১. ড্রেসিং টেবিলের সামনে

আইভি ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে, বাসি খোলা চুলে বিলি কাটছে। ও এখন চান করতে যাবে। অনেক কালের পুরনো ড্রেসিং টেবিল। ডিমের বা ডিম্বাকৃতি আয়না কেন বলা হয় কে জানে। ডিমের আকৃতি আলাদা। তবে অনেকটাই ডিমের মতো আকার, সেই জন্যেই ওভূল শব্দটা এসেছে। কি না, ভাষাবিদরাই বলতে পারে। ওভারি ডিম্বকোষ আর ওভল ডিম্বাকৃতি। বুক-সমান টেবিল আর দেরাজ, তার ওপরে কাঠের ফ্রেমের গায়ে, পুরনো আমলের দামি আয়নাটার গায়ে কয়েক জায়গায় ছোটখাটো ছোপ লেগে গিয়েছে। সেখানে কিছু দেখা যায় না। অনেকটা ফরসা মুখে ছুলির দাগের মতো।

আইভির দিকে তাকিয়ে, আভা কথাগুলো ভাবছিল। ড্রেসিং টেবিল থেকে বেশ খানিকটা দূরে, খাটের ওপর আধশোয়া হয়ে, ও আইভিকে দেখছিল। ঠিক দেখবে বলে দেখছিল না। ওর হাতে আজকের একটা ইংরেজি দৈনিক। পাশ ফেরা, আধশোয়া ভঙ্গিতে ও খবরের কাগজেই চোখ বোলাচ্ছিল। পুব দিকের জানালার পরদা, হঠাৎ বাতাসে উড়ে, একটা ঝাপটা খেতেই, ও চমকে উঠেছিল। মুখের কাছ থেকে কাগজটা সরিয়ে, জানালার দিকে তাকিয়েছিল। আর ওর পিছনে, কাত হয়ে অঘোরে ঘুমিয়ে থাকা দশ মাসের ছেলেটির গায়ে একটা হাত রেখেছিল। চোখে ছিল ত্রস্ত শঙ্কা। বুকের মধ্যে ধকধক করে উঠেছিল। প্রায় দু মিনিট অপলক উদ্বিগ্ন চোখে জানালার দিকেই তাকিয়ে ছিল। দমকা হাওয়ার একটা জোর ঝাপটা এক বারই পরদায় শব্দ তুলেছিল। তারপরে মৃদু বাতাসে কয়েক বার দুলে দুলে, পরদাটা জানালার গায়ে লেপটে গিয়েছিল। সময়ের হাওয়া এটা না। বর্ষার সময়েই পুবের জলো আর ঝড়ো বাতাস বহে। এখন তো উত্তর-দক্ষিণে, বাতাসের যেন যুদ্ধ চলছে। ফাল্গুনের মাঝামাঝি। প্রত্যাশা, এ সময়ে দক্ষিণের বাতাসই একটানা থাকবে। প্রকৃতির মতিগতি আলাদা। মাঝে মাঝেই উত্তরে হাওয়াও দিতে আরম্ভ করে, আর সেই হাওয়ায় একটা ঠাণ্ডা শিরশির ভাবও থাকে। সামান্য দু-তিন মাসের জন্য এসে, সহসা যেন বিদায় নিতে চায় না। কিন্তু দু-এক দিনের বেশি টিকে থাকতেও পারে না। হঠাৎ দক্ষিণের বাতাস সমুদ্র থেকে শহরের বুকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। উত্তরের বাতাস তখন উধাও। দক্ষিণের বাতাসে থাকে একটা আমেজ, কিন্তু দুপুরে কিছু উত্তাপ ছড়ায়। সেই সঙ্গে ঈষৎ ঘাম। তখন পাখা খুলতে ইচ্ছা করে।

ঋতু বদলের সময়টাই রীতি ভেঙে বিপরীত হয়ে ওঠে। এলোমেলো থাকে বলে। তবু পুবের জানালার পরদায় ও রকম বাতাসের ঝাপটা, চমকে দেবার মতোই। আর সেই রকম মনে হয়। অথচ এমন নয় যে, উত্তর দক্ষিণের বাতাসে, হঠাৎ হঠাৎ পুবের জানালায় ঝাপটা দিয়ে যায় না। আসলে, সবটাই মনের ব্যাপার। একটা দুরন্ত ভয় আর শঙ্কা সব সময়েই ওকে গ্রাস করে আছে। যেকারণে ও রকম চমকে উঠেছিল, পিছনে গায়ের কাছে লেপটে থাকা ঘুমন্ত ছেলের গায়ে হাত রেখেছিল, আর জানালার দিকে রুদ্ধশ্বাস ভয়ার্ত চোখে তাকিয়েছিল। দু মিনিট পরে ও নিশ্চিন্ত হয়েছিল, গরাদহীন জানালায় কোনও মানুষের অস্তিত্ব নেই। নিতান্তই হাওয়ার বেগে, কোথায় একটা ঝটকা মোচড় খেয়ে পুবের পরদায় এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

আভা নিশ্চিন্ত হয়েই, পরমুহূর্তে সংকুচিত লজ্জায় আইভির দিকে তাকিয়েছিল। ভেবেছিল, আইভি হয় তো ওকে দেখছে। দেখলে নিশ্চয়ই হেসে কিছু বলত। হয় তো ঠাট্টা করত কিন্তু বিদ্রূপ করে বা। আভা আঘাত পেতে পারে, এমন কিছু বলত না। আইভি আয়নায় নিজেকেই দেখছিল। আভাকে দেখছিল না। বাতাসে জানালার পরদা ঝাপটা ওর কানেই যায়নি। যাবার কথাও না। ব্যাপারটা এমন কিছু না, যাতে কান দিতে হবে। আইভির পক্ষে চমকাবার প্রশ্নও নেই। এ সব যা কিছু, সব আভার। সামান্য একটু শব্দে, এমনকী অন্যমনস্ক অবস্থায় সামান্য একটা ছায়া দেখলেও, ও ভয়ংকর আতঙ্কে চমকে ওঠে। বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ নাকাড়া বাজে। রুদ্ধশ্বাস ভয়ে মুখ সাদা হয়ে যায়। এই রকম চকিত ভয় পাওয়া মুহূর্তে, প্রথমেই ছেলেকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে। যেমন, এখনই বাতাসের ঝাপটায় পরদার শব্দে, ওর হাত আপনা থেকেই ঘুমন্ত ছেলের গায়ে গিয়ে পড়েছিল।

আভা এখন নিশ্চিন্ত, স্থির। আইভি ওর ভয়ে চমকে ওঠা লক্ষ করেনি। অতএব, মিথ্যা ভয়ে চমকে ওঠার জন্য লজ্জা বা সংকোচও এখনও নেই। কিন্তু দুরন্ত ভয় চমকের রেশটা কাটতে একটু সময় লাগে। গরাদহীন জানালা দিয়ে একটা মানুষের পক্ষে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়া অসম্ভব কিছু না। কিংবা, ঘরে না ঢুকেও, তাগ কষে রিভলবার থেকে গুলি ছোঁড়াটাও, এমন কিছু অকল্পিত ব্যাপার না। আর গুলি যদি অব্যর্থ লক্ষ্যে ছুটে এসে আগে আভাকে বেঁধে, তা হলে ছেলেকে রক্ষা করা অসম্ভব। ও মরতে মরতেও নিশ্চয় ববকে রক্ষা করবার চেষ্টা করবে। কিন্তু আততায়ীর রিভলবারে একটা মাত্র গুলি থাকবে না। সে ববকে বাঁচাবার অবকাশ না দিয়েই, আভাকে আগেই শেষ করে দেবে। তারপরে ববকে একটা গুলিতেই…।

না, এ রকম একটা বীভৎস দৃশ্যের কথা আভা ভাবতে চায় না। ভাবলেই ভয়টা তার ভয়ংকর অদৃশ্য থাবা তুলে, টুটি টিপে ধরতে আসে। যদিও, অবিশ্যি ও এই দুঃসহ উদ্বেগ থেকে একেবারে রেহাই পায় না। বাসগৃহের মেঝের কোনও এক জায়গায়, গর্তের মধ্যে একটা ভয়ংকর বিষাক্ত সাপ আস্তানা গেড়ে আছে, এটা জানার পরে কেউ নিশ্চিন্ত থাকতে পারে না। সাপটা কখন ঘুমিয়ে থাকবে, কখন বেরিয়ে আসবে, কেউ বলতে পারে না। ঘরবাসীর পক্ষে সব সময়েই সেটা একটা অপ্রত্যাশিত মরণ আঘাতের উদ্বেগ নিয়ে জেগে থাকে। আভার মনের অবস্থাটাও অনেকটা সেই রকমের।

অথচ, ঠিক মতো ভেবে দেখতে গেলে, দোতলার ওপর এ ঘরের, পুব দিকের জানালার দিক থেকে কোনও লোকের উঠে আসার আশঙ্কা অনেকটা অমূলক। এমনকী যদি সে এ অঞ্চলের চেনা লোকও হয়। পুব দিকে, নীচে পাঁচিল ঘেরা বাড়িটার সামনের চত্বরে মোটর মেরামতের ছোটখাটো একটা কারখানা। জায়গার তুলনায় হাবিব মিঞার কারখানা খুবই ব্যস্ত। সকাল থেকে অনেক রাত অবধি কাজ হয়। বারো-চৌদ্দ বছরের ছেলে থেকে বয়স্ক মিলিয়ে, হাবিবের কাজের লোকের সংখ্যা আট-ন জনের কম না। কয়েক দিনের মধ্যেই আভা লক্ষ করেছে, অনেক বিশিষ্ট ভদ্রলোকেরা গাড়ি নিয়ে হাবিবের কাছে যাতায়াত করে। এমনকী, খুব ঝরঝরে গাড়ি তার চত্বরে দেখা যায় না। মোটর মেকানিক হিসাবে তার নাম আছে। সব সময়েই, ওখান থেকে কাজ কর্মের আর লোকজনের কথাবার্তা শোনা যায়। একমাত্র রবিবার ছাড়া। রবিবার কোনও কাজ হয় না। এবং আজ রবিবার না। এলিয়ট রোডের গলির মধ্যে এ বাড়িটা পুরনো। পাশের বাড়িটা আরও পুরনো, এবং দোতলা। আর তুলনায় এ বাড়িটার থেকে নিচু। সামনের দিকে বড় থাম, প্রশস্ত ছাদ, ঢাকা বারান্দা। সেই বারান্দায়, বাড়ির মালিক মিঃ মিলার আর তাঁর বৃদ্ধা স্ত্রী, বেশির ভাগ সময় বারান্দায় বসে থাকেন। আভা অনেক বার দেখেছে। শুনেছে, ওঁরা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। ওঁদের ছেলেমেয়েরা সব আলাদা থাকে। রবিবারে নিজেদের ছেলেমেয়ে নিয়ে দেখা করতে আসে। সামনের বারান্দা, ভিতরে একটি মাত্র ঘর আর বাথরুম ছাড়া, সবই ভাড়া দেওয়া। ভিতরে নাকি অনেক ঘর আছে। ভাড়াটেরা ভারতীয়, নানা প্রদেশের। চত্বরটাও ভাড়া হিসাবেই হাবিবকে দেওয়া আছে, সেই সঙ্গে পুরনো গ্যারেজটাও। তার মধ্যেই, হাবিবকে অবিশ্যিই যাতায়াতের জায়গা ছেড়ে রাখতে হয়েছে। ঢোকবার গেটের সামনে, ডান দিকে একটা বুড়ো পাম গাছ। শরীরে বার্ধক্য, দীর্ঘ ঝালর পাতা এখন মাত্র কয়েকটি। এখন আর নিবিড় ঝাড়ালো নেই। বাঁ দিকেও নিশ্চয় একটা ছিল, গেট বাহারের সুন্দর জুটি। সেটি মারা গিয়েছে। কিন্তু পুব দিকের পাঁচিল ঘেঁষে, বড় কৃষ্ণচূড়া গাছটি এখনও ডালে পাতায় নিবিড় আর সতেজ। পাতা ঝরতে আরম্ভ করেছে। ফুলের কুঁড়ি ধরেছে। চৈত্র-বৈশাখে থোকা থোকা লালে লাল হয়ে ওঠে। রোজ রোদ আসতে একটু সময় লাগে। কারণ মিলারদের পাশের বাড়িটা চারতলা। কিন্তু রোদ যখন গাছে লাগে, চৈত্র-বৈশাখে ফুলের সময়ে, তখন এ ঘরের জানালাটা দিয়ে, ঘরের মধ্যে একটা রক্তিম আলো ছড়িয়ে পড়ে। আভা দেখেছে। এর আগে যখন প্রায়ই বেড়াতে এসেছে এ বাড়িতে। সেই সব বেড়াতে আসা ছিল অন্য রকম। সেই সব দিন ছিল অন্য রকম। এ বারের আসা অন্য রকম, একেবারে আলাদা। তাড়া করা বাঘের চোখ ফাঁকি দিয়ে, ছানা কোলে হরিণীর মতো।

আভা শরীর না ফিরিয়ে, মুখ ঘুরিয়ে ঘুমন্ত ববকে এক বার দেখল। আবার এক বার জানালার দিকে। এখন বড় জোর পৌনে ন’টা, সকাল বেলা। মিলার দম্পতি নিশ্চয় প্রাতরাশের পরে এখন বারান্দায় বসে আছেন। চত্বর থেকে ঠুকঠুক, খসখস ধাতব শব্দের সঙ্গে গলার স্বর ভেসে আসছে। গলির বাইরে থেকে ট্রামের ঘরঘর, গাড়ির গর্জন শোনা যায়। এ সময়ে পুবের জানালায় কারোর পক্ষে উঠে আসা সম্ভব না। আভার তবু ভয়। যে কোনও শব্দে, অন্যমনস্ক অবস্থায় হঠাৎ কোনও ছায়া নড়ে উঠতে দেখলেও, ভয় বুকের মধ্যে ধক করে ওঠে। একমাত্র বিজিত যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, ততক্ষণ ভয়টা কম হয়। মিনিট দশেক আগেই বিজিত অফিসে বেরিয়ে গিয়েছে। সাড়ে আটটা নাগাদই ও রোজ বেরিয়ে যায়। তারপরেও আইভি যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, মনে কিঞ্চিৎ ভরসা থাকে। এ বার আইভিও স্নান করে, পোশাক বদলে বেরিয়ে যাবে। স্নানের জন্য বাথরুমে ঢোকবার আগে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, ঘাড় ছাঁটা চুলে একটু বিলি কাটছে। আইভিও একটা অফিসে স্টেনোর কাজ করে। দশটায় হাজিরা, সাড়ে ন’টায় ও বেরিয়ে যায়। ওই সময় নাগাদ ওদের অফিসের গাড়ি ট্রাম রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। সাউথ থেকে আরও কয়েকজন মহিলা-পুরুষ কর্মীকে তুলে, অফিসের ভ্যান গাড়িটা ওকে তুলতে আসে। বিজিতকে নিতে কোনও গাড়ি আসে না। ও স্কুটারে যায়। ও একটা ইংরেজি পাবলিকেশন ফার্মের ডেপুটি ম্যানেজার। দিল্লি বমবে মাদ্রাজ হায়দ্রাবাদ আর কলকাতায় ওদের পাবলিশিং অফিস আছে। চাকরিটাও ওর ট্রানসফারেবল। অন্তত চাকরির শর্তটা তা-ই। তবে এখনও পর্যন্ত ওকে কলকাতার বাইরে যেতে হয়নি। যোগ্যতা আর দায়িত্বশীলতা, এ দুটোই ও কাজের দ্বারা প্রমাণ করেছে। সেই কারণেই কলকাতা শাখা অফিসের ডেপুটি ম্যানেজারের পদ পেয়েছে। কলকাতার বাইরে যাবার প্রস্তাব যে আসেনি, তা না। এসেছে। বিধবা মা, কলকাতার সংসার, চাকুরে স্ত্রী আইভি, ইত্যাদি সব নানা প্রসঙ্গ তুলে, এখনও পর্যন্ত অন্য কোথাও বদলির আদেশটা আটকে রাখতে পেরেছে। চিরদিন অবিশ্যি পারবে না। এক সময়ে যেতেই হবে। এখনও বছরে কয়েক বার দিল্লি বমবে যেতেই হয়। বিশেষ করে বছরের একটা সময়, যখন ভারতের কোথাও না কোথাও, ওদের পাবলিশিং কনসার্নের একজিবিশান এবং কনফারেন্স হয়।

আইভির গায়ে এখনও রাত্রের পোশাক। গলা থেকে পায়ের গোড়ালি অবধি ঢাকা, খুব পাতলা নাইটি না। হলুদ জমি, লাল ফুল, বড় গলা, বুকের কাছে ভি। আভা আয়নার বুকে, আইভির প্রায় কোমরের কাছ থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে। ও বাঙালি না, নেপালি। আসল নাম রতি চিত্রকর।

আইভি নামটা বিজিতের দেওয়া। নেপালি বললেই যে রকম চোখ-মুখের ছবি মনে আসে, আইভির চোখ মুখ মোটেই সে রকম না। রংটা পাহাড়িদের মতোই ফরসা, ঈষৎ রক্তাভ। কিন্তু কালো চোখ বেশ বড়ই। নাক চোখা। অনধিক পুষ্ট ঠোঁট, মুখের গড়ন প্রায় গোল। প্লাক করা ভুরু সরু। মাঝারি লম্বা, মেদহীন শরীরের গঠন নিখুঁত। আইভি স্বাস্থ্যবতী, সুন্দরী। বয়স চব্বিশ-পঁচিশ। হিল তোলা জুতো পরলে, ওকে বেশ লম্বা দেখায়। ও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, দু হাত তুলে, মোলায়েম-প্ৰায় খয়েরি রঙের চুলের ভিতরে আঙুল চালাচ্ছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, ও নিজেকে দেখছে বলে মনে হয় না। ওর চোখের দৃষ্টি অন্যমনস্ক। ও কিছু ভাবছে। আভা নিজেকে আয়নায় দেখতে পাচ্ছে না। আইভির দেখতে পাওয়ার কথা। কিন্তু আইভি দেখছে না। নিজেকেও দেখছে না। ও কিছু ভাবছে। তা না হলে, খবরের কাগজটা ঝটিতি সরিয়ে, আভার ভীত সন্ত্রস্ত চমকে ওঠা দেখতে পেত।

কী ভাবছে আইভি? গতকাল রাত্রে বিজিতের সঙ্গে ওর কোনও রকম ঝগড়াঝাঁটি বা মন কষাকষি হয়নি। আভা পাঁচ দিন আগে, রাত্রি প্রায় বারোটার সময় এ বাড়িতে এসেছে। তার মধ্যে এক দিন, এ ঘরেই দরজা বন্ধ করে, ওদের দুজনের মধ্যে কোনও ব্যাপার নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়ে ছিল। খুব একটা চিৎকার চেঁচামেচি কিছু হয়নি। ওরা দুজনে এক সঙ্গেই রাত্রি আটটা নাগাদ বাড়ি ফিরে এসেছিল। প্রায় রোজই তাই ফেরে। আইভির ছুটি আগেই হয়ে যায়। বিজিতের ছুটি হতে দেরি হয়। আইভির ছুটির পরে, বিজিতের কাছে আসে। কিংবা অন্য বন্ধুদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে, বিজিতের কাছে আসে। বিজিতের কাজ মিটে যাবার পরে, আইভিকে স্কুটারে পিছনে বসিয়ে একসঙ্গে বাড়ি। অবিশ্যি রোজই সরাসরি বাড়ি ফিরে আসে না। মাঝে মধ্যে দুজনেরই বন্ধু বান্ধবীদের সঙ্গে কোনও বার রেস্তোরাঁয় বসে। একটু গলা ভিজিয়ে আসে। গলা ভেজানো মানে, একটু সরস হয়ে আসা। বা রঙিন হয়ে আসা। বিজিত হয়তো দু-তিন পেগ হুইস্কি নেয়। স্কুটার চালিয়ে আসার দায়িত্বটা আছে। আইভি হয়তো দু পাত্র ভোদকা বা ব্লাডি মেরি। আর এমনিতে প্রত্যেক শনিবার রাত্রেই প্রায় বাড়িতে বন্ধুবান্ধব নিয়ে পানাহার হয়। নিজের বাড়িতে না হলে অন্য বন্ধুর বাড়িতে। এ সব রুটিন আভা আগে থেকেই জানে। ও নিজেও। অনেক বারই এসেছে।

কিন্তু গত পরশুর আগের দিনের ব্যাপারটা একটু আলাদা। রাত্রি আটটা নাগাদ দুজনে একসঙ্গেই ফিরেছিল। নীচে স্কুটারের শব্দ শোনা গিয়েছিল। স্কুটারের শব্দ শুনলেই, আভার সারাদিনের ভয়ের ধুকপুকুনিটা কমে। এ বাড়ির নীচে, সামনের দিকে জায়গা কম। গেট দিয়ে ঢুকে, বাঁ দিকে গ্যারেজ। কিন্তু গ্যারেজ হিসাবে সেটাকে ব্যবহার করা হয় না। নীচের ভাড়াটেদের গাড়ি নেই, অন্য কারোকেও ভাড়া দেওয়া হয়নি। যদিও নাকি, অনেকেই গ্যারেজটা ভাড়া নিতে চেয়েছিল, বা এখনও চায়। দেওয়া হয়নি, কারণ বাড়ির কাজের লোক আলি তার সাকিনাকে নিয়ে গ্যারেজেই থাকে। সাকিনাও এ বাড়ির কাজ করে। তার কাজ বাসন মাজা আর কাপড় কাঁচা। আলির কাজ ঘর-দরজা পরিষ্কার রাখা। বাজার করা থেকে নানা রকম ফাইফরমাশ এবং পিসিমাকে রান্নার কাজে সাহায্য করা পর্যন্ত। পিসিমা হলেন বিজিতের মা। আভার বাবার সহোদরা নন, মাসতুতো বোন। বাবা তাঁর এই বোন লাবণ্যর (পিসিমা) বিয়ের পর, প্রথম দিকে কোনও সম্পর্ক রাখতেন না। কারণ লাবণ্য বাঙালি খ্রিস্টানকে বিয়ে করেছিলেন। পরে অবিশ্যি পিসেমশাইয়ের সঙ্গে বাবার খুবই বন্ধুত্ব হয়েছিল। শালা ভগ্নিপতি ছিলেন এক গেলাসের ইয়ার, এবং দুজনেই বেশ মাতাল ছিলেন। দুজনেরই অসম্ভব ঘোড়া রোগ ছিল রেস যাকে বলে। তা ছাড়া তিন তাসের নেশাও ছিল। যার ফলে এক সময়ে পিসিমা আর মা, দুজনের মেলামেশায় ভীত হয়ে পড়েছিলেন। মায়ের সঙ্গে বাবার ঝগড়া হত। পিসিমার সঙ্গে পিসেমশাইয়ের। চেষ্টা করা হত, যাতে দুজনের সঙ্গে দুজনের দেখা সাক্ষাৎ মেলামেশা না হয়। কিন্তু রোধ করার কোনও উপায় ছিল না। দুজনেই তাঁদের স্ত্রীদের কাছে রোজ প্রতিজ্ঞা করতেন, আর মেলামেশা করবেন না। এবং, ঘরে থেকে অনেক সময় জানা যেত না, তাদের গোপন দেখা সাক্ষাতের কথা। গাই বাছুরে ভাব থাকলে বনে গিয়ে দুধ দেয়। তাঁদের সম্পর্কটা প্রায় সেই রকমই ছিল। জানাজানিও হয়ে যেত।

জানাজানি না হয়ে উপায় ছিল না। এক দিক থেকে দেখতে গেলে, কলকাতার বিভিন্ন সমাজের গতিবিধির সীমা খুবই ছোট। বাবা আর পিসেমশাইয়ের বিচরণ ক্ষেত্র, ক্রমে আভা বিজিতদেরও বিচরণ ক্ষেত্রের সীমায় এসে পড়েছিল। বিশেষ করে ঘোড়দৌড়ের মাঠ। অবিশ্যি তাঁরা যে সব জায়গায় সন্ধ্যায় আড্ডায় যেতেন, আভারা বা বিজিতরা সে সব জায়গায় যেত না। আসলে, বাবা আর পিসেমশাইয়ের বন্ধুত্বে বা মেলামেশায় এমনিতে আপত্তির কোনও কারণ ছিল না। তাঁরা দুজনেই ছিলেন প্রাচীন বনেদি বংশের সন্তান, শিক্ষিত বনেদিয়ানার যেটা মূল স্তম্ভ, সেই ধন-সম্পত্তির পড়ন্ত অবস্থায় তাঁরা মানুষ হয়েছিলেন। বাপ ঠাকুরদার অতীত বিষয়-আশয়ের কথা বলতে তাঁরা গৌরব বোধ করতেন। পিসেমশাই প্রথম জীবনে ছিলেন যাজক। তারপরে যাজকবৃত্তি ছেড়ে কিছুকাল মিশনারি কলেজে অধ্যাপনাও করেছিলেন। সেই সময়েই পিসিমার সঙ্গে প্রেম, এবং বিয়ে ঘটে। পিসিমাও পরে এক মিশনারি স্কুলে টিচারের চাকরি নিয়েছিলেন, আর পিসেমশাই অধ্যাপনা ছেড়ে তাঁর এক বন্ধুর বিদেশে আমদানি-রপ্তানি ফার্মের ওয়ার্কিং পার্টনার হয়েছিলেন। সেই সময় থেকেই তাঁর পুরনো জীবনের সঙ্গে বিচ্ছেদ, নতুন জীবনের শুরু হয়েছিল। আর আভার বাবা ঠাকুরদার পদাঙ্ক অনুসরণ করে, আইনজীবী হয়েছিলেন। ক্রিমিনাল ল-ইয়ার হিসাবে, রোরিং বিজনেস বলতে যা বোঝায়, তাঁর তাই ছিল। কিন্তু মদ জুয়া, সে সব তাঁদের পূর্বপুরুষের রক্ত থেকেই পাওয়া। অথচ প্রথম জীবনে দুজনেই ছিলেন রক্ষণশীল, আদর্শবাদী, সংসারের প্রতি দায়িত্ববান। পরে সে সবের কোনওটাই যেন ছিল না। বিশেষ করে, সংসারের প্রতি দায়িত্ব বোধ। দুজনের মেলামেশার ব্যাপারে, দুই পরিবারের এটাই ছিল সব থেকে। বিপত্তি ও আপত্তিকর বিষয়। অবিশ্যি দুজনের কেউ-ই এখন আর বেঁচে নেই। ষাট বছর পার করতে না করতেই মারা গিয়েছেন। পিসেমশাই আর যাই করুন, তাঁর এই পৈতৃক বাড়িটার গায়ে হাত দিতে পারেননি। পিসিমার জন্যেই পারেননি। কিন্তু আভার বাবা, তাঁর পৈতৃক বাড়ির প্রাপ্ত অংশও শেষ জীবনে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। মায়ের সঙ্গে পিসিমার সেখানেই তফাত। বাবাকে মা ভয় করতেন। পিসিমা পিসেমশাইকে যথাসম্ভব দাবড়ে রাখার চেষ্টা করতেন।

গত পরশুর আগের দিন, স্কুটারের শব্দ থামতে না থামতেই, কাঠের সিঁড়িতে আওয়াজ তুলে আইভি ওপরে উঠে এসেছিল। আভা তখন পিসিমার সঙ্গে বাইরের হল ঘরে বসেছিল। বাইরের ঘরটা হল ঘরের মতোই বড়। উত্তরে বেশ খানিকটা অংশ ডাইনিং স্পেস হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কাঠের ফ্রেমের সঙ্গে পরদা টাঙিয়ে আলাদা করা। দু পাশে দুটো বড় শোবার ঘর, আর দুটো ঘরেরই দক্ষিণে লম্বা-চওড়া ব্যালকনি। উত্তর দিকে সংলগ্ন বাথরুম। ব্যালকনি বললে কম বলা হয়। রেলিং ঘেরা, থামের মাঝখানে কাঠের জাফরি দেওয়া চওড়া জানালা। শোবার ঘর থেকে কিছুটা ছোট। নীচের ভাড়াটেরা শোবার ঘর হিসাবেই ব্যবহার করে। আইভির উঁচু হিলে, কাঠের সিঁড়িতে দ্রুত গটগট শব্দের মধ্যেই যেন ওর খারাপ মেজাজ টের পাওয়া গিয়েছিল। আভার সঙ্গে পিসিমার এক বার চোখাচোখি হয়েছিল। তারপরেই বেজে উঠেছিল টুংটাং কলিং বেল। আভাই গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছিল। আইভি একটা কথাও বলেনি। পারফিউমের গন্ধ উপছে, ওর নিশ্বাসেই ভোদকার হালকা চেনা গন্ধ পাওয়া গিয়েছিল। চোখ দুটোও ছিল লাল। পিসিমা তাকিয়েছিলেন। আইভি কোনও দিকে না তাকিয়ে, কোনও কথা না বলে, ওর ঘরে ঢুকেছিল। ওর ঘর, মানে এ ঘরটাই। এখন যে ঘরের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ও মাথার চুলে বিলি কাটছে। নীচে তখন স্কুটারের গর্জন থেমে গিয়েছিল। বারান্দায় স্কুটার ভোলার জন্য একটা সিমেন্টের ঢালু স্ল্যাব করা আছে। বারান্দাটা ছাদ ঢাকা, কাঁচ দিয়ে ঘেরা, আর ঢোকবার দরজা আছে। স্কুটারটা রাখা হয় কাঠের সিঁড়ির নীচে। নীচের দরজা রাত্রে লক করার দায়িত্ব ভাড়াটেদের। স্কুটারের জন্যে তাদের ওপর বিশ্বাস রাখতেই হয়। কোনও কারণে ঢাকা বারান্দার দরজা খোলা থাকলে, বাইরের বড় গেট খুলে, যে কেউ স্কুটার চুরি করে নিয়ে যেতে পারে।

আইভি ঢোকবার পরেও, আভা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। বিজিতের উঠে আসার জন্যই অপেক্ষা করছিল। বিজিতের জুতোর শব্দ কাঠের সিঁড়িতে শোনা গিয়েছিল। তার আগে ও বোধ হয় আলিকে কিছু বলছিল। কারণ আলির গলা শোনা গিয়েছিল, জি না। বিজিত ওপরে উঠে এসেছিল। ওর মুখও শক্ত, আর চোখে রাগ। এক বার আভার জিজ্ঞাসু ভীরু মুখের দিকে দেখেই, সোজা চলে গিয়েছিল ডাইনিং স্পেসের পরদার আড়ালে। পিসিমার সঙ্গেও কোনও কথা বলেনি। ওর নিশ্বাসেও হালকা গন্ধ পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু ডাইনিং স্পেসে, ফ্রিজের পাশেই সেলার খোলার শব্দ পাওয়া গিয়েছিল। সেলারের চাবিটা বিজিতের কাছেই থাকে। সেলার খোলা, গেলাস বের করা, পানীয় ঢালা, ফ্রিজ খোলা, গেলাসে জল ঢালা, সব শব্দই, হল ঘরের যথেষ্ট দূরত্বে থেকেও আভা শুনতে পাচ্ছিল। ও দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছিল। বিজিত ডাইনিং স্পেসের পরদা সরিয়ে বেরিয়ে এসে গেলাস হাতে ওর ঘরে ঢুকেছিল। ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। পিসিমা গম্ভীর মুখে, প্রায় নির্বিকার চোখে সবই দেখছিলেন, আর জলের জাগের একটা ঢাকনা কুরুশ কাটিতে বুনছিলেন। আভা পিসিমার দিকে চোখ রেখে, আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে, তাঁর পাশের সোফায় বসেছিল। বব তখন বাঁ দিকের শোবার ঘরে ঘুমোচ্ছিল। ওই ঘরে আভা পিসিমার সঙ্গে বড় খাটে শোয়। হল ঘর মাঝখানে রেখে, দুটো শোবার ঘর আর দক্ষিণের ঘরের মতোই বারান্দা মুখোমুখি। আভার মনে তখন একটাই ভয়, একটাই আশঙ্কা। যে কোনও খারাপ পরিস্থিতি আর ঘটনার মাঝখানে দাঁড়িয়ে মানুষ আগে নিজের কথা ভাবে। আভার ভয় আর আশঙ্কা ছিল, আইভি হয়তো এ বাড়িতে ওর আশ্রয় নেওয়াটা পছন্দ করেনি। তাই নিয়েই হয় তো দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি ঝগড়া হয়েছে। আর সেটা বাইরেই হয়েছে, কারণ বাড়িতে আভার সামনে আইভি নিশ্চয় এ প্রসঙ্গ নিয়ে বিজিতের সঙ্গে কোনও কথা বলতে চায়নি। এবং পরশুর আগের দিন রাত্রে ও ভাবে বিজিতের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেওয়াটাও আভার সন্দেহের সমর্থক। ঘরের ভিতরে ওরা গলার স্বর চড়িয়ে কথা বলেনি। আভার আশঙ্কা সেইজন্যই আরও তীব্র হয়েছিল। দু-চারটে উঁচু ঝাঁজালো স্বরের ইংরেজি কথা যা শোনা যাচ্ছিল, আভার সন্দেহ তাতে যেন আরও পোক্ত হয়েছিল। যথা: বিজিত উঁচু স্বরে, (বাংলা তর্জমা) আমি একটা মূৰ্থ নই। আইভির ঝাঁজালো স্বর, তুমি নিজেকে সব থেকে বেশি বুদ্ধিমান আর চালাক ভাব।…বেশ খানিকক্ষণ পরে, আবার এক বার বিজিতের রাগত স্বর: ‘আমি স্পষ্টই জানিয়ে দিচ্ছি, তোমার মতের সঙ্গে আমার মত মিলবে…’ আরও খানিকক্ষণ পরে, আইভির স্বরে কান্না মেশানো ঝাঁজ: ‘ঠিক তাই, হ্যাঁ ঠিক তাই, পৃথিবীতে আমার থেকে নিকৃষ্ট আর কেউ নেই।’..তারপরেই সব চুপচাপ। যদি কোনও কথা হয়েও থাকে, বাইরে থেকে শোনা যায়নি।

আভার যা মানসিক অবস্থা, এক রকম নিঃসন্দেহই হয়ে গিয়েছিল, বিজিত আর আইভির ঝগড়া, ওর এ বাড়িতে আশ্রয় নিয়েই হয়ে ছিল। ভয়ে আর হতাশায় ওর কান্না পাচ্ছিল। কিন্তু পিসিমার সামনে ও কাঠ হয়ে বসেছিল। কালো পাড়, সাদা শাড়ি পরা, দোহারা চেহারা, এখনও ধারালো চোখ মুখ, মাথায় ধূসর চুল পিসিমা খুবই রাশভারি মহিলা। কথা কম বলেন। কিন্তু স্নেহ মমতা আছে। বিজিত। আইভিকে ভালবাসেন। আভার আশ্রয় সম্পর্কে তাঁর কোনও আপত্তি ছিল না। বরং চিন্তিত ছিলেন। ববকে খুবই আদর করেন। বাড়িতে বিজিতের বন্ধুবান্ধব আসা, আড্ডা দেওয়া, পান-ভোজন অপছন্দ করেন না। নিজেও সকলের সঙ্গে মিশতে পারেন। তবে, কোনও ব্যাপারেই বাড়াবাড়ি তাঁর অপছন্দ। আইভির উত্তেজিত হয়ে ঘরে ঢোকা, বিজিতের সেলার খুলে, গেলাসে পানীয় নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করা, সব কিছু দেখার মধ্যেই তাঁর মুখে একটা তৃষ্ণীম্ভাব বিরাজ করছিল। সহসা কোনও কথা বলবার পাত্রী তিনি নন। মুখ খুলতে হলে, যথাসময়েই খোলেন।

আভার মনে পিসিমা সম্পর্কে একটা ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধা আছে। ভয়ে আর হতাশায় কান্না পেলেও, পিসিমার সামনে ও কাঠ হয়ে বসে ছিল। কিছু বলতেও সাহস পাচ্ছিল না। কারণ পিসিমা নিজে কিছুই বলছিলেন না। আভা ওর মনের আশঙ্কা প্রকাশ করলে, হয় তো তিনি রেগে উঠতেন। অথচ একেবারে চুপচাপ বসে থাকতেও পারছিল না। পিসিমা ঠোঁট টিপে, মুখ নিচু করে, যন্ত্রের মতো কুরুশ কাটি দিয়ে ঢাকনা বুনছিলেন। আভার চোখ থেকে থেকেই বিজিতের ঘরের বন্ধ দরজার ওপরে পড়ছিল। সারা বাড়িতে একটা স্তব্ধতা। পিসিমা কী ভাবছিলেন, তাও অনুমান করা দুঃসাধ্য ছিল। অথচ ও মনের মধ্যে একটা তীব্র আশঙ্কা ও ভয় নিয়ে স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছিল না। বিজিতের ঘর একেবারে স্তব্ধ হয়ে যাবার দশ মিনিট পরে ও উঠে দাঁড়িয়েছিল। অস্ফুট স্বরে কোনও রকমে বলেছিল, আসছি। বলেই বাঁ দিকের শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকেছিল। প্রথমেই দেখেছিল, বব চিত হয়ে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। ববের ডান হাতে ধরা আভার ব্যবহৃত একটা স্লিভলেস ব্লাউজ। ঘুম আসবার সময়, তন্দ্রা ঘোরে বব যখন মাকে ছাড়তে চায় না, তখন মায়ের গায়ের গন্ধ লেগে থাকা জামা বা রুমাল, যা হোক একটা কিছু ওর হাতে ধরিয়ে দিলে, সেটা মুখে পুরে বা নাকের কাছে রেখেই ঘুমিয়ে পড়ে। ববের ডান হাতের মুঠিতে সেইজন্যই ব্লাউজটা ধরা ছিল। বব ফরসা কিন্তু গোলগাল না, বরং দশ মাসেই ওকে বেশ লম্বা দেখায়। মাথায় বেশ ঘন চুল, চোখা নাক, চওড়া কপাল। দেখলেই বোঝা যায়, বব ওর বাবার মতো দেখতে হয়েছে। আভা ববের দিকে কয়েক মুহূর্ত দেখে, আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসেছিল। তারপরেই দু হাতে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে কেঁদে উঠেছিল। মনে মনে বলছিল, কী হবে আমার। হে ভগবান, কী আছে আমার কপালে? ববের কী হবে? এখান থেকে যদি আমাকে চলে যেতে হয়, কোথায় যাব? কার কাছে যাব? সংসারে আমি তো কারোর কাছে কিছু চাই না। কারোর কাছে কোনও দাবি নেই। কেবল ববকে নিয়ে বাঁচতে চাই। ববকে মানুষ করতে চাই। ওকে মানুষ করতে হলে, যা কিছু করা দরকার, আমি সবই করতে পারি। একটা চাকরি জোগাড় করতে পারি, আমি একলাই আমার দায়িত্ব নিতে পারি কিন্তু সে সব পথ আমার বন্ধ। ববকে বাঁচাবার জন্য, আর নিজের বেঁচে থাকার জন্যই আমাকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এভাবে কত দিন পালিয়ে বাঁচা যায়? এখন তো সন্দেহাতীতভাবে জানা গিয়েছে, আমাকে আর ববকে হত্যা করার ব্যবস্থা পাকা হয়ে গিয়েছে। ছায়ার মতো আততায়ী আমার পিছনে ফিরছে। আমি মরতে রাজি আছি। কিন্তু বব? আমি বেঁচে থাকতে ববকে খুন হতে দেব কেমন করে? অথচ আমরা কারোর জীবনের কোনও রকম বাধা সৃষ্টি করতে চাই না। তার জন্যে যে কোনও রকম স্বীকৃতি দিতেও আমি আপত্তি করিনি। তবু–।

আভার উৎকণ্ঠিত ভয়ের কান্না উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল। মুখে আঁচল চেপে, শব্দ রোধ করেছিল। প্রায় পনেরো মিনিট পরে বিজিতের ঘরের দরজা খোলার শব্দ শোনা গিয়েছিল। আভা তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে, বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দিয়েছিল। নিজের আঁচল দিয়েই জল মুছেছিল, এবং বেসিনের ওপরে আয়নার দিকে তাকিয়েছিল। ওর আয়ত চোখ জোড়া লাল দেখাচ্ছিল। ফরসা নাকের ডগাও লাল। চুল খোলা। শ্যাম্পু করা বা তেল মাখার বালাই নেই। রীতিমতো রুক্ষ আর দীর্ঘ চুলের গোছা সাপের মতো এক-এক জায়গায় পাকিয়ে জট পড়েছে। সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা, মেদহীন, প্রায় একহারা ওর শরীরের গঠন দেখে, এখনও সাতাশ বছর বয়সের তুলনায় কম দেখায়। ওর আয়ত চোখের তারা ঈষৎ পিঙ্গল, ভুরু জোড়া স্বাভাবিক সরু আর টানা, ছোট কপাল, টিকোলো নাক, পুষ্ট ঠোঁট, কিঞ্চিৎ লম্বাটে মুখ, দীর্ঘ গ্রীবা, সব মিলিয়ে এখনও ওকে রূপসী বলা চলে। মৃত্যু তাড়িত মুখে ভয়ের ছায়া, চোখের কোলে কালি থাকলেও, ঘন সংবদ্ধ ভরাট বুকে, কটির ক্ষীণতায়, এবং বুকের থেকে কিঞ্চিৎ চওড়া কোমরে, শরীরে এখনও যৌবনের উজ্জ্বল মহিমা। কিন্তু ওর শুকনো ঠোঁট, মুখের শীর্ণতা, চোখের কোলে কালি, যেন শরীরের মহিমাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে।

কিন্তু নিজেকে দেখবার বা বাথরুমে দাঁড়িয়ে থাকার সময় ওর ছিল না। বিজিতের ঘরের দরজা খোলার শব্দে ওর কৌতূহল তীব্র হয়ে উঠেছিল। তা ছাড়া, পিসিমা ওর হঠাৎ ঘরে চলে আসায়, কিছু ভাবতে পারেন। ও তাড়াতাড়ি বাইরের ঘরে এসেছিল। দেখেছিল, বিজিত পিসিমার বড় সোফাটারই এক পাশে বসেছে। ওর গায়ে তখন পাজামা আর গেঞ্জি। মাথার চুল আঁচড়ানো, গায়ে পাউডার ছড়ানো। সেই মাত্রই এসে বসেছিল। তখনও পিসিমার সঙ্গে কোনও কথা হয়নি। আভাকে দেখে বিজিত চোখ তুলে, খুব স্বাভাবিক, কিছুটা অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করেছিল, কীরে তুই ঘুমিয়ে ছিলি নাকি?

‘না, এমনি একটু–’। আভা কথাটা শেষ না করে, চকিতে এক বার বিজিতের ঘরের ভেজানো দরজার দিকে দেখেছিল। তারপরে বিজিতের চোখের দিকে।

বিজিত আভার থেকে সামান্য এক ফুট লম্বা হতে পারে। রোগা না, মোটাও না, কাটাকাটা নাক মুখ, কালো চোখ। একটা তীক্ষ্ণতা আছে ওর মুখে, অথচ কেমন একটা মেয়েলি কোমলতাও যেন মাখানো। আভার থেকে বছর দুয়েকের বড়। বিজিতদা বলে ডাকে। বিজিতের ওপরে এক বোন, সে বমবেতে থাকে স্বামীর সঙ্গে। তাঁর ওপরে অজিত, গত পাঁচ বছর ধরে লন্ডনে আছে। অজিতের বউ জার্মান মেয়ে। তাদের দুই ছেলে। পাঁচ বছরে, দু বার কলকাতায় এসেছিল।

বিজিতের চোখ একটু লাল দেখালেও, মুখে কোনও রাগ বা উত্তেজনা ছিল না। ওর জিজ্ঞাসার জবাবে, পিসিমাই মুখ না তুলে বলেছিলেন, আভা তোদের দরজা খুলে দিল, এর মধ্যেই ঘুমোবে কেমন করে?

‘তাও তো বটে।’ বিজিত হেসেছিল।

পিসিমা মুখ তুলে ডান দিকের দেওয়ালে ঘড়ির দিকে দেখেছিলেন। তারপর হলের সামনের বন্ধ দরজার দিকে। বলেছিলেন, তোদের ব্যাপার স্যাপার দেখে বোধ হয় মন খারাপ হয়েছিল, তাই ঘরে গিয়ে বসেছিল।

বিজিত আভার দিকে তাকিয়ে হেসেছিল। কিছুটা বিব্রত হাসি। বলেছিল, বাজে ব্যাপার। আভার চোখ দেখে মনে হল, ও বুঝি ঘুম থেকে উঠে এসেছে।

পিসিমা আভার মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। আভা চোখ নামিয়ে সংকুচিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু পিসিমা কিছুই বলেননি। আসলে আভার চোখ লাল দেখাচ্ছিল। যে কারণে বিজিতের ঘুমের কথা মনে হয়েছিল। আভার মনে হয়েছিল, পিসিমা বোধ হয় ওর কান্নার ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন। তিনি সামনের সেন্টার টেবিলের ওপরে কুরুশ কাটি, সুতোর বান্ডিল আর অসমাপ্ত জালি ঢাকনা রেখে, হাই তুলেছিলেন। বলেছিলেন, সাড়ে আটটা বেজে গেছে। আলিকে ডাকা দরকার। ফ্রিজ থেকে ও বেলার। রান্নাগুলো নর্মাল করতে দেওয়া দরকার। আটা মাখতে আর দেরি করলে হবে না।

পিসিমার কথা শেষ না হতেই কলিং বেলের টুং টাং শব্দ বেজে উঠেছিল। আভার বুকে সেই শব্দ বোমার মতো বুম বুম করে বেজে উঠেছিল। ও ফ্যাকাশে মুখে, ভয়ার্ত চোখে দরজার দিকে দেখে, বিজিতের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। বিজিত উঠে দাঁড়িয়েছিল। পিসিমা দরজার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, বোধ হয় আলি।

আমি দেখছি। বিজিত পা বাড়াবার আগে আভাকে বলেছিল, তুই ঘরে যা। আভার বুকে কাঁপুনি শুরু হয়ে গিয়েছিল। হয়তো সত্যি আলিই এসেছিল, কিন্তু সকলের মুখেই উদ্বেগ ফুটে উঠেছিল। আভা আসার পর থেকে কলিং বেল বেজে উঠলেই, সকলের চোখে মুখে সন্দেহ আর উদ্বেগ ফুটে ওঠে। আভা ঝটিতি বাঁ দিকের শোবার ঘরে ঢুকে পড়েছিল। খাটের কাছে গিয়ে উৎকর্ণ অথচ দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়েছিল। ওর চোখের সামনে ভাসছিল বিজিত, অথচ দরজার গ্লাস হোল-এ চোখ লাগিয়ে, বাইরের লোকটাকে দেখছে। কে হতে পারে? মিনিট খানেকের মধ্যেই দরজা খোলার শব্দ হয়েছিল। বিজিতের গলা শোনা গিয়েছিল, আলি, তুমি এখন থেকে দু বার কলিং বেল বাজাবে বুঝলে?

জি। আলির গলার স্বর শোনা গিয়েছিল।

আলির সাড়া পেয়েই, আভা নিজেকে অনেকখানি সামলে নিয়েছিল। বুকের কাঁপুনি থেমেছিল। তাড়াতাড়ি আঁচলে মুখ মুছে, বাইরের ঘরে ঢুকে বলেছিল, পিসিমা, আমি রান্না ঘরে যাচ্ছি, আপনি বসুন।

তোরা বোস। পিসিমা উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, এমন কিছু কাজ তো নেই এখন। রুটি তৈরি আর খাবার গরম করা। দুপুরের রান্নার সময় তো থাকিসই। পিসিমা পিছনে গিয়ে, ডাইনিং স্পেসের পরদা সরিয়ে ভিতরে গিয়েছিলেন।

ডাইনিং স্পেসের উত্তরে রান্নাঘর। দুটো শোবার ঘরের সংলগ্ন বাথরুমও উত্তর দিকে। দুটো বাথরুম থেকেই লোহার স্পাইরাল সিঁড়ি পিছন দিকে নেমে গিয়েছে। জমাদার ওই সিঁড়ি দিয়ে বাথরুম পরিষ্কার করতে আসে। বিজিতের মুখ গম্ভীর, চিন্তিত। কলিং বেলের প্রতিক্রিয়া। ও নিজের ঘরে ঢুকে, এক মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে এসেছিল। হাতে সিগারেটের প্যাকেট। লাইটার আর শূন্য গেলাস। সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার টেবিলের ওপর রেখে আভাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুই কিছু নিবি। নাকি?

না। আভা মাথা নেড়েছিল। ব্যগ্র জিজ্ঞাসু দৃষ্টি বিজিতের চোখের দিকে। আইভির সঙ্গে ঝগড়ার কারণটা জানবার জন্য মনটা ছটফট করছিল।

বিজিত বলেছিল, এ রকম টেনশন, একটু কিছু নিলে পারিস, জিন বা ভোদকা। একটু রিল্যাকস।

‘রিল্যাকস?’ আভা মাথা নেড়েছিল, কিছু খেতে ভাল লাগছে না। রিল্যাকস করার কথা ভাবতেই পারি না। কিছুতেই একটু ইজি হতে পারি না। পরে ঘুমের ওষুধ খাব। তুই নে।

বিজিত যেন খানিকটা কৈফিয়তের সুরে বলেছিল, ‘হ্যাঁ, একটু নিই। মেজাজটা একদম ভাল লাগছে না।’ ও পিছনে গিয়ে পরদা সরিয়ে ভিতরে গিয়েছিল। একটু পরেই গেলাসে রামের সঙ্গে জল মিশিয়ে নিয়ে বাইরে এসেছিল। আভাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলেছিল, বোস।

আভা সোফার কাছে সরে গিয়েছিল, বসেনি। বিজিতের ঘরের ভেজানো দরজার দিকে দেখেছিল। বিজিত সোফায় বসে গেলাসে চুমুক দিয়েছিল। আভা ওর দিকে তাকিয়েছিল। বিজিতও তাকিয়েছিল, এবং একটু হাসির ভঙ্গি করে, চোখ কুঁচকে বলেছিল, এমন কিছু না। ঠিক হয়ে যাবে।

আভা বিজিতের চোখের দিকে তাকিয়েছিল। কিন্তু মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করতে পারেনি, কী নিয়ে ওদের ঝগড়া হয়েছে। জিজ্ঞেস করতে পারেনি, ওকে নিয়ে আইভি কিছু বলেছে কি না। বিজিতের কথা ও ভাব-ভঙ্গি থেকে অবিশ্যি মনে হয়েছিল, তেমন গুরুতর ব্যাপার কিছু না। কিন্তু কথার ভাব-ভঙ্গি থেকে কি গুরুতর বিষয়টি সবসময় ধরা পড়ে? আভার জীবনের অভিজ্ঞতা তা বলে না। আইভি যদি আভার এ বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার বিষয়ে কিছু বলেও থাকে, বিজিত ওর সামনে তা কখনওই মুখ ফুটে বলতে পারবে না। পারবে না, সেটাও একেবারে নিশ্চিন্তে ধরে নেওয়া যায় না। পারতে হতে পারে, অন্য রকম ভাবে৷ তবু ও দরজার দিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, আইভিকে ডাকবি?

থাক না। বিজিত বলেছিল, এখন ও ওর মতো থাকুক।

আভার চোখ বিজিতের চোখ থেকে সরতে চাইছিল না। নিজেকে যথেষ্ট শক্তি দিয়েই, ঝগড়ার কারণ জিজ্ঞাসা থেকে, দমিয়ে রাখতে হয়েছিল। বিজিত আইভির বিয়ের আগে বা পরে দু-একবার ওদের খুনসুটি ঝগড়া যে ওর সামনে হয়নি, তা নয়। সে সময়ে অনায়াসেই জিজ্ঞেস করত, কী নিয়ে ওদের ঝগড়া। কিন্তু এখন সময় আর পরিস্থিতি আলাদা। ও জিজ্ঞেস করতে পারেনি। বোধ হয়, ওর নিজের মনেও একটা ভয় ছিল। যদি ওর সন্দেহের কথাটাই বিজিতের মুখ থেকে শুনতে হত? তারপরে তো আর কিছুই বলার বা জিজ্ঞাসার থাকত না।

‘আজ তা হলে কেউ আসেনি?’ বিজিত গেলাস তুলে চুমুক দিয়েছিল, অবিশ্যি এলে তো এতক্ষণে জানতেই পারতাম। বোস না, একটা কথা আছে।

কথা আছে! আভার চোখে শঙ্কিত জিজ্ঞাসা ফুটেছিল। ও পাশের সোফায় বসেছিল। বিজিত একটা সিগারেট ধরিয়ে বলেছিল, লাঞ্চ আওয়ারের পরেই অফিসে একটা টেলিফোন এসেছিল। গায়কের মতো বেশ ভরাট আর সুরেলা পুরুষের গলা। ইংরেজিতে বলল, বিজিত দত্তর সঙ্গে কথা বলতে চাই। বলল, বিজিত দত্ত বলছি। কে বলছেন? জবাব পেতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল, তারপরে বাংলায় বলল, আপনার সঙ্গে দু-একবার দেখা হয়েছিল, মনে আছে কি না জানি না। আমার নাম সুকুমার দাশ– আভার বন্ধু। আমার স্ত্রীর নাম মঞ্জু। বিজিত গেলাস তুলে চুমুক দিয়েছিল।

আভার আয়ত চোখ দুটো আরও বড় হয়ে উঠেছিল। সেই বড় চোখের দৃষ্টিতে সন্দিগ্ধ আতঙ্কের ছায়া। বুকে হাত চেপে ভয়-রুদ্ধশ্বাস স্বরে বলেছিল, কয়েলস করপোরেশনের সুকুমার। ওর গলা মোটা বেসুরো, ভরাট সুরেলা কেন হবে? কী বলেছে ও?

আমাকে তোর কথা জিজ্ঞেস করল। বিজিত বলল, আমার অবিশ্যি সুকুমারের গলা মোটেই মনে নেই। চেহারাটা মনে করতে পারছিলাম।

আভা বাধা দিয়ে বলে উঠেছিল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তা ও আমার কথা কী জিজ্ঞেস করছিল।‘

‘জানি না, ও যদি সেই সুকুমার দাশই হয়, আমাকে জিজ্ঞেস করল, আভার সঙ্গে একটু দরকার ছিল, মানে আভার দরকারেই দরকার। ওর মায়ের কাছে শুনলাম, উনি ঠিক জানেন না, আভা কোথায় আছে। তাই আপনার কাছে খোঁজ নিচ্ছিলাম, ও কি আপনার ওখানে আছে?’ বিজিত সিগারেটে টান দিয়েছিল।

আভার মুখটা যেন মুহূর্তেই শুকিয়ে সাদা হয়ে গিয়েছিল, বলে উঠেছিল সাংঘাতিক! তুই কী বললি?

আমি খুব অবাক হয়ে বললাম, আমার ওখানে? না তো! বিজিত হেসে গেলাস তুলে চুমুক দিয়েছিল, কলকাতায় আভার অনেক জায়গা আছে। ওর নিজের দাদা দিদিরা আছে এখানে ওখানে। এত জায়গা থাকতে আমার কাছে আসবে কেন? আর মামিমা জানেন না, এমন কোথায় ও যেতে পারে? আমার ওখানে এলে তো মামিমা জানতেই পারতেন। তা আমার কথা শুনে, নোকটা যদি সুকুমার দাশই হয়, বলল, সেটা ঠিক। তবে আভার মা বললেন কি না, উনি ঠিক জানেন না, আভা কোথায় গেছে বা আছে। আমি ওর দিদি শোভা, ওর বড়দা রণবীরের বাড়িতেও খোঁজ করেছিলাম। শুনলাম, সেখানেও যায়নি। রণবীরই আমাকে আপনার কথা বলল, হয়তো আভা আপনার ওখানে যেতে পারে।

মিথ্যে কথা।

আভা বাধা দিয়ে, ভয়-ত্ৰস্ত উত্তেজনায় বলে উঠেছিল, বড়দা কখনওই তোর নাম বলতে পারে না, তুইও ভালই জানিস। বড়দা সে রকম অ্যাসিউম করলেও আমি কোথায় থাকতে পারি, এ কথা কারোকে বলবে না। লোকটা কখনওই সুকুমার দাশ নয়। হলেও মিথ্যে বলেছে।

বিজিত গেলাসে চুমুক দিয়ে, আস্তে মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, তুই আমাকে সে কথা কী বলবি? আমি জানি না? আমি বরং উলটে বললাম, রসোদা আমার বাড়ির কথা বলেছেন? আশ্চর্য! আপনি বোধ হয় জানেন না, আভাদের বাড়ির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তেমন ভাল নয়। রণোদা তো আমাদের পছন্দই করেন না। বিজিত চোখের পাতা কুঁচকে হেসেছিল, আমি ইচ্ছে করেই ও রকম একটা গুল দিয়েছিলাম। তারপরে বললাম, রণোদা কেন আপনাকে আভার খোঁজের জন্য আমার বাড়ির কথা বলেছেন, বুঝতে পারছি না। আভা যে বাড়ি ছেড়ে কোথাও চলে গেছে, এ কথাও আপনার মুখেই প্রথম শুনছি। তখন লোকটা, মানে, যদি সে সুকুমার দাশই হয়, একটু যেন চিন্তিত হয়ে বলল, মে বি, রণবীর হয় তো একটা অনুমান করে বলেছিল। আপনি তো জানেনই, আভার জীবনে কী ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটে গেল, তাই নিয়েই ওর সঙ্গে আমার একটা জরুরি কথা ছিল। আমি অবাক হয়ে বললাম, সে তো যা ঘটবার ঘটে গেছে, কোর্ট তার জাজমেন্টও দিয়ে দিয়েছে। এখন আর তা নিয়ে কী জরুরি কথা থাকতে পারে, আমি অবিশ্যি জানি না।

বিজিতদা৷ আভা ভয়ে ও উত্তেজনায় অন্যমনস্ক চোখে ডেকে উঠেছিল, এ লোকটা কয়েলস করপোরেশনের সুকুমার দাশ নয়। আর যদি হয়, তা হলে ও নিশ্চয়ই ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, আমাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিন্তু কী বলব, মঞ্জু ওর বউ তো সত্যি আমার বন্ধু, সুকুমারও তাই। ওরা ভালই জানে, কোর্টে জাজমেন্টের পরে, আমি তা নিয়ে ফারদার মুভ করার কথা এক বারও ভাবিনি। আমার যা সর্বনাশ হবার, তা হয়ে গেছে, ওদের সঙ্গে লড়বার শক্তি আমার নেই। তবু কেন আবার ও সব নিয়ে জরুরি কথা বলতে চাইছে। নিশ্চয়ই এর মধ্যে গোলমাল আছে। সুকুমারকেও আমি আর বিশ্বাস করি না।

বিজিত মুখের কাছ থেকে গেলাস নামিয়ে বলেছিল, ফোনে যে-ই কথা বলে থাকুক, তাকে আমিও বিশ্বাস করিনি। কোর্টের ভার্ভিক্টের পর, সবই শেষ হয়ে গেছে। খবরের কাগজগুলো পর্যন্ত কোনও রকমে দায়সারা গোছের নিউজ করেছিল, অথচ প্রথম ঘটনাটা যখন ঘটেছিল, তখন খবরের। কাগজগুলো কী বিরাট হেডলাইন আর ফটো দিয়ে, সারা দেশে হইচই ফেলে দিয়েছিল। অবিশ্যি সাধারণ লোকের মুখ চাপা দেওয়া কঠিন। কোর্টের ভার্জিক্ট যাই হোক, তারা এখনও তোর কেসটা নিয়ে ভীষণ একসাইটেড। সবখানেই আলোচনা হয়। কোর্টের রায় শুনে সবাই অবাক হয়েছে, কেউ খুশি হয়নি। যাকগে ও সব কথা, যা চুকেবুকে গেছে, তা নিয়ে আমাদের আর ভাববার কিছু নেই। আসলে টেলিফোনের লোকটা, সে আসল আর ঝুটা-যে-সুকুমারই হোক, আমার কথা শুনে, শেষটায় কবুল করেই ফেলল, দেখুন আমি সেই কেসটা নিয়ে ফারদার মুভ করার কথা কিছু ভাবছি না, বা আভাকে সে অ্যাডভাইস দেবার জন্যেও ওকে খুঁজছি না। আমার বলার বিষয় হচ্ছে, আভা যদি ভেবে থাকে, কোর্টের রায়ের পরেই সব ব্যাপারটা মিটে গেছে, তা হলে ভুল হবে। আমি আর আমার স্ত্রী মঞ্জু এ নিয়ে অনেক আলোচনা করেছি, আফটার অল, আভা আমাদের বন্ধু, ওর স্বার্থ দেখাটাও আমাদের উচিত। আর তার জন্যেই ওর সঙ্গে কথা বলা দরকার। আমি বললাম, কিন্তু সুকুমারবাবু, আমি তো এ ব্যাপারে আপনাকে কোনও সাহায্যই করতে পারছি না। আভার খোঁজ-খবর আমি রাখি না, কিছু জানিও না। তখন লোকটা যেন একটু ভেবে বলল, হুম, আচ্ছা, সরি টু ডিসটার্ব ইউ মিঃ দত্ত। ইট ইজ মাই ব্যাড লাক। আভার ভালর জন্যেই ওকে খুঁজছিলাম, না পাওয়া গেলে আর কী করা যাবে। তারপর থ্যাংকু জানিয়ে লাইন কেটে দিল। আর আমি তারপরেই রণোদার অফিসে একটা টেলিফোন করলাম। বিজিত গেলাস তুলে চুমুক দিয়েছিল। ওর মুখটা শক্ত হয়ে উঠেছিল, হাতটাও যেন একটু কাঁপছিল।

‘পেয়েছিলি বড়দাকে?’ আভা ব্যগ্র মুখে ঝুঁকে পড়েছিল।

বিজিত গেলাস নামিয়ে বলেছিল, পেয়েছিলাম। একটা কথা তো সত্যিই, রণোদা বা শোভাদিরা আমাকে পছন্দ করে না। তুইও জানিস, তবু টেলিফোন না করে পারিনি। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, সুকুমার দাশ তার কাছে তোর খোঁজ করেছিল কি না। রোদা বলল, সুকুমার দাশ নামে এক জন টেলিফোন করেছিল। আমি জানতে চাইলাম, তুই আমার কাছে থাকতে পারিস, এমন কোনও কথা সুকুমারকে বলেছে কি না। রণোদা বেশ অবাক আর একটু কেঁজেই বলল, আমি কেন তোর কথা বলতে যাব। আভা কোথায় আছে, আমি কিছুই জানি না। বারো-তেরো দিন আগে, আমার ওখানে দিন দুয়েক ছিল, তারপরে তো একটা ঘটনা ঘটে যাবার পরে, আমার ওখান থেকেও চলে গেছে। তার কাছে আভা যেতে পারে, আমার মাথায় আসেনি, আমি কারোকে সে রকম কিছু বলিওনি। আমি রণোদাকে সুকুমারের টেলিফোনের কথা বললাম, তখন রণোদা একটু ঠাণ্ডা হল, বলল, ব্যাপারটা দেখছি সত্যি ঘোরালো হয়ে উঠেছে। আমি তোর কথা কারোকে বলিনি। আমিও তো জানতে চাই, আভা কোথায় আছে? সত্যি কি তোদের ওখানে নাকি?

‘কী বললি তুই?’ আভার বড় হয়ে ওঠা চোখের সঙ্গে, ঠোঁট জোড়া খুলে হা হয়ে গিয়েছিল।

বিজিত মাথা নেড়ে হেসেছিল, আমি বলেছি, না। হয়তো এ রকম মিথ্যে কথা বলতাম না। কিন্তু সত্যি কথা বললে, রণোদা আবার হয়তো আমার ওপর চটে যেত। রণোদা তারপরে খালি বলল, জানি না, আভার কপালে কী আছে। আমরা সবাই হেল্পলেস।

তা হলে–আভা ফ্যাকাশে মুখে অন্যমনস্ক চোখে যেন নিজের মনেই বলেছিল, লোকটা আসলে সুকুমার দাশ নয়। হলেও আশ্চর্যের কিছু না, হয়তো ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। আর তোকে মিথ্যে কথা বলেছে।

বিজিত ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলেছিল, সেটা তো প্রমাণই হয়ে গেল।

আভার চোখের গভীরে ভয়, কিন্তু ক্লান্ত হয়ে সোফার গায়ে এলিয়ে পড়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, আজ অফিসে যাবার সময় সেই লোকটাকে গলির মোড়ে দেখেছিলি নাকি?

না, অন্তত চোখে পড়েনি। বিজিত বলেছিল, অবিশ্যি যদি কোনও দোকানে টোকানে ঢুকে লক্ষ রেখে থাকে, তা হলে চোখে পড়বার কথা নয়।

আভা এ বাড়িতে আসার পরদিনই, বিজিত অফিসে যাবার সময় একটি লোককে দেখেছিল। ঠিক গলির মোড়ে না। ট্রাম রাস্তা থেকে, একটু ভিতরে ঢুকে, লোকটা বিজিতদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছিল। গলিটা খুব সরু বা ঘিঞ্জি না। দুটো গাড়ি কোনও রকমে পাশাপাশি যেতে পারে। খুব একটা ভিড়ের রাস্তাও না। তবু কলকাতার মতো জায়গায়, একটা লোক রাস্তায় দাঁড়িয়ে, কোনও বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখবে, সেটা আশ্চর্যের বিষয় কিছু না। কিন্তু ঘটনাটি সন্দেহজনক হয়ে ওঠে লোকটির আচরণ, লক্ষ করে দেখার বিশেষ ভঙ্গি দেখে। বিজিত দেখেছিল, লম্বা রোগা একটি লোক, যার বয়স তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে হতে পারে। বয়সের তুলনায় লোকটির চোখের পাশে, কপাল এবং গালে যেন রেখা ও ভাঁজ বেশি। মাথার পাতলা চুল ঘাড় অবধি নেমে এসেছে। ভুরুতে চুল প্রায় নেই, ছোট চোখ দুটো শিকারি পাখির মতো তীক্ষ্ণ। রীতিমতো সুটেড বুটেড। নীল রঙের টেরিউলের স্যুট পরেছিল সে। বিজিত সিঁড়ির নীচে থেকে স্কুটার বের করে, ছোট চত্বরে নামিয়ে, গেটের বাইরে নিয়ে গিয়েছিল। স্টার্ট করবার আগেই, লোকটির ওপর ওর চোখ পড়েছিল। না পড়ে উপায় ছিল না। লোকটি তখন, পিছন দিকে মাথা হেলিয়ে, ঘাড় ফিরিয়ে বিজিতদের বাড়ির ওপর দিকে তাকিয়ে ছিল। দক্ষিণের ছাদ ঢাকা থামওয়ালা ব্যালকনি রাস্তার ওপরেই। থামের দু পাশে জানালা দুটো বন্ধ ছিল। অন্যান্য দিন খোলাই থাকে। আভা আগের দিন আসার জন্যই, রাস্তার ধারের ব্যালকনির জানালা বন্ধ করা ছিল। বিজিত গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে যখন স্কুটার স্টার্ট করে, আইভি তখন জানালায় দাঁড়িয়ে ওকে টা টা করে। সেদিন তা করার উপায় ছিল না। আভার নিরাপত্তার কথা ভেবেই, জানালা বন্ধ রাখা হয়েছিল।

বিজিত প্রথমে ভেবেছিল, অচেনা লোকটি বোধ হয় হাবিবের মোটর গ্যারেজ খুঁজছে। কিন্তু লোকটির দৃষ্টি যে ওদের দোতলার ব্যালকনির দিকে, বিজিত তা মুহূর্তেই বুঝতে পেরেছিল। তা ছাড়া আভার মুখে আগেই শুনেছিল ও যেখানেই যায়, কেউ না কেউ ওকে সবসময় অনুসরণ করে। যেখানেই থাকে, সেখানেই সবসময় লক্ষ রাখা হয়। অবিশ্যি তার চেয়েও গুরুতর ঘটনা আগেই ঘটে গিয়েছিল, যে কারণে আভা ববকে নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বিজিতের মাথায় সে-চিন্তাটাও ছিল। তবুও হয়তো বিজিত সন্দেহ করত না। লোকটি ওর সন্দেহ বদ্ধমূল করেছিল। সে বিজিতকে তার দিকে অনুসন্ধিৎসু চোখে তাকাতে দেখেই, ঝটিতি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। এবং এমন একটা ভাব করেছিল, যেন সে ভুল করে কোনও রাস্তায় ঢুকে পড়েছে। কিন্তু তাড়াহুড়ো না করে, ধীরে সুস্থে হেঁটে ট্রাম রাস্তার দিকে চলে গিয়েছিল। লোকটি চোখের আড়ালে চলে যাবার পরে, বিজিত স্কুটারটা স্ট্যান্ডের ওপর দাঁড় করিয়ে রেখে, ছুটে বাড়ির ভিতর গিয়ে দোতলায় উঠেছিল। কলিং বেল বাজিয়েছিল। আলি দরজা খুলে দিয়েছিল। বিজিত আভাকে লোকটির কথা বলেছিল। আইভি সামনে দাঁড়িয়েছিল। বিজিতের কাছ থেকে লোকটির বর্ণনা শুনতে শুনতে, আভার মুখ রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছিল। চোখের তারা দুটো আতঙ্কে বড় হয়ে উঠেছিল। প্রায় ফিসফিস করে বলেছিল, এ তো সেই লোকটাই। নির্ঘাত সেই লোকটা, রোগা লম্বা, মুখে হিজিবিজি দাগ। এ লোকটাই আমাদের বাড়িতে ঢোকবার মুখে, সন্ধের আবছা অন্ধকারে, রিকশা থেকে নামবার সময়, আমার কোল থেকে ববকে ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করেছিল। হা ভগবান। কী হবে এখন বিজিতদা?

বিজিতের কথার মাঝখানেই ওর মা এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বিজিত, তোর ফিরে বাড়িতে আসাটা ঠিক হয়নি। লোকটা যদি সেই লোকটাই হয়, তা হলে তোর বাড়ি ফেরা লক্ষ করে, ওর মনে সন্দেহ বাড়বে। তুই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যা। দিনের বেলা তেমন ভয়ের কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। আর যদি তেমন কিছু ঘটে, আমি আছি। আভা আর ববকে আমি ঠিক পাচার করে দেব।

আভা তখন ভয়ে রুদ্ধশ্বাস, শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পিসিমা ওকে হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়েছিলেন। বিজিত আর এক মুহূর্ত দেরি না করে, নীচে নেমে গিয়েছিল। স্কুটার স্টার্ট করে, গলির মোড়ে এসে ওকে থামতে হয়েছিল। একটা ট্রাম তখন এসপ্ল্যানেডের দিকে যাচ্ছিল। ওকে মোড় নিতে হবে ডান দিকে। ট্রামটা চলে যাবার পরেই, ওর চোখে পড়েছিল, বিপরীত দিকের ময়লা ছড়ানো পেভমেন্টের ওপরে সেই লোকটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। লোকটির সঙ্গে ওর চোখাচোখি হয়েছিল। হলেও, লোকটি এমন কোনও ভাব দেখায়নি সে ঠিক বিজিতকেই দেখছে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সে মুখ না ঘুরিয়ে, দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে নিয়েছিল। বিজিতও আদৌ কোনও কৌতূহল না দেখিয়ে, স্বাভাবিক ভাবে মুখ ফিরিয়ে, ডান দিকে স্কুটার ঘুরিয়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু একটা অস্বস্তি আর উদ্বেগ চেপে বসেছিল ওর মনে। অফিসের কাজে মনোযোগ দিতে পারেনি। বাড়িতে টেলিফোন ছিল না। কোনও খবরও নিতে পারেনি। ওকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল, আইভির অফিস থেকে ফেরার পথ চেয়ে। আইভি সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ওর অফিসে এসেছিল, এবং জানতে পেরেছিল, আইভি বাড়ি থেকে বেরোবার আগে পর্যন্ত কেউ বাড়িতে আসেনি। তবু অস্বস্তি আর উদ্বেগ কমেনি। ও ম্যানেজারকে বলে, আইভিকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছিল। দরজা খুলে দিয়েছিলেন মা। বিজিত কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই, ওর উৎকণ্ঠিত জিজ্ঞাসু মুখের দিকে তাকিয়ে লাবণ্য বলেছিলেন, কেউ আসেনি।

বিজিত কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়েছিল। আইভি একটা দমকা নিশ্বাস ফেলে বলেছিল, বাঁচা গেল।

 কিন্তু আভা জানত, ওটা বাঁচা না। ওর কোনও সান্ত্বনাই ছিল না। ও নিশ্চিত বুঝেছিল, যারা ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, তারা জেনে হোক বা না জেনে থোক, এ বাড়িতে অব্যর্থ সন্ধানেই এসেছিল। বিজিত পরের দিনও অফিসে যাবার সময় লোকটিকে দেখেছিল। কিন্তু গলির মোড়ে না। একটু দূরে, সে একটা ট্রাম স্টপেজের কাছে, কয়েকজনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল। বিজিত আগেই দেখেছিল। লোকটিও নিশ্চয় ওকে দেখেছিল। বিজিত না দেখতে পাওয়ার ভান করে, জোরে স্কুটার চালিয়ে চলে গিয়েছিল। এ সংবাদ পাবার পরে, আভার আর কোনও সন্দেহ ছিল না, যে কোনও মুহূর্তেই লোকটা বাঘের মতো এসে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। ওর একমাত্র ভরসা ছিলেন পিসিমা। তিনি বলে রেখেছিলেন, তুই কিছু ভাবিস না। আমি একটা প্ল্যান ঠিক করে রেখেছি। তা ছাড়া, আলি যথেষ্ট বিশ্বস্ত, তাগড়া জোয়ান। ওকে আমি বিশেষ ভাবে লক্ষ রাখতে বলেছি। তবে কথা হচ্ছে একটাই। এ ভাবে কত দিন চলবে। পরশুর আগের দিন রাত্রে, বিজিতের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, প্রতি মুহূর্তে আতঙ্ক উত্তেজনায় ক্লান্ত হয়ে, আভা সে সব কথাই ভাবছিল। সুকুমার দাশ বা যেই হোক, টেলিফোনের বিষয়টি গুরুতর। সন্ধানীরা এক রকম নিশ্চিত হয়েই ও রকম টেলিফোন করেছিল। পিসিমার রক্ষা কবচটি কী, তা ও জানত না। কিন্তু তাঁর সেই কথাগুলো ভোলবার না। এভাবে কত দিন চলবে।’…খুবই যুক্তিসঙ্গত কথা। যে বাড়ির সঙ্গে বেশ কিছুকাল কোনও সম্পর্কই ছিল না, তারা কেনই বা এ রকম একটা আচমকা উৎকণ্ঠাজনক ঝামেলা বহন করবে। যাকে বলে, উটকো ঝামেলা। সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়, ব্যাপারটা তো এই রকমই। এমনকী নিয়মিত সম্পর্ক থাকলেও, কোনও পরিবারই এ রকম একটা ব্যাপারকে মেনে নিতে পারে না। তা ছাড়া, আলি যথেষ্ট বিশ্বস্ত তাগড়া জোয়ান। আভার কাছে এটা কোনও সান্ত্বনাই না। টাকা এমন ভয়াবহ বস্তু, সমস্ত বিশ্বাসকে তা কিনে নিতে পারে। সমস্ত শক্তিকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে। মাত্র কয়েক মাসের অভিজ্ঞতায়, আভা অত্যন্ত ভয়ংকর ভাবে তা বুঝতে পেরেছে। আইন, শাসন, ইত্যাদি সমস্ত ব্যাপারগুলোই বা কী চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ভাবতে গেলে ওর গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। এবং তারপরে আইভি। বিজিতের কথা থেকে, ওদের ঝগড়ার কারণ কিছুই বোঝাই যায়নি। সকালে বা অফিস থেকে ফেরার পরে, আইভির সঙ্গে ওর কথা হয় সামান্য। ওর চোখে মুখে কোনও উদ্বেগের ছায়া নেই। সমবেদনা হয়তো কিছুটা আছে। দু-একটা কথাবার্তা শুনলে সে রকম মনে হয়। কিন্তু আভাকে নিয়ে ওর কৌতূহলের ব্যাপারটা অন্য দিকে। ও আভার গায়ে বিশ্রী ভাবে হাত দেয়। গাল টিপে, বুকে হাত দিয়ে, হেসে ঠাট্টা করে বলে, এত রূপ যৌবন নিয়ে, দিন কাটাও কেমন করে? ইচ্ছে করে না? জলির সঙ্গে শোয়াও অনেক দিনই বন্ধ। নিশ্চয়ই এত দিন শরীরটাকে একেবারে উপোস দিয়ে রাখোনি। অবিশ্যি এখনকার অবস্থার কথা আলাদা। তবু, এটা ছাড়াই বা চলে কী করে? কারোকে যে জুটিয়ে দেব, তারও উপায় দেখি না। জানি, তোমারও অনেক পাটি আছে, তাদের সঙ্গেও দেখা করার উপায় নেই। তোমার কোনও কোনও বন্ধু আমাকে তোমার কথা বলে। বেচারিরা তোমাকে পাচ্ছে না, আমিও বলতে পারি না। আইভি এ রকম কথা বলে। ও বাংলা ভালই বলতে পারে। ইংরেজি আর হিন্দি তো পারেই। ওর এই সব কথার জবাবে, আভা ম্লান মুখে হাসে। ভিতরটা যন্ত্রণায় জ্বলতে থাকে। জলি ওর স্বামীর ডাক নাম। অনেক দিন কেন, গত এক বছরের মধ্যে, জলির সঙ্গে ওর বিছানায় সাক্ষাৎ ঘটেছে ক্কচিৎ। তাও, জলির নিতান্ত অনিচ্ছায়, বা অত্যন্ত মদের ঘোরে, মিলনের বিফল প্রচেষ্টা। শরীরের একটা ক্ষণিকের চাহিদা মেটানোর জন্য, দুর্বল আর অশক্ত ইচ্ছাপূরণ। সুখের থেকেও তা বঞ্চনার অধিক। কিন্তু আইভির মুখ থেকে ও সব কথা শোনবার পরে, একটা শঙ্কিত সংশয়ে ওর মন দুলতে থাকে। বিজিত বা পিসিমার বিশ্বস্ততায় কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু আইভি? বিজিত তো কিছুতেই বলতে পারেনি, কেন আইভির সঙ্গে ওর ঝগড়া হয়েছিল? পরশুর আগের দিন রাত্রে, সোফায় এলিয়ে পড়ে আভা এ সব কথা ভাবছিল, আর ওর। ভিতরটা ভয়ে সংশয়ে শুকিয়ে উঠছিল। অবিশ্যি, তার পরদিনই, বিজিতের সঙ্গে আইভি হাসতে হাসতে ফিরে এসেছিল। ওদের ঝগড়া মিটে গিয়েছিল। আভা ছিল, যে তিমিরে, সেই তিমিরেই।