৩. জিপের কাছে এসে

১১.

জিপের কাছে এসে গোপেন বলল, তুমি বাড়ি যাও। আমি একটু যাব বোসদার বাড়ি।

আমাকে নিয়ে যাবে না? কলকাতার বোসদা তো?

হ্যাঁ। কলকাতার বোসদাই। কিন্তু তুমি গিয়ে কী করবে? ফ্যামিলি তো আনেননি উনি। অন্য একজন কলিগের সঙ্গে ফ্ল্যাটে শেয়ার করে থাকেন। তা ছাড়া, আমরা তাস খেলব। তুমি তো তাস চেনোই না।

না।

 স্বামী স্ত্রীর কিছু কমোন ইনাররেস্টস থাকা উচিত। নইলে প্রবলেম হয়।

জানি।

শ্ৰী বলল।

খাবে কোথায়? তুমি?

খেয়ে নেব যা হয় কিছু। বোসদার ওখানেই।

ফিরবে কখন?

 বলতে পারি না। দেরি হবে আমার। তুমি নেমে বাইধরকে পাঠিয়ে দিয়ো।

বাইধর যখন গাড়ি ঘুরোচ্ছিল তখন গোপেন বলল, এম ডি বলছিলেন, তোমাকে কোথায় যেন দেখেছেন। একটি কবিতা বললেন তোমাকে দেখে।

কবিতা?

হ্যাঁ। ইংরিজি কবিতা। আমি অবশ্য ওসব কাব্যি-টাব্যি বুঝি না। আমি এঞ্জিনীয়র মানুষ।

কবিতার জগতে অপাঙতেয় বলে কেউই নেই। প্রত্যেক শিক্ষিত মানুষেরই কবিতা পড়া এবং বোঝা উচিত। সাহিত্য। সুপ্রিম কোর্টের জজসাহেব থেকে তোমার মত এঞ্জিনীয়র, সকলের কাছেই কবিতা সমান সম্মানিত। সাহিত্যও।

কোনো জবাব না দিয়ে গোপেন বলল, এসো। বলে জিপের দরজা খুলে দিল।

বাইধর অ্যাকসিলারেটরে পায়ের পাতা দিয়ে চাপ দেবার আগে বলল, এম ডি যেমন মনে করার চেষ্টা করছেন কোথায় দেখেছেন তোমাকে, তুমিও তেমনি মনে করার চেষ্টা করো। কী হয়েছিল তোমার? এখন যেমন কথার তুবড়ি ফুটোচ্ছ তাতে তো মনেই হয় না যে একটু আগে তুমি প্রায় ভিরমি খেয়েই পড়েছিলে!

আমার?

 হ্যাঁ। তোমার কথাই তো বলছি।

জানি না। হাসপাতাল আমার ভালো লাগে না। এ জন্যেই আমি আসতে চাইনি। তা ছাড়া আমি তো বলিনি শরীর খারাপ। তোমার এম ডি-ই তো অসুস্থ করে দিলেন।

হ্যাঁ সেটা অবশ্য দেখলামই।

তারপর গোপেন বাইধরকে বলল, যাও। ফিরে, বোসদার বাড়িতে এসো। এখান থেকে কারো সঙ্গে চলে যাব আমি সেখানে।

বাইধর কম্পাউণ্ড পেরিয়ে পথে পড়েই জোর ছোটাল জিপ।

বলল, কেমন দেখলেন মেমসাহেব, বড়োসাহেবকে?

ভালো না।

ভালো না?

না:। মানুষ চিনতে পারছেন না।

তাই? ঈশশ। বড়োসাহেব ভালো না হয়ে উঠলে কী যে হবে ভাবাই যায় না।

একটু পরে শ্রী বলল, তোমাদের বড়োসাহেবের বাড়ি থেকে কেউ আসেননি? খবর দেওয়া হয়নি কাউকে?

হয়েছে তো! ওঁর মা এসেছেন। হাসপাতালেও আসেন রোজ সকালবেলা।

তাই? উঠেছেন কোথায়?

বড়োসাহেবের বাংলোতেই।

আর কেউ আসেননি?

 বোধহয় না। এলে তো দেখতাম!

বাবা?

 বাবা বোধহয় নেই। উনি তো বিধবা। তবে খুব শিক্ষিত।

কী করে বুঝলে? কথায় কথায় ইংরিজি বলেন বুঝি?

বাইধর হাসল।

বলল, ইংরিজি-জানা অশিক্ষিতই তো দেখি চারধারে। উনি ইংরিজি জানেন না যে, তা নয়। তবে, শিক্ষিত বলছি অন্য কারণে। প্রত্যেকের সঙ্গে এত ভালো ব্যবহার করেন। সেইটাই তো আসল শিক্ষা।

শ্রীর মনে পড়ল সেদিনের কথা, যেদিন সুমন প্রথম ওকে নিয়ে ওদের বাড়িতে যায়। তখনও সুমনের বাবা বেঁচেছিলেন। শ্রী প্রণাম করায়, সুমনের মা, মাসিমা, ওঁর চিবুক ছুঁয়েছিলেন। তারপর গালে চুমু খেয়েছিলেন আদর করে। বলেছিলেন, তোমার নামটি সার্থক।

সুমন বলে উঠেছিল, মুখ দেখেই ভুলে যেয়ো না মা। হার লুক ইজ ডিসেন্টিভ।

বাড়িতে যখন বাইধর নামিয়ে দিয়ে গেল তখন বড়ো ভারশূন্য, উদ্দেশ্যহীন মনে হল শ্রীর নিজেকে। একা বাড়িতে এখন একা খাবে। খেতে হয় বলে খাবে। তারপর কোনো বই পড়বে। নয়তো ওড়িয়া হরফ চিনবে। দৈনিক সমাজ রাখে এককপি করে গোপেন তাড়াতাড়ি ওড়িয়া লিখতে পড়তে পারবে বলে। তারপর আর সময় কাটবে না। পাথরের মতো ভারী হয়ে বসে থাকবে।

শ্ৰী ঠিক করল দু-একদিনের মধ্যেই সুমনের মার কাছে যাবে ও। এই সময়ে ওঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ানো দরকার। কিন্তু মাসিমা যদি অপমান করেন! যদি খারাপ ব্যবহার করে চলে যেতে বলেন। মায়ের মন তো সবই বোঝে। সুমনের এই অবিবাহিত জীবন, এত সুখের মধ্যেও এত অসুখের এত ছটফটানির; আসল কারণ যে শ্রীই, তা আর কেউ না বুঝুন মাসিমা তো নিশ্চয়ই বোঝেন!

তবে, এটা হয়তো শ্ৰীর ভুল। প্রায় একদশকেরও বেশি সময় হয়ে গেছে। এর মধ্যে শ্রীকে ভুলে যাওয়াই উচিত সুমনের। আর কত নারী নিশ্চয়ই এসেছে গেছে এর মধ্যে। শ্রী জানবে কী করে!

 বাইধর চলে গেল। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ওর হঠাৎ মনে পড়ল দীপার চিঠিটির কথা। হঠাৎই ভারশূন্যতা কেটে গেল।

 ভরত দরজা খুলেই বসেছিল, বলল, এ কী! তোমরা যে বললে দুপুরে নাও ফিরতে পারো?

বলেছিলাম। কেন? রান্না করিসনি?

না। তা কেন করব না? তবে বিশেষ কিছু করিনি। মানে পদ। ভেবেছিলেন একা খাব তো! এক ঝামেলা করে!

ভাত করিসনি?

ভাত করতে কতক্ষণ? এখন তো এগারোটাও বাজেনি। কিন্তু বেঁধেছি ধোঁকার ডালনা আর সজনে-কুমড়োর চচ্চরি। আর করব কিছু?

খুব ভাল। আর কিছু করতে হবে না।

 যখন খাবে তার পনেরো মিনিট আগে বোলো।

ঠিক আছে। বসার ঘরেই বসে দীপার চিঠিটি খুলল শ্রী।

সতপতিকুঞ্জ
হুরহুলাগড়
১/৫/৯০

 শ্রীদিদি, প্রীতিভাজনীয়াসু।

ভেবেছিলাম, তোমাকে একটা চিঠির মতো চিঠি লিখব। কিন্তু পাড়ার ছেলেদের কী এক অনুষ্ঠান। সেই উপলক্ষ্যে ফাংশন হচ্ছে। সাধু মেহের এসেছেন। অজন্তা পট্টনায়ক। কুঞ্জবিহারী পাত্র। বাতিঘর সিনেমার গান গাইছেন কে যেন, সীমাহীন দরিয়া। ছবিটা সুপারফ্লপ হয়েছিল; যদিও বক্তব্য ছিল চমৎকার। ওই গল্প নিয়ে অত্যন্ত আধুনিক, significant ছবি হতে পারত। যাইহোক, Redeeming feature হয়েছিল ওই ছবির গানগুলি। বহুবছর অবধি ওড়িশার সব শহরে রজোর সময়ে, পুজোর সময়ে প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে ওই ছবির সব গান বেজেছে।

যাকগে। যা বলার জন্যে এই চিঠি লেখা, তাই বলি। সময় বেশি নেই।

গতবারে আমি যখন এখানে এসেছিলাম তখন সুমনদা আমাকে এক রাতে খেতে বলেছিলেন তাঁর বাড়িতে। সুমনদার বেডরুমের লাগোয়া ড্রেসিংরুমের টেবলে তোমার একটি বাঁধানো ছবি দেখেছিলাম। কার ছবি জিজ্ঞেস করাতে সুমনদা এমবারাসড হয়েছিলেন। ওঁর বেডরুমের বাথরুমে কারোই যাওয়ার প্রয়োজন ঘটে না। কিন্তু সেদিন সিটিংরুমের লাগোয়া টয়লেটটির দরজার তালা ঝোড়ো হাওয়াতে দড়াম করে পড়ে লক হয়ে গেছিল। হঠাৎই। আমি যাওয়ার একটু আগেই।

তোমাকে আমি কৈশোরের প্রথমে একঝলক দেখেছিলাম। সত্যি কথা বলতে কী তোমার চেহারা আমার মনে ছিল না। তবে খুব চেনা চেনা লেগেছিল ফোটোর চেহারাটি। আবার কখনো দেখা যে হবে তা তো জানা ছিল না!

আমার অকারণ ঔৎসুক্য ছিল না। আমি কিছুই জিজ্ঞেস করিনি। সুমনদাই নিজে থেকে। বলেছিলেন, দীপা, তুমি হয়তো ভাবছ, কার ছবি! আমার এক প্রিয় বান্ধবীর ছবি।

তিনি কোথায় এখন? জিজ্ঞেস করেছিলাম।

 সুমনদা বলেছিলেন, হারিয়ে গেছে।

সে কী।

 হ্যাঁ। আণ্ডার মীস্টিরিয়াস সারকামস্ট্যান্সেস।

সেবারে আমি আর কেনো প্রশ্ন করিনি।

এবারে হুরহলাগড়ে এসে তোমাকে দেখেই আমার সন্দেহ হয় যে, সুমনদার ড্রেসিংরুমে তোমার ছবিই দেখেছিলাম। তোমার কাছে আসার পরদিনই আমি সুমনদার কাছে যাই। তাঁকে বলি যে, আপনার যে প্রিয় বান্ধবী মীস্টিরিয়াস সারকামস্ট্যান্সেসস-এর মধ্যে হারিয়ে গেছিলেন তাঁকেই বোধহয় দেখলাম।

কোথায়?

এই হুরহলাগড়েই। আমি যাঁকে দেখেছি তাঁর নাম শ্রীপর্ণা। ছোটো করে বললে, শ্ৰী।

শ্রী?

সুমনদা উত্তেজনা গোপন করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারেননি।

শি ইজ ম্যারেড। আই নো।

সুমনদা বলেছিলেন।

তারপর আমাদের মধ্যে কী কথোপকথন হয়েছিল তা বলি।

আমি বলেছিলাম, আপনি কী সারকামস্ট্যান্সেস-এ উনি হারিয়ে গেছিলেন আপনার জীবন থেকে, তার কিছুটা জানতেন। পুরোপুরি মীস্টিরিয়াস ছিল না, তাই না? সারকামস্ট্যান্সেস?

ইয়েস দীপা। উ্য আর ওলমোস্ট রাইট; বাট নট কোয়াইট!

ওঁর স্বামী আপনাদেরই এক কোম্পানির অফিসার।

কোন কোম্পানির?

আমি জানি। কিন্তু বলব না। যে আপনাকে আঘাত দিয়ে গত আট দশ বছর ধরে অন্যের ঘর করছে তাকে আপনি কী বলবেন? ছেড়ে আসতে বলবেন স্বামীকে? যদি তারা সুখী হয়ে থাকে, তবেও? দাবার চাল একবার চেলে দিলে আর ফিরোনো যায় না সুমনদা।

না, না। পাগল। আমি কিছুই বলব না। দাম্পত্য ছাড়াও তো সংসারে হাজার সম্পর্ক থাকে। বন্ধুত্বর সম্পর্ক, মমত্বর সম্পর্ক, প্রীতির সম্পর্ক, একই সুরুচির সম্পর্ক, কী? থাকে না?

তোমার সঙ্গেও কি আমার কোনো সম্পর্ক নেই? না থাকলে, একদিনের জন্যেও বুড়লা থেকে এলেই যোগাযোগ করো কেন?

আমার কথা ছাড়ন। আমি আপনার একজন অ্যাডমায়রার। আমার সম্পর্ক, আপনার সঙ্গে ভাই-বোনের। আমি গর্বিত, বিস্মিত, মুগ্ধ এক বোন আপনার।

সুমনদা হেসে বলেছিলেন, তুমি বুঝি শিব্রাম চক্কোত্তির লেখা পড়োনি?

কোন লেখা?

ওই যে, পাড়ার একটি ছেলের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখে শুধিয়েছিলেন, ও কে রে?

ছেলেটি বলেছিল, বোন।

 তাতে শিব্রামের প্রশ্ন ছিল পিসতুতো, না কিসতুতো?

আমি হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, আমি পিসতুতোও নই, কিসতুতোও নই। কিন্তু আমি আপনার দারুণ বোন। আর আপনি আগে যেসব সম্পর্কর কথা বললেন সেগুলো খুব ডেঞ্জারাস, বর্ডার-লাইন সম্পর্ক। প্রান্তিক। ওই সব সম্পর্কর যে-কোনোটিই যে-কোনো মুহূর্তেই অফ-সাইড হয়ে কর্নার-কিক নয় পেনাল্টি-কিক-এর উদ্ভব করে একেবারে প্রেমের নেটেই বলকে পাঠাতে পারে। ওগুলো অ্যাজ গুড, অর ফর দ্যাট ম্যাটার; অ্যাজ ব্যাড অ্যাজ প্রেমের সম্পর্ক!

সুমনদা হেসেছিলেন। কিন্তু সে হাসিতে উচ্ছ্বাস ছিল না।

ওঁদের ছেলে-মেয়ে কী?

নেই। এখনও হানিমুন চালিয়ে যাচ্ছে।

শ্রীর স্বামী আমাকে চেনেন?

চেনেন মানে? আপনার অধস্তন অফিসার আপনাকে চিনবেন না?

আঃ, সে তো একুশ অফিসার আছেন। আমার সঙ্গে পার্সোনালি জানা শোনা আছে কি না? আমি বোধ হয় ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছি না, না?

না। তা পারছেন না। কিন্তু আমি বুঝেছি। আমি সন্ধান দিয়ে গেলাম। বলে গেলাম যে, প্রদীপের নীচেই অন্ধকার। অথবা, বাগানের মধ্যেই ফুটে আছে ফুল, আপনি দেখতে পাননি।

তুমি তো বড়ো ধাঁধাতে ফেলে দিলে আমাকে দীপা।

সুমনদা, ধাঁধাই তো জীবন।

গতকাল হাসপাতাল গেছিলাম, ইচ্ছে করে নাম ভাঁড়িয়ে। ভেবেছিলাম, সুমনদা মিসেস জি ব্যানার্জি, দেখে আন্দাজ করতে পারবেন। মনে পড়ে যাবে। কু পাবেন একটা। কিন্তু উনি এখনও আদৌ সুস্থ হননি। মাথার চোটগুলিই গোলমাল করছে। কী হবে জানি না। তবে ওঁর ধারণা পেটের উৎসই মারাত্মক। কিন্তু ডাক্তারদের মত অন্য।

আমি যেতেই কিন্তু চিনতে পারলেন। সকালেই সুমনদার মাও বসেছিলেন। প্রণাম করলাম। আমাকে আদর করলেন। ভারি সম্ভ্রান্ত মহিলা। চেহারায়, আচারে; আচরণে।

 সুমনদা কী বললেন জানো শ্রীদি? বললেন, জানো দীপা, ক-দিন আগে মিটিং করছি, একটি স্ট্রেঞ্জ ফোন-কল এল, ভেরি স্ট্রেঞ্জ ইনডিড। সে শুধু জিজ্ঞেস করল আমি কেমন আছি। কিন্তু নাম বলল না, নাম্বার দিল না। গলা শুনে মনে হল…।

 হাঁপাচ্ছিলেন এটুকু বলেই। আমি কথা বলতে নিষেধ করলাম। সুমনদার মাও।

কিন্তু দম নিয়ে বললেন, ম্যানুয়াল এক্সচেঞ্জ-এর গ্রুতে কলটা এসেছিল। দু-তিনবার। প্রথম দু-বার কোনো কথাই বলেনি। জানো।

আমি ভালো হয়ে উঠি তারপর ঠিক বের করব কল-এর ওরিজিন।

সুমনদার মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কার কথা বলছে সুমু?

আমি বললাম, ওঁর একজন বন্ধুর কথা।

তোমাকে একটা কথা বলব শ্রীদিদি। আমাকে তুমি ভুল বুঝো না। আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নয় যে, তুমি গোপেনদাকে ছেড়ে সুমনদার কাছে চলে যাও। কিন্তু আমার এও একটুও ইচ্ছে নয় যে, তুমি বাকি জীবন, অন্যকৃত অপরাধের জন্যে নিজেকে এবং সুমনদাকেও অভিশপ্ত করো। তোমার বিয়ে তোমার ইচ্ছেয় হয়নি যে তা আমি জানি। কিন্তু তোমার আর সুমনদার মধ্যে ভালোবাসাটা দুজনের ইচ্ছেতেই হয়েছিল। এখনও এদেশে ক-জন মেয়ের বিয়ে নিজের ইচ্ছায় হয়? বরকে মানিয়ে নিতে হবে, নিয়ে যেনতেন প্রকারেণ খুশি থাকতে হবে, ছেলে মেয়েদের মা হতে হবে, এই আমাদের শেখানো হয় শিশুকাল থেকে। আমাদের বাঁচার মতো বাঁচতে শেখানো হয় না আদৌ। অনেকেই একজনকে ভালোবাসে এবং অন্যজনকে বিয়ে করে। এবং করে যে সুখীও হয় তেমন দৃষ্টান্তও ভূরি ভূরি জানা আছে আমার। বিয়েটা খেলা নয়, একটা Contract, কিন্তু যে Contract-এর নানা অনুচ্ছেদ ও ধারা দিয়ে inconformity, dissatisfaction বেনোজলের মতোই ঢুকে পড়ে তাকে অনন্তকাল ধরে টিকিয়ে রাখবে কি না, এবং রাখা উচিত কি উচিত নয়, সেটা তোমারই সিদ্ধান্ত। আমার নয়। সে সিদ্ধান্ত অন্য কেউই তোমার ওপর চাপাতে পারে না। এ ব্যাপারে সাহায্যও করতে পারে না।

সুমনদা তোমাকে যেমন করে ভালোবাসে তেমন ভালোবাসার গল্প শুধু ফেয়ারি-টেলস এই পড়া যায়। সুমনদার অনেক মহিলার সঙ্গে আলাপ আছে, বন্ধুত্ব আছে, যেমন আমার সঙ্গেও আছে কিন্তু কারো সঙ্গেই তাঁর প্রেমের সম্পর্ক নেই। প্রেমজনিত শারীরিক সম্পর্ক কারো সঙ্গে আছে কি না আমি জানি না, থাকলেও সেটাকে আমি দোষের বলে মনে করি না। কিন্তু আমার সঙ্গে নেই। ওঁকে যতটুকু জেনেছি, তাতে মনে হয়; তুমিই ওঁর জীবনের একীলিসেস হীল। তুমিই অনন্যা।

গোপেনদার সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা আর পাঁচজন বাঙালি দম্পতিরই মতো। তোমরা সুখী। কিন্তু সেটা সহজ convenience-এর সুখ। নিরুপায়ের সুখ। তোমরা আনন্দিত নও। তোমরা দুজনে একসঙ্গে বাজাও দুজনকে কিন্তু যুগলবন্দী কাকে বলে, তা তোমরা জানো না। তোমার জীবনে ফাঁক আছে অবশ্যই, ফাঁকি না থাকলেও। তাই তোমাকে এই চিঠি লিখছি দুঃসাহসে ভর করে। লিখছি, কারণ আমি আমার জীবনকে ভীষণ ভালোবাসি। একটামাত্র জীবনকে আমি পুরোপুরি এনজয় করতে চাই, উইদাউট এনি রিগ্রেটস। উইদাউট এনি হ্যাঁঙ্গ-আপস। শ্ৰীদিদি, আমার মনে হয় যে তোমার জীবনে, জীবন নিয়ে ভাববার প্রয়োজন এবং অবকাশ আছে। ভেবে দেখো। সুমনদার সঙ্গে দেখা কোরো। তাঁর মা এখানেই থাকবেন এখন। যদি তাঁকে তুমি চেনো তো, তাঁর সঙ্গে দেখা কোরো। এটা তোমার কর্তব্য। বিশেষ করে এখন।

আমার মায়েদের, মাসিপিসিদের জীবনে ডিভোর্স ব্যাপারটা অত্যন্ত দুরূহ, লজ্জাকর, চূড়ান্ত লোকভয়ের ব্যাপার ছিল। আজ আর তা নেই। যথেষ্ট মনোরম পরিবেশে, মারামারি না করে, বা একে অন্যর বিরুদ্ধে কাদা-ছোঁড়াছুড়ি না করেও ডিভোর্স পাওয়া বা দেওয়া হয়ে থাকে আজকাল। এই ব্যাপারে নরম হওয়া বা দুর কী হবে! ভাবা আর নিজের জীবনটা নষ্ট করে দেওয়া একই ব্যাপার।

সিদ্ধান্তটা তোমার। পুরোপুরিই তোমার।

তুমি কি কখনো ভেবেছিলে স্বপ্নে অথবা দুঃস্বপ্নেও যে এই হুরহুলাগড় নামক একটা বিচ্ছিরি নামের অখ্যাত জায়গাতে তোমার ভবিষ্যৎ-জীবন তোমার মুখপানে চেয়ে, চোখে চোখ রেখে এমন তীব্র পুলকভরে ডাক দেবে তোমাকে? বলবে, আয় বাছা আয়! যা তোর চিরকালের, যা ক্ষণকালের লীলাস্রোতের ষড়যন্ত্রে চোখের আড়ালে চলে গেছিল, তা-ই ফিরে এসেছে। ফুটে আছে, জানালার পাশের বাগানে বৃষ্টি-ধোওয়া ম্যাগনোলিয়া গ্র্যাণ্ডিফ্লোরা ফুলেরই মতো; নিষ্কলুষ, শ্বেত এবং পবিত্র সত্তায়। বলবে, আয়! আয়! অভ্যেস ছেড়ে, তুরীয় আনন্দের জীবনে আয়, যেখানে তোর জন্যে জগতের সব পসরা নিয়ে তোর জন্ম-জন্মের প্রেমিক তোর অপেক্ষায় আছে।

শ্ৰীদিদি সেদিন তুমি ঠিকই বলেছিলে।

 আমি একটি অদ্ভুত মেয়ে। কিন্তু আমি একটি সলিড মেয়ে। আমার মধ্যে কোনো প্রশ্ন নেই, দ্বিধা নেই, ধোঁয়াশা নেই, এবং ভয় নেই। আমার বিবেক যা করতে বলে, আমি তাই করে গেলাম।

আমার ঠিকানা রইল। যদি সাহস চাও তো সাহস, পরামর্শ চাও তো পরামর্শ, টাকা ধার চাইলে টাকা, আর ফুলশয্যার রাতে যদি আড়ি পাতার লোকের অভাব হয় তো বান্ধবী। সবই তোমার জন্যে, তোলা রইল। যখন যা চাইবে পাবে। দৌড়ে আসব তুমি ডাকলেই।

যদি এমন দুঃসাহসিক কাজ করতে না চাও, তো কোরো না। কিন্তু আয়নার সামনে, আকাশের সামনে, প্রকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে চিরে চিরে দেখো। কারো প্রতি অন্যায় করলেও বা করতে পারো, শুধু নিজের প্রতি কোনো অন্যায় কোরো না। সেসব ইডিয়াসি করত সতী-সাধ্বী ভারতীয় নারীরা, সেইসব হতভাগিনী বাল-বিধবারা, হারামজাদা পুরুষেরা যাদের তেলেভাজা-মুড়ির–চেয়ে একটুও বেশি সম্মান দেয়নি।

 গোপেন ব্যানার্জির জন্যে তুমি তোমার বাকি জীবনটা নষ্ট কোরো না। এবং কোরো না সুমন সেন-এর জন্যেও। তার প্রভাব, প্রতিপত্তি, সুনাম, বাংলো, গাড়ি এসব থেকে আলাদা করে মানুষটাকে যদি ভালোবাসতে পারো, দয়া বা অনুকম্পা নয়; পিওর অ্যাণ্ড সিম্পল মনের এবং শরীরের ভালোবাসা, তবেই গোপেনদাকে ছেড়ো।

বাইরে থেকে সত্যিই সব বোঝা যায় না দাম্পত্যর। মানি, কথাটা। গোপেনদা হয়তো সুমন সেনের চেয়েও অনেক ভালো স্বামী। সেটা সত্যি কি না তা তুমিই বলতে পারবে।

আমার মা আমাকে চিরদিন বলতেন, ঘর-জ্বালানি মেয়ে। এখন দেখছি আমি ঘর-ভাঙানিও বটে।

গোপেনদা ও সুমনদা কারো প্রতিই আমার কোনো বিরূপতা বা পক্ষপাতিত্ব নেই। একথা তোমায় স্পষ্ট করে জানানো দরকার।

ভালো থেকো। গোপেনদা সুমনদার চেয়েও, নিজেকে ভালোবেসো অনেক বেশি।

ইতি তোমার প্রীতিধন্য, দীপা
যে, আলো হাতে অন্ধকার ভাঙে।

.

১২.

পর পর চার বোর্ড হারল গোপেন। রুটি আর কষা-মাংস আনিয়ে খেয়েছে ওরা। সঙ্গে বিয়ার। খেলতে ভালো লাগছে না। কালুকে নিজের জায়গায় বসিয়ে বারান্দায় এসে বসেছে আরাম করে একটা সিগারেট খাওয়ার জন্যে।

এমন করে হারে না কখনো। সকলেই ওকে ভয় পায়। যেখানেই ও খেলে সেখানেই জেতে। আজ কিছুই মনে রাখতে পাচ্ছে না। হাতের তাস, অতীতের কথা! ভবিষ্যৎ-এর স্বপ্ন।

চ্যাটার্জি ওকে একটি বই পড়তে দিয়েছিল। জিডু কৃষ্ণমূর্তীর। কৃষ্ণমূর্তীর মূল বক্তব্য ছিল এই যে, আমাদের মধ্যে খুব কম মানুষই বাঁচতে জানি। আমাদের মধ্যে অধিকাংশই সকালবেলাটা কাটাই অফিসে গিয়ে কী কী করব সেই ভেবে। অফিসে যখন থাকি তখন অফিস ছুটির পর কী করব তাই ভেবে কাটাই আর অফিস ছুটি যখন সত্যিই হয় তখন থেকে ভাবতে শুরু করি কাল অফিসে গিয়ে কী করব। প্রতিমুহূর্তেই হয় আমরা অতীতে বাঁচি, নয় ভবিষ্যতে। বর্তমানে বাঁচতে জানি খুব কম মানুষই। মুহূতাঁর মালা গেঁথেই বর্তমান। তাই এই মুহূর্তটিতে কীভাবে বাঁচছি, কতটুকু আনন্দ করছি, সে কাজ করেই হোক, কি তাস খেলেই হোক, কি প্রেম করেই হোক, সেইটেই আসল কথা।

থিওরি খুবই ভালো সন্দেহ নেই। কিন্তু বর্তমানেই বাঁচতে শিখতে হবে।

বোসদা একবার ঘুরে গেলেন বারান্দাতে এসে। জোর শব্দ করে নাক ঝাড়লেন একটিপ নস্যি নেওয়ার পর। তারপর তির্যক চোখে চেয়ে লাল রুমাল দিয়ে নাক মুছতে মুছতে বললেন, বউ-এর সঙ্গে ঝগড়া করেছ বুঝি?

না। তবে করব হয়তো।

ভবিষ্যতে?

হ্যাঁ।

ভবিষ্যৎকে গুলি মারো। কালু দু-বোর্ড খেলল। দারুণ জিতছে। এখনও এসো, লাক ফিরতে পারে।

মাই লাক হ্যাজ রান আউট বোসদা। ইট অ্যাপিয়ারস।

তাই?

বলে, চিন্তান্বিত মুখে তাকালেন বোসদা গোপেনের চোখে। তারপর বললেন, মে বি, ফর দ্য ডে। বরাবরের জন্যে তো নয়। বুঝলে ভায়া, কপাল হচ্ছে দোলনার মতো। একবার দূরে যায়, আরেকবার কাছে আসে। তুমি যদি মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকো তবে তৈরি থেকো কখন কপাল ত্বরাতে ফিরে আসে তোমার কাছে। তৈরি না থাকলে বা অন্যমনস্ক হলেই কপাল এসে তোমারই কপাল কুঁড়ে ভুতলশায়ী করবে তোমাকে। তাড়াহুড়ো যে করেছে, সে-ই মরেছে। টাইমকে টাইম দিতে হবে। যা সময় লাগবে, যা কিছুর জন্যেই হোক না কেন, তা তো দিতেই হবে। বোর্ডে ফেরার সময় হয়েছে তোমার। চলো। ফেরা।

আপনি যান। যাচ্ছি আমি।

বলল, গোপেন।

পকেট থেকে সিগারেট বের করে বুকপকেট থেকে লাইটার বের করতে গিয়েই চিঠিটার সঙ্গে আঙুল ঠেকে গেল। দীপার চিঠি। Strictly Personal স্বামী স্ত্রীকে একসঙ্গে! আশ্চর্য মেয়েটি। আন-ইউজুয়াল, নন-কনফরমিস্ট।

সিগারেটটা ধরিয়ে, লাইটারটা বুক পকেটে রেখে চিঠিটা বের করল গোপেন। তারপর বারান্দাটা যথেষ্ট নিরিবিল মনে না হওয়াতে, উঠে গিয়ে সামনের পার্কের একটা গাছতলার বেঞ্চে গিয়ে বসল। খামটা ছিঁড়ে চিঠিটা বের করল।

সতপতিকুঞ্জ
 হুরহুলাগড়
১/৫/৯০

 ব্যানার্জি মশায়, শ্রদ্ধাভাজনেষু।

ঠিক কীভাবে আরম্ভ করব ভেবে পাচ্ছি না। অথচ চিঠি একটি আপনাকে লেখা আমার বড়োই দরকার।

আরম্ভটাই মুশকিল।

 আচ্ছা, প্রথমেই বলি যে, আপনাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। মানে, ন্যাকামি করব না কোনো; আপনি যদি অবিবাহিত হতেন, অথবা শ্ৰীদিদিকে বিয়ে না করতেন তবে আমি লড়ে যেতাম। শুনছেন তো মশাই। নোট করে রাখুন কথাটা যে, আপনাকে আমার খুবই ভালো লেগেছে।

আমাকে আপনার কেমন লেগেছে জানি না। বোধ হয় ভালো লাগেনি। তা ছাড়া লাগবেই বা কী করে? আমার গুণপনার তো কিছুই আপনাকে এই স্বল্পপরিসরের মধ্যে এবারে জানিয়ে আসা গেল না। আমি কিন্তু খুব ভালো গান গাই। শোনানো হল না এবারে। দারুণ রান্নাও করি। তবে আমার পছন্দসই মানুষের জন্যে না হলে বড়ো একটা রাঁধি না। রান্নাও তো প্রেমের প্রকাশের এক বিশেষ মিডিয়াম। যাকে তাকে খাইয়ে ও যেমন তেমন করে খাইয়ে এ গুণের অসম্মান করাটা উচিত নয়। পরের বার আপনাকে খাওয়াব। এবং যদি জোড়ে এখানে আসতে পারেন, আমি নতুন কোয়ার্টার পাবার পর, তবে এখানেও খাওয়াতে পারি। যদি সাহস করে একা আসতে পারেন (আমার সাহসের অভাব নেই।) তবে তো কথাই নেই। We will beat it up.

এবারে আসল কথাতে আসি। আপনি হয়তো ভাববেন যে, আমি কোনো Manners জানি না, আমার সহবৎ নেই; এবং আমি অত্যন্ত অসভ্য। কিন্তু এই ছোট্ট জীবন এবং বিশেষ করে যৌবনে, Manners, সহবৎ, সভ্যতা এসবের পরাকাষ্ঠা করতে করতেই যৌবন-জীবন ফুরিয়ে যায়। তখন এটা করা হল না, ওটা করা হল না, করা হল তো তাও তেমন করে করা হল না; এমনই সব অভিযোগ জমা হতে থাকে। এবং সেই জমা-হওয়া অভিযোগ পুঞ্জীভূত হতে হতে একদিন নিজেরই বুকের মধ্যে বিস্ফোরিত হয়। ছিন্নভিন্ন করে দেয় নিজেকে, তখন বেঁচে থাকলেও আমরা ভেজিটেবেল হয়ে বেঁচে থাকি। কোনো মানুষের জীবনেই সেইরকম বাঁচা অভিপ্রেত নয়।

আপনি কি যথেষ্ট বেঁচে আছেন? প্রত্যেক মানুষই তো জীবিকার জন্যে কিছু না কিছু একটা করেই। টাকা রোজগার করে, খায়-দায়, বিয়ে করে, ছেলে-মেয়ে হয়, তাদের ভাবনা ভাবে। তারপর দেখতে দেখতে বুড়ো হয়ে গিয়ে ছেলে-মেয়েদের জীবনকেই নিজেদের জীবন মনে করে ঘানির বলদের মতো খাটতে খাটতে একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করে যে, বুড়ো হয়ে গেছে। পায়ে বাত, বুকে ইসকিমিয়া, অ্যানজাইনা, রক্তে সুগার এবং ক্লোরোস্ট্রাল। সবচেয়ে মজার কথা এই যে, তখন সামর্থ্য থাকলেও কেদারবদ্রী যেতে পারবেন না, মরুভূমি পেরোতে পারবেন না, সার্ক-রাইডিং করতে পারবেন না; অবস্থাপন্ন মানুষেরা যেসব করে থাকেন। এবং সেই মুহূর্তেই আমি যেমন আবিষ্কার করে অবাধ্য হচ্ছি, তেমনই আবিষ্কার করবে যে, তাদের জীবনটা তাদেরই। জীবনটা উপভোগ করবার। তারা ভুলে যাবে বেমালুম, আমি যেমন অনায়াসেই গেছি যে; তাদের মা-বাবা দাদারা নিজেদের অনেকই ভাবে বঞ্চিত করে ছেলে-মেয়েদের মানুষ করে তোলবার জন্যে নিজেদের জীবন বরবাদ করেছেন।

 অথচ তাঁদের ত্যাগটাও যেমন সত্য, ছেলে-মেদের নিজেদের জীবন নিজেদের এই দাবিটাও তেমন সত্য। আমাদের বাবা-মায়েরা নিজেরা স্বার্থপর না হরে নিজেদের জীবন নষ্ট যে করেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই বলে আপনারা আমরাও যদি তা করি, তাহলে তো মুখামির চূড়ান্ত হবে। অন্যদের দেখেও যদি শিখতে না পারি তাহলে দেখে শেখার সুযোগ আর আমাদের হবে না।

আমার বাড়ির সামনেই একটি পাঁচতলা ফ্ল্যাট বাড়ি আছে। রাতের বেলা যখন ন্যাশানাল নেটওয়ার্কে ন-টার সময় ছবি দেখায় তখন আমি আমার বারান্দাতে দাঁড়িয়ে দেখি যে, প্রতি ফ্ল্যাটে আলো জ্বলছে। প্রতি বসবার ঘরে টিভির সামনে বসে বাবা-মা ছেলে-মেয়ে ছবি দেখছে। প্রতিটি ফ্ল্যাটই আনন্দের প্রতিমূর্তি যেন। আজ থেকে কুড়ি পঁচিশ বছর পর এই সব ফ্ল্যাটের দৃশ্যই একেবারে অন্যরকম হবে। বুড়োবুড়ি নয়, শুধু বুড়ো, শুধু বুড়ি একজনমাত্র চাকর বা আয়ার দয়াতে অথবা কারো বিনা দয়াতেই বড়ো করুণ বাঁচা বাঁচাবেন। ছেলে-মেয়ে মানুষ করে, তাদের সেটল করে উদবৃত্ত আর কিছুমাত্রই থাকবে না যা দিয়ে অত্যন্ত Well deserved Retirement-কে সুখের করে তোলা যায়।

তাই বলি যে, ভবিষ্যৎ কথাটা এই পৃথিবীর প্রেক্ষিতে একেবারেই out-dated হয়ে গেছে। বর্তমানটাই আসল। এবং বর্তমানেই ভবিষ্যৎকে গেঁথে না-রাখতে যে পারবে, তার ভবিষ্যৎ তো ফাই; বর্তমানও ফক্কা।

আপনি হয়তো এতক্ষণে ভাবছেন যে unsolicited এত জ্ঞান দেওয়ার আমার কী দরকার। আমি আপনার কে?

এখন কেউ নই কিন্তু হতে তো পারি।

 কিছু মনে করবেন না, আমার মনে হয়েছে, যে-কোনো কারণেই হোক, যে আপনি আর শ্রীদি একে অন্যর সঙ্গে যথেষ্ট সম্পৃক্ত নন। অথবা, দড়ি দিয়ে বাঁধা জোড়া-ডোঙা যেমন মাঝ বিলে গিয়ে হঠাৎ দড়ি ছিঁড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তেমনই আপনাদের সম্পর্ক। পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন এখনও হয়নি কিন্তু দড়ি ছিঁড়ে গেছে। কিছুক্ষণ ঘেঁষাঘেঁষি ঠোকাঠুকি করে একসঙ্গে ভাসবেন হয়তো কিন্তু কিছুদিন পরেই আলাদা হয়ে যাবেন। তখন আদিগন্ত বিলের ওপর সূর্য ডুবে আসবে। স্বচ্ছ জলের তলায় কচি-কলাপাতা রঙা ঝাঁঝিদের তখন শেষবিকেলের আলোয় কমলা-রঙা দেখাবে। পানকৌড়ি গলা লম্বা করে দু-ডানায় আলো মেখে মুহূর্তের জন্যে সুন্দরী হবে। ময়ূরকণ্ঠী-নীল আর সিঁদুরে-লাল শরীরে কাম পাখিরা তাদের কাম চারিয়ে দিয়ে মসৃণ আয়নার মতো নিস্তরঙ্গ জলে ফাটা-ফাটা রেখা ফোঁটাবে। কোনো জলচর সাপ সেই শান্ত সুন্দর স্তব্ধ জলজ ছবিকে দ্বিখন্ডিত করে সাঁতরে চলে যাবে আলোর দেশ থেকে অন্ধকারের দেশে। আর আপনি সেই শীতার্ত, আদিগন্ত, নীর-সাম্রাজ্যে নিরুপায়ে বসে ভাববেন কী ভুলই না করেছেন! কী ভুল!

অথচ পৃথিবীতে এমন একজনও পুরুষ অথবা নারী নেই যার জীবন অপর একজন নারী বা পুরুষের দয়া-নির্ভর। এই পৃথিবী মস্ত বড়ো মশায়! পৃথিবী জমজমাট। কোনো একজন, যা চেয়েছিল; তা দিল না বলে পা-ছড়িয়ে কাঁদতে বসা শুধুমাত্র শিশুদেরই মানায়; প্রাপ্তবয়স্কদের আদৌ নয়।

এই কথাটা সুমন সেনের মতো কেউকেটা তালেবর মানুষকে কিছুতেই বোঝানো গেল না। কবে কাকে ভালোবেসেছিল, এক কলকাতার মেয়ে, তাদের বাড়ি নাকি ছিল যোধপুর পার্কে, তাঁকে ডিচ করেছে বলে জীবনের সব প্রাপ্তি তাঁর অসার হয়ে গেল। মানুষটা নেহাৎ Fluke-এ বড়ো হয়ে গেছে। সত্যিকারের বড়ো পুরুষের কোনো লক্ষণ তাঁর মধ্যে আমি অন্তত দেখি না। এমন লোক, বাথরুম-সংলগ্ন ড্রেসিং রুমে তাঁর প্রেমিকার ফোটো সাজিয়ে রেখে হুরহুলাগড় ইণ্ডাস্ট্রি চালাবার অনুপ্রেরণা পায়–এ আমার পক্ষে বিশ্বাসযোগ্য নয়। যে-কোনো সফল নারী ও পুরুষের জীবনে Sex is very important৷ যতদিন না আমরা এই কথা মেনে না-নেওয়ার ভন্ডামি কাটিয়ে উঠতে পারছি ততদিন আমাদের সফলতাও সেরকমই হবে। আপনি দেখবেন যে, সুমন সেন যদি তার ওল্ড-ফ্লেম খুঁজে না পান, তাঁর সঙ্গে মিলিত হতে

পারেন তবে আপনাদের হুরহুলাগড় ইণ্ডাষ্ট্রিজ একদিন ধ্বসে যাবে। আফটার অল ইট ইজ দ্য হিউম্যান মেটিরিয়াল হুইচ ম্যাটারস। জার্মানিতে জাপানে মানুষ ছিল তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিশাপ ঝেড়ে ফেলে তারা আবার পৃথিবীকে চোখ রাঙাচ্ছে। সেইরকম মানুষ আসে একমাত্র তৃপ্ত পুরুষ ও নারীর প্রজন্ম থেকেই। এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

 যদি পারেন তো সুমন সেনের সঙ্গে তাঁর প্রেমিকার মিলন ঘটিয়ে দিন। একদিন ছলছুতোতে এম ডির বাংলোয় চলে গিয়ে সেই ফোটোটি দেখে আসুন তারপর গোরু খোঁজার মতো খুঁজতে শুরু করুন। যার গরু হারিয়েছে তাকে তার গরু ফিরিয়ে দিয়ে। জানি সে গাভী এতদিনে সবৎসা হয়েছে কি না! হুরহলাগড়কে বাঁচান। সেটাই হবে, এম ডির এবল অ্যাসিট্যান্ট হিসেবে প্রথম এবং সবচেয়ে জরুরি কাজ।

সুমন সেনকে আমিও ভালোবাসি। মানুষটার জন্যে আমার কষ্ট হয়। যদি তাঁর প্রেমিকাকে কখনো খুঁজে পান এবং দেখেন যে তিনি বিয়ে-টিয়ে করে সুখে সংসার করছেন, (খবর তো সেরকমই।) তাহলে তাঁর সংসার ভেঙেও তাঁকে সুমন সেনের কাছে পাঠিয়ে দিন। তাঁর সংসারে যে ফাঁক হবে বা ক্ষয়, তা আমি পূরণ করতে রাজি আছি। তা সে ভদ্রলোক যেমনই হোন না কেন। কথা দিচ্ছি।

আপনি একা নন। ওই ফোটোটি পেলে প্রিন্ট বা জেরোক্স করিয়ে নিয়ে আপনার সব কলিগকে দিন। সুমনদাকে কোনো ডাক্তারই বাঁচাতে পারবে না। পারলে পারে সেই মেয়েটি। তার নাম জানি না আমি।

 এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝলেন যে আমার কী স্বার্থ। আমার স্বার্থ এই যে সুমন সেনকে আমি ভালোবাসি। তাঁর মতো মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করতে যে-কোনো মানুষেরই যে-কোনো মূল্য দিতে রাজি থাকা উচিত। কারণ ওঁর মতো মানুষ আমাদের দেশে কমে আসছে। উনি হলেন সেই হাইলি-এনডেনজারড স্পেসিজের একজন। যে দুজন পাবলিক-সেকটর আণ্ডারটেকিং এর এম ডি এই নরমেধ যজ্ঞে মেতেছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে কেস হলেও তাঁরা বেকসুর খালাস হবেন, চাকরিও যাবে না। তাঁদের শিক্ষা একমাত্র সুমন সেনই দিতে পারেন যদি তিনি ভালো হয়ে ওঠেন।

আইন এদেশে এখনও প্রকৃতার্থে বলবতী হয়নি। কবে যে হবে তাও জানি না।

ভালো থাকবেন। আমি সুমনদার জন্যে এবং আপনার জন্যেও কী করতে পারি জানাবেন।

ইতি-অবিশ্বাস্য, আনইউজুয়াল; দীপা
যে দীপ জ্বেলে যায়।

চিঠিটা পড়ে অনেকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইল গোপেন।

 মেয়েটি হয় পাগল, নয় ইমবেসাইল।

এম ডি কে যাঁরা মারবার চক্রান্ত করেছিলেন তাঁদের হয়ে কাজ করছে না তো মেয়েটি? দীপা। হয়তো ওরা চায়, এম ডিকে প্রাণে মারতে পারল না বলে একটা যাচ্ছেতাই স্ক্যাণ্ডাল রটিয়ে তাকে লোকের কাছে ছোটো করতে। নইলে এইরকম চিঠির তো কোনো মানেই বোধগম্য হচ্ছে না।

মাথার মধ্যে ভোঁ ভোঁ করছিল গোপেনের।

পার্কটা এখন নির্জন। কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে অনেকগুলি। দুটো বাঁদর-লাঠি গাছ। একটি আকাশমণি, বা আফ্রিকান টিউলিপ। গোল্ডেন-ওরিওল পাখি ডাকছে কৃষ্ণচূড়া গাছের ওপরে বসে।

এত সব জানত না গোপেন, বোসদার কাছে শিখেছে, এখানে এসে। কলকাতায় থাকতেই বোসদা বার্ড-ওয়াচিং ক্লাবের সভ্য ছিলেন। নিজের ভাঙা হেরাল্ড গাড়ি করে প্রতিরবিবারই প্রায় বেরিয়ে পড়তেন পাখি দেখতে। কান টানলেই যেমন মাথা আসে তেমন পাখি চিনতে গিয়েই গাছ চিনেছিলেন। কিছু কিছু তাঁর কাছ থেকেই চিনেছে গোপেন।

চিঠিটা আবারও বের করল গোপেন। চিঠিটা দ্ব্যর্থক। আনসলিসিটেড জ্ঞানমাত্র নয়, ও চিঠিতে আরও কোনো গভীর ও বিপজ্জনক বার্তা আছে বলে সন্দেহ হচ্ছে। আজ সকালে হাসপাতালে এম ডি এবং শ্রীর রি-অ্যাকশান এবং দীপার এই চিঠি; এই দুইয়ের মধ্যে কোথায় যেন এক অদৃশ্য যোগাযোগ আছে।

আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে চিঠিটা খুলে আরেকবার খুব আস্তে আস্তে পড়ল গোপেন। এবার মানেটা যেন প্রাঞ্জল হয়ে আসতে লাগল আস্তে আস্তে। যোধপুর পার্কে বাড়ি? হ্যাঁ। তাই তো। যোধপুর পার্কেই তো বাড়ি শ্রীদের। রহস্যর উন্মোচন যেমন হল তেমন হঠাৎ এক বিষণ্ণতাও তাকে ছেয়ে ফেলল।

এমন সময় বোসদা বারান্দায় এসে তাকে খুঁজে না পেয়ে বাগানের দিকে চেয়ে তাকে দেখতে পেয়ে এদিকে আসতে লাগলেন। পেছন পেছন কালু। তার পেছন পেছন বোসদার ডালমেশিয়ান কুকুর, ইয়ার।

বোসদা বললেন, হলটা কী?

কী হল তোমার গোপেন?

পেট ব্যথা করছে বোসদা। মাংসটা ভালো ছিল না।

হতেই পারে না। ইয়াকুবের দোকানের মাংস। কলকাতার রয়্যাল হোটেলের চেয়েও ভালো।

তা কী জানি। পেটে খুব ব্যথা করছে। বাড়ি যাব।

বাড়ি যাবে, তা যাও কিন্তু মিথ্যে ইয়াকুবকে দোষী করছ কেন ভায়া?

বলেই বললেন, যা কালু। গোপেনের জিপ যাচ্ছে, চলে যা এইবেলা। পানিট্যাঙ্কির মোড়ে নেমে একটু আনাজ কিনে নিয়ে আয়। রাতে খাবিটা কী? কাল কারখানায় যাবার আগে? যাচ্ছিস যখন তখন ইয়ারকেও সঙ্গে নিয়ে যা। চেনটা ঘর থেকে নিয়ে আয়। ওর একটু একসারসাইজ হবে। তিন বছরের কুকুর। বাড়ি বসে বসেই বাতে ধরে গেল। যেন আমার ন-কাকা।

গোপেনের মনটা ভালো ছিল না। একাই যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সঙ্গে জিপ থাকাতে, না করাটা ভালো দেখায় না।

ও আস্তে আস্তে জিপের দিকে হেঁটে এগোল। কালু ভেতরে গেল থলে আর চেন আনতে।

জিপের কাছে দাঁড়িয়ে ভাবছিল গোপেন যে, এখন তিনটে বাজে। এই সময় বাড়ি গিয়ে কীই বা করবে। শ্রীকে ফেস করতে হবে। শ্রীরও ফেস করতে হবে ওকে।

শ্রীর চিঠিতে কী লিখল দীপা কে জানে!

 কালু এসে জীপে বসল। ইয়ারকে পেছনে তুলে দিয়ে বলল, বেশি আহ্লাদ করবে তো মারব পোঁদে এক নাথি। বোস আহ্লাদে-আহ্লাদে এটাকে মাথায় চড়িয়েছে। আলাদা কোয়ার্টার পাওয়া মাত্র কেটে পড়ব গোপেনদা। মশারির মধ্যে কোলবালিশ করে শোয়, টেবল-এ খেতে বসে আমাদের উলটোদিকের চেয়ারে ইয়ার বসে খায়। গা ঘিন ঘিন করে। বোসদা বলেন, আহা! কুকুর বলে কি মানুষ নয়। আদিখ্যাতা আর সহ্য হয় না।

 পানিট্যাঙ্কির আগে হিলভিউ বার। বাগানে চেয়ার পাতা আছে লাল-নীল ছাতার নীচে। জিপটা তার কাছাকাছি এলেই গোপেন বলল কীরে কালু, হবে না কী?

আর এসব সু-অভ্যাস ভুলেই গেছি গোপেনদা। ছুটিতে যখন ঢেনকানল-এ যাই তখন হয় একটু আধটু। বোসদার মোক্ষ তো বিয়ার। তাও গেলাস প্রতি দুটি করে জেলুসেল এম পি এস খাবেন। চলে না। চরিত্রটাই নষ্ট হয়ে গেল তোমাদের কলকাতার এই কায়স্থ পার্টির খপ্পরে পড়ে।

নামবি কি বল?

চলো গুরু। তোমার সঙ্গে জাহান্নামেও যেতে রাজি।

বাইধরটা বসে থাকবে।

ছেড়ে দাও না। তুমি চালিয়ে যাবে।

আমি কি চালাই নাকি? আমার যখন দশ বছর বয়েস তখন বাড়ির শেষ গাড়ি বিক্রি হয়ে যায়।

শিখে নাও।

শিখেছিলাম, আমাদের ড্রাইভার রঘুবীর সিং-এর কোলে বসে। স্কুল যেতাম আসতাম নিজেই চালিয়ে।

ভুলে গেছ?

জিপ থেকে নামতে নামতে কালু শুধোল।

পরক্ষণেই ইয়ারের কথা মনে পড়াতে বাইধরকে দুটো টাকা দিয়ে বলল ওই যে চিনেবাদাম বিক্রি হচ্ছে। কিনে নিয়ে খেতে খেতে বাইধর ভাই এটাকে একটু হাঁটিয়ে দাও তো।

ঠিক আছে। বলল, বাইধর।

 কালু আবার বলল ভুলে গেছ? গাড়ি চালাতে?

 অন্যমনস্ক ছিল গোপেন। ওর মাথা কাজ করছিল না সকাল থেকেই। বলল কী বললি?

কঁড় হে আজ তন্থকু? বলছিলাম, গাড়ি চালানো ভুলে গেলে?

হ্যাঁ।

বাজে কথা। তিনটে জিনিস একবার কেউ শিখলে, তিনটে নয় চারটে জিনিস; কখনো ভোলে না।

কী? কী?

ফাকিং, সাইক্লিং, ড্রাইভিং আর সুইমিং। যতই আউট অফ প্রাকটিস হোক না কেন, ঠিক চালিয়ে যাবে।

অন্যদিন হলে কালুর চোখা চোখা কথা-বার্তা অ্যাপ্রিশিয়েট করত গোপেন।

আজ কেমন ম্যাদামারা হয়ে গেছে।

 কী খাবে?

হুইস্কি।

সুর্য তো ডোবেনি এখনও। শীতকালও তো নয়। তার ওপর খাওয়ার সময়ে তো বিয়ার খেলে। আফটার বিয়ার হুইস্কি ইজ রিসকি। নেশা হয়ে যাবে।

আজ আমার নেশা করতে ইচ্ছে করছে।

গোপেন বলল।

ওরে বাবা। তারপরে আবার অন্য কিছুর ইচ্ছা হবে না তো! তোমার কী হয়েছে বলো তো আজ। তাসে হেরে গেলে অতগুলো হাত। সাহেব লোক, চিরদিনই এল হইস্কি আফটার সান-ডাউন আর আজ তুমিই!

আজ একটা বিশেষ দিন।

কী ব্যাপার।

তুই জিতেছিস। জীবনে তো কোনোদিনও জিতিসনি।

 তা ঠিক। মাই প্লেজার। আমিই খাওয়াব আজ।

না। খাওয়াব আমিই। আমিই তোকে নিয়ে এলাম তো!

সে হবেন।

ওই দেখো। আজ আমার বরাতই খুলে গছে। দেখো, নতুন কী একটা ব্র্যাণ্ড ডিস্টিলার চালু। করছে তাই আজ এক পেগ অর্ডার করলে দু-পেগ দিচ্ছে।

তাই?

তাই।

 বেয়ারা এসে হুইস্কি দিয়ে গেল। গোপেন সোডা আর বরফ দিয়ে খাচ্ছে। কালু শুধু জল দিয়ে।

কীরে। বোস। বসে খাচ্ছিস না কেন?

কী যে এল না। আমাদের চেনকানলের সুরবাবুদের বড়োছেলের হাতে প্রথম মাল খেয়েছিলাম। সে ভুজুবাবু কখনো বসে খেতে দিত না।

কেন?

বলত, সায়েবরা কী বলে জানিস না? বলে, হাউ মেনি ড্রিঙ্কস ক্যান উ স্ট্যাণ্ড? বসেই যদি খাওয়ার নিয়ম থাকত তবে তো বলত, হাউ মেনি ড্রিঙ্কস ক্যান উ সিট?

হো হো করে হেসে উঠল গোপেন। বলল, সকলকে বলার মতো গল্প।

মদের টেবলে বসলে যা সবচেয়ে আগে হারায় তা হচ্ছে সময়। তার অনেক পরে স্বভাব, চরিত্র, লিভার ইত্যাদি। উঠল যখন টেবল ছেড়ে তখন আটটা বাজে। আটটা খেয়েছে গোপেন। জীবনে অতগুলো হুইস্কি একসঙ্গে কখনো খায়নি। বড়ো। কালু খেয়েছে ছ-টা। ও গোপেনের জন্যে একটু চিন্তিত।

কালু বলল, চলো, তোমাকে বাড়িতে আগে পৌঁছে দিই। বউদিকে বলব আমিই তোমাকে জোর করে। তোমার দোষ নেই।

তা কেন। তা ছাড়া দোষগুণের কী আছে? রোজ থোরিই খাই আমি!

সে আমিও তো বছরে মাত্র দু-দিন খাই।

 কালু বলল।

কোন কোন দিন?

একটু জড়ানো গলায় শুধোল গোপেন?

কালু বলল, যেদিন বৃষ্টি পড়ে সেদিন আর যেদিন বৃষ্টি পড়ে না সেদিন।

হেসে উঠল গোপেন। মাতালের হাসি। মুখে বলল, শালা!

গোপেন কখনোই ভাষাতে ঢিলে দেয় না। বলেই, বুঝতে পারল ওর মধ্যে অনেকগুলো গোপেন ছিল। তারই মধ্যে এক শুকিয়ে-থাকা-শালা আজ থলি থেকে বেরিয়েছে। মাল ক্যাচ।

জিপে উঠে গোপেন বলল, তোর আনাজ? বোসদা রাতে কী খাবেন?

দেবদারু পাতা ভেজে দেব সঙ্গে জবাফুলের ঝোল। ছাড়ো তো। আরে! ইয়ার, ইয়ার কোথায়?

তারপরই ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, যা ভেবেছিলাম! দেখো! গাড়িতে অপকর্ম করেছে। কী দুর্গন্ধ!

বাইধর কোথায়?

তাই তো। ও। ওই দেখো। সেও নালার ধারে অন্ধকারে অপকর্ম করছে। তা বাবা এটাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে পারতি তো! যত্ব সব।

কালু ইনসিসট করল যে, আগে গোপেনকে নামিয়ে দিয়ে যাবে।

বাইধর যখন জিপটাকে এনে দাঁড় করাল গোপেনদের বাড়ির দরজায় তখন কালু নেমে চেঁচিয়ে বলল, বউদি, ক্ষমা করে দেবেন। দাদাকে আমরাই আটকে রেখেছিলাম।

আনাজ নিয়ে যাবি নাকি কিছু?

 গোপেন শুধোল। কালুর কথাতে ভ্রূক্ষেপ না করে।

দুর দুর। ছাড়োতো! বললাম তো, দেবদারু পাতা ভাজা আর জবার ফুলের ঝোল।

ওপর থেকে শ্রীর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।

কালু বলল, কী বুঝলে? বউদি বাড়ি নেই। ইউ আর লাকি। চান করে দু-খিলি পান আর বাবা জর্দা দু-শো নম্বরের, মুখে ফেলে দাও। কেউ বুঝতেই পারবে না।

 গোপেন ভাবছিল, এরকম তো কখনোই হয়নি। শ্রী যদি কোথাও গিয়েও থাকে, ভরতের কী হল?

কী ভাবছ?

কালু বলল।

না:।

বাড়িতে তো ঢোকাই যাবে না এখন। তালা বন্ধ যে।

 আমাদের ওখানে ফিরে চলো।

এমন সময় বাইধর বলল, ডিজেল নিতে হবে।

 বিরক্তি-মাখা গলায় গোপেন বলল বাইধরকে, এতক্ষণ কী করছিলে? দিনভর মনে ছিল। না?

স্লিপ?

কালু বলল, আমি যখন ফিরব, নিয়ে নেব এখন।

চল আমিও তোর সঙ্গে যাচ্ছি।

যাবে? রাত হয়ে যাবে না?

হলে, হবে।

গোপেনের চোয়াল শক্ত হয়ে আসতে দেখল কালু।

বাইধর জিপের মুখ ফেরাল টাউনশিপের দিকে।

.

১৩.

ওযে যাবে একথাটা বিকেলে যখন গা ধুতে গেল তখনও স্থির করেনি শ্ৰী। গা ধুতে ধুতেই ওর মনে এমন একটা প্রত্যয় জন্মাল যে, সুমনের মায়ের কাছে তার এই মুহূর্তে থাকাটা খুবই দরকার।

 চান করে উঠে একটি সাদা শাড়ি পরল শ্ৰী। তাতে কমলা-রঙা পাড়। কমলা-রঙা মেগিয়া স্লিপের ব্লাউজ। কমলা টিপ পরল। সামান্য পারফিউম স্প্রে করল কানের লতির নীচে। বগলতলিতে; স্তনসন্ধিতে। কমলা-রঙা যে ফুলটি ভরত তাকে রোজ এনে দেয় সন্ধ্যেবেলায়, তার কৈশোরের নৈবেদ্য হিসেবে, সেই ফুলটি জল খোঁপাতে।

 ভরত যখন সন্ধের পরে ফুল এনে দেয় ওকে, তখন ভরতের চোখে কিছু একটা দেখে শ্ৰী। ফুল বড়ো খারাপ জিনিস। সন্ধেবেলাটাও খারাপ সময়। এই সময়টিতে সদ্য-স্নাতা প্রসাধিতা সব বয়েসি নারীই বিপজ্জনক। ভরসা এইটুকুই যে, ভরত নিজে এখনও বিপজ্জনক বয়েসে এসে পৌঁছায়নি। অথচ এই বয়েসই উত্তীয়র বয়েস। শ্রী যদি নরম করে বলে ভরতকে যে, সে খুশি হবে যদি ভরত ছাদ থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ে, তবে ভরত আগে পিছে বিবেচনা না করেই বিলক্ষণ লাফাবে। কিশোর বয়েসি পুরুষের কাছে যুবতী নারীর শরীরের, সন্ধেবেলার হাওয়ার, ফুলের গন্ধের, চাঁদের আলোর, পাখির ডাকের যে গভীর অনুন্মোচিত রহস্য এবং সেই রহস্যর প্রতি যে তীব্র দিগবিদিক-জ্ঞানশূন্য আকর্ষণ, তা চিরদিনই থেকে যাবে; পৃথিবী যতদিন থাকে কম্পুটার আর স্যাটালাইটেরা মানুষের এই নিবিড় অন্ধ আনন্দে কোনোদিনও ভাগ বসাতে পারবে না। তাকে কোডিফাই করতে পারবে না।

দু-হাতের পাতাতে ফুল হাতে এসে, জোড়-করে, শ্রীকে নিবেদন করে, ছাদের সুগন্ধি প্রায়ন্ধকারে দাঁড়িয়ে ভরত বলল, আর কী করব বউদি?

শ্রী বলল, এখানে ট্যাক্সি কোথায় ভাড়া পাওয়া যায় জানিস?

জানি না। তবে ভানু মহাপাত্রর দোকানে জিজ্ঞেস করলেই ওঁরা বলে দেবেন।

ঠিক বলেছিস। আনতে পারবি ট্যাক্সি একটা? ভালো দেখে।

কোথায় যাবে?

টাউনশিপ-এ। যাব এবং আসব। দাঁড়িয়ে থাকতে হবে সেখানে কিছুক্ষণ। কত ভাড়া নেবে জিজ্ঞেস করবি।

ভালো ট্যাক্সিওয়ালা মানে সুন্দর দেখতে?

নারে। মাতাল-টাতাল না হয়, গুণ্ডা-টুণ্ডাও না হয়। ভদ্র সভ্য, বিচ্ছিরি-গন্ধের বিড়ি খায় না; এইরকম।

বিড়ি খায় না তো সিগারেট তো খাবে।

সিগারেট খেলেও, যেন আজে বাজে ব্র্যাণ্ড না খায়। চামড়া পোড়া গন্ধ মনে হয় আমার।

দেখি! এত কিছু দেখে শুনে, মিলিয়ে কি ট্যাক্সি আনতে পারব!

যন্ডা-গুণ্ডা হলে কিন্তু তোকে যেতে হবে আমার সঙ্গে। আমাকে বাঁচাবে কে? কেউ যদি খারাপ হয়! কত্বরকম লোক আছে তো। তার ওপর রাতের বেলা।

আমিই বাঁচাব বউদি। আমার লাঠিটা নিয়ে যাব। নুয়াগড়ের কাছের উঁচু পাহাড়ের ওপর থেকে আমার দাদু বাঁশ কেটে এনে নিজে হাতে আমাকে বানিয়ে দিয়েছিলেন। এ লাঠি যার মাথাতেই পড়বে সেই আলো বাপ্পালো! বলে, চিৎপটাং হবে। তোমার সেই কবিতার মতো, হলদে সবুজ ওরাং ওটাং ইটপাটকেল চিৎপটাং!

 বলে নিজেই নিজের রসিকতায় হেসে উঠল।

যা ভরত। গেলে, দেরি করিস না।

দাদাবাবু যদি ফিরে আসেন আমরা যাওয়ার পরে!

এলে আসবেন। দাদাবাবুর কাছে তো একটা চাবি থাকেই।

তবু এসে অবধি আপনি তো একদিনের জন্যেও এমন করে যাননি। দাদাবাবু যদি চাবি। নিতে ভুলে গিয়ে থাকেন?

অত আমি জানব কী করে! তা ছাড়া সময়ও নেই বেশি। গেলে, তাড়াতাড়ি যা।

 যাই তাহলে।

ভরত যখন ট্যাক্সি নিয়ে এল, ভানু মহাপাত্ৰই ফোন করে ঠিক করে দিয়েছিলেন। এখানের মানুষরা অত্যন্ত কো-অপারেটিং; ভদ্র। ব্যতিক্রম হয়তো সব জায়গাতেই থাকে। কিন্তু শ্রী এখানে এসে অবধি কলকাতার সঙ্গে এখানের যে মস্ত তফাত এইসব ব্যাপারে তা ভালো করেই বুঝতে পারছে।

ট্যাক্সিওয়ালা ভাড়া অনেকই চাইল। কিন্তু শ্রীর যতখানি তাড়া ছিল সে তুলনাতে ভাড়াটা কিছুই নয়। তার ওপরে ভানু মহাপাত্রর চেনা ট্যাক্সি।

চলি রে ভরত।

বাঃ। আমি যাব না? একা যাবে তুমি? বললে যে, সঙ্গে যেতে হবে আমাকে। লাঠি হাতে এসে ভরত বলল।

তাহলে চল। দোনামনা করে বলল শ্রী।

ট্যাক্সিটা স্টার্ট করতেই বুঝতে পারল যে, কাজটা ভুল হল। এই সময়ে, এবং ভরতকেও সঙ্গে নিয়ে বেরোনোটা অত্যন্তই অন্যায় হল।

কিছু কিছু অন্যায় থাকে যা করার মুহূর্ত থেকেই নিজেকে পীড়া দিতে থাকে, অপরাধবোধে জর্জরিত করে নিজেকে, অথচ ফিরে যাবার বা তা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করার কোনো তাগিদ অথবা উপায়ই থাকে না। শ্ৰী বুঝল যে, আজ রাতে ও সেই ধরনেরই কোনো অন্যায় করছে।

ম্যানেজিং ডিরেক্টারের বাংলোর বিরাট কম্পাউন্ড। মস্ত বাগান। নুড়ি বিছোনো পথ। উঁচু লোহার গেট। তার সামনে দুজন সিকিউরিটির লোক। একজোড়া মার্কারি-ভেপার ল্যাম্প জ্বলছে। তাদের খয়েরি-রঙা আলোয় পুরো বাগান আর গেট আর স্লোসেম-রং করা সাদা বাংলোটাকে কেমন অলৌকিক বলে মনে হচ্ছে।

 সিকিউরিটির লোকেরা প্রথমে যেতে দিচ্ছিল না। শ্রী তার স্বামীর পরিচয় দেওয়াতে এবং সুমনের মায়ের সঙ্গে দেখা করার কথা বলাতে তারা স্যালুট করল। শ্রীর মনে হল একজন কৌতূহলী সিকিউরিটি গার্ড মাথা নীচু করে শ্রীকে একটু ভালো করে দেখেও নিল। সে দেখার রকমটা অন্য। মেয়েরাই একমাত্র জানে পুরুষের দেখার কতরকম হয়।

বাংলোর সিঁড়ির সামনেও আবার সিকিউরিটি গার্ড। এসব নতুন হয়েছে বলে মনে হল। ভরত বলল, আমি একবার একনাম্বার বাংলা দেখতে এসেছিলাম বাবার সঙ্গে, তখন গেটে শুধু একজন দারোয়ান ছিল। তাও রাইফেল ছিল না। লাঠি হাতে।

শ্রীর মনে হল, প্লেইনড্রেসে আশেপাশে পুলিশের লোকও আছে নিশ্চয়ই।

বাংলোটার নাম একনম্বর?

 শ্ৰী শুধাল ভরতকে।

হ্যাঁ। একনাম্বার সাহেব থাকেন তাই একনাম্বার।

সাদা-রঙা উর্দিপরা একজন বেয়ারা এসে বলল, কার কাছে এসেছেন আপনি? সাহেব তো হাসপাতালে। আপনি জানেন না?

শ্রী একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, মা কি আছেন?

কার মা?

এম ডির মা।

আছেন। কিন্তু উনি তো এইসময়ে কারো সঙ্গে দেখা করেন না। আপনার না কী বলব?

বলবে, শ্রী।

শ্রী?

হ্যাঁ।

দেখছি। আপনারা বসুন।

 বলেই, মস্ত বসবার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল লোকটি। একতলায় বারান্দাতেও দিব্বি বসা যেত। চমৎকার সাদা-রঙা সব বেতের চেয়ার। প্যাস্টেল কালারের বিভিন্ন হালকা শেড-এর স্ট্রাইপ কাভার। ধবধবে সাদা মার্বেলের মেঝের পটভূমিতে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। রট আয়রনের রাউণ্ড টেবল, দু-দিকে দুটি। ওপরে গ্লাস-টপ। তাতে রোজেনথালের হালকা বেগুনি রঙা ফুলদানিতে ফিকে গোলাপি গোলাপ সাজানো।

গার্ড বলল, এই বাংলা বালাসাহেব বানিয়েছিলেন। আগের বড়োসাহেব। সেনসাহেব শুধু সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছেন। ওই দেখুন বাগানের বড়ো বড়ো গাছের মধ্যে একটি ছোট্ট কুঁড়ে ঘর, তার পাশে দোলনা, সেনসাহেব ওইখানেই বেশি সময় থাকেন। অতিথি এলে তবে এতে আসেন। মা আছেন এখন।

ওখানেই খাওয়া-দাওয়া?

সব বন্দোবস্তই আছে। ছোট্ট কিচেনেট, বাথরুম। সাহেব নাকি বলেন, আমার চাকরবাকরদের কাছ থেকেই শুনেছি যে, অত বড়ো বাড়িতে থাকা একটি অপচয়। এই কোম্পানি চলে দেশের ট্যাক্সদাতাদের টাকায়। যতখানি সাশ্রয় করা যায় তাই করা উচিত।

সুমনের মা দোতলা থেকে নেমে এলেন। সাদা শাড়ি, হালকা কালো পাড়। সাদা ব্লাউজ। হাতে একগাছি করে সোনার চুরি। চোখে চশমা। পায়ে রাবারের চটি। আরও সুন্দরী হয়েছেন মাসিমা। কপালের দু-পাশের চুল সাদা হয়ে গেছে। বাই-ফোকাল চশমার মধ্যে আলো পড়ে চোখের তলাটাকে অসমতল বলে মনে হচ্ছে।

শ্রী বলল, ভরত। তুই বাইরে গিয়ে দাঁড়া।

আচ্ছা বউদি।

ওই পরিবেশে, অত আলোর মধ্যে খাকি হাফপ্যান্ট আর ছেঁড়া একটি নীলরঙা হাফ শার্ট পরা ভরতকে একদমই মানাচ্ছিল না। মানাচ্ছিল না হয়তো শ্রীকেও। কিন্তু বাইরে পাঠাল ভরতকে, অন্য কারণে।

মাসিমা কাছে আসতেই নীচু হয়ে দু-পায়ে দু-হাত দিয়ে প্রণাম করল শ্ৰী। উনি ওকে তুলে ধরে ওর কপালে আর গালে চুমু খেলেন। থুতনিতে আঙুল ছোঁওয়ালেন।

বললেন, তুমি কি সেই শ্রী? সুমুর পুরোনো শ্রী?

 হ্যাঁ মাসিমা।

বলেই, মাথা নীচু করে রইল।

তারপর বলল, খবর শুনে এলাম।

 তাই? তুমি কোত্থেকে এলে? কলকাতা? থাকো কোথায় এখন? খবর পেলে কী করে মা?

আমি এখন এইখানেই যে থাকি মাসিমা। আমার স্বামী সুমনের আণ্ডারে কাজ করেন। উনি এঞ্জিনীয়র।

কী নাম?

গোপেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি।

ও হ্যাঁ। তাঁকে তো দেখেছি হাসপাতলে। সুমনদের বয়েসিই হবেন। হয়তো দু-এক বছরের বড়ো হতে পারেন। বেশ ছেলেটি।

শ্ৰী উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকল।

 তা বোসো। কী খাবে বল।

 খেতে তো আসিনি মাসিমা।

খেতে, কে আর কার বাড়িতে আসে এল, মা! একটু আদর, একটু যত্ন, একটু ভালো ব্যবহার…।

এটা বোঝে ক-জন মাসিমা?

সেটা ঠিকই বলেছ! বেশি মানুষই একথাটা বোঝেন না।

সুমন কেমন আছে এখন? আমি সকালে দেখতে গেছিলাম। ঠিক চিনতে পারল না।

 হ্যাঁ। এইরকমই হচ্ছে। কদিন আগেও হয়েছিল।

তারপর বললেন, তুমি কতদিন এসেছ এখানে।

তা বেশ কয়েমাস হয়ে গেল।

এতদিন দেখা করোনি সুমনের সঙ্গে? সুমন জানত না?

না। আমিও জানতাম না।

তুমি যে বিয়ে করেছ তা তোমাকে দেখলে তো বোঝা যায় না। আজকাল অবশ্য বেশিরভাগ মেয়েকে দেখেই বোঝার উপায় নেই। সুমনের বোনকে তুমি দেখেছ কখনো, স্মৃতিকে?

না। তবে সুমনের কাছে শুনেছি অনেক।

সে তো কানাডার মনট্রিয়ালে থাকে। তার স্বামী জিওলজিস্ট। নর্থ কানডাতেই তাকে বেশি থাকতে হয়, তবে স্মৃতি মনট্রিয়ালেই থাকে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। যে জন্যে বলা, ও কিন্তু পুরোপুরি বাঙালিই রয়ে গেছে। কোমর সমান চুল, সিঁথিতে চওড়া করে সিঁদুর দেয়, শাড়ি পরে, হাতে শাঁখা ও চুরি।

খুব ভালো।

অপরাধীর গলায় বলল শ্রী।

তোমার ছেলে-মেয়ে কী শ্ৰী?

নেই।

ক-বছর বিয়ে হয়েছে?

তা আট-ন বছর হল।

এতদিন!

 হ্যাঁ।

 তা সুমনকে কিছু বলব মা?

না। কী আর বলবেন। বলবেন, আমি এসেছিলাম। প্রার্থনা করছি।

প্রার্থনা?

 হ্যাঁ।

প্রার্থনার প্রয়োজন বোধ হয় আছে। জানি না ছেলেটার আমার কী হবে।

ভালো হয়ে উঠবে। দেখবেন।

সুমনের মা চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, গান-টান কি একেবারেই ছেড়ে দিয়েছ?

প্রায়।

কেন?

ভালোবেসে শোনার লোক না থাকলে গান-টান হয় না মাসিমা।

একেবারেই বাজে কথা। গান গাইবে নিজেরই জন্যে। গানের মতো জিনিস আছে! এত আনন্দ, এত শুদ্ধি আর কিছুতেই হয় না। এমনকী ছবি আঁকাতেও নয়। একসময় আমি সবই করতাম, বুঝেছ। সব ছেড়ে দিয়ে এখন শুধু গানটুকুকে রেখেছি। গান এক ধরনের পুজো, উত্তরণ; প্রার্থনা। যাকগে, সুমু ভালো হয়ে বাড়ি আসুক, একদিন তোমাদের খেতে বলব। আর যদি পারো তো হাসপাতালে ওকে মাঝে মাঝে দেখতে যেয়ো।

তারপর গলা নামিয়ে বললেন, সুমু তোমাকে বিশেষই পছন্দ করত। আমার একমাত্র ছেলে, সে যত বড়োই হোক না কেন আমাকে সব কথাই বলে। আমি ওর বন্ধু। ও বলে, প্রায়ই যে, ও একটি জায়গায় হেরে গেছে। পরীক্ষা দেওয়ার বা যুদ্ধ করার সুযোগটুকু পর্যন্ত পেল না ও। তোমার বিয়েটা, ওকে ঘুণাক্ষরে না জানিয়ে; ওকে খুব আহত করেছিল। এবং বিয়ের পরে তোমার শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা পর্যন্ত তোমার বাড়ি থেকে না দেওয়াতে ও ভীষণই অপমানিত বোধ করেছিল। এতখানি অপমানিত ও জীবনের আর কোনো ঘটনাতেই বোধ হয় হয়নি।

 জানি। মাসিমা। আমি সব জানি। আমারও দোষ ছিল। আমার পরিবারের তো ছিলই। আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি। এরকম একটি প্রাগৈতিহাসিক ঘটনা যে আমাদের পরিবারের মানুষেরা ঘটাতে পেরেছিলেন সেকথা আজকেও ভাবলে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই।

কে বলতে পারে মা, প্রাক-ইতিহাসের মোড়ক হয়তো আমাদের সকলের গায়েই লেগে আছে। সবসময় দেখা যায় না তো, এই যা। তা ছাড়া…

 ক্ষমা করার কী আছে! বিয়েটা তো একাট নিবন্ধ। এই দেখো, তুমি যাকে বিয়ে করেছ। সেও যথেষ্ট ভালো ছেলে। অবশ্যই ভালো। আমি তো তাকে দেখেওছি। সে সুমনের খুব প্রিয়ও। অথচ এও যেমন নিবন্ধ আবার নির্বন্ধ এও যে, গোপেন এই হুরহুলাগড়েই এল এবং এল তো এল সুমন যেখানে সর্বেসবা। এল একে নিবন্ধ বলবে, কি বলবে না। কী শ্রী?

 শ্ৰী উত্তর না দিয়ে মুখ নামিয়ে নিল।

একটু শরবত-টরবত অন্তত খাও।

না মাসিমা। ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে এসেছি।

কেন? গাড়ি নেই তোমার?

জিপ আছে। সে তো ওর সঙ্গেই থাকে কাজে-কর্মে।

তা যখনই আসতে ইচ্ছে করবে আমাকে একটা ফোন করে দেবে, গাড়ি পাঠিয়ে দেব। হাসপাতালে যেতে চাইলেও ফোন কোরো বিনা-সঙ্কোচে। গাড়ি না থাকলে। আমি তো তোমার মায়েরই মতো। মানো তো শ্রী? তোমার শ্বাশুড়িমাও তো হতে পারতাম।

মানি, মাসিমা।

শ্রীর গলা ভারী হয়ে এল।

চলি।

শ্রীকে এগিয়ে দিতে দিতে উনি বললেন, আমার নামটা মনে আছে তো? সুমন সেনের মা ছাড়াও আমার অন্য একটা পরিচয় ছিল এবং এখনও আছে। বুকু সেনের স্ত্রী। আমার নাম কাঞ্চন।

কাঞ্চন ফুলের গাছ দেখেছ কখনো? এখানে অনেক আছে। এখনও ফুটছে কিছু। খেয়াল করে দেখো। আসলে নাম ছিল মনোরমা। তোমার মেশোমশায়ের মতে অত্যন্ত সেকেলে ছিল সে নাম। বিয়ের পর একদিন একটি ফুলে-ভরা কাঞ্চন গাছতলাতে দাঁড়িয়ে উনি আমার নামকরণ করেছিলেন, কাঞ্চন। সেই থেকেই কাঞ্চন। কাঞ্চনগাছে ফুল এলে তাঁর কথা মনে পড়ে খুব। মনে হয়, পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। জানো মা, এই না-থাকাটাই সত্যি; থাকাটাই মিথ্যে। তাঁর শখের টেবল, ফার্নিচার, ঘড়ি, কলম সবই রয়ে গেছে। একইরকম। যত্ন করে রাখলে তারা থেকে যাবে আরও বহুশতবছর। কিন্তু যতই যত্ন করো, মানুষকে রাখতে পারবে না। এ পৃথিবীতে মানুষের মতো এত কম সময় বিধাতা বেশি প্রাণীকে দেননি।

 বারান্দায় পৌঁছে বললেন, একথা কেন মনে এল জানো? এই জন্যেই মনে এল যে, তোমাকে বলা দরকার যে, জীবনের টোটাল লেংথের মধ্যেও মাত্র অল্প ক-টি বছরই রিয়ালি ম্যাটার করে। বড়ো জোর বিশ পঁচিশ বছর। তার আগে যায় কল্পনায়। স্বপ্নে। তার পরে স্মৃতিচারণে। বাঁচতে হলে এই বেলা বাঁচো মা। সময় বড়ো কম।

যাই মাসিমা।

যাওয়া নেই। এসো মা।

নীচু হয়ে শ্রী প্রণাম করল। ওর দেখাদেখি ভরতও হাতের নুয়াগড়ের লাঠিটিকে পাশে শুইয়ে রেখে ভক্তিভরে প্রণাম করল কাঞ্চন দেবীকে। এম ডি সাহেবের মাকে।

একে তো চিনলাম না মা।

এ আমার বাহন, ভরত।

হেসে বলল শ্রী।

সরস্বতীর বাহন হাঁস, লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা, কার্তিকের বাহন ময়ূর। আর তুমি? তোমার দেবীর নাম কি গো ছেলে?

ভরত ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল চোখ দুটি তুলে বলল, শ্ৰী।

ওঁরা দুজনেই হেসে উঠলেন ওর কথা শুনে।

.

১৪.

বাড়িতে, মানে বোসদাদের বাড়িতে, ওদের ফেরা হয়নি। আবার, ওই বার–এই গিয়ে উঠেছিল। বাইরধরকে খাওয়ার টাকা দিয়ে খেয়ে নিতে বলেছিল গোপেন।

হুইস্কির হলুদাভার দিকে চেয়ে বসে গোপেন ভাবছিল, শ্রী কোথায় যেতে পারে? কোনো বিপদ-আপদ হল না তো! যারা এম ডিকে মেরেছিল তারাই শ্রীকে উঠিয়ে নিয়ে গেল না তো! ভানু মহাপাত্রর দোকানে বা প্রতিবেশীদের কাছে খোঁজ করা উচিত ছিল অতিঅবশ্য। তা না করে অভিমানের বসে সে বাড়ি থেকে ফিরে এল বলে নিজের ওপর রাগ হচ্ছিল গোপেনের। অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো হয়েছে কাজটা।

কালু বলল, খাচ্ছ না কেন গোপেনদা? খাও।

আমার এখুনি যেতে হবে. শ্রীর যদি কোনো বিপদ-আপদ হয়ে থাকে।

ছাড়ো তো! যত্ব নাই-ভাবনা। খাও খাও। খেতে খেতে অন্যসব কথা বোলো না। ওই দিকে তাকিয়ে দেখো, ওই কোনার টেবল-এ, মেয়েটার কেমন রিকি-ঝিকি ভাব। এমন মেয়ে দেখলেই ইচ্ছে করে যে…

আঃ। কালু।

বিরক্তির গলায় বলল গোপেন।

কালু তাতে দমল না। মদ, বড়ো-ছোটো, গুর-লঘু, ন্যায়-অন্যায়কে একসমতলে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। সেইদিক দিয়ে দেখলে মদের মতো কম-অনিষ্ট বা কম্যুনিস্টো জিনিস আর দুটি নেই। কালু নেশাগ্রস্ত হওয়াতে গোপেনকে আর সম্ভ্রমের চোখে দেখছিল না।

চলো এবারে।

গোপেন বলল।

কোথায় যাবে? তোমার বাহন তো খেতে গেছে। সেও কি একটু পানমৌরী বা সল্পর রস না টেনেই খাবার খাবে? আমাদের দেখে ইনসপায়ারড হয়েছে তো। এখন সে কতক্ষণে ফেরে তাই দেখো। তারপরে তো ফেরার কথা।

গোপেনের মুখে বিরক্তি ফুটছিল। অথচ বিরক্তি যে ঠিক কার প্রতি তা সে নিজেই বুঝতে পারছিল না। গোপেনের মনে হচ্ছিল যে তার জীবনে কোনো বিশেষ ঘটনা আজ ঘটবে। সকাল থেকেই মনে হচ্ছিল। কী যে ঘটবে, তা ও বলতে পারছে না। কিন্তু ঘটবে। এক ধরনের অস্থিরতা তাকে বারবার বিস্রস্ত করে দিচ্ছিল। তাসের বোর্ডে এমন করে হারা, তারপর দীপার চিঠিটা পড়া তারওপর কালুর সঙ্গে বসে এমন মদ্যপের মতো মদ খাওয়া এই সবের কিছুরই কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছিল না সে। এই বিস্রস্তার সুযোগেই তার মধ্যের চিৎ মদ্যপটা তাকে আজ এমন করে কবজা করেছে। লজ্জিত সে যেমন হচ্ছে, তেমন বিচলিতও। দীপার চিঠিটার কথা বারবার মনে পড়ছে এবং আশ্চর্য, দীপার ঝকঝকে, সুশ্রী, উজ্জ্বল দীপ্ত চোখদুটির কথাও। আরও আশ্চর্য এই যে, একবারও শ্রীর কথা মনে পড়ছে না। সম্পূর্ণ বিনা কারণেই নিজের স্ত্রী শ্রীর প্রতি এক ধরনের বিরূপতা বোধ করছে ও।

আজকে কালুই বা এমন করে তার সঙ্গ ধরল যে কেন, তারও কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছে না গোপেন। এই সব ব্যাখ্যাহীনতার মধ্যে দিয়ে একটি অস্পষ্ট ব্যাখ্যা তার মনে উঁকি মেরেই পালিয়ে যাচ্ছে। উঁকি মারার আর উঁকি মারার সঙ্গে সঙ্গেই সে অত্যন্ত মথিত ও উত্তেজিত বোধ করছে। আর উঁকি মেরে পালিয়ে যাওয়ার পরই আবার এক ধরনের ভোঁতা স্বস্তিতে জবুথবু হয়ে যাচ্ছে।

এখন রাত প্রায় বারোটা বাজে। লাস্ট-ড্রিঙ্কের অর্ডার নিয়ে গেছে বেয়ারা।

এবারে বার বন্ধ হবে। ক্লান্ত বেয়ারা, মাতাল খদ্দেররা, এবং সঙ্গী জুটোতে না পারা একটি নষ্ট মেয়ে, যে অগণ্য পুরুষদের নানাধরনের ভ্রষ্টতা থেকে প্রতিরাতে বাঁচায়, লন-এর পাশেই বাড়ির দেওয়ালে ঝোলানো বড়ো ঘড়ির কাঁটার দিকে মনোযোগী চোখে চেয়ে আছে।

একচুমুকে বটমস-আপ করে গোপেন বলল, চলো।

কালুও বললো চলো।

এবারে যখন গোপেনের বাড়ির সামনে গিয়ে জিপটা পৌঁছোলো তখনও বাড়িতে কোনো আলো দেখা গেল না প্রথমে। তারপরে ভালো করে লক্ষ করে দেখল গোপেন যে, বসবার ঘরের মৃদু আলোটি জ্বলছে। এবং রান্নাঘরের দিক থেকেও আলোর আভা ঠিকরে বেরুচ্ছে।

আছে।

স্বগতোক্তির মতো বলল কালু।

 তুমি কি ভেবেছিলে? নেই?

অত্যন্ত বিরক্তির গলায় বলল গোপেন। সমস্ত পৃথিবীর ওপরেই ও প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে উঠেছে।

না, তা নয়। তবে মেয়েছেলেদের ব্যাপার। কিছু কি বলা যায়। এই আছে, এই নেই। বিয়ে করলে কী হয় গোপেনদা, মেয়েছেলে কিছু ঘাটাঘাঁটি করেছি এই লাইফে।

এমন করে কথাটা বলল কালু, যেন ক্লেদ বা ময়লা ঘাঁটাঘাঁটির কথাই বলছে। কালুর কথার ধরনটা ভালো লাগল না গোপেনের। পৃথিবীর সব মেয়ের প্রতিই ওর গভীর শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি আছে। অথচ কেন যে, তা নিয়ে কোনোদিনও মাথা ঘামায়নি ও! মেয়েদের প্রসঙ্গ ওঠাতে কলকাতার আদি বাসিন্দারা যে কখনো কখনো এই মেয়েছেলে কথাটা ব্যবহার করেন এটাও গোপেনের একেবারেই পছন্দ নয়।

জিপটা ঘোরাচ্ছিল বাইধর। টেইল-লাইটটার লাল-এর ঝলক দেখিয়েই জিপটা মিলিয়ে এল টাউনশিপ-এর দিকের পথের বাঁকে।

বাইকধরকে ও যে আজ এত রাত অবধি আটকে রেখেছিল সে কারণে কোনো অপরাধও বোধ করল না।

দরজার সামনে গিয়ে পৌঁছোবার আগেই ভরত এসে দরজা খুলে দিল। দেখে মনে হল, বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল।

কোথা গেছিলি? তোরা?

এম ডি সাহেবের বাংলোয়।

তোর বউদি কোথায়?

বসবার ঘরে। আপনি খাবেন না? আজ ধোঁকার ডালনা বেঁধেছিলাম।

না। তুই শুয়ে পড়।

 বউদি তো খাননি এখনও।

কেন?

আপনি আসেননি।

ঢং।

 ভরত গোপেনের এই ভাবান্তরে একটু অবাক হল। গোপেনকে এই অবস্থাতে আগে কখনোই দেখেনি। গোপেন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না। রেলিং ধরে ধরে কোনোক্রমে দোতলাতে উঠে এসেছিল। ভরত চলে গেল সামনে থেকে।  

বসার ঘরে বসে শ্রী একটি বই পড়ছিল।

শ্রী মুখ তুলে বলল, কী ব্যাপার! আজ এত দেরি। কোথায় কাটালে সারাদিন এবং রাতের আধখানা?

তুমি কোথায় গেছিলে? সেকথা আগে শুনি। একবার এসে তো ফিরে গেলাম। এরকম না বলে-কয়ে উধাও হয়ে যাবার মানে কী? ভরতকেও সঙ্গে নিয়ে গেলে কোন আক্কেলে?

শ্রী জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল।

কী হল! কথা বলছ না যে! খুব স্বাধীন হয়ে গেছ দেখছি।

পরাধীন তো কখনো ছিলাম না। স্বাধীনতার প্রমাণ কখনো দাখিল করিনি বলেই বুঝি ভেবেছিলে আমি পরাধীন? এর আগে হয়তো সে প্রমাণ দাখিল করার প্রয়োজন হয়নি।

সুমন সেনের বাড়িতে গেছিলে কেন?

 ওঁর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে।

হঠাৎ?

হঠাৎ আবার কী! ছেলের অমন অবস্থা! মায়ের সঙ্গে সে জন্যেই দেখা করা প্রয়োজন মনে করেছিলাম।

আমাকে ডিঙিয়ে লাফিয়ে যাবার কী দরকার ছিল? আমাকে বললে তো আমিই নিয়ে যেতাম। আমাকেও তো উনি চেনেন।

হ্যাঁ। তাই তো বললেন! তবে আমার সঙ্গে বহুদিনের চেনা জানা তো! তুমি সঙ্গে থাকলে উনি নিজেকে খুলতে-মেলতে পারতেন না।

তোমার সঙ্গে কতদিনের চেনা?

 বহুদিনের।

 তা হলে সুমন সেনকেও চিনতে?

শ্ৰী মাথা নামিয়ে বলল, হ্যাঁ।

এতদিন তাহলে এত নাটক করলে কেন আমার সঙ্গে?

নাটক করলাম?

অবাক-হওয়া গলায় শ্রী বলল, মুখ তুলে।

তা ছাড়া কী?

নাটক করছি ভেবে নাটক করিনি। আমি আগে জানতাম না যে, ওঁকে আমি চিনি। মানে, এই সুমন সেনই…

ন্যাকামি করার আর জায়গা পাওনি?

শ্রী গোপেনের মুখচোখের ভাব এবং ভাষাতে স্তব্দ হয়ে গেল। গোপেনের অনেকই অপূর্ণতা ছিল। কিন্তু তার মধ্যে অভদ্রতা ছিল না। চুপ করে চেয়ে রইল শ্রী গোপেনের মুখে চেয়ে।

গোপেন আবার বলল, সব ব্যাপার খুলে বলো। নইলে ভালো হবে না কিন্তু।

তুমি আজ অসুস্থ। আজকে চান করে, খেয়ে, শুয়ে পড়। কাল সব বলব। তুমি আজকে সব শুনলেও তুমি বুঝতে পারবে না। কিছুই বুঝতে পারবে না। তুমি অপ্রকৃতিস্থ আছ।

অপ্রকৃতিস্থ?

বলেই, গোপেন শ্রীর কাছে এগিয়ে এসে ওর হাত দুটি চিতার থাবার মতো শ্রীর দু-কাঁধে রেখে বলল, আমি এখুনি শুনব। বল।

না। এখন কিছুই বলব না। এমন অভদ্র মানুষের সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই। তুমি তো কোনোদিনও এমন ছিলে না।

ছিলাম। কী জানি! হয়তো ছিলাম না। তুমিই আমাকে এমন করেছ। প্রত্যেক পুরুষই অভদ্র। কেউ কেউ ভদ্রতার মুখোশ পরে থাকে। তেমন সংকটে পড়লেই সে মুখোশ খুলে পড়ে। সহজেই খুলে পড়ে।

তোমার ভদ্রতাও মুখোশ ছিল?

হ্যাঁ। মুখোশ ছিল। মুখোশের ভারে মুখ আমার কেটে গেছে। আজকে নিজের মুখ দেখা ও দেখানোর সময় এসেছে।

দেখো। কিন্তু দেখাবার প্রয়োজন নেই কোনো।

বলতেই, ঠাস করে একচড় মেরে দিল গোপেন শ্রীর গালে।

স্তম্ভিত হয়ে গিয়ে শ্রী উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ছোটোলোক।

আমি ছোটোলোক! তুমি একটি নোংরা মেয়ে। বাজে। বাজে। বাজে।

শ্রী কোনো কথা না বলে দৃপ্ত ভঙ্গিমায় উঠে দাঁড়াল সোফা ছেড়ে। বলল, এনাফ ইজ এনাফ। ইটস রিয়্যালি এনাফ।

গোপেন টলতে টলতে শোওয়ার ঘরে দিকে চলে গেল। এবং গোপেন চলে যেতেই গুটি গুটি ভরত ঢুকল এসে ঘরে। সমব্যথীর চোখে তাকাল শ্রীর মুখে। ভরতের দু-চোখ জলে ভরে এল। এতক্ষণ গোপেনের এমন ব্যবহারেও শ্রীর মুখে তেমন কোনো বৈকল্য ঘটেনি কিন্তু ভরতের চোখের জল শ্রীকে অভিভূত করল। বড়ো বড়ো চোখের পাতা ভিজিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে গেল শ্রীর গাল বেয়ে।

শ্ৰী বলল ভরতকে, কাঁদবার কী হয়েছে? অ্যাঁ? কাঁদবার কী হয়েছে?

ভরত ভাবল, শ্রী নিজের দুঃখেই কাঁদছে। কিন্তু শ্রী জানত যে গোপেনের দুঃখর কাছে তার নিজের দুঃখটা কিছুই নয়। সত্যি কথা বলতে কী, তার দুঃখের চেয়ে সুখের মাত্রা অনেকই বেশি ছিল। এবং সেই কারণেই গোপেনের কথা ভেবে তার দুঃখ হচ্ছিল। শ্ৰী বুঝল হঠাৎ করে যে তাদের দাম্পত্য-সম্পর্কটা এমনিতে শীতের দিনেরবেলার মতো, নিস্তরঙ্গ ছিল তাতে সুর্যোদয়, সূর্যাস্ত, চাঁদ আর তারারা প্রতিবিম্বিত হয়েই তাকে চরিত্র দান করেছিল। হয়তো এমনিতে তার নিজস্ব চরিত্র বলতে কিছু ছিল না। কিন্তু ঝড় যখন উঠল তখন শান্ত নির্লিপ্ত দাম্পত্যর চেহারাটা আমূল বদলে গেল। সেই শান্ত মাধুর্যে বহুবছর অভ্যস্ত থাকার পর তার ভয়াবহ অচেনা রূপে দু-পক্ষই চমকে উঠল। অবাক হয়ে গেল শ্রী, এবং হয়তো গোপেনও একথা জেনে যে, যে-সম্পর্ককে চিরদিনের বলে মেনে নিয়ে ফুলশয্যার রাতের পর থেকে সহজসুখে নিশ্চিন্ত ছিল সেই সম্পর্কের ভিত এত বছরেও যথেষ্ট দৃঢ় হয়নি। কী আশ্চর্য। কথাটা মনে পড়ল, দা স্ট্রেন্থ অফ আ চেইন ইজ ইটস উইকেস্ট লিঙ্ক।

ভরত বলল, দাদাবাবু খাবে না বলেছে।

আমিও খাব না। তুই খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়।

 আমিও খাব না।

 ভরত বলল, মুখ গোঁজ করে।

তবে খাস না।

আজ রাতে কারো সঙ্গেই আর বেশি কথা বাড়ানোর ইচ্ছা ছিল না শ্রীর।

চান করে ওঠার পর কী করল গোপেন, তা বোঝা গেল না। গোপেনের আর সাড়া শব্দও পাওয়া গেল না। শ্ৰী বসবার ঘরের সোফাতেই শুয়ে পড়ল আলো নিভিয়ে দিয়ে। ঘরের আলো নিভতেই বাইরের আলোর আভা ধীরে ধীরে ঘরকে ভরে দিল। পাখাটা নিভিয়ে দিতেই গভীর রাতের নিজস্ব সব অস্ফুট শব্দ বইরে থেকে এসে ঘরের দখল নিল। নীড়ের পাখির নড়াচড়ার ডানা-ঝাঁপটানোর শব্দ। দূরের কুয়োতলির বালতি এবং জলের শব্দ। রাতের শব্দর সঙ্গে রাতের গন্ধও এসে ঘর ভরে দিল। হুরহুলাগড় স্টেশানের ইয়ার্ডে মালগাড়ি শান্টিং-এর আওয়াজ রাতের নিস্তব্ধতাকে মথিত করে হুড়গুম দুরগুম শব্দ করে উঠল। তেমনই শব্দ শুনল শ্রী তার নিজের বুকের মধ্যেও। নৈঃশব্দ্যর শব্দ, শব্দর শব্দর চেয়ে অনেক বেশি প্রকট হল। সুমনের মুখটা ভেসে উঠল, ওর চোখের সামনে। এবং পরক্ষণেই গোপেনের মুখও। বড়ো কষ্ট হতে লাগল শ্রীর বুকের মধ্যে। পাশ ফিরে শুল ও। কষ্টটাকে বুক চাপা দেওয়ার জন্যে। কিন্তু সোফাতে পাশ ফিরে স্বচ্ছন্দ হওয়ার মতো যথেষ্ট জায়গা ছিল না। তাই আবার চিত হয়ে শুল। বাগান থেকে নানারকম ফুলের, পাতার, অসম বয়েসি পুরুষের উরুর মতো নানা গড়নের কান্ডর, শাখাপ্রশাখার মিশ্র গন্ধ ভেসে আসছিল রাতের গায়ের নিজস্ব গন্ধর সঙ্গে। শ্রীর ভবিষ্যৎ জীবনের গন্ধও। সেও মিশ্র গন্ধ। তবে সেই মিশাল এর রকম বোঝা যায় না।

শেষরাতে শীত-শীত করছিল। জোর করে সোফা ছেড়ে উঠে শোবার ঘরে গেল শ্ৰী একটি চাদর আনবার জন্যে। ঠিক তখুনি পেটা ঘড়িতে তিনটে বাজল।

বাথরুমের আলোটা নেভায়নি গোপেন। খাটের এককোনাতে চিত হয়ে অজ্ঞানের মতো শুয়ে ছিল সে। একটি হাত এবং একটি পা খাট থেকে ঝুলে ছিল। বিচ্ছিরি আওয়াজ করে নাক ডাকছিল সে। ড্রিঙ্ক করাতে হুঁশ না থাকায় শুধু গায়ে পায়জামা পরেই শুয়েছিল গোপেন। পাঞ্জাবিটি খাটের পাশে মেঝেতে পড়েছিল। বাথরুম থেকে আলো এসে গোপেনের মুখে পড়েছিল। চাদরটা তুলে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল খাটের ধারে শ্রী। বড়ো অসহায় দেখাচ্ছিল তাকে। ঘুমন্ত গোপেনের দিকে চেয়ে শ্রীর মন গভীর রাত্রে কবোষ্ণ নীড়ের মধ্যে হঠাৎ নড়াচরা করে-ওঠা পাখির মতো নড়ে-চরে উঠল। নিজেকে বোঝে না ও। এর আগে নিজেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝার এমন প্রয়োজনও আর বোধ করেনি সে এমন তীব্রভাবে। নিজেকে ওর গোপেনের চেয়েও অনেক বেশি অসহায় বলে মনে হল।

 সব রাতই পোহায়। সুখের রাত, দুখের রাত, ফুলশয্যার রাত : বৈধব্যর রাত। এই তীব্র মিশ্র অনুভূতির, আধো-ঘুম আধো-জাগরণের রাতও একসময় পোহাল। শ্রী বাথরুমে গিয়ে ফিরে এসে ছাদে গেল। গোপেন এখনও ঘুমুচ্ছে। অনেকক্ষণ ঘুমুবে আজ ও। মাতাল হওয়াটা যাদের অভ্যাসের মধ্যে পড়ে না তাঁদেরই মত্তাবস্থা কাবু করে সবচেয়ে বেশি। যখন করে।

ভরতও ঘুমোচ্ছ। শ্ৰী এবং গোপেনের জীবনের হঠাৎ-ওঠা তরঙ্গমালার ছোঁয়া ভরতকেও লেগেছে। আজ সেও ঘুমোবে অন্যদিনের চেয়ে অনেকক্ষণ বেশি।

.

১৫.

পারিজাবাবু বললেন, আজকে হাসপাতালে গেলেন না স্যার?

না:।

গোপেন বলল।

বিকেলে যাবেন?

ভাবছি বিকেলেও যাব না!

কেন?

এম ডিকে দেখতে যাওয়ার লোকের কি অভাব? তা ছাড়া হাসপাতালে ভিড় করাটা আমাদের দেশেই প্রথা; নাম প্রেজেন্ট করার, নাম কেনার। ভ্যাগাবণ্ডদের দেশ তো!

সেকথা নয়। এতদিন তো আপনি বলতে গেলে হাসপাতালেই হত্যে দিয়ে পড়ে রইলেন। আপনি তো আর ভ্যাগাবণ্ড নন! তা ছাড়া এম ডি আপনাকে কাছে চান বলেই তো অন্য ডিরেক্টরেরা আপনাকে যেতে বলেন।

গেছি তো রোজই। হাসপাতালের পরিবেশে আমি অসুস্থ বোধ করি। ক্রাইসিস তো বলতে গেলে কেটেই গেছে।

তা গেছে। কিন্তু শুনতে পাচ্ছি সাইকো-সোমাটিক ডিজিজের ভয় দেখা দিয়েছে।

 সাইকিক রোগ আমাদের সকলেরই আছে। আজকের দিনে মানসিক সুস্থতা কি একজনও শারীরিকভাবে সুস্থ মানুষের আছে?

তা ঠিক।

 বলেই, পারিজাবাবু তর্কে নিবৃত্তি দিলেন। বুঝলেন যে, আজকে ব্যানার্জিসাহেব তর্কে হারবেন না বলে মনস্থ করেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন। তবে ব্যানার্জিসাহেবকে দেখে পারিজাবাবু একটু অবাকও যে হলেন না, তাও নয়। কী একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে মানুষটার মধ্যে। একদিনের মধ্যে।

 পারিজাবাবু চলে যেতেই গোপেন কাজে মন দিল। সকালে চান করেই বেরিয়ে এসেছিল। বাড়িতে ব্রেকফাস্টও খায়নি। আজ অফিসে বসেই কাজ করছে। শপে যায়নি একবারও। কাজ করছে বটে কিন্তু কাজে মোটে মন বসছে না। হুরহুলাগড় ইন্ড্রাট্রিজ, এবং এম ডি সুমন সেন এতদিন তাকে ভীষণভাবে পেয়ে বসেছিল। শ্রী কত ঠাট্টা করেছে একদিন গোপেনকে নিয়ে। আজও নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছে। তবে ঠাট্টার রকমটা ভিন্ন। তার কাজ, তার কোম্পানি, তার ম্যানেজিং ডিরেক্টর কিছুরই আর বিশেষ কোনো ভূমিকা নেই গোপেনের নিজের কাছে। ও বুঝতে পারছে যা ওর নিজের জগৎ, তা ওকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। ও-ই সেই জগতের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। আজকে সেই জগতের চেহারাটা পুরোপুরিই পালটে গেছে। এবং পালটে গেছে বলেই অন্য কিছুরই দাম নেই আর বিন্দুমাত্র।

হ্যালো।

আমি বলছি।

কে?

আমি শ্ৰী।

শ্রীর গলা সত্যিই চিনতে পারেনি গোপেন। নিজেই অবাক হয়ে গেল গলা চিনতে না পারায়।

আমি শ্রী।

শ্ৰী আবারও বলল।

কোত্থেকে?

 ভানু মহাপাত্রের দোকান থেকে।

কী চাই?

কিছুই চাই না। সকালে কিছু না খেয়ে চলে গেলে কেন? আমি ছাদে ছিলাম। এককাপ চা ও তো খেলে না! জিপ নিয়ে বাইধর এসেছে। আমি তাকে বসিয়ে রেখেছি।

কেন?

আমি একটু হাসপাতালে যাব। সুমনকে দেখতে। ওকে নিয়ে যেতে পারি কি? বারোটা সাড়ে বারোটা নাগাদ বাড়ি ফিরেই ওকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিলে হবে?

হাসপাতালে যাবে? একা?

একা কেন? ওখানে তো কত লোকই থাকবেন। সুমনের মাও থাকবেন।

 গেলে যাবে। তা আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? আমার অনুমতির কি দরকার আছে কোনো?

নিশ্চয়ই নেই। আমি তো কিণ্ডারগার্টেনের ছাত্রী নই। তোমার গাড়িটা আটকে রাখব, তোমার অসুবিধা হবে কি না সেই কথাই শুধু জিজ্ঞেস করছিলাম। তোমার গাড়ি না পেলেও আমাকে যেতে হবে। মাসিমা বলেছিলেন, বললেই তিনিই গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন।

মাসিমাটি কে?

 সুমনের মা। তাঁর নাম কাঞ্চন।

ওঃ। তাহলে তাঁকেই বল না।

তাই বলব। তবে বাইরের সঙ্গে হাসপাতালে পোঁছেই তোমার কাছে ওকে পাঠিয়ে দেব। কাল থেকে ওঁকেই বলব গাড়ি পাঠাতে। তোমাকে আর বিরক্ত করব না।

শ্রী আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু অসহিষ্ণু গলায়, ঠিক আছে বলেই, রিসিভারটা নামিয়ে রাখল গোপেন।

ফোনটা আবার বাজল।

 হ্যালো।

আমি শ্ৰী বলছি। ফোনটা অমন ভাবে রেখে দিলে কেন? কাল রাতের অভদ্রতা, অসভ্যতা সহ্য করেছি বলে মনে কোরো না যে, বারবার করব।

আবারও গোপেন রিসিভারটা নামিয়ে রাখল। এবার আরও জোরে। ঘটাং শব্দ করে।

আবার বাজল ফোনটা।

দাঁতে দাঁত চেপে চিলের মতো ছোঁ মেরে রিসিভারটাকে তুলে খুব গম্ভীর গলায় গোপেন বলল, হ্যালো!

গোপেনদা? আমি কালু বলছি।

একইরকম বিরক্তির গলায় গোপেন বলল, বল।

এই কালুর জন্যই কাল ড্রাঙ্ক হয়ে গেছিল গোপেন এবং শ্রীকে চড় মেরেছিল। তার ভেতরের অন্য এক অজানা গোপেন বেরিয়ে পড়ে বড়োই মুশকিলে ফেলেছিল গোপেনকে।

হাতপাতালে যাবে না?

না।

 কেন? কী হল? বউদির সঙ্গে রাগারাগি করেছ বুঝি রাতে?

কাজের কথা থাকলে বল।

এ তো কাজের কথা। মনে হচ্ছে, রাগারাগি করেছ। আজকে আমি লাঞ্চ-এর সময় অবধি কারখানা করে ছুটি নিচ্ছি।

কেন?

এমনিই। কাজ করতে ভালো লাগে না। সুমন সেন-এর নামের জন্য অনেক করেছি। কোন পাবলিক সেক্টর কোম্পানিতে এত কাজ করে লোকে? বেশির ভাগ কোম্পানিতেই তো কোটি কোটি টাকা লস।

আমরা যে প্রফিট করে দিচ্ছি এত, তাতে আমাদের কী লাভ?

 তুই তো রাম পালের মতো কথা বলছিস দেখছি। তুইও কি ওদের সঙ্গে ঘোঁট পাকাচ্ছিস?

ফু:। সেটা পাকাতে হলে আমি একাই পারি। কারো সঙ্গই দরকার হয় না। তবে ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবা দরকার। সেনসাহেব চোখের সামনে থাকলে এ চিন্তা মাথায় আনাও মুশকিল ছিল। কিন্তু কথায় বলে না out of sight, out of mind! তাই এখন ভাবছি। আমরা সকলে সেনসাহেবের spell-এর মধ্যে আছি। ঘোরের মধ্যে। ওঁর বশীকরণ মন্ত্র বশীভূত। তুমি কী এল?

আমি আর কী বলব? কাজ তো মানুষে নিজের আত্মসম্মানের জন্যেই করে বলে জানতাম। কাজ যারা করে না, অথচ মাইনে নেয়, তারা মানুষই নয়। নিজের সন্তুষ্টির জন্যেই কাজ করি আমি। সুমন সেনের জন্যে নয়।

ভেবে দেখো আমার কথাটাও। আমি লাঞ্চ-এর সময়ে বেরিয়ে যাব চামুন্ডি মন্দিরে। বহু দিন যাইনি।

হঠাৎ।

না। মনটা বড়ো উচাটন হয়েছে।

কেন? মাঝে মাঝেই আমার এমন হয়। কী যেন কামড়ায় আমাকে। নিজের বেয়ারিং কারেক্ট করার সময় আসে।

গোপেন চুপ করে রইল। কালু আবার বলল, হাবিব থেকে কাবাব পরোটা নিয়ে নেব। ভোদকার বোতল নেব। ওখানে…

মন্দিরে কাবাব পরোটা আর ভডকা?

 মন্দিরের মধ্যে কে ঢুকছে! আমি ভগবান-ফগবান মানি না। মন্দিরের মধ্যে কী আছে জানি না। জানতে চাইও না। তবে মন্দিরের চারপাশের বন-পাহাড়ের দৃশ্য অতিচমৎকার। ঝরনাও আছে। ঝরনার পাশে কোথাও বসব জঙ্গলের মধ্যে। মনটা শান্ত হয়ে যাবে। বড়ো শান্তি বনে। জঙ্গলে, বড়ো বড়ো গাছের নীচে। জানো গোপেনদা। মাইরি বলছি।

যাবি কীসে করে? কেন?

আমার স্কুটার নেই যেন।

 খেয়ে-দেয়ে স্কুটার চালিয়ে ফিরবি? উলটে মরবি পাহাড়ি পথে।

তা আর কী করব। গাড়ির মালিক হয়ে তারপর মাল খেতে হলে তো জিন্দগি কাবার হয়ে যাবে গো আমার। যাই হোক, তোমাকে জানিয়ে রাখলাম। আমি ঠিক একটাতে বেরোব। কার্তিক মাস যেমন কুকুরদের সিজন, মে মাস যেমন রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইয়েদের সিজন; তেমনই এটা হচ্ছে আমার মাল খাওয়ার সিজন।

ফিরবে কখন? গোপেন শুধোল।

রাতের বেলা ফিরব। শুক্লপক্ষ এখন। জ্যোৎস্না থাকবে। জ্যোৎস্না বলে একটি মেয়ে আমাকে ডরি দিয়েছিল। যখন অ্যাপ্রেন্টিস ছিলাম। শুক্লপক্ষের রাতে বনের মধ্যে গেলেই সেই শালিকে আমি আমার কাছে, খুব কাছে অনুভব করি। সে চলে গিয়ে চিরদিনের মত আমারই হয়ে আছে। মন অশান্ত হলেই বনে যাবে, দেখবে মন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। জল ছড়ানো শেতল-পাটির মতো। ছাড়লাম।

বলেই, কটাং করে রিসিভার নামিয়ে রেখে দিল কালু।

 রিসিভারটা নামিয়ে রেখেই গোপেনেরও মনে হল সুমন সেন-এর জন্যে শুধু কালুই নয়, রমেনই নয়, যাকে ও স্যাক করেছিল; ও নিজেও একটু বাড়াবাড়ি করছে। ওরা তো সকলেই কম্পোনেন্টসই মাত্র। কৃতিত্ব তো সুমন সেনেরই একার। তাদের কথা আর কে জানবে, কে অ্যাপ্রিশিয়েট করবে?

ফোনটা উঠিয়েই কালুর ডিপার্টমেন্টের লাইন চেয়ে বলল, কালু স্কুটার নিস না। বাইধরকে নিয়ে আমি যাব। দু-বোতল ভডকা নিস। আমি খাওয়াচ্ছি আজকে। কাল তুই খাইয়েছিলি। কাবাবের সঙ্গে চাঁপও নিস। আমি একটার সময়ে তোকে তুলে নেব। মহুয়া গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে থাকিস।

কোন মহুয়া গাছ গোপেনদা?

কো-অপারেটিভ স্টোরের সামনের।

আচ্ছা।

আজকেও ও ড্রাঙ্ক হয়ে বাড়ি ফিরবে। ঠিক করল গোপেন। এই মুহূর্তে এর চেয়ে খারাপ অথবা ভালো কিছু করার নেই বলে। মদ খাওয়া বা ড্রাঙ্ক হওয়ার মধ্যে কোনো বাহাদুরি তো নেই-ই বরং এক ধরনের লজ্জা আছে। সেই কথাই গোপেন জানত চিরদিন। ও হঠাৎ এমন করছে কেন, তা নিজেই বুঝতে পারল না। সময়মতো কালুও যে কেন তার গায়ে জোঁকের মতো সেঁটে গেল এ রহস্যও বুদ্ধির বাইরে।

বাইধরকে আসতে দেখল কিছুক্ষণ পরে। জিপটা পার্ক করিয়ে বাইধর ঘরে এল। গোপেন বলল, তুমি খেয়ে নাও। আমি একটা বাজতে পাঁচ মিনিট আগে বেরোব। তেল আছে তো? জিপে?

কোথায় যাবেন?

ন্দির। যাওয়া-আসা হবে? যাবে?

হ্যাঁ স্যার।

তবে যাও।

 মেমসাহেব এই চিঠিটি দিয়েছেন।

 বলেই, বুক পকেট থেকে একটি মুখবন্ধ সাদা খাম বের করে দিল বাইধর গোপেনকে।

মেমসাহেব হাসপাতালে গেছেন?

হ্যাঁ।

ফিরবেন কী করে?

তা তো জানি না। তবে বললেন, আমাকে যেতে হবে না।

ঠিক আছে।

বাইধর চলে গেলেই চিঠিটা খুলল গোপেন।

প্রীতিভাজনেষু, একজন মারাত্মকরকম আহত, মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষকে দেখতে যাওয়ার এবং তাঁর মাকে দেখতে যাওয়ার মধ্যে এমন কী অপরাধ থাকতে পারে তা আমার বুদ্ধির বাইরে। তুমি তো আমাকে কত দিন বলেছ সুমন সেনকে দেখতে যাওয়ার জন্যে। সুমন সেন যে আমার পূর্বপরিচিত তা তো আমি আগে জানতাম না। কিন্তু পূর্বপরিচিত হলেও তাতে তোমার বিশেষ উম্মার কী কারণ তাও আমার বুদ্ধির বাইরে। নিজেকে আমার অবস্থায় ফেলেই বিচার কোরো। তাহলে বুঝতে পারবে আমার ব্যবহার স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক।

 তোমার দুর্ব্যবহার নিয়ে আমি কাল প্রায় সারারাত এবং আজ সারাটা সকাল অনেকই ভেবেছি। এখনও ভাবছি। আমি মনস্তত্ববিদ নই। কিন্তু আমার মনে হয় যে তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো বলেই সুমন আমার পূর্বপরিচিত ও বন্ধু জেনে তুমি ঈর্ষান্বিত হচ্ছ। তুমি ভয় পাচ্ছ।

 তোমার ও আমার বিয়েটাও হয়েছিল সম্বন্ধ করেই। দুজনেই দুজনকে প্রাণপণ সুখী করতে চেয়েছি। ফাঁকি যদি এই সম্পর্কের মধ্যে কোথাও থেকে থাকে সেটা আমাদের কৃত বা অকৃত কর্মর মধ্যে নয়। যাঁরা আমাদের অভিভাবক, তাঁরাই জানেন যে, ফাঁকি ছিল কি না।

 কিন্তু তুমি তো আমার প্রতি একদিনের জন্যেও দুর্ব্যবহার করোনি গোপেন। তোমার বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগও নেই। ছেলে-মেয়ে না-হওয়ার জন্যে দোষ যদি কিছু থাকে তা তো আমারও সমান। অন্তত এখন পর্যন্ত জানা যায়নি কার অক্ষমতার দরুন আমাদের সন্তান হয়নি।

আমাদের বিবাহিত জীবনে চিড় ধরবার মতো কিছু ঘটেছে বলে আমি মনে করি না। আমাকে তুমি কী ভাবো তা আমি জানি না। শুধু আমিই নই, বেশির ভাগ মেয়েই অত্যন্ত সংযমী। এবং হয়তো তোমাদের চেয়ে বেশি সৎ এবং কর্তব্যনিষ্ঠ। আমার বিরুদ্ধে তোমার অভিযোগ ঠিক কী এবং কেন, তা জানা আমার একান্তই দরকার। তা না জানিয়ে যদি কালকে রাতের মতো ব্যবহার আবারও কোনো দিন করো তাহলে তোমার সঙ্গে আমি আর নাও থাকতে পারি। তা যদি ঘটে, তবে তা ঘটবে অন্য কারো সঙ্গে থাকার জন্যে নয়, তোমারই দুর্ব্যবহারে।

একথাটা সত্যি বলে জেনো।

ইতি–শ্রী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *