৩. ছাড়াছাড়ি হওয়ার কারণটা

‘‘এত অবধি যা যা বলেছ সেসব শুনেও কিন্তু তোমার আর অনির্বাণের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হওয়ার কারণটা বুঝতে পারলাম না৷ মানে তোমার কিছু অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেটা নাহয় মানলাম৷ কিন্তু তার সঙ্গে তোমাদের বিচ্ছেদের কোনো সম্পর্ক তো খুঁজে পাচ্ছি না৷’’

কথাটা হচ্ছিল আমার ঘরে বসে৷ তখন সবে সন্ধে নামছে৷ কাকার কথামতো আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসেছি মাধুরীর কাহিনির শেষটুকু জেনে নেওয়ার জন্য৷

এখানে কাকার কথাটা বলে নেওয়া আবশ্যক৷ ইনি আমার নিজের কাকা নন, এমনকি রক্তের সম্পর্কেরও কেউ নন৷ কাজের সূত্রে আমাদের অফিসে একবার এসেছিলেন ভদ্রলোক, সেই থেকে আলাপ৷ এই মিষ্টভাষী, সদালাপী, জ্ঞানী ব্রাহ্মণবটুকে আমার প্রথম দর্শনেই বেশ ভালো লেগে যায়৷ দিনে দিনে সেই আলাপ বাড়তে বাড়তে ঘনিষ্ঠতায় পর্যবসিত হতে দেরি হয়নি বেশি৷

ভদ্রলোকের বয়েস তখন ছিল প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি, তাই শ্রদ্ধা দেখিয়ে কাকা বলে ডাকতাম৷ উনি অবশ্য মৃদু অনুযোগ করেছিলেন সে নিয়ে, ওঁকে দাদা বলে ডাকলেই নাকি ঠিক হত৷ বলা বাহুল্য সেসব কথায় কান দিইনি৷

ভদ্রলোকের বিভিন্ন বিষয়ে ইন্টারেস্ট আছে, সে নিয়ে পড়াশোনাও করেছেন প্রচুর৷ তবে আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছিল ওঁর তন্ত্রচর্চা৷ ভদ্রলোক ছিলেন একজন বিশিষ্ট তন্ত্রশাস্ত্রবিদ, ওঁর নিজের ভাষায়, ‘প্র্যাকটিসিং তান্ত্রিক’৷ ওঁকে দেখে অবশ্য দেখে সেসব বোঝার কোনো উপায় নেই৷ তান্ত্রিক বলতেই যেরকম গেরুয়া পরা, জটাজূটধারী, উগ্র স্বভাবের লোকজনের কথা মাথায় আসে, তাঁদের সঙ্গে এঁর কোনো মিলই নেই৷ ইনি দিব্য শার্ট-প্যান্ট পরিহিত, মাছেভাতে থাকা নিপাট মধ্যবিত্ত বাঙালি ভদ্রলোক৷ অন্নসংস্থান বলতে ইনশিওরেন্সের দালালি আর আমার মতোই দুষ্প্রাপ্য আয়ুর্বেদিক গাছগাছড়ার খোঁজ করা৷ গুণের শেষ ছিল না ভদ্রলোকের৷ খুব ভালো বাঁশি বাজাতে পারতেন, রান্নায় অসামান্য দক্ষতা ছিল আর যেটা সবচেয়ে ভালো পারতেন, সেটা হচ্ছে কোষ্ঠীবিচার৷ আমি নিজেও ওঁর কাছে প্রচুর শিখেছি এ ব্যাপারে৷

কাল আমার কথা শুনেই কাকা বলেছিলেন যে আমার ওপর একটা সাংঘাতিক বিপদ আসতে চলেছে৷ বিপদটা ঠিক কী, সেটা উনি অকুস্থলে না এলে বুঝতে পারবেন না৷ তবে আমি যেন আমার পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার আগে একটু অপেক্ষা করে যাই, কাল বিকেলের মধ্যেই উনি তিনসুকিয়া আসার চেষ্টা করছেন৷ তার আগে আমার একটাই কাজ, আমি যেন মাধুরীর থেকে ওর যাবতীয় কাহিনি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে জেনে নিই৷

ফোন রেখে দেওয়ার আগে একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম ওঁকে—

‘‘কেসটা কোনদিকে গড়াচ্ছে কিছু বুঝতে পারছেন কাকা?’’

‘‘পারছি বই কি!’’

‘‘সে কী? বুঝতে পারছেন? তাহলে সে বিষয়ে আমাকে বলুন কিছু৷’’

‘‘সময় এলে সবই জানতে পারবে ভাইপো৷ তোমার উচিত ছিল শিলিগুড়ি ছাড়ার আগে ওই গোলকপুষ্পের পুথিটার ব্যাপারে আমার সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া৷’’

‘‘সে নাহয় মানছি যে সেখানে আমার একটা ভুল হয়েইছে৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও…’’

‘‘ওহে আয়ুর্বেদাচার্য, গোলকপুষ্প মানে কী?’’

‘‘মানে আবার কী, গোল আকারের পুষ্প৷ কুঁড়িটার আকার ছোট গোলমতো, সে তো দেখেই এলাম৷’’

কাকা সচরাচর এসব ক্ষেত্রে অট্টহাসি হেসে আমার জ্ঞানের অপ্রতুলতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন৷ কিন্তু সেদিন ভদ্রলোকের স্বর খুব গম্ভীর শোনাল৷

‘‘শোনো ভাইপো, সম্পূর্ণ অজান্তে তুমি যেখানে পা দিয়েছ সে বড় বিপজ্জনক ফাঁদ৷ মুশকিল হচ্ছে এখন সেখান থেকে তুমি চাইলেও বেরিয়ে আসতে পারবে না৷’’

‘‘কেন? পারব না কেন?’’

‘‘কারণ স্বয়ং মদনদেব তাতে বাধা দেবেন৷’’

ঘোরতর প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলুম৷ তার আগেই আমাকে থামিয়ে দিলেন কাকা, ‘‘শোনো বাপু, সংসার করিনি তো কী হয়েছে, তাই বলে সাংসারিক জ্ঞান আমার কিছু কম নয়৷ শুনেছ তো, লালন গেয়ে গেছেন, অমাবস্যায় পূর্ণিমার তিথি, পুরুষের ক্ষয়ের ভীতি৷’’

ইঙ্গিতটা বুঝতে কষ্ট হল না৷ কানটা সামান্য গরম হয়ে উঠল৷ ছি ছি ছি, আমার বলার মধ্যেই এরকম কিছু ইঙ্গিত লুকিয়ে ছিল নাকি?

তবে সে সংশয় দূর হল কাকার পরের কথায়, ‘‘অত কিছু ভেবে লাভ নেই ভাইপো, এ তোমার ভবিতব্যের লিখন৷ তোমার কুষ্ঠী আমার মুখস্থ৷ আমি জানতাম যে তোমার জীবনে এই দিনটা আসতে চলেছে৷ আমার দৃঢ় ধারণা সেটা তুমি নিজেও দেখেছ, কিন্তু লক্ষ করোনি৷ একটা বিশাল ঝড় আসতে চলেছে তোমার ওপর৷ সেটা তুমি একা সামলাতে পারবে না৷ তার জন্য এই শর্মাকে তোমার দরকার৷ আমাকে ওখানে আসতেই হবে৷’’

এর পরে আর কথা চলে না৷ কাকা বললেন, যে করে হোক উনি পরের দিন সকাল নাগাদ তিনসুকিয়া চলে আসবেন৷ তার মধ্যেই আমি যেন মাধুরীর কেসটা ভালো করে জেনে রাখি৷

সেদিন পরাগদের ওখান থেকে যখন বাড়ি ফিরি তখন বেশ দুপুর৷ কাকিমা জানতেন যে আজ আমি বাড়িতেই খাব৷ দেখি আমার পছন্দের বোয়াল মাছের ঝাল আর কুমড়োফুলের বড়া রান্না করা হয়েছে৷ সঙ্গে ঘরে পাতা দই৷

মাথা নীচু করে খাচ্ছি, কাকিমা কানের কাছে ফিসফিস করে সতর্ক স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘কথা কিছু এগোল বাবা?’’

আড়চোখে তাকিয়ে দেখি রান্নাঘরে মাধুরী, বড়া ভাজছে৷ কাকিমার সতর্কতার কারণ বুঝলাম৷

‘‘আপনাকে কিছু বলেছে?’’

কাকিমা তড়িৎগতিতে মাধুরীর দিকে একবার তাকিয়েই ফের এদিকস্থ হলেন, গলাটা আরও নীচু করে বললেন, ‘‘না৷’’

আমিও গলা নামিয়ে খুব সংক্ষেপে জানালাম যে বার্তালাপ শুরু হয়েছে বটে৷ কিন্তু এখন তিনি বা কাকু এর মধ্যে বরং না ঢুকলেই ভালো৷ বিশদে কিছু বললাম না আর, কারণ ব্যাপারটা আমি নিজেই ভালো করে বুঝে উঠতে পারিনি৷

আড়চোখে দেখলাম প্লেটে আরও কয়েকটা কুমড়োফুলের বড়া নিয়ে মাধুরী এদিকেই আসছে৷ আমি স্বাভাবিক হলাম৷ উচ্চকণ্ঠে মাধুরীর রান্নার প্রশংসা করলাম৷ মেয়েটার গাল দুটো অল্প লাল হল৷ অল্প হেসে বলল, ‘‘তাও তো আমার দিদিমার হাতের রান্না খাননি৷’’

‘‘তাই নাকি? তিনি এর থেকেও ভালো রাঁধতেন?’’

‘‘ভালো? অসাধারণ বললেও কম বলা হয় বাবা’’, এবার জবাব দিলেন কাকিমা, ‘‘আমার মায়ের হাতের রান্না একবার যে খেয়েছে সে জীবনে ভুলতে পারত না৷ আর শুধু রান্নাবান্না কেন, অনেক কিছুতেই মায়ের হাত একেবারে সোনায় মোড়া ছিল৷ হোমিওপ্যাথি জানতেন খুব ভালো, অপূর্ব সুন্দর গান গাইতে পারতেন, সেলাই-ফোঁড়াই থেকে শুরু করে বাগান করা, আমার মায়ের সবেতেই আশ্চর্য দক্ষতা ছিল৷’’

‘‘আরিব্বাস, দিদিমার তো অনেক গুণ ছিল বলতে হবে৷’’

‘‘সে আর বলতে? তা ছাড়াও মায়ের ছিল দয়ার শরীর৷ পাড়ায় কার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, টাকার অভাবে কার বাচ্চার পড়াশোনা আটকে আছে, কার শরীর খারাপ, কে মা-বাবাকে দেখছে না, সব কিছু মায়ের নখদর্পণে থাকত৷ লোকে ভগবানের মতো মানত মাকে৷ মায়ের নামটিও ছিল তেমনই মানানসই, মহামায়া৷’’

‘‘আর আমাকে যে খুব ভালোবাসত দিদুন, সে কথা বললে না?’’ আদুরে গলায় বলল মাধুরী৷

‘‘সে তো বাসতেনই’’, আদর করে মেয়ের নাকটা টিপে দিলেন কাকিমা৷ তারপর আমাকে বললেন, ‘‘বুঝলে বাবা, আমার মেয়েকে প্রাণের থেকেও ভালোবাসতেন আমার মা৷ দিনরাত কোলে নিয়ে বসে থাকতেন আর মাথায় বুকে হাত বুলোতেন৷ আমাকে বলতেন, ‘ওকে খুব যত্ন করে মানুষ করিস মা, তোর মেয়ে ভৈরবীচিহ্ন নিয়ে জন্মেছে৷ ও ঈশ্বরকোটির মেয়ে, ও সাধারণ মেয়ে নয়’৷’’

ভৈরবীচিহ্ন, ঈশ্বরকোটি, এসব শুনে মাথার মধ্যে কিছু একটা টিকটিক করে উঠল৷ কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই মাধুরীর ফের সেই আদুরে গলা, ‘‘আর ওই যজ্ঞটার কথা বললে না মা?’’

‘‘ধুর পাগলি৷ সেসব কি এখন বলার সময়?’’ মেয়ের মাথায় আদরের হাত বুলিয়ে দিলেন কাকিমা৷

‘‘কীসের যজ্ঞ? শুনি শুনি’’, বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠলাম৷

‘‘আরে সে এমন কিছু নয়’’, সামান্য হাসলেন কাকিমা, ‘‘আমার মা খুব ধার্মিক মানুষ ছিলেন বাবা৷ যত কাজই থাক, ঈশ্বরচিন্তা করতে ভুলতেন না৷ কতদিন দেখেছি দিনরাত সংসারের নানা কাজ সামলে রাত্রে ধ্যানে বসতে৷ মানে ধরো আমি পাশে শুয়ে আছি ঘুমের ভান করে, আর চোখ পিটপিট করে দেখছি মা শিরদাঁড়া সোজা করে পদ্মাসনে বসে ধ্যান করছেন৷’’

‘‘বাপ রে! এসব তো সাধিকা যোগিনীরা করেন৷’’

‘‘তা আমার মা কোনো যোগিনীর থেকে কম ছিলেন না বাবা৷ আর হবে নাই বা কেন, কার মেয়ে সেটা দেখতে হবে তো৷ আমার দাদামশাই কৃষ্ণশঙ্কর মণ্ডল ছিলেন একজন বিখ্যাত অবধূত, গৃহী তান্ত্রিক৷ বহু লোকের উপকার করেছেন জীবনে৷ গোটা পরগনার লোক আমার দাদামশাইকে যেমন ভালোবাসত, তেমনই ভক্তিশ্রদ্ধা করত৷ এমনও শুনেছি দাদামশাই রাস্তায় বেরোলে নাকি লোকে রাস্তার ধারে সরে যেত, যাতে ওঁর ছায়ার ওপর কারও পা না পড়ে, এমনই সম্মান পেতেন মণ্ডলমশাই৷ আমার মা তেমনই সাধকের বেটি বটে!

তা আমার মা যখন মারা যান, তখন মাধুর বয়েস আট৷ একদিন হঠাৎ আমাকে ডেকে বললেন, ‘আমার আর বেশিদিন নেই রে শর্মিলা, সামনের কৌশিকী অমাবস্যায় আমি দেহ রাখব৷ তোরা যজ্ঞের আয়োজন কর৷’ আমরা তো অবাক৷ তখনও মায়ের চুল সব পাকেনি, দিব্যি কর্মঠ আছেন৷ কিন্তু তাঁর কথা অমান্য করার উপায় নেই, যজ্ঞের আয়োজন করতেই হল৷’’

‘‘কীসের যজ্ঞ?’’ আমার খাওয়ার গতি স্তব্ধ হয়ে এল৷

‘‘সে বলতে পারব না বাবা৷ তিনি যজ্ঞের আয়োজন করলেন কৌশিকী অমাবস্যার ঠিক আগের রাতে৷ তার আগেই বাড়ির সব্বাইকে বলা হয়েছিল সে রাতটা বাইরে অন্য কোথাও কাটাতে, বাড়িতে শুধু আমি, মা আর মাধু৷ রাত বারোটার সময় মা হোমে বসলেন৷ যেসব বিচিত্র জিনিস দিয়ে সে যজ্ঞে আহুতি দিলেন মা, তা দেখে তো আমার বুক ভয়ে দুরুদুরু৷ সে যজ্ঞ চলল ভোররাত অবধি৷ ততক্ষণ যজ্ঞস্থল ছেড়ে মা আমাদের দুজনকে উঠতে অবধি দেননি৷ হোম শেষ হওয়ার পর মা যজ্ঞকুণ্ডে জল ছিটিয়ে মাধুকে বললেন, ‘ছাইয়ের ভেতরে হাত দে মেয়ে’৷’’

‘‘তারপর?’’

এবার মাধুরীর গলা, ‘‘আমি তো ছাইয়ের ভেতরে হাত দিয়ে হাতড়াচ্ছি৷ দিদুন আমার দিকে উদ্বিগ্নভাবে চেয়ে আছেন৷ এমন সময় নরম নরম গোলমতো কী একটা যেন আমার হাতে ঠেকল৷ দিদুনকে সেটা বলতেই দিদুন বলল, ‘এক্ষুনি ওটা বার করে আন মা৷’ আমি বার করতেই দিদুন ওটা আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিল প্রায়৷’’

‘‘সেইদিন ভোরে মা একটা মাদুলি দিয়ে যান ওকে সবসময় পরার জন্য৷ আর সেইদিনই সন্ধে আটটা নাগাদ মা মারা যান৷’’

আবার খাওয়াতে মনোনিবেশ করলাম৷ এরকম গল্প জীবনে কম শুনিনি৷ বাংলার হাটেবাজারে কান পাতলেই এমন গল্প হাজার একটা শোনা যায়৷ একটা কুমড়োফুলের বড়া মুখে দিয়ে বেশ আয়েশ করে বললাম, ‘‘আরও একজন মস্ত বড় সাধক তিনসুকিয়া আসছেন কাল বিকেল নাগাদ, এই মাধুরীর ব্যাপারেই আমাকে একটু সাহায্য করতে, জানেন তো?’’

‘‘কে বাবা? কে আসছেন?’’ সাধক শুনেই কাকিমা উত্তেজিত হয়ে পড়লেন৷

খেতে খেতে আমি কাকার আসার কথা বললাম৷ কাকিমা শুনে সবিশেষ সন্তুষ্ট হলেন, তাঁর মেয়ের সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে আরও একজন এক্সপার্ট যোগ দিচ্ছেন বলে৷ মাধুরী কিছু বলল না বটে, তবে হাবেভাবে বোঝা গেল যে তার বিশেষ আপত্তি নেই৷ গত কয়েকদিনের কাঠিন্য এখন অনেকটাই উধাও৷

খেয়েদেয়ে ঘরে গিয়ে একটু গড়িয়ে নিতে নিতেই বেলা বয়ে গিয়ে বিকেল৷ ঘর থেকে উঠে বাইরে বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম৷ চারিদিকে দিব্যি ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে, কাকুর বাংলোর সামনে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তিনসুকিয়া টাউনের শান্ত অলস বিকেল৷ কলতলার দিক থেকে শিউলিফুলের হালকা সুবাস ভেসে আসছে৷ মাথা উঁচু করে একটা ধোঁয়ার রিং ছাড়লাম৷ আকাশে ঝকঝকে সাদা মেঘের দল৷ কোথায় ভেসে যাচ্ছে কে জানে?

সিগারেট শেষ করতে না করতেই কানের কাছে একটা মৃদু ঘসঘস আওয়াজ শুনলাম৷ চোখ নামিয়ে দেখি মাধুরী৷ পরে এসেছে একটা খুব সাধারণ মেখলা শাড়ি৷ জমির রং সাদা, পাড় গাঢ় সবুজ রং-এর৷ হঠাৎ করে আমার কেমন যেন মনে হল উজনি আসামের এই উন্মুক্ত প্রকৃতির যিনি অধীশ্বরী, সেই সাক্ষাৎ বনদেবীই যেন নেমে এসেছেন আমার সামনে৷ এই প্রথম লক্ষ করলাম মাধুরীর সুঠাম সুডৌল শরীর, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ ত্বক, পদ্মকাণ্ডের মতো ফর্সা দুটি হাত আর গভীর কালো আঁখি দুখানি৷ মুখে একটা হালকা হাসির আভাস৷ এই প্রথম লক্ষ করলাম যে হাসলে মাধুরীর গজদন্ত দুটি সামান্য উন্মুক্ত হয়, আর তাতে ভারী সুন্দর দেখায় তাকে৷

মনটাকে শক্ত করলাম৷ অনেক দিন ধ্যান প্রাণায়াম এসব হয় না, তাই চিত্ত কুপিত হয়েছে৷ নইলে এসব উদ্ভট চিন্তা মাথায় আসবে কেন?

মাধুরীকে নিয়ে ঘরের ভেতরে এসে বসলাম৷ তারপর সেই প্রশ্নটা করলাম, যেটার উল্লেখ প্রথমেই করেছি৷

মাধুরী খানিকটা বিবর্ণ হয়ে গেল যেন৷ একটু আগের সেই ঝলমলে ভাবটা উধাও৷ মাথা নীচু করে কী যেন ভাবল একটা৷ তারপর বলতে লাগল, ‘‘এইখান থেকে যে কী হল দাদা, সে আমি এখনও বুঝিনি৷ তবে পুরো বিষয়টা মনে পড়লেই গা ঘিনঘিন করে ওঠে৷

ওদের বাড়িতে যখন পৌঁছোই, তখন দুপুর হবে হবে করছে৷ দরজায় দাঁড়িয়ে সবে বেল বাজিয়েছি কি বাজাইনি, দরজাটা খুলে গেল৷ দেখি দিভাই বেরিয়ে এসেছেন৷ কোথাও যেন একটা যাচ্ছিলেন৷ আমাকে দেখে একটু চমকে গেলেন, বললেন, ‘এ কী মাধু, মুখ-চোখ এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন? শরীর ভালো তো?’

দিভাইকে প্রণাম করে ঘরে গিয়ে উঠলাম৷ যাদবকাকু লাগেজ পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেলেন৷ অনির্বাণ ভেতরেই ছিল, সেও সাততাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল৷

দুজনকে পুরো ঘটনাটা বললাম৷ জ্বরের কথা, স্বপ্নের কথা, ভোরের দিকে হঠাৎ করে জ্বর ছেড়ে যাওয়া, সবই বললাম৷ দিভাই মাথায় হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন৷ অনির্বাণ শুনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল ডাক্তার দেখানোর জন্য৷ আমিই বারণ করলাম৷ বললাম যে বিকেল বা সন্ধের দিকে দেখালেও হবে৷

সেদিন রাত্রে খাওয়াদাওয়া করে শুতে যাব, এমন সময় দিভাই ঘরে এলেন৷ ব্যস্তসমস্ত ভাবে বললেন, ‘মাধু, তোকে যে ঠাকুরের মূর্তিটা দিয়েছিলাম, ওটা কোথায়?’

মূর্তিটা নীচে আমাদের আলমারিতে রেখে দিয়েছিলাম৷ শুনে দিভাই ভারী রাগ করলেন, বললেন, ‘ও কি ঘর সাজাবার জিনিস? সঙ্গে রাখতে হয়৷ ওইজন্যই তো তোর এত অসুখবিসুখ! এক্ষুনি নিয়ে আয় ওটাকে, মাথার দিকে ওই কুলুঙ্গির মধ্যে রাখ৷’

আমি তাই করলাম৷ শুধু লক্ষ করলাম যে মূর্তির গায়ে সিঁদুরের একটা নতুন পোঁচ৷ আমার কেমন যেন কৌতূহল হল, কোন দেবীর মূর্তি এটা?

একটু একটু করে সিঁদুরের প্রলেপ খুঁটে খুঁটে তুলে ফেললাম৷ মূর্তিটা একটু অদ্ভুত, কোমর থেকে ওপরের দিকটা সাপের মতো, তার পাঁচটা মাথা৷ নীচের দিকটা কোনো মহিলার৷ দেখে মনে হল মনসার মতো কোনো দেবীর মূর্তি৷ ভাবলাম হবেও কেউ, হয়তো ওদের পারিবারিক দেবতা৷

সেদিন রাতে বেশ কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্ন দেখলাম, তবে তার কোনোটাই ভয়ংকর কিছু না৷ তবে প্রবলেম শুরু হল পরের দিন সকাল থেকে৷

সকালে ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে অনির্বাণের সঙ্গে একচোট ঝগড়া হয়ে গেল৷ অথচ তেমন কিছু ছিল উপলক্ষ্য ছিল না, নিতান্তই মামুলি ব্যাপার৷ অথচ ঝগড়া করতে করতে দুম করে আমার মাথাটা এমন গরম হয়ে গেল যে, এক টান মেরে খাবারদাবার সব ফেলে দিয়ে দুম দুম করে উপরের ঘরে চলে এলাম৷

খানিক পরে মাথাটা ঠান্ডা হতে খুব অনুতপ্ত বোধ হতে লাগল৷ এমনিতে আমি খুব ঠান্ডা মাথার মেয়ে৷ অমন একটা তুচ্ছ কারণে অতটা রেগে যাওয়া মোটেও উচিত হয়নি৷ নীচে গিয়ে সব গুছিয়েগাছিয়ে অনির্বাণকে সরি বলে এলাম৷

কিন্তু সেখানে গল্পের শেষ না, শুরু!

লক্ষ করতে শুরু করলাম যে দিভাই আর অনির্বাণের মধ্যে একটা অদ্ভুত ঘনিষ্ঠতা আছে৷ একটু অস্বাভাবিক৷’’

‘‘অস্বাভাবিক বলতে?’’ ব্যাপারটা পরিষ্কার হল না আমার কাছে৷

‘‘কীরকম অস্বাভাবিক সেটা আপনাকে বোঝানো একটু মুশকিল৷’’ একটু অস্বস্তির সঙ্গে নড়েচড়ে বসল মাধুরী, ‘‘ভাইবোনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা থাকবে সে আর এমন কী, তাই না? আমিও প্রথমে তাই ভেবেছিলাম৷ কিন্তু দু’দিনের মধ্যে বুঝলাম যে ব্যাপারটার মধ্যে একটা অ্যাবনর্ম্যাল কিছু আছে৷ আমার চোখে ব্যাপারটা একটু কেমন জানি অন্যরকম মনে হতে লাগল৷’’

‘‘কীরকম?’’ আমি একটু সামনের দিকে ঝুঁকে এলাম৷

‘‘ওটা আপনাকে বোঝানো একটু মুশকিল দাদা৷ আমরা মেয়েরা বুঝতে পারি৷ চোখের ইশারায়, দৃষ্টিতে, অনির গায়ে মাথায় দিভাইয়ের হাতের ছোঁয়ায়… মোটমাট আমার মাথার মধ্যে কে যেন বলতে লাগল ব্যাপারটা খুব একটা স্বাভাবিক না৷

এদিকে শুরু হল অন্য সমস্যা৷ রোজই আমাদের মধ্যে কথায় কথায় তুমুল অশান্তি আর ঝামেলা শুরু৷ প্রতি কথায় বাকবিতণ্ডা হতে হতে সে প্রায় মারামারি কাটাকাটি হওয়ার মতো অবস্থা৷ অনির্বাণ খুব ঠান্ডা মাথার লোক, তাকে আমি কোনোদিন রাগতে দেখিনি৷ সেও গলা উঁচিয়ে সমানে ঝগড়া করে যেতে লাগল৷ দিভাই এক-দুবার শান্ত করতে এসে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলেন৷

সেদিন দুপুরে সিঁদুর পরতে গিয়ে ফের সেই ডাক শুনলাম, তবে আগের থেকে অনেক ক্ষীণ৷ তখন আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে চিনতেই পারছিলাম না৷ স্নান করে আসা সত্ত্বেও দেখি মাথার চুলগুলো হাওয়ায় সাপের মতো উড়ছে৷ চেহারার মধ্যে একটা ক্রুদ্ধ রুক্ষ ভাব৷ নিজেকে কখনও ওই চেহারায় আগে দেখিনি৷

সিঁদুর পরে একটু মাথাটা ঠান্ডা করে ভাবার চেষ্টা করলাম যে কেন আমি এরকম করছি৷ যে মানুষটাকে আমি নিজে ভালোবেসে বিয়ে করেছি, তার সঙ্গে এত অশান্তি কেন? ভেবে দেখতে গেলে ঝগড়ার কারণগুলোও কিন্তু খুবই তুচ্ছ৷ যেমন নুনদানিটা কেন ওখানে রাখা আছে, কাঁটাচামচ এগিয়ে দেওয়ার সময় ও কেন মাথার দিকটা ধরে এগিয়ে দিল, বাথরুমে জল পড়ে আছে কেন, এইসব৷ এসব সামান্য, অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া করার কথা আমি ভাবতেও পারি না৷ অথচ ঠিক সেটাই ঘটছে৷

সেদিন থেকে দিভাইয়ের আচরণও আমার কাছে আরও বিসদৃশ ঠেকতে লাগল৷ অনির মুখে খাবার লেগে আছে, উনি বুকের আঁচল খসিয়ে মুখ মুছে দিচ্ছেন৷ ভাই ঝগড়া করতে করতে মুখ ভার করছে, উনি ভাইয়ের মাথাটা বুকের মধ্যে চেপে ধরলেন৷’’

এতটা বলেই একটু সংকুচিত হয়ে পড়ল মাধুরী, ‘‘দাদা, আপনি কি আমাকে পারভার্ট বলে ভাবছেন? ডার্টি মাইন্ড?’’

শাস্ত্রে বলে স্ত্রিয়াশ্চরিত্রম ভগবানেরও অগম্য৷ যে মেয়েটাকে আমি দু’দিনের বেশি চিনি না তার চারিত্রিক গুণাবলির ব্যাপারে এখনই কোনো সার্টিফিকেট দেওয়া ঠিক হবে না ভেবে চুপ করে রইলাম৷

‘‘বিকেলের দিকে ভাবলাম একটু বেড়িয়ে আসি, বাড়ির গুমোট ভাবটা কাটবে৷ একটা রিকশা করে অনির্বাণকে নিয়ে ব্রহ্মপুত্রের ধারে হাওয়া খেতে গেলাম৷ লক্ষ করলাম রিকশাতে অনির্বাণ কেমন যেন কাঠ হয়ে বসে আছে৷ আমার খুব খারাপ লাগল, ভাবলাম হয়তো সকালের ঝগড়াঝাঁটির জের৷ এক-দুবার ওর হাতটা ধরার চেষ্টা করলাম, কোনো সাড়া পেলাম না৷

সেদিন বেড়ানোটা মোটেও সুখের হয়নি৷ ফেরার পথে রাস্তাতেই একবার কথা কাটাকাটি হয়ে গেল, তাও রিকশাওয়ালার ভাড়া সংক্রান্ত তুচ্ছ একটা বিষয়ে৷ ফিরে এসে খানিকক্ষণ গোঁজ হয়ে বসে রইলাম দুজনেই৷ সে যাই হোক, খেয়েদেয়ে রাতে শুতে গেছি, এমন সময় মনে হল সারা ঘরে কেমন যেন একটা অদ্ভুত গন্ধ৷’’

‘‘কীসের গন্ধ?’’ সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলাম৷

‘‘কেমন যেন ভিজে কাঠ পোড়ার গন্ধ৷ একটু ভারী, ভ্যাপসা, দম আটকে আসার মতো একটা গন্ধ৷’’

আশা করছিলাম এই উত্তরটাই আসবে৷ তাই বিশেষ চমকালাম না৷

‘‘ঘরে ঢুকে ফ্যান চালিয়েও যখন গন্ধটা গেল না, তখন চেষ্টা করলাম গন্ধটা কোথা থেকে আসছে সেটা খোঁজার৷ আঁতিপাঁতি করে মেঝে, খাটের তলা, আলমারির পেছন ইত্যাদি খুঁজেও তার হদিস পেলাম না৷ শেষমেশ ঘরের চারিধারে খুঁজতে গিয়ে বুঝলাম যে গন্ধটা আসছে কুলুঙ্গি থেকে, যেখানে মূর্তিটা আছে৷

কেন জানি না ওটা আর নেড়েঘেঁটে দেখতে ইচ্ছে করল না৷ আমি মশারি টাঙিয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম৷ তখনও অনির্বাণ শুতে আসেনি৷ কিছুক্ষণ মনে মনে গজগজ করলাম, নবাবপুত্তুরের এমন কী অভিমান যে এখনও শুতে আসতে পারছেন না?

খানিকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করার পর উঠে বসলাম৷ হাতঘড়িটা মাথার কাছেই ছিল, দেখি প্রায় বারোটা বাজে৷ এখনও শুতে এল না লোকটা?

ও বাড়ির দোতলায় একটাই ঘর, আমাদের৷ ভাবলাম বাবু বুঝি অভিমান করে ছাদে হাওয়া খেতে গেছেন৷ বিছানা থেকে নেমে দেখি না, তা নয়৷ দোতলাটা ফাঁকা৷ ছাদে যাওয়ার দরজা তালাবন্ধ৷ একতলায় দিভাইয়ের ঘরে আলো জ্বলছে৷ সেখান থেকে কথাবার্তার মৃদু আওয়াজ ভেসে আসছে৷ একটু পরেই দেখি অনির্বাণ বেরিয়ে আসছে৷ আমি একটু সরে এলাম৷ দিভাইয়ের ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল৷

অনির্বাণ শুতে এলে আমি আর দেরি হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলাম না, এমনই অভিমান হয়েছিল ওর ওপর৷ হোক যতই ঝগড়াঝাঁটি, তাই বলে মাঝরাত অবধি সেসব দিদিকে বলতে হবে?

পরের তিন-চারটে দিন এইভাবেই গেল৷ সকাল থেকে উঠেই অশান্তি, ঝগড়া শুরু৷ কেউ কারও সঙ্গে বিশেষ কারণ ছাড়া কথাই বলছি না৷ দিভাইও চেষ্টা করে করে হাল ছেড়ে দিয়েছেন৷ সকালে ঠুকঠাক দিয়ে শুরু হয়, বিকেলের পর মারাত্মক আকার নেয়৷ নতুন বউকে দেখতে আসা প্রতিবেশীদের ভিড়ও পাতলা হয়ে এসেছে৷ একদিন শুনলাম কাজের লোক দিভাইকে আড়ালে বলছে, পাড়ায় বলাবলি শুরু হয়েছে, এ কোন খাণ্ডারনি মেয়ে বউ হয়ে এসেছে এ পাড়ায়? শুনে আমার মেজাজ একেবারে সপ্তমে৷ কাজের মেয়েটিকে ডেকে যাচ্ছেতাই করে বললাম৷ সে নিয়ে আবার একপ্রস্থ অশান্তি৷

এদিকে অনির্বাণ রোজই মাঝরাত পার করে শুতে আসছে৷ খাওয়ার পর মাঝরাত অবধি ও দিভাইয়ের ঘরে কাটায়, ঘরের দরজা বন্ধ থাকে৷ আমার মেজাজ যাচ্ছে আরও খিঁচড়ে৷ সবে বিয়ে হয়েছে, হানিমুন কাটিয়ে ফিরেছি৷ কোথায় স্বামীসঙ্গ উপভোগ করব, তার বদলে তাঁর আবার দিদির প্রতি এতই আঠা যে মাঝরাত অবধি আড্ডা না মেরে উনি শুতে আসতে পারছেন না!’’

এইখানে এসে মাধুরীকে থামালাম আমি৷ এই জায়গাটা আমার পক্ষে খুব গুরুত্বপূর্ণ৷

‘‘একটা কথা বলো তো মাধুরী, খোলাখুলি জিজ্ঞেস করছি৷ তোমাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক কেমন ছিল?’’

একটু সোজা হয়ে বসল মাধুরী৷

‘‘দেখুন দাদা, বলতে যখন বসেছি, তখন সবই বলব৷ তা ছাড়া ডাক্তার আর উকিলের কাছে এমনিতেও কিছু লুকোতে নেই৷ আমাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক বিয়ের আগেও এক-দুবার হয়েছে৷ সেদিক দিয়ে আমার বা অনির, কারোরই কোনো অসুবিধা ছিল না৷ বরং এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়া ছিল৷ ভুটানের হানিমুনের দিনগুলোতেও আমরা চুটিয়ে একে অপরের সঙ্গ উপভোগ করেছি৷

কিন্তু যেদিন ওদের বাড়িতে ফিরে গেলাম, সেদিন থেকেই মনে হল ওর প্রতি সেই শারীরিক টানটা আর অনুভব করছি না৷ হঠাৎ করেই মনে হল ও একটু বেশি নরমসরম, মেয়েলি গোছের, সেই শক্তপোক্ত পুরুষালি ব্যাপারটা নেই৷ তার ওপর বেঁটে, মাথায় হালকা টাক৷ আমার কাছে ও আর সেই ভালোবাসার অনির্বাণ রইল না৷ ওর শারীরিক খুঁতগুলোই আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিতে লাগল৷’’

‘‘কিন্তু তাতে করে কী…’’

‘‘হ্যাঁ দাদা, তাতে করেই কেমন যেন আমার মনে হতে লাগল যে এই লোকটা আমাকে রাত্রে ছোঁবে? ম্যা গো! প্রথম দিন রাতে আমার কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করতেই কড়া গলায় ওকে বলে দিই আমাকে যেন একদম ডিস্টার্ব না করে৷ ও আর চেষ্টা করেনি৷ অথচ প্রতিরাতে ও যখন দিভাইয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে শুতে আসত, একটা নোংরা ঈর্ষায় আমার বুকটা জ্বলে যেত৷ শুধু মনে হত, এই যৌবন নিয়ে আমি বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি, আর উনি দিদির ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে এমন কী আড্ডা মারছেন শুনি? অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, যে মুহূর্তে লোকটা আমার ঘরে ঢুকত তক্ষুনি লোকটাকে আমি ঘেন্না করতে শুরু করতাম৷’’

‘‘সে আবার কী?’’ মনে হল হয়তো ঠিক শুনলাম না আমি, ‘‘ঘেন্না করবে কেন? এই যে বললে ঈর্ষায়..’’

‘‘ওটাই তো প্রবলেম দাদা’’, একটা তিক্ত অথচ বিষণ্ণ হাসি খেলে গেল মাধুরীর কমনীয় ঠোঁটদুটি ছুঁয়ে৷ ‘‘যতক্ষণ ও আমার চোখের বাইরে থাকত, ততক্ষণ মনে হত কোথায় গেল লোকটা? খুব অভিমান হত৷ অথচ ও আমার সামনে এলেই অদ্ভুতভাবে ওর প্রতি একটা অন্ধ রাগ জেগে উঠত বুকের মধ্যে৷ মনে হত বোমার মতো ফেটে পড়ে ছারখার করে দিই লোকটাকে৷ আমার সঙ্গেই পুড়ে মরে যাক ও৷’’

জানি না, শেষ কথাটা শুনে আমার বুকের মধ্যে কোথাও অতি সূক্ষ্ম কী একটা টং করে এসে বিঁধল৷ চুপ করে রইলাম৷ ঘরের মধ্যে অখণ্ড নীরবতা৷ দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারটা হাওয়ায় অল্প অল্প উড়ছিল৷ সেখান থেকে একটা ঠকঠক আওয়াজ আসছিল শুধু৷

মাধুরী একটু থেমে ফের বলতে লাগল, ‘‘দিনে দিনে এই অশান্তি বেড়েই চলল৷ প্রতিপদে ওর ভুলগুলো নজরে পড়তে লাগল৷ আর আমার মনে হতে লাগল এই ভুলগুলো ও করবে কেন? কী অধিকার আছে ওর ভুল করার? আমি ওকে সেগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে লাগলাম৷ ও কিছু বললেই খুব রূঢ় ভাষায় জবাব দিতে থাকলাম৷ দিভাইও এক-দুবার মাঝখানে কিছু বলতে এসে অপমানিত হলেন৷ ওই মহিলাকে আমার আর সহ্য হচ্ছিল না৷ এরই মাঝে একদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল৷’’

‘‘কী সেটা?’’

মাথা নীচু করে রইল মাধুরী৷ বুঝলাম খুব জটিল কিছু বলতে চলেছে আমাকে৷

‘‘যেদিন সবকিছু গুছিয়ে এ বাড়িতে চলে আসি, তার আগের দিনের ঘটনা৷ রাতের খাওয়ার শেষে আমি ওপরে এসে শুয়েছি৷ একটু তন্দ্রামতন এসেছে কি আসেনি, এমন সময় কানের কাছে ফের শুনতে পেলাম সেই ডাক, ‘আমাদের বারণ শোন মেয়ে, ও সিঁদুর পরিসনি, ও সিঁদুরে বিষ আছে, ও সিঁদুর মহা সর্বনাশী…’ আমি শুনতে শুনতে যেন আরও গভীর ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যেতে লাগলাম৷ আমার মনে হতে লাগল আমার শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে৷ হাতে-পায়ে একদম সাড় নেই৷ অথচ হুঁশ কিন্তু আবছা হলেও আছে৷

মড়ার মতো খাটে শুয়ে আছি, এমন সময় মনে হল কে যেন ধীরপায়ে দরজা খুলে ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল৷ একইসঙ্গে অদ্ভুতভাবে বন্ধ হয়ে গেল মাথার দিকের জানলাটাও৷ ঘরের মধ্যে একটা গা ছমছমে অন্ধকার৷ আমার হঠাৎ করে খুব শীত করতে লাগল৷

প্রথমে ভাবলাম বুঝি অনির্বাণই এসেছে বাইরে থেকে৷ তার পরমুহূর্তেই ভুল ভেঙে গেল৷ ওর পায়ের শব্দ আমি চিনি৷ কিন্তু এখন যে ঢুকেছে তার হাঁটাচলার কোনো শব্দ নেই৷

বুঝতে পারলাম যে লোকটা, সে যেই হোক না কেন, নিঃশব্দে আমার দিকে এগিয়ে আসছে৷

আমার গা-টা কেমন যেন একটু শিউরে উঠল প্রথমে৷ ঘরের ভেতর সবকিছু একদম চুপচাপ, পাখা ঘোরার আওয়াজটাও শোনা যাচ্ছে না৷ সেই স্তব্ধ অন্ধকারের মধ্যে দেখলাম যে লোকটা আমার ওপর ঝুঁকে এসে আমাকে দেখছে ভালো করে৷ সঙ্গে সঙ্গে একটা নোংরা পচা বিচ্ছিরি গন্ধে আমার নাক বন্ধ হয়ে এল প্রায়৷ আমি মুখটা সরিয়ে নিতে চাইলাম, কিন্তু ঘাড়টা স্টিফ হয়ে রইল৷’’

আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল প্রায়৷ ‘‘কী সাংঘাতিক! তারপর?’’

‘‘তারপর লোকটা একহাতে আমার আঁচলটা টেনে মাটিতে ফেলে দিল৷ তারপর দুহাতে আমার ব্লাউজ ছিঁড়ে ফেলল৷’’

ঘরের মধ্যে কোনো শব্দ নেই, দেওয়ালঘড়ির টিকটক ছাড়া৷ আমি ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি৷ আমার রক্ত গরম হয়ে উঠেছে৷ হাতের মুঠো শক্ত৷

ভাবলেশহীন ভাবে বলে যেতে লাগল মাধুরী, ‘‘আমি ছিটকে উঠতে গিয়েও পারলাম না৷ আমার শরীর শক্ত হয়ে থাকল কাঠের মতো৷ লোকটা ধীরেসুস্থে আমার ওপর ঝুঁকে এল৷ আর তখনই ওর চোখদুটো নজরে এল আমার৷ বাপস রে!’’ চেয়ারে বসেই থরোথরো করে কেঁপে উঠল মাধুরী৷

প্রবল উত্তেজনায় ঝুঁকে এলাম আমি, ‘‘কেমন দেখতে লোকটাকে?’’

‘‘আমার দু’চোখ বন্ধ হয়ে এসেছে, সেটা প্রবল ভয়ে না ঘেন্নায় বলতে পারব না, তার মধ্যেই দেখলাম যে লোকটার গায়ের রং কালো৷ কুচকুচে কালো, কয়লার ওপর আলকাতরা লেপে দেওয়ার মতো কালো৷ অত কালো মানুষ আমি জন্মে দেখিনি৷’’

‘‘তুমি ঠিক দেখেছ?’’

‘‘একদম৷’’ বলতে বলতে হাঁপাচ্ছিল মাধুরী৷ ওর দু’চোখ বিস্ফারিত, ফর্সা চোখমুখ লাল হয়ে এসেছে৷ নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে শিশিরের মতো৷ একটু ঝুঁকে এসেছে মেয়েটা, বুকের আঁচল সরে গেছে অনেকখানি৷ শঙ্খের মতো সাদা স্তনবিভাজিকাটি আমার লোভী চোখের সামনে উন্মুক্ত৷ আমি দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলাম৷

‘‘তারপর লোকটা আমার শাড়িটা সায়াসুদ্ধু কোমরের ওপর তুলে দিল৷ প্যান্টিটা খুলে নামিয়ে দিল গোড়ালি অবধি৷ তারপর আমার ওপর চড়ে বসল৷

আমি আতঙ্কে শিউরে উঠলাম, বুঝতে পারলাম যে লোকটা কী করতে চাইছে৷ কিন্তু আমি অসহায়, আমার চৈতন্য আছে সাড় নেই, বোধ আছে কিন্তু শক্তি নেই৷ অসহায়, নিষ্ফল আক্রোশে আমার সমস্ত শরীর ফেটে পড়তে চাইছে, কিন্তু আমি পারছি না৷

লোকটা অতি ধীরে আমার সারা শরীর ঘাঁটতে লাগল৷ ঘেন্নায়, কষ্টে আর অসহায়তায় আমার সমস্ত শরীর গুলিয়ে উঠল৷ আমার সমস্ত শরীর মোচড়াতে লাগল৷ মনে হল এক্ষুনি, এই মুহূর্তে আমি মরে যাচ্ছি না কেন৷

তারপর লোকটা আমার ওপর ঝুঁকে এল৷ আমার চুলের মুঠিটা ধরে আমার মুখটা ওর দিকে ফেরাল৷’’

দেখি মাধুরীর সর্বাঙ্গ ভিজে গেছে ঘামে৷ চোখদুটো বিস্ফারিত, সমস্ত মুখ লাল, হাত-পা থরথরিয়ে কাঁপছে৷ খেয়াল করলাম আমার বুকের মধ্যেও একটা বন্য ক্রোধ হিংস্র অজগরের মতো মাথা তুলছে৷ নিজের নখগুলো ধারালো হয়ে কেটে বসছে নিজেরই চামড়ার ওপর৷ কানের দু’পাশ দিয়ে আগুনের হলকা বইছে যেন৷

‘‘তারপর কী হল মাধুরী?’’

আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকাল মাধুরী৷ সেই ভয়াবহ উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি আমি জীবনে ভুলব না৷

‘‘দেখলাম দু’জোড়া বড় বড় হলদেটে চোখ আমার দিকে তাকিয়ে৷ আর চোখের মণিদুটো লাল, টকটকে লাল৷’’

নিজের বুকের ধকধক শব্দটাও পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলাম৷ মনে হল হৃৎপিণ্ডটা যেন আমার গলায় উঠে আসবে৷

‘‘লোকটা সেই গনগনে লাল চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে৷ তাতে ঘেন্না, রাগ, নিষ্ঠুরতা পেরিয়েও যেটা জেগে আছে সেটা হচ্ছে লোভ৷ নারীশরীরের প্রতি সীমাহীন লোভ৷ পুরুষমানুষের ওই দৃষ্টি আমরা মেয়েরা জন্ম থেকেই চিনি৷ কিন্তু সেই হাড় হিম করা আতঙ্কের মধ্যেও কিন্তু একটা জিনিস আমি লক্ষ করতে ভুলিনি দাদা৷’’

‘‘কী সেটা?’’

‘‘লোকটার সারা শরীরে চামড়া নেই৷ তার জায়গায় যেটা রয়েছে সেটা পালক৷ পাখির পালক৷’’

ঘরের মধ্যে গাঢ় আর টানটান নিঃশব্দ উদ্বেগ৷ সময় যেন সন্ধে পেরিয়ে রাত হওয়ার দিকে গুটিগুটি এগোতে গিয়ে এই ঘরে এসে ধরা পড়ে গেছে৷ ঘরের বালবের আলোটা হঠাৎ করেই একটু স্তিমিত হয়ে এল৷

‘‘লোকটা নিজেকে আমার ভেতরে সজোরে ঢোকাতে যাবে, আমার সমস্ত স্নায়ু রাগে ঘেন্নায় আর আতঙ্কে যেন ফেটে যাওয়ার মুখে, ঠিক সেই সময়ই কোথা থেকে যেন ঘরের মধ্যে একটা আলোর রেখা এসে পড়ল৷ লোকটা থেমে গেল একটু, আর কে যেন সশব্দে লাথি মেরে আমার ঘরের দরজাটা খুলে দিল৷ একঝলক দামাল দমকা হাওয়া ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতর৷ সেই হাওয়া আর আলোর ঢেউতে চঞ্চল হয়ে উঠল লোকটা৷

যতটা সম্ভব ঘাড় বেঁকিয়ে দরজার দিকে তাকালাম আমি৷ অতি কষ্টে মাথাটা তুলে দেখলাম দরজার সামনে এক মহিলার সিল্যুয়েট৷ সম্ভবত বৃদ্ধা, কারণ সামান্য সামনের দিকে ঝুঁকে আছেন তিনি, হাতে একটা লাঠি৷ মাথার চুল উড়ছে শনের মতো৷ ঘরের মধ্যে একটু এগিয়ে এসে খুব ক্রুদ্ধ গলায় কী যেন একটা বললেন লোকটার উদ্দেশে৷ ভাষাটা অজানা৷ লোকটা সেই শুনে একবার পেছনে ফিরে তাকাল৷ তারপর তড়িঘড়ি উঠে এগোল জানালার দিকে৷ তারপর জানলা খুলে ঝাঁপ মারল বাইরে৷’’

‘‘তারপর?’’

‘‘তারপর আর কিছু মনে নেই দাদা৷ আমার হুঁশ ছিল না৷’’

উঠে গিয়ে জানলাটা খুলে দিলাম৷ পাখাটা বন্ধ ছিল, এক পয়েন্টে চালিয়ে দিলাম৷

ঘরের মধ্যে কোনো শব্দ নেই৷ আমার ঘরে একটা দেওয়ালঘড়ি আছে৷ সেটার দিকে তাকাচ্ছি ঘন ঘন৷ শিলিগুড়ি থেকে বিকেলের বাস বা ট্রেন তিনসুকিয়া আসতে কত সময় নেয় যেন?

‘‘তারপর জানি না কতক্ষণ পর কোনোমতে উঠে বসলাম খাটের ওপর৷ প্রথমে ভেবেছিলাম দুঃস্বপ্ন দেখছি বুঝি৷ তারপর নিজের হাল দেখে বুঝলাম, না, ওটা দুঃস্বপ্ন ছিল না৷

কোনোমতে নিজেকে গুছিয়ে উঠে বসলাম৷ তখনও অনি আসেনি ঘরে৷ ওকে যে ডাকব, সেই জোরটুকুও গলায় ছিল না আমার৷ পাশে একটা জলের জগ ছিল৷ একটুখানি জল নিজের মাথায় দিলাম, খানিকটা খেলাম৷ সামান্য ধাতস্থ হয়ে ভাবলাম একবার নীচে যাই৷

কোনোমতে একটু একটু করে সিঁড়ির রেলিং ধরে নামছি, দেখি দিভাইয়ের ঘরের দরজা আজ অন্যদিনের মতো বন্ধ নয়, খোলা৷ ঘরের ভেতর থেকে একটা নীল আলো বাইরে ডাইনিং রুমের মেঝেয় পড়ছে৷ আর সেই আলোতে দেখলাম…’’

থেমে গেল মেয়েটা৷

‘‘কী দেখলে মাধুরী?’’

‘‘দেখলাম…দেখলাম…ওই নীল আলোতে মেঝেতে দুটো মানুষের ছায়া এসে পড়েছে৷ আর ওরা…ওরা যেটা করছে, সেটা…সেটা সেক্স ছাড়া আর কিছু না!’’

আমার দিকে বোবা চোখে তাকিয়ে রইল মেয়েটা৷ বুঝলাম, নিজের চোখে যেটা দেখেছে সেটা ও এখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না!

‘‘এবারে আপনিই বলুন দাদা, নিজের বিয়ে করা বরকে তার নিজের দিদির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে দেখার পরেও কি ও বাড়িতে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল? আমি বাড়িতে এসে মা-বাবাকে কী বলতাম? বলতাম যে আমার বর তার দিদির সঙ্গে শোয়? বলতাম যে সিঁদুর পরতে গেলেই আমি মাথার মধ্যে অদ্ভুত সব স্বর শুনি? বলতাম যে একটা সারা গায়ে পাখির পালকওয়ালা লোক আমাকে রেপ করতে এসেছিল? আমার মা-বাবা আমাকে পাগল ভাবত না?’’

চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম৷ এই মুহূর্তে একটা সিগারেট না খেলে আমার মাথাটা খুলবে না৷ মাথাটা অসাড় হয়ে গেছে৷ এমনিতেও আমি আর কিছু শুনতে চাই না, যতক্ষণ না কাকা এসে পৌঁছোচ্ছে৷

বাইরে এসে সিগারেট ধরিয়ে নিশ্চুপে টানতে লাগলাম৷ মাধুরী আমার ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল৷ আকাশের বেশ খানিকটা মেঘে ঢাকা৷ চারিদিকে একটা অস্বাভাবিক দম বন্ধ করা আবহাওয়া৷ দিন দুয়েকের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে মনে হয়৷

সিগারেট ফেলে চলে আসছি, এমন সময় কোথাও কিছু নেই হঠাৎ করে আমার ঘাড়ের রোঁয়াগুলো দাঁড়িয়ে গেল৷ মনে হল কলতলার ওপার থেকে কে আমাকে দেখছে৷ ঘুরে দাঁড়াতেই মনে হল সাদা কাপড় পরা একটা অবয়ব ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল৷ আমি তাকাতেই স্যাঁৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেল কোথায়৷

প্রবল চিন্তা নিয়ে ঘরে এসে শুলাম৷ যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে না৷ একদমই ঠিক হচ্ছে না৷

 * * * *

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি হল বেশ৷ গত কয়েকদিনের মানসিক উদ্বেগ আমাকে পেড়ে ফেলেছিল একেবারে৷ সেই ক্লান্তি কাটতে কাটতেই সকাল দশটা! ইশ, এত বেলা হয়ে গেল?

বিছানা থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে রুমে আসতেই দেখি দরজার সামনে শ্রীমান মংকুকুমার বত্রিশ পাটি বিকশিত করে দাঁড়িয়ে৷ একটু ধমকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘কাল ছিলি কোথায় সারাদিন? পাত্তা নেই যে?’’

তিনি কোলগেটের জ্বলন্ত বিজ্ঞাপন হয়ে উত্তর দিলেন, ‘‘পরাগদা একটা কাজ দিয়েছিল৷ তাই আসতে পারিনি৷’’

রেগে গিয়ে দুটো কড়া কথা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলাম৷ হাজার হোক, মংকু আমার মাইনে করা কর্মচারী নয়৷ কাকুর আদেশে আমাকে একটু সাহায্য করছে এইমাত্র, তাও বিনা পয়সায়৷ রোজ রোজ অফিসের বাবুদের মতো সকাল নটায় আমার দরজায় এসে ‘গুড মর্নিং’ বলে দাঁড়াবে, এতটা আশা করা অন্যায় নয় কি?

একটু নরম হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘তাহলে আজ কী মনে করে? পরাগদা আজ কোনো কাজ দেয়নি তোমাকে?’’

কথাটার জবাব দিল না মংকু, শুধু চোয়ালটা আরও চওড়া করে বলল, ‘‘একজন বাবু শিলিগুড়ি থেকে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন৷ বাইরের ঘরে বসে আছেন৷ বাবু আপনাকে খবর দিতে বললেন৷’’

বুকটা ধক করে উঠল৷ কাকা এসে গেলেন নাকি? কাকু-কাকিমাকে আমার বলাই ছিল ওঁর আসার ব্যাপারে৷ কিন্তু এত তাড়াতাড়ি আসার তো কথা না! শিলিগুড়ি থেকে ট্রেন ডিব্রুগড় অবধি টাইম নেয় প্রায় ষোলো ঘণ্টা৷ কাকার সঙ্গে কথা হয়েছে কাল সকাল এগারোটা নাগাদ৷ উনি যদি তখনই রেডি হয়ে বেরোন, তাতেও ট্রেন ধরতে ধরতে বিকেল৷ মানে এখানে আসতে আসতে আজ প্রায় সন্ধেবেলা হওয়ার কথা৷ এত সকালে পৌঁছোনোর তো প্রশ্নই ওঠে না৷ নাকি কাকার বদলে অন্য কেউ দেখা করতে এসেছেন?

তাড়াহুড়ো করে একটা টিশার্ট গলিয়ে বৈঠকখানায় এসে পৌঁছে দেখি যা ভেবেছি ঠিক তাই৷ ঘরের মধ্যে সদানন্দকাকু আর কাকিমা হাজির, এক কোণে মাধুরীও বসে আছে জড়োসড়ো হয়ে৷ আর প্রধান চেয়ারটাই দখল করে আছেন আর কেউ না, স্বয়ং কাকা!

বললে বিশ্বাস হবে না, লোকটাকে দেখামাত্র কোথা থেকে যেন বুকের ভেতর থেকে একটা পাথর নেমে গিয়ে সেই জায়গায় বেশ খানিকটা জোর, বেশ খানিকটা সাহস চলে এল৷ মনে হল এই লোকটা একবার যখন এসে গেছে তখন আর ভয় নেই৷

এখানে বলে রাখা ভালো, কাকার পুরো অ্যাপিয়ারেন্সের মধ্যেই একটা ভরসা দেওয়ার মতো ব্যাপার ছিল৷ ঠান্ডা মাথার লোক, কোনো কিছু আগ বাড়িয়ে বলেন না বা বোঝেন না৷ কোনো মতামত শোনা মাত্রই নস্যাৎ করেন না বা অন্ধের মতো বিশ্বাসও করেন না৷ কাউকে ছোট করেন না, কাউকে অযথা পাত্তা দেন না৷ শুধু ঠোঁটের ডগায় একটা স্মিত ঝুলিয়ে রেখে সমস্যাগুলো শোনেন আর আশ্চর্য বুদ্ধিমত্তায় সেগুলোর সমাধান করেন৷

‘‘কাকা, কখন এলেন?’’ হাঁপাতে হাঁপাতে প্রশ্ন করলাম৷

‘‘এই তো ভোরের ফ্লাইটে৷’’ উজ্জ্বল চোখদুটো আমার দিকে মেলে হাসিমুখে জবাব দিলেন কাকা৷ একটু লজ্জিত হলাম, এই অপশনটার কথা মাথাতেই আসেনি! আবার একটু অবাকও লাগল, ফ্লাইটে এসেছেন মানে সে তো কম খরচার ব্যাপার না৷ আমার কথা ভেবে এতটা খরচ করলেন উনি? মনে মনে ভাবলাম, এই সমস্যার সমাধান করে যেদিন শিলিগুড়িতে পা দেব সেইদিনই এই টাকাটা মিটিয়ে দেব ওঁকে৷

হায়, যদি জানতাম, সে সুযোগ আর কখনই পাব না!

কাকিমাকে দেখলাম প্রায় গলবস্ত্র হয়ে বসে আছেন, যেন কোনো গুরুঠাকুর এসেছেন৷ অথচ আমি কিন্তু এখনও এঁদের কাকার ব্যাপারে বিশদে কিছু বলিইনি৷ তবে কাকার শান্ত সমাহিত ভাব দেখে অনেকেই ওঁকে সাধু-সন্ন্যাসী গোছের ভাবেন৷ লোকেরও অবশ্য দোষ নেই৷ মাঝে মাঝেই আশেপাশের লোকজনকে এমন এমন কথা বলে চমকে দেন, লোকে তার থই পায় না৷ অথচ কাকাকে গেরুয়া দূরে থাক, হাফহাতা শার্ট আর ঢোলা ট্রাউজার ছাড়া অন্য কিছু পরতে দেখিনি৷ তবুও লোকটার মধ্যে একটা ভূয়োদর্শী সাধক সন্ন্যাসী গোছের ভাব বড়ই প্রবল ছিল৷

গিয়ে বুঝলাম যে একটা অনুরোধ-উপরোধের মধ্যে এসে পড়েছি৷ কাকিমা অনুরোধ করছেন এ বাড়িতেই থেকে যেতে৷ অনুরোধটা অসংগত নয়, এ বাড়িতে আরও একটা গেস্ট রুম আছে৷ কিন্তু কাকা দেখলাম স্মিতহাস্যে ক্রমাগত ঘাড় নেড়ে সে অনুরোধ উপেক্ষা করে চলেছেন৷ শেষমেশ কাকিমা হতাশ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘বাবা, তুমিই ওনাকে বলো না এখানে থেকে যেতে?’’

আমি কিছু বলার আগেই কাকা আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত অথচ দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘‘না ভবতারণ, আমার পক্ষে এখানে থাকায় কিছু অসুবিধা আছে৷ এখানে থাকব না বটে, তবে আমি যখন তোমার কথা শুনে এসেছি, এঁদের সব সমস্যার সমাধান করে দিয়ে যাব৷ কিন্তু তোমারও এখানে আর এক মুহূর্ত থাকা উচিত নয়৷ আমি বলছি, আধঘণ্টার মধ্যে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও৷ আমরা সার্কিট হাউসে গিয়ে থাকব৷’’

একটু আশ্চর্য হলাম৷ কাকা এমনিতে খুবই মৃদুভাষী লোক৷ এমন আদেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে আজ অবধি আমার সঙ্গে কোনোদিন কথা বলেননি৷ কেন জানি আমার ভেতরে কে যেন বলল এই আদেশ আমার মান্য করা উচিত, তাতে আমার ভালোই হবে৷

পরক্ষণেই চোখ পড়ল মাধুরীর দিকে৷ জানি না সেই দৃষ্টিতে কী ছিল, আকুতি নাকি অনুরোধ, আমার বুকের ভেতর যেন কী একটা সজোরে বিঁধে গেল৷ আমি শান্ত স্বরে কাকাকে বললাম, ‘‘না কাকা, এই মুহূর্তে এই বাড়ি ছেড়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ এঁরা আমার ওপর অনেক ভরসা করে আছেন৷’’

কাকা একবার আমার দিকে, একবার মাধুরীর দিকে তাকালেন৷ চোয়াল দুটো সামান্য শক্ত হয়ে এল ওঁর৷ চোখ বুজলেন একবার, বিড়বিড় করে কী যেন উচ্চারণ করলেন৷ তারপর চোখ খুলে বললেন, ‘‘ঠিক আছে, তাহলে তাই হোক৷ কিন্তু তোমাকে এই বাড়িতে রেখে যাওয়ার আগে তোমার জন্য একটি ক্রিয়া করতে হবে যে আমাকে৷’’

‘‘ক্রিয়া? কীসের ক্রিয়া?’’

কাকা কিছু বললেন না৷ একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ৷ তারপর হঠাৎ উঠে আমার হাত ধরে টেনে বললেন, ‘‘চলো, একটা জিনিস দেখাই তোমাকে৷’’

বলে আমাকে টেনে এনে বাইরে রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দিলেন৷ তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘দেখলে?’’

চারিদিকে তাকালাম৷ কই, বিশেষভাবে লক্ষ করার মতো তো কিছু নজরে পড়ল না!

‘‘ওখানে নয়, নীচে৷ নিজের ছায়ার দিকে তাকাও৷’’

তাকালাম৷ আমার মাথার পেছনে সকাল এগারোটার সূর্য৷ পায়ের কাছে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে আমার ছায়া৷ তার সব কিছুই ঠিকঠাক, শুধু মাথাটা নেই৷

সেই কবন্ধ ছায়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আমার ভীষণ শীত করতে লাগল৷ কাকার দিকে তাকিয়ে কাতর সুরে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘এর মানে কী কাকা?’’

কাকা ফিসফিস করে বললেন, ‘‘কাউরীবুড়ির ছায়া পড়েছে তোমার ওপর ভাইপো৷ এ বড় ভয়ংকর ছায়া৷ এ বাড়িতে কাউরীবুড়ির ছায়া ঢুকেছে৷ থেকে থেকে কোনো বিধবা মহিলাকে দেখতে পাও না?’’

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম৷ অন্তত দু-দুবার কাকে যেন দেখেছি ওই কুয়োতলার পাশে৷

‘‘কাউরীবুড়ির ডাক তোমার পিছনে ফিরছে ভবতারণ৷ যেদিন তুমি ওই মন্দিরে গেছিলে, সেদিন থেকেই এ ছায়া তোমার পিছু নিয়েছে৷ তোমার নিস্তার নেই তার হাত থেকে৷ সেই রোষে তুমিও মরবে, এদেরও মারবে৷’’

‘‘আর মাধুরী? তার কী হবে কাকা?’’ ঠকঠকানিটা আটকাতে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম কথাটা৷

‘‘ও আর বেঁচে নেই ভবতারণ’’, ধীর অথচ শান্ত সুরে বলা কথাটা আমার মগজে সেঁধোতে একটু সময় নিল, ‘‘ওর ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে গেছে৷ ওর আয়ু আর মাত্র দু’দিন৷’’

 * * * *

গতকাল ওই সকালেই আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন কাকা৷ প্রথম গন্তব্য ছিল পরাগ বসুমাতারির বাড়ি৷ প্রথম দিনই পরাগের অফিসের ফোন নাম্বার চেয়ে নিয়েছিলাম আমি, তাই তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বেশি কষ্ট করতে হয়নি৷

‘‘কিন্তু কাকা’’, রিকশা করে যেতে যেতে একটা বাম্পারে ঝাঁকুনি খাওয়ার মুখেই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে ফেললাম, ‘‘আবার ওর বাড়ি গিয়ে কী হবে? যা জানবার সেসব তো আমি জেনেই এসেছি৷’’

কাকা কোনো জবাব দিলেন না৷ মুখটা অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে আছে৷ আমি আবার খোঁচালাম, ‘‘আপনার কী মনে হয়, আরও কিছু জানার আছে ওদের থেকে?’’

রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিতে দিতে গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন কাকা, ‘‘অনেক কিছু জানার আছে ভাইপো, অনেক কিছু৷ তুমি কিছুই জানোনি৷’’

‘‘কেন?’’ একটু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলাম আমি, ‘‘যা যা জেনেছি তা সবই তো বলেছি আপনাকে, বলিনি?’’ পরাগের বাড়ি যাওয়ার পথে হাঁটতে হাঁটতে বললাম আমি৷

‘‘তাই?’’ হাঁটা থামিয়ে আমার দিকে তাকালেন ভদ্রলোক, ‘‘সব জানিয়েছ?’’

‘‘হ্যাঁ৷’’

‘‘সব জেনেছ?’’

‘‘হ্যাঁ৷’’

আমার দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে মাথা নাড়া শুরু করলেন ভদ্রলোক৷ ‘‘ভুল ভাইপো, ভুল৷ তুমি যা যা জেনেছ তার সবই আমাকে বলেছ বটে, কিন্তু যেগুলো জানা উচিত ছিল সেগুলোই জানোনি৷ অথবা জানার চেষ্টা করোনি৷ অথচ এই রহস্য ভেদ করতে গেলে…’’

বেশ দৃঢ় আপত্তি জানালাম এই কথায়, ‘‘আপনি ঠিক বলছেন না কাকা৷ যে যে তথ্য দরকার তার সবই তো বলেছি আপনাকে৷’’

‘‘বটে?’’ মৃদু হাসলেন কাকা, ‘‘তাহলে বলো তো ভায়া, অনির্বাণের সঙ্গে কথা বলেছিলে?’’

‘‘সে কী করে বলব?’’ আমি আপত্তির সুরে বললাম, ‘‘তাকে তো কাকু-কাকিমা খুঁজেই পাচ্ছেন না৷’’

‘‘খুঁজেই পাচ্ছেন না মানে? অত বড় একটা চা-বাগানের একজন দায়িত্বশীল কর্মীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? যেখানে সদানন্দবাবু নিজে একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী? কথাটা বিশ্বাস হল তোমার?’’

মাথা চুলকোতে লাগলাম৷ সত্যিই তো, এভাবে তো ভেবে দেখিনি৷

‘‘তুমি নিজে খোঁজ করার চেষ্টা করেছিলে?’’

মাথা নাড়লাম, ‘‘না…মানে সময় পেলাম কই?’’

‘‘ছেলেটাকে না পেলে যে এই রহস্যের একটা বড় দিক অন্ধকারে থেকে যাচ্ছে সেটা বুঝছ?’’

বুঝলাম৷ এরপর মাথা নীচু করে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না৷ তবে কাকা ছাড়বার লোক নন৷ তাঁর পরের প্রশ্নবাণ ধেয়ে এল, ‘‘কাউরীবুড়ির মন্দিরে যে মহিলার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল তাঁর নাম কী?’’

‘‘ইয়ে, মানে নামটা তো জিজ্ঞেস করা…’’

‘‘কে তিনি? নিশ্চয়ই লোকাল লোক, নইলে অনেক দূর থেকে উজিয়ে কেউ পুজো করতে আসে না৷’’

‘‘সে আমি কী করে জানব?’’

‘‘জানার চেষ্টা করেছিলে?’’

এবার ঘোরতর প্রতিবাদ করে উঠলাম, ‘‘এ তো বড় অসম্ভব কথা বললেন কাকা৷ এত বড় শহরে কোথায় খুঁজব ওই মহিলাকে?’’

‘‘এত বড় শহর?’’ কাকার গলায় বিদ্রুপের ছাপ স্পষ্ট, ‘‘কত বড় টাউন তিনসুকিয়া? কলকাতার থেকেও বড়? শিলিগুড়ির থেকেও বড়?’’

চুপ করে রইলাম৷

‘‘মাধুরীকে কোন মূর্তি দিয়েছিলেন ওর দিভাই? তার বর্ণনা জানার চেষ্টা করেছ?’’

মাথা নাড়লাম৷ না৷

‘‘সিঁদুর পরার সময় কার সতর্কবাণী শুনত মাধুরী? সে স্বর কি ওর চেনা কারও?’’

এর উত্তরও জানি না৷ তবে চেনা কারও হলে কি মাধুরী আমাকে সেটা জানাত না?

‘‘পরাগ কেন রাজি হয়ে গেল ওই লতা তুলে আনতে? শুধুই টাকার লোভ?’’

‘‘সে তো বটেই৷ এ ছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে বলুন?’’

‘‘একজন দেওরি আদিবাসী, খুব সম্ভবত প্রথম প্রজন্মের শিক্ষিত, সে নাকি শিক্ষাদীক্ষা পেয়ে এতটাই সংস্কারবিহীন হয়ে উঠেছে যে অমন ভয়ংকর মন্দিরে তোমার সঙ্গে এক্সপিডিশনে যেতে রাজি হয়ে গেল? ওর বড় ঠাকুর্দা কিছু বললেন না বা বারণ করলেন না? তিনিও হঠাৎ প্রচণ্ড সংস্কারমুক্ত নাস্তিক হয়ে পড়লেন নাকি?’’

চুপ করে রইলাম৷

‘‘আমি বাজি ধরতে পারি ভাইপো, ওই দাদু-নাতি মিলে একটা মস্ত কিছু চেপে যাচ্ছে তোমার কাছে৷ আমি জানি না সেটা কী, তবে আন্দাজ করতে পারি৷’’

‘‘সেটা কী কাকা?’’ গলাটা শুকনো শুকনো লাগছিল আমার৷

‘‘ওই বুড়ো জানে পাতরগোঁয়্যাদের গ্রামে কী হয়েছিল৷ ও জানে যে কাউরীবুড়ি কী অভিশাপ দিয়েছিলেন৷ ও জানে কীসের অভিশাপে ছারখার হয়ে গেছিল সেই জনজাতি৷ সেটা ও চেপে যাচ্ছে ভবতারণ৷ আমি এ বিষয়ে একদম নিঃসন্দেহ৷’’

‘‘কিন্তু আমাকে এসব লুকিয়ে ওদের লাভ?’’ কাতর কণ্ঠে বললাম৷

‘‘সে লাভ-লোকসানের গল্প তো ওই বুড়ো বলবে ভাইপো৷ আর বলবে ওর নাতি, শ্রীমান পরাগ বসুমাতারি৷’’

‘‘কিন্তু সেসব জেনে আমাদের বিশাল কিছু লাভ হবে কি কাকা?’’

কাকা ঘুরে দাঁড়িয়ে দু’হাতে আমার কাঁধদুটো খামচে ধরলেন, ‘‘লাভ মানে? এই পুরো রহস্যে এই দুটো মাত্র সূত্রই তো আমার কাছে অধরা আছে ভাইপো৷ বাকি তো সব দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার৷’’

ভদ্রলোক যে কী বলছেন সেসব আমার মাথায় ঢুকছিল না৷ বাকি সবই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার মানে? গত তিনদিন ধরে যে রহস্য নিয়ে আমি থই খুঁজে পাচ্ছি না, উনি স্রেফ একদিনের মধ্যেই প্রায় তার সমাধান করে ফেললেন? তাও দুটো মাত্র সূত্র বাদ দিয়ে?

‘‘কোন দুটো সূত্র কাকা? জানতে পারি?’’

‘‘প্রথম হচ্ছে ওই পাতরগোঁয়্যাদের শেষ গল্পটা৷ কী হয়েছিল ওদের? কী এমন ভয়ানক অপরাধ করেছিলেন ওদের সেই বড়দেওরি, যে, তার জন্য ওদের পুরো জাতটাই ধ্বংস হয়ে গেল?’’

‘‘আর দ্বিতীয়টা?’’

‘‘সেদিন মাধুরীকে রেপড হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে কে এসেছিলেন? কে সেই বৃদ্ধা?’’

‘‘সে তো মাধুরী বললই যে ও চিনতে পারেনি…’’

আমার দিকে গভীরভাবে তাকালেন কাকা৷ তারপর বললেন, ‘‘ব্যাপারটা যত সহজ ভাবছ তত সহজ নয় ভাইপো৷ এর মধ্যে অনেক জটিলতা আছে৷ ওটা না জানলে এই রহস্যের জট ছাড়াতে পারব না হে৷ বাকি সবই আমার মোটামুটি জানা৷’’

কথাটা আমার বিশ্বাস হতে চায় না৷ ‘‘কী বলছেন কী কাকা? বাকি সবই জেনে গেছেন আপনি?’’

গম্ভীর মুখে মাথাটা দুবার ওপর-নীচে করলেন কাকা৷ ‘‘জেনে গেছি বই কি ভাইপো৷ আর যদি মাথা ঠান্ডা করে নিজেই নিজেকে কতগুলো প্রশ্ন করতে, তাহলে বুঝতে পারতে কথাটা কেন বলছি আমি৷’’

‘‘যেমন?’’ চ্যালেঞ্জের সুরে বললাম আমি৷

‘‘এত ভিজে পোড়া কাঠের গন্ধ পাও কেন ভবতারণ, ভেবেছ কখনও? কাউরীবুড়ির মন্দিরে এত কাক কেন? পাতরগোঁয়্যাদের বড়দেওরির প্রথম সন্তান জন্মাবার পর বিধবা হতে হতই কেন? সত্যি বলো তো ভাইপো, তুমি কি কিছুই আন্দাজ করতে পারোনি?’’

বেকুবের মতো মাথা নাড়লাম৷

কাকা ফের চলতে শুরু করলেন৷

যেখানে রিকশা থেকে নেমেছিলাম, সেখান থেকে পরাগের বাড়ি যেতে সময় লাগল ঠিক দশ মিনিট৷ সহজ রাস্তা, গুলোবার চান্সই নেই৷

পরাগ বাড়িতেই ছিল৷ আমাদের বসতে বলল দাওয়াতে৷ লক্ষ করলাম কালকের তুলনায় একটু গম্ভীর হয়ে আছে ছেলেটা৷ আমাদের দেখে একটি ছোট মেয়েকে বড় ঠাকুর্দাকে নিয়ে আসার জন্য আদেশ দিল পরাগ৷ মেয়েটি উঠোনে এক্কাদোক্কা খেলছিল৷ বেজার মুখে ভেতরে গেল বুড়োকে ডেকে আনতে৷

এই অবসরে কাকার সঙ্গে পরাগের আলাপ করিয়ে দিলাম৷ পরাগ স্মার্টলি হ্যান্ডশেক করে ‘‘হ্যালো’’ বলতেই একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল৷ কাকা ওর হাত কিছুক্ষণ ধরে থেকে দুম করে বলে বসলেন, ‘‘মেয়েটার উদ্দেশ্য ভালো না ভাই, দয়া করে ওর জালে ফাঁসবেন না৷ আপনাকে খেলাচ্ছে ও৷ সোনার হার, দামি রিস্টওয়াচ এসব দিয়েছেন ঠিক আছে৷ তবে আর কোনো আর্থিক চাহিদা মেটাতে যাবেন না কিন্তু, আখেরে পস্তাবেন৷ এ মেয়ে ভালো নয়, আপনাকে ফতুর করে উড়ে গিয়ে অন্য ডালে বসবে৷ আর হ্যাঁ, অফিসের ক্যাশ ভাঙার কথা ভুলেও ভাববেন না৷ যে সাবানে অফিসের ক্যাশবাক্সের চাবির ছাপ তুলে নিয়ে এসেছেন, ওটা ফেলে দিন৷ আপনার বড় সাহেব কিন্তু এসবের আঁচ পেয়েছেন, আপনার ওপর নজর রেখে চলেছেন উনি৷ বিন্দুমাত্র বেচাল দেখলেই আপনি জেলে যাবেন, লিখে রাখুন৷’’

আমি তো স্তব্ধ! তবে দেখার মতো অবস্থা হল পরাগের৷ দশ সেকেন্ড মতো হাঁ করে কাকার দিকে চেয়ে রইল সে৷ তারপর কাটা কলাগাছের মতো কাকার পায়ে পড়ে গেল, ‘‘স্যার…স্যার…আপনি ভগবান স্যার৷ জালে আটকে গেছি স্যার৷ বেরোতে পারছি না৷ দয়া করে বাঁচান আমাকে৷’’

কাকা ঝট করে নীচু হয়ে পরাগের কাঁধে হাত দিয়ে তুলে ধরলেন ওকে৷ তারপর বললেন, ‘‘টাকা ব্যাপারটা ভালো, তবে যদি সৎপথে আসে, তবেই৷ আর মেয়েটা সত্যিই ভালো না৷ কী করে সে?’’

‘‘শিলিগুড়ির ডান্সবারে কাজ করে৷ ডান্সগার্ল৷’’

‘‘আমার গণনা বলছে মেয়েটি কোনো আত্মঘাতী, স্বজাতিদ্রোহী কাজের সঙ্গে যুক্ত৷ এর সঙ্গে থাকলে আপনার অপঘাত মৃত্যু অনিবার্য৷’’

‘‘আমি পারছি না স্যার, মাইরি বলছি৷ আজকাল সত্যিই ওর রকমসকম আমার অদ্ভুত ঠেকছে৷ আমি চাইলেও এই জাল কেটে বেরিয়ে আসতে পারছি না স্যার৷ ও শুধু আমাকে থ্রেট দিচ্ছে, বলছে যে আমার সবকিছু ও এখানে এসে ফাঁস করে দেবে৷’’

কাকা বরাভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে হাত তুললেন, ‘‘সেসব আমি দেখে নেব ভাই৷ আপনি শুধু কথা দিন, দরকারের সময় আপনি আমাদের সাহায্য করবেন?’’

পরাগ খুব সম্ভবত কাকার পায়ে আবার ডাইভ দিতে যাচ্ছিল৷ আমি আটকালাম, কারণ ততক্ষণে পরাগের বুড়ো ঠাকুর্দা দরজা খুলে বারান্দায় এসে উপস্থিত৷

আমাকে দেখে স্মিত হাসল বুড়ো, তারপর কাকার দিকে দু’হাত তুলে নমস্কার করে বলল, ‘‘এনাকে তো চিনলাম না বাবু৷’’

কাকাও প্রতি-নমস্কার করে হাসিমুখে বললেন, ‘‘পৃথিবীতে কে-ই বা আর অন্য কাউকে ভালো করে চেনে বলুন৷ আমি কে. এন. ভট্টাচার্য, শিলিগুড়িতে থাকি৷ ভবতারণ আমার নিজের ভাইপো বললেই চলে৷ ও বলল কীসব নাকি দামি লতার খোঁজ পেয়েছে, তাই আমার সাহায্য দরকার৷ সুযোগ বুঝে আমিও চলে এলাম এখানে৷ আসামের এই দিকটা আমার দেখা ছিল না কিনা৷’’

বুড়োর মুখে স্মিত হাসি, যেন কেমন একটা ‘‘মিথ্যে কথার দরকার ছিল না বাবু, আমি জানি আপনি কেন এসেছেন’’ মার্কা হাবভাব৷ তারপর সরাসরি বলল, ‘‘বলুন বাবু, কী জানতে চান৷’’

‘‘আজ থেকে আড়াইশো বছর আগে পাতরগোঁয়্যাদের গ্রামে কী হয়েছিল দাদামশাই? কীসের অভিশাপ দিয়েছিলেন কাউরীবুড়ি?’’

বুড়ো আর পরাগ তো বটেই, আমিও হকচকিয়ে গেছিলাম এমন আক্রমণের সামনে পড়ে৷ কাকাকে চিরকালই দেখে এসেছি ধীরস্থির একজন মানুষ হিসেবে৷ কোনো তাড়াহুড়ো করার লোক তিনি নন৷ সেই তিনিই যে আলাপ-পরিচিতির বালাই না রেখে এমন একটা কামান দেগে বসবেন সে আমরা জানব কী করে?

বুড়ো স্পষ্টতই এই আক্রমণের সামনে হতচকিত৷ আমার আর পরাগের দিকে ইতিউতি তাকাচ্ছে৷ আমার দিকে তাকিয়ে অবশ্য লাভ ছিল না, আমিও একই রকম বিস্ময়বিমূঢ়৷ পরাগ দেখলাম মাথাটা একেবারে বুকের কাছে সেঁটে পায়ের ডান আঙুল দিয়ে মাটিতে আঁচড় কাটছে৷

‘‘কীসের কথা বলছেন বাবু, কিছুই তো বুঝছি না৷’’

সামান্য হাসলেন কাকা, তারপর বললেন, ‘‘ভবতারণের কাছ থেকে সবই শুনেছি দাদামশাই৷ কাল যে পরাগ আর ভবতারণ কাউরীবুড়ির মন্দির থেকে গোলকপুষ্পের লতা তুলে আনতে যাওয়ার প্ল্যান করেছে সেও জানি৷’’

বুড়ো কিছু বলল না, সরু চোখে কাকার দিকে চেয়ে রইল৷

‘‘এতে আপনার সায় আছে দাদামশাই?’’

‘‘আমার সায় থাকা না থাকায় আর কী এসে যায় বলুন৷ আজকালকার বাচ্চা, ওরা কি আর আমার কথা শুনে চলে বাবু?’’

‘‘সে কী! অমন বিপজ্জনক জায়গা, যেখানে গেলে নাকি কেউ বেঁচে ফেরে না, সেখানে আপনার নাতি যাচ্ছে প্রাণ হাতে করে, তাতে আপনার আপত্তি নেই?’’

বুড়ো একটু নড়েচড়ে বসল, শরীরী ভাষায় স্পষ্টতই একটা অস্বস্তির ভাব৷ ‘‘দেখুন বাবু, আপনাকে বরং খুলেই বলি৷ পরাগের একটু টাকার দরকার হয়ে পড়েছে হঠাৎ করে৷ তাই ও ভাবছিল যদি এই মওকায়…’’

‘‘কথাটা কি খুব বিশ্বাসযোগ্য হল দাদামশাই? আপনাদের দেওরিদের তিন-তিনটে জনজাতির এতদিনের বিশ্বাস ভেঙে শুধুমাত্র টাকার জন্য আপনার নাতিকে আপনি সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চাইছেন?’’

সবাই চুপ৷ বুড়ো মাথা নীচু করে বসে আছে৷ কাকা সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে৷ বুঝতে পারছি যে একটা মানসিক লড়াই চলছে দুজনের মধ্যে৷

‘‘আমি যদি বলি যে আপনি জানেন আজ থেকে আড়াইশো বছর আগে পাতরগোঁয়্যাদের গ্রামে কী হয়েছিল, সেটা খুব ভুল বলা হবে কি?’’

ঘন ঘন মাথা নাড়ছে বুড়ো, ‘‘না বাবু, আমি কিছু জানি না, কিচ্ছু জানি না৷’’

‘‘আপনি জানেন যে কাউরীবুড়ি কী অভিশাপ দিয়েছিলেন ওদের৷’’

‘‘না বাবু৷ আমি সত্যিই জানি না৷’’

‘‘আপনি এও জানেন যে ওদের সেই অভিশপ্ত বড়দেওরি ঠিক কী পাপ করেছিলেন৷’’

‘‘না বাবু, আমি…’’

‘‘এবং আমি এও অনুমান করতে পারছি আপনি কেন পরাগকে ওখানে পাঠাতে চাইছেন৷ টাকার জন্য নয়, ও গোলকপুষ্পের লতা তুলে আনতে চাইছে সম্পূর্ণ অন্য একটা কারণে৷’’

‘‘না বাবু, আপনি ঠিক…’’

‘‘যে কাজ আপনারা অনেকদিন ধরে করতে চাইছেন, কিন্তু পারছেন না৷ পারছেন না, কারণ আপনারা এমন একজনকে খুঁজছিলেন যে জানবে ওখানে যাওয়ার আর ফিরে আসার রাস্তাটা কী…’’

‘‘বাবু…বাবু…’’

‘‘আজ ভবতারণ আপনাদের সামনে সেই সুযোগ এনে দিয়েছে৷ তাই মংকুর মুখে খবর পেয়েই দৌড়ে এসেছিল পরাগ৷ তাই…’’

কাকার কথাটা শেষ হল না, বুড়ো দেখি ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করেছে৷ পরাগ দৌড়ে এসে না ধরলে হয়তো দাওয়াতে পড়েই যেত লোকটা৷ আমিও ব্যস্তসমস্ত হয়ে এগিয়ে গেলাম ওদিকে৷ একমাত্র কাকাই কিছু করলেন না, শান্ত চোখে দেখতে লাগলেন ব্যাপারটা৷

অবশ্য বেশি কিছু করতে হল না৷ মুখেচোখে একটু জলের ছিটে দিতেই উঠে বসল বুড়ো৷ এখন তার চোখমুখের ভাব পুরো পালটে গেছে৷ চালাকচতুর হাবভাবের বদলে সেখানে এখন একটা হতভম্ব ভাব৷

বুড়ো একটু থিতু হতেই এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসলেন কাকা৷ তারপর শান্ত স্বরে বললেন, ‘‘আমাকে যদি সবকিছু খুলে বলেন দাদামশাই, আমি কথা দিচ্ছি যে কাজ শেষ করার জন্য আপনি পরাগকে ওখানে পাঠাচ্ছেন, আমি সর্বতোভাবে তাতে সাহায্য করব৷’’

বুড়ো খানিকক্ষণ চুপ করে রইল৷ তারপর মুখ তুলে চাইল আকাশের দিকে৷ মেঘলা আকাশ, একটা ভ্যাপসা গুমোট আবহাওয়া চারিপাশে৷ একফোঁটা হাওয়া নেই৷ গাছের একটা পাতা নড়ছে না৷

‘‘সে অনেক পুরোনো গল্প বাবু৷ আজ থেকে অনেক দিন আগেকার… ওই যে বললেন আড়াইশো বছর, ওই আড়াইশো বছর আগেকার কথা৷

পাতরগোঁয়্যাদের বড়দেওরি ছিলেন রাজকুমারী চাংদেওমাই৷ হ্যাঁ, বড়দেওরিকে ওরা রাজকুমারীই বলত৷ ওরা মনে করত বড়দেওরি স্বয়ং কাউরীবুড়ির বংশধর৷

দেওরিদের উপকথা অনুযায়ী ওরা হল জিমো ছাঁয়া, মানে সূর্যদেব আর চন্দ্রদেবীর সন্তান৷ পাতরগোঁয়্যারা বলত কাউরীবুড়ি হচ্ছেন সেই চন্দ্রদেবীর প্রথম কন্যাসন্তান৷ কাউরী মানে কাক৷ লোকে বলত চন্দ্রদেবী অস্তাচলে গেলে প্রথম যে পাখি ডেকে ওঠে সে হচ্ছে কাক৷ কাকেরা চন্দ্রদেবীর প্রতিভূ হয়ে পৃথিবীর দেখাশোনা, রক্ষণাবেক্ষণ করে৷ আর সেই কাকেদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হচ্ছেন কাউরীবুড়ি৷ আর এই কাউরীবুড়ির থেকেই পাতরগোঁয়্যাদের উৎপত্তি৷ কাউরীবুড়ির যে প্রথম সন্তান, সেও ছিল একটি মেয়ে৷ সেই মেয়েই পাতরগোঁয়্যাদের প্রথম বড়দেওরি৷

বড়দেওরিকে ওরা ঈশ্বরের সমান শ্রদ্ধা করত৷ তিনি ছিলেন পাতরগোঁয়্যাদের সব কিছু, তাঁর আদেশই ছিল শেষ কথা৷’’

‘‘প্রথম সন্তান মানে? বড়দেওরিদের আরও সন্তান হত নাকি?’’

‘‘আগে হত৷ তখন বড়দেওরিরা অনেক সন্তানের জন্ম দিতে পারতেন৷ যদিও প্রথম সন্তান সবসময় মেয়েই হত৷ তিনিই হতেন পরের বড়দেওরি৷’’

‘‘সেটা উঠে গেল কবে?’’ প্রশ্ন করলেন কাকা৷

জানা গেল, যবে থেকে ওরা মনে করা শুরু করল বৈধব্য ব্যাপারটা খুব পবিত্র, তবে থেকেই৷ ওরা বিশ্বাস করত যে কাউরীবুড়ি ছিলেন বিধবা, এবং বৈধব্য একটা পবিত্র ব্যাপার৷ এমনকি পাতরগোঁয়্যাদের মেয়েদের মধ্যেও বিধবা হওয়া ব্যাপারটা জাঁকিয়ে বসে৷ তার ওপর ওদের তুকতাকের ব্যাপারটা জুড়ে দিয়ে লোকে বলা শুরু করল যে পাতরগোঁয়্যাদের মেয়েরা বিয়ের পর মন্তর পড়ে তাদের স্বামীদের মেরে ফেলে, জোর করে বিধবা হয়৷ যাতে করে তারা কাউরীবুড়ির আরও প্রিয়পাত্রী হয়ে ওঠে৷

‘‘পাতরগোঁয়্যাদের প্রতিটি বড়দেওরিকে তার প্রথম সন্তানের জন্মের পর বিধবা হতেই হত, এমনকি সেই সন্তানের প্রথম জন্মদিনে তার হতভাগ্য বাবাকে বলিও দেওয়া হত৷ এতদিন অবধি সেই নিয়মের কোনো ব্যত্যয় হয়নি৷ হল এই চাংদেওমাইয়ের সময়ে৷

চাংদেওমাই তাঁর বিবাহিত স্বামীকে খুব ভালোবাসতেন৷ তিনি ঠিক করলেন তাঁর স্বামীকে যে করে হোক বলির হাত থেকে বাঁচাবেন৷

যেদিন বলি হবে, তার আগের রাত থেকেই ওদের গ্রামে উৎসব শুরু হত৷ মদ আর মাংসের এলাহি বন্দোবস্ত থাকত৷ চাংদেওমাই করলেন কী, ওই গোলকপুষ্প লতার একটা তখনও না-ফোটা কুঁড়ি বেটে মদের গামলায় মিশিয়ে দিলেন৷’’

‘‘কেন? গোলকপুষ্পের কুঁড়ি কেন?’’

‘‘আপনার ভাইপোকে কালই বলেছি বাবু, এ দুনিয়ার ফুলই নয়, পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর পাতাল থেকে তুলে আনা অভিশাপ৷’’ শুকনো গলায় বলল বুড়ো, ‘‘ও ফুল বছরে একবারই ফোটে, কামাখ্যা মায়ের অম্বুবাচী পুজোর দিন৷ তখন সেই ফুল থেকে আশ্চর্য সব ওষুধ তৈরি করা যায়৷ কিন্তু তার আগে যদি ওই ফুল তোলা হয় বাবু, তবে তা সাক্ষাৎ কালসাপের গরল৷ ওই একটিমাত্র ফুলের এত তীব্র বিষ, যা একটা গোটা গ্রামের লোককে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারে৷

চাংদেওমাই অবশ্য অতটা চাননি৷ বড়দেওরিরা বংশানুক্রমে এই ফুলের ব্যবহার জানতেন৷ তিনি ততটাই প্রয়োগ করেছিলেন, যতটা করলে এক রাতের জন্য গোটা গ্রাম ঘুমিয়ে থাকে৷ তাঁর মতলব ছিল যে সেই সুযোগে তিনি তাঁর স্বামী আর কন্যাকে নিয়ে পাতরগোঁয়্যাদের গ্রাম ছেড়ে, সমাজ ছেড়ে অনেক দূরে অন্য কোথাও চলে যাবেন৷

কিন্তু তাঁর পরিকল্পনা ফলল না৷ বড়দেওরির কাজে যারা সাহায্য করে, তাদের বলে সারুদেওরি৷ বড়দেওরির মতো এরাও ছিল মেয়ে৷ দুই সারুদেওরির কোনো কারণে চাংদেওমাই-এর ওপর সন্দেহ হয়৷ সেই রাতে পুরো গ্রাম হুল্লোড় করে মদ-মাংস খেলেও তারা ওসব না ছুঁয়ে আড়াল থেকে নজর রাখছিল চাংদেওমাই-এর ওপর৷

মাঝরাতে যখন চাংদেওমাই চুপিচুপি গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন, তখন সেই দুই সারুদেওরি তাঁদের পথ আটকে দাঁড়ায়৷ পাতরগোঁয়্যাদের কাছে সমাজ ছেড়ে চলে যাওয়া ছিল মস্ত বড় অপরাধ, নিজেদের গোষ্ঠীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল৷ সেখানে স্বয়ং বড়দেওরি নিজে ওদের প্রথা অমান্য করে স্বামীকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন, সে কত বড় অনর্থ!

সেই রাতে বড়দেওরি আর তাঁর স্বামীর সঙ্গে দুই সারুদেওরির প্রবল কথা কাটাকাটি হয়৷ উত্তেজনার মাথায় বড়দেওরি তাঁর দুই বিশ্বস্ত সহচরীকে কোনো ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খুন করে বসেন৷’’

এতটা বলে আমাদের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকাল বুড়ো৷ কাকা বললেন, ‘‘কী হল দাদামশাই, থামলেন কেন?’’

‘‘আর তারপরেই নেমে এল কাউরীবুড়ির কোপ৷’’

এবার আর আমরা কেউ কোনো প্রশ্ন করলাম না বুড়োকে৷

‘‘সেই রাতেই আকাশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে এল কাউরীবুড়ির অনুচরেরা৷ তারা এই দুনিয়ার কাক নয় বাবু, সাক্ষাৎ নরক থেকে উঠে আসা রাক্ষসের দল৷ তারা প্রথমেই খুবলে নিল অচেতন হয়ে থাকা মানুষগুলোর চোখ৷ বিষমদের নেশায় ঝাঁঝে বেসামাল হয়ে ছিল ওরা, কিছুতেই কিছু আটকাতে পারল না৷ সেই কাকেদের দল চাংদেওমাইয়ের চোখের সামনে একটু একটু করে ছিঁড়ে খেল জ্যান্ত মানুষগুলোকে৷

চাংদেওমাই বুঝতে পেরেছিলেন কী হতে চলেছে৷ কিন্তু তাঁর আর কিছু করার ছিল না৷ নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত তাঁকে করতেই হত৷ নিজের জাদুবিদ্যার জোরে তিনি নিজের স্বামীকে সেই রাক্ষুসে কাকদের হাত থেকে কোনোমতে রক্ষা করে গ্রামের বাইরে বার করে দিলেন৷ বলে দিলেন তিনি যেন কাল এসে তাঁদের মেয়েকে এখান থেকে নিয়ে যান৷

আর চাংদেওমাই তাঁর মেয়েকে নিয়ে রয়ে গেলেন গ্রামের মধ্যে৷ চারিদিকে এত মৃত্যুর হাহাকার দেখে তীব্র অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলেন পাতরগোঁয়্যাদের বড়দেওরি চাংদেওমাই৷ তিনি তাঁর জানা সমস্ত জাদুমন্ত্র দিয়ে নিজের সন্তানকে সুরক্ষিত করলেন৷ তারপর তার মাথায় একটি চুমো খেয়ে দেওথানের উঠোনের অশ্বত্থগাছ থেকে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়লেন!’’

আমরা সবাই স্তব্ধ৷

স্তব্ধতা ভাঙলেন কাকাই৷ গলাটা একটু খাঁকরে যে প্রশ্নটা করলেন, তাতে বুঝতে পারলাম কেন লোকটাকে আমি এত শ্রদ্ধা করি৷

‘‘একটা কথা বলুন তো দাদামশাই৷ এই কাহিনি আপনি জানলেন কী করে?’’

‘‘আমার বাপ-দাদাদের থেকে বাবু৷ এ ভারী গোপন কাহিনি৷ তাঁরা আমাদের এও বলে গেছেন যে আমাদের পরিবারের বাইরের যেন কেউ…’’

‘‘আপনার বাপ-দাদারাই বা এই গল্প জানলেন কী করে?’’

বুড়ো বোধহয় প্রশ্নটা বোঝেনি৷ হাঁ করে চেয়ে রইল কাকার দিকে৷ আমিও বুঝতে পারলাম না কাকা হঠাৎ এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করছেন কেন৷

সংশয়ের অবসান হল কাকার পরের প্রশ্নেই৷

‘‘আপনার কথামতো পাতরগোঁয়্যাদের গ্রামে সেই রাতে যা ঘটেছিল সেটা কারও জানার কথা নয়৷ সবাই তো মরে গেছে, বলবে কে? আর এদিকে পরাগ যে গল্পটা ভবতারণকে বলেছিল তাতেও তো বাইরের অন্য কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয়৷ আপনার বাপ-দাদারা জানলেন কী করে?’’

এইবার প্রশ্নের কারণটা বুঝলাম৷ বুড়োর মুখ অন্ধকার হয়ে এল৷ পরাগের মুখেও একটা ধরা পড়ে যাওয়া অপরাধীর ভাব৷

‘‘সেই রাতে পাতরগোঁয়্যাদের গ্রামে যা ঘটেছিল সেটা দেখেছিলেন মাত্র তিনজন৷ কারণ বাকিরা অচৈতন্য হয়ে ছিল, তারা কিছু দেখার কোনো সুযোগই পায়নি৷ তিনজনের মধ্যে একজন চাংদেওমাই নিজে৷ তিনি এ কথা কাউকে বলার সুযোগ পাননি, কারণ সেই রাতেই তিনি আত্মহত্যা করেন৷ দ্বিতীয়, তাঁর কন্যাসন্তান৷ কিন্তু তখন তার বয়েস মাত্র এক, তার সেসব মনে থাকার কথা নয়৷ আর পড়ে থাকেন একজন৷ যিনি পুরো ঘটনাটা সামনে থেকে দেখেছেন৷ স্ত্রীর দৌলতে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন৷ পরের দিন সময়-সুযোগ মতো এসে নিজের মেয়েকে নিয়েও গেছেন স্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী৷

এবার বলুন তো দাদামশাই, যে ঘটনার এই পৃথিবীতে একজন মাত্র প্রত্যক্ষদর্শী, সেই ঘটনা আপনার বাপ-দাদারা জানলেন কী করে?’’

বুলস আই হিট! পলকে বুড়োর সারা মুখ রাঙা৷ পরাগ একদম শক্ত হয়ে আছে৷ আমারও মনে হচ্ছে যেন বুকের মধ্যে একটা ইঞ্জিন দৌড়োচ্ছে৷

শোনা যায় না এমন একটা দুর্বল স্বর ভেসে এল বুড়োর কাছ থেকে, ‘‘চাংদেওমাইয়ের স্বামীর নাম ছিল মগলহানজামা৷ সেই অভিশপ্ত রাতের পরের দিন সন্ধেবেলায় মগলহানজামা লুকিয়ে লুকিয়ে ফেরত আসেন তাঁর গ্রামে৷ তারপর মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যান অরুণাচল প্রদেশের দিকে৷’’

বলে আরেকটু থামে বুড়ো, তারপর ধীর স্বরে বলে, ‘‘ওখানে গিয়ে তিনি আরেকটি বিয়ে করেন৷ অনেকদিন পরে মগলহানজামা তাঁর প্রথম কন্যা, দ্বিতীয় স্ত্রী এবং আরও দুটি পুত্রসন্তান নিয়ে ফিরে আসেন এখানে, আর দিবংগোঁয়্যাদের সমাজে মিশে যান৷ এখানে এসে একটা নতুন নাম নেন তিনি৷ আটন৷ আটন বসুমাতারি৷’’

 * * * *

পরাগের বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে বেশ বেলা হয়ে গেল৷ আমরা ফোনে কাকিমাকে বলে দিলাম যে লাঞ্চটা বাইরেই সারব৷

পরাগ কেন ওখানে ফিরে যেতে চায় সেটা আমাদের কাছে এখনও খুব একটা স্পষ্ট নয়৷ পরাগের বক্তব্য, যেহেতু ওরা আসলে পাতরগোঁয়্যাদের উত্তরাধিকারী, তাই সে তার পূর্বপুরুষের বাসভূমিটা একবার দেখে আসতে চায়৷ বলা বাহুল্য, এ যুক্তিটা আমাদের খুব একটা মনে ধরেনি৷ তবে কাকা ওর কাছ থেকে কথা আদায় করে নিয়েছেন যে ও আমাদের সবরকম সাহায্য করবে৷ ওকে বলেছি গোলকপুষ্পের লতা তুলে দিতে আমাকে সাহায্য করলেই যথেষ্ট৷ বাকি ওর পিতৃপুরুষের ভিটে নিয়ে ও যা খুশি করুক৷

‘‘একটা কথা বলুন কাকা, সেদিন যে ভদ্রমহিলাকে দেখেছিলাম কাউরীবুড়ির মন্দিরে, তিনি যদি চাংদেওমাইয়ের উত্তরসূরি হন, তাহলে তো তিনি লতায় পাতায় এই পরাগেরই আত্মীয় হবেন, তাই নয় কি? তাহলে তো পরাগের জানার কথা তিনি কে, কী বলেন আপনি?’’ একটা রাস্তার হোটেলে বসে ডাল দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে প্রশ্নটা করলাম৷

‘‘মনে হয় না৷ সেক্ষেত্রে পরাগ এতদিন অপেক্ষা করে থাকত না৷ আর একটা কথা ভেবে দ্যাখো, মগলহানজামা আর পরাগের মধ্যে আড়াইশো বছরের ব্যবধান৷ তার মধ্যে মন্বন্তর এসেছে, দু-দুখানা বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, দাঙ্গা, এর মধ্যে ফ্যামিলির কে কোথায় ছিটকে যায় কেউ তার খেয়াল রেখেছে? রাখা সম্ভব?’’

‘‘তার মানে আপনার মতে ওদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই, মগলহানজামার দুই স্ত্রীর সন্তানের পরিবার একদম আলাদা হয়ে গেছে, কারেক্ট? তার মধ্যে পরাগের পরিবার জানে যে ওরা পাতরগোঁয়্যাদের একমাত্র উত্তরসূরি৷ আর চাংদেওমাইয়ের সেই মেয়েটির উত্তরসূরিরা কাউরীবুড়ির মন্দিরে পুজোর ট্র্যাডিশনটাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে৷ ঠিক বলেছি তো?’’

‘‘একদম ঠিক বলেছ৷ এ ছাড়া অন্য কিছু হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই৷’’

‘‘আচ্ছা, চাংদেওমাই যখন মারা যান, তখন তাঁর মেয়ের বয়েস এক৷ তিনি নিশ্চয়ই তাঁর জাদুবিদ্যার কিছুই তাঁর মেয়েকে শিখিয়ে দিয়ে যেতে পারেননি৷ তাহলে ওই মন্দিরে যে ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার দেখা হল, তাঁর মধ্যেও কি বড়দেওরি হওয়ার জন্য কিছু অলৌকিক শক্তি-টক্তি থাকা সম্ভব?’’

খেতে খেতে থেমে গেলেন কাকা, বললেন, ‘‘বলা মুশকিল ভাইপো৷ ইন ফ্যাক্ট এই প্রশ্নটাই তো আমাকে সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে হে৷ ধরো এমনটাও তো হতে পারে, চাংদেওমাই তাঁর বেশ কিছু গুপ্তবিদ্যা তাঁর ভালোবাসার মানুষ মগলহানজামাকে শিখিয়ে দিয়ে গেছিলেন৷ মগলহানজামা আবার তাঁর প্রথম সন্তানকে সেই গুপ্তবিদ্যার উত্তরাধিকার দান করে দিয়ে যান৷ সেই থেকে চাংদেওমাইয়ের মেয়েরা বংশানুক্রমে পাতরগোঁয়্যাদের বড়দেওরির গুপ্তজ্ঞানের অধিকারী৷ ইনফ্যাক্ট আমার মনে হয় সেটাই ঘটেছিল৷ নইলে অন্য কারও পক্ষে এতদিন ধরে ওই গোলকপুষ্পের লতা বা ফুলের পরিচর্যা করে যাওয়া সম্ভব নয়৷’’

‘‘আপনি কী সত্যিই বিশ্বাস করেন যে ওই লতাটার মধ্যে অলৌকিক শক্তি আছে?’’

‘‘না৷’’ কাকার সংক্ষিপ্ত জবাব৷

‘‘কিন্তু তাহলে কি ওই পুথিটা ফেক? গোলকপুষ্পের ফুলের গল্পটা ভুল?’’

‘‘তা তো বলিনি ভাইপো৷ গোলকপুষ্পের লতার বা ফুলের একদম অজানা কোনো আয়ুর্বেদিক গুণ থাকতেই পারে৷ সেটা অলৌকিক হতে যাবে কেন? তাহলে তো কুইনাইন, পেনিসিলিন এসবকেও অলৌকিক বলে ধরতে হয়৷’’

‘‘কিন্তু সেই ভদ্রমহিলা যে বললেন কাউরীবুড়ির কাছে বলি দেওয়া পশু বা পাখির রক্ত ছাড়া ও লতা বাঁচে না! আপনি আজ অবধি শুনেছেন এমন কোনো লতা যা রক্ত খেয়ে বাঁচে?’’

‘‘তুমি না আয়ুর্বেদের ছাত্র?’’ মৃদু ধমক দিলেন কাকা, ‘‘গাছগাছড়া নিয়ে এত কম জ্ঞান নিয়ে আয়ুর্বেদচর্চা করো কী করে? নেপেনথিস, মানে পিচার প্ল্যান্টের নাম শোননি? ভেনাস ফ্লাই ট্র্যানপ? রাউন্ডলিফ সানডিউ? গাছ পোকামাকড় খেতে পারে, আর রক্ত খেতে পারে না?’’

দমে গেলাম৷ তাহলে তো সত্যিই সে লতা তুলে নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই!

আড়চোখে আমার দিকে তাকালেন কাকা, তারপর বললেন, ‘‘ভেঙে পড়ার কিছু হয়নি ভাইপো৷ তুমি স্বচ্ছন্দে ও লতা তুলে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে চাষ করতে পারবে৷ ওর কোনো অসাধারণ ভেষজ গুণ থাকতে পারে বটে, কিন্তু ও নিরামিষাশী লতা৷ ওই বলির রক্তের গল্পটা ভাঁওতা৷’’

‘‘কী করে বুঝলেন যে বলির রক্তের গল্পটা ভাঁওতা?’’ সোজা হয়ে বসলাম চেয়ারে৷

আমার দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন কাকা, ‘‘শুধু শুনে গেলে হবে ভাইপো, যেটা শুনলে সেটা তলিয়ে ভাববে না? এতক্ষণ অবধি যা যা শুনেছ, তার মধ্যেই তোমার প্রশ্নের লুকিয়ে আছে৷ একটু যুক্তি দিয়ে ভাবো দেখি৷’’

বলা বাহুল্য, অনেক ভেবেও কোনো কূলকিনারা করতে পারলাম না৷ কাকার কাছে আত্মসমর্পণ করতেই হল৷

‘‘মগলহানজামা যখন তাঁর মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যান, তার কত বছর পর ফিরে এসেছিলেন?’’

‘‘বেশ কয়েক বছর পর৷ তখন সঙ্গে তাঁর মেয়ে, দুই ছেলে আর দ্বিতীয় স্ত্রী৷’’

‘‘নিশ্চয়ই সেই বেশ কয়েক বছরের পরেই মগলহানজামা ওরফে আটন বসুমাতারি তাঁর মেয়েকে কাউরীবুড়ির মন্দিরে নিয়ে যান পুজো চালু করতে, তাই না?’’

‘‘নিশ্চয়ই তাই৷’’

‘‘তাই যদি হয়, তাহলে ওই বেশ কয়েক বছর ওই পরিত্যক্ত মন্দিরে কে যেত কাউরীবুড়ির সামনে বলি দিতে? সেই ক’বছর কে বলির রক্ত গোলকপুষ্পের গোড়ায় ঢালত? অত বছর বলির রক্ত ছাড়া ও লতা বাঁচল কী করে?’’

হাত এঁটো না থাকলে তক্ষুনি কাকার পায়ের কাছে উপুড় হয়ে পড়তাম তাতে সন্দেহ নেই৷ সাধে লোকটার ফ্যান আমি?

অর্থাৎ আমার আগের প্ল্যান বলবৎ রইল৷ এইখান থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে একবার কালিম্পং পৌঁছোনোর ওয়াস্তা, ব্যস! জয়ত্তারা, জয় কালিকে শ্মশানবাসিনী!

কাকা খেতে খেতে অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘‘অলৌকিক ওখানে নেই হে৷ অলৌকিক কিছু রয়েছে তোমার সদানন্দকাকার বাড়িতে, বুঝলে৷ খুব খারাপ কিছু একটা ঘটছে ওখানে, খুব খারাপ৷ মুশকিল হচ্ছে কাউরীবুড়ির ছায়া ওই বাড়িতে ঢুকল কেন বা কী করে, সেটা আমার মাথায় এখনও ঢুকছে না৷’’

‘‘আপনিই তো বললেন আমি ওখানে গেছিলাম বলে…’’

‘‘উঁহুঁ, প্রথমে তাই ভেবেছিলাম বটে, কিন্তু এখন ভেবে দেখছি তা নয়৷ তাহলে তোমার যা ক্ষতি হওয়ার সেদিনই হয়ে যেত৷’’

‘‘কিন্তু তাহলে…’’

‘‘তাহলে দুটোর মধ্যে কিছু একটা যোগ তো আছেই৷ কিন্তু সেই যোগটা যে কী সেটা বলতে পারছি না৷ তবে আমার গণনা বলছে আগামীকাল দুপুরের মধ্যে তার একটা সুরাহা না হলে তোমার, মাধুরীর, এমনকি সদানন্দবাবু ও তাঁর স্ত্রীর ওপরে মারাত্মক কিছু একটা হতে পারে৷’’

আমি প্রথম দিন মাধুরীর হাত দেখে কী জানতে পেরেছিলাম সেটা বললাম কাকুকে৷ বৈধব্য যোগের কথাটাও জানালাম৷

‘‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, অনির্বাণও হতে পারে৷’’ অন্যমনস্কভাবে বললেন কাকা, ‘‘মোটমাট ও বাড়ির কারও একজনের গভীর প্রাণসংশয় আছে ভবতারণ৷ এবং সেটা বোধহয় আটকানো যাবে না৷’’

বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল৷ মনে পড়ল সকালে কাকুর বাড়ির উঠোনে আমার কবন্ধ ছায়াটার কথা৷

‘‘উপায় কী কাকু?’’ ধরা গলায় জিজ্ঞেস করলাম৷ সকালের সেই ভয়ের অনুভূতিটা আবার আমার বুকের মধ্যে ফিরে আসছিল৷

‘‘মাধুরীর স্বপ্নের সেই বৃদ্ধা মহিলা কে, সেটা যদি একবার জানা যেত’’, দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কাকা, ‘‘তাহলে হয়তো একটা চেষ্টা করলেও করা যেতে পারত৷ মুশকিল হচ্ছে যে টাইম কমে আসছে, কাল রাত্রের মধ্যেই যা করার করে ফেলতে হবে৷ এর মধ্যে কী করে…’’

‘‘কেন? কাল রাত্রের মধ্যে কেন?’’

‘‘কাল মহালয়া বলে৷’’ হোটেলের বাইরে এসে মৌরি মুখে ফেলে বললেন কাকু, ‘‘পরাগ তোমাকে মহালয়ার দিনটার কথাই বলল কেন, সেটা ভেবেছ কখনও?’’

‘‘কেন কাকা?’’

‘‘কাল মহালয়া৷ পিতৃপুরুষদের উদ্দেশে তর্পণের দিন৷ যাঁরা একদিন অনেক রক্ত ঘাম কষ্টের বিনিময়ে আমাদের এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলেন, আমাদের বেঁচে থাকার একটা ন্যূনতম ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছিলেন, তাঁদের প্রতি ধন্যবাদ জানাবার দিন৷ কাল তাঁরা তাঁদের বাসস্থান ছেড়ে নেমে আসবেন পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি, দেখে যাবেন তাঁদের রক্তের উত্তরাধিকারীরা কে কোথায় আছে, কেমন আছে৷ এই দিনেই যে পরাগ বসুমাতারি তার পূর্বপুরুষের বাসভূমিতে ফিরে যেতে চাইবে, তাতে আর সন্দেহ কী?’’

কথাটা শুনে একটা কথা মাথায় স্ট্রাইক করে গেল, ‘‘কাকা, আপনার এই মহালয়া আর পূর্বপুরুষদের কথা শুনে একটা কথা মনে পড়ে গেল৷ সেদিন খাওয়ার টেবিলে মাধুরী একটা বেশ ইন্টারেস্টিং গল্প বলেছিল বটে৷’’

‘‘কী সেটা?’’

কাকাকে মাধুরীর দিদিমার কথাটা বিশদে বললাম৷ দিদিমার সাধন-ভজন, মাধুরীকে বলে যাওয়া যে ও ঈশ্বরকোটির মেয়ে, ওর মধ্যে ভৈরবীচিহ্ন আছে, ওর নামে করা বিশেষ যজ্ঞ, সেই যজ্ঞ থেকে পাওয়া মাদুলি, সব কথাই খুলে বললাম৷

আমার কাঁধটা খামচে ধরলেন কাকা, ‘‘এসব কথা আমাকে আগে বলোনি কেন?’’

মাথা চুলকে বললাম, ‘‘আসলে খেয়াল হয়নি৷ এখন ওই মহালয়ার কথাটা বললেন বলে মনে পড়ল৷’’

কাকা দ্রুত পায়ে বাইরে বেরিয়ে এদিক-ওদিক দেখে চেঁচিয়ে একটা রিকশা ডাকলেন৷ আমাকে বললেন, ‘‘রিকশায় ওঠো৷ এক্ষুনি সদানন্দবাবুর বাড়ি যেতে হবে৷ মাধুরীর সঙ্গে আমার কথা বলা প্রয়োজন, খুব প্রয়োজন৷’’

 * * * *

রাত বারোটা৷ আমার ঘরটার মাঝখানে একটা টেবিল এনে রাখা হয়েছে৷ তার চারদিকে চারটে চেয়ার৷ তিনটে চেয়ারের একটায় আমি, একটায় কাকা আর একটায় মাধুরী৷ অন্য চেয়ারটা ফাঁকা৷

ঘরের দরজা-জানলা সব বন্ধ৷ মাথার ওপর ফ্যানটা অফ করে দেওয়া হয়েছে৷ অফ করে দেওয়া হয়েছে টিউবলাইটও৷

ঘরের মধ্যে আলোর উৎস বলতে তিনটে মোটা মোমবাতি৷ মোমবাতিগুলো জ্বালিয়ে টেবিলের ওপরে রাখা৷ টেবিলের ওপর আরও কয়েকটা জিনিস রাখা৷ কয়েকটা ছোট বাটি, একটা তামার পাত্র, কয়েকটা শেকড়বাকড় ইত্যাদি৷

কাকার বেশবাস এখন অন্যরকম৷ পরনে একটি লাল রঙের ধূতি৷ খালি গা৷ মাথায় একটি ছোট গেরুয়া কাপড়ের টুকরো ফেট্টির মতো করে বেঁধেছেন৷ কপালের একটি লাল টিকা, মোমবাতির আলোয় চকচক করে জ্বলছে সেটি৷

কাকাকে যতই দেখছি ততই অচেনা লাগছে৷ আজ দুপুরে পরাগের ওখান থেকে ফিরে এসে মাধুরীর সঙ্গে বন্ধ ঘরে কীসব আলোচনা করলেন৷ তারপর উধাও হয়ে গেলেন কোথাও৷ বললেন যাচ্ছেন এক জায়গায়, উনি ফেরার আগে এ বাড়ির কেউ যেন এক পা-ও বাড়ির বাইরে না রাখে৷ উনি সন্ধে নাগাদ ফিরবেন৷ রাতে আমাকে আর মাধুরীকে ডিনার করতে বারণ করলেন৷

কাকা ফিরেছেন ঘণ্টাখানেক আগে৷ দেখলাম স্নান করে এসেছেন৷ আমাকে আর মাধুরীকেও স্নান করে নিতে বললেন৷ বললেন রাতে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে আমাদের দুজনের৷ সেটা ঠিকঠাকভাবে সম্পন্ন না হলে নাকি আমাদের সবার সমূহ বিপদ!

এই সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজ?

কাকা প্রথম কথা বললেন মাধুরীকে উদ্দেশ করে, ‘‘মাদুলিটা এনেছ?’’

মাধুরী মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল৷

‘‘মাদুলিটা খুলে ফেলা তোমার উচিত হয়নি মা৷’’

‘‘আসলে…আসলে দিভাই বললেন বলে…আমি তো বিয়ের পর মাদুলি পরেই গেছিলাম ও বাড়ি৷’’

‘‘তাহলে খুললে কেন?’’

‘‘কী করব বলুন? দিভাই বললেন যে!’’

‘‘কী বললেন দিভাই?’’ টেবিলের ওপর একটু ঝুঁকে এলেন কাকা, ‘‘কী করলেন? স্টেপ বাই স্টেপ বলে যাও৷’’

‘‘স্টেপ বাই স্টেপ?’’ প্রশ্নটা শুনে চোখ বন্ধ করে ভুরু কুঁচকে ভাবতে লাগল মাধুরী, ‘‘ও বাড়ি গিয়ে বরণ-টরণ সব হল৷ তারপর বাড়িতে ঢুকে দিভাইকে প্রণাম করলাম৷ দিভাই আমাকে তুলে জড়িয়ে ধরতে গিয়েই কেমন একটু পিছিয়ে গেলেন৷ কিছু বললেন না৷ তারপর আমি যখন ঘরে ঢুকে মুখ-হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে অন্য একটা শাড়ি পরে বসেছি, এমন সময় দিভাই ঘরে এলেন৷ বাকি সবাইকে ঘর থেকে বার করে দিয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন৷ হাতের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘এটা কী পরেছিস রে ভাই?’

বললাম, ‘মাদুলি৷ আমার দিদুন মারা যাওয়ার আগে দিয়ে গেছিলেন৷’

দিভাই তখন কিছু বললেন না৷ শুধু লক্ষ করলাম যে তারপর থেকে আমাকে একটু এড়িয়ে এড়িয়ে চলছেন৷ রাতের বেলা শুতে যাব, দেখি দিভাই ঘরে এলেন৷ একটা-দুটো কথার পর বললেন, ‘তোকে একটা কথা বলি ভাই, সব ফ্যামিলির তো কিছু নিয়ম-টিয়ম থাকে৷ তা আমাদের বাড়ির নিয়ম হচ্ছে বাইরের কোনো মাদুলি তাগা তাবিজ এইসব না পরা, বুঝলি তো?’ আমি তো বুঝিনি, বললাম, ‘বাইরের বলতে?’ তখন দিভাই বললেন, ‘মানে এ বাড়িতে কারও কোনো মাদুলি, জলপড়া ইত্যাদির দরকার হলে আমিই ব্যবস্থা করে দিই৷ অন্য কারও বানানো মাদুলি-টাদুলি এই বাড়িতে ঢোকে না ভাই৷’ আমিও ভাবলাম, হবেও বা, কত বাড়িরই তো কত নিয়ম থাকে৷ তাই আমিও খুলে আমার ভ্যানিটি ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলাম৷’’

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কাকা, বললেন, ‘‘কর্ণ যদি কুরুক্ষেত্রে নামার আগেই তার কবচ-কুণ্ডল ফেলে আসে, তাহলে আর তাকে বাঁচায় কে? তা এখন মাদুলিটা সঙ্গে করে এনেছ তো?’’

‘‘হ্যাঁ এনেছি’’, বলে সঙ্গের বটুয়ায়াটা থেকে মাদুলিটা বার করে টেবিলের ওপরে রাখতে গেল মাধুরী৷ কাকা সঙ্গে সঙ্গে হাত তুলে আটকালেন, ‘‘এখন নয়, যখন বলব তখন৷’’

কাকা এবার সঙ্গের জিনিসগুলো নিয়ে কাজ শুরু করলেন৷

প্রথমে যে জিনিসটা হাতে তুলে নিলেন, সেটা আমি খুব ভালো চিনি৷ ওটা শ্বেতবেড়েলার মূল৷ তারপর নিলেন কয়েকটা নিমকাঠের ডাল আর আমার অজানা কোনো গুল্মলতা, ফুল সহ৷

তিনটি মোমবাতি একত্র করে তার আগুনের ওপর তিনটি একত্র করে ধরলেন৷ গোছাটা পুড়তে পুড়তেই একটা বাটি থেকে সামান্য চন্দনবাটা নিয়ে তার ওপর আঙুলের ছোঁয়ায় ছিটিয়ে দিলেন৷ সঙ্গে সঙ্গে একটা তীব্র মিষ্টি অথচ কড়া গন্ধে ঘরটা ভরে গেল৷

এবার গোছাটা আগুন থেকে সরিয়ে আনলেন কাকা৷ তারপর মাথার দিকটা একসঙ্গে বাঁধলেন৷ এবার তিনটে বাটিতে রাখা তরলগুলো তামার পাত্রে ঢালতে লাগলেন৷

‘‘এগুলো কী কাকা?’’

‘‘শ্বেতসর্ষের তেল, ধনে ফুলের মধু আর রক্তচন্দন৷’’

তিনটে তরল ওই আধপোড়া গোছা দিয়ে বেশ করে ঘেঁটে নিলেন কাকা৷ তারপর একটা ছোট বেলকাঁটা বার করে মাধুরীর হাতে দিয়ে বললেন, ‘‘তিন ফোঁটা রক্ত লাগবে মা৷’’

ভেবেছিলাম মাধুরী ইতস্তত করবে৷ তার বদলে বেশ স্মার্টলি কাঁটাটা নিয়ে আঙুলে ফোটাতে উদ্যত হল৷

‘‘আঙুলের রক্ত নয় মা৷ বুকের৷’’

এবার থমকাল মাধুরী৷ একবার কাকার দিকে, একবার আমার দিকে তাকাল৷ চোখ বন্ধ করল মুহূর্তের জন্য৷ তারপর বাঁদিকে খানিকটা ঘুরে গিয়ে শাড়ির আঁচলটা সরিয়ে বাম স্তনের ঠিক ওপরে কাঁটাটা ফুটিয়ে দিল৷

আমি স্বভাবতই মাথাটা নীচু করে ফেলেছিলাম৷ কাকার দেখলাম কোনো বিকার নেই৷ সহজ অথচ গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘‘বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে এক এক করে ঠিক তিনটি ফোঁটা রক্ত এই মিশ্রণের মধ্যে ফ্যালো মা৷’’

আমার ঠিক চোখের সামনে ছিল তামার পাত্রটা৷ দেখলাম মাধুরীর চাঁপাকলির মতো আঙুল থেকে তিনবার তিনটি রক্তবিন্দু মিশে গেল সেই মিশ্রণে৷

চোখ বুজলেন কাকা৷ তারপর গম্ভীর স্বরে আবৃত্তি করলেন,

‘‘ওঁ চামুণ্ডে শ্মশানকালিকে রক্তবর্ণা ত্রিনয়না৷
ভূতাদি প্রেতাদি সঙ্গা মহারত পরায়ণা৷৷
প্রসীদ প্রসীদ দেবীভূত্যাস্তবম্মকান্৷
সর্ব্বসিদ্ধিপ্রদা দেবি সিদ্ধি সর্বত্র দেহি মে৷’’

আগে কখনও কাকাকে এইভাবে দেখিনি৷ আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল৷

এইবার কাকা আধপোড়া গোছাটা মিশ্রণে ডুবিয়ে টেবিলের ওপর একটা একটা অদ্ভুত জ্যামিতিক নকশা আঁকলেন৷ নকশাটা দেখতে অনেকটা স্টার অফ ডেভিডের মতো, তফাত হচ্ছে যে এতে ছটার বদলে পাঁচটা মাথা৷ সেই পাঁচটা মাথা ছুঁয়ে একটি বৃত্ত৷ সেই বৃত্তটিকে বেষ্টন করে আরও একটি বৃত্ত৷ এবার ওই পঞ্চমুখী তারার পাশাপাশি দুটি মাথা থেকে সমদূরত্বে দুই বৃত্তের মাঝখানে পাঁচটি ফোঁটা আঁকলেন৷ সবশেষে একটি চতুর্ভুজ আঁকলেন কেন্দ্রস্থলে৷

আমি আর মাধুরী এতক্ষণ কাকার কাজকর্ম দেখছিলাম, কিছু বলিনি৷ আমাদের মধ্যে মাধুরীই প্রথমে জিজ্ঞাসা করল, ‘‘এটা কী কাকামশাই?’’

কাকা বললেন, ‘‘এর নাম চণ্ডকাত্যায়নীচক্র মা৷ আজ আমি এই চক্রের মাধ্যমে এইখানে তোমার দিদিমার আত্মাকে আহ্বান করব৷ কাল মহালয়া৷ এই সময়ে আমাদের পূর্বসূরিরা এই জড়জগতের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকেন৷ এই পুণ্যলগ্নে আমি সেই মহীয়সী সাধিকাকে আহ্বান জানাব আমাদের মার্গনির্দেশের জন্য, আমাদের অজ্ঞানের অন্ধকার দূর করার জন্য৷’’

‘‘কিন্তু তার জন্য এসব…’’

‘‘এই কাত্যায়নীচক্রসাধন অতি গূঢ়, অতি গুহ্যবিদ্যা মা৷ এই পৃথিবীতে মাত্র গুটিকয় সাধক এর প্রয়োগ জানেন৷ তোমার দিদিমা ছিলেন মহাসাধিকা, মহাযোগিনী৷ তাই কোনো সাধারণ চক্রাধার তাঁর আত্মার বিপুল বেগ ধারণ করতে সক্ষম নয়৷’’

‘‘কিন্তু কেন কাকামশাই? মানে এসব করে কী হবে?’’

মাধুরীর দিকে তাকালেন কাকা৷ বললেন, ‘‘মা, তুমি যে এখনও অবধি বেঁচে আছ সে তোমার ওই দিদুনের কৃপায়৷ নিজের মৃত্যু আসন্ন জেনে সেই মহাসিদ্ধযোগিনী তাঁর অলৌকিক বিভূতির খানিকটা তোমায় দিয়ে গেছিলেন, তারই জোরে তুমি এখনও নিঃশ্বাস নিতে পারছ মা৷ সেদিন মহাধর্মনাশের হাত থেকে তিনিই তোমাকে বাঁচিয়েছেন৷ নইলে তুমি যে সংকটের মধ্যে পড়েছ, এক মৃত্যু ছাড়া তার থেকে উদ্ধার পাওয়া অসম্ভব৷’’

কাকার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোমবাতির শিখাগুলো যেন একবার লাফিয়েই স্থির হয়ে গেল৷ আর আমার ঘাড়ের ঠিক কাছে কে যেন ঠান্ডা ফুঁ দিল একটা৷ আমার সমস্ত শরীর শক্ত হয়ে উঠল৷ আড়চোখে তাকিয়ে দেখি মাধুরীও যেন ভয় পেয়েছে কিছুটা৷

কাকা লক্ষ করলেন সেটা৷ তারপর বললেন, ‘‘দুজনকেই বলে রাখি, এই চক্রসাধনপথে কিন্তু মহাবিঘ্নভয় উপস্থিত হবে৷ যে অপশক্তি এ বাড়ির আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সে কিন্তু অত্যন্ত ক্রুরকর্মা, অত্যন্ত শক্তিশালী৷ সে সর্বতোভাবে চেষ্টা করবে যাতে আমরা সফল না হই৷ তাহলেই তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ৷ এই সময় তোমরা নিজের সাহস বজায় রাখবে৷ কোনোমতেই বুদ্ধিভ্রষ্ট হবে না, তাহলেই কিন্তু মহা সর্বনাশ৷ মাধুরী মা, এইবার তোমার দিদুনের দেওয়া মাদুলিটা নিয়ে এসো৷ এই চক্রের মাঝখানে যে চতুর্ভুজটি আছে, তার মধ্যে রাখো৷’’

মাধুরী ওর মুঠোটা টেবিলের ওপর আনতেই হঠাৎ করে একটা দুম করে আওয়াজ৷ মনে হল কে যেন আমাদের ঘরের ছাদের ওপর বড় ইট বা পাথর ছুড়ে মারল একটা৷

মাধুরী থমকে গেছিল৷ কাকা দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘‘নিজের মনোযোগ বিঘ্নিত হতে দিও না মা৷ আজ উন্মত্তভৈরব স্বয়ং আমাদের রক্ষা করবেন৷ যা বলছি সেটা করো৷’’

মাধুরী ধীরে ধীরে মাদুলিটা ওই নকশার মধ্যিখানে নিয়ে যেতে শুরু করতেই মনে হল ঘরের চারিপাশে যেন তাণ্ডব শুরু হয়েছে৷ দরজা-জানলাগুলো বিপুলভাবে কাঁপতে লাগল৷ সারা ছাদ জুড়ে কেউ যেন হাতুড়ি পিটছে উন্মত্তের মতো৷ ইতিমধ্যেই আমার হাত-পা কাঁপছে, কানের পাশ দিয়ে গড়াচ্ছে গরম ঘামের ফোঁটা, পেটের মধ্যেটা ফাঁকা৷ সমানে গুরুমন্ত্র জপে যাচ্ছি৷

মাধুরীকে দেখে বুঝলাম তারও অবস্থা আমার থেকে খুব বেশি ভালো না৷ কেবলমাত্র মনের জোরে সে তার ক্রমাগত কাঁপতে থাকা হাতটা নিয়ে যাচ্ছে নকশার দিকে৷

মাধুরীর মুঠোটা ঠিক চণ্ডকাত্যায়নীচক্রের মধ্যিখানে পৌঁছেছে, ঠিক সেই সময় সবকিছু হঠাৎ করে থেমে গেল৷ কোথাও কিছু নেই৷ চারিদিকে অপার পাথুরে স্তব্ধতা৷

তারপর শব্দটা শুরু হল৷ শুরু হল ধীরে ধীরে৷ মনে হল দরজার ওপর ধারালো নখ দিয়ে কে যেন আঁচড়াতে শুরু করেছে৷ একটা ভয় ধরানো ক্যারররররর আওয়াজ ধীরে ধীরে হিংস্র শ্বাপদের মতো আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকল অনিবার্য নিয়তির মতো৷

মাধুরীকে মনে হল চেয়ার থেকে পড়ে যাবে এবার৷ হাতটা থরথর করে কাঁপছে৷ চাইলেও মুঠোটা খুলতে পারছে না৷ আমি উঠতে যাচ্ছিলাম সাহায্য করব বলে৷ কাকু হাত দেখিয়ে বারণ করলেন৷ মাধুরীকে আদেশ করলেন, ‘‘মাদুলিটা ওখানে রাখো মা৷’’

অনেক চেষ্টা করে মাধুরী হাতের মুঠো খুলে মাদুলিটা চক্রের মধ্যে রাখল, ঠিক সেই সময় দরজার বাইরে কে যেন গম্ভীর আর কর্কশ স্বরে ডেকে উঠল একবার, ‘ক্রা ক্রা’৷

মাধুরী অস্ফুটে বলল, ‘‘সেই লোকটা!’’

কাকু আমল দিলেন না৷ বললেন, ‘‘তোমার দুই বুড়ো আঙুল এই তারার দুটি শীর্ষবিন্দুতে রাখো মা৷ আর তোমার দিদুনের কথা ধ্যান করো৷ সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে, সমস্ত সত্তা দিয়ে, সমস্ত চৈতন্য দিয়ে৷’’

আমাকে বললেন, ‘‘ডানহাতে পইতেটা জড়িয়ে মনে মনে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করো৷ একটি শব্দও যেন ভুলভাবে উচ্চারিত না হয়৷ তাহলে কিন্তু অনর্থ হয়ে যাবে৷’’

এবার কাকা তাঁর নিজের তর্জনী দুখানি সেই চণ্ডকাত্যায়নীচক্রের দুটি শীর্ষবিন্দুতে স্থাপন করলেন৷ আর একটি মাত্র শীর্ষ অস্পর্শিত রইল৷

সেটি চতুর্থ ফাঁকা চেয়ারটির দিকে নির্দিষ্ট৷

চোখ বন্ধ করলেন কাকা৷ গম্ভীরস্বরে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন,

‘ব্যোমবক্ত্রম মহাকায়ং প্রলয়াগ্নিসমপ্রভম্৷

অভেদ্যভেদকং স্তৌমি ভূতডামর-নামকম্৷৷

আদিবীজং সমুধৃত্য ততো রুদ্রভয়ংকরী,

অট্টট্টহাসিনি সাধকপ্রিয়ে পদ্মুদ্ধরেৎ…’’

অনেক দূর থেকে একটা শোঁ শোঁ আওয়াজ কানে আসছিল৷ এবার মনে হল আওয়াজটা যেন ক্রমেই বাড়ছে৷ মনে হচ্ছে কোনো এক বিশাল দৈত্য ক্রুদ্ধভাবে দৌড়ে আসছে আমাদের দিকে৷ তার হুংকারে কান পাতা দায়— ক্কড়ক্কড়কড়াৎ করে একটা বাজ পড়ল কাছেই৷ কয়েক সেকেন্ড বাদে তার বিস্ফোরণের শব্দটা আমাদের কানে আছড়ে পড়তেই শুরু হয়ে গেল ঝড়ের দাপট৷ দরজা-জানলাগুলো ছটফট করতে লাগল পাগলের মতো৷ ঘরের চারিদিকে মনে হল প্রলয়মাতন লেগেছে৷ ঘন ঘন বজ্রপাত আর ঝড়ের অট্টহাসির জেরে কান পাতা দায়৷

আমার বুকের মধ্যে কে যেন দুরমুশ পিটছে৷ তবুও আমি চোখ বন্ধ করে একমনে গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলাম৷ ওদিকে কাকা উচ্চারণ করে চলেছেন,

‘‘বিষমুদ্ধৃত্যাপি সুরতপ্রিয়ে দিব্যলোচনি৷

কামেশ্বরী জগন্মোহিনী ততশ্চ সুভগে পদম৷

ততঃ কাঞ্চমালেতি ভূষণীতি পদং বদেৎ৷

ততো নূপুরশব্দেন প্রবিশদ্বয়মুদ্ধরেৎ…’’

ওদিকে বাইরে প্রলয়ের তাণ্ডব বেগ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী৷ মনে হচ্ছে কোনো বিপুল বলশালী দৈত্য যেন বুলডোজার দিয়ে বাড়িটা গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে৷ আমি মন্ত্র জপ করে যাচ্ছি বটে, কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে৷ যে-কোনো মুহূর্তে আমি মন্ত্র ভুলে যেতে পারি৷

এমন সময় একটা অজানা গন্ধ আমার নাকে এল৷ ঘি, কর্পূর, ধূপধুনো, গুগ্গল মেশানো একটা সুবাস৷ তার সঙ্গে একটা অজানা ফুলের গন্ধ৷

কাকা চাপা গলায় বললেন, ‘ব্যস৷’

চোখ খুললাম৷ তিনটি মোমবাতির আগুনই নিভু নিভু প্রায়৷ ঘরের মধ্যে কে যেন একটা ছায়া ছায়া অন্ধকারের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে৷ আমি কাকা আর মাধুরীর শুধু অবয়ব দেখতে পাচ্ছি৷ আর দেখতে পাচ্ছি আরও একটা জিনিস৷

চণ্ডকাত্যায়নীচক্রের পঞ্চম শীর্ষবিন্দু ছুঁয়ে আছে আঙুলের মতো কীসের যেন একটা ছায়া!

লক্ষ করলাম বাইরের ঝড়ের তাণ্ডব একেবারে স্তব্ধ৷ কোথাও কোনো একটা পিন পড়ারও আওয়াজ নেই৷ কিছু একটা ঘটার প্রত্যাশায় ঘরের নৈঃশব্দ্য যেন অধীর আগ্রহে কাঁপছে৷

স্তব্ধতা বন্ধ করে প্রথম কথা বললেন কাকা, চাপা অথচ স্পষ্ট স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘মা, আপনি এসেছেন?’’

যেন কোন অতল গহ্বর থেকে থেকে এক ক্ষীণ, অতি ক্ষীণ বৃদ্ধার কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘‘আহ…বড় কষ্ট…বড় কষ্ট…কেন…কেন ডাকলে আমায়…’’

‘‘আপনার নাতনির জীবন আজ বিপন্ন মা৷ নইলে আপনাকে জীবস্তরে ডেকে আনার ধৃষ্টতা করতাম না, সন্তানের অপরাধ ক্ষমা করুন৷’’

‘‘আমি তো বলেছিলাম…ও সিঁদুর পরিসনে মেয়ে…বলেছিলাম ও সিঁদুর অলুক্ষুণে…বারণ…বারণ করেছিলাম…ও মেয়ে আমার বারণ শোনে না কেন… আমার কথা শোনে না কেন…’’

‘‘দিদুন…দিদুন…তুমি সত্যি এসেছ দিদুন…’’

‘‘নিষেধ শুনিস না কেন মা…ও মাদুলি কেন খুললি…ও শয়তানির দেওয়া অমঙ্গলমূর্তি কেন রাখলি ঘরে…’’

‘‘ও কীসের মূর্তি দিদুন?’’

‘‘ও মূর্তি ঘোর পাতালের অভিশাপ…ও বিদ্বেষনাগিনীর মূর্তি…ওই মূর্তি যার ঘরে থাকে তার সবকিছু ছারখার করে দেয়…তাকে তিল তিল কষ্ট দিয়ে নাশ করে…’’

‘‘কিন্তু কেন মা? কে ওর অমঙ্গল চাইছে? আর কেন?’’ এবার কাকা প্রশ্ন করলেন৷

‘‘শোন রে মেয়ে…তোর ভালোবাসার মানুষের ওপর নজর পড়েছে কালনাগিনীর…সে তার নিজের সহোদরা…তার অতৃপ্ত যৌবন কুরে কুরে তুলে এনেছে উগ্র কামবাসনার গরল৷ সে তোকে তোর শত্রু মনে করে…সে চায় তার পথের কাঁটাকে উপড়ে ফেলতে৷’’

‘‘কিন্তু কেন দিদুন…কেন?’’

‘‘সে পাপিনীর রক্তের সম্পর্কের বোধ নেই…এতই তীব্র তার অতৃপ্ত কামনার আগুন৷ কিন্তু তাকে দুর্বল বলে ভাবিসনি মেয়ে…সে বড় শক্ত ঠাঁই…সেই পাপিষ্ঠা পারে না হেন সিদ্ধাই নেই…সে চাইছে তোর ধর্মনাশ হোক, তোর সর্বনাশ হোক, তোর প্রাণনাশ হোক…’’

‘‘দিদুন…দিদুন…সেদিন তুমিই আমাকে বাঁচাতে এসেছিলে দিদুন?’’

দেখতে পাচ্ছি না বটে, তবে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম মাধুরী কাঁদছে৷

‘‘আহ…বড় মায়া…বড় কষ্ট…ওরে আমার ঈশ্বর যে আমার ভৈরবীচক্র তোর বুকেও এঁকে দিয়েছেন রে মেয়ে…তুই যে আমারও অংশ…তোর বিপদ দেখে আর ঠিক থাকতে পারি?…আহা…বড় মায়া রে মেয়ে…বড় মায়া…আহ…’’

বুঝতে পারছিলাম যে যিনি এসেছেন তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছে এখানে থাকতে৷ মোমবাতির শিখাদুটো এখন একদম নিভে গেছে৷

‘‘শোন রে মেয়ে…কাল অমাবস্যার রাতে ওই নাগিনী তোর প্রাণের মানুষকে নিয়ে বসবে যক্ষিণীচক্রে৷ যে করেই হোক সেই চক্রসাধন আটকা…নইলে তোর মহাসর্বনাশ হবে রে মেয়ে…চিরকালের জন্য হারাবি তোর সবকিছু…’’

‘‘কীভাবে মা? কী করে? কোন পথে আটকাব এই অনর্থ?’’

‘‘কর্মের ফল সবাইকেই ভুগতে হয় বাবা’’, আওয়াজটা ক্রমেই মিলিয়ে আসছিল, ‘‘ওই শয়তানি যে মহাবিষ মিশিয়েছে আমার বাছার সিঁদুরে, সেই বিষই তার কাল হবে…’’

‘‘কোথায় মা…কোথায় হবে এই যক্ষিণীচক্র?’’

সেই অলৌকিক স্বর নিভে এসেছে প্রায়, ‘‘মন্দিরে যাস বাবা…বিলের ধারে গভীর জঙ্গলের মধ্যে আছে ওই নাগজাতির আরাধ্যা দেবীর মন্দির, সেখানে যাস…সেখানেই হবে ওই যক্ষিণীচক্র৷’’

আমি শোনামাত্র স্তম্ভিত হয়ে গেলাম৷ কাউরীবুড়ির মন্দিরে? কেন? ওইখানে কেন?

এবার কাকাও মনে হল একটু বিচলিত হলেন এই উত্তর শুনে, ‘‘কিন্তু… কিন্তু…মা…ওখানে কেন? ওই মন্দিরের সঙ্গে কী সম্পর্ক এই কালনাগিনীর? আর ওই শয়তানি অমন জটিল চক্রসাধন করার মতো এমন অলৌকিক শক্তি পেলই বা কোথা থেকে?’’

অনেক দূর থেকে ভেসে আসতে আসতে মিলিয়ে গেল সেই স্বর, ‘‘ওর রক্তে আদিম নাগজাতির উপাসনার উত্তরাধিকার বইছে যে বাবা…অনেক হাজার বছরের উত্তরাধিকার…ও যে পাতরগোঁয়্যাদের বড়দেওরি…’’

 * * * *

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *