অধ্যায় ৩০
হোমিসাইড প্রধান ফারুক আহমেদ মুখ ভার করে বসে আছে। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না জেফরি কেন এ রকম কথা বলছে। কিছুক্ষণ আগে তার এই প্রিয়পাত্রটি এসে তাকে যা বলেছে সেটাকে পাগলের প্রলাপ বলেই মনে হচ্ছে।
একটা মীমাংসিত কেস নিয়ে কেউ এ রকম কথা বলতে পারে!
এখনও জেফরি তার সামনেই বসে আছে।
“ঐ অজ্ঞাত যুবকটি নিয়ে তুমি খুব বেশি মাথা ঘামাচ্ছো, জেফ,” বলল সে। “এটারও অনেক ব্যাখ্যা হতে পারে…অ্যালোটিদেরই কারো গেস্ট হয়তো। অ্যাপার্টমেন্টে একটা খুন হয়েছে জানার পর ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে পারে মনে করে ভয়ে সটকে পড়েছে।”
এ কথাটা জেফরির সহকারী জামানও তাকে বলেছিল। মাথা নেড়ে সায় দিল জেফরি। আরেকটা বিষয় আছে যেটা সে নিজের বসের কাছে খুলে বলতে পারছে না।
“আবার এমনও হতে পারে, কোনো ফ্ল্যাটে হয়তো অসামাজিক কার্যকলাপ চলে থাকে যেটা ওখানকার কেউ জানে না। আজকাল তো ফ্ল্যাটগুলোতে এ রকম হচ্ছেই…সে ধরণের একজন ক্লায়েন্ট হয়তো ভোরের দিকে চলে গেছে।”
ফারুক সাহেবের উর্বর কল্পনা শক্তির প্রশংসা না করে পারল না সে।
“ওরকম কিছু হবার সম্ভাবনা একবারেই কম। ভিটা নুভায় যারা থাকে তারা এই সমাজে বেশ প্রতিষ্ঠিত,” জেফরি বলল। একটু থেমে দ্বিধা কাটিয়ে উঠল সে। “স্যার, জায়েদ সাহেব যে রাতে খুন হন সে রাতে তার স্ত্রী আর তার প্রেমিক আলম শফিক…”।
ভুরু তুলে তাকাল ফারুক সাহেব।
“…মানে, উনারা দু’দুবার শারীরিকভাবে মিলিত হয়েছিলেন…”
“উমমম! তো?”
“এটা কি অস্বাভাবিক ব্যাপার না?”
ফারুক আহমেদ এবার ভুরু কুঁচকে ফেলল। “অস্বাভাবিককেন? তোমার কাছে এ রকম কেন মনে হচ্ছে?”
জেফরি বেগ মুশকিলে পড়ে গেল। এ রকম একটি ব্যাপার নিজের বসের সামনে খোলামেলা আলোচনা করাটা তার জন্যে বিব্রতকর। তবে সাহায্যের জন্যে ফারুক আহমেদই এগিয়ে এল।
“তুমি বলতে লজ্জা পাচ্ছো কেন? খুলে বলো?”
“ব্যাপারটা প্রথমে আমার কাছে গুরুত্ব পায়নি কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটা স্বাভাবিক না। খুন করার পরিকল্পনা করে কেউ কি এসব করবে?”
একটু চুপ থেকে ফারুক সাহেব বলল, “তা করবে না।”
“তাহলেই বুঝুন?”
“মানে সাধারণত করবে না…কিন্তু—”
“কিন্তু কি, স্যার?”
“সাইকোপ্যাথদের ব্যাপারে এ রকম কাজ করা অসম্ভব নয়।”
উফ! মনে মনে বিরক্ত হলো জেফরি। তার এই স্যার মাঝেমাঝে খুবই হাস্যকর কথা বলে। “স্যার, আপনি কি মনে করছেন উনারা দুজনেই সাইকোপ্যাথ?”।
“ঠিক তা বলছি না তবে তারা দুজন যে স্বাভাবিক নয় সেটা তো মানবে? স্বাভাবিক মানুষ ঠাণ্ডা মাথায় খুনখারাবি করতে পারে না।”
আশাহত হলো জেফরি। ব্যাখ্যাটা তার মনোপুত হচ্ছে না। ব্যাপারটা ফারুক সাহেবও হয়তো বুঝতে পারল।
“শোনো, জেফ। খুন হবার আগে তারা দুজন অনেকটা সময় একসাথে ছিল…ছিল না?”
মাথা নেড়ে সায় দিল বেগ। “তিন-চার ঘণ্টার মতো।”
“তিন-চার ঘণ্টা! তো এই তিন-চার ঘণ্টায় দুজন নারী-পুরুষের মধ্যে সেরকম কিছু হতেই পারেই। এজন্যে অবশ্য তাদেরকে সাইকোপ্যাথ ভাবাটাও ঠিক হবে না,” কথাটা বলেই হেসে ফেলল সে।
“কিন্তু খুন হবার পরেও তারা আরেকবার মিলিত হয়েছিল। এটা কি অস্বাভাবিক না?”
একটু চিন্তায় পড়ে গেল হোমিসাইড প্রধান।
“স্যার, আপনার কথা আমি মেনে নিচ্ছি, তারপরও আমি চাইছি একটু ভালোভাবে তদন্ত করে বিষয়টা পরিস্কার করে নিতে।”
“ভালোভাবে? এরচেয়ে ভালোভাবে এই দেশে আর কোনো তদন্ত হয়েছে। কি না আমি জানি না। কতো দ্রুত আসামী ধরা হলো! একেবারে ক্রাইমসিন থেকে! সবই তো পরিস্কার। এ ঘটনার আর কি বাকি আছে?”
“স্যার, আমি কেবল কিছু অসঙ্গতি দূর করে নিতে চাইছি।”
“অসঙ্গতি।” ফারুক সাহেব যেন আপন মনে বলল কথাটা।
“পলিগ্রাফ টেস্টের কথাটা বাদই দিলাম। একবার ভেবে দেখুন, জায়েদ রেহমান যখন খুন হচ্ছেন তখন তার অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে এক যুবককে পুলিশ সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখে। ছেলেটাকে অবশ্য পুলিশ ধরতে না পারলেও সেই সূত্রেই কিন্তু ভিটা নুভায় পুলিশ খোঁজ নিতে গিয়ে এই ঘটনাটি আবিষ্কার করে। তারপর ভোরবেলায় এক অজ্ঞাত যুবক অ্যাপার্টমেন্ট ভবন থেকে সটকে পড়ল। তারচেয়েও বড় কথা জয়েদ সাহেব খুন হবার ঠিক কিছুক্ষণ আগে একজনকে মেইল করে গেছেন এমন একটি ল্যাপটপ থেকে যেটা কি না তার হাতের নাগালের বাইরে ছিল। এতোগুলো অসঙ্গতি দূর না করে এই তদন্ত শেষ হয় কিভাবে?”
ফারুক সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। “ওকে, তোমার যদি মনে হয় কেসটা আরো তদন্ত করতে হবে তুমি সেটা করতে পারো, কিন্তু…”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল জেফরি বেগ।
“…সেটা যেন কেউ জানতে না পারে। অফিশিয়ালি এই তদন্ত এখন আমাদের জন্য ক্লোজড হয়ে গেছে। পুলিশকে আমরা সব তথ্য-উপাত্ত আর আলামত দিয়ে দিয়েছি। যদি তুমি নতুন কোনো কু পাও শুধু আমাকে জানাবে। আর কাউকে না। তারপর আমি ভেবে দেখবো কি করা যায়।”
শর্তটা মেনে নিলো জেফরি। “ঠিক আছে, স্যার।
উঠে দাঁড়াল সে, দরজার দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে ফারুক আহমেদ বলল, “ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি সময় নষ্ট কোরো না। মনে রাখবে কেসটা এখন পুলিশ দেখছে।”
কোনো কথা বলল না জেফরি বেগ, শুধু মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বের হয়ে গেল ঘর থেকে।
.
অধ্যায় ৩১
পাভেল আহমেদ লা ডিপ্লোম্যাট বার থেকে সোজা বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়েছে একটা ইয়েলো ক্যাব নিয়ে। আজ একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছে। পকেটে প্রচুর টাকা থাকার কারণে নিজেকে সামলাতে পারেনি।
কথা ছিল স্বদেশ টিভির রিপোর্টার, তার বন্ধু হামিদ আলম বারে এসে তাকে বাকি পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে যাবে কিন্তু অনেকক্ষণ বসে থাকার পরও সে আসেনি।
শেষে হামিদ আলমের কাছ থেকে পাভেল একটা ফোন পায়; সে জানায় একটা জরুরি কাজে আটকা পড়ে যাওয়ায় আজ আর আসতে পারছে না, কাল নিজে পাভেলের বাড়ি এসে টাকাটা দিয়ে যাবে। অফিস থেকে টাকাটা তুলে নিজের কাছেই রেখে দিয়েছে সে। পাভেল যেন এ নিয়ে কোনো চিন্তা না করে।
এতো গেল পঁচিশ হাজার কিন্তু আগামীকাল দুপুরের মধ্যে যে দুই লাখ টাকা তার পকেটে চলে আসবে সেটা অবশ্য হামিদ আলম জানে না।
ইয়েলো ক্যাবে হাত পা ছড়িয়ে ভাবছে এরপর কি করবে।
পাভেল জানে স্বদেশ টিভির মালিক কে। ভদ্রলোক ঠিক কতো টাকার মালিক নিজেও জানে কি না সন্দেহ। এ রকম একজন ধনীর কাছে দুচার লাখ টাকা তেমন কিছু না। এখন তার আফসোস হচ্ছে দু’লাখ টাকা চেয়েছিল বলে। নজরটা একটু বড় করো, মনে মনে বলল সে। এখনও কিছু চাইতে গেলে খুব বেশি চাইতে পারে না সে। জন্মগত স্বভাব। নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্মালে এই এক সমস্যা। কিছু চাইতে গেলে নিজে থেকেই মনে হয় বেশি চেয়ে ফেললাম কি না।
যা হবার হয়েছে। ইন্টারভিউটা নিয়ে আর বেশি কিছু করবে না। এক জিনিস দু’বার বিক্রি করছে এটাই অনেক বেশি। কিন্তু ইন্টারভিউতে ছোট্ট একটা ঘটনার উল্লেখ আছে, আর কেউ না জানলেও সে জানে। জায়েদ রেহমান তার স্ট্রোকের জন্য একজনকে দায়ি করেছেন। স্ট্রোকের পর পর ইন্টারভিউটা নেয়া হয়েছিল তাই কথাটা তিনি মুখ ফসকে বলে ফেলেছন। এই ঘটনাটির জন্যেই চ্যানেল কর্তৃপক্ষ ইন্টারভিউটা চালাতে রাজি হয়নি। আর এখন এটাকে ধামাচাপা দেবার জন্যে চ্যানেল কর্তৃপক্ষ উঠেপড়ে লেগেছে। তার পরবর্তী কাজ হবে সেই তথ্যটাকে কাজে লাগানো।
আবর্জনা যততা ঘাঁটা হবে ততোই দুর্গন্ধ বের হবে। তো আরেকটু ঘাঁটাঘঁটি করে দেখি না কি হয়?
ধনী হলেও অনেক সমস্যা! মানসম্মান রক্ষা করার ব্যাপারটা অনেক বড় হয়ে ওঠে তখন। সিদ্দিকী সাহেবও নিজের মানসম্মান রক্ষা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ঠিক আছে, আপনার মান সম্মান অক্ষত থাকবে। নো প্রবলেম! তো একটু খরচাপাতি করেন।
কথাটা ভাবতেই তার মাতাল ঠোঁটে মুচকি হাসি দেখা গেল।
ক্যাবের গতি কমে এলে আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে পেল নিজের বাড়ির কাছে চলে এসেছে।
অবিবাহিত পাভেল এক রুমের একটা ঘরে একা থাকে। কিছু দিন আগেও মেসে ছিল কিন্তু এখন বেশ ভালো বেতন পায় বলে একটা আলাদা রুম ভাড়া নিয়েছে। সাংবাদিক বলে তাকে বেশ সমীহ করে বাড়ির মালিক। লোকটা আদম ব্যবসা করে সুতরাং পাভেলের মতো ক্রাইম রিপোর্টার তার বেশ উপকারে লাগে। দু’একবার ছোটখাট সমস্যায় পাভেল তাকে সাহায্যও। করেছে যার পুরস্কার হিসেবে মাসের এক তারিখে বাড়ি ভাড়া দিতেই হবে এ রকম একটি নিয়ম তার বেলায় প্রয়োগ করা হয় না।
ক্যাব থেকে নামার আগে চুলটা হাত দিয়ে আঁচড়ে জামাকাপড় ঠিকঠাক করে নিলো সে। নিজেকে ভদ্রস্থ করে সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে গেল যেন কেউ দেখে বুঝে না যায় সে মদ খেয়ে এসেছে।
প্ৰচর মদ খাওয়ার পর চার তলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে বেশ বেগ পেল সে, হাফিয়ে উঠল একেবারে। পকেট হাতরিয়ে চাবিটা বের করে ঘরে ঢুকেই অবাক।
তার চৌদ্দ ইঞ্চি রঙ্গিন টিভিটা চলছে। তবে কোনো শব্দ হচ্ছে না। এনিম্যাল প্রানেট নামের পাভেলের সবচাইতে অপছন্দের একটি চ্যানেলে চলছে টিভিতে!
দুপুরে ঘর থেকে বের হবার সময় টিভি সেটটা কি সে বন্ধ করে যায়নি?
নেশার ঘোরে মনে করতে পারল না। দরজাটা বন্ধ করে বাতি জ্বালিয়ে বিছানায় পড়ে থাকা রিমোটটা হাতে তুলে নিলো জঘন্য চ্যানেলটা বদলানোর জন্য। শুধু জন্তু জানোয়ারের কাজকারবার! মানুষ এই চ্যানেলটা দেখে কী করে!
রিমোটের বাটনে টিপ দেবার আগেই মাথার পেছনে প্রচণ্ড জোরে একটা আঘাত হতেই পাভেল আহমেদ টলে গেল। আচমকা চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেলে ক্ষণিকের জন্য তার কাছে মনে হলো বিদ্যুতের লোডশেডিং হয়েছে। বুঝি।
কিন্তু আর কিছু ভাবার সুযোগ পেল না সে।
কানে ভো ভো শব্দে পাভেল আহমেদের জ্ঞান ফিরে আসতে শুরু করল। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে কেন বুঝতে পারছে না। দু’চোখ টেনে খোলার চেষ্টা করল সে।
প্রথমে ঘোলা ঘোলা দেখলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই দৃষ্টিটা স্পষ্ট হয়ে আসতেই চোখের সামনে তার সবচাইতে অপছন্দের চ্যানেলটা দেখতে পেল আবার।
শিকার ধরে উদরপূর্তি করছে দেখতে কদাকার একটি সিংহ।
টিভির আলো ছাড়া ঘরে আর কোনো আলো নেই। কয়েক সেকেন্ড পর সে বুঝতে পারল টিভি সেটের সামনে একটা হাতাওয়ালা চেয়ারে বসে আছে। তার দুহাত চেয়ারের হাতলের সাথে বাধা। তার দু’পা কি দিয়ে যেন বেধে রাখা হয়েছে, পাভেল আন্দাজ করতে পারল না। তবে তার মুখটা যে কাপড় দিয়ে শক্ত করে বেধে রাখা হয়েছে সেটা বুঝতে পারল বেশ ভালোভাইে।
এক অজানা আশঙ্কায় পাভেল আহমেদের হৃদপিণ্ডটা হাতুড়ি পেটার মতো করে শব্দ করতে শুরু করল। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো তার। কিছুই বুঝতে পারছে না। যেন আচমকা তাকে ধরে নরকে নিক্ষেপ করা হয়েছে। নিজের ঘরটাকে এর আগে আর কখনই তার কাছে এতোটা ভীতিকর লাগেনি।
হঠাৎ তার গা ছম ছম করে উঠল। শরীরের সমস্ত পশম দাঁড়িয়ে গেল এক নিমেষে।
একটা আবছায়া মনুষ্যমূর্তি আস্তে করে পেছন থেকে চলে এল তার ঠিক সামনে। ঘরের আলোর স্বল্পতার কারণে চেহারাটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। তবে খুব চেনা চেনা লাগছে তার কাছে। লোকটা একটু পিছিয়ে গিয়ে ঘরের এক কোণ থেকে একটা চেয়ার টেনে ঠিক তার সামনে বসে পড়লে টিভির আলোয় পাভেল আহমেদ চেহারাটা দেখতে পেল।
হায় আল্লাহ্!
.
অধ্যায় ৩২
আবেদ আলীর মোবাইলে দশ-পনেরোটি মেসেজ এসে জমা হয়েছে, সবগুলোই করেছে মিলি। একটারও জবাব দিতে পারেনি সে। একদমই ফুরসত পাচ্ছে না। সারাটা দিন গেছে বিভিন্ন কাজ করে। দারুণ ব্যস্ততা যাচ্ছে আজ।
কবি হামিদ কায়সারের ব্যারিস্টার বন্ধু বলেছে বইটা প্রকাশ করার ব্যাপারে তার কোনো আইনী ঝামেলা হবে না। কপিরাইটের নিয়ম অনুযায়ী জায়েদ রেহমানের সাবেক স্ত্রী গোলনূর আফরোজ তরফদারকে প্রাপ্য টাকা দিয়ে দিলেই হবে।
কথাটা শোনার পর থেকেই আবেদ আলী দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছে। অনেক দিন পর কাজেকর্মে এতো ব্যস্ততায় সারাটা দিন কাটছে তার। বইটা যতো দ্রুত সম্ভব প্রকাশ করতে হবে। এটাই এ মুহূর্তে তার একমাত্র চ্যালেঞ্জ।
লেখক জায়েদ রেহমানের মৃতদেহ এখনও পড়ে আছে হাসপাতালের পোস্টমর্টেম রুমে। শোনা গেছে দুদিন পর তার লাশ দাফন করার সম্ভাবনা রয়েছে। আবেদ আলী চাচ্ছে যে করেই হোক দুদিনের মধ্যেই বইটা প্রকাশ করতে। একেবারে তাক লাগিয়ে দেবে সবাইকে।
কিন্তু তার ম্যানেজার আর কর্মচারীরা এখনও এসবের কিছুই জানে না, তাদেরকে শুধু বলা হয়েছে পাঁচশ’ পৃষ্ঠার একটি নতুন বই প্রকাশ করতে হবে দুদিনের মধ্যে। বইটা বের হবার ঠিক আগে সবাইকে জানাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। আর এ কারণে তাকেই সব ব্যবস্থা করতে হচ্ছে।
পুরো পাণ্ডুলিপি একদম রেডি, তারপরও কবি হামিদ কায়সারকে দিয়ে একটু দেখিয়ে নিচ্ছে। পাঁচশ’ পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি দেখা মুখের কথা নয় তবে হামিদ কায়সার বন্ধুর জন্যে কাজটা করতে রাজি হয়েছে।
দুটো স্প্যানিশ ভদকা স্মিরনফ নিয়ে আবেদ আলীর বাড়িতে বসেছে তারা। কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের সাথে যোগ দেবে আর্টিস্ট মাসুম তারেক। বিকেলের দিকে আবেদ আলী তাকে ফোন করে জরুরি ভিত্তিতে জায়েদ রেহমানের সর্বশেষ বই, তার আত্মজৈবনীমূলক উপন্যাস কথার জন্য একটা প্রচ্ছদ করে দিতে বলেছে।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে একটা বইয়ের প্রচ্ছদ! কথাটা শুনে প্রথমে রাজি না হলেও নিয়মিত পারিশ্রমিকের তিনগুন প্রস্তাব দেয়াতে কাজটা করতে সম্মত হয়েছে সে। কথা দিয়েছে রাত এগারোটার পর আবেদ আলীর বাড়ি এসে প্রচ্ছদটার সিডি দিয়ে যাবে সেই সাথে একটু পানাহার করবে গভীর রাত পর্যন্ত।
টাকা আর মদ দুটোর টোপই দেয়া হয়েছে। আবেদ আলী জানে দ্বিতীয়টার জন্যে এই আর্টিস্ট বেশি লালায়িত।
কবি হামিদ কায়সার সেই বিকেল থেকে বিরতিহীনভাবে কথা’ নামের জায়েদ রেহমানের আত্মজৈবনীমূলক উপন্যাসটির প্রুফ দেখে যাচ্ছে। খুব একটা ভুল নেই। কিছু বানানের ভুল আর অনেক জায়গায় এক কথা দু’বার টাইপ করা হয়েছে। তারপরও পাঁচশ’ পৃষ্ঠার একটি বই পড়ে শেষ করা যেইসেই কথা নয়।
সন্ধ্যার পর থেকে তার পড়ার গতি আরো বেড়ে গেছে ভদকার আর্বিভাবে। আবেদ আলীর ড্রইংরুমের মেঝেতে কার্পেটের উপর তারা হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে। কবির চোখ প্রিন্ট করা পাণ্ডুলিপির দিকে থাকলেও ভদকার গ্লাসে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে ঘনঘন।
বইটা যতোই পড়ছে ততোই অবাক হচ্ছে হামিদ কায়সার। উল্লেখযোগ্য অংশগুলো জোরে জোরে আবৃত্তি করে শোনাচ্ছে পাশে বসে থাকা আবেদ আলীকে, সে ব্যস্ত আছে প্রোডাকশন কস্টের হিসেব নিয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ভালো আবৃত্তি করতে হামিদ কায়সার, এখনও মাঝেমধ্যে স্বরচিত কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করতে হয় তাকে, দরাজ কণ্ঠে চুম্বক অংশগুলো রসিয়ে রসিয়ে আবৃত্তি করে বেশ মজা পাচ্ছে সে।
“জায়েদ রেহমান এতোটা সাহসী আগে জানতাম না,” পাণ্ডুলিপি থেকে চোখ না সরিয়েই বলল হামিদ কায়সার। শব্দ করে ভদকার গ্লাসে লম্বা একটা চুমুক দিল।
“কিন্তু আমি যতোদূর জানি সে মোটেও সহাসী ছিল না,” দ্বিমত পোষণ করল আবেদ আলী। “সব সময় একটা ভণ্ডামির মুখোশ পরে থাকতো। নিজেকে একজন রহস্যময় মানুষ হিসেবে প্রজেক্ট করতো, আর এই কাজটা করতো একেবারে পরিকল্পনা করে।”
“তবে এখানে সে অনেক সাহসী কথা লিখেছে। হয়তো শেষের দিকে রিয়ালাইজ করতে পেরেছিল। দেখো না এখানে কি লিখেছে :
“ ‘নিজের মেয়ের বান্ধবী বর্ষার সাথে কেন জড়াতে গেলাম? এই প্রশ্নটি আমি অনেকবারই করেছি নিজেকে। আমার প্রথম স্ত্রী গোলনূরকে নিয়ে আমার তো কোনো আক্ষেপ ছিল না। তারপরও আমি আস্তে আস্তে বর্ষার দিকে ঝুঁকেছি। পরিবার, সমাজ সংসার সবকিছুকে তোয়াক্কা না করে এগিয়ে নিয়ে গেছি এই সম্পর্কটি আমার নিজের মেয়ে আর ছেলে লজ্জায় ঘৃণায় আমাকে পরিত্যাগ করেছে। এখন জীবনের এ পর্যায়ে এসে স্বীকার করতেই হচ্ছে আমি একজন উভকামী। হতে পারে এটা আমার এক ধরণের রোগ। মৃত্যুরদ্বারপ্রান্তে এসে আমি আরো স্বীকার করছি আমি একজন পেডেরাস্ট ছিলাম…”
পাণ্ডুলিপি থেকে মুখ তুলে তাকাল হামিদ কায়সার। “উভকামী!? পেডেরাস্ট!? আবেদ ভাই, অল্পবয়সি মেয়েদের ব্যাপারে জায়েদ রেহমানের ঝোঁক ছিল জানতাম কিন্তু উভকামী, পেডেরাস্ট!?”
আবেদ আলী কাঁধ তুলল। “আমি অবশ্য এ রকম কোনো কথা শুনিনি।”
“জায়েদ সাহেব নিজের বারোটা বাজালেও আপনার কিন্তু কপাল খুলে দিয়ে গেছে।”
আবেদ আলীও জানে সেটা। তবে মুখে কিছু বলল না।
“আমি কোনো বাঙালী লেখকের আত্মজীবনীতে এ রকম সাহসী কথা পড়িনি। সাহিত্যিকদের মধ্যে একমাত্র ফরাসি ঔপন্যাসিক আঁদ্রে জিদই প্রথম নিজেকে পেডেরাস্ট বলে স্বীকার করেছিলেন।”
“কিন্তু পাঠক ব্যাপারটা কিভাবে নেবে বলে মনে করেন?” জানতে চাইল আবেদ আলী।
“কমার্শিয়ালি এটা হবে এ দেশের সবচাইতে বেশি বিক্রিত বই, এটা আমি বলতে পারি…আর পাঠক কিভাবে নেবে? উমমম…একেকজন একেকভাবে নেবে। কেউ হয়তো জায়েদ রেহমানের এই স্বীকারোক্তিটাকে সাধুবাদ জানাবে, কেউ হয়তো তার এসব কথা পড়ে তাকে আরো বেশি ঘৃণা করবে। কিন্তু যা-ই করুক না কেন পকেট ভারি হবে আপনারই।”
আবেদ আলী এবারো কিছু বলল না। যেন জবাব দেবার হাত থেকে বাঁচার জন্যেই ভদকার গ্লাসটা তুলে নিয়ে চুমুক দিতে লাগল।
এমন সময় ড্রইংরুমে এসে হাজির হলো আর্টিস্ট মাসুম তারেক। বাড়ির কাজের লোককে আগে থেকেই বলে রাখা ছিল সে এলে তাকে যেন সরাসরি ড্রইংরুমে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
“আরে আর্টিস্ট,” আবেদ আলী উঠে দাঁড়াল। “আসো আসো। এখনও পুরো একটা বোতল ইনট্যাক্ট আছে।”
প্রথমে আবেদ আলী এবং পরে কবি হামিদ কায়সারের সাথে হাত মিলিয়ে কার্পেটের উপর বসে পড়ল সে। “ভাই, সেই বিকেল থেকে আপনার কাজ করে যাচ্ছি, একদম টায়ার্ড। আগে মাল দিন। একটু টেনে দম নিয়ে নেই।”
আবেদ আলী হাসতে হাসতে আর্টিস্টের জন্য এক গ্লাস ভদকা ঢেলে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আমার কাজ কতো দূর?”
কথাটা আমলেই নিলো না আর্টিস্ট। পুরো এক গ্লাস ভদকার অর্ধেকটা এক ঢোকে শেষ করে হাসি হাসি মুখে তাকাল আবেদ আলীর দিকে। “ফাটাফাটি একটা কভার করেছি। এতো দ্রুত এ রকম ভালো কাজ জীবনেও করিনি।”
“পুরো কাজ শেষ?”
গ্লাসের বাকিটুকু শেষ করে ফেলল আর্টিস্ট মাসুম তারেক। “শেষ!”
“কোন্টার কথা বলছো, ভদকার না আমার কাজের?” আবেদ আলী ঠাট্টাচ্ছলে বলল।
দাঁত বের করে হাসল মাসুম তারেক। “দুটোই।”
তারা তিনজনেই হো হো করে হেসে উঠল একসঙ্গে।
.
অধ্যায় ৩৩
পাভেল আহমেদের দু’চোখ বিস্ফারিত হয়ে আছে। মুখ শক্ত করে বাধা সেজন্যে কোনো কথা বলতে না পারলেও এক ধরণের চাপা গোঙানী বের হচ্ছে।
তার সামনে যে লোকটি তার দিকে ঝুঁকে আছে সে একেবারেই ধীরস্থির আর শান্ত। দেবদূতের মতো ফুটফুটে চেহারার এই যুবককে এ শহরে হাতেগোনা যে অল্প কয়েকজন লোক চেনে তাদের মধ্যে পাভেলও রয়েছে। ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে অনেক সন্ত্রাসী আর মাস্তানের মুখোমুখি হয়েছে সে কিন্তু তার সামনের এই যুবকটি সেরকম কেউ না, আর এটাই হলো তার ভয়ের কারণ।
একজন পেশাদার খুনি!
একটা ভয় জেঁকে বসল তার মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে সারা গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল। যুবকটি ঠিক তার সামনে আরেকটা চেয়ারে বসে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল পাভেলের দিকে।
“তুমি জানো আমি কেন এখানে এসেছি।” খুব কোমল করে বলল কথাটা।
গোঙানীর মতো একটা শব্দ করল পাভেল।
“ওটা কোথায়?” জানতে চাইল অজ্ঞাত যুবক।
আবারো গোঙানী হলো।
“ও!” কোমর থেকে একটা অটোমেটিক পিস্তল বের করল সে। “আমি এখন তোমার মুখের বাধন খুলে দেবো, তুমি শুধু বলবে ওটা কোথায় রেখেছে। এর থেকে বেশিও না…কমও না। ঠিক আছে?”
পাভেল আহমেদ বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল।
“আমার কথা বুঝতে পারছো?”
উদভ্রান্তের মতো মাথা দোলাল সে।
“গুড।”
মুখের বাধন খুলে দেবার পর পাভেল আহমেদ বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে নিলো। কিন্তু যুবকের হাতে পিস্তলটা দেখে চিৎকার করার সাহস দেখাতে পারল না।
“ওটা কোথায় রেখেছো?” আবারো জানতে চাইল সে।
“কিসের কথা বলছেন?” ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল পাভেল আহমেদ।
নিঃশব্দে মাথা নাড়ল যুবক। যেন অবুঝের মতো একটা কথা বলে। ফেলেছে সাংবাদিক। “যে জিনিস তুমি দু’বার বিক্রি করতে চাইছো।”
“আমাকে খুন করবেন না। প্লিজ। আমি ওটা দিয়ে দিচ্ছি। প্লিজ। আমাকে।”
হিস্ শব্দ করে মুখে আঙুল দিয়ে তাকে থামিয়ে দিল অজ্ঞাত যুবক। “শুধু ওটা কোথায় রেখেছো সেটাই বলবে। অন্য কিছু না,” বলেই পিস্তলটা তার মুখের সামনে তুলে ধরল।
“ঐ যে…টিভির পাশে যে ড্রয়ারটা আছে…”
“কোন্ ড্রয়ারে?”
“উপরেরটায়…” বলেই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল পাভেল।
যুবক ড্রয়ারটা হাতরে ক্যাসেটটা পেয়ে গেল খুব সহজেই। পাভেলের দিকে দেখিয়ে বলল, “এটাই তো?”
“হ্যাঁ…”
পকেটে ভরে রাখল সেটা। তারপর আবারো পাভেলের সামনে এসে বসল সে। “আর কোনো ব্যাকআপ রেখেছো?”
“না।”
মুচকি হাসল যুবক। “এখনও সময় আছে, পরে যদি জানতে পারি আরেকটা রেখে দিয়েছো তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হবে।”
পাভেল আহমেদ একটু আশার আলো দেখতে পেল। তার মানে আমাকে এখন খুন করবে না! “সত্যি বলছি। আর কোনো কপি নেই। আপনি পুরো ঘর তল্লাশী করে দেখতে-”
হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল দেবদূতের মতো দেখতে যুবকটি। পাভেল এতোক্ষণে খেয়াল করেনি বিছানার সাইডটেবিলের উপর একটা বিদেশি মদের বোতল আর একটা গ্লাস রাখা আছে। যুবক সেই বোতলটা হাতে তুলে নিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে পাভেলের সামনে এসে বসল আবার। “তোমার ঘরে একটাই গ্লাস দেখতে পাচ্ছি। মেহমান এলে কিভাবে আপ্যায়ন করো কে জানে। সমস্যা নেই। আমি গ্লাসে খাচ্ছি। তুমি বোতল থেকে খাও।” বলেই বোতলটা বাড়িয়ে দিল পাভেলের দিকে।
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল পাভেল।
“খাও।” তাড়া দিল যুবক।
“বারে অনেক খেয়েছি…আর খেতে ইচ্ছে করছে না।”
“তোমাকে এখন খেতেই হবে। অর্ধেক বোতল খেয়ে মাতাল হবে তারপর আমি তোমার কাছ থেকে কিছু সত্য কথা জেনে নেবো। আমি জানি, মাতাল না হলে তুমি সত্য বলবে না।”
“আপনি আমাকে বলুন, আমি সব বলবো। যা জানতে চান-”
যুবক তার পিস্তলটা পাভেলের কপালে ঠেকালো। “আমি যা বলবো তাই করবে। কোনো প্রশ্ন করবে না।”
“ঠিক আছে। খাচ্ছি,” কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল পাভেল। “এটা সরিয়ে রাখুন। আমি খাচ্ছি।” পিস্তলের দিকে ইঙ্গিত করল সে।
যুবক পিস্তলটা নামিয়ে রাখল। পাভেলের হাত-পায়ের বাধন না খুলেই বোতলটা তার মুখে ঠেসে ধরল সে। ভয়ে বাধ্য ছেলের মতো আকণ্ঠ পান করে গেল পাভেল আহমেদ। জীবনে আর কখনও মদ নামক জিনিসটা এতো বিস্বাদ আর তেতো লাগেনি তার কাছে। বুঝতে পারল প্রচণ্ড ভয়ে খাচ্ছে বলে এমনটি হচ্ছে।
বোতলটা অর্ধেকের মতো খালি হয়ে গেলে যুবক সেটা তার মুখ থেকে সরিয়ে নিজের চোখের সামনে তুলে ধরল। “চলবে।” কথাটা বলেই বোতলটা বিছানার উপর ফেলে দিলে বোতলের বাকি মদ গড়িয়ে পড়ল সেখানে।
পাভেল আহমেদ বিস্ময়ে চেয়ে রইল সেদিকে। তারপর যুবকের দিকে ফিরে বলল, “কি জানতে চান, বলুন?”
যুবক স্থির চোখে তাকাল তার দিকে। নিজের মুখের কাছে তর্জনী এনে চুপ করতে ইশারা করে পিস্তলটা পাভেলের মুখের কাছে ধরে শান্ত কণ্ঠে বলল, “আমি এখন চলে যাবো। মনে রাখবে তোমার সাথে আমার দেখা হয়নি…তুমি আমাকে চেনো না। ঠিক আছে?”
পাভেল আহমেদ ভয়ে মাথা নেড়ে সায় দিল।
“তুমি বেশ বুদ্ধিমান। আশা করি বাকিটা আর বলে দিতে হবে না।”
“বুঝতে পেরেছি। কিছু বলবো না। কাউকে কিছু বলবো না।”
“গুড।” যুবক এরপর পাভেলের হাত-পায়ের বাধন খুলে দিয়ে পাভেলকে উঠে দাঁড়াতে বলল। “আমি চলে গেলে চুপচাপ দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকবে। কাউকে ফোন করবে না।”
পাভেল মাথা নেড়ে সায় দিল আবারো।
“আমি বাইরে থেকে কিছুক্ষণ লক্ষ্য রাখবো। তুমি যদি কিছু করো…”
“আমি কিছু করবো না। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, কাঁপাকাপা গলায় বলল পাভেল।
পাভেলের গালে আলতো করে চাপড় মেরে দরজার দিকে পা বাড়াল সে। দরজাটা আস্তে করে খুলে সিঁড়ির দিকটা দেখে নিয়ে পাভেলের দিকে ফিরল আবার। “যা বললাম তাই করবে।”
পাভেল উদভ্রান্তের মতো মাথা দোলাল। এই দানব যতো জলদি তার ঘর থেকে বের হয়ে যায় ততই মঙ্গল।
“গুড,” বলল অজ্ঞাত যুবক। “আরেকটা কথা মনে রাখবে…কোটিকোটি টাকার মালিকদের কখনই ব্ল্যাকমেইল করবে না…” কথাটা বলেই বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিল সে।
পাভেল আহমেদ সঙ্গে সঙ্গে দরজার লক বন্ধ করে দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেন। প্রচুর মদ খাওয়াতে মাথাটা চক্কর দিতে শুরু করেছে। বিছানার উপর ধপাস করে বসে পড়ল সে। এ যাত্রায় অল্পের জন্যে বেঁচে গেছে। এখনও ভয়ে থর থর করে কাঁপছে তার সারা শরীর।
কিছুক্ষণ পরই টের পেল তার নিশ্বাস আবার দ্রুত হয়ে উঠছে। কিন্তু কেন বুঝতে পারল না।
দশ মিনিট পর হাত-পা মৃগীরোগীর মতো কাঁপতে শুরু করলে অজানা এক আশঙ্কায় পাভেল আহমেদ পকেট হাতরিয়ে মোবাইলটা বের করার চেষ্টা করল।
নেই!
মোবাইলটা গেল কোথায়?
দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। বিছানা থেকে উঠে দরজার কাছে এগোতেই বুঝতে পারল দুপা অবশ হয়ে গেছে।
হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মেঝেতে।
*
পাভেল আহমেদের বাড়ি থেকে দুশ গজ দূরে এক নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে কালো জ্যাকেট আর কালো প্যান্ট পরা দেবদূতের মতো দেখতে এক যুবক ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে।
রাস্তার পাশে ফুটপাতে প্রচণ্ড শীতের রাতে চট আর ছেঁড়াফাড়া কম্বল মুড়ে কুঁকড়ে পড়ে আছে এক বুড়ো। যুবকটি সেই লোকের দিকে এগিয়ে গেল। আস্তে করে হাঁটু মুড়ে বুড়োর পাশে একটা দামি মোবাইল ফোন রেখে আবার হাঁটতে লাগল ধীর পায়ে।
.
অধ্যায় ৩৪
লেখক জায়েদ রেহমান খুন হবার তিন দিন পর তার আত্মীয়স্বজনের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হলো। পোস্টমর্টেম খুব দ্রুত সম্পন্ন হলেও আইনগত কিছু ঝামেলার কারণে এই দেরি। ঐ দিন বিকেলেই তার জানাযা শেষে দাফন করার সমস্ত আয়োজন করা হয়েছে।
এদিকে বিস্ময়করভাবেই দ্রুততার সাথে জায়েদ রেহমানের সর্বশেষ বই কথা’র কাজ শেষ করে ফেলেছে প্রকাশক আবেদ আলী। এমনিতে একটি পত্রিকা রাখলেও আজকের জন্যে তিনটি দৈনিক পত্রিকা রেখেছে সে। জায়েদ রেহমানের নতুন বইয়ের চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন দিয়েছে এইসব পত্রিকায়।
তিনটি পত্রিকা খুলেই আবেদ আলী বিজ্ঞাপনগুলো ভালো করে দেখে সন্তুষ্ট হলো। সে নিশ্চিত প্রকাশনা ব্যবসার সবাই নড়েচড়ে বসবে এই বিজ্ঞাপনগুলো দেখে। বিজ্ঞাপনের ভাষা লিখে দিয়েছে তার কবি বন্ধু হামিদ কায়সার। একেবারে ভিন্নভাবে তৈরি করা হয়েছে এই বিজ্ঞাপনটি। যতোই দেখছে আবেদ আলী ততোই মুগ্ধ হচ্ছে। জায়েদ রেহমানের চমৎকার একটি রঙ্গিন ছবি, তার পাশে সাদা আর হলুদ রঙের অক্ষরে কিছু কথা লেখা :
খুন হবার কিছুক্ষণ আগে জনপ্রিয় লেখক জায়েদ রেহমান তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে একটি ই-মেইল করে নিজের এই আত্মজীবনীটি প্রকাশ করার তাগিদ দেন …যতো বাধাই আসুক এই বইটি প্রকাশ কোরো…তোমার সাথে হয়তো আর দেখা হবে না…আমাকে ক্ষমা করে দিও…! না। আমরা কোনো বাধাই তোয়াক্কা করিনি। লেখকের শেষ ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে প্রকাশ করা হলো কথা! এটি জায়েদ রেহমানের শেষ কথা! এটি তাঁর সব কথা!
দু’দিন অমানুষিক পরিশ্রম করে একটি অসাধ্য কাজ করেছে সে। লেখক জায়েদ রেহমানের লাশ দাফন হওয়ার আগেই তার সর্বশেষ একটি বই প্রকাশ হতে যাচ্ছে অবয়ব প্রকাশনী থেকে খুব সম্ভবত এ রকম একটি কাজ ইতিহাসেই বিরল।
এমন সময় তার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলে আবেদ আলী সেটা রিসিভ করল। তার কবি বন্ধু হামিদ কায়সার ফোন করেছে।
“হ্যাঁ, কি খবর?”
“নির্মল প্রকাশনী থেকে ফোন করেছিল আপনাকে?” কবি জানতে চাইল।
“না!” বিস্মিত হলো আবেদ আলী। “ওরা কেন আমাকে ফোন করবে?”
এই নির্মল প্রকাশনী হলো আবেদ আলীর দু’চোখের বিষ। কাপড় ব্যবসায়ি থেকে প্রকাশক বনে যাওয়া এক অর্বাচীন শুধুমাত্র টাকার জোরে লেখক জায়েদ রেহমানকে তার কাছ থেকে অনেকটা ছিনিয়ে নিয়েছে দু’বছর আগে।
“ওরা তো আজব একটা কথা বলছে…”
“কি বলছে?” উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল অবয়ব প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী।
“বলছে লেখক জায়েদ রেহমানের সর্বশেষ বইয়ের পাণ্ডুলিপি না কি তাদের কাছে আছে। তারাই না কি এর বৈধ প্রকাশক।”
আবেদ আলী ক্রোধে ফেঁটে পড়ল। “তাদের কাছে যদি সত্যি পাণ্ডুলিপিটি থেকে থাকে তাহলে প্রকাশ করছে না কেন!?” দু’বছর ধরে তারা জায়েদ রেহমানকে কজা করে রেখেছিল, এখন আবার নতুন নাটক শুরু করেছে। “কে ফোন করেছিল?”
কবি হামিদ কায়সার শান্ত কণ্ঠে বলল, “একটু আগে বিজ্ঞাপন দেখে কুদরত সাহেব নিজে আমাকে ফোন করে বললেন।”
এই কুদরত সাহেব হলো নির্মল প্রকাশনীর মালিক।
“আচ্ছা,” বলল আবেদ আলী। “আর কি বলল?”
“বলল বইটা যদি প্রকাশ করা তাহলে সে না কি আদালতে যাবে।”
একটু ভাবলো আবেদ আলী। “আদালতে গেলে যাবে আমার কি করার আছে? আমি তো বইটা চুরি করে আনিনি, জায়েদ নিজে আমাকে সেটা দিয়ে গেছে।”
“আমাকে ফোন করে বার বার বলল আমি যেন আপনাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে এ কাজ করা থেকে বিরত রাখি। তা না হলে আজ সন্ধ্যায় তারা না কি একটি প্রেসকনফারেন্স ডাকবে।”
“প্রেসকনফারেন্স ডাকবে!”
“হ্যাঁ।”
“শালার সাহস কতো বড়! আমি হাজার হাজার কপি বই বের করে তাদের ভয়ে গুদামে রেখে দেবো?” আবেদ আলী ক্ষিপ্ত হয়ে গেল। “মনে। করেছে তার এই হুমকিতে আমি পেচ্ছাব করে দেবো, অ্যাঁ?”
“আমার মনে হয় আমার ব্যারিস্টার বন্ধুর সাথে এ নিয়ে কথা বলা দরকার। আপনি কি বলেন?”
“অবশ্যই। এক্ষুণি কথা বলতে হবে।”
“তাহলে আমার এখানে চলে আসুন। দু’জন এক সঙ্গেই যাই।”
একটু ভেবে আবেদ আলী জানাল, “ঠিক আছে, আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে আসছি।”
*
সাংবাদিক পাভেল আহমেদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হলো সকাল দশটার দিকে। বাড়িওয়ালা নিজে কী একটা প্রয়োজনে পাভেল আহমেদের খোঁজ করতে গিয়ে আবিষ্কার করে সাংবাদিক নিজের ঘরে মরে পড়ে আছে।
একটু বেশি পান করে ফেলায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে রাতের কোনো এক সময় মৃত্যু হয়েছে তার-পুলিশ এটাই ধরে নিয়েছে।
ঘরের দরজা ভেতর থেকে লক্ করা ছিল, আর বিছানায় একটা খালি মদের বোতলও খুঁজে পাওয়া গেছে। অতিরিক্ত মদ্যপানই যে মৃত্যুর একমাত্র কারণ সে ব্যাপারে কারোর মনে কোনো সন্দেহ দেখা দিল না। অপমৃত্যুর জন্য কোনো মামলাও রেকর্ড করা হলো না পুলিশের খাতায়। ফলে তার এই মৃত্যু নিয়ে তেমন একটা হৈচৈ হলো না বলা চলে। কারো মনে হলো না জ্বলজ্যান্ত একজন সাংবাদিক এভাবে মরে গেল কেন।
পাভেল আহমেদের ঘরে সব কিছু অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেলেও পুলিশ তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনটি খুঁজে না পেয়ে সেটাতে রিং দিতেই অনেকক্ষণ পর এক বৃদ্ধ ভয়ার্ত কণ্ঠে জবাব দিল। সে জানাল সকালে ঘুম থেকে উঠেই পায়ের কাছে এই ফোনটা পড়ে থাকতে দেখে। নিতান্তই একজন বাস্তুহারা, থাকে পাভেল আহমেদের বাড়ির খুব কাছের একটা ফুটপাতে।
পাভেল আহমেদ একজন সাংবাদিক হলেও তার মৃত্যুর খবর কোনো টিভি চ্যানেল আর পত্রিকায় গুরুত্ব পেল না কারণ এদিনের সবচাইতে বড় খবর ছিল লেখক জায়েদ রেহমানের নামাজে জানাযা এবং তার সর্বশেষ একটি বই প্রকাশের ঘটনা।
লেখকের জানাযা আর সকারের অনুষ্ঠান বেশিরভাগ চ্যানেলই লাইভ ব্রডকাস্ট করল আর পরদিন সমস্ত দৈনিক পত্রিকায় এই একটি খবরই ঠাঁই পেল প্রধান শিরোনাম হিসেবে।
অবশ্য পাভেল আহমেদ যে পত্রিকায় কাজ করতো তারা ভেত দু’কলামের একটা বক্সনিউজ করলেও অন্য দুয়েকটি পত্রিকা এক কলামে ছোট্ট একটা দায়সারাগোছের নিউজ করল। বাকিরা তাও করল না।
জায়েদ রেহমান সংক্রান্ত সংবাদের ডামাডোলে খবরটা খুব বেশি লোকের চোখেও পড়ল না।
.
অধ্যায় ৩৫
কুদরত হোসেনের মেজাজ বিগড়ে আছে। কোনোভাবেই ঘুম আসছে না তার। এমনিতেই দু’তিন ধরে মনের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না, তার উপর এই ঘটনা তার ব্লাড প্রেসার আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
লেখক জায়েদ রেহমানের মৃত্যুতে কার কি ক্ষতি হয়েছে সে জানে না, সে শুধু জানে, অপরিমেয় ক্ষতি হয়ে গেছে তার। সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মৃত্যু হলে যেমন হয় আর কি।
এই যে তার আজকের প্রতিষ্ঠা সেটা তো এককভাবে লেখক জায়েদ রেহমানের কল্যাণেই সম্ভব হয়েছে। প্রকাশক হিসেবে সম্মান আর প্রতিপত্তির সাথে কোটি টাকার মালিকও বনে গেছে সে। তাই জায়েদ রেহমানের মৃত্যুতে অনেক কষ্ট পেলেও মেনে নিয়েছিল। জন্ম-মৃত্যুর উপর তো মানুষের হাত থাকে না। সবাইকে একদিন না একদিন মরতেই হয়। কিন্তু অবয়ব প্রকাশনী এ কী বলছে! জায়েদ রেহমান তার শেষ বইটা তাদেরকে দিয়ে গেছে!?
এই বইটির কাজ লেখক শুরু করেছিলেন তার হার্ট অ্যাটাক হবারও আগে, ওপেন-হার্ট সার্জারির পর পরই। সে জানে, এখনও ওটা শেষই হয়নি, অথচ অবয়ব প্রকাশনী আজকে বইটি প্রকাশ করে ফেলেছে!
অসম্ভব।
বেশ বড় একটা বই-ধীরে ধীরে সময় নিয়ে লিখছিলেন লেখক। কুদরত হোসেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল বইটির লেখা শেষ হবার জন্য। এ বাবদ কয়েক লাখ টাকাও দিয়ে দিয়েছিল লেখককে। গত সপ্তাহে যখন জায়েদ রেহমানের সাথে দেখা করতে গেল তখনও লেখক তাকে জানালেন বইয়ের কাজ অনেকটুকুই বাকি আছে। তাকে কথা দিলেন, সামনের বই মেলার ঠিক আগে কাজটা শেষ করতে পারবেন বলে। বই মেলা আসতে তো এখনও দেড়মাস বাকি। এই সময়ের মধ্যে অবশ্যই লেখাটা শেষ করতে পারতেন।
তাছাড়া মিসেস রেহমানের সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। জায়েদ রেহমান খুন হবার আগের দিনও তার সাথে কথাবার্তা হয়েছে, মিসেস রেহমান বলেছিল জায়েদ রেহমান না কি এখন অন্য একটা উপন্যাস লিখছে, আত্মজীবনীর কাজ আপাতত বন্ধ আছে।
কোনোভাবেই হিসেব মেলাতে পারছে না কুদরত হোসেন। মিসেস রেহমান নিজেই এখন খুনের দায়ে জেলে আছে, সে থাকলে জানা যেতো আসলে কি হয়েছে।
বিগত দু’বছর ধরে যে লেখকের বই ছেপে যাচ্ছে সে তার সবচাইতে আলোচিত এবং সাড়া জাগানো বইটি কি না ছেপে বসেছে অবয়ব প্রকাশনীর আবেদ আলী! এই আবেদ আলী লোকটি যেমন তাকে অপছন্দ করে ঠিক তেমনি সেও তাকে প্রচণ্ড ঘৃনা করে।
কী অহংকার। তাকে বলে কি না অশিক্ষিত প্রকাশক! তার কাপড়ের ব্যবসার কথা ইঙ্গিত করে সবার কাছে বলে বেড়ায় হাঁটু ভেঙে যে বসে বসে কাপড় কাটতো সে হয়েছে প্রকাশক!
এখন এই উন্নাসিক আর অহংকারী লোকটা তাকে টেক্কা মেরে দিয়েছে। এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। তার সাথেই তো জায়েদ রেহমান কথাই বলতো না!
অসম্ভব!
প্রেসকনফারেন্স করেছে আজ সন্ধ্যার দিকে, তার আগে বিকেলের দিকে আদালতে গিয়ে মামলাও করে এসেছে কিন্তু তাতে কিছুই হচ্ছে না। বইটা হটকেকের মতো বিক্রি হচ্ছে। আদালত থেকে নিষেধাজ্ঞা চেয়েছিল কিন্তু সেটা পাওয়া যাবে এক সপ্তাহ পর।
নিজের টেনশন দূর করার জন্য স্লিপিং পিল খেলো কুদরত হোসেন। এক ঘন্টা আগেও একটা খেয়েছিল কাজ হয়নি।
বেডসাইড ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ১২:৫০।
তার পাশেই তার বউ কী নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। এভাবে ঘুমাতে পারলে হাই প্রেসারটা একটু নিয়ন্ত্রণে আনা যেতো। দুচোখ বন্ধ করে মাথা থেকে সব রকম ব্যবসায়িক চিন্তা বাদ দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল নির্মল প্রকাশনীর কুদরত হোসেন।
মাঝরাতের দিকে তার ঘুম ভেঙে গেল ল্যান্ডফোনের রিঙের শব্দে। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে উঠে বসল বিছানায়। এতো রাতে কোন্ গর্দভ ফোন করল তাকে?
রিংঙের শব্দে তার বউয়েরও ঘুম ভেঙে গেল। “আরে ফোনটা ধরো না।”
ফোনটা তুলে নিলো কুদরত হোসেন। “হ্যালো!”
“আমি মোরশেদ, স্যার,” একটা কণ্ঠ বলল তাকে।
“মোর্শেদ…?” কুদরত সাহেবের নির্মল প্রকাশনীর ম্যানেজার।
“স্যার”
“এতো রাতে আমাকে কেন ফোন করেছো?” তার কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে জানতে চাইল কুদরত হোসেন।
“স্যার, আমাদের অফিসে চুরি হয়েছে। ওখানকার দারোয়ান একটু আগে আমাকে ফোন করে জানাল।”
“কি?” কুদরত সাহেব নড়েচড়ে বসল।
“আমি এখন ওখানেই যাচ্ছি। পুলিশকে খবর দেয়া হয়েছে।”
“অফিসে চুরি হয়েছে! ওখানে তো আমরা টাকা-পয়সা রাখি না। শুধু কিছু বই আর…” কুদরত হোসেন আর বলতে পারল না। “হায় হায়!”
“স্যার…?” উদ্বেগের সাথে বলল ম্যানেজার।
“জলদি যাও। দ্যাখো কি কি চুরি হয়েছে…”
কুদরত সাহেব জানে তার কম্পিউটারে অনেক বইয়ের পাণ্ডুলিপি রয়েছে কিন্তু সেটা তো চুরির করার মতো বস্তু নয়। পাণ্ডুলিপি চুরি করলেই তো আর সেটা প্রকাশ করা যাবে না। তাহলে…?
“জি, স্যার,” বলল ম্যানেজার। “আপনি চিন্তা করবেন না, আমি এক্ষুণি যাচ্ছি ।”
“হ্যাঁ, ওখানে গিয়ে আমাকে জানাও কি চুরি হলো।”
“ঠিক আছে, স্যার।”
কুদরত সাহেব ফোনটা রেখে দিল। টের পেল হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। তার প্রকাশনা অফিসে চুরি করার মতো এমন কিছু থাকে না।
তবে হ্যাঁ, একটা জিনিস আছে যেটা চোরের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে। খুব সম্ভবত সেটাই চুরি হয়েছে।
.
অধ্যায় ৩৬
লেখক জায়েদ রেহমানকে চিরনিদ্রায় শায়িত করতে না করতেই তার সর্বশেষ বইটি নিয়ে আরেকটি নতুন বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে, আর ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত গড়িয়েছে আদালতে।
এই খবরটা ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগকে বেশ কৌতূহলী করে তুলল। সে জানে অবয়ব প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী আবেদ আলীকে লেখক নিহত হবার কিছুক্ষণ আগে এই বইটি মেইল করে দিয়ে গেছেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে বিগত দু’বছর ধরে জায়েদ রেহমানের বই যে প্রকাশনী থেকে বের হচ্ছিল সেই নির্মল প্রকাশনী দাবি করছে তাদের কাছে লেখকের আত্মজৈবনীমূলক উপন্যাস কথা’র পাণ্ডুলিপি রয়েছে। তারাই না কি এই বইটি প্রকাশ করার একমাত্র আইনগত অধিকার রাখে।
তবে নির্মল প্রকাশনীর মালিক কুদরত সাহেব দেরি করে ফেলেছে। লেখক জায়েদ রেহমানকে যে দিন কবর দেয়া হলো সেদিনই কথা নামের তার সর্বশেষ বইটি প্রকাশ হয়ে যায়। সকালবেলা দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখেই ভদ্রলোক প্রথম জানতে পারে জায়েদ রেহমানের এই বইটি আজ অবয়ব প্রকাশনী থেকে বের হচ্ছে। আদালতের শরণাপন্ন হবার আগেই হু হু করে বিক্রি হয়ে গেছে কয়েক হাজার কপি। শোনা যাচ্ছে আদালতে যাবার বিষয়টি আর এ সংক্রান্ত বির্তকের খবর জানাজানি হবার পর বইয়ের বিক্রি আরো কয়েকগুন বেড়ে গেছে।
আবেদ আলীকে কোনোভাবেই থামিয়ে রাখা যায়নি। জেফরি অবশ্য জানে তাকে থামানোর মতো আইনগত ভিত্তিও তাদের ছিল না। তারপরও চেষ্টা করেছিল।
জামানের কথাই ঠিক। ব্যবসায়ি ভদ্রলোক লাভের গন্ধ আঁচ করতে পেরে ঠিক সময় দান মেরে দিয়েছেন।
তবে কুদরত সাহেবও বসে নেই, আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে সে। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় বেশ খবর হয়েছে। ক্রমশ ঘোলা হয়ে উঠছে পরিস্থতি। শুরুতে যে কেসটাকে মনে হয়েছিল পানির মতো সহজ এখন সেটা ঘোলা পানির মতো অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে; জেফরির আশঙ্কা শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা কাদার মতো দলা পাকিয়ে পিচ্ছিল না হয়ে যায়!
এই মুহূর্তে জেফরির হাতে তিনটি রিপোর্ট আছে : জায়েদ রেহমানের পোস্টমর্টেম এবং সিগারেট ফিল্টার থেকে পাওয়া সালিভার রিপোর্ট আর পলিগ্রাফ টেস্টের প্রিন্ট কপি।
লেখক জায়েদ রেহমানকে শ্বাসরোধ করে নয়, বরং তার বুকে প্রচণ্ড আঘাত করে হার্টের বাল্ব অকেজো করে হত্যা করা হয়েছে। আর সিগারেট ফিল্টারে যে লালা বা সালিভা পাওয়া গেছে সেটা অবধারিতভাবেই মিসেস রেহমানের প্রেমিক আলম শফিকের।
কিন্তু তারচেয়ে বড় একটা তথ্য হলো গতকাল পুলিশ রিমান্ডে মিসেস রেহমান আর আলম শফিক এই হত্যাকাণ্ডে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা একদম অস্বীকার করেছে। জেফরি ভেবেছিল পুলিশ রিমান্ডে হয়তো আসামীরা হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে নেবে।
জেফরি বেগের কাছে এগুলো নতুন কোনো তথ্য নয়, তারপরও তার মনে ক্ষীণ আশা ছিল ফরেনসিক রিপোর্টে হয়তো এমন কিছু থাকবে যা তার সন্দেহকে দৃঢ় করবে। কিন্তু আবারো গোলকধাঁধার মতো কানাগলিতে ফিরে এসেছে সে। সেই সাথে পুলিশ রিমান্ডে আসামীদের স্বীকারোক্তি তাকে অনেকটাই ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। তার মনে হচ্ছে না মিসেস রেহমান আর তার প্রেমিক আলম শফিক এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি এখন এমনই যে, সে যদি বলে লেখক জায়েদ রেহমানের হত্যাকাণ্ড অন্য কেউ করেছে তাহলে তাকে পাগল ভাববে সবাই।
গতকাল লেখক জায়েদ রেহমানের নতুন উপন্যাসটির উল্লেখযোগ্য অংশ হাইলাইটস করে মেইল করে পাঠিয়েছে তার সহকারী জামান। তারপর থেকে কম্পিউটারের সামনে বসে বসে অনেকখানিই পড়েছে। এই বইটি যে পড়বে তার বদ্ধমূল ধারণা হবে খুনটা করেছে মিসেস রেহমান আর তার প্রেমিক।
জায়েদ রেহমান যে তার অল্পবয়সি স্ত্রীকে সন্দেহ করতেন, তার কাছ থেকে খারাপ কিছুর আশঙ্কা করতেন সেসবের অনেক বর্ণনা রয়েছে বইতে। এমন কি মিসেস রেহমান কয়েক মাস ধরে লেখককে তার সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি তার এবং শিশু সন্তানের নামে লিখে দেয়ার জন্যে রীতিমতো চাপও দিচ্ছিল।
যতোই পড়ছে ততোই অবাক হচ্ছে সে। এ বই প্রকাশ হলে জায়েদ রেহমান সম্পর্কে যেসব মুখরোচক গালগল্প চালু আছে সেগুলো আরো দৃঢ় হবে, তার নিন্দুকেরা হয়ে উঠবে আরো উৎসাহী। এ রকম একটি লেখা প্রকাশ করার জন্য জীবনের অন্তিম মুহূর্তে লেখকের মরিয়া হয়ে ওঠার কোনো কারণই খুঁজে পাচ্ছে না জেফরি।
আর পড়তে ইচ্ছে করছে না বলে কম্পিউটারটা বন্ধ করে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে জায়েদ রেহমানের হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাবতে লাগল সে।
লেখক জায়েদ রেহমানের মৃত্যুতে সবচাইতে লাভবান হয়েছে কে?
অবধারিতভাবেই উত্তরটা হতে পারতো মিসেস রেহমান কিন্তু ভদ্রমহিলা এখন যে অবস্থায় আছে তাতে করে এ কথা বলার আর কোনো জো নেই। বেনিফিসিয়ারি তত্ত্ব দিয়ে সব সময় সব ঘটনাকে বিচার করা ঠিক নয়। অনেক সময় দৃশ্যমান সুবিধাভোগী আদতে কোনো সুবিধাই পায় না। আর কে লাভবান হচ্ছে না হচ্ছে সেটা বের করাও খুব একটা সহজ নয়।
তারপরও জেফরি জানে এখন পর্যন্ত জায়েদ রেহমানের মৃত্যুতে একজনই সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে : প্রকাশক আবেদ আলী।
তাকে কেউ সন্দেহের চোখে দেখছে না, অথচ লেখকের মৃত্যুর পর সে এখন কোটি টাকার মুনাফার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। সমস্ত সন্দেহ মিসেস রেহমান আর তার প্রেমিকের উপর নিবদ্ধ। তাদেরকে কোনোভাবেই বেনিফিশিয়ারি বলার উপায় নেই।
জায়েদ রেহমানের শেষ বইটি এমন একজন প্রকাশক দাবি করে বসেছে। যে কি না বিগত দু’বছর ধরে জায়েদ রেহমানের সমস্ত বই প্রকাশ করে আসছে। আবেদ আলীর সাথে লেখকের কথাবার্তা পর্যন্ত বন্ধ ছিল অথচ তাকেই দিয়ে গেলেন নিজের শেষ বইটি?
নিজের মনে উদয় হওয়া ভাবনাটি নিজের কাছেই খুব বেশি উর্বর কল্পনা বলে মনে হচ্ছে। তারপরও এ জগতে অনেক অসম্ভব ঘটনার মতো এই দূরকল্পনাটিও যে সম্ভব হতে পারে সেটা জানে জেফরি বেগ।
আবেদ আলীকে নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় এসে গেছে।
মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে একটা নাম্বারে ডায়াল করল সে।
“হ্যাঁ, জামান, কোথায় আছো?”
“অফিসে, ওপাশ থেকে তার সহকারী জামান জবাব দিল।
“নির্মল প্রকাশনীর প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ করে তার কাছ থেকে জায়েদ রেহমানের শেষ বইয়ের পাণ্ডুলিপিটা জোগাড় করার চেষ্টা করবে। উনি হয়তো দিতে চাইবেন না কিন্তু তুমি তাকে বোঝাবে, সেটা দিলে আমরা আবেদ আলীর ব্যাপারে একটু তদন্ত করে দেখবো জায়েদ রেহমানের হত্যাকাণ্ডের সাথে ভদ্রলোকের কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি না। বুঝেছো?”
জামান বুঝতে পেরেছে। এই মুহূর্তে নির্মল প্রকাশনীর প্রকাশক আবেদ আলীর উপর মহা ক্ষেপে আছে। এসব বললে ভদ্রলোক সোৎসাহে পাণ্ডুলিপি দিয়ে দেবে।
“ঠিক আছে, স্যার। আমি তার সাথে যোগাযোগ করে আপনাকে জানাচ্ছি।”
ফোনটা রেখে দিল বেগ।
জেফরির সহকারী জামান ইয়েলো পেজ ঘেঁটে নির্মল প্রকাশনীর নাম্বারটা বের করে সেখানে ফোন করলে তিনচার বার রিং হবার পর একজন ফোনটা ধরল।
“আমি একটু আপনাদের প্রকাশকের সাথে কথা বলতে চাইছিলাম,” বলল জামান।
“কোত্থেকে বলছেন?” ওপাশ থেকে জানতে চাইল।
“হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট।” কোনো সাড়া শব্দ নেই।
“হ্যালো?” জামান তাড়া দিল।
“জি, বলছি,” জবাবে বলল একটা কণ্ঠ।
“আমি আপনাদের প্রকাশকের সাথে—”
“জি, আমিই প্ৰকা ক…বলুন।”
“আপনার নাম?”
“কুদরত হোসেন।”
“কুদরত সাহেব, আমি হোমিসাইড থেকে সহকারী ইনভেস্টিগেটর জামান আহমেদ বলছি।”
“জি, বলুন?” কণ্ঠটা ভয়ার্ত শোনাচ্ছে এখন।
“আমি লেখক জায়েদ রেহমান হত্যাকাণ্ডের সহকারী ইনভেস্টিগেটর। আপনারা দাবি করছেন লেখক তার সর্বশেষ বইটির পাণ্ডুলিপি আপনাদের দিয়ে গেছেন-”
“জি।”
“আপনারা তো এই বিষয়টা আদালতে নিয়ে গেছেন, তাই না?”
“জি। গতকালকেই আমরা আদালতে একটি আর্জি দিয়েছি।”
“আপনাদের কাছে জায়েদ রেহমানের যে পাণ্ডুলিপিটা আছে সেটার একটা কপি আমাদেরকে দিতে হবে।”
ওপাশ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
জামান বলতে লাগল। “আমরা জায়েদ সাহেবের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে আবেদ আলীকে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাচ্ছি। তো আপনাদের কাছে থাকা উনার পাণ্ডুলিপিটা আমাদের হাতে থাকলে অনেক সাহায্যে আসবে।”
ওপাশ থেকে যেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলার আওয়াজ শোনা গেল। “কিন্তু সেটা তো আমরা আপনাকে দিতে পারবো না।”
জামান অবাকই হলো। সাধারণত হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টকে সবাই সমীহ করে। আজ পর্যন্ত কোথাও থেকে সাহায্য চেয়ে বিমুখ হয়নি সে। “কেন দিতে পারবেন না সেটা কি জানতে পারি?”
“ওটা গতকাল রাতে চুরি হয়ে গেছে,” নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল ভদ্রলোক।
.
অধ্যায় ৩৭
জেফরি বেগের সন্দেহটা ক্রমশ গাঢ় হয়ে উঠছে। প্রকাশক আবেদ আলী লোকটার ব্যাপারে আরো ভালো করে খোঁজ খবর নিতে হবে। পুরো ঘটনায় একমাত্র লাভবান এই লোককে নিয়ে আসতে হবে সন্দেহের মাইক্রোস্কোপের নিচে।
জায়েদ রেহমান খুন হবার আগে তাকে একটা মেইল করে সর্বশেষ বইয়ের পাণ্ডুলিপি দিয়ে গেছেন। এখন দেখা যাচ্ছে সেই পাণ্ডুলিপির দাবিদার আরেকজন প্রকাশক। সব কিছু বিবেচনায় নিলে সেই প্রকাশকের দাবিটাই বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়, কিন্তু এখন তার অফিস থেকে পাণ্ডুলিপি চুরির ঘটনায় মনে হচ্ছে তার দাবিটা একেবারেই সত্যি।
জামানকে সঙ্গে নিয়ে জেফরি এখন কুদরত সাহেবের অফিসে এসেছে। যেহেতু হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট এখন আর অফিশিয়ালি এই কেসের তদন্ত করছে না, সেটা অপর্ণ করা হয়েছে পুলিশের উপর তাই ওখানে প্রকাশককে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করাটা ঠিক হবে না বলে নিজেই চলে এসেছে।
তারা বসে আছে কুদরত সাহেবের প্রাইভেট অফিসে। লোকটা হোমিসাইডের নাম শুনে প্রথমে একটু ভড়কে গেলেও এখন খুব সহযোগীতা করছে। বেশ আন্তরিকতার সাথে ব্যবহার করছে তাদের সাথে। কারণটা স্পষ্ট : তার প্রধানতম ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছে ভদ্রলোক।
“আপনি বলছেন মাসখানেক আগে পাণ্ডুলিপিটা হাতে পেয়েছিলেন?” জেফরি প্রশ্ন করল কুদরত সাহেবকে।
“জি।”
“ওটা কি হাতে লেখা ছিল?”।
“না। স্ট্রোকের পর থেকে উনি হাতে লিখতেন না। ল্যাপটপে লিখতেন। পাণ্ডুলিপিটা সফট কপির ছিল।”
“তাহলে কম্পিউটার থেকে ওটা চুরি হয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
অবাক হলো জেফরি।
“চুরির কথা শুনে আমি ভেবেছিলাম অফিসের কম্পিউটার চুরি হয়েছে। কারণ এর আগেও এখান থেকে মূল্যবান কম্পিউটার আর প্রিন্টার চুরি হয়েছিল। কিন্তু আজব ব্যাপার হলো অফিসের তালা ভাঙা থাকলেও জায়েদ রেহামনের পাণ্ডুলিপির প্রিন্ট কপি এবং সিডিটা ছাড়া আর কিছুই খোয়া যায়নি। সকালে এসে কম্পিউটার চেক করে দেখি হার্ডডিস্কও একেবারে ফাঁকা।”
“আপনাদের কাছে কোনো প্রিন্ট করা পাণ্ডুলিপি ছিল না?”
“এক কপি ছিল। সেটাও চুরি হয়েছে।”
“বলেন কি!” জেফরির কাছে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তার মানে আপনাদের কাছে সেই পাণ্ডুলিপির আর কোনো কিছুই নেই…সিডি, প্রিন্ট কপি এমনকি কম্পিউটারে রাখা…সবগুলোই?”
“জি, সবগুলোই।”
“আপনি পাণ্ডুলিপিটা পড়ে দেখেছিলেন?”
একটু ইতস্তত করল প্রকাশক সাহেব। “ইয়ে…মানে…আমি তো অনেক কাজে ব্যস্ত থাকি, সময় পাই না। তবে আমার এক লোক আছে পাণ্ডুলিপির প্রুফ দেখার জন্যে…সে ওটা পড়েছিল।”
“আচ্ছা। সেই লোক কি এখন আপনার এখানে আছে?”
“হ্যাঁ, আছে। এখানেই কাজ করে।”
“তার সাথে একটু কথা বলতে চাই।”
কুদরত সাহেব ইন্টারকমটা তুলে নিয়ে বাবু নামের এক লোককে তার কাছে পাঠিয়ে দিতে বলল। “কমল বাবুই আমার পাণ্ডুলিপি দেখেটেখে দেয়। বাংলা ভাষাটা তার ভালো জানা আছে। আমি এই ব্যবসা শুরু করার পর থেকেই আমার এখানে কাজ করছে।“
দরজায় নক হতেই কুদরত সাহেব ভেতরে আসতে বললে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো ষাটোর্ধ বয়সের এক রোগাপাতলা বৃদ্ধ। দেখে মনে হয় সারা বছরই অসুস্থ থাকে এই লোক।
“বাবু, ঐ চেয়ারটায় বসেন, কুদরত হোসেন বলল। তারপর জেফরি আর জামানের দিকে ফিরল সে। “উনারা হলেন হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের লোক। আমাদের এখান থেকে জায়েদ সাহেবের যে পাণ্ডুলিপি চুরি হয়েছে সে ব্যাপারে উনারা কিছু জানতে চান।”
পুলিশের কথা শুনে বাবু নামের লোকটি যেন কুকুঁড়ে গেল। মোটা কাঁচের চশমার ভেতর দিয়ে পিটপিট করে তাকাল জেফরি আর জামানের দিকে।
“আমাদের বেশিরভাগ পাণ্ডুলিপি বাবুই দেখাশোনা করেন, তবে জায়েদ রেহমানের পাণ্ডুলিপি উনি ছাড়া আর কেউ দেখেন না। আপনাদের যা জানার উনাকে জিজ্ঞেস করুন।”
“কমল বাবু, জায়েদ সাহেবের শেষ পাণ্ডুলিপিটা কি আপনি পড়ে দেখেছিলেন?” জেফরি জানতে চাইল।
মাথা নেড়ে জবাব দিল বুড়ো। মুখে কিছু বলল না।
“পুরোটা পড়েছিলেন?”
আবারো মাথা নেড়ে জবাব দিল। “পুরোটা তো হাতে পাইনি। জায়েদ রেহমান ওটা শেষ করে উঠতে পারেননি।” জবাব দিল ভগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী কমল বাবু।
জেফরি অবাক হয়ে তাকাল কুদরত সাহেবের দিকে। “আপনার কাছে পুরো পাণ্ডুলিপি ছিল না?”
একটু ইতস্তত করে জবাব দিল প্রকাশক। “না…মানে, উনি বলেছিলেন সামনের বইমেলার আগে পুরো কাজ শেষ করে ফেলবেন। প্রায় সত্তর-আশি ভাগ কাজ হয়ে গিয়েছিল। উনি আমাকে বললেন, আপনি প্রুফ দেখাতে থাকেন এই ফাঁকে আমার বাকি কাজ শেষ হয়ে যাবে…”
“আচ্ছা।” জেফরি একটু থেমে আবার বলল কমল বাবুকে। “আপনার কাছে তো একটা কপি ছিল সেটার কি অবস্থা?”
“গত সপ্তাহে ওটার প্রুফ দেখা শেষ হলে আমি অফিসে জমা দিয়ে দেই। ওটাও চুরি হয়ে গেছে।”
“এই চুরির ব্যাপারে আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন?” কুদরত সাহেবের দিকে ফিরে বলল জেফরি বেগ।
“অবশ্যই,” নিজের চেয়ারে সোজা হয়ে বসল ভদ্রলোক। “এটা তো পানির মতো পরিস্কার…আবেদ আলী এই কাজ করিয়েছে। একটা ভুয়া পাণ্ডুলিপি জায়েদের নামে চালিয়ে ব্যবসা করছে এখন। যে-ই জানতে পারল আমার কাছে আসলটা আছে সঙ্গে সঙ্গে সেটাও চুরি করে নিলো। “
“আপনার সাথে কি আবেদ আলীর সম্পর্ক খারাপ ছিল?”
“আমাদের সাথে আসলে ওরকম কিছু হয়নি। ব্যাপরটা একেবারেই ব্যবসায়িক। জায়েদ রেহমানকে নিজের কজায় রেখে দীর্ঘদিন ব্যবসা করেছে সে, কোটিকোটি টাকা কামিয়েছে। বন্ধুত্বের সুযোগে লেখককে ঠকিয়ে গেছে দিনের পর দিন। জায়েদ সাহেবের আগের স্ত্রীর সাথে তার ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আবেদ আলী লেখককে একেবারে নিজের পকেটে রেখে দিয়েছিল…” একটু থেমে আবার বলতে লাগল কুদরত হোসেন। “উনি যখন আমাকে উনার বই দেয়া শুরু করলেন তখন থেকেই আমার সাথে তার দ্বন্দ্ব। আমার নামে যা তা বলে বেড়াতো। জায়েদ সাহেবের সাথেও তার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় তখন থেকে
“আপনার সাথে জায়েদ রেহমানের পরিচয় কিভাবে হলো?” তার কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলল জেফরি।
থতমত খেয়ে গেল প্রকাশক ভদ্রলোক। জবাবটা মনে মনে গুছিয়ে নেবার জন্যে একটু ভেবে নিলো। “উনার দ্বিতীয় স্ত্রী আমার আত্মীয় হয়…বেশ ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বলতে পারেন।”
একটু চুপ করে থেকে জামানের দিকে তাকাল জেফরি। এতোক্ষণ ধরে সে কোনো কথা বলেনি। “কুদরত সাহেব, আপনি মনে করছেন লেখক জায়েদ রেহমানের যে বইটি অবয়ব প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে সেটা আসলে তিনি লেখেননি?”
“অবশ্যই। তার সাথে তো জায়েদ সাহেব কথাই বলতেন না। তাছাড়া উনার খুন হবার কয়েক দিন আগেও আমি দেখা করে এসেছি। উনি আমাকে বলেছেন এই বইয়ের কাজ শেষ করতে আরো এক-দেড় মাসের মতো সময় লাগতে পারে।”
“আপনি কি অবয়ব প্রকাশনী থেকে বের হওয়া বইটি পড়ে দেখেছেন?”
“হ্যাঁ, যেদিন বের হয় সেদিনই কিনে এনেছি কয়েক কপি। কিছুটা পড়েও দেখেছি। একেবারে জালিয়াতি। এ রকম জালিয়াতি এ দেশের প্রকাশনা ইতিহাসে আর কখনও হয়নি।”
“আপনার কাছে যে পাণ্ডুলিপিটা ছিল সেটা তো আপনি পড়েননি তাহলে কি করে বুঝলেন ওটা জাল?”
কুদরত সহেব একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। “ইয়ে…মানে-”
“আমি পড়েছি…”
কুদরত সাহেবকে রক্ষা করতে কমল বাবু এগিয়ে এলে তার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল জেফরি বেগ।
“উনি ঠিকই বলেছেন। যেটা বের হয়েছে সেটা জাল। আমাদের কাছে যে পাণ্ডুলিপি ছিল সেটার সাথে এই বইয়ের কিছু কিছু জায়গায় একেবারেই মিল নেই।”
“কিছু কিছু জায়গায় মিল নেই!? তার মানে কিছু কিছু জায়গায় মিল আছে?”
কমল বাবু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। “হ্যাঁ, মিল আছে।” কথাটা কুদরত সাহেবের পছন্দ না হলেও এ নিয়ে কিছু বলল না সে।
একটু ভেবে জেফরি বলল, “দুয়েকটি উদাহরণ দিতে পারবেন? মানে ঠিক কোন্ কোন্ জায়গায় অমিল আছে?”
“সব তো মনে নেই তবে একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত…” কুদরত সাহেবের দিকে তাকাল ভদ্রলোক। “অবয়ব প্রকাশনী থেকে যে বইটি বের হয়েছে সেখানে জায়েদ সাহেব নিজের জীবনে এমন কিছু কথা স্বীকার করেছেন যেটা আমাদের কাছে থাকা পাণ্ডুলিপিতে একদমই ছিল না।”
“আরেকটু পরিস্কার করে বলুন?”
“…যেমন তার দাম্পত্য জীবন, নারীঘটিত ব্যাপারগুলো…ওখানে যেভাবে অকপটে লেখক স্বীকার করেছেন সেরকম কিছুই আমাদের কাছে থাকা পাণ্ডুলিপিটাতে ছিল না।”
কুদরত সাহেবের দিকে তাকাল জেফরি। ভদ্রলোকের চোখেমুখে তিক্ত হাসি লেগে রয়েছে। “বুঝলেন না, এক ঢিলে দুই পাখি মারা। বাণিজ্যও হলো প্রতিশোধও নেয়া হলো!”
“প্রতিশোধ?”
“হ্যাঁ, জায়েদ রেহমানের উপর প্রতিশোধ। আমার কি মনে হয় জানেন, ঐ আবেদ আলীর সাথে জায়েদ সাহেবের আগের স্ত্রীও জড়িত আছে। তারা দু’জনে মিলেই কাজটা করেছে।”
“কোন্ কাজটা?”
কুদরত সাহেব ধন্দে পড়ে গেল। তার খুব বলতে ইচ্ছে করছে জায়েদ রেহমান খুনের কথা কিন্তু সেটা বলা ঠিক হবে না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে উল্টো তাকেই সন্দেহ করে বসতে পারে এই ইনভেস্টিগেটর। “মানে, এই চুরি আর জালিয়াতির কথা বলছি আর কি…”
“আপনার কথা যদি ঠিক হয় তাহলে তো এটাও ধরে নিতে হবে জায়েদ রেহমানকে খুন করার পেছনে তাদের হাত রয়েছে!” কথাটা বলে জেফরি স্থির চোখে চেয়ে রইল কুদরত সাহেবের দিকে।
ভদ্রলোক কি বলবে বুঝতে পারল না। একটু আমতা আমতা করে অবশেষে বলল, “আমি তো সেটা বলতে পারবো না, তবে আপনারা তদন্ত করে দেখতে পরেন তারা জড়িত আছে কি না। আমার যা মনে হচ্ছে আমি কেবল সেটাই বলছি।”
জেফরি বেগ ভাবনায় পড়ে গেল। তার আশঙ্কাই সত্যি হয়ে উঠছে। এই কেসটা একেবারেই জটিল। গোলকধাঁধার মতো অসংখ্য গলি আছে কিন্তু বের হবার পথ পাওয়া যাচ্ছে না। বার বার একই জায়গা ফিরে আসছে নয়তো কানা গলিতে গিয়ে ঢুকে পড়ছে সে।
.
অধ্যায় ৩৮
সি ই এ সিদ্দিকী ছেলেকে বোম্বের এক রিহ্যাবে রেখে দেশে ফিরে এসেছেন গতকাল রাতে। তার সাথে দেখা করতে এসেছে অমূল্য বাবু।
এ ক’দিনে কি কি ঘটেছে সে সম্পর্কে জানার জন্যে সিদ্দিকী সাহেব উদগ্রীব হয়ে আছেন।
তারা বসে আছে বিশাল ড্রইংরুমে।
অমূল্য বাবু একটা ছোট্ট প্যাকেট বাড়িয়ে দিল সিদ্দিকী সাহেবের দিকে। “এটা রাখুন। নষ্ট করার আগে একবার দেখে নিতে পারেন।”
প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখলেন তিনি। “এটা কি?”
“জায়েদ রেহমানের সেই ইন্টারভিউয়ের টেপ।”
“আপনি কিভাবে পেলেন?” কথাটা বলেই সিদ্দিকী সাহেব মনে মনে ভাবলেন তার এটা বলা ঠিক হয়নি। এই লোক যে কতোভাবে কতো কিছু করতে পরে সেটা তিনি নিজেও জানেন না।
“লম্বা গল্প। পাভেল আহমেদ নামের এক সাংবাদিক এই ইন্টারভিউটা নিয়ে আমাদেরকে ব্ল্যাকমেইর করতে চেয়েছিল।”
“ব্ল্যাকমেইল!?”
অমূল্য বাবু আলতো করে মাথা দোলাল।
“তার মানে সে জেনে গেছে! কিভাবে জানল?”
“জেনে গেছিল কি না জানি না তবে মনে হয় কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিল।”
অমূল্য বাবুর কথা শুনে সিদ্দিকী সাহেবের কাছে কেমন জানি খটকা লাগল। “তাহলে তো বিপদের কথা
সিদ্দিকী সাহেবকে মাঝপথে থামিয়ে দিল বাবু। “এটা নিয়ে চিন্তা করবেন না।”
সিদ্দিকী সাহেব প্যাকেটটার দিকে একবার তাকিয়ে অমূল্য বাবুর দিকে তাকালেন। একটা আশঙ্কা তার মনে উঁকি মারছে কিন্তু মুখে সেটা বললেন না।
“ঐ সাংবাদিক এখন কোথায়?” আস্তে করে জানতে চাইলেন তিনি।
অমূল্য বাবু দুচোখ বন্ধ করে রাখল কয়েক সেকেন্ড। তারপর চোখ খুলে বলল, “অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে…তার কথা বাদ দিন; ইরাম কেমন আছে?”
সিদ্দিকী সাহেবের শিড়দাঁড়া দিয়ে শীতল একটি প্রবাহ বয়ে গেল। “ভালো আছে। আগের মতো আর পাগলামি করেনি। মনে হয় না ওখান থেকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারবে।”
“ওটা এশিয়ার মধ্যে সেরা রিহ্যাব। আশা করি সে সুস্থ হয়ে ফিরবে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলেন সিদ্দিকী সাহেব। “ডাক্তার বলেছে কমপক্ষে ছ’মাস লাগবে। ড্রাগটা তো খুবই আনইউজুয়াল, তাই সময় নেবে।”
“চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
উদাস ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে সায় দিলেন সি ই এ সিদ্দিকী। “বাকি খবর কি?”
“সব ঠিক আছে। চিন্তার কিছু নেই।” অমূল্য বাবু একটু থেমে আবার বলল, “জায়েদ রেহমানের শেষ বইটা বের হয়েছে।”
কথাটা শুনে স্থির চোখে চেয়ে রইলেন তিনি। “তাই না কি?”
“বেশ ভালো বিক্রি হচ্ছে। এদিকে জায়েদ রেহমানের বই যে প্রকাশনী থেকে দু’বছর ধরে বের হয়ে আসছে তারা দাবি করছে তাদের কাছে না কি জায়েদ রেহমানের আসল বইটি ছিল।”
ভুরু কুঁচকে তাকালেন সিদ্দিকী। “তারপর?”
“ঐ প্রকাশক এ নিয়ে আদালতে গেছে।”
সিদ্দিকী সাহেবকে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে দেখে অমূল্য বাবু সঙ্গে সঙ্গে বলল, “চিন্তার কোনো কারণ নেই, ওরা ওদের পাণ্ডুলিপিটা খুঁজে পাচ্ছে না।”
এবার আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না সিদ্দিকী সাহেব।
“ওটা চুরি হয়ে গেছে।” কথাটা বলেই অমূল্য বাবু আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে দু’চোখ বন্ধ করে মাথাটা একটু নাড়লেন।
“জায়েদ রেহমানের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কতোদূর এগোলো?” প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইলেন সিদ্দিকী সাহেব।
“যা হবার তাই হচ্ছে। মিসেস রেহমান আর তার প্রেমিক যে খুনটা করেছে সেটা এখন প্রতিষ্ঠিত।”
“তাহলে ইরামের ব্যাপারে কোনো রকম ইনকোয়ারি হবার সম্ভাবনা নেই?”
“না, নেই।”
স্বস্তি বোধ করলেন সিদ্দিকী সাহেব।
.
অধ্যায় ৩৯
কুদরত হোসেনের সাথে কথা বলে আসার পর থেকে জেফরির মনে সন্দেহটা আরো দৃঢ় হয়েছে। তার সহকারী জামান খোঁজ নিয়ে জেনেছে কথা নামের যে বইটি প্রকাশ হয়েছে সেটির রয়্যালটি বাবদ অনেক টাকা চলে গেছে লেখকের সাবেক স্ত্রীর ভ্যানিটিব্যাগে।
এখন দেখা যাচ্ছে লেখকের মৃত্যুতে আসলে দু’জন মানুষ লাভবান। হয়েছে : আবেদ আলী আর জায়েদ রেহমানের প্রথম স্ত্রী গোলনূর আফরোজ তরফদার।
তাহলে কি কুদরত সাহেবের কথাই ঠিক? আবেদ আলী আর গোলনূর আফরোজ তরফদার কোনো পেশাদার খুনিকে দিয়ে কাজটা করায়নি তো?
কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? জায়েদ রেহমান নিজের বাড়িতে খুন হয়েছেন। ঐ সময় সেখানে ছিল তার স্ত্রী আর তার প্রেমিক। ব্যাপারটা তো পানির মতোই পরিস্কার।
তারপরেও নিজের সহকারী জামানকে দিয়ে কিছু তথ্য জোগাড় করে নিয়েছে সে। এই তথ্যগুলো খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে তার কাছে।
জায়েদ রেহমান খুন হবার এক সপ্তাহ আগে থেকে এখন পর্যন্ত আবেদ আলী যাদের সাথে ফোন করেছে কিংবা তাকে যারা ফোন করেছে সেটার একটা তালিকা জোগাড় করে নিয়ে এসেছে জামান। হোমিসাইডের জন্য কাজটা তেমন কঠিন কিছু না। সরকারী বেসরকারী সব ফোন কোম্পানিই আইন মোতাবেক হোমিসাইডকে যেকোনো ফোন নাম্বারের কললিস্ট দিতে বাধ্য। আর এই কম্পিউটারের যুগে সেটা হাতের মুঠোয় পাওয়া কয়েক মিনিটের ব্যাপার।
লেখক খুন হবার সাত দিন আগে আবেদ আলী মোট ৯৮টি কল করেছে আর রিসিভ করেছে ১২৫টি। সংখ্যাটা একজন ব্যবসায়ির জন্য খুব বেশি কি না বুঝতে পারছে না বেগ। তবে একটা জিনিস দেখে সে অবাকই হলো :
আমেরিকার একটি নাম্বার থেকে আবেদ আলীকে এই সাত দিনে ৫১২টি এসএমএস করা হয়েছে যার জবাবে আবেদ আলী নিজে করেছে ৪৮৮টি!
আমেরিকার ঐ নাম্বারটি ট্র্যাক-ডাউন করে জানা গেছে সেটা সাগুফতা হোসেন মিলি নামের এক মহিলার। জেফরি বুঝতে পারল প্রবাসী কোনো বাংলাদেশিই হবে। বিপত্নীক আবেদ আলী হয়তো ঐ মহিলার সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।
এই সাত দিনে দেশের ভেতরে আবেদ আলী যে নাম্বারে সবচাইতে বেশি ফোন করেছে সেটা আর কেউ নয়-জায়েদ রেহমানের সাবেক স্ত্রী গোলনূর আফরোজ তরফদার।
মোট ৯ বার ফোন করেছে তাকে। আর মহিলা আবেদ আলীকে ফোন করেছে ১২ বার।
ব্যাপারটা বেশ রহস্যজনক ঠেকলো জেফরির কাছে।
জায়েদ রেহমানের হত্যাকাণ্ডের পুরো চিত্রটা আরেকবার ভেবে নিলো জেফরি। অনেক অসঙ্গতি আছে এই হত্যাকাণ্ডে :
শয্যাসায়ী অবস্থায় জায়েদ রেহমান নিজের ঘরে খুন হবার ঠিক আগে আবেদ আলীকে একটা মেইল করে গেলেন এমন একটি ল্যাপটপে যেটা ছিল তার নাগালের বাইরে। পাশের ঘরে তখন তার তরুণী স্ত্রী আর প্রেমিক অভিসারে মত্ত। ঠিক সেই সময় অ্যাপার্টমেন্টের নিচে এক অজ্ঞাত তরুণকে পুলিশ সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখলে তাকে ধরার চেষ্টা করে কিন্তু যুবক পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
পরবর্তীতে পুলিশ আবারো যখন জায়েদ রেহমানের অ্যাপার্টমেন্টে খোঁজ নিতে যায় তার ঠিক আগে দিয়ে ফজরের আজানের পর পরই অ্যাপার্টমেন্টের আরেক বাসিন্দা হানিফ সাহেবের পেছন পেছন আরেক অজ্ঞাত যুবক অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। সেই যুবকের কোনো পরিচয় বের করা যায়নি এখন পর্যন্ত। অবাক করার বিষয় হলো ঐ দিন ভিটা নুভায় কোনো অ্যালোটির ফ্ল্যাটেই গেস্ট ছিল না।
তাহলে সেই যুবক কে?
জেফরি এখন অনেকটা নিশ্চিত লেখক জায়েদ রেহমানের হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে বা যারা জড়িত তারা অনেক বেশি সতর্ক আর দক্ষ।
পেশাদার কেউ?
সম্ভাবনাটি উড়িয়ে দেয়া যায় না ।
মিসেস রেহমান আর তার প্রেমিক যদি খুন না করে থাকে তাহলে কাজটা আর যে-ই করুক সে এটা করিয়েছে একজন পেশাদার লোককে দিয়ে। তবে এ মুহূর্তে আরো ভালো করে তদন্ত না করে এসব কথা কারো সাথে শেয়ার করা যাবে না। কারণ ঐ ভদ্রমহিলা আর তার প্রেমিক যেভাবে ফেঁসে গেছে তাতে করে এই ব্যাপারটা প্রমাণ করা খুব কঠিন হয়ে উঠবে।
ঘটনা যাই হোক না কেন জেফরি জানে এই কেসে অনেক প্রশ্ন আছে যেগুলোর উত্তর মিলছে না। শুরুতে অভাবনীয় সাফল্য পেয়ে যাওয়ার কারণেও এই কেসটার প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারেনি সে। একটা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত যেভাবে যে পদ্ধতি প্রয়োগ করে করতে হয় সেভাবেই
তদন্ত করতে হবে। সে এটাও জানে কাজটা খুব একটা সহজ হবে না। তার নিজের ডিপার্টমেন্টই তাকে এখন সহযোগীতা করবে না।
হোমিসাইডে নিজের অফিসে বসে বসে ভাবছে সে। তার সামনে বসে আছে সহকারী জামান।
“আপনি কি এই ব্যাপারটা নিয়ে তদন্ত করতে চাইছেন?” জিজ্ঞেস করল জামান।
“হ্যাঁ।”
“তাহলে এখন আমরা কী করবো?” জানতে চাইল সে।
“আমি ভিটা মুভায় গিয়ে আরেকটু দেখে আসতে চাইছি।”
জামান বুঝতে পারল না ভিটা নুভায় গিয়ে কী খুঁজে পাবে সে।
*
জামানকে সঙ্গে নিয়ে ভিটা নুভার সামনের রাস্তায় এসে দাঁড়াল জেফরি বেগ। ভালো করে অ্যাপার্টমেন্ট ভবনটি দেখে নিলো সে। আর সব লাক্সারি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের চেয়ে আলাদা কিছু না।
ছয় তলার এই ভবনের নিচ তলার পুরোটাই পার্কিং এরিয়া। প্রতি তলার লিফট আর সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের দু’পাশে দুটো করে মোট চারটি ফ্ল্যাট আছে। তার মানে পাঁচটি তলায় সর্বমোট বিশটি ফ্ল্যাট রয়েছে। জেফরির সহকারী জামান যতোটুকু খোঁজ নিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে মাত্র ষোলো জন অ্যালোটি রয়েছে এখানে। যে চারজন অ্যালোটির দুটো করে ফ্ল্যাট আছে তার মধ্যে স্বয়ং জায়েদ রেহমানও আছেন।
রাস্তার ওপার থেকে পুরো ভবনটি দেখে নিলো জেফরি বেগ। ঢাকা শহরের অন্য অনেক উঁচু ভবনের মতোই ভিটা নুভার ছয়তলার ছাদে একটি মোবাইলফোন কোম্পানির টাওয়ার রয়েছে। এর আগে ব্যাপারটা তার চোখে পড়েনি। অবশ্য এটা চোখে পড়ার মতো কোনো ব্যাপারও নয়।
রাস্তাটা পার হয়ে ভিটা নুভার দিকে এগিয়ে গেল সে, তার পেছন পেছন সহকারী জামান।
নাইটগার্ড আসলামের জায়গায় এখন ডিউটি করছে মহব্বত নামের এক ছেলে। দিনের বেলায় সে-ই ডিউটি করে। ছেলেটা তাকে দেখেই সালাম দিয়ে এগিয়ে এল কাছে।
নিজের পরিচয় দিয়ে এটা ওটা জানতে চেয়ে আসল কথায় চলে এল বেগ। “ঐদিন দিনের বেলায় তুমিই তো ডিউটিতে ছিলে?”
“জি, স্যার। সন্ধ্যা পর্যন্ত আমিই ডিউটি দেই” কথাটা বলেই মহব্বত নামের দারোয়ান ছেলেটি গেটের দিকে তাকাল। এইমাত্র এক লোক গেট দিয়ে ঢুকে পড়েছে। “স্যার, একটু দাঁড়ান, আমি আসতাছি…” মহব্বত সেই লোকের কাছে এগিয়ে গেল।
আগত লোকটার দিকে একবার তাকিয়ে জামানের দিকে ফিরল জেফরি। “জামান, এই ভিটা নুভার ফ্লোরপ্ল্যানটা জোগাড় করতে হবে।”
“ঠিক আছে, স্যার।”
“এই অ্যাপার্টমেন্টের বিল্ডার্সের কাছে গিয়ে চাইবে, বলবে ভেতর এবং বাইরের…” থেমে গেল জেফরি। ঘাড় ঘুড়িয়ে মহব্বত আর ভিজিটরের দিকে তাকাল সে। একটা কথা তার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
“ঐ দিন না একজন আইলো…আবার কি হইলো? টাওয়ারে কি প্রবলেম হইছে না কি?” মহব্বত ভিজিটরের আইডিকার্ড চেক করে দেখে জানতে চাইল।
“ঐ দিন একজন এসেছে মানে!?” লোকটা বিস্মিত হলো। “গত মাস থেকে এই জোনটা তো আমিই দেখাশোনা করছি…আমি ছাড়া আবার কে আসবে?”
“আরে আমি নিজে ছিলাম, আপনাগো এক লোক আইছিল-”
“কী যে বলেন না,” মেইনটেনান্স ক্রু বলল। “আপনি
“মহব্বত, কি হয়েছে?” তাদের কাছে এগিয়ে এসে জেফরি জানতে চাইল।
জেফরিকে দেখামাত্র মহব্বত আইডি কার্ডটা ফিরিয়ে দিয়ে ভিজিটরকে তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে যেতে বলে জেফরির দিকে ফিরে বলল সে, “না, স্যার, কিছু না। টাওয়ারের লোক।”
“ওকে তুমি কী যেন বলছিলে…কয়েক দিন আগে ওদের আরেকজন লোক এসেছিল…”।
“ও, দাঁত বের করে হেসে বলল মহব্বত। কয়েক দিন আগে ওগো আরেকজন আইছিল তো, আবার এখন আরেকজন আইছে, তাই জিজ্ঞাস করছিলাম টাওয়ারে কোনো প্রবলেম হইছে কি না।”
“ঐ দিন মানে কোন্ দিন?” বেগ জানতে চাইল।
“জায়েদ স্যার যে রাইতে খুন হইলেন, ঐদিন সন্ধ্যার একটু আগে…”
“আচ্ছা। তাহলে ও যে তোমাকে বলল কেউ আসেনি?”
“হ, তাই তো কইলো।”
“ঐ দিন টাওয়ারের লোকটা এই লোক ছিল না?”
“না। অন্য আরেকজন আইছিল।”
“ঐ লোকটা কখন এখান থেকে চলে গেছিল?”
‘আমি কইবার পারুম না। আমি তো তার একটু বাদেই ডিউটি শ্যাষ কইরা চইলা যাই। এটই কইবার পারবো আসলাম ভাই।”
জেফরি বেগ জামানের দিকে তাকাল। মনে হলো তার সহকারী জামানও কৌতূহলী হয়ে উঠেছে তথ্যটা জেনে।
“আসলাম এখন কোথায়?” জানতে চাইল জামান।
“ঘরেই আছে,” পার্কিংএরিয়ার শেষ প্রান্তে একটা ছোট্ট ঘর দেখিয়ে বলল মহব্বত। “সারা রাত ডিউটি কইরা ঘুমাইতাছে।”
“ঠিক আছে। ওকে একটু ডেকে আনেনা। ওর সাথে কথা বলবো।”
পাঁচ মিনিট পর আসলাম এসে উপস্থিত হলো। তার চোখে সদ্য ঘুম থেকে জেগে ওঠার স্পষ্ট লক্ষণ।
“টাওয়ারের লোকটি কখন এই ভবন থেকে বের হয়ে গিয়েছিল?” বেগ প্রশ্ন করল আসলামকে।
“টাওয়ারের লোক!? আমি তো কিছু জানি না!” আসলাম বিস্মিত।
জেফরি তাকাল মহব্বতের দিকে। “ও জানে না?”
“আমি তো তারে কই নাই। ডিউটি শ্যাষ কইরা ওরে বুঝাইয়া দিয়া চইলা গেছি,” জবাবে বলল মহব্বত। তারপর আসলামের দিকে তাকিয়ে বলল সে, “আসলাম ভাই, আমার ডিউটি শ্যাষ হইবার একটু আগে টাওয়ারের এক লোক আসছিল…তারে কি আপনি বের হইয়া যাইতে দেহেন নাই?”
“না। এ রকম কাউরে তো দেহি নাই।”
জেফরির গোয়েন্দা মন বলছে কিছু একটা আছে। “আসলাম, তুমি এ রকম কাউকে বের হয়ে যেতে দ্যাখোনি, ঠিক করে বলো?”
“না, স্যার। আমি তো জানিই না টাওয়ারের লোক ঢুকছে।” আসলাম ঘাবড়ে গিয়ে বলল।
এবার মহব্বতের দিকে ফিরল জেফরি। “আচ্ছা, টাওয়ারের যে লোকটি সন্ধ্যার একটু আগে এখানে ঢুকেছিল তাকে কি তুমি চেনো?”
“একেক সময় একেক লোক আসে, চিনমু কেমনে?”
জামানের দিকে তাকাল জেফরি। টাওয়ারের মেইটেনান্স ক্রু লিফট দিয়ে উপরে চলে গেছে।
“জামান, ঐ লোকটাকে ডেকে আনন…”
*
মেইনটেনান্স ক্রুকে ছয়তলার ছাদ থেকে ডেকে এনে জেফরি আর জামান ভালো করে জিজ্ঞাসাবাদ করে নিশ্চিত হয়েছে বিগত পনেরো দিনে এই প্রথম সেলফোন কোম্পানি থেকে টাওয়ারের মেইনটেনান্স ক্রু ভিটা নুভায় এসেছে। জায়েদ রেহমান যে রাতে খুন হয়েছে সেদিন সন্ধ্যার একটু আগে তাদের কোনো লোকই এখানে আসেনি।
একটা ক্লু পাওয়া গেল। জায়েদ রেহমান খুন হবার পর ভোরের দিকে ফজরের আজানের পর পর যে অজ্ঞাত যুবক ভিটা নুভা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল তার সম্ভাব্য একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে এখন।
মেইনটেনান্স ক্রু’কে জেরা করা শেষ করে জেফরি আর জামান সোজা চলে এল ভিটা নুভার ছয় তলার সিঁড়িঘরের উপর স্থাপিত মোবাইলফোন টাওয়ারের কাছে।
ছয়তলা ছাদ থেকে একটা স্টিলের মই বেয়ে ওটার উপরে উঠতে হয়। ছোট্ট একটা চিলেকোঠার মতো ঘর আর তার ছাদেই স্থাপিত করা হয়েছে লোহার ফ্রেমের তৈরি সেলফোন টাওয়ারটি। এখানে কোনো লোক খুব সহজেই লুকিয়ে থাকতে পারবে। এখন প্রশ্ন, সম্ভাব্য খুনি এখান থেকে জায়েদ রেহমানের ঘরে ঢুকলো কী করে?
ছাদের চারপাশটা ঘুরে দেখল জেফরি। চার ফিট উঁচু দেয়াল দিয়ে পুরো ছাদটি ঘেরা। সেই দেয়ালের উপর রেলিংয়ের মতো মোটা লোহার পাইপ আছে। আজকাল অনেক অ্যাপার্টমেন্টেই এ রকম ডিজাইনের রেলিং থাকে।
দক্ষিণ দিকের বাউন্ডারি দেয়ালের কাছে এসে নিচের দিকে তাকাল সে। জেফরি এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক তার নিচেই জায়েদ রেহমানের ঘরটা। সেই ঘরের দক্ষিণমুখী বেলকনিটা দেখতে পাচ্ছে উপর থেকে। তার পাশেই, অল্প দূরে মিসেস রেহমানের ঘরের বেলকনি। একেবারে পাশাপাশি। দুটোর মাঝখানে দূরত্ব বড়জোর তিন ফিট হবে, কিন্তু জেফরির মনোযোগ চলে গেল অন্য দিকে।
ছাদের যে অংশে সে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে লেখকের বেলকনিতে খুব সহজেই নামা যাবে। একটা দড়ি রেলিংয়ে বেধে নিলেই কাজটা করা সম্ভব।
পুরো দৃশ্যটা ভাবলো সে : টাওয়ারের মেইনটেনান্স ক্রু সেজে দারোয়ান বদলির ঠিক আগে দিয়ে অজ্ঞাত এক যুবক ঢুকে পড়ে ভিটা নুভায়। তারপর টাওয়ারের উপর গিয়ে লুকিয়ে থাকে সে। রাত গম্ভীর হলে ছাদের রেলিংয়ে দড়ি লাগিয়ে জায়েদ রেহমানের বেলকনিতে নেমে পড়ে সেই যুবক। লেখককে খুন করে আবার সেই দড়ি বেয়েই উঠে পড়ে ছাদে। ভোর হবার আগপর্যন্ত অপেক্ষা করে। তারপর ফজরের নামাজ পড়তে যাচ্ছে এ রকম একটা ভান করে অ্যালোটি হানিফ সাহেবের পেছন পেছন বেরিয়ে পড়ে ভিটা নুভা থেকে।
অসাধারণ! মনে মনে ভাবলো জেফরি বেগ।