দ্বিতীয় খণ্ড
২.০১
সমস্ত দিনটা মা’র চোখের সামনে নাচতে লাগলো সেই শোভাযাত্রার ছবি! অস্থির, উন্মনা হয়ে কখনো তিনি ভাবেন, কখনো বাইরের দিকে শূন্য-দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন।
সন্ধ্যার পর পুলিস এলো তৃতীয়বার বাড়িতে। মাকে বললো, ছেলেদের মনে রাজভক্তি, ধর্মভাব জাগাতে পারো না? এতো তোমাদের মায়েদেরই দোষ। তারপর ভালো করে খানাতল্লাশী করে চলে গেলো। ফুঁ দিয়ে আলো নিভিয়ে মা খানিকক্ষণ অন্ধকারে বসে রইলেন। তারপর ঘুমিয়ে পড়লেন বিছানায়।
ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলেন, সেই শোভা-যাত্রা… নায়ক পেভেল, এণ্ড্রি … গান চলেছে… পেভেলের দিকে চেয়ে চলেছেন তিনি শহরের পথে… পেভেলের কাছে যেতে লজ্জা হচ্ছে, কারণ তার পেটে একটি সন্তান… আর একটি কোলে মাঠে আরো অনেক ছেলের মেলা, বল খেলছে তারা…কোলের ছেলেটা তাদের দেখে জোরে কাঁদছে… সৈন্যরা ধেয়ে আসছে সঙিন উঁচিয়ে…মা ছুটে গিয়ে আশ্রয় নিলেন মাঠের মাঝখানে উঁচু গির্জায়… শ্রাদ্ধকৃত্য চলছে সেখানে, পুরুত গাইছে…একজন পুরুত আলো নিয়ে এসে দাঁড়ালো তাঁর কাছে, তারপর হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো, গ্রেপ্তার কর…দেখতে দেখতে পুরুত হয়ে গেলে সামরিক কর্মচারী সবাই ছুটে পালাচ্ছে…মা পলাতকদের সামনে কোলের ছেলেটাকে ফেলে দিয়ে বলছেন, পালিয়োনা, ছেলেটার মুখ চাও…এণ্ড্রি, ছেলেটাকে কাঠ-বোঝাই গাড়িতে চাপিয়ে দিলো…নিকোলাই গাড়ির পাশে হেঁটে চলেছে…হেসে বলছে, এবার একটা শক্ত কাজের ভার পেয়েছি।… কাঁচা পথ…জানলায় জানলায় নর-মুণ্ডের ভিড়। এণ্ড্রি বলছে, গাও মা জীবনের জয়গান…মা ঠাট্টা ভেবে রাগছেন…তারপর হঠাৎ পথের পাশের অতল গহ্বরে টলে পড়ে গেলেন…আতঙ্ক-ভরা চীৎকারে মা’র ঘুম ভাঙলো। মা উঠে পড়লেন। তারপর হাত-মুখ না ধুয়েই তিনি ঘর গোছতে লেগে গেলেন। নিশানের টুকরো তুলে উনোনে দিতে গিয়ে, হঠাৎ কি ভেবে লাল কাপড়টা ছাড়িয়ে নিয়ে ভাঁজ করে পকেটে রাখলেন। জানলা ধুলেন, মেঝেয় ধুলেন, স্নান করলেন, চা চাপালেন তারপর যেন আর কোনো কাজই রইল না তার। কেবল মনে হতে লাগলো, এখন?—এখন কি করি?
হঠাৎ মনে পড়লো, প্রার্থনা করা তো হয়নি!
প্রার্থনায় বসলেন…প্রার্থনা করলেন, কিন্তু প্রাণ তবু শুন্য। সময় আর কাটে না!
এমন সময় নিকোলাই আইভানোভিচ এসে দেখা দিলো। মা ভয় পেয়ে বলে উঠলেন, এখানে এসেছ কেন? টের পেলেই ধরবে ওরা।
আইভানোভিচ মাকে আশ্বস্ত করে বললো, এণ্ড্রি পেভেলের সঙ্গে কথা ছিল, তারা ধরা পড়লে তোমায় আমি শহরে নিয়ে যাবে। যাবে তো, মা!
যাবো, ওরা যখন বলে গেছে—আর তোমার যদি কোনো অসুবিধা হয়।
অসুবিধা কিছু হবে না, মা। সংসারে লোক মাত্র আমরা দু’টি–আমি আর আমার বোন শোফি। কিন্তু সেও থাকে না, মাঝে মাঝে আসে।…
মা বললেন, হাঁ, যাবো আমি। এখানে নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকতে পারি না।
আইভানোভিচ বললো, কাজ তুমি আমাদের ওখানে পাবে, মা।
আমি ঘরের কাজের কথা বলছিনে!
ঘরের কাজ নয়, যে কাজ তুমি চাও, তাই।
কি কাজ দেবে আমায়?
জেলে পেভেলের সঙ্গে দেখা করে সেই চাষী যে কাগজ বের করবার কথা বলেছিল, তার ঠিকানা যদি আনতে পারো!
মা সোৎসাহে বলে উঠলেন, জানি, তার ঠিকানা আমি জানি। কাগজ দাও, আমি দিয়ে আসছি তাদের।…আমায় একাজে টেনে নাও…সর্বত্র আমি যাবো তোমাদের কাজে…শীত মানবো না, গ্রীষ্ম মানব না, মৃত্যু দেখেও শিউরে উঠবে না…সত্য-পথে দৃঢ় পদে এগিয়ে এগিয়ে যাবো… আমায় কাজ দাও।
চারদিন পরে আইভানোভিচ মাকে তার শহরের বাড়িতে নিয়ে গেলো।
.
২.০২
মা যেন এক ছেলের বাড়ি থেকে আর এক ছেলের বাড়ি এসেছেন। কোন সংকোচ, কোন অসুবিধা নেই তার। সংসারে কোন কিছু গোছানো ছিল না, মা তা পরিপাটি করে গুছিয়ে নিলেন।
চা খেতে খেতে আইভানোভিচ বললো, আমি যে বোর্ডে কাজ করি, মা, তার কাজ হল চাষীদের অবস্থা নিরীক্ষণ করে রিপোর্ট দেওয়া–বাস, ঐ পর্যন্ত। তাদের দুঃখমোচন করার কোনো চেষ্টা আমরা করি নে।…আমরা দেখি…তাদের ক্ষুধার জ্বালা, তাদের অকালমৃত্যু–আমরা দেখি, তাদের ছেলেরা জন্মায় ক্ষীণপ্রাণ, মরে মাছির মতো…তাদের দুঃখের কারণ কি, তাও আমরা জানি, আর তার জন্য বেতন পাই।
মা জিগ্যেস করলো, তুমি ছাত্র নও?
না। আমি বোর্ডের অধীনে জনৈক গ্রাম্য শিক্ষক।…চাষীদের বই পড়তে দিতুম…এই অপরাধে আমার জেল হ’ল…জেল থেকে বেরিয়ে এক বইয়ের দোকানে কাজ নিলুম এবং সেখানেও সতর্ক হয়ে চললুম না বলে আবার জেল…তারপরে আর্চাঞ্জেলে নির্বাসন। সেখানে হ’ল গভর্ণরের সঙ্গে সংঘর্ষ…ফলে ঠেলে পাঠালে শ্বেতসাগরের উপকূলে …পাঁচ বছর সেখানে কাটিয়ে এলুম।…
এমন ভীষণ দুঃখকেও মানুষ কেমনভাবে এতো সহজ করে নিতে পারে।…মা সেই কথা ভাবতে লাগলেন।
আইভানোভিচ বললো, শোফি আসছে আজ।
বিয়ে হয়েছে তার?
সে বিধবা।…তার স্বামী সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত হয়। তারপর পালায় সেখান থেকে। পথে ঠাণ্ডায় সর্দি হয়ে মারা যায়—প্রায় দু’বছর আগে।
শোফি কি তোমার ছোট?
দু’বছরের বড়। তার কাছে আমি বহুঋণে ঋণী। ওঃ, সে যা পিয়ানো বাজায়, চমৎকার!
থাকে কোথায়?
সর্বত্র। যেখানে সাহসী লোকের দরকার সেইখানেই শোফি হাজির।
এ কাজে আছে?
নিশ্চয়।
দুপুরের দিকে শোফি এসে হাজির হ’ল। আসতে-আসতেই মার সঙ্গে ভাব হয়ে গেলো তার, বললো, পেভেলের মুখে তোমার কথা শুনেছি, মা।
পেভেল অন্যের কাছেও তার কথা বলতে শুনে মার মনটা খুশিতে ভরে উঠলো।
শোফি বললো, মার বুঝি খুব কষ্ট হচ্ছে?
মা বললেন, কষ্ট, হাঁ, কষ্ট বৈ কি! আগে হলে কষ্টই হত–কিন্তু এখন জানি, সে একা নয়, আমিও একা নই।
শোফি তখন কাজের কথা পাড়লো, বললো, এখন সব চেয়ে দরকারী কথা হচ্ছে, ওদের যাতে জেলে না পচতে হয়। বিচার শিগগিরই হচ্ছে। তারপর যক্ষুণি তাদের নির্বাসনে পাঠানো হবে, আমরা পেভেলকে মুক্ত করার চেষ্টা করব। সাইবেরিয়ায় তার কিছু করার নেই, তাকে এখানে দরকার।
মা বললেন, মুক্ত যেন সে হ’ল কিন্তু ফেরারী হয়ে থাকবে কি করে?
শোফিয়া বললো, আরও শত শত ফেরারী যেমন করে থাকে। এইতো, এই মাত্র একজনকে বিদায় দিয়ে এলুম। দক্ষিণ অঞ্চলে কাজ করতো সে। পাঁচবছরের নির্বাসন-দণ্ড ছিল…রইল মাত্র সাড়ে তিন মাস…তাইতো আমার এই পোশাকের জাকজমক নইলে সত্যিই কি আর আমি এতোটা বাবু!
পুলিসের চোখে ধুলো দিতেই শোফি সাজ-পোশাক করেছিল ফ্যাশান-দুরুস্ত, মুখে ছিল তার সিগারেট! এবার সে-সব ধরাচূড়া ছেড়ে সহজ, সরল, স্বাভাবিক মানুষ হয়ে পিয়ানো নিয়ে বসলো।
আইভানোভিচ মিথ্যা বলেনি। শোফি পিয়ানো বাজায় অপূর্ব! তার হতে, পিয়ানো যেন কথা কইতে লাগলো। নানা ভাব, নানা রস শ্রোতাদের মনের মধ্য দিয়ে ঢেউ খেয়ে গেলো। মা মুগ্ধ হয়ে শুনলেন সে সঙ্গীত। তাঁর সমস্ত অতীত যেন বুকের মধ্যে তোলপাড় করে উঠলো দুঃখ-করুণ ছন্দে ছন্দে। মার মুখ ফুটলো। ধীরে ধীরে তিনি বর্ণনা কবে গেলেন তার দুর্বিষহ বন্দিনী জীবনের মর্মন্তুদ দুঃখ কাহিনী।…এতো তিনি শুধু তার নিজের কথা বলছেন না—তারই মধ্য দিয়ে লক্ষ লক্ষ নিপীড়িত নরনারীর অকথিত কাহিনী ব্যক্ত হচ্ছে। সেই জীবনের পর এই জীবন-জাগ্রত, জ্বলন্ত জীবন যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, মানুষ কি ছিল, কি সে হয়েছে এবং কি সে হতে পারে।
মার কাহিনী শুনে শোফি বললো, একদিন আমি মনে করেছিলুম, আমি অসুখী…তখন আমি একটি ক্ষুদ্র শহরে নির্বাসিত হাতে কোন কাজ নেই…নিজের কথা ছাড়া আর কিছু ভাববার নেই–কাজেই দুঃখগুলিকে জড়ো করে ওজন করতে বসে গেলুম…তারপর বাবার সঙ্গে বিচ্ছেদ হল—জিসিয়াম থেকে আমি বিতাড়িত, লাঞ্ছিত হলুম… তারপর জেল-সহকর্মীর বিশ্বাসঘাতকতা, স্বামীর নির্বাসন…আমার পুনরায় কারাদণ্ড এবং নির্বাসন, স্বামীর মৃত্যু—এমনি বহু দুঃখ পেয়েছি আমি। কিন্তু এসব এবং এর দশগুণ দুঃখ একত্র করেও তোমার জীবনের একমাসের দুঃখের সমান হয় না, মা! বছরের পর বছর, প্রত্যেকটি দিন তুমি কি যাতনাই না সহ্য করেছে। এমন সহ্যশক্তি তোমরা কোথায় পাও, মা!
মা বললেন, আমদের সইতে সইতে অভ্যাস হয়ে যায়। শোফি বললো, আমি ভেবেছিলুম, জীবনকে আমি পুরোপুরি চিনেছি। কিন্তু আজ দেখছি ভুল। বইয়ে যা পড়েছি, কল্পনায় যা তার আন্দাজ করে নিয়েছি—তোমার মতো ভুক্তভোগীর কথা শুন বুঝলুম, তার চাইতে ঢের, ঢের বেশি ভীষণ বাস্তব জীবন!…
এমনি আরো অনেক কথা হ’ল।
কাগজ সম্বন্ধে স্থির হ’ল, শোফি মার সঙ্গে গ্রামে গিয়ে সেই চাষীর সঙ্গে সব ঠিকঠাক করে আসবে। গ্রামটা সেখান থেকে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে।
.
২.০৩
তিনদিন পরে মজুরানীর ছদ্মবেশে শোফি আর মা মখন বেরিয়ে পড়লেন গ্রামের উদ্দেশে, তখন তাঁদের চেনাই দায় হল। মনে হল যেন তারা আজীবন এই বেশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।
দু’পাশে গাছের সারি, মাঝখানে পথ। হাঁটতে হাঁটতে মা প্রশ্ন করলেন, হাঁটতে কষ্ট হবে না তো?
শোফি হেসে বললো, এ পথে কি আমি এই নতুন বেরিয়েছি ভাবছ, মা? আমার এসব অভ্যেস আছে।…
তারপর মানুষ যেমন করে ছেলেবেলায় খেলা-ধূলোর কথা বর্ণনা করে তেমনি করে বলে গেলো শোফি তার বিচিত্র বিপ্লব-কাহিনী। কখনো সে রয়েছে নাম ভাড়িয়ে, দলিল-পত্র করেছে জাল। কখনো গোয়েন্দাদের চোখে খুলি দিতে আত্মগোপন করেছে রকম-বেরকমের ছদ্মবেশে। শহরে শহরে চালান করেছে শত শত নিষিদ্ধ পুস্তক। নির্বাসিত সঙ্গীদের মুক্তির আয়োজন করে দিয়েছে…সঙ্গে করে তাদের বিপদসীমার বাইরে রেখে এসেছে। তার বাড়িতে একটা ছাপাখানা ছিল…পুলিস খানাতল্লাশ করতে এলে এক মিনিটের মধ্যে ভেল বদলে চাকরের সাজে আগন্তুকদের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলে সে…তারপর গায়ে একখানা র্যাপার জড়িয়ে, মাথায় রুমাল বেঁধে, হাতে একটা কেরোসিনের টিন নিয়ে কেরোসিন-ওয়ালীর বেশে শীতের কনকনে হাওয়ায় শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে গেলো। আর একবার সে এসেছে নতুন এক শহরে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে…তাদের বাড়িতে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে এমন সময় দেখতে পেলে তাদের ঘরে খানাতল্লাশ করছে পুলিস; ফেরা তখন নিরাপদ নয়…এক সেকেণ্ড ইতস্তত করে নির্ভীকভাবে সে নিচের তলায় একটা ঘরের ঘন্টা বাজিয়ে ব্যাগ হাতে অপরিচিত লোকদের মধ্যে ঢুকে পড়লো তারপর সরলভাবে নিজের অবস্থার কথা ব্যক্ত করে বললো, আমার ইচ্ছা হলে আপনারা পুলিসের হাতে দিতে পারেন; কিন্তু আমি জানি, আপনারা তা দেবেন না। লোকগুলো অত্যন্ত ভয় পেলো। সমস্ত রাত ঘুমোলোনা। প্রত্যেক মিনিট আশঙ্কা করে, এই বুঝি পুলিস এসে দরজা ঠেলে…কিন্তু তবু আমাকে ধরিয়ে দিতে মন উঠল না…পরদিন এই নিয়ে হাসাহাসি। …তারপর আর একবার সে রেলগাড়িতে চলেছে একজন গোয়েন্দার সঙ্গে একই গাড়িতে, একই আসনে…তার সন্ন্যাসিনীর ছদ্মবেশ…গোয়েন্দাটি তখন তারই খোঁজে বেরিয়েছিল তারই কাছে গোয়েন্দা গল্প জুড়ে দিলো, কেমন দক্ষতার সঙ্গে সে শোফিকে খুঁজে বের করেছে…শোফি নাকি ঐ গাড়িরই দ্বিতীয় শ্রেণীর এক কামরায় আছে গাড়ি থামে, আর প্রত্যেকবার সে খুঁজে দেখে এসে শোফিকে বলে, না, তাকে দেখছি না, ঘুমোচ্ছ বোধ হয়। ওদের তো মেহনৎ কম নয়, আমাদের মতো ওদেরও জীবন বিপদসংকুল!…
মা তার কাহিনী শুনে প্রাণ খুলে হাসেন। শোফির দীর্ঘ উন্নত দেহ, গভীর কালো চোখ দিয়ে ফুটে বেরোয় একটা দীপ্তি, একটা সাহস, একটা অনাবিল আনন্দ। পাখির গান শুনতে শুনতে, পথের ফুল তুলতে তুলতে, নৈসর্গিক দৃশ্যের ওপর মুগ্ধ-দৃষ্টি বুলোতে বুলোতে দু’জন গ্রামের দিকে এগিয়ে চললো। শোফির আনন্দোজ্জ্বল মুর্তিখানির দিকে চেয়ে মা বললেন, তুমি এখনো তরুণ!
শোফি হাসতে হাসতে বললো, আমার বয়স, মা, বত্রিশ বছর।
মা বললেন হোক, কিন্তু তোমার চোখ, তোমার কণ্ঠ এত সজীব যে তোমাকে তরুণী বলে মনে হয়। এতে বিপদসংকুল জীবন তোমার অথচ প্রাণ তোমার হাসছে।
শোফি বললো, প্রাণ আমার হাসছে, চমৎকার বলেছে, মা, কিন্তু কষ্ট! কই, না তো! আমিতো মনে করি, এর চেয়ে সুন্দর, এর চেয়ে মজার জীবন আর হতে পারে না!
মা বললেন, সব চেয়ে তোমাদের এই জিনিসটা আমার ভালো লাগে! তোমরা জান, মানুষের প্রাণে ঢুকতে হয় কোন্ পথ দিয়ে। নির্ভয়ে, নির্ভাবনায় মানব-প্রাণের সমস্ত কিছু তোমাদের সামনে খুলে যায়। পৃথিবীতে অন্যায়কে তোমরা জয় করেছে, সম্পূর্ণভাবে জয় করেছে।
শোফি জোর দিয়ে বললো, হাঁ, মা, আমরা জয়ী হব; কারণ আমরা মজুরদের সঙ্গে এক হয়ে দাঁড়িয়েছি। তাদের কাছ থেকেই আমরা পাই আমাদের কর্মশক্তি-সত্য যে জয়যুক্ত হবে এই স্থিরবিশ্বাস। তারাই হচ্ছে আমাদের সমস্ত দৈহিক এবং অলৌকিক শক্তির অফুরন্ত উৎস। তাদেরই মধ্যে নিহিত আছে সকল সম্ভাবনা, তাদেরই নিয়ে হচ্ছে সকল কিছু সম্ভব। শুধু উদ্বুদ্ধ করা চাই তাদের শক্তি, তাদের জ্ঞান, তাদের আশা, তাদের বর্ধিত হবার, বিকশিত হবার স্বাধীনতা।
মা বলেন, কিন্তু এর জন্য কি পুরস্কার পাবে তোমরা!
শাফি সগর্বে জবাব দিলো, পুরস্কারতো আমরা পেয়েই গেছি, মা! আমরা এমন এক জীবনের আস্বাদ পেয়েছি যা আমাদের তৃপ্তি করেছে প্রসারিত, পরিপূর্ণ আত্মার শক্তিতে সমুজ্জ্বল আমাদের জীবন দুনিয়ায় আর কি চাই আমাদের?
.
তিনদিনের দিন তারা সেই গাঁয়ে এসে পৌঁছলো। মাঠে একজন চাষী কাজ করছিল। তার কাছ থেকে রাইবিনের ঠিকানা জেনে নিয়ে তারা গায়ের মধ্যে ঢুকে পড়লেন।
রাইবিন, ইয়াফিম্ এবং আরো দু’জন চাষী টেবিলে বসে খাচ্ছে। এমন সময় মা গিয়ে ডাক দিলেন, ভালো আছে, রাইবিন!
রাইবিন ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে মার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাইলো। মা বললেন, আমরা বেড়াতে বেরিয়েছি, রাইবিন। ভাবলুম পথে ভাইকে একবার দেখে যাই। এ আমার বন্ধু আনা।
রাইবিন শোফিকে অভিবাদন করে মাকে বললো, কেমন আছছ?…মিছে কথা বলো না…এ শহর নয়, …সব আমাদেরই লোক এখানে মিছে বলার দরকার নেই।
সবাই আগন্তুকদের দিকে চেয়ে আছে।
রাইবিন বললো, আমরা সন্ন্যাসীর মত আছি এখানে কেউ আমদের কাছ দিয়ে ঘেঁসে না…কর্তাও বাড়ি নেই…কর্ত্রী গেছেন হাসপাতালে …আমি হলুম এখন সুপারিন্টেন্টে বস…নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত তোমরা … ইয়াফিম, দুধ নিয়ে এসো ভাই।
ইয়াফিম ধীরে ধীরে উঠে গেলো দুধ আনতে। আর দু’জন সঙ্গীর পরিচয় দিলো রাইবিন…এই ইয়াকব, এই ইগ্নাতি।
তারপর জিগ্যেস করলে, পেভেল কেমন আছে?
মা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, সে জেলে!
জেলে! আবার! জেল বুঝি ভারি ভালো লেগেছে তার!
ইয়াফিম মাকে বসালো। রাইবিন শোফিকে বললো, বস।
শোফি একটা গাছের গুড়ির ওপর বসে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করতে লাগলো রাইবিনকে।
রাইবিন মাকে জিগ্যেস করলো, কবে নিয়ে গেলো পেভেলকে? তোমার দেখছি কপাল মন্দ কি হয়েছিল?
মা সংক্ষেপে পয়লা মের ব্যাপার বর্ণনা করে গেলেন। শুনে ইয়াফিম বললো, গায়ে ও রকম শোভাযাত্রা করলে চাষীদের ওরা জবাই করবে।
ইগ্নাতি বললো, ত ঠিক।…কারখানাই ভালো, আমি শহরে যাবো।
রাইবিন জিগ্যেস করলো, পেভেলের বিচার হবে?
হাঁ!
কি শাস্তি হতে পারে? শুনেছে কিছু?
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা নির্বাসন—মা শান্ত কম্পিত কণ্ঠে উত্তর দিলেন। তিনজন চাষী একসঙ্গে বিস্মিত হয়ে মার দিকে চাইলো। রাইবিন মুখ নিচু করে ফের জিগ্যেস করলো, কাজে যখন নেবেছিল, তখন সে একথা জানতো?
মা বললেন, জানিনে, জানতো বোধ হয়!
শোফিয়া হঠাৎ জোরগলায় বলে উঠলো, ‘বোধ হয়’ নয়, ভালো করেই জানতো।
সবাই নীরব, নিশ্চল, যেন জমাট বেধে গেছে শীতে।
রাইবিন ধীরে ধীরে বললো, আমারও তাই মনে হয়, সে জানতো। খাঁটি লোক, না ভেবে কোন কাজে নাবে না। সে জানতো, তার সম্মুখে সঙিন, তার সম্মুখে নির্বাসন। জেনে শুনেই সে গেলো। যাওয়া দরকার, তাই সে গেলো। যদি মা তার পথ রোধ করে শুয়ে থাকতেন, সে ডিঙিয়ে চলে যেতো। নয় কি, মা?
হাঁ।
রাইবিন তার সঙ্গীদের দিকে চেয়ে চাপা গলায় বললো, এই হচ্ছে আমাদের আদর্শ নেতা।
আবার খানিকক্ষণ সবাই চুপচাপ বসে রইলো। তারপর ইয়াকব হঠাৎ বলে উঠলো, ইয়াফিমের সঙ্গে গিয়ে সৈন্য-বিভাগে যোগ দিলে আমাদের লেলিয়ে দেওয়া হবে এই পেভেলের মতো মানুষের ওপর।
রাইবিন গম্ভীর মুখে বললো, তবে আর কাদের ওপর লেলিয়ে দেবে মনে কর? আমাদেরই হাত দিয়ে ওরা আমাদেরই কণ্ঠরোধ করে। এইখানেই তো ওদের যাদু।
ইয়াফিম জেদের সুরে বললো, কিন্তু আমি সৈন্যদলে যোগ দেবোই। ইগ্নাতি বলে উঠলো, কে বারণ করছে তোমায়? যাও, মরোগে।…
তারপর হেসে বললো, গুলি যখন করবে আমাদের, মাথা লক্ষ্য করে কোরো…যেন এক গুলিতেই সাবাড় হই…আহত হয়ে মিছি-মিছি না ভুগি।
রাইবিন সঙ্গীদের লক্ষ্য করে বললো, এই মাকে দেখ…ছেলেকে এঁর কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে, কিন্তু তাতে কি ইনি দমেছেন?–না, দমেন নি! ছেলের স্থান পূর্ণ করেছেন এসে তিনি নিজে।
তারপর সজোরে টেবিল চাপড়ে বললো, ওরা জানে না, অন্ধের মতো কিসের বীজ বুনে চলেছে ওরা! কিন্তু জানবে, সেদিন জানবে, যেদিন আমাদের শক্তি হবে পরিপূর্ণ সেদিন এই বীজ পরিণত হবে বিষের ফসলে—আর আমরা কাটব সেই অভিশপ্ত ফসল।…
রাইবিনের রক্তচক্ষু থেকে যেন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে, দুর্দমনীয় ক্রোধে মুখ হয়ে উঠেছে লাল। একটু থেমে আবার সে বলতে লাগলো, সেদিন এক সরকারী কর্মচারী আমাকে ডেকে বলে, এই পাজি, পুরুতকে তুই কি বলেছিস্? জবাব দিলুম, আমি পাজী হলুম কি করে? কারো কোনো ক্ষতিও করিনে, আর খাইও মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, খেটে। বলতেই হুংকার দিয়ে উঠে লাগালে মুখে এক ঘুষি!…তিন-দিন তিনরাত রাখলল হাজতে পু’র!…
অদৃশ্য সরকারী কর্মচারীর উদ্দেশে তর্জন করে রাইবিন বললো, এমনি করে তোমরা লোকের সঙ্গে কথা কও-না? শয়তানের দুল, মনে ভেবেছে ক্ষমা করব? না, ক্ষমা নেই। অন্যায়ের প্রতিশোধ নোবই নোব। আমি না পারি, আর কেউ নেবে। তোমাদের না পাই, তোমাদের ছেলেদের ধরব। মনে রেখে এ কথা। লোভের লৌহ-নখর দিয়ে মানুষকে তোমরা রক্তাক্ত করেছে, তোমরা হিংসার বীজ বপন করেছে, তোমাদের ক্ষমা নেই।
রাগ যেন রাইবিনের মনে গর্জাতে লাগলো। শেষটা সুর একটু নরম করে সে বললো, আর, পুরুতকে আমি কি বা বলেছিলুম? গ্রাম্য পঞ্চায়েতের পর চাষীদের নিয়ে পথে বসে তিনি বোঝাচ্ছেন, মানুষ হচ্ছে মেষপাল, আর তাদের সব সময়ের জন্যই চাই একজন মেষ পালক! তা শুনে আমি ঠাট্টা করে বললুম, হাঁ, সেই যেমন এক বনে শেয়ালকে করে দেওয়া হল পক্ষী-পালক। দু’দিন বাদে দেখা গেলো, রাশি রাশি পালকই পড়ে আছে বনে, পক্ষা আর নেই। পুরুত আমার দিকে একবার আড়নয়নে চেয়ে বলে যেতে লাগল, চাই ধৈর্য, ঈশ্বরের কাছে কেবল প্রার্থনা কবে, প্রভু, আমার ধৈর্য দাও। আমি বললুম, প্রভুটির যে ফুরসুৎ নেই শোনার, নইলে ডাকতে কি আমরা কসুর করছি? পুরুত তখন অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, তুই ব্যাটা আবার কী প্রার্থনা করে থাকিস্? আমি বললুম, করি ঠাকুর, একটা প্রার্থনা আমি করি,—যা শুধু আমি কেন, মানুষ মাত্রেই করে থাকে। সেটা হচ্ছে এই, হে ভগবান, দুনিয়ার এই কর্তাগুলোকে দিয়ে একবার ইটের বোঝ বওয়াও, পাথর ভাঙাও, কাঠ ফাড়াও…পুরুত আমার কথাটাও শেষ করতে দিলে না।
তারপর আচমকা শেফির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো, আপনি কি ভদ্রমহিলা?
শোফি এই আকস্মিক, অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন শুনে মৃদুকণ্ঠে বললো, আমাকে ভদ্রমহিলা বলে মনে করার কারণ?
রাইবিন হেসে বললো, কারণ? কারণ, ছদ্মবেশও আপনাকে ঢেকে রাখতে পারেনি। ভিজে টেবিলে হাত পড়তেই আপনি শিউরে হাত টেনে নিলেন বিরক্তিভরে, তাছাড়া, আমাদের মেয়েদের মেরুদণ্ড অতত সোজা হয় না।
রাইবিন পাছে শোফিকে অপমান করে ফেলে এই ভয়ে মা বললেন, ইনি আমাদের দলের একজন নামজাদা কর্মী! এই কাজে ইনি মাথার চুল পাকিয়েছেন। তোমার ওসব বলা উচিত নয়।
রাইবিন বললো, কেন? আমি কি অপমানকর কিছু বলেছি, বলে শোফির দিকে চাইলো।
শোফি হেসে বললো, না কিন্তু কিছু বলতে চাও আমায়?
আমি বলবনা কিছু। ইয়াকবের এক ভাই কি যেন কি বলবে। তাকে ডাকব?
ডাকো।
রাইবিন তখন ইয়াফিকে অনুচ্চকণ্ঠে বললো, তুমি যাও, বোললা, সন্ধ্যার সময় যেন আসে।
তারপর মা ও শোফি পোটলা খুলে মেলা বই এবং কাগজ বের করে দিলেন রাইবিনকে। রাইবিন বই-কাগজ পেয়ে খুশি হল। শোফির দিকে চেয়ে বললো, কতদিন ধরে একাজে আছেন আপনি?
বারো বছর।
জেলে গেছেন?
হাঁ।
অপরাধ নেবেন না এসব প্রশ্নে। ভদ্রলোক আর আমরা যেন আলকাতরা আর জল, মিশিনে সহজে।
শেফি হেসে বললে, আমি ভদ্র নই, আমি শুধু মানুষ।
রাইবিন, ইগ্নাতি, ইয়াকব বই-কাগজ নিয়ে সানন্দে ঘরের ভেতর চলে গেলো। তারপর পড়তে শুরু করলো অসীম আগ্রহে। শোফি দেখলে, সত্য জানার জন্য এদের কী বিপুল আগ্রহ—আনন্দদীপ্ত মুখে সে এসে দেখতে লাগলো, তাদের পাঠ।
ইয়াকব কি একটা পড়ে মুখ না তুলেই বললো, কিন্তু এসব কথায় আমাদের অপমান হয়।
রাইবিন বললো, না ইয়াকব, হিতাকাঙ্ক্ষীরা যাই বলুন, তাতেঁ অপমান হতে পারে না।
ইগ্নাতি বললো, কি লিখছে শোনো, চাষীরা আর মানুষ নেই। থাকবে কি করে? তোমরা এসে দু’দিন থাকে। আমাদের ভেল নিয়ে–দেখবে তোমরাও আমাদেরই মতো হয়ে গ্যাছে।
এমনিভাবে চললো পড়া।
মা ঘুমিয়ে পড়লেন। খানিকক্ষণ বাদে পড়া শেষ করে চাষীবাও চলে গেলো কাজে।
.
২.০৪
সন্ধ্যার সময় রাইবিনর কাজ থেকে ফিরে এসে চা খেতে বসলো। হঠাৎ ইয়াফিম বলে উঠলো, ঐ কাশির শব্দ শুনচ?
রাইবিন কান পেতে শুনে শোফিকে বললো, হাঁ, ঐ সে আসছে… সেভলি আসছে। পারলে আমি ওকে শহরের পর শহরে নিয়ে যেতুম, পাবলিক স্কোয়ারে দাঁড় করিয়ে দিতুম, লোকে ওর কথা শুনতে। ও একই কথা বলে সব সময়, কিন্তু সে কথা সকলেরই শোনার যোগ্য।
বনের আড়াল থেকে ধীরে ধীরে লাঠি ভর করে বেরিয়ে এলো এক আনত, শীর্ণ, কঙ্কালতার নিশ্বাসের শব্দ কানে এসে বাজছে। গায়ে গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা একটা কোট, শুকনো খাড়া কটা চুল, মুখ আদ্দেক হা-করা, চোখ কোটরাগত, ধক ধক করে জ্বলছে…রাইবিন শোফির সঙ্গে তার পরিচয় করে দিতেই বললো, আপনিই চাষীদের জন্য বই এনেছেন?
হাঁ।
চাষীদের পক্ষ হয়ে আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি! ওরা এখনো এই বই, যাতে সত্য প্রচার করা হয়েছে, তার মর্ম বোঝে না। এখনো ওদের চিন্তাশক্তির স্ফুরণ হয়নি, কিন্তু আমি সব নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছি এবং সেই জন্যই ওদের হয়ে আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।…
এত কথা বলতে গিয়ে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো, কাঠির মতো আঙুলগুলি দিয়ে বুক চেপে অতি কষ্টে সে ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগলো শুকনো মুখের মধ্য দিয়ে। শোফি বললো, সন্ধ্যাবেলায় এতো ঠাণ্ডায় বেরোনো ভাল হয়নি আপনার।
ভালো! আমার পক্ষে ভালো এখন একমাত্র মরণ–আমি মরতে চলেছি। মরব, কিন্তু মরার আগে লোকের একটা উপকার করে যাবো, সাক্ষ্য দিয়ে যাবো—কত পাপ, কত অনাচার, আমি প্রত্যক্ষ করেছি। আমার দিকে চেয়ে দেখুন, আটাশ বছর বয়স আমার—কিন্তু এখনই আমি মরতে চলেছি! দশ বছর আগে অনায়াসে পাঁচশো পাউণ্ড আমি কঁধে তুলে নিতে পারতুম…এ শক্তি নিয়ে সত্তর বছর বাঁচার কথা, কিন্তু দশ বছরের মধ্যেই আমি শেষ হয়ে গেলুম। কর্তারা ডাকাত তারা আমার জীবন থেকে চল্লিশটা বছর ছিনিয়ে নিয়েছে, চল্লিশটা বছর চুরি করেছে!
রাইবিন শাফির দিকে চেয়ে বললো, শুনলেন তো—এই হচ্ছে ওর সুর।
সেভলি বললো, শুধু আমার নয়, হাজার হাজার লোকের সুর এই। কিন্তু তারা আওড়ায় এটা তাদের নিজেদের মনে মনে। বোঝেনা, তাদের এই মন্দভাগ্যজীবন দেখে মানুষ কতবড় একটা শিক্ষা পেতে পারে। কতলোক মরণের কোলে হেলে পড়েছে শ্রমের নিপীড়নে; কত লোক পঙ্গু বিকলাঙ্গ হয়ে ক্ষুধায় ধুকতে ধুকতে নীরবে প্রাণ দিচ্ছে। বজ্রকণ্ঠে আজ সেই কথা প্রচার করা দরকার, ভাইসব, বজ্রকণ্ঠে সেই কথা প্রচার করা দরকার।
উত্তেজনায় সেভলি কাঁপতে লাগলো।
ইয়াফিম বললো, তা কেন? মানুষ আমি, সুখ যতটুকু পাই, তার কথাই জানুক, দুঃখ আমার মনে মনেই থাক, কারণ সে আমার একান্ত নিজস্ব জিনিস।
রাইবিন বললো, কিন্তু সেভলির দুঃখ শুধু ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়, ইয়াফি…লক্ষ লক্ষ মানুষ আমরা যে দুঃখ ভুগছি, ও তারই একটা জ্বলন্ত উদাহরণ। ওর মাঝে আমরা নিজেদের ভাগ্যই প্রতিফলিত দেখতে পাই। ও একদম তলা পর্যন্ত নেবেছে…ভুগেছে…তার পর দুনিয়ার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলছে, হুসিয়ার, এদিক পানে পা বাড়িয়ে না।
ইয়াকব সেভলিকে ধরে নিয়ে গিয়ে টেবিলের কাছে বসালো। বসে সেভলি আবার বলতে আরম্ভ করলো, কাজের চাপে মানুষকে পিষে মারে ওরা। ধ্বংস করে মানুষের প্রাণ! কেন? কিসের জন্য? আজ জবাব চাই তার। আমার মুনিব…তার কাপড়ের কলে আমার জীবন দিলুম আমি… আর তিনি? তিনি করলেন কি?–এক প্রণয়িনীকে সোনার হাত-পোয়র পাত্র উপহার দিলেন।…শুধু তাই নয়, প্রণয়িনীর প্রত্যেকটি প্রসাধন-দ্রব্য হল শোনার। সেই পাত্রের মধ্যে আমার বুকের রক্ত, সেই পাত্রের মধ্যে আমার সমগ্র জীবন। ওরই জন্য জীবন গেছে আমার। একটা লোক আমাকে খাটিয়ে খুন করলো। কেন? না,—আমার রক্ত ছাড়া তার প্রণয়িনীর সুখ-সুবিধা হয় না, তার প্রণয়িনীর জন্য সোনার পাত্র কেনা হয় না।
ইয়াফিম মৃদু হেসে বললো, ঈশ্বরের মুঠি ধরে নাকি মানুষ তৈরি হয়েছে–সেই ঈশ্বরের মুর্তির এই অবস্থা! চমৎকার বলতে হবে।
রাইবিন টেবিল চাপড়ে বললো, আর আমরা চুপ করে থাকবে না।
ইয়াকব যোগ করলো, সহ্য করবো না।
মা শোফির দিকে ঝুঁকে পড়ে আস্তে আস্তে শোফিকে জিগ্যেস করলেন, যা বলছে তা সত্যি?
হাঁ। খবরের কাগজে এরকম উপহারের কথা বেরোয়। আর ও যেটা বললো, ও ব্যাপারটা মস্কোর।
রাইবিন প্রশ্ন করলো, কিন্তু সেই মুনিবের–ফাঁসি হ’ল না তার? কিন্তু হওয়া উচিত ছিল। তাকে ঘর থেকে টেনে বের করে জনসাধারণের সামনে হাজির করে, টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে, তার অপবিত্র নোঙরা মাংসপিণ্ড কুকুরের মুখে ফেলে দেওয়া উচিত ছিল। একবার মানুষ জাগুক, তখন তারা এক বিরাট বধ্যমঞ্চ প্রস্তুত করবে, আর সেখানে ওদের অজস্র রক্তধারায় ধৌত করবে এতদিনের অন্যায়। ওদের রক্ত ওদের নয়…ও আমাদের…আমাদের রক্ত আমাদের শিরা থেকে শোষণ করে নিয়েছে ওরা।
সেভলি বলে উঠলো, শীত করছে।
ইয়াকব তাকে ধরে আগুনের কাছে বসিয়ে দিলো। রাইবিন সেভ লিকে দেখিয়ে অনুচ্চস্বরে শোফিকে বলতে লাগলো, বইয়ের চেয়ে টের বেশি মর্মস্পর্শী এই জীবন-গ্ৰন্থ। মজুরের হাত যখন কাটা পড়ে-দোষ মজুরের নিজের। কিন্তু এমনিভাবে একটা লোকের রক্তমোক্ষণ করে তার শবটাকে যখন ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়, তখন?—তখন কি বুঝতে হবে? হত্যার অর্থ বুঝি, কিন্তু এই নির্যাতন, এর মানে বুঝতে পারিনে। আমাদের ওপর ওদের এ নির্যাতন…ওরা কেন করে জানো?- করে দুনিয়ার আমোদ-উৎসব, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সব আত্মসাৎ করবে বলে করে যাতে মানুষের রক্ত দিয়ে ওরা সব-কিছু কিনতে পারে সুন্দরী গণিকা, ব্যার্মিজ টাট্ট… চাঁদির ছুরি, সোনার থালা, ছেলেমেয়ের খেলনা। তোরা কাজ কর, কাজ কর, আমরা কাজ কর, কেবল কাজ কর, আর আমরা? আমরা তোমাদের মেহনতের কড়ি জমাই, আমাদের প্রণয়িনীকে সোনার পাত্র কিনে এনে দিই।…
সেভলি বললো, আমি চাই তোমরা এর প্রতিশোধ গ্রহণ কর। এই রিক্ত-সর্বস্ব জনগণের ওপর অনুষ্ঠিত অন্যায়ের প্রতিশোধ নাও।
রাইবিন বললো, বোজ ও আমাদের এই কথা শোনাবে।
মা বলে উঠলেন, আর কি শুনতে চাও তোমরা? হাজার হাজার মানুষ যেখানে দিনের পর দিন কাজ করে মরছে, আর মুনিব তাদের মেহনতের কড়ি দিয়ে মজা লুঠছে, সেখানে আর কি শুনতে চাও তোমরা?
শোফি তখন দেশ-বিদেশের মজুর-প্রগতির কথা জ্বলন্ত ভাষায় বর্ণনা করে গেলো, তারপর বললো, দিন আসছে, যেদিন সারা দুনিয়ার মজুরেরা মাথা তুলে দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করবে, এ জীবন আর চাইনে আমরা। এ জীবনের এইখানেই পরিসমাপ্তি হোক। সেদিন লুব্ধ ধনীর কাল্পনিক শক্তি তাসের ঘরের মত লুটিয়ে পড়বে, তাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাবে, তাদের অবলম্বন অন্তহিত হবে।
রাইবিন বললো, আর তার জন্য চাই একটা জিনিস–নিজেদের হীন মনে করোনা, তাহলেই তোমরা সমস্ত কিছু জয় করতে পারবে।
মা উঠে দাঁড়ালেন, এবার তাহলে আমরা যাই।
শোফি বললো, হাঁ চলে।
চাষীরা তাদের বিদায় দিলো—পরম আত্মীয়কে মানুষ কেমনভাবে বিদায় দেয়।
পথে আসতে আতে মা বললেন…এ যেন একটা সুন্দর স্বপ্ন। মানুষ আজ সত্য জানবার জন্য উন্মুখ। উৎসবের দিন, প্রত্যুষে দেখেছি মন্দির জনহীন অন্ধকার…ধীরে ধীরে সূর্যও ওঠে, আলো জাগে, নরনারী সম্মিলিত হয়। এও তেমনি আমাদের প্রত্যুষ–
শোফি বললো, হ, আর আমাদের মন্দির এই সমগ্র পৃথিবী।
.
২.০৫
এমনি বিচিত্র গতিতে বয়ে চললো মা’র জীবন-তে। শোফিও টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে দেশময়—দু’দিন থাকে, তারপর কোথায় উধাও হয়ে যায়, কেউ টের পায় না, তারপর আবার অকস্মাৎ এসে হাজির হয়। আইভানোভিচ রোজ ভোর আটটায় চা খেয়ে মাকে খবরের কাগজ পড়ে শোনায়, তারপর নটায় আফিসে চলে যায়। মা ঘরের কাজ করেন, বই পড়তে শেখেন। আর ছবির বইয়ের দিকে মনসংযোগ করেন —ছবি দেখতে ভারি ভালো লাগে তাঁর সমস্ত দুনিয়ার সমস্ত কিছু জিনিস তার চোখের সামনে যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। তারপর চলে তার প্রধান কাজ নিষিদ্ধ পুস্তক এবং ইস্তাহার ছড়ানো। নানা ছদ্মবেশে, নানা স্থানে, নানারকম লোকের সঙ্গে তিনি চলেন, ফেরেন, গল্প করেন, মনের কথা কৌশলে বার করেন। গোয়েন্দারা তাকে কোনোদিনও ধরতে পারেনা। এমনিভাবে ধোরার ফলে মানুষের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র তার কাছে আরো জীবন্ত হয়ে উঠলো। দুনিয়ায় অফুরন্ত ধন, আর তার মাঝে মানুষ দরিদ্র …রাশি রাশি অন্ন, আর তার মাঝে মানুষ উপবাসী।…শত সহস্র জ্ঞানভাণ্ডার, আর তার মাঝে মানুষ নিরক্ষর, শিক্ষাহীন…মানুষ পথের ধুলোয় বসে হাঁকে, একটি কড়ি ভিখ, দাও, বাবা—আর তারই সামনে স্বর্ণশীর্ষ, স্বর্ণগর্ভ দেব-মন্দির!…এই সব দেখে দেখে যে মা এতে প্রার্থনা পরায়ণা ছিলেন, তারও যেন ধীরে ধীরে প্রার্থনার প্রতি আগ্রহ কমে এলো।
পেভেলের বিচারের তারিখ এখনো স্থির হয়নি। পেভেলের কথা ভেবে মা আর তত আকুল হন না। পেভেলের সঙ্গে সঙ্গে আর সকল শহীদের কথাও তার মনে জাগে–দুঃখের পরিবর্তে জাগে এক অনাস্বাদিত-পূর্ব গৌরব আর আরব্ধ-ব্রতে নিষ্ঠা।
শশেংকা মাঝে মাঝে দেখা করতে এসে পেভেলের কথা সুপোয়, বলে, সে কেমন আছে? আমার কথা জানিয়ে তাকে তারপর চলে যায়। শশেংকা পেভেলকে ভালোবাসে, মা জানেন। তার বুক থেকে বেরিয়ে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস।
অবসর পেলেই মা বই নিয়ে বসেন।
আইভানোভিচ মার চোখের সামনে এক গৌরবোজ্জ্বল ভবিষ্যতের ছবি তুলে ধরে বলে, মানুষ আজ অর্থের কাঙালী, কিন্তু একদিন…যখন অর্থের চিন্তা আর তার থাকবেনা, শ্রম-দাসত্ব থাকবে না, তখন সে চাইবে সোনার চাইতেও বড় সম্পদ–জ্ঞান।
মা মুগ্ধ হয়ে ভাবেন, কবে–কতকাল পরে সে শুভদিন আসবে?