দিন চলে গেল।
মেঘনাদ রোজ বেরিয়ে যায়। বিজয় প্রতিদিন থাকে না। কারখানা ছুটির পর সে বাড়ি আসে না। মজুরদের অফিস আছে, ইউনিয়ন অফিস। সেখানে চলে যায়। মেঘনাদ একলা বেরোয়।
বেরিয়ে রোজ এসে দাঁড়ায় সেই হোটেলের কাছে, তন্দুরের সামনে। যে লোকটি গলদঘর্ম হয়ে রুটি বানায়, আলাপ হয়ে গেছে তার সঙ্গে। নাম তার ইদ্রিস। কথায় কথায় আলাপটা গাঢ় হয়ে। উঠেছে। মেঘনাদের মুখে বেকারির কথা শুনে ইদ্রিস ফেটে পড়ে উৎসাহে। মেঘনাদ কারবার। করতে চায় শুনে ইদ্রিসের আনন্দ আরও বেশি। মেঘনাদ ভেবেছিল ইদ্রিস অবাঙালি। কথায়। কথায় পরিচয় হয়েছে। ইদ্রিস বাঙালি। বাড়ি তার পাণ্ডুয়া, বর্ধমানের শুরুতেই।
কথায় কথায় জানা গেছে, ইদ্রিস শুধু কারিগর নয়। একজন ওস্তাদ মিস্তিরি। এক হাতে রুটির লেচি টিপে টিপে চওড়া করে। অন্য হাতে শিক দিয়ে, রুটি তোলে তন্দুর থেকে। আর বলে, বাবু আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা মুর্শিদাবাদের লবাববাড়ির কাজ করত। বাপ বলত, সেই তন্দুর দেখলে নাকি হাফ দিমাক খতম। রোজ একশো মন কাঠ পুড়ত লবাববাড়ির তন্দুল তাতাতে। আজকের বেকারি তো তার কাছে ছেলেমানুষ।
সত্যাসত্য পরে। ওইটুকুনই যথেষ্ট। আলাপ জমে দু জনেরই। মেঘু বলে, আচ্ছা?
ইদ্রিস বলে, তবে? আর এখনকার বেকারিতে ছ মন কাঠ পুড়িয়ে, চার মন ময়দার কাজ করে লোকে বলে জিন দত্যির কাজ করে ফেলল। আর ;বাববাড়িতে নাকি দশটা টিল্ডাল ছেল সিরিফ কাঠ পোড়াবার জন্য। আর আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা জরিদার কামিজ হেঁকে টিমপার দেখত। পঞ্চাশরকম ময়দার খাবার হত। পঞ্চাশটা লোক খাটত। লবাব খেয়ে বলত, তোফা।
জরিদার কামিজ পরে তণ্ডুলের টিমপার অর্থাৎ তাত পরীক্ষা করা যায় কি না, সেটা পরের কথা।
মেঘনাদ বলে, লবাবি খানা দু চারটে শিখে রেখেছে?
ইদ্রিস হাসে, লজ্জা আর হতাশার হাসি। মুখটি পরিষ্কার। কেবল চিবুকে ঘন এক গুচ্ছ দাড়ি। তার কটা রং-এর শক্ত বুকটা লাল হয়ে থাকে সব সময় তন্দুরের তাপে। বলে, তা হলে কি আর এখানে বসি। চলে যেতাম লবাব বাদশার ঘরে।
যেন লবাব বাদশার ছড়াছড়ি চারদিকে। ইদ্রিস দাড়ি নিংড়ে ঘাম ঝেড়ে বলে, তাই বা কী বলব বাবু। ব্যাটাদের নিয়ে কারখানা খুলেছিলাম চুচড়োয়। কিছু না হোক হপ্তায় মন খানেক মালের কাজ করতাম। লড়াই লাগল, ময়দা হাওয়া হয়ে গেল। চার ব্যাটাসুদ্ধ নিজে বেকার। এখন এক ব্যাটা কাজ করে হাওড়ায় এক বেকারিতে। আর তিন ব্যাটা গাঁয়ে বসে। এক ব্যাটা গেল সাল থেকেই খেত মজুরিতে লেমেছে। এই সালে বাকি দুই ব্যাটাও লেমে যাবে। কী করব? চার ব্যাটার চার বউ। দশটা আমার লাতি। দুই বেটির শাদি দিয়েছিলাম, দুই মিস্তিরির সঙ্গে। কলকাতা বেকারি কারখানায় কাজ করত তারা। লড়ায়ের ধাক্কায় বেকারি গেল। বেকার হল, এক জামাই মরে গেল না খেয়ে। মেয়েটা নিকা করল কি করল না, জানিনে। বে-পাত্তা হয়ে গেছে। আর একটা আছে, জামাইটাও বেঁচে আছে। গত সালের দাঙ্গার পর থেকে তাদের কোনও পাত্তা মেলেনি। তারপর, দেশ ভাগাভাগি তো শুরু হয়ে গেছে। এবার কোনদিন আমাকেও তলপি গোটাতে হবে।
মেঘুর মন জয় করে ফেলেছে ইদ্রিস প্রথম থেকেই। একের ব্যথা আর একজনের লাগে। এখন শুধু দু জনে দেখা হলে হাসে। চোখে চোখ তাকালেই মনের কথা বুঝতে পারে তারা।
কোনও কোনওদিন ইদ্রিস হঠাৎ বলে, আমাদের গাঁয়ে ছ ঘর এ কাজই করে আসছি। দু ঘরের একই হাল।
দেশের সর্বত্র উত্তেজনা। এখানে সেখানে সভা। প্রত্যেক শনি রবিবারই রাস্তায় রাস্তায় মিছিল। কেউ বলছে, হিন্দুস্থান চাই। কেউ বলছে চাইনে। ভাল মন্দ বোঝার কোনও উপায়। নেই। যুক্তি উভয় পক্ষেই আছে।
মেঘু ইদ্রিসকে ছাড়িয়ে যায় আরও দূরে। শহরতলির মানুষ ছড়ানো রাস্তা। চারদিকে বস্তির ভিড়। ধোঁয়ায় আর ধুলোয় যেন দম আটকে আসে। কখনও মনে হয়, নারায়ণগঞ্জের উপর দিয়ে চলেছে। কখনও চাঁদপুরের মেঘনার ধারে কিংবা ইসলামপুর–আরমানিটোলার ভিতর দিয়ে। তার পথের কোনও স্থিরতা নেই। সোজা যায়, সোজা আসে। বেঁকতে ভয় হয়। ভয় নয়, পথ হারিয়ে যাবে। সেজন্য যায় না।
বাইরে থেকে তার অস্থিরতা ধরা যায় না। কিন্তু তলে তলে প্রচণ্ড স্রোত পাড় ভাঙতে আরম্ভ করেছে। তার যাতায়াতের পথে তিন চারটে দেশি মদের দোকান পড়ে। পানের ঝোঁকটা অনেকদিনের। যে দিন মন টেনে নিয়ে যায়, সে দিন আর রুখতে পারে না। কোনও কোনওদিন ঢুকে পড়ে সেখানে। গেলাসের পর গেলাস খেয়েও অবাক হয়ে বসে থাকে। কিছুই হয় না।
দোকানের যারা রোজকার খদ্দের মেঘনাদ এলে তারা সবাই ঘিরে আসে তাকে। মেঘনাদের মদ খাওয়া দেখে তারা। মেঘনাদের মতো হিম্মতওয়ালা মহাপুরুষ তারা কোনওদিন দেখেনি নাকি। বলে, এ রকম মাল খাওয়া দেখলেই নেশা লাগে। খেতে হয় না। তাও মাত্র তিন চারদিন খেয়েছে। তার মধ্যেই পরিচয়টা ছড়িয়ে পড়েছে।
মেঘু বেরিয়ে আসে ভয়াবহ অতৃপ্তি নিয়ে। ভয়াবহ-ই বলতে হয় সেই অতৃপ্তিকে। একটু পা টলে না, মাথা ঘোরে না। শুধু চাউনিটা হয়ে ওঠে আরও ভয়ংকর। চলাফেরা হয়ে ওঠে ধীর। সব মিলিয়ে তাকে আরও প্রকাণ্ড দেখায়।
বাড়ি ফিরে এলে নকুড় ভয়ে মুখ খোলে না। সুকুমারী দূরে থাকে। ষোড়শী তো পালায়। লীলা বিদ্রূপ করে। হাসে খিলখিল করে। ঘরের মধ্যে দরজা বন্ধ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেঘনাদের উপর। কথা বলাতে চায় মেঘনাদকে। মদ খাওয়ায় যে তার তেমন আপত্তি আছে মনে হয় না। কিন্তু মদ খেয়ে মেঘুর এই পাথুরে স্তব্ধতা আর অপলক চাউনি সে সহ্য করতে পারে না। সে চায় মত্ততা। হাসি ও সোহাগের মত্ততা। সমস্ত স্তব্ধতাকে সে ভেঙে ফেলতে চায় খান খান করে। ওই জমাট পাথরের অন্ধ গুহাটার মধ্যে অজস্র আলো জ্বালিয়ে তুলতে চায়।
কিন্তু মেঘনাদের বুকের অন্ধকারে আলো জ্বলে না। পাষাণ গলে না। কোনও গুঞ্জনই ওঠে না সেখানে। লীলা শুধু বিষদাঁত ভাঙা ক্রুদ্ধ কালসাপিনীর মতো পড়ে থাকে বিস্ত বেশবাসে। অসুরের মতো মেঘনাদ। একটা তুলোর দলার মতো ছিন্নভিন্ন করে ফেলে রাখে তাকে। ঢেকে রাখে। তার বদ্ধ হৃদয়ের অন্ধকার দিয়ে। তার পাথুরে স্তব্ধতার থাবাড়ি দিয়ে ফেলে রাখে। আর লীলা শুধু অসহ্য আক্রোশে ফোঁস ফোঁস করে। জ্বলন্ত চোখে মেঘুর বিশাল শরীরটার দিকে তাকিয়ে থাকে। অভিশাপ দেয়। অপমান বোধ হয়। দুরন্ত ক্রোধে গালে খামচি কেটে কেটে মোছে চোখের জল। দেহের তৃপ্তি নয়। মনের অতৃপ্তি জ্বলে ওঠে তারপর দাউ দাউ করে। মেঘনাদকে সে তার নিজের মতো করে ভেঙে গড়তে চায়। মেঘনাদের আসল যন্ত্রণা সে বোঝে না। সে জানে মানুষ মদ খায় সুখে। সুখ ভোগ বেপরোয়া প্রেমের জন্য।
অস্থির হয়ে ওঠে বিজয়। বাড়িতে সে কারও সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে না। কথা বলে মেঘনাদেরই সঙ্গে। তার অস্থিরতা অন্য রকম। মেঘু সেটা বোঝে। বুঝেও, দু জনে আলোচনা ঠিক জমিয়ে তুলতে পারে না। আসল ব্যাপারের শুরুটা বিজয়ও ভাল জানে না।
তারপর বিজয় রাজীবের সঙ্গে আলোচনা করাই স্থির করে।
দূর থেকে তাকিয়ে দেখে শুধু তিলি। মা বাপের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে না সে। এ সব কতখানি বোঝে, সে-ই জানে। কেবল বড় বড় দুটি চোখে তাকিয়ে থাকে। লীলার সে সবটুকু। ভেবে উঠতে পারে না। দিদির ব্যবহারে কখনও তার বিতৃষ্ণা, কখনও বিদ্বেষ দেখা দেয়।
সে ব্যথা পায় মেঘনাদকে দেখেই। লীলা তাকে নিয়ে এখানে সেখানে যাচ্ছে। বাবা মা দিনরাত্রি ফুসুর ফুসুর, গুজুর গুজুর করছে। ষোড়শী ছেলে নিয়ে, সংসার ও বিজয়কে নিয়ে মেতে আছে। শুধু ওই একটি লোক। যার মুখে কোনও কথাই নেই। চোখ তুলে তাকালে মায়া হয়। যেন একটা বোবা জীব। অশ্রুহীন চোখে, দিবানিশি গুমরে গুমরে মরছে। যার খেতে সাধ নেই, কথায় মন। নেই। কাউকে আঘাত দেয় না। নিজের দুঃখের ভাগ দিতে চায় না কাউকে। সে বোঝে, এ সংসারে এক জনের দুঃখের কথা কেউ জানতে চায় না। এক জন যখন দুঃখে নীরব, আর এক জন তখন শুধু হাসে। এই তো সংসারের নিয়ম। এ বোধটুকু তিলির মর্মে মর্মে আছে।
অথচ মেঘনাদ বিজয়ের সঙ্গে হেসে কথাও বলে। তিলিকে মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে। শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলে ভদ্রভাবে। অথচ দিদি জামাইবাবুকে শুধু বিদ্রূপ আর ঠাট্টা করে। রাগে জ্বলে ওঠে। সিনেমার নেশায় উন্মাদিনী। সন্ধে হলেই বলে, চল টকি দেখে আসি। টেনে নিয়ে যাবে তিলিকে। আর খালি বলবে, দ্যাখ ঠুমি, লোকটা কেমন ঠায় তাকিয়ে আছে মাইরি। বলে সে নিজেও তাকিয়ে থাকবে! প্রশ্রয়ের হাসি হাসবে রাস্তার হাসির জবাবে। আশকারা পেয়ে কেউ হয়তো পিছুই নেয়। তিলি ভয় পায়, রাগ করে।
লীলা বলে, হেসে, দ্যাখ, ভগবান ভক্তের মুখ চায়। এরাও তো ভক্ত।
তিলি বলে, তোর মুণ্ডু। জানিসনে তো। দেখবি একদিন সর্বনাশ করবে।
লীলা বলে, একটু হাসলেই সব ঠাণ্ডা। সর্বনাশ করবে ওরা?
ইতিমধ্যেই লীলার খ্যাতি রটেছে পাড়ায়। বিজয় মিস্তিরির দিদিকে নিয়ে সব জায়গায় আলোচনা। সিনেমার প্রতিটি কর্মচারী চেনে তাকে। সব জায়গায় কিছু কিছু রং ছুড়ে দিয়েছে। লীলা।
কোনও কোনওদিন তিলিকে ছাড়াই বেরিয়ে যায় লীলা। যতক্ষণ ফিরে না আসে তিলির বুকের মধ্যে ধুক ধুক করে। কেউ এসে ডাকলে চমকে ওঠে। হয়তো কোনও দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে। অথচ লীলাকে বলার কেউ নেই। মা তো দিবানিশি কেবলই খোশামোদ করছে। বাবাও তাই। বিজয় সংবাদই রাখে না হয়তো। তিলিকে মানে না লীলা।
দু দিকে দুই রকম। মেঘনাদের দিকে তাকালে তিলির বুকের মধ্যে টনটন করে। কোনও পাপ নিয়ে সে তাকায় না মেঘনাদের দিকে। এক জন অসহায় মানুষের দিকে যেমন করে তাকায়, তেমনি করুণ চোখেই তাকায়।
মেঘনাদ হঠাৎ ঠাট্টা করে বলে, কী গো, দিদি আর কিছু দিল?
তিলিও ঠাট্টা করে বলে, তোমার ভয়ে কিছু দেওয়ার যে আছে নাকি?
লীলা সামনে থাকলে বলে, নিজে দেও না এনে। খালি মুখে বলে কী হবে। মেঘনাদ হেসে বলে,দেব দেব, দাঁড়াও কাজে হাত দিই। যদি ভাগ্যে থাকে, গা ভরে দেব একেবারে।
লীলা বিদ্রূপ করে হাসে। তিলির মনটা যায় ভার হয়ে। . বিজয়ের কথানুযায়ী অপেক্ষা করতে লাগল মেঘনাদ। রাজীব আসবে দু একদিনের মধ্যেই। বিজয়দের রাজীবদা, তাদের ইউনিয়নের নেতা। বিজয় আশ্বাস দিয়েছে, রাজীব প্রাথমিক ব্যবস্থা একটা করে দিতে পারবে।
চৌদ্দোই আগস্ট সারারাত্রিই একটা কোলাহলের মধ্যে কাটল। রাস্তায় রাস্তায় লোকের ভিড়। গলিতে গলিতে সবাই জেগে। যাদের বাড়িতে রেডিয়ো আছে, তাদের বাড়ির সামনেই ভিড় সবচেয়ে বেশি। রাত্রি বারোটার পর জওহরলাল নেহরু বক্তৃতা দিলেন। পনেরোই আগস্ট শুধু মিছিল। মিছিলের পর মিছিল। ড্রাম আর বিউগলের বাজনা। বাড়িতে বাড়িতে পতাকা উড়ছে। দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। দেশ ভাগাভাগি হয়ে গেল।
আজ শেষ দিন। সিরাজদিঘার হাট পাকিস্তানের আঞ্চলিক বন্দর। একটা পোস্টকার্ড আর দোয়াতকলম নিয়ে বসে রইল মেঘনাদ। বিপিনকে চিঠি লিখবে। কিন্তু লিখতে পারছে না। আঁকাবাঁকা করে খালি লিখেছে, ভাই বিপিনদা…।
বিজয় একবার বাড়িতে আসছে, আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। মেঘনাদকে ডাক দিয়ে গেছে কয়েকবার। বলেছে, শত হলেও, নিজের দেশের লোকেরা দেশের ভার নিচ্ছে। আজ আমরা স্বাধীন। আজ আনন্দ করতেই হবে।
মাতামাতির কয়েকদিন পর রাজীব এল। এ বাড়িতে সে অনেকবার এসেছে, চেনে সবাইকে। এ মহল্লার সবাই চেনে তাকে। মাঝখানে আসতে পারেনি পনেরোই আগস্টের ব্যস্ততায়
নকুড় বলল, আসুন আসুন। বলে পায়ে হাত দিতে গেল। ব্রাহ্মণের কৃপাভিক্ষা নকুড়ের রক্তে। সুকুমারীরও তাই। তাড়াতাড়ি তার ছেড়া মাদুর পেতে দিল। বলল, বসুন, বাবা। অনেক দিন বাবাকে দেখতে পাইনি।বলে পায়ে হাত দিতে গেল। দু বারই পেছিয়ে গেল রাজীব। বলল, ছি ছি ছি, অনেকদিন বারণ করেছি। এ সব আমার খুব খারাপ লাগে। কিন্তু যে আলোতে সে ভাল মন্দ বোঝে, নকুড়ের কাছে সে আলো অনাচারের সামিল।
বিজয় বলল, বোনাই কোথায়?
বলে নিজেই ছুটে গেল কোণের ঘরে। চুপচাপ বসেছিল মেঘু গালে হাত দিয়ে। সেই ছোটবেলার অভ্যাস এমনি গালে হাত দিয়ে বসা। বিপিন ধমকে উঠত, গাল থেকে হাতটা নামাও দিকি।
বিজয় বলল, চলো, রাজীবদা এসেছে।
মেঘনাদ এল কাপড়ের খুট গায়ে দিয়ে।
ভাবে ভঙ্গিতে সব সময় যেন বড় ব্যস্ত রাজীব। মাঝারি লম্বা, রোগা রোগা দেখতে। ফরসা রং। ওর উপরে খদ্দরের পায়জামা পাঞ্জাবি তাকে মানিয়েছে ভাল। মাথার চুলগুলি বেশ বড়। একটু অগোছাল, কিন্তু অবিন্যস্ত নয় ! উড়ন্ত পাখির মতো দুটি অত্যুজ্জ্বল চোখ। দিকে দিকে দৃষ্টি। যেন কী ভাবে। কী যেন খোঁজে সব সময়। সব মিলিয়ে একটা তীব্রতা আছে তার মধ্যে। কোনও কথা বলে পার পাওয়া যাবে না এর কাছ থেকে। দৃষ্টির বাইরে পালিয়ে যেতে পারবে না কেউ।
মাইল খানেক দূরের এক মাঝারি ব্যবসায়ীর অনেকগুলি ছেলের এক ছেলে সে। বিয়াল্লিশের আন্দোলনে জেল খেটেছিল। লেখাপড়া ছেড়েছিল তার অনেক আগে। তখন সে ভাবত, পদব্রজে পৃথিবী ভ্রমণ করবে। কিন্তু বিয়াল্লিশ সালটা তার জীবনের মোড় ফিরিয়ে দিয়েছে। জেল থেকে ফিরে এসে দেখল, একটা নতুন রাজ্যে এসে পড়েছে সে। এতদিন সে ছিল আর দশটা ছেলেরই মতো। পাড়ায় এবং বাড়িতে সব জায়গাতেই। জেল থেকে ফিরে দেখল, সে অনন্যসাধারণ হয়ে উঠেছে। সে নায়ক হয়ে উঠেছে। যোগাযোগ ঘটে গেল কলকাতার সঙ্গে। কলকাতার নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা হল। সেখান থেকে দু চারটে এমন কথা শুনল সে, তার চোখে কানে স্থির বিদ্যুতের মতো লেগে রইল সেগুলি। কলকাতার নেতাদের মধ্যে যাদের যাতায়াত ছিল এখানকার শ্রমিক অঞ্চলে, তাদের সঙ্গে ঘোরাফেরা করল সে। দেখা গেল, নেতৃত্বের ব্যাপারে তার প্রতিভা। কিছু কম নেই। আশেপাশে বিরোধ ছিল অনেক। কিন্তু তার সদ্য জেল-খাটা জীবনের ধারে, নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার কথার ভাবে আসর জমে উঠেছে তার।
নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার একটা তীব্র ইচ্ছে তার সত্যি। বিলোতে গিয়ে দেখল, নেবার পাত্র নেই। বিতৃষ্ণা এসে পড়ল মনে। দেখল, শ্রমিকদের মধ্যে আর যা-ই থাক, দেশপ্রেম বলে বস্তুটি নেই। উলটো বলো, সোজা বলো, সব কিছুতেই মাথা নেড়ে যায় এরা। ব্যক্তিত্বের কাছে সব বর্ষার কাদামাটির কেঁচো। মাঝে মাঝে খেপে যায়। তখন ওরা ভগবানকেও মানে না। সেটা এদের নীচ জীবনে যে পশু লুকিয়ে আছে, তারই কারসাজি। এক শ্রেণীর মানুষ আছে, তারা ওই পশুটাকে খেপিয়ে তোলে মাঝে মাঝে। এই মানুষগুলিকে নিয়ে তাকে আন্দোলন করতে হবে ভেবে, হতাশায় ভেঙে পড়েছিল সে এক সময়। এরা কখন শান্ত, কখন খ্যাপা, কখন কী বোঝে সেটাই আজ অবধি। ধরা গেল না। ছেড়ে দিতে চেয়েছিল এ কাজ।
কিন্তু কলকাতা ছাড়ল না। কলকাতা তাকে বুঝিয়েছিল, লোকগুলিকে সামলে রাখো। যে মহান ব্ৰত আমরা পালন করতে যাচ্ছি, এরা খেপে গেলে তা অনাচারে পথভ্রষ্ট হবে। ওদের জড়ো করো আমাদের রাস্তার ধারে ধারে
রাজীব সেই সামলে রাখার দিকটাই বজায় রেখে এসেছে এতদিন। ওটা মিশে গেছে তার হাড়ে মজ্জায়। সে জানে, সামলে রাখাটাই কাজ। তার জন্য বল বিদ্যা বুদ্ধির প্রয়োজন। দিনে দিনে সেটা আয়ত্ত করেছে রাজীব। তার সামনে জগতের বিচিত্র এক দুয়ার খুলে গেছে। তার পরিচয়ের পরিধি হয়েছে বিস্তৃত। রোমাঞ্চকরও নিঃসন্দেহে।
আজ সে এখানে কোনও আশা নিয়ে আসেনি। ভেবে চিন্তেও আসেনি। বিজয় ডেকেছে বলে এসেছে। বিজয় যেমন বাড়িতে, তেমনি কারখানায়। হেঁকে ডেকে সে সব জায়গায় এমন একটি অনায়াস আসর তৈরি করে রেখেছে, সেখানে আর কারও কথা বিশেষ চলে না। রাজীবকে বিজয়। মানে। কেন মানে, সেটা বড় বিচিত্র। রাজীবের জেল-খাটা জীবনের প্রতি, তার কথা ও চলাফেরা সব মিলিয়ে বিজয় খানিকটা মুগ্ধ আর রাজীব বোঝে বিজয়কে খানিকটা। সে জানে, কারখানার ওই দুর্বোধ্য মেজাজের লোকগুলিকে বিজয় জানে। বিজয় হল তার চাবিকাঠি। ওই চাবি দিয়ে সে ওই লোকগুলির অন্ধ কুঠুরিতে মাঝে মাঝে যাতায়াত করে। বিজয়কে সামলানো মানে, একটা। পশুশক্তিকে সামলানো। এইটুকুই বুঝে, রাজীব বিজয়ের ইচ্ছা পূরণে কার্পণ্য করে না।
বিজয় ডেকে নিয়ে এল মেঘনাদকে। রাজীব তার মুখের দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত কথা বলতে পারল না। মানুষ ভেবে আসে এক রকম, হয় আর এক রকম। বিজয়ের ভগ্নিপতিকে যে রকম ভেবেছিল সে, সে রকম নয়। সে ভেবেছিল নিরীহ চেহারার আধবুড়ো একটি গেঁয়ো মানুষ হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু সামনের লোকটি একেবারে অন্য রকম। মনে হয় কথা বলতে গেলে ধমকে উঠবে বুঝি।
কিন্তু ওটাই মেঘনাদের চেহারা। মানুষ হিসেবে দুর্দান্ত নয়। নিরীহ ভাবটুকু তার চোখেমুখে এমনভাবে আত্মগোপন করে থাকে, হঠাৎ ধরা যায় না।
রাজীব বলল, বসুন।
মেঘনাদ বসল। রাজীবের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি হতে লাগল তার। এ সব লোকের সঙ্গে কোনওদিন আলাপে অভ্যস্ত নয় সে। কারবারে তো অনেক দূরে। জীবনে দু একজন স্বদেশি লোক দেখেছে সে। সিরাজদিঘার কাছে শ্রীনগরের মহাদেব বসু এক ঘোরতর স্বদেশি মানুষ। তার জীবনের বিচিত্র কাহিনী শুনে মেঘু মনে মনে নমস্কার করেছে। এঁরা দেশ স্বাধীনে ব্যস্ত, প্রাণ তুচ্ছ। ব্যবসা, কোনও কিছু উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে যন্ত্রণা, কষ্ট, প্রতি মুহূর্তে ঘা খাওয়া, ভেঙে পড়া, তবু মাথা তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা ; তার যে আনন্দ, যে মহত্ত্ব, এসব মানুষের সঙ্গে কথা বললে, সে সব কেমন নিরর্থক মনে হয়। স্বাধীনতা না বোঝা পাপ। কিন্তু রুটির কারখানার অবস্থা না বোকাটা তো তাদের অন্যায় নয় ! স্বদেশি করে ইংরেজ তাড়ানোর কথা বলে সবাই। মেঘনাদ ভাবে, সুযোগ পেলে ইংরেজের মতো যন্ত্র দিয়ে নতুন মাল বাজারে ছাড়ত সে। একবার দেখে নিত, কেমন করে পয়সা নিতে পারে ওরা। সে না হয়ে, গুনোহাটির বদরুদ্দিনও যদি এ কাজটুকু করতে পারত, তার কোনও বিদ্বেষ থাকত না। কেন না, যে কাজের মধ্যে সে নিত্য নতুন উদ্ভাবনের আনন্দ পেয়েছে, তার সেই কাজের প্রথা রীতি নীতিকে ওরা ওদের যন্ত্র ও অর্থের আলোয় চিরদিন বিদ্রূপ করেছে। চেয়েছে ধুয়ে মুছে দিতে। মিথ্যা দোষারোপ করে অপমান করেছে।
একই পথের শরিক হয়ে ওরা ডক্কা মেরে চলে। আত্মসম্মানে লাগবে না মেঘনাদের। কিন্তু এ বোধ তো দেশপ্রেম নয়। এ তো শুধুমাত্র ব্যবসায়ীর চিন্তা। রাজীবের সঙ্গে কী কথা বলবে সে। তার সমস্যা রাজীব বুঝবে কেমন করে।
রাজীব চঞ্চল ছেলের মতো একটু নড়েচড়ে বসল। আরও বার কয়েক দেখল মেঘনাদের মুখের দিকে। যেন সে কোনও বক্তৃতামঞ্চে উঠেছে। আড়ষ্টতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। মেঘনাদ এসে যদি বলত, এই যে এসেছেন কী ভাগ্যি! আপনারই পথ চেয়ে বসেছিলাম। তা হলে আর ছি ছি গোছের কোনও পোশকি কথা বলে শুরু করতে পারত সে। কিন্তু এমন পাথরের মতো নিরেট আর নিশূপ। যেন ধাক্কা মারলেও কথা বলবে না।
তারপরে হঠাৎ রাজীব বলে উঠল, তা হলে জামাইবাবু আপনার কী অসুবিধে হচ্ছে আমাকে বলুন তো।
তার এ আত্মীয়তার সুরটা যেন বেজে উঠল বেসুরের মতো। নকুড় আর সুকুমারী বিগলিত হয়ে হাসতে গেল। কিন্তু হাসি হাসি ভাবটা আড়ষ্ট হয়ে রইল। বিস্মিত খুশিটুকু কেমন যেন মূঢ় করে দিল। রাজীব জামাইবাবু বলছে ঝুমির বরকে! মেঘুর গৌরবে গরব নয়। এ গৌরব রাজীবের বলার গরবে।
মেঘনাদ বিব্রত হল। তার সমস্ত অস্বস্তিটুকু এসে জমা হল গোঁফের ফাঁকে। লজ্জিত হয়ে বলল, না, অসুবিধে আর কী!
কিন্তু কথাটা শোনাল যেন, না না জামাইবাবু বলার কী আছে। তা ছাড়া, কেমন যেন হাস্যকর মনে হতে লাগল সমস্ত ব্যাপারটা। মেঘনাদের অসুবিধা ! তাও শুনতে চায় রাজীব। কাজ যার স্বদেশি করা। মেঘনাদ অন্তত তা-ই জানে ! কত অসুবিধে! দেশ ভাগটাই একটা মস্ত অসুবিধে। সমস্ত কিছু ভেঙে তছনছ করে দেওয়ার মূলে। আর সেই দেশ বিভাগকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছে রাজীবেরা।
রাজীব ভোলেনি, মেঘনাদ আর যা-ই হোক, বিজয়ের ভগ্নীপতি। রাজীবের সামনে মুখ খুলতে তার লজ্জা সঙ্কোচ তো হবেই। দেখতে যা-ই হোক, চরিত্রটা যাবে কোথায়। সে যেমন করে শ্রমিকদের বোঝায়, তেমনি করে বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করল মেঘনাদের সামনে। বিষয়বস্তু হল স্বাধীন ব্যবসা ও স্বাধীন দেশ। সে বলল, এতদিন মেঘনাদের মতো ব্যবসায়ীরা ছিল পরাধীন। তাদের পেছনে ছিল না কোনও শক্তি, কোনও শক্ত খুঁটি। কোনও সহৃদয় রক্ষাকতা, কোনও অভিভাবক। আজকে এসেছে সেইদিন। স্বাধীন ব্যবসার এতদিন কোনও অর্থ ছিল না। আজকেই তো শুরু করতে হবে। সেই শুভদিন উপস্থিত হয়েছে আজ। যে শুভদিনকে মেঘনাদেরা এনেছে সমবেতভাবে। …
মেঘনাদ অবাক হয়ে শুনতে লাগল। মোম লাগানো সুতোর মতো টান টান হয়ে উঠল তার গোঁফজোড়া। চিবুকের হাড় দুটো নেমে গিয়ে চোখ দুটি বেরিয়ে এল মোটা ভুর তলা থেকে। সে অবিশ্বাস করছে না রাজীবকে। বুঝতে পারছে না। বোঝার উপর নির্ভর করে বিশ্বাস অবিশ্বাস ! ব্যবসার কথা শুনেছে অন্যরকমভাবে। এরকমভাবে নয়! এরকম স্বদেশির মুখ থেকে। তা হলে একটু একটু মাথা নাড়তে পারত সে।
মাথা নাড়ছিল নকুড়। লোমহীন ভূ দুটি কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে, বিস্মিত শ্রদ্ধায় মাথা নাড়ছে। যেন বলতে চাইছে, অ্যাাঁ ! আঁই এই হচ্ছে আসল কথা। সুকুমারী সবাইকেই দেখছে। মাথা নাড়ছে না, হাসছে না। এমনকী রাজীবের কথাগুলিও ঠিক শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। বোঝা না বোঝা তো দূরের কথা। চোখে তার অন্য কিছু। মুখে তার অন্যভাব। দুশ্চিন্তার রেখাগুলি ঘন হয়ে উঠছে শুধু সারা মুখে। তার ঘষা ঘষা বৃদ্ধ চোখে দুরন্ত অভিমান ফুটছে থেকে থেকে, যখন সে নকুড়ের দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু নকুড় যেন রাজীবে লয়।
ভেতরের বারান্দার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে লীলা আর তিলি। লীলা রাজীবকে দেখছে। চোখ বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে তাকাচ্ছে তিলির দিকে। ফিসফিস করে বলছে, বিজার রাজীবদা বেশ দেখতে। তুই কী বলে ডাকিস?
তিলি বলল, রাজীবদা-ই বলি।
কনুই দিয়ে একটু চাপ দিয়ে বলল, ভাব জমিয়েছিস বুঝি খুব?
হেসে বলল, তিলি, খুউব।
দরজার স্বল্প পরিসরে আবার কনুই দিয়ে ঠেলে দিল লীলা তিলিকে। বলল, অমনি চাপছিস। কত ছেনালি যে জানিস।
গালাগাল নয়। ওটুকু লীলার সোহাগের ভাষা। তিলি বলল চাপা হাসি হেসে, চাপলাম কোথায়। বললাম তো, একেবারে গলায় গলায় পিরিত।
তবু লীলার চোখ দুটি বেঁকে রইল। পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি সে। আর এতক্ষণে বেঁকে বেঁকে উঠতে লাগল তিলির ঠোঁট। রাজীবের কথাই ভাবছে সে। রাজীবও তাকে ভাসিয়ে নিতে চায়। কিন্তু চোরাবন্যায়। রাজীব শিস দেয় না, গান গায় না। হেসে হেসে রাশি রাশি কথা বলে না প্রেমের। প্রেমে বোকা হতে চায় না সে। এমনকী তার ফরসা ধবধবে মুখে কোনও ভাবের উদয় হয় না। ভূ কাঁপিয়ে, চোখের নিঃশব্দ চোখা চোখা কথা ছুড়ে দেয় সে। যখন সে পুরোমাত্রায় সপ্রতিভ অনর্গল কথা বলে অন্য বিষয়ে, তখন চোখ দিয়ে সে বাণ ছোঁড়ে। অবলীলাক্রমে খবর পাঠায়। আর একটা জগৎ আছে যে রাজীবের। সেই জগতের সম্মানকে ক্ষুণ্ণ হতে দিতে চায় না সে। পারেও না যে। তা ছাড়া বিজয় মিস্তিরির বোন যে! নিজেকে প্রকাশ করবে কেমন করে। তাই শুধু নিঃশব্দ কথা। আশ্চর্য ! যার উদ্দেশে বলা, যেন তাকেও জানতে দিতে চায় না। যদি বা দেয় তা অস্পষ্ট। হঠাৎ আক্রান্ত হলে, যেন চট করে জবাব দিতে পারে। আত্মসম্মান ও পালটা আক্রমণের পথ থাকে যেন খোলা
আর তার চোখের নিঃশব্দ কথাগুলি যত শোনে তত হাসি পায় তিলির। কী বোকা ! স্কুল উল্লসিত মানুষগুলির চেয়ে, এ বোকামি আরও বড়। সব ঢেকে একটুখানি খুলে রাখার মতো। বাকি মানুষগুলির সবটাই ভোলা। বুঝতে কারওই কষ্ট হয় না। বরং বিশ্বাসের তারতম্য ঘটে। নকুড়ের সঙ্গে কথা বলতে, সুকুমারীর কথা শুনতে বিজয়কে কারখানার কথা বোঝাতে বোঝতে কথা বলে সে চোখে চোখে, বাঃ বেশ। কী সুন্দর তুমি। তোমার মুখ, তোমার বুক, চলায় চলায় তোমার কী বিচিত্র কটি-তল উল্লাস। আমাকে কেমন লাগে? আমি রাজীব মুখুজ্জে, রাজনীতি জ্ঞানসম্পন্ন, শ্রমিক নেতা, আমার এই সুন্দর চেহারা। কেমন লাগে?
তিলি কাছে কাছে, দূরে দূরে কাজে কাজে ফেরে, আর নিঃশব্দে বলে, বুঝিনে বুঝিনে কিছু। না বুঝে সে সরলভাবে মিঠে মিঠে হাসে। অবাক হয়ে চায়। মুখ ঘুরিয়ে হাসে, বিদ্রূপ করে। অপমানে। ও ব্যথায় খচ করে একটা ব্যথা ধরে যায়। কেউ বোঝে না, বুঝবে না। ভাসিয়ে নিয়ে যাবে আর অতিকায় সরীসৃপের মতো জড়িয়ে জাপটে ডুবিয়ে দেবে অতলে। অথচ এ শূন্য বুকের ঝড় আর। সহ্য হয় না।
লীলাকে কী বলে বোঝাবে সে। ওর কাছে পুরুষ যেন তাসের সারি। সেরা রংটি এলে, রং। খেলে, খেলার নম্বর নেয় গুনে গুনে।
মেঘনাদও ঠিক বুঝতে পারছে না। রাজীবের কথাগুলি যেন অন্য কোনও জগৎ থেকে ভেসে আসছে। কোনও দূর বেতারের অস্পষ্ট নিরর্থক বক্তৃতার মতো। তবু মাঝে মাঝে এক একটা কথা মনটা টেনে নিচ্ছে। রাজীব যখন বলছে, আপনারা দেশের সম্পদ। আপনারাই তো দেশের পয়সা দেশে রাখতে পারবেন। সম্পদ কিনা মেঘনাদ জানে না। কিন্তু দেশের পয়সা দেশে থাকার প্রয়োজনীয়তা কেতাবে শেখেনি সে। ওটা তার ব্যবসা জীবনের অভিজ্ঞতা। নিজের কারখানার মাল যদি সে নিজে দশটা জেলায় দশটা দোকান করে কাটাতে পারত, তবে পাইকেরের ঘরে পয়সা যেত না। এটা সেই রকম। দেশে সে তো একলা নয়। কারবারি আছে আরও অনেক। সকলে যেটা রাখতে পারত ঘরের ব্যবসা বাড়াতে, সেই টাকাটা অন্য দেশে গিয়ে অন্য ব্যবসা ফাঁদছে।
রাজীবের গলা আস্তে আস্তে ভারী আর আবেগে উঠল ভরে, এবার আপনাদের গভর্নমেন্ট পেয়েছেন। আপনাদের সকলের সুযোগ সুবিধে সকলের আগে। আপনারা যাতে আরও উন্নতি করতে পারেন, ব্যবসাকে আরও বাড়াতে পারেন, গভর্নমেন্ট সেদিকেই নজর দেবে। স্বাধীন যুগে আমাদের বাণিজ্য জাহাজ ভিড়েছে বিশ্বের বন্দরে বন্দরে। আজ আবার আমরা বাণিজ্য করতে বেরিয়ে পড়ব সমুদ্রে…
কলকল করে জলোচ্ছ্বাস প্লাবিত করল হঠাৎ মেঘনাদের মন। আজ বয়স হয়েছে, বুদ্ধিও বেড়েছে। তবু, সেই সওদাগর বসে আছে বুকে মসলিনের ছিন্ন পোশাকে মুখ ঢেকে। পৃথিবীর হাটে হাটে, ঘাটে ঘাটে বাণিজ্য করে ফিরবে সে। এই তার মনে ছিল।
সেই মন আজ পেকেছে অনেকখানি। আজকের সওদাগর সপ্তডিঙা ভাসায় না। তার দ্রব্যসম্ভার যায় পৃথিবীর দেশে দেশে জাহাজ ভাসিয়ে। পূর্ববঙ্গের জেলায় জেলায় গেছে একদিন। আজ রাজীব তাকে আরও বিস্তৃত করে দিচ্ছে চোখের সামনে। আচ্ছা যদি, রাজীবের কথাই সত্য হত । যদি সত্য হয়। মদন সা’র বেটা মেঘুর তা হলে স্বপ্ন সার্থক হয়। সে হবে ধনপতি সওদাগর। সওদাগর মেঘনাদ দাস। ওটাই তো তার হৃদয়ের মূলধন।
রাজীব বসেছে বারান্দার দরজার মুখোমুখি। কিন্তু নজরে পড়েনি দুই বোনকে। সে কথা বলতে বলতে লক্ষ করছে মেঘনাদকে। মেঘনাদের প্রতিটি ভূভঙ্গি, গোঁফের ওঠানামা, চোখের আলোছায়া। এমনকী মেঘনাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। যেমন করে সে তার পরিচিত প্রত্যেকটি মজুরকে দেখে। এমনি করেই দেখে। এমনি দ্রুত চিন্তিত অস্থির তীক্ষ্ণ চোখে। মজুরকে দেখে, তার। নির্দেশের এবং আদেশের অন্তরায় হবে কিনা। মজুর যাচাই করাই তার কাজ।
আরও কিছু তার কাজ আছে জীবনে। যে জীবনটাকে আজ সে ত্রিশ বছর পার হয়ে সুচিন্তিত ও ধীরভাবে দেখতে শিখেছে। জীবনে একটা পথ বেছে নিয়েছে সে। অনেক দূরে, বহু দূরে, অনেক উঁচুতে গেছে তার নজর । একটা অস্পষ্ট সিঁড়ি তার চোখে পড়েছে। যে সিঁড়িটার সামনে অনেক। ভিড়, ঠেলাঠেলি, মারামারি, কাড়াকাড়ি। ভিড় করা লোকগুলির সব গাল-ভারী স্বদেশি পদবি আছে। কিন্তু রাজীবের তুলনায় তারা ইডিয়েট। রাজীব তা বোঝে। সে বিশ্বাস করে, তার মতো স্কুল পালানো, সেই দুরন্ত ছেলেটাই আজ সবচেয়ে ভাল খেলোয়াড় হতে পারে। পাখোয়াজ হিরোর মতে পারে ওই ভিড় কাটিয়ে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে। সে অনেক অভিজ্ঞতা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। আর তার হাতেখড়ি হয়েছে এই শিল্প এলাকায়। যেখানে বিজয়দের মতো লোকেরা। এমনিতে শান্ত। সংশয় হলেই মুঠি বাড়ায়। শত্রুকে হাতে পেলেই প্রাণের ভয় না করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মজুর জীবন থেকে, কলকাতার চেম্বারের প্রতিটি অন্ধ গলির অন্ধিসন্ধি জানা আছে তার। ওই লোকগুলির মতো সে দুর্বল নয়, ভীরু নয়, যারা শুধু চেয়ারে বসে আমলা দিয়ে কাজ চালাতে চায়। বোকার মতো অবিশ্বাস্য সব বক্তৃতা দেয় জনসাধারণের সামনে।
কিন্তু অনেক দুরূহ পথ পার হতে হবে তাকে। এই পথে, সেই মেঘনাদেরাও এক একটি পরীক্ষাকেন্দ্র।
আর মেঘনাদ ! রাজীবের চোখে যেন একটা খ্যাপা আর বোকা মানুষ বলে মনে হচ্ছে। এবার সে মুখ খুলেছে।
বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ, ব্যবসা তো করবই। সেই জন্যই এসেছি। ভয় পাইনে, তবে নতুন জায়গা, জীবনে কোনওদিন আসিনি তো। তা–আপনারা দশজনে রয়েছেন।
মেঘনাদ হাসল। গোঁফের ফাঁকে তার শক্ত দাঁতের সারি চকচক করে উঠল। সে আবার বলল, জীবনে কখনও বসে খাইনি, জানেন। এখন খেতে গেলে হাত ওঠে না। মানুষ দু পয়সা রোজগার করলে খরচ করতে পারে। রোজগার নেই। এদ্দিন এসেছি মশাই একটা তণ্ডুল চোখে দেখিনি।
রাজীব অবাক হয়ে বলল, তণ্ডুল কী?
মেঘনাদের বড় বড় চোখ দুটো ঝিকিমিকিয়ে উঠল। নাকটা আরও বোঁচা হয়ে, বোকা হয়ে উঠল হাসিটা। বলল, তণ্ডুল মাল সেঁকে। উনুন বলতে পারেন, তাতানো খোপ বলতে পারেন। কারখানার ওইটাই অর্ধেক। মুসলমানেরা বলে তন্দুর।
রাজীব বলল, ও, বুঝেছি ; আপনি বলছেন যাতে তন্দুরি রুটি তৈরি হয়।
মেঘনাদ হাসল, রাজীবের বুঝতে পারাটা দেখে।
রাজীবের চোখ পড়েছে তখন দুই বোনের দিকে। তিলিকে সে চেনে। লীলাকেই দেখছে বেশি। বিজয়ের মতো দেখতে। কিন্তু একটা অদ্ভুত তীব্রতা চোখে মুখে এবং দেহে। তিলিকে যেন নিভই মনে হয়। হঠাৎ মনে হয় রাজীবের চোখ দুটি বাঁদরের মতো। চকিত এবং ঘূর্ণিত। আনমনা সে। তাই মেঘনাদের প্রতি কান দুটো গরহাজির হতে লাগল।
মেঘনাদ বলেই চলল, হাতের কাজ, পরোয়া করিনে। তবে ভেবেই ঠিক করতে পারছিনে, কী ভাবে শুরু করব। তাল পাইনে। একলা কাজ তো নয়। ছোট করে করলেও দু চার জন লোক লাগবে। বাজারটা ঘুরে দেখেছি। মনে হয়, খুব খারাপ হবে না। তবে বিলাতি কোম্পানি একচেটে করে রেখেছে, তাদের মার নেই।…
রাজীব এক ফাঁকে বলে ফেলল, আপনার আগের কারখানা কেমন ছিল?
রাজীব অন্যমনস্কভাবে জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু ব্যথা ও সঙ্কোচে বিচিত্র হয়ে উঠল মেঘনাদের মুখ। গজ চোখের দৃষ্টি যেমন দুদিকে চলে যায়, তেমনি তার দুটি চোখের একটি মণি রাজীবকে ছাড়িয়ে চলে গেল পিপুলতলায়। সঙ্কোচ তার, নিজের সুদিনের কথা বলতে। ব্যথা, সে সুদিন নেই। সে প্রায় চাপা গলায় বলতে লাগল, কী রকম কারখানা ছিল তার…।
কিন্তু রাজীবের কানে গেল না সব কথা। মন নেই, ভাল লাগছে না। তবে মেঘনাদকে একেবারে হাতছাড়া করতে চায় না সে। তারপর হঠাৎ মধ্যপথেই বলে উঠল, আচ্ছা আপনার ময়দা চাই তো? তার জন্য একটা পারমিট দরকার। সে জন্য কোনও ভাবনা নেই। আপনার কাছে আমি বিনয়বাবুকে নিয়ে আসব। মস্তবড় লোক, শিক্ষিত মানুষ। ওঁর এরকম ব্যবসা করার ইচ্ছে ছিল। এক বেকারি কারখানার ব্যবসা। বিনয়বাবুর সঙ্গে কথা বললে, আপনি সব ঠিক করতে পারবেন, আপনাকে অনেক সাহায্য করতে পারবেন। পারমিট বলুন, লোকজন বলুন, সব। আমি তো রইলামই।
মেঘনাদ একটু অবাক হয়ে চুপ করে গেছে। ভ্রূ দুটি কুঁচকে যাওয়ায় হাঁ করা মুখটা কঠিন দেখাচ্ছে। যদিও মন তার কঠিন হয়নি। কথা বলতে বলতে হকচকিয়ে গেছে মাত্র।
সুকুমারী উঠে গেছে অনেকক্ষণ। নকুড়কে আচ্ছন্ন মনে হচ্ছে। নাক ঠোঁট লাল, সব যেন ঝুলে পড়েছে। নাকের পাশের গভীর কোঁচ দুটিতে রাজ্যের বিতৃষ্ণা ও বিষাদ। সে অনেকক্ষণ থেকেই কোনও কথা শুনছে না আর।
রাজীব ভেতরের দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, কই ঠুমি, একটু চা খাওয়াবে নাকি?
চমকে উঠল নকুড়। ডেকে উঠল সে, কই লো ঠুমি।
তিলি বলে উঠল, হ্যাঁ, এই যে দিচ্ছি।
তিলি ভিতরে চলে। লীলা তার চুলের কুঁটি নেড়ে দিয়ে বলল, ও। তলে তলে বেশ জমিয়ে রেখেছিস। দু চোখ মেলে তো গিলছিল দেখছিলাম।
তিলি বলল, তোকে না, আমাকে?
লীলা বলল, আমাকে কেন ! অমন মিষ্টি করে ঠুমি ডাকলে তোকে।
তিলি বলল, বেশ, এবার থেকে তোকে ডাকতে বলব।
হেসে উঠল সে। বারান্দায় রান্না করছিল তার মা, বাটনা বাটছে ষোড়শী।
তিলি হঠাৎ ভ্রূ কুঁচকে কামড়ে ধরল। বলল, ওমা! চা–নেই যে! কী দেব!
লীলা বলল, কিনে নিয়ে আয়।
কিনে নিয়ে এসে চা দিতে দেরি হবে। ভাড়াটেদের কাছ থেকে চা চেয়ে নিয়ে এল সে। এদিকে আবার দুধ নেই। সারাদিনে এক পো দুধ। কয়েক চামচ চায়ে যায় আর বিজয়ের ছেলে সাবুর সঙ্গে খায়।
লীলা বলল, পয়সা দিচ্ছি, কিনে নিয়ে আয়।
তিলি বলল, কিনতে যাব কোথায়। সে যে বড় রাস্তার ওপরে।
তার এ অস্থিরতাটুকু লীলার কাছে প্রেমের ব্যাকুলতা মাত্র। ঠোঁট টিপে বলল, তবে না হয় নাই দিলি।
তিলির মনে ভদ্রতা ও আতিথেয়তার দুশ্চিন্তা। একটু চায়ের জন্য দারিদ্র্য স্বীকার করতে বাধে তার। ঘরের মানুষ নয়। আপনজন নয়, ঘনিষ্ঠও নয়, যাকে বলা যায়, দিতে পারলাম না। না দিতে পারলেই রাজীবেরা বিরক্ত হয়ে করুণা করতে চায়। বলল, ছি, তা কী করে হয়।
ষোড়শীকে জিজ্ঞেস করল, বউদি, সোনাদা কোথায় গেল?
বউ বলল, জানিনে তো।
অগত্যা আবার গেল মহীন্দর মিস্তিরির বউয়ের কাছে। মহীন্দরের ঘরে লোক কম। সুকুমারীর ভাষায়, দুধখেগো যম নেই। অর্থাৎ শিশু নেই ঘরে। রাজীবের নাম শুনে একটু দুধ দিল সে। দিয়ে বলল, তোমার বোনাইয়ের কারবারের জন্য এসেছে বুঝি?
তিলি বলল, হ্যাঁ।
ও! বলে মহীন্দরের বউ ভাল মানুষের মতো অপাঙ্গে দেখল একবার তিলিকে।
ঠাণ্ডা গলায় বলল, যাও, চা দেও গে।
মুখ ঘুরিয়ে চলে এল তিলি। কী কুৎসিত ঠাণ্ডা গলা। কী ভয়াবহ ভালমানুষ বউ! কী অদ্ভুত চাপা ইঙ্গিত! ভাল মন্দ, সকলের একটাই সংশয়। হবেই তো ! চব্বিশ বছরের আইবুড়ো মেয়ে যে ! সংসারের কোথাও পিছল নেই তো। পিছল যে তারই পায়ের তলাটুকু শুধু।
বারান্দায় এসে দেখল, লীলা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে ঘরের দিকে। পরিষ্কার বোঝা যায়, নজরটা রাজীবের দিকে। তিলি ঠোঁট টিপে হাসল আপন মনে। রাজীব অবাক মুগ্ধ চোখে অনেকবার তাকিয়েছিল লীলার দিকে। রাজীবের অবাক মুগ্ধতা ! জোরে হেসে উঠতে ইচ্ছে করল তিলির। কিন্তু জোরে হাসা যায় না এখন। সত্যি, দিদিকে এখন কী সুন্দর দেখাচ্ছে। অন্যমনস্কতার ভান করে কেমন তাকিয়ে আছে। কপালের পাশ দিয়ে নেমে গেছে কোঁচকানো চুলের গোছা। একটু অগোছাল উড় উড় কুন্তলচুর্ণ। আঁচল তার সব সময় খসেই থাকে। জামার বোতাম বন্ধ থাকে না পুরো কখনওই। সোনার হারটি এমন বিচিত্রভাবে এলিয়ে থাকে ওর বুকে। পান-খাওয়া রক্তঠোঁটে চোরা হাসি। চোখ দুটি যেন ছুরির ফলার মতো চকচক করে।
মহীন্দর মিস্তিরির ভাই যেমন গায়, ও সে হোক না কালো আমার বড় ভাল লেগেছে, পটলচেরা চক্ষু দিয়ে চাকু মেরেছে!…তারপর বলে ওঠে, মাইরি !
তিলির তেমনি বলে উঠতে ইচ্ছে করে, মাইরি! তার কালো রূপে আর ভাল কী আছে। কালোরূপ তার দিদির ! চাকু কেন, অনেক কিছু মারতে পারে। বুঝি প্রাণেও মারতে পারে।
চায়ের জল বসিয়ে টুক করে ঢুকে গেল সে লীলার কোণের ঘরে। ছোট্ট একটি ফোকর দিয়ে উঁকি মেরে দেখল পাশের ঘরে। যা ভেবেছে ! রাজীবের লাল মুখ ঘামছে দরদর করে। চোখ দুটি বেঁকে গেছে। যাকে বলে খোঁচা খেয়ে বেঁকে যাওয়া। দিদির এক খোঁচায়, ভেঙে দুমরে যাচ্ছে। রাজীব আস্তে আস্তে।
আর মেঘনাদ ! বোনাই আবার মুখ খুলেছে। কী বিশাল শরীর! পাশে রাজীবকে যেন লিলিপুটিয়ানের মতো দেখাচ্ছে। সঙ্কোচের বাঁধ খুলে গেছে মেঘনাদের গলার। টিনের শেড ঘরটার মধ্যে গমগম করছে গলার স্বর । কী বড় বড় চোখ ! এখন খুশি উত্তেজিত দৃষ্টি পূর্ণ উন্মীলিত। মুখের কোথাও অসবলতা নেই। অন্যমনস্কতা নেই একটুও নিজের কথায়। বলছে, দু মন, চার। মন, যা-ই হোক ময়দার ব্যবস্থা না হলে কিছুই করতে পারছি না। লোকজন পেতে কিছুই কষ্ট হবে না। ইদ্রিসের ছেলেদের নিয়ে আমি কাজ আরম্ভ করতে পারি। এই পারমিট, কী যে অভিশাপ ! কী বলব আপনাকে! তবে হ্যাঁ, বিলাতি কারখানার মতো মেশিন বসাবার আমার বড় সাধ ! উপায় থাকলে, কী বলব আপনাকে
বলতে বলতে স্বপ্ন নেমে এল মেঘনাদের চোখে। কিন্তু কে শুনছে !
সমস্ত দৃশ্যটি উড়িয়ে নিল তিলির ঠোঁটের হাসি। ভার হয়ে উঠল বুকটা। বাইরে থেকে ডাক দিল সুকুমারী, তুমি, চায়ের জল গরম হয়ে গেছে।
নিঃশব্দে বাইরে এসে পড়ল তিলি ! জল নামিয়ে চা তৈরি করতে লাগল। ভাঙা কাপ। রাজীব একটুখানি খেয়েই দেবে রেখে। তবু চায়। চা খানিকটা কমিয়ে আর একটা গেলাসে ঢালে সে। নইলে, নকুড় আধ কানার মতো তাকাবে আর সাপের মতো জিভ দিয়ে চাটবে ঠোঁট। মুখে বলতে পারবে না কিছুই। অভিশাপ দেবে মনে মনে।
তিলি মনে মনে ভাবে
ভালবাসা ! ভালবাসা !…হায়রে ভালবাসা ! মেঘনাদ যে কী অপরাধ করেছে এই মানুষগুলির কাছে, তা ওরাই জানে। দিদি শুধু সর্বনাশের মাতাল। আগুন নিয়েই ওর খেলা দিবানিশি। আর বিজয় কেন এনেছে রাজীবকে, কে জানে। সে শুধু অন্যমনে যেন কীসের ছল খুঁজে বেড়াচ্ছে।
সুকুমারী জ্বলন্ত চোখে দেখে তিলিকে। চোখে তার মহীন্দর মিস্তিরির বউয়ের মতোই সন্দেহের বিষ। হঠাৎ চাপা তীব্র গলায় বলে উঠল, এখন দিয়ে আয় চা, ভাবিস পরে।
উঠে পড়ল তিলি ! নতুন তো নয়। মায়ের মুখের দিকেও তাকাবার কোনও দরকার নেই।
এ তো জানাই কথা। ভেবেও সে যে কিছু করতে পারে না, সেটাই তো মায়ের দুঃখ।
দরজায় এসে বলল, সর দিদি।
লীলা ফিরল। চোখ বাঁকিয়ে চাপা গলায় বলল, হল চা এতক্ষণে ! বেচারি মরছে।
তিলি শুধু বলল, বাঁচা যেত মরলে। তুই মরিসনে কেন।
লীলা হেসে উঠে বলল, আমার তো মরণ নেই। মরবার পালা তো কেবল তোরই।
বলে আঁচলের চাবির গোছা দিয়ে মারল তিলির পিঠে।
রাজীব বলে উঠল, কই ঠুমি,তুমি তো আর নারী সমিতিতে যাও না।
তিলি হাসল। একবার চোখাচোখি করল লীলার সঙ্গে। চা দিয়ে বলল, সময় পাই না একেবারে।
রাজীব রীতিমতো উৎফুল্ল। লীলা তিলি, দু জনের মাঝখানে হৃদয় তার প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে রসে। বলল, তা বললে কী হয়। একটু সময় করে তোমার যাওয়া উচিত। মজুর পরিবারের মেয়েরা, লেখাপড়া শিখে, হাতে কলমে কাজ শিখে বড় হয়ে উঠুক, এইটি আমরা চাই। আবার নতুন করে নারী সমিতি বসছে। আমিও গেছি কয়েকদিন। তুমি এসো না?
চোখ তার দুদিকেই ঘুরছে। আর দুদিকেই সে একই কথা ছুড়ে মারতে চাইছে।
তিলি না হেসে পারছে না।
নকুড় এবার বলে উঠল, হ্যাঁ গেলেই তো হয়। আমি বলেছি।
নীরব শুধু মেঘনাদ। নারী সমিতি, মজুর পরিবার, এই সব কথাগুলির অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে চাইছে যেন।
রাজীবকে বলল তিলি, আচ্ছা দেখি। আমার দিদিকে পাঠাব।
রাজীব চকিতে একবার লীলার দিকে তাকাল, বলল, নিশ্চয়, নিশ্চয় ! তোমার দিদি মানে, মেঘনাদবাবুর স্ত্রী তো। খুব ভাল হবে।
লীলা আচমকা হেসে উঠল খিলখিল করে। বলল, আমি?
বলে আবার হেসে উঠল। কেঁপে কেঁপে উঠল তার শিথিলবাস অঙ্গ। আর সকলের হাসিটুকু অবাক বিস্ময়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল। বিশেষ রাজীবের।
তিলি বলল মেঘনাদকে, তোমার হয়েছে বোনাই?
মেঘনাদ বলল, হ্যাঁ, হল, কথাটা শেষ করে নিই।
তিলি হঠাৎ বলে উঠল, আর কতক্ষণ কথা বলবে।
মেঘনাদ তিলির মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। পাকা গিন্নির মতো রীতিমতো গম্ভীর মুখ তিলির। মেঘনাদের ভাল লাগল। বলল, বলতে হয় গো
কিন্তু কথা বলা তার আর হল না। রাজীব উঠল। হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বলল, আমি কাল আসব জামাইবাবু। পারি তো বিনয়বাবুকে নিয়েই আসব।
তিলি চোখ কপালে তুলে বলল, এখেনে নিয়ে আসবেন?
রাজীব বলল, নয় কেন? তোমরা যা ভাবছ, তা নয়। বিনয়বাবু বড় লোক বটে, কিন্তু নিরহঙ্কার। জানো তো, বস্তিতে বসেও উনি আড্ডা দেন। তখন বোঝা যায় না যে, লোকটা এম, এ. পাশ করেছেন। জামাইবাবুর সঙ্গে আগে ভিড়িয়ে দিই, তারপরে দেখো, কী রকম কাজ হয়। ব্যবসা বোঝেন কি না। বিজয় কোথায় গেল।
তিলি বলল, কী জানি। বোধ হয় বেরিয়ে গেছে। বিকেলে
দেখা করতে বোলো। চলি জামাইবাবু। বলে রাজীব তাকাল লীলার দিকে। লীলার পান খাওয়া ঠোঁট বেঁকে ছিল। ভ্রূ দুটি কেঁপে উঠল কয়েকবার
রাজীবের মুখ আবার লাল। তিলির মুখের দিকে একবার দেখে বেরিয়ে গেল সে।
মেঘনাদ অবাক চোখে তাকিয়ে রইল বোকার মতো। তারপর হঠাৎ হেসে উঠে বলল তিলিকে, তা হলে কাজ আরম্ভ করা যাবে শিগগিরই মনে হচ্ছে।
তিলি আড়ষ্ট হাসি হেসে একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। লীলা চোখ কুঁচকে একবার মেঘনাদকে দেখে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।