২০. দরজা জানালা বন্ধ

অধ্যায় ২০

দরজা জানালা বন্ধ একটা ঘরে টিভি চলছে। ঘরে আর কোনো বাতি জ্বলছে না। টিভির আলোতে ঘরের অন্ধকার কিছুটা হয়েছে, সেই আলো বদলে যাচ্ছে খুব দ্রুত। কখনও বেড়ে যাচ্ছে তো পরক্ষণেই হয়ে যাচ্ছে ম্রিয়মান। আসলে টিভি সেটটার চ্যানেল বদল করা হচ্ছে খুব দ্রুত। সবগুলো দেশি চ্যানেল একের পর এক যেন চক্রাকারে ফিরে আসছে। কোনো চ্যানেলই দশ সেকেন্ড বেশি স্থায়ী হচ্ছে না। কখনও কখনও সেটা দুই তিন সেকেন্ডও নেমে আসছে। এর ফলে আলো আর শব্দের এক ধরণের ছন্দময় দ্যোতনা সৃষ্টি হয়েছে ঘরের ভেতর।

…স্ত্রী আর তার প্রেমিককে গ্রেফতার করা হয়েছে… দেশের জনপ্রিয় লেখক জায়েদ রেহমান নিজ ঘরে খুন হয়েছেন…গতকাল রাতে স্বনামধন্য লেখক জায়েদ রেহমান…লেখকের বাড়ির সামনে হাজার হাজার ভক্ত…লেখকের তরুণী স্ত্রী আর তার প্রেমিককে…আমরা গভীর বেদনার সাথে জানাচ্ছি প্রখ্যাত লেখক…

সব চ্যানেলে একই খবর।

…হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট এখনও কোনো কিছু না জানালেও কিছুক্ষণ আগে নির্ভরযোগ্য এক সূত্রে জানা গেছে…

এই চ্যানেলটা আর বদলে গেল না।

…দুজন আসামী জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। তারা সরাসরি হত্যাকাণ্ডের সাথে নিজেদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে নিয়েছে। হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের মহাপরিচালক ফারুক আহমেদ আমাদের রিপোর্টারের কাছে এক সাক্ষাঙ্কারে জানিয়েছেন…

একটা হিংস্র চিতাবাঘ ছুটতে ছুটতে ঝাঁপিয়ে পড়ল পলায়ণরত হরিণ শাবকের উপর…নির্মমভাবে ঘাড় মটকে দিল সেটার…

টিভির পর্দায় অ্যানিমেল প্লানেট চ্যানেলটায় স্থিরে হয়ে রইল কিছুক্ষণ।

তারপর ঘন অন্ধকার।

টিভিটা বন্ধ করে দেয়া হলে ঘরটা অন্ধকারে ঢেকে গেল মুহূর্তে। সেই সাথে গাঢ় নিস্তব্ধতা। কেবল একজন মানুষের নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এখন।

এই ঘরের একমাত্র ব্যক্তিটির ঠোঁটের কোণে যে তীর্যক হাসি ভেসে উঠল সেটা অন্ধকারের কারণে দেখা গেল না, শুধু বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ার কারণে মৃদু একটা শব্দ হলো।

.

অধ্যায় ২১

পাভেল আহমেদ বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। অন্যান্য দিনের মতো পত্রিকা অফিসের বিরক্তিকর কেন্টিন কিংবা সস্তা হোটেলে লাঞ্চ না করে ধানমণ্ডির পিজ্জা হাটে চলে এসেছে সে। চিকেন গার্লিক পিজ্জা খাচ্ছে এখন।

ডান পকেটে হাত দিয়ে একটা জিনিস স্পর্শ করতেই মুচকি হাসল। তার পকেটে এখন পঁচিশ হাজার টাকা। মাত্র পঁচিশটা নোট!

কিছুক্ষণ আগে স্বদেশ টিভির হামিদ আলমের কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে ছোট্ট একটা জিনিস বেঁচে দিয়েছে সে। অবশ্য পুরো টাকার অর্ধেক হাতে পেয়েছে, কালকের মধ্যে বাকিটা পেয়ে যাবে। তার আনন্দের আরেকটি কারণ হলো হামিদ আলমের কাছ থেকে সমস্ত তথ্য রেডিমেড নিয়ে নিয়েছে। তাকে আর কষ্ট করে সংবাদ সংগ্রহ করতে হবে না।

একটা সুড়সুড়ি টের পেল পাভেল আহমেদ। মোবাইল ফোনটায় ভাইব্রেশনে দেয়া ছিল, বুক পকেট থেকে সেটা বের করে দেখল।

নিউজ এডিটর।

কি বলবে সব আগে থেকেই ঠিক করে রাখা আছে।

“এইমাত্র ওখান থেকে অফিসের দিকে রওনা দিয়েছি, ভাই,” বলল পাভেল আহমেদ। “…হ্যাঁ, দশ মিনিটের মধ্যে চলে আসতে পারবো…তেমন কোনো খবর নেই…না, পুলিশের কারোর সাথে কথা হয়নি…মুখ খুলছে না…জি, ভাই…আমি বরং লাঞ্চ করেই আসি…আচ্ছা…স্লামালাইকুম।”

ফোনটা পকেটে রেখে কোকের গ্লাসটা তুলে নিলো সে।

হামিদ আলমের কাছ থেকে মোটামোটি সব তথ্যই পেয়ে গেছে, এখন শুধু অফিসে গিয়ে আরাম করে টিভিতে ভারত-পাকিস্তানের ওয়ান ডে ম্যাচ দেখবে আর নিউজটা দাঁড় করাবে। আজ একটু আগেভাগে বের হয়ে যাবে অফিস থেকে। সাতটার দিকে হামিদ আলম তাকে গুলশানের লা ডিপ্লোম্যাট-এ আসতে বলেছে। অনেক দিন ধরে স্কটল্যান্ডের পানি খাওয়া হয় না। আজ আকণ্ঠ পান করবে কারণ বিলের চিন্তা তাকে করতে হবে না।

.

আবেদ আলী নিজের বাসায় ফিরে এসেছে। ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ জিজ্ঞাসাবাদের মাঝখানে হুট করে ক্ষান্ত দিয়ে তাকে ছেড়ে দিয়েছে। শুধু বলেছে পরবর্তীতে তার সাথে আরো কথা বলবে, আর লেখক জায়েদ রেহমান যে তাকে মেইল করেছে সেটা যেন কাউকে না বলে।

ড্রইংরুমে বসে থাকলেও আবেদ আলী টিভি দেখছে না। টিভিতে ঐ এক খবরই চলছে সকাল থেকে। আবেদ আলী জানে এটা আরো দু’তিন দিন ধরে চলবে-কিংবা কে জানে আরো বেশিও হতে পারে।

ফেসবুকে যেতে ইচ্ছে করছে না তার। মিলিকে যে একটা এসএমএস করে আশ্বস্ত করবে, তার উদ্বিগ্নতা কমাবে সেটাও করতে ইচ্ছে করছে না। সে জানে মিলি এতো বেশি জানতে চাইবে যে অতিষ্ঠ করে তুলবে তাকে। মিলির এই একটি দিক তার ভালো লাগে না। সব জানতে চাইবে। না বললে অভিমান করে বলবে তুমি আমাকে ভালোবাসো না, আমাকে আপন মনে করো না, আমার কি জানার অধিকার নেই?’ এ রকম কতো ন্যাকামি মার্কা কথা!

কিন্তু এখন কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না। আবেদ আলী জানে মিলি আরো অনেকগুলো এসএমএস করেছে এই সময়ে। আমি ভালো আছি। চিন্তা কোরো না। এক বন্ধু মারা গেছে। ব্যস্ত আছি। পরে জানাবো, এ রকম কিছু লিখে একটা এসএমএস করার জন্য অনিচ্ছায় ফোনটা হাতে তুলে নিলো সে।

কিন্তু মোবাইলের ডিসপ্লেতে তাকিয়ে দেখল পাঁচটা মিস কল জমে আছে। হোমিসাইডে ঢোকার আগে সাইলেন্স মুডে রেখেছিল তাই কল হলেও বুঝতে পারেনি। কে কল করেছে সেটা দেখতেই আবেদ আলী সঙ্গে সঙ্গে কলব্যাক করল।

গ্যাট!

“হ্যাঁ, ভাবি?”

“আপনাকে অনেক বার ফোন দিয়েছি ধরেননি…” নারী কণ্ঠটা বলল।

“সরি, ভাবি। মোবাইলটা সাইলেন্স মুডে ছিল। খবরটা নিশ্চয় জানেন?”

“হ্যাঁ,” মহিলা বেশ ধীরস্থিরভাবে বলল। তার মধ্যে শোকের লেশমাত্র নেই। “আমি জানতাম এ রকম কিছু একটা হবে।”

আবেদ আলী কোনো কথা বলল না। “ওইটার প্রেমিক তো অ্যাপার্টমেন্ট থেকে অ্যারেস্ট হয়েছে।”

“জি, ভাবি।”

“আপনাকে কেন হোমিসাইড ডেকে নিয়ে গিয়েছিল?”

আবেদ আলী ভিমড়ি খেলো। তার এই খবরটা গ্যাট জানল কী করে? আজব! “আপনি জানলেন কিভাবে?”

“হোমিসাইডে আমার এক খালাতো বোনের ছেলে কাজ করে। ওকে ফোন করলে কথা প্রসঙ্গে জানাল আপনাকে না কি ডেকে পাঠিয়েছে ওরা।”

“আর বলবেন না, কী যে সমস্যায় পড়েছি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“এতো মানুষ থাকতে আপনাকে কেন ডাকবে?” মহিলার কণ্ঠে সান্ত্বনার আভাস।

আবেদ আলী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গোলনূর আফরোজ তরফদারকে মেইল আর অ্যাটাচমেন্ট ফাইলের কথাটা বলল, যদিও জেফরি বেগ তাকে বারণ করে দিয়েছিল।

“কী বলছেন?” গ্যাটের কণ্ঠে স্পষ্ট বিস্ময়।

আবেদ আলী নিশ্চুপ।

“খুন হবার আগে আপনাকে মেইল করেছে! মাই গড। মেইলে কি বলেছে? আপনার সাথে না তার কথাবার্তা পর্যন্ত হোতো না? তার একটা বইও দিয়েছে!” এক নাগাড়ে বলে গেল গ্যাট।

“আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না, ভাবি। পুলিশ তো আমাকেও সন্দেহ করছে এখন,” আবেদ আলী বলল।

“সন্দেহ করলেই হলো? কাজটা করেছে ঐ হারামি। নিজের প্রেমিককে নিয়ে পরিকল্পনা করে খুন করেছে। সারা দেশের মানুষ জেনে গেছে। মামলা তো খুবই সোজা। খুনিদেরকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। এখন আবার আপনাকে নিয়ে টানাটানি করার কী আছে?”

“ঐ যে মেইলটা, ওটাই আমাকে বিপদে ফেলে দিয়েছে।”

“আচ্ছা, বললেন না তো ও আপনাকে মেইলে কি লিখেছে?”

একটু দ্বিধায় পড়ে গেল আবেদ আলী। জেফরি বেগের নিষেধের কথাটা স্মরণ করল সে।

“আমাকে বলতে সমস্যা আছে?” ওপাশ থেকে তাড়া দিয়ে বলল গ্যাট।

“না, ভাবি। আসলে হয়েছে কি, হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর মেইলের কথা কারো কাছে না বলার জন্য বলে দিয়েছে। আপনাকে যে বলছি সেটা কাউকে বলবেন না।”

“আরে আমি আবার কাকে বলতে যাবো! আপনি নিশ্চিন্তে বলতে পারেন।” মহিলা অভয় দিল।

“আসলে বেশি কিছু লেখেনি। তোমাকে এই বইটা দিলাম। প্রকাশ কোরো। যতো বাধাই আসুক এটা প্রকাশ করবে। এখানে আমার সব কথা লেখা আছে। আর হয়তো তোমার সাথে দেখা হবে না। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।”

জায়েদ রেহমানের মেইলটা আবেদ আলীর প্রায় মুখস্ত হয়ে গেছে। সেই সকাল থেকে মেইলটা পাবার পর কম করে হলেও দশ-বারো বার পড়েছে।

“ও তাহলে বুঝতে পারছিল কিছু একটা হবে?” প্রশ্ন করলেও গ্যাটের কথাটা প্রশ্নের মতো শোনালো না।

আবেদ আলী চুপ করে থাকল।

“আচ্ছা, বইটাতে কি বলেছে?”

“আমি তো সেটা এখনও পড়ে দেখিনি।”

“কী বলেন! এখনও পড়েই দেখেননি?” গ্যাট অবাক হয়ে বলল।

“কখন পড়বো, বলুন? মেইলটা পাবার পরই টিভি সংবাদে দেখলাম জায়েদ খুন হয়েছে…তার উপর হোমিসাইডে গিয়ে দেখা করতে বলল। এই তো কিছুক্ষণ আগে ফিরেছি ওখান থেকে।”

“ও আচ্ছা,” বলল গ্যাট। “তাহলে এক কাজ করুন, পড়তে শুরু করে দিন। আমার মনে হয় বইয়ে অনেক কিছু আছে। আর শুনুন, দেরি না করে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বইটা বের করে ফেলুন। লক্ষ-লক্ষ কপি বিক্রি হবে।”

এতোটা সময় ধরে আবেদ আলী ভুলেই গেছিল মেইলটা শুধু তার জন্য বিড়ম্বনাই বয়ে আনেনি, সেই সাথে নিয়ে এসেছে বিশাল পরিমাণের লাভের সম্ভাবনা।

নড়েচড়ে বসল আবেদ আলী। “এই মুহূর্তে বইটা বের করলে আমার আবার কোনো সমস্যা হবে না তো?”

“আপনার কি সমস্যা হবে? কী যে বলেন না। সাহস রাখুন। আপনি তো আর এমনি এমনি বের করছেন না। ও খুন হবার আগে এটা আপনার কাছে মেইল করে গেছে, এর নিশ্চয় কারণ আছে। যতো যাই হোক না কেন, শেষে বুঝতে পেরেছে আপনিই হলেন একমাত্র সত্যিকারের বন্ধু। বাকিরা তো সব চামচার দল। ওকে বানিয়ে খেয়েছে। আপনাকে বইটা বের করার জন্য ওই তো বলেছে। বন্ধুর শেষ ইচ্ছেটা রাখবেন না?”

আবেদ আলী উদ্যম ফিরে পেল যেন। গ্যাট তো ঠিকই বলছে!

“আবেদ ভাই, বইটা কাকে উৎসর্গ করেছে, জানেন?” গোলনূর আফরোজ তরফদার জানতে চাইল।

“আমি তো এখনও পড়ে দেখিনি। অনেক বড় বই। পাঁচশ’ পৃষ্ঠার বেশি হবে।”

“কী বলেন! আপনার তো কপাল খুলে গেল। কোটি টাকার ব্যবসা করবেন। জলদি দেখুন তো, কাকে উৎসর্গ করেছে? আমি লাইনেই আছি।”

আবেদ আলী বুঝতে পারছে না বইটার উৎসর্গ নিয়ে গ্যাট এতো আগ্রহ দেখাচ্ছে কেন।

কম্পিউটারটা চালু অবস্থাতেই ছিল, মোবাইলটা কানে চেপে চেয়ারে বসে সকালে ডাউনলোড করা ফাইলটা ওপেন করল আবেদ আলী। সে নিশ্চিত মেইলে কাকে উৎসর্গ করা হবে সে ব্যাপারে জায়েদ কিছু লেখেনি। প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় করে লেখা : কথা।

দ্বিতীয়-তৃতীয়-চতুর্থ-পঞ্চম পৃষ্ঠা…

আবেদ আলী নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

উৎসর্গ–

গোলনূর আফরোজ তরফদার
যার প্রতি আমি সবচাইতে বেশি অবিচার করেছি।
…আমাকে ক্ষমা করে দিও

তার নিচে এক লাইনের আরেকটা কথা লেখা আছে। সেই লেখাটা পড়েও আবেদ আলী অবাক হলো।

“তবে আমি অবাক হচ্ছি না,” আবেদ আলী জায়েদ রেহমানের উৎসর্গের কথাটা জানালে গোলনূর আফরোজ তরফদার ধীরস্থিরভাবে বলল কথাটা। “আমার প্রতি তো আর কম অবিচার করেনি! শেষের দিকে হয়তো বুঝতে পেরেছিল।”

“ভাবি…” আবেদ আলী ইতস্তত করে বলল।

“কি?”

“এই বইটার স্বত্ত্ব দিয়ে গেছে আপনাকে,” আস্তে করে বলল অবয়ব প্রকাশনীর স্বত্ত্বাধিকারী।

মহিলা কিছু বলল না। একটু পর কণ্ঠটা নিচে নামিয়ে এনে শুধু বলল, “বিশ্বাস করেন আমি একটুও অবাক হইনি।”

.

অধ্যায় ২২

দীর্ঘ ত্রিশ বছরের কর্মজীবনে অনেকবারই পুলিশের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আলাতুন্নেছাকে, তবে কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এই প্রথম। তারপরও মহিলা নিজেকে স্বাভাবিক রেখেছে। অন্তত বাইরে থেকে সে রকমই দেখাচ্ছে তাকে।

জেফরি বেগ আর ইন্সপেক্টর জামান ভিটা নুভায় এসে পৌঁছেছে দশ মিনিট হলো। বাড়ির সামনে লোকজনের যে ভিড় তারা দেখেছে সেটা অভাবনীয়। সেই ভিড় ঠেলেঠুলে হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের একটি আনমার্ক করা গাড়িতে করে জেফরি আর জামান ভেতরে প্রবেশ করেছে অ্যাপার্টমেন্টে। ইচ্ছে করেই জেফরি আনমার্ক গাড়ি নিয়ে এসেছে। সে জানে সাংবাদিকের দল হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের গাড়ি দেখলে ঘেঁকে ধরবে।

জায়েদ রেহমানের বাড়িতে পুলিশের প্রহরা জোরদার করা হয়েছে মিসেস রেহমান আর তার প্রেমিককে গ্রেফতার করার পর থেকেই। বাড়ির অন্যান্য বাসিন্দা বলতে হাউজনার্স আর দু’জন কাজের মহিলা। তাদের সবাইকে পুলিশ প্রহরায় রাখা হয়েছে ভিটা নুভায়। এদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বিকেলের মধ্যেই।

আলাতুন্নেছা ড্রইংরুমে বসে আছে, তার সামনে আছে জেফরি বেগ আর জামান। এই হাউজনার্সই সর্বপ্রথম আবিষ্কার করে জায়েদ রেহমান খুন হয়েছেন।

“আপনি ঘরে ঢুকে কি দেখলেন সেটা বলুন?”

জেফরির প্রশ্নটা শুনে মহিলা কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। “এ কথা তো এর আগেও বলেছি।”

“হ্যাঁ, বলেছেন। আবার বলুন। একটা বিষয় পরিস্কার হওয়া দরকার, জেফরি যতোদূর সম্ভব নরম করে বলল। এই মহিলার কাছ থেকে সহযোগীতা পাবার দরকার আছে।

“ঘরে ঢুকে দেখি জায়েদ সাহেবের মুখে বালিশ চাপা দেয়া। এটা দেখেই চিৎকার দিয়ে উঠি…”

“হ্যাঁ, বলতে থাকুন, মহিলা থেমে গেলে জেফরি বলল।

“তারপর তো মিসেস রেহমান নিজের ঘর থেকে দৌড়ে এলেন। আমি উনাকে বালিশ সরাতে দেইনি। উনার নিস্তেজ শরীর দেখেই বুঝে গেছিলাম মারাত্মক একটা ঘটনা ঘটে গেছে। নিজেকে ধাতস্থ করে জায়েদ সাহেবের নাড়িস্পন্দন পরীক্ষা করে কনফার্ম হই উনি আর বেঁচে নেই। হাতটা একেবারে শক্ত হয়ে গেছিল। মনে হলো অনেক আগেই মারা গেছেন।”

“পুলিশ আসার আগে জায়েদ রেহমানের ঘরে সব কিছুই কি আগের মতো ছিল? কেউ কি কোনো কিছু সরিয়েছে?”

“কোনো কিছুই সরানো হয়নি। সরানোর কোনো উপায়ও ছিল না। কয়েক সেকেন্ডর মধ্যেই তো পুলিশ চলে এল। এরপর থেকে পুরো অ্যাপার্টমেন্টের দায়িত্ব চলে যায় পুলিশের কাছে।”

“আচ্ছা, উনি তো ল্যাপটপ ব্যবহার করতেন, তাই না? খুন হবার রাতে উনি কি সেটা ব্যবহার করেছিলেন?” এই প্রশ্নটার উত্তর জানা জেফরির জন্য খুবই জরুরি।

“হ্যাঁ।”

“কখন?”

“রাত এগারোটার দিকে উনার ঘরে গিয়ে দেখি ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছেন। আমি তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়ে ল্যাপটপটা রেখে ঘুমিয়ে পড়তে বললাম।”

“তারপর?”

“উনি বললেন, আপা ঘুম তো আসে না। আমাকে উনি আপা বলে ডাকতেন। আমি বললাম, চেষ্টা করেন। আপনি হার্টের রোগি, এতো রাত পর্যন্ত জেগে থাকা ঠিক না। এ কথা বলার পর উনি আর কিছু বলেননি। তারপর আমি ল্যাপটপটা উনার কোল থেকে নিয়ে পাশের ছোট টেবিলে রেখে বিছানাটা সোজা করে বালিশ ঠিকঠাক করে তাকে শুইয়ে দেই।”

“আপনি নিজে ল্যাপটপটা রেখেছিলেন?” জেফরি জানতে চাইল।

“হ্যাঁ।”

“ওটা কি চালু অবস্থায় ছিল?”

“হ্যাঁ।”

“আপনি কি ওটা বন্ধ করেননি?”

“ল্যাপটপ কিভাবে বন্ধ করতে হয় সেটা তো আমি জানি না। আমি ওটা উনার কোল থেকে নিয়ে টেবিলে রেখে দেই।”

“এরপর কি করলেন?”

“উনাকে শুইয়ে দিয়ে ঘরের সব জানালা বন্ধ করতে গেলে উনি বললেন দক্ষিণ দিকের বেলকনির স্লাইডিং ডোরটা যেন খোলা রাখি, পূর্ণিমার আলো যাতে ভেতরে আসতে পারে। তারপর আমি ঘরের বাতি বন্ধ করে দরজাটা ভিজিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে আসি।”

“আপনি চলে আসার পর কি তার ঘরে কেউ গিয়েছিল?”

“মনে হয় না। গেলেও আমি জানতে পারবো না। আমি তো বারোটার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”

জামানের দিকে তাকাল জেফরি তারপর মহিলার দিকে ফিরে বলল, “ঠিক আছে, আপনি এখন যেতে পারেন। আমরা কোনো নির্দেশ না দেয়ার আগ পর্যন্ত আপাতত এই বাড়িতেই থাকবেন।”

“আমি আমার বাড়িতে যেতে চাচ্ছিলাম,” মহিলা বলল।

“বিকেলের দিকে যেতে পারবেন। এখন এখানেই থাকতে হবে।”

মহিলা আর কিছু না বলে উঠে চলে গেল। “জায়েদ রেহমানের ঘরে চলো,” জামানকে বলল জেফরি।

জায়েদ রেহমানের ঘরটা তালা মারা। দায়িত্বরত পুলিশ কনস্টেবলের কাছে থেকে চাবিটা নিয়ে তালা খুলল জামান।

জেফরি বেগ ঠিক যেভাবে দেখে গিয়েছিল সেভাবেই সবকিছু আছে। বিছানার পাশে কফি টেবিলটার দিকে তাকিয়ে আরেকবার নিশ্চিত হলো অসঙ্গতিটা খুবই ভয়াবহ।

জায়েদ রেহমানের হসপিটাল বেড থেকে কফি টেবিলটা কমপক্ষে ছয় ফিট দূরে। একজন পক্ষাঘাগ্রস্ত লোকের পক্ষে বিছানা থেকে কফি টেবিলটার নাগাল পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার।

তাহলে কি জায়েদ রেহমান নিজেই উঠে গিয়ে…

অসম্ভব!

জেফরি বেগ শুধু বুঝতে পারল একটা গোলকধাঁধার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে সে। এ পর্যন্ত যা জেনেছে তার মধ্যে অনেক অসঙ্গতি রয়েছে।

.

অধ্যায় ২৩

“তোমার কথা শুনে তো কিছুই বুঝতে পারছি না,” ফারুক আহমেদ বলল বেগকে।

ভিটা নুভা থেকে জেফরি সোজা চলে এসেছে ফারুক আহমেদের অফিসে।

“স্যার, এই কেসে দুটো মারাত্মক অসঙ্গতি আছে,” বলতে শুরু করল বেগ। “পলিগ্রাফ টেস্টের ব্যাপারটা আর-”

“ওটা নিয়ে তুমি খামোখাই চিন্তা করছে, তার কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলল ফারুক আহমেদ।

“ঠিক আছে। পলিগ্রাফ টেস্টের কথা না হয় বাদ দেয়া গেল…ল্যাপটপের ব্যাপারটা কি বলবেন? একজন প্যারালাইজড লোক কি করে নিজের বিছানা থেকে উঠে মাঝরাতে ল্যাপটপ থেকে মেইল করবে?”

ফারুক সাহেব চুপ মেরে রইল। তবে তার মধ্যে চিন্তা করার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, বরং কিছুটা বিরক্তি ফুটে উঠেছে চোখেমুখে।

“সব কিছুর ব্যাখ্যা এখনই পেয়ে যাবে এ রকমটি ভাবছো কেন? সময় এলে সব জানতে পারবে। ল্যাপটপের যে কথাটা বললে, আমার কাছে সেটাকে বড় কোনো অসঙ্গতি বলে মনে হচ্ছে না। সেটারও নিশ্চয় ব্যাখ্যা আছে। সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর ব্যাপারটা জানা যাবে। এখনও তো প্রাইমারি অবস্থায় রয়েছে। এ রকম ছোটখাট দুয়েকটি অসঙ্গতির কারণে তো আমরা এক লাফে অন্য কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারি না। ভুলে যাচ্ছো কেন দু’জন খুনি ধরা পড়েছে হাতেনাতে।”

কথাটা মেনে নিলো বেগ। মহাপরিচালক ভুল বলেনি। সময়ে সব জানা যাবে।

“শুনলাম সকাল থেকে কিছু খাওনি। বাসায় চলে যাও। আজ আর অফিস করতে হবে না। রেস্ট নাও,” ফারুক আহমেদ বলল তাকে।

“স্যার, ভিটা নুভায় দু’জন কাজের মহিলা আর হাউজনার্স আছে পুলিশের প্রহরায়, তাদের কি হবে?”

“পুলিশ কাস্টডিতে রাখতে হবে। কিছু করার নেই।”

বেগও জানে এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল সে। “তাহলে আমি যাই, স্যার?”

“ওকে, মাই বয়। গেট রেস্ট,” কথাটা বলেই দাঁত বের করে হাসল ফারুক সাহেব।

বেগ যখন দরজার কাছে তখনই ফারুক সাহেব বলে উঠল, “থ্যাংকস ফর অল দিস।”

পেছনে ফিরে মুচকি হেসে চলে গেল জেফরি বেগ।

.

হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে জেফরি ভাবলো ভালো একটা রেস্তোরাঁয় গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নেবে। জামান ছেলেটাকেও সঙ্গে নেবার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয়নি। সারা রাত অনলাইন ডিউটি করে একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। জেফরির মতো সেও সকাল থেকে কিছু খাওয়ার সুযোগ পায়নি। ছেলেটা বাড়ি চলে গেছে।

মোবাইলটা বিপ করে উঠলে পকেট থেকে সেটা বের করে দেখল জেফরি।

অজ্ঞাত একটি নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। ওপেন করল মেসেজটা।

আই এম সরি

তিনটি ছোট্ট শব্দে একটি এসএমএস। নাম্বারটা অজ্ঞাত হলেও জেফরি জানে মেসেজটা কে পাঠিয়েছে। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার ভেতর থেকে। গত দু’তিন ধরে তার ব্যক্তিগত জীবনে একটা ওলপালট ঘটে গেছে। কেউ জানে না। কাউকে বলার মতোও নয়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। কোনো কাজেই মন বসাতে পারছে না। আজকের কেসটায় যতোটুকু সাফল্য এসেছে সেটা নেহায়েতই ঘটনাচক্রে। এখানে জেফরির তেমন ভূমিকা ছিল না। কথাটা আর কেউ না জানুক জেফরি নিজে সেটা ভালো করেই জানে।

আই এম সরি। এই ছোট্ট কথাটা দিয়ে কিভাবে সব কিছু মুছে ফেলা যাবে? প্রচণ্ড কষ্টে হেসে ফেলল সে।

তুমি না, রেবা, আমিই দুঃখিত। জেফরি বেগ হবার জন্য। তোমাকে….

আর কিছু ভাবতে পারল না সে। অনেক ঘটনা, অনেক স্মৃতি হুরমুর করে এসে ভিড় করল তার মধ্যে।

রেবা। তার একমাত্র ভালোবাসা। এখন জীবন থেকে ছিটকে পড়েছে। দু’দিন আগে কাবিন হয়ে গেছে রেবার। কিছু দিন পর হয়তো কানাডায় চলে যাবে প্রবাসী স্বামীর সাথে। তাদের দীর্ঘ দিনের সম্পর্কটা যে এভাবে, এতো দ্রুত শেষ হয়ে যাবে সেটা জেফরি কল্পনাও করতে পারেনি।

প্রায় এক বছর ধরেই একটা টানাপোড়েনের মধ্যে ছিল তাদের সম্পর্কটা কিন্তু জেফরির কেন জানি মনে হোতো শেষ পর্যন্ত সব ঠিক হয়ে যাবে। কারণ তাদের এই সমস্যাটা নিজেদের তৈরি ছিল না। তাদের কোনো ভুলে সম্পর্কটা হুমকির মুখে পড়েনি। রেবার বাবা, জাঁদরেল আমলা আনজার হোসেন বাধা হয়ে দাঁড়ান। জেফরির এখনও সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে, লোকটার প্রতিটি কথা তাকে প্রতিনিয়ত খোঁচায়। তাকে অপমান করে। সে দিনের কথা এ জীবনে কখনও ভুলবে না। ভোলা সম্ভবও নয়।

ভার্জিনিয়া থেকে এফবিআইএ’র ট্রেনিং শেষে ফিরে এসেছে দেশে। রেবার জোরাজুরিতেই তার বাবার সাথে দেখা করতে রাজি হয় জেফরি। কুশল বিনিময়ের পরই ভদ্রলোক জানতে চাইলেন জেফরির বাবা-মায়ের কথা। এখানেই জেফরি এই পৃথিবীতে সবচেয়ে নীরব। অসহায়।

“আমি ফাদার জেফরি হোবার্টের কাছে মানুষ হয়েছি,” বলেছিল জেফরি। “উনি আর এখন বেঁচে নেই।”

“আচ্ছা,” চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আনজার হোসেন বললেন, “তো উনি তোমাকে কিভাবে পেলেন? আই মিন উনার সাথে তোমার কানেকশানটা কিভাবে হলো?”

এই পৃথিবীতে যতো অপ্রিয় বিষয় আছে এটা হলো জেফরির কাছে সবচাইতে অপ্রিয়তম। কিন্তু কিছু করার নেই। একান্ত অনিচ্ছায় জেফরিকে বলতে হলো সেটা। উনি আমাকে রাস্তা থেকে তুলে এনেছিলেন।”

আনজার সাহেব স্থির চোখে চেয়ে রইলেন। জেফরি টের পেল তার নিজের নিশ্বাস বেড়ে যাচ্ছে। একটা সুতীব্র অস্বস্তি জমাট বেঁধে যাচ্ছে বুকের ভেতর।

“রাস্তা থেকে…তখন তোমার বয়স কতো ছিল?”

‘সাত-আট মাস।”

“আর তোমার বাবা-মা?”

“উনারা…” গলায় একটা গিট পাকিয়ে এল, তারপরও জোর করে বলল, “…উনারা ৭৪-এ মারা গেছিলেন।”

“৭৪-এ?”

“হ্যাঁ।”

আনজার সাহেব স্থিরচোখে চোখে চেয়ে রইলেন। “আমার মেয়ে অবশ্য আমাকে এসব কথা বলেছে কিন্তু আমার বিশ্বাস হয়নি,” কথাটা নিজের মেয়ে রেবার দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি। রেবা মাথা নিচু করে রেখেছিল কথাটা শুনে অবিশ্বাসে তাকাল বাবার দিকে।

“আপনার কথাটা বুঝলাম না?” বলল জেফরি বেগ।

আনজার সাহেব নিজের মেয়েকে বাড়ির ভেতরে যেতে বললে রেবা চুপচাপ চলে গেল। এটা জেফরির কাছে খুব বিস্ময়ের মনে হয়েছিল। কারণ রেবা খুবই দৃঢ়চেতা মেয়ে।

“এমনও তো হতে পারে,” কথাটা বলে আনজার সাহেব দরজার দিকে তাকালেন, নিশ্চিত হলেন রেবা ঘর থেকে চলে গেছে কি না। “তোমার মা তোমাকে ফেলে চলে গেছেন?”

“আপনি কি বলতে চাচ্ছেন?” অবিশ্বাসে জেফরি বলল। ‘অবৈধ সন্তান ফেলে দেয়াটা তো বিরল কোনো ঘটনা নয়।”

নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারল না জেফরি বেগ। এ জীবনে অনেক অপ্রিয় কথা সে শুনেছে কিন্তু কেউ কখনও তার জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে এমন নোংরা আর কুৎসিত কথা বলেনি। জেফরির বিশ্বাস হচ্ছে না তার সামনে বসে থাকা লোকটি দেশের একজন উচ্চপদস্থ আমলা। সুশিক্ষিতও বটে।

“বড় বড় কথা অনেকেই বলতে পারে আমি সেরকম কিছু বলবো না। সমাজে আমার একটা অবস্থান আছে। তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছে ব্যাপারটা।” আনজার সাহেব কাটাকাটাভাবে বললেন।

“বুঝতে পারছি।”

“তোমাকে নিয়ে অনেক সমস্যা। একে তো তোমার কোনো জন্মপরিচয় নেই, তার উপর একজন খৃস্টান ফাদারের কাছে মানুষ হয়েছে। লোকজনকে ব্যাপারটা ব্যাখ্যাই করতে পারবো না।”

“আপনার মেয়ে কিন্তু আমার সব কিছু জেনেই-”

জেফরির কথার মাঝখানে হাত তুলে বাধা দিলেন আনজার সাহেব। গম্ভীরভাবে বললেন, “সব জানে না। তুমি যা বলেছো কেবল তাই জানে, আর আমার সহজ সরল মেয়ে সেসব কথা বিশ্বাস করে নিয়েছে।”

জেফরি ভুরু কুঁচকে অবিশ্বাসে চেয়ে রইল আনজার সাহেবের দিকে। “আপনি বলতে চাচ্ছেন আমি আপনার মেয়েক মিথ্যে বলেছি?”

“না, না,” সঙ্গে সঙ্গে বললেন আনজার হোসেন। “তুমি বলতে যাবে। কেন। তুমি যে কাহিনীটা বললে সেটা নিশ্চয় ফাদার তোমাকে বলেছে?”

বেগ মাথা নেড়ে সায় দিল।

“আমার ধারণা ফাদার তোমার কাছে একটা বানোয়াট গল্প বলেছেন। উনি জানতেন আসল সত্যটা বললে তুমি সহ্য করতে পারবে না।”

অনেকক্ষণ ধরে জেফরি বাকরুদ্ধ হয়ে থাকল। এ জীবনে নিজের মা’র সম্পর্কে এই প্রথম এতো বাজে কথা শুনতে পেল সে। তার কল্পনায় তার মা

এমন একজন অসহায় নারী যে কি না ক্ষুধার যন্ত্রণায় মরে গেছে কিন্তু নিজের সন্তানকে মরতে দেয়নি। তার অল্পবয়সি মা তার কাছে চিরদুঃখি। কিন্তু এখন এসব কী শুনছে! তার কল্পনার মায়ের ছবিটা এই ভদ্রলোক এক হলকায় বিকৃত করে দিয়েছে। জেফরি টের পেল তার হাত-পা রীতিমতো অসাড় হয়ে যাচ্ছে।

“কোথায় যাচ্ছো?” হঠাৎ করে জেফরি উঠে দরজার দিকে পা বাড়ালে আনজার সাহেব বললেন।

দরজার কাছে গিয়ে থামল সে। “আমার মনে হয় আপনার সাথে আর কথা বলার কোনো দরকার নেই…”।

“সত্য সব সময়ই—”

জেফরি হাত তুলে কথার মাঝখানেই থামিয়ে দিল। “আপনি আপনার মনগড়া সত্য নিয়ে থাকুন। আর আমাকে আমার সত্য নিয়ে থাকতে দিন।”

এরপর আনজার সাহেব পেছন থেকে কিছু বললেও জেফরির কানে সেসব পৌঁছায়নি। একটা ঘোরের মধ্যে ঘর থেকে বের হয়ে যায় সে। কততক্ষণ পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছিল সেটা তার মনে নেই। তবে রাতে বাড়ি ফিরে এক ফোঁটাও ঘুমাতে পারেনি।

পরের দিনই রেবার সাথে জেফরির দেখা হয়।

“তুমি ওভাবে চলে এলে কেন? কি হয়েছিল?” রেবা জানতে চেয়েছিল তার কাছে।

“কেন, তুমি জানো না?” পাল্টা বলল জেফরি।

“না!?”

চুপ করে রইল সে। অনেকক্ষণ পর বলল, “আমার মনে হয় তোমার বাবা আমাদের বিয়েতে রাজি না। উনি আমাকে মেনে নিতে পারছেন না।”

“আমি ভেবেছিলাম তোমাকে দেখার পর, তোমার সাথে কথা বলার পর উনি হয়তো রাজি হয়ে যাবেন,” মুখ ভার করে বলল রেবা। তারপর অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “এখন আমি কি করবো, জেফ?”

সুতীব্র যন্ত্রণায় অবাক হয়ে বেগ চেয়ে থাকল রেবার দিকে। “আমি জানি না।”

জেফরির হাতে হাত রেখে রেবা তাকে আশ্বস্ত করল। “একটু সময় দাও। আমি সব ঠিক করে ফেলবো। আমার মনে হয় কিছু দিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে।”

রেবা খুব জোর দিয়ে বললেও সেদিনের পর থেকে আর কোনো কিছুই ঠিক হয়নি। নিজের বাব-মা, পরিবার না কি একজন জেফরি বেগ-এই দ্বন্দ্বে পড়ে যায় সে। জেফরি বুঝতে পারে সে হেরে যাচ্ছে। দিনের পর দিন তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। কমে আসতে থাকে যোগাযোগ। আস্তে আস্তে রেবা নামের মেয়েটি, যার সাথে দীর্ঘ পাঁচ বছরের সম্পর্ক, জেফরির কাছ থেকে চিরকালের জন্যেই দূরে চলে যায়। দু’দিন আগে হঠাৎ রেবার কাছ থেকে একটা এসএমএস পায় সে। নিজের মুখে হয়তো বলার মতো সাহস অর্জন করতে পারেনি, তাই এসএমএস’র সাহায্যে জানায় আগামীকাল তার কাবিন। তাকে যেন জেফরি ক্ষমা করে দেয়।

খবরটা পাওয়ার পর থেকে জেফরির ভেতরে ভেতরে যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে সেটা কেউ জানে না। নিজের ভেতর লুকিয়ে রেখেছে সে। কিন্তু কাজেকর্মে কোনোভাবেই মন বসাতে পারছে না।

এমন একটা কারণে সে রেবাকে হারিয়েছে যেটার জন্য সে নিজে দায়ি নয়। ইচ্ছে করলেও সে এসব কিছু মুছে ফেলতে পারে না।

খুব কাছে একটা রেস্তোরাঁ থেকে চিকেন গ্রিলের সুস্বাদু দ্বাণ তার ভাবনায় ছেদ ঘটালেও কোনো কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না এখন। তিক্ত আর করুণ একটা স্মৃতি এসে ভর করেছে তার মাঝে। যে স্মৃতি প্রথম ধাক্কাতেই ক্ষুধা নামক জিনিসটাকে তাড়িয়ে দেয়।

জেফরি বেগ দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল রেস্তোরাঁটা পাশ কাটিয়ে।

.

অধ্যায় ২৪

১৯৭৪ সাল এ দেশের জন্যে একটি স্মরণীয় বছর হয়ে থাকবে। স্বাধীনতার পর পরই যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। কতো লক্ষ লোক সেই দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল সেই হিসেব কারো কাছে নেই। তবে অনুমাণ করা যায় সংখ্যাটা নেহায়েত কম হবে না।

দলে দলে লোক ছুটে আসতে থাকে ঢাকা শহরে। ছোট্ট এই শহর এতো মানুষের ভার সইতে পারেনি। অনেককে ঠাই দিতে পারলেও অসংখ্য মানুষ ঝরে যায় অকালে। খাদ্যের অভাবে ভিক্ষার জন্য হাত পাততে দ্বিধা করেনি এক সময়কার সচ্ছল পরিবারের লোকজনেরাও। ভাতের অভাবে ভাতের মাড় হয়ে ওঠে অনেকের কাছে বিকল্প খাদ্য।

শহরের পথেঘাটে হাজার হাজার নরনারীর কঙ্কালসার দেহ এখনও বন্দি হয়ে আছে সেই সময় তোলা অসংখ্য স্থিরচিত্রে আর মানুষের স্মৃতিতে। রাস্তায় নামলেই মানুষের হাহাকার টের পাওয়া যেতো।

ফাদার জেফরি হোবার্ট একজন ধর্মপ্রাণ খৃস্টান পাদ্রী। পয়ষট্টি সাল থেকে এই ঢাকা শহরে আছেন। একাত্তরের যুদ্ধ দেখেছেন, আর এখন দেখছেন দুর্ভিক্ষ। এ দেশের অভাগা মানুষের জন্যে তার হৃদয়টা ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। কিন্তু তিনি একা একজন মানুষ কতোটুকুই বা করতে পারেন।

ফাদার জেফরি হোবার্ট যাজকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি পুরনো ঢাকার প্রসিদ্ধ সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবেও কাজ করেন। প্রথম দিকে শিক্ষকতাকে শখের বিষয় হিসেবে নিলেও এখন এটাই হয়ে উঠেছে তার প্রধান মিশন। শিক্ষা দিয়ে মানুষের সেবা করাকে তিনি মনে করেন শ্রেষ্ঠ কাজ। সুতরাং যাজকের কাজের চেয়ে এটাকে তিনি কোনো অংশেই ছোট করে দেখেন না।

চিরকুমার জেফরি হোবার্ট আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসের বাসিন্দা-কেনেডিদের নেটিভ ল্যান্ড। আমেরিকার একমাত্র ক্যাথলিক সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য এটি। বাবা-মা বেশ সচ্ছল হবার পরও মানুষের সেবা করবেন বলে যাজকের পেশা বেছে নিয়েছিলেন। এখনও তার দেশে যে সম্পদ রয়েছে তা দিয়ে বাকি জীবনটা আরামে কাটিয়ে দিতে পারেন কিন্তু তিনি চান এইসব গরীব মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে। দুর্ভিক্ষ তাকে ভারাক্রান্ত করে রেখেছে। কাজে মন দিতে পারেন না। নাখাভুখা মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকালে তার বুকটা হু হু করে ওঠে! মাত্র কয়েক বছর আগেই তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু করিম বেগ স্বাধীনতা যুদ্ধে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। অসংখ্য শহীদের কাতারে চলে গেছে সে। প্রিয় বন্ধুকে হারানোটা ছিল তার জন্যে চরম বেদনার একটি ঘটনা।

তার এই বন্ধুটি আট বছরের এক ছেলে সন্তান রেখে গেছে। এখন যার বয়স এগারো। তারই স্কুলে পড়াশোনা করে। দুদিন হলো ছেলেটা স্কুলে আসছে না। ফাদার ঠিক করলেন স্কুল ছুটির পর কিছু কাজ সেরে বিকেলের দিকে ছেলেটার বাড়িতে যাবেন।

নিজের প্রিয় বাহন সাইকেলটা নিয়ে হেলেদুলে পুরনো ঢাকার অলিগলি দিয়ে খুব দ্রুত পৌঁছে গেলেন রামকৃষ্ণ মিশন রোডে। তার বন্ধুর বাড়ি কমলাপুর রেলস্টেশনের পরেই।

যাবার সময় দেখতে পেলেন রেললাইনের দু’পাশে অসংখ্য কঙ্কালসার মানুষ শুয়ে-বসে আছে। দুর্ভিক্ষের করুণ চিত্র। কিছুক্ষণ থেমে দৃশ্যটা দেখলেন ফাদার। অসহ্য লাগল তার কাছে।

এক হাড্ডিসার মহিলা, বয়স বড়জোর পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে, রেললাইনের একপাশে চটের উপর পড়ে আছে। কিন্তু ফাদারের দৃষ্টি আর্টকে রইল মহিলার পাশে ফুটফুটে এক বাচ্চার দিকে। সাত-আট মাস বয়সি একটা বাচ্চা ছেলে। সদ্য জন্ম নিয়েই এমন এক ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে সে। ছেলেটার পাঁজরের হাঁড় বের হতে শুরু করেছে। দুর্ভিক্ষের ছোবল থেকে সেও যে রেহাই পাবে না ফাদার সেটা ভালো করেই জানেন। বাচ্চাটার মায়ের অবস্থা খুবই নাজুক। জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বের হতে চাচ্ছে। ফাদার জেফরি হোবার্ট আর সহ্য করতে পারলেন না। সাইকেল চালিয়ে চলে গেলেন রেললাইনের ওপারে।

বন্ধুর বাড়ি গিয়ে জানতে পারলেন ঘটনা তেমন গুরুতর নয়, বন্ধুর ছেলে জ্বরের কারণে স্কুল যেতে পারেনি। যাহোক ছেলেটার পাশে কিছুক্ষণ বসে ছেলের মায়ের সাথে গল্পগুজব করে রওনা হলেন নিজের স্কুলের দিকে-ওখানেই তিনি থাকেন।

রেললাইনের কাছে আসতেই হঠাৎ কী যেন মনে করে থামলেন তিনি। একটু আগে এখান দিয়ে যাবার সময় বাচ্চাসহ যে মহিলাকে দেখেছিলেন তার খোঁজ করতেই দেখতে পেলেন মহিলার অসাড় দেহের সামনে এক হ্যাংলা-পাতলা যুবক দাঁড়িয়ে আছে। মুখে চাপ দাড়ি, কাঁধ পর্যন্ত চুল। হালফ্যাশনের বেলবটমের ফুলপ্যান্ট পরা যুবকটি যে কিছু দিন আগে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল সেটা বুঝতে পারলেন তিনি। বেশিরভাগ যুবা মুক্তিযোদ্ধাই যুদ্ধ শেষে মুখে দাড়ি রেখে দিয়েছে। এদেরকে দেখলেই চেনা যায়।

যুবকটির চোখেমুখে প্রচণ্ড ক্রোধ দেখে ফাদার হোবার্ট নিজের সাইকেলটা নিয়ে এগিয়ে গেলেন।

ফাদারকে দেখে যুবকটি লাল টকটকে চোখে তাকাল। মুখে কিছু না বললেও ফাদার জেফরি হোবার্ট বুঝতে পারলেন বাচ্চাটার মা আর বেঁচে নেই। নীরবনিথর মায়ের দেহের পাশে ফুটফুটে বাচ্চাটা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে আর আপন মনে দু’পা শূন্যে লাথি মেরে যাচ্ছে। অবোধ শিশু জানে না এতিম হয়ে গেছে সে।

“ওর বাবা কোথায়?” ইংরেজি টানে স্পষ্ট বাংলায় বললেন ফাদার। দীর্ঘদিন এদেশে থাকার কারণে বেশ ভালোই রপ্ত করে ফেলেছেন ভাষাটি।

“কেঠায় জানে!” যুবকটি রেগেই বলল। স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় বললেও ফাদারের বুঝতে অসুবিধা হলো না।

“এখন ওর কি হবে?” জেফরি হোবার্ট উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলেন।

“জানি না! কিছু জানি না,” যেন কারোর বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝারছে এমনভাবে বলল যুবকটি। “হালায় এইসব দ্যাহনের লাইগ্যা দ্যাশ স্বাধীন করছিলাম না কি!”

ফাদার রাগি যুবকটির কাঁধে আলতো করে হাত রাখলে যুবক ঘুরে তাকাল তার দিকে। ক্রোধ ছাপিয়ে এখন দু’চোখ ভরে অশ্রু ছলছল করছে।

অবোধ শিশুটির দিকে তাকিয়ে ফাদার জেফরি হোবার্টের বুকটা হাহাকার করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে কোলে তুলে নিলেন বাচ্চাটাকে।

“আমি একে নিয়ে যাবো?” কম্পিত কণ্ঠে ফাদার বললেন।

যুবক ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ফাদারের দিকে। “নিয়া যান, ফাদার। অন্তত একজন রে বাঁচান। আমার নিজের তো কোনো চালচুলা নাই। আমি তো এরে পালতে পারুম না।” কথাটা বলেই দু’চোখ মুছে যুবকটি হনহন করে চলে গেল।

রাগি সেই যুবক টুকটাক গানবাজনা করতো, এই ঘটনাটি নিয়ে সেদিন রাতেই একটা গান লিখে ফেলল সে আর ফাদার জেফরি হোবার্ট নিজের ঘরে ফিরে এলেন জীবনের আরেকটি মিশন শুরু করার জন্য।

স্কুল কম্পাউন্ডে ফাদারের বাসায় ঠাঁই পেল ছেলেটি। বেচে গেল দুর্ভিক্ষের ছোবল থেকে। ছেলেটিকে ফাদার জনি বয় নামে ডাকতেন, কিন্তু স্কুলে ভর্তি করার সময় যখন এল তখন একটা নাম রাখার প্রয়োজন দেখা দিল। অনেক ভেবেও ফাদার কোনো নাম ঠিক করতে না পেরে অবশেষে নাম রাখলেন নিজের প্রথম নাম জেফরি। কিন্তু একজন মুসলিম ছেলের নাম শুধু জেফরি হবে সেটা যেন ফাদারের মনোপুত হলো না; অগত্যা নিজের প্রিয় বন্ধুর টাইটেল বেগ মিলিয়ে নাম রাখলেন জেফরি বেগ।

.

অধ্যায়

সিদ্দিকী সাহেব নিজের অফিস থেকে আজ তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছেন। সাধারণত অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায় তার। কাজ শেষে প্রতিদিনই ঢাকা ক্লাবে যান। তার সামাজিক জীবন বলতে এখন এই ক্লাব জীবনটাই। কিন্তু আজ তিনি ক্লাবে যেতে পারবেন না। সত্যি বলতে কি, আগামী দুদিন তিনি যেতে পারবেন না ওখানে। তাতে অবশ্য তার মনে কোনো আফসোস নেই, বরং বিরাট একটা দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হওয়াতে বেশ নির্ভার লাগছে।

কী যে ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিলেন, ভাবাই যায় না।

লেখক জায়েদ রেহমান যখন নিজঘরে খুন হয়েছেন তার ছেলে কি না তখন লেখকের বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল? শুধু কি তাই! পুলিশের কাছে ধরা পড়ে থানা-হাজতে পর্যন্ত যেতে হয়েছে তাকে। সিদ্দিকী সাহেব খুব দ্রুত থানা থেকে তাকে ছাড়িয়ে না আনলে কী যে হোতো ভাবতেই গা শিউড়ে ওঠে তার।

কিন্তু থানা থেকে শুধু ছাড়িয়ে আনলেই যে ঝামেলা থেকে মুক্ত হওয়া যাবে না সেটা সিদ্দিকী সাহেব ভালো করেই জানতেন, সেজন্যই স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দিয়ে থানার রেকর্ড থেকে ছেলের গ্রেফতার হওয়ার প্রমাণ যেমন রাখেননি সেই সঙ্গে যে পুলিশ অফিসার তাকে গ্রেফতার করেছিল তার মুখও বন্ধ করার ব্যবস্থা নিয়েছেন। অবশ্য কাজটা করতে তাকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। তবে আরেকটু দেরি করলেই সব ওলটপালট হয়ে যেতো।

ধানমণ্ডি থানার ইন্সপেক্টর এলাহী নেওয়াজ ভালোমতোই সব সামলেছেন। সিদ্দিকী সাহেব এজন্যে তার উপর খুবই খুশি। লোকটা খুব কাজের। তার কথা তিনি মনে রাখবেন।

অমূল্য বাবু আবারো অসাধ্য সাধন করেছে, নিজের কারিশমা দেখিয়ে লোকটা সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে জাদুর মতো। সিদ্দিকী সাহেবের মতো ক্ষমতাধর ব্যক্তিও অমূল্য বাবুর ক্ষমতায় মুগ্ধ।

শাওয়ার থেকে বের হয়ে এক পেগ হুইস্কি খেয়ে নিলেন তিনি। ব্যাগট্যাক সব গুছিয়ে রাখা হয়েছে। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় তার ফ্লাইট। ঢাকা থেকে বোম্বাই।

ঘড়িতে সময় দেখলেন চৌধুরি ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী। চারটা। সাড়ে চারটায় বিমানবন্দরের দিকে রওনা দেবেন তিনি। হাতে এখনও আধঘণ্টা সময় আছে। ড্রইংরুমের সোফায় বসে টিভিটা ছেড়ে দিলেন।

সব চ্যানেলে একটাই খবর : জনপ্রিয় লেখক জায়েদ রেহমান খুন হয়েছেন।

অন্য কোনো চ্যানেলে না গিয়ে স্বদেশ টিভি নামের একটি চ্যানেলে সুইচ করলেন খবর দেখার জন্য। এই চ্যানেলটি তার কাছে বিশেষ প্রিয় হবার কারণ খুবই সহজ সরল : চ্যানেলটির পঞ্চান্ন শতাংশ মালিকানা তার নিজের। তার মানে তিনিই এই চ্যানেলের সর্বেসর্বা।

এ সময় তার মোবাইল ফোনটা বিপ্ করে উঠলে একটু বিরক্তই হলেন তিনি। ডিসপ্লেতে নাম্বারটা দেখে সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ করলেন।

“হ্যাঁ, কি হয়েছে?” বললেন সি ই এ সিদ্দিকী।

“স্যার, একটা জরুরি প্রয়োজনে ফোন করলাম। খুবই জরুরি,” ওপাশ থেকে সিদ্দিকী সাহেবের সমস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জেনারেল ম্যানেজার রাইসুল আনাম শিকদার উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল।

“তুমি জানো না একটু পরই আমার ফ্লাইট,” সিদ্দিকী সাহেবের কণ্ঠে বিরক্তি। “যা বলার সংক্ষেপে বলো।”

“সরি, স্যার। স্বদেশ টিভির মহাপরিচালক ইকরাম সাহেব ফোন দিয়েছিলেন…” ম্যানেজার বলল।

“কি হয়েছে!”

“…উনি আপনার সাথে সরাসরি কথা বলতে চাচ্ছেন। আমি উনাকে বলেছি একটু পরই আপনার ফ্লাইট আছে তারপরও ভদ্রলোক চাপাচাপি করলেন। তবে আপনি যদি বলেন আমি নিজেই কথা বলতে পারি?”

একটু ভাবলেন সিদ্দিকী সাহেব। “আচ্ছা, এক্ষুণি ফোন করতে বলো। আমার হাতে বেশি সময় নেই।”

ম্যানেজারের সাথে কথা শেষ হবার মিনিটখানেক পরই স্বদেশ টিভির মহাপরিচালক ইকরাম সাহেবের কাছ থেকে একটা কল পেলেন সিদ্দিকী সাহেব। ভদ্রলোক খুব বেশি সময় নিলেন না, সংক্ষেপে যা বললেন তাতে করে সিদ্দিকী সাহেবের কপালে বেশ কয়েকটি ভাঁজ পড়ে গেল।

নতুন একটা সমস্যার আর্বিভাব হলেও এ যাত্রায় অনেকটা ভাগ্যের জোরেই সিদ্দিকী সাহেব পার পেয়ে গেছেন। তাকে কিছু করতে হয়নি। যা করার স্বদেশ টিভির মহাপরিচালকই করেছেন। লোকটার কাণ্ডজ্ঞানের প্রশংসা করলেন মনে মনে। এই কাজের পুরস্কার তাকে দেয়া হবে।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন সাড়ে চারটা বাজতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। উঠে দাঁড়ালেন। সময় হয়েছে রওনা দেবার।

.

অধ্যায় ২৬

লেখক জায়েদ রেহমানের হত্যাকান্ত্রে দিনটি যদি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার হয়ে থাকে তাহলে পরের দিনটি নিঃসন্দেহে প্রিন্ট মিডিয়ার।

সবগুলো জাতীয় দৈনিকে ব্যানার হেডলাইনে ঠাঁই পেল এই প্রখ্যাত লেখকের হত্যাকাণ্ডের খবর। একেকজন একেকভাবে তুলে ধরল জায়েদ রেহমানের ঘটনাটি। সবার মধ্যেই একটা প্রবণতা ছিল-গতকাল ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় যেসব খবর বের হয়েছে তারচেয়ে ভিন্ন কিছু দিতে হবে। এরফলে লেখকের হত্যাকাণ্ডের চেয়ে বেশি জায়গা বরাদ্দ পেয়েছে তার তরুণী স্ত্রীর পরকীয়া প্রেম আর লেখকের বিতর্কিত জীবনের ঘটনাগুলো।

তবে এদের মধ্যে আসমান-জমিন পত্রিকাটি লেখকের প্রেম ও যৌন জীবন নিয়েই বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। তারা কতোগুলো ফিচার রিপোর্ট ছেপেছে যার অনেকগুলোই সত্য।

জেফরি বেগ সকালে ঘুম থেকে উঠে যথারীতি জগিং করে নিজের ঘরে ফিরে এসে দুটো দৈনিক পত্রিকা পড়ে ফেলেছে। একটা পত্রিকার ছোট্ট একটা বক্স আইটেমের দিকে তার দৃষ্টি গেল।

তার একটা পুরনো ছবি দিয়ে এক কলামের একটা রিপোর্ট ছেপেছে তারা। শিনেরানাম দিয়েছে : একজন জেফরি বেগ…

মুচকি হাসল সে। কারণ রিপোর্টার এমনভাবে তার কথা লিখেছে যে পাঠক পড়ে মনে করবে গতকাল সে রিপোর্টারের কাছে একটা ইন্টারভিউ দিয়েছে।

জেফরি বেগ কিভাবে অতি দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে মিসেস রেহমানের প্রেমিককে গ্রেফতার করল সেটার মনগড়া একটা কাহিনী বিবৃত করেছে রিপোর্টার। নিউজটা খুব বেশি বড় নয়।

ভেতরের পৃষ্ঠায় লেখক জায়েদ রেহমানের জীবনবৃত্তান্ত দেয়া আছে। মোটামোটি তার জীবনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনাই উল্লেখ করা আছে তাতে। জেফরি মনোযোগ দিয়ে পড়ল সেটা। এই লেখাটাসহ আরো যেসব লেখায় জায়েদ রেহমানের জীবনবৃত্তান্ত কিংবা তার জীবনের টুকরো টুকরো ঘটনার উল্লেখ আছে সেসবই সংগ্রহ করতে হবে। লেখক জায়েদ রেহমানের সম্পর্কে জেফরির তেমন কোনো ধারণাই নেই। এই বিখ্যাত লেখককের কোনো বই পড়েছে বলেও মনে করতে পারল না সে। সিদ্ধান্ত নিলো লেখকের কিছু বইও পড়বে। তবে মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে মেইল করে যে বইটা তিনি একজন প্রকাশককে পাঠিয়েছেন সেটা পড়তে হবে সবার আগে। প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার। একটি বই। অনেক সময় লাগবে।

গতকাল রাতে তার সহকারী জামান বাড়িতে এসে পলিগ্রাফ টেস্টের প্রিন্ট কপি দিয়ে গেছে। সেই সাথে আরো জানিয়ে গেছে, লেখক জায়েদ রেহমানের পোস্টমর্টেম করা হয়েছে। অভিনব কিছু নেই। এটি যে হত্যাকাণ্ড সে ব্যাপারে প্রমাণ পাওয়া গেছে তবে রিপোর্ট তৈরি করতে আরো দু’একদিন লেগে যাবে।

জায়েদ রেহমান যে খুন হয়েছেন সেটা ফরেনসিক রিপোর্ট পাওয়ার আগেই মোটামোটি নিশ্চিত হওয়া গেছে তারপরেও জেফরির মনে হচ্ছে কোথাও যেন একটা সমস্যা আছে। এই কেসটার পেছনে যতোটুকু মনোযোগ দেবার দরকার ছিল সেটা সে দিতে পারেনি অথচ পরিহাসের বিষয় হলো এটাই এখন পর্যন্ত তার ক্যারিয়ারে সবচাইতে দ্রুত সমাধান করা কেস-অন্তত সবাই সেরকমই মনে করছে।

নাটকীয়ভাবে দ্রুততার সাথে সবকিছু ঘটে যাওয়াতে এই হত্যাকাণ্ডের অনেক কিছুই জেফরির চোখ এড়িয়ে গেছে। পুরো বিষয়টা ভালো করে খতিয়ে দেখতে হবে। কেসটা নিয়ে ধীরস্থিরভাবে ভাবতে শুরু করার আগে ভালো করে এক কাপ গরম চা বানিয়ে নিলো সে।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নিজেকে যতোটা সম্ভব ধীরস্থির করে পুরো ব্যাপারটা খতিয়ে দেখল। এ পর্যন্ত সে যা জানে তার মধ্যে অসঙ্গতিগুলো কি এবং সেটা কতোটা শক্তিশালী।

প্রথম অসঙ্গতি, পলিগ্রাফ টেস্টের ফলাফল। হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টে এখন পর্যন্ত পলিগ্রাফ টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ হয়নি। কিন্তু এই ঘটনায় আশ্চর্য রকমেই সেটা নেগেটিভ। অবশ্য তার বস্ ফারুক সাহেব এটাকে তেমন আমলে নিতে চাচ্ছে না।

দ্বিতীয় অসঙ্গতিটা ল্যাপটপ নিয়ে। হাউজনার্সের কথা যদি ঠিক হয় তাহলে একজন চলৎশক্তিহীন মানুষ কিভাবে তার নাগালের বাইরে থাকা কফি টেবিলের উপর রাখা ল্যাপটপ থেকে মেইল করল?

অনেক দিন আগে জেফরি একটা হলিউডি ছবি দেখেছিল, নামটা অবশ্য এ মুহূর্তে মনে করতে পারল না; সারা ছবিতে প্রধান চরিত্রটি অন্ধ হলেও শেষে দেখা যায় সে আসলে অন্ধ নয়, অন্ধ হবার ভান করেছিল কেবল, আর সেই সুযোগে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে যায় সন্দেহের উর্ধ্বে থেকে।

মুচকি হেসে ফেলল জেফরি। লেখক জায়েদ রেহমানের বেলায় এমন কিছু হয়েছে বলে বিশ্বাস করতে পারল না।

সম্ভাব্য খুনি হিসেবে আটক থাকা মিসেস রেহমান আর তার প্রেমিক আলম শফিক যে এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে সে ব্যাপারে এখন সবাই নিশ্চিত। কিন্তু জেফরির মনে একটা খটকা লেগেই আছে-এটা হলো তার কাছে তৃতীয় অসঙ্গতি।

আলম শফিক আর মিসেস রেহমান-যদি তারা খুনটা করেই থাকে তাহলে সেই রাতে দু’দুবার শারীরিকভাবে মিলিত হলো কিভাবে?

পাশের ঘরে খুন করে এসে এ রকম একটি কাজ করা কি স্বাভাবিক কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব? এরজন্য যে পরিমাণ শক্ত নার্ভের দরকার সেটা এই দুজনের কারো মধ্যেই নেই, বিশেষ করে আলম শফিকের তো মুরগি কাটার মতো নার্ভ আছে কি না তাতেও জেফরির সন্দেহ রয়েছে।

অনেক খুনি দেখেছে জেফরি। তাদের অনেকেই পেশাদার। কিন্তু খুন করার আগে-পরে তারাও নিজেদের নার্ভ ঠিক রাখার জন্য মদ পান করে থাকে। অনেকে আবার শক্তিশালী ড্রাগও নেয়।

প্রথমে এই ব্যাপারটা জেফরির কাছে ধরা পড়েনি কিন্তু এখন যখন পুরো কেসটা নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে বসেছে এক এক করে সব তার কাছে ধরা পড়ছে।

হঠাৎ উঠে দাঁড়াল সে। একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। ভিটা নুভায় যেতে হবে।

.

নাস্তা করার আগেই জামান ফোন পেল জেফরি বেগের কাছ থেকে। তড়িঘড়ি নাস্তা করেই রওনা দিল সে। বেগ তাকে সরাসরি ভিটা নুভায় চলে যেতে বলেছে।

লেখক জায়েদ রেহমানের অ্যাপার্টমেন্টের দরজাটা খোলা দেখে সে। বুঝতে পারল জেফরি বেগ তার অনেক আগেই এসে পৌঁছেছে।

পুরো অ্যাপার্টমেন্টটি পুলিশ সিজ করে রেখেছে। হাউজনার্স আর দু’জন কাজের মহিলাকে আপাতত পুলিশ কাস্টডিতে রাখা হয়েছে। পুরো অ্যাপার্টমেন্টে কেউ নেই। লেখকের এক বছরের একটি ছেলে সন্তান আছে, তাকে তার নানা-নানী নিয়ে গেছে। দুজন পুলিশের সার্বক্ষণিক পাহারা বসানো হয়েছে সেখানে। তাদের কোনো কাজ নেই। শুধুমাত্র লেখক জায়েদ রেহমানের অ্যাপার্টমেন্টের দরজার সামনে বসে থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

ঘরে লেখকের অনেক ব্যবহার্য জিনিসপত্র সিজার লিস্টে ঠাঁই পেয়েছে তবে আসবাবপত্র আর বাকি সব জিনিস আগের মতোই আছে। জামান লেখকের ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেল জেফরি বেগ এক মনে লেখকের ফাঁকা বিছানার দিকে চেয়ে আছে। তার উপস্থিতি টের পেলে ঘুরে তাকাল কেবল।

“কখন এসেছেন, স্যার?”

“দশ-পনেরো মিনিট হবে,” বলল বেগ।

জামান তার কাছে এগিয়ে গেল। “স্যার, পোস্টমর্টেমের রেজাল্ট তৈরি হচ্ছে। তবে আমার কাছে খবর আছে, জায়েদ রেহমানের মৃত্যু শ্বাসরোধ করে করা হয়নি।”

“তাহলে কজ অব ডেথ কি?” জানতে চাইল জেফরি।

“হার্ট অ্যাটাক।”

“উমমম।” একটু ভেবে তারপর বলল সে, “ফরেনসিক টিম কি। একেবারে নিশ্চিত?”

মাথা নেড়ে সায় দিল জামান।

“বুকের বাম পাশে যে একটা লালচে দাগ ছিল সেটার ব্যাপারে কিছু জানা গেছে?”

“ওখানে আঘাত করার আলামত পেয়েছে তারা। পাঁজরের ঐ জায়গার হাঁড়ে না কি ফ্র্যাকচার আছে।”

জেফরি এটা আগেই আন্দাজ করেছিল।

“স্যার, আমি তো ভেবেছিলাম উনাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। মুখে একটা বালিশ চাপা দেয়া ছিল।”

“মুখ দিয়ে যাতে শব্দ না বের হয় সেজন্যে দেয়া হয়েছিল,” বলল জেফরি বেগ।

“সেটা তো হাত দিয়েও করা যেতো?”

“বালিশ দিয়ে করলে কাজটা অনেক সহজ হয়।”

যুক্তিটা যুতসই বলেই মনে হলো জামানের কাছে। কিন্তু মিসেস রেহমান আর তার প্রেমিক এতো বড় একটা ভুল করল কেন? তারা তো কাজ শেষে বালিশটা মুখ থেকে সরিয়ে রাখতে পারতো? এমনভাবে রাখতে পারতো যাতে মনে হোতো জায়েদ সাহেব ঘুমের মধ্যে মারা গেছেন। ন্যাচারাল ডেথ।”

“আমরা সবাই ভুল করি, জামান। যেভাবে পরিকল্পনা করা হয় সেভাবে সব ঠিকঠাক মতো করা যাবে এটা ভাবছো কেন। হয়তো নার্ভাস হয়ে তারাও কিছু ভুল করেছে। আবার এমনও হতে পারে, তারা সব কিছু ঠিকঠাক করার আগেই অপ্রত্যাশিতভাবে পুলিশ এসে পড়াতে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। আমার অবশ্য সে রকমই মনে হচ্ছে “ জেফরি বলল।

“তাহলে ল্যাপটপের ব্যাপারটা?”

“সেটাই তো সবচাইতে বড় খটকা।” কথাটা বলে জেফরি একটু চুপ থেকে আবার বলল, “এই কেসে তিনটি খটকা আছে যার ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত আমরা জানি না।”

“তিনটি?” অবাক হলো জামান। “আমি তো ভেবেছিলাম ল্যাপটপের ব্যাপারটাই শুধু…বাকি দুটো কি, স্যার?”

“পলিগ্রাফ টেস্টের রেজাল্ট। ওদের ভাইটাল কোয়েশ্চেনের জবাবগুলো একদম সঠিক।”

“কিন্তু ফারুক স্যার যে বললেন এটা তেমন কোনো-”।

জামানের কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে জেফরি বলল, “টেকনিক্যালি উনার কথাই ঠিক। পলিগ্রাফ টেস্ট একেবারেই আমাদের নিজেদের সুবিধার্থে করা হয়ে থাকে। এটা আমাদেরকে ইন্টেরোগেশনে সাহায্য করে। এ ছাড়া আর কিছু না।”

“তাহলে…?”

“এই প্রথম পলিগ্রাফ টেস্টের ফলাফল এ রকম হলো। এটাই আমাকে ভাবাচ্ছে। তবে এটা তেমন বড় কোনো কারণ নয়।”

“এরচেয়েও বড় কারণ আছে, স্যার?”

“তিন নাম্বার কারণটা একটু জটিল। তবে ল্যাপটপের চেয়ে এটাই এখন আমার কাছে বেশি বড় বলে মনে হচ্ছে।”

জামান কথাটা শুনে আরো বেশি আগ্রহী হয়ে উঠল। “সেটা কি?”

“জায়েদ রেহমান খুন হবার আগে এবং পরে মিসেস রেহমান আর তার প্রেমিক আলম শফিক শারীরিকভাবে মিলিত হয়েছেন…এটা আমরা তাদের জবানবন্দি থেকেও জেনেছি…আর আমাদের কাছে তো এর সপক্ষে প্রমাণও আছে…”

জামান একটু লজ্জা পেল। কোনো প্রশ্ন করল না সে।

“…দুজন নারী-পুরুষ খুন করার আগে এবং পরে এ রকম কিছু করবে, …ভাবাই যায় না।”

“আপনি এখন কি করতে চাচ্ছেন, স্যার?” জানতে চাইল জামান।

“জামান, গতকাল আমাদের ভাগ্য খুবই ভালো ছিল। কোনোরকম প্রচেষ্টা ছাড়াই আমরা অভাবনীয় সাফল্য পেয়ে গেছি। সত্যি বলতে কি, এই কেসে আমাকে তেমন কিছুই করতে হয়নি, অথচ দ্যাখো, কতো দ্রুত সাফল্য পেয়েছি আমরা।”

জামান চুপ করে থাকল।

“পুরো কেসটা একেবারে প্রথম থেকে তদন্ত করতে চাই আমি।”

জামান মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না। “আপনি কি মনে করছেন এই হত্যাকাণ্ডটি মিসেস রেহমান আর আলম শফিক করেননি?”

বেগ মাথা নাড়ল। “ব্যাপারটা সেরকম নয়, জামান। আমি কিছুই মনে করছি না। শুধু অসঙ্গতিগুলো বুঝতে চাইছি।”

“মিসেস রেহমান আর আলম শফিক ছাড়া কে এই কাজ করতে যাবে?”

“সম্ভবত কাজটা তারাই করেছে, কিন্তু এখানে আরো কিছু ঘটনা রয়ে গেছে।”

“ফারুক স্যার কি ব্যাপারটা জানেন?”

মুচকি হাসল বেগ। “বলেছিলাম তবে সিরিয়াসলি বলিনি।”

জামান চুপ করে রইল।

“আমাদের কাজ কিন্তু খুনি ধরা নয়, জামান,” বলল জেফরি। “আমাদের কাজ সত্যিকার ঘটনাটি তদন্ত করে বের করা।”

মাথা নেড়ে জামান সায় দিল।

“গতকাল হয়তো আমরা খুনি ধরতে পেরেছি কিন্তু ঘটনাটি আসলে কি সেটা এখনও জানতে পারিনি।”

“আপনি কি মিসেস রেহমান আর আলম শফিককে আবারো জিজ্ঞাসাবাদ করবেন?” জামান বলল।

“তাদেরকে নয়,” কথাটা বলেই দরজার দিকে পা বাড়াল জেফরি বেগ। “আমি এই অ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ান আর অন্যান্য অ্যালোটিদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাই।”

.

“এইটা তো আমি কইবার পারুম না, স্যার,” ভিটা নুভার নাইটগার্ড আসলাম জেফরির প্রশ্নের উত্তরে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বলল।

গতকাল থেকে সে প্রচণ্ড ভয়ে আছে। ভেবেছিল নাইটগার্ডের চাকরিটার চেয়ে নির্ঞ্ঝাট চাকরি এ দুনিয়ায় দ্বিতীয়টি নেই, কালকের পর থেকে অবশ্য সেটা আর তার কাছে মনে হচ্ছে না। কী জানি কোন্ বিপদে পড়ে যায় এই ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে সে।

“কাল রাতে তো তুমিই ডিউটিতে ছিলে?” বলল জেফরি।

“আমি তো সন্ধ্যা সাতটার পর থেইকা ডিউটি দেই,” আসলাম সতর্ক হয়ে বলল।

“তাহলে তুমি ডিউটিতে যোগ দেবার পর কারা কারা এখানে ঢুকেছে আর বের হয়ে গেছে সেটা বলো?”

“এতো মানুষ থাকে এহানে আমি কেমনে কমু? আমার তো কিছু মনে নাই।”

“এই ফ্ল্যাটের লোকজনের কথা বলছি না, বাইরের লোকদের কথা বলছি,” জেফরি বলল।

“না, স্যার। বাইরে থেইকা কেউ আসে নাই,” আসলাম নিশ্চিত হয়ে বলল ইনভেস্টিগেটরকে।

জেফরি জানে ছেলেটা ঠিকই বলছে কারণ মিসেস রেহমান তার গাড়িতে করে আসলাম শফিককে যে ভিটা নুভায় নিয়ে এসেছিলেন সেটা তার জানা কথা নয়।

তারা বসে আছে নিচের পার্কিংলটের শেষমাথায় দারোয়ানদের ছোট ছোট দুটো ঘরের সামনে। “কোনো অপরিচিত লোকজনকে তুমি দ্যাখোনি?” জেফরি আবারো জানতে চাইল।

“সন্ধ্যার পর থেইকা দেহি নাই, তয়…”

“তাহলে কী…বলো?” ছেলেটাকে তাড়া দিয়ে জামান বলল পাশ থেকে।

“ভোর বেলা ফজরের আজান দিবার পর এই ফ্ল্যাটের দোতলার হানিফ স্যার নামাজ পড়তে বাইর হইছিলেন, উনার সাথে বোধহয় উনার এক গেস্টও ছিল। আমি উনারে চিনি না, স্যার।”

“তুমি চেনো না মানে আগে কখনও দ্যাখোনি?”

“না, দেহি নাই।”

“ঐ গেস্ট এখন কোথায়?”

“তাতো কইবার পারুম না। উনারে আর দেখতাছি না।”

“হানিফ সাহেব কি নিজের ফ্ল্যাটেই আছেন?” জেফরি জানতে চাইল।

“মনে হয় আছেন।”

জামানের দিকে ফিরল জেফরি। “হানিফ সাহেবের সাথে দেখা করতে হবে। চলো।”

.

হানিফ সাহেব যেন আকাশ থেকে পড়লেন। “আমার গেস্ট? ঐ ইডিওটটা কি আপনাদেরকে এ কথা বলেছে?”

পুলিশের লোক পরিচয় দেবার পর এই লোক প্রথমে একটু ভড়কে গেছিলেন, দরজা ফাঁক করেই পুরো আলাপ সেরে নিতে চেয়েছিলেন তিনি। তার ধারণা ছিল লেখক জায়েদ রেহমানের হত্যাকাণ্ডের সমস্ত রহস্য উন্মোচিত হয়ে গেছে, সুতরাং খামোখা কেন অ্যালোটিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে এখন? জেফরি যখন বলল তার ঘরে বসে তার সাথে কিছু জরুরি কথা বলতে হবে তখন অনেকটা অনিচ্ছায় জামান আর জেফরিকে ভেতরে ঢুকতে দিয়েছেন ভদ্রলোক। বিশাল ড্রইংরুমের রাজকীয় দুই সেট সোফার একটাতে বসেছে তারা। জেফরি খেয়াল করেছে ভেতরের ঘর থেকে দুজন মহিলা উঁকি মেরে তাদের কথা শোনার চেষ্টা করছে।

“আপনি বলছেন আপনার কোনো গেস্ট ছিল না?” জেফরি বলল।

“গতকাল তো দূরের কথা বিগত এক মাসে আমার কোনো গেস্ট আসেনি।” ভদ্রলোক পুলিশের জেরার ভয়ে কৃত্রিম রাগ দেখানোর চেষ্টা করছেন।

“আমি বিগত এক মাসের কথা জানতে চাইনি, গতকালকের কথা জানতে চাইছি।”

মুখ টিপে হাসছে জামান। ভদ্রলোককে খুব মজার মানুষ মনে হচ্ছে তার কাছে।

“না। আমার কোনো গেস্ট ছিল না,” কাটাকাটাভাবে বললেন হানিফ সাহেব।

“দারোয়ান ছেলেটা যে বলল আপনার সাথে আরেকজন ছিল। আপনারা ফজরের আজান দেবার পর পরই বের হয়েছিলেন?”

“ঐ ইডিওটটা কেন এ কথা বলছে আমি জানি না। আমার স্পষ্ট কথা শুনে রাখুন, আমি একাই বের হয়েছি। সব সময় একাই বের হই। এই অ্যাপার্টমেন্টে ফজরের নামাজ পড়ার লোক আছে না কি?” হানিফ সাহেব দৃঢ়তার সাথে বললেন।

“জামান, দারোয়ান ছেলেটাকে নিয়ে আসো এখানে,” জেফরি জামানকে বললে সে উঠে চলে গেল।

“আপনি কি নিয়মিতই নামাজ পড়েন?” হানিফ সাহেবকে প্রশ্ন করল বেগ।

“ফজরের নামাজ যে পড়তে পারে ধরে নিতে হবে সে নিয়মিতই নামাজ পড়ে।”

“এই অ্যাপার্টমেন্টে তাহলে আর কেউ নামাজ পড়ে না?”

দ্রলোকের মুখে তিক্ত হাসি দেখা দিল। “নামাজ পড়বে এরা! হা। একেকটা বদমাশ। আকাম কুকাম করেই সময় পায় না নামাজ পড়বে কখন?”

“তাহলে পুরো ফ্ল্যাটে আপনি একাই নামাজ পড়েন?”

“সেটা আমি বলতে পারবো না। তবে আমি কাউকে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যেতে দেখিনি। জুম্মার নামাজ অবশ্য অনেকেই পড়ে। এই অ্যাপার্টমেন্টে ফ্ল্যাট কিনে কী যে ভুল করেছি! একেকটা পিশাচ থাকে এখানে। আর এখন তো সারা দেশ জেনে গেল এখানে কী সব ঘটনা ঘটে!”

“কিন্তু দারোয়ান ছেলেটা বলছে আপনার সাথে আরেকজন ছিল। নিশ্চয় কোথাও কোনো ভুল হয়েছে। ভালো করে ভেবে দেখুন,” বলল জেফরি।

“ভাবাভাবির কিছু নেই। অবশ্যই ভুল হয়েছে, তবে সেটা আমার নয়, ঐ ছেলেটার,” বললেন হানিফ সাহেব।

আড়চোখে তাকিয়ে ড্রইংরুমের শেষমাথায় একটা দরজার পদার আড়ালে দু’জন মহিলাকে দেখে নিলো জেফরি।

জামান ফিরে এল দারোয়ান ছেলেটাকে সাথে নিয়ে।

“এই হারামজাদা! আমার সাথে কাকে দেখেছিস…অ্যাঁ?” দারোয়ান ছেলেটাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই রেগেমেগে বললেন হানিফ সাহেব।

“প্লিজ, হানিফ সাহেব। আপনি কিছু বলবেন না। আমাকে বলতে দিন,” জেফরি লোকটাকে নিবৃত্ত করে বন্ধুসুলভ কণ্ঠে দারোয়ান ছেলেটাকে বলল, “তুমি কি নিশ্চিত দেখেছো, হানিফ সাহেবের সাথে আরেকজন ছিল?”।

“জি, স্যার,” নাইটগার্ড আসলাম বলল জবাবে।

“তুমি তো বলেছো লোকটাকে তুমি চেনো না, তাহলে কি করে বুঝলে ঐ লোক হানিফ সাহেবের গেস্ট হতে পারে?”

ছেলেটা মনে হলো ধন্দে পড়ে গেছে। “না, মানে…উনারা দু’জন একসাথে বের হইছিলেন তো…”

“আরে ব্যাটা তুই কি বলছিস! তোর…”

“প্লিজ,” জেফরি আবারো নিবৃত্ত করল হানিফ সাহেবকে। “হানিফ সাহেব কি ঐ লোকটার সাথে কথা বলতে বলতে বের হচ্ছিলেন?” আসলামকে প্রশ্ন করল সে।

“না।”

“তাহলে…?”

“আজান দেয়ার কিছুক্ষণ পর হানিফ স্যার নাইমা আসেন…তার পেছন পেছন আরেকজন লোক ছিল…মাথায় টুপির দেয়া…পাঞ্জাবি পরা…উনার ঠিক পেছনেই ছিল…তাই আমি ভাবলাম-”

“অ্যাই ব্যাটা, আমার পেছনে দেখেছিস মানে?” হানিফ সাহেব আবারো ফেটে পড়লেন।

জেফরি লোকটার দিকে স্থির চোখে তাকাল। “হানিফ সাহেব, আমি কিছু না বললে আপনি কোনো কথা বলবেন না। এটা একটা খুনের ঘটনা। ব্যাপারটা খুবই সিরিয়াস।”

এ কথায় কাজ হলো। খুনের ঘটনা শুনেই চুপসে গেলেন তিনি।

“যে লোককে উনার পেছন পেছন তুমি বের হতে দেখেছো তার বয়স কেমন হবে?” আসলামকে বলল জেফরি বেগ।

একটু চিন্তা করে বলল সে, “আপনার মতোই বয়স অইবো।”

“আমার বয়সি?” আসলামের কথাটার প্রতিধ্বনি করল সে।

“জি, স্যার।”

“দেখতে কেমন?”

“আপনার মতোই সুন্দর—”

“হা-হা-হা–” হানিফ সাহেব হেসে ফেললেন। “ভাগ্য ভালো যে বলেনি আপনাকেই দেখেছে…হা হা হা!” হানিফ সাহেব কথাটা বলেই বুঝতে পারলেন কথার মাঝখানে তার মুখ খোলাটা ঠিক হয়নি। চুপ মেরে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে।

জেফরি কিছুটা বিরক্ত। এই লোকের মুখ বন্ধ রাখা খুব সহজ কাজ নয়। “লোকটাকে দেখলে তুমি চিনতে পারবে?”

“ঠিক কইরা কইতে পারতাছি না, স্যার। তয় চিনতে পারুম মনে হয়…”

“ঐ লোকটাকে আগে কখনও তুমি দ্যাখোনি, না?”

“না, দেহি নাই।”

“হানিফ সাহেব বোধহয় তার পেছনে থাকা লোকটাকে দেখতে পাননি?”

“উনি ঘুম থেইকা মাত্র উঠছিলেন তো…দুই চোখ তহনও ঘুমে ঢুলুঢুলু। করতাছিল। ঐ লোকের সাথে অবশ্য স্যারকে কোনো কথা কইতে দেহি নাই। উনিও পিছন ফিরা তাকান নাই।”

“তাহলে তুই ব্যাটা বুঝলি কি করে ঐ লোক আমার গেস্ট?” হানিফ সাহেব আবারো নিজেকে সামলাতে পারলেন না।

“না, মানে…আইডিয়া কইরা কইলাম আর কি…”

“ব্যাটা মূর্খ, আইডিয়া করে বলে দিলি আমার গেস্ট হয়!”

বেগ নিরুপায় হয়ে মাথা চুলকালো। হানিফ সাহেব লোকটাকে কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। “মি. হানিফ…”

“সরি…সরি,” ভদ্রলোক হাত তুলে নিজেকে বিরত রাখার ইশারা করলেন।

“আপনি নামাজ পড়ে ফিরলেন কখন?” হানিফ সাহেবকে জিজ্ঞেস করল বেগ।

“ঘড়ি তো দেখিনি…তবে নামাজ পড়া শেষ হতেই নিজের ফ্ল্যাটে চলে আসি আমি। ঢুকতেই দেখি গেটের সামনে পুলিশ।”

ভিটা নুভার নাইটগার্ড আসলামকে এবার বলল বেগ, “উনি যখন ফিরে এলেন তুমি সেটা দ্যাখোনি?”

“না, স্যার। তহন তো গেটে পুলিশ ছিল। তারা আমারে ভিতরে বসাইয়া রাখছিল তাই উনি কখন ঢুকছেন আমি কইবার পারুম না।”

এক অজ্ঞাত যুবক ফজরের আজান দেবার পর পরই হানিফ সাহেবের পেছন পেছন নামাজ পড়তে বের হয়ে গেছে যাকে এই অ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ান চেনে না। আগে কখনও দেখেওনি। তারপর হানিফ সাহেব নামাজ পড়ে ফিরে এলেও সেই রহস্যময় লোকটি ফিরে আসেনি।

বেগ বুঝতে পারছে হানিফ সাহেব মিথ্যে বলেননি, আর এই দারোয়ান ছেলেটাও সত্যি কথাই বলছে। এই কেসটা তার কাছে আরো জটিল বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে একটা বিশাল গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়েছে সে, যার অনেকগুলো পথ কিন্তু নির্মম ব্যাপার হলো তার বেশিরভাগই কানাগলি।

এই ফ্ল্যাটের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। যেভাবেই হোক বের করতে হবে কে এই যুবক। জেফরির জন্য তার পরিচয়টা জানা খুবই দরকারি হয়ে পড়েছে এখন।

.

অধ্যায় ২৭

পাভেল আহমেদ ভেবে পাচ্ছে না কি কারণে গতকাল রাতে অনুষ্ঠানটি প্রচার হলো না। রাতে বার থেকে দ্রুত বাড়ি ফিরে এসেছিল কেবল অনুষ্ঠানটি দেখার আশায়। হামিদ আলম তাকে জানিয়েছিল রাত সাড়ে নটার দিকে প্রোগ্রামটা দেখাবে। এ রকম একটা জিনিস তো পাবলিক খুব ভালো মতোই খেতো। হয়তো শিডিউলে কোনো সমস্যা হয়েছে। মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে হামিদ আলমকে ফোন করল সে।

“প্রোগ্রামটা গেল না কেন?” পাভেল আহমেদ জানতে চাইল হামিদ আলমের কাছে।

“বুঝতে পারছি না। নিউজ প্রডিউসারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম উনি যা বললেন তাতে তো মনে হচ্ছে এই প্রোগ্রামটা আর যাবে না…”

“বুঝলাম না?”

“আমিও তো কিছু বুঝতে পারছি না,” হামিদ আলম বলল। “কথাটা কাউকে বোলো না, নিউজ প্রডিউসার আমাকে ডেকে নিয়ে বলেছে, এই ইন্টারভিউয়ের কথা যেন কারো সাথে আলাপ না করি। আর তোমার পাওনা বাকি পঁচিশ হাজার টাকা আজই দিয়ে দেবে তারা। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

পাভেল আহমেদ অবশ্য কিছু একটা বুঝতে পারল। একটা স্কুপের গন্ধ পাচ্ছে সে। “আমার বিক্রি করার দরকার ছিল বিক্রি করে দিয়েছি। এখন তোমরা প্রচার করবে না কি ডাস্টবিনে ফেলে দেবে সেটা তোমাদের ব্যাপার। তাহলে আমার বাকি টাকাটা কখন দিচ্ছো?”

“সন্ধ্যার পর।”

“কালকে যেখানে বসেছিলাম সেখানেই?”

“হ্যাঁ,” হামিদ আলম বলল। কাল সন্ধ্যার পর তারা দুজনে বসেছিল লা ডিপ্লোম্যাট বারে।

পাভেল আহমেদ ফোনটা রেখে ভাবতে লাগল। দীর্ঘ দিন ক্রাইম রিপোর্টারের কাজ করে সে অন্তত এটুকু বুঝতে পারছে ব্যাপারটা অনুসন্ধান করলে কিছু একটা পাওয়া যাবে হয়তো। পঞ্চাশ হাজার টাকায় বিক্রি করে ভেবেছিল বেশ লাভ হয়েছে কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে ওটার মূল্য আরো বেশি।

.

ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ আর জামান একটা কফিশপের এককোণে বসে আছে। ভিটা নুভা থেকে কাজ সেরে সোজা এখানে চলে এসেছে তারা। ওখানকার অন্যান্য অ্যালোটিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তারা নিশ্চিত হয়েছে গতকাল তাদের কারোরই কোনো গেস্ট ছিল না। দারোয়ান ছেলেটার বর্ণনা অনুযায়ী কোনো যুবককে তারা গতকাল দেখেওনি।

“স্যার, এমনও তো হতে পারে কোনো অ্যালোটির গেস্ট ঠিকই এসেছিল কিন্তু জায়েদ সাহেবের হত্যাকাণ্ডের কথা শুনে ভয়ে কেটে পড়েছে। এখন ভয়ে আর সেটা স্বীকার করতে চাচ্ছে না কেউ। আমাদের দেশের মানুষ তো পুলিশকে ঠিক আস্থায় নিতে পারে না। ওরা মনে করে থাকতে পারে এতে করে খামোখাই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বে।”

বেগ মাথা নেড়ে সায় দিল। “ফজরের আজানের পর হানিফ সাহেব যখন নামাজ পড়ার জন্য বের হলেন তখনও জায়েদ সাহেবের খুন হবার কথা কেউ জানতো না। নামাজ শেষে ফিরে এসে হানিফ সাহেব ভিটা নুভায় ঢুকতে গিয়ে জানতে পারলেন কিছু একটা হয়েছে। তোমার কথা যদি ঠিক হয় তাহলে ধরে নিতে হবে ঐ অজ্ঞাত যুবক জানতো জায়েদ রেহমান খুন হয়েছেন। সেজন্যেই ভিটা নুভা থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি। সেই সাথে এটাও ধরে নিতে হবে তাকে আশ্রয় দিয়েছে এই অ্যাপার্টমেন্টেরই কোনো লোক। ব্যাপারটা তো আরো জট পাকিয়ে যাচ্ছে।”

“তা ঠিক,” বলল জামান। “স্যার, আপনি কি মনে করছেন মিসেস রেহমান আর শফিক সাহেব ছাড়াও অন্য কেউ এই খুনের সাথে জড়িত থাকতে পারে?”

“এটা আমার আগেও মনে হয়েছে। ধানমণ্ডি থানার ইন্সপেক্টর এলাহী সাহেব এক ছেলেকে ভিটা নুভার সামনে সন্দেহজনকভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল। ছেলেটাকে ধরতে পারেনি সে কিন্তু তারও মনে হয়েছিল ছেলেটা কোনো অঘটন ঘটানোর উদ্দেশ্যে ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল…” জেফরি একটু অন্যমনস্ক হয়ে থেমে গেল।

“স্যার, আলম শফিক কি আরো কয়েকজনকে নিয়ে এই কাজটা করেছে?”

একটু ভেবে মাথা নেড়ে সায় দিল বেগ। “হতে পারে।”

“স্যার?” জামান বললে জেফরি অন্যমনস্কতা কাটিয়ে উঠে তার দিকে তাকাল। “আপনি মনে হয় নিশ্চিত হতে পারছেন না খুনটা মিসেস রেহমান আর আলম শফিক করেছে?”

বেগ চুপ করে থাকল।

“আগামীকাল আসামী দু’জনকে পুলিশ রিমান্ডে নেয়া হবে। একটু অপেক্ষা করেই দেখুন না পুলিশের কাছে আলম শফিক আর ঐ মহিলা কোনো স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় কি না।”

“তাদেরকে আগামীকালই রিমান্ডে নেয়া হবে? তোমাকে কে বলল?”

“লেখকের ছোট ভাই সাহেদ রেহমান আজ সকালে তার ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডের জন্য থানায় কেস করেছে। পুলিশ এখন সেই কেসে তাদেরকে রিমান্ডে নেবে। অবশ্য জায়েদ রেহমানের ভাই কেস না করলে পুলিশ নিজেই বাদী হয়ে মামলা করতো।”

“তাহলে দেখি পুলিশের কাছে তারা কি বলে,” বেগ কথাটা বলে আবারো অন্যমনস্ক হয়ে গেল।

“স্যার, একটা কথা বলবো?” জামানের দিকে ফিরে তাকাল বেগ। “বলো।”

“এই কেসের তদন্তে আপনি যা করার করেছেন। দু’জন সন্দেহভাজনকে ধরেছেন। এখন বাকিটা পুলিশের উপর ছেড়ে দিন। ওদের কাছে তো আপনি যথেষ্ট প্রমাণ আর আলামত তুলে দিয়েছেন। এখন ওরা খুব সহজেই কেসটার ফয়সালা করতে পারবে।”

“কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে পুলিশ এই কেসটা নিয়ে হিমশিম খাবে। আমরা এখন পর্যন্ত যা জানি তারচেয়ে অনেক জটিল আর কঠিন বলেই মনে হচ্ছে কেসটাকে।”

জামানের কাছে অবশ্য কেসটা জটিল বলে মনে হচ্ছে না তবে মুখে কিছু বলল না।

“অসঙ্গতিগুলো দূর না করে কিভাবে সন্তুষ্ট হই যে কেসটা সভ হয়েছে?” বেগ বলল।

“স্যার, এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে যেসব প্রমাণ আর আলামত আছে। তা দিয়ে আদালতে আসামীদের খুব সহজেই কনভিক্টেড করা যাবে,” জেফরিকে আশ্বস্ত করার জন্য বলল জামান।

“তা যাবে…কিন্তু হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের কাজ হচ্ছে সুষ্ঠু তদন্ত করা। আদালতে কি হবে না হবে সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়।”

জামান আর তর্কে গেল না।

“আমি এই কেসটা নিয়ে এখনও পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারছি না,” কফির মগে একটা চুমুক দিল জেফরি। “যেকোনো হত্যাকাণ্ডের তদন্তের মূল কাজ আসলে দুটো। কে বা কারা খুন করেছে সেটা বের করার পাশাপাশি কিভাবে খুন করেছে সেটাও বের করতে হয়। আমরা হয়তো খুনিদেরকে চিহ্নিত করতে পেরেছি কিন্তু তারা কিভাবে কাজটা করেছে সেটা এখনও জানি না।”

“ঠিক আছে, পুলিশ রিমান্ড পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করে দেখি…” বলল জামান।

জেফরির মোবাইলটা বিপ করে উঠলে সে পকেট থেকে বের করে দেখল একটা মেসেজ এসেছে। ওপেন করল সেটা।

ফরগিভ মি

তিক্ত মুখে ফোনটা পকেটে রেখে দিল সে। রেবার এইসব মেসেজ তাকে দুদণ্ড শান্তি তো দিচ্ছেই না বরং দগদগে ঘায়ে নতুন করে আঘাত দিয়ে যাচ্ছে।

“স্যার, কোনো সমস্যা?” জেফরির মুড অফ হতে দেখে জামান বলল।

“না।” ছোট্ট করে বলল সে।

গত পরশু রেবার কাবিন হয়ে গেছে। এখনও তাকে যখন তখন মেসেজ করে যাচ্ছে, ব্যাপারটা জেফরির কাছে মোটেই ভালো লাগছে না। এ পর্যন্ত অনেকগুলো মেসেজ পাঠালেও জেফরি একটারও জবাব দেয়নি। দেয়ার আছে কি! কী বলবে সে?

“স্যার?”

জামানের কথায় অন্যমনস্কতা কাটিয়ে উঠল জেফরি। “কি?”

“আপনি কি জায়েদ রেহমানের মেইল করা বইটা পড়েছেন?”

“প্রথম দিকের কয়েক পৃষ্ঠা পড়েছি।”

“আমি অনেকটুকু পড়েছি…ভেতরের দিকে, মানে উনার দ্বিতীয় স্ত্রীর ব্যাপারে উনি এমন কিছু কথা লিখেছেন যা পড়লে বুঝতে পারবেন উনি নিজেও মহিলাকে সন্দেহ করতেন।”

জেফরি একটু কৌতূহলী হয়ে উঠল। “কী রকম?”

“জায়েদ রেহমান আশঙ্কা করছিলেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী বর্ষা তাকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে…”

“তাই না কি!?”

“জি, স্যার। তার এই বইটা কিন্তু অনেকটা কনফেশনের মতো। অনেক কিছুই তিনি স্বীকার করে গেছেন। বইটা প্রকাশ হলে বেশ বিতর্কের সৃষ্টি হবে।”

জামান ছেলেটা যে বেশ বই-টই পড়ে সেটা জেফরি জানে। কিন্তু বাড়িতে বসে বই পড়ার মতো মনের অবস্থা নেই তার। “তুমি বইটার যেসব জায়গায় এ রকম তথ্য আছে সেগুলো হাইলাইটস করে আমাকে দিতে পারবে?”

“অবশ্যই পারবো, স্যার।”

“থ্যাঙ্কস।”

“স্যার, বইটাও প্রমাণ করে মিসেস রেহমান আর তার প্রেমিকই খুনটা করেছে।”

মাথা নেড়ে সায় দিল জেফরি।

“তবে বইটা বের হলে লেখকের অনেক অজানা কথা জানা যাবে। উনি অনেক বিষয়েই খোলামেলা স্বীকার করেছেন।”

“যেমন?”

“বিশেষ করে নারীঘটিত ব্যাপারগুলো…যদিও আমরা অনেকেই সেসব কাহিনী জানি তারপরও তিনি নিজে বিস্তারিত স্বীকার করে গেছেন। এজন্যে নিজের অনুতপ্ত হবার কথাও বলেছেন বার বার।”

“তা হতেই পারে। জীবনের অন্তিম অবস্থায় এসে অনেকেরই এ রকম বোধোদয় ঘটে,” বলল বেগ। “তবে কোনো বাঙালী লেখক এ রকম স্বীকারোক্তি করে গেছেন নিজের আত্মজীবনীতে সেটা বোধহয় বিরল।”

“বইটা কি আবেদ আলী সাহেব প্রকাশ করবেন?”

“আমি তাকে এ ব্যাপারে মুখ খুলতে বারণ করে দিয়েছি। ভদ্রলোক বেশ ভয়ে আছেন। মনে হয় না প্রকাশ করার মতো সাহস দেখাবেন।”

“স্যার, আমার মনে হয় উনি বইটা খুব জলদিই প্রকাশ করবেন। কোটি টাকার প্রফিট হবে। এটা উনিও জানেন।”

“বলো কি! কোটি টাকা!?” অবাক হলো জেফরি।

“জি, স্যার। কম করে হলেও বইটা দু’লক্ষ কপি বিক্রি হবে। পাঁচশ পৃষ্ঠার বই…বিশাল আকার। কোটি টাকাই হবে।”

“আমি চাইছি না বইটি এখনই প্রকাশ হোক। এটা প্রকাশ করার আইনী অধিকার কি তার আছে?”

“সেটা আমি বলতে পারবো না। আমাদের নিজস্ব লিগ্যাল অ্যাডভাইজারের সাথে কথা বলে দেখতে হবে। তবে আমি নিশ্চিত, উনি প্রকাশ করার চেষ্টা করবেন। আর সেটা করবেন খুব দ্রুত।”

“আবেদ আলীকে দেখে আমার কিন্তু অতো সাহসী বলে মনে হয়নি। ভদ্রলোক বেশ ভয় পেয়ে গেছিলেন।”

“বিশাল অঙ্কের প্রফিট ভীত ব্যবসায়িকেও সাহসী করে তোলে, স্যার।”

“এটা থামাতে হলে কি করতে হবে না হবে সে ব্যাপারে আমাদের লিগ্যাল অ্যাডভাইজারের সাথে আলাপ করে দ্যাখো তো।”

“ঠিক আছে, স্যার।”

“আবেদ আলীর সাথেও কথা বলে জেনে নিও উনি বইটি প্রকাশ করার ব্যাপারে কিছু ভাবছেন কি না।”

মাথা নেড়ে সায় দিল জামান।

“পুরো তদন্ত শেষ হবার আগে বইটা প্রকাশ হওয়া ঠিক হবে না। পাবলিক সেন্টিমেন্ট চলে যেতে পারে ভিন্ন দিকে। যেভাবেই হোক উনাকে থামাতে হবে।”

.

অধ্যায় ২৮

আবেদ আলী আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে তবে ভয়ে নয় বিশাল অঙ্কের মুনাফার কথা ভেবে।

লেখক জায়েদ রেহমানের পাঠানো নতুন বইটা সারা রাত জেগে জেগে অনেকখানিই পড়ে ফেলেছে সে। বই তো নয় যেন বোমা। এই বোমাটা যখন ফাটবে সারা দেশ কেঁপে উঠবে। এভাবে আর কোনো বাঙালী লেখক নিজের জীবনের সব কথা অকপটে স্বীকার করেছে বলে মনে করতে পারল না সে। এই বই শুধু লেখক জায়েদ রেহমানের ভক্তরাই কিনবে না তার চরম শত্রু আর তার লেখা যারা অপছন্দ করে তারাও কিনবে, আবেদ আলী এ ব্যাপারে নিশ্চিত।

জায়েদ রেহমানের সর্বোচ্চ বিক্রি হওয়া বইটি এক লাখ কপির মতো বিক্রি হয়েছে। আবেদ আলীর ধারণা এই নতুন বইটা যদি এক্ষুণি প্রকাশ করা হয় তাহলে তিন-চার লাখ কপি কয়েক মাসেই শেষ হয়ে যাবে। কোটি কোটি টাকার ব্যপার। দেরি করা যাবে না। এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর সেজন্যেই পরামর্শ নিতে সবচাইতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু কবি হামিদ কায়সারকে ডেকে নিয়ে এসেছে নিজের প্রকাশনা অফিসে।

“আইনী ঝামেলা আছে কি না বুঝতে পারছি না,” আবেদ আলী তার বন্ধুকে বলল।

“কী রকম?” জানতে চাইল লম্বা দাড়ি আর বাবরি চুলের কবি।

“হোমিসাইড থেকে আমাকে এ ব্যাপারে কোনো কিছু না বলার জন্য বলে দেয়া হয়েছে। এখন যদি প্রকাশ করি।”

“আপনি খামোখাই ভয় পাচ্ছেন। এ রকম একটা রেডি আর হটকেক পাণ্ডুলিপি হাতে পেয়ে এখনও বসে আছেন! কিসের আইনী ঝামেলা? জায়েদ রেহমান খুন হবার আগে আপনাকে মেইল করে এটা দিয়ে গেছেন। এমনকি কাকে উৎসর্গ করবেন, এর সত্ত্ব কে পাবে সবই তো বলে দিয়েছেন। সমস্যা কি?”

“কিন্তু ই-মেইলের কি আইনী কোনো ভিত্তি আছে?”

“ঠিক আছে, সেটার জন্য আমরা কোনো লিগ্যাল অ্যাডভাইজ নিতে পারি। আপনি চাইলে আমি আমার এক ব্যারিস্টার বন্ধুকে এখনই ফোন করে এ ব্যাপারে পরামর্শ চাইতে পারি।”

আবেদ আলী আগ্রহী হয়ে উঠল। ডেস্কে রাখা ল্যান্ডফোনটা বাড়িয়ে দিল কবি হামিদ কায়সারের দিকে। “এক্ষুণি করুন।”

ফোনটা হাতে তুলে নিতেই রিং হবার শব্দ শোনা গেলে হামিদ কায়সার প্রথমে বুঝতে না পারলেও একটু পরই বুঝতে পারল আবেদ আলীর মোবাইল ফোনটা বাজছে। তার মোবাইলে নস্টালজিয়া নামের রিংটোন সেটা করা আছে। এই টোনটা একেবারে পুরনো দিনের ল্যান্ডফোনের রিঙের মতো।

কলটা রিসিভ করল আবেদ আলী।

“জি, বলছি…হা…” মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল তার। তার সামনে বসে থাকা কবি হামিদ কায়সার ভুরু তুলে জানতে চাইলে আবেদ আলী মোবাইলটা একটু সরিয়ে ফিসফিস করে বলল, “হোমিসাইড থেকে…”

কিছুক্ষণ ওপাশের কথা শুনে গেল আবেদ আলী। “জায়েদ আমাকে এই বইটা বের করার জন্য স্পষ্ট তাগিদ দিয়ে গেছে…এখন বন্ধুর প্রতি আমারও তো একটা কর্তব্য আছে, না কি…না, এখনও সিদ্ধান্ত নেইনি…বলতে পারছি …উমমম…আমি আমার লিগ্যাল অ্যাডভাইজারের সাথে কথা বলে আপনাকে জানাচ্ছি…না, এখন বলতে পারছি না।”

কবি হামিদ কায়সার মাথা নেড়ে সায় দিল।

“…আচ্ছা, ঠিক আছে…ওকে, আমি জানাবো।”

“কি বলল,” আবেদ আলী ফোনটা রাখতেই কবি জানতে চাইল।

“লিগ্যাল অ্যাডভাইজারের কথা শুনে চুপসে গেছে,” আবেদ আলী আত্মবিশ্বাসী হয়ে বলল বন্ধুকে। “এক্ষুণি আপনার ব্যরিস্টার বন্ধুকে ফোন করুন।”

.

পাভেল আহমেদ খুব অবাক হয়েছে। তার ধারণাই ঠিক। কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে। তবে খোঁড়াখুড়ি করার ইচ্ছে তার নেই যদি না তার সাথে সহযোগীতা করা হয়।

একটা নাম্বারে ফোন করে বন্ধ পেয়ে অন্য আরেকটা নাম্বারে কল করে জেনে নিয়েছে বন্ধ করে রাখা নাম্বারের মালিক দেশের বাইরে চলে গেছে গতকাল।

হঠাৎ এক দিনের নোটিশে বিদেশে? অন্য কিছুর গন্ধ পাচ্ছে এখন। পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে কেনার পরও এ রকম জিনিস প্রচার করা হবে না! বিশাল কোনো কারণ আছে এর পেছনে। এত আগ্রহ করে জিনিসটা নেবার পরও…

পাভেল আহমেদ জানে কাকে ফোন করলে তার উদ্দেশ্য সফল হবে।

.

অধ্যায় ২৯

সি ই সিদ্দিকী সাহেবের বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যে অমূল্য বাবু একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তবে সে কোনো কর্মচারী নয়, আবার সিদ্দিকী সাহেবের ব্যবসায়িক অংশীদারও যে নয় সেটাও নিশ্চিত। অমূল্য বাবু যে আসলে কি সেটা সবার কাছেই একটা রহস্য। সিদ্দিকী সাহেবের সমস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অমূল্য বাবুকে বেশ সমীহের চোখে দেখে থাকে। তারা জানে সিদ্দিকী সাহেবের উপর এই লোকের অপরিসীম প্রভাব রয়েছে।

সিদ্দিকী সাহেব দেশের বাইরে গেছেন দু’তিন দিনের জন্য, তবে কোথায় গেছেন সেটা কেবল জানে অমূল্য বাবু, কারণ সে-ই সমস্ত ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সিদ্দিকী সাহেবের অবর্তমানে অমূল্য বাবুই যে সব কিছুর দেখাশোনা করে সেটা রীতিতে পরিণত হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে কোনো দরকার হলে তার কাছেই ম্যানেজার লেভেলের কর্মকর্তারা যোগাযোগ করে থাকে।

সিদ্দিকী সাহেবের সমস্ত ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড যেখান থেকে পরিচালিত হয় সেই হেড অফিসের দশ তলায় অমূল্য বাবুর একটি প্রাইভেট রুম আছে, আজ দুদিন ধরে সেখানেই অফিস করছে সে। তেমন কোনো কাজ নেই শুধু উপস্থিত থাকা। ব্যাপারটা অমূল্য বাবুর কাছে বিরক্তিকর হলেও চরম ধৈর্যশীল একজন মানুষ সে। ভারত-পাকিস্তানের ওয়ান ডে সিরিজ চলছে বলে তার জন্য সময়টা নিতান্ত মন্দ কাটছে না। সকাল থেকে বসে বসে টিভিতে খেলা দেখছে।

টিভির ভলিউমটা বেশি থাকার কারণে বুঝতে পারেনি মোবাইল ফোনটা বাজছে। তিনবার রিং হবার পর টের পেল।

“হাঁ, বলুন?” বলল অমূল্য বাবু।

“স্যার, একটা সমস্যা হয়েছে, স্বদেশ টিভির মহাপরিচালক ইকরাম সাহেব ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে বলল।

“বলুন।”

দ্বিধাগ্রস্ত মহাপরিচালক গলা খাকারি দিয়ে বলতে শুরু করল। সে জানে অমূল্য বাবু অল্প কথার মানুষ। যতোটুকু সম্ভব সংক্ষেপে বলে গেল ঘটনাটি। অমূল্য বাবু কোনো কথা বলল না, চুপচাপ শুনে গেল। শেষে কেবল বলল, “ঠিক আছে। তাকে বলুন আগামীকাল দুপুরের মধ্যে টাকাটা পেয়ে যাবে। আর কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।”

ফোনটা রেখে অমূল্য বাবুর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। টিভিতে ক্রিকেট খেলা চললেও সেটাতে আর মনোযোগ দিতে পারল না। একটা উটকো ঝামেলা তৈরি হয়েছে। সেটাকে ঝেড়ে ফেলতে হবে খুব দ্রুত।

মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে একটা নাম্বার ডায়াল করল সে।

রিং হবার সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশ থেকে ফোনটা ধরা হলো। যে ফোনটা ধরেছে সে কোনো দিনই আগে থেকে কিছু বলবে না, অমূল্য বাবু সেটা জানে। লোকটার মৃদু নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। গভীর করে দম নিয়ে নিলো অমূল্য বাবু।

“এক ঘণ্টার মধ্যে দেখা করো…ঠিক যেখানে এর আগে দেখা করেছিলাম।”

ফোনটা রেখে উদাস হয়ে পেছনের কাঁচের ভেতর দিয়ে দশ তলার নিচে ঢাকা শহরের ভিউ দেখতে লাগল সে।

তার প্রিয় খেলোয়াড় শচীন টেন্ডুলকার ব্যাট করছে এখন কিন্তু সেদিকে তার ভ্রূক্ষেপ নেই। এক নাদান এই পৃথিবীর সবচাইতে জঘন্য একটা কাজ করছে তাদের সাথে। সিদ্ধান্ত নিলো কোনো রকম অনুকম্পা দেখানো হবে না।

সব কিছু সহ্য করতে পারে কিন্তু ব্ল্যাকমেইল একদমই সহ্য করতে পারে অমূল্য বাবু।

.

কিছুক্ষণ আগে একটা ফোন পাবার পর থেকেই পাভেল আহমেদের মেজাজ ফুরফুরে হয়ে আছে। ঠিক যা ভেবেছিল তাই হয়েছে। তবে যে কাজটা সে করতে যাচ্ছে সেটা অনৈতিক। নিজের বিবেক একটু খচখচ করে উঠলেও সেটাকে তেমন একটা পাত্তা দিল না সে।

আগামীকাল এ সময় তার পকেটে চলে আসবে দু লাখ টাকা।

ভাগ্যিস আরেকটা কপি রেখেছিল। ব্যাপারটা যে এক মুরগী দুবার বিক্রি করার মতো হয়ে যাচ্ছে সেটা ভেবে মজা পেল সে। স্বদেশ টিভির রিপোর্টার হামিদ আলমকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি নিউজ প্রডিউসার কাশেম হাবিবকে ফোন করেছিল। নিজের পরিচয় দিয়ে গতকাল বিক্রি করা একটি দুর্লভ সাক্ষাৎকার কেন প্রচার করা হলো না সে বিষয়ে জানতে চায়।

“আমি নিজে ঐ ইন্টারভিউটা নিয়েছিলাম। আপনারা গতকাল সেটা প্রচার করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন, কিন্তু সেটা প্রচার হয়নি। আমি জানতে পেরেছি ওটা আর প্রচার করবেন না আপনারা।”

“আমি এ ব্যাপারে কিছু জানি না, তাই আপনাকে কিছু বলতে পারছি,” প্রডিউসার কাশেম হাবিব বলেছিল।

“তাহলে যে জানে তাকে ফোনটা দিন। তা না হলে আমি অন্য ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো।”

“মানে?”

“আমার কাছে ঐ ক্যাসেটটার আরেকটা কপি আছে। ব্যাকআপ কপি। আপনারা প্রচার না করলে আমি সেটা অন্য জায়গায় দিয়ে দেবো,” পাভেল আহমেদ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল।

“আপনি কিন্তু ওটা আমাদের কাছে বিক্রি করেছেন-”

কাশেম হাবিবকে মাঝপথে থামিয়ে দিল পাভেল আহমেদ। “আমি বিক্রি করেছি ওটা প্রচার হবার জন্য, ডাস্টবিনে ফেলে দেবার জন্য নয়। আপনারা যদি ওটা কালকের মধ্যে প্রচার না করেন তবে অন্য কোনো চ্যানেল সেটা প্রচার করবে।”

কাশেম হাবিব একটু ভেবে বলল, “আমি আপনাকে একটু পর ফোন করে জানাচ্ছি।”

মাত্র দশ মিনিট পরই পাভেল আহমেদের কাছে ফোন করা হয় তবে সেটা কাশেম হাবিব করেনি করেছিল চ্যানেলের মহাপরিচালক ইকরাম সাহেব নিজে। ভদ্রলোক সময় নষ্ট না করে সরাসরি আসল কথায় চলে আসে।

“আপনার কাছে থাকা দ্বিতীয় ক্যাসেটটাও যদি আমরা কিনে নেই তাহলে কতো দিতে হবে?”

“তার মানে আপনারা ইন্টারভিউটা প্রচার করবেন না?”

“আমরা প্রচার করি বা না করি সেটা নিয়ে আপনি মাথা ঘামাবেন না, এই শর্তে দ্বিতীয় ক্যাসেটটা বিক্রি করতে হবে। কতো দিতে হবে বলুন?”

একটু ভেবে পাভেল আহমেদ বলল, “দুই লাখ?”

“ওকে। ক্যাসেটটা কখন দিচ্ছেন?” ঝটপট জানতে চাইল ইকরাম সাহেব।

পাভেল আহমেদ ভাবতেই পারেনি এক কথায় রাজি হয়ে যাবে। সে ভেবেছিল দু’লাখ চাইলে শেষ পর্যন্ত এক লাখে রফা হবে। আগামীকাল।”

“কখন?”

“উমমম…দুপুরের দিকে?”

“ঠিক আছে।”

পাভেল আহমেদ কিছু বলতে যাবে অমনি ভদ্রলোক গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আর কোনো চালাকি করবেন না। আর কোনো ব্যাকআপ কপি যদি থাকে। তাহলে সেটা আপনার জন্য ভালো হবে না। কথাটা মনে রাখবেন।”

একটু ভয় পেয়ে গেল পাভেল। “ঠিক আছে। তাহলে-”

লাইনটা কেটে দেয়া হয় অপর পাশ থেকে।

ভয়টা তার মধ্যে অল্পক্ষণই ছিল, তারপরই পাভেল আহমেদের ঠোঁটে মুচকি হাসি দেখা দেয়। আমাকে ভয় দেখায়! শালা!

.

অন্ধকার একটা ঘরে টিভি চলছে।

অ্যানিমেল প্লানেট। একটা সিংহ ওৎ পেতে আছে শিকার ধরার জন্যে। আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে সেটা। খুবই সতর্ক আর নিঃশব্দ। শিকারের খুব কাছে আসার পরই আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল সেটার উপর…

টিভিটা বন্ধ করে দেয়া হলে ঘরে নেমে এল নিকষ কালো অন্ধকার। কিছুক্ষণ সেই অন্ধকার থাকার পর ঘরে মৃদু আলোর ডিম লাইট জ্বলে উঠল। আবছায়া এক মানব মূর্তি বিছানা থেকে উঠে অ্যাটাচড বাথরুমে চলে গেল ধীরে ধীরে। সম্পূর্ণ নগ্ন সে। সুগঠিত শরীরটা ডিম লাইটের মৃদু আলোতেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

আজ দুদিন ধরে এই ঘর থেকে সে বের হয়নি। একটানা কয়েক দিন ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে তার মোটেও খারাপ লাগে না। তিন-চারদিনের খাবারদাবার এক সঙ্গে কিনে এনে নিজের ঘরে বন্দি হয়ে থাকাটা তার প্রিয় মুহূর্ত। কিন্তু এখন তাকে আবারো বের হতে হবে। শীত হোক গ্রীষ্ম হোক, সব সময়ই ঠাণ্ডা পানিতে গোসল না করে সে বাইরে বের হয় না। ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করলে তার মধ্যে এক ধরণের ধীরস্থিরতা চলে আসে। ধীরস্থির থাকাটা তার জন্যে অনেক বেশি জরুরি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *