২.৭ কোজাগরী পূর্ণিমা পড়ে গেল কার্তিক মাসে

পুজো গেল। কোজাগরী পূর্ণিমা পড়ে গেল কার্তিক মাসে। আকাশে রং লেগেছে হেমন্তের। শরতের সোনায় পাক ধরে যাওয়া কেমন যেন গোলাপি আভা লেগে গেছে রোদে। হালকা বাতাস বইছে মাঝে মাঝে উত্তর থেকে। হিমালয়ের বাতাস, হেমন্তে পূর্বাভাস দিচ্ছে শীতের।

মেঘনাদ বেরুবার জন্য অপেক্ষা করছে। রাজীব আসবে। লীলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেখছে। তিলি আর সুকুমারী গেছে গঙ্গায় স্নান করতে। নকুড় বসে আছে বড় ঘরে। ষোড়শী একলাই রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত। লীলা শুয়ে শুয়ে দেখছে মেঘনাদকে। দেখছে সিরাজদিঘার সেই পাগলা বাতাস ছুটে এসেছে এখানে। মেঘনাদ মত্ত হয়ে উঠেছে। আপন মনে হাসছে, ভু কোঁচকাচ্ছে। চলতে ফিরতে হঠাৎ কখনও আদরও করছে লীলাকে। এমনকী হাঁকডাকও শুরু করেছে সিরাজদিঘার মতোই। লীলা বুঝতে পারে, এ সব কিছুর মধ্যেই এক নতুন আনন্দ নতুন ফুর্তি আছে। এক নতুন উদ্যম ও নতুন প্রেরণার বশে সে দিবানিশি আচ্ছন্ন।

লীলা যে ঠিক পদে পদে মেঘনাদের পরাজয় নিরাশা আর গ্লানি চেয়েছে, তা নয়। তবু, মেঘনাদের এই আশার উচ্ছ্বাস, আনন্দ কেন যেন তার রক্তে কেবলই জ্বালা ধরায়।

চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিনচৌ-এর করুণ চোখ দুটি। কী ব্যাকুলতা সেই চোখে। তেমনি করে মেঘনাদ একদিনও ফিরে তাকায়নি তার দিকে। বিনচৌও ছোট কারবারি নয় কিন্তু পুরুষ হিসাবে মেঘনাদ আর সে কত তফাত। বিনচৌ চাইতে পারে, টানতে পারে, ডাকতে পারে। একটু পাওয়ার জন্য লুটিয়ে পড়তে পায়ে পায়ে।

আর মেঘনাদ। কাজ ও উদ্যোগের এক বিশাল যন্ত্র। ফাঁক পেলে, প্রেমের ভারে চটকে দলা পাকিয়ে দিয়ে যায়। তা ছাড়াও তিলির কাছে, এ বাড়ির মেয়েদের কাছে বিনচৌ-এর সম্পর্কে অদ্ভুত গল্প শুনেছে সে। শুনেছে, বিনচৌ নাকি তার বউয়ের সঙ্গে কথা বলে না, বেরোয় না। তাদের মুখ দেখাদেখি নেই। বিনচৌ-এর বাড়ির ঠাকুর চাকরের কাছেই নাকি তারা শুনেছে। কী একটা আছে, কে জানে। বড় আশ্চর্য ! আগুরিদের মুক্তই তো বলেছে, বিনচৌ-এর বিবির সঙ্গে নাকি বিনচৌ-এর বিয়েই হয়নি। দিল্লি থেকে চুরি করে নিয়ে এসেছে। সে বিবি এখন বিনচৌকে তার ঘরেই ঢুকতে দেয় না।

তবে সবাই বলেছে, দেখতে কিন্তু বেশ।

কত বেশ ! বেশ ! মনসার রক্তে রক্তে বিষ বিস্তার হয়েছে। লীলা তার কালো রূপের কথা জানে । যৌবনের স্পর্ধা তার বড় বেশি। আর, রক্তে রক্তে তার কৌতূহল বিনচৌ-এর জন্য। সেই তো সেই চোখ, ভিক্ষুকের প্রাণঢালা সরলতা। ভয়ই বা কীসের।

লীলা শুনেছে, বিনচৌ-এর বউ বাইরে গেছে। ঠোঁটের কোণ কুঁকড়ে ওঠে লীলার। মনে হয়, বিনচৌ-এর ঢুলু ঢুলু চোখ যেন তার দিকে তাকিয়ে বলছে, তোমারি জন্য, তোমারি জন্য।

মেঘনাদের দিকে তাকাল সে। সংবিৎ নেই যেন মানুষটির। দাঁড়িয়ে আছে সোজা। সারামুখে ভাবনা ভরা। চুলগুলি অনেক বড় হয়েছে। সিংহ কেশরের মতো পাকিয়ে পাকিয়ে পড়েছে ঘাড়ে । লাউডগার মতো এসে পড়েছে কপালের দিকে। গোঁফজোড়ার শেষাংশ ঢেউ খেলে গেছে পাকিয়ে। যেন যাত্রার দলের রাজা।

হঠাৎ লীলা কাত হয়ে, জামা ধরে টানল তাকে। একটু জোরেই টেনেছে। মেঘনাদ সরে এসে, তাকাল তার দিকে। স্থির দৃষ্টি লীলার।

কী ভাবছ?

মেঘনাদ বলল গভীর চিন্তিত স্বরে, বিপিনদার চিঠি কেন এল না, তাই ভাবছি।

লীলা অবাক হয়নি। মনটা মিইয়ে গেল। বলল, বোধ হয় মরে গেছে। মরে গেছে? মেঘনাদ বিস্মিত ব্যথায় চমকে উঠল। বলল, কেন, মরবে কেন?

লীলা হেসে উঠল, তোমার জন্য মরতেও পারবে না নাকি?

মেঘনাদ বলল, বিপিনদা মরে যাবে, এ কথা ভাবতে পারিনে মহাজনগিন্নি।

মহাজনগিন্নি ! ওই নামে কারখানার সবাই ডাকত। মেঘনাদ আদর করে ডাকত ওই নামে।

লীলার ঠোঁট বেঁকেই উঠল। বলল, তা হলে বাজারের সেই বেশ্যেটা নিয়ে এখন কতার ভিটেয় সুখে আছে। আর জবাব দিতে মন চাইছে না।

এমন সময় নকুড়ের ডাক ভেসে এল, বাবাজি এসো। রাজীবঠাকুর এসেছেন।

মেঘনাদ উঠে পড়ল। বালিশের তলা থেকে, ঠোঙায় পোরা একরাশ টাকা বার করে পকেটে নিল। লীলা বলল, কোথায় যাচ্ছ?

লীলার কথায় মনটা খারাপ হয়ে উঠছিল মেঘনাদের। নতুন দিনের ডাক এসে পড়ল। মন খারাপ করতে পারল না। বলল, আজ যে মেশিন কিনব।

বেরিয়ে গেল সে। সেইদিকে তাকিয়ে অবশ হয়ে পড়ে রইল লীলা। হঠাৎ বিনচৌ, রাজীব, সকলের উপরেই বিদ্বেষের একটা ঝিলিক দিয়ে উঠল তার মনে।

রাজীব বলল, বিনয়দার কারখানায় যেতে হবে।

মেঘনাদও তাই চাইছিল। যন্ত্রটি আবার দেখে আসা হবে। আপাতত যন্ত্রটি বিনয়ের কাছেই থাকবে। মেঘনাদের ঘর উঠলে আনা হবে। তা ছাড়া রাখবার জায়গা কোথায়।

নকুড় বলল, একটু আস্তে আস্তে যেতে হবে কিন্তু। আমিও যাব। ১৪৪

রাজীবের ভ্রূ দুটি কুঁচকে উঠল। দেখল মেঘনাদের মুখের দিকে। মেঘনাদ খুশি হয়ে বলল, যাবেন বইকী! চলুন, আস্তেই যাব।

নকুড় চলতে চলতে আপনমনেই বলল, যেতে হয়, বুঝলে বাবা! আজ বড় আনন্দের দিন কি । তোমার বাবা থাকলে

কথাটা শেষ হল না। মনে মনে বলল, আর কি সুযোগ আছে কিছু! আর কি সময় আছে। আশা আছে! কী যে মরীচিকা। কিছুতেই চুপচাপ বসে থাকা যায় না।

বিনয় প্রস্তুত হয়েছিল। আরও দু জন লোক ছিল তার অফিসে। টাকাটা গুনে দিল রাজীব বিনয়ের সামনে। স্ট্যাম্পকাগজে সই করে দিল দু জনেই। সাক্ষী হিসাবে সই করল নকুড় আর রাজীব।

তারপর আবার যন্ত্রটি দেখতে গিয়ে মনটা ভরে উঠল মেঘনাদের। তবু বুকটার মধ্যে খচখচ করতে লাগল। তারই জিনিস, কিন্তু জায়গার অভাবে নিয়ে যেতে পারবে না। নকুড় বলল, তা হলে একবার বাড়ি গিয়ে ঝুমি ওদের পাঠিয়ে দিতে হয়। মেঘনাদ বলল, কেন? কেন কি বাবা ! তুমি সা ঘরের সন্তান। কারবারের দস্তুর। তেল সিঁদুর দিয়ে, ঘরের লক্ষ্মীকে নমো হয়ে বরণ করতে হবে তাকে।

ব্যবসার মধ্যে লৌকিক আচারটা কোনওদিনই রপ্ত করতে পারেনি মেঘনাদ। আপত্তি করল না সে। কেন-ই বা করবে। বলল, বেশ তো। আপনি তা হলে বলুনগে ওদের, ওরা আসুক।

তাই যাই।

লাঠি ঠক ঠক করে চলল নকুড়। তার মনে প্রাণে যেন হঠাৎ নতুন বল এসেছে। মনে মনে ভাবছে, চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। থাকতে হবে সঙ্গে সঙ্গে। থাকতে থাকতে মিশে যাবে। কাজে। কাজের মধ্যে থাকলে তার কি কোনও প্রতিদান সে পাবে না। কোনও নতুন রাস্তাই কি খুলবে না চোখের সামনে।

মেঘনাদের মনের পালে বাতাস লেগে গেছে। সত্যি, আজ তার বাবা বেঁচে থাকলে কী করত ! তার সেই ছেলে মেঘু, আজ মেশিন কিনল। অনন্তীর ঘাটে শেষ বিদায় দিয়ে আর তো দেখা হয়নি বাবার সঙ্গে।

তার মুখের দিকে তাকিয়ে রাজীব আর বিনয় চোখাচোখি করতে লাগল। কারখানার মেয়েরা কাজের ফাঁকে ফাঁকে দেখছে এদিকে তাকিয়ে। কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। তাদের সদার নাগাই চিৎকার করে হুকুম দিচ্ছে, হাত চালাও মাগিলোগ, হাত চালাও, হাত চালাও।

চটকলের লরি এসে পড়ল ফেঁসো নিয়ে। বিনয় গেল, দেখতে।

আধঘণ্টা পরেই এল সবাই। সকলের আগে তিলি, তারপর লীলা। সুকুমারী। লীলার সঙ্গে আবার ভাব হয়েছে সুকুমারীর। তবে একটি ফাঁক যেন কোথায় থেকেই গেছে।

ব্যাপার দেখে কাজ প্রায় সব বন্ধ হয় কারখানার। নাগাই চিৎকার করেই চলেছে।

তিলির হাতে পেতলের রেকাবি। রেকাবিতে ধান দুর্বা সিঁদূর পান সুপারি । পেতলের ছোট একটি ঘটে জল। ব্রত নয়, পুজো নয়, এ শুধু বরণ।

লীলার প্রথম চোখ পড়ল বিনয়ের উপর। দাঁড়িয়েছিল লরির পাশে। চোখাচোখি হতেই, বিনয় ঢুলু ঢুলু চোখে হেসে বিচিত্রভাবে ঘাড় নোয়াল। লীলা রানির মতো সোজা যেতে যেতে তাকাল চোখের কোণ দিয়ে। ভু কাঁপাল, হাসল ঠোঁট টিপে। পাশ থেকে তিলি শুধু বলে উঠল চাপা গলায়, দেখিস একেবারে লটকে পড়িসনে।

লীলা বলল, পড়বই তো।

মেঘনাদ তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল। তার খুশি দেখে লীলার ঠোঁট কুঁকড়ে উঠল।

মেঘনাদ বলল, এসো যন্ত্র দেখবে।

তিলি বলে উঠল, বউটিকে ডেকে তো দেখাচ্ছ। তা বরণের কথা কি একবারও মনে পড়েনি কাল? কথা নেই বার্তা নেই উপশান্তর গিয়ে সব হাজির।

সুকুমারী ঘোমটা টেনে বলল, ও-সব কি ওর মনে রাখার কথা। ঘরের মেয়ে-বউরাই সে-খবর রাখে।

রাজীব দেখছিল তিলিকে। মাঝে মাঝে লীলাকে, লীলার দিক থেকে দূরে বিনয়কে আর সামনে মেঘনাদকে দেখছে। কিন্তু তিলির সঙ্গেই চোখাচোখি করতে চাইছে।

তিলি তা জানে। সদ্য গঙ্গা স্নান করে এসেছে সে। চুল এলানো। ধোয়া জামা পরা। সে জানে, রাজীব তাকিয়ে আছে তার দিকে। কিন্তু একবারও তাকাতে ইচ্ছে করছে না।

সবাই এল গুদামঘরে। মেঘনাদ যন্ত্র দেখাল। সুকুমারী অবাক হয়ে বলল, ঝুমি, চান করিসনি সকালে?

লীলা ঘাড় নাড়ল। সুকুমারী হতাশ হয়ে বলল, তা হলে? কাপড় ছেড়েছিস সকালে?

লীলা বলল, ভ্রু কুঁচকে, তা ছেড়েছি। কিন্তু কেন?

সুকুমারী বলল, ও মা! বরণ তো তুই করবি।

লীলা চকিতে একবার রাজীবকে দেখে অবজ্ঞাভরে ফিরে তাকাল মেঘনাদের দিকে। মেঘনাদ তার দিকেই তাকিয়েছিল।

রাজীব হেসে বলল, অভাবে নিয়ম নাস্তি। হয়ে যাক এইভাবেই। গঙ্গা জল ছিটিয়ে একটু শুদ্ধ করে নেওয়া যাক।

সুকুমারী আর একবার ঘোমটা টেনে ফোগলা দাঁতে সলজ্জ হেসে বলল, তা বটে। বামুন রয়েছে কাছে। দে ইমি, রেকারি দে ঝুমির হাতে।

লীলা আবার ভু কুঁচকে তাকাল মেঘনাদের দিকে। ভাবখানা, এ সবও আমাকে দিয়ে?

রেকাবি নিল সে হাতে। সুকুমারী বলল, গায়ে তেল সিঁদুর দে, ধান-দূর্বা, পান-সুপারি দে, গঙ্গাজল দে। বল, আমার ঘরে তুমি ধন-দৌলত দাও, লক্ষ্মী ছিরি দাও, সুখ শান্তি পুত্র কন্যা দাও। তোমাকে আমি বরণ করে ঘরে তুলোম। যেন জন্ম জন্ম তুলতে পারি।

লীলা মন্ত্রের মতো বলে গেল মনে মনে। তেল সিঁদুর ধান-দূর্বা দিল। সুকুমারী বলল, গলবস্ত্র হয়ে পেন্নাম কর।

লীলা হেসে উঠে তাই করল। সুকুমারী লু লু করে উলু দিয়ে উঠল।

মেঘনাদের মনে হল, কীসের একটা তীব্র স্রোত কলকল করে তার বুকের থেকে ফেটে বেরিয়ে আসছে চোখ দিয়ে।

মনে মনে বলল, জন্মে জন্মে নয়, যেন এ জন্মেই অনেক, অনেক যন্ত্র তুলতে পারি। এক সঙ্গে মিলে সেই যন্ত্র উচ্চরোলে মাতিয়ে তুলবে শহর।

কারখানার মেয়েরা কাজ করবে কি ! তাদের সর্দার নাগাইও অবাক হয়ে এ-দৃশ্য দেখছে।

 বিনয় এসে সামনে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণ। সুকুমারী বলল, ঝুমি, এনারা বামুন। পেন্নাম কর, আশীবাদ চা।

 লীলার চোখের চকিত বিদুৎ খেলে গেল বিনয়ের মুখে। এক মুহূর্তের জন্য বিনয়ের মন এলোমেলো হয়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য এ সমস্ত পরিবেশ তার বুকের এক অন্ধ গুহায় খোঁচা দিল। সে বলতে চাইল, থাক থাক। পারল না।

লীলা তাকে প্রণাম করল পায়ে হাত দিয়ে। অপ্রতিভভাবে শুধু হাসল বিনয়। সে সোজাসুজি তাকাতে পারল না লীলার মুখের দিকে।

তারপর রাজীবের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও প্রণাম নিতে হল।

একে একে তিলি সুকুমারীও প্রণাম করল। ব্রাহ্মণ নমস্য। কিন্তু অবাক হল সুকুমারী মেঘনাদকে দেখে। সে শুধু হাঁ করে দেখছে। সা বংশের ছেলে। এমনদিনে ব্রাহ্মণের পায়ে হাত দিচ্ছে না ! নকুড় হলে এতক্ষণে ব্রাহ্মণের পায়ে গড়াগড়ি দিত।

সুকুমারী না বলে পারল না। এমন দিনে নইলে পাপ হবে যে ! বলল, বাবা মেঘু, তুমিও এনাদের আশীর্বাদ চাও বাবা। নিজের গাঁয়ে ভিটার হলে আজ সারা গাঁয়ের বামুনকে ঘুরে ঘুরে পেন্নাম করতে হত।

সংবিৎ ফিরে পেল যেন মেঘু। কিন্তু কই, সিরাজদিঘার শুরুর দিনে তো কাউকে সে প্রণাম করেনি ঘুরে ঘুরে। হয়তো লালমিঞার সাকরেদ ছিল বলে। শাশুড়ির কথা রক্ষার্থে এগিয়ে এল সে। 

সে এক বিচিত্র দৃশ্য ! বিশাল দেহ কুঞ্চিত কেশ মেঘনাদ যেন সাকার্সের শিক্ষিত সিংহের মতো এগিয়ে এল। আর বিনয় ও রাজীবের মুখ দুটো আড়ষ্ট হাসিতে অন্ধকার। দুই ব্রাহ্মণ পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে, প্রায় লাফিয়ে উঠল, আরে না না, ছি ছি…।

উবু হওয়া আর হল না। প্রণাম হল আধখ্যাচড়া। চিৎকার শোনা গেল বিজয়ের। সেও এসে পড়েছে ততক্ষণে। বোধ হয় কারখানা থেকে বাড়ি গিয়েই সোজা এসেছে।

সকলের ব্যস্ততার ফাঁকে রাজীব বলল তিলিকে, ব্রাহ্মণের দক্ষিণাটা পাওনা রইল।

তিলির চোখে সেই একই মিঠে বিদ্রুপের হাসি। যে হাসিতে প্রতিপক্ষের লাগে আমেজ।

মেঘনাদ তখন বিজয়কে মেশিন দেখাতে ব্যস্ত। বিজয় খুঁটিয়ে দেখল। একজন ওস্তাদ মিস্তিরির মতো ঝুঁকে পড়ল সে মেশিনের উপর। মিসিং-এর গোল হ্যান্ডেল ধরে ঘোরাতেই কয়েক পাউন্ড ওজনের পাথরের দুটি চাকা পরস্পর দু দিকে ঘুরে গেল। বিজয় বুঝে নিল, ওর চাপেই ময়দা ঠাসা হয়। কিন্তু এক সঙ্গে সাজানো থাকা সত্ত্বেও পাশের মেশিনটি অনড়। তারপর..এটা…এটাকে কী যেন বলে? হ্যাঁ রোলিং, তারপরে এটা ফেনসিং..

সুকুমারী তাকিয়ে দেখছে তাদের দিকে।

লীলা এদিকে আর বিনয়কে, দু দিকেই দেখছে। বিনয় হঠাৎ বলল, একদিন মেঘনাদবাবুর সঙ্গে আসুন না আমাদের বাড়িতে। লীলার সব কিছুতেই, একটু চোখমুখ ঘোরানো অভ্যাস। বলল, একলা-ই না হয় যাব।

বিনয় অফুটে বলল, বেশ তো।

তারপর তার চোখ পড়ল নাগাইয়ের উপর। চোখাচোখি হতেই নাগাই হাঁক দিল, খাটুকে খাও মাগিলোগ।

সবাই চমকে উঠল। সকলে পুবপাড়ার ভিতর দিয়ে বড় রাস্তায় এসে পড়ল ; মেঘনাদ চলল দক্ষিণের দিকে।

বিজয় বলল, চললে কোথায় এত বেলায়?

মেঘনাদ বলল, তোমরা যাও, আমি একটু ইদ্রিসের কাছে যাব। আমার তন্দুর তৈরি করবে কে, তাই ভাবছি।

সুকুমারী বলল, এত বেলায়?

লীলা বলল, এত বেলায় আর কি। সারাদিনে ফেরে তবে তো?

মেঘনাদ চলে গেল। বিজয় বলল লীলাকে, জানিস দিদি, বোনাই বড় কড়া মানুষ। কাজে ফাঁকি পাবে না।

লীলা বলল, ঢেঁকির মতো। স্বর্গে গেলেও ধান ভানবে তোর বোনাই।

এতক্ষণ উনুনের ধারে বসে ষোড়শীর মুখ অভিমানে থমথম করছে। বুঝি ঠোঁটও ফুলছে। ষোড়শী বুঝি মানুষ নয়। তার কাছে বুঝি এক দণ্ড একলা থাকতে নেই বিজয়ের।

মেঘনাদ ততক্ষণে মুসলমান হোটেলে এসে উঠেছে। তার নামটি এখন সর্বত্র প্রচারিত। সে বেকারি খুলতে যাচ্ছে, জানে সবাই। তাকে চিনেছে সকলে। খাতির বেড়েছে। হোটেলের মালিক ডেকে বসাল। এ সময়টা হোটেলে শ্রমিকদের খাওয়ার ভিড়। ইদ্রিস তার তন্দুর ছেড়ে নড়তে পারছে না। তন্দুরের চাপাটি গরম গরম সেঁকে না দিলে খেতে চায় না কেউ।

তবু, অল্পক্ষণ পরেই ইদ্রিস এল তার কাছে। চিবুকের দাড়িতে ঘাম নিংড়ে বলল, কী খবর বাবু?

মেঘনাদ বলল, ইদ্রিস ! মেশিন তো কিনে ফেললাম। আজকালের মধ্যেই জমি দেখে, আমার কারখানা তুলব। দু-এক মাস লেগে যাবে তাতে। কিন্তু আমার তন্দুর বানাবে কে?

তন্দুর। খামচি দিয়ে ইদ্রিস ধরল তার দাড়ি। ভাববার কথা। বলল, বাবু, এই সারা। পশ্চিমবাংলা মুলুকে তন্দুর বানাবার মিস্তিরি নেই আর।

মেঘনাদের চোখের বদলে গোঁফজোড়াই বড় হয়ে উঠল। তবে? ঘোড়া নেই, চাবুক কিনে বসে আছে সে। মেশিনের কারখানা হলে দেশি তন্দুরের দরকার হত না। কিন্তু সারা দেশের বেকারি তো এখনও দেশি তন্দুরেই চলছে।

মেঘনাদ বলল, বলছ কী মিঞা ! এদেশে তন্দুর বানাবার লোক নেই? তা হলে ব্যবসা হবে কী করে?

ইদ্রিস বলল, নেই কী করে বলি, আছে। মাত্তর এট্টা বংশ আছে। বস্ফোমানের জলিল শেখ জানত। নিজের ব্যাটা আর ভাইটাকে শিখিয়ে গেছে। সেই খুড়ো-ভাইপো ছাড়া সারা দেশে আর তন্দুরের মিস্তিরি নেইকো। কলকাতা-ই বলেন আর ইদিকের শহরের কথা-ই বলেন। সে বড় বড় তন্দুর ওরা খুড়ো-ভাইপোতে করেছে।

মেঘনাদ জানে, ঢাকাতেও তন্দুরের মিস্তিরির বড় অভাব। ঢাকা বরিশাল আর চাটগাঁয়, তিন জায়গায় আছে অল্প দু এক জন করে। কিন্তু এখন চিঠি লিখে তাদের এখানে আনাতে, অনেক কাঠখড় পোড়াবার ব্যাপার। বলল, ইদ্রিস তাদের কোথায় পাব?

ইদ্রিস বলল, গাঁয়ের নামটা তো ভুলে গেছি বাবু। বদ্ধামানের দুএকটা আগের ইস্টিশান হল মেমারী। মেমারী থেকে কোশ দুই আড়াই হবে জলিল শেখের ঘর। শুনেছিলাম, তারা আবার পাকিস্তানে চলে যাবে। গেল কিনা এতদিনে, কে জানে?

মেঘনাদ : পাকিস্তানে কেন যাবে তারা?

ইদ্রিসের চোখে দুশ্চিন্তা দেখা দিল। বলল, বাবু কেন যাবে, সে কথা এই দিনকালকে পুছ করেন। যেমন দিনকাল হয়েছে, তেমন তো হবে।

মেঘনাদ এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। বলল, তবু একবার দেখতে হবে মিঞা। নইলে আমার সব আয়োজন যে ভণ্ডুল হয়ে যাবে।

মেঘনাদের মুখের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল ইদ্রিস। তারপর হঠাৎ বলল, বাবু, আপনি যাবেন?

: কোথায়?

: মেমারী?

:এদেশ কোনওদিন দেখিনি, চিনিনে। বলো তো যেতে পারি। একটু ভাল করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে দাও।

ইদ্রিস আবার চুপ করে রইল। বলল, বাবু এবার আবাদ ভাল হয় নাই, ব্যাটার চিঠি এসেছে কাল। তা আমার একটা ব্যাটাকে আপনার কারখানায় নেবেন তো?

মেঘনাদ একটু অবাক হল ইদ্রিসের কথা শুনে। সেই সত্যি করিয়ে ইদ্রিস তাকে তন্দুর-মিস্তিরির ঠিকানা বলবে নাকি। বললে, মিঞা, কারখানা হলে তোমার ছেলেই তো আগে আসবে। এক ব্যাটা কেন? তোমার দুই ব্যাটা আর তুমি, তোমাদের তিন বাপ-ব্যাটাকেই আমি চাই।

শোহানআল্লা। গোঁফহীন উপর ঠোঁট তুলে, দাড়ি কাঁপিয়ে হেসে বলল ইদ্রিস, আপনাকে দিয়ে কসম খাওয়াচ্ছিনে বাবু। গোসা করবেন না ; তা হলে নিজেই একবার যেতাম আপনার সঙ্গে। মেমারীর পথে একবার বাড়ি হয়ে আসতাম। তবে আপনাকে যেতে হবে তন্দুর-মিস্তিরির বাড়ি। আমার কথায় যদি না আসে।

মেঘনাদের গোঁফজোড়া হাসিতে খাড়া হয়ে উঠল। বলল, যাব বইকী, নিশ্চয় যাব। কবে যাবে?

: পরশুকে চলেন।

: পরশু আমার জমি রেজিস্টারি হবে।

: তবে এতোয়ারটা বাদ দিয়ে, সোমবার লাগাত চলেন।

: সেই ভাল। ক-দিন লাগবে?

: এক দিনে হয়। দু দিনেই ভাল হয়। একটা রাত্রি গরিবের ঘরে কাটাবেন।

: তিন রাত কাটাবার আমার সময় নেই। নইলে তাই কাটাতাম গো ইদ্রিস মিঞা। হাসতে হাসতে চলে গেল মেঘনাদ।

জমি দেখা হল তার পরদিনই। একটু উত্তরে, বড় রাস্তার উপরেই পশ্চিমদিকে, জমিটা ছিল বিধবা মুক্তর। বন্ধকি থেকে হয়েছিল বিনয়ের মৌরসি। জমিটার আশেপাশে দুতিন ঘর আগুরির বাস। আছে এখনও। আরও উত্তরে কিছু বস্তি, কয়েকটা দোকানপাট, একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা।

দক্ষিণে জংলা পুকুর, তারপর পাড়া ; পুবদিকেও পাড়া, সামনের দিকে নানান শ্রেণীর দোকান।

বিনয় যখন জমি দেখাচ্ছে বিজয় মিস্তিরির বোনাইকে, দূরের শজনেতলা থেকে দাঁড়িয়ে দেখল মুক্ত। একটি কথাও বলল না। তার মা অবলা ফুঁসে উঠতে চাইল। মুক্ত দিল না। করের রাড়ি ঘুসকি বলে তাকে সবাই। সে ঘুসকি কি না কে জানে। কিন্তু বিনচৌ তার সব লজ্জা-ই লুটে নিয়েছে। তবু, খারাপ মেয়েমানুষ হয়েও তার লজ্জা হল কিছু বলতে। শুধু দেখল সে নীরবে। আর দেখল অবাক হয়ে, বিজয় মিস্তিরির বোনাইকে।

জমি মাপজোক হল। খুঁটি পোতা হল। প্রায় সোয়াবিঘা জমি আছে। জমি দেখা হল সকালে। দরাদরি হবে বিকালে।

নকুড় বলল মেঘনাদকে, বলো তো আমি একবার মিত্তির মশাইদের জিজ্ঞেস করে আসি, জমির দর কী রকম যাচ্ছে। ওঁরা তো মেলাই জমি বিক্রি করছেন।

বিনয়ের উপর কোনও সংশয় ছিল না মেঘনাদের। তবু বলল, দেখতে পারেন। দোষ কী আছে।

নকুড় লাঠি ঠুকঠুক করে বাইরে এল। প্রথমে এল অমর্তের মুদি দোকানে। অমর্ত শ্বশুরের মতো খাতির করে বসাল তাকে। নকুড় বলল, নতুন মানুষ জামাই ; বললেন, বাবা একবার জমির দামটা কী রকম যাচ্ছে, জেনে আসুন কোথাও। তাই বেরিয়েছি।

অমর্ত বলল অন্য কথা।

বিনয়ের বিরুদ্ধে কিছু বলল না। বলল, জামাই কাছে থাকতে থাকতে ছোট মেয়েটার বে দিয়ে দিন না? বলে ছানি পড়ার মতো ভু কুঁচকে তাকাল সে।

নকুড় বলল, সে তো জামাই দিয়ে দেবে বলেছে। আমাকেও বলছিল একটা মুদিখানা করে বসতে।

অমর্তের বুকে কেটে কেটে বসল বুড়োর কথাগুলি। মেয়েটাকে বিয়ে দেবে। আবার মুদিখানা করবে! জিজ্ঞেস করল, মুদিখানা কোন পাড়ায় হবে?

নকুড় বুঝল, অমর্ত নিজের কথা ভাবছে। যদি এ পাড়ায় হয়, তবে তার মুশকিল। বলল, হলে, বাজারের দিকেই হবে। তবে, এই বুড়ো বয়সে, বুঝতেই তো পারছ অমর্ত…

নকুড়ের বুকের মধ্যে কনকনিয়ে উঠল। বিদায় নিয়ে বাইরে এসে, আবার রাস্তা ধরল। মিত্তিরের বাড়ির বড় ছেলের সঙ্গে কথা বলে বুঝল, বড় রাস্তার উপরে কম করে প্রতি কাঠা পাঁচশো টাকার কম হবে না। অনেকদিনের চেনা মানুষ মিত্তিরেরা। খবরও রাখে সব। বড় ছেলে নকুড়কে বলল, আপনার জামাই তো জমি কিনবে শুনছি চৌধুরীর কাছ থেকে। একটু দেখে-শুনে কিনতে বলবেন। মুক্ত ঘুড়ির জমিটা তো পাঁচশো টাকায় ফুসলে নিয়ে নিল।

নকুড় ফেরার পথে দেখল, সে মাঠের রাস্তায় এসেছে। হেমন্তের হলেও রোদ বেশ কড়া লাগছে। ঘাম ঝরছে। কিন্তু মাঠের পথে কেন। বুকটা ধুক ধুক করছে নকুড়ের। বড় ভয় করছে ; যাব না যাব না করে বিনয়ের কারখানায় এসে পড়ল। কিন্তু কেন? কী বলবে সে বিনয়কে?

বলবে নাকি, মিত্তিরদের কাছে এই শুনে এলাম। জামাই আমাকে জমির দর জানতে পাঠিয়েছে। তা যদি আমাকে জমির টাকা কিছু দাও…তবে…

সেই মুহূর্তে বিনয় বেরিয়ে তাকে দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে বলল, কী খবর?

নকুড় ততোধিক বিস্মিত হাঁপ ধরা গলায় বলল, অ্যাাঁ? ও! কী কাণ্ড দেখুন। কোথায় যাব, কোথায় এসেছি। ভুল করে এসে পড়েছি। হেঁ হেঁ…..

ফিরে চলল সে। বিনয়ের ঠোঁটের কোণটা কুঁকড়ে উঠল। বলে উঠল, দরকার হলেই যেন আসা হয়। আমি কিছু মনে করব না।

: আজ্ঞে? হ্যাঁ হ্যাঁ, আসব। আসব।

বলতে বলতে গলাটা ধরে এল নকুড়ের ; কোঁচকানো গাল বেয়ে জল ঝরে পড়ল। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, বুড়োর ঘাম ঝরছে সারা মুখে, পড়ছে টপটপ করে।

তবু, বিনয় অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত।

.

বিকেলবেলা মেঘনাদ এল বিনয়ের বাড়ি। কিন্তু ইতিমধ্যেই বিমর্ষ হয়ে উঠেছে সে। জমির সম্ভাব্য দামের কথা শুনে সে থমকে গেছে। তার মধ্যে সেই মানুষটি আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। যে মানুষ আবেগে চলতে চলতে, হঠাৎ ঝিমিয়ে পড়ে ভাটার বেলায়। ঝিমিয়ে পড়ে, শঙ্কিত হয়। নাবির মুখে, তলে তলিয়ে যাবে বুঝি। নাবির মুখে, মোহনার ঢেউ সমারোহ বড় বেশি। সেখানে ধাপে ধাপে ওঠার কোনও রাস্তা নেই।

 মেঘনাদ ছোট, বড় ছোট। আজ সব দিক থেকে এইটি বড় যন্ত্রণা। চারদিকে সবই বিপুল, বিশাল, বিরাট আয়োজন। মেঘনাদ সেখানে কত তুচ্ছ, কত ছোট। যেন একটি বড় চাকে, একটি মৌমাছির মতো। ছোট হওয়ার অনেক লজ্জা, অনেক ব্যথা। এখানে ছোট করে ভাবতে পারে না। এখানে অনেক বড় শুরু, তারপর আরও বড়, তারও চেয়ে বড়। আর বর্ষাকালের পিঁপড়ের মতো মাটিতে বুক ঠেকিয়ে ধীরগতিতে চলেছে মেঘনাদ। পিঁপড়ের অভিযান, সে তো শুধু মাত্র শীতের সঞ্চয়। কিন্তু সওদাগরের অভিযান, সে তো কোনও ঋতুর সীমা মানে না। ছোট, মেঘনাদ বড় ছোট। কেমন করে তাল মিলিয়ে ছুটবে সে আজ এখানে !

বিনয় ছিল বাইরের ঘরেই। হেসে অভ্যর্থনা করল মেঘনাদকে। বসতে দিল চেয়ারে। মেঘনাদ হাসতে চেষ্টা করল। সারা মুখে দুশ্চিন্তা। গোঁফের ফাঁকে হতাশা ও লজ্জায় মেশা অদ্ভুত হাসি। বিনয়ের কাছে সে ভিক্ষে করতে আসেনি। হার স্বীকার করতে এসেছে। চেয়ারে বসতে তার কত কুণ্ঠা ছিল। কিন্তু সে কুণ্ঠার কথা মনেও নেই এখন। নিঃশব্দে বসল শোফায়।

বিনয় অপলক তীক্ষ্ণ চোখে দেখল মেঘনাদকে।

তার কারখানার অফিস ঘরের সঙ্গে, এখানকার কোনও মিল নেই। এখানে দেওয়ালে দেওয়ালে কামিনী রায় আর রতনলালের পেন্টিং। রবীন্দ্রনাথের মস্তবড় ছবি।

সবিনয় বলল, কী ব্যাপার, আপনাকে এত ভার ভার দেখছি যে! কিছু হয়েছে নাকি?

মেঘনাদের শিরদাঁড়ায় মোচড় লেগেছে। সে যেন নত হয়ে পড়ছে। মুখে তার অসহায় করুণ ভাব। বলল, ভার? ভার নয়, বোধ হয় একেবারেই পাতলা হয়ে যাবে এবার।

বলে, এক মুহূর্ত নীরব রইল। বিনয়ও চুপ। সে মেঘনাদের মুখ থেকেই কিছু শুনতে চাইছে। মেঘনাদ আবার বলল, জমিটা আমার পছন্দ হয়েছে। দামের বিষয়টা আপনার সঙ্গে একটু

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, আমি তো সেইজন্যেই বসে রয়েছি।

বিনয়ের টানা টানা চোখে দুষ্টামির ঝিকিমিকি। কাগজ টেনে, কলম নিয়ে লিখতে লিখতে, না তাকিয়েই বলল, আপনি হয়তো জানেন রাস্তার ধারের জমি, খুব কম করেও পাঁচশো টাকার কমে কাঠা পাওয়া যাবে না। অবশ্য জমির দাম আরও বাড়বে, শিগগিরই বাড়বে। যে রেটে পূর্ববঙ্গ থেকে আসতে আরম্ভ করেছে মনে হয় না আর এক ছিটে জমিও পড়ে থাকবে। সে যাকগে, পাঁচশো টাকা কাঠা হলে সোয়াবিঘার দাম কত হয় মেঘনাদবাবু?

কত হয়? তা কি জানে না বিনয়। বিনয়ের গলায় কোথাও কি বিদ্রুপের আভাস রয়েছে ! না কি নিষ্ঠুর উপহাসে মেঘনাদকে ভাসিয়ে দিতে চাইছে। বুকের রক্তে নাগের বিষ যেন পড়ছে টপটপ করে। সোয়াবিঘার দাম কত হয়, সেটাও কি কষতে পারবে না মেঘনাদ। শুধু হিসাব কষা কেন, মেঘনাদ কি সেই দামেই জমি নিতে পারে না। পারে। 

পারে, কিন্তু সঞ্চয়ের থলিটায় এত বড় একটা থাবা ফেলবার জন্য প্রস্তুত হয়নি তার মন। তবু বলল, সাড়ে বারো হাজার টাকা দাম হয়।

বিনয় হেসে উঠে বলল, আশ্চর্যরকম শস্তা। অবশ্য আপনার পক্ষে বলছিনে। কোনও সাহেব কোম্পানি সাড়ে বারো হাজার টাকায় কারখানার সোয়াবিঘা জমির দাম শুনলে দশ হাত লোহা ঢুকিয়ে দেখত সেই জমিতে, নীচে পুকুর আছে কিনা। নইলে অত শস্তা কেন? কলকাতায় লোকে বসতবাড়ি করে দশ হাজার টাকায় এক কাঠা কিনে। আর মফস্বলে এখনও জলের দর।

জলের দর। সত্যি হয়তো জলের দর। কিন্তু মেঘনাদের কাছে, তা যেন জলহীন মরুভূমির বুকে, প্রাণের বিনিময়ে তৃষ্ণার একফোঁটা জলের দাম।

বিনয় আবার বলল, অবশ্য এর থেকে অনেক অল্প দামের জমি আপনাকে আমি দেখাতে পারি। কিন্তু মেঘনাদবাবু, আপনার একটা ভবিষ্যৎ আছে। তা ছাড়া, বেশি ভেতরে হলে, পাইকেরদের নজর এড়িয়ে যাবে, খুচরা ব্যবসায়ীরা যেতে চাইবে না। ভেতরে ঢুকে যাওয়ার অনেক সমস্যা।

তারপরে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হঠাৎ বলল, আপনার সঙ্গতি কেমন তা তো আমি জানিনে। তবে, আমার মনে হয়, সাড়ে বারো হাজার টাকা জমির পেছনে ব্যয় করা আপনার পক্ষে এই সময়ে বোধ হয় একটু অসুবিধে হবে।

মেঘনাদ একটু করুণভাবে হাসল। হাসিটুকু বোধ হয় তার অসুবিধা স্বীকারের হাসি। পর। মুহূর্তেই মেঘনাদের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। গোঁফের ফাঁকে একটি অদ্ভুত দৃঢ় রেখা উঠল ফুটে। বলল, হ্যাঁ, অসুবিধে তো আছেই। আমার সবই খুব সামান্য। বুঝতেই তো পারছেন। আমরা বিলের দেশের মানুষ, জমির বিষয়ে আমরা মাথায় হাত দিয়ে কোনওদিন ভাবিনি। কিন্তু আমি যা। করতে যাচ্ছি, তা শুরু করতে গেলে এ দেশে আমাকে পেছুলে তো চলবে না।

বিনয়ের স্বরে তরলতা, সুর অন্তরঙ্গ। বলল, কিন্তু আপনি এত বিমর্ষ কেন? জমির জন্য বুঝি ! বুঝতে পারছি, ওই জমিটা আপনার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আমিও সেইজন্যই ওটা আপনাকে দেখিয়েছি।

বলতে বলতে সেও হঠাৎ গম্ভীর হল। বলল, যত দাম-ই হোক, আমি আপনাকে ওইখানেই কারখানার ভিত গাড়তে বলব। ফ্যাক্টরির প্রেস্টিজ চাই। সামনেই একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাক্টরি। রয়েছে আর একটি নতুন কারখানা করবার কথা শোনা যাচ্ছে কাছেপিঠে। মেঘনাদবাবু–যেন অনেকগুলি ওয়ার্নিং বেলের পর, হঠাৎ ফাঁইনাল ঘণ্টা বেজে উঠল বিনয়ের গলায়। মেঘনাদ বলল, বলেন।

বিনয় বলল, আমি ব্যবসা করি। আমিও আপনার মতো বড় হতে চাই। আপনাকে আমি যা তা বলতে পারব না। সাড়ে বারো হাজার আমি চাইব না আপনার কাছ থেকে।

মেঘনাদের দু চোখ নিঃশব্দ উচ্ছ্বাসে বলে উঠল, কত, কত?

বিনয়ের চোখের সামনে মুক্তর মুখখানি ভেসে উঠেছে। কাঁদো কাঁদো করুণ অবলা মুখ নয় । ভয় ভয়, শ্রদ্ধামাখা গোপন প্রেমের নেশা লাগা মুক্তর দুটি চোখ। মুক্তর পায়ের থেকে মাথা পর্যন্ত, সব দেখা যাচ্ছে। স্বাস্থ্যবতী মুক্ত, পুষ্ট, উন্নত। স্বামীর শোকটা যেন দেহ ও মন থেকে ঝেড়ে ফেলে, মুক্ত হতে চেয়েছিল। আর মুক্ত হতে চেয়েছিল, চারু স্যাকরার পাঁচশো টাকা বিনয়ের কাছ থেকে নিয়ে। আজ বিনয়ও মুক্ত হতে যাচ্ছে। বিনয় বলল, আপনি আমাকে দশ হাজার টাকা দেবেন মেঘনাদবাবু। বাকি আড়াই হাজার টাকা আপনার অন্য কাজে লাগবে, সেটা আপনাকে আমি বলছি। আর সেই আড়াই হাজার টাকাই দেবে আপনাকে আসল জিনিস।

গানের ওস্তাদ যেন দ্রুত লয়ে গেয়ে চলেছে। আর উৎসুক সাকরেদের মতো মেঘনাদ বিনয়ের প্রতিটি কথা শোনবার বোঝবার চেষ্টা করছে। আসল জিনিস আড়াই হাজার টাকায়। সেটা আবার কী!

বিনয় বলল, আপনি রাজি মেঘনাদবাবু।

একটু ধীরে। শত হলেও মেঘনাদ ধলেশ্বরী তীরের মহাজন। সব কথা সহজে বোঝে না। বলল, কীসে রাজি!

: জমির ব্যাপারে !

: নিশ্চয়। আমি তো বললাম আপনাকে, আমি পেছুব না। কিন্তু আসল জিনিস কী বলছেন আপনি, আমি বুঝতে পারছি না।

বিনয়ের গলায় একটু উত্তেজনার ধার ফুটে ছিল। চোখে মুখেও ছিল সেই আভাস। যেন এই মাত্র ঘোড়দৌড়ের মাঠ থেকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়ায় হঠাৎ উত্তেজনা শান্ত হয়ে গেছে। বলল, বলছি।

রাস্তায় রাস্তায় একটা গণ্ডগোল শোনা যাচ্ছে। ছুটি হয়েছে, কিন্তু শুধু ছুটির গণ্ডগোল নয়। আরও কিছু যেন পথে পথে কীসের জটলা চলছে।

বেলা ছোট হয়ে গেছে। সন্ধ্যা নামছে এর মধ্যেই। বিনয় বলল, দেখুন, যতদূর জানি বাংলা দেশের গভর্নমেন্ট বোধ হয়, এ দেশে বিস্কুট ম্যানুফ্যাকচারিং বন্ধ করে দেবে। অর্থাৎ বাংলা দেশে। বোধ হয় নয়, দেবেই বন্ধ করে দু এক মাসের মধ্যে। সুতরাং পারমিটটা আমাদের আদায় করতে হবে। দিল্লি থেকেই। আপনাকে আমি সেন্ট্রালের পারমিটের কথা এই জন্য আগেই বলে রেখেছিলাম।

আমি দরখাস্তের সব রকম ফর্মই এনে রেখেছি, আপনি সই করে দেবেন।

ড্রয়ার থেকে কয়েকটি ফর্ম বের করল সে। কিন্তু আসল কথা বলা হয়নি তখনও। বরং অন্য কথা জিজ্ঞেস করল সে, আপনি নিজে দিল্লি যেতে পারবেন তো?

দিল্লি ! মেঘনাদ অবাক হয়ে বলল, দিল্লি কোথায় যাব?

বিনয় আশ্বস্ত করার সুরে বলল, আপনাকে একলা যেতে বলছিনে। সঙ্গে রাজীবও যাবে। নিশ্চয়ই বোঝেন, এরকম হাজার হাজার ফর্ম সই হয়ে, কলকাতার ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের পারমিট অফিসে পড়ে আছে। পড়ে আছে, ধুলো পড়ছে, নষ্ট হচ্ছে, শত শত রিমাইন্ডার পড়ছে। কিছুই হচ্ছে না। নিয়মমাফিক দরখাস্ত আমরাও করব। কিন্তু, দরখাস্তে যোবা কথা বলে না। নিজেদের কাউকে দিল্লিতে যেতে হবে, আর.আর…

হেসে উঠল বিনয়। বলল, আর বোবাকে কথা বলাবার জন্য কিছু টোটকাটুটকিও করতে হবে।

মেঘনাদ কিছুটা বিস্মিত, বেয়াকুফ হয়েছিল এতক্ষণ। শুধু শুনছিল, একটার পর একটা কথা। নতুন নতুন তার মানে। এবার গোঁফজোড়া নড়ে উঠল ঈষৎ। হাসি ফুটল মুখে, কিছুটা শ্লেষপূর্ণ বাঁকা হাসি। বলল, টোটকা আর কী ! টোটকা একমাত্র টাকার বাজনা বাজাতে হবে কানের কাছে।

বিনয় হাসল। দৃষ্টির তলে তলে তার বিস্ময়। অদ্ভুত বুদ্ধিদীপ্ত তীব্র ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মনে হচ্ছে মেঘনাদকে। এরকম কথাও কি বলতে পারে নাকি সে।

পারে, মার খাওয়া মানুষ পারে। ঢাকা শহরেই দুই জন কেরানিকে সে হাজার টাকা দিয়েছিল জল খেতে। ঘটনার ধাপে ধাপে সেই কথাই মনে পড়ে গেছে তার। পারমিট নেওয়ার জন্য দরখাস্ত করতে হবে, ঢাকা না গিয়ে যেতে হবে দিল্লিতে। তারপর…তারপর তো বোবাকে কথা বলানোর কাজ ছাড়া আর কিছু নেই। তা হলেই সব আসবে। এই তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চিত আছে আগেই। সুতরাং বলতে পারবে না কেন এমন কথা। তবে, সেইটা ঢাকা, এটা কলকাতাও নয়, একেবারে দিল্লি। দিল্লির বোবারা কততে কথা বলে কে জানে।

বিনয় বলল, দিল্লি আর কলকাতা দু জায়গাতেই কিছু দিতে হবে। অবশ্য দেওয়ার বন্দোবস্ত আমিই করব । এইটিই আপনার আসল কাজ বলছিলাম। আড়াই হাজার টাকা

মেঘনাদ বলে উঠল, তা হলে আপনাকে আমার একটি কথা রাখতে হবে। আড়াই হাজার টাকা আমি দেব সে জন্য। কিন্তু, ওই সোয়াবিঘা জমি থেকে পাঁচ কাঠা আপনি আলাদা করে ঘিরে রাখেন। বিক্রি করে দেন আর কাউকে। এতগুলো টাকার ক্ষতি কেন করবেন আপনি আমার জন্য?

যদিও বোঝা যায় না ওপর থেকে, তবু সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছে বিনয়ের চোখ। মেঘনাদকে অন্যরকম লাগছে। করুণ অসহায় ছায়াটুকু সরে গেছে মেঘনাদের মুখ থেকে। এখন যেন কিছুটা ঝাঁঝের আভাস।

সত্যি, জ্বলছে মেঘনাদের বুকের মধ্যে। যত জ্বলছে, তত সংশয় পুড়ে পুড়ে ছাই হচ্ছে মনের মধ্যে। দৃঢ় হচ্ছে মন। ভাবছে, কেন সে ভুলে গেছল, সে সব ছেড়ে এসেছে। এসেছে রাজধানী, মহারাজধানীর পাল্লায়। সব দিতে হবে, সর্বস্ব। অনেক ঘুষ দিতে হবে সব কিছুর জন্য। আর কী রকম আশ্চর্য শান্ত গলায় প্রতিটি কথা বলছে বিনয় । বিনয় যত শান্ত, তত অশান্ত তার হৃদয়। কিন্তু, কেন এত অশান্ত হচ্ছে সে। কী লাভ তাতে। সে ছোট, অনেক ছোট। কিন্তু তাতে ভেঙে পড়ে কী হবে। করুণ হয়ে লাভ কী, বিনয়ের পাঁচ কাঠা জমি বিনামূল্যে নিয়ে, যদি কুড়ি কাঠার দাম। দেওয়া যায়।

বিনয় লালমিঞা নয়। তবু ব্যবসায়ীর দরদে পাঁচ কাঠাও দিতে চেয়েছে। ব্যবসায়ী হয়ে সে কেন ব্যবসার মর্যাদা নষ্ট করে।

বিনয় হঠাৎ অস্বস্তিকর ভঙ্গিতে মাথায় হাত ঘষল। তারপর বলল বিষঃ গলায়, মেঘনাদবাবু, পাঁচ কাঠা জমিটাই বড় হল? বন্ধু না হতে পারি, সামান্য চেনাশোনার জন্যেও কি এটুকু আমি করতে পারিনে! মেঘনাদবাবু, আপনি যদি ওই পাঁচ কাঠা আলাদা করেন, আমি খুব দুঃখ পাব।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। পশ্চিমের দরজা জানালা দিয়ে গাঢ় রক্তাভা এসে পড়েছে সরল রেখায়। হেমন্তর ঝকঝকে তীব্রতা সেই রঙে।

মেঘনাদের মনটা ভরে উঠল। একটি স্নিগ্ধ প্রলেপ বুলিয়ে দেওয়ার মতো বিনয়ের কথাগুলি। বিনয়ের সব কথাই এমনি শান্ত। ব্যবসার কথা, দুঃখের কথা, কোনও কথার সুরে নেই ওঠা নামা।

মেঘনাদ নিজেই লজ্জিত হয়ে উঠল। সে বলল, না না, আপনি কেন দুঃখ পাবেন ; আমি আপনার ক্ষতির কথা বলছিলাম। আপনি যদি কিছু দেন, সে তো আমার সৌভাগ্য।

বিনয় বলল, সৌভাগ্য নয়, আমারই ভাগ্য, নিজের ক্ষতি না করেও আপনার সামান্য উপকারে লাগল।

বিনয় হাসল শান্তভাবে। শান্ত, অথচ দ্রুত, আকাশের রং বদল হয়ে যাচ্ছে। রাস্তার মানুষের, চোখ নাক মুখ হারিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। ছায়া ছায়া হয়ে উঠছে। ঘনিয়ে আসছে আকাশটা। আরও লাল হচ্ছে, কালচে লাল, কালকের আরও আগের জমানো, গতদিনের রক্তের মতো।

মেঘনাদ বলল, আড়াই হাজার টাকায় ওদিকটা হবে তো?

বিনয় বলল, ওই টোটকা? হবে বইকী। আর আপনি যদি যান দিল্লি

মেঘনাদ বলল, আমি যেতে পারব না। যেতেও চাই না। এ কাজ রাজীববাবু একলা পারবেন না?

তা পারবে। কাজ তো কিছু নয়, শুধু দিল্লি যাওয়ার কষ্টটুকু ছাড়া। আমি চিঠি দিয়ে দেব। সেইটি নিয়ে দিতে হবে গিয়ে। বরং রাজীব একলা গেলে আপনার কিছু খরচা কমই হবে।

মেঘনাদ বলল, সে-ই ভাল। রাজীববাবুই যান। আমাকে আবার দু এক দিনের মধ্যেই একবার বর্ধমান যেতে হবে তন্দুর মিস্তিরির জন্য। এখন থেকে তাদের বায়না দিয়ে না রাখলে, সময়মতো পাওয়া যাবে না।

রাস্তায় চিৎকার চেঁচামেচি চলেছে। কিছুটা উত্তেজনার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কে একজন চিৎকার করে উঠল, হারগিস নহি চলেগা। বিনা খানা মে কারখানা নহি চল সকতা।

কারখানা নহি চল সকতা! বিনয়ের কানের মধ্যে কথাটা আটকা-পড়া মাছির মতো ফরফর করতে লাগল।

হঠাৎ, কীসের জটলা শুরু হল চারদিকে। অস্বস্তি দেখা দিচ্ছে তার মুখে, অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে। তবু, ফর্ম এগিয়ে দিল মেঘনাদের দিকে।

ইংরেজি লেখা ফর্ম। কালো কালো অক্ষরের কতগুলি অজানা কথা। মেঘনাদ বোঝে না। তার অতবড় মুখটি ভরে উঠল ছেলেমানুষের বিস্ময়ে, কৌতূহলে। এ বেদনা বয়স্ক মানুষের।

বিনয় ফাউন্টেন পেন দিল তার হাতে। জায়গা দেখিয়ে দিল সই করবার। একটু অবিশ্বাস কিংবা সংশয় হল না তার মনে। গুটি চারেক সই করল মেঘনাদ, বাংলায় আঁকাবাঁকা অক্ষরে, শ্রীমেঘনাদ দাস।

বিনয় বলল, তা হলে জমি রেজিস্টারি কালকেই করবেন?

মেঘনাদ বলল, তা ছাড়া আর তো সময় নেই।

বিনয় বলল, হ্যাঁ। জমির কাজটা মিটে গেলেই, রাজীবকেও পাঠিয়ে দেওয়া যাক দু এক দিনের মধ্যেই।

পরদিন, শনিবারেই জমি রেজিস্টারি সম্ভব হল না। সোমবার জমি রেজিস্টারি হল। অনেকগুলি টাকা ব্যয় করে, বুকের জ্বালাটা বাড়ল না মেঘনাদের। বরং কমে গেল। আরও কাজের নেশা পেয়ে বসল তাকে।

বিজয় কারখানার ব্যাপারে ব্যস্ত রয়েছে। আবার নতুন গণ্ডগোলের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কোম্পানি নোটিশ দিয়েছে, তারা ভাবছে চিপ র‍্যাশন বন্ধ করে দেবে। তার দামটা দিয়ে দেবে শ্রমিকদের।

সমস্ত কারখানায় উত্তেজনা, রাজীব বলছে, কোম্পানি ভাবছে মাত্র, বলেনি বন্ধ করে দেবে। এর মধ্যেই চেঁচামেচি শুরু করার কী আছে। আলাপ-আলোচনা চলুক। শোনা যাক কোম্পানির যুক্তি। শ্রমিকদের দাবি হাজির করা হবে পরে।

বিজয় দিশেহারা অবাক। সে বলল, কী বলছেন রাজীবদা! কোম্পানির ভাবার মানে, এও কি আবার বুঝতে হবে।

রাজীবকে শান্ত নির্বিকার দেখে, শ্রমিকেরা অবাক। তারা চিৎকার করছে, ইউনিয়ন থাক। মজুর তার নিজেরটা নিজে বুঝে নেবে।

এই রকম সংশয় আর উত্তেজনার মুহূর্তে, বিজয় শুনল, বোনাই তিন হাজার টাকা দিয়েছে শুধু ময়দার পারমিট বের করার জন্য।

বিজয় বলল, কবে টাকা দিলে বোনাই?

মেঘনাদ বলল, কেন, আজই জমি রেজিস্টারির সময়।

কে নিল টাকাটা তোমার কাছ থেকে? বিনচৌ? 

বিনচৌ! বলল, ও, হ্যাঁ বিনচৌ।

বিজয় বিস্ময়ে স্থবির হয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। অবুঝ শিশুর মতো বলল, তবে যে রাজীবদা বলে, এটা এখন স্বাধীন দেশ !

মেঘনাদের জ্বালা অনেকখানি থিতিয়ে এসেছে। তবু, তীব্র বিদ্রুপে হা-হা করে হেসে উঠল। বলল, বিজয়, তুমি পাক্কা শালা। স্বাধীন হলে বুঝি ঘুষ নেয় না?

কিন্তু বিজয় তেমনি বিস্মিত বিভ্রান্ত। তাকে দেশপ্রেমিক বলা যাবে কি না, জানিনে। মজুর ইউনিয়নে থাকতে থাকতে, অনেক কথা শুনতে শুনতে এ দেশের ভালমন্দ সে ভাবতে আরম্ভ করেছিল। অবশ্য তার নিজের মতো করে। স্বাধীনতার ব্যাপারেও তাই। সে ভাবল, স্বাধীন যদি, তবে আবার ঘুষ কেন, আর সেই ঘুষের টাকা-ই হাতে করে নিয়ে যাবে রাজীবদা ! আবার রাজীবদাই বলবে, এ দেশ তোমার, এ দেশ স্বাধীন!

তার মাথার মধ্যে দলা পাকিয়ে গেল সব। চটকল কোম্পানি চলে তার নিজের মরজি মতোই, চারদিকে যেমন ছিল তেমনই আছে। সেই পাপ লোভ লুঠ। আসলে, কারখানার ব্যাপারটিই তার মাথায় ঘুরছে চক্রাকারে।

সে ছুটে গেল রাজীবের কাছে। রাজীব তাকে বুঝিয়ে দিল অনেক কিছু। সে জানত, বিজয় এমনি মজুর-সুলভ কিছু বলবে তাকে। সে বোঝাল, কিন্তু বিজয় বুঝল না।

রাজীব অপমানিত বোধ করে, তীব্র গলায় বলল, তোমার বোনাইয়ের ব্যাপারে, তুমি কেন মাথা গলাচ্ছ। তোমার বোনাই তুমি নয়। কিছু আদায় করতে গেলে কিছু দিতে হয়। ওটা শোধবোধের ব্যাপার। কিছু না বুঝেই কি তোমার বোনাই তিন হাজার টাকা দিচ্ছে। সে একজন কারখানার মালিক হতে যাচ্ছে। ঘুষ দিচ্ছে সে তার স্বার্থে।

কথাগুলি শুনল বিজয়। কিন্তু কতগুলি নিরর্থক প্রলাপের মতো সব কথাগুলি তার মগজটিকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খেপিয়ে তুলল। রাজীবের কথার মধ্যে কোনও সামঞ্জস্য খুঁজে পেল না সে। সে চিৎকার করে উঠল, ধোঁকাবাজি, সব ধোঁকাবাজি। শালার দুনিয়াটা আমাদের উল্লুক ঠাউরেছে।

তারপর ঘুরে ফিরে এল সেই কথা, ইউনিয়ন নিয়ে যা খুশি করুন আপনারা রাজীবদা। কোম্পানির শস্তা র‍্যাশন আমরা চাই। মজুরেরা নিজেদেরটা নিজেরা বুঝে নেবে।

ক্রোধে ও বিস্ময়ে আত্মহারা রাজীব নির্বাক। বিজয় পথে আসতে আসতে, ভাবতে ভাবতে হঠাৎ নতুন জিনিস আবিষ্কার করল। মনে পড়ল বোনাইয়ের সেদিনের কথা। সেই মন্দির! সবটাই তো ধোঁকাবাজি। সবটাই তো শেষ পর্যন্ত সেই একই পাপের কারসাজি।

মেঘনাদকে সে কিছু বলতে পারল না। এখন মনে হল, বোনাই যে হেসে উঠেছিল তার কথা শুনে, সে হাসি এই মিস্তিরি শালার পাগলের মতো কথা শুনে। পাগলের মতো কথা ! বোনাইদের পয়সা আছে, কারখানাকে বলে মন্দির। ওদের কথা সে বুঝবে না। ঘুষ দিতে ওরা পেছপা নয়, কিছু পাবে বলে। পাগলই তো সে।

তবু বুকটা ভরে উঠল অভিমানে। অভিমানে রাগে ঘৃণায়। রাজীব, বিনচৌ, ইউনিয়ন আর বোনাই, সব মিলিয়ে স্তব্ধ হয়ে রইল সে। আশ্চর্য ! বোনাই মানুষটিকে সে ভালবেসেছে। যাদের জীবনে কোথাও মিল নেই, কোনওদিন থাকবে না, তাদের আবার ভালবাসা। দায়ে পড়ে যে আছে। আজ তার ভাঙা ঘরে, কাল সে মুখ ফিরিয়ে চলে যাবে। যাবেই তো। এ মিস্তিরির ঘরে তো বোনাই চিরকাল থাকতে আসেনি।

বিজয়ের ভাব কেউ না বুঝলেও মেঘনাদ কিছুটা আন্দাজ করল। সবটুকু যে বুঝল, সে ষোড়শী। এই কালো শক্ত রূঢ় মুখটিতে কখন কোন রঙের ছায়া, সে চেনে। কিন্তু বিজয় তাকে শুধু ভালবাসে। শুধু সোহাগ করে। রাগ-দুঃখ, চিন্তাভাবনা, কোনও কথা বলে না।

নকুড় একেবারে নির্বাক। সে যেন এ বাড়িতে নেই। কত কথা ভেবেছিল, কত পন্থা চিন্তা করেছিল। পারল না কিছু করতে। তারই চোখের সামনে, তারই ঘরে বসে হাজার হাজার টাকার লেনদেন চলেছে। সে বসে রইল স্থবির জড় পদার্থের মতো। যন্ত্রণা শুধু, সেই জড়ের মধ্যেও প্রাণ চলছে এখনও ধিকিধিকি, জ্বলছে ধ্বকধ্বকিয়ে। স্থবিরের এই পোড়া চোখ দুটিতে এখনও নজর আছে। এখনও দেখতে হচ্ছে।

ঠাকুরগলির বেশ্যাপল্লীতে তার ছেলে অনন্ত তাকে বুদ্ধি দিয়েছিল, নজর রেখো, রেজিস্টারির সময়, মুক্তকে দিয়ে সই করিয়ে নেওয়া দলিলটি বিনচৌ বোনাইকে দিয়ে দেয় কি না। যদি না দেয়, সামনে কিছু বোলো না, আড়ালে গিয়ে ধরা বিনচৌকে। কিছু আদায় হয়ে যাবে। বড় ভয় করেছিল নকুড়ের। চোখের দিকে তাকাতে পারেনি বিনচৌ-এর। কিন্তু পাকা লোক বিনচৌ। জানত, চেনাশোনা সাব-রেজিস্ট্রারকে সে ফাঁকি দিতে পারবে না। মুক্তর দলিল গোপন করেনি সে।

নকুড় মনে মনে বলেছে, আমি সেই চিরকালের ব্যর্থ নকুড়, হাজা মজা পচা, অলক্ষ্মীর কালপ্যাঁচা। আমারই দুর্ভাগ্য, বিনচৌ ফাঁকি দিতে পারল না।

আর সুকুমারীর চোখে কী তীব্র ধিক্কার। তলে তলে প্রচণ্ড ঘৃণা লীলার উপর। তবু, যেন ভুলে গেছে সব অপমান। মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু নকুড়কে বিদ্যুৎ হানছে প্রতিমুহূর্তে। চোখে তার এত বহ্নি যৌবনেও কোনওদিন, বুঝি দেখেনি নকুড়। চোখের কালো কোলে তার হাজার রেখা। নির্বাক ধিক্কার হানছে, পারলে না তুমি। আজও চাই মুখে পান, পায়ে আলতা ; কপালে সিন্দুর দিয়ে গলায় পরব সোনার সাতনরী হার। নতুন গদিতে বসবে তুমি, আমি হব মহাজনগিন্নি। আমার চিরজন্মের সাধ। কিন্তু পারলে না তুমি। লক্ষ্মী গড়াগড়ি যাচ্ছে তোমারই দরজায়। তুমি বসে আছ ঘাটের মড়ার মতো।

বুঝি তাই। নকুড় যেন বোবা অন্ধ হয়ে গেছে। মড়মড় করছে বুকের হাড়। তবু ভাঙছে না।

মেঘনাদের মনে হয়েছিল একটু, শ্বশুর যেন নিস্পৃহ চুপচাপ। একটু আনন্দও নেই। কিছু যে হয়েছে, মেঘনাদ যে কিছু করেছে সেটুকুও বোঝা যাচ্ছে না তাকে দেখে। অথচ মেশিন কেনার দিন কত উৎসাহ ছিল। শাশুড়িও তেমনি। নির্বিকার একেবারে।

তারপর ভেবেছে, শ্বশুর-শাশুড়ি, দুজনেরই নিশ্চয় অসুখ করেছে। কেমন যেন শুকিয়ে উঠছে দু জনেই। কিংবা, বুড়ো বুড়ি মানুষ, মন খারাপ আছে কোনও কারণে।

কিন্তু তীব্র বিদ্রূপভরা হাসি নিয়ে তার দিকে ফিরে তাকাল লীলা। তেরছা নজরে চেয়ে দেখল নতুন দলিলটি মেঘনাদের হাতে। মেঘনাদ হাসতে হাসতে এল। দশ হাজার টাকার সম্পত্তি তার। এসে হাতে দিতে গেল তার।

লীলা বলল, আমাকে কেন? কী করব ওটা দিয়ে আমি?

মেঘনাদ বলল, রেখে দেও।

লীলা বলল, বিতৃষ্ণাভরা গলায় তোমার কারখানার দলিল, তুমিই রাখো। মলে আমাকে পোড়াবার সময় চিতায় দিয়ো। তবু বুঝব, মরার পরেও তোমার সব কিছুর চেয়ে আমিই বড় ছিলাম। তখন পারবে তত দিতে?

কেন, জ্যান্ত থাকতেই তো দিতে চাইছি।

তোমার এখন কারবারের আনন্দ। কী না দিতে পারো এখন। তোমার দশটা হাত পা গজাবে, রাজা হবে। আমার কী!

তার কী ! লীলার কি কিছুই নয়। এ তর্ক অনেক হয়েছে জীবনে। তর্ক করার ধরনধারণ, তর্কে ধরাশায়ী করার ছলাকলা মেঘনাদ শেখেনি। যত তর্ক হয়েছে জীবনে, লীলা তত হিস হিস করে বিষ ঢেলেছে।

জীবনের মাঝখানে কোপ মেরে দুভাগে ভাগ করে দিয়েছে লীলা। যাকে হয় বেছে নাও। ময়দার ড্যালার সুখ দুঃখের উদ্বৃত্তে প্রাণ ভরবে না লীলার।

কিন্তু ময়দার ড্যালার সুখ দুঃখের উদ্বৃত্তের কথা কোনওদিন ভাবেনি মেঘনাদ। সে জানত, তার ব্যবসা, সতীনের চেয়েও ঘৃণার বস্তু লীলার কাছে। ওই দিয়ে নাকি সে লীলাকে শুধু ঠকিয়েছে, জ্বালিয়েছে, পুড়িয়েছে। কেমন করে, সেটা আজও জানে না মেঘনাদ।

সে জানত, আজকেও এ কথাই বলবে লীলা। তবু, প্রাণ চেয়েছিল, তাই এসেছিল কাছে। আজ কারবারের আনন্দ না থাক, উন্মাদনা আছে দারুণ। সে আর স্থির থাকতে পারছে না।

থমথমে মুখেও হাসি ফুটিয়ে নিজেই সে দলিলটি রাখল। তবু, বুকটার মধ্যে টনটন করতে লাগল। এ সময়ে, একমাত্র মনে পড়ছে বিপিনদার কথা। যে তাকে হেসে, আনন্দ করে, উৎসাহ দিতে পারত। কিন্তু তার কোনও চিঠিপত্রও পর্যন্ত এল না।

তিলি বাইরে দাঁড়িয়েছিল। শুনেছে সব কথাই। হাতে তখনও হলুদের জল রয়েছে লেগে। আসছিল, মেঘনাদকে বকুনি দিতে। সেই গেছে বেলা দশটায় না খেয়ে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে কখন। রুক্ষ মুখ, পাগলের মতো একমাথা চুল। ও বেলার বাড়া ভাত রয়েছে তেমনি। কাজের ফাঁকে কি একবার খেয়ে যেতেও পারত না সে।

কিন্তু, দিদির সঙ্গে কথাবার্তা শুনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। শুনতে শুনতে বুকের মধ্যে একটি যন্ত্রণা পাকে পাকে জড়াতে লাগল। হঠাৎ মনে হল, সত্যি যেন দিদির জীবনে কোথায় কী ঘটিয়েছে। বোনাই। নইলে বারে বারে ঘুরে ফিরে সেই কথা কেন।

কিন্তু মেঘনাদের মুখের দিকে তাকিয়ে, পাকে পাকে জড়ানো যন্ত্রণাটা তীব্র ব্যথার মতো টনটন করে উঠল। ওই মুখে সেই পাপ কোথায়, ভীরুতা কোথায় !

চব্বিশ পঁচিশের অনূঢ়া বুকের এ ব্যথা এই সংসারের চোখে পাপ। কিন্তু, তিলি নিজে তো জানে, কোনও পাপই নেই তার প্রাণে। দিদি ভগ্নীপতি, দু জনকেই ভালবাসে সে। তাই বড় লাগে বুকে।

তারপর হলুদের হাত মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকল সে। হেসে হেসে ধমকের সুরে বলল, কী হচ্ছে দু জনের ঘরে বসে বসে। দু জনেই কি রাজা-রানি হয়ে বসে আছ নাকি? খাওয়াদাওয়া সব কি চুকেবুকে গেছে?

লীলা বলল ঠোঁক বেঁকিয়ে, রানি হয়নি কেউ। রাজা হয়ে এসেছে তোর বোনাই।

তিলি বলল, তাই দেখছি। সারাদিনে নাওয়া-খাওয়া নেই, বাড়ি আসা নেই

মেঘনাদ বলল, কী করে আসি বলো। কাজটি তো আর ছোটখাটো নয়। আজ যে জমি রেজিস্টারি হল আমার।

তিলি বলল, আমার আমার করে তো খুব মশগুল আছ। আমাদের বুঝি আর একটু আনন্দ করতে নেই!

তোমাদের আনন্দ ! মেঘনাদের মুখে আলো ফুটে উঠল। বলল, আমার কাজে তোমাদের আনন্দ, তা কি হবে কোনওদিন?

তিলি লীলার দিকে চেয়ে হেসে বলল, আনন্দের ভাগ দিলে কেন হবে না। যা একালসেরে তুমি!

তারপরে হঠাৎ বলল, তা, দু জনে অমন চুপচাপ বসে আছ যে? ঝগড়া করেছ নাকি?

মেঘনাদ বলল, ঝগড়া নয়। তোমার দিদিকে দলিল দেখাচ্ছিলাম।

লীলা তেমনি নির্বিকারভাবে চুপ করে রয়েছে। তিলি বলল মেঘনাদকে, আমাকে তো একটু দেখালে না।

মেঘনাদ বলল, দেখবে !

কত আগ্রহ মেঘনাদের। দিদি রাগ করতে পারে ভেবে বলল, পরে দেখব, তুমি আগে হাত পা ধুয়ে এসে খেয়ে নাও।

মেঘনাদ বলল, না, আমি চান করব। হাত পা ধুলে শরীরের গ্লানি কাটবে না।

সে স্নান করতে গেল। তিলি বলল, দলিলটা তুই নিলিনে কেন দিদি?

লীলা বলল, আমার বয়ে গেছে নিতে। ওর দশ লাখ টাকার দলিলও আমি ছুঁতে চাইনে।

কেন ছুঁবিনে?

আমার খুশি।

তিলি বলল, খুশির মরণ তোর। বিনচৌ-এর কথা ভাবছিলি বুঝি?

লীলা হেসে উঠল, সত্যি। চল এক দিন যাই ঠুমি।

কোথায়?

বিনচৌ-এর বাড়িতে।

মরতে?

হ্যাঁ।

তিলি রেগে উঠল মনে মনে। হাসল না। কিন্তু রাগ প্রকাশ করতেও সাহস করল না। মনে আছে সেদিনের কথা। শুধু মুখ তার কালো হয়ে উঠল আরও। এই ভরা সংসারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কী ভীষণ জ্বালা। বুকের মধ্যে যন্ত্রণা নিয়ে সরে গেল সে। ওদিকে রান্না পুড়ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *