২. সন্ধ্যার সময় গ্রেগর ঘুম থেকে জেগে উঠল

সন্ধ্যার সময় গ্রেগর ঘুম থেকে জেগে উঠল। ঘুম নয়, বরং মূৰ্ছার মতো। নিজে থেকে সে, নিশ্চয়ই আর বেশি দেরি না করেই জেগে উঠত, কারণ বেশ ভালো ঘুম আর বিশ্রাম হয়েছে তার, কিন্তু তার মনে হল কে যেন লঘু পায়ে এগিয়ে এসেছিল, তারপর সতর্কভাবে হলঘরে যাবার দরজা বন্ধ করেছে, আর ওই শব্দ তাকে জাগিয়ে দিয়েছে। রাস্তার বিজলি বাতি ঘরের ছাদ আর আসবাবপত্রের উপরের দিকটায়, এখানে ওখানে আলোর ঝলক ফেলেছে। কিন্তু নিচে, যেখানে সে শুয়ে আছে, সেখানে অন্ধকার। ধীরে ধীরে, ব্রিতকরভাবে, সে তার শুড়গুলো নেড়েচেড়ে দেখল, এই প্রথমবার সে সানন্দে এর তাৎপর্য উপলব্ধি করল, তারপর ওদিকে কী হচ্ছে দেখার জন্য দরজার দিকে নিজেকে ঠেলে নিয়ে গেল। সমস্ত বাঁ দিকটা টন টন করছে, একটা টানা দীর্ঘ আঘাতের দাগ সেখানে, বস্তুতপক্ষে তার দুসারি পায়ের উপর তাকে রীতিমতো খুঁড়িয়ে চলতে হচ্ছে। তার উপর আজকের সকালের ঘটনায় একটা পা প্রচণ্ড জখম হয়েছে—শুধু একটা পা-ই যে জখম হয়েছে সে এক অলৌকিক ব্যাপার—আর সেই পা-টা এখন অকেজো হয়ে তার পেছনে পেছনে লটর-পটর করছে।

সত্যি সত্যি কিসের আকর্ষণে সে দরজার দিকে এগিয়ে গেছে সেটা আবিষ্কার করার আগেই সে দরজার কাছে পৌঁছে গেল। খাবারের গন্ধ। এক পাত্রভর্তি তাজা দুধ, তার মধ্যে ছোট ছোট সাদা রুটির টুকরো ভাসছে। আনন্দে সে প্রায় হেসে উঠতে যাচ্ছিল; সকালের চাইতেও এখন সে বেশি ক্ষুধার্ত দুধের বাটিতে সে প্রায় চোখ অবধি তার মাথা ডুবিয়ে দিল। কিন্তু তাড়াতাড়ি, হতাশ হয়ে, সে মাথা তুলে নিল। একে তো তার আহত কোমল বাঁ দিকের জন্য তার খেতে কষ্ট হচ্ছিল—নিজের গোটা শরীরের কম্পমান সার্বিক সহযোগিতা ছাড়া তার পক্ষে খাদ্য গ্রহণ কিছুতেই সম্ভব নয়—তার উপর দুধটা খেতে তার একটুও ভালো লাগল না, অথচ এই দুধ ছিল তার প্রিয় পানীয়, এবং নিশ্চয়ই সেজন্যই তার বোন তার জন্য এখানে দুধভর্তি এই পাত্র রেখে গেছে। কিন্তু এখন প্রায় ঘৃণাভরে সে ওই পাত্রের কাছ থেকে সরে এসে হামাগুড়ি দিতে দিতে ঘরের মাঝখানে ফিরে গেল।

দরজার ফাঁক দিয়ে সে দেখল যে বসবার ঘরে গ্যাসের আলো জ্বালানো হয়েছে, কিন্তু এই সময়ে তার বাবা সাধারণত জোরে জোরে তার মাকে, এবং অনেক সময় তার বোনকেও, যে দ্বিপ্রহরিক খবরের কাগজ পড়ে শোনাতেন, তার জায়গায় এখন সেখানে টু শব্দটিও শোনা যাচ্ছে না। তবে, তার বোন আলাপ-আলোচনায়। এবং চিঠিপত্রে প্রায়ই যার উল্লেখ করেছে, বাবা হয়তো এখন জোরে জোরে কাগজ পড়ার সেই অভ্যাসটা ত্যাগ করেছেন। কিন্তু ফ্ল্যাটজুড়ে সর্বত্র একই নীরবতা বিরাজ করছে, অথচ ফ্ল্যাটটি মোটেই অধিবাসীশূন্য নয়। গ্রেগর আপন মনে বলল, আমার পরিবারের লোকজনরা কী প্রশান্ত জীবনই না যাপন করছে! মা-বাবা আর বোনের জন্য সে কী সুন্দর ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে, নিশ্চল হয়ে বসে অন্ধকারে দুচোখ মেলে দিয়ে গ্রেগর বেশ অহংকারের সঙ্গে সেকথা ভাবল। কিন্তু এই প্রশান্তি, এই আরাম, এই তৃপ্তি যদি এখন একটা ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে নিঃশেষ হয় তা হলে কী হবে? এই দুশ্চিন্তার কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য গ্রেগর নড়াচড়ায় মনোনিবেশ করল। সে ঘরময় হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরতে লাগল।

দীর্ঘ বিকেলের মধ্যে একবার মাত্র এক পাশের দরজা একটু খুলেই আবার দ্রুত বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, পরে অন্য পাশের দরজার ক্ষেত্রেও তাই করা হয়। স্পষ্টতই কেউ-একজন ভেতরে আসতে চেয়েও পরে মত পাল্টায়। গ্রেগর এবার বসবার ঘরের দরজার ঠিক মুখের সামনে এসে অবস্থান নিল, যে কোনো দ্বিধান্বিত দর্শনার্থীকে সে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ভিতরে ঢোকাতে বদ্ধপরিকর হল, অন্তত লোকটি যে কে সেটা সে দেখবে। কিন্তু দরজা আর খুলল না; বৃথাই সে অপেক্ষা করল। ভোরবেলা, দরজা যখন তালাবন্ধ ছিল, তখন তারা সবাই ভেতরে ঢোকার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, আর এখন, যখন সে একটা দরজা খুলে দিয়েছে, অন্যটাও স্পষ্টতই দিনের কোনো-একসময় খুলে দেয়া হয়েছিল, এখন আর কেউ ভেতরে ঢুকছে না, এমনকি চাবিগুলো পর্যন্ত এখন দরজার অন্য পাশে লাগানো রয়েছে।

তখন অনেক রাত, বসবার ঘরে তখনও আলো নেভানো হয়নি। গ্রেগর সহজেই বুঝতে পারল যে তার বাবা-মা ও বোন তখন পর্যন্ত জেগে আছে। সে স্পষ্ট তাদের পা টিপে টিপে হাঁটার শব্দ শুনতে পেল। এখন আর কেউ তাকে দেখতে আসবে না, অন্তত সকাল পর্যন্ত, এ বিষয়ে সে সুনিশ্চিত। কাজেই ভবিষ্যতের জন্য সে নিজের জীবনকে কীভাবে গুছিয়ে নেবে সেটা ধীরেসুস্থে ভাবার মতো তার হাতে এখন যথেষ্ট সময় আছে। কিন্তু এই উঁচু শূন্য ঘর, যার মেঝেতে এখন তাকে সটান শুয়ে থাকতে হচ্ছে, এটা তাকে ভীত করে তুলল, যার কারণ সে বুঝতে পারছে না। গত পাঁচ বছর ধরে এটাই তো ছিল তার একান্ত নিজস্ব ঘর। অর্ধ-সচেতনভাবে, তার সঙ্গে যে সামান্য লজ্জার ভাব মিশে ছিল না এমন নয়, সে সুড়সুড় করে সোফার নিচে ঢুকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার বেশ ভালো লাগল, যদিও পিঠটা একটু চাপাচাপি হল, মাথাটাও উঁচু করতে পারছে না, তবু। তার আসল দুঃখের কারণ হল এই যে তার শরীরটা বড় বেশি চওড়া হবার জন্য দেহের সবটুকু সে সোফার নিচে ঢোকাতে পারল না।

গোটা রাতটা সে ওখানে কাটিয়ে দিল। খানিকক্ষণ তন্দ্রার মধ্যে ঝিমাল, ক্ষুধার জ্বালায় সে মাঝে মাঝেই চমকে জেগে উঠছিল; খানিকক্ষণ সে নানা দুশ্চিন্তায় এবং ভবিষ্যৎ আশার ছবি এঁকে কাটিয়ে দিল। শেষপর্যন্ত একটি সিদ্ধান্তেই সে উপনীত হল : আপাতত তাকে চুপচাপ থাকতে হবে। তার বর্তমান অবস্থায় নিজের পরিবারকে যে অসুবিধার মধ্যে সে ফেলেছে তার জন্য ধৈর্য ও পরম বিবেচনার সঙ্গে তাকে তার পরিবারকে যথাযোগ্য সাহায্য করতে হবে, যেন তারা সেটা সহ্য করতে পারেন।

পরদিন খুব সকালে, তখনো প্রায় রাত, গ্রেগর তার নতুন সিদ্ধান্তগুলো কত দৃঢ় সেটা পরীক্ষা করবার সুযোগ পেল, কারণ তার বোেন, প্রায় পুরোপুরি পোশাক পরে, হলঘরের দিক থেকে দরজাটা খুলে ভেতরে একবার উঁকি দিল। ওকে তার বোন সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেল না, কিন্তু সোফার নিচে যখন তাকে দেখল—তো, তাকে তো কোথাও থাকতে হবে, সে তো উড়ে চলে যেতে পারে না, নাকি?—তখন তার বোন এমন চমকে গেল যে সে নিজের অজান্তেই দরজাটা আবার সশব্দে বন্ধ করে দিল। কিন্তু পরক্ষণেই, যেন এই ব্যবহারের জন্য অনুতপ্ত হয়ে, সে পা টিপে টিপে আবার দরজার কাছে ফিরে এল, মনে হল সে যেন কোনো রোগী, এমনকি কোনো-একজন অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে আসছে। গ্রেগর তার মাথা সোফার একেবারে ধার পর্যন্ত ঠেলে দিয়ে তাকে লক্ষ করছিল। ও কি লক্ষ করবে যে গ্রেগর দুধ স্পর্শও করেনি, এবং সেটা ক্ষুধার অভাবের জন্য নয়। ও কি তার পক্ষে আরেকটু রুচিকর অন্য কোনো খাবার নিয়ে আসবে? নিজে থেকে যদি না করে, তবে উপোস করে মরে গেলেও সে এ বিষয়ে বোনের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে না, যদিও তার ভীষণ ইচ্ছা করছিল যে সোফার তলা থেকে বেরিয়ে এসে ওর পায়ের উপর পড়ে তাকে কিছু খেতে দেবার জন্য মিনতি জানায়। কিন্তু তার বোন তৎক্ষণাৎ সবিস্ময়ে লক্ষ করল যে পাত্রটা তখনো ভর্তি, সামান্য একটু দুধ ছলকে পড়ে চারপাশে শুধু লেগে আছে, সে সঙ্গে পাত্রটা তুলে নিল, অবশ্য খালি হাতে নয়, একটা কাপড়ে জড়িয়ে সে ওটা নিয়ে গেল। তার বদলে এবার সে কী আনবে সেটা জানবার জন্য গ্রেগরের অদম্য কৌতূহল হল এ নিয়ে সে নানা জল্পনা-কল্পনা করল। কিন্তু অতঃপর তার বোন নিজের হৃদয়ের উদারতা থেকে যা করল সেটা সে কল্পনাও করতে পারেনি। তার কী রকম খাবার পছন্দ সেটা বুঝবার জন্য ও একটা পুরনো খবরের কাগজের উপর নানা ধরনের এক গাদা খাবার নিয়ে এসেছে। সেখানে রয়েছে বাসি অর্ধেক-পচা শাক-সবজি, গত রাতের খাবারের উচ্ছিষ্ট হাড়-গোড় যার উপর পুরু হয়ে সস্ জমে আছে; কিছু কিসমিস ও বাদাম; এক টুকরা পনির যা দুদিন আগেও গ্রেগর অখাদ্য। বিবেচনা করত, একটা শুকনো রুটি, একটা মাখন-মাখানো রুটি এবং একটা রুটি যাতে মাখন ও লবণ দুই-ই মাখানো আছে। এসব ছাড়াও সে ওই আগের পাত্রটাই একপাশে নামিয়ে রাখল, এখন তার মধ্যে সে কিছু পানি ঢেলে দিয়েছে, বোঝা গেল যে এখন থেকে ওই পাত্রটাই তার একক ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এবং তীক্ষ্ণ্ণ বিবেচনার সঙ্গে, গ্রেগর যে, তার উপস্থিতিতে খাবে না এটা বুঝতে পেরে, সে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে গেল। শুধু তাই নয়, সে চাবিও লাগিয়ে দিল, গ্রেগর যেন বুঝতে পারে যে সে তার ইচ্ছামতো সময় নিয়ে খেতে পারবে। গ্রেগরের পাগুলো সরসর করে খাবারের দিকে ছুটে গেল। তার আঘাতগুলো নিশ্চয়ই সম্পূর্ণ সেরে গিয়েছিল, কারণ এখন আর সে কোনো রকম অক্ষমতা অনুভব করছে না। ভীষণ অবাক হয়ে গেল সে, সে ভাবতে লাগল যে এক মাসেরও বেশি আগে ছুরি দিয়ে তার একটা আঙুল সামান্য কেটে গিয়েছিল এবং এই গত পরশুদিন পর্যন্ত তার আঙুলটা ব্যথা করছিল। আমি কি তাহলে আগের চাইতে কম স্পর্শকাতর হয়ে পড়েছি? এ কথা ভাবতে ভাবতে সে লোভীর মতো পনিরটা চুষতে লাগল। অন্য সব খাবারের চাইতে এটাই তাকে তাৎক্ষণিক এবং সবচাইতে প্রবলভাবে আকর্ষণ করল। চোখ দিয়ে তৃপ্তির অশ্রু ফেলতে ফেলতে সে একের-পর-এক পনির, শাকসবজি আর সস খেয়ে ফেলল। পক্ষান্তরে, তাজা খাবারগুলোর প্রতি সে বিন্দুমাত্র মনোযোগ দিল না, তার গন্ধ পর্যন্ত ওর সহ্য হল না, প্রকৃতপক্ষে সে তার না-খাওয়া খাবারগুলো একটু দূরে টেনে সরিয়ে রাখল। খাওয়া শেষ করবার বেশ খানিকক্ষণ পরে, সে যখন ওই জায়গাতেই অলসভাবে শুয়ে ছিল তখন, তার বোন খুব ধীরে ধীরে চাবিটা ঘোরাল, তাকে ইঙ্গিতে জানাল যে এবার তার লুকিয়ে পড়বার সময় হয়েছে। প্রায় ঘুমিয়ে পড়লেও, এই শব্দটা পেয়ে তৎক্ষণাৎ জেগে উঠে সে দ্রুত সোফার নিচে চলে গেল। যে অল্প সময়টুকু তার বোন ওই ঘরে রইল সে সময়টুকুও সোফার নিচে পড়ে থাকার জন্য তাকে প্রচুর আত্মসংযমের পরিচয় দিতে হল, কারণ খাওয়া-দাওয়ার পর তার দেহ খানিকটা ফুলে উঠেছিল, আর সোফার নিচে তার এমন চাপাচাপি হচ্ছিল যে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হল। মাঝে মাঝে মনে হল যেন তার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে। এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অচেতন তার বোন, একটা ঝাটা দিয়ে, তার খাবারের অবশিষ্ট ছিটেফোঁটাগুলোই শুধু নয়, যা সে স্পর্শও করেনি সেগুলোও, যেন তা আর অন্য-কারো কোনো ব্যবহারেই আসতে পারবে না, পরিষ্কার করে, তাড়াতাড়ি একটা বালতিতে তুলে তার উপর একটা কাঠের ঢাকনা চাপিয়ে বাইরে নিয়ে গেল, আর এ দৃশ্য দেখতে দেখতে গ্রেগরের মনে হল তার মাথার ভেতর থেকে বুঝি তার চোখ দুটি ঠেলে বেরিয়ে আসবে। তার বোন পিছনে ফিরতে-না-ফিরতে গ্রেগর সোফার নিচ থেকে বেরিয়ে এসে হাত-পা ছড়িয়ে একটু স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলল।

এইভাবে গ্রেগরকে খাওয়ানো হতে লাগল, একবার খুব ভোরে, যখন তার বাবা-মা ও পরিচারিকা মেয়েটি ঘুমিয়ে থাকে, আর দ্বিতীয়বার সবার দুপুরের খাওয়ার পর, যখন বাবা-মা একটু ঘুমিয়ে নেয় আর কাজের মেয়েটিকে তার বোন কোনো একটা ফাই-ফরমাশ দিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দেয়। অবশ্য ও যে না খেয়ে মরুক এটা তারা কেউ চাইত না, কিন্তু তারা হয়তো শোনা-কথার চাইতে আরও প্রত্যক্ষভাবে তার খাবার ব্যাপারটার কথা জানার বেদনা সহ্য করতে পারত না, হয়তো তার বোনই তাদেরকে ওই যন্ত্রণা থেকে যতটা সম্ভব রক্ষা করতে চেয়েছিল, কারণ এমনিতেই তো তাদের কম কষ্ট সইতে হচ্ছিল না।

 

সেই প্রথমদিনে কী অজুহাতে ডাক্তার আর তালাওয়ালাকে বিদায় দেয়া হয়েছিল গ্রেগর তা আবিষ্কার করতে পারেনি, কারণ যেহেতু তার কথা অন্য কারো বোধগম্য হয়নি, সেই হেতু সে যে তাদের কথা বুঝতে সক্ষম তা ওদের কারো মাথায়, এমনকি তার বোনের মাথায়ও ঢোকেনি। আর তাই ওর বোন ওর ঘরে এসে কখনো কখনো শুধু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলত, কখনো কখনো সন্তদের কাছে প্রার্থনা করত, আর গ্রেগরকে এটা শুনেই তৃপ্ত থাকতে হত। পরে যখন তার বোন বর্তমান পরিস্থিতিতে কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে ওঠে—পুরোপুরি অভ্যস্ত সে কখনোই হয়ে উঠতে পারেনি–তখন মাঝে মাঝে তার মুখ থেকে কিছু সহৃদয় মন্তব্য, অন্তত সহৃদয় বলে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে এমন মন্তব্য, শোনা যেতে লাগল। গ্রেগর যখন ভাল করে, চেটে পুটে সব খাবার খেয়ে নিত তখন সে বলত, তো, আজকে ওর খাবারটা বেশ পছন্দ হয়েছে, আর যখন সে ভাল করে খেত না, এবং ইদানীং ঘন ঘনই তা হচ্ছিল, তখন সে বিমর্ষভাবে বলত, সবই তো আবার যেমন ছিল তেমনি পড়ে রয়েছে।

কিন্তু যদিও গ্রেগর সরাসরি কোনো খবর পেত না তবু পাশের ঘরের অনেক কথাবার্তা তার কানে এসে পৌঁছুত। আর তাই ওখানে কোনো কণ্ঠস্বর শোনা গেলেই সে সংশ্লিষ্ট দরজার কাছে ছুটে গিয়ে তার গায়ে গা-সেঁটে দাঁড়িয়ে থাকত। প্রথম কয়েকদিন তার সম্পর্কে ছাড়া, অন্তত পরোক্ষভাবে তার সম্পর্কে নয়, এমন কোনো কথাবার্তাই হয়নি। গোটা দুদিন ধরে, প্রত্যেক বেলা খাওয়ার সময়, এখন কী করণীয় তা নিয়ে পারিবারিক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। শুধু তাই নয়, খাওয়ার মধ্যবর্তী সময়েও বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। সর্বক্ষণ বাড়িতে পরিবারের অন্তত দুজন সদস্য থেকেছে, কারণ কেউ একা ফ্ল্যাটে থাকতে রাজি হয়নি আর বাড়ি একদম খালি রাখা তো ছিল অচিন্ত্যনীয় ব্যাপার। আর একেবারে প্রথমদিনই বাড়ির রাঁধুনি মহিলা—সে ব্যাপারটা কী এবং কতটুকু জেনেছে তা পরিষ্কার বোঝা গেল না—তার মায়ের পায়ের কাছে নতজানু হয়ে কাজ ছেড়ে চলে যাবার অনুমতি ভিক্ষা করে; এবং মিনিট পনের পর চলে যাবার সময় তাকে ছেড়ে দেবার জন্য অশ্রুভরা চোখে এমন অজস্র ধন্যবাদ দেয় যেন তার ভীষণ উপকার করা হয়েছে, আর কোনোরকম। উৎসাহ-ইঙ্গিত ছাড়াই সে দিব্যি গেলে বলে উঠল যে, যা ঘটেছে সে-সম্পর্কে একটি কথাও সে কক্ষনো কাউকে বলবে না।

এখন গ্রেগরের বোনকেও রান্নার কাজে মাকে সাহায্য করতে হয়, যদিও সত্যি বলতে, রান্না তেমন করতে হত না, কারণ ওরা প্রায় কিছুই খাওয়া-দাওয়া করত না। গ্রেগর প্রায় সারাক্ষণ শুনত যে পরিবারের একজন আরেকজনকে খাবার জন্য ব্যর্থ অনুরোধ করছে, কিন্তু ধন্যবাদ, যথেষ্ট খেয়েছি ছাড়া আর কোনো উত্তর পাওয়া যেত না, কিংবা ওই জাতীয় অন্যকোনো কথা। ওরা হয়তো পানীয়ও গ্রহণ করত না। প্রায়ই তার বোন বাবাকে জিজ্ঞাসা করত তিনি একটু বিয়ার খাবেন কিনা, তাহলে সে নিজে গিয়ে নিয়ে আসবে, আর তার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে সে বলত যে সে দারোয়ানকে গিয়ে বিয়ার নিয়ে আসতে বলতে পারে, এবং তখন বাবা সুস্পষ্টভাবে না বলতেন এবং সমস্ত প্রসঙ্গটা সেখানেই চাপা পড়ত।

এই ঘটনার একেবারে প্রথমদিকেই গ্রেগরের বাবা তার মা ও বোনের কাছে পরিবারের আর্থিক অবস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা বুঝিয়ে বলেছিলেন। পাঁচ বছর আগে তার ব্যবসায় লাটে ওঠার পর তিনি সামান্য কিছু ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এখন, মাঝে মাঝে টেবিল থেকে উঠে গিয়ে, ছোট সিন্দুকটা খুলে তিনি তার মধ্য থেকে কোনো ভাউচার বা মেমোরান্ডাম নিয়ে এলেন। সিন্দুকের জটিল তালাটি খোলার, কাগজপত্র নাড়াচাড়া করার, এবং আবার সিন্দুক বন্ধ করার শব্দ স্পষ্ট শোনা গেল। গ্রেগরের বন্দিজীবন শুরু হবার পর থেকে তার বাবার সেই উক্তিই তাকে প্রথমবারের মতো একটা আনন্দের সংবাদ দিল। তার ধারণা হয়েছিল বাবার ব্যবসায়িক বিপর্যয়ের পর আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না, অন্তত তার বাবা এই ধারণা ঘুচিয়ে দেবার মতো বিপরীত কথা কখনো বলেননি, অবশ্য সেও কোনোদিন সরাসরি এ-সম্পর্কে তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। সে সময় গ্রেগরের একমাত্র বাসনা ছিল ওই ব্যবসায়িক বিপর্যয়ের কথা যত শীঘ্র সম্ভব ভুলে গিয়ে তারা যেন চরম হতাশার হাত থেকে মুক্তি পায় সেজন্য পরিবারকে তার দিক থেকে যথাসাধ্য সাহায্য করা। সে-উদ্দেশ্যে সে অস্বাভাবিক উদ্যমের সঙ্গে কাজ শুরু করে দেয়, এবং প্রায় রাতারাতি একটি ক্ষুদ্র কেরানির পরিবর্তে একজন বাণিজ্যিক ভ্রাম্যমাণ চাকুরে হয়ে ওঠে, ওই পথেই আছে বেশি অর্থ রোজগারের সুযোগ, এবং তার সাফল্য সঙ্গে সঙ্গে সুডৌল মুদ্রায় রূপান্তরিত হল, আর সে সক্ষম হল তার পরিবারের বিস্মিত ও আনন্দিত সদস্যদের সামনে ওই মুদ্রা টেবিলের উপর সাজিয়ে দিতে। চমৎকার ছিল ওই দিনগুলো, অবশ্য আর তার পুনরাবৃত্তি ঘটেনি, অন্তত ওই রকম গৌরবদীপ্তভাবে, যদিও পরবর্তী সময়ে গ্রেগর এত অর্থ উপার্জন করে যে তা দিয়ে পরিবারের সকল খরচপাতি বহন করা তার পক্ষে সম্ভব হয়, এবং সে তা করেও বটে। আর কিছু নয়, ওরা ব্যাপারটায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল মাত্র, পরিবারের। সদস্য এবং গ্রেগর নিজেও। অর্থটা গৃহীত হত কৃতজ্ঞতার সঙ্গে, প্রদত্ত হত। আনন্দের সঙ্গে, কিন্তু তার মধ্যে কোনো বিশেষ উষ্ণ আবেগ-অনুভূতির উচ্ছ্বাস মিশে থাকত না। শুধু বোনের সঙ্গে তার একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বজায় ছিল। তার একটা গোপন পরিকল্পনা ছিল যে তার বোন, যে সংগীত ভীষণ ভালোবাসে, গ্রেগরের মতো নয় ও, যে চমৎকার বেহালা বাজাতে পারে, তাকে সে সামনের বছর, প্রচুর খরচের ব্যাপার হলেও কনসার্ভেটোরিয়ামে পাঠাবে, অর্থের ব্যাপারটা সে অন্য কোনোভাবে সমাধা করে নেবে। ভ্রাম্যমাণ জীবনের ফাঁকে সে যখন স্বল্প সময়ের জন্য বাড়ি আসতো তখন বোনের সঙ্গে কথাবার্তার সময় ওই সংগীত শিক্ষা নিকেতনের কথা প্রায়ই উচ্চারিত হত, কিন্তু সবসময়ই একটা সুন্দর স্বপ্ন। হিসাবে, যা বাস্তবে কৃদাচ রূপায়িত হবে না, আর তার বাবা-মা ওই নির্দোষ কথাবার্তাকেও সবসময় নিরুৎসাহিত করতেন। কিন্তু গ্রেগর নিজে বিষয়টি সম্বন্ধে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল এবং বড় দিনের সময় যথাযোগ্য গাম্ভীর্যের সঙ্গে সে কথাটা সবাইকে জানাবে বলে মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল।

দরজার গায়ে সোজা হয়ে ঝুলতে ঝুলতে পাশের ঘরের কথাবার্তা কান পেতে শোনার সময় নিজের বর্তমান সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থায় তার মাথার মধ্যে ওইসব ভাবনা খেলে গেল। কখনো কখনো, নিছক ক্লান্তির ভারে, সে ওদের কথাবার্তা না শুনে নিজের মাথাটাকে আলস্যের সঙ্গে দরজার উপর ঢলে পড়তে দিত, কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সে সতর্ক হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াত, কারণ ওই সামান্য শব্দও পাশের ঘরে শোনা যেত, আর সঙ্গে সঙ্গে ওরা তাদের কথাবার্তা থামিয়ে ফেলত। একটু পরে ওর বাবা জিজ্ঞাসা করতেন, এখন কী করছে ও?, স্পষ্টতই দরজার দিকে তাকিয়ে তিনি এ প্রশ্ন করতেন, এবং শুধু তারপরই আবার তাদের বাধা পড়া কথাবার্তা নতুন করে শুরু হত।

গ্রেগর এখন পরিস্থিতি সম্পর্কে যথেষ্ট অবিহিত হতে সক্ষম হল। কারণ তার বাবা বারবার পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করলেন, কিছুটা এই জন্য যে দীর্ঘদিন তিনি এসব ব্যাপার নিয়ে নাড়াচাড়া করেননি, আর কিছুটা এই জন্য যে তার মা ব্যাপারটা চট করে ধরতে পারছিল না। তাদের টাকা-পয়সা মারা যাবার পরও লগ্নীর একটা অঙ্ক, সত্য বটে খুবই সামান্য অঙ্ক, এখনও টিকে আছে, এমনকি ডিভিডেন্ডগুলো ইতোমধ্যে স্পর্শ করা হয়নি বলে সেই অঙ্ক সামান্য পরিমাণে বৃদ্ধিও পেয়েছে। তাছাড়া প্রতি মাসে গ্রেগর যে টাকা বাড়িতে নিয়ে আসত—নিজের জন্য সে মাত্র সামান্য কয়েক ডলার রাখত—তা সম্পূর্ণ খরচ হত না। এখন সেটা জমতে জমতে ছোট্ট একটা মূলধনে পরিণত হয়েছে। এই অপ্রত্যাশিত মিতব্যয়িতা এবং দূরদৃষ্টির প্রমাণ পেয়ে গ্রেগর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সোৎসাহে তার মাথা নাড়ল। সত্য বটে, তার বাড়তি টাকা দিয়ে সে বড়কর্তার কাছে তার বাবার ঋণ আরও কিছুটা শোধ করে দিতে পারত এবং নিজের দিক থেকে তার চাকরি ছেড়ে দেবার তারিখটা হয়তো আরেকটু নিকটে আনতে সক্ষম হত কিন্তু নিঃসন্দেহে তার বাবা যে ব্যবস্থা করেছেন সেটাই ও বেশি ভালো হয়েছে।

তবু গোটা পরিবারের পক্ষে শুধু সুদের উপর বেঁচে থাকার মতো ওই মূলধন যথেষ্ট ছিল না। মূলের ওপর নির্ভর করে ওরা হয়তো এক বছর, বড়জোর দুবছর বেঁচে থাকতে পারবে, বৎস, ওই পর্যন্তই। কিন্তু ওই মূলধন তো স্পর্শ করা উচিত নয়, দুর্দিনের জন্য সেটা তুলে রাখা দরকার। দৈনন্দিন ভরণ-পোষণের টাকাটা রোজগার করতে হবে। তার বাবা অবশ্য এখনও সুস্থ সমর্থ, কিন্তু তার বয়স হয়ে গেছে, গত পাঁচ বছর ধরে তিনি কোনো কাজকর্ম করেননি এবং এখন খুব বেশি কিছু করতে পারবেন এমন আশাও করা যায় না। এই পাঁচ বছরে, তাঁর পরিশ্রমী, যদিও অসফল, জীবনের প্রথম বিশ্রামের দিনগুলোতে, তিনি বেশ মোটা এবং কিছুটা অলস ও ধীরগতি হয়ে পড়েছেন। আর গ্রেগরের বৃদ্ধা মা, তার হাঁপানি নিয়ে তিনি কীভাবে জীবিকার জন্য অর্থ রোজগার করবেন, হাঁপানির জন্য ফ্ল্যাটের মধ্যে হাঁটাচলা করতেই যার কষ্ট হয়, মাঝে মাঝেই যাকে খোলা জানালার পাশে সোফায় শুয়ে পড়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে হয়? আর তার বোন, এখনও মাত্র সতেরো বছরের এক বালিকা যার জীবন এ-পর্যন্ত সুখে কেটেছে, সুন্দর কাপড়জামা পরে যে শুধু মিষ্টি করে সেজেছে, দীর্ঘ ঘুম দিয়েছে, সংসারের কাজে টুকটাক সাহায্য করেছে, মাঝে মাঝে ছোটখাটো আনন্দ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছে, সবার উপরে বেহালা বাজিয়েছে, তাকে কি এখন তার নিজের রুটি নিজে রোজগার করতে হবে? প্রথমদিকে টাকা রোজগারের প্রয়োজনীয়তার কথা উঠলেই প্রচণ্ড লজ্জা ও ক্ষোভে গ্রেগর এমন অস্থির হয়ে উঠত যে সে দরজা ছেড়ে দিয়ে সোফার ঠাণ্ডা চামড়ার মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকত।

প্রায়ই সে দীর্ঘ রাতগুলো দ্রিাহীন অবস্থায় কাটাতে লাগল, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সোফার চামড়ার গায়ে আঁচড় কাটল। কিংবা স্নায়ুগুলো শক্ত করে, প্রচণ্ড প্রয়াসে, একটা আরামকেদারা জানালার পাশে ঠেলে নিয়ে গিয়ে তার গা বেয়ে জানালার কার্নিশে গিয়ে উঠত, তারপর জানালার শার্সিতে হেলান দিয়ে দাঁড়াত। স্পষ্টতই জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকালে সর্বদা সে যে একটা মুক্তির স্বাদ অনুভব করত তার স্মৃতিই তাকে এটা করতে উদ্বুদ্ধ করছিল। কারণ বাস্তবে কিন্তু দিনের-পর-দিন তার দৃষ্টির সামনে সামান্য দূরের জিনিসও একটু একটু করে ক্রমেই বেশি ঝাঁপসা হয়ে উঠছিল। সারাক্ষণ চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বলে যে হাসপাতালকে সে চিরকাল গাল দিয়ে এসেছে এখন তা আর তার দৃষ্টির সীমানার মধ্যে মোটেই ধরা পড়ছে না। আর সে যদি না জানত যে সে শার্লট স্ট্রিটে বাস করছে, নিঃসন্দেহে একটা শান্ত চুপচাপ রাস্তা, কিন্তু শহরের রাস্তা তো। বটে, তা হলে তার নিশ্চিত মনে হত যে তার জানালার বাইরেই রয়েছে একটা মরুভূমির শূন্যতা, যেখানে ধূসর আকাশ আর ধূসর ভূমি পরস্পরের মধ্যে লীন হয়ে গেছে। তার তীক্ষ্ণ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন বোনকে মাত্র দুবার লক্ষ করতে হয় যে আরামকেদারাটা জানালার পাশে রাখা আছে; এরপর থেকে ওর ঘর পরিষ্কার। করার পর সে সবসময় চেয়ারটা আবার জানালার পাশে সেই একই জায়গায় ঠেলে নিয়ে গিয়ে রাখত, এমনকি জানালার ভেতরদিকের শার্সিটাও খুলে রেখে যেত।

গর যদি তার সঙ্গে কথা বলতে পারত, ওর জন্য সে যা করছে সেজন্য। তাকে ধন্যবাদ দিতে পারত, তাহলে তার সেবাযত্ন সে আরেকটু ভালোভাবে সহ্য করতে পারত। বর্তমান অবস্থায় সেটা তাকে রীতিমত পীড়িত করতে শুরু করল। তার বোন অবশ্য এই অরুচিকর কাজটা হাল্কাভাবে নেবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছিল, এবং সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সেক্ষেত্রে ক্রমশ অধিকতর সাফল্যও অর্জন করছিল, কিন্তু কালপ্রবাহ গ্রেগরের দৃষ্টিশক্তিকেও স্বচ্ছতর করে তুলেছিল। যেভাবে সে তার ঘরে এসে ঢুকত সেটাই তাকে ভীষণ পীড়া দিত। ঘরে ঢুকেই সে সোজা জানালার কাছে ছুটে যেত, দরজাটা বন্ধ করার তর সইত না তার, সাধারণত গ্রেগরের ঘরকে অন্যদের চোখের আড়ালে রাখার জন্য সর্বপ্রকার সতর্কতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও সে একাজটা করত, তারপর, যেন তার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এমনিভাবে, দ্রুত আঙুল চালিয়ে জানালার শার্সিগুলো সে। হুড়মুড় করে খুলে দিত। এবং ভীষণ ঠাণ্ডার মধ্যেও খোলা দমকা হাওয়ায় সে ওখানে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিত। তার ওই সশব্দ দ্রুত পদচারণা গ্রেগরকে দিনে দুবার করে ভয়ানক অস্বস্তিতে ফেলত; পুরো ওই সময়টুকু সে সোফার নিচে গুটিসুটি হয়ে থরথর করে কাপত, যদিও গ্রেগর নিশ্চিত জানত যে তার বোন যদি তার সঙ্গে একঘরে জানালা না খুলে কোনরকমে থাকতে পারত তাহলে তাকে কিছুতেই এই কষ্টটা সে দিত না।

গ্রেগরের রূপান্তরের প্রায় মাসখানেক পর একদিন, যখন তার চেহারা দেখে ওর চমকে ওঠার কোনোই কারণ ছিল না, তার বোন সাধারণ সময়ের চাইতে একটু আগে তার ঘরে এসে উপস্থিত হয়ে তাকে জানালার সামনে একেবারে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখল। তাকে নিশ্চয়ই ভূতের মতো দেখাচ্ছিল। সে যদি মোটেই ঘরে না ঢুকত তাহলেও গ্রেগর খুব আশ্চর্য হত না, গ্রেগর ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তার পক্ষে জানালা খোলাই সম্ভব ছিল না, কিন্তু তার বোন যে শুধু পিছিয়ে গেল তাই নয়, সে এক লাফে, যেন ভীষণ ভয় পেয়ে, বেরিয়ে গিয়ে সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিল। অপরিচিত কেউ হলে ঠিক ভাবত যে সে বুঝি ওখানে তার জন্য ঘাপটি মেরে বসে আছে, সুযোগ পেলেই তার গায়ে কামড় বসিয়ে দেবে। গ্রেগরকে অবশ্য তৎক্ষণাৎ সোফার নিচে গিয়ে আত্মগোপন করতে হয়, দুপুর পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হয়, দুপুরের আগে আর তার বোন আসেনি, এবং যখন এল তখনো মনে হল সে যেন আগের তুলনায় অনেক বেশি ব্ৰিত। তার দৃষ্টিতে সে যে এখনও কত কুৎসিত এটা সে স্পষ্ট বুঝল, এবং এটা অব্যাহত থাকবে। সোফার তলা থেকে তার শরীরের যে সামান্য অংশ বেরিয়ে আছে সেটা চোখে পড়ার পর এখান থেকে ছুটে পালিয়ে না যাবার জন্য তার বোনকে যে কী ভীষণ কষ্ট করতে হচ্ছে তাও সে উপলব্ধি করল। তাই, তাকে এই কষ্ট থেকে পরিত্রাণ দেবার জন্য সে একদিন পিঠে করে একটা চাদর সোফার কাছে নিয়ে এল—এ কাজটা করতে তাকে চার ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হয়—তারপর চাদরটা এমনভাবে সাজাল যেন সে সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে, এমনকি তখন নিচু হয়ে তাকালেও তার বোন তাকে দেখতে পাবে না। চাদরটাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করলে সে নিশ্চয়ই সেটা সোফার উপর থেকে সরিয়ে ফেলত, কারণ এইভাবে পর্দা-ঢাকা বন্দি অবস্থা যে গ্রেগরের কাছে তৃপ্তিকর নয় সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছিল, কিন্তু তার বোন চাদরটা যেমন ছিল তেমনি রেখে দিল, এমনকি গ্রেগর যখন চাদরটা অতি সামান্য একটুখানি তুলে মাথা বার করে এই নতুন ব্যবস্থা তার বোনের কেমন লাগছে সেটা বুঝতে চেষ্টা করল তখন সে যেন তার চোখে একটা সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিও দেখতে পেল।

প্রথম এক পক্ষকাল তার মা-বাবা গ্রেগরের ঘরে ঢুকবার মতো অবস্থায় নিজেদের মনকে তৈরি করে উঠতে পারেননি। তবে, ইতিপূর্বে যেখানে তাঁরা প্রায়ই তার বোনকে কিছু কাজের নয় বলে, তিরস্কার করতেন, এখন সেখানে তার কার্যাবলির জন্য তাঁরা প্রশংসাসূচক কথাবার্তা বললেন এবং সেসব কথা তার কানে এসে পৌঁছুতে লাগল। এখন তার মা-বাবা উভয়েই প্রায়ই দরজার বাইরে অপেক্ষা করে থাকতেন, এবং তার ঘরদোর সাফ করে বাইরে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার বোনকে তার মা-বাবার কাছে সবকিছু খুঁটিয়ে বলতে হত—ঘরের অবস্থা কী রকম, গ্রেগর কী খেয়েছে, তার অবস্থার সামান্য একটুও উন্নতি ঘটেছে কি-না ইত্যাদি। তার মা-ও অল্পদিনের মধ্যেই তার সঙ্গে দেখা করতে চাইতে আরম্ভ করলেন, কিন্তু তার বাবা আর বোন নানা যুক্তি দেখিয়ে মাকে নিরস্ত করল। গ্রেগর খুব মন দিয়ে সেসব যুক্তি শুনল এবং মোটের উপর তার সারবত্তাও সে অনুমোদন করল। কিন্তু, পরবর্তী সময়ে, যখন তিনি চিৎকার করে বলতে লাগলেন, আমাকে গ্রেগরের কাছে যেতে দাও! ও আমার দুর্ভাগা ছেলে! কেন বুঝতে পারছে না যে আমাকে ওর কাছে যেতেই হবে! এবং যখন তাঁকে রীতিমতো বল প্রয়োগ করে আটকে রাখতে হত, তখন গ্রেগরের মনে হল যে তাকে বোধ হয় ঢুকতে দেয়াই ভালো হবে, অবশ্য রোজ নয়, কিন্তু ধরো সপ্তাহে। একবার; নিঃসন্দেহে তিনি সবকিছু তার বোনের চাইতে ভালোভাবে বুঝতে পারবেন। ও অবশ্য যথেষ্ট চেষ্টা করছে এবং হয়তো একটা ছেলেমানুষি অবিমৃষ্যকারিতার বোধ থেকেই এই রকম একটা কঠিন কাজ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে; কিন্তু আসলে তো সে নিতান্ত ছেলেমানুষ ছাড়া আর কিছু নয়।

গ্রেগরের মাকে দেখার সাধ শিগগিরই পূর্ণ হল। মা-বাবার প্রতি বিবেচনাবোধ থেকে গ্রেগর দিনের বেলায় জানালার সামনে দাঁড়াতে চাইত না, কিন্তু মেঝের এই সামান্য কয়েক বর্গগজ জায়গার মধ্যে তো তার পক্ষে বেশি ঘুরে বেড়ান সম্ভব ছিল না, অথচ সারারাত চুপচাপ শুয়ে থাকাও তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠল। অন্যদিকে খাওয়া-দাওয়া সম্পর্কে তার যে উৎসাহ দেখা দিয়েছিল তাও দ্রুত স্তিমিত হতে আরম্ভ করে। অগত্যা একটু বিনোদনের জন্য সে দেয়ালে আর ছাদের গায়ে আড়াআড়িভাবে চলে বেড়াবার অভ্যাস করে ফেলল। বিশেষ করে। ছাদের বুক থেকে ঝুলে থাকাটা সে বেশ উপভোগ করতে শুরু করল, মেঝেতে শুয়ে থাকার চাইতে এটা অনেক ভালো, অনেক সহজে এখানে নিঃশ্বাস নেয়া যায়, তার দেহ এই অবস্থায় মৃদুমন্দ গতিতে দোল খেত; আর ওই পরম তৃপ্তিকর। দোদুল্যমান অবস্থায় আত্মবিস্মৃত হয়ে সে হয়তো কখনো কখনো নিজের হাত পা ছেড়ে দিত, এবং তখন অবাক হয়ে দেখত যে সে ধপাস করে মেঝেতে পড়ে গেছে। তবু তার শরীর এখন নিঃসন্দেহে আগের চাইতে বেশি স্বনিয়ন্ত্রণে আছে, এবং অত উঁচু থেকে পড়ার জন্যও তার তেমন ক্ষতি হল না। গ্রেগর যে নিজেকে ভোলাবার জন্য একটা নতুন জিনিস আবিষ্কার করেছে তার বোন সেটা সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ করল। যেখান দিয়েই সে গুটগুট করে যেত সেখানেই কিছু কিছু চিহ্ন পড়ে থাকত। তার বোনের মনে হল চলে-ফিরে বেড়াবার জন্য গ্রেগরকে যত বেশি জায়গা সম্ভব তা ছেড়ে দেয়া দরকার, আসবাবপত্র সরিয়ে ফেলা প্রয়োজন, বিশেষভাবে আলমারি আর লেখার টেবিলটা। কিন্তু তার একার পক্ষে একাজ করা সম্ভব নয়; বাবাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে বলার সাহস সে পেল না; আর কাজের মেয়েটিকে, ষোল বছরের এক বাচ্চা মেয়ে, রাঁধুনি মহিলা চলে যাবার পরও মেয়েটি সাহস করে থেকে গিয়েছে, তাকে সাহায্য করতে বলা যাবে না, কারণ সে ইতোমধ্যে একটা বিশেষ অনুরোধ করে রেখেছিল, রান্নাঘরের দরজা সে তালা বন্ধ করে রাখবে, এবং একমাত্র সুনির্দিষ্ট ডাক পড়লেই শুধু সে ওই দরজা খুলবে। অতএব মাত্র একটা পথই খোলা আছে, বাবা যখন বাইরে থাকবেন তখন সে মাকে সাহায্য করতে বলবে। আর ওই বৃদ্ধা রমণী সঙ্গে সঙ্গে অধীরভাবে সানন্দ ধ্বনি করতে করতে এগিয়ে এলেন, তবে গ্রেগরের ঘরের দরজার সামনে আসতে আসতেই তার আনন্দ যেন উবে গেল। গ্রেগরের বোন, অবশ্য, আগে ঘরে ঢুকল, মাকে ঢুকতে দেবার আগে সবকিছু ঠিকঠাক আছে। কিনা দেখে নিল। গ্রেগর তাড়াতাড়ি করে চাদরটা আরও নিচে টেনে নামাল, এমনভাবে সেটা সাজাল যেন মনে হয় আকস্মিকভাবে তা সোফার উপর পড়ে গেছে। আর এবার সে তার তলা থেকে উঁকি মেরে তাকাল না। এবার সে মাকে দেখার আনন্দ থেকে নিজেকে স্বেচ্ছায় বঞ্চিত করল, তিনি যে এসেছেন এতেই সে খুশি হল। এস, ওকে দেখা যাচ্ছে না, এ-কথা বলে তার বোন, স্পষ্ট বোঝা গেল, হাত ধরে মাকে ঘরের ভেতর টেনে আনল। গ্রেগর এবার শুনতে পেল ওই দুই মহিলা ভারী আলমারিটা ধস্তাধস্তি করে সরাবার চেষ্টা করছেন, তার বোন বেশি পরিশ্রমের কাজটা নিজে করতে চাইছে, আর তার মা তাকে বারণ করছেন, বলছেন যে ওর কষ্ট হবে, ক্ষতি হবে। কাজটা করতে অনেকক্ষণ লাগল। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা টানাটানি করার পর মা বললেন যে আলমারিটা যেখানে আছে। সেখানে থাকাই ভালো, কারণ প্রথমত, ওটা বড় বেশি ভারী, তার বাবা বাড়ি ফিরে আসার আগে ওটাকে কিছুতেই সরানো যাবে না, আর ঘরের ঠিক মাঝখানে পড়ে থাকলে গ্রেগরের চলাফেরার আরও অসুবিধাই হবে, দ্বিতীয়ত, আসবাবপত্রগুলো সরালে তাতে যে গ্রেগরের সত্যি সত্যি কোনো উপকার হবে তাও সুনিশ্চিত নয়। মায়ের ধারণা বরং উল্টো। নিরাভরণ শূন্য দেয়ালের চেহারা তার নিজের মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে; গ্রেগরের কোনো অনুরূপ অনুভূতি হবে না? বিশেষত এইসব জিনিস তার কত দিনের পরিচিত। এগুলো না থাকলেই হয়তো তার একা একা লাগবে। তাছাড়া মা নিচু গলায় বললেন, বস্তুতপক্ষে সারাটা সময় তিনি ফিসফিস করে কথা বলছিলেন, তিনি যেন গ্রেগরকে, সে যে ঠিক কোথায় আছে তা তিনি বুঝতে পারছিলেন না, তাঁর কথার সুরটুকুও শোনাতে চাননি, কারণ গ্রেগর যে তার কথাবার্তা একটুও বুঝতে পারছে না সে বিষয়ে তার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না, তাছাড়া, ওর আসবাবপত্রগুলো সরিয়ে নিলে ও কি ভাববে না যে আমরা ওর ভালো হবার আশা বিসর্জন দিয়ে তাকে ঠাণ্ডা মাথায় সম্পূর্ণ তার নিজের উপর ছেড়ে দিচ্ছি? আমার মনে হয় ওর ঘর সর্বদা যেমন ছিল ঠিক সেই রকম অবস্থায় রেখে দেওয়াই ভালো, যাতে সে আবার আমাদের মাঝে ফিরে এলে সবকিছু অপরিবর্তিত দেখতে পায় এবং তখন মধ্যবর্তী সময়ে যা কিছু ঘটেছে তার কথা সে সহজেই ভুলে যেতে পারবে।

মায়ের মুখ থেকে এই কথাগুলো শোনার পর গ্রেগর বুঝতে পারল যে বিগত দু-মাস ধরে সর্বপ্রকার প্রত্যক্ষ মানবিক সংলাপ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে এবং পারিবারিক জীবনের একঘেয়েমির দরুন তার চিত্ত বিকল ও বিভ্রান্ত হয়ে গেছে, তা না হলে সে যে সত্যিই নিজের ঘরকে সম্পূর্ণ আসবাবপত্রহীন দেখার জন্য অধীর হয়ে উঠেছিল কী করে তার কারণ ব্যাখ্যা করা যাবে? সুনিশ্চিতভাবে যে দিকে খুশি সেদিকে অবাধে ঘুরে বেড়াবার সুবিধার জন্য, সে কি সত্যি সত্যি তার মানবিক পটভূমির সকল স্মৃতিকে বিসর্জন দেবার মূল্যেও চেয়েছিল যে প্রাচীন পারিবারিক আসবাবপত্রে আরামদায়কভাবে সুসজ্জিত তার এই উষ্ণ মনোরম ঘরটি একটা নিরাভরণ আস্তানায় রূপান্তরিত হোক? প্রকৃতই সে বিস্মৃতির অতল খাদের এত কিনারে এসে পৌঁছেছিল যে একমাত্র তার মায়ের কণ্ঠস্বর, যা সে কতকাল শোনেনি, তাকে সেখান থেকে টেনে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। তার ঘর থেকে কিছু সরানো যাবে না; যেমন ছিল সবকিছু হুবহু সেই রকম থাকবে; নিজের মনের উপর আসবাবপত্রগুলোর সুপ্রভাব সে কিছুতেই হারিয়ে যেতে দেবে; যদি চক্রাকার তার অর্থহীন ঘুরে বেড়ানোর ক্ষেত্রে আসবাবগুলো কিছু বাধার সৃষ্টি করে তবুও সেটা কোনো ক্ষতি নয়, বরং একটা লাভের ব্যাপার।

দুর্ভাগ্যবশত তার বোনের মত ছিল উল্টোটা। গ্রেগরের ব্যাপারে সে তার মা-বাবার তুলনায় নিজেকে, অবশ্য সংগত কারণেই, একজন বিশেষজ্ঞ ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, তাই মায়ের পরামর্শ শোনার পর নিজের সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়িত করতে সে আরও দৃঢ়সংকল্প হল। প্রথমে সে ভেবেছিল যে শুধু আলমারি আর লেখার টেবিলটা সরাবে, এখন ঠিক করল অপরিহার্য সোফাটি ছাড়া সব আসবাবপত্রই সে সরিয়ে ফেলবে। শুধু ছেলেমানুষি অবাধ্যতা কিংবা এত মূল্যে এবং এরকম অপ্রত্যাশিতভাবে তার নবাৰ্জিত আত্মবিশ্বাসের জন্যই সে এ-ব্যাপারে অত দৃঢ়সংকল্প হয়ে ওঠেনি। সে সত্যি সত্যি দেখেছিল যে গুটি গুটি করে ঘুরে বেড়াবার জন্য গ্রেগরের যথার্থই অনেকখানি জায়গা দরকার হয়; পক্ষান্তরে, যতটা বোঝা যাচ্ছিল, ওর আসবাবপত্রগুলো সে কখনই ব্যবহার করত না। এর পেছনে আরেকটা জিনিসও কাজ করে থাকতে পারে, সেটা হল একটি কিশোরী মেয়ের উৎসাহ-উদ্দীপনাময় স্বভাব, যা সুযোগ পেলেই পরিতৃপ্তি খুঁজে বেড়ায়, এবং সেজন্যই গ্রেটা এখন তার ভাইয়ের বর্তমান পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে ইচ্ছা করে বাড়িয়ে তুলতে প্রলুব্ধ হল, যেন তার জন্য সে আরও বেশি করে কাজ করতে পারে। একটা ঘর, যার নিরাভরণ শূন্য দেয়ালে গ্রেগর একাধিপত্য করে বেড়াবে, যেখানে একমাত্র সে ছাড়া আর কারো পা দেবার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না।

আর তাই তার মায়ের কথাবার্তা তাকে তার সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারল না। তার উপর গ্রেগরের ঘরে মার বেশ অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল এবং সেজন্য তাঁর। মতামতের ক্ষেত্রেও একটা অনিশ্চিত ভাব দেখা দিল। শিগগিরই তিনি চুপ করে গেলেন। আর যতটুকু সম্ভব মেয়েকে আলমারিটা ঠেলে বাইরে সরাবার কাজে সাহায্য করতে লাগলেন। তা, প্রয়োজন হলে, আলমারিটা ছাড়া গ্রেগর চালিয়ে নিতে পারবে, কিন্তু লেখার টেবিলটা তাকে রাখতেই হবে। রমণী দুজন হাঁসফাঁস করতে করতে আলমারিটা ঠেলে ঘরের বাইরে নিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেগর সোফার নিচ থেকে তার মাথা বার করল। সে দেখতে চাইল কীভাবে সে, যথাসম্ভব সতর্কতা ও সহৃদয়তার সঙ্গে, ওদের এই কাজে বাধা দিতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তার মা-ই ঘরের মধ্যে প্রথম ফিরে এলেন। গ্রেটা তখন পাশের ঘরে একাই সমস্ত শক্তি দিয়ে আলমারিটাকে দু-হাতে ধরে সরাবার চেষ্টা করছে, যদিও নিজের জায়গা থেকে সে ওটাকে একটুও সরাতে পারল না। মা তো গ্রেগরের চেহারা দেখতে এখনও অভ্যস্ত হননি, তাই পাছে তার ভীষণ খারাপ লাগে এই ভয়ে গ্রেগর তাড়াতাড়ি সোফার অন্য প্রান্তে সরে গেল, কিন্তু এটা করতে গিয়ে সামনের দিকে চাদরটা একটু দুলে উঠল, সেটা সে বন্ধ করতে পারল না। এতেই কিন্তু তার মা সতর্ক হয়ে গেলেন। তিনি এক মুহূর্ত নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর গ্রেটার কাছে ফিরে গেলেন।

গ্রেগর নিজেকে এই বলে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করল যে অস্বাভাবিক কিছুই ঘটছে না, শুধু কিছু আসবাবপত্র পাল্টানো হচ্ছে, কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যে তাকে স্বীকার করতে হল যে তার মনের মধ্যে একটা ভয়ানক অস্থিরতা চলছে। এই যে দুজন মহিলা এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছেন, উহ্ আহ্ করে উঠছেন, মেঝের উপর দিয়ে আসবাবপত্র টানাহেঁচড়ার শব্দ হচ্ছে, এইসব একসঙ্গে চারদিক থেকে ছুটে আসা একটা বিশাল বিপর্যয়ের মতো তাকে আঘাত করল। যতই সে তার মাথা আর পাগুলো গুটিয়ে নিয়ে একেবারে মেঝের ভেতরে সেঁধিয়ে যেতে চেষ্টা করল ততই তাকে স্বীকার করতে হল যে এই অবস্থা সে আর বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারবে না। ওরা তার ঘর থেকে তার সব জিনিসপত্র সরিয়ে নিচ্ছে; সে যা কিছু ভালোবাসে সব তারা নিয়ে যাচ্ছে; ওই আলমারিটায় সে চিরকাল তার করাত ও অন্যান্য কাজের টুকিটাকি হাতিয়ার রাখত, সেটা তারা ইতোমধ্যে নিয়ে গেছে; এখন ওরা, প্রায় মেঝের মধ্যে বসে-যাওয়া, তার লেখার টেবিলটা টেনে আলগা করছে, ও যখন কমার্শিয়াল একাডেমিতে পড়ত তখন সে ওই টেবিলে তার সব হোমওয়ার্ক করেছে, তারও আগে গ্রামার স্কুলে পড়ার সময়, এমনকি, হ্যাঁ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়েও তাই করেছেনা, ওই দুই মহিলার শুভ ইচ্ছার দিকটা পরিমাপ করে নষ্ট করার মতো সময় আর তার হাতে এখন নেই, ইতিমধ্যে সে ওদের অস্তিত্বের কথা প্রায় ভুলে যেতে বসেছিল, কারণ ওরা এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যে এই পর্যায়ে ওরা নীরবে কাজ করে যাচ্ছিল, শুধু তাদের পায়ের টেনে টেনে চলার ভারী শব্দ হচ্ছিল।

ওরা তখন পাশের ঘরে লেখার টেবিলটার গায়ে হেলান দিয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল। গ্রেগর তার জায়গা থেকে ছুটে বেরিয়ে এল, চারবার সে তার গতি পরিবর্তন করল, কারণ কোন জিনিসটা প্রথম বাঁচাবে তা সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না, তারপর তার চোখ পড়ল ঠিক উল্টো দিকের দেয়ালে, সে-দেয়াল। ইতোমধ্যে প্রায় পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে, শুধু ফার দিয়ে সর্বাঙ্গ আচ্ছাদিত ওই মহিলার ছবিটি তখনো সেখানে ঝুলছে। গ্রেগর দ্রুত ছবিটির গা বেয়ে উঠে কাচের উপর নিজেকে চেপে ধরল, বেশ ভালোভাবে নিজেকে আটকে রাখার মতো সুন্দর সমতল একটা জায়গা, তার তেতে ওঠা পেটটা ভারি আরাম পেল। তার নিচে ছবিটা এখন প্রায় সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে গেছে : অন্তত এই ছবিটা সে। কাউকে এখান থেকে সরাতে দেবে না। ওরা দুজন ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে সে যেন তাদের লক্ষ করতে পারে সেজন্য সে বসবার ঘরের দরজার দিকে নিজের মাথা ঘুরিয়ে রাখল।

ওরা অবশ্য খুব অল্পক্ষণই বিশ্রাম নিল, ইতোমধ্যে ওরা এদিকে চলে আসতে শুরু করেছে। গ্রেটা তার মাকে জড়িয়ে ধরে আছে, তাকে একরকম বয়ে নিয়ে আসছে সে। চারদিকে নজর ফেলে সে বলল, এবার কী নেব আমরা? তার চোখ গিয়ে পড়ল দেয়ালের গায়ে গ্রেগরের চোখের উপর। সে মাথা ঠিক রেখে স্থির থাকল, স্পষ্টতই তার মায়ের কথা ভেবে, তারপর মাকে উপর দিকে তাকানো থেকে নিবৃত্ত রাখার উদ্দেশ্যে নিজের মাথা নিচু করে হড়বড় করে, কিছু না। ভেবেচিন্তেই, মাকে বলে বসল, আমরা বরং খানিকক্ষণের জন্য বসবার ঘরে থাকি, কী বল, মা? গ্রেগর বোনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার বুঝতে পারল। সে মাকে নিরাপদ জায়গায় রেখে এসে তাকে দেয়াল থেকে তাড়িয়ে নামাবে। ঠিক আছে, একবার চেষ্টা করে দেখুক! সে সোজা উড়ে গিয়ে গ্রেটার মুখের উপর পড়বে।

কিন্তু গ্রেটার কথা মাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। তিনি একপাশে একটু সরে। গেলেন, আর তখনই ফুলের নকশা-আঁকা ওয়াল-পেপারের গায়ে বসে থাকা বিরাট বাদামি বস্তুটির উপর তার চোখ পড়ল। যা তিনি দেখছেন সেটা যে গ্রেগর সে সম্পর্কে যথার্থ সচেতন হবার আগেই তিনি ভাঙা গলায় সজোরে চিৎকার করে উঠলেন, হা ভগবান! হা ভগবান! চিৎকার করেই সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে, তিনি দুবাহু প্রসারিত করে সোফার উপর লুটিয়ে নিশ্চল হয়ে গেলেন। তার বোন নিজের হাত দুটি মুঠি করে নাড়তে নাড়তে তার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, গ্রেগর! তার রূপান্তরের পর এই প্রথমবার সে সরাসরি গ্রেগরকে উদ্দেশ্য করে কথা বলল। মায়ের মূৰ্ছা ভাঙাবার জন্য গন্ধযুক্ত তরল কিছু একটা ওষুধ আনতে সে পাশের ঘরে ছুটে গেল। গ্রেগরও চাইল সাহায্য করতে—ছবিটা বাঁচাবার এখনও সময় আছে—কিন্তু কাচের গায়ে তার শরীর শক্ত হয়ে সেঁটে গেছে, বেশ জোর করে তার নিজেকে সরিয়ে আনতে হল। তারপর সে তার বোনের পেছন পেছন পাশের ঘরে ছুটে গেল, চিরকাল তাকে যেমন পরামর্শ দিয়েছে এখনও যেন সেইরকম নির্দেশ আর পরামর্শ দেবে; কিন্তু এখন তাকে তার বোনের পেছনে গিয়ে অসহায়ভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে হল? ইতোমধ্যে তার বোন এক গাদা ছোট ছোট বোতল হাতড়ে বেড়াচ্ছে; একবার মুখ ঘুরিয়ে। ওকে দেখতে পেয়েই সে ভয়ে চমকে উঠল; একটা বোতল মেঝেতে পড়ে ভেঙে গেল; একটুকরা কাচের আঘাতে গ্রেগরের মুখ কেটে গেল, আর কি একটা ঝাঁঝাল ওষুধ ছলকে পড়ে তাকে ভিজিয়ে দিল। আর এক মুহূর্ত না থেমে গ্রেটা চোখের পলকে সবগুলো বোতল তুলে নিয়ে তার মায়ের কাছে ছুটে গেল, তারপর পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিল। গ্রেগর এখন মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন; তার মা হয়তো তারই জন্য প্রায় মরতে বসেছেন। পাছে বোন ভয়। পায় সেই আশঙ্কায় সে দরজা খুলতে ভরসা পেল না, বোনকে এখন মায়ের কাছে থাকতেই হবে; অপেক্ষা করা ছাড়া তার আর এখন কিছুই করবার নেই; দুশ্চিন্তায় আর আত্মধিক্কারে অস্থির হয়ে সে দেয়াল, আসবাবপত্র, ছাদ, সবকিছুর গা বেয়ে ঘুরতে আরম্ভ করল, এবং অবশেষে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে, যখন তার মনে হল যে গোটা ঘরটা তার চারধারে বন বন করে ঘুরছে, সে ধপ করে বড় টেবিলটার ঠিক মাঝখানে পড়ে গেল।

কিছু সময় কেটে গেল; গ্রেগর তখন দুর্বলভাবে পড়ে রয়েছে, চারদিকে সব চুপচাপ, এটা হয়তো একটা সুলক্ষণ। এমন সময় দরজার ঘণ্টি বেজে উঠল। কাজের মেয়েটি তো রান্নাঘরে তালা বন্ধ করে বসে আছে, কাজেই গ্রেটাকেই দরজা খুলে দিতে হবে। বাবা এসেছেন। ঢুকেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে? গ্রেটার মুখ দেখেই তিনি নিশ্চয় সবকিছু বুঝে ফেলেছিলেন। গ্রেটা অবরুদ্ধ গলায় বলল, বোঝা গেল যে সে বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে কথা বলছে, মা মূৰ্ছা গিয়েছিলেন, কিন্তু এখন অনেকটা ভালো। গ্রেগর বেরিয়ে পড়েছে। বাবা বললেন, আমি জানতাম ঠিক এরকম কিছু একটা ঘটবে। তোমাদের তো বারবার এ-কথা বলেছি আমি, কিন্তু তোমরা মা-মেয়ে আমার কথায় কান দাওনি। গ্রেগর স্পষ্ট বুঝল যে গ্রেটার অতিরিক্ত সংক্ষিপ্ত উক্তির সবচাইতে খারাপ ব্যাখ্যা করে নিয়েছেন তার বাবা। তিনি ধরে নিয়েছেন যে গ্রেগর নিশ্চয়ই হিংসাত্মক কিছু একটা কাজ করেছে। অতএব গ্রেগরকে এখন তার বাবাকে ঠাণ্ডা করতে হবে, এখন তাকে সবকিছু ভালোভাবে বোঝাবার সময় বা উপায় নেই। তাই সে দ্রুত নিজের ঘরের দরজার কাছে ছুটে গিয়ে সেখানে গুটিসুটি হয়ে লেগে থাকল যেন বাবা হলঘর থেকে এদিকে আসলেই তাকে দেখতে পান এবং বুঝতে পারেন যে তার ছেলের মনে এই মুহূর্তে নিজের ঘরে ঢুকে যাবার সদিচ্ছা রয়েছে, কাজেই তাকে সেখানে তাড়িয়ে ঢোকাবার কোনো আবশ্যকতা নেই, শুধু দরজাটা খুলে দিলেই সে তার ঘরের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে।

কিন্তু নিজের বর্তমান মানসিক অবস্থায় বাবা ওই সূক্ষ্ম তারতম্য লক্ষ করলেন। গ্রেগরকে দেখেই তিনি আহ! বলে চিৎকার করে উঠলেন। তাঁর গলার স্বর শোনাল একইসঙ্গে ক্রুদ্ধ ও উল্লসিত। গ্রেগর দরজার কাছ থেকে তার মাথা টেনে নিল, তারপর মাথা উঁচু করে বাবার দিকে তাকাল। সত্যি, মনে মনে সে বাবাকে যেরকম কল্পনা করেছিল ইনি তো সেরকম নন; অবশ্য এটা স্বীকার্য যে ইদানীং সে ছাদের গা বেয়ে ঘুরে বেড়াবার নতুন খেলায় এমন মেতে উঠেছিল যে বাড়ির অন্যত্র কিসব ঘটছে তা আর আগের মতো ঔৎসুক্য নিয়ে লক্ষ করতে পারেনি। সত্যি, সত্যি, কিছু পরিবর্তনের জন্য তো তার প্রস্তুত থাকা উচিত ছিল। কিন্তু তবু, তবু, এই কি তার বাবা? যখনই গ্রেগর ব্যবসায়ের কাজে ভ্রমণে বেরুত তখন যে মানুষটি বিছানায় ক্লান্তভাবে এলিয়ে পড়ে থাকতেন, রাত্তিরে ঘরে ফিরে এলে যিনি ড্রেসিং গাউন পরে লম্বা একটা আরাম কেদারায় শুয়ে শুয়ে গ্রেগরকে স্বাগত জানাতেন; তিনি যথার্থভাবে উঠে পর্যন্ত দাঁড়াতে পারতেন না, শুধু হাত তুলে তাকে শুভ সম্ভাষণ জানাতেন; বিরল কয়েকটি সময়ে, বছরে দু-এক রবিবারে কিংবা বিশেষ ছুটির দিনে, যখন পরিবারের অন্যদের সঙ্গে বেড়াতে বেরুলে যিনি গ্রেগর আর তার মায়ের মাঝখানে অবস্থান নিয়ে হাঁটতেন, যারা এমনিতেই আস্তে আস্তে হাঁটত, আর যিনি তাদের চাইতেও ধীর গতিতে হাঁটতেন, তার পুরনো ওভার-কোটটায় নিজেকে ভালোভাবে ঢেকে-ঢুকে যিনি বেশ কষ্ট করে, প্রতি পদক্ষেপের সময় তার হাতের মাথা-বাকানো লাঠিটা সতর্কতার সঙ্গে ঠুকতে ঠুকতে তার সাহায্যে, ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতেন, এবং কিছু-একটা বলতে চাইলে প্রায় একদম দাঁড়িয়ে পড়ে তার সঙ্গীদের কাছে ডেকে আনতেন, ইনি কি সেই ব্যক্তি? ওই-তো এখন তিনি ওখানে চমৎকারভাবে দাঁড়িয়ে আছেন; তাঁর পরনে একটা কেতাদুরস্ত নীল ইউনিফর্ম, সোনালি বোতাম-আঁটা তাতে, ব্যাঙ্কের বার্তাবাহকরা যে রকম পোশাক পরে সেই রকম; তার কোটের উঁচু শক্ত কলারের উপর দিয়ে। তার বলিষ্ঠ দ্বিত্ব চিবুক ফুলে ঝুলে পড়েছে; ঘন ভ্রুযুগলের নিচ থেকে তার কালো দুচোখ তীক্ষ্ণ্ণ সতেজ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে; তার একদা এলোমেলো সাদা চুল এখন চকচকে, সযত্নে ভাগ করা, সিথির দুপাশে পাট করে আঁচড়ানো। তাঁর টুপির গায়ে সোনালি মনোগ্রাম আঁকা, সম্ভবত কোনো ব্যাঙ্কের প্রতীকচিহ্ন; টুপিটা তিনি ছুঁড়ে দিলেন, বাঁকা হয়ে ঘুরে, ঘরের গোটা দৈর্ঘ্য পেরিয়ে, সেটা গিয়ে একটা সোফার উপরে পড়ল; কোটের প্রান্তদেশ পেছনে ঠেলে দিয়ে, দু-হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে কঠোর মুখভঙ্গি করে তিনি গ্রেগরের দিকে এগিয়ে গেলেন। সম্ভবত নিজের উদ্দেশ্য তিনি নিজেও ঠিকমতো জানতেন না; কিন্তু তিনি তার পা অস্বাভাবিক রকম উঁচু করে তুলেছিলেন, আর গ্রেগর তার জুতার তলার সুবিশাল আকৃতি দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। কিন্তু গ্রেগর কোনো প্রতিবাদী ভূমিকা নিয়ে তাঁর মুখোমুখি হবার ঝুঁকি নিতে চাইল না, কারণ নিজের নতুন জীবনের একেবারে প্রথম দিন থেকেই সে লক্ষ করেছিল যে তার সঙ্গে ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাবা। কঠোরতম প্রক্রিয়াকেই সবচাইতে উপযোগী বলে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছিলেন। আর তাই সে তার বাবার আগে আগে ছুটল, তিনি থামলে সেও থামল, এবং বাবা একটু নড়লেই সেও আবার শুটশুট করে সামনে এগিয়ে গেল। এইভাবে ওরা কয়েকবার ঘরটির মধ্যে চক্রাকারে ঘুরল, কোনো কিছুই চূড়ান্তভাবে ঘটল না। সত্যি বলতে কী সমস্ত কাণ্ডটা পশ্চাদ্ধাবনের মতোও দেখাল না, কারণ এই ছোটাছুটিটা পরিচালিত হল অত্যন্ত ধীর গতিতে। আর তাই গ্রেগর মেঝে ছেড়ে অন্যত্র গেল না; তার ভয় হল সে যদি দেয়াল বা ছাদ বেয়ে ওঠে তাহলে বাবা নিশ্চয়ই তার ওই অভিযানকে একটা অস্বাভাবিক শয়তানি বলে মনে করবেন। তবু এই অবস্থা সে আর বেশিক্ষণ চালিয়ে যেতে পারবে না, কারণ তার বাবা যেখানে একটিমাত্র পদক্ষেপ নিচ্ছিলেন সেখানে তাকে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অনেকগুলো অংশকে একসঙ্গে নাড়াতে হচ্ছিল। পূর্বতন জীবনে যেমন তার ফুসফুস খুব নির্ভরযোগ্য ছিল না, এখনও ঠিক তেমনিভাবে সে এরই মধ্যে হাঁপাতে শুরু করেছিল। সে টলমল পায়ে এগিয়ে গেল, দৌড়ানোর উপর তার সমস্ত শক্তি কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করল, চোখ দুটি কোনোরকমে একটু খোলা রাখল শুধু; নিজের বিভ্রান্ত অবস্থায় সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া পলায়নের আর কোনো পথের কথা সে একবারও চিন্তা করল না; সে-যে সহজেই দেয়াল বেয়ে উঠে যেতে পারে একথা সে প্রায় ভুলে গেল, আর এই ঘরের দেয়াল তো নানা জিনিসের চমৎকার কাজ করা হাতল, দণ্ড এবং খাজে সুসজ্জিত—এই সময় হঠাৎ তার পেছনে, খুব কাছে, হালকাভাবে ছুঁড়ে দেয়া কী একটা জিনিস এসে পড়ল, তারপর সেটা গড়িয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল। একটা আপেল; তারপর প্রায় তক্ষুনি আরেকটা আপেল এসে পড়ল তার পাশে। গ্রেগর ভয় পেয়ে থমকে দাঁড়াল। আর দৌড়াবার কোনো মানে হয় না, কারণ বাবা এখন তার উপর বোমাবর্ষণ করতে বদ্ধপরিকর। সাইডবোর্ডের উপরে-রাখা একটি পাত্র থেকে তিনি অনেকগুলো ফল তুলে তার পকেটভর্তি করেছেন, এবং এখন এই মুহূর্তে, খুব ভালো রকম নিশানা না-করেই। তাকে লক্ষ করে একটার-পর-একটা আপেল ছুঁড়ে মারছেন। ছোট ছোট লাল আপেলগুলো যেন চুম্বকের আকর্ষণে গড়িয়ে গড়িয়ে একটার গায়ে আরেকটা সশব্দে আঘাত হানছে। হালকা জোরের সঙ্গে ছোড়া একটা আপেল গ্রেগরের পিঠ ছুঁয়ে, কোনো বিপদ না ঘটিয়েই, পিছলে পড়ে গেল। কিন্তু ঠিক পরের মুহূর্তে আরেকটা আপেল সোজা তার পিঠে পড়ে তাকে ঠেসে ধরল। গ্রেগর নিজেকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করল, যেন এই অবিশ্বাস্য চমক জাগানো বেদনা সে পিছনে ফেলে রেখে যেতে পারে, কিন্তু তার মনে হল তাকে যেন কেউ পেরেক দিয়ে ওই জায়গায় গেঁথে দিয়েছে, আর তখনই তার সকল ইন্দ্রিয়ানুভূতির চরম ওলট-পালটের মধ্যে সে নিজেকে মেঝের উপর যতটা সম্ভব ছড়িয়ে দিল। তার শেষ সজ্ঞান দৃষ্টি দিয়ে সে তার ঘরের দরজাকে প্রচণ্ড বেগে খুলে যেতে দেখল, তার বোন চিৎকার করছে, আর তার বোনের আগে আগে ছুটে বেরিয়ে আসছেন, মায়ের উর্ধ্বাঙ্গে শুধু অন্তর্বাস, কারণ মা যেন সহজে নিঃশ্বাস নিতে পারেন, তাড়াতাড়ি যেন তার মূৰ্ছা ভাঙে, সেজন্য মেয়ে তার কাপড় ঢিলা করে দিয়েছিল। সে দেখল ছুটে যাচ্ছেন বাবার দিকে, যেতে যেতে তাঁর ঢিলা করে দেয়া পেটিকোটগুলো একটার পর একটা মেঝেতে ছেড়ে যাচ্ছেন, এবং সেগুলোর উপর দিয়ে হুমড়ি খেয়ে তিনি সোজা তার বাবার বুকে পড়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন—তাঁর সঙ্গে যুক্ত হলেন পরিপূর্ণ মিলনে—কিন্তু এই পর্যায়ে গ্রেগরের চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসতে শুরু করেছিল- মা তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে পুত্রের প্রাণভিক্ষা করলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *