২. নন্দা আর নলিনী

বিকেল চারটে বাজে। রবিবার। নন্দা আর নলিনী বসেছিল বসার ঘরে। এখনও চা খাওয়ার সময় হয়নি। ওরা পাঁচটাতে চা খায়। নন্দন তার ঘরেই থাকে। তার চা ঘরেই পাঠিয়ে দেয় বেয়ারা রবিকে দিয়ে। আজ রবিবার। দুপুরের খাওয়া হয় দেরি করে। খাওয়া-দাওয়ার পর আড়াইটে নাগাদ ঘুমোতে যায় নন্দন। একটু পরে নন্দাও যায়। রবিবারের দুপুরে আদর করে নন্দন ওকে। আদরটাকে আদর বলে মনে হয় না নন্দার, সাদা একটি নরম পেলব কবুতর যেন, হুলোবেড়ালের হাতে ছিন্নভিন্ন হয়, অনাবৃতও হতে বলে না নন্দন নন্দাকে। কে দেখে তার রূপ আর লাবণ্য! গুহাচারী একটা পশুর মতো; কচুবনে শুয়োরের মতো, উইঢিবিতে ভালুকের মতো কিছুক্ষণ সশব্দে তার শরীরে বিচরণ করে অ্যাটাচড বাথরুমে চলে যায় নন্দন। কড়িকাঠের দিকে চেয়ে একটি মৃতদেহের মতো পড়ে থাকে অতৃপ্ত শরীর আর মন নিয়ে নন্দা।

তার আনন্দ নিয়ে তার রোমান্টিসিজম নিয়ে কখনো মাথা ঘামায়নি নন্দন। এই ব্যাপারটা একটা Mundane, রুচিহীন, একতরফা কর্তব্য হয়ে গেছে। বিয়ের পর পর প্রাত্যহিক ছিল ব্যাপারটা, এখন সাপ্তাহিকে এসে ঠেকেছে। এই মনহীন, ভালোবাসাবিহীন, রোমান্টিকতাহীন চর্ম-ঘর্ষণ যে, অবিবাহিতা ও বিবাহিতার বিভাজন করে ওকথা ভাবলেই অবিবাহিতা রমণীদের প্রতি অসূয়া হয়। বিয়েটা সত্যিই লিগালাইজড প্রস্টিট্যুশান–এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমারই মতো অন্য লক্ষ লক্ষ বিবাহিতাই এই জীবনকেই মেনে নিতে বাধ্য হয়। আজকালকার স্বাবলম্বী মেয়েরা যে, বিয়ে করতে চায় না, বেশ করে। তবে ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। আমার-ই জানাশোনা অনেক মেয়ে আছে তারা বিয়ে করে সত্যিই সুখী হয়েছে সব দিক দিয়ে। তারা আমাদের মতো সুখের ভান করে না। আমার বাপেরবাড়ি অবস্থাপন্ন হলে, আমি নিজে স্বাবলম্বী হলে কখনোই এই অপমানকর সম্পর্কে আজীবন বাঁধা থাকতাম না।

তার একমাত্র ননদ নলিনী। শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী, সংবেদনশীল এবং মমত্বসম্পন্ন বলে নন্দা অনেক কথাই বলে নলিনীকে। বলে সেসব কথা, যেসব কথা একজন মেয়েই শুধু বলতে পারে অন্য একজন মেয়েকে।

নলিনী নন্দার কথা শুনে দুঃখিত হয়। নন্দার জন্যে, যেমন দুঃখিত হয়, তেমন তার দাদার জন্যেও।

নলিনী আতঙ্কিত গলাতে বলে, এসব জেনে বিয়ে করতে বড়ো ভয় করে বউদি।

তুই যাকে বিয়ে করবি সে অন্যরকম পুরুষ।

কী করে জানলে?

জানি। একদিন আমি দেখেছি।

খুব ভয় পেয়ে যায় নলিনী।

বলে, কী দেখেছ তুমি? দেখবার মতো কিছু তো ঘটেনি।

ঘটেছিল। গতবছর পিঙ্কির বিয়েতে আমরা সকলে গেছিলাম, মনে আছে?

হ্যাঁ।

তোর দাদা তাড়াতাড়ি খেয়ে মহান্তিদের বাড়ি তাস খেলতে চলে গেলে, আতশ, আমি আর তুই হেঁটে ফিরলাম। মনে আছে?

হ্যাঁ।

পূর্ণিমা ছিল। ফুটফুট করছিল জ্যোৎস্না। আতশ বলল, চলো বউদি, আমাদের বাড়ি। এককাপ করে কফি খেয়ে যাবে আর একটু গান-টানও হতে পারে। নন্দনদাও তাস খেলতে গেল। কী করবে একা বাড়িতে?

‘চলো।’ বলেছিলাম আমি।

আতশদের বাড়িটাতে ঢুকলেই আমার মনে হয় নন্দনকাননে এলাম। বসন্তের দিন। হু হু করছে নানারকম ফুলের গন্ধ বয়ে আনা বাসন্তী’ হাওয়া। ছমছম করছে ডাইনি জ্যোছনা। মাউসি কটকে গেছিলেন তখন ছোটোবোনের বাড়ি। আতশ পটাকে বলল কফি করতে। আমরা তিনজনে বারান্দাতে বসেছিলাম। তুই হঠাৎ গান ধরলি, পূর্ণচাঁদের মায়ায় আজি ভাবনা আমার পথ ভোলে, যেন সিন্ধুপারের পাখি তারা, যায় যায় যায় চলে। মনে আছে?

আছে।

আমি বললাম, আমি একটু বাথরুমে যাব।

আতশ বলল, মায়ের বাথরুমে নানা জিনিস ডাঁই করা আছে তুমি আমার বাথরুমেই যাও।

আমি বাথরুমে গেলাম। বাথরুমের জানলাটা ভোলা ছিল। হাওয়াতে পর্দা উড়ছিল এলোমেলো। আমি দেখলাম, তোকে চেয়ার থেকে তুলে আতশ তোর গ্রীবাতে আলতো করে চুমু খেল। তারপর চুমু খেল তোর দু-চোখে। তুই যেন, চাঁদের আলো আর ‘পিউ-কাঁহা’র ডাকের মধ্যে একেবারে গলে গেলি। জানি না, শরীরেও হয়তো গলেছিলি। আমাকেও যদি, কোনো ভালোবাসার পুরুষ অমন করে আদর করত, আলতো করে, স্বপ্নের মতো, আমিও হয়তো গলে যেতাম। খুব কম পুরুষ-ই জানে মেয়েরা কীসে খুশি হয়, তাদের কী করে আদর করতে হয়। তোর আতশ জানে। ও একটা অন্যরকম পুরুষ।

বাথরুম থেকে এসে তোকে আমার খুব ঈর্ষা হচ্ছিল। তোর দাদা যদি জানত, অমন করে আদর করতে। তা তো সে জানে না। আমি তার তৈলার ফসলের-ই মতো একটি ফসল। তার সঙ্গে আমার মনিব-চাকরের সম্পর্ক। আমি তার আজ্ঞাবাহী প্রাণী। তার বেশি কিছুই নই। আসলে তার অভিধানে, আতশ-এর অভিধানে যা আছে, তার কিছুই নেই। তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, তোর দাদার দোষ নেই। এসব পরিশীলিত ব্যাপার-স্যাপার তো

এমনিতে কোনো পুরুষের কুক্ষিগত হয় না। এরজন্যে পড়াশোনা, সুরুচি, সুন্দর ভাবনা, সাহিত্যপ্রীতি সংগীতপ্রীতির প্রয়োজন হয়। তারপর বলল, সেই একটা গান ছিল-নাঃ Nothing comes from nothing, nothing ever could, I must have done something good in my youth or in my childhood. এই হচ্ছে আসল ব্যাপার।

একটু চুপ করে তারপর নন্দা বলল, বিয়ের কথা কিছু হল কাল?

না, না। কী যে বলো? আমার পড়াশোনা শেষ হতে তো আরও দু-বছর লাগবে। যৌবনের সবচেয়ে সুন্দর আরও দুটো বছর একা একা কাটাবি? যৌবন তো চিরদিন থাকে না রে। বড়ো তাড়াতাড়িই ফুরিয়ে যায়। শরীরের যৌবন ফুরোনোর অনেক আগেই মনটা বুড়িয়ে যায়–এটা অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও–ঘটনা। বিয়েটা কি আগেই সেরে ফেলা যেত না?

না বউদি। তা ছাড়া ও যেন, কেমন হয়ে গেছে। সবসময়ে আদর্শ আর দেশ আর জনযুদ্ধ। ওকে যেন, ভূতে পেয়েছে। অন্য দশজন সাধারণ মানুষের মতো আর নেই ও। মনে হয় অসুস্থ হয়ে গেছে–একটা ঘোরের মধ্যে আছে ও।

নন্দা বলল, হতেই পারে। ও তো কোনোদিনও আর দশজনের মতো ছিল না, আর ছিল না

বলেই তো তুই হাজার ছেলের মুগ্ধতা অবহেলে ঠেলে সরিয়ে হিরেকে বেছেছিলি। ও যে, আর দশজনের মতো হবে, এমন তুই ভাবিস কী করে?

নারে বউদি, তোকে ঠিক বোঝাতে পারব না। ও যেন, কেমন একসেন্ট্রিক হয়ে গেছে। আমাদের বাড়ি যেদিন যাবে সেদিন এই প্রসঙ্গ উঠলে তুই নিজেই বুঝতে পারবি ওর মধ্যে কী পরিবর্তন এসেছে। সবসময়ে এম. সি. সি. আর জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর কথা বলছে।

তা বলছে হয়তো তাদের আইডিয়োলজির প্রতি ওর সমর্থন আছে বলেই। তা বলে ও কি ল্যাণ্ডমাইন আর ডিনামাইটের কারবারি হয়ে উঠবে?

কী হয়ে উঠবে তা আমি জানি না।

তোর দাদাও কিছুদিন হল এইসব নিয়ে ভাবছে। এখানকার অন্য ব্যবসায়ীরাও আলোচনা করছে এ-নিয়ে। সবাই চিন্তিত। ওড়িশার এ-অঞ্চলে ওই আতঙ্কবাদীদের হাত পৌঁছোতে পারে।

দাদা তো কোনো অন্যায় করে না। তার তেলকল, ময়দাকল তো অ্যাবাভ বোর্ড। তেলকলে তো শুধু সরষের তেল হয় না, মহুয়া, নিম, করৌঞ্জ আরও কত তেল হয়। নলিনী বলল।

সেটাই তো চিন্তার। মহুয়া, নিম, করৌঞ্জের সাপ্লায়ার তো জঙ্গলের মানুষেরাই। আর এম. সি. সি. জনযুদ্ধের সকলের ঘাঁটি তো হল জঙ্গলেই। তা ছাড়া তোর দাদা সরষের তেলে ভেজাল দিলে কী, তোকে আমাকে বলে দেবে? টাকার লোভ বড়ো মারাত্মক লোভ রে।

অন্যায় না করলে আর কীসের চিন্তা?

তা অবশ্য ঠিক।

প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে এবারে নলিনী বলল, আতশ বলছে, একদিন মাউসিকে নিয়ে গাড়ি ভাড়া করে কটকে যাবে। কটকের বন্দুকের দোকানে ওর কী কাজ আছে, আর মাউসি কটকচন্ডীর মন্দিরে পুজোও দেবে। বহুদিন যাননি নাকি। তা ছাড়া মাউসির ছোটোবোনও তো থাকেন কটকের-ই মঙ্গলাবাদ-এ না, কটকচন্ডী বোড়-এ। তাঁর সঙ্গেও দেখা করে আসতে পারবেন। যাবে বউদি? বেশ আউটিং হবে।

আমি যাব? আমার যেতে কী আপত্তি? কিন্তু আমি গেলে তোদের ডালমে কালা হবে না তো?

বা বাঃ হিন্দি ছবি দেখে দেখে তো খুব উন্নতি হয়েছে দেখছি।

তা কী করব বল? রিমোট টিপলেই সারাপৃথিবী ঘরের মধ্যে। টি. ভি. যে, আমার মতো, অসংখ্য বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মতো, কত মানুষকেই আত্মহত্যা থেকে বাঁচিয়েছে তা তোকে কী বলব!

তার মানে?

মানে, তোদের তো ভবিষ্যৎ বলে অনেক কিছু আছে, ভবিষ্যতের স্বপ্ন আছে কতরকম– আমার যে, কিছুই নেই। থোড় বড়ি খাড়া-খাড়া বড়ি খোড়। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদেরও তাই। তাঁদের সব একাকিত্ব। ছেলে, ছেলে-বউ-এর অবহেলার দুঃখ তাঁরা টিভির সামনে বসে ভুলে যান।

আর এই টিভির ওপরেই যা রাগ-না আতশের! পারলে স্ক্রিন-ই ভেঙে দেয়।

তাই?

না তো কী?

নন্দা বলল, তবে এটা ঠিক-ই যে, অল্পবয়েসিদের পক্ষে, অভাবীদের পক্ষে টি. ভি. তো খারাপ-ই। অসময়ের নানা অনুভূতির জন্ম দেয় অল্পবয়েসিদের মনে, আর অভাবীদের মনে লোভ জাগায়। কাম জাগাতে পারে সকলের-ই মনে–যা অবদমিত হয়ে সমাজের নানা ক্ষতি করে। অবদমতি লোভও নানা ক্ষতি করে। একথাও সত্যিই যে, টি. ভি. আসার পরেই সারাদেশে চুরি, ডাকাতি, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ ভীষণভাবে বেড়ে গেছে। আতশ যা বলে, তার কিছুটা তো সত্যিই।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, আমি আমার কথা বলতে পারি। কী আছে বল আমার জীবনে? তাও তুই যখন, ভুবনেশ্বর থেকে আসিস একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। মনের জানালাগুলো সব খুলে যায় যেন, তখন। তুই যখন থাকিস না, মাঝে মাঝে তিয়াসাতে মাউসির কাছে যাই। ফোনে তো কথা বলি রোজ-ই এক দু-বার। বয়স্কা হলে কী হয়, মানুষটা পড়াশুনো নিয়ে থাকেন তাই মনটা খুব উদার। আধুনিকও। অনেক কিছু জানেনও। টি. ভি. দেখলে একরকমের জানা হয় আর ওঁর মতো মানুষের কাছে গিয়ে বসলে অন্য নানারকম জানা। এখানকার লাইব্রেরি থেকে, কটকের বইয়ের দোকান থেকে কত বই আনান উনি। এ যুগে বই কেনা একটা অপচয় বলে মনে করেন অনেকে। তুই কিনিস কিন্তু তোর দাদা কি গত সাতবছরে একটি বইও কিনেছে? একটিও নয়। বই উপহার দেওয়ার রেওয়াজও কমে গেছে। আমাদের ছেলেবেলাতে জন্মদিনে, বিয়ের তারিখে, পইতেতে, বিয়েতেও কত বই উপহার দিতে দেখেছি মানুষকে। আসলে মানুষের গভীরতা কমে গেছে। একটা ভালো বই পড়ার, বার বার পড়ার যা-আনন্দ, তা কি অন্য কিছুতে আছে? বল তুই

সত্যিই হয়তো টি. ভি. আমাদের গভীরতা নষ্ট করে দিচ্ছে। এর মূল্য আমাদের দিতে হবে।

তারপর বলল, মাউসির কাছ থেকে অনেক বই এনে পড়ি। কোনো বই ওঁর ভালো লাগলে উনি নিজেও পাঠিয়ে দেন পটাকে দিয়ে। আর একটু চুপ করে থেকে বলল, এই মোবাইল ফোন, কম্পিউটার এসবের জন্যেই হয়তো মূল্য দিতে হবে। ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে? আর সেই মূল্যের পরিমাণটা যে, ঠিক কীরকম হবে তাই বা কে বলতে পারে।

আতশ কিন্তু নেয়নি মোবাইল ফোন। বলে, দুস কী হবে? স্কুলে এবং বাড়িতে ল্যাণ্ডলাইন আছে। ওর বাড়িতে ইলেকট্রিসিটিও নেই। ও বলে, নেই বলেই দারুণ লাগে। বলে, আমি কে এমন কেষ্টবিষ্ট যে, মোবাইল-এর দরকার আমার?

সেলসম্যান-টেলসম্যান, বিদেশে যেমন ট্যাক্সি-ড্রাইভার, এদের মোবাইল ফোন জরুরি। নইলে মোবাইল ফোন থাকলেই মানুষ অকারণে বিরক্ত করে। কোনো মানে হয় না।

তোর দাদা তো অয়েল মিল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠেই রোজ ফোন করবে, কী রান্না হল আজ? দেখ একবার পনেরো মিনিট পরে, বাড়ি ফিরে হাত ধুয়ে খেতে বসলেই তো দেখতে পাবে কী রান্না হয়েছে। তা, না। তা ছাড়া এসব বাড়ালেই বাড়ে। সব প্রয়োজনের বেলাতেই এ-কথা খাটে।

সেটা ঠিক-ই বলেছ। আমরা যখন ছোটো ছিলাম বাড়িতে না ছিল টি. ভি. না মোবাইল ফোন–টেলিফোন-ই তো ছিল না তখন, কিন্তু সেজন্যে আনন্দ কী আমাদের কম ছিল। প্রকৃতির সঙ্গে যোগাযোগটাও নিবিড় ছিল। মাঠে না হোক উঠোনেও আমরা কতরকম খেলা খেলতাম। গাছপালা আর পাখপাখালির মধ্যে বড়ো হয়ে উঠেছি আমরা। তার একটা স্থায়ী প্রভাবও পড়েছে আমাদের ওপরে।

তা যা বলেছিস। ছেলে-মেয়েরা আজকের মতো সহজে মেলামেশা করতে পারত না বটে কিন্তু আমাদের যে, ঘোরাটোপের মধ্যে রাখতেন গুরুজনেরা সে-কারণে অনাত্মীয় ছেলেদের মধ্যে, তাদের সম্বন্ধে এক ধরনের রহস্য থাকতই আমাদের। ছেলেদেরও নিশ্চয়ই থাকত আমাদের প্রতি। জীবনকে সুন্দর করতে রহস্যময়তারও দরকার আছে। তাই-না? তুই কী বলিস?

আছেই তো। এখনকার ছেলেমেয়েরা যেমন পেয়েছে অনেক কিছু, যা আমরা ছেলেবেলাতে পাইনি, সেইসঙ্গে হারিয়েছেও অনেক কিছু, যা আমাদের-ই নিজস্ব ছিল।

নিশ্চয়ই। একথা এক-শোবার সত্যি।

.

দেখতে দেখতে ছুটি শেষ হয়ে গেল আতশের। করতপটাতে ফিরে এসেছে। অঙ্গুলে কাটানো ছুটির দিনগুলো পেছনে ফেলে এল স্বপ্নের মতো। এই স্বপ্নের মধ্যে একটা কাঁটাও আছে। কাঁটার ওপরে ফুলও আছে, যেমন থাকে। সেকথা ভাবলে এক দারুণ আনন্দ যেমন হচ্ছে, তেমন এক গভীর অপরাধবোধেও সে জর্জরিত হচ্ছে। আদর্শবান আতশ আদর্শচ্যুত হয়েছে। ও ভাবতেও পারে না, কী করে ঘটনাটা ঘটে গেল।

সংসারে বোধ হয় এরকম-ই ঘটে থকে। একজনের আনন্দই অন্যজনের দুঃখ। ব্যাপারটা যে, ঘটতে পারে, তা তার আগের মুহূর্তেও ভাবেনি। অথচ ঘটে গেল ঘটনাটা। নলিনীর সঙ্গে কি সে, বিশ্বাসঘাতকতা করল? নলিনীকে এই ঘটনার কথা বলাও যাবে না–কোনোদিনও না। বুকের মধ্যে বয়ে বেড়াতে হবে এই গোপন কথা।

স্কুলে ওর চেয়ারে বসে এসব কথা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল ও। কাদম্বিনী বলল, বাড়ি যাবেন না, আতশদা? আবার বৃষ্টি আসছে কিন্তু। এ তো সেই গরমের সিউডো বর্ষা নয়, রিয়াল বর্ষা।

তারপর বলল, এবার রজোৎসবের সময়ে কটকে গেছিলাম, মা আপনার জন্যে একটা সিল্কের পাঞ্জাবির কাপড় দিয়েছেন। আজ আনতে ভুলে গেছি। কাল আনব।’

আতশ হেসে বলল, কোনো মানে হয়? মাউসি আছেন কেমন? এবারে অঙ্গুল থেকে একবার কটকে গেছিলাম। সকালে গিয়ে বিকেলে ফিরে এলাম। সঙ্গে মা আর আমাদের পাশের বাড়ির নলিনী আর তার বউদি নন্দাও গেছিল। আমার একটু কাজ ছিল বন্দুকের দোকানে। মা আর ওরা কটকচন্ডীর মন্দিরে পুজো দিলেন।

একটু চুপ করে থেকে বলল, কটকে তোমাদের বাড়ি কোন পাড়াতে?

বাখরাবাদে। মহানদীর খুব কাছে। একসময়ের বিখ্যাত শিকারি এবং বর্তমানের বিখ্যাত চিত্রী সমরেন্দ্র দে, চাঁদবাবুর বাড়ির প্রায় লাগোয়া। উলটোদিকে দে’জ মেডিকেলের একটা ডিপো আছে, মানে গুদাম। যদি কখনো যান তো যাকে বলবেন সে-ই দেখিয়ে দেবে।

যাব কখনো যদি, এর পরে কটকে যাই। তারপর বলল, তোমার বিয়ের কতদূর এগোল?

কাদম্বিনী বলল, বিয়ে কি এককথাতে হয়? হাজার কথা লাগে। মা আর মামারা দেখছেন। একটি ছেলে দেখেছিলেন, খুব অবস্থাপন্ন–কিন্তু সে, ফরসা মেয়ে চায়, সে মানে, তার বাড়ির লোকজন। আমি তো ফরসা নই।

নাই বা হলে। তুমি তো খুবই সুন্দরী। কালো, জগতের আলো। তোমার দু-টি গজদন্ত আর হাসলে দু-গালের যে, দু-টি টোল পড়ে তা আর কার আছে? তুমি যে, বড় বাচ্চা। নইলে আমিই তোমাকে বিয়ে করতাম। তুমি খুব ভালো মেয়ে।

কাদিম্বনীর গালে আর কানের লতিতে রক্ত ছুটে এল। জাম-রাঙা হয়ে গেল মুখটি।

বলল, এরকম সুন্দর মিথ্যে কথা আর ক-জনকে বলেছেন আতশ দাদা?

আতশ হেসে বলল, আর কারোকেই নয়। তোমাকে যে-বোন পাতিয়েছি আর তুমি যে, এখনও ছোট্টটি আছ-নইলে ঠিক তোমাকে বিয়ে করতাম।

বিয়ে-টিয়ে আস্তে আস্তে উঠে যাবে দেশ থেকে। আমি তো চাকরি ছাড়তে পারব না। আর পুরুণাকোটের স্থায়ী বাসিন্দা কোথায় পাব, বর হিসেবে?

তুমি আরও একটা বছর পড়াও। টিচারও তো তুমি খুব-ই ভালো। তোমাকে খুব ভালো রেকমেণ্ডেশান দেব। তুমি কটক, ভুবনেশ্বর, সম্বলপুর এসব জায়গাতে লাগাতার অ্যাপ্লাই করতে থাকো।

ভুবনেশ্বর বা সম্বলপুর হলে তো হবে না। মায়ের জন্যে কটকেই সবচেয়ে সুবিধে আমার। মা যতদিন আছেন। মা চলে গেলে আমিও মুক্ত হয়ে যাব। তবে তেমন মুক্তি আমি চাই না।

মাউসির বয়স কত হল?

ষাট। আমি তো সবচেয়ে ছোটোসন্তান। আমার Tদার একজনও থাকলে আমার কোনো চিন্তা থাকত না।

দু-জনেই কি একইসঙ্গে মারা গেছিলেন?

দু-জনে এবং বাবাও। বাবা তো জঙ্গলের ঠিকাদারি করতেন। জিপ চালিয়ে আসছিলেন, সম্বলপুর-অঙ্গুল রোডে জিপ উলটে তিনজনেই মারা যান একসঙ্গে।

ইস। তোমার কপালটাই খারাপ।

আমার তখন সাতবছর বয়েস। বাবার অনেক ধারদেনাও ছিল। সব কিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেল। থাকতাম আমরা ভাড়াবাড়িতেই তবে বড়োবাড়ি ছিল। সে-বাড়ি ছেড়ে দিয়ে বাখরাবাদে মামাবাড়িতে এসে উঠলাম। তারপরে মামাদের-ই আশ্রিত। মামারা আদর করেই রেখেছিলেন আমাকে আর মাকে কিন্তু দুই মামাই সামান্য চাকরি করেন। তাঁদেরও ভাড়াবাড়ি। চার মামাতো ভাই-বোন, তাদের লেখাপড়ার খরচ ছিল। তবে আমাকে মামারা কখনো বুঝতে দেননি যে, আমার বাবা নেই। আপন ভাই-বোনের-ই মতো বড়ো হয়েছি আমরা। এক দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। অন্য দিদি এল.আই.সি.-তেচাকরি করে। বিয়ে করবে না সে।

কেন?

একজনকে ভালোবাসত। একটি মুসলমান ছেলেকে। দিদিকেও মুসলমান করে বিয়ে করতে চেয়েছিল। সেইজন্যেই মামারা রাজি হয়নি। দিদিরও এ-ব্যাপারে আপত্তি ছিল। তবে কাদের দাদা চমৎকার ছেলে। সে এসব চায়নি কিন্তু তার এক কাকা মৌলবি। কট্টর মুসলমান। তিনি রাজি হননি। বিয়েও হয়নি।

তোমার কাদেরদা বিয়ে করেছেন?

হ্যাঁ। তার বিবির নাম নুরুন্নেসা। তবে দেখতে ভালো নয়। তাদের চার ছেলে মেয়ে হয়ে গেছে।

কাদেরদা দিদির সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছে?

সম্পর্ক মানে কী? ন-মাসে ছ-মাসে আসে, চা খায়, আমাদের সকলের সঙ্গেই গল্প করে, বকরি ইদে খুব ভালো বিরিয়ানি বেঁধে পাঠায় আর ফিরনি, আমরাও বিজয়াতে মিষ্টি পাঠাই। এই সম্পর্ক আর কী!

তোমার দিদি তো খুব বোকা। সেও কেন অন্য কারোকে বিয়ে করল না?

করল না। দিদি একটু শক্ত ধাতের মেয়ে। কাদেরদাদের বাড়ির সামনে দিয়েই রোজ অফিসে যায়। নুরুন্নেসা বোরখা পরে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে দিদিকে দেখে। দিদি যে, স্বাধীন। মুসলমান মেয়েদের মতো পর্দানশিন বা পরাধীন নয়, সেটা দেখায় দিদি–দিদি তার স্বাধীনতাকে পুরোমাত্রায় উপভোগ করে। দিদির অফিসের একজন বিবাহিত সহকর্মীর সঙ্গে একটা রোমান্টিক সম্পর্ক আছে, তবে গোপনীয় কিছু নয়। তাঁর স্ত্রীও দিদির বন্ধুই। ওরা তিনজনে নানা জায়গাতে বেড়াতে যায়, সিনেমাতে যায়, এই আর কী।

তুমি কি আজ বাড়ি ফিরবে না?

ফিরব তো। আপনার সঙ্গে কথা বলতে খুব ভালো লাগে।

–আমার সঙ্গেই কথা বলতে ভালো লাগে বলে নয়, মাঝে মাঝে সব মানুষকেই কথাতে পায় কিন্তু পেলে কী হয়? কথা বলার মানুষ তো বেশি পাওয়া যায় না।

ঠিক বলেছেন আতশদা।

তা ছাড়া, ওয়েভ লেংথ-এরও একটা ব্যাপার থাকে। তুমি তো গান গাও। স্কেলের ব্যাপারটা তো বোঝো। তুমি যদি ‘জি’ শার্প-এ কথা বলো তবে যে, তোমার কথা শুনবে তার স্কেলকেও ‘জি’ শার্প-এই নামিয়ে আনতে হয়। তা না করতে পারলে একজনের বলা কথা অন্যের পায়ের কাছে গিয়ে পড়ে, নইলে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায়। জীবনে একটাই ট্র্যাজেডি। এক-ই স্কেলে কথা বলা মানুষ খুব বেশি পাওয়া যায় না।

বাঃ কী সুন্দর করে কথা বলেন আপনি। তাই তো আপনার সঙ্গে কথা বলতে, এত ভাল লাগে।

বলেই, হাতঘড়ির দিকে চেয়ে বলল, না; এবার বাসের সময় হল। চলি আতশদা।

এসো।

একটা ফলসা-রঙা কটকি শাড়ি পরেছে কাদম্বিনী। বাটিকের ব্লাউজ, ফলসার ওপরে সাদা কাজ করা। ব্লাউজটা ছোটোহাতা। দু-বেণি করেছে। চোখে কাজল। কাদম্বিনী মাথাতে একটি কদমফুল গুঁজেছে। সুগন্ধি মেখেছে ভালো, কিংবা চুলের তেলও হতে পারে। এলিন’ হবে, ভারি সুন্দর গন্ধ। কাদম্বিনী যতক্ষণ ছিল ততক্ষণ, ঘরটা তার অস্তিত্বে ভরে ছিল। আতশ ভাবছিল, মেয়েদের মধ্যে বিধাতা এমন কিছু উপাদান দিয়েছেন যা, একজন পুরুষের জীবনকে পূর্ণ করে। সে-নারী স্ত্রীই হোক, কী বান্ধবী, কী সহকর্মী। ঝগড়াটে মেয়ে আতশ একদম সহ্য করতে পারে না। মেয়েরা চেঁচিয়ে কথা বললে বা ঝগড়া করলে আতশের সব রোমান্টিকতা চুরমার হয়ে যায়। ভীষণ-ই বিরক্ত বোধ করে ও। সংসারে তেমন মেয়েও আছে কিছু। কী আর করা যাবে!

কাদম্বিনীই শেষে গেল। কাদম্বিনী চলে যাওয়ার একটু পরেই অঙ্গুল থেকে বাসটা হর্ন দিতে দিতে এসে বাস-রাস্তাতে দাঁড়াল। কাদম্বিনী নিশ্চয়ই পৌঁছে গেছে এতক্ষণে। স্কুলের নাইটগার্ড আর ঝাড়ুদারকে প্রয়োজনীয় কিছু কথা বলে সেও উঠল। হেঁটে চলল বাড়ির দিকে। তাড়াতাড়ি পা চালাল। কাদম্বিনী ঠিক-ই বলেছিল, খুব জোর বৃষ্টি আসবে।

আতশ ভাবছিল, কাদম্বিনী তার মেস-এ গিয়ে কী করবে? ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে কাজ করা একটি মেয়ে, পোস্ট অফিসে কাজ করা একটি মেয়ে আর কাদম্বিনী এই তিনজনে মিলে মেস করে থাকে। ওঁদের দুজনের বয়স হয়েছে, মানে মাঝবয়েসি। পাকাবাড়ি নয়। হেঁচা বেড়ার বাড়ি–মাথায় খড়ের চাল। দু-টি শোয়ার ঘর। একটি ছোটো আর অন্যটি বড়ো। রান্না খাওয়ার জন্যে একটি ঘর। ছোটো রান্নাঘর। বারান্দাও আছে একটি। কাদম্বিনী একা থাকে ছোটোঘরটিতে। একটি স্থানীয় মেয়ে আছে। ভোরে আসে, রাতে ওদের রান্না করে দিয়ে সে চলে যায়। নন্দিনী-নালার পাশের তৈলাতে তার মাসি কাজ করে। রাতে তার নিজের বাড়ি ফিরে সে, রাতের রান্না করে। দুপুরে তার স্বামী যা-হোক কিছু ফুটিয়ে নেয়। সকালের জলখাবার, দুপুরের খাওয়া এবং বিকেলের চা-টা কাদম্বিনীদের সঙ্গেই খায়।

এতকথা জানে আতশ কারণ, ওই তৈলাটি অঙ্গুলের বিমলজেঠুর। উনিই বলে দিয়েছিলেন যে, সময় পেলে গিয়ে খোঁজখবর নেবে। ফলের গাছগুলো বড়ো হয়ে গেছে কিন্তু অন্য ফসল, সরষে, তিসি, মটরশুটি, কচু, শুটি এইসব, যখনকার যা। বিমলজেঠু মাসে একবার করে আসেন তাঁর অ্যাম্বাসাডার গাড়ি নিয়ে। লোকজনের মাইনেপত্র দিয়ে যান, কলাটা, মুলোটা, লেবুটা নিয়ে যান। আমের সময়ে আম। আতশকেও দিয়ে যান গাড়ি ঘুরিয়ে এসে।

আতশ একদিন পুরুণাকোটে গিয়ে কাদম্বিনীদের মেস-এ ঘণ্টা দুয়েক ছিল। ছুটির দিন ছিল। খুব আপ্যায়ন করেছিল কাদম্বিনী এবং তার সঙ্গিনীরা। এঁচড়ের ডালনা, থোকার ডালনা এবং টিকরপাড়া থেকে আনা পাকালাল, গোঁফআলা মহাশোল মাছভাজা এবং তার কালিয়াও খাইয়েছিল। খাওয়ার পর পোড়াপিঠা। মধুরেণ সমাপয়েৎ।

এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ি পৌঁছোতেই বাইধর বলল, গদাধরদাদা দু-বার এসে ফিরে গেছে। আবারও আসবে বলেছে। খুবই জরুরি দরকার। স্কুলে আতশ কারো সঙ্গেই দেখা করে না। তাই সাহস করে গদাধর স্কুলে যায়নি।

শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সারাবছর-ই ও দু-বার স্নান করে। বাইধর স্নানঘরে গরম জল, লুঙ্গি, বাড়িতে পরার খদ্দরের ফতুয়া, তোয়ালে এসব দিয়ে দিয়েছে। আদা আর বিটনুন দিয়ে এক কাপ চা খেয়েই আতশ স্নানে গেল।

স্নান থেকে বেরোতে-না-বেরোতে বাইরে গদাধরের গলা পেল। বাইধর ততক্ষণে তাকে বারান্দাতেই বসিয়েছে। বসিয়ে চা খাবে কি না জিজ্ঞেস করছে। গদাধর বলছে, কিছুই খাবে না, বাবুর সঙ্গে দেখা করেই সে চলে যাবে।

আতশ পায়ে চটি গলিয়ে বারান্দাতে এসে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার গদাধর? এই নিয়ে তিনবার এলে?

গদাধর বলল, আমার বড়ো বিপদ বাবু। মেয়েটাকে বোধ হয় বাঁচাতে পারলাম না।

কী হলটা কী?

ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া। পাঁচদিন জ্বর।

ওষুধ দিয়েছ? সুঁই-ছুঁই?

পুরুণাকোটের হাসপাতালের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিলাম। তিনি ‘লারিয়াগো’ বলে একটা ওষুধ দিয়েছিলেন। জ্বর আজও না কমাতে সাইকেলের পেছনে মেয়েকে বসিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলাম।

সাইকেলে করে গেল কী করে অতজ্বর নিয়ে? কত বয়স তোমার মেয়ের?

এগারো বছর বাবু। আমার ছ-বছরের ছেলে ক্যারিয়ারের পিছনে বসে দিদিকে ধরেছিল।

তারপর? হাসপাতালে কী হল?

ডাক্তারবাবু বললেন, ফ্রি বেড় নেই। তিনটি মোটে ফ্রি বেড–সব ভরতি।

তা পেয়িং-বেড-এ ভরতি করালে না কেন?

ডাক্তারবাবু দু-হাজার টাকা চাইলেন। বললেন, তাঁর ফি, ওষুধ ইঞ্জেকশনের খরচ, বেডের ভাড়া বাবদ ওই টাকা অগ্রিম দিতে হবে। আমি অত টাকা কোথা থেকে পাব বাবু? ডাক্তারবাবু বললেন, তোমার মেয়ের লিভার নষ্ট হয়ে গেছে জ্বরে। হেপাটাইটিস না কী যেন হয়ে গেছে। মেয়েকে বাঁচানো মুশকিল।

এতকিছু বলেও ভরতি করলেন না?

না বাবু।

তারপর?

ওই অবস্থাতে তো আবার পাহাড়ি পথে চড়াইয়ে সাইকেলে তাকে নিয়ে যাওয়া যায় না। তাই আমাদের-ই গোস্নানির এক কাবাড়ির বাড়িতে তাকে আর ছেলেকে রেখে টাকার জোগাড়ে বেরিয়ে পড়েছি আমি বিকেল চারটেতে।

জোগাড় হয়েছে টাকা?

হয়েছে। আড়াইশো টাকা। তা ছাড়া আমার বাড়িতে যা, ছিল সব-ই নিয়ে এসেছিলাম সঙ্গে করে।

কত টাকা?

সাড়ে তিনশো টাকা।

আমার বাড়িতে এগারো-শো টাকা মতো হবে। টাকার বেশি প্রয়োজন হয় না। সোমবারে পুরুণাকোটের পোস্ট অফিস থেকে তুলব। সাড়ে তিন-শো আর আড়াই-শো ছ-শো আর আমার এগারো-শো, সাড়ে সতেরো-শো টাকা হল।

বলেই বাইধরকে ডেকে বলল, এই তোর কাছে কত টাকা হবে?

ষাট টাকা আইজ্ঞাঁ।

তা তোর ষাট টাকাটাও দে। সোমবারে তোকে দিয়ে দেব।

বলেই, মোটরসাইকেলটা আর টর্চটা নিয়ে বারান্দা থেকে নামল আতশ। গদাধরকে বলল, তোমার সাইকেলটা এখানেই রেখে যাও।

লুগা-পটা বদল করিলানি আপুনি বাবু?

না। সময় নেই কাপড় বদলাবার। বিলিরুবিন কত তা কি বলেছে ডাক্তার?

সেটা কী জিনিস বাবু?

রক্ত পরীক্ষা করেছিল ডাক্তার?

না, পয়সাই তো দিতে পারিনি। রক্ত নেবে কেন?

হুঁ। এই হাসপাতাল কি সরকারের?

হুঁ আইজ্ঞা। পঞ্চায়েত চালায়।

হুঁ।

সেগুন বনটার কাছে আসতে-না-আসতেই তুমুল বৃষ্টি নামল। ওরা দু-জনে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল। মোটরসাইকেলের হেড লাইটের আলোতে বৃষ্টির ফোঁটা ইলিশ মাছের আঁশের মতো চকচক করতে লাগল। বৃষ্টির সঙ্গে হাওয়ার দাপটও কম ছিল না। ভিজে গায়ে শীত করতে লাগল আতশের।

মিনিট পনেরো জোরে বাইক ছুটিয়ে যাওয়ার পরে, সামনে পুরুণাকোট বাজারের আলো দেখা গেল। আতশ বলল, চলো, আগে মেয়েটাকে তুলে নিই তারপর হাসপাতালে যাব।

যা ভালো মনে করবেন আপনি।

পুরুণাকোট থেকে টুল্টবকার দিকে যাওয়ার পথে বনদপ্তরের ডানদিকে যে, ছোটোবস্তিটি আছে তার-ই একটি ঘরে গিয়ে ‘দশরথ দশরথ’ করে ডাকতে লাগল বাইধর। ওই অন্ধ বৃষ্টির মধ্যে একটা ঝুপড়ির দরজা খুলে গেল। গদাধর নেমে ভেতরে গিয়েই দশরথের সঙ্গে মেয়েকে ধরে ধরে এনে মোটরসাইকেলের পেছনে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বসল। তার ছেলেও সঙ্গে সঙ্গে এসেছিল। গদাধর বলল, তুই এখন এখানেই থাক। আমরা দিদিকে হাসপাতালে দিয়ে ফিরে আসব।’

হাসপাতালের লাগোয়াই ডাক্তারের কোয়ার্টার। তিনি বসার ঘরে লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে বসে, টি. ভি. দেখছিলেন।

আতশ শুনল, তিনি কাজের ছেলেটিকে বলছেন, যারে পিল্টবা। কাঁই আসিলা এমিতি দুর্যোগমধ্যে? তাঁকু কহি দে কালি সকালেরে আসিবাকু।

ছেলেটা দরজা খুলে ওই কথা বলবার আগেই আতশ বাইকে গদাধর আর তার মেয়েকে বসিয়ে রেখে ভেতরে ঢুকে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, পম্পাশর থেকে একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছিল বিকেলে গদাধর মোহান্তি–ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার রোগিণী–ফ্রি বেড-এ জায়গা নেই বলে আপনি ভরতি করেননি।

ডাক্তার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তারজন্যে কি আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে?

আমি করতপটা প্রাইমরি স্কুলের হেডমাস্টার ডাক্তারবাবু।

সে আপনি কটকের র‍্যাভেনশ কলেজের প্রিন্সিপালও হতে পারেন। টাকা ছাড়া তো আমি পেয়িং-বেডে ভরতি করতে পারি না।

টাকা এনেছি ডাক্তারবাবু। মেয়েটা বাইরে আমার মোটরবাইকে ভিজছে। এখন-ই ভরতি না করে নিলে হয়তো মরেই যাবে। দয়া করে একটু আসুন।

এই দুর্যোগে যাব কী করে? আপনারা হাসপাতালে যান, আমি জামাকাপড় বদলে ছাতা নিয়ে যাচ্ছি।

আতশ মোটর বাইকে ফিরে গিয়ে হাসপাতালে পৌঁছোল। ওয়ার্ড বয়কে বলল, এখুনি পেশেন্টকে ভরতি করে নিতে। যে দু-জন নার্স ডিউটিতে ছিলেন তাঁদেরও বলল।

মেয়েটা একেবারে নেতিয়ে গেছিল। গায়ে আগুনের মতো জ্বর। হুঁশ নেই কোনো।

একজন নার্স বলল, বিকেলেই তো এসেছিল। চোখ দেখে মনে হল, জণ্ডিস একেবারে গেড়ে বসেছে। বিলিরুবিন কত তা কে জানে! এখানে তো রক্ত পরীক্ষা করার কোনো বন্দোবস্ত নেই। রক্ত আমরা নিতে পারি কিন্তু পরীক্ষা করাতে হবে সেই অঙ্গুলে কী বৌধ-এ গিয়ে। তাও রাতে তো কোনো ক্লিনিকাল ল্যাবরেটরি খোলা পাবেন না। সকাল সাতটাতে খুলবে।

তারপর বলল, টাকা এনেছেন?”

আতশ বলল, এনেছি কিন্তু দু-হাজারের কিছু কম আছে। আমি এখুনি গিয়ে আড়াই-শো নিয়ে আসছি একজনের কাছ থেকে।

তারপর বলল, আমি করতপটা স্কুলের হেডমাস্টার, আতশ দাস।

নার্সটি বলল, ও ও ও–আপনার কথা অনেক শুনেছি কাদম্বিনীর কাছে। আমি তো ওদের মেসেই থাকি। ফরেস্টের দিদিমণি রেঢ়াখখালে বদলি হয়ে গেছেন সেই জায়গাতে আমি ঢুকেছি। আপনি কি কাদম্বিনীর কাছ থেকেই টাকা আনতে যাচ্ছেন?

ঠিক ধরেছেন।

আপনি যান। আমি মেয়েটিকে ভরতি করে নিচ্ছি। নিচ্ছি বটে কিন্তু বাঁচার আশা কম।

রোগিণীর, যদিও সে বেঁহুশ এবং তার বাবার সামনে, ভরতি না করেই ‘বাঁচার আশা কম’ –যিনি বলেন তিনি কীরকম নার্স কে জানে!

ওদের ভেতরে দিয়ে আতশ কাদম্বিনীদের মেস-এর দিকে বাইক ছোটাল। কাদম্বিনীরা দু জনে বসে গল্প করছিল। লুঙ্গি পরে ভিজে চুপচুপে হয়ে আতশকে দেখে খুব-ই অবাক হল।

আতশ বলল, আমাকে কিছু টাকা ধার দিতে পারো? সোমবারেই ফেরত দিয়ে দেব।

কত টাকা? বেশি টাকা তো নেই। তোমার কাছে কত আছে রেখাদি?

তিন-শো মতো হবে।

আমার কাছেও তাই। এক-শো টাকা রেখে দিয়ে পাঁচশো টাকা দিচ্ছি। হবে তত এতে? এই দুর্যোগের মধ্যে টাকার কী দরকার হল?

আতশ সংক্ষেপে বলল, যা বলার।

তারপর বলল, সোমবার স্কুলের পরে বিস্তারিত বলব। এখন চলি। অনেক ধন্যবাদ।

হাসপাতালে ফিরতেই ডাক্তার বললেন, বাকি টাকাটা এনেছেন?

হ্যাঁ। এই নিন বলে, আড়াইশো টাকা দিয়ে দিল ডাক্তারকে।

ডাক্তার বললেন, রোগী যদি বাঁচে তবে, কাল-পরশু আরও টাকা লাগবে।

কত?

আতশ শুধোল।

তা কী করে বলব আগে থেকে। পঞ্চাশ এক-শোও হতে পারে, এক দু-হাজারও হতে পারে।

আপনার নামটা জানতে পারি ডাক্তারবাবু?

কেন পারবেন না? আমার নাম গণপতি বিশ্ববল। নাম জানতে চাইছেন কেন? কমপ্লেইন করবেন নাকি?

আতশের মনে হল যে বলে, কমপ্লেইন করলেই যদি কাজ হত এই দেশে তবে কি আপনার মতো হৃদয়হীন ডাক্তারের চাকরি থাকত? শতবার চাকরি যেত। কমপ্লেইন করলে কোনো লাভ হয় না–তা ছাড়া কমপ্লেইন করার সাহসও হয় না, এইসব গরিব অসহায় মানুষদের। তাই এরা নীরবে মরে এসেছে যুগের পর যুগ। এ এক, আশ্চর্য অচলায়তন। এর ই নাম ‘ভারতবর্ষ।

আতশ মুখে না বলে মনে মনে বলল, কবে আসবি তোরা এম. সি. সি.-র তরতাজা ছেলেরা? জনযুদ্ধের যোদ্ধারা? মেধাবী নকশালেরা চিতা থেকে উঠে? কবে ধড়াধ্বড় করে লাশ ফেলবি এই জন্তুজানোয়ারগুলোর, এই বিবেকহীন, হৃদয়হীন অসৎ আমলাদের? শিক্ষা, চিকিৎসা, সমাজসেবা সব জায়গাতে এই এক-ই ছবি। সব রাজ্যেই। বাঙালি বলে আতশের পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে গর্বিত হওয়ার বিন্দুমাত্রও কারণ নেই। বিহার ওড়িশা পশ্চিমবঙ্গ–কোনো তফাত নেই। লজ্জা! লজ্জা!! লজ্জা!!!

তোমার মেয়ের নাম কী? শুধোল গদাধরকে।

হেমা। হেমামালিনীর নামে নাম রেখেছিল আমার বউ অঙ্গুলে হেমামালিনীর সিনেমা দেখে। লজ্জিত মুখে বলল, গদাধর’। নার্সটি চেনা বেরোতে একটু ভরসা পেল আতশ এবং গদাধরও।

ও বলল, আপনারা চলে যান। এখন আমাদেরও কিছু করার নেই, আপনাদেরও না। কাল সকালে এসে খোঁজ নেবেন। কোনো ওষুধ যদি আনতে হয় অঙ্গুল থেকে। কাল তো রবিবার, তবে কিছু ওষুধের দোকান খোলা থাকে। আমাদের হাসপাতালে থাকলে তো ভালোই। কিছু ওষুধ আমাদের রাখতেই হয়। তবে ফুরিয়ে গেলেও রিপ্লেসড হতে অনেক সময় নেয়। বোঝেন-ই তো সরকারি ব্যাপার!

ডাক্তার গণপতি বিশ্ববল নার্সকে ধমক দিয়ে বললেন, অতকথা কীসের? নিজের কাজ করো। স্যালাইন দাও, প্রেশার চেক করো, জ্ঞান ফিরলে কী কী কষ্ট জিজ্ঞেস করো পেশেন্টকে। তোমার কি আজ নাইট ডিউটি?

না স্যার।

মল্লিকা আসেনি?

সময় হয়নি।

এলেই কেস ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে তারপরে যেয়ো। রাতে নিতান্তই প্রয়োজন না পড়লে যেন, আমাকে না ডাকে। আজ কাজল আর শাহরুখ খানের একটা ছবি আছে অমিতাভ আর জয়া বচ্চনও আছে।

নার্স বলল। “কভি খুশি কভি গম’? আমরাও দেখব।

আতশ বাইরে বেরিয়ে বলল, তুমি আমার সঙ্গেই ফিরে চলো করতপটা। কাল ভোরে চা খেয়ে তোমার সাইকেলটা নিয়ে চলে এসো। ছেলে আজ তোমার সহকর্মী দশরথের বাড়িতেই থাকুক। চলো, তাকে বলে যাই সে-কথা। আর এই সাড়ে তিন-শোটা টাকা তোমার কাছেই রাখো গদাধর। কখন কী দরকার হয়।

আমার জন্যে আপনি টাকা ধার করলেন বাবু?

তাতে কী হয়েছে? এখন আমাদের প্রয়োজন।

.

বৃষ্টিটা তখনও হয়ে যাচ্ছিল ‘টিপ টিপ’ করে কিন্তু গদাধরের সহকর্মীর বাড়ি পৌঁছোবার আগেই থেমে গেল। সহকর্মীকে যা-বলার বলে, ছেলেকেও বুঝিয়ে বলে গদাধর এসে বসল মোটরসাইকেলের পেছনে।

বড়োরাস্তাতে পৌঁছে বাইকের মুখ ঘুরিয়ে চলল উলটোদিকে। কাদম্বিনীদের মেস-বাড়িতে পোঁছে কাদম্বিনীকে বলল, তোমাদের নতুন অতিথির নাম কী? মানে, নার্সটির?

কাদম্বিনী বলল, মালতী।

তারপর, মোটরসাইকেলে বসেই যা বলার বলল কাদম্বিনীকে। তারপর বলল, রাতে যদি কোনো ক্রাইসিস হয় তবে, আমাকে কি কোনো খবর দেওয়া সম্ভব হবে? এখানে কি কোনো পাবলিক টেলিফোন বুথ আছে?

না, তা নেই। তবে হাসপাতালেই আছে। আপনি যাওয়ার সময়ে মালতাঁকে নাম্বারটা জানিয়ে যান, যে সিস্টার নাইট ডিউটিতে থাকবে তাকে ও দিয়ে রাখবে। মালতীর ডিউটি আটটাতে শেষ হয়ে যাবে। ও এলে, ওর কাছ থেকে জানব রোগিণীর অবস্থা কেমন। তেমন হলে আমি হঠবাবুর বাড়িতে গিয়ে সেখান থেকে আপনাকে ফোন করে দেব।

হঠবাবু কে?

হঠবাবু কটকের শূরবাবুদের জঙ্গলের মুহুরি ছিলেন। রিটায়ার করে এখন, পুরুণাকোটেই বাড়ি করে থিতু হয়েছেন। তিনি খুব বুড়ো হয়ে গেছেন কিন্তু তাঁর দুই জোয়ান ছেলে আছে। বাড়িঘর এবং পি. ডব্লু. ডি-র কনট্রাক্টারি করেন। আমাকে ওঁদের বাড়ির সকলেই চেনে। মাঝরাতেও আমি গিয়ে ফোন করতে পারি।

দ্যাখো, মাঝরাতে গেলে একা যেয়ো না। দিনকাল ভালো নয়।

তা তো জানি আতশদা। গেলে, লালুকে সঙ্গে নিয়ে যাব।

লালু কে? এখন তো দেশে একজন-ই লালু আছে বলে জানি।

কোন লালু?

জাতীয় ভাঁড়।

না। ও আমাদের দো-আঁশলা কুকুর লালু। বড়োবাঘের সঙ্গেও টক্কর দিতে জানে আমাদের লালু।

ঠিক আছে।

করতপটার দিকে বাইক চলতে থাকল। বৃষ্টিটা থেমে গেছে।

লালু যাদব কিন্তু বেশ লোক। গদাধর বলল।

সেটা ঠিক। এদেশে এরকম নেতার-ই দরকার। রেলে মাটির ভাঁড়, খদ্দর চালু করার কথা তো আর কারো মনে হয়নি। অথচ মনে হওয়া অনেকদিন আগেই উচিত ছিল।

সকলে বলে, লালু চোর।

চোর কোন নেতা নয়? তুমি তো সব কথা জানো না, নরসিংহ রাও-এর ঘরে যে, স্যুটকেস-ভরা কোটি টাকা দিয়ে এল হর্ষদ মেহতা তার কী হল? সি. বি. আই., কোর্ট, সবাই তো আছে কিন্তু তারা আছে সাধারণের হেনস্তার-ই জন্যে। আজ অবধি একজন নেতারও জেল হয়েছে কি? তবে আমাদের ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী সৎ। অবশ্য ওঁর টাকার দরকার-ই বা কী? বাবা যা রেখে গেছেন, তাতেই তো কয়েক পুরুষের চলে যাবে। তবে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী ‘ওড়িয়া’ বলতে পারেন না, এটা একটা ভাববার মতো বিষয় বটে। উনি তো সাহেব-ই। ইদানীং খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি ছাড়া কিছু পরেন না। আমাদের নেহরুসাহেব আর পাকিস্তানের জিন্নাসাহেবও তো থ্রি-পিস-স্যুট পরা সাহেব-ইছিলেন। জিন্না সাহেব তো একটিও ভারতীয় ভাষাও জানতেন না। না। উর্দু পর্যন্ত নয়। এই দেশের মহাদুর্ভাগ্য এই যে, ইংরেজদের তাড়িয়ে দিয়ে ইংরেজরাই-ইংরেজি শিক্ষিত ব্যারিস্টার, এম. বি. এ., ইকনমিস্ট এঁরাই দেশের দন্ডমুন্ডের কর্তা হলেন, যাঁরা দেশকে জানেন না, দেশকে ভালোবাসেন না, যাঁদের বিদ্যা সব পুথি নির্ভর–গুণের মধ্যে তাঁরা কেবল বক্তৃতা দিতে পারেন।

‘থ্রি-পিস-স্যুট’টা কী জিনিস বাবু?

তা জেনে তুমি কী করবে গদাধর? কিন্তু তোমার টনক-ই যদি নড়ল তবে এতদেরি করে নড়ল কেন? আগেই কেন হাসপাতালে আনলে না মেয়েকে?

আগে তো বুঝতে পারিনি বাবু। আমাদের জ্বর-জ্বারি হলে উপোস করে শুয়ে থাকি দু-তিন দিন। জ্বর বেশি হলে মাথার নীচে বড়ো কচুপাতা দিয়ে ঢালু ঢালু জল ঢালি মাথাতে, মাথাতে খুব বেশিব্যথা হলে ঝাণ্ডুবাম’ ঘষে দিই একটু। ওষুধ আমরা পাবই বা কোথায়? ওষুধের খোঁজে হাসপাতালে আসতেও তো পাহাড়ে জঙ্গলে সাত কিলোমিটার নামতে-উঠতে হয়।

তোমাদের গ্রামে ক-ঘর মানুষের বাস?

গ্রামে তো আমি থাকি না। গ্রামে জমির দাম অনেক। গ্রাম থেকে আধ কিলোমিটার দূরে লবঙ্গী যাওয়ার পথের পাশে, বাবুর দেওয়া টাকাতে একগুঁঠ জমি বন্দোবস্ত করে বাঁশের হেঁচা বেড়া আর মাটি দিয়ে বাড়ি বানিয়েছি। দুটো ঘর একটা উঠোন। কাছেই ঝরনা আছে। বারোমাস জল থাকে।

বর্ষাকালেও সেই ঝরনার জল খাও? ঝরনার জলের পাশে-পাশে যা-জল জমে থাকে, তাতে মশারা ডিম পাড়ে। সেই মশা কামড়ালে বা সেই জল থেকে ম্যালেরিয়া হয়। ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া। আমার একবার হয়েছিল তাই জানি। বাবার সঙ্গে শিকারে গিয়ে জঙ্গলের ঝরনার জল খেয়েছিলাম। মাথাতে যে কী যন্ত্রণা! যার না হয়েছে, সে বুঝবে না। তোমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বা পোস্ট অফিসের অ্যাকাউন্ট নেই গদাধর?

এখানে ব্যাঙ্ক পোস্ট অফিস কোথায়? যে-পোস্ট অফিস আছে, তাতে টাকা রাখার বন্দোবস্ত নেই।

কে বলেছে নেই? আমি তো পোস্ট অফিসেই টাকা রাখি।

তারপর বলল, তবে তোমার সঞ্চয় রাখোটা কোথায়? কত বছর মুহুরির কাজ করছ তুমি পাল্টববাবুদের কাছে?

সে তো হল প্রায় পঁচিশ বছর।

কটকের জঙ্গলের ঠিকাদার শূরবাবুদের মুহুরি হঠবাবু যে-পুরুণাকোট শহরে বাড়ি করলেন। উনি পারলেন, তো তুমি কেন পারবে না?

হ্যাঁ? ওঁর আয় আর আমার আয়! শূরবাবুরা মস্ত বড়ো ঠিকাদার। তা ছাড়া, হঠবাবু তো তখনকার দিনের আই.এ. পাশ ছিলেন। শুনেছি ডি.এফ.ও সাহেবদের সঙ্গে ইংরেজিতে রীতিমতো দাবড়ে কথা বলতেন। নরেন শূর ক্কচিৎ-কদাচিৎ আসতেন জঙ্গলে–নিলামে জঙ্গল ডাকা থেকে রাস্তা বানানো, কাঠ-কাটা, কাঠ শহরে পাঠানো ইত্যাদি সব কাজ-ই হঠবাবুই করতেন। পাল্টববাবুদের কাছে মুহুরির কাজ করার আগে কিছুদিন হঠবাবুর আণ্ডারে মেট এর কাজ করেছিলাম। কাজ তো সেখানেই শিখি। ওঁর সঙ্গে আমার তুলনা!

তোমার সঞ্চয়ের টাকা কোথায় রাখো তা তো বললে না!

আমার আবার সঞ্চয়। আমার হিসাব সব পাল্টববাবুদের ব্যবসার ক্যাশবাবু জগবন্ধু পানিগ্রাহীর হাত-চিঠাতে লেখা থাকে। বছরের প্রথমে কাজ শুরু হওয়ার আগে কালীপুজোর পরে একবার করে কটকে গিয়ে হিসাব দেখে আসি–টাকার দরকার পড়লে কিছু টাকা উঠিয়েও আনি। আপনার কাছে আজ যা-ধার হল, তাও সেই সময়েই শোধ করে দেব। তখন বউকেও কিছু টাকা দিয়ে দিই–সংসার খরচের জন্যে। তেমন দরকার হলে ট্রাক-ড্রাইভার মারফত জগবন্ধুবাবুকে চিঠি পাঠাই–ট্রাক-ড্রাইভার এনে দেয় টাকাটা। সঙ্গে হাত-চিঠাটাও নিয়ে আসে, তারিখ দিয়ে সই করে দিই।

তা গত পঁচিশ বছরে কত টাকা জমেছে তোমার?

সে অনেক টাকা।

তবু, কত টাকা?

সে দশ-পনেরো হাজার টাকা তো হবেই।

দশ আর পনেরো হাজার কী এককথা হল নাকি?

না, তা হল না, তবে সব খরচাখরচ বাদ দিয়েই তো জমেছে। আমার নিজের জন্যে তো সারাবছর আমার খরচ-ই হয় না। থাকাটা, খাওয়াটা, লুগা-পটাটা মানে লুঙ্গি শার্ট গামছা এসব তো বাবুরাই দেন। একওঁঠ জমি কেনার টাকা, বাড়ি তৈরির টাকা–সে নয় নয় করে তো হাজার চার-পাঁচ হবেই–সেটাও তো তাঁরাই দিয়েছেন।

তোমার মাস-মায়না কত?

সে তো আমি বলতে পারব না বাবু। মানে, আমি জানি না। মেজোবাবু বলেন, আমি বেঁচে থাকতে তোর চিন্তা কী রে গদাধর? কখন কী প্রয়োজন আমাকে শুধু বলবি। তা আমার তেমন কোনো প্রয়োজন-ই নাই, বলব কী? গত বছর একটা ফিলিপস-এর ট্রানজিস্টার কিনেছিলাম বউ-এর জন্যে। বিবিধ ভারতী আর এফ. এম. শুনবে বলে বায়না ধরেছিল।

তোমার ছেলে-মেয়েকে আমার স্কুলে পাঠাও-না কেন?

কী হবে? গরিব লোক আমরা। পড়াশুনো দিয়ে হবেটা কী? আমি মরলে, ছেলে কুড়ুল কাঁধে নিয়ে পাল্টববাবুদের জঙ্গল-ক্যাম্পে শামিল হয়ে যাবে আর মেয়েটা এখন-ই রাঁধতে বাড়তে শিখে গেছে-পনেরো বছর হলেই ওর বিয়ে দিয়ে দেব।

দূর থেকে করতপটার আলো দেখা যাচ্ছিল। যে-নালাটা পথটাকে কেটে গেছে তার ওপরে একটা কজওয়ে আছে। সেখানে একটা বড়ো মার্কারি ভেপার ল্যাম্প জ্বলে। গত বছরে পি, ডব্লু. ডি. থেকে লাগিয়েছে। দু-পাশের পথেই বহুদূর থেকে সেই আলো দেখা যায়। বৃষ্টিস্নাত, বনের মধ্যে একটা উজ্জ্বল বাদামি-রঙা রহস্যের সৃষ্টি করে এই আলো।

এসে গেছে ওরা। বড়োরাস্তা ছেড়ে ওর বাড়ির দিকে বাইকের মুখ ঘুরিয়ে আতশ বলল, আজকালকার দিনে পড়াশুনো না করলে কোনো উপায়ই নেই। মানে, কোনো ভবিষ্যৎ। তোমাদের দিন শেষ হয়ে গেছে গদাধর। তোমার সঙ্গে হঠবাবুর তফাত দেখেও কী একথা বোঝোনি গদাধর? ছেলে-মেয়েকে আমার স্কুলে পাঠাও।’

জঙ্গলের মধ্যে পথ-ই তো প্রায় চার-পাঁচ কিলোমিটার তারপর বড়োরাস্তাতে পড়েও এতখানি। সারাটা দিনই তো ওদের হেঁটে হেঁটেই কাবার হয়ে যাবে। বাড়ির কাজ, পড়াশুনো এসব করবে কখন?

কথাটা ভাববার মতো বটে। শুনে, আতশ চুপ করে রইল।

গদাধর বলল, তার ওপরে স্কুলের মাইনেও তো আছে। সে কত টাকা হবে?

তাদের দুজনের মাইনে না-হয় আমিই দিয়ে দেব। নয় স্কুলের মালিক মাধববাবুকে বলে মকুব করিয়ে দেব।

বইপত্র খাতা এসবের খরচও তো আছে। স্কুলে এলে তখন জামাকাপড় পরে তো আসতে হবে-সে জামাকাপড় তো নোংরা থাকলেও চলবে না।

তারপর-ই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গদাধর বলল, নাঃ এ-জন্মে হবে না বাবু। পরের জন্মে দেখা যাবে। যদি ভাগ্য করে এসে থাকি তাহলে পরজন্মে পড়বে স্কুলে আমার ছেলে মেয়েরা।

.

বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়াতে বাড়ি ফিরে আবার চান করতে হল গরম জলে। বাইধর শুকনো লুঙ্গি আর জামা দিল গদাধরকে। সেও পরিষ্কার হয়ে নিল। তারপর বাইধর গরম গরম খিচুড়ি, পেঁয়াজি আর ডিমভাজা করে দিল আতশদের।

রাতে দু-বার চান করার জন্যেই বোধ হয় আতশের একটু জ্বরভাব হয়েছিল। পুবে আলো ফুটতে-না-ফুটতেই সাইকেলে চলে গেছিল গদাধর। আতশের ঘুম ভাঙল সকাল সাতটা নাগাদ। আজ স্কুল আছে। স্কুলে বসে দশটাতে, পৌনে ন-টাতে জামাকাপড় পরে এককাপ চা খেয়ে সেও বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল পুরুণাকোটের হাসপাতালের দিকে।

হাসপাতালের সামনে একটু মাঠমতো আছে। দূর থেকেই দেখল যে, সেখানে গদাধর, গদাধরের ছেলে, তার নাম জিজ্ঞেস করা হয়নি কাল, এবং কাদম্বিনী চানটান করে স্কুলে যাওয়ার পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে।

আতশ যেতেই গদাধর কেঁদে তার পায়ের ওপরে পড়ল, তারপর কাটা-পাঁঠার মতো ছটফট করতে লাগল। বলল, মোর ঝিওটা চান্টিব গল্টবা বাবু, ঝিওটা চালি থলা। আপনংকু এত্বে টংকা বরবাদ হেল্টবা।

আতশ কাদম্বিনীকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

কাদম্বিনী বলল, মালতী সকালে ডিউটিতে গিয়েই ফিরে এসে আমাদের খবর দিল। ভোর পাঁচটাতে চলে গেছে মেয়েটা। কিডনি ফেল করে গেছিল জণ্ডিস-এ।

ডাক্তারবাবু কোথায়?

তিনি তো কোয়ার্টারেই আছেন। আসবেন ন-টা নাগাদ।

রাতে ডাক্তারবাবু ছিলেন না রোগীর কাছে?

না তো। উনি নার্সদের যা-যা করণীয় তা করতে বলেই চলে গেছিলেন।

ডাক্তারবাবু পৌনে ন-টার সময়ে এলেন সাদা অ্যাপ্রন পরে।

এসেই গদাধরকে বললেন, আরও দুইশত টংকা দিব লাগিব।

গদাধর তার পকেট থেকে টাকাটা বের করে দিল।

রোগীর কী হল?

আতশ ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল।

তাংকু টাইম হইথিলা, চালি থলে।

তারপর বললেন, আমরা তো ম্যাজিশিয়ান নই। সময়মতো আনলে কিছু করা যেত। শেষসময়ে আনলে আমরা কী করতে পারি? ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিচ্ছি। নিয়ে গিয়ে দাহ করুন। মরা বেশিক্ষণ রাখার কোনো বন্দোবস্ত এই ছোটো হাসপাতালে নেই।

গদাধর বলল, ওর মা একবার শেষদেখা দেখবে না?

আতশ বলল, ওকে তোমার বাড়িতে না নিয়ে গিয়ে, ওর মাকে এখানে নিয়ে এলে হয়? বলেই গদাধরের ছেলেকে বলল, তুমি আমার সঙ্গে চলল। তোমার মাকে বাইকের পেছনে বসিয়ে নিয়ে আসব। তুমি দাহ করার বন্দোবস্ত করো গদাধর।

গদাধরের যে-কাবাড়ি সহকর্মী ছেলেকে রাতে রেখেছিল সে এবং পুরুণাকোটের আরও দশ-পনেরোজন লোক জড়ো হয়ে গেল। সেই সহকর্মীই, যার নাম দশরথ, সঙ্গীদের নিয়ে নন্দিনী-নালার পাশের শ্মশানে চলে গেল কাঠ কাঠতে। অন্যরা বাঁশঝাড়ে গিয়ে বাঁশ কেটে তাড়াতাড়ি একটা চাকি তৈরি করে এনে গদাধরের মেয়েকে তাতে উঠিয়ে হাসপাতালের কম্পাউণ্ডে একটি তেঁতুলগাছের নীচে শুইয়ে রাখল। মেয়েটির মুখে গভীর ক্লান্তির ছাপ। বড়ো ক্লিষ্ট। দেখে মনে হচ্ছিল তার মা বোধ হয় একটু আগে তার চুলটা বেঁধে দিয়েছে। শুয়ে রইল গদাধরের মেয়ে হেমা, হেমামালিনীর নামে যার নাম। যে বেঁচে থাকলে, পনেরো বছর বয়সে বিয়ে দিত গদাধর।

আতশ গদাধরের ছেলেকে নিয়ে চলে গেল। সে-ই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে পম্পাশরে। যাওয়ার সময়ে আতশ শুনল দু-তিনজন লোক বলাবলি করছে, এই ডাক্তারটাকে একদিন খুন করতে হবে। এ ছাড়া এই হারামির আর কোনো ওষুধ নেই।

আমরা এত বড়ো বড়ো গাছ কুড়ল দিয়ে কাটি আর এই ষড়াকে কোপাতে পারব না?

একটি অল্পবয়েসি রক্তগরম কাবাড়ি বলল। তার শালপ্রাংশু চেহারা।

গদাধরের ছেলে তাকে দেখে ভেঙে পড়ল। বলল, ভীম্বকাকা-আ-আ।

ছেলেটার নাম ভীম্ব। জানল আতশ। আতশের চোয়াল শক্ত হয়ে এল। ভাবল, এরা। উত্তেজিত হয়ে মুখে এসব বলছে স্পষ্ট কিন্তু এদের মধ্যে কারোরই সাহস হবে না, ওই ডাক্তারকে মারবার। ডাক্তারকে মারলে থানা-পুলিশ তো হবেই, ওদের সারাজীবন জেলে পচতে হবে। নয়তো ফাঁসিতে ঝুলতে হবে। কোনো আইন-ই গরিবের পক্ষে নেই। হেমার মতো আরও কত রোগীকে অপার ঔদাসীন্যে এই ডাক্তার পরপারে পাঠিয়েছেন তা কে জানে! তার ওপরে আর্থিক অত্যাচার। যারা প্রায় না খেয়ে থাকে, তাদের কাছ থেকে এমন জবরদস্তি করে টাকা আদায় করা। মানুষে নিরুপায় হয়ে মেনে নেয়। টাকার তো কোনো রসিদ-টসিদও দিলেন না উনি। ফিরে এসে রসিদ চাইবে ও ঠিক করল।

তারপর ভাবল, বন্দুকটা তো এবারে নিয়ে এসেছে। তা দিয়ে বউনি এই বুড়োটাকে মেরে করলেই হল। ব্যাপারটা মাথায় থাকল, থাকবে আতশের। এই পুরুণাকোটের ডাক্তারকে খুন করেই বিপ্লব শুরু করবে ও।

কেহি রহি নাই
রহিব নাই
রহিব না ইট্টি।
এই ভব রঙ্গ।
ভূমিতলে স্বব্বে নিজ নিজ
অভিনয় সারি
বাহুরিবে কালবেলে।।

এই কবিতাটি আতশদের বাড়ির বুড়োমালি মাইচা মৌসা প্রায়-ই আবৃত্তি করত। বুড়ো মালির আসল নামটা কেউই জানত না। সে একটু মেয়েলি ছিল কথাবার্তাতে এবং চেহারাতেও, তাই সকলেই তাকে ‘মাইচা’ অর্থাৎ মেয়েলি বলে ডাকত। তিয়াসা বাড়ির বাগান-ই তার প্রাণ ছিল। থাকত সে একা ঢেনকানল যাওয়ার পথের পাশের এক কুঁড়েতে। বিয়ে-থা করেনি বা হয়নি। সারাদিন-ই থাকত আতশদের বাড়িতেই। বাবার খুবই প্রিয় ছিল সে। একেবারে রাতের খাওয়া সেরে সে, বাড়ি গিয়ে ঘুমোত। কাজের লোকদের কোয়ার্টারে কখনো রাত কাটাত না। অন্য কাজের লোকেদের বলত, বাবার জীবদ্দশাতেও অনেক কাজের লোক ছিল, আমার নিজের বাসা নেই, কী যে আমি তোদের মতো এখানে থাকব?’

কবিতাটির মানে হল, কেউই নেই, কেউই থাকবে না এখানে। থাকবে না। এই হল ভবের রঙ্গ। এখানে সকলেই নিজের নিজের অভিনয় সাঙ্গ করে একদিন এই রঙ্গভূমি ছেড়ে সময় হলেই চলে যাবে।

বাবা চলে গেছেন, মাইচা বুড়োও চলে গেছে। কিন্তু তাঁরা গিয়েছেন পরিণত বয়সে। গদাধরের মেয়েটার যাওয়াটা বড়ো অসময়ে হল। হেমামালিনীর নামে নাম রাখলে কী হয়, কোনোরকম অভিনয় করার সুযোগ পাওয়ার আগেই, সে চলে গেল। তবে ওই ডাক্তারকে আতশ দেখে নেবে। তার নাম কী বিশ্ববল যেন? ভুলে গেছে নামটা। সময় সুযোগমতো বোঝাঁপড়া করবে তার সঙ্গে আতশ।

স্কুলে আসতে খুব-ই দেরি হয়ে গেল। তবে কাদম্বিনী সময়মতো পৌঁছে সকলকেই খবরটা দিয়েছিল। রোজ একঘণ্টা আগে সে স্কুলে আসে, এ-কথা সব টিচারেররা, ওর ছাত্র ছাত্রীরাই জানে তাই কেউ কিছু মনে করেনি। দু-টি ক্লাস মিস হয়েছে ওর। অন্য টিচারেরা সে, দু-টি ক্লাস নিয়ে নিয়েছেন।

বাড়ি ফিরে স্নান করে আতশ শুয়েছিল। বাইধর সব শুনেছে, আতশের কাছে। ওরও মন খারাপ খুব।

গদাধরের বউ খুব-ই ছেলেমানুষ। তারও বোধ হয় পনেরো বছরেই বিয়ে হয়েছিল, যে বয়সে হেমার বিয়ে দেবে বলে ঠিক করে রেখেছিল গদাধর। দেখতে শুনতে ভালোই, তিরিশের নীচে বয়েস। সে কী করে ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়ে নিয়ে এই গভীর জঙ্গলবেষ্টিত গ্রামে বছরের অনেকগুলো মাস প্রোষিতভর্তৃকা হয়ে থাকে, তা কে জানে! জংলি জানোয়ারের তো অভাব নেই। হালকা পলকা বাঁশের কঞ্চির বেড়া ভেঙে বুনো শুয়োর বা বারা ও শজারুরা তো আসেই, এসে ফসল খেয়ে যায়। তা ছাড়া, মানুষদের মধ্যেও তো ‘জানোয়ার’ এর অভাব নেই। তা ছাড়া ওদের বাড়ি তো গ্রামেও নয়, গ্রামের বাইরে।

ডাল-টাল লাগালে হরিণ শম্বরও আসে। মটরশুটি লাগলে আসে ধাড়ি খরগোশগুলো।

এসব কথা জানে আতশ মাধবজেঠুর তৈলার মানুষদের কাছ থেকে। জঙ্গলের মধ্যের আবাদকে ওড়িয়াতে বলে “তৈলা’। বিমলজেঠু কখনো-কখনো অঙ্গুলের শিকারি বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। রাতে রাম আর খিচুড়ি খাইয়ে তাদের খুশি করে তাদের দিয়ে শুয়োর-শজারু মারিয়ে দিন কয়েকের জন্যে নিশ্চিন্ত হন। সেই বারা আর শজারুর মাংস গরিব মানুষগুলো মহানন্দেই খায়। সেই জমায়েতে রেঞ্জার সাহেবকেও ডেকে নেন। বিমলজেঠু নিজের খেতের ওপরে জানোয়ার মারলে বনের আইন লঙ্ঘিত হয় না। বজ্র আঁটুনি, ফসকা গেরো। তবে বিমলজেঠুর মুখেই শুনেছে যে, শিগগিরি ওসব অঞ্চল সাতকোশীয়া নণ্ড অভয়ারণ্য নামের এক অভয়ারণ্যের অধীনে চলে যাবে। তখন এখানে খরগোশ মারলেও জেলে যেতে হবে, ফাইনও হবে।

মহানদী তার উৎসমুখ থেকে বেরিয়ে চোদ্দো মাইল অর্থাৎ সাতকোশ পথ এক গভীর গন্ড দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। সেই গন্ডে বড়ো বড়ো রুই, মহাশোল মাছ এবং কুমির আর মেছোকুমিরের বাস। নদীর ওপারে টিকরপাড়া, যেখানে কুমির প্রকল্পও হয়েছে। নদী বা নদের এপারে পুরুণাকোট, বাঘবমুন্ডা, টুল্টবকা, লবঙ্গী, রায়গড়া ইত্যাদি জঙ্গল আর টিকরপাড়ার ঘাটে ফেরি পেরিয়ে ও পারে গেলে দশপাল্লা, বৌধ, ও ফুলবাণীর জঙ্গল। গদাধরের মুখে এপারে-ওপারের সেইসব ভীষণ গহন জঙ্গলের কথা শুনেছে আতশ কিন্তু এপর্যন্ত কোথাও যাওয়া হয়নি এক পুরুণাকোট হয়ে টিকরপাড়া যাওয়া ছাড়া। যাবে এবার পুজোর ছুটিতে। পুজোর ছুটি দেখতে দেখতে এসে যাবে। এবারে নাকি লবঙ্গীর জঙ্গল নিলামে নিয়েছেন পাল্টববাবুরা। জঙ্গলের গভীরে একটা নালার পাশে খড়ের ঘরের ক্যাম্প তৈরি হবে। সেখানে গিয়েই থাকবে তখন গদাধর। আতশও সঙ্গে যাবে।

শুয়ে শুয়ে নানা কথা ভাবছিল এখন সময়ে ফোনটা বাজল। কাদম্বিনী ফোন করেছে পুরুণাকোট থেকে। বলল, দাহ শেষ করে গদাধরদা এসে হাসপাতালে নার্সকে বলে গেছে যে, আজ আর আপনার কাছে যেতে পারবে না–ওর বউ-ছেলেকে নিয়ে ফিরতে হবে বাড়িতে। কাল আপনার সঙ্গে দেখা করবে। আপনি যে-টাকাটা দিয়েছেন তা কী করে শোধ করবে তাও তখন বলবে। পরশু সে নাকি কটকে যাবে ওর বাবুদের কাছ। বাবু যেন, কিছু মনে না করেন।

ফোন ছেড়ে দিয়ে আতশ ভাবছিল মানুষটার বিবেকের কথা। আতশ নিজে শবদেহ চিতায় ওঠানোর পরেই চলে এসেছিল। গদাধরের স্ত্রীর কান্না আর সহ্য করতে পারছিল না। তা ছাড়া আরও অনেকে তো সেখানে ছিল, যারা গদাধরের আপন লোক। যাদের সঙ্গে গদাধর স্বচ্ছন্দ বোধ করে। শত হলেও আতশের শ্রেণি তো বাবুর-ই শ্রেণি। যতই ও গদাধরের কাছের মানুষ বলে নিজেকে ভাবুক না কেন–তা কাকের ময়ূরপুচ্ছর-ই মতো হয়ে যায় নিশ্চয়ই ওদের কাছে। বিভিন্ন শ্রেণির এই বিন্যাসকে এক করে তুলতে আর কতদিন লাগবে কে জানে! আতশের জীবদ্দশাতে কি দেখে যেতে পারবে?

রিসিভারটা নামিয়ে রেখে যখন ফিরে এসেছিল তখন ফোনটা আবারও বাজল।

তুলতেই শুনল ও পাশ থেকে নন্দা বউদির গলা। চোরের মতো গলা।

আতশের সমস্ত মন বিতৃষ্ণায় ভরে গেল নন্দার গলা শুনেই। এক গভীর অপরাধবোধে ওর মন নতুন করে বর্ষার ঘন কালো মেঘের মতো হয়ে গেল।

নন্দা বউদি বলল, একটা এস. টি. ডি. বুথ থেকে বলছি। বাড়ি থেকে কী তোমাদের বাড়ি থেকেও তো এ-কথা বলা যেত না।

কী কথা?

এ-মাসে আমার হয়নি।

বিরক্ত গলাতে আতশ বলল, তার মানে?

মানে, আমি কনসিভ করেছি।

লজ্জাতে আতশের সারাশরীর রি রি করে উঠল। নলিনীর সুন্দর অপাপবিদ্ধ মুখটি চোখের সামনে ভেসে উঠল। আতশ মুখে কিছু বলল না। চুপ করে থাকল।

নন্দা বলল, এবারে নলিনীর দাদা নন্দনকে বলতে হবে কথাটা। জানি না, কীভাবে নেবে ব্যাপারটা। ও বিশ্বাস করবে কি না! তবে তোমার সঙ্গে ওর গায়ের রং ও চেহারার এমন-ই মিল যে, বেবি যখন হবে, তখন ওর সব সন্দেহের নিরসন হবে।

তারপর বলল, আসল বাবা তো তুমিই। তাই তোমাকেই সবচেয়ে আগে জানালাম। মাউসি আর নলিনীকেও জানাব। ওরাও খুব খুশি হবেন এই শুনে। আমার মাকেও জানাতে হবে। তাঁরও খুশির শেষ থাকবে না। আর তোমাকে কী বলব আতশ। আমি সারাজীবনের মতো তোমার বাদি হয়ে থাকব। তুমি যখন চাইবে, আমাকে পাবে আর যদি কখনো না চাও, আমাকে ঘেন্না করো, তাহলে নিজেকে দূরে সরিয়েই রাখব। বাকিজীবন আমার আদরের সন্তান হয়ে তুমি তো আমার চোখেই থাকবে। তাতেই খুশি থাকব আমি। আমার কাছ থেকে এ-জীবনের মতো তুমি কোথাওই পালাতে পারবে না।

আতশের বিরক্তি যাচ্ছিল না।

বলল, নলিনী কবে ফিরে গেল ভুবনেশ্বরে?

তুমি যাওয়ার পরদিন-ই তো। তোমাকে চিঠি লিখবে বলেছে। ও এমন-ই ভালোবাসে আমাকে যে, কোনোদিন এই সত্য প্রকাশ হয়ে পড়লেও ও আমাকে ক্ষমা নিশ্চয়ই করবে। আমার বিশ্বাস আছে। আমার দুঃখের রকমটা যে, ওর জানা–দুঃখের নানা রকম হয়–যা শুধুমাত্র একজন মেয়ের-ই বোঝার। কোনো পুরুষের পক্ষে, এই কষ্টর কথা বোঝা কখনোই সম্ভব নয়। তাদের বলেও লাভ নেই। অনেক কথাই থাকে, যা, একজন মেয়ে অন্য আর একজন মেয়ের কাছেই বলতে পারে।

তারপর বলল, ভালো থেকো। সন্ধে সাতটার আগে আমাকে ফোন কোরো। যদি সময় পাও। আর তোমাদের বাড়িতেও করতে পারো, শনিবার সকাল এগারোটা থেকে একটার মধ্যে আমি তখন তোমাদের বাড়িতেই থাকি। মাউসির সঙ্গে তোমার কথা হয়ে গেলে আমি তোমার সঙ্গে বলব কথা।

তারপর-ই বলল, না, থাক, আমাকে ফোন করার দরকার নেই তোমার। আমি এস. টি. ডি. বুথ থেকে তোমাকে ফোন করে নেব। রাখছি। ভালো থেকো। তোমার কাছে, যা-ঋণ জমা রইল তা এ-জীবনে শেষ করার নয় আতশ।

ছেড়ে দেওয়ার আগে আবার বলল, তুমি দেখো, তোমার ছেলে অথবা মেয়ে যা-ই হোক, তাকে কেমন করে মানুষ করে তুলি। ছাড়ছি।

এবারে ফোনটা সত্যিই ছেড়ে দিল।

এক গভীর বিষণ্ণতাতে ডুবে গেল আতশ।

বাইধরকে বলল, কী বেঁধেছিস আজ?

রুটি আর ছানার ডালনা।

ক্ষীর আছে?

আছে।

আম আছে?

আছে। আম আর পাওয়া যাবে না। আর দু-একদিন।

ক্ষীর দিয়ে আম দিয়ে খাব।

হহউ আইজ্ঞাঁ। বাইধর বলল।

ওড়িয়াতে দুধকে ‘ক্ষীর’ বলে।

বাইধর বলল, পনসও আর বেশিদিন পাওয়া যাবে না। তাই কাল পনসর তরকারি করব।

করিস যা খুশি, অন্যমনস্ক গলাতে বলল আতশ।

সে ফোন্বটা কার আসিথিলা?

তা দেইকি তম কন কাম্ব? যা নিজকার্য কর যাইকি।

হউ! আইজ্ঞাঁ।

বলে, বাইধর চলে গেল।

বর্ষা পুরো নেমে গেছে। লাগাতার বৃষ্টি পড়ছে। একবার জোরে, একবার আস্তে। ছেলে আর বউকে নিয়ে অতখানি পথ, এই দুর্যোগের মধ্যে পাহাড়ে-জঙ্গলে কী করে গেল গদাধর কে জানে! সারাদিন তো ওদের খাওয়াও হয়নি কিছু। রাতে বাড়ি পৌঁছেই বা কী খাবে? সন্তান-হারা, পাঁচরাত জেগে-থাকা মা কি রাঁধতে পারবে কিছু? না খেয়েই হয়তো থাকবে তিনজন। সারাবছর-ই তো না খেয়ে থাকার মতোই থাকে। তবু কিন্তু পুরো উপবাসে তো থাকে না। কোনো অনুযোগ নেই, প্রতিবাদ নেই, রাগ নেই, ক্ষোভ নেই, প্রতিহিংসা নেই, এক আশ্চর্য ‘মনুষ্যেতর জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে ওরা। ওদের গায়ে চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছে করে আতশের, লাগে কি না। সর্বংসহ হয়ে গেছে ওরা, ওই অরণ্যবাসী লোজন ও স্কুলের পোড়াদের বাবা-মায়েরা।

এই অঞ্চলের অর্থনীতি পুরোপুরিই অরণ্যনির্ভর। অরণ্যই তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। বাড়িঘর বানাবার মতো সামগ্রী, সারাবছরের খাদ্যসংস্থান–অরণ্যের ফুল, শাকপাতা মূল, অরণ্যের পশুপাখি, অরণ্যের মধ্যে থেকে বাঁশ, কাঠ, মধু, নানা ভেষজ দ্রব্য আহরণকারী ঠিকাদারদের হয়ে দিন-মজুরি খাটা এই তাদের জীবিকা। এইসব ঠিকাদারদের অধিকাংশই শহরে থাকেন। তাঁদের হয়ে কাজ করে তাঁদের মুহুরিরা। নানা মহীরুহ উৎপাটন করে প্রকান্ড মোটা মোটা কাঠের লগ, ট্রাকের পর ট্রাক চলে যায় কটকের কাঠপট্টিতে। সেখান থেকে সারাভারতবর্ষে। শাল, সেগুন, তেঁতরা, সিধা, মিটকুনিয়া, বিজা, হলুদ, গেন্ডুলি, নানা কাঠ। প্রাসাদোপম বাড়িতে বাস করেন মালিকেরা–নতুন নতুন মডেলের গাড়ি চড়েন। তাদের ছেলেমেয়েরা দিল্লি, হায়দরাবাদ, পুণে, ভুবনেশ্বর, কলকাতায় পড়ে তারপর চলে যায় বিলেত, আমেরিকা, কানাডা, আজকাল অস্ট্রেলিয়াতেও যাচ্ছে অনেক ছেলে-মেয়ে-তারপর বেশির ভাগ-ই থেকেই যায় সেইসব দেশে, নিজের দেশে আর ফেরে না। নবীন পট্টনায়েকও হয়তো ফিরতেন না, যদি-না মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্যে নির্বাচনে দাঁড়াতেন। এই গদাধর বা বাইধর বা কাদম্বিনীদের জন্যে কারোর-ই মাথাব্যথা নেই। বক্তৃতা আছে, প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি আছে কিন্তু দরদ নেই–কোনো রাজ্যেই নেই-ওড়িশা কোনো ব্যতিক্রম নয়। লাল, নীল, হলুদ পতাকাধারী নানা দলের চোর ডাকাত খুনে গুণ্ডারা গদি দখল করে বসে আছে! নির্বাচনে অবাধ রিগিং হচ্ছে। দুর্নতিতে ডুবে গেছে সারাদেশ। সাধারণ মানুষ আরও কতদিন সহ্য করবে? হাতে বন্দুক তুলে নেওয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা আছে এই বদমায়েশদের শায়েস্তা করবার জন্যে?

আতশ-এর চোখের সামনে সেই ধুতি-পরা গায়ে গামছা জড়ানো টগবগে যুবকের মুখটা মনে পড়ে গেল। যে বলছিল, হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে, ভীম্ব না কী যেন নাম, বলছিল, এই ডাক্তারটাকে শিক্ষা দেওয়া দরকার। গদাধর তাড়াতাড়ি তাকে চুপ করতে বলেছিল ভয় পেয়ে। এই অঞ্চলে অন্য কোনো ডাক্তারও নেই, অন্য কোনো হাসপাতালও নেই। ওরা করবেই বা কী?

বাইধরকে বলল, আজ তাড়াতাড়ি খেতে দিয়ে দিস বাইধর।

হউ আইজ্ঞাঁ।

বলল বাইধর।

বড়ো অপরাধী বোধ করছে আতশ। বোধ করছে গত পনেরো দিন থেকেই। অথচ সেই অপরাধের কথা কারোকে বলে যে, হালকা হবে তারও কোনো উপায় নেই। একা একাই কষ্ট পেতে হচ্ছে তাকে। শুধু কষ্টই নয়, এই অপরাধবোধের মধ্যে এক গর্হিত আনন্দও সুপ্ত আছে। কারোকেই বলা যাবে না তা।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে ভাবছিল, সেই ঘটনার কথা। ব্যাং ডাকছে। নালার পাড়ে সাপে ব্যাং ধরেছে। বৃষ্টির মধ্যেই দুটো পেঁচা উড়ে-ঘুরে ঝগড়া করছে। রাতের শেষ বাস হর্ন বাজাতে বাজাতে বড়োরাস্তা দিয়ে চলে গেল অঙ্গুলের দিকে। টিকরপাড়া থেকে আসে সে বাস। চাদরটা পায়ের কাছ থেকে টেনে গায়ে দিল আতশ তারপর কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে পড়ল।

মা আর নলিনী প্রশান্ত পারিজার নাতনির অন্নপ্রাশনে গিয়েছিল। এগারোটা নাগাদ গিয়েছিল, ফিরতে ফিরতে বিকেল হবে। প্রশান্তবাবু বাবার খুব বন্ধু ছিলেন। তিনিও গত হয়েছেন। তাঁর দুই ছেলে একসঙ্গেই থাকে। দু-জনেই ভালো চাকরি করে। বাবার করে যাওয়া বাড়িতে থাকে। মা আছেন। প্রশান্তবাবুর স্ত্রীও আতশ-এর মায়ের খুব-ই বন্ধু। এঁরা সবাই অঙ্গুলের পুরোনো বাসিন্দা। ওঁর ছটোছেলের প্রথম মেয়ের অন্নপ্রাশন।

ওঁরা সাইকেলরিকশা করে যেতে-না-যেতেই নন্দা বউদি এলেন ওদের বাড়িতে। ওদের কাজের লোক পটারও আজ নেমন্তন্ন। যাওয়ার আগে বেঁধে দিয়ে গেছে। আতশের এইসব সামাজিক ক্রিয়াকান্ড ভালো লাগে না, তাই সে যায়নি। নলিনী যখন এল মাকে নিয়ে যেতে তখন বলল, বউদিকে বলে এসেছি, এসে তোমার খাবার গরম করে তোমাকে খাইয়ে তারপর বাড়ি যাবে। এখানেও খেয়ে যেতে পারো ইচ্ছে করলে। দাদা তো দুপুরে ফেরে না।

বাঃ বাঃ। এর কী দরকার ছিল? খাবারটা কি আমি, একদিন গরম করে নিতে পারতাম না?

মা বলেছিলেন, চুপ কর। তুই কি গ্যাস জ্বালাতে জানিস? খালি জানিস তো পড়াশুনো করতে। অকর্মার টেকি একটা।

যাওয়ার সময়ে নলিনী বলল, বউদিকে আসতে বলেছি। কিন্তু দেখো ফাঁকা বাড়ি, আমার অপরূপা সুন্দরী বউদির সঙ্গে কোনো দুষ্টুমি কোরো না যেন। বউদি কিন্তু খুব কনজারভেটিভ। আর দাদা যে, রগচটা তা তো জানোই।

মা বললেন, কথা শোনো ফাজিল মেয়ের।

চললাম, বলল নলিনী। ফিরে এসে কফি খাব আর তোমার সঙ্গে গল্প করব।

মা বললেন, তোরা দুজনে সারাজীবন কি পড়াশোনাই করবি? বিয়ে-থা করে কবে সেটল করবি।

নলিনী আতশ-এর দিকে আড়চোখে চেয়ে বলল, বিয়ে করার মতো ছেলেই দেখি না।

মা চুপ করে রইলেন। বললেন না কিছু।

নন্দা বউদি এল, ওরা চলে যাওয়ার মিনিট পনেরোর মধ্যেই। নন্দার মুখ-চোখ দেখে মনে হল জ্বর হয়েছে। একটা লাল-কালো রঙা কটকি শাড়ি পরেছে। জরির কাজ করা। সঙ্গে লাল ব্লাউজ। কিছুক্ষণ আগেই স্নান করেছে। আতর মেখেছে বোধ হয়, জুই কিংবা বেলি। চুল বাঁধেনি। পিঠের ওপরে ভরা শ্রাবণের মতো ভিজে চুল খোলা। ‘জবাকুসুম’ কী ‘লক্ষ্মীবিলাস’ তেল মেখেছে মাথাতে। নাকি ‘এলীন’? সুগন্ধ ভুর ভুর করছে।

নন্দা হাতে করে এক প্যাকেট ধূপকাঠি নিয়ে এসেছিল। রান্নাঘরে গিয়ে গ্যাস জ্বালানোর লাইটারটি দিয়ে চারটি ধূপকাঠি একসঙ্গে ধরিয়ে আতশের পড়ার টেবিলের ওপর পেপার ওয়েট চাপা দিয়ে রাখল। ঘরময় সুন্দর ধূপের গন্ধ ভরে গেল।

মুখ নীচু করে বলল, সমলেশ্বরীর মন্দিরে এই, গণপতি মার্কা ধূপ জ্বালানো হয়।

ঘরের দরজাটা এবং বাগানের দিকের দুটো জানলাই খোলা ছিল। রঙ্গনের ঝোপে মৌটুসি এবং পেয়ারাগাছের ডালে বুলবুলি শিস দিচ্ছিল। খোলা জানলা দুটোর দিকে চেয়ে নন্দা বলল, গেটের চাবিটা কোথায় থাকে?

বসার ঘরে দেওয়ালে টাঙানো আছে। কিন্তু কেন?

বলব পরে।

‘আমি একটু আসছি’–বলেই নন্দা গেট-এর চাবিটা নিয়ে বাগান পেরিয়ে বাইরের গেট এর কাছে চলে গেল। গেটটা বন্ধ করার শব্দ শোনা গেল। তেল না দেওয়াতে ‘ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে গেটটা খোলা-বন্ধর সময়ে। তারপর, ঘরে ফিরে এসে, দরজাটা লাগিয়ে দিল। বলল, জানলা খোলাই থাক।

আতশ হতবাক হয়ে গিয়েছিল। গলা শুকিয়ে আসছিল তার ভীষণ ভয়ে, উদবেগে।

নন্দা আতশকে বিছানার ওপরে টেনে নিল। বলল, একটা ভিক্ষা নিয়ে এসেছি আমি। জানি আতশ, তুমি ভাবছ আমি নলিনীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছি। কিন্তু বিশ্বাস করো, জানতে পারলেও নলিনী হয়তো আমাদের ক্ষমা করবে।

দীর্ঘক্ষণ পরে নন্দা বলল, উঠতে তো হবেই, ছেড়ে যেতেও হবে। তোমার কাছে একটি সন্তানের ভিক্ষা নিয়ে এসেছিলাম। তুমি আমাকে সম্পূর্ণা করলে আতশ। এ যে, কত বড়ো দান, তুমি আজ দিলে তা তোমাকে বোঝাতে পারব না। আমি জানি, নলিনীর প্রতি, আমি চরম বিশ্বাসঘাতকতকা করলাম। তোমারও তেমন-ই মনে হতে পারে। কিন্তু এই ঘটনা নিহিত সংগোপনে থাকবে আমাদের মাঝে। যখন আমার সন্তান হবে তখন তুমি তাকে দেখে জানবে ও তোমার-ই মুহূর্তের দান। তোমার নন্দনদাও খুব খুশি হবে, খুশি হবে নলিনী। এতে খুশি হবেন ঈশ্বর। আমরা তো কারোরই কোনো ক্ষতি করিনি আতশ।

আতশ অস্ফুটে বলল, আজ তুমি ভিক্ষা চাইলে আমার কাছে। ভবিষ্যতে যদি তোমার কাছ থেকে আমি ভিক্ষা চাই?

চেয়ো না আতশ। চাইলে, আমি না করতে পারব না তোমাকে। কিন্তু নলিনীর কথা ভেবে আমাদের দুজনের-ই সেই চাওয়া-পাওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে। তুমি একদিন নিজেই বুঝতে পারবে যে, পাওয়ার চেয়েও না-পাওয়ার আনন্দ, কত গভীর। তোমাকে আজ তা বোঝাতে পারব না।

কাপড়জামা নিয়ে নন্দা উঠে বাথরুমে গেল।

যাওয়ার আগে বলল, শুনছ, গেট-এর তালাটা এবারে খুলে দিয়ে এসো।

বাইধর এসে, আতশের চিন্তার জাল ছিঁড়ে-খুঁড়ে দিয়ে বলল, খাবার লাগিয়ে দিয়েছি বাবু।

চমকে উঠল আতশ। ও তো করতপটাতে ওর ভাড়াবাড়িতে আছে। এক গভীর আচ্ছন্নতাতে ডুবেছিল সে। বড়ো পাপ হে, বড়ো পাপ! নিজের মনেই বলল আতশ! তারপর খেতে গেল।

আগামীকাল মুসলমানদের কী একটা পরব আছে। স্কুল বন্ধ। আজ বন্ধ থাকলে ভালো হত। গদাধরের মেয়ের দাহর শেষ অবধি থাকতে পারত এবং গদাধরের বউ আর ছেলেকে বাইকের পেছনে বসিয়ে পৌঁছিয়েও দিয়ে আসতে পারত।

নন্দার টেলিফোনের অভিঘাতের ধাক্কাটাও বড়ো কম ধাক্কা নয়। সামলাতে সময় নেবে। আগামীকাল ছুটি হয়ে ভালোই হল। এই ছুটিটা, ওই ধাক্কাটা সামলাতে সাহায্য করবে কিছুটা। আতশ যে, বাবা হবে –এই ভাবনাটাই তাকে রীতিমতো বিধ্বস্ত করেছে অথচ ওর ভীষণ-ই সুখী হওয়ার কথা ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *