নানা আজেবাজে স্বপ্ন দেখার পর একদিন সকালে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে গ্রেগর সামসা দেখল যে এক বিশাল পতঙ্গে রূপান্তরিত হয়ে সে তার বিছানায় শুয়ে আছে। চিৎ হয়ে নিজের শক্ত পিঠের উপর সে শায়িত, পিঠটা যেন বর্মে মোড়া, আর মাথা একটু উঁচু করতেই তার চোখে পড়ল গম্বুজের মতো নিজের বাদামি পেট, শক্ত বাঁকানো অংশে বিভক্ত, তার উপরে, লেপটা ঠিকমতো রাখতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল, পিছনে প্রায় সম্পূর্ণ পড়ে যাচ্ছিল সেটা। তার অসংখ্য পাগুলো শরীরের অন্যান্য অংশের তুলনায় পীড়াদায়ক রকম সরু, আর তার চোখের সামনে সেই পাগুলো এখন অসহায়ভাবে নড়ছে।
সে ভাবল, কী হয়েছে আমার? এ কোনো স্বপ্ন নয়। সুপরিচিত চার দেয়ালের মধ্যে এই তো তার ঘর স্থির হয়ে পড়ে রয়েছে, একটা স্বাভাবিক মানবিক শয়নকক্ষ, একটু বেশি ছোট এই যা। টেবিলের উপর কাপড়ের নমুনার সংগ্রহ খোলা, কাপড়গুলো খুলে বিছানো—সামসা একজন ভ্রাম্যমাণ কর্মজীবী, ঘুরে ঘুরে কাপড়ের নমুনা দেখিয়ে বেড়ায়—একটু উপরে একটা ছবি ঝুলছে, অল্প কদিন আগে একটা সচিত্র পত্রিকা থেকে কেটে সুন্দর গিল্টি-করা ফ্রেমে বাঁধিয়ে ওখানে ঝুলিয়ে দিয়েছে সে। এক মহিলার ছবি, মাথায় ফারের টুপি, গায়ে ফারের কোট, সোজা বসে দর্শকের দিকে একটা বিরাট ফারের দস্তানা বাড়িয়ে ধরেছেন, যার মধ্যে তার বাহুর প্রায় গোটাটা ঢুকে গেছে!
এরপর গ্রেগরের চোখ পড়ল জানালার উপর, আর মেঘে ঢাকা আকাশের উপর-জানালার পাশের নর্দমায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছিল—গ্রেগরের মন রীতিমতো বিষণ্ণ হয়ে উঠল। সে ভাবল, এই আজেবাজে ব্যাপারটা ভুলে গিয়ে আরও কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকলে কেমন হয়, কিন্তু সেটা পারা গেল না, কারণ ও ডান পাশে শুয়ে ঘুমুতে অভ্যস্ত, অথচ তার বর্তমান অবস্থায় সে পাশ ফিরতে পারছিল না। যত জোরেই সে ডান দিকে ফিরতে চেষ্টা করল, প্রত্যেকবারই সে গড়িয়ে চিৎ হয়ে পড়ে যেতে লাগল। অন্তত একশোবার সে চেষ্টা করল, নিজের অস্থির চঞ্চল পাগুলো যেন দেখতে না হয় সেজন্য সে চোখ বন্ধ করে তার প্রয়াস চালিয়ে গেল, এবং ইতিপূর্বে কখনও অনুভব করেনি, পাশের দিকে সে ধরনের একটা ভোতা বেদনা অনুভব করার পরই শুধু সে তার প্রয়াসে ক্ষান্ত দিল।
হেই ভগবান, সে ভাবল, কী প্রচণ্ড অবসাদ জাগানো কাজই আমি বেছে নিয়েছি! দিনের পর দিন ঘুরে বেড়ানো! দপ্তরে বসে আসল কাজ করার চাইতে এটা অনেক বেশি বিরক্তিকর, তাছাড়া এখানে রয়েছে নিরন্তর ভ্রমণের ঝামেলা, ঠিকমতো ট্রেন-কানেকশন পাওয়া যাবে কিনা সে সম্পর্কে দুশ্চিন্তা, থাকা আর অনিয়মিত খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপার নিয়ে দুর্ভাবনা, নিত্যি-নতুন লোকজনের সঙ্গে ক্ষণিক পরিচিতি, যারা কখনও অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে উঠতে পারে না। জাহান্নামে যাক এইসব! পেটের কাছটায় সে সামান্য একটু চুলকানি অনুভব করল; ধীরে ধীরে চিৎ হয়ে শুয়ে সে খাটের উপরের দিকটায় নিজেকে একটু ঠেলে দিল যেন তার মাথা আরেকটু সহজে তুলতে পারে; চুলকানির জায়গাটা সে দেখল, তার চারপাশে সাদা ছোট ছোট কয়েকটা দাগ, যার প্রকৃতি সে বুঝতে পারল না; একটা পা দিয়ে সে ওই জায়গাটা স্পর্শ করতে চেষ্টা করল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে পা টেনে নিল, কারণ ওখানে পা লাগতেই তার সারা শরীর দিয়ে একটা ঠাণ্ডা কাঁপুনি বয়ে গেল।
একটু পিছলে নেমে সে আবার তার পূর্বতন অবস্থায় ফিরে গেল। এই রকম ভোরে ওঠা, সে ভাবল, মানুষকে বুন্ধু বানিয়ে দেয়। মানুষের ঘুম দরকার। অন্য বাণিজ্যিক প্রতিনিধিরা হেরেমের মেয়েদের মতো ন্দ্রিা দেয়। যেমন, আমি যে। সব অর্ডার সংগ্রহ করেছি সেগুলো লিখে ফেলার জন্য সকালবেলায় যখন কোনো হোটেলে ফিরে আসি তখন দেখি যে আর সবাই সবেমাত্র নাশতার টেবিলে এসে বসছে। আমি যদি সেরকম কিছু করতাম তাহলে বড়কর্তা তক্ষুনি আমার চাকরি খেয়ে দিতেন। অবশ্য কে বলতে পারে, সেটা হয়ত আমার জন্য ভালোই হত। বাবা-মার কথা ভেবে আমি যদি চুপ করে না থাকতাম তাহলে বহু আগে আমি নিজেই চাকরি ছাড়ার নোটিশ দিতাম, সোজা বড়কর্তার কাছে গিয়ে তার সম্পর্কে আমি কী ভাবি সেটা ওর মুখের ওপর শুনিয়ে দিতাম। ডেস্কের উপরেই তাহলে তিনি ঢলে পড়ে যেতেন! এমনিতেই ব্যাপারটা অদ্ভুত, তিনি একটা ডেস্কের ওপাশে উঁচুতে বসে কর্মচারীদের দিকে ঝুঁকে নিচু হয়ে কথা বলেন, তার উপর তিনি কানে কম শোনেন, তাই কর্মচারীদেরকে তার খুব কাছে এগিয়ে যেতে হয়। তবে এখনও আশা আছে। ওর কাছে বাবা-মার যে ঋণ আছে সেটা পরিশোধ করার মতো টাকা জমাবার পর—আর পাঁচ-ছ বছরের মধ্যেই তা হয়ে যাবে—আমি অবশ্যই এ কাজটা করব। নিজেকে আমি তখন সব বাধা-বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে নেব। কিন্তু তার আগে, এখনকার মতো আমি বরং উঠে পড়ি, সকাল পাঁচটায় আমার ট্রেন ছেড়ে যাবে। সিন্দুকের উপর টিকটিক-করা এলার্ম ঘড়িটার দিকে তাকাল সে। উরেঃ বাবা! সাড়ে ছটা বেজে গেছে, ঘড়ির কাঁটা ধীরভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, অর্ধ-ঘণ্টার বিন্দুটা ইতোমধ্যে পার হয়ে গেছে, এগিয়ে যাচ্ছে পৌনে সাতটার দাগের দিকে। এলার্মটা কি তাহলে বাজেনি? খাট থেকেই সে দেখতে পাচ্ছে যে এলার্ম চারটাতেই ঠিকমতো দেয়া ছিল; নিশ্চয়ই সেটা যথাসময়ে বেজে উঠেছিল। হা। কিন্তু ওই কান-ফাটানো শব্দ উপেক্ষা করে তারপরেও নির্বিবাদে ঘুমানো কি সম্ভব? অবশ্য সে মোটেই নির্বিবাদে ঘুমায়নি, যদিও মনে হচ্ছিল ঠিক তার উল্টোটা। কিন্তু এখন কী করবে সে? পরের ট্রেন ছাড়ে সাতটায়। ওই ট্রেন ধরতে হলে তাকে পাগলের মতো তাড়াহুড়া করতে হবে, আর এদিকে তার নমুনাগুলো এখনও প্যাক করা হয়নি, নিজেকেও তেমন সতেজ ও সকর্মক মনে হচ্ছে না। আর ট্রেন ধরতে পারলেও বড়কর্তার সঙ্গে ঝগড়া সে এড়াতে পারবে না, কারণ ফার্মের দারোয়ান পাঁচটার ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করে থেকে, তাকে সেই ট্রেনে না-আসতে দেখে, নিশ্চয়ই সে কথা বড়কর্তাকে অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছে। দারোয়ান হল বড়কর্তার নিজের লোক, মেরুদণ্ড হীন ও নির্বোধ। আচ্ছা, গ্রেগর যদি বলে যে তার অসুখ করেছে। সেটা খুব অপ্রীতিকর হবে, দেখাবেও সন্দেহজনক, কারণ এই পাঁচ বছরের চাকরিকালে সে একদিনের জন্যও অসুস্থ হয়নি। বড়কর্তা নিঃসন্দেহে নিজেই রোগ-বীমার ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে চলে আসবেন, তার বাবা-মাকে পুত্রের আলসেমির জন্য তিরস্কার করবেন, বীমা-ডাক্তারের মতামতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার সব অজুহাত নাকচ করে দেবেন, আর বীমা-ডাক্তার তো সমস্ত মানবজাতিকেই মনে করেন রীতিমত সুস্থ, ফাঁকিবাজ একটা গোষ্ঠী। আর এক্ষেত্রে কি তার সিদ্ধান্ত খুব ভুল হবে? আসলে গ্রেগরের শরীর তো বেশ ভালোই আছে, শুধু একটু ঘুম-ঘুম পাচ্ছে, অত দীর্ঘ দ্রিার পর যার কোনো মানে হয় না। আর তার অস্বাভাবিক রকম ক্ষুধাও পেয়েছে।
সে বিছানা ছেড়ে-উঠবে-কি উঠবে না এ-সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে অসমর্থ অবস্থায় উপরোক্ত চিন্তাগুলো যখন তার মনে প্রচণ্ড দ্রুতবেগে ছুটে চলেছে—ঘড়িতে এইমাত্র পৌনে সাতটা বাজার ঘণ্টাধ্বনি হল—তখন খাটের মাথার ওপাশে দরজার ওপর একটা সতর্ক টোকা পড়ল। গ্রেগর—তার মায়ের গলা শোনা গেল—পৌনে সাতটা বাজে। তোমার ট্রেন ধরতে হবে না? সেই স্নিগ্ধ কণ্ঠস্বর! গ্রেগর জবাব দিতে গিয়ে নিজের গলার আওয়াজ শুনে অসম্ভব চমকে গেল। তার নিজেরই গলার আওয়াজ, সে-কথা সত্য, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরের আড়ালে ভয়ঙ্কর নিচুগ্রামের একটানা একটা কিচকিচ শব্দ হল, যার ফলে শুধু প্রথম এক মুহূর্তের জন্য কথাগুলো স্পষ্ট আকৃতি পেল, তারপরই গমগম করে উঁচু লয়ে উঠে সেই ধ্বনির আড়ালে কথাগুলোর সমস্ত অর্থ নস্যাৎ হয়ে গেল, ফলে কারো পক্ষে সে যে যথার্থ কি শুনল তা বোঝা আর সম্ভবপর হল না। গ্রেগরের ইচ্ছা হল সমস্ত ব্যাপারটা সে বিশদ ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলে, কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনা করে সে শুধু বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ধন্যবাদ, মা। আমি এখুনি উঠে পড়ছি। তাদের দুজনের মধ্যবর্তী কাঠের দরজার জন্য নিশ্চয়ই তার কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন বোঝা যায়নি, কারণ তার মা ওই কথা শুনে সন্তুষ্ট হয়ে পা টেনে টেনে সরে গেলেন। তবু ওই সামান্য সংলাপের ফলেই পরিবারের অন্যরা বুঝতে পারল যে গ্রেগর এখনও বাড়িতে আছে, এটা তারা আশা করেনি, আর তাই তার বাবা ইতোমধ্যে পাশের দিকের একটা দরজায় হাতের মুঠি দিয়ে আস্তে আস্তে ধাক্কা দিতে শুরু করেছেন। তিনি ডাক দিলেন, গ্রেগর, গ্রেগর, তোমার কী হয়েছে? একটু পরে তিনি আবার ডাকলেন, এবার আগের চাইতে ভারী গলায়। পাশের দিকের অন্য দরজার কাছ থেকে তার বোন নিচু করুণ গলায় জিজ্ঞাসা করল, গ্রেগর, তোমার কি শরীর খারাপ? কিছু লাগবে তোমার? গ্রেগর একই সঙ্গে দুজনকে উত্তর দিল, প্রতিটি শব্দ আস্তে আস্তে, সুস্পষ্টভাবে, দুশব্দের মধ্যে অনেকখানি বিরতি দিয়ে, ভেঙে ভেঙে, সে বলল, যেন তার কণ্ঠস্বর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক শোনায়, এই আমি তৈরি হয়ে গেলাম বলে। ওর বাবা তখন আবার নাশতার টেবিলে ফিরে গেলেন কিন্তু বোন ফিসফিস করে বলল, গ্রেগর দরজা খোল। খোল! কিন্তু দরজা খোলার কথা গ্রেগর মোটেই ভাবল না, আর বাইরে ভ্রমণ করার সময় রাত্রিতে ঘরের দরজায় তালা দিয়ে শোবার যে প্রাজ্ঞ অভ্যাস সে রপ্ত করেছিল, বাড়িতেও যা সে বজায় রেখেছিল, তার জন্য এখন নিজেকে সে ধন্যবাদ জানাল।
তার তাৎক্ষণিক ভাবনা হল কোনোরকম বাধা-বিপত্তি ছাড়া চুপচাপ বিছানা ছেড়ে ওঠা, কাপড়-জামা পরা, সর্বোপরি সকালের নাশতাটা খাওয়া, এবং তারপর আর কী করা যায় সেটা ঠিক করা, কারণ সে বেশ বুঝতে পারছিল যে বিছানায় শুয়ে শুয়ে হাজার ভাবনা-চিন্তা করলেও কোনো তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্তে সে পৌঁছুতে পারবে না। তার মনে পড়ল যে অনেক সময় বিছানায় শোয়া অবস্থায় সে শরীরের নানা স্থানে বহু ছোটখাটো ব্যথা-বেদনা অনুভব করেছে, সম্ভবত বেকায়দায় শোয়ার জন্য, তারপর বিছানা ছেড়ে ওঠার পর দেখা গেছে যে সেসব ব্যথা-বেদনা সবই কাল্পনিক। গভীর প্রত্যাশা নিয়ে সে ভাবল যে আজকের সকালের এই দুঃস্বপ্ন-বিভ্রান্তিও আস্তে আস্তে কেটে যাবে। তার কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন আর কিছু নয়, একটা কঠিন ঠাণ্ডার আক্রমণের পূর্বাভাস মাত্র, তার মতো ভ্রাম্যমাণ বাণিজ্যিক কর্মচারীদের নিত্যদিনের অসুখ, এ বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না।
লেপটা সে খুব সহজে সরিয়ে দিতে পারল; নিজেকে একটু ফোলাতেই সেটা আপনা থেকে পিছলে পড়ে গেল। কিন্তু এর পরবর্তী কাজটা বেশ কঠিন হল, বিশেষ করে তার অস্বাভাবিক প্রশস্ততার কারণে। নিজেকে উঁচু করে তুলে ধরার জন্য তার দরকার ছিল হাত আর বাহুর; সে জায়গায় তার আছে শুধু অজস্র ছোট ছোট পা, যেগুলো একটুও স্থির না-থেকে সারাক্ষণ শুধু এদিক-ওদিক নড়ছে আর যার নড়াচড়া সে কিছুমাত্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সে একটা পা বাঁকাতে চেষ্টা করল, কিন্তু ওটা সঙ্গে সঙ্গে আবার সোজা হয়ে গেল। একটা পা যখন সে শেষপর্যন্ত বাঁকাল তখন দেখা গেল যে অন্য পাগুলো ভয়ঙ্কর বিরক্ত ও অস্থির হয়ে পাগলের মতো নড়ছে। গ্রেগর আপন মনে বলল, কিন্তু এই রকম অলসভাবে বিছানায় শুয়ে থাকলেই-বা কী লাভ হবে?
তার মনে হল প্রথমে শরীরের নিচের অংশটার সাহায্যে সে বোধ হয় বিছানা থেকে নামতে পারবে, কিন্তু এই নিচের অংশটা সে এখনও দেখেনি, এ সম্পর্কে কোনো পরিষ্কার ধারণাই তার হল না, আর ওই অংশ নাড়ানও, দেখা গেল, দুঃসাধ্য। খুব আস্তে আস্তে সেটা নড়ল, তারপর বিরক্তিতে প্রায় ক্ষেপে গিয়ে সে যখন শেষপর্যন্ত নিজের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে বেপরোয়াভাবে একটা ধাক্কা দিল, তখন দেখা গেল যে সে দিকের হিসেবে ভুল করেছে, খাটের পায়ের দিকে গিয়ে তার দেহ ধাক্কা খেয়েছে, আর তক্ষুনি একটা প্রচণ্ড জ্বালাময় ব্যথা তাকে জানিয়ে দিল যে এই মুহূর্তে সম্ভবত তার দেহের নিম্নাংশই সবচাইতে বেশি স্পর্শকাতর।
কাজেই সে তার শরীরের ঊর্ধ্বাংশ প্রথমে বাইরে নামিয়ে আনতে সচেষ্ট হল। খুব সতর্কতার সঙ্গে সে নিজের মাথা খাটের কিনারার দিকে নিয়ে গেল। এটা বেশ সহজেই করা গেল এবং তার দেহের প্রশস্ততা ও ঘনত্ব সত্ত্বেও অবশেষে সেটা তার মাথার গতিধারা অনুসরণ করতে সক্ষম হল। তবু, যখন সে তার মাথা শেষপর্যন্ত খাটের কিনারার ওপাশে নিয়ে যেতে সক্ষম হল, তখন সে আর অগ্রসর হতে সাহস করল না, কারণ এইভাবে যদি সে নিজেকে নিচে পড়তে দেয় তাহলে কোনো অলৌকিক কাণ্ড ছাড়া নিজের মাথাকে সে আঘাতের হাত থেকে কিছুতেই বাঁচাতে পারবে না। আর, যে করেই হোক, এখন তার সংজ্ঞা হারান চলবে না, ঠিক এই মুহূর্তে। তার চাইতে সে বরং বিছানাতেই শুয়ে থাকবে।
কিন্তু আরেকবার সেই একই রকম চেষ্টার পুনরাবৃত্তির পর সে যখন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে পূর্বতন অবস্থায় শুয়ে পড়ল আর তার পাগুলোকে, সম্ভব হলে আগের চাইতেও বেশি অস্থির হয়ে, পরস্পরের সঙ্গে জড়াজড়ি করে নড়তে দেখল, এবং ওই স্বতঃস্ফুর্ত অসম্বন্ধ বিভ্রান্তির মধ্যে শৃঙ্খলা আনবার কোনো উপায়ই সে খুঁজে পেল না, তখন সে আপন মনে আবার বলল যে বিছানায় শুয়ে থাকা অসম্ভব। এখন বিছানা থেকে উঠে পড়তে পারার ক্ষীণতম সম্ভাবনার জন্য সর্বস্ব পণ করে ঝুঁকি নেয়াই হবে তার পক্ষে সবচাইতে বেশি বুদ্ধিমানের কাজ। একইসঙ্গে সে ইত্যবসরে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিতে ভুলল না যে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করা, যতটা সম্ভব ঠাণ্ডা মাথায়, ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্তের চাইতে বহুগুণ ভালো। এইরকম মুহূর্তে সে যথাসম্ভব তীক্ষ্ণ্ণ চোখে জানালার দিকে তাকাল, কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত, ভোরের কুয়াশার একটা সম্ভাবনা তখন সরু রাস্তার ওপাশ পর্যন্ত ঝাঁপসা করে তুলেছে, ফলে ওই দৃশ্য তার জন্য কোনো উৎসাহ বা সান্ত্বনা আনয়ন করল না। এলার্ম ঘড়িটা আবার বেজে উঠতেই সে মনে মনে বলল, সাতটা হয়ে গেল এর মধ্যে, সকাল সাতটা, অথচ এখনও এত ঘন কুয়াশা। সামান্য কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে থাকল সে, শ্বাস-প্রশ্বাস নিল হাল্কাভাবে, যেন এইরকম পরিপূর্ণ প্রশান্তির ফলে, সে আশা করছে, সবকিছু আবার বাস্তব ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে।
কিন্তু তখনই সে আবার মনে মনে বলল, সোয়া সাতটা বাজবার আগে আমাকে যে করে তোক পুরোপুরি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তেই হবে। এর মধ্যে আপিস থেকে কেউ-না-কেউ আমার খোঁজ করতে এসে পড়বে, কারণ সাতটার আগেই তো আপিস খুলে যায়। এবার সে তার সারাশরীর একই তালে একটু করে দোলাতে শুরু করল, বাইরে পরিকল্পনা ছিল এইভাবে দুলতে দুলতে সে একবার বিছানার বাইরে চলে আসতে পারবে। ওইভাবে যদি সে নিজেকে তুলে আনতে পারে তাহলে ঠিক পড়ার মুহূর্তে সে মাথাটাকে সম্পূর্ণ একপাশে বাকিয়ে জখমের হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে। পিঠটা বেশ শক্তই মনে হচ্ছে, কার্পেটের উপর পড়লে তেমন ক্ষতি হবে না। তার সবচাইতে বেশি দুশ্চিন্তা হল এই ভেবে যে পড়ার সময় ধপাস করে যে জোর একটা শব্দ হবে সেটা সে কিছুতেই রোধ করতে পারবে না, এবং সেটা শুনে দরজার ওপাশের সবাই আতঙ্কিত না হলেও সম্ভবত খুবই চিন্তিত হয়ে পড়বে। কিন্তু, তবু, ওই ঝুঁকি তাকে নিতে হবে।
যখন সে খাট থেকে প্রায় অর্ধেক বার হয়ে এসেছে—এই নতুন পদ্ধতিটা বিশেষ একটা প্রয়াসের চাইতে তার কাছে অনেকটা খেলার মতোই বেশি মনে হল, কারণ এখন শুধু দুলতে দুলতে নিজের দেহটা একটু একটু করে সরিয়ে নিয়ে আসা—তখন তার হঠাৎ মনে পড়ল সে যদি একটু সাহায্য পেত তাহলে ব্যাপারটা কত সহজ হয়ে যেত। দুজন শক্তিশালী মানুষ—বাবা আর কাজের মেয়েটির কথা মনে পড়ল তার—থাকলেই যথেষ্ট হত। তার পিঠের নিচ দিয়ে ওদের বাহু ঢুকিয়ে তাকে খাট থেকে তুলে নিচে নামিয়ে দিলেই হবে, তারপর ওরা একটু ধৈর্য ধরে থাকলে সে নিজেই মেঝের উপর তার শরীরটাকে উল্টে নিতে পারবে, তার আশা আছে যে ততক্ষণে ওর পাগুলো নিজেদের স্বাভাবিক। কর্মক্ষমতা ফিরে পাবে। তাহলে, তালাবন্ধ দরজাকে উপেক্ষা করে ওর কি সাহায্যের জন্য চেঁচিয়ে ওঠা উচিত? নিজের দুর্দশা সত্ত্বেও এ-কথা ভেবে সে হাসি চাপতে পারল না।
এখন ও এতখানি এগিয়ে গেছে যে দেহের ভারসাম্য আর প্রায় রাখতে পারছিল, সে সজোরে নিজেকে একটা দোলা দিল, শিগগিরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য তার স্নায়ুকে শক্ত করে নিতে হবে, কারণ আর পাঁচ মিনিট পরেই সোয়া সাতটা বেজে যাবে—আর ঠিক তক্ষুনি সামনের দরজায় ঘণ্টি বেজে উঠল। আপন মনে সে বলল, ওই যে আপিস থেকে লোক এসেছে; তার শরীর শক্ত টানটান হল, শুধু তার ছোট ছোট পাগুলো আগের চাইতেও দ্রুতবেগে নড়তে লাগল। একটুখানি সময়ের জন্য পূর্ণ নীরবতা বিরাজ করল। একটা যুক্তিহীন আশায় বুক বেঁধে গ্রেগর মনে মনে বলল, ওরা দরজা খুলবে না। কিন্তু না, কাজের মেয়েটি তার স্বভাবসিদ্ধ ভারী পা ফেলে বাইরের দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে সেটা খুলে দিল। দর্শনার্থীর প্রথম সুপ্রভাত কথাটি শোনামাত্র গ্রেগর বুঝতে পারল কে এসেছে—মুখ্য কেরানি স্বয়ং। কী ভাগ্য! সামান্যতম বিচ্যুতি যেখানে গভীরতম সন্দেহের জন্ম দেয়। সেইরকম একটি ফার্মে তাকে কাজ করতে হচ্ছে! সকল কর্মচারীই কি হাড় বজ্জাত? তাদের মধ্যে কি এমন একজনও বিশ্বস্ত নিবেদিতচিত্ত মানুষ থাকতে পারে না যে ফার্মের ঘণ্টাখানেক সময় অপচয় করার জন্য বিবেকের দংশনে প্রায় পাগল। হয়ে যেতে পারে, যে সত্যি সত্যি তার শয্যা ত্যাগ করতে অক্ষম? যদি খোঁজ নেয়ার দরকারই হয় তাহলে কি একজন শিক্ষানবিশকে পাঠালেই চলত না? স্বয়ং মুখ্য কেরানিকেই আসতে হবে, যেন সমস্ত পরিবারের সামনে, একটি নিরপরাধ পরিবারের সামনে, এই ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেয়া যায় যে এই রকম সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে তার চাইতে কম অভিজ্ঞ কাউকে খোঁজ নেবার জন্য পাঠানো যায় না? এবং অন্য কোনো সক্রিয় ইচ্ছার চাইতে এইসব ভাবনাপ্রসূত। উত্তেজনার ফলেই সে তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে নিজেকে বিছানার বাইরে ঠেলে ফেলতে সক্ষম হল। ধপ করে একটা শব্দ হল, বেশ জোরেই, কিন্তু চুরমার করার মতো প্রচণ্ড জোরে নয়। কার্পেটটা তার পতনের বেগ কমিয়ে দিল, আর তার পিঠও যে যতটা ভেবেছিল ততটা টানটান মনে হল না। ফলে একটা স্থূল ধপাস শব্দ হল শুধু, তেমন চমকাবার মতো কিছু নয়। কেবল সে যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে তার মাথা উঁচু করে ধরতে পারেনি, তাই সেখানে একটু চোট পেয়েছে। সে মাথাটা ঘুরিয়ে ব্যথা আর বিরক্তিতে কার্পেটের উপর ঘষল সেটা।
মুখ্য কেরানি বাঁ পাশের ঘর থেকে বলে উঠল, ওখানে কী একটা পড়ার শব্দ হল। গ্রেগর মনে মনে ভাবতে চেষ্টা করল আজ তার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা যেন কোনো-একদিন মুখ্য কেরানির ভাগ্যে ঘটে। এমন-যে ঘটতে পারে তা কারো পক্ষে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই অনুমানের কড়া প্রতিবাদরূপেই যেন পাশের ঘর থেকে মুখ্য কেরানির দৃঢ় পদক্ষেপের শব্দ শোনা গেল, তার পেটেন্ট চামড়ার বুটজুতোর মচমচ আওয়াজ উঠল। ডান পাশের ঘরের দিক থেকে তার। বোন তাকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করার জন্য ফিসফিস করে বলল, গ্রেগর, মুখ্য কেরানি এসেছেন। গ্রেগর আপনমনে অস্ফুট কণ্ঠে বলল, জানি; কিন্তু সে গলা উঁচু করতে সাহস পেল না আর তাই তার বোন ওর কথা শুনল না।
এবার তার বাবা বাঁ পাশের ঘর থেকে বললেন, গ্রেগর, মুখ্য কেরানি সাহেব এসেছেন, তিনি জানতে চান তুমি ভোরের ট্রেনটা ধরনি কেন? আমরা তাকে কী। বলব জানি না। তাছাড়া তিনি মুখোমুখি নিজে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান। দয়া করে দরজা খোল। তোমার ঘরের অগোছালো অবস্থার জন্য তিনি কিছু মনে করবেন না। ইতোমধ্যে মুখ্য কেরানি অমায়িক কণ্ঠে সম্ভাষণ জানালেন, সুপ্রভাত, মি. সামসা। বাবা তখনও দরজার ওপাশ থেকে তাকে লক্ষ করে কথা বলছেন, আর একইসঙ্গে তার মা মুখ্য কেরানিকে উদ্দেশ করে বললেন, ওর শরীর ভালো নেই। বিশ্বাস করুন, ও অসুস্থ। তা না হলে ও কী জন্য ট্রেন মিস করবে? কাজ ছাড়া ওর মাথায় আর কোনো ভাবনা নেই। সন্ধ্যায় কোথাও বেড়াতে বেরোয় না; মাঝে মাঝে আমি তো চটে যাই। গত আট দিনের মধ্যে ও একদিন বিকেলেও বাইরে যায়নি। চুপচাপ টেবিলে বসে সে হয় খবরের কাগজ পড়ে, নয়তো রেলওয়ে টাইমটেবিলের পাতা উল্টেপাল্টে দেখে। একমাত্র টুকটাক হাতের কাজ করে সে যা আনন্দ পায়। এই-তো, দুতিন দিন ধরে বিকেলে কাজ করে সে ছোট্ট একটা ছবির ফ্রেম তৈরি করেছে, কী চমৎকার যে হয়েছে আপনি দেখলে বুঝবেন। এক্ষুনি গ্রেগর দরজা খুললেই দেখতে পারেন; ওর ঘরে ঝুলিয়ে রেখেছে। আপনি আসায় আমি সত্যি খুশি হয়েছি, স্যার। আমাদের কথায় ও কিছুতেই দরজা খুলত না, ভীষণ একরোখা ও। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে ও অসুস্থ, কিন্তু আজ সকালে ও সে-কথা মানতেই চাইছে না। গ্রেগর ধীরে ধীরে খুব সাবধানে বলল, আমি এক্ষুনি আসছি। পাছে ওদের কথাবার্তা শুনতে না-পায় সেই ভয়ে ও দরজার কাছ থেকে এক ইঞ্চি নড়ল না। মুখ্য কেরানি বললেন, আমি-তো, ম্যাডাম, আর অন্য কোনো কারণের কথা ভাবতে পারছি না। আশা করি সিরিয়াস কিছু নয়। অবশ্য, অন্য দিক থেকে, আমাকে এ-কথাও বলতে হবে যে আমাদের ব্যবসায়ীদের, সৌভাগ্যবশতই বলুন কিংবা দুর্ভাগ্যবশতই বলুন, ছোটখাটো অসুস্থতা উপেক্ষা করতে হয়, কারণ ব্যবসা-সংক্রান্ত কাজকর্ম তো আর ফেলে রাখা যায় না। গ্রেগরের বাবা অধৈর্য হয়ে দরজায় আবার ধাক্কা দিয়ে বললেন, তো, মুখ্য কেরানি সাহেব কি এখন ঢুকতে পারবেন? গ্রেগর বলল, না। এই অস্বীকৃতির কথা শুনে বাঁ-দিকের ঘরে একটা বেদনাদায়ক নীরবতা নেমে এল আর ডান দিকের ঘরে তার বোন ডুকরে কাঁদতে শুরু করল।
তার বোন অন্যদের সঙ্গে যোগ দেয়নি কেন? হয়ত এইমাত্র সে বিছানা ছেড়ে উঠেছে, এখনও হয়ত কাপড়জামা পরতেই আরম্ভ করেনি। তো, সে কাঁদছে কেন? সে যে উঠে মুখ্য কেরানিকে ঘরে ঢুকতে দিতে পারছে না সেজন্য, নাকি তার চাকরি খোয়াবার সম্ভাবনা আছে সেজন্য? নাকি মুখ্য কেরানি আবার সেই পুরনো ঋণের জন্য তার মা-বাবাকে অস্থির করে তুলবেন সেজন্য? এই মুহূর্তে ওসব জিনিস নিয়ে নিশ্চয়ই মাথা ঘামাবার দরকার নেই। গ্রেগর এখনও বাড়িতে আছে, আর তার পরিবারকে ত্যাগ করার কথা সে একটুও ভাবছে না। সত্য বটে, এই মুহূর্তে, সে কার্পেটের উপর শুয়ে আছে এবং তার বর্তমান অবস্থার কথা জানা থাকলে কেউ নিশ্চয়ই আশা করতে পারত না যে গ্রেগর এখন দরজা খুলে মুখ্য কেরানিকে ঘরে ঢুকতে দেবে। কিন্তু এই রকম সামান্য অসৌজন্যের জন্য, যার কারণ কি-না, পরে কোনো-একসময় পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেয়া যাবে, গ্রেগরকে নিশ্চয়ই তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত করা চলে না? গ্রেগরের মনে হল এখন কান্নাকাটি আর অনুরোধ-উপরোধ না করে তাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিলেই সেটা সঙ্গত হত। অবশ্য নিজেদের অনিশ্চয়তা তাদেরকে বিভ্রান্ত করে দিয়েছিল এবং সেজন্য তাদের আচরণ অবশ্য ক্ষমার্হ।
এবার মুখ্য কেরানি আরেকটু গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, মি. সামসা, আপনার কী হয়েছে? ঘরের মধ্যে আছেন আপনি, দরজা বন্ধ করে রেখেছেন, শুধু হাঁ কিংবা না বলে প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন, মা-বাবাকে অনর্থক কষ্ট দিচ্ছেন। আর, এটা অবশ্য এমনি প্রসঙ্গক্রমে বলছি, অবিশ্বাস্যভাবে আপনি আপনার ব্যবসায়িক দায়িত্ব অবহেলা করছেন। আমি আপনার মা-বাবার নামে, আপনার কর্মাধ্যক্ষের নামে, জিজ্ঞাসা করছি, আমি মিনতি করছি, আপনি এক্ষুনি আপনার আচরণের। একটা পরিষ্কার ব্যাখ্যা দিন। আপনি আমাকে অবাক করছেন, সত্যি অবাক করছেন। আমি আপনাকে ভেবেছিলাম একজন চুপচাপ নির্ভরযোগ্য মানুষ, আর। এখন আপনি হুট করে এই ধরনের একটা বিশ্রী আচরণ করতে শুরু করে দিলেন? আপনার হাওয়া হয়ে-যাওয়ার একটা সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে অবশ্য কর্মাধ্যক্ষ আজ সকালে আমাকে একটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন—সম্প্রতি ক্যাশ পেমেন্টের জন্য আপনার জিম্মায় যে টাকা দেয়া হয়েছে তার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন তিনি—কিন্তু আমি এরকম জোর দিয়ে বলেছি যে এটা হতেই পারে না। কিন্তু এখন, আপনার অবিশ্বাস্য গোয়ার্তুমি প্রত্যক্ষ করার পর, আপনার। পক্ষাবলম্বনের আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। আর ফার্মে আপনার অবস্থানও তেমন সুদৃঢ় নয়। আমি গোপনে আপনাকে এ-কথা বলার ইচ্ছা নিয়ে এখানে এসেছিলাম; কিন্তু আপনি যখন এইভাবে অনর্থক আমার সময় নষ্ট করছেন তখন আপনার মা-বাবাও সব কথা শুনুক। কিছুদিন যাবৎ আপনার কাজকর্ম খুবই অসন্তোষজনক হচ্ছিল। স্বীকার করি যে বর্তমান মৌসুম খুব একটা চুটিয়ে ব্যবসা করার সময় নয়, তবু কোনো ব্যবসাই করা যাবে না তা তো হতে পারে না। তা হতে পারে না, মি. সামসা। এবার উত্তেজনায় আত্মবিস্মৃত হয়ে, সব। কিছু ভুলে গিয়ে, গ্রেগর বলে উঠল, কিন্তু স্যার, আমি তো এক্ষুনি দরজা খুলে দিচ্ছি। সামান্য একটু অসুস্থতা, হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গেল, তাই আমি বিছানা থেকে উঠতে পারিনি। এখনও আমি বিছানায় শুয়ে আছি। কিন্তু এখন ভালো লাগছে শরীর। উঠে পড়ছি এক্ষুনি। আর দুএক মিনিট সময় দিন আমাকে! নাহ্, যতটা ভালো ভেবেছিলাম ততটা ভালো নেই আমি। কিন্তু আসলে ঠিকই আছি। কিন্তু ওই রকম সামান্য একটা জিনিস কীভাবে একজনকে এমন কাবু করে ফেলতে পারে! কাল রাতেই তো আমি সম্পূর্ণ ঠিক ছিলাম, আমার মা-বাবা আপনাকে সে-কথা বলতে পারবেন, অবশ্য কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে তার একটু আভাস পেয়েছিলাম ঠিকই। তার কিছু লক্ষণ নিশ্চয়ই আমার আচরণে ফুটে উঠেছিল। এ-কথা আমি আপিসে রিপোর্ট করিনি কেন? কারণ মানুষ সবসময়ই ভাবে যে বাড়িতে বসে না-থেকেও অসুস্থতা সারিয়ে তোলা যায়। স্যার, আমার বাবা-মাকে রেহাই দিন। আমাকে যে-কথা বলে আপনি তিরস্কার করছেন তার কোনো ভিত্তি নেই। আমাকে কেউ এর বিন্দুবিসর্গও আগে বলেনি। সম্ভবত আমি যে সর্বশেষ অর্ডারগুলো জোগাড় করেছি তাও আপনি দেখেননি। যাই হোক, আমি এখনও আটটার ট্রেন ধরতে পারব। এই কয়েক ঘণ্টার বিশ্রামে আমার উপকারই হল। আপনাকে, স্যার, আমি আর আটকে রাখতে চাই না। আমি শিগগিরই কাজে লেগে পড়ব, আপনি দয়া করে সেকথা কর্মাধ্যক্ষের কাছে। গিয়ে বলুন, এবং আমার ক্ষমা প্রার্থনার কথা তাকে জানান।
হুড়মুড় করে গ্রেগর কথাগুলো বলল, কী যে বলছে তার সঠিক জ্ঞানও নেই, আর বলতে বলতে সে বেশ সহজে সিন্দুকটার কাছে পৌঁছে গেল। শুয়ে শুয়ে যে অভ্যাস করেছিল, বোধহয় সেজন্যই এটা সম্ভব হল। এখন সে তার সাহায্যে নিজেকে উপরে তুলতে চেষ্টা করল। সে সত্যি সত্যি দরজা খুলে দিতে চাইল, নিজেকে দেখাতে ও মুখ্য কেরানির সঙ্গে কথা বলতে চাইল। তাদের ওই রকম পীড়াপীড়ির পর তাকে দেখে ওদের কী প্রতিক্রিয়া হয় সেটা জানতে চাইল ও। তারা যদি ভয়ে। শিউরে ওঠে তাহলে তার আর দায়দায়িত্ব থাকবে না, তখন সে চুপচাপ পড়ে থাকতে পারবে। কিন্তু তারা যদি শান্তভাবে ব্যাপারটা মেনে নেয় তাহলে তার অস্থির হবার কোনোই কারণ থাকবে না। তখন তাড়াহুড়া করলে সে সত্যি সত্যি স্টেশনে গিয়ে আটটার ট্রেনটা ধরতে পারবে। প্রথমদিকে সে কয়েকবার সিন্দুকের মসৃণ গা বেয়ে পিছলে পড়ে গেল, কিন্তু অবশেষে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সোজা দাঁড়াতে সক্ষম হল। শরীরের নিমাংশের যন্ত্রণাকে সে আর আমল দিল না, যদিও তা খুব জ্বালা করছিল। এরপর সে নিজেকে নিকটবর্তী একটা চেয়ারের পেছন দিকে নামিয়ে এনে তার ছোট ছোট পাগুলো দিয়ে তার কিনারা আঁকড়ে ধরল। এর ফলে সে আবার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেল, এবং নিজে কথা বলা বন্ধ করল, কারণ এখন সে মুখ্য কেরানির কথা শুনতে পাচ্ছে।
মুখ্য কেরানি বলছিলেন, আপনারা ওর কথা কিছু বুঝতে পেরেছেন? ও নিশ্চয়ই আমাদের সবাইকে বোকা বানাবার চেষ্টা করছে না? তার মা কাঁদতে-কাঁদতে বললেন, উহ, ভগবান, ও হয়ত ভীষণ অসুস্থ আর আমরা ওকে এইভাবে কষ্ট দিচ্ছি! গ্রেটা! গ্রেটা! ওপাশ থেকে তার বোন জবাব দিল, কী, মা? গ্রেগরের ঘরের দুদিক থেকে তারা চিৎকার করে একে অন্যের সঙ্গে কথা বলছে। তোমাকে এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। গ্রেগরের শরীর খারাপ। তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডেকে আনে। ও কীভাবে কথা বলছিল শুনেছ? মায়ের তীক্ষ্ণ্ণ স্বরের পাশে, চোখে পড়ার মতো নিচু গলায়, মুখ্য কেরানি বললেন, ওটা কোনো মানুষের কণ্ঠস্বর নয়। আর বাবা হাততালি দিয়ে, হলঘরের মধ্য দিয়ে রান্নাঘরের উদ্দেশে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলেন, আনা! আনা! এক্ষুনি একটা তালা খোলার লোক নিয়ে এস! তরুণী দুটি স্কার্টের হুশহুশ শব্দ তুলে ইতোমধ্যে হলঘরের ভেতর দিয়ে ছুটতে শুরু করেছে—তার বোন এত তাড়াতাড়ি পোশাক পরতে পারল কীভাবে?—সামনের দরজা সশব্দে খুলে ওরা বেরিয়ে গেল। দরজাটা বন্ধ করার কোনো শব্দ হল না? স্পষ্টতই, কোনো বাড়িতে বিরাট একটা দুর্যোগ ঘটার পর যেমন হয় তেমনিভাবে ওরা দরজা খোলা রেখে চলে গেছে।
কিন্তু গ্রেগর এখন অনেক বেশি সুস্থির। তার কথা, আপাতদৃষ্টিতে, এখনও বোঝা যাচ্ছে না, যদিও তার নিজের কাছে তা বেশ স্পষ্ট মনে হচ্ছে, এমনকি আগের চাইতেও বেশি স্পষ্ট, সম্ভবত ওই ধ্বনির সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার জন্যই। যাই হোক, ওরা এখন বিশ্বাস করেছে যে তার একটা কিছু বিপর্যয় ঘটেছে এবং ওরা তাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। সেই উদ্দেশ্যে ওরা যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার সুস্পষ্ট নিশ্চয়তা তাকে আশ্বস্ত করল। তার মনে হল আবার তাকে মানুষের বৃত্তের মধ্যে টেনে নেয়া হয়েছে। ডাক্তার আর তালাঅলা উভয়েই বিরাট ও তাৎপর্যপূর্ণ কিছু করতে পারবে বলে তার আশা হল, যদিও ওই দুজনের মধ্যে যথার্থ পার্থক্য যে কী তা সে বুঝে উঠতে পারছিল না। অত্যাসন্ন চূড়ান্ত সংলাপের জন্য তার কণ্ঠস্বরকে যতটা সম্ভব স্পষ্ট করার লক্ষ্যে সে একটু গলা-ঝেড়ে নিল, অবশ্য যথাসম্ভব আস্তে, কারণ, সে যা বুঝতে পারছে, তাতে তার ওই গলা ঝাড়ার শব্দও কোনো মানুষের গলা-ঝাড়ার মতো শোনাল না। ইত্যবসরে পাশের ঘরে বিরাজ করতে শুরু করেছিল সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতা। হয়ত তার মা-বাবা মুখ্য কেরানিকে নিয়ে টেবিলে বসে আছেন, ফিসফিস করে কথা বলছেন, হয়ত তারা সবাই দরজার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, কান পেতে শুনছেন।
গ্রেগর ধীরে ধীরে চেয়ারটা দরজার কাছে ঠেলে নিয়ে গেল, তারপর সেটা ছেড়ে দরজাটা ধরল, যেন পড়ে না যায়—তার ছোট ছোট পায়ের তলা কেমন আঠাল হয়ে গেছে—তারপর এতখানি পরিশ্রম করার পর দরজার গায়ে হেলান দিয়ে সে এক মুহূর্ত বিশ্রাম করল, এবং তারপর নিজের মুখ দিয়ে দরজার চাবিটা ঘোরাবার কাজে মনোনিবেশ করল। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত মনে হল তার কোনো দাঁত নেই—তাহলে সে কী করে চাবিটা শক্ত করে ধরবে?—পক্ষান্তরে তার চোয়াল খুবই শক্তিশালী; তার সাহায্যে সে চাবিটা নাড়াতে সক্ষম হল, অবশ্য সেটা করতে গিয়ে সে তার চোয়ালকে কোনো এক জায়গায় নিঃসন্দেহে জখম করল, বাদামি একটা রস সেখান থেকে বেরিয়ে চাবির উপর দিয়ে গড়িয়ে টিপটিপ করে মেঝেতে পড়ল, কিন্তু সেদিকে কোনো নজর দিল না সে। মুখ্য কেরানি পাশের ঘর থেকে বললেন, ওই শুনুন, ও চাবি ঘোরাচ্ছে। কথাগুলো গ্রেগরকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করল। কিন্তু ওদের সবারই উচিত ছিল তাকে উৎসাহ দেয়া, তার বাবা আর মায়েরও। ওদের বলতে হত, চেষ্টা করতে থাক, গ্রেগর। চেষ্টা করতে থাক, চাবিটা শক্ত করে আঁকড়ে থাক। ওরা তার সকল প্রয়াস মন দিয়ে অনুসরণ করছে এই বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে তার সর্বশক্তি দিয়ে মরিয়া হয়ে তার চোয়ালের সাহায্যে চাবিটা চেপে ধরল। চাবির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সে তালার চারদিকে বৃত্তাকারে ঘুরতে লাগল, এখন শুধু মুখ দিয়ে ধরে আছে, প্রয়োজন অনুযায়ী কখনও চাবিটা ঠেলছে, কখনও শরীরের সমস্ত ভার দিয়ে নিচে টেনে নামাচ্ছে। তালা খুলে যাবার অপেক্ষাকৃত বড় আওয়াজটা পাবার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেগর আক্ষরিকভাবে প্রবল উত্তেজনা অনুভব করল। স্বস্তির একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে সে মনে মনে বলল, তো, তালাঅলা আর আনার দরকার হল না। তারপর দরজাটা হাট করে খুলে দেবার উদ্দেশ্যে সে তার হাতলের উপর নিজের মাথা স্থাপন করল।
দরজাটা তাকে ভেতর দিকে টেনে খুলতে হল তাই সেটা সম্পূর্ণ খোলার পর সে দৃষ্টির আড়ালে থেকে গেল। জোড়া-দরজার কাছের দিকটার পাশ দিয়ে তাকে ধীরে ধীরে, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ঘুরে, সামনে আসতে হল, যেন চৌকাঠে ধাক্কা লেগে চিৎ হয়ে পড়ে না যায়। এই কঠিন কাজটা করতে সে এত ব্যস্ত থাকল যে আর কোনো দিকে নজর দেবার সময় পেল না। হঠাৎ সে মুখ্য কেরানিকে উচ্চকণ্ঠে একটা ওহ! ধ্বনি করে উঠতে শুনল—মনে হল যেন একটা দমকা হাওয়ার শব্দ হল। এবার সে তাকে দেখতে পেল, দরজার সবচাইতে কাছে ছিলেন তিনি, হাঁ-হয়ে যাওয়া, মুখের উপর তিনি একটা হাত চাপা দিয়েছেন, তারপর আস্তে আস্তে পেছনে সরে যাচ্ছেন যেন কোনো অদৃশ্য চাপ তাঁকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। তার মা-মুখ্য কেরানির উপস্থিতি সত্ত্বেও তার চুল তখনও বাঁধা হয়নি, চারদিকে এলোমেলো উঁচু হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে—প্রথমে নিজের মুখে। হাত-চাপা দিয়ে ওর বাবার দিকে তাকালেন, তারপর গ্রেগরের দিকে দুপা এগিয়েই মেঝের উপর পড়ে গেলেন। বুকের উপর ঝুলেপড়া তার মুখ এখন প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। বাবা একটা ভয়ঙ্কর মুখভঙ্গি করে নিজের হাত মুষ্ঠিবদ্ধ। করলেন, যেন গ্রেগরকে ধাক্কা দিয়ে ঘরের মধ্যে পাঠিয়ে দেবেন, তারপর তিনি। বিমূঢ়ভাবে বসবার ঘরের দিকে তাকিয়ে দু-হাত দিয়ে চোখ ঢেকে হুহু করে কেঁদে উঠলেন। তাঁর বিশাল বক্ষ ফুলে ফুলে উঠল।
গ্রেগর তখন আর বসবার ঘরে গেল না। দরজার শক্ত করে বন্ধ-করা অংশটার ভেতর দিকে হেলান দিয়ে দাঁড়াল সে। তার দেহের শুধু অর্ধেকটা এখন দেখা যাচ্ছে। দরজার ওপর দিয়ে মাথাটা একপাশে নিচু করে সে অন্যদের দেখছে। ইতোমধ্যে আলো আরও জোরাল হয়েছে। রাস্তার ওপারে, ঠিক উল্টো দিকে, দীর্ঘ নিরানন্দ ধূসর অফুরন্ত দালানটার একটা অংশ এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওটা একটা হাসপাতাল—নিয়মিত ছেদ দিয়ে সারি সারি জানালা বসানো রয়েছে সেখানে। তখনও বৃষ্টি পড়ছে, বড় বড় ফোঁটায়, আলাদা আলাদা করে লক্ষ করা যায়, আক্ষরিকভাবে একটা একটা করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাচ্ছে। টেবিলের উপর নাশতার বিপুল আয়োজন করা রয়েছে। গ্রেগরের বাবার জন্য সকালের নাশতাই হল দিনের প্রধান আহারপর্ব। অনেকগুলো খবরের কাগজ হাতে নিয়ে তিনি নাশতার টেবিলে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেন। গ্রেগরের ঠিক উল্টো দিকের দেয়ালে সামরিক পোশাক পরিহিত তার একটা ফটো ঝুলছে, লেফটেনান্টের পোশাক, তরবারির উপর হাত রাখা, মুখে নিরুদ্বিগ্ন হাসি, যেন তার ইউনিফর্ম আর সামরিক ভাবভঙ্গিকে শ্রদ্ধা জানাবার জন্য সে সবাইকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। হলঘরের দিকের দরজাটা খোলা। সামনে প্রবেশ-পথের দরজাও খোলা, তার ভেতর দিয়ে বাইরে নিচে রাস্তায় নেমে-যাবার সিঁড়ির প্রথম ধাপগুলো চোখে পড়ছে।
গ্রেগর বুঝতে পারল যে একমাত্র তারই মানসিক স্থৈর্য অক্ষুণ্ণ আছে। সেটা ভালোভাবে জেনেই সে বলল, আমি এক্ষুনি কাপড়জামা পরে স্যাম্পলগুলো প্যাক করে, রওনা হব। আপনারা শুধু আমাকে যেতে দেবেন তো? দেখুন, স্যার, আমি মোটেই একগুঁয়ে নই, আমি কাজ করতে ইচ্ছুক, ঘোরাঘুরির জীবন বেশ কঠিন, কিন্তু সেটা ছাড়া আমি বাঁচব না। আপনি কোথায় যাচ্ছেন, স্যার? অফিসে? হ্যা? আপনি আমার ঘটনাটার সত্যি বর্ণনা দেবেন তো? কেউ সাময়িকভাবে অক্ষম হয়ে পড়তে পারে, কিন্তু তখনই তো তার পুরনো দিনের কর্তব্যপালনের কথা স্মরণ করা দরকার, এবং পরে, আবার সক্ষম হয়ে ওঠার পর সে-যে আরও মন দিয়ে আরও অধ্যবসায়ের সঙ্গে কাজ করবে, সে-কথা মনে রাখা উচিত। বড়কর্তার প্রতি অনুগত থেকে দায়িত্বপালন করতে আমি বাধ্য, এ-কথা আপনি বেশ ভালো করে জানেন। আমাকে আমার মা-বাবা ও বোনের ভরণ-পোষণ করতে হবে। আমি মহা অসুবিধায় আছি, কিন্তু এটা আমি কাটিয়ে উঠব। পরিস্থিতি এমনিতেই কঠিন, একে আপনি আরও খারাপ করে তুলবেন না। ফার্মে আপনি আমার সপক্ষে কথা বলবেন। আমি জানি যে আমার মতো ভ্রাম্যমাণ কর্মচারীরা সেখানে জনপ্রিয় নয়। লোকে ভাবে যে তারা গাদাগাদা টাকা কামাই করে, আর ফুর্তি করে বেড়ায়। এ দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাবার বিশেষ কোনো কারণ অবশ্য নেই। কিন্তু আপনি, স্যার, স্টাফের অন্যদের চাইতে ব্যাপকতর দৃষ্টিকোণ থেকে জিনিসটা দেখতে পারেন, হ্যাঁ, আপনাকে গোপনে বলছি যে স্বয়ং বড়কর্তার চাইতেও পূর্ণতর ও সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী আপনি। মালিক হবার কারণে বড়কর্তা সহজেই তার কর্মচারীদের কোনো একজনের বিরুদ্ধে ভ্রান্ত মতামত পোষণ করতে পারেন। আর আপনি তো ভালো করেই জানেন, বাইরে বাইরে ঘুরতে হয় বলে ভ্রাম্যমাণ কর্মচারীকে আপিসে প্রায় সারা বছর ধরে দেখাই যায় না; নানারকম গুজব, অসমর্থিত অভিযোগ আর দুর্ভাগ্যের সহজ শিকারে পরিণত হয় সে, যার প্রায় কিছুই সে জানতে পারে না; এবং তখন এর কুফল ভোগ করতে হয় তাকে, অথচ সমস্ত ব্যাপারটার; মূল ও প্রাথমিক কারণগুলোর হদিশ সে আর পায় না। স্যার, স্যার, আপনি-যে মনে করেন যে আমি ঠিক কথা বলছি অন্তত কিছু পরিমাণে, সেটা বোঝাবার জন্য একটা কিছু না-বলে চলে যাবেন না!
কিন্তু গ্রেগর মুখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে মুখ্য কেরানি পিছু হটে গিয়েছিলেন। আঁকুপাঁকু করা কাঁধের উপর দিয়ে তিনি বিস্ফারিত মুখে চোখ বড় বড় করে তাকে লক্ষ করলেন। যতক্ষণ গ্রেগর কথা বলছিল ততক্ষণ তিনি এক মুহূর্তের জন্যও এক জায়গায় স্থির হয়ে না-দাঁড়িয়ে, চুপি চুপি গ্রেগরের উপর থেকে চোখ না তুলে, ইঞ্চি ইঞ্চি করে, বাইরের দরজার দিকে সরে যেতে থাকেন, যেন এই ঘর ছেড়ে চলে যাবার কোনো একটা গোপন নির্দেশ পালন করছেন তিনি। ইতোমধ্যে তিনি হলকক্ষে পৌঁছে গেছেন। তারপর যে রকম দ্রুত আকস্মিকতার সঙ্গে তিনি বসবার ঘর থেকে তাঁর শেষ পদক্ষেপটি নিলেন তাতে মনে হতে পারত যে তাঁর পায়ের তলা বুঝি পুড়ে যাচ্ছে। হলকক্ষে পৌঁছে তিনি তাঁর সামনের সিঁড়ির দিকে নিজের ডান বাহু প্রসারিত করে দিলেন, যেন কোনো দৈবশক্তি তাঁকে মুক্তি দেবার জন্য সেখানে অপেক্ষা করছে।
গ্রেগর উপলব্ধি করল যে মুখ্য কেরানিকে তার মনের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কিছুতেই এখান থেকে চলে যেতে দেয়া যাবে না, তাহলে ফার্মে গ্রেগরের অবস্থান ভীষণ বিপদের সম্মুখীন হবে। তার বাবা-মা এ-কথা তেমনভাবে বুঝতে পারছেন না। তাঁদের ধারণা গ্রেগর ওই ফার্মে সারাজীবনের জন্য পাকাঁপাকিভাবে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। তাছাড়া নিজেদের তাৎক্ষণিক বহু ঝামেলা নিয়ে তাঁরা এত ব্যস্ত থাকতেন যে ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি দেবার মতো অবস্থা তাদের ছিলই না। কিন্তু গ্রেগরের সে ভবিষ্যদৃষ্টি ছিল। মুখ্য কেরানিকে আটকে রাখতেই হবে, তাকে শান্ত করে ব্যাপারটা ভালো করে বোঝাতে হবে, এবং শেষপর্যন্ত তাকে তার নিজের দলে আনতে হবে। গ্রেগর আর তার পরিবারের সমস্ত ভবিষ্যৎ এটার ওপর নির্ভর করছে। শুধু তার বোন যদি এখানে থাকত! গ্রেগর যখন চুপ করে চিৎ হয়ে মাটিতে পড়ে ছিল তখন তার বোন কাঁদতে আরম্ভ করে। আর মুখ্য কেরানি, মেয়েদের প্রতি সবসময় যার পক্ষপাতিত্বের কথা সর্বজনবিদিত, নিঃসন্দেহে তার বোনের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হত। তার বোন ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে দিয়ে মুখ্য কেরানির সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাকে আতঙ্কমুক্ত করত। কিন্তু সে এখানে নেই, এখন গ্রেগরকেই পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে, এককভাবে এবং এখনও নড়েচড়ে বেড়াবার কতটুকু ক্ষমতা তার আছে সে সম্পর্কে অসচেতন থাকা সত্ত্বেও, এমনকি তার কথাবার্তা আগের মতো এখনও হয়ত, হয়ত কেন প্রায় নিশ্চিতভাবে বোধের অগম্য হবে এ-কথা স্মরণ না-করেই, সে দরজার পাল্লাটা ছেড়ে দিয়ে তার ফাঁক দিয়ে নিজেকে সামনে ঠেলে দিল, হাঁটতে শুরু করল মুখ্য কেরানির দিকে, যিনি ইতোমধ্যে সিঁড়ির রেলিংয়ের উপর দুহাত দিয়ে হাস্যকরভাবে ঝুলতে আরম্ভ করেছিলেন। কিন্তু, তক্ষুনি, যখন ভর দেবার জন্য সে কিছু একটা খুঁজছে, ঠিক সেই সময়, ছোট্ট একটা চিৎকার করে গ্রেগর মাটিতে তার পাগুলোর উপর পড়ে গেল। নিচে পড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু সে আজ সকালে এই প্রথমবারের মতো একটা শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্যের ভাব অনুভব করল; তার পায়ের নিচে মাটি মনে হল শক্ত; পাগুলো যে এখন তার সম্পূর্ণ অনুগত এই উপলব্ধি তাকে আনন্দিত করল। যেদিকে ইচ্ছা এখন তাকে সেই দিকে নিয়ে যেতে পর্যন্ত তার পাগুলো চেষ্টা করছে। তার মনে হল তার যাবতীয় কষ্টের বুঝি, শেষপর্যন্ত, উপশম হতে যাচ্ছে। কিন্তু সে ঠিক যে মুহূর্তে দেখল যে সে মেঝের উপর পড়ে গেছে, এগিয়ে যাবার অবরুদ্ধ উত্তেজনায় দুলছে একটু একটু করে, ঠিক তক্ষুনি, তার খুব কাছে, বস্তুতপক্ষে একেবারে সামনে দাঁড়ানো তার মা, যাকে দেখে এতক্ষণ মনে হচ্ছিল যে তিনি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছেন, মুহূর্তের মধ্যে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন, এবং দুহাত বাড়িয়ে আঙুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ঈশ্বরের দোহাই, বাঁচাও বাঁচাও! তারপর তিনি নিজের মাথা একটু নিচু করলেন, যেন গ্রেগরকে ভালো করে লক্ষ করতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু সেই সঙ্গে সঙ্গে দুর্বোধ্যভাবে, তিনি পিছু হটে যেতে থাকলেন। পেছনে যে খাবার ভর্তি টেবিল আছে তার কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে তিনি যেন বেখেয়ালে, ঝট করে টেবিলের উপর বসে পড়লেন। এবং যখন ঝাঁকুনি খেলেন, তাঁর পাশের বড় কফির পাত্রটা উল্টে গিয়ে মেঝেতে কার্পেটের উপর কফি পড়ে জায়গাটা ভিজিয়ে দিল, তখনও যেন তাঁর চেতনায় এসব কিছু ধরা পড়ল না।
গ্রেগর নিচু গলায় ডাকল, মা! মা! মায়ের মুখের পানে তাকাল সে। মুখ্য কেরানির কথা মুহূর্তের জন্য সে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিল। তার বদলে, কফির স্রোতধারা দেখার সঙ্গে সঙ্গে সে তার চোয়ালের ওঠানামা কিছুতেই বন্ধ করতে পারল না। এটা দেখে মা আবার চিৎকার করে উঠলেন, টেবিলের কাছ থেকে ছুটে পালাতে গিয়ে তিনি গ্রেগরের বাবার প্রসারিত বাহুর মধ্যে ধরা পড়লেন। ইতোমধ্যে বাবা তাকে ধরবার জন্য দ্রুত ছুটে এসেছিলেন। কিন্তু গ্রেগরের তখন মা-বাবার কথা ভাববার সময় নেই; মুখ্য কেরানি ততক্ষণে সিঁড়িতে পৌঁছে গেছেন; সিঁড়ির রেলিং-এ চিবুক ঠেকিয়ে তিনি শেষবারের মতো পিছনে ফিরে সমস্ত দৃশ্যটা দেখে নিতে চাইলেন। তাঁর সামনে গিয়ে পড়ে তাঁকে আটকাবার উদ্দেশ্যে গ্রেগর একটা লাফ দিল; কিন্তু মুখ্য কেরানি নিশ্চয়ই ওর মতলব বুঝে ফেলেছিলেন, কারণ তিনিও লাফ দিয়ে কয়েক ধাপ সিঁড়ি টপকে চোখের নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তখনো তিনি আহ্ আহ্! করে চেঁচাচ্ছিলেন, আর সিঁড়ি জুড়ে তার চিৎকারের প্রতিধ্বনি উঠছিল।
দুর্ভাগ্যবশত, মুখ্য কেরানির পলায়নের সঙ্গে সঙ্গে গ্রেগরের বাবা ভয়ানক অস্থির হয়ে পড়লেন। এতক্ষণ তিনি মোটামুটি শান্ত ছিলেন; কিন্তু এখন, লোকটার পিছনে নিজে ছুটে না-গিয়ে, অন্তত গ্রেগরকে তার প্রয়াসে বাধা না-দিয়ে, তার পরিবর্তে, তিনি চেয়ারের উপর ফেলে যাওয়া মুখ্য কেরানির বেড়াবার লাঠিটা নিজের ডান হাতে তুলে নিলেন—মুখ্য কেরানি তার টুপি আর ওভারকোটও ফেলে রেখে গিয়েছিলেন—আর বাঁ হাত দিয়ে তিনি টেবিলের উপর থেকে একটা বৃহদাকার খবরের কাগজ তুলে নিয়ে, মেঝেতে পা ঠুকতে ঠুকতে, লাঠি আর কাগজটা উঁচিয়ে ধরে, নাড়তে নাড়তে, গ্রেগরকে তার নিজের ঘরে ঠেলে পাঠিয়ে দিতে চেষ্টা করলেন। গ্রেগরের কোনো কাকুতি-মিনতিতে কাজ হল না, বস্তুতপক্ষে তার কোনো কাকুতি-মিনতি কারো বোধগম্যই হল না, কারণ সে যত নরম হয়ে তার মাথা নিচু করুক না কেন, তার বাবা মেঝেতে ততই আরো জোরে জোরে পা ঠুকতে লাগলেন। বাবার পেছনে দাঁড়ানো তার মা ঠাণ্ডা আবহাওয়া সত্ত্বেও একটা জানালা হাট করে খুলে দিয়ে দুহাতে নিজের মুখ ঢেকে মাথাটা অনেক দূর অবধি বার করে দিলেন। রাস্তা থেকে সিঁড়ি বেয়ে একটা জোর দমকা হাওয়া বয়ে এল, জানালার পর্দাগুলো ফুলে উঠল, টেবিলের উপরকার খবরের কাগজের পাতাগুলো ফরফর করে শব্দ করল, আলগা পাতাগুলো মেঝের উপর ছড়িয়ে পড়ল ইতস্তত। নির্মমভাবে গ্রেগরের বাবা তাকে হুশ। হুশ। হুশ। শব্দ করতে করতে একটা বুনো প্রাণীর মতো ঠেলে পিছনে হটিয়ে দিলেন। কিন্তু গ্রেগর যেহেতু পেছনে হাঁটায় একটুও অভ্যস্ত ছিল না তাই ব্যাপারটা করতে অনেক সময় নিল। যদি সে একবার তার দেহটা ঘোরাবার সুযোগ পেত, তা হলে সে তৎক্ষণাৎ নিজের ঘরে ফেরত চলে যেতে পারত, কিন্তু ওইভাবে ধীরে ধীরে ঘুরতে অনেকখানি সময় নেবে এবং অত সময় নিতে তার সাহস হল না, বাবা ক্ষেপে যাবেন, আর তার বাবার হাতের লাঠি এখন যে কোনো মুহূর্তে তার পিঠে কিংবা মাথায় মারাত্মক আঘাত হানতে পারে। কিন্তু শেষপর্যন্ত তাই করা ছাড়া তার গত্যন্তর থাকল না, কারণ চরম আতঙ্কের সঙ্গে সে আবিষ্কার করল যে পেছনে চলতে গিয়ে সে তার পাগুলোকে কোনো নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত করতে পারছে না, গতিধারার উপর কোনো নিয়ন্ত্রণই আর তার নেই; অতএব, নিজের কাঁধের উপর দিয়ে বাবার মুখের উপর সারাক্ষণ সন্ত্রস্ত চোখ রেখে, সে যতটা সম্ভব দ্রুত গতিতে ঘুরতে শুরু করল, যদিও সেই গতি আসলে ছিল ভীষণ ধীর। বাবা হয়তো তার সদিচ্ছা উপলব্ধি করলেন, কারণ এই প্রক্রিয়ায় তিনি বাধা দিলেন না, বরং মাঝে মাঝে দূর থেকে তার লাঠির মাথা দিয়ে তাকে একটু-আধটু সাহায্য করলেন। শুধু যদি তিনি তার ওই ভয়ঙ্কর হুশ হুশ শব্দটা থামাতেন! ওই শব্দটা গ্রেগরকে দিশাহারা করে দিচ্ছে। সে যখন প্রায় সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়িয়েছে ঠিক তক্ষুনি ওই শব্দটা তাকে এমন বিভ্রান্ত করে দিল যে সে আবার অল্প একটু ভুল দিকে ঘুরে গেল। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে সে যখন তার মাথাটা শেষপর্যন্ত দরজার ঠিক সামনে নিয়ে আসতে সক্ষম হল তখন দেখা গেল যে তার শরীর এত চওড়া যে ওই ফাঁকটুকু দিয়ে সেটা ঢুকবে না। তার বাবা অবশ্য নিজের বর্তমান মানসিক অবস্থায় গ্রেগরকে আরেকটু জায়গা করে দেবার জন্য দরজার অপর অর্ধাংশ খুলে দেবার কথা ভাবতেই পারছিলেন না। তাঁর মনে তখন একটাই চিন্তা, গ্রেগরকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঠেলে নিজের ঘরে ফেরত পাঠিয়ে দিতে হবে। এই পরিস্থিতিতে গ্রেগর যে পায়ের উপর ভর দিয়ে কোনো। রকমে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকে যাবার চেষ্টা করবে তার বাবা সে সময়টুকুও তাকে দিতে আদৌ রাজি নন। হয়তো গ্রেগরকে তাড়া দেবার। আগ্রহে, তার সামনে যেন কোনো বাধা নেই এই ভেবে, তিনি আগের চাইতেও বেশি শব্দ করছিলেন। গ্রেগরের কাছে ওই শব্দ এখন আর কোনো একক পিতার কণ্ঠস্বর বলে মনে হল না। পরিস্থিতি সত্যিই অত্যন্ত সংকটময়। যা হবার তাই হবে, মরিয়া হয়ে গ্রেগর দরজা দিয়ে নিজেকে সজোরে ঠেলে দিল। তার শরীরের একটা দিক উঁচু হলদরজাপথে তার দেহ কাত হয়ে থাকল, একটা পাশ রীতিমতো ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে, সাদা দরজার গায়ে বিশ্রী দাগ পড়ল, শিগগিরই সে ফোকরের মধ্যে শক্ত হয়ে আটকা পড়ল, নিজের চেষ্টায় সে আর নড়তেই পারল না, এক ধারে তার পাগুলো বাতাসে থরথর করে কাঁপছে, অন্য ধারে মেঝের উপর অন্য পাগুলো প্রায় দুমড়ে মুচড়ে গেছে, ভীষণ যন্ত্রণা সেখানে—আর ঠিক তখুনি তার বাবা তাকে একটা জোর ধাক্কা দিলেন, আক্ষরিক অর্থেই সেটা তাকে মুক্তি দিল। সে রক্তাক্ত দেহ নিয়ে ঘরের মধ্যে অনেক দূরে ছিটকে পড়ল। লাঠির আঘাতে তার পেছনে সশব্দে দরজা বন্ধ হয়ে। গেল। আর তারপর, অবশেষে, নামল নীরবতা।