২.০৬-১০ আইভানোভিচ রোজ সময়মত

২.০৬

আইভানোভিচ রোজ সময়মত আফিস থেকে ফেরে। সেদিন সে অনেকটা দেরি করে ফিরলো—আর ফিরলে এক গরম খবর নিয়ে, কোন একজন মজুর-কয়েদী জেল পালিয়েছে, কে তা জানা যায়নি এখনো।

মার প্রাণ যেন আশায় উত্তেজিত হয়ে উঠলো, কিন্তু কণ্ঠকে জোর করে সংযত করে বললেন, হয়তো পেভেল।

আইভানোভিচ বললো, খুব সম্ভব। আমি রাস্তায় বেড়াচ্ছিলুম দেখতে পাই কি না—বোকামি আর কাকে বলে! না, আবার বেরুচ্ছি।

মা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমিও যাচ্ছি।

হাঁ, তুমি ইয়েগরের কাছে গিয়ে দেখো, সে কিছু জানে কি না।

মা বেশ জোর পায় ইয়েগরের বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে যাচ্ছেন, হঠাৎ দুয়োরের দিকে চেয়ে চোখ তার বিস্ফারিত হল…নিকোলাই না? ঐ তো গেটের কাছে পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে! কিন্তু…না, কেউ তো নেই? তবে কি চোখের ধাঁধাঁ! সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে আবার থমকে দাঁড়ালেন…মৃদু সন্তৰ্পিত পদশব্দ কিন্তু আবার নিচে চেয়েই মা চীৎকার করে উঠলেন, নিকোলাই, নিকোলাই,তারপরই ছুটলেন তার দিকে। নিকোলাই হাত নেড়ে অনুচ্চ কণ্ঠে বললো, যাও, যাও,–

মা যেমন নেবেছিলেন, তেমনি উঠে গিয়ে ইয়েগরের ঘরে ঢুকে ফিসফাস করে বললেন, জেল পালিয়েছে নিকোলাই।

ইয়েগ হেসে বললো, তোফা। কিন্তু উঠে সম্বর্ধনা করবে এমন শক্তি তো আমার নেই।

বলতে না বলতে পলাতক নিজেই ঘরে এসে ঢুকে দোর বন্ধ করে হাসি মুখে দাঁড়ালো। ইয়েগর বললে, বস ভাই।

নিকোলাই নিঃশব্দে হাসিমুখে মার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার হাত চেপে ধরে বললো, ভাগ্যিস তোমায় দেখলুম, মা। নইলে জেলেই আবার ফিরতুম। শহরের কাউকে আমি চিনিনে; তাই খালি ভাবছিলুম, কেন পালালুম? এমন সময় তোমার সঙ্গে দেখা।

কেমন করে পালালে?

সোফার একপাশে বসে ইয়েগরের হাতে হাত দিয়ে নিকোলাই তার পলায়নকাহিনী ব্যক্ত করে গেলো। ওভারশিয়ারদের ধরে কয়েদীরা ঠ্যাঙাতে শুরু করে…পাগলা-ঘন্টি বেজে ওঠে…গেট খুলে যায়, এই ফাঁকে সে পালায়…তারপর ছন্নছাড়া হয়ে ঘুরে বেড়ায় একটা লুকোবার হান আবিষ্কার করার জন্য।

পেভেল কেমন আছে?

ভালোই আছে। আমাদের একজন মাতব্বর সে…কর্তাদের সঙ্গে বাদানুবাদ করে…আর সবাই তাকে মানে।…কি খাবো? ভয়ানক ক্ষুধা পেয়েছে।

ইয়োর বললো, সেলফের ওপর রুটি আছে, ওকে দাও। তারপর বাঁ পাশের ঘরটায় গিয়ে লিউদমিলাকে ডেকে বল, খাবার নিয়ে আসুক। মা গিয়ে ডাকতেই লিউদমিলা বেরিয়ে এসে জিগ্যেস করলো, কি? অবস্থা খারাপ নাকি?

না, খাবার চাইছে।

চলো–খাবার সময় হয়নি এখনো।

দু’জনে ইয়েগরের ঘরে গিয়ে দাঁড়াতেই ইরেগর বললো, লিউদমিলা ভ্যাসিলিয়েম, ইনি কর্তাদের হুকুম না নিয়ে জেল থেকে চলে এসেছেন–পয়লা একে কিছু খেতে দাও, তারপর, একে দিন-দু’তিন লুকিয়ে রাখো।

লিউদ্‌মিলা মাথা নেড়ে রোগীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বললো, তা রাখছি কিন্তু মুখটা থামাও দেখি, ইয়েগর। জানো, এ তোমার পক্ষে ক্ষতিকর! ওরা আসামাত্র আমায় খবর দেওয়া উচিত ছিল। আর দেখছি ওষুধও খাওনি—এসব গাফেলি করার মানে কি? ওষুধ এক ডোজ খেলে একটু আরাম বোধ কর, এতো তুমি নিজেই বলো তোমরা আমার ঘরে এসো…এ হাসপাতালে যাবে।

ইয়ের বললো, হাসপাতালে না পাঠিয়ে ছাড়বে না তাহলে?

আমিও যাবো তোমার সঙ্গে।

অর্থাৎ হাসপাতালে গিয়েও তোমার হাত থেকে নিস্তার নেই।

বোকোনা বলছি।

তারপর ইয়েগরের বুকে কম্বলটা টেনে দিয়ে শিশিতে ওষুধ কতটা আছে দেখে মার দিকে ফিরে বললো, আমি চললুম একে নিয়ে। তুমি ইয়েগরকে এক দাগ ওষুধ দিয়ো…কথা বলতে দিয়ো না।

তারা চলে যেতেই ইয়েগর বললো, চমৎকার মহিলাটি। ওর সঙ্গে যদি কাজ করতে, মা! ওই আমাদের কাগজপত্র সব ছাপিয়ে দেয়।

চুপ, ওষুধ খাও।–

ইয়ের ঢক ঢক করে ওষুধ গিলে বললো, মরব ঠিকই, মা, কথা না বললেও। আর তার জন্য কুচপোয়া নেই…বাঁচার আনন্দের সঙ্গে মরার বাধ্যবাধকতা থাকবেই।

কথা কয়োনা।

কথা কবো না? বলল কি, মা। চুপ করে থেকে লাভ? মাত্র কয়েক সেকেণ্ড বেশি বেঁচে থাকবো…বেশি দুঃখ সইবো। আর হারাববা সুলোকের সঙ্গে কথা কইবার আনন্দ। পরলোকে কি আর এমন কথা কইবার লোক খুঁজে পাবো, মা!

চুপ কর, ঐ মহিলাটি এসে এর জন্য আমায় বকবেন।

মা, ও আমাদের দলেরই একটি কর্মী। বকবে ও তোমায় নিশ্চয়ই। কারণ বকা ওর অভ্যাস।

লিউদমিলা এসে ঘরে ঢুকে দোর ভেজিয়ে বললো, নিকোলাইর পোশাক বদলে এক্ষুণি এস্থান ত্যাগ করা দরকার। এক্ষুণি গিয়ে পোশাক নিয়ে এসো।

মা কাজ পেয়ে খুশি হয়ে পথে বেরোলেন। তারপর ধারে-কাছে স্পাই আছে কিনা ভালো করে দেখে নিয়ে গাড়ি করে বাজারে গেলেন। পলাতকের পোশাক বদলি করার জন্য কেউ কাপড় কিনতে আসে কিনা তা লক্ষ্য করার জন্যই পাই ঘুরছিল বাজারে। মা তাদের চোখে খুলি দিয়ে পোশাক কিনলেন, আর কেবল বগর-বগর করতে লাগলেন…এমন লোক নিয়েও পড়েছি, খালি মদ, খালি মদ …আর মাস গেলেই এক-এক সুট পোশক। পুলিস ভাবলো, ওর মাতাল স্বামীর জন্য পোশাক কিনে নিয়ে যাচ্ছে।

পোশাক এনে নিকোলাইর ভেল বদলে তাকে নিয়ে মা আবার বাস্তায় বেরুলেন। তারপর তাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরে চললেন।

পথে খবর পেলেন ইয়েগরকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। অবস্থা সংকটাপন্ন। তার যাওয়া দরকার। মা তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে শুনলেন, ইয়েগর ডাক্তারকে বলছে, আরোগ্য হচ্ছে এক রকম সংস্কার! নয় কি, ডাক্তার?

ডাক্তার গম্ভীব কণ্ঠে বললো, বাজে বোকোনা।

ইয়ের বললো, কিন্তু আমি বিপ্লবী…আমি সংস্কারকে ঘৃণা করি।

মা দেখলেন, ডাক্তারও তাদেরই একজন সহকর্মী। তার সঙ্গে আলাপ হল।

ইয়েগরকে আধা-শোয়া অবস্থায় রাখা হয়েছিল। এবার সে বলে উঠলো, ও, বিজ্ঞান…আর পারিনে–একটু শুই, ডাক্তার?

না।

তুমি গেলেই শোবো।

ডাক্তার মাকে বললো, দিয়োনা যেন শুতে। শুলে ওর ক্ষতি হবে।

ডাক্তার চলে যেতে ইয়োর ধীরে ধীরে চোখ না খুলে বলে যেতে লাগলো, মরণ যেন আমার দিকে এগোচ্ছে আস্তে আস্তে-অনিচ্ছার সঙ্গে আমার জন্য যেন ওর দরদ জাগছে…আহা এমন সুন্দর অমায়িক লোক তুমি…

চুপ করো, ইয়েগর।

একটু সবুর কর, মা, শীগগিরই চুপ করবো, চিরদিনের মতো চুপ করবো।

তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তবু ধীরে ধীরে, একটু একটু করে বলতে লাগলো সে,তোমার সঙ্গ চমৎকার লাগছে, মা তোমার চোখ, তোমার মুখ, তোমার ভাবভঙ্গি অতি সুন্দর কিন্তু এর পরিণাম?– অন্তরকে প্রশ্ন করি।ভাবতে দুঃখ লাগে—কারাগার, নির্বাসন, নিষ্ঠুর অত্যাচার অন্যান্য সবাইর মতো তোমারও অপেক্ষা করছে।…মা, তুমি কারাগারকে ভয় কর?

না।

কর না? কিন্তু কারাগার সত্যিই নরক। এই কারাগারই আমায় মরণ-আঘাত দিয়েছে, মা।…সত্যি কথা বলতে কি, আমি মরতে চাইনে, মা—আমি মরতে চাইনে।

মা সান্ত্বনা দিতে গেলেন, এখনই মরার কি হয়েছে। কিন্তু ইয়েগরের মুখের দিকে চেয়ে কথাগুলো যেন জমে গেলে মুখে।

ইয়েগর বলতে লাগলো, অসুখ না হলে আজও কাজ করতে পারতুম। কাজ যার নেই… জীবন তার লক্ষ্যহীন বিড়ম্বনা।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যার আঁধার ছেয়ে এলো। মা কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পরে দুয়োর বন্ধ করার মৃদু শব্দে জেগে উঠে বললেন কোমলকণ্ঠে, ঐ যা, ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। মাপ করো।

ইয়েগরও তেমনি কোমল কণ্ঠে জবাব দিলো, তুমিও মাপ কোরো।

হঠাৎ তীব্র আলো ফুটে উঠলে ঘরে—লিউদমিলা এসে দাঁড়িয়েছে, ঘরে, বলছে, ব্যাপার কি?

মার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে জবাব দিলো ইয়েগর, চুপ।

মুখ হা করে খুলে মাথা উঁচু করলো সে। মা তার মাথাটা ধরে মুখের দিকে চাইলেন। সে মাথাটা সজোরে ছিটকে নিয়ে বলে উঠলো, বাতা:বাতাস। তার শরীর থর থর করে কেঁপে উঠলো, মাথাটা ভেঙে পড়লো কাঁধের ওপর। উন্মুক্ত চোখের মধ্যে প্রতিফলিত হল দীপের শুভ্র শিখা। মা চেঁচিয়ে উঠলেন, ইয়েগর, বাপ আমার!

লিউদমিলা জানালার কাছে গিয়ে শুন্যের দিকে চেয়ে বললো, আর কাকে ডাকছো, মা!

মা নুয়ে পড়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।

.

২.০৭

তারপর ইয়েগরকে বালিশের ওপর শুইয়ে দিয়ে, তার হাত দু’খানা ভেঙে বুকের ওপর রেখে মা লিউদমিলার কাছে এসে তার ঘন চুলে হাত বুলোতে লাগলেন। লিউদমিলা কম্পিতকণ্ঠে ধীরে ধীরে বলতে লাগলো…অনেকদিন ধরে জানতুম ওকে। একসঙ্গে নির্বাসনে ছিলুম, এক সঙ্গে হেঁটেছি একসঙ্গে কারাবাস করেছি। মাঝে মাঝে বিপদ এসেছে, দুঃখ এসেছে, বহু লোক হতাশ হয়ে পড়েছে, কিন্তু ইয়েগরের আনন্দের কমতি ছিল না কখনো। হাসি-কৌতুকের প্রলেপ দিয়ে সে বেদনাকে ঢাকতো–দুর্বলকে বল দিতো। সাইবেরিয়ায় অলস জীবন যেখানে মানুষকে করে তোলে নিজের ওপর বিতৃষ্ণ,… সেখানেও সে ছিল দুঃখজয়ী… যদি জানতে কতবড় সঙ্গী ছিল সে! নির্যাতন অনেক সয়েছে, কিন্তু কেউ কখনো অভিযোগ করতে শোনেনি তাকে। আমি তার কাছে বহুঋণে ঋণী—তার মনের কাছে ঋণী…তার অন্তরের কাছে ঋণী। বন্ধু … সঙ্গী…প্রিয় আমার…বিদায় বিদায় তোমার চিহ্নিত পথে চলবে আমি…সন্দেহে না টলে…সমস্ত জীবন…বিদায় বন্ধু, বিদায়!

লিউদমিলা মৃতের পায় মাথা লুটিয়ে দিলে।

পরদিন অন্ত্যেষ্টির আয়োজন হ’ল। আইভানোভিচ, শোফি, মা চায়ের টেবিলে বসে গম্ভীরভাবে ইয়েগরের কথা আলোচনা করছেন।

হঠাৎ আবির্ভূত হল শশেংকা, অন্ধকারের বুকে একটা দীপ্ত মশালের মতো। আনন্দ-উজ্জ্বল তার মুর্তি।

ইয়েগরের মৃত্যুর কথা সে জানেনা। এইদিন তার এই আনন্দকে অন্যায় মনে করে সবাই বেশ একটু বিরক্ত হয়ে বললো, আমরা ইয়েগরের কথা বলছিলাম।…

শশেংকা বললো, ইয়েগর?…চমৎকার লোক। নয়? বিনয়ী…নিঃসন্দিগ্ধ…দুঃখজয়ী চির-কৌতুকোচ্ছল…রসিক…সুকর্মী বিপ্লবচিত্র অঙ্কনে সিদ্ধহস্ত, বিদ্রোহ-দর্শন রচনায় সুক্ষ। কী সোজা সরল ভাষায় মিথ্যা এবং অত্যাচারকে সে জীবন্ত করে ফুটিয়ে তোলে …ভীষণের সঙ্গে কৌতুক মিশিয়ে কী অপূর্ব কৌশলে বাস্তবকে করে তোলে আরো ভীষণ, আরো হৃদয়গ্রাহী। আমি তার কাছে ঋণী। তার হাসিমুখ, তার কৌতুক, বিশেষ করে সন্দেহক্ষণে তার সেই আশ্বাসবাণী …তা আমি কখনো ভুলবোনা…আমি তাকে ভালবাসি।

শোফি বললো, সেই ইয়েগর আজ মৃত।

মৃত!..শশেংকা চমকে উঠলো। তারপর বললো, ইয়েগর মৃত…একথা আমার পক্ষে বিশ্বাস করা শক্ত।

আইভানোভিচ মৃদুহাস্যে বললো, কিন্তু এ সত্য কথা, সে মরেছে।

শশেংকা ঘরের এদিক-ওদিক পাইচারি করে হঠাৎ সোজা দাঁড়িয়ে আশ্চর্য এক সুরে বলে উঠলো, মরেছে অর্থ কি? কি মরেছে? ইয়েগরের ওপর আমার ভক্তি? তার প্রতি আমার প্রেম? আমার বন্ধুত্ব? তার প্রতিভা? তার বীরত্ব? তার কর্ম? মরেছে এই সব? মরেনি, মরতে পারে না। তার যত কিছু ভালো, আমি জানি, তা আমার কাছে কখনো মরবেনা! একটা মানুষকে মরেছে বলে বিদায় করে দিতে আমাদের একটুও দেরি হয় না—তাই আমরা এতো তাড়াতাড়ি ভুলে যাই যে মানুষ কখনো মরেনা, যদি না আমরা ইচ্ছে করে বিস্মৃত হই, তার মনুষ্যত্বের গৌণব, সত্য এবং সুখকল্পে তার আত্মত্যাগী চেষ্টা,ভুলে যাই, জীবন্ত যাদের প্রাণ তাদের মধ্যে সকল জিনিস সর্বকালে চিরজীবী হয়ে থাকে। চিরজীবী, চির-ভাস্বর আত্মাকে তার দেহের সঙ্গে সঙ্গে এতো তাড়াতাড়ি মাটিচাপা দিয়োনা, বন্ধু…

কথা প্রসঙ্গে পেভেলের কথা উঠলো। শশা বললো, সে সঙ্গীদের চিন্তাতেই সদা-বিব্রত। বলে কি জানো? সঙ্গীদের জেল-পালানোর বন্দোবস্ত করা দরকার এবং তা নাকি খুবই সোজা।

শোফি বললো, তুমি মনে কর, শশা, সত্যি সম্ভব এ?

মা চায়ের কাপ টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে কেঁপে উঠলেন। শশার মুখ বিবর্ণ, ঐ কুঞ্চিত হয়ে উঠলো। তারপর হেসে বললেন, পেভেল এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ—আর সে যা বলে তা যদি ঠিক হয়, তবে …চেষ্টা করা আমাদের উচিত, আমাদের কর্তব্য।

শ্রোতাদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। শশা বেশ একটু আহত হয়ে বললো, তোমরা ভাবছ, আমার এতে ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ আছে!

শোফি বললো, সে কি শশা?

পাংশুমুখে শশা বললো, হাঁ, তোমরা যদি এর বিবেচনা করার ভার নাও, তাহলে আমি কোনো কথা কইবো না।

আইভানোভিচ বললো, পালানো সম্ভব হলে সে সম্বন্ধে দু’মত থাকতে পারে না; কিন্তু সবার আগে আমাদের জানা চাই, বন্দী বন্ধুরা এ চান কিনা!

মা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, তারা কি মুক্তি চাইবেনা, এও কি সম্ভব?

আইভানোভিচ বললো, পরশু পেভেলের সঙ্গে দেখা করে একটা চিঠি দিয়ো…তাদের মত আমরা জানি আগে…

মা বললেন, তা পারবো।

শশা উঠে চলে গেলো ধীর মন্থর পদে…শুষ্ক চোখে।

মা কান্নার সুরে বলে উঠলেন, একটিবার, একটি দিনের জন্য যদি ওদের দু’হাত এক করতে পারতুম!

.

২.০৮

পরদিন ভোরে হাসপাতালের সামনে লোকে লোকারণ্য, মৃত বীরের শবদেহ শোভা যাত্রা করে নিয়ে যেতে এসেছে সবাই। জনতা নিরস্ত্র, আর তাদের মধ্যে শান্তিরক্ষা করতে এসেছে পুলিস রিভলবার, বন্দুক, সঙিন নিয়ে।

গেট খুলে গেলো…তারপর বেরিয়ে এলো শবাধার…ফুলের মালায় সাজানো…লাল ফিতা দিয়ে বাঁধা। সবাই নীরবে টুপি খুলে মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করলো, এমন সময় এক লম্বাপানা পুলিশ অফিসার একদল সৈন্য নিয়ে ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে শবাধারটি ঘিরে ফেলে হুকুম দিলেন, ফিতে সরিয়ে ফেল!

মৃতের প্রতি এই অসম্মানের সূচনায় জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। পুলিস অফিসারটি তা গ্রাহ না করে সুর চড়িয়ে হুকুম দিলেন, ইয়াকোলেভ, ফিতে কেটে ফেল।

হুকুমমাত্র ইয়াকোলেভ তরবারি কোষমুক্ত করে ফিতে কেটে ফেললো। জনতা নেকড়েদলের মতো গর্জন করে উঠলো। পুলিসের সঙ্গে মারামারি বাধে আর কি! নায়করা কোন মতে থামিয়ে রাখলো। লোকদের বললো, বন্ধুগণ, এখন আমাদের সব সয়ে যেতে হবে যে পর্যন্ত-না আমাদের দিন আসে!…

শোভাযাত্রা গোরস্থানে প্রবেশ করলো। সবাই নীরব, নিঃশব্দ। হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলে একটি যুবক, সদ্য-প্রস্তুত কবরের ওপর দাঁড়িয়ে সে শুরু করলো, সঙ্গিগণ!…

পুলিস অফিসারটি উচ্চৈঃস্বরে বললেন, পুলিস সাহেবের হুকুম, বক্তৃতা করা নিষেধ।

যুবকটি বললো, আমি মাত্র দু-চারটি কথা বলব। সঙ্গিগণ, আমাদের এই শিক্ষক এবং বন্ধুর কবরের ওপর দাঁড়িয়ে এস আজ আমরা নীরবে এই শপথ করি যে, আমরা এর অভিলাষ ভুলবো না, প্রত্যেকে অবিশ্রান্তভাবে খনন করতে থাকবো এই স্বেচ্ছাচারতন্ত্রের কবর, যে স্বেচ্ছাচারতন্ত্র আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশের দুশমন।…

পুলিস অফিসার হুকুম দিলেন, গ্রেপ্তার কর ওকে।

কিন্তু তার কণ্ঠস্বর ডুবে গেলো জনতার উন্মত্ত চিৎকারে, ‘স্বেচ্ছাচারতন্ত্র নিপাত যাক্‌’ ‘দীর্ঘজীবী হ’ক স্বাধীনতা’ ‘আমরা তার জন্য বাঁচব, তার জন্য প্রাণ দেব।’

তৎক্ষণাৎ পুলিস ঝাঁপিয়ে পড়লো অস্ত্র হাতে নিরস্ত্র জনতার ওপর। মাও সেখানে ছিলেন। দেখলেন, মার খেয়েও জনতা সেই বক্তা যুবকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেন ছিনিয়ে নেবে পুলিসের হাত থেকে। পুলিস তাকে ঘিরে রয়েছে…জনতার ওপর সঙিন চলছে, তলোয়ার চলছে, রক্তে গোরস্থান লাল হয়ে উঠেছে…যুবক তখন মিনতি করে বললো, ভাইসব, শান্ত হও, আমি বলছি, আমায় যেতে দাও।…

তার কথায় জন-সমুদ্র স্থির হয়ে দাঁড়ালো। তারপর এক-এক করে ছত্রভঙ্গ হয়ে চলে যেতে লাগলো। শোফি একটা আহত ছেলেকে এনে মার কাছে দিলো, বললো, শীগগির একে নিয়ে ভাগো এখান থেকে।ও

ছেলেটির নাম আইভান। মা আহত আইভানকে একটা গাড়ি করে বাড়িতে নিয়ে এলেন।

.

২.০৯

আগের সেই ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে আইভানের সেবা-শুশ্রষার রীতিমতো বন্দোবস্ত করে কর্মীরা কাজের কথা পাড়লো।

ডাক্তার বললো, প্রচারকার্য আমাদের খুবই কম চলছে। ওটা বেশ জোবে এবং ব্যাপকভাবে শুরু করা দরকার।

আইভানোভিচ সে কথায় সায় দিয়ে বললো, চাবদিক থেকেই বইয়ের তাগিদ আসছে, অথচ আজো একটা ভালো ছাপাখানা হল না আমাদের। লিউদমিলা খেটে খেটে মরছে- তাও একজন সাহায্যকারী দরকার।

শোফি বললো, কেন, নিকোলাই?

শহরে সে থাকতে পারবে না। নতুন ছাপাখানাটা হলে সেখানে সে ঢুকে পড়বে,-সেখানেও আর একজন লোক লাগবে।

মা বলে উঠলেন, আমি হলে চলে না?

শহরের বাইরে থাকতে হবে, মা, পেভেলের সঙ্গে দেখা করতে পারবে না এতো…তোমার কষ্ট হবে।

হক। আমি বাবো, রাধুনীর কাজ করবো।

শহরের উত্তেজনা আর ভালো লাগছিল না বলে মা এই কাজ বেছে নিলেন।

পরদিন জেলে ছেলের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। হাতের মুঠোয় ছিল ছোট করে ভাঁজ-করা চিঠি। হ্যাণ্ডসেক করার সময় পেভেলের হাতে তা খুঁজে দিলেন।

বাড়ি এসে শশার সঙ্গে দেখা। মার কাছে পেভেলের খবর নিয়ে শশা বলণে, তুমি কি মনে কর, মা, সে রাজি হবে?

জানিনে—হবে বোধহয়। বিপদই যদি না থাকে তো আর কি আপত্তি থাকতে পারে!

শশা, ধীর করুণ-কণ্ঠে বললো, আমি জানি, সে রাজি হবে না। তোমার কাছে মিনতি, মা—তাকে মত করিয়ে বলে, তাকে দরকার, তাকে নইলে কাজ চলবে না…তার আসা চাই-ই…

মা শশাকে কোলে টেনে বললেন, সে কি কারো কথা শোনে; মা?

ঠিক বলেছো, মা, শোনে না…চল রোগীকে খেতে দিইগে।

মা এসে আইভানের পাশে বসে গল্প জুড়ে দিলেন। আইভান মাকে চিনতো না। কথায় কথায় বললো, পেভেলের কথা শুনেছো? সে-ই সর্বপ্রথম আমাদের নিশান উড়িয়েছে প্রকাশ্যে—আর তার মা তিনিও আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন তারপর…অদ্ভুত রমণী তিনি।

মা একটু হাসলেন। বললেন, খাও দেখি আরো। যত তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাবে, তত তাড়াতাড়ি কাজে লাগতে পারবে। দেশ আজ চায় সবল হাত, শুদ্ধ হৃদয়, সাধু মন। …

সন্ধ্যার সময় শোফি বললো, একবার গ্রামে যেতে হবে, মা।

কেন বলোতো? কখন যেতে হবে?

কাল। গাড়ি করে ভিন্ন এক পথ দিয়ে যেয়ো। সেখানে খুব ধর-পাকড় হয়েছে। তবে রাইবিন যে পালাতে পেরেছে এটা এক রকম নিশ্চিত।…কিন্তু আমাদের থামলে চলবে না…নিষিদ্ধ পুস্তিকা ছড়িয়ে যেতেই হবে। পারবে? ভয় পাবেনা তো?

মা দস্তুরমতো আহত হয়ে বললেন, ও প্রশ্ন করো না, ভয় আর কিছুতেই পাইনে আমি। কিসের জন্যে পাবো? কি আছে আমার? একটি মাত্র ছেলে। তার জন্যই ছিল যত ভাবনা, যত ভয়। এখন আর কি।…

শোফি বললো, মাপ করো, মা। আর অমন কথা বলবো না কখনো।

.

২.১০

পরদিন প্রত্যুষে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে গাড়োয়ানের সঙ্গে কত কি কথা কইতে কইতে মা রওয়ানা হলেন গ্রামের দিকে। বিকালবেলা নিকোলস্ক পৌছুলেন।

নিকোলস্ক একটি গণ্ডগ্রাম। একটা সরাইয়ে ঢুকে মা চায়ের অর্ডার দিয়ে জানালার কাছে বেঞ্চিতে বসে বাইরে বাগানের দিকে চেয়ে রইলেন। বাগানের গায়েই টাউন-হল। তার সিঁড়ির ওপর বসে একজন চাষী ধূমপান করছে।

হঠাৎ গ্রামের সার্জেন্ট জোর ঘোড়া ছুটিয়ে টাউনহলের সামনে এসে উপস্থিত হল; তারপর হাতের চাবুকটা ঘুরিয়ে চেঁচিয়ে চাষীকে কি বললো। চাষী উঠে হাত বাড়িয়ে কি একটা দেখালো। সার্জেন্ট তৎক্ষণাৎ লাফ দিয়ে মাটিতে নাবলো, তারপর চাষীর হাতে ঘোড়ার লাগামটা দিয়েই টাউনহলের মধ্যে ঢুকে পড়লো।

আর কোন সাড়া-শব্দ পাওয়া গেলো না।

সরাইর একটি মেয়ে পরিচারিকা চাপ-প্লেট এনে টেবিলের ওপর রেখে সোৎসাহে বলে উঠলো, একটা চোর ধরেছে এইমাত্র। নিয়ে আসছে এখানে।

মা বললেন, সত্যি? কি রকম চোর বলতো?

জানিনে।

কি চুরি করেছিলো?

কে জানে? শুনলুম তাকে ধরেছে। চৌকিদার ছুটে পুলিস কমিশনারের কাছে গেলো।

মা জানালা দিয়ে চেয়ে দেখলেন, টাউনহলের সিঁড়ির ওপর চাষীরা জড়ো হচ্ছে দলে দলে …সবাই চুপ-চাপ। মা বইয়ের ব্যাগটা বেঞ্চির তলায় লুকিয়ে রেখে শালটা মাথায় জড়িয়ে সরাই থেকে বেরিয়ে সেখানে গিয়ে হাজির হলেন। সিঁড়ির ওপর উঠে দাঁড়াতেই তার শরীরের রক্ত যেন হিম হয়ে এলো… শ্বাস রুদ্ধ…পা অসাড়। বাগানের মাঝখানে রাইবিন, পিঠ-মোড়া করে হাত বাঁধা…দু’পাশে দু’জন পুলিস।

মা স্থান-কাল-পাত্রেব কথা বিস্মৃত হয়ে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন রাইবিনের দিকে। রাইবিন কি যেন বললো, কিন্তু তা মার কানে গেলে না! মার কাছেই দাঁড়িয়েছিল একজন চাষী…নীল তার চোখ…মা তাকে জিগ্যেস করলেন, কি হয়েছে?

ঐ তো দেখছে। একটি রমণী চীৎকার করে উঠলো, উঃ, কী ভীষণ দেখতে চোরটা!

রাইবিন মোটা গলায় বলে উঠলো, চাষী বন্ধুগণ, আমি চোর নই। আমি চুরি করিনে, আমি কারও ঘরদোরে আগুন লাগাইনে। আমি শুধু যুদ্ধ করি মিথ্যার বিরুদ্ধে। তাই ওরা আমাকে ধরেছে। তোমরা কি শোনোনি সে-সব বইয়ের কথা, যার মধ্যে আমাদের চাষীদের সম্বন্ধে সত্য কথা বলা হয়েছে? আমি তাই ছড়িয়েছি চাষীদের মধ্যে। তারই … জন্য আমার এ শাস্তি।

জনতা রাইবিনের দিকে চেপে দাঁড়ালো। রাইবিন উচ্চকণ্ঠে বললো, চাষীবন্ধুগণ, এই বইগুলোতে বিশ্বাস করে। এর জন্য আমায় হয়তো আজ প্রাণ দিতে হবে। কর্তারা আমাকে মেরেছে, যন্ত্রণা দিচ্ছে, কোথেকে আমি এ বইগুলি পাই তা জানার জন্য–আরো মারবে। কেন জানো? এই বইয়ের মধ্যে সত্য কথা লেখা হয়েছে। খাঁটি পৃথিবী আর সাচ্চা বাত তার কদর রুটির চাইতে বেশি—এই হচ্ছে আমার কথা।

চাষীর কথাগুলো শুনছে, কিন্তু তাদের মনে কেমন যেন একটা ভয়, কেমন যেন একটা সন্দেহ। একজন বললো, এসব বলে কেন মিছামিছি নিজের অবস্থা কাহিল করছে।

সেই নীলচোখ চাষীটি জবাব দিলো, ওতো মরতেই চলেছে, তার চাইতে তো আর কাহিল করতে পারবে না!

সার্জেন্ট হঠাৎ আবিভূত হ’ল, এতে লোক কিসের? কে বক্তিমে করছে?

তারপর রাইবিনের দিকে এগিয়ে তার চুল ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললো, তুই বক্তিমে করছিস? পাজি, গুণ্ডা কোথাকার, তুই বক্তিমে করছিস?

জনতা তখনও শবের মতো শান্তু…মার বুকে অক্ষম বেদনার জ্বালা।। একজন চাষী ফেললো দীর্ঘনিশ্বাস। রাইবিন আবার বলে উঠলো, দেখছে তো, ভাইসব?

চুপ, ব’লে সার্জেন্ট তার মুখে এক ঘা দিলো।

রাইবিন ঘুরে পড়ে বললো, ওরা শুধু এমনি করে মানুষের হাত বেঁধে মারে, যা খুশি করে নেয়।

ধরে ব্যাটাকে। ভাগ, ব্যাটারা–বলে সাজেন্ট রাইবিনের সামনে লাফিয়ে পড়ে উপর্যুপরি ঘুষি চালাতে লাগলো, মুখে, বুকে, পেটে।

একবার জনতার যেন ধৈর্যচ্যুতি হল।

মেয়োনা।…মারছো কেন? অকেজো পশু কোথাকার!…ছিনিয়ে নিয়ে চলো ওকে।…

সেই নীল-চোখ চাষীটি রাইবিনকে সঙ্গে নিয়ে চললো টাউনহলের দিকে। সাজেন্ট গর্জন করে উঠলো, খবদার, নিয়ে যেয়োনা!…

নীল-চোখ চাষীটি জবাব দিলো, না, নোব; নইলে তোমরা একে মেরে ফেলবে।

রাইবিন এবার বেশ জোর গলায় বললো, চাষীবন্ধুগণ, তোমরা কি বুঝতে পারছে না, কী শোচনীয় তোমাদের জীবন? তোমরা কি বুঝতে পারছে না, ওরা কেমন করে তোমাদের লুণ্ঠন করে—প্রতারণা করে— রক্ত পান করে? এই দুনিয়াকে রক্ষা করছে কারা—তোমরা। কাদের উপর দাঁড়িয়ে আছে এই বিশ্বব্যাপী সভ্যতা?—তোমাদের ওপর। বিশ্বের সমস্ত কিছুর মূলীভূত শক্তি কাদের মধ্যে?—তোমাদের মধ্যে। কিন্তু সেই তোমরা কি পেয়েছে?…পেয়েছে উপবাস। ওই তোমাদের একমাত্র পুরস্কার।…

যথার্থ কথা! আরো বলো, আরো বলল, তোমার গায়ে হাত তুলতে দেবো না। ওর হাত খুলে দাও।

না, থাক।

খুলে দাও বলছি।

পুলিসরা ভয়ে হাত খুলে দিয়ে বললো, শেষটা পস্তাবে!

রাইবিন বললো, ভাই সব, আমি পালাবো না। পালিয়ে আমি আত্মগোপন করতে পারি কিন্তু সত্যকে কেমন করে গোপন করবো? সে যে এইখানে…আমার অন্তরে।

জনতা এবার যেন গরম হয়ে উঠলো। রাইবিন তার রক্তমাখা হাত দু’খানা ঊর্ধ্বে তুলে বলতে লাগলো, ভাইসব, আমি দাঁড়িয়েছি তোমাদেরই জন্য…তোমাদেরই দাবি নিয়ে। এই দেখ আমার রক্ত সত্যের জন্য এ রক্তপাত হয়েছে। সেই সত্যের দিকে তোমরা নজর রেখো, সেই বই পড়ো। কর্তারা, পুরুতরা বলবে…আমরা নাস্তিক, ধ্বংসবাদী:তাদের কথায় বিশ্বাস কোরো না। সত্য চলেছে পৃথিবীর বুকের ওপর গোপন-পদসঞ্চারে, মানুষের মধ্যে খুঁজছে সে নীড়। কর্তাদের চোখের সামনে প্রকাশিত হচ্ছে অগ্নি-তপ্ত ছুরিকার মতো…তারা একে সইতে পারে না…এ তাদের কেটে-পুড়িয়ে দিয়ে যাবে।…এ তাদের মরণ-শত্রু; তাই এর গতি গুপ্ত। কিন্তু এই সত্যই তোমাদের পরম মিত্র।

সাঁচ্চা কথা। কিন্তু ভাই এর জন্য তোমার সর্বনাশ হবে।…

কে ধরিয়ে দিলো একে?

একজন পুরুত…একটি পুলিশ বললো।

এমন সময় পুলিস-সাহেব ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেন। জনতা কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকে পথ করে দিলো। সাহেব এসেই রাইবিনের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বললে, ব্যাপার কি? এর হাত বাধা নেই কেন?…এই বাঁধো…

একজন পুলিস বললে, বাধাই ছিলো হুজুর, ওরা খুলে দিলো।

সাহেব জনতার দিকে চেয়ে হুমকি দিয়ে বললেন, ওরা কারা? কোথায় সে লোক?…তুমি? সুমাখভ ব’লে সেই নীল চোখ চাষীটির বুকে তরবারির মুঠো দিয়ে দিলেন এক ঘা। আর তুমি… মিশিন বলে, আর একজনের দাড়ি ধরে দিলেন টান। তারপর বাকি লোক গুলোকে তাড়া দিয়ে বললেন, ভাগ, ব্যাটার।…সাহেব যে খুব অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন তা নয়, সব যেন তিনি যন্ত্রের মত করে যাচ্ছেন।

জনতা পালালো না, শুধু খানিকটে সরে সরে দাঁড়ালো।

সাহেব পুলিসটির দিকে চেয়ে বললেন, কিহে, হাত বাধছে না যে? ব্যাপার কি?

জবাব দিলো রাইবিন, আমি হাত বাধতে দিতে চাইনে। কেন। বাঁধবে? পালাচ্ছিনে, লড়াইও করছিনে।

সাহেব তার দিকে এগিয়ে বলেন, কি বলছো?

রাইবিনও চড়া গলায় জবাব দিলো, বলছি, তোমরা পশু–তাই মানুষকে এমনভাবে নির্যাতিত কর। কিন্তু সাবধান, সেই রক্ত দিবস

অচিরেই আসছে।…সেই দিন কড়ায়-গণ্ডায় শোধ হবে এর।

কী! কি বললি পাজি, বদমাস। কি বললিবলে সাহেব রাইবিনের মুখে এক প্রচণ্ড ঘুষি বসিয়ে দিলেন।

রাইবিন তার দিকে মুখ তুলে বললো, ঘুষি দিয়ে সত্যকে বধ কর। যায় না, কর্তা!… আমি জানতে চাই, কোন্ অধিকারে কুকুরের মতো কামড়াচ্ছে আমায়?

সাহেব আর এক ঘুষি ছুঁড়লেন, কিন্তু রাইবিন চকিতে সরে দাঁড়াতে সাহেব প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। জনতার মধ্যে হাসির হররা বয়ে গেল। রাইবিন গর্জন কবে বললো, খবর্দার, নরকের পশু… গায়ে, হাত তুলিসনি…আমি তোর চেয়ে দুর্বল নই… চেয়ে দেখ,…

সাহেব দেখলেন গতিক বড় ভাল নয়। লোকগুলো ক্রমশ ঘনিয়ে আসে তার দিকে। তখন এদিক-ওদিক চেয়ে ডাকলেন, নিকিতা!

ভিড় ঠেলে গাট্টা-গোট্টা চেহারার একটি চাষী এসে সাহেবের সামনে দাঁড়ায়।

এই ব্যাটার কান প্যাঁচিয়ে বেশ একটা নম্বরি ঘুষি চালাও তত।

চাষীটি রাইবিনের সামনে গিয়ে ঘুষি পাকালো। রাইবিন নড়লোনা একটুকুও। সোজা তার মুখের দিকে চেয়ে প্রগাঢ় স্বরে বললো, দেখ ভাইসব, পশুরা কেমন করে আমাদের হাত দিয়েই আমাদের কণ্ঠরোধ করে। দেখ, দেখ…একবার ভাব…কেন এ আমাকে মারতে চায়? কেন?… বলতে বলতে নিকিতার ঘুষি এসে পড়লো তার মুখে।

জনতা কোলাহল করে উঠলো,–নিকিতা, পরকালের কথা একেবারে ভুলে বসে আছিস বুঝি!

সাহেব নিকিতার ঘাড়ে ঠ্যালা দিয়ে বলে, আমার হুকুম, মারো।

নিকিতা একপাশে সরে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে গভীরভাবে বললো, আমি আর পারবোনা।

কী?

সাহেব রেগে আগুন হ’য়ে নিজেই রাইবিনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তারপর দু’ঘুষিতে রাইবিনকে মাটিতে ফেলে বুকে, পাশে, মাথায় লাথি ছুড়তে লাগলেন। জনতাও পলকে উত্তেজিত হয়ে হুংকার দিয়ে এগিয়ে এলো সাহেবের দিকে। সাহেব ব্যাপার দেখেই তরবারি হাতে নিয়ে বলে উঠল, বটে, দাঙ্গা করছে, তোমরা দাঙ্গা করছো?…তারপর এদিকওদিক চেয়ে অবস্থার গতিক দেখে বলে, বেশ, নিয়ে যাও, ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু জেনে রেখো, এ একজন রাজনৈতিক আসামী…জারের বিরুদ্ধে… একে তোমরা আশ্রয় দিচ্ছো তোমরাও তাহলে বিদ্রোহী…

জনতা এ কথায় ভয়ানক দমে গেলো।…তাদের সে উত্তেজনা দূর হয়ে সুরে ফুটে উঠলো যেন মিনতির ভাব। বলতে লাগলো, দোষ করেছে আদালতে নিয়ে যাও… মেয়োনা-মাপ কর ওকে…এসব অত্যাচারের অর্থ কি? দেশে কি এখন বে-আইনের রাজত্ব?…এমনি করে সবাইকে ঠ্যাঙাতে শুরু করলেই হয়েছে আব কি শয়তানের দল, খালি মারধর শিখেছে।

জন-কয়েক চাষী রাইবিনকে মাটি থেকে তুললো। পুলিসরা আবার তার হাত বাঁধতে গেলো।

জনতা বাধা দিয়ে বললো, একটু সবুরই কর না।

রাইবিন হাত দিয়ে রক্ত মুছে দাঁড়াতেই দেখলো, মা…ভিড়ের মধ্যে। মার সঙ্গে ইঙ্গিত-বিনিময় করে পাশে-পাড়ানো সেই নীল-চোখ চাষীর সঙ্গে বাক্যালাপ করে রাইবিন। তারপর জনতাকে সম্বোধন করে বলে উঠলো, সাহস এবং আশা-ভরা কণ্ঠে : বন্ধুগণ, কোন ভয় নেই। আমি দুনিয়ায় একা নই। সকল সত্যকে ওর গ্রেপ্তার করতে পারবে না আমি যাবে, কিন্তু আমার স্মৃতি থাকবে…একটি নীড় ওরা নষ্ট করে দেয় দিক…আরো বহু নীড়, বহু বন্ধু, বহু সঙ্গী আছে আমার…তারা সত্যের নব নব নীড় রচনা করবে।…তারপর একদিন বেরোবে তারা মুক্তির অভিযানে। মানুষকে করবে মুক্তি-প্ৰভায় সমুজ্জ্বল।

সাহেবের সুর তখন অনেকটা নরম হয়ে এসেছে…বলে, আমি মেরেছি বলেই তোমরা আমার বিরুদ্ধে হাত তুলবে? এতো সাহস তোমাদের?

কেন?…তুমি কোন্ স্বর্গ থেকে নেমে এসেছো?… রাইবিন জবাব দিলো। তারপরই আবার শুরু হল জনতার কোলাহল।

তর্ক কোরোনা।…তুমি কাদের বিরুদ্ধে লেগেছে, জানো?–সরকারের।

রাগ করবেন না হুজুর। ওর মাথার ঠিক নেই।

শহরে নিয়ে যাবে তোমায়।

সেখানে সুবিচার পাবে।

পুলিসরা রাইবিনকে নিয়ে টাউন-হলের মধ্যে চলে গেলো। চাষীরাও যে যার বাড়ি চলে গেলো।

তারপর একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো টাউন-হলের সামনে। রাইবিনকে হাত-বাঁধা অবস্থায় এনে ঠেলে ভরে দেওয়া হলো তার মধ্যে। রাত্রির সেই অন্ধকার ভেদ কবে বেজে উঠলো রাইবিনের কণ্ঠস্বর : বিদায়, বিদায় বন্ধুগণ! সত্য সন্ধান কোবো, সত্য রক্ষা কোবো, সত্য-সেবক যে তাকে বিশ্বাস করো, সাহায্য করে, সত্যব্রতে আপনাকে উৎসর্গ করে দাও… কিসের জন্য দুঃখ করছে তোমরা? এ জীবন তোমাদের কি দিয়েছে? কেন তোমরা মরতে বসেছে…অনাহারে? মুক্তির জন্য বুক বেঁধে বাড়াও।…মুক্তি তোমাদের মুখে অন্ন দেবে। সত্যের উদ্বোধন করে।…

বলতে বলতে গাড়ি চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে যায়। রাইযিনের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ, ক্ষীণতর, ক্ষীণতম হ’য়ে বাতাসে মিলিয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *