিজেকে কেমন বিষণ্ণ মনে করেছিল। কোনও কারণ নেই, তবু শান্ত নিবিড় দুপুরে, যখন আকাশের তলায় কয়েকটা চিল ডানা মেলে উড়ছে, পাকা হরীতকীর মতন রং ধরা শূন্যতা চারপাশে, অলস কাক কোথাও বসে ভাবছে এবং শিউলি গাছটার তলা থেকে কদাচিত বাতাসে গন্ধ ভেসে আসছে–তখন তুষার অনুভব করল তার কোথাও যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তুষার সাহেবদাদু, ইতি, আশাদি জ্যোতিবাবুর কথা ভাবল। মলিনার কথাও। কিন্তু এদের ভাবনার মধ্যে তুষার নিজের মনকে ডুবিয়ে রাখতে পারল না। আদিত্যর কথা তার বার বার মনে পড়ছিল।

আদিত্য এখনও যায়নি। তার যাবার কথা তুষার শুনেছে। গতকালই তার চলে যাওয়া উচিত ছিল। যায়নি। গেলে দেখা হত, আদিত্য দেখা করত। কেননা নুটুর গাড়ি ছাড়া উপায় নেই যাবার। আর নুটুর গাড়ি কালও এসেছে তুষারের বাড়িতে। আদিত্যর যাওয়ার কথা কেউ বলেনি।

আদিত্যর কথা ভাবতে ভাবতেই তুষার ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়েছিল। শিশিরটা ঘুমোচ্ছে। বিছানায় শুয়ে তুষারেরও ঘুমোতে ইচ্ছে করল। কিন্তু সাহস হল না। অতক্ষণ মাথা ঘষার পর দুপুরে ঘুমোতে ভরসা পাচ্ছিল না, বিকেলে মাথা ভার হবে, সর্দিও হয়ে যেতে পারে। তুষার না ঘুমিয়ে শিশিরের ঘর থেকে একটা মাসিক পত্রিকা এনে শুয়ে পড়ল।

একটা গল্প পড়ল তুষার। ভাল লাগল না। পাতা ওলটাল এ-লেখা সে-লেখায়, মন বসল না। পাতা উলটে উলটে বিজ্ঞাপন দেখল। তারপর পত্রিকাটা রেখে দিল।

অবশেষে জানলা দিয়ে মরে আসা দুপুর দেখতে লাগল। দুপুর ফুরিয়ে আসছে দেখলে কেমন মায়া হয়; মনে হয় যে সকালটি সুশোভিত হয়ে দেখা দিয়েছিল, তার যাবার বেলা হয়ে এল। আর এসব কথা মনে পড়লেই কেন যেন অলস মন যত অদ্ভুত চিন্তা করে। চিন্তা করে যে, সব জিনিসই ফুরিয়ে আসে, সব জিনিসেরই পরিণাম আছে। যেমন করে সকাল ফুরোল, এমনি করেই শরৎ ফুরিয়ে আসছে, শীত আসবে তাও ফুরোবে। তুষারও ফুরিয়ে আসছে। আশাদির মতন।

সব শুরুই কেমন সুখের, সব ফুরিয়ে যাওয়াও কেমন দুঃখের। তুষার সাহেবদাদুর কথা ভাবল। সাহেবদাদু একেবারে শেষ বেলায় এসে পড়েছেন। এবার ডুবে যাবেন। কী হবে তখন শিশুতীর্থের? জ্যোতিবাবু কর্তা হবেন। জ্যোতিবাবু দায় দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে সাহেবদাদুর অত সাধের শিশুতীর্থকে চালাবেন। পারবেন কি? হয়তো পারবেন। জ্যোতিবাবুর না পারার কারণ নেই। তিনি জীবনে অন্য কিছু কামনা করেন না। আর করলেও সেই কামনা বড় কিছু নয়। হয়তো মলিনাকে বিয়ে করলে সে কামনাও মিটবে।

আশাদি কথাটা বলেছে তুষারকে। বলেছে, মলিনার ওপর জ্যোতিবাবুর যেমন টান তুষার, তাতে মনে হয় মেয়েটাকে জ্যোতিবাবুই বিয়ে থা করবেন।

কথাটা তুষার বিশ্বাস করতে চায় না। আবার পুরোপুরি অবিশ্বাসও নয়। মলিনাই বা কেমন? আদিত্যর সঙ্গে তার মেশামিশিতে আটকায় না, আবার জ্যোতিবাবুর মায়া মমতাটুকুও সুযোগ বুঝে নেওয়া চাই। ওই মেয়েটাকে তুষারের কোনও দিনই ভাল লাগে না। নামই মলিনা নয়, ওর মনও বড় মলিন।

ভাবতে ভাবতে তুষারের চোখে তন্দ্রা জমেছিল। কয়েকবার চোখের পাতা খুলে সে দুপুরের দিকে চেয়ে থাকল, সতর্ক হল, ঘুমোতে চাইল না। তবু কখন তন্দ্রা এসে তার চোখের পাতা জুড়ে দিল। তুষার বালিশের কোলে মাথা মুখ চেপে ঘুমিয়ে পড়ল।

.

ঘুম ভাঙল বিকেলে। রোদ পালিয়েছে। বিকেলের রং ঘন হয়েছে, বাগানের চেহারা নিরুজ্জ্বল। রোদের কিরণ কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ছায়ার আঙুলগুলো যেন ঘরের জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে পড়েছে, এবার ঘরে ঢুকবে। তুষার ধড়মড় করে উঠে বসল। শিশিরের ঘরে কার যেন গলার শব্দ।

বাইরে এসে তুষার কলঘরে গেল। বেরিয়ে এসে আকাশ দেখল, রোদের ঈষৎ আভা আকাশের তলায় লেগে আছে। একটা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ নিচু দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। চোখ মুখের জল আঁচলে মুছতে মুছতে রান্নাঘরের দিকে তাকাল তুষার। বাইরে কুয়োতলার কাছে ঝিয়ের গলা শোনা যাচ্ছে। অবেলার ঘুমের জন্যে হাই উঠছিল তুষারের। ইস সেই ঘুমিয়ে পড়েছিল তুষার। মাথাটা অবশ্য এখনও ভার লাগছে না।

শিশিরের ঘরের কাছে দু দণ্ড দাঁড়িয়ে শেষে তুষার ঘরে ঢুকল। যতীন।

তুষারকে দেখে যতীন বলল, এই যে দিদি, আপনি গিয়েছিলেন শুনলাম। আমি দুটোর পর ফিরেছি। স্নান খাওয়া করে এলাম। বলে যতীন একটু লজ্জার হাসি হাসল, বলল, শিশিরের কাছে শুনলাম। আমার জিপ অচল। কাল সকালে আপনাকে গাড়ির ব্যবস্থা করে দেব।

কাল।

খুব সকালেই পাবেন। জিপটার ব্রেক ধরছে না ঠিক মতন। সারতে লাগিয়ে দিয়েছি।

 তবে তাই। সকালেই পাঠিয়ে দিয়ে। আমার বেশি দেরি হবে না। তুষার হাসল।

যতক্ষণ খুশি আপনি আটকে রাখবেন। কাল থেকে আমার চার পাঁচটা দিন নো-ওয়ার্ক। যতীন হাসল।

যতীনের বয়স বেশি নয়। চেহারাও ভাল। কাঠগোলার ব্যবসায় দু পয়সা মন্দ করছে না। ছেলেটি ভাল, ভদ্র, বিনীত। তুষারের হঠাৎ ইতির কথা মনে পড়ল। যতীনের কথা সাহেবদাদুকে বললে হয়।

চা খেয়েছ? তুষার শুধোল।

 খেয়েছি।

কী ঘুম ঘুমোলি তুই। শিশির বলল তুষারের দিকে তাকিয়ে, এই রেটে গোটা ছুটি ঘুমোলে মোটা হয়ে যাবি।

তুষার ভাইকে দেখল। শিশির তাকে ডেকে দিতে পারত। ডাকেনি। দিদির ওপর কত মায়া! হাই আসছিল তুষারের আবার, মুখে হাত আড়াল দিয়ে তুষার হাই তুলল, বলল, সারা বছর কাজ করি, ছুটিতে একটু ঘুমোব না? ..যাক গে, চা খাবে আর একটু যতীন?

খাবে। তুই তৈরি করে নিয়ে আয় তো! শিশিরই জবাব দিল।

রান্নাঘরে চলে গেল তুষার। স্টোভ ধরিয়ে চা করল। অবেলার ঘুম বড় আলসামি মাখিয়ে দেয় সারা গায়ে। তুষারের সর্বাঙ্গে সেই আলস্য, যেন তুলোর মতন কোমল, মনে হয় আবার গিয়ে বিছানায় চুপ করে শুয়ে থাকি। শুয়ে থেকে থেকে সন্ধ্যাকে দেখি, দেখি রাত কেমন করে আসে, কেমন করে সেই রাতের মধ্যে ডুবে যাই।

শিশিরদের চা দিয়ে, নিজে চা খেয়ে তুষার যখন রুক্ষ চুল নিয়ে বসেছে, তখন সন্ধে হয়ে আসছিল। আর ঠিক সন্ধের মুখে আদিত্য এল। ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে।

তুষার অবাক। মানুষটা এ-ভাবে এসেছে কেন? সে কি আজও যাবে না? ব্যাপার কী?

শিশিরের ঘরেই বসেছিল আদিত্য। কথা হচ্ছিল শিশিরের সঙ্গে। তুষার বলল, আমি ভেবেছিলাম আপনি চলে গেছেন।

কাল যাব। ..আদিত্য বলল, আজ একবার লাস্ট ভিজিট সেরে নিচ্ছি।

 শহরে আর কার সঙ্গে দেখা করতে আসবে আদিত্য। তুষারের ইচ্ছে হল পরিহাস করে বলে, মলিনার সঙ্গে দেখা হল? অথচ মনে মনে কোনও সাড়া পেল না তুষার। বলল না। মলিনাকে শেষ দেখা করার লোক বলে ভাবতেও পারল না।

কথাটা শিশিরই পাড়ল হঠাৎ। বলল, দিদি, তুই তো সঙ্গী পেয়ে গেলি।

সঙ্গী! তুষার ভাইয়ের দিকে তাকাল অবাক চোখে। আদিত্যবাবু তাঁর রথ নিয়ে এসেছেন। শিশির হাসিমুখে ব্যাখ্যা করল। আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল, দিদি শিশুতীর্থে যাবার জন্যে সকাল থেকে জ্বালাচ্ছে। আপনিই নিয়ে যেতে পারেন।

তুষারের ইচ্ছে হল শিশিরের মুখের কথা কেড়ে নেয়, থামিয়ে দেয়। কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই না কি ওর! অত দরদ দেখাবার কী দরকার পড়ল শিশিরের! তুষার বিরক্ত বোধ করে শিশিরের দিকে ভর্ৎসনার চোখে তাকাল। তুষার পাগল হয়নি। ওই মানুষের সঙ্গে পথে বেরিয়ে কি সে আরেক জ্বালার মধ্যে পড়বে না কি! না। শিশিরের কথার পর-পরই তুষার আপত্তি জানাতে গেল, না না, এখন নয়। সকালে যাবার দরকার হয়েছিল একটু!

আদিত্য, তুষারের দিকে প্রত্যাশার চোখে তাকাল। আমি ঘোড়ার গাড়িটা এনেছি চলুন।

না-না। তুষার মাথা নাড়ল।

না কেন–! শিশির বলল, চলে যা না। তোর অসুবিধে কী! জিনিসগুলো দিয়ে আসবি, বেড়ানোও হয়ে যাবে।

শিশিরের মূর্খতায় তুষার রাগ না করে পারল না। কে তোকে বলেছে ঘরের কথা ঢাক পিটিয়ে বাইরের লোকের কাছে বলতে? তোর অত মাথা ব্যথার দরকার কী? যা করার তুষার করবে। এমন অসভ্য আর মোড়ল হয়েছে শিশির! তুষার ভাইয়ের ওপর বিরূপ বিরক্ত হল।

আদিত্য কি এই অপ্রত্যাশিত সুযোগই খুঁজছিল! তুষার দেখল আদিত্য যেন উৎসাহের আবেগে প্রদীপ্ত। আতিশয্য প্রকাশ করে বলল, না কেন, চলুন, আমি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে যাব আবার।

এখন থাক; এমন কিছু জরুরি ব্যাপার নয়।

নাই বা হল। এমনি বেড়িয়ে আসবেন। …ঘোড়াটা ভাল ছুটছে, খুব মজা পাবেন। ইউ উইল এনজয় দি রাইড।

তুষার মাথা নাড়ল। না, এখন সে যাবে না।

আদিত্য অনুমান করতে পারল তুষারের আপত্তি কোথায়, কেন তুষার যেতে চাইছে না। আহত এবং ক্ষুব্ধ দেখাল তাকে। মুখ ম্লান। আদিত্যের দৃষ্টি যেন বলছিল, আমায় অতটা অবুঝ ভাবার কী আছে? আমি কি তোমার কোনও ক্ষতি করব?

শিশির দিদির এই হেঁয়ালি বুঝতে পারছিল না। যাবার দরকার যখন তখন ঘুরে আসুক না কেন। কালকের অপেক্ষায় বসে থেকে কী লাভ! যতীনের গাড়ি যদি ঠিক না হয়! যন্ত্রের কথা কে বলতে পারে! শিশির বলল, কাল সকালে যতীনের গাড়ি ঠিক না হলে আবার সেই গজ গজ করবি। হাতের সুযোগ পায়ে ঠেলে ফেলছিস তখন জলে পড়বি।

আদিত্য তুষারকে যেন ভাল করে লক্ষ করে নিল। গলায় সামান্য জ্বালা, বলল, বেশি বুদ্ধিমানরাও মাঝে মাঝে বোকামি করে।

আবহাওয়া কেমন আড়ষ্ট হয়ে উঠেছিল। তুষার বুঝতে পারল, ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু হয়ে উঠেছে। আদিত্য স্পষ্ট বুঝতে পারছে, তুষার তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে, তার সঙ্গে পথে বেরোতে রাজি হচ্ছেনা। স্বভাবতই নিজেকে অপমানিত বোধ করছে আদিত্য, ব্যথিত এবং ক্ষুব্ধ হচ্ছে। শিশিরই বা কী ভাবছে কে জানে। দিদির এই হঠাৎ আপত্তির কারণও কি সে অনুমান করতে পারছে। তুষারের মনে হল, শিশির বরাবরই যেন এই জিনিসটা লক্ষ করছে, আদিত্যের সম্পর্কে তুষারের কেমন যেন একটা সঙ্কোচ, এড়িয়ে থাকার চেষ্টা। কেন? শিশির কি এই কেন-র দিকে তাকিয়ে কিছু ভাববার চেষ্টাও করছে! বলা যায় না। সেদিন, আদিত্যর আসার কথা শুনে তুষার যে পালিয়ে গিয়ে বসেছিল শিশির পরে তা বেশ বুঝতে পেরেছে। বুঝে বলেছিল, ভদ্রলোককে তুই অত ভয় পাস কেন। কেন ভয় পায় শিশির কেমন করে জানবে।

তুষার অস্বস্তি বোধ করছিল। হঠাৎ বলল, এখন সন্ধে হয়ে গেছে, এসময় লাভ কী গিয়ে।

ওর এই কারণ দেখানো এখন যেন খুব জলল, ছেলেমানুষির মতন শোনাল। মনে হল, নিতান্ত একটা ছুতো দেখাবার জন্যেই কথাটা বলল তুষার। শিশির আদিত্যর চোখে চোখে তাকাল, তারপর দিদিকে দেখল। যাবি তো চার পাঁচ মাইল রাস্তা, তাও গাড়িতে তার আবার সন্ধে।

আদিত্য হাসল, হাসিটা ব্যঙ্গের। সন্ধে হয়ে গেলে পথে বোধ হয় ভূত বেরোয়।

তুষার বিদ্রূপ গায়ে মাখল না। মাখলে অন্য জালে জড়িয়ে পড়তে হবে। বরং সাধারণ ভাবে হেসে বলল, আপনার ভরসায় বেরিয়ে তারপর গাড়ি উলটে মরি।

কেন? আদিত্য তাকাল।

আপনাকে ভরসা কী! যদি লাগাম সামলাতে না পারেন, তবেই মরেছি।

কথাটার কি কোনও সূক্ষ্ম অর্থ ছিল। হয়তো, হয়তো নয়। আদিত্য দু মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, লাগাম ধরতে পারি কি পারি না একবার ট্রায়াল দিয়েই দেখুন। …অত সহজে মানুষ মরে না–গাড়ি উলটে গেলেও নয়।

তুষার তবু হাসল। যেন হাসিতেই তার শেষ বক্তব্য লুকোনো আছে। হাত পা ভাঙে তো!

 হাত পা ভাঙা এমন কিছু নয়। আবার জুড়ে যায়।

 শিশির অসহিষ্ণু হয়ে বলল, তোর খালি কথা। যাবি তো যা, না হয় যাস না। অত হ্যাঁ না করার কী আছে।

আদিত্য পকেট থেকে সিগারেট বার করল। দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালাতে জ্বালাতে বলল, সাহস না পেলেই কিন্তু থাকে। কী বলুন!

তুষার যেন কী ভাবছিল। হঠাৎ বলল, বেশ চলুন। আমি কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরব।

আদিত্যর মুখ দেখে মনে হল সে সন্তুষ্ট হয়েছে। এক মুখ ধোঁয়া জানলার দিকে উড়িয়ে দিয়ে ও বলল, তা হলে তাড়াতাড়ি বেরুতে হয়।

তুষার দ্বিতীয় কোনও কথা বলল না। বাইরে চলে গেল। ত্বরিতেই সে তৈরি হয়ে নেবে। চুল আর বাঁধবে না, রুক্ষ্ম চুল জড়িয়ে এলো খোঁপা করে নেবে, আর গায়ের শাড়িটা পালটে নেবে। কতক্ষণ আর লাগবে তার। সামান্যক্ষণ। ততক্ষণে সন্ধে আরও ঘন হয়ে আসবে। বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে তুষার আকাশের দিকে তাকাল। তারা ফুটেছে।

.

১৫.

আকাশের তলায় অন্ধকার। যেন কালো মোম দিয়ে সমস্ত আকাশটা কেউ ঘষে দিয়েছে। তারাগুলো সেই অন্ধকারে খচিত হয়ে আছে। এখন অনেকটা রাত। কত রাত কেউ জানে না। প্রসারিত অরণ্য ওদের চক্ষু থেকে সমস্ত সংসার আবৃত করে রেখেছে। তুষার একটা বড় পাথরের ওপর বসে, আদিত্য পাশের ছোট পাথরটার ওপর দাঁড়িয়ে। ঘোড়ার গাড়িটা সামান্য তফাতে। তার গায়ে টিমটিমে দুটো বাতি জ্বলছে। মাঝে মাঝে ঘোড়াটা পা ঠুকছিল, কদাচিত ঊর্ধ্বে মুখ তুলে অরণ্যকে তার সম্ভাষণ জানাচ্ছিল।

তুষার নীরব। শিশুতীর্থ সে অনেকক্ষণ আগে ফেলে এসেছে। ফেলে আসাই। এখন সেই রকম মনে হচ্ছে। যেন কোন সন্ধ্যাকালে একবার সেখানে গিয়েছিল, সাহেবদাদুর পায়ে পশমের চটিটা পরিয়ে প্রণাম করেছে, ইতিকে দিয়ে দিয়েছে তুষারের সেই ভাল-লেগে-যাওয়া শাড়িটা, আশাদির সঙ্গে দেখা করেনি আর, আদিত্যর গাড়িতে চেপে বসেছে আবার। আর আদিত্য তাকে কেমন অদ্ভুত যাদুমন্ত্র বলে যেন নিয়ে এসেছে এই পাহাড় সন্নিকট অরণ্যে।

সেও যেন কতক্ষণ, মনে হয় সময়ের হিসেব পাওয়া যাবে না। প্রতিটি মুহূর্ত যেখানে মাসান্ত বলে মনে হয় সেখানে এই দীর্ঘ সময় একটি যুগও মনে হতে পারে। কিন্তু তা নয়। কেননা ওই আকাশের এই অন্ধকার অচিরে হালকা হয়ে আসবে, আর তারপর একটি শীর্ণ চাঁদ দেখা দেবে, ষষ্ঠীর চাঁদ।

আদিত্যকে দেখা যাচ্ছে না। বৃক্ষছায়ার মতন অন্ধকারে সে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে।

তুষার হাঁটু ভেঙে বসেছিল। হাঁটুর ওপর চিবুক। তার দৃষ্টি আকাশ অথবা নক্ষত্রের শোভা দেখছে না। সামনের কয়েকটা পাথর, দু একটি বন্য চারা আর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে সে বসেছিল। প্রত্যহের স্বাভাবিক চেতনা থেকে সে ছিন্ন। যেন এই প্রকাশ্য চেতনা তার মনের অন্য কোথাও হারিয়ে গেছে, তুষার তাকে খুঁজে পাচ্ছিল না। তার যেন সে আগ্রহও ছিল না। হয়তো এই পরিত্যক্ত নির্জন নিস্তব্ধ জগতের মধ্যে নিজেকে সমর্পণ করে সে তৃপ্ত। হয়তো এই নিভৃতি এবং অন্তরাল তাকে মোহাচ্ছন্ন করেছে।

আদিত্য আজ সত্যই তুষারকে মোহাচ্ছন্ন করেছে। তুষার নিজের বোধ ও জ্ঞান ওই মানুষটির কাছে কেমন করে বিসর্জন দিতে পারল সে জানে না। অথচ আদিত্য যে ক্রমশ এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তুষারের স্বাভাবিক চেতনাকে অপহরণ করেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

সামান্য আগে কোনও বাক্যালাপ উভয়কে অকস্মাৎ এমন এক বেদনা দিয়েছিল যারপর স্তব্ধতা ভিন্ন উপায় ছিল না। আদিত্য তুষারের কাছ থেকে উঠে গিয়েছিল, তুষার অর্ধ-আনত চোখে সামনের অন্ধকার দেখছিল।

অবশেষে তুষার নিশ্বাস ফেলল। নিশ্বাস ফেলে মুখ তুলল। সন্নিকট অরণ্যের অন্ধকার যবনিকার মতন দাঁড়িয়ে আছে। সেই যবনিকার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে তুষারের মনে হল, জীবনের এই অপ্রকাশ্য রূপটি কেন স্থায়ী নয়। কেন? কেন এই রাত্রি, এই বিচ্ছিন্নতা, এমন মুক্তি সম্ভব হয় না?

আদিত্য আবার সামনে এল। কাছে। তুষারের পাশে নিচু পাথরটায় বসে পড়ল।

সমস্যার শেষ হয় না। আদিত্য বলল আচমকা, যেন তার ভাবনার একটি অসম্পূর্ণ অংশ ব্যক্ত করল। আমরা বড় মূর্খ, সব সময় সমস্যাটাকে বড় করে দেখি।

তুষার কোনও জবাব দিল না। বাতাস তার কপালের রুক্ষ চুলের গুচ্ছ চোখে ফেলছিল। কপাল থেকে চুল সরাল নিঃশব্দে।

আমি হিসেব করতে শিখিনি। আদিত্য বলল।

আদিত্যর মুখ দেখল তুষার। দেখা যায় না। অন্ধকারে ছায়ার মতন হয়ে আছে।

ছেলেবেলায় একটি মেয়ের সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল। আদিত্য কী ভেবে বলল, সে খুব হিসেবি ছিল। আমায় হিসেব করে দেখিয়েছিল আমার বয়স যখন বাইশ হবে, তার আঠারো–তখন আমাদের কোথাও কোনও বাধা থাকবে না। … হিসেবটা ভুল হবার কথা নয়; তবু তার ষোলো বছরে বিয়ে হয়ে গেল এক জুয়েলারের সঙ্গে।

আদিত্যর বাল্য-প্রণয় তুষারকে উৎসাহী করল না। সেই মেয়েটি যে বয়সে হিসেব শিখেছিল, হয়তো সেবয়সে ভাল করে কিছু শেখা যায় না।

আমরা কি নিজের গড়া জগতে বাস করি? আদিত্য আগের প্রসঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করল কথাটা।

করি না? তুষার মুখ ফেরাল আবার।

না, করি না।

তবে?

জানি না। আমার কোনও ইচ্ছে নেই জানার। আমি এই বাঁচাটুকু বিশ্বাস করি। যা আমার চোখের সামনে আমার হাতের কাছে, আমার প্রার্থনা সেখানে। এর বেশি জেনে আমার কী লাভ!

কী জানি! তুষার দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল।

অল্প সময় আবার নীরবতা। আদিত্য যেন আরও ঘন হয়ে এল তুষারের কাছে। কোনও মুহূর্তে প্রেমিকের মিনতির মতন তুষারের একটি হাত তুলে নিল। তুষার বাধা দিল না।

তুষার।

তুষার কথা বলল না। তার হৃদয় যেন আবার কেমন আশ্চর্য কুহকে আচ্ছন্ন হচ্ছিল।

 আমার সমস্ত কিছুই ছেলেমানুষি নয়। আদিত্য তুষারের হাঁটুর এত কাছে মুখ এনেছিল যে, তুষার উষ্ণ নিশ্বাস পাচ্ছিল। তুমি আমায় বিশ্বাস করতে পারো।

কে অবিশ্বাস করেছে।

তুমি।

না।

তা হলে?

তা হলে কী? কেন তুষার স্বীকার করছে না, আদিত্যর ভালবাসা সে নির্দ্বিধায় গ্রহণ করছে। আমি তোমার এই প্রেম আমার প্রাণকে নিতে দিয়েছি আদিত্য, আমার কোনও কুণ্ঠা নেই, আমি সুখী। তুষার যদি অবিশ্বাস না করবে তবে আদিত্যর প্রেমকে উদ্দেশ্য করে অনুচ্চারিত ভাবে এই কথাগুলো বলতে পারত। পারা উচিত ছিল। তুষার তা পারছে না। এই প্রেম তার কাছে মধুর, এর স্বাদ তাকে বহুক্ষণ পূর্ব থেকেই রোমাঞ্চিত করছিল, আদিত্যর হাতের তালুর মধ্যে কিছুক্ষণ আগে সে আরও একবার এখনকার মতন নিজেকে সমর্পণ করে বসেছিল। তখন যেন তুষার এই মুহূর্তেরও অধিক আনন্দ পেয়েছিল। এখন যেন সেই আনন্দ ঈষৎ হ্রাস পেয়েছে।

রাত হয়েছে অনেক। তুষার বলল।

আদিত্য তুষারের হাত নরম করে নিজের দিকে আকর্ষণ করল, মুখের পাশে রাখল। তুষার তার সমস্ত মমতা হাতে নির্ভর করতে চাইল। তার বুকের তলায় এখন যেন একটি তুলোর হৃদয় সমস্ত অনুভূতিকে স্নিগ্ধ কোমল করতে চাইছিল।

তুষারের নরম হাত নিজের মুখ গাল কপাল এবং চোখে রাখছিল আদিত্য। বুলিয়ে নিচ্ছিল। আহত কাতর ব্যক্তি যেমন করে স্বস্তি ও শান্তির স্পর্শ পেতে চায়, আদিত্য সেই ভাবে তুষারের করতল নিজের উষ্ণ মুখে রাখছিল।

তুষারের অঙ্গে শিহরণ ছিল। কিন্তু ক্রমশ তার স্নায়ু শিহরণকে সহনশীল করে তুলেছে।

ফিরতে হবে। তুষার বলল চাপা গলায়।

না। আদিত্য ছেলেমানুষের গলায় জবাব দিল।

না ফিরে তারপর?

কিছু না। আমরা বসে থাকব।

পাগলামি। তুষার বিষণ্ণ মধুর করে হাসল।

আদিত্য তুষারের আঙুল নিজের ঠোঁটে রাখল! ফুলের পাপড়ির মতন আলগা করে বুলোতে লাগল।

তুমি ওই গানটা কেন গাইলে, তুষার। আদিত্য কাতর ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল, যেন অভিমানের পর এখন সে আঘাত প্রকাশ করছে। এই মণিহার তোমায় কেন সাজবে না?

তুষার আজ ওই গানটা গেয়েছিল। আদিত্য তাকে দিয়ে গাইয়েছিল। তুষার জানত না কী গান গাইবে। গাইতে শুরু করে তার কণ্ঠ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই ওই গানের কলিটা এসে গিয়েছিল। কেন এসেছিল তুষার জানে না।

তুমি ভিতু। আদিত্য বলল, তোমার মনে সাহস নেই।

নেই।

কেন নেই?

কী করে জানব।

তুমি সমস্ত জান। তুমি জান একে ছেঁড়া কষ্টের।

একে পরাও যায় না, কষ্ট হয়।

ওটা তো গানের কথা।

আমার কথাও।

তুষার-আদিত্য পাগলের মতন মাথা নাড়ল। না, না; গানের কথাকে তুমি তোমার কথা বোলোনা । আদিত্য তুষারের করতল চুম্বন করল, তুষারের হাত দিয়ে নিজের চোখ ঢাকল। মনে হচ্ছিল এই প্রত্যাখ্যান আদিত্য স্বীকার করবে না। তুষার তুমি আমার কষ্ট দেখছ না।

কষ্ট।

 আমি তোমায় কী করে বোঝাব…

আমি বুঝি। তুষার আবার হাত টেনে নিল। বলল, আর দেরি করা যায় না। ফিরতে হয়।

আদিত্য উঠল না। তার স্বাভাবিক উত্তেজনাও এত প্রখর নয়। এখন সে আরও ব্যাকুল, উদভ্রান্ত, অস্থিরচিত্ত। জ্ঞানহীনের মতন আদিত্য তুষারের পায়ে–জানুর ওপর মুখ রাখল। ফিরে গেলে তুমি আবার বদলে যাবে।

শিশির ভাবছে। অনেক রাত হয়ে গেল। তুষার আদিত্যর মাথা সরাতে গিয়ে কয়েক মুহূর্ত তার চুলে হাত রাখল। কষ্ট হচ্ছিল তুষারের। এই স্পর্শ আর কোনওদিন অনুভব করবে না তুষার।

আদিত্য শিশুর মতন তুষারের জানুতে মুখ রেখে যেন কাঁদছিল। তুষার নিঃসাড় হয়ে বসে। ঘোড়াটা অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠল। তার পা ঠুকছিল। এই নিস্তব্ধ আবহাওয়ায় পশুটার কর্কশ ডাক বন্যজন্তুর কান্নার মৃতন শোনাল।

ওঠো! তুষার নিবিড় করে ডাকল, আদিত্যর মাথা সরিয়ে দিল কোমল করে, আর রাত করা উচিত না।

আদিত্য উঠল। ঘোড়াটা বড় অস্থির হয়ে পড়েছে। একেবারে বুনো ঘোড়া। এত অন্ধকার আর রাত্রে ওই ঘোড়াটাকে সামলে নিয়ে যাওয়া খুব মুশকিল।

.

আদিত্য উঠে দাঁড়িয়েছে দেখে তুষারও উঠে দাঁড়াল। পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকার দরুন তুষার নিজেকে আদিত্যর চেয়ে অনেক দীর্ঘ মনে করল। তার মনে হল, এই উচ্চতা তাকে রক্ষা করেছে।

সম্পূর্ণ নীরবতার মধ্যে দুটি মানুষ গাড়িতে এসে বসল। আদিত্য সামনে, তুষার পিছনে। গাড়িটা ছোট। পিছনের দিক নিচু হয়ে আছে। পাদানে পা রেখে তুষার সামনের কাঠে হাত রেখে হেলে বসল। আদিত্য ঘোড়ার লাগাম ধরে। ঘোড়াটার মুখ ঘুরিয়ে নিল আদিত্য।

জঙ্গলের পথ; গাড়িটা উঁচু নিচু রুক্ষ অসমতল পথ দিয়ে যাবার সময় লাফিয়ে উঠছিল, কাত হয়ে যাচ্ছিল। তুষার সেই ঝাঁকুনিতে গড়িয়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিচ্ছিল।

এই রাস্তাটা তুমি জানো? আদিত্য বলল।

না।

কখনও আসোনি আগে?

 কই আর এসেছি

 ডান দিকে গেলে আমরা পাহাড়ে গিয়ে পড়ব।

আমরা তো বাঁ দিকে যাচ্ছি।

তোমার শিশুতীর্থের দিকে।

সামান্য সময় আর কথা হল না। ঘোড়াটা বোধ হয় তার চেনা পথের গন্ধ পেয়েছে বলে এখন খানিকটা শান্ত হয়ে পথ চলছিল। বাতির আলো এত অনুজ্জ্বল যে পথ ভাল করে দেখা যায় না। আদিত্য হাত বাড়িয়ে গাড়ির গায়ে ঝুলোনো বাতির শিখা আরও উজ্জ্বল করে দিল।

আমার ভাগ্য খুব খারাপ, তুষার। আদিত্য বলল। আমার মার ভাগ্য নিয়ে আমি জন্মেছি।

 উনি না আত্মহত্যা করেছিলেন?

সম্মানে লেগেছিল বলে।

আত্মহত্যায় কোনও লাভ নেই।

আমি বোকা নয়। মরব না।

আমার কেমন মনে হয়–

কী?

 তুমি পাহাড়ের খারাপ জায়গায় দাঁড়িয়ে আছ। ভয় করে।

আমি ইচ্ছে করলে অন্ধকারে ঝাঁপ দিতে পারি। কিন্তু দেব না।

 এত বেপরোয়া, অবুঝ হলে চলে না। সংসার কেবল খরচ করার জায়গা নয়। তুমি কেন নিজেকে খরচ করে ফুরিয়ে যাচ্ছ?

আমি ফুরিয়ে যাচ্ছি কিনা জানি না। একটা কিছু হয়ে ওঠার জন্যে আমি পাগল। আমার কিছু হচ্ছে না।

হবে। আরও পরে। তোমার এই অস্থির স্বভাব একদিন শান্ত হয়ে এলে তুমি নিজেকে বুঝতে পারবে।

আদিত্য কথা বলল না। ঘোড়ার খুরের শব্দ এবার কানে যাচ্ছিল, সামনের পথ অনেকটা সমতল। তুষার আদিত্যর শক্ত কালো পিঠের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকল।

খানিকটা পথ শেষ হল। এবার রাস্তা পাওয়া যাবে। আদিত্য ঘোড়াটার লাগাম আলগা করে দিল।

আমি তোমার কথা ভুলব না। আদিত্য বলল।

 জোর করে কিছু বলা ঠিক না। তুষার মৃদু গলায় বলল।

আদিত্য কথাটা শুনল কিনা বোঝা গেল না। ঘোড়ার পিঠে আলগা করে চাবুক কষাল।

এই শিশুতীর্থ তোমায় কতকাল ধরে রাখবে, আমার জানতে সাধ হয়। একদিন তোমার কাছে এর দাম থাকবে না। আদিত্য মুখ ফেরাল না, সামনের দিকে তাকিয়েই বলল।

আমি জানি।

জান! আগে তো বলোনি?

আগে জানতাম না, এখন জানতে পেরেছি। তুষার নিজের মনের সঙ্গে কথা বলার মতন করে বলল। আমার ভাগ্যও খুব সুখের নয়, আমার চারপাশের দায় দায়িত্বও কম নয়।

তুমি খুব সাবধানী।

 কে জানে! ..

ঘোড়াটা রাস্তা পেয়ে গেছে। আদিত্য অনুভব করল তার হাতের লাগামটা আলগা, ঘোড়াটা কদমের জোর বাড়িয়েছে।

তুষার কপাল থেকে চুলের গুচ্ছ সরাল। ভাল করে গুছিয়ে বসল। গাড়িটা আর তাকে অস্বস্তি দিচ্ছে না। অন্ধকারের মোম ঘষা পৃথিবী কেমন নরম হয়ে এসেছে।

এবার চাঁদ উঠবে। আদিত্য বলল।

আজ ষষ্ঠী, এতক্ষণে ওঠা উচিত। তুষার আকাশের দিকে তাকাল।

 চাঁদ ওঠেনি এখনও, উঠবে বলে আকাশের একদিকে অন্ধকার ফিকে হয়ে এসেছে।

 তোমাদের শিশুতীর্থ–আদিত্য হাত বাড়িয়ে অদুরের দু একটি মৃদু আলো দেখল।

তুষার বুঝতে পারল, সাহেবদাদুর ঘরে বাতি জ্বলছে, বাতি জ্বলছে আশাদির ঘরে, আরও কোথাও কোথাও। জোনাকির আলোর মতন বিন্দু বিন্দু আলোগুলো দেখে তুষার অনুভব করল, সে আর-এক জগত পেরিয়ে নিজের জগতে এসে পড়েছে।

ঘোড়াটা ছুটতে ছুটতে হঠাৎ ডেকে উঠল। আর তখনি তুষার দেখল, আকাশে চাঁদ উঠেছে, শীর্ণ চাঁদ।

শিশুতীর্থ পেরিয়ে এল গাড়িটা। চাঁদ ম্লান আলো এনে ওদের গাড়িকে পথ দেখাল এতক্ষণে। আদিত্য ঘোড়ার পিঠে আবার চাবুক মারল। ঘোড়াটা একবার পিছু দিকে লাফিয়ে উঠে হঠাৎ দ্রুততা আনল তার ছোটার বেগে।

তুষার অবলম্বনটা আঁকড়ে ধরল।

তোমার দুঃখ হচ্ছে না, তুষার? আদিত্য শুধোল।

হচ্ছে। মাথা হেলিয়ে তুষার বলল।

কীসের দুঃখ?

কীসের দুঃখ তুষার কেমন করে বোঝাবে। হয়তো সে নিজের সঙ্গে প্রবঞ্চনা করেই এই দুঃখ লাভ করল। সুখ পাবার লোভে সে গিয়েছিল, সুখ পেয়ে আবার সেই সুখকে হারিয়ে এল, কেননা এই দুঃখ তাকে প্রলুব্ধ করেছিল।

বললে না! আদিত্য আবার শুধোল।

তুষার অস্বস্তি বোধ করল। সে কিছু বলতে চায়, পারছে না। আদিত্যকে নিজের হিসেবটা দেখাতে বিব্রত বোধ করছিল তুষার।

গাড়ি আরও এগিয়ে এল। তুষার নিচু গলায় বলল, বুঝতে পারছি না।

তুমি কিছুই বুঝতে পার না।

সত্যিই তুষার কিছু বুঝতে পারে না। সে বুঝতে পারছে না, কেন সে আদিত্যর সঙ্গে এই অভিসারে এসেছিল। সে জানত, তার অভিসার সত্য নয়, সে আদিত্যকে গ্রহণ করতে পারবে না, সে এই ছেলেমানুষির খেলায় নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারবে না, তবু সে এসেছিল। কেন?

হয়তো তুষার তার মহিমা দেখতে চেয়েছিল, হয়তো তুষার জানতে চেয়েছিল, সে মলিনার ঊর্ধ্বে কি না, হয়তো তার ইচ্ছা হয়েছিল এই খেলায় সুখ কেমন তা অনুভব করবে।

আদিত্য পথে আলো পেয়ে ঘোড়াটাকে চাবুক কষাচ্ছিল। পর পর। আর বন্য ঘোড়াটা দুরন্ত হয়ে উঠেছিল, সে যেন হিংস্র উন্মত্ত। তার গতিতে কোনও সংযম ছিল না, সাবধানতা ছিল না।

ঘোড়াটা বড় খারাপ ছুটছে। তুষার বললে শঙ্কিত গলায়।

আর সামান্য পথ। আদিত্য জবাব দিল।

এই ভয়ে কি তুষার এতক্ষণ পরে নিজের চেতনাকে আবিষ্কার করল! অকস্মাৎ তুষারের কাছে এই রাত্রির রহস্য মরে গেল।

যে জগত তুষারকে মোহাচ্ছন্ন আবৃত ও পৃথক করেছিল, এখন সেই জগত স্বপ্নের জগতের মতন দূরে পড়ে থাকল। খেলার জগৎ থেকে ফিরে এল তুষার, ফিরে এসে দেখল, পথের ধুলোয় চাঁদের আলো মেটে রং ধরে আছে, মাঠ-ঘাট তার চেনা, দেখল, ট্রেন লাইনটা সামনে।

নিজের প্রাত্যহিক জগতের দিকে তাকিয়ে তুষারের মনে হল যে জগত থেকে সে ফিরে এল তার সবটাই সোনার ছিল, স্বর্গের। তার খেলনাগুলো কেবল দ্যুতি ঠিকরে দেয়, তারা চোখকে বিস্মিত ও মুগ্ধ করে, সেই মণিমাণিক্য বিহ্বল হয়ে দেখার মতন, কিন্তু তাকে ব্যবহার করা যায় না।

তুষার এমন খেলনা নিয়ে কিছু করতে পারত না। তার ব্যবহারযোগ্য জিনিস ওটা নয়।

গাড়িটাকে আদিত্য আরও বেপরোয়া ভাবে ছোটাচ্ছিল। যেন তার কোনও দিকে গ্রাহ্য নেই, মমতা নেই। দুরন্ত কোনও নেশা তাকে ছোটাচ্ছে, কিসের আক্রোশ তাকে উন্মত্ত করে রেখেছে।

ধাবমান গাড়িতে বসে তুষার অনুভব করতে পারল, আদিত্যর প্রেম এই রকম, অসাবধান অসতর্ক, দুঃসাহসী ও দুরন্ত; অতি দ্রুততায় তার সমস্ত উত্তজনা প্রখর পৌরুষের মতন দেখায়, অথচ এমন অনিশ্চয় যে, যেকোনও সময় তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে পারে।

তুষার স্বীকার করল, জীবনকে এমন করে সে অনিশ্চয়ের মধ্যে ফেলে দিতে পারত না। হয়তো স্তিমিত শান্ত সুস্থির কোনও ভালবাসা সে কামনা করেছিল। হয়তো মলিনা তা পাবে। পাক। তুষার জ্যোতিবাবুর জন্যে আন্তরিক কষ্ট পেল। অনুভব করল, তার হৃদয়ে শূন্যতা বিচরণ করছে।

রেল লাইনের লোহায় অশ্বখুরের স্ফুলিঙ্গ তুলে গাড়িটা লাফ মেরে অন্য পারে চলে গেল।

ভীত কণ্ঠে তুষার বলল, আমায় নামিয়ে দিন।

আদিত্য তুষারকে নামাল না।

.

বাড়ির কাছে এসে আদিত্য গাড়ি থামাল। তুষার নামল। তার সর্বাঙ্গ কাঁপছিল। এই ভ্রমণ যে কী ভয়ঙ্কর তুষার যেন এখন তা সম্পূর্ণ অনুভব করতে পারছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *