জীবন যখন শুকায়ে যায়
করুণাধারায় এসো
পাল্কি চলেছে বিস্তীর্ণ ধানখেতের মাঝ দিয়ে, আল ধরে। দুটো পাল্কি। প্রতিটিতে দুই বেহারা। পেছন পেছন হাঁটছেন সালু মিঞা। তাঁর পেছনে দুজন মুনিষ, মাথায় দুটো ট্রাঙ্ক নিয়ে চলছে তারা। এই কাফেলার অগ্রভাগে রয়েছে আর একজন মুনিষ। তার কাঁধে চড়ে তিন বছরের শিশু রবি। সালু মিঞার একমাত্র পুত্রধন।
পাল্কির একটিতে শামু বিবি। তিনি সালু মিঞার স্ত্রী, বয়স তিরিশ পেরিয়েছে কেবল। পেছনের পাল্কিতে দুই কিশোরী, সালু মিঞা ও শামু বিবির দুই কন্যা। রাণি আর ইলা। ইলা তখন কেবল দশ পেরিয়েছে, আর রানির চলছে তেরো।
বেশ দুলকি চালে চলছে পাল্কিদুটো। বেহারাদের হুম-হুমা শব্দও কিঞ্চিত শোনা যাচ্ছে আকাশে বাতাসে। সূর্য প্রখর। দুপুর হয়নি এখনও। পৌষের প্রাক-দুপুর। ধান কাটা চলছে মাঠে মাঠে।
পাকা ধানের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে নাকে। একটু দূরে পগারে সারি সারি তালগাছগুলোর পাতায় সূর্যের মোলায়েম আলো যেন পিছলে পিছলে পড়ছে। দুটো একটা চিল উড়তে উড়তে হাঁক দিচ্ছে হঠাৎ। অতীব গুরুগম্ভীর এক আবহ যেন আঁকড়ে ধরেছে পুরো পরিবেশকে।
এই কাফেলার যিনি প্রধান ব্যক্তি, তাঁর মনেও নানান উদ্বেগ, তাঁর হাঁটার তালেও স্পষ্ট প্রতীয়মান সেই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। তাঁর এক মন বলছে কাজটা ঠিকই হয়েছে। অন্যমন ভয় দেখাচ্ছে। চোখ রাঙাচ্ছে-এভাবে অজানা ভবিষ্যতের পথে পা বাড়ানো কি উচিৎ হলো তার? শীতের রোদটুকুও তাঁকে পর্যুদস্ত করে ফেলেছে। ফর্সা ধবধবে মুখটাও লালবর্ণ ধারণ করেছে। হাঁটার কষ্টে নয়। বরং মানসিক টানাপোড়েনে কপালে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ঘামের চিহ্ন। ট্রেন যেন ক’টায়?
হাতঘড়িটা দেখলেন একবার চমকে উঠে।
সর্বনাশ, দশটা বেজে গেছে।
জলদি চলরে ভাই। সময় নেই কিন্তু।
তাড়া দিলেন বেহারাদের।
আবার ঘড়ি দেখলেন। না, বন্ধ না!
ঘড়িটা কলকাতার ওয়াসেল মোল্লার দোকান থেকে সেকেন্ড হ্যান্ড হিসেবে ন’ টাকায় কেনা। বহু অনুনয় বিনয়ের পর ন’ টাকায় দিতে রাজী হয়েছিল তারা। মাঝে দু একবার বন্ধ হয়েছে যদিও, ভালই কাজ দিচ্ছে বলা যায়।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন সালুমিঞা। ঘড়ি হয়তো থেমে থেমে হলেও চলমানই থাকবে, কিন্তু তাঁর আর তাঁর পরিবারের দিন চলবে তো ঠিকঠাক মতোন? নিজেকেই প্রশ্নটা করেন তিনি। সামনে তাকালেন রবির দিকে। তিন কন্যার পর ওই পুত্র। বড়ই কাঙ্ক্ষিত এই পুত্রধন! তার জন্মের সময় কত কীই না হলো-মিলাদ, মিষ্টি, খানাপিনা! এরই বা ভবিষ্যত কী? অস্পষ্ট সবই।
আনমনে হাঁটতে লাগলেন সালু মিঞা। একটু এগিয়ে মেয়েদের পাল্কির কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন-
পানি খাবে তোমরা?
না। বলল রাণি।
মন খারাপ কেন? ট্রেনে করে নতুন দেশে যাবো আমরা। কত মজা হবে দেখো।
উত্তর দেয় না কেউ।
কত নতুন বন্ধু পাবে ওখানে। তখন কত আনন্দ লাগবে। পাকা বাড়িতে থাকবো আমরা। ভর্তি হবে স্কুলে। নতুন নতুন বই পাবে।
এসব অনেকবার বলেছেন আব্বা! ভালো লাগছে না শুনতে।
ইলার কান্নাভেজা কণ্ঠ।
ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সালুমিঞা এগিয়ে গেলেন স্ত্রীর কাছে। অন্য পাল্কির পাশে।
শামু-
আর বলতে পারলেন না সালু মিঞা। কাঁদছেন শামু।
কাঁদছো কেন?
আমার লালী-
উত্তর নেই সালু মিঞার।
লালীর কষ্ট তো তাঁরও মনে বিরাট ক্ষত হয়ে রয়েছে। লালী তাঁর তৃতীয় কন্যা। কী ফুটফুটে মেয়েটা ছিল। কথা তো নয় যেন খই ফুটতো মুখে। মাত্র চার বছর বয়সেই সবার মন কেড়েছিল মেয়েটা!
কলকাতাতেই খবর পেলেন, ভীষণ জ্বর। ছুটে এলেন, কিন্তু না, হলো না কিছুই, গ্রামের ডাক্তারের মিক্সচার তার ধনুষ্টংকার পারেনি সারাতে। চলে গেল অকালে। ঝরে গেল একটি কলি তাঁদের জীবন থেকে। এই দেশের মাটিতেই তাকে শুইয়ে রেখে আজ পাড়ি দিচ্ছেন সালু মিঞা বিদেশে।
না, বিদেশে বলাটা তো আর ঠিক নয়। সেটাকে স্বদেশ মেনেই তো চললেন সপরিবারে। আত্মজাকে ফেলে গেলেন বিদেশের মাটিতে। আর কোনোদিন কি আসা হবে, ওর কবরে সামান্য দোয়াদরুদ পড়তে? কে জানে!
এবার আরো দীর্ঘ একটি নিশ্বাস বেরিয়ে এল তাঁর বুক চিরে।
কেঁদো না। আল্লাহ দেখবেন তাকে।
স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে আবার হাঁটতে লাগলেন সালু মিঞা। চোখটা গেল রবির দিকে। দূর
থেকে বোঝা গেল, রবির উৎসাহের শেষ নেই কোনো। মুনিষটাকে অস্থির করছে হাজারো প্রশ্ন করে-এটা কী? ওটা কেন? ইত্যাদি।
আবার দেখলেন ঘড়িটা।
না, চলছে।
বাজে প্রায় সাড়ে দশটা।
কমপক্ষে আরো ঘন্টা দেড়েকের পথ স্টেশনের।
পাল্কির বেহারারা প্রচণ্ড ক্লান্ত। দরদর করে ঘামছে। মুনিষ ক’টারও একই অবস্থা।
বড্ড মায়া হলো তাঁর।
শোনো, সামনে বাঁশঝাড়ের নিচে একটু জিরিয়ে নাও তোমরা।
ওরা যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেল।
থামলো সবাই।
মেয়েরা পাল্কি থেকে নামলো না। শামু বিবিতো নয়ই।
ছুটে বেড়াতে লাগলো রবি।
মহা আনন্দে সে।
নতুন পৃথিবী দেখার আগাম আনন্দ তার চোখে মুখে।
রাজ্যের চিন্তা মাথায় নিয়ে গাছতলায় বসে সালু মিঞা ভাবছেন আর ভাবছেন-অনাগত দিনগুলোর কথা।
.
সালার রেলস্টেশন পৌঁছুতে লেগে গেল আরো প্রায় ঘন্টা খানেক। একটি ছোটখাটো স্টেশন এই সালার। কাটোয়া-আজিমগঞ্জের এই লাইন দিয়ে বেশ কিছু ট্রেন যাতায়াত করে।
সালু মিঞাদের কান্দি সাবডিভিশনে সালার একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। কলকাতার সাথে যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, জজান গ্রাম থেকে মাইল দশেকের মতো দূরত্ব হবে। ট্রেন স্টেশনের জন্যে আরো বেশি গুরুত্ব এই শহরের। বহু বিখ্যাতজন এই শহর থেকে রাজনীতির মঞ্চে নাম করেছেন সে সময়।
সালু মিঞার নিয়মিত যাতায়াত এই লাইনে। কলকাতা-সালার তাঁর নিত্য যাতায়াতের পথ ছিল। এখন থেকে আর তা থাকবে না।
ভুলে যেতে হবে সবকিছু। সালারের কথাও হয়তো আর থাকবে না মনে।
ওয়েটিং রুম খুবই ছোট। লোক ভর্তি তখন। তাঁর মত আরো কিছু পরিবারও ছুটেছেন অজানা স্বদেশের উদ্দেশ্যে। চেনা মানুষও বেরুলো কিছু। দু’চারটি কথা হলো কেবল, সবার মনেই শঙ্কা!
একটু ছায়ামত যায়গা বের করে প্ল্যাটফর্মেই মুনিষরা ওদের বসার যায়গা করে দিল। বেদনার্ত মুখচোখ নিয়ে সবাই অপেক্ষায় থাকলো কখন আসবে ট্রেন নামক যন্ত্রদানব। শামুবিবি ট্রেন দেখলেও ছেলেমেয়েরা জীবনেও চোখে দেখেনি এ যন্ত্রদানবকে। বেদনার্ত হৃদয়ে ট্রেন দেখার জন্য উৎসুক হয়ে রয়েছে তারাও।
রবি ছুটছে এধার থেকে ওধারে। শত নিষেধ উপেক্ষা করে দৌড়ে বেড়াচ্ছে প্ল্যাটফর্মের এদিক থেকে ওদিকে। সমবয়সী জুটেছে দু’একজন।
একটু ছুটে বাবার কাছে আসে এক সময়।
ভোক লেগেছে আব্বা। কী খাবে?
জানি না। খুব ভোক লেগেছে।
মা ডাকলেন এবার।
আয় আমার কাছে।
ছুটে যায় মা-র কাছে রবি।
দেন, খেতে দেন।
দাঁড়া।
মা টিফিন বাটি খুলে হালুয়া আর একটা পরোটা দিলেন।
সেটা হালুয়াতে পেঁচিয়ে নিয়েই আবার দৌড় দিল রবি। হালুয়া পরোটা তার খুব পছন্দের খাবার।
ছুটিস না বাপ, পড়ে যাবি।
কার কথা কে শোনে।
রবি তখন নতুন উদ্যোমে খেলায় মেতে গেছে।
মেয়েরা কেউ খাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেখালো না মোটেই।
টিফিন বাটি বেঁধে রেখে আবার অপেক্ষার পালা।
কখন আসবে সেই অজানা-যাত্রার বাহক ট্রেন গাড়ি!
সারা স্টেশন জুড়ে হৈ চৈ চলছে ঠিকই, কিন্তু এদের বিষণ্ণতা এক অনন্য চিন্তা যোগ করেছে পুরো পরিবেশটাতে।
এ স্টেশনে কুলির ব্যবস্থা নেই, যে যার মতো মালপত্র নিয়ে বসেছে। যেহেতু বেশিরভাগ মানুষই ভিটেমাটি ত্যাগ করে যাচ্ছে-প্রত্যেকেরই লটবহর বেশ ভারী গোছের। এগুলো নিয়ে যায়গা মতো পৌঁছোতে পারবে কিনা সে চিন্তাও আছে সবার মনে। একদিকে জান নিয়ে টানাটানি তাতে আবার লটবহর।
সালু মিঞা কিন্তু চলে গেছেন অন্য জগতে। এসব চিন্তার বাইরে অদূর অতীতে।
এই স্টেশন দিয়েই তো একদিন গিয়েছিলেন চাকরির ইন্টারভিউ দিতে কলকাতা শহরে। আহা। স্বপ্নের শহর কলকাতা! কত না হাতছানি দেয় সর্বক্ষণ। মনোহারী দোকানগুলোই মাথা নষ্ট করে দেয়।
ইন্টারভিউতে পাশ করে চাকরিও হলো। টালি ক্লার্ক। মাসে পনেরো টাকা মাইনে! মাস শেষে এতগুলো টাকা হাতে! ইশ্!
আহা, সেই স্বপ্নের দিন গুলো। চাকরি করবেন কি করবেন না-সেটা নিয়ে বাবার সাথে বাহাস। অতপর বাহাসে জয়ী হওয়া। কলকাতায় বসবাস। মেস জীবন। বিয়ে, সন্তানের বাবা হওয়া— তারপর বদলি হয়ে সুদূর চট্টগ্রাম। সি.আর.বি. রেলওয়ে কলোনি!
কত কথা মনের জানালায় ভেসে বেড়াচ্ছে এই মুহূর্তে তাঁর।
আসছে গো আসছে।
হল্লা শোনা গেল হঠাৎ। শুরু হয়ে গেল দৌড়াদৌড়ি গোটা প্ল্যাটফর্মে। কে কার আগে উঠবে গাড়িতে। মুনিষরা এসে গোটাতে লাগলো মালপত্র।
রবি অবাক হয়ে বাবার কোলের কাছে এসে দাঁড়ালো।
কি আসছে আব্বা?
ট্রেন আসছে বেটা। ওটাতেই আমরা যাবো। দেখবে কত মজা হবে! অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে রবি, ট্রেন নামক বস্তুটাকে দেখার জন্যে! উহ্, আরো মজা অপেক্ষায় আছে তার? অবশেষে তাঁর চেহারা দৃশ্যমান হলো। হুড়োহুড়ি পড়ে গেল নতুন করে। কালো ধোঁয়া উড়িয়ে ঝকঝক করতে করতে এলেন ট্রেনবাবাজি।
প্ল্যাটফর্মে মানুষের হুটোপুটি দেখে বিকট এক হুইসিল দিল যন্ত্রদানব কালো ইঞ্জিনটা।
সাথে সাথে রবি এক আর্তচিৎকার দিয়ে মুখ লুকালো বাবার কোলে।
এরপর আর কোল থেকে নামানো যায়নি তাকে।
রেলগাড়ি ভ্রমণের মজাটা থেকে বঞ্চিত হলো সে। শুধু সেদিনকার জন্যে। এরপর তো তার রেলের সঙ্গেই বসবাস। দীর্ঘদিনের।
.
সালু মিঞা ছেলে কোলে নিয়ে থার্ড ক্লাস খুঁজে বের করলেন।
ভিড়ভাট্টা ঠেলে কোনো রকমে লটবহর সামাল দিয়ে সবাই ট্রেনে চড়ে বসলো, চোখের জলে ভেসে।
মুনিষদের মজুরি দিয়ে বিদায় দেয়া হলো এক সময়।
তারাও চলে গেল চোখ মুছতে মুছতে। গ্রামেরই মানুষ তারা, হয়তো বা বহু দূরের আত্মীয়ও।
ঘণ্টা বাজলো টং টং টং।
সবুজ পতাকা নাড়লেন গার্ড সাহেব। সাথে বাঁশিতে ফুঁ।
আবার কালো যন্ত্রদানবের বিকট হুইসেল।
চলতে লাগলো যান্ত্রিক দানব যার নাম ট্রেন, একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে।
প্রথমে ধীর গতিতে, তারপর দ্রুত, ক্রমশ গতি বৃদ্ধি হতে হতে বেশ দ্রুত চলতে লাগলো ট্রেনটি। ঝক ঝক, ঝক ঝক!
স্টেশনের সমস্ত কোলাহল থেমে গেছে এখন। সবাই নীরব, নিথর। বাক্যহীন। যে যার মতন ঠাঁই করে নিয়েছে ভীড়ের মধ্যে। ট্রেনের ঢুলুনীর সাথে নিজেদের মনও এক অনাগত দিনের চিন্তায় দোদুল্যমান।
দেশের মাটি ক্রমশ পিছনে চলতে শুরু করেছে। একটু পরে এসবের সান্নিধ্য আর পাবে না এরা কেউ। রেল লাইনের ধারের বাবলা গাছগুলো সরে সরে যেতে লাগলো ক্রমশ। নীরবে কাঁদছেন শামু বিবি। মেয়ে দুটো গভীর বেদনায় কাতর।
রবি ফোঁপাচ্ছে বাবার কোলে মুখ ঢেকে। ট্রেনে চড়ার আনন্দ তাকে মোটেই আকর্ষণ করতে পারছে না।
সালু মিঞা তাকিয়ে আছেন জন্মভূমির মাটির পানে। বাড়ি ঘর, গাছপালা ক্রমে ক্রমে সরে যাচ্ছে পেছনে। তার সাথে পেছনে চলে যাচ্ছে কত আনন্দ বেদনার, আশা হতাশার স্মৃতিমাখা দিনগুলো। আপনজনদের মুখ ভেসে উঠছে মনের পর্দায়। সরে যাচ্ছে সিনেমার পর্দার মতো।
ক্রমশ: ঝাপসা হয়ে এলো সালু মিঞার দৃষ্টি।
কাঁদছেন তিনি।
.
সুহৃদ পাঠককুল নিশ্চয় অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন যে, এতক্ষণ যা বয়ান করা হলো তা আমার কল্পনার অবয়ব মাত্ৰ।
নাহ্! পুরোপুরি কল্পনাই বলি কেমন করে?
আব্বার কাছে শুনেছি কতবার সেদিনকার কথা।
মা-ও আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে কতবার বলেছেন সেই বেদনা বিধূর দিনটির আদ্যোপান্ত। আমি তো তার কিছু প্রকাশ করতে পারলাম ক’টা লেখায়।
বড় বোন দুটির ছায়াতেই তো রবি নামের সেই ছোট্ট খোকাটি মানুষ হয়েছি— তাদের স্মৃতিকথাও শুনেছি কত কত বার!
আর আমার স্মৃতি?
তিন বছরের কোনো স্মৃতি কি মনে থাকে?
জানি না। তবে আমার আবছা স্মৃতিটুকু অকপটে বলতেই হয়—
এইটুকু নিশ্চয় মনে ছিল আমার-
এক, মুনিষের কাঁধে চড়ে স্টেশনে আসা।
দুই, কালো ইঞ্জিনের বিকট আওয়াজে মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম ও কান্না।
তিন, স্টিমারের ডেকে নতুন বন্ধুর সাথে পরিচয়।
হ্যাঁ, বাল্যকালের যে ক’টা স্মৃতি আবছা একটা চেহারা নিয়ে আজও মনের আয়নায় দাঁড়ায়— তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অবশ্যই ওই স্টিমারের ডেকের ওপর খেলাধূলা। সালার থেকে ট্রেনে চেপে পূর্ব পাকিস্তানের পথে রওয়ানা দিয়েছিলেন আমার আব্বা খোন্দকার মোহাম্মদ আব্দুস সালাম তাঁর পরিবার নিয়ে। মাঝে নৈহাটি ব্যান্ডেলে ট্রেন বদলে দর্শনা বর্ডার দিয়ে পাকিস্তানে ঢুকে সোজা গোয়ালন্দ ঘাট। তখন সন্ধে পেরিয়ে গিয়েছিল।
আব্বা চেপেছিলেন রেলের স্টিমারে সবাইকে নিয়ে। রেলের আর এক ভদ্রলোক, আফসার সাহেবের পরিবারও ছিলেন সেই স্টিমারে। ভদ্রলোক আব্বার পরিচিত এবং একই পাড়ায় বসবাসকারী। সঙ্গে ছিল তাঁর বেশ কটি ছেলেমেয়ে। তাঁরা আসছিলেন হুগলী থেকে। তাঁর দুই ছেলে আমার আশেপাশের বয়সের হওয়ায় তাদের সাথে এক ধরনের সখ্য গড়ে উঠে ছিল অতি দ্রুত। বুলু আর বেবি। বেবি এখন প্রয়াত। বুলুর বন্ধুত্ব আজও অটুট। শুধু বন্ধুত্ব নয়, আজ আমার, অন্যতম নিকট আত্মীয়ও।
স্টিমারের ওই খেলার সাথী পাওয়ার পর মনে নেই আর কিছুই। থাকার কথাও না। তবে বহুবার শোনা কথাগুলো সাজালাম, যাতে কিছুটা হলেও পাঠক অনুভব করতে পারেন জন্মভূমির নাড়ি-ছিঁড়ে আসা মানুষগুলোর হৃদয়ের বেদনা!
.
পরদিন সকালে স্টিমার পৌঁছলো চাঁদপুর ঘাটে।
আবার সেখান থেকে ট্রেনে সোজা চট্টগ্রাম। সালু মিঞার কর্মস্থল। রেলওয়ে কোয়ার্টার তৈরিই ছিল। মান্নাফ নামের এক কলিগের সাথে যৌথভাবে এ্যালটমেন্টে পাওয়া সরকারি কোয়ার্টার!
কোয়ার্টার নম্বর T-37B টাইগার পাস রেলওয়ে কলোনি।
টি ৩৭/বির গল্প কাহিনি তো হবেই। জীবনের বাইশটি বছর কেটেছে ওই ঠিকানায়।
তার আগে আরো একটু শুরুর আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন আছে না। সে পর্বে যাবার আগে তারও দুটো কথা বলে নি এই অবসরে।
সেই কথাটি মনে রেখো
তোমাদের এই হাসি খেলায়, মনে রেখো
সালু মিঞার পরিবার যদিও ভিটেমাটি হারিয়ে শরণার্থী হয়ে আসেননি পাকিস্তানে, তবুও তাঁরা হয়ে গেলেন রিফিউজি। নিজের জন্মস্থান, আত্মীয় পরিজন, ভিটেমাটির মায়া এক সময় অবশ্য ত্যাগ করতে হলো চিরদিনের জন্যে।
শামু বিবির কাছে শুনেছি— কত বিনিদ্র রজনী করেছেন পার, কত ফেলেছেন চোখের জল, তার হিসেব কিতাব নেই। সালু মিঞা অফিসের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন বলে ভাববার সময় কম পেতেন। মন খারাপ করলে চলবে না তো তাঁর-কারণ তাঁর মুখের দিকে তাকিয়েই তো শামু বিবি দুই মেয়ে রাণি, ইলা আর পুত্র রবিকে নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন অজানার পথে।
স্বজন বিচ্ছেদের কষ্ট তো রয়েছেই। তার চেয়ে বড় কষ্ট তৃতীয় কন্যা লালীর কবরটা আর কোনোদিন হয়তো দেখা হবে না— কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানিও এক সময় শুকায়। রবির তো কিছু বুঝবার বা মনে রাখার বয়স ছিল না তখন— তাই বোন লালীর কিছুই জানতো না সে। মার কাছে আর রাণি আপা-ইলা আপার কাছে শুনেছে— লালী তাকে সবসময় কোলে করে রাখতে চাইতো। ‘আমার ভাই, আমার ভাই’ বলে সাদর সম্ভাষন করতো সারাক্ষণ। ফুটফুটে পরীর মত বোনটা— সবার প্রিয়। চলে গেল না-ফেরার দেশে ধনুষ্টংকারে।
কিসের থেকে কী হয়েছিল, তা বোঝার আগেই সে জগতের মায়া ত্যাগ করে সবাইকে কাঁদিয়ে পরপারে পাড়ি দেয়। বড় হয়ে সব শুনে রবিও ভাবতো— কী হতো যদি বোনটা থাকত। সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে বহুবার সে এই নিষ্ঠুরতার জন্য অভিযোগ গেঁথেছে মনে মনে। আজ এই বয়সেও হঠাৎ হঠাৎ এক একদিন মনে হয় লালী বোনটা কেন এত আগে চলে গেল। আজ ভাববার অনেক বিষয়ই আছে তার। কালের গহ্বরে কত কিছু পতিত হলো এ অবধি। সালু মিঞা— শামু বিবি সেই কবে চলে গেছেন। গেছেন রাণি আপা, ইলা আপা। তারপর আরও দুটো বোন হয়েছে পাকিস্তানে এসে-এদের একজন রবির সাত বছরের ছোট— মমতাজ, অন্যজন-পুতুল, রবির তেরো বছর পর জন্মায়।
আগেই বলেছি রবিরা এসে উঠলো চট্টগ্রামে। চট্টলা শহরের রেলওয়ে এলাকায়। টাইগারপাস রেলওয়ে কলোনির টি-৩৭/বি বাসায়। বাইশ বছরের ইতিহাস রবির জীবনে-এই বাড়িতে।
বিরাট বাগান এবং উঠানসহ রেলওয়ে কোয়ার্টার। বিশাল সাইজের দুটো ঘর, একটি দশ বাই দশ ড্রইং রুম এবং ৫/১০ স্টোর রুম ছাড়াও প্রশস্ত রান্নাঘর, গোসলখানা, টয়লেট, বারান্দা। মোটামুটি এলাহী কাণ্ড—।
তবে একটি ঘর মানে ড্রইংরুমটি দখলে ছিল সালু মিঞার সহকর্মী মান্নাফ সাহেবের। তিনি ওইটুকুর বরাদ্দ পেয়েছিলেন অফিস থেকে। কারণ অবিবাহিত মানুষ তিনি।
তাতে কারও কোনো সমস্যা ছিল না-সমস্যা একটাই দেশত্যাগের যন্ত্রণা। মনে মনে কাঁদে সবাই। আবার প্রত্যেকে প্রত্যেককে দেয় সান্ত্বনা।
রবি মুক্তবিহঙ্গ, ছুটে বেড়ায় নতুন বন্ধুর খোঁজে। নতুন ঠিকানায় এক সময় থিতু হয় পুরো পরিবারটা।