প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড

২.৬ আজ হতে অর্ধ শতাব্দী আগে

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

১.

আজ হতে অর্ধ শতাব্দী আগে ৬২ পেতিত র‍্যু পিকপাস অতি সাধারণ এক বাগানবাড়ি ছিল। এর সদর দরজাটা সব সময় আধখোলা অবস্থায় থেকে পথিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেই দুটো জিনিস নজরে পড়ত। প্রথমেই নজরে পড়ত আঙুরলতায় ঢাকা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এক উঠোন আর এক অলস দারোয়ানের মুখ। প্রাচীরের বাইরে কতকগুলি গাছের মাথা দেখা যেত। যখন সূর্যের উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়ত বাগানবাড়ির উঠোনটায় এবং মদপানের ফলে দারোয়ান সজীব হয়ে উঠত তখন কোনও পথিক তার পাশ দিয়ে যেতে যেতে সেদিকে একবার তাকিয়ে আনন্দ অনুভব না করে পারত না। কিন্তু তার বহিরঙ্গের এই হাস্যোজ্জ্বল ভাব সত্ত্বেও বাড়ির ভেতরটায় একটা বিষাদ জমে থাকত সব সময়। কারা যেন তার মধ্যে সব সময় প্রার্থনা করত আর কাঁদত।

কেউ যদি ভেতরে একবার ঢুকত তা হলে একটা সরু সিঁড়ি পেত যাতে দু জন লোক পাশাপাশি উঠতে পারত না। সেই সিঁড়ি দিয়ে একটা বারান্দায় উঠে গিয়ে দেখত বারান্দাটা অন্ধকার এবং দুটো জানালা দিয়ে তাতে বাইরে থেকে কিছুটা আলো আসত। সেই বারান্দা দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে গেলে একটা ছোট ঘরের দরজা দেখতে পেত। সে দরজায় কখনও তালাচাবি থাকত না। দরজাটা ঠেলে খুলে দু ফুট বর্গাকার একটা ঘরে ঢুকে দেখত ঘরটা একেবারে নির্জন এবং ঠাণ্ডা। দেয়ালগুলো সাধা ধবধবে। একটামাত্র জানালা দিয়ে দিনের আলো ঘরে আসত। ঘরের মধ্যে কোনও কিছু দেখতে পাওয়া যেত না কোনও পদশব্দ শোনা যেত না। ঘরের মধ্যে কোনও আসবাবপত্র ছিল না। একটা চেয়ার পর্যন্ত ছিল না। দেয়ালগুলোও ছিল একেবারে ফাঁকা। ঘরের। মধ্যেই ঢুকেই দেখত সামনের দেয়ালে সবুজ ফুল আঁকা একটা কাগজ চিটোন ছিল। ঘরের মধ্যে যে একটামাত্র জানালা ছিল তাতে ঘন করে লোহার গ্রিল দেওয়া ছিল, যার মধ্যে কোনও মানুষ ঢুকতে পারত না। তার ডান দিকে একটা দড়িতে একটা ঘণ্টা ঝোলানো ছিল।

ঘরখানায় কেউ সাহস করে ঢুকে পড়লে ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে এক নারীকণ্ঠ তাকে প্রশ্ন করত, কে ওখানে?

সে নারীকণ্ঠ ছিল বিষাদে ভরা। কিন্তু কোনও নারীকে চোখে দেখা যেত না। মনে হত সমস্ত ঘরখানা এক সমাধিগহ্বর। চারদিকের স্তব্ধ অন্ধকার দেয়ালগুলোর বাইরে কোনও জগৎ নেই। নারীকণ্ঠ তখন আবার বলত, আলোর দিকে ফের।

দরজার উল্টোদিকের দেয়ালে ভালো করে দেখলে একটা কাঁচের সার্সিওয়ালা দরজা পাওয়া যেত। সেই দরজা ঠেলে ভেতরে গেলে থিয়েটারের বক্সের মতো একটা ছোট ঘর পাওয়া যেত। তার মধ্যে দুটো চেয়ার আর একটা ছেঁড়া মাদুর পাতা থাকত।

আর এক নারীকণ্ঠ আবার বলত, আমি এখানে আছি। আপনি কী চান?

মানুষের কণ্ঠ শোনা গেলেও কোনও মানুষ দেখা যেত না। এমনকি কারও শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত শুনতে পাওয়া যেত না। মনে হত সমাধির ভেতর থেকে কোনও প্রেতাত্মা কথা বলছে।

আগন্তুক যদি ঠিকমতো সে কথার উত্তর দিত তা হলে ঘরখানার সামনের দিকে বদ্ধ একটা জানালার কিছুটা ভোলা হত। আর সেই আধখোলা জানালাপথে কালো অবগুণ্ঠনে ঢাকা একটা শুধু মাথা দেখা যেত। কালো অবগুণ্ঠনের ভেতর থেকে শুধু মুখ আর চিবুক ছাড়া আর কোনও অঙ্গ দেখা যেত না। আগন্তুক অন্ধকারে বসে থাকত আর সেই অবগুণ্ঠিত অশরীরী মুখটা শুধু কথা বলত, কিন্তু সে মুখ আগন্তুকের মুখপানে একবারও তাকাত না।

আগন্তুক অনেক চেষ্টা করেও সেই রহস্যময় মূর্তির কিছু দেখতে পেত না। শুধু শীতের কুয়াশায় ঢাকা সমাধিগহ্বরের ছায়া আর অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখতে পেত না। এক ভয়ঙ্কর প্রশান্ত স্তব্ধতা আচ্ছন্ন করে রাখত জায়গাটাকে। কোনও প্রেমূর্তি পর্যন্ত দেখা যেত না। কোনও দীর্ঘশ্বাস পর্যন্ত শোনা যেত না।

এমনি করে সমস্ত কনভেন্টটা এক সুকঠোর স্তব্ধতা আর বিষাদে জমাট বেঁধে থাকত সব সময়। এই হল বার্নাদিনে কনভেন্ট। আগন্তুক যেখানে গিয়ে বসত, সেটা হল বড় বৈঠকখানা। যে নারীকণ্ঠ কথা বলত তার সঙ্গে সে এক সিস্টার। ভেতরের ঘরের একটামাত্র জানালার কাঁচের সার্সি দিয়ে বাইরের পৃথিবীর সামান্য কিছু আলো আসত। এই পবিত্র স্থানে বাইরের কেউ আসতে পারত না। কেউ কিছু দেখতে পেত না।

কিন্তু সেই ছায়া আর অন্ধকারের ওপারে জীবন আর আলোর এক বিষণ্ণ নীরব সমারোহ ছিল। কিন্তু সে আলো জীবন-মৃত্যুর মতোই হিমশীতল আর প্রাণচাঞ্চল্যহীন। তার ভেতরে কী হত না হত তা বাইরের জগতের কেউ দেখতে বা জানতে পারত না। কেউ কোথাও তা বর্ণনা করেনি।

.

২.

১৮২৪ সালে পেতিত র‍্যু পিকপাসে যে কনভেন্ট ছিল সেখানে বার্নাদিনে সম্প্রদায়ের কিছুসংখ্যক সন্ন্যাসিনী মার্কিন ভার্গার নিয়ম-কানুন মেনে চলত। কিন্তু যারা ক্লেয়ারভয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিল তারা ছিল বেনেডিক্টাইনদের মতো সিটো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। তারা ছিল সেন্ট বার্নার্দ নয়, সেন্ট বেনেডিক্টের অধীন। ১৯২৫ সালে মার্তিন ভাগা বেনেডিক্টাইন বার্নাদিনে সম্প্রদায়ের মিলনে এক যুগ্ম ধর্মসভার প্রতিষ্ঠা করেন, যার সদর দপ্তর ছিল সালামাঙ্কাতে এবং আলকালাতে তার এক সহ-প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়।

এই ধর্মসভার কতকগুলি শাখা ইউরোপের ক্যাথলিক দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। এই সব শাখা রোমের মতো চার্চের নির্দেশ মেনে চলত।

বার্নাদিনে বেনেডিক্টাইন দলের সন্ন্যাসীরা মার্কিন ভার্গা’র অধীনে বেনেডিক্টাইনদের মতো অক্ষয় ভক্তির প্রার্থনা করে চলে। একমাত্র ভক্তিমূলক প্রার্থনা করে চলে। একমাত্র ভক্তিমূলক প্রার্থনা ছাড়া পেতিত পিকপাসের কনভেন্টের সন্ন্যাসিনীগণ অন্যান্য বিষয়ে ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বিশেষ করে তাদের পোশাক ছিল আলাদা। অন্যান্য দলের মেয়েরা সাদা পোশাক পরত, পেতিত পিকপাসের মেয়েরা পরত কালো পোশাক। ভক্তিমূলক উপাসনা এবং প্রার্থনাই ছিল দুটি সম্প্রদায়ের একমাত্র যোগসূত্র। যিশু ও মেরির বাল্যজীবন, পরবর্তী জীবন ও মৃত্যু সম্বন্ধেও দুই দলের ধারণা একই রকমের ছিল।

মার্তিন ভার্গা’র নিয়ম-কানুন ও রীতি-নীতি বড় কঠোর ছিল।

এই সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসিনীরা সারা বছর কঠোর আত্মনিগ্রহের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করত। তারা লেন্ট ও অন্যান্য তিথি উপলক্ষে উপবাস করত। তারা রাত্রি একটার সময় ঘুম থেকে উঠত। তার পর তাদের ধর্মীয় নিয়ম-কানুনের বই পড়ত এবং রাত তিনটে পর্যন্ত প্রার্থনা গান করত। তারা খড়ের তোষকের উপর মোটা খসখসে চাদর পেতে তার উপর শুত। তারা একেবারেই স্নান করত না। শীতে আগুন জ্বালাত না। প্রতি শুক্রবার নিজেদের চাবুক মারত। একমাত্র আমোদ-প্রমোদের সময় ছাড়া তারা কোনও কথা বলত না। সব সময় মৌত অবলম্বন করে থাকত। আমোদ-প্রমোদের সময়কাল খুবই অল্প ছিল। বছরের ছয় মাস চুল দিয়ে তৈরি এক রকমের জামা পরতে হত তাদের। ১৪ সেপ্টেম্বর হতে ঈস্টারের দিন পর্যন্ত। আগে সারা বছরই এই জামা পরার নিয়ম ছিল। গরমকালে এই জামা পরা অসম্ভব এবং অসহ্য হত বলে পরে এই নিয়মের পরিবর্তন করে ছয় মাস করা হয়। কিন্তু ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে এই জামা পরতে শুরু করলেই কয়েক দিন যাবৎ সন্ন্যাসিনীদের দারুণ কষ্ট হত। অনেকের জ্বর হত। আনুগত্য, দারিদ্র্য, সতীত্ব, সারাজীবন চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকা প্রভৃতি নিয়মগুলো শপথ করে তাদের পালন করতে হত।

যেসব সন্ন্যাসিনী মাদার উপাধি লাভ করেছে তাদের মধ্য থেকে একদলকে কনভেন্টের প্রধান নির্বাচিত করা হত তিন বছরের জন্য। এই মাদারদেরই একমাত্র কথা বলার অধিকার ছিল। তাই এদের লাতিন ভাষায় বলা হত ‘মেরে ভোকালে বা সোচ্চার মাতা। কথা বলার অধিকারসম্পন্ন প্রধানাই পিকপাসের কনভেন্টে কোনও আগন্তুক এলে কথা বলত তার সঙ্গে। এই প্রধানা জীবনে মাত্র পর পর দু বার নির্বাচিত হতে পারত। অর্থাৎ তার কার্যকাল নয় বছরের বেশি হতে পারবে না।

কনভেন্টের ভারপ্রাপ্ত যাজককে কোনও সন্ন্যাসিনী চোখে দেখতে পেত না। এই যাজক যে চ্যাপেলে বাস করত সেই চ্যাপেল আর কনভেন্টের মাঝখানে সাত ফুট উঁচু এক দেয়ালের বাধা ছিল। যাজক যখন বক্তৃতা মঞ্চ থেকে বক্তৃতা দিত, সন্ন্যাসিনীরা তখন মুখের উপর অবগুণ্ঠন টেনে দিয়ে বক্তৃতা শুনত। তারা খুব নিচু সুরে কথা বলত পরস্পরের সঙ্গে। তারা সব সময় মাথা নিচু করে পথ হাঁটত। একমাত্র একজনেরই প্রবেশাধিকার ছিল কনভেন্টে, তিনি হলেন স্থানীয় ধর্মীয় অঞ্চলের আর্কবিশপ।

আর একজন পুরুষ ছিল কনভেন্টে। সে হল বাগানের মালী। সে ছিল বয়সে বুড়ো। তার উপস্থিতি সম্পর্কে সন্ন্যাসিনীরা যাতে সতর্ক হয়ে উঠতে পারে তার জন্য তার হাঁটুতে একটা ঘণ্টা বাধা থাকত।

প্রধানার নির্দেশমতো সব নিয়মকানুন অকুণ্ঠভাবে মেনে চলতে হত সন্ন্যাসিনীদের। সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে। এক দ্বিধাহীন ধর্মগত আত্মসমর্পণের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হত নিজেদের। তারা তাদের প্রধানার অনুমতি ছাড়া কোনও কিছু পড়তে বা লিখতে পারত না। এ বিষয়ে তাদের আনুগত্য ছিল অন্ধ। কেউ কোনও প্রশ্ন বা প্রতিবাদ করতে পারত কখনও।

সন্ন্যাসিনীদের প্রত্যেককে পালাক্রমে একে একে প্রায়শ্চিত্ত ব্ৰত সাধন করতে হত। পৃথিবীতে যেখানে যত ভুল, আইন ও নীতিভঙ্গ, শৃঙ্খলাভঙ্গ, অসাম্য, অন্যায়, অবিচার প্রভৃতি পাপকর্ম অনুষ্ঠিত হয়–এ প্রায়শ্চিত্ত হল সেই সব পাপ আর অন্যায়ের জন্য। বিকাল চারটে থেকে রাত চারটে পর্যন্ত একটানা বারো ঘণ্টা ধরে প্রায়শ্চিত্তকারিণী সিস্টারকে প্রধান বেদির সামনে পাথরের মেঝের উপর নতজানু হয়ে বসে থাকতে হত। তার হাত দুটি জোড়া থাকত এবং তার ঘাড়ে একটা দড়ি বাধা থাকত। যখন সে খুব বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ত, যখন সে ক্লান্তি ও অবসাদ দুঃসহ হয়ে উঠত তার কাছে তখন সে শুধু সেইখানে হাত দুটো আড়াআড়িভাবে ক্রসের মতো করে উপুড় হয়ে পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়তে পারত। এইভাবে তাকে পৃথিবীর সমস্ত পাপীর জন্য প্রার্থনা করতে হত। এ কাজ নিঃসন্দেহে মহত্ত্বের পরিচায়ক।

যেখানে প্রায়শ্চিত ব্রত পালিত হয় তার সামনে একটি স্তম্ভের উপর সব সময় একটি বাতি থাকত।

প্রধান বেদির সামনে সব সময় একজন না একজন সিস্টার নতজানু হয়ে বসে প্রার্থনায় স্তব্ধ হয়ে থাকে। একেই বলে ‘পার্পেচুয়াল অ্যাডোরেশান’ বা চিরস্থায়ী প্রার্থনার প্রতিষ্ঠান।

মাদার উপাধিধারিণী সিস্টারদের নামঁ সেন্ট বা শহীদদের নাম অনুসারে রাখা হত না, তাদের নাম রাখা হত যিশু অথবা মাতা মেরির জীবনের বিভিন্ন ঘটনাবলির এক-একটিকে ভিত্তি করে, যেমন মাদার নেটিভিটি, মাদার কনসেপশান, মাদার অ্যানানসিয়েশান, মাদার প্যাশান প্রভৃতি। সেন্টদের নাম অনুযায়ী নাম রাখার কোনও বিধি নেই।

সন্ন্যাসিনী সিস্টারদের শুধু মুখগহ্বরটুকু ছাড়া দেখতে পাবে না কেউ। মুখ খুললেই তাদের হলুদ দাঁতগুলো দেখতে পাওয়া যাবে। কারণ দাঁত মাজার ব্রাশ কনভেন্টে ঢুকতে দেওয়া হয় না। সাধনার ঊর্ধ্বস্তরে উন্নীত একমাত্র বয়োপ্রবীণা সিস্টাররাই দাঁত মাজার অধিকার লাভ করে।

সিস্টাররা যেসব জিনিস দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করে সেই সব জিনিস কখনও ‘আমার একথা বলতে পায় না বলে সব সময় আমাদের বলতে হয় তাদের। যেমন আমাদের অবগুণ্ঠনবস্ত্র, আমাদের জামা প্রভৃতি। কখনও কখনও তারা কোনও বই, কোনও প্রাচীন বস্তু বা মেডেলের প্রতি অতি মাত্রায় আসক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু পার্থিব কোনও বস্তুর প্রতি কোনও আসক্তি তাদের পক্ষে অন্যায়। তাই এই আসক্তির কথা তারা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে সে আসক্তি সেন্ট থেরেসা’র কথা স্মরণ করে ত্যাগ করে। একবার এক মহিলা সেন্ট থেরেসা’র কনভেন্টে যোগদান করার সময় তাকে বলে, হে শ্রদ্ধেয়া মাতা, আমাকে একখানি পবিত্র বাইবেল গ্রন্থ দয়া করে দেবেন, কারণ এ গ্রন্থ আমি অন্তরের সঙ্গে ভালোবাসি।

একথা শুনে সেন্ট থেরেসা উত্তর করেন, হায়, তা হলে কোনও এক বস্তুর প্রতি অন্তরে তোমার একটা আসক্তি আছে। তা হলে আমাদের প্রতিষ্ঠানে যোগদান করা তোমার চলবে না।

কোনও সিস্টার একটা ঘরে একা থাকতে পেত না। অথবা ঘর বন্ধ করে বিশ্রাম করতে পেত না।

খোলা চালার মধ্যে সকলে মিলে থাকতে হত তাদের। যখন তারা দু জনে কখনও মিলিত হত তখন একজন আর একজনকে বলত, বেদির উপর যে দেবতা রয়েছে তার গুণগান ও প্রার্থনা করো।

তখন অন্যজন তার উত্তরে বলত, “চিরদিন। কেউ কারও ঘরের দরজার সামনে গেলেও ওই কথা বলত এবং ঘরের ভেতর যে থাকত সে-ও তার উত্তরে বলত, ‘চিরদিন।

অনেক সময় প্রথম কথা বলতে না বলতেই অন্যজন ‘চিরদিন’ কথাটা তাড়াতাড়ি বলে ফেলত। এই কথাটা বলাটা তাদের এক যান্ত্রিক অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। অনেক সময় কোনও আগন্তুক এসেই বলত, ‘মেরির গুণগান করো।’

তখন অন্যজন বলত, তিনি মহিমাময়।

এইভাবে তারা পরস্পরকে ‘শুভদিন জানাত, পরস্পরকে অভ্যর্থনা করত।

দিনের বেলায় যখনই গির্জার ঘণ্টা প্রতিটি প্রহর ঘোষণা করত যেমন পাঁচটা, আটটা অর্থাৎ ঘড়িতে যতটাই বাজত তখনই তারা পরস্পরে বলাবলি করত, শুধু এখন নয়, সব সময় সব প্রহরে বেদির দেবতা উপাসিত ও প্রশংসিত হন।

ঘণ্টার প্রহর ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যে যা করত অর্থাৎ কিছু কথা বলত, কিছু করত বা চিন্তা করত–সব কাজ থামিয়ে দিয়ে উপাসনা ও প্রার্থনার কথা বলত। এইভাবে প্রতিটি প্রহরের ঘণ্টাধ্বনি তাদের চিন্তার প্রবাহকে থামিয়ে দিয়ে ঈশ্বরের অভিমুখে ধাবিত করত। এই রীতি সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রচলিত ছিল। শুধু তাদের ছিল ভিন্ন। যেমন শিশু যিশুর উপাসকগণ প্রহরের ঘণ্টা শুনে বলত, শুধু এখন এই মুহূর্তে নয়, সব সময় যিশু খ্রিস্টের প্রেম আমার অন্তরে উজ্জ্বল হয়ে উঠুক।

মার্তিন ভার্গা’র অধীনস্থ বেনেডিক্টেনে বার্নাদিনে সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসিনীরা আজ হতে পঞ্চাশ বছর আগে পেতিত পিকপাসে সমবেত হয়। তারা শুধু প্রার্থনা করে করে সমস্ত কনভেন্টটাকে সমাধিভূমির মতো বিষাদময় করে তুলেছিল। মাঝে মাঝে তারা প্রার্থনা থামিয়ে নিচু গলায় বলে উঠত, যিশু-মেরি-জোসেফ।

কথাটা তারা এত নিচু গলায় বলত যে তা শোনাই যেত না।

পেতিত পিকপাসের কর্তৃপক্ষ প্রধান বেদির নিচে মাটি খুঁড়ে একটা গহ্বর তৈরি করে তার মধ্যে সব মৃতদেহকে সমাহিত করত। কিন্তু সরকার এইভাবে এক জায়গায় সব মৃতদেহ সমাহিত করার অনুমতি দিত না। সরকার হুকুম দিয়েছিল মৃতদেহকে কনভেন্টের বাইরে সমাধিভূমিতে নিয়ে যেতে হবে। এ হুকুম কনভেন্টের রীতির ওপর এক অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ হিসেবে গণ্য হয়। তবে তাদের সান্ত্বনা এই যে তারা ভগিয়ার্দের কবরখানার এক কোণে একটা বিশেষ জায়গায় এক বিশেষ সময়ে মৃতদেহকে সমাহিত করার অনুমতি লাভ করে। এই কবরখানা বেনেডিক্টেনে বার্নাদিনে সম্প্রদায়ের অধিকারে ছিল।

প্রতি বৃহস্পতিবার রবিবারের মতো দিনের বেলায় এবং সন্ধ্যাবেলায় সমবেত প্রার্থনায় যোগদান করত সবাই। তারা এমন সব উৎসব ও তিথির দিন পালন করত যার কথা বাইরের জগতের লোক জানত না। তাদের প্রার্থনা, প্রার্থনাকালের সংখ্যা এবং দৈর্ঘ্য এত বেশি ছিল যে তারা নিজেরাই তাতে বিরক্তবোধ করত।

সপ্তায় একদিন করে স্বীকারোক্তি অনুষ্ঠান হত। সারা সপ্তা ধরে প্রতিটি সিস্টার যেসব দোষ ও পাপ করত, তারা পালাক্রমে নতজানু হয়ে প্রধান সিস্টারদের সামনে অকুণ্ঠভাবে স্বীকার করত। প্রতিটি স্বীকারোক্তি পর্ব শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে মাদার উপাধিধারী সিস্টারের আলোচনা করে স্বীকারোক্তিকারিণীর দ্বারা কৃত ও স্বীকৃত পাপের জন্য শাস্তির বিধান দান করত।

তবে স্বীকারোক্তির ব্যাপারটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোনও পাপ বা অন্যায়ের জন্য নির্দিষ্ট থাকত। এ ছাড়া লা কুলপে নামে এক ধরনের অনুষ্ঠান হত। যদি কোনও সিস্টার বুঝত সে কোনও পাপ বা অন্যায় করেছে তখন সে প্রধান মাদারের সামনে উপুড় হয়ে শুয়ে হাত দুটো ছড়িয়ে রেখে শুয়ে থাকত। প্রধানা যে কাঠের উপর বসত সেই কাঠের গাঁয়ে তিনবার টোকা না দিলে শায়িত সিস্টার কিছুতেই উঠত না। কতকগুলি ছোটখাটো অন্যায় বা নিয়মভঙ্গের জন্য অনুশোচনার ব্যবস্থা ছিল। গ্লাসভাঙা, ঘোমটার কাপড় ছেঁড়া, অপরিচ্ছন্নতা ও প্রার্থনাগানের লাইন ভুলে যাওয়া বা সুর ভুল করা প্রভৃতি ছোটখাটো ভুলগুলোর ক্ষেত্রে ভুলকারিণী সিস্টার নিজেই নিজের বিচার করে অনুতাপ বা অনুশোচনা করত।

বসার ঘরে প্রধানা কোনও সিস্টার ডেকে পাঠালে প্রধানা নিজে অন্য সিস্টারদের মতো মাথার ঘোমটাটা মুখের উপর টেনে দিয়ে শুধু মুখগহ্বরের কাছটা সামান্য একটু খুলে রাখতেন। যেমন বাইরে থেকে কোনও আগন্তুক এলে করা হত। একমাত্র প্রধানাই বাইরে থেকে কোনও আগন্তুক এলে কথা বলতে যেত তার সঙ্গে। অন্য সিস্টারেরা শুধু তাদের বাড়ির আত্মীয়স্বজন ছাড়া আর কোনও বাইরের লোকের সামনে বেরোতে বা দেখা করতে পেত না। তবে আত্মীয়স্বজনদের দেখা করার অনুমতি খুব কমই মিলত। অতীতে কোনও সিস্টারকে ভালোবাসত এমন কোনও পুরুষ যদি কনভেন্টে এসে দেখা করার অনুমতি চাইত তা হলে সে অনুমতি দেওয়া হত না। সিস্টারের অতীতের কোনও বান্ধবী এই ধরনের অনুমতি পেতেন।

সেন্ট বেনেডিক্টের এই সমস্ত নিয়মকানুনগুলো মার্তিন ভার্গা আরও কঠোর করে তোলেন।

.

৩.

কনভেন্টের শিক্ষাকাল হল দু বছরের। এই কালের মধ্যে শিক্ষার্থিনী না পারলে আরও চার বছর শিক্ষাকাল বেড়ে যায়। তবে শিক্ষার্থীকে তেইশ-চব্বিশ বছরের মধ্যে শিক্ষাকাল শেষ করে শপথ গ্রহণ করতে হয়। কোনও বিধবাকে কনভেন্টে গ্রহণ করা হয় না। শপথ গ্রহণের পর শিক্ষার্থিনীকে নির্জন ঘরের মধ্যে আত্মনিগ্রহের জন্য এমন সব সাধনা করতে হয় যেগুলো গুহ্য এবং যার কথা তারা বলে না।

যেদিন শিক্ষাকাল শেষ করে শিক্ষার্থিনী শপথ গ্রহণ করে সেদিন ভালো জমকালো পোশাক পরে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। তার দেহের উপর একটা কালো চাদর ঢাকা দেওয়া হয়। অন্য সিস্টারেরা দুটি সারিতে বিভক্ত হয়ে তার দু পাশে দাঁড়ায়। তারা মৃত্যুকালীন প্রার্থনার গান গায়। তার পর একজন সকরুণ সুরে বলে, আমাদের সিস্টার মারা গেছেন।

আর একজন তখন বলে, খ্রিস্টের মধ্যে সে নবজীবন লাভ করেছে।

সেকালে এই কনভেন্টে একটি স্কুল ছিল এবং ছাত্রীদের এক আবাস ছিল। সেখানে ধনীদের মেয়েরা থেকে পড়াশুনো করত। সেই সময় এক ইংরেজ বালিকা ছিল সেখানে। ক্যাথলিক তালবতের নামে ধারণ করেছিল। সন্ন্যাসিনী সিস্টারদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করে ও প্রাচীরঘেরা এক বাড়িতে সব সময় বাস করে বাইরের জগৎ, জীবন ও বর্তমান যুগকে ঘৃণার চোখে দেখতে থাকে তারা। এই কনভেন্টের একটি মেয়ে একবার এই গ্রন্থের লেখককে বলে, রাস্তার পাথর দেখলেই মাথা থেকে গা পর্যন্ত আমার কাঁপতে থাকে। তারা নীল রঙের জামা-প্যান্ট আর সাদা টুপি পরত। ব্রোঞ্জ অথবা এনামেলের ক্রস গাঁথা থাকত তাদের বুকে। কতকগুলি উৎসবের দিন বিশেষ করে সেন্ট মার্থার জন্মদিনে ছাত্রীরা সিস্টারদের পোশাক পরে সারাদিন আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম করার এক বিশেষ অনুমতি পেত। প্রথম প্রথম সিস্টারেরা ছাত্রীদের ওই দিনে তাদের কালো পোশাক পরতে দিত। কিন্তু এটা প্রায় অধর্মাচরণের শামিল বলে কনভেন্টের প্রধানা অধিকত্রী তা নিষিদ্ধ করে দেন। আসল কথা, কনভেন্টের কর্তৃপক্ষ এই অনুমতি দান করলে ছাত্রীরা। সিস্টারদের পোশাক পরে ধর্মীয় জীবনযাপনের এক পূর্বাস্বাদ লাভ করে তারা সত্যিকারের একটা আনন্দ লাভ করত। এটা তাদের ছাত্রজীবনে একটা নতুনত্ব আর পরিবর্তন নিয়ে আসত। নির্দোষ নিরীহ সরলপ্রাণ শিশুদের কাছে এ এক পরম আনন্দের ব্যাপার।

কয়েকটি চরম আচরণ ছাড়া কনভেন্টের জীবনযাত্রা ও প্রথাগত সব আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে ছাত্রীরা একরকম অভ্যস্ত হয়ে পড়ত। তাদের জীবনের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ত একে একে সবকিছু। একজন ছাত্রী কনভেন্ট যাবার পর বিয়ে করে সংসারজীবনে প্রবেশ করেও কনভেন্টের কথা ভুলতে পারেনি। কোনও অতিথি তাদের বাড়িতে এলেই দরজা খুলে পুরনো অভ্যাসের বশে বলে উঠত, ‘চিরদিন। সিস্টারদের মতো সে-ও তাদের আত্মীয়স্বজনদের বৈঠকখানা ঘরে বসিয়েই কথাবার্তা বলত, বাড়ির ভেতরে নিয়ে যেত না। কনভেন্টের ছাত্রীরা কনভেন্ট ছেড়ে বাড়িতে আসার পর তাদের মাকেও তাদের আলিঙ্গন করতে দিত না। কনভেন্টের অভ্যাস এবং জীবনচর্যার কথা ভুলতে পারত না তারা সারা জীবনের মধ্যে। কনভেন্টের মধ্যে এত কড়াকড়ি ছিল যে ছাত্রীদের মায়েরা গিয়ে তাদের মেয়েকে চুম্বন করার অনুমতি পেত না। একবার এক ছাত্রীর মা তার তিন বছরের এক মেয়েকে নিয়ে কনভেন্টে তার মেয়েকে দেখতে যায়। কিন্তু সেই ছাত্রীর তিন বছরের বোনকেও তার দিদিকে চুম্বন করতে দেওয়া হয়নি। এমনকি জানালার গরাদের ভেতর দিয়ে সেই ছোট মেয়েকে তার হাতটা ঢুকিয়ে তার দিদিকে স্পর্শ করার অনুমতিও দেওয়া হয়নি।

.

৪.

সে যাই হোক, এই ছাত্রীরাই সমস্ত বিষাদাচ্ছন্ন প্রতিষ্ঠানটার মধ্যে এক ঝলক আলোর উজ্জ্বলতা এনে দিয়েছিল।

আমোদ-প্রমোদের জন্য ঘণ্টা বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বাগানে যাবার দরজাটা খুলে যেত আর বাগানের পাখিরা যেন মেয়েদের আহ্বান করে বলত, এখানে এস মেয়েরা। উদ্দাম তারুণ্যের এক বিরাট বন্যা বয়ে যেত যেন সারা বাগানময়। শিশুদের হাসিখুশিভরা উজ্জ্বল মুখ আর কপালগুলো বাগানের সব ছায়ান্ধকার দূর করে এক নতুন প্রভাতের আলো নিয়ে আসত যেন। অফিসের কাজকর্ম ও প্রার্থনার গান শেষ হয়ে গেলেই শিশু ও মেয়েদের কলকণ্ঠ শোনা যেত। সে কণ্ঠস্বর ছিল মৌমাছিদের গুঞ্জনধ্বনির থেকেও মধুর।

পাখির মতো এক-একটা ঝাক বেঁধে খেলা করত মেয়েরা। তারা পরস্পরকে ডাকাডাকি করত। ছোটাছুটি করত। তারা যখন হাসত তখন তাদের সাদা ঝকঝকে দাঁতগুলো দেখা যেত। তাদের এই সব হাসি, খেলা কিছুটা দূর থেকে অবগুণ্ঠিত সন্ন্যাসিনীরা আগ্রহভরে লক্ষ করত। মনে হত কতকগুলি ছায়ামূর্তি যেন সূর্যালোকের পানে সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তাতে কী যায়-আসে? তাতে তাদের সেই হাসির উজ্জ্বলতা ম্লান হত না কিছুমাত্র। যে সুখকে কনভেন্টের সন্ন্যাসিনীরা ঘৃণার চোখে দেখত সেই সুখের আলোর এক আশ্চর্য প্রতিফলনে এখানকার বিষাদময় প্রাচীরগুলো এক মায়াময় আনন্দের আবেগে প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠত। যেন মনে হত শোকাচ্ছন্ন এক পরিবেশের ওপর কে যেন একরাশ গোলাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে। সন্ন্যাসিনীদের চোখের সামনেই শিশুরা আনন্দে চঞ্চল হয়ে ছোটাছুটি করত। তাদের নির্দোষ সরলতা সন্ন্যাসিনীর দৃষ্টির আঘাতে বিচলিত হয় না কিছুমাত্র। ছোট ছোট মেয়েরা লাফাত ঝপাত আর বড় বড় মেয়েরা নাচত। এইভাবে কনভেন্টের সুকঠোর নিয়মনিষ্ঠা শিশুদের আন্তরিক সরলতার দ্বারা মেদুর হয়ে উঠত অনেকখানি। এইভাবে খেলাধুলার চঞ্চলতা আর ধর্মাচরণের স্তব্ধতা মিশে যেত একসঙ্গে। শিশুদের প্রাণচঞ্চল পাখনার হাওয়ায়। এখানকার জমাট স্তব্ধতার অনেকখানি যেন কেটে যেত। হোমার যেন পেরালতের সঙ্গে এই শিশুদের এই প্রাণখোলা হাসিতে যোগদান করতে পারতেন। এমন সুন্দর ও মহৎ দৃশ্য আর হতে পারে না। এই ছায়াচ্ছন্ন বাগানবাড়িতে যে তারুণ্যের উজ্জ্বল স্বাস্থ্য, প্রাণের হিল্লোল আর আনন্দের উত্তেজনা উত্তাল হয়ে উঠত মাঝে মাঝে তা সুদূর মহাকাব্যিক বা রূপকথার যুগের পিতামহীসুলভ সন্ন্যাসিনীদের কুঞ্চিত মুখের যুগান্তসঞ্চিত বিষাদগুলোকে বিদূরিত করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল।

মাঝে মাঝে শিশুদের এক-একটা কথা শুনে একই সঙ্গে হাসি ফুটে উঠত বড়দের মুখে আর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসত তাদের বুক থেকে। একবার পাঁচ বছরের একটি মেয়ে। একজন সন্ন্যাসিনীকে বলেছিল, আচ্ছা মাদার, একটা বড় মেয়ে আমাকে বলল, আমি নাকি এখানে আর নয় বছর দশ মাস থাকব। কত মজা! কী সুন্দর কথা!

আর একবার এক মাদার একটি ছয় বছরের মেয়েকে বলেছিল, তুমি কাঁদছ কেন মেয়ে?

মেয়েটি তখন উত্তর করেছিল, আমি অ্যালিক্সকে বলেছিলাম, ফরাসি দেশের ইতিহাস। আমি জানি। কিন্তু সে বলল, আমি জানি না।

নয় বছরের এক অ্যালিক্স তখন বলেছিল, না, ও জানে না।

মাদার বলেছিল, ব্যাপারটা কী? আসলে কী হয়েছিল?

অ্যালিক্স তখন বলেছিল, ও আমাকে ইতিহাস বইটা খুলে আমাকে তার থেকে যে। কোনও প্রশ্ন ধরতে বলল। আমি তাই করেছিলাম। কিন্তু ও উত্তর দিতে পারেনি।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। ও উত্তর দিতে পারেনি।

কিন্তু কী প্রশ্ন তুমি ওকে ধরেছিলে?

ও বলেছিল বইটার যে কোনও পাতা খুলে আমি প্রথমেই যে প্রশ্ন পাব সামনে তাই ধরব।

কিন্তু প্রশ্নটা কী?

প্রশ্নটা হল এই যে, তার পর কী ঘটেছিল?

একবার এক বাইরের লোক যে টাকা দিয়ে কনভেন্টে খেত সে একদিন এক শিশু ছাত্রীর খাওয়া দেখে আশ্চর্য হয়ে যায়। মেয়েটিকে খুব তাড়াতাড়ি গোগ্রাসে খেতে দেখে সে বলল, দেখ দেখ, বাচ্চা মেয়েটা একজন বয়স্কা মহিলার মতো খাচ্ছে।

কনভেন্টে যে সব স্বীকারোক্তির অনুষ্ঠান হত তা দেখে ছাত্রীরাও এখানে-সেখানে তাদের স্বীকারোক্তি লিখত বড়দের মতো। একবার সাত বছরের একটি মেয়ে মেঝের উপর তার স্বীকারোক্তি লিখে রাখে। সে লেখে, ফাদার, আমি স্বীকার করছি আমার অর্থলোভ আছে। আমি স্বীকার করছি আমি ব্যভিচার করেছি। আমি স্বীকার করছি আমি ভদ্রলোকদের পানে তাকিয়েছি।

এই কাহিনীটি একবার ছয় বছরের একটি মেয়ে কোনও এক নদীর ধারে ঘাসে ঢাকা তীরের উপর বলেছিল। কোনও একটা ফুলে ভরা ঝোপে তিনটে মোরগ বাস করত। তারা প্রথমে অনেক ফুল তুলে পকেটে ভরল। তার পর পাতাগুলো খেলনার মধ্যে ভরল। সে দেশের বনের মধ্যে একটা নেকড়ে ছিল। সেই নেকড়েটা সেই মোরগ তিনটেকে খেয়ে ফেলল।

পিতামাতার দ্বারা পরিত্যক্ত একটি শিশুকে কনভেন্ট লালন-পালন করত। সে একদিন এক মর্মবিদারক কথা বলে। সে বলে, আমার যখন জন্ম হয় আমার মা তখন ছিল না।

একজন মোটা চেহারার সিস্টার সব ঘরের চাবি রাখত। তার নাম ছিল আগাথা। মেয়েরা তাকে আগামোকলশ বলত–অর্থাৎ চাবির আগাথা।

বাগানের দিকে আয়তক্ষেত্রাকার একটা বড় ঘর ছিল। সে ঘরের প্রতিটি কোণের মেয়েরা এক-একটা নাম দিয়েছিল। যেমন মাকড়সার কোণ, আরশোলার কোণ, কাঠপোকার কোণ এবং ঝিঁঝি পোকার কোণ। তবে ঝিঁঝি পোকার কোণটা রান্নাঘরের কাছে থাকার জন্য গরম বলে সেটাকে অনেকে পছন্দ করত। ছাত্রীরা যে যে কোণে বসত সেই নামে অভিহিত হত তারা।

একবার আর্কবিশপ পরিদর্শন করতে এসে এক কোণে সুন্দর চুলওয়ালা একটি সুন্দরী বাচ্চা মেয়েকে দেখে বলেন, মেয়েটি কে?

তখন মেয়েরা বলে, ও হচ্ছে মাকড়সা।

আর্কবিশপ বলেন, তাই নাকি? ওই কোণের ওই মেয়েটি কে?

ও হচ্ছে ঝিঁঝি পোকা।

আর ও?

ও হচ্ছে আরশোলা।

বাহ্, আর তোমার নাম?

আমার নাম কাঠপোকা।

তখনকার দিনে এই সব প্রতিষ্ঠানে অনেক অনাথ শিশুমেয়েকে রেখে প্রতিপালন করা হত। উৎসবের দিনে এই মেয়েরা খুব আনন্দ পেত। কোনও এক উৎসবের দিন কুমারীরা যখন ফুল নিয়ে বড় বেদির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন একটি সাত বছরের মেয়ে ষোলো বছরের একটি মেয়েকে বলে, তুমি তো কুমারী, কিন্তু আমি কুমারী নই।

.

৫.

কনভেন্টের খাবার ঘরের দরজার সামনে বড় বড় কালো অক্ষরে একটি শিশুর প্রার্থনা লেখা আছে। এই প্রার্থনার নাম হোয়াইট পেটার নস্টার। এই প্রার্থনার কথা কেউ পড়লে সরাসরি স্বর্গে চলে যাবে। লেখা আছে, হে ক্ষুদ্র হোয়াইট পেটার নস্টার, যাকে ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন, ঈশ্বর যার সঙ্গে কথা বলেন, যাকে ঈশ্বর স্বর্গে স্থান দিয়েছেন, রাত্রিতে বিছানায় শুতে গিয়ে আমার বিছানায় তিনটি দেবদূতকে দেখতে পাই। একজন দেবদূত আমার পায়ের দিকে, একজন আমার মাথার দিকে, আর একজন কুমারী মাতা মেরি। আমার পা আর মাথার মধ্যভাগে এসে দাঁড়ান। তিনি আমাকে কোনও কিছুকে ভয় না। করে শান্তভাবে শুয়ে থাকতে বলেন। ঈশ্বর আমার পিতা, কুমারী মাতা আমার মা, তিনজন ঈশ্বর প্রেরিত ধর্মপ্রচারক আমার তিন ভাই আর তিনজন কুমারী আমার তিন বোন। ঈশ্বর জন্মগ্রহণকালে যে পোশাক পরেছিলেন সে পোশাকে আবৃত আছে আমার দেহ। সেন্ট মার্গারেটের ক্রস আঁকা আছে আমার বুকে। কুমারী মাতা মাঠের উপর দিয়ে হেঁটে যাবার সময় সেন্ট জনের সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। তিনি সেন্ট জনকে জিজ্ঞাসা করেন, কোথা থেকে আপনি আসছেন মঁসিয়ে সেন্ট জন?

সেন্ট জন উত্তর করেন, আমি আসছি আভে সেলাস থেকে।

তুমি কি ঈশ্বরকে দেখেছ? কোথায় তিনি?

তিনি আছেন ক্রসের কাঠের উপর। তার পাদুটো ঝুলছে। তাঁর হাত দুটোতে পেরেক পেটানো আছে। তার মাথায় আছে কাটার টুপি।

যে এই কথাটা রাত্রিকালে আর সকালবেলায় তিনবার করে উচ্চারণ করে সে মৃত্যুর পর স্বর্গলাভ করে।

১৮২৭ সালে দেয়ালের উপর চুনকাম করার সময় এই প্রার্থনার কথাগুলো মুছে যায়। এ প্রার্থনার কথা কনভেন্টের পুরনো ছাত্রীদের স্মৃতি থেকে মুছে গেছে একেবারে। সেদিনের সেই শিশু মেয়েরা আজ হয়তো বুড়ি হয়ে গেছে।

খাবার ঘরের সামনের দেয়ালে একটি বড় ক্রস টাঙিয়ে ঘরের শোভাবর্ধন করা হয়েছে। ঘরের একটা মাত্র দরজা বাগানের দিকে খোলা। দুটো সরু টেবিল ঘরের মধ্যে সমান্তরালভাবে পাশাপাশি রাখা আছে। ঘরের দেয়ালগুলো সাদা এবং টেবিলগুলো কালো। শোকসূচক বিষাদের পটভূমিকায় এই একটা মাত্র রঙের বৈপরীত্যকে মেনে নেওয়া হয়েছে কনভেন্টে। ছাত্রীদের খাবারও খুব সাদাসিধে ছিল। প্রত্যেককে এক ডিশ মাংস অথবা নোনা মাছ আর কিছু সবজি দেওয়া হত। ছাত্রীরা নীরবে খেত এবং একজন মাদার তাদের দেখাশোনা করত। এই নীরবতা ভঙ্গ করে যদি একটা মাছি গুনগুন করে উড়ে আসত তা হলে সে-ও আর না উড়ে একটা কাঠের মই-এর উপর বসে পড়ত। কেউ কোনও কথা বলত না। শুধু ঘরখানার জমাটবাঁধা নিস্তব্ধতার মাঝে ক্রসের নিচে দাঁড়িয়ে একটি বড় মেয়ে সেন্টদের জীবনী পাঠ করে যেত। প্রতিটি বড় মেয়েকে এক সপ্তা করে কাজ করতে হত। একটা টেবিলের উপর কতকগুলি জলভরা মাটির পাত্র সাজানো থাকত। খাওয়ার পর মেয়েরা তাদের ডিশগুলো ধুত। যদি তাতে কোনও অভুক্ত খাবারের টুকরো পড়ে থাকত তা হলে তার জন্য শাস্তি পেতে হত তাদের।

যদি কোনও মেয়ে কথা বলে কখনও নীরবতা ভঙ্গ করত তা হলে তাকে শাস্তি পেতে হত। তা হলে তাকে পাথরের মেঝের উপর জিব দিয়ে ক্রস আঁকতে হত। যে ধূলিকণা সব মানুষের আনন্দময় জীবনের পরিণতি, ছোট্ট জিব দিয়ে সেই ধূলিকণা চেটে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে শিখতে হত। এইভাবে নিয়মভঙ্গকারী উদ্ধত জিবকে শাস্তি দেওয়া হত।

কনভেন্টে একটা বিরল বই ছিল। এই বই একখানা মাত্র ছাপা ছিল এবং সেই বই পড়া নিষিদ্ধ ছিল। বইটাতে ছিল সেন্ট বেনেডিক্টের নিয়মকানুন। কোনও অধর্মাচারীর অপবিত্র দৃষ্টি যেন সে বইয়ের ভেতর প্রবেশ করতে না পারে। ছাত্রীরা অনেক সময় বইটা কোনও রকমে হাতে নিয়ে গোপনে পড়ত। ধরা পড়ে যাবার ভয়ে তারা সব সময়। সন্ত্রস্ত হয়ে থাকত পড়ার সময়। তবে সেই বই পড়ে বিশেষ কোনও আনন্দ পেত না তারা। ছেলেদের পাপকর্ম সম্বন্ধে লেখা কতকগুলি পাতা শুধু তারা দেখত। সে লেখাগুলো এমনই দুর্বোধ্য ছিল যে তারা ভালো করে বুঝতেই পারত না।

বাগানবাড়ির একটা পথের দু ধারে কতকগুলি ফলের গাছ ছিল। কড়া নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কখনও কখনও মেয়েরা একটা কাঁচা আপেল, একটা পচা আতা অথবা পোকা খাওয়া নাশপাতি ফল পেড়ে নিত গাছ থেকে। এ বিষয়ে একখানি চিঠি আমার সামনে আছে। কনভেন্টের এক ভূতপূর্ব ছাত্রী বর্তমানে একজন ডিউকপত্নী এবং প্যারিস শহরের একজন অতি সম্ভ্রান্ত মহিলা। তার চিঠিখানিতে লেখা আছে, বাগানে কোনও ছাত্রী কোনও ফল পাড়লে তাকে সেটা লুকিয়ে রাখতে হত। সেই ফল বিছানায় শুতে গিয়ে সেখানে খেতে হত। এটাই ছিল আমাদের সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার।

আর একবার আর্কবিশপ কনভেন্ট পরিদর্শনে আসেন। ম্যাদময়জেল বুশার্দ নামে একটি সাহসী ছাত্রী আর্কবিশপের কাছে এক দিনের ছুটির জন্য আবেদন করে। এ প্রতিষ্ঠানে কড়া নিয়ম-কানুনের মধ্যে এই ধরনের আবেদন প্রথাবিরুদ্ধ এবং ভয়ঙ্কর। তবু সে আবেদন মঞ্জুর করেন আর্কবিশপ। যারা সেখানে উপস্থিত ছিল তারা এটা বিশ্বাস করতেই পারেনি। শুধু এক দিন নয়, তিন দিনের ছুটি মঞ্জুর হয়। মেয়েরা যখন সারবন্দিভাবে দাঁড়িয়েছিল এবং আর্কবিশপ যখন তাদের দেখতে দেখতে তাদের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন তখন বেশ লম্বা চেহারার সুন্দরী বুশার্দ সাহস করে এগিয়ে গিয়ে আর্কবিশপের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, মঁসিয়ে, আমি এক দিনের ছুটি প্রার্থনা করছি।

আর্কবিশপ মঁসিয়ে দ্য কেলের মৃদু হেসে বললেন, মাত্র এক দিনের? এটা মোটেই যথেষ্ট হবে না মেয়ে। আমি তিন দিনের ছুটি মঞ্জুর করছি।

মহামান্য আর্কবিশপ যখন কথা দিয়ে ফেলেছেন তখন কনভেন্টের প্রধানা কত্রীর কোনও ক্ষমতা ছিল না তার ওপর। এটা কনভেন্টের নিয়মকানুনের ওপর এক বিরাট হস্তক্ষেপ, কিন্তু ছাত্রীদের পক্ষে এক বিরাট জয় এবং আনন্দের ব্যাপার।

যেসব উঁচু প্রাচীর দিয়ে কনভেন্ট ঘেরা ছিল সেসব প্রাচীর কিন্তু একেবারে দুর্ভেদ্য ছিল না। বাইরের জগতের কথা, অনেক নাটক ও অনেক প্রেমের কাহিনী প্রতিধ্বনিত হত সে প্রাচীর ভেদ করে।

এমন একটি ঘটনার বিবরণ নিচে দেওয়া হল, যে ঘটনাটার সঙ্গে আমাদের মূল কাহিনীর কোনও সম্পর্ক না থাকলেও তার দ্বারা কনভেন্টের একটা সাধারণ ছবি পাওয়া যাবে।

সেই সময় মাদাম আলবার্তিনে নামে একজন সম্ভ্রান্ত মহিলা একবার কনভেন্টে বেড়াতে আসে। তাকে সবাই শ্রদ্ধা করত। তার সম্বন্ধে খুব একটা বেশি কিছু জানা যায়নি। শুধু জানা গিয়েছিল তার মাথাটা ঠিক ছিল না এবং অনেকের ধারণা সে নাকি। মারা গেছে। বিরাট অভিজাত ঘরে তার বিয়ে হলেও বিয়ের যৌতুকের ব্যাপারে যে অশান্তির উদ্ভব হয় তাতে তার মাথা খারাপ হয়ে যায়।

মহিলাটির বয়স তিরিশের বেশি হবে না। তার মাথার চুল কালো এবং মুখখানা খুবই সুন্দর ছিল। তার চোখদুটোও বেশ কালো আর আয়ত ছিল। সে প্রায়ই কালো কালো চোখের দৃষ্টি ছড়িয়ে দূরে কী দেখত। কিন্তু আসলে সে কী কিছু দেখত? সে এত ধীর শ্লথ গতিতে হাঁটত যে সে চলছে বলে মনেই হত না। সে কখনও কারও সঙ্গে কথা বলত না। মনে হত তার নাক দিয়ে নিশ্বাস পড়ছে না। তার হাত দুটো ছিল বরফের মতো ঠাণ্ডা। সে যেখানেই যেত তার স্তব্ধ ও হিমশীতল সৌন্দর্যের এক বিষণ্ণ প্রভাব ছড়িয়ে পড়ত চারদিকে। একদিন সেই মহিলার পাশ দিয়ে যাবার সময় একজন সিস্টার আর একজনকে বলল, উনি যেন মৃত।

মাদাম আলবার্তিনেকে ঘিরে অনেকে অনেক গল্প করত। সে ছিল সবার কাছে অনন্ত কৌতূহলের এক অফুরন্ত উৎস। চ্যাপেলের মধ্যে একটা স্টলের মতো খোলা জায়গা ছিল। সেখান থেকে সে প্রার্থনায় যোগদান করত এবং যাজকদের নীতি-উপদেশ শোনাত।

একদিন উচ্চপদস্থ একজন যুবক যাজক নীতি-উপদেশ দান করতে আসেন। তাঁর নাম ছিল রোহ। ফ্রান্সের এক জমিদারবাড়ির সন্তান। পরে তিনি প্রিন্স দ্য লিয় উপাধিতে ভূষিত হয়ে সেনাবাহিনীর এক অফিসার নিযুক্ত হন এবং ১৮৩৩ সালে মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি বেসাকনের কার্ডিনাল ও আর্কবিশপ হন।

বোহ এবার এই প্রথম এই কনভেন্টে নীতি-উপদেশ প্রচারের কাজে আসেন। মাদাম আলবার্তিনে সাধারণত প্রার্থনার পর প্রচারিত নীতি-উপদেশ ও ধর্মকথা শান্ত ও স্তব্ধ হয়ে শুনত। সেদিন কিন্তু সে মঁসিয়ে দ্য রোহাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে আসন থেকে কিছুটা উঠে ‘সেকি আগান্তে। বিস্ময়ের সঙ্গে এই কথা দুটো বলে ওঠে। চ্যাপেলের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত নীরবতার মাঝে তার এই বিস্ময়সূচক কণ্ঠস্বর শুনে ধর্মসভার সকলেই চমকে ওঠে এবং নীতিপ্রচারক রোহও মুখ তুলে তাকায় মাদাম আলবার্তিনের দিকে। কিন্তু মাদাম আলবার্তিনের কথাটা বলেই ততক্ষণে আবার তার আসনে স্থির হয়ে বসে পড়েছে। প্রাণচাঞ্চল্যের একটা দমকা হাওয়া, যৌবন জীবনের এক উদ্দাম আলোকরশ্মি অকস্মাৎ যেন বাইরে থেকে এসে মাদাম আলবার্তিনের মৃত্যুর মতো হিমশীতল মুখখানাকে সজীব ও প্রাণবন্ত করে তোলে। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই সে আলো, সে হাওয়া চলে যেতেই এক সাক্ষাৎ মৃত্যুর প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠে সেই মুখখানা।

কিন্তু মাদাম আলবার্তিনের এই সামান্য কথা দুটো প্রচুর জল্পনা-কল্পনার সৃষ্টি করল কনভেন্টের মধ্যে। সেকি অগাস্তে! এই কথা দুটোর মধ্যে যেন এক রহস্যময় অজানিত কাহিনী লুকিয়ে আছে। মঁসিয়ে দ্য রোহ’র শৈশবের নাম অগাস্তে একথা ঠিক। আর এটাও সত্য কথা যে মাদাম আলবার্তিনে নিজে অভিজাত বংশের মেয়ে এবং উচ্চ অভিজাত সমাজে ঘোরাফেরা করত। তা না হলে রোহ’র মতো উচ্চপদস্থ ব্যক্তিকে এমন ঘরোয়া নাম ধরে ডাকতে পারত না। নিশ্চয় তা হলে রোহ’র সঙ্গে তার একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। সেটা রক্তগত সম্পর্কও হতে পারে। তা না হলে তার ছেলেবেলায় ঘরোয়া নামটা জানা সম্ভব হত না তার পক্ষে।

মেসদেম দ্য ক্লয়সিউল আর দ্য সেরেন্ত নামে দু জন ডিউকপত্নী তাদের সামাজিক মর্যাদার জোরে কনভেন্টে প্রায়ই বেড়াতে আসত। কিন্তু তারা আসার সঙ্গে সঙ্গে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ত কনভেন্টের সকলে। এই দু জন মহিলা যখন ছাত্রীদের পাশ দিয়ে চলে যেত তখন তারা তাদের চোখ নামিয়ে ভয়ে কাঁপত।

কনভেন্টের ছাত্রীদের প্রতি মঁসিয়ে দ্য রোহ’র আগ্রহটাও ক্রমশ বেড়ে ওঠে। অথচ তাঁর এই ক্রমবর্ধমান আগ্রহের কথাটাকে তিনি নিজেই তাঁর সচেতন মনের মধ্যে ধরতে পারতেন না। সম্প্রতি তিনি প্যারিসের আর্কবিশপের সহকারী হিসেবে গ্র্যান্ড ভিকার পদ লাভ করেন এবং পদোন্নতির পরবর্তী ধাপ বিশপের পদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। সম্প্রতি পেতিত পিকপাসের চ্যাপেলে আসাটা একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে রোহার। পর্দানশীন যুবতী সন্ন্যাসিনীরা চোখে দেখতে পেত না তাকে। কিন্তু তার নরম অথচ কিছুটা মোটা কণ্ঠস্বর তারা সবাই চিনত। আগে তিনি একজন সামরিক অফিসার ছিলেন। পোশাক-আশাকের ব্যাপারে তার একটা খুঁতখুঁতে ভাব ছিল। তাঁর মাথার বাদামি চুলগুলো সুন্দরভাবে আঁচড়ানো থাকত সব সময়। তার আলখাল্লাটা খুব সুন্দর ছিল এবং সিল্কের একটা কাপড়ে কোমরটা বাঁধা থাকত। ষোড়শী তরুণীদের কাছে তাঁর চেহারাটা সত্যিই খুব প্রিয় ছিল।

বাইরের জগৎ থেকে কোনও শব্দের ঢেউ এসে কখনও ঢুকত না কনভেন্টের প্রাচীরঘেরা সীমানার মধ্যে। কিন্তু গত এক বছর হল একটা বাঁশির সুরলহরী কনভেন্টের মধ্যে ভেসে আসে। সে সুর প্রায়ই শোনা যায় কনভেন্টের মধ্যে। সেদিন যারা এ কনভেন্টের ছাত্রী ছিল তারা সবাই আজও মনে রেখেছে সে কথা। যে গানটা বাঁশির সুরে ফুটে উঠত সে গানের প্রথম লাইন হল, জেতালবে, এস, তুমি এসে রাজত্ব করো আমার অন্তরে। এই গানের সুর সে বাঁশিতে দিনে বেশ কয়েকবার ধ্বনিত হত। সে সুর শুনে স্কুলের মেয়েরা মোহিত হয়ে যেত, সন্ন্যাসিনী মাদাররা ক্রুদ্ধ হয়ে উঠত, ছাত্রীদের মনোযোগ ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ত। ফলে শাস্তির বিধান করতে হত বারবার। এই ব্যাপারটা চলে কয়েক মাস ধরে এবং মেয়েরা সেই অদৃশ্য অজ্ঞাত বংশীবাদকের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। প্রতিটি মেয়েই নিজেকে জেতাবে ভাবে।

বাঁশির সুরটা আসত র‍্যু দ্ৰয়েত মুরের দিক থেকে। এ সুর শুনতে শুনতে কনভেন্টের। মেয়েরা এমনই মুগ্ধ হয়ে উঠেছিল যে, যে অচেনা-অদেখা যুবক এ বাঁশি বাজায় তাকে শুধু একবার চোখের দেখা দেখার জন্য তারা তাদের জীবনের সবকিছু দিয়ে দিতে পারত। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অবসর সময়ে তিনতলার একটা ঘরে ঢুকে জানালা দিয়ে র‍্যু দ্ৰয়েত মুরের দিকে তাকিয়ে সেই বাঁশির বাদককে দেখার এক ব্যর্থ চেষ্টায় ফেটে পড়ত। কেউ কেউ জানালার ভেতর দিয়ে হাত বার করে একটা রুমাল ওড়াত। দু জন মেয়ের সাহস সবচেয়ে বেশি ছিল। তারা বিপদের ঝুঁকি নিয়ে সব ভয় ঝেড়ে ফেলে একদিন ছাদের উপর উঠে সেই বাঁশি যে বাজায় তাকে দেখে। কিন্তু তারা যা ভেবেছিল তা নয়, সে বয়সে যুবক নয়, সে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক। সে এখন অন্ধ এবং নিরাশ্রয়। হাতে কোনও কাজ না থাকায় সময় কাটাবার জন্য বাঁশি বাজায়।

.

৬.

পেতিত পিকপাসের মাটিতে তিনটে পৃথক বাড়ি ছিল। একটাতে ছিল মূল কনভেন্ট, একটা বাড়িতে থাকত সন্ন্যাসিনীরা আর একটা বাড়ি ছিল বোর্ডিং-হাউস বা ছাত্রীদের আবাস। সেটাকে লিটল কনভেন্ট বলা হত। এই বোর্ডিংয়ের সামনে একটা বাগান ছিল। এ বাড়িতে অন্যান্য সম্প্রদায়ের অনেক প্রবীণা সন্ন্যাসিনীও থাকত। বিপ্লবের সময় যেসব কনভেন্ট ধ্বংস হয়ে যায় তারা আগে থাকত সেই সব কনভেন্টে। তারা কালো, ধূসর, সাদা প্রভৃতি নানারকমের পোশাক পরত।

সম্রাট এই সব বিধ্বস্ত কনভেন্টগুলোর সিস্টার ও সন্ন্যাসিনীদের বেনেডিক্টিনে বার্নাদিনে সম্প্রদায়ের দ্বারা যৌথভাবে চালিত কনভেন্টে আশ্রয় নেবার অনুমতি দান করেন। সরকার। তাদের জন্য কিছু করে বৃত্তির ব্যবস্থা করেন এবং পেতিত পিকপাসের কর্তৃপক্ষ তাদের সাদরে গ্রহণ করে। তারা আপন আপন মতে চলত। তারা মাঝে মাঝে স্কুলের মেয়েদের তাদের কাছে যেতে দিত। তাদের মধ্যে যাদের কথা ছাত্রীদের মনে রেখাপাত করে তারা হল মেরে সেন্ত বেসিল, মেরে সেন্ত স্কুলেশটিক আর মেরে জ্যাকব।

তাদের মধ্যে সে অয়ে সম্প্রদায়ের একজন প্রবীণা সিস্টার অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পেতিত পিকপাসের একটা ঘরে এসে বাস করতে থাকে। এই সম্প্রদায়ের এই একজন মাত্র সিস্টারই বেঁচে থাকে। সে খুব গরিব ছিল এবং তার সম্প্রদায়ের জন্য নির্দিষ্ট জমকালো পোশাক পরার তার আর্থিক সামর্থ্য ছিল না। সে তাই একটা পুতুলকে সে পোশাক পরিয়ে রাখত। তার মৃত্যুকালে সে পুতুলটা কনভেন্টকে দিয়ে যায়। ১৮২৪ সাল পর্যন্ত সেই সিস্টার তার সম্প্রদায়ের একমাত্র প্রতিভূ হিসেবে বেঁচে ছিল। আজ শুধু তার পুতুলটা পড়ে আছে।

বিভিন্ন সম্প্রদায়ের এই সব ভক্ত মাদার উপাধিধারিণী সিস্টারদের সঙ্গে মাদাম আলবার্তিনের মতো কিছু বয়স্ক মহিলা লিটল কনভেন্টের বোর্ডিংয়ে থাকার অনুমতি লাভ করে। এ ছাড়া আর যে তিনজন এই অনুমতি পায় তারা হল মাদাম দ্য বোফোর্ত, মাদাম দ্য হতপোল আর মাদাম লা মাই দুফ্রেসনে। আর একজন মহিলা থাকত যে মাঝে মাঝে নাকি সুরে দারুণ গোলমাল আর হট্টগোল করত। স্কুলের মেয়েরা তার নাম দিয়েছিল ডাকারমিনি বা বজ্রপাত।

১৮২০ সালের কাছাকাছি মাদাম দ্য জেনলিস নামে একজন বাইরের মহিলা কনভেন্টে একদিন আবাসিক অতিথি হিসেবে থাকার অনুমতি চায়। সে লা ইসজেপিদে নামে একটি সাময়িক পত্রিকা সম্পাদনা করত এবং রাজার ভাই দিউক দ্য অলিয়ান্স তাকে এখানে থাকতে দেবার জন্য সুপারিশ করেন। তাতে বিরক্তির এক গুঞ্জন জাগে কনভেন্টের মধ্যে এবং অজানা আশঙ্কার এক ছায়া নেমে আসে। এই মাদাম জেলিস নাকি কয়েকটা উপন্যাস লেখে আগে। কিন্তু পরে উপন্যাস লেখা ছেড়ে পুরোপুরি ধর্মীয় জীবনযাপন করতে থাকে। কিন্তু কয়েক মাস বাস করার পরই কনভেন্ট ছেড়ে চলে যায় মাদাম জেলিস। সে নাকি যাবার সময় বলে যায় এখানকার বাগানে যথেষ্ট ছায়া নেই। সে চলে গেলে সন্ন্যাসিনীরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। অবশ্য মাদাম জেলিস মানুষ হিসেবে খারাপ ছিল না এবং বয়সে বৃদ্ধ হলেও সে বীণা বাজাতে পারত।

কনভেন্ট চ্যাপেল বা ছোট গির্জাটা ছিল প্রধান কনভেন্ট এবং স্কুলবোর্ডিংয়ের মাঝখানে। বড় রাস্তার দিকে এই চ্যাপেলের একটা দরজা ছিল এবং সেদিক দিয়ে বাইরের কিছু লোক আসত। কিন্তু কনভেন্টের সন্ন্যাসিনী বা সিস্টারেরা তাদের মুখ দেখতে পেত না। সাত ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছায়া-ছায়া বিষাদের অন্ধকারে ভরা কনভেন্ট চ্যাপেলে সমবেত প্রার্থনার সময় কনভেন্টের সিস্টাররা বাঁ দিকে সার দিয়ে দাঁড়াত, ডান দিকে দাঁড়াত স্কুলের মেয়েরা আর আবাসিক অতিথিরা পেছনের দিকে থাকত শিক্ষানবিশ সন্ন্যাসিনীরা। চ্যাপেলের জানালাগুলো ছিল বাগানের দিকে এবং সেই দিক থেকেই যা কিছু আলো আসত।

.

৭.

১৮১৯ থেকে ১৮২৫ সাল পর্যন্ত পেতিত পিকপাসের প্রধানা কত্রী ছিলেন ম্যাদময়জেল দ্য ব্লেমুর যার সন্ন্যাসজীবনের নাম ছিল মেরে ইনোসেন্তে। যে মার্গারিতে দ্য ব্লেমুর গত শতাব্দীতে বেনেডিক্ট সম্প্রদায়ের সেন্টদের জীবনকাহিনী লেখেন সেই ব্লেমুরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ম্যাদময়জেল ব্লেমুরের বয়স ছিল প্রায় ষাট। তার চেহারাটা ছিল বেঁটে-খাটো আর মোটাসোটা। তার গলার স্বর মোটেই ভালো ছিল না। যখন গান করতেন তখন তার গলাটা ফাটা পাত্রের মতো কর্কশ শোনাত। তবু মানুষ হিসেবে তিনি খুব ভালো ছিলেন। তাদের দলের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে হাসিখুশিসম্পন্না মহিলা এবং তাঁকে সবাই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত। তাঁর পূর্বপুরুষদের অনেক গুণই আয়ত্ত করেন তিনি। অনেক পড়াশোনা করে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন তিনি। ইতিহাসে গভীর জ্ঞান ছিল তাঁর। এ ছাড়া লাতিন, গ্রিক এবং হিব্রু ভাষাতেও পাণ্ডিত্য ছিল তাঁর।

ম্যাদময়জেল ব্লেমুরের সহকারিণী ছিল স্পেনদেশীয় এক সন্ন্যাসিনী যার নাম ছিল মেরে সিনে রেস। তার অনেক বয়স হয়েছিল এবং চোখে ভালো দেখতে পেতেন না। অন্যান্য সম্প্রদায় থেকেও কয়েকজন সিস্টার এসে যোগদান করে পেতিত পিকপাসের কনভেন্টে। কিন্তু তাদের কাছে এখানকার নিয়মকানুনের কঠোরতা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। তাদের দু-একজন পাগল হয়ে যায়। তাদের মধ্যে শেভালিয়ের রোজের বংশধর তেইশ বছরের এক সুন্দরী যুবতী ছিল, যার সন্ন্যাসীজীবনের নাম ছিল মের অ্যাজামশান।

উপাসনা পরিচালনার ভার ছিল মেরে সেন্ত মেশতিনদের ওপর। উপাসনার সময় সেই সিস্টার ছাড়া সাত থেকে দশজনের মতো ষোলো বছরের ছাত্রীকে নিত। মাথার উচ্চতা অনুসারে তাদের সার দিয়ে সাজানো হত। তাদের দাঁড়িয়ে গান করতে হত। দেখেশুনে মনে হত যেন দেবদূতরা বাঁশি বাজাচ্ছে। সিস্টার সুর সেন্ত মার্থে ও সুর সেন্ত মাইকেলকে মেয়েরা সবচেয়ে ভালোবাসত। সেন্ত মাইকেলের লম্বা নাকটা দেখে ছাত্রীরা হাসত।

সিস্টাররা কঠোর সন্ন্যাস জীবনযাপন করলেও তাদের শাসনপাশ ছাত্রীদের প্রতি একটু শিথিল ছিল। সিস্টাররা তাদের ঘরে আগুন জ্বালাতে পারত না। কিন্তু ছাত্রীদের বোর্ডিংয়ে আগুন জ্বালানো হত। তারা সবাই ছাত্রীদের স্নেহের চোখে দেখত। তবে কোনও মেয়ে যখন কোনও সিস্টারের পাশ দিয়ে যাবার সময় কোনও কথা বলত তখন সিস্টার উত্তর দিত না।

নীরবতার এই ব্যাপক অনুশাসনের মাঝে মানুষের কাছ থেকে সব বাকশক্তি কেড়ে নিয়ে যেন কয়েকটি নির্জীব বস্তুকে সে বাকশক্তি দান করা হয়। কখনও গির্জার ঘণ্টা, কখনও বাগানের মালীর ঘণ্টার ধ্বনিগুলো যেন বারবার কথা বলে যেত। প্রহর ঘোষণা ছাড়াও দারোয়ানের ঘণ্টার ধ্বনিগুলো সকলকে তাদের আপন আপন কর্তব্যের কথা। স্মরণ করিয়ে দিত। আবার যদি কাউকে অফিসঘরে বা বসার ঘরে ডাকা হত কোনও কারণে তা হলেও ঘণ্টা বাজানো হত। যেমন প্রধানাকী ও শিক্ষয়িত্রী কাউকে ডাকলে পরপর দু বার ঘণ্টাধ্বনি করা হত আর তার সহকারিণী ডাকলে একবার আর পরে দুবার ঘণ্টাধ্বনি করা হত। ছ’টা পাঁচের ঘণ্টাধ্বনি ক্লাসে যোগদান করার জন্য ছাত্রীদের ‘ডাকত। আবার চারটে চার মিনিটের ঘণ্টাধ্বনি ছিল প্রার্থনার জন্য মাদাম জেলিসের ডাক। এ ঘণ্টাধ্বনি প্রায়ই শোনা যেত। অনেক ছাত্রী বিরক্ত হয়ে মাদাম জেলিসকে বলত চারশিংওয়ালী এক শয়তান।

উনিশটি ঘণ্টাধ্বনি এক বড় রকমের ঘটনাকে সূচিত করত। তখন খুব ভারী ধাতু দিয়ে তৈরি সদর দরজাটা খুলে যেত। কিন্তু একমাত্র আর্কবিশপের আগমন ছাড়া সে দরজা খুলত না।

আর্কবিশপ আর বাগানের মালী ছাড়া আর কোনও পুরুষ ঢুকতে পেত না কনভেন্টে। তবে স্কুলের ছাত্রীরা আর দু জন পুরুষকে দেখতে পেত। তারা হল আব্বে বানে যার ওপর ভার ছিল ভিখারিদের ভিক্ষা দান করার আর একজন হল অঙ্কন শিক্ষক মঁসিয়ে আলসিয়, যাকে অনেকে এক বুড়ো কুঁজো বলে বর্ণনা করত।

.

৮.

কনভেন্টের নৈতিক দিকটার একটা চিত্র তুলে ধরার পর তার বাস্তব বহিরঙ্গ সম্বন্ধে কিছু বলা উচিত। অবশ্য পাঠকবর্গ আগেই এ বিষয়ে কিছু কিছু জেনেছেন।

পেতিত পিকপাসে ও সেন্ট আঁতোনের কনভেন্টটা ছিল আয়তক্ষেত্রাকার এবং চতুর্ভুজবিশিষ্ট। তার চারদিকে ছিল চারটি রাস্তা। এই রাস্তা চারটি হল র‍্যু পলোনসো, র‍্যু দ্রয়েত মুর, পেতিত র‍্যু পিকপাস এবং অধুনালুপ্ত এক কানাগলি। আগের যুগের মানচিত্রে এই গলিটাকে র‍্যু অমারাই নামে উল্লিখিত আছে। চারদিকে উঁচু পাঁচিল দিয়ে। ঘেরা ছিল গোটা কনভেন্টের সীমানাটা। তার মধ্যে অনেকগুলো বাড়ি আর একটা বাগান ছিল।

কনভেন্টের প্রধান বাড়ির আশপাশে অনেকগুলো ছোটখাটো বাড়ি ছিল। এ বাড়ির মধ্যে থাকত সিস্টাররা, মাদাররা আর শিক্ষানবিশরা। স্কুলের ছাত্রীরা থাকত তাদের বোর্ডিং হাউসে। এই বোর্ডিং বাড়িটা পেতিত র‍্যু পিকপাস আর র‍্যু অমারাই-এর মাঝখানে বাইরে থেকে দেখা যেত। বাগানের মধ্যে একটা ছিল প্রধান পথ আর আটটা ছোট পথ তার সঙ্গে যুক্ত ছিল। পথগুলোর দৈর্ঘ্যের মধ্যে কোনও সমতা ছিল না। পথগুলোর দু পাশে ছিল অনেক ফলের গাছ। প্রধান পথটার ধারে ফাঁকা জায়গায় ছিল একটা লম্বা পাইনগাছ। পপলার গাছে ঘেরা আজ যেখানে লিটল কনভেন্ট নামে মেয়েদের স্কুলটা আছে সেখানেই ছিল আগেকার পুরনো কনভেন্টের ধ্বংসাবশেষ। আজ হতে পঁয়তাল্লিশ বছর আগেও এখানে এই পেতিত পিকপাসে বার্নাদিনে সম্প্রদায়ের এক কনভেন্ট ছিল।

কনভেন্টের চারদিকের যে রাস্তাগুলোর নাম বলা হল, এ রাস্তাগুলো প্যারিসের সবচেয়ে পুরনো রাস্তা। র‍্যু দ্ৰয়েত মুর ছিল আবার সবচেয়ে পুরনো আর দু পাশে ছিল ফুলের গাছ। মনে হয় মানুষ পাথর দিয়ে পথগুলোকে গাঁথার অনেক আগেই ঈশ্বর ফুল তৈরি করেন।

.

৯.

প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ এই কনভেন্টের রুদ্ধ দরজা পাঠকদের সামনে খুলে দিয়ে আমরা তার জীবনযাত্রা সম্বন্ধে অনেক কথা বললাম। এবার আমরা আরও এমন একটা ঘটনার কথা বলার জন্য অনুমতি চাইছি পাঠকদের কাছে, যে কথার সঙ্গে আমাদের মূল কাহিনীর কোনও সম্পর্ক নেই। তবে এই ঘটনা থেকে জানা যাবে আগে কনভেন্টে কী ধরনের চরিত্রের মহিলারা থাকত।

লিটল কনভেন্টে যেসব আবাসিক অতিথি থাকত তাদের মধ্যে প্রায় একশো বছরের এক বৃদ্ধা মহিলা থাকত। তার বাড়ি ছিল আব্বায়ে দ্র ফঁতেলতে। বিপ্লবের আগে এই মহিলা খুব শৌখিন রুচিসম্পন্না ছিল। কথায় কথায় সে প্রায়ই মঁসিয়ে দ্য মিরোমেলনিল আর কোনও এক মাদাম দুপ্লাতের কথা বলত। মঁসিয়ে মিরোমেলনিল ছিল ষোড়শ লুই-এর সিলমোহরের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী আর মাদাম দুপ্লাত ছিল এক বিচারপতির স্ত্রী। কথা প্রসঙ্গে সুযোগ পেলেই এই নামগুলোর সে উল্লেখ করত আর। প্রায়ই বলত তেল শহরের কথা, প্রাচীরঘেরা যে শহরটার মধ্যে ছিল অনেক। ভালো ভালো রাস্তা।

এই বৃদ্ধা যখন ছোট ছোট মেয়েদের সঙ্গে কথা বলত, বা গল্প বলত মেয়েরা তা মন। দিয়ে শুনত। তার কথা বলার ধরন দেখে মুগ্ধ হত তারা। সে যাজকের কাছে শপথবাক্য পাঠ করার সময় বলত, এই শপথবাক্য প্রথমঁ সেন্ট ফ্রান্সিস সেন্ট জুলিয়েনকে দিয়ে যান, তার পর সেন্ট জুলিয়েন আবার সেন্ট ইউসেবিয়াসকে দিয়ে যান, সেন্ট ইউসেবিয়াস আবার দিয়ে যান সেন্ট প্রবোপিয়াসকে এইভাবে হে ধর্মপিতা, আমিও আপনাকে এ শপথ দিয়ে যাচ্ছি।

তার কথা শুনে মেয়েরা যখন খিলখিল করে হাসত তখন মাদাররা রেগে গিয়ে ভ্র কুঞ্চন করে তাকাত তাদের পানে।

বৃদ্ধা আরও অনেক গল্প শোনাত। সে বলত সে যখন বয়সে যুবতী ছিল তখন গির্জার যাজকরা সৈন্যদের মতোই ছিল ব্যভিচারী। এমনি করে একটা শতাব্দী যেন তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে উঠত। যে শতাব্দী হল অষ্টাদশ শতাব্দী। সে চার ধরনের মদের কথা বলত। বিপ্লবের আগে যখন ফ্রান্সের মতো উঁচুদরের এক লর্ড শহরে একজন সম্মানিত অতিথি হিসেবে আসতেন তখন শহরের কাউন্সিল চারটে পানপাত্রে চার রকমের মদ দিত। চার রকমের মদে চার রকমের ফল পাওয়া যেত–আনন্দ, ঝগড়া-বিবাদ, হতবুদ্ধিভাব আর ঝিমুনিভাব।

বৃদ্ধা একটা ঘরের মধ্যে থাকার অনুমতি পেয়েছিল। একটা আলমারিতে তালাচাবি দিয়ে কী একটা জিনিস সে ভরে রাখত। সে জিনিসের কথা কেউ জানত না। যখনই কোনও লোক তার ঘরের কাছে আসত সে তাড়াতাড়ি আলমারিটা তালাচাবি বন্ধ করে দিত। কেউ যদি তাকে সেই জিনিসের কথা বলত তা হলে সে চুপ করে থাকত। এমনিতে সে বেশি কথা বললেও এ বিষয়ে কোনও কথা বলত না। তার ফলে একটা বিরাট কৌতূহল সকলের মনে দানা বেঁধে উঠত।

এ নিয়ে কনভেন্টের অনেকে বলাবলি করত নিজেদের মধ্যে। ওই একশো বছরের বৃদ্ধা কী এমন ধন লুকিয়ে রেখেছে আলমারির মধ্যে? কোনও ধর্মগ্রন্থ নিশ্চয়। অথবা কোনও প্রাচীন বস্তু। বৃদ্ধা মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলমারি খুলে সেই রহস্যময় বস্তুটা বার করা হয় তাড়াতাড়ি। দেখা গেল একটা লিনেনের কাপড় দিয়ে একটা ছবি বেঁধে রাখা হয়েছে। ছবিটা পুরনো কোনও দোকান থেকে কেনা। সে ছবিতে ছিল এক প্রেমিক আর এক প্রেমিকার ছবি। প্রেমিকের মুখে ছিল শয়তানের হাসি আর প্রেমিকার মুখ যন্ত্রণায় কাতর এবং বিকৃত। এই ছবি থেকে একটা নীতিশিক্ষাই পাওয়া যায়। যন্ত্রণার কাছে প্রেম পরাভূত।

বৃদ্ধা বাইরের কোনও অতিথির সঙ্গে দেখা করত না। কারণ সে বলত বসার ঘরটা খুবই অন্ধকার।

.

১০.

কনভেন্টের যে বৈঠকখানা ঘরের কথা আগেই বলা হয় সে ঘরটা ছিল সমাধিগহ্বরের মতোই অন্ধকার। সে ঘরের জানালা ও দরজায় ছিল কালো পর্দা। অন্যান্য কনভেন্টের বসার ঘরটা চমৎকারভাবে সাজানো থাকত। সে ঘরের জানালায় থাকত সিল্কের বাদামি রঙের পর্দা, আর দেয়ালগুলোতে নানারকমের ছবি আঁকা। অন্যান্য কনভেন্টের নিয়ম-কানুন পেতিত পিকপাসের মতো এত কঠোর ছিল না। র‍্যু দু তেম্পল ছিল এই ধরনের এক কনভেন্ট। যে কনভেন্ট চালিত হত বেনেডিক্ট সম্প্রদায়ের দ্বারা।

র‍্যু দু তেম্পল কনভেন্টের বাগানে এমন একটা বিরাট বাদামগাছ ছিল, যা সারা ফ্রান্সের মধ্যে ছিল সবচেয়ে পুরনো আর সবচেয়ে সুন্দর। অষ্টাদশ শতকের লোকেরা বলত, এই বাদামগাছটা ও রাজ্যের সব বাদামগাছের পিতা।

আমরা আগেই বলেছি র‍্যু দু তেম্পল কনভেন্টটি চিরস্থায়ী ভক্তিপ্রচার সংস্থার বেনেডিক্টেনে সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসিনীদের দ্বারা পরিচালিত হত। এরা ছিল সিটো সম্প্রদায়ের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। ভক্তিপ্রচার সংস্থাটি আজ হতে দুশো বছর আগে স্থাপিত হয়। প্রচার সংস্থা স্থাপনের পেছনে এক ইতিহাস আছে। ১৬৪৯ সালে সেন্ট। সালপিস আর সেন্ট জাঁ এনগ্রেডে নামে দুটি চার্চে মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে পর পর দু বার অধর্মাচরণের ঘটনা ঘটে। সেখানে নাকি মার্কুই দ্য বুস আর কাউন্টেস দ্য শ্যাতোভো নামে দু জন মহিলার শালীনতাহানি করা হয়। এই অমার্জনীয় অধর্মাচরণ ও ধর্মস্থানের পবিত্রতাহানিরূপ পাপের প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ সেন্ট জার্মেন দে প্রেসের প্রধান ভিকার সমস্ত যাজকদের নিয়ে এক গুরুগম্ভীর ধর্মীয় শোভাযাত্রার ব্যবস্থা করেন। এই ধরনের অধর্মাচরণের অপরাধ এর পরে আর অনুষ্ঠিত না হলেও এই পাপের কথাটা দেশের ধর্মজগতের কর্তৃপক্ষের মনে এক প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিশেষ করে ওই দু জন ক্ষুব্ধ মহিলা কর্তৃপক্ষের দ্বারা অবলম্বিত ব্যবস্থায় তৃপ্ত হতে পারেননি। তাঁরা ভাবছিলেন আরও চরম প্রায়শ্চিত্তের কথা। তারা সকলে তখন ঠিক করল এই অধর্মাচরণের প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ এক চিরস্থায়ী ভক্তি সংস্থা গড়ে তুলঁতে হবে। ঠিক হল সেটা হবে এমনই এক প্রতিষ্ঠান যেখানে হলি সেক্ৰামেন্টের সন্ন্যাসিনীরা নিরন্তর উপাসনা আর প্রার্থনার দ্বারা চিরকাল ধরে এক প্রায়শ্চিত্ত করে যাবে। তখন ওই দু জন মহিলা মোটা টাকা দিয়ে র‍্যু কসেত্তে নামে এক জায়গায় মেয়েদের জন্য এক কনভেন্ট স্থাপন করে। বেনেডিক্টে সম্প্রদায়ের অধীনস্থ সিস্টার ও মাদারদের দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে এই কনভেন্ট এবং এর প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সেন্ট জার্মেনের অধ্যক্ষ মঁসিয়ে দ্য মেৎস অনুমতি দান করেন।

এই হল বেনেডিক্টে সম্প্রদায়ের চিরস্থায়ী ভক্তিপ্রচার সংস্থার উদ্ভবের ইতিহাস। সিস্টার অফ চ্যারিটি সম্প্রদায় যেমন প্রতিষ্ঠিত হয় সেন্ট লাজারাসের অধ্যক্ষের দ্বারা, অর্ডার অফ সেক্রেড হার্ট-সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠিত হয় যেমন জেসুটদের দ্বারা, তেমনি বেনেডিক্টে সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে ওঠে সেন্ট জার্মেনের অধ্যক্ষের দ্বারা।

পেতিত পিকপাসের বার্নাদিনে সম্প্রদায় থেকে বেনেডিক্টে সম্প্রদায় ছিল একেবারে পৃথক। ১৬৫৭ সালে পোপ আলেকজান্ডার সপ্তম এক বিশেষ হুকুমনামা জারি করে পেতিত পিকপাসের বার্নাদিনে সম্প্রদায়কে চিরস্থায়ী ভক্তিসংস্থার নির্দেশ অনুযায়ী উপাসনা করে যাবার অনুমতি দান করেন। তবু তাদের সঙ্গে হলি সেক্ৰামেন্টের বেনেডিক্টেনে সম্প্রদায় অন্য সবদিক থেকে একটা পার্থক্য রয়ে যায়।

.

১১.

পেতিত পিকপাসের কনভেন্টের অবক্ষয় বা পতন শুরু হয় রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর থেকে। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলোর যে পতন শুরু হয় পেতিত পিকপাস কনভেন্টের পতন সেই পতনেরই এক অঙ্গবিশেষ। আসলে বিপ্লব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও প্রথাগত ভিত্তিগুলোর উপর চরম আঘাত হানে। ফরাসি বিপ্লব ধর্মের উচ্ছেদ সাধন না করলেও সামাজিক অগ্রগতির সঙ্গে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলোকে খাপ খাইয়ে নিতে বলে।

পেতিত পিকপাস ধর্মসম্প্রদায়ের দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। ১৮৪০ সালের মধ্যে তার অন্তর্গত লিটল কনভেন্ট ও স্কুলের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। বয়োপ্রবীণ সিস্টারদের মৃত্যু ঘটে এক একে এবং ছাত্রীরা সব একে একে চলে যায়।

চিরস্থায়ী ভক্তিপ্রচার সংস্থার নিয়মকানুন এমনই কঠোর যে যারা এখানে একবার প্রবেশ করে তারা কিছুকালের মধ্যে বিরক্ত হয়ে ওঠে এবং নতুন আর কেউ আসতে চায় না। ১৮৪৫ সালে কিছু সিস্টার ছিল স্কুলে পড়াবার জন্য, কিন্তু ধর্মে উৎসর্গীকৃতপ্রাণ কোনও সন্ন্যাসিনী ছিল না। চল্লিশ বছর আগে এই সন্ন্যাসিনীর সংখ্যা ছিল একশো এবং পঞ্চাশ বছর আগে ছিল আটাশ। ১৮৪৭ সালে এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাচিত করা হয় চল্লিশের নিচের এক নারীকে। অথচ আগে সাধারণত এ পদে আরও বয়স্কা নারী ছাড়া বসতে পারত না। এর থেকে বোঝা যায় যোগ্য প্রার্থিনী না থাকায় বাদ্য হয়ে এই নির্বাচন করতে হয়েছিল কর্তৃপক্ষকে। সিস্টারদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় তাদের কাজের চাপ বেড়ে গিয়েছিল। প্রত্যেককে কঠোর পরিশ্রম করতে হত। সিস্টারদের সংখ্যা কমে গেলেও নিয়মকানুনের কঠোরতা কমেনি কিছুমাত্র। মনে হয় সে সংখ্যা কমে গিয়ে ডজনে নেমে এলেও তাদের নিয়মকানুনের কঠোরতা ঠিকই মেনে চলতে হবে। এত কাজের চাপ সহ্য করতে না পেরে অবশিষ্ট সিস্টারদের মৃত্যু ঘটে। এই গ্রন্থের লেখক যখন প্যারিসে অবস্থান করছিলেন তখন পঁচিশ ও তেইশ বছরের দু জন সিস্টারের মৃত্যু ঘটে। এইভাবে সিস্টারদের একে একে মৃত্যু ঘটায় স্কুল তুলে দিতে হয়।

আমরা একমাত্র জাঁ ভলজাঁকে অনুসরণ করতে গিয়েই এই লুপ্তপ্রায় কনভেন্টের বাগানবাড়িতে প্রবেশ করি। আমরা এই প্রতিষ্ঠানের সুকঠোর নিয়মকানুন ও অদ্ভুত প্রথাগুলোকে বর্ণনা করেছি। কিন্তু তার অর্থ ঠিকমতো বুঝতে পারিনি। তবে বুঝতে না পারলেও কোনও কিছুকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দিইনি। আমরা জোসেফ মেস্তারের হোসানা সম্প্রদায়ের কথাবার্তাও বুঝতে পারিনি, তারা যিশুর ঘাতককে সমর্থন করে, যেমন ভলতেয়ারের মতো জ্ঞানী লোক ক্রসকে উপহাস করেন। অতিমানবিক শক্তিসম্পন্ন যিশুকে যারা অস্বীকার করেন তাঁদের কাছে এদের কি দাম আছে?

আজকের এই উনিশ শতকে মানুষের ধর্মবিশ্বাসের এক জোর সংকট চলছে। অনেক জ্ঞানের বস্তু মানুষ এ যুগে মন থেকে সরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু অন্য জ্ঞানের বস্তুকে গ্রহণ করতে পারেনি তারা। কিন্তু মানুষের অন্তরে এই ধরনের শূন্যতা থাকা উচিত নয়।

যেসব জিনিস চলে গেছে আমাদের সামনে থেকে সেগুলোকে খুঁটিয়ে বিচার করে ফেলতে হবে আমাদের। অনেক সময় অতীতের অনেক পুরনো জিনিস নাম পাল্টে আমাদের সামনে এসে হাজির হয়। সেসব জিনিসকে ভবিষ্যৎ বলে ভুল করা উচিত নয়। অতীতের প্রেতাত্মারা অনেক সময় ভবিষ্যতের মুখোশ পরে এসে বিভ্রান্ত করে আমাদের। সেই মৃত অতীতের মুখখানা হল কুসংস্কারের মূর্ত প্রতীক আর ভণ্ডামিই হল তার মুখোশ। সে মুখ আর মুখোশটাকে টেনে ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া উচিত আমাদের।

সাধারণভাবে সব কনভেন্ট সভ্যতা ও স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এক জটিল সমস্যা সৃষ্টি করে। সভ্যতা তাদের ধিক্কার দেয় আর স্বাধীনতা তাদের রক্ষা করে চলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *