অধ্যায় ৩৭ – ঋগ্বেদ
১২০০ সাল নাগাদ ভবিষ্যৎ ভারতের আর্যরা চীনের শ্যাং সাম্রাজ্যের মতো নদীর তীরে অবস্থিত বিভিন্ন উপত্যকা ও সমতলভূমিতে ছড়িয়ে যায়। তবে মজার বিষয় হল, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আর্য শাসকরা ইতিহাসের চোখ এড়িয়ে নিভৃতে থেকে যান। মাঝে মাঝে দুই-একজনের মুখচ্ছবি কোনো ইতিহাসের বইয়ের পাতায় ভেসে উঠলেও তাদের বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য আমরা জানতে পারিনি।
যে গোত্রগুলো নিজেদেরকে আর্য হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, তারা মূলত সিন্ধুনদের তীরে বসতি গড়ে। এসব এলাকায় আগে থেকেই যেসব মানুষ বসবাস করছিলেন, তাদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা ও বিয়েশাদি করে আর্যরা। ফলে তারা তাদের আত্মীয় হিসেবে বিবেচিত মিটান্নিদের চেয়ে অনেক দ্রুত বংশবিস্তার করছিল।
পরবর্তী ৩০০ বছরে আর্যরা বেশ জাঁকিয়ে বসে। নিজেদের এককালের যাযাবরজীবনকে ভুলে যেয়ে তারা হারিয়ে যাওয়া হরপ্পা সভ্যতার সদস্যদের মতো জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে থাকে। এমনকি, অনেকে ভুলেও যেতে থাকে যে, কোনো একসময় তারাও ভ্রাম্যমাণ, যাযাবর সম্প্রদায় ছিল। সংস্কৃত শব্দ ‘গ্রামা (বস্তুত বাংলা ‘গ্রাম’ শব্দটির আদি রূপ) একসময় ভিন্ন অর্থে ব্যবহার হত। এর মূল অর্থ ছিল ‘এমন একটি গোত্র যারা গরুর গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াত।’ কিন্তু যাযাবর থেকে থিতু হওয়ার পর শব্দটির অর্থ বদলে আজকের দিনের গ্রামের রূপ পায়।
আর্যরা তাদের যাযাবর পূর্বপুরুষদের বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য রেখে যায়নি। কিন্তু এটুকু জানা গেছে যে, খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ সাল নাগাদ তারা থিতু হয় এবং তাদের নিজস্ব শ্রুতি তৈরি হয়। ঋগ্বেদ বা রিগ বেদ হচ্ছে ভারতীয় ভক্তিমূলক শ্লোকের সবচেয়ে প্রাচীন সংকলন। কবিতার ছন্দে লেখা ঋগ্বেদ রচিত হয় প্রাচীন ভারতীয়দের নিজস্ব ভাষায়, যার নাম সংস্কৃত বা ইংরেজিতে সাংস্কৃৎ।
এই ঋগ্বেদ থেকে আমরা প্রাচীন আমলের আর্যদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাই।
ঋগ্বেদ রচনার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃতি ও ভারতীয় দেবদেবীদের আচার আচরণের ব্যাখ্যা দেওয়া। ঋগ্বেদের শেষের দিকের শ্লোকগুলো রচনার সময় আর্যদের পূজারিরা ঐশ্বরিক বিষয়ের বিশেষজ্ঞতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। পূজারিদের সন্তানরাও পূজারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন এবং তারা অন্য পূজারিদের কন্যাদের বিয়ে করতেন। ঋগ্বেদের ধর্মীয় কবিতাগুলো ছিল আর্যদের প্রথম লেখনী এবং পূজারিরা ছিলেন তাদের প্রথম, প্রকৃত অভিজাত সমাজের প্রতিনিধি।
প্রাচীন পৃথিবীর অন্য জাতিদের থেকে আর্যরা একদিক দিয়ে বেশ ভিন্ন ছিল। ভবিষ্যতের ‘ভারতীয়’রা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন বা সামরিক শক্তিমত্তার মাধ্যমে নয়, বরং ধর্ম ও দর্শনের মাধ্যমে একাত্ম হয়েছিল। রিগ বেদে দেবদেবীদের উপাসনার বিষয়ে অনেক কিছু জানা যায়। স্বভাবতই, ধর্মগ্রন্থের আদলে লেখা এই বইতে আর্যদের বিস্তৃত ভূখণ্ড সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। এই সংকলনটি ১০টি অধ্যায় বা চক্রে বিভক্ত, যেগুলোকে মান্ডালা বলা হয়। প্রতিটি মান্ডালাতে আছে দেবতাদের স্তুতিমূলক শ্লোক। এছাড়াও, বলিদান, উৎসর্গ ও অন্যান্য ধর্মীয় আচারের সময় শব্দ করে পড়ার জন্য অন্যান্য শ্লোকও রয়েছে এতে।
প্রাচীন ভারতের দেবদেবীরা ছিলেন প্রকৃতি-নির্ভর। আর্যদের উপাস্যদের মধ্যে ছিলেন আকাশের দেবতা বরুণ, রাতের আত্মা রাত্রি, আগুন-দেবতা অগ্নি, ‘গাছ ধ্বংসকারী’ বৃষ্টির দেবতা পার্জন, সূর্যদেব মিত্র, গোলযোগ দূরীভূত করার দেবতা ইন্দ্ৰ। ঘটনাচক্রে ইন্দ্র, বরুণ ও মিত্র মিটান্নি রাজা ও হিট্টিটদের সুপ্পিলুলিউমার মধ্যে স্বাক্ষরিত এক চুক্তিতে সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এতে প্রমাণিত হয়, মিটান্নিরাও আর্য ছিলেন এবং আর্যরা পশ্চিম ও দক্ষিণে আলাদা হয়ে যাওয়ার আগে একই দেবতার উপাসনা করতেন।
ঋগ্বেদের দ্বিতীয় থেকে সপ্তম বইয়ে ভারতীয়দের পূর্বসূরিদের রাজনৈতিক ও সামরিক অবকাঠামো সম্পর্কে আমরা অল্প কিছু তথ্য জানতে পারি।
ঋগ্বেদের বর্ণনামতে, দেবতা অগ্নি তার অস্ত্র দিয়ে ‘প্রাচীরে আঘাত হানেন, যার অর্থ হচ্ছে, আর্যসভ্যতার বিকাশ ও বিস্তারের পেছনে কাঠের প্রাচীরঘেরা গ্রামগুলোতে অগ্নিসংযোগের কৌশল একটি বড় ভূমিকা রেখেছে। এছাড়াও, একটি শ্লোকে ‘কালো রঙের’ মানুষের সঙ্গে আর্যদের যুদ্ধের উল্লেখ আছে। পণ্ডিতদের মতে, অপেক্ষাকৃত ফর্সা চামড়ার আর্যরা কালো চামড়াধারী একটি নিম্নশ্রেণির স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করেছিলেন এবং এই শ্লোক সে-ঘটনার প্রমাণ। তবে সপ্তম মাণ্ডালায় এক যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে, যেখানে ১০ আর্য রাজা একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। বস্তুত আর্যরা নিজেদের মধ্যে যতটা লড়েছেন, ঠিক ততটাই লড়েছেন নদ-নদীর উপত্যকা ও সমতলভূমিতে অবস্থিত অন্যান্য গোত্রের বাসিন্দাদের সঙ্গে।
ঋগ্বেদের প্রথম শ্লোকের সময়কালে পূজারিশ্রেণির পাশাপাশি একটি অভিজাত যোদ্ধাশ্রেণিরও উদ্ভব হয়। এই যোদ্ধাশ্রেণীর সদস্য ছিলেন বিভিন্ন গোষ্ঠীর শাসক রাজা। তাদের মাঝেও পিতার কাছ থেকে পুত্রের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের চিরন্তন প্রথা বজায় ছিল। কিন্তু তাদের বিষয়ে এর চেয়ে বেশিকিছু জানা যায় না। এমনকি, এসব পূজারি ও যোদ্ধা-নেতাদের নামও জানা সম্ভব হয়নি।