1 of 2

৩৮. যখন আবারো ইতিহাসের চাকা ঘুরল

অধ্যায় ৩৮ – যখন আবারও ইতিহাসের চাকা ঘুরল

খ্রিস্টপূর্ব ১২১২ থেকে ১১৯০ সালের মধ্যে অ্যাসিরীয়রা হিট্টিট, ব্যাবিলনীয় ও এলামাইটদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। অপরদিকে, মিশরের ১৯তম রাজবংশ কিছু পিছু হটে পশ্চিমের দিকে সরে যায়। জোড়াতালি দেওয়া হিট্টিট সাম্রাজ্যেও ছেঁড়া-ফাটা দেখা দিয়েছে ততদিনে।

মিশরীয় ও হিট্টিটদের মধ্যে চুক্তি তখনও কার্যকর ছিল। মিশর কাদেশ পর্যন্ত পশ্চিমা সেমাইটদের ভূমি শাসন করত আর হিট্টিটরা আরও উত্তরের শহরগুলোর দখল নিয়েছিল। রামসেস দ্বিতীয়র মৃত্যুর পর তার বর্ষীয়ান পুত্ৰ মেৰ্নেপতাহ সিংহাসনে বসলেন। তিনি ছিলেন রামসেসের ১৩তম পুত্র। রামসেস জীবিত থাকতেই তার ১২ পুত্রসন্তান পরলোকগমন করেন। নতুন ফারাওর ক্ষমতায় আসার সংবাদে উত্তরের কিছু মিশরীয় প্রদেশ বিদ্রোহ করার চেষ্টা করে। কিন্তু দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী মিশরীয় বাহিনী তাদেরকে খুব সহজেই ধ্বংস করে।

ইতোমধ্যে হিট্টিটরা খরায় আক্রান্ত হয়েছে। শস্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, গবাদি পশুদের মৃত্যু হচ্ছিল গণহারে। গ্রামবাসীদের পেট ক্ষুধার আগুনে দাউদাউ করে জ্বলছিল। সেসময় হিট্টিট রাজধানী থেকে মিশরের রাজদরবারে পাঠানো এক চিঠিতে জানা যায়, ফারাও রাজা এক হিট্টিট রাজকন্যাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে সে চিঠিতে আর্জি জানানো হয়, ফারাও যেন দ্রুত এসে তার স্ত্রী ও যৌতুক হিসেবে নির্ধারিত গবাদি পশুগুলোকে নিয়ে যান। কারণ খুব শিগগির হিট্টিটদের আস্তাবলে আর কোনো খাদ্যশস্য থাকবে না আর ‘যৌতুক’গুলো না- খেতে পেয়ে মারা যাবে!

হাউসিলিস তৃতীয় তার ছেলে তুধালিয়াকে তার নিজস্ব দেহরক্ষীদলের প্রধানের পদ দেন। এর মাধ্যমে তিনি তার পিতার শতভাগ আস্থা পেলেন (এ বিষয়টি হিট্টিট রাজপরিবারে খুব একটা দেখা যেত না)। যখন হাটুসিলিস তৃতীয় মারা গেলেন, তার পুত্র রাজা হলেন এবং তার নাম হল ‘রাজা তুধালিয়া চতুর্থত। তবে রাজত্বের পাশাপাশি তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে একটি দুর্ভিক্ষও পেলেন। প্রতি বছর এই দুর্ভিক্ষের রূপ আরও খারাপ হতে হচ্ছিল।

দুর্ভিক্ষের সমাধানে তুধালিয়া মিশরের রাজার কাছে খাদ্যসহায়তা চেয়ে চিঠি পাঠালেন। পিতার সিংহাসনে ছিলেন মেরনেপ্তাহ। তিনি দুই জাতির ঐতিহাসিক চুক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলেন। শিলালিপিতে জানা যায় তিনি তুধালিয়ার দেশকে বাঁচিয়ে রাখার মতো যথেষ্ট পরিমাণ শস্য পাঠিয়েছিলেন। তুধালিয়া তার শাসনাধীন একটি শহরের কাছে শস্য পরিবহণের জন্য জাহাজ চেয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন, যেখানে জানা যায় প্রতি চালানে প্রায় ৪৫০ টন শস্য এসেছিল।

তারপরেও হিট্টিটদের গোলাঘরগুলো মোটামুটি শূন্যই ছিল।

যে রাজাকে শুধুমাত্র তার দেশের মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিদেশি রাষ্ট্রের কাছে হাত পাততে হয়, নিঃসন্দেহে সে রাজার অবস্থান বেশ নড়বড়ে ছিল। সেসময় থেকে হিট্টিটদের ভাগ্যের চাকা স্তিমিত হয়ে পড়ে, তাদের শ্রেষ্ঠত্ব হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। যে রাজ্যের খাদ্যশস্য নেই, সে রাজ্যের কোনো টাকাপয়সাও নেই। যে রাজ্যের টাকা নেই, সে রাজ্যে যোদ্ধারাও একেবারে শেষমুহূর্তের আগে বেতন-ভাতার দেখা পান না, বা পেলেও, তাদের কাজ অনুযায়ী পান না। কম বেতনে কাজ করা সেনারা সবসময়ই নিয়মিত বেতনভোগী সেনাদলের তুলনায় যুদ্ধক্ষেত্রে সুশৃঙ্খলতার অভাব দেখায়। হিট্টিট সেনাবাহিনীতেও এ সমস্যা দেখা দিয়েছিল।

তবে তুধালিয়া নিজে ছিলেন একজন অভিজ্ঞ যোদ্ধা ও দক্ষ সেনাপ্রধান। তিনি ১২ বছর বয়সে তার পিতার সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রথমবারের মতো যুদ্ধে গেছিলেন। কিন্তু দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্যের পাশাপাশি, তাকে সিংহাসনের নিরাপত্তা নিয়েও ভাবতে হত। তার পিতা আগের রাজাকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন, এবং রাজত্বে তখনও আগের রাজার প্রচুর রক্তসম্পর্কের আত্মীয়স্বজনের আনাগোনা ছিল। এক চিঠিতে তিনি ‘সুপ্পিলুলিউমা, মুর্সিলি, মুওয়াতাল্লি ও হাউসিলির অসংখ্য বংশধরদের’ নিয়ে অভিযোগ করেন।

নিজেকে রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ‘তুধালিয়া চতুর্থ’ স্থাপত্য শিল্পে মনোযোগ দেন। তিনি তার রাজধানী শহরের বড় আকারের সম্প্রসারণ করেন এবং অসংখ্য নতুন মঠ, ২৬টি মন্দির এবং আরও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেন। এছাড়াও পুরনো শহরের আকারও দ্বিগুণ করেন তিনি।

এ-ধরনের বড় আকারের অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প ছিল প্রাচীন মিশরীয়, মহান রাজাদের জন্য খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে তুধালিয়া সদ্য-দেহত্যাগ-করা মিশরীয় রাজা রামসেস দ্বিতীয়কে অনুকরণের চেষ্টা করছিলেন।

তবে নতুন এসব স্থাপনা তুধালিয়ার রাজকীয় ‘ব্র্যান্ডিং’-এ সহায়তা করলেও প্রকারান্তরে তিনি তার রাজকোষ খালি করে ফেলেছিলেন। যে রাজ্য ইতোমধ্যে দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষের কশাঘাতে জর্জরিত, তিনি সে-রাজ্যের সব সম্পদ খরচ করছিলেন অবকাঠামো নির্মাণে। ফলে হিট্টিট সৈনিকদের বেতন দেওয়ার মতো যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ তার হাতে ছিল না।

যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বিভিন্ন গোত্রের মানুষ হিট্টিট রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তারা দেখতে লাগল, বছরের পর বছর দেশের সেনাবাহিনী দুর্বল হচ্ছে। তুধালিয়া তার শাসন কায়েম করার অল্পদিনের মধ্যেই জানতে পারলেন, রাজত্বের পশ্চিমপ্রান্তের ২২টি শহর তার বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। তিনি সেনাবাহিনী নিয়ে স্বয়ং পশ্চিমে হাজির হলেন, এবং এই জোটকে ছত্রভঙ্গ করে দিলেন। তবে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে, লাশের গন্ধ পেয়ে আকাশে শকুন-শকুনি ওড়া শুরু করে দিয়েছে!

অ্যাসিরীয়ার নতুন রাজা তার রাজত্বকে সম্প্রসারণের একটি সুবর্ণ সুযোগ খুঁজে পেলেন। শালমানেসের প্রথম ইতোমধ্যে মিটানিদের পুরনো ভূখণ্ডগুলো দখল করে নিয়েছিলেন। এবার তার ছেলে, তুকুলতি-নিনুরতা হিট্টিট রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে হামলা চালালেন।

তুধালিয়া তার প্রতিরক্ষাবাহিনীকে শত্রুর ভূখণ্ড পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন এবং দুই দেশের সেনাবাহিনী এরবিলার সমতলভূমিতে মুখোমুখি হল। আমরা যদি অ্যাসিরীয়দের বর্ণনা বিশ্বাস করি, তাহলে বলতে হয়, তুধালিয়া এ যুদ্ধজয়ের সম্ভাবনা নিয়ে খুব একটা নিশ্চিত ছিলেন না।

যুদ্ধের আগে তুকুলতি-নিনুরতার সঙ্গে তুধালিয়ার চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ হয়। তিনি সেই চিঠি প্রসঙ্গে তার অপর এক মিত্রকে বিস্তারিত জানিয়ে আরও একটি চিঠি পাঠান। সেই চিঠি ইতিহাসবিদরা উদ্ধার করেন। অ্যাসিরীয় রাজার বর্ণনা মতে :

তুধালিয়া আমাকে জানালেন, আপনি এমন কিছু বণিকদের বন্দি করেছেন, যারা আমার প্রতি বিশ্বস্ত ছিল। আসুন, আমরা যুদ্ধ করি। আমি আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উদ্দেশে রওনা হয়েছি।

আমি আমার সেনাবাহিনী ও রথগুলোকে প্রস্তুত করলাম। কিন্তু তার শহরে পৌঁছানোর আগেই হিট্টিটদের রাজা তুধালিয়া আমার কাছে এক দূত পাঠালেন, যার হাতে ছিল ৩টি ট্যাবলেট। ২টি ট্যাবলেটে আক্রমণাত্মক কথাবার্তা ছিল। দূত আমাকে সেই ট্যাবলেটগুলো প্রথমে দেখায়। আমার সেনাবাহিনী সেসব কটু কথাবার্তা শুনে নিমিষেই আক্রমণ করার জন্য অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে। তবে তৃতীয় ও সর্বশেষ ট্যাবলেটের বার্তা শুনে সবাই অবাক হয়ে গেল। তুধালিয়া বলেন, ‘আমি আমার ভাই আসসুরের রাজার প্রতি বিরূপ নই। তাহলে কেন ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ হবে?’

কিন্তু আমি তার কথায় পাত্তা না দিয়ে সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হতে লাগলাম। তুধালিয়া তার সৈন্যদের নিয়ে নিহরিজা শহরে ঘাঁটি গেড়েছিল। আমি তাকে বার্তা পাঠালাম, ‘আমি এখন এ শহরে হামলা চালাব। তুমি যদি প্রকৃতপক্ষে আমার প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে থাকো, তাহলে এ মুহূর্তে এ শহর ছেড়ে চলে যাও।’ কিন্তু সে আমার এই বার্তার কোনো উত্তর দেয়নি।

আমি আমার সেনাদলকে শহর থেকে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলাম। তখন এক পলাতক হিট্টিট সেনা তুধালিয়ার ঘাঁটি থেকে পালিয়ে এসে আমার কাছে পৌঁছলও। সে আমাকে জানাল, ‘রাজা তোমাকে চিঠি লিখে বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠার নামে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার সেনারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত আছে। যে-কোনো মুহূর্তে হামলা আসবে।’

ফলে আমি আমার সেনাদের ডাক দিলাম আর তুধালিয়ার বিরুদ্ধে আক্রমণ চালালাম। আমি বেশ বড়সড় জয় পেলাম।

.

তুকুলতি-নিনুরতা পরবর্তীতে গর্ব করে ঘোষণা দেন তিনি ২৮ হাজার ৮০০ হিট্টিট সেনাদের আটক করেছেন, যা অবিশ্বাস্য একটি সংখ্যা। তবে নিঃসন্দেহে তিনি হাজারো হিট্টিট সেনাকে আটক করে অ্যাসিরীয়াতে ফিরিয়ে এনেছিলেন। সে-যুগে দখল-করা রাষ্ট্রের বাসিন্দাদের নিজের শহরে নিয়ে আসার রেওয়াজ ছিল। এতে সেই জাতির মানসিক দৃঢ়তা কমে যেত এবং তারা হঠাৎ করে বিদ্রোহ করার সাহস পেত না।

এই যুদ্ধ প্রাচীন পৃথিবীতে যথেষ্ট সাড়া ফেলতে পেরেছিল। গ্রিকদের সবচেয়ে পুরনো বইগুলোতেও তুলিতি-নিনুরতার উল্লেখ রয়েছে। গ্রিকরা তাকে নিনাস নাম দেন এবং তাকে সার্ভিসের দূরসম্পর্কের আত্মীয় হিসেবে চিত্রায়িত করে। তারা হিট্টিট রাজ্যে তুকুলতি-নিনুরতার অভিযানের একটি ঈষৎ-বিকৃত রূপ লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

তুধালিয়া যুদ্ধে হেরে নিজের রাজধানীতে ফিরে গেলেন। শারীরিকভাবে অক্ষত থাকলেও তাকে তার রাজত্বের বাইরের অংশের মায়া ত্যাগ করেই ঘরে ফিরতে হল। ততদিনে বিষয়টা পরিষ্কার; এককালের প্রতাপশালী হিট্টিট বাহিনীর শক্তিমত্তা ক্ষয়ে যাচ্ছিল। উগারিতের তত্ত্বাবধায়ক শাসকের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে তুধালিয়া অভিযোগ করেন, উগারিত হিট্টিটদের মূল সেনাবাহিনীতে যথেষ্ট পরিমাণ সেনা পাঠায়নি। তিনি এমনকি এটাও জিজ্ঞাসা করলেন : উগারিত কি নিজ সেনাবাহিনী সুসংহত করে বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিচ্ছে? আরেক ট্যাবলেটে জানা যায়, কারচেমিশ শহর থেকে আসা অসংখ্য জাহাজ নৌযাত্রার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ, তুধালিয়ার রাজত্বের বাইরের অংশগুলো একে একে ঝরে পড়ছিল।

ইতোমধ্যে ঘরে ফিরে তুকুলতি-নিনুরতাও দক্ষিণ থেকে আসা নতুন এক সমস্যার সম্মুখীন হলেন।

অ্যাসিরীয়ার সঙ্গে ব্যাবিলনের সম্পর্ক কখনোই খুব বেশি ভালো ছিল না।

তারা বিভিন্ন সময় একে অপরকে শাসনের চেষ্টা চালিয়েছে। ব্যাবিলন ও আসসুর শুধুমাত্র শক্তিমত্তার দিক দিয়েও একইরকম ছিল, তা নয়। এই দুই দেশের ঐতিহ্যও অনেকটাই একইরকম ছিল।

হাম্মুরাবির শাসনামলে এই দুইটি দেশই একই রাজত্বের অংশ ছিল। উভয় অঞ্চলের ওপর ব্যাবিলনের প্রভাব সুস্পষ্ট ছিল। অ্যাসিরীয়া ও ব্যাবিলনের দেবতাগুলোও প্রায় একই। মাঝে মাঝে শুধু তারা দুই দেশে ভিন্ন নাম নিয়েছেন। দেবতাদের গল্পগুলোও একইরকম এবং উভয় জাতিই তাদের লেখালেখি ও খোদাইয়ের কাজের জন্য কুনেইফর্ম ব্যবহার করেছেন।

এত মিল থাকার কারণে সাধারণত অ্যাসিরীয় রাজারা ব্যাবিলনে হামলা ও লুটপাট চালাতে আগ্রহী হতেন না। এমনকি, সুযোগ পেলেও না। কিন্তু তুকুলতি- নিনুরতা যুগ যুগ ধরে চলে আসার রীতি মানতে খুব বেশি আগ্রহী ছিলেন না। তিনি গর্ব করে বলেছেন (যা শিলালিপিতে ধারণ করা হয়েছিল), যারা তাকে অমান্য করার দুঃসাহস দেখিয়েছে, তিনি পর্বতের গুহা ও গিরিখাতগুলোতে তাদের মরদেহের স্তূপ তৈরি করেছেন।

‘হঠাৎ দেখলে মনে হবে ফটকের পাশে শস্যদানা স্তূপ করে রাখা হয়েছে। আমি তাদের শহরগুলো ধ্বংস করেছি এবং সেগুলোকে ধ্বংসস্তূপে রূপান্তরিত করেছি’, যোগ করেন তিনি।

তুকুলতি-নিনুরতা উত্তরে হিট্টিটদের নিয়ে ব্যস্ত আছে, এই ধারণা মনে নিয়ে ব্যাবিলনের রাজা অ্যাসিরীয় ও ব্যাবিলনীয় সীমান্তে কিছু বিতর্কিত ভূমি দখল করে নেওয়ার চেষ্টা চালান। কাশটিলিয়াশ চতুর্থ নামের এই রাজার বিষয়ে আমরা প্রায় কিছুই জানি না। তবে তার কার্যক্রম থেকে আমরা বুঝতে পারি, তিনি মানুষ চিনতে খুব একটা পারদর্শী ছিলেন না। তুকুলতি-নিনুরতা ঝামেলার আভাস পেয়ে দক্ষিণে রওনা হলেন এবং ব্যাবিলনের মন্দিরগুলো লণ্ডভণ্ড করে রেখে আসলেন। এ কাজের মাধ্যমে তিনি বহুযুগ ধরে পালন হয়ে আসা একটি অ্যাসিরীয় ঐতিহ্য ভঙ্গ করলেন—ব্যাবিলনের পবিত্র স্থাপনায় হামলা করলেন তিনি। তিনি এমনকি মন্দির থেকে দেবতাদের ছবিগুলোও সরিয়ে নিলেন, যেটা খুবই বিপজ্জনক একটি কাজ ছিল, কারণ ধারণা করা হত এ-ধরনের কাজে অ্যাসিরীয় দেবতারাও অসন্তুষ্ট হবেন। এ ঘটনার বর্ণনায় আমরা জানতে পারি, ‘তিনি মহান দেবতা মারদুককে তার থাকা জায়গা থেকে সরিয়ে নিলেন। তিনি আসসুরের পথে মারদুককে ছেড়ে দিলেন।’

যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি স্বয়ং ব্যাবিলনের রাজার মুখোমুখি হন। শিলালিপির তথ্য অনুযায়ী, ‘যুদ্ধের মাঝে আমার হাত কাশতিলিয়াশকে পাকড়াও করল। আমি তার রাজকীয় গলায় পা দিয়ে চাপতে লাগলাম। আমি সুমের ও আক্কাদ পর্যন্ত আমার সীমানা বিস্তার করলাম। উদীয়মান সূর্যের নিম্নগামী সমুদ্র পর্যন্ত আমি আমার ভূখণ্ডকে প্রতিষ্ঠা করলাম।’

তারপর তিনি নিজেকে ব্যাবিলন ও অ্যাসিরীয়ার রাজা হিসেবে ঘোষণা দিলেন। ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো এই দুই রাজত্ব একীভূত হল।

তুকুলতি-নিনুরতা ব্যাবিলনের পরাজিত রাজা কাশতিলিয়াশকে নগ্ন ও শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় আসসুরে ফিরিয়ে আনলেন। তিনি ব্যবিলনকে একজন অ্যাসিরীয় প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে ছেড়ে দিলেন।

যুদ্ধের ফল হিসেবে অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের সীমান্ত পশ্চিমের সেমাইটদের ভূমির উত্তর অংশ থেকে শুরু করে একেবারে দক্ষিণে মেসোপটেমিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হল। তুকুলতি-নিনুরতা পুরো অঞ্চলের একমাত্র প্রভাবশালী রাজা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার পর রাজা-সুলভ কাজ শুরু করলেন। তিনি নতুন মন্দির বানালেন। আসসুরের প্রাচীরকে আরও শক্তিশালী করলেন, নিজের জন্য সম্পূর্ণ নতুন একটি রাজকীয় শহর বানালেন। এই শহরটি আসসুর থেকে কিছুটা উত্তরে ও আকারে কিছুটা ছোট ছিল। এ শহরের নিজস্ব পানি সরবরাহ ও কারাগার ব্যবস্থা ছিল। এটি রাজধানীর ওপর নির্ভরশীল ছিল না। স্বয়ংসম্পূর্ণ এ শহর চালানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ কর্মীও নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

তুকুলতি-নিনুরতা দাবি করেন, দেবতা আসসুরের মনের ইচ্ছা হচ্ছে তিনি একটি নতুন শহর নির্মাণ করেন, যেখানে ‘নেই কোনো বাড়ি কিংবা থাকার জায়গা।’ কিন্তু নিজেকে প্রাচীরের পেছনে, আসসুরের জনমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার—সবকিছু তার পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছিল না। ব্যাবিলনের মানুষ মন্দিরে হামলার ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ে।

ব্যাবিলনের ঘটনাপঞ্জি মতে, ‘তিনি ব্যাবিলনকে তরবারির অগ্রভাগে এনেছিলেন। তিনি ব্যাবিলনের ঐশ্বর্যগুলোকে অপবিত্র করেন এবং মহান দেবতা মার্দুককে অ্যাসিরীয়া থকে বিতাড়ন করেন।’

তুকুলতি-নিনুরতার স্পর্ধামূলক কাজ অ্যাসিরীয়ার ধর্মপ্রাণ মানুষও সহজভাবে নিতে পারেনি। ব্যাবিলনের বিরুদ্ধে জয় উদযাপন উপলক্ষে তিনি যে বিজয়গাথা রচনা করতে বলেন, সেখানেও রয়েছে বেশি সন্ধিমূলক ভাব। সেখানে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, কীভাবে তিনি প্রকৃতপক্ষে ব্যাবিলনের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক ও কাশতিলিয়াশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। এই বিজয়গাথায় আরও দাবি করা হয়, ব্যাবিলনের রাজা স্বয়ং অ্যাসিরীয় অঞ্চলে এসে লুটপাট চালাতে চেয়েছিলেন, এবং এ-কারণেই ঈশ্বর ব্যাবিলন ছেড়ে চলে যান এবং অ্যাসিরীয়দের ওপর তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব অর্পণ করেন।

এখানে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, ‘মহান’ রাজা তুকুলতি-নিনুরতার ওপর প্রচণ্ড চাপ ছিল। কেন তিনি অলিখিত চুক্তি ভেঙে ব্যাবিলনে হামলা চালালেন, আর কেনই বা তিনি সে অঞ্চলের দেবদেবীদের সব নিদর্শন বহন করে নিজের শহরে নিয়ে এলেন—এর কোনোটারই সঠিক কোনো ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারেননি।

স্বভাবতই, এই দুর্বল ব্যাখ্যায় কোনো কাজ হয়নি এবং তুকুলতি-নিনু তার ধৃষ্টতাই তার পতনের কারণ হল। ব্যাবিলনের ঘটনাপঞ্জি আমাদেরকে আরও জানায়, ‘তুকুলতি-নিনুরতা, যিনি ব্যাবিলনে অশুভ শক্তিদের নিয়ে এসেছিলেন— তার ছেলে আর অ্যাসিরীয়ার অন্যান্য অভিজাত বংশের সদস্যরা বিদ্রোহ করে এবং তাকে সিংহাসন থেকে উৎখাত করে তার নিজেরই প্রাসাদের হাজতে ভরে রাখে। পরবর্তীতে তাকে একটি তরবারির কোপে হত্যা করা হয়। এই মহান রাজার শাসনামল ছিল ৩৭ বছর।’

তুকুলতি-নিনুরতার মৃত্যুর পর তার ছেলে সিংহাসনে বসে। তিনি তার পিতার কুকর্মগুলো মুছে ফেলার চেষ্টা চালান। তিনি ব্যাবিলনে মারদুকের মূর্তি ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু এতেও রাগান্বিত ব্যাবিলনীয়রা সন্তুষ্ট হয়নি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ব্যাবিলন বিদ্রোহে ফেটে পড়ে এবং অ্যাসিরীয় প্রশাসক নিজের প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাঁচেন। একজন অভিজাত কাসসাইট সিংহাসনের দখল নেন এবং শহরটিকে অ্যাসিরীয়দের আধিপত্য থেকে মুক্ত ঘোষণা করেন।

অ্যাসিরীয়দের এই দুর্বল অবস্থার আঁচ পেয়ে এলামাইটদের ঝুঁকি (যেটি আসলে কখনোই প্রশমিত হয়নি) আবারও জেগে ওঠে। তারা অ্যাসিরীয়ার পূর্ব সীমান্তে জড়ো হতে শুরু করে। তারা সুদূর নিপপুর থেকে সেখানে এসে দুই- দুইবার সীমান্তবর্তী শহরের অ্যাসিরীয় তত্ত্বাবধায়ক শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করতে সক্ষম হয়। তারা একইসঙ্গে ব্যাবিলনেও হামলা চালায়। তাদের ক্ষমতা এত জোরদার ছিল যে তারা ব্যবিলনের সড়কগুলোতে সেনাবাহিনী নিয়ে চলে আসে, মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায় এবং (আবারও) মারদুকের মূর্তি বেহাত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে। শিগগির এলামাইটরা বিজয়ীর বেশে সুসা শহরে চলে যায়। তারা হাম্মুরাবির আইনসংক্রান্ত স্টেলেটাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যায়, যেটি কয়েক হাজার বছর পর প্রত্নতত্ত্ববিদরা আবিষ্কার করেন। কিছুটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও তারা ব্যাবিলনের রাজাকে অপহরণ করে। তিনি মারদুকের মূর্তি বা হাম্মুরাবির আইনের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন এবং এ ঘটনার পর তার নাম ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যায়।

তুকুলতি-নিনুরতার ছেলের নাম ছিল আসসুরনাদিন-আপলি। সার্বিক বিবেচনায়, তিনি খুবই অগুরুত্বপূর্ণ একজন অ্যাসিরীয় রাজা। বিভিন্ন ধরনের গোলযোগের মধ্যে তিনি মাত্র ৩ বছর সিংহাসন ধরে রাখতে সমর্থ হন। আমরা তার মৃত্যুর ব্যাপারে তেমন কিছু জানি না, তবে এটুকু বোঝা যায়, এটি স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। তার দেহাবসানের পর তার ছেলে নয়, বরং ভাতিজা সিংহাসনে বসেন, যিনি মাত্র ৬ বছর শাসন করার পর অন্য এক চাচার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন। এই চাচাকেও ৫ বছর পর জোরপূর্বক (খুব সম্ভবত হত্যা করে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন একজন উৎখাতকারী ব্যক্তি। সিংহাসনের ওপর এই ব্যক্তির তেমন জোরালো কোনো দাবি ছিল না। তিনি দাবি করেন, তিনি তুকুলতি- নিনুরতার দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়র সন্তান।

অপরদিকে, ব্যাবিলনেও পরিস্থিতি খুব একটা উন্নত ছিল না। এলামাইটরা তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার পর তথাকথিত দ্বিতীয় ইসিন রাজবংশ ক্ষমতার দখল নেয়। এই রাজবংশের প্রথম ৪ শাসকের আসা-যাওয়ার মাঝেই ১৫ বছর চলে যায়—তারা তেমন কিছুই করতে পারেননি এ সময়ে।

হিট্টিটদের তুধালিয়া চতুর্থ মারা যান। সেসময়ের রাজাদের মধ্যে দুর্লভ হয়ে পরা ‘স্বাভাবিক, বার্ধক্যজনিত কারণেই তিনি মারা যান বলে ধারণা করা হয়। ততদিনে তুধালিয়ার রাজ্য একচিলতে ভূখণ্ডে পরিণত হয়েছে। সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভূমির দখল নিয়ে মারামারি-কাটাকাটি করতে থাকে তার ছেলেরা ও চাচাতো ভাইয়েরা।

মিশরের শাসকদেরও দিনকাল ভালো যাচ্ছিল না। বর্ষীয়ান মেরনেপতাহ’র মমিকরণ শেষ হতে-না-হতেই তার উত্তরসূরি নির্বাচন নিয়ে ঝামেলা দেখা দেয়। মেরনেপতাহ’র সহ-শাসক ও ছেলে সেতি দ্বিতীয়কে সাময়িকভাবে সিংহাসনচ্যুত করেন তার সৎভাই। ৩ বছর পর আবার সেতি ক্ষমতা ফিরে পান। অল্পদিন পরে তার মৃত্যু হয় এবং তার পুত্র শাসনভার পান। এই সন্তানও বেশিদিন বাঁচতে পারেননি। তার মমি পরীক্ষা করে ধারণা করা হয়, পোলিওতে আক্রান্ত হয়ে এই শাসক খুব অল্পবয়সে মারা যান। এ পর্যায়ে মৃত রাজার সত্মা তুয়োসরেত ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন এবং এরপর থেকে রাজার তালিকা পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে যায়। সমস্যা আরও ঘনীভূত হয় বদ্বীপ থেকে উঠে আসা যাযাবর লুটেরাদের আগমনে। পরবর্তীতে একটি প্যাপিরাস খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে বলা হয়েছিল, ‘খুব সহজেই মিশরের শাসনব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়। প্রতিটি মানুষকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। মিশরীয় ভূখণ্ড স্থানীয় যোদ্ধা-নেতাদের দখলে চলে যায়। তারা একে অপরের প্রতিবেশীকে কচুকাটা করছিলেন।’

এভাবেই দেশটির ১৯তম রাজবংশের কলঙ্কজনক সমাপ্তি হয়।

সমগ্র পৃথিবীকে যদি চাকা হিসেবে দেখা যায়, তাহলে বলা যায়, সেসময় চাকাটি প্রবল বেগে ঘুরছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে ক্ষমতার পালাবদল হয়। তবে এককভাবে কোনো রাজা বা সভ্যতা চাকার কেন্দ্রে বসতে পারেনি। কেউ উত্তরে, দক্ষিণে, পূর্বে বা পশ্চিমে বসে সেদিকে চাকাটিকে হেলে পড়তে বাধ্য করেন। কিন্তু খানিক বাদে অপরদিকে আরেকজন বসে ভারসাম্য এনে দেন।

সব মিলিয়ে, দশকের পর দশক চলতে থাকা যুদ্ধে সকল রাজত্বই দরিদ্র হয়ে পড়ে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *