২.২ সেলিম

০৯. সেলিম

আমি দুঃখিত জাহাপনা, ওনার মাসিক রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়নি। খাজানসারা (হেরেম তদারককারি) ভীত দৃষ্টিতে আকবরের দিকে তাকালো যেনো হীরাবাঈ এর গর্ভধারণের ব্যর্থতার দোষটি কোনোভাবে তার উপরই বর্তেছে। রানীমা সর্বদাই বিষণ্ণ থাকেন, আপনাদের বিয়ের পর থেকেই যেমনটা রয়েছেন। তিনি ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করেন না। তিনি কদাচিৎ নিজের কক্ষ ছেড়ে হেরেমের বাগানে বেড়াতে যান। তিনি অম্বর থেকে সাথে করে আনা পরিচারিকাদের সঙ্গেই কেবল কথা বলেন এবং হেরেমের অন্য নারীদের থেকে দূরে থাকেন। তাঁদের কোনো খেলা বা বিনোদনে যোগ দেন না। হয়তো তার কোনো অসুখ হয়েছে…আমি কি আরেকবার হেকিম কে খবর দেবো?

 না। মাত্র ছয় সপ্তাহ আগে একজন বৃদ্ধ চিকিৎসক মাথা কাপড়ে ঢেকে (হেরেমের নারীদের যাতে দেখতে না পারেন) দুইজন খোঁজার তত্ত্বাবধানে হীরাবাঈকে পরীক্ষা করে গেছেন। আকবরও তখন কক্ষে ছিলেন। খোলের মধ্য থেকে উঁকি দেওয়া একটি কাছিমের মতো হাত বাড়িয়ে তিনি হীরাবাঈ এর পোষাকের নিচে শরীর হাতড়ে পরীক্ষা করেছেন। আমি কোনো সমস্যা দেখতে পাচ্ছি না জাহাপনা, অবশেষে তিনি মন্তব্য করেন। ওনার জরায়ু পথ দৃঢ় এবং সুগঠিত।

আকবর বিষণ্ণ দৃষ্টিতে খাজানসারার দিকে তাকালেন। তিনি হীরাবাঈ এর কথা ভাবছেন। প্রতিবারই তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার সময় তিনি কোনো প্রকার পরিবর্তন আশা করেছেন কিন্তু সে শিথিল হয়ে শুয়ে থেকেছে, কোনো প্রকার সাড়া দেয়নি। তিনি তার নিস্পৃহতায় যতোটা বিরক্ত হয়েছেন বাধা দান করলে হয়তো ততটা হতেন না। সে কি এখনো তাঁকে ছুরিকাঘাত করার স্বপ্ন দেখে? তিনি খাজানসারাকে সতর্ক করেছেন কোনো ধারাল বস্তু যেনো রানীর কক্ষে না থাকে। তত্ত্বাবধায়কটি কিছুটা কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলো, কিন্তু আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। হীরাবাঈ এর নিজের নিরাপত্তা এবং তার নিরাপত্তার জন্য এই আদেশ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। কারণ মাঝে মাঝে আকবরের আশঙ্কা হয়েছে সে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করতে পারে। তিনি তাকে একটি দ্বিতল কক্ষে স্থানান্তর করেছেন যার বারান্দা থেকে যমুনা দেখা গেলেও মার্বেল পাথরের আচ্ছাদনের কারণে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়া অসম্ভব।

 জাহাপনা?

আকবর ভুলে গিয়েছিলেন খাজানসারা তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক আছে, তুমি এখন যেতে পারো। একমাস পরে আবার আমার সঙ্গে দেখা করবে-আল্লাহর ইচ্ছায় হয়তো তখন আমাকে দেয়ার জন্য তোমার কাছে কোনো ভালো সংবাদ থাকবে।

 আকবর কিছুক্ষণ একা বসে থাকলেন। বাইরে পরিচ্ছন্ন মেঘহীন আকাশ। বর্ষাকাল শেষ হয়ে গেছে। এখন তার উচিত বাজপাখি উড়াতে যাওয়া বা শিকার করতে যাওয়া। কিন্তু হীরাবাঈ সংক্রান্ত ভাবনা কেনো তাকে আচ্ছন্ন। করে রেখেছে? হয়তো সেটা ভালোবাসা নয়, হয়তো সেটা তার অহংকার… সকলেরই অনুমান করতে পারার কথা যে সম্রাট এবং রানীর মধ্যে কোনো প্রকার সমস্যা হয়েছে। একমাত্র রাতে হীরাবাঈ এর বিছানায় হানা দেয়া ছাড়া তারা একসঙ্গে আহার করেন না বা সময় কাটান না। তারপরও রাতের কাজ শেষে তিনি নিজের পৃথক কক্ষে ফিরে আসেন। আজ পর্যন্ত একদিন ভোরেও হীরাবাঈ এর বাহুতে তাঁর ঘুম ভাঙ্গেনি।

হয়তো মা তাকে এ বিষয়ে কোনো বিচক্ষণ উপদেশ বা সান্তনা দিতে পারবেন। এখনো পর্যন্ত মায়ের কাছে সবকিছু প্রকাশ করতে তিনি ইতস্তত বোধ করেছেন। প্রতি মাসেই তিনি আশা করেছেন হীরাবাঈ এর গর্ভধারণের সংবাদ পাবেন। কিন্তু সময় বয়ে যাচ্ছিলো এবং তিনি তাঁর প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ডে মনোযোগ দিতে পারছিলেন না। বৃদ্ধ জওহর যে কথাটি তাকে বলেছে সেটা যদি সত্যি হয়-অধিক ক্ষতিকর কোনো পরিস্থিতি হয়তো দানা বেধে উঠছে। আকবরের একজন অমুসলিমকে বিয়ে করার বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হবে, ভগবান দাশের এই অনুমানটি সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। মাওলানারা গোপনে এমন কথা বলাবলি করছিলো যে, আকবরের সন্তান না হওয়ার বিষয়টি আল্লাহ্ প্রদত্ত শাস্তি, কারণ তিনি একজন বিধর্মী হিন্দুকে বিয়ে করেছেন।

*

হামিদা পড়ছিলেন, কিন্তু আকবরকে দেখে তিনি তাঁর কবিতার বইটি নামিয়ে রাখলেন। কি হয়েছে? তোমাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে।

একটু আগে খাজানসারার সঙ্গে কথা হলো।

 সে কি বললো?

 হীরাবাঈ এখনো গর্ভধারণ করতে পারেনি।

 তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে। তুমি মাত্র ছয় মাস আগে বিয়ে করেছে।

 আমি নিজেকে একথা বলেই সান্তনা দেই। কিন্তু আর কতো দিন আমাকে অপেক্ষা করতে হবে?

 তোমার বয়স এখনো কম। প্রয়োজনে আরো স্ত্রী গ্রহণ করবে। তোমার সন্তান নিশ্চয়ই হবে-এমনকি পুত্রও-তবে তারা হীরাবাঈ এর গর্ভে নাও হতে পারে।

বিষয়টি এখন আর আমার ধৈর্যহীনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। দুই সপ্তাহ আগে জওহর আমার কাছে এসেছিলো। তাকে আমার উজির বানানোর পর থেকে আরো বেশি তথ্য তার কাছে পৌঁছাচ্ছে।

 রাজপ্রাসাদে প্রচলিত গুজবের কোনো গুরুত্ব নেই।

 কিন্তু এটির আছে। কিছু উচ্চপদস্থ মাওলানা-মানে ওলামারা-দাবি করছেন যে হীরাবাঈ কখনোই সন্তান ধারণ করতে পারবে না। একজন বিধর্মীকে বিয়ে করে আমি ইসলামের বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছি, তারজন্য এভাবে আল্লাহ্ আমার বিচার করছেন।

 সাম্রাজ্য শাসন করো তুমি, ওলামারা নয়।

আমি তাদেরকে বা তাদের সংকীর্ণ কুসংস্কারকে ভয় করি না। তবে স্বীকার করছি প্রথমে আমার মনে হয়েছে তাঁদের কথায় হয়তো কিছুটা সত্য থাকতে পারে। কিন্তু এ বিষয়ে আমি যতোই গভীর ভাবে চিন্তা করেছি ততই আমার মনে হয়েছে যে একজন ক্ষমাশীল করুণাময় আল্লাহ বিশ্বাসের ভিন্নতার কারণে তার সৃষ্ট মানুষকে কিছুতেই বর্জন করতে পারেন না। কিন্তু ওলামাদের বক্তব্য যতোই অসম্ভব হোক না কেনো হয়তো আমার প্রজাদের কেউ কেউ তা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে। এর ফলে রাজ্যে ঘৃণা এবং বিভক্তি সৃষ্টি হতে পারে। ওলামারা ভালো করেই জানেন কেনো আমি একজন হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করেছি-কেবল আমার সামরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্যই নয় বরং এটাও প্রমাণ করার জন্য যে মোগল শাসন ধর্মনিরপেক্ষ।

 তুমি বিচক্ষণ, হামিদা বললেন। তুমি সম্ভাব্য বিপদ আগেই অনুমান করতে পারো।

আমার পিতা আমাকে এ বিষয়ে উৎসাহ প্রদান করেছেন। তিনি বলেছিলেন তার সম্ভইরা যে তার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেবে সেটা তিনি অনেক দেরিতে বুঝতে পেরেছিলেন।

সেটা সত্যি। এর জন্য আমরা প্রায় জীবন হারাতে বসেছিলাম।

 একই রকম ভুল আমি করতে চাই না, যদিও আমি যে বিপদের সম্মুখীন হয়েছি তার প্রকৃতি ভিন্ন।

 আমাকে হীরাবাঈ সম্পর্কে বলো। আমি জানি তুমি ওকে নিয়ে খুশি নও…আমাকে ক্ষমা করো বাবা, কিন্তু আমার এবং গুলবদনের কানে অনেক কথাই আসে। হীরাবাঈ কি তোমাকে সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে?

সে আমাকে ঘৃণা করে।

কেনো?

চিত্তরগড়ের যোদ্ধাদের হত্যার জন্য সে আমাকে দোষারোপ করে এবং দূর্গশহর ধ্বংস করার জন্য…সে আমাকে তার স্বজাতীয়দের সর্বনাশের কারণ মনে করে।

সে এমন মনোভাব কীভাবে পোষণ করে যখন তারই ভাই তোমার মিত্র হতে পেরে এতো খুশি?

আকবর কাঁধ ঝাঁকালেন। আমার মনে হয় এর জন্য সে তার ভাইকেও অপছন্দ করে…কিন্তু সরাসরি আমাকে সে এ কথা বলেনি।

তুমি কি এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে তুমি তাকে পুরোপুরি বুঝো? হয়তো আমাদের রাজপ্রাসাদ তার কাছে আপন মনে হয় না এবং রাজস্থানের জন্য তার মন কাঁদে। এক সময় হয়তো তার পরিবর্তন হবে।

আমি তাকে ভালোই বুঝতে পারি মা। বিয়ের রাতে সে আমাকে ছুরিকাঘাত করতে চেয়েছিলো। আকবর কথাটি বলতে চাননি কিন্তু নিজেকে বিরত করতে তিনি ব্যর্থ হলেন।

 সে কি করেছে বললে? পুত্রবধূর প্রতি হামিদার সমস্ত সমবেদনা নিমিষেই উবে গেলো এবং তার চোখ দুটি রাগে ঝলসে উঠলো। এর জন্য তাকে তোমার মৃত্যুদণ্ড দেয়া উচিত ছিলো যেমন তোমার পিতার উচিত ছিলো প্রাথমিক বিদ্রোহের সময়ই তার ভাইদের হত্যার আদেশ দেয়া। তুমি একটু আগেই বললে তোমার পিতার ভুল গুলি থেকে তুমি শিক্ষা নিয়েছে, অথচ এখনো তুমি ঐ মেয়েটির সঙ্গে বিছানায় যাও যে তোমার মৃত্যু কামনা করে। আমি এর কিছুই বুঝতে পারছি না।

আমি জানতাম তুমি বুঝবে না। তাই আমি এতোদিন তোমাকে কিছু বলিনি। আমি হীরাবাঈকে ত্যাগ করিনি কারণ তাকে আমি মিত্রতার প্রতীক মনে করি। এই বিবাহের ফলে রাজপুতরা খুশি হয়েছে। তাকে মৃত্যুদণ্ড দিলে এই মিত্রতা কি বজায় থাকতো? আর নিজ দেবতাদের উপাসনা করার যে স্বাধীনতা হীরাবাঈ পেয়েছে তা আমার হিন্দু প্রজাদের জন্য একটি জীবন্ত প্রমাণ। এর ফলে তারা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে আমার কাছ থেকে তাদের ভয়ের কিছু নেই। বাইরের মানুষ আমাদের রাজপ্রাসাদের জীবন সম্পর্কে কিছুই জানে না। তারা খুশি মনে দেখছে যে মোগল সম্রাট একজন হিন্দু স্ত্রী গ্রহণ করে নির্বিঘ্নে জীবন যাপন করছে।

হামিদা চুপ করে ছিলেন, তাঁর সুন্দর ভ্রু দুটি চিন্তায় কুচকে আছে। হয়তো তোমার ভাবনাই ঠিক, অবশেষে তিনি বললেন। আঘাত এবং মাতৃত্বসুলভ ক্রোধের কারণে আমি বেসামাল হয়ে পড়েছিলাম। আমি হীরাবাঈ এর ঐ আচরণের কথা কাউকে বলবো না-এমনকি গুলবদনকেও না। তবে আমি আমার পরিচারিকাদের নির্দেশ দেবো তার উপর নজর রাখতে যাতে সে তার গর্ভধারণ প্রতিরোধের জন্য কিছু করতে না পারে। গর্ভধারণ প্রতিরোধের অনেক কৌশল প্রচলিত আছে। যেমন, তিক্ত ভেষজ ঔষধ সেবন, মিলনের আগে ভিনিগারে ভেজানো স্পঞ্জ যযানি পথের ভিতর ঢুকিয়ে রাখা, এমনকি মিলনের পরে ভেড়ার লোম পেচানো ছোট ডাল দিয়ে জরায়ু পরিষ্কার করার পদ্ধতিও রয়েছে। রাজপুত নারীদেরও নিজস্ব কৌশল থাকতে পারে।

 ইতোমধ্যেই তার উপর নজর রাখা হয়েছে। খাজানসারা জালি পর্দার আড়াল থেকে মিলনের সময় আমাদের উপর নজর রাখে যদিবা হীরাবাঈ মিলনের আগে বা পরে অস্বাভাবিক কিছু করে তা আবিষ্কারের জন্য…আমার প্রতি তার ঘৃণার কারণে কি তার গর্ভধারণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে? সে প্রবল ইচ্ছাশক্তির অধিকারী এবং মন শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় যদিও বা সে সন্তান জন্ম দেয় তা কি মঙ্গল জনক হবে?

 এসব বোকার মতো চিন্তা, আকবর। আর কেই বা বলতে পারে…হীরাবাঈ এর বয়স এখনো অনেক কম, সন্তানের মা হলে হয়তো তার মন পরিবর্তিত হয়ে যাবে।

তার বয়স ততোটা কম নয় বাবাকে বিয়ে করার সময় তোমার বয়স যতোটা কম ছিলো।

 আমি ভাগ্যবতী। তোমার বাবা আমাকে ভালোবেসে পছন্দ করেছিলেন এবং আমিও তাকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু আমি কেবল একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির কন্যা ছিলাম, হীরাবঈ এর মতো রাজকন্যা নয়। তোমার বাবা এবং আমার মধ্যকার সম্পর্ক অনেক বেশি সহজ ছিলো।

 আকবর, আমি হয়তো তোমাকে সাহায্য করতে পারবো। গুলবদন আমাকে শেখ সেলিম চিশতি নামের একজন সুফি সাধকের কথা বলেছে। সে তার সঙ্গে দেখা করেছে এবং বলেছে আমার পিতামহের মতো তিনিও ভবিষ্যৎ দেখতে পান। হয়তো তিনি তোমাকে এমন কিছু বলতে পারবেন যা শুনে তুমি শান্তি পাবে।

 তিনি কোথায় থাকেন?

 শিক্রিতে, এখান থেকে বেশি দূরে নয়।

 আমি জায়গাটা চিনি। আমি একবার শিকার করতে গিয়ে ঐ জায়গায় থেমেছিলাম পানি খাওয়ার জন্য।

*

আকবরের নেতৃত্বে ছোট আকারের একটি সৈন্যদল ধূলিময় পথের উপর দিয়ে শিক্রির মালভূমির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। তার দুটি প্রিয় শিকারী কুকুর পাশাপাশি দৌড়াচ্ছিলো এবং দুইজন শিকারের সহচর ও একজন কোৰ্চি ছাড়াও কিছু সংখ্যক দেহরক্ষী তাকে অনুসরণ করছে। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা একটি অল্প বয়সী হরিণকে তিনি হত্যা করেছেন এবং সেটা ইতোমধ্যে আগ্রার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ঘোড়ার পিঠে হরিণটিকে ঝুলিয়ে বেঁধে একজন শিকারের সহচর সেটা নিয়ে গেছে। তিনি যে অভিযানে বেরিয়েছেন সেটা শিকারের অভিযান, কোনো সাধুর সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয় নয়-এমন ধারণা সৃষ্টি করাই যুক্তিসঙ্গত বলে আকবরের মনে হয়েছে।

দুপুরের রোদের উষ্ণ আবরণের মধ্য দিয়ে দূরে মালভূমির প্রান্তে মাটির ইটে তৈরি ঘরবাড়ির আবয়ব দেখা গেলো, সেটাই শিক্রি। রৌদ্রের তাপ কিছুটা কমে না আসা পর্যন্ত আমরা ওখানে বিশ্রাম করবো, তিনি কোৰ্চিকে বললেন। আমি একজন সুফি সাধকের গল্প শুনেছি যিনি ঐ গ্রামে থাকেন এবং আমার কৌতূহল হচ্ছে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য। তুমি ঘোড়া চালিয়ে ওখানে যাও এবং তাকে জিজ্ঞেস করো সম্রাটের সঙ্গে তিনি দেখা করবেন কি না।

তরুন কোৰ্চিটি যখন ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে গেলো আকবর মালভূমির খাড়া ঢাল বেয়ে ধীরে তাকে অনুসরণ করলেন। গ্রামে পৌঁছে একটি ঘন বিন্যস্ত আমগাছের পাশে তিনি ঘোড়া থেকে নামলেন। কয়েক মিনিট পর তিনি তার কোৰ্চিকে ফিরে আসতে দেখলেন।

জাহাপনা, শেখ সেলিম চিশতি হুজুর আপনাকে স্বাগত জানিয়েছেন। আমার সঙ্গে আসুন।

আকবর গ্রামের মধ্য দিয়ে তার কোচিঁকে অনুসরণ করে একটি নিচু একতালা বাড়ির সামনে উপস্থিত হলেন। বাড়িটিতে প্রবেশের দরজার দুইপাশে জানালা হিসেবে মাত্র দুটি ফোঁকর রয়েছে। ভেতরে প্রবেশ করে তিনি নিজেকে অন্ধকারের মধ্যে আবিষ্কার করলেন। তারপর যখন তাঁর চোখে আধার সয়ে এলো তখন তিনি সামনের মেঝেতে একজন মোটা কাপড়ের সাদা আলখাল্লা পরিহিত ব্যক্তিকে কেবলামুখী হয়ে নামাজ পড়তে দেখলেন।

মাফ করবেন জাহাপনা, আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছিলাম যাতে তার নির্দেশনায় আমি আপনার উপকার করতে পারি। কথা বলতে বলতে বৃদ্ধটি একটি মাটির মোমদানিতে মোম জ্বালালেন। মোমের হালকা আলোয় আকবর সুফিটির আখরোটের মতো কুঞ্চিত মুখ দেখতে পেলেন।

 আপনি কীভাবে জানলেন আমি আপনার কাছে সাহায্যের জন্য এসেছি? আকবর তার আশেপাশে তাকাতে তাকাতে জিজ্ঞাসা করলেন। মেঝেতে পাতা একটি গাঢ় লাল রঙের জায়নামাজ, একটি অমসৃণ কাঠের তৈরি বাক্স এবং বিছানা হিসেবে ব্যবহৃত দড়ির চৌপায়া ছাড়া কক্ষটিতে আর কিছু নেই।

 যারা আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তাঁদের সকলেই আমার কাছে ঐশ্বরিক সহযোগীতা কামনা করেন, যদিও তারা নিজেরা মনে করেন তারা কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে আমার কাছে এসেছেন। মনে হচ্ছে আপনি অবাক হয়েছেন জাহাপনা। আপনি হয়তো ভাবছেন আমি নিজের সম্পর্কে বাড়িয়ে বলছি। আমার যে সামান্য ক্ষমতা রয়েছে তা অর্জনের জন্য আমি কখনোও প্রার্থনা করিনি, কিন্তু আল্লাহর ঐশ্বরিক কৃপায় কখনো কখনো আমি তার মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হই। এগিয়ে এসে আমার সামনে বসুন যাতে আমি আপনাকে ভালো করে দেখতে পারি।

আকবর সাধুর সামনে পাতা মাদুরে আসনপিঁড়ি হয়ে বসলেন। বেশ কিছু সময় সাধুটি কিছু বললেন না। কিন্তু তার পেচার মতো উজ্জ্বল চোখের তারা দুটি আকবরকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো, যেনো আকবরের মনের ভিতরে কি আছে তাও তিনি জেনে যাবেন। একসময় তিনি সামান্য দুলতে লাগলেন, তাঁর লম্বা সরু হাত দুটি বুকের উপর ভাঁজ করা, তিনি নিচুস্বরে একটি প্রার্থনা বাক্য পুনরাবৃত্তি করতে লাগলেন, আমাকে জ্ঞান দাও, আমাকে পথ দেখাও। সাধুটি কখনো তাকে জিজ্ঞাসা করবেন তাঁর আগমনের কারণ? আকবর ভাবলেন। কিন্তু তিনি যখন অপেক্ষা করছিলেন, একটি প্রশান্তিময় অনুভূতি তাঁর মনে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। তার চোখ দুটি বন্ধ হয়ে এলো এবং তার দেহ ও মন চাপ ও দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হতে লাগলো। তার কামনা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলিও ক্রমশ তার মধ্য থেকে অপসারিত হতে লাগলো যতোক্ষণ পর্যন্ত না তিনি একটি শিশুর মতো দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে পড়লেন।

এখন আরম্ভ করার জন্য আমরা প্রস্তুত। সাধুটি হাত বাড়িয়ে আলতোভাবে আকবরের কাঁধ স্পর্শ করলেন। আকবর চমকে চোখ খুললেন, ভাবছেন কতোক্ষণ ধরে তিনি এমন অর্ধ নিদ্রিত হয়ে ছিলেন যা আশ্চর্যজনক ভাবে অত্যন্ত আরামদায়ক ছিলো। আপনি আমার কাছে কি জানতে চান জাহাপনা?

জানতে চাই আমার স্ত্রী কোনো পুত্র সন্তান জন্ম দিতে পারবে কি না।

আর কিছু জানতে চান না? এটাতো খুব সাধারণ একটি প্রশ্ন।

হয়তো ততটা সাধারণ নয়। আপনি কি জানেন আমার স্ত্রী একজন হিন্দু?

 নিশ্চয়ই জানি জাহাপনা। সমস্ত হিন্দুস্তানের মানুষ তা জানে।

 নিজে একজন মুসলমান হিসেবে আপনি কি মনে করেন আমার স্ত্রীর সন্তান না হওয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার উপর বর্ষিত শাস্তি, যেহেতু আমি একজন বিধর্মীকে বিয়ে করেছি?

 না। একজন সুফি হিসেবে আমি বিশ্বাস করি আল্লাহর কাছে পৌঁছানোর একাধিক পথ রয়েছে। আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব নিজেদের নির্দিষ্ট পথটি খুঁজে বের করা।

 আমাদের ধর্ম বিশ্বাস যেমনই হোক?

হ্যাঁ। আল্লাহ্ আমাদের সকলেরই স্রষ্টা।

সুফি ঠিক কথাই বলেছেন, আকবর ভাবলেন। তিনি বোকার মতো ওলামাদের কথার গুরুত্ব দিয়েছেন। হীরাবাঈ তাকে ঘৃণা করে বলে সন্তান ধারণ করছে না এমন ধারণাও তার বোকামী। তিনি কখনোও ভাবেননি তার অহংকার এবং মর্যাদাকে অতিক্রম করে একজন অপরিচিত মানুষের মুখ থেকে তিনি এই সত্য উদঘাটন করবেন।

 আমার স্ত্রী আমাকে ভালোবাসে না। যখনই আমি তার সঙ্গে মিলিত হতে যাই, আমি তার মাঝে আমার প্রতি ঘৃণা দেখতে পাই….আমি তার সঙ্গে যথেষ্ট ভালো ব্যবহার করেছি…কিন্তু…

সুফি হাত তুলে আকবরকে থামিয়ে দিলেন। আরো কাছে আসুন।

আকবর সামনের দিকে ঝুকলেন এবং সুফি তার মুখ ধরে নিজের কপালের সঙ্গে আলতো ভাবে তার কপাল স্পর্শ করালেন। আবারো ভালো লাগার একটি বিস্ময়কর অনুভূতি আকবরকে পাবিত করলো, তাঁর মনে হলো তিনি যেনো আলোর বন্যায় স্নানরত।

আপনি দুঃশ্চিন্তা করবেন না জাঁহাপনা। আপনার স্ত্রী শীঘ্রই একটি পুত্র সন্তান ধারণ করবেন এবং আপনার আরো দুইজন সন্তান হবে। মোগল বংশের রক্তপ্রবাহ হিন্দুস্তানের বুকে বহু প্রজন্ম পর্যন্ত স্থায়ী হবে।

 ধন্যবাদ শেখ সেলিম চিশতি, অসংখ্য ধন্যবাদ। আকবর তার মাথা নত করলেন। তাঁর আত্মবিশ্বাস আবার ফিরে এসেছে, সবরকম আত্মসন্দেহ দূর হয়ে গেছে। তিনি অনুভব করলেন সবকিছুই তার পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবে রূপ নেবে। নিজ সন্তানদের সহায়তায় তিনি একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য গঠন করবেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর তারা অগ্রসর হতে থাকবে…মোগল বংশ আরো ঐশ্বর্যমণ্ডিত হয়ে উঠবে। আপনি যা বললেন সেসব যখন বাস্ত বায়িত হতে থাকবে তখন আমি শিক্রিকে একটি সমৃদ্ধ শহরে পরিণত করবো আপনার সম্মানে। এখানে নির্মিত রাজপ্রসাদ, ঝর্না, বাগান প্রভৃতি সমগ্র পৃথিবীর জন্য বিস্ময়ে পরিণত হবে এবং আমি আমার রাজপ্রাসাদ আগ্রা থেকে এখানে স্থানান্তরিত করবো।

আপনার স্ত্রী যখন অন্তঃসত্ত্বা হবেন তাকে এখানে পাঠাবেন। এই গ্রামের বাইরে ছোট একটি আশ্রম আছে, সেখানে রানীমার যত্নের ব্যবস্থা করা যাবে। আর, হয়তো রাজপ্রাসাদের বাইরে এলে তার মনও অনেক শান্তি লাভ করবে এবং তখন তিনি আরো সহজে মাতৃত্বের প্রস্তুতি নিতে পারবেন।

 সে কি এখানে তার ধর্মের চর্চা করতে পারবে?

নিশ্চয়ই পারবে। আমি তো আপনাকে আগেই বলেছি স্রষ্টাকে পাওয়ার একাধিক পথ রয়েছে।

 তাহলে অবশ্যই আমি তাকে এখানে পাঠাবো। আকবর উঠে দাঁড়ালেন।

আপনাকে আবারো ধন্যবাদ। আপনি আমাকে স্বস্তি এবং আশা প্রদান করেছেন।

 আমি নিজেও আনন্দিত। কিন্তু আরেকটি বিষয় আপনাকে আমার জানানো উচিত এবং সেটি আপনার পছন্দ নাও হতে পারে।

 সেটা কি? আকবর অত্যন্ত নম্রভাবে সুফির কাঁধে তাঁর হাত রাখলেন।

যদিও আপনি তিন জন বলিষ্ঠ পুত্রসন্তান লাভ করবেন, কিন্তু মনে রাখবেন-ক্ষমতার লোভ এবং তা অধিকার করার আকাঙ্ক্ষা সবচেয়ে নিবিড় পারিবারিক বন্ধনকেও বিষাক্ত করে তুলতে পারে। সহজাত ভাবেই আপনার পুত্ররা আপনাকে ভালোবাসবে কিম্বা নিজেদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে এমনটা আশা করবেন না।

 তার মানে? আপনি কি বুঝাতে চাইছেন আমার পিতা যেমন পারিবারিক বৈরিতার শিকার হয়েছিলেন তেমনি আমিও হবো?

 এ বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত নই জাঁহাপনা। আমি প্রত্যক্ষ করেছি আপনি পুত্র সন্তান লাভ করবেন এবং আপনার সাম্রাজ্য সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হবে, কিন্তু এর বাইরে আমি কালো ছায়াও দেখতে পেয়েছি। কিন্তু এখনো তা সম্পূর্ণ আকৃতি লাভ করেনি, এর মাঝে অবশ্যই কোনো সতর্কতা সংকেত নিহিত রয়েছে। আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে জাহাপনা। আমার কথা গুলি মনে রাখবেন। আপনার পুত্ররা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত তাঁদের প্রতি নজর রাখবেন যাতে এই কালো ছায়া তাঁদের মাঝে ক্রিয়াশীল হওয়ার আগেই আপনি এর প্রভাব থেকে তাঁদের মুক্ত করতে পারেন।

সেদিন দিন শেষে আগ্রার পথে ফেরার সময় আকবর সুফির সতর্কবাণী নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে লাগলেন। তাঁর পূর্বপুরুষ তৈমুরের সময় থেকে শুরু করে বহুবার মোগলরা বাইরের শত্রুর পরিবর্তে নিজেদের মধ্যে কলহে জড়িয়ে পড়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পতিত হয়েছে। তিনি এ জাতীয় লক্ষণের দিকে সর্বদা নজর রাখবেন। কিন্তু সেসব অনেক দূরবর্তী ভবিষ্যতে অবস্থিত। এই মুহূর্তে তিনটি পুত্র সন্তান লাভের স্বপ্নে পাবিত আকবর অপেক্ষাকৃত দ্রুত গতিতে তাঁর ঘোড়া ছুটালেন।

*

ছয় সপ্তাহ পর আকবর খাজানসারার কাছে শুভ সংবাদটি পেলেন।

 জাহাপনা, রানীমা অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন।

সন্তান কবে ভূমিষ্ঠ হবে?

হেকিম জানিয়েছেন অগাষ্ট মাসে।

 আমি এখনই হেরেমে যাব। আকবর অনন্দ অশ্রু সংবরণ করতে করতে প্রায় দৌড়ে মহিলা মহলের দিকে অগ্রসর হলেন। হীরাবাঈ এর কক্ষে প্রবেশ করে তিনি আগরবাতির পরিচিত মিষ্টি ঘ্রাণ পেলেন। একটি হাসিহীন বহু বাহু বিশিষ্ট দেবী মূর্তির সামনে রাখা পিতলের পাত্রে হীরাবাঈ সর্বদাই এই আগরবাতি জ্বালিয়ে রাখে। সে একটি বার্ণিশ করা নিচু রাজপুত-অসনে বসেছিলো এবং পরিচারিকা তার চুল আচড়ে দিচ্ছিলো। আকবরের মনে হলো তাঁর স্ত্রীর আড়ষ্ট এবং অনিশ্চিত চেহারা ইতোমধ্যে নরম হতে শুরু করেছে এবং ত্বকে নতুন করে উজ্জ্বলতা তৈরি হতে শুরু করেছে। কিন্তু তার স্বাভাবে কোনো কোমলতা যদি তিনি আশা করে থাকেন তাহলে তাকে হতাশ হতে হলো। সে যখন মুখ তুলে তাকালো আকবর লক্ষ করলেন তার মুখভাব আগের মতোই অনমনীয় এবং দূরবর্তী।

 তুমি যেতে পারো, আকবর পরিচারিকাটিকে আদেশ দিলেন। সে চলে যেতেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সত্যিই কি তুমি মা হতে চলেছো?

 হ্যাঁ। নিশ্চয়ই খাজানসারা আপনাকে এ কথা বলেছে।

 আমি একজন সাধারণ স্বামীর মতো তোমার মুখ থেকেই সংবাদটি শুনতে চেয়েছিলাম। হীরাবাঈ-আমার ঔরসজাত সন্তান তোমার গর্ভে, হয়তো সে আগামী মোগল সম্রাট হবে। এই মুহূর্তে আমি কি এমন কিছুই করতে বা বলতে পারি না যাতে তুমি আমার প্রতি সদয় হতে পারো এবং নিজে খুশি হতে পারো?

একমাত্র অম্বরে আমাকে ফেরত পাঠালেই আমি খুশি হতে পারি, কিন্তু তা অসম্ভব।

শীঘ্রই তুমি একজন মা হবে। তোমার কাছে কি এর কোনো তাৎপর্য নেই? হীরাবাঈ ইতস্তত করলো। আমি সন্তানটিকে ভালোবাসবো কারণ তার শিরায় আমার স্বজাতীয়দের রক্তও প্রবাহিত হবে। কিন্তু আপনার প্রতি আমার যে ভালোবাসা নেই তার মিথ্যা অভিনয় আমি করতে পারবো না। আমি প্রার্থনা করি আপনি অন্য স্ত্রী গ্রহণ করে আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবেন।

আমাকে একটি সুস্থ্য পুত্র উপহার দাও, কথা দিচ্ছি তোমার সঙ্গে আর কোনো দিন আমি শোব না। হীরাবাঈ কিছু বললো না। আমি চাই আজ থেকে এক সপ্তাহ পর একটি ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার জন্য তুমি প্রস্তুত

আপনি আমাকে কোথায় পাঠাতে চান? প্রথম বারের মতো হীরাবাঈ এর শিথিল আচরণের মধ্যে খানিকটা উৎকণ্ঠার আভাস পাওয়া গেলো।

 ভয়ের কিছু নেই। তোমাকে আমি একটি শুভ আশীর্বাদপূর্ণ স্থানে পাঠাতে চাই-শিক্রিতে। আমি তোমাকে আগে কথাটি বলিনি কারণ আমি জানি তুমি আমার ধর্মকে অবিশ্বাস করো, কিন্তু শিক্রিতে একজন মুসলিম সুফি বাস করেন। তিনি ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন যে তুমি আমার জন্য একটি সন্তান ধারণ করবে এবং আমাকে বলেছিলেন তোমাকে সেখানকার একটি আশ্রমে পাঠাতে যেখানে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত তোমার পর্যাপ্ত যত্ন নেয়া হবে। আমার শ্রেষ্ঠ হেকিমদের তোমার সঙ্গে পাঠাবো এবং তুমি যে কয়জন ইচ্ছা পরিচারিকা সাথে নিতে পারো। সেখানকার আবহাওয়া খুবই ভালো-আগ্রার তুলনায় ঠাণ্ডা ও স্বাস্থ্যকর। এই সব সুবিধা তোমার এবং তোমার গর্ভের সন্তানের উপকারে আসবে। এছাড়া তুমি সেখানে তোমার ধর্মও চর্চা করতে পারবে।

 হীরাবাঈ তার কোলের উপর ভাজ করে রাখা হাতের দিকে তাকালো। আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী সবকিছু হবে।

আমি কি তোমার ভাইকে খবরটা জানাবো?

হীরাবাঈ মাথা নাড়লো। সে আরো কিছু বলতে পারে এমন আশা করে আকবর কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করলেন। আমি সন্তানটিকে ভালোবাসবো, সে বলেছে, কিন্তু বাস্তবে কি তা হবে? সে যদি বাবাকে ঘৃণা করে তাহলে সন্তানটির জন্য তার কতোটুকু ভালোবাসা সৃষ্টি হতে পারে? সুফির সতর্কবাণী এক মুহূর্তের জন্য তার মনে এলো। তাঁর স্ত্রীর বৈরিতা কি সুফির প্রত্যক্ষ করা দূরবর্তী ছায়া গুলির একটি আরেকবার হীরাবাঈ এর আন্তরিকতাহীন চেহারা পর্যবেক্ষণ শেষে আকবর কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন এবং অনুভব করলেন তার মাঝে আবার আনন্দ উচ্ছ্বাস ফিরে আসছে। তিনি প্রথম বাবা হতে চলেছেন…

*

যে পবিত্র মানুষটি তোমার জন্মের ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন তাঁর নাম অনুসারে আমি তোমার নাম সেলিম রাখলাম।

 মোচড়াতে থাকা সদ্য জন্মলাভ করা শিশুটিকে কোলে নিয়ে আকবর বললেন। শিশুটি তার বাম হাতে ধরা। এবার ডান হাতে একটি পিরিচ ভর্তি ছোট ছোট স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে তিনি খুব যত্নের সঙ্গে শিশুটির মাথায় ঢাললেন। সেলিম তার ক্ষুদ্র হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে এবং তার মুখ কুচকে গেলো কিন্তু সে কাঁদলো না। গর্বের হাসি দিয়ে আকবর সেলিমকে উঁচু করে ধরলেন যাতে সকলে তাকে দেখতে পায়। তারপর তিনি তার বয়স্ক উজির জওহর এর ধরে থাকা সবুজ মখমলের চওড়া গদিতে তাকে শুইয়ে দিলেন। এবার কালো পাগড়ি পরিহিত প্রধান ওলামা শেখ আহমেদ এর বক্তব্য প্রদানের পালা। একটি হিন্দু মায়ের গর্ভজাত সন্তানকে আশীর্বাদ করার ব্যাপারে তার মনোভাব কেমন হতে পারে? তার ঘন দাড়ি আচ্ছাদিত মুখ বৈশিষ্টহীন। তার মনের মধ্যে যাই থাকুক তা প্রকাশ পাচ্ছিলো না, যদিও তার অভিসন্ধিমূলক ফতোয়াকে ব্যর্থ করে দিয়ে শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়েছে।

 সেলিমের জন্মের জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে ওলামা বয়ান শুরু করলেন: এই ভুবন আলো করা শিশুটির মঙ্গলময় আগমনকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি ওলামা সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে যাদের মহানুভব সম্রাট শিক্রিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে সম্মানিত করেছেন। যুবরাজ সেলিম, আল্লাহ আপনাকে পথপ্রদর্শন করুন এবং এক সমুদ্র ঐশ্বরিক ঐশ্বর্য আপনার উপর বর্ষিত হোক এই কামনা করছি।

 ঐদিন সন্ধ্যায় শিক্রির মালভূমিতে টাঙ্গানো বহু সংখ্যক শামিয়ানার নিচে সেলিমের জন্ম উপলক্ষে আয়োজিত ভোজসভা চলছিলো। মোগলদের আদি জন্মস্থান থেকে বয়ে আনা রীতিতে নাচ গানের অনুষ্ঠানও চলছিলো। রীতি অনুযায়ী আকবর, আহমেদ খান এবং অন্যান্য সেনাপতিদের হাতে ধরে চক্রাকারে নাচের ভঙ্গিতে কয়েক বার পাক খেলেন। এ সময়ে আকবরের মনে হলো তাঁর এখন আরেকটি জিনিস করা দরকার।

 তখন রাত আরো গম্ভীর হয়েছে। আকবর ঘোড়ায় চড়লেন এবং অল্প কয়েকজন রক্ষী নিয়ে হীরাবাঈ যে আশ্রমে অবস্থান করছে সে দিকে রওনা হলেন।

সম্রাট এসেছেন! তার একজন রক্ষী চিৎকার করে জানান দিলো, যখন তারা আশ্রমের তোরণের সামনে উপস্থিত হলেন। অম্বর থেকে আগত কমলা পাগড়ি পরিহিত রাজপুত সৈন্যরা পাহারায় ছিলো। বর্তমান অবস্থায় তাদের রাজকন্যার নিরাপত্তা প্রদানের জন্য আকবর তাঁদের অনুমতি দিয়েছেন। সৈন্যরা সোজা হয়ে দাঁড়ালো এবং তাদের দলনেতা এগিয়ে এলো।

স্বাগতম জাহাপনা।

আকবর ঘোড়া থেকে নামলেন এবং নিজের কোর্চির দিকে লাগামটা ছুঁড়ে দিয়ে প্রবেশ পথ দিয়ে একটি স্বল্প আলোকিত উঠানের দিকে অগ্রসর হলেন। আবার কেউ চিৎকার করে ঘোষণা দিলো, সম্রাট এসেছেন! এবারে হীরাবাঈ এর একজন রাজপুত সেবিকা ছায়ার মধ্য থেকে প্রদীপ হাতে এগিয়ে এলো।

আমাকে আমার স্ত্রীর কাছে নিয়ে চলো।

 হীরাবাঈ নীল রঙের তাকিয়ার ঠেস দিয়ে নিচু বিছানায় শুয়ে ছিলো। সেলিম তার বুকের দুধ পান করছিলো এবং আকবর হীরাবঈ এর চেহারায় এমন একটি তৃপ্তির ভাব লক্ষ্য করলেন যা তিনি আগে কখনোও প্রত্যক্ষ করেননি। সেটা এতোই অপ্রত্যাশিত যে তাকে তার কাছে অচেনা মনে হলো। কিন্তু যখন সে আকবরের দিকে তাকালো, তার চেহারা থেকে সেই পরিতৃপ্তির আভা অদৃশ্য হলো। আপনি কেনো এসেছেন? আপনারতো এখন ভোজ সভার অতিথিদের সঙ্গ দেয়ার কথা।

 হঠাৎ আমার পুত্রের মুখ দেখতে ইচ্ছা হলো…এবং আমার স্ত্রীকে।

 হীরাবাঈ কিছু বললো না, কিন্তু সেলিমকে স্তনের বোঁটা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তার পরিচারিকার কোলে দিলো। হঠাৎ দুধ পান করা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় শিশুটি কাঁদতে লাগলো, কিন্তু হীরাবাঈ ইঙ্গিতে তাকে আকবরের কাছে নিয়ে যেতে বললেন।

হীরাবাঈ, আমি শেষ বারের মতো তোমার কাছে আবেদন করতে এসেছি। জীবনের বাকি সময়টা সেলিম আমাদের মাঝে রক্ত-মাংসের সংযোগ সূত্র হয়ে থাকবে। আমরা কি অতীতকে ভুলে তার জন্য আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করতে পারি না? আমি চাই আমার বাকি সন্তানদেরও তুমি ধারণ করো যাতে পরবর্তী জীবনে তারা পরস্পরকে সহযোগীতা করতে পারে আপন ভাই হিসেবে।

আমার দায়িত্ব শেষ হয়েছে। আমি আপনাকে আগেই বলেছি আমাকে একা শান্তিতে থাকতে দিতে। আপনি আমাকে কথা দিয়েছেন পুত্র সন্তান উপহার দিলে আপনি তা করবেন। আপনার বাকি সন্তানদের বাবা হওয়ার জন্য অন্য নারীদের গ্রহণ করুন।

সৎভাই থাকলে ভবিষ্যত সম্রাট হিসেবে সেলিমের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে। সৎ ভাইরা তার প্রতি কম বিশ্বস্ত থাকবে। তুমি কি সেটা বিবেচনা করেছো? তোমার পুত্রের অবস্থান যথাসম্ভব শক্তিশালী করার জন্য তোমার কি কোনোই দায়বদ্ধতা নেই?

 আমার পুত্রের শিরায় রাজপুত রক্ত প্রবাহিত। সে যে কোনো বিরোধীতা ধূলায় পদদলিত করবে। হীরাবাঈ চিবুক উঁচু করে বললো।

 হীরাবাঈ এর এমন নিরুদ্বেগ একগুঁয়ে অহমিকা এবং দুনিয়া সম্পর্কে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী আকবরকে ভীষণ হতাশ করলো। একবার তার মনে হলো ভবিষ্যত সম্পর্কে সুফির নেতিবাচক অনুমানের কথা হীরাবাঈকে জানাবেন। কিন্তু তিনি অনুভব করলেন সে তাতে মতো পরিবর্তন করবে না। তবে তাই হোক, কিন্তু তিনি এমন মেয়ের কাছে তাঁর পুত্রের লালন পালনের ভার অর্পণ করবেন না।

ঠিক আছে, তোমার ইচ্ছাই বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু তুমি যা করতে চাচ্ছ তার একটি মূল্য তোমাকে দিতে হবে। তোমার যখন ইচ্ছা হবে তুমি সেলিমকে দেখতে পারবে, কিন্তু তাকে আমি আমার মায়ের তত্ত্বাবধানে রাখবো। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মোগল যুবরাজরা তাদের আপন মায়ের বদলে বয়োজ্যষ্ঠ রাজমাতাদের তত্ত্বাবধানে লালিত হয়। আমার মা ওর জন্য একজন দুধ-মা নিযুক্ত করবেন যা মোগল রীতিরই অংশ। আমার পুত্র রাজপুত নয় বরং মোগল রাজপুত্র হিসেবে মানুষ হবে।

হীরাবাঈ আকবরের দিকে তাকালো। কিন্তু তার মাঝে কষ্টবোধ বা প্রতিবাদের কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না। সামান্য শক্ত হয়ে উঠা চোয়াল থেকেই তার একমাত্র প্রতিক্রিয়া বুঝা গেলো। আপনি সম্রাট। আপনার কথাই আইন। তার কণ্ঠস্বর কিছুটা উদ্ধত শোনালো। আকবর এসেছিলেন একটা শেষ চেষ্টা করতে যদিও তিনি আগেই অনুভব করেছিলেন হীরাবাঈ এর মনের বন্ধ দরজা কিছুতেই উন্মুক্ত করা সম্ভব নয়।

.

১০. জগতের একটি বিস্ময়

আপনি আমাকে ব্যাপক সম্মান প্রদান করলেন এবং আমার উপর অত্যন্ত বিশাল দায়িত্ব অর্পণ করলেন জাহাপনা।

 আমি জানি তুমি নিষ্ঠার সঙ্গে তোমার দায়িত্ব পালন করবে আবুল ফজল। আমি চাই আমার শাসন আমলের ঘটনাপঞ্জি পরবর্তী প্রজন্মগুলির জন্য অনুসরণীয় গ্রন্থ হয়ে থাকুক। এতে ভালো বা মন্দ সব ঘটনার সত্য বিবরণ তুমি লিপিবদ্ধ করবে। কখনোই আমার তোষামোদ করবে না।

আমি অকৃত্রিমতার ঘ্রাণযুক্ত কলম দিয়ে প্রতিটি শব্দ লিপিবদ্ধ করবো জাহাপনা।

 আকবর তাঁর সদ্য নিয়োগকৃত প্রধান ঘটনাপঞ্জিলেখকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। যদিও তাঁর অন্য একাধিক অনুলেখক ছিলো তবুও তিনি এমন একজন লেখকের প্রয়োজন অনুভব করছিলেন যে তাঁর প্রদান করা বক্তব্যের চেয়েও বেশি কিছু লিখতে পারবে-যে বিশ্বস্ততার সঙ্গে তাঁর রাজত্ব কালের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সমূহ লিপিবদ্ধ করবে যখন তিনি বেঁচে থাকবেন না তখনো। আবুল ফজল একজন বৃষস্কন্ধ এবং বক্র পা বিশিষ্ট লোক এবং বয়সে তার চেয়ে সামান্য ছোট। তার পিতা শেখ মোবারক যিনি একজন ধর্মতাত্ত্বিক পণ্ডিত, কয়েক বছর আগে পারস্য থেকে সপরিবারে মোগল রাজ দরবারে আগমন করেন। একজন উপদেষ্টা এবং রাজনীতিক বিশ্লেষক হিসেবে আবুল ফজলের দক্ষতা ইতোমধ্যেই আকবরের নজর কেড়েছে। কিন্তু তাঁর উজির জওহর এর সুপারিশে তিনি তাকে প্রধান ঘটনাপঞ্জিলেখকের পদে নিয়োগ করলেন। জওহর বলেছিলো যদিও আবুল ফজল একজন নিষ্ফল এবং নির্লজ্জ তোষামোদকারী তবুও তার মধ্যে চাতুর্য এবং বিশ্বস্ততা রয়েছে। ঘটনা সমূহের কেন্দ্রে অবস্থান করায় সে সেগুলিকে মহিমান্বিত করে তুলবে এবং তুলনামূলকভাবে সংযত এবং অবসরগামী লেখকদের চেয়ে কাজটি অধিক দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করতে পারবে। আবুল ফজলের পরিচ্ছন্নভাবে কামানেনা মুখের বিগলিত হাসি দেখে আকবর অনুমান করতে পারছিলেন এমন একটি আস্থানির্ভর কাজের দায়িত্ব পেয়ে সে কতোটা কৃতজ্ঞ বোধ করছে।

সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থায় আমি যে সংস্কার করতে যাচ্ছি তার বিবরণ অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তোমাকে লিপিবদ্ধ করতে হবে। ঘটনাপঞ্জি লিপিবদ্ধ করার একটি প্রধান উদ্দেশ্য হলো আমার উত্তরসূরিদের নির্দেশনা প্রদান করা।

 নিশ্চয়ই জাঁহাপনা। তড়িৎ বেগে হাত নেড়ে আবুল ফজল একজন পরিচারককে ইঙ্গিত করলো। পরিচারকটি একটি উঁত কাঠের তৈরি ছোট আকারের ঢালু লেখার টেবিল তার সামনে রাখলো এবং কাগজ, কলম ও কালি সরবরাহ করলো।

 তাহলে শুরু করা যাক। আকবর উঠে তার কক্ষের মধ্যে পায়চারী শুরু করলেন। আমি ইতোমধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রথমত আমি আমার সকল কর্মকর্তাদের একটি মাত্র ক্রমবিভক্ত ধারায় সংগঠিত করতে চাই। তারা সেনাবাহিনীর সদস্য হোক বা না হোক প্রত্যেকে নির্দিষ্ট সংখ্যক সৈন্যের দলনেতা হিসেবে নিযুক্ত থাকবে। তোমাকে বিস্মিত দেখাচ্ছে আবুল ফজল, কিন্তু এমন বিশাল এবং অসম সাম্রাজ্যের জন্য আমাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রশাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। এমনকি এদের মধ্যে রাজকীয় রন্ধনশালার প্রধানও অন্তর্ভূক্ত হবে-সে ছয়শো সৈন্যের দলনেতা হিসেবে নিযুক্ত হবে। আমার উপদেষ্টা এবং ঘটনাপঞ্জিকার হিসেবে তুমি চার হাজার সৈন্যের দলনেতা হিসেবে নিযুক্ত হবে।

আবুল ফজলের মুখে সন্তুষ্টির হাসি দেখা গেলো এবং সে আবার নুয়ে লিখতে শুরু করলো যখন আকবর বলা শুরু করলেন। দ্বিতীয়ত আমার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত কিছু ভূমি রাজ সম্পত্তি হিসেবে অধিগ্রহণ করা হবে এবং আমার কর্মকর্তাগণ সেগুলির উপযুক্ত কর সংগ্রহ করে সরাসরি আমার কোষাগারে পাঠাবে। বাকি ভূখণ্ড একাধিক জায়গিরে বিভক্ত করা হবে-এবং সেগুলি আমার সভাসদ এবং সেনাপতিদের অধীনে শাসনের জন্য প্রদান করা হবে। সেখানকার কর আদায়ের দায়িত্ব তাঁদের এবং করের একটা অংশ তারা সিংহাসনের পক্ষে লড়তে আগ্রহী একটি সেনাবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাখতে পারে। এর ফলে যখন আমার যুদ্ধে যাওয়ার প্রয়োজন হবে তখন খুব কম সময়ের মধ্যে আমি একটি বৃহৎ আকারের সুপ্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী গঠন করতে পারবো।

জায়গিরের প্রশাসকরা কি তাদের সন্তানদের উক্ত জায়গির প্রদান করতে পারবে জাহাপনা?

না। তাদের মৃত্যু হলে জায়গির আমার তত্ত্বাবধানে ফেরত আসবে এবং আমার প্রমোদের ব্যয়ভার মেটানোর জন্য ব্যবহৃত হবে। আকবর থামলেন। আমার অধীনস্থ প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সাম্রাজ্যের কর্মচারী(জায়গিরদার) হিসেবে নিযুক্ত হবে। গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের আমি জায়গির থেকে বিতাড়িত করবো এবং জায়গিরদারদের মৃত্যু হলে আমি সেই জায়গির বাজেয়াপ্ত করবো। এর ফলে আমার প্রশাসকরা আমার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে এবং আমার বিরুদ্ধে শক্তি সঞ্চয় করে বিদ্রোহ করতে পারবে না। আকবর থামলেন এবং কিছুক্ষণের জন্য কেবল আবুল ফজলের কলম চালানোর খস খস শব্দ শোনা গেলো। সব পরিস্কার ভাবে বুঝেছো? এতোক্ষণ যা বললোম তার সব কিছু ঠিক মতো লিখতে পেরেছো?

 জ্বী জাহাপনা। আমি বিস্তারিত বিবরণ সহ সবকিছু অক্ষরে অক্ষরে লিপিবদ্ধ করেছি। যারা এই বিবরণী পাঠ করবে তারা আপনার মহান বিচক্ষণতা, অতুলনীয় দূরদৃষ্টি এবং সাংগঠনিক দক্ষতা সম্পর্কে অধ্যয়ন করে সীমাহীন উপকার লাভ করবে।

আবুল ফজল এতো বেশি বকর বকর করে কেন? আকবর ভাবলেন। বোধহয় সে মনে করে লাগাতার চাটুকারীতা তার অধিক আস্থাভাজন হওয়ার একমাত্র পথ। পারসিকরা কি এরকম আচরণই করে? কিন্তু বৈরাম খান তো এমন ছিলেন না। তাঁর সাবেক অভিভাবকের স্মৃতি এবং তার প্রতি তাঁর আচরণের বিষয়টি এখনো তার জন্য বেদনাময় এবং আকবর জোর করে তাঁর মন থেকে এই চিন্তা সরিয়ে দিতে চাইলেন।

 চলো আমরা বাইরে যাই। বাকি কথা আমরা সেখানে যেয়ে আলাপ করবো। আকবর তাঁর ব্যক্তিগত কক্ষ থেকে আবুল ফজলকে নিয়ে বাইরের উঠানে উপস্থিত হলেন। সেখানে তাঁর তিন পুত্র খেলা করছিলো। পাঁচ বছরের সেলিম একটি খেলনা গাড়িতে বসে ছিলো এবং তার থেকে এগারো মাসের ছোট মুরাদ গাড়িটা টানছিলো। অন্য জন দানিয়াল, তার বয়স সাড়ে তিন বছর। একটি নিম গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা আকবর এবং আবুল ফজলের উপস্থিতি তারা টের পায়নি এবং খেলা চালিয়ে যাচ্ছিলো। সেলিম দ্রুত বেড়ে উঠছিলো। তার দৈহিক গড়ন হীরাবাঈ এর মতো চিকন এবং ছিপছিপে। তার ঘন কালো চুল এবং লম্বা লম্বা চোখের পাপড়িও মায়ের মতোই। মুরাদ ওর কাছাকাছি লম্বা কিন্তু অধিক স্বাস্থ্যবান, অনেকটা আকবরের মতোই, কিন্তু জয়সলমিরের রাজপুত রাজকন্যা মায়ের মতো তামাটে চোখ তার। ছোট্ট দানিয়াল নাদুস নুদুস গড়নের, কিন্তু সে আকবর বা তার সুন্দরী পারসিক মায়ের চেহারা বা গড়ন পায়নি।

আকবর সন্তুষ্ট চিত্তে তাদের পর্যবেক্ষণ করছিলেন যেমনটা তিনি সবসময় করে থাকেন। শেখ সেলিম চিশতি যেমন ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন তেমনটাই ঘটেছে, তিনি তিনটি বলিষ্ঠ পুত্র লাভ করেছেন। ওদেরকে দেখো আবুল ফজল, উত্তরসূরি হিসেবে ঐরকম তিনজন স্বাস্থ্যবান পুত্রের মতো সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপনের চেয়ে আমার সাম্রাজ্যের জন্য বেশি আর কি করা আমার পক্ষে সম্ভব হতো? আল্লাহ্ আমার প্রতি অনেক সদয় হয়েছেন।

 নিশ্চয়ই জাহাপনা। আল্লাহ্ তাঁর ঐশ্বরিক আলো আপনার উপর বর্ষণ করেছেন।

শিশুদের গাড়িটা উঠানের অন্য প্রান্তে পৌঁছে থেমে গেছে এবং মুরাদ সেটায় চড়ার চেষ্টা করছে, সন্দেহ নেই এবার তার পালা। সেই মুহূর্তে সুফির সতর্কবাণীর কথা মনে পড়তেই আকবরের পরিতৃপ্তভাব বাধাগ্রস্ত হলো। তাদেরকে একাগ্রচিত্তে পর্যবেক্ষণ করতে করতে আকবর ভাবলেন তাঁকে তাদের শিক্ষার জন্য বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে হবে এবং তাঁদের মধ্যে হিংসা বা বৈরিতার কোনো লক্ষণ দেখা যায় কি না সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। কিন্তু দেখা গেলো সেলিম হাসতে হাসতে মুরাদকে গাড়িতে বসার জায়গা ছেড়ে দিলো। তারা এখনো অনেক ছোট….তিনি বোকার মতো চিন্তা করছেন। তার ভাবনার অবকাশ সৃষ্ঠি হতে এখনো বহু বছর বাকি আছে- যদিওবা কোনো দুশ্চিন্তার অবকাশ সৃষ্টি হয়। তিনি তাদের কাছে এগিয়ে যেতে নিলেন কিন্তু সেই সময় কোৰ্চি তাঁর দিকে এগিয়ে এলো।

জাহাপনা, শিক্রির নির্মাণ পরিকল্পনা আলোচনা করতে স্থপতিরা এসেছেন।

 চমৎকার। আমি এখনই আসছি। তুমিও আমার সঙ্গে এসো আবুল ফজল। আমি চাই এই প্রকল্পের সবকিছু তুমি জানো। শেখ সেলিম চিশতিকে দেয়া ওয়াদা অনুযায়ী আমি শিক্রিতে একটি নতুন রাজধানী নির্মাণ করতে যাচ্ছি, এই সুফি সাধক আমার তিন পুত্রের জন্মের ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন। স্থাপত্যশিল্পের প্রতি আপনার আগ্রহের কথা সর্বজনবিদিত জাহাপনা। দিল্লীতে আপনার পিতার সমাধিটি সারা হিন্দুস্থানের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ স্থাপনা।

এই প্রথম বারের মতো আবুল ফজল বাড়িয়ে বলছিলো না। আকবর ভাবলেন। বালুপাথর এবং মার্বেল পাথরে তৈরি হুমায়ূনের অষ্টভুজ সমাধিটি সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। এর দ্বিতল গম্বুজ এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ রুচিশীল বিন্যাস সমরকন্দে অবস্থিত তৈমুরের সমাধির কথা মনে করিয়ে দেয়, যার অঙ্কন চিত্র আকবর দেখেছেন।

 তোমাকে এর বিস্তারিত বিবরণ ঘটনাপঞ্জিতে লিপিবদ্ধ করতে হবে আবুল ফজল। শিক্রির গঠন শৈলী সবকিছু থেকে ভিন্ন মাত্রার হবে-এ পর্যন্ত আমার, আমার পিতার অথবা আমার পিতামহের দ্বারা হিন্দুস্তানে যা কিছু নির্মিত হয়েছে তার তুলনায়। আমি আমার হিন্দু প্রজাদের নির্মাণশৈলীতে শহরটি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই জন্য আমি হিন্দু স্থপতিদের নির্বাচন করেছি। ইতোমধ্যে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আমি বহু ঘন্টা ব্যয় করেছি। নির্দেশনা পাওয়ার জন্য তাঁদের কাছে প্রাচীন অনেক গ্রন্থ রয়েছে যাতে সবকিছুর বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে। কীভাবে উত্তম ইট তৈরি করতে হয় তার থেকে শুরু করে স্থাপনার অবস্থান কেমন হলে এর অধিবাসীদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনবে, এর সবকিছু।

আকবরের সম্মেলন কক্ষে দুইজন স্থপতি অপেক্ষা করছিলো। তাঁদের একজন লম্বা এবং মধ্যবয়সী এবং অপরজন অনেক তরুণ এবং তার বগলে কিছু লম্বা আকারের পেচানো কাগজ দেখা যাচ্ছিলো। তারা আকবরকে কুর্ণিশ করলো। আকবর তাঁদের মধ্যে যে বয়োজ্যেষ্ঠ তাকে সম্বোধন করলেন। স্বাগতম তুহিন দাশ, তোমার পরিকল্পনা জানার জন্য আমি উদ্গ্রীব হয়ে আছি। তোমার ছেলের হাতের ঐ কাগজগুলিতে কি রয়েছে?

এগুলিতে কিছু প্রাথমিক অঙ্কন চিত্র রয়েছে জাঁহাপনা।

 ওগুলি খুলে ধরো, আমি দেখতে চাই।

নিশ্চয়ই। মোহন, জাঁহাপনা যা বললেন করো।

 আকবর অপেক্ষা করতে লাগলেন যখন মোহন টেবিলের উপর একটা একটা করে নকশা গুলি মেলে ধরে সেগুলির চারকোণায় পাথর চাপা দিতে লাগলো। তার আঙ্গুলের অগ্রভাগগুলি কালি মাখা এবং সেগুলি সম্ভবত উত্তেজনায় সামান্য কাঁপছিলো। মোহনের কাগজগুলি মেলে রাখার কাজ শেষ হওয়ার আগেই আকবর সাগ্রহে তার উপর ঝুঁকে পড়লেন। কাগজগুলি চতুর্ভুজ দাগ বিশিষ্ট যার বিভিন্ন অংশে স্থাপনাগুলি চিহ্নিত করা আছে।

জাহাপনা আমরা এই অঙ্কনটা দিয়ে শুরু করলে ভালো হয়। তুহিন দাশ সবচেয়ে বড় আকারের অঙ্কনটার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। এখানে আমি সমগ্র রাজপ্রাসাদের ভবনগুলির যৌগিক বিন্যাস অঙ্কন করেছি। আপনার নির্দেশ অনুযায়ী প্রধান শহরটিকে নিচে রেখে মালভূমির উপরে এর অবস্থান নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এর তিন দিকে প্রাচীর থাকবে এবং উত্তর-পশ্চিম অংশে থাকবে বিশাল হ্রদ। এই হ্রদ শিক্রির নিরাপত্তাই শুধু রক্ষা করবে না বরং এর পানির চাহিদাও পূরণ করবে। আকবর সম্মতি সূচক মাথা নাড়লেন।

আমি প্রস্তাব করছি রাজপ্রাসাদ, মসজিদ এবং অন্য সকল ভবনগুলি অঙ্কিত ঢালের শীর্ষে অবস্থিত এই রেখা বরাবর নির্মাণ করা হোক যা দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রসারিত। কিন্তু দয়া করে মনে রাখতে হবে জাহাপনা, যদিও আমরা আপনার ইচ্ছা বাস্তবায়নের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি তবুও এই অঙ্কনগুলি আমাদের প্রাথমিক ধারণার বাস্তবায়ন মাত্র।

 এই নকশাটি আমাকে আরেকটু বুঝাও। আকবর বললেন।

 রাজপ্রাসাদটি ধারাবাহিক ভাবে সংযুক্ত একাধিক উঠানের সংযোগে গঠিত হবে। আজ আমরা প্রসাদের প্রধান ভবন গুলির অঙ্কিত নকশা নিয়ে এসেছি। এগুলি আপনার পছন্দ হলে আপনাকে আরো স্পষ্ট ধারণা দেয়ার জন্য আমরা এদের কাঠের তৈরি ক্ষুদ্র সংস্করণ বানিয়ে আনবো।

 এই জায়গাটা কি? আকবর অঙ্কন চিত্রের একটি বিশাল দেয়াল ঘেরা অংশ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

এটা হেরেম সারা-আপনার নির্দেশ অনুযায়ী পাঁচশো নারী যাতে তাদের পরিচারিকাদের নিয়ে আরামে বসবাস করতে পারে তেমন বড় করে এর কাঠামো অঙ্কিত হয়েছে। তাঁদের অধিকাংশেরই এই প্রাসাদে কক্ষ থাকবে, এর নাম পাঁচমহল। তুহিন দাশ একটি উঁচু পাঁচতলা ভবনের নকশা আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন। আমি পারস্য ভ্রমণের সময় যে সব ভবন দেখেছি তার অনুকরণে এর নমুনা তৈরি করেছি। পারসিকরা অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে ভবন গুলিতে ঠাণ্ডা বায়ু প্রবাহের জন্য জাফরি এবং সুরঙ্গের ব্যবস্থা রেখেছে এবং আমিও এই ভবনটিতে একই ব্যবস্থা রেখেছি। আমি এই প্রাসাদের সৌন্দর্যের দিকেও বিশেষ নজর দিয়েছি-এই দেখুন, প্রতিটি তলা কেমন সরু স্তম্ভের উপর ভর করে আছে। একদম উপরের তলায় অঙ্কিত হয়েছে হাওয়া মহল-এখানে গম্বুজ আকারের আচ্ছাদনের নিচে প্রচুর হাওয়া বাতাসের মধ্যে মহিলারা বসে সময় কাটাতে পারবে।

ভালো, আকবর বললেন। তাঁর স্ত্রী এবং রক্ষিতাঁদের উপযুক্ত বিলাসিতার ব্যবস্থা থাকা উচিত। সংখ্যায় ক্রমবর্ধমান রক্ষিতাদের মধ্যে এখনোও তিনি মায়ালার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, কামনার চেয়ে এতোদিনের ভালোবাসাই বোধহয় এর কারণ। যদিও অন্যরা আরো অধিক দৈহিক আকাক্ষা সৃষ্টি করতে পারছে। নবাগত একটি রুশ দেশীয় মেয়ে-যাকে এক ধনী মোগল সওদাগর উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে-মেয়েটি তার নীলা সদৃশ চোখ, ফ্যাকাশে চামড়া এবং সূর্যালোকের বর্ণে বর্ণিল চুল নিয়ে ইদানিং আকবরের অধিক মুনোযোগ কাড়ছিলো।

এই যে ভবনগুলির নকশা দেখছেন, এগুলি আপনার মাতা, ফুফু এবং প্রধান স্ত্রীদের জন্য নির্ধারণ করেছি জাঁহাপনা।

আকবর তুহিন দাশের অঙ্কিত কতিপয় অভিজাত প্রাসাদের নকশার উপর চোখ বুলালেন। রানী হীরাবাঈ এর জন্য তুমি কোনো প্রসাদটি প্রস্তাব করছো?

এটি জাহাপনা। দেখুন, এর ছাদের উপর একটি ছত্রী রয়েছে যেখানে তিনি চাঁদ দেখার জন্য যেতে পারবেন এবং পূজা অর্চনাও করতে পারবেন।

আকবর সতর্কতার সঙ্গে নকশাটি দেখলেন। যদিও তিনি কদাচিৎ হীরাবাঈ এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন তবুও প্রথম স্ত্রী এবং বড় ছেলের মা হিসেবে তার উপযুক্ত মর্যাদা প্রদানের দিকে তার মনোযোগ ছিলো।

চমৎকার! কিন্তু আমার প্রাসাদ কোনটি?

 এই যে, হেরেমের পাশেই এর অবস্থান। এটি ছাদ বিশিষ্ট হাঁটাপথ এবং ভূগর্ভস্থ সুরঙ্গের মাধ্যমে হেরেমের সঙ্গে যুক্ত। আপনার প্রাসাদের সম্মুখের বিশাল উঠানটিতে থাকছে অনুপ তালাও বা অতুলনীয় জলকুণ্ড। এটি বার ফুট গভীর এবং হ্রদের সঙ্গে একাধিক জলনালী দ্বারা সংযুক্ত, ফলে সর্বদা আপনি জল প্রবাহের সতেজ কলধ্বনি শুনতে পাবেন।

সমগ্র শহরে সরবরাহ করার মতো যথেষ্ট পানি হ্রদটিতে থাকবে, এ বিষয়ে তুমি কি নিশ্চিত?

প্রকৌশলীরা এ বিষয়ে আমাদের ইতিবাচক আশ্বাস প্রদান করেছে জাহাপনা।

 এটা কি? আকবর তার প্রস্তাবিত প্রাসাদের একপাশে বেশ বড় জায়গা নিয়ে তৈরি একটি আয়তক্ষেত্রাকার আকৃতি সামান্য বিভ্রান্তি নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছিলেন।

 এটা আপনার ব্যক্তিগত চত্বর জাঁহাপনা, তবে এর মেঝে সাধারণ পাথরের বর্গাকার খণ্ড বিছিয়ে তৈরি না করে দাবার ছকের মতো করে তৈরি করার প্রস্তাব করছি আমি। আপনি এবং আপনার সভাসদগণ এখানে বিশাল আকৃতির ঘুটি বসিয়ে দাবা খেলতে পারবেন অথবা বিশ্রাম নিতে পারবেন। চমৎকার। তুমি ব্যাপক উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছো তুহিন দাশ। আর এটা কি?

আমি এর নাম দিয়েছি দেওয়ান-ই-খাস, আপনার ব্যক্তিগত সভার স্থান। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে এটি দ্বিতল বিশিষ্ট ভবন কিন্তু বাস্তবে এটি একটি কক্ষ। মোহন তোমার অঙ্কন করা অভ্যন্তরীণ নকশাটা দেখাও।

এখন মোহনকে খানিকটা আত্মবিশ্বাসী মনে হলো। সে তার বাম কাঁধে ঝোলানো চামড়ার ব্যাগ থেকে একটি কাগজের পাতা বের করে টেবিলের উপর মেলে ধরলো। আকবর সেখানে অঙ্কিত একটি উঁচু ছাদ বিশিষ্ট কক্ষ দেখতে পেলেন যার ঠিক মধ্যখানে করুকার্যখচিত স্তম্ভ রয়েছে। স্তম্ভটির নিম্নাংশ সরু কিন্তু সেটা উপর দিকে প্রসারিত হয়ে বৃত্তাকার ঝুলবারান্দার ভর কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে এবং ঝুলবারান্দার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কক্ষের চার দিকে প্রসারিত চারটি সেতু। সত্যিই আকর্ষণীয়, কিন্তু এটা কি ধরনের ঘর?

 আমি ঠিক বুঝলাম না। অতো উঁচুতে অবস্থিত বরান্দা কি কাজে আসবে?

ঐ বারান্দায় সিংহাসনে বসে আপনি প্রজাদের বক্তব্য শ্রবণ করবেন জাহাপনা। আর আপনার সাম্রাজ্য যেহেতু পৃথিবীর একচতুর্থাংশ ভূখণ্ডে প্রসারিত তাই এই বাস্তবতার প্রতীক হিসেবে সেতু চারটি স্থাপন করা হয়েছে। যে কেউ আপনার কাছে বক্তব্য পেশ করতে চাইবে সে ঐ সেতুগুলির একটি দিয়ে আপনার কাছে অগ্রসর হবে। বাকি সভাসদরা নিচে অবস্থান করে সবকিছু দেখবে ও শুনবে।

আকবর একাগ্রচিত্তে নকশাটি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। তিনি আশা করেছিলেন তুহিন দাশ সম্রাটের উপযুক্ত একটি সাধারণ সভা কক্ষের পরিকল্পনা করবে কিন্তু সে তার নিজের অবস্থানকে অতিক্রম করে গেছে। যতোই তিনি নকশাটি পাঠ করলেন এবং সেটার তাৎপর্য অনুধাবন করলেন ততোই বেশি তিনি সেটা পছন্দ করলেন।

 তুমি এই ধারণা কোথায় পেলে? পারস্যের শাহ এর কি এমন কোনো স্থাপনা রয়েছে?

 অন্য কোনো রাজা বা সম্রাটের এমন নকশার ভবন বা কক্ষ নেই জাহাপনা। এটা সম্পূর্ণ আমার নিজস্ব পরিকল্পনা। আপনি কি এতে সন্তুষ্ট?

 বোধহয় আমি সন্তুষ্ট…কিন্তু কেন্দ্রস্থলের এই স্তম্ভটি, মনে হয় এটি কাঠ দিয়ে তৈরি করা হবে এবং সেটা চন্দন কাঠ?

না জাহাপনা। সেতুগুলির ভার সহ্য করার জন্য আমাদেরকে এটি বালুপাথর দিয়ে তৈরি করতে হবে।

অসম্ভব! এর নকশা অত্যন্ত জটিল।

 আমার ভিন্ন মতের জন্য দুঃখিত জাঁহাপনা, কিন্তু আমি নিশ্চিত ভাবে জানি এই জটিল নকশা বালুপাথর দিয়েই তৈরি করা সম্ভব। হিন্দুস্তানের কারিগররা এতোই দক্ষ যে তারা বালুপাথরকে কাঠের মতোই কেটে বা খোদাই করে নকশা সৃষ্টি করতে পারবে-কোনো নকশাই তাঁদের জন্য কঠিন নয়।

 তোমার কারিগররা যদি সত্যিই তা করতে পারে তাহলে সমগ্র রাজপ্রাসাদের প্রতিটি স্তম্ভ, ঝুলবারান্দা, জানালা এবং প্রবেশ পথ বালুপাথর (স্যাণ্ডস্টোন) দিয়ে তৈরি করা হোক। আমরা এমন একটি গোলাপ লাল শহর তৈরি করবো যা সমগ্র জগতের মাঝে একটি বিস্ময় হয়ে থাকবে… মনের দৃষ্টিতে ইতোমধ্যেই আকবর তার নতুন রাজধানী দেখতে পাচ্ছিলেন, একটি গহনার বাক্সের মতোই সূক্ষ্ম কারুকার্য খচিত, বালুপাথরের সুদৃঢ় গাঁথুনীতে বলিষ্ঠ। এটি কেবল শেখ সেলিম চিশতির উপযুক্ত শ্রদ্ধার্ঘই হবে না বরং মোগল শ্রেষ্ঠত্বের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবেও অমর হয়ে থাকবে।

*

তুহিন দাশকে আকবর শিক্রির নির্মাণ কাজের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবেও নিযুক্ত করেছেন। সে জানিয়েছে ইতোমধ্যেই ত্রিশ হাজার নির্মাণ শ্রমিক সেখানে কাজ করছে এবং এই সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। প্রতিদিন জ্বলন্ত সূর্যের নিচে অসংখ্য পুরুষ এবং কতিপয় নারীর লম্বা রেখা মালভূমি পর্যন্ত প্রসারিত বিশেষভাবে তৈরি মাটির রাস্তা দিয়ে প্রয়োজনীয় মালালাম চূড়ায় নিয়ে যাচ্ছে এবং বিভিন্ন বর্জ ও পাথরকুচি ঝুড়িতে করে মাথায় নিয়ে নেমে আসছে। দূর থেকে তাঁদের দেখতে অনেকটা পিঁপড়ের সারির মতো লাগে যারা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অন্তহীন ধৈর্য এবং পরিশ্রমের সঙ্গে চলমান। তাঁদের পরিধানে অপ্রতুল পোষাক-পুরুষদের পরনে ময়লা ধূতি অথবা নেংটি এবং মহিলাদের পরনে সুতির শাড়ি। কোনো কোনো মহিলার পিঠে আবার তাঁদের দুগ্ধপোষ্য শিশু ঝুলিয়ে বাঁধা রয়েছে। মেটেবর্ণের বস্ত র আচ্ছাদনের নিচে পাতা মাদুরে রাতে তাদের ঘুমানোর ব্যবস্থা এবং সেখানেই তারা ঘুঁটে দিয়ে ডাল, সজি এবং হাতে বানানো চ্যাপ্টা গোলাকৃতির রুটি বানিয়ে আহার করে।

আকবর যখন ঘোড়ায় চড়ে নির্মাণ এলাকা পরিদর্শন করছিলেন তখন তাঁর মনে হলো এ যেনো তাঁর নেতৃত্বাধীন একটি ভিন্ন ধরনের সেনাবাহিনীর যুদ্ধরত অবস্থা। তিনি তুহিন দাশকে নিয়ে প্রায়ই নির্মাণ কর্ম পরিদর্শনে আসেন। তুহিন দাশ সন্তুষ্টিপূর্ণ দৃষ্টিতে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করছিলো। দেখুন জাঁহাপনা ইতোমধ্যেই কতোটা অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ভূমি সমতল করা শেষ এখন তা ভবন নির্মাণের জন্য প্রস্তুত। শীঘ্রই আমরা প্রথমিক ভিত্তিপ্রস্তর গুলি খুড়তে পারবো।

আর বালুপাথর আহরণের কাজের অগ্রগতি কতোটা?

 দুইহাজার অমসৃণ প্রস্তর খণ্ড ইতোমধ্যেই কাটা সম্পন্ন হয়েছে এবং আগামী সপ্তাহে সেগুলি বলদটানা গাড়িতে করে এখানে নিয়ে আসা শুরু হবে। তারপর এখানে কারিগররা সেগুলিকে আকৃতি প্রদানের কাজ শুরু করবে।

আমার মাথায় একটি বুদ্ধি এসেছে যার ফলে কাজের গতি আরো দ্রুততর হবে। আমাদের হাতে সব নির্মিতব্য ভবনের বিস্তারিত নকশা রয়েছে। তাই পাথর সংগ্রহের স্থানেই প্রধান খণ্ডগুলি কেটে প্রতিটি ভবনের আকৃতি প্রদান করা যায়। তারপর সেগুলিকে শিক্রিতে এনে যথাস্থানে জুড়ে দিলেই হবে।

 চমৎকার বুদ্ধি জাহাপনা। এর ফলে ভবনগুলি অল্প সময়ের মধ্যে সন্নিবেশিত করা সম্ভব হবে এবং নির্মাণ এলাকার হট্টগোল ও ভিড় হ্রাস পাবে।

 আমি চাই সকল শ্রমিককে উত্তম পারিশ্রমিক দেয়া হোক। ঘোষণা দাও আমি তাদের দৈনিক মজুরী দ্বিগুণ করে দিচ্ছি এবং কাজ যদি ভালো গতিতে আগায় তাহলে সপ্তাহে একদিন রাজশস্যভাণ্ডার থেকে তাদের বিনামূল্যে শস্য সরবরাহ করা হবে। আমি চাই প্রতিদিন শ্রমিকরা চাঙ্গা ভাব নিয়ে কাজে যোগ দিক এবং আমি আরেকটি উত্তম উদাহরণ সৃষ্টি করতে চাই।

কীভাবে জাঁহাপনা?

 আমাকে পাথর সংগ্রহের স্থানে নিয়ে চলল। আমার প্রজাদের সঙ্গে আমি পাথর কাটতে চাই এবং তাঁদের দেখাতে চাই যে তাঁদের সম্রাট কঠোর শারীরিক পরিশ্রমকে ভয় করেন না।

দুই ঘন্টা পরের ঘটনা। আকবরের নগ্ন গা বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। তিনি দৃঢ় মনোযোগের সঙ্গে পথরের উপর গাঁইতি চালাচ্ছিলেন। ঠিক লড়াই এর সময় তিনি যেমন করে যুদ্ধকুঠার বা বর্শা চালান তেমনি অব্যর্থ লক্ষে গাইতির চোখা অগ্রভাগ পাথরের সঠিক অবস্থানে আঘাত হানছিলো। সেটা ছিলো প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির কাজ। আগামীকাল তার শরীরের পেশীগুলি তেমনই আড়ষ্ট হয়ে পড়বে যেমনটা হয়ে থাকে যুদ্ধের কঠিন লাড়ই এর পর। কিন্তু কদাচিৎ তিনি এমন আনন্দবোধ করেন। নিয়তি তাঁর জন্য অনেক মহান কর্ম নির্ধারণ করে রেখেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে একজন সাধারণ মজুরের মতো কঠোর পরিশ্রম করতে তাঁর মোটেই খারাপ লাগছিলো না, যৌবনের শক্তিতে গৌরবান্বিত এবং ভবিষ্যতের দুর্ভাবনা মুক্ত হয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *