বিহারী পর্ব

৩০. ছানাপোনার কাহিনি

ছানাপোনার কাহিনি

আগেই বলেছি, সেই ছাত্র থাকা কালে কিংবদন্তী লেখক তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বিপাশা’ উপন্যাসটি পড়ে এতই মনে ধরেছিল— মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম আমার কন্যা জন্মালে অবশ্যই তার নাম রাখবো ‘বিপাশা’। বিয়ের পর শিরীর সাথে কথা বলে এ বিষয়টি চূড়ান্ত করে ফেলি।

তার পরের ঘটনাতো বলেছি— উত্তাল একাত্তর, আমি ঢাকা মেডিকেল হাসপাতলে মৃত্যুর সাথে লড়ছি, ওদিকে হলি ফ্যামিলিতে বিপাশার জন্ম হলো ২৩ শে মার্চ ১৯৭১. ডেট ছিল এপ্রিলের শেষের দিকে, কিন্তু আমার অসুখের কারণে প্রচণ্ড টেনশনে শিরীকে আগেই হাসপাতাল যেতে হয়। ভোর ১-১৭ মিনিট পৃথিবীর আলো দেখে সে।

কারফিউ তোলার পর ২৭ তারিখ শিরী ওকে নিয়ে হেঁটে চলে যায় আমার শ্বশুরবাড়ি বেরাইদ।

আমি হাসপাতাল থেকে যাই ২৯ তারিখ। আমার কোলে বাচ্চা দেন আমার ফুপু শ্বাশুড়ি। এই লও তোমার বিপাশা।

দারুণ আনন্দের ব্যাপার ছিল আমার কাছে— এত দুঃখ কষ্টের মাঝেও—

আমার দেয়া নামটা এর মধ্যে রাখা হয়েছে— এই ছিল আনন্দ। বিপাশা আজও গর্বের সাথে উচ্চারণ করে তার জন্মদিনটি।

স্কুল শুরু করলো ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরিতে, ছোটবেলা থেকে ফুল, পাখি, গাছপালা এসব তার প্রিয় বস্তু ছিল। প্রতিদিন সকালে প্রিন্সিপাল আপাকে একটা ফুল দেয়া তার ছিল নিয়মিত ব্যাপার।

থ্রি পাশ করার পরই আমরা গেলাম লিবিয়া। ফোরের বই পুস্তক নিয়ে যাওয়া হলো-কিন্তু বাংলা স্কুল এবং কাছাকাছি কোনোও স্কুল না থাকায় তিনটি বছর আর প্রাতিষ্ঠানিক পড়া হলো না। ঘরে বসে আমরা যতটুকু যা পেরেছি পড়িয়েছি।

আমাদের প্রকল্পতে প্রথম কয়েকমাস একজন সমবয়সী বান্ধবী পেয়েছিল তারপর একাই। নাতাশা ছোট, ওর সাথেই সময় কাটতো আর কখনো কখনো দেখেছি একা একা প্ৰকল্প এলাকায় আমার কোয়ার্টারের আশে পাশে ঘুরে বেড়াতো। প্রকৃতির সাথে একটা নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল ওর। পাথুরে ফুল গাছগুলো আর পাখিরা ছিল ওর বন্ধু— একটি বিড়াল কোথা থেকে এসে হয়ে গেল ওর প্রিয় বন্ধু। একটা খরগোশ পালতে শুরু করে -পরে কারা যেন সেটা জবাই করে খেয়েও ফেললো। আরবরা খরগোশের মাংস খুব পছন্দ করে। সেটা নিয়ে কী কান্না ওর।

রোমান সামাজ্যের ধ্বংসাবশেষে যতবার গেছি ওর আনন্দ আর উচ্ছাস ছিল অবাক করা মত। এগুলো ওকে আলোড়িত করে তখনই খেয়াল করেছি। ওর চিত্রাঙ্কনে তার ছাপ সব সময় দেখা যায়। মিউজিয়াম ওর প্রিয় যায়গা সব সময়। স্মৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া করাটা ওর প্রিয় কর্মযজ্ঞ। দেশে ফিরে মতিঝিল স্কুলে ভর্তি করা হল। কিন্তু এখানে নিজেকে খাপ খাওয়ানো ওর পক্ষে সম্ভব হয়নি। পরের বছরই ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চলে এল ভিকারুননিসায়।

ওর অভিনয়ের প্রতি আকর্ষণ ছোট্টবেলা থেকে। আমার নাটক সে মনোযোগ দিয়ে দেখতো, রেডিও নাটকগুলো শুনতো-আমি ওর হাতে script দিয়ে মুখস্ত পরীক্ষা দিতাম ডায়লগের। লিবিয়াতে যখন আমার নির্দেশনায় নাটক হলো ছ’মাস মহড়ায়, সে প্রতিটি মহড়ায় ছিল— কখনো আমার বাসায়, কখনো অন্য কারো বাসায়-ও কিন্তু খেলে বেড়াতো না। মন দিয়ে মহড়া দেখতো। এবং এক সময় দেখলাম পুরো নাটক তার মুখস্ত। জিজ্ঞাসা করলে শুধু মুখস্ত বলতো না, অভিনয় করে বলতো।

বাচ্চারা সাধারণত ফুল লতা পাতা মানুষ এসব ছবি আঁকতে পছন্দ করে, বিপাশাও করতো, তবে এর ভেতর ঠিকই তার নিজস্ব চিন্তা ভাবনাটাও বেরিয়ে আসতো-সে কারণেই স্থাপত্যকলায় পড়াশুনার ছিল অসম্ভব ঝোঁক।

একদম ছোটবেলায় একবার ‘এসো গান শিখি’তে ওর মা নিয়ে গিয়েছিল। ওটাই প্রথম স্ক্রিনে আসা। তবে আমাদের ইচ্ছা ছিল আমাদের সন্তান সংস্কৃতিমনা হবে। আর পড়াশোনাতো করতেই হবে-সেটাই আমাদের প্রথম চাওয়া ছিল ওদের কাছে।

বিপাশা গানে ভর্তি হলো, নাতাশা নাচে। আবার নাগরিকে তো বিপাশার সংশ্লিষ্টতা জন্ম থেকে। আমাদের সব শিল্পীদের কোলে কোলেই বড় হয়েছে সে। লিবিয়া থেকে আসবার পর ওর প্রথম নাটক ‘খোলা দুয়ার’ বিটিভিতে। মামুনুর রশিদের লেখা, মোস্তাফিজুর রহমানের প্রযোজনায়। তারপর এক সময় নায়িকাই হয়ে গেল— হুমায়ুন আহমেদের নাটক ‘অয়োময়’-এ। এবং দেশের প্রথম সারির একজন শিল্পী বিপাশা! ভাবতেও অবাক লাগে। গান-এর প্রতি বেশি সময় দেয়নি, যদিও সানজিদা খাতুন এবং মিতা হকের কাছেও শিখেছে বেশ কিছুদিন। কিন্তু নাটকের প্রতি তার ভালোবাসা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে বয়েস বৃদ্ধির সাথে সাথে। বই পড়া তার অনেক প্রিয় ব্যাপার-আমার অভিনয়ের বইগুলো তার সেই ষোলো সতেরোতেই পড়া সারা।

ছোটবেলায় মেয়েদের জন্মদিনে আমরা ওদের অন্য কোনো গিফটের সাথে সাথে একটা দুটো বই উপহার দিতাম। সেখান থেকেই ওর নেশা। রাশিয়ার একটা বাচ্চাদের বই ও ছোটকালে পুরো মুখস্ত ছিল।

ওর পড়া বইয়ের তালিকা শুনলে অবাক হতে হয়। পাঠ্য বইয়ের চেয়ে বাইরের বই পড়ার প্রতি ওর আকর্ষণ সবসময় বেশি ছিল— এখন কাজে কর্মে ব্যস্ততার ভীড়ে ঠিকই পড়ার সময় বের করে নেয়। খেয়াল করেছি, মাঝে মাঝে Audio Book শোনাটা ও তার নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি অবাক হয়ে গেছি যখন শুনেছি ও সেই ১৮/২০ বছরে কোরানের বাংলা অনুবাদ, গীতা আর বাইবেল এগুলোও পড়ে।

নিজের মেয়ে বলে হয়তো বেশিই বলছি, কে জানে— কিন্তু সত্যি ও আমাকে অবাক করে যখন ওর সাথে কোনো বিষয়ে আলোচনায় বসি। তৌকিরের মধ্যেও এই গুণ লক্ষ্য করেছি— এখনো বেশি সময় তৌকির বইপত্র নিয়েই থাকে।

SSC পাশ করলো খুবই ভালোভাবে। তিনটি লেটারসহ স্টার মার্কস। বিজ্ঞানেই পড়াশোনা করে HSC ও ভাল ফল নিয়ে ২টি লেটারসহ পাশ করে বুয়েটে স্থাপত্যকলায় ভর্তি পরীক্ষা দিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ওর নাম এল অপেক্ষার তালিকায় ২৬ নম্বরে। সুতরাং ওয়েটিং লিস্ট-এ ঝুললো কিছুদিন— তারপরই হৃদয় বিদারক ঘটনাটি ঘটলো-২৫ নম্বর ছাত্রীটি ভর্তির সুযোগ পেল এবং সেখানেই শেষ-আর কেনো সুযোগ নেই-ভীষণ মনখারাপ ছিল ওর শখের বিষয় নিয়ে পড়া হলো না বলে-

তারপর নিজেই ভর্তি হলো ইডেন কলেজে, ইংরেজিতে অনার্সে। মাস তিনেক পর বেঁকে বসলো— ইংরেজি পড়বে না। তাহলে কী পড়বে?

বলে, আমি আর্ট ইন্টসটিউটে ভর্তি হব।

তাতে কিন্তু তোমার ক’টা বছর নষ্ট হবে, খেয়াল করেছ?

আমি বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম।

হোক, আমার পছন্দ ওটাই।

এবার ওর মা বেঁকে বসলো।

না আর্ট কলেজে সব গাঁজাখোর। ওখানে তুমি পড়বে না।

না, না, ওখানে নয়।

যুক্তিতে না পেরে বিপাশা প্রস্তাব দিল, চল আমার সাথে একটা পুরোদিন তুমি আর্ট কলেজে থাকবে, ঘুরবে ফিরবে দেখবে, তারপর যদি বল না তুমি ওখানে পড়বে না, আমি কিছু বলবো না।

পুরো একটা দিন ঘুরে এসে শিরীতো মুগ্ধ, আবেগে আপ্লুত-

ইয়া আল্লাহ্, এত সুন্দর, এত চমৎকার পরিবেশ—

ইত্যাদি ইত্যাদি, আরও কত বিশেষণ যে জুড়লো।

ব্যাস বিপাশা হয়ে গেল আর্ট ইন্সটিটিউটের ছাত্র। ওদিকে চুটিয়ে নাটকও চলতে লাগলো। আউটডোরে ছবি আঁকা প্রজেক্ট করতে ঝামেলা হতো একটু কিন্তু সেটা সামাল দিত ওর বন্ধুরা। বিশেষ করে বিপ্লব সাহা, জাকির প্রমুখ। এই পড়াশোনাটা আসলে খুবই উপভোগ করেছে সেটা বুঝতাম তার আন্তরিকতা লক্ষ্য করে। তখন আসলে বিপাশার জন্য ছিল খুবই ব্যস্ত সময়, পড়াশুনা, নাটক দুটোই চলছিল সমান তালে। আবার নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়েও কাজ করছিল— অভিনয় করছে, আবার সেট ডিজাইনেও কাজ করলো।

পাশ করে বেরুলো এর মধ্যে। মাস্টার্স-এ ভর্তিও হলো। কিন্তু প্যাকেজের ব্যস্ততা এতই বেড়ে গেল যে— অন্য দিকে সময় দেয়ার মত সময় তার ছিল না বললেই চলে।

এমন সময় একদিন তৌকির এল আমাদের বাসায়। অবাক হইনি কেন এসেছে, কারণ চ্যানেল আই-এর সিরাজ একটু ইশারা দিয়ে রেখেছিল। সরাসরিই কথা হলো— তাদের বিয়ের ব্যাপারে প্রস্তাব দিল-আমাদের আপত্তি থাকার কোনো কারণ ছিল না। মেয়েকে ওই স্বাধীনতা আমরা দিয়ে রেখেছিলাম— নিজের জীবনসঙ্গী নিজেই পছন্দ করবে সে। ঘটনাটা আর পরিবারিক রইল না-কারণ বিপাশা-তৌকিরের জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে—‘চ্যানেল আই’ দায়িত্ব নিল, ঘোষণা দেয়ার ব্যবস্থা হলো মহাখালির একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। বিশাল সংবাদ সম্মেলনে দুই পরিবারের সকল সদস্যদের উপস্থিতিতে ফরিদুর রেজা সাগর এবং শাইখ সিরাজ ঘোষণা করলো বিপাশা-তৌকিরের বিয়ের সিদ্ধান্ত।

প্রবল করতালিতে সাংবাদিকবৃন্দ সেটাকে অভিনন্দিত করলেন। পরদিন সকল জাতীয় দৈনিকে প্রথম পাতায় খবর বেরুল। কদিন পর হোটেল শেরাটনে একটি ছোটখাটো অনুষ্ঠানে চূড়ান্ত হলো বিয়ের তারিখ। ১৯৯৯এর ২৩শে জুলাই, স্থান সেনাকুঞ্জ। দুই পক্ষ মিলে একটি অনুষ্ঠান হবে।

সেই দিনটিতে ঘটলো এক অচিন্তিত ঘটনা। আমাদের আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন প্রায় ২০০০ হাজার জন। কিন্তু উপস্থিত হলেন প্রায় হাজার পাঁচেক মানুষ, লোকে লোকারণ্য এক বিবাহ অনুষ্ঠান। খাবার টেবিলে সব আমাদের অপরিচিত ব্যক্তি। বিশেষ করে সৈনিকদের পরিবার ক্যান্টনমেন্ট থেকে চলে এসেছে দলে দলে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও এসেছে— শুধু তৌকির-বিপাশাকে একনজর দেখার জন্যে। তারা খাবার ব্যাপারে মোটেই উৎসাহী নয়, সে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা! news আর কি! আমাদের আমন্ত্রিত অতিথিদের অবস্থাও বিব্রতকর-খাওয়া তো দূরের কথা বসতেও পারছেন না তাঁরা। তখন উপায়ন্তর না দেখে আমরা তৌকির-বিপাশাকে বাসায় পাঠিয়ে দিলাম। তারপর ভিড় কমতে লাগলো— এদিকে অতিথিদের অনেকে এ অবস্থা দেখে ফিরে যাচ্ছিলেন। তারপর ভাঙ্গা হাট। যাঁরা ছিলেন তাঁরা কোনো রকমে আপ্যায়িত হলেন— কিন্তু নষ্ট হলো খাবার-আমন্ত্রিত যদিও দুই হাজার আমরা অতিরিক্ত আরও দু হাজার মানুষের ব্যবস্থা রেখেছিলেম। সেই বিয়েতে তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মাননীয় বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়াও ছিলেন আমন্ত্রিত। কিন্তু জনগণের ওই অবস্থার খবর পেয়ে তাঁদের কেউই এদিক মুখো হননি।

বিয়ের পর ওদের জনপ্রিয়তা কয়েক গুন বৃদ্ধি পেয়েছিল— ওরা তখন প্রায় মাসের তিরিশ দিন কাজ করতো— এবং যা রোজগার করতো তার প্রায় সবটাই খরচ করতো একটি যায়গায়। হ্যাঁ, আর সে যায়গটি ছিল গাজীপুরের চেনাসুখানিয়া গ্রামে একটি Resort তৈরি করার পরিকল্পনায়। প্রথমে আমরা একটু অবাকই হয়েছিলাম ওই অজপাড়াগাঁয়ে জমি কিনে হবেটা কী? বুঝলাম বেশ পরে, যখন রিসোর্টটির চেহারা ফুটে উঠতে লাগলো-নক্ষত্রবাড়ি রিসোর্ট। একজন স্থপতি, অন্যজন চিত্রশিল্পী (এর মধ্যে মাস্টার্সও পাশ হয়ে গেছে বিপাশার) মনের মাধুরী মিশিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললো-সুন্দর তো নিশ্চয়ই, তার চেয়ে বড় কথা— যায়গাটাকে আসলে একটি শান্তির নীড় বলা যায়। আমি যে কত কত দিন কাটিয়েছি ওখানে তার হিসেব নেই। গেলে আর আসতে ইচ্ছে করে না।

আসলে হয়েছে কি, কথা বলার দিক ঠিক রাখতে পারি না এখন, বিপাশার কথা লিখতে বসেছি— এদিক ওদিক চলে যাচ্ছি। দুঃখিত পাঠকবৃন্দ।

মেয়েটি আমার অন্তর্মুখী। ভাবুক। প্রকৃতিপ্রেমিক। সিরিয়াস পড়ুয়া, স্পষ্টভাষী, কাউকে বা কোনো কিছুকে ভাল না লাগলে সরাসরি বলে ফেলে। সে কারণে অনেকে হয়তো তাকে ভুল বোঝে।

ওর মনটা ভীষণ নরম। কোনো কিছুর প্রতি লোভ বলতে নেই এতটুকু পরিমানে। আজ অবধি কোনো কিছু চাইতে দেখিনি আমাদের কাছে। যা দিয়েছি, তাই সই। হয়তো দুবোনের জন্য দুটো এনেছি কোনো জিনিস-সব সময় নাতাশার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেছে—

তুমি আগে নাও।

নিজের সাজগোজ, পোশাক পরিচ্ছদের ব্যাপারে উদাসীন-কিন্তু সৃজনকর্মের প্রতি ভীষণ সিরিয়াস— নিষ্ঠাবান— পরিশ্রমী। একটি নাটকের চরিত্র সৃষ্টির জন্যে ওর যে প্রচেষ্টা মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যেতাম।

মা হওয়ার পর কাজ প্রায় বন্ধই করে দিল। কেন? না আমি যদি এখন কাজ করি তাহলে বাচ্চারা মায়ের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হবে। আসলেই দীর্ঘদিন সে অনুপস্থিত থেকেছে মিডিয়া থেকে।

আবার একটা সময় যখন দেখলো বাচ্চারা বেশ বড় হয়েছে— একটু একটু করে মিডিয়ার কাজে সময় দিতে শুরু করলো।

এ সমস্ত বিষয়ে তৌকির ওর যথার্থ জীবনসঙ্গী। ক্যাডেট কলেজের ছাত্র, অনেক গোছানো, কর্মঠ এবং পরিশ্রমী, কিন্তু শিল্পের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা। বিপাশার মত বইপড়ার পোকা। দুজনের রসায়নের অদ্ভুত ম্যাচিং বলতে হয়।

ওরা এক সময় প্রডাকশন হাউসও খুললো। টিভি নাটক করার জন্য। দুজনেরই থিয়েটার এবং নাটকের অভিজ্ঞতার আর লেখাপড়ার ব্যাকগ্রাউন্ডে ভালই কাজ করছিল— তখনই আবার সিনেমা বানাবার ইচ্ছা হলো তৌকিরের। আমেরিকায় গিয়ে একটি কোর্সও করে আসলো। শুরু হলো জয়যাত্রা। আমি তো ছিলামই, আরও অনেকেই, আমাদের মিডিয়ার অনেক স্বনামধন্য শিল্পীও অভিনয় করেছিলেন সে সিনেমায়, বিপাশা তো ছিলই।

হ্যাঁ, বিপাশার প্রথম সিনেমা কিন্তু হুয়ায়ুন আহমেদের আগুনের পরশমনি। তখনতো ছাত্র। আমরা প্রথমে দিতেই চাইনি। হুমায়ুনের আগে আরও অনেকে নামকরা পরিচালক ওকে নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেও আমরা একটি কারণেই রাজী হইনি যে, পড়াশুনার ক্ষতি হবে। তা ছাড়া মেইনস্ট্রিম সিনেমায় দিতেও চাইনি— আমি নিজেই তখন শত চাহিদা সত্ত্বেও চলচ্চিত্রে যাইনি ওভাবে।

হুমায়ুনের ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল। আমরা তখন হুমায়ুনের এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি, অয়োময়, ইত্যাদি আরও অনেক খণ্ড নাটক করে, একটা ঘরানা তৈরি করে ফেলেছিলাম-এবং সেই ঘরানার শিল্পী নিয়েই হুমায়ুন আগুনের পরশমনি তৈরি করেছিলেন-। শুটিংটাও যেন আমাদের ঘরোয়া আড্ডার মতই হয়েছিল— FDC-র একটা ফ্লোরে প্রতিদিন আমাদের শুটিং এর সাথে সাথে ঘরোয়া আড্ডা আর খাওয়া দাওয়া চলতো। মনেই হতো না যে আমরা কোনো সিনেমার কাজ করছি।

আরীব এবং আরীষা, ছেলে মেয়ে দুটোকে নিয়ে তাদের সংসার আর মিডিয়ার কাজ, সঙ্গে বিপাশার দেশে বিদেশে নানান চিত্র প্রদর্শনী নিয়ে ভালই চলছিল— এ সময় তারা সিদ্ধান্ত নিল যুক্তরাষ্ট্রে খুঁটি গাড়বে। ওদের কাজেকর্মে সুন্দর সময় কাটছে এখন ওখানে। ছেলে মেয়েদের নিয়ে নিয়মিত আসা যাওয়া করছে দেশে।

ছেলে আরীব (২১) পড়ে স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ে, ইংরেজি সাহিত্যে দ্বিতীয় বর্ষ। ফুটবল-পাগল সেই ছোটবেলা থেকে, এখনও খেলে সুযোগ পেলেই। মা-বাবার মত বই-এর পোঁকা। ভিডিও গেম নিয়েও প্রচুর নাড়াচাড়া ওর। সহজ সরল জীবন যাপন পছন্দ।

মেয়ে আরীষা (১৮) দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী, আগামী বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকবে ইনশাল্লাহ। মায়ের মতই অন্তর্মুখী স্বভাব, কিন্তু বুদ্ধিমত্তায় টনটনে। ছিমছাম থাকা ওর পছন্দ, সিনেমা দেখতে ভালবাসে-প্রায় অবসরে মার সঙ্গে বসে সিনেমা দেখাটা ওর নৈমিত্তিক এখন। ক্লাসের রেজাল্টের জন্য প্রায়ই প্রশংসাপত্র আসে বাবা-মার কাছে। নাচ শিখছে, আর আঁকার হাতও চমৎকার!

ছানার কথা হলো, এবার পোনার কথা বলি। নাতাশা। আগেই বলেছি— ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ ধানমন্ডির ১৩-এ রোডের ডা. ওদুদ এবং ডা. সুফিয়ার ক্লিনিকে তার জন্ম। সেদিনও আমার মহিলা সমিতিতে শো ছিল। ভাগ্যের চাবিকাঠি নিয়ে এসেছিল আমার জন্য। চাকরির উন্নতি!

ছোটরা যেমন হয়, ও তার ব্যতিক্রম নয়। একটু উচ্ছল, বেশ উদ্যমী সব ব্যাপারে। বিপাশার বিপরীত, বহির্মুখী স্বভাব। চঞ্চলও বটে। নিজের ভাগ বুঝে নেবার বেলায় কোনো কসুর করে না। আর এখন এই বয়সে আমাদের ওপর খবরদারী পুরাদমে চলে। আমরা নাম রেখেছিলাম— বিপাশার সাথে মিলিয়ে। বিপাশার হলো শারমীন হায়াত-ওর রেখেছিলাম আফরীন হায়াত। SSC পরীক্ষার ফরমে দুজনই নাম পাল্টে ফেলে-এক এক জন এক এক ধরনের। এতেই বোঝা যায় ওদের মানসিক অবস্থান— শারমীন হায়াত বিপাশা হলো বিপাশা। আর ছোটজন করলো কি? নাতাশা হায়াত, ব্যাস। আফরীন চিরকালের জন্য গায়েব!

আমার ওয়াসাতে এক বামপন্থী বন্ধু ছিল। ইকবাল হোসেন, এখন যে প্রয়াত। নাতাশা নামটি তার স্ত্রী চুনি ভাবী দিয়েছিলেন-বিপাশার বোন হবে নাতাশা। তাই সই। মেনে নিয়েছিলাম আমরা। চোদ্দ মাস বয়সে লিবিয়া গেল আমাদের সাথে। আমি চলে যেতাম কাজে, বিপাশা একা একা প্রকল্প এলাকায় ঘুরতো আর নাতাশা মায়ের পায়ে পায়ে জড়িয়ে থাকতো। একটু বড় হওয়ার পর-বালি নিয়ে খেলাটা ছিল ওর অতি প্রিয়, বাগানে আমাদের একটা পানির কল ছিল— ওই কলতলাটা খুবই প্রিয় তার-বেশিরভাগ সময় ছোটছোট হাঁড়ি পাতিল নিয়ে বালি আর পানি নিয়ে খেলতো আর মাঝে মাঝে এদিক ওদিক দেখে ঝপ করে এক মুঠো বালি দিয়ে দিতো মুখে— আমরা যদি কখনো দেখে ফেলে চিৎকার দিতাম-

কী হচ্ছে নাতাশা?

আমি বালি খাইনি।

এই ছিল ওর উত্তর।

লিবিয়ায় বিপাশা মাসখানেকের মধ্যে ওর সমবয়সী এক বান্ধবী পেয়েছে প্রজেক্টেই, কিন্তু নাতাশা বেচারা তাতে হয়ে গেল আরও একা।

সহকর্মী প্রকৌশলী আজিজের স্ত্রী লাবন্য রেখা এল ক’দিন পর। নিঃসন্তান তারা, বেশ কিছুদিনের বিবাহিত জীবন যদিও, তাদের একটা দুঃখ ছিল এ নিয়ে। শিরী নাতাশাকে শিখিয়ে দিল লাবন্যকে ‘মা’ ডাকতে। তখন থেকে লাবন্য (পেশায় একজন ডাক্তার, বর্তমানে ফ্লোরিডার বাসিন্দা) হয়ে গেল নাতাশার তায়িজ মা। আজিজ বলতে পারতো না, বলতো তায়িজ মা।

প্রকৃতির কি খেলা বছর না ঘুরতেই লাবন্য মা হলেন। নাতাশার একটা খেলনা হলো সেই পিচ্চি। সেই পিচ্চি আদনানের বিবাহের ২৫ বছরের দাওয়াত খেতেই ২০২৩-এ গেলাম ফ্লোরিডা, লিখেছি আগে।

দেশে ফিরে এলাম ১৯৮১ ডিসেম্বরে। নাতাশা ভর্তি হলো মালিবাগের কিন্ডার গার্টেন মনি মুকুরে। পরে গেল ভিকারুননিসাতে। সেখান থেকে SSC, HSC.

পড়াশোনার ব্যাপারে কারো কথা শুনতো না। গান শোনার রোগ খুব। ইংরেজি, হিন্দি গানের পাগল ছিল এক সময়। বিপাশার সাথেই নাচের স্কুলে ভর্তি হলো। সম্ভবত ৮৮-র দিকে আমার পরিচালনায় নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের নাটক বিসর্জনে রাজা গোবিন্দমানিক্যের পুত্রের চরিত্রে অভিনয় দিয়ে শুরু নাটকে অভিনয়।

অভিনয় করার মত ধৈর্য নেই ওর। অথচ ভীষণ স্বতস্ফূর্ত অভিনয় করে। আমি তো প্রায় জোর করেই ওকে দিয়ে, কয়েকটি কাজ করিয়েছি— ও দোনোমনো করে করেছে সেগুলো-এবং আশ্চর্য ব্যাপার-সবগুলোতেই দারুণ অভিনয় ছিল তার। BTVতে আমার লেখা বন্দী নাটকে অসাধারণ অভিনয় করে সাড়া ফেলেছিল— তখন তার বয়স ছিল বোধহয় ১০ কি ১১। ওই যে বললাম, বিপাশার একবারে বিপরীত— পোশাক আশাকের ব্যাপারে টনটনে। ফ্যাশন পছন্দ— দেখি সে স্কুল জীবন থেকে জামা কাপড় বানানোতেও উৎসাহী। একবার বোধহয় তখন কলেজে পড়ে মায়ের কাছে থেকে হাজার বিশেক টাকা ধার নিয়ে বেশ কিছু মেয়েদের কামিজ বানিয়ে বাসার Drawing room-এ Exhibition করেছিল— আর দাওয়াত দিয়েছিল আত্মীয়স্বজনদের। দ্রুতই বিক্রি হয়ে গেল সবগুলো পোশাক।

স্কুলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লিডিং রোল তার। সে বেশ ভাল সংগঠক তখন থেকেই। কিন্তু ওর মায়ের হাজার অভিযোগ তার পড়াশুনার ব্যাপারে।

আমি আমার মতো পড়ি, তোমাকে বলতে হবে না।

আসলেই কখন যে গান শোনে, কখন computer নিয়ে কাজ করে, আর কখন পড়াশোনা করে-এ নিয়ে ওর মা বিভ্রান্ত।

তার ওপর আবার নাগরিকেও যাতায়াত চলছে— নাচের স্কুল আছে। একটা মারদাঙ্গা অবস্থা। প্রাইভেট টিচারের বাসায় যাওয়া, আসা-সে আর এক ধুন্ধুমার কারবার, ড্রাইভার তো ছিল না, আমিই শত ব্যস্ততায়ও এ কাজটা করতাম, কোনো কারণে না পারলে বেচারি শিরী রিকশায় ওদের নিয়ে ছুটতো।

এসে গেল SSC পরীক্ষা। শিরীর ব্লাড প্রেশার গেল বেড়ে। এটা ওর মেটাবলিজমের বিষয়। বিপাশার SSC Result-এর সময় হঠাৎ হার্টবিট ওঠা নামা শুরু করল কোনো নিয়ম ছাড়া। বিট ড্রপ শুরু হলো— যত রেজাল্টের দিন কাছে আসতে লাগলো। আবার সব ঠিক হয়ে গেল রেজাল্ট বের হবার পর।

এবারও তাই, কোথায় যেন শিরী খবর পেল নাতাশার SSC Result বেরিয়েছে। পত্রিকা অফিসে গেলেই খবর পাওয়া যাবে, বললাম কালতো পেপারে পাবো, না আজকেই জানতে হবে।

কাকে জিজ্ঞেস করি? হঠাৎ মনে পড়ে গেল মতিউর রহমানের কথা। আমার সেই মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সহযাত্রী মতিউর। তখন সে ভোরের কাগজের সম্পাদক। ফোন করে নাতাশার রোল নম্বরটা দিলাম-

দেখতো ভাই রেজাল্টটা কি? তোমার ভাবির তো প্রেসার উঠে গেছে। মতির কাছ থেকে উত্তর আর আসে না। এদিকে প্রেসার উঠছে শিরীর। আমি আবার ফোন করলাম। হ্যাঁ, হায়াত ভাই, নাতাশার রোল নম্বারটা কত? ঠিক বলেছেন তো?

ঠিকই তো বলেছি আশা করি।

নম্বর আবার মিলিয়ে নিলাম।

এরপর মতি একটা বিরাট হাসি দিয়ে বলল-আপনার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল পরীক্ষা খুবই খারাপ হয়েছে। আপনার মেয়ে তো ৬টা লেটার নিয়ে স্টার পেয়েছে।

আসলেই তাই, প্রায় ৮৬০-র কাছাকাছি টোটাল ছিল ওর SSC তে।

এরপর থেকে ওর পড়াশুনার ব্যাপারে শিরী আর উচ্চবাচ্য করতো না। HSC-র বিষয় বাছাই-এর সময় বললাম ৪র্থ বিষয়টা কি নেবে?

তোমরা বল।

তুমি তো বিজ্ঞানের ছাত্র ইঞ্জিনিয়ারিং-এ সুযোগ থাকছেই— বায়োলজি নাও, তাহলে ডাক্তারির একটা সুযোগও থাকবে, বংশে একজন ডাক্তার নেই, তুমি না হয় ডাক্তার হলে? ক’দিন পর বলল-ডাক্তারি পড়বে না। computer science নিল। ভাল। এবার HSC তেও স্টার নম্বর নিয়ে, পাশ হলো।

আবার বেঁকে বসলো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে না।

তাহলে কি পড়বে?

ইকোনোমিকস।

বেশ।

আসলে আমরা কোনোদিনই ওদের দুই বোনকে জোর করিনি কিছুতেই।

শুধু ইচ্ছাটিই প্রকাশ করেছি আমাদের।

নর্থ সাউথে পড়বে সে, ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ভাল করেছে ফল-বি.বি.এ.তে ভর্তি হলো। গ্রামীণ ফোনে পার্ট টাইম চাকরিও শুরু করলো। গাড়ি চালানো শিখলো-বিপাশা ও চারুকলায় পড়ার সময়ই গাড়ি কিনলো লাক্সের বিজ্ঞাপনে করে-তখনই ড্রাইভিংও শিখে নিয়েছিল।

যাই হোক শেষ পর্যন্ত বেশ ভালো Result করে পাশ করলো (GPA-3.55) গ্রামীনেই ঢুকলো চাকরিতে। এর মধ্যে দু’চারটে নাটক জোর করেই করিয়েছিলাম আমি। তার মধ্যে আনিসুল হকের লেখা একটি নাটক, শাপলুডুতে শাহেদ শরীফ খানের সাথে জুটি বেঁধে করেছিল। ওখানেই ওদের পরিচয়।

ওই যে অস্থির প্রকৃতির ছিল একটু— চাকরি বদল হলো দু’-একবার। একদিন বিপাশা বললো শাহেদের সাথে সম্পর্কের কথা-ওর বাবা মা এলেন প্রস্তাব নিয়ে। ২০০৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বিডিআর দরবার হলে হয়ে গেল বিয়েটা।

এক সময় আমরাই বললাম মাস্টার্সটা করো।

করবো কিন্তু MBA না। মার্কেটিং ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স করবো।

করো।

দেশে করবো না।

এটাই ওর ধরন। ইংল্যান্ডে যোগাযোগ করে ফেলেছে এর মধ্যে।

এই পড়ার জন্য ভাল একটা অর্থকরী ব্যাপারও তো আছে। ওর মা বললো-আমার কিছু জমানো আছে— দিয়ে দেব, দেখ হয় কিনা। হয়ে গেল তাতেই। ওর BBA result এবং কাজের অভিজ্ঞতা দেখে Middlesex University ওকে ভর্তি ফিতে ৫০% ছাড় দিল। সেখানে Academic merit নিয়ে পাশ করে এসে যোগ দিল Radio ফূর্তিতে। কিছুদিন পর সেটাও ভাল লাগলো না। চলে গেল Warid telecoms-এ, এর সাথে আবার সেই পুরোন শখটা জেগে উঠলো— বুটিক শপ করবে, করলো-বিপাশা, নাতাশা আর টিনা (ওর বান্ধবী) তিনজন মিলে।

চলতে লাগলো দুটোই, সময় এগোচ্ছে, জীবন বদলাচ্ছে। দুই সন্তনের মা হলো— শ্রীষা আর শাবীব। বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে গিয়ে ভাবলো, চাকরি করা আর বাচ্চা সামলানো যথার্থ হবে না। দিল ছেড়ে চাকরি। আবার যখন এদিকটা সামলে উঠলো, যোগ দিল East West university তে অধ্যাপনায়। বুটিকটাও তেমন সুবিধার হলো না, নানান কারণে। অধ্যাপনায়ও চরম বিরক্ত ছাত্রদের মেধার দৌড় দেখে।

আব্বু এদের পড়াবো কি? এরা তো বুঝে না কিছুই।

বুঝলাম ওর ওই ধৈর্য নেই। সুতরাং দু’দিন পর ইস্তফা।

আবার লেগে পড়লো বুটিক নিয়ে Irises designer studio-র নতুন রূপে। পার্টনার পরিবর্তন হলো। ওর সাথে লোপা। মেয়ের বান্ধবীর মা। খুবই ভাল মেয়েটা— আমাদের তো ভীষণ পছন্দ। এ পর্যন্ত পাঁচটা স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি হয়েছে— এখন আবার একটার পড়া শোনা চলছে। এখন নাতাশা থিতু বলা যায়। বড় ফ্যাক্টরি করেছে। বনানীতে outlet সুন্দর করে সাজানো পশ এলাকায়। দেশে বিদেশে চেনে ওর বুটিক। দু’টি সন্তান ওদেরও। শ্রীষা পনের, ক্লাস এইটে এবার, ছিমছাম সুন্দর জীবন ওর পছন্দ। সব ব্যাপারেই ছিমছাম ও। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে ভীষণ বাছবিচার-মাছ-মাংস পছন্দ নয় একেবারেই। বাস্কেট বল খেলে, বাড়িতে অবসরে সিনেমা দেখে পরিবারের সাথে। ছেলে শাবীব, বাবার মতই নায়ক সাজতে পছন্দ তার। এবার সিক্সে উঠলো। বয়স তের। বাস্কেট বল, ফুটবল আর ভিডিও গেম খুব পছন্দ। বড় বাস্কেটবল খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে। ছেলে মেয়ের পড়াশোনায় নাতাশা-শাহেদ সিরিয়াস। শাহেদ নাটকে অভিনয় ছাড়াও নানান রকম ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে ট্রায়াল এ্যান্ড এররে কাজ করে। আমার কেন যেন মনে হয় ওর যে quality সেই অনুযায়ী মিডিয়াতে সুযোগ আর স্থান হয়নি শাহেদের। মার্কেটিং-এ মাস্টার্স করা সুপুরুষ-মডেল হিসেবেই মিডিয়ায় আগমন-দেখা যাক শেষ পর্যন্ত অভিনেতা থাকে নাকি পরিচালনায় লেগে যায়। পরিচালনার ব্যাপারে ভীষণ ন্যাক আছে ওর, আমি ওর একটা কাজে ছিলাম। ভাল লেগেছিল। বেশ উদ্ভাবন শক্তি দেখেছি ওর মধ্যে।

এই হলো আপাতত আমার ছানাপোনার গল্প। জানি না আমার জীবন কাহিনির বর্ণনা দিতে গিয়ে ওদের নিয়ে বিশেষ চ্যাপ্টার প্রাসঙ্গিক হলো কিনা। তারপরও মনের কথা বলার ইচ্ছা দমন করা কঠিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *