২.৩ ধূসর সাগর

১১. ধূসর সাগর

জাঁহাপনা আপনি যখন গুজরাটের সমরাভিযান শেষ করে ফিরবেন ততোদিনে নতুন শহরের রক্ষাপ্রাচীরের নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যাবে, তুহিন দাশ আকবরকে বললো। আকবর, আবুল ফজল এবং তুহিন দাশকে নিয়ে ঘোড়ায় করে শিক্রির প্রতিরক্ষা প্রাচীর পরিদর্শন করছিলেন। বর্তমানে প্রাচীরটি ছয় ফুট উচ্চতায় পৌঁছেছে।

তোমার কথা তোমাকে রক্ষা করতে হবে, আকবর উত্তর দিলেন। আমার যুদ্ধাভিযান বেশি দীর্ঘ হবে না। আহমেদ খান এবং অন্যান্য সেনাপতিদের সাথে নিয়ে আমার পিতা প্রায় চল্লিশ বছর আগে গুজরাট জয় করেছিলেন। তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। শেরশাহ্ বলপূর্বক আমার পিতাকে গুজরাটের ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করেছিলো। এইবার আমি গুজরাট জয় করার পর তা চিরকাল মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়ে থাকবে।

ক্যাম্বে এবং সুরাত দিয়ে যে সব তীর্থযাত্রী আরবের উদ্দেশ্যে পবিত্র ধর্মযাত্রা করেন তারা যদি যাত্রা পথে নিরাপত্তা লাভ করেন, তাহলে তারা ব্যাপক ভাবে আপনার প্রশংসা করবেন জাহাপনা। গুজরাটের রাজ পরিবার গুলির অন্তঃকলহের ফলে সেখানে আইন-শৃক্ষলা পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটেছে তার কারণে ভ্রমণকারীদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে, আবুল ফজল সুললিত কণ্ঠে বলে উঠলো। গুজরাজ আবার মোগলদের নিয়ন্ত্রণে এলে এর বন্দরগুলি থেকে যে কর আদায় হবে, আমি নিশ্চিত তা আমাদের রাজস্ব আয়ের একটি বিরাট অংশ পূরণ করবে।

 তুমি ঠিকই বলেছো আবুল ফজল। গুজরাজ এখনোও একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্র। আমার ইচ্ছা শিক্রির অলংকরণের জন্য সেখান থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ যুদ্ধ লুষ্ঠিত মালামাল নিয়ে আসা।

কথা শেষ করে আকবর সেখানে তুহিন দাশ ও আবুল ফজলকে রেখে ঘোড়া ছুটিয়ে মালভূমি পেরিয়ে নিচের সমতল ভূমির দিকে রওনা হলেন। সেখানে তার সৈন্যরা শিবির স্থাপন করেছে। আকবর যখন সেদিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন তখন তিনি অনুশীলনরত সৈন্যদের গাদাবন্দুকের গুলিবর্ষনের ধোয়া দেখতে পেলেন। আরেক দিকে গোলন্দাজবাহিনী নতুন তৈরি করা ব্রোঞ্জের কামানের ধ্বংস ক্ষমতা পরীক্ষা করছিলো। আকবরের নিজের কারখানায় কামানগুলি নির্মাণ করা হয়েছে। নতুন আবিষ্কার থেকে বেশি সুবিধা লাভের জন্য তিনি পরীক্ষামূলক ভাবে এমন বিশাল নলের কামান তৈরি করিয়েছেন যে আহমেদ খানের ধারণা সেটা স্থানান্তর করতে একহাজার ষাঁড় দরকার হবে। যদিও আকবর জানতেন আহমেদ খান বাড়িয়ে বলছেন তারপরও তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন গুজরাট অভিযানে এই দানবাকৃতির অস্ত্রগুলি না নেয়ার। কারণ তাঁর ধারণা, অবরোধ সৃষ্টি করার বহু সময় পরেও দেখা যাবে ঐ অস্ত্র যথাস্থানে স্থাপন করে কার্যক্রম শুরু করা যায়নি।

আকবর দেখলেন আহমেদ খান এবং মোহাম্মদ বেগ একটি তাবুর পাশে দাঁড়িয়ে পরস্পরের সঙ্গে তর্ক করছে। আকবরকে ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে আসতে দেখে উভয়ে কুর্ণিশ করলো।

আপনারা দুজন কি বিষয়ে তর্ক করছেন?

যুদ্ধ যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ এবং শস্য সংগ্রহের সময় নিয়ে জাহাপনা, আহমেদ খান বললেন।

আমি এক মাস দেরি করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম জাঁহাপনা, মোহাম্মদ বেগ বললেন, এই সময়ের মধ্যে আমরা যাতে পর্যাপ্ত শস্য সংগ্রহ করতে পারি।

কিন্তু জাহাপনা, আমার বক্তব্য হলো-আমরা যদি কম মালামাল নিয়ে দ্রুত অগ্রসর হতে পারি তাহলে আমাদের অপেক্ষাকৃত কম রসদ প্রয়োজন হবে। আবার অন্যদিকে গুজরাটের রাজপরিবারের ভিন্নমতাবলম্বী সদস্যরা বিশেষ করে মির্জা মুকিম এর উপর আমরা নির্ভর করতে পারি প্রয়োজনীয় রসদের জন্য।

 আমি আপনার সঙ্গে একমত আহমেদ খান, আকবর বললেন। যুবরাজ মুকিম আমার হস্তক্ষেপ কামনা করে যে বার্তা পাঠিয়েছেন তার জন্য আমাদের গুজরাট আক্রমণ অধিক বৈধতা লাভ করবে এবং তার কাছ থেকে আমি সৈন্য ও রসদ সহায়তা নেবো। সেক্ষেত্রে আমরা কবে রওনা হতে পারি?

এক সপ্তাহের মধ্যেই জাহাপনা, মোহাম্মদ বেগ বললেন।

 ঠিক আছে, তাহলে আমরা এক সপ্তাহের মধ্যেই রওনা হচ্ছি।

*

জাহাপনা, আপনি কি দিগন্তের ঐ ধূলার মেঘ দেখতে পাচ্ছেন? নিশ্চয়ই বহু সংখ্যক মানুষ একসঙ্গে যাত্রা করেছে, আকবর এবং আহমেদ খান একদল অগ্রবর্তী সৈন্য নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তারা গুজরাটের আহমেদাবাদ শহরের কাছাকাছি অবস্থিত পাকতে থাকা শস্যের মাঠ অতিক্রম করছেন। আকবর তার ধাতব দস্তানা পরিহিত হাতের সাহায্যে চোখের উপর ছায়া সৃষ্টি করে ধূলার তরঙ্গের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন। ওটা নিশ্চয়ই গুজরাটের স্বঘোষিত শাহ্ ইত্তিমাদ খানের বাহিনী। মির্জা মুকিমের অনুমানই সঠিক। তার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় সে বলেছিলো আকবর যদি দ্রুত অগ্রসর হোন তাহলে আহমেদাবাদের কাছে মোগল বাহিনী ইত্তিমাদ খানের মুখোমুখী হতে পারে। আমি নিশ্চিত ওটা ইত্তিমাদ খানের বাহিনী। যদি তাই হয়, তহলে আমরা ওদের চমকে দেয়ার সুবিধা পাবো।

 আমরা শীঘ্রই এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারবো জাঁহাপনা। আমি কি আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আদেশ দেবো?

নিশ্চয়ই।

 কয়েক মিনিট পর কালো স্ট্যালিয়নের পিঠে সওয়ার আকবর একদল ঘনবিন্যস্ত সৈন্যকে নেতৃত্ব দান করে পাকা ফসলের ক্ষেত মাড়িয়ে ধূলি মেঘের দিকে অগ্রসর হলেন। আকবরের মাথায় ময়ূর পুচ্ছ যুক্ত গম্বুজাকৃতির শিরোস্ত্রাণ, দেহে সোনার পাত মোড়া বক্ষবর্ম এবং হাতে উন্মুক্ত তলোয়ার আলমগীর। তার ঠিক পেছনেই দুইজন কোৰ্চি সবুজ মোগল পতাকা বহন করছে ঘোড়ায় চড়ে। তাঁদের ঘোড়ার প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে গুজরাটি অশ্বারোহীদের অবয়ব অধিক স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আকবর পরিষ্কার বুঝতে পারলেন যে শত্রুপক্ষ তাঁর বাহিনীকে চিনতে পেরেছে এবং পিছিয়ে গিয়ে আহমেদাবাদ এর প্রাচীরের আড়ালে আশ্রয় নেয়ার পরিবর্তে তারা সোজা তদের দিকে ধেয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঘোড়ার খুরের শব্দ ছাপিয়ে আকবর চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলেন, ওরা সংখ্যায় কতো জন হবে আহমেদ খান?

বলা কঠিন, হয়তো পাঁচ হাজার জাঁহাপনা।

 তারা নিশ্চয়ই ভাবছে তারা সংখ্যায় আমাদের তুলনায় যথেষ্ট বেশি, কিন্তু বাস্তবতা সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না, কি বলেন?

এই মুহূর্তে উভয় বাহিনীর মধ্যে দূরত্ব এক হাজার গজেরও কম এবং দ্রুত এই দূরত্ব কমে আসছে। আকবরের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়ে তার অশ্বারোহী তিরন্দাজেরা রেকাবে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রথম পশলা তীর ছুড়লো গুজরাটিদের দিকে। এ সময় গুজরাটিরাও পাল্টা তীর ছুড়লো। আকবর দেখলেন অগ্রবর্তী একজন গুজরাটির ঘোড়া ঘাড়ে দুটি তীর বিদ্ধ হয়ে আছড়ে পড়লো। সেই সাথে সেটির সওয়ারী ফসলের উপর ছিটকে পড়লো। একই সঙ্গে আরেকজন সওয়ারী গালে তীর বিদ্ধ হয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে লুটিয়ে পড়লো। আকবর নিজের পিছনে পতনের শব্দ পেলেন এবং সেই সঙ্গে আর্তচিৎকার। তার সৈন্যদের কেউ তীর বিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু পেছনে দেখার সময় নেই কারণ তখনই উভয় পক্ষের ঘোড়সওয়ারদের মধ্যে মুখোমুখী তীব্র সংঘর্ষ হলো। শেষ মুহূর্তে এক গুজরাটি আকবরকে চিনতে পেরে নিজের বাদামি ঘোড়াটি তার ঘোড়র উপর উঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো। আকবরের মাঝে দ্রুত প্রতিক্রিয়া হলো। লাগামে হেচকা টান মেরে তিনি নিজের স্ট্যালিয়নটিকে কিছুটা ঘোরাতে সক্ষম হলেন। কিন্তু তার ঘোড়াটি প্রতিপক্ষের ঘোড়াটির নিতম্বে প্রচণ্ড শক্তিতে আঘাত হানলো। ফলে ঘোড়াটি যেমন পড়ে গেলো একই সাথে এর সাহসী সওয়ারীটিও সেটার পিঠ থেকে যেনো প্রায় উড়ে গেলো। সংঘর্ষের তীব্র বেদনা নিয়ে আকবরের স্ট্যালিয়নটি পিছনের দুপায়ে ভর দিয়ে প্রায় দাঁড়িয়ে গেলো এবং আকবর সেটার পিঠ থেকে নিজের পতন ঠেকাতে সেটার ঘাড়ের উপর ঝুঁকে দুই হাঁটু দিয়ে সর্বশক্তিতে সেটার পেট আকড়ে থাকলেন। তিনি প্রায় সফল হচ্ছিলেন, কিন্তু ঘোড়াটির সামনের পা দুটি যখন মাটি স্পর্শ করলো সেটা একদিকে কাত হয়ে গেলো এবং মাটিতে পড়ে থাকা মোগল পতাকার কাপড়ে সেটার পা জড়িয়ে গেলো। প্রথম সংঘর্ষের সময়ই আকবরের এক পায়ের রেকাব ছুটে গিয়েছিলো, এবার তিনি আর আসনে স্থির থাকতে পারলেন না-জিন থেকে একপাশে পিছলে নেমে গেলেন এবং বাম হাতে লাগাম ধরে স্ট্যালিয়নটির সঙ্গে ঝুলে রইলেন।

কয়েক মুহূর্ত পর আরেক জন গুজরাটি তাঁর দিকে ধেয়ে এলো, উদ্দেশ্য বর্শার ফলায় তাঁকে বিদ্ধ করা। আকবর লাগাম ছেড়ে একপাশে ঝাঁপ দিলেন। তবে পড়ার সময় তিনি শত্রুকে লক্ষ করে দ্রুত তলোয়ার চালালেন। কঠোর মুষ্ঠিতে আলমগীর ধরে থাকা সত্ত্বেও সেটি অপর হাতের ধতব দস্তানার সঙ্গে সশব্দে ঘসা খেলো, তবে লক্ষ্যচ্যুত হলো না। আলমগীরের ধারালো ফলা শত্রুর হাঁটুর হাড়মাংস ভেদ করে তার ঘোড়ার নিতম্বে আঘাত করলো। ঘোড়া সহ সে ভূপাতিত হলো এবং আকবরের এক অগ্রসরমান সৈনের ঘোড়ার খুরের নিচে তার মস্তক পিষ্ট হলো।

মোগলদের প্রথমিক আক্রমণের চাপে গুজরাটিরা কিছুটা পিছিয়ে গেছে এবং এই মুহূর্তে আকবরের দেহরক্ষীরা তাঁকে ঘিরে আছে। তার স্ট্যালিয়নটি মাত্র কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। আলমগীর কোষবদ্ধ করে তিনি মাটিতে পতিত পতাকাটি উঠিয়ে নিলেন এবং ছুটে গিয়ে নিজের ঘোড়ার পিঠে চড়লেন। সকলে অগ্রসর হও, আমাদের এ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে, তিনি চিৎকার করে হুকুম দিলেন। স্ট্যালিয়নটি তার প্রণোদনা পেয়ে সামনে এগুলো এবং উড়ন্ত পতাকা নিয়ে আকবর গুজরাটি অশ্বারোহীদের দিকে ধেয়ে গেলেন। দাঁত দিয়ে লাগাম কামড়ে ধরে তিনি এক স্থূলকায় শত্রুর দিকে আলমগীর চালালেন কিন্তু তলোয়ারটির ফলা তার বক্ষবর্মের উপর ঘষা খেয়ে বেরিয়ে গেলো। কিন্তু তার পরবর্তী আঘাত অপর একজন গুজরাটির বাহুর সামনের অংশে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করলো এবং পর মুহূর্তে তিনি বিশৃঙ্খল লড়াই এর আরেক পাশে নিজেকে আবিষ্কার করলেন। এখানে আবার তাঁর দেহরক্ষীরা তাকে ঘিরে ফেললো। তাদের একজনের হাতে পতাকা দিয়ে আকবর চারদিকে তাকাতে তাকাতে দম নিলেন। এখনো তীব্র লড়াই চলছে, বিশেষ করে তার বাম পাশে প্রায় দুইশ গজ দূরে যেখানে গুজরাটিদের লাল পতাকা দেখা যাচ্ছে। দ্রুত চোখের উপর জমা ঘাম মুছে তিনি সেদিকে ঘোড়া ছুটালেন। সেই মুহূর্তে একরাশ অক্ষত থাকা শস্য গাছের মধ্যে তিনি একজন লাল পাগড়ি পড়া গুজরাটিকে টলমলপায়ে উঠে দাঁড়াতে দেখলেন। সে তার হাতে থাকা লম্বা ছোরাটি আকবরকে লক্ষ্য করে ছুড়লো। তার হাতের টিপ উত্তম, কিন্তু আকবর সময়মতো তাঁর ঘোড়ার ঘাড়ের উপর নুয়ে পড়ায় ছোরাটির ফলা তার শিরোস্ত্রাণের সঙ্গে ঘষা খেয়ে ছিটকে পড়লো। অন্যদের হাতে যোদ্ধাটিকে ছেড়ে আকবর সামনে এগিয়ে গেলেন। শীঘ্রই তিনি লাল পতাকার চারদিকের বিশৃঙ্খলা ঠেলে এগুতে লাগলেন এবং ডানে বামে প্রচণ্ড শক্তিতে তলোয়ার চালাতে লাগলেন।

 বাদামি রঙের ঘোড়ার পিঠে বসা একজন লম্বা গড়নের গুজরাটি বর্শা নিয়ে আকবরকে আক্রমণ করলো। শেষ মুহূর্তে আকবর তাকে দেখলেন এবং তলোয়ার চালিয়ে বর্শার আঘাত প্রতিহত করলেন। সর্বশক্তিতে লাগাম টেনে ধরে গুজরাটি যোদ্ধাটি আবার আকবরকে আক্রমণ করলো কিন্তু এবার তিনি প্রস্তুত ছিলেন। যোদ্ধাটির আক্রমণকে পাশ কাটিয়ে তিনি তার শরীরের বাম অংশে গভীর ভাবে তলোয়ার ঢুকিয়ে দিলেন এবং আক্রমণের ধাক্কায় সে ঘোড়ার উপর থেকে মাটিতে আছড়ে পড়লো।

আকবর ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছেন, তিনি দেখলেন সংখ্যা গরিষ্ঠ মোগলদের প্রচণ্ড আক্রমণে ধীরে ধীরে গুজরাটিরা পিছু হটছে এবং অনেকে ঘোড়া ঘুরিয়ে নিয়ে আহমেদাবাদ এর প্রাচীরের নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটছে। আকবর একদল পলায়নরত প্রতিপক্ষকে ধাওয়া করতে চাইলেন কিন্তু তার হাঁপ ধরা স্ট্যালিয়নটি প্রথমে তেমন সাড়া দিলো না। সেই মুহূর্তে ফসলে জলসেচের নালা ঘোড়া সহ লাফিয়ে পার হওয়ার সময় এক গুজরাটির ঘোড়া ভেজা মাটিতে পিছলে পড়ে গেলো। ক্রমান্বয়ে আরো তিন জন ঘোড় সওয়ার প্রথম জনের পিছনে ধারাবাহিক ভাবে হোঁচট খেয়ে পড়লো। পড়ে যাওয়া একজন যোদ্ধা অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করলো কিন্তু গলায় আকবরের একজন দেহরক্ষীর তলোয়ারের কোপ খেয়ে নালার মধ্যে পড়ে গেলো। তার ক্ষত থেকে উৎক্ষিপ্ত লাল রক্ত নালার সবুজ পানিতে ছড়িয়ে পড়লো। বেশ কয়েকজন গুজরাটি তাদের ঘোড়ার গতি কমিয়ে ঘোড়া থেকে মাটিতে পড়ে যাওয়া সঙ্গীদের উদ্ধারের চেষ্টা করছিলো। আকবর তাদের একজনের দিকে এগিয়ে গেলেন।

 যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। নিজেদের জীবন বাঁচাও। আমার দেহরক্ষীরা তোমাদের ঘিরে ফেলেছে এবং উত্তম লড়াই এর পর আত্মসমর্পণ করার মাঝে কোনো লজ্জা নেই। আকবর প্রতিপক্ষের যোদ্ধাটিকে চিৎকার করে বললেন। কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করতে করতে সে তার আশেপাশে থাকা অবশিষ্ট সঙ্গীদের পর্যবেক্ষণ করলো, তার গালে সৃষ্ট ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে-তারপর নিজের তলোয়ারটি হাত থেকে ফেলে দিলো। তার সঙ্গীরাও তাকে অনুসরণ করলো।

আকবরের রক্ষীরা যখন যুদ্ধবন্দীদের বাঁধছিলো তখন তিনি দেখলেন মোহাম্মদ বেগ কিছু সৈন্য নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছেন। তাঁদের মধ্যে একজন সৈন্য একটি ছাই রঙের ঘোড়ার লাগাম ধরে রয়েছে। ঘোড়াটির পিঠে ছিপছিপে গড়নের একজন অল্পবয়সী তরুণ বসা। সে সাদা আলখাল্লার উপর চুনি খচিত বক্ষবর্ম পড়ে আছে। এটি ইত্তিমাদ খান জাঁহাপনা। আমরা তাকে তার মৃত ঘোড়ার পাশে শস্য ক্ষেতের মধ্যে লুকানো অবস্থায় আবিষ্কার করেছি। তার দেহরক্ষীরা তাকে ত্যাগ করে পালিয়েছে।

তুমি কি সত্যিই ইত্তিমাদ খান? আকবর জিজ্ঞেস করলেন।

 জ্বী এবং আমি আপনার কাছে আত্মসমর্পণ করছি, তরুণটি মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে বললো।

তুমি কি তোমার সৈন্যদের লড়াই বন্ধ করার আদেশ দিতে প্রস্তুত এবং আহমেদাবাদ সহ তোমার নিয়ন্ত্রিত গুজরাটের অন্যান্য অঞ্চল আমার অধীনে ছেড়ে দিতে রাজি আছো? যদি এতে সম্মত হও তাহলে তোমাকে এবং তোমার অধীনস্ত লোকদেরকে প্রাণে মারবো না এবং তোমার পছন্দ মতো গুজরাটের কোনো একটি ছোট রাজ্যে তোমাকে পুনর্বাসিত করবো।

ইত্তিমাদ খানের মসৃণ মুখে স্বস্তি ফিরে এলো। আমি স্বেচ্ছায় আপনার আদেশ পালন করবো। আপনি যদি আটককৃত, ঐ বন্দীদের কয়েকজনকে মুক্তি দেন তাহলে আমি তাঁদের দূত হিসেবে পাঠাতে পারি।

আকবরের কাছ থেকে ইঙ্গিত পেয়ে তার কয়েকজন রক্ষী বন্দীদের মুক্ত করতে এগিয়ে গেলো কিন্তু তাদের বাধন খোলার আগেই ইত্তিমাদ খান আবার কথা বলে উঠলো। জাহাপনা, আপনাকে জানাতে চাই যে ক্যাম্বে ও সুরাত বন্দরের উপকূল এবং তাদের পশ্চাত্বর্তী অঞ্চল সমূহ আমার নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। আমার বিদ্রোহী চাচাতো ভাই ইব্রাহিম হোসেন ঐ সব অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে। ইত্তিমাদ খান একটু থামলো, তারপর আবার নিচু স্বরে বলতে লাগলো, এছাড়াও আশঙ্কা করছি আমি আত্মসমর্পণের আদেশ দেয়া সত্ত্বেও আমার কতিপয় সেনাপতি হয়তো আমার হুকুম মানবে না।

আমি উপকূল এলাকার পরিস্থিতি জানি এবং শীঘ্রই সেখানে হামলা করে হিব্রাহিম হোসেনকে পরাস্ত করবো। আর তোমার সেনাপতিরা তোমার অদেশ পালন করলেই ভালো করবে। আমার পক্ষ থেকে তাদের কাছে নির্দেশ পাঠাও যে তারা একবার মাত্র আত্মসমর্পণের সুযোগ পাবে। এই সুযোগ যদি কাজে না লাগায় তাহলে নিশ্চিত ভাবে তারা মৃত্যুবরণ করবে। ইত্তিমাদ খান সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো। আকবর ঘোড়া ঘুরিয়ে অন্য দিকে রওনা হলেন। ইত্তিমাদ খানের করুণ পরিণতি তাকে কিছুটা বিব্রত করেছে। আকবর অনুভব করছিলেন এমন লজ্জাকর পরিস্থিতির শিকার হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচানোর মতো পর্যাপ্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট এবং শক্তি তার রয়েছে এবং এজন্য তিনি কৃতজ্ঞও বোধ করলেন। যখন তাঁর পুত্র এবং তাদের পুত্ররা আবুল ফজলের লিখিত ঘটনাপঞ্জি পাঠ করবে তখন তারা তার যুদ্ধাভিযানে এমন লজ্জাকর দুর্বলতা বা ব্যর্থতার নিদর্শন পাবে না, বরং তার বিজয় এবং ক্ষমতার প্রতিপত্তি প্রত্যক্ষ করে উল্লাসিত হবে।

*

সাগর তখন শান্ত, ছোট ছোট ঢেউ গুলি কমলা বর্ণের বালুতীরে ধীরে অছড়ে পড়ছে। সৈকত ঘিরে থাকা নারকেল গাছের পাতা মৃদুমন্দ উত্তরা বাতাসে দুলছে। আকবর দেখতে পাচ্ছিলেন সোয়া মাইল দূরে উপকূল রেখা বরাবর সাগরের দিকে বর্ধিত হয়ে থাকা উচ্চভূমিতে (শৈলান্তরীপ) অবস্থিত ছোট আকারের একটি দূর্গের ভিতরে এবং বাইরে ইব্রাহিম হোসেনের সৈন্যরা সন্নিবেশিত হচ্ছে। ঐ দূর্গটি সমুদ্র বা স্থলপথে ক্যাম্বেতে আগতদের প্রতিরোধ করার লক্ষে নির্মাণ করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি জাহাজ উচ্চভূমি সংলগ্ন বন্দরে নোঙর করা রয়েছে। আকবর আহমেদ খানের দিকে ফিরলেন। আপনি তো আমার বাবার সঙ্গে ক্যাম্বেতে এসেছিলেন, বলতে পারেন ঐ জাহাজ গুলো কিসের জন্য ওখানে নোঙর করা?

 ওগুলোর বেশির ভাগই আরবদের জাহাজ। তারা হজ্জ্বের তীর্থ যাত্রীদের আরব দেশে আনা নেওয়া করে এবং অন্য সময় মশলা এবং কাপড়ের বাণিজ্য করে। আমি আগে যখন এখানে এসেছিলাম তখনো ওগুলোকে দেখেছি। তবে ঐ যে তিনটি কালো রঙ্গের চৌকো আকৃতির উঁচু কিনার বিশিষ্ট জাহাজ দেখা যাচ্ছে ঐ ধরনের জলযান আমি আগে দেখিনি।

ওগুলোর একটার পেছন দিকের ফোকর দিয়ে বেরিয়ে থাকা নলটি কি কামান?

 আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না জাঁহাপনা।

 আহমেদ খান যখন কথা বলছিলেন তখন তিনটি জাহাজের মধ্যে যেটি তাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী, সেটার নাবিকদের পাল তুলতে দেখা গেলো। পাল সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হওয়ার পর আকবর সেটাতে বিশাল আকারের লাল রঙে আঁকা ক্রুশচিহ্ন দেখতে পেলেন। কিছু নাবিক জাহাজটি থেকে নামানো একটি দাঁড়বাওয়া নৌকায় চড়ছিলো এবং জাহাজটির সঙ্গে নৌকাটি দড়ির সাহায্যে যুক্ত ছিলো। শীঘ্রই ছোট নৌকাটির নাবিকদের দাঁড় বাওয়ার টানে এবং উন্মুক্ত পালে লাগা বাতাসের চাপে বড় জাহাজটি ধীরে ধীরে অকবরদের অবস্থানের দিকে ঘুরতে লাগলো।

ইত্তিমাদ খানকে পরাজিত করার পর এই সমুদ্র উপকূলে পৌঁছাতে আকবরের ছয় সপ্তাহ সময় লেগেছে। তিনি তাঁর সকল ভারী সরঞ্জাম পেছনে ফেলে ক্লান্তিহীন ভাবে ঘোড়া ছুটিয়েছেন। পথে যেখানেই ইব্রাহিম হোসেনের সৈন্যদের সম্মুখীন হয়েছেন তাঁদের পরাজিত করে ছত্রভঙ্গ করেছেন। গতকাল আকবরের সৈন্যরা উপকূল বরাবর কয়েক মাইল দূরে একটি অর্ধভগ্ন ছোট আকৃতির দূর্গ দখল করে। দূর্গটির ভিতর তারা পাঁচটি প্রাচীন নকশার কামান আবিষ্কার করে। আকবরের নির্দেশে তার লোকেরা আশেপাশের গ্রামের কৃষকদের কাছ থেকে মালটানা ষাঁড় ক্রয় করে। আকবর সেই কামানগুলি সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন এই ভেবে যে ক্যাম্বে আক্রমণের সময় হয়তো সেগুলি কাজে লাগতে পারে। তাই এই মুহূর্তে কামান বিশিষ্ট জাহাজটিকে তাঁদের দিকে ঘুরতে দেখে তিনি ঘাবড়ালেন না।

কামান প্রস্তুত করো, যাতে প্রয়োজনে ঐ জাহাটির দিকে গোলা বর্ষণ করা যায় এবং বন্দুকধারীদের তৈরি হতে বলো, আকবর আদেশ দিলেন। আধ ঘন্টা পর মোগলদের অবস্থানের ঠিক বিপরীত দিকে, সমুদ্র উপকূল থেকে মাত্র পৌনে একমাইল দূরে পালে কুশ অঙ্কিত কালো রঙের জাহাজটি নোঙর করলো। দেহে উজ্জল বক্ষবর্ম পরিহিত লম্বা গড়নের একটি লোক দড়ির মই বেয়ে জাহাজটি থেকে দাঁড়বাওয়া নৌকাটিতে নামলো যোটি জাহাজটিকে অবস্থান নিতে এতোক্ষণ সাহায্য করেছে। লম্বা লোকটিকে অনুসরণ করে সাদা পাগড়ি এবং বেগুনি আলখাল্লা পরিহিত আরেকটি লোক নৌকায় চড়লো। তারা দুজন যখন ছোট নৌকাটিতে বসলো তখন নাবিকরা সেটার বড় জাহাজটির সঙ্গে যুক্ত বাঁধন খুলে দাঁড় বেয়ে তীরের দিকে রওনা হলো। নৌকাটি যে মুহূর্তে অগভীর জলে পৌঁছালো লম্বা লোকটি তার সঙ্গীকে নিয়ে পানিতে লাফিয়ে নেমে পানি ভেঙে তীরের দিকে আসতে লাগলো। তারা উভয়েই মাথার উপর হাত তুলে রেখেছে বোঝানোর জন্য যে তারা নিরস্ত্র।

আকবর কৌতূহল নিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। যখন তারা নিশ্চিতভাবে জানে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী তখন কি উদ্দেশ্যে তারা তার কাছে আসছে? অস্ত্র আছে কিনা দেখার জন্য ওদের দেহ তল্লাশী করে আমার কাছে নিয়ে এসো, তিনি তাঁর দেহরক্ষীদের অধিনায়ককে আদেশ দিলেন। অধিনায়কটি দৌড়ে আগন্তুকদের দিকে এগিয়ে গেলো এবং তারা তাকে তল্লাশী করার সুযোগ দিলো। তারা নিরস্ত্র এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে অধিনায়কটি তাঁদের আকবরের কাছে নিয়ে এলো। তারা কাছে আসার পর আকবর বুঝতে পারলেন বেগুনি পোষাক পরিহিত লোকটি গুজরাটি কিন্তু তার লম্বা সঙ্গীটি একজন বিদেশী। বিদেশীটির মুখভর্তি বাদামি রঙের দাড়ি এবং নাকটি অত্যন্ত খাড়া ও লম্বা। তার সমতল বক্ষবমটি কেবল বুক ঢেকে রেখেছে এবং শরীরের নিচের অংশে হাঁটু পর্যন্ত দীর্ঘ কালো এবং সোনালী ডোরা বিশিষ্ট পাৎলুনের মতো পোশাক। তার হাঁটুর নিচের অংশে মোজা রয়েছে এবং তার লবনের দাগ বিশিষ্ট কালো পাদুকাটি এমন নকশার যা আকবর আগে কখনোও দেখেননি।

 তোমরা কে? আকবর জিজ্ঞেস করলেন যখন তারা তাঁকে কুর্ণিশ করছিলো।

 আমি সৈয়দ মোহাম্মদ, গুজরাটের লোক, বেগুনি পোশাক পরিহিত লোকটি উত্তর দিলো, এবং ইনি হলেন ডন ইগনাসিও লোপেজ, পর্তুগালের লোক। ঐ তিনিটি বড় জাহাজের অধিনায়ক তিনি। আমি ওনার দোভাষীর কাজ করি।

তাহলে এই বাদামি দাড়ি বিশিষ্ট লোকটি একজন পোর্তুগীজ এরা ইউরোপের দূরবর্তী অঞ্চল থেকে কয়েক বছর আগে গোয়ায় এসেছে নতুন বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করার জন্য। আকবর সতর্কতার সঙ্গে অশান্তুকটির যোগ্যতা নিরূপণের চেষ্টা করলেন। তিনি আগেই পোর্তুগীজদের কষ্মা শুনেছেন। তারা ইতোমধ্যেই বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র সরবরাহের জন্য প্রশংসা অর্জন করেছে, এছাড়া তারা জাহাজ নিয়ে যুদ্ধ করতেও বেশ পারদর্শী। কিন্তু এই প্রথম তিনি তাদের একজনের মুখোমুখী হলেন।

ও আমাকে কি বলতে চায়? আকবর জিজ্ঞেস করলেন। দোভাষীটি পোর্তুগীজটির সঙ্গে এমন এক ভাষায় কথা বললো আকবর যা আগে শুনেননি এবং উত্তর জেনে নিয়ে সে আকবরের দিকে ফিরলো৷ ডন ইগনাসিও নিজ রাজার পক্ষ থেকে আপনাকে সম্ভাষণ জানিয়েছেন। দুঃসাহসী যোদ্ধা এবং শক্তিশালী সম্রাট হিসেবে তিনি আপনার পরিচয় জানেন। তার ঐ তিনটি জাহাজ বহু শক্তিশালী কামান এবং গোলাবারুদে সজ্জিত। ইব্রাহিম হোসেন তাকে একাধিক সিন্দুক ভর্তি ধন-রত্নের বিনিময়ে তার পক্ষে আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুরোধ করেছিলো। কিন্তু তিনি এই যুদ্ধের ব্যাপারে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকতে চান।

 এ কথা শুনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হলাম। কিন্তু তার এই সিদ্ধান্তের বিনিময়ে সে কি আমার কাছে কোনো উপকার আশা করে?

 দোভাষীটি আবার বিদেশী ভাষায় তার প্রভুর সঙ্গে আলাপ করলো, তারপর বললো, আপনি ক্যাম্বে বন্দর জয় করার পর তিনি এখানে বাণিজ্য করার অনুমতি চান।

যখন এই বন্দর আমার হবে তখন আবার ওকে বলবে আমার কাছে প্রস্তাব পেশ করতে এবং সে তখন ইতিবাচক উত্তর পাবে। এখন তোমরা তাড়াতাড়ি ফিরে যাও। ইব্রাহিম হোসেনের উপর আক্রমণের জন্য আমি আর দেরি করতে চাই না।

 ডন ইগনাসিও এবং তার দোভাষী আকবরকে ঝুঁকে কুর্ণিশ করলো, তারপর যে পথে এসেছিলো সেই পথেই নৌকায় ফিরে গিয়ে নিজেদের জাহাজের দিকে অগ্রসর হলো। তাদেরকে আকবরের অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার ইচ্ছা ছিলো কিন্তু এই মুহূর্তটি কৌতূহল মেটানোর উপযুক্ত সময় নয়, তিনি যুদ্ধের ময়দানে রয়েছেন। তিনি আহমেদ খানের দিকে ফিরলেন। আক্রমণের আদেশ দিন। আমরা সৈকতের ধারে অবস্থিত নারকেল গাছ গুলি বরাবর অগ্রসর হবো যেখানে বালু অপেক্ষাকৃত দৃঢ়। ইব্রাহিম হোসেন এবং তার লোকেরা এখন শঙ্কিত হয়ে আছে কারণ পোর্তুগীজটির কাছে তাদের সাহায্যের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, এছাড়া ধারাবাহিক ভাবে আমরা তাদের সকল প্রতিরোধ মোকাবেলা করে এসেছি এবং বর্তমানে তাদের তুলনায় আমাদের সৈন্য সংখ্যা বেশি।

আধ ঘন্টা পরে, আকবর সৈকতের উপর দিয়ে তীব্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তার কালো স্ট্যালিয়নটির খুরের আঘাতে বালু ছিটকে পড়ছিলো। তার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে তার দেহরক্ষীরা, এদের মধ্যে চারজন সবুজ মোগল পতাকা বহন করছে, আরো দুইজন শিঙ্গা বাজাচ্ছে। তারা যখন ইব্রাহিম হোসেনের অগ্রবর্তী প্রতিরোধ প্রাচীরের কাছাকাছি পৌঁছালো বোঝা গেলো সেগুলি তাড়াহুড়া করে বালু খুঁড়ে অস্থায়ী ভাবে বানানো হয়েছে। এর পেছনে অবস্থিত দূর্গের ইটের প্রাচীর অত্যন্ত নিচু এবং ভাঙাচোরা। কিন্তু স্পষ্ট বুঝা গেলো ইব্রাহিম খানের কামান রয়েছে। কারণ আকবর দেখতে পেলেন দূর্গের ভিতরে অবস্থিত একটি দোতলা ভবন থেকে কমলা বর্ণের আগুনের হল্কা এবং ধোঁয়া ছুটছে। সেই মুহূর্তে কামানের প্রথম গোলার আঘাতে তার একজন শিঙ্গাবাদকের মস্তক বিচ্ছিন্ন হলো।

আরো কিছু অশ্বারোহী ঘোড়া থেকে ভূপাতিত হলো, তারা বন্দুকের গুলি বা তীর বিদ্ধ হয়েছে, কিন্তু ইব্রাহিম হোসেনের লোকেরা কামান পুনরায় ছোঁড়ার জন্য প্রস্তুত করতে অনেক বেশি সময় নিচ্ছিলো। ইতোমধ্যে আকবর ঘোড়া সহ লাফিয়ে প্রথম প্রতিরোধ এবং তার পেছনের খাদ পেরিয়ে গেছেন। তবে খাদ পেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি তার মধ্যে অবস্থিত এক তীরন্দাজকে লক্ষ করে তলোয়ার চালিয়েছেন। আঘাতটি তার মুখের একপাশ কেটে দিয়েছে।

আকবর এ সময় আরেকবার কামান দাগার শব্দ শুনলেন এবং তার উপর বালুকণার বৃষ্টি হলো। গোলাটি তাঁর সামনে অবস্থিত প্রতিরোধের উপর আঘাত হেনেছে। গুজরাটি গোলন্দাজ কামানের নল নিচু করে অগ্রসরমান মোগল সেনাদের দিকে গোলা বর্ষন করতে চেয়েছিলো কিন্তু সেই গোলার আঘাতে তাদেরই তৈরি করা প্রতিরোধ প্রাচীর ভেঙে গেছে। ঘোড়ার লাগাম সবলে টেনে ধরে আকবর নতুন সৃষ্ট ফাটলের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হলেন। সেখানে বালুর উপর দুজন গুজরাটি যোদ্ধার ছিন্নভিন্ন দেহ পড়ে ছিলো।

আকবর পাশে তাকিয়ে দেখলেন তাঁর সহযোদ্ধারা একই পদ্ধতিতে প্রতিরোধ পেরিয়ে ঢুকে পড়ছে। তার থেকে কিছুটা সামনে এক দল মোগল যোদ্ধা ঘোড়া থেকে নেমে দূর্গের ভাঙা প্রাচীর বেয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। তিনি তাঁদের দিকে অগ্রসর হলেন। ইতোমধ্যে কয়েক জন দূর্গের ভিতর ঢুকে পড়েছে। আকবর লাফিয়ে ঘোড়া থেকে নামলেন এবং তাঁর সৈন্যদের অনুসরণ করলেন। বাম হাতের মুষ্টিতে দেয়ালে গাঁথা একটি ধাতব শলাকা আকড়ে ধরে নিজের শরীরকে টেনে তুললেন। তিনি তাঁর সৈন্যদের পিছু পিছু শত্রুদের শক্ত ঘাঁটি দোতলা ভবনটির দিকে অগ্রসর হলেন। এখান থেকে দেখে তিনি বুঝতে পারলেন দূর্গের প্রাচীরের ভিতর ওটাই একমাত্র ভবন।

আবার কামানের গোলা বর্ষিত হলো। তার একজন সৈন্য পড়ে গেলো কিন্তু পরমুহূর্তেই ধড়মড় করে আবার উঠে দাঁড়ালো, বুঝা গেলো গোলার আঘাতে নয়, সে হোঁচট খেয়ে পড়েছে। সম্ভবত একটি কামান ভবনের ভিতর এখনো সক্রিয় আছে। পলায়নকারী গোলন্দাজদের খুলে রেখে যাওয়া দরজা দিয়ে আকবর এবং তার সৈন্যরা ঢুকে পড়লো। ভেতরের অন্ধকার চোখে সয়ে আসতেই তারা একটি পাথরে তৈরি খাড়া সিঁড়িপথ দেখতে পেলো এবং সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলো। সিঁড়ি পেরিয়ে এসে তারা দেখলো সেখানে এক গুজরাটি সেনাকর্তা একাই কামানের একটি ভারী গোলা কামানে ব্রার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। পেছন থেকে আকবরের এক সৈন্য প্রায় এক ফুট লম্বা ফলা বিশিষ্ট একটি ছোরা তাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলো। পিঠে ছোরাবিদ্ধ হয়ে সেনাকর্তাটি কামানের কাঠ নির্মিত গাত্তি উপর পড়ে গেলো।

জলদি করো, আকবর তার দুইজন দেহরক্ষীকে লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে উঠলেন, তুমি ছাদে গিয়ে আমাদের পতাকা উড়িয়ে দাও, এর ফলে বুঝা যাবে আমরা দূর্গটি দখল করতে পেরেছি। আর তুমি, মোহাম্মদ বেগকে খুঁজে বের করো। তাঁকে বলো তিনি যাতে বাকি সৈন্যদের আদেশ দেন যতো দ্রুত সম্ভব এই দূর্গটির চারদিক ঘিরে ফেলার জন্য যাতে গুজরাটিরা পালিয়ে উত্তরে ক্যাম্বে শহরে ফিরে যেতে না পারে।

*

ঐদিন সন্ধ্যায় আকবর ক্যাষে বন্দর রক্ষাকারী বাঁধের উপর নির্মিত ছোট একটি পাহারাচৌকির উপর দাঁড়িয়ে ছিলেন। এই মুহূর্তে তিনি যুদ্ধের উত্তেজনার সঙ্গে মিশ্রিত বিজয়োল্লাস অনুভব করছেন। গুজরাট এখন নিশ্চিতভাবে তার বর্ধিষ্ণু সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত। বন্দরের প্রধান ভবনগুলির ছাদে মোগল পতাকা শোভা পাচ্ছে। ইব্রাহিম হোসেন কাঁধে কুঠার বিদ্ধ হয়ে আহত অবস্থায় আত্মসমর্পণ করেছে এবং বন্দীত্ব বরণ করে সে এখন নিয়তির অপেক্ষায় রয়েছে।

 সম্মুখে অবস্থিত সাগরটি কি অপূর্ব এর ধূসর তরঙ্গের উপর বেলা শেষের সূর্যটি বেগুনি মেঘের আগ্রাসনে পশ্চিম দিগন্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ আকবর সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি স্বশরীরে সমুদ্রের সান্নিধ্য গ্রহণ করবেন, সমুদ্রের নিকটবর্তী হওয়ার অভিজ্ঞতা এর আগে তার হয়নি।

একঘন্টা পর দেখা গেলো আকবর একটি পঞ্চাশ ফুট দীর্ঘ আরবী জাহাজের অগ্রভাগে দাঁড়িয়ে আছেন। সেটি ক্রমশ উঁচু হতে থাকা ঢেউ এর ধাক্কায় উঠা নামা করছিলো। জাহাজের অধিনায়ক আকবরকে আগেই সতর্ক করেছেন যে দিগন্তে আবির্ভূত কালো মেঘ সামুদ্রিক ঝড়ের পূর্বসংকেত। কিন্তু আকবর জেদ ধরেন তিনি কিছুক্ষণের জন্য হলেও জাহাজ থেকে সমুদ্র পর্যবেক্ষণ করবেন। আকবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণ কোৰ্চিটি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সে নিজের পোশাকের উপর বমিও করে দিয়েছে। আরেকজন মাস্তুলের নিচে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে প্রাণে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রার্থনা কছে।

 হঠাৎ বিশাল আকারের একটি ঢেউ জাহাজের কিনার অতিক্রম করে আকবর এবং তার পাশে দাঁড়ানো আহমেদ খানকে উষ্ণ ফেনিল জলে গোসল করিয়ে দিলো। আহমেদ খানকে বেশ বিচলিত মনে হলো যখন তিনি আকবরের দিকে ফিরলেন। জাহাপনা চলুন আমরা আরেকটু নিরাপদ অবস্থানে যাই, সেটাই এই মুহূর্তে বুদ্ধিমানের মতো কাজ হবে। আকবরের দীর্ঘ ভেজা চুল বাতাসে পেছন দিকে উড়ছিলো। তিনি তাঁর পা দুটি ঈষৎ ফাঁক করে দাঁড়িয়ে জাহাজের এই অপরিচিত দোলার সঙ্গে একাত্ব হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তিনি আহমেদ খানের প্রস্তাবের উত্তরে মাখা নাড়লেন। সমুদ্রের এই স্পন্দন আমাকেও কিছুটা ভীত করছে। কিন্তু জাহাজের অধিনায়ক আমাকে জানিয়েছে বড়টির প্রচগুতা কিছুক্ষণের মধ্যেই কমে যাবে। সমুদ্রের ঝঙা উপেক্ষা করে আমি আমার নিজের সাহস পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম। এই মুহূর্তে ঝড়ের তান্ডব এবং এর ফলে সৃষ্ট অসুবিধার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও আমি শিখছি…আছড়ে পড়া প্রলয়ঙ্করী ঢেউ এবং সমুদ্রের অসীম শক্তি আমাকে বিনয়ের সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে অতিঅহঙ্কারী বা সীমাহীন আত্মবিশ্বাসী হওয়া আমরা উচিত হবে না। যদিও আমি অন্য অনেক রাজার তুলনায় অধিক শক্তিশালী সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছি, মহান বিজয় অর্জন করেছি, কোষাগার উপচে পড়া ধন-রত্ন আহরণ করেছি এক কোটি কোটি মানুষের শাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়েছি-তবুও আমি একজন সাধারণ মানুষ, নগন্য এবং প্রকৃতির অনন্ত অস্তিত্বের তুলনায় নিতান্তই রূণশীল একটি প্রাণী।

.

১২. এক ডেকচি ভর্তি মস্তক

চমৎকার নকশা করেছ। বাঘটিকে দেখে মনে হচ্ছে সেটা যে কোনো মুহূর্তে ঝাঁপ দেবে, আকবর তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কারিগরটিকে বললেন। তারা দুজন শিক্রির বালুপাথর খোদাই করা আকর্ষণীয় ভবনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন না যা আকবর গুজরাট বিজয়ের পর ফিরে এসে পরিদর্শন করেছেন। তারা আগ্রার যমুনা তীরবর্তী কাঠের জেটিতে দাঁড়িয়ে একটি নতুন তৈরি করা জাহাজের সম্মুখের চেহারা দেখছিলেন। সম্মুখে বাঘ বিশিষ্ট এই জাহাজটি বংলায় যুদ্ধাভিযানে আমার প্রতীক হিসেবে চমৎকার ভূমিকা পালন করবে।

আকবর শিক্রিতে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার দায়িত্বে নিয়োজিত তাঁর প্রধান সেনাপতি মুনিম খানের কাছ থেকে সংবাদ আসে। প্রথম সংবাদটি থেকে জানা যায়, বাংলার তরুণ শাসনকর্তা শাহ দাউদ, যে কিছুদিন আগে পিতার মৃত্যুর পর ঐ এলাকার জায়গিরদার হিসেবে নিযুক্ত হয়েছে সে বিদ্রোহ করেছে। এছাড়াও সে রাজকীয় কোষাগার সমূহ এবং প্রধান মোগল অস্ত্রাগার লুট করেছে। তবে বার্তাটিতে মুনিম খান উল্লেখ করেন যে তিনি নিজেই দাউদকে এই ধৃষ্টতার জন্য শাস্তি দেবেন। দ্বিতীয় বার্তাটি অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত, উল্লেখ করা হয়েছে, শাহ দাউদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান যেমন অনুমান করা হয়েছিলো তার তুলনায় কঠিন হয়ে পড়েছে এবং মুনিম খানের আরো সৈন্য সহায়তা প্রয়োজন। এই বার্তা দুটি পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই তৃতীয় আরেকটি বার্তা আসে। এতে স্বয়ং আকবরকে সেখানে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে এই জন্য যে, সেখানে মারাত্মক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ মুনিম খান দাউদের পাটনা দূর্গ অবরোধ করেছেন ঠিকই কিন্তু পর্যাপ্ত সৈন্যের অভাবে তার এই অবরোধ দুর্বল হয়ে পড়ছে।

সদ্য পশ্চিম উপকূলে সাম্রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে পূর্বদিকে বাংলা এবং এর উপকূলবর্তী অঞ্চল নিজের করতলগত করার সুযোগ আকবরকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছে। তিনি তাঁর উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই মুনিম খানের তৃতীয় বার্তাটির তাৎক্ষণিক উত্তর প্রদান করেছেন। উত্তরে আকবর মুনিম খানকে জানিয়েছেন তিনি যাতে নিজের বাহিনীর সদস্যদের অহেতুক বিপদের সম্মুখীন না করেন। পাশাপাশি আকবর সেখানে পৌঁছানোর পূর্ব পর্যন্ত রসদ এবং যুদ্ধসরঞ্জাম যথাসম্ভব সংরক্ষণের চেষ্টা করেন। এছাড়াও আকবর অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে মুনিম খানকে জানিয়েছেন, নিশ্চিত বিজয়ের জন্য পর্যাপ্ত সৈন্য সংগৃহীত হওয়ার আগে তিনি যাত্রা শুরু করবেন না। তাছাড়া তার সৈন্যদের নিয়ে জলপথে পাটনা আসার জন্য পর্যাপ্ত জলযান যোগাড় করতেও কিছুটা সময় লাগবে। এর অর্থ পাটনা পৌঁছাতে তার কমপক্ষে তিন মাস বা তার কিছু বেশি সময় লাগবে।

আকবর তাৎক্ষণিক ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যেহেতু পাটনা যেতে হলে তাঁকে তাঁর সাম্রাজ্যেন প্রধান দুটি নদীপথ যমুনা ও গঙ্গা দিয়ে অগ্রসর হতে হবে তাই এর উভয় পারের প্রজাদের মধ্যে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা সৃষ্টির জন্য বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে হবে। তাকে এমন আকর্ষণীয় একটি নৌবহর নিয়ে অগ্রসর হতে হবে যা ঐসব অঞ্চলের মানুষ আগে কখনোও দেখেনি। যেদিন মুনিম খানের চিঠির উত্তর দিয়েছেন সেই দিনই তিনি তার প্রকৌশলী এবং জাহাজ নির্মাতাদের ডেকে পাঠিয়েছেন। তিনি তাঁদের প্রশস্ততল বিশিষ্ট নৌকা ও জাহাজ নির্মাণের আদেশ দিয়েছেন যেগুলিতে করে যুদ্ধতি এবং বিশাল আকৃতির কামন ও গোলা বহন করা সম্ভব হবে। তার সৈন্যদের বহন করার মতো যথেষ্ট সংখ্যক নদীগামী জলযানও সংগ্রহ ও পুনর্নির্মাণ করতে বলেছেন।

*

জাহাপনা, আজ আমাদের পক্ষে যাত্রা করা সম্ভব হবে না, আহমেদ খান বললেন। প্রচণ্ড বর্ষণের কারণে বন্যার পানি এতো তীব্র বেগে ভাটির দিকে প্রবাহিত হচ্ছে যে জাহাজের অধিনায়করা আশঙ্কা করছেন এই মুহূর্তে রওনা হলে জাহাজের গতি নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে এবং দিন শেষে যাত্রা বিরতির সময় সেগুলিকে নোঙর ফেলে একস্থানে স্থির রাখাও সম্ভব হবে না। এছাড়া যে অশ্বারোহী বাহিনী নদী তীর দিয়ে আমাদের সঙ্গে অগ্রসর হবে তারাও গভীর কাদা এবং ডোবা নালা অতিক্রম করতে অসুবিধার সম্মুখীন হবে।

আকবর এক মুহূর্ত ভাবলেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আহমেদ খান অনেক বেশি সাবধানী হয়ে উঠছেন। না, আজই রওনা হওয়ার ব্যাপারে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, আমাদের যদি ধীরেও অগ্রসর হতে হয় তাতে কোনো সমস্যা নেই। আমরা যথাসম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করবো এবং প্রয়োজনে একটার বেশি জাহাজ ছাড়বো না। কিন্তু যাত্রা আমরা আজই শুরু করবো। যখন কেউ নদী পথে যাত্রা করার সাহস করবে না তখন যদি আমরা অগ্রসর হই সেটা আমাদের অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা প্রকাশ হবে, যা সম্পর্কে আমি আমার প্রজাদের অবগত করতে চাই। বিশেষ করে শাহ্ দাউদকে। আমি যতোটা ভাবছি সে যদি তার তুলনায় অধিক নির্বোধ না হয়, তহলে সে অবশ্যই আমার গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য গুপ্তচর নিযুক্ত করেছে।

এক ঘন্টা পরের ঘটনা। বৃষ্টি পড়া সাময়িক ভাবে বন্ধ আছে এবং সাদা মেঘের ফাঁক দিয়ে বৃষ্টিস্নাত আবছা সূর্য দেখা যাচ্ছে। আকবর তার পতাকাবাহী জাহাজের অগ্রভাগে খোদাই করা বাঘের মস্তকের ঠিক উপরে দাঁড়িয়ে আছেন। শুধুমাত্র নেংটি পরিহিত দাড়িরা (বইঠা বাওয়ার লোক) সামনে পিছনে নুয়ে বইঠা বাইছে আর দরদর করে ঘামছে। তারা বহু কষ্টে স্রোতের বিপরীতে জাহাজটিকে মাঝ নদীতে রাখার চেষ্টা করছে। অন্যান্য বিশাল আকৃতির নৌকা গুলিকে অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের নৌকার সাহায্যে টানা হচ্ছে। দুই একবার প্রশস্ততল নৌকাগুলি পরস্পরের সঙ্গে বাড়ি খাওয়া ছাড়া বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। আকবর ঈশ্বরের কাছে এই মর্মে প্রার্থনা করলেন যাতে তার অভিযানে কোনো বড় ধরনের বিঘ্ন না ঘটে। তাছাড়া এই অভিযানের সাফল্যের জন্য তার নিজের সতর্কতা ও পরিকল্পনারও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

*

দিগন্তে বিস্তৃত কালো মেঘে উজ্জ্বল পাতের মতো বিদুৎ ঝলসে উঠছে। তার মাঝে ভৃত্যরা সারিবদ্ধভাবে জাহাজ থেকে তীরে ফেলা কাঠ নির্মিত ঢালু সিঁড়ি বেয়ে কিছুক্ষণ আগে শিকার করা পশুর মৃতদেহ বয়ে আনছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে আটটি বাঘ-তার মধ্যে একটির মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত দৈর্ঘ্য সাত ফুটের কম নয়-বাঁশের সাথে বেঁধে চারজনের এক একটি দল সেগুলো কাঁধে বয়ে আনছে। তাদের পিছনে অন্যরা বয়ে আনছে নাড়িভুড়ি অপসারিত হরিণের দেহ, সেগুলি চামড়া ছিলে টুকরো করলেই সান্ধ্য ভোজের জন্য রান্না করা যাবে। লাইনের শেষের ভৃত্যদের কাঁধে ঝুলছে স্থির হয়ে থাকা হাঁসের গুচ্ছ।

আকবর ইতোমধ্যে তাঁর বৃষ্টিতে ভেজা কাদামাখা পোষাক ছেড়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে নতুন পোষাক পরিধান করছেন। লাল শাস বিশিষ্ট তরমুজের রসে চুমুক দিতে দিতে তিনি যাত্রার চুড়ান্ত প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। রওনা হওয়ার পর থেকে অধিকাংশ অপরাহ্নেই আকবর শিকার করার উৎসাহ প্রদর্শন করেছেন। জাহাজের নাবিকরা তাঁর এই ইচ্ছার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। আকবর যুক্তি দেখান যে, শিকার করার ফলে অশ্বারোহীরা অনুশীলনের সুযোগ পাচ্ছে এবং বন্দকধারীরাও তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারছে। সেই সঙ্গে তাঁর নিজের শখও পূরণ হচ্ছে। এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেছে সপ্তাহে অন্তত একবার। তখন তিনি মোহাম্মদ বেগ, রবি সিং এবং অন্যান্য সেনাপতিদের আদেশ করেছেন- যেকোনো শুকনো নদীপারে পদাতিক সৈন্যদের কুচকাওয়াজ করানোর জন্য। দশ দিন আগে তিনি যমুনা এবং গঙ্গা নদীর সঙ্গম স্থলের পাশে অবস্থিত পবিত্র নগরী এলাহাবাদে নেমেছিলেন। তারপর সেখানকার প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনা করে ঐ নগরীতে একটি শোভাযাত্রার আয়োজন করেন। পরে সন্ধ্যায় তাঁর সফর সঙ্গী হিসেবে আগত কাশগড়ের জাদুকরেরা শহর প্রাচীরের উপর এক বর্ণাঢ্য আতশবাজি প্রদর্শনীর আয়োজন করে।

 আকবর তাঁর পাশে থাকা আহমেদ খানের দিকে ফিরলেন। পাটনা পৌঁছাতে আমাদের আর কয় সপ্তাহ সময় লাগবে বলতে পারেন?

হয়তো এক মাস লাগবে, কিন্তু এক্ষেত্রে মূলত, বর্ষা পরিস্থিতির উপর সবকিছু নির্ভর করছে। এখনো পর্যন্ত আমাদের ভাগ্য ভালোই রয়েছে স্বীকার করতে হবে। সবচেয়ে ক্ষতিকর দুর্ঘটনা ছিলো সেটাই, যখন দুটি প্রশস্ততল নৌকা পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে তিনটি কামান যমুনা গর্ভে হারিয়ে যায়। তবে এখন যেহেতু গঙ্গা নদী ক্রমশ চওড়া হচ্ছে তাই আমরা আমাদের গতিপথে অধিক সংখ্যক অগভীর এবং কর্দমাক্ত তীর পাবো। ফলে তীরে নামার সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। শাহ দাউদ আমাদেরকে দেরি করিয়ে দেয়ার জন্য ঐসব জায়গায় গুপ্ত আক্রমণের পরিকল্পনাও করতে পারে। আমি জানতে পেরেছি সে কতিপয় নদীদস্যুকে আমাদের উপর আক্রমণ করার জন্য উৎকোচ প্রদানের চেষ্টা করেছে।

কিন্তু নদীদস্যুরা বিচক্ষণতার সঙ্গে তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে, তাই না?

 জ্বী জাহাপনা। তাঁদের কেউ কেউ বিষয়টি সরাসরি আমাদেরকে জানিয়েছেও। তাছাড়া আমাদেরকে নদীদূর্গ গুলির প্রতিও সতর্ক থাকতে হবে যেগুলি পাটনার প্রবেশপথ রক্ষায় নিয়োজিত। আমাদের তথ্য সংগ্রহকারীরা জানিয়েছে সেগুলি পর্যাপ্ত লোকবল এবং রসদ সমৃদ্ধ।

নদী পথে চলতে চলতে আমি এ বিষয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা করেছি যে কীভাবে তরুণ শাহ দাউদ এর মনোবল নষ্ট করা যায় এবং তার প্রতি তার সৈন্যদের আস্থা দুর্বল করা যায়। এখন সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার উপযুক্ত সময়।

আপনি কি বোঝাতে চাইছেন জাঁহাপনা? কীভাবে তা সম্ভব? আহমেদ খানকে ভীষণ অবাক মনে হলো।

 আমার সেনাবাহিনীর শক্তি সম্পর্কে বর্ণনা দিয়ে আমি তাকে একটি চিঠি লিখতে পারি এবং প্রস্তাব দিতে পারি সে যাতে প্রতিনিধি পাঠিয়ে আমার দাবি যাচাই করে। তাকে আরো জানাতে পারি যে- সৈন্য সংখ্যা, গোলাবারুদ এবং অন্যান্য রসদ সমৃদ্ধ হয়ে আমি যে সুবিধাজনক অবস্থানে আছি তা কাজে লাগানো থেকে আমি বিরত হবো যদি সে কেবল একটি যুদ্ধের মাধ্যমে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে রাজি হয়।

 কিন্তু সে রাজি হলে কি করবেন?

আমি নিশ্চিত সে রাজি হবে না, কিন্তু রাজি হলেও সমস্যা নেই। যে কোনো লোকের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে আমার কোনো দ্বিধা নেই, আর সে তো একজন অনভিজ্ঞ তরুণ হিসেবে সুপরিচিত। একটি যুদ্ধে সবকিছু সমাধান হয়ে গেলে অনেক মানুষের প্রাণ বেঁচে যাবে, সেইসঙ্গে সময় এবং জটিলতাও।

 সে ক্ষেত্রে তার প্রতিক্রিয়া কি হবে বলে আপনি মনে করেন?

 সে আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে, কিন্তু সে যদি সত্যিকার সাহসী না হয় অথবা ভালো অভিনেতা, তাহলে তার আশেপাশের লোকজন তাকে বিচলিত হতে দেখবে। তার সৈন্যরা যখন আমার প্রস্তাব সম্পর্কে জানতে পারবে এবং সেটা আপনাকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে-তখন তারা আমাদের আত্মবিশ্বাস প্রত্যক্ষ করে অভিভূত হবে। একক যুদ্ধের প্রস্তাব দাউদ প্রত্যাখ্যান করার পর তারা তাকে কাপুরুষ বলে গণ্য করবে এবং তাদের মনোবল দুর্বল হয়ে পড়বে।

এই বুদ্ধিতে কাজ হতে পারে জাঁহাপনা, আহমেদ খান বললেন, তবে তাকে সন্দিহান মনে হলো।

কাজ হবেই। আমার নিজের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে যে আমার পিতামহ বাবরের এই বক্তব্যটি সঠিক ছিলো। সেটা হলো যতো যুদ্ধ সৈন্যরা যুদ্ধ ক্ষেত্রে মুখোমুখী লড়াই করে জয়ী হয় ঠিক সম সংখ্যক যুদ্ধ মনস্তাত্ত্বিক ভাবে বিজিত হয়। তবে যাই হোক, শাহ দাউদকে প্রস্তাব পাঠাতে আমাদের তেমন কোনো ক্ষয় স্বীকার করতে হবে না।

সেই মুহূর্তে মাথার উপর বজ্রপাতের গর্জন শোনা গেলো এবং পুনরায় বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়া শুরু হলো। সেই ঘন বর্ষার মাঝে আকবরের নৌবহর যাত্রার প্রস্তুতি নিতে লাগলো।

*

আকবর ও আহমেদ খান গঙ্গা নদীর কর্দমাক্ত পারে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাদের দৃষ্টি পাটনার প্রবেশ মুখের পাশে অবস্থিত দূর্গের দিকে। দূর্গটির দেয়াল প্রায় পঞ্চাশ ফুট উঁচু। দেয়ালের নিচের অংশ পাথরে তৈরি এবং উপরের দিকে ইটের গাথুনি। দূর্গ প্রাচীরের ফোকরে ব্রোঞ্জ নির্মিত কামানের নল দেখা যাচ্ছিলো। নদী এবং নদী তীরের ধান ক্ষেত কামানগুলির নিশানার আওতায় রয়েছে। নদী তীরের অধিকাংশ ভূমি জুড়ে ফলে থাকা ধানগাছ গুলি উজ্জ্বল সবুজ বর্ণের। দূর্গের প্রাচীরে আঘাত হানার জন্য মোগল সৈন্যদের এই ধান ক্ষেত পেরিয়ে দ্রুত বেগে অগ্রসর হতে হবে।

 আকবরের অনুমান অনুযায়ী একক যুদ্ধের প্রস্তাবের কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি শাহ্ দাউদ। তাঁর রণতরী সমূহ বর্ষা জনিত অসুবিধা অতিক্রম করে গঙ্গা নদীর বর্তমান অবস্থানে পৌঁছেছে দুই দিন আগে। গত রাতে একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ সভা শেষে আকবর আদেশ দেন তাঁর নৌবহরের একাংশ যাতে রবি সিং এর নেতৃত্বে রাতের আধার আড়ালকে ব্যবহার করে দূর্গ পেরিয়ে অগ্রসর হয় এবং কিছুটা ভাটিতে পৌঁছে একটি শক্তিশালী বাহিনী তীরে নামিয়ে দেয়। যাতে তারা সেদিক থেকে দূর্গ আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসতে পারে। আকবর বুঝতে পারছিলেন যে ভাগ্য তাকে সহায়তা করছে। কারণ ঐ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার সময় বর্ষার কালো মেঘ চাঁদকে ঢেকে রেখেছিলো এবং অবিরাম বৃষ্টি ঝরছিলো। ফলে দূর্গের প্রায় সামনে দিয়ে জাহাজ গুলি পেরিয়ে যাচ্ছিলো অস্তিত্ব গোপন রেখে। কিন্তু শেষ দিকে দূর্গের এক প্রহরী বিপদ সংকেত দিলে সেখান থেকে কামানের গোলা বর্ষণ শুরু হয়। পাঁচটি হাতি বহনকারী একটি প্রশস্ততল পোর্টুন (মালবাহী বড় আকারের নৌকা) কামানের গোলার আঘাতে ডুবতে শুরু করে, ভাটিগামী প্রচণ্ড স্রোতের তোড়ে কিছু তীরন্দাজ বহনকারী নৌকা অর্ধনিমজ্জিত পোনটুনটির সঙ্গে ধাক্কা খেলে জলসীমার নিম্নভাগে ফুটো হয়ে যায়। ফলে সেটিও ডুবতে শুরু করে এবং দূর্গ থেকে সেটার যাত্রীদের লক্ষ্যকরে কামান ও বন্দুকের গোলা বর্ষণ শুরু হয়। বহু তীরন্দাজ আহত হয় এবং মৃত্যুবরণ করে। যারা বেচে ছিলো তারা তাদের বক্ষবর্ম এবং অস্ত্র ত্যাগ করে সাঁতড়ে পারে উঠার চেষ্টা করে বা অন্য নৌকা গুলিতে উঠার চেষ্টা করতে থাকে। হঠাৎ কালো জলে কিছু সর্পিল আকৃতিকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়- একটু পরে বুঝা যায় সেগুলি রক্তের গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে এগিয়ে আসা কুমির। পানিতে থাকা লোকগুলি একে একে অদৃশ্য হতে শুরু করে এবং কুমিরের ধারাল দাঁতের আগ্রাসনে হাতিগুলি রক্তাক্ত মাংস পিণ্ডে পরিণত হয়।

সকালের প্রথম আলোতে আকবরের লোকেরা তীরন্দাজদের ডজন খানেক ছিন্নভিন্ন মৃত দেহ আবিষ্কার করে যেগুলি ভাটির দিকের অগভীর জলে ভাসছিলো। মৃতদেহ ভক্ষণ করতে এগিয়ে আসা একদল হাড্ডিসার বেওয়ারিশ কুকুরের দলকেও তাড়া করে সরিয়ে দিতে হয়েছে। এই ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও আকবর এই মর্মে শুভ সংবাদ পেলেন যে রবি সিং এর নেতৃত্বাধীন বাকি জাহাজগুলি সংঘর্ষ এড়িয়ে নিরাপদে দূর্গের ভাটি এলাকায় পৌঁছেছে অপেক্ষাকৃত কম হতাহত যাত্রী নিয়ে এবং সেখানে সৈন্য ও সরঞ্জাম পারে নামাচ্ছে। যুদ্ধসভায় গৃহীত কৌশল অনুযায়ী দূর্গটি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে আক্রমণ করার প্রস্তুতি চলছে।

 আহমেদ খান, আমরা যে সৈন্যদের উজানে নামিয়ে দিয়েছি তাদের সঙ্গে ভাটিতে নামা সৈন্যদের মিলিত হতে কততক্ষণ সময় লাগবে?

হয়তো আর এক ঘন্টা জাহাপনা। দূর্গ থেকে তাদের বাধা দানের কোনো চেষ্টার খবর পাওয়া যায়নি।

 ভালো। আর কামানবাহী পোন্টুন গুলি কি দূর্গের কাছাকাছি অবস্থান নিয়েছে, যেখান থেকে আমার আদেশ পেলে তারা আমাদের সৈন্যদের সাহায্য করার জন্য দূর্গের দিকে গোলা বর্ষণ করতে পারবে?

 জ্বী, গোলন্দাজেরা কামানে গোলা ভরে প্রস্তুত রয়েছে। এছাড়া যেসব সৈন্য দূর্গের নদীমুখী প্রবেশ পথ আক্রমণ করবে তারাও দাঁড়বাওয়া নৌকায় চড়ে প্রস্তুত রয়েছে।

এক ঘন্টা পর আকবরের আদেশ পেয়ে মধ্য নদীতে অবস্থান করা কামানবাহী দশটি পন্টুন নোঙ্গর তুলে অগ্রসর হতে লাগলো। নাবিকদের বৈঠার টানে বিশাল কাঠের জাহাজগুলি দ্রুত ভাটির দিকে অগ্রসর হলো। কামানবাহী পন্টুনগুলিকে নেতৃত্বদানকারি লোকটি লম্বা গড়নের, তার মুখভর্তি দাড়ি এবং সর্বাঙ্গে লাল পোশাক পরিহিত। দূর্গটি গোলাবর্ষণের আওতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে সে তার অধীনস্ত দুটি কামান ছোঁড়ার আদেশ দিলো।

ক্যানভাসের আচ্ছাদনের নিচে থাকা সত্ত্বেও কামানগুলির কাছে বৃষ্টির ছাট আসছিলো। সাবধানে হাতের সাহায্যে অগ্নিসংযোগকারী লাঠি ঢেকে দুই গোলন্দাজ কামানের স্পর্শরন্ধ্রে আগুন ছোঁয়ালো। আর্দ্রতার আগ্রাসন সত্ত্বেও দুটি কামানই প্রচণ্ড শব্দে গোলাবর্ষণ করলো এবং বিস্ফোরণের ধাক্কায় পন্টুনটি ভীষণভাবে দুলে উঠলো। ফলে একজন গোলন্দাজ ছিটকে নদীতে পড়ে গেলো, তবে সঙ্গীর সহায়তায় পরক্ষণেই সে আবার জলযানে উঠে পড়তে সক্ষম হলো। তারা যখন তাদের আন্দোলিত হতে থাকা জলযানে আবার মরিয়া হয়ে কামান প্রস্তুত করতে লাগলো তখন অন্য পন্টুনে থাকা কামানের গোলা বর্ষিত হলো এবং নদীর ঐ অংশ বিস্ফোরণের সাদা ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত হতে লাগলো।

পার থেকে নদীর মধ্যে বর্ধিত হয়ে থাকা একটি উদগ্রভূমিতে আকবর দাঁড়িয়ে ছিলেন। ধোঁয়ার মাঝে সৃষ্ট সাময়িক ফাঁক দিয়ে তিনি লক্ষ্য করলেন দূর্গের জলদ্বার (পানি পথে দূর্গে প্রবেশের দরজা) কামানের গোলার আঘাতে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এর বিশাল কাগুলি দেয়াল থেকে প্রায় আলগা হয়ে গিয়েছে। প্রতিপক্ষ ক্ষতি মেরামত করার আগেই এখন আক্রমণ করতে হবে। নৌকার সৈন্যদের অগ্রসর হতে বলল, তিনি চিৎকার করে উভয় দিকের কামানের গর্জন ছাপিয়ে নিজের কণ্ঠস্বর শ্রবনযোগ্য করতে চাইলেন।

 এ সময় আকবর দেখতে পেলেন তার যুদ্ধ হাতিগুলো কাদাপানি পূর্ণ ধানক্ষেত মাড়িয়ে দূর্গের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। হাতির পিঠে অবস্থিত হাওদা থেকে বন্দুকধারীরা দূর্গের গোলন্দাজদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছে। পদাতিক সৈন্যরা বহুকষ্টে কাদাপানির উপর দিয়ে হাতির দেহকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের মধ্যে অনেকে দূর্গের প্রাচীর বেয়ে উঠার জন্য লম্বা মই বহন করছিলো। একটি হাতি মাথায় কামানের গোলার আঘাত লেগে ধান ক্ষেতে লুটিয়ে পড়লো। মোগল পদাতিকরা সেটার আড়ালে জড়ো হতে লাগলো দূর্গের প্রাচীরে চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য। বর্তমানে সব কিছু ভালো মতোই আগাচ্ছে।

হঠাৎ গঙ্গা নদীর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আকবর দেখতে পেলেন মোগল সৈন্যতে পূর্ণ একটি নৌকা সৈকত থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে রয়েছে যেটি দূর্গের জলদ্বারে (পানি পথে দূর্গে প্রবেশের দরজা) আঘাত হানার জন্য অগ্রসর হয়েছে। আহমেদ খান হাত বাড়িয়ে আকবরকে বিরত করতে চাইলেন কিন্তু তিনি তা উপেক্ষা করে অগভীর পানির উপর দিয়ে দৌড়ে নৌকাটির দিকে অগ্রসর হলেন, কুমিরের আক্রমণের আশঙ্কাকেও গুরুত্ব দিলেন না। সোনা মোড়া বক্ষবর্ম দেখে নৌকার সৈন্যরা আকবরকে চিনতে পারলো এবং উল্লাসে চিৎকার করতে করতে তাকে সবলে টেনে নৌকায় তুললো। দ্রুত তিনি নৌকার সম্মুখ ভাগে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন এবং দাঁড়িদের দূর্গের জলদ্বারের কাছে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিতে থাকলেন। কয়েক মুহূর্ত পরে হঠাৎ আকবরের মনে হলো কোনো দৈত্যাকৃতি হাত তাকে বুকের উপর সজোরে ধাক্কা মেরেছে। তিনি বেশ খানিটা পিছিয়ে বেকায়দাভাবে নৌকার পাটাতনের উপর পড়ে গেলেন। কি হলো? তিনি বিভ্রান্তবোধ করলেন। তিনি রক্তক্ষরণের কোনো আলামত পেলেন না কিন্তু তার শরীরের ডান পাশটা অবশ মনে হলো। আকবর হাতড়ে তাঁর বক্ষবর্মটি পরীক্ষা করতে লাগলেন। সেটা কোথাও ফুটো হয়নি তবে এক জায়গায় টোল খেয়েছে এবং শরীরের সেই স্থানে ভোঁতা ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে যা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। এখন আকবর অনুমান করতে পারলেন এটা গাদাবন্দুকের গুলির আঘাত।

তাকে ঘিরে থাকা সৈন্যদের হাত নেড়ে সরিয়ে তিনি উঠে বসলেন নৌকার অবস্থান জানার জন্য। দেখলেন নৌকাটি দূর্গের জলদ্বার থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে রয়েছে। ভাগ্যের সহায়তায় বা খুব ভালো নিশানার বদৌলতে তার ভাসমান কামান থেকে ছোঁড়া গোলার আঘাতে দশ ফুট উঁচু কাঠের দরজাটির সম্মুখের লোহার জাফরিটি(গ্রিল) ভেঙ্গে গেছে এবং কাঠের দরজাটিও উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে অন্য আরেকটি মোগল নৌকা থেকে সৈন্যরা লাফিয়ে তীরে নেমে আকাবাকা গতিতে দ্বারটির দিকে ছুটছিলো যাতে দূর্গ প্রাচীরের উপর থেকে তাঁদের দিকে ছোঁড়া তীর বা গুলি লক্ষভ্রষ্ট হয়। কিন্তু তবুও আকবর দেখলেন তাঁদের অনেকে আক্রান্ত হয়ে পড়ে গেলো এবং বাকিরা পালাতে লাগলো। কেউ কেউ তাদের আহত সঙ্গীদের টেনে দরজা থেকে দশ গজ দূরে অবস্থিত জেটির পাশের ছোট পাথরের কুটিরের আড়ালে কিছুটা নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিলো। আকবর তাঁর নৌকাটি তীর স্পর্শ করার আগেই এক ফুট পানির মধ্যে লাফিয়ে নামলেন, পানি ছিটিয়ে তীরের দিকে দৌড়ে যাওয়ার সময় তিনি চিৎকার করলেন, জলদ্বারের দিকে আমাকে অনুসরণ করো সবাই। যতো দ্রুত দৌড়াবে বিপদ তত কমে যাবে। যতোটা সম্ভব সামনের দিকে ঝুঁকে তলোয়ার বাগিয়ে ধরে তিনি এগিয়ে গেলেন। তৎক্ষণাৎ তিরিশ জনের মতো সৈন্য তাঁকে অনুসরণ করলো, বন্দুকের গুলি এবং তীর তাঁদের আশপাশের বাতাস কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে। আকবরকে অগ্রসর হতে দেখে পাথরের কুটিরটির আড়ালে আশ্রয় নেয়া সৈন্যরাও এগিয়ে এলো।

 সবুজ পাগড়ি পরিহিত আকবরের এক সেনাকর্তা প্রথমে ক্ষতিগ্রস্ত দরজাটি পার হলো। কিন্তু সে চিৎকার করে নিজের লোকদের অগ্রসর হওয়ার আদেশ দেয়ার পর পরই কপালে বন্দুকের গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়লো। তবে তার লোকেরা তার শেষ আদেশ পালন করলো এবং আকবর যখন সেখানে পৌঁছালেন তার আগেই প্রায় এক ডজন সৈন্য সেখানে পৌঁছে গেলো। তারা যতোটা সম্ভব দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে এগুতে লাগলো যাতে প্রতিপক্ষের গুলি এবং তীর থেকে রক্ষা পেতে পারে। আরো অনেকগুলি নৌকা থেকে নামা সৈন্যরাও তখন এগিয়ে আসছে।

 আকবর উপরে দূর্গপ্রাচীরের দিকে তাকালেন। তিনি বুঝতে পারলেন দূর্গরক্ষাকারী সৈন্যরা স্থলভাগ দিয়ে এগিয়ে আসা মোগলদের নিয়েই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, ফলে জলদ্বার দিয়ে অগ্রসর হওয়া সৈন্যদের দিকে তাদের মনোযোগ কমে গেছে। চল্লিশ গজ দূরে অবস্থিত একটি পাথরের ঊর্ধ্বমুখী সিঁড়ি পথের দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে আকবর চিৎকার করে বললেন, চলো আমরা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠি এবং দূর্গরক্ষাকারীদের পেছন থেকে আক্রমণ করি, এবং নিজে দেয়াল ঘেষে দৌড়ে এগিয়ে গেলেন। একটি তীর আকবরের বক্ষবর্মে আঘাত করে ছিটকে পড়লো কিন্তু আরেকটি তার ঠিক পেছনে অবস্থিত সৈন্যটির গলায় বিধলো। আকবর থামলেন না, জোরে শ্বাস টানতে টানতে খাড়া সিঁড়ি পথের গোড়ায় পৌঁছে গেলেন এবং সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলেন।

হঠাৎ দূর্গ প্রাচীরের উপর থেকে বর্শাবিদ্ধ এক সৈনিক আকবরের ঠিক সামনে সিঁড়ির উপর সশব্দে আছড়ে পড়লো। তিনি দেহটিকে পাশ কাটিয়ে উঠে গেলেন এবং সেটা গড়িয়ে নিচে চলে গেলো। বাকি ধাপ গুলি লাফ দিয়ে দিয়ে পার হয়ে তিনি দূর্গপ্রাচীরের উপরে পৌঁছে গেলেন। সেখানে একজন ছোটখাট গড়নের সৈন্য প্রাচীরের গায়ে আকবরের সৈন্যদের স্থাপন করা মই ঠেলে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছিলো। আকবরের তলোয়ার তার গলায় আঘাত করলো। সে পড়ে যেতেই দ্বিতীয় আরেক জনকে আকবর আঘাত করলেন যে কার্ণিশের উপর ঝুঁকে মই বেয়ে উঠতে থাকা মোগলদের দিকে গুলি করছিলো। আঘাতটি তার হাঁটুর পেছনের মাংসপেশী কেটে দিলো এবং সে প্রচীরের উপর দিয়ে হুমড়ি খেয়ে নিচে পড়ে গেলো। তৃতীয় একজন আকবরের মুখোমুখী হলো এবং তিনি তার আনাড়ি হাতের তলোয়ারের আক্রমণ সহজেই নিজ তলোয়ার দ্বারা প্রতিহত করলেন, তারপর আরেক হাতে থাকা লম্বা ফলাযুক্ত ছোরা লোকটির পাঁজরের মধ্যদিয়ে ঢুকিয়ে দিলেন। ছোরাটা টেনে বের করতেই লোকটি পড়ে গেলো এবং তার মুখ এবং ক্ষতস্থান দিয়ে রক্ত ক্ষরণ হতে লাগলো।

আশেপাশে তাকিয়ে আকবর দেখতে পেলেন তার সৈন্যদের অনেকেই এই মুহূর্তে মই বেয়ে অথবা পাথরের সিঁড়ি দিয়ে উঠে সেখানে উপস্থিত হয়েছে। এবং দূর্গরক্ষাকারীদের তুলনায় তারা সংখ্যায় বেড়ে গেছে। দূর্গের সৈন্যরা কিছুক্ষণ সাহসের সঙ্গে লড়াই করলো, কিন্তু তারপর আহত এবং কোণঠাসা হয়ে নিজেদের তলোয়ার ফেলে আত্মসমর্পণ করতে লাগলো।

 দূর্গটি এখন আমাদের, আকবর বিজয় উল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন। খেয়াল রেখ দূর্গের কেউ যাতে পালাতে না পারে।

তার আরেকটি বিজয় অর্জিত হলো।

*

সেইদিন সন্ধ্যায় আকবর পাটনায় প্রবেশ পথের সদ্য অধিকার করা দূর্গের উঠানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অগণিত মশা তার চারপাশে বিরক্তিকর ভন ভন শব্দে পাক খাচ্ছে। মানুষ অথবা জানোয়ার কেউই তাঁদের সূচাল হুলের আক্রমণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আহমেদ খানের দিকে ফিরে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে কি?

 একজন উচ্চ পদস্থ সেনাকর্তা আমাদের জানিয়েছে আপনার একক যুদ্ধের প্রস্তাবে শাহ্ দাউদ এর মাঝে অস্বস্তি প্রকাশ পেয়েছে। সে আরো বলে, দাউদ চিঠিটি দুই তিন বার পাঠ করে, প্রতিবার পাঠের সময় তার চেহারা ফ্যাকাশে থেকে ফ্যাকাশেতর হতে থাকে, তারপর সে তার কপালে জমে উঠা ঘাম মুছতে মুছতে চিঠিটি দলামোচড়া করে আগুনে নিক্ষেপ করে। চিঠিটি পাওয়ার দুই দিন পরে সে এ বিষয়ে তার মতামত প্রকাশ করে। সে বলে যে, সাধারণ চোর ডাকাতরা তাদের ঝগড়া মেটানোর জন্য এমন কৌশল অবলম্বন করে, রাজাদের বিরোধ মেটানোর উপায় এটা নয়। যাইহোক সেনাকর্তাটি আমাদের আরো জানিয়েছে যে, দাউদ তার দেহরক্ষীর সংখ্যা দ্বিগুণ করেছে আপনি তার উপর গুপ্ত আক্রমণ করতে পারেন এই আশঙ্কায়।

তরুণ দাউদের সাহস এবং সিদ্ধান্তকে আমাদের এ ধরনের পরীক্ষা দ্বারা যদি সহজেই প্রভাবিত করা যায়, তাহলে তাকে আরেকটু ভয় দেখানোর জন্য আমাদের নতুন কিছু চিন্তা করা উচিত। কথা বলতে বলতে আকবরের দৃষ্টি উঠানের অপরিচ্ছন্ন একটি কোণের দিকে নিবদ্ধ হলো। সেখানে তার একজন নিম্নপদস্থ সেনাকর্তা শত্রু সৈন্যদের মৃতদেহ স্তূপ আকারে জড়ো করার কাজ তদারক করছিলো। হঠাৎ তার মাথায় একটি বুদ্ধি এলো এবং তিনি আবার বলা শুরু করলেন,ঐ মৃত লোকগুলির আত্মা তাদের দেহ ত্যাগ করে বহু দূরে চলে গেছে, তাই না আদম খান?

আমাদের ধর্ম থেকে আমরা এমন শিক্ষাই পাই জাঁহাপনা।

কিন্তু তবুও ঐ মৃতদেহগুলি তাদের স্বপক্ষের যোদ্ধাদের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করতে পারে শাহ্ দাউদকে অপেক্ষাকৃত কম সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পণে প্ররোচিত করে।

কীভাবে তা সম্ভব?

পঞ্চাশটি মৃতদেহের ধর থেকে মাথা আলাদা করে মাথাগুলিকে একটি বড় রান্নার ডেকচির মধ্যে ভরুন। তারপর ডেকচির মুখ সোনালী রেশমের কাপড় দিয়ে ঢেকে শক্ত করে বাধুন। এরপর সেটিকে যুদ্ধবিরতির সাদা পতাকাবাহী নৌকায় করে পাটনা শহরের দিকে পাঠিয়ে দিন। সঙ্গে একটি চিঠিও যুক্ত করে দিবেন। তাতে লেখা থাকবে, আবারও আমি তাকে একক যুদ্ধের সুযোগ দিতে চাই এবং সে যদি এবারও আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাহলে তার আরো সৈন্য এভাবে অকারণে মাথা হারাবে এবং এই মৃত্যুর জন্য সেই দায়ি থাকবে।

 এ ধরনের কিছু করলে আমাদেরকে কি অসভ্য বর্বর মনে হবে না, আমাদের শত্রুরা আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ প্রায়শই করে থাকে? আহমেদ খানকে কিছুটা মর্মাহত মনে হলো।

অধিক ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর এটাই একমাত্র উপায়। আমরা নিজেরা জানি আমরা বর্বর নই এবং শাহ্ দাউদ ও তার দলের লোকদের মাঝে আমরা যতো বেশি ভীতি সৃষ্টি করতে পারবো ততো দ্রুত তারা আত্মসমর্পণ করবে। এখনই গলা কাটার কাজ শুরু করতে বলুন।

*

মুণ্ডু ভর্তি ডেকচি আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে জাঁহাপনা। যখন সেটি শাহ্ দাউদের কাছে পৌঁছায় তখন গরমের কারণে মাথা গুলিতে পচন ধরে গিয়েছিলো। যখন সে বাঁধন খুলে ঢাকনাটি উন্মুক্ত করিয়ে ভিতরে কি আছে দেখার জন্য উঁকি দেয়, সেই মুহূর্তে কড়াই এর মুখ দিয়ে সহস্র মাছি দ্বারা সৃষ্ট কালো মেঘের পাশাপাশি অকল্পনীয় পচা গন্ধ বেরিয়ে আসে। শাহ্ দাউদ ছিটকে সরে গিয়ে হরহর করে বমি করতে থাকে এবং সেখানে উপস্থিত সকলের একই অবস্থা হয়। এর অল্পক্ষণ পরেই সে পাটনা ত্যাগের আদেশ দেয় এবং দুই ঘন্টার মধ্যেই সৈন্যসামন্ত সহ পাটনার সিংহদ্বার অতিক্রম করে চলে যায়।

আকবরের মুখে আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দেখা গেলো। তাঁর শাহ্ দাউদ সম্পর্কিত মূল্যায়ন সঠিক হয়েছে এবং হাড়ি ভর্তি মাথা অনেক প্রাণ রক্ষা করতে নিশ্চিতভাবে সফল হয়েছে। একেই বলে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। আপনি এভোকিছু জানলেন কীভাবে? আকবর জিজ্ঞাসা করলেন।

কিছু সৈন্য সহ একজন সেনাপতিকে শাহ্ দাউদ পিছনে রেখে যায় এবং তাকে আদেশ দেয় যতোক্ষণ সম্ভব শহরটিকে আমাদের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে। সেনাপতিটি সময় নষ্ট না করে আমাদের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে যে, তার জীবনের বিনিময়ে সে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত।

 নিশ্চয়ই আপনি তার প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান করেছেন?

জ্বী।

 প্রমাণ করুন আমরা আদতেই বর্বর বা অসভ্য নই। ঐ সেনাদলের সঙ্গে উত্তম আচরণ করার আদেশ দিন। এক মুহূর্ত পর আকবর যোগ করলেন, দুই তিন দিন পরে কিছু সৈন্যকে পালানোর সুযোগ করে দেবেন। পলাতক সৈন্যরা দূরবর্তী দূর্গগুলিতে অবস্থিত তাদের স্বপক্ষের লোকদের কাছে এই সংবাদ বয়ে নিয়ে যাবে যে তাদের প্রতি অত্যন্ত ভালো ব্যবহার করা হয়েছে। এর ফলে তাদের সঙ্গীরাও আত্মসমর্পণ করতে প্রলুব্ধ হবে।

 জ্বী জাঁহাপনা।

শাহ্ দাউদ এর গন্তব্য কোথায়?

 সে প্রাচীর বেষ্টিত শহর গোমরার দিকে অগ্রসর হচ্ছে যেটি তার পূর্বপূরুষের অধিকৃত ভূখণ্ডের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত।

 শহরটির অবস্থান কোনো দিকে এবং সেটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন?

শহটি উত্তর দিকে অবস্থিত জাঁহাপনা। এটি প্রাচীরে ঘেরা এবং শাহ্ দাউদ হয়তো সেখানে শক্ত ঘাঁটি তৈরি করে সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা করছে। এছাড়া সেখানে অবস্থানকারী তার বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়রা হয়তো তার তুলনায় অধিক সাহসী এবং তাদের সহায়তায় সে পুনরায় আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে পারে।

সেখানে পৌঁছানোর আগেই আমাদের উচিত তাকে বাধা দেয়া।

*

পাটনার আত্মসমর্পণের পর দুই সপ্তাহ পার হেয়েছে। ভারী বর্ষণ স্থগিত হলেও নিচু দিয়ে ভেসে চলা ধূসর মেঘ গুলি সকালের সূর্যের আলো ফোঁটায় অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। একটি নিচু পাহাড়ের উপর আকবর দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর মাথার উপরের নারকেল গাছের আচ্ছাদন থেকে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির পানি পড়ছে। তিনি যেখানে রয়েছেন সেখান থেকে পৌনে এক মাইল দূরে আরেকটি পাহাড়ের উপরে মাটির দেয়াল ঘেরা ছোট একটি শহরে শাহ্ দাউদ শিবির স্থাপন করেছে। আকবর যে পাহাড়টির উপর দাঁড়িয়ে আছেন সেটার উচ্চতা মধ্যম পর্যায়ের হলেও এখান থেকে আশপাশের জলাভূমি স্পষ্ট নজরে আসে। মোগলদের বিশ হাজার সৈন্যের একটি বিশাল অগ্রগামী দল, যাদের মধ্যে বহু অশ্বারোহী বন্দুকধারী এবং তীরন্দাজ রয়েছে, গতকাল বিকালে এই অবস্থানে এসে পৌঁছায়। তাঁদের দেখে শাহ্ দাউদের বাহিনী অবস্থান ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করেনি। পক্ষান্ত রে সারা রাত ঝড়ো আবহাওয়ায় মধ্যে তারা মশালের আলোতে সাধ্যমতো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। মালগাড়ী উল্টে মাটির প্রাচীরের ফাঁক পূরণ করেছে এবং বৃষ্টিতে ক্ষয়ে যাওয়া অংশ ঠেকা দেয়ার চেষ্টা করেছে।

 আকবর ভাবছেন তার প্রতিপক্ষ অল্প সময়ের মধ্যে যথেষ্ট ভালো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। তিনি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করলেন। কারণ শাহ্ দাউদ তাঁর মতোই দ্রুত অগ্রসর হওয়ার জন্য সাথে করে কেবল হালকা ছোট আকারের কামান গুলি নিয়ে এসেছে। তাছাড়া দাউদের সৈন্য সংখ্যা তার সৈন্যদের প্রায় কাছাকাছি হলেও তাঁদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ গাদাবন্দুক রয়েছে এবং তাদের অবরোধ উপস্থিত উদ্ভাবনী চিন্তা কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হলেও যথেষ্ট দৃঢ় মনে হচ্ছে। আকবরের তথ্য সংগ্রহকারীরা জানিয়েছে তাদের শত্রুপক্ষ শহরবাসীদের বিছানা, তৈজসপত্র এবং ঘরের দরজাও অবরোধ তৈরির কাজে ব্যবহার করেছে। তাদের এতো ঐকান্তিক পরিশ্রম সত্ত্বেও আকবর উপলব্ধি করতে পারছিলেন যে, একটি সমন্বিত আক্রমণই শহরটিকে দখল করার শ্রেষ্ঠ উপায়। আর শাহ্ দাউদকে পরাজিত করার মাধ্যমেই বাংলার বিদ্রোহের অবসান ঘটবে এবং এই উর্বর সমৃদ্ধ ভূমি তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হবে। আহমেদ খান যথারীতি আকবরের পাশেই ছিলেন। আকবর তার দিকে ফিরলেন। আমাদের অশ্বারোহীদের কি শহর ঘেরাও করা শেষ হয়েছে?

 জ্বী। এক ঘন্টা আগেই সে কাজ সমাপ্ত হয়েছে।

তাহলে এখন কেবল শিঙ্গাবাদক এবং দুলিদের আদেশ দিলেই তারা আমাদের সৈন্যদের চারদিক থেকে সমন্বিত আক্রমণের জন্য সশব্দ সংকেত দিতে পারে।

জ্বী জাঁহাপনা, তবে আপনার পিতার একজন সহযোদ্ধা হিসেবে এবং আপনার বর্ষিয়ান প্রধান সেনাপতি হিসেবে আপনার কাছে আমি একটি বিনীত অনুরোধ করতে চাই। নদী দূর্গে আক্রমণের সময় যেরকম ঝুঁকি আপনি নিয়েছিলেন দয়া করে এবার আর তেমনটা করবেন না। আমার মনে আছে আপনার পিতা হুমায়ূন আপনাকে রাজবংশের স্বার্থে নিজের প্রাণ রক্ষা করতে আদেশ দিয়েছিলেন এবং একইভাবে বৈরাম খান আপনাকে উপদেশ দিয়েছিলেন হিমুর বিরুদ্ধে লড়াই এর সময়। আপনার পুত্ররা এখনো শিশু। আপনার কিছু হলে তাঁদের জীবন বিপন্ন হবে এবং সাম্রাজ্যেরও অপূরণীয় ক্ষতি হবে।

 আমি জানি আপনি বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে কথাগুলি বলেছেন এবং আপনি যা বললেন তা নিঃসন্দেহে উত্তম উপদেশ। কিন্তু আমি আমার সহজাত প্রতিক্রিয়ার কারণে ঝুঁকি নেই, হয়তো এর আরেকটি কারণ এই যে আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যুদ্ধ ক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করা আমার ভাগ্যে লেখা নেই- অন্তত এতো তাড়াতাড়ি নয় যখন আমি আমার সাম্রাজ্য সম্পূর্ণ বিস্তৃত করতে পারিনি। আমার নিজের বিশ্বাস এবং জ্ঞানী সাধুগণ, যাদের সঙ্গে আমি এ বিষয়ে আলোচনা করেছি তারাও মতো দিয়েছেন যে, আমার জন্য যা মারাত্মক বিপদ বলে গণ্য হতে পারে তার অবস্থান যুদ্ধক্ষেত্রে নয়।

 কিন্তু আপনার পিতা উপলব্ধি করেছিলেন, কোনো মানুষের কর্মই তার চূড়ান্ত নিয়তি নির্ধারণ করে, তারা পরিকল্পনা বা নিয়তি সম্পর্কিত ভাবনা নয়…যদিও আপনার আত্মবিশ্বাস এবং সাহস অদ্যাবধি অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডে আপনাকে সাফল্য এনে দিয়েছে যেখানে অন্যরা হয়তো ব্যর্থ হতো, আপনার উচিত নয় সর্বদা এমন অনুভূতির উপর নির্ভর করা।

 আকবর সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। যুদ্ধের সময় তাকে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কখনো কখনো একজন নেতা হিসেবে উদাহরণ সৃষ্টি করা এবং বেপরোয়া আচরণের মধ্যকার পার্থক্য অত্যন্ত সূক্ষ্ম হয়, সেটা আমি জানি। এই বাস্তবতা যতোটা সম্ভব আমি স্মরণ রাখার চেষ্টা করবো। ইতোমধ্যে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজকের প্রথম আক্রমণটি মোহাম্মদ বেগের নেতৃত্বে ছেড়ে দেবো। আমি এবং আমার দেহরক্ষীরা সঞ্চিত শক্তি হিসেবে অবস্থান করবো যাতে প্রয়োজনের সময় আপনাদের আক্রমণে সহায়তা করতে পারি।

তাহলে আমি কি এখন মোহাম্মদ বেগকে আক্রমণ শুরু করতে আদেশ দেবো?

হ্যাঁ।

আকবর এবং আহমেদ খান দর্শকের ভূমিকা নিলেন যখন শিঙ্গার সূচনা সংকেত পেয়ে মোগল অশ্বারোহীরা চারদিক থেকে জলাবদ্ধ মাঠ পেরিয়ে পাহাড়ের উপরে অবস্থিত শহরটির দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। গভীর জল এড়িয়ে, চকচকে কালো পিচ্ছিল কাদা পেরিয়ে যেতে তাদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছিলো। মোহাম্মদ বেগ এবং তার দেহরক্ষী একদম সম্মুখবর্তী দলে সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছিলো। তাদের কয়েক জন সবুজ মোগল পতাকা বহন করছিলো। তারা যখন গাদাবন্দুকের নিশানার আওতার মধ্যে পৌঁছালো, তখন থেমে থেমে দাউদের সৈন্যদের বন্দুক ছোঁড়ার ধোঁয়া দেখা যেতে লাগলো। এখানে সেখানে কয়েকটি ঘোড়া গুলি বিদ্ধ হলো এবং আরোহী সহ কাদাপনিতে আছড়ে পড়লো। মাঝে মাঝে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাওয়া সৈন্যরা পিছন থেকে এগিয়ে আসা অশ্বারোহীদের ঘোড়ার খুরের নিচে চাপা পড়ছিলো। পিঠে আরোহীবিহীন ঘোড়াগুলি ভারমুক্ত হওয়ায় দৌড়ে অনেক সামনে চলে যাচ্ছিলো। এরকম একটি ঘোড়া সর্বপ্রথম, সবচেয়ে সম্মুখবর্তী একটি প্রতিরোধ লাফিয়ে পেরিয়ে গেলো।

 সৈন্যদের অগ্রগতি ভালোভাবেই সম্পন্ন হচ্ছে, আকবর ভাবলেন। কিন্তু হঠাৎ মোহাম্মদ বেগ তার লোকদের নিয়ে যেদিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন সেদিকের মাটির প্রতিরোধের উপর থেকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সম্মিলিত গুলিবর্ষণের শব্দ পাওয়া গেলো। তারপর মাটির দেয়ালের একটি ফাঁক অবরোধ করে রাখা মালগাড়ি ঠেলে সরানো হলো এবং সেখান দিয়ে একদল অশ্বারোহী পাহাড়ের ঢাল বেয়ে প্রতিআক্রমণ করার জন্য এগিয়ে এলো। তাদের দেহ ঘোড়ার ঘাড়ের উপর নুয়ে আছে, হাতে বর্শা। মোহাম্মদ বেগের অগ্রসরমান সৈন্যরা এই আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা পিছিয়ে এলো। তাদের অনেকে তাল সামলাতে না পেরে ঘোড়াসহ কাদার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো। এ সময় দেয়ালে আরো ফাঁক সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে আরো অশ্বারোহী যুদ্ধে অংশ নিতে এগিয়ে এলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে আরো বেশি সংখ্যক মোহাম্মদ বেগের লোক হতাহত হলো এবং একটি মাত্র মোগল পতাকা খাড়া থাকলো।

আকবর আর স্থির থাকতে পারলেন না-যুদ্ধের সামগ্রিক ফলাফলের জন্য এই লড়াইটির গুরুত্ব অপরিসীম এবং তার এখন উচিত স্বশরীরে মোগলদের নেতৃত্ব দেয়া। তিনি এক টানে খাপ থেকে আলমগীর বের করে আনলেন এবং সংঘর্ষের এলাকার দিকে তার ঘোড়া ছুটালেন। বিশ্বস্ত দেহরক্ষীরা তাকে অনুসরণ করলো। পাহাড়ে পৌঁছাতে তার সর্বোচ্চ তিন মিনিট সময় লাগলো, যদিও একটি জলাশয় লাফিয়ে পার হওয়ার সময় তার ঘোড়াটি কাদায় পিছলা খেলো।

 তিনি যখন তার ঘোড়াটিকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে লড়াই এর এলাকায় এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করতে লাগলেন, তখন তিনি শাহ দাউদের বন্দুকধারীদের নিশানার আওতায় পৌঁছে গেলেন। শাহ দাউদের লোকেরা তার সোনা মোড়া বক্ষবর্ম দেখে তাকে চিনতে পারলো এবং তার উপর গুলি বর্ষণে মনোযোগী হয়ে উঠলো। আকবর শুনতে পেলেন বন্দুকের গুলি এবং তীর তার দুপাশ দিয়ে বাতাসে শিস কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তাঁর ঘোড়াটি এক মুহূর্তের জন্য টলমল করে উঠলো এবং তিনি অনুভব করলেন সেটার রক্ত তাঁর ডান উরু ভিজিয়ে দিচ্ছে। পাঁজর এবং পায়ের সংযোগস্থলে বন্দুকের গুলি খেয়ে ঘোড়াটি আর এগুতে পারছিলো না, সেটার মাথাটিও ক্রমশ মাটির দিকে নুয়ে পড়ছিলো। ঘোড়াটি আছড়ে পড়ার আগমুহূর্তে আকবর কাদার উপর লাফ দিলেন এবং ঝট করে এক পাশে সরে গেলেন তাকে কাছ থেকে অনুসরণ করা দেহরক্ষীটির সঙ্গে সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য।

 দেহের ভারসাম্য ফিরে পাওয়ার পর তিনি চিৎকার করে তার এক রক্ষীর কাছে আরেকটি ঘোড়া চাইলেন। তৎক্ষণাৎ রক্ষীটি ঘুরে এসে তার ঘোড়ার লাগামটি আকবরের হাতে দিলো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তিনি আবার ঘোড়ায় চড়ে বসলেন এবং কাদার পুরু আবরণযুক্ত বুট জোড়া সেটার রেকাবে ঢুকিয়ে নিলেন।

আকবরের ঘোড়াটি আহত হওয়ার কারণে তার এবং তার দেহরক্ষীদের আক্রমণের গতি কিছুটা শ্লথ হয়ে পড়েছে। শাহ্ দাউদের কিছু অশ্বারোহী সৈন্য প্রায় তাদের কাছে পৌঁছে গেছে। আকবর ঠিক সময় মতো ঘোড়া নিয়ে কিছুটা সরে গেলেন যখন বিশাল দেহী একজন বাঙ্গালী তার কাটাযুক্ত যুদ্ধকাস্তে আকবরের শিরোস্ত্রাণবিহীন মাথা লক্ষ্য করে ঘুরালো। কিন্তু লোকটি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপর থেকে ছুটে আসার কারণে নিজ ঘোড়ার গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। সবলে লাগাম টেনে ধরা সত্ত্বেও সে আকবরকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলো, তবে আকবর লোকটির মাথার পেছনে আলমগীরের কোপ বসাতে দেরি করলেন না। আকবর নিজের হাতে তীব্র ঝাঁকি অনুভব করলেন তবে এটা নিশ্চিত হলেন যে তাঁর তলোয়ারের আঘাত লক্ষ্যভেদ করেছে।

কয়েক মুহূর্ত পর আকবর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তাঁকে আক্রমণ করতে এগিয়ে আসা দ্বিতীয় অশ্বারোহী বাঙ্গালীটিকে লক্ষ্য করে তলোয়ার চালালেন কিন্তু সে মাথা নিচু করে আঘাতটি ব্যর্থ করে দিলো। লোকটি ঘুরে আবার আকবরের দিকে এগিয়ে এলো কিন্তু এবারে আকবর ঢালের উপরের দিকে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। ফলে বাঙ্গালীটি পুরু কাদার স্তর পেরিয়ে আকবরের কাছে পৌঁছানোর আগেই তিনি তার কাছে গিয়ে তলোয়ারের আঘাতে তার হাতের বর্শটি ফেলে দিলেন এবং তারপর আলমগীরের ধারালো ফলা লোকটির উরু ও পেটের সংযোগ স্থলে ঢুকিয়ে দিলেন।

আসন্ন বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে আকবর হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুখে জমে উঠা ঘাম মুছলেন এবং আশেপাশে তাকালেন। বাম দিকে তাঁর কাছ থেকে ষাট গজ দূরে মোহাম্মদ বেগের খাড়া থাকা সবুজ পতাকাকে ঘিরে তুমুল লড়াই চলছে। দেহরক্ষীদের তাঁকে অনুসরণ করার ইঙ্গিত দিয়ে তিনি যুদ্ধ ক্ষেত্রের বিশৃঙ্খল ভীড় ঠেলে মোহাম্মদ বেগের দিকে অগ্রসর হলেন। বন্দুক এবং কামানের সম্মিলিত গোলা বর্ষণের চাপে মোহাম্মদ বেগের আক্রমণ প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। বহু ঘোড়া কাদার মধ্যে পড়ে ছিলো। আকবর খেয়াল করলেন একটি ঘোড়া নিস্তেজভাবে সেটার পিছনে পা ছুড়ছে। আরেকটি ঘোড়ার নিচে চাপা পড়া অবস্থায় তিনি মোহাম্মদ বেগের মৃত কোর্চিকে দেখতে পেলেন।

 তীব্র লড়াই চলছে। কিছু সংখ্যক বাঙ্গলীকে দেখা গেলো মোহাম্মদ বেগের ঘোড়াচ্যুত সৈন্যদের বর্শায় গেথে ফেলার চেষ্টা করছে। ঐ সৈন্যরা একটি পাথরে হেলান দিয়ে মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে থাকা কাদা মাখা দেহকে রক্ষার চেষ্টা করছিলো। সেটা স্বয়ং মোহাম্মদ বেগ, তাকে চিনতে পেরে আকবর আতঙ্কিত বোধ করলেন। তিনি মরিয়া হয়ে সেদিকে অগ্রসর হলেন। যুদ্ধরত উভয় পক্ষের যোদ্ধাদের কেউই তাঁর উপস্থিতি খেয়াল করলো না। তিনি তাঁর কাছাকাছি অবস্থিত এক বাঙ্গালীর ঘোড়ার পাছায় তলোয়ারের চআপ্টা অংশ দিয়ে আঘাত করলেন। তিনি যা চেয়েছিলেন তাই ঘটলো, ঘোড়াটি পিছনের পায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে উঠে সেটার আরোহীকে ফেলে দিলো এবং আরোহীটি আকবরের ঘোড়ার খুরের আঘাতে পিষ্ট হলো।

এরপর আকবর আরেকজন বাঙ্গালীর ঘাড়ে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করলেন যে একজন কোর্চিকে বর্শাবিদ্ধ করতে এগিয়ে যাচ্ছিলো। আঘাতের পর তার হাত থেকে বর্শাটি খসে পড়লো। এই সময়ের মধ্যে আকবরের দেহরক্ষীরা আরো তিনজন বাঙ্গালীকে ধরাশায়ী করলো এবং বাকিরা লড়াই করার সাহস হারিয়ে ঘুরে শহর প্রাচীরের দিকে ফিরতে চেষ্টা করলো আঠালো মাটি পেরিয়ে। তাঁদের মধ্যে একজন কেবল সফল হলো তবে প্রাচীর অতিক্রম করার পূর্বে সে তার বাহুর উপরের অংশে নিক্ষিপ্ত ছোরা বিদ্ধ হলো।

একটু থেমে অকবর একজন কোর্চিকে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন, মোহাম্মদ বেগের কি হয়েছে?

তিনি যখন আমাদের সবুজ পতাকার সাথে অগ্রসর হচ্ছিলেন বাঙ্গালীরা তাকে আমাদের একজন সেনাপতি হিসেবে চিনে ফেলে। একটি কামানের গোলা তার কাঁধে আঘাত করে। ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়ার সময় তিনি মাথায় আঘাত পান এবং পরে একজন বাঙ্গালী তার উরুতে বর্শা দিয়ে আঘাত করে।

তাকে যতদ্রুত সম্ভব হেকিমের কাছে নিয়ে যাও। তিনি যথেষ্ট শক্ত না হলে এতোক্ষণ পর্যন্ত বাঁচতেন না।

এবারে আকবর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে শহরের প্রতিরোধ প্রাচীরের দিকে অগ্রসর হলেন। তাঁর কিছু সৈন্য ইতোমধ্যে দেয়ালের বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে ঢুকে গেছে এবং এখন তারা গুচ্ছ গুচ্ছ মাটির কুটিরের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। আকবরের তিন জন বন্দুকধারী একটি কুয়ার আড়ালে নিচু হয়ে বসে সেটার দেয়ালের উপর বন্দুক রেখে গুলি বর্ষণ করছিলো এগিয়ে যাওয়া সঙ্গীদের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য।

এ সময় অকবর দেখলেন শাহ্ দাউদ এর হলুদ পতাকা বিশিষ্ট কুটির গুলির পিছনে পাহাড়ে সবুজ মোগল পাতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। স্পষ্ট বুঝা গেলো তার লোকেরা শহরের বিভিন্ন অংশের প্রাচীর অতিক্রম করে ঢুকে পড়েছে এবং লড়াই করে শত্রুদের পর্যদস্ত করতে পেরেছে। কয়েক মুহূর্ত পর তিনজন লোক কয়েকটি কুটির থেকে বেরিয়ে এলো। তাদের একজন আত্মসমর্পণের ভঙ্গীতে হাত তুলে আকবরের লোকেদের দিকে এগিয়ে এলো। বাকি দুজন প্রথমে তাদের হাতে থাকা হলুদ পতাকা কাদায় ছুঁড়ে ফেললো এবং তারপর মাথার উপর হাত তুললো। তার বিজয় হয়েছে, ভবতে ভাবতে আকবর তার মাথার উপর শূন্যে ঘুষি চালালেন। কি ঘটেছে। উপলব্ধি করে তার সৈন্যরাও বিজয় এবং বেঁচে যাওয়ার মিলিত আনন্দে উল্লাস প্রকাশ করতে লাগলো।

ওকে বল শাহ দাউদকে ধরে আমার কাছে নিয়ে আসতে, আকবর চিৎকার করে আদেশ দিলেন। যে বাঙ্গলীটির উপর আদেশটি বর্তালো তার চেহারা আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে গেলো কিন্তু সে বিলম্ব না করে পেছন দিকের একটি কুটিরের মধ্যে অদৃশ্য হলো। কয়েক মিনিট কাউকে দেখা গেলো না এবং যেই আকবর বলপূর্বক তাদের ধরে আনার আদেশ দিতে যাবেন সেই মুহূর্তে একজন শীর্ণ চেহারা বিশিষ্ট দীর্ঘদেহী লোক কুটিরের দ্বারে আবির্ভূত হলো এবং মাথা নিচু করে আকবরের দিকে এগিয়ে এলো। আকবরের কাছ থেকে পনেরো ফুট দূরে থাকতে সে অধোমুখে মাটির উপর পতিত হলো। স্পষ্টই বোঝা গেলো তার বয়স শাহ্ দাউদের মতো উনিশ বছর নয় বরং এর দ্বিগুণ।

 তুমি কে? শাহ্ দাউদ কোথায়? সে যদি ভিতরে লুকিয়ে থাকে, এক্ষুণি তাকে আমার সামনে হাজির হতে বলল।

আমার নাম ওস্তাদ আলী, আমি শাহ্ দাউদের মামা। তার উত্থানের সমগ্র সময়টায় আমি তার প্রধান উপদেষ্টা ছিলাম। সে যা কিছু করেছে তার সকল দায়ভার আমার। আমি যখন গতরাতে বুঝতে পারলাম কঠিন লড়াই সত্ত্বেও আমরা জিততে পারবো না তখন আমি শাহ্ দাউদকে ছদ্মবেশে এখান থেকে সরিয়ে দেই। তার সমস্ত ধন-রত্ন ঐ কুটির গুলির মধ্যে রয়েছে। এই ধন-সম্পদ এবং বাংলাকে আমি তার পক্ষ থেকে আপনার কাছে সমর্পণ করছি।

*

একটি উঁচু অগ্রভাগ বিশিষ্ট কাঠের ডাউ (আরব নাবিকদের ব্যবহৃত এক মাস্তুল বিশিষ্ট জাহাজ) এর পাটাতনে দাঁড়িয়ে আকবর বঙ্গোপসাগরের বিস্তৃত জলরাশির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। গুজরাটের পশ্চিম উপকূলে সমুদ্র দর্শনের পর পুনরায় তা দেখার আকাঙ্ক্ষা তার মনে রয়ে যায়। তাই এবারে তিনি পূর্বের সমুদ্র দর্শন করে তার সেই ইচ্ছা পূরণ করছেন। এ সময় হঠাৎ উষ্ণ দমকা হাওয়া ডাউটির তিনকোণা পালে আঘাত করলে সেটি দুলে উঠলো এবং আকবর তাঁর পা দুটি আরেকটু ফাঁক করে দাঁড়ালেন। তখন মধ্যাহ্নের পর কিছু সময় পেরিয়েছে এবং সাগরের জল এতো উজ্জ্বল রূপালী বর্ণের দেখাচ্ছিলো যে সেদিকে তাকিয়ে থাকাই কষ্টকর মনে হচ্ছিলো। আকবর ঠোঁটে সাগরের লোনা স্বাদ পাচ্ছিলেন।

তাঁর সেনাবাহিনী বাংলার সকল প্রধান শহর বন্দর করতলগত করেছে। কিন্তু শাহ দাউদকে এখনো পাকড়াও করা সম্ভব হয়নি, তবে ধারণা করা হচ্ছে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে বন্দী করা যাবে। সমগ্র বাংলা এখন মোগল সাম্রাজ্যের অধীনস্থ। আজ সকালেই তিনি অবুল ফজলের কাছ থেকে আরো সুসংবাদ পেয়েছেন। সে জানিয়েছে পশ্চিমের রাজ্যগুলিতে শান্তি বজায় রয়েছে এবং শিক্রির নির্মাণ কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। সাগরের ঢেউ দেখতে দেখতে তিনি হাসলেন। আকবরের মনে হচ্ছিল তাঁর শাসন আমলের একটি অধ্যায় সমাপ্ত হয়েছে। তিনি তাঁর সাম্রাজ্যকে তাঁর পিতা, পিতামহ এবং নিজের আকাক্ষার চেয়েও অধিক বিস্তৃত করতে পেরেছেন। তবে তিনি তার এই সাম্রাজ্য বিস্তার অব্যাহত রাখবেন, কেবল তাঁর অনুসারীদের যুদ্ধের উত্তেজনা ও লুষ্ঠিত সম্পদের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্যই নয়, বরং এই বিস্তৃত সাম্রাজ্যের উপর তাঁর শাসন ক্ষমতা সুদৃঢ় করার জন্যেও। একদিন যে সাম্রাজ্য তিনি তাঁর বংশধরদের দান করে যাবেন তা অবশ্যই অজেয় হতে হবে। এই পরিকল্পনা সফল করার জন্য তাকে নতুন, পুরাতন, হিন্দু, মুসলিম সকল প্রজার সম্মান অর্জন করতে হবে। প্রজারা যাতে তাকে একজন শক্তিশালী দখলকারী বা বহিরাগত শত্রু মনে না করে তা নিশ্চিত করতে হবে। এমনটা ভাবা যতো সহজ, বাস্তবায়ন করা ততোটা সহজ নয়। কিন্তু তিনি এই নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এবার লড়াই শুরু করবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *