২. অনেক রাতে

০৬.

অনেক রাতে ফিরল সেদিন গোপেন।

কেন এত রাত হল তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করল না শ্রী।

গোপেনই বলল, আমার খোঁজ করতে কেউ এসেছিল?

কে?

কোনো লোক?

না তো!

শোনো, আজকে কারখানাতে একটা ঘটনা ঘটেছে।

কী?

তোমাকে জানিয়ে রাখা দরকার।

 কী, বল না।

আমি একজনকে সাসপেণ্ড করেছি তিন মাসের জন্যে। তার নাম রমেন পাল।

 তো?

সে আমাকে থ্রেটন করেছে। পুরো হুরহুলাগড়-এর সমস্ত ইউনিটেই এর রিপারাকেশন পড়তে পারে। স্ট্রাইক হতে পারে। অন্যভাবে কাজের ক্ষতি করতে পারে ওরা। বাইরের লোক আছে এর পেছনে তবে তারা কারা বা কে তা জানতে হবে।

কী করে জানবে?

জানতে হবে।

তা তোমাদের এম ডি কি শুধু নাম কেনবার জন্যেই আছেন? ঝামেলা-ঝক্কি তো সব দেখছি তোমাদের মতো চুনোপুঁটিদেরই ঘাড়ে।

বাথরুমে যেতে যেতে গোপেন হাসল।

 বলল, তুমিও তো দেখছি রমেন পালের মতোই কথা বলছ। ঝামেলা-ঝক্কি এড়িয়ে যাবার মানুষ সুমন সেন নন। আমাদের জোরটা কি আমাদের জোর? সব জোরই আসে ওপর থেকে। এরকম স্ট্রং, ডেয়ার-ডেভিল, কুডনট-কেয়ার-লেস এম ডি না থাকলে কি হুরহুলাগড়ের নাম সারাওড়িশা কেন, সারাভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ত! তুমি কি জানো যে সুমন সেনকে পাবার জন্যে আই টি ডি সি, স্টেট ট্রেডিং কর্পোরেশন, আই এ সি, এইচ এম টি-র মতো কোম্পানিরাও ছটফট করছে? আমাদের এম ডি-কে স্লাইট কোনো না। হি ইজ অ্যান এক্সট্রা অর্ডিনারি পার্সন। এই তো, আজ বাড়ি ফিরছিলাম, তখন কটা বাজে? ন-টা হবে। আমাদের বাড়িরই একটু আগে, স্টেশানে যাবার আগে যে দোমহনীটা আছে তারই কাছে একটা মাটির ঘর থেকে বেরোতে দেখলাম এম ডি-কে। একটি কালো রঙের গেঞ্জি আর সাদা শর্টস পরে। সত্যি। মানুষটা যাই-ই পরুক না কেন এমনই মানিয়ে যায়।

তা সেই কুঁড়েঘরে কী করতে গেছিলেন তিনি? রক্ষিতা থাকে না কি সেখানে? না চোলাই মদ খেতে?

গোপেন আহত এবং অবাক হয়ে তাকাল শ্রীর চোখের দিকে। একটু চুপ করে থেকে বলল, ওর পার্সোনাল পিওনের বাবা-মা ওখানে থাকে। টাউনশিপের কোয়ার্টারে যায়নি তারা। একটু জমিজমা আছে কাছেই, তাই দেখাশোনা করে।

তাতে এম ডি-র কী?

আঃ। পুরোটা শোনোই-না। পিওনটির বাবা অসুস্থ। ডাক্তার সন্দেহ করছে ক্যানসার। তা বুড়ো কোয়ার্টারে কিছুতেই যাবে না। অথচ টাউনশিপের হাসপাতালের কাছে না থাকলে রে টে দেওয়ার অসুবিধা। ডাক্তার বলছেন, ওপেন করলেই, গ্যালপিং স্টেজে বেড়ে যাবে।

তা তোমাদের মহৎ এম ডি-র তাতেই বা কী?

তিনি বুড়োকে বোঝাতে এসেছিলেন। বুঝিয়ে ছেলের কোয়ার্টারে নিয়ে যেতে।

রাজি হল!

হল তো।

কাল আমি সকালে যাবার সময় বুড়ো-বুড়িকে আমার জিপে করে নিয়ে যাব। অবশ্য। শিব্বও আসবে সকালে।

এম ডি নিজের গাড়ি নিয়ে এলেন না কেন? কী গাড়ি তাঁর? মার্সিডিজ?

আগের এম ডি-র তাই ছিল। সেনসাহেব দিশি গাড়ি নিয়েছেন। সাদা কন্টেসা। প্লান্ট-এর মধ্যে অবশ্য মারুতি জিপসি চড়েন।

তারপর? কোন গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন?

না। গাড়ি নিয়ে আসেননি। এসেছিলেন সাইকেল চালিয়ে।

কেন?

হয়তো বিকেলের একসারসাইজটাও সারবার জন্যে। দ্বিতীয়ত, এম ডি জানেন কার কাছে কীসে করে যেতে হয়। সেই জন্যেই তিনি সুমন সেন।

ফু:। এই হিরো-ওরশিপিং-এর দেশে তোমরা পাথরকে দেবতা বানাও, বাঁদরকে শিব। তোমাদের মতো শিক্ষিত মানুষদেরও এসব ব্যাপারে কোনো ব্যালান্স থাকে না। অথচ থাকা উচিত ছিল।

গোপেন সেকথা গায়ে না মেখে বললো, ওই যা! তোমাকে বলাই হয়নি, উনি তো আমাদের বাড়িতে আজ এসেছিলেন।

আজ? কখন?

শ্রীর বুকের মধ্যেটা ধকধক করে উঠল।

শিব্বর বাবার বাড়ি যাওয়ার আগে।

তার মানে? ক-টা হবে?

ধরো, পৌনে-আটটা।

বাজে কথা।

বাজে কথা? এম ডি মিথ্যে বলবেন?

ভরত। এই ভরত।

ডাকল শ্ৰী ভরতকে।

 কী রে! আমরা স্টেশন থেকে ফেরার পর কোনো বাবু এসেছিলেন?

 হ্যাঁ।

আমি কোথায় ছিলাম?

 আপনি দরজা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে ছিলেন।

সন্ধেবেলা দরজা বন্ধ করে কেন?

গোপেন অবাক গলায় বলল।

আমার শরীর ভালো ছিল না। কিন্তু আমাকে ডাকলি না কেন?

বাবু মানা করলেন।

কী বললেন?

বললেন, দাদাবাবু যেদিন বাড়ি থাকবেন সেদিন এসে মেমসাহেবের সঙ্গে আলাপ করে যাবেন। এদিকে নাকি অন্য কোন কাজে এসেছিলেন।

শ্রীর তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না।

বললেন, কী পরে ছিলেন?

সাদা প্যান্ট আর কালো গেঞ্জি। দারুণ দেখতে বাবুকে। ফিল্মস্টারের মতো।

শ্রীর বুকের জ্বালাটা আরও বেড়ে গেল।

ভরতকে বকে বলল, সে তো তোর দাদাবাবুকেও তাই দেখতে।

যাঃ দাদাবাবু ভিলেইন। অন্যরকম। হিরো আর ভিলেইন কি এক হয়।

গোপেনের মুখে কোনো রাগ ছিলো না, একধরনের স্মিত হাসি ছিল। গোপেন বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করতে করতে বলল, ঠিকই বলেছে ভরত। ভরতের অবসার্ভেশন খুব শার্প।

বন্ধ দরজার মুখেই শ্ৰী বলল, খাবার কি লাগাতে বলব?

হ্যাঁ। চান করেই খাব।

চান হয়ে গেলে গিজারটা বন্ধ করে দিয়ে। নতুন লাগানো, আলোটা…

ঠিক আছে।

শ্রী রান্নাঘরে গিয়ে ভরতকে বলল, চটপট গরম গরম রুটি বানিয়ে ফেলতে। অন্য খারারগুলোওগরম করতে। একটু পায়েস বানিয়েছিল দুপুরে, সেটা ফ্রিজ থেকে বের করে দিতে বলল, মনে করে; খাবার সময়ে।

বাবু আর কী বলল রে ভরত?

কোন বাবু?

অন্যমনস্ক ভরত বলল।

 আঃ। যে বাবু এসেছিলেন।

বললেন, নাম জিজ্ঞেস না করে কখনো দরজা খুলবে না আর বউদি একা থাকেন, বউদিকে ভালো করে দেখাশোনা কোরো। বাড়িটা টাউনশিপ থেকে তো অনেকখানিই বাইরে দেখছি।

আর কী বললেন?

আমি বললাম, দরজা ধাক্কে বউদিকে ডেকে দিই?

উনি বলেন, আমাকে চেনেন না তো! যখন দাদা থাকবেন তখন আসব এখন একদিন। তারপর এইটে দিলেন।

কী?

ভরত তার প্যান্টের পকেট থেকে কার্ড বের করল একটা।

দিসনি কেন আগে?

সময় পেলাম কই? এমন পনস এনেছেন বাজার থেকে, পনস না যেন পাথর। এর চেয়ে লোহা গলানো সহজ ছিল।

পনস মানে কাঁঠাল, এঁচড় সবই।

 শ্রী বলল, পনস তো দুপুরেরই ছিল।

সেইটাকেই তো ভালো করে একটু গরম মশলা-টশলা দিয়ে নতুন করে বানালাম।

শ্রী কার্ডটি নিয়ে চলে গেল।

 বিশেষ কিছুই লেখা নেই। সুমন সেন, এম ডি, হুরহুলারগড় ইণ্ডাস্ট্রিজ লি:। অফিসের পি বি এক্স এর নাম্বার। নিজের ডাইরেক্ট নাম্বার। তারপর বাড়ির পিবি এক্স-এর নাম্বার। একই।

কার্ডটিকে ব্লাউজের ভেতরে চালান করে দিল শ্রী। নাম্বারগুলো লিখে রেখে পরে কার্ডটা গোপেনকে দিয়ে দেবে কাল সকালে। আজ বিকেলে জয়িতার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকেই, হুরহুলাগড়-এর এম ডি যে ওই সুমন সেন তা জানার পর থেকেই নিজের ওপর এক গভীর বিতৃষ্ণা আর বিরক্তি পুঞ্জীভূত হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। আর এক ধরনের ঘৃণা গোপেনর প্রতি। বেচারি গোপেন! কে এই সুমন সেন?

রাতে শুয়ে গোপেন বলল, আজ এম ডি বলছিলেন…

তোমার এই বাঁশবনের শেয়ালরাজা এম ডি ছাড়া আলোচনার কি আর কিছুই নেই? আমি তো ফেড-আপ হয়ে গেলাম।

কী অন্যায়! কথাটা শোনোই আগে।

 কী কথা?

উনি কলকাতার একজন গায়নাকলজিস্টের নাম সাজেস্ট করেছেন। বলেছেন, কোনো ব্যাপারই নেই। আট বছর কী, উনি পনেরো বছর, কুড়ি বছরের চাইল্ডলেস কাপলসদেরও…

 তুমি কী এল তো! এই সব পার্সোনাল ব্যাপারও কি তোমার এম ডি-র জুরিসডিকশানে পড়ে? কোন দিন শুনব সপ্তাহে কবে কবে তুমি আমাকে আদর করবে তাও তোমার এম ডি বলে দেবেন। তাঁকে তাঁর নিজের স্ত্রী আর ছেলে-মেয়েদের কথা ভাবতে বোলো। আমার ব্যাপারে মাথা ঘামানোর দরকার নেই কোনো। বিচ্ছিরি!

গোপেন লজ্জা পেয়ে চুপ করে রইল।

তারপর বলল, তুমি মিথ্যে রাগ করছ। উনি কি আর গায়ে পড়ে বলেছেন। কথায় কথায় বেরিয়ে গেল।

ওই তো কায়দা ওসব লোকের। দুশ্চরিত্র লোকেরা তো ওইরকম হয়। পরের বউ-এর নাড়ি-নক্ষত্র জানাই তো তাদের কাজ। তার ওপর নিজের বউকে ভিড়িয়ে দিয়ে এম ডি-র কাছে প্রোমোশান পাওয়ার লোকের তো অভাব নেই দেশে। তাঁর নিজের ছেলে-মেয়ে কী?

কী যে বল! ভদ্রলোক বিয়েই করেননি। তার ছেলে-মেয়ে! আমাকে হাসতে হাসতে বললেন : আ ব্যাচেলর ইজ আ স্যুভেন্যির অফ উওম্যান হু হ্যাড ফাউণ্ড আ বেটার ওয়ান অ্যাট দ্য লাস্ট মোমেন্ট।

তাই? বলেই, চুপ করে গেল শ্ৰী। বুকের মধ্যে খুব কষ্ট হতে লাগল।

গোপেন বলল, হ্যাঁ। তাই।

নিজেকে সামলে নিয়ে শ্রী বলল, দেখো গিয়ে, কোনো প্রেম-ট্রেম ছিল হয়তো। পাকেনি। তাই ব্যাচেলর রয়ে গেছেন। এই সব গে-ব্যাচেলরেরাই ডেঞ্জারাস হয়।

হ্যাঁ। যা খুশি তাই বললেই হল। মানুষটা কাজ ছাড়া আর কিছুই জানে না। এম ডি-র ঘরের দরজাতে কী লেখা আছে জানো?

কী?

ওয়ার্ক ইজ ওরশিপ। কাজই পুজো।

 ভড়ং যত। শ্রী বলল, পাশ ফিরে শুয়ে।

ঘরে একটা দারুণ পোস্টার আছে। একজন লোক পেছন ফিরে ছিপ ফেলে আছে, ঘন বনের মধ্যের একটি হ্রদে।

পোস্টার-এ কী লেখা আছে?

লেখা আছে, নার্থিং ক্যান ডিসটার্ব মি, বাট মাইসেল্ফ।

বাঃ।

লেখাটা ভালো। কিন্তু এটাও ভড়ং।

 সেনসাহেবের নাকি একটা প্রেমও ছিল।

বাঃ! জেনে আশ্বস্ত হওয়া গেল যে তোমাদের সেনসাহেব ভূত-ভগবান নন, নেহাৎই একজন মানুষ।

তারপরই বলল, তোমাকে কে বলল?

শ্রীর গলার স্বরটি কেমন টেন্সড শোনাল।

 গোপেন একটু অবাক হল।

ওই কোল-ওয়াশারির চাটুজ্যে বলছিল। কলকাতার ছেলে। সেন্ট জেভিয়ার্স-এ পড়ত। আমরা একসঙ্গে এন সি সি করতাম। আশুতোষ আর প্রেসিডেন্সি ছিলো এ কোম্পানিতে।

তা কী বলল?

ওরা নাকি একটা কাগজ বের করত প্রেসিডেন্সি ও সেন্ট জেভিয়ার্স-এর ছেলে-মেয়েরা মিলে। মান্থলি। সেই সুবাদে আলাপ। সুমন সেনের নাকি হার্টথ্রব ছিল ওরই ক্লাসের একটি মেয়ে।

নাম কী?

নামটা বলেছিল। কিন্তু ভুলে গেছি। সীমন্তী না শ্রীলা কী যেন।

তোমার এরকম ব্যাড টেস্ট হয়েছে কেন? এসব নিয়ে কোনো ভদ্রলোকে আলোচনা করে?

আরে আমি কী করব! লাঞ্চ খেতে খেতে বকর বকর করছিল। কলকাতার ছেলে তো। গোরুর যেমন জাবর না কাটলে ঘাস হজম হয় না, কলকাতার ছেলেদেরও তো না গ্যাঁজালে, পরনিন্দা-পরচর্চা না করলে ভাত হজম হয় না।

তোমাদের এম ডি লাঞ্চরুমে লাঞ্চ করেন না?

না:।

 উনি তো লিকুইডের ওপরেই থাকেন। নিজের ঘরেই ফ্রিজ আছে। ফ্রিজে হ্যাম, সসেজ, বেকন ইত্যাদি থাকে। ডিম। রুটি। নিজেই কিছু ভেজেভুজে নেন। সঙ্গে কোনোদিন একটু পিংক জিন। কোনোদিন জিন অ্যাণ্ড টনিক। কোনোদিন নিট-হুইস্কি। টাটকা টোম্যাটো থাকলে, কোনোদিন ব্লাডি-মেরি।

এই নইলে সাহেব।

সাহেব তিনি মোটেই নন।

 তোমার এই স্তবগান আর শুনতে চাই না।

আজ ভীষণ টেনশান গেছে। আজকে তোমাকে আদর করব। এসো।

দুম করে বলল গোপেন।

দূরে সরে গিয়ে শ্রী বলল, সিঙ্গাপুরে রাবার-ডল পাওয়া যায় শুনেছি। পূর্ণাবয়ব নারীমূর্তী। শরীরের যেখানে যা থাকার তার সবই আছে। শুধু মন থাকে না। একটা আনিয়ে নাও না কেন! আমি তো একটা মানুষ। পূর্ণ মানুষ। তোমার সেক্স আর আমার সেক্সটাই শুধু আলাদা। আমি তো ডল নই! আদর করার অনেকই রকম আছে। মেয়েদের বোঝে খুব কম পুরুষই! তুমি তো বোঝোই না!

তুমি অনেকই বদলে গেছ শ্রী।

তাই? তবে তুমিও।

তুমিই তো হুরহুলাগড়ে জবরদস্তি করে আনালে আমাকে, আমার শিকড় উপড়ে। অথচ তুমিই সবচেয়ে বেশি অনুযোগ করছ সবসময়। এল তো আবার ট্রান্সফার নিয়ে ফিরে যাই কলকাতাতে। এল?

যেতে পারো। তবে তোমাদের বাড়িতে আমি আর গিয়ে উঠব না। কোম্পানি যদি আলাদা ফ্ল্যাট দেয় তবেই যেতে পারি। তোমাদের পৈত্রিক বাড়িতে অনেক মার্বেল, মেজাইক আছে, ল্যাজারার্স কোম্পানির ফার্নিচার : কিন্তু অনেক অনাচার, অনেক কুশিক্ষা, অনেক গোঁড়ামি বাসা বেঁধে আছে সেখানে পায়রাদের বাসার মতন। ওখানে আমি আর যাব না। আমাকে এখানেই একটা চাকরি জুটিয়ে দাও না। তোমার ওল-পাওয়ারফুল গডফাদার এম ডি কে বলে।

উনি নিজেই তো সেদিন বলছিলেন।

কী?

এবারে এদিকে পাশ ফিরে শুল শ্ৰী। উত্তেজিত দেখাল একটু। আধো-অন্ধকারেও। মনে হল গোপেনের।

উনি বলছিলেন, তোমার মতো বিদুষী মহিলা নিজে স্বাবলম্বী হবেন না কেন?

গোপেন বলল।

ও। সে ভাবনাটাও তোমার এম ডি-ই ভাববেন বুঝি! বেশ আছ কিন্তু তুমি! আত্মসম্মানটাও খুইয়েছ।

 থাকগে। আমি ঘুমোচ্ছি। সারাদিন ধকল পুইয়ে এসে ঘুমুবার সময়ে এত কথা ভালো লাগে না।

কিছুক্ষণ পর গোপেনের নাক ডাকার আওয়াজ শুনতে পেল শ্রী। গোপেনের নাক ডাকার আওয়াজ মেয়েদের নাক ডাকার আওয়াজের মতো। ফিস ফিস শব্দ হয়।

জ্যোৎস্না এসে শোবার ঘরের মেঝে, এমনকী খাটও ভরে দিয়েছে। প্রাণময়ী জ্যোৎস্না। বাইরে পাহাড়তলিতে নানারকম পাখি ডাকছে। সেসব রাতচরা পাখির নাম জানে না শ্রী। গোপেন তো একেবারেই জানে না। বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার সামনে এসে দাঁড়াল শ্রী কিছুক্ষণ। এখানে রাতগুলি এখনও ঠাণ্ডা। গায়ে মোটা চাদর বা পাতলা কম্বল দিয়ে শুতে হয়। শ্রী ভাবল, একতলায় নেমে দরজা খুলে একবার পাহাড়তলির দিকে চলে যায়। চামুন্ডি মন্দির এখান থেকে কত দূরে তা কে জানে! কিন্তু আশ্চর্য! আজকের রাত থেকে তার মন অন্যরকম হয়ে গেছে। এতদিন যখন কিছু হয়নি তখন গোপেনের কাছ থেকে সে আর সন্তান চায় না। ইচ্ছাটাই মরে গেছে সুমনের কথা জানার পর থেকে। যা হয়েছে, ভালোই হয়েছে। ভাবল ও।

ওর সুমনই কি?

 দরজা খুলে ছাদে গেল শ্রী। ছমছম করছে রাত। দূরে স্টেশানের ফ্লুরোসেন্ট আলোগুলো দেখা যাচ্ছে। ট্রেন চলে যাচ্ছে রাতের নিস্তব্ধতাকে ডিজেল এঞ্জিনের একটি চাপা গুমগুমানিতে ভরে দিয়ে। পাথর আর ম্যাঙ্গানিজ আর ডোলোমাইট আর লোহা আর ইস্পাতের ভরতি ভারী ওয়াগনগুলো। আকাশকে নীলচে-সাদা দেখাচ্ছে চাঁদের আলোতে। দূরের পাহাড়ের রোঁয়া-রোঁয়া গায়ের প্রাগৈতিহাসিক জানোয়ারের মুখের মতো রহস্যময় বলয় আর ঘন জঙ্গল যেন হাতছানি দিচ্ছে শ্রীকে।

 মনটা ভারি খারাপ লাগছে। এত মানুষ থাকতে ওরই কেন এমন হল। সুমন কেন সোজাসুজি বলল না যে শ্রীকে ছাড়া তার চলবে না। ও-ই বা কেন রাজি হয়ে গেল গোপেনের সঙ্গে বিয়েতে রাজি তো হয়েছিল সুমনের ওপরে তীব্র অভিমানেই। অথচ যার ওপরে রাগ করে সে এমন করল সেই মানুষটা জানল না পর্যন্ত। একেই বোধহয় বলে চোরের ওপরে রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়া।

সুমন বিদেশ থেকে ফিরে এসেই শ্রীদের বাড়িতে এসেছিল। কিন্তু সেকথা বউদি শ্রীকে বলেন এক বছর বাদে। তখন মন বেঁকে গেছিল শ্রীর। সুমন বলে যে তার জীবনে বিশেষ কেউ ছিল একদিন সে কথা মন থেকে মুছেই ফেলতে চেয়েছিল ও। সুমনও হয়তো তীব্র অভিমানে আর যোগাযোগ করার চেষ্টাও করেনি তার সঙ্গে। সবচেয়ে লজ্জাকর ব্যাপার হয়েছিল, সুমন যেদিন এসেছিল, সেদিন মা বাবা এবং দাদার কাছে শ্রীর শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা এবং স্বামীর অফিসের ঠিকানাও নাকি চেয়েছিল। তাও নাকি মা-বাবা তাকে দেননি। এই যুগে কোনো শিক্ষিত পরিবারের মানুষ যে এমন ব্যবহার কারো সঙ্গে করতে পারেন একথা বিশ্বাস করাও শ্রীর পক্ষে মুশকিল ছিল। একথাও বউদিই শ্রীকে বলেন। দাদা বা বাবা বা মা কেউই বলেননি তাকে।

 এমনই যদি ব্যবহার বা ঔদার্য হবে তবে মেয়েকে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে ডক্টরেট করিয়ে লাভ কী হল মা বাবার? পাত্রী হিসেবে ভালো করে তোলার জন্যেই আজকের দিনে কেউ কি এমন করে? পাত্রও বা এমন কী! ভবানীপুরে বিরাট এক মান্ধাতার আমলের বাড়ি, মাৰ্বল মোজাইক-এ মোড়া। ঘোড়াশালে ঘোড়া নেই। গাড়িহীন গ্যারাজগুলো ধূলিমলিন, পাড়ার বেওয়ারিশ কুকুরে বাচ্চা দেয় সেখানে, ভায়ে ভায়ে মিল নেই। ঘরে ঘরে আলাদা হাঁড়ি। দারুণ নাকি পরিবার! কেউ ধূলিমলিন, কেউ ব্যারিস্টার, বিরাট ঐতিহ্যপূর্ণ পরিবার। সেখানে ঠাট-বাট রাখতে প্রাণ বেরিয়ে যায়। ব্যারিস্টার দু-বেলা বাপঠাকুরদার বইয়ের পাহাড়ের ধুলোর মধ্যে বসে চটি-পরা পা নাচান। কোর্টে রোজই বেরুলে কী হবে, মক্কেল নেই প্রায় একজনও। কীসের এই ঐতিহ্য আর কেমন এ বনেদিয়ানা তা শ্রী বিয়ের পর দিন থেকেই বোঝে না। গোপেন নিজেও পাত্র হিসেবে কোনো দিক দিয়েই আহামরি কিছু নয়। না চেহারায়, না পড়াশুনোয়, না সপ্রতিভতায়; না খেলাধুলায়। তাই কী দেখে যে মা-বাবা শ্রীর মতো সর্বগুণসম্পন্না মেয়েকে গোপেনের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তা মা-বাবাই জানেন। তবে গোপেন সম্বন্ধে একটা কথা বলবে শ্রী, যে সে খুবই ভদ্র। ভদ্রতাই যদি বনেদিয়ানা হয়, তবে গোপেনরা অবশ্যই বনেদি। ওরা এতই বাড়াবাড়ি রকম ভদ্র যে সেই ভদ্রতাটাকে পৌরুষের অভাব বলে মনে হয়।

বিয়ের তিন চার বছর পরে গোপেনদের বাড়ির পাশের বাড়ির ঘোষকাকিমা একদিন বলেছিলেন, শ্রীকে, বুঝলে মা! তোমার বাবা তোমাকে ঘুস দিয়েছেন জজসাহেবকে।

ঘুস! কেন?

 অবাক হয়ে গেছিল শ্রী।

হ্যাঁ মা। তোমার কাকাবাবু, মানে আমার উনি সবই জানেন। তোমার বাবা একটি কোম্পানির ডিরেক্টর ছিলেন। সে কোম্পানিকে ব্যাঙ্ক বহু টাকা ধার দিয়েছিল। সেই টাকা তোমার বাবা আর অন্য আরেকজন ডিরেক্টর নাকি আত্মসাৎ করেন। তোমাদের যোধপুর পার্কের নতুন বাড়িও হয় সেই টাকাতেই। ব্যাঙ্ক কেস করে। নীচের কোর্টে হেরে যাবার পর হাইকোর্টে আপিল আসে। গোপেনের বাবারই এজলাসে। গোপেনের মা তোমাকে একদিন দেখেছিলেন তোমার মামাতো বোন মুনমুনদের বাড়ি, মানে মামাবাড়িতে : যে মামা এখন টাটায় চলে গেছেন। তোমাকে দেখেই ঠিক করেন গোপেনের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেবেন। তোমার সম্বন্ধে সব খোঁজখবরও তিনি নেন মামাবাড়ি থেকে। তার কিছুদিন পরই ওই মামলা আসে তোমার শ্বশুরমশায়ের কোর্টে। অন্য ডিরেক্টরের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে তোমার বাবা। বেকসুর খালাস হয়ে যান।

শ্ৰী স্তম্ভিত হয়ে বলেছিল, আপনি এত সব জানলেন কী করে কাকিমা?

বলিনি বুঝি! তোমার কাকাবাবুই যে উকিল ছিলেন তোমার বাবার। তোমার কাকাবাবুর হাতও ছিল এ ব্যাপারে। তবে ওঁরা অন্যায় করেছেন তা আমি বলব না। ছেলের জন্যে বিদুষী সুন্দরী বউ আনার চেষ্টা করা তো অপরাধের নয় মা। আর ছেলেও তো কিছু কানা-খোঁড়া নয়। স্বভাব চরিত্রও ভালো। হ্যাঁ তুমি বলতে পারো যে, এর চেয়ে ভালো বিয়ে তোমার হতে পারত। কিন্তু সেটাও কোনো কথা নয় মা। বিয়েটা পুরোপুরিই নিবন্ধ। যার যেখানে লেখা আছে। এসব ঘটনা নিমিত্তমাত্র।

 এসব কথা মনে করলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না যে শ্রীর নিজের জীবনেই এত সব ঘটেছিল। এমন নাটক-নভেলে ঘটার মতোই সব ঘটনা।

কেন যে আজ এত সব অসংলগ্ন কথা মনে আসছে শ্রীর তা কে জানে! বেচারা সুমন। তার কাছে যে আজীবন কত বড়ো অপরাধী হয়ে থাকতে হবে শ্রীকে তার ঠিক নেই। কী করে মুখ দেখাবে তাকে? তার বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি; কারো সঙ্গেই সে আর কোন সম্পর্কই রাখবে না ভাবছিল। বড়ো রাগ, বড়ো অভিমান হতে লাগল সকলের ওপরেই। অথচ এখানেও তার থাকা হবে না, চাকরি করাও নয়। সুমন যেখানের সর্বেসর্বা সেই জায়গাতে তার অধস্তন কর্মচারীর স্ত্রী হিসেবে সুমনের অনুকম্পাতে বেঁচে থাকতে পারবে না ও। সুমন হয়তো তাকে ভীষণ অপমান করবে দেখা হলে। হয়তো চিনবেই না।

না। এখান থেকে তাকে চলেই যেতে হবে।

কিন্তু কোথায়? যাবেটা কোথায়?

পাগল পাগল লাগছিল শ্রীর। খোলা ছাদের পাঁচিলে হেলান দিয়ে একা দাঁড়িয়ে।

হঠাৎ যেন মনে হল, কে তার পিঠে হাত রাখল।

চমকে উঠল শ্রী।

এ কী! তুমি কাঁদছ! কী হয়েছে তোমার শ্রী?

পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা গোপেন শ্রীকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরল।

 চলো, চলো, ঘরে চলো। ঠাণ্ডা লেগে যাবে।

শ্রীর ভেতর থেকে এতদিনের পুঞ্জীভূত অভিমান, রাগ, যন্ত্রণা, সকলের বিরুদ্ধে, এমনকী তার নিজের বিরুদ্ধেও যা জমেছিল সব যেন এই নিরালা রাতের উৎসমুখে উঠে এল তীব্র উৎসারে। বাইরে এল সব। গোপেনের দু-হাতের বাঁধনে বাঁধা থেকে তার বুকে মুখ রেখে সে হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ভারি লজ্জা হল পরমুহূর্তেই। ও যে এমন নাটুকে, আবেগপ্রবণ, সস্তা হয়ে উঠবে কখনো, তা দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি।

গোপেন বলল, চলো, ঘরে চলো।

ভরত ঘুমচোখে দৌড়ে এসে বলল, হো কঁড়? কাঁকড়াবিছা কাটিলা কি? বউদি?

গোপেন বলল না রে, ভরত। হয়নি কিছু। যা তুই, শুয়ে পড়।

কিশোর ভরতের অনাবিল জগৎ জীবনের প্রায় সমস্ত জটিলতারই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ছিল। দারিদ্র্য ছাড়া অন্য কোনো কষ্ট তার জানা ছিল না। সে শ্রীর এই অজানা কষ্টে বড়োই ব্যাথিত হয়ে বলল, তোমার কপালে কি হাত বুলিয়ে দেব বউদি?

শ্রী কাঁদতে কাঁদতেই ভরতের কথাতে হেসে ফেলল। বলল, না রে, পাগলা। তুই গিয়ে ঘুমো।

ভরত ভাবছিল, কীসের দুঃখ। বউদি ভালো ভালো শাড়ি পরে, বই পরে, ভালো খায় দায়, ঘুমোয়, মাঝেমধ্যে জিপগাড়ি করে বেড়িয়েও আসে। এত সুখ যার জীবনে তার কাঁদবার মতো দুঃখ কী থাকতে পারে!

ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে গোপেন ইজিচেয়ারে বসে একটা সিগারেট ধরাল।

আবার খাচ্ছ?

 খাটে বসে শ্ৰী বলল।

 খাই না তো আজকাল। এখন একটা দরকার।

বলেই, সিগারেট ধরাল।

ধোঁয়া ছেড়ে গোপেন বলল, তোমার কীসের দুঃখ, শ্রী? তুমি যা যা চেয়েছ আজ অবধি, তাতে আমার যত অসুবিধেই হোক না কেন, আমি তার সবই তোমাকে দেবার চেষ্টা করেছি। কলকাতা ছেড়ে চলে এসেছি। সবাইকে ছেড়ে। তবু..

সেসব কিছু নয়।

 তুমি মা হতে পারোনি বলে তোমার দুঃখ?

না। সেও নয়। সত্যি বলছি, সেও নয়।

তবে? আমি অযোগ্য বলে? তোমার স্বামী, সুমন সেনের মতো কেউ নয় বলে তোমার দুঃখ? সকলেই কি একনম্বর হতে পারে জীবনে শ্রী? যে-কোনো প্রতিষ্ঠানেই, একজনই একনম্বর হন।

আঃ। আজেবাজে কথা বোলো না! হঠাৎ সুমন সেন এল কোথা থেকে? সবসময় ওই নাম আর ভালো লাগে না।

জানো শ্ৰী। তোমার কথায় এখানে এসেছিলাম বটে কিন্তু তুমি এ জায়গা ছেড়ে চলে যেতে বললেও আমি বোধহয় চলে যেতে পারব না। পুরো জীবনটা কেমন ওলোটপালট হয়ে গেল।

কেন?

অবাক হয়ে শ্রী শুধোল।

কারণ, বললে হয়তো তুমি বিশ্বাস করবে না, আমি আমার জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছি এই বিচ্ছিরি নামের জায়গাটিতে এসেই। আমাদের এম ডি সুমন সেন-এর সঙ্গে যার একবার দেখা হয়েছে, যে একবার তার কাছে এসেছে, তার পক্ষে তার সঙ্গ ছেড়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভবই।

একটু চুপ করে থেকে গোপেন বলল, জানো, কালকেই উনি বলছিলেন, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে নাকি বলতেন যে, দেয়ারস আ ডিফারেন্স বিটউইন মুভমেন্ট অ্যাণ্ড অ্যাকশান। সৈন্যরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় মুভ করে প্রায়ই। ট্রেনে, ট্রান্সপোর্ট প্লেনে, জাহাজে। কিন্তু Movement আর Action-এর মধ্যে তফাত আছে। আমাদের মধ্যেও বেশির ভাগ মানুষই সমস্তটা জীবন শুধুমাত্র মুভ করেই কাটিয়ে দিই। Action দেখাই হয় না। আমাদের হুরহুলাগড়ে আমরা প্রতিটি মুহূর্তই action-এর মধ্যে থাকি। সেনসাহেব বলছিলেন, ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান নাকি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবের বক্তৃতাতে একবার TG169 : More than intelectual abiliy and skill, what makes you valuable to the society is your devotion to great cause. আমাদের এই অল্পবয়েসি এম ডি-র মতো কিছু মানুষ এদেশে থাকলে দেশের চেহারাটাই পালটে যেত শ্ৰী। ইটস অ্যান অনার, আ। প্রিভিলেজ টু ওয়ার্ক উইথ হিম; আণ্ডার হিম।

তুমি দেখছি, রীতিমতো পজেসড হয়ে গেছ। তোমার ওপর কোনো মাথাব্যথা নেই।

না, নেই।

আমি তো তোমাকে এখান থেকে চলে যেতে বলিনি। শ্ৰী বলল। তা হলে মাঝরাতে উঠে ছাদে বসে কাঁদছিলে কেন?

বাঃ রে আমি একটু কাঁদতেও পারব না একটু বসে? তোমাকে তো আমি বিরক্ত করিনি।

গোপেন এবারে হেসে ফেলল।

বলল, একেই বলে মেয়েলি যুক্তি। তোমরা সত্যিই অদ্ভুত প্রাণী।

 সিগারেটটা খাওয়া হয়ে গেলে গোপেন বলল, চলো, এবারে শুয়ে পড়া যাক।

 আচ্ছা তোমাদের এই এম ডির বয়েস কত হবে? সুমন সেন-এর? পঞ্চাশ?

পঞ্চাশ! তুমি কি পাগল! আমাদের মতোই হবে। সামান্য উনিশবিশ। আমার চেয়ে ছোটোও হতে পারে বয়েসে।

 এরকম একটি বাচ্চা ছেলের মধ্যে তোমরা কী দেখলে, তোমরাই জানো! মানুষটা সত্যিই তোমাদের জাদু করেছে। কিছু তুকতাক অবশ্যই জানে!

হয়তো। আলাপ করবে?

না:। আই অ্যাম নট দ্য লিস্ট ইনারেস্টেড। তোমার বসকে নিয়ে তুমিই থাকো। অমন আদেখলাপনাতে আমার বিশ্বাস নেই। আলাপ করব না। কোনোদিনও না।

তা নাই করলে! কিন্তু এরকম কান্নাকাটি কোরো না। লোকে ভাববে, একা বাড়িতে তোমার ওপরে অত্যাচার করি আমি। নতুন বিয়ের পর মানুষে শ্বশুরবাড়িতে এসে কান্নাকাটি করে তাও একটা মানে হয়। ননদ নেই, শাশুড়ি নেই, শ্বশুরবাড়ির খারাপ মানুষজনের মুখ পর্যন্ত দেখতে হয় না দিনে তবুও মন খারাপ কেন? কীসের জন্যে মন খারাপ? বিয়েও তো কম দিন হয়নি। এতদিন তো আমার খারাপত্বে অভ্যস্তই হয়ে যাওয়ার কথা ছিল তোমার।

মন থাকলেই মাঝে মাঝে তা খারাপ হয়। মেয়েদের তো হয়ই!

আমার কিছু বলার নেই। কালকেই এম ডি-কে মনে করাতে হবে তোমার চাকরির কথাটা। নিজে থেকেই যখন বলেছিলেন তখন তো লজ্জার কোনো কারণই নেই।

তোমার এম ডি-র কোনো দয়াই আমি চাই না। ওঁর দয়া ছাড়া যদি অন্য কোনো চাকরি জোগাড় করতে পারো তো দেখো। আমারও সময় কাটে না। কলকাতা ছেড়ে আসাটাই ভুল হয়েছে।

ইটস টু লেট নাউ। ফিরে গেলে তোমাকে একাই ফিরতে হবে।

শেষে তাই হয়তো করতে হবে।

অস্ফুটে বলল শ্রী।

 সকালে গোপেন অফিসে চলে যাবার পর শ্রী সুমন সেন-এর কার্ডটা বের করল। এ বাড়িতে টেলিফোন নেই। কার্ডটাকে রেখে দিল আবার নিজের হ্যাঁণ্ডব্যাগে।

তারপর নিজের মা ও শ্বাশুড়িমাকে একটি করে চিঠি লিখল। কর্তব্যর চিঠি। শুকনো। তবে ও শিগগিরি ভালো করে দুটি চিঠি লিখবে ওঁদের দুজনকেই। একজন মানুষ তার ভবিষ্যৎ পুরোপুরি মা-বাবার ওপর সঁপে দিয়েছিল বলেই যে তাঁরা নিজেদের স্বার্থপরতাতে শ্রীকে জলে ভাসিয়ে দেবেন তা তো শ্রীর জানা ছিল না। মা এবং শাশুড়িমা দুজনকেই ঘোষকাকিমার কাছে যা শুনেছিল সে সম্বন্ধে জানাবে ও।

সবচেয়ে মুশকিল হচ্ছে গোপেনকে নিয়ে। না খুব-ভালো, না খুব-মন্দ স্বামীর ঘর করা বড়োই আনইন্টারেস্টিং। শ্রীর মনে হয়, ওর এই মতের সঙ্গে লক্ষ লক্ষ বিবাহিতা মহিলা একমত হবেন। গোপেন যদি ওর সঙ্গে একটু খারাপ ব্যবহার করত তাহলেও হয়তো সে সেই বিরোধের মধ্যে একটু দীপ্তি পেত। মনের গতিপ্রকৃতির সহজ এবং অব্যাহত বহমানতার জন্যেই মরচে ধরে গেল মেধাবী এবং দৃপ্ত শ্রীর মনে। এমন একঘেয়েমি, মৃত্যুর চেয়েও মৃত করে দেয় মানুষকে। শরীরের মধ্যেও আর কোনো আনন্দ নেই। সব কিছুই একঘেয়ে, পুরোনো হয়ে গেছে এই কয়েক বছরে! গোপেনের শরীর শ্রীর শরীরকে আর উজ্জীবিত, উদ্দীপ্ত, তৃপ্ত করে না। হয়তো ওর নিজের শরীরও করে না গোপেনকে। কিন্তু সেকথাও যদি মানুষটা হাবেভাবেও কখনো জানাত শ্রীকে! এমন অনুযোগহীন, সবতাতেই খুশি; মানুষকে নিয়ে ঘর করা, দেবদেবীর ছবিকে নিয়ে ঘর করা বোধহয় একই কথা। গোপেন একটা আটারলি আনইন্টারেস্টিং মানুষ। এমন স্বামী সে কোনোদিনও চায়নি। অথচ তার বিরুদ্ধে কোনো বিশেষ অভিযোগ যে করবে এমন সুযোগও দেয়নি গোপেন তাকে কোনোদিনও।

কলিং বেলটা বাজল।

ভরত রান্নাঘর থেকে সাড়া দিল।

শ্রী বলল, তুই কাজ কর। আমি যাচ্ছি।

ও কখনোই দরজা নিজে খোলে না। কিন্তু সুমন এসেছিল তবু দেখা হয়নি এই কথাটা জানবার পর দরজা নিয়ে খেলবার জন্যে মন আকুলিবিকুলি করে। তাই নিজেই গেল। কিন্তু দরজা খুলেই যাকে দেখল তাকে চিনতে পারল না। অত্যন্ত সুন্দরী, সুরুচিসম্পন্না, তন্বী, ঝকঝকে, বুদ্ধিদীপ্ত, একটি বাইশতেইশ বছরের মেয়ে। এরকম মেয়ে হুরহলাগড়ে নিশ্চয়ই বেশি নেই।

ঠিক চিনতে পারলাম না তো ভাই। কাকে চাইছেন?

কে আর কাকে চিনতে পারে এল? নিজস্ব পরিচয়ে কেউই সংসারে কাউকে চেনে না। অথচ চিনলে কী ভালোই না হতো। আমি নীপার বোন দীপা।

ওঃ মা! দীপা! সত্যি?

সত্যি!

 তুই কোত্থেকে? হঠাৎ উদয় হলি?

আমি হঠাৎ? না, তুমিই হঠাৎ?

আয়, আয়, ভেতরে আয়। কী খাবি বল?

 কিছুই খাব না। তোমার বরকে খেতে পারতাম। কিন্তু তিনি তো বাড়িতে নেই।

শ্রী ওর কথার ধরনে হেসে উঠল। বলল, তুই নরখাদক হলি কবে থেকে?

সব নারীই নরখাদক। কেউ গুলি খাওয়ার মতো চোট পেয়ে হয়; কেউ বা জন্মবাধি।

বাবা :! খুব কথা শিখেছিস তো!

 কথাই তো মানুষ আর জন্তুর মধ্যে ব্যবধান রেখেছে। কথাই না বলতে পারব তো মানুষ হলাম কেন?

গোপেনকে না হয় পরেই খেলে। চা, বা কফি তো খাবি অন্তত।

না:। যেখানেই যাই সেখানেই তোতাপাখির মতো সকলেই এই একই কথা বলে চা, না কফি। অন্য কিছু খাওয়াতে পারো? চা-কফি ছাড়া?

কী খাবি তাই বল?

এই ধরো, কোকো।

নেই রে।

জানতাম। কারো বাড়িতেই থাকে না। অথচ ভ্যারাইটি ইজ দ্য স্পাইসেস অফ লাইফ। তাহলে ফ্রেশ লাইম উইথ সোডা খাওয়াও।

তাও নেই। সোডাটাড়া নেই। তোর জামাইবাবু তো ডিঙ্ক করে না। তাই বাড়িতে সোড়া থাকে না।

ড্রিঙ্ক করে না? ভারি ব্যাকডেটেড তো। আমি কিন্তু করি, অকেশন-টকেশনে।

ইয়েস। লেমোনেড আছে? জিঞ্জার এল?

না:। থামস আপ, লিমকা, অরেঞ্জ এসব আছে।

এসবও সকলের বাড়িতেই থাকে। সকলে যা করে, সকলে যা খায়, আমি তা করি না, খাই না। জল খাওয়াও আমায় একগ্লাস একটু লেবু-চিনি দিয়ে। লেবু আছে তো!

হ্যাঁ। ফ্রিজের জল দিয়ে বানিয়ে দেব?

না। এমনি জল। গান গাই তো। তাই ফ্রিজের জল খাই না।

আনছি তোর জন্যে। কী গান গাস রে? রবীন্দ্রসঙ্গীত?

না। সকলেই রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় বলে আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত একেবারেই গাই না।

 তবে কী গান গাস?

অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, মানে বদ্যিদের ধরেছি আমি বৈতরণী পার হবার জন্যে।

শ্ৰী হেসে বলল, বেশ করেছিস। বোস একটু আমি আসছি।

ওর জন্যে শরবত করতে করতে একা একাই হাসছিল শ্রী। পরিবেশটাই অন্যরকম করে দিয়েছে দীপা এসে। কতটুকু দেখেছিল! গত পনেরো বছরে কী আমূল বদলে গেছে! ভারি জীবন্ত মেয়েটা!

তুই আমার এই একঘেয়ে জীবনে বড়ো খুশি নিয়ে এলি রে দীপা। এই নে। খা।

আমি সব জায়গাতেই খুশি নিয়ে যাই। অন্ধকারকে আলোয় ভরে দিই। আমার নাম যে দীপা। আসলে দীপান্বিতা। তবে চিন্তা নেই। অখুশিও নিয়ে আসব। আমি তোমার কাছে আসিনি, তোমার জন্যেও নয়। তোমার বরের প্রশংসা শুনে শুনে দিদিদের কাছে এবং তাঁর ফোটো দেখে খুবই ইনকুইজিটিভ হয়েছি আমি। তোমার বরকে তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিলে তুমি রাগ করবে না তো?

রাগ? যদি পারিস, তো তোকে তুই যা চাইবি তাই দেব।

 প্রতিপক্ষ হিসেবে আমি কিন্তু ফ্যালনা নই, যা বলছ, ভেবে বলছ তো?

খুবই ভেবে বলছি। রাগের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

আমার কাছে হেরে গেলেও রাগ হবে না?

হারজিতের প্রশ্নই ওঠে না। আমি তো তোর সঙ্গে খেলবই না। ওয়াকওভারই যখন পাবি, তখন আমার রাগ করার প্রশ্ন আসে কীসে!

তা ঠিক। উ আর গ্রেট। আজকাল তোমার মতো সে-কনফিডেন্ট এবং উদার মহিলাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

তোর মতো সেল্ফ-কনফিডেন্ট এবং খোলামেলা মহিলার সংখ্যাও।

 সারাটা জীবন, এল তো শ্রীদি; এবং তাও এই একটা মাত্র জীবন একজন মাত্র পুরুষের সঙ্গেই কাটিয়ে দেওয়াটা কি অত্যন্ত আনইন্টারেস্টিং নয়? মাত্র একজনের সঙ্গে?

যা বলেছিস।

আর এসব নিয়ে মেয়েতে মেয়েতে ঝগড়ার প্রশ্নই বা ওঠে কেন তাও জানি না। বৃষ্টির পরে যেমন ফড়িং ওড়ে তেমন অগণ্য ফড়িং-এর মতো পুরুষ উড়ে বেড়াচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে, কপাকপ ধরে গিলে খা না! ফ্লাই-ক্যাচার পাখিদের মতো! একজন বিশেষ পুরুষের শোকে যেসব মেয়েদের চোখে জল আসে তারা মেয়ে জাতের কুলাঙ্গার। তুমি কী এল?

শ্রী চোখ বড়ো বড়ো করে দীপার কথা শুনছিল।

বলল, এগজাক্টলি। একশোবার ঠিক। তোর মতো মেয়ে ভারতের ঘরে ঘরে জন্মাক।

সত্যি বলছ শ্রীদি? না ঠাট্টা? পরে আবার আমাকেই পোড়ারমুখী, ভাতার-খেকো এসব বলবে না তো?

শ্ৰী হেসে ফেলে বলল, সত্যি! কিছু শব্দও জানিস তুই। ভাতার-খেকো মানে কী?

 ওমা! ভাতার থেকেও ভাতার-খেকো মানে জানো না? তুমি কী গো?

 কী? সত্যি জানি না।

 যে স্ত্রী, স্বামীকে খায়।

 সে তো যে নিজের স্বামীকে খায়, মানে বিধবা হয়।

 সেই মানেটা পুরোনো হয়ে গেছে। এখনকার মানে হচ্ছে, যে মেয়ে পরপুরুষকে খায়। নিজের স্বামীকে খেয়ে সুখ কীসের? পটাপট পরের স্বামীদের খেলে, তবে না সুখ!

বাংলা ভাষাটা তাহলে বদলাতে হবে তোর জন্যে?

 হেসে বলল শ্রী।

প্রয়োজনে, দেশাচারে, সময়ের ব্যবধানে ভাষা তো বদলায়ই! উচ্চারণ বদলায়, বানান বদলায়; মানে বদলায়। ভাষার জীবনেও বদলটা মানুষের জীবনেরই মতো জরুরি। নইলে সে ভাষা মরেহেজে যায়।

যতই ওকে দেখছিল, ওর কথা শুনছিল, ততই মুগ্ধ হচ্ছিল শ্ৰী। বহুবছর কোনো মেয়ে তাকে এমন মুগ্ধ করেনি।

শ্রী বলল, তুই তো ডাক্তারি পড়িস। তাই না?

পড়ি মানে? আর ক-মাস পরেই পুরোপুরি স্পেশ্যালিস্ট ডাক্তার। এমবিবিএস তো পাস করেছি আগেই।

কোথায় যেন পড়ছিস তুই? নীপাদি বলছিল, সম্বলপুরের কাছে…

হ্যাঁ বুড়লা মেডিকেল কলেজে।

স্পেশালাইজ করছিস? কীসে?

 আমি গায়নাকোলজিস্ট।

আজকাল এত নতুন নতুন রোগ থাকতে এমন প্রাচীনতম পেশা?

পুরুষরা মেয়েদের সঙ্গে প্রাচীনতম কাল থেকে যে দুর্ব্যবহার করে এসেছে তারই প্রতিবিধানের জন্যে।

মানে?

আমি অ্যাবর্শানে স্পেশালাইজ করেছি। আই আর এইট, বা তাইচুং-এর বীজ এর মতো বেঁটে-লম্বা কালো-ফর্সা যুবক-প্রৌঢ় সুযোগসন্ধানী পুরুষরা লাগাতার অন্যায়ভাবে গর্ভাধান করে মেয়েদের। আর আমি তাদের পরিত্রাতার মতো গর্ভপাত করে যাব। লাগাতার। ঠিক ডিসিশান নিইনি?

আজকাল এতরকম কিছু বেরিয়ে গেছে, গর্ভাধান তো ইডিয়টদেরই হয়।

তুমি কী জানো শ্রীদি! পুরুষের রিপু যখন চাপে তখন তার বুদ্ধিভ্রংশ হয়। শুয়োর হয়ে যায় তারা। তা ছাড়া, এখনও তো মেয়েদের তারা মানুষ বলেই গণ্য করে না।

তা ঠিক অবশ্য।

হুরহুলাগড়ে আসার পর কী কী দেখলে এল। নাকি এই গর্তর মধ্যেই এসে অবধি সেঁধিয়ে আছ?

বলতে পারিস, একরকম তাই-ই।

 শ্রী বলল।

বলেই বলল, তোদের হুরহুলাগড়ে দর্শনীয় বস্তু কী কী আছে?

বলেই, শ্ৰীর মনে হল যে, দীপা আসাতে এবং দীপার সঙ্গে কথা বলতে বলতে ওর নিজের ভাষাও বদলে গেছে। অনেক ঔজ্জ্বল্য পেয়েছে। অভিনয়ের বেলায় যেমন সহ অভিনেতার অভিনয়ের মানের ওপরে অন্যর অভিনয়ের মান নির্ভরশীল হয়, কথোপকথনের বেলাতেও যার সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে তার বাক্যবিন্যাসের ওপরে নিজের ভাষার তূণের শব্দ এবং বিন্যাস অনেকখানি নির্ভর করে।

দর্শনীয় বস্তুর মধ্যে চামুন্ডি মন্দির, ভীমধারা ফলস, রজোর সময়ে যে মেলা বসে, গড় হুরহুলায়; সেই মেলা।

রজো কী?

রজো ওড়িশার খুব বড়ো উৎসব। গরমের সময়েই হয়।

এখানে গড় আছে বুঝি? মানে দুর্গ?

বাঃ। আছে না? সেই জন্যই তো জায়গার নাম হুরহুলাগড়। মস্ত গড়। এখন অবশ্য ভেঙেচুরে গেছে।

আমরা যখন ছোটো ছিলাম তখন মানুষখেকো বাঘের আড্ডা ছিল। কটকের বাখরাবাদের শিকারি চাঁদুবাবু আর কলকাতার বিখ্যাত শিকারি ঋজু বোস এসে একবার জোড়া-বাঘ মেরেছিল।

ছোটো তুই এখনও আছিস। তোর ছোটোবেলা ফুরোয়নি এখনও। বোধহয় ফুরোবেও না কোনোদিন।

ভাবছ তাই। তোমার বরের ঘাড়ে চাপি আগে তখন বুঝবে হাড়ে হাড়ে কেমন ছোটো আমি।

আর কিছু নেই দর্শনীয়?

 আর আছে হুরহুলাগড়ের নানা কারখানা। তবে তাদের চেয়েও বেশি দর্শনীয় হচ্ছে তাদের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সুমন সেন।

তাই?

বলেই, অন্যমনস্ক হয়ে গেল একটুর জন্যে শ্ৰী।

তারপরই বলল, তা বটে! এসে অবধি সকলের মুখে তাঁর কথাই শুধু শুনছি। তোর জামাইবাবু তো তাঁর বস-এর প্রেমে এমনভাবেই পড়েছেন যে দুষ্টু লোকে হোমোসেক্সয়ালিটির সন্দেহও করতে পারে।

ইঃ! ওই শব্দটা উচ্চারণ কোরো না শ্রীদি প্লিজ। ওই একটি শব্দ আমি সহ্য করতে পারি না। গা ঘিনঘিন করে আমার।

আর লেসবিয়ানিজম?

উঃ! সেটাতো আরও। অন্য কথা এল।

সুমন সেনকে তুই নিজে দেখেছিস?

 হ্যাঁ।

কেমন?

জাস্ট ইরেজিসস্টেবল। একজন পুরুষের মধ্যে আমরা মেয়েরা যা যা চাই, যা যা কল্পনা করি, প্রথম যৌবন থেকে শিবের মাথায় জল, ঘড়া ঘড়া জল ঢালার সময়ে যা যা বলি মনে মনে না-আসা বর সম্বন্ধে, তার সবকিছুই সুমন সেনের মধ্যে আছে। এক-শোতে এক শো দশ।

আমি যা শুনেছি তার সম্বন্ধে, তাতে তোর সঙ্গে তাকে খুবই মানায় কিন্তু। ভদ্রলোক তো ব্যাচেলর!

হ্যাঁ। ব্যাচেলর। তুমি যা বললে তার প্রতিবাদ আমি করব না। আমার নিজের সম্বন্ধে ধারণাটা বিশেষ উঁচু হলেও এবং সুমন সেন বয়েসে আমার চেয়ে অনেকই বড়ো হলেও তোমার উইশফুল থিংকিং রিয়্যাল হলে আমি বর্তে যেতাম। কিছু-কিছু পুরুষের বেলায় সাধারণ নিয়মকানুন খাটে না। সুমন সেন সেই জাতের পুরুষ। কিন্তু সে তো বিয়ে করবে না।

ধনুক ভাঙা পণ? কিন্তু কেন? তা জানিস?

যখন বিলেতে পড়তে গেছিল তখন কলকাতার স্টুপিড মেয়েটি অন্য কাউকে বিয়ে করেছে। তাকে নাকি খুবই ভালোবাসত। সে-মেয়ে দাগা দিয়েছে। যাই বল আর তাই বল আমাদের মেয়ে জাতের মধ্যেও কিছু মিন লোদসাম ক্রিচারস আছে শ্রীদি! তবে আমি ভাবতে পারি না কত বড়ো ইডিয়ট সে-মেয়েটি যে সুমন সেনের মতো ছেলেকেও ডিচ করতে পারে। অ্যানথিংকেবল! রিয়্যালি আনথিংকেবল!

তুই দেখছি খুবই অ্যাডমায়ারার।

 না, বলব না। দ্রাক্ষাফল টক। সুমন, তাই সুমন সেনকে এখন আমি দাদার মতো ভালোবাসি। অমন মানুষকে যে-কোনো সম্পর্কের মাধ্যমেই ভালোবেসে সুখ আছে। তুমি কী বলবে জানি না, আমার মত হচ্ছে এই যে, যাকে তাকে ভালোবাসার চেয়ে, যাকে তাকে বিয়ে করার চেয়ে ভালো না-বাসা, বিয়ে-না-করাও অনেক ভালো।

ঠিক।

শ্ৰী বলল।

তারপর বলল, তোর সঙ্গে আমি হান্ড্রেড পারসেন্ট একমত।

 একটু চুপ করে থেকে বলল, তবে কী জানিস, তোর মতো মেয়েই বা ক-জন হয়? সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্না, এবং সবচেয়ে বড়ো কথা, স্বাবলম্বী। এখনও নিরানব্বই ভাগ মেয়েদের বিয়েটা তাদের জীবনে এমন একটা ঘটনা যে তার ওপরে তাদের নিজেদের কিছুমাত্র হাত নেই। যারা সাধারণ তারাই শুধু সহজে সুখী হতে পারে। যারা নয়, সুখ তাদের জন্যে নয়।

দীপা তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইল শ্রীর দু-চোখের দিকে।

একেবারে চোখের মণিতে নিজের চোখের দুটি মণি ফেলে তাকায় দীপা। মনের গহনের কোনো গোপন কথাই আর সেই চোখের দৃষ্টি তীব্রতাতে গোপন থাকে না। ধরা পড়ে গেল। শ্রী দীপার কাছে। গেল কি?

দীপা কিছু বলার আগেই শ্রী বলল, আমি আমার কথা বলছি না কিন্তু।

দীপা বলল, জানি। কেই বা অন্যকে নিজের কথা বলে।

বলেই বলল, সুমনদার সঙ্গে তোমার আলাপ হওয়া দরকার, জীবনে অনেক কিছু না পেয়েও শুধুমাত্র জীবনকে ভালোবেসে, এই আকাশ, বাতাস, পাখির ডাককে ভালোবেসে, নিজের কাজকে ভালোবেসেও যে চমৎকারভাবে বেঁচে থাকা যায় তা সুমনদাকে কাছ থেকে দেখলে তুমি বুঝতে পারতে। নিজের জীবন নিয়ে ব্রুড করার মতো পাপ আর-দুটি নেই। সুমনদার সঙ্গে আলাপ হওয়াটা তোমার খুবই দরকার। আমি শিগগিরই বন্দোবস্ত করছি।

না। আমার কোনো দরকার নেই। আমি এমনিতেই সুখী।

 সুখের প্রকৃত প্রকৃতি যারা না জানে তারাই এমন কথা বলে নিজেদের ভোলায়।

এখানে তুই ক-দিন থাকবি? দীপা?

 কথা ঘুরিয়ে বলল শ্রী।

বেশিদিন নয়। দিন পনেরো। তবে অন্যভাবে ভাবলে আবার অনেকই দিন। দিনগুলো নিয়ে কে কী করে তার ওপরেই তো সব…।

তা ঠিক।

 শ্রী বলল, বিদ্ধস্ত গলায়।

ও বুঝতে পারছিল ধীরে ধীরে ওর পায়েরতলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। দীপার মত মানুষেরা, চোখ-কান বন্ধ করে, মশারির নীচে বসে-থাকা, নিজের ঘরে কল্পনার সুখে–সুখী মানুষদের মিথ্যে সুখের গোড়া ধরে নাড়া দিয়ে যায়। এমন মানুষদের সঙ্গ এড়িয়ে চলাই ভালো। এরা হাহাকারে ভরে দিয়ে যায় অন্যদের, খিদে জাগিয়ে দিয়ে যায় জীবন সম্বন্ধে কিন্তু নিবৃত্তির উপায় বাতলায় না।

তোকে দেখে খুব ভালো লাগল রে দীপা। তোর কথা বলেছিল বটে নীপাদি কিন্তু ঠিক এতটা বলেনি।

আমারও খুব ভালো লাগল শ্রীদি, তোমাকে দেখে। তবে গোপেনদার সঙ্গে দেখা হল না। আমি থাকতে থাকতে একদিন খেতে এল আমাকে। বলবে নিশ্চয়ই?

কবে আসবি বল?

ও মা! নেমন্তন্ন করবে তুমি তার আমি কী বলব? তোমার বরের সঙ্গে কথা বলে তাকে পাঠিয়ো। গলবস্ত্র হয়ে নেমন্তন্ন করে আসবে। নীপার বোনের সঙ্গে দীপার তফাত আছে। তু করলেই খেতে চলে আসব এমন ভেবো না। চলোম।

চল তোকে পৌঁছে দিয়ে আসছি।

কোথায়?

নীচ অবধি।

 ও। তাই এল।

দরজা খুলে দেবার পর শ্রী দেখল দীপা গিয়ে একটি স্কুটারে উঠল। ও আসবার সময়ে যখন দরজা খোলে তখন স্কুটারটা লক্ষ করেনি।

তুই স্কুটারে এলি? নিজে চালিয়ে?

হ্যাঁ। জামাইবাবুকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে চলে এলাম। বুড়লাতে তো আমার নিজের স্কুটার আছে। কিনেটিক–হণ্ডা। জামাইবাবুরটা বাজাজ।

নিজের মোবিলিটি থাকাটা একান্তই দরকার। তুমি কি আলুর বস্তার মতো বাড়িতেই বসে থাকো? গোপেনদা যখন তোমাকে যেখানে নিয়ে যাবেন, সেই ভরসাতে? মেয়েদের ইমমোবাইল করে রাখা পুরুষদের আরেকটা ক্যালকুলেটেড চক্রান্ত।

বলেই, স্কুটারে বসে, গোঁ গোঁ করে স্টার্ট করল।

আবার আসিস।

শ্রী বলল।

কাল তোমার কী প্রোগ্রাম?

 আমার আবার কী প্রোগ্রাম?

কাল তো রবিরার।

চলে আয়। আমার বরের সঙ্গে আলাপ হবে।

বাড়িতে আলাপ করে কী হবে! চলল গড়হুরহুলায় যাই। পিকনিক করা যাবে।

এখন কি পিকনিক-এর সময়?

 গড় হুরহুলায় সবসময়েই পিকনিক-এর সময়। অনেক উঁচু যে।

কীসে করে যাবি? একটা গাড়িতে আটবে? এতজন।

এতজন আবার কে কে? দিদির তো ধুলোতে অ্যালার্জি। গাড়িতে কোথাও ট্র্যাভেল করতে পারে না, অশেষদা বেরসিক। তার সঙ্গে কনভার্সেশন চলে না। সঙ্গে নিয়ে গেলে বোরড হয়ে যাব। আমরা তিনজনেই যাব। তোমার আপত্তি?

আমার বরও তেমন রসিক নয়।

আরে নিজের স্ত্রীর কাছে সব পুরুষই বেরসিক। শালির কাছে বা পরস্ত্রীর কাছে এলেই একেবারে রসের ভিয়েন। পাজির জাত যে! তবে আমার জামাইবাবু একসেপশান। থর মরুভূমি!

পিকনিক করতে কী কী নিতে হবে?

 তোমাদের কিছুই নিতে হবে না। শুধু বডিটি নিয়ে যাবে। সে আমিই সব নিয়ে নেব।

তুই গাড়ি ভাড়া করবি? ওকে বললে হয় না? অফিসের জিপটা বন্দোবস্ত করবে। মানে, গোপেনকে।

তাহলে তো ফার্স্ট ক্লাসই হয়। গরিবের টাকাটা বেঁচে যায়।

 ওকে তাহলে ফোন করতে হয় একটু। এখানে কাছাকাছি কোথায় ফোন আছে জানিস?

ভানু মহাপাত্রর স্টেশনারি দোকানে ফোন আছে। দু-টাকা করে নেয়, একটি কল করতে।

কোথায় দোকানটা?

ওই তো! ওই যে পেট্রল পাম্পটা দেখছ সামনের মোড়ে, তার ডানদিকের রাস্তায় গেলেই ডানদিকেরই প্রথম দোকান। তুমি এল তো, আমরা পেছনে বসে যেতে পারো।

আমি কখনো স্কুটারে চড়িনি। পড়ে যাব।

 কখনো তো জীবনে অনেকেই অনেক কিছু করে না। তবে আরম্ভ করতে অসুবিধে কী?

ভয় করে।

বিয়ের পরেও কি ভয় করেছিল? কখনও না-করা কিছু করতে?

তোর মুখে কিছু আটকায় না।

আমরা তো অ্যাডোলেসেন্ট নই। অ্যাডাল্টদের তো অ্যাডাল্টদের মতোই কথাবার্তা বলা উচিত। আমাদের কথাবার্তায়, জীবনে, সাহিত্যে অ্যাডাল্টহুড কখনো আসবে না। ন্যাকামি আর ভন্ডামিই আমাদের হলমার্ক।

তুই একটা অদ্ভুত মেয়ে।

যাবে তো এল, ফোন করতে।

না। তুই যা। আমি চান করে উঠে ফোন করে নেব। কাছেই তো!

তুমি নাম্বারটা বললে আমিও করতে পারি বাড়ি থেকে। তোমার বরকে। নাকি আপত্তি?

আপত্তির কী? তাহলে তো খুবই ভালো হয়।

তাহলে নাম্বারটা দাও। আমিই না হয় করে দেব। পারলে তুমিও কোরো। অধিকন্তু না দোষায়ঃ।

তুই করলেই ভালো, জিপটা পাওয়া যাবে কি যাবে না তা জানা যাবে। না পাওয়া গেলে গাড়িটা ভাড়া করিস কিন্তু ভাড়াটা আমরাই দিয়ে দেব।

তুমি তো রোজগার করো না, আমি করি। ভাড়া করলে আমিই ভাড়া দিয়ে দেব। সেটা কোনো ব্যাপারই নয়।

সে দেখা যাবে। তাহলে তুই-ই করছিস। হুরহুলাগড় চার-শো তিরিশ। এক্সটেনশান পঁয়ত্রিশ।

চারশো তিরিশ, এক্সটেনশান পঁয়ত্রিশ। মনে থাকবে। ডায়রেক্ট নাম্বার নেই কোনো? সুমনদার তো আছে।

তিনি তো এম ডি।

তা বটে।

তোকে একটা কথা বলব। তোদের এই সুমন সেনের সঙ্গে আমি আলাপ করতে চাই না।

সে কী? তুমি কি পাগল?

আমি পাগলই। আমি, আমি। তোকে সত্যিই বলছি, আই অ্যাম রিয়্যালি নট ইন্টারেস্টেড।

বাট হোয়াই? কেন শ্রীদি?

কোনো বিশেষ কারণ নেই। যার সম্বন্ধে এত ভালো ভালো কথা শুনছি সকলের কাছেই তাকে না দেখাই ভালো। হয়তো টোটালি ডিস অ্যাপয়েন্টেড হব।

নেভার।

কত্ব কিছুই তো দেখিনি। অজন্তা ইলোরা, খাজুরাহো, ভীমবৈঠকা। দর্শনীয় সবকিছু যে দেখতে হবেই তারই বা মানে কী?

খাজুরাহো আর সুমন সেন এক হল? সত্যি সুমনদাকে বলতে হবে কথাটা।

তুই আমাকে জানিস না দীপা। আমি অন্যরকম।

সকলে তার নিজেরই মতো, অন্যরকম। একইরকম দুজন কি হয়? এল? ঠিক আছে। তোমার যা খুশি। চলি। তোমার বরকে বোলো যে গেছো-শালি এসেছিল স্কুটারে চড়ে। এবার পুজোয় মায়ের স্কুটারে আগমন। সত্যি বলছি। পাঁজিতে লিখেছে।

শ্ৰী হেসে হাত নাড়ল।

লাল ধুলো উড়িয়ে চলে গেল দীপা।

 একটা অদ্ভুত মেয়ে!

.

০৭.

চানটান করে বেরুল শ্ৰী।

ভানু মহাপাত্রর দোকানটি বেশ বড়। ওদের বাড়ির এত কাছেই যে এত দোকানবাজার ছিল তা দীপা না বললে জানতই না। কচি পাঁঠা কেটে বিক্রি হচ্ছে। দাগা করে মাছ। ভরতটা আর গোপেন তো স্টেশানের দিকের বাজারেই যায়। বেশ দূরও এখান থেকে। যেহেতু এদিকটা গোপেনের অফিস যাওয়া আসার পথের বাইরে এদিকে হয়তো আসেইনি কখনো। ঠিক করল এবার থেকে সকালে বেরিয়ে ও নিজেই বাজারটা করে ফেলবে। বিকেলে হয়তো মাছ-মাংস বসে না। তবু, জিজ্ঞেস করে করবে।

টেলিফোনটা একটা কোনায়। বেশ নিরিবিলিতে। অল্পবয়েসি একটি মেয়ে নীচু গলায় ফোন করছিল। বোধ হয় প্রেমিককে। এটা অন্যদের ব্যবহারের জন্যে। নিজেদের ব্যবহারের জন্যে অন্য একটি ফোন আছে। সেটা প্রায় সবসয়ই ব্যস্ত। দীপা বলেছিল, স্টেশনার্স, কিন্তু শ্রী দেখল রীতিমতো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্স। পেছনে মস্ত গুদাম দেখা যাচ্ছে, উঠোন, হার্ডওয়্যারের জিনিসে ঠাসা।

মেয়েটি কথা শেষ করে চলে গেল।

শ্ৰী ফোনের কাছে গিয়ে, নিজের হাতব্যাগ থেকে সুমনের কার্ডটা বের করল। তারপর ওর ডায়রেক্ট নাম্বারটা ডায়াল করল। দুটি নাম্বারের প্রথমটি।

এক্সচেঞ্জের পুরুষ অপারেটর বললেন, হ্যালো।

শ্রী নাম্বারটা বলল। কাঁপা কাঁপা গলায়।

 রিসিভারটা কেউ ওঠাল। এবং ওঠাতেই অনেক মানুষের গলা শুনতে পেল শ্ৰী। বোধহয় কনফারেন্স চলছে ঘরে।

তারপরই সুমনের গলার স্বর শুনল। কত্ব বছর বাদে! গলাটা অনেক ভরাট ও ভারী হয়েছে। সুমন বলল, জেন্টেলমেন, প্লিজ এক্সকিউজ মি ফর আ সেকেণ্ড। ইয়েস, সেন হিয়ার।

সেন হিয়ার। হু ইজ ইট? স্ট্রেঞ্জ।

বলেই, ঘটাং করে রিসিভারটা নামিয়ে রাখল। বিরক্ত হয়ে। গলার স্বর চিনতে পারেনি। কী করেই বা চিনবে। কতদিন হয়ে গেল।

শ্রী রিসিভার না নামিয়ে আঙুল দিয়ে কানেক্টরটা টিপে ডিসকানেক্ট করে আবারও লাইনটা চাইল।

ইয়েস, সুমন সেন। সেন হিয়ার।

একটুখানি নীরবতা।

সেন স্পিকিং। আই রিয়্যালি ডোন্নো হোয়াটস হ্যাপনিং। হু ইজ ইট? প্লিজ ডোন্ট বি ফানি! অপারেটর!

বলেই, ঘটাং করে রিসিভার রেখে দিল। সুমন।

আবারও আঙুল দিয়ে ডিসকানেক্ট করে লাইন চাইল শ্ৰী। রিং হতে লাগল। কনফারেন্সের মধ্যে ভুতুড়ে কল-এ বিরক্ত হয়ে রিসিভার আর তুলল না সুমন।

দু-মিনিট রিসিভার নামিয়ে রাখার পর আবারও লাইন চাইল শ্রী। এবারে অপারেটর বললেন, আপনি কথা বলছেন না অথচ লাইন চাইছেন, আশ্চর্য তো!

সুমন রিসিভার তুলল। একই ভাবে বলল, ইয়েস। সেন স্পিকিং।

 ভালো আছ তুমি?

শ্ৰী বলল। অনেক দ্বিধার সঙ্গে।

 বাক্যটি বলে ফেলতে পেরে খুব স্বস্তি পেল।

কে? কে তুমি? আপনি কে?

ভালো আছ কি না বলতে পারছ না?

আপনার নাম্বার কত? কী ব্যাপারে ফোন করছেন?

এবারেও গলার স্বর চিনতে পারল না সুমন! তাহলে তাকে কি চিনতেই পারবে না?

আমার কোনো নাম্বার নেই সুমন। আমি আনলিস্টেড। আমি লস্ট। ফর এভার।

তুমি আপনি কে বলছেন?

আমার নাম নেই সুমন।

তুমি কে? আমার..

আমি তোমার কেউ নই সুমন। তবে তোমার জন্যে আমার খুব গর্ব হয়। আর আমার জন্যে লজ্জা।

 প্লিজ। নাম্বারটা দাও। কোত্থেকে বলছ? কলকাতা?

না।

তবে? দিল্লি? বম্বে? কোত্থেকে?

তা দিয়ে কী হবে? ভালো থেকো। এখন ব্যস্ত আছ, বুঝতে পারছি। পরে আবার ফোন করব। অন্য কোনো দিন।

বলেই, রিসিভারটা আস্তে নামিয়ে রাখল শ্রী, যাতে সুমনের কানে না লাগে।

 তারপর কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে ফোনের সামনে বসে থাকল।

 ভানু মহাপাত্রর দোকানের একজন কর্মচারী এসে বললেন, ফোন হয়েছে মা?

শ্রী উঠে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যাঁ। এই নিন ছ-টাকা তিনটি ফোন করেছি।

তিনটি কোথায় করলেন? একটি লাইন তো পেলেন মাত্র। আমি দেখেছি।

শ্ৰী হেসে ফেলল। বলল, দেখেছেন তাহলে! অনেকক্ষণ ফোনটা আটকে রাখলাম তো! তাই…।

না, না সে কী কথা। লাইন না পেলে আপনি কী করবেন? দু-টাকা দেবেন শুধু।

আপনি গোপেনবাবুর স্ত্রী তো! আপনার কাছ থেকে আমাদের পয়সা নেওয়াই উচিত নয়। বাবু বলছেন।

না, না। তা কেন! পয়সা না নিলে তো আমি ফোন করতেই পারব না।

ওই দু-টাকাই দেবেন। যে কটা ফোনই করুন না কেন।

 ক্যাশ কাউন্টারের সামনে বসা ছিপছিপে, সুদর্শন, মাঝবয়েসি ভানু মহাপাত্র বসে বসেই মাথা ঝুঁকিয়ে জোড়হাত করে নমস্কার করলেন শ্রীকে।

শ্ৰী মনে মনে বলল, গুণ আর বিনয় না থাকলে এতবড়ো ব্যাবসার মালিক হওয়া যায় না।

শ্রীও প্রতিনমস্কার করে দোকান থেকে বেরিয়ে এল।

এই এক বিপদ হল। গোপেনকে এঁরা চেনেন। অতএব আজ ফোন করার কথা এবং ভবিষ্যতেও যদি কখনো করে সেকথাও গোপেনের কানে যেতে পারে। ঠিক করল গোপেনকেও একটি করে ফোন করতে হবে এখানে এলেই। এখানের এক্সচেঞ্জ অটোমেটিক নয়। অপারেটরের মাধ্যমে সুমন যদি জানতে পারে কোন টেলিফোন থেকে ফোন আসছে তাহলেও বিপদ! মহামুশকিলেই পড়ল। শ্রী।

দোকান থেকে বাইরে বেরিয়ে সাইকেল রিকশা আর সাইকেলের ঘণ্টার আওয়াজের মধ্যে সুমনের অতিপরিচিত কিন্তু ভরাট গলার স্বর ওর কানে বাজতে থাকল। একজন মানুষের সামান্য দু-একটি কথা যে অন্য একজনকে এতখানি উত্তেজিত ও মথিত করতে পারে তা ভেবেও ও রোমাঞ্চিত হল। সুমনও নিশ্চয়ই উত্তেজিত। বিশেষ করে, পরিচয় গোপন করেছে বলে শ্ৰী। সামনে তাকিয়ে দেখল লাল ধুলোর সোজা পথটা পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে যেন সেঁধিয়ে গেছে। ওই দিকেই চামুন্ডি মন্দির। গড় হুরহুলা কোনদিকে, কে জানে।

অনেক বছর পর সুমনের গলার স্বরে দুটি কান ভরে নিয়ে খুশিতে ডগমগ হয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল শ্রী।

ভরত দরজা খুলে দিল। বাড়িতে ঢুকেই দোতলাতে শোবার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে সেই চিঠির ঝাঁপিটা বের করে রাখল। তারপর বাথরুমে গিয়ে পা ধুয়ে এসে খাটে উঠে জোড়াসনে বসে খুলল সে ঝাঁপিটি।

চিঠিগুলি মলিন হয়ে গেছে। লালচে হয়ে গেছে কাগজ। বেগুনি আভা লেগেছে ব্রিটিশ ইনল্যাণ্ড লেটার ও খামের নীলচে রঙে। তাই বলে চিঠির বার্তা কিছু মলিন হয়নি। তা আরও ঔজ্জ্বল্য পেয়েছে। চিঠিগুলি যখন পেয়েছিল তখন সেগুলি পড়ে যতখানি পেত আনন্দ আজ এতবছর পরে তা বারেবার পড়ে তার চেয়েও অনেক বেশি আনন্দ পায়। আনন্দর তীব্রতা আরও অনেক বেশি হয় যখনই ভাবে যে চিঠিগুলি চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছে। যে লিখত তাকে আমার শ্রী, শ্রীময়ী, শ্রীপর্ণা বলে সম্বোধন করে, সে আর চিঠি লিখবে না কোনোদিন।

বাগানে অনেক পাখি ডাকছে। পাহাড় ও বন থেকে দলে দলে পাখি এসে দিনময় হুটোপাটি করে এখানে। স্টেশান অবধি চলে যায় তারা। শ্ৰী শুধু টিয়াপাখির ঝাঁক দেখে চিনতে পারে। অন্য পাখিদের চোহারাও চিনছে একে একে কিন্তু নাম তো জানে না কারোরই! কলকাতায় চড়াই আর কাক ছাড়া পাখি দেখেনি। এত পাখির কিচিরমিচির তাকে হঠাৎ হঠাৎ বিবশ করে দেয়, অন্যমনস্কও। পাখিমাত্ররই উড়ে যাওয়ার মধ্যে, এগাছ থেকে ওগাছে গিয়ে বসার সিদ্ধান্তর মধ্যে, ফল আধখানা খেয়ে ঠুকরে ফেলে দেওয়ার মধ্যে যে একধরনের দুর্মর স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতা, উড্ডীন তাদের রঙিন ডানায় ডানায় চমকে চমকে ওঠে, তা অনুভব করেই শ্রীর মন খারাপ হয়ে যায়। সুমন বিশেষ করে এখানে আছে তা জানার পর থেকে আরও বেশি খারাপ হয়। ও যে খাঁচার পাখি, তা এই বনের পাখিদের দেখে বুঝতে পারে। এবং বুঝতে পেরে বড়োই মন খারাপ লাগে।

রবিবার সকাল
শ্রী, কল্যাণী,

 তুমি এখন কী করছ অনুমান করতে পারি। হয়তো চান করছ চানঘরে। খুব ভালো করে, রবিবারের চান। নয়তো বাথরুমের আয়নায় তোমার নগ্ন শরীরের প্রতিবিম্ব দেখে নিজের প্রতি ভালোবাসাটা চাড়িয়ে নিচ্ছ, বাড়িয়ে নিচ্ছ।

জানো, নিজেকে ভালোবাসাটা, নিজের শরীর, নিজের মন, নিজের নিজস্বতাকে ভালোবাসাটা বেঁচে থাকার পক্ষে খুবই জরুরি। তুমি আছ বলেই এই পৃথিবী আছে, অন্তত তোমার কাছে। তোমার চোখ দিয়ে তুমি তোমার চারপাশের পৃথিবীকে দেখছ, তোমার মন দিয়েই তুমি তোমার পারিপার্শ্বিককে বিচার করছ, ভালোবাসছ; বা বাসছ না। এই কারণে তোমার নিজস্বতা, তোমার মন, তোমার শরীরকে ভালোবাসা বিশেষই দরকার।

না কি তুমি এখন ব্রেকফাস্ট খাচ্ছ? আমি এখুনি ব্রেকফাস্ট বানিয়ে খেলাম। থোর-বড়ি খাড়া –খাড়া-বড়ি-থোর। মাঝে মাঝে ব্রেকফাস্টে চিড়ের পোলাউ, বা গাজরের হালুয়া বা লুচি আলুভাজা বা ফেনাভাত ডিমেসদ্ধ আলুসেদ্ধ খেতে খুব ইচ্ছে করে। সেই সব ইচ্ছেকে সযত্নে লালন করার আরেক নামই হোম-সিকনেস। খাওয়ার মধ্যে যে নিছক উদরপূর্তির ব্যাপার ছাড়াও আরও যে অনেক সুন্দর ব্যাপার আছে তা দেশে থাকতে প্রতিমুহূর্তে বুঝতে পারতাম। নিজে বেঁধে বেড়ে খেয়ে একটুও মজা নেই। শুধুই পেট-ভরানো পশুর বৃত্তি, মানুষের নয়।

ইংরেজ জাতটার মস্ত গুণ এই যে, এরা সহজে বড়ো হতে চায় না। আমাদের দেশে যে বয়েসে পুরুষমানুষ মাত্রই জ্যাঠা-জ্যাঠা ভাব করে আর মেয়েরা দিদিমা হয়ে যায় ওরা সেই বয়েসেও বুড়ো-খোকা বুড়ো-খুকি সেজে থাকে।

আজ রবিরার। প্রায় প্রত্যেক পুরুষ যার হাত-পা মোটামুটি অক্ষত আছে এবং বাতগ্রস্ত হয়নি, সে ফুটবল খেলার নাম করে বাড়ি থেকে সকালে অবশ্যই বেরিয়ে পড়বে ব্রেকফাস্টের পর। কেউ কেউ সত্যিই খেলবে। কেউ কেউ ফুটবলে দু-চার লাথি মেরে মাঠ ছাড়বে। কারো সঙ্গে ফুটবলের বা মাঠের দেখা পর্যন্ত হবে না। কিন্তু একটি জায়গাতে সকলেরই দেখা হবে সেটি হচ্ছে পাড়ার পাব। ইংরেজদের সংস্কৃতিতে এই পাব-এর একটি বিশেষ আসন আছে। আকণ্ঠ বিয়ার পান করে বাড়ি গিয়ে বলবে প্রচন্ড ফুটবল খেলে এলাম। এদিকে খুকিরাও বসে থাকবে না। তাদেরও নিজেদের Pockets of Interest আছে। অনেক খুকিরা Pub-এও আসবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর অনেকদিন চলে গেছে। এই সময়ের ইংরেজদের সামনে অর্থনৈতিক সমস্যা ছাড়া অন্য কোনো বিশেষ সমস্যা নেই। জীবন বা স্বাধীনতা হারাবার ভয় নেই। তাই এরা বড়ো বেশি খোকা-খুকু হয়ে গেছে।

ওদের আমরা বহির্মুখী বলে নস্যাৎ করে দেবার চেষ্টা করি যদিও কিন্তু আমাদের বেশিরভাগের মতো মেকী-অন্তর্মুখী হওয়ার চেয়ে এমন সৎ-বহির্মুখী হওয়াটা অনেকই বেশি স্বাস্থ্যকর। আমরা, বিশেষ করে বাঙালিরা, যে অন্তর্মুখীনতার গর্ব করি, তা কিন্তু প্রায়ই মিথ্যে। বই না পড়েই আমরা পন্ডিত, গান না গেয়ে অথবা না শুনেই আমরা বোদ্ধা; ছবি না এঁকে এবং না বুঝেই আমরা আর্ট-ক্রিটিক। আমাদের মতো এরা মিথ্যে দাবি নিয়ে সংস্কৃতি সম্পন্ন বলে নিজেদের প্রমাণিত করার চেষ্টায় সময় নষ্ট না করে যা কিছুই করতে ভালোবাসে, করে আনন্দ পায়; তাই করে সুখে থাকে।

রবীন্দ্রনাথের সহজ হবি, সহজ হবি কথাটা মনে পড়ে।

তুমি হয়তো একমত হবে না আমার সঙ্গে, হয়তো অনেকেই হবেন না, কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ততই আমার মনে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ প্রতিভাবান হিসেবে যতই বড়ো হোন না কেন, মানুষ হিসেবে হয়তো তেমন বড়ো ছিলেন না। তাঁর ব্যক্তিগত চিঠিপত্র পড়লে মনে হয় উনি একজন অন্য মানুষ। অতিসাধারণ Mundane বিষয়ে লিপ্ত-থাকা একজন মানুষ। অথচ তাঁর অন্য একটি পোশাকি সত্ত্বা যখন তাবৎ বিশ্বজনের জন্যে বা Consciously চিঠি লেখেন বা ডাইরি, তখন তা পড়ে মনে হয় যে, উনি বুঝি দেবাদিদেব।

দেশ পত্রিকায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা কিছু প্রোট্রেট প্রকাশিত হয়েছিল এবং তাঁর চিত্রাঙ্কন সম্বন্ধে কিছু কথা। কাদম্বরী বউঠানের স্বামী, রবীন্দ্রনাথের জ্যোতিদাদার অঙ্কনপ্রতিভা দেখে সত্যি চমকে উঠতে হয়। অথচ রবীন্দ্রনাথ নিজের জীবদ্দশাতে এই দাদার প্রতিভার কোনো প্রচারই করেননি। আমরা কেন, আমাদের পূর্বপুরুষরা কেউই জানতেন না জ্যোতিদাদার অঙ্কন প্রতিভা ঠিক এই মাপের ছিল। সারাজীবন উনি নিজের প্রচারের জন্যে যা কিছু করেছেন তার ছিটেফোঁটা তার কাছের গুণীজনদের জন্যে করলে তাঁর মনুষ্যত্বর দাবি প্রোজ্জ্বল হত বিলক্ষণ।

আমার কেন যেন মনে হয় রবীন্দ্রনাথের গানের কান্ডারী দীনদা মানে দীনু ঠাকুরকেও রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট মর্যাদা দেননি। তাঁর গানের বাণীর কোনো তুলনা নেই স্বীকার করি, কিন্তু তাতে দীনু ঠাকুরের সুর না লাগলে সে-বাণী খড়মোড়া টিয়াপাখির মতো হত। প্রাণ পেত না সে গান।

সম্প্রতি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি চিঠি পড়ে (পশুপতি চট্টোপাধ্যায়কে লেখা, সামতাবেড় থেকে, ১০ই অক্টোবর ১৯২৭ তারিখের চিঠি) স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। বাঙালিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও তাবড় তাবড় ব্যক্তিত্ব আরও হয়েছেন এবং এখনও জীবিত আছেন যাঁদের নাম দেশে বিদেশে ছড়িয়ে গেছে, সাদা চামড়ার সাহেবরা যাদের গুণী বলে মেনে নিয়েছেন, অতএব তাঁদের গুণ সর্বসন্দেহের অতীত।

পুরস্কার রাখার জায়গার যাঁদের অকুলান হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই কি দ্বৈত-সত্তার মানুষ? আসল মানুষটি এক ধরনের আর যে মানুষটি জনসমক্ষে পৃথিবীর সামনে এসে দাঁড়ান তিনি কি সম্পূর্ণ অন্য ধরনের?

দেশে ফিরে এই বিষয় নিয়ে আমার কিছু গবেষণার ইচ্ছে আছে।

শরৎবাবু, পশুপতিবাবুকে লিখছেন :(ভালো করে মনোযোগ দিয়ে পড়ো) আমার লেখা সাহিত্যের রীতিনীতি পড়ে তুমি ক্ষুণ্ণ হয়েছ লিখেছ। তোমার মনে হয়েছে যে রবিবাবুকে আমি অযথা কটুক্তি করেছি। কিন্তু কোথায় যে শ্লেষ অথবা বিদ্রূপ আছে লেখাটা আরও একবার পড়েও তা আমি খুঁজে পেলাম না।

তাঁকে আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধাভক্তি করি–আমার গুরুস্থানীয় তিনি এ তো তুমি জানোই। তবে হয়তো লেখার দোষে যা বলতে চেয়েছি তা বলতে পারিনি–আর একরকম অর্থ হয়ে গেছে। দোষ যদি কিছু হয়েও থাকে সে আমার অক্ষমতার, আমার অন্তরের নয়।

তোমরা একটা কথা জানো না যে আমার ভাষার ওপরে অধিকার সত্যিই কম। বিনয়ের জন্যে বলিনি, তোমার মতো আত্মীয়ের কাছে মিছে বিনয় করে লাভ কী বলো তো? তবুও বলছি এ একথা আমার যথার্থই মনের কথা….।

বুঝলে, শ্ৰী, আমি বলব যে, শরৎবাবুর ভাষার দখলের সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই যে ভাষা ওঁর ওপরে কোনদিনও দখল নেয়নি। গ্রামের রাখালবালকের মতো ভাষাকে তিনি গোপালের মতো অনাড়ম্বর সাবলীলতায় চরিয়ে, এবং চারিয়ে নিয়ে গেছেন।

লেখালেখি যে আদৌ কঠিন কাজ একথা তাঁর লেখা পড়ে কখনোই মনে হয়নি। এবং সেখানেই তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব।

তারপর উনি লিখছেন :

সে যাই হোক নবীন লেখকদের প্রতি আমার আন্তরিক স্নেহ এবং টান আছে। তাদের ভুলচুক হয় জানি, তাই বলে তাদের লোকসমাজে অশ্রদ্ধেয় প্রতিপন্ন করলে আমার অত্যন্ত ব্যথা লাগে। তা ছাড়া কত বড়ো অন্যায় অপবাদ তাদের দেওয়া হয়, যখন ইঙ্গিত করা হয় এরা গরিব বলেই এসব নোংরা ব্যাপার ঘাঁটাঘাঁটি করে অর্থ রোজগার করতে চায়। আমি ভালো করেই জানি যে বিরুদ্ধদলের লোকরা এইরকমই বলে বেড়ায়।

কোনোদিন যদি তোমার বড়দাকে (শরৎবাবু) ভালো করে জানতে পারো, বুঝবে বিদ্বেষ বলে জিনিসটা তার মধ্যে নেই বললেও অতিশয়োক্তি হবে না।

একটা কথা তোমাকে জানাই, কারুকে বোলো না। পথের দাবী যখন বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল তখন রবিবাবুকে গিয়ে বলি যে আপনি যদি একটা প্রতিবাদ করেন তা একটা কাজ হয়  যে পৃথিবীর লোকে জানতে পারে যে গভর্নমেন্ট কীরকম সাহিত্যর প্রতি অবিচার করছে। অবশ্য বই আমার সঞ্জীবিত হবে না। ইংরেজ সে পাত্রই নয়। তবু সংসারের লোক খবরটা পাবে।

রবীন্দ্রনাথকে বই দিয়ে আসি।

তিনি জবাবে আমাকে লেখেন

পৃথিবী ঘুরে ঘুরে দেখলাম ইংরেজ রাজশক্তির মতো সহিষ্ণু ও ক্ষমাশীল রাজশক্তি আর নেই। তোমার বই পড়লে পাঠকের মন ইংরেজ গভর্নমেন্টের প্রতি অপ্রসন্ন হইয়া ওঠে। তোমার বই চাপা দিয়ে তোমাকে কিছু না বলা, তোমাকে প্রায় ক্ষমা করা। এই ক্ষমার উপরে নির্ভর করে গভর্নমেন্টকে যা তা নিন্দবাদ করা সাহসের বিড়ম্বনা।

ভাবতে পারো পশুপতি, বিনা অপরাধে কেউ কাউকে এতো বড়ো কটুক্তি করতে পারে? এ চিঠি তিনি ছাপবার জন্যেই দিয়েছিলেন, কিন্তু আমি ছাপতে পারিনি এই জন্যে যে, কবির এত বড় সার্টিফিকেট (ইংরাজ গভর্নমেন্টের মহত্বর বাবদে) তখুনি স্টেটসম্যান প্রভৃতি ইংরিজি কাগজওয়ালারা পৃথিবীময় তার করে দেবে। এবং এই যে আমাদের দেশের ছেলেদের বিনা বিচারে জেলে বন্ধ করে রেখেছে এবং এই নিয়ে যত আন্দোলন হচ্ছে সমস্ত নিষ্ফল হয়ে যাবে।

ঠিক বলতে পারিনে, হয়তো এই কথা আমার মনের মধ্যে অলক্ষে ছিল যখন সাহিত্যের রীতিনীতি লিখি। তবেই বোধহয় কোথাও কোনো জায়গায় একটু আধটু তীব্রতার ঝাঁঝ এসে গেছে। যাই হোক। যা হয়ে গেছে তার এখন উপায় কী ভাই?

বল শ্রী? কী বুঝলে ব্যাপার? রবীন্দ্রনাথ কি সত্যিই এই চিঠি লিখেছিলেন? লিখেছিলেন কি না সে বিষয়ে তদন্ত হওয়া দরকার। লিখে থাকলে, দেশপ্রেমী রবীন্দ্রনাথের নবমূল্যায়ন হওয়াও দরকার। না লিখে থাকলে পথের দাবীর লেখক শরৎচন্দ্রর সতোরও নবমূল্যায়ন হওয়া দরকার। এ চিঠি কবে লিখেছিলেন? এবং জালিওয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডর পরে বিদেশি সম্মান করে ফেরত দিয়েছিলেন তাও জানা দরকার। ফেরত দেওয়া ব্যাপারটা ঠিক কীরকম ছিল তাও। কোনো গবেষকের কাছে জেনে আমাকে জানিয়ে।

আমার ক্রমশই এই ধারণা গড়ে উঠছে শ্ৰী যে, যশস্বী বাঙালিদের মধ্যে বেশিরভাগেরই ভন্ডামি এবং মিথ্যাচারের প্রবণতা ছিল এবং আছে। স্বদেশে যেহেতু কোনো প্রকৃত জীবনী (সে আত্মজীবনীই হোক কি পরের লেখাই হোক) আজ অবধি লেখা হয়নি, যা লেখা হয়েছে। সব ঢাকা-চুকি চাপা-চুপি দেওয়া। কাউকে ভগবান বানানো বা ভূত বানানোর পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্তে ভর করে, তাই সতোর ব্যাপারটা নিয়ে স্বদেশীয় যশস্বীরা এবং গবেষকেরাও মোটেই মাথা ঘামাননি। অথচ অবশ্যই ঘামানো উচিত।

 এই অবধি পড়ে শ্রী থামল। চিঠিটি কোলে নামিয়ে রাখল। ফিনফিনে অনিয়ন স্কিন কাগজে লেখা পাতার পর পাতা চিঠি।

সুমনের কথা ভেবে ভারি গর্ব হল তার। সুমনের ব্যক্তিত্ব ছিল সত্যিই বহুমুখী। জীবনের কোনো দিক সম্বন্ধেই তার আগ্রহের কোনো ঘাটতি ছিল না। মনের দিক দিয়ে সে ছিল যথার্থ প্রাপ্তবয়স্ক, সেই কলেজের দিনগুলি থেকেই। বাঙালিদের অনেকেই গুমোর নিয়ে চিতায় চলে যান, গুমোরটা যুক্তিযুক্ত কি না তা না জেনেই। যথার্থ প্রাপ্তবয়স্ক আর হয়ে ওঠা হয় না তাঁদের। হলে, সাহিত্যে, জীবনে, কখনো এমন শুচিবাই শিকড় গেড়ে থাকতে পারত না। এই শুচিবায়ুগ্রস্ততা ভন্ডামিজনিত। অথবা ভন্ডামিটাই শুচিবাইজনিত। এই কথাটাই একটু আগে বলে গেল দীপা। অ্যাডাল্ট হওয়ার কথা।

প্রেম তো অনেক ছেলে-মেয়েই করে কিন্তু শ্রীর গর্ব ছিল প্রমথ চৌধুরী আর ইন্দিরা দেবীর প্রেমের পর সুমন আর শ্রীর মতো প্রেমিক-প্রেমিকা বঙ্গভুমে আর হয়নি। সুমন এতই ভালো চিঠি লিখত যে শ্রী লজ্জায় সংকোচে কখনোই উত্তর দিয়ে উঠতে পারেনি একটিরও। অনিয়মিত উত্তর দেওয়া প্রেমিকাকেও যে কেউ এমন নিয়মিত এবং জগতের তাবৎ বিষয় সম্পর্কিত চিঠি লিখতে পারে তা জেনে শ্রী মুগ্ধ হয়ে যেত। তবে সুমন বলত শ্রীকে, তুমি দারুণ চিঠি লেখো। মহাত্মা গান্ধিজির ইংরজির মতো তোমার বাংলা।

গোপেন একদিন বলেছিল সুমন সম্বন্ধে, যে উনি হাজারদুয়ারি মনের মানুষ। কথাটা বড়ো ভালো লেগেছিল শ্রীর। সুমন সেন সম্বন্ধে এর চেয়ে বেশি লাগসই আর কোনো শব্দই হতে পারে না। হাজারদুয়ারি।

আবার চিঠিটি পড়া শুরু করল শ্রী… কত বিষয়েরই যে অবতারণা করে সুমন তার চিঠিতে যে, সত্যিই মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়—

রবীন্দ্রনাথকে লেখা শরৎবাবুর আরেকখানি চিঠিও তোমাকে তুলে না দিয়ে পারছি না। তুমি তো সাহিত্যের ছাত্রী। তুমি এই চিঠির যাথার্থ আমার চেয়ে ভালো বুঝবে। এ চিঠিটি পানিব্রাস হাওড়া থেকে লেখা, ২৬শে ফাল্গুন ১৩৩৪ (কত খ্রিষ্টাব্দ?) দিশি লেখক লিখছেন, ব্যালাব্রুয়ী, ব্যাঙ্গালোর বা মংপু বা শিলং থেকে নন, আমাদের একেবারে দিশি কাদা প্যাচপ্যাচ পানিত্রাস থেকে।

 এ জীবনে নানা অবস্থার মধ্যেদিয়ে যাবার কালে চোখে পড়েছে অনেক জিনিস। আপনি যাকে বলেছেন এ দেশের লোকযাত্রা সম্বন্ধে আমার অভিজ্ঞতা। কিন্তু অনেক কিছু দেখা এবং জানা সাহিত্যিকের পক্ষে নিছক ভালো কি না এ বিষয়ে আমার সন্দেহে জন্মেছে। কারণ অভিজ্ঞতায় কেবল শক্তি দেয় না, হরণও করে। এবং সাংসারিক সত্য সাহিত্যিক সত্য নাও হতে পারে। বোধ হয় এই বইখানাও তার একটি উদাহরণ (যোড়শী)। এটা লিখি একটা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে জানা বাস্তব ঘটনাকে ভিত্তি করে। সেই জানাই হল আমার বিপদ। লেখবার সময় পদে পদে জেরা করে সে আমার কল্পনার আনন্দ ও গতিকে কেবল বাধাই দেয়নি, বিকৃতও করেছে। সত্য ঘটনার সঙ্গে কল্পনা মেশাতে গেলেই বোধ হয় এমনি ঘটে। জগতে দৈবাৎ যা সত্যই ঘটেছে তার যথাযথ বিবৃতিতে ইতিহাস রচনা হতে পারে, কিন্তু সাহিত্য রচনা হয় না।

চমৎকার। তাই না। পুরোপুরি একমত আমি এই মন্তব্যর সঙ্গে। আর তুমি?

 তারপর, শরৎবাবু লিখছেন :

একসময় আমি শুধু ছবি আঁকতাম।

শরৎবাবুর কোনো ছবি তুমি দেখেছ? আমি দেখিনি। খুব কম মানুষই হয়তো দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথের মতো অর্গানাইজড ও ওয়েল-অফফ হলে হয়তো তাঁর সব ছবিই রাখা থাকত এবং তা নিয়ে অনেক হই-চই-ও হত!

একসময়ে আমি শুধু ছবি আঁকতাম। ছবিতে এর মুন্ডু, ওর ধড় তার পা এক করে চমৎকার জিনিস দাঁড় করানো যায়। কারণ সে কেবল বাইরের বস্তু, চোখে দেখেই তার বিচার চলে। কিন্তু সাহিত্যের চরিত্র সৃষ্টির বেলায় তা হয় না। মানুষের মনের খবর পাওয়া কঠিন। সেখানে নিজের খেয়াল বা প্রয়োজন মতো এর একটু, তার একটু, কতক সত্য, কতক কল্পনা জোড়া দিয়ে উপস্থিত মতো লোকরঞ্জন করা যায়, কিন্তু কোথায় মস্ত ফাঁকি থেকে যায় এবং উত্তরকালে এই ফাঁকটাই একদিন ধরা পড়ে।

কী বুঝছ শ্রী? এর মধ্যে কি রবীন্দ্রনাথের আধা-কল্পনা আধা-বাস্তব উপন্যাসগুলিরও প্রতি বক্রোক্তি দেখতে পাচ্ছ? আমার কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে যে, শরৎবাবু যা বলার তা চমৎকারভাবেই বলেছেন। মেরেছ কলসির কানা তাই বলে কি প্রেম দেব না? এই ফিলজফিতে উনি বিশ্বাসী ছিলেন না।

আবার লিখছেন :

কী জানি। হয়তো এই জন্যেই আজকাল প্রখর বাস্তব সাহিত্যর চলন শুরু হয়েছে। তাতে দলে দলে লোক আসে, সবাই ছোটো, সবাই সত্য, সবাই হীন কারও কোনো বিশেষত্ব নেই, অর্থাৎ যেমনটি সংসারে দেখা যায়। অথচ সমস্ত বইখানা পড়ে মনে হয়, এতে লাভ কী? কেউ হয়তো বলবে, লাভ নেই। অমনি।

মাঝে মাঝে হয়তো অত্যন্ত সাধারণ মামুলি বিষয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ও নিপুণ বর্ণনা থাকে, তার ভাষাও যেমন আড়ম্বরও তেমনি, কিন্তু তবুও মন খুশি হয় না অথচ এরা বলে এই তো সাহিত্য।

এরপর যা Quote করছি, তা বাঁধিয়ে রেখো। বারবার পড়ার মতো। যাঁরা শরৎবাবুকে মেয়েদের লেখক, আদৌ লেখকই নন ইত্যাদি বলে নিজেদের মিথ্যা উচ্চমন্যতার বোধকে আস্কারা দিয়ে এসেছেন যুগে যুগে তাঁদের এই অংশটি পড়ে দেখা উচিত। অন্য কাউকে নয়, শরৎবাবু লিখছেন স্বয়ং ভগবান রবীন্দ্রনাথকে।

 আপনি পরিপ্রেক্ষিতের উল্লেখ করেছেন। ছবিতে আঁকায় এতে দূরত্বের পরিমাণে বড়ো জিনিস ছোটো, গোল জিনিস চ্যাপটা, চৌকো জিনিস লম্বা, সোজা জিনিস বাঁকা দেখায়। কতদূরে, কোন সংস্থানে বস্তুর আকারে প্রকারে কীরূপ এবং কতটা পরিবর্তন ঘটাবে তার একটা বাঁধাধরা নিয়ম আছে। এ নিয়ম ক্যামেরার মতো যন্ত্রকেও মেনে চলতে হয়। তার ব্যতিক্রম নেই।

 কিন্তু সাহিত্যের বেলা তো এর তেমন কোনো বাঁধাধরা আইন নেই। এই সমস্তই নির্ভর করে লোকের রুচি ও বিচারবুদ্ধির ওপরে। নিজেকে কোথায় কতদূরে যে দাঁড় করাতে হবে তার কোনো নির্দেশই পাবার জো নেই। সুতরাং ছবির Perspective এবং সাহিত্যের Perspective কথার দিক দিয়ে এক হলেও কাজের দিক দিয়ে এক নয়।

 তা ছাড়া সাহিত্যের বর্তমান কালটা যত সত্য, ভবিষ্যৎ কালটা কিছুতেই ঠিক অত বড়ো সত্য নয়। নর-নারীর যে একনিষ্ঠ প্রেমের ওপর এতকাল এত কাব্য লেখা হয়েছে, মানুষে এত তৃপ্তি পেয়েছে, এত চোখের জল ফেলেছে, সেও হয়তো একদিন হাসির ব্যাপার হয়ে যাবে। অন্তত অসম্ভব নয়। কিন্তু তাই বলে আজ তাকে কল্পনাতেও গ্রাহ্য করা চলে না।

পরিশেষে আপনি আমার শক্তি উল্লেখ করে লিখেছেন তুমি যদি উপস্থিত কালের দাবি ও ভিড়ের লোকের অভিরুচিতে না ভুলতে পারো তাহলে তোমার এই শক্তি বাধা পাবে। আপনি নানাকাজে ব্যস্ত, কিন্তু আমার ভারি ইচ্ছে হয় যে আপনার কাছে গিয়ে এই জিনিসটি ঠিকমতো জেনে আসি। কারণ উপস্থিত কালটাও যে মস্ত ব্যাপার, তার দাবি মানব না বললে সেও যে শাস্তি দেয়।

আপনি অনুমতি না দিলে আপনার সময় নষ্ট করে দিতে আমার সংকোচ হয়। আমার চিঠি লেখার ধরনটি বড়োই এলমেলো–কোনো কথাই প্রায় গুছিয়ে বলতে পারিনে। লেখার দোষে কোথাওই যদি অপরাধ হয়ে থাকে মার্জনা করবেন।

–সেবক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

শ্রী, তুমি বুঝতেই পারছ যে এই চিঠি পাবার পর রবীনদ্রনাথ নিশ্চয়ই শরৎবাবুকে জিনিসটি বোঝবার জন্যে ডাকেননি কারণ শরৎবাবুর চিঠিতেই সেই বোঝাবুঝির অত্যন্ত স্পষ্ট আভাস ছিল। শরৎবাবুর বক্তব্যও তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাসনির্ভর ছিল। সেই বিশ্বাসের ভিতও ছিল পাকা।

তুমি শরৎবাবুর ইংরিজি পড়েছ? পড়ে দেখো। সমকালীন কম বাঙালি লেখকই অমন ইংরিজি লিখতেন।

দেখো, রবিবারের প্রায় পুরো সকালটাই তোমাকে চিঠি লিখেই ফুরিয়ে দিলাম। তবে এমন বিষয় নিয়ে এ চিঠি যে তা কখনো পুরোনো হবে না বা ফুরোবে না। এই চিঠিটি যত্ন করে রেখো কারণ যাঁর বই থেকে এই সব উদ্ধৃতি দিলাম (আমাদের এখানের উমাপদদা) তাঁকে বই ফেরত দিতে।

দেখা যাচ্ছে যে, সবকালেই যেসব লেখক জনপ্রিয় তাঁদের সমকালীন লোকেরা সস্তা লেবেল লাগিয়ে বাতিল করার নানাবিধ চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ বা ভয় দেখিয়েছেন যে মহাকালের ধোপে তুমি বাপু ট্যাঁকবে না। যাদের বই বিক্রি হয় না তাঁরাই স্বভাবগত বড়ো লেখক এবং যাঁদের বই বিক্রি হয়, তাঁরা ছোটো লেখক। এই তথাকথিত ছোটো লেখকদের প্রতিভূ হয়ে সমকালীন সূর্যসম কোনো লেখককে কেউই বলার সাহস রাখেননি যে উপস্থিত কালটাও যে মস্ত ব্যাপার। তার দাবি মানব না বললে সেও যে শাস্তি দেয়।

ভালো থেকো। বড়ো করে লিখতে পারো না? সমস্ত স্বদেশ তার সব মানুষজন আকাশ বাতাস পাখি প্রজাপতি তোমার হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে আছ আর আমার স্বদেশ বলতে তুমি! শুধুই তুমি! তাই দয়া কোরো। চিঠির ব্যাপারে অন্তত কৃপণ হোয়ো না। চিঠির মধ্যে দিয়ে আমরা যেমন করে একে অন্যকে প্রকাশ করতে পারি, পেতে পারি; তেমন করে সঙ্গমের মাধ্যমেও পাওয়া সম্ভব নয়। মানো তো?

‘আমি নিশিদিন তোমায় ভালবাসি, তুমি অবসরমতো বাসিও। আমি নিশিদিন হেথায় বসে আছি তোমার যখন মনে পড়ে আসিও’।

ইতি তোমার সুমু! তোমার জন্যে চুমু।

.

০৮.

খবরটা সকাল আটটার মধ্যে দাবানলের মতো ছড়িয়ে গেলো হুরহুলাগড় ইণ্ডাস্ট্রিজের হাসপাতাল থেকে কারখানায় তো বটেই কারখানার চত্বর পেরিয়ে পুরো টাউনশিপ-এ এবং টাউনশিপ ছাড়িয়ে পুরো হুরহুলাগড় জনপদে।

সুমন সেন, পারাদীপ থেকে গাড়িতে করে হুরহুলাগড়ে ফিরে আসছিলেন। পোর্টের অথরিটির সঙ্গে মিটিং ছিল ইণ্ডাস্ট্রিজের এক্সপোর্টের সুষ্ঠু সম্পাদনের ব্যাপারে। মিটিং চলে বিকেল সাড়ে পাঁচটা অবধি। ওঁরা বলেছিলেন যে, রাতটা গেস্ট হাউসেই থেকে যেতে। থাকলে, গেস্ট হাউস ছাড়াও সেন সাহেবের থাকার বহু জায়গাই ছিল। কিন্তু পরদিনই রথোসাহেবের লোক সি আই ডির সব খবরাখবর নিয়ে সকালেই এসে পৌঁছোবে বলে উনি থাকতে চাননি। গোপেন জানত।

যে-পথে উনি আসছিলেন সেই পথটিকে টাউনশিপ থেকে মাইল দুয়েক আগে একটি ঘাট পেরিয়ে হুরহুলাগড়ের দিকে আসতে হয়। উঁচু ঘাট, তবে হেয়ারপিন বেণ্ড বেশি নেই, কিন্তু ঘন জঙ্গল আছে। এ পথটি দিয়ে ট্রাক বিশেষ চলাচল করে না তাই প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে সকলে ওই পথেই যাতায়াত করেন পারাদীপ বা কটক বা ভুবনেশ্বর থেকে যাওয়া-আসার জন্যে। ওই ঘাটে যখন সেনসাহেবের কন্টেসা এসে পৌঁছোয় তখন রাত প্রায় এগারোটা। রাত আটটার পরে ওই পথে গাড়ির যাতায়াত প্রায় থাকেই না। ট্র্যাফিক প্রায় থাকে না বলে এবং জঙ্গল পাহাড় থাকায় আটটার পর এলে সকলেই মেইন হাইওয়ে দিয়েই যাওয়া-আসা করেন।

একটি ট্রাক উলটোদিক থেকে সেনসাহেবের গাড়িকে আটকে দেয় পথে। আড়াআড়ি করে এসে। ঘাটের ওপরে। বাঁকের মুখে। পথ জুড়ে।

অ্যাকসিডেন্ট হতে পারত। সেন সাহেব নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ড্রাইভার পাশে বসেছিল। ড্রাইভারের কাছে গোপেনরা শুনেছে পরে যে, উনি পেছনের সিটে বসে হুইস্কি খাচ্ছিলেন। হুরহলাগড়ের মাইল পঞ্চাশেক আগে ড্রাইভারকে পেছনে যেতে বলে নিজে স্টিয়ারিং নেন।

কোনোক্রমে গাড়িটাকে ট্রাকের প্রায় মুখে এনে দাঁড় করান তিনি। এবং তখুনি ট্রাক থেকে আট-দশজন লোক নেমে সেনসাহেবকে গাড়ি থেকে নামিয়ে লোহার রড এবং ছুরি দিয়ে মারে। ড্রাইভারকেও মারে। তবে শুধু লোহার রড দিয়ে। অজ্ঞান অবস্থায় তাঁদের গাড়িতে তুলে দিয়ে ট্রাক দিয়ে গাড়িকে ধাক্কা মেরে তারা খাদে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, এমন সময় কোল ওয়াশারির পট্টনায়েকসাহেব তাঁর পরিবার নিয়ে ফিয়াট গাড়িতে কটক যাচ্ছিলেন তাঁর দাদার হঠাৎ মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ওই পথ দিয়েই, পাঁচ মাইল শর্টকাট করার জন্যে।

পট্টনায়েকসাহেবের গাড়ি এসে পড়ায় ট্রাকটি বেগতিক দেখে এবং অতজন সাক্ষী থাকবে জেনে ওঁদের গাড়িকেও ধাক্কা মারে। রেডিয়েটর ফেটে যায় ফ্যান ঢুকে যায় রেডিয়েটরের ভেতরে। এঞ্জিনেও চোট লাগে। মিসেস পট্টনায়কের দাঁত ভেঙে যায় দুটি। তাঁর নিজের বুকের পাঁজর ভাঙে। গাড়ি উনিই চালাচ্ছিলেন। ওই অবস্থাতে দুই গাড়িকে ফেলে রেখে সেই ট্রাকটি চলে যায় হুরহুলাগড়েরই দিকে। পট্টনায়েকসাহেবের ছেলে ট্রাকের নাম্বার লিখে রাখে কিন্তু পরে সে নাম্বার ভুয়ো বলে জানা যায়।

পট্টনায়েকসাহেবের এগারো বছরের ছেলে, গভীর রাতে দু-মাইল পথ একা অন্ধকারে পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে দৌড়ে এসে টাউনশিপের মেইন গেটের দারোয়ানদের খবর দেয়। তারা ফোনে খবর দিলে দুটি অ্যাম্বুলেন্স চলে যায় আগে। পরে অন্যরা।

বেলা এখন এগারোটা। সুমন সেনের জ্ঞান এখনও ফেরেনি। মালটিপল উস। মাথাতেও অনেক চোট। সারাশরীরে আট দশ জায়গায় স্ট্যাবিংও হয়েছে। ড্রাইভারের জ্ঞান ফিরেছে সকালেই। তার নিজের জন্যে সে যত না উদ্বিগ্ন তার চেয়ে অনেকই বেশি উদ্বিগ্ন তার মালিকের জন্যে।

গোপেন, সেনসাহেবের পি-এর মাধ্যমে ভুবনেশ্বরে সেনসাহেবের বন্ধু পুলিশ অফিসারদের ফোন করে দিয়েছিল। হাসপাতালের সামনে এখন পাঁচশো মানুষ জড়ো হয়েছেন। হোমরা চোমড়ারা থেকে দিনমজুরেরা পর্যন্ত। মানুষটাকে হুরহুলাগড়ের প্রত্যেকে যে সত্যিই খুব ভালোবাসে। যে মানুষ শ্রমিকদের ইউনিয়নে বিশ্বাস করেন না সেই মানুষেরই জন্যে দরদ সবচেয়ে বেশি শ্রমিকদেরই যে তা নিজেদের চোখে দেখে ওপর মহলের অফিসারেরা গর্ববোধ করছিলেন। চোখ ছলছল করছিল তাঁদের। সেনসাহেব শ্রমিকদের বলতেন যে এদেশের শ্রমিক-আন্দোলন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের আত্মসম্মানজ্ঞানহীন ভিখিরি করে তোলে। ভিক্ষাবৃত্তির মধ্যে কোনো গরিমা নেই। আপনারা এখানে সবচেয়ে বেশি সম্মানিত।

তাই সেনসাহেবের আরোগ্য এবং জীবনের জন্যে অগণ্য মানুষ আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করছে এই মুহূর্তে! এবং যে বা যারা ওঁর এই অবস্থার জন্যে দায়ী, তাদের অভিসম্পাত দিচ্ছে। নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে সব স্তরের কর্মীদের মধ্যেই আততায়ী কারা হতে পারে সে সম্বন্ধে।

গোপেন ব্যানার্জিকেও কলিগরা সাবধানে থাকতে বলেছেন। হামলা তার ওপরেও হতে পারে যে-কোনো মুহূর্তে।

 সুমন সেন অজ্ঞান অবস্থাতে শুয়ে থাকলেও তার যজ্ঞ ঠিকই চলছে। নাম্বার টু, ধাওয়ানসাহেব হাতজোড় করে, যাঁরা হাসপাতালে ছিলেন তাঁদের সকলকেই কাজে যেতে বললেন। বললেন, যার যে কাজ তা করাই হবে সেনসাহেবের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা এবং অনুরাগ দেখানো। ওঁর কাছে কাজ আর পুজো চিরদিনই এক ছিল। ডাক্তারেরা রয়েছেন। কটক ও ভুবনেশ্বর থেকেও ডাক্তারেরা রওয়ানা হয়েছেন। তাঁরা এসে পৌঁছলেন বলে। হাসপাতালের কর্মীদের এঁদের কাজ করতে দিন। প্রতি আধঘণ্টা অন্তর পাবলিক রিলেশানস অফিসার প্রত্যেক কারখানাতে সেনসাহেবের অবস্থা সম্বন্ধে জানিয়ে দেবেন। তাঁর অফিসে স্পেশ্যাল মেসেঞ্জাররা থাকবেন। অ্যাডিশনাল ফোন লাগিয়ে দিতে বলে দিয়েছি পোস্ট অ্যাণ্ড টেলিগ্রাফের লোকদের।

গোপেন একবার টুল শপ থেকে ফিরে এসেছে। উত্তেজনা ও অপরাধবোধটা টুল শপ-এই বেশি। তাদেরই একজন সহকর্মী এই ব্যাপারের পেছনে রয়েছে। ফিরে এসে ধাওয়ানসাহেবকে বলে ও হাসপাতালেই থাকল। উনিও বললেন, কারো কারো তো এখানে থাকতে হবে।

একটা অবধি জ্ঞান ফিরল না সুমন সেন-এর। বড়ো ডাক্তার এবং সার্জেনরা এসে গেছেন। কটক এবং ভুবনেশ্বর থেকে। তাঁরা বুলেটিন দিলেন জয়েন্টলি সই করে যে, বিপদ এখনও কাটেনি। সার্জারি হয়েছে। এবং আরও হবে। আটচল্লিশ ঘণ্টা না গেলে কিছুই বলা যাচ্ছে না।

পুলিশের অফিসার আর জওয়ানেরা হাসপাতাল ঘিরে রেখেছে। এস ডি পি ও-র নির্দেশে গোপেনের বাড়ির সামনেও নাকি প্লেইন-ড্রেসে আমড-গার্ড দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে একজন সাদা পোশাকের বডি গার্ড-ও থাকবে।

দুপুরে একবার খেতে এল বাড়িতে। হাসপাতাল থেকে অফিসার্স ক্যানটিন যত দূরে বাড়িও ততই দূরে। খবরটা শ্ৰী জানত না। যদিও জানালা দিয়ে পথে চেয়ে একটি অস্থিরতা লক্ষ করেছিল। বরত বাজার থেকে শুনে এসেছিল, কারখানার হাসপাতালে সকলেই দৌড়োচ্ছে। খুব বড়ো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে নাকি কাল রাতে। কাল রাতে শুনে শ্রী, গোপেনের যে কিছু হয়নি তা জেনে নিশ্চিন্ত ছিল।

গোপেন যখন অসময়ে এল তখন শ্রী খেতে বসেছে। তাড়াতাড়ি তাকেও খেতে বসিয়ে সব শুনল। মুখ সাদা হয়ে গেল শ্রীর। নিজের উত্তেজনায় নিজে মথিত ছিল বলে গোপেন শ্রীর মুখ-চোখের দিকে তাকাবার অবকাশই পেল না।

তাড়াতাড়ি খেতে খেতে গোপেন বলল, কতদিন বললেন ভদ্রলোক। তুমি তো যেতেই চাইলে না। আর কোনোদিনও দেখা হবে কি না, যেতে পারবে কি না এখন সেইটাই প্রশ্ন।

শ্রী খেতে খেতে মুখ ঘুরিয়ে জানালার দিকে চেয়ে বলল, ভালো হয়ে উঠবেন উনি। তুমি দেখো।

কিছুই বলা যায় না। সাংঘাতিক অবস্থা। ডাক্তারেরা কোনো আশাই দিতে পারছেন না।

এত লোকের ভালোবাসার কি কোনো দাম নেই? ঈশ্বর দেখবেন ওকে।

ছাড়ো তোমার ঈশ্বর! লেখাপড়া শিখেও যে কী করে এমন অশিক্ষিতর মতো ঈশ্বর ঈশ্বর করো তা তুমিই জানো।

অত্যন্ত অসহিষ্ণু গলায় বলল গোপেন। এইভাবে গোপেন কখনো কথা বলে না শ্রীর সঙ্গে।

 শ্রী অবাক হয়ে একবার তাকাল গোপেনের মুখে।

মনে মনে বলল ঈশ্বরবোধ, ঈশ্বরবিশ্বাস সবই ভেতরের জিনিস। কারো থাকে, কারো থাকে না। যার নেই, তার পক্ষে ব্যাপারটা ধারণা করাও মুশকিল। কিন্তু নিজের যা নেই তার দৈন্যর কারণে অন্যকে হেয় করার মধ্যে আর যাই থাকুক না কেন, শিক্ষা একটুও নেই। কিন্তু মুখে ও বিষয়ে আর কিছু বলল না। শ্লথ মন যাদের, তাদের কিছু বললেই যে দ্রুতগতি হয়ে উঠে সব বোঝাবুঝির আঙিনা তারা পেরিয়ে যাবে একদৌড়ে, তেমন আশা নেই।

মুখে বলল, তুমি খুব টেন্সড হয়ে আছ।

 ন্যাচারালি!

 আর ভাত নেবে?

 না। জমিয়ে খাওয়ার মতো সময় এবং মন দুইয়ের কোনোটাই নেই।

না-থাকাটাই স্বাভাবিক।

 আমার সঙ্গেও আর্মড-গার্ড আছে। বাড়ির সামনেও আছে। সাবধানে থেকো।

তোমার সঙ্গেই থাকুক। এ বাড়িতে তুমি ছাড়া, দামি বলতে তো কিছুমাত্রই নেই। না সম্পত্তি; না মানুষ।

 বলেই, উঠে পড়ে বেসিনে হাত ধুতে গেল শ্রী। তুমি কি ভয় পেয়েছ? তোমার গডফাদার এম ডির জন্যে? না, তোমার নিজের জন্যে?

গোপেনও উঠে এল হাত ধুতে হাত ধুয়ে, বেসিনের পাশে-রাখা তোয়ালে দিয়ে হাতমুখ মুছতে মুছতে হঠাৎই ঘুরে দাঁড়াল গোপেন। সর্পাহতর মতো, বলল, শ্রীকে। হয়তো তোমার জন্যে। ভয়।

 স্তব্ধ হয়ে গেল শ্ৰী। মুখে কথাই ফুটল না। তারপরে নিজের মধ্যের সমস্ত জোরকে একীভূত করে সে গোপেনের দিকে মুখ তুলে বলল, তার মানে?

নিজের ভয়ার্ত স্বরকে নিজেই চিনতে পারল না শ্রী।

আমার কিছু হলে বিধবা তো তুমিই হবে। সেনসাহেবের কিছু হলে শুধু আমারই নয় পুরো হুরহুলাগড়েরই যে কী হবে বলা যায় না। আমি এখান থেকে চলেও যেতে পারি। আমার ক্ষতির সঙ্গে তোমার ক্ষতি যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তুমি যে এদেশের অগণ্য মেয়েদেরই মতো একজন পতি-নির্ভর স্ত্রী। লকারে-রাখা তোমার অব্যবহারের গয়নাও যা, সেখানে রাখা তোমার ডিগ্রিগুলোও তাই।

কোনো কথা বলল না শ্ৰী।

 আমি চলি। কোথাও বেরিয়ো না। আমার চিন্তা আর বাড়িয়ো না।

ঠিক আছে।

অস্ফুটে বলল, শ্রী।

গোপেন চলে গেলেই খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়ে বেসিনে গেল হাত ধুতে। হাতে ভাত লেগেছিল। কয়েকটি ভাত। চেটে খেল ভাত ক-টি। বড় অপমানের ভাত। যার যতই শিক্ষা থাকুক, যে নারী স্বাবলম্বী নয়, তার বুককে মাঝে মাঝে তীক্ষ্ণ ছুরির মতো অপমান এসে বিদ্ধ করেই।

গোপেন কিন্তু এর আগে কখনোই এমন করে কথা বলেনি শ্রীর সঙ্গে। ওর ভদ্রতা সম্বন্ধে শ্রীর কোনোদিনই বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। আজ কেন যে এমনভাবে কথা বলল গোপেন। সুমনের ব্যাপারে খুবই আপসেট হয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই। শ্ৰী যে সুমনকে ফোন করেছিল তা জেনে যায়নি তো গোপেন? পরক্ষণেই মনে পড়ল যে পরশুদিন, রবিবার, সে জানালা দিয়ে দেখেছে ভানু মহাপাত্রর সঙ্গে গল্প করতে করতে গোপেন আসছে। ভানুবাবু হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কী যেন বলছিলেন গোপেনকে।

এই মুহূর্তে হুরহুলাগড়ের সব মানুষই হয়তো সুমন সেনের জীবনের জন্যে প্রার্থনা করেছিলেন। কিন্তু শ্রী তাঁর মৃত্যু কামনা করল। শ্ৰীই একমাত্র জানে যে, সুমন বেঁচে উঠলে শ্রীকে মরতে হবে সুমনকে বাঁচাতে। নয়তো পালাতে হবে শ্রীকে এখান থেকে। শ্রী এখানে থাকলে সুমনের কষ্ট মৃত্যুযন্ত্রণার চেয়েও বেশি হবে। বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে এঁটো হাত ধুতে ধুতে শ্রীর মুখে এক গভীর বেদনা ফুটে উঠল। দু-গালে জলের ধারা বইতে লাগল। এঁটো হাত তবু ধোওয়া যায় সাবান দিয়ে। কিন্তু এঁটো জীবন?

পেছন থেকে, বাসন তুলতে তুলতে ভরত বলল, চোখে লঙ্কা গেছে বুঝি? না লেবু?

উত্তর দিল না শ্রী।

লেবু-লঙ্কার চেয়েও অনেক বেশি জ্বলনের জিনিস যে আছে সংসারে, ভরত এখনও জানে না।

মুখ চোখ ধুয়ে ভরতকে বলল, সেদিন রাতে যে সাহেব এসেছিলেন না? তাকে গুণ্ডারা খুব মেরেছে। রড দিয়ে, ছোরা দিয়ে। বোধ হয় বাঁচবেন না।

তাই? ঈশশ। সাহেবটা বড়ো ভালো।

সকলেই বলে।

 শ্রী বলল।

তারপর বলল, যাকে তাকে হুট-হাট করে দরজা খুলবি না। গুণ্ডারা তোর বাবুকেও মারতে পারে।

আমার বাবুকে? কেন?

সেসব অনেক কথা। আমিই জানি না ভালো করে, তার তোকে বলব কী।

চলো, আমরা পালিয়ে যাই এখান থেকে বউদি।

কোথায়?

যেখানে হয়।

ভয় নিয়ে কেউই পালাতে পারে না। যেখানেই যাব সেখানেই ভয় তাড়া করে ফিরবে।

যা বাব্বা!

বলে, ভরত চলে গেল।

শ্রী চলে-যাওয়া ভরতের দিকে চেয়ে নিরুচ্চারে বলল, শরীর সহজে দূরে যেতে পারে। কিন্তু মন? এই হুরহুলাগড়ে যে কী কুক্ষণে সে এসেছিল! সুমন যদি বেঁচে ওঠে তবে শ্রী নির্ঘাৎ মারা যাবে। শরীরে মনে সুমনের যদি একটু অপূর্ণতা থেকে যায় এই দুর্ঘটনার পরে, পূর্ণ হওয়া বাকি থেকে যায় এই দুর্ঘটনার পরে, তবে শ্রী সারাটা জীবনই হয়তো পূর্ণ হওয়া থেকে অনেকই দূরে থাকবে। শূন্যতাও যে কখনো কখনও মস্ত বড়ো পূর্ণতার দ্যোতক হয়ে আসে, এই কথাটা এই মুহূতাঁর আগে ও এমন করে অনুভব করেনি।

ঘরে জানালার পাশে দাঁড়াল একবার। আকাশে মেঘ। আজ সকাল থেকেই পাহাড় জঙ্গল থেকে ঝুর ঝুরু করে হাওয়া আসছে একটা। নিমগাছ থেকে নিমফুল উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। দূরে দূরে। আর সেই বনের পাখিগুলো! মেঘলা আকাশ আর গর্ভবতী হওয়ার কাছ থেকে ওদের কী যে প্রত্যাশা তা ওরাই জানে কিন্তু ওদের চঞ্চলতার আজ কোনো সীমা নেই। জানালার গরাদের এপাশে দাঁড়ানো শ্রীকে ওরা যেন চিৎকার করে বলছে, বেরিয়ে এসো, ভাঙো গরাদ।

অপর্ণা সেনের পরমা! ছবিটি যখন প্রথমবার গোর্কিসদনে দেখানো হয় তখন তাতে একটি দৃশ্য ছিল, বালবিধবা পাগল পিসির। ছাদের চিলেকোঠায় গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য। আরও একটি দৃশ্য ছিল সেই পিসিরই পালিয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টার। ছবিটি যখন কমার্শিয়ালি রিলিজড হয় তার আগে সত্যজিৎ রায় ছবিটি এডিট করে দেন। একথা অপর্ণার মুখেই শোনা। শ্রীর খুব পরিচিত এক ভদ্রলোককে অপর্ণা নিজের মুখেই বলেছিলেন। গোর্কি সদনে ছবিটি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল শ্রীরও। ওই দৃশ্যদুটি না কাটলে পরমার বক্তব্য এবং পিপাসা আরও অনেক বেশি তীব্র ও পরিষ্কার হত। একজন মেয়ে হিসেবে এই কারণে অপর্ণা সেনের কাছে শ্রীর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

 এই মুহূর্তে গরাদের পেছনে দাঁড়িয়ে পথের দিকে চেয়ে থাকা শ্রী নিজের মধ্যে স্বাধীনতার, বাঁচার মতো বাঁচার এক তীব্রতম ইচ্ছা অনুভব করল। পরমা না দেখলে ওই ইচ্ছা হয়তো ওর মধ্যে জাগরূকই হত না। পরমা তাকে বুঝিয়েছিল যে বাঁচার অনেকই রকম হয়। সংসারের অভ্যাসের বাঁধনটা শ্রীর মতো মেয়েদের সব অনুভূত বোধকে বড়ো ভোঁতা করে দেয়। বাঁচা আর জীবনধারণ যে সমার্থক নয় এই কথাটা তাকে বড়ো বিক্ষুব্ধ এবং অশান্ত করেছে। বিশেষ করে এখানে আসার পর থেকে। ওর নিজস্ব, শিক্ষিত, মার্জিত একটি মন আছে বলেই ওর পক্ষে অন্য দশজন মেয়ের মতো সহজে সুখী হওয়া হল না এ জন্মে।

সুমনের ব্যাপারটা শোনার পর থেকেই পাগল পাগল লাগছে ওর। কী করবে ও এখন? সুমনের চিঠিগুলি নিয়ে কি বসবে? না, না। চিঠিগুলি পড়লেই সে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়ে। মনের এই অবস্থাতে মনকে আরও বিস্রস্ত করার ইচ্ছে নেই।

দীপা মেয়েটা এই মুহূর্তে এসে পড়লে বেশ হত। ওর কথা শুনেই সময় কেটে যেত। মনের মেঘ তো বটেই, আকাশের মেঘও কেটে যেত। ওদের পিকনিক-এ যাওয়া হয়নি বটে হুরহুলাগড়ে, কিন্তু গোপেনের সঙ্গে দীপার আলাপ হয়েছিল। শ্রীদেরই বাড়িতে। দীপার উপস্থিতি এবং সঙ্গ গোপেনকে এক ধরনের মুগ্ধতা দিয়েছিল। যা গোপেনের মধ্যে শ্রী আগে দেখেনি। এমন উচ্ছ্বাসময় এমন আনন্দিত গোপেনকে কখনো দেখেনি দীপা আগে। খুব অবাক হয়েছিল। এই গোপেনকে ও কোনোদিনও চিনত না। গেপেনের মধ্যে যে এই গোপেন আদৌ ছিল, সেকথা পর্যন্ত অজানা ছিল শ্রীর কাছে।

প্রত্যেক মেয়ের শরীরেই কিছু সুইচ থাকে, যাতে হাত ছোঁয়ালে শরীরময় আলো জ্বলে ওঠে। প্রত্যেক পুরুই জানে যে এই সুইচের অবস্থান বিভিন্ন শরীরে বিভিন্ন জায়গাতে। অনেক পুরুষ আবার জানেও না। তারা নিজেরাই অভাগা নয়, তাদের সঙ্গিনীরাও অভাগী। এই আলোই জানোয়ার আর মানুষের শরীরবৃত্তর বিভাজক।

 শরীরের আলো জ্বালানোর মতোই মনেরও আলো জ্বালাবার ব্যাপার আছে। গোপেনের মনের মধ্যের সেই সুইচের খোঁজ জানা ছিল না শ্রীর। যে-আলো সে জ্বালতে পারেনি, দীপা এসে সেই আলো জ্বেলে দিয়েছে। কার হাতের ছোঁওয়ায় যে কোন আলো জ্বলবে তা আগে থাকতে যে জানাও যায় না ছাই।

 দীপা একদিন বলছিল, আমি যে দীপা। আলো জ্বালানোই তো আমার কাজ। সকলেই অন্ধকারকে ভাঙতে চায় শ্রীদি। কিন্তু অন্ধকার ভাঙতে গিয়ে অধিকাংশ মানুষই ভুল করে আলোই ভাঙে।

ভারি খুশি হয়েছিল শ্রী নিজের চোখের সামনে গোপেন ও দীপাকে অমন খুশি দেখে। দীপারও বেশ পছন্দ হয়েছে গোপেনকে। গোপেনের আড়ালে হেসে বলেছিল, তোমার বরকে খাব কি না ভাবছি। ঈশ্বর ওঁকে একটু আণ্ডার-ডান করে বানিয়েছেন। আমার পেটে কি সেদ্ধ হবে? অমন গুরুপাক খাবার?

শ্ৰী হেসেছিল।

বলেছিল, আণ্ডার-ডানকে মিডিয়াম-ডান বা ওভার-ডান করে নেওয়া যায় কিন্তু ওভার ডান যারা তাদের খাওয়া যদি না যায় তবে ফেলে দেওয়া বা কাউকে দিয়ে দেয়া ছাড়া গতি থাকে না কোনোই। সেটা দুর্ভাগ্যর। তাই নয় কি?

তা বটে!

দীপা বলেছিল। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গিয়ে।

সপ্রতিভ, সময়-বিশেষে প্রগলভ, অত্যন্ত হাসিখুশি দীপা গোপেনের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকেই কেমন বিষণ্ণ, অন্যমনস্ক এবং বোকা-বোকা হয়ে গেছিল। শ্রীর চোখে কিছুই এড়ায়নি। গোপেনের পরিবর্তনটা এসেছিল অন্যভাবে। ওর মনের তানপুরার তার চিরদিনই ঢিলে করে বাঁধা ছিল। দীপাই বোধহয় তার অদৃশ্য আঙুলে তা টান টান করে বেঁধে দেওয়ায় গোপেনের মন এখন ঝনঝন করছে। বাদল হাওয়া অথবা আচমকা ঘরে-ঢাকা ভ্রমরের ডানার ছোঁয়াতেই সেই তানপুরা তীব্রস্বরে বেজে উঠছে।

তিরবেগে বয়ে-চলা জোয়ারের এক নদী ছিল দীপা। তার মধ্যে হঠাৎই ভাটার টান শুরু হয়েছে। খড়কুটো ভেসে যাওয়ার অস্ফুট সরসর শব্দ, কালু পাখির তীব্র বিষণ্ণ স্বর, নদী পার থেকে ঘরে ফেরা অনামা পাখিদের শীৎকারের সঙ্গে মিলেমিশে যাওয়া বেদানার-কোয়া-রঙা বিকেলবেলার আলো যেন দীপার নরম মুখশ্রীতে এসে বাসা বেঁধেছে।

শেষবিকেলের আলোর মতোই মানব-মানবীর নিটোল প্রেম বড়োই ক্ষণস্থায়ী। জলেরই মতো। এই প্রেমকে জীবনের সমস্ত আন্তরিকতা দিয়েও আঁজলা ভরে বন্দি করা যায় না। প্রায় সবটুকুই গড়িয়ে গিয়ে উপচে পড়ে যায়। যা থাকে, তা সিক্ততা; স্মৃতি। এটুকুই। শ্রী সুমনকে ভালোবেসেছিল বলেই এই সত্যকে জানতে পেরেছিল। আজ দীপা জানছে। এবং গোপেনও।

.

০৯.

দাপা সত্যিই এল। পরদিন। গোপেন কারখানায় বেরিয়ে যাওয়ার পরই। দীপা বলল, তুমি তো গেলে না শ্রীদি পিকনিক-এ। তোমার বরও গেল না। কত্ব মজা করলাম আমরা।

আর কারা গেছিল?

সবাই আমার ছেলেবেলার বন্ধু।

বান্ধবী?

বন্ধুও। আজকাল স্ত্রীলিঙ্গ তো অব্যবহার্য হয়ে গেছে। মানে, ভাষার বেলায়। বন্ধু বলতে বন্ধু-বান্ধবী দুই-ই বোঝায়। দুজন পুরুষ বন্ধু ছিল আর দুজন মেয়ে বন্ধু। বাঙালি?

না। ওড়িয়া। আমি তো ওড়িয়াই।

যেতে পারলি? তোর সুমনদার খবর শুনে যাসনি?

বাঃ। আমরা তো গেছিলাম গতসপ্তাহে। তখন তো দুর্ঘটনা ঘটেনি।

 ও।

 কী সাংঘাতিক কান্ড! না?

 শ্রী চুপ করে রইল।

জানো তো, চারজন লোক ধরা পড়েছে আজ। নুয়াগড়-এ। কতদিন পরে ধরা পড়ল।

 তাই? নুয়াগড় কোথায়?

নুয়াগড়, নুয়াগড়ে। আগে দেশীয় করদ রাজ্য ছিল।

শুনেছিলাম, আরও লোক ছিল। মানে যারা মেরেছিল ওদের এম ডিকে, তাদের সঙ্গে?

 তাও ধরা পড়বে। বাছাধনেরা মারের চোটে কবুল করবে সবই।

এর পেছনে কে বা কারা ছিল?

শুনছি তো অনেক বড়ো চক্র। লোকগুলো ভাড়াটে। এর পেছনে নাকি তিন চারটি বড়ো পাবলিক সেক্টর কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টরেরা আছেন। যাঁরা ডিসঅনেস্ট। প্রচুর পয়সা করেছেন ট্যাক্সপেয়ারদের টাকা মেরে। এদিকে কোম্পানিগুলোতে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা লস। আর নিজেদের আঙুল ফুলে কলাগাছ। তারা সুমনদার মতো অনেস্ট, কেপেবল মানুষের শত্রু তো হবেই! সুমন সেনের জন্যে তাদের মুখ রাখাই দায় হয়ে উঠেছে যে! সুমনদাকে না কি পদ্মশ্রী দেওয়া হবে এবার। জানো?

এ মা:। উনি নেবেন? তোমার সুমনদা? এসব উপাধি-টুপাধি ভালো নয়।

 বাঃ রে? দিলে নেবেন না কেন? রাষ্ট্রপতি দেবেন। না নিলে স্বদেশকে অপমান করা হবে না?

 তা কেন? সরকারি খেতাবের সঙ্গে স্বদেশের সম্মান তো বাঁধা নেই। অনেকেই তকমা চান না। সাহেবদের আমলে মোসাহেব আর তোলাবাজ টাকাওয়ালা মানুষেরা রায়বাহাদুর আর রায়সাহেব খেতাবের জন্যে কাঙালপনা করতেন।

শুনেছি। আমি তো আর দেখিনি।

আমিও তো শুনেইছি। দেখব আর কোত্থেকে বল?

 একটু চুপ করে থেকে শ্রী বলল, তোর সুমনদাকে দেখতে গেলি না?

 লাভ কী?

কেন?

এই সময়ে কোনো পছন্দের মানুষকে দেখতে হয়? অজ্ঞান, ক্ষতবিক্ষত, নাকে অক্সিজেনের নল, পেট ফুটো করে নল; রক্তর বোতলের নল।

তুই তো ডাক্তার। তুইও দেখতে পারিস না! রোজই তো এসব দেখিস।

 রোজ তো আর সুমনদার মতো কাউকে দেখি না! যাদের দেখি, তারা তো রোগী; পেশেন্ট। তাদের অস্তিত্বটা আমার কাছে পুরোপুরি ইম্পার্সোনাল। কিন্তু সুমনদার ব্যাপারই আলাদা।

তবু, তুই নিজে ডাক্তার। তোর একবার যাওয়া উচিত ছিল। অন্তত জেনে আসতে পারতিস সত্যিই ব্যাপারটা কতখানি সিরিয়াস।

খুবই সিরিয়াস শ্রীদি। আসলে আমি হাসপাতাল থেকেই আসছি। যদি এযাত্রা বেঁচেও ওঠে, তবে হয়তো প্যারাটিক হয়ে যাবে। নয়তো ব্রেইন ড্যামেজড হয়ে যাবে। কী হবে না হবে তা এখন কিছুই বলা যায় না।

তাই?

ইমপার্সোনল গলাতে বলল শ্রী।

যারা সুমনদাকে মেরেছে, তারা জানে না যে; যে-টিম সুমনদা হুরহুলাগড়ে গড়ে তুলেছেন, যে ডেডিকেশন, ফিলিং অফ অ্যাচিভমেন্ট এখানকার প্রতিটি অফিসার এবং কর্মচারী ঐতিহ্য হিসেবে গড়ে তুলেছেন তাঁদের নিজ নিজ বুকের মধ্যে, তা এই ঘটনাতে শুধু শক্তই হবে। কাজটা শেষ করে ফেলতে পারলে, মানে, হিউম্যান মেটেরিয়ালকে ইনসপায়ার করার কথা বলছি; এই সব বাধা বিপত্তি সেই উদ্দেশ্যকে আরও মোমেন্টাম দিয়ে বেগবান করে, সুমন সেন আর একা মানুষ নন। একটি ইনস্টিশন। ওল বাই হিমসেল্ফ। বিজু পট্টনায়ক রোজ ফোন করছেন। ডিরেক্টর অফ হেলথ সার্ভিসেস এসে ঘুরে গেছেন ইতিমধ্যে। ভারতবর্ষের সব খবরের কাগজে, টিভিতে, রেডিয়োতে সুমনদার খবর রোজ বলছে। সুমন সেনই, ভারতের পাবলিক সেক্টর ইণ্ডাস্ট্রিজের কলঙ্কিত মুখ উজ্জ্বল করতে পারে। এইচ এম টি, ভেল, ইত্যাদি মুষ্টিমেয় কয়েকটি কোম্পানি ছাড়া হুরহুলাগড়ের ধারে কাছে আসতে পারে এমন তো কমই আছে। তা ছাড়া, সুমনদা অল্প ক-বছরে যা করছেন, প্রফিটের অঙ্কে নয়; টোটাল ম্যানেজমেন্ট, পার্সোনাল ম্যানেজমেন্ট, লেবার রিলেশন-এর ক্ষেত্রে, তাও একটা দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে।

তুই ডাক্তার হয়ে এত সব জানলি কী করে দীপা?

ওমা : এটুকু জানতে কী লাগে! একটা ইন্টাররেস্ট থাকলেই হয়। ব্যস্ত এঞ্জিনীয়ার যদি প্রথম সারির লেখক হতে পারেন, অ্যাকাউন্ট্যান্ট যদি চিত্রকর হতে পারেন আমি ডাক্তার হয়ে এই সামান্য খবরাখবরও রাখতে পারব না? আসলে কী হয় জানেন? আমরা জীবিকার জন্যে একটা কিছু করেই একেবারে ফুরিয়ে যাই। জীবিকার সঙ্গে টোটাল জীবনের যে অনেকই তফাত এই কথাটা কম মানুষই বুঝি।

আর যারা আমার মতো? যাদের একটি সামান্যতম জীবিকা পর্যন্ত নেই?

তারা তো ফরচুনেট। তাদের উদ্বৃত্ত সময়টুকুকে নিয়ে তারা কত কিছু করতে পারে। ছবি আঁকতে পারে, গান গাইতে পারে, বাগান করতে পারে, পরোপকার করতে পারে নানারকম। সোশ্যাল সার্ভিস, নিরক্ষরদের সাক্ষরতা দান; নগর পরিষ্কার। নার্সিং। কাজের কি অভাব আছে শ্রীদি? সময় থাকলে আর ইচ্ছে থাকলে কত কাজই তৈরি করে নিয়ে করা যায়! তা না, সচ্ছল বাড়ির মেয়ে-বউরা শুয়ে শুয়ে নভেল পড়ে।

নভেলের ওপর তোর এত রাগ কেন? অন্তত বাংলা নভেলের ওপর রাগ করিস না। কারণ, সচ্ছল ঘরের মেয়ে-বউয়েরা সব মেমসাহেব হয়ে গেছে এখন। বাংলা গান, বাংলা সাহিত্য বেঁচে আছে শুধু মধ্যবিত্তদের জন্যে। বাংলার সঙ্গে সম্পর্কটা রাখিস।

রাখি তো! অত্যন্ত কষ্ট করে হলেও রাখি। এখানে তো বাংলা শেখার কোনো সুযোগই নেই। মণিদিরা লিখেছিল, হাজারিবাগেও ওই একই অবস্থা। বাঙালিদের পয়সাও নেই, একতাও নেই। করে কে এসব?

 শ্রী চুপ করে ছিল। এখন এত কথা ওর ভালো লাগছিল না। ও যদিও ক-দিন ধরেই ভাবছিল দীপার কথা কিন্তু আসলে এই মুহূর্তে ও একটু একা থাকতে চায় সুমনের জন্যে প্রার্থনা করতে চায়। কিন্তু…

দীপা বলল, কই, আজ যে চা-কফি কিছুই খেতে বললে না আমাকে?

সেদিন তুই অতিথি ছিলি। আজ তো বাড়ির মেয়ে। যা খেতে ইচ্ছে হয়, ভরতকে বল। বানিয়ে দেবে। এখানে খেয়েই যা না আমার সঙ্গে। দুপুরে।

 তাও খেতে পারি। তবে এখনও মনঃস্থির করিনি। তোমার বরের সঙ্গে দেখা হল হাসপাতালে। তিনি বললেন, দুপুরে আরেকবার গিয়ে সুমনদার খোঁজ করে যেতে।

তাই? তবে তাই যাস। ওদের অফিসার্স ক্যানটিনের খাওয়াও খুব ভালো। শুনেছি। ওখানেই খেয়ে নিস তাহলে গোপেনের সঙ্গে।

তুমি রাগ করবে না তো?

রাগ? কেন? খুশি হব বরং।

খুশি হবে? কেন?

অন্যকে খুশি দেখলে আমার খুব খুশি লাগে।

তোমার স্বামী কি তোমার কাছে অন্য কেউ? আমিও কি অন্য?

 সকলেই এই সংসারে অন্য রে।

 কী জানি বাবা! তুমি রাগ করে বলছ কি না। তোমার বরের কি আমাকে পছন্দ হয়েছে?

খু-উ-ব। আর তোর? পছন্দ হয়নি গোপেনকে?

কী জানি! অবিবাহিত পুরুষ হলে ফট করে পছন্দ হয়ে যেতে পারত। বিবাহিত তো! তার ওপরে আবার তোমার বর! পছন্দর অ্যাকসিলারেটরের ওপর থেকে পা সরিয়ে ব্রেকের ওপর রাখতে হচ্ছে সর্বক্ষণ। ম্যারেড পুরুষদের সঙ্গে স্পিনস্টারদের মেলামেশা করাই উচিত নয়। দুঃখ পেতে হয়।

আর ব্যাচেলারদের সঙ্গে ম্যারেড মেয়েদের? উচিত কি মেলামেশা?

ওই একই প্রবলেম। প্রেম কী, জানো! গাঁয়ের শেয়াল। রোজই মওকা খুঁজে বেড়ায় কিন্তু কবজা করতে পারে না। কিন্তু কোনদিন যে ভরসন্ধ্যায় বা মাঝরাতে তোমাকে মুরগি বা ছাগলছানার মতো ক্যাঁক করে ধরে নিয়ে জীবনের বাঁশঝাড়ের দিকে দৌড় লাগাবে, তা তুমি বুঝতেই পারবে না। প্রেম ব্যাপারটা এনকেফেলাইটিসের চেয়েও খারাপ। কোন মশার কামড়ে যে হবে আগে থাকতে বুঝতেই পারা যাবে না। আর হলে! নিস্তার নেই। বোঝার আগেই ফওত।

শ্ৰী হেসে উঠল দীপার কথা শুনে।

বলল, কিছু উপমাও তোর স্টকে আছে। শুধুই উপমা।

 তোকে আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। জানিস দীপা।

রোজই দেখায়। তুমি হয়তো ভালো করে দেখোনি আমাকে আগে। সুন্দর করে তাকাওনি।

সত্যি! তুই সাজতে জানিস।

কী করব বলো? না জেনে তো উপায় নেই। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যেই সাজতে শিখেছি। তোমার মতো সুন্দরী হলে না জানলেও চলত।

একটু চুপ থেকে বলল, কই? কিন্তু তুমি তো বললে না, তোমার বরের আমাকে পছন্দ কি না!

তুই কি আমার বলার অপেক্ষাতে আছিস? তোকে একটা কথা বলব দীপা? কথাটা একমাত্র তোকেই বলতে পারি।

নিশ্চয়ই বলবে। বল।

তোর গোপেনদাকে তোর খুব পছন্দ, না? তোর গোপেনদারও তোকে খুব পছন্দ। তোদের দুজনকে চোখের সামনে এত সুখী দেখে আমায় যে কী ভালো লাগে।

দীপা একদৃষ্টে শ্রীর মুখে চেয়ে রইল। কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলল না।

 কী? উত্তর দিবি না?

দেব।

তা দে।

তোমাকে একটা কথা বলব শ্রীদি? তোমার মধ্যে যতখানি মহত্ত্ব অথবা ঔদার্য আঁটে তার চেয়ে বেশি মহৎ বা উদার বলে নিজেকে কখনো মনে কোরো না।

একটা ধাক্কা খেল শ্রী।

বলল, তুই আমাকে কতটুকু জানিস?

যতটুকু জানলে চলে। কেই বা কাকে পুরো জানে এল!

তুই অনেক জানিস, বুঝিস, দীপা কিন্তু সব বুঝিস না। বয়েস যে অভিজ্ঞতা দেয়, বা। জীবন; তা তুই শুধু বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে কখনোই পেতে পারবি না।

ব্যতিক্রমও থাকে শ্রীদি। সব ব্যাপারেই ব্যতিক্রম থাকে।

তুই, গোপেনকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবি?

এ আবার কী পারভার্শন! ভালোলাগে বলেই কি ছিনিয়ে নিতে হবে। কোনো ফুলকে ভালোলাগে বলেই যে তাকে ছিঁড়ে এনে ফুলদানিতে রাখতে হবে একথা আমি বিশ্বাস করি না।

 ছিনিয়ে নিলে আমার খুব উপকার হয়। জানিস।

কেন একথা বলছ তুমি? ঠাট্টা করছ? কিন্তু মুখ দেখে তো ঠাট্টা বলে মনে হচ্ছে না।

অনেকই কারণ। আমাদের ছেলে-মেয়েও হয়নি। গোপেনের মস্ত ক্ষোভ এ বাবদে। তবে অপারগতাটা যে কার তা নিশ্চিতভাবে জানা নেই। আমাদের দেশে এখনও সব দোষ মেয়েদেরই। এই নেগেটিভ ব্যাপারটা আমাকে যেমন মুক্ত রেখেছে, তেমন তোকে হয়তো বন্দি করবে। তুই যদি ছেলে-মেয়ে ভালোবাসিস তবে…।

দীপা বলল, এমনভাবে তুমি কথা বলছ যেন সোনপুরের মেলায় উট বিক্রি করতে এসেছ। যাকে তুমি আমাকে দিয়ে দিতে চাও, সে তো ইন-অ্যানিমেট অবজেক্ট নয়। তারও তো কিছু বক্তব্য আছে; অন্তত থাকতে পারে।

সে খুশিই হবে। তার মন আমি বুঝি। সে ক্লান্ত, বিরক্ত আমাকে নিয়ে।

আর তুমি?

আঃ। আমার কথা তো বলেইছি।

আট বছরের দাম্পত্যসম্পর্ক যদি এমনি করেই স্বামীর অজানিতে নিলামে উঠতে পারে তবে তা জেনেশুনেও দাম্পত্যে নিজেকে জড়াই কী করে এল? বেশ তো আছি!

দাম্পত্যে প্রবেশ না করলে দাম্পত্যের বৈচিত্র কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়। বলে না, দিল্লি কা লাড্ড। যো খায়া উও পস্তায়া, যো নেহি খায়া উওভি পস্তায়া। দাম্পত্য ব্যাপারটা বাইরে থেকে বোঝার নয়। সাঁতার শেখার মতো। জলে নামাটা জরুরি।

তোমার কথা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না শ্রীদি। দিস ইজ টু স্ট্রেঞ্জ টু বি বিলিভড।

তা ঠিক। তবে, Like Truth; life, as well, is stranger than Fiction জানিস তো।

তুমি কী কারণে গোপেনদাকে ডাম্প করতে চাইছ? জানতে পারি কি?

 ডাম্প তো করিনি। তোকে দেখে কিছু বুঝেছি বলেই এমনটি চাইছি।

কী বুঝেছ?

হয়তো বুঝেছি কিছু।

 আই থট অ্যাজ ম্যাচ।

তুমি কোনো কারণে আজ খুব আপসেট আছ শ্রীদি। ঊ্য আর নট ইন ইওর নর্মাল সেন্স। আমি আজ যাচ্ছি। পরে আসব আবার। কিন্তু কী তোমাকে এত আপসেট করেছে? সুমন সেনের ব্যাপারটা?

বাজে কথা। আই হার্ডলি নো হিম। তা ছাড়া আমি তো আর হুরহুলাগড় ইণ্ডাস্ট্রিজের কর্মী নই। আমার কোনো ফিলিংই নেই তার সম্বন্ধে। তাকে চোখে দেখিইনি কখনো। আই অ্যাম টায়ার্ড অফ হিয়ারিং দ্যাট নেম। ওই নামটি হুরহুলাগড়ের অবসেশান।

তা ঠিক। ম্যাগনিফিশেন্ট অবসেশান। তবে, চোখে না দেখেও এখানের এবং অন্য বহু জায়গার বহু মেয়ে-বউই তাঁকে স্বপ্নে দেখে। আফটার অল, হি ইজ আ ফেনোমেনান। তুমি স্বপ্নেও কি দেখোনি তাকে?

দীপা তুই এবার ওঠ। তুই কথা ভালো বলিস। স্পার্কলিং কনভার্সেশনিস্ট তুই। কিন্তু অ্যাট টাইমস, ঊ্য টক ননসেন্স। আটার ননসেন্স।

আই নো। আই এ্য। উঠলাম আমি। আই অ্যাম এওয়ার অফ এভরিথিং আই ড্যু।

 কোথায় যাবি এখন?

কেন? হাসপাতালে। তুমি যাকে ডাম্প করতে চাও, তোমার সেই বরের কাছেই যাচ্ছি। লাঞ্চ খাব।

দীপা উঠে, স্কুটারের চাবিটা আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, শ্রীদি আর উ্য রিয়্যালি সিরিয়াস?

চমকে উঠে শ্রী বলল, কী ব্যাপারে?

 বাউট গোপেনদা?

শ্রী মুখ নামিয়ে নিয়ে ভাবল একটু। তার পর বলল, হ্যাঁ।

দীপা তরতরিয়ে সিঁড়ি নেমে নিজেই দরজা খুলে চলে গেল।

ওর পেছনে পেছনে নেমে গিয়ে শ্রী খোলা দরজাতে দাঁড়াল।

দীপা মুখ ফিরিয়েও দেখল না। হাতও তুলল না। জোরে স্টার্ট করল স্কুটার।

ওর স্কুটার ধুলো উড়িয়ে টাউনশিপ-এর দিকে চলে গেলে দীপার মুখে এক স্মিত হাসি ফুটে উঠল। ও ভাবছিল, দীপা কি সত্যিই নরখাদক? হলেও, শ্রীর কিছুতেই কিছু যায় আসে না। ওর জীবনে এখন খাদ্য ও খাদক দুই-ই ইকুয়ালি আনইম্পর্টেন্ট হয়ে গেছে। ও এখন সত্যিকারের ইম্পর্ট্যান্ট কিছুর সন্ধান পেয়েছে। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জীবনের মতো, মাদার টেরিসার জীবনের মতো তার জীবনও অন্য এক মাত্রা পেতে পারে। যদি…

ভরত বলল, বউদি খাবার লাগাব?

 অন্যমনস্ক গলায় শ্রী বলল, একটু পরে। একটার সময়ে।

আজও আকাশ মেঘলা। রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। সকলেই বলছে, ঘোর কলি! সমস্ত পৃথিবীর আবহাওয়াই পালটে গেছে। গ্রীষ্মে বর্ষার আমেজ। এবার নহার নৌকো ভাসাবার সময় আসছে। সৃষ্টি নাশ হবে।

 আজও পাখিগুলো এসেছে। ভারি মন খারাপ করে দেয় ওরা। বনের পাখিগুলো; আকাশ, দূরের মায়াঞ্জন-ঘেরা জঙ্গল পাহাড়, মাথা-উঁচু হুরহুলাগড়ের পাহাড়, এই জানালার এই গরাদ তাকে রোজই এই সময়টাতে তার জীবনের অসারতা সম্বন্ধে সচেতন করে তোলে। যতই সচেতন করে তোলে ততই পাগল-পাগল লাগে। কর্মহীনতা-জনিত ক্লান্তি ওকে পেয়ে বসে। এই একঘেয়ে বৈচিত্রহীন জীবন তার কোনোদিনই প্রার্থনার ছিল না। গোপেনের মতো না খুব-ভালো না-খুব খারাপ স্বামীর কামনা ছিল না। নিঃসন্তান জীবনও সে চায়নি।

 রোজ এই সময় যখন মনটা খুবই খারাপ হয় ঠিক তখনই এই জানালা থেকে দেখা-না পাওয়া একটি কারখানা থেকে পেটা-ঘড়িতে একবার জোর শব্দ করে একটা বাজে। পাখিরা কলকাকলিতে মধ্যাহ্নর অলস অবসর ভরে দিয়ে ফুঙ্কারে উড়ে যায় বন আর পাহাড়তলির সবুজ অন্ধকারের দিকে। শ্ৰীর মনে হয়, তারও দাঁড় ছেড়ে ওড়ার কথা ছিল ওদের সঙ্গে। কিন্তু হল না।

নিঃশব্দ পায়ে পেছনে ভরত এসে বলে, একটা বাজল। এবার খাবার লাগাচ্ছি বউদি।

শ্ৰী খেতে বসেছিল, এমন সময় গোপেনের জিপের শব্দ শুনল নীচে। অবাক হল ও। তাহলে কি দীপা যায়নি হাসপাতালে? কিংবা খারাপ কোনো খবর?

খাওয়া থামিয়ে ও দরজার দিকে তাকাল।

কিছু খাওয়ার আছে?

থাকবে না কেন সবই আছে।

ঠাণ্ডা গলায় বলল শ্রী।

বলেই গলা তুলে ডাকল, ভরত! প্লেট নিয়ে আয় আর একটা।

তারপর বলল, তোমাদের এম ডি কেমন আছেন?

ভালো। অনেক ভালো। বারোদিন তো হয়ে গেল। কথাবার্তাও বলছেন। আজকে বলেছেন আমারও সঙ্গে।

কী বললেন?

তোমাকে নিয়ে যেতে বললেন কাল।

আমাকে?

অপ্রতিভ গলায়, বিষম খেয়ে বলল শ্ৰী। কেন?

হ্যাঁ, তোমাকে। কেন আবার কী? অনেকেই তো সস্ত্রীক যাচ্ছেন। আমাকে উনি হেসে বললেন, ব্যানার্জিসাহেব, শুধুমাত্র আপনার স্ত্রীর সঙ্গেই আলাপ হয়নি। এযাত্রা বেঁচে যখন গেলাম তখন কালই নিয়ে আসুন ওঁকে।

তুমি কী বললে?

কী আবার বলব? বললাম, নিয়ে আসব।

আমাকে জিজ্ঞেস না করেই বলে দিলে? আমি তোমাদের এম ডি-র সঙ্গে দেখা করতে চাই না। যার কথা এত শুনেছি তাকে দেখতে চাই না। মোহভঙ্গ হবে।

উলটোটাও তো হতে পারে।

বলে, হাত ধুতে গেল গোপেন বেসিনে।

উলটো-সোজা যাই হোক আমি যাব না।

তুমি যাবে না তো তোমার ঘাড় যাবে। আমার কি মান-সম্মান বলে কোনো ব্যাপার নেই?

একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল শ্রী, গোপেনের মুখের দিকে। ওর এই আশ্চর্য রুঢ় ব্যবহারে হতবাক হয়ে গেছিল শ্ৰী।

শ্ৰী আবারও বলল, আমি কিন্তু যাব না। বলে দিলাম।

সে কাল দেখা যাবে, তুমি যাবে কি যাবে না! এখন এ নিয়ে আর কথা বলতে চাই না।

শ্ৰী স্তব্ধ হয়ে বসে ভরতের এনে দেওয়া প্লেটে গোপেনের খাবার তুলে দিতে লাগল।

গোপেন বলল, আমি নিজেই নিতে পারব।

এই রূঢ় ব্যবহারের কারণ নিশ্চয়ই দীপা। ভাবল, শ্রী।

বলল, দীপা এল না? কোথায় খেল সে?

 দীপা?

হ্যাঁ। দীপা

তুমি নাকি দুপুরে যেতে বলেছ তাকে হাসপাতালে? সকালে যখন ও গেছিল তখন নাকি বলেছিলে তুমি?

দীপা! আশ্চর্য। আজ তো সকালে আমি কারখানাতেই ছিলাম হাসপাতালে যাইনি। বিধাওয়ান সাহেব বললেন ব্যানার্জি, এম ডি তোমার খোঁজ করছিলেন সকালে আমি যখন গেছিলাম। লাঞ্চের সময়, মানে লাঞ্চ আওয়ারের আগেই একবার যেয়ো। তারপর বাড়িতেই না-হয় খেয়ে ফিরে এসো। সেই মতোই তো গেছিলাম।

 তোমার সঙ্গে আজ দেখা হয়নি দীপার? সে তো এখান থেকে একটু আগেই গেল। কোথায় গেল তবে?

আশ্চর্য তো! তোমার বোন আমি কী করে জানব। এসব হেঁয়ালির মানে বুঝি না আমি!

হাত ধুয়ে খেতে খেতে গোপেন বলল, তোমাকে বুঝি এই সব গুল মেরে গেছে?

গুল কি না জানব কি করে! কিন্তু তাই তো বলে গেল।

 গোপেন হেসে ফেলল। বলল এই জন্যেই ওকে আমার ভালো লাগে। শালিই যদি হবে তবে এমনই হওয়া উচিত। কেমন মিশ্চিভাস মেয়ে দেখো! আর তুমিও তেমন! ওর গুল খেয়ে বসে আছ।

এখানে আসার পর থেকে গোপেনের ভাষার কৌলিন্য আর নেই। মজুরদের ভাষায় কথা বলে ও এখন। কারখানার প্রভাব।

ভাবছিল শ্রী।

যেমনভাবে বলেছিল, তাতে অবিশ্বাস করার তো কিছু ছিল না।

মিথ্যাচার অবশ্যই করছে কেউ। তবে তা কে, সেটা জানা দরকার।

শ্রী বলল।

খাওয়া থামিয়ে গোপেন বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?

আমি? আমি কী বলব! দীপা যা বলে গেল তাই

 দীপাকে বলে দেবে, আর যেন আমাদের এখানে না আসে। মানুষের মন সবসময় রসিকতার জন্যে তৈরি থাকে না। আশ্চর্য ইরেসপনসিবল মেয়ে তো!

তুমি কী করে জানলে যে সকালে ও হাসপাতালে যায়নি?

আমি জানি। ভিজিটার্সদের লিস্ট ছিল মেট্রনের কাছে।

 তাতে দীপার নাম ছিল না?

না।

কোনো মহিলার নামও ছিল না?

ছিল। একজন মহিলার নাম। মিসেস জি ব্যানার্জি।

তার মানে? আমি গেছিলাম বলছ?

 তুমি কেন যেতে যাবে। কিন্তু আর তো একজনও জি ব্যানার্জি নেই হুরহুলাগড়-এ।

খাওয়া থামিয়ে শ্রী রাগে লাল হয়ে উঠে বলল, তাহলে আমিই গেছিলাম।

কী হল! খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলে যে!

খাব না আমি। ভালো লাগছে না।

এগুলো নষ্ট হবে?

পেটে গেলেও তো নষ্টই হত। মনে করো, পেটেই গেছে।

 ভরত দই নিয়ে এসেছিল।

 শ্রী অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ভরত আমি সকালে বাড়ি থেকে কি কোথাও বেরিয়েছিলাম?

কই? না তো। দীপা দিদিমণি এসেছিল তো। তুমি কখন বেরোলে!

গোপেন খুব অবাক হয়ে গেল। খেতে খেতে, মুখ না তুলেই বলল, আই অ্যাযুম সরি! কেউ তোমাকে ইমপার্সোনেট করেছে।

কে?

 তা কী করে জানব! তবে তুমিই যদি সকালে যেতে, তো আমাকে উনি বলতেন কেন কাল সকালে তোমাকে নিয়ে যেতে?

দুপুরবেলায় রোগীকে বিরক্ত করতে যাও কেন?

 দুপুরে কোথায়? আমি সাড়ে বারোটা নাগাদ গেছিলাম। তারপর লক্ষ্মীপতির সঙ্গে হাসপাতালেরই ক্যানটিনে একটা মিটিং সেরে আসছি।

শ্ৰী হাতমুখ ধুয়ে শোবার ঘরে চলে গেল। আজ আর গোপেনের খাওয়া দেখার মতো মানসিক অবস্থা ছিল না ওর। ওই দীপা মেয়েটি সাংঘাতিক। ও কখন যে কী করছে তা বোঝা দুষ্কর। শ্রীর মনে গভীর সন্দেহ জাগল যে দীপাই গেছিল হাসপাতালে শ্রীর নাম ভাঙিয়ে।

কিন্তু কেন?

.

১০.

মনটা উচাটন তো হয়েছিলই। দুর্বলও কম হয়নি।

আজ রবিবার। একটু পরেই সত্যি সত্যি যেতে হবে হাসপাতালে ওকে গোপেনের সঙ্গে। গতকাল খাওয়ার সময় যাবে না বলেছিল বটে গোপেনকে কিন্তু না-যাওয়ার কোনো বুদ্ধি ও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ সে খুঁজে পেল না। বরং তার মন বলল যে, না-গেলেই গোপেনের মনে সন্দেহ দানা বাঁধবে।

ওরা ব্রেকফাস্ট করছে, এমন সময় নীচে একটি স্কুটারের আওয়াজ শোনা গেল।

রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে উঠল শ্ৰী। নিশ্চয়ই দীপা। যখন যাবে বলে হাসপাতালে মনঃস্থির করেই ফেলেছে, তখন আর কোনো বাধারই মুখোমুখি হতে চায় না ও।

গোপেন দেখতে গেল। মুখ গম্ভীর করে। কিন্তু তার গাম্ভীর্য উপছে এক ধরনের খুশিও চকচক করছিল মুখে। লক্ষ করল শ্রী।

দীপা নয়। অশেষদা।

গোপেন ঘোষণা করল ল্যাণ্ডিং থেকে।

 আসুন। আসুন! বলল শ্রী। বসুন। কী খাবেন? নীপাদি কেমন আছেন? দীপা?

এত প্রশ্ন একসঙ্গে করলে জবাব দিই কী করে? বসব না। কিছু খাব না। তোমার নীপাদি ভালো আছেন এবং দীপা আজই সকালে চলে গেল।

কোথায়?

বুড়লাতে। সম্বলপুরের বাস ধরল পাঁচছক থেকে।

 সেকী? আমাদের না বলে চলে গেল।

গোপেন বলল, অবাক গলায়।

 গতকালই তো এসেছিল। কই ঘুণাক্ষরে কিছু জানাল না তো।

আমার শ্যালিকাটি অমনই। তার দিদির ঠিক উলটো। তার দিদি তোমাদের এখানে এলেও পাড়ার লোক সাতদিন আগে জানতে পারে আর দীপার যাওয়া-আসা শরতের মেঘের মতো। এই আছে তো, এই নেই! চোখের পলকে ছায়া মিলিয়ে যায়।

তবু এমন করে যাওয়ার মানে কী? কোনো রহস্য আছে?

রহস্য হয়তো আছে। কারণ, সত্যিই এমন হঠাৎ সে কখনোই যায় না। কিন্তু সে রহস্যটি আমাদের জানা নেই। তোমরা জানো কি না তাইতো জানতে এলাম।

আমরা কোত্থেকে জানব? অবাক লাগছে আমাদের।

ওঃ। ভালো কথা। তোমাদের দুজনকে দুটি চিঠি দিয়ে গেছে। গতরাতে প্রায় দুটো অবধি ওর ঘরে আলো জ্বলেছে। নীপা বকাবকি করাতে বলেছে কী একটি জরুরি পেপার তৈরি করছে। বোধ হয় তখুনি চিঠি লিখেছিল।

আমাদেরও একটি করে দিয়েছে।

দেখি আমারটা।

শ্ৰী হাত বাড়াল।

 বেশ, মোটা একটি খাম দিলেন অশেষদা, শ্রীর হাতে। ওপরে লেখা Strictly Personal.

আমারটা।

গোপেনের হাতেও একটি খাম দিলেন। সেলোটেপ আঁটা। সেটির ওপরেও লেখা Strictly Personal

শ্রী উঠে গিয়ে চিঠিটি ওর হাতব্যাগের মধ্যে রাখল। বলল, আপনাদের দুজনকেও এইরকম Strictly Personal চিঠি দিয়েছে অশেষদা?

তোমার দিদিরটিও তাই শুধু আমারটি ছাড়া। অথচ দেখো একমাত্র শালি যদি একমাত্র জামাইবাবুকেই Personal চিঠি না লেখে তো কে লিখবে এল!

কী লিখেছে দীপা আপনাকে?

দেখবে? এই দেখো। পকেটেই নিয়ে বেড়াচ্ছি–

অশেষদা,

ক-দিন খুব মজা করে গেলাম।

মা বাবা নেই, দাদা নেই; দিদি আর আপনিই আমার সব। দিদির চেয়েও আপনি অনেক ভালো।

এ ক-দিন যে যত্ন আদর পেয়ে গেলাম এবং মজা করে গেলাম, তার স্মৃতি থাকবে পুরো একবছর।

শিগগিরই আমি চমৎকার কোয়ার্টার পাব। পেলেই জানাব। আপনারা সকলেই বেড়াতে আসবেন আমার কাছে। Fauna আর Floraকেও নিয়ে আসবেন। আপনি একাও আসতে পারেন। দিদির ব্লাড-প্রেশার বাড়িয়ে দেব বেশ।! মেয়েরা সব বয়েসেই বোধহয় স্বামীকে হারাবার ভয় পায়।

বিয়ের বাউণ্ডারি ওয়াল সম্প্রতি আবিষ্কার করেছি, খুবই হালকা-পলকা। ভঁড়ো শেয়াল অথবা তস্করের যখন তখন ঢুকে পড়াটা আদৌ বিচিত্র নয়। তাই সুদূর ভবিষ্যতে বিয়ের কথা আদৌ ভাবছি না। আমার কোয়ার্টারে আপনাদের জন্যে অঢেল জায়গা থাকবেই।

ভালো থাকবেন। দিদিকে একটু বকবেন। প্রেশারের ওষুধটা যেন নিয়মতি খায় দু-বেলা মনে করে।

ইতি/দীপা

অশেষদা অতিসরল প্রকৃতির লোক। বললেন, তোমাদের কী লিখল?

 শ্রী বলল, Stricitly Personal তো।

গোপেন বলল, আমারটাও তাই।

অশেষদার মুখে পান ছিলই। তাতে একটু জর্দা ফেলে বললেন, সেই গান আছিলো না। তোমাগো রবিঠাকুরের একটা। হঠাৎ মনে পইড়া গেল গিয়া। ইরা পররে আপুন করে, আপুনারে পর।

অশেষদার কথাতে গোপেন এবং শ্রী দুজনেই একসঙ্গে হেসে উঠল।

অশেষদা বললেন চলি। আইস্যো তুমরা। কী মাছ খাইবা আগে কইয়া দিয়ে। চাঁদবালি থিক্যা আনাইয়া থুমুঅনে।

আপনারা সকলে আসবেন। এখানে একদিন খান, সারাদিন থাকুন সকলে। কবে আসবেন বলুন। আমিও নতুন কোয়ার্টার পেয়ে যাব আরও মাস দুয়েকের মধ্যেই। নদী আর পাহাড়মুখো। দোতলার চমৎকার বারান্দা। তখন তো প্রতি রবিবারে আসতে হবে। এই বাড়িতে কষ্ট হয় আপনাদের।

ছাড়ান দ্যাওতো। শালির বড়ি আসুম তায় আবার কষ্ট! হঃ। যাই তাইলে আইজ।

শ্ৰী বলল, যাওয়া নেই। আসুন।

অশেষদাকে সিঁড়ি অবধি পোঁছোতে গিয়ে গোপেন বলল, তুমি নেমে এসো। আমি নীচেই আছি।

 শ্রী বলল, আচ্ছা। তারপর তৈরি যদিও হয়েইছিল তবু শেষবারের জন্যে একবার আয়নার সামনে দাঁড়াল। এই শ্রীকে কি ভালো লাগবে সুমন সেনের? লেজেণ্ডারি ম্যানেজিং ডিরেক্টর। সুমন রং হিসেবে ফলসা বিশেষ পছন্দ করত। শ্রী সাদা ব্লাউজ পরেছে একটি। ফলসা-রঙা শাড়ি। তাতে চওড়া বেগুনি পাড়। কপালে বেগুনি রঙা লিপস্টিকের টিপ। ঝুটো মুক্তোর বেগুনি-রঙা মালা। রুপোর পায়জোর পায়ে। হালকা বেগুনি লিপস্টিক।

নীচ থেকে গোপেন ডাকল, হল?

আয়নার সামনে শেষবারের মতো নিজেকে দেখে নিয়ে শ্রী বলল। যাই।

 তারপর নেমে জিপে উঠে বসল। বাইরের পাশে গোপেন। একেবারে বাঁ-পাশে শ্ৰী।

ভরত এসে দরজা বন্ধ করে দিল।

 গোপেন বলল, খেয়ে-দেয়ে বাড়িতেই থাকিস। আমরা আজ দুপুরে ফিরতে নাও পারি।

ভরত বলল, জানি তো!

জিপটা চোখের আড়ালে যেতেই একটি বিড়ি ধরল ভরত। আর গান ধরল, ফুলরসিয়ারে মন মোর ছুঁই ছুঁই যা না আ-আ-আ…।

 জিপটাকে, ড্রাইভার বাইধর, হাসপাতালের কমপাউণ্ডে পার্ক করাল।

লিফটে ওঠার সময়ে পা কাঁপছিল শ্রীর। লিফট থেকে নেমে কাঁপুনিটা থেমে গেল। ভিজিটার্স রুমে বসে কার্ড পাঠাল গোপেন। আরও তিনটি কাপল এসেছিলেন দেখা করতে। শ্রীদের ডাক পড়ল না। অন্যদের আগে ভেতরে যেতে বলা হল। গোপেন একটু ছটফট করছিল। শ্ৰীকে এম ডি সম্বন্ধে এতদিন যা বলেছে, তাতে সে যে এম ডি-র খুবই কাছের লোক এমন আভাস ছিল। শ্রীর কাছে ইমপর্ট্যান্স থাকছে না।

খুব অভিমান হল শ্রীর। এমনি করেই কি প্রতিশোধ নিচ্ছে সুমন। অপমান করে বোঝাচ্ছে যে, সে তার স্বামীর বস-এর বস। তাহলে ডাকাই বা কেন?

জানালা দিয়ে চোখ ছড়িয়ে সে বাগান দেখতে লাগল। এবং তার হাতে-ধরা লাল গোলাপের তোড়াটিকে।

 সেই তিনটি কাপলকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ছুটি করার পর শ্রীদের ডাকলেন নার্স। শ্রী দেখল, ওদের ঢুকিয়েই সুমনের স্যুইটের বাইরে নো ভিজিটার্স বোর্ড টাঙিয়ে দিলেন উনি।

 নার্স বললেন, বেশিক্ষণ থাকবেন না কিন্তু। আজ সকাল থেকে আবার লোক চিনতে পারছেন না মাঝে মাঝে। ডা: চোপরা খুব ওয়ারিড।

এই যে স্যার। আমার স্ত্রী এসেছেন!

 গোপেন বলল, গর্বর গলায়।

এই সংসারে কত গর্বই যে জানা বা অজানা লজ্জাতে মোড়া থাকে। যদি তা গর্বিত মানুষেরা জানতেন!

ক্ষীণ কণ্ঠে সুমন বলল, আসুন। আসুন।

শ্রীর দু-চোখে চোখ রাখল সুমন। সেই মুহূর্তেই ও নিজে মানুষ হিসেবে যে বেশ ছোটো তা বুঝতে পেরে একটা ধাক্কা খেল। নিজের সম্বন্ধে ধারণাটা অন্যরকম ছিল।

শ্ৰী নমস্কার করল না সুমনকে। সেটা লক্ষ করল গোপেন।

সেনসাহেবের কাছে গিয়ে শ্রী ফুলের তোড়াটা তাঁর হাতে দিল। কিন্তু অন্যদিকে চেয়ে।

গোপেন সেটাও লক্ষ করল।

শ্রী বলতে গেল, কেমন আছেন? সুমনকে।

কিন্তু কিছুই বলতে না পেরে মাথা নীচু করে বসে থাকল।

 গোপেন বলল, আমি ব্যানার্জি, স্যার। গোপেন ব্যানার্জি।

 শরীরটা ভালো নেই। আপনি কে?

শ্রীর মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ বেরোল। সেটা হ্যাঁও নয়, নাও নয়।

একটা ক্ষমাপ্রার্থনা-সূচক সংক্ষিপ্ত অস্ফুট শব্দ। খুবই করুণ। সুমনের জন্যে এবং নিজের জন্যেও বড়ো কষ্ট হচ্ছিল শ্রীর।

 সুমন খাটের সঙ্গে লাগানো বেল-এর সুইচ টিপে দেওয়াতে নার্স ভেতরে এলেন। সেনসাহেব বললেন, নার্স প্লিজ অ্যাটে টু হার।

গোপেন বলল, না স্যার। ওঁর তো কিছুই হয়নি।

হয়েছে। এটা টুলশপ নয় ব্যানার্জিসাহেব। আমি যা বলছি, শুনুন। ওঁর কিছু একটা হয়েছে। সেটা কী তা আমি জানি না। প্রেশারও হতে পারে, সুগারও হতে পারে। উনি কোলাপস করে যাচ্ছিলেন। লক্ষ করেননি আপনি? চেক-আপ করিয়ে ওঁকে সাবধানে বাড়ি নিয়ে যান।

নার্স শ্রীকে নিয়ে পাশের ঘরে গেলেন।

কী নাম আপনার স্ত্রীর? ব্যানার্জি সাহেব? উ্য শুড বি প্রাউড অফ ইওর ওয়াইফ।

নাম? শ্রীপর্ণা। বাড়িতে শ্রী বলেই ডাকি।

আঃ। নো নেম কুড বি মোর অ্যাপট ফর হার। ওঁকে আজকে নিয়েই যান। ওষুধ-টষুধের গন্ধেও হয়তো শরীর খারাপ হতে পারে। আমারও শরীরটা আজ সকাল থেকেই ভালো নেই। পেটের এক জায়গার সেলাই ছিঁড়ে গেছে। মাথাতেও বড়ো যন্ত্রণা। উনি সুস্থ হলে এবং আমি একটু ভালো হলেই আবার আসবেন।

স্যার। আমার স্ত্রী…

শ্রী?

হ্যাঁ আমার স্ত্রী শ্রী খুব ভালো সাবুর খিচুড়ি করতে পারেন। আপনার জন্যে একদিন করে নিয়ে আসতে বলব স্যার?

আমার সৌভাগ্য। নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই।

চলি স্যার।

আসুন ভাই।

দরজার কাছে যখন গোপেন গেছে তখন সুমন কী যেন বলল।

গোপেন আবার ফিরে গেল।

 কিছু বলছেন সেনসাহেব?

হ্যাঁ।

সুমন সেন যেন অনেকদূর থেকে কথা বলছেন এমনভাবে বললেন, ভাই ব্যানার্জি। আপনার স্ত্রীকে আমি কোথায় যেন দেখেছি। ভারি চেনা লাগল। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না। আই মাস্ট সার্চ ডাউন মাই মেমোরি লেন। নট ন্যাউ। সাম আদার টাইম। হোয়েন আই গো ব্যাক টু মাইসেল্ফ। মানুষ চিনতে পারছি না। চেনা লোক নাম বলে কাছে এসে দাঁড়ালে আন্দাজ করতে পারি গলার স্বরে, চেহারা দিয়ে নয়। আপনাকে অবশ্য পারলাম।

কোথায় দেখেছেন স্যার? আমরা স্ত্রীকে?

বলতে পারছি না ব্যানার্জিসাহেব। লেসলি এবার কম্বির একটা কবিতা পড়েছিলেন?

কী কবিতা স্যার?

She she, Like a visiting sea
Which no door could ever restrain

 শ্ৰী। নামটাও খুব চেনা। কিছুতেই মনে করতে পারছি না। পরে। পরে আশাকরি মনে করতে পারব। উঃ ভীষণ যন্ত্রণা। নার্স।

 গোপেন ছুটে পাশের ঘরে গিয়ে ডাকল ওঁদের। নার্স শ্রীর প্রেশার দেখছিলেন। ফোনে ডাক্তারকে ডাকা হল। ততক্ষণে সেনসাহেব পাস-আউট করে গেছেন তখনকার মতো। শ্রীর হাত থেকে লাল গোলাপের তোড়টা নিয়েছিলেন। বুকের ওপরে ফুলগুলো এলিয়ে ছিল।

ডঃ চোপরা বললেন, আপনারা স্টার্ন হোন সিস্টারস। উনি চাইলে কী হবে? রোগীর কথায় আমরা চলব, না আমাদের কথায় উনি চলবেন? উনি এম ডি হলে কী হবে? সুমন সেন হলেও হবে না। আনলেস হি অ্যাণ্ড ইউ ওল ওবে মাই অডার্স আই অ্যাম গোয়িং টু। রিসাইন। স্টপ ওল ভিজিটার্স।

স্যার। কী করব বলুন? সবাই যে কোম্পানির লোক।

মেট্রন বললেন। সকলে যে ওঁকে ভালোবাসেন। বাধহয় হঠাৎ কোনো শক–এ পাস-আউট করে গেছেন।

ওঁদের ভালোবাসা কি মিস্টার সেনকে বাঁচাবে? ওঁদের সকলের ভালোবাসার চেয়ে ওঁর আরোগ্যটা আমাদের কাছে বেশি জরুরি। মাথার রেস্ট-এর দরকার। অ্যাবসলুট রেস্ট। নেক্সট সাতদিন অ্যাবসলুটলি নো ভিজিটার্স। দ্যাট মীন্স নো-ভিজিটার্স। নো ওয়ান ইজ পারমিটেড। দ্যাটস মাই অর্ডার। আবার একটা ই-ই-জি করুন। এক্ষুনি। আমি দাঁড়িয়ে আছি। ডঃ হাটাকে খবর দিন ইন্টারকম-এ। আপনারা বুঝতে যদি না পারেন যে আওয়ার পেশেন্ট ইজ আ ভি ভি আই পি এবং হিজ কণ্ডিশান ইজ প্ৰিকারিয়াস তবে আমার বলার কিছুই নেই। প্রেশার ঠিকই ছিল শ্রীর। মাথাটা যে কেন ঘুরে গেছিল, তা শারীরবিদদের জানবার কথা নয় লিফট-এর কাছে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছিল ও গোপেনের সঙ্গে। ডঃ চোপরার কথাগুলো ওর কানে গেছিল। ওঁদের ভালোবাসার চেয়ে ওঁর আরোগ্যটা আমাদের কাছে বেশি জরুরি কথাটা কানে বাজছিল। কান লাল হয়ে গেছিল শ্রীর।

ওর শরীর খারাপ হয়েছে একথা জানা সত্ত্বেও গোপেন ওর পাশে ছিল না। পেছনে ছিল। গোপেন যেন ওকে ছেড়ে দিয়েছিল। যেন সব দাবি তুলে নিয়েছিল ওর ওপর থেকে। সুমনের ঘরে শ্রী ঢোকার পর থেকেই।

মনে হল, শ্রীর।

শ্রীর কানে…বাজছিল ওই পাঞ্জাবি ডাক্তারে গম্ভীর গলা। আওয়ার পেশেন্ট ইজ আ ভি ভি আই পি।

ভি ভি আই পি!

এর আগে কখনোই এমন মনে হয়নি। কিন্তু আজ সুমনের পটভূমিতে গোপেনকে বড়ো সাধারণ, পরিচয়হীন একজন অসফল মানুষ বলে মনে হল তার। শ্রী ভাবল, আরেকবার একা ঘরে গিয়ে দেখে যায় সুমনকে। তারপরই নিবৃত্ত করল নিজেকে। লিফটের দিকে ধীর পায়ে এগোতে এগোতে শ্রী ভাবছিল, রূপ, টাকা-পয়সা এসব একজন পুরুষকে কখনোই তা দিতে পারে না, যা দিতে পারে মর্যাদা। এবং যশ।

গোপেন বলল, এদিকে জিপ নেই। জিপ ওদিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *