জয়জয়ন্তী – উপন্যাস – হুমায়ূন আহমেদ
একদা এমনই বাদলশেষের রাতে–
মনে হয় যেন শত জনমের আগে
সে এসে, সহসা হাত রেখেছিল হাতে,
চেয়েছিল মুখে সহজিয়া অনুরাগে।
সে-দিনও এমনই ফসলবিলাসী হাওয়া
মেতেছিল তার চিকুরের পাকা ধানে;
খুঁজেছিল তার আনত দিঠির মানে।
একটি কথার দ্বিধাথরথর চূড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী।
–(শাশ্বতী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত)
০১.
আমি ঘুরে-ফিরে একটা স্বপ্নই দেখি –মামুন এবং আমি পাশাপাশি একটা রিকশা করে যাচ্ছি। রিকশার চাকার সঙ্গে কি করে যেন শাড়ি পেঁচিয়ে গেল। আমি চেঁচিয়ে বলছি –রিকশা থামাতে বল, রিকশা থামাতে বল। মামুন চিৎকার করছে –এই রিকশা, থাম্ থাম। কিন্তু রিকশাওয়ালা কিছুই শুনছে না –সে সমানে প্যাডেল করে যাচ্ছে। আশেপাশে লোক জমে যাচ্ছে। একজন ট্রাফিক পুলিশ পর্যন্ত রিকশা থামাবার জন্য ছুটে আসছে … স্বপ্নের এই জায়গায় আমি জেগে উঠি। আমার বুক ধ্বক ধ্বক করতে থাকে। পানির পিপাসা হয়। নিজেকে ধাতস্থ করতে অনেক সময় লাগে। বিছানায় চুপচাপ বসে হাঁপাতে থাকি। এই সময় বাবা এসে আমার দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে বলেন, কি হয়েছে রে মা? কি হয়েছে?
বাবার ঘর দোতলার শেষ মাথায়। রাতে তার ঘুম হয় না বললেই হয়। তিনি সামান্য শব্দেই চটি পায়ে বের হয়ে আসেন। আমি দুঃস্বপ্ন দেখতে দেখতে যে শব্দ করি তা নিশ্চয়ই সামান্য না।
আমার পাশের ঘরে বাবলু ঘুমায়। তার ঘুম অবশ্যি কখনো ভাঙে না। আমার মত সেও দুঃস্বপ্ন দেখে। তার দুঃস্বপ্নগুলি বিকট এবং বারবার। সে বিশ্রী ধরনের গোঙানির শব্দ করতে থাকে, হাত-পা ছুঁড়তে থাকে। আমি নিজেই ভয়ে অস্থির হয়ে পড়ি। বাবা ছুটে এসে দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে বলেন –কি হয়েছে? এই বাবলু, এই! দরজা খোল, দরজা খোল। বাবলুর দুঃস্বপ্নগুলি সহজে ভাঙে না। সে গো গো শব্দ করতে থাকে এবং বিছানায় নড়াচড়া করতে থাকে। এক একবার মনে হয়, বিছানা থেকে গড়িয়ে বোধহয় মেঝেতে পড়ে যাবে। বাবা ভয় পেয়ে আমাকে ডাকেন –রাত্রি! রাত্রি মা! আমি বাবার পাশে দাঁড়াই। দুজনে মিলে দরজা ধাক্কাতে থাকি। এক সময় বাবলুর ঘুম ভাঙে কিন্তু চেতনা পুরোপুরি ফিরে আসে না –কারণ সে কাঁপা গলায় ডাকতে থাকে –মা! মা! বাতি জ্বালাও মা। তার মনে থাকে না যে। মা মারা গেছেন আট বছর আগে। ছেলের দুঃস্বপ্নের সময় তিনি এসে বাতি জ্বালাতে পারবেন না।
বাবা ব্যস্ত হয়ে ডাকেন –ও বাবলু! বাবলু!
বাবলু ক্লান্ত গলায় বলে, জ্বি।
আমরা আছি এখানে। আমি আছি, রাত্রি আছে। কি হয়েছে রে?
বোবায় ধরেছে।
দরজা খুলে বের হয়ে আয়।
বাবা, পানি খাব।
দরজা খোল –পানি নিয়ে আসছি।
পানি আনার জন্যে বাবা নিজেই চটি ফটফট করতে করতে একতলায় নেমে যান। বাবলু দরজা খুলে আমাকে দেখে বোকার মত হাসে।
বোবায় ধরেছিল। বুঝলি আপা, বুকের উপর চেপে বসেছিল– আজ আমাকে মেরেই ফেলত।
আয়, বারান্দায় খানিকক্ষণ বোস।
একটা তাবিজ-টাবিজ কিছু নিতে হবে –নয়ত বেকায়দায় ফেলে ভূতটা আমাকে মেরেই ফেলবে।
ভূত-টুত কিছু না। তুই স্বপ্ন দেখছিলি।
আরে রাখ। স্বপ্ন আর বোবায় ধরা এক জিনিস না। বোবায় যাকে ধরে সে জানে। বোবা করে কি জানিস? প্রথমে একটা স্বপ্ন দেখায় –ভয়ের স্বপ্ন। তারপর বুকের উপর চেপে বসে গলা চেপে ধরে। নিঃশ্বাস নিবি সেই উপায় নেই, নড়াচড়া করবি সেই উপায় নেই। সাধারণ নিয়ম হল –একটা বোবা একজনকে ধরে। আমার সবই উল্টা। আমার কাছে দু’টা বোবা আসে। একটার বয়স কম। সেটা চুপচাপ আমার পায়ের উপর বসে থাকে।
বাবা পানি নিয়ে আসেন। বাবলু এক চুমুক পানি খায়। সে পানি খেতে পারে না। তার গলার ফুটাটা না-কি এমন যে ফুটা দিয়ে সব খাবার নামে, শুধু পানি নামে না। পানি জমা হয়ে থাকে।
এক চুমুক পানি খেয়েই বাবলু সুস্থ হয়ে আবার ঘুমুতে চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার নাক ডাকার শব্দ আসতে থাকে।
আমার দুঃস্বপ্ন বাবলুর দুঃস্বপ্নের মত ভয়ংকর না, কিন্তু আমি বাবলুর মত চট করে ঘুমুতে পারি না। আমি জেগে থাকি –জেগে জেগে ভাবি –রিকশায় শাড়ি পেচানোর এই স্বপ্ন আমি কেন বার বার দেখি?
প্রথম কথা হচ্ছে, মামুনের সঙ্গে আমি কখনো রিকশায় চড়িনি। তার রিকশ ভীতি আছে। ছোটবেলায় সে ঝাঁকুনি খেয়ে রিকশা থেকে নিচে পড়ে মাথায় চোট পেয়ে অনেকদিন হাসপাতালে ছিল। তারপর থেকেই সে রিকশায় চড়ে না। প্রয়োজনে সে হাঁটবে, বাসে চড়বে, কিন্তু কখনো রিকশায় না। বিয়ের পর আমরা ঘুরতাম ওদের মরিস মাইনর গাড়িতে। গাড়ি চালাতো মামুন, আমি তার পাশে বসা এবং পেছনের সীটে ওদের ড্রাইভার। মামুন খুব ভাল গাড়ি চালায়, তারপরেও গাড়িতে উঠলেই সে ড্রাইভারকে সঙ্গে নেবে। তাদের বাড়ি থেকে নিউমার্কেট যাবে, পাঁচ মিনিটের পথ –পেছনে ড্রাইভার থাকবেই। তার যুক্তি হচ্ছে –আমি গাড়ির কলকজার কিছুই জানি না। গাড়ি পথে বিগড়ে গেল –তখন করবটা কি? তাছাড়া ধর, একটা একসিডেন্ট করলাম। ঢাকা শহরের জাগ্রত জনতা আমাকে ঘিরে ধরল। মেরে তক্তা বানানোর মতলব করছে। তখন নিজের একজন মানুষ লাগবে যে আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে। প্রয়োজনে জীবন তুচ্ছ করে পুলিশ ডেকে আনবে। ড্রাইভার সঙ্গে রাখার এই হল ব্যাকগ্রাউন্ড স্টোরি।
মামুনকে দেখলে মনে হবে সে খুব আপনভোলা স্বভাবের একজন মানুষ। মনে। হবে কিছুই বোধহয় সে লক্ষ্য করছে না –আসলে সে সবই লক্ষ্য করছে। খুব সাবধানী, খুব হিসেবী একজন মানুষ। বিয়ের পর পর একদিন সকালে নাশতা খেতে বসেছে। সিগারেট চাইল –আমি সিগারেটের প্যাকেট এনে দিলাম। সিগারেট ধরিয়েই সে ভুরু কুঁচকে বলল, চারটা সিগারেট থাকার কথা। তিনটা কেন?
আমি বললাম, তোমার সিগারেট কে নেবে? তিনটাই ছিল।
অসম্ভব। রাত এগারোটার সময় দেখেছি –ছটা সিগারেট। শুতে যাবার আগে একটা খেলাম, রইল পঁচ। ভোরবেলা বেড-টির সঙ্গে একটা খেয়েছি –রইল চার। এখন দেখি তিনটা। কারণ কি?
আমি হাসতে হাসতে বললাম –তুমি হিসাব-নিকাশ বন্ধ কর তো। তুচ্ছ একটা সিগারেট!
মোটেই তুচ্ছ না। কোথায় গেল বের করতে হবে।
কে তোমার সিগারেট নেবে বল? দুটা কাজের মেয়ে ছাড়া এখানে কেউ আসেনি।
ওরাই নিয়েছে।
ওরা সিগারেট দিয়ে কি করবে?
খাবে। তুমি জান না লোয়ার লেভেলে স্মোকিং হ্যাবিট খুবই প্রবল। তুমি কাজের মেয়ে দুটাকে ডাক। জেরা করব।
আমি অবাক হয়ে বললাম, এটা কোন কথা হল? সামান্য একটা সিগারেটের জন্যে তুমি বাসায় কোর্ট বসাবে?
অবশ্যই বসাব। ব্যাপারটা তুমি যত সামান্য ভাবছ, আমি ভাবছি না। You start by Killing a cat, you end up by Killing a man. ডাক দু’জনকে।
আমার সামনে তুমি এটা করতে পারবে না।
বেশ, আমি আড়ালেই করব। তুমি শুধু ডেকে দাও।
আমি দু’জনকে ডেকে চায়ের কাপ হাতে ওদের বাড়ির ছাদে উঠে গেলাম। পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে এত অস্বাভাবিক লাগছিল! মামুন দশ মিনিটের মাথায় ছাদে উঠে এসে হাসিমুখে বলল, চুরনি ধরা পড়েছে। মতির মা স্বীকার করেছে।
কি বলেছে?
ও সুন্দর একটা গল্প সাজিয়েছে। ঘর ঝাট দিতে গিয়ে সে দেখল সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট মোঝেতে কি করে যেন পড়ে গেছে। মাটিতে পড়ে থাকা সিগারেট আমি আর খাব না ভেবে সে সিগারেটটা তার ট্রাংকে রেখে দিয়েছে। দেশে যখন যাবে তখন মতির বাবাকে দেবে।
এই গুরুতর অপরাধের জন্যে তুমি তাকে কি শাস্তি দিয়েছ? মেরেছ?
না। ওকে এক মাসের বেতন, দেশে যাবার গাড়িভাড়া এবং একটা সিগারেট কেনার পয়সা দিয়ে বলেছি পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দিতে।
তুমি সত্যি এটা করেছ?
অবশ্যই। তুমি পাঁচ মিনিট পর নিচে নামলে মতির মা’কে দেখবে না। রাত্রি, তুমি এরকম অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছ কেন?
অবাক হয়েছি, এই জন্যেই অবাক হয়ে তাকাচ্ছি।
অল্পতে অবাক হয়ো না। বী প্র্যাকটিক্যাল।
আমি প্র্যাকটিক্যাল ম্যান হতে পারিনি। চেষ্টাও করিনি। তিন বছর একজন প্র্যাকটিক্যাল মানুষের সঙ্গে বসবাস করেছি। এবং এক সময় মনে হয়েছে –পারছি না। আর পারছি না। টুকুনের বয়স তখন দেড় বছর। সে আমাদের সঙ্গে ঘুমোয় না। আলাদা ঘরে বেবীখাটের উপর ঘুমায়। রাতে তাকে দেখাশোনা করে একজন ট্রেইন্ড আয়া।
আমাদের সঙ্গে ঘুমুলে সে বার বার জাগে, কাঁদে। বিছানা ভিজিয়ে দেয়। মামুনের ঘুমের অসুবিধা হয়। তার দরকার পুরো রাতের ঘুম। সে ঘুম নষ্ট করতে রাজি না।
এক রাতে সে টুকুনের কান্নায় বিরক্ত হয়ে বলল, আমার এক রাতের অনিদ্রার অর্থ জান? এক রাতের অনিদ্রা মানেই দিনের কাজকর্ম ভণ্ডুল। এই অবস্থায় দিনে কাজকর্ম ভণ্ডুল করতে দেয়া যায় না। আমার মাথাটা এখন থাকবে ভাদ্র মাসের দিঘির পানির মত। ঢেউ থাকবে না। ঘূর্ণি থাকবে না। বুঝতে পারছ?
পারছি।
মুখে পারছি বলেলও তুমি আসলে পারছ না। আমাকে হৃদয়হীন মানুষ বলে মনে করছ। ব্যাপার সে রকম না। আমি একটা ইন্ডাস্ট্রি শুরু করছি। বাপ-দাদার জমানো সব টাকা সেখানে ঢেলেছি। ব্যাংকের কাছে আমার পোন কত জান? দুই কোটি পঁচিশ লক্ষ টাকা। আমার দায়িত্ব বুঝতে পারছ? হয় আমি আকাশ ফুড়ে ওঠে যাব –নয় পাতালে প্রবেশ করব। কাজেই এত সাবধানতা। তুমি এই সময়ে কোন কিছু নিয়ে আমাকে বিরক্ত করবে না। এমন কিছু করবে না যাতে আমি আমি …
বিরক্ত হও।
বিরক্তির কথা আগেই বলেছি, অন্য একটা টার্ম খুঁজছি।
রাগ?
হ্যাঁ রাগ। অবশ্যি রাগ আমি কখনো হই না। আমার লিমিট হচ্ছে বিরক্তি পর্যন্ত। আমার ব্যাপারে তোমার ভেতর যদি কোন খটকা তৈরি হয় সেই খটকা দূর করার জন্যও ব্যস্ত হবার দরকার নেই। যথাসময়ে খটকা দূর হবে। দয়া করে তিনটা বছর যেতে দাও, আমি ব্যবসা দাঁড় করিয়ে ফেলি …।
ওর সম্পর্কে নানান ধরনের খটকা আমার মধ্যে তৈরি হতে লাগল। যেমন– নানান কাজে ছ’দিন-সাতদিনের জন্যে তাকে বাইরে যেতে হয়। তার সঙ্গি থাকে তার অফিসের এক মহিলা টাইপিস্ট। বেঁটেখাট, কালো একজন মহিলা — পুরুষদের মত গলা। দেশের বাইরে এত কি টাইপ করার কাজ থাকে যে একজন টাইপিস্ট নিয়ে যেতে হয়? অবশ্যি কুরূপা একজন বয়স্কা মহিলা –অন্য কিছু ভাববার। অবকাশও নেই। তবু একবার রাতে খাবার সময় জিজ্ঞেস করলাম, তুমি বাইরে কোথাও যেতে হলেই টাইপিস্ট নিয়ে যাও কেন? টাইপের কাজ এত কি বল তো?
মামুন খাওয়া বন্ধ করে আমার দিকে তাকাল। তার ভুরু কুঁচকে গেল। অর্থাৎ সে বিরক্ত হচ্ছে।
তুমি কি সত্যি সত্যি জানতে চাও?
হ্যাঁ।
জানতে চাচ্ছ যখন বলি– উত্তরটা পছন্দের হবে না, তারপরেও বলি এবং ঝামেলা শেষ করে রাখি। নয়ত বার বার তুমি এই প্রসঙ্গ তুলবে, ঝামেলার সৃষ্টি করবে। শুরুতেই আমাদের মধ্যে এক ধরনের বোঝাঁপড়া হয়ে যাওয়া ভাল। তুমি তোমার সীমা জানবে, আমি আমার সীমা জানব। বুঝতে পারছ?
না। তবে বোঝার চেষ্টা করছি।
আমার টাইপিস্ট ফরিদাকে তুমি দেখেছ। তার প্রেমে আমার হাবুডুবু খাওয়ার কোন কারণ নেই তা বোধহয় তুমি ধরতে পারছ। পারছ না?
পারছি।
আমি যখন বাইরে যাই তখন সাইট সিইং-এর জন্যে যাই না। এটা কোন আনন্দের ভ্রমণ না, কাজের ভ্রমণ। সে সময় আমাকে কি পরিমাণ খাটুনি করতে হয় তা তোমাকে একবার নিয়ে দেখিয়ে আনব। যাই হোক, যে কথা বলছিলাম –পৃথিবীর সকল পুরুষ মানুষদের মতো আমারও কিছু শারীরিক চাহিদা আছে। আমি তো আর দেশের বাইরে গিয়ে প্রস্টিটিউট খুঁজে বেড়াতে পারি না। আমার সময়ও নেই, আগ্রহও নেই। ফরিদাকে এই কারণেই আমাকে নিয়ে যেতে হয়।
মামুন খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে সহজ ভঙ্গিতে সিগারেট ধরাল। আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। কোন মানুষ এত সহজে এমন কথা বলতে পারে? সে কি করেই-বা ভেবে নিল এই কথাগুলো শোনার পর আমি স্বাভাবিক থাকব? মামুন বলল, কাউকে বল আমাকে হালকা করে কফি দিতে। চিনি যেন আধ চামচ দেয়।
আমি কফির কথা বলে এসে তার সামনে বসলাম। মামুনের ভুরু কুঁচকাল। সে বিরক্ত হচ্ছে। সে কি ধরেই নিয়েছিল তার সব কথাবার্তা হজম করে আমি শান্ত ভঙ্গিতে ঘুমুতে যাব?
মামুন বলল, কিছু বলবে?
হ্যাঁ।
ফরিদা প্রসঙ্গে?
না, ফরিদা প্রসঙ্গে না। আমার নিজের প্রসঙ্গে।
বল।
আমি তোমার সঙ্গে বাস করতে পারব না।
মামুন আমার দিকে ঝুঁকে এসে বলল, কেন? আমি সত্যি কথা বলেছি বলে? সত্যবাদীর সঙ্গে বাস করা যায় না? সত্যি কথাটা না বললে তুমি কোনদিনই জানতে পারতে না।
আমি বললাম, তুমি ধরেই নিয়েছ আমার তোমাকে ছাড়া গতি নেই। এই জীবন আমার তোমার সঙ্গেই কাটাতে হবে। এই প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের কারণেই তুমি অনায়াসে কিছু কুৎসিত কথা আমাকে বলে ফেললে। এটা হল শুরু। এরপরে বাকি জীবনে তুমি আরো অনেক কুৎসিত কাজ করবে, আমাকে সেই সব সহ্য করতে হবে। তোমার সঙ্গে আমি নানা জায়গায় বেড়াতে যাব। পার্টিতে যাব। বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠানে যাব। হাসিমুখে গল্প করব। সবাই বলবে– বাহ! মেয়েটা তো বেশ সুখী। এটা হতে দেয়া ঠিক হবে না।
কি চাও তুমি? সেপারেশন? ডিভোর্স?
আমি লক্ষ্য করলাম, এই কঠিন বাক্যটা বলার ফাঁকে মামুন ঠোঁট চেপে হাসল। সে ধরেই নিয়েছে আমি হাস্যকর কিছু কথা বলছি। মামুন হাই তুলতে তুলতে বলল, তুমি যা চাও তাই হবে। তুমি যদি প্র্যাকটিক্যাল মানুষের মত সব দিক বিবেচনা করে আমার সঙ্গে থাকতে চাও, থাকতে পার। শর্ত একটাই –আমাকে নিয়ে মাথা ঘামাবে না। আমার জীবনযাপনের কিছু বিশেষ পদ্ধতি আছে। তোমাকে সে সব মেনে নিতে হবে আর তুমি যদি চলে যেতে চাও, তাও যেতে পারবে।
আমি চলে যাব।
গুড। তোমাকে ছয় মাস চিন্তা করার সময় দেয়া হল। তুমি তোমার বাবার কাছে চলে যাও। ছ’মাস চিন্তা কর। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা কর –ছ’মাস পর তোমার যদি মনে হয় তোমার ডিসিসান ভুল ছিল, তুমি স্যুটকেস নিয়ে চলে আসবে। আমি একটি কথাও জিজ্ঞেস করব না। আর ছ’মাস পর যদি মনে হয় তোমার সিদ্ধান্ত সঠিক, তাহলে তো কথা নেই।
টুকুনকে আমি সঙ্গে নিয়ে যাব।
টুকুনের কথা এখানে আসছে কেন? আমি রক্ষিতা ধরনের একটা মেয়েকে নিয়ে দেশের বাইরে যাই এই সংবাদে টুকুন খুব চিন্তিত বলে তো মনে হয় না। টুকুন এখানেই থাকবে। আর এই ছ’মাস তুমি তার সঙ্গে দেখাও করবে না।
কেন?
সঙ্গত কারণেই করবে না। দুজনের দেখা-সাক্ষাত মানেই ভালবাসার ব্যাপারটা জিইয়ে রাখা। এতে পরবর্তী সময়ে টুকুনেরও কষ্ট হবে, তোমারও কষ্ট হবে। ভালবাসার বন্ধন পুরোপুরি কেটে যাওয়াই ভাল।
আমি যাতে এখানে থেকে যাই তার জন্যে তুমি এক ধরনের চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছ।
না। আমি প্র্যাকটিক্যাল মানুষ। আমি সমস্যাটা একজন বাস্তববাদী মানুষ হিসেবেই দেখার চেষ্টা করছি। আমাকে যদি ছেড়ে চলে যাও তাহলে তুমি বাকি জীবন একা একা কাটাবে, এটা আমি মনে করি না। আমার তো একা থাকার প্রশ্নই উঠে না। টুকুনকে দোটানায় রাখার কোন মানে নেই।
তুমি ওকে কি বলবে আমি মরে গেছি?
সস্তা উপন্যাসের ডায়লগ আমি বলি না। যেটা সত্যি সেটাই বলব।
আমি সেই রাতে এক মুহূর্তের জন্যে ঘুমুলাম না। পুরো রাত জেগে কাটালাম। মামুন আমার পাশেই নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমুল।
পরদিন দুটা স্যুটকেস হাতে বাবার কাছে চলে এলাম। বাবা বললেন –কি হয়েছে রে মা?
আমি হেসে বললাম, চলে এসেছি বাবা, তুমি আমাকে তোমার বাড়িতে থাকতে দেবে?
বাবা কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
ছ’মাস কেটে গেল। এই ছ’মাসে আমার কখনো ঐ বাড়িতে ফিরে যাবার ইচ্ছে হয়নি। টুকুনের জন্য কষ্ট হয়েছে। তীব্র কষ্ট। যে কষ্টের কোন সীমা-পরিসীমা নেই।
জীবন কাটছিল এক ধরনের ঘোরের মধ্যে। যেন আমি অসুস্থ। বোধশক্তিহীন মানুষ। খাচ্ছি, ঘুমুচ্ছি, চলাফেরা করছি।
আমার সমস্যা কি বাবা কোনদিন জানতে চাইলেন না। তবে মামুনের সঙ্গে তিনি। কথা বলতে গেলেন। তাদের মধ্যে কি হল তাও আমি জানি না। এম্নিতেই বাবা চুপচাপ। আরো চুপচাপ হয়ে গেলেন। তাঁর একমাত্র কাজ হল বারান্দায় জলচৌকিতে বসে খবরের কাগজ পড়া।
বাবলুর সঙ্গে বাসার কোন যোগ নেই –সে মাঝে মধ্যে খুব হৈ-চৈ করত –সংসারে এসব কি হচ্ছে? কি হচ্ছে এসব? বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে এরকম গুজব কেন কানে আসছে? আমি কিন্তু টলারেট করব না –ঐ লোকটার কানে ধরে আমি স্টেডিয়ামের চারদিকে চক্কর দেওয়ার। আমার এই পাওয়ার আছে। মারাত্মক সব লোকজনের সঙ্গে আমার কানেকশন আছে। ফজলু ভাইয়ের সঙ্গে সপ্তাহে তিন চারদিন এক টেবিলে চা খাই। ডেঞ্জারাস লোক। একদিন বাসায় নিয়ে আসব। বুঝলি আপা, আমি সহজ লোক না । আমাকে ভয় পাওয়ার দুই হাজার দুইটা কারণ আছে।
বাবলুর সবকিছুই সাময়িক। হৈ-চৈও সাময়িক। কিছুক্ষণ হৈ-চৈয়ের পর সে সহজ স্বাভাবিক মানুষ। খাচ্ছে-দাচ্ছে, ঘুমুচ্ছে। আমি বাসায় থাকায় তাকেই সবচে’ খুশি মনে হয়। খুশিটা সে গোপন করে না।
তুই যে এখানে আছিস –খুব ভাল হয়েছে। বাসাটা শুশানের মত ছিল। আমি আর বাবা এত বড় একটা বাড়ি– চিন্তা কর অবস্থা! এখন ফাইন হয়েছে। তাছাড়া কোন বাড়িতে মহিলা না থাকলে বাড়িটা ছেলেদের হোস্টেল হয়ে যায় — সব মন্দের একটা ভাল দিক আছে। তুই এখানে আছিস, এর মারাত্মক একটা ভাল দিক আছে …।
আট মাসের মাথায় মামুনের চিঠি পেলাম। ভুল বললাম, মামুনের চিঠি না –মামুনের উকিলের চিঠি। গাধা চিঠি। এরকম চিঠি এডভোকেট সাহেব নিশ্চয়ই অনেককে পাঠিয়েছেন। চিঠিতে কোর্টের দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর প্রক্রিয়ায় না গিয়ে দু’জন একত্রে কাজি অফিসে উপস্থিত হয়ে তালাকনামা প্রস্তুতের সুপারিশ করা হয়েছে।
আমি উকিলের চিঠি বাবাকে দেখালাম। বাবা বললেন, কি করবি? যাবি?
আমি হা-সূচক মাথা নাড়লাম।
যা করছিস ভেবে-চিন্তে করছিস তো?
হ্যাঁ।
বাবা শ্রান্তস্বরে বললেন, আচ্ছা।
বাবা সেদিন যদি শুধু ‘আচ্ছা’ শব্দটা না বলে অন্যকিছু বলতেন তাহলে আমার সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হত কি? হয়ত হত। বাবার কথা অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই– বাবা এই ব্যাপারটা জানেন বলেই বোধহয় শুধু বললেন –আচ্ছা। মা বেঁচে থাকলে তিনি কি করতেন? ভয়ংকর এইসব ঘটনায় হাসির কিছু খুঁজে পেয়ে হয়ত হেসে ফেলতেন। ছোটবেলায় ফুটবল খেলতে গিয়ে বাবলু হাত ভেঙে বাসায় ফিরল। বন্ধু বান্ধব ধরাধরি করে নিয়ে আসছে। বাবলু কিছুক্ষণ পর পর ঠোঁট গোল করে ওহোহো ওহোহো জাতীয় শব্দ করে কাঁদছে। মা বললেন –বাবলু, তুই এমন। ইংরেজি ভাষায় কাঁদছিস কেন? বলেই হেসে ফেললেন। মা’কে সেদিন আমার খুব নিষ্ঠুর মনে হয়েছিল। এখনো মনে হয়।
কাজি অফিসে মামুন এসেছিল সিল্কের একটা হাওয়াই শার্ট পরে। ধবধবে সাদা জমিনের উপর হালকা সবুজ পাতার ছাপ দেয়া শার্ট। ক্রীম কালারের প্যান্ট। চুল সুন্দর করে আঁচড়ানো। মুখও হাসি-হাসি। যেন সে কোন একটা উৎসবে এসেছে। তার সঙ্গে অফিসের কয়েকজন কর্মচারি। বাইশ-তেইশ বছরের হালকা পাতলা গড়নের একটা মেয়েও সঙ্গে আছে। সেও সম্ভবত অফিসেরই কেউ হবে। স্যার স্যার বলছে। মামুন হয়ত ইচ্ছা করেই মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। আমি রিকশা থেকে নামতেই সে এগিয়ে এল। সহজ ভঙ্গিতে হাসল। একজন হাসলে উত্তরে। অন্যজনকেও হাসতে হয়। আমি হাসতে পারলাম না। কেন জানি নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল।
মামুন বলল –কি, ভাল?
আমি মাথা নাড়লাম।
কাগজপত্র সব রেডি করা আছে। দু’জন শুধু একসঙ্গে যাব –সই করব। দ্যাটস অল। তোমাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে। আমার লইয়ারকে একটা জিনিস জানতে পাঠিয়েছি। ও এসে পড়বে। তুমি আস আমার সঙ্গে। কাজি সাহেবের অফিসে একটা আইসোলেটেড ঘর আছে– সেখানে বোস। চা-টা কিছু খাবে?
না। টুকুন কেমন আছে?
ভাল আছে বলেই তো মনে হয়।
ভাল আছে কি-না তুমি জান না?
গত পরশুর খবর জানি –ভাল আছে। ও তো এখানে থাকে না। আমার বড়বোনের সঙ্গে ওকে ইংল্যাণ্ড পাঠিয়ে দিয়েছি। আপাতত সে বোনের সঙ্গেই আছে। চার বছর হলে পাবলিক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব।
আমাকে তুমি কিছুই জানাওনি।
তোমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করিনি।
আমার নিজের ছেলে — সে কোথায় থাকবে, কোথায় থাকবে না তা আমি জানব না?
তোমাকে আগেও বলেছি। এখনো বলছি। তোমার না জানাই ভাল। তোমাদের ভেতর যোগাযোগ থাকলে –তোমার জন্যও সমস্যা, তার জন্যেও সমস্যা। আমি সমস্যা পছন্দ করি না। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করি সমস্যা কমাতে। আমার কাছ থেকে শেখার কিছু নেই– কিন্তু এই ব্যাপারটা শিখতে পার।
আমি কোনদিন আমার বাচ্চাকে দেখতে পারব না?
পারবে। দেখতে পারবে না এমন কথা তো হচ্ছে না। তবে তার আগে আমাকে নিশ্চিত হতে হবে যে, এখন দেখাদেখি হলে সমস্যা হবে না। ভাল কথা, তুমি যদি টুকুনের অভিভাবকত্ব দাবি কর তাহলে তোমাকে কিন্তু কোর্টে যেতে হবে। ডিভোর্স। স্যুট ফাইল করতে হবে। তাও তুমি করতে পার, আমার আপত্তি নেই।
কথা বলতে বলতে মামুন হাসছে। পরম শত্রুকে কোণঠাসা করার যে আনন্দ, মামুনের চোখে-মুখে সেই আনন্দ। আমার চোখে পানি এলে সে আরো আনন্দিত হবে। আমি যদি কাঁদতে কাঁদতে বলি, টুকুনকে আমার কাছে দিয়ে দাও, তাহলে সে নিশ্চয়ই মনের আনন্দে হেসে ফেলবে।
আমি তাকে সেই আনন্দ দিলাম না। সহজভাবেই কাগজপত্র সই করলাম। মামুন বলল –ভাল থেকো।
আমি বললাম, চেষ্টা করব।
মামুন হালকা গলায় বলল, টুকুনকে নিয়ে তুমি কোন দুঃশ্চিন্তা করবে না। ও ভাল আছে, ভাল থাকবে। টুকুন ঢাকায় এলে তোমাকে খবর দেব, তুমি এসে দেখে যেও।
ও কবে আসবে?
তা তো বলতে পারছি না।
ফেরার পথে আমি রিকশায় এলাম না। মামুন তার গাড়িতে করে আমাকে নামিয়ে দিল। পেছনের সীটে আমি এবং মামুন। সামনের সীটে ড্রাইভারের পাশে ওর অফিসেরই কোন কর্মচারি। মামুন সারাক্ষণই সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে ফ্যাক্টরির স্ট্রাকচারাল কি সমস্যা নিয়ে কথা বলতে লাগল। আমি যে তার পাশে বসে আছি এটা তার মনে রইল না।
সেই রাতেই আমি প্রথম স্বপ্নটা দেখলাম। রিকশা করে আমি এবং মামুন যাচ্ছি। আমার শাড়ি আটকে গেছে রিকশার চাকায়। মামুন রিকশা থামাবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছে। রিকশা থামছে না।
.
০২.
এখনকার বখা ছেলেরা গলায় রুমাল বাধে না। কিন্তু বাবলু গলায় লাল রঙের একটা স্কার্ফ জড়িয়েছে। ভিডিও দোকানের বারান্দায় কয়েকটা চেয়ার এবং একটা টুল একত্র করে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। মনে হয় আকাশের সৌন্দর্যে সে মুগ্ধ। আমি তাকে দেখেও না দেখার ভান করলাম। সে আকাশ দেখছে, দেখুক। এমন প্রকৃতিপ্রেমিককে বিরক্ত করা ঠিক না। আমি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি– বাবলু তড়াক করে উঠে বসে বলল –আপা, কোথায় যাচ্ছিস?
আমি দাঁড়ালাম কিন্তু জবাব দিলাম না। জবাব দেয়ার কিছু নেইও। আমি কোথাও যাচ্ছি না। রাস্তায় ঘুরতে বের হয়েছি। রিকশায় করে শহরে ঘুরব। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে এক সময় ফিরে আসব। বাবলু উদাস গলায় বলল, গুলিস্তানের দিকে যাবি না, হেভী গ্যাঞ্জাম হচ্ছে। টিয়ার গ্যাস ফাটাফাটি। দু’জন স্পট ডেড।
বাবলু আশা করেছিল আমি জানতে চাইব কি নিয়ে গ্যাঞ্জাম। জিজ্ঞেস করলে সে দীর্ঘ এক গল্প ফাদার সুযোগ পেয়ে যেত। সে সুযোগ তাকে দেয়া যায় না। আমি দরদাম ঠিক না করেই একটা ফাঁকা রিকশায় উঠে পড়লাম। বাবলু আহত চোখে তাকিয়ে আছে। থাকুক। যা ইচ্ছা করুক। ওর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
পরশু রাতে সে বাসায় ফিরেছে মদ খেয়ে। চোখ লাল, মুখের কথা জড়ানো। হাঁটা দূরের কথা –ঠিকমত দাঁড়াতেও পারছে না। বাবা হতভম্ভ হয়ে বললেন, তোর কি হয়েছে? বাবলু আনন্দিত গলায় বলল, নাথিং। কিছুই হয়নি।
শরীর খারাপ নাকি রে?
শরীর খারাপ না। শরীর ভাল। মনটা হেভী খারাপ।
বাবা কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি বললাম, বাবা, ও মদ খেয়ে এসেছে।
বাবা হতভম্ভ গলায় বললেন, সে কি?
তিনি বোধহয় তার আটষট্টি বছরের জীবনে এত বিস্মিত আগে আর হননি। তিনি একবার বাবলুর দিকে তাকাচ্ছেন, একবার আমার দিকে তাকাচ্ছেন। বাবলু যদি এখন বলে –আপা মিথ্যা কথা বলছে, আমি মদ খাইনি, তাহলে তিনি তার। কথাই বিশ্বাস করবেন।
মাতালরা সত্যবাদী হয়, কাজেই বাবলু সত্যি কথাই বলল –দাঁত বের করে বলল, খুব সামান্য খেয়েছি বাবা। টেস্ট করেছি। বন্ধুবান্ধবরা ধরল। না বলতে পারলাম না। মনটাও ছিল হেভী উদাস।
বাবার বিস্ময় কাটছে না। বাবলু যেমন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে না, দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছে, বাবারও সে রকম অবস্থা। তিনিও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। অল্প অল্প কাঁপছেন। আমি বললাম, বাবা, তুমি ওকে বল বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। আর কখনো যেন এ বাড়িতে না ঢুকে।
বাবলু চোখ লাল করে বলল, চলে যাব কেন? এটা কি তোর একার বাড়ি? তোর যেমন রাইট আছে, আমারো রাইট আছে। তোর হাফ রাইট, আমার ফুল রাইট। আন্ডারস্ট্যান্ড?
বলতে বলতে বাবলু বসে পড়ল এবং বিকট শব্দে বমি করতে লাগল। বমির সঙ্গে তার নাড়িভুড়ি পর্যন্ত উঠে আসছে এমন অবস্থা। বাবা বসে দুহাতে বাবলুর মাথা ধরলেন। বাবলু তার গায়েও বমি করল।
বমি করার ফাঁকে ফাঁকে বাবলু বলল, গরম পানি লাগা তো আপা। হেভী গোসল দিতে হবে। শালা মাখামাখি হয়ে গেছি। ঘরে সাবান আছে না?
এই দৃশ্য দাঁড়িয়ে দেখা মুশকিল। আমি রান্নাঘরে এসে চুলায় পানি চড়িয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। পানি ধীরে সুস্থে গরম হোক। আমি বসে থাকব। ঘরে যে কাণ্ড ঘটছে তা দেখতে ইচ্ছা করছে না।
বাবা রান্নাঘরে ঢুকে বললেন, গরম পানি কি হয়েছে খুকী?
হচ্ছে।
তিনি ইতস্ততঃ করে বললেন, ছেলেমানুষ একটা ভুল করে ফেলেছে। বদ বন্ধু বান্ধব জুটলে যা হয়। তুই মন খারাপ করিস না।
আমি মন খারাপ করছি না। আমার জন্যে তোমাকে ব্যস্ত হবে হবে না।
বাজে কিছু বন্ধু বান্ধব জুটেছে –ওরাই …?
তোমাকে সাফাই গাইতে হবে না, বাবা।
মা, তুই রাগ করিস না– রাগ করিস না।
আমি রাগ করছি না। পানি গরম করছি।
আচ্ছা মা, আচ্ছা।
বালতি ভর্তি গরম পানি নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দেখি বাবা এর মধ্যেই বাথরুম থেকে পানি এনে নোংরা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে ফেলেছেন। বাবলুকে কলঘরে একটা জলচৌকির উপর বসিয়ে রেখেছেন। বাবলু শান্তমুখে বসে আছে। আমাকে দেখে বলল, আপা, গরম পানি বাথরুমে দিয়ে যা।
বাবলুকে বাবা গোসল করালেন। আমি কলঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখলাম। বাবলুর চোখে-মুখে লজ্জা বা অস্বস্তির বিন্দু মাত্র নেই। মনে হচ্ছে সে বেশ আনন্দ পাচ্ছে। মাঝে মাঝে মুখে পানি নিয়ে কুলকুচা করে সেই পানি অনেক দূরে ছিটাচ্ছে। বাবা বললেন –শরীর খারাপ ভাবটা কি দূর হয়েছে?
বাবলু খুশিখুশি গলায় বলল, শরীর তো আমার ঠিকই আছে। মনটা হেভী খারাপ। সাবান দিয়ে গোসল করলে তো আর মন-খারাপ ভাব দূর হয় না?
কি জন্যে মন খারাপ সেটা সকালে শুনব। এখন বাতি নিভিয়ে লেপ গায়ে দিয়ে শুয়ে থাক। কিছু খাবি?
পান খাব, বাবা। মুখ টক হয়ে আছে।
ঘরে পান ছিল না। বাবা নিজেই পান কিনে আনলেন। সেই পান বাবলু খেতে পারল না। তার আগেই ঘুমিয়ে পড়ল। নাক ডাকিয়ে ঘুম।
রাতে আমরা দুজনই কিছু খেলাম না। বমি ঘাঁটার জন্যে বাবার কিছু খেতে ইচ্ছা করছিল না। আমার খেতে ইচ্ছা করছিল না রাগের জন্যে।
আমি এবং বাবা, আমরা দুজন অনেক রাত পর্যন্ত বারান্দায় বসে রইলাম। দু’জনই চুপচাপ। একবার বাবা বললেন, তোর এম. এ. পরীক্ষার রেজাল্ট কবে হবে? আমি বললাম, সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে।
গুড, ভেরি গুড।
বাবা যখনই কথা বলার কিছু পান না, তখনই আমার পরীক্ষার রেজাল্ট কবে হবে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। প্রায়ই আমাকে আমার পরীক্ষার রেজাল্ট কবে হবে তা বলতে হয়।
বাবলুকে নিয়ে কি করা যায় বল তো?
বাড়ি থেকে বের করে দাও। ঘাড় ধরে বের করে দাও।
তুই তো মা রাগের কথা বলছিস। চিন্তা-ভাবনা করে কিছু বল।
চিন্তা-ভাবনা করেই বলছি।
বাবা ঘুমুতে গেলেন রাত বারোটার দিকে। বারোটার আগে তিনি কখনোই ঘুমুতে যান না। বারোটার পর তিনি তাহাজ্জুতের নফল নামাজ পড়েন। এই নামাজ রাত বারোটার পর পড়তে হয় বলে তাকে বারোটা পর্যন্ত জেগে থাকতে হয়।
বাবার ঘুমুতে যাবার পরও আমি অনেক রাত পর্যন্ত একা একা বারান্দায় বসে রইলাম। আমাদের দোতলার দক্ষিণ অংশের ভাড়াটে নাজমুল সাহেবের বাড়িতে অনেক রাত পর্যন্ত বাতি জ্বলে। নাজমুল সাহেব গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনা এবং লেখালেখি করেন। মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে তিনি বারান্দায় এসে সিগারেট ধরান। দু তিনটা টান দিয়েই সেই সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে আবার ঘরে ঢুকে যান। নাজমুল সাহেবরা অনেকদিন থেকেই আমাদের বাড়িতে আছেন। এত দীর্ঘদিন কেউ থাকলে তার সঙ্গে সহজ সম্পর্ক হয়ে যাওয়ার কথা। এই ভদ্রলোকের সঙ্গে হয়নি। তিনি কারো সঙ্গেই কথা বলেন না। সম্ভবত নিজের স্ত্রীর সঙ্গেও না। রাস্তায় হঠাৎ আমার সঙ্গে দেখা হলে ঝট করে চোখ ফিরিয়ে নেন কিংবা রাস্তার দিকে তাকিয়ে হাঁটতে। থাকেন যাতে চোখে চোখ না পড়ে কিংবা কথা বলতে না হয়। তাকে স্লমালিকুম দিলে তিনি বেশির ভাগ সময়ই না শোনার চেষ্টা করেন। সেটা সম্ভব না হলে উ ঊ বলে মাথা নাড়েন। পরিবারে একজন অস্বাভাবিক মানুষ থাকলে তার ছোঁয়া অন্য সবার মধ্যেই পড়ে। সেই জন্যেই বোধহয় নাজমুল সাহেবের স্ত্রী পান্না ভাবীর স্বভাবও খানিকটা বিচিত্র। তিনি প্রচুর কথা বলেন। প্রচুর গল্প করেন –সেই সব গল্পের সবই হল ভয়ংকর ধরনের গল্প। কোথায় কে কাকে খুন করেছে এই জাতীয় গল্প। নিখুঁত বর্ণনা। স্বামী সম্পর্কেও তিনি প্রচুর গল্প করেন, যেসব গল্প কোন সুস্থ মাথার স্ত্রী তার স্বামী সম্পর্কে কখনো করবেন না–
তোমার ভাইকে বাইরে থেকে ফেরেশতার মত মনে হয় না? ফলস ফেরেশতা। আসল জিনিস না, নকল। পুরোটাই মুখোশ। রাত-দিন বই পড়ে, লিখে –মনে হবে, বাবা, কি বিরাট স্কলার! নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই। আসলে ফলস স্কলার। মুখের সামনে বই ধরে রাখলেই স্কলার হয় না। মুখের সামনে বই ধরে রাখে কেন জান? যাতে আমার সঙ্গে কথা বলতে না হয়। আমার কথা বিশ্বাস করলে না, তাই না? ভাবছ, পান্না ভাবী বানিয়ে বানিয়ে কথা বলছে। আমি নিজেও এটা শুরুতে ধরতে পারিনি। শুরুতে আমার মনে হয়েছিল– আহা, কত বড় স্কলারকে বিয়ে করেছি। আমার জীবন ধন্য। পরে বুঝলাম, সবই ভান। ওর। সবটাই ভান। পায়ের নখ থেকে মাথার চল পর্যন্ত ভান। ও যে নিঃশ্বাস ফেলে সেই নিঃশ্বাসটা পর্যন্ত ভান। ও হচ্ছে ভান-সম্রাট।
রাস্তায় তোমার সঙ্গে দেখা হলে চোখ তুলে তাকাবে না। সালাম দিলে –সালাম। পর্যন্ত নিবে না। কিন্তু তলে তলে মেয়েমানুষ দেখার জন্যে শুধুই ছোঁক ছোঁক করে। বাসায় কাজের মেয়ে-টেয়ে যে রাখি ওর নজর সেই দিকে। এরা সারাদিন কাজ করে, রাতে মরার মত ঘুমায়। ঘুমের সময় তো আর সব সময় কাপড়-চোপড় ঠিক থাকে না –এই হয়ত পা থেকে শাড়ি খানিকটা ওঠে গেল, বা ব্লাউজের একটা বোতাম খুলে গেল। তোমার ভাইয়ের তখন ঈদ উৎসব। হা করে তাকিয়ে থাকবে। চোখে পলক পড়বে না। তার ধারণা কেউ কিছু জানে না। আমি তো বিছানায় শুয়ে ঘুমুচ্ছি। আমি দেখব কি? সে তো জানে না –আমি জেগে থাকি। মটকা মেরে পড়ে থাকি। স্পাইয়ের মত পা টিপে টিপে একবার এসে দেখে যাই। কি দেখি জান? দেখি, আমাদের স্কলার সাহেব হা করে বোতাম খোলা ব্লাউজের দিকে তাকিয়ে আছেন। কাজের মেয়েরা তো আর ব্লাউজের নিচে কিছু পরে না। ওদের ব্লাউজের বোতাম খোলো মানে অনেক কিছু। আমি করি কি –আড়াল থেকে দেখে চলে আসি। কিছু বলি না। একেবারেই যে বলি না তা না –একবার বললাম, কি দেখছ?
সে আমার দিকে তাকিয়ে স্কলারের মত গলায় বলল –প্রাচীন ভারতে চারটা ক্লাস ছিল –ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র। এই ক্লাসগুলি এখনো আছে। প্রবলভাবেই আছে। এই মেয়েটাকে দেখ আজকের ক্লাস সিস্টেমে সে শুদ্র। অস্পৃশ্য।
অস্পৃশ্য কে বলল –ওকে ছুঁয়ে দিলে কিছু হবে না। যাও, ছুঁয়ে এসো।
স্কলার সাহেব এমনভাবে তাকালেন যেন আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমার চিকিৎসা দরকার। আসল চিকিৎসা কার দরকার তা জানি শুধু আমি … ।
.
নাজমুল সাহেবকে দেখছি বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছেন। তার স্ত্রীও নিশ্চয়ই আড়াল থেকে লক্ষ্য করছেন। ছায়ার মত পেছনে পেছনে আছেন। লক্ষ্য না করার কথা না। আজকে যে নাটক বাড়িতে হল সেই নাটকের পুরোটা পান্নাভাবী জানেন, এটাও নিশ্চিত।
বারান্দায় আলো নেই। আমি অন্ধকারে বসে আছি। আমাকে ভদ্রলোক দেখতে পারছেন না। আমি তাকে দেখছি। স্নামালিকুম বলে আমি ভদ্রলোককে চমকে দেব না-কি? স্নামালিকুম বললে উনি কি করবেন? উ ঊ জাতীয় শব্দ করে এক দৌড়ে ঘরে ঢুকে যাবেন?
আমি নিজের অজান্তে হঠাৎ বলে ফেললাম, স্লামালিকুম নাজমুল ভাই। উনি চমকালেন না। অবাক হলেন না। আমাকে অবাক করে দিয়ে স্বাভাবিকভাবে বললেন –তুমি এত রাত পর্যন্ত জেগে আছ যে?
আমি তো খুব রাত জাগি।
তা জানি।
জানেন? আশ্চর্য তো! আমি ভেবেছিলাম –আপনি শুধু আপনার বই এবং লেখার খাতায় কি ঘটছে তা জানেন। আর কিছু জানেন না।
নাজমুল সাহেব আবারো আমাকে অবাক করে দিয়ে শব্দ করে হাসলেন। এই প্রথম দেখলাম তিনি সিগারেট দুটা টান দিয়ে ফেলে দিলেন না। বারান্দার রেলিঙে ঝুঁকে গল্প করবে লাগলেন —
এম. এ. পাশ করার পর কি করবে কিছু ঠিক করেছ?
জি করেছি।
কি করবে?
ঘুমাব। আরাম করে ঘুমাব।
আরাম করে তো এখনো ঘুমুতে পার। এখন তো আর পড়াশোনা নেই।
পড়াশোনা না থাকলেও টেনশন আছে। পাশ করব কি করব না।
কি বলছ তুমি! খুব ভাল পাশ করবে তুমি। যে ভাবে পড়াশোনা কর তাতে খারাপ রেজাল্টের কোন সম্ভাবনা নেই
আমি কি খুব পড়াশোনা করেছি।
দিন রাতই তো দেখতাম পড়ছ।
আপনি চারপাশে কি ঘটে তা লক্ষ্য করেন? আশ্চর্য!
তিনি আবারো শব্দ করে হাসলেন। আর তখন ঘুম ভেঙে বাবলু উঠে এসে বলল, আপা, ভাত দে। খিদে।
রাত বাজে কটা জানিস?
কটা?
প্রায় তিনটা।
তিনটার সময় ভাত খাওয়া যাবে না –এমন কোন কথা আছে? আছে এমন। কোন আইন? থাকলে বল– পেনাল কোডের কোন ধারায় আছে?
আমি রাত তিনটায় বাবলুর জন্যে ভাত বাড়তে গেলাম। অনেক যন্ত্রণা করতে হবে। ঠাণ্ডা ভাত সে খাবে না। ভাত গরম করতে হবে। তরকারী গরম করতে হবে। সালাদ বানাতে হবে। খেতে বসে বলে বসতে পারে –মাছ খাব না, ডিম ভেজে দে। ঘরে ডিম আছে কি-না তাও জানি না।
বাবলু গোগ্রাসে খাচ্ছে। তার খুব যে খিদে পেয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। সন্ধ্যারাতে সে কি কাণ্ড করেছে তাও বোধহয় তার মনে নেই।
আপা, একটা ডিম ভেজে দে।
ডিম নেই।
সামান্য একটা ডিমও ঘরে থাকে না?
থাকে। আজ নেই।
আজ নেই কেন? সংসারে আমরা তিনটা মোটে মানুষ, একটা কাজের লোকও নেই। মাসের শেষে ছ’ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া পাস। যায় কোথায় টাকাটা?
কথা বলিস না। চুপ করে খা।
চুপ করে খাব কেন? আমি একটা প্রশ্ন করেছি। আমি তার আনসার চাই। গিভ মি এন এক্সপ্লেনেশন।
ওর সঙ্গে কথা বলা নিরর্থক। আমি চুপ করে রইলাম –সে ভাতের থালা সরিয়ে দিয়ে বলল, –যা, খাব না তোর ভাত।
না খেলে উঠে যা।
আমি উঠব কি উঠব না সেটা আমার ব্যাপার।
তাহলে বসে থাক। আমি চললাম।
বাবলু বলল, তোর দেমাগ খুব বেশি হয়ে গেছে, সেটা কি তুই জানিস? তুই ডুবছিস তোর দেমাগের জন্যে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। তোর হাসবেন্ড যে ঘাড় ধরে তোকে বার করে দিয়েছে –তোর দেমাগের জন্যে বার করে দিয়েছে। অন্য কিছু না। এ বাড়িতে তুই পড়ে আছিস আমার দয়ার উপর। আর কিছু না।
আমি তাকিয়ে আছি বাবলুর দিকে। এইসব কি নেশাগ্রস্ত মানুষের কথা? নাকি তার মনে এই ব্যাপারগুলি আছে? নেশার কারণে বের হয়ে আসছে?
নিজের ছেলেকে তুই ঈদের দিনেও চোখের দেখা দেখতে পারিস না। কেন পারিস না? তোর দেমাগের জন্যে।
চুপ কর বাবলু।
বাবুল চুপ করল। আমি শান্ত ভঙ্গিতে থালা-বাসন সরালাম। টেবিল মুছলাম। বাবলু বলল, পানি খাব।
আমি পানি এনে দিলাম। সহজ গলাতেই বললাম, চল ঘুমুবি। বাবলু আপত্তি করল না। উঠে এল। আমি শুয়ে পড়লাম নিজের ঘরে। হঠাৎ খুব ক্লান্তি বোধ করছি। মনে হচ্ছে অনেকদিন ঘুমুইনি। অনেকদিন পর যেন আজ প্রথম ঘুমুতে যাচ্ছি। খুব ক্লান্ত মানুষ ঘুমুতে পারে না। আমিও ঘুমুতে পারছি না। ঘুমুতে না পারার আরেকটা বড় কারণ হল, বাবলু ঠিক আমার ঘরের সামনে হাঁটাহাঁটি করছে। শব্দে করে হাঁটা, ইচ্ছা করেই যেন এত শব্দ করছে। শুধু যে শব্দ করে হাঁটছে তা না, চেয়ার পরেও টানাটানি করছে। সম্ভবত সে চাচ্ছে আমি বলি –শব্দ করছিস কেন? যাতে সে আরেকটা ঝগড়া বাধাবার সুযোগ পাবে।
এখন আমার দরজায় ধাক্কা পড়ছে। আমি বললাম, কি হয়েছে বাবলু?
একটু দরজা খুলবি আপা?
কেন?
খুব জরুবী একটা কথা বলব। খুবই জরুরী। এক মিনিট লাগবে।
সকালে শুনব।
সকালে না আপা –এখন শুনতে হবে।
বাবলু, তুই খুব বিরক্ত করছিস।
দরজা না খুললে আমি আরো বিরক্ত করব। লাথি দিয়ে দরজা ভেঙে ফেলব।
ধমাধম শব্দে দরজায় লাথি পড়তে লাগল। শব্দে নিশ্চয়ই পাড়া জেগে উঠেছে। পান্নাভাবী বাতি নিভিয়ে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে আছেন কি হচ্ছে শোনার জন্যে। আমি বাবার চটির শব্দ শুনলাম। বাবা কঠিন গলায় কখনো কথা বলতে পারেন না। আজও পারলেন না –নরম গলায় বললেন, কি হয়েছে রে?
বাবলু কোন শব্দ করল না। বাবা বললেন –তুই আমার সঙ্গে আয়।
কোথায় যাব?
আমার ঘরে আয়। তোর সঙ্গে কথা বলি।
রাত-দুপুরে কি কথা? রাত-দুপুরে যদি দরজা ভাঙাভাঙি করা যায় তাহলে কথাও শোনা যায়।
উপদেশ শুনতে ভাল লাগে না, বাবা।
উপদেশ শুনতে হবে না। আয় তুই।
না আমি যাব না। আমাকে সে দুই চোখে দেখতে পারে না। কেন পারে না? আমি কি করেছি? আমি হয়েছি দুনিয়ার খারাপ, সে হয়েছে মহিলা-ফেরেশতা। সে যে একজন বিবাহিত লোকের সঙ্গে রাত তিনটার সময় প্রেম করে সেটা কিছু না?
বাবা ক্লান্ত গলায় ডাকলেন, বাবলু!
বাবলু পাত্তা দিল না। গলার স্বর আরো উঁচিয়ে বলল, আমি কিছু করলেই দোষ হয়ে যায়। কারণ আমি নন্দঘোষ। যত দোষ নন্দঘোষ। আপার কোন দোষ নেই। সে মহাপবিত্র। রাত তিনটায় প্রেম করলেও কিছু না –বিবাহিত মানুষের সঙ্গে ট্যাক্সি করে ঘুরলেও কিছু না।
সে কথা বলেই যাচ্ছে। বলেই যাচ্ছে। তাকে এখন আর থামানো যাবে না। একটা সূঁচ-সূতা এনে তার ঠোঁট সেলাই করে ফেললেও সে কোন না কোনভাবে কথা বলবে। আমি মাথার উপর লেপ টেনে দিলাম। অন্যকিছু ভাবতে চেষ্টা করছি। মিষ্টি কোন স্মৃতি –যা আমাকে বর্তমান ভুলিয়ে দেবে। এমন কিছু কি আছে? টুকুনের কথা ভাবব? না না, টুকুন না, টুকুনের কথা ভাবব না। কিছুতেই না। তবে মনে মনে তার কাছে একটা চিঠি লেখা যায়। মনে মনে লেখা চিঠি নাকি পৌঁছে যায়। এই পৃথিবী খুব রহস্যময়। পৃথিবীর অনেক রহস্যের একটা রহস্য হচ্ছে– মনের চিঠি। ঠিকানা লাগে না, পোস্টাল কোড লাগে না। চিঠি লিখলেই হল —
আমার ছোট্ট বাবা টুকুন সোনা,
তুমি এখন কি করছ গো সোনা? ভাল আছ? ঘুমুচ্ছ? আজ বেশ শীত পড়েছে, তাই না বাবা? গায়ে লেপ আছে তো? তোমার বিশ্রী অভ্যাস আছে গা থেকে লেপ ফেলে দেয়ার। ঠাণ্ডা লেগে গেলে খুব কষ্ট হবে। কাজেই সাবধান। খালি পায়ে মেঝেতে হাঁটাহাঁটি করবে না। এবং কখনো মন খারাপ করবে না। যদি কোন কারণে মন খারাপ হয়, সঙ্গে সঙ্গে বাবাকে বলবে। ছাদের রেলিং ধরে কখনো নিচে উঁকি দেবে না। আর একা একা ছাদে যাবারও দরকার নেই।
বাবা, তুমি কি এখন গল্পের বই পড়তে পার? আমি সুন্দর সুন্দর কিছু গল্পের বই কিনে তোমাকে পাঠাব। আর একটা সুন্দর খাতা এবং কলম কিনে পাঠাব। ঐ খাতাটায় তুমি রোজ মাকে চিঠি লিখবে। আমি একদিন গিয়ে তোমার সেই খাতা নিয়ে আসব।
শোন বাবা, এবার কি তোমার জন্মদিন খুব ধুমধাম করে হয়েছে? জন্মদিনে কি কি উপহার পেয়েছ? একদিন এসে সব দেখে যাব। আমি তোমার জন্যে জন্মদিনের একটা উপহার কিনে রেখেছিলাম। দিতে পারিনি। সমস্যা কি হয়েছে জান বাবা –আমি ইচ্ছা করলেই তোমাদের বাড়িতে আসতে পারি না। তোমার বাবার সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছে। বড়রাও মাঝে মাঝে ঝগড়া করে। কাজেই দুজন দুজায়গায় থাকছি। কিন্তু আমরা দুজনই তোমাকে অনেক অনেক ভালবাসি। এখন তুমি তা বুঝতে না পারলেও … যতই দিন যাবে ততই বুঝতে পারবে …
না, চিঠিটা ভাল হচ্ছে না। আমি মনে মনে লেখা চিঠির পাতাটা ছিঁড়ে ফেললাম। টুকুনের চিঠিতে বড়দের ঝগড়ার কথা কিছু থাকার প্রয়োজন নেই। ওর চিঠি থাকবে ভালবাসায় ডুবানো।
বারান্দায় বাবলুর কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে না। ও কি চলে গেছে? কখন গেল? পানির পিপাসা হচ্ছে। উঠতে ইচ্ছা করছে না। চোখে ঘুম নেমে আসছে। ঘুমের মধ্যেই ঠিক করলাম, কাল সকালে মামুনের সঙ্গে দেখা করব –তাকে বলব … কি বলব তাকে? …
.
০৩.
প্লেট ভর্তি ভাপা পিঠা নিয়ে ভোরবেলাতেই পান্না ভাবী উপস্থিত। তিনি হাসিমুখে বললেন, রাত্রি নাও তোমার জন্যে গরম পিঠা এনেছি। এক্ষুণী খাও –ঠাণ্ডা হলে খেতে পারবে না।
পান্না ভাবী ভোরবেলাতেই গোসল করেছেন। চুল ভেজা। পাট ভাঙ্গা নতুন শাড়ি পরেছেন। তাকে সুন্দর লাগছে। কাল রাতে বাবলুর কুৎসিত কথা তিনি নিশ্চয়ই শুনেননি। শুনলে এত হাসিখুশি তাঁকে দেখাতো না। আমি বললাম, ভাবী আপনাকে সুন্দর লাগছে। সকালবেলা এত সাজ গোজ?
আজ তোমার ভাইয়ের জন্মদিন। ভাবলাম সাজগোজ করে –পিঠা বানিয়ে জন্মদিনের মানুষটাকে চমকে দেই। ভাপা পিঠা তোমার ভাইয়ের খুব পছন্দ।
নাজমুল ভাইকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে দেবেন ভাবী।
আমি জানাব কেন? তুমি জানিও। তুমি জানালেই বেশি খুশি হবে। পিঠা খাও– ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
আমি পিঠা মুখে দিলাম। আগুন গরম-ভাপ উঠছে।
কেমন হয়েছে?
খুব ভাল।
পিঠার মধ্যে ভাপা পিঠা বানানোই সবচে কঠিণ যদিও দেখে মনে হয় সবচে সহজ। একটু উনিশ বিশ হয়েছে কি পিঠা শক্ত হয়ে যাবে। খেয়ে স্বাদ পাবে না।
মোটেও শক্ত হয় নি। খেতে খুব ভাল হয়েছে।
ছ পিস এনেছি। তোমাদের সবার জন্যে দু পিস করে।
পান্না ভাবী থংকস।
যার জন্যে সাতসকালে পিঠা বানালাম সে এখনো ঘুমে। মনে হয় কাল অনেক রাত পর্যন্ত জেগেছে। তার ঘুম ভাঙ্গার আগেই কিছু ফুল এনে বিছানায় ছড়িয়ে দেব। আইডিয়া কেমন?
খুব ভাল আইডিয়া।
ফুলের দোকান কি খুলেছে?
এত সকালে কি খুলবে।
পান্না ভাবী নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তাহলে বরং একটু পরেই যাই। তুমি চা করতো রাত্রি। তোমার সঙ্গে বসে চা খাই। শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছে। কাল রাতে কি হয়েছে শোন –রাত এগারোটার সময় মার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হল। অকারণে মার সঙ্গে খানিকক্ষণ রাগারাগি করলাম। সাংঘাতিক মাথা ধরল। রাগ কমানোর জন্যে ছটা হিপনল খেয়ে শুয়েছি– এক ঘুমে রাত কাবার।
আমি মনে মনে হাসলাম। কাল রাতের ব্যাপার পান্নাভাবী সবই জানেন। এটা কাটান দেয়ার জন্যেই ঘুমের ট্যাবলেট হিপনলের কথা নিয়ে এসেছেন।
আমি চা বানাচ্ছি– পান্না ভাবী আমার সামনে মোড়ায় বসে আছেন। আমি যতদূর জানি পান্নাভাবী চা খান না। চা খাওয়ার এই ভণিতার পেছনেও নিশ্চয়ই কোন করাণ আছে। কে জানে কি সেই কারন।
রাত্রি!
জি ভাবী।
তোমাকে আমি আমার ছোটবোনের মত মনে করি।
আমি জানি ভাবী।
না তুমি জান না। তোমাকে যে আমি কতটা ভালবাসি তা আমি জানি। অন্য কেউ জানে না। অন্য কারোর জানার কথাও না। আমিতো আর আমার মনের কথা শহরে ঢোল দিয়ে সবাইকে বলব না —
তাতো বটেই।
নিতান্ত আপনজন ভেবে আমি তোমাকে কয়েকটা কথা বলব বোন।
আমি শংকিত গলায় বললাম –বলুন। আমার ভয় হচ্ছে পান্না ভাবী কাল রাতের ব্যাপারটা তুলে আনেন কি-না। তিনি গলা অনেকখানি নামিয়ে ফিস ফিস করে বললেন –তুমি কি ইদানীং আমার কাজের মেয়ে রাণীকে লক্ষ্য করেছ?
কেন বলুনতো?
লক্ষ্য করেছ কি-না বল।
রোজইতো দেখি।
সেই দেখা না– ভাল করে দেখেছ কি-না। ওর শরীর এখন কেমন ভার ভারন্ত মনে হয় না?
আমি তাকিয়ে আছি পান্নাভাবী গলা আরো নামিয়ে প্রায় ফিস ফিস করে বললেন –মনে হয় কোন একটা কান্ড হারামজাদী বাঁধিয়েছে– কাকে সন্দেহ করছি বলব? শুনে আকাশ থেকে পড়বেনা– সন্দেহ না, আমি জানি — মূল নায়ক আমার কর্তা। সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক নাজমুল হক পি এইচ ডি –গবেষক — পন্ডিত –যিনি মেয়েদের দিকে চোখ ভুলেও তাকান না।
কি যে বলেন ভাবী।
না জেনে কিছু বলি না –জেনে শুনে বলি। ঐদিন কি হয়েছে শোন তোমার নাজমুল ভাই বই পড়ছে –আমি রাণীকে বললাম –যাও খালুকে চা দিয়ে আস। সে চায়ের কাপ নিয়ে যাচ্ছে আমি আড়াল থেকে দেখছি। কি দেখলাম জান রাণী চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল, তারপর চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাসি। স্ত্রী রাধিকার লীলা।
ভাবী এসব আপনার কল্পনা।
কল্পনা না বাস্তব পঞ্চাশটা টাকা খরচ করলেই ধরা পড়ে যাবে। প্রেগনেন্সি টেস্টে পঞ্চাশ টাকা লাগে। আমি চুপ করে আছি, কিছু বলছি না। কয়েকটা দিন যাক তারপর তোমার গবেষক ভাই বুঝবে রাত দুপুরে মেয়েমানুষ নিয়ে গবেষণা করলে কি হয়। আমি কি করব শুনতে চাও?
জি না আমি শুনতে চাচ্ছি না।
শোন। শোন –আমি মারামারি কাটাকাটির মধ্যে নেই ঐসব আমি করব না। আমি কাজী ডেকে এনে বিয়ে পড়িয়ে দেব। বিয়ে হয়ে গেলে কাজের মেয়ের সমস্যাও সমাধান হয়ে যাবে। কাজের মেয়েতো বেশিদিন থাকে না — আজ এই বাড়ি –কাল ঐ বাড়ি … পরশু গার্মেন্টস বিয়ে হয়ে গেলে স্বামীর সংসারে থাকবে।
পান্নাভাবী চা খাচ্ছেন না। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কথা বলে যাচ্ছেন। আমি হতভম্ব হয়ে শুনছি।
রাত্রি উঠি ফুলের দোকান বোধহয় খুলেছে।
পান্নাভাবী ঠাণ্ডা চা, এক চুমুকে শেষ করে উঠে পরলেন। ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছেন ফুলের খোঁজে। রান্নাঘর থেকে বের হতেই তার দেখা হল বাবলুর সঙ্গে –তিনি আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন, কি রে বাবলু ভাল আছিস? তিনি বাবলুকে তুই করে বলেন। বাবলুর সঙ্গে তার আলাদা খাতির। বাবলু তার উত্তরে কি বলল বোঝা গেলো না।
কাল রাতে এমন হৈ চৈ শুরু করলি কেন?
আমি যা ভেবেছিলাম তাই। পান্নাভাবী কাল রাতের হৈ চৈ পুরাটাই শুনেছেন ভালমতই শুনেছেন।
বাবলু কাল রাত হয়েছিল কি?
কিছুই না। নাথিং।
বাবলু বলতো ফুলের দোকান খুলেছে কি না?
ফুলের দোকান দিয়ে কি করবে?
তোর দুলাভাইয়ের জন্মদিন –ফুল কিনব। তোর কি এখন কোন কাজ আছে?
হাতমুখ ধোব। নাস্তা খাব।
হাতমুখ পরে ধুলেও হবে। তুই আয়তো আমার সঙ্গে ফুল কিনব। ফুল পছন্দ করে দিবি।
ফুলের আবার পছন্দ অপছন্দ কি? ফুল দেখতে সব এক রকম।
তুই চলতো।
মুখ ধুইনিতো।
কুলি করে নে। কুলি করলেই হবে –তুই আজ আমার সঙ্গে নাশতা খাবি।
ওকে ভাবী। ওকে।
আমি মনে মনে হাসলাম। পান্নাভাবী আজ আর বাবলুকে ছাড়বেন না। জেঁকের মত পেছনে লেগে থাকবেন। কাল রাতে কি হয়েছিল তা খুঁটে খুঁটে বের করবেন। আমাকে মিথ্যা কথাটা বলার দরকার ছিল কি? কেন বললেন –কাল রাতে হিপনল খেয়ে মরার মত ঘুমিয়েছেন।
.
বাবাকে নাশতা দিতে গেলাম। বাবা বললেন, বাবলু খেয়েছে?
ও পান্না ভাবীর সঙ্গে ফুল কিনতে গেছে।
বাবলুর সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।
কথা থাকলে কথা বলবে। ও আসুক তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলি।
বাবা নাশতা খেলেন না –খালি পেটে চায়ে চুমুক দিলেন –আমি চাইনা ও এ বাড়িতে বাস করুক।
এ বাড়িতে বাস না করলে কোথায় বাস করবে?
ওর বন্ধু বান্ধব আছে। ওরকি থাকার জায়গার অভাব আছে?
বাবা তুমি রাগের কথা বলছ।
রাগের কথা বলাটাকি অন্যায় হচ্ছে?
হ্যাঁ অন্যায় হচ্ছে।
আমাকে তুই কি করতে বলিস?
চুপ করে থাকতে বলি।
চুপ করেইতো আছি।
আরো চুপ করে যাও।
বাবলুর কি হবে?
ওকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই বাবা। খুব মন্দ হবার কোন ক্ষমতা ওর নেই। ওর দৌড় মাঝে মাঝে নেশা ভাং করে হৈ চৈ করা পর্যন্ত।
নেশা ভাং করাটা তোর কাছে তেমন গুরুত্ব পূর্ণ কিছু মনে হচ্ছে না? বাইশ তেইশ বছরের একটা ছেলে নেশা করে বাসায় আসবে?
ওর একটাই সমস্যা বাবা। ও বোকা। ও যা করছে বোকা বলেই করছে। বুদ্ধি থাকলে ও নেশা ঠিকই করতো –কিন্তু নেশা করে বাসায় আসত না। বোকা হবার। দায় দায়িত্ব তার না। কাজেই ওকে সামলাতে হবে অন্য ভাবে।
কি ভাবে?
চিন্তা করছি। তুমি কিছু ভেবো না। শুধু চা খাচ্ছ কেন বাবা –নাশতা খাও।
কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না।
বাবলুকে নিয়ে আমার তেমন কোন চিন্তা নেই বাবা। আমার চিন্তা তোমাকে নিয়ে।
আমাকে নিয়ে কিসের চিন্তা?
অবসর সময়ে মানুষকে কাজে কর্মে ব্যস্ত হতে হয়। ব্যস্ত না হলে নানান সমস্যা– তুমি কিছুই করছ না। দিন রাত বসে থাক। ব্যস্ততা বাড়াও বাবা।
কি করব?
সেটা তুমি ভেবে বের কর। আমরা সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে চলে গেলে কেমন হয় বাবা? খামার বাড়ির মত কর। হাঁস মুরগী, গরু বাছুর এইসব থাকবে। শাক শজি ফলাবে। আমিও তোমার সঙ্গে থাকব। বাবলু থাকবে। ব্যাক টু দ্যা ভিলেজ।
এইসব বলা খুব সহজ মা। করা কঠিণ।
যে টা সহজে বলা যায় সেটা সহজে করাও যায়। কেউ করতে চায় না, কারণ মনে করে করা যাবে না।
তুই যা ভাবিস তা করতে পারিস?
হ্যাঁ পারি। কাল রাত থেকে ভাবছি –আজ দুপুরে আমি টুকুনকে নিয়ে আসব। টুকুন আমার সঙ্গে কয়েকদিন থাকবে।
ওতো শুনেছি দেশের বাইরে।
আমার কেন জানি মনে হয় এখন সে দেশেই আছে। বাচ্চা একটা ছেলে। এতদিন বাইরে থাকবে না।
বাবা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আমি বললাম, তোমার কি ধারনা আমি টুকুনকে নিয়ে আসতে পারব না?
ওরা কি দেবে?
হ্যাঁ দেবে।
কখন যাবি?
দুপুরে যাব।
দুপুরে কেন এখন চলে যা–
না এখন না। আমি ওদের কি বলব না বলব তা খুব সুন্দর করে আগে গুছিয়ে নেব। আমার সময় লাগবে।
বাবার চোখ চকচক করছে। তিনি হাসলেন। আনেকদিন পর বাবার হাসিমুখ দেখলাম। এই বাড়িতে হাসি নেই বললেই হয়। আমরা কেউ হাসি না। শুধু মা হাসতেন। কথায় কথায় হাসতেন। হয়ত দেয়ালে বসা একটা টিকটিকি টিকটিক করে উঠল। মা চেঁচিয়ে বলবেন, ও খুকি শুনলি টিকটিকিটা কেমন চিকণ গলায় টিকটিক করল –হি হি হি। আমার ধারনা মা তার সঙ্গে সব হাসি নিয়ে চলে গেছেন। কোন একদিন আবার একজন কেউ সব হাসি নিয়ে ফিরে আসবে। সেই একজন কে? সেকি টুকুন? না টুকুন না। টুকুনও হাসতে জানে না। সে জন্ম থেকেই গম্ভীর। দু বছর বয়সেই সে কেমন ভুডু কুঁচকে তাকাত। জটিল জটিল সব বাক্য তৈরী করত। একবার সে বলল, মা আমার জুতায় কংকর। কি অদ্ভুত কান্ড। কংকর শব্দটা তাকে কে শেখাল। এমন কঠিণ শব্দ আমি নিজে কখনো বলি না। তার বাবা কি শিখিয়েছে। আমি মামুনকে বললাম, আচ্ছা টুকুনকে কংকর শব্দটাকি তুমি শিখিয়েছ?
সে টুকুনের মতই ভুডু কুঁচকে বলল –কংকর মানে কি? আমি কংকর টংকর শেখাব কেন? তাছাড়া বাচ্চাদের কিছু শেখাতে হয় না –দে পিক আপ ওয়াইস।
কোত্থেকে পিক আপ করে?
কে জানে কোত্থেকে? এটা এমন জরুরী কোন সমস্যা না। এটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ কেন? টংকর কংকর যা ইচ্ছা বলুক। কথা শিখছে –এটাই কথা।
অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ শিখছে …।
কংকর কোন অদ্ভুত শব্দ না। অল্পতে উত্তেজিত হয়ো না তো।
আমার তিন বছরের বিবাহিত জীবনে মামুন আমাকে অল্পতে উত্তেজিত না। হবার জটিল বিদ্যা শেখানোর চেষ্টা করেছে। আমি শিখতে পারিনি। এই কঠিণ বিদ্যা শিখেছি তাকে ছেড়ে চলে আসার পর। উত্তেজিত হওয়া বা বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা আজ আমার নষ্ট হয়ে গেছে।
বাবা!
উ।
বাবলুকে ধরে একটা বিয়ে দিয়ে দিলে কেমন হয়?
বাবা বিরক্ত গলায় বললেন, বিয়ে?
হু বিয়ে। ফুটফুটে একটা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে। সারা বাড়ি জুড়ে ছোটাছুটি করবে। এই ছাদে উঠবে, এই ছাদে নামবে। বাবলুর সঙ্গে ঝগড়া করবে, আবার ঝগড়া মিটমাট হবে।
জেনেশুনে অগাটার সঙ্গে একটা মেয়ের বিয়ে দেব। একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করব?
উল্টোটাও হতে পারে। বিয়ে দেবার কারণে মেয়েটা বাবলুকে ঠিকঠাক করে ফেলতে পারে।
যদি ঠিকঠাক করতে না পারে?
না পারলে মেয়েটার জীবন ছাড়খাড় হয়ে যাবে। মনের কষ্টে হয়ত সে বিষ খাবে, কিংবা ছাদ থেকে লাফিয়ে রাস্তায় পড়ে যাবে। এটা হল মেয়ে হয়ে জন্মানোর খেসারত। ভয়ংকর এক্সপেরিমেন্ট মেয়েদের দিয়েই করানো হয়।
বাবা বললেন –এ রকম কোন এক্সপেরিমেন্ট আমি করব না। ভুলেও এইসব মাথায় স্থান দিবি না। ভুলেও না। জেনেশুনে এক নেশাড়ুর সঙ্গে একটা মেয়েকে জুড়ে দেব। তুই আমাকে এত ছোট ভাবলি?
বাবলু ফিরে এসেছে। উঠোনে বসে দাঁত মাজছে। তার টুথপেস্ট আছে। ব্রাশ আছে। কিন্তু এখন দাঁত মাজছে লবণ দিয়ে। আঙ্গুলের ডগায় লবন নিয়ে সমানে ডলছে। তার কোন জ্ঞানী বন্ধু-বান্ধব হয়ত তাকে বলেছে লবন দিয়ে দাঁত মাজলে দাঁত ভাল থাকে।
আজ নাশতা খাব না, পান্নাভাবীর ওখানে নাশতার দাওয়াত।
আচ্ছা শুনলাম।
আজ দুপুরেও কিছু খাব না –দুপুরেও দাওয়াত। বজলুর বোনের বিয়ে। বজলুকে চিনেছতো? আসে মাঝে মাঝে জোড়া ভুডু … ওর বোনটারও জোড়া
ভাল।
আপা রাতে ফিরতে দেরি হবে। বজলুর বোনের বরের নারায়ণগঞ্জে নিজের বাড়ি –বরকনেকে ঐ বাড়িতে পৌঁছে তারপর আসতে হবে। রাতেও কিছু খাব না। তোদের অনেক পয়সা বাঁচিয়ে দিলাম। তিনবেলার খোরাকির খরচ বেঁচে গেল। এই জমানায় তিনবেলার খোরাকী বাঁচা সহজ কথা না।…
বাবলু দাতে লবন ঘসতে ঘসতে কথা বলে যাচ্ছে। আমি লক্ষ্য করলাম, বাবা তার কথা মন দিয়ে শুনছেন। বাবার চোখের দৃষ্টিতে হতাশা ও ক্লান্তি। এই বাবলু প্রথম যখন কথা শিখল তখনও নিশ্চয়ই তিনি এমনই মন দিয়ে তার কথা শুনতেন। তার প্রতিটি শব্দ শুনে তার মন নিশ্চয়ই আনন্দে অভিভূত হতেন …..
মামনুদের অফিসের কর্মচারীদের কেউ আমাকে চেনে না। কিংবা চিনলেও তারা এমন কিছু করল না যাতে মনে হতে পারে আমি তাদের পরিচিত। একজন মহিলা সেক্রেটারী মিষ্টি গলায় বললেন– এম ডি সাহেবতো এখন খুব ব্যস্ত। লাঞ্চ আওয়ার। লাঞ্চ আওয়ারে তিনি কারো সঙ্গে দেখা করেন না। আপনি তিনটার পর আসুন।
আমি বললাম, খুব জরুরী একটা দরকার ছিল।
মেয়েটি মিষ্টি করে হেসে বলল –এখন দেড়টা বাজে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনটা বাজবে। যত জরুরী কথাই থাকুক দেড় ঘন্টায় তেমন কোন ক্ষতি বোধহয় হবে না।
একটা কাগজ দিন। আমি একটা স্লীপ লিখে দি। স্লীপটা উনাকে দেখান।
মেয়েটি আবারো হাসল। মাথার চুল ঠিক করতে করতে বলল, আপনার কথা। থেকে মনে হচ্ছে স্লীপটা পাঠালেই স্যার আপনাকে ডেকে পাঠাবেন। কিন্তু আপনি আমার দিকটা দেখুন। আমরা কাজটা হচ্ছে একটা থেকে তিনটা পর্যন্ত কেউ যেন স্যারের সঙ্গে দেখা করতে না পারে সেটা দেখা। যাই হোক –এই নিন কাগজ। স্লীপ কি লিখতে চান লিখুন। সঙ্গে কলম আছে?
মেয়েটি স্লীপ নিয়ে ঘরে ঢুকল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এসে বলল, স্যার আপনাকে আগামী মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে এগারোটার মধ্যে আসতে বলেছেন। এর আগে তিনি সময় করতে পারবেন না।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। মেয়েটা নরম গলায় বলল –স্লীপ না পাঠালে ভাল করতেন। আমি তিনটার সময় স্যারের ঘরে আপনাকে ঢুকিয়ে দিতাম। মেয়েটা স্লীপটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল –স্লীপটা নিয়ে যাবেন?
আমি হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিয়ে নিলাম –কাগজে লিখেছিলাম –টুকুনের মা।
.
০৪.
শেষরাতে প্রচন্ড শোঁ শোঁ শব্দ, দমকা বাতাস।
আমাদের বারান্দায় ঝুলন্ত তারের মাথায় চল্লিশ পাওয়ারের যে বাতি সারারাত জ্বলে, সেই বাতি খুব দুলছে। আমি অবশ্যি বাতির দুলুনি দেখছি না আমার ঘর থেকে বারান্দা দেখা যায় না তবে এই দুলুনির সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতরে আলো এবং ছায়াও দুলছে। বাহ, ভাল লাগছে তো! আমার ঘরটাকে নৌকার মত লাগছে। না ঘর না, আমার বিছানাটাকে নৌকার মত লাগছে। পালতোলা নৌকা, মাথার উপরে মশারিটা হল নৌকার পাল। আমি লেপের ভেতর ঢুকে পড়লাম। ঝড়-বাদলার সময় লেপের ভেতর গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকতে ভাল লাগে। শোঁ শোঁ শব্দ খুব বাড়ছে, দমকা বাতাস জোরালো হচ্ছে। প্রচণ্ড শব্দে খুব কাছেই কোথাও বাজ পড়ল। নিশ্চয়ই কোন লাইটপোস্টের উপর। বারান্দার বাতি নিভে গেল। এই বাতির সঙ্গে শহরের সব বাতিও সম্ভবত নিভে গেল। কি গাঢ় কি তীব্র অন্ধকার!
এইবার বোধহয় বাবলু জেগেছে। পাশের ঘর থেকে খটখট শব্দ পাচ্ছি। বাবলু নিশ্চয়ই বাতি জ্বালাবার চেষ্টা করছে। এক্ষুণি সে কিছু একটার সঙ্গে ধাক্কা খাবে, চায়ের কাপ বা গ্লাসটাস কিছু ভেঙে দারুণ চেঁচামেচি শুরু করবে। আমি ছুটে গিয়ে দেখব, হাত কেটে ফেলেছে। রক্ত পড়ছে।
বাবলু দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে চেঁচাচ্ছে –রাত্রি, এই রাত্রি। ভূমিকম্প হচ্ছে। ভূমিকম্প!
আমি নিজের মনে হাসলাম। ভয় পেলে বাবলু প্রথম যে বাক্যটি বলবে তা হল, ভূমিকম্প হচ্ছে। ভূমিকম্প। এখন সে যা করবে তা হল পাগলের মত দরজা খুঁজে বেড়াবে। কিন্তু খুঁজে পাবে না। দরজা পেলেও দরজার ছিটকিনি খুঁজে পাবে না। এক সময় বাইশ-তেইশ বছরের এই যুবক বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করবে।
বাবলু প্রচণ্ড শব্দে দরজায় লাথি দিচ্ছে। এখনো কাঁদতে শুরু করেনি, তবে শুরু করবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু করবে। আমি জেগে আছি, কিন্তু আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। বাবলুর সঙ্গে আজকাল আমার একেবারেই কথা বলতে ইচ্ছা করে না। কাল রাতে আবার মদ খেয়ে এসে খুব হৈ-চৈ শুরু করল। বাবা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হৈ-চৈ শুনে উঠে এসে অবাক হয়ে বললেন, কি হয়েছে?
বাবলু হাসিমুখে বলল, কিছু হয়নি তো বাবা। আপনি উঠে এসেছেন কেন? আপনি ওল্ডম্যান। আপনার রেস্ট দরকার।
চেঁচাচ্ছিস কেন?
বাবলুর মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হল। এক ধরনের সুখি-সুখি গলায় বলল, আমি চেঁচাচ্ছি না। আপনার মেয়ে চেঁচাচ্ছে। আপনার মেয়ে আমার সঙ্গে মেজাজ করছে। ভাত দিতে বলছি, ভাত দিচ্ছে না। গেটের দরজাও খুলছিল না। আমি প্রায় আধঘণ্টা ধরে দরজা ধাক্কালাম, কড়া নাড়লাম। নো রেসপন্স। আমাকে সে মানুষ বলেই মনে করে না।
বাবা ক্লান্ত গলায় বললেন, রাত্রি মা, বাবলুকে খেতে দে।
বাবুল মধুর স্বরে বলল, তুমি শুয়ে পড় বাবা। আমার জন্যে তোমাকে ভাবতে হবে না। কেউ আমার জন্যে ভাবুক এটা আমি চাইও না। তুমি আরাম করে ঘুমাও। তোমার ঘুম দরকার, রেস্ট দরকার।
কিছুক্ষণ আগেই বাবাকে সে আপনি আপনি করছিল, এখন তুমি তুমি করছে। নেশা করলে তার এই অবস্থা হয়।
বাবা চটি ফটফট করে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। মেঝের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গির হাঁটা। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হতাশ একজন মানুষ। তিনি বিছানায় শুয়ে থাকবেন, কিন্তু ঘুমুবেন না। যত রাতই হোক আমি যদি তার ঘরের কাছের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ডাকি –বাবা! তিনি সঙ্গে সঙ্গে কোমল গলায় বলবেন, কি হয়েছে রে মা! জীবনের শেষ দিনগুলি তিনি হয়ত জেগে জেগেই কাটাবেন।
আমি বাবলুকে ভাত বেড়ে দিলাম। সে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসল। আমি জানি সে কিছুই খেতে পারবে না। নেশা করে সে যখন আসে, কিছুই খেতে পারে না। খানিকক্ষণ ভাত নাড়াচাড়া করে উঠে পড়ে। আজও উঠে পড়বে। কিন্তু খেতে দেবার সময় তাকে খুব গুছিয়ে খাবার দিতে হবে। আলাদা প্লেটে কাঁচামরিচ, লবণ, পেঁয়াজ। কাঁচামরিচ না থাকলে শুকনো মরিচ তেলে কড়া করে ভেজে দিতে হবে।
খেতে বসে বাবলু ভুরু কুঁচকে বলল, আইটেমের অবস্থা তো খুবই খারাপ। রাস্তার ফকির-ফাঁকারও এরচে ভাল খায়। তুই ডিম ভেজে নিয়ে আয়। ডিম আছে না?
আছে। কিন্তু ডিম তো তুই খাবি না, এক কণা মুখে দিয়ে খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়বি।
ভাল করে ডিম ভেজে আন তো। খিদেয় আমার নাড়ি জ্বলে যাচ্ছে …।
আমি ডিম ভেজে আনলাম। বাবলু যথারীতি ডিম ভাজা নাড়াচাড়া করতে লাগল। আমি বলাম, খাবি না?
বাবলু বলল, খিদেটা হঠাৎ ভ্যানিস হয়ে গেল। বেশি খিদে লাগলে এটা হয় –হঠাৎ খিদে চলে যায়। চা খাব। আগুন মার্কা চা।
তুই চাও খাবি না। এক চুমুক দিয়ে রেখে দিবি …
আরে না, চা খেতে হবে। চা বানিয়ে আন্তু রন্ত চা নিয়ে আসবি। তুরন্ত কি জানিস তো? তুরন্ত হচ্ছে ভেরি কুইক। বিনা চিনির চা। ডায়াবেটিসের ব্যাপারে আগে থেকে প্রিকশান নিচ্ছি। তুইও বিনা চিনির চা খাওয়া অভ্যাস কর, নয় তো বুড়ো বয়সে কষ্ট পাবি। দিনের মধ্যে পঞ্চাশবার বাথরুমে যেতে হবে। মেয়ে ছেলের জন্যে সেটা খুবই অপমান জনক।
চা বানিয়ে এনে দেখি টেবিলে মাথা রেখে বাবলু ঘুমুচ্ছে। নাক ডাকিয়ে ঘুম। তাকে অনেক করে ডেকে তুললাম, সে ঘুম ভেঙেই খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চায়ের কাপে দুটা চুমুক দিয়ে ঘুমুতে চলে গেল। তার যাওয়ার ভঙ্গি দেখে আমার একটু হিংসা লাগল। কি স্বাভাবিক একজন মানুষ! স্বাভাবিক এবং সুখি। পৃথিবীর কোন। দুঃখ-কষ্ট তাকে স্পর্শ করছে না। সে বাস করছে আনন্দময় ভুবনে …
অবশ্যি রাতের এই ঝড় বোধহয় তাকে কাবু করে ফেলেছে। নেশাও হয়ত কাটেনি। সে দরজা ধাক্কাচ্ছে পাগলের মত। ইচ্ছা করলেই আমি তার ভয় কমাতে পারি। ইচ্ছা করলেই আমি বলতে পারি –চেঁচামেচি করিস না। ভূমিকম্প-টম্প কিছু হচ্ছে না। ঝড় হচ্ছে। চুপ করে শুয়ে থাক। এতে কি বাবলু চুপ করবে?
বারান্দায় চটির ফটফট আওয়াজ আসছে। বাবার পায়ের চটির শব্দ এত সুন্দর! শব্দটার ভেতরই এক ধরনের ভরসা আছে। যেন বাবা তার চটির শব্দ দিয়ে জানাচ্ছেন –ভয় পাস না। আছি, আমি আছি। আমি তোদের পাশেই আছি।
বাবার চটির শব্দ বাবলুর ঘরের কাছে এসে থেমে গেল। বাবা কোমল গলায় ডাকলেন, বাবলু!
বাবলু কাঁপা গলায় বলল, ভূমিকম্প হচ্ছে বাবা। ভূমিকম্প হচ্ছে।
ঝড় হচ্ছে, ভূমিকম্প না।
বাবা, ঝড়-টর না, ভূমিকম্প হচ্ছে। তোমরা বুঝতে পারছ না।
আমার ঘরের একটা অংশ আলোকিত হল। বাবা টর্চলাইট জ্বেলেছেন। আশা করা যাচ্ছে, এই আলোয় বাবলু তার দরজার ছিটকিনি খুঁজে পাবে। হুড়মুড় শব্দ হল। বকুল গাছের ডাল ভেঙেছে নিশ্চয়ই। বাবার ঘরের লাগোয়া পুরানো একটা বকুলগাছ আছে। ঝড়-টর হলেই তার একটা ডাল ভাঙবে। ঝড় হয়েছে অথচ বকুলগাছের কোন ডালপালা ভাঙেনি এমন কখনো হয়নি।
ডাল ভাঙার শব্দ মিলিয়ে যাবার আগেই বাবলু আতঙ্কে অস্থির হয়ে চেঁচাল, কি হল বাবা? কি হল?
ডাল ভেঙেছে।
ডাল ভাঙল কেন?
তুই দরজা খুলে বের হয়ে আয়।
ছিটকিনি পাচ্ছি না।
টর্চ লাইট ধরে আছি। তুই শান্ত হ।
বাবলু ছিটকিনি খুঁজে পেয়েছে। খুট করে শব্দ হল। বাবা বললেন, তুই এমন হাঁপাচ্ছিস কেন? ভয়ের কি আছে?
ভূমিকম্প হচ্ছে! ভয় পাব না?
ধর, আমার হাত ধর।
পানি খাব বাবা।
বসে থাক, আমি পানি নিয়ে আসি।
আমি একা একা বসে থাকব না।
আচ্ছা, তুই আয় আমার সঙ্গে।
আমি তাদের পায়ের শব্দ পাচ্ছি। না, আমি শুধু চটি পায়ে বাবার যাবার শব্দই শুনছি, ধরে নিচ্ছি, বাবলুও সঙ্গে যাচ্ছে। খুব সম্ভব বাবার হাত ধরে ধরেই যাচ্ছে। একটা শিশু তার বাবার সঙ্গে ঝড়-বৃষ্টির রাতে যে ভাবে যাবে, বাবলু সে ভাবেই যাচ্ছে। সব মানুষের ভেতর একজন শিশু বাস করে। মাঝে মাঝে তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। বাবলুর ভেতরের শিশুটি মনে হয় সারাক্ষণ জেগে থাকে।
বড় ঝড় কখনো বৃষ্টি ছাড়া হয় না। আমার দেখা মতে এই প্রথম এত দীর্ঘ সময়। নিয়ে বৃষ্টিবিহীন ঝড় হল। এখন বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। আমাদের বাড়িটা পাকা দালান হলেও বারান্দাটা টিনের। টিনের ছাদে ঝনঝন শব্দ উঠছে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাবলু এবং বাবা ফিরছেন। আমি বাবলুর বিরক্ত গলা শুনলাম –এ কি, আমি তো ভিজে যাচ্ছি। বিরক্তি সে বাবার দিকে প্রকাশ করল। যেন তার ভিজে যাওয়ার দায়ভাগ বাবার।
বাবা শোনে, আমি একা একা এখন এই ঘরে ঘুমুতে পারব না।
আয়, আমার ঘরে চলে আয়।
না, আপনার ঘরে গেলে আমার ঘুম আসবে না।
তাহলে কি করবি?
আপনি আমার সঙ্গে ঘুমুবেন।
আচ্ছা চল।
আপনি দেয়ালের দিকে ঘুমুবেন বাবা। আমি দেয়ালের দিকে ঘুমুতে পারি না।
আচ্ছা তাই হবে।
বাবা, শিলাবৃষ্টি হচ্ছে নাকি?
না, সাধারণ বৃষ্টিই হচ্ছে।
সাধারণ বৃষ্টিতে এত শব্দ হবে কেন?
বাবা সেই সেই কেন প্রশ্নের জবাব দিলেন না। এখন বাবলুর কোন কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে না। সম্ভবত সে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাবাকে জড়িয়ে ধরেই হয়ত ঘুমুচ্ছে। আমি জেগে আছি। বাবাও নিশ্চয়ই জেগে আছেন। আমি জানি, ইদানিং বাবার ঘুমের খুব সমস্যা হচ্ছে। আজকের রাতটা ঘুমুবার জন্যে খুব ভাল। প্রচণ্ড শীতে লেপের আরামদায়ক ওম, বৃষ্টি ও বাতাসের শব্দ। আজ রাতে শহরের লোকজন খুব আরাম করে ঘুমুবে। তারপরেও কেউ কেউ জেগে থাকবে। লেপের উষ্ণতা, বৃষ্টির ঘুমপাড়ানি শব্দেও তাদের ঘুম আসবে না। এ রকম লোকের সংখ্যা কতজন হবে? পাঁচ, দশ, পঞ্চাশ, হাজার … নাকি তার চেয়েও বেশি?
বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। সকালে ঘুম ভেঙে দেখব ভেতরে, উঠোনে পানি থৈ থৈ করছে। অল্প বৃষ্টিতেই পানি জমে যায়। আজ বৃষ্টি যা হচ্ছে আজ তো মনে হয় এক হাঁটু পানি জমে যাবে। এত পানি একসঙ্গে দেখতে পেলে টুকুন কি করতো? তার মাথা খারাপের মত হয়ে যেত। পানির সঙ্গে এই ছেলেটার কোন একটা যোগ আছে। পানি দেখলেই সে ছটফট করে ওঠে।
আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছি, খুব ভোরবেলায় বাবলুকে যদি পাঠিয়ে দেই টুকুনকে আনার জন্যে, তাহলে কি টুকুনকে মামুন পাঠাবে? বেশিক্ষণের জন্যে না, ঘণ্টাখানিকের জন্যে। বেশি হলে দুঘণ্টা। আসবে? দুঘণ্টা মার সঙ্গে থাকবে, তারপর চলে যাবে। দেশে না থাকলে ভিন্ন কথা। কিন্তু যদি থাকে তাহলেকি তারা তাকে আসতে দেবে? একটা চিঠি লিখে আমি বাবলুকে পাঠাতে পারি। তাতে কি লাভ হবে? বাবলু তো ঐ বাড়িতেই ঢুকতে পারবে না। দারোয়ান চিঠি হাতে নিয়ে যাবে। বাবলুকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে গেটের বাইরে। কিছুক্ষণ পর দারোয়ান এসে বলবে –সাহেব নাই।
কিংবা এমনও হতে পারে, বাবলু যাবেই না। রাস্তায় নেমেই চিঠি ফেলে দেবে। গভীর রাতে বাসায় ফিরে উদাস গলায় বলবে –আপা, তোর এক্স-হাসবেণ্ডের কাছে গিয়েছিলাম। পেলাম না। কেউ নেই। ব্যাংকক-ফ্যাংকক চলে গেছে। বড়লোকের কারবার। এরা থুথু ফেলার জন্যেও ব্যাংকক চলে যায় …।
আমি নিজেও যেতে পারি। তবে কাল হল সোমবার আমার যাবার কথা মঙ্গলবার। একদিন আগেই না হয় গেলাম। টুকুনকে আগে কখনো আনতে যাই নি। এই প্রথম যাচ্ছি। মার দাবী কি খুব তুচ্ছ করার মত কিছু? ঝড় বৃষ্টিতে টুকুনও। বাবলুর মত ভয় পাচ্ছে নাতো? সেকি ভূমিকম্প শব্দটা বলতে পারে? আচ্ছা, আমি এইসব কি ভাবছি? কেনই-বা ভাবছি? টুকুন ভাল আছে। আনন্দে আছে। তার মার বাড়ির উঠোনে জমে থাকা ময়লা পানি দেখার জন্যে তার আসার দরকার। নেই।
ঝুম ঝুম শব্দে বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই। আষাঢ় মাসেও তো এত বৃষ্টি হয় না। আজ নিশ্চয়ই উঠোন ছাপিয়ে পানি একতলার ঘরে ঢুকে যাবে। একবার কি নিচে নেমে দেখে আসব? অন্ধকারে কোন কিছু দেখা যায় না, কিন্তু পানি দেখা যায়, অন্ধকারে পানি চকচক করতে থাকে। আচ্ছা, পানির কি নিজস্ব কোন আলো আছে?
বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ঝড় কমে এসেছিল। এখন আবার শুরু হয়েছে। বকুল গাছের আরেকটা ডাল কি ভাঙবে? আচ্ছা, রান্নাঘরের জানালা কি বন্ধ করে রেখেছিলাম? বন্ধ না করে থাকলে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে।
পান্না ভাবী জেগেছেন। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কি যেন বলছেন। স্বামীকে বোধহয় ধমকাচ্ছেন। ঝড় বৃষ্টির মত একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হবে আর তার স্বামী ধমক খাবেন না –তাতো হয় না। ঝড়ের শোঁ শোঁ শব্দ শুনতে শুনতে পান্নাভাবীর চেঁচামেচি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুমের মধ্যেও শব্দ হতে থাকল। তবে সেই শব্দ আর ঝড়ের শব্দ থাকল না– ট্রেনের শব্দ হয়ে গেল। লম্বা একটা ট্রেন এঁকেবেঁকে ছুটছে, কোথাও থামছে না। কি দুলুনি সেই ট্রেনের!