২. বিকেলের শেষ মলিন-আলোয়

০৬.

সেদিন বিকেলের শেষ মলিন-আলোয় তুষার অবাক হয়ে দেখল আদিত্য তার বাড়ির গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

আপনি? তুষার বাগানে জল দিয়ে ঝারি হাতে দাঁড়িয়েছিল। শুকনো মাটিতে সদ্য জল পড়ে সোঁদা গন্ধ উঠছে। পাশে কয়েকটা কলকে ফুল বাতাসে দুলছিল।

গেটের মধ্যে সাইকেল ঢুকিয়ে আদিত্য বাগানের সদরে পা দিল। খোঁজ নিতে এলামআদিত্য বলল অক্লেশে। গেটটা বন্ধ করল না।

তুষার মাটিতে ঝারি নামিয়ে রাখল। তার পরনে সাদামাটা শাড়ি, গায়ের জামাটা বাসন্তী রঙের। এখনও চুল বাঁধেনি তুষার। পিঠময় চুল ছড়িয়ে আছে।

আসুন। তুষার নিজেকে সামলে নিয়ে বলল। সে বুঝতে পারছিল না, খোঁজ নিতে এলাম কথাটার অর্থ কী।

আদিত্য সাইকেল ঠেলে সিঁড়ির কাছে এগিয়ে গেল। তার ভঙ্গিতে কোনও আড়ষ্টতা নেই। যেন এইভাবে সে রোজই এখানে আসে।

গেটটা তুষার বন্ধ করে দিল। বিকেলের আলো আর নেই। শুন্যের রং ময়লা। গাছের মাথায় পাখিরা কলরব করছে। গেট বন্ধ করে ফেরার সময় শিউলি ফুলের ঈষৎ গন্ধ পেল তুষার।

সাইকেলটা একপাশে ফেলে রেখে সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আদিত্য সিগারেট খাচ্ছে। এই মাত্র ধরিয়েছে। তুষার লক্ষ করল, আদিত্য আজ প্যান্ট আর হাতকাটা শার্ট পরে এসেছে। এই পোশাকটা সেদিনও পরে এসেছিল আদিত্য যেদিন শহরে আচমকা দেখা হয়ে গেল তুষারের সঙ্গে। তুষার বাজারের দিকে মণিদির বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিল–ফেরার পথে আদিত্যকে বান্ধব চা কেবিনের পাশে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল। তুষার একটু অবাক হয়েছিল। পরিচিত লোককে পথে দেখলে মানুষ হন হন করে চলে যেতে পারে না। তুষারও পারেনি। আদিত্য সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এল।

আদিত্য তার শহরে আসার কৈফিয়ত দিতে চায়নি। কিন্তু কথায় কথায় বলেছিল, কিছু জিনিসপত্র কিনতে সে শহরে এসেছে। তুষার পথে-ঘাটে বাজারে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, আর এই সদর বাজারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলা তার স্বভাবের বাইরে। তুষার হাঁটতে আদিত্যও পাশে পাশে আসতে লাগল। কথা বলছিল অনর্গল। তুষার একান্ত সৌজন্যবশেই সেদিন ওকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে এসেছিল। আমন্ত্রণ না জানালে ব্যাপারটা খুবই দৃষ্টিকটু হত।

আজ আবার আদিত্য এসেছে। নিজেই।

তুষার সিঁড়ির কাছে আসতে আসতে গায়ের আঁচল আরও সামান্য ঘন করে জড়িয়ে নিল।

বাজারে এসেছিলেন? তুষার মুখ তুলে ভদ্র আলাপে বলল।

না। আদিত্য মাথা নাড়ল। আঙুল দিয়ে সিগারেটের মুখের ছাই পরিষ্কার করল। এক বিন্দু রক্তের মতন আগুনের ঢিপ জ্বলতে লাগল।

সিঁড়িতে পা দিল তুষার। দুধাপ উঠে কী ভেবে একটু দাঁড়াল, সাইকেলটা দেখল। জ্যোতিবাবুর সাইকেল? কথাটা এমন স্বরে বলল তুষার যেন মনে হয়, পরের সাইকেল আরও একটু যত্ন করে রাখতে হয়।

আদিত্য বোধ হয় কথাটা শুনল না। শুনলেও কিছু বুঝল না। বলল, আপনি গাছে জল দেন?

 প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে না পেরে তুষার তাকাল চোখ তুলে। আদিত্যর মুখে হাসি, হাসিটা পরিহাসের না উপহাসের বোঝা মুশকিল।

তুষার ভাবল এক মুহূর্ত। বলল, ছুটির দিন ছাড়া বড় একটা সময় হয় না। এই দুদিন সামান্য যত্ন করি।

এবার একটা তপোবন করে ফেলুন। আদিত্য উপহাসের হাসি হাসল।

তুষার কিছু বুঝল না, অথচ আড়ষ্ট বোধ করল হাসির শব্দে।

বৃক্ষলতা, হরিণ শাবক…, আপনি তো প্রায় শকুন্তলা হয়ে উঠেছেন। আদিত্য হাসছিল, হাসতে হাসতে সিগারেটটা ছুঁড়ে দিল বাগানে।

তুষার বুঝল। বুঝে কেমন লজ্জা পেল। বলল, হরিণ কোথায় দেখলেন?

দেখিনি। কিন্তু চতুষ্পদ জন্তু ছাড়াও তো জন্তু আছে, তাদেরও শাবক থাকে। আপনার দ্বিপদ শাবক তো কয়েক গণ্ডা।

তুষার রাগ করল না। আদিত্যর কথা বলার ধরন সে জানে। এমন নয়, সব কথা আদিত্য বুঝে বলে, বিবেচনা করে বলে। ঠোঁটের গোড়ায় কথাকে ও-মানুষটা লাগাম পরাতে পারে না।

আপনি গাছপালাও পছন্দ করেন না? তুষার স্নিগ্ধ স্বরে বলল।

না।

 ওরা তো জন্তু নয়। তুষার জন্তু শব্দটার ওপর জোর দিল। আদিত্য শিশুতীর্থের ছেলেমেয়েদের জন্তু বলে গণ্য করে।

জন্তুর সমান। আদিত্য জবাব দিল।

তুষার বারান্দায় উঠে এসেছিল। এক পাশে বেতের একটা চেয়ার সব সময় পড়ে থাকে বারান্দায়। আজ চেয়ারটা ছিল না। মেরামত করার জন্যে শিশির পাঠিয়ে দিয়েছে। ইতস্তত করে তুষার বলল, বসার কিছু এনে দি, আপনি বসুন।

আদিত্য বাধা দিল সঙ্গে সঙ্গে। বসার কিছু দরকার নেই আমার। আমি বেশ দাঁড়িয়ে আছি। দাঁড়াতে আমার কষ্ট হয় না।

তুষার কান দিল না কথায়। ভেতরে চলে গেল চেয়ার আনতে।

সামান্য পরেই ফিরে এল তুষার। কাঠের চেয়ার বয়ে এনে রাখল। আদিত্য পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাড় মুখ মুছছিল।

আমি সিঁড়ির ওপর বসতে পারতাম। আদিত্য বলল।

সিঁড়ির ওপর বসবেন কেন ময়লায়। চেয়ার দেখাল ইঙ্গিতে তুষার, বসুন।

আপনি?

 আমি দাঁড়িয়ে আছি। আপনি বসুন।

উঁহু-আপনিই বসুন, আমি এই সিঁড়িতে বসছি।

না, না–সে কি! ছি! তুষার বিব্রত কণ্ঠে বলল।

আদিত্য হাসল। পদপ্রান্তে বসাই কি ভাল না?

 তুষার কথাটা শুনতে না শুনতেই ফুরিয়ে গেল। যেন লহমার জন্যে একটি শিখা তাকে স্পর্শ করে অদৃশ্য হল। বিমূঢ় বোধ করল তুষার। অর্থটা বুঝল কি বুঝল না স্পষ্ট করে, কেমন শিহরিত ও সঙ্কুচিত হল। নতচোখে বারান্দার অন্ধকার দেখছিল।

আদিত্য কথা বলল। আমায় বসতে দিয়ে আপনি দাঁড়িয়ে থাকলে আতিথ্য পালন করা হয় বটে, কিন্তু উদ্দেশ্যটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

উদ্দেশ্য?

 হ্যাঁ। অর্থাৎ অতিথিকে বিদায় করতে চান বলেই একতরফা ব্যবস্থা।

কই না, আমি তেমন কিছু ভাবিনি। তুষার সবিস্ময় কুণ্ঠায় বলল।

সব কিছু বলতে হয় না। ব্যবহার অনেক কিছু প্রকাশ করে।

আপনি বসুন, আমি একটু কাজ সেরে আসছি।

অপেক্ষা করব?

তুষার জবাব দিল না। পাশের দরজা দিয়ে ঘরে চলে গেল।

ঘরে এসে তুষার হাঁপ ছাড়তে পারল। এ-রকম মানুষ সে আর দেখেনি। সন্দেহ হয়, লোকটা সভ্য সমাজে মিশেছে কি না। অভদ্র… তুষার কথাটা বলতে গিয়েও পারল না, আটকাল। কেন আটকাল? সৌজন্য জ্ঞানহীন ওই অদ্ভুত মানুষটাকে আর কী বলা যায়? অসভ্য, ইতর..?

না। তুষার বিরক্ত হয়েছে বলেই একজনকে অত সহজে অভদ্র বা ইতর বলতে পারে না। তুষারের স্বভাবই সে-রকম নয়। সে কখনও জোরে, রাগ করে কিংবা জ্ঞান হারিয়ে কিছু করে না, করতে পারে না। আদিত্যর কথাবার্তা আচরণে অস্বস্তি এবং সঙ্কোচ বোধ করেছিল তুষার, কিন্তু রাগ করেনি।

নিজের ঘরে দাঁড়িয়ে তুষার টেবিলের বাতিটা দেশলাই দিয়ে জ্বালিয়ে দিল। ঘরগুলো অন্ধকার হয়ে গেছে। বাইরে উঠোন ও দালানে সন্ধ্যা নেমে গেছে। গঙ্গাকে দেখতে পাচ্ছে না তুষার। গঙ্গা কি এখনও কুয়াতলায়?

শিশিরের ঘরে কোনও সাড়াশব্দ নেই। তুষার বাইরে বারান্দায় এসে নিচু গলায় গঙ্গাকে ডাকল– গঙ্গা, এই গঙ্গা। দালানের ওদিকে পিছন কুয়াতলায় গঙ্গা দাঁড়িয়ে আছে।

ডাক শুনে গঙ্গা তাকাল, হন হন করে এগিয়ে এল।

 বাতি জ্বালবি না? তুষার বলল।

 জ্বালব। গঙ্গা মাথা নাড়ল।

আর কখন জ্বালবি? রাত হয়ে গেলে?

গঙ্গা উঠোন বারান্দা ঘরের দিকে তাকিয়ে যেন অন্ধকার পরীক্ষা করে নিল। যেন দেখে নিল, এই অন্ধকার বাতি জ্বালার উপযুক্ত অন্ধকার কি না। তারপর বাতি জ্বালতে চলে গেল।

শিশির অন্ধকারে শুয়ে ছিল। সে এই ভাবে শুয়ে থাকে। সে বিকলাঙ্গ। পায়ের দিকটা আজও চেয়ারের পায়ার মতন সরু, বেঁকানো বেতের মতন বেঁকা। ছেলেবেলায় পোলিও হয়েছিল। চিকিৎসা করেছিলেন বাবা সাধ্য মতন, দুবার অপারেশন করা হয়েছিল, দেড় বছর ছিল হাসপাতালে কিছু হয়নি। ডাক্তারে বলেছিল আরও সাতবার অপারেশন করতে হবে। বাবা রাজি হননি। প্রাণটা তবু তো আছে ছেলেটার, সেটুকুই থাক।

এই বাড়ি, সামান্য কিছু জমিজমা–সবই বাবা ছেলের মুখ চেয়ে করেছিলেন। তুষারের জন্যে তাঁর ভাবনা ছিল না। তিনি জানতেন, মেয়ে তাঁর জীবনের ঢেউয়ের তলায় ডুবে যাবে না, প্রয়োজন হলে একটা ব্যবস্থা সে করে নিতে পারবে। কিন্তু শিশির…?

শিশিরের কথা ভেবেই যা কিছু ব্যবস্থা, কিন্তু তুষার সেই ব্যবস্থার শরিক তো নিশ্চয়, এমনকী এর দায়-দায়িত্বও তুষারের ঘাড়ে চাপানো। তুষার না থাকলে বাবা বোধ হয় পাগল হয়ে যেতেন।

ভাইয়ের ঘরে ঢুকে তুষার অন্ধকারে বিছানার দিকে তাকাল। জানলার কাছে বিছানা। বালিশ সাজিয়ে শিশির নিত্য দিনের মতন বসে আছে।

শিশির

উঁ—

সন্ধে হয়ে গেল রে! দাঁড়া বাতি জ্বালি। তুষার অন্ধকারে ঘরের মধ্যে দেশলাই খুঁজতে লাগল।

কে এল রে দিদি, তখন?

সেই ভদ্রলোক। তুষার কেন যেন বিব্রত বোধ করল সামান্য।

শিশির সাইকেলের শব্দ শুনতে পেয়েছিল। এখান থেকে তাকালে বাইরের বাগান রাস্তা দেখা যায় বটে, কিন্তু গেটের দিকটা ঠিক মতন চোখে পড়ে না। সাইকেলের শব্দে শিশির গেটের দিকে তাকিয়ে আগন্তুককে দেখতে পায়নি। গঙ্গা বাতি দুলিয়ে আসতেই তুষারের খেয়াল হল, সে বোকার মতন দেশলাই খুঁজছিল। এ-ঘরের বাতিটা পরিষ্কার করার জন্যে গঙ্গা বিকেলেই বাইরে নিয়ে গিয়েছিল।

তুষার বাতি নিল গঙ্গার হাত থেকে। সব ঘরে বাতি দিয়েছিস?

 মাথা নাড়ল গঙ্গা, দিয়েছে।

একটু জল ছিটিয়ে দে লক্ষ্মী, চৌকাটে। তুষার বলল, বলেই আবার যোগ করল, তোর উনুন ধরিয়েছিস?

চুলায় অনেক আগ৷ গঙ্গা জবাব জিল। গঙ্গা হিন্দুস্থানি ঝি–এদেশের লোক, অনেক কাল এ বাড়িতে কাজ করছে, বাংলা বলে হিন্দি মিশিয়ে মিশিয়ে।

মুহূর্তের জন্যে ভাবল তুষার। আদিত্যকে চা দিতে হয়। আতিথ্য। চায়ের সঙ্গে আর কী দেবে? কুচো নিমকি না পাঁপড় ভাজা? ডিম ভেজে দিলে কেমন হয়? ঘরে অন্য কিছু আছে বলে মনে হল না।

ডিম আছে রে? তুষার শুধোল গঙ্গাকে।

আছে। গঙ্গা মাথা দুলিয়ে জানাল, আছে। তুষার চায়ের জল চড়াতে বলল। তুই বাইরে একটা বাতি দিয়ে চায়ের জল চাপিয়ে দে, আমি আসছি।

গঙ্গা চলে গেল। তুষার ভাইয়ের দিকে তাকাল।

সদ্য আলো পেয়ে অন্ধকার ঝাপসা ঘরটা অনেকখানি দৃশ্যময় হয়ে উঠেছে। শিশিরের বিছানার পায়ের দিকটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। শিশিরকেও দেখা যাচ্ছিল। তুষার ভাইয়ের বিছানার কাছে সরে এল। শিশিরের মুখ চোখ বিশেষ করে চোখ দুটি বড় সুন্দর দেখতে। ভাই-বোনের মুখের আদলে মিল আছে। তবে তুষার আরও ফরসা, আরও লাবণ্যময়। শিশিরের চোখ তুষারের চেয়ে সুন্দর। কেন সুন্দর বলা মুশকিল। হয়তো ঘন কালির মতন কালো পুরু জোড়া ভুরুর জন্যে চোখ দুটি অমন সুন্দর দেখায়, হয়তো শিশিরের চোখের দৃষ্টিতে যে অসহায় বেদনা মেঘলার মতন মাখানো–তার জন্যেই করুণাবশত ওর চোখ অনেক সুন্দর মনে হয়।

আজ একটুও বাইরে বসলি না রে? তুষার ভাইয়ের বিছানার পাশ ঘেঁষে এসে বসল।

শিশির কোনও জবাব দিল না কথার। বালিশের পাশে একটা বই উপুড় করা ছিল। শিশির বইটা । মুড়ে রাখল। আমাকেও আর এক পেয়ালা চা দিস, দিদি।

দেব। আর কী খাবি?

 কিছু করবি তুই?

যা খেতে চাস বল, করব।

কর যা হয় একটা। শিশির হাই তুলল। ভদ্রলোককে বাইরে বসিয়ে রেখে তুই দিব্যি ঘরে ঢুকে পড়লি। শিশির কৌতুকের মুখে হাসল।

তুষার গলার হারের আংটটা নখ দিয়ে টিপছিল। চোখ তুলে তাকাল। বলল, কী বিপদে পড়লাম দেখ তো। এখনও আমার চুলটা পর্যন্ত বাঁধা হয়নি, সন্ধে উতরে গেল। বাইরে লোক এসে বসে।

তুই রাত বারোটায় যদি চুল বাঁধিস, লোকের কী দোষ!

তুষার পিঠের পাশ থেকে এলো চুল মুঠো করে সামনে টেনে নিল। আজ একটা নাগাদ মাথা ঘষেছি, চুলই শুকোয় না।

নিয়ে আয় তোর ফিতে চিরুনি–আমি বেঁধে দিচ্ছি। শিশির হাসিমুখে বলল।

 থাক। তুষার ডান হাত তুলে ক্ষান্ত করার ভঙ্গি করল।

 থাক কেন, দে, আমি বেঁধে দি।

মাথা নাড়ল তুষার। না। তুই এখনও গোড়া বাঁধতে পারিস না। এমন শক্ত করে দিস যে মাথা ধরে যায়।

তুষার কথা বলতে বলতে ঘরের ডান দিকের পরদা সরিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। পাশের ঘরে পায়ের শব্দ শোনা যেতে লাগল।

শিশির দিদির চলাফেরার শব্দ শুনছিল। সে মাঝে মাঝে দিদির চুল বেঁধে দেয়। এই তাদের ভাই-বোনের এক অদ্ভুত প্রীতি-সান্নিধ্য। কেমন করে যেন ছেলেবেলা থেকেই শিশিরের দিদির চুলের ওপর ঝোঁক। ছেলেবেলায় এই চুল সে দু হাতে মুঠো করে ধরে ছিড়ত, বয়স বাড়লে পছন্দটা কেমন পালটে গেল। এক সময় যা রাগ করে ছিড়ত, পরে তা ভালবেসে বেঁধে দেয়। তুষারের কাছ থেকে কত কষ্ট করে তবে এই চুল বাঁধা শিখতে হয়েছে।

তুষার নিজের ঘর থেকে চিরুনি আর কাঁটা নিয়ে এসেছে। ভাইয়ের বিছানায় বসল। বলল, আজ আর চুল বাঁধব না, এলোখোঁপা করে জড়িয়ে নি। বলে দ্রুত হাতে চুল আঁচড়াতে লাগল।

শিশির দিদিকে দেখছিল। কেরাসিনের আলোয় দিদিকে কেমন যেন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। কী ভাবছে দিদি? বাইরে লোক বসিয়ে রেখে এসেছে বলে অস্বস্তি বোধ করছে?

দিদি, ভদ্রলোককে তুই ঘরে এনে বসাতে পারতিস।

ঘরে এনে?

বাইরে একা বসে থেকে চলে না যায়।

তাই বলে ঘরে এনে বসাব। যাঃ।

 শিশির বুঝল না যাঃ কেন। তার বন্ধুরা সকাল বিকেল কি তার ঘরে এসে বসে না? অন্য লোকজন এলেও তো কত সময় ঘরে এসে বসে। বাইরে চুপচাপ একটা লোককে বসিয়ে রাখার চেয়ে ঘরে এনে বসালে ভাল দেখায় বইকি।

তোর যে কী জ্ঞানবুদ্ধি বাড়ছে, দিদি-কে জানে। শিশির অভিভাবকের গলায় বলল।

থাম। তুষার হাসিমুখে ভাইকে ধমকে দিল, আমার বুদ্ধি বাড়ছে না, বাড়ছে তোর। তাও যদি না চার বছরের ছোট হতিস।

শিশির হাত তুলে হতাশার ভঙ্গি করল। এবং খুব গম্ভীর গলায় বলল, দিন দিন তোর হিসেব বেড়েই যাচ্ছে। আগে বলতিস আড়াই তিন বছরের বড়, তারপর সাড়ে তিন বলতে লাগলি, এখন চারে দাঁড়িয়েছে। …যেন তোর বয়সটা এগিয়ে যাচ্ছে, আমারটা পিছিয়ে যাচ্ছে।

তুষার প্রায় চঞ্চল হাঁসের মতন হঠাৎ হাসির দমকে ভাইয়ের কোলের কাছে বালিশে ঝাঁপিয়ে এসে লুটিয়ে পড়ল। খিল খিল হাসি তুষারের নরম চিকণ গলায় তরঙ্গ তুলে ঘরে আবহাওয়াকে কেমন অবিচ্ছিন্ন গাঢ় সুখী ও তৃপ্ত করে তুলল।

শিশিরও হাসছিল।

.

আদিত্য বাইরে ছটফট করছিল। ধৈর্য ধরে জগন্নাথের মতন এক জায়গায় বসে থাকা তার স্বভাবে নেই। গোটাকয়েক সিগারেট টানল, বাগানে পায়চারি করল খানিক, কয়েকবার সাইকেলের ঘন্টি বাজিয়ে যেন ভেতরে তার অধৈর্যের সংবাদ পাঠাল, শেষে প্রায় চিৎকার করে ডাকতেই যাচ্ছিল তুষারকে–এমন সময় তুষার এল।

শাড়ি পালটায়নি তুষার, তেমনি ভাবেই ঘরোয়া করে পরা, জামাও বদলায়নি; চুলই যা এলো খোঁপা। করে বেঁধে নিয়েছে। তুষারের হাতে ডিম ভাজা আর চা।

আদিত্য খুব রেগেছিল। বলল, চমৎকার ব্যবহার আপনার।

তুষার ডিমের প্লেট এগিয়ে দিল। ধরুন।

ফেলে দিন। আদিত্য বুকের কাছে দুহাত গুটিয়ে নিল।

ফেলে দেব–তুষার চোখের পাতা কৌতুকে বড় করল, আদিত্যের ছেলেমানুষি রাগ দেখে তার মজা লাগছিল। নিন।

আমি খেতে আসিনি। আদিত্যের আত্মসম্মান আহত হয়েছে, যেন সে তারই প্রতিশোধ নিচ্ছে এমন এক গলা করে জবাব দিল।

তুষার অনুভব করতে পারছিল, ভদ্রতা এবং সৌজন্যের দিক থেকে তার ব্যবহার কিছুটা দৃষ্টিকটু .. হয়েছে। এতটা দেরি তুষার না করলেও পারত। রান্নাঘরে বসে চা খাবার করার সময়ও তুষারের মনে হয়েছে সে যেন একটু বাড়াবাড়ি করছে। আদিত্যকে এভাবে অপেক্ষা করানো অনুচিত, ভদ্রতা বিরুদ্ধ। আদিত্য আহত হতে পারে। অথচ তুষার কেমন জোর করে এই অনুচিত বোধকে তরল করে দেখছিল। …আদিত্যর আহত স্বরে তুষার সামান্য অনুশোচনা বোধ করল। মানুষ যেমন সাধারণ ছোটখাটো কোনও অন্যায় করে ফেললে ব্যাপারটা মুছে ফেলতে চায়, তুষার সেইভাবে মালিন্য মুছে ফেলার চেষ্টা করল। সলজ্জ সঙ্কুচিত হাসি এবং ত্রুটি স্বীকারের মুখ করে বলল, বা, আমি রান্নাঘরে বসে বসে করে আনলাম…। চা না দিলে আপনিই কি খুব খুশি হতেন—

আদিত্য তাকিয়ে থাকল কয়েক পলক। হাত বাড়াল বলল, আমি বোধহয় টাটকা তোলা পাতার চা খাচ্ছি।

খোঁচাটা তুষার হাসিমুখেই সহ্য করল।

আদিত্য যে রাগ করেছিল বা অপমানিত বোধ করছিল কয়েক মুহূর্ত পরে আর তা বোঝার উপায় থাকল না। ও এমন করে খেতে লাগল যেন কত ক্ষুধার্ত, মুখের এমন ভঙ্গি করে খাচ্ছিল যেন কী উপাদেয় বস্তু খাচ্ছে। তুষার আড়চোখে লক্ষ করছিল। মজা লাগছিল, হাসি পাচ্ছিল, আবার ভালও লাগছিল।

আপনার চা?

আনি।

 হ্যাঁ, আনুন। আদিত্য বলল, আসবার সময় এক গ্লাস জল নিয়ে আসবেন।

তুষার চলে যাচ্ছিল। আদিত্য মনে করিয়ে দিল, দেখবেন আবার যেন বাতাস হয়ে যাবেন না। আমি তা হলে ঘন্টি বাজাতে শুরু করব।

হেসে ফেলেছিল তুষার। চলে গেল।

.

ক্রমে রাত হয়েছে। বাইরের ঘেরা ছোট বারান্দায় একপাশে টিমটিমে লণ্ঠনটা জ্বলছে। এ আলোয় অন্ধকারকে চেনানো যায়। বাগানে শিউলি ফুলের গন্ধ এসেছে, বাতাসে আচমকা একবার সেই গন্ধ ভেসে আসছে। আদিত্য চেয়ারে বসে। তুষার বেতের মোড়ায়। চায়ের কাপ ডিমের প্লেট অন্ধকারে একপাশে পড়ে আছে কখন থেকে। ওরা কথা বলতে বলতে এক সময় হঠাৎ দুজনেই চুপ করে গেছে কখন। অনেকক্ষণ নীরবে কেটে যাবার পর আদিত্য পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাল।

এই ভেড়ার পাল চরিয়ে আপনি কী সুখ পান আমি জানি না। তামাকের ধোঁয়া ছেড়ে আদিত্য বলল।

সকলের সুখ এক রকম নয়। তুষার জবাব দিল।

হ্যাঁ– আদিত্য সামনের দিকে তাকিয়ে যেন স্বগতোক্তির মতন বলল, তা ঠিক। তবে অনেকে নিজের সুখ কীসে তাও জানে না।

ওদের কথাবার্তার ধরন থেকে বোঝা যাচ্ছিল অনেকটা সময় কথা বলতে বলতে ওরা দুজনেই এক ধরনের আলাপী অন্তরঙ্গতা বোধ করছিল। তুষার এখন আড়ষ্ট বা সঙ্কুচিত নয়; স্বল্প পরিচয়ের বা তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার যে অস্বাচ্ছন্দ্য, আপাতত তুষারের মধ্যে সেই অস্বাচ্ছন্দ্য এত কমে গেছে। যে ওকে সহজ বলেই মনে হয়। আদিত্য যেন সহজ ভাসা ভাসা কথার জগৎ থেকে ক্রমশ কোনও আন্তরিক জগতে প্রবেশ করবার চেষ্টা করছে, পারছে না।

আমি অত বুঝি না। তুষার মন দিয়ে আদিত্যের কথা শুনছিল, মৃদু গলায় জবাব দিল, এই বাচ্চাকাচ্চা আর শিশুতীর্থ নিয়ে আমি তো বেশ সুখেই আছি।

দেখছি তা। আপনার সুখ অন্যের ফরমাসে গড়া।

 মানে! তুষার বিস্মিত হল।

অন্যে বলে এতে সুখ আছে, আপনিও সে কথা বিশ্বাস করেন।

না, আমায় কেউ বলেনি। আমি নিজেই বেছে নিয়েছি।

 আদর্শ?

জানি না।

 ডেডিকেশান। ..য়ুরোপে অনেক ক্রিশ্চান মেয়ে এইভাবে নিজেদের সমর্পণ করে ধর্মের কাছে। নান। আপনি জানেন?

শুনেছি।

আমাদের দেশে রামকৃষ্ণ আশ্রমের সাধুরা আছে, সন্ন্যাসিনীরাও।

ভালই তো।

কে বললে ভাল? অন্ধকারেও আদিত্যকে অসহিষ্ণু উগ্র দেখাল। এরা নিজেদের ঠকায়। বঞ্চনা করে।

তা কেন। আপনি আপনার দিক থেকে ভাবছেন বলেই ও-রকম মনে হচ্ছে। তুষার আস্তে আস্তে নরম গলায় বলল, ভাল না লাগলে, সুখ-শান্তি না পেলে মানুষ কেন নিজেকে সেখানে জড়িয়ে রাখবে।

আদিত্য সিগারেটের মুখের ফুলকি জোর করল, ধোঁয়া ছাড়ল, বলল, মানুষের স্বভাব নিজেকে ঠকানো৷

কেন? লাভ কী ঠকিয়ে?

 বড় রকম লোকসানের দুঃখ থেকে সান্ত্বনা পাওয়া। আদিত্য যেন অন্তর থেকে নিজের বিশ্বাসের কথা বলছিল। আপনি বাচ্চাদের মন হাতড়াতে মশগুল, যাদের বাচ্চা সেই মা-বাপের–মানে মানুষের মন নিয়ে ভেবেছেন, কখনও। জানা উচিত, এলিমেন্টারি স্কুলের আগে এলিমেন্টাল ম্যানের কথা জানা দরকার।

পরে জানব। তুষার অন্যমনস্ক গলায় বলল।

কেন, পরে কেন? এখন জানতে দোষ কী? আদিত্য যেন তুষারকে তার তর্কের বা যুক্তির নাগালে পেয়ে গেছে এমন নিঃসন্দেহ গলায় বলল, খুব সোজা একটা কথা ভেবে দেখুন না, যারা কোনও না কোনও কারণে দুঃখী, অসুখী, অতৃপ্ত, তারাই আশ্রমে ঢোকে, মন্ত্র নেয়, বৈরাগ্য ধরে।

তুষার কথা বলল না। তার হঠাৎ প্রতিভাদির কথা মনে হল। প্রতিভাদি বিয়ের বছরখানেকের মধ্যে বিধবা হয়েছিল। পরে কোথায় যেন দীক্ষা নিয়ে সন্ন্যাসিনী হয়ে যায়। তুষার ছেলেবেলায় প্রতিভাদিকে দেখেছিল, তার কথা শুনেছিল। আজ আর তার মুখ মনে পড়ে না।

আমি যা বলছি এর মধ্যে কোনও ভেজাল নেই। আদিত্য বলল, বিছানা যাদের জোটে না, তারা মাদুরের ওপর শুয়ে ভাবে সাত্ত্বিক ধর্ম পালন করলাম।

ভাল লাগছিল না তুষারের। আদিত্যর কথায় সে চঞ্চলতা বা দুর্বলতা অনুভব করছিল এমন নয়, কিন্তু এই আলোচনা তার খুব পছন্দ হচ্ছিল না। আদিত্য কেন যে ভাবছে, তুষার সুখী নয়–তাও তুষার বুঝতে পারছিল না। আর সে সুখী কিনা সেটা তার নিজের ব্যাপার, অন্য লোক এসে সেটা বুঝিয়ে দেবে কেন! না, আদিত্যর এই মাথা গলানো কি জবরদস্তির জন্যে সে ঠিক রাগ করতেও পারে না। রাগের মতন কথা তো হচ্ছে না।

যার যা ভাল লাগে তাই করাই ভাল। তুষার ছোট করে তার সাধারণ মতামত বলল। যেন এসব কথা এখানেই শেষ করে দিতে চাইল।

আদিত্য থামল না। তাকে কথায় পেয়েছে, সে ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত। বলল, যার যা ভাল লাগে সে যদি তাই করতে পারবে তবে জগৎটা স্বর্গ হয়ে যেত। আমার রাস্তা পুব দিকে, সংসার আমাকে পশ্চিমের পথে ঠেলে দিল। এই সংসারের এটাই মজা।

আপনার পক্ষে অবশ্য তাই। তুষার আলগা ভাবে বলল। বলার সময় তার ওই কথাটা মনে হচ্ছিল, এর পথ ছিল অন্য কোথাও, জোর করে শিশুশিক্ষার রাজ্যে ঢুকে পড়েছে।

আমার বেলায় কেন, সকলের বেলাতেই। আদিত্য বলল, আমি প্রকাশ করি–ঠকতে চাই না, সাত্বনাও পেতে চাই না। তবে সব লোক আমার মতন নয়। আমার বাবার মতন লোকও আছে।

বাবার কথায় তুষার তাকাল আদিত্যের দিকে। আদিত্যের রং ঠিক ময়লা নয়, আধ-ফরসা। বেশ লম্বা শক্ত চেহারা। মুখ পুরু। চোখ নাক শক্ত। মাথার চুল কোঁকড়ানো। সুপুরুষ চেহারা হলেও আদিত্যর চোখের দৃষ্টিতে গালের ভাঁজে কেমন একটা চাঞ্চল্য এবং অস্থিরতার ভাব আছে যাতে ওকে এখনও নাবালক মনে হয়। তুষার মৃদু আলো এবং অধিক অন্ধকারে আদিত্যের মুখের দিকে তাকিয়ে ওর অসহিষ্ণুতা অনুভব করতে পারল। আপনার বাবা

জোচ্চোর ছিল। আদিত্য অক্লেশে বলল। শুধু বলল না, মনে হল যেন রাগে ক্ষোভে ক্ষেপে গিয়ে চিৎকার করে উঠল।

চমকে উঠে তুষার অপলক চেয়ে থাকল।

আমার বাবা বড় রকমের জালিয়াত ছিল। ব্যাঙ্কে চাকরি করত। নানা জোচ্চুরি জালিয়াতি করে জেলে গেল হাজত খাটতে। মা আমায় নিয়ে মামার বাড়িতে এসে উঠল। একটা লোকবাবার কোনও বন্ধু–এ লোফার–আমাদের টাকাপত্র দিতে আসত মাঝে মাঝে, বলত বাবা গচ্ছিত রেখে গেছে। একদিন সেই লোফারকে মামা গালাগাল দিল, মাকে ধমকাল। কিছুদিন পরে মা আফিং খেয়ে মারা গেল। আমি তখন তেরো চৌদ্দ বছরের ছেলে। আন্দাজ করতে পেরেছিলাম কিছুটা। মা অযথা অকারণে আত্মহত্যা করেছিল। সত্যি সত্যিই বাবা চোরাই টাকা কিছু তার বন্ধুর কাছে গচ্ছিত রেখেছিল, লোকটা আমাদের সেই টাকা দিতে আসত, কিন্তু চেহারাটা ছিল লোফারদের মতন। মামার হাতে টাকা দিলে গণ্ডগোলটা হত না। আদিত্য যেন এক নিশ্বাসে এতগুলো কথা বলে হাঁফ ছাড়ল। কয়েক মুহূর্ত পরে আবার বলল, জেল থেকে ফিরে এসে আমার বাবা মার দুঃখে হাউ-মাউ করে কাঁদল। তারপর দেড় বিঘে বেনামি কলকাতার জমি বেচে টাকাটা আশ্রমে দিয়ে সাধু হয়ে গেল। সাধুরাও মরে, আমার বাবা বছরখানেকের মধ্যে পরপারে চলে গেল। আমি যেমন ভিখিরি তেমন ভিখিরি থেকে গেলাম। আমার বাবা স্বভাবে ছিল জোচ্চোর, হঠাৎ যে কেন সাধু হতে গেল বুঝলাম না। আমার মা ছিল অভিমানী অহংকারী, মা অভিমান করে মরল।

তুষার আড়ষ্ট। নিশ্বাসের শব্দ করতেও তার কুণ্ঠা হচ্ছিল। আদিত্যের বাবার চেহারা অন্ধকারে পশুর মতো ছায়া নিয়ে কল্পনায় দেখা দিল, মা-র মূর্তি পাথরের মতন শক্ত হয়ে বাবার পাশে দুলছিল। তুষার ঠোঁট খুলে মুখে নিশ্বাস নিচ্ছিল, বুক ধক ধক করছিল।

নীরব। সমস্ত নীরব। ঘরে শব্দ নেই, বাইরেও না। তুষার ঘামছে। আদিত্য হঠাৎ চেয়ারের হাতলে ঘুষি মেরে বিড় বিড় করে কী বলল, বলে উঠে দাঁড়াল।

তুষার সচেতন হল। আদিত্য সিঁড়ি দিয়ে দুধাপ নেমেছে। সাইকেলটা উঠিয়ে নেবে। তুষার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

আপনার আলো আছে তো? তুষার শুধোল।

না। আদিত্য তাচ্ছিল্যের গলায় বলল।

সে কী! এতটা রাস্তা অন্ধকারে যাবেন কী করে? তুষার উদ্বিগ্ন। দাঁড়ান, আমাদের টর্চটা এনে দি।

তুষার টর্চ আনতে ঘরে গেল তাড়াতাড়ি।

 টর্চ খুঁজে ফিরে আসার সময়ই তুষার আদিত্যের গলা পেল। বেল বাজিয়ে গেট খুলে রাস্তায় সাইকেলে উঠতে উঠতে আদিত্য তার মোটা গলায় কী বলল। তুষার বারান্দায়। প্রায় পলকেই অন্ধকারে আদিত্য উধাও। খানিক দূর থেকে তার ভারী গলার ক্ষিপ্ত গান শোনা গেল।

তুষার স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

 সেদিন আরও ঘণ্টাখানেক পরে পাতলা একটু চাঁদ উঠেছিল।

.

০৭.

আদিত্যের চরিত্র তুষার ক্রমে ক্রমে বুঝে ফেলেছিল। যাদের একগুঁয়েমি, জেদ, নির্লজ্জতা দেখলে ভাবনা হবার কথা, আদিত্য তেমন নয়। তুষার যত তার সংস্পর্শে আসতে লাগল, ততই বুঝতে পারছিল আদিত্যের চরিত্রে দুটি জিনিস প্রবল, উচ্ছ্বাস আর উম্মা। নিজেকে সংযত শালীন করতে আদিত্য শেখেনি; আদিত্যের উচ্ছ্বাস বালকের মতন, সহজে সে উত্তেজিত হয়, অকারণে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। বুদ্ধি আছে আদিত্যের, কিন্তু সেই বুদ্ধি নিজের জন্যে খরচা করা তার স্বভাব নয়। ভীষণ আবেগ তার, আবেগই তাকে যেন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

শিশুতীর্থের কয়েকটা ঘটনা পর পর এমন ঘটতে লাগল যার ফলে আদিত্যের চরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। বাড়িতেও মাঝে মাঝে হানা দিচ্ছিল আদিত্য। এর মধ্যে শিশুতীর্থের গুটি দুয়েক এবং বাড়ির একটা ঘটনা তুষার কিছুতেই ভুলতে পারবে না।

শিশুতীর্থে একদিন ছুটির বেলায় এক কাণ্ড হয়ে গেল। বাবলু আর কমল কাঠচাঁপার গাছ বেয়ে উঠে নীচের ডালে বসে বসে পা দোলাচ্ছিল। কমল একটু দুষ্টু গোছের ছেলে, নানান ফন্দি তার মাথায়। বাবলুর সঙ্গে খুনসুটি করে ঝগড়া বাঁধিয়ে তাকে ঠেলে ফেলে দিল ডাল থেকে। বাবলু পড়ে গেল নীচেমুখ থুবড়ে, কমল নির্বিকার বসে থাকল। …তখন ছুটির বেলা, ছেলেমেয়েরা চারপাশে ছুটোছুটি করছে, তুষাররা যে যার নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পরস্পরের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে। হঠাৎ দেখা গেল কোনও আড়াল থেকে আদিত্য বেরিয়ে এসে দ্রুত পায়ে বাবলুর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বাবলু উঠে বসেছে ততক্ষণে কিন্তু কাঁদছে। তুষার আর আশাদি এগিয়ে যাচ্ছিল, জ্যোতিবাবুও আসছিলেন তার আগেই আদিত্য পকেট থেকে রুমাল বের করে বাবলুর ডান হাতের কবজির ওপরটা জোর করে বেঁধে ফেলেছে।

জ্যোতিবাবু পাশে, তুষাররা কয়েক পা দূরে। আদিত্য জ্যোতিবাবুকে বলল, একে আস্তে করে তুলে নিয়ে যান, হাতটা সামলে ধরবেন। হাত ভেঙেছে।

হাত ভেঙেছে! জ্যোতিবাবু তাড়াতাড়ি হাঁটু গেড়ে বসে বাবলুকে ধরলেন।

আদিত্য চোখ তুলে গাছের ডালের দিকে তাকাল। কমল বসে আছে। ছেলেটা বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। কী যেন হল আদিত্যের কাঠচাঁপার একটা পলকা ডাল পট করে ভেঙে ফেলল, তারপর প্রায় এক হেঁচকা টানে কমলকে নীচের ডাল থেকে মাটিতে টেনে নামিয়ে পাগলের মতন কয়েক ঘা পিটিয়ে দিল। আরও মারত, তুষাররা হতচকিত হয়ে গিয়েছিল, জ্যোতিবাবুই চিৎকার করে কী যেন বললেন। ততক্ষণে আশাদির সংবিত ফিরেছে। তুষারও যেন বোধ ফিরে পেয়েছে। ওরা বাধা দিল ছুটে এসে। আদিত্যের হাতের পলকা ডাল ভেঙে গিয়েছিল। তার চোখ নিষ্ঠুর পশুর মতন, মুখ কেমন রাগে নীলচে হয়ে গেছে, যেন শরীরের সমস্ত রক্ত মুখে এসে জমে গেছে।

তখনকার মতন সব শান্ত হয়ে গেলেও ব্যাপারটা পরের দিন অন্য দিকে গড়াল। বিকেলে ছুটির পর সাহেবদাদুর কাছে তুষারের ডাক পড়ল। সাহেবদাদুর ঘরে তখন আশাদি, আদিত্য জানলার দিকে বিরক্তিকর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, জ্যোতিবাবু বসে ছিলেন একপাশে, হাতে একটা চিঠি।

তুষার ঘরে ঢুকে দাঁড়াল। সাহেবদাদুর শান্তভাবে তাঁর ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে বসে।

গতকালের কথাটা উঠল। কমলের বাবা চিঠি দিয়েছে সাহেবদাদুকে। জ্যোতিবাবুর হাতে সেই চিঠি।

সাহেবদাদু বললেন, কাজটা কি অন্যায় হয়নি?

না। আদিত্য মাথা নাড়ল।

আশাদি জ্যোতিবাবু এবং তুষার তিনজনেই আদিত্যের দিকে তাকাল।

সাহেবদাদু বললেন শান্ত গলায়, এখানে কারও গায়ে হাত তোলা হয় না। মারধোর খেয়ে যদি ছোট ছেলেরা ভালমন্দ শিখতে পারত তবে আমরা এখানে হাজত তৈরি করতাম, মাস্টারের বদলে কনস্টেবল রাখতাম।

আদিত্য শুনল কথাগুলো। সকলকে এক পলক দেখে নিল তাকিয়ে। বলল, উত্তর চান, না কৈফিয়ত শুনতে চান? আদিত্য ইংরেজিতেই বলেছিল কথাটা।

না, উত্তর। সাহেবদাদু সৌজন্য এবং ভদ্রতা রেখে বললেন, বাংলাতেই।

আদিত্য সাহেবদাদুর দিকে চেয়ে থাকল সামান্য, তারপর জবাব দিল। কিছু কিছু ছেলেমেয়ে আছে তারা অন্যদের নিরীহদের ওপর অত্যাচার করে আনন্দ পায়। যে ছেলেটা কাল গাছ থেকে আর একটাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল সে ওই রকম। আমি নিজে দেখেছি, সে ধাক্কা মেরে বাচ্চাটাকে ফেলে দিচ্ছে।

কমল একটু দুষ্টু স্বভাবের। আশাদি বললেন।

দুষ্টু নয়, বদমাশ স্বভাবের। আদিত্য কঠিন গলায় বলল। আমি লক্ষ করে দেখেছি ও রোজ একে মারে, ওর চোখ খামচায়, অন্যের বইয়ের পাতা ছিঁড়ে দেয়–এমনকী আরও দু একটা কাজ যা করে তা শুনলে আপনাদের গা কাঁটা দেবে।

সকলে চুপ। আবহাওয়া কেমন থমথমে। ..সাহেবদাদুই কথা বললেন মৃদু গলায়, আপনি কি ভাবেন রাগ করে মেরে ধরে ওকে শোধরানো যাবে?

আদিত্য অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল। হঠাৎ সে জানলা থেকে সরে এসে সাহেবদাদুর পায়ের তলায় বসে পড়ল। বলল, শিশুতীর্থের যে সব পদ্ধতি তাতেও ওই ছেলে বিন্দুমাত্র শোধরায়নি। শুধরেছে কি? এমনকী ছেলেটা দুষ্টু এই বাজে কথা বলে আপনার এখানে ওকে আরও বদমাইশি করার প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। বলেই আদিত্য হাত বাড়িয়ে সাহেবদাদুর হাঁটু স্পর্শ করল। একটা কথা আমায় আপনি বলুন, আপনি নিশ্চয় সত্যি কথাই বলবেন। ছেলেবেলায় আপনি কি বাবা মা কারও শাসন পাননি, কেউ কি আপনার গায়ে হাত তোলেনি কখনও?

সাহেবদাদু ভীষণ অবাক হয়েছিলেন। কেমন হতভম্ব হয়ে সোজা হয়ে বসতে গেলেন। খানিক পরে বললেন, তা দু-চার দিন কি আর মার খাইনি। খেয়েছি।

বোধহয় সেই মার খেয়ে আপনি অমানুষ হয়ে যাননি। যদি দু-চার ঘা মার দিলে মনে হয় শিশুহত্যা করা হচ্ছে তবে আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু এসব জিনিসকে কায়দা করে শিক্ষা পদ্ধতির উন্নতি বলা বাজে কথা। শাসনের হাত তো একটা নয়, অনেক। যে ছেলেমেয়েকে আপনারা মারেন না–সে যে বাড়ি গিয়ে বা খেলা করতে গিয়ে অন্য কোথাও মারধোর খায় না–কে বলল। …তা ছাড়া

কী?

জীবনভোর অনেক বড় মার খেতে হবে এদের। এই হাতের দু-চার ঘা কিছু নয়। নাথিং।

আবার নীরবতা। কেউ কোনও কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। সাহেবদাদু অবশেষে বললেন, আপনি যা বলছেন তার হয়তো অনেক কিছুই সত্য। কিন্তু আমাদের এখানে শাস্তি দেওয়া বারণ।

আমি শাস্তি দিইনি।

শাস্তি দেননি? আশাদি অস্ফুট গলায় বলল।

না। আমি আমার শান্তি পাবার চেষ্টা করছিলাম। আই হেট। একটা শয়তান বদমাশ স্বাস্থ্যঅলা ছেলে নিরীহ গোবেচারি একটা ছেলেকে ঠেলে ফেলে দেবে গাছের ডাল থেকে, আই হেট ইট। কোনও বড় মানুষ এরকম কোনও কাজ করলে আমি তাকে মারতাম। আই অ্যাম নট গোয়িং টু টলারেট এনি ব্লুটালিটি।

সাহেবদাদু নির্বাক। তুষাররাও। তুষারের হঠাৎ চোখ পড়ে গেল, দেখল আদিত্যর চোখে যেন জলের ঝাপসা আড়াল।

আদিত্য উঠে পড়ল। আপনাদের অপছন্দ হয়ে থাকলে আমার করার কিছু নেই। আমি চলে যেতে পারি। কাল কি পরশু চলে যাব।

আদিত্য চলে গেল ঘর ছেড়ে।

তুষাররা নীরবে বসে থাকল। ঘরের আবহাওয়া কেমন ভারী এবং বিষাদে ভরে উঠেছিল। সাহেবদাদু অনেকক্ষণ পরে বললেন, ছেলেটি অদ্ভুত।

.

আর একদিনের ঘটনা তুষার ভুলবে না। এই ঘটনা ঘটেছিল বাড়িতে।

সেদিন সন্ধের মুখে আদিত্য হাঁটতে হাঁটতে এসে হাজির। তুষার শিশিরের সঙ্গে বসে বসে তাস খেলছিল। সময় কাটানো আর কি। তাস খেলতে খেলতে গল্প হচ্ছিল দুই ভাই বোনে।

আদিত্য এসে ডাকল। ডাকার ভঙ্গি বড় অদ্ভুত। মানুষ মানুষকে নাম ধরে ডাকে, কিংবা দরজায় ধাক্কা দেয়, কড়া নাড়ে–আদিত্য ও-সবের ধার দিয়ে গেল না।

বারান্দায় উঠতে উঠতে তার সেই মোটা গলায় গান ধরল: পথভোলা এক পথিক এসেছি।

হাতের তাস নিয়ে তুষার প্রায় চমকে উঠল। বুঝতে পারেনি প্রথমে, চেনা গলার স্বর কানে একটু থিতিয়ে আসতেই জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। শিশিরও অবাক। হঠাৎ কেমন আড়ষ্ট সঙ্কুচিত হয়ে হাতের তাস ফেলে দিয়ে তুষার ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাল।

কী রে দিদি?

 সেই ভদ্রলোক। আদিত্যবাবু। কী যে বিরক্ত করে…। বলতে বলতে তুষার উঠে দাঁড়াল, ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারছিল না, বলল, দাঁড়া, বিদায় করে দিয়ে আসি। নয়তো ও যা লোক চেঁচিয়েই যাবে।

শিশির ঠোঁট উঁচু করে ঠাট্টার হাসি হাসল। বেশ তো গাইছে, গাইতে দে। তুই বোস।

বেশ গাইছে! তুষার চোখ বড় করল।

পুরুষমানুষের মতন! কেমন গম্ভীর গলা।

বাজে বকিস নাতুষার ছটফট করে উঠল, গানের তুই কী বুঝিস?

বুঝি। সব তুই একা বুঝবি বুঝি। …জানিস, আমি কবিতা লিখি।

রাখ তোর বোঝা। লোকটাকে আমি থামাব।

অযথা গানটা বন্ধ করে দিবি? গাক না ও, তুই বোস।

তুষার বসবে না। শিশির বুঝবে কোথা থেকে এভাবে আদিত্য এসে ওকে কি বিশ্রী লজ্জার এবং অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছে।

কিন্তু শিশির বোধহয় বুঝেছিল। তুষার চলে যাচ্ছে দেখে হেসে বলল, তাস গুটিয়ে রাখছি রে, দিদি।

তুষার বাইরে এল। আদিত্য বেপরোয়া গলায় গান গাইছে। যেন ও জানে এই পরিহাস আনন্দেরই, এতে কোনও গ্লানি নেই লজ্জা নেই। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দরজার দিকে তাকিয়েই আদিত্য গান গাইছিল। তুষারকে দেখে থামল।

তুষার এক পলক দেখে নিল আদিত্যকে। হঠাৎ এদিকে?

 এলাম। আজ খুব ভাল লাগছিল।

দেখছি তাই, নয়তো আর গান হবে কেন।

 আমি রাস্তায় আসতে আসতে ভাবলাম কোন গানটা উপযুক্ত হবে, মানে স্যুটেবল। এইটেই মনে এল।

মনের খুব বাহাদুরি রয়েছে। তুষার গম্ভীর হয়ে বলতে চাইল।

গানটা কিন্তু খুব স্যুটেবল হয়েছে, বলুন ঠিক কি না। আদিত্য হাসল জোরে জোরে, রবীন্দ্রনাথ এই একটা কাজ করে গেছেন, অনেক সময় মানুষ যা বলতে চায় একটু হাতড়ালেই দেখতে পাবে বুড়ো একটা গান বেঁধে গেছেন।

তুষার কৌতুক বোধ করল। উনি কি জানতেন আপনার মতন লোক তাঁর গান গেয়ে গলা সাধবে।

মানে। হোয়াট ডু ইউ মিন? আমি বাজে গাই?

 কে বলছে! চমৎকার গান।

আদিত্য আবার হাসল। সিগারেট বের করতে করতে বলল, আমি গোটা পঁচিশেক গান সত্যি সত্যি জানি। এ ভেরি পুয়োর স্টক ইনডিড। কিন্তু বেশ লাগে।

তুষার কিছু বলল না। কথাটা কিন্তু খুব মিথ্যে নয়। সব বাঙালি ছেলের মতন আদিত্যও কয়েকটা জানে। হয়তো সুর কোথাও ভুল হয়ে যায়, শব্দ শুদ্ধ হয় না, কিন্তু এখানে সেটা বড় কথা নয়। তুষারও কিছু গান জানে। হয়তো তার সুরও কোনও জায়গায় ভুল, শব্দ অশুদ্ধ। আদিত্যর গলা সত্যিই গম্ভীর ভারী। মন্দ শোনায় না, তুষার যতই ঠাট্টা করুক শিশিরের কাছে।

সিগারেট ধরিয়ে আদিত্য বলল, কী করছিলেন?

ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করছিলাম।

ও! আদিত্য ধোঁয়া ছেড়ে কী যেন ভাবল সামান্য। বলল, আমি আপনার ভাইয়ের কথা শুনেছি।

তুষার তাকাল। আদিত্য অন্য দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। বাগানের দিকে। চাঁদের আলো বাগানে।

তা হলে থাক। আমি চলি। আদিত্য চাপা গলায় বলল।

 তুষার বুঝতে পারল। যে দুঃখ নিশ্বাসের মতন স্বাভাবিক ভাবে বয় বলে তুষার সচেতন থাকে না, সেই দুঃখকে আদিত্য চেতনায় আনল। মানুষ যদি প্রতিটি নিশ্বাস-প্রশ্বাস সম্পর্কে হঠাৎ সচেতন হতে চায়, দু মুহূর্ত পরেই কেমন অস্বস্তি বোধ করবে। তুষার সেই রকম অস্বস্তি বোধ করছিল। শিশিরের কথা সে কাউকে বলতে চায় না। পছন্দ করে না। শিশিরও নয়। ওরা ভাইবোনে তাদের দুঃখ হাটে টেনে এনে না অনুকম্পা না করুণা চায়।

নিজেকে সামলে নিতে নিতে তুষার বলল, যাবেন কেন, বসুন। কথাটা বলে তুষার সিঁড়ির দিকে তাকাল। খেয়াল হল, আদিত্য সাইকেল আনেনি, মনে পড়ল, ও হেঁটে আসার কথা বলছিল। আলোচনা অন্য দিকে নিয়ে যাবার মতন সুযোগ পেল তুষার। সাইকেল কোথায়?

সাইকেল নিইনি, হেঁটে বেরিয়েছি।

হেঁটে–তুষার অস্ফুট বিস্ময় জানাল।

ভাল লাগছিল হাঁটতে। আজ আমার খুব ভাল লাগছে। এক একটা দিন মাঝে মাঝে মানুষের অসম্ভব ভাল লেগে যায়। আপনার লাগে না?

তুষার সামান্য অন্যমনস্ক চোখে আদিত্যর দিকে তাকাল। মাথা নাড়ল, অথচ এই জবাব–এই হ্যাঁ জানানো সে বাস্তবিক ভেবে বলল না।

রাস্তায় আসতে আসতে আমি ভাবছিলাম আজ এখানে এসে আপনাকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাব। আদিত্য অকৃত্রিম আবেগে বলল।

বেড়াতে! তুষার যেন খুব অবাক।

চলুন। আমার যে কী ভাল লাগছে আজ! আদিত্য ছেলেমানুষের মতন তার বিহ্বলতা জানাল। তুষার অনুভব করতে পারছিল, ভদ্রলোক আজ খুশিতে টলমল করছে। ওর খুশির ভাগ গলার স্বরে উপচে উঠছিল।

এখন কি আমার বেড়ানোর সময়! তুষার নরম করে হেসে বলতে গেল।

এখন নয়তো কখন! সবে সন্ধে। মস্ত বড় একটা চাঁদ রয়েছে আকাশে, পুরো শরতের বাতাস। চলুন।

তুষার কী করে বলবে, শিশির একা বসে রয়েছে; কী করে বোঝাবে, এ-ভাবে বেড়াতে বেরোলে শিশির কী মনে করবে! তা ছাড়া তুষার কখনও কি একজন পরিচিত পুরুষের সঙ্গে এই শহরের কোথাও বেড়াতে বেরিয়েছে। আদিত্যকে সরাসরি না বলতে তার বাধছিল। অস্বস্তির মধ্যে পড়েছে তুষার। আদিত্যও তেমন, তার জোর জবরদস্তি অনুরোধ বিন্দুমাত্র শিথিল হচ্ছে না।

বিখ্যাত লেখকের এক বিখ্যাত কথা আছে জানেন না–আদিত্য বলল, দিনের মধ্যেই আমরা বাঁচি, কিন্তু কোনও কোনও দিনই আমাদের সত্যিকারের বাঁচায়।

তুষারকে বাধ্য হয়ে যেতে হল। আদিত্য কিছুতেই ছাড়বে না। আর আদিত্য যখন ঝোঁক ধরে সে-ঝোঁক ঠেকাবার সাধ্য মানুষের থাকে না। তুষার চেষ্টা করেও ওই অবুঝ জেদি মানুষটাকে ঠেকাতে পারল না।

রাস্তায় পা দিয়ে তুষার দক্ষিণ মুখে এগুতে লাগল। শহরের দিকে সে যাবে না। খানিকটা আড়ষ্ট, মনে কেমন অস্বস্তি, ভাল লাগছে না, অথচ খারাপ লাগার যথার্থ কোনও কারণও খুঁজে পাচ্ছে না তুষার। …পথে হাঁটতে হাঁটতে তুষার দক্ষিণের দিকে অন্যমনস্ক ভাবেই এগিয়ে গেল।

আদিত্য প্রায় সমানে কথা বলে যাচ্ছে। নানান কথা। তার উচ্ছ্বাস এবং আনন্দের প্রাবল্য অনুভব করা যাচ্ছিল সর্বসময়, সে সেই ভাবে হাঁটছে, কথা বলছে, হাসছে।

এক সময় তুষার অবাক হয়ে লক্ষ করল, পায়ে ধুলো মেখে মেখে তারা মেঠো পথ, ঘাস এবং তারপর রুক্ষ কাঁকর পেরিয়ে সেই টিলাটার কাছে চলে এসেছে। টিলার ওপাশে শহরটাকে দূরে দেখা যায়–অনেকটা ঢালুতে দাঁড়িয়ে আছে, ছায়ার মতন, আলোর বিন্দু কিছু। এ পাশে টিলার এদিকটা নির্জন নির্বাস প্রান্তর, মাঠ আর জংলা ভূমি, দূরে সেই ছোট নদীর সাঁকো।

টিলার ওপরে উঠে আসতেই তুষার অনুমানে ট্রেন লাইন দেখতে পেল। কিছুটা তফাত দিয়ে চলে গেছে, গাছের আড়াল দিয়ে দেখা যাচ্ছে না।

আজ পরিষ্কার জ্যোৎস্না। গত কাল পূর্ণিমা গেছে। মাথার ওপর নীলচে আলো লেপা আকাশ, চাঁদ প্রায় রুপোর থালার মতন গোল।

 আদিত্য বসল। তুষারও এক টুকরো পাথরের ওপর আলগা হয়ে বসল। জায়গাটা ঝিম ঝিম করছে। কোনও সাড়াশব্দ নেই। বাতাসের চাঞ্চল্য এবং বেগ অনুভব করা যাচ্ছিল। এই ফাঁকায় তুষারের হঠাৎ কেমন মনে হল, সে অনর্থক যেন কীসের ভয় পাচ্ছে।

আপাতত আদিত্যও আচমকা নীরব হয়ে গেছে। জ্যোৎস্নধৌত ভূভাগের দিকে তাকিয়ে সে প্রায় সম্মোহিতের মতন বসে ছিল। তুষার নির্বাক। প্রত্যহের জীবন থেকে পরিবেশ থেকে কে যেন আলাদা করে এই সময়টুকু ওদের কাছে এনে দিয়েছে। তুষার ভাবছিল, আদিত্য ঠিক বলেছে, রোজই আমরা বেঁচে থাকি কিন্তু প্রত্যহের সেই বাঁচা আর একটা টুকরো সময়ের মধ্যে নিবিড় হয়ে, মগ্ন হয়ে বেঁচে থাকা আলাদা। তুষার অনুভব করতে পারছিল, তার মন এখানে এই স্তব্ধতা জ্যোৎস্না বাতাস এবং নির্জনতার মধ্যে এক ধরনের চাপা বিষাদ ও প্রশান্তি অনুভব করতে পারছে।

আদিত্য কাঠি জ্বালাল। সিগারেট ধরিয়ে নিল। আলোর একটি পিপীলিকা যেন পাখা পেয়ে হঠাৎ উড়ে এসেছিল আবার হারিয়ে গেল।

আমার একটা কথা মনে পড়ছে।

 তুষার ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল।

বিদেশে থাকার সময় আমার একটি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, সুইডিস মেয়ে, গ্রামার স্কুলে চাকরি করত, একদিন আমায় একটা গল্প বলেছিল, তাদের দেশের রূপকথার গল্প। সুন্দর গল্প। চাঁদের বিয়ে, দুই রাজকন্যাই তাকে বিয়ে করতে চায়, একজন প্রচুর উপঢৌকন নিয়ে এলবাজনা বাজিয়ে দাস দাসী নিয়ে; চাঁদ কিছু বলল না। পরের দিন আর এক রাজকন্যা এল, একা–তার সঙ্গে কেউ নেই, না আলো বাজনানা দাস দাসী। চাঁদ বলল, তুমি একা? আমার জন্যে কিছু আনননি? রাজকন্যা জবাব দিল, এনেছি। দি সাইলেন্স… চাঁদ তৃপ্ত হয়ে হাসল। বলল, তুমিই জিতলে। আদিত্য গল্প শেষ করল। করে অভিভূত গলায় বলল, গল্পটা ভাল নয়?

তুষার মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। মাথা হেলিয়ে সায় দিল।

আদিত্য অনেকক্ষণ পরে বলল, মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, যারা অন্ধ, যারা বোবা–এই সংসারে তারাই সুখী।

কেন? তুষার অস্ফুট গলায় প্রশ্ন করল।

 কিছু দেখতে হয় না, কোনও কথা বলা যায় না। …আমরা দেখি বলে পুড়ি, কথা বলতে পারি বলে না বলার দুঃখে বুক জ্বলে যায়।

আদিত্যের কথার মর্ম তুষার বুঝতে পারল না।

সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে খানিক বসে থাকল আদিত্য, মাথা ওঠাল, ছটফট করল, তারপর বলল, আমার যা বলতে ইচ্ছে করছে তা বলতে পারছি না।

তুষার তার অন্তরের ভয় এবার স্পষ্ট করে অনুভব করতে পারল। কিন্তু প্রকাশ করল না। উঠে দাঁড়াল হঠাৎ। বলল, চলুন, ফিরি এবার।

আদিত্য বোধহয় প্রত্যাশা করেনি, তুষার সমস্ত মোহ মায়া তুচ্ছ করে এমন করে উঠে পড়বে। অবাক হয়ে ঘাড় তুলে তাকিয়ে থাকল আদিত্য। তারপর ক্ষুণ্ণ হল। এভাবে উঠে পড়লেন যে!

বা, বাড়ি ফিরতে হবে না। রাত হয়ে যাচ্ছে। তুষার সহজ সরল গলা করে বলল, যেন যা করা উচিত তুষার তা করেছে। কথাটা বলে তুষার টিলার ঢালুর দিকে এগিয়ে গেল।

আদিত্য উঠল না। তুষারকে দেখছিল। তুষার দশ বিশ পা এগিয়ে গেলে আদিত্য উঠে পড়ল। আহত ক্ষুব্ধ মানুষ যে ভাবে দ্রুত পায়ে ছুটে আসে আদিত্য সেই ভাবে যেন হেঁটে এল। এভাবে আপনি পালিয়ে যাচ্ছেন কেন? ভয়?

ভয়! তুষার হাসিমুখে চোখ তুলল। ভয়ের কী আছে। তুষারের গলা এবং হাসি দেখলে মনে হবে যেন কীসের ভয় কেন ভয় সে কিছুই বুঝতে পারছে না।

আদিত্য পাশে পাশে হাঁটতে লাগল। তুষারকে লক্ষ করছিল।

 আমি বাঘ সিংহনই। আদিত্য অশান্ত।

 কে বলেছে।

আপনার ব্যবহার দেখে তাই মনে হয়।

নাকি?

আমাকে কি আপনি ছেলেমানুষ মনে করেন।

 ছেলেমানুষ! তুষার টিলার ঢালু দিয়ে খানিকটা নেমে এসে সমতল পেয়ে হাঁটতে লাগল, আদিত্যের দিকে তাকাল, মুখভরা শান্ত হাসি, বলল, সত্যিই আপনি ছেলেমানুষ।

আদিত্য আচমকা তুষারের হাত ধরে ফেলল। তার ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল যেন পাগলামি করছে। আমার বয়েস আটাশ। আমায় বোকা ভাববেন না।

তুষার হাত ছাড়াবার জন্যে ব্যগ্রতা দেখাল না। বলল, এমন কি বয়েস আপনার, আমার বয়েস বাইশ। …মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে সব সময় বেশি বুদ্ধিমান হয়। তুষার জোর করল না, ছটফট করল না, কেমন অক্লেশে স্নিগ্ধ স্বরে কথা বলতে বলতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল। জানেন না, মেয়েদের বয়স এক বছরে যা, ছেলেদের তাতেই দুবছর। …ওই দেখুন–তুষার হাত বাড়িয়ে দিল সামনের দিকে। শুনতে পাচ্ছেন?

গাড়ির শব্দ?

হ্যাঁ। সাড়ে আটটার মেল ট্রেন। কতটা রাত হয়ে গেছে দেখেছেন।

তাই তো।

শিশির একা বসে আছে। আপনারও না অতটা রাস্তা যাবার আছে, তাও আবার সাইকেল আনেননি। কী করে যাবেন?

যাব না আজ।

যাবেন না?

আদিত্য মাথা নাড়ল। ট্রেনের শব্দ ফাঁকায় প্রতিধ্বনিত।

কী সর্বনাশ! যাবেন না তো কী করবেন? মাঠে মাঠে ঘুরবেন? তুষার হালকা কৌতুকের গলায় বলল।

আদিত্য জবাব দিল না। খানিকটা পথ চুপচাপ। তারপর আদিত্য বলল, আপনি এমন সুন্দর রাতটা নষ্ট করে দিলেন।

আমি?

কী ভাল লেগেছিল আজ, এখন মনে হচ্ছে আপনাকে জোর করে টেনে এনেছি। কেন তখন বললেন না, আপনার আসতে ইচ্ছে নেই। আদিত্যর গলায় বিষাদ, মনস্তাপ।

তুষার শাড়ির আঁচল টেনে নিতে গিয়ে আদিত্যর হাতে স্পর্শ দিল। মধুর প্রশান্ত হাসি তার মুখে। বলল, ইচ্ছে না থাকলে কেউ কি আসে। …কিন্তু চাঁদের আলোই তো সব নয়; আমার ঘর বাড়ি ভাই আছে–আপনারও…

আমার কিছুই নেই। আদিত্য তুষারের কথা টেনে নিয়ে বলল। সে যেন ভীষণ অধৈর্য, আহত, বিক্ষুব্ধ।

তুষার চোখের দৃষ্টি বাঁকা করে দেখে নিল আদিত্যকে। কিছু নেই বলবেন না।

কেন বলব না?

বলতে নেই। …শুনতেও ভাল লাগে না।

রাস্তায় এসে পড়েছিল তুষার। বাড়ি দেখা যাচ্ছে। তুষারের কোনও উদ্বেগ নেই; এই উদ্বেগ টিলার আসন ছেড়ে উঠে পড়ার পর থেকেই ক্রমে কেমন মিলিয়ে গেছে। এতটুকু আড়ষ্টও আর বোধ হচ্ছে না। আদিত্যকে তার সত্যিই ছেলেমানুষ মনে হচ্ছে। বোধ বুদ্ধি-সাংসারিক বোধ বুদ্ধি ওর নেই। তুষার মায়া এবং মমতা বোধ করছিল আদিত্যের জন্যে।

আমাকে আরও পৌঁছে দিয়ে কী লাভ? এতটুকু যেতে আমার অসুবিধে হবে না। আপনি বরং ফিরুন, অনেকটা রাত হয়েছে।

আদিত্য কথার জবাব দিল না। হাঁটতে লাগল।

কী হল, যাবেন না?

না।

না কি! কোথায় থাকবেন সারারাত। তুষার বিপদে পড়ল।

যে কোনও জায়গায়।

পাগলামি করবেন না। তুষার যেন ভর্ৎসনা করল মৃদু গলায়। সারারাত রাস্তায় রাস্তায় কেউ ঘোরে নাকি?

আমি ঘুরি। …আমি অনেক ঘুরেছি এ-ভাবে। আদিত্য উপেক্ষার গলায় বলল, একদিন না ঘুমোল মানুষ মরে না।

বাড়ির গেটের কাছে এসে পড়েছে তুষার। দাঁড়াল। আদিত্যকে চোখ ভরে দেখল। কী রকম মানুষ

যে আপনি। তুষার ভেবে পাচ্ছিল না কী বলবে। সামান্য চুপ করে থেকে বলল, আমায় কেন দুর্ভাবনায় ফেলছেন?

আদিত্যের মাথায় বোধহয় কোনও বুদ্ধি এসেছিল। বলল, কিছু না। আপনি যান। আমি স্টেশনে চললাম।

স্টেশন? তুষার আকাশ থেকে পড়ল।

স্টেশনের ওয়েটিং রুমে খাবারের দোকান আছে, লম্বা লম্বা বেঞ্চি আছে…

এই…। তুষার প্রায় আঁতকে উঠে বলল, স্টেশনের ওয়েটিং রুমে…, না, ছি, সে কি…।

আদিত্য তুষারের গেট খুলে দিয়ে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল। তুষার বিমূঢ়। আপনি বরং এখানে খাওয়া-দাওয়া

স্টেশনে রাত কাটাতে আমার ভাল লাগে। আদিত্য পা বাড়াল।

প্ল্যাটফর্মে বসে থাকব, ঘুমন্ত স্টেশন, একটা দুটো গাড়ি চলে যাবে…

আদিত্য দু-চার পা এগিয়ে মুখ ফেরাল হঠাৎ, আপনার কথা ভাবব। যদি ইচ্ছে হয় চলে আসব। আপনি তখন ঘুমোবেন।

না, না–তুষার শিউরে উঠে বাধা দিল। হাত নাড়ল। ছি ছি। না, ওসব করবেন না।

করা কি আমার হাতে। মন যদি করায়–আদিত্য কী এক আনন্দ যেন মুঠোয় পেয়েছে। হাসতে হাসতে পা বাড়াল।

তুষার গলা উঁচুতে তুলে শেষ বারের মতন বলল, না, আপনি দয়া করে আসবেন না।

আদিত্য তাকাল না। মনেই হল না, তুষারের কথায় সে কর্ণপাত করেছে। তুষার স্তব্ধ কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

তুষারের কী দুশ্চিন্তা সেদিন। ভীষণ ভয়। যদি আদিত্য আসে। ওকে বিশ্বাস নেই, ওর মতিগতি তুষার বুঝতে পারে না। হয়তো আসবে সত্যিই, হয়তো চাঁদের আলোয় বাগানের পাশ দিয়ে তার ঘরের জানলার সামনে এসে ডাকবে–তুষার, তুষার।

তুষারের মনে হচ্ছিল আদিত্য যেন সব চেনে, তার ঘর–তার জানলা, তার বিছানার শিয়রের বাতায়ন–সবই যেন আদিত্যের পরিচিত। এমনকী তুষারের ভয়ও।

আদিত্য আসবে এই ভয়ে তুষার ঘুমোতে পারল না, শিশিরের ঘরের দিকে দরজাটা আস্তে করে ভেজিয়ে দিল পুরোপুরি, বাতি নিভিয়ে দিল, আর উৎকণ্ঠা সম্বল করে বসে থাকল বিছানায়।

বাগানে চাঁদের আলো ফুট ফুট করছে, বাতাস বয়ে যাচ্ছে, পাতার শব্দ উঠছিল মাঝে মাঝে, তুষার চমকে উঠছিল। সব নিস্তব্ধ, চরাচর নিদ্রিত, তুষার বিছানায় শুয়ে থাকল আড়ষ্ট হয়ে।

এক সময় বাগানে ছায়া দীর্ঘ হয়ে এল, বাতাস শিশিরার্জ হল, নিশীথের নিদ্রা আরও যেন গম্ভীর হয়ে সমস্ত অসাড় নিশ্চেতন করে ফেলল। তুষার জেগে থাকল।

আদিত্য এল না?

এল। তুষার তখন বুঝি ঘুমে অচেতন। আদিত্য জানলার কাছে এসে মৃদু সুরে ডাকল, তুষার তুষার।

তুষার চোখ মেলতে পারল না। ঘুম তার সর্ব ইন্দ্রিয় প্রাণহীন করে ফেলেছে।

তুষার। আমি এসেছি।

তুষার স্বপ্নের ঘোরে যেন অস্ফুট শব্দ করল।

তুষার এই যে আমি। তোমার জানলায়।

তুষার উঠল। আদিত্য জানলার কাছে। ঘুমে আলস্যে তন্দ্রাজড়িমায় তুষার যেন আদিত্যকে ভাল করে চিনতে পারল না। জ্যোতিবাবুর মুখের মতন মনে হল। তুষার চমকে উঠল। পরে চিনতে পারল আদিত্য।

আপনি?

আমি। বাইরে এসো তুষার।

না।

একটিবার। লক্ষ্মীটি এসো।

না।

এখানে কত আলো, তোমায় এই আলো ধুইয়ে দেবে। এখানের বাতাস শিশিরে ভিজেছে, তোমার কী ভাল যে লাগবে।

না আমি যাব না। তুমি যাও। তুষার জানালা বন্ধ করে দিল শব্দ করে।

ঘুম বেঙে তুষার নুটুর গাড়ির শব্দ পেল। মাথার দিকের জানলা সত্যিই বন্ধ। তুষার জানলা খুলে তাকাল। নুটু গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে নীচে নেমেছে।

আজ তুষার স্নিগ্ধ হাসতে পারল না। তার প্রতিদিনের হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা করতে ভুলে গেল। রোদ উঠছে। বাগানে সকালের ফরসা। পাখিদের কাকলি। তুষার লক্ষ করে দেখল। আদিত্য কি এসেছিল? তুষার বুঝতে পারল না।

এই প্রথম তুষার বড় ক্লান্ত অনুভব করল নিজেকে। তার ইচ্ছে হল ছুটি নেয়। নুটুকে বলে, আজ আমি যাব না নুটু, তুমি যাও।

বলতে পারল না তুষার। তাকে যেতে হবে। শিশুতীর্থ তার পথ চেয়ে বসে আছে।

 জানলার কাছ থেকে সরে আসার সময় তুষারের চোখে জল এল।

 এই প্রথম, চোখের জল দিয়ে তুষারের ভোর শুরু হল।

.

০৮.

নুটুর গাড়ি নিত্যকার মতন তুষারকে শিশুতীর্থে এনে পৌঁছে দিল। তুষার নেমে দাঁড়াল; ছেলেমেয়েগুলো হুড়োহুড়ি করে নামল, ঠেলাঠেলি, কলরোল, দেখতে দেখতে কয়েকজন মিলে দৌড় দিল। তুষার দাঁড়িয়ে।

সোনার জল দিয়ে যেন রং করা এই রোদ, কী উজ্জ্বল শরতের নীল আকাশের তলায় শান্ত নদীর মতন পড়ে আছে, তুষার রোদ দেখল না। বাচ্চাগুলো ছুটতে ছুটতে ঘাস মাটি গাছতলা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, তুষার সেদিকেও তাকিয়ে নেই। একটা বেগুনি রঙের বড় প্রজাপতি তুষারের পায়ের তলায় ঘাসের ডগায় বসে পাখা গুটোচ্ছে, আবার মেলছে, তুষার তা লক্ষ করল না।

শিশুতীর্থ যেন ফাঁকা, নিস্তব্ধ। যেন তুষার হঠাৎ আজ সকালে কোনও অপরিচিত জায়গায় চলে এসেছে তার পরিচিত কেউ কোথাও নেই। অন্যমনস্ক, স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে থাকল তুষার।

নুটু প্রত্যহের অভ্যেস মতন তুষারের বেতের টুকরি সিট থেকে নামিয়ে নিয়েছে। তুষারদিদিমণিকে আজ কেমন যেন লাগছে নুটুর। সারাটা পথ দিদিমণি আজ চুপচাপ এসেছে। বরাবর রাস্তার দিকে তাকিয়ে, কথা বলেনি একরকম, বাচ্চাদের সঙ্গেও না কথা না আর কিছু। নুটুর মনে হল, তুষারদিদিমণির শরীর খারাপ।

নুটুর সাড়া পেয়ে তুষার সচেতন হল।

অন্যদিন তুষার নিজেই গাড়িতে ওঠে, কোন ছেলেমেয়ে কী ফেলে গেছে কুড়িয়ে নেয় যত্ন করে। আজ তুষার আর গাড়িতে উঠল না। নুটুর কাছ থেকে নিজের টুকরিটা হাতে নিয়ে মৃদু গলায় বলল, ভেতরটা একবার দেখে এসো, নুটু।

নুটু গাড়িতে উঠল।

তুষার চারপাশে তাকাল। সব ফাঁকা। মাঠ সবুজ, রোদে নরম। গাছের পাতা বাতাসে কাঁপছে মৃদু। জঙ্গলের দিকে বুঝি একটা গরুর গাড়ি চলেছে, ঘণ্টা বাজছে, গরুর গলায় বাঁধা ঘণ্টা।

নুটু একটা ব্যাগ, একটা চকোলেটের বাক্স, কার যেন পেনসিল কুড়িয়ে এনে তুষারের হাতে দিল।

আর ঠিক এ-সময় তুষার অবাক হয়ে দেখল, অনেকটা দূরে ফাঁকা মাঠে একটা ঘোড়া। ঘোড়াটা চরছিল, চরতে চরতে ডেকে উঠল।

নুটু–তুষার ঘোড়র দিকে চোখ রাখল, ঘোড়া কোথা থেকে এল?

 নুটু মাঠের দিকে তাকিয়ে কেমন করে যেন হাসল একটু। বলল, ধনীরামের ঘোড়া, দিদি।

কার?

 ধনীরাম। জঙ্গলের গাছ কাটায় ধনীরাম।

তুষার চলে যাচ্ছিল। নুটু বলল আবার, নতুন যে বাবু এসেছেন, সেই বাবু একটা ঘোড়ার কথা বলছিলেন। সাহেবদাদুর টমটমে জুতে চড়বেন। ধনীরামবাবুকে বলেছিলাম। কাল বিকেলে এনেছি। বড় বদমাশ ঘোড়া ওটা।

তুষার থমকে দাঁড়াল। আদিত্য ঘোড়া আনিয়েছে! সাহেবদাদুর সেই পুরনো গাড়িটায় ঘোড়া জুতে চড়বে! তুষার গভীর বিস্ময় বোধ করছিল।

নুটু নিজের গাড়ির মুখ খুলতে এগিয়ে গেল। কেমন একটা গন্ধ বেরোচ্ছে, তেল না কোনও কিছু পোড়ার কে জানে।

তুষার ফটকের দিকে এগিয়ে গেল।

 মালতী লতার টোপর পরানো ফটকের তলায় এসে তুষারের পা কেমন অবশ হয়ে এল একটু। পাশে ঝাউয়ের কুঞ্জ থেকে একটা পাখি ডাকছে। জবা আর অপরাজিতার ঝোঁপ রোদ গায়ে দাঁড়িয়ে, অনেকগুলো ঘাস ফড়িং ঝোঁপের চারপাশে উড়ে উড়ে নাচছে। তুষার এসব চোখ চেয়ে ভাল করে দেখল না, চোখে পড়ল। চোখে পড়ল, সামনের মাঠে ক্ষুদে কুকুরটা চড়ুইয়ের সঙ্গে যেন কুমির কুমির খেলা খেলতে গিয়ে তুষারকে দেখেছে, ছুটে আসছে।

আরও দূরে জ্যোতিবাবু। আমতলায় বেতের মোড়া পেতে বসে জ্যোতিবাবু। তাঁর ছেলেমেয়েরা সবাই তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে।

তুষার হাঁটছিল। কুকুরটা গায়ের কাছে এসে লাফিয়ে উঠল। শাড়ির পাড় মুখে করে টানতে টানতে ক পা গেল, তারপর একটা পাখির বাচ্চা দেখে ছুটে আবার অন্য দিকে পালাল।

আশাদির ঘর থেকে গানের সুর ভেসে আসছে না। আজ কি তবে অনেকটা দেরি হয়ে গেল তুষারের!

আদিত্যকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তুষার পথ চলতে চলতে চারপাশে তাকাল, গাছগাছালির আড়ালে কোথাও যদি লুকিয়ে থাকে আদিত্য তবে সেকথা আলাদা, কিন্তু কোথাও তাকে দেখা যাচ্ছে না।

তুষার বিরক্ত বোধ করল। আদিত্যের ব্যবহার আজ তার কাছে বিরক্তিকর মনে হল। এতক্ষণ, সেই সকাল থেকে এ-পর্যন্ত, গাড়িতে আসতে আসতে তুষার এই বিরক্তি অনুভব করেনি। কালকের সেই মাঠ টিলা চাঁদের আলো, আদিত্যের অবুঝ ছেলেমানুষি, তার আসব বলে ভয় দেখানো, এবং স্বপ্ন সব যেন মিলেমিশে কেমন সম্মোহিত করে রেখেছিল তাকে। তুষার কী ভাবছিল ভাল করে মনে করতে পারল না।

হয়তো তুষার কখনও ভেবেছে পুরোটাই স্বপ্ন, কখনও মনে করেছে আদিত্য বাস্তবিকই অবুঝ ছেলেমানুষ, আবার কখনও কিছু ভাবেনি, শুধু কালকের নির্জন দৃশ্যগুলি টুকরো টুকরো ভাবে ছবির মতো দেখেছে।

সারাটা পথই–তুষার যাই ভাবুক, মনে মনে নিজেকে আজ খুব শুন্য মনে করছিল। তার মন ভার হয়ে ছিল। এ অনেকটা সেই রকম, সকালে ঘুম থেকে চোখ মেলেই মেঘলা দেখা, যে-মেঘলা সর্বত্র যার শেষ নেই, মনকে যা অকারণে বিষণ্ণ অপ্রসন্ন করে তোলে।

শিশুতীর্থে পা দিয়ে অকস্মাৎ তুষার এই বিশ্রী সম্মোহন থেকে যেন মুক্তি পেয়ে প্রথমেই বিরক্ত ও অপ্রসন্ন বোধ করল। তার উচিত অনুচিত বোধ, তার ভালমন্দ জ্ঞান, এবং অভ্যস্ত জীবনের নীতি তাকে ধিক্কার দিল। ছি ছি, তুমি কী বলে ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে একা ফাঁকায় বেড়াতে গেলে? তুমি কী করে ওর হাত ধরা হয়ে থাকলে কোন দুঃসাহসে ও তোমার কাছে ওই সব আবদার জানায়-আপনার কথা ভাবব। যদি ইচ্ছে হয় চলে আসব। আপনি তখন ঘুমোবেন। …

আদিত্য কাল কী করে এসব কথা বলতে পারল, তার সাহস জোগাল কেমন করে, তুষার ভাবছিল। ক্রমশ মাঠ ধরে গাছতলা দিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে আসছিল তুষার। জ্যোতিবাবুর দিকে তার চোখ পড়ল। জ্যোতিবাবু আকাশের দিকে হাত তুলে তাঁর ছেলেমেয়েদের কিছু বোঝাচ্ছেন।

আদিত্যের অত সাহসের জন্যে তুষার হঠাৎ নিজেকেই দায়ি করল। ভাবল, তার প্রশ্রয় না পেলে আদিত্য কখনওই অত কথা বলতে পারত না। তুষার লোকটাকে বেশি প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছে। আর প্রশ্রয় পেয়েই লোকটা মাথায় উঠেছে; কী বলা উচিত, কী বলা উচিত না সে-জ্ঞান লোপ হয়েছে ওর। আশ্চর্য, কোনও ভদ্রলোক কোনও মেয়েকে কী করে বলে, রাত্রে ঘুমের বেলায় সে তার বাড়ি আসবে।

তুষার এখন যত ভাবছিল, যত ঘুরে ঘুরে কালকের সেই বিদায় মনে করছিল ততই অসন্তুষ্ট হচ্ছিল। আদিত্যের ওপর তার রাগ হচ্ছিল। নিজের অক্ষমতার কোনও সঙ্গত কারণ খুঁজে না পেয়ে নিজের ওপরই ক্রুদ্ধ হচ্ছিল।

তুষারের ঘরে নিত্যকার মতন কোলাহল। ছেলেমেয়েরা খেলা করছে, ছড়া পড়ছে সমস্বরে, গান গাইছে, ডিগবাজি খাচ্ছে। তুষার ঘরে ঢুকল। সবাই দেখল, মনে হল না তাতে তাদের কোনও ব্যাঘাত ঘটেছে।

.

যমুনা আর বেবি বি কুইক খেলছে। দুজনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, দুজনেরই দুটো করে হাত বুকের কাছে তালি দেবার মতন করে ধরা, তিনবার করে তুড়ি দিচ্ছে, বার দুই করে তালি মারছে নিজেদের হাতে, তারপর পরস্পরের হাতে তালি দিয়ে যমুনা বলছে ব্ল্যাক বোর্ড…বি কুইক…বেবি পালটা তুড়ি দিয়ে, তালি মেরে যমুনার হাতে হাত ঠুকে বলছে, দিদিমণি…বি কুইক…।

ওরা দুজনেই একেবারে তুষারের বসার জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে। তুষারকে দেখেও হৃক্ষেপ করল না। কারণ যমুনা একটা শক্ত কথা বলে ফেলেছে, বেবি কিছুতেই আর শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না–তার পুঁজি ফুরিয়ে গেছে, সে হেরে যাচ্ছে।

তুষার তার বসার জায়গায় মেয়েদের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলা করতে দেখে হঠাৎ কেমন রেগে গেল। আর কখনও যা করে না, করেনি এ-যাবৎ, যমুনার কাঁধে হাত দিয়ে ঠেলে দেবার মতন করে মৃদু ধাক্কা দিল। নিজের জায়গায় যাও। নিজের জায়গায়। অসভ্য মেয়ে।

যমুনা এবং বেবি দুজনেই হাত নামাল। দুজনেই অবাক। ছোট ছোট দুটি মেয়ে নির্বোধ বিস্মিত চোখ তুলে তাদের তুষারদিদিকে দেখছিল।

কথা শুনতে পেলে না? তুষার গম্ভীর গলায় বলল, তার চোখে মুখে বিরক্তি।

যমুনা মাথা নাড়ল, কথা শুনতে পেয়েছে।

তবে এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?

 বেবি আগে, পরে যমুনা চলে গেল।

ঘরে তখনও হট্টরোল চলছে।

তুষার ব্ল্যাকবোর্ডের কাছ থেকে ডাস্টার তুলে নিয়ে টেবিলে ঠুকল, ঠুকে আওয়াজ করল; দু এক জন সেই শব্দে তুষারের দিকে চোখ ফেরালেও অন্যেরা খেলা এবং মজা ছাড়ল না। তুষার গলা তুলে বলল, চুপ করো। তোমরা চুপ করো সবাই। …এই শানু নিজের জায়গায় যাও। অশোক–এই অশোক, তোমায় আমি থামতে বলছি না, কানে কথা ঢুকছে না? বলতে বলতে তুষার ঘরের মধ্যে গিয়ে একে ছাড়াল ওকে বসাল, তাকে ঠেলে সরিয়ে দিল।

ছেলেমেয়েগুলো থতমত থেকে শান্ত হয়ে আসছিল। তুষার তাদের তিরস্কার করছে: সারাক্ষণ খেলা…! অবাধ্য অশান্ত সব ছেলেমেয়ে। তোমাদের কানে কথা যায় না, না? আমি চেঁচিয়ে যাচ্ছি, তোমরা নিজের মনে খেলা করে যাচ্ছ। এই অশোক, তুমি জানলার কাছে গিয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকো। শানু, বোর্ডে গিয়ে তেরোর ঘরের নাম লেখো। …ছি ছি ছি। এই ঘরটা কী? মেলা নাকি? কেউ ঘরে ঢুকলে কী বলবে তোমাদের? ছি ছি…?

ঘর শান্ত স্তব্ধ। যে-ঘর সামান্য আগে শিশুকোলাহলে মুখর ও জীবন্ত হয়ে ছিল, সেই ঘর চুপ হয়ে গেল। এত চুপ যে মনে হবে, এ-ঘরের সমস্ত ছেলে ছুটির পর চলে গেলে ঘর যেমন নিঃসাড় নীরব হয়ে থাকে, তেমনি। কেউ আর কথা বলছিল না, ঠোঁট পর্যন্ত খুলছিল না। সকলেই বুঝতে পারছিল তুষারদিদিমণি খুব রেগেছে। ওরা কখনও, বা এত কম–এক আধবার তুষারদিদিকে গম্ভীর হতে, রাগ করতে দেখেছে যে, আজকের রাগ সবাই অবাক হয়ে দেখছিল। তুষারদিদি অনেকদিন আগে একবার মন্টুকে কান ধরার শাস্তি দিয়েছিল, আজ অশোককে। অশোক জানলার কাছে গিয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

শানু বোর্ডে তেরোর ঘরের নাম লিখছিল। সাত তেরোং একানব্বই পর্যন্ত লিখে আট তেরোংয়ের হিসেবটা মনে মনে ভাবছিল।

এই যমুনা, এদিকে এসো। তুষার ডাকল।

 যমুনা জায়গা ছেড়ে গুটি গুটি পায়ে তুষারের কাছে এল।

গ্লোবের কাছে যাও।

যমুনা গ্লোবের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। গ্লোবের দক্ষিণ দিক কোনটা?

যমুনা যেন ঝপ করে পুকুরে পড়ে গেল। গ্লোবের দক্ষিণ দিক। সেটা কী? যমুনা গ্লোব থেকে মাত্র দুটো জিনিস বার করতে পারে ভারতবর্ষ আর উত্তরমেরু। তবু, শুকনো মুখে, বড় মানুষের মতন জিব দিয়ে ঠোঁট চাটতে চাটতে যমুনা গ্লোবে হাত রাখল। হাত দিলেই গ্লোব ঘুরে যায়। উত্তর মেরু উত্তরে এটা মনে মনে ঠাওর করলেও যে-গ্লোব ক্রমাগত হাত দিলেই ঘুরে যাচ্ছে, তার দিকনির্ণয় তার অসাধ্য। সে কি ছাই উত্তর দক্ষিণ জানে!

তুষার তার বেতের টুকরিটা এতক্ষণ মোড়ার ওপর নামিয়ে রেখেছিল। এবার তুলে নিল। বলল, হই হই, হট্টগোল করতে তো কষ্ট হয় না, নামতা লিখতে বললেই আর পারো না; দক্ষিণ দিক কোনটা তাও জান না। …আমি আর আসব না তোমাদের ঘরে। অন্য ঘরে চলে যাব। বলতে বলতে তুষার শানুর হাত থেকে খড়ি নিয়ে তেরোর নামতা পুরো লিখে দিল। যমুনাকে দক্ষিণ দিক দেখিয়ে চোখের দৃষ্টিতে ভর্ৎসনা করল, করে ছোট দরজা দিয়ে তার কুঠরি-ঘরে চলে গেল।

ঘরটা শান্ত স্তব্ধ, কেমন যেন আকস্মিক ঝড়ে নিয়মিত আবহাওয়া থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্য রকম হয়ে থাকল। ছেলেমেয়েগুলো নীরব। সবাই মুখ শুকনো করে বসে। তুষারের ভর্ৎসনায় যেন আহত, ক্ষুব্ধ।

কুঠরি-ঘরে তুষার অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। এ-ঘরে এক চিলতে জানলা। জানলার দিকে মুখ করে ক্যাম্বিসের চেয়ারটা পাতা থাকে, আরও পাশে ছেলেমেয়েদের খেলাধুলোর আর পড়াশোনার কিছু জিনিসপত্র। ওরই মধ্যে তুলো আর কাপড় দিয়ে তৈরি মস্ত একটা হাঁস। ধুলোয় তার গা ময়লা হয়ে আছে।

জানলা দিয়ে তাকালেই দুরে জ্যোতিবাবুকে চোখে পড়ছিল। জ্যোতিবাবু তাঁর ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন। ঘরে চোখ ফিরিয়ে নিলে হাঁসটা চোখে পড়ছিল। এই হাঁসটাও জ্যোতিবাবুর তৈরি।

তুষার কখনও বাইরে তাকাচ্ছিল কখনও ঘরে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল। বাইরে শরতের বেলা বেড়ে উঠছে। কাঁচের গায়ে রোদ পড়লে যেমন আলো ঠিকরে ওঠে, এখন রোদ তেমনি ঠিকরে আসছে; সবুজ ঘাসে যেন পালিশ তুলে দিয়েছে কেউ, বাতাসে গাছগুলোর ডাল পাতা মাঝে মাঝে কাঁপাচ্ছিল, আর পাখিরা ডাকছিল।

অনেকটা সময় চুপচাপ বসে তুষার নিজের বিরক্তি রাগ সামলে নেবার চেষ্টা করল। সে যে কেন রাগল, কেন অসন্তুষ্ট হল–তার যথার্থ কারণ খোঁজা কঠিন নয়। আদিত্যর ওপর মনে মনে যতটা রেগেছে তুষার, যেরকম অসন্তুষ্ট হয়েছে, তারই খানিকটা অযথা বাচ্চাগুলোর ওপর যেন ফলিয়ে এসেছে।

খারাপ লাগছিল তুষারের, অনুতাপ হচ্ছিল। নিজের এই অকারণ মানসিক চাঞ্চল্যের জন্যে গ্লানি বোধ করছিল।

পরে অশোক শানু যমুনার জন্যে তুষারের কেমন কষ্টও হল। ওদের দোষ নেই, ওরা কি জানত রোজ ওরা যা করে যেভাবে সময় কাটায়, আজ তুষারদিদি তাতে হঠাৎ রাগ করে বসবে!

তুষার উঠল। মনে মনে ঠিক করল আজ অশোক শানু যমুনাকে দিয়ে অন্য রকম ভাবে ইতিহাসের একটা গল্প পড়াবে।

.

দুপুরের খাওয়ার ছুটিতে আদিত্যকে দেখা গেল। তুষার ছেলেমেয়েদের নিয়ে খাবার ঘরের দিকে যাচ্ছে, আদিত্য গাছতলায় দাঁড়িয়েছিল।

ছেলেমেয়েরা চলে গেছে অনেক, তুষার যাচ্ছে, আদিত্য গাছতলা থেকে ডাকল।

 তুষার দাঁড়াল। দাঁড়িয়েই ভাবল, তার চলে যাওয়া উচিত ছিল।

আদিত্য কয়েক পা এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল। মুখে চোখে প্রবল হাসি মাখানো। কী খবর?

তুষার মুখ তুলল না। মানুষটার গলার স্বর থেকেই সে আদিত্যর উৎফুল্লভাব অনুমান করতে পারছিল। এত আনন্দের কী আছে! তুষার বিরক্ত হয়ে ভাবল, এত খুশি হবার মতন কী পেয়েছে ও?

কাল আপনার জন্যে যা ভুগলাম। আদিত্য দুর্ভোগের মাত্রা জানাবার জন্যে তার কথার স্বর ও শব্দে ঝোঁক দিল।

তুষার কথা বলল না। কে ভুগেছে কাল? যে-লোক শাসায়, না, যে-লোক সর্বক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকে? আদিত্যর এই নির্লজ্জ উক্তিতে যেন তুষারের আরও রাগ হচ্ছিল।

কাল দেখলাম, মানুষ কত অভদ্র হয়। আদিত্য বলল।

 তুষার মুখ তুলল, দেখল আদিত্যকে। লোকটা তাকে অভদ্র বলছে! তুষারের কপালের কাছটায় জ্বালা করে উঠল। কী দুঃসাহস, কতখানি ঔদ্ধত্য তার! কে অভদ্র?

আপনাদের স্টেশন-স্টাফ।

 তুষার রুক্ষ চোখে দেখছিল আদিত্যকে। কথা পালটে নিয়েছে আদিত্য, তুষার সন্দেহ করল, বে-ফসকা কথাটা বলে এখন সামলাবার চেষ্টা করছে।

আমি মাঝরাতে স্টেশনের ওয়েটিং রুমে একটু শোব ভেবে ছিলাম। তালা বন্ধ ঘর, বললাম– মশাই একটু খুলে দিন। দিল না; বলল, আপনি তো প্যাসেঞ্জার নন। আদিত্য নিজের মনেই বলে চলল, লোকগুলো একেবারে অ্যানিমাল…।

যে-সে এসে থাকতে চাইলেই ঘর খুলে দেবে–তুষারের মুখ থেকে কথাটা বেরিয়ে গেল। সে স্টেশনের প্রসঙ্গে কথাটা বললেও আসলে এই কথার অর্থ ছিল, ভিন্ন ইঙ্গিত। আদিত্য তাকে ইঙ্গিত করেছে আগে, কাজেই তুষার সেই ইঙ্গিতের প্রত্যুত্তর দিল। আর কিছু বেশি হয়তো দিল, আদিত্যকে ভদ্রতা এবং ভদ্র বোধ সম্পর্কে কিছু জ্ঞান।

যে সে–! যে সে মানে কী! …ওয়েটিং রুম কারও ভাড়া করা বাড়ি নয়।

আপনিও প্যাসেঞ্জার নন।

আদিত্য হাসল। বলল, আঃ-হা, তা একটা লোক যখন বিপদে পড়েছে তখন অত নিয়ম কী। নেসেসেটি…।

সবাই নিয়ম ভাঙতে চায় না। তুষার অন্য অর্থে বলল।

 সে যারা ভিতু, বা…নিতান্ত প্রেজুডিস…

আপনি তা মনে করতে পারেন। তুষার বলল, বলে হাঁটতে শুরু করল।

পাশে পাশে হাঁটছিল আদিত্য। হাঁটতে হাঁটতে বলল, আপনি কাল যদি কিছু খাইয়ে দিতেন তা হলেও বাঁচতাম। রাত্রে খিদে পেয়ে গেল খুব। পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখি মাত্র পাঁচ আনা পয়সা। খেয়াল ছিল না, টাকা পয়সা নেই।

অনাহার এবং অনিদ্রা, তুষার ভাবল, কাল এই মানুষটার অনাহারে এবং অনিদ্রায় রাত কেটেছে, কাটুক, তুষার তার কী করতে পারে!

তারপর ওই খালি পেটে ভোর হতে না হতেই হাঁটতে শুরু করেছি। হেঁটে হেঁটে এতটা পথ। আদিত্য হাসল কেমন করে যেন, হাসি থামলে বলল, খুব শিক্ষা দিলেন।

তুষার ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। শিক্ষা পেয়েছে না কি লোকটা? পেয়েছে যদি তবে হাসছে কেন?

পাওয়া উচিত। তুষার বলল, জোর দিয়েই বলল।

উচিত?

নয় তো কি ভাবছেন আপনার কোনও জ্ঞান হত।

আমার জ্ঞান কি আপনার চেয়ে কম?

 আপনার কোনও জ্ঞানই নেই।

 আদিত্য উচ্চস্বরে হেসে উঠল। তুষারের কথা বলার গাম্ভীর্য এবং রাগের ভাবে যেন সে অসাধারণ কোনও মজা পাচ্ছিল।

অপ্রত্যাশিত এই হাসি তুষারকে কেমন বিব্রত করল। মনে হল, তার সমস্ত কাঠিন্য, বিরক্তি যেন অর্থহীন হয়ে গেছে; আদিত্যকে কিছু স্পর্শ করতে পারছে না। কিছুই সে গ্রাহ্য করছে না।

তাড়িয়ে দিয়েও অত বড় বড় কথা শোনাচ্ছেন কেন? আদিত্য হাসি মুখে বলল।

তুষার নীরব। খাবার ঘরের কাছাকাছি তারা পৌঁছে গেছে।

কাল আপনি আমায় যেভাবে তাড়ালেন, মনে হল যেন কোনও ডাকাত কিংবা চোর-ফোরকে বাড়ির ত্রিসীমানা থেকে সরালেন!

মনে মনে তুষার স্বীকার করল, হ্যাঁ। হ্যাঁ সে এই মানুষটাকে ভয় পেয়েছিল। লোকটা তার বাড়িতে অবাঞ্ছিত ছিল। এমন মানুষকে কেউ আশ্রয় দেয় না। দেওয়া উচিত না।

খিদের মুখে আমার যা রাগ হচ্ছিল আপনার ওপর…! দুটো খেতে দিয়েই না হয় বাড়ি থেকে। তাড়াতেন!

তুষার বলব কি বলব না করে শেষ পর্যন্ত বলল, আপনিই কি আমায় খুব স্বস্তি দিয়েছেন?

আই ডিড নাথিং।

না, কিছুই করেননি। …খালি শাসিয়ে গেলেন, যখন খুশি চলে আসতে পারেন।

কিন্তু আমি আসিনি।

কী যেন বলতে যাচ্ছিল তুষার, অকস্মাৎ অনুভব করল, আদিত্য আসেনি বলেই কি তুষার এত বিরক্ত অপ্রসন্ন শূন্য বোধ করছে। আজকের এই ক্ষোভ দুঃখ রাগ মনমরা ভাব কি আদিত্যর না আসার জন্যে?

স্বপ্নের কথা মনে পড়ল তুষারের। আর সহসা সে নিজেকে ধিক্কার দিয়ে উঠল, ছি ছি, এই সব বিশ্রী চিন্তা তার মনে আসছে কেন? কে আদিত্য, তার সঙ্গে তুষারের কীসের সম্পর্ক? কেন তার আসা না আসার ওপর তুষারের মন বিরক্ত বা অপ্রসন্ন হবে, কেন তার স্বপ্ন দেখে তুষার চোখের জল দিয়ে ভোর শুরু করবে।

তুষার কোনও কথা বলল না, দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল।

.

০৯.

দিদি?

কী?

তুই কোথায় গিয়েছিলি? বাইরে?

না। বাগানে ছিলাম। বসে ছিলাম। তুষার অন্যমনস্ক গলায় বলল।

শিশির দিদিকে দেখছিল। লণ্ঠনের মেটে আলোয় তুষারকে নিষ্প্রভ দেখাচ্ছিল, আলোটাও জানলার দিকে, তুষার দেরাজের কাছে দাঁড়িয়ে। শিশির দিদিকে লক্ষ করছিল। আজ এখন পর্যন্ত দিদি তার সঙ্গে তেমন কোনও কথা বলেনি। স্কুল থেকে ফিরে, অবেলায় অনেকক্ষণ নিজের ঘরে শুয়েছিল, সন্ধের পর উঠে চা খেয়ে, কাপড় ছেড়ে একবার এ-ঘরে এসেছিল, দু একটা কথা বলে চলে গেছিল। তারপর অনেকক্ষণ পরে হয়তো ঘণ্টা খানেকেরও বেশি বাইরে থাকার পর, এই ফিরল।

দিদিকে ভাল দেখাচ্ছে না। অবেলায় শোয়ার জন্যেই হোক, কিংবা দিদির কোনও কারণে শরীর খারাপ হয়েছে হয়তো, তাই কেমন ম্লান মনমরা শুকনো দেখাচ্ছে দিদিকে।

বাগানে ছিলি এতক্ষণ? কী করছিলি একলা একলা? শিশির বলল।

বসে ছিলাম।

তুই আবার একা বসে থাকতে পারিস নাকি? শিশির যেন বিশ্বাস করল না, কিংবা দিদির স্বভাবকে নিন্দেই করল। সে আমি, একা থেকে থেকে অন্য অভ্যেসই হয়ে গেছে।

বাইরেটা ভাল লাগছিল। তুষার দেরাজ থেকে থেকে পুরনো ওষুধের শিশি সরিয়ে কী যেন খুঁজছিল।

আমায় ডাকলি না কেন? শিশির বলল।

তুষার কথার জবাব দিল না। সে একা ছিল। একা থাকার সময় ভাইকে ডাকা যায় না। ডাকতে ইচ্ছে করে না।

হ্যাঁরে, এখানে না একটা অ্যাসপিরিনের শিশি ছিল? তুষার ভাইয়ের দিকে তাকাল।

দেখ, আছে ওখানেই। …তুই অ্যাসপিরিন খাবি?

মাথা ধরেছে বড়।

 অবেলায় ঘুমোলি যে।

না। ঘুমোইনি। শুয়েছিলাম। তুষার অ্যাসপিরিনের শিশি খুঁজে পেল। সকালের দিকে ঠাণ্ডা লেগেছে বোধ হয়। তুষার কথা বলতে বলতে দেওয়ালের দিকে গেল। কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে নিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল, বলল, কটা খাব রে? দুটো? চারটে?

না না, চারটে নয়, বুক ধড়ফড় করে মরবি। দুটো খা।

তুষার অ্যাসপিরিন মুখে দিয়ে জল খেল। অনেকটা জল। তারপর শিশি জায়গা মতন রেখে ভাইয়ের বিছানায় এসে বসল।

ভাই বোন মুখোমুখি। তুষার বিছানায় পা গুটিয়ে বসল। তাস খেলবি?

 না, মাথা নাড়ল শিশির। তোর তো এমনিতেই মাথা ধরে আছে।

 তা হোক; তাস আনি। তুষার নেমে পড়ছিল।

না রে দিদি, তাস না। ভাল লাগছে না। বরং দুটো গল্প করি।

তুষার আবার পা গুটিয়ে নিল। ভাইয়ের মুখ দেখল কপলক। শিশিরের মুখ বেশ সুন্দর। নরম পাতলা টিকলো নাক, শান্ত চোখ, কপাল বেশ লম্বা। তুষারের মুখের সঙ্গে নীচের মুখের মিল আছে ওপর মুখের নেই। ভাইয়ের মুখ মাঝে মাঝে তুষারকে কেমন বেদনা দেয়। কারণ এমন সুন্দর নরম মুখের পুরুষ মানুষটি কোনওদিন জীবনের সব তৃপ্তি পাবে না। ভগবানের নিষ্ঠুর অভিশাপ তাকে কী ভীষণ অক্ষম করে রেখেছে।

হ্যাঁরে দিদি, আমাদের বাগানে শিউলি ফুটেছে?

 ফুটেছে। এখন অল্প।

আমি কালও গন্ধ পেয়েছি যেন। শিশির জানলার দিকে তাকাল, গাছটাকে এবছরে এমন নষ্ট করে দিল।

তার জন্যেই তো! তুষার বলল।

 শিশির চুপ করে থাকল। শিউলি গাছটাকে এক বন্ধুর কথা শুনে লোক ডেকে ডাল পালা ছাঁটিয়ে দিয়েছিল শিশির। নতুন ডালপালা, নতুন অজস্র পাতার স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু গাছটাকে আগামুড়ো অমন করে কুপিয়ে কেটে দিলে এক বর্ষার জল আর কত তার গা ভরতে পারে।

আমায় কাল কিছু ফুল এনে দিস তো৷ শিশির বলল।

তুষার মাথা নাড়ল। দেবে। তারপর কী ভেবে আচমকা একটু ঠাট্টা করল। ফুল দেখে কবিতা লিখবি?

লিখলেই বা৷ শিশির জবাব দিল। দিদির চোখে চোখে চেয়ে হঠাৎ তার মাথায় কোনও দুষ্টুবুদ্ধি এল, বলল, আমরা ফুল দেখলে কবিতা লিখি, তোরা হলে মালা গাঁথতিস।

গাঁথতাম, অন্যায়টা কী হত।

 কিছু না। মেয়েদের সবটাই তো কাজে লাগে এমন কিছু করা, প্র্যাকটিক্যাল পারপাস ছাড়া…

থাম, তুই আবার ছেলে মেয়ে কী বুঝিস? এক ফোঁটা তো ছেলে।

বুঝি না?

ডিম বুঝিস।

আচ্ছা, তা হলে, তোকে..ধর তোকে নিয়েই একটা গল্প লিখি।

গল্প?

 লিখি না একটা। …আগে দু তিনটে লিখেছি। …আজকাল গল্প লিখতেও ইচ্ছে করে, দিদি। শিশিরের গলায় কোনও এক রকম বিষাদ। যেন বলতে চাইছে, সারাদিন সারাটা দিন একা একা আর পারি না রে, বড় অসহ্য লাগে। এই অসহ্য একঘেয়ে সময় কাটানোর জন্যে আর কী করা যায়, এক বসে বসে গল্প লেখা ছাড়া! আমি পারি, এই অফুরন্ত সময় নিয়ে বসে বসে, খোলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আমি এক মনে একটা একটা করে গল্প লিখতে পারি।

তুষার নীরব থাকল। ভাইকে আর দেখছিল না। শিশির কি কিছু বলতে চায়, শিশির কি কোনও কিছু বুঝতে পারে! তুষারের মনে হল, এই গল্প লেখার কথাটা একেবারে অকারণে নয়; তার সন্দেহ হল, শিশির কিছু ভাবে, হয়তো ভেবেছে।

ভাই বোন দুজনেই অল্প সময় নীরব থাকল। বাইরে শরতকাশের চাঁদ স্নিগ্ধ পূর্ণ জ্যোৎস্না ঢেলেছে, জানলার গা দিয়ে সেই জ্যোৎস্না ঘরে আসার অপেক্ষা করছে। শীতল মৃদু বাতাস আসছিল। রাস্তা দিয়ে কখনও কখনও সাইকেল যাচ্ছে। সাইকেলের ঘন্টি শোনা যাচ্ছে অস্পষ্ট ভাবে। তুষার ঘন্টির সঙ্গে অন্যমনস্ক এবং ভীত হচ্ছিল।

শিশির–তুষার কিছু ভাবতে ভাবতে বলল, এবারে পুজোর সময় কান্তিমামাদের ওখানে যাবি?

কান্তিমামা! শিশির বোধ হয় অবাক হয়েছিল।

 চল না। অনেকবার তো বলেছে।

তুই পাগল। শিশির বলল।

পাগল! –কেন?

 এই ঘর বাড়ি ফেলে যাওয়া! …তা ছাড়া আমাদের সঙ্গে তার কিই বা আত্মীয়তা?

আমাদের কার সঙ্গেই বা আত্মীয়তা! তুষার বলল, ওসব আত্মীয়তার কথা ধরলে তোর আমার যাবার জায়গা কোথাও নেই। এখানেই সারা জন্ম থাকতে হয়।

রয়েছি তাই। শিশির দিদির চোখে চোখে তাকিয়ে বলল।

তুষার কেমন যেন বাধা পেল। কয়েক পলক ভাইকে দেখল, অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল, মৃদু গলায় বলল, একবার না দুবার আমরা বাইরে গেছি, বাবা বেঁচে থাকতে। তারপর সেই যে এখানে পড়ে আছি, কোথাও যাইনি। আর ভাল লাগে না রে!

দিদির গলার স্বর শিশির মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। দিদির কথায় হতাশা ক্লান্তি, দিদির মন তার গলার স্বরে ধরা পড়ছিল। শিশির স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, দিদির যেন আজ কদিন কিছু আর ভাল লাগছে না।

অল্প সময় শিশির নিজমনে কিছু ভাবল। ভেবে নিশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, ও সব তোর খেয়ালের কথা ছাড়। এখান থেকে তুই কোথাও গিয়ে থাকতে পারবি না, যেতেও পারবি না। কেন বাজে কথা বলছিস, দিদি।

তুষার বুঝতে পারল না, বাস্তবিক এই অসম্ভব অকারণ কথা কেন সে বলতে গেল। এখান ছেড়ে এবাড়ি ছেড়ে কোথাও কি কখনও গিয়েছে তুষার? যাবার কথা কি ভেবেছে?

অথচ যখন তুষার কথাটা বলেছিল, তখন মনে হয়েছিল, সত্যিই এখানের একঘেয়েমি এবং ক্লান্তি সে অনুভব করছে; অন্য কোথাও যেতে পারলে হয়তো বাঁচে।

শিশির হাত বাড়িয়ে একটা বালিশ টেনে নিল, কোলের ওপর রাখল। জ্যোতিদার খবর কী রে?

তুষার যেন শুনতে পায়নি। মুখ সামান্য বেঁকা করে বসেছিল। জানলার দিকে সরাসরি মুখ নয়, কিন্তু জানলা দেখা যাচ্ছিল। জ্যোৎস্না এসেছে, জানলার শিক গলে, শিকের ছায়া ফেলে আলো এসে গেছে।

জ্যোতিদার সঙ্গে তোর দেখা হয় না? শিশির আবার বলল।

কথাটা এতক্ষণে তুষার শুনতে পেয়েছে। জ্যোতিদা…! শিশিরের মুখের দিকে তাকাল তুষার। জ্যোতিবাবুর কথা প্রায় ভুলে গিয়েছিল তুষার এমন চোখ করে তাকিয়ে থাকল। বলল, দেখা হয়।

একদিন আসতে বলিস না। অনেক দিন আসেননি।

 তুষার শুনল। কোনও জবাব দিল না। মনে মনে জ্যোতিবাবুর কথা ভাবছিল।

এ-রকম মানুষ আমি দেখিনি। শিশির বলল, স্কুল নিয়ে মাতল তো মাতলই, আর এ-মুখো হল না।

অনেক কাজকর্ম নিয়েছেন যে। তুষার অন্যমনস্ক গলায় জবাব দিল। সামান্য চুপ করে থেকে আরও বলল, সারাদিনই একটা না একটা ঝাট থাকে।

বাড়িতেও আসে না। শিশির বালিশের ওপর কনুই রেখে সামান্য কুঁজো হল। তোকে বলিনি। সেদিন জয়ন্তীদি এসেছিল।

এখানে?

হ্যাঁ। শিশির মাথা নাড়ল। বলল, দুপুরবেলায় কী কাজে বেরিয়ে এখানে এসেছিল, অনেকক্ষণ ছিল। গল্প করল অনেক।

কী বলল? তুষার আগ্রহ বোধ করছিল।

সে অনেক কথা শিশির পিঠ সোজা করল। জ্যোতিদা বাড়ি আসে না, ছেলেমেয়ে নিয়ে জয়ন্তীদি একলা। বড় ছেলেটা হাত ভেঙেছে। মেয়েটার জ্বর। তার ওপর এমন দুই ভাড়াটে জ্যোতিদাদের, রোজই ঝগড়া মারপিট করছে, একজন আবার থানায় গিয়ে ডায়রি করেছে।

তুষার মন দিয়ে শুনছিল। বলল, জ্যোতিবাবুকে বলব।

 বলিস!

সামান্য ইতস্তত করে শিশির বলল, আরও একটা কথা, দিদি।

কী?

তোকে বলব? শিশিরের মুখে সামান্য দ্বিধা।

 আমায় বলবি না! কী কথা?

 তোদের সেই মলিনার বাবা একদিন জ্যোতিদাদের বাড়ি গিয়ে যা তা করেছে।

যা তা–! অস্ফুট বিস্মিত স্বর বেরুল তুষারের গলা দিয়ে। তুষার অপলকে তাকিয়েছিল। শিশির সসঙ্কোচে মৃদু গলায় বলল, একদিন মদ ফদ খেয়ে হাজির হয়েছিল জ্যোতিদাদের বাড়িতে। জয়ন্তীদিকে যা তা বলে গেছে। জ্যোতিদা নাকি তার মেয়েকে ভুলিয়ে স্কুলে নিয়ে গেছে! শিশির আর কিছু বলল না।

তুষার স্তব্ধ হয়ে বসে থাকল।

.

১০.

 জ্যোতিবাবু এই শহরের লোক। তুষাররা যত দিনের তার চেয়ে অবশ্য কম। তবু পুরনো বাসিন্দেই বলা যায়। জ্যোতির বাবা ছিলেন পুলিশ দারোগা। চাকরির শেষ পর্বে এখানে এসে ছিলেন, তারপর অবসর নিয়ে আর অন্য কোথাও যাননি, পুরনো হাটের দিকে অনেকটা জায়গা কিনে বাড়ি তুলেছিলেন। বাংলো ছাঁদের বাড়ি, একতলা। বাড়ির মাথায় টালির ছাউনি। মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন এখানে বসেই। সেই মেয়ে পাঁচ বছরের মধ্যেই বিধবা হয়ে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি ফিরে এল! জ্যোতির মা তার আগেই মারা গেছেন।

বিধবা মেয়ে ও নাতি নাতনিদের নিয়ে কয়েকটা বছর হরসুন্দর দারোগার কেটে যায়, তিনি বজ্রাঘাতে মারা যান। লোকে বলত পাপের জীবন এমনি করেই শেষ হয়। হরসুন্দর দারোগার কোথায় পাপ কেউ জানত না, তিনি এ-শহরে এসে এমন কিছু করেননি যাতে পাপের কথা মুখে আসে, তবু লোকে বলত। প্রথমে স্ত্রী, তারপর জামাতা হারালেন। শেষে নিজে ভগবানের পায়ে ঠাঁই নিলেন। সবই যে তাঁর পাপের ফল এ-ধারণা এখানের বহু লোকেরই ছিল, হয়তো আজও আছে।

বাবা মারা যাবার সময় জ্যোতি সবে মাত্র কলেজের পড়া শেষ করেছে। বছর বাইশ তেইশ বয়স। এই ছেলে ছিল আলাদা প্রকৃতির। শহরে তার কোথাও ঘনিষ্ঠতা ছিল না। বাল্যাবধিই বাইরের স্কুল কলেজে পড়েছে, হোটেল-বোর্ডিংয়ে থেকেছে। ছুটিতে বাবার কাছে এসেছে, কিন্তু সে-থাকা এত নিভৃত নিঃসম্পর্ক যে শহরের তার সমবয়সীরাও তার নাগাল পায়নি।

সংসারটা, বাবার মৃত্যুর পর, জ্যোতির ঘাড়ে পড়ল। দিদি আর ভাগ্নে ভাগ্নি সংসারে, সবে কলেজ ছেড়ে এসেছে ও। কী করবে ভেবে পায়নি। প্রথম প্রথম দু এক জায়গায় কাজ করেছে, ভাল লাগেনি বোধহয়, ছেড়ে দিয়েছে। বাস কোম্পানির এজেন্টগিরি করেছে কিছুদিন, তাও ছেড়ে দিয়েছে পরে। শেষে একটা মনিহারি দোকান খুলেছিল। বছর দুয়েক পরে সে-দোকানও উঠিয়ে দিল।

শেষে শিশুতীর্থ। শিশুতীর্থে জ্যোতিই সব চেয়ে পুরনো, তারপর আশাদি, তারপর তুষার। তুষারকেও জ্যোতিই শিশুতীর্থে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।

ঘটনাটা এই রকম। জ্যোতি এই শহরের যে দু পাঁচজনের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত পরিচিত হয়েছিল, বা যাদের সঙ্গে মোটামুটি তার একটা সৌহার্দ্যর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে শিশির একজন। শিশিরের কোনও বন্ধুর সঙ্গে জ্যোতি একদিন এ বাড়ি এসেছিল। শিশিরকে দেখে কেমন গভীর সহানুভূতি বোধ করেছিল, আর সেই সহানুভূতির দরুন মাঝে মাঝে আসত এ বাড়িতে! তুষারের সঙ্গে পরিচয় সেইসূত্রে।

সাহেবদাদুর শিশুতীর্থে জ্যোতি নিজের জায়গা করে নেবার পর তুষারকেও নিয়ে গেল। কথাটা অন্যভাবেও বলা যায়, বরং সেটাই বলা উচিত। …শিশুতীর্থের তখনও নামকরণ হয়নি, সবে সাহেবদাদু কয়েকটা আদিবাসী ছেলে জোগাড় করে একটা পাঠশালার মতন চালাচ্ছেন, এবং আরও দু পাঁচজন ছেলে জোগাড়ের চেষ্টা করছেন আশপাশ থেকে। এসময় একদিন জ্যোতি বেড়াতে গিয়ে ছিল ওদিক পানে। সাহেবদাদুর সঙ্গে তার চোখের পরিচয় ছিল, বেড়াতে গিয়ে সেই পরিচয় পাকা হল। তারপর সাহেবদাদুর কাছে যাওয়া আসা করে জ্যোতি সাহেবদাদুর কল্পনার কথা শোনে, এবং ক্রমশ ওদিকে জড়িয়ে পড়তে থাকে। সাহেবদাদুই জ্যোতিকে ডেকেছিলেন: তুমি এলে আরও একটু ভরসা পাই জ্যোতি, নতুন করে কিছু কাজও করা যায়।

জ্যোতি শিশুতীর্থের প্রয়োজনে নিজেকে উৎসর্গ করল। তারপর শিশুতীর্থ একটু একটু করে বেড়েছে, আর জ্যোতি একে একে তাদের নিয়ে গেছে, তুষারকে মলিনাকে। আশাদিকে সাহেবদাদু নিজেই খুঁজে বের করেছিলেন। প্রফুল্ল গিয়েছে আশাদির ডাকে।

তুষারকে যেদিন শিশুতীর্থের কথা বলেছিল জ্যোতি, তুষার অবাক হয়েছিল। তার ধারণায় আসেনি কেমন করে কী গুণে তুষার শিশুতীর্থে জায়গা পেতে পারে।

আমি! তুষার সবিস্ময়ে বলেছিল।

জ্যোতি নীরব। শিশির পাশে বসে আছে। জ্যোতি শিশিরের দিকে তাকিয়ে, যেন কথাটা সে শিশিরকেই বলেছে।

আমাদের লোকের বড় অভাব। জ্যোতি বলেছিল, ছেলে মেয়ে কিছু হয়েছে, তোক পাচ্ছি না।

তা বলে আমি! তুষার তখনও বিশ্বাস করতে পারছিল না। শিশুতীর্থের কাজ সে নিতে পারে, সে যোগ্যতা তার আছে।

তুমি বেশ ভাল পারবে। জ্যোতি বলল। (জ্যোতি তুষারকে তুমি বলত। ) বলে তুষারের চোখে চোখে তাকিয়ে অনুরোধের মতন করে স্মিত হাসল যেন, তোমার স্বভাব শান্ত।

কথাটা শুনে তুষার হেসে ফেলেছিল, শিশিরের দিকে তাকিয়ে আরও যেন মজা পেল, বলল, শিশির বলেছে বুঝি?

শিশির কেন বলবে, আমি দেখেছি। জ্যোতি মৃদু গলায় জবাব দিল, তুমি আমাদের শিশুতীর্থ দেখেছ? দেখোনি। দেখলেই বুঝতে পারবে–এ অন্য ধরনের কাজ। স্বভাব মন ইচ্ছা থাকলেই আমাদের কাজ হয়।

আমি নিজেই কিছু জানি না, অন্যদের কী পড়াব?

না পড়ালে। তোমার যা জানা আছে তাই শেখাবে ওদের। জ্যোতি যেন নিঃসন্দেহ, তুষার পিরবে; নিঃসন্দেহ বলেই আর কথা বাড়াতে চাইল না।

মনে মনে তুষার ঈষৎ রোমাঞ্চিত হলেও ভরসা পাচ্ছিল না। তা ছাড়া শিশির আছে; শিশিরকে একা বাড়িতে ফেলে রেখে সে কী করে সারাদিনের মতন বাইরে যেতে পারে। নুটুর গাড়ি তখনও আসত না। তাকে কে নিয়ে যাবে, কী ভাবে সে যাবে! সমস্যা অনেক। আমায় দিয়ে হবে না।

হবে। না হলে শিখিয়ে নেব। জ্যোতি শান্ত করে হাসল, বলল, কাজটাকে কাজ মনে কোরো না। তোমায় আমরা টাকা পয়সা দিতে পারব না। যদি মন ভরে, ভাল লাগে তুমি নিজেই সব পারবে।

তুষার নীরব ছিল। তার ভাল লাগবে কি!

শিশির হঠাৎ কথা বলল। বলল, সারাদিন বাড়িতে বসে থাকিস তুই। একবার এ-ঘর, একবার ও-ঘর করিস। এ তোর ভাল লাগবে দিদি। সময়টা কাটবে।

তুষার আর আপত্তি করেনি।

কিন্তু শিশুতীর্থ তুষারকে সামান্য দিনেই মোহের মতন টানল। তুষার ভাবেনি, তার সাধ্য আছে; তুষারের সন্দেহ ছিল–এই কাচ্চাবাচ্ছাদের নিয়ে তার দিন কাটবে কিনা; এবং তুষার ভেবে ছিল, জ্যোতিবাবু তাকে দায়ে পড়ে বেশি রকম বিশ্বাস করে যেখানে নিয়ে যাচ্ছে সেখানে সে উপযুক্ত পাত্র নয় এটা প্রমাণিত হয়ে যাবে।

আশ্চর্য, তুষার শিশুতীর্থের মধ্যে খাপ খেয়ে গেল। সাহেবদাদু তাকে যাদু করল; সে কী এক পবিত্র গন্ধ পেল এখানে, কীসের আনন্দ, দিন ব্যয়ের সুখ, আত্ম নিবেদনের শান্তি যে তুষার শিশুতীর্থকে তার প্রত্যহের অস্তিত্বের সঙ্গে একাত্ম করে ফেলল। সুখ বা শান্তি হয়তো এই রকমই। যে ভেবে নেয় পেলাম সে পায়। কোন গল্পে আছে না, মাটিকে সোনা ভেবে এক ফকির পুঁটলি ভরে মাটি বয়ে গ্রামে ফিরেছিল দীর্ঘকাল পরে। লোকে বলল, হায় বোকা–এ তো মাটি, এতদিন পরে এই মাটি তুমি সোনা ভেবে বয়ে এনেছ! ফকির হাসল, বলল, এই সোনা যে মাটি নয় সেটা বুঝতেই এতকাল বাইরে ছিলাম।

সুখ শান্তিও তেমনি। তুষার ক্রমে ক্রমে ভেবে নিল এই শিশুতীর্থের মধ্যেই সুখ আনন্দ তার। সুখ আনন্দ পেল। তুষার ভেবে নিল, নিজেকে ব্যয় করার এই পথটিই তার মনকে তৃপ্তি দিচ্ছে সুতরাং তুষারের মন ভরে থাকল।

রাত্রে বিছানায় শুয়ে তুষার অনেকদিন পরে পুরনো কথাগুলো আজ ভাবল। জ্যোতিবাবুকে সে কখনও গভীর করে খুব কাছাকাছি এনে ভাবেনি। কারণ জ্যোতিবাবু তেমন মানুষ যাকে কাছে আনার বা কোনও নিকট সম্পর্কে এনে ভাবার সুযোগ পাওয়া যায় না। তুষারের সঙ্গে জ্যোতিবাবুর পরিচয় পুরনো, অথচ তুষার কখনও এই শান্ত নম্র ধীর স্থির মানুষটিকে অকারণে মনে করতে পারেনি। অপ্রয়োজনে তার সামনে যেতে বা কথা বলতে পারেনি। তার ফলে পরিচয় সত্ত্বেও, জ্যোতিবাবু তাকে শিশুতীর্থের মায়ায় জড়িয়ে দেওয়ার কারণ হলেও, তুষার ওঁকে দূরে দূরে রেখেছে, তুষার ওঁকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করেছে। জ্যোতিবাবুকে দেখলে তুষারের মনে যে ভাব হয়েছে তাকে ঠিক কী ভাবে বর্ণনা করা যায় তুষার জানে না। তবু যদি বর্ণনা করতেই হয়, তুষার বলবে, বুঝলি শিশির, তোদের জ্যোতিদাকে মিশনের সাধু-টাধু মনে হয়।

প্রকৃতপক্ষে জ্যোতিবাবুকে তেমন করে কেউ দেখে না। জ্যোতিবাবু কোনও উঁচু জায়গায় চড়ে নেই। খুব সাধারণ সরল কাজের মানুষ। অথচ এই মানুষটিকে কখনও অন্তরঙ্গ ভাবা যায় না, উপায় নেই ভাববার। কেন?

বোধ হয়, তুষার ভাবল, বোধ হয় জগতে এই রকম কিছু মানুষ থাকে, যারা আত্মীয়তা ও প্রীতি সম্পর্কের নাগালের মধ্যে থাকলেও শ্রদ্ধা-সম্মানের পাত্র হলেও, কোনও আশ্চর্য কারণে ঘনিষ্ঠ হতে পারে না।

আদিত্য এবং জ্যোতির তুলনা তুষারের এই মুহূর্তে মনে পড়ল। আকস্মিক ভাবেই।

এদের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত। তুষার মনে মনে ভাবল, দুই মূর্তিকে দুপাশে দাঁড় করিয়ে যেন দেখল অল্পক্ষণ, তারপর অপ্রসন্ন বোধ করল।

দিদি শিশির কথা বলল।

তুষার তখনও ভাবছিল। অন্যমনস্ক চোখে শিশিরের দিকে তাকাল। শিশিরকে এখন কেমন ছায়ার সঙ্গে জ্যোৎস্না মেশানো ছবির মতন দেখাচ্ছে। চাঁদের আলো যে কখন জানলা দিয়ে আরও এগিয়ে বিছানায় এসেছে, কখন যে শিশির সেই আলোর দিকে সরে বসেছে তুষার জানে না। সে খুব অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। এখন খেয়াল হল।

তোদের পুজোর ছুটি কবে হচ্ছে রে? শিশির শুধোল।

জানি না। তুষার জবাব দিল। কেন?

জিজ্ঞেস করছি।

হবে শীঘ্রি। পুজোর তো আর দেরি নেই।

 ছুটি একটু আগে আগে হলে ভাল হয়। বাড়িটায় এবার চুনকাম করা দরকার। দেখছিস না দেওয়াল-টেওয়ালগুলো কেমন হলদে হয় যাচ্ছে।

তুষার দেওয়ালের দিকে তাকাল। লণ্ঠনের অপ্রচুর আলোয় চারপাশটাই আবছা হয়ে আছে, অন্ধকারই বেশি, দেওয়ালগুলো কালো ছায়ার মতন দেখাচ্ছে।

তোর ছুটি না থাকলে হবে না! শিশির বলল।

গলার হারটায় তুষার অযথা আঙুল দিয়ে ঘষছিল। শিশিরের পায়ের কাছে চাঁদের আলো সাদা লোমঅলা পোষা বেড়ালের মতন যেন ঘুমিয়ে আছে। তুষার অকস্মাৎ অনুভব করল, তার চারপাশে কেমন বেদনার নীরবতা। নিরানন্দের একটি জগতে তারা দুই ভাইবোনে বসে আছে। তারা দেওয়ালে চুনকামের কথা ভাবছে। তারা তাদের গৃহবাসকে হলুদ মলিন বিবর্ণ হয়ে আসছে দেখে উজ্জ্বল করে তোলার প্রয়োজন অনুভব করছে। কিন্তু তা কি সম্ভব?

সহসা বাইরে সাইকেলের ঘন্টি বাজল। চমকে উঠল তুষার। কান পেতে থাকল। তার বুকের শব্দ ঈষৎ দ্রুত, নিশ্বাস অনিয়মিত। কপালে সামান্য উষ্ণতা অনুভব করছিল।

তুষার মনে মনে স্থির করল, আদিত্যকে সে আজ বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দেবে না। রূঢ় এবং নিস্পৃহ। আচরণ দেখাবে। মানুষটা সহজ সৌজন্যের সুযোগে অনেক বেশি মাথায় উঠেছে। না, তুষার আর ওই লোকটিকে ছেলেমানুষ ভেবে, কৌতুক অনুভব করে, অকারণে ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ দেবে না।

বিছানা ছেড়ে ওঠার জন্যে যেন তুষার অপেক্ষা করতে লাগল। আদিত্যকে স্পষ্ট করে তুষার আজ বলে দেবে, সন্ধেবেলায় আমার কাজ থাকে, গল্প করার সময় আমার কই। আপনি বরং অন্য কোথাও…

বাগানে কোনও শব্দ হল না। সাইকেলের ঘন্টি আরও দূরে বার কয়েক বেজে বেজে আর বাজল না। তুষার বুঝতে পারল, আদিত্য নয়। রাস্তা দিয়ে কেউ চলে গেল।

তুষারের উচিত ছিল স্বস্তি অনুভব করা, কিন্তু তুষার স্বস্তি পাচ্ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *