২.২৫ চলছিল গিরির আনাগোনা

হ্যাঁ, চলছিল গিরির আনাগোনা।

মাঝে মাঝেই কাপড়ের বোঁচকা নামিয়ে পা ছড়িয়ে বসে জল খেতে দেখা যায় তাকে এ বাড়িতে, পান চাইতে দেখা যায়। কাপড় না। গছিয়েও চলে যাচ্ছে, আবার আসছে।

গিরি এখনো যেমনটি ছিল যেন ঠিক তেমনটিই আছে।

সুবৰ্ণলতার চেহারায় কত ভাঙচুর হলো, সুবৰ্ণলতার স্বাস্থে্যু কতই ক্ষয় ধরলো, গিরি অটুট অক্ষয়। শুধু কাপড়ের মোটের মাপটা একটু গছাতে পারে না বলে, তা কে জানে! আজকাল যেন লোকের তাঁতিনীর কাছে কাপড় কেনার থেকে দোকানের ওপরই বেশি ঝোঁক।

তাই গিরি। আর মোটা আটপৌরের বোঝা বেশি বয়ে বেড়ায় না, বাছাই বাছাই জরিপোড়ে শান্তিপুরী, মিহি মিহি ফরাসডাঙ্গার আধুনিক ধরনের পাড়ের দু-চারখানি শাড়ি, এই নিয়ে বেরোয়।

আর এসেই বলে, শ বাজারের রাজবাড়িতে দিয়ে এলাম এককুড়ি শাড়ি, ওতোরপাড়ার রাজাদের বেয়াইবাড়িতে দিয়ে এলাম এককুড়ি সাতখানা শাড়ি, নাটোরের মহারাণীর বাপের বাড়িতে দুকুড়ি শাড়ির বরাত আছে, যেতে হবে সেখানে।

রাজবাড়ি ছাড়া কথা নেই। আজকাল গিরির মুখে। দিন গত হয়ে আসবার আভাস যত স্পষ্ট হয়ে উঠছে, ততই কি শুধু প্রচারের জোরে প্রতিষ্ঠা বজায় রাখবার চেষ্টা গিরির?

ঘটকালি তো গেছেই, এ ব্যবসাটাও যেন গেল গেল।

কিন্তু ঘটকালিটা কি একেবারে গেছে?

এ বাড়িতে তবে আজকাল কোন কাজে আনাগোনা তার? হ্যাঁ, সেই পুরনো ব্যবসাটাই আবার ঝালাতে বসেছে গিরি!

সুবৰ্ণলতার সেজ ছেলে মানুর জন্যে একটি কনের সন্ধান এনেছে।

মানুর বিয়ের বয়েস আগেই হয়েছিল, বছরের আড়াআড়ি পিঠোপিঠি ভাই তো ওরা–ভানু, কানু, মানু। তবে মানু কৃতী হয়ে বিদেশে চাকুরি করতে চলে যাওয়ার দরুন বিয়েটা পিছিয়ে গেছে। আর হয়তো বা সুবৰ্ণলতার অনাগ্রহেও গেছে।

নচেৎ মেয়ের বাপেদের তো মেয়ে নিয়ে ধরাধরির কামাই নেই।

সুবৰ্ণলতা বলে, ছেলে ছুটিতে বাড়ি আসুক, তখন কথা হবে। আজকাল ছেলেদের নিজের চোখে দেখে নেওয়া রেওয়াজ হয়েছে।

ইচ্ছে করে ছেলেকে এই বেহায়াপনা শিক্ষা দেবার ব্যাপারে বাড়ির কারুরই অনুমোদন নেই। যে দম্পতিযুগলের না দেখে বিয়ে হয়েছে, তারা সরবে বলে, কেন বাবা, আমরা কি ঘর করছি না?

তবু সুবর্ণ বলে, তা হোক। যে কালে যা ধর্ম!

ওই বলে বলে তো ছেলেটাকে বিদেশীযাত্রায় প্ররোচিত করলো সুবৰ্ণই। এই যে ছেলেটা ঘরবাড়ি ছেড়ে দিল্লীতে পড়ে আছে, তাতে কি খুব সুখ হচ্ছে তোমার? প্ৰবোধ কি আপত্তি করে নি? বলে নি কি এ বংশের কেউ কখনো ভাত ভাত করে দেশছাড়া হয় নি?

সুবৰ্ণ বলেছে, কখনো হয় নি বলে কখনো হবে না? তোমার ঠাকুদা প্র-ঠাকুদ্দারা তো কখনো গায়ে কাটা কাপড় তোলেন নি, পায়ে চামড়ার জুতো ঠেকান নি, তুমি মানছো সেই সব নিয়ম? নিয়ম জিনিসটা কি হিমালয় পাহাড় যে, সে নড়বে না?

অতএব মানু দিল্লীতে চলে গিয়েছিল।

ছুটিছাটায় যখন আসে, মানুকে আর এক বাড়ির ছেলের মত লাগে। বেআন্দাজী বেপরোয়া আর শৌখিন তো ছিলই চিরকাল। এদের এই সনাতনী বাড়ির প্রলেপ যেন আর রঞ্জিত রাখতে পারছে না তাকে।

সুবৰ্ণর এটায় যেন আলাদা সুখ।

বললে লোকে ছিছি করবে, তবু মাতৃস্নেহের মুখ রাখে না সুবৰ্ণলতা।

মানু বরাবর বাইরেই থাকুক, ওখানেই সংসার পাতুক, এই তার একান্ত ইচ্ছে।

তা সম্প্রতি মানুর চিঠি পড়ে মনে হয় যেন ওই সংসার পাতার ইচ্ছেটা উঁকি মারছে। রাধুনে ঠাকুরের হাতে যে খাওয়া-দাওয়া ভাল হচ্ছে না। এটা প্রায়শই জানাচ্ছে।

তবু সুবৰ্ণলতা ঔদাসীন্যের খোলস ত্যাগ করে বিয়ের তোড়জোড় করছিল না, হঠাৎ এই সময় গিরি একটি মেয়ের সন্ধান নিয়ে এসে ধরে বসলো।

একেবারে নেহাৎ গরীবের ঘর, অসহায় বিধবার মেয়ে, তবে মেয়ে পরমাসুন্দরী। মেজবৌমার দয়ার শরীর বলেই গিরি এখানে এসে পড়েছে।

গরীবের ঘর!

অসহায়া বিধবার মেয়ে!

পরমাসুন্দরী!

এই তিনটে শব্দ যেন সুবৰ্ণকে কিঞ্চিৎ বিচলিত করে এনেছিল।

তারপরই গিরি শাড়ির ভাঁজ থেকে কনের একখানা ফটো বার করলে! বললো, এ ছবি তোমার ব্যাটাকে যদি পাঠিয়ে দাও দিও, মোট কথা গরীবের কন্যাদায়টা উদ্ধার করতেই হবে তোমায়।

সুবৰ্ণ ফটোখানা চোখের সামনে তুলে ধরলো, আর তন্মুহুর্তেই যেন আত্মসমর্পণ করে বসলো।

আহা কী নাম ভঙ্গী, কী নমনীয় মুখ, কী কোমর চাউনি! অথচ কেমন একটি দীপ্ত লাবণ্য! দেখলে বার বার দেখতে ইচ্ছে করে!

গিরি এদিকে কথা চালিয়ে যায়, মেয়ের পিসের বুঝি ফটক তোলার শখ, তাই কবে একখানা ফটিক তুলেছিল সেইটুকু সম্বল, নইলে গরীব বিধবার মেয়ে, কে কী করছে! বংশ খুব উঁচু  গো, তোমার মামার বাড়ির সঙ্গে কি যেন সুবাদ আছে!

আমার মামার বাড়ি?

সুবৰ্ণ যেন চমকে ওঠে।

সুবৰ্ণর আবার মামার বাড়ি কোথায়? এদের এই বাড়িটা ছাড়া সুবর্ণর আর কোথাও কোনো বাড়ি আছে নাকি? মাসীর বাড়ি, পিসির বাড়ি, দিদির বাড়ি, জেঠি-খুড়ীর বাড়ি, যা সব থাকে। লোকের? তাই মামার বাড়ি থাকবে?

সুবৰ্ণ স্নান হাসির সঙ্গে বলে, আমার আবার মামার বাড়ি! ভূতের আবার জন্মদিন!

গিরিও হাসে, আহা, তা উদিশ তারা না করলেও, ছিল তো একটা মামার বাড়ি? তুইফোঁড় তো নয়!

আমার তো নিজেকে তাই মনে হয়।

সুবৰ্ণ ছবিখানা আবার হাতে তুলে নেয়, দেখে নিরীক্ষণ করে।

গিরি আঁচল থেকে গুলের কোটো বার করে একটিপ দীতের খাজে রেখে বলে, তা তুমি খবরাখবর না রাখলেও তেনারা রাখে। এই মেয়ের যে দিদিমা তার সঙ্গে দেখা হলো। তিনিই বললো, তুমি পাত্তরের মাকে বোলো, আমি হচ্ছি। তাঁর মায়ের জ্ঞাতি পিসি। পিসি ভাইঝি আমরা একই বয়সী ছিলাম, গলায় গলায় ভাব ছিল। কি যেন ছাই নাম ছিলো তোমার মায়ের? বললো সেই নাম–

কিন্তু কাকে বলছে গিরি?

সুবৰ্ণ যে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে গেছে হঠাৎ।

তার মায়ের সমবয়সী পিসী?

গলায় গলায় ভাব ছিল?

কে সে? কী নাম তার?

সুবৰ্ণ যেন নিথর সমুদ্রে ড়ুবুরি নামাতে চেষ্টা করে! মার কাছে মার ছেলেবেলার গল্প শুনেছিল না?

নাম জানো তার—

আস্তে বলে।

গিরি দেখে ওষুধ ধরেছে!

গিরি। অতএব পান বার করে এবং পানটি খেয়ে একটু কালক্ষেপ করে বলে, জানি— নাম তো বললে বুড়ি। তোমার মায়ের পিসি হয় বললো, পুণ্যি পিসি না কি। বললো, ওই বললেই বোধ হয় বুঝতে পারবেন।

পুণ্য পিসি! পুণ্যি পিসি!

বিস্মৃতির কোন অতল থেকে ভেসে উঠল এ নাম? একখানি উজ্জ্বল হাসি হাসি মুখ থেকে ঝরে পড়তো না। এই নামটি?

আমি আর পুণ্য পিসি, এই দুটিতে ছিলাম একেবারে দুষ্টুমির রাজা!… একদিন আমি আর পুণ্যি পিসি, হিহি হি, দুজনে পাল্লা দিয়ে এমন সাতার কাটলাম যে ফিরে এসেই সঙ্গে সঙ্গে কথামুড়ি দিয়ে তেড়ে জ্বর!… পুণ্যি পিসি ছিল এদিকে ভারি ভীতু—

সুবৰ্ণ চোখ তুলে বলে, উনি মেয়ের কে হন বললে?

দিদিমা গো! খোদ মায়ের মা! অবস্থা একদা উঁচু  ছিল, ভগবানের মারে পড়ে গেছে সে অবস্থা—

সুবৰ্ণ স্থির গলায় বলে, তুমি এখানেই কথা কও গিরি ঠাকুরবি, এই মেয়েই আমি নেব।

এই মেয়েই আমি নেব।

এই মেয়েই আমি নেব।

যেন যপের মন্ত্ৰ!

এই ছবির মুখে যেন কী এক শান্তির আশ্বাস পেয়েছে সুবর্ণ।

এই ছবির মুখে কি সুবর্ণর মার মুখের আদল আছে?

কিন্তু কেন তা থাকতে যাবে?

কোনো যুক্তি নেই, তবু সুবৰ্ণর মনে হতে থাকে, এই মেয়ের মধ্যে তার মার মাধুরী মাখানো আছে। আছে সুরে সুরে সাদৃশ্য। এই যোগসূত্র কে এনে ধরে দিল? নিশ্চয়ই ভগবান! সুবর্ণ নিজে তো যায় নি খুঁজতে?

তবে?

এ ভগবানের খেলা!

সুবৰ্ণর ভয়ানক শূন্যতার দিকটায় বুঝি পূর্ণতার প্রলেপ দিতে চান তিনি এতদিনে!

ছবিখানা মানুর কাছে পাঠিয়ে দিতে হলে— হয় স্বামীকে, নয় পুত্তুরদের জানাতে হবে। সুবর্ণ তো আর পার্শেল করতে যাবে না? আগের মত দিন থাকলে সুনিৰ্মলকেই বলতো। কিন্তু ওই পড়া আর পড়ানো নিয়ে এমন বিশ্ৰী একটা আবহাওয়া হয়ে গিয়েছে যে, তেমন সচ্ছন্দে আর ডেকে কাজ বলা যায় না।

অথচ এখুনি এই ছবির খবরটা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কাউকে। এ যেন সুবর্ণর নিজস্ব গোপন ভারি দামী একটি সম্পত্তি।

একখানি মিষ্টি মুখ, এত প্রভাবিত করতে পারে মানুষকে?

আমিই এই—, মনে মনে একটু হাসে সুবৰ্ণ, তবে আর ভবিষ্যতে আমার ছেলেকে দোষ দেওয়া চলবে না। সে তো আত্মহারা হয়েই বসবে। ফটো আর পাঠিয়ে কাজ নেই, মূৰ্ছা যাবে।

ফটোটা পাঠাল না। সুবর্ণ, এমনি একটা চিঠি লিখলে ছেলেকে।

তাতে জানালো, সে মেয়ে অপছন্দ হবার নয়, দেখলেই বুঝবে মার নজরটি কেমন। এক দেখায় বলা যায় পরমা সুন্দরী মেয়ে, তাই আর কালবিলম্ব না করে কথা দিয়ে দিয়েছি। তুমি পত্রপাঠ ছুটির দরখাস্ত করবে। গরীব বিধবার মেয়ে, বয়েসও হয়েছে, তারা একান্তই ব্যস্ত হয়েছে।

 

আবার সেই বাডির কর্তাকে বাদ দিয়ে, বড় বড় ছেলেদের উপেক্ষা করে কথা দেওয়া!

শিক্ষা আর সুবর্ণর হবে না!

তা মাস্টার রাখা এবং কলেরা কাণ্ডের পর থেকে সুবৰ্ণকে যেন সবাই ভয় করতে শুরু করেছে।

 

ভক্তি নয়, হয়!

চৈতন্য হয়ে সমঝো যাওয়া নয়, রাগে গুম হয়ে থাকা। অতএব এই কথা দেওয়া নিয়ে আড়ালে যতই সমালোচনা চলুক, সামনে কেউ কিছু বলে না।

তবে সুবর্ণ যদি বলে সে— গিরির সঙ্গে একবার ওদের বাড়ি যাই না? তাতেও চুপ করে থাকবে মানুষ?

বিরক্ত প্ৰবোধ না বলে পারে না, ওদের বাড়ি যাবে তুমি? ছেলের মা ছুটবে মেয়ের মার পায়ে তেল দিতে?

পায় তেল দিতে আবার কি? সুবর্ণ বলে, শুনলে তো বাড়িতে পুরুষ অভিভাবক তেমন নেই, মা আর দিদিমা। তা দিদিমা তো আমার থেকে সম্পর্কে বড়, গুরুজন, যেতে দোষের কি আছে?

বলে এ কথা সুবর্ণ।

দোষের কিছু দেখে না সে।

কিন্তু কেউ যদি কেবলমাত্র নিজের দৃষ্টিভঙ্গী দিয়েই দোষ-গুণের বিচার করে, সেটা তো সংসারসুন্ধু লোকে মানতে পারে না?

সুবৰ্ণ যদি ছেলের মা হয়েও হ্যাংলার মত মেয়ের বাড়িতে যায়, তারা তো একথাও ভাবতে পারে, নিৰ্ঘাত ছেলের কিছু গলদ আছে, নচেৎ এত গরজ কিসের?

কথাটা উড়িয়ে দেবার নয়। বুনো সংসারী লোকেরা তো এই ভাবেই ভাবতে অভ্যস্ত। যেখানেই দেখবে চুলচেরা হিসেবের বাইরে কিছু ঘটছে, সেখানেই ধরে নেবে নিশ্চয় কোথাও কোনো গলদ আছে, নচেৎ এমন বেহিসেবী কেন?

পাত্ৰপক্ষ সিংহাসনে আসীন থাকবে পাত্রীপক্ষ জুতো শুকতলা ক্ষয়াবে, এই নিয়ম! এর বাইরে যেতে যেয়ে না। তুমি সুবর্ণ।

অতএব যাওয়া হয় না।

শুধু সুবর্ণ ভবিষ্যৎ বাংলার ছবিতে মেয়েদের জন্যে মড়ক প্রার্থনা করে, বাংলাদেশের মেয়েদের ওপর এমন কোনো মড়ক আসে না গো, যাতে দেশ মেয়েশুন্যি হয়ে যায়? তখন দেখি তোমরা মহানুভব পুরুষসমাজ কোন সিংহাসনে বসে ক্রীতদাসী সংগ্ৰহ কর? এ অহঙ্কার ফুরোবে তোমাদের। তোমাদেরই জুতো শুকতলা ক্ষয়াতে হবে, এই আমি অভিশাপ দিচ্ছি। নিজ মনে এই ভয়ানক কথা উচ্চারণ করে সুবর্ণ বলে, হে মোর দুর্ভাগা দেশ যাদের করেছ অপমান-

তবু এই বিয়ে উপলক্ষে আবার যেন ঝেড়ে উঠছে সুবর্ণ। আশ্চর্য, কোথায় লুকনো আছে তার এই অদম্য প্রাণশক্তি যে শতবার ভেঙে লুটিয়ে পড়ে পড়েও আবার ওঠে খাঁড়া হয়ে?

কতবারই তো মনে হয়। এইবার বুঝি ফুরিয়ে গেল সুবৰ্ণলতা, আবার দেখা যায়, আরো এ যে আবার জীবন্ত মানুষের ভূমিকা নিয়েছে!

বকুলের বুড়ো মাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে তো দিব্বি কথাবার্তা শুরু করে দিয়ে মেয়ের পড়ার তত্ত্ববার্তা নিচ্ছিল, আবার তাকে ধরেই আলাদা এক অঙ্কর মাস্টার রাখিয়েছে, বছরের মধ্যেই মেয়েকে এস্ট্রেস একজামিন দেওয়াবে বলে।

ভানু আর ভানুর বৌ হাসে আড়ালে।

বলে, মা তার ছোট কন্যাটিকে গাগী মৈত্ৰেয়ী লীলাবতী না করে ছাড়বেন না!

কানু আর কানুর বৌ হাসে আর বলে, এ হচ্ছে সেই দাদার বন্ধুর বোনের ওপর আক্রোশ!

আর কানুর বৌ আর ভানুর বৌ বলে, মার দেখছি মন্ত্রের সাধন শরীর পাতন। মেয়েকে জলপানি না নিইয়ে ছাড়বেন না। তবে কিনা কথায় আছে, হিংসেয় সব করতে পারে— বাঁজা পুত বিয়োতে নারে। মগজে ঘি থাকলে তবে তো জলপানি!

ধরে নেয় নেই ঘি।

কিন্তু ওরাই কি পরম পাপে পাপী? সংসার তো এই নিয়মেই চলে।

বহির্দৃশ্য নিয়েই তো তার কারবার। কে কি করছে, সেটাই দেখে লোকে। কেন করছে তা কি অত দেখতে যায়? দেখতে যায় না, তাই নিজেদের হিসেব অনুযায়ী একটা কারণ নির্ণয় করে নিয়ে সমালোচনার স্রোত বহায়!

সুবৰ্ণর এই ব্যবহারটা হিংসুটে মনের আক্রোশের মতই তো দেখাচ্ছিল।

আবার মানুর বিয়েতে বেশি উৎসাহ দেখলেও নিৰ্ঘাত লোকে বলবে, বেশি রোজগেরে আর দূরে-থাকা ছেলে কিনা! জগতের রীতিই তো বাইরের জামাই মধুসূদন ঘরের জামাই মোধো।

এ ছেলে বাইরে আছে, নগদ টাকা পাঠাচ্ছে, অতএব মানু দামী ছেলে।

তবে দামী বৌ হচ্ছে না। এই যা।

এ কথা জনে জনে বলছে।

চাঁপা তো গাড়িভাড়া করে এসে বলে গেল, রূপ নিয়ে কি ধুয়ে জল খাবে মা? মেয়ে তো শুনছি ডোমের চুপড়ি-ধোয়া! মানুর মতন দামী ছেলেকে তুমি কানাকড়িতে বিকিয়ে দেবে? অথচ আমার পিসশ্বশুর অত সাধ্যসাধনা করলেন, তখন গা করলে না তুমি। উনি মেয়েকে মেয়ের ওজনে সোনা দিতেন, তার ওপর খাট-বিছানা, আশি, আলনা, ছেলের সোনার ঘড়ি, ঘড়ির চেন, হীরের আংটি, সোনার বোতাম–

সুবৰ্ণ হঠাৎ খুব জোরে হেসে উঠেছিল।

বলেছিল, তা হলে তো স্যাকরার দোকানের সঙ্গে বিয়ে দিলে আরো ভালো হয় রে চাপা!

চাঁপার ওই জমিদার পিসশ্বশুর সম্পর্কে সমীহর শেষ নেই, তাই চাপা রাগ করে উঠে যায়।

সুবৰ্ণ ভাবে, জঞ্জালের বোঝাকে এত বেশি মূল্য দেয় কেন মানুষ? সুবর্ণ ভাবে চাপাটা চিরকেলে মুখু!

তা হয়তো সত্যি। মুখ্যু চাপা মুখ্যুর মত কথা বলেছে।

 

কিন্তু মানু?

মানু তো মুখ্যু নয়?

মানু তো বিদ্যের জোরেই তিন-তিনশো টাকা মাইনের চাকরি করছে।

সে তবে এমন চিঠি লেখে কেন?

মানুর চিঠির ভাষা কৌতুকের। তবে বক্তব্যটা অভিন্ন। সেও বলেছে, এযুগে রূপের চেয়ে রূপোর আদর বেশি। তা ছাড়া হাড়দুঃখী বিধবার মেয়ে বিয়ে করে চিরকাল যে তাদের টানতে হবে। তাতে সন্দেহ নাস্তি। কাজ কি বাবা অন্ত ঝামেলায়। বরং নিজেরই এখন নগদ কিছু টাকা হাতে পেলে ভাল হয় তার। একটা ভাল চাকরির সন্ধান পেয়েছে, দিল্লী-সিমলের কাজ–ভবিষ্যতের আশা আছে, তবে নগদ পাঁচটি হাজাবি জমা দিতে হবে।

অতএব এই বিয়েটাকেই তাক করে আছে মানু ওই টাকার সুরাহার ব্যাপারে। তা সে সুরাহার মুখও একটু দেখা যাচ্ছে। বর্তমান অফিসের বড়কর্তার নাকি তাকে জামাই করে ফেলবার দারুণ ইচ্ছে এবং সেই ইচ্ছের খাতে ওই টাকাটি দিতে পারেন। অবশ্য বিয়ের আনুষঙ্গিক দান-সামগ্ৰী, বরাভরণ, মেয়ের গহনা ইত্যাদিতে কিছু ঘাটতি হতে পারে, কিন্তু কি লাভ কতগুলো জঞ্জালের স্তূপে?

জঞ্জালের স্তপ!

তো বলেছে তার ছেলে, তবে আর আমন সাপে-খাওয়ার মত স্তব্ধ হবার কি আছে সুবৰ্ণলতার?

ছুটি নিয়ে এল মানু বিয়ে করতে। বড়কর্তার স্ত্রীপুত্র পরিবার সবই কলকাতায়। সত্যিই তাঁয়া জঞ্জালটা বেশি দিলেন না। তবে ঘটা-পটার ত্রুটি হলো না। এ পক্ষেও হলো না। বড়লোকের বাড়ি বিয়ে হচ্ছে বলে মানরক্ষার ব্যাপারে তৎপর হলো মানুর বাপ-ভাই।

সানাই বাজলো তিন দিন ধরে, আলো জ্বললো অনেক, অ্যাসিটিলিন গ্যাসের লাইন চললো বরের সঙ্গে সঙ্গে, এদিকে ছাদ জুড়ে হোগলা ছাওয়া হলো, এটো গেলাস কলাপাতায় ফুটপাথ ভর্তি হয়ে গেল, কাকেরা আর কুকুরেরা সমারোহের ভোজ খেয়ে নিশ্চয় শতমুখে আশীৰ্বাদ করলো।

চাঁপা-চন্নন তো কাছের মেয়ে এলোই, দূরের মেয়ে পারুলও এলো।

আর মায়ের সঙ্গে প্রথম দেখা হতেই চমকে উঠলো। সে, এ কী চেহারা হয়েছে মা তোমার?

তারপর গল্পপ্রসঙ্গে বললো, বেশ করছে। ওকে লেখাপড়ায় এগোচ্ছে। বিদ্যোটা করে ফেলতে পারলে তবে তো এ প্রশ্ন তোলা যাবে–মেয়েমানুষই বা চাকরি করবে না কেন? মেয়েমানুষেরই বা চিরকুমারী থাকতে ইচ্ছে করলে সে ইচ্ছে পূরণ হবে না কেন? বলা যাবে–মেয়েদেরই বিয়ে না। হলে জাত যায়, পুরুষের যায় না, এ শাস্ত্ৰটা গড়লো কে?

তারপর বকুলের সঙ্গে একান্তে দেখা হলে হেসে বললে, প্রেমের ব্যাপারে কতদূর এগোলি?

বকুল বললো, আঃ সেজদি!

আঃ কেন বাবু! তবু একজনেরও যদি জীবনে কোন নতুন ঘটনা ঘটে, দেখে বাঁচি।

খুব কবিতা লিখছিস বুঝি আজকাল? বকুল অনেক দিন পরে সেজদিকে পেয়ে মনের দরজা খুলে যায় যেন তার। কতদিন একটু সরস কথার মুখ দেখে নি। তাই হেসে হেসে বলে, প্রেমের কবিতা? তাই এত ইয়ে—

পারুল একটু চুপ করে থাকে, তারপরে বলে, নাঃ, কবিতা আর লিখি না।

লিখিস না? মূর্তিমান কাব্যতেই একেবারে নিমগ্ন হয়ে আছিস?

তাই আছি।

পারুলের মুখে কৃষ্ণপক্ষের জ্যোৎস্নার মত একটা স্নান হাসির আভা।

এই শোন্য সেজদি, বেশি চালাকি করিস না, ইতিমধ্যে কটা খাতা ভরালি দেখবো। এনেছিস তো?

পারুল উড়িয়ে দেয় সে কথা। তারপর একসময় হেসে উঠে বলে, প্রেমের কবিতা বড় ভয়ানক বস্তু রে! ও লোকবিশেষকে জলবিছুটি দেয়। প্রেম ব্যতীত প্রেমের কবিতা এ তার বিশ্বাসের বাইরে।

হুঁ! বকুল আস্তে বলে তার মানে— উচ্চশিক্ষা জিনিসটা শুধু একটা শার্টকোটের মত! গায়ের ওপর চড়িয়ে বাহার দেবার!

পারুল একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, কি জানি, সর্বত্রই তাই, না কোথাও কোথাও সেটা অস্থিমজ্জায় গিয়ে মিশে চিত্তকে উচ্চে তোলে!

এই সত্যি, সেজ জামাইবাবু প্রেমের কবিতা দেখলে চটে?

চটে! উঁহু না তো,–পারুল হেসেই বলে, চটে না! শুধু বলে গুপ্ত প্ৰেম না থাকলে এত গভীর প্রেমের কবিতা আসতেই পারে না। পাতায় পাতায় এই যে তুমি আর তোমার জন্যে হাহাকার, তার লক্ষ্যস্থল যে হতভাগা আমি নয়, সে তো বুঝতেই পারা যাচ্ছে। তা এই প্রেম যখন আইবুড়ো বেলা থেকেই আছে, তখন আর এ হতভাগার গলায় মালা দেওয়া কেন?

চমৎকার! কবিরা সব প্রেমে পড়ে পড়ে। তবে—

থাক বকুল, ও কথা রাখ। তোর কথা বল এতদিন এখানে কি হলোটলো বল।

সে তো মহাভারত!

পারুল হাসে। পারুল তার ভেতরের সমস্ত বিক্ষোভকে নিজের মধ্যে সংযত রেখে স্থির থাকবে, এই বুঝি পারুলের পণ! অভিমানের কাছে সব পরম কে বলি দেবে এই বুঝি ওর জীবন-দর্শন!

তাই পারুল সব কিছুকে চাপা দিয়ে বলে, তবে তো হাতে সুপুরি হতুকি নিয়ে বসতে হয় রে। মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস ভনে শুনে পুণ্যবান।

 

তা যে যেভাবেই হোক, এ বিয়েটার উপলক্ষে আমোদ-আহ্লাদটা করলো খুব, নববিবাহিত মানু একদিন নিজের পয়সা খরচ করে সবাইকে নতুন একটা জিনিস দেখালো, বাংলা বায়োস্কোপ!

চন্নন একদিন নতুন বৌয়ের ছুতোয় গুষ্টিবৰ্গ সবাইকে নেমস্তন্ন করলো। শুধু সব কিছু আহ্লাদ থেকে বঞ্চিত থাকলো সুবর্ণ। সুবৰ্ণকে আবার ঘুষযুষে জ্বরে ধরেছে।

আর বকুল কোনো আমোদেতে যোগ দেয় না। তার স্বভাবগত কুনোমিতে।

তবু সুবর্ণর যে মনে হয়, অসুস্থ মা একা বাড়িতে পড়ে থাকবে এটা অনুমোদন করছে না বলেই বকুলের এতটা কুনোমি। নইলে সেজদি পারুলের সঙ্গে তো আছে হৃদ্যতা।

বায়োস্কোপ দেখতে, নেমন্তন্ন খেতে দুদিনই মায় প্ৰবোধ সবাই বেরিয়ে যায়। সুবর্ণ ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকে, যেন দেওয়ালে কত কি লেখা আছে, পড়ছে সেই সব।

সুবৰ্ণর ছোট ছেলে সুবল কোথায় থাকে বোঝা যায় না, শুধু হঠাৎ এক এক বার এসে ঘরের মাঝখানে স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে পড়ে আস্তে বলে, ওষুদ-টষুধ কিছু খাবার ছিল নাকি? নয়তো বলে, বলছিলে নাকি কিছু? অথবা বলে, খাবার রেখে গেছেন ওঁরা?… জল আছে?

তোমার খাবার— এ স্পষ্ট করে বলে না। শুধু খাবার।

তবু মায়ের জন্যে যে উৎকণ্ঠিত সে, এটা বোঝা যায়।

কিন্তু সুবর্ণর এই ছোট ছেলে যদি এসে বিছানার ধারে বসে পড়ে বলতো, মা, তোমার কি বেশী জ্বর এল নাকি?… কিংবা নীরবে কপালে হাতটা রেখে অনুভব করতে চেষ্টা করতো উত্তাপের মাত্ৰাটা কতখানি?

হয়তো সুবৰ্ণ বেঁচে যেত।

তা সে করে না।

শুধু মার ধারে-কাছে কোথায় যেন তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, একটু কাশির শব্দ পেলেই দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। হয়তো ওর ইচ্ছে হয়, মার বিছানার ধারে বসে মার গায়ে হাত রাখে, অনভ্যাসের বশে পারে না। তাই শুধু তার চোখে-মুখে এতটা বিপন্ন উৎকণ্ঠার ভাব ফুটে ওঠে।

দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকলেও সুবর্ণ অনুভব করতে পারে সেই মুখচ্ছবি। তবু সুবৰ্ণও তো বলে না, আয় না। সুবল, আমার কাছে এসে একটু বোস না।

বলে না নয়, বলতে পারে না।

সুবৰ্ণর সমস্ত অন্তরাত্মা বলবার জন্য আকুল হয়ে ওঠে। তবু বোবা হয়ে থাকে বাকযন্ত্র। যেন ক্ষুধিত তৃষ্ণার্তা সুবর্ণর হাতেই মজুত রয়েছে তার ক্ষুধার খাদ্য, তৃষ্ণার জল, কিন্তু রয়েছে একটা সীল করা বাক্সে, আর সেই সীল ভেঙে ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটাবার ক্ষমতা সুবর্ণর নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *