কয়দিন পর। বেলা তখন প্রায় আটটা। শিবনাথ কাছারির বারান্দায় চিন্তান্বিত মুখে বসিয়া ছিল। সে ভাবিতেছিল পিসিমার কথা। কাজটা কি ভাল হইল? পরদিন প্রভাত হইতেই সে কথাটা ভাবিতেছে। এ চিন্তার হাত হইতে কোনোক্রমেই যেন নিস্তার নাই। পিসিমার অভাব যে আজ চারিদিকে পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে। সমস্ত বাড়িখানার গতিধারাই যেন পাল্টাইয়া গিয়াছে। আর তাহার মনে এ কী কঠিন আত্মগ্লানি! তাহার মাথা হেঁট হইয়া পড়ে। গৌরী ও পিসিমার মধ্যে এমন নির্লজ্জ অকৃতজ্ঞতার সহিত গৌরীকে বড় করিয়া তুলিল কী করিয়া? কিন্তু পিসিমাও যে গৌরীকে কোনোমতেই সহ্য করিতে পারিলেন না। গৌরীকেই বা বিসর্জন দিবে সে কোন্ ধর্ম, কোন্ নীতি অনুসারে?
রাখাল সিং আসিয়া তাঁহার এই চিন্তায় বাধা দিয়া বলিলেন, একটা যে মুশকিল হয়েছে বাবু।
মুশকিল। বিস্মিত হইয়া শিবনাথ রাখাল সিংয়ের মুখের দিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিল, কী মুশকিল?
মাথা চুলকাইয়া রাখাল সিং বলিলেন, মানে, এই একটা অস্থাবর-বাকি সেসের সার্টিপিট এসে গিয়েছে।
সেসের সার্টিফিকেট? সেস কি আমাদের দাখিল করা হয় নি?
আমাদের, আজ্ঞে, সেই সমস্ত পাই-পয়সা মিটিয়ে দেওয়া আছে।
তবে?
মানে, এ আপনার শরিকান মহলের সেস, অন্য কোনো শরিক বাকি ফেলেছে আর কি। আর সার্টিপিট আপিসের ব্যাপার তো, দিয়েছে উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে।
হুঁ। কত টাকা লাগবে? দিয়ে দিন তাহলে।
আবার রাখাল সিং মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে বলিলেন, মানে, সেই তো হয়েছে মুশকিল। লাগবে আপনার একশো বার টাকা পাঁচ আনা তিন পাই। তা মজুত তো এত হবে না।
শিবনাথ চমকিয়া উঠিল, সে কী, সামান্য একশত বার টাকা পাঁচ আনা তিন পাইও তাহার ঘরে জমা নাই? এমন কথা তো স্বপ্নেও সে ভাবিতে পারে নাই।
রাখাল সিং বলিলেন, মানে, এস্টেটে টাকা দাঁড়াতে সময় পেলে কই? এই ধরুন আপনার বিয়েতে মোটা টাকা খরচ গেল, তারপর আপনার মায়ের শ্রাদ্ধে তিন হাজারের ওপর খরচ। আর যুদ্ধের বাজার, এক টাকার জিনিসের দাম তিন টাকা হয়েছে। খরচ বেড়েছে তিন গুণ, আয়। আপনার সেই একই। আবার সেদিন পিসিমা গেলেন, তার জন্যে দেওয়া হয়েছে একশো টাকা।
হুঁ, তা হলে উপায়?
গোটা পাঁচেক টাকা ঘুষ দিয়ে ফিরিয়ে দিই আজকে।
চকিতের মধ্যে শিবনাথের একটা পরিবর্তন ঘটিয়া গেল, মুহূর্তে তাহার চিন্তান্বিত বিমৰ্ষতা কোথায় চলিয়া গেল, আত্মচেতনার গাম্ভীর্যে তাহার সর্বাঙ্গ যেন জাগ্রত হইয়া উঠিল, মাথা তুলিয়া রাখাল সিংয়ের মুখের দিকে উষ্ণ দৃপ্ত দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল, না।
সে দৃষ্টিতে রাখাল সিং সঙ্কুচিত হইয়া চুপ করিয়া গেলেন। শিবনাথ আবার চিন্তান্বিতভাবে সম্মুখের দিকে দৃষ্টি ফিরাইল। সহসা খামার-বাড়ির ধানের মরাইগুলি তাহার চোখে আজ এক বিশিষ্ট রূপ লইয়া যেন ধরা দিল। ওই তো! ওই তো স্থূপীকৃত সম্পদ খড়ের আবরণের তলে সঞ্চিত হইয়া রহিয়াছে। সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ধান বেচে ফেলুন দেড়শো দেড়শো কেন, দুশো টাকার।
মাথা চুলকাইয়া রাখাল সিং বলিলেন, ধান!
হ্যাঁ।
কিন্তু এ বছরের গতিক তো বেশ ভাল নয়, ওদিকেও দু বছর ধান তেমন সুবিধে হয় নি। মানে, এখন কার্তিক মাসে জল না হলে আবার–। সঙ্কোচে তিনি কথা শেষ করিতে পারিলেন না।
শিবনাথ এবার বিরক্ত হইয়া উঠিল, সকাল অবধি পর পর বিমর্ষ বিষণ্ণ চিন্তার ভারে তাহার মন ভারাক্রান্ত হইয়া উঠিয়াছে, এ ভারের লাঘব হইলে সে বাঁচে। তাই ভবিষ্যতের ভাবনায় সদ্য-উদ্ভাবিত উপায়টিকে নাকচ করার প্রস্তাবে সে বিরক্ত না হইয়া পারিল না, তবুও যথাসাধ্য সে ভাব গোপন করিয়া বলিল, যদিগুলো এখন বাদ দিন সিংমশায়: ভবিষ্যতে কী হবে, না হবে, সে ভাবনা এখন থাক। এখন যা বলছি তাই করুন।
রাখাল সিং আর প্রতিবাদ না করিয়া চলিয়া গেলেন। সদ্য এই উদ্বেগক চিন্তাটা হইতে নিস্তার পাইয়া শিবনাথ আবার পিসিমার কথা ভাবিতে বসিল। পিসিমার অভিমান-ত্রুটি বৈশাখের অপরান্ত্রের মেঘের মত পরিধিতে ধীরে ধীরে তাহার মানসলোকে বাড়িয়া উঠিতেছিল। কিন্তু তবুও কেমন একটি বিমর্ষ উদাস ভাবের আচ্ছন্নতা হইতে সে কোনোরূপেই আপনাকে মুক্ত করিতে পারিল না। সংক্রামক রোগের ছোঁয়াচ লাগিলে গঙ্গাস্নানে শুচি হইয়াও যেমন তাহার প্রভাব অতিক্রম করা যায় না, তেমনিভাবেই ওই চিন্তার বীজ তাহার অন্তরে সংক্রামিত হইয়া বসিয়াছিল, উদাসীন বিমর্ষতা তাহার প্রভাব, কোনোরূপেই সে প্রভাবকে কাটানো যায় না।
কিছুক্ষণ পরেই রাখাল সিং আবার আসিয়া সঁড়াইলেন, তাঁহার পিছনে গ্রামেরই একজন ধান-চালের কারবারি। লোকটি হেঁট হইয়া শিবনাথকে একটি নমস্কার বা প্রণাম জানাইল। রাখাল সিং বলিলেন, তা হলে—
শিবনাথ তাঁহার অসমাপ্ত কথা বুঝিয়া লইয়া বলিল, হ্যাঁ, দিয়ে দিন ধান।
মাথা চুলকাইয়া রাখাল সিং বলিলেন, মানে, দর ঠিক হল তিন টাকা।
বেশ।
ব্যবসায়ী বলিল, সে আপনি বাজার যাচাই করে দেখুন কেনে। এক পয়সা কম বলে থাকি দু পয়সা বেশি দেব আমি। সে জুয়োছুরি কেষ্টগতির কুষ্টিতে লেখে নাই। কেউ যদি সে কথা। প্রমাণ করতে পারে তো পঞ্চাশ জুতো খাব আমি।
ঈষৎ হাসিয়া শিবনাথ বলিল, তুমি খেতে চাইলেও আমি সে মারতে পারব না দত্ত। আর যাচাই করবার দরকার নেই। কাজ সেরে নাও।
দত্ত তৎক্ষণাৎ বসিয়া পড়িয়া কাপড়ের খুঁট খুলিতে খুলিতে বলিল, টাকাটা গুনে নিন, টাকা আমি নিয়েই এসেছি। এদিকের কাজ আপনার মিটে যাক, তারপর ধান নেব আমি। গাড়ি বস্তা নিয়ে আমি আসছি।
রাখাল সিং টাকাগুলি গুনিয়া বাজাইয়া লইতে আরম্ভ করিলেন। দত্ত বলিল, আমার বাবু, ঝাড়া-ঝাপটা কাজ; টাকা আমার আগাম, জিনিস বরং দু দিন পরে হয়, তাও আচ্ছা। কেউ যে বলবে, ওই ব্যাটা কেষ্টগতির কাছে একটা পয়সা পাব, সে কাজ করা আমার কুষ্টিতে লেখে নাই। তা হলে পেনাম। আমি আসছি লোকজন বস্তা গাড়ি নিয়ে। আবার তেমনই একটি প্রণাম করিয়া দত্ত চলিয়া গেল।
অস্থাবরের টাকা মিটাইয়া দেওয়া হইল, রসিদ লওয়া হইল। মিটিয়া গেলে সার্টিফিকেটবাহী পিয়নটা লম্বা সেলাম করিয়া বলিল, হুজুর, আমার পাওনাটা হুকুম করে দ্যান।
সবিস্ময়ে শিবনাথ বলিল, তোমার পাওনা?
আবার একটা সেলাম করিয়া সে বলিল, হুজুরের দরবারে আমরা বকশিশ থোড়াথুড়ি পেয়ে থাকি।
শিবনাথ সবিস্ময়ে লোকটাকে দেখিতেছিল, লেকটার এক চোখ কানা, লোকা যেমন বিনীত, তেমনই যেন ক্রুর। অদ্ভুত লোক! তবুও সে তাহার নিবেদন অগ্রাহ্য করিল না, বলিল, ওকে একটা টাকা দেবেন সিংমশায়।
ধান বিক্রয় শেষ হইতে বেলা প্রায় একটা বাজিয়া গেল। শিবনাথ বাড়ির মধ্যে আসিয়া জামা খুলিবার জন্য উপরের ঘরে প্রবেশ করিল। জামা খুলিয়া উদাসভাবেই সে দোতলার খোলা জানালা দিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার জীবনের গতিবেগ ওই বিমর্ষ উদাসীনতার মধ্যে সমাহিত হইয়া পড়িয়াছে। শেষ শরতের আকাশ গাঢ় নীল, কোথাও এক ফোঁটা মেঘের চিহ্ন নাই। সাধারণ শরৎ-রৌদ্রের চেয়ে রৌদ্ৰ যেন প্রখরতর হইয়া উঠিয়াছে। কচি কচি গাছগুলির পাতা ম্লান শিথিল হইয়া ভাঙিয়া পড়িয়াছে। গৌরী এক গ্লাস শরবত লইয়া ঘরে প্রবেশ করিল। শরবতের গ্লাসটি শিবনাথের দিকে অগ্রসর করিয়া দিয়া বলিল, হ্যাগা, ধান বিক্রি করলে কেন বল তো? ছি, ধান বিক্রি করে তো চাষাতে!
কথাটা তীরের মত শিবনাথের অন্তরে গিয়া বিদ্ধ হইল। সচকিত হইয়া সে গৌরীর মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল, অবজ্ঞার সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি রেখায় রেখায় তাহার মুখে ফুটিয়া উঠিয়াছে। তবুও সে আত্মসংবরণ করিয়া বলিল, হঠাৎ টাকার কিছু দরকার হয়ে পড়ল; একটা সেসের সার্টিফিকেট এসে পড়েছিল।
সবিস্ময়ে গৌরী প্ৰশ্ন করিল, সে আবার কী?
গবর্মেন্টকে জমিদারির খাজনার সঙ্গে সেস দিতে হয়। সেই সেস বাকি পড়লে গবর্মেন্ট অস্থাবর করে টাকা আদায় করে।
অস্থাবর? যাতে ঘটিবাটি বিক্রি করে নিয়ে যায়?
হ্যাঁ। কিন্তু টাকা দিলে আর নিয়ে যায় না।
তোমাদের নামে অস্থাবর এসেছিল? ঘটিবাটি নিলেম করতে এসেছিল?–গৌরীর কণ্ঠস্বরের ভঙ্গিমায় হতাশা, অবজ্ঞা, ক্রোধের সে এক বিচিত্র সংমিশ্রণ! পরমুহূর্তেই গৌরী কাঁদিয়া ফেলিল। শিবনাথ লজ্জায় মাথা হেঁট না করিয়া পারিল না। শুধু লজ্জাই নয়, গৌরীর মুখের দিকে চাহিয়া সে শিহরিয়া উঠিল।
মানব-জীবনের মজ্জাগত জীবনধর্মের প্রেরণায়, শিরায় শিরায় ফাটিয়া পড়া শোণিতকণার উষ্ণ আবেগে, যৌবন-স্বপ্নের মোহময় দৃষ্টিতে, নীলাভ আলোর প্রভায় গৌরীকে মনে হইয়াছিল ফুলের মত কোমল সুন্দর, কিন্তু আজ দিনের পরিপূর্ণ আলোকে শিবনাথ গৌরীকে দেখিয়া শঙ্কিত বিস্ময়ে চকিত হইয়া উঠিল। গৌরীর মুখে চোখে, শিবনাথের মনে হইল, তাহার সর্বাঙ্গে দম্ভের উগ্রতা ক্ষুরের ধারের নিষ্ঠুর হাসির মত বিচ্ছুরিত হইতেছে। রাত্রিতে তাহার যে মসৃণ ললাটে আলোর প্রতিবিম্ব ঝলমল করিতেছিল, দিবালোকে শিবনাথ দেখিল, বিরক্তির কুঞ্চনরেখা সেখানে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। রাত্রিতে তাহার যে অধরকোণে আবেগময় হাসি দেখিয়া পৃথিবী ভুলিয়াছিল, প্ৰভাতে শিবনাথ সেই অধরপ্রান্তে তীক্ষ্ণ শ্লেষের বাকানো হাসির মধ্যে ছুরির ধারের শাণিত দীপ্তি দেখিয়া শিহরিয়া উঠিল।
খাওয়াদাওয়ার পর গৌরী বলিল, দেখ, এক কাজ কর। দাদা আমাকে বলে গেছে, মামাদের আপিসে তুমি চাকরি কর, তুমি লিখলেই দেবে। আপিসে চাকরি করে ব্যবসা শিখে পরে তুমি নিজে ব্যবসা করবে। কিন্তু এখনই যদি ব্যবসা কর, মামারা টাকা দেবে, তারপর তুমি শোধ দিও।
শিবনাথ চুপ করিয়া রহিল; সে নীরবে ভাবিতেছিল কমলেশ ও রামকিঙ্করবাবুর কথা। তাহার মনে পড়িয়া গেল, তাহারই বাড়িতে দাঁড়াইয়া রামকিঙ্করবাবুর ক্রোধের রক্তবর্ণ মুখচ্ছবি, কলিকাতার ফুটপাতে দাঁড়াইয়া তাহাদের সে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিমা, কমলেশের গল্প-কয়লার ব্যবসায়ে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন হইবে। প্রত্যেকটি স্মৃতি তাহার মনে কঁটার মত বিধিতেছিল।
গৌরী আবার বলিল, কথা কইছ না যে?
ম্লান হাসিয়া শিবনাথ বলিল, ভেবে দেখি।
এর আবার ভাববে কী? চাকরি করবে, রোজগার হবে, এতে ভাববার কী আছে?
শিবনাথ রক্তিমমুখে এবার বলিল, দাসখত লেখবার আগে ভেবে দেখতে হবে বৈকি। অন্তত যার পায়ে লিখতে হবে, তার সম্বন্ধেও তো বিবেচনা করতে হবে।
গৌরীর মুখচোখ লাল হইয়া উঠিল। সে বলিল, কেন তুমি আমার আত্মীয়স্বজনদের হেয়। কর বল দেখি?
শিবু দৃঢ়স্বরে বলিল, না হেয় আমি করি নি। তা ছাড়া আরও একটা কথা তুমি জেনে রাখ, আমার জীবনে অর্থ উপার্জনটাই সবচেয়ে বড় জিনিস নয়। তার চেয়ে বড় কাজ আমি করতে চাই।
গৌরী আশ্চর্য হইয়া গেল, কথাটা সম্পূর্ণ সে বুঝিতেও পারিল না, কিন্তু উত্তপ্ত অন্তর লইয়া নিরুত্তর হইয়াও সে থাকিতে পারিল না, বলিল, তাই বলে তোমার হাতে পড়ে আমাকে সুদ্ধ পথে পথে ভিক্ষে করতে হবে নাকি?
শিবনাথ গম্ভীরভাবে বলিল, ভিক্ষে করতে হলে আমিই করে নিয়ে এসে তোমাকে খাওয়াব। ভয় নেই, তোমাকে ভিক্ষে করতে হবে না।
ক্রুদ্ধা গৌরী মুখ বাঁকাইয়া উঠিল, থাক আমার জন্য তোমায় ভাবতে হবে না। আমার ব্যবস্থা আমার মা-বাপেই করে গেছেন। তোমার নিজের কথা তুমি ভাব।
শিবনাথ নির্বাক হইয়া ক্রুদ্ধ বিস্ময়ে গৌরীর দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল।
দুর্জয় ক্রোধে সে অধীর হইয়া উঠিতেছিল; কিন্তু আপনাকে হারাইয়া ফেলিবার পূর্বে সে স্থান ত্যাগ করিয়া বাহিরে চলিয়া গেল।
কাছারি-বাড়িতে আসিয়া সে অসুস্থের মত বসিয়া পড়িল। অবরুদ্ধ ক্ৰোধ তাহার মাথার মধ্যে যেন আগুনের মত জ্বলিতেছে। সতীশ চাকর আসিয়া সেই মুহূর্তে ঘরে প্রবেশ করিল; শিবনাথ ক্ৰোধে জ্বলিয়া উঠিল, অত্যন্ত রূঢ় কঠোর স্বরে সে বলিল, কী? কে তোকে ঘরে আসতে বললে? সতীশ সভয়ে খানদুই চিঠি ও খবরের কাগজ প্রভুর সম্মুখে রাখিয়া দিয়া বলিল, আজ্ঞে, ডাক এসেছে।
ডাক! আত্মসংবরণ করিয়া শিবনাথ চিঠি ও কাগজখানা তুলিয়া লইল; সতীশ পলাইয়া বচিল। চিঠি দুইখানা সদর হইতে উকিল দিয়াছেন। সেগুলো একপাশে সরাইয়া রাখিয়া সে কাগজখানা খুলিয়া বসিল।
উঃ, পশ্চিম-সীমান্তে নিউপোর্ট ইপ্রেস মার্নে বেলফোর্ট ভার্টুন হইয়া ছয় শত মাইলব্যাপী যুদ্ধ চলিয়াছে। প্যারিসের অনতিদূরে জাৰ্মান সৈন্য খুঁটি গাড়িয়া বসিয়াছে। ওদিকে পূর্ব-সীমান্তে প্রায় শত শত মাইল বিস্তৃত যুদ্ধক্ষেত্ৰ। লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ, প্রত্যেক জাতির সমগ্র ধনভাণ্ডার জাতীয় গৌরবরক্ষার্থে নিয়োজিত হইয়াছে। ভারতবর্ষ হইতে ভারতীয় সৈন্য প্রেরণের পরিপূর্ণ আয়োজন চলিতেছে।
শিবনাথ কাগজ হইতে মুখ তুলিয়া আকাশের দিকে চাহিল। জাতীয় গৌরব! জাতি—দেশ, জন্মভূমি! অকস্মাৎ জীবনে যেন একটা পটপরিবর্তন হইয়া গেল। জীবনের আকাশে কামনার কালবৈশাখীর কালো মেঘে সমস্ত আবৃত হইয়া গিয়াছিল, সে মেঘ কাটিয়া যাইতেই আবার দেখা দিল সেই আকাশ, তাহার সকল জ্যোতিষ্কমণ্ডলী। মনের মধ্যে সুপ্ত বিস্মৃতপ্রায় কামনা আবার তাহার জাগিয়া উঠিল, দেশের স্বাধীনতা।
কিন্তু পথ? পথ কই? রক্তাক্ত পথের কথা মনে জাগিয়া উঠিতেই সে শিহরিয়া উঠিল। তাহার মনে পড়িয়া গেল, সেইদিনের সেই ঘটনার কথা, অতি সাধারণ আকৃতির এক মহাপুরুষের কথা; সঙ্গে সঙ্গে তাহার মনে পড়িয়া গেল মাকে। গভীর চিন্তায় আচ্ছন্নের মত বসিয়া থাকিতে সে বাহির হইয়া পড়িল। গ্রাম ছাড়াইয়া মাঠের মধ্য দিয়া সে সেই কালীমায়ের আশ্রমের দিকে চলিয়াছিল। সরু আলপথের দুই দিকে ধানের জমি; প্রায় কোমর পর্যন্ত উঁচু ধানগাছে মাঠ ভরিয়া উঠিয়াছে। সহসা একটানা একটা শো শো শব্দে আকৃষ্ট হইয়া সে থমকিয়া দাঁড়াইল। কোথায় এ শব্দ উঠিতেছে? কিসের শব্দ? তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গভীর মনঃসংযোগ করিয়া সে আবিষ্কার করিল, শব্দ উঠিতেছে জমিতে, অনাবৃষ্টিতে রৌদ্রের প্রখর উত্তাপে জমির জল শুকাইয়া যাইতেছে, মাটি ফাটিতেছে।
উঃ, তৃষ্ণার্ত মাটি হাহাকার করিতেছে! মাটি কথা কহিতেছে! মাটি–মা—দেশ–জন্মভূমি কথা কহিতেছেনঃ চোখ তাহার জলে ভরিয়া উঠিল। হ্যাঁ, কথাই তো কহিতেছেন। সে যেন সত্যই প্ৰত্যক্ষ করিল মৃত্তিকার আবরণের তলে জাগ্ৰত ধরিত্রী-দেবতাকে। চোখের সম্মুখে সুতার মত ফাটলের দাগগুলি ক্রমশ মোটা হইয়া সুদীর্ঘ রেখায় অগ্রসর হইয়া চলিয়াছে। শস্যগর্ভা ধানের গাছের দীর্ঘ পাতাগুলি ম্লান হইয়া মধ্যস্থলে যেন ভাঙিয়া পড়িয়াছে। লক্ষ্মী দেহত্যাগ
করিতেছেন।
এ ধ্যানও তাহার ভঙিয়া গেল একটা আকস্মিক কোলাহলে। দৃষ্টি তুলিয়া সে দেখিল, সম্মুখেই কিছু দূরে দুইটা লোকের মধ্যে ক্রুদ্ধ বাক্যবিনিময় হইতেছে। সহসা একজন অপরের গালে সজোরে একটা চড় মারিয়া বসিল। সঙ্গে সঙ্গে প্রহৃত লোকটা কী একটা উদ্যত করিল। শিবনাথ। দূর হইতেও বেশ বুঝিল, সেটা কোদালি। সে চিৎকার করিয়া উঠিল, এই এই এই! সঙ্গে সঙ্গে নিজেও ছুটিয়া সেই দিকে অগ্রসর হইল। তাহার চিৎকারে ফল হইল। বিবদমান লোক দুইটি তাহাকে চিনিয়া পরস্পরের দিকে আক্রোশভরা দৃষ্টিতে চাহিয়া নিরস্ত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
শিবনাথ আসিয়াই বলিল, সর্বনাশ! করছ কী? খুন হয়ে যেত যে এখুনি।
লোক দুইটি উভয়েই চাষী; শিবনাথকে দেখিয়া তাহারা দুই জনেই ঈষৎ সরিয়া দাঁড়াইল; প্রহৃত ব্যক্তিটি বলিয়া উঠিল, আপনি তো দেখলেন বাবু, ওই তো আমাকে আগুতে চড়িয়ে দিলে! ব্যাটার বাড় দেখেন দেখি!
অপরজন বলিয়া উঠিল, মারব না? আমার জল চুরি করে ঘুরিয়ে নিলি কেনে?
জল তোর বাবার? আমার ধান মরে যাবে, আর লালার জল ও একলা লেবে!
পাশেই একটি নালায় ঝরনার জল অতি ক্ষীণ ধারায় বাহিয়া চলিয়াছে, সেই জল লইয়া ঝগড়া। লোকটা তখনও বলিতেছিল, আমার গঙ্গদে থোড়ওয়ালা ধান শুকিয়ে মরে যাবে, আর ওর ধান একা শিষ দুলিয়ে পেকে ঢলে পড়বে! লোকটি অকস্মাৎ কাঁদিয়া ফেলিল।
শিবনাথ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, আচ্ছা, মাঠে জল দেবার কি কোনো উপায় নেই?
চোখ মুছিতে মুছিতে লোকটি বলিল, আজ্ঞে, দেবতার জল না হলে কি পৃথিবীর শোষ মেটে? তবে আপনকারা দয়া করলে কিছু কিছু বাচে। পুকুরের জল যদি ছেড়ে দ্যান আপনকারা।
আমাদের পুকুর?
আজ্ঞে না। এ মাঠে আপনকাদের পুকুরের জল আসবে না; তবে সব বাবুরাই আপন আপন পুকুরের জল ছেড়ে দ্যান তো সব মাঠই কিছু কিছু বাঁচবে।
শিবনাথ তাহাদের আশ্বাস দিয়া কলহ করিতে নিরস্ত করিয়া বাড়ির দিক ফিরিল। পথের দুই ধারের জমি হইতে একটা শো শো শব্দ নির্জন প্রান্তরের বায়ুস্তরের মধ্যে মিলাইয়া যাইতেছে। মাঠ শেষ হইল, শুষ্ক শস্যহীন পতিত ডাঙাটায় ধুলা উড়িতে আরম্ভ করিয়াছে। প্রান্তরের পর গ্রাম আরম্ভ হইল, মানুষের বসতির কলরব ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। কিন্তু শিবনাথের কানে তখনও যেন ধ্বনিত হইতেছিল ওই শোঁ শোঁ শব্দ; জল চাহিতেছেন মৃত্তিকাময়ী মা—সুজলা সুফলা মলয়জশীতলা তৃষ্ণায় চৌচির হইয়া ফাটিয়া যাইতেছেন।
কাছারি-বাড়িতে আসিয়া সে ডাকিল, সিংমশায়!
সেরেস্তা-ঘরে বসিয়া রাখাল সিং লিখিতেছিলেন, শিবনাথের ডাক শুনিয়া চশমাটা নাকের ডগায় টানিয়া দিয়া ঐ ও চশমার ফাকের মধ্যে দিয়া দৃষ্টি প্রসারিত করিয়া আসিয়া দাঁড়াইলেন, আমাকে বলছেন?
হ্যাঁ। কেষ্ট সিংকে ডাকুন, এখানকার মহলে ঢোল দিয়ে দিন, আমাদের যত পুকুর আছে, সমস্ত পুকুরের জল আমরা ছেড়ে দোব। কিন্তু তারা মারামারি করতে পারবে না, একটা করে পঞ্চায়েত করে দিন, তারাই জল ভাগ করে দেবে।
রাখাল সিং বিস্ময়ে চোখ দুইটা বিস্ফারিত করিয়া বলিলেন, সে কী?
হ্যাঁ, মাটি ফাটছে, চৌচির হয়ে গেল। ধান বাঁচবে না।
কিন্তু বহু টাকার মাছ নষ্ট হবে যে!
উপায় নেই। মাছ মরে, আবার হবে। মাটি ফেটে যাচ্ছে। ধান মরে গেলে মানুষ বাঁচবে না।
কত টাকার মাছ নষ্ট হবে, জানেন?
জানি না। কিন্তু জল দিতেই হবে। অন্যান্য মহলেও লোক পাঠিয়ে দিন; যেখানে যত পুকুর আছে আমার, মহল বে-মহল যেখানে হোক জল ছেড়ে দেওয়া হবে।
শিবনাথ বাড়ির মধ্যে চলিয়া গেল। দ্বিপ্রহরের মনের গ্লানি নিঃশেষে মুছিয়া গিয়াছে। রাখাল সিং আপন মনেই ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, উঁহুঁ, বে-মহল ছেড়ে দোব কেন? কিসের গরজ আমাদের? মহলে বরং-তাও প্রজারা সব কড়ার করুক যে, খাজনাটি ঠিক দেবে, তবে দোব। দেওয়া উচিতও বটে, রাজধর্মও বটে। কী বল হে কেষ্ট।
কেষ্ট বলিল, কী বলব, মাশায়? হুকুম তো শুনলেন? সহসা সে দারুণ আক্ষেপভরে বলিয়া উঠিল, সায়েরের এক-একটা মাছ বার সের চোদ্দ সের-আধ মন পর্যন্ত কাতল দু-চারটে আছে।
রাখাল সিং বলিলেন, ক্ষেপে তুমি, সায়েরের মাছের জল না রেখে আমি জল দোব! সে করতে গেলে চাকরি আমি ছেড়ে দোব।
গৌরী বিছানায় চুপ করিয়া শুইয়া ছিল। শিবনাথ ঘরে ঢুকিয়া হাসিয়া বলিল, কী রকম, এখনও শুয়ে রয়েছ যে?
নির্লিপ্তভাবে গৌরী উত্তর দিল, আছি।
একটু চা করে দেবে?
বল না বামুন ঠাকুরুকে, কি নিত্যকে।
তুমিই বলে দাও। আমি আর পারি না, যেন স্নান করে উঠেছি।
বিছানা ছাড়িয়া গৌরী বলিল, যাওয়া হয়েছিল কোথায় এই রোদের মধ্যে?
মাঠে—বলিতে বলিতেই আবেগে শিবনাথের বুক ভরিয়া উঠিল, সে বলিল, জান গৌরী, মাঠে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেলাম, মনে হল, মাটি যেন কথা কইছে, জল শুকিয়ে মাঠের জমি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। মানুষ যেমন তেষ্টায় হা-হা করে, মাঠের মাটির মধ্যে তেমনই শব্দ অবিরাম উঠছে!
গৌরী বলিল, আমরা তো আমরা, আমাদের চৌদ্দপুরুষে এমন কথা কখনও শোনে নি। বলিয়া সে বাহিরে যাইবার উপক্রম করিল। শিবনাথ ক্ষুণ্ণ হইলেও বুঝিল, এটুকু গৌরীর। অভিমান। সে খপ করিয়া তাহার হাত ধরিয়া বলিল, রাগ হয়েছে? শোন শোন।
না। আমরা সব ছোটলোক, ওসব বড় কথা আমরা বুঝি না। ছাড়, ছাড়, চা করে আনি। বলিয়া হাতটা সজোরে টানিয়া লইয়া চলিয়া গেল।
কিছুক্ষণ পর চায়ের কাপ লইয়া ফিরিয়া আসিয়া বলিল, আবার এ কী হুকুম হয়েছে?
সবিস্ময়ে শিবনাথ বলিল, কী?
সমস্ত পুকুরের জল ছেড়ে দেবে নাকি?
হ্যাঁ, বলেছি। তুমি মাঠের অবস্থা দেখ নি গৌরী–
মুখের কথা কাড়িয়া লইয়া অসহিষ্ণু গৌরী বলিল, দরকার নেই আমার দেখে। কিন্তু পুকুরের মাছ কী হবে শুনি?
আবেগময় কণ্ঠে শিবনাথ বলিল, মানুষ মরে যাবে গৌরী, ধান না হলে মানুষ মরে যাবে।
কিন্তু মাছের যে টাকাটা লোকসান হবে, সে কে দেবে?
লোকসান স্বীকার করতে হবে, না করে উপায় নেই। ধান না হলে দুর্ভিক্ষ হবে, আমরাও হয়ত খেতে পাব না।
বাবাঃ, তোমার ধানের চরণেও প্ৰণাম, তোমার জমিদারের চরণেও প্রণাম।
শিবনাথ চুপ করিয়া রহিল, এ কথার কোনো উত্তর দিল না। কিন্তু আবার তাহার মন ধীরে ধীরে অস্থির হইয়া উঠিতেছিল; এইটুকু কিশোর বয়সে স্বার্থের এমন লোলুপতা দেখিয়া তাহার সমস্ত অন্তর দুঃসহ ক্ষুব্ধতার গ্লানিতে ভরিয়া উঠিল।
গৌরী আবার বলিল, এইজন্যে বলেছিলাম, চাকরি কর। চাকরি করলে কলকাতায় সুখেস্বচ্ছন্দে আরামে থাকবে। আজ না জল নেই, কাল না ধান নেই, পরশু না অমুৰ নেই—এ ঝাঁট পোয়াতে হবে না, এখানকার টাকা জমবে, অবস্থার উন্নতি হবে।
শিবনাথ দৃঢ়স্বরে বলিল, সে হবে না গৌরী, সে আশা তুমি ত্যাগ কর। এ মাটি ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারব না।
শিবনাথ নিজে দাঁড়াইয়া তাহার নিজের সমস্ত পুকুরের মুখ কাটাইয়া দিল। প্রত্যহ প্রভাতে ঘোড়ায় চড়িয়া গ্রামান্তরে ঘুরিয়া নিজের প্রত্যেকটি পুকুরের জল নিঃশেষে মাটির তৃষ্ণা নিবারণের জন্য ছাড়িয়া দিল। মাছ কিছু বিক্রয় হইল, অধিকাংশই নষ্ট হইয়া গেল। রাখাল সিং কেষ্ট সিং, চোখের জল না ফেলিয়া পারিল না। রাখাল সিং অনেক বিবেচনা করিয়া পিসিমাকে চিঠি লিখিলেন; কিন্তু সে পত্রের জবাব আসিল না। শেষে তিনি চণ্ডীদেবীর গদিয়ান গোঁসাই-বাবাকে গিয়া ধরিলেন। গোঁসাই-বাবা বলিলেন, উ তো হামি পারবে না ভাই রাখাল সিং দান-ধরমমে হামি বাধা কেমন করিয়ে দিবে দাদা?
মাস্টার রতনবাবু আসিয়া মহা উৎসাহে শিষ্যের সহিত কোমর বাঁধিয়া লাগিয়া গেলেন। বললেন, গ্ৰেট, গ্ৰেট, দিস ইজ রিয়েলি গ্রেট, আই অ্যাম প্রাউড অব হিম, আই অ্যাম হিজ টিচার। রাখাল সিং বলিলেন, বাংলা করে বলুন মাশায়, ইংরিজি-ফিংরিজি আমি বুঝি না।
রতনবাবু বলিলেন, এই হল বড় মানুষ, সত্যিকারের বড় মানুষ। আমি শিবুর শিক্ষক, আমার অহঙ্কার হচ্ছে।
রাখাল সিং কিছুক্ষণ তাহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, তবে তো আপনি খুব বললেন মাশায়! কাপড় ফাটল আর ফুটল, ধোপার কী? সেই বিত্তান্ত!–বলিয়া তিনি রাগ করিয়া স্থানত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন।
শিবনাথের দৃষ্টান্তে আরও অনেকেই জল ছাড়িয়া দিলেন। কিন্তু ক্ৰোশ-ক্রোশব্যাপী শস্যক্ষেত্রের অনুপাতে সে জল কতটুকু! ঐরাবতের বুক-ফাটা তৃষ্ণার সম্মুখে গোস্পদের জল কতটুকু?
সেদিন গ্রামান্তরে পুকুর কাটাইয়া দিয়া সে ফিরিতেছিল; বেলা তখন প্রায় আড়াইটা বাজিয়া গিয়াছে। শরীরের অপেক্ষা মন তাহার অধিক ক্লান্ত; হতাশার ভারে মন যেন মাটিতে লুটাইয়া পড়িতে চায়। ঘোড়াটাও মন্থর গমনে চলিয়াছিল, ক্ষুধায় তৃষ্ণায় শক্তিমান বাহনটিও ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে। শিবনাথ শুনিল, দুই পাশের জমি হইতেই আবার সেই শো শো শব্দ উঠিতেছে। সে আশ্চর্য হইয়া গেল, কাল এইসব জমিতে জল দেওয়া হইয়াছে। ইহার মধ্যে আবার তৃষ্ণা জাগিয়া উঠিয়াছে! সে দ্রুতবেগে ঘোড়াটা চালাইয়া দিল। বাড়িতে আসিয়া ঘোড়াটা ছাড়িয়া দিল ও কাছারির ভিতর দিয়া অন্দরের দিকে অগ্রসর হইল। সতীশ চাকর খানকয়েক চিঠি তাহার হাতে দিল, ডাকে আসিয়াছে।
একখানা তাহার মামার বাড়ির চিঠি। দ্বিতীয়খানা খুলিয়া দেখিল, লিখিয়াছেন গৌরীর দিদিমা। লিখিয়াছেন, গৌরী অনেকদিন গিয়াছে, তাহাকে একবার লইয়া আসিতে চাই। গৌরী লিখিয়াছে তাহার শরীর নাকি খারাপ। অতএব ভায়াজীবন, গৌরীকে লইয়া অতি সত্বর তুমি এখানে আসিবে।
তাহার ভ্রূ কুঞ্চিত হইয়া উঠিল, গৌরী লিখিয়াছে, তাহার শরীর খারাপ! মনশ্চক্ষে সে গৌরীকে আপাদমস্তক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখিয়া লইল, গৌরীর রঙ অবশ্য একটু ময়লা হইয়াছে, কিন্তু স্বাস্থ্য যে পরিপূর্ণ নদীর মত ভরিয়া উঠিয়াছে। সে বাড়ির ভিতরে আসিয়া চিঠিখানি গৌরীর হাতে দিয়া বলিল, তোমার নাকি শরীর খারাপ?
উত্তপ্ত পরিশ্রান্ত শিবনাথের কথার সুরের মধ্যে জ্বালা যেন ফুটিয়া বাহির হইতেছিল। গৌরী এক মুহূৰ্ত নীরব থাকিয়া মাথা তুলিয়া বলিল, শরীর খারাপ লিখব না তো কি লিখব যে, এ রকম মহাপুরুষের কাছে আমি থাকতে পারছি না, তোমরা আমায় নিয়ে যাও?
কেন?—দুরন্ত ক্রোধে শিবনাথের মাথাটা যেন ফাটিয়া পড়িবার উপক্রম হইল।
কেন আবার কী? মহাপুরুষেরা আবার কোন্ কালে স্ত্রী নিয়ে ঘর-সংসার করে? তার চেয়ে আমার সরে যাওয়াই ভাল; তুমি কেন সংসার ছাড়বে?
বেশ। তা হলে কালই যাবে, মাস্টারমশায় তোমাকে রেখে আসবেন।—বলিয়া সে মাথায় তেল না দিয়াই স্নানের ঘরে ঢুকিল, রুক্ষ মাথার উপরে হুড়হুড় করিয়া ঠাণ্ডা জল ঢালিয়া ঢালিয়া সে আপন মনেই বলিল, আঃ!
পরদিন প্রাতঃকালের ট্রেনেই গৌরী রামরতনবাবুর সঙ্গে রওনা হইয়া গেল। শিবনাথ ট্রেনে তুলিয়া দিয়া আসিল, কিন্তু একটি কথাও বলিল না। গৌরীও ট্রেনের বিপরীত দিকে জানালা দিয়া চাহিয়া রহিল, অবগুণ্ঠনের অন্তরাল হইতে একবারও শিবনাথের দিকে ফিরিয়া চাহিল না।
বাড়ি ফিরিয়াই শিবনাথ ঘোড়ায় চড়িয়া রওনা হইল।
কার্তিকের প্রারম্ভ, শেষত্রে শীতের আমেজ দেখা দিয়াছে, প্রভাতে শিশিরকণায় সমস্ত যেন ভিজা হইয়া থাকে। সূর্য দক্ষিণায়নে ক্রমশ দূর হইতে দূরান্তরে চলিয়াছেন, তবুও এবার রৌদ্রের প্রখরতা এখনও কমে নাই। প্ৰাতঃকাল অতিক্রান্ত হইতে না হইতেই রৌদ্রের মধ্যে যেন একটা জ্বালা ফুটিয়া ওঠে, সে জ্বালার শোষণে মাটির বুকের রস নিঃশেষিত হইয়া শুষ্ক হইতে চলিয়াছে। দিগন্তপ্রসারী শস্যক্ষেত্রে শস্যশীর্ষগর্ভাধান্যলক্ষ্মী নীরস ধরণীর বুকের উপর তৃষ্ণায় মৃতপ্রায় কিশোরী কন্যার মত এলাইয়া পড়িয়াছে। ধীরে ধীরে মৃত্যুর বিবৰ্ণতা কিশোরীর সর্বাঙ্গে সঞ্চারিত হইতেছে। মাঠজোড়া ধানগাছগুলির পাতার প্রান্তভাগ হলুদ হইয়াছে। তবুও উদামোনানুখ ধান্যশিষের একটি ক্ষীণ হৃদ্য গন্ধে প্রান্তরটা ভরিয়া উঠিয়াছে—ধান্যলক্ষ্মীর অঙ্গসৌরভ। আর কানে বাজিতেছে, মাঠজোড়া শোঁ শো শব্দ। তৃষ্ণায় মরণোন্মুখ কিশোরী কন্যার জন্য, আপন তৃষ্ণার জন্য ধরিত্রী জল চাহিয়া কাঁদিতেছেন।
গৌরীর এ শুনিবার কান নাই, এ দেখিবার চোখ নাই, এ বুঝিবার মন নাই। শিবনাথ সজল চক্ষে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া অগ্রসর হইল।