বিহারী পর্ব

৩৫. তামাম শোধ

তামাম শোধ

সব কিছুরই শেষ আছে। কিন্তু জীবন পথের নেই শেষ, পথ চলছেই, কিন্তু থেমে যায় পথিকের যাত্রা। আসছে ৭ সেপ্টেম্বর আমি পূর্ণ করবো আশি। দীর্ঘ পথ পরিক্রমণ হলো। আমি মানসিকভাবে ক্লান্ত নই। কিন্তু শরীর তো মানতে চায় না, এক ধরনের স্থবিরতা পেয়ে বসতে চায়। বলতে চায়, অনেক হয়েছে এবার থামো।

চলা থামাবে কবে জানি না, তবে কলমটা থামাতেই হবে আপাতত। রবিপথের কলেবর আর বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। হাতে সময়ও কম ছাপতে হবে ওই ৮০তম জন্মদিনে— এমনই দাবী আমার পরিবারের নিকটজনের, প্রকাশকেরও তো অবশ্যই।

শেষের প্রথমেই আমি জানাতে চাই আন্তরিক ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা, সেই সব মানুষকে যাঁরা আমার এই দীর্ঘ যাত্রার প্রতিপদে আমাকে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন— আমার পরিবারের প্রতিটি সদস্য, বন্ধুজন, আমার সহকর্মী (প্রকৌশল ক্ষেত্রে এবং নাটক সিনেমা সকল মিডিয়ায়) যাদের গুরু মেনেছি সেই সব প্রবীণ ও অভিজ্ঞ শ্রদ্ধেয়জন, সাংবাদিকবৃন্দ এবং সর্বোপরি জনগণ সকলকে জানাই আবেগ আপ্লুত অভিবাদন। আপনাদের জন্যই আজ আমি এই যতদূর, যা জেনেছি, শিখেছি। আপনাদের ভাললাগা, মন্দলাগা, আলোচনা, সমালোচনা আমাকে দিয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার সাহস ও উদ্যম। একজন শিল্পী এভাবেই তৈরি হয়— সেই উপলব্ধি আজ আমার প্রতিটি রন্ধ্রে অনুরণিত। সারাটা জীবন পেশা এবং ভালোবাসা পাশাপাশি রেখে পথ পরিক্রমণ করেছি-সৎভাবে প্রতিটি কাজ করার চেষ্টা করেছি তা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি। নানান ওঠাপড়া ছিল আমার জীবনেও— তা পার হয়ে এসেছি শ্রম ও নিষ্ঠার সাথে। বিদেশে চাকরি করে সুনাম অর্জন করেছি শুধু নিষ্ঠা আর সততার জন্যেই।

মিডিয়ার প্রতি ভালোবাসায় গড্ডালিকায় ভেসে যাইনি শুধু আপনাদের কারণেই, ভেবেছি আরো ভাল করতে হবে, দর্শক বিনোদনের ক্ষেত্রে ভাল করতে হবে, বন্ধু বান্ধব, আত্মীয়স্বজনের মুখ উজ্জ্বলতর করার জন্যে। সে লক্ষ্যেই কাজ করেছি অবিরাম। কখনো যে ব্যর্থ হইনি সে কথা তো বলা যায় না। সেটাকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি শুধু আত্মার জোগানো সাহসের কারণে।

আমার শিল্পীজীবনের সবচেয়ে সার্থক কাজ মনে করি আমি ১৯৬৯, ১৯৭০, ৭১-এর সাংস্কৃতিক আন্দোলনটিকে। দেশের মুক্তির জন্য স্বৈরাচারের অত্যাচারের জবাব দিয়েছি, আমার ভালোবাসার কাজ অভিনয় দিয়ে। উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছি জনগণকে— যতটুকুই পেরেছি, সেটাই আমার জীবনের উল্লেখযোগ্য পাথেয়।

জীবনের পথ তো দুঃখ কষ্ট, ব্যথা বেদনা, ব্যর্থতা-ছাড়া হতে পারে না। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। আমার মনে পড়ে আব্বা আম্মার কথা-আর্থিক অবস্থা এতই দুর্বল ছিল যে তাঁদের যথাযথ চিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি আমার দ্বারা। এই দুঃখ আমায় সব সময় খোঁচায়— কেন পারলাম না— আমি কি চেষ্টার ত্রুটি করেছি? মন বলে। না, ওটুকুই সান্তনা।

আর একটা কথা মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্নের মতো উঁকি দেয় আমার চোখের সামনে। আমাদের সেই মিকি-র ত্যাগ করে আসাটা। কি করবো? জীবনের বাস্তবতা বড়ই নিষ্ঠুর। নিজের কাছে নিজেই অপরাধী হয়ে থাকি! ক্ষমা চাই সৃষ্টিকর্তার কাছে।

অনেকদিন ধরে এ বইটি লেখার তাগিদ অনুভব করছিলাম, কেন জানি না। শুরুও করেছিলাম দশ বছর আগে। আজ এতদিন পর শেষ পরিচ্ছেদ লিখছি। কেন লিখছি এর উত্তর একটাই— উত্তর পুরুষের কাছে আমার দীর্ঘযাত্রার অভিজ্ঞতা বর্ণনাটাই প্রধান কারণ। যারা প্রকৌশলী, যাঁরা মিডিয়ায় কাজ করেন-তারাও হয়তো কোনো ব্যাপারে এই একটা অতি সাধারণ জীবনকাহিনী পড়ে সামান্যতম ভাবে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন। সেই আশায়ও লেখা। আমি যেমন প্রায় প্রতিদিনই স্মরণ করি আমার সেই সব পূর্বপ্রজন্মকে যাঁরা আমাকে শিখিয়েছেন অনেক কিছু— সবচেয়ে বড় জিনিসটা হলো শিল্পীর দায়বদ্ধতা। আমিও চাই উত্তর প্রজন্মও জানুক, শুনুক, হয়তো মানতেও পারে নিশ্চয়। এটুকু তো বুঝবে এই যাত্রাপথ সহজ ছিল না, ছিল না মসৃণ-কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছানোর যে উন্মাদনা, সেটা থেকে যেন কখনো বিচ্যুত না হয় তারা— সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

বক্তব্য কি গুরু গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে, তাহলে একটু হালকা করা প্রয়োজন। আমার জীবনের কোনো এক মজার এবং গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা বলি আপনাদের-খুব ছোট একটা ঘটনা— কিন্তু আজো ভুলিনি আমি।

বুয়েটের ছাত্র তখন— উচ্চতর গণিত পড়াতেন গোল্ডমেডালিস্ট স্যার ইমান আলী। তখন আমাদের পড়ানো হতো Tensor. প্রথম ক্লাসে বোর্ডে লিখলেন স্যার-Tensor কি?

“Tensor is an algebric object that describes a multilinear relationship between sets of Algebraic objects related to a vector space” লেখাটা আমরা খাতায় লিখে ফেললাম— কিন্তু একজন আরেক জনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি— কি আজব জিনিস রে বাবা-মাথায় ঢুকছে না।

স্যার ততক্ষণে ব্যাখ্যা দেওয়া শুরু করেছেন Tensor সম্পর্কে। আমরা কিন্তু নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করে দিয়েছি এটা নিয়ে। স্যারের কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছিল আমাদের জন্য। স্যার তাঁর কথা থামিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন-Silence please. তারপরই হলো আমার সাথে চোখাচোখি। ব্যাস, ধরে বসলেন আমাকে-আমি তো আমার নাটকের কারণে মার্কামারা।

হায়াত বলো তো কি বলেছি? বুঝেছ?

জী স্যার!

স্যার হেসে দিলেন।

শুনেছ, আবুল হায়াত কি বলে? আমিই আজও বুঝিনি Tensor কি জিনিস, আর ও বলে বুঝে ফেলেছে।

কি রকম বিব্রতকর অবস্থা বুঝতেই পারছেন।

জীবন যাত্রায় এ ধরনের ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়েছি। নিতে বাধ্য হয়েছি, বাধ্য হয়েছি কারণ— ওই থিয়েটার— শিখিয়েছে দায়বদ্ধতা, শৃঙ্খলা-ধৈর্য-চেষ্টা। স্যার-এর ব্যাখ্যাটা শুনলে হয়তো আমাকে সবার সামনে অমন বিব্রত হতে হতো না-

—ঐ কিন্তু শেষ, আর কখনো নয়।

অতি ক্ষুদ্র ঘটনা জীবন পথের যাত্রায় হয়তো লিখতামও না-কিন্তু এখনই মনে হলো, এসব ঘটনারও মূল্য অনেক।

এই ছোট্ট ঘটনাটিরই একটা মূল্য হয়তো আছে, যার অন্তর্নিহিত নির্যাস টুকুও কখনো বা কারো মনে দাগ কাটতে পারে।

দেখা, জানা, শেখাটাকে আমি সারা জীবন গুরুত্ব দিয়ে এসেছি। নবীনদের কাছেও সেই অনুরোধ আমি রাখবো। কখনো মনে করো না ‘আমি সব জানি।’ আরো জানবার চেষ্টা করো। আমি মেন্টরদের সঙ্গে সময় কাটাতাম— তাঁদের দেখার জন্য, তাঁদের কাছ থেকে শোনার জন্য— আর তাতেই অনেক কিছু শেখা হয়ে যেতো। আবার নতুন প্রজন্মের অনেক নির্মাতাদের নির্দেশনায় আমি অনেক কাজ করেছি— শুধু দেখার জন্য, আর শেখার জন্য— শেখার তো শেষ নেই— ওরা নতুন, নতুন নতুন সব চিন্তা ভাবনার উদ্ভাবন তো তাদের হাত ধরেই আসবে— আমি কেন সেটা মিস করবো। নিজের জানার ঝুলিটাকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঋদ্ধ করতে চাই আমি।

তেমনিভাবে আমার এ দীর্ঘযাত্রাও তো অনেকের কাছে অনন্যই হবে— এখান থেকে আমার এই অন্তদর্শী অভিজ্ঞতাটা তাকে কোনো না কোনো ভাবে উদ্বুদ্ধ করতে পারে আরো নতুন কোনো উদ্যোগে। আর সেটাই হয়তো আমার জন্যে সামান্য হলেও তৃপ্তির স্বাদ এনে দেবে মনে ও মননে।

প্রায় প্রতিটি পরিচ্ছেদে মনের ইচ্ছামত একটা শীর্ষলাইন দেবার চেষ্টা করেছি আমি-জানি না কতটা যুৎসই হয়েছে— তারপরও যাবার বেলা রবি ঠাকুরের গান দিয়েই লিখে যেতে যাই শেষ কথাটা।

আশি বছর, দীর্ঘ সময়। আল্লাহ তায়ালা দীর্ঘ জীবন দিয়েছেন আমাকে— আমি প্রতি মুহূর্তে বলি শোকর আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু যা কিছু করতে চেয়েছিলাম— তার সবই কি করা হয়েছে? না, হয়নি। এটাই একমাত্র অপূর্ণতা আমার জীবনে-এই দীর্ঘ জীবনে আরও বহু কিছুই করার ছিল, দেবার ছিল, দেশকে, দেশের মানুষকে-কিন্তু পারিনি। তারপরও বলতে ইচ্ছে করে –

জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ।
ধন্য হল ধন্য হল মানবজীবন।।
নয়ন আমার রূপের পুরে
সাধ মিটায়ে বেড়ায় ঘুরে,
শ্রবণ আমার গভীর সুরে হয়েছে মগন।।
তোমার যজ্ঞে দিয়েছ ভার, বাজাই আমি বাঁশি-
গানে গানে গেঁথে বেড়াই প্রাণের কান্না হাসি।
এখন সময় হয়েছে কি?
সভায় গিয়ে তোমায় দেখি
জয়ধ্বনি শুনিয়ে যাব এ মোর নিবেদন।।

***

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *