কিছুদিন আগে অবধিও আতশের মা ‘চান্দ্রায়ণ’ ব্রত পালন করতেন। এখন দিদিদের বকাবকিতে আর আতশেরও কথাতে করা বন্ধ করেছেন। কোনো পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যে, এই ব্রত পালিত হয়। আতশ জানে না, কোন পাপ স্থালনের জন্যে, মা ওই ব্রত পালন করতেন। তবে সংসারে এমন মানুষ কী একজনও আছেন যাঁর পাপ নেই কোনো? গোপন পাপ। তবে যেসব দু-কান-কাটা মানুষের ‘পাপবোধ’-ই নেই তাঁদের কথা আলাদা।
এই ব্রত চাঁদের তিথি অনুসারে পালিত হয়। পূর্ণিমাতে পনেরো গ্রাস খেয়ে তারপর থেকে প্রত্যেকদিন এক এক গ্রাস কম করে খেতে খেতে, অমাবস্যাঁতে এসে পূর্ণ উপবাস। তারপর এক এক গ্রাস করে খাওয়া বাড়িয়ে পূর্ণিমাতে পৌঁছে আবার পনেরো গ্রাস খাওয়া। পূর্ণ আহার। তার মানে, এই ব্রত পালনে পুরো একমাস লাগে।
আতশ ভাবছিল, তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চান্দ্রায়ণ করবে ও এবারে। প্রায়শ্চিত্ত হোক আর নাই হোক মনটা তো শান্ত হবে।
কাগজগুলো পড়া হয়ে গেছে। জলখাবার খাওয়া হয়েছে। আচারের তেল দিয়ে মুড়ি মেখে দিয়েছে বাইধর সঙ্গে কাঁঠালের বিচিভাজা। গতবছরের কাঁঠালের বিচি রোদে শুকিয়ে রেখেছে বাইধর ধুয়ে-টুয়ে। মুড়ি দিয়ে কাঁঠালের বিচিভাজা খেতে বেশ লাগে।
তখন সাড়ে আটটা বাজে। অঙ্গুলের দিক থেকে বাসটা গেল টিকরপাড়ার দিকে। অঙ্গুল থেকে শাটল-বাসও আসা-যাওয়া কবে পুরুণাকোট হয়ে টিকরপাড়া অবধি আবার কটক থেকেও টিকরপাড়া অবধি আসে বাস চৌদুয়ার, হিন্দোল, ঢেনকানল এবং অঙ্গুল হয়ে। ঢেনকানলের বড়ো রাস্তার ওপরেই অঙ্গুলে আসতে ডানদিকে পড়ে সরু সরু থামআলা সরু বারান্দা সমেত একতলা একটি বাড়ি। এটি অন্নদাংশকর রায় মোয়দের বাড়ি। তাঁর। ছেলেবেলা ঢেনকানলেই কেটেছিল। তখন অবশ্য ঢেনকানল আজকের ঢেনকানল ছিল না। বিমলজেঠুর মুখে ঢেনকানল-এর নিনিকুমার অর্থাৎ ছোটোকুমারের কথা অনেক শুনেছে আতশ। তিনি নাকি খুব ভালো শিকারি ছিলেন। কলকাতা থেকে তাঁর এক বন্ধু আসতেন শিকারে। সুধীরঞ্জন দাস মশায়ের ছোটোছেলে মানিক দাস। সাহেবি আমলের অ্যান্ড্র ইউল কোম্পানিতে কাজ করতেন। হোম লিভ’-এ বিলেতে না গিয়ে জঙ্গলে আসতেন শিকারে। সপরিবারে বন-বাংলোয় থাকার পারমিট নিয়ে আসতেন। এখানের বাঘবমুন্ডা বাংলোতে থেকে তিনি একটি বড়োবাঘ মেরেছিলেন। পারমিট রিনিউ করার জন্যে এক শীতের দুপুরে বাঘবমুন্ডা থেকে অঙ্গুলে গিয়ে ফিরে আসার সময়ে জিপ-অ্যাকসিডেন্টে উনি এবং ওঁর একমেয়ে মারা যান। স্ত্রী এবং অন্য মেয়েও সাংঘাতিক আহত হন। নিনিকুমার-ই জিপ চালাচ্ছিলেন। দুপুরবেলা, মদ-টদও কেউই কিছু খাননি।’নিয়তি’ কাকে বলে?
বারান্দাতে বসেই আতশ দেখল, গদাধর আসছে।
তুমি কোথা থেকে গদাধরদাদা?
বাইধর বলল।
এই তো। কটক থেকে। কাল আমি আর বাড়ি ফিরিনি। হেমার দাহ হয়ে গেলে ভীষই বউ আর ছেলেকে নিয়ে গেছিল আমার বাড়িতে। আমি কটকের বাস ধরে রাতেই মঙ্গলাবাদে বাবুদের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছোলাম। সব শুনে তো মেজোবাবু খুবই দুঃখ করলেন। তখন বাবু খেতে বসেছিলেন। আমাকেও খেতে দিতে বললেন ঠাকুরকে। রান্নাঘরের বারান্দাতে বসে খেয়ে নিলাম। খেতে ইচ্ছে করছিল না মোটে কিন্তু কী করা যাবে? শরীর তো রাখতে হবে।
খাওয়ার পরে মেজোবাবু জঙ্গলের কথা পাড়লেন। বললেন, এবারে তো পুজো দেরিতে। অঙ্গুলের নিলামে এবার লবঙ্গীর জঙ্গলটাই ডেকে নেব ঠিক করেছি গদাধর। শূরবাবুরা যত দাম-ই তুলুন আমি এবারে ছবি দাস বা নরেন শূরের ছেলেদেরও নিতে দেব না। তোমরাই তো ভরসা। তোমরাই তো আমার হাত-পা।
তুমি কী বললে?
আতশ বলল।
আমি বললাম, সে তো এক-শোবার। আমরা তো আপনাদের জন্যেই বেঁচে আছি।
তারপর মেজোবাবু বললেন, তোমার মেয়েটার বয়েস কত হয়েছিল?
এগারো বছর বাবু।
তাহলে তো ক-বছর পরে বিয়েও দিতে, নাকি?
তাতো বটেই। ভেবে তো ছিলাম পনেরোতে পড়লেই বিয়ে দিয়ে দেব।
তোমার অনেকগুলো টাকা বেঁচে গেল। কী বলে?
বাবু বললেন।
তাই বললেন?
হ্যাঁ বাবু। শুনে আমার খুব কষ্ট হল। আমার মেয়েটাই চলে গেল। ক-টাকা আর বাঁচল? মেয়ের বিয়েতে কীই বা খরচ করতে পারতাম? বাবু হয়তো দেড়-দু-হাজার ধরে দিতেন।
সে কী? তোমার সব টাকা তো ওঁর কাছেই জমা আছে। তুমি যত টাকা চাইতে তত টাকাই তো ওঁর দেওয়ার কথা।
তা কি ওঁরা পারেন বাবু? কতরকম কারবার–কত দিকে কত টাকা খাটছে–বললেই কী আর ঝপ করে টাকা দিতে পারেন?
তারপর বলল, আমি আপনার কথা বললাম মেজোবাবুকে। শুনে খুব খুশি হলেন। বললেন, তাহলে তো ভালো মুরুব্বিই জুটিয়েছ গদাধর, এতদিনে। কিন্তু একটু দূরে দূরে থেকো। ওই মাস্টার-ফাস্টার মানুষগুলো সুবিধের হয় না, বদবুদ্ধি দিতে ওস্তাদ।
আমি তখন বললাম, হেডমাস্টারবাবু নিজের থেকে এবং ধার করে আমাকে দু-হাজারের বেশি টাকা দিয়েছেন। তাঁকে টাকাটা শোধ দিতে হবে বলেই আমি আপনার কাছে এসেছি।
তা মাস্টার তো দেখছি মস্ত বড়োলোক হে! সে করতপটার মতো স্কুলে মাস্টারি করছে কেন?
তা তো বলতে পারব না।
তারপর বাবু বললেন, শেয়ার বাজারে ধস নেমেছে তা কি জান?
সেটা কী বাবু?
গদাধর বলল।
ওসব জেনে তোমার লাভও নেই। কিন্তু আমার প্রাণ যাওয়ার মতো অবস্থা। সেনসেক্স একেবারে শুয়ে পড়েছে।
তিনি কে বাবু?
ও তুমি চিনবে না।
তুমি পনেরো-শো টাকা নিয়ে যাও, না-হয় আরও এক হাজার নাও। ধার শুধবে, একমাস খাবে। সবসুন্ধু আড়াই হাজার দিতে বলছি ক্ৰষ্ণ ক্যাশিয়ারকে। বলেই, ডাকলেন ক্ৰষ্ণ’ বলে।
তারপর বললেন, সেবার সহদেব গাছ চাপা পড়ে মরল টুল্টকাতে–তার ছেলেকে কত দিয়েছিলাম মনে আছে?
আছে বাবু। আড়াই হাজার।
তোমাকে দিলাম আড়াই হাজার। খুশি তো তুমি?
আমি বললাম, খুব খুশি।
আতশ বলল, তোমার সবসুন্ধু কত টাকা জমেছে বাবুর কাছে?
তা তো জিজ্ঞেস করিনি বাবু।
তিনিও তোমাকে বলেননি কখনো?
না তো বাবু।
এই আড়াই হাজার টাকা কি তোমার টাকা থেকেই দিলেন, না, বাবু খয়রাত করলেন তোমাকে?
না, না, আমার টাকা থেকেই। ক্যাশিয়ার সই করিয়ে নিল হাত-চিঠায়।
আতশ বলল, হু। রাতে থাকলে কোথায়?
বাবুদের গদিঘরে। তক্তপোশের ওপরে শতরঞ্জি পাতা, তাতেই শুয়ে পড়লাম খাওয়ার পর হাতে মাথা দিয়ে।
জঙ্গলে যখন কাজ হবে তখন বাবু একদিনও আসবেন না জঙ্গলে?
তা এক-দু-দিন আসবেন নিশ্চয়ই। নিজের জিপ নিয়ে আসবেন। পঞ্চানন ড্রাইভার জিপ চালিয়ে আসবে। তবে রাতে জঙ্গলে থাকেন না বাবু। লবঙ্গীতে এলে সেখান থেকে বিকেল বিকেল বেরিয়ে পুরুণাকোটের বন-বাংলোতে থাকবেন এসে, নয়তো অঙ্গুলের সার্কিট হাউসে। পরদিন ভোরেই বেরিয়ে অঙ্গুলে চা-জলখাবার খেয়ে সোজা কটক।
তোমার বাবুর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
বাইধর গদাধরকেও আমের আচারের তেলমাখা মুড়ি আর কাঁঠালবিচিভাজা এনে দিয়েছিল। আর চা।
গদাধর তার ধুতির খুঁট খুলতে খুলতে বলল, আগে টাকাটা রাখুন বাবু। এই আড়াই হাজার। আমি আলাদা করে গিট দিয়ে এনেছি।
আগে খাও তত গদাধর।
খাচ্ছি। কিন্তু টাকাটা ধরুন।
আমাকে তোমার টাকা শোধ দিতে হবে না। তুমি পুরুণাকোটের কাদম্বিনী দিদির টাকাটা শুধু শোধ করে দিয়ো।
সে কী বাবু? আমাকে আপনি এ, কী পাপের মধ্যে ফেললেন? আমার যে, চান্দ্রায়ণ ব্রত করতে হবে নইলে, এ-পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে কী করে?
খাও, মুড়ি খাও।
গদাধর, চায়ে এক চুমুক দিয়ে বলল, সারাটা জীবন ধরেই তো চান্দ্রায়ণ করছি বাবু তবু প্রায়শ্চিত্ত হল কোথায়? পাপের কী শেষ আছে, আমার, আমাদের?
আতশ-এর চোখে জল এসে গিয়েছিল। সে মুখটা ঘুরিয়ে নিল। এই ওর এক দোষ। ইদানীং ভীষণ-ই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে। কথায় কথায় চোখে জল চলে আসে। দুঃখে তো আসেই, আনন্দেও আসে। সত্যি!
নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আচ্ছা গদাধর, কাল হাসপাতালের সামনে একটি ছেলে দাঁড়িয়েছিল, লম্বা-চওড়া, খুব ভালো স্বাস্থ্য–কী যেন, নামে ডাকলে তুমি? ভীম্ব না কী যেন? সে বলছিল, এই ডাক্তারকে একটু শিক্ষা দিতে হবে কিংবা ওরকম কিছু!
হ্যাঁ হ্যাঁ। মনে পড়েছে। ভীম্বই তো। গদাধর বলল। তারপর বলল, ও খুব সাংঘাতিক ছেলে বাবু। ও তো আমাদের-ই কাবাড়ি।
পুরুণাকোটের ননার দোকানে বিড়িবড়া আর গুলগুলা বিক্রি করত, আগে চায়ের গ্লাস ধুত, অন্যসব ফরমাশ খাটত। সকাল থেকে রাত, দিনে চার টংকা পেত। আমিই তো ওকে ডেকে নিয়ে লাগালাম কোম্পানিতে। আমার কথা তো কোম্পানি শোনে, আমিই তো হেড মুহুরি। এখন মাসে তিনশত টংকা পায়। অবস্থা ফিরে গেছে। ও-ই তো আমার পরিবারের দেখাশোনা করে। আজ বলে নয়, প্রায় দশ বছর হল। আমার বউও ওকে খুব পছন্দ করে।
ওর টাকাও মেজোবাবুর কাছে জমা থাকে?
হ্যাঁ। ওর টাকাও। ও তো একা লোক। মা-বাবা নেই। বিয়ে করেছিল, বউ সাপের কামড়ে মারা গেছে একমাসের মধ্যেই। আর বিয়ে করেনি। কিন্তু ভীষণ খরুচে। এইচ. এম. টি. ঘড়ি কিনেছে। রোলেস গামছা ছাড়া অন্য গামছা ব্যবহার করে না। জিনস-এর প্যান্ট পরে, নাইলনের গেঞ্জি। চোখে গগলস লাগায়। হাটবারে তার ড্রেস যদি দেখেন। আমার বউকেও রঙিন ফিতে, কাঁচুলি-টাচুলি কিনে দেয়। এসব কারণেই তো মেজোবাবু ওর হাতে পুরো টাকা দেন না। বলেন, বছরে ন-মাস তো জঙ্গলেই থাকিস–খেতে অত পয়সা লাগে না। তোর হাতে টাকা পড়লেই তুই নষ্ট করবি, আমার কাছেই থাক বরং। যখন যেমন, দরকার চেয়ে নিবি।
চা খাওয়া হয়ে গেলে আতশ বলল, যাবে কীসে?
হাঁটতে থাকি–কোনো-না-কোনো বাস ওদিকে যাবে, চড়ে পড়ব রাস্তাতে। কোনো ট্রাক ধরেও যেতে পারি।
…বউটারও জ্বর কাল থেকে। তারও আবার ম্যালগানা না-হয়। গদাধর বলল।
জ্বর হলেই সঙ্গে সঙ্গে এই ওষুধটা পুরুণাকোটের ওষুধের দোকান থেকে কিনে খাইয়ে দেবে। আর অসুখটার নাম ম্যালগানা নয়। ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া।
ওই হল।
আতশ ডাকল, বাইধর।
সে এলে বলল, আমার টেবল থেকে একটু কাগজ আর একটা কলম নিয়ে আয়। কাগজ কলম এনে দিলে আতশ লিখে দিল, লারিয়াগো’। বলল, এমনি জ্বর হলে এটা দেবে না। যদি কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে তবেই দেবে। আর এমনি ঠাণ্ডা লেগে জ্বর হলে ওই ওষুধটা দেবে, বলে, লিখে দিল ‘ক্যালপল। আর যদি খুব বেশি জ্বর হয় তবে ক্রোসিন’ দেবে। ক্রোসিনের নামটাও লিখে দিল ইংরেজিতে। তিনটি ওষুধের পাশে এক, দুই, তিন নাম্বার বসিয়ে দিয়ে গদাধরকে বুঝিয়ে দিল। গদাধর মুখস্থ করতে করতে উঠে দাঁড়াল।
বলল, এইসব ওষুধ-ই কি অল্প অল্প কিনে বাড়িতে রাখব মাস্টারবাবু?
রাখলে তো ভালোই হয়। তবে উলটোপালটা ওষুধ খাইও না।
তারপর বলল, জ্বর হলে খবর দিয়ো। আজকাল যেখান-সেখান থেকে ওষুধ কেনাও মুশকিল। সব জাল ওষুধ। আমার কাছে যা যা আছে, দু-চারটে করে দিয়ে দিচ্ছি। অঙ্গুলের পানিগ্রাহী কোম্পানি থেকে কেনা এসব–একেবারে খাঁটি।
ওষুধেও ভেজাল?
অবাক হয়ে বলল, গদাধর।
হ্যাঁ, বলল, আতশ।
তারপর মনে মনে বলল, শুধু ওষুধেই নয়, তেলে, আটায়, ময়দায়, সাবানে, শ্যাম্পুতে, সব জিনিসেই ভেজাল। মানুষ’-এই ভেজাল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এসব কথা গদাধরকে বলে লাভ নেই।
গদাধর বলল, যাউচি আইজ্ঞাঁ।
আতশ বলল, হউ।
.
সেদিন সন্ধেবেলা ফোনটা এল অঙ্গুল থেকে। আতশ দুপুর বেলা মাকে করেছিল। মাকে ফোন করলেই সেই একই কথা–কী খেলি? রাতে কী খাবি? ভালো করে খাওয়া-দাওয়া কর। তোর হাতদুটো শুকিয়ে গেছে। এইসব।
মা-ই আজ বললেন, জানলি, একটা সুখবর আছে।
কী?
নন্দা কনসিভ করেছে। নন্দনও খুব খুশি। নলিনী গতকাল ফোন করেছিল। তাকেও জানালাম খবরটা। ও ফোন করবে বলেছে নন্দাকে।
আতশের বুক শুকিয়ে যাচ্ছিল শুনতে শুনতে। ভাবছিল, মা যদি জানতে পারেন যে, নন্দার কোল আলো করে যে-আসবে সে, ছেলেই হোক কী মেয়ে, সে তাঁর-ই নাতি বা নাতনি, তাহলে কী হবে?
এই ফোনটা নন্দা বউদির। বলল, কী করছ?
কী আর করব? একটা বই পড়ছিলাম।
তারপর বলল, আজ দুপুরে তোমার কথা খুব মনে হচ্ছিল। ঘটনাটা স্বপ্ন কী দুঃস্বপ্ন এখনও বুঝে উঠতে পারছি না। এখনও হজম হয়নি ব্যাপারটা।
স্বপ্নও নয়, দুঃস্বপ্নও নয়। তবে স্বপ্নের-ই মতো সুন্দর কিছু। তারপর-ই বলল, তুমি কী সুন্দর তাই ভাবছিলাম আর ভেবে শিহরিত হচ্ছিলাম।
নন্দনদা কিছু বুঝতে পারেনি তো?
বুঝতে কী করে পারবে? তবে অবাক হয়েছে। যত অক্ষমতাই থাক, ও তো কখনো নিজের অক্ষমতা স্বীকার করেনি, নিজের পরীক্ষাও করায়নি কখনো তাই মনে মনে উইশফুল থিংকিং হয়তো একটা ছিলই যে, ও সক্ষম। সাতবছর পরে হঠাৎ কী করে, এই অঘটন ঘটল তা-নিয়ে ভেবেছে নিশ্চয়ই। কিন্তু খুবই খুশি হয়েছে। কে বলতে পারে? তোমার এই দান আমার আর নন্দনের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে। আমাদের সন্তান, সেতু গড়ে দেবে আমাদের দু-জনার মধ্যে।
তারপর বলল, একটা সমস্যা হয়েছে। ডাক্তার বলছেন, আর কিছুদিন পর থেকে আমার নাকি মায়ের কাছে গিয়ে থাকা উচিত। তুমি তো জানো যে, টানা কয়েকমাস থাকার মতো পরিবেশ, আর্থিক অবস্থা কিছুই নেই আমার এখনকার বাপের বাড়িতে।
আমার মায়ের কাছ গিয়ে থাকো। আতশ বলল।
নন্দা হেসে উঠল।
বলল, যে-বিপদ থেকে বাঁচতে আলাদা থাকা, সে বিপদ তো তুমিও ঘটাতে পারো। তুমি তো পুজোর সময়েই আসবে।
এবার নাও আসতে পারি। এবারে পুজোর ছুটিটা জঙ্গলেই কাটাব। ভাবছি।
কোন জঙ্গলে?
এখনও ঠিক নেই। তবে সম্ভবত লবঙ্গীর জঙ্গলে। পাল্টববাবুরা এবারে অঙ্গুলে বনবিভাগের নিলামে সেই জঙ্গল-ই ডাকবেন বলে বদ্ধপরিকর। তাই হয়তো লবঙ্গীতেই যাব।
পুজোর, কটা দিন তো পৃথিবীসুষ্ঠু বন্ধ। মাউসি বলছিলেন, মহাষ্টমীর দিনে কটকের কটকচন্ডীর কাছে পুজো দিতে যাবেন। নলিনীও আসবে ভুবনেশ্বর থেকে। নন্দন-ই গাড়ি করে নিয়ে যাবে আমাদের। তুমি থাকলে আরও আনন্দ হবে। পুজোর, দিনকটা অন্তত কাটিয়ে যেয়ো অঙ্কুলে।
দেখি। জানি না নন্দনদার সামনে কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াব।
বোকা বোকা কথা বোলো না। ও কোনো কিছু সন্দেহই করেনি। তা ছাড়া, দোষ তো সব আমার। তুমি তো কিছু করোনি, আমি জোর করেছি। ধর্ষণের কথা যদি ওঠেই তবে আমিই তোমাকে ধর্ষণ করেছি।
জানি না।
ছেড়ে দিচ্ছি। ভালো থেকো। নলিনী কি ফোন করেছিল?
একদিন করেছিল। ও তো তোমার মতো বড়োলোক নয়। বেচারি ছাত্রী তো এখনও। আমি তো বড়োলোকের বউ। নিজে তো বড়োলোক নই। তাও আবার দু-জন বর আমার। একজন অর্থে বড়োলোক আর অন্যজন…
আতশ কথা কেটে বলল, অনর্থে বড়োলোক।
হাসল নন্দা।
বলল, ছাড়লাম।
গদাধরের মেয়েটা ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়াতে মারা গেল। তাদের তিনজনের কোনো প্রিভেন্টিভ খাওয়া উচিত। কারণ, জঙ্গলের মধ্যে ওদের বাড়ি যা, দেখে এল আতশ, তা কহতব্য নয়। ঝরনার জল-ই খায় শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা।
পুরুণাকোটের ডাক্তারের ওপরে ভরসা তো নেই-ই, লোকটার মুখও দেখতে ইচ্ছে করে না আতশের। তাই অঙ্গুলে ওদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানকে ফোন করে ওষুধের নাম লিখে নিয়েছিল। ওষুধ কিনবে পুরুণাকোটের দোকান থেকেই।
আগামীকাল রবিবার। এরমধ্যে গদাধর আর আসেনি। তারও জ্বর হল কি না কে জানে! তাই ঠিক করল দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরে ওষুধগুলো নিয়ে যাবে গদাধরের বাড়ি। রবিবার দোকান বন্ধ থাকে। তাই শনিবার-ই, মানে গতকাল বাইধরকে বাসে করে পাঠিয়ে ওষুধগুলো আনিয়ে নিয়েছিল।
দুপুরে খেতে দেরি হয় রবিবারে। আসলে, জলখাবার খেতেই দেরি হয়ে যাওয়াতে রান্না বান্না সারতে সময় নেয় বাইধর। তা ছাড়া রবিবারে দু-একটা পদ বেশিও করে। অনেকদিন সকালের বাসে টিকরপাড়া চলে গিয়ে সেখান থেকে টাটকা বড়োমাছ কেটে নিয়ে আসে। টিকরপাড়ার মাছ পুরুণাকোটের বাজারেও আসে কোনো কোনোদিন। যদিও রোজ আসে না। সেখান থেকেই কিনে আনে, টিকরপাড়া অবধি যেতে হয় না।
খাওয়া-দাওয়ার পরে একটু বিশ্রাম নিয়ে মোটরসাইকেলে চড়ে বেরিয়ে পড়ল ওষুধগুলো সঙ্গে নিয়ে পম্পাশরের দিকে।
গদাধরের মতোই অবস্থা এখানের অধিকাংশ মানুষের। সকলকে মদত দেওয়ার সামর্থ্য তো নেই আতশের। তা ছাড়া, এখানে এসে, এই স্কুলের পত্তন করার দিনেই গদাধরের সঙ্গে আলাপ। পম্পাশরের একটি পঞ্চম ফেল ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল সে, পিয়োনের চাকরির জন্যে। কিন্তু সব অ্যাপয়েন্টমেন্ট-ই মাধববাবু নিজেই অঙ্গুলে এবং পুরুণাকোটে বসে করেছিলেন। কারোকেই চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা আতশের ছিল না। কিন্তু গদাধরের চেহারা এবং কথাবার্তা ওর ভারি ভালো লেগেছিল। কিছু মানুষ থাকে সংসারে, যাদের ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস দু-শো ভাগ এবং হয়তো সেই কারণেই সংসারের হাতে তারা প্রতিনিয়ত মার খায়। গদাধরের মুখের মধ্যে সেরকম মানুষের আদল ছিল। এবং পরে তার সঙ্গে মিশে দেখেছে আতশ যে, তার অনুমান এক-শো ভাগ-ই সত্যি। মানুষটার মতো হাসিমুখে ঠকতে আর বেশি মানুষকে দেখেনি আতশ ওর এই বয়েস অবধি এবং সে কারণেই গদাধর মানুষটার প্রতি তার একবিশেষ দুর্বলতা জন্মে গেছে।
পুরুণাকোটে পৌঁছে কিছু পোড়াপিঠা এবং গুলগুলা কিনে নিল। কিছু বিরিডালের বড়া। পৌঁছোতে পৌঁছোতে অবশ্য বড়াগুলো ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
ও যখন এসব কেনা-কাটা করছে তখন-ই হঠাৎ দেখল ভীম্বকে। দোকানের সামনের জটলার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। ছোটো জায়গায় রবিবারের জটলা।
আতশ বলল, আমি গদাধরের বাড়ি যাচ্ছি। তুমি যাবে কি?
ভীম্ব একবাক্যে রাজি হয়ে গেল। বলল, আমি বিকেলে আজ এমনিতেই যেতাম। ভালোই হল। অতখানি চড়াইতে যেতে হবে না পায়ে হেঁটে। আপনার মোটরবাইকের পেছনে বসে আরামে চলে যাবে।
মিষ্টি আর নোনর প্যাকেটটা ওর হাতে দিয়ে দিল আতশ। তার কাঁধের গামছা দিয়ে সেগুলোবেঁধে নিয়ে চড়ে পড়ল ভীম্ব।
মোটরবাইকে যেতে মিনিট কুড়ি-পঁচিশ লাগে যাওয়ার সময়ে। পুরোটাই চড়াই তো। সরু পথ। বর্ষার জল পেয়ে জঙ্গল যেন, শত শত ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে চারদিকে। ভয় ভয় করে। এই পাহাড়ের ঢালে হাতি নাকি কখনো আসে না যদিও, পুরুণাকোটের কাছেই বাঘমুন্ডার একটু দূরেই হাতিগির্জা পাহাড়। সেখানে অনেক হাতির বাস। কিছুদিন আগেও পুরুণাকোট বাজারের উলটোদিকে এবং হাসপাতালের পেছনের ধানখেতে ধান পাকলে হাতির দল নেমে আসত প্রতিরাতে। তবে এ-অঞ্চলের হাতি মানুষের কোনো ক্ষতি করে না, যদি-না কোনো হাতি হঠাৎ দলছুট বা রোগাক্রান্ত হয়ে যায়। হাতি না এলে কী হয়! ভীম্ব বলছিল, গদাধরের বাড়িটা যেহেতু পম্পাশর গ্রাম-এর বাইরে, ওখানে বাঘ, ভালুক, চিতা, শুয়োর, শজারু এবং নানা জাতের হরিণের অবাধ রাজত্ব। পাখিদের মধ্যেও ময়ূর, মুরগি, টিয়া বিস্তর। ধনেশপাখিও আছে। তবে তারা বড়ো বড়ো কুচিলাগাছে আর অপেক্ষাকৃত ছোটো ডালিয়া গাছে বসে ‘হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁক’ আওয়াজ করতে করতে ফল খায়। বড়ো বড়ো ধনেশগুলোর নাম ‘কুচিলা খাঁই’ আর ছোটোগুলোর নাম ‘ভালিয়া খাঁই। যেটুকু সামান্য জমি আছে তাতেও কোনো ফসল-ই করা যায় না। করা যায়। কিন্তু ঘরে ওঠানো যায় । সাপের জন্যেও এই পাহাড় কুখ্যাত। কতরকমের সাপ-ই যে, আছে। এই পথের ওপরেই বড়ো বড়ো গাছের গোড়াতে বিষধর সাপেরা থাকে। সন্ধের পরে হাতে আলো ও লাঠি নিয়ে খুব সাবধানে পথ চলতে হয়। এই দুঃসাহসী মানুষদেরও।
এইরকম জায়গাতে গদাধরের বউ, ছেলে-মেয়ে নিয়ে একা একা থাকে কী করে? বলল, আতশ।
ভীম্ব দার্শনিকের মতো বলল, কী করা যাবে বাবু। আমরা গরিব লোক, এইভাবে থেকেই আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে। একবার থেকে গেলে কিন্তু অত ভয়াবহ মনে হবে না। আমরাও গান গাই, হাসি, মজা করি। সব-ই যে, দুঃখ তেমন নয়। আপনারা শহরের মানুষ তো তাই এত ভয়াবহ মনে হয়।
এদিকে বাইসন বা গয়াল আসে না?
না বাবু। গয়াল আর হাতিরা গভীর জঙ্গলের প্রাণী। এই ঢালে তারা আসে না। বড়বাঘও ক্কচিৎ কদাচিৎ আসে। তবে চিতা আসে নিয়মিত। ওদের জ্বালায় পাঁঠা, ছাগল, বারা’, মানে শুয়োর এমনকী মুরগিও রাখা মুশকিল। শিয়াল আর ভাম তো আছেই।
দূর থেকে মোটরসাইকেলের আওয়াজ শুনেই গদাধর আর তার ছেলে ঘরের মধ্যে থেকে বাইরে এল। তারপর আতশ আর ভীম্বকে দেখে খুবই খুশি হল।
ভীম্ব গদাধরের ছেলেকে বলল, মাকে যাই কহন্তু বাবু কেত্বে জিনিস আনিচি তমমান পাঁই। আমি বাবু কহ ইটি।
ছেলে ভীম্বের হাত থেকে গামছা জড়ানো জিনিসগুলো নিয়ে ভেতরে গেল।
গদাধর বউকে ডাকল, বলল সীতা, বাবু আসিল্টবা, আসিকি তাঁকু ভেটিবি নাকি তু ঘর। মধ্যরে পশিকি রহিবি?
আতশ মোটরবাইক থেকে নেমে বাইকটা পাশ করে রাখল।
সীতা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে, আতশের দু-পায়ে দু-হাত রেখে মাথাটা পায়ের পাতার ওপর রেখে প্রণাম করল। ওড়িশার এমন-ই রীতি। শহরে এমন করে প্রণাম করার রেওয়াজ আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছে, বিনয় এখন দুর্বিনয়ের দিকে যাচ্ছে কিন্তু ওড়িশার গ্রামে-গঞ্জে এই রীতি এখনও আছে।
সীতা একটা মাদুর পেতে দিল বাইরের বারান্দাতে। ঝকঝকে করে মাজা পেতলের ঘটিতে জল আর গ্লাস নিয়ে এল, সঙ্গের রেকাবিতে দু-টি বাতাসা।
আতশ বলল, জলের বোতল আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছি। বাইধর ফুটিয়ে দেয় জল। তোমরাও জল ফুটিয়ে খাও না কেন? জল থেকেও তো ম্যালেরিয়া হয়। শুধু মশার কামড়েই হয় না।
বাবু বর্ষাকালে রান্না করার জন্যে শুকনো কাঠ-ই জোগাড় করা কঠিন তার ওপরে আবার জল ফোঁটানোর কাঠ। ও আমাদের কিছু হয় না। এইভাবেই তো আমাদের বাপঠাকুরদা সকলে জীবন কাটিয়ে গেলেন। দীনবন্ধুর ‘দয়া থাকলে কোনো অসুবিধাই অসুবিধা নয়। তবে হেমাটাকে যে, কেন দীনবন্ধু নিয়ে গেলেন!
দু-ফোঁটা চোখের জল গড়াল গদাধরের বউ সীতার চোখ দিয়ে। তারপরেই মুখে হাসি ফুটিয়ে আতশকে বলল, বাতাসা দুটো তো খাবেন বাবু?
হ্যাঁ হ্যাঁ। নিশ্চয়ই খাব। তোমাদের জন্যে যা-এনেছি তোমরা খাও। ভীম্বকেও দাও। বড়াগুলো বোধ হয় ঠাণ্ডা হয়ে গেল। দ্যাখো তো ঠাণ্ডা হয়ে গেলে একটু গরম করে নাও।
হেব্ব হেব্ব, সব হেব্ব। বলল গদাধর।
তারপর বলল, আমাদের কী সৌভাগ্য যে, আপনি এলেন। ভীম্ব কি চিনিয়ে নিয়ে এল?
বাঃ সেদিন তোমার ছেলের সঙ্গে এসেছিলাম না, সীতাকে নিয়ে যেতে।
হ্যাঁ হ্যাঁ। ভুলেই গেছিলাম। তবে রাতে এসেছিলেন তো। ওই জঙ্গলে পথ চিনে আসা ভারি কঠিন। একটা ভুল বাঁক নিলেই জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে হবে। জঙ্গলের পথে চিহ্ন করে নিয়ে চলতে হয়।
মানে?
মানে, ধরুন একটা মস্ত মহুয়া গাছ, বা মস্ত শিমুল গাছ বা একটা বাজে পোড়া শাল। এইসব চিহ্নগুলো মনে রাখলেই আর রাস্তা ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
আতশ বলল, কই সীতা, তোমরা খাবারগুলো খাও সকলে, আমি দেখি। দেখে, খুশি হই।
হউ আইজ্ঞাঁ। বলল সীতা।
আদুড় গায়ে একটা লাল খাটো শাড়ি জড়িয়ে পরেছে। শায়া নেই, ব্লাউজ নেই, দু-পায়ে শুধু দুটো পেতলের পায়জোর আছে আর গলাতে একটা পেতলের সরু হার। বিনা প্রসাধনেই, বিনা আভরণেই আতশ বুঝল যে, সীতা যথেষ্টই সুন্দরী। সেদিন রাতে লক্ষ করার মতো মানসিকতাটা ছিল না ওর।
একটু পর আতশ দেখে যুগপৎ অবাক এবং খুশি হল যে, ক-দিন আগে এগারো বছরের মেয়ে হারানোর শোক ভুলে হাসতে হাসতে সীতা পোড়পিঠা, গুলগুলা এবং বিরিবড়া খাচ্ছে।
একটু চা করতে হবে বাবুর জন্যে।
গদাধর বলল।
ওরা কী করে চা বানায়, তা আতশ জানে। ঘটির মধ্যে, ঘটিকে ওড়িয়ারা ‘ঢাল্টব’ বলে, গুঁড়োচা একটু দিয়ে তারমধ্যে দুধ আর জল দিয়ে কিছুক্ষণ ফোঁটায়। তারপরে তার সঙ্গে চিনি মিশিয়ে খায়। আতশ জানে যে, সেই চা অপেয়। কিন্তু ভালোবেসে দিলে খেতেই হবে।
তোমরা এখানে দুধ পাও কোত্থেকে? পম্পাশরে কারো কারো বাড়িতে গোরু আছে। যাদের গোরুর বাছুর হয়েছে তাদের বাড়িতে ছেলেকে পাঠাই। ও ঢাল্ট করে একটু দুধ নিয়ে আসে। কখনো বেশিও দেয় তারা। এখন দুগ্ধপোষ্য তো কেউই নেই এখানে। চা-টাই হয় দুধ দিয়ে। এমনিতে দুধ কারোরই খাওয়া হয় না।
কত করে নেয় দাম?
পয়সা নেয় না। আমাদের খেতে যখন যা হয় লাউ, কুমড়ো, শাক, আলু, পটল তাই একটু-আধটু পাঠাই।
সীতা গলা তুলে বলল, এখানে টাকাপয়সা কম আছে বাবু, ভালোবাসা আছে। হেমার মৃত্যুর পরদিন পম্পাশর গ্রাম থেকে কত মানুষ যে, এসেছিল। ওর কাজ আর কে করবে? কিন্তু সাতদিনে রান্না করতে দেয়নি। দু-বেলাই তারা রান্না খাবার দিয়ে গেছে আমাদের জন্যে।
বাঃ। শুনলেও ভালো লাগে।
আতশ বলল।
তারপর বলল, তোমাদের জন্যে ওষুধ নিয়ে এসেছি। অঙ্গুলের ডাক্তারকে ফোন করে নাম জেনেছি। এই ওষুধটা তিনজনে অথবা চারজনেই, ভীম্ব যদি এখানে থাকে, তবে সকালে একটা বিকেলে একটা করে খাবে। জ্বর হওয়ার পরের ওষুধ তো সেদিনে দিয়েই দিয়েছি। নামও লিখে দিয়েছি।
হ্যাঁ তা তো দিয়েছেন-ই।
তাহলে একটা করে এখুনি খেয়ে নাও ওষুধটা।
ওরা সকলেই খেয়ে নিল।
কথাবার্তা বলতে বলতে চা খাওয়াও হল।
গদাধর বলল, রাতে এখানে খেয়ে যাবেন বাবু? সীতা খুব ভালো খিচুড়ি রাঁধে। বাইধরের চেয়েও অনেক ভালো। ভারি আনন্দ হবে আমাদের, আপনি খেয়ে গেলে। তারপর খাওয়ার পরে আমিও আপনার সঙ্গে চলে যাব। কাল সকালের বাস ধরে কটকে যাব এবার। মেজোবাবুর সঙ্গে দেখা করতে হবে। যা-টাকা আপনি দিয়েছেন, তাতে জঙ্গলে যাওয়া অবধি খাওয়া-দাওয়া হয়ে যাবে কিন্তু যদি আবার কারো অসুখ-বিসুখ করে? তা ছাড়া, আমার-ই টাকা যখন, তার কিছু আমার কাছেই বা থাকবে না কেন?
সে তো এক-শোবার ঠিক। এতদিন এই হুঁশটা যে, কেন হয়নি তাই তো বুঝি না।
আসলে অভাবের সংসার। হাতে টাকা এলে তা খরচ হয়ে যেতে বেশিক্ষণ লাগে না। সেই ভয়েই নিই না।
তা বললে তো চলবে না গদাধর। সঞ্চয় করাটাও একটা শিক্ষার মধ্যে পড়ে। শুধু গাছ চিনলে আর বাবুদের ট্রাকের পর ট্রাক গাছ কেটে ভরে দিলেই তো চলবে না। নিজেদের ভালোমন্দ তো বুঝতে শিখতে হবে।
এবার থেকে তাই শিখব।
ভীম্ব এতক্ষণ চুপচাপ-ই বসেছিল। ও বলল, শিখব বললেই কী আর বাবুরা শিখতে দেবেন? এই গদাধরা কারো কথাই শোনে না। বাবুদের সবচেয়ে বড়ো দালাল-ই হচ্ছেন উনি।
এই! মুখ সামলে কথা বল। ননার দোকানে তো বাসন মাজতিস আর বিড়িবড়া গুলগুলা দিতিস জনে জনে। ক-পয়সা দরমা পেতিস? তোকে আমি হাত ধরে নিয়ে গেলাম বাবুদের কাছে আর আজ তুই-ই এসেছিস আমার বিচার করতে? ভালো না লাগে তো যাস না জঙ্গলে আর। এ-বছর তোকে আর ডাকব না, যাঃ।
তোমার পাল্টববাবুরা ছাড়া আর কি বাবু নেই? আমি এ-বছর রবি দাসের কোম্পানিতে চলে যাব। যার গায়ে জোর আছে, খাটার ক্ষমতা আছে, দুটো হাত আছে তার কীসের অত। চিন্তা? তা ছাড়া আমার তো আর তোমার মতো বউ, মেয়ে, ছেলে নেই। আমি একা মানুষ। কোন চিন্তা আমার?
মেয়ের কথা তোলাতেই সীতার চোখের কোণ দুটো আবার ভিজে এল।
আতশ বলল, আর একদিন সকাল সকাল আসব। দুপুরে তোমাদের সঙ্গে খাব। তারপর বেলাবেলি আবার করতপটাতে ফিরে যাব। আজ আমি উঠব। গদাধর যাবে তো উঠে পড়ো। রাতে আমার ওখানেই খেয়ে শুয়ে থেকো। কাল যেয়ো কটকে সকালের বাসে।
গদাধর বলল, ভীম্ব তুই এখানে থাক।
তোমার বউ, ছেলেকে রোজ রোজ পাহারা দিতে পারব না আমি। অনেক দিন তুমি আমাকে এই বেগার খাঁটিয়েছ। এবার আমাকে ছেড়ে দাও।
গদাধর কিছু না বলে, কাপড়ের ঝোলাতে একটা লুঙ্গি ও জামা নিয়ে ঝোলাটা কাঁধে ঝুলিয়ে এসে বসল বাইকের পেছনে। ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে। আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা। যখন তখন বৃষ্টি নামতে পারে।
আতশ বাইকে উঠে বলল, চললাম সীতা, চললাম ভীম্ব।
–আসুন্ত আইজ্ঞাঁ। ওরা দুজনেই বলল।
মোটরবাইকটা স্টার্ট করে কিছুটা আসতেই গদাধর বলল, নামতে সময় লাগবে না। তবে সাবধানে নামতে হবে। বর্ষার দিন। আর পাথর মাটি সব-ই তো ভেজা।
তারপর-ই স্বগতোক্তির মতো বলল, ওই ভীম্বর একটা কিছু করতে হবে। কথায় কথায় ‘তোমার বউ’ ‘তোমার ছেলে’ বলে কথা শোনায় অথচ আমি কী জানি না যে-ছেলেটা ওর? হেমা আমার মেয়ে ছিল। বলরাম হওয়ার সময়েই সীতার অপারেশন করে দিয়েছে ডাক্তার, অবশ্য আমার অনুমতি নিয়েই, আর ছেলে-মেয়ে তো ইচ্ছা করলেও হবে না। ভীম্ব ভাবে, ও খুব চালাক।
তুমি জানলে কী করে যে, ছেলে তোমার নয়, ওর?
কথাটা বলতে বলতে আতশের গলা শুকিয়ে গেল। ওর হঠাৎ মনে হল গদাধর নয় নন্দনদা কথা বলছে।
গদাধর বলল, যে-বছরে বলরাম হল সে-বছরে, আমি আটমাস দশপাল্লার নেষুগছার জঙ্গলে ছিলাম। রাস্তা ভেঙে যাওয়াতে খুব বিপদ হয়েছিল। বর্ষার আগে সব কাঠ বের করতে না পারলে বাবুদের অনেক লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়ে যেত। আমায় থাকতেই হয়েছিল। তারপর বলল, ষড়া বেধুয়া। সীতা ওরও বউ, যেমন আমারও। আর বলরাম তো ওর-ই।
–কী সাংঘাতিক কথা বলছ তুমি গদাধর?
আতশ বলল। আতশের বুকের মধ্যে কষ্ট হচ্ছিল। খুব কষ্ট। গদাধরের জন্যে। এবং নন্দনদার জন্যেও।
তারপর সারাপথ আর কোনো কথা বলল না গদাধর। আতশও বলল না। পুরুণাকোটের বড়ো রাস্তাতে পড়ার পরেই বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির অঝোর ধারা দ্রুতগামী বাইকে সামনে বসা আতশের চোখে-মুখে লাগতে লাগল এসে তিরের ফলার মতো। বৃষ্টির ধারার সঙ্গে, আতশ জানে, তার চোখের জলও মিশে গেল তাতে। তার কোমরের কাছে জাপটে বসে থাকা গদাধরের চোখের জলে ভিজতে লাগল আতশের পিঠ। গদাধর ভাবছিল, এমন একটা গোপন কথা সে বলে ফেলল আতশকে। ও চিরদিন-ই এমন কান্ডজ্ঞানহীন-ই থাকবে। আতশ ভাবছিল, আতশকে চান্দ্রায়ণ করতেই হবে। নইলে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত কিছুতেই হবে না। নন্দনদার সঙ্গে গদাধরের তফাত এই যে, নন্দনদা জানবে না তার সন্তানের বাবা কে? আর গদাধর তা জানে।
আতশ ভাবছিল, শুধুমাত্র মায়েরাই জানে, তার কোন সন্তানের জন্মদাতা কে? সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে বোকা বাবারা পরের সন্তানকে নিজের বলে জেনে তাকে বুকে জড়িয়ে পুলকভরে চুমু খেয়ে এসেছে। পুরুষ জাতটাই বড়ো বোকা।
করতপটাতে যখন ফিরল তখন, দু-জনেই চুপচুপে হয়ে ভিজে গেছে। আতশ গরম জলে স্নান করল, গদাধরও। তারপরে দু-জনেই জামাকাপড় বদলে এসে বারান্দাতে বসল। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। ভেজাবনের সোঁদা গন্ধ ভাসছে হাওয়াতে, চাঁপার গন্ধ, কেয়ার গন্ধ। কয়েক-শোজোনাকি নিভতে-জ্বলতে, জ্বলতে-নিভতে জঙ্গলের গভীর থেকে ভাসতে ভাসতে এসে ডবা বাঁশের একটা মস্ত ঝাড়ের ওপরে থিতু হল। শয়ে শয়ে নীলচে-সবুজ টুনি বালব যেন, জ্বলতে লাগল বাঁশঝাড়ের মাথাতে।
গদাধর সেদিকে চেয়ে হঠাৎ বলল, একটা গান গাইতে ভীষণ ইচ্ছে করছে বাবু। গাইব? আমার হেমা মা এই গানটা বড়ো ভালো গাইত।
কোনো সিনেমার গান?
না না বাবু, দীনবন্ধুর গান। আমি বাড়ি থাকলে প্রতিসন্ধেতে, সে আমাকে এই গানটা গেয়ে শোনাত।
আতশ বলল, তুমি গানের চর্চা করো?
কখনো করিনি বাবু। জঙ্গলে থাকি। সারাদিনের কাজের পরে সন্ধেবেলা নালাতে চান করে এসে ক্যাম্পের বারান্দাতে দুটো ধূপকাঠি জ্বালিয়ে একটু গান করি। বলতে পারেন, ওই আমার পুজো। জানেন বাবু, গভীর জঙ্গলে থেকে থেকেই আমার ঈশ্বরে বিশ্বাস জন্মেছে। ওইসব আদিম জঙ্গলে না থাকলে আমি মানুষটা অন্য দশজন মানুষের মতোই হতাম। জঙ্গল পাহাড়ের নানা রূপ, নানা ঋতুকে দেখে আমার মন শান্ত হয়ে গেছে। টাকাপয়সা, ঘরসংসার এসব কিছুই ভালো লাগে না আর। সবাইকেই ক্ষমা করে দিতে পারি, কারো ওপরেই কোনো রাগ নেই আমার।
তুমি ভীম্বকেও ক্ষমা করে দিয়েছ?
নিশ্চয়ই। কবে ক্ষমা করেছি। বলরামের বয়স তো সাত হতে চলল। ক্ষমা কেন করব না বলুন? ও আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোটো, অনেক ভালো স্বাস্থ্য ওর, লম্বা-চওড়া, ওই নির্জনে যদি একা মানুষ একজন যুবতীর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকে তাহলে তার তো ইচ্ছে হতেই পারে। এ তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। তা ছাড়া আমিই তো ওদের সুযোগ করে দিয়েছি। এ-সংসারে বদলে কিছু না পেয়ে কেউ কী কিছু দিতে চায়? দেবে যে, তা ভাবাটাই তো অন্যায়।
আর সীতাকে? তাকেও ক্ষমা করেছ তুমি?
তাকেও। কেন করব না বলুন? সীতার মতো সুন্দরী মেয়েকে তো আমি রাবণের মতো আশোক কাননে সীতার মতো করেই দুঃখে রেখেছি এত বছর। দেওয়ার মতো কীই বা দিতে পেরেছি তাকে বলুন? ও যদি ওর যা উদবৃত্ত তা অন্যকে দিয়েই থাকে তা নিয়ে আমি অনুযোগ করব কেন? তা করলে তো অন্যায় করা হত।
তুমি যে, সীতাকে সুখে রাখতে পারোনি তার জন্যে, দায়ী তো তোমার মেজোবাবু। এত বছরে তো তোমার মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা তিনি রোজগার করেছেন। তোমাকে কী দিয়েছেন?
সেটা তো বাবু আমার দেখার নয়। এই সংসারে যে-যার কপাল নিয়ে আসে। ওই রঙ্গমঞ্চে যে-যার ভূমিকা নিয়ে আসে এবং সেই ভূমিকাতে অভিনয় শেষ হলে চলে যায়। এই স্বাভাবিক। প্রকৃতির মধ্যে যেমন, অনেক নিয়ম থাকে। বাঘ যখন হরিণ ধরে খায়, আমাদের খুব খারাপ লাগে কিন্তু তারমধ্যে বীভৎসতা তো কিছু নেই, কারণ, সেটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। মেজোবাবুর ভূমিকা তাঁর। আমার ভূমিকা আমার। অন্যের কপাল নিয়ে ঈর্ষা’ করলে কখনো সুখী হওয়া যায় না জীবনে।
তুমি কি সুখী গদাধর?
আমার নিজের কোনো নিজস্ব দুঃখ তো নেই। আমি নিশ্চয়ই সুখী। যতটুকু অসুবিধে হয় সীতা আর ছেলে-মেয়ের জন্যে। ওদের চাহিদা আছে, থাকা স্বাভাবিক। তাই আমার যতটুকু অনুযোগ তা ওদের-ই কারণে।
তারপর বলল, আমার কথা আপনি ঠিক বুঝতে পারবেন না বাবু। আমার সঙ্গে এবারে জঙ্গলে চলুন, দেখবেন মন কী শান্ত হয়ে যাবে। কত অল্পেতে আমরা সুখী হতে পারি সে কথা আপনি বুকের মধ্যে অনুভব করবেন। আমাদের সব দুঃখ, সব অশান্তি আমাদের নানারকম চাওয়া ও আশার-ই জন্যে। কিছু আশা যে না করে, সে কখনোই নিরাশ হয় না।
তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, আপনাকে একবার ময়ূরভঞ্জের রাজার জঙ্গল সিমলিপালে নিয়ে যাব। পাল্টববাবুদের কোম্পানি মাত্র একবার সে-জঙ্গল ডেকেছিলেন বারিপদার ফরেস্ট অফিসে গিয়ে। সেসব তো জঙ্গল নয়, দেবপুরী। মেঘের মতো, পাহাড়ের পর পাহাড়, কত নালা, কত ঝরনা, কতরকম গাছ। কত জঙ্গল! চাহালা, ভঞ্জবাসা, রাজাদের পদবি তো ভঞ্জ তাই ভঞ্জবাসা, বাছুরিচরা, জেনাবিল, ধুধুরুচম্বা, জোরাণ্ডা, বড়াইপাণি, নআনা আরও কত কী? ওই যে, জোরাণ্ডা, যেখানে একটা বাংলো আছে, তার নীচে খাড়া খাদ আর সেই খাদের মধ্যে বহুওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে জোরাণ্ডা জলপ্রপাত। সেই খাদের গা এমন-ই খাড়া যে, পাখিরও পা পড়ে না সেখানে, মানে, পাখি পর্যন্ত বসতে পারে না। অথচ সেই খাদের-ই গায়ে রাতের বেলা নানা ভৌতিক আলো জ্বলে আর নেভে। দেব-দেবতার বাস সেখানে। আসল নাম তত জোরাণ্ডা নয়–আসল নাম জাউরন্ধা। জগন্নাথদেব আগে বহুদিন ওখানেই থাকতেন। জগন্নাথের প্রসাদ যে ভাত, তাকে তো বলে ‘জাউ’, সেই জাউই সেখানে রান্না হত, তাই জাউরন্ধা। সাহেবরা উচ্চারণ করতে পারত না তাই বলত জোরাণ্ডা। কত হাতি, গয়াল, বুনো মোষ, বুনো কুকুর, হরিণ, ময়ূর, কুটরা, গুরাণ্ডি, বড়ো বড়ো বাদামি রঙা নেপালি ইঁদুর, তারা যখন বড়ো বড়ো তেঁতরা আর মিটকুনিয়া গাছের উঁচু ডাল থেকে অন্য ডালে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে বেড়ায় তখন শীতকালের ভোরে বৃষ্টির মতো শিশির ঝরে নীচে। কত রং, কত গন্ধ। কত ছবি সেই ভঞ্জরাজাদের সিমলিপালে, গেলে আর ফিরে আসতেই ইচ্ছে করবে না বাবু আপনার।
গানটা গাইলে না গদাধর?
হ্যাঁ বাবু, গাইছি। বলে গদাধর গান ধরলঃ
দয়া করো দীনবন্ধু শুভে যাউ আজদিন
কলিযুগে জগন্নাথ বিজে চক্ৰহস্ত
সাধিয়ে পউঠ অন্ন আপে করুছ ভবন
তুমি এ-সংসারে সার আউড় সব মায়া ঘর
কুতাংত ভর উঠরো কহে দীন জনহীন
দয়া করো দীনবন্ধু শুভে যাউ আজদিন…
গদাধরের পরমভক্তিভরে এবং আশ্বাসে গাওয়া গানটি, দীনবন্ধু দয়া করো, দয়া করো, আজ যেন, আমার দিনটি ভালো যায়, এই বৃষ্টিভেজা সান্ধ্য অরণ্য প্রকৃতির পরিবেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন, ভরে গেল।
গদাধর কিছু না বলে চুপ করে অন্ধকারে চেয়ে বসে রইল। এ-বাড়িতে, এই জায়গাতে বিজলি আলো নেই। যদিও রাস্তাতে মাঝে মাঝে আছে। লণ্ঠনটা ফিতে কমিয়ে রাখা আছে বারান্দার দরজার আড়ালে, যেন চোখে আলো না লাগে আর সাপ-বিছেও বারান্দাতে উঠে এলে দেখা যায়।
গদাধরের ঈশ্বরভক্তি আর জঙ্গলের বর্ণনাতে আবিষ্ট হয়ে গেছিল আতশ।
বাইধর এসে বলল, খাবার লাগিয়ে দিয়েছি।
ক-টা বাজে?
ন-টা।
বলিস কী রে?
হ্যাঁ বাবু। আপনারা তো সাতটা থেকে বারান্দাতে বসে আছেন। কত গল্প করল গদাধরদা কতরকম, টুকরো-টাকরা আমিও শুনেছি রান্নাঘর থেকে তবে গানটা ভারি ভালো শুনলাম, বুঝলে গদাধরদা।
গদাধর বলল, হউ।
আতশের মনে এক তীব্র বাসনা জন্মাল গদাধরের মতো হতে, একজন এক-শো ভাগ ভারতীয় হতে, যারা সাধারণ সুখ-দুঃখের নাগালের বাইরে থেকেও বাঁচতে জানে, বেঁচে এসেছে যুগযুগান্তর ধরে। তারা যদি সুখী হয়, সুখী থাকে, তবে আতশের কোন অধিকার আছে, নিজেদের সুখ-দুঃখের সংজ্ঞা জবরদস্তি করে তাদের ওপরে প্রয়োগ করে।
আতশ ভাবছিল কটকের পাল্টববাবুদের মেজোবাবু কি চান্দ্রায়ণ করবেন? করা তো উচিত। অন্তত তিনি করুন আর নাই করুন, আতশ করবে।
দয়া, ওগো দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে।
নইলে কী আর পারব তোমার চরণ ছুঁতে।।
তোমায় দিতে পূজার ডালি বেরিয়ে পড়ে সকল কালি,
পরান আমার পারি নে তাই, পায়ে থুতে।
দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে।
না গেয়ে, গানটি গাইল আতশ।
বাইরের জমাটবাঁধা ভেজা অন্ধকারে চেয়ে বসে রইল ও।
বাইধর আবার এসে বলল, চালন্তু আইজ্ঞাঁ।
আতশ, নীচু গলায় বলল, চলো।