সারমেয় সমাচার…
মিকি, বহুদিন আমাদের পরিবারের একজন হয়ে ছিল, তার কথা যদি না বলি, অন্যায় হবে। আর বিশেষ করে তার প্রতি যে একটি অন্যায় করা হয়েছে, সেটাও বলে ফেলে ভারমুক্ত হওয়াটাও প্ৰয়োজন।
ও আমাদের বাসায় যখন এসেছিল বয়স তখন কয়েক দিন মাত্র। হ্যাঁ, মিকি একটি কুকুর ছানা, আব্বার কোনো বসের বাসা থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। আমরা তো মহা খুশি আমি তখন বোধহয় নাইন কি টেনে পড়ি। মমতাজ পুতুল তো আনন্দে আত্মহারা। মাটিতে ফেলেই না তাকে। নামটা কে রেখেছিল মনে নেই। আব্বাই হয়তো বা। আদরের চোটে সে তো অস্থির। কুৎকুৎ চেয়ে থাকে, একবার একে একবার ওকে দেখে। শুধু নাখোশ আম্মা।
বাড়িতে কুকুর নিয়ে এলেন, নামাজ হবে?
আব্বা শুধু হাসলেন।
আম্মা শেষ পর্যন্ত নিমরাজী হলেন। বলেন মেয়েদের-
ঠিক আছে রাখ, কিন্তু আমার ধারে কাছে আনবে না।
ব্যাস, মিকির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে গেল। মিকি সালাম সাহেবের বাসার আদর যত্নে মহাসুখে বড় হতে লাগল। এখন সে মানুষ চিনে গেছে—
কেউ ডাকলে দৌড়ে আসে। খেলা শিখেছে— বল ধরে খেলে-বল দূরে ছুঁড়ে দিলে, নিয়ে আসে ছুটে গিয়ে। কোলে উঠতে চায়।
আর ওর কি যেন কেন, আম্মার কাছে যাওয়ার ভীষণ ইচ্ছা— সুযোগ পেলেই আম্মার পায়ের কাছে গিয়ে লুটিয়ে পড়ে, কখনো শাড়ি কামড়ে ধরে, আম্মা আর কি করবেন-
দূর, দূর, আমার নামাজ গেল
বলে নিজেই সরে যান তিনি।
তাতে মিকির কোনো বিকার নেই। সে তো মহানন্দে বোতলে দুধ খায়। ক’দিন পর দেখি বাজার থেকে ওর জন্যে আব্বা মাংস আনা শুরু করলেন। বোনদের দিয়ে খিচুড়ি মাংস রেঁধে খাওয়ানো শুরু হলো।
আমারও খুব আদরের ছিল মিকি। আমি বাইরে থেকে এসে মিকি ডাকলেই ছুটে এসে পা ধরে শুয়ে পড়তো। সবার ভালোবাসা পেল, শুধু আম্মা ছাড়া।
আরও বড় হলো মিকি। আম্মার সাথে ভাব হলো না। বরং আম্মা একদিন বললেন— ওকে বাড়ি থেকে না তাড়ালে আমিই চলে যাবো একদিন।
আব্বা বুঝলেন কেস বেগতিক। আমাকে বললেন, যাও ওকে পাহাড়ে ফেলে দিয়ে এসো। আমাদের মন খারাপ, মমতাজ পুতুলের চোখে জল, কিন্তু আব্বার নির্দেশ অবশই মান্য। ফেলে দিয়ে এলাম পাহাড়ে।
বাসায় ঢুকলাম, আম্মার শুরু হলো জেরা।
ফেলে এসেছিস?
হ্যাঁ।
তাহলে এটা কে?
তাকিয়ে দেখি আমার পেছনে পায়ের কাছে মিকি দাঁড়িয়ে।
বাড়িতে বেশ হাসির একাটা রোল উঠলো,কিন্তু প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত আম্মা।
আমি থাকবো না এ বাড়িতে।
এখন কী করা। আব্বা শেষ পর্যন্ত কঠিন নির্দেশ দিলেন— ওকে বাটালি পাহাড়ের পেছনে ফেলে এসো। বস্তায় পুরে নিয়ে যাও। যাতে পথ চিনতে না পারে।
তাই সই, দিয়ে এলাম সেই ভাবে ফেলে।
বাসায় ঢুকে শুনি আমার আগেই মিকি বাসায় এসেছে। এবং আসার পর থেকে উঠানের
মাঝে আনার গাছের গোড়ায় চুপ করে বসে আছে। কারো ডাকে সাড়া দেয় না, শুধু চোখ তুলে দেখে আর মাথা নামিয়ে নেয়।
একে কিছু খেতে দাও। আব্বা বললেন।
বোনরা হুটোপুটি করে খাবার দিল, পানি দিল।
না, কোনো আগ্রহই নেই তার খাওয়ার প্রতি। সবাই চেষ্টা করলো-কোনো সাড়াই নেই তার তরফ থেকে।
এরপর কি যেন কী হলো, আম্মা খাওয়ার থালাটা নিয়ে ওর কাছে বসে ওকে এগিয়ে দিলেন।–নে খা।
মিকি শুধু চোখ তুলে একবার আম্মাকে দেখলো, সঙ্গে সঙ্গে শুরু করলো খেতে।
আমরা হাততালি দিলাম। কি সুন্দর দৃশ্য। অসাধারণ আবেগী মুহূর্ত, সেদিন থেকে আম্মা হলেন মিকির সবচেয়ে প্রিয় মানুষ, আর মিকিও হলো আম্মার সন্তানসম। ওর খাওয়া দাওয়া, খবর নেয়া সব আম্মাই বেশি করতেন, আম্মার গায়ে লটপট করা ওর প্রিয় খেলা। দু একবার এমনও হয়েছে আম্মা নামাজ পড়ছেন ও পাশে বসে দেখতো। এক সময় আম্মা সেজদা দিতে গিয়ে দেখেন ও জায়নামাজে বসে রয়েছে। ধমক দিলে সরে গেছে, দুতিনবার এমন হবার পর তাকে বোঝানো হলো— এটা অন্যায়— ওটা করবে না। মানুষকে বোঝানো কঠিন, কিন্তু পশুপক্ষী তো অবিশ্বাসী হতে পারে না। ওরা নিষ্পাপ প্রাণি।
বড় হতে লাগলো মিকি। আমি ঢাকায় চলে এলাম পড়তে। ছুটিছাটায় গেলে— সে যে কী করবে বুঝে উঠতে পারতো না। দিন কাটতে লাগলো। এর মধ্যে সে মা হয়েছে কয়েকবার-আমরা আর বাচ্চা রাখিনি, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে সেসব।
আরও বড় হলো মিকি। আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ঢাকায় চাকরি নিলাম। আব্বার অসুখের খবর পেয়ে ছুটে গেলাম। তখনও দেখি মিকি, প্রায় সময় এসে আব্বার খাটের পাশে বসে থাকতো। একটু স্থবিরতা এসেছে ওর মাঝে।
আব্বাকে ঢাকায় নিয়ে এলাম। মোহাম্মদপুরে বাসা নিলাম। মিকিও এল সঙ্গে। অপরিচিত যায়গা, মিকির বেশিরভাগ সময় কাটতো চেইনযুক্ত হয়ে। আব্বার ঘরের পাশে জানালার ধারেই বাঁধা থাকতো। প্রায়ই জানালায় দুপা দিয়ে ধরে দেখতো ভেতরে। জানি না তার মনে কী কাজ করতো।
আব্বার মৃত্যুর পর কাঁদতে বোধহয় দেখেছিলাম। কয়েকদিন খাওয়া দাওয়াও বন্ধ ছিল তার। বিহারী-বাঙালি রায়ট হওয়ার কারণে বাসা ছেড়ে চলে এলাম মালিবাগে। সঙ্গত কারণে আমাদের মিকিও এল। কদিনেই এলাকায় পরিচিত হয়ে গেল। একাত্তরের যুদ্ধের সময় সে বাড়ি পাহারা দিয়েছে যখন আমরা গ্রামে। আমি যখন অসুস্থ, বিছানায় পড়ে, একটু পরপর দরজায় এসে দাঁড়াতো— দেখেছি চোখে তার মায়া ঝরছে-কি করে যেন বুঝতে পারতাম আমি।
৭৪ সনে আমি একটি সরকারি বাসা পেলাম, বকশীবাজার-পলাশী-র সঙ্গে। ফ্ল্যাটটা ছিল চারতলার ওপর। সবাই খুশী, একটা নিশ্চিন্ত ছাদ পাওয়া, যতদিন চাকরি থাকবে-আর বাসা খুঁজতে হবে না। যাবার দিন ঠিক হলো, গোছগাছ হচ্ছে— হঠাৎ জানা গেল— ওই ফ্ল্যাট বাড়িতে কুকুর নেয়া যাবে না।
সবার মন খারাপ হয়ে গেল বাসার। আম্মাকে দেখলাম একটু বেশি মনমরা। কিন্তু নিরুপায়। ওই বাসার যা নিয়ম, সেটা মেনেই উঠতে হবে সেখানে।
শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো যাওয়ারই। বাসা সহজলভ্য নয়। লাইন দিয়ে এক সময় আসে সুযোগ। সুতরাং চলো যাই।
যাওয়ার দিন পিকআপে মালামাল উঠানোটা মিকি খুব মন দিয়ে দেখছিল। একবার ঘরে যায় আবার ঘুরে দেখে গাড়ির কাছে। মালপত্র এক পিকআপ যাবার পর আর একটায় গেল বাকীগুলো। সেই একই বিহেভিয়ার ওর। একটু অস্থির সে।
এবার জিপে আমাদের যাবার পালা। সবাই উঠলো ওকে আদর করে, ওর অস্থিরতা বাড়তে লাগলো। সবার শেষে আমি যখন জীপের পেছনের সিটে উঠতে গেলাম, মিকি আমার পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওকে আদর করে বললাম,
তোকে আবার এসে নিয়ে যাব, গাড়িতে যায়গা নেই।
ওকি আমার কথা বুঝলো? দুতিনবার বলার পর একটু সুস্থির হয়ে দাঁড়ালো। আমি গাড়িতে উঠে গেলাম। সে গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে লাগলো যেতে। গলি থেকে বেরুবার সময় ওকে বললাম— এখানে থাকো। থেমে গেল ও। গাড়ি চলে গেল রামপুরা রাস্তায়। আমি তাকিয়ে রইলাম ওর চোখের দিকে।
কি দেখেছিলাম সে চোখে?
দুঃখ নাকি অবিশ্বাস।
বোধহয় দুটোই।
মাস খানেক পরে খবর পেলাম মিকি নেই, কেউ বলতে পারে না কোথায়— কিন্তু আমাদের চলে আসার পর রাত দিন সে প্রধান দরজাটায় বসে থাকতো, আর গাড়ির আওয়াজ পেলেই ছুটে যেতো রাস্তায়।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আজ মিকির সেই চোখ দুটোই মনে পড়ে বারবার। মাফ চাই আল্লার দরবারে।