নিস্তব্ধ হয়ে গেল বাড়ি, স্তিমিত হয়ে গেল দিনের প্রবাহ। রোগের বৃদ্ধি থেকে এই পর্যন্ত চলছিল তো উত্তাল ঝড়া! ক্লান্ত মানুষগুলো এবার অনেক দিনের ক্লান্তি পুষিয়ে নিতে ঘুমিয়ে নেবে কিছুদিন দুপুর-সন্ধ্যোয়।
বকুলও ঘুমিয়ে পড়েছিল ভরদপুরে, জেগে উঠলো বেলায়। তাড়াতাড়ি বুঝি দীর্ঘদিনের অভ্যাসে ছুটে এল বারান্দার দিকে। ভুল বুঝতে পারলো, আস্তে ফিরে এল, ছাতে চলে গেল।
দেখলো পশ্চিমের আকাশে বিশাল এক চিতা জ্বলছে। তার অগ্নি আভা ছড়িয়ে পড়েছে আকাশের মাটিতে।
বকুল শ্মশানে যায় নি, মায়ের চিতা জ্বালা দেখে নি, তাই বুঝি নির্নিমেষে তাকিয়ে রইল সেদিকে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল।… যখন আস্তে আস্তে নিভে গেল। সে আগুন, মনে পড়লো আর একদিনের কথা। এই ছাতেরই ওই কোণটায় আর এক চিতা জুলতে দেখেছিল সে। কোনোদিন জানলো না কী ভস্মীভূত হয়েছিল সেদিন।
আজ ঘুমের আগে মার ফেলে যাওয়া সমস্ত কিছু তন্নতন্ন করে দেখছিল সে, কোথাও পায় নি। একটি লাইন ও হস্তাক্ষর। সুবৰ্ণলতা যে নিরক্ষর ছিল না, সে পরিচয়টা যেন একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে গেছে সুবৰ্ণলতা।
বকুল ছাতের সেই চিতার কোণটায় বসে রইল অন্ধকারে।
কড়া নাড়ার শব্দে এগিয়ে এসে দরজাটা খুলে দিলেন জগুই।
অবাক হয়ে বললেন, তুই এই রোদ্দুরে? কার সঙ্গে এসেছিল?
বিয়ের সঙ্গে।
ঝিয়ের সঙ্গে একা এলি তুই? বলিস কি? খুব সাহস আছে তো? কিন্তু কেন বল তো হঠাৎ?
বকুল আস্তে বলে, জ্যাঠামশাই, আপনার প্রেসটা দেখতে এলাম।
প্রেসটা? আমার প্রেসটা? এখন দেখতে এলি তুই? হা-হা করে হেসে ওঠেন জগু, অথচ বকুলের মনে হয়, বুড়োমানুষটা যেন কেঁদে উঠলেন, হা-হা করে।
হাসিই। হাসি থামিয়ে জগু কথাটা শেষ করেন, প্রেসূ আর নেই, প্রেস তুলে দিয়েছি।
তুলে দিয়েছেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ, ও তুলে দেওয়াই ভালো, জগু হঠাৎ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ান, জোরে জোরে বলেন, কে অত ঝামেলা পোহায়? ওই যে শূন্য ঘরখানা পড়ে আছে দাঁত খিঁচিয়ে!
বকুল মুহূর্ত কয়েক স্তব্ধ থেকে বলে, আচ্ছা জ্যাঠামশাই, যে সব বই ছাপা হয়, তার পাণ্ডুলিপিগুলো কি সব ফেলে দেওয়া হয়?
জগু সন্দিগ্ধ গলায় বলেন, কেন বল দিকি?
এমনি, জানতে ইচ্ছে করছে।
জগু তেমনি গলাতেই বলেন, এমনি? না তোর—ইয়ে, মার সেই খাতাটা খুঁজতে এসেছিস?
না এমনি। বলুন না। আপনি, থাকে না?
থাকে, ছিল—, জগু হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠেন, গুদোমঘরে সব ডাঁই করা পড়েছিল। আদি অন্তকালের সব। ওই ব্যাটা নিতাই, দুধকলা দিয়ে কালসাপ পুষেছিলাম আমি, প্রেস উঠিয়ে দিলাম দেখেই যেখানে যা ছিল বোটিয়ে শিশি-বোতলওয়ালাকে বেচে দিয়েছে! শুনেছিস কখনো এমন কাণ্ড? দেখেছিস এমন চামার? আমিও তেমনি। দিয়েছি দূর করে! আর হোক দিকিনি এমুখো।… আয়, বসবি আয়।
না থাক, আজ যাই।
সে কি রে? এই এলি রোদ ভেঙে, বসবি না?
আর একদিন আসবো জ্যাঠামশাই-
হেঁট হয়ে প্ৰণাম করে বকুল জ্যাঠাকে।
জগু ব্যস্ত হয়ে সরে দাঁড়ান, থাক থাক। বুড়ী ঘুমোচ্ছে, দেখা হলো না।
বকুল বোধ হয় ভুলে আরো একবার প্রণাম করে জ্যাঠাকে, তারপর বলে, যাচ্ছি। তবে!
যাচ্ছিস! চল না হয় আমি একটু এগিয়ে দিই-
না না, দরকার নেই। আপনি বুড়োমানুষ এই রোদ্দুরে—
তবে যা, সাবধানে যাস।
আপনি বুড়োমানুষ-এই অপমান গায়ে মেখেও দাঁড়িয়েই থাকেন জগু দরজায়। শেকলটা টেনে দিয়ে বেরিয়ে পড়েন না। সঙ্গে সঙ্গে গটগট করে।
তার মানে বকুলের কথাই ঠিক। বুড়ো হয়ে গেছেন জগু।
বকুল রাস্তায় নামে।
হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বুঝি সেই দাঁত-খিচোনো ঘরটার উদ্দেশ্যেই মনে মনে একটা প্ৰণাম জানিয়ে মনে মনেই বলে, মা, মাগো! তোমার পুড়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া লেখা, না-লেখা সব আমি খুঁজে বার করবো, সব কথা আমি নতুন করে লিখবো। দিনের আলোর পৃথিবীকে জানিয়ে যাব অন্ধকারের বোবা যন্ত্রণার ইতিহাস।.
যদি সে পৃথিবী সেই ইতিহাস শুনতে না চায়, যদি অবজ্ঞার চোখে তাকায়, বুঝবো আলোটা তার আলো নয়, মিথ্যা জৌলুসের ছলনা! ঋণ-শোধের শিক্ষা হয় নি তার এখনো!
সামনের রাস্তা ধরে সোজা এগিয়ে যায় বকুল, পিছু পিছু আসা দেহরক্ষিণীটার কথা ভুলে গিয়ে!
–শেষ–