০৫.
ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে দেখি সুন্দর সকাল। ঝকঝকে রোদ। আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটা নেই। উঠোনে পানি জমেনি। রান্নাঘর লণ্ডভণ্ড হয়নি। বকুল গাছের ডাল ভাঙার শব্দ শুনেছিলাম। তেমন কিছু না, ছোট্ট একটা ডাল ভেঙেছে। অথচ রাতে মনে হয়েছিল পুরো গাছটা বুঝি ভেঙে পড়ে গেছে।
বাবা একতলার বারান্দায় চাদর গায়ে জবুথবু হয়ে বসে আছেন। তিনি আমাকে দেখে হাসলেন। হাসির ধরন অন্য রকম। যেন এই হাসির আড়ালে কোন মজার রহস্য আছে। সেটা কি? কলঘরের দিকে তাকিয়ে দেখি তকতক করছে। এটাই হল রহস্য। বাবা ফজরের নামাজ শেষ করেই বাড়ি ঝাঁট দিয়েছেন। যে জন্যে বকুল গাছের একটা পাতাও উঠোনে পড়ে নেই। বাবার বাড়ি পরিষ্কারের বাতিক আছে। হঠাৎ হঠাৎ এই বাতিক মাথাচড়া দিয়ে উঠে। তাঁর শরীর ভাল না। কিছুদিন থেকেই বুকে ব্যথা হচ্ছে। এ রকম বুকে ব্যথা নিয়ে এতটা পরিশ্রম করা কি উচিত? বাবাকে এইসব কে বোঝাবে?
শুধু বারান্দা এবং উঠোন না, বাথরুমও ঝকঝক করছে। দেয়ালে ঝুল জমেছিল, এখন কিছু নেই। দুটা বালতি কানায় কানায় পানি ভর্তি। পানি ভর্তি বালতি দেখে আজ যাত্রা শুরু। দিনটা হয়ত ভাল যাবে। চোখে-মুখে পানি দিতে দিতে ভাবছি– আজ কি নাশতা বানানো যায়? সকালে ঘুম ভাঙতেই নাশতার সমস্যাটা মেজাজ খারাপ করে দেয়। বাবলু পরোটা ছাড়া কিছু খেতে পারে না। অন্য কিছু নাকি তার গলা দিয়ে নামে না। গলার ফুটার কাছে আটকে থাকে। বাবা পরোটা খেতে পারেন না, তাঁর জন্যে খুব পাতলা করে রুটি বানাতে হয়। আমি নিজে দুটার কোনটাই খেতে পারি না। আমার পছন্দ হল পাতলা খিচুড়ি। এত পাতলা যে প্রায় স্যুপের মত। মজার ব্যাপার হল, পাতলা স্যুপের মত খিচুড়ি রান্নার কৌশল আমার জানা নেই। মার কাছ থেকে এই বিদ্যা যে শিখে রাখা দরকার ছিল তা কখনো মনে হয়নি। সব সময় মনে হয়েছে রান্নাবান্না শেখার দরকার কি? মা তো আছেনই। একবার শীতের সময় মা হঠ্যৎ এসে বললেন, ও খুকি, আয় তোকে একটা রান্না শিখিয়ে দেই। তোর বাবার খুব পছন্দের রান্না। কঁচা টমেটো পুড়িয়ে ভর্তা। আমি গল্পের বই পড়ছিলাম। বই থেকে মুখ না তুলেই বললাম, টমেটো ভর্তা বানানোর কৌশল আমি শিখতে চাচ্ছি না মা। গুপ্ত বিদ্যা তোমার কাছেই থাকুক। মা কিছু না বলে আমার বিছানার পাশে বসলেন। আমি বললাম, কিছু বলবে? মা বললেন, না। আমি বললাম, তাহলে দয়া করে উঠে যাও। আমি খুব দুঃখের একটা উপন্যাস পড়ছি। উপন্যাস পড়তে পড়তে আমি কাঁদতে শুরু করব। অন্যের সামনে কাঁদতে ভাল লাগে না। মা হাসিমুখে বললেন, কি বইরে খুকি? আমি বললাম, কি বই জেনে কি করবে? তুমি তো আর বই পড় না। মা আবারো হাসলেন। নরম গলায় বললেন, চা খাবি খুকী? চা বানিয়ে দেই? আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, চা খাব না। তুমি আর বিরক্ত করো না তো মা। মা ওঠে গেলেন, দশ মিনিটের মাথায় আবার ফিরে এলেন। একহাতে পিরিচে ঢাকা চায়ের কাপ, অন্য হাতে এক বাটি মুড়ি। তখন আমি বইটি পড়ে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছি। মা চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে হাসিমুখে বললেন, তুই কি যে পাগল! বই পড়ে কেউ এরকম কাঁদে? বইটা জানালা দিয়ে ফেলে দে তো। আমি বই মেঝেতে ফেলে দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কাঁদতে লাগলাম। মাকে জড়িয়ে ধরে সেই আমার শেষ কান্না।
সেদিন সন্ধ্যাতেই হঠাৎ মার শরীর খারাপ হল। শরীর খারাপ হলে তিনি কাউকে কিছু বলেন না। সেদিনও বললেন না। নিজের ঘরে চুপচাপ শুয়ে রইলেন। শুয়ে থাকতেও তার বোধহয় ভাল লাগল না। তিনি সেখান থেকে উঠে এসে। বারান্দায় মেঝেতে বসলেন। আমি বললাম, তুমি ঠাণ্ডা মেঝেতে বসে আছ কেন মা? মা হাসিমুখে বললেন, এম্নি। খুকি, তুই বাবলুকে বল তো একটু আসতে।
আমি বললাম, ওকে ডেকে দিচ্ছি। কিন্তু তুমি আমাকে খুকি ডাকা কবে বন্ধ করবে?
আচ্ছা যা, আর ডাকব না।
আমি বাবলুকে খবর দিতে গেলাম। সে বিরক্ত মুখে বলল, কি জন্যে ডাকছে? উপদেশ দিতে চায়? আমার উপদেশ লাগবে না। এডভাইস আমি হেইট করি।
সে বছরই বাবলু দ্বিতীয়বারের মত আই. এ. ফেল করেছে। ফেল করায় খুব মেজাজ হয়েছে। কেউ ডাকলেই সে ভাবে উপদেশ দেবার জন্যে ডাকা হচ্ছে। বাবলু এল না। গটগট করে মার সামনে দিয়েই বের হয়ে গেল। মা ডাকলেন, এই শোন। বাবলু থমথমে গলায় বলল, আমার কাজ আছে। মা হাসতে লাগলেন, যেন তার কনিষ্ঠ পুত্রের ব্যবহারে তিনি খুব মজা পাচ্ছেন। আমাকে বললেন, ফেল করার পর মনে হয় বাবলুর কাজের চাপ খুব বেড়েছে।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, তুমি হেসে হেসে ওর এই সর্বনাশ করেছ। কখনো রাগ করো না, কখনো ধমক দাও না, তোমার ছেলেমেয়েরা পরীক্ষা ফেল করবে না তো কি?
মা বললেন, খুকি, তোর বাবা কোথায় জানিস?
না।
অফিস থেকে ফিরতে তো দেরি করে না। আজ এত দেরি করছে কেন?
খুব বেশি দেরি হয়নি মা। পাঁচটার সময় অফিস ছুটি হয়– এখন বাজছে মাত্র ছটা। বাবার দেরি দেখে তুমি কি ভয় পাচ্ছ?
না, ভয় পাচ্ছি না।
ঠাণ্ডার মধ্যে মেঝেতে বসে থাকবে না মা, তোমাকে দেখে আমারই ঠাণ্ডা লাগছে –ঘরে গিয়ে খাটের উপর বোস।
ঘরে যেতে ইচ্ছা করছে না। তুই বরং একটা কম্বল এনে বিছিয়ে দে, আমি কম্বলের উপর শুয়ে থাকি।
সন্ধ্যাবেলা কম্বলের উপর শুয়ে থাকবে কেন? তোমার কি শরীর খারাপ?
না, আমার শরীর খারাপ না। শরীর ভালই আছে।
আমি একটা কম্বল এনে ভাজ করে বিছিয়ে দিলাম। মা কম্বলে উঠে এলেন।
বালিশ দেব মা?
না, বালিশ লাগবে না। খুকি, তুই কি তোর বাবার অফিসে একটা টেলিফোন করে দেখবি দেরি হচ্ছে কেন?
ঠিক করে বল তো মা, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?
মা আবারো হাসলেন। মাথা নেড়ে বললেন, শরীর ভালই আছে।
আমাদের টেলিফোন নেই, পান্না ভাবীদের আছে। আমি দোতলায় টেলিফোন করতে গেলাম –এই ফাঁকে খালি বাড়িতে মা মারা গেলেন। টেলিফোন শেষ করে ফিরে এসে দেখি তিনি কাত হয়ে শুয়ে আছেন। তার ঠোঁটের কোণায় হাসি। সারাজীবন তার হাসিমুখ দেখেছি। মৃত্যুর সময়ও হাসিমুখ দেখলাম।
.
কলঘর থেকে বের হয়েই মনে হল –কি আশ্চর্য! আজ তো বাবা-মার ম্যারেজ ডে। আজ পৌষ মাসের ছ তারিখ। ভোররাতে উঠে বাবা যে ঘর ধুয়ে ঝকঝকে করে ফেলেছেন –এই হল তার রহস্য। মা নোংরা দেখতে পারতেন না। বিশেষ বিশেষ দিন মার এই স্বভাবের কথা বাবার হয়ত মনে পড়ে। তার ঘর পরিষ্কারের বাতিক মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।
রান্নাঘরে ঢুকতে যাচ্ছি বাবা ডেকে বললেন, আমার জন্যে নাশতা বানাবি না।
কেন?
শরীরটা ভাল লাগছে না। ভাবছি, রোজা রেখে ফেলব।
শরীর ঠিক রাখার রোজা? শেষ রাতে কিছু খাও নি …।
উপবাস একটা বয়সে খুব কাজে লাগে। আমার এখন যাচ্ছে –উপবাসের বয়স।
হুটহাট করে রোজা রাখার এই ব্যাপারটা বাবার ইদানিংকালের। প্রায়ই এরকম হয় –নাশতা নিয়ে গেছি, বাবা বলেছেন– আজ কিছু খাবনা রে মা। ভাবছি, রোজা রেখে ফেলব।
তবে আজকের রোজার অন্য অর্থ আছে। বিশেষ দিন সামনে রেখে উপবাস। সেই বিশেষ দিনের কথা মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। আর বললেই কি হবে? আমরা তো আর উৎসব করতে পারব না। যে দুজনকে নিয়ে বিবাহবার্ষিকী তার একজনকে দিয়ে উৎসব হয়না।
খুকি!
জ্বি বাবা।
বাবলুকে নিয়ে কি করা যায় বল তো মা –ও তো ভাল যন্ত্রণা করছে!
নেশা করার কথা বলছ?
এটা তো আছেই –বাড়ি বিক্রির তাল ধরেছে। আজ না-কি দালাল আসবে।
কখন আসবে?
সকালেই আসার কথা।
তুমি বাবা এসব নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাবে না। যা ইচ্ছা বাবলু বলুক, কিচ্ছু যায় আসে না। তোমার বাড়ি তুমি বিক্রি করবে না। এর উপর কথা কি? না কি তুমি বিক্রি করতে চাও?
না-না।
তাহলে সমস্যা কি?
না, কোন সমস্যা নেই।
বাবা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে গেলেন। আমি চলে গেলাম রান্নাঘরে। ঘুম ভাঙলেই বাবলু নাশতার জন্যে হৈচৈ শুরু করবে। তার জন্যই বোধহয় হৈচৈ-এর জন্যে হয়েছে।
চায়ের কেতলী চুলায় বসিয়েছি। পান্না ভাবীর কাজের মেয়েটি এক কাপ লবণ নিতে এল। পান্না ভাবী লবণ চেয়ে পাঠিয়েছেন। একটা চিরকুটও দিয়েছেন —
রাত্রি,
এক কাপ লবণ রাণীর হাতে দিয়ে দিও।
সময় করে এসো। কথা আছে।
–পান্না ভাবী।
পান্নাভাবী মানুষটা বেশ অদ্ভুত। দিনের মধ্যে তিন-চারবার স্লিপ পাঠাবেন। তাঁর রান্নাঘরে এক গাদা কাগজ সুতো দিয়ে বাঁধা। কাগজের সঙ্গে একটা পেনসিলও ঝুলছে। তিনি সেখান থেকে কাগজ ছিঁড়েন এবং স্লিপ লেখেন। রাত এগারোটায় একবার স্লীপ এল —
রাত্রি,
তোমার ভাই খেতে বসেছে। কাঁচামরিচ চাচ্ছে। রাণীর হাতে একটা কাঁচামরিচ পাঠিয়ে দাও (যদি থাকে)।
–তোমার পান্না ভাবী।
যদিও স্লিপ পাঠানোর কোন দরকার নেই, রাণী মুখে বললেই হয়। কিংবা তিনি দোতলার রেলিং ধরে দাঁড়ালেও আমার সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
আমি কাপে লবণ ভরতে ভরতে বললাম, তোদের বুঝি লবণ শেষ হয়ে গেছে? রাণী অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে হাসল।
হাসছিস কেন?
আমার ঘরে লবণ আছে।
লবণ আছে তাহলে নিচ্ছিস কেন?
আমি ক্যামনে বলব আফা? আমরার আম্মার মাথার ঠিক-ঠিকানা নাই –কি করে কি না করে …।
রাণী আবার মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে হাসছে। তার বেগম সাহেবের মাথার ঠিক ঠিকানা না থাকায় সে মনে হয় খুব মজা পাচ্ছে।
গত দুই দিন ধইরা সাহেবরে কি সব কথা বলতাছে না তুললে বিশ্বাস হইব না। বুঝছেন আফা, লজ্জায় আমি মইরা যাই –এমন অবস্থা। আমারে লইয়া কথা। ছিঃ ছিঃ কি শরম!
রাণী, তুমি এখন যাও — আমি কাজ করছি।
পরে এক সময় আইয়া আফনেরে সব বিত্তান্ত বলব।
আমাকে কিছু বলতে হবে না।
আফনেরে একবার যাইতে বলছে। আফনের লগে আম্মার জরুরী কথা আছে।
আমি যাব একসময়। তুমি এখন ওঠ।
বাবলু পানির জগ নিয়ে বারান্দায় বসেছে। বাবার সঙ্গে খুব চেঁচামেচি শুরু করেছে। সে একাই চেঁচাচ্ছে, বাবা শুধু শুনে যাচ্ছেন। চেঁচামেচির বিষয়বস্তু হচ্ছে –কেন বাড়ি বিক্রি হবে না? কি আছে এই ভাঙা বাড়িতে? বাবা একবার শুধু বললেন, সকালবেলা কেন চেঁচাচ্ছিস?
বাবলু রীতিমত হুংকার দিল, এমন কোন আইন আছে যে সকালে চেঁচানো যাবে না? বলুন আইনের কোন ধারায় আছে পেনাল কোডের কোথায় লেখা আছে?
আচ্ছা, ওর কি মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে? ও এরকম করছে কেন? বাবার উচিত চুপচাপ বসে থেকে কিছু একটা করা।
এক পয়সা কেপিট্যাল নাই যে ব্যবসা করব। মাত্র তিন লাখ টাকা হলে ভিডিও-র দোকান দিতে পারি। চালু একটা ভিডিও দোকান থাকলে –আর কি লাগে? কিছুই লাগে না। কাকে আমি এটা বুঝাব? আমার কথার কি কোন দাম আছে? কোন দাম নেই।
বাবা বললেন, চুপ কর।
আমি চুপ করব কেন? আপনি চুপ করেন। এখন আর আপনার কথামত সংসার চলবে না। এখন এখন …
সকালবেলা এইসব কি শুরু করলি …?
আমি কিছুই শুরু করিনি। আপনি শুরু করেছেন। আমি বসে বসে ভেরেন্ডা ফ্রাই করব? আমার একটা লাইফ নেই? আমি আপনার কোন কথা শুনতে চাই না—- আজ এগারোটার সময় লোক আসবে –আপনি তাদের সঙ্গে কথা বলবেন … অবশ্যই বলবেন। যদি না বলেন … ।
না বললে কি করবি? তুই মারবি না-কি আমাকে?
আমি বারান্দায় এসে বললাম, বাবলু, নাশতা খেতে আয়। বাবলু খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রান্নাঘরে ঢুকল। তাকে দেখে কে বলবে যে কিছুক্ষণ আগেই হৈ চৈ করে এসেছে? চুলার আগুনের উপর হাত মেলে দিয়ে খুশি গলায় বলল –শালার শীত কাকে বলে দেখলি? নাশতা এখানেই দে। আগুনের পাশে বসে নাশতা খেয়ে ফেলি। তোর সাথে আমার আর্জেন্ট কথা আছে। নাশতা খেতে খেতে কথা সারি।
তোর সঙ্গে আমার কোন কথা নেই।
তোর কথা নেই। কিন্তু আমার আছে …। বাবা আমার কথা শুনতে চাচ্ছে না, তোকে শুনতে হবে। মোট বার কাঠার উপরে আমাদের এই ভাঙা বাড়ি। আমরা দেড়তলা নিয়ে থাকি –অর্ধেকটা ভাড়া দেই। সেই ভাড়ায় সংসার চলছে। কি ভাবে চলছে? গরুর গাড়ির মত –টুকুর টুকুর। টুকুর টুকুর। অথচ এখন ঢাকা শহরের এরকম একটা জায়গায় বার কাঠা জমি হল গোল্ডমাইন। স্বর্ণখনি … তুই আমার কথা শুনছিস তো?
শুনছি।
বাড়িটা বিক্রি করে দিলে যে টাকা পাওয়া যাবে সেটা শুনলে তোর হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে যাবে। সেই টাকায় গুলশান এলাকায় বাড়ি ভাড়া করে আমরা পায়ের উপর পা তুলে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারি।
তুই তোর ভিডিও-র দোকানটাও দিতে পারিস।
অবশ্যই পারি। ভিডিও-র দোকান বলে হেলা করিস না। আমি যা করতে যাচ্ছি তা হল –ফুল ভিডিও ইউনিট। রেন্টাল সেকশান তো থাকবেই। রেন্টাল সেকশানের বাইরে থাকবে ভিডিও ইউনিট প্লাস স্টুডিও … তুই তো আমার কথা শুনছিস না?
শুনছি।
শুনলে কিছু বলছিস না কেন?
তোর কথা বলার কথা। আমার বলার কথা না।
হ্যাঁ, দ্যাটস রাইট। টোটাল পরিকল্পনা করা আছে। অনেকের সঙ্গে কথাও বলেছি। একজন তার একটা পুরো ভিডিও ইউনিট বিক্রি করে দিচ্ছে পানির দামে।
তোর ভিডিও ইউনিটে কত টাকা লাগবে?
শুরুতে লাগবে লাখ দশেক। কিছু রানিং কপিটেল লাগবে। কর্মচারীদের বেতন। দোকান ভাড়া …।
আমি তোকে দশলাখ টাকা দেব। বাড়ি বিক্রি হবে না।
বাবলু চোখ বড় বড় করে বলল –দশ লাখ টাকা তুই আমাকে দিবি?
হ্যাঁ।
পাবি কোথায়?
কোথায় পাব সেটা দিয়ে তো তোর দরকার নেই। তোর পেলেই হল। তবে একটা কঠিন শর্ত আছে।
কি শর্ত?
বাড়ি বিক্রির নামও মুখে আনবি না।
কেন?
এই বাড়িতে আমরা ছোট থেকে বড় হয়েছি। বকুল গাছের নিচে মার কবর আছে। দাদাজানের কবর আছে। এর উপর দশতলা বিল্ডিং হবে?
বাবলু চিন্তিত মুখে সিগারেট ধরিয়েছে। আমি বললাম, আরেক কাপ চা দেব?
দে? তোর কাছে সত্যি দশলাখ টাকা আছে?
হু।
পেয়েছিস কোথায়? মামুন সাহেব দিয়েছে?
সেটা জানা তো জরুরী না। জরুরী হল –টাকাটা তুই পাবি কি পাবি না।
আমি পাব?
হ্যাঁ।
কখন পাব?
তুই খোঁজ-খবর করতে থাক। আজই তো আর তোর দশ লাখ টাকার দরকার নেই?
না, আজ দরকার নেই।
এত বড় একটা ব্যবসায় নামছিস, ভালমত খোঁজ খবর করবি না? এক লোক পানির দামে তার ভিডিও ইউনিট বিক্রি করে দিতে চাচ্ছে। কেন চাচ্ছে? সেটা দেখার দরকার না? হয়ত ঐ যন্ত্রটাই নষ্ট। ছবি উল্টা আসে।
বাবলুর ভুরু কুঁচকে আছে। সে গভীর চিন্তায় পড়েছে। আমি বললাম, খোঁজ খবর কর। ঘোরাঘুরি করতে খরচ আছে –আমি সেই খরচ দিয়ে দিচ্ছি। ঐটা দশলাখ টাকা থেকে কাটা যাবে। তবে যেহেতু এটা ক্যাপিটেল থেকে দিচ্ছি সেহেতু প্রতিটি পাই-পয়সার হিসাব খাতায় লিখে রাখবি।
তা তো রাখতেই হবে। আপা, তুই কি আমার পার্টনার হবি?
না।
তোর কি সত্যি দশ লাখ টাকা আছে?
আছে, এক কথা কবার বলব।
টাকাটা রেখেছিস কোথায়? ব্যাঙ্কে?
ব্যাঙ্ক ছাড়া কোথায় রাখব? তোষকের নিচে তো রাখতে পারি না। ফিক্সড ডিপোজিটে রাখা আছে।
ভাল। ফিক্সড ডিপোজিটে রাখাই ভাল।
বাবলু আরাম করে সিগারেটে টান দিচ্ছে। ওর দিকে তাকিয়ে আমার মায়াই লাগছে। ওর এত কম বুদ্ধি! বিশ্বাস করে ফেলেছে যে আমার দশলাখ টাকা আছে। কি করে বিশ্বাস করতে পারল? একবারও ভাবল না, এতগুলি টাকা কোত্থেকে আসবে?
বাবলু নাশতা শেষ করে আমার সঙ্গে উঠে এল। আমি তাকে দু হাজার টাকা দিলাম। সে হতভম্ব গলায় বলল, মাত্র দু হাজার?
দু হাজারের বেশি টাকার এখন তো তোর দরকার নেই। এই টাকাটা তো তুই রিকশা ভাড়াতেই খরচ করবি –এই টাকাটা দিয়ে তো তুই আর ভিডিও ইউনিট কিনতে যাবি না।
তা ঠিক।
হিসাবপত্র তুই কিন্তু লিখে রাখবি।
অবশ্যই লিখে রাখব।
আর শোন, এগারোটার সময় তোর কি সব দালাল-ফালালের বাবার সঙ্গে দেখা করার কথা –ওরা যেন না আসে।
আচ্ছা, ওদের বলে দেব।
আরেকটা কথা শোন বাবলু, বাড়ি আমরা বিক্রি করব কেন? দরকার হলে বাড়ি ভেঙে নিজেরাই মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং করব। মাটির নিচে থাকবে পার্কিং স্পেস। একতলায় তোর ভিডিও ইউনিট। দোতলা থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত ফ্ল্যাট।
বাবলু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না, আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না। সে ইতস্তত করে বলল, পুরো একতলাটা ভিডিও ইউনিট হবে?
তোর প্রয়োজন হলে হবে। প্রয়োজন না হলে দোকানপাট হতে পারে।
আমার পুরোটাই লাগবে। ভিডিও ইউনিটের সঙ্গে আমার একটা ফটোগ্রাফির দোকানও থাকবে। স্টিল ফটোগ্রাফি।
স্টিল ফটোগ্রাফির ব্যবসা কি আর ভাল হবে? স্টুডিওতে আজকাল কেউ ছবি তুলতে যায়? ছবি যা তোলার ঘরেই তুলে।
বাবলু উৎসাহের সঙ্গে বলল ফটোগ্রাফি ব্যবসার তুই কিছুই জানিস না। ঢাকা শহরে পাসপোর্ট সাইজ ছবি কতগুলি তোলা হয় তুই জানিস? ইউনিভার্সিটি এডমিশন টেস্টে লাগে, কলেজে লাগে, স্কুলে লাগে, যে কোন এপ্লিকেশনে লাগে। এমনকি মরার পরে কবর দেয়ার জন্যে লাগে—পাসপোর্ট সাইজ ছবি তো তুই আর ঘরে বসে তুলতে পারবি না –স্টুডিওতে গিয়ে তুলতে হবে।
মরা মানুষ স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তুলবে কি ভাবে?
পুরানো পাসপোর্ট সাইজ ছবি দিয়ে ওদের কাজ সারতে হবে।
ও আচ্ছা।
স্টুডিওর ব্যবসা হল –এই যুগের সবচে রমরমা ব্যবসা।
বেশ তো। তুই তাহলে একটা স্টুডিওর ব্যবস্থাও রাখ।
রাখতেই হবে, উপায় নেই। সারভাইভেলের জন্যে রাখতে হয়।
বাবলু আনন্দিত মুখে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। বাবার সঙ্গে সে সহজভাবে কথাবার্তা বলবে। দুহাজার টাকা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার মেজাজ কিছু দিনের। জন্যে ঠাণ্ডা থাকবে।
বাবলু ঠিকই নিচে বাবার সঙ্গে কথা বলছে। বাবলুর গলাই শুধু শুনছি। বাবা হা হুঁ করে যাচ্ছেন। বাবলু বলছে –বাবা, ঠিক করেছি বাড়ি অন্যের কাছে বিক্রি করব না। যা করার নিজেরাই করব। এগারোটার সময় দালাল পার্টি চলে আসবে। আমি তো আর থাকব না –আমার অন্য কাজ আছে। আপনি ওদের বলে দেবেন –পথ দেখ।
আচ্ছা।
বলবেন– কথাবার্তা যা বলার আমার ছেলের সঙ্গে বল– সংসার এখন আমার ছেলেই দেখছে। আমি এখন ওল্ডম্যান, রিটায়ার্ড করেছি –আল্লা-বিল্লা নিয়ে থাকি ….।
আচ্ছা যা, বলব।
কিছু কিছু মানুষের সুখী হবার ক্ষমতা দেখলে ঈর্ষায় গা জ্বলে। বাবলু তাদের একজন। প্রতিদিন অন্তত কয়েকবার সে নিজেকে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ ভাবে। এরচে আনন্দময় ব্যাপার আর কি হতে পারে!
.
বাবুল চলে যেতেই বাবা বললেন, রাত্রি মা, তোর কথাটা নিয়ে আমি খুব ভাবছি। কাল অনেক রাত পর্যন্ত ভাবলাম।
কোন কথাটা বাবা?
ঐ যে বাবলুকে বিয়ে দেবার কথা বললি –নতুন একজন মানুষ এলে সংসারের সৌন্দর্য বাড়ে। তোরও একজন সঙ্গি হয়।
আমার সঙ্গির চেয়ে বড় কথা তোমার সঙ্গি হয়। তোমারই কথা বলার লোক দরকার।
বাবা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কথা হচ্ছে –বাবলুকে কে মেয়ে দেবে? কার এতো দায় পড়েছে? তাছাড়া লুকোছাপা করে তো বিয়ে দেয়া যাবে না। ছেলে যে কি চিজ সেটা আগেভাগেই বলে নিতে হবে। তার তো গুণের অভাব নেই।
পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দেব –পরপর তিনবার আই এ, ফেল পাত্রের জন্য সুন্দরী, শিক্ষিতা, গৃহকর্মে নিপুণা সদ্বংশজাত পাত্রী প্রয়োজন। পাত্রের নেশাভাং করার সামান্য অভ্যাস আছে। মেজাজ খারাপ হলে সে করে না এমন জিনিস নেই। হৈ-চৈ, ভাংচুর, মারামারি তার মধ্যে অন্যতম। পাত্রের ভাল দিকের মধ্যে একটি হল –পাত্রের বাবা এই পৃথিবীর সেরা মানুষদের একজন।
বাবা হেসে ফেললেন। অনেকদিন পর তাকে হাসতে দেখলাম। হাসি ভয়ংকর ছোঁয়াচে, আমি নিজেও হাসছি। দুজনই হাসছি বেশ শব্দ করে। আমাদের হাসির শব্দ শুনেই বোধহয় দক্ষিণের বারান্দায় পান্নাভাবী এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বারান্দায় কাপড় শুকাতে দিচ্ছেন। কাপড় শুকাতে দেয়ার ব্যাপারটা তাঁর অজুহাত। তিনি আমাদের হাসি শুনে বারান্দায় এসেছেন দেখার জন্যে যে কি হচ্ছে। আমরা যতক্ষণ হাসাহাসি করব ততক্ষণ তিনি বারান্দাতেই থাকবেন। নড়বেন না।
বাবা!
কি রে মা?
তুমি কি সত্যি বাবলুর বিয়ে দিতে চাও?
বুঝতে পারছি না।
সত্যি সত্যি যদি চাও তাহলে পান্নাভাবীকে বলতে পারি। বিয়ে-টিয়ের ব্যাপারে তাঁর দারুণ উৎসাহ। দেখবে, এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে যাবে। বলব উনাকে?
না থাক। মেয়েটার জীবন নষ্ট করে দেবে। দরকার কি?
আমি মনে মনে হাসলাম। জীবন নষ্ট হবার হলে নষ্ট হবেই। কোন হিসাব নিকাশ কাজে লাগবে না। মামুন ছেলে হিসেবে কি চমৎকার ছিল না? সুন্দর, সুপুরুষ। কি প্রচণ্ড প্রাণশক্তি! সে কথা বলতে শুরু করলে মুগ্ধ হয়ে শুনতে হবে। সে যখন যা বলবে তখন মনে হবে এটাই সত্যি। টুকুনকে সে আমার সঙ্গে দেখা করতে দিচ্ছে না। ভয়ংকর একটা অন্যায় সে করছে কিন্তু কেন করছে সেই যুক্তি যখন সে দেয় তখন মনে হয় সে যা করছে ভালই করছে। ব্যাপারটা এরকমই হওয়া উচিত।
দক্ষিণের বারান্দা থেকে পান্নাভাবী ডাকলেন –রাত্রি, এই রাত্রি।
আমি তাকালাম। পান্নাভাবী বললেন, তাড়াতাড়ি একটু আস তো। তাঁর গলার স্বরে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে ভয়ংকর কিছু ঘটে যাচ্ছে। যদিও কিছুই ঘটছে না। পান্নাভাবীর গলার স্বরে থাকে সার্বক্ষণিক উদ্বেগ। এই উদ্বেগের কোন ভিত্তি নেই। আমি দোতলার দিকে রওনা হলাম।
পান্নাভাবীর বসার ঘরে নাজমুল ভাই। তিনি চাদর গায়ে সোফায় বসে আছেন। তার হাতে বই বা প্যাড এবং কলম থাকার কথা, এখন কিছুই নেই। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে সুন্দর এই সকালে তিনি ভয়ংকর কোন দুঃস্বপ্ন নিয়ে বসে আছেন। আমি বললাম, কেমন আছেন নাজমুল ভাই?
তিনি কোন শব্দ করলেন না। তাঁর দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। পান্নাভাবী বললেন, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করেছে আর তুমি পাথরের মূর্তি হয়ে গেছ। ব্যাপার। কি? কিছু একটা বল।
নাজমুল ভাই কিছু বললেন না, আরো একটু গুটিয়ে গেলেন। পান্নাভাবী বললেন, রাত্রির সঙ্গে দিনের আলোয় কথা বলতে তোমার এত লজ্জা কেন? বেচারীর নাম রাত্রি বলে যে তার সাথে শুধুই রাত্রে কথা বলতে হবে তা তো না। তোমার অস্বাভাবিক আচরণ সহ্য করা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুমি রাত্রির দিকে তাকিয়ে একটু হাস তো।
নাজমুল ভাই ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। আমি বললাম, আমাকে কি জন্যে ডেকেছেন ভাবী?
শোবার ঘরে আস। বলছি।
জরুরী কিছু?
জরুরী তো বটেই। খুবই জরুরী।
পান্নাভাবী আমার হাত ধরে আমাকে তাঁর শোবার ঘরে নিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি বললাম, আপনার জরুরী কথার আগে আগে আমি একটা জরুরী কথা বলে নেই। পরে ভুলে যাব –ভাবী, আপনার সন্ধানে কি ভাল কোন মেয়ে আছে? মিষ্টি স্বভাবের হাসি-খুশি মেয়ে।
কেন?
বাবলুর বিয়ে দেব।
মেয়ে তো একটা না, গণ্ডায় গণ্ডায় আছে। ভাল ভাল মেয়ে আছে। একটা মেয়ে আছে — জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজিতে এম. এ. পড়ছে। অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস থার্ড হয়েছিল।
আমি অবাক হয়ে বললাম, এরকম একটা মেয়ে বাবলুর মত ছাগলকে বিয়ে করবে কেন?
ছাগল বলছিস কেন? সুন্দর চেহারা। ঢাকা শহরে এতবড় বাড়ি। সংসারের দায়দায়িত্ব কিছুই নেই।
আই এ, ফেল বখা একটা ছেলে। নেশাভাং করছে।
পুরুষ মানুষ তো গাছ না –পুরুষ মানুষ একটু এদিক-ওদিক করে। বিয়ের পর নেশাভাং না করলেই হল। আর আই এ. ফেল এইটা বলার দরকার কি? কেউ তো আর সার্টিফিকেট পরীক্ষার জন্যে আসছে না? মেয়ের বাবা-মারা কখনো ছেলের পরীক্ষার সার্টিফিকেট দেখে না। তারা দেখে বাড়িঘর। তুমি এখন আমার কথা শোন।
বলুন শুনছি।
রাণীর ইউরিন টেস্ট করতে দিয়েছি। আজ রেজাল্ট দেবে। আমি আনতে যাচ্ছি।
ও আচ্ছা।
পান্নাভাবীর চোখ চকচক করতে লাগল। মহিলা কি অসুস্থ? সুস্থ কোন মেয়ে এমনভাবে কথা বলে না। পান্নাভাবী গলা নামিয়ে প্রায় ফিস ফিস করে বললেন –টেস্ট পজিটিভ হলে মজা দেখবে। আজই বিয়ে পড়িয়ে দেব। চাকরাণী নিয়ে বাসর করবে। আমি পাশেই বসে থাকব।
আমি বললাম, এইটাই কি আপনার জরুরী কথা?
হ্যাঁ, এইটাই জরুরী কথা। তোমার শোনা দরকার।
আমার শোনা দরকার কেন?
আমার আপনজন তো কেউ নেই। তোমাকে ছোটবোনের মত দেখি এই জন্যেই বলা।
পান্নাভাবী আমাকে ঘরে রেখেই কাপড় বদলাতে শুরু করলেন। এই তাঁর আর এক অদ্ভুত মানসিকতা। ব্যাপারটা এর আগেও কয়েকবার ঘটেছে। পরনে শুধু পেটিকোট রেখে তিনি আর সবকিছু খুলে ফেলেন এবং বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই কথাবার্তা বলতে থাকেন। যেন কাপড় পরার ব্যাপারটা তিনি ভুলে গেছেন। অর্ধনগ্ন অবস্থায় চুল আঁচড়াতে বসেন যেন কাপড় পরার আগে চুল আঁচড়ানোটা সেরে ফেলা দরকার। পান্নাভাবী এটা কেন করেন? তাঁর শরীরটা যে খুব সুন্দর এটা কি আমাকে দেখাতে চান? তার কি কোন প্রয়োজন আছে?
পান্নাভাবী, আমি যাই।
যাই যাই করছ কেন? বোস না, কাপড়টা পরি, তারপর একসঙ্গে বের হই।
কাপড় পরতে ভাবীর অনেক সময় লাগল। কোন শাড়িই পছন্দ হয় না। একটা পছন্দ হল, সেটা খানিকটা কুঁচকে আছে। রাণীকে ডাকলেন শাড়ি ইস্ত্রি করে দেবার জন্যে। তিনি শুধু পেটিকোট পরে আমার সঙ্গে গল্প করছেন। রাণী শাড়ি ইস্ত্রি করছে। শাড়ি ইস্ত্রি করতে করতেই সে একবার মুখ নিচু করে হাসল। পান্নাভাবী থমথমে গলায় বললেন –হাসছিস কেন? কেন হাসছিস? তুই ভেবেছিস কি নষ্টামি করে এত সহজে পার পেয়ে যাবি? এত সহজে তোকে আমি ছেড়ে দেব? কত ধানে কত চাল তোকে বুঝিয়ে ছাড়ব।
রাণী গালাগালি গায়ে মাখছে না। সে ইস্ত্রি করে যাচ্ছে। পান্নাভাবীর গলার স্বর উঁচু থেকে উঁচুতে উঠছে। আমি তাদের এই অবস্থায় রেখে চলে এলাম।
আমার নিজেরই অনেক সমস্যা, অন্যের সমস্যায় জড়িয়ে পড়ার কোন কারণ নেই। চলে আসার সময় নাজমুল ভাইকে দেখে খুব মায়া লাগল। কেমন জবুথবু হয়ে বসে আছেন। তাঁকে জড় পদার্থের মত লাগছে। আমি বললাম, নাজমুল ভাই, যাচ্ছি। তিনি চোখ তুললেন না। মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
.
সেই রাতে এক কাণ্ড হল। রাত দশটার মত বাজে। আমি ছাদে হাঁটতে গেছি। ছাদে হাঁটা আমার নিত্যদিনের অভ্যাস না। মাঝে মাঝে যাই। আমাদের ছাদটা তেমন সুন্দর না –ছাদে ওঠার সিঁড়িটাও সরু এবং অন্ধকার। তার চেয়েও বড় কথা –ছাদের না-কি কি একটা দোষ আছে। অনেকেই ছাদে লম্বা লম্বা মানুষ হাঁটাহাঁটি করতে দেখেছে। মা বেঁচে থাকা অবস্থায় কখনোই একা আমাকে ছাদে আসতে দিতেন না। এখন মাঝে মাঝে আসি। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবা সিঁড়িঘরের কাছে এসে ব্যস্ত হয়ে আমাকে ডাকতে থাকেন, রাত্রি, নেমে আয় তো মা। নেমে আয়।
আজও তাই হল। ছাদে কিছুক্ষণ হাঁটার পরই বাবা এসে ডাকলেন, নেমে আয় তো মা। আমি বললাম, আমি নামব না বাবা, তুমি উঠে এসো।
বাবা বললেন, নাজমুল সাহেব তোকে খোঁজ করছেন। উনার স্ত্রী সকালে বাড়ি থেকে বের হয়েছেন, এখনো ফেরেননি। ভদ্রলোক খুব অস্থির হয়েছেন।
অস্থির হলে আমি কি করব? আমি তো জানি না ইনি কোথায়?
তোর সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন, নেমে আয় না।
নাজমুল ভাই আমাদের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন। সকালের সেই জবুথবু ভাব আরো বেড়েছে পান্নাভাবী না ফেরায় তিনি যে খুব চিন্তিত সেটা বোঝা যাচ্ছে। কথাও ঠিকমত বলতে পারছেন না, জড়িয়ে যাচ্ছে। আমাকে বললেন, ও বাইরে গেলে কখনো একঘণ্টা-আধঘণ্টার বেশি থাকতে পারে না। আজ কি ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি কি জান কোথায় গিয়েছে?
কোথায় গিয়েছেন আমি জানি –রাণীর প্রেগনেন্সি টেস্টের রিপোর্ট আনতে। কিন্তু সেই কথা নাজমুল ভাইকে বলা যায় না। আমি চুপ করে রইলাম।
নাজমুল ভাই প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বললেন, আমাকে নিয়ে ওর নানা সন্দেহ। অকারণ সব সন্দেহ। আমি জানি তোমাকে সে সব বলেছে –এই জন্যেই প্রসঙ্গটা বললাম। তুমি কি না কি ভাবছ ….
আমি কিছুই ভাবছি না।
ও এরকম ছিল না। বিয়ের পর পর ওর জরায়ুতে টিউমার ধরা পড়ল। ডাক্তাররা জরায়ু কেটে বাদ দিল। তারপর থেকে ওর ধারণা হয়েছে, যেহেতু তার কোনদিন বাচ্চা-কাচ্চা হবে না সেহেতু আমার কাছে তার কোন দাম নেই। তখন থেকেই সন্দেহ-রোগ। তুমি কিছু মনে করো না।
আমি কিছু মনে করছি না। আপনি আমাকে নিয়ে কোন চিন্তা করবেন না।
ওর সন্দেহটা তুমি ক্ষমার চোখে দেখো। সাইকোলজিক্যাল সমস্যা। ভাল কোন সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখাতে চাই –ওকে সেই কথাটা বলারও সাহস নেই –হুঁট করে রেগে উঠবে। রাত্রি, তোমার কাছে আমি খুব লজ্জিত।
আমার কাছে লজ্জিত কেন?
উনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন –ওর সবচে বড় সন্দেহ তোমাকে নিয়ে। ওর ধারণা, তুমি স্বামী-সংসার ছেড়ে এ বাড়িতে চলে এসেছ শুধুই আমার কারণে।
সে কি?
তোমাদের বাড়ি ছেড়ে আমি অন্য কোথাও বাসা ভাড়া নিতে চেয়েছিলাম, সে তাও করতে দেবে না। আমি কি যে বিপদে পড়েছি সেটা শুধু আমি জানি। কাল রাতে তোমার সঙ্গে কথা হয়েছে– সে শুনে ফেলেছে, তারপর থেকে মাথা খারাপের মত হয়ে গেছে।
আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। অবাক হয়ে দেখছি ভদ্রলোকের চোখে পানি এসে গেছে। তিনি চোখের পানি গোপন করার চেষ্টা করলেন না। চোখ মুছলেন। শান্ত গলায় বললেন, ও যদি জানতো তাকে আমি কতটা ভালবাসি তাহলে এইসব পাগলামী সে করতো না। সেটা জানানোর বুদ্ধি কি তাও আমি জানি না। ওর বাচ্চা-কাচ্চা হবে না তাতে কি হয়েছে? ওকে আমি ওর জন্যেই ভালবাসি।
দোতলার দক্ষিণের বারান্দা থেকে রাণী উৎফুল্ল গলায় বলল, আম্মা আসছেন। এই অক্ষণ বেবীটেক্সী থাইক্যা নামছেন।
নাজমুল ভাই তাঁর ঘরে যাচ্ছেন। আমি যাচ্ছি তাঁর পেছনে পেছনে। কি ব্যাপার জেনে আসা যাক।
পান্নাভাবী আমাকে দেখে আনন্দিত গলায় বললেন, বাবলুর জন্যে এত দেরি হল। ওর জন্যে মেয়ে দেখতে নানান জায়গায় গেলাম। একটির সঙ্গে কথাবার্তা মোটামুটি বলে এসেছি। কাল এ বাড়িতে নিয়ে আসব। তুমি দেখ পছন্দ হয় কিনা। মেয়ের একটাই শুধু ডিফেক্ট– গায়ের রঙ শ্যামলা।
আমি বললাম, যে রিপোর্টের জন্যে গিয়েছিলেন সেই রিপোর্ট কি?
পান্নাভাবী গম্ভীর গলায় বললেন, রিপোর্ট কিছু পাওয়া যায়নি। তোমার ভাই তো আর বোকা না। এত কাঁচা কাজ করবে না। প্রপার প্রিকশান নিয়ে মাঠে নামবে। করেছেও তাই। ভাল কথা –মেয়েটার নাম বীনু। ওরা পাঁচ বোন, সে হচ্ছে সবচে বড়। কোন ফ্যামিলিতে অনেকগুলি মেয়ে যদি থাকে তাহলে বড় মেয়েটা হয় সবচে ভাল। তাকে সংসার দেখতে হয়, বোনদের মানুষ করতে হয়– এইসব করতে করতে ওরা খুব কাজের মেয়ে হয়। বীনু এবার লালমাটিয়া কলেজে বি. এ. পড়ছে। তার বাপ-মা এখনি বিয়ে দিতে চায়। অনেকগুলি মেয়ে তো এখন থেকে পার করা না ধরলে সমস্যা। ওদের সংসারের অবস্থাও নড়বড়ে। দিনে আনি দিনে খাইয়ের চেয়েও খারাপ।
পান্নাভাবী কথা বলেই যাচ্ছেন। বলেই যাচ্ছেন। আমি শুনছি। পান্নাভাবীর মুখ থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না। এই মহিলা যে এত রূপবতী তা আগে কখনো লক্ষ্য করিনি। এরকম একটা ব্যাপার ওদের চোখ এড়িয়ে গেল কি করে বুঝতে পারছি না।
.
০৬.
মামুনদের অফিসের মেয়েটি আমাকে চিনল। হাসি মুখে বলল, ও আপনি এসেছেন? আমি মাথা নাড়লাম। আজ মঙ্গলবার। দশটা এখনো বাজে নি। ছসাত মিনিট বাকি আছে। মামুন আমাকে সকাল দশটায় আসতে বলেছে। রীতিমত এপয়েন্টমেন্ট করে আসা।
মেয়েটি বলল, আপনি চলে যান। স্যার ঘরে একা আছেন।
দশটাতো এখনো বাজে নি।
না বাজুক ঢুকে যান।
মামুনের ঘর অন্ধকার। বড় সাহেবদের কামরায় আলো কম থাকার নিয়ম। আলো কম মানেই রহস্য। বড় সাহেবরা চারদিকে রহস্য রাখতে পছন্দ করেন। মামুন বলল, এসো এসো। আমি বললাম, ভাল আছ?
হ্যাঁ ভাল আছি। তিন পাউন্ড ওজন পর্যন্ত বেড়েছে। ঐ দিন তোমাকে দেখা করতে দেইনি– মেজাজ খুব খারাপ ছিল –তার চেয়ে বড় কথা অন্য একটা এপয়েন্টমেন্ট ছিল।
সাফাই দেবার দরকার নেই।
সাফাই গাইছি না। যেটা সত্যি সেটা বলছি। মালয়েশিয়ার সঙ্গে কোলাবোরেশনে আমার ইন্ডাসট্রি। ওদের একজন রিপ্রেজেনটেটিভ এসেছিলেন। এসেই নানান ফ্যাকড়া। প্রথম দিনেই বললেন –তার লোনলি লাগছে একজন কোম্পেনিয়ন পেলে ভাল হয়। কোম্পেনিয়ন কি আশাকরি বুঝতে পারছ।
পারছি।
সোহারওয়ার্দি উদ্যানের কুড়ি টাকা রোটের কোন মেয়েকে নিয়ে দিলেতো হবে না –আমার এমন মেয়ে দরকার হোটেল সোনারগায়ে থেকে যার অভ্যাস আছে। যে ইংরেজি বলতে পারে। ইন্টারেস্টিং কনভারসেসান চালাতে পারে। বিছানাতেও যার পারফরমেন্স চমৎকার …
আমাকে এসব কেন শুনাচ্ছ?
শুনতে ভাল লাগছে না?
না।
শোন এই গল্পের শেষটা খুব ইন্টারেস্টিং। গল্পের শুরু ভাল না লাগলেও –শেষটা ভাল লাগবে। যাই হোক ভদ্রলোকের জন্যে একজন কোম্পেনিয়ন জোগাড় করে দিলাম। আমি মেয়েটিকে খুব ভালমত চিনি। কোম্পেনিয়ান হিসেবে এরচে ভাল কিছু কল্পনাও করা যায় না। সমস্যা দেখা দিল তারপর।
কি সমস্যা?
মামুন হাসতে হাসতে বলল, এই দেখ তুমিও এখন আগ্রহ বোধ করছ গল্প শুনতে চাচ্ছ — যাই হোক শোন সেই মালয়েশিন তার কোম্পেনিয়ান পেয়ে এতই আনন্দিত আমাকে টেলিফোন করে বলল –এই মেয়েটিকে বিয়ে করে সে দেশে নিয়ে যেতে চায়। এই টেলিফোনটা পেলাম তোমার স্লীপ পাঠানোর দশ মিনিট আগে। ব্যাটা টেলিফোনেই কেঁদে ফেলে এমন অবস্থা– রাগে আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। তুমি ফুর্তি করতে চাও –ফুর্তি কর উটাস ঝামেলা কেন? আর তুমি চাইলেই ঐ মেয়ে তোমাকে বিয়ে করবে কেন? মেয়েটার স্বামী আছে, সংসার আছে।
স্বামী সংসার আছে?
অবশ্যই আসে। পারিবারিক জীবনে এইসব মেয়েরা সুখী ধরণের হয়। সুখ প্রধানত আছে অর্থনৈতিক মুক্তি থেকে। এইসব মেয়েদের অর্থনৈতিক মুক্তি থাকে। শরীরকে মন্দির মসজিদ ভাবলে চলে না। শরীর হচ্ছে শরীর। শরীরের আবার পবিত্রতা কি?
তুমি এসব আমাকে কেন শুনাচ্ছ?
কেন শুনাচ্ছি নিজেও জানি না। যাই হোক কেন এসেছ বল।
টুকুনের জন্যে এসেছি। ও এখন কোথায়?
আগে যেখানে ছিল সেখানেই আছে তবে শিগগীরই দেশে আসছে।
আমার সঙ্গে কিছুদিন ওকে থাকতে দেবে?
কিছুদিন না। ঘন্টা খানিক কিংবা ঘন্টা দুই ওর সঙ্গে কাটাতে চাইলে কাটাবে। মা-ছেলের কঠিণ ভালবাসাকে এড়াতে চাই –সেই জন্যেই এই ব্যবস্থা।
টুকুন কবে আসবে?
একজাক্ট ডেট জানি না। ও এলে অবস্থা বুঝে তোমাকে খবর দেব। রিসিপশনিষ্ট মেয়েটিকে পাঠিয়ে দেব। ওর নাম –তপতী। সুন্দর নাম না?
হ্যাঁ।
মালয়েশীয়ান ব্যাটা যে মেয়ের জন্যে পাগলের মত হয়ে আছে –তপতী হচ্ছে সেই মেয়ে।
এই জাতীয় মেয়ে তাহলে তোমার হাতের কাছেই থাকে?
রাখতে হয়। রাত্রি তুমি কি আমার সঙ্গে লাঞ্চ করবে? না।
অনেকদিন পর তোমাকে দেখে ভাল লাগছে –এই জন্যে বলছি। বন্ধু হতেতো বাধা নেই।
বাধা আছে। আমি উঠব।
বোস আরেকটু বোস। দুটা কথা বলি মন দিয়ে শোন –স্ত্রী হিসেবে তুমি চমৎকার। ইচ্ছে করলে তুমি আবারো আমার কাছে ফেরত আসতে পার। একটাই শর্ত — আমাকে আমার মত থাকতে দিতে হবে।
তোমার কাছে ফিরে যাবার আমার কোন ইচ্ছা নেই।
একদিন ইচ্ছা হবে তখন আর সময় থাকবে না। আমি বিয়ের কথা ভাবছি। তোমার সন্ধানে কোন ভাল মেয়ে আছে?
কি রকম মেয়ে চাও? এমন কেউ যাকে কখনো কোন পুরুষ স্পর্শ করে নি?
মামুন শব্দ করে হাসতে লাগল। আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, আমার সন্ধানে তেমন কেউ নেই –আর থাকলেও জেনেশুনে তোমার কাছে পাঠাতাম না।
মামুন বলল, টুকুনের কিছু রিসেন্ট ছবি এসেছে –তুমি দেখতে চাও?
না। ছবি দেখব না। আমি ওকেই দেখব।
মামুনের ঘর থেকে বের হতেই তপতী বলল –স্যারের সঙ্গে কথা শেষ হয়েছে?
আমি মাথা নাড়লাম।
তপতী মিষ্টি করে হাসল। মেয়েটার হাসি এত সুন্দর। এত পবিত্র।
.
০৭.
ভোরবেলা সত্যি সত্যি বীনু মেয়েটি এসে উপস্থিত। পান্নাভাবী মেয়েটিকে আমার কাছে এনে বললেন –এ হল বীনু, আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয় –আমার এখানে বেড়াতে এসেছে। আমি আবার আজ সারাদিন একটা কাজে ব্যস্ত থাকব। বাইরে যেতে হবে। রাত্রি, তোমার সঙ্গে ও খানিকক্ষণ থাকুক, তারপর চলে যাবে।
আমি মুগ্ধ হয়ে পান্নাভাবীর বানানো কথা শুনছি। মেয়েটিকে কি জন্যে এখানে আনা হয়েছে তা সে যেমন জানে আমিও জানি। মাঝখানের এই মিথ্যা কথাগুলির প্রয়োজন কি ছিল? মেয়েটি খুব অস্বস্তি বোধ করছে। সংকোচে এতটুকু হয়ে গেছে। চোখ তুলে তাকাতেও পারছে না। সে নিচু হয়ে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করতে গেল। আমি কপ করে তার হাত ধরে ফেললাম।
পান্নাভাবী বললেন, সালাম করতে চাচ্ছে, বাধা দিচ্ছ কেন? সালাম করবে না? মুরুব্বীদের সালাম না করলে দোয়া পাবে কোত্থেকে? দোয়া তো গাছ থেকে পড়ে না। মানুষের কাছ থেকেই আসে।
বোঝা যাচ্ছে সালামের ব্যাপারটা পান্নাভাবীই শিখিয়ে দিয়েছেন। মনে হয় তিনি আটঘাট বেঁধেই নেমেছেন।
রাত্রি, বাবলু কি ঘরে আছে?
হ্যাঁ আছে। ঘুমুচ্ছে।
ওকে ডেকে তোল। ওর সঙ্গে কথা আছে।
বাবলুকে ডেকে তুলতে হল না, সে নিজেই উঠে এল। অপরিচিত তরুণী একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে –সে ব্যাপারটাকে মোটেই পাত্তা দিল না। রান্নাঘর থেকে লবণ এনে সবার সামনে দাঁত মাজতে বসল। পান্নাভাবী বললেন –দাঁতে লবণ ঘসছিস কি জন্যে? কি হয়েছে?
বাবলু গম্ভীর গলায় বলল, কিছু হয়নি। দাঁত ঠিক রাখতে হবে না? দাঁত ঠিক রাখার একটাই উপায় –লবণ। চিনি হল দাঁতের বিষ। লবণ দাঁতের অমৃত।
কে বলেছে তোকে?
বলতে হবে কেন? এটা হল জেনারেল নলেজ। সামুদ্রিক মাছের দাঁত এত ভাল হয় কেন? লোনা পানিতে থাকে বলেই এই অবস্থা।
বীনু ফিক করে হেসে ফেলেছে। হাসি গোপন করার জন্যে চট করে সে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাতে হাসি লুকানো যাচ্ছে না। হাসির উচ্ছ্বাসে তার শরীর কাঁপছে। তৎক্ষণাৎ মেয়েটিকে আমার পছন্দ হয়ে গেল। হালকা-পাতলা মেয়ে। গায়ের রঙ শ্যামলা নয়, কালোই বলতে হবে। সেই কালোর স্নিগ্ধতা চোখে পড়ার মত। এক ধরনের মানুষ আছে যাদের দেখলেই মনে হয় পৃথিবীর কোন দুঃখ কষ্ট ওদের স্পর্শ করার ক্ষমতা রাখে না। এই মেয়ে মনে হয় সেই জাতের।
পান্নাভাবী বাবলুর দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, বাবলু, তুই কি আমার একটা উপকার করতে পারবি?
কি উপকার?
বীনুর দিকে একটু তাকিয়ে দেখ– এ হল আমার দূর-সম্পর্কের বোন। আমার এখানে বেড়াতে এসেছে। সারাদিন থাকবে, বিকেলে চলে যাবে। তুই বিকেলে ওকে একটু বাসায় পৌঁছে দিবি। পারবি না?
না।
না কেন? ও থাকে গোরানে। একা একা যাবে এতদূর?
বাবলু বিরক্ত হয়ে বলল, ও একা একা যাবে না দোকাতিকা যাবে ওটা তার। ব্যাপার। আমার কাজ আছে।
বীনু দেখি আবার অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে হাসছে। হাসির গমকে তার শরীর কাঁপছে। বাহ, খুব চমৎকার মেয়ে তো!
পান্নাভাবী বললেন, কি কাজ?
তুমি তা জেনে কি করবে? শতেক কাজ।
বিকেলে এক ফাঁকে একটু সময় করতে পারবি না?
না
বিপদের সময় সামান্য সাহায্যও করবি না?
নো।
বাচ্চা একটা মেয়ে, একা একা এতদূর যাবে?
বাবলু মাথা ঘুরিয়ে বীনুর দিকে একবার তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বলল –বাচ্চামেয়ে তুমি কোথায় দেখলে? ঢাকা শহরে বাস করলে একা একা ঘোরাফেরা করতেই হবে। এখান থেকে ওখানে গেলেই যদি পুলিশ স্কর্ট লাগে তাহলে তো সমস্যা। পুরো দেশটাই এখন মেয়েদের হাতে –খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী, শেখ হাসিনা বিরোধী দলের প্রধান, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রধান জাহানারা ইমাম … এই অবস্থায় একটা মেয়ে একা একা গোরান যেতে পারবে না?
বীনু বলল, আমি একা একা যেতে পারব।
বাবলু খুশিখুশি গলায় বলল, গুড। ভেরী গুড!
সে মুখ ভর্তি পানি নিয়ে বিকট শব্দে গার্গল করতে লাগল। আমি বীনুকে বললাম, বীনু, তুমি এসো আমার সঙ্গে।
.
আমরা দুজন রান্নাঘরে বসে আছি। বীনুকে চা বানিয়ে দিয়েছি। সে শান্ত ভঙ্গিতে চা খাচ্ছে। মেয়েটি খুব যে শান্ত তা মনে হচ্ছে না। তার চোখে ছটফট ভাব আছে। একটা নীল রঙের সূতির শাড়ি পরেছে। এটিই বোধহয় তাদের পরিবারের সবচে দামী শাড়ি। ঠোঁটে লিপিস্টিক দিয়েছিল, পরে মুছে ফেলেছে –আভাস আছে। যে স্যাণ্ডেল পরে এসেছে সেই স্যাণ্ডেল জোড়া সস্তা এবং পুরানো। আমি বললাম, তারপর বীনু, বল তুমি কেমন আছ?
বীনু থমমত খেয়ে বলল, জ্বি ভাল আছি।
আমার ভাইটাকে তোমার কেমন লাগল?
বীনু হকচকিয়ে গেছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে আছে। এক সময় ক্ষীণ গলায় বলল, ভাল।
ও যে বোকা সেটা কি বুঝতে পেরেছ?
বীনু এক পলক আমার চোখের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে হা-সূচক মাথা নাড়ল।
আমি বললাম, তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। কিছু কিছু মানুষকে প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়ে যায়। তোমার বেলাতেও তাই হয়েছে। পান্নাভাবী তোমাকে এ বাড়িতে কেন এনেছেন তা তুমি ভাল করেই জান। আমিও জানি। কাজেই কোন রকম লুকোছাপা না করে এসো আমরা সহজভাবে কথা বলি। পারবে না সহজভাবে কথা বলতে?
পারব।
শোন বীনু, আমি নিজে খুব দুঃখী একটা মেয়ে। কেন দুঃখী তাও তুমি জান। পান্নাভাবী নিশ্চয়ই তোমাকে বলেছেন। বলেননি?
জি বলেছেন।
দুঃখী মেয়েরা সাধারণত ভাল হয়। আমিও ভাল। এই জন্যেই তোমার সঙ্গে সরাসরি সব কথা বলব। ঠিক আছে?
জ্বি, ঠিক আছে।
বাবলু সম্পর্কে পান্নাভাবী তোমাকে কি বলেছেন?
তেমন কিছু বলেননি।
ও পড়াশোনা কি করেছে সেসব কিছু বলেনি?
বলেছেন এম. এ. পড়তে পড়তে পড়া ছেড়ে দিয়েছেন। টিচারের সঙ্গে কি নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল। উনি তো স্বাধীনচেতা ধরনের, কাজেই বলে বসলেন –আর পড়বেন না। তবে শিগগিরই না-কি আবার ভর্তি হবেন।
পান্নাভাবী কিছুই ঠিক বলেননি। ও তিনবার আই, এ. ফেল করে হ্যাটট্রিক করেছে। ফুটবলে হ্যাটট্রিক করলে খেলোয়াড়রা যেমন আনন্দিত হয় –পরীক্ষায় হ্যাটট্রিক করেও সে তেমনি আনন্দিত।
বীনু হেসে ফেলল। এবং সহজ হয়ে গেল। আমি বললাম, দেখ বীনু, বখা ছেলে বলতে যা বোঝায় আমার এই ভাই সে রকম। গুণ্ডা হবার ক্ষমতা তার নেই। গুণ্ডা হতে হলে সাহস লাগে, কিছু বুদ্ধিও লাগে। এই দুয়ের কোনটাই তার নেই। তার প্রধান কাজ হল –আজেবাজে কিছু বন্ধু বান্ধবের পেছনে ঘোরা। ওদের খেদমত করা। মাঝে মাঝে মদ-টদ খেয়ে বাসায় ফিরে। এরকম একটা ছেলেকে তুমি কি জেনেশুনে বিয়ে করবে?
না।
না করাই উচিত। আমি কখনোই করতাম না। যেটা আমি করব না সেটা তোমাকে করতে বলতে পারি না। তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি চাই তোমার খুব ভাল বিয়ে হোক।
আমাকে আপনার পছন্দ হয়েছে কেন?
তোমাকে আমার পছন্দ হবার প্রধান কারণ হল –তোমার স্বভাব অনেকটা আমার মার মত। মাও তোমার মত শুধু শুধু হাসতেন। বাবলু যখন প্রথমবার আই এ. ফেল করে মাকে গম্ভীর গলায় বলল –মা, রেজাল্ট হয়েছে। ফেল করেছি। মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন– পা ছুঁয়ে সালাম কর। বাবলু রাগী গলায় বলল, সালাম করব কেন? মা বললেন, পরীক্ষায় পাশ করলে দোয়া নেবার জন্যে মানুষ সালাম করে। তুই ফেল করেছিস, তোর তো ডবল দোয়া দরকার। তুই দুবার সালাম করবি। বলেই মার কি যে হাসি!
বীনু হাসতে শুরু করেছে। আমিও হাসছি। অনেকদিন পর এ বাড়িতে হাসির তুফান উঠল। হাসির শব্দে বিস্মিত হয়ে বাবা রান্নাঘরে চলে এলেন। বাবা বীনুর দিকে তাকিয়ে বললেন, এ কে?
এ হল বীনু। ওর সঙ্গে বাবলুর বিয়ে হবে। আমি এই মেয়েকে ছাড়ব না। এর জীবন নষ্ট হলে নষ্ট হবে –ওকে থাকতে হবে আমার সঙ্গে।
বাবা তাকিয়ে আছেন। কিছু বুঝতে পারছেন না। আবার যেন সব কিছুই বুঝে ফেলেছেন। তাঁর চোখে বিস্ময় এবং খানিকটা বিষণ্ণতা। বীনু বাবাকে সালাম করতে গেল। বাবা তাকে জড়িয়ে ধরলেন ধরা গলায় বললেন, মা, তুমি আমার ছেলেটাকে ঠিক করে দাও। তুমি পারবে। তোমাকে পারতেই হবে।
.
বীনু সারাক্ষণ আমার পাশে পাশে রইল। ঘরে বাজার ছিল না। আমি তাকে সঙ্গে নিয়ে নিউ মার্কেটের কাঁচা বাজার থেকে বাজার করে আনলাম। ও অনেক গল্প করল। সরল ধরনের দুঃখ নিয়ে গল্প। অভাব-অনটনের গল্প।
বুঝলেন আপা, আমাদের সংসারটা আমাকে চালাতে হয়। মা কোন হিসাব নিকাশ করতে পারেন না। হিসাব-নিকাশ কি রাখবেন, তার কোন মেয়ের কি নাম সেটাই তাঁর মনে থাকে না। অনেকগুলি মেয়ে হলে যা হয়। নাম রাখার সময় গণ্ডগোল করেছেন। মিল দিয়ে দিয়ে নাম বীনু, লীনু, ঝিনু, নিনু, টিনু … কে নাকি মাকে বলেছিল মিল দিয়ে নাম রাখলে বেহেশতে একসঙ্গে থাকা যায়। মা আমাদের বেহেশতে এক সঙ্গে রাখার ব্যবস্থা করতে গিয়ে এমন ঝামেলা করেছেন। তাঁর হয়ত দরকার লীনুকে, তিনি ডাকছেন ঝিনু, ঝিনু–। যে কথা বলছিলাম আপা, মাসের এক তারিখে বেতন এনে বাবা পুরো টাকাটা আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেন, খুব সাবধানে খরচ করবি। খুব সাবধান। একটা পয়সা যেন এদিক-ওদিক না হয় –কষ্টের পয়সা। আপনারা তো আপা বড়লোক মানুষ, আমাদের সমস্যা বুঝবেন না। মাসের ত্রিশটা দিন ত্রিশটা বৎসরের মত। প্রায়ই লোকজনদের বলতে শুনি, টাকাপয়সা তুচ্ছ। যারা এসব বলে আমার ইচ্ছা করে এদের কিছুদিন এনে আমাদের সংসারে রাখি। মাসখানিক থাকলেই এরা বলতে শুরু করবে– পৃথিবীর সবচে বড় জিনিস হল অর্থ।
তোমার বাবা সম্পর্কে তো তুমি কিছু বলছ না? উনি কেমন?
সাধারণ একজন মানুষ। মন্দও না, ভালও না। সারাক্ষণ মেজাজ খারাপ করে। থাকেন। দিনের মধ্যে দশবার বলেন, মাকে বিয়ে করে তাঁর এই হাল। মা হচ্ছে। মেয়ে-তৈরীর একটা যন্ত্র বিশেষ। মাঝে মাঝে এমন হয় –আমরা বোনরা মিলে ঠিক করি সবাই এক সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাব।
কোথায় পালাবে?
কোথায় পালাব ঠিক করতে পারি না বলেই তো পালানো হয় না। বিয়ে করে অন্য সংসারে চলে যাওয়াও এক ধরনের পালানো। তাই না আপা?
হ্যাঁ তাই।
আমার বিয়ে হলে বাবার খুব সুবিধা হবে। আমার ছোট দুই বোন খুবই রূপবতী। ওদের সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে হবে যাবে। ওদের ভাল ভাল বিয়ের প্রস্তাব আসছে। একজন হল ইউনিভার্সিটির টিচার। কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে কানাডা যাচ্ছে। ওদের খুব আগ্রহ। বাবা রাজি হচ্ছেন না।
রাজি হচ্ছেন না কেন?
বাবা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, বড় মেয়ের বিয়ে না দিয়ে আমি ছোট মেয়েদের বিয়ে দেব না। অসম্ভব। এম্নিতেই আমার মেয়ের কষ্টের সীমা নেই। তাকে বাদ দিয়ে ছোট বোনদের বিয়ে দিয়ে কষ্ট বাড়াব –তা হবে না।
তুমি একটু আগে বললে তোমার বাবা ভালও না, মন্দও না। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তিনি নিতান্তই ভাল মানুষ।
তাঁর ভালমানুষি এই একটাই –আমাকে খুব আদর করেন। অতিরিক্ত আদর। এটাও তো ঠিক না। সব মেয়েকেই সমান আদর করা উচিত না?
দুপুরে খাবার পর ওকে নিয়ে এক সঙ্গে বিছানায় গড়াতে গেলাম। অনেকদিন পর দুপুরে কথা বলার একজন সঙ্গী পাওয়া গেল। আমি বললাম, বীনু, আমি ঝোঁকের মাথায় বাবাকে বলেছি, এই মেয়েটিকে আমি যেতে দেব না। এখানে রেখে দেব। বাবলুর সঙ্গে বিয়ে দেব। তুমি ঝোঁকের কথায় কোন গুরুত্ব দিও না। ভালমত ভাব। ভেবে যদি ঠিক কর তুমি আমার ভাইকে বিয়ে করবে তাহলে আমি একটা কাজ করব।
কি কাজ?
বাবাকে বলব এই বাড়িঘর তোমাকে লিখে দিতে।
কেন?
সঙ্গত কারণেই এটা করতে হবে। নয়ত বাবলু সব বিক্রি-টিক্রি করে তোমাকে নিয়ে ভিক্ষা করতে বের হবে।
বীনু গম্ভীর গলায় বলল, এই কাজ কখনো করবেন না। এটা করলে মনে হবে আপনি লোভ দেখিয়ে আমাকে রাজি করাচ্ছেন। আমি এম্নিতেই রাজি। আমি জানি এরচে ভাল বিয়ে আমার হবে না।
.
বিকেলে বাবলু চলে এল। আমার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আপা, ঐ ছোঁকরি আছে না চলে গেছে?
আছে।
ওকে বের হতে বল, দিয়ে আসি। পান্নাভাবী যে এক একটা ঝামেলা তৈরি করে ভাল লাগে না! অসহ্য বোধ হয়।
বাবলু সন্ধ্যাবেলা বীনুকে পৌঁছে দিয়ে আসতে গেল। ফিরল রাত এগারোটায়। মহা বিরক্ত।
ঐ মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে কি যে ঝামেলায় পড়েছি কহতব্য নয়। গিয়ে দেখি হেভী গ্যাঞ্জাম। মেয়েটার বাবা তার ছোট মেয়েকে হেভী চড় লাগিয়েছে। মেয়ে মেঝেতে পড়ে গিয়ে মাথাটাথা ফাটিয়ে রক্তারক্তি। বীনু তার বোনের অবস্থা দেখে শুরু করল মরাকান্না। কি আর করি বীনুকে! তার বোনকে নিয়ে গেলাম মেডিকেলে। স্টিচ করালাম, এটিএস দিলাম। বাসায় পৌঁছে দিলাম। তারপর আর আমাকে আসতে দেবে না। ভাত খেয়ে আসতে হবে। চিন্তা কর গ্যাঞ্জাম।
তুই কি করলি? ভাত খেয়ে এলি?
উপায় কি?
কি দিয়ে খেলি?
আজেবাজে খাওয়া– ডাল, ছোটমাছ। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম –ডিম ভেজে দাও।
তখন বীনু কি করল? নিশ্চয়ই হেসে ফেলল?
বাবলু বিস্মিত হয়ে বলল, তুই কি করে বুঝলি?
আন্দাজে বলেছি।
কারেক্ট আন্দাজ করেছিস। বীনুর এমন হাসি! এর মধ্যে হাসার কি আছে? তারপর খেতে বসে আরেক যন্ত্রণা! সব কটা বোন গোল হয়ে আমার সামনে বসা।
বোনগুলি সুন্দর না খুব?
হ্যাঁ সুন্দর। পরীর হাট।
তোকে ডিম ভেজে দিয়েছিল?
হ্যাঁ।
আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললাম –বাবলু, তুই বীনু মেয়েটাকে বিয়ে করবি?
বাবলু হা করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
.
০৮.
বসার ঘরে চশমা পরা অল্পবয়েসী একটা ছেলে বসে আছে। আমি ঘরে ঢুকে চমকে গেলাম। ছেলেটি.আরো বেশি চমকাল। নার্ভাস গলায় বলল, বাবলু সাহেব আমাকে এখানে বসিয়ে রেখে সিগারেট কিনতে গেছেন।
ও কি বাবলুর বন্ধু বান্ধবদের কেউ? কথাবার্তায় সে রকম মনে হচ্ছে না। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। হালকা সবুজ শার্টের উপর সাদা স্যুয়েটার। রোগা পাতলা একটি ছেলে। বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। এ বাবলুর বন্ধু হতে পারে না। বাবলুর বন্ধুরা এত বিনয়ী নয়। তা ছাড়া তারা ঘরেও ঢুকে না। ভিডিও দোকানের সামনের বেঞ্চে বসে আড্ডা দেয়।
আমি বললাম, তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? বোস।
তুমি বলাটা বোধহয় ঠিক হয়নি। বাবলু আমার এক বছরের ছোট। তার চেনামানুষরা তার বয়েসী হবে এটা ভাবার কোন কারণ নেই। তাছাড়া বাবলু আমার ছোট ভাই এবং তাকে তুই করে বলি বলেই তার পরিচিত সবাইকে তুমি বলব সেটাই-বা কেমন কথা? তবে ছেলেটিকে দেখেই ফস করে মুখ দিয়ে তুমি বের হয়ে। গেছে। এখন আপনি বলা অর্থহীন। নিজের অস্বস্তি ঢাকার জন্যেই কিছু কথা বলতে হয়। কথা খুঁজে পাচ্ছি না।
তুমি কি চা খাবে?
জ্বি না। এক গ্লাস পানি খেতে পারি। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না –কারো হাতে পাঠিয়ে দিলেই হবে।
আমি নিজেই পানি নিয়ে এলাম। সে যেভাবে পানি খেল তাতে মনে হল খুবই তৃষ্ণা পেয়েছে। বাবলু এখনো ফেরেনি। সিগারেট কিনতে তার এতটা সময় লাগার কথা না। সামনেই দোকান, যাবে আর নিয়ে আসবে।
বাবলুর সঙ্গে কি দরকার?
উনি বলছিলেন আপনার এই বাড়ি ভেঙে মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং করবেন। আমি একজন আর্কিটেক্ট –গত মাসে আমার রেজাল্ট হয়েছে।
ও আচ্ছা। বাবলু তোমাকে নিয়ে এসেছে?
জ্বি। আমি আপনাদের কাছেই থাকি –মেইন রোডের ওপাশে হলুদ রঙের একটা তিনতলা দালান আছে না? তার ঠিক পেছনের দোতলা বাড়িটা আমাদের।
ও আচ্ছা। বাবলুর সঙ্গে তোমার পরিচয় কি ভাবে?
আমি আর্কিটেক্ট শুনে উনি পরশুদিন গিয়েছিলেন। উনি হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি বাড়ির ডিজাইন করবার জন্যে আমার কাছে গিয়েছিলেন। আমি এত খুশি হয়েছিলাম। আমি উনাকে বলেছিলাম আপনার বাড়ির ডিজাইন আমি বিনা টাকায় করে দেব।
বাবলুর জন্যে তো ভালই হল।
নতুন পাশ করা আর্কিটেক্টের উপর তো মানুষের কনফিডেন্স থাকে না– তাদের অনেক কষ্ট করে উপরে উঠতে হয়।
সেটা তো সবার জন্যেই সত্যি। বাবলু বোধহয় সিগারেট আনতে গিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। তুমি না হয় অন্য আরেকদিন এসো। তুমি করে বলছি বলে রাগ করছ না তো? তোমাকে বাচ্চা বাচ্চা দেখাচ্ছিল –তুমি বলে ফেলেছি।
তাতে কোন অসুবিধা নেই। আমি কি আপনাদের বাড়িটা একটু দেখতে পারি? এর মধ্যে বাবলু সাহেব হয়ত চলে আসবেন।
বাড়ি দেখতে কোন অসুবিধা নেই, দেখ।
আপনি কিন্তু এখনো আমার নাম জানতে চাননি –আমার নাম ইস্তিয়াক।
ও আচ্ছা আচ্ছা –এসো, বাড়ি দেখ।
ইস্তিয়াক খুব উৎসাহ নিয়ে ভেতরের উঠোনে এসে দাঁড়াল। হালকা গলায় বলল, পুরানো বাড়ির একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে। আপন আপন লাগে। আধুনিক বাড়িগুলিতে নিজেদের অতিথির মত লাগে। আচ্ছা, আপনার কাছে কি গজফিতা আছে?
কেন বল তো?
একটু মাপব।
গজফিতা নেই।
আচ্ছা, গজফিতা আমি নিয়ে আসব। আপনি আমাকে একটা কাগজ আর পেন্সিল দিতে পারবেন? কয়েকটা পয়েন্ট নোট করে নিয়ে যেতাম।
কাগজ আর পেন্সিল অবশ্যই দিতে পারব। মুশকিল হচ্ছে আমি এখন বেরুব। তুমি বরং বাবলুর সঙ্গে যোগাযোগ করে অন্য একদিন এসো।
আজ বিকেলে যদি আসি আপনাদের অসুবিধা হবে?
না, আমার কোন অসুবিধা হবে না।
আপনি বোধহয় আমার উপর তেমন কনফিডেন্স পাচ্ছেন না। আমি এবার ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়েছি। ডিজাইনে আমি রেকর্ড নাম্বার পেয়েছি।
তাই নাকি?
জ্বি। নিজের মুখে নিজের কথা বলতে আমার খুবই লজ্জা লাগছে– কিন্তু আপনি এত অবহেলার সংগে আমাকে দেখছিলেন বলে বাধ্য হয়ে বললাম।
বলে ভালই করেছ।
আমি আমার জীবনের প্রথম ডিজাইনটা বিনা পারিশ্রমিকে করব বলে কেন ঠিক করেছি সেটাও আপনাকে বলি –লুই ক্যান তাই করেছিলেন।
লুই ক্যান কে?
লুই ক্যান হলেন পৃথিবীর সেরা স্থপতিদের একজন। ঢাকার সেকেণ্ড ক্যাপিটেল– সংসদ ভবন — এইসব তাঁর করা।
ও আচ্ছা।
আপনার সঙ্গে অনেক বকবক করে ফেলেছি। আপনি বোধহয় আমাকে বাঁচাল ভাবছেন। এম্নিতে আমি খুব কম কথা বলি।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, এম্নিতে কম কথা বল –তাহলে এখন এত বেশি কথা কেন বলছ?
ইস্তিয়াক হাসল আর তখনি বাবলু ঢুকল। আমি হাঁপ ছেড়ে বাচলাম। অপরিচিত কারো সঙ্গে ভদ্রতা বজায় রেখে দীর্ঘ সময় কথাবার্তা বলতে ভাল লাগে না। তাছাড়া অনেক কাজ পড়ে আছে। বাবার হজমের সমস্যা হচ্ছে। তাঁর জন্যে পেপের তরকারী রান্না করতে হবে। পান্নাভাবী আমাকে নিয়ে কোথায় নাকি যাবেন। তিনি এমন এক মহিলা –একবার যখন ঠিক করেছেন আমাকে নিয়ে বের হবেন তখন বের হবেনই। কতক্ষণ লাগবে উনার কে জানে? অল্প সময়ের ব্যাপার হলে –দুপুরের রান্না চড়াবার আগেই সেরে আসা যায়। সমস্যা হচ্ছে– পান্নাভাবী। বলছেন না– তিনি কোথায় যাবেন, কতক্ষণের জন্য যাবেন।
.
.
আমি পান্নাভাবীর সঙ্গে বের হলাম ভরদুপুরে। ইস্তিয়াক তখনো আছে। গজফিতা নিয়ে এসেছে। দুজনে মিলে মাপামাপি করছে। ইস্তিয়াকের যতটা উৎসাহ বাবলুর উৎসাহ তারচে বেশি। বাবা বারান্দায় বসে কিছুটা অবাক হয়েই মাপামাপি দেখছেন।
পান্নাভাবী কোথায় যাচ্ছেন সেই রহস্য রিকশায় উঠে ভেদ করলেন। তিনি যাচ্ছেন অসম্ভব ক্ষমতাসম্পন্ন এক সাইকিকের কাছে। সেই সাইকিক নাকি বিবাহিত মেয়েদের চোখের দিকে তাকিয়ে তাদের স্বামীদের অনেক গুপ্ত ব্যাপার বলে দিতে পারেন। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম –নাজমুল ভাইয়ের গুপ্ত ব্যাপার আপনি জানতে চাচ্ছেন জানুন –কিন্তু আমাকে সঙ্গে নিচ্ছেন কেন? আমি তো কিছু জানতে চাচ্ছি না।
একা যেতে অস্বস্তি লাগে এই জন্যেই তোমাকে নিচ্ছি। আরেকটা কারণও অবশ্যি আছে। ঐ সাইকিক ভদ্রলোকের বাড়ির পাশেই বীনুদের বাসা। ওদের কাছ থেকেও ঘুরে আসব। বাবলুর সঙ্গে বীনুর বিয়ের কতদূর কি হল। তুমি তো বলেছিলে মেয়েটিকে পছন্দ হয়েছে। তারপর কি?
পছন্দ হওয়া পর্যন্তই। আর এগুচ্ছে না। বাবলুর মেয়েটিকে পছন্দ হয়েছে। বলেই মনে হয়। তবে সে ঘোষণা দিয়েছে কোটিপতি না হবার আগে বিয়ে করবে না। মনে হচ্ছে –বাবলুর কোটিপতি না হওয়া পর্যন্ত বীনুকে অপেক্ষা করতে হবে
সাইকিক ভদ্রলোককে এই ব্যাপারেও কাজে লাগানো যাবে। উনি বশীকরণ মন্ত্রও জানেন।
বশীকরণ মন্ত্র দিয়ে বশ করিয়ে তারপর বাবলুকে বিয়ে দিতে হবে?
প্রয়োজনে দিতে হবে।
এই যুগে মন্ত্রতন্ত্র কেউ বিশ্বাস করে ভাবী?
আগের যুগে বিশ্বাস করলে যদি কোন ক্ষতি না হয়ে থাকে –এ যুগে বিশ্বাস করলেও কোন ক্ষতি নেই। মন্ত্র তন্ত্র, কুফুরী কালাম এইসব আছে। তুমি ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বললেই বুঝবে।
উনি কত টাকা নেন?
ধরাবাঁধা কিছু নেই। খুশি হয়ে তুমি যা দেবে তাই নেবেন। কিছু না দিলেও ক্ষতি নেই।
ভাবী, আমি ঐ লোকের কাছে যেতে চাচ্ছি না।
তোমার নিজের জন্যেও তো তাঁর কাছে তোমার যাওয়া দরকার। পরীক্ষা করে। দেখতে দোষ কি? তুমি তোমার ছেলের কথা তাঁকে জিজ্ঞেস কর। দেখ উনি কি বলেন।
ভদ্রলোক আর্মির রিটায়ার্ড সুবাদার। আর্মির সঙ্গে সাইকিক ক্ষমতার যোগসূত্র –ভাবতেই অস্বস্তি লাগে। লম্বা চওড়া মানুষ। মাথায় এক গাছি চুলও নেই– বেলের মত পরিষ্কার চকচকে একটা মাথা। মুখে প্রকাণ্ড গোঁফ আছে। ধবধবে সাদা। গোঁফ। ভাবভঙ্গি অমায়িক। দুপুরের খাওয়া সেরে পান চিবুচ্ছেন তখন আমরা উপস্থিত। অসময়ে উপস্থিত হওয়ায় ভদ্রলোক বিরক্ত না হয়ে খুশি হলেন বলে মনে হল। পান্নাভাবী এই লোকের অপরিচিত নন। পান্নাভাবীকে দেখেই তিনি হাসিমুখে বললেন, আবারো কোন সমস্যা?
পান্নাভাবী হাসলেন।
ভদ্রলোক বললেন –আপনি আপনার স্বামী নিয়ে শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছেন। উনি ভাল আছেন –উনার কোন সমস্যা নাই।
ঠিক বলছেন তো?
অবশ্যই ঠিক বলছি।
আমার এক বোনকে নিয়ে এসেছি। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলুন তো।
ভদ্রলোক আমার দিকে তাকালেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, আপনাকে কিছু বলতে হবে না। পান্নাভাবী বললেন –না না, আপনি বলুন। আপনি ওর ছেলের সম্পর্কে বলুন। ওর ছেলের নাম টুকুন। ছেলেটা কেমন আছে?
ভাল আছে।
ও এখন কোথায় আছে? দেশে না দেশের বাইরে?
ও এখন দেশেই আছে।
আমি স্পষ্ট বিরক্তি নিয়ে বললাম, পান্নাভাবী, চলুন বাসায় যাই। আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।
আর একটু বোস না।
না, আমি আর এক সেকেণ্ড বসব না। প্লীজ ভাবী, চলুন।
নিতান্ত অনিচ্ছায় পান্নাভাবী উঠলেন।
.
মানুষের মন যে কত দুর্বল তার সবচে বড় প্রমাণ হল ঐ দিন সন্ধ্যাবেলায় আমার খুব অস্থির লাগতে লাগল। বার বার মনে হচ্ছে –হতেও তো পারে –সাইকিক ভদ্রলোক ঠিকই বলেছেন। টুকুন এসেছে। মানুষের অস্বাভাবিক ক্ষমতা একেবারে যে থাকে না –তা তো না। ইএসপি নিয়ে পশ্চিমা দেশে আজকাল কত গবেষণা হচ্ছে।
মানুষের ক্ষমতার কতটুকুই বা আমরা জানি? একবার খোঁজ নিয়ে আসতে তো দোষের কিছু নেই।
রাত নটার দিকে অস্থির হয়ে পড়লাম। বাবলু আজ বাড়িতেই আছে। ওকে সঙ্গে নিয়ে মামুনের বাড়িতে উপস্থিত হওয়া যায় না। ওকে কিছু বলতে লজ্জা লাগছে। রাত নটা এমন কিছু রাত না। আমি একাই যেতে পারি, যেতে কতক্ষণ আর লাগবে? সত্যি সত্যি মামুনদের বাড়িতে উপস্থিত হলাম। মামুনের ইদানিং অনেক টাকাপয়সা হয়েছে– কিন্তু সে বাড়ি রেখেছে আগের মতই। সেই পুরানো গেট। পুরানো দেয়াল। শুধু দারোয়ান নতুন। সে আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে রইল। তাকানোর ধরন থেকেই বলা যাচ্ছে নানান ধরনের প্রশ্ন করে সে আমাকে বিরক্ত করবে। আমি তাকে সে সুযোগ না দেয়ার জন্যেই বললাম –মামুন কি আছে?
দারোয়ান হকচকিয়ে গিয়ে বলল, জি স্যার আছেন। যান, চলে যান।
এ বাড়িতে আজ বোধহয় কোন পার্টি। অনেক গাড়ি –অনেক লোকজন। ড্রয়িং রুমে জায়গা না হওয়ায় অনেকে বসেছে বারান্দায় বেতের চেয়ারে। তপতী মেয়েটি বারান্দায় বসে কার সঙ্গে যেন গল্প করছে। মেয়েটা তো ভারী সুন্দর। সাদা শাড়িতে স্বরস্বতী প্রতিমার মত দেখাচ্ছে। রূপবতীদের ধবধবে সাদা শাড়িতে খুব মানায়। কিন্তু রূপবতীরা কেন জানি সাদা রং পছন্দ করে না। আমি কি করব? চলে যাব না সিঁড়ি বারান্দায় হতচকিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকব?
রাত্রি, তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? এসো।
মামুন নিজেই আমাকে এগিয়ে নিতে এলো। এরকম ভঙ্গি করল যেন আমি নিমন্ত্রিত অতিথিদের একজন। আসতে দেরি করেছি।
কোন পার্টি না-কি?
হু। আজ ফ্যাক্টরি স্টার্ট হল সেই উপলক্ষে পার্টি। তুমি ভাল দিনে এসেছ। এসো, ভেতরে এসো।
তোমার পার্টির রসভঙ্গ করতে চাই না। টুকুন কি তোমার কাছে?
না। ওর আসার কথা, আসেনি। এই মাসেই এসে যাবে। এলেই খবর পাবে। শুধু টুকুনের খোঁজ নিতেই এসেছ?
হু। এখন যাই।
একটু বসে যাও।
না।
চল তোমাকে গাড়ির ব্যবস্থা করে দেই, পৌঁছে দেবে।
গাড়ি লাগবে না।
মামুন হেসে ফেলে বলল, আমি তোমার বন্ধু না হতে পারি, শত্রু না। তুমি শত্রুর মত আমাকে দেখছ কেন? ড্রাইভার যাবে, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। ঢাকা শহরের যা অবস্থা –একা একা রাতে রিকশায় চলাই মুশকিল। তুমি একা এসেছ?
আমি জবাব দিলাম না। এত মন খারাপ লাগছে –আমি ধরেই নিয়েছিলাম টুকুনকে পাওয়া যাবে। দেখা হলে প্রথম কোন কথাটা বলব তাও ভেবে এসেছি — কেমন আছেন গো বড় ব্যাটা টুকুন সোনা? এই বাক্যটির বিশেষ মাহাত্ম আছে। চির গম্ভীর টুকুনের গাম্ভীর্য এই বাক্যটিতে কেন জানি ভেঙে যেত। সে ফিক করে হেসে ফেলতো। হেসে ফেলেই বুঝতো, হাসা ঠিক হয়নি। সে গম্ভীর হবার চেষ্টা করে আরো বেশি হেসে ফেলতো।
.
বাসায় ফিরে দেখি –বাবলু চিন্তিত মুখে বাইরে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছে। সে আমাকে দেখেই হুংকার দিয়ে উঠল –কাউকে কিছু না বলে কোথায় গিয়েছিলি? আমরা চিন্তায় চিন্তায় অস্থির। বাবা এর মধ্যে একশবার দোতলা একতলা করেছেন। গিয়েছিলি কোথায়?
কোথাও না –রিকশা করে রাস্তায় ঘুরেছি।
কেন?
এম্নি ঘুরলাম। ভাত খেয়েছিস?
না। তোর কোন খোঁজ নেই –আমি চিন্তায় চিন্তায় অস্থির। এর মধ্যে ভাতও খেয়ে ফেলব? তুই ভাবিস কি আমাকে?
আয় ভাত খেয়ে নেই। খিদে লেগেছে।
বাবা বললেন, রাতে কিছু খাবেন না। শুধু এক গ্লাস লেবুর শরবত খাবেন। আমি কোথায় গিয়েছিলাম –কেন গিয়েছিলাম কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। আমি যে ফিরে এসেছি এই আনন্দেই তিনি অভিভূত।
.
খেতে বসে বাবলু হড়বড় করে নানান কথা বলতে লাগল। বুঝলি আপা, ইস্তিয়াককে তো দেখেছিস স্কলার ছেলে। ছোট-খাট দেখতে কিন্তু ধানী মরিচ। রেকর্ড মার্ক পেয়ে বেড়াছেঁড়া অবস্থা। স্কলারশীপ পাওয়ার সম্ভাবনা। পেলেই বিদেশ চলে যাবে। স্কলার ছেলে তো দেশে থাকে না। আমার কাজটা বিনা পয়সায়। করে দেবে।
বিনা পয়সায় তুই-ই-বা কেন একটা লোককে দিয়ে কাজ করাবি?
টাকা নিতে না চাইলে আমি কি করব? আমি তো দিতেই চাই।
তুই তাহলে সত্যি সত্যি মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং বানাচ্ছিস?
অবশ্যই বানাচ্ছি। দুটা এ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করব। ব্যাংক লোন নেব। ব্যাংক লোনের ব্যবস্থাও ইস্তিয়াক করবে –ওর এক মামা হলেন অগ্রণী ব্যাংকের এম. ডি।
তুই তো দেখি মাছের তেলে মাছ ভেজে ফেলেছিস।
বাবলু আনন্দে হেসে ফেলল। অনেকদিন পর আজ এই প্রথম খাওয়া নিয়ে হৈ চৈ করল না।
আপা!
কি?
বাবলু ইতস্তত করে বলল, আজ বিকেলে বীনুদের বাড়ি গিয়েছিলাম। ওদের বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ মনে হল, ঐদিন ছোট মেয়েটা মাথায় ব্যথা পেয়েছে –খোঁজ নিয়ে যাই। নয়ত আবার ভাবতে পারে –কেমন মানুষ, খোঁজ নিল না!
খোঁজ নিয়েছিস?
হু।
আছে কেমন?
ভালই আছে –তবে বীনুর জ্বর। ওর নাকি রাতে শোবার আগে গোসল করার অভ্যাস। গোসল করতে গিয়ে ঠাণ্ডা লাগিয়েছে। চুল লম্বা তো –গোসল করে ভেজা চুল শুকায় না।
তুই কি চুল মেপে এসেছিস?
মাপতে হবে কেন? লম্বা চুল দেখে বোঝা যায় না?
কি কথা হল বীনুর সঙ্গে?
কথা আর কি হবে? আমি যাই বলি এই মেয়ে শুধু মুখ অন্যদিকে নিয়ে হাসে। দেশের পলিটিকস নিয়ে একটা সিরিয়াস কথা বলেছি, সেটা শুনেও হেসে ফেলেছে।
তোর সিরিয়াস কথা না বলাই ভাল। সবার মুখে সিরিয়াস কথা মানায় না।
বাবলু বিরক্ত হয়ে বলল, তুই ঠাট্টা করছিস? আমাকে তুই এত বোকা ভাবিস কেন? আমার কাজকর্ম, কথাবার্তা বোকার মত, বুদ্ধি বোকার মত না।
আমি হাসলাম। বাবলু বলল, শুধু শুধু হাসিস না –ভাল কথা, আমি বীনুকে বলেছি তুই তাকে এ বাড়িতে আসতে বলেছিস। তোর কি যেন জরুরী কথা।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কই, কখন বললাম?
আহা, আমি মিসটেক করে একটা কথার কথা বলে ফেলেছি, তুই তাই ধরে রেখেছিস কেন? মানুষ মিসটেক করে না?
বীনু কখন আসবে?।
অসুখ কমলেই আসবে। কে জানে অসুখ নিয়েই হয়ত আসবে। তুই জরুরী কথা বলার জন্যে ডেকেছিস এটা শুনেই সে অস্থির হয়েছে।
আমি হাসছি। আমার হাসি দেখে বাবলু খুব বিরক্ত হচ্ছে।