বিহারী পর্ব

৩৩. কোন আলো লাগলো চোখে

কোন আলো লাগলো চোখে
বুঝি দীপ্তিরূপে ছিলে সূর্যলোকে-

পৃথিবীতে/সমাজে কিছু দীপ্তিমান মানুষ আছেন, যাঁরা তাঁদের শিক্ষা, জ্ঞান, কথাবার্তা, আচার ব্যবহার দিয়ে অন্যের মনে আলো ছড়ান। আমাদের দেশেও এমন অনেকেই আছেন— ছুপা রুস্তমের মত-এঁদের বোঝা যায় না, এঁরা সহজে ধরা দেন না-কিন্তু যাঁরা সেই সব আলোতে আলোকিত হন তাঁরা কোনো না কোনো সময়ে উপলব্ধি করেন ওইসব ব্যক্তিত্বের প্রভাব তাদের জীবনে চলার পথ কতটা সুগম করেছে।

আমি খুবই সাধারণ একজন মানুষ। প্রতিটি মানুষ যেমন তার নিজের জীবনের নায়ক/নায়িকা আমিও তাই। একটি শিল্পকর্ম আমাকে শৈশবে আকৃষ্ট করেছিল। রক্তমজ্জায় সৃষ্টি করেছিল আলোড়ন— সেটাকেই ধরেছিলাম আঁকড়ে— ভাল লাগা থেকে ভালোবাসা-ভালবাসা (passion) থেকে পেশা হলো।

এই ভালোবাসার বয়স সত্তর বছর। হ্যাঁ, দশ বছর বয়সে মঞ্চ দিয়ে শুরু ছিল যার। সুতরাং দীর্ঘ পথ পরিক্রমন বলাই যায়। কত ভাবে কত জনের সাথে আলাপ-পরিচয় বন্ধুত্ব, স্নেহের বন্ধন, ভালোলাগার আবেগ উচ্ছ্বাস— সেই সবার মধ্যে বেছে নিলাম ক’জন— তাঁদের নিয়ে দুটো কথা বলতেই হয়। নইলে বোধকরি রবিপথ পরিক্রমন অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। তাঁদের প্রতি আমার ক্ষুদ্র শ্রদ্ধাঞ্জলি নীচের ক’টি প্যারাগ্রাফে গ্রথিত থাক না!

‘যাত্রা সম্রাট অমলেন্দু বিশ্বাস’। তাঁর সম্পর্কে বলেছি আগেই। চট্টগ্রামের ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউটের মঞ্চে তাঁর অভিনয় থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই আজ আমি আমার এই অবস্থানে। আব্বার বন্ধু ছিলেন সেই সূত্রে বাসায় সস্ত্রীক দুএকবার আসায় কাছে থেকেও দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল— ব্যক্তিগত পরিচয় বলতে ওই টুকুই, কিন্তু আজও তাঁর সেই মঞ্চ দাপিয়ে দরাজ গলার অভিনয় আর আবৃত্তি ভুলতে পারিনি। চোখে ভাসে ছোট্টবেলার স্মৃতি— স্বপ্নেও দেখি তাঁর ছড়ানো সেই অভিনয়ের দ্যুতি।

সৈয়দ হাসান ইমাম। আমাদের প্রিয় হাসান ভাই। আমার সাক্ষাৎ গুরু। প্রথম পরিচয় ১৯৬৩তে। বুয়েটের নাটকে অভিনয় করছিলাম— পরিচালক ওবায়দুল হক সরকার। আমাদের মহড়া শেষ হওয়ার পর একদিন সবাই ধুয়া তুললো-চিত্রনায়ক হাসান ইমামকে দেখবো। তখন হাসান ভাই অত্যন্ত জনপ্রিয় মঞ্চে এবং চলচ্চিত্রে। ওবায়দুল হক সরকার আমাদের সেই রাতেই নিয়ে গেলেন— যায়গাটার নাম মনে নেই এখন— পুরোন ঢাকার কোনো এক বাসায় নাটকের রিহার্সাল চলছিল, সেখানে।

আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম, তাঁকে ডেকে আনলেন সরকার ভাই— তিনি ওই নাটকেরও নির্দেশক। তিনি এলেন, আমরা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম। সুপুরুষ হাসান ইমাম, চমৎকার কথা বলার ঢং, হাসিটা বড়ই আকর্ষণীয়। সর্বোপরি রুচিশীল পোশাক পরিচ্ছদ। আমরা তাঁর সিনেমা দেখে ভক্ত হয়েছিলাম, এবার ভক্তিটা দ্বিগুণ হলো সামনাসামনি দেখার পর। তারপর দেখা হলো ১৯৬৮-র শেষে বা ১৯৬৯-এর প্রথম দিকে। প্রকৌশলী অভিনেতা গোলাম রাব্বানী (তখন আমরা মেসে থাকি আজিমপুরে) নিয়ে গেলেন এক মহড়ায়। নাটক কবিগুরুর রক্তকরবী। নির্দেশনায় সৈয়দ হাসান ইমাম, প্রযোজনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের ছাত্র ইউনিয়নের ‘সংস্কৃতি সংসদ’। নাটকটি মঞ্চায়ন হবে সামরিক সরকারের রবীন্দ্রনাথ বিরোধী আচরণের জন্য। নিষিদ্ধই করা হয়েছিল কবিগুরুকে, সেই নাটকে অভিনয়ের জন্যই ডাকা হয়েছিল। পেয়ে গেলাম দারুণ এক চরিত্র-অধ্যাপক, প্ৰায় এক বছর মহড়ায় হাসান ভাই-এর অনেক কাছে আসার সুযোগ হলো আমার। মুগ্ধতা তো ছিল-এবার সেটা এক ধরনের আবিষ্টতায় পরিণত হলো।

অভিনয় তো করি ১০ বছর থেকে, কিন্তু কেউ কোনোদিন-এভাবে চরিত্র বুঝিয়ে দেয়নি, কেউ কোনো দৃশ্যওয়ারী চরিত্রের গুরুত্ব বুঝিয়ে দেয়নি, যা হাসান ভাই দিয়েছিলেন— আর হ্যাঁ, সংলাপের প্রক্ষেপণ অসাধারণ— একটি সংলাপ যে শুধু প্রক্ষেপনের কারণে যথাযথ স্ক্যান আর আরটিকুলেশনে অর্থ বদলে দিতে পারে— শিখেছিলাম তাঁর কাছে— যা পরবর্তী জীবনে ব্যবহার করে প্রচুর প্রশংসা অর্জন করার সৌভাগ্য হয়েছে।

যখনই একটি নাটকে নির্দেশনা দিই বা কখনো নাটকের ক্লাস নিই, ওই কাজগুলোকেই ব্যবহার করে কিছু সৃষ্টির চেষ্টা করি-আর ছাত্রদের মাঝে ছড়িয়ে দেবার প্রচেষ্টা পাই। ৫০ বৎসর অধিক সময় ধরে মানুষটির সাথে সম্পর্ক। আজ অবধি কখনো দেখিনি -মেজাজ হারাতে কোনো কারণে। ১৯৬৯, ১৯৭০, ৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন পর্যন্ত প্রায় প্রতি মাসেই আন্দোলনের নাটক করতাম আমরা। হাসান ভাই-এর নির্দেশনায়। সেই সব নাটক ছিল মুক্তির নাটক, বিপ্লবের নাটক। এক একটি একএক ধরনের। কত বৈচিত্র দেখেছি তাঁর কাজে। তাঁর জীবনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও মুগ্ধ করতো আমাকে। রাজনীতি সচেতন মানুষ, সমাজ সেবায় অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব, হাসান ভাইকে গুরু বলে স্বীকার করে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি আমি। তিনিই আমাকে ঋত্বিক কুমার ঘটকের কাছে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন

এই যে হায়াত, একজন ভাল অভিনেতা এনে দিলাম আপনার জন্যে।

সেই আমার বড় পর্দায় পদার্পণ।

এই গুরুই কিন্তু আবার আমার নির্দেশনায় টেলি নাটকে অভিনয় করেছেন, সেখানেও শেখার শেষ ছিল না। কি করে নিঃশ্বব্দে নীরবে নির্দেশকের নির্দেশমত কাজ করতে হয়, সেটাও শিখেছি তাঁর মত শিল্পীদের কাছ থেকেই। ভীষণ ভাবে বৈষয়িক মানুষ। বাইরে তাঁর এত কাজ তবুও ভাবীর সাথে যে বন্ধন সেটা এতটাই মধূর, যে সেটাও অন্য শিল্পীদের কাছে একটা শেখার মত দৃষ্টান্ত। অভিনয়, নির্দেশনা, আবৃত্তি, দেশপ্রেম, যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, সতীর্থ শিল্পীদের কল্যাণে ঝাঁপিয়ে পড়া— এসবই তাঁকে নিয়ে গেছে অন্য এক উচ্চতায়। সব তো শিখতে পারিনি।

কৃতজ্ঞতার শেষ নেই হাসান ভাই, আপানি ভাল থাকেন, সুস্থ থাকেন, আরও অনেকদিন চাই আপনার সান্নিধ্য।

গোলাম মুস্তাফা। এই মানুষটির সাথে দেখা হবার পূর্বেই আমি তাঁকে গুরু মেনেছি। সেই ক্লাস টেনে পড়ার সময় তাঁর একটা সিনেমা ‘হারানো দিন’ দেখে পাগল হয়ে গুরু মেনে বসলাম কিংবদন্তী শিল্পী গোলাম মুস্তাফাকে।

দেখা হলো ওই রক্তকরবীতে অভিনয় করতে এসে। ‘রাজা’-র চরিত্র করার জন্য প্রথমে এলেন আর এক কিংবদন্তী আনোয়ার হোসেন, তিনি দুঃখ প্রকাশ করে চলে গেলেন, কারণ তাঁর সময়ের অভাব, তখন তিনি বাংলাদেশের ব্যস্ততম চলচ্চিত্র শিল্পী— তারপরই আমন্ত্রিত হলেন মুস্তাফা ভাই।

প্রথম দিনেই আসর মাতিয়ে তুললেন— দেখলাম একটি মানুষ যাঁকে আমি ভার্চুয়ালি গুরু মেনেছি— তাঁর জ্ঞানের পরিধি, আসর জমানোর দক্ষতা, মানুষকে কাছে টেনে নেয়ার ক্ষমতা। এক সঙ্গে কাজ করলাম, একটি বছর। নানান কারণে নাটকটির মহড়া হয়েছিল প্রায় বছর খানেক। নাটক হলো বাংলা একাডেমি মাঠে ১৯৭০ এর জানুয়ারিতে।

তারপর আর দেখা হয়নি অনেকদিন। উনিও তখন চলচ্চিত্রের অন্যতম ব্যস্ত শিল্পী। আর আমি তো চাকরি করি সরকারের। নাটক করি মাঠে ঘাটে, শহীদ মিনারে সরকারের বিরুদ্ধে। লাল খাতায় নাম উঠেছিল শুনেছি-কিন্তু কী করে যেন চাকরিটা বজায় ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর ঋত্বিকদার সিনেমায় আবার দেখা মুস্তাফা ভাইয়ের সাথে। শুটিংএ গেছি আরিচায়। বালিয়াড়িতে শুটিং চলছে, আমি তো নতুন শিল্পী, কি পার্ট তাও জানি না। গাড়ি থেকে নেমে ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে শুনি কেউ চিৎকার করছে-জীবন বাবু, ও জীবন বাবু!

বুঝতে পারলাম না কে কাকে ডাকছে। আমি চলে যাচ্ছিলাম, শুনি এবার আর একটু জোরে ডাক।

আরে ও জীবন বাবু।

এবার ফিরে দেখি মুস্তাফা ভাই।

সালাম দিলাম।

আরে সাহেব তখন থেকে ডাকছি। শুনতে পাচ্ছেন না।

আমাকে ডাকছিলেন?

আপনাকেই তো— আপনার নাম হায়াত না?

হ্যাঁ।

হায়াত মানে কি? জীবন না?

এবার হাসা ছাড়া উপায় কি?

এই ধরনের Wit তাঁর ছিল সহজাত। আসলে একটা পণ্ডিত বলতাম আমি মুস্তাফা ভাইকে। এমন কোনো বিষয় নেই যে বিষয়ে তিনি তর্ক করতে, বা কথা বলতে পারতেন না। পড়ার পোকা। আমার নির্দেশনায় টেলি নাটকে অভিনয় করেছেন— নাটক পিতা-র নাম ভূমিকায় অসাধারণ কাজ তাঁর।

একদিন বলেছিলাম, এই শটটা এরকম করে নিতে চাই—

উনি প্রায় ধমকে উঠলেন—

No. আপনি ডিরেক্টর, আপনি যা করবেন কনফিডেন্টলি করবেন। কাউকে জিজ্ঞেসা করবেন না। চলেন শট নেন।

আপনি বলাটা ছাড়তে পারেন নি কোনোদিন।

একদিন বলেছিলাম

মুস্তাফা ভাই, আমি আপনার চেয়ে অনেক ছোটো, আপনি আপনি করেন, খুব খারাপ লাগে। তুমি বলবেন প্লিজ।

আরে না না, আপনাকে দেখলেই মুরুব্বি মনে হয়— কী করে তুমি বলি? আপনিই ভাল। চুটকির ভান্ডার তিনি একজন। অভিজাত চুটকি থেকে শুরু করে একেবারে সাধারণ মানের চুটকিও তাঁর র‍্যাপেটুয়ারে ছিল।

হাসান ভাইয়ের মত মুস্তাফা ভাই ধীরগতির ড্রাইভার। এতেই কিন্তু তাঁদের মানসিক অবস্থা বোঝা যায়। হুড়োহুড়ি নেই কোনো কিছুতেই, হচ্ছে, হবে, অপেক্ষা করো— এমন একটা নীতি তাদের।

অভিনয়ে তাঁর দক্ষতা আর নতুন করে বলার নেই। যে কোনো চরিত্রকে নিজের মত করে তৈরি করাটা তাঁর অনায়াস সাধ্য ব্যাপার ছিল।

অনেকে বলতেন-মুস্তাফা চরিত্রে ঢোকেন না। আমি বলি উনি চরিত্রকে নিজের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলেন— তাতেই আলাদা একটা ব্যঞ্জনার সৃষ্টি হয়। এটা সবাই পারে না। কচিৎ কেউ কখনো পারে, সেটাই তাঁদের কৃতিত্ব।

মুস্তাফা ভাইয়ের আবৃত্তি যদি কেউ না শুনে থাকেন, তাহলে তিনি তাঁকে চেনেনই না। প্রথম যেদিন তাঁর কণ্ঠে শুনলাম আবৃত্তি, আমি তো নির্বাক। এত সুন্দর করে কবিতাকে কথা বানিয়ে দিতে ক’জন পারে! শুধু গলা কাঁপালেই কি আবৃত্তি হয়? হয় না। তার প্রমাণ মুস্তাফা ভাই— উচ্চারণ, আর্টিকুলেশন, স্ক্যান, যেখানে থেকে বাক্যের অর্থ বের হয়, সেটা নিয়ে খেলায় ওস্তাদ ছিলেন তিনি।

শেষ করি তাঁর অভ্যেস নিয়ে। চা খাওয়া, শুটিং এসে বলতেন আমার সহকারীকে—

লিটু, আমি বই পড়ছি, আমার দৃশ্য এলে স্ক্রিপ্ট নিয়ে আমার কাছে এসো, আর মাঝে মাঝে আমাকে একটু চা দিও। যে কোনো কাপে, কোনো সমস্যা নেই। এই এ্যাত্তটুকু।

আঙ্গুল দুটো দিয়ে মাপটা বুঝিয়ে দিতেন—

মুস্তফা ভাই, আপনাকে এ্যাত্তটুকু না-অনেকটুকু শ্রদ্ধা ও সালাম জানাই। ভুলিনি আপনাকে, ভুলবো না কখনো।

সিরাজুল ইসলাম। আমার ফুপাতো বোনোর স্বামী, সেই সূত্রে সম্পর্কে ছোটো, কিন্তু অভিনয়ের জগতে অগ্রজ। পরিচয় নয়, চিনেছি প্রথম সিনেমায়। ‘ধারাপাত’ সিনেমায় দেখলাম একজন সিরাজুল ইসলামকে— সুন্দুর বাচনভঙ্গি, পরিমিত শারীরিক অভিনয়ে একজন দুর্জনের চরিত্রে। পরিচয় হলো বোন মারুফার সাথে বিয়ের পর। সম্পর্কে মুরুব্বী হওয়ায় সবসময় ভাই ডাক পেয়েছি।

এই মানুষটি ছিলেন বিনয়ের অবতার। মিডিয়ায় এমন কোনো শিল্পী বোধহয় খুঁজ পাওয়া যাবে না-যারা একবার তার সান্নিধ্যে এসেছে, সে তাঁর ভক্ত হয়নি। মারে, বাবারে, ছাড়া কাউকে সম্বোধন করতে দেখিনি— প্রত্যেক স্তরের মানুষ ছিল তাঁর আপনজন।

সরকারি অফিসের একজন উর্দ্ধতন কর্মকর্তা, কাজে ব্যস্ত থাকতে হতো প্রায় সর্বদা। DFP তো খুবই জরুরি বিভাগ সরকারের। সেখানেও সততা এবং নিষ্ঠার সাথে কাজ করেও Passion-এর যায়গাটাতে ছিল তাঁর দায়বদ্ধতার প্রতি সৎ আচরণ।

অভিনেতার দায়বদ্ধতা আবার কি? অনেকে বলেন একথা। কিন্তু যাঁরা মঞ্চের শিল্পী তাঁরা কখনো এমন প্রশ্ন করেন না, কারণ সেখানে শিল্পী প্রথমেই সবক নেন দায়বদ্ধতার। প্রথম কাজটি যদি হয় নিজের চরিত্রে যথাযথ অভিনয় করা, তো দ্বিতীয় জরুরী বিষয় হলো Commitment to the script, to the Co-artist, to the society, to the country. এমন কিছু করবেন না যা দর্শককে বিব্রত করে, বা ক্রুদ্ধ করে, আপনার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়— এটা হলো শিল্পের প্রতি অবিমৃষ্যকারীতা।

কোনো চরিত্রে অভিনয় করতে গেলে তিনি-সেই চরিত্র পড়ে-তাঁর নিজের সম্পূর্ণ সংলাপগুলো নিজের হাতে একটি খাতায় লিখতেন-যাতে সংলাপ ভুল বা বিকৃত না হয়। সেটাই Commitment -এর প্রথম ধাপ।

তিনি বলতেন আমার জন্য unit যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। তাই ন’টায় কল দিলে তিনি পৌনে ন’টায় এসে উপস্থিত হতেন, এর ব্যত্যয় হতে দেখিনি আমি। এটাও ওই Commitment -এর অংশ।

বলতেন, আমার সংলাপ ঠিকমত না হলে Co-artist ঠিকভাবে Perfrom করতে পারবে না। নাট্যমুহূর্ত তৈরিতে বিঘ্ন হবে। কেউ ভাবে এমন করে? তিনি ভাবতেন— তাই কোনোদিন দেখিনি তাঁর সংলাপ ভুলের কারণে retake করতে হয়েছে।

পরিচালকের নির্দেশ ব্যতিরেকে কোনোদিন সেট ছেড়ে কোথাও গেছেন এমন রেকর্ড নেই তাঁর। মেকআপরুমে ধুমপান! অসম্ভব। পরে অবশ্য ছেড়ে দিয়েছিলেন ধুমপান এক সময়। সংসার, স্ত্রী, ছেলে মেয়ে এসব নিয়ে আত্মীয়স্বজনদের সাথে মিলেমিশে থাকতে খুব পছন্দ করতেন তিনি।

আর কত বলবো? আমার অনেকগুলো নাটকে তাঁকে নিয়ে কাজ করছি-আমি মুরুব্বী ঠিক আছে, কিন্তু অভিনয়ে সিনিয়র শিল্পী, কিন্তু কখনো সেটা জাহির করতে দেখিনি— হ্যাঁ শিল্পী হলে এমনই হতে হয়। নতুনদের কাছে role model তিনি। চলাফেরা, কথাবার্তা, ব্যবহার, পোশাক পরিচ্ছদে— কোথাও অহংবোধের চিহ্ন কোনোদিন কেউ দেখেনি তাঁর। আমার নাটক, চখাচখিটা সবাইকে দেখার অনুরোধ করবো, তাঁকে চেনার জন্যে।

যেখানে আছেন ভাল থাকবেন সিরাজ ভাই। আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আপনার জন্যে।

আবুল খায়ের। অদ্ভুত রকমের এক বড় মাপের অভিনয় শিল্পী। এক সময় সরকারি চাকুরে ছিলেন, পরে পুরোপুরি অভিনয়-পেশায় নিয়োজিত।

আমার প্রথম দেখা তাঁকে টেলিভিশনে, তাঁর একটা পাঁচ-দশ মিনিটের রম্য অনুষ্ঠান হতো সেটাতে। তখন আমি ছাত্র, তাঁর ভিন্ন ধরনের কণ্ঠ এবং ব্যতিক্রমী বাচনভঙ্গি আমাকে আকর্ষণ করেছিল। কথাগুলো বলতে বলতে ব্যাঙ্গাত্মক হাসি, সাথে মুখে ঝোলটানার মত একটা শব্দ পুরো ব্যাপারটাকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিত। তার মানে তিনি যে শুধু হাস্যরসাত্মক চরিত্রে অভিনয় করতেন, তা নয় কিন্তু-সব ধরনের চরিত্রেই খাপে খাপ। কীভাবে সম্ভব সেটা। সম্ভব হতো তাঁর চরিত্রের প্রতি সততা এবং সেটা নির্মাণে নিষ্ঠা। Actors preparation বলতে যা বোঝায়, তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ খায়ের ভাই।

 সরাসরি পরিচয় হলো বেশ পরে। টেলিভিশনে রবি-ঠাকুরের শেষরক্ষা নাটকে অভিনয় ছিল আগের রাতে-পরদিন সকালে কোনো এক কাজে অভিনেতা সিরাজুল ইসলামের অফিসে (সেক্রেটারিয়েটে, ইডেন বিল্ডিং-এ) গিয়েছিলাম। সেখানে দেখি খায়ের ভাইকে-উনি তখন সিরাজ ভাই-এর বস, জানা ছিল না আমার।

উনি অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে সিরাজ ভাইকে বললেন— সিরাজ, কাল রাতে রবীন্দ্রনাথের নাটকে কি এই ভদ্রলোককে দেখেছি আমরা?

সিরাজ ভাই হেসে, আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

ব্যাস সেই থেকে আমরা পরিচিত। প্রথমে আপনি, তারপর তুমি, শেষকালে তুইতে নেমে এসেছিলেন। সহজাত ভাবে মিশুকে মানুষ। কারো অভিনয় ভালো না লাগলে মুখের ওপর বলতে কসুর করতেন না।

অভিনয়ে নিজের চরিত্রটি একেবারে নিখুঁতভাবে তৈরি করার জন্য কী না করতেন— বিশেষ করে ড্রেস এবং প্রপস জোগাড় করার জন্য জান-প্রাণ দিয়ে ফেলতেন— সেই সঙ্গে কো-আর্টিস্টের ব্যাপারেও দারুণ সচেতন ছিলেন। তাকে উপদেশ দিতেন, চরিত্র নির্মানে, আর recording-এর আগে তার সাথে অসংখ্যবার মহড়া দিয়ে তৈরি করতেন। ভাল করে শিখে নে, নাইলে আমার সাথে অভিনয় করবি কি করে?

সময়ানুবর্তিতার ব্যাপারে কট্টর একেবারে। আড্ডাবাজিতেও কম যেতেন না। আসলে এরকম স্বতস্ফূর্ত ব্যক্তি, সহজ সরল মানুষ আধুনিক যুগে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এরা কিংবদন্তী, আমাদের পথপ্রদর্শক। এদের নাম মনে পড়লে শ্রদ্ধায় মাথা ঝুঁকে আসে। খায়ের ভাই-সালাম ও শ্রদ্ধা।

মাসুদ আলী খান। আর এক জীবন্ত কিংবদন্তী অভিনেতা। সরকারি চাকরি, অবসরের পর বেসরকারী প্রতিষ্ঠানেও চাকরি করেছেন, পরবর্তীতে পুরোপুরো নিয়োজিত অভিনয় পেশায়। কবে পরিচয় হয়েছিল বলতে পারবো না। হয়তো সেই উনসত্তর সত্তরে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়— যখন সংস্কৃতি সংসদের তাসের দেশ নাটকের নির্দেশনা দিয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন

তিনি। না, আমি তখন সংস্কৃতি সংসদের সাথে জড়াই নি। কিন্তু পরিচয় হয়েছে রক্তকরবীর কাজের সময়।

থিয়েটার গ্রুপ ড্রামা সার্কেলের সাথেও ছিলেন মাসুদ ভাই। সুতরাং থিয়েটারের শিক্ষা— সামাজিক এবং শিল্পীর দায়বদ্ধতা তাঁর কাছে অবশ্য পালনীয় মনে হতো-আসলে এই যে কয়জন কিংবদন্তীর কথা বললাম-এঁরা আমাদের শিখিয়েছেন প্রবীণ শিল্পীদের শ্রদ্ধা করা, তাঁদের সাথে নাটকের বিষয়ে আড্ডা দেয়া (Sharing experience) সময়ানুবর্তিতা, অন্যের প্রতি সহনশীলতা ইত্যাদি-আর ঠান্ডা মাথায় কাজ করা।

মাসুদ ভাই এত ঠান্ডা যে, মাঝে মাঝে মনে হয়— ওঁর মাথায় বোধহয় বরফকল আছে!

আমার নির্দেশনায় ধারাবাহিকে কাজ করেছেন— এমন সুশীল শিল্পী পাওয়া একজন পরিচালকের জন্য ভাগ্যের ব্যাপার।

দেখা হলে এত সুন্দর করে বলেন-

কেমন আছো হায়াত। তোমার এই কাজটা দেখলাম। খুব ভালো লেগেছে, তুমি তো এমনিতেই ভালো করো।

ভাল লাগে শুনতে নিজের স্তুতি, কারণ এটা আজকাল আর কেউ বলে না। যদি কোনো ভাল কাজ করে ফেলি তো ব্যাস-যাকে জিজ্ঞেস করি সেই বলে-

ও তাই নাকি, দেখিনি তো নাটকটা। দেখতে হবে। ইত্যাদি-

নব্বই পেরিয়েছেন মাসুদ ভাই, হাঁটা চলার বেশ অসুবিধা। আমরাই এখন আশিতে, মাঝে মধ্যে লাঠি ধরতে হয়।

সবচেয়ে ভাল লাগে কখন জানেন? যখন হঠাৎ করে এক একদিন ফোনের ওপার থেকে most naturalistic voice-এ শুনতে পাই-

কেমন আছো হায়াত? তোমার খবর নেবার জন্য ফোন করলাম।

ভাল আছি মাসুদ ভাই, ভাল থাকার চেষ্টা করছি, আপনার মত করে।

হাসেন, সেটাও খুবই মিষ্টি করে স্বাভাবিক স্বরে।

আসল কথাটা তো বলা হয়নি-মাসুদ ভাই আমাদের মিডিয়াতে একজন অসাধারণ স্বাভাবিক অভিনয়ের পথিকৃত শিল্পী।

সালাম ও শ্রদ্ধা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *