৩. কিচকিচ ঘরঘর শব্দে

পাখাটা কিচকিচ ঘরঘর শব্দে ঘুরতে আরম্ভ করেছিল। বব সেদিকে মুখ তুলে অবাক চোখে তাকিয়েছিল। মজা পেয়ে, ছোট দাঁত বের করে হেসেছিল। সেই ফাঁকে বীণা আভাকে সূরয সিং-এর নামোচ্চারণ না করে বলেছিল, ওর বাবাই সুরজি সিং-কে মোটর পার্টসের একটা ছোট দোকান খুলতে সাহায্য করেছে। সে আমার বাবার কাছে কৃতজ্ঞ। লোকটার একটাই দোষ, বড় বেশি মদ খায়। মালতীও এমনিতে ভালই। তবে হরিয়ানার দূর গ্রাম থেকে বছর খানেক হল কলকাতায় এসেছে। আমাদের মতোই, ওরাও রিফুজি। বীণা তারপরে পাশের ঘরে গিয়েছিল, মালতীর সঙ্গে কথায় কথায় গলা নামিয়ে কিছু বলেছিল। আভা বুঝতে পারছিল, ওরা আভার আর ববের দুপুরের খাবারের কথা আলোচনা করছে। বাইরের জানালাটা খোলা ছিল। সেখান থেকে দোতলা বাড়ির কোণ, আর বাইরে যাবার ফালি রাস্তার মোড়টা কেবল দেখা যায়। ও ভাবছিল, পিসিমার বাড়িতে কী ঘটছে। ওরা কি মিঃ কাপুরের ঘরে ঢুকেছে? না কি আদৌ আসেনি? আভা এ ঘরে বসে কিছুই জানতে পারছিল না। অনুমান আন্দাজ আর ভয়ংকর কল্পনা ছাড়া, মাথায় কিছুই আসছিল না। যে কোনও অবিশ্বাস্য ঘটনা, যে কোনও মুহূর্তেই ঘটে যেতে পারে। ওকে ঘিরে, সমস্ত ঘটনাই যেন অবিশ্বাস্যভাবে ঘটে যাচ্ছে। বরং যা কিছু বিশ্বাসজনক বলে একদা মনে হত, জীবনের অভিজ্ঞতায় সবই যেন অবিশ্বাস্য বলে প্রতিভাত হচ্ছে। সবই বিপরীত আর এলোমেলো। অন্যথায়, পিসিমার বাড়ির উত্তরে, মিলারদের গায়ের পাঁচিল ভাঙা মিঃ কাপুরের চোখে পড়ল কেন? যে কথা সে একজন ভাড়াটে হিসাবে তার নিরাপত্তার জন্য বলবে ভেবেছিল, সে কথাটাই আভার পরিত্রাণের জন্য মনে পড়বে কেন? আর সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত, সেই আততায়ী কেমন করেই বা ঠিক পিসিমার বাড়িতে হানা দিতে এল! নীলিমার মতো অন্তরঙ্গ বন্ধু, আর ওর স্বামী নরেশ, আভার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওদের ভাবভঙ্গি দেখে কেন বিশ্বাসঘাতকতার ভাব মনে এসেছিল? অথচ ওদের প্রতি আভার বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস ছিল না। থাকলে, ও ববকে নিয়ে ওদের বাড়ি যেত না। তারপরেও পালিয়ে আসবার সময়, ওরা যে নজর রাখতে পারে, এটা অসম্ভব বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু মিঃ কাপুরের যুক্তি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। নীলিমারা যদি লক্ষ রেখে না থাকে আততায়ী একেবারে নির্ঘাত পিসিমার বাড়িতেই খুঁজতে আসবে কেন?

বুক কাঁপে, ভাবলে। অবিশ্বাস কেবল বাড়তেই থাকে। কে বিশ্বাসযোগ্য, আর কে না, এটা স্থির করার দায়িত্ব যেন দৈব আর অলৌকিক কোনও শক্তি তার হাতে তুলে নিয়েছে। এই বিশেষ পরিস্থিতিতে, সমস্ত জীবনের অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যৎ যেন এমনই একটা পটভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে।

বব কি গেলাসে চুমুক দিয়ে খেতে পারবে। বীণা এ ঘরে এসে জিজ্ঞেস করেছিল।

আভার মনে পড়েছিল, ববের ফিডিং বোতল একটা নীলিমার বাড়িতে ফেলে এসেছিল। বিজিত পরের দিন একটা কিনে এনেছিল। সেটাও পিসিমার ঘরে পড়ে আছে। বলেছিল, একটা চামচ দিয়ে খাওয়াবার চেষ্টা করি। আর ও যদি চুমুক দিয়ে খেতে পারে, ভালই।

মালতী একটা পরিষ্কার কাচের গেলাসে, পাতলা করে খাবার গুলে নিয়ে এসেছিল। বীণা পাশের ঘরে ঢুকে একটা চামচ ধুয়ে নিয়ে এসেছিল। বব তখনও নিচু ছাদের গায়ে, সিলিং ফ্যানটার ঘোরা দেখছিল, আর বোধ হয় ফ্যানটার নানা রকম শব্দ শুনে, সেটার সঙ্গেই গলা মেলাবার জন্য, নানা রকম শব্দ করছিল। আভা চামচ করে তরল খাদ্য ওর মুখে তুলে দিয়েছিল। অনভ্যস্ত বব চামচ মুখে নিতে চায়নি। খাবার ঠোঁটের কষ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু খাবারের স্বাদ পেয়ে, ফ্যানের থেকে, ওর মন আর চোখ দুই-ই ফিরে এসেছিল। গেলাসটাকেই ফিডিং বোতল ভেবে দু হাতে ধরবার চেষ্টা করছিল। সেটা সম্ভব ছিল না। গেলাস থেকে খাবার চলকে পড়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল। আভা চামচ দিয়ে খাওয়াবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু বব চামচ মুখে নিতে চায়নি। অথচ খিদের জন্য ছটফট করে, গেলাস টেনে নেবার চেষ্টা করছিল। আভা তখন গেলাসটাকে শক্ত করে ধরে, ববের মুখের সামনে ধরেছিল। এবং আভাকে অবাক করে দিয়ে, শিশুটি জীবনে সেই প্রথম গেলাসে চুমুক দিয়ে, তরল খাবার মুখে নিয়ে, গলাধঃকরণ করেছিল। সামান্যই একটু খাবার নষ্ট করেছিল, সময় নিয়েছিল বেশি। কিন্তু বব ওর দশ মাসের জীবনে সেই প্রথম গেল,সে চুমুক দিয়ে ওর খিদে মিটিয়েছিল।

আভা সেই সময়টার জন্য, ওর চারপাশের সর্বনাশের কথা ভুলে গিয়েছিল। ওর মুখে হাসি ফুটেছিল। অথচ ববের খাওয়া দেখে, ওর বুকের মধ্যে কেমন কষ্টও হচ্ছিল। বীণা আর মালতী ববের খাওয়া দেখছিল। আভা বলেছিল, বব যে এ রকম করে খেতে পারবে, আমি ভাবতেই পারিনি।

মানুষের আর পশুর বাচ্চা, সবই সমান। মালতী হেসে বলেছিল, খিদে এইরকম জিনিস।তারপর সে তার স্বভাবসিদ্ধ গ্রাম ইতর ভাষায়, বালিকাদের যৌন আচরণের কথা বলেছিল। সে মানুষের সমস্ত ক্ষুধাকে একাকার করে দেখেছিল, এবং তা অমোঘ বলে, ছোট ছোট ছড়া কেটে প্রমাণ দিয়েছিল।

বীণার পক্ষে সে সব শুনে, চোখ মেলে, মুখ লাল না করে থাকা সম্ভব ছিল না। আভার পক্ষে মালতীর এতটা প্রবৃত্তিজাত আচরণের কথা শুনতে অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু এ কথাও মনে হয়েছিল, মালতীর কথার মধ্যে কোথায় একটা সত্য কুৎসিত আর প্রকট রূপ নিয়ে লুকিয়ে আছে। তারপরে বীণা আভাকে খাবারের কথা জানিয়েছিল। আভা খাবার নিয়ে মোটেই চিন্তিত ছিল না। ও বলেছিল, সামান্য একটু গলানো ভাত আর একটা হাফ বয়েল ডিম হলেই, ববের দুপুরের খাবার মিটে যাবে। মালতী জানিয়েছিল, তার কোনও অসুবিধাই হবে না। বীণা বিদায় নিয়েছিল। আভা তাকে ইংরেজিতে বলেছিল, আমি ও বাড়ির ঘটনা জানবার জন্যে খুবই উদ্বেগ নিয়ে বসে থাকব। সম্ভব হলে, তুমি অবিশ্যিই আমাকে এক বার জানবার চেষ্টা কোরো।

নিশ্চয়ই আমি আবার আসবার চেষ্টা করব। বীণা বলেছিল, এবং মালতীকে বলে চলে গিয়েছিল।

কিন্তু বীণা আর সারা দিনে এক বারও আসেনি। আসলে আসতে পারেনি। মিঃ কাপুরের সেই রকমই নির্দেশ ছিল। তাঁর ভয় ছিল, বীণার আর মিলারদের বাড়ি না যাওয়াই ভাল। ওরা যদি লক্ষ রাখে, আর কোনও কারণে সন্দেহ হয়, তা হলে সূরয সিং-এর ঘরেও হানা দিতে পারে। অতএব, আভা সংবাদের জন্য ছটফট করলেও, সারা দিন কোনও খবরই পায়নি।

বীণা চলে যাবার পরে, মালতী আলনার কাছে মেঝেয় পড়ে থাকা, ছেড়ে রাখা ট্রাউজার শার্ট ইত্যাদি নিয়ে, সেই টিনের চালার বাথরুমে গিয়েছিল। আভাকে বলে গিয়েছিল, জল থাকতে থাকতে জামাকাপড় কাঁচা আর স্নান সেরে নিতে হবে। মালতী যখন জামাকাপড় কেচে, স্নান করে ঘরে ফিরেছিল, তখন একটা নিংড়ানো ভেজা শাড়ি কোনও রকমে তার গায়ে জড়ানো ছিল। হাতে ছিল ধোয়া জামাকাপড় ভরা বালতি। বব তখন ঘুমোচ্ছিল। আভা খাটের একপাশে, উৎকণ্ঠিত, উৎকর্ণ হয়ে বসে ছিল।

মালতী ঘরে ঢুকে ভিতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলেছিল, জল আর বেশিক্ষণ থাকবে না। তুমি চান করে কাপড় ধুয়ে এসো। আমার একটা শাড়ি পরে নিয়ো। তোমার শাড়িটা যাতে আগে শুকোয়, সে ব্যবস্থা আমি করব। বুঝতেই পারছ, ঘরের সামনে খুঁটির সঙ্গে ঝোলানো তারেই আমাদের জামাকাপড় শুকোতে হয়। রোদ তো পাওয়াও যায় না। বাতাসেই শুকোতে হয়। বর্ষাকালে ভেজা জামাকাপড় জমে থাকে আর ঘরেও জল ঢোকে। তবু এর ভাড়াই মাসে দুশো টাকা। দিল্লি কলকাতার মতো শহরে, টাকার দাম মানুষের কমিয়ে ফেলা চুলের থেকেও কম।

মালতী একটা শায়া কোমরে গলিয়ে, অনায়াসেই গা থেকে ভেজা কাপড়টা খুলে ফেলেছিল। আভা ওর জীবনে নগ্নতা কিছু কম দেখেনি। তবু, ফরসা মোটাসোটা, বুকের দুই মাংসল পিণ্ড সহ খালি গা মালতীকে দেখে, ও চোখ ফেরাতে বাধ্য হয়েছিল। মালতী তা খেয়ালও করেনি, বা গায়েই মাখেনি। একটা জামা গায়ে দিয়েছিল, যার হাতা কাঁধ কাটা। চুল থেকে তখনও জল চুঁইয়ে গায়ে ও মেঝেতে পড়ছিল। বলেছিল, এই একটাই মাত্র সময়, আমি শাড়ি না পরেও ঘরের বাইরে যেতে পারি। উলটো দিকের ভাড়াটে পুরুষরা সব বাড়ির বাইরে। মেয়েদের সামনে মেয়েদের আর লজ্জাই বা কী। আমি বালতি খালি করে দিচ্ছি, তুমি চান করে এসো। সাবান আর গা মোছর তোয়ালে আমি ভেতরেই রেখে। এসেছি।বলে সে শায়া আর শুধু ব্লাউজ গায়েই ভেজা জামাকাপড়ের বালতি নিয়ে, দরজা খুলে বেরিয়ে গিয়েছিল।

আভা অস্বস্তি বোধ করছিল। ঘরের বাইরে যাওয়াটা উচিত হবে কি না, ঠিক করতে পারছিল না। স্নান করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু মালতীর সাবান আর তোয়ালে ব্যবহার করার কথা ভেবে, শরীরটা কেমন সিঁটিয়ে উঠছিল। পালিয়ে বেড়াবার পর থেকে, এ রকম কোনও পরিবেশে ওকে যেতে হয়নি। যদিও, সে সব ভেবে কোনও লাভ ছিল না। এ সবই তো অবিশ্বাস্য। বব গেলাসে চুমুক দিয়ে খেতে পারবে, এটা কি কখনও ভাবতে পেরেছিল।

মালতী বালতি খালি করে দিয়েছিল। আলনায় ভাঁজ করে রাখা, ওর সব থেকে ভাল শাড়িটাই আভাকে পরতে দিয়েছিল। আর হেসে বলেছিল, আমার জামা তত তোমার গায়ে ঢল ঢল করবে। আমার সবই বড়, তোমারটা এখনও সবই ছোট আর কচি মতো দেখতে। তোমার সবই বেশ সুন্দর, চেহারাটাও। তবু তোমার স্বামী–আচ্ছা যাক, ও সব কথা পরে হবে। ইচ্ছে করলে আমার একটা গায়ে গলাতে পারো। না গলালেই বা এ ঘরে কে দেখছে? শাড়িটাই গায়ে জড়িয়ে নিয়ো।

আমার বাইরে যাওয়া উচিত হবে কি না, বুঝতে পারছি না। আভা উৎকণ্ঠিত দ্বিধায় বলেছিল।

মালতী হেসে উঠেছিল, তোমার স্বামী কি আমার ঘরের কাছে ওত পেতে আছে? যদি থাকে, তা হলেই বা কী? মারধোর করবে? আমি তোমাকে বাঁচিয়ে দেব। লড়ে যাব তোমার স্বামীর সঙ্গে।

মালতী ঘটনার গুরুত্ব বা ভয়ংকরতা জানত না। তার পক্ষে ও রকম বলাই স্বাভাবিক ছিল। আভা সাহস করে, বালতি নিয়ে, সেই ছোট টিনের চালায় ঢুকেছিল। ঢুকতেই দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে এসেছিল। তবু দরজাটা বন্ধ না করে পারেনি। কলের মুখ খুলে বালতি বসিয়েছিল। কিন্তু জীবনের অস্তিত্বই যেখানে বিপন্ন, সেই মৃত্যুর চোখে ফাঁকি দেওয়ার অবকাশেও, মালতীর সাবান আর তোয়ালে ও ব্যবহার করতে পারেনি। কোনও রকমে কয়েক মগ জল গায়ে ঢেলেছিল। চুল ভেজায়নি। আর প্যানের দুপাশে পা রেখে, নিজের শাড়ি জামা ব্রা (ব্রা ছাড়া শাড়ি আর জামা আইভির ছিল।) খুলে ফেলেছিল। নিজের। শাড়ি নিংড়ে গা মুছেছিল। মালতীর শাড়ি জামা পরে নিয়েছিল। অবিশ্যি মালতীর গায়ের গন্ধ লেগে থাকায়, কেমন একটা বিরাগ বোধ করছিল। তবু না পরে উপায় ছিল না। বালতির জলে ডুবিয়ে নিজের শাড়ি-জামাও নিংড়ে নিয়েছিল। মালতীর যে কোনও কাজের লোক ছিল না, সেটা প্রথম থেকেই নজরে পড়েছিল।

মালতী আভার শাড়ি-জামা নিজেই বাইরের তারে মেলে দিয়েছিল। তারপরে সে পাশের ঘরে গিয়ে, রান্নার আয়োজনে বসেছিল। আভাকেও পাশের ঘরে ডেকেছিল। আভা বাইরের দরজাটা বন্ধ করে, মালতীর কাছে গিয়েছিল। কোনও টেবিল ছিল না। সবই মেঝের ওপর। দুটো স্টোভ ছিল। একটা ঝুড়িতে আনাজপত্র। ছোট একটা জালের পাল্লা দেওয়া মিটসেফ। তার মধ্যে কয়েকটা ডিম দেখা যাচ্ছিল। মালতী নিজের পশ্চাদ্দেশের তলা থেকে একটা নিচু ছোট জলচৌকি আভার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, বোসো। আমি মেঝেতে বসেই আটা মাখছি। তোমার ছেলের জন্য ভাত করতে আমার বেশি সময় লাগবে না। রুটি আর ডিম ভাজি আমাদের। নাকি তুমিও ভাত খেতে চাও?

না না, আমি রুটিই খাব। আভা ব্যস্ত হয়ে বলেছিল, আপনি বলে দিলে, আমি তরকারি কাটতে পারি। কিংবা আটাও মাখতে পারি।’

মালতী হেসে, আভার হাঁটুতে একটা খোঁচা মেরেছিল, আমাকে আপনি করে বলতে হবে না। অবিশ্যি তুমি আমার থেকে ছোটই হবে, তবু আপনি বলার কী দরকার? তুমি চৌকিটায় বসছ না কেন?

আপনিই বসুন, আপনার অসুবিধে হবে।আভা সংকুচিত হয়ে বসেছিল। মালতী ধমক দিয়েছিল, আর মেঝেয় চেপে বসেছিল, তোমাকে যা বলছি, তাই করো তো। আলু পেঁয়াজ কাটো, রসুন ছাড়াও। তরকারির ঝুড়িতেই ছুরি আছে।’

আভা নিচু হয়ে চৌকিটায় বসে স্বস্তিই পেয়েছিল। তরকারির ঝুড়িটা সামনে টেনে নিয়ে বলেছিল, বব ঘুম থেকে উঠলে, ওকে আমি একটু গরম জল দিয়ে গা মাথা মুছিয়ে দেব।’

তা দিয়ো৷’ মালতী আটা মাখতে মাখতে বলেছিল, তোমাকে দেখে বুঝতে পারছি, তুমি গরিব নও, এ রকম ঘরে থাকতেও অভ্যস্ত নও। ঠিক বলিনি।

আভা কী জবাব দেবে, ভেবে পাচ্ছিল না। ছুরিটা হাতে নিয়ে, চিন্তিত বিষণ্ণ মুখে বলেছিল, গরিব বড়লোকের চিন্তা এখন আমার নেই। এখন আমি ও সবের বাইরে।

মালতী খিলখিল করে হেসে উঠেছিল। আভার কাঁধে একটা খোঁচা মেরেছিল, বেশি বাড়াবাড়ি কোরো না। ঘরে মেয়ে মরদের ঝগড়া হয়েই থাকে। তা, কী নিয়ে তোমাদের লেগেছে? সে একটা অ্যালুমিনিয়ামের থালা আভার সামনে এগিয়ে দিয়েছিল।

আভা কোনও জবাব না দিয়ে, কুটনো কুটছিল। আসলে, জবাব ওর তৈরি ছিল না। মালতী তার স্বভাবসিদ্ধ ভাষায়, ঠাট্টা আর বিদ্রূপ মিশিয়ে বলেছিল, তোমার স্বামীর খাঁই বেশি? মেটাতে পার না? নাকি, তোমার খাঁই সে মেটাতে পারে না? অনেক মেয়েরা তোমার মতো দেখতে সুন্দর আর শান্তশিষ্ট হলেও, তাদের শরীরের খাঁই কম হবে, এমন কোনও কথা নেই। কোনটা নিয়ে লেগেছে?

আভার মুখে লজ্জার ছটা লাগলেও, হাসতে পারেনি। বলছিল, ও সব কিছু না।

তবে কী?

মালতী নাছোড়বান্দা হয়ে উঠেছিল, আমার কাছে বলতে তোমার লজ্জা কীসের? পুরুষদের মেজাজ খারাপের তো কয়েকটা মাত্র কারণই আছে। বউ যদি অন্য পুরুষের সঙ্গে লটঘট করে, তা হলে ক্ষেপে যায়। সন্দেহে বাতিকগ্রস্ত হতে পারে। তারা খুবই বদমেজাজি হয়। নয় তো, তুমি খাঁই মেটাতে পারো না, বা সে তোমার পারে না। এতেও পুরুষদের মেজাজ খারাপ হয়। যদিও ওরা মেয়েদের মেজাজের কথা মনেই রাখতে চায় না। যেমন আমার স্বামী। এত বেশি মদ গেলে, আর মাতাল হয়ে আমাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেললেই বা কী যায় আসে? আঁ, কী বলো? আসল তো ঢু ঢু। মদ তো সে আমাকেও গেলাতে ছাড়ে না। তাতে আমার মেজাজ আরওই চড়ে যায়, মনে হয় ওকে পুড়িয়ে মেরে ফেলি। তবে হ্যাঁ, আমি ছেড়ে দিইনা, সময় বুঝে ঠিক উসুল করে নিই৷’ বলতে বলতে তার মুখ হাসিতে রক্তাভ আর ফুলে উঠেছিল।

আভার ভয় হয়েছিল, ছুরি দিয়ে আনাজ কাটতে গিয়ে, ওর হাত কাটবে। মালতীর ভাষাগুলো খুব ইতর, অশ্লীল। গ্রাম্য রসিকতায় ভরা। কিন্তু সারল্য ছিল, সত্যও ছিল। অথচ আভার ও সব বিষয়ে কিছু বলবার ছিল না। এমনকী, ওর মুখে রঙের ছটা লাগছিল। মালতী আবার একটা গ্রাম্য ছড়া কেটে বলেছিল, পেটের খিদে আর শরীরের খিদে না মিটলে, কোনও জীবেরই চলে না। আমার স্বামীকে যদি আমি ধরে রাখতে না পারি, তা হলে আমারই কপাল পুড়বে। এমনিতেই আমাদের কপাল পুড়েই আছে। এমন পুরুষ আর কটা আছে, বউকে ছাড়া অন্য মেয়েদের কাছে যায় না? মেয়েরাও চায়। চায় না? আমি তো কলকাতার শহরের এ ঘরে বন্দি। ইচ্ছে থাকলেও, কারোর সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ পাই না। সিং যদি আমাকে বারোমাস ভুখা রাখে, আমি কী করে থাকব? আমার আর কী আছে? একটা ছেলেপিলে নেই। মাঝে মধ্যে পিকচার দেখতে নিয়ে যায়, বাস৷

.

মালতীর মতো স্ত্রীলোকের এর থেকে সরল স্বীকারোক্তি আর কী থাকতে পারে? সে তার গণ্ডির মধ্যে বাঁধা। গণ্ডির মধ্যে না থেকেও, আভা কি জীবনে এর থেকেও বেশি ভোগ করেনি। পারমিসিভ সোসাইটি বলতে যা বোঝায়, তার স্বাদ ওর ভালই জানা আছে। সেই তুলনায় মালতীকে সৎ বলতেই হবে। সে আরও বলেছিল, হ্যাঁ, আর একটা কারণে পুরুষরা ক্ষেপে যায়। তা হল টাকা। তুমি যদি নিয়মিত স্বামীর পকেট মারতে থাকো, তা হলে মেজাজ খারাপ হতে পারে। আর সে টাকা যদি তুমি না জানিয়ে বাপের বাড়ি চালান কর, না তো নয়ছয় কর, তা হলে পুরুষ কখনও তা মেনে নেবে না। আমি এ রকম অনেক দেখেছি। অনেক বউয়ের চুরি করা অভ্যাস আছে। তুমি কি সে রকম কিছু করেছ?

আভা মাথা নেড়ে বলেছিল, না, আমি চুরি করিনি।

তবে কী নিয়ে তোমাদের গোলমাল লেগেছে?’ মালতীর কৌতূহল কিছুতেই মিটতে চাইছিল না, তোমার কি স্বামীকে পছন্দ নয়? আমার মনে হচ্ছে, সে রকমই কিছু হবে, আর তুমি ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে, বেচারির মেজাজটা খারাপ করে দিয়েছ। তা নইলে, তুমি মার খাবার ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসতে না। আর সেও তোমাকে বাড়ি বাড়ি খুঁজে বেড়াত না। আর না তো, নিশ্চয়ই অন্য পুরুষের সঙ্গে লটঘট পাকিয়ে বসে আছ। আমাকে বলতে না চাও, বলো না। তবে যা-ই ঘটে থাকুক, তোমাকে বুদ্ধি খাঁটিয়ে চলতে হবে। এ রকম ঝগড়া করে, বাড়ি ছেড়ে কত বার পালিয়ে বেড়াবে? চিরকাল এ রকম চলতে পারে না। তাই না?

আভাকে সম্মতি জানিয়ে, আস্তে আস্তে মাথা ঝাঁকাতেই হয়েছিল। ওর উপায় ছিল না, ও ব্যাখ্যা করবে, মালতীর আর ওর জীবন, দুই মেরুতে। ওদের জগৎ, চিন্তা-ভাবনা, সুখ-দুঃখ-সংকট, কোথাও কোনও মিল নেই। কিন্তু যাদের জন্য ওর উৎকণ্ঠিত প্রতীক্ষা সেই বীণা বা লীনা বা মিসেস কাপুর, কেউ-ই আসছিল না। পিসিমার প্রত্যাশা ও করেনি। তাঁর পক্ষে এ বাড়ি আসা সম্ভব ছিল না। আলিকে পাঠাবারও কোনও প্রশ্ন ছিল না।

বব যথাসময়ে উঠেছিল। ওকে গরম জলে গা মুছিয়ে খাওয়ানো হয়েছিল। আভা আর মালতী খেয়েছিল। এবং মালতী একই প্রসঙ্গে, ঘুরিয়ে কথা বলছিল। খাবার পরে, ট্রানজিস্টারে গান শুনছিল। গান শুনতে শুনতে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আর সেই একই উৎকণ্ঠিত প্রত্যাশায় সময় কেটেছিল। হাবিবের গ্যারেজের কাজের, আর লোকদের কথাবার্তার শব্দ ভেসে আসছিল। বড় রাস্তার ট্রাম আর গাড়ির শব্দ এ ঘর থেকে খুব কম শোনা যাচ্ছিল। মালতীর ঘুম ভেঙেছিল। সন্ধ্যা গড়িয়ে অন্ধকার নেমেছিল। প্রায় সাড়ে সাতটা নাগাদ প্রথমে এসেছিল সূরয সিং। লম্বা শক্ত শরীর লোকটা আভার সামনে খুবই বিনীত ভাবে এসে দাঁড়িয়েছিল। কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার জানিয়ে, জানতে চেয়েছিল, আর কোনও কষ্ট হয়েছে কি না। এবং এও জানিয়েছিল, কাপুরজি এখুনিই এসে পড়বে। মিঃ কাপুর প্রায় রাত্রি আটটায় এসেছিল।

আভা খাটের এক কোণে, ববকে কোলে নিয়ে বসে আছে। বসবার মতো আর কিছুই নেই। মিঃ কাপুরও খাটের আর একধারে বসেছে। সূর্য সিং বাইরে, মিঃ কাপুরের নির্দেশে। মালতী পাশের ঘরে। মিঃ কাপুর সকালবেলার সব ঘটনাই আভাকে বলল। বীণা বা লীনাকে যে সে এ বাড়িতে আজ না আসার নির্দেশও তার স্ত্রীকে দিয়ে গিয়েছিল, সে কথাও বলল। কথাবার্তা সবই ইংরেজিতে হচ্ছিল। তারপরে মিঃ কাপুর বলল, আমি আমার শো-রুমে গিয়ে, আপনার ভাই বিজিতকে টেলিফোন করেছিলাম। সে অবিশ্যি আইভির কাছ থেকে আগেই প্রথম ঘটনাটা শুনেছিল। তারপরে আমার কাছে শুনল, ওরা আমাদের নীচের তলায়ও এসেছিল। আমি লোকাল থানায় যাবার কথা ওকে বললাম।

‘থানায়?’ আভা যেন ভয়ে সচকিত হয়ে উঠল।

মিঃ কাপুর মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আপনাকে তো আগেই বললাম, থানায় না যাওয়াটা আমাদের দিক থেকে ভুল হত। বিজিতও প্রথমে থানায় যেতে একটু দ্বিধা করেছিল। আমিই তাকে বুঝিয়ে রাজি করিয়েছি। আমরা দুজনে একসঙ্গে থানায় গেছলাম।

থানার মতিগতি কী রকম দেখলেন?’ আভার দুই চোখে ব্যগ্র ঔৎসুক্য।

মিঃ কাপুর ঠোঁট বাঁকিয়ে, গোঁফ জোড়ায় এক বার আঙুল বোলালেন, যে অফিসার ডিউটিতে ছিল, আমাদের কমপ্লেন লজ করল, সে খুবই যেন আশ্চর্য হল। যেন আমাদের কথা তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না। ভাবটা এইরকম, আপনার কেসটা যখন চুকেই গেছে, তখন আবার এ সব ঘটনা ঘটবে কেন? আমি বললাম, সে জবাব তো আমার ঠিক জানা নেই। যা ঘটেছে, তাই বলছি। লোক দুটোই সশস্ত্র ছিল, তাও বললাম।

জিজ্ঞেস করল, অস্ত্র দেখতে পেয়েছি কিনা? বললাম, দরজার সামনে লোকটার হাতে রুমাল ঢাকা অস্ত্র ছিল। আইভি যে নীল স্যুট পরা লোকটার কোটের ভেতরে হলস্টার দেখতে পেয়েছিল, তাও বলেছি। কিন্তু আমার মনে হল, অফিসারটি সে রকম কোনও গুরুত্বই দিল না।

আমি এটাই অনুমান করছিলাম। আভার নিচু স্বরে অন্যমনস্কতা। চোখে আতঙ্ক ফুটল, লোকটার বেপরোয়া ভাব দেখেই সন্দেহ হচ্ছিল।

মিঃ কাপুর ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি ধারণা, ওর সঙ্গে পুলিশের যোগাযোগ আছে?

আমার ধারণায় কী যায় আসে বলুন।আভা হতাশ স্বরে বলল, এ রকম একটা অভিযোগ পেয়েও, পুলিশ কোনও গুরুত্বই দিতে চায়নি। লোকটার বেপরোয়া ভাব আর পুলিশের আচরণে কোনও যোগসূত্র আছে কি না, ঈশ্বরই জানেন।

মিঃ কাপুর মাথা ঝাঁকালেন, হুম, আপনার কথা ভেবে দেখবার মতো। কেননা অফিসার বলল, মিসেস মজুমদারকে কেন এ রকম লোক খুঁজে বেড়াবে, এর কোনও যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না। যাই হোক, আপনারা তো আর মিথ্যে অভিযোগ করতে আসেননি। আর এ কথাও সত্যি, আপনারা মিসেস মজুমদারকে আশ্রয়ও দেননি, তাই না? অফিসারের প্রশ্নে আমি পরিষ্কার জবাব দিলাম, না। আমি তাঁকে কোনও দিন চোখেই দেখেনি, খবরের কাগজে ছবি দেখেছি। বিজিত একটু থতমত খেয়েছিল, কিন্তু আশ্রয় না দেবার কথাটা কোনও ভাবেই বলতে পেরেছিল। অফিসারের পালটা জিজ্ঞাসায় মনে হল, আমরা আশ্রয় দিয়েছি কি না, সেটা জানতে সেও বেশ উৎসুক। তারপরে বলল, আপনারা কি চান, আপনাদের বাড়ির ওপর আমরা নজর রাখি?

কী বললেন আপনারা?’ আভা আঁতকে উঠল।

মিঃ কাপুর বলল, অফিসারকে বললাম, ঘটনা যা ঘটেছে, তা আপনাকে জানালাম। লোকটা সত্যি আমাদের কোনও জিনিসে হাত দেয়নি, খারাপ কথাবার্তাও বলেনি। এখন যা করা কর্তব্য, আপনারাই করবেন। মিঃ কাপুরের মোটা ভুরু জোড়া কুঁকড়ে জুড়ে গেল, পুলিশের নজর রাখার কথাটা আমারও বিশেষ মনে ধরেনি। গোড়া থেকেই সে আমাদের অভিযোগ তেমন মূল্য দিতে চায়নি। অথচ বাড়ির ওপর নজর রাখার কথা বলেছিল। জানি না, রেখেছে কি না।

আভার মুখ আতঙ্কে রক্তশূন্য দেখাল। কোনও কথা বলতে পারল না। মিঃ কাপুর ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, আমি আপনার মনের কথা বুঝতে পারছি। আরও একটা দুঃসংবাদ হল–আপনার পিসিমা বা বিজিত, বিজিতের বউ কেউই চায় না, আপনি আবার তাদের বাড়িতে ফিরে যান। এখানে আসবার আগেও, তাদের সঙ্গে বাড়িতেই আমার কথা হয়েছে।

এটা আমি অনুমান করেছিলাম। কথাটা বলতে গিয়ে, আভার স্বর রুদ্ধ হয়ে এল, তবে তাদের আমি দোষ দিতে পারি না।

মিঃ কাপুর মাথা ঝাঁকাল, হ্যাঁ, দোষ সত্যি তাদের দেওয়া যায় না। কেউই নিজেকে এভাবে বিপন্ন করতে চায় না।’ বলেই সে সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়াল। হিপ পকেট থেকে আভার নরম ছোট হাতব্যাগটা বের করে এগিয়ে দিল, আপনার পিসিমা এটা আপনাকে দিতে বললেন। আর আমার সামনেই ব্যাগ খুলে দেখিয়ে দিলেন, ভেতরে কী কী আছে। আপনি একটু মিলিয়ে নেবেন?

দরকার দেখছি না। আভার বিষণ্ণ স্বর। আয়ত দিশাহারা দুই চোখের কোণ চিকচিক করছে। ও ব্যাগটা হাতে নিল। বব সেটার ওপর হাত রাখলে।

মিঃ কাপুর বলল, তবু আমিই বলছি। আপনার ব্যাগে সামান্য কিছু ক্যাশ টাকা ছাড়া, চেক বই আর একটা ডট পেন আছে। আর আছে একটা হিরার আংটি, মেয়েদের কানের দুটো মুক্তোর অলংকার।

আভা জানে পিসিমাকে এ সব বিষয়ে অবিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। ও মাথা ঝাঁকিয়ে, প্রায় চুপিচুপি স্বরে বলল, ঠিক আছে।

কিন্তু আসলে ওর কিছুরই ঠিক নেই। মিঃ কাপুরের একটি কথাই ওর কানে বাজছে, কেউ-ই নিজেকে এভাবে বিপন্ন করতে চায় না।’ এবং মিঃ কাপুর এ কথাও বলতে ভোলেনি, তাকে ভাঙা পাঁচিল ডিঙিয়ে এ বাড়িতে আসতে হয়েছে। সেটা নিজেকে বিপন্ন করার থেকেও, আভার জন্যই বিশেষ করে। এদের সকলের কাছে ও কৃতজ্ঞ। সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মতো মনের অবস্থা বা ভাষা এখন ওর অনায়ত্ত। নিজের মা, দাদা, দিদি এবং আরও তিন জনের আশ্রয় ছেড়ে ওকে এ ভাবেই পালিয়ে আসতে হয়েছে। সম্ভবত, একমাত্র নীলিমাকে ছাড়া ও সবাইকেই ওর বিপদের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছিল। যারা ওকে আর ববকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, তারা যে ঠাণ্ডা মাথার হিংস্র খুনি, সেটা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। অতএব, ওকে আশ্রয় দেবার দায়িত্ব নিয়ে, সেই সব লোকের হাতে নিজেদের জীবনকে কেউ সঁপে দিতে পারে না। এমনকী নিজের মা ভাই বোন দাদা দিদিও না। আভার পক্ষে এ কথাটা হৃদয়ঙ্গম না করতে পারার আর কোনও কারণ নেই।

আভার চোখের সামনে সেই ভয়ংকর দৃশ্যগুলো ভেসে উঠছে। সতেরো দিন আগে, তখনও একটু শীত, সন্ধ্যায় নিজেদের বাড়িতে ফিরছিল। ও একজনের কাছে একটা চাকরির উমেদারি করে ফিরছিল। সঙ্গে ববকে নিয়ে গিয়েছিল। মায়ের পক্ষে ববকে রাখা সম্ভব ছিল না। তাঁর সারা শরীরে আর্থারাইটিসের কষ্ট। বলতে গেলে শয্যাশায়ী। একেবারে ছোট বোন জবা একটা চাকরি করে। রাত্রি নটার আগে কোনও দিনই বাড়ি ফেরে না। ছোট ভাই তরুণের কোনও প্রশ্নই নেই। সেও চাকরি করে, এবং সকালে বেরিয়ে, রাত্রে ফেরার কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই। জবা তরুণ, কেউ বিয়ে করেনি। ওদের আয়েই সংসার চলে। মা ওদের ওপর নির্ভরশীল। অবিশ্যি দাদা অরুণ, দিদি শোভা মাকে কিছু সাহায্য করে। ভাড়াটে ফ্ল্যাটে কাজের লোক একটিই–একজন সবসময়ের মাঝবয়সি নেপালি স্ত্রীলোক। নাম মাইলি।

আভা রিকশার ভাড়া মিটিয়ে যখন ফ্ল্যাটের গেট দিয়ে ঢুকতে যাচ্ছিল, তখনই ওর ওপরে একজন ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে প্রথমেই ববকে ওর কোল থেকে ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করেছিল। শীতের সন্ধ্যায় রাস্তায় আলো জ্বলছিল। যদিও গেটের সামনে কোনও আলো ছিল না। রাস্তার আলোয় ঝাপসা মতো ছিল। লোকজনও মোটামুটি চলাফেরা করছিল। ও চিৎকার করে উঠেছিল। ববকে আঁকড়ে, গেটের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। চিৎকারের মুহূর্তেই, ওর মুখে সপাটে একটা থাপ্পড় পড়েছিল। ববের গায়েও লেগেছিল। গেটের সামনে, লম্বা ফালি জায়গায়, অন্যান্য ফ্ল্যাটের কয়েকজন চাকর গল্প করছিল। তারা ছুটে এসেছিল। তার মধ্যে লোকটা ববের পা ধরে হ্যাঁচকা টান মেরেছিল। আর একটু হলেই বব পিছলে মাথা নিচু অবস্থায় লোকটার হাতে চলে যেত। আভা আবার চিৎকার করে, ববকে জড়িয়ে নিয়ে বসে পড়েছিল। ফ্ল্যাটের কাজের লোকেরা তখন সামনে এসে পড়েছিল। নিচু স্বরে ইংরেজিতে গর্জে উঠেছিল। মনে রাখিস কুত্তি, তোকে আর তোর বাচ্চাকে আমি ছাড়ব না।’…

ঘটনাটা এমনই আকস্মিক আর আতঙ্কজনক, আভা প্রথমে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। তবে সেটাই ছিল শুরু। ওর ঠোঁট আর মাড়ি ফেটে রক্ত বেরিয়েছিল। কোমরেও শক্ত চোট লেগেছিল। যারা ওকে ঘিরেছিল, তারাও ব্যাপারটা কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। আভাকে চারতলায় উঠতে সাহায্য করেছিল। বব কাঁদছিল। আভা মা’কে সব কথাই বলেছিল। মায়ের চোখ দুটো আতঙ্কে বড় হয়ে উঠেছিল। কেবল বলেছিলেন, এ নিশ্চয়ই ওদের কাজ।

আভার মনেও সেই সন্দেহই হয়েছিল। রাত্রে তরুণ আর জবাকেও ঘটনা বলা হয়েছিল। ওরা দুজনেই টিপসি ছিল। রোজই থাকে সন্ধ্যার পরে। তরুণ রীতিমতো মাতাল। ওরা ব্যাপারটার মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারেনি। বরং আভার সাম্প্রতিক বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মেলামেশা নিয়ে, নানা রকম জল্পনা কল্পনা করেছিল। যার অর্থ, প্রেমবশত আভার ওপর ঈর্ষার কারণেই, কেউ ও রকম করে থাকবে অথচ আভা কারোর সঙ্গে সে রকম মেলামেশাই করছিল না। ওর সমস্ত জীবনটাই তখন পট পরিবর্তনের মুখে, অন্য খাতে বইছিল।

আভা বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করে দিয়েছিল। রাস্তার ধারের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে লক্ষ করার চেষ্টা করত, এ ফ্ল্যাটের দিকেই কেউ নজর রাখছে কি না। বুঝতে পারত না। সারকুলার রোডের কাছ ঘেঁষে, পাড়াটা একটু ফাঁকাই। তারপরেই একটা ঘটনা ঘটেছিল। আভা প্রায়ই তিনতলায় একটি ফ্ল্যাটে যেত। ঘটনার তিন দিন পরে, দুপুরে ও সেই ফ্ল্যাটে গিয়েছিল। বিকেলে নিজেদের ফ্ল্যাটে ফিরে ও মায়ের কাছে শুনেছিল, একটি লোক ওকে খুঁজতে এসেছিল। নাম বলেনি। মাইলি দরজা খুলে দিতেই সে ঘরের মধ্যে ঢুকে এসেছিল। বেপরোয়া লোকটার ভাবভঙ্গি ছিল খুবই খারাপ। সে শোবার ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিল। মাকে আর মাইলিকে জিজ্ঞেস করেছিল, আভা কোথায় গিয়েছে। দুজনেই জবাব দিয়েছিল, কিছুই জানে না। লোকটার জ্বলজ্বলে চোখে ছিল সন্দেহ আর অবিশ্বাস।

আভার বুকের মধ্যে কেঁপে উঠেছিল। তরুণ আর জবা ভয় পেয়েছিল, বিরক্তও হয়েছিল। তারপরের দিনই, তরুণ আর জবাকে অফিসে টেলিফোন করে, কেউ আভার কথা জানতে চায়। ওরা দুজনেই বলেছিল, আভার সংবাদ ওদের জানা নেই। সে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে। আভা রাস্তার ধারের ব্যালকনিতে যাওয়া বন্ধ করেছিল, এবং তাড়াতাড়ি কোথাও পালাবার কথাই ভেবেছিল। সেই দিনই, শীতের অকাল সন্ধ্যায়, আর একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছিল।

আভা ফ্ল্যাটের পিছনে, একটা জানালার ধারে ববকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বব বাইরে যাবার জন্য। কান্নাকাটি করছিল। ওকে ভোলাবার জন্য, জানালায় দাঁড়িয়ে, পিছনের গলি পথটার দিকে দেখাচ্ছিল। ভেবেছিল, পিছনের রাস্তাটা নিরাপদ। হঠাৎ ওর কানের পাশে সজোরে এসে কিছু লেগেছিল। তৎক্ষণাৎ দুম করে একটা শব্দ, আর জানালার কাচের শার্সি ঝনঝন করে ভেঙে পড়েছিল। গুলি! আভা ববকে নিয়ে ঝটিতি বসে পড়েছিল। বসেও ও দেরি করেনি। ববকে নিয়ে, বাইরের দরজা খুলে, সিঁড়ি ভেঙে, সেই তিনতলার ফ্ল্যাটে গিয়ে ঢুকে পড়েছিল। যাবার আগে মাইলিকে কেবল বলেছিল, কেউ খুঁজতে এলে বলে দিয়ো, আমি নীচে নেমে গেছি থানায় যাবার জন্যে। আর একটা কথাও না।

বাবা পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করে দেবার পরে, সেই ফ্ল্যাটে চারতলায় ভাড়া এসেছিলেন। ব্যবস্থা করেছিলেন, তাঁরই এক উকিল বন্ধু, যিনি এখনও বেঁচে আছেন, এবং তিনতলায় থাকেন। অবস্থা খারাপ হলেও বাবা ছেলেমেয়েদের ভাল ইংলিশ মিডিয়াম ইস্কুলেই পড়াতেন। আভা তখন ইস্কুল পড়ত। উকিল ভদ্রলোকের একমাত্র মেয়ে দীপাও ওর সঙ্গে একই ইস্কুলে পড়ত। দীপার বাবা আভাকে ভালবাসতেন, এখনও বাসেন। ওর জীবনে, এই পিতৃবন্ধু, আইনজীবী মিঃ মল্লিকের একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। সেটা অবিশ্যি অনেক পরের ঘটনা। দীপা এখন বম্বেতে থাকে। তবু ওদের পরিবারের সকলের সঙ্গেই ওর বিশেষ ঘনিষ্ঠতা। বিশেষ করে, দীপার ওপরের দাদা সুকান্ত, বলতে গেলে এক সময়ে ওর প্রেমিক ছিল। এখন অবিশ্যি সুকান্ত আর বাবার সঙ্গে থাকে না। সে বিয়ে করেছে, বড় চাকরি করে। আলিপুরে থাকে। ছুটির দিনে আসে। দীপার বাবা এখনও প্র্যাকটিস চালিয়ে যাচ্ছেন, বয়স যদিও সত্তর অতিক্রম করেছে। দীপার মা আছেন। আর ওর বড়দা, তার স্ত্রী এবং দুটি ছেলে মেয়ে সেই ফ্ল্যাটে থাকে। আভা দীপার বড়দাকে বড়দা এবং বড় বউদিকে বড় বউদি বলে ডাকে। দীপার বাবা-মাকে মাসিমা ও মেসোমশায়।

জানালায় গুলি ছিটকে আসার পরেই, ও তিনতলায় দীপাদের ফ্ল্যাটে চলে গিয়েছিল। ওর চোখমুখের অবস্থা দেখে, বড় বউদি আর মাসিমা শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন। মেলোমশায় তখনও কোর্ট থেকে ফেরেননি। ও সমস্ত ঘটনা বলেছিল। আগের ঘটনাও তাঁদের জানা ছিল। মাসিমা বলেছিলেন, তোমার মেসোমশাইকে বাড়ি ফিরতে দাও। তিনি কী বলেন, শোনা যাক।

আভা যে আশঙ্কা করেছিল, তা ঘটেনি। সেই সন্ধ্যায় বা রাত্রে আর কেউ ওদের ফ্ল্যাটে আসেনি। মিঃ মল্লিক বাড়ি ফিরে সব শোনার পরে, একেবারে গুম খেয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর রেখাবহুল বৃদ্ধ মুখেও মোটা লেনসের ভিতরে দুই চোখে গভীর উৎকণ্ঠা ফুটে উঠেছিল। প্রথমে কেবল উচ্চারণ করেছিলেন, এটা নিছক হত্যার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু না।’…তিনি প্রথমে দিনের ঘটনা শুনেও, মায়ের কথারই প্রতিধ্বনি করেছিলেন, এটা ওদেরই কাজ।তারপরে আভাকে তাঁর ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরোতে বারণ করে জামাকাপড় বদলেছিলেন। চা খেতে খেতে, চিন্তিত উৎকণ্ঠিত মুখে বলেছিলেন, এর পরে থানায় সংবাদ দেওয়াই সঙ্গত। কিন্তু তোমার পক্ষে সেটা সম্ভব না। তরুণ আর জবা যদি থানায় যেতে চায়, যাবে। বলতে গেলে, তুমি এখন এক ভয়ংকর শত্রুর বন্দুকের মুখে আছ। আমার ফ্ল্যাটও তোমার পক্ষে নিরাপদ না। ঠিকমতো ভেবে দেখতে গেলে, বিপদ আমাদেরও। তুমি আমাদের ফ্ল্যাটে আছ জানলে, ওরা আমাদের ওপরেও হোস্টাইল হয়ে উঠবে। তার মানে এই না, তোমাকে আমি তোমাদের ফ্ল্যাটেই ফিরে যেতে বলছি। তোমাকে এই ফ্ল্যাট বাড়ি থেকেই অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। আর তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, তাই করতে হবে। অথচ খুব সাবধানে।

আভা একটা কথাও বলতে পারেনি। তখনও ওর চোখে প্রচুর জল ছিল। ঝরেও ছিল। এখন ঝরবার মতো জলও, আতঙ্কে শুকিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তখনও অসহায় ভয়ে, অঝোরে কেঁদেছিল। মিঃ মল্লিক বলেছিলেন, তোমার বড় ছেলে, জোজোর কেস নিয়ে, তোমাকে আমি অনেক কথা বলেছি। কেস চলার সময়ে, তোমাকে আমি একরকম বলেই দিয়েছিলাম, এ কেসে তোমার পক্ষে জেতা প্রায় অসম্ভব। ঠিক তাই ঘটেছে। তখনই আমার মনে একটা খটকা লেগেছিল। হোয়াট নেক্সট? জোজোর কেসের পরেই সব শেষ হতে পারে না, তারপরেও অনেক কিছু থেকে যাচ্ছে। সেই থেকে যাওয়ার ব্যাপারটাই হল এই সব ঘটনা। এই পর্যন্ত বলে তিনি অনেকক্ষণ চুপ করে ছিলেন। কম্পিত হাতে চুরুট ধরিয়ে ছিলেন।

আভার সঙ্গে কথা বলবার সময়, মাসিমা আর বড় বউদিও মেলোমশায়ের সামনে, স্তব্ধ উৎকণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারপরে মেলোমশায়, প্রায় একরকম ভেঙে পড়ে বলেছিলেন, আভা, তোমাকে আমি আমার মেয়ের মতোই ভালবাসি। আমি একজন আইনজীবী। আইন কী, বিচার কী, আমি কিছু জেনেছি। অনেক মামলায় জিতেছি, হেরেছিও, কিন্তু সদর্থে, সুবিচার আর মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের সঙ্গে, তার যোগসূত্র কতটা আজ এই বয়সে সেটাও যেন বুঝে উঠতে পারছি না। তোমাকে আর কী বলব। এর পরে, সরকার আর গণতন্ত্রর কথা বলতে গেলে, তা তোমার কাছে আরও নিষ্ঠুর বলেই মনে হবে। ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান হন, আর তিনি তোমাকে রক্ষা করতে চান, তবেই তুমি রক্ষা পেতে পারো। এর বেশি আর কিছুই বলতে পারছি না। তাঁর চোখের কোল থেকে, ভাঙাচোরা রেখাঙ্কিত গালে জলের রেখা চিকচিক করে উঠেছিল।

মাসিমা মেসোমশায়কে শান্ত করার জন্য তাঁর কাঁধে হাত রেখেছিলেন। তিনি অস্থির ভাবে বলে উঠেছিলেন, এ সব করার সময় নেই। এখুনি আভাকে এ বাড়ি থেকে অন্য কোথায় পাঠানো যায়, সেটাই ভেবে দেখতে হবে। সম্ভব হলে ওর কিছু জামাকাপড়, পয়সাকড়ি কিছু থাকলে, এখনই সে সব নিয়ে, এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে, একটা অন্য আশ্রয়ে যাওয়াটাই সবথেকে জরুরি।

বড় বউদিই চিন্তা করে, আভার এই বাড়ি থেকে বেরোবার পথ করে দিয়েছিলেন। তিনিই একটা ব্যাগে, ওর কিছু শাড়ি জামা আর, হাতব্যাগটা চারতলা থেকে নামিয়ে এনেছিলেন। আভা চারতলায় উঠে, মায়ের সঙ্গে দেখা করে আসতে পারেনি। পাশের বাড়িটি ছিল পার্শিদের। সেই বাড়িতে যাবার একটা দরজা ছিল, পাঁচিলের শেষ দিকে। যা কখনওই খোলা হত না। বড় বউদি নিজে পার্শিদের বাড়ি গিয়ে পাঁচিলের ওপাশ থেকে সেই দরজা খুলিয়েছিলেন। পার্শিদের বাড়ির সংলগ্ন একটি একতলা মুসলমান বাড়ি। বলেকয়েই, তাদের বাড়ির ভিতরে পাঁচিল ডিঙিয়ে ঢুকতে হয়েছিল। সেই বাড়ির পিছনের দরজা খুললেই, একটা মসজিদ। মসজিদ ঘিরে একটা বস্তি। সেই বস্তির ভিতর দিয়ে আভা পালিয়েছিল। বড় বউদি বলে দিয়েছিলেন, সুকান্তর নিউ আলিপুর বাড়িতে যেতে। আভা একটা টাক্সি নিয়ে, সেখানে গিয়েছিল।

কিন্তু বড় বউদি বুঝতে ভুল করেছিলেন। সুকান্তর স্ত্রীকে তিনি যথার্থ চিনতেন না। সপ্তাহান্তে সুকান্ত স্ত্রী চন্দ্রাকে নিয়ে বাবা মায়ের কাছে আসে। এলে, আভাও যেত। আভার সঙ্গে চার মোটামুটি ভাবই ছিল। অনেক রাত্রি অবধি গল্প, পান-ভোজন চলত। কিন্তু আভা যখন ববকে নিয়ে সেই রাত্রে সুকান্তর। বাড়ি গিয়েছিল, চন্দ্রা মোটেই খুশি হয়নি। সব ঘটনা শোনার পরে একেবারেই বেঁকে বসেছিল। সুকান্তর পক্ষে সম্ভব ছিল না, আভার সঙ্গে অতীত প্রেমের কথা মনে রেখে চন্দ্রার বিরুদ্ধাচরণ করবে। সে চন্দ্রাকে এক রাত্রি আশ্রয়ের জন্য সম্মত করাতে পেরেছিল। পরের দিনই, সন্ধ্যার পরে, সুকান্ত আভাকে পৌঁছে দিয়েছিল ওর নিজের বড়দার বাড়িতে।

বড়দা তরুণের কাছ থেকে টেলিফোনে সব সংবাদই পেয়েছিল। তরুণ বা জবা, পুলিশকে কোনও খবর দেয়নি। অরুণের কাছে পরামর্শ চেয়েছিল। অরুণ নেতিবাচক জবাব দিয়েছিল, ব্যাপারটা ঠিক। বোঝা যাচ্ছে না। সত্যি জানালায় গুলি করেছিল কি না, সেটা ঠিক দেখতে হবে। পুলিশকে খবর দিলেই বা তারা কী করে এ রহস্য ভেদ করবে?

আভা অরুণের বাড়ি ঢুকেই বুঝতে পেরেছিল, ও সেখানে আদৌ বাঞ্ছিত না। বউদিরও মনোভাব একই রকম ছিল। যদিও সামনে কেউ-ই রূঢ় আচরণ করেনি। তবে, অরুণ পুরনো দিনের কথা তুলেছিল। উদ্দেশ্য ছিল, আভাকে জানিয়ে দেওয়া, বাবার মৃত্যুর পরে, ও সিনিয়র কেমব্রিজ পরীক্ষা না দিয়েই, কী রকম যথেচ্ছাচার করে বেড়াত। কিন্তু এ কথা বলেনি, অরুণ পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল, ভাই-বোনদের পড়াশোনার দায়িত্ব সে বহন করতে পারবে না। শোনাতে ছাড়েনি, মা আভাকে প্রশ্রয় দিয়ে, জাহান্নামের পথে ঠেলে দিয়েছিলেন। তারই পরিণতি, এই বর্তমান অবস্থা।

আভা অরুণের মুখের ওপর জবাব দিতে পারেনি। কিন্তু জবাব দেবার মতো অনেক কথা ছিল। বাবার মৃত্যুর পরে, সংসারের চেহারা অনেকটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। দিদি শোভার বিয়ে আগেই হয়ে গিয়েছিল। অরুণের সঙ্গে তখন ওর স্ত্রীর প্রাক-বিবাহ প্রেমপর্ব চলছিল। আর বাবা ছাড়া, সংসারে তখন সেই ছিল একমাত্র উপার্জনশীল পুরুষ। আভা সিনিয়র কেমব্রিজের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। অবিশ্যি লেখাপড়ায় কখনও ও খুব ভাল ছিল না। দেখতে সুন্দরী, অনেকের দৃষ্টি কাড়বার মতো। সুকান্তর পক্ষেও সম্ভব ছিল না আভাকে প্রেমের জোরে আটকে রাখে। ওর স্তাবকের সংখ্যা আর পরিধি, ছাত্র সমাজকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। লাঞ্চ ডিনারে প্রচুর নিমন্ত্রণ। ভাল নাচতে পারত–পশ্চিমি নাচ। তরুণ আর জবাও ওর সঙ্গে যেত। নিমন্ত্রণ পেত অরুণও। এমনকী শোভা আর রঞ্জনদাও। শোভার বরের নাম রঞ্জন। আভার উপহার জুটত অনেক। তাও ভাগাভাগি হত। সেই অবস্থায়, জলির সঙ্গে হোটেলের ক্যাবারে ফ্লোরে পরিচয়। জলিকলকাতার বিখ্যাত স্যার জে. সি. মজুমদারের একমাত্র ছেলে, জলধর মজুমদার। উচ্চমহলে, জলি উচ্চারণেই, অজস্র উচ্ছ্বাসের ফোয়ারা উঠত। আর সেই জলির সঙ্গেই আভার বিয়ে হয়েছিল। অসামান্য ঘটনা। আর অসামান্য ঘটনাই ইতিহাস সৃষ্টি করে। কলঙ্কিত অথবা গৌরবের। বীভৎস অথবা সৌন্দর্যের।

অরুণ সেই সব পুরনো কথা তুলেছিল। উদ্দেশ্য, আভাকে ধিক্কার দেওয়া। উদ্দেশ্য, আভাকে বুঝিয়ে দেওয়া, এ শাস্তি ওর প্রাপ্য ছিল। এর সব দায়দায়িত্বও, অতএব আর কারোরই না, আভার–একমাত্র। আভা শুনেছিল, কোনও প্রতিবাদ করেনি। জবাব দেয়নি। নিছক ওর আর ববের শারীরিক অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। আশ্রয়ের জন্য। জানত, বউদির মনোভাব একই। তবু অরুণ ওকে তাড়িয়ে দেয়নি। দিত না, যদি না ঠিক দুদিন পরেই ওর বাড়িতে সেই টেলিফোন আসত, আমি বিভু ব্যানার্জি বলছি, চুমকির হাজব্যান্ড–আভা আমাদের বিশেষ বন্ধু। ও কি আপনার ওখানে আছে?

দাদা প্রথমেই জবাব দিয়েছিল, না, আভা তো আমার এখানে নেই। সে লোকটি যে-ই হোক, তারপরে বলেছিল, আমাকে বোধ হয় আপনার মনে আছে অরুণদা, আমি নাইট ডোভ হোটেলের বার ম্যানেজার। আভাকে বাড়িতে খোঁজ করে পাইনি। তরুণ জবারাও ঠিক বলতে পারছে না, ও কোথায় গেছে। তাই ভাবলাম, আপনার কাছে যদি গিয়ে থাকে। অরুণ স্পষ্টই জানিয়েছিল, না এখানে আভা আসেনি। এলে বলব। টেলিফোনের স্বর একটু যেন থমকে গিয়ে রহস্যের সঙ্গে বলেছিল, হুম, তা হলে তাই বলবেন। বলবেন, ওর বিশেষ প্রয়োজনেই, ওকে খুঁজছি।’…অরুণ বলেছিল, বলব। টেলিফোন ছেড়েই সে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। বলেছিল, এ কখনওই বিভু ব্যানার্জির গলা না। আমি তার গলা চিনি। তার মানে, হয় ওরা জানতে পেরেছে, আভা এখানে আছে। অথবা আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছে। কিন্তু নিশ্চয়ই আমার ফ্ল্যাটে নজর রাখতে আরম্ভ করেছে।

বিভু ব্যানার্জি যে টেলিফোন করেনি, পরের দিনই অরুণ খোঁজ নিয়েছিল। সে নিজেই বিভুকে ওর হোটেলে টেলিফোন করেছিল, না, আমি তো আভার খোঁজ করিনি। কেন বলুন তো?’ পালটা প্রশ্নে অরুণকে বলতে হয়েছিল, না, আসলে আভা কোথায় গেছে, কিছুই জানি না। গতকাল রাত্রে একজন। আমাকে টেলিফোন করে জিজ্ঞেস করছিল। মনে হল, গলাটা তোমারই। আমি আর তখন নাম টাম কিছু জিজ্ঞেস করিনি। বিভু বলেছিল, না দাদা, আমি ফোন করলে নাম বলতাম। আভা কি ওর মায়ের কাছে। নেই?’ অরুণ জবাব দিয়েছিল, না। বিভু তারপরে আর কোনও কৌতূহল বা উৎসাহই দেখায়নি, টেলিফোন ছাড়বার আগে কেবল বলেছিল, কপালটা ওর সত্যি খারাপ।

অরুণ আরও শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল। আভার শঙ্কা ছিল আরও তীব্র। আশ্রয়দাতার শাস্তি কী ছিল, ওর ধারণা ছিল না। কিন্তু ওর কপালে কী ছিল, সে অভিজ্ঞতা ছিল। ওর ষষ্ঠেন্দ্রিয় ইঙ্গিত দিয়েছিল, ওরা যে কোনও সময়েই অরুণের বাড়িতে হানা দিতে পারে। অরুণের ফ্ল্যাটের মুখোমুখি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা ছিল সুখী পায়রার মতো এক নবদম্পতি। মেয়েটি স্বামীকে অফিসে যাবার সময় বিদায় দিতে, দু-একবার আভাকে দেখেছিল। আভার কোলে ববকে দেখেই মেয়েটির দৃষ্টি বেশি আকৃষ্ট হয়েছিল। আভা সেই সুযোগ নিতে ছাড়েনি। ববকে কোলে নিয়ে মেয়েটির দরজায় কলিং বেল বাজিয়েছিল। যেচে আলাপ করেছিল। এইটুকু করবার মতো গুণ ওর যথেষ্টই ছিল। জীবনে ওকে দেখে কেবল পুরুষই ভোলেনি। ওর ব্যবহার মেয়েদের মুগ্ধ করতে সক্ষম ছিল। সবথেকে বড় সুবিধা ছিল, সেই মুখোমুখি ফ্ল্যাটেও টেলিফোন ছিল। আভা মেয়েটির এক ঝিসহ সংসারের নিঃসঙ্গতা কাটিয়েছিল। মেয়েটি খুশিই হয়েছিল। বিশেষ করে ববকে তার খুব পছন্দ ছিল। কেবল, আভার প্রকৃত পরিচয়টা সে জানত না।

আভা সেই বাড়ি থেকে, লুকিয়ে রাস্তার দিকে চোখ রাখত। যদিও কারোকেই ওর চেনবার উপায় ছিল না। কিন্তু দুপুরে অরুণের ফ্ল্যাটে খেতে যেতেই হত। মেয়েটির স্বামী ফিরে আসার আগে, আসন্ন সন্ধ্যায় চলে যেতেই হত। আর তারপরেই সেই আতঙ্কজনক ভয়ংকর একটা অপ্রত্যাশিত কিছুর প্রতীক্ষা। অরুণ তার ছেলে মেয়ে দুটির সঙ্গেও ভাল করে কথা বলত না। বউদির সঙ্গেও না। আভার সঙ্গে তো একেবারেই না। এসেই মদের বোতল নিয়ে বসে যেত। তারপরেই, চতুর্থ দিনে, অরুণ বেরিয়ে যাবার এক ঘণ্টা পরে ওরা এসেছিল। আভা তখন ববকে নিয়ে, উলটো দিকের ফ্ল্যাটে। সেই ফ্ল্যাটের টেলিফোন বেজে উঠেছিল। মেয়েটিই টেলিফোন ধরেছিল, এবং আভাকে বলেছিল, আপনার বউদি কথা বলবেন।

আভার বুকের মধ্যে ছাঁৎ করে উঠেছিল। মেয়েটির সামনে ও মুখের রক্তশূন্য আতঙ্ক চাপতে পারেনি। বউদি বলেছিল, দুটো লোক তোমাকে খুঁজতে এসেছিল। এক জন বাইরে দাঁড়িয়েছিল, আর এক জন ভেতরে ঢুকেছিল। বেপরোয়া লোকটা প্রায় আমাকে ঠেলেই ঘরের মধ্যে ঢুকে, গোটা ফ্ল্যাট তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। আমাকে আর অতুলকে (কাজের লোক) জিজ্ঞেসও করেছে, তুমি ববকে নিয়ে এখানে এসেছিলে কি না। আমরা না বলে দিয়েছি। যাবার সময় আবার এ ভাবে বাড়ি ঢোকবার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করে গেল। কিন্তু লোক দুটোকে দেখলেই ভয় লাগে। তুমি কী করবে ভেবে দেখ। আমি এখুনি তোমার দাদাকে অফিসে টেলিফোন করে সব কথা জানাচ্ছি।’.বউদি লাইন কেটে দিয়েছিল। মেয়েটি অবাক জিজ্ঞাসু চোখে আভার মুখের দিকে তাকিয়েছিল, কোনও দুঃসংবাদ নাকি?

আভার বুকের মধ্যে কাঁপছিল। জিভ অনড়। কথা বলতে পারেনি। কেবল ঘাড় ঝাঁকিয়েছিল, যার মানে, হ্যাঁ। কিন্তু বাঁচবার প্রেরণা মানুষকে বেশিক্ষণ নিষ্ক্রিয় অবশ করে রাখতে পারে না। বিশেষত যেখানে মায়ের কাছে সন্তানের প্রাণও বিপন্ন। মেয়েটিকে সব কথা বলার পরিণাম কী হতে পারে, সেই দিগন্ত ওর অজানা। তবু ও বলতে বাধ্য হয়েছিল, ওর আর ববের জীবন বিপন্ন। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে। দাদার ফ্ল্যাটে ওকে খুঁজতে আসা, এবং সেখানে আর ফিরে না যেতে পারার কথা বলেছিল। স্পষ্টতই মেয়েটি ভয় পেয়েছিল। কিন্তু স্বামীর ফিরে আসা পর্যন্ত সে আভাকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছিল। আধ ঘণ্টা পরে, অফিস থেকে দাদার টেলিফোন এসেছিল। সে পরিষ্কার বলেছিল, তোর বউদির মুখ থেকে যা শুনলাম, এর পরে কোনও রিস্ক নিতে আমি ভয় পাচ্ছি। যারা ও রকম ভাবে জোর করে ঘরে ঢুকতে পারে, তারা যা খুশি তাই করতে পারে। ওদের পেছনে কত বড় শক্তি কাজ করছে, তাও তোকে বুঝিয়ে বলতে হবে না। কলকাতা সম্পর্কে কত লোকে কত কী বলে, পদ্য লিখে দেয়ালে টাঙায়, কিন্তু কলকাতায় কারা আসলে রাজত্ব করে সেটা ভেবে দেখার দরকার। ছেলেমেয়ে বউ নিয়ে তুই আমাকে বাঁচতে দে। আমি জানি ওরা আবার আসবে। তুই নিশ্চয় আমাকে স্বার্থপর ভাববি, তবু বলছি, আমার ফ্ল্যাটে আর ঢুকিস না। পাশের ফ্ল্যাট থেকেই কোথাও চলে যাবার ব্যবস্থা কর।’ টেলিফোনে দাদার গলা কাঁপছিল। আভা কোনও রকমে বলেছিল, তাই হবে।

তারপরে ও নিজেই অরুণের ফ্ল্যাটে গিয়ে ওর জামাকাপড়ের ব্যাগ আর হাতব্যাগটা নিয়ে এসেছিল। আসন্ন সন্ধ্যায় মেয়েটির স্বামী ফিরে এসেছিল। আভাকে আর ববকে দেখে, তেমন একটা অবাক হয়নি। কিন্তু শোবার ঘরের ভিতরে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার পরেই, তার মুখের চেহারা বদলে গিয়েছিল। আভা বাইরের ঘরে বসে ছিল। যুবকটির মুখে গাম্ভীর্য থাকলেও, চোখে ছিল অবাক কৌতূহল। সে আভার সামনে এসে বলেছিল, আপনাকে প্রথম দিন দেখেই আমার কেমন চেনা মনে হয়েছিল। এখন চিনতে পারছি, কাগজে আপনার ছবিও দেখেছি। যোগাযোগটা অদ্ভুত, ভাবতেই পারিনি। যাই হোক, আমার স্ত্রীর মুখ থেকে যতটুকু শুনেছি, তাতেই আপনার অবস্থা আমি মোটামুটি বুঝে নিয়েছি। এ অবস্থায়, ওপনলি রাস্তায় বেরিয়ে, আপনি পুলিশের কাছেও যেতে পারছেন না। আপনাকে ফ্র্যাংকলি বলছি, আমি কলকাতায় অনেক কাল আছি, আসলে কলকাতার লোক নই। প্রবাসী বাঙালি। চাকরির দৌলতে ফ্ল্যাট আর গাড়ি, কিন্তু বন্ধুবান্ধব ডেকে পার্টি দিই না। বিয়ে না করলে, কোথাও পেয়িং গেস্ট হিসাবেই কাটিয়ে দিতাম। আমি কলকাতাকে চিনি না। আপনার দাদাই যখন আপনাকে শেলটার দিতে পারছেন না, সেখানে আমি কী করে সে সাহস দেখাব।

আপনাকে আমি সে দায়িত্ব নিতে বলতে পারি না। আভা বলেছিল, আমি যাবার জন্যই প্রস্তুত। কী ভাবে যাব, সেটাই ভাবছি। আর তা ছাড়া, আপনার কাছে আমার একটাই জিজ্ঞাসা, আপনার দিক থেকে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারি তো?

যুবকটি ভ্রুকুটি অবাক চোখে তাকিয়েছিল। কিন্তু সে বুদ্ধিমান। হেসে উঠে বলেছিল, হান্ড্রেড পার্সেন্ট! আমার নিজের সিকিউরিটির জন্যেই আমার ফ্ল্যাটের কথা কারোকেই বলব না। বরং আপনাকেই আমার বিশেষ অনুরোধ, আমার কথা কোথাও বলবেন না। আপনি এখন কোথায় যেতে চান, কিছু ভেবেছেন?

হ্যাঁ ভেবেছি৷’ আভার স্বরে দ্বিধা ও নৈরাশ্য ছিল, এবং মনে গভীর আতঙ্ক, কিন্তু বেরোব কী ভাবে, বুঝতে পারছি না। জানি না, এ বাড়ির ওপর নজর রেখে কেউ বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কি না।’

যুবকটি একটু ভেবে বলেছিল, আপনি একটা কাজ করতে পারেন। এই ফ্ল্যাট থেকে নেমে, গাড়ি পার্কিং পেরিয়ে, পাশের ব্লকে চলে যান। পাশের ব্লকের ঢোকবার রাস্তা অন্য উলটো দিকে। আমি সেখান থেকে আপনাকে আমার গাড়িতে তুলে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি।

আভা যুবকটির চোখের দিকে তাকিয়েছিল। কিন্তু চোখে সন্দেহ ফুটতে দেয়নি। অবাক হয়েছিল, তার সাহস দেখে। এবং পৌঁছে দিতে রাজি হওয়ার কথাও। ও এতটা প্রত্যাশা করেনি। তবুও, ওকেই সাহসে বুক বাঁধতে হয়েছিল। ব্যাগ আর ববকে কোলে তুলে, মেয়েটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। লিফটে নামবার সময় ওর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। ফ্ল্যাট বাড়ির চৌহদ্দিতেই কেউ ওর জন্য ওত পেতে বসে নেই তো? নীচে নেমে, কোনও দিকে না তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে, ও পার্ক করা গাড়িগুলোর আড়ালে চলে গিয়েছিল। পাশের ব্লকে পৌঁছে, কয়েক মিনিট সময় নিয়েছিল, উলটো দিকের গেটে যেতে। ও একটা গাড়িকে, পাশের ব্লকের পিছন দিয়ে বেরোতে দেখেছিল। কয়েকজন অচেনা লোক ওর আশপাশ দিয়ে যাতায়াত করছিল, যাদের মুখের দিকে ও তাকায়নি। ও যখন পাশের ব্লকের বাইরের গেটের কাছে গিয়েছিল, যুবকটি তখন গাড়িতে ওর জন্যে বসে ছিল। কাছে যেতে, নিজেই পিছনের দরজা খুলে দিয়েছিল। আভা দ্রুত ব্যাগ আর ববকে নিয়ে গাড়িতে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছিল। গাড়িও তৎক্ষণাৎ স্টার্ট করেছিল। যুবকটি সামনে থেকে, গন্তব্য জানতে চেয়েছিল। আভা রাস্তার নাম ঠিকানা বলেছিল।

গন্তব্যে পৌঁছুতে সময় লেগেছিল মিনিট পাঁচেক। যুবকটি ওকে নামিয়ে দিয়েই, কোনও রকমে হাত তুলে, বিদায় নিয়েছিল। আভা দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে তেতলায় উঠেছিল। একটা দরজায় কলিং বেল টিপেছিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দরজা খুলে গিয়েছিল। দরজার সামনে দিদি শোভা। তার চোখ দুটো আতঙ্কে বড় হয়ে উঠেছিল। প্রথম চিৎকার করে উঠেছিল, তুই! তারপর নিজেই মুখে হাত চাপা দিয়ে, দরজার কাছ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল। আভা ঢুকতেই দরজা বন্ধ করে, ভয়ংকর স্বরে বলেছিল, মাত্র দশ মিনিট আগে ওরা তোকে এখানে খুঁজতে এসেছিল।

কারা?’ আভা ববকে আর ব্যাগটা হাতে নিয়ে, শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।

শোভা বলেছিল, চিনি না। দুটো লোক এসেছিল। একজন সোজা ঘরের মধ্যে ঢুকে এসেছিল।’..

শোভার বলার ফাঁকেই রঞ্জনদা এগিয়ে এসেছিল। তার চোখে উৎকণ্ঠিত বিস্ময়, ওরা তোমাকে দেখতে পায়নি তো?

আভা দাঁড়াতে পারছিল না। শোভার মেয়ের বয়স প্রায় দশ। সে এগিয়ে এসে ববকে কোলে নিয়েছিল। আভাকে কাঁপতে দেখে, শোভা ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে, সোফায় বসিয়েছিল। আর লোকটার বেপরোয়া ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে, খোঁজার কথা বলছিল। রঞ্জনদার তখনও একটাই জিজ্ঞাসা, ওরা তোমাকে দেখতে পায়নি তো?

আভা নিঃশব্দে মাথা নেড়েছিল, আমি কারোকে দেখতে পাইনি।

ওরা শাসিয়ে গেছে, আবার আসতে পারে। শোভা বলেছিল, লোকটা বারেবারেই বলছিল, আভা কোথায় আছে জানলে বলে ফেলুন। জানতাম তো বটেই, তুই অরুণের ওখানে ছিলি। অরুণ টেলিফোনে রঞ্জনকে বলেছে। কিন্তু আমরা বলেছি, জানি না। ওরা চলে যাবার পরে রঞ্জন আমাকে বোঝাচ্ছিল, কেন ওরা তোকে খুঁজছে৷’ বলতে বলতে শোভা শিউরে উঠেছিল।

রঞ্জন বলেছিল, আমি কিছুই ভুল বলিনি। ওরা আভাকে আর ববকে এই পৃথিবী থেকে সে কথাটা শেষ করেনি। ববকে কোলে, সামনে দাঁড়ানো নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়েছিল।

বাড়িতে মেলোমশায় আমাকে সে কথা ভাল করেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। আভা রুদ্ধ চুপিচুপি স্বরে বলেছিল। চোখে অসহায় আতঙ্ক, কিন্তু আমি তো ওদের কাছে কিছুই বলতে যাইনি।

রঞ্জন বলেছিল, তোমার কথা না বলায় কিছু যায় আসে না।

আভা হাত তুলে, মাথা ঝাঁকিয়েছিল। ও সবই বুঝতে পেরেছিল। শোভা ভয় শিহরিত স্বরে বলেছিল, ওরা করতে পারে না, এমন কোনও কাজ নেই। সেটা আগেই প্রমাণ হয়ে গেছে। আমার সাহস নেই, তোকে আর ববকে এক মুহূর্ত এ বাড়িতে রাখি। ওরা যদি ভাবে, তোকে লুকিয়ে রেখে মিথ্যা কথা বলেছি। সে সেই ভয়ংকর পরিণামের কথা উচ্চারণ করতে পারেনি। রঞ্জনের দিকে তাকিয়েছিল।

আমি তোমাদের বাড়ি গিয়ে, পেছনের জানালাটা দেখে এসেছি।’ রঞ্জন বলেছিল, ওটা কোনও হাতে বানানো বন্দুকের গুলি না, রীতিমতো আধুনিক রিভলবারের গুলি ছোঁড়া হয়েছিল। লাগলে–

মিঃ কাপুর গলা খাঁকারি দিল। এক দিগন্তব্যাপী অলৌকিক স্তব্ধতার মধ্যে সেই শব্দ যেন বজ্রের মতো শোনাল। আভা চমকে, শিউরে উঠল। রক্তশূন্য ওর মুখ। আতঙ্কিত চোখে তাকাল। মিঃ কাপুর বলল, আমি আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি মিসেস মজুমদার।

আভা মুখ ফিরিয়ে জানালার দিকে তাকাল। পিছনের দিনগুলো ওকে তাড়া করে নিয়ে আসছিল। আবার সেই ভয়ংকর বিষয়টি ওর মনে জেগে উঠল। এখন, এই রাত্রে ওকে এই ঘরও ছেড়ে যেতে হবে। কোথায়? অনেক মুখ, অনেক ঘর ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কিন্তু কার কাছে, কোন ঘরে ও যাবে? কোনও ঘরের দরজা কি ওর জন্যে ভোলা আছে?

আমার মনে হয়, নিজের আত্মীয় স্বজন কারোর বাড়িতেই আপনার যাওয়া চলবে না। মিঃ কাপুর যেন দৈব ঘোষণা করল, কারণ, যারা আপনাকে খুঁজছে, তারা ঘুরে ফিরে, সেই সব বাড়িতেই যাবে। এমনকী, আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বাড়িও তারা বাদ দেবে না। হয়তো সে সব বাড়িতে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছে। বোধ হয় আপনি নিজেও সবাইকে প্রাণ ধরে, এ সময়ে বিশ্বাস করতে পারছেন না। আমি আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি।

তথাপি আপনাকে এবার এখান থেকে পাততাড়ি গুটাতে হবে, মিসেস মজুমদার! দুঃখের সঙ্গে এ কথাটাই আমাকে বলতে হচ্ছে। কারণ কেউ-ই এভাবে নিজেকে বিপন্ন করতে চায় না। মিঃ কাপুর থেমে গেলেও, আভা যেন এই নির্মম আর অনিবার্য কথাগুলো তার গলায় শুনতে পেল। বব কোলের ওপর ঢলে পড়েছে। আভার শাড়ির আঁচল টেনে, নিজেই মুখে পুরে চুষছে। হাতব্যাগটা ববেরই মাথার নীচে। পাশের ঘরের দরজার আড়ালে থেকে মালতী আভার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। অবুঝ অবাক তার চোখের দৃষ্টি, কারণ ইংরেজি কথা সে বুঝতে পারে না। ফাল্গুনের বাতাস, এই ঘর আর দোতলা বাড়িটার ফাঁকে ঢুকে পড়ছে, আর ফিসফিস শব্দ তুলে মিলিয়ে যাচ্ছে।

আমার মনে হয়, ওরা আমাদের বাড়ির সম্পর্কে আপাতত নিঃসন্দেহ হয়েছে। মিঃ কাপুর আবার বলল, আমার অনুমান, এখন ওরা এখান থেকে সরে গেছে, অন্য কোথাও জঙ্গল পিটিয়ে বেড়াচ্ছে। এই সুযোগটা ছাড়া উচিত হবে না। আমি আমার গাড়িটা, আমাদের বাড়ির গেটের সামনেই ঢুকিয়ে রেখেছি। অবিশ্যি তার আগে আপনাকে ভেবে দেখতে হবে।’

আভার নিশ্বাস বন্ধ, বুকের মধ্যে আতঙ্কের ধারালো নখ ছিঁড়ছে। ও মিঃ কাপুরের দিকে তাকাল। ডোভ এর বিভু ব্যানার্জির মুখটাই ওর চোখের সামনে ভাসছে। ও ববকে চেপে ধরে, গোটানো দু পা খাট থেকে নামাল। মিঃ কাপুর বলল, কিন্তু সে-ফ্ল্যাটে আপনাকে দেখাশোনা করার কেউ নেই যেখানে আপনাকে আমি নিয়ে যেতে চাইছি। অথচ আর সবই আছে। পাইপ গ্যাস-ওভেন-ফ্রিজ-টেলিফোন, এমনকী রান্নার বাসনপত্রও। আমার এক অবিবাহিত বাঙালি বন্ধুর ফ্ল্যাট। সেও এখন কলকাতার বাইরে। তার ফ্ল্যাটের একটা চাবি আমার কাছে থাকে। আমার বন্ধুটি কাজের জন্য বাইরে ঘুরে বেড়ায়। মাসে সাত-দশ দিন কলকাতায় থাকে কি না সন্দেহ। আপাতত সেখানে নিয়ে যাওয়া ছাড়া, আমার মাথায় আর কিছুই আসছে না। অবিশ্যি আপনি রাজি থাকলেই।

মিঃ কাপুরের কথাগুলো যেন অলৌকিক আর দৈববাণীর মতো শোনাচ্ছিল। পুঞ্জীভূত অন্ধকারে, এক বিন্দু আলোর মতো ওর আতঙ্কগ্রস্ত প্রাণে আশা জাগল। ওর গলা বন্ধ হয়ে আসছিল, তবু কোনও রকমে উচ্চারণ করল, আমি নিশ্চয়ই রাজি আছি।’

আমি ভেবে দেখেছি, জায়গাটা আপনার পক্ষে নিরাপদ। মিঃ কাপুর বলল, আমি ইচ্ছে করেই, এ আশ্রয়ের কথা আপনার পিসিমাদের বা আমার বাড়ির কারোকেও বলিনি। না বলার কারণ আর কিছু না, আপনার গোপন আশ্রয় সম্পর্কে, যত কম জানাজানি হয়, ততই ভাল। অবিশ্যি এদের কৌতূহল মেটাবার জন্য, একটা কাল্পনিক আশ্রয়ের কথা আমাকে বলতেই হবে।

আভা মিঃ কাপুরের মোটা ভুরুর নীচে, উজ্জ্বল চোখ দুটো দেখছিল। ওর মনের মধ্যে কোথায় একটা ভিন্নতর উৎকণ্ঠা দূর আকাশে মেঘের মতো জেগে উঠছে। কিন্তু এখন সে কথা ভাববার সময় নেই। ও জিজ্ঞেস করল, আপনার বন্ধুর কোনও রকম আপত্তি।

সে দায়িত্ব আমার। মিঃ কাপুর উঠে দাঁড়াল, তা না হলে আপনাকে আমি সেখানে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিতাম না। এটা নিয়ে আমি সারা দিনই ভেবেছি। আমি আমার বন্ধুটিকেও চিনি। পরে আপনাকে তার সম্পর্কে বলবার সময় পাব। আমি বেরোচ্ছি। সূরয সিং এসে আপনাকে বলবে, আপনি কোনখানে এসে আমার গাড়িতে উঠবেন। সে মাথা ঝাঁকিয়ে, ঘরের বাইরে চলে গেল।

আভা এই মুহূর্তে, রাস্তায় কেউ নজর রেখে দাঁড়িয়ে আছে কি না, বা নতুন আশ্রয়ে পৌঁছুবার আগেই, এখান থেকে বেরোতে গিয়ে, ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে কি না, ভাববার অবকাশ পেল না। মালতী পাশের ঘর থেকে, এক রকম ছুটে এসে ওর ঘাড়ের ওপর পড়ল। তার দ্রুকুটি চোখে সন্দিগ্ধ জিজ্ঞাসা। সে তার ভাষায় যা বলল, তার বাংলা অর্থ এইরকম, মাগ ভাতারের ঝগড়া অনেক দেখেছি, কিন্তু তোমার ব্যাপারটা আমার কাছে অন্য রকম লাগছে। ভাতারের সঙ্গে ঝগড়া করে পালিয়ে এসেছ তো কী হয়েছে? তার জন্যে এত কথা কীসের?না হয় দু-চার ঘা মার খাবে, খুন করে তো ফেলবে না। বদমেজাজি আর মাতাল পুরুষ কী করতে পারে না পারে, তা অবিশ্যি বলা যায় না। মানি, কিন্তু আমার কেমন খটকা লাগছে, তুমি অন্য কোনও রকম গোলমাল পাকিয়েছ। কাপুরজির সঙ্গে হ্যাঁ ড্যা করে তোমার এত কী কথা হল?

মালতী আভার কাঁধে হাত রেখেছিল। মালতীর সরল প্রশ্নে আভা বলল, কাপুরজি বললেন, আমার স্বামী আমাকে মারবার জন্যে বন্দুক নিয়ে ঘুরছে। হয়তো সে জানতে পেরেছে আমি এ দিকেই কোথাও আছি।’

বন্দুক!’ মালতীর গোল মুখের মোটা ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে গেল। গোল চোখ দুটো আরও গোল হয়ে উঠল, বন্দুক নিয়ে ঘুরছে তোমার মরদ? ডাকাত? ওকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে না কেন?

আভা ঠিক মিথ্যা কথা বলেনি, এক রকমের সত্য ছিল ওর কথায়। বলল, সে নাকি এমন ভাবে চলাফেরা করছে, পুলিশের ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

তা তোমাকে কাপুরজি কী বলে গেলেন?’ মালতীর স্বরে ব্যগ্র উৎকণ্ঠা।

আভা বলল, তিনি বলে গেলেন, তোমার স্বামী এসে আমাকে যখন বেরোতে বলবে, তখনই যেন আমি বেরিয়ে যাই।

অসম্ভব!’ মালতী বলল, তোমার একদম ঘর ছেড়ে বেরোনো উচিত না। বন্দুকবাজকে বিশ্বাস কী? আমি তো তোমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছি না, আমার স্বামীও তোমাকে যেতে বলবে না। তুমি এখানেই থাকো, আমার স্বামী কাপুরজির ঘরে শুতে যাবে। তুমি দশ দিন থাকলেও আমার আপত্তি নেই। তুমি কি ভাবছ, স্বামীর সঙ্গে এক দিনও না শুয়ে আমি থাকতে পারি না?

অতুলনীয় মালতীর সারল্য। এবং আভা দেখল, মালতীর উৎকণ্ঠিত চোখে এক হৃদয়বতী রমণীর স্নেহ উপছে পড়ছে। ও মালতীর একটি মোটা নরম হাত ধরল, আমি মোটেই তা ভাবিনি। কাপুরজি যা করছেন, তা আমার ভালর জন্যেই করছেন। বন্দুকবাজের হাতে যাতে আমাকে না পড়তে হয়, উনি সেই ব্যবস্থাই করছেন। তোমার কথা আমি কখনও ভুলব না। কেবল একটা কথা বলে রাখি, তোমার এখানে এসে কেউ যদি আমার খোঁজ করে, তুমি একেবারে উড়িয়ে দেবে।

এটা আবার আমাকে শেখাতে হবে নাকি? মালতী যেন আহত বিস্ময়ে বলল, আমি সে রকম মেয়ে নই। আমার মুখে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দিলেও একটা কথা বের করতে পারবে না। কিন্তু কথা হচ্ছে, তোমার বাচ্চা রাত্রে কী খাবে? যেখানে যাচ্ছ, সেখানে ওর খাবার জুটবে তো? নয় তো বলল, আমি সেই খাবারের বোতলটা তোমাকে দিয়ে দিই।’

আভা সহসা এ কথার জবাব দিতে পারল না। মালতী অত্যন্ত বাস্তব প্রসঙ্গই তুলেছে। খাবারের কোনও কথাই মিঃ কাপুরের সঙ্গে হয়নি। নিজের জন্য চিন্তা নেই। বব রাত্রে কিছু খেতে চাইবেই। না। পেলে, সারা রাত্রিই খিদের কষ্টে কাঁদবে। অবিশ্যি মালতী আভার সম্মতির অপেক্ষায় ছিল না। ও পাশের ঘর থেকে, সেই মোটা বেঁটে কাচের বোতলটা আভার সামনে এনে রাখল। বলল, হয়তো। কিছুই হবে না। তোমার ওই বন্দুকবাজ ভাতারটি, ঝগড়া মিটে যাবার পরে, তোমার উরতে মুখ দিয়ে পড়ে থাকবে।

আপনি আসুন।’ মালতীর কথা শেষ হতে না হতেই, দরজায় সূরয সিং এসে দাঁড়াল, কাপুরজি এ বাড়িরই গেটের সামনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আপনি বাচ্চা নিয়ে গিয়ে সোজা গাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ুন।

আভা ঝটিতি উঠে দাঁড়াল। ববকে কোলে নিয়ে, হাতব্যাগটাও বুকে চেপে ধরল। মালতী তার মধ্যেই, খাবারের বোতলটা ওর হাতে ধরিয়ে দিল, মহাদেব শঙ্কর তোমাদের বাঁচান।’…।

হাবিবদের গ্যারাজের কাজ এখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সামনের চত্বরে কেউ নেই। রাস্তার আলো তেমন জোর না। আভা মিঃ কাপুরের গাড়িটা দেখতে পেল। এঞ্জিন স্টার্ট করার শব্দ হল। ও এগিয়ে যেতেই, পিছনের দরজা খুলে গেল। ও ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই, গাড়ি অস্বাভাবিক দ্রুত ট্রাম রাস্তায় এসে পড়ল। মোড়ের রিকশাগুলোকে বাঁচিয়ে, গাড়ি বাঁ দিকে ছুটল। পিছন থেকে অন্য গাড়ির হেডলাইটের আলো এসে পড়ল। আভার বুক কেঁপে উঠল। নিচু হয়ে বসে পড়বে কি না ভাবল। দেখল, মিঃ কাপুরের চোখ রিয়ার ভিউফাইন্ডারের দিকে। সামনের দিক থেকে একটা ট্রাম আসছে। পিছনের গাড়ির হেডলাইটের আলো নিভছে না। ওভারটেক করার ইনডিকেশান দেওয়াও নিষ্প্রয়োজন। ট্রাম আসছে। …ট্রাম বেরিয়ে গেল। ট্রামের পিছনে কয়েকটা গাড়ি। মিঃ কাপুরের গাড়ির সামনে দুটো রিকশা মেয়ে যাত্রী নিয়ে আস্তে আস্তে চলেছে। সে হেডলাইট জ্বালিয়ে ঘন ঘন হর্ন দিল। পিছনের গাড়িটার হেডলাইট নিভে গেল। রিকশাওয়ালা পিছন ফিরে মিঃ কাপুরের উদ্দেশে বলল, যাইয়ে না সাব। হম কিধর যায়েগা।

মিঃ কাপুর নিরুপায়। গাড়ির গতি কমাতেই হচ্ছে। তারপরেই একটু বেশি রিস্ক নিয়ে, রিকশা দুটোকে ওভারটেক করল। উলটো দিক থেকে আসা একটা গাড়ির হেডলাইট জ্বলে উঠল, আর সেই সঙ্গে একটা খিস্তিসহ চিৎকার। ট্রাম রাস্তার মোড়। ট্রাফিক পুলিশ নেই। মোড়ে গাড়িগুলো এলোমেলো৷ পিছনের গাড়ির হেডলাইটের আলো মিঃ কাপুরের গাড়ির ভিতরটা ঝলসে দিল। আভার বুকের মধ্যে বিদ্যুতের তার ভেঁড়া শক লাগল। উদভ্রান্ত আতঙ্কে রিয়ার ভিউফাইন্ডারের দিকে দেখতে। চেষ্টা করল। মিঃ কাপুর এলোমেলো গাড়িগুলোর মধ্য দিয়ে সোজা চালাল। মোড় পেরোবার সময়, সব চালকেরই যেন একটা জেদ চেপে যায়। সকলেরই হেডলাইট জ্বলছে। হর্ন বাজছে একসঙ্গে, অনেকগুলো। পার্ক স্ট্রিটের দিক থেকে আসা একটা গাড়ির সঙ্গে, মি. কাপুরের মাত্র কয়েক ইঞ্চি ফাঁক। সেই গাড়ির চালক জাকুটি মুখ বের করে দেখল। মিঃ কাপুর না থেমে বেরিয়ে গেল। পিছনের গাড়ির আলো আড়ালে চলে গেল। কিন্তু ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে গাড়ি ডান দিকে মোড় নেবার আগেই, আবার পিছনের আলো ঝলসে উঠল। মিঃ কাপুরের গলা থেকে একটা গোঙানো স্বর শোনা গেল। কী অর্থ এই শব্দের।

ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে এখনও বেশ ভিড়। মিঃ কাপুর বেপরোয়া। হেডলাইট জ্বেলে, হর্ন বাজিয়েই চলেছে। আভা ছেলেকে কোলে রেখেছে। যতটা সম্ভব বাইরে থেকে আড়াল করে রাখা যায়। এখন আর হিসাব রাখা সম্ভব হচ্ছে না, একটা গাড়িই পেছনে আসছে কিনা। অনেক বার পিছনে আলো জ্বলল, নিভল। কিন্তু মিঃ কাপুর কোনও গাড়িকেই ওভারটেক করতে দেয়নি। ফ্রি স্কুল স্ট্রিট বাঁ দিকে এস এন ব্যানার্জি রোড। কর্পোরেশন বিল্ডিঙের পাশ দিয়ে বাঁ দিকে, আবার ডাইনে। চৌরঙ্গির বাঁয়ে সোজা। তারপরে আবার একটা ছোট বাঁয়ের মোড়ে…।

আসলে কেউই আমাদের পেছন নেয়নি। মিঃ কাপুর প্রথম কথা বলল। গাড়ির গতি কম। আভা ঘেমে গিয়েছে। বুকের মধ্যে তোলপাড় করছে। নিশ্বাস ঠিকমতো পড়ছে না। মালতীর দেওয়া খাবারের বোতলটা কোথায় ছিটকে গিয়েছে। বব বিরক্ত, কোলের ওপর জোরে চেপে ধরে রাখার জন্য। প্রতিবাদের সুরে কান্নাটা এখন শোনা গেল। অন্য হাতের মুঠোয় নরম হাত ব্যাগটা।

যাদের পেছন নেবার কথা, তারা যদি পেছন নিত, এতক্ষণে কিছু ঘটে যেত।’ মিঃ কাপুরের স্বরে নিশ্বাসের রুদ্ধতা, পেছনের প্রথম গাড়িটার হেডলাইট ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। গাড়ি একটা গেটের ভিতর দিয়ে, প্রায়ান্ধকার চত্বরে ঢুকল।

মিঃ কাপুরের প্রথম কথা শোনবার পরেই, আভা চোখ বুজেছিল। লক্ষ করেনি, কোন রাস্তা দিয়ে, কোথায় এসে গাড়িটা ঢুকল। চোখ মেলে দেখল, প্রায়ান্ধকার চত্বরটা বেশ বড়। গোটা তিনেক গাড়ির অবয়ব দেখা যাচ্ছে, ডাইনে বাঁয়ে। চত্বরের দু পাশেই একতলা ঘর। গ্যারেজ সারভেন্টস কোয়ার্টার বলে মনে হয়। মূল বাড়িটা কত বড়, ক’তলা, গাড়ির ভিতর থেকে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। চত্বরে ঢুকে, ডান দিকে ঘুরে, ছাদ ঢাকা গাড়িবারান্দা রয়েছে। সেখানে দরজার কাছে, মাথার ওপরে খুব কম শক্তির একটা আলো টিমটিম করছে। মিঃ কাপুর গাড়ি নিয়ে সেদিকে গেল না। ভিতরে গিয়ে, বাঁ দিকে গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে থামল। হেডলাইটের আলোয়, পাঁচিলের ধার ঘেঁষে দু-একটা ছোট গাছ দেখা গেল। বাতাসে দুলছে। মিঃ কাপুর হেডলাইট অফ করে, এঞ্জিন বন্ধ করে নামল। গাড়ির কাঁচ তুলে, দরজা লক করল। আভার দরজা খুলে দিল, নেমে আসুন।

আভা ববকে নিয়ে নামতে গেল। নীচে খাবারের বোতলের ওপর পা পড়ল। গাড়ির বাইরে এসে, বোতলটা বের করে নিল। মিঃ কাপুর জিজ্ঞেস করল, কী ওটা?’

ববের খাবার জন্য সূরয সিং-এর স্ত্রী দিয়েছে। আভা বাইরের গেটের দিকে মুখ ফেরাল। রাস্তার আলো উজ্জ্বল, লোক চলাচল কম। ও বাড়িটার দিকে মুখ তুলে দেখল। একতলার সামনেই, খোলা, অর্ধবৃত্তাকার ছাদ। আলসে ঘেরা। মনে হল, তিনতলায় কোনও জানালায় আলো জ্বলছে। বড় নিঝুম আর চুপচাপ বাড়ি। গেটে আলো নেই কেন?

সুরযের স্ত্রীর বুদ্ধি আছে। মিঃ কাপুর বলল, আসুন, ভেতরে যাওয়া যাক।লক চেপে গাড়ির দরজা বন্ধ করল।

আভার আতঙ্ক কিছু কমেনি। তীব্র উত্তেজনায় এখনও স্নায়ুগুলো কাঁপছে। চকিতেই মনে হল, বাইরে দাঁড়ানোটা নিরাপদ না। ও মিঃ কাপুরের অনুসরণ করল। বব খুঁতখুঁত কান্নার শব্দ করছে। আভা ওর গালে চোখে ঠোঁট ছোঁয়াল। মিঃ কাপুর গাড়ি বারান্দার নীচে, তিন ধাপ সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠল। টিমটিমে বাতির জন্য বাড়ির প্রবেশমুখটার চেহারা যথার্থ বোঝা যাচ্ছিল না। আসলে, দরজার ভিতরে জায়গাটা বেশ বড়। সেখানেও আলোটা কমজোরি। দেয়ালের শেষ প্রান্তে, বড় মাপের একটা বন্ধ দরজা। দরজার গায়ে পিতলের নেমপ্লেট চকচক করছে। ইংরেজি অক্ষর: এস কে ঘোষ। ভিতরে ঢুকে ডান দিকে ওপরে ওঠার সিঁড়ি। বাঁ দিকে এলিভেটরের কোলাপসিবল দরজা বন্ধ। লিফট নীচেই, ভিতরে আলো জ্বলছে। ভিতরে কেউ নেই। মিঃ কাপুর এগিয়ে গিয়ে, আগে কোলাপসিবল দরজাটা টেনে, বলল, আসুন।

আভা ভিতরে ঢুকল। উজ্জ্বল আলো, আর একটা আয়না পিছনে। ঢাকার মুখে নিজের মুখটা দেখল। রক্তশূন্য, বড় দুটো কালো তারা চোখ ছাড়া কিছুই যেন দেখতে পেলে না। মিঃ কাপুর ভিতরে ঢুকে বাইরের ও ভিতরের দুটো দরজা টানল। উচ্চতম বোতাম তিন নম্বর টিপল। সচরাচর চারতলা বাড়িতে এলিভেটর দেখা যায় না। নতুন বাড়ি না, পুরনো। সেটা বাইরে থেকেই অনুমান করা যাচ্ছিল। শক্ত চওড়া দেওয়ালের উঁচু বাড়ি। চারতলায় লিফট থামল। মিঃ কাপুর দরজা খুলল। আভা বেরিয়ে এল।

ডান দিকে সিঁড়ি চারতলাতেই শেষ। সামনের জায়গাটা বেশ লম্বা, চওড়াও। ডাইনে বাঁয়ে দু দিকে দুটো দরজা, মুখোমুখি। দুটোই বন্ধ। কোথাও কোনও সাড়া শব্দ নেই। মাথার ওপরে একটি টিমটিমে আলো জ্বলছে। ডান দিকের দরজায় কাঠের ওপর সাদা প্লাস্টিক প্লেটের ওপর ইংরেজি কালো অক্ষরে নাম লেখা। আভা পড়তে পারল না। মিঃ কাপুর বাঁ দিকের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। হিপ পকেট থেকে একটা চাবি বের করে, যথাস্থানে ঢুকিয়ে, দরজা খুলল। ভিতরে অন্ধকার। মিঃ কাপুর ভিতরে

আভা ভিতরে ঢুকতেই, মিঃ কাপুর দরজা বন্ধ করে দিল। আভার মনে হল, ঘরের ভিতরটা দম চাপা। মিঃ কাপুর সরে গিয়ে সুইচ টিপতেই, একটা পাখা বনবন করে ঘুরতে লাগল। আর একটা উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠল। আভার চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা অতি আশ্চর্য সুন্দর আর বড় সাজানো ঘর। তিন ফুট মেঝে ছেড়ে হলুদ নকশার লাল কার্পেট পাতা। মাঝখানে সেন্টার টেবিল। এক পাশে দুটো সিঙ্গল আর একটা ডবল সোফা। বাকি দুটো সুবৃহৎ, দামি লাল কাপড়ে মোড়া সোফাকে, বেড কাম সোফা বলে ভুল হয়। আসলে তা না। ভাঁজ করতে না পারলেও, একজন মানুষের শোবার পক্ষে যথেষ্ট লম্বা চওড়া। কয়েকটা পিলোও রয়েছে। কার্পেটের বাইরে, আভার যে দিকটাকে পুব বলে মনে হচ্ছে, এবং যে দিকের দেওয়ালের কাছে গিয়ে, মিঃ কাপুর জানালা খুলে দিচ্ছে, সে দিকে ডাইনিং টেবিল। টেবিল ঘিরে কিছু চেয়ার। টেবিলের উত্তরে, দেওয়াল ঘেঁষে বড় মাপের ফ্রিজ। এ সব ছাড়াও, গোটা ঘরটা অনেক ছড়ানো আর বড়। সেন্টার টেবিলের নীচের থাকে কিছু দেশি-বিদেশি সাময়িকপত্র। দেওয়ালের দু দিকে দুটো অয়েলের ছবি, বোধ হয় একে অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট বলে। আভা ছবি বোঝে না, মনে একটা কল্পনা কাজ করে। পুব দিকের দেওয়ালে, দুই জানালার মাঝখানে, কাঠের ওপর কাজ করা দুটো লম্বা পাল্লা বন্ধ। চওড়ায় দেড় ফুট। তার নীচেই এয়ার কুলার মেশিন। দক্ষিণে বড় সোফার পাশে, ছোট একটা টুলের ওপর নীল রঙের টেলিফোন।

বব প্রায় পিছলেই আভার কোল থেকে নেমে গেল। হামাগুড়ি দিয়ে গালিচার ওপরে গেল। জানালা খুলে দেওয়ায়, ঘরে এখন বেশ বাতাস খেলছে। ঢোকবার মুখে দরজার ওপরে আলোটা কম শক্তির। মাঝখানের বড় আলোটার গোল ঢাকনাটা, পূর্ণিমার চাঁদের মতো। নরম কিন্তু উজ্জ্বল আলো সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়েছে।

আসুন, আপনাকে বাকি সব দেখিয়ে দিই। মিঃ কাপুর উত্তর দিকে গেল।

আভা ববের দিকে এক বার দেখল। ওর লক্ষ্য সেন্টার টেবিলের নীচে, তামার একটি বড় ছাইদানির দিকে। ছাইদানিটা পরিষ্কার, অতএব ময়লা ঘাঁটবার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ওর নিজের পায়ে এক জোড়া হাওয়াই চটি। ও গালিচা বাঁচিয়ে, উত্তর দিকে গেল। ফ্রিজের পাশ দিয়ে, কয়েক হাত দুরে, একটি দরজা। মিঃ কাপুর দরজার হাতল টেনে খুলল। ভিতরে সুইচ টিপে আলো জ্বালল। টেবিলের ওপর গ্যাসের পাইপ লাইন এবং ওভেন। পাশেই থালা বাসন ধোবার গভীর বেসিন। কলের মুখ খুলতেই, জল পড়তে লাগল। মিঃ কাপুর ট্যাপ বন্ধ করে, অন্য পাশে টেবিল মিটসেফ এবং কাচের আলমারির মধ্যে ডিনার সেট, কফি ও চায়ের কাপ ডিস পট, ডজন দুয়েক কাচের গেলাস, সবই দেখিয়ে দিল। টেবিলের ড্রয়ার টেনে দেখাল ভিতরে নানা মাপের প্রচুর ছুরি চামচ ও ফর্ক। চা চিনি কফি সবই মজুদ। এমনকী দেশলাইও। বিস্কুটের বাতাস চাপা কৌটো। পুব দিকের ছোট জানালাটা খুলে এক বার দেখিয়ে দিল। পাশেই একটা বাড়ির বড় পার্কিং স্পটে অনেকগুলো গাড়ি পার্ক করা রয়েছে। সেটা বন্ধ করে, উত্তর দিকের জানালা খুলে বলল, নীচে তাকিয়ে দেখুন। সামনে রাস্তা আর ঢোকবার গেট। ওই গেট দিয়েই আমরা ঢুকেছি। এ জানালা খুললেও, আপনাকে এ ঘরে দেখা যাবে না। আপনি মুখ বাড়ালে আলাদা কথা। তবে না বাড়ানোই ভাল। আসুন।

মিঃ কাপুর রান্নাঘরের বাইরে এসে ফ্রিজ খুলে দেখাল। পাল্লার গায়ে কিছু সোডা আর বিয়ারের বোতল, এবং কয়েক বোতল জলও রয়েছে। সামনের থাকেই রয়েছে বড় কাচের বাটিতে ঢাকা মাখন, আর একটা কাচের আধারে আধ পাউন্ডের মতো চিজের টুকরো। একটা জমানো দুধের কৌটো। একেবারে নীচে পড়ে আছে দুটো আপেল। আভার আতঙ্ক এবং উত্তেজনা যেন একটা পরদা আড়াল করে রেখেছে এবং সেই পরদারই অন্য পাশে এসে ও দাঁড়িয়েছে, যেখানে অন্য ছবি ও পটভূমি। ও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ফ্রিজটা অন করা রয়েছে?

শুধু ফ্রিজটাই থাকে। মিঃ কাপুর ফ্রিজের পাল্লা চেপে বন্ধ করল, আমি এবং কেউ কেউ সুবীরের অনুপস্থিতিতে এসে থাকি, একটু সময় কাটিয়ে যাই। সুবীর, বুঝতেই পারছেন, আমার বন্ধুর নাম, যার এই ফ্ল্যাট। ফ্রিজের ভেতরে বোতলের জল টাটকাই আছে, আপনি ব্যবহার করতে পারবেন। সে আর একটু দক্ষিণে গিয়ে, দুই জানালার মাঝখানে, লম্বা কাঠের চেম্বারের হাতল ধরে টানল, এ ফ্ল্যাটে সুবীরের মূল্যবান কিছু থাকে কি না জানি না, এগুলো থাকে।

আভা দেখল, একটা সেলার। যার মধ্যে রয়েছে দামি স্কচ হুইস্কির কয়েকটি বোতল, কনিয়াক আর ওয়াইনের বোতল কিছু। নতুন চিত্র ও পটভূমির চরিত্রটা যেন ফুটে উঠছে।

এগুলো চাবিবন্ধ থাকে না। দেখবারও এমনিতে কোনও কারণ নেই। তবু দেখিয়ে রাখলাম আপনার সবই জানা থাকুক। মিঃ কাপুর সেলার বন্ধ করে, দক্ষিণে এগিয়ে গেল।

আভা মিঃ কাপুরের পিছন দিকটা তাকিয়ে দেখল। এ সব বিলাস বৈভব, উত্তেজক সুখদায়ক পানীয়, কিছুই ওর কাছে নতুন না। বরং অতীত এবং সে-চিত্র আরও বর্ণাঢ্য মহার্ঘ ছিল। পটভূমি ছিল একটি অতলান্ত ঘূর্ণির মতো। চরিত্র অখণ্ড দুর্বল অথচ নীতিহীন আর সীমাহীন লোভী, ক্লেদাক্ত উচ্ছুঙ্খল আর সাপের মতো শীতল-ভয়ংকর বিষাক্ত। ও মুখ ফিরিয়ে ববের দিকে এক বার দেখল। বব গালিচার ওপর উপুড় হয়ে ছাইদানিটা টেনে নিয়েছে।

দক্ষিণে তিনটি দরজা। মাঝামাঝি দুটো বন্ধ দরজা বড়। পুব দিকে, দরজাটি একটু ছোট। মিঃ কাপুর তার সামনের বড় দরজাটি ঠেলে খুলতে খুলতে, বাঁ দিকের ঘোট দরজাটি দেখিয়ে বলল, ওটা বাথরুম। ভিতরে ঢুকে আলো জ্বালল। আভা ভিতরে গেল। বড় ঘর। বাঁ দিকে খাটের ওপর নরম গদি মোড়া বিছানার ওপর বেডকভার পাতা। পুব দক্ষিণে চারটি বন্ধ জানালার গায়ে পরদা। বাঁ দিকে বাথরুমের দরজা বন্ধ। বাইরের ঘর থেকেও এই বাথরুমে ঢোকা যায়, আভা বুঝে নিল। পাশের ঘরে যাবার একটি দরজা রয়েছে মাঝখানে। মিঃ কাপুর সেই খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে আলো জ্বালল। আভা ভিতরে ঢুকে দেখল, পশ্চিমের দেওয়ালে কোনও দরজা জানালা নেই। দক্ষিণে দুটো জানালা, আর সে দিকেই একটি ডাবল বেড-এর খাটে, একই রকম বিছানা পাতা। দক্ষিণ পশ্চিম কোণের কাছে, একটি দরজা। নিঃসন্দেহে বাথরুম। মিঃ কাপুর তবু এক বার সেটা খুলল। আভা গিয়ে উঁকি দিল। বড় বাথরুম, বাথ টাব, কমোড, গরম জলের ব্যবস্থা, সবই আছে। সবই ঝকঝকে পরিষ্কার। দুই ঘরেই রয়েছে স্টিলের আলমারি আর ওয়ারড্রোব। এ ঘরে বাড়তি একটা বড় ড্রেসিং টেবিল।

মহিলাদের ব্যবহারের যোগ্য জামাকাপড় এখানে নেই। মিঃ কাপুরের টিয়া পাখি নাকের নীচে, গোঁফ জোড়ায় বিব্রত হাসি ফুটল। আগামীকালের মধ্যে কিছু ব্যবস্থা করা যাবে। তার মোটা ভুরুর নীচে চোখ জোড়া আভার শরীরকে দেখল। আপনি এ ঘরেই শোবেন। আমি এখন যা পারি, আপনার জন্য কিছু খাবার পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছি। সে উত্তর দিকের বন্ধ দরজার কাছে এগিয়ে গেল।

আভা যেন চকিত ঘুম ভাঙা স্বরে বলল, কোনও দরকার নেই।

মিঃ কাপুর দরজা খুলল। বাইরের ঘরে পা রাখল। আভাও বাইরের ঘরে এল। ববকে দেখল, তামার ঝকঝকে ছাইদানিটি উপুড় করে, জিভ দিয়ে চাটছে। মিঃ কাপুর বলল, রাত্রে খাবেন কী?

রাত্রে খাবার কোনও দরকার নেই। আভা ব্যস্ত স্বরে বলল, বিশ্বাস করুন। দুটো বিস্কুট খেলেই আমার চলে যাবে। ববের ব্যবস্থা আছে।

মিঃ কাপুর মাথা ঝাঁকাল, হুম। সকালটাও আপনার কষ্টে কাটবে। তারপরে সব ব্যবস্থাই হয়ে যাবে। বলে রাখি, টেলিফোন বাজলেও আপনি কিছুতেই ছোঁবেন না। আপনার পক্ষে খুবই নিরাপদ জায়গা, তবু সাবধানের মার নেই।

আমি কখনওই টেলিফোন রিসিভ করব না। আভার চোখে উৎকণ্ঠিত বিস্ময়।

মিঃ কাপুর বলল, জানি, তবু এক বার বললাম। সুবীরের জন্য একটা চিরকুট খাবার টেবিলে রেখে দিয়েছি। যদি রাত্রেই ফেরে, ওটা পড়লেই সব জানতে পারবে। আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের কেউ অনুসরণ করেনি, অতএব আপনি নিশ্চিত থাকুন। রাত্রি এখন পৌনে দশটা। সে ববের দিকে এক বার দেখে, বাইরে যাবার দরজার কাছে এগিয়ে গেল।

আভার বুকের ভিতরে ভয় একটা সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়েছে। অথচ জীবন্ত সেই সাপের জিভটা নিরন্তর ভিতর বাহির করছে। ওর টিপে রাখা ঠোঁটের ওপর অনেকগুলো জিজ্ঞাসা থমকে রয়েছে। যা বাহ্যিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত, অন্যতর এক উৎকণ্ঠায় গভীর। ওর চোখে আর্ত অসহায়তা। মিঃ কাপুরের দিকে তাকাল।

আমি জানি, এত ঘটনা ঘটে যাবার পরে, আপনার একলা থাকতে ভয় করবে। মিঃ কাপুর বলল।

আভা মাথা ঝাঁকাল, হ্যাঁ।

কিন্তু

কোনও প্রশ্নই নেই। আভা মিঃ কাপুরের হাতে চাবিটার দিকে দেখে বলল, খুনিদের হাত থেকে আপাতত আমি মুক্ত, এটা সবথেকে বড় কথা। কিন্তু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভুলে গেল।

মিঃ কাপুর দরজা খুলে বেরিয়ে যাবার আগে, হাত তুলে উচ্চারণ করল, শুভরাত্রি।

ঘরের মধ্যে টেনে নিয়ে যাওয়া, আর সবলে বুকে চেপে ধরে, আভার দুই ঠোঁট রাহুর মতো নিজের তপ্ত গ্রাসের মধ্যে টেনে নেওয়া, অপ্রত্যাশিত ছিল না। অপ্রত্যাশিত ছিল বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ হয়ে যাওয়া। প্রায় নিঃশব্দে দরজাটা কেউ বাইরে থেকে ঠেলে বন্ধ করে দিয়েছিল। আভা চমকে উঠেছিল। ভয়ে বিস্ময়ে চোখ দুটো বড় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কথা বলতে পারছিল না। সে তখন উন্মত্তের মতো আভার গ্রাসের ভিতরে জিভ দিয়ে যেন গলানালি পর্যন্ত স্পর্শ করতে চাইছিল। অনাস্বাদিত ছিল না সেই ঠোঁটের স্পর্শ, এবং চুম্বনের প্রকৃতি অনভ্যস্ত ছিল না প্রতিদানে। বরং একটা অনিবার্য আবেগে, উত্তাপে আভা নিজেও সেই গাঢ়তার মধ্যে ডুবে যেত। অতি পটিয়সীর মতো, নিজের দান দেওয়া আর তুলে নেওয়া। কিন্তু দরজাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, একটাই মাত্র পরিণামের ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। যে পরিণামের জন্য আভা প্রস্তুত ছিল না। সন্দেহে ভয়ে গলা দিয়ে একটা শব্দ করেছিল। ঠোঁট বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিল। পারেনি। সে কিছুই মানতে চায়নি। আভার চোখের দিকে তাকায়নি। ঘর জোড়া সবুজ গালিচার ওপর দিয়ে খাটের কাছে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। আভার পা থেকে পেন্সিলটো স্যান্ডেল খুলে গিয়েছিল। খাটের নরম গদির ওপর পড়ে যেতেই, ঠোঁট বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। আভা বলে উঠেছিল, দরজা বন্ধ করে দিল কেন?

তখন আভার বুকের ওপরে তার থাবা। চোখ দুটো আরক্ত। নিশ্বাস দ্রুত, কপালে ঘামের বিন্দু। স্বাভাবিক সুন্দর হাসি, কামার্ত উল্লাসে হা হয়ে গিয়েছিল। বিকৃত দেখাচ্ছিল মুখটা। আরক্ত চোখের দৃষ্টি গিয়েছিল বদলে। বলেছিল, এ সময়ে তো দরজা বন্ধ করেই দিতে হয়।

কেন? কী হবে?’ আভার নিশ্বাস আটকে যাচ্ছিল। ওর সারা মুখ ঘামে ভিজে উঠেছিল। ওর চোখও বেশ লাল ছিল। স্বাভাবিক। কটা ভোদকার পরে, কতটা রেড ওয়াইন খেয়েছিল নিজেরই হিসাব ছিল না। এ ঘরের দরজা বন্ধ হবার আগেও ও বেশ মাতাল বোধ করছিল। ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যাবার পরেই, ওর মাতাল আবেশ কেটে গিয়ে, ভিতরের আর একটা দরজা খুলে গিয়েছিল। যে ভিতরটায় ওর আজন্ম বিশ্বাস সংস্কারগুলো জীবিত ছিল তখনও জানত না, ওর জীবনযাপনের পদ্ধতি, মেলামেশার জগৎ আর পরিবেশে, সে সব অর্থহীন। মূল্যবোধেরও প্রশ্ন ছিল অবিশ্বাস্য।

সে অবাক উল্লাসে হেসে উঠেছিল, কী হবে? তুমি জানো না কী হয়?

উহ লাগছে।আভা আর্তনাদ করে উঠেছিল। শরীরটা বেঁকে উঠেছিল।

সে তাড়াতাড়ি আভার বুক থেকে হাত সরিয়েছিল, সরি, বুঝতে পারিনি। আভাকে উলটে দিয়ে, জামার পিছনের জিপ টেনে খুলে দিয়েছিল। অন্তর্বাস ঠেলে তুলে দিয়েছিল। সামনে ফিরিয়ে দিয়ে বুকে মুখ নামিয়েছিল। শরীরের অনিবার্য ক্রিয়া আর মনের সম্পূর্ণ বিরাগ, দুই বৈপরীত্যের মাঝখানে আভার অনুভূতি ছিল জড়। তখন ওর স্কার্টের কোমর বন্ধনীও খোলা হয়ে গিয়েছিল। আর সে গোঙানো স্বরে বলেছিল, আমি তোমার জন্য পাগল। আমি মরে যাচ্ছি।

আমি ভয় পাচ্ছি। আভার গলার কাছে কান্না ঠেকেছিল। ও কি জানত না, কী হবে? ও তো নিশ্চিতই বুঝতে পেরেছিল, কী হতে যাচ্ছে।

সে হাসতে হাসতেই ভুরু কুঁচকে বলেছিল, ভয়? কেন?

আমি এ সব জানি না।’আভার রুদ্ধ স্বরে আকুতি ছিল। ভয় ছিল। আপত্তিও ছিল। প্রতিবাদ ছিল না। সেটা নিরর্থক জেনে না। সেই সংকটের মুহূর্তেও আভার সংবিৎ ছিল, তার কাছে এক বিরাট

তার দুই আরক্ত চোখ, অভূতপূর্ব বিস্ময়ে বড় হয়ে উঠেছিল, রিয়্যালি? দিস ইজ ফার্স্ট টাইম? বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হচ্ছে না।

আমি মিথ্যা বলছি না। আভার স্বর মুক্তির আশায় করুণ শুনিয়েছিল। কিন্তু স্কার্ট খুলে পড়েছিল খাটের নীচে।

তার মুখে চোখে সত্যিই একটা উন্মত্ততা দেখা দিয়েছিল। হেসেছিল। হেসেছিল অস্বাভাবিক শব্দে। মত্ত হয়ে উঠেছিল অতি উগ্রতায়। নিজেকে সে কখন বিবস্ত্র করেছিল, আভা টের পায়নি, ভার্জিন! উচ্চারণে অবিশ্বাস্য উল্লাস ছিল তার গলায় আমি কখনও ভার্জিন মেয়ে পাইনি। মিথ্যা বললেও জানতাম, অনেক হাত ঘোরা। কিন্তু তোমাকে মনে হচ্ছে তাই! সে আবার আগ্রাসী চুম্বনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

আভার মনে তখনও ক্ষীণ প্রত্যাশা মুক্তির। কারণ ভার্জিন! কিন্তু তার হাসি ও উল্লাসের মধ্যে অদ্ভুত একটা বিকারের লক্ষণ যেন দেখা দিয়েছিল, এই তো আমার স্বপ্ন ছিল, আই উইল রেপ এ ভার্জিন। রেপ! একজন পুরুষের কাছে এর থেকে সুখের কিছু নেই। সেডিউস অ্যান্ড রেপ-বেস্ট প্লেজার অফ আ-ম্যান।’ ও দুর্বার হয়ে উঠেছিল।

আভার মনে হয়েছিল ও ছিন্নভিন্ন হচ্ছে। অচ্ছেদ্য আর দুর্গম ঝোঁপের ভিতরে একটা ভয়ংকর বন্য শূকর যেন মাথা ঠেলছিল। নখে নিষ্পিষ্ট হচ্ছিল শরীর। গলার ভিতর থেকে উদ্যত আর্তনাদ তার ঠোঁটের গ্রাসে দংশনে চাপা পড়েছিল। যন্ত্রণায় আকুঞ্চিত হয়ে উঠেছিল সারা শরীর…।

বব হঠাৎ একটা পা ছুড়ল, আর ঘুমের ঘোরে কেঁদে উঠল। আভা পাশেই চিত হয়ে শুয়ে ছিল। ওপরের সিলিঙে চলন্ত পাখার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে ছিল। চোখের ওপর সেই দৃশ্য ভাসছিল। আড়ষ্ট নিশ্চল শরীরে, অনেক দিন পরে সেই যন্ত্রণার অনুভূতি জেগে উঠছিল। তাড়াতাড়ি পাশ ফিরে, ববের গায়ে হাত দিল। আঁচলটা ঠোঁটের কাছে ধরল। ঘুমন্ত ববের হাত আপনা থেকেই আঁচলে এসে পড়ল। আভা আঁচলের অংশ পাকিয়ে ববের ঠোঁটে ছোঁয়াতেই ক্ষুধার্ত শাবকের মতো মুখের মধ্যে নিয়ে চুষতে লাগল।

নিশ্চিন্ত। ববের ব্যাপারে। কিন্তু ভিতর থেকে যেন নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। পারলে, এই দুঃসহ উত্তেজনা আর ক্লান্তিতে, এখন ঘুমিয়ে পড়া উচিত ছিল। ও পাশের ঘরটায়, ডাবল বেড বিছানায় এসে শুয়েছে। ভেবে আর চিন্তা করেই, ও এ ঘরে এসেছে। তবু কিছুটা নিরাপদ মনে হয়েছিল। মাঝের দরজা, আর বাইরের ঘরে যাবার দরজা, ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছে। ফ্ল্যাটের মধ্যে কেউ ঢুকলেও, এ ঘরে সহজে আসতে পারবে না। দরজায় শব্দ করে জানাতে হবে। সেটাও ভয়ংকর, নিঃসন্দেহে। তবু ভিতর থেকে বন্ধ ঘরে, একটা সান্ত্বনা।

ববের খাবার তৈরি করতে করতেই এ ঘরে থাকা স্থির করে নিয়েছিল। ফ্রিজ খুলে জল বের করার সময় ও একটা আপেলও তুলে নিয়েছিল। ঠাণ্ডা বিয়ারের বোতলের দিকে দেখেছিল। আশ্চর্য, কোনও তৃষ্ণা বোধ করেনি। অথচ ঠাণ্ডা বিয়ার গলা দিয়ে নামা যেন অনুভব করেছিল, আর সেই চোখ জুড়ে আসা ঘুম। মহৌষধের মতো মনে হয়েছিল। গরমে, ক্লান্তিতে, এ রকম মহৌষধ জীবনে অসংখ্য বার গলায় ঢেলেছে। কিন্তু আজ এক বারও ইচ্ছা করেনি। ফ্রিজ বন্ধ করে, আপেলটা ববের হাতে দিয়েছিল। বব কার্পেটের ওপর উপুড় হয়ে, আপেলটাকে মুখে পুরে দেবার অক্ষম চেষ্টা করেছিল। ছোট দুটি দাঁত দিয়ে আপেলের গায়ে বসাবার চেষ্টা করেছিল, আর গলা থেকে অদ্ভুত শব্দ করছিল।

আভা সেই ফাঁকে কিচেনে ঢুকে দ্রুত খাবার তৈরি করেছিল। মালতীর দেওয়া সেই বোতলের খাবার। ববকে খাইয়ে ঘুম পাড়ানোটাই সবথেকে আগে দরকার ছিল। তরল খাদ্যের সঙ্গে, ববকে একটা বিস্কুটও ভিজিয়ে নরম করে খাইয়েছিল। দক্ষিণের বাঁ দিকের শোবার ঘরে ঢুকে, ওয়ারড্রোব খুলে ধোয়া পরিচ্ছন্ন ভোয়ালে পেয়েছিল। সেই ঘরেরই বাথরুমে ঢুকে দেখেছিল, পুরুষের ব্যবহার্য সবরকম বস্তুই ছিল। টুথপেস্ট ব্রাশ শেভিং রেজার ব্রাশ, আফটার শেভ লোশন ও পাউডার, শেম্পু, ক্রিম, তেল, আর ট্যালকম পাউডার। ট্যালকম পাউডারটাই বিশেষ প্রয়োজন ছিল। তোয়ালেয় সামান্য জল ছুঁইয়ে, ববকে সারা গা মুছিয়ে দিয়েছিল। পাশের ঘরে পাখা খুলে, বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পাউডার মেখে দিয়েছিল। খাটের সংলগ্ন বক্স খুলে দেখেছিল, বালিশ আর বিছানার আরও কিছু সরঞ্জাম রয়েছে। একটা বেড শিট বের করে ববের গায়ে ঢাকা দিয়েছিল। বব আপেলটা হাতে করেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।

ভয় উৎকণ্ঠা উত্তেজনাবশত ক্লান্তি, সবকিছুর মধ্যেও, বাথরুমে ঢুকে ভাল করে স্নান করার জন্য ওর শরীরের প্রতিটি রোমকূপ যেন তৃষ্ণার্ত ছিল। খাওয়ার থেকেও সেটা অনেক বেশি প্রয়োজন ছিল। এত ভাল বাথরুম, অনেক কাল পরেও ওর কপালে জুটেছে। বব ঘুমিয়ে পড়ার পরেই, ও সেই ঘরের বাথরুমে প্রথমে ঢুকেছিল। গায়ের শাড়ি জামা খুলে রেখেছিল। ভেজাবার উপায় ছিল না। গরম আর ঠাণ্ডা জলে, অনেকক্ষণ ধরে স্নান করেছিল। মনে হয়েছিল, ভিতরের ভয় উৎকণ্ঠা সন্দেহে জমে ওঠা গ্লানিও যেন ধুয়ে গিয়েছিল। অনেক দিন পরে নিজেকে বেশ সুস্থ আর ঝরঝরে লাগছিল। পাখার তলায় চুল মুছতে মুছতে মনে হয়েছিল, চোখে ঘুম নেমে আসছে। সেটাই তো স্বাভাবিক ছিল। বিবস্ত্র হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাত্র এক বার নিজেকে দেখেছিল। বহু প্রশংসিত ওর রূপ, শরীরের গঠন, কেমন একটা লজ্জাকর গ্লানি আর ধিক্কার জাগিয়ে দিয়েছিল। আয়নার কাছ থেকে সরে গিয়ে, গায়ে। পাউডার ঢেলেছিল। শাড়ি জামা বদলে, কিচেনে গিয়েছিল। এক বার ভেবেছিল, এক কাপ কফি তৈরি করে খাবে। ইচ্ছা হয়নি। দুটো বিস্কুট খেয়ে, বোতল উপুড় করে ঠাণ্ডা জল গলায় ঢেলেছিল। তারপরেই দক্ষিণের ডান দিকের ঘরে গিয়ে, বাইরের আর মাঝখানের দরজা দুটো বন্ধ করেছিল। বাইরের ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু শোবার ঘরের আলো নেভাতে পারেনি। সম্পূর্ণ নিচ্ছিদ্র অন্ধকার ঘরে ববকে নিয়ে একা, অচিন্তনীয় ছিল। দক্ষিণের একটা জানালা খুলে দিয়েছিল। পরদা ফাঁকা করে বাইরে দেখেছিল। একটা গাছ দেখা যাচ্ছিল, জানালা থেকে কিছুটা দূরে। নীচেও কিছু গাছপালা। বাগান কিনা, বোঝা যায়নি। তারপরে একটা দোতলা বাড়ির অবয়ব। বিন্দুর মতো দু একটা আলো। বাতাসে পরদা উড়লেও, এ ঘরের কিছু দেখা যাবে না। ও খাটের ওপর উঠে, ববের পাশে শুয়েছিল। চোখ বুজেছিল। আসলে ও ছিল উৎকর্ণ। বুকের ভিতরে কুণ্ডলী পাকানো সাপের মতো ভয়টা ছিল জমাট আর স্তব্ধ। তখনই ওর চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল সেই ছবি। কখন ও চোখ মেলেছিল, খেয়াল নেই। অপলক দৃষ্টি ছিল ঘুরন্ত পাখার দিকে। আর সেই ছবি…।

ভাবী স্বামীর সঙ্গে, সেই ওর প্রথম দৈহিক মিলন। কয়েক মাস পরিচয়ের পরে, যার সেই অস্বাভাবিক উৎকট রূপ দেখেছিল। জীবনে সেই প্রথম শুনেছিল, সেডিউস অ্যান্ড রেপ, বেস্ট প্লেজার অফ-আ ম্যান। এবং নিঃসন্দেহে, জলি ওকে, প্রকৃত অর্থেই উন্মাদের মতো ধর্ষণ করেছিল। স্থান, স্যার জে সির বিখ্যাত বাড়ি–ম্যাসিভ ম্যানসন। মিক্সড ওয়েস্ট অ্যান্ড ওরিয়েন্টাল ম্যানসন-সাহেব আর্কিওলজিস্টের নকশায় তৈরি।

স্যার জে সির বাড়ি। জলির জন্যে নির্দিষ্ট উইংয়-এ বিলাসবহুল শোবার ঘরে। আভার তখন কুড়ি বছর বয়স। এবং আভা মিথ্যা বলেনি, যে-অর্থে পুরুষের সঙ্গে নারীর সহবাস’ বোঝায়, অথবা সেই এক নির্দিষ্ট অর্থে যাকে বলে, কৌমার্যহরণ’ ওর জীবনে প্রথম ঘটেছিল।

কিন্তু যথার্থ ঘটনা হল, আভা ওর সতেরো পেরোতে না পেরোতেই, পার্ক স্ট্রিট, আর চৌরঙ্গি এলাকার মৌচাকে গুঞ্জন তুলেছিল। বাবার আকস্মিক মৃত্যু তখন ঘটে গিয়েছে। আভার জুনিয়র কেমব্রিজের প্রস্তুতি যেন এক অদৃশ্য শক্তিবলে শিথিল হয়ে পড়েছিল। দিদি শোভার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রঞ্জনদার সঙ্গে দিদির প্রেমলীলার নানা রোমাঞ্চকর ঘটনা ওর চোখের সামনেই ঘটেছিল। অরুণের প্রেম পর্ব চলছিল। অরুণ আর জবা তখন আভার থেকে বয়সে চার আর ছ’ বছর পিছিয়ে। বাবা বেঁচে থাকতেই, পৈতৃক বাড়ি বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। আর্থিক কৌলীন্য ছিল তার আগে থেকেই নিম্নগামী। অথচ হিন্দু পরিবারে, বারো মাসে তেরো পার্বণ দুরের কথা, মা যে সব হিন্দু লৌকিক আচার আচরণ নিয়ে এসেছিলেন, সেই সব পূজা ব্রত উপবাস বাবা তুলে দিয়েছিলেন। সে সব ছিল পিসিমার খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের আগে, বাবা যখন পিসিমার সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন। পরে আবার পিসেমশায়ের সঙ্গে বাবার বন্ধুত্ব হয়েছিল। বাবার ঝোঁক ছিল, ছেলেমেয়েদের ইংরেজি কেতায় মানুষ করবেন। সেই সঙ্গে পরিবারের হিন্দু সংস্করণটাকেও একেবারে খোল নলচে সুদ্ধ বদলে দেবেন। ছেলেমেয়েদের মুখে ইংরেজি বুলি শুনতে ভালবাসতেন। পছন্দ করতেন সাহেবি আদবকায়দা। এমনকী পোশাকে-আশাকেও। কিন্তু তার জন্যে যে আর্থিক সচ্ছলতা দরকার ছিল, মূলে হা ভাত সেখানেই। পরিপাটি ঔজ্জ্বল্য রক্ষা করা যায়নি। বাবার আকাঙ্ক্ষা আর ব্যক্তিগত জীবনধারণের মধ্যে। ছিল দৃষ্টিকটু বৈপরীত্য। আকাঙ্ক্ষার পরিপূরক দায়িত্ববোধ ছিল না। মদ্যপানে ছিল ঘোরতর আসক্তি। ততোধিক ঘোড়দৌড়ে। কিন্তু যে কালচারের আমদানি করতে চেয়েছিলেন, ছেলেমেয়েদের মধ্যে তা চুঁইয়ে গিয়েছিল। পরিণামটা ভাল হয়নি। ছেলেমেয়েরা সংসারে দৈন্যদশাকে ঘৃণা করত। বাবা বেঁচে থাকতেই অরুণ বিদ্রোহী হয়েছিল। কোনও যুক্তিসম্মত নতুন উদ্ভাবনী শক্তি নিয়ে না। কলেজে পড়তে পড়তেই মদ ধরেছিল। বাবার সঙ্গে ঘোড়দৌড়ের মাঠেও দেখা হত। বাবা শাসন করতে গিয়ে অপমানে মাথা নিচু করে সরে গিয়েছিলেন। দৈন্যদশার কারণে, অপমান বোধটা ছিল সব ছেলেমেয়ের মধ্যেই। বাবা মারা যাবার পরে, বিপর্যস্ত সন্তানেরা নিজেদের করুণ দিকটা দেখতে পেয়েছিল আরও স্পষ্ট। সে অবস্থাটাকে কাটিয়ে ওঠার জন্য, সুসঙ্গত স্থির কোনও লক্ষ্য ছিল না। সকলেই যে যার মতো গা ভাসিয়ে দিয়েছিল। শোভা বিয়ের আগেই, রঞ্জনের সঙ্গে যেখানে খুশি যেত। মদ খেতে শিখেছিল, পার্টিতে নাচগান হুল্লোড়ে মেতে থাকত। আভাকেও সঙ্গে নিয়ে যেত। সে সব অনেক আগের কথা। আর অনেক আগে থেকেই, আভার ভবিষ্যৎও তৈরি হচ্ছিল।

মা ছিলেন অসহায় দর্শক। অরুণের আর শোভার একান্ত কৃপার পাত্রী। আভাকেই বা তিনি ধরে রাখবেন কেমন করে। পারমিসিভ সোসাইটির যা কিছু কলাকৌশল, সে সব তখন ওর আয়ত্তে। পরীক্ষায় জলাঞ্জলি দিলেও, ওর নিজের মেলামেশার জগৎটা বাড়ছিল। ও যে নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম ইস্কুলে পড়ত, সেখানে ওর মেয়ে বন্ধুদের গোষ্ঠীটা ছিল কসমোপলিটান। পার্ক স্ট্রিটের। মিশনারি কলেজের অনেক ছাত্রদের সঙ্গেই ওর মেলামেশায় নানান তালে তাল দেওয়া ছিল। রেস্তোরাঁয় গিয়ে বিয়ার পান, নাচ আর হই হুল্লোড়ে আড্ডা ছিল জমজমাট। নাচে ওর জুড়ি ছিল না আর কেউ, বলতে গেলে। ছেলেরা সবাই ওর সঙ্গে নাচতে চাইত। সকলের বক্ষলগ্ন হয়ে, নিজেও নাচতে ভালবাসত। তখনই পান-ভোজন বয়ফ্রেন্ডদের কাছ থেকে কিঞ্চিৎ উপহার জুটত ক্যাশ অ্যান্ড কাইন্ড। সেটাকে ও পাওনা বলেই ধরে নিয়েছিল। কখনও ফাঁকা বাড়ির সুযোগে, অথবা অন্ধকার নির্জন সিঁড়িতে, সুকান্তর ভীরু প্রেম বড়ই জলো হয়ে উঠেছিল। তথাপি ওর ঠোঁটে প্রথম স্পর্শের দাগটা, সেই ভীরু ঠোঁটেই এঁকে দিয়েছিল। এবং এমনকী আড়ষ্ট আলিঙ্গনও।

দারিদ্রলাঞ্ছিত প্রাণে যদি থাকে আকাঙ্ক্ষা, সামনে দুয়ার থাকে খোলা, হাতছানি থাকে অজস্র, সেটা এক রকমের প্লাবন। প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা, ফরসা ছিপছিপে নিখুঁত গঠন শরীরে উপছানো যৌবনের ঢল। চুল আর আয়ত চোখের তারা ঈষৎ পিঙ্গল। টানা ভুরু, অনধিক উন্নত নাক, কিঞ্চিৎ স্কুল রক্তিম ঠোঁট। চোখের তারা অতিমাত্রায় ঘূর্ণিত না, বা ঠোঁটে সর্বদাই হাসি। কিন্তু যথাস্থানে চোখের গভীরে অর্থপূর্ণ ঝিলিক, ঠোঁটে প্রশ্রয়ের হাসি, চলার ভঙ্গিতে অনতি ঢেউ তোলা ছন্দ ককেট্রি পটিয়সী। ককেট্রিকে যদি সাবলাইম বিশেষণ দেওয়া যায়, তবে তাই। তখন এই সব মহিমা দিয়ে আভার মূর্তি তৈরি হয়েছে। প্লাবনে ও ভেসে যাবে, সেটা একরকম অমোঘ নিয়তির নির্দেশ। ছেলে বন্ধুদের মধ্যে কে ছাত্র আর কে ছাত্র না, সে সীমারেখা বিচার করা অপ্রয়োজনীয়। কাড়াকাড়ির কোন হাতে ওর হাত চলে যেত, কার গাড়িতে ফ্রন্ট সিটে বসে গায়ে গা ঠেকিয়ে উড়ে বেরিয়ে যেত, লক্ষ করবার অবকাশ ছিল না।

খ্যাতনামা পাশ্চাত্য নৃত্যকুশলী নিকোলাস, আভার সঙ্গে নেচেই কেবল তৃপ্ত হয়নি। নিজের লার্নার ফ্লোরে আভাকে নিয়ে যেতে পেরে কৃতজ্ঞ হয়েছিল। নাচ শেখাতে পেরে কৃতার্থ হয়েছিল। অভিজাত পরিবারের মেয়ে আর পুরুষদের কাছে নিকোলাসের লার্নার ফ্লোর একটি অনিবার্য শিক্ষাকেন্দ্র। বাঙালি লোকটির নাম কেন নিকোলাস, তার শরীরে প্রকৃত কোন মানব গোষ্ঠীর রক্ত কে জানে। সে এমনকী আভাকে যৌন উত্তেজক ক্যাবারে নাচেও রীতিমতো দক্ষ করে তুলেছিল। হোটেলের নাচের ফ্লোরে কোনও দিন নাচেনি। কিন্তু আভা তখন এমন স্বপ্নও দেখত, জীবিকার জন্য ক্যাবারে নাচেও ও জুড়ি রাখবে না।

অজস্র নিমন্ত্রণ, প্রচুর পার্টি। লাঞ্চ ডিনার প্রতি দিনই ঘরে বাইরে। গোলাপি নেশায় মশগুল হয়ে, রাত্রে বাড়ি ফিরতে দেরি হত। মা ওর দিকে সন্দিগ্ধ-ভীরু চোখে তাকাতেন। সেই দৃষ্টির অর্থ, আভার অজানা ছিল না। পারমিসিভ সোসাইটির সব কিছু আয়ত্তে থাকা সত্ত্বেও, হিন্দু মধ্যবিত্তের সংস্কারটা ওর নিজেরও ছিল বেশ শক্ত। অতএব, ঠোঁটের স্পর্শ পেয়েই ফিরে যাও, আলিঙ্গন পর্যন্তই তুষ্ট থাকো। তার বেশি কারোকেও এগোতে দেয়নি। চেষ্টা যদিও অনেকে করেছে। অনেক শপথ আর নিরঙ্কুশ আত্মসমর্পণের নিশ্চয়তাসহ। পারেনি। জীবনযাপনের প্রণালীর মধ্যেই সহজাত প্রবৃত্তি তীক্ষ্ণ হয়েছিল। নেহাত বোকাও ছিল না। জবরদস্তির কাঁটাকে কাঁটা দিয়েই কেমন করে তুলতে হয়, সেটা বুঝে নিয়েছিল।

আটকাতে পারেনি জলিকে।

জলি মজুমদারের সঙ্গে পরিচয় হওয়াটা এমন কিছু আশাতীত ঘটনা ছিল না। অভূতপূর্ব বিস্ময়ের কারণ ছিল তার ব্যগ্র ব্যাকুল মুগ্ধতা। জলির সঙ্গে পরিচয়ের দিনটিতে ঠিক কার নিমন্ত্রণে আভা। ডিনারের নিমন্ত্রণে হোটেলে গিয়েছিল মনে নেই। দিদি আর রঞ্জনদাও আভার গৌরবে নিমন্ত্রিত ছিল। ছিল সস্ত্রীক অরুণও। জলি মজুমদারের নামটা দু-একবার শোনা ছিল। এত উঁচু, যে মনে রাখবার কারণ ছিল না। কিন্তু ঘটনা ঘটে গিয়েছিল অন্য রকম। প্রথমে টেবিলে-টেবিলে ফিসফাস, জলি, জলি!…তারপরে জলি স্বয়ং মাইক টেনে নিয়ে গান পরিবেশন করেছিল। এ রকম তো প্রায়ই করে থাকে। কলকাতার যে-কোনও বড় আর নামী হোটেল রেস্তোরাঁয় অনেকেই তার গান শুনেছে। আভা সেই প্রথম। প্রচুর হাততালি আর প্রশংসা। আভার তেমন আহামরি মনে হয়নি। কিন্তু স্যার জে সি-র ছেলে বলে কথা! আভার হোস্ট বলেছিল, গ্রেট!

আভা ওর হোস্টের সঙ্গে প্রথম রাউন্ড নেচে এসে বসেছিল। ওর প্রতি জলির প্রশংসা শুনিয়েছিল যেন দেবসভার ইন্দ্রের স্তুতির মতো। ও কি আসবে না এক বার জলির টেবিলে?

নিশ্চয়। আভার হোস্ট স্বয়ং আভাকে হাত ধরে তুলে নিয়ে, যেন জলির কাছে পুস্পাঞ্জলি দিয়েছিল। ইংরেজিতে বলেছিল, ও ভাগ্যবতী, তাই আপনার চোখে পড়েছে।

জলি উঠে দাঁড়িয়ে, আভার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, অপরূপ! (সপ্লেন্ডিড-এর বাংলা যদি এই হয়–সেই ক্ষেত্রে।) অনেকের ভিড়ের মধ্যেও, আপনার নাচ চোখে না পড়ে উপায় ছিল না। সকলের থেকে আলাদা আপনার নাচের ভঙ্গি। আপনার শরীরটাই যেন নাচের ছন্দে তৈরি। বসবেন না দয়া করে?

ধন্যবাদ!’ আভার স্বর খুশি ও লজ্জায় অর্ধোচ্চারিত ছিল। জলির পাশের চেয়ারটাই ওর জন্য খালি ছিল। আশেপাশের অনেক টেবিল থেকেই এ ঘটনা অনেকে দেখেছিল। গুঞ্জন করছিল।

আভার হোস্টকেও জলির টেবিলের একজন মহিলা বসতে অনুরোধ করেছিল। সে এক্ষুনি আসছি’ বলে চলে গিয়েছিল। জলি চেয়ারে বসে আভাকে নিজের নাম বলেছিল। তার ডান দিকে, একজনের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, আমার কাজিন সিস্টার জয়া।

হেলো। জয়া মাথা ঝাঁকিয়ে, মেপে হেসেছিল। স্লিভলেস লো কাট জামায়, তার যৌবনকে উদ্ধত দেখাচ্ছিল। প্রসাধন আর সাজগোজ বাদ দিয়েও, জয়া যে রূপসী, তা বোঝা গিয়েছিল। এবং জয়ার সচেতনতাও। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ মনে হয়েছিল। বিবাহিতা কি না, নামের পরিচয়ে বোঝা যায়নি। তাকে যেন একটু বেশি গম্ভীর মনে হয়েছিল। এবং গর্বিত। অন্যান্য যুবতী মহিলা ও দু-একজন পুরুষের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। দেবার ভঙ্গিটাই এমন ছিল, আভা তাদের নাম মনে রাখবার প্রয়োজন বোধ করেনি। আভা জলির গানের প্রশংসা না করে পারেনি। জলির মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। সলজ্জ হেসে, জয়াকে এক বার দেখে, মাথা নেড়ে বলেছিল, কিছু না, মামুলি। টেবিলে ছড়ানো ছিল স্কচের বোতল, যা সচরাচর দেখা যায় না। বিয়ার, ওয়াইন, আর সোডার বোতল। কিছু স্ন্যাকস। আভা কী খাচ্ছে, জলি জিজ্ঞেস করেছিল। আভা আগে এক গেলাস বিয়ার পান করেছিল। কিন্তু ও মিথ্যা বলেছিল, কিছু না।

তা হলে কী আপনার পছন্দ? একটু ওয়াইন দিই?’ জলি জিজ্ঞেস করেছিল।

আভা ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়েছিল। একজন যুবতী মহিলা গেলাসে ওয়াইন ঢেলে এগিয়ে দিয়েছিল। সকলেই অভিলাষ সূচক গ্লাস হাতে তুলেছিল, জয়া ছাড়া। কিন্তু সে বলেছিল, প্রাপ্তির ফল যেন কারোর উপকারে লাগে। ইংরেজিতে কথাটার মধ্যে বিদ্রুপের হুল। জলি জয়ার কাঁধে হাত দিয়েছিল। চোখে ছিল যেন সকাতর অনুরোধ। জয়া গ্লাস হাতে নিয়েছিল। গান শেষ হয়েছিল। নাচের জন্য আবার অনেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল। জলি আভার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। আভাও। দুজনেই নেচেছিল। জলি মোটেই আভাকে গায়ের সঙ্গে লেপটে রাখতে চায়নি। আভার নাচ দেখবার জন্য, একটু বেশি ফাঁক রেখেছিল। এক প্রস্ত না হয়ে যাবার পরেও, জলি বাদকদের দিকে হাত তুলে ইশারা করেছিল। বাদকেরা খুশি ও কৃতার্থ হয়ে, নতুন বাজনার ঝংকার তুলেছিল। অন্যান্য জোড়া সব সরে। গিয়েছিল। ফ্লোরে ছিল কেবল জলি আর আভা। উজ্জ্বল স্পট লাইট ছিল ওদের ওপর। আভা বাজনা শুনে আর জলির নাচের ইঙ্গিত থেকেই ট্যাঙ্গো নাচতে আরম্ভ করেছিল। লয়ে একটু দ্রুত, জলি মাঝে মাঝেই আভার হাত ছেড়ে দিচ্ছিল। আভার বিশ বছরের উদ্ধত তারুণ্য এক অপরূপ সুষমায় ঝংকৃত হচ্ছিল। ও তন্ময় হয়ে নেচেছিল, এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে, দ্রুত লয়ে আবার জলির হাতে এসে ধরা দিচ্ছিল। সমস্ত টেবিলের নরনারী স্তব্ধ বিস্ময়ে সেই নাচ দেখেছিল।

নাচের শেষে করতালির ধ্বনিতে বিরাট হলঘরটি যেন ফেটে পড়েছিল। কেউ কেউ বলে উঠেছিল, কোনও বিদেশিনীর নাচও এত ভাল অনেক দিন দেখিনি। সব আলোগুলো জ্বলে উঠেছিল। আভার নিজের ওপর একটা আত্মবিশ্বাস অনুভূত হয়েছিল, ও যথার্থভাবেই নাচের অনুষ্ঠানটি সার্থক করেছিল। জলি মুগ্ধ আর উত্তেজিত ছিল। আভা জলির নাচেও মুগ্ধ না হয়ে পারেনি। ও স্খলিত স্বরে জলিকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল। জলি আভার কোমরে হাত রেখে, টেবিলে ফিরে আসতে আসতে আবেগের সঙ্গে বলেছিল, ধন্যবাদ আমাকে না, তোমাকে। বলতে গেলে এটা তোমার একলা অনুষ্ঠান, আমি নিমিত্ত মাত্র। অসাধারণ! তোমার মধ্যে আশ্চর্য প্রতিভা আছে। মনে হচ্ছিল তুমি যেন দক্ষিণ আমেরিকার এক আজন্ম ট্যাঙ্গো শিল্পী।

টেবিলে ফিরে বসবার পরে, সবাই আভাকে স্তুতি বাক্যে প্রশংসা করেছিল। জলিকে অবিশ্যিই। এবং আভা নিজেই বলেছিল, মিঃ মজুমদার আমাকে নাচতে সাহায্য করেছেন। ও না হলে, এখানে এ নাচ পরিবেশন করতে সাহস পেতাম না।

জলির প্রতি আভার সেই প্রশংসায় সকলেই খুব খুশি হয়েছিল। বলেছিল, খুব সত্যি কথা।’ জয়া সকলের মতো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেনি। তার মন্তব্য যেন খুবই মূল্যবান, এই ভাবে ঈষৎ হেসে বলেছিল, বেশ ভাল।তারপরেই আর বসে থাকতে অনিচ্ছা জানিয়েছিল, জলি, আমি এবার উঠতে চাই।’

জলি জয়ার বাহু চেপে ধরেছিল। মুখে ছিল বিব্রত অস্বস্তির হাসি। চোখে সকাতর অনুরোধ, আর একটু বোসো৷ আমরা একসঙ্গেই উঠব।

আভা লক্ষ করেছিল, টেবিলের সবাই যেন একটু অস্বস্তি আর উৎকণ্ঠা নিয়ে জয়ার দিকে তাকিয়েছিল। কেন? আভার মনে প্রশ্ন জেগেছিল। কাজিন সিসটার বলতে, ঠিক কী রকম সম্পর্কের বোন, বোঝা যায়নি। এবং দুজনের মধ্যে সম্পর্কটাই বা কোন স্তরের, তাও ঠিক হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি। কেবল এটা বুঝতে পেরেছিল, জয়ার কথাবার্তা আচরণের মধ্যে বিশেষ একটি কর্তৃত্বের ভাব রয়েছে। জলির ওপরে তার প্রভাব, জলির আচরণেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। আভা তখনও সঠিক জানত, জলির বিবাহিত কি না। বিবাহের বয়স তার নিশ্চয়ই হয়েছিল। ত্রিশ বা তার কিছু কিঞ্চিৎ উর্ধে আভার অনুমান।

জয়া উঠে যায়নি। জলির কথা রেখেছিল। এবং আভা স্পষ্টই বুঝতে পারছিল, জলি ওর বা জয়ার, কার দিকে বেশি মনোযোগ দেবে, এই সংকটে পড়েছিল। জলি জয়ার দিকে ঝুঁকে বসেছিল। কিন্তু ওর বাঁ হাত আভার চেয়ারের পিছনে, নীচের দিকে, বারেবারেই কোমরের কাছে স্পর্শ করছিল। হলের টেবিলে টেবিলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল, জলি আভা। আভা জলি।…আভা খুব দ্রুত ওয়াইন পান করছিল। ওর মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। এবং নিজেকে ওর প্রকৃতই সৌভাগ্যবতী মনে হচ্ছিল। জলি বোতল থেকে জয়াকে হুইস্কি ঢেলে দিচ্ছিল, এবং নিজেও নিচ্ছিল। পেগের কোনও মাপ ছিল না। ক্যাবারে শুরু হতেই, হলের চেহারা বদলে গিয়েছিল। কিন্তু জলি সেদিকে চোখ ফেরায়নি। জয়াও না। আভার পিছনে নাচ চলছিল, মুখ ফেরাতে পারেনি। বাকিরা বেশ মেতে গিয়েছিল। তখনই জয়া আভাকে জিজ্ঞেস করেছিল, মনে হয়, নিকোলাসের কাছে তুমি নাচ শিখেছ।’

হ্যাঁ। আভা অবাক হয়নি। বিনীত হেসে বলেছিল। জলি বলেছিল, আমারও ঠিক এ কথাই মনে। হয়েছিল, আভার নাচে নিকোলাসের প্রভাব রয়েছে। লোকটি সত্যি গুণী শিক্ষক। জয়াও নিকোলাসের কাছে নাচ শিখেছে, আর আমেরিকা, ইওরোপে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ওরও বিশেষ প্রতিভা আছে।

জয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসেছিল, বাজে কথা বোলো না জলি। আমার কথা ছাড়ো, আভার নাচ সত্যি দেখবার মতো। নিকোলাস নিশ্চয়ই যথেষ্ট দরদ দিয়ে শিখিয়েছে।

আভা কতটা ওয়াইন পান করেছিল, খেয়াল করেনি, প্রায়ই চোখ তুলে দিদি দাদা রঞ্জনদা বউদিকে খুঁজছিল। তাদের দেখতে পাচ্ছিল না। ইতিমধ্যে টেবিলে খাবার পরিবেশিত হয়েছিল। জলি আভাকে অন্যমনস্ক দেখে, জেনে নিয়েছিল, ও দাদা দিদিকে খুঁজছে। জলি বলেছিল, এ নিয়ে ভাববার কোনও কারণই নেই। আমরা তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসব।

তা অবিশ্যি দিতে হয়নি। তবে জলিরই একটা বিদেশি বড় গাড়ি আভাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। তার আগে, দাদা বউদি দিদি রঞ্জনদার সঙ্গে জলি আর জয়ার পরিচয় হয়েছিল। জলিই পরিচয় করেছিল। এবং আবার একটি দিন ও স্থান নির্দেশ করে, নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আভাকে জলি নিজে হাত ধরে গাড়িতে তুলে দিয়েছিল। বিদায়ের সময় তার অবাক চোখে মুগ্ধ আবেগ ছিল।