৩০. পরদিন প্ৰভাতে

পরদিন প্ৰভাতে সে উঠিল পরম নিশ্চিন্ত, প্রশান্ত মন লইয়া। বিগত রাত্রির স্মৃতিটা তার কাছে স্বপ্নের মত বোধ হইতেছিল। সে চায়ের জন্য তখনও শুইবার ঘরেই বসিয়া ছিল; গৌরী চা লইয়া আসিবে। চায়ের অপেক্ষা গৌরীর প্রতীক্ষাই সে যেন অধিক ব্যগ্রতার সহিত করিতেছিল। গৌরীর ওপর বিরূপতাও আজ শান্ত হইয়া আসিয়াছে। কেবলই মনে পড়িতেছে সেই দুইটি জীর্ণ কদাকার নরনারীর কথা। সকাল হইতে আকাশ মেঘে ছাইয়া গিয়াছে, এলোমেলো বাতাসও বহিতে আরম্ভ করিয়াছে। বৃষ্টি নামিবে এইবার। চারিদিক হইতেই এ দিনটিকে তাহার মধুর মনে হইতেছিল।

গৌরী চা লইয়া আসিতেই শিবনাথ স্মিত হাসিমুখে তাহাকে যেন সংবর্ধনা করিয়াই বলিল, বোলসা, অনেক কথা আছে।

ক্রোধে অভিমানে গৌরীর অন্তর ভরিয়া উঠিল। কেন, অনেক কথা তাহাকে কেন? অনেক কথা কী, সে তাহা জানে, নিজে সে তাহা যাচিয়া শুনিতেও চাহিয়াছে, দিবার জন্য সে তাহার গহনাগুলিও খুলিয়া গুছাইয়া রাখিয়াছে। মুখচোখ লাল করিয়া তাহাকে প্রত্যাখ্যানের কথাও তাহার মনে আছে। আজ কোন্ লজ্জায় এমন স্মিত হাসিমুখে শিবনাথ অনেক কথা বলিতে চাহিতেছে, সে ভাবিয়া পাইল না। তবুও সে যথাসম্ভব আত্মদমন করিয়া বলিল, অনেক কথা শুনে আমি আর কী করব? আর তোমারও উচিত নয়, ঘরের মানসম্মানের কথা পাঁচজনের কাছে বলা।

শিবনাথ ইহাতে রাগ করিল না, বরং আরও খানিকটা হাসিয়াই সে বলিল, তুমি ভয়ানক রাগ করে আছ দেখছি, বস বস।

গৌরী স্বামীর দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিল, স্ত্রীর কাছে টাকা চাইতে তোমার লজ্জা করছে না? আর কী করে তুমি এমন হাসিমুখে তোষামোদ করছ, তাও যে আমি ভেবে পাচ্ছি না!

শিবনাথ চমকিয়া উঠিল, গৌরীর মনের গতিপথের দিকনির্ণয় সে এতক্ষণ করিতে পারে নাই; তাহার নিশ্চিন্ত প্রশান্ত মনশ্চক্ষুর দৃষ্টি সোজা সরল পথেই প্রসারিত ছিল; অকস্মাৎ আশপাশের বাঁকা গলিপথ হইতে গৌরীর বাক্যবাণে আহত হইয়া সে চমকিয়া উঠিল। কিন্তু আঘাতের বেদনা সংবরণ করিয়াই বলিল, তুমি জান না, টাকা আমার হয়ে গেছে গৌরী, তোমার টাকা আমি চাই নি।

কথাটা শুনিবামাত্র গৌরীর মুখ বিবৰ্ণ হইয়া গেল, অকারণে তাহার চোখে জল আসিবার উপক্ৰম করিল। গৌরীর মুখের এ পরিবর্তনে শিবনাথ যেন উৎসাহিত হইয়া উঠিল, সে হাসিতে হাসিতেই বলিল, তোমার টাকা সুদে-আসলে দিন দিন গোকুলের কৃষ্ণচন্দ্রের মত বেড়ে উঠুক। আমি সেখানে পুতনা বা দন্তবক্রের মত হানা দিতে চাই না; তোমার শঙ্কিত হবার কোনো কারণ

নেই।

গৌরীর চিবুক থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল, পরমুহূর্তে মুখ ফিরাইয়া লইয়া দ্রুতপদে ঘর হইতে যেন ছুটিয়াই পলাইয়া গেল। শিবনাথ নীরবে কিছুক্ষণ তাহার গমনপথের দিকে চাহিয়া থাকিয়া একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কাছারি-বাড়ি যাইবার জন্য উঠিল। গতরাত্রির সুখস্মৃতির আনন্দ প্রভাতেই গৌরীর উষ্ণ নিশ্বাসে ঝলসিয়া ম্লান হইয়া গেল।

কাছারিতে লোকজন বড় কেহ ছিল না, রাখাল সিং টাকা দাখিলের জন্য সদরে গিয়াছেন, কেষ্ট সিং কাজে বাহির হইয়াছে; থাকিবার মধ্যে আছে সতীশ, কিন্তু সেও এখন অনুপস্থিত, প্রভাতী গঞ্জিকাসেবনের জন্য কোথাও সরিয়া পড়িয়াছে। মাস্টার আপন মনে ইংরাজি কবিতা আবৃত্তি করিতেছিলেন

Of Mans First Disobedience, and the Fruit
Of that Forbidden Tree, whose mortal taste
Brought Death into the World, and all our woe,
With loss of Eden, till one greater Man
Restore us,–

শিবু আসিয়া দাঁড়াইল, ঈষৎ হাসিয়া আবৃত্তি বন্ধ করিয়া মাস্টার বলিলেন, বল্ তো শিবু, এ কিসের থেকে আমি আবৃত্তি করছি? আবার তিনি আরম্ভ করিলেন–

Sing Heavnly Muse, that on the secret top
Of Oreb or of Sinai,–

আবৃত্তির ফাঁকে মুহূর্তের অবসর পাইয়া শিবু বলিল, মিলটন’স প্যারাডাইস লস্ট্‌।

মাস্টার খুব খুশি হইলেন, বলিলেন, ইয়েস। মিলটন ইজ এ গ্রে-ট পোয়েট। পড়েছি তুই প্যারাডাইস ল? আবৃত্তি করতে পারিস? তোর যেখানটা ভাল লাগে আবৃত্তি কর, আমি শুনি।

শিবনাথ মৃদু হাসিয়া খানিকটা ভাবিয়া লইয়া আবৃত্তি করিল–

So saying, she embracd him, and for joy
Tenderly wept, much won that he his love
Had so ennobld, as of choice to incurr
Divine displeasure for her sake, or Death
… … from the bough
She gave him of that fair enticing Fruit
With libral hand.

শিবনাথ চুপ করিল, মাস্টার তাহার মুখের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া ছিলেন, একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া তিনি বলিলেন, ইউ ডোন্ট লাভ আওয়ার বউমা, আই অ্যাম সিওর।

শিবনাথ এই আকস্মিক প্রসঙ্গে লজ্জিত এবং বিস্মিত দুই-ই হইল। মাস্টার বলিলেন, রাখাল সিং আমাকে বলেছিলেন, আমি বিশ্বাস করি নি। কিন্তু দিস ইজ ব্যাড, ভে–রি ব্যান্ড, মাই বয়। না না, লজ্জা করিস না আমাকে। তুই বড় হয়েছিল, লজ্জা কিসের তোর?

শিবনাথের মুখ রাঙা হইয়া উঠিল, তবুও সে বলিল, নো। আই লাভ হার; অ্যাডাম যেমন ইভকে ভালবাসত, তেমনিই ভালবাসি। জানেন, তারই জন্যে আমি পিসিমাকে হারিয়েছি?

মাস্টার বহুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, যা। কিন্তু তোকে এমন শুকনো শুকনো ঠেকছে কেন, বল্ দেখি?

ম্লান হাসি হাসিয়া শিবনাথ বলিল, কয়েকদিন তো অনেক দুশ্চিন্তাই গেল, কাল রাত্রেও ভাল ঘুম হয় নি, বোধহয় সেইজন্যেই।  মাস্টার বলিলেন, সকাল সকাল স্নান কর, খেয়ে নে, তারপর এ লং পি, লম্বা একটা ঘুম দিয়ে দে। অল্ রাইট হয়ে যাবে।

উদাসীনের মতই শিবনাথ বলিল, তাই করব।

হ্যাঁ। তারপর যা বলছিলাম বলি, শোন। ইউ মাস্ট ড়ু সামথিং, মাই বয়। একটা কিছু তোকে করতে হবে, এই জমিদারির মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখা চলবে না। নিজেকে কিছু উপার্জন করতে হবে। যা আছে, সেটাকে বাড়াতে হবে, সেটাকে ক্ষয় করলে চলবে না।

শিবনাথ একটু চিন্তা করিয়া বলিল, করব মাস্টারমশায়, কিন্তু দেশ ছেড়ে আমি যেতে চাই। না। শহরে আমি যেন হাঁপিয়ে উঠি।—বলিতে বলিতেই সাঁওতাল পরগনার একটি আশ্রমের কথা তাহার মনে পড়িয়া গেল। চন্দ্রালোকিত প্রান্তরের মধ্যে সবজি ও ফসলের ক্ষেত, ক্ষেতের মাথায় মাথায় কুয়া হইতে জল তুলিবার ট্যাড়ার ঊর্ধ্ববাহু বাঁশগুলি, পথের পাশে পাশে ছোট ছোট ঘর, আর সে সমস্তের মধ্যে হাস্যময় নির্ভীক একটি মানুষ, সব মনে পড়িয়া গেল। তাহার চোখমুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল; সেখানে গৌরী থাকিবে না; জমিদারির চিন্তা থাকিবে না; মিথ্যা মর্যাদা রক্ষার বালাই থাকিবে না; সেখানে থাকিবে শুধু সে আর মাটিযে মাটি কথা কয়, জলের জন্য তৃষ্ণায় হা-হা করে, জ্বরজর্জরের মত উত্তপ্ত নিশ্বাস ফেলে। সে উৎফুল্ল হইয়া বলিল, আমি প্রকাণ্ড একটা প্লট জমি নিয়ে চাষ করব মাস্টারমশায়!

চাষ? গুড আইডিয়া! তাই কর, তুই তাই কর, শিবু। তবে নদীর ধারে জমি নিতে হবে। তোদের বিগ্রাম মহালে কিন্তু ময়ূরাক্ষীর ধারে অনেক জমি আছে। ওইখানেই তুই চাষ আরম্ভ করে দে। প্লেন লিভিং অ্যান্ড হাই থিংকিং। গুড আইডিয়া, ভেরি গুড আইডিয়া। মাস্টার কাগজ কলম টানিয়া লইয়া বলিলেন, লাভ-লোকসান খতিয়ে একটা দেখি, পঁড়া। কিন্তু লাভ বা লোকসান দুইটার কোনোটাতেই উপনীত হইতে দিল না নিত্য-ঝি। উৎকণ্ঠিত মুখে সে আসিয়া তিরস্কারের সুরেই বলিল, এ আপনার কী রকম কাজ দাদাবাবু?

সবিস্ময়ে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া শিবনাথ বলিল, কেন, হল কী?

হল কী! বউদিদি আজ আবার সকাল থেকে দুবার বমি করলেন। কাল বলেছি আপনাকে, কাল পরশু দুদিনই বমি করেছেন। তা ডাক্তার-টাক্তারকে তো একবার ডাকতে হয়!

আবার আজ বমি করছে? শিবনাথের ভ্রূ কুঞ্চিত হইয়া উঠিল। চিন্তায় অসন্তোষে তাহার মন ভরিয়া উঠিল। সে আবার বলিল, ডাক্তার আমি ডাকাচ্ছি এখুনি, কিন্তু এমন করে কোনো দিন তিনটে, কোনো দিন চারটের সময় খেতে কে বলেছিল শুনি?

নিত্য বলিল, সে আর আমরা কী বলব, বলুনঃ অল্প বয়সে গিন্নি সাজতে গেলেই এমনই হয়। তা ছাড়া বাড়িতেই যে আপনার বার মাসে তের পাবন, সে উপোসগুলো কে করবে?

শিবনাথ ডাকিল, সতীশ! সতীশ!

সদ্য গাঁজা টানিয়া সতীশ আসিয়া সম্মুখে স্বচ্ছনের মত স্থির হইয়া দাঁড়াইল। শিবনাথ বলিল, একবার ডাক্তারের ওখানে যা, তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবি, বুঝলি?

বুঝিল কি বুঝিল না, সে উত্তর সতীশ দিল না, বিনা বাক্যব্যয়ে সে কাছারি হইতে বাহির হইয়া গেল। গঞ্জিকাসেবনের পর প্রথম কিছুক্ষণ সতীশ এমনই মৌনব্রত অবলম্বন করিয়া থাকে।

 

ডাক্তার প্রবীণ লোক, গৌরীকে দেখিয়া শুনিয়া তিনি বলিলেন, তাই তো হে শিবনাথবাবু, সায়েবের মাছগুলো কত বড় বড় হল, বল দেখি?

শিবনাথ হাসিয়া বলিল, ধরবেন একদিন ছিপে?

ডাক্তার ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, ছিপে ধরতে পারব না, তবে খেতে হবে একদিন।

বেশ তো!

অসহিষ্ণু হইয়া মাস্টার জিজ্ঞাসা করিলেন, বউমাকে কেমন দেখলেন?

ভালই দেখলাম। চলুন, বাইরে চলুন। কাছারিতে আসিয়া তিনি বলিলেন, নিত্যকে একবার ডাক তো সতীশ, কয়েকটা কথা আবার জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলাম।

মাস্টার আবার প্রশ্ন করিলেন, বউমার অসুখ সিরিয়াস কিছু নয় তো? মানে ডিস্পেপসিয়াও একটা সিরিয়াস ডিজিজ বলে আমি মনে করি।

ডাক্তার বলিলেন, না না। তবে শিবনাথবাবুর একটা ভোজ লাগবে মনে হচ্ছে। তাই তো জিজ্ঞেস করলাম, সায়েরের মাছগুলো কত বড় বড় হল?

নিত্য-ঝি আসিয়া দাঁড়াইল, বলিল, আমাকে ডাকছিলেন?

ডাক্তার বলিলেন, হ্যাঁ, তুমি একবার বলিতে বলিতেই উঠিয়া গিয়া কয়েকটা কথা নিম্নস্বরে বলিলেন, চট করে জেনে এস দেখি।

মাস্টার বলিলেন, এ যে একটা হেঁয়ালি আরম্ভ করে দিলেন আপনি!

ডাক্তার হাসিয়া উঠিলেন, বলিলেন, বাড়িতে প্রবীণ মেয়ে থাকলে এ জন্যে আমাদের ডাকতে হয় না।

মাস্টার বলিলেন, পিসিমা যে চলে গেলেন। কিছুতে যে ধরে রাখা গেল না।

শিবনাথ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল; মনে মনে বারবার বলিল, না, তিনি গিয়াছেন ভালই হইয়াছে; তিনি পারিলেও গৌরী তাঁহাকে সহ্য করিত না। তাহার মত সে এবার নিজেকেও নির্বাসিত করিবে, শান্তির জন্য তাহার মন ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছে।

নিত্য ফিরিয়া আসিয়া হাসিমুখে বলিল, আজ্ঞে, হ্যাঁ, তাই বটে।—বলিয়াই সে চলিয়া গৈল।

ডাক্তার হাসিতে হাসিতে বলিলেন, ভোজ তা হলে একটা লাগল শিবনাথবাবু। বউমা আমাদের অন্তঃসত্ত্বা।

মাস্টার বিপুল বিস্ময়ে প্রশ্ন করিলেন, হোয়াট?

শিবনাথবাবুর রাঙা খোকা হবে গো।

মাস্টার কাগজ-কলম ফেলিয়া দিয়া উঠিয়া পাশের ঘরে চলিয়া গেলেন, সেই সেদিনের ছোট ছেলেটি শিবনাথ, সে সন্তানের পিতা হইবে। তিনি আপন মনেই নির্জন ঘরে হাসিয়া সারা হইয়া গেলেন।

ডাক্তার শিবনাথকে যেন একটা অদ্ভুত বাৰ্তা দিলেন। একটা উত্তেজনাই তাহার মনে শুধু সঞ্চারিত হইল না, তাহার কল্পনার ভাবী জীবনচিত্রের ওপর দিয়াও যেন একটা বিপ্লব বহিয়া গেল। লজ্জিত আনন্দে তাহার মনখানি পরিপূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে অনুভব করিল, গৌরী যেন বিপুল শক্তিশালিনী হইয়া উঠিয়াছে; যে শক্তির বলে গৌরীর ইচ্ছা অনিচ্ছার কাছে তাহার মাথা নত না করিয়া উপায় নাই; ভাবী সন্তান মাতৃগর্ভ হইতেই যেন তাহার মায়ের শক্তির সঙ্গে আপন শক্তি মিলিত করিয়া তাহাকে খর্ব করিবার চেষ্টা করিতেছে।

ডাক্তার বলিলেন, শিবনাথবাবু, পিসিমাকে চিঠি লেখ। আর তিনি না এলে চলবে না বাপু। নাতিকে আদর করবে কে? মানুষ করবে কে?

ডাক্তার চলিয়া গেলেন।

মাস্টার হাসি সংবরণ করিয়া বাহিরে আসিয়া বলিলেন, ইমিডিয়েটুলি, এখুনি পত্র লিখতে হবে। শি মাস্ট কাম।

শিবনাথ আবার ভাবিল, তাহার এই সন্তান হয়ত দেশের মধ্যে এক মহাশক্তিশালী পুরুষ হইবে, রূপে গুণে বিদ্যায় প্রতিভায় সমগ্ৰ দেশ উজ্জ্বল হইয়া উঠিবে। তাহাকে শিক্ষা দিবে সে নিজে, আপন আদর্শে তাহাকে দীক্ষিত করিবে। তাহার অসম্পূর্ণ কর্ম সম্পূর্ণ করিবে তাহার ওই

সন্তান।

মাস্টার আবার বলিলেন, চিঠির চেয়েও আমি বলি, তুই কাশী চলে যা শিবু, পিসিমাকে ধরে নিয়ে আয়।

হ্যাঁ, তাই সে যাইবে। এই প্রসঙ্গে পিসিমার স্মৃতি মনে পড়িয়া গেল, পিসিমা বলিতেন, শিবুর ছেলে হইবে, সে ট্যাঁ-ট্যাঁ করিয়া কাঁদবে; শিবু বিরক্ত হইয়া বউকে বলিবে, যাও, পিসিমার কোলে ফেলিয়া দিয়া এস; তাহাকে আমি সোনায় মুড়িয়া রাখিব, আকাশের চাঁদ পাড়িয়া দিব। রূপকথার রাজপুত্রের মতই তাহাকে তিনি কল্পনা করিতেন। তিনি নিশ্চয়ই আসিবেন। কিন্তু গৌরীগৌরী কি তাহা সহ্য করিবে?

নিত্য-ঝি আবার আসিয়া দাঁড়াইল।

মাস্টার বলিলেন, কী, আবার কী?

নিত্য বলিল, দাদাবাবু একবার বাড়িতে আসুন।

কেন?

বউদিদি কী বলছেন।

শিবনাথ বাড়ির দিকে অগ্রসর হইল। মাস্টার নিত্যকে ডাকিয়া বলিলেন, এই দেখ নিত্য, আজ সব ঠাকুরবাড়িতে পুজো দিতে হয়, রতনকে গিয়ে বল, যা যা করতে হয়, সব যেন নিখুঁতভাবে করা হয়।

শিবু ও নিত্য চলিয়া গেলে মাস্টার আবার মৃদু মৃদু হাসিতে আরম্ভ করিলেন; শিবুকে তিনি বলিলেন, নটি বয়—দুষ্ট ছেলে। সেই দুষ্ট ছেলে সন্তানের পিতা হইতে চলিয়াছে! কিমাশ্চর্য অতঃপরম্‌!

গৌরী আপন বক্তব্য যেন জিহ্বাগ্রে লইয়া বসিয়া ছিল, শিবনাথ ঘরে ঢুকিবামাত্র বলিল, দেখ, পিসিমার সঙ্গে একসঙ্গে ঘর আমি করতে পারব না।

কথাগুলি প্রচণ্ড বেগে গিয়া শিবনাথকে আঘাত করিল। কিছুক্ষণ পূর্বেই তাহার মনে নানা চিন্তা, নানা কল্পনা, নানা সঙ্কল্পের ফলে যে একটি আনন্দময় অনুভূতির সৃষ্টি হইয়াছিল, এই আঘাতে মুহূর্তে সব যেন বিপর্যস্ত হইয়া গেল। একটি মাত্র প্রশ্ন তাহার মুখ হইতে বাহির হইল, মানে?

গৌরী বলিল, মানে, আমি বসে বসেই শুনছি, সকলেই বলছে, এইবার পিসিমাকে আনতে হবে। বাইরেও নাকি সেই কথা হচ্ছে, নিত্য আমাকে বললে। সেইজন্যে আমি বলছি, সময় থাকতে বলে রাখছি, সে আমি পারব না।

ভাল। কিন্তু তিনি আসবেন, এমন ধারণা করাটা তোমার ঠিক হয় নি। আর আমি আনতে যাব, এ ধারণাটাও ভুল। তুমি আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গৃহত্যাগের প্রয়োজন তিনিও বুঝেছিলেন, আমিও বুঝেছিলাম; সেইজন্যেই আমি বাধা দিই নি, বুঝলে? ভয় নেই তোমার, তিনি আসবেন না।

ভাল, কথাটা জেনে রাখলাম। কিন্তু ধারণা করা আমার ভুল হয় নি। সংসারে আগে কথা হয়, পরে কাজ হয়; কথা শুনলাম, পাঁচজনে বলছে, কাজেই সময় থাকতে আমি বলে রাখাটাই ভাল মনে করলাম। এতে আমার এমন কিছু অপরাধ হয় নি। অপরাধ হয়ে থাকলে, যারা কথা তুলছে, তাদেরই হয়েছে।

না, তাদেরও হয় নি। তারা আমাদের হিতকামনা করেই কথাটা তুলেছে। তোমার এ অবস্থায় সংসারে প্রবীণ অভিভাবকের কার, যিনি যত্ন করবেন।

এবার অসহিষ্ণু হইয়া গৌরী শিবনাথের মুখের কথা কাড়িয়া লইয়া বলিল, সেজন্য আমার দিদিমা আছেন, আরও পাঁচজন আছেন, তাঁরা সংবাদ পেলেই আমাকে নিয়ে যাবেন, তোমাকে বা অন্য কাউকে তার জন্যে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।

শিবনাথ বলিল, বেশ, সে সংবাদ আজ আমি তাঁদের জানিয়ে দিচ্ছি।

গৌরী সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, আমার মহা উপকার করা হবে তা হলে, আমি নিশ্চিন্ত হয়ে হেসে খেলে বাঁচব। এমনকি যদি আর আমাকে না টানাটানি কর, তবে চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকব তোমার কাছে। এত দুশ্চিন্তা আমি সইতে পারছি না।

শিবনাথ এ কথার জবাব দিতে পারি না, তাহার মনে হইল, বুকের মধ্যে একটা দুঃসহ দুঃখের আবেগে তাহার শ্বাস রুদ্ধ হইয়া গেল। সে উত্তর না দিয়াই কাছারিতে আসিয়া উঠিল। সেরেস্তা-ঘরে গিয়া চিঠির কাগজ টানিয়া লইয়া সে কমলেশকে চিঠি লিখিয়া ফেলিল। এই সংবাদটা জানাইয়া সে লিখিল, আমার বাড়ির কথা তুমি জান, প্রবীণ অভিভাবিকা কেহ নাই। এই অবস্থায় তাহাকে কে দেখিবে? সুতরাং একটি দিন স্থির করিয়া গৌরীকে ওখানে লইয়া যাওয়াটাই আমি নিরাপদ মনে করি।

 

দিনকয়েক পরেই কমলেশ আসিয়া গৌরীকে লইয়া গেল।

গৌরী প্রণাম করিয়া সম্মুখে দাঁড়াইয়া বলিল, কেউ তোমাকে আর অশান্তিতে পুড়িয়ে মারবে না। আমি চললাম।

শিবনাথ তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, তুমিও নিশ্চয় নিশ্চিন্ত হয়ে হেসে খেলে বাঁচবে।

গৌরী বিস্মিত হইয়া গেল, শিবনাথ তাহার সে কথাটা এমন অক্ষরে অক্ষরে মনে রাখিয়াছে। বাকিটুকু সে নিজেই বলিয়া পরিপূর্ণ করিয়া দিল, হ্যাঁ, এমনকি আর যদি আমাকে টানাটানি না কর, তবে চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকব তোমার কাছে।

শিবনাথ উঠিয়া পড়িল, সে যেন চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল, চেষ্টা করিয়া আত্মসংবরণ করিয়া সে বলিল, বেশ, তাই হবে।

ইহার কয়দিন পর শিবনাথ আপনার জীবনের অতি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি গুছাইয়া লইয়া বিল্বগ্রামের চরের উপর বাসা বাধিবার জন্য রওনা হইল। জিনিসের মধ্যে বইয়ের সংখ্যাই

বেশি।

ময়ূরাক্ষী-গর্ভের ধু-ধু-করা বালুরাশির মধ্যস্থলে স্বল্প জলস্রোত বহিয়া চলিয়াছে; বর্ষায় কয়েক পসলা বৃষ্টি হইয়াছে মাত্র; ইহার মধ্যে জলে লাল রঙের ঘোর ধরিয়াছে। বালুচরের কোলে গাঢ় সবুজ ঘাসে ঢাকা নদীর চর, এখানে ওখানে চারিদিকে শরবন বাতাসের প্রবাহে। সর সর শব্দ তুলিয়াছে। চরের অদূরে ছোট্ট গ্রামখানি। শিবনাথ ঘাসের উপর শুইয়া ধরিত্রীর কোলে দেহ এলাইয়া দিল। তাহার মন শান্তিতে ভরিয়া উঠিয়াছে, আনন্দে সে পরিতৃপ্ত হইয়া গিয়াছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *