৩. কত রাত ঠাহর পাওয়া যায় না

অনেক রাত। কত রাত ঠাহর পাওয়া যায় না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল সুরজ-এর। প্রথমে মনে হল ইঁদুর আর ছুঁচো ঘুরে বেড়াচ্ছে বেঞ্চির তলায়, তারই ঘট ঘট শব্দ হচ্ছে। মিশমিশে অন্ধকার, কিছুই দেখা যায় না। ঘট ঘট শব্দটা ভারী পায়ের শব্দ মনে হচ্ছে। দুপ দাপ আর খসখস শব্দ।

হয় তো একাধিক লোক এসেছে। ” মনে হতেই সুরজের পলাতক বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠল। চকিতে কোমরের থেকে রিভলবার বার করে সে এক মুহূর্ত প্রতীক্ষা করল। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিটে বেড়ার ঘরে পড়তেই মনে হল, পেছনের ঝাঁপটা আধ খোলা, কাছেই একটা মানুষের মূর্তি। সর্বনাশ! পথরোধ করেছে সুরজের। সামনের দরজায় তালা বন্ধ। ধরা পড়তে হবে।

মরিয়া হয়ে সুরজ উঠে বসল। হয় তো একটা কিছু ঘটে যাবে এখুনি, কিন্তু চেষ্টা করতে হবে। ঝাঁপের দিকে রিভলবার তাগ করে সুইচটা টিপে দিতেই, মনে হল তার চোখের সামনেই ভেসে উঠল একটা ভীষণ দর্শন জানোয়ার। গোলাকার ভীত দুটো ছোট ছোট চোখ, আর হাঁ করা মুখের মধ্যে একরাশ কী সব খাবার।

পরমুহূর্তেই সুরজ দেখল; জানোয়ার নয় বিশে। খেতে খেতে মাথা দুলাচ্ছিল। বাতি জ্বলতে দেখেই থেমে গিয়েছে, আর একটা ভীত চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে তার মুখ দিয়ে।

কথা বেরুল না সুরজের মুখ দিয়ে। ভয়-মুক্ত হয়েছে তার মনটা, কিন্তু মানুষের এমন খাবার দৃশ্য জীবনে সে আর কোনওদিন দেখেনি। তাড়াতাড়ি সে রিভলবারটা লুকিয়ে ফেলল। বলল, বিশ্বনাথ।

বিশে অভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি আড়ষ্ট মুখটা নেড়ে খাবারগুলো গিলতে লাগল। সন্ধ্যাবেলা লুকিয়ে রাখা কয়েকটা চপ আর কয়েক টুকরো মাংস। খেতে খেতেই বলল, শুয়ে পড়ো খোকাবাবু। তোমার বাবা এলে আমি বলব, মাইরি বলব।

তারপর খাওয়াটা শেষ হতেই সে হঠাৎ প্রায় কেঁদে উঠে সরু গলায় ড়ুকরে উঠল, মাইরি খোকাবাবু, ঠাকুরকে বলো না যেন, মাইরি ঠেঙিয়ে আমার আঁটা ওড়াবে। কী করব, শালা নোলা আমার মানে না।

সুরজের মনটা ভীষণ দমে গিয়েছে। একবার খালি মনে হল, যদি সে গুলি করত। লোকটা খেতে খেতেই শেষ হত। বলল, শুয়ে পড়। বলব না।

বিশে ঢক ঢক করে সের খানেক জল খেয়ে নিঃশব্দে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ল তার মাদুরে। বারকয়েক চোরা চোখে তাকিয়ে দেখল সুরজকে।

সুরজ আলোটা নিভিয়ে দিল। আজ রাত্রেই সে পালাবার কথা ভাবছে। এরকম একটা জায়গাতে আত্মগোপন করে থাকাটা তার কাছে আর সুবিধে বলে মনে হচ্ছে না। একে রেস্টুরেন্ট, তায় স্টেশনের ধারে। যে কোনও মুহূর্তে বিপদ ঘটতে পারে। তা ছাড়া, তার কাজও শেষ হয়েছে। এবার শুধু নিরাপদে পৌঁছুনো।

.

ভোর রাত্রে পুলিশের ডাকাডাকিতে বিশের ঘুম ভাঙল। চোখ ঘষে পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখল পো সেপাই তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে। প্রথমেই তার মনে হল কালকের খাওয়ার ব্যাপারে ভজনঠাকুর তাকে ধরিয়ে দেবার জন্য পুলিশ ডেকেছে। দেখল, সেই খোকাবাবুও নেই।

তার মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরুল না। প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখে ভীত হতভম্ব চোখে সে তাকিয়ে রইল। একটু পরেই একজন যুবক পুলিশ অফিসার বিশেকে ডাকল। বিশে দেখল পালাবার কোনও উপায়ই নেই। সে হাত জোড় করে সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

যুবক পুলিশ অফিসারের বোধ করি হাসি পেল বিশেষে দেখে। বলল, তোমার মনিব কোথায়?

এঁজ্ঞে বাড়িতে।

তাকে নিয়ে এসো।

বিশে ছুটল ভজনকে ডাকতে।

ভজন যখন এল, তখন স্টেশন এলাকাটা পুলিশের ভিড়ে থমথম করছে। ভজনের রাত্রের মত কেটেছে ঝিমুনিটা কাটেনি। বিশের কাছে শুনে নিয়েছে সে, সুজ ঘরে নেই। মনে মনে ভাবছে, পাঁচ পয়সা বরাত করলাম মা কালী, ছোঁড়াদকে পার করে দিস।

তাকে দেখে পুলিশ অফিসারটি বলল, একটা সার্চ ওয়ারেন্ট আছে।

ভঞ্জন ফল, কার? আমার না শ্রীমতী কাফের?

অফিসারটি হাসল। বলল, উভয়েরই। আপনার এখানে ইউ পির কোনও লোক সেলটার দিয়েছিল?

ভজন অফিসারটির মুখের দিকে অকিয়ে ফল, মশাইয়ের কি ঠাট্টা করা হচ্ছে আমার সঙ্গে? নাকি নেশটা আমি একলাই করেছি?

অফিসারটি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। একজন এস, আই-কে তল্লাসির নির্দেশ দিয়ে সে ভজনের চেয়ারে বসতে যাচ্ছিল। ভজন তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বলল, উ ই, ওটি করবেন না। ওটা প্রোপ্রাইটারের চেয়ার। বিশে, বাবুকে চেয়ার এগিয়ে দে।

ছোকরা অফিসারের মুখ চোখ লাল হয়ে উঠল। চেয়ারে না বলে সে নিজেও তল্লাসিতে লাগল।

ভজন আবার বলল, কাপ ডিলগুলো ভাঙবেন না।

অফিসারটির মুখ দিয়ে প্রায় হুকুমের সুরে বেরিয়ে এল, আপনাকে সেকথা না বললেও চলবে।

ভজন বলল, ভগবান জানে …।

রাস্তায় ভিড় হয়েছে। দেখছে সবাই শ্রীমতী কাফের তল্লাসি। নানান জনে বলাবলি করছে নানান কথা। ভিড় করেছে গাড়োয়ান, রাস্তার কাজে ঝাড়ার মেথর, স্টেশনের রেলওয়ে স্টাফ আর কুলি, আশেপাশের দোকানদার আর পথচারীরা। বলাবলি করছে নিজেদের মধ্যে, বোমা নাকি পাওয়া গিয়েছে দুটো। কেউ বলছে, ভজুলাটের দাদা জেল ভেঙে পালিয়ে এসেছেন। কেউ বা ঘোষণা করছে, ভজুলাট নিজেও একজন! হুঁ হুঁ বাবা ওসব রক্তবীজের ঝাড়। মাতাল হয়ে পড়ে থাকলে কী হবে।

পুলিশ ভিড় হটিয়ে দিচ্ছে, সরিয়ে দিচ্ছে লোকজনকে। একটা ডালপুরীওয়ালা বেচবার ছল করে চেঁচাচ্ছে, ডালপুরী চাই, ডালপুরী তরকারি। কাফের ভিতরে বিশে কালকে ভজনের দেওয়া আনিটা হাতে নিয়ে ঘষছে, আর ডালপুরীর হাঁকটা তার মর্মে গিয়ে একেবারে জিভের ডগায় ফোঁটা ফোঁটা জল জমে উঠছে।

স্টেশনের সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে হীরেন। সে রোজকার মতো আজও আসছিল শ্রীমতী কাফেতে। পুলিশ দেখে, সরে গিয়ে সিঁড়িতে উঠেছে। কাছে পড়ে গেলে বলা তো যায় না। উদোর বোঝা বুদোর ঘাড়ে পড়তে কতক্ষণ। কিন্তু সে বিরক্ত হয়েছে ভজনের উপর। কেন সে এসব ঝামেলা পোয়াতে যায়। তা ছাড়া হীরেনের মনটার মধ্যে ছটফট করছে। উৎসুক চোখে সে দেখছে রাস্তার দিকে। তার আবিষ্কৃত ভারতের আত্মা এই সময়ে রোজ আসে। সেই পবিত্র অথচ কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অস্পৃশ্য অথচ অকলঙ্ক হৃদয়। অশিক্ষিত তবু বুদ্ধিদীপ্ত ললাট তার। প্রভাতী সূর্যের মতো তার হাসি। কৃতজ্ঞতা তার দুই চোখে। কণ্ঠে তার নমস্তে বাবুজি ধ্বনি যেন মন্দিরের পবিত্রতা বয়ে নিয়ে আসে। সে কোথায়?

রথীন আর সুনির্মল মিশে আছে ভিড়ের মধ্যে। তাদের চোখে মুখে উৎকণ্ঠা। সুরজের কাছে শুধু রিভলবার নয়, কয়েকটা কাগজপত্রও রয়েছে। সেসব পেলে, নবীন গাঙ্গুলীর অস্ত্রাগারসুদ্ধ ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।

খানিকটা দক্ষিণে ভিড় করেছে নাড়পুরোতের গলির মেয়েরা। নাড়পুরোতের গলি মানে বেশ্যাপল্লী। অকাল-নিদ্রা ভঙ্গে তাদের কোটরাগত চোখ লাল। তারা আভাসে জেনেছে, ভিড় দেখে ভিড় করেছে। মজা দেখার জন্য নয়। লাটবামুনকে তারা মহামানব বলে জানে। দেহজীবিনীর পুলিশের ভয় নয়, প্রতিবেশিনীর উৎকণ্ঠা তাদের মনে।

ভজন ভাবছে সুরজের কথা। ছোকরা যদি গঙ্গা পেরিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে এ-যাত্রা বেঁচে যাবে। যেতে পেরেছে, নাকি কাছাকাছি কোথাও আটকে পড়ে আছে।

তল্লাসি শেষ হল। ওলটপালট করে দিয়েছে শ্রীমতী কাফের সর্বাঙ্গ। অগোছাল এলোমেলো করে ছড়িয়ে দিয়েছে সমস্ত জিনিসপত্র। কিন্তু একটা কাগজও পুলিশ হস্তগত করতে পারল না।

ছোকরা অফিসারটি বলল অমায়িকভাবে, অনেক সময় wrong report-এ আমাদের এসব করতে হয়। উভয়পক্ষেরই হয়রানি, কিছু মনে করবেন না।

ভজন জবাব দিল, মনে কিছু না করা খুব শক্ত। ভাবছি শ্রীমতী কাফের কপালটার কথা।

সার্চ ওয়ারেন্টে ভজনের একটা সই করিয়ে পুলিশদল বেরিয়ে গেল। সারিবদ্ধভাবে মার্চ করে তারা এগিয়ে গেল উত্তর দিকে। লেফট—রাইট–লেফট!…

ভজন বলল, বিশে, উনানে আগুন দিয়ে ঘর সাফ কর।

কিন্তু বিশে ততক্ষণে ডালপুরীওয়ালার কাছ থেকে আর একটু তরকারি বাগাবার জন্য সব উদ্ভট গল্প শোনাতে আরম্ভ করেছে তাকে। সেই উদ্ভট গল্প শোনবার জন্য আবার তার কাছে ভিড় করেছে একদল লোক।

ভিড়টা তখনও থমকে আছে। সকালবেলার খদ্দেররা কেউ দোকানে ঢুকছে না। দাঁড়িয়ে আছে, ভয়ে ও সংশয়ে। স্টেশনের টিকেট কালেক্টার আর গুডস-ক্লার্ক। তাদের মাসকাবারি বন্দোবস্ত শ্রীমতী কাফের সঙ্গে। পকেট ফাঁকা, প্রাণ চা চা করছে। কিন্তু পুলিশ-ভীতি কাবু করে দিচ্ছে।

প্ল্যাটফর্মের মাথার কালো শেডের আড়াল থেকে সূর্য উঠছে। রক্তবর্ণ সূর্য, স্পষ্ট মনে হচ্ছে সেটা ঘুরতে ঘুরতে উপরে উঠছে। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে তার আলো। ছড়িয়ে পড়েছে শ্রীমতী কাফের দরজায় দেওয়ালের পাথরে।

সেইদিকে তাকিয়ে ভজন আপন মনে বিড়বিড় করে বলে উঠল,

কিরীটিনং গদিনং চক্রিঞ্চ
তেজোরাশিং সর্বতো দীপ্তিমন্তম্।

বাইরে এসে চেঁচিয়ে বলল, বোমা নয়, পিস্তলও নয়, সূর্য ধরতে এসেছিল। সে তো আকাশে, ওই যে। বলে, আকাশের দিকে আঙুল দেখিয়ে দিল।

ভিড়ের জনতা ফিরে তাকাল পুর্বদিকে। অবাক হয়ে মুখ চাওয়াচায়ি করতে লাগল পরম্পরে।

সুনির্মল গা টিপল রথীনের। অর্থাৎ সুরজ পালিয়েছে। বুঝল সে কথা হীরেনও। সে এসে বসল তার রোজকার জায়গাটিতে। কিন্তু থলে থেকে বার করতে ভুলে গেল তকলি আর তুলল। মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সে আসেনি, হয় তো আসবে না এই পুলিশের হাঙ্গামায়।

কিন্তু ভজনের মুখে চিন্তার ছায়া ঘনিয়ে এসেছে। সে বুঝেছে, শ্রীমতী কাফেতে কদিনের জন্য খন্দরের আনাগোনায় ভাঁটা পড়বে। নিজের উপরে বিরক্তি এল তার। দোকানটা হয় তো উঠিয়ে দিতে হবে। কিন্তু খদ্দের নিয়ে তো জীবনধারণ সম্ভব নয়। আর যারা তার জীবনে রয়েছে, তারা না ছাড়লে সে কী করে ছাড়বে তাদের। এ-সবে তার বিশ্বাস নেই সত্য, কিন্তু এরা ছাড়া এ দেশে আর আছে কারা? তার প্রাণের চেয়ে প্রিয় শ্রীমতী কাফেতে সে টাঙিয়েছে তার দাদার দেবতা চক্রধারী নরনারায়ণের ছবি। সেই নারায়ণের শিষ্যদের সে কোথায় যেতে বলবে।

বিশে উনুনে আগুন দিয়েছে। ভজন বেরিয়ে গেল! বকুলমা সব জানবার জন্য অপেক্ষা করছেন। বাড়ি থেকে সে বাজারে যাবে।

রাস্তায় ভিড় কেটে গিয়েছে। চলে গিয়েছে যে যার কাজে। শুধু ট্রেনের যাত্রীর আনাগোনা আর গাড়ির গাড়োয়ানের চিৎকার।

এমন সময় এল হীরেনের সেই ভারতের আত্মা। বছর বিশ বাইশ বয়সের এক পশ্চিমা মেয়ে, পশ্চিমা ধরনের কুঁচি দিয়ে উলটো দিকে ফরসা শাড়ি পরেছে সে। মাজা মাজা রং, রুক্ষ চুল মাঝারিগড়ন। মুখে তার শঙ্কা, তবু হাসছে কালো সরল চোখে তার ভয়, জিজ্ঞাসা ও ক্ষমা প্রার্থনা। গলায় মাদুলি, সে মিউনিসিপালের ঝাড়দারনী, নাম রামা।

হীরেনের মনে পড়ে একবছর আগে সদ্য জেল প্রত্যাগত সে এমনি বসেছিল, এইখানটিতে এই সময়ে। এই মেয়েটি এসে ভিক্ষা চাইল। হীরেন চোখ তুলে দেখল। ময়লা পোশাক পরা একটি মেয়ে। এমনি তার জীর্ণ দশা যে, তার পক্ষে লজ্জা নিবারণ করাও সম্পূর্ণ হয়ে ওঠেনি। তার পিচুটি ভরা চোখে শিশুর সারল্য। ময়লা দাঁতের মাড়ি বেরিয়ে পড়েছে তার বাঁকা কুঞ্চিত ঠোঁটের ফাঁকে। সে ঠোঁটে ক্ষুধার কান্না। সারা গায়ে খড়ি উঠেছে চুলকে চুলকে। জট পাকিয়ে গিয়েছে মাথার চুল। হীরেনের আজন্ম সংস্কারাচ্ছন্ন চোখ নত হয়ে এসেছিল তার ভোলা বুকের সারল্য দেখে। জেল থেকে ফিরে মনটা তার ভার হয়েছিল। সেদিন আচমকা বেদনায় ভরে উঠেছিল তার বুকটা। মনে হয়েছিল গান্ধীজির সেই নিরন্ন, অশিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতবাসী এসে আজ দাঁড়িয়েছে তার সামনে। জিজ্ঞেস করে সে জেনেছিল মেয়েটি বিহারের নট জাতীয়া। এখানে একটা ইটখোলায় কাজ করতে এসেছিল স্বামীর সঙ্গে। স্বামী মারা গিয়েছে, সে বেকার, ভিক্ষাবৃত্তি ধরেছে।

হীরেন তার জন্য কাজ জোগাড় করে দিয়েছে মিউনিসিপালিটিতে। তাকে শুনিয়েছে গান্ধীজির বাণী, শিখিয়েছে পরিচ্ছন্নতা, বুঝিয়েছে অস্পৃশ্যতার অভিশাপ, নির্দেশ দিয়েছে তকলিতে সুতো কাটার।

সেদিনের সেই রামার কিছু পরিবর্তন হয়েছে বই কী। সে ফিটফাট হতে শিখেছে, প্রত্যহ সুলতা কেটে দিয়ে যায় এই সময়ে শ্রীমতী কাফেতে, হীরেনের হাতে। হীরেন তাকে শোনায়, এই ভারতবাসীর কী হবে, কী তার ভবিষ্যৎ।

হীরেনের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে প্রত্যহ এখানে এসে রামার সঙ্গে দেখা করা। রামা না এলে উৎকণ্ঠা বোধ করে সে। দুশ্চিন্তা হয় মনে।

সত্যি, অনেক পরিবর্তন হয়েছে রামার, কিন্তু তাকে থাকতে হয় ঝাড়দার বস্তিতে। ইতিমধ্যে বস্তির অনেকেই তাকে বিয়ে করতে চেয়েছে। অনাচার মনে করেছে অনেকে তার এ পুরুষহীন একলা জীবনকে। এমন কী পঞ্চায়েতে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে, একথাও বলেছে।

কিন্তু রামার মনে থেকে থেকে কেবলি মনে হয়, এই কি তার জীবন! তাই যদি, তবে কোন্ সে বস্তু যে তার হৃদয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বিচিত্র বন্ধনের সৃষ্টি করেছে। তার মনে, চলায়, কথায়, ব্যবহারে, তার সবখানি জুড়ে ঘিরে রয়েছে পদে পদে আড়ষ্টতা। এক এক সময় এ যেন তার কাছে অভিনয়ের মতো ঠেকে। খানিকটা বা উপকারী হীরেনের মর্যাদার জন্যই। তবু হঠাৎ সে কোনও কোনও দিন বেধড়ক তাড়ি পান করে ফেলে, ঝাড়দার বস্তির হট্টগোলে মেতে যায়, হাসি গানে রঙ্গ করে যুবকদের সঙ্গিনী হয়ে ওঠে। পড়ে থাকে তার তুলো তকলি ও অবসর সময়ে সুতো কাটা, উলটে পালটে পড়ে থাকে হীরেনের দেওয়া বর্ণপরিচয়। এসবের পর দু একদিন তার শ্রীমতী কাফেতে আসা হয় না।

তখন হীরেন যায় ঝাড়দার বস্তিতে। বুঝতে পারে সমস্ত ব্যাপারটা। তার রাগ হয় না, বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠে। বেদনা অনুভব করে। ভয় হয়, যেন তার হাতে গড়া প্রাসাদটা ভূমিকম্পে টলমল করছে চোখের সামনে। আমাকে কেন্দ্র করেই এই ঝাড়দার বস্তিতে সে পরিচিত হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে সে ঝাড়দার বুস্তিতেও সবাইকে নিয়ে সভা করে, তাদের বোঝয়। সে যখন আসে, তখন সবাই ঘিরে ধরে। বোঝা যায়, সবাই তাকে মান্য করে, গান্ধীজির চেলা বলে।

রামার মধ্যে সম্প্রতি নতুন চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। এ বিশ্বের বাইকে ফাঁকি দেওয়া যায়, হীরেনের চোখকে তো ফাঁকি দেওয়া যাবে না। রামার চোখে মুখে আজ বিচিত্র ভাব ও হাসি। সে ভাব ও হাসির নাম জানে না হীরেন। তবু বোঝে, রামার, অজান্তেই শিশুর দেয়ালার মতো তার চোখে মুখে হৃদয়ের নতুন ভাব ছড়িয়ে পড়েছে। হীরেনের জীবন-দর্শন ছাড়া আরও কিছু পেয়েছে সে। সে পাওয়া যেন এক মহা সর্বনাশের মতো ভয় ধরিয়ে দিয়েছে হীরেনের বুকের মধ্যে। তার এত ভাব ও ব্যাকুলতা এই জন্যই। দুর্বল মুহূর্তে হীরেন বারবার আবৃত্তি করেছে,

ইন্দ্রিয়ানাং হি চরতাং সম্মোনহনু বিধীয়তে,
তদস্য হরতি প্রজ্ঞাং বায়ুনাবমিবাসি।

কিন্তু পরমুহূর্তেই সে মনে মনে চিৎকার করে উঠেছে, না না কোনও ইন্দ্রিয় আসক্তি আমার হৃদয়কে বাতাসের নৌকার মতো উন্মার্গগামী করেনি। এ যে আমার আদর্শ, আমার কর্তব্য। তাকে কেমন করে আমি পদদলিত হতে দেখব।

রামা ভয়চকিত চোখে শ্রীমতী কাফের ভেতরের দিকে তাকিয়ে বলল, নমস্তে বাবুজি।

হীরেন গম্ভীর মুখে হাসল। করুণ হাসি। বলল, নমস্তে। তোমার ডিউটি শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে এসেছ?

রামা বলল উৎকণ্ঠিত গলায়, না বাবু, বহুত ডর লেগেছে পুলিশ দেখে। হামার দিল রোতা রাহা। শোচলাম, হামার বাবুজিকে পুলিশ পাকড়ে লিয়ে যাবে।

রামার চোখ ছলছল করে উঠল, তবুও ভয়মুক্ত হাসি ফুটল তার ঠোঁটে।

হীরেনের বুকের মধ্যে বেজে উঠল এক মিঠে তাল ও রাগিণী। তার সারা চোখে আলো ফুটল রামার চোখে জল দেখে। তার উৎকণ্ঠায়, তার গলার স্বরের বেদনাভরা উক্তি, হামার দিল রোতা হামার বাবুজি বুকটাকে ভরে দিল তার। মনে মনে ভাবল, মিথ্যে তার আশঙ্কা। তারই আদর্শে গড়ে উঠেছে রামা। সে বলল, পুলিশ একজনকে খুঁজতে এসেছিল। কিন্তু, আজ না হোক, একদিনতো আমাকে যেতে হবে রামা।

দু ফোঁটা জল জমে উঠল রামার দুই চোখে। বলল, স মগর বাবুজি হামার দিল চৌপাট হয়ে যাবে।

দিল চৌপাট হয়ে যাবে! হীরেনের হৃৎপিণ্ডের রক্তধারায় কথাটা বাংলা অনুবাদ হয়ে আকণ্ঠ ভরে দিয়ে তাকে মুহূর্ত নির্বাক করে দিল। তার রাজনৈতিক ও ব্যক্তিজীবনের নানান সমস্যা ও চিন্তার মধ্যে এক নতুন স্বাদ এনে দিল ওই কটি কথা। দু ফোঁটা জল। হলই বা সে ঝাড়দারনী, নীচ জাতীয়া অবাঙালিনী, সে যে আমারই শিষ্যা। তঁা শিষ্যা। ভাবল, হায়! মানুষ কত বড় কিন্তু সে কত সামান্য বস্তুর কাঙাল।

কিন্তু এখানে থামা যায় না। রামার ওই অতল কালো চোখে যে সে দেখতে পেয়েছে যুগপৎ করুণা ও আগুনের শিখা। সে যে নবভারতের নায়িকা। মৃৎশিল্পী যে মূর্তি নিজের হাতে তৈরি করে খড় মাটি দিয়ে, সেই মূর্তির পায়ে একদিন তারই পুস্পাঞ্জলি পড়ে। হীরেন তার কল্পনা-চোখে দেখতে পেল, গান্ধীজির পাশে দাঁড়িয়েছে রামা। রামা যুগেশ্বরী।

শ্ৰীমতী কাফের ঘড়িতে কিশোরী গলার কলসির মতো ঠুং ঠুং করে বেজে গেল নটা। হীরেন চমকে উঠল। হৃদয়াবেগের রাশ টেনে ধরল সে। চোখ তুলে দেখল, রামা তার দিকে ব্যর্থ চোখে তাকিয়ে আছে।

রামা! আবার একটু চমকাল হীরেন। রামার গা থেকে একটা কীসের সুগন্ধ ভেসে আসছে। দেখল, তার এলো খোঁপায় বাসি ফুল, কানে পরেছে নতুন রূপোর দুল। সে ভেবে পেল না, রামার দেহের প্রতিটি রেখা হঠাৎ এত তীব্র, জীবন্ত হয়ে উঠল কেমন করে।

রামা বলল, বাবুজি, আপনার খারাপ তবিয়ত হয়েছে।

হীরেন বলল, না। তারপর একটু থেমে বল, তোমার সুতো এনেছ রামা?

রামা মাথা নিচু করে সঙ্কোচে হাসল। বলল, বানাবার ফুরসত মিলে নাই বাবু।

মুহূর্তে হীরেনের সারা মুখে মেঘ ঘনিয়ে এল। জিজ্ঞেস করল, কেন?

লজ্জা ও সঙ্কোচে চুপ করে রইল খানিকক্ষণ রামা। তারপর খানিকটা অস্বস্তির হাসি হেসে বলল, ওরা সব পাকড়কে লিয়ে গেল।

পাকড়কে! উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করল হীরেন, কোথায়?

রামলীলা শুনতে। বলেই উৎসাহ ভরে বলে উঠল, বহুত বঢ়িয়া খেল বাবুজি। বলেই হঠাৎ কী মনে পড়তে খিলখিল করে হেসে উঠল।

হীরেন দেখল, তার সামনে রামা নেই, এক অপরিচিতা উচ্ছল বেদে নট-নারী। সে হাসছে। যে হাসিতে আকাশ চমকায়, বাতাস থমকায়, পাথরকে কথা বলায়।

হীরেন উৎকণ্ঠিত ব্যগ্র গলায় ডাকল, রামা।

বাবুজি।

তোমার উপর আমার কত ভরসা। আমার নয়, সারা বস্তির, তোমার আপনার, তোমার পর, সকলের, তোমার দেশের। সে ভরসা তুমি ভেঙে দিতে চাও?

হাসি থামল। লজ্জা ও বিস্ময় ফুটল রামার চোখে। নিরুত্তরে তাকিয়ে রইল হীরেনের দিকে।

হীরেন বলে চলল, তুমি ঝাড়দার বস্তিতে থাকতে পারে। কিন্তু তোমার পথ আলাদা। তুমি গঙ্গা, ওই সব নোংরা খাল নালাকে তুমি তোমার পথে টেনে নিয়ে আসবে, তোমাকে সমুদ্রে যেতে হবে কিন্তু তুমি যে গঙ্গা হয়ে খালের পথ ধরেছ। ও পথ তোমার নয়, তুমিই যে ওদের শেখাবে।

রামার ভ্রূ-লতা বেঁকে উঠল দুর্বোধ্য বিস্ময়ে। বলল, সচ্‌ বাবুজি।

হীরেনের গলা ভাবাবেগে কেঁপে উঠল, সে বলেই চলল, তোমাকে আমি দেখতে সই সকলের আগে। তুমি সারা দেশকে পথ দেখাবে।

বাঁধভাঙা বন্যার মতো হীরেনের মুখ থেকে কথা বেরিয়ে আসতে লাগল। রামা নীরব। সে বুঝেছে, বাবুজিকে সে দুঃখ দিয়েছে, তখলিপ বাড়িয়েছে। লজ্জায় ও ব্যথায় সে নির্বাক হয়ে রইল। হীরেনের সব কথা সে বুঝল না। কেবল চুপ করে শুনে গেল।

পরে বলল, বাবুজি, হামার গোস্তাকি হয়েছে। হাম আপকো দিল দুখায়া। বাবুজি, আয়না আর না হবে।

হীরেন নীরবে তাকিয়ে রইল রামার দিকে।

এমন সময় দেখা গেল ভজন আসছে বাজার থেকে। শুধু বাজার থেকে নয়, এর মধ্যেই কোথা থেকে মদ গিলে এসেছে সে। তেমন বিশেষ টলছে না, আপন মনে হাসছে সে। তার সারা মুখটা আগুনের মতো লাল হয়ে জ্বলছে। হাসিটা বাঁকা না ব্যথার, ঠাওর পাওয়া যায় না।

ভজনকে রামার বড় ভয়। না, এ বাবু তাকে কোনওদিন অপমান করেনি, তাড়িয়ে দেয়নি। তবুও ভয়। এ বাবুর হাসি কথার মানে সে কিছুই বুঝতে পারে না। এ বাবু মাতাল, দিলদার, এক একসময় মনে হয় যেন একটা জোয়ান ঝাড়দারের মতো সাদাসিধে। কিন্তু গান্ধীর চেলা নয়, গম্ভীর নয়। হাসে আর বলে, কী রে বেটি কগজ এগুলি? অর্থাৎ কত সুতো কাটা হল। কখনো বলে, তুই ঝাড়দারনী না রজকিনী রামী, ঠাওর করতে পারছি না। একথা বললে সে দেখে, তার বাবুজি হীরেনের মুখটা কালো হয়ে যায়। হীরেনও অস্বস্তি বোধ করে ভজনের কথায়। বলে, ভজন, আর যা-ই করো এখানে আর তুমি অমন করে সার্থক কাজের চেষ্টাকে ভেঙে দিয়ো না। ভজন বলে, মাইরি, ভাঙা ছাড়া কিছু গড়তে পারলুম না এ জীবনে। তোরা গড়, আমি দেখব। তারপর হাত-জোড় করে বলে,

ডান হাতে তোর খড়গ জ্বলে,
বাঁ হাত করে শঙ্কা হরণ।

মা, দু পিস পাঁউরুটি খেয়ে যা। এ অবোধ সন্তানের গোস্তাকি নিসনে। কিন্তু দোকানটা মাঝে মাঝে। ঝাড় দিয়ে যাস।

রামা এখানে অনেকদিন ঝাড় দিয়েছে এবং খেয়েছে, কিন্তু বুঝেছে বাবুজি তাতে দুঃখ পান। তাই তার খেতেও সঙ্কোচ। হীরেন জানত, এ-সব কাজে মানুষকে কত কী শুনতে হয়। বিশেষ, ভজনের উপহাস ধরতে গেলে এ বিশ্বে কিছুই করা যায় না।

ভজনকে আসতে দেখেই রামা বলল, কাল সবেরে ফির আসব বাবু। অখুন যাই।

হীরেনও তাড়াতাড়ি বলল, যাও।

রামা ফিরতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে হেসে কী যেন ভাবল এক মুহূর্ত। তারপর বলে ফেলল, বাবুজি, আপনি এক রোজ ঝাড়দার বস্তিতে খাবেন বলেছেন। সবকোই বলছে, এ হামলোগা পাপ।

হীরেনের মুখে আবার সেই হাসি ফেরে এল। বলল, না রামা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নের কোনও জাত নেই। তোমরা যে অস্পৃশ্য নও, এটুকু প্রমাণ করার জন্যই আমি তোমাদের হাতে খাব, তোমাদের সকলের সঙ্গে। সে হবে আমাদের সার্বজনীন চড়ইভাতি। এতে তোমাদের লজ্জার কিছু নেই।

তবু যেন একটু দ্বিধায় হাসল রামা। হেসে চলে গেল। ঘোমটা ভোলা। খসা আঁচল। শক্ত মাঝারি শরীরটা তার পেছন থেকে যেন হাওয়ায় দোলা সদ্য বেড়ে ওঠা গাছের চারা গাছের মতো। আচমকা একটা নিশ্বাস পড়ল হীরেনের। ভজন বারান্দায় উঠেই বলে উঠল,

বসন্ত হরেছে মোর প্রাণের স্বাদ,
কি বা জ্বালা যাহা ছুঁই, সবই বিস্বাদ।

বলেই চড়া গলায় হাঁকল, বি-শে!…

হীরেন তাড়াতাড়ি ভেতর দিকের কোণে একটা চেয়ারে বসে, তুলো তলি বার করে সুতো কাটতে আরম্ভ করল। বিরক্তির রেখা ফুটে উঠল তার কপালে।

বিশে এল না, তার জবাবও পাওয়া গেল না। ভজন বলল, হারামজাদা গেল কোথায়? বলে সে নিজেই ঘরের মধ্যে ঢুকেই হুঙ্কার দিয়ে উঠল, আজ মেরে ফেলব খোলক্লাসের বাচ্চাটাকে।

বিশে এই অল্প অবসরের ঝোঁকেই কয়েকটা আলু সেদ্ধ করে সবে ছাড়াবার উদ্যোগ করছিল। ভজনের আওয়াজ পেয়ে লুকোতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছে। ভজনের শক্ত হাতে ঘাড় ধরা অবস্থায় তাকে দেখাচ্ছে যেন, নোংরা দাঁতে, পিটপিটে চোখে একটা সন্ত কালো উল্লুক। নিস্তেজ গলা দিয়ে শব্দ বেরুচ্ছে হুম হুম রবে।

ভজন বলল, কী করছিলি?

বিশে বলল, সরু সুতো কাটা গলায়, তোমার চবের আলু সেদ্ধ করছিলুম।

চবের আলু সেদ্ধ? তবে লুকোচ্ছিলি কেন?

এক মুহূর্ত চুপচাপ। হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বিশে ভজনের পা জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠল, মাইরি ঠাকুর বড় ক্ষুদা জেগেছিল, মাইরি। মেরো না, আমাকে ছাড়িয়ে দেও ঠাকুর মাইরি।

ছাড়িয়ে দেব বলে অবাক হয়ে হঠাৎ হা হা হা করে হেসে উঠল ভজন। ব্যস, হার মানিয়েছি আমাকে। তবু তুই খাওয়া ছাড়তে পারবিনে, এই তোর সাফ কথা। এর পরে আর কথা কীসের। আলু সেদ্ধ করেছিল, এবার নুন নে, পেঁয়াজ নে, পাউরুটি কাট, তারপরে খা। তোকে ছাত্ব না, ব্যবসাটা তুলে দেব।

বলে সে সামনের ঘরে গিয়ে বসে হীরেনকে বলল, তুমি রাজনীতি করেছিলে, আর ও ব্যাটা আমার কবর খুঁড়ছে। হীরেন।

ভজন গম্ভীর গলায় ডাকল। হীরেনের তলিতে সুড় সড় করে খানিকটা সুতো পাকিয়ে গেল অন্যমনস্কতার জন্য। ভাবল না জানি আবার কী বলবে ভজন। বলল, কী বলছ?

বলছি, চিচিং ফাঁক মানে কী, বলতে পারো? হীরেনের চোখে মুখে ভয় দেখা দিল, কী বলতে চায়, মাতালটা? বলল, অর্থাৎ?

হেসে বলল ভজন, অর্থাৎ বলতে পারলে না। চিচিং ফাঁক মানে, সোনাদানা আর মোহর হে। আর দোকান ফাঁক মানে কি জানো? হীরেন তবুও তাকিয়ে রইল।

ভজন বলল, পুলিশ ঘুরে গেছে দোকানে। খদ্দেররা আমার সব ভারতমাতার বড় বড় শ্যাম্পেল। দোকান ফাঁক তুমি বুঝবে না। তুমি হয়তো ভাবছ দেশনেত্রী তৈরির কথা।

এবার সুযোগ পেয়ে হীরেন বলে উঠল, তোমারই তো দোষ।

ভজন বুঝল এ আবার হীরেন ও সুরজদের সেই আলাদরি রাগ। তাই দোষ বিচারে ওরা চিরদিনই সিদ্ধহস্ত। বলল, সে ভাবে যদি বলল, তুমি ছাড়া পাবে না বাবা। কিন্তু, এ সংসারে দোষী কে, তা কি আমরা কেউ জানি? বলতে বলতে ভজন টেবিলের উপর মাথাটা পেতে দিল। হীরেনও কেমন অন্যমনস্কর মতো তাকিয়ে রইল, সামনের স্টেশনের দিকে। চমকে উঠল আর মনটা। ষ্টেশনের রকে ঝাড় দিচ্ছে একটা মেয়ে। কিন্তু রামা নয়, আর কেউ। মনটা কলি, সুতো, শ্রীমতী কাফে সব ছেড়ে হারিয়ে গেল হীরেনের।

দুপুর নামছে। রাত্রে একটু শীত লাগে। দুপুরের রোদ যেন ঘায়ের মতো জ্বলে। রোদ চড়ছে, ঝিমিয়ে আসছে ধ্ব। কমে গিয়েছে ট্রেনের যাতায়াত। মুখে কাপড় চাপা দিয়ে ঘুমাচ্ছে কুলি আর যাত্রীরা। ঘোড়ার গাড়ি একটাও নেই। জলদানিটা থেকে উপছে পড়ছে জল। সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে যাকে বলে একটা খোদাই ষাঁড়। বোধ হয় ভাবছে ঘোড়ার জলদানিতে বেআইনি মুখ দেওয়াটা তার ঠিক হবে কিনা। চতুষ্পদীয় হলেও গরু ঘোড়ায় তফাত আছে তো!

আকাশের দক্ষিণ পশ্চিম কোণ থেকে উঠে আসছে সাদা সাদা দলা দলা মেঘ। যেন কোনও খেলোয়াড় অদৃশ্যলোক থেকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে বুড়ির মাথার পাকা চুল। সেদিকে তাকিয়ে একটা পাগল কী যেন বলছে ফিসফিস করে, হাসছে, আবার কখনও রেগে উঠে শাসাচ্ছে। কালো অসুরের মতো চেহারা, মাথাটা বারো মাসই প্রায় কামানো, গলায় আবার তুলসীর মালা। পাগলামি ছেড়েও যখন মাঝে মাঝে কুলিগিরি ধরে, তখন যাত্রীদের লাঞ্ছনার আর অন্ত থাকে না। ওকে সবাই বলে কুটে পাগলা।

ভজন যখন মাতাল হয়ে পড়ে, তখন কুটে পাগলা হা হা করে অট্টহাসি হেসে বলে, ব্যাটা বাবু পাগলা। সে যখন আকাশের দিকে তাকিয়ে ওরকম করছে, তখন অদূরে অশখ তলার কাজহীন মুচিটা নিরালার টিকটিকির মতো জিভটা ঠোঁটের কাছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। হাসি পাচ্ছে না, ভাবছে, কুটিয়া পাগলার নিশ্চয়ই কোনও সেয়ানা প্রম বাবা আছে। নইলে অমন অপদেবতার সঙ্গে কথা বলছে কী করে।

রাস্তাটা ফাঁকা হয়ে আসছে। নেমে আসছে দুপুরের নিঝুমতা।

হীরেন সুতো কাটছে না। বাড়ি যেতে মন চাইছে না। বাড়িতে অবশ্য মন তার কোনওদিনই টেকে না। না, সেখানে অভাব অনটন নেই। বরং সবাই জানে, নিয়োগী বাড়ির অফুরন্ত ঐশ্বর্যের কথা। নইলে হয় তো এমন করে তার পক্ষে বেরিয়ে পড়া সম্ভব হত না। কিন্তু সেই বিরাট একান্নবর্তী পরিবারের কারণে অকারণে ঝগড়া বিবাদ, এক পাল ভ্রাবধুর গহনা ও মাৎসর্যের নোংরামি তার সহ্য হয় না। তাদের বিরাট অন্দর মহলে, অনেক জোড়া সুন্দর চোখ, সম্পর্কের ঠাট্টার আড়ে প্রশ্রয়ের হাসি ও রাখঠাকহীন কথা কোনওদিন তার মনটাকে একটুও টানেনি, টলায়নি। উপরন্তু সেই পরিবেশে তার মনে একটা ঘৃণার উদ্রেক করেছে। খাওয়ার সময় মেয়েরা ভিড় করে থাকলে, তার খাওয়া পর্যন্ত হয় না।

অথচ সামান্য রামাকে তার মনে হয়েছে এদের চেয়ে অনেক মহৎ, অনেক বড়। মনে মনে বলল হীরেন এখানে সৌন্দর্য রূপে নয়, গুণে। চেহারায় নয়, চরিত্রে। তা না হলে, রামার সৌন্দর্য তো নিয়োগী বাড়ির বাছা বাছা ঝিয়ের কাছেও টিকবে না। কিন্তু রামা তার আবিষ্কৃত ভারতের নিপীড়িত আত্মা। এখানে দেখার প্রশ্ন নেই, অনুভবের সাধনা। রামা তার আদর্শের সৃষ্টি। এই আত্মাকে সে সঠিক পথে নিয়ে যাবে, এই তার পণ। সেইজন্যেই মনটা কেবলি ঘুরে ফিরে এক কথাই ভাবছে।, সে থামবে না। সে এগিয়ে যাবে তার পথে। কৃপাল হয় তো শীঘ্রই বিয়ে করবে। এমন কী সে লুকিয়ে সিগারেট পর্যন্ত খায়। তার কাছে দেশ সেবা অন্য রকমের হলেও হীরেন কোনওদিন সে জীবনের দিকে ফিরেও তাকাবে না। হীরেন তার জীবনকে বিসর্জন দেবে, এই নিরন্ন অস্পৃশ্য দেশবাসী, ওই দরিদ্র নারায়ণ কি চরণে মে!

ভিতরের চালা ঘরটায় উনুনের পাশে বিশে তেমনি দাঁড়িয়ে আছে ভূতের মতো। ঘরটা দিনের বেলাও আঘো অন্ধকার। পেছনের নর্দমার ধারে জমে উঠেছে রাবিশ, তরকারির ফেলে দেওয়া আবর্জনা। মাছি ভ্যান ভ্যান করছে, পোকা কিলবিল করছে নর্দমায়।

বিশের হাতে তখনও আলুসেদ্ধ কটা রয়েছে। ঘেমো হাতের ময়লা লেগেছে সেগুলোতে। ঠোঁটের পাশে লালা চকচক করছে। সে হতভম্বের মতো অনেকক্ষণ ভেবে ভেবে, আর নিজেকে চেপে রাখতে পারল না। ভাবলেশহীন মুখে প্রায় আস্ত গিলে খাওয়ার মতো আলু কটা সে খেয়ে ফেলল। তারপর হঠাৎ অবিশ্বাস্যরকমভাবে তার চোখে চক চক করে উঠল কয়েক ফোঁটা জল। ঠোঁট দুটো কুঁচকে মুখটা সে উপর দিকে তুলে ধরল ছুঁচোর মতো। বিশে কাঁদছে না ছুঁচোর মতো খাবারের শোকে তার ষ্টুলো ঠোঁট কাঁপছে, ঠিক বোঝা গেল না।

এই অবস্থায় খানিকক্ষণ থেকে সে হঠাৎ একেবারে সামনের ঘরে গিয়ে ভজনের পা জড়িয়ে ধরল। ডাকল, ঠাকুর।

ভজন মাতাল নয়, কীসের ঘোরে যেন মগ্ন ছিল। চোখ বুজেই বলল, আবার কী খেয়েছিস?

বিশের গলাটা যেন একটু মোটা হয়ে উঠল, কিছু না।

তবে?

দোকানটা তুমি তুলে দিয়ো না ঠাকুর। আমাকে ছাইড়ে দেও।

ভজন অবাক হয়ে তাকাল বিশের দিকে। হীরেনও তাই। তার নাকের পাশে একটা বিরক্তি ও ঘৃণার রেখা ফুটে উঠল।

বিশে বোধহয় কান্নার জন্যই দো আঁশলা গলার স্বরে বলতে লাগল, ঠাকুর তোমাদের বিশের মরণ নেই। কেন, যদি বলল, তবে বলি, এই অতটুনকালে খোলা উঠোনে ফেলে মা দুদিন, দুরাত কোথায় হাওয়া হয়ে গেছল, আমাকে শেয়াল কুকুরে খায়নি, মাইরি। আমার ভাই বোন একটাও বাঁচত না বলে, শালা বাপটা পিটত আর বলত, এটা-ই ওগুলোকে খেয়ে ফেলে। ছোটকাল থেকে, এতবড়টা মাইরি আমি এই করে খেয়েছি। ধরবাবুরা আমার জিভ কেটে দিতে চেয়েছিল ছোঁচামির জন্য মাইরি। এজন্যে আমার বে অবধি হল না। আমাকে তুমি তাইড়ে দেও ঠাকুর।

হীরেন মুখটা ফিরিয়ে নিল। তার কী রকম অস্বস্তি হচ্ছে। মনে হচ্ছে, তার সামনে একটা কুৎসিত-দর্শন প্রেত ঘ্যান্‌ ঘ্যান্ করে কাঁদছে। সে তার তুলো তকলি গুছিয়ে উঠে পড়ল।

ভজন হঠাৎ কোনও জবাব দিতে পারল না। সে কোনওদিন ভাবতেও পারেনি, বিশে এমন সদা সত্য কথা বলে নিজেকে খুলে ধরবে। বিশের কথাগুলো শুনতে শুনতে তার কেমন একটা ভয় ধরে গিয়েছে। বারবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল থালায় বাড়া ভাত, মাছ-তরকারি। মনে হল, তার ক্ষুধার সময়, কে যেন তার থালাটা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তার মনে হল, বুঝি তাকেও একদিন পাড়ায় পাড়ায় এমনি ছ্যাচড়াবৃত্তি করে ঘুরে বেড়াতে হবে। মনে পড়ল তার দুটো ছেলে হয়েছে। আরও একটা কিছু হবে। হয় তো একদিনও ওরাও এমনি বিশের মতো দারুণ ক্ষুধায় মানুষ থেকে অমানুষ হয়ে উঠবে। সেইদিন!.কিন্তু যুঁই। কোমলে কঠিনে ধরিত্রীর চেয়েও সহ্যশীলা যুঁই যে ওদের মা। হলই বা। এ ধরিত্রীর বুকেও কি দুর্ভিক্ষ হয় না।

পরমুহূর্তেই মনে হল, কেন ভাবছে সে একথা। সে ভজন, ভজুলাট। তার ছেলে হবে বিশে, এ কোন্ চিন্তা পেয়ে বসেছে তাকে। সে তাকিয়ে দেখল, বিশে তার দিকেই হাঁ করে তাকিয়ে আছে।

ভজন বলল, তোকে তাড়াব না বিশে, দোকানটাতে যদি তোর এত মায়া, তবে এটাকে বাঁচিয়ে খাস্। খা, যা তোর প্রাণে চায়। ভজুলাট লাভের বরাত করেনি কিন্তু বাঁচতে চায়রে, বাঁচাতে চায়।

বলে সে উঠে পড়ল। কেমন যেন একটা জ্বালা ধরে গিয়েছে তার মনে। মনে হচ্ছে, তাকে যেন একটা জ্বলন্ত মশাল দিয়ে পিটছে, তাড়া করছে কেউ। সে ঝড়ো বেগে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

.

এই দিনটাতে সত্যি স্থানীয় অনেকেই শ্রীমতী কাফেতে পা বাড়াল। আই বি ডিপার্টমেন্ট আচমকা এতই তৎপর হয়ে উঠল যে, সারাদিন প্রায় ডজন খানেক নূতন মুখ এদিক ওদিকে উঁকি ঝুঁকি মেরে বেড়াল। জনাকয়েক চা-ও খেয়ে গেল।

ভজন প্রায় সারাটা দিন মদে ড়ুবে রইল। দোকানের খাবার পর্যন্ত তৈরি করল না। বিশে ভাবল, অপরাধটা তারই। তার সারাদিনের টুকটাক খাওগার খেলাটা ভাল জমল না। তা ছাড়া মনটা তার কী রকম থতিয়ে গিয়েছে।

সন্ধ্যাবেলা শ্রীমতী কাফে তেমনই জমজমাট হয়ে উঠেছে। কিন্তু তারা খদ্দের নয়। আশেপাশের সমস্ত রাজনীতিক বন্ধুরা একত্র হয়েছে। আসেনি খালি রথীন সুনির্মলের দল। কিছুদিন আগে পর্যন্ত কৃপালের সঙ্গে বিতর্ক হয়েছে তাদের। গত বছরের আগের বছর মাদ্রাজ কংগ্রেসে ডাক্তার আনসারীর সভাপতিত্বে যে সাইমন কমিশন বয়কটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, সে বিষয়ে স্থানীয় কোনও আন্দোলনে স্থানীয় কংগ্রেস কমিটি তাদের সাহায্য করেনি। হীরেন ছিল জেলে। সে জেল থেকে এসে দেখল, কথাবার্তা নেই, হরতাল করাটা একটা দেশের রাজনৈতিক ফ্যাশান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বছরেই একমাসের মধ্যে সুনির্মল হাই স্কুলে তিনবার ধর্মঘট করেছে, দুমাস জেল খেটে এসেছে। রথীন পুলিশের মার খেয়েও শায়েস্তা হয়নি। বিচিত্র ওদের আন্দোলন। মাঝখান থেকে লাভ হয়েছে কয়েকজন নিরীহ মজুর হাজত বাস করে এসে চাকরি খুইয়ে বসে আছে। তারা এখন নেতা হয়েছে। হাসি পেয়েছে হীরেনের। যাদের কোনও শিক্ষা দীক্ষা নেই, তাদের দিয়ে এসব ক্যারিকেচার খেলানো কেন?

এই সব আলোচনাতেই আজকের আসর জমে উঠেছে। সন্ত্রাসবাদ ও ট্রেড ইউনিয়ন, এই দুটি বিষয়ের উপর ব্রিটিশ সরকার একেবারে নির্দয়। বিশেষ, আজকেই শ্রীমতী কাফেতে এ রকম একটা পুলিশি হাঙ্গামা ঘটে যাওয়ার দরুন, আলোচনাটা এদিকেই বইছে। কেবল জওহরলাল পন্থী কয়েকজন নীরব। কৃপাল হীরেনের মতো, একটু বয়স্কদের সঙ্গে তাদের ঠিক জমছে না। মিউনিসিপালিটি এলাকার কংগ্রেস সভ্যরা প্রায় সকলেই আজ হাজির। বোঝা যাচ্ছে না, এটা শ্ৰীমতী কাফে না কংগ্রেস অফিস।

বিশে অবাক হয়ে এদের কথাগুলো শুনছে। ভেতরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে এমনভাবে শুনছে, যেন তার সামনে কেউ দুর্বোধ্য উর্দু আরবি ভাষায় কথা বলছে। এরা চা, খাবার, জল, কিছুই চায় না। শুধু কথা। এত কথা মানুষ বলতে পারে।

ভজন এতক্ষণ ছিল না। হঠাৎ এল ঊর্ধ্বশ্বাসে। মত্ত অবস্থায়। এসেই থমকে দাঁড়াল বারান্দায়। একে তো তার চোখ দুটো কটা। তারপরে যখন নেশায় ওই চোখে রক্ত উঠে আসে, তখন মনে হয় একটা হিংস্র সিংহ তাকিয়ে আছে। সে সকলের উপর দিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে কলল, বাঃ, এই তো মানিয়েছে। একেবারে সভাস্থল করে তুলেছ বাবা। ফিরে এসে দেখব,পুলিশের থানা বসে গেছে। বিশে!

বিশে নিঃশব্দে ভজনের কাছে এসে দাঁড়াল। তার চোখে মুখে একটা চাপা খুশির ভাব ছড়িয়ে পড়েছে। অর্থাৎ, এতক্ষণে এই কথাখেকো বাবুগুলো একটু শায়েস্তা হবে।

ভজন বলল, ব বাবুকে এক কাপ করে চা দে। পয়সা নিতে ছাড়িস নে যেন। খালি ঠাকুরদার কাছ থেকে পয়সা নিসনি, বুঝলি?

বিশে খালি বলল, হুঁ!

ঠাকুরদা মানে গোলক চাটুজ্যে মশাই। তিনি যথানিয়মে এসেছেন কিন্তু আজকের আসরে তিনি উপেক্ষিত। নিছক ঝিমুনোর বরাত।

ঘর সুদ্ধ লোক সব নিশ্চুপ। বিশেষ নবীন কংগ্রেস কর্মীরা তো প্রায় তটস্থ। বোঝা গেল, এখানে আইন অমান্য সম্ভব নয়।

ভজন গিয়ে দাঁড়াল ভুনুর গাড়ির কাছে। হাতে তার একটা কাগজ। কাগজ নয়, চিঠি। চিঠি দিয়েছেন যুঁইয়ের বাবা, ভজনের শ্বশুর। দিয়েছেন ভজুর বাবা হালদার মশাইকে, গালাগাল দিয়ে। ঠিক পালাগাল নয়, হালদার মশাইয়ের নিস্পৃহতার দরুন ছেলের বউয়ের তিনি খবর নেন না। মেয়ের অযত্ন হয়েছে, সেই অজুহাতে তিনি লিখেছেন, এ বয়সে আপনার একটু প্রকৃতিস্থ হওয়া উচিত। চিঠির কথাটা কানে শোনা মাত্র ভজন পাগলের মতো ছুটে এসেছে। শ্বশুরবাড়ি প্রায় দশ মাইল দূর। আর এখুনি কোনও ট্রেনও নেই। অথচ ভজনের কুষ্ঠিতে লেখা নেই কোনও বিষয়ে এক মুহূর্ত চুপ করে থাকা। চুপ করে থাকা মানে, ব্যাপারটা তার কাছে জুড়িয়ে যাওয়া। এখুনি কিছু করলে, হয় তো এ জীবনে আর হবে না।

ভুনুর মাদী মরদা দুটো ঘোড়াকেই গালাগাল দিলেও সে তাকেই গিয়ে বলল, দ্যাখ ভুন, বউ আনতে যেতে হবে এখুনি শ্বশুরবাড়ি। তোকে হতে হবে আজ আমার সারথী। যাকে বলে একেবারে কেষ্টঠাকুর, বুঝলি? আমি হলাম অর্জুন। কিন্তু তোর ওই ঘেয়ো পঙ্খীরাজকে…

ব্যস। এক কথায় বেঁকে বসল ভুনু। বলল, পঙ্খীরাজ মত কহো লাটবাবু, কহো, রাজারানী।

বোঝা গেল, কালকের রাগটা তার এখনও যায়নি। ভজন তার আগুনের মতো লাল মুখটা ভুনুর কাছে এগিয়ে নিয়ে বলল, ঘোড়া যখন রাজারানী হয়, তাকেই বলে পঙ্খীরাজ। না হয় তোর পঙ্খীরানীও আছে। কিন্তু, আজ ওদের আসল রাজারানী হতে হবে। পারবি?

ভুনু অতশত বুঝল না। সন্ধ্যার ঝোঁকেই পুরো দু ভাঁড় খালি করে সে বুদ হয়ে বসেছিল। একটাও প্যাসেঞ্জার আসছে না দেখে সে মনে মনে প্যাসেঞ্জারেরই বাপান্ত করছিল। এখন লাটবাবু এসে তার গাড়িতে উঠতে চাইছে দেখে প্রথমটা সে বিশ্বাস করতে পারল না। ভাবল, তার রাজারানীকে দিল হালাল করা দিশ্লেগির এটা একটা কায়দা ভজুলাটের।

কিন্তু মন্ত ঘোরালো চোখে সে লাটবাবুর দিকে এক মুহূর্ত সংশয়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বুঝল, ব্যাপারটা ঠাট্টা নয়। তবুও তাজ্জব হল সে এই ভেবে, সকালে যার দোকানে পুলিশ ঘুরে গিয়েছে, দোকানে যার দোস্ত ইয়ারদের আড্ডায় ঘুঘু চরতে বসেছে, সে কিনা এই রাত্রে যেতে চায় শ্বশুরবাড়ি বউ আনতে। তাও কিনা আবার ভুনুর গাড়িতে। ভাবল, লাটবাবু শুধু মাতাল নয় তার ঘরওয়ালি মনিয়ার মতোই এ বাবুও দুর্বোধ্য। মনিয়া তার বউ।

কিন্তু সেসব ছেড়ে ওই আসল রাজারানী হতে হবে কথাটা তার ঝিম-মারা মগজে চট করে ধরে গেল চুম্বক লোহার মতো।

সে মোটা গলায় প্রায় হুকুমের সুরে খালি বলল, অন্দরমে আপনি বসে যাও লাটবাবু।

সারথীর চেয়ে অবশ্য ধনুর্ধারীর অবস্থা ভাল নয়। ভজুলাট হুমড়ি খেয়ে কোনও রকমে গাড়ির মধ্যে পড়তেই বোঁ করে একটা পাক খেয়ে ভুনুর রাজারানী ছুটল দক্ষিণে। দক্ষিণে দীর্ঘবাক সড়ক। খোয়া বাঁধানো রাজপথ। এবড়ো-খেবড়ো। বর্ষায় গাড়ি চলে চলে দুপাশ নিচু হয়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝে পাথুরে খোয়া মাথা উঁচিয়ে আছে। যেন বিদ্রূপ করে হাসছে পথচারী জানোয়ার ও গাড়ির চাকার উদ্দেশ্যে! অন্ধকার। হালকা কুয়াশা আর ধোঁয়া ছড়িয়ে আছে। হেমন্তের রাত্রে হাওয়া-শুন্য কুয়াশা আর ধোঁয়া যেন ঝুলছে মাকড়সার জালের মতো। বেঁটে বেঁটে কাঠের পোটের মাথায় টিম টিম করে জ্বলছে কেরোসিনের বাতি।

কিছুক্ষণ পর ভজুর মনে হল, সত্যি বুঝি সে পঙ্খীরাজে করে উড়েই চলেছে। গাড়িটার ঘড়ঘড় মড়মড় শব্দের মধ্যে সে খালি শুনতে পাচ্ছিল একটা তীক্ষ্ণ শিস্ আর জোড়া ঘোড়ার খুরের কদম ছুটের জোড় মেলানো শব্দ। মাঝে মাঝে গাড়িটা কাত হয়ে উলটে পড়ার উপক্রম করছে, কখনও এমনভাবে লাফিয়ে উঠছে যেন হুড়মুড় করে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ল বুঝি। এমন কী, কয়েকবার গেল গেল চিৎকারে তার চড়া নেশাটা মাটি হবার উপক্রম করল। গেল গেল করে চেঁচাচ্ছে রাস্তার লোক।

প্রথমটা ভজুর মনে হল, বোধ হয় নেশার জন্য এরকম মনে হচ্ছে। কিন্তু বাইরের দিকে চোখ পড়তে সে দেখল, অবিশ্বাস্যরকম তীব্র বেগে তার দৃষ্টি থেকে সব হারিয়ে যাচ্ছে। এই দুর্ধর্ষ গতি দেখে সে একবার ভুনুর ঘেয়ো রাজারানীর চেহারা দুটো ভাবার চেষ্টা করল। কিন্তু তার চোখের সামনে ভেসে উঠল দুটো শক্তিশালী, মাংসল, কেশর উচনো ছুটন্ত ঘোড়ার ছবি। ওই নির্জীব ঘোড়া দুটোর এত ক্ষমতা কোত্থেকে হবে!

শ্বশুরবাড়িতে এসে যখন পৌঁছুল ভজন, এতখানি উত্তেজনার পর শ্বশুরের উপর রাগটা তার কেমন পড়ে গেল। আর এসেই শুনল কিছুক্ষণ আগেই যুঁইয়ের এক ছেলে হয়েছে।

আশ্চর্য হয়ে বাড়ির সবাই ঘিরে দাঁড়াল ভজনকে। হঠাৎ কেউ কথা বলতে পারল না। ভজনের মুখ লাল। রক্ত ফেটে পড়ছে যেন। উত্তেজিত। ঘর্মাক্ত। চোখ তো নয়, বুকের অন্তস্থল বিদ্ধকারী দুটো ঝকঝকে বর্শা ফলক।

এই কিছুক্ষণ আগেই এই বাড়ির সকলে একটা উদ্বেগের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। অনায়াসে প্রসব করেছে যুঁই। তার পরেই বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতো যে এল, সে কি না যুঁইয়েরই বর। জামাইবাবু, মেজদির ছেলে হয়েছে। বলল যুঁইয়ের এক বোন। ভজনের বিবাহিতা শালী।

ভজন শুনেছে। আবার শুনে ফিরে তাকাল শালীর দিকে। শালী সুন্দরী। যুঁইয়ের মতো স্বাস্থ্য, গায়ের রং ফরসা। সুন্দরী, কিন্তু ধার নেই। হাসছে সসম্রমে। ভয়ে ভয়ে।

কাউকে প্রণাম করার কথা মনে হল না ভজনের। জিজ্ঞেস করল না শশুরমহাশয়ের কথা। শালীকে বলল, তোমার মেজদিকে একবার দেখব, নিয়ে চলো।

সবাই অবাক হল, হাসল নিঃশব্দে। নবজাতককে নয়, একেবারে মেজদিকেই।

শালাজ ঠাট্টা করল, খালি হাতে?

ভজন বলল শালাজের দিকে তাকিয়ে, সেইজন্যই তো মেজদির ছেলে দেখতে চাইনি। দেখা মানুষকে দেখতে চেয়েছি। দেখবার জন্যই এসেছি।

বাতি দেখিয়ে শালী নিয়ে চলল ভজনকে আঁতুড়ঘরের দিকে। রান্নাঘরের পাশে, বাড়ির পেছনে, বাগানের খিড়কির দরজার ধারে। পেছনে এল আরও কয়েকজন।

আঁতুড়ঘরের দরজা ভেজানো। ভেতরে ধাইমার কথা শোনা যাচ্ছে। যুঁই আধ-শোয়া, আধবসা। সে ক্লান্ত, কিন্তু সবলা। কোলের কাছেই, একরাশ কাপড়-চোপড়ের ভেতর থেকে একটা মুখ উঁকি মারছে। একটা লাল রবারের পুতুলের মুখ। ধুসর রোঁয়া ভরা এক চিমটি মাথা। কোঁচকানো ভু। ঠেটি নড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে যুঁই হাসছে। হাসতে হাসতে কী ভেবে অবাক গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে।

এমন সময় সামনে তাকিয়ে দারুণ বিস্ময়ে একেবারে আড়ষ্ট হয়ে গেল। যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। মনে হল, তার অন্তর্যামী তাকে একটা খেলা দেখাচ্ছে। এ কী করে সম্ভব। সে যেন মনে মনে এই মানুষটির কথাই ভাবছিল। মনে মনে কথা বলছিল। কত কথা। মনের সে নিগুঢ় কথা যে এক অন্তর্যামী ছাড়া আর কাউকে বলবার নয়। এই অবুঝ নবজাতককে সাক্ষী রেখে যে সে বলছিল প্রাণের কথা। ভাবছিল, সে এখন কোথায়? বুঝি কোথাও পড়ে আছে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায়। আর তুই যে সংসারে এসেছিস্ বাছা, সে সংবাদ সে কারও কাছেও পাবে না আজ। কিন্তু আমি আর পারিনে বাপু এমনি করে তোদের এ সংসারে আনতে। তাকে আমি বলব! বলব।

ভজনের দিকে তাকিয়ে তার লজ্জা হল, হাসি পেল, অভিমান হল, কান্না পেল। আচমকা তার বুকের ভেতর থেকে যেন যুগ যুগান্তরের বিরহ পাষাণ ভার নেমে গেল। এক রক্তক্ষয়ী বেদনার উপশম হতে না হতে, ভজনের ঘন সান্নিধ্যের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল তার মন। কী লজ্জা! হায়! কী বিচিত্র মানুষের মন, কী অদ্ভুত মতি।

পর মুহূর্তেই মনে হল, ভজন যে অন্তর্যামী। ছি ছি ছি, সে যে সবই জানতে পারছে। তাড়াতাড়ি ঘোমটা টেনে ক্লান্ত শরীরে নিজেকে গুছোবার চেষ্টা করতে লাগল যুঁই।

ভজন বলল, থাক, থাক, এখন ওসব থাক। আমি এখুনি যাব।

পেছনে ফিরে শালাজকে বলল, বউদি কাউকে বলুন এক গামলা জল বাইরে দিয়ে আসতে। রাজারানীর তেষ্টা পেয়েছে। আমাদের ভুনু কোচোয়ানের ঘোড়ার ওই নাম। নাম সার্থক। এতক্ষণে মরে গেল কিনা, তাই বা কে জানে।

হঠাৎ ভজন লক্ষ করল প্রায় সকলের নাকে কাপড় চাপা। ও! মদ খেয়েছে ভজন। মদের গন্ধ–লেগেছে সকলের নাকে। মনে পড়ল, এই নিয়ে এখনও যুইয়ের সঙ্গে তার বিবাদ। মদের প্রতি তার বড় ঘৃণা। যুঁইয়ের বাবার চিঠিতে সে ইঙ্গিত অনেকবার দেওয়া হয়েছে।

ভাবতে ভাবতে ভজনের মনে সেই অপমানবোধটা আবার মাথা তুলল। শালীর দিকে ফিরে বলল, তোমার বাবা কোথায়?

শালী বলল, মেজদির ছেলে হওয়ার পর বাবা তার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছেন। বেড়াতে, পাশা খেলতে।

যুঁই বলল একটু বা দাবির সুরে, আজকের রাতটা থেকে যাও না। গৌর, নিতাই রয়েছে।

গৌর, নিতাই ভজনের দুই ছেলে। ভজন বলল, না। তারপর হঠাৎ যুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি মাতাল। তোমার বাবা অসন্তুষ্ট হবেন। যুঁই, তোমার বাবাকে দুটো কথা বলতে এই রাতে এসেছিলুম। দেখা পেলুম না। তোমারও শরীর খারাপ, তবু বলো। বলল আমার বাবাকে আর উপদেশ দেওয়ার সময় নেই। আর আমি নিজের যত্ন ভাল জানিনে, তাই হয় তো পরের যত্নও বুঝিনে। আমাদের বাড়িতে তোমার নিজের যত্নের ভার নিজে না নিলে, তোমার আদরের জায়গা তোমাকেই বেছে নিতে হবে, সে স্বাধীনতা তোমার আছে।

শালী অবাক। অন্তরালে শাশুড়ী সন্ত্রস্ত। যুঁইয়ের বিস্মিত কান্নায় বুক ভরে উঠল, জিজ্ঞেস করল, কেন বলছ এ-সব কথা?

তোমার বাবা জানতে চেয়েছিলেন।

বলে সে ফেরবার উদ্যোগ করতেই যুঁই ডাকল, শোনো।

ভজন দাঁড়াল। যুঁই জিজ্ঞেস করল, বাবা কেমন আছেন?

বাবা মানে শ্বশুরমশায়। জবাব দিল ভজন, ভাল।

ভাসুর ঠাকুরের কোনও সংবাদ এসেছে জেল থেকে?

না। আমি তিন দিন পরে যাব, ইন্টারভিউ করতে।

আর তোমার…

যুঁই থেমে গেল। শ্রীমতী কাফের কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে থেমে গেল যুঁই। ওই শ্ৰীমতী কাফের প্রতি বরাবরই তার বড় বিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েছে যেন ওই কাফেটা তার সতীন। কোনওদিন জিজ্ঞেস করেনি, আজ জিজ্ঞেস করতে গিয়ে বড় বাধো বাধো ঠেকল, প্রসঙ্গ পালটে বলল, বাবার হয় তো কোনও কারণে মন খারাপ হয়েছিল। তাই কিছু লিখেছেন। তুমি চলে গেলেও বাবা দুঃখ পাবেন।

ভজন বলল, উপায় নেই যুঁই। আমাকে যেতে হবে।

শাশুড়ি আড়াল থেকে এসে বললেন, না থাকো, কিছু না খাইয়ে তোমাকে কেমন করে ছাড়ব বাবা?

ভজন বলল, কিছু মনে করবেন না। আমার সময় নেই। আমি আর একদিন এসে খেয়ে যাব।

ভজনের গলার স্বর শুনে মনে হয়, এর পরে আর কথা চলে না। যুঁইয়ের মার মনের নিগুঢ়ে একটা আকাঙক্ষা ছিল, এই মাতৃহীন শিক্ষিত ছেলেটিকে তিনি মেহের আঁচলে বেঁধে রাখবেন। পারেননি। সে বাঁধা পড়ার নয়। তাঁর পেটের সেরা যুঁই তাকে বাঁধতে পারেনি।

ভজন আবার ফিরল। শাশুড়ির উপস্থিতিতে লজ্জা না করেই বলল, যুঁই নিজে নিজেকে দিন রাত ধিক্কার দিই অপরে দিলে সইতে পারিনে। তবু যদ্দিন বেঁচে থাকব, তোমাদের ভাবনা কাউকে ভাবতে হবে না। হেসে উঠে বলল, লোকে যে আমাকে ভজুলাট বলে।বলে সে এগিয়ে এল।

যুঁইয়ের চোখের কোণে বড় বড় ফোঁটার জল জমে উঠল। না, ভজনের কথায় নয়। ভজনের চলে যাওয়ায় এক নিতান্ত সাধারণ মেয়ের প্রেমের কান্না উথলে উঠল তার। এমনি করেই ভজন বার বার তার বুকে হাহাকার তুলে দিয়ে গিয়েছে। তার ঠোঁট নড়ল। কী বলল, বোঝা গেল না।

এ বাড়িতে যেন একটা ঝড় বয়ে গেল। ভজন চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝড় থেমে এল।

ভজন বাইরে এসে দেখল, ঘোড়া দুটো ছোলা আর জল খাচ্ছে। ভুনু গাড়ির ভিতরে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। মানুষ ও বাতি দেখে ঘোড়া দুটো ফোঁস ফোঁস করে উঠল, চক চক করে উঠল তাদের দুটো সন্ত্রস্ত চোখ।

ভজন ডাকল, ভুনু সারথী।

ভুনু বেরিয়ে এল। একবার তাকিয়ে দেখল ভজনের পেছনে তার আত্মীয়দের, শালীকে দেখে ভাবল লাটবাবুর বউ। সে ঘোড়া দুটোর মুখের কাছ থেকে ছোলার পাত্র নিয়ে রেখে দিল তার আসনের নীচে। তারপর পরম আদরে ঘোড়া দুটোর গায়ে হাত বুলোতে লাগল।

ভজন বলল ভুনু হাজারবার মানি, এ তোর আসল রাজারানি! জীবনে কোনওদিন এমন ঘোড়ার গাড়ি চাপিনি। তুই কি মন্তর জানিস্?

ভুনুর মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরুল না। মাদি ঘোড়াটা তার ঘাড়ের উপর দিয়ে এমনভাবে মাথাটা এলিয়ে দিল, দেখে ভুনুর বুকের মধ্যে টনটন করে উঠল। মনে হল তার মস্ত চোখ ফেটে এসে জলে পড়বে। ঘোড়ার মাথাটা দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বলল বহুত খলিফ হুয়া হ্যায়, না রানী!…মেরা রানী!..ক্যয়া বে রাজা চলনে কো তবিয়ত মাংতা? লাটবাবু মান গিয়া, তুম দুনো রাজারানী হ্যায়। বহুজিকে উঠতে বলো লাটবাবু।

কিন্তু ভজন বুঝল। কেমন করে যেন সে যুঁইয়ের প্রতিটি ঠোঁটের সঙ্কেতও বুঝতে পারে। বেরুতে গিয়ে সে শালীর দিকে ফিরে বলল, কোথায় আছে গৌর, নিতাই, চলো তো দেখে আসি।

শালীর ঠোঁটে বিদ্যুতের মতো হাসির ঝিলিক খেলে গেল। বোধ হয় আশা হল, জামাইবাবু থাকবে। কিন্তু কে সাহস করে একটা কথা বলবে ওই মুখের দিকে তাকিয়ে। মুখ নয়, আগুন।

সিঁড়ি দিয়ে উপরে এল ভজন শালীর সঙ্গে। দেখল ঘুমিয়ে আছে তার ছেলে গৌর আর নিতাই। ফরসা আর কালো, পাশাপাশি দুই ছেলে। প্রথম ছেলে গৌর, সে পেয়েছে বাপের বর্ণ ও মুখ। পিতৃমুখ ছেলে নাকি সুখী হয় না। মাতৃমুখ নিতাই। ছেলে তো নয়, যেন বাচ্চা মেয়ে যুঁই। নিতাই সুখী হবে তো!

ঘুমন্ত ছেলে দুটোর দিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যে টনটন করে উঠল ভজনের। ওরা যে মাতালের ছেলে। যার ভবিষ্যৎ নেই, তারই ছেলে। কী আছে ওদের ভবিষ্যৎ জীবনে। সে নিজে অভিশপ্ত, অভিশপ্ত তার শ্রীমতী কাফে। ওদের জীবনে শাপমুক্তি ঘটবে তো!

ভজন ওদের ঘুমন্ত গায়ে হাত বুলিয়ে দিল। দমকা নিশ্বাস পড়ল ছেলেদুটোর।

ভজন উদগত নিশ্বাস চেপে বেরিয়ে এল! ওরা ভয় পাবে ওদের বাপকে দেখলে। কাঁদবে।

জামাইবাবুর এ নিঃশব্দ হাত বুলোনো দেখে শালীরও বুকের মধ্যে অজান্তে মোচড় দিয়ে উঠল। তবু কথা তার বলতে বাধল। সে আলো নিয়ে নেমে এল সঙ্গে।

ভজন আর কোনওদিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে গেল।

বহুজি যাবে না রে সারথী। এ যাত্রা হরণ করা হল না। বউ আঁতুড় ঘরে। তুই আর আমি-ই যাব। বলে সে ভিতরে যেতে গিয়ে থেমে আবার বলল, ভুনু, তোর মত সারথী পেয়েছি, আজ তোর পাশে বসে যাব।

ভুনু না বলে পারল না, তুমি সাথী পেলে, আর হামার রাজারানীর জিন্দেগী চার সাল মে, দু সাল বিতৃ গেল। মগর আফসোস নেই।

মনে মনে বলল, শালা একেই বোধ হয় বলে তেজপক্ষের বউয়ের ভাইয়ের মরজি রাখা। রাগটা অবশ্য তার নিজের উপরেই হল।

দুজনেই তারা উপরে গিয়ে বসল। গাড়ি চলল ট্যাঙস ট্যাঙস করে।

সামনে অন্ধকার রাতও মন্দ হয়নি। আকাশের তারা হাসছে যেন ওড়নার আড়াল থেকে। জোনাকি জ্বলছে, উড়ছে।

ভুনু গাড়োয়ান আর ভজুলাট পাশাপাশি, গায়ে গায়ে বসেছে। কেউ কথা বলছে না।

পেছনে শাশুড়ি, শালাজ, শালী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। অবাক কাণ্ড! এমন মানুষ তারা কোনওদিন দেখেনি। আর যুঁই ভাবছিল, তবু তো সে এসেছিল। আশ্চর্য! এসেছিল আজকেই, এখুনি। যখন সে মনে মনে শুধু তাকেই ভাবছিল। সেই নিষ্ঠুর মানুষটিকে। সেইজন্যই এ কান্না রোধ করা যায় না।

দুদিন পর রাত্রি একটা বেজে গিয়েছে। চারিদিক নিস্তব্ধ। অন্ধকার। শ্রীমতী কাফের সামনে রাস্তাটা ফাঁকা। একটা ছেড়ে দেওয়া নির্জীব ঘোড়া, ঘোড়ার গাড়ির আস্তানার কাছে পড়ে থাকা দু চারটে ছোলা চিবুচ্ছে।

শীত পড়ছে একটু একটু করে। কেরোসিনের ল্যাম্প চিমনিতে হিম পড়ে ঝাপসা হয়ে উঠেছে।

বাতি জ্বলছে শ্রীমতী কাফের পেছনে। এত রাত্রে বাতি জ্বলে না, আজ জ্বলছে। বিশে বমি করার জন্য বাতি জ্বেলে উঠে এসেছে নর্দমার কাছে। আর উঠতে পারছে না। ওইখানেই মাটির উপর এলিয়ে রয়েছে। তার মাথা ঘুরছে। শিথিল হয়ে আসছে হাত পা।

শুধু বমি। বিশে প্রথমে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ভাবল রক্তবমি হচ্ছে। কিন্তু রক্ত নয়, খয়েরি রং এর এক অসহ্য একটু স্বাদ-যুক্ত শুধু জল। ভীষণ দুর্গন্ত। তার সঙ্গে আবার একটা অ্যালকোহলিক ফজ। এক একটা উৎকট শব্দের সঙ্গে ভলকে ভলকে বমি আসছে তার।

মাথা আর ওঠানো যাচ্ছে না। সে একবার ওঠার চেষ্টা করল, পারল না। চুড়ান্ত সিদ্ধির নেশার মতো তার মাথাটা ঘাড় থেকে যেন ছিটকে পড়বার উপক্রম করল। চোখের সামনে সব ঘুরছে, ঝাপসা হয়ে আসছে। পেটের তলা থেকে যেন কোনও ঘাপটি মারা জানোয়ার হঠাৎ মাথা তুলে সব উপর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ড সুদ্ধ গলা দিয়ে বেরিয়ে আসবে।

বিশের কোটরাগত চোখে ভয় দেখা দিল। সে দেখল, কে যেন বাতিটা কমিয়ে দিচ্ছে। অন্ধকার হয়ে আসছে। প্রাণের ভয়ে চিৎকার করে উঠল সে, ঠাকুর, ঠাকুর বাঁচাও। সে চিৎকার তার নিজের কানেও পৌছুল না। তবু সে চিৎকার করছে। একটা গোঙানির শব্দ বেরুচ্ছে তার গলা দিয়ে।

হুড় হুড় করে কলের জলের মতো ঠোঁটের কষ বেয়ে বিষাক্ত তরল পদার্থ বেরিয়ে আসছে। মাটিতে গড়িয়ে পড়ে তার গা ভিজে যাচ্ছে। মাটিতে গোঁজা মুখ মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে।

বিশের চোখের সামনে ভাসছে মস্ত বড় জামবাটির এক বাটি মাংস, অনেকখানি ডাল, আর এক থালা জল দেওয়া গলে গলে ভাত। মাংস আর ডাল হুঁকো টলে। বিয়েছিল খেতে, বাজারের হোটেলের বামুনটা। চেয়েছিল বিশে, তাই দিয়েছিল। একবার মনে হয়েছিল সবই যেন পচা পচা। কিন্তু খাওয়া দেখলে সে গন্ধ মানে না। জিভের স্বাদ মানে না। শুধু খাবার। মাংস, ডাল, ভাত।

নাকের কাছে যেন কীসের সুড়সুড়ি লাগছে। সাড় আছে তার এখনও। সে দেখতে চেষ্টা করল; কিন্তু দেখতে পেল না। অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। কে আরও কমিয়ে দিচ্ছে বাতিটা।

ছুঁচো শুকছে তার নাকের কাছে। নির্ভয়ে চিকচিক শব্দ করে, ছুঁচলো লালচে ঠোঁট কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে। ইঁদুর পালাচ্ছে তার গায়ের উপর দিয়ে। যার দাপটে এ ঘরে ইঁদুর ছুঁচোর দৌরাত্ম্য করার কোনও জো ছিল না।

ভয়ের চেতনা স্তিমিত হয়ে আসছে বিশের। নতুন চেতনা আসছে। সে বাঁচতে চাইছে। সে যেন কেমন করে বুঝেছে যে, সে মরে যাচ্ছে। তাই সে বাঁচবার জন্য ভেতরে ভেতরে নিজেকে ঠেলা দিয়ে উঠিয়ে দিতে চাইছে।

মায়ের মুখটা মনে পড়ছে তার। মনে পড়ছে বাবার কথা, তার শৈশবের কথা। গঙ্গার ওপারে, মগরার কাছে এক গ্রাম। মুচিপাড়ার ছেলে বিশ্বনাথ। হারুচির প্রথম ছেলে। কালো, হোঁকা, এই এতবড় ছেলে। যেন কালো কুলো বাবা বিশ্বনাথটি। ছেলেকে কী করবে হারু? ঢুলি? ঢোল বাজাবে। ওমা! ছেলের হাতে পায়ে একটু ক্ষমতা হতে না হতে ছেলে আপনি আপনি বেরিয়ে গেল। খেতে পায় না যে! মা মারে, বাপে মারে। বাবা বিশ্বনাথ গঞ্জে হাটে ভিক্ষে মেগে বেড়ায়, এটা সেটা হাত ছাপিয়ে নিয়েই মুখে পুরে দেয়। মার খায়, তবুও। ঘরেও তাই। সেই রূপকথার পিঠের ছ্যাক ছ্যাক শব্দ গোনার মতো। আড়ালে আবডালে লুকিয়ে দেখে, মা কী চড়িয়েছে উননে। পেট ভরে তো দেবে না। তাই চুরি করে খায়। বিশ্বনাথ নয়, বিশে রাক্ষস। বাপ মা মরে গেল, রইল খালি বিশে। অনেক ঘাট ঘুরে এখানে। এটার কী নাম! নাম জানে না দোকানের। বেরোয়মুখ দিয়ে। খালি জানে ভজনকে। ভজন নয়, ঠাকুর, লাটঠাকুর।

মনে হল ঘুম আসছে বিশের। বমি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবে ভাল হয়ে যাবে? বোধ হয় তাই। এ যাত্ৰা বুঝি বেঁচে গেল।

কী বলেছিল ঠাকুর কালকে। কালকে আবার তাকে বলেছিল ঠাকুর, বিশে পেটে যার খিদে, ওরা সবাই তোর মতো রে। জন্ম থেকে না খেয়ে খেয়ে, খিদে তোর বাই হয়ে গেছে। একদিন কেটে যাবে এ স্বভাব। বলেছিল, খিদে যার পেটে, তার যে ভগবানও নেই, জাত নেই, দেশ নেই। তার মনুষ্যত্বও থাকে না। আর কী বলেছিল, সে সব বোঝেনি বিশে। বোঝা যায় না। মাতালের কথা কি না।

হঠাৎ বিশের কালো চামড়া কুঁচকে গা হাত পা বেঁকে উঠল। মনে হল, পেটের ভেতরে, যা কিছু আছে, সব দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসছে। উঁচ বিঁধছে মাথার মধ্যে। চোখ ফেটে বেরিয়ে আসছে।

না না, এ যাত্রাটা বাঁচতে দাও। আমার এ স্বভাব কেটে যাবে। আমি অন্য মানুষ হব। ভাল মানুষ, আর একটা মানুষ। এক জন্মে নতুন জন্ম হবে আবার। মানুষের মতো। এখনও কত বাকি। মানুষের মতো, বিয়ে-ঘর-সংসার।

মা এসেছে। মাগো! আমি আবার বাঁচতে চাই। উড়ে ঠাকুর, আর কোনওদিন তোমার কাছে খেতে চাইব না, মাইরি লাট ঠাকুর! একবার তোমার খোস, রাক্ষস, হারামজাদা শুয়োর, হা-ভাতে বিশের কপালে পা ছুঁইয়ে দিয়ে যাও। এ যাত্রা রেখে দাও আমাকে।

বিশের গলা দিয়ে একটা অস্বাভাবিক আ আ শব্দ হতে হতে হঠাৎ থেমে গিয়ে তার নাক দিয়ে মুখ দিয়ে তীব্র বেগে খয়েরি বিষাক্ত দুর্গন্ধ তরল পদার্থ কাঁচা এবড়ো-খেবড়ো মেঝেটাকে একেবারে ভাসিয়ে দিল।

হুস করে একটু হাওয়া এল। ঠাণ্ডা হাওয়া। বাইরে রাত কাবার হয়ে আসছে। পূর্ব দিগন্তে আকাশের কোল দেখা যাচ্ছে। ডাইনে একটা মেল ট্রেন এসে দাঁড়িয়েছে। যাত্রীরা নামছে। উঠছে না কেউ শুধু নামছে। স্টেশনে কলরব শোনা যাচ্ছে।

শিশির পড়ছে। শিশির জমে উঠেছে শেষ রাত্রে স্টেশনের শেডে, রাস্তার ধারে, অশখের পাতায়। পাতা থেকে টপটপ করে জল ঝরছে। শ্রীমতী কাফের বিরাট সাইনবোর্ডের গায়ে জমা শিশির বিন্দু থেকে ফোঁটা হয়ে ঝরে পড়েছে।

রথীনের সঙ্গে আরও দুটি ছেলে ছড়িয়ে পড়েছে এ-দিকে ও-দিকে। দেওয়ালে দেওয়ালে, গাছে গাছে, সেঁটে দিচ্ছে কাগজ। ছোট ছোট কাগজ, হাতে লেখা কার্বন কপি। তাতে লেখা রয়েছে, সম্পূর্ণ নতুন কথা। এ অঞ্চলের মানুষের চোখে কখনও এরকম ভাষা আর চোখে পড়েনি। লেখা রয়েছে,

আরউইনের প্রস্তাবিত স্বায়ত্তশাসন কেবল ধোঁকাবাজি।

লর্ড আরউইন ধ্বংস হোক। সর্বহারা বিপ্লব ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা আনবে। অস্ত্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভূত্থান চাই। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক।

বন্দেমাতরম্!

শ্ৰীমতী কাফের পেছনের ঘরে বাতিটা জ্বলছে লাগল। ঘরটা যেন একটা জেলখানার সেলের মতো শ্বাসরোধী হয়ে উঠেছে। বোবার উৎকট চাউনির মতো সমস্ত ঘরটা হাঁ করে তাকিয়ে আছে। খুঁটে, কয়লা, জলের জালা, উনুন, মাকড়সার ঝুল, সব নিঃশব্দ, আড়ষ্ট কিন্তু প্রাণবন্ত। বিশের বাঁচতে চাওয়ার তারা বোবা সাক্ষী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *