দ্বিতীয় খণ্ড
প্রথম পরিচ্ছেদ – রহস্য গভীর হইল
যমুনাকে দেখা পর্যন্ত নগেন্দ্রনাথের হৃদয় বড়ই চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল। তাহার সুন্দর মুখ তাঁহার হৃদয়ে সুস্পষ্ট অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল। তিনি তাহার কথা ভাবিবেন না মনে করা স্বত্ত্বেও সর্ব্বদাই তাহার মুখ তাঁহার হৃদয়ে উদিত হইতে লাগিল। তিনি গৃহমধ্যে বসিয়া নিজ মনে সুন্দরী যমুনার কথাই ভাবিতেছিলেন। এই সময়ে কাহার পদশব্দে তিনি চমকিত হইয়া ফিরিলেন। দেখিলেন, যমুনাদাস।
তিনি তাঁহাকে বাড়ীর ঠিকানা দিয়া আসিয়াছিলেন। যমুনাদাস তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে কালবিলম্ব করেন নাই। তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “দেখ্ছ, আমি তোমার সঙ্গে দেখা করিতে একদিনও দেরী করি নাই—এস; সেই ছেলেবেলার কথা কহা যাক্।”
নগেন্দ্রনাথের মন ভাল ছিল না—নানা চিন্তায় তাঁহার হৃদয় পূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। কেন এরূপ হইয়াছে, তিনি তাহা বুঝিতে পারিতেছিলেন না। তিনি প্রথমে যমুনাদাসের বাচালতা ও উচ্চ হাস্যে কিছু বিরক্তি বোধ করিলেন; কিন্তু ক্রমে দেখিলেন, তাঁহার সহিত কথোপকথনে নিজের হৃদয় অনেকখানি আনন্দানুভব করিতে লাগিল। ক্রমে দুই বন্ধুতে অনেক হাস্য-পরিহাস চলিল। কৌতুকামোদে অৰ্দ্ধ ঘন্টা অতিবাহিত হইলে নগেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন কি করিতেছ?”
যমুনাদাস হাসিয়া বলিলেন, “এখন ভবঘুরে হয়েছি। বাবার যাহা ছিল, তাহা ফুঁকে দিতে অধিকদিন লাগে নাই। তারপর মা মরে গেলেন, আমিও ভেসে পড়লাম– “
“কাজ-কর্ম্ম কিছুই করিতেছ না?”
“ভগবান্ আমাকে কাজের জন্য বানান নাই। পরিশ্রম? বাপ্–সে আমার যম।”
“তবে চলবে কেমন করে?”
“চলে যায়—ভালই যায়। আবার দেখিতেছ না, শীঘ্রই বিবাহ করিয়া সংসারী হইয়া পড়িতেছি। এইবার ভ্রমণ বন্ধ হইল আর কি—”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তুমি তাহা হইলে অনেক দেশ বেড়াইয়াছ?”
“অনেক দেশ! জগৎ-জুড়ে বলিলে হয়।”
“পঞ্জাবে গিয়াছ?”
“পঞ্জাবে? গ্রামে গ্রামে—পঞ্জাবের কোথায় না গিয়াছি!”
“অমৃতসহরে?”
‘সেখানে একাধিক্রমে ছয়মাস ছিলাম।”
“তাহা হইলে পঞ্জাবের তুমি সব দেখেছ?”
“যাহা দেখা উচিত তাহাও দেখিয়াছি যাহা দেখা অনুচিত তাহাও দেখিয়াছি।”
নগেন্দ্রনাথ শিবলিঙ্গটি টেবিল হইতে বাহির করিয়া যমুনাদাসের সম্মুখে ধরিয়া বলিলেন, “এটা কি বলিতে পার?”
“বাপ্!” বলিয়া যমুনাদাস লাফাইয়া উঠিলেন—চারি পদ সরিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহার মুখ মলিন হইয়া গেল; তিনি বিস্ফারিতনয়নে নগেন্দ্রনাথের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
নগেন্দ্রনাথ তাঁহার ভাব দেখিয়া অত্যন্ত বিস্মিত হইয়াছিলেন। তিনি ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “ব্যাপার কি?”
যমুনাদাস প্রায় রুদ্ধকণ্ঠে বলিলেন, “কি সৰ্ব্বনাশ! তুমি এটা কোথায় পাইলে?”
উমিচাঁদ এই শিবলিঙ্গ দেখিয়া মূৰ্চ্ছা গিয়াছিল। যমুনাও মূৰ্চ্ছা গিয়াছিল। যমুনাদাস মূৰ্চ্ছা না গেলেও অনেকটা সেই রকমই হইলেন। তাঁহার কপালে ঘাম ছুটিল। তিনি কম্পিতকণ্ঠে বলিলেন, “তুমি—তুমি—তুমি কি সেই সম্প্রদায়ের লোক?”
যমুনাদাসের নিকটে এই সম্প্রদায়ের বিষয়ে আরও কিছু জানিবার জন্য নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “কোন্ সম্প্রদায়?”
যমুনাদাস কম্পিতহস্তে সিন্দূররঞ্জিত শিবলিঙ্গটি দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, “এই এটা যাহাদের চিহ্ন?”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আমি তোমায় সত্যই বলিতেছি, আমি এই সম্প্রদায়ের কিছুই জানি না।” এই কথায় যমুনাদাস কতকটা প্রকৃতিস্থ হইলেন। বলিলেন, “আমি মনে করিয়াছিলাম, আমার দফা আজ রফা হল। এখনও দিনকতক বাঁচবার ইচ্ছা আছে।”
“এটা দেখে এমন ভয় করিবার কি আছে?”
“আছে, আমি মনে করিয়াছিলাম, তুমি আমাকে এখনই খুন করিবে। ও দেখলেই লোকে খুন হয়—খুনের চিহ্ন।”
“সত্যই কি তাই?”
“হাঁ, আমি আশ্চৰ্য্য হইতেছি, কেন তুমি এখনও খুন হও নাই। ভাল চাও ত এখনই ওটাকে গঙ্গার জলে ফেলে দিয়ে এস, নতুবা রক্ষা নাই—আমি বলছি, একেবারে রক্ষা নাই।”
যমুনাদাসের কথায় নগেন্দ্রনাথ বিশেষ আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। এই শিবলিঙ্গ সম্বন্ধে বিবরণ বিশেষ অবগত হইবার জন্য ব্যগ্র হইলেন; কিন্তু পাছে তিনি কৌতূহল প্রকাশ করিলে যমুনাদাস কোন কথা না বলে, এইজন্য তিনি প্রথমটা নীরবে রহিলেন।
যমুনাদাস তাঁহার দিকে কিয়ৎক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, “তুমি এটা কোথায় পাইলে?”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “হুজুরীমল যেখানে খুন হইয়াছিলেন, সেইখানেই এটা পাওয়া গিয়াছে, তাঁহার মৃতদেহের কাছেই পড়িয়াছিল।”
যমুনাদাস তাঁহার কথা শুনিয়া অতি অস্পষ্টস্বরে বলিলেন, “এতেই বুঝিতে পারা যাইতেছে, সেই সম্প্রদায়ই তাহাকে খুন করিয়াছে।”
“সম্প্রদায় তাহাকে খুন করিবে কেন?
“কেমন করিয়া জানিব? নিশ্চয়ই কোন কারণে তাহার উপর তাহাদের রাগ হইয়াছিল।”
“এ সম্প্রদায়টা কি? এরা কেন মানুষ খুন করিয়া বেড়ায়?”
যমুনাদাস বলিলেন, “এ সম্প্রদায় সম্বন্ধে যাহা জানি, বলিতেছি।”
এই বলিয়া যমুনাদাস উঠিয়া জানালাটা দেখিয়া আসিলেন। দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিলেন। তাঁহার সেই সশঙ্ক ভাব দেখিয়া নগেন্দ্রনাথ হাসিয়া বলিলেন, “ভয় নাই, এখানে তোমার সম্প্রদায় কিছু করিতে পারিবে না।“
যমুনাদাস বলিলেন, “হুজুরীমলকে এই সহরেই খুন করিয়াছে।”
এই কথায় কেমন আপনা-আপনি নগেন্দ্রনাথেরও প্রাণ কাঁপিয়া উঠিল।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
ক্ষণপরে নগেন্দ্রনাথ নিজ মনোভাব গোপন করিয়া বলিলেন, “এ সম্প্রদায়ের কাজ কি?”
“যা জানি বলিতেছি, এটা একটা ধৰ্ম্মসম্প্রদায়—অন্ততঃ ইহাই লোকে জানে।”
“এ সম্প্রদায়ে কাহারা আছে?”
“ইহাদের সব কাজ গোপনে হয়; এরা কি করে তাহা এরাই জানে। সম্প্রদায়ভুক্ত না হইলে কিছুই জানিবার উপায় নাই।”
“ইহাদের উদ্দেশ্য কি?”
“আমার সব শোনা কথা। ইহারা নাকি কি কার্য্যকলাপ করে, তাহাতে নানা আশ্চর্য্য আশ্চৰ্য্য ক্ষমতা জন্মে।”
“তুমি এদের বিষয় কিরূপে জানিলে?”
“তাহাই বলিতেছি। আমি তখন অমৃতসহরে। একদিন অনেক রাত্রে এক বন্ধুর বাড়ী থেকে বাইনাচ দেখে আমি বাড়ী ফিরিতেছি। পথে তখন জনমানব নাই—চারিদিকে খুব অন্ধকার। এই সময়ে সম্মুখে কাহার আর্তনাদ শুনিলাম; কে কাহাকে যেন মারিতেছে। আমি ছুটিয়া সেইদিকে অগ্রসর হইলাম। আমি দূর হইতে বুঝিলাম, আমার পায়ের শব্দ শুনিয়া দুইজন লোক যেন ছুটিয়া পলাইল।”
“তারপর?”
“তারপর আমি দেখি, একজন লোক রাস্তায় পড়িয়া আছে। লোকটার বুকে কে ছোরা মারিয়াছে—রক্তে তাহার কাপড় ভিজিয়া গিয়াছে। তাহার পাশে দেখি, এইরকম একটা সিঁদুরমাখা শিব।”
“ঠিক এইরকম?”
“ঠিক এইরকম।”
“তারপর আমি সেই শিব কুড়াইয়া লইয়া দেখি, লোকটা ভয়ে অজ্ঞান হইয়াছে। এরূপ অবস্থায় একে পথে ফেলিয়া যাওয়া উচিত নয় ভাবিয়া আমি তাহাকে বাসায় আনিলাম। আমার বাসা সেখান হইতে নিকটেই ছিল।”
“তুমি তখনই পুলিসে খবর দিলে না কেন?”
“সেই লোকটির কাকুতি-মিনতিতে। সে কিছুতেই আমাকে পুলিসে খবর দিতে দিল না। তাহার পরম সৌভাগ্য যে, গায়ে একটা তুলাপোরা জামা ছিল, সেজন্য ছুরি বুকে বসে নাই—কেবল মাংস একটু কাটিয়া গিয়াছিল।”
“তাহার পর সে লোক এ সম্বন্ধে তোমায় কিছু বলিয়াছিল?”
“কিছু কেন? সব। সে এই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল, কোন কারণে দল ছাড়িয়া চলিয়া আসে। তাহাতে সেই দলের লোক ইহার উপর ক্রুদ্ধ হয়। দলের নিকট কোন অপরাধ করিলে তাহার একমাত্র দণ্ড হইতেছে—প্রাণদণ্ড।”
“কে খুন করে?”
“তাহা কেহ জানে না—যাহার উপর ভার পড়ে, তাহাকেই খুন করিতে হয়; না বলিবার যো নাই, তাহা হইলে তাহারও প্রাণদণ্ড।”
“কি ভয়ানক! তারপর?”
“এ লোকটা জানিত যে, তাহার উপর প্রাণদণ্ডের আজ্ঞা হইয়াছে।”
“কেমন করিয়া জানিল?”
“এরূপ প্রাণদণ্ডের হুকুম হইলে সেই লোকের কাছে যেমন করিয়া হউক, এইরূপ একটা শিব আসে। এই শিব আসিলেই সে লোক নিশ্চয়ই বুঝিতে পারে যে, তাহার দিন শেষ হইয়াছে—সমিতির লোক নিশ্চয়ই তাহাকে হত্যা করিবে।”
“কি ভয়ানক!”
“খুন হইলে মৃত ব্যক্তির কাছেও এইরূপ একটা শিব তাহারা রাখিয়া যায়; তাহাতেই সকলে বুঝিতে পারে যে, লোকটা সেই গুপ্ত সমিতির কোন লোকের দ্বারা খুন হইয়াছে।”
“পুলিস ইহাদিগে ধরে না কেন?”
“পুলিস কি করিবে? এ সম্প্রদায়ে কে আছে, এ সম্প্রদায় কোথায়, তাহার কিছুই কেহ জানে না। যাহারা দলে আছে, তাহারা প্রাণ থাকিতে কোন কথা বলে না। পুলিস কিছুই করিতে পারে না।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তারপর কি হইল? সে লোক কোথায় গেল?”
যমুনাদাস বলিলেন, “সে আমার বাড়ীতে কয়েকদিন লুকাইয়া ছিল; কিছুতেই আমাকে তাহার পরিচয় দিল না। শেষে একদিন আমাকে না বলিয়া কোথায় চলিয়া গেল, আর তাহাকে খুঁজিয়া পাইলাম না।”
“এ সম্প্রদায় সম্বন্ধে আর কিছু সন্ধান লইলে না কেন?”
“সন্ধান লওয়া। আমি অমৃতসহর ছাড়িয়া পলাইতে পথ পাই না।”
“কেন হে?”
“সেই শিবটা আমার কাছে ছিল। পরে জানিলাম, যে ইহাদের সম্প্রদায়ের লোক নয়, এমন কোন লোকের কাছে ইহারা এ শিবলিঙ্গ থাকিতে দেয় না। অথচ তাহার সম্মুখে আসিয়া চাহিয়া ও লইতে পারে না——তাহা হইলে সম্প্রদায়ভুক্ত বলিয়া ধরা পড়িবে।”
“তোমার কাছে ছিল বলিয়া তাহারা কি করিল?”
“চার-পাঁচদিন রাত্রে আমাকে খুন করিবার চেষ্টা পাইয়াছিল, তাহার পর বাড়ীতে থাকা অসম্ভব হইয়া উঠিল।”
“কেন?”
“অনেক রাত্রে ক্রমাগত ঢিল পড়ে—হঠাৎ দরজা খুলে যায়—রাত্রে ঘুমাইয়া আছি, কে খাট ধরিয়া নাড়া দেয়—নানারকম উপদ্রব।”
“তাহার পর তুমি কি করিলে?”
“একটি পঞ্জাবের ভদ্রলোক এই ব্যাপার আমার কাছে শুনিয়া আমাকে বলিলেন, “মহাশয়, যদি প্রাণে বাঁচিতে চান, তবে শীঘ্র এটাকে বিদায় করুন। জানেন নাকি, তাহারা সহজে এটা না পাইলে এই সম্প্রদায়ের লোক তাহাকে খুন করিয়া এটা লইয়া যায়।”
এ কথা শুনিয়া নগেন্দ্রনাথের হৃদয় কাঁপিয়া উঠিল, যথার্থই তাঁহার ভয় হইল—নিজ দুর্ব্বলতার জন্য তিনি লজ্জিত হইলেন। বলিলেন, “তুমি সেটা কি করিলে?”
“এ কথা শুনিয়া আমি রাত্রে সেটাকে আমার দরজার পার্শ্বে রাখিয়া দিলাম। সকালে দেখি কে লইয়া গিয়াছে।”
“তাহার পর আর কোন সন্ধান পাইলে?”
“এইসকল ব্যাপারে—সত্য কথা বলিতে কি, আমার মেজাজটা বড় খারাপ হইয়া গিয়াছিল। আমি একেবারে পঞ্জাব থেকে পলাইলাম। প্রাণের মায়া বড় মায়া!”
“এই সম্প্রদায়ের কি অনেক টাকা আছে?”
“শুনেছি, অনেক টাকা আছে। এই টাকা আর কোনখানে জমা রাখে না, একজনের কাছেও রাখে না। সম্প্রদায়ভুক্ত ভিন্ন ভিন্ন লোকের কাছে রাখে।”
“গুরুগোবিন্দ সিং কি এই সম্প্রদায়ভুক্ত একজন??”
কেমন করিয়া জানিব? খুব সম্ভব।”
“এই সম্প্রদায়ের কোন টাকা কি তাহার কাছে আছে?”
“তাহাই বা আমি কিরূপে জানিব? তাহার সঙ্গে আমার আলাপ হুজুরীমলের বাড়ীতে। তবে ভাগবতিকে বোধ হয়, তাহার কাছে সম্প্রদায়ের কিছু টাকা থাকিলেও থাকিতে পারে।”
নগেন্দ্রনাথ, এইবার অক্ষয়কুমারের গাম্ভীর্য্য অনুকরণ করিয়া বলিলেন, “সম্প্রদায়ের দশ হাজার টাকা তাঁহার কাছে ছিল।”
যমুনাদাস নিতান্ত বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “তুমি কেমন করিয়া জানিলে?”
নগেন্দ্রনাথ সেইরূপ গম্ভীরভাবেই বলিলেন, “এই দশ হাজার টাকা গুরুগোবিন্দ সিং হুজুরীমলের নিকটে রাখিতে দিয়াছিল। তিনি এই টাকা তাঁহার সিন্দুকে রাখিয়াছিলেন—সে টাকা চুরি গিয়াছে?”
“কি ভয়ানক! কে চুরি করিল?”
“কেমন করিয়া বলিব? তাহারই সন্ধান হইতেছে, খুনের সঙ্গে চুরির নিশ্চয়ই সম্বন্ধ আছে। তাহাই অক্ষয়বাবু তদন্ত করিতেছেন, তিনি অনুগ্রহ করিয়া আমাকে সঙ্গে লইয়াছেন। তোমার কথা তাঁহাকে বলিয়াছিলাম।”
যমুনাদাস অতিশয় ব্যগ্র হইয়া বলিলেন, “তিনি—তিনি—কি বলিলেন?”
“তিনি তোমাকে দলে লইতে সম্মত হইয়াছেন।”
“দেখিতেছি, তিনি অতি ভদ্রলোক।”
“আমরা যতদূর যাহা জানিয়াছি, তাহা তোমার শোনা উচিত; নতুবা আমাদের কাজে যোগ দিতে পারিবে না।”
“বল—সব আমার শোনা চাই।”
নগেন্দ্রনাথ খুন সম্বন্ধে অক্ষয়কুমার ও তিনি যাহা কিছু সন্ধান করিয়া জানিতে পারিয়াছিলেন, সমস্তই একে একে যমুনাদাসকে বলিলেন। কেবল গঙ্গার হাতে যে অঙ্গুরীয় ছিল এবং গঙ্গা যে গোপনে রাত্রে হুজুরীমলের সহিত দেখা করিত, খুনের দিনও দেখা করিয়াছিল, তাহা বলিলেন না। তিনি জানিতেন, এ কথা তাঁহাকে বলিলে তিনি বিশ্বাস করিবেন না—হাসিয়া উড়াইয়া দিবেন। তিনি গঙ্গার প্রেমাকাঙক্ষী।
সকল কথা যমুনাদাস নীরবে শুনিলেন। নগেন্দ্রনাথের কথা শেষ হইলে তিনি বলিলেন, “এখন এ খুন কে করিয়াছে, তাহা বলা বড় কঠিন নহে।”
তাঁহার কথায় নগেন্দ্রনাথ বিস্মিত হইলেন। বলিলেন, “কে খুন করিয়াছে—তুমি মনে কর?” যমুনাদাস বলিলেন, “দুই খুনের লাসের কাছেই শিবলিঙ্গ পাওয়া গিয়াছে—সুতরাং পঞ্জাবের সম্প্রদায় কর্তৃক দুই খুন হইয়াছে, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। গুরুগোবিন্দ সিং এই সম্প্রদায়ের লোক। তিনি সম্প্রদায়ের টাকা হুজুরীমলের নিকটে রাখিয়াছিলেন; সেই টাকা চুরি গিয়াছে—এ খুন কে করিয়াছে, তাহা কি আর স্পষ্ট করিয়া বলিতে হইবে?”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তুমি কাহাকে সন্দেহ কর?”
যমুনাদাস উত্তর করিলেন, “সন্দেহ নয়—নিশ্চিত। খুন করিয়াছে—গুরুগোবিন্দ সিং।”
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
যেসময়ে নগেন্দ্রনাথের বাড়ীতে যমুনাদাস আসিয়াছিলেন, ঠিক সেই সময়ে এদিকে ডিটেক্টিভ- ইনস্পেক্টর অক্ষয়কুমারের বাড়ীতে আর একজন আসিয়াছিলেন।
অক্ষয়কুমার কখন ভাবেন নাই যে, তিনি সন্ধান করিয়া তাঁহার বাড়ীতে আসিবেন। তাঁহার আগমনে খুন সম্বন্ধে নিজের যে ধারণা হইয়াছিল, তাহা সমস্তই উল্টাইয়া গেল। তিনি নিজ গৃহে বসিয়া কতকগুলি কাগজ-পত্র দেখিতেছিলেন। এই সময়ে তাঁহার ভৃত্য আসিয়া বলিল, “দুইজন স্ত্রীলোক দেখা করিতে চান্।”
‘স্ত্রীলোক!” বলিয়া অক্ষয়কুমার মাথা তুলিলেন। বলিলেন, “কোথা হইতে আসিতেছেন?” ভৃত্য বলিল, “তাহা জানি না। তারা আপনার সঙ্গে দেখা করিতে চান। গাড়ী করে এসেছে।” অক্ষয়কুমার সেই স্ত্রীলোক দুটিকে সেখানে আনিবার অনুমতি দিয়া নিজের কাগজ-পত্র গুছাইতে লাগিলেন। ভৃত্য চলিয়া গেল। কিয়ৎক্ষণ পরে দুইটি স্ত্রীলোককে সঙ্গে করিয়া লইয়া সে ফিরিয়া আসিল।
অক্ষয়কুমার দেখিলেন, দুইটিই হিন্দুস্থানী স্ত্রীলোক। একটিকে দেখিলে অপরটির দাসী বলিয়া স্পষ্টই বুঝিতে পারা যায়। দাসীর বয়স হইয়াছে, তাহার অবগুন্ঠন নাই; কিন্তু অপরের মুখ অবগুন্ঠনে আবৃত। দেখিলেই সম্ভ্রান্ত মহিলা বুঝা যায়।
অক্ষয়কুমার অতি সম্মানের সহিত কর্ত্রী ঠাকুরাণীকে বলিলেন, “আপনারা কি কাজের জন্য আমার নিকট আসিয়াছেন—সাধ্য হইলে নিশ্চয়ই সম্পন্ন করিব।”
রমণী অবগুন্ঠনের ভিতর হইতে অতি মৃদুস্বরে বলিলেন, “আমার স্বামীই সেদিন খুন হইয়াছেন।” অক্ষয়কুমার নিতান্ত বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “আপনি কি হুজুরীমল বাবুর স্ত্রী?” রমণী গ্রীবা হেলাইয়া নিম্নস্বরে বলিলেন, “হ্যাঁ।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “আপনার স্বামীর খুনের তদন্তই আমি করিতেছি।”
রমণী তাঁহার কথার কোন উত্তর না দিয়া দাসীকে কি বলিলেন; সে বাহিরে চলিয়া গেল। তখন রমণী অক্ষয়কুমারের আরও নিকটে আসিলেন। অক্ষয়কুমার একটু সরিয়া দাঁড়াইলেন।
রমণী বলিলেন, “আপনি আমাদের ওখানে গিয়াছিলেন—অসুখের জন্য আপনার সঙ্গে সেদিন দেখা করিতে পারি নাই। অনেক অনুসন্ধান করিয়া আপনার বাড়ীর ঠিকানা জানিয়া এখানে আসিয়াছি।”
“কিজন্য আসিয়াছেন, বলুন।”
“যে খুন করিয়াছে—তাহাকে কি পাইয়াছেন?
“না—তাহাকে এখনও পাই নাই।”
“কে খুন করেছে, আমি জানি—তাহা বলিতে এসেছি।”
অক্ষয়কুমার বিস্মিতভাবে তাঁহার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “কে খুন করিয়াছে, আপনি মনে করেন?” রমণী বলিলেন, “গঙ্গা।”
“গঙ্গা!” বলিয়া অক্ষয়কুমার বিস্ময়াবেগে দাঁড়াইয়া উঠিলেন। রমণীর দিকে কিয়ৎক্ষণ চাহিয়া রহিলেন। তৎপরে বলিলেন, “আপনি কেমন করিয়া জানিলেন?”
রমণী অতি বিচলিতভাবে বলিলেন, “আমি জানি—আমি শপথ করিতে পারি। সে ডাকিনী- সে সয়তানী।”
অক্ষয়কুমার ধীরে ধীরে বলিলেন, “কেবল জানি বলিলে খুন সপ্রমাণ হয় না; কিরূপে জানিলেন, সেটাও বলুন।”
রমণী ব্যগ্রভাবে বলিতে লাগিলেন, “যতদিন এই সয়তানী আমাদের বাড়ীতে আসে নাই, ততদিন আমি স্বামীর সঙ্গে বড় সুখে ছিলাম। এই ডাকিনী আসিয়া আমার স্বামীর মন ভাঙাইয়া লয়। আমি জানিতাম—অনেকদিন হইতে জানিয়াছি, সে লুকিয়ে আমার স্বামীর সঙ্গে কলিকাতায় দেখা করিত- সেই আমার স্বামীকে চুরি করিয়া লইয়াছিল।”
“যখন সে আপনার স্বামীকে আত্মসাৎ করিবার চেষ্টা করিতেছিল, তখনই আপনি তাহাকে তাড়াইয়া দেন নাই কেন?”
“আমি তাড়াইবার কে? আমি কিছু বলিলে তিনি কোন কথা শুনিতেন না, ঐ সয়তানীই তাঁহার মন ভুলাইয়া লইয়াছিল। আমি জানিতে পারিয়াছিলাম—পরেও জানিয়াছি, এই সয়তানী তাঁহার সঙ্গে সেদিন রাত্রে এদেশ ছাড়িয়া পলাইবার বন্দোবস্ত করিয়াছিল। সে তাঁহাকে ভালবাসিত না, তাঁহার টাকা ভুলাইয়া লইবার ফন্দীতে ছিল। টাকার লোভেই সে তাহার কোন ভালবাসার লোক দিয়ে তাঁকে খুন করেছে, আমি শপথ করিয়া এ কথা বলিতে পারি।”
“আপনি কি মনে করেন যে, তবে যমুনাদাসই হুজুরীমলবাবুকে খুন করিয়াছে?”
রমণী তীক্ষ্ণকন্ঠে বলিয়া উঠিলেন, “সে সয়তানী, বেইমানী, সে মুখে যমুনাদাসকে ভালবাসা দেখায়, তাকে বে করিবে বলিয়াছে—সেই মূর্খও তাই বিশ্বাস করিয়াছে; আমি সে সয়তানীকে খুব চিনি। যমুনাদাস খুন করে নাই।”
“তবে কাহাকে দিয়া খুন করাইয়াছে মনে করেন?”
“ললিতাপ্রসাদ—ললিতাপ্রসাদ—তাকেই সয়তানী ভালবাসে, তার জন্যে প্রাণ দিতে পারে; আমি জানি, তাহার দ্বারাই সে আমার স্বামীকে খুন করিয়াছে।”
রমণীর কথায় অক্ষয়কুমারের বিস্ময় চরমসীমায় উঠিয়াছিল। তিনি অবাঙ্মুখে রমণীর দিকে চাহিয়া রহিলেন। রমণী কিয়ৎক্ষণ পরে বলিলেন, “আমি চলিলাম, সয়তানী যদি পালায়, তবে আমার স্বামীর রক্ত তোমার উপর—আমার শাপ তোমার উপর।”
অক্ষয়কুমার কথা কহিবার পূর্ব্বেই তিনি চঞ্চলচরণে সে কক্ষ হইতে বাহির হইয়া গেলেন হুজুরীমলের স্ত্রীর কথা শুনিয়া অক্ষয়কুমার কেবল যে বিস্মিত হইলেন, এরূপ নহে—তিনি স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। ভাবিলেন, সংসারে লোকে যাহা ভাবে, তাহা প্রায়ই হয় না, এই হুজুরীমল সহরে খুব বড়লোক বলিয়া গণ্য ছিল। তাহাকে ধাৰ্ম্মিক, দানশীল—অতি বদান্য লোক বলিয়া সকলে জানিত। কিন্তু কি আশ্চৰ্য্য, এই বুড়ি বদমাইস সকলের চোখে ধূলি দিয়া ভিতরে ভিতরে কি ভয়ানক কাজই না করিতেছিল? দাসী গঙ্গার সঙ্গে তাহার প্রণয়—কি ঘৃণা! আবার তাহাকে লইয়া দেশ ছাড়িয়া পলাইতেছিল? পরের টাকা লইয়াও চম্পট দিতেছিল, কি ভয়ানক! আমি যাহা ভাবিতেছিলাম, এই মাগীর কথায় একদম সব উল্টাইয়া গেল, দেখিতেছি। যাহা হউক, সহজে ইহার কথাও বিশ্বাস করা যায় না। স্ত্রীলোকের রাগ হইলে সব করিতে পারে, সব বলিতে পারে। দেখা যাক্, কতদূর কি হয়।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
অক্ষয়কুমার সব কাজ ফেলিয়া তাড়াতাড়ি ললিতাপ্রসাদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে চলিলেন। প্রথমে অক্ষয়কুমারকে দেখিয়া ললিতাপ্রসাদ যেন চমকিত হইয়া উঠিলেন; তাঁহার মুখ যেন শুকাইয়া গেল; কিন্তু তিনি মুহূৰ্ত্ত মধ্যে নিজ হৃদয়ভাব গোপন করিয়া বলিলেন, “আসুন, আজ কি জন্য আসিয়াছেন?” অক্ষয়কুমার বসিলেন। ধীরে ধীরে বলিলেন, “হুজুরীমলবাবুর স্ত্রীর সহিত আমার দেখা হইয়াছে।” এই কথা শুনিয়া ললিতাপ্রসাদ স্পষ্টতঃ বিচলিত হইয়া উঠিলেন। বলিলেন, “এই ঘরে আসুন।” উভয়ে পার্শ্ববর্ত্তী গৃহে যাইয়া বসিলেন। ললিতাপ্রসাদ জিজ্ঞাসমান নেত্রে তাঁহার মুখের দিকে চাহিলেন। তখন অক্ষয়কুমার গম্ভীরভাবে বলিলেন, “হুজুরীমলবাবুর স্ত্রীর সহিত আমার দেখা হইয়াছে।” ললিতাপ্রসাদ কথা কহিলেন না। অক্ষয়কুমার বলিলেন, “তাঁহার কাছে জানিলাম, হুজুরীমল সাহেব বৃদ্ধ হইলেও তাঁহার অনেক গুণ ছিল।”
“কি জানিলেন?”
“জানিলাম, তিনি গঙ্গার জন্য পাগল হইয়াছিলেন।”
“মিথ্যাকথা!” বলিয়া তিনি লাফাইয়া উঠিলেন। তৎপরে আত্মসংযম করিয়া বসিয়া বলিলেন, “হুজুরীমলের স্ত্রী ঈর্যাবশে এইরূপ বলিয়াছেন—তাঁহার একটা কথাও সত্য নয়।”
“আরও জানিলাম, সেই গঙ্গা আবার আপনার জন্য পাগল।”
ললিতাপ্রসাদের মুখ রাগে লাল হইয়া গেল—তিনি ক্রুদ্ধভাবে বলিলেন, “মহাশয় কি আজ আমাকে অপমান করিতে এখানে আসিয়াছেন?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “ইহাতে আমার লাভ কি? আমি ইহাও জানিয়াছি যে, যমুনাদাসবাবুর সঙ্গে তাহার বিবাহ হইবার কথা হইয়াছে?”
ললিতাপ্রসাদ এবার অব্যক্ত শব্দ করিলেন। তিনি কি বলিতে যাইতেছিলেন—কিন্তু বলিলেন না। অক্ষয়কুমার তাঁহার মুখের দিকে কিয়ৎক্ষণ এক দৃষ্টে চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, “আপনি কি গঙ্গাকে ভালবাসেন?”
এবার ললিতাপ্রসাদ আর ক্রোধ সম্বরণ করিতে পারিলেন না। বলিলেন, “আপনি এখনই এখান হইতে উঠুন। আমার সহিত আপনার কোন কথা নাই।”
অক্ষয়কুমার গম্ভীরভাবে বলিলেন, “না থাকিলে উঠিতাম, সময় নষ্ট করিতাম না। আমার বিশ্বাস যে গঙ্গা এই খুনে জড়িত।”
“মিথ্যাকথা!”
“বটে? সেইজন্য সে লুকাইয়া লুকাইয়া রাত্রে হুজুরীমলের সহিত দেখা করিত।”
ললিতাপ্রসাদ কি করিবে না জানিবার পূর্ব্বেই সহসা অক্ষয়কুমারকে ক্ষিপ্ত ব্যাঘ্রের ন্যায় আক্রমণ করিলেন। সবলে তাঁহার কন্ঠদেশ টানিয়া ধরিলেন।
অক্ষয়কুমার দুর্বল ছিলেন না—তাঁহার শরীরেও অসীম বল ছিল; তিনি নিমেষ মধ্যে নিজেকে মুক্ত করিলেন। তৎপরে সবলে ললিতাপ্রসাদকে ধরিয়া বসাইয়া দিলেন। ললিতাপ্রসাদ সশব্দে হাঁপাইতে লাগিলেন।
অক্ষয়কুমার মৃদুহাস্য করিয়া শ্লেষপূর্ণ স্বরে বলিলেন, “ললিতাপ্রসাদ বাবু, শরীরের বল স্থান বুঝিয়া ব্যবহার করিবেন। যাহা হউক, আপনি কিছু না বলা সত্ত্বেও আমার যাহা জানিবার, তাহা জানিয়াছি। আপনি গঙ্গাকে বড় ভালবাসেন।”
ললিতাপ্রসাদ বলিলেন, “হাঁ, আমি তাহাকে ভালবাসি। সে হুজুরীমলকে প্রাণের সঙ্গে ঘৃণা করিত, সেখ্যমুনাদাসকেও ভালবাসে না।”
“সেই কথাই আমি বলিতেছিলাম। তবে সে আপনাকেও ভালবাসে না—”
“মিথ্যাকথা।”
“মিথ্যা হউক, সত্য হউক আপনিই জানেন। উপস্থিত এই খুন সম্বন্ধে তাহার কি হাত আছে, তাহাই জানা আমার কর্তব্য ও প্রয়োজন।
“আপনি তাহার সঙ্গে দেখা করিবেন?”
“নিশ্চয়ই।”
এই বলিয়া অক্ষয়কুমার সে স্থান পরিত্যাগ করিলেন।
ললিতাপ্রসাদও তাঁহার পশ্চাতে যাইতে উদ্যত হইলেন; কিন্তু আত্মসংযম করিলেন। তৎপরে সত্বর একখানি পত্র লিখিয়া এক ব্যক্তিকে ডাকিলেন। তাহাকে কানে কানে কি বলিয়া পত্রখানি দিয়া বিদায় করিলেন।
অক্ষয়কুমার রাস্তায় আসিয়া বলিলেন, “একে সময় দেওয়া উচিত নহে। আমাকে এখনই একবার চন্দননগর যাইতে হইবে।”
তিনি তৎক্ষণাৎ একখানা গাড়ী ভাড়া করিয়া হাওড়া ষ্টেশনের দিকে চলিলেন। আধ ঘন্টার মধ্যেই একখানি ট্রেন ছাড়িবে।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
অক্ষয়কুমার চন্দননগর ষ্টেশনে নামিয়া হুজুরীমলের বাড়ীর দিকে চলিলেন। দেখিলেন, আর একটি লোকও গাড়ী হইতে নামিয়া দ্রুতপদে হুজুরীমলের বাড়ীর দিকে ছুটিয়াছে। তাহার হাতে একখানি চিঠি।
অক্ষয়কুমার মনে মনে বলিলেন, “দেখিতেছি, ললিতাপ্রসাদ গাধা নহে। আগে হইতে গঙ্গাকে সাবধান করিয়া দিবার জন্য চিঠী লিখিয়া লোক পাঠাইয়াছে? দেখা যাক্—কতদূর দৌড়।”
তিনি হুজুরীমলের বাড়ীতে আসিয়া গঙ্গার সহিত দেখা করিতে চাহিলেন। ভৃত্যগণ পূৰ্ব্বেই তাঁহাকে পুলিসের লোক বলিয়া জানিত, সুতরাং তাঁহার হুকুম অমান্য করিতে কাহারও সাহস হইল না।
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “আমি যে আসিয়াছি, আর কাহাকেও বলিয়ো না, বলিলে সব বেটাকে ধরিয়া লইয়া যাইব।”
তাহারা গঙ্গাকে ডাকিয়া দিল। গঙ্গা তাঁহার নিকটস্থ হইয়া সলজ্জভাবে মৃদু হাসিয়া বলিল, “ খুনী বুঝি এবার ধরা পড়িয়াছে, তাহাই আমাদিগকে বলিতে আসিয়াছেন!”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “না, খুনী এখনও ধরা পড়ে নাই—সেইজন্যই তোমার কাছে আসিয়াছি।”
“আমার কাছে! আমার কাছে কেন?”
“তুমি কি জান যে, হুজুরীমলবাবুর উপরে কাহার রাগ ছিল?”
“আমি কেমন করিয়া জানিব?”
“তুমি লুকাইয়া তাঁহার সঙ্গে রাত্রে দেখা করিতে।”
“আমি?”
“হাঁ—তুমি। তুমি যদিও ঘোমটায় মুখ ঢাকিয়া যাইতে, তবুও তোমাকে লোকে চিনিতে পারিয়াছে, তোমার ঐ আংটীটাই তোমাকে ধরাইয়া দিয়াছে।”
গঙ্গা বিস্মিতভাবে আংটীর দিকে চাহিল। তৎপরে ধীরে ধীরে বলিল, “এই আংটী—কেন এই আংটী—এ ত আমি দুই-একদিন হাতে পরিয়াছি মাত্র।”
তাহার কথায় অক্ষয়কুমার বিস্মিত হইলেন। ভাবিলেন, তবে কি যথার্থই এ হুজুরীমলের নিকট যায় নাই। বলিলেন, “একটি স্ত্রীলোক, হুজুরীমল যে রাত্রে খুন হয়, সেইদিন রাত্রি নটার পরে তাঁহার সঙ্গে দেখা করিয়াছিল।”
“সে আমি নই—আপনি অপেক্ষা করুন—আমি যমুনাকে ডাকি।”
অক্ষয়কুমার বাধা দিবার পূর্ব্বেই গঙ্গা তীরবেগে গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া গেল। অক্ষয়কুমার ভাবিলেন, “পলাইল না ত। পলাইবে কোথা? এখন দেখিতেছি, এ খুন না করুক—যে খুন করিয়াছে জানে। অনেক মামলা তদন্ত করিলাম—এমন গোলযোগে মাম্লা আর দেখি নাই। সে বুড়ো বেটা নিজেও মরলো, আর আমাদেরও হাড়মাস কালি করিয়া গেল।”
এই সময়ে গঙ্গা যমুনাকে সঙ্গে লইয়া সেখানে ফিরিয়া আসিল। বলিল, “যমুনা জানে যে, প্ৰায় দুই-তিন-মাস এ আংটা আমার হাতে ছিল না।”
যমুনা বিস্মিতভাবে একবার গঙ্গার মুখের দিকে চাহিল—পরে অক্ষয়কুমারের মুখের দিকে চাহিল। ক্ষণপরে ধীরে ধীরে বলিল, “কেন আংটীর কি হইয়াছে?”
গঙ্গা বলিল, ইনি বলিতেছেন, এ আংটা আমার হাতে ছিল।”
যমুনা মৃদুস্বরে বলিল, “না, আংটীটা গঙ্গার হাত হইতে বাগানে পড়িয়া গিয়াছিল। প্রায় দু’মাস ঘাসের মধ্যে পড়িয়াছিল, কেহ খুঁজিয়া পায় নাই। আমি দশ-পনের দিন হইল, খুঁজিয়া পাইয়াছিলাম। পাছে আবার হারাইয়া যায় বলিয়া নিজের হাতে পরিয়াছিলাম। গঙ্গাকে দিতে গেলে সে বলিল, তোমার হাতে বেশ মানাইয়াছে, তোমার হাতেই থাক্।’ সেই পৰ্যন্ত আমার হাতেই ছিল। তিনি- চারিদিন হইল, তাহাকে দিয়াছি। এ আংটীর কি হইয়াছে?”
অক্ষয়কুমার অতি গম্ভীরভাবে বলিলেন, “যে রাত্রে হুজুরীমলবাবু খুন হন, সেইদিন একটি স্ত্রীলোক তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিল। তাঁহার একজন ভৃত্য সেই স্ত্রীলোকের হাতে এই আংটী দেখিতে পায়। তাহা হইলে কি আপনি সে রাত্রে কলিকাতায় গিয়া হুজুরীমলবাবুর সহিত দেখা করিতে গিয়াছিলেন?”
যমুনা কোন উত্তর না দিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। অক্ষয়কুমার অতি কঠোরভাবে বলিলেন, “চুপ্ করিয়া থাকিলে চলিবে না—তোমাকে ইহার ঠিক জবাব দিতে হইবে।”
যমুনা কম্পিতকণ্ঠে বলিল, “আমি–আমি—হাঁ আমি—”
“কি আমি? স্পষ্ট বল।”
“আমি গিয়াছিলাম।”
“তুমি একবার আমাকে মিথ্যাকথা বলিয়াছিলে, ঠিক করিয়া বল।”
যমুনার চক্ষুদ্বয় সজল হইল। সে বাষ্পরুদ্ধ কম্পিতকণ্ঠে বলিল, “হাঁ, আমি—আমিই সে রাত্রে তাঁহার সঙ্গে দেখা করিয়াছিলাম।”
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
অক্ষয়কুমার নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, “তবে সে স্ত্রীলোক তুমি!”
যমুনা কোন উত্তর দিতে পারিল না—তাহার আপাদমস্তক কাঁপিতে লাগিল! সে পড়িয়া যাইবার মত হইল। গঙ্গা তাড়াতাড়ি তাহাকে ধরিয়া ফেলিল; এবং অন্য গৃহে লইয়া যাইবার উপক্রম করিল। যেমন তাহারা দ্বারের নিকটে গিয়াছে, অক্ষয়কুমার কঠোরভাবে বলিলেন, “দাঁড়াও।”
উভয়ে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় দাঁড়াইল। এবং ফিরিয়া আসিয়া কৌচের উপর বসিল। গঙ্গা বলিল, ‘দেখিতেছেন, আপনার কি বিষম ভুল, আমার হাতে এ আংটী ছিল না, আমি কলিকাতায় গিয়া হুজুরীমলবাবুর সঙ্গে দেখা করি নাই।”
অক্ষয়কুমার গম্ভীরভাবে বলিলেন, “আপনি ললিতাপ্রসাদের নিকট হইতে এইমাত্র যে পত্ৰ পাইয়াছেন, তাহা আমি দেখিতে চাই।”
গঙ্গা বিস্মিতভাবে তাঁহার দিকে চাহিল। ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া বিরক্তভাবে বলিল, “আপনি কেমন করিয়া জানিলেন যে, তিনি আমাকে পত্র লিখিয়াছেন?”
অক্ষয়কুমার মৃদুহাস্য করিয়া বলিলেন, “পুলিসে কাজ করিতে হইলে আমাদিগকে অনেক সংবাদ রাখিতে হয়। যে লোককে চিঠী দিয়া ললিতাপ্রসাদবাবু পাঠাইয়াছিলেন, সে আমার সঙ্গে এক গাড়ীতেই চন্দননগরে আসিয়াছে।”
গঙ্গার মুখ লাল হইয়া গেল—সে ভ্রূকুটিকুটিল মুখে গ্রীবা বাঁকাইয়া তীক্ষ্ণকণ্ঠে কহিল, “হাঁ, আমি পত্র পাইয়াছি।”
“আমি সে পত্র দেখিতে চাই।”
“সে পত্র আমি তখনই ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়াছি।”
“কোথায় ফেলিয়াছেন—চলুন দেখি।”
“সে পত্র আমি পুড়াইয়া ফেলিয়াছি।”
“দেখুন—গোল করিবেন না। সে পত্র আমি দেখিতে চাই—দেখিবই।”
“সে পত্র আমি কিছুতেই দেখাইব না।”
“বুঝিলাম, খুনের ব্যাপার কিছু তাহাতে আছে।”
“আপনি কি মনে করেন, আমি খুন করিয়াছি?”
“অতদূর এখনও মনে করি নাই—তবে আপনি জানেন, কে খুন করিয়াছে।”
“মিথ্যাকথা।”
এতক্ষণ যমুনা নতনেত্রে নীরবে বসিয়াছিল—সহসা কোথা হইতে তাহার দেহে কি অমানুষিকী শক্তির সঞ্চার হইল; সে সগৰ্ব্বে মস্তক তুলিল। অতি দৃঢ়ভাবে বলিল, “না—মিথ্যাকথা নয়।”
অক্ষয়কুমার বিস্মিত হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিলেন। চাহিয়া গঙ্গার মুখের দিকে চাহিলেন। মুখ দেখিয়া বুঝিলেন, যমুনার কথায় গঙ্গা প্রথমে আশ্চর্যান্বিত হইল; পরক্ষণে তাহার বিশালায়ত নেত্রদ্বয় একবার দীপ্তিশীল উল্কাপিণ্ডের ন্যায় জ্বলিয়া উঠিল; এবং ক্রোধে মুখখানা আরক্ত হইয়া উঠিল—সর্ব্বশরীর কাঁপিতে লাগিল। গঙ্গা ওষ্ঠে ওষ্ঠ পেষিত করিয়া ক্রোধ দমন করিবার চেষ্টা করিল। এবং যমুনার মাথাটা একদিকে ঠেলিয়া দিয়া কহিল, “যমুনা, তোর মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছে।”
যমুনা মুখ না তুলিয়া নিজের পায়ের দিকে চাহিয়া কহিল, “তোমার জন্য লোকে ভবিতেছে যে, আমিই খুন করিয়াছি। তোমাকে আমি বড় ভালবাসিতাম, তাহাই কোন কথা বলি নাই। এখন দেখিতেছি, আমার মাসী তোমার বিষয় যাহা বলিয়াছেন, তাহাই ঠিক।”
গঙ্গা ক্রোধে গৰ্জ্জিয়া কহিল, “কি ঠিক?”
এই দৃশ্যে অক্ষয়কুমার মনে মনে ভারী সন্তুষ্ট হইলেন। মনে মনে হাসিয়া বলিলেন, এইবার কিছু আসল কথা জানিতে পারা যাইবে।
যমুনা এবারও মুখ তুলিয়া চাহিল না—চাহিলে সে নিশ্চয়ই ভয় পাইত। যমুনা সেইরূপভাবে মৃদুকণ্ঠে বলিল, “মাসী-মা তোমাকে অনেকদিন জেনেছিলেন। মেসো মহাশয় তোমার বাপের বয়সী, তুমি তাঁহার সঙ্গে—“
গঙ্গা আর ক্রোধ সম্বরণ করিতে পারিল না। বলিল, “যমুনা মুখ সাম্লাইয়া কথা কহিয়ো।” এবার যমুনা সবেগে উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল, “গঙ্গা, তোমাকে আমি বড় ভালবাসিতাম বলিয়া এত সহ্য করিয়াছি; আর নয়, আমি আগে জানিতাম না যে, তুমি এমন–“
গঙ্গা চোখ রাঙাইয়া তীব্রকন্ঠে বলিয়া উঠিল, “আমি কলিকাতায় রাত্রে হুজুরীমলের সঙ্গে দেখা করিতে যাই নাই।”
যমুনা অতি সংযতভাবে বলিল, “হাঁ, যাও নাই—সেদিন যাও নাই—মধ্যে মধ্যে বরাবর যাইতে। পাছে কেহ আংটী দেখিয়া তোমায় চিনিতে পারে বলিয়া ছল করিয়া আংটী হারাইয়াছিলে, আমি বুঝিতে পারি নাই, তুমি ইচ্ছা করিয়া আংটী আমার হাতে রাখিয়াছিলে।”
গঙ্গা বলিল, “তোমার মাথা খারাপ হইয়া-“
“না মাথা বড় খারাপ হয় নাই। তুমি সেদিন মেসো মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করিতে যাও নাই—কিন্তু তুমিই দাসী রঙ্গিয়াকে তাঁহার সঙ্গে দেখা করিবার জন্য রাত্রে পাঠাইয়াছিলে।”
“মিথ্যাকথা।”
এই বলিয়া গঙ্গা, অক্ষয়কুমার তাহাকে বাধা দিবার পূর্ব্বেই গৃহ পরিত্যাগ করিয়া গেল। অক্ষয়কুমার তাহার অনুসরণ করিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু দাঁড়াইলেন।
কিয়ৎক্ষণ যমুনার দিকে চাহিয়া থাকিয়া তিনি বলিলেন, “রঙ্গিয়াকে যে, গঙ্গা হুজুরীমলের সহিত দেখা করিতে পাঠাইয়াছিলেন, তাহা আপনি কিরূপে জানিলেন?”
যমুনা ধীরে ধীরে বলিল, “যে কাপড়খানা তাহার পরা ছিল; সেখানা গঙ্গার। সেদিনও তাহার সে কাপড় পরা ছিল, নিশ্চয়ই সে তাহার নিজের কাপড় পরাইয়া তাহাকে মেসো মহাশয়ের সহিত দেখা করিতে পাঠাইয়াছিল।”
অক্ষয়কুমার বলিয়া উঠিলেন, “ঠিক কথা—তাই ত–বুঝিয়াছি।”
যমুনা তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “এখন বুঝিয়াছি, হুজুরীমলের সঙ্গে রাত্রে রাণীর গলিতে গঙ্গারই দেখা করিবার কথা ছিল। হুজুরীমল তাহাকে লইয়া বোম্বে যাইবার জন্য দু-খানা টিকিট কিনিয়াছিল; কিন্তু কোন কারণে গঙ্গা তাহার সঙ্গে দেখা করিতে যায় নাই, দাসী রঙ্গিয়াকে নিজের কাপড় পরাইয়া পাঠাইয়া দিয়াছিল। নিশ্চয়ই ইহাতে বুঝিতে পারা যাইতেছে যে, তাহার মতলব ছিল, হুজুরীমল রঙ্গি য়াকে তাহার কাপড় পরা দেখিয়া ভাবিবে, সেই আসিয়াছে—”
অক্ষয়কুমার নিজ মনেই এই সকল বলিয়া যাইতেছিলেন, যমুনা নীরবে দাঁড়াইয়াছিল। সহসা অক্ষয়কুমার থামিলেন, ভাবিলেন, এরূপ উচ্চৈঃস্বরে চিন্তা করা উচিত নহে।
তিনি যমুনাকে বলিলেন, “আমি আপনাকে আরও দুই-একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই।” যমুনা মৃদুস্বরে বলিল, “বলুন।”
অক্ষয়কুমার তাহার দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া অতি গম্ভীরভাবে বলিলেন, “আপনি স্বীকার করিয়াছেন, আপনি সে রাত্রে হুজুরীমলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলেন?”
যমুনা স্পষ্টভাবে বলিল, “হ্যাঁ।”
“কেন গিয়াছিলেন, আমায় বলুন।”
যমুনা উত্তর দিল না।
অক্ষয়কুমার আবার বলিলেন, “না বলিলে আপনি বিপদে পড়িবেন।“
এবারও যমুনা উত্তর দিল না।
অক্ষয়বাবু কঠোরভাবে বলিলেন, “সব কথা খুলিয়া না বলিলে আমি এই খুনের জন্য আপনাকে গ্রেপ্তার করিব।”
যমুনা অতি মৃদুস্বরে বলিল, “আমি খুনের কিছুই জানি না।”
“আপনি কি জন্য সে রাত্রে হুজুরীমলের সহিত দেখা করিয়াছিলেন, তাহাই বলুন।”
“কিছুতেই বলিব না।”
“আমি এখনও আপনাকে বলিতেছি, না বলিলে আপনি ভয়ানক বিপদে পড়িবেন।”
“বিপদ্ যেমনই ভয়ানক হউক, কিছুতেই আমি বলিব না—প্রাণ থাকিতে বলিব না।”
সপ্তম পরিচ্ছেদ
অক্ষয়কুমার সহজে রাগিতেন না। কিন্তু আজ এই বালিকার দৃঢ়তা দেখিয়া তিনি না রাগিয়া থাকিতে পারিলেন না। বলিলেন, “এখনও আপনাকে ভাবিবার সময় দিলাম। আমি আবার আপনার সঙ্গে দেখা করিব—এখনও বলিতেছি, বলুন।
যমুনা অতি দৃঢ়ভাবে বলিল, “প্রাণ থাকিতে বলিব না।”
“আচ্ছা আবার দেখা করিব,” বলিয়া অক্ষয়কুমার ক্ষুব্ধভাবে সে গৃহ পরিত্যাগ করিলেন। বাহিরে আসিয়া বলিলেন, “এরকম বদ্ মেয়ে আমি কখনও দেখি নাই। এ নিজে খুনের ভিতরে না থাকিলেও খুনের সব কথা জানে। দেখিতেছি, যত বদমাইসের গোড়া হইতেছে এই গঙ্গাটি। সংসারে মানুষ চেনা দায়। যাহা হউক, এখন অনেক বিষয় জানিতে পারা গিয়াছে, ক্রমে বাকীটুকুও জানা যাইবে।”
তিনি মনকে এইরূপ প্রবোধ দিলেন বটে; কিন্তু এতদিনে এই খুনের কিনারা করিতে পারিলেন না, বলিয়া মনে মনে বড়ই বিরক্ত হইলেন। মনটা বড় উষ্ণ হইয়া উঠিল। তিনি অতি বিরক্তভাবে গাড়ীতে আসিয়া উঠিলেন।
কলিকাতায় আসিয়া তিনি প্রথমে নগেন্দ্রনাথের সহিত দেখা করিতে চলিলেন। কয়েকদিন তিনি তাঁহার সহিত দেখা করিবার সময় পান নাই। নগেন্দ্রনাথও একটু উদ্বিগ্নভাবে তাঁহার প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। তিনি অক্ষয়কুমারকে দেখিয়া সত্বর অগ্রবর্ত্তী হইলেন। অক্ষয়কুমারের মেজাজটা তখনও অতিশয় বিগড়াইয়া ছিল; তিনি বিরক্তভাবে একখানি চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন। তাঁহার ভাব দেখিয়া নগেন্দ্রনাথ বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “ব্যাপার কি—নূতন কিছু জানিতে পারিলেন?”
অক্ষয়কুমার চক্ষু মুদিত করিয়া বসিয়াছিলেন। নিমীলিতনেত্রেই বলিলেন, “সব নূতন।” নগেন্দ্রনাথ আরও বিস্মিত হইলেন। বলিলেন, “আপনার কথা আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।”
অক্ষয়বাবু গম্ভীরভাবে বলিলেন, “না পারিবারই কথা।”
“খুলিয়া সব বলুন! “
“খুলিয়া বলিব আমার মাথা।”
“এত রাগিলেন—কাহার উপর?”
“নিজের উপর।”
“তা হইলে এ খুনের বিষয় কিছুই করিয়া উঠিতে পারিলেন না। দেখিতেছি, আপনিই হার মানিলেন।”
অক্ষয়কুমার উঠিয়া বসিলেন। বলিলেন, “মশাই গো, এই এত ডিটেক্টিভ উপন্যাস লিখিতেছেন—এই খুনের যে পর্য্যন্ত হয়েছে, মনে করুন, ইহাই আপনার অর্দ্ধ লিখিত উপন্যাস—এই পৰ্য্যন্ত লেখা হইয়াছে, তাহার পর কি লিখিবেন—কিরূপে উপসংহারটা করিবেন, বলুন দেখি। দেখি বিধাতার উপন্যাসের সঙ্গে শেষে আপনার উপন্যাসের কতখানি মিল হয়।”
নগেন্দ্রনাথ হাসিয়া বলিলেন, “আপনার ন্যায় সুদক্ষ ডিটেটিভ যখন হার মানিলেন, তখন এ খুনের রহস্য কখনও প্রকাশ হইবে না।”
অক্ষয়বাবু বলিলেন, “তবে কি আপনার উপন্যাসেরও ঐ পর্য্যন্ত?”
নগেন্দ্রনাথ হাসিয়া বলিলেন, “আমি ত অনেকদিনই হার মানিয়াছি।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “আপনার সখ—আমার দায়। আমি হার মানিলে আমাকে ছাড়ে কে?”
“আর কতদূর কি করিলেন?”
“ললিতাপ্রসাদ আর উমিচাঁদের সঙ্গে আবার দেখা করিয়াছি।”
“তাহাদের নিকটে নূতন কিছু জানিতে পারিয়াছেন?”
“ব্যস্ত হইবেন না—সব শুনিতে চান যদি, চুপ করিয়া শুনুন। গঙ্গা আর যমুনার সঙ্গে আমি দেখা করিয়াছি।” নগেন্দ্রনাথ নড়িয়া উঠিলেন—ব্যগ্রভাবে কি বলিতে যাইতেছিলেন; কিন্তু তাঁহার এই ভাব দেখিয়া অক্ষয়কুমার চেয়ারে ঠেস দিয়া বসিলেন, চক্ষু মুদিত করিলেন। কোন কথা কহিলেন না।
অক্ষয়কুমারের হঠাৎ এরূপ নিদ্রাকর্ষণ দেখিয়া নগেন্দ্রনাথ বিস্মিত হইলেন। হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “আমি ত কোন কথা কহি নাই।”
অক্ষয়কুমার চক্ষু খুলিলেন না—সেই অবস্থায় থাকিয়া বলিতে লাগিলেন, “গোড়ায় আমরা কিছুই জানিতাম না। কেবল জানিতাম, এই সহরে একরাত্রে প্রায় এক সময়ে একটি স্ত্রীলোক আর একটি পুরুষ খুন হইয়াছে। ক্রমে জানিলাম, তাহাদের একজন হুজুরীমল—অপরে তাহারই দাসী রঙ্গিয়া। আর কি দেখিলাম—”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “সিঁদুরমাখা শিব।”
অক্ষয়কুমার বিরক্তভাবে বলিলেন, “চুপ করুন।”
নগেন্দ্রনাথ নীরব রহিলেন। তখন অক্ষয়কুমার সেইরূপভাবে বলিলেন, “তাহার পর দেখিলাম, হুজুরীমলের বাড়ীতে চারিটি স্ত্রীলোকের ব্যাপার; একটি হুজুরীমলের স্ত্রী, অপর একটি যমুনা, আর একটি গঙ্গা, আর একটি দাসী রঙ্গিয়া। শেষের তিনটি যুবতী। আরও দেখিলাম, হুজুরীমলের এই খুনের মামলায় আরও চারিটি লোককে আনা যায়, একটি ললিতাপ্রসাদ, একটি উমিচাঁদ, একটি গুরুগোবিন্দ সিং আর একটি যমুনাদাস।”
নগেন্দ্রনাথ কি বলিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু নিরস্ত হইলেন, অক্ষয়কুমার বলিলেন, “এই ব্যাপারের মধ্যে তাহা হইলে পাইলাম, চারিটি স্ত্রীলোক—চারিটি পুরুষ—আর পাইলাম, তিনটি জিনিষ।” নগেন্দ্রনাথ এবার আর নীরবে থাকিতে পারিলেন না—বলিয়া ফেলিলেন, “কি জিনিষ?” অক্ষয়কুমার ভ্রূকুটি করিলেন, তাঁহার কথায় কোন উত্তর না দিয়া বলিলেন, “আর পাইলাম, তিনটি জিনিষ; প্রথমতঃ সিঁদুরমাখা শিব—দুটো। দ্বিতীয়তঃ টাকা—দশ হাজার টাকার দশখানা নোট। তৃতীয়তঃ ভালবাসা, দ্বেষ, ঈর্ষা, প্রতিহিংসা—ব্যস্।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “সিঁদুরমাখা শিবই এ খুনের কারণ স্পষ্ট দেখাইয়া দিতেছে। পঞ্জাবের সেই সম্প্রদায়ের লোক যে এ খুন করিয়াছে, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।”
অক্ষয়কুমার এবার উঠিয়া ভাল হইয়া বসিলেন। পরে নগেন্দ্রনাথের দিকে ভ্রূকুটি করিয়া চাহিয়া বলিলেন, “কেন?”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আমরা জানিতে পারিয়াছি যে, পঞ্জাবে এইরকম একটা সম্প্রদায় আছে।”
“ভাল।”
“সেই সম্প্রদায়ের চিহ্ন এই সিঁদুরমাখা শিব।”
“খুব ভাল।”
“কেহ যদি এই সম্প্রদায়ের বিরাগভাজন হয়, তাহা হইলে তাহাকে এই সম্প্রদায়ের লোকে খুন করিয়া থাকে। এইরূপ খুন হইলে লাসের কাছে এইরকম সিঁদুরমাখা শিব তাহারা রাখিয়া যায়।”
“স্বীকার করিলাম।”
“দুই লাসেই সিঁদুরমাখা শিব পাওয়া গিয়াছে, সুতরাং বুঝিতে হইবে, এ খুন সেই সম্প্রদায়ের কাজ।”
“তা হলে আপনার মতে গুরুগোবিন্দ সিং দুই খুনই করিয়াছে।”
“হাঁ, হুজুরীমল সম্প্রদায়ের টাকা লইয়া পলাইতেছে, সংবাদ পাইয়া গুরুগোবিন্দ সিং তাহার পশ্চাতে যায়। সেই রাগে সম্প্রদায়ের হুকুমে হুজুরীমলকে খুন করে, কিন্তু তাহার নিকটে টাকা দেখিতে পায় নাই।”
অক্ষয়কুমার হাসিয়া বলিলেন, “কেন?”
“হুজুরীমল গঙ্গাকে লইয়া পলাইবার বন্দোবস্ত করিয়াছিল, সে তাহার নিকট টাকা দিয়াছিল, কাজেই গুরুগোবিন্দ সিং টাকা না পাইয়া গঙ্গার কাপড় পরা রঙ্গিয়া দাসীর পশ্চাতে যায়। তাহার পর হুজুরীমলকেও খুন করিয়া টাকা লইয়া চলিয়া যায়।”
অক্ষয়কুমার হাসিয়া বলিলেন, “তাহার পর রঙ্গিয়া খুন হইল কেন?”
“সে টাকা লইয়াছিল বলিয়া।”
“বটে? তবে গুরুগোবিন্দ সিং টাকা হারাইয়াছে বলিয়া এমন তম্বি করিবে কেন?”
লোকের চোখে ধূলি দিবার জন্য।”
“আর যদি আমি বলি, গুরুগোবিন্দ সিং আবার টাকা ফেরৎ পাইয়াছে?”
নগেন্দ্ৰনাথ আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া অক্ষয়কুমারের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। অক্ষয়কুমার হাসিতে লাগিলেন।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “এ কথা ত আগে বলেন নাই?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “আগে শুনি নাই।”
“কাহার কাছে শুনিলেন?”
“উমিচাঁদ, ললিতাপ্রসাদ আর খোদ গুরুগোবিন্দ সিং-এর নিকট শুনিয়াছি।”
“তাহারা কি বলে?”
“গত রাত্রে কে একজন গুরুগোবিন্দ সিং-এর বাসায় একখানা পত্র রাখিয়া যায়। সেই পত্রের ভিতরে দশ হাজার টাকার নোট।”
“কে সে লোক?
“গুরুগোবিন্দ সিংহের চাকর বলে যে, সে একজন দারোয়ান। কোথা হইতে আসিয়াছে, জিজ্ঞাসা করিলে সে বলে, “চিঠিতে সব লেখা আছে, চিঠি বাবুকে দিও।’ এই বলিয়াই সে চলিয়া যায়।”
“আশ্চৰ্য্য, সন্দেহ নাই।”
“এখন কে খুন করিয়াছে বলিয়া বোধ হয়?”
“আমার বিশ্বাস, এসবই গুরুগোবিন্দ সিংহের ফন্দী।”
“ভুল।”
“তবে আপনি কি স্থির করিয়াছেন, বলুন।”
“কিছুই পাকা স্থির করিতে পারি নাই, তবে কতক বিষয় জানিতে পারিয়াছি। সে রাত্রে গঙ্গা হুজুরীমলের সঙ্গে দেখা করে নাই।”
“কে করিয়াছিল?”
“যমুনা। সে এ কথা নিজ মুখে স্বীকার করিয়াছে; কিন্তু কিজন্য দেখা করিয়াছিল, তাহা সে কিছুতেই বলিবে না—কাজেই সে এ চুরি ও খুনের বিষয় জানে।”
“তবে বলিতেছে না কেন?”
“কাহাকেও ঢাকিবার জন্য।”
“কাহাকে ঢাকিবার জন্য?”
“বলিয়াছি ত হুজুরীমলের স্ত্রীকে।”
“আপনি কি মনে করেন, সে-ই খুন করিয়াছে?”
“মনে করা না করায় কি আসে যায়—প্ৰমাণ চাই।”
“কিন্তু তাহার খুন করিবার কারণ কি?”
“ঈর্ষা—সে মনে করিয়াছিল, হুজুরীমল গঙ্গাকে লইয়া পলাইতেছে।”
“রঙ্গিয়াকে খুন করিবে কেন?”
“ঈর্ষা—ঈৰ্ষাবশে স্ত্রীলোক সকল কাজই করিতে পারে। যেমন করিয়া হউক, সে জানিয়াছিল যে, গঙ্গা তাহার স্বামীর সঙ্গে দেখা করিবে। তাহাই সে তাহাদের সন্ধানে গিয়াছিল। রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হইয়া তাঁহার বুকে ছুরি বসাইয়াছিল। তখন রঙ্গিয়া এই ব্যাপার দেখিয়া ভয়ে পালায়। হুজুরীলের স্ত্রী তাহার পিছনে যায়, তাহার পর তাহাকেও খুন করে।”
“সিঁদুরমাখা শিব?”
“হুজুরীমলের স্ত্রী পঞ্জাববাসিনী। নিশ্চয়ই সে এই সম্প্রদায়ের একজন—কাজেই তাহার কাছে এই সিঁদুরমাখা শিব ছিল। সম্প্রদায়ের একজনের উপর এরকম ব্যবহার করিলে তাহাকে খুন করাই বোধ হয়, তাহাদের নিয়ম। তাহাই দুইজনকে খুন করিয়া সে সেই সিঁদুরমাখা শিব লাসের কাছে রাখিয়া দিয়াছিল।”
“এ খুব সম্ভব হইতে পারে বটে; কিন্তু তাহা হইলে আপনার গাড়োয়ানের কথা ঠিক হয় কিরূপে? সে একজন স্ত্রীলোককে আর একজন পুরুষকে গাড়ীতে লইয়াছিল।”
‘এইজন্য বোধ হয়, হুজুরীমলের স্ত্রী একাকী আসে নাই—সে একজন পুরুষকে সঙ্গে লইয়া যায়। যেরূপ জোরে ছোরা মারিয়াছে, তাহাকে কোন স্ত্রীলোকের কাজ বলিয়া বোধ হয় না; কোন পুরুষ ইহার ভিতরে আছে।”
“এ পুরুষ কে মনে করেন?”
“তাহারই সন্ধান করিতেছি।’
“এ লোক গুরুগোবিন্দ সিংও হইতে পারে। কেননা, গুরুগোবিন্দ সিং পঞ্জাবের লোক, সে নিজে স্বীকার করিয়াছে যে, সে এই সম্প্রদায়ের লোক। সম্ভবতঃ এক সম্প্রদায়ের লোক বলিয়া হুজুরীমলের স্ত্রী নিজের স্বামীর দুর্ব্যবহারের কথা ইহাকে জানাইয়াছিল; তাহাতে খুব সম্ভব, গুরুগোবিন্দ সিং তাহার সহিত রাণীর গলিতে যায়, তাহার পর সে-ই খুন করে।”
“সম্ভব, কিন্তু টাকা চুরি করে কে?”
“টাকার কথা সবই মিথ্যা—সন্দেহ দূর করিবার একটা ফন্দী।”
“উমিচাঁদ নিজের হাতে টাকা সিন্দুকে রাখিয়াছিল।”
“উমিচাঁদকে ইহারা হাত করিয়াছে।”
“টাকা না লইয়াই কি হুজুরীমল গঙ্গাকে লইয়া পলাইবার চেষ্টা করিয়াছিল? এ কোন কথাই স্থির হইতেছে না। এই মোকদ্দমা লইয়া খুব বেশী রকমে মাথা ঘামাইতে হইবে, দেখিতেছি।”
বিরক্তভাবে অক্ষয়কুমার উঠিলেন।
নবম পরিচ্ছেদ
অক্ষয়কুমার নগেন্দ্রনাথকে কি বলিতে যাইতেছিলেন, এই সময়ে সবেগে তথায় যমুনাদাসের দ্রুতবেগে প্রবেশ। তিনি অতি ক্রুদ্ধভাবে অক্ষয়কুমারের দিকে চাহিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিলেন, “আমি আপনার সন্ধানেই এখানে আসিয়াছি।”
অক্ষয়কুমার অতি গম্ভীরভাবে বলিলেন, “আমি ত উপস্থিতই আছি।”
যমুনাদাস ক্রোধভরে বলিলেন, “মহাশয় আপনি আমাদের গঙ্গার সহিত এরূপ ব্যবহার করিয়াছেন—কোন্ সাহসে?”
অক্ষয়কুমার মৃদুহাস্য করিয়া বলিলেন, “ওঃ! তিনি কি আপনাকে আমায় শাসন করিতে পাঠাইয়াছেন?”
“না, আমি নিজেই আসিয়াছি। আপনি জানেন গঙ্গা আমার ভাবী স্ত্রী।”
“তাহা অবগত আছি।”
“তবে আপনি কোন্ সাহসে তাহাকে অপমান করিয়াছেন?”
“তাঁহাকে অপমান করি নাই—কর্তব্যের অনুরোধে তাঁহাকে দুই-একটা কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছি মাত্ৰ।”
বন্ধুর সহিত অক্ষয়কুমারের একটা বিবাদ ঘটে দেখিয়া নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “যমুনাদাস, অক্ষয়বাবু যাহা জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, প্রকৃতই তাহা তিনি কর্তব্যের অনুরোধে করিয়াছেন।”
“তবে কি উনি মনে করেন যে, গঙ্গা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত?”
অক্ষয়কুমার ধীরে ধীরে বলিলেন, “তা না হলে তিনি তাঁহার কাপড় পরাইয়া রাত্রি বারটার সময়ে রঙ্গিয়াকে রাণীর গলিতে হুজুরীমলের সঙ্গে দেখা করিতে পাঠাইয়াছিলেন কেন?”
যমুনাদাস অতিশয় রুষ্ট হইয়া বলিলেন, “না, গঙ্গা পাঠায় নাই।”
অক্ষয়কুমার কোনরূপ চাঞ্চল্য প্রকাশ না করিয়া গম্ভীরভাবে বলিলেন, “প্রমাণ লইয়া আমাদের কাজ—আমরা ইহার প্রমাণ পাইয়াছি। আপনার কথা শুনিব কেন?”
“আপনি কি মনে করেন, গঙ্গা এই দুইটা খুন করিয়াছে?”
“না, তাহা বলি না—তবে তিনি ভিতরের অনেক রহস্য জানেন।”
“মিথ্যাকথা।”
“মহাশয়, মিথ্যাকথা নহে। রাত্রে হুজুরীমলের সঙ্গে তাঁহারই দেখা করিবার কথা ছিল; তাঁহাকে লইয়াই হুজুরীমল পলাইবে মনে করিয়াছিলেন। যে কারণেই হউক, তিনি অনুগ্রহ করিয়া না গিয়া তাঁহার কাপড় পরাইয়া রঙ্গিয়াকে পাঠাইয়াছিলেন।”
“বুড়া হুজুরীমলের সঙ্গে সে পলাইতে যাইবে কেন?” বিশেষতঃ তাহার সহিত আমার বিবাহ স্থির হইয়াছে।”
“মহাশয়ের এক পয়সারও সঙ্গতি নাই; কিন্তু হুজুরীমলের টাকা অনেক ছিল।”
যমুনাদাস ক্রোধে উন্মত্তপ্রায় হইয়া বলিলেন, “আমি জানি, জুয়া খেলিয়া হুজুরীমলের এক পয়সাও ছিল না। গঙ্গাও তাহা জানিত।”
অক্ষয়কুমার মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “তবে গঙ্গা আরও জানিত যে, সেই খুনের রাত্রে হুজুরীমলের কাছে দশ হাজার টাকা ছিল।”
যমুনাদাস সে কথায় কান না দিয়া বলিলেন, “আমার কোন কাজ কৰ্ম্ম ছিল না বলিয়া আমি এই সন্ধান করিব মনে করিয়াছিলাম। এখন গঙ্গার অপযশ ও মিথ্যা অপবাদ দূর করিবার জন্য আমি প্রাণপণে চেষ্টা করিয়া যে খুন করিয়াছে, তাহাকে বাহির করিব।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “ভগবান্ আপনার সাহায্য করুন, আমরা ত এক রকম হাল ছাড়িয়া দিবার মত হইয়াছি।”
যমুনাদাস সবেগে বলিলেন, “আমি জানি, এই খুন কে করিয়াছে। পঞ্জাবের সম্প্রদায় হইতে যে এ খুন হইয়াছে, তাহা আমি বেশ শপথ করিয়া বলিতে পারি। আমি জানি, গুরুগোবিন্দ সিংহই খুন করিয়াছে, আমি শীঘ্রই ইহার প্রমাণ দিব —দেখিবেন।”
এই বলিয়া যমুনাদাস উঠিয়া গেলেন। তখন নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “যমুনাদাস যাহা বলিল, আমার মনেও তাহাই লয়।”
অক্ষয়কুমার বিরক্তভাবে বলিলেন, “ও কথা অনেকবার শুনিয়াছি; আমি বলিতেছি, আপনার সম্প্রদায়ের সঙ্গে এ খুনের কোন সম্বন্ধ নাই।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “কিছুই ত স্থির হইতেছে না।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “একটা কিছু স্থির করিতে হইবে; এখন আমার সঙ্গে একবার আসুন, একটা কাজ আছে।”
নগেন্দ্রনাথ সত্বর বেশ পরিবর্ত্তন করিয়া অক্ষয়কুমারের সহিত বাহির হইলেন। তাঁহারা উভয়ে ললিতাপ্রসাদের পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চলিলেন।
হুজুরীমলের খুনের সময়ে ললিতাপ্রসাদের পিতা কলিকাতায় ছিলেন না। পশ্চিমে গিয়াছিলেন। এখন তিনি কলিকাতায় ফিরিয়াছেন। অক্ষয়কুমার এ পর্য্যন্ত তাঁহার সহিত দেখা করিবার সুবিধা পান নাই; আজ তাহাই একবার তাঁহার সঙ্গে দেখা করা নিতান্ত প্রয়োজন মনে করিলেন। ভাবিলেন, যদি তাঁহার নিকটে কোন সন্ধান পান।
দশম পরিচ্ছেদ
নগেন্দ্রনাথ ও অক্ষয়কুমার বড়বাজারে আসিয়া জানিতে পারিলেন যে, ললিতাপ্রসাদের পিতা গদিতে আছেন। উভয়ে গদিতে প্রবেশ করিলেন।
অক্ষয়কুমার দেখিলেন, তিনি এক স্থবির মাড়োয়ারি—বুদ্ধিমান্ ব্যবসাদার, চতুর মাড়োয়ারীর যেরূপ হওয়া উচিত, তিনি ঠিক সেইরূপ মাড়োয়ারী। তাঁহাকে দেখিয়া অক্ষয়কুমার বুঝিলেন যে, তাঁহার নিকটে কোন কথা বাহির করা সহজ নহে।
অক্ষয়কুমারকে দেখিয়া তিনি জিজ্ঞাসিলেন, “আপনার কি দরকার?”
অক্ষয়কুমার নিজ পরিচয় বলিলেন। তখন তিনি উঠিয়া বলিলেন, “এইদিকে আসুন।”
উভয়কে এক নিৰ্জ্জন গৃহে লইয়া গিয়া বলিলেন, “আপনি এখনও খুনের কিছুই সন্ধান করিতে পারেন নাই?”
“খুনী ধরিতে পারি নাই—তবে কতক সন্ধান পাইয়াছি।”
“কি পাইয়াছেন?”
“আপনাকে বলিতে পারি না। আমাদের সেরূপ রীতিও নহে।”
“আমার কাছে কি প্রয়োজনে আসিয়াছেন?”
“দুই-একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে। আপনি হুজুরীমলবাবুকে কি খুব ভাল লোক বলিয়া জানিতেন?”
“নিশ্চয়—সকলেই তাহা জানিত।”
“তাঁহার কি কোন দোষ ছিল না?”
“সংসারে কাহার না দোষ আছে?”
“তাহা হইলে অনুগ্রহ করিয়া বলুন, তাঁহার কি দোষ ছিল।”
“আপনি কি তাঁহার দোষ অনুসন্ধানের জন্য আমার নিকটে আসিয়াছেন? কোন্ সাহসে আপনি
এ কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন?”
“কর্তব্যের অনুরোধে জিজ্ঞাসা করিতেছি। কিজন্য তিনি খুন হইয়াছেন, তাহা জানিতে না পারিলে খুনীকে কখনও ধরা যায় না। তিনি জুয়াড়ী ছিলেন।”
“মিথ্যাকথা।”
“জুয়া খেলিয়া তিনি সৰ্ব্বস্বান্ত হইয়াছিলেন।”
“আপনি কোন্ সাহসে হুজুরীমলকে এ কথা বলেন?”
“সাহস—প্রমাণ। তিনি বাঁচিয়া থাকিলে দেউলিয়া হইতেন।”
“আপনি কি আমাদের গদির বদনাম রটাইতে এখানে আসিয়াছেন?”
“সত্যকথা অনেক জানিয়াছি; সেজন্য অনুরোধ করিতেছি যে, আপনি হুজুরীমল সম্বন্ধে যাহা জানেন, আমাকে খুলিয়া বলুন।”
রাগে বৃদ্ধের মুখ লাল হইয়া গেল। তিনি ক্রোধ-কম্পিতস্বরে বলিলেন, “মহাশয়, আপনি পুলিসের লোক—কি বলিব? যাহাই হউক আমি আপনাকে আর একটি কথাও বলিব না।”
অক্ষয়কুমার উঠিলেন। গম্ভীরভাবে বলিলেন, “তবে আমিই বলি, হুজুরীমল জুয়া খেলিয়া সর্ব্বস্বান্ত হইয়াছিলেন। তাহার উপরে আরও গুণ ছিল—তিনি গঙ্গাকে লইয়া এ-দেশ ছাড়িয়া পলাইবার বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন। গুরুগোবিন্দ সিংহ দশ হাজার টাকা তাঁহার নিকটে জমা রাখিয়াছিলেন; তিনি সেই টাকা লইয়া পলাইতেছিলেন। সেদিন খুন না হইলে পলাইতেনও।”
বৃদ্ধ মাড়োয়ারী আরও রুষ্ট হইয়া বলিলেন, “সব মিথ্যাকথা—”
অক্ষয়কুমার দেখিলেন, এই কঠিন মাড়োয়ারীর নিকট হইতে কোন কথাই জানিবার উপায় নাই; সুতরাং তিনি নিতান্ত বিরক্ত হইয়া তথা হইতে বিদায় লইলেন।
বাহিরে আসিয়া অক্ষয়কুমার নগেন্দ্রনাথকে বলিলেন, “এ বেটাও হুজুরীমলের মত বদমাইস। কে জানে, বেটারা হয়ত পাওনাদারকে ফাঁকী দেবার জন্য হুজুরীমলকে ইহজীবনের মত সরিয়েছে।”
নগেন্দ্রনাথের মনে এ কথা একবারও উদয় হয় নাই। তিনি নিতান্ত বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “বলেন কি—ইহাও সম্ভব?”
অক্ষয়কুমার গম্ভীরভাবে বলিলেন, “সকলই সম্ভব। এখন ইহাদের বিস্তর দেনা হইয়াছে; হুজুরীমল বড় অংশীদার, তারই নামে সমস্ত লোকের পাওনা; তাহার বেঁচে থাকিলে রক্ষা নাই, আজ হউক কাল হউক, দুইদিন পরে সকল কথা প্রকাশ হইয়া পড়িত; তখন হুজুরীমলকে জেলে যাইতে হইত। এ অবস্থায় হাজার লোকে প্রত্যহ আত্মহত্যা করিতেছে, খুনও হইতেছে। এই বুড়ো মাড়োয়ারী যেরূপ বদমাইস, তাহাতে আর আশ্চর্য্য কি?”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তবে কি এই বুড়োই লোক দিয়া নিজের অংশীদারকে খুন করিয়াছে। তাহা হইলে আমরা যাহা কিছু ভাবিতেছিলাম সকলই আমাদের ভুল?”
অক্ষয়কুমার গম্ভীরভাবে বলিলেন, “তাহাই যে ঠিক, তাহা বলি না, তবে সম্ভব—খুব সম্ভব। বুড়ো মাড়োয়ারী যেরূপ চতুর, তাহাতে সে নিজেকে বাঁচাইবার জন্য এও পারে—তবে প্রমাণ নাই—ঐ হল মুস্কিল।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “এটা খুব সম্ভব বটে, সন্ধান করা উচিত।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “তাহা না করিয়া সহজে ছাড়িব কি?”
একাদশ পরিচ্ছেদ
অক্ষয়কুমার কিয়দ্দূর আসিয়া বলিলেন, “আসুন, একবার গুরুগোবিন্দ সিংহের সঙ্গে দেখা করিয়া যাই।”
উভয়ে গুরুগোবিন্দ সিংহের বাসায় আসিলেন। সৌভাগ্যের বিষয়, তিনি তখন বাসায় ছিলেন। তিনি তাঁহাদের উভয়কে সমাদরে বসাইলেন। অক্ষয়কুমার বলিলেন, “নোট সম্বন্ধে আপনাকে দুই- একটা কথা জিজ্ঞাসা করিবার জন্য আসিলাম।”
গুরুগোবিন্দ বলিলেন, “বলুন, কি জানিতে চাহেন?”
“যে দারোয়ান আপনার নামের চিঠীসহ নোট আপনার চাকরকে দিয়াছিল, তাহাকে এখন দেখিলে সে চিনিতে পারিবে?”
“সে বলে যে, লোকটা ছদ্মবেশ পরিয়া আসিয়াছিল। তাহার বড় লম্বা দাড়ী ছিল; বোধ হয়, সে দাড়ী পরচুলের হইবে।”
“তবে সে তাহাকে তখনই ধরিল না কেন?’ “সে লোকটা এক মিনিটও দেরী করে নাই।”
“যাহা হউক, নোটগুলি কি দেখিতে পাইব?”
“পাইবেন,” বলিয়া গুরুগোবিন্দ অন্য গৃহ হইতে নোটগুলি আনিয়া অক্ষয়কুমারের হাতে দিলেন। তিনি নোটগুলি বিশেষরূপে দেখিয়া বলিলেন, “এই দশখানা নোটই কি আপনি হুজুরীমলবাবুকে রাখিতে দিয়াছিলেন?”
“না।”
অক্ষয়কুমার সবিস্ময়ে বলিলেন, “তবে এ নোট কোথা হইতে আসিল?”
“গুরুগোবিন্দ সিং বলিলেন, “আমিও ইহার কিছুই ভাবিয়া পাই নাই। এ নোট আমি হুজুরীমলের
নিকট জমা রাখি নাই; সে নোটের নম্বর আমার কাছে আছে—সে এ নোট নয়।”
“ইহার মধ্যে কি একখানিও আপনার সেই নোট নয়?”
“একখানিও না।”
“তবে এ নোট কোথা হইতে আসিল?”
‘কেমন করিয়া বলিব? বোধহয়, যে চুরি করিয়াছিল, সে নোট বদলাইয়া ফেলিয়াছিল, এখন সেই বদ্লান নোট ফেরৎ দিয়াছে।”
“কেন ফেরৎ দিয়াছে?”
“হয়ত ভয়ে–হয়ত বা অনুতাপে।”
“যে এই দশ হাজার টাকা পাইবার জন্য দুইটা খুন করিয়াছিল, সে কি সহজে টাকা ফেরৎ দেয়?”
“আমি ত কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।”
“যাহা হউক, আপনার নোট কে ভাঙাইয়াছিল, জানিতে পারিলে খুনীর সন্ধানও হইবে। আপনার সেই নোটের নম্বরগুলি দিন।”
গুরুগোবিন্দ উঠিয়া গিয়া আবার একখানি কাগজ লইয়া আসিলেন।
অক্ষয়কুমার নোটের নম্বর লইয়া গুরুগোবিন্দের বাড়ী হইতে বহির্গত হইলেন। নগেন্দ্রনাথ পথে আসিয়া বলিলেন, “এ নোট সম্বন্ধে আপনি কি মনে করেন?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “আমি এখন কিছুই মনে করি না। আশ্চর্য্যের বিষয়, এই নোট কে ভাঙাইয়াছিল, তাহা এখনও প্রকাশ পায় নাই।”
“হয়ত সে নোট এখনও কেহ ভাঙায় নাই।”
“এমন কে মহাত্মা যে, ঘর থেকে দশ হাজার টাকা দান করিবে?”
“ইহাও ত গুরুগোবিন্দ সিং-এর একটা ফন্দী হইতে পারে।”
“নগেন্দ্রবাবু ইহা উপন্যাস লেখা নয়—ইহাতে অনেক গোলযোগ—ক্রমেই গোলযোগের বৃদ্ধি রহস্য ক্রমেই জটিল হইতেছে। যাহাই হউক, আমি আপনাকে একটা কাজের ভার দিতেছি।”
“বলুন।”
“এ নোট কেহ কোথায়ও ভাঙাইয়াছে কি না, আপনি এখন তাহারই সন্ধান করুন।”
“যথাসাধ্য চেষ্টা করিব।”
“যদি কেহ নোট ভাঙাইয়া থাকে, নিশ্চয়ই জানিতে পারা যাইবে।”
“তাহা হইলে কি আপনি খুনী ধরিতে পারিবেন?”
“খুব সম্ভব। আমার বিশ্বাস। হুজুরীমল যখন খুন হয়, তখন তাহার নিকট গুরুগোবিন্দ সিং-এর দশ হাজার টাকার নোট ছিল। যে খুন করিয়াছে, সে সেই নোটগুলি লইয়াছিল।”
“তাহাই যদি হয়, তবে সে বেনামী করিয়া নোট ভাঙাইতে পারে।”
“সম্ভব; তবুও তাহাকে বাহির করিতে পারিলে অনেক সন্ধান পাওয়া যাইবে। আপনার উপরে এই ভার থাকিল।”
“প্রাণপণে চেষ্টা করিব।”
“এদিকে আমি অন্য চেষ্টায় রহিলাম। যতদূর যাহা করিতে পারেন, সংবাদ দিবেন।”
“দিব, তবে মধ্যে মধ্যে আপনার সঙ্গে দেখা হওয়া প্রয়োজন।”
“দেখা করিব বই কি।”
তখন উভয়ে উভয় দিকে প্রস্থান করিলেন। নগেন্দ্রনাথ সেইদিন হইতে সেই নোট কোথায় কে ভাঙাইয়াছে, তাহারই সন্ধানে ঘুরিতে লাগিলেন।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
দিনের পর দিন অতিবাহিত হইতে লাগিল। অক্ষয়কুমার খুনের এখনও কোন কিনারা করিতে পারেন নাই। তাঁহার বিশ্বাস, রঙ্গিয়ার কোন ভালবাসার লোক ছিল; সে কোন গতিকে জানিতে পারে যে রঙ্গিয়া রাত্রিতে গোপনে একাকী হুজুরীমলের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইতেছে, তাহাই সে তাহার অনুসরণ করিয়াছিল। সেই রাগে উন্মত্ত হইয়া প্রথমে হুজুরীমলকে খুন করে। তৎপরে সেই রঙ্গিয়ার সঙ্গে আসিয়া গাড়ীতে উঠে। পরে গঙ্গার ধারে আসিয়া তাহাকেও খুন করে। এরূপ খুন প্রায়ই হয়। কিন্তু কে রঙ্গিয়ার ভালবাসার লোক ছিল, তাহা অক্ষয়কুমার এতদিনে কিছুতেই জানিতে পারিলেন না। তাঁহার দৃঢ় বিশ্বাস যে, কেহ নিশ্চয়ই ছিল—কিন্তু কে যে, ইহাই সমস্যা। অনেক অনুসন্ধানেও তিনি ইহা জানিতে পারিলেন না।
তিনি এই খুনের বিষয় লইয়া নিজ গৃহে বসিয়া আন্দোলন করিতেছিলেন। এই খুন লইয়া তাঁহার আহার নিদ্রা গিয়াছে—দিন রাত্রিই তিনি এই বিষয় লইয়া ব্যতিব্যস্ত—নাস্তানাবুদ।
অদ্যও এ বিষয়ে কি করিবেন না করিবেন, মনে মনে ভাবিতেছিলেন, এই সময়ে সেখানে অত্যন্ত ব্যস্তভাবে নগেন্দ্রনাথ উপস্থিত হইলেন। তিনি গৃহে প্রবিষ্ট হইয়াই বলিলেন, “যে কাজের ভার দিয়াছিলেন, তাহা সম্পন্ন করিয়াছি।”
অক্ষয়কুমার তাঁহার ভাব দেখিয়া বলিলেন, “ব্যাপার কি?”
নগেন্দ্ৰনাথ ব্যগ্র হইয়া বলিলেন, “নোট যেখানে ভাঙাইয়াছে, তাহা সন্ধান করিয়া বাহির করিয়াছি।” অক্ষয়কুমার শুনিয়া সন্তুষ্ট হইলেন। বলিলেন, “খুনের আগেই লোকটা নোট ভাঙাইয়াছিল; কাজেই গুরুগোবিন্দ সিংহের নোটের নম্বর চারিদিকে দেওয়ায় নোট ধরা পড়ে নাই। আমি জানি, কেন আগে ভাঙাইয়াছিল।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “কেন? আপনি কি মনে করিতেছেন?”
“নোট চুরি প্রকাশ হইবার অনেক আগে না ভাঙাইলে, এত বড় নম্বরী নোট পরে ভাঙাইবার আর উপায় ছিল না।”
“কে ভাঙাইয়াছে আপনি অনুমান করিতেছেন?”
“এ মনে করা কি কঠিন কাজ।”
কে আপনি মনে করেন?”
“কেন হুজুরীমল।”
“তা নয়।”
“তবে কে?”
“ললিতাপ্রসাদ!”
“ললিতাপ্রসাদ,” এই বলিয়া অক্ষয়কুমার সবেগে লাফাইয়া দাঁড়াইয়া উঠিলেন। বলিলেন, “ইহা আমি একবারও মনে করি নাই। ঠিক জানিয়াছেন?”
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “হাঁ, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। এই কলিকাতারই একটা বড় গদিতে ভাঙাইয়াছে; তাহারা ললিতাপ্রসাদকে বেশ চেনে।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “শীঘ্র আসুন, আমরা এখনই ললিতাপ্রসাদের সঙ্গে দেখা করিব।” নগেন্দ্রনাথ বলিলে, “আপনি তাহাকে গ্রেপ্তার করিবেন নাকি?”
“নিশ্চয়ই, যদি কারণ দেখি।”
“জানি না, সে কি বলিবে।”
“দু’হাজার মিথ্যাকথা বলিবে।”
“নাও বলিতে পারে।”
“ফাঁসী-কাঠ হইতে গৰ্দ্দান সরাইতে অনেকে অনেক মিথ্যাকথা বলে।”
“তবে কি আপনি মনে করেন, সে-ই খুন করিয়াছে?”
“আমি এখন কিছুই বিবেচনা করি নাই। দেখি, তাহার কি বলিবার আছে।”
উভয়ে সত্বর আসিয়া ললিতাপ্রসাদের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। তাঁহারা মনে করিয়াছিলেন যে, ললিতাপ্রসাদকে এ কথা জিজ্ঞাসা করিলে তিনি ইতস্ততঃ করিবেন, কি হয়ত একেবারে অস্বীকার করিবেন—নিশ্চয়ই তাঁহার ভাব-ভঙ্গির পরিবর্ত্তন হইবে; কিন্তু ললিতাপ্রসাদের ভাবে তাঁহারা উভয়েই বিশেষ আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। তাঁহাকে এ কথা জিজ্ঞাসা করিবামাত্র তিনি এ কথা স্বীকার করিলেন। তিনি বিন্দুমাত্র ইতস্ততঃ করিলেন না। বলিলেন, “হাঁ, আমিই নোট ভাঙাইয়াছিলাম।’
অক্ষয়কুমার তাঁহাকে সন্দেহ করিয়াছেন বলিয়া তিনি মহারুষ্ট হইলেন। বলিলেন, “আমি নোট ভাঙাইয়াছিলাম বলিয়া আপনি মনে করিয়াছেন যে; আমি এই খুনের মধ্যে আছি। আপনি অদ্ভুত লোক, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।”
অক্ষয়কুমার মৃদুস্বরে বলিলেন, “অনেক সময়ে আমাদিগকে অদ্ভুত হইতে হয়। তবে শুনিতে পাই কি, আপনি এ নোট কিরূপে ভাঙাইলেন। নোট হইল গুরুগোবিন্দ সিংহের, তিনি জমা রাখিলেন হুজুরীমলের কাছে, নোট ভাঙাইলেন আপনি—কেন?”
ললিতাপ্রসাদ ক্রুদ্ধভাবে বলিলেন, “হাঁ, আমি নোট ভাঙাইয়াছিলাম।” হুজুরীমলবাবু অনুরোধ করিয়াছিলেন বলিয়া ভাঙাইয়াছিলাম।”
অক্ষয়কুমার সেইরূপ মৃদুস্বরে বলিলেন, “কেন?”
ললিতাপ্রসাদ বলিলেন, “গুরুগোবিন্দ সিংহ হুজুরীমলকে নোট বদ্লাইয়া রাখিতে অনুরোধ করিয়াছিলেন।”
অক্ষয়কুমার নগেন্দ্রনাথের দিকে চাহিলেন। নগেন্দ্রনাথও কিছু বুঝিতে না পারিয়া তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলেন। উভয়েই অবাক্।
চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ
কিয়ৎক্ষণ পরে অক্ষয়কুমার বলিলেন, “এ কথা ঠিক নহে। নোট বদ্লান হইয়াছে দেখিয়া, গুরুগোবিন্দ সিংহ আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়াছিলেন; তিনি ইহার কিছুই জানিতেন না।”
ললিতাপ্রসাদ বিরক্তভাবে বলিলেন, “আমি তাহা জানি না। হুজুরীমলবাবু খুন হইবার প্রায় তিন সপ্তাহ পূর্ব্বে তিনি একদিন গোপনে লইয়া গিয়া আমাকে একটা কাজ করিবার জন্য বিশেষ অনুরোধ করেন। তিনি আমাদের গদির অংশীদার—আমার পিতৃবন্ধু, আমি তাঁহার অনুরোধ রক্ষা করিতে বাধ্য।”
“নিশ্চয়ই। অনুরোধটা কি শুনিতে পাই না?”
“তিনি বলেন যে, গুরুগোবিন্দ সিংহ পঞ্জাবের একটা সম্প্রদায়ের লোক, তিনিও তাহাই। এই সম্প্রদায়ের দশ হাজার টাকা কি কাজের জন্য গুরুগোবিন্দ সিং কলিকাতায় আনিয়াছেন। এই সম্প্রদায়ের সব কাজই গোপনে হয়—কে এই সম্প্রদায়ে আছে, তাহা কেহ জানিতে পারে না। অনেক বড়লোক এই সম্প্রদায়ভুক্ত, তাঁহারাই টাকা দিয়া থাকেন। কিন্তু তাঁহারা কিছুতেই ইচ্ছা করেন না যে, অপরে ইহা জানিতে পারে। এই সকল নম্বরী নোট তাঁহারাই দিয়াছিলেন; পাছে গুরুগোবিন্দ সিং বা হুজুরীমল ভাঙাইলে কাহাদের নোট লোকে জানিতে পারে, এইজন্য তিনি আমাকে নোটগুলি ভাঙাইয়া দিতে অনুরোধ করেন। এ কি অন্যায় কাজ?”
“নিশ্চয়ই নয়।”
“তাই আমি নোট ভাঙাইয়া অপর নোট আনিয়া তাঁহাকে দিয়াছিলাম—লুকাইয়া গোপনে নোট ভাঙাই নাই।
“এ কথা আগে বলেন নাই কেন?”
“হুজুরীমলবাবু এ কথা প্রকাশ করিতে বিশেষরূপে নিষেধ করিয়াছিলেন। পাছে অপরকে দিয়া ভাঙাইলে প্রকাশ হয় বলিয়াই তিনি আমাকে অনুরোধ করিয়াছিলেন।”
“তিনি খুন হওয়ার পরেও আপনি বলেন নাই কেন?”
“বলিবার ইচ্ছা করিয়াছিলাম, কিন্তু পাছে আপনারা আমাকে সন্দেহ করেন, এই ভয়ে বলি নাই।”
“আপনি কি শুনেন নাই, গুরুগোবিন্দ সিং নোট ফেরৎ পাইয়াছেন?”
“হাঁ শুনিয়াছি।”
“আপনি যে নোটগুলি ভাঙাইয়া আনিয়াছিলেন, ঠিক সেইগুলি নম্বরে মিলিয়াছে?”
“হইতে পারে, যে চুরি করিয়া লইয়াছিল, সে-ই ভয়ে ফেরৎ দিয়াছিল।”
“আপনি স্বচক্ষে দেখিয়াছিলেন যে, যখন হুজুরীমল বাহির হইয়া যান, তখন উমিচাঁদ নোটগুলি
সিন্দুকে রাখিয়াছিল?”
“হাঁ, আমি সেখানে ছিলাম।”
“তাহার পর আর কেহ সেখানে আসে নাই?”
“তা ঠিক বলিতে পারি না। উমিচাঁদ জানে।” এই বলিয়া ললিতাপ্রসাদ উঠিলেন। বলিলেন, “মহাশয়, আমার অনেক কাজ আছে। এখন আপনারা বিদায় হইতে পারেন। ভদ্রলোককে অনর্থক বিপদগ্রস্ত করা আপনাদের স্বভাব। ভদ্রলোকের নামে কখন এরূপ অপবাদ দিবেন না।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “আপনার নামে কোন অপবাদ দেওয়া হয় নাই—কেবল জিজ্ঞাসা করা হইয়াছে, আপনি নোট ভাঙাইয়াছিলেন কি না, আর ভাঙাইয়াছেন—কেন?”
ললিতাপ্রসাদ বলিলেন, “আপনারা এখন যাইতে পারেন।“
নগেন্দ্রনাথ এই যুবকের ব্যবহারে নিজেকে অপমানিত মনে করিয়া ক্রুদ্ধ হইলেন। অক্ষয়কুমার বাহিরে যাইবার সময়ে মস্তকান্দোলন করিয়া বলিলেন, “অতি দর্পে হত লঙ্কা!”
ললিতাপ্রসাদ কথা কহিলেন না। ভ্রূকুটি করিয়া অন্যদিকে চলিয়া গেলেন।
****
রাস্তায় আসিয়া নগেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন কি করিবেন?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “একবার গুরুগোবিন্দ সিংহকে জিজ্ঞাসা করিব, সে যথার্থই নোট ভাঙাইবার জন্য অনুরোধ করিয়াছিল কি না।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আমি একবার যমুনার সঙ্গে দেখা করিতে চাই—আপনি কি বলেন?” অক্ষয়কুমার হাসিয়া বলিলেন, “নগেন্দ্রবাবু, দেখিবেন, যেন হঠাৎ প্রেমে পড়িবেন না।”
“আপনার সব সময়ই বিদ্রূপ।”
“বড় বিদ্রূপ নয়।”
“যাক্—এখন আপনি এ বিষয়ে কি বলেন?”
“সে যে এ ব্যাপারে কোন কথা বলিবে বলিয়া আমার বোধ হয় না।”
“আপনাকে পুলিসের লোক বলিয়া না বলিতেও পারে।”
“মহাশয়কেও ঠিক তাহাই স্থির করিবে।”
‘চেষ্টা করিয়া দেখিতে ক্ষতি কি? কেন সে রাত্রে হুজুরীমলের সঙ্গে দেখা করিয়াছিল, যদি সে বলে, তাহা হইলে হয়ত আমরা নূতন কিছু জানিতে পারিব।”
“কেবল হুজুরীমলের সঙ্গে দেখা করা নয়। তাহার একটু আগে উমিচাঁদের সঙ্গে গদিতে দেখা করিয়াছিল।”
“এ কথা কে বলিল? আপনি ত আমাকে এ কথা বলেন নাই?”
“আগে জানিতে পারি নাই।”
“কেন আসিয়াছিল?”
“উমিচাঁদ বলে হুজুরীমল তাহাকে পাঠাইয়াছিল।”
“কেন?”
“টিকিট আনিবার জন্য হুজুরীমল তাহাকে পাঠাইয়াছিল।”
“আশ্চর্য্যের বিষয়—সন্দেহ নাই। টিকিট আনিবার জন্য হুজুরীমল কি আর লোক পায় নাই!”
“যাইতেছেন—দেখুন, যদি কিছু তাহার নিকটে জানিতে পারেন।”
“চেষ্টা করায় ক্ষতি কি?”
নগেন্দ্রনাথ চন্দননগরে যাওয়া স্থির করিয়া রওয়া হইলেন। অক্ষয়কুমার, গুরুগোবিন্দ সিংহের বাসার দিকে চলিলেন।
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
কেবল যে অক্ষয়কুমার যমুনাকে লইয়া নগেন্দ্রনাথের সহিত রহস্য করিলেন—তাহা নহে, প্রকৃতপক্ষেই যমুনাকে দেখিয়া অবধি নগেন্দ্রনাথের হৃদয়ে তাহার মূর্ত্তি অঙ্কিত হইয়া গিয়াছে; তবে সে হিন্দুস্থানী—তিনি বাঙ্গালী—তবুও তিনি তাহাকে একবার দেখিবেন বলিয়াই চন্দননগরে চলিলেন। তাহার নিকটে যে, তিনি অধিক কিছু জানিতে পারিবেন, এ আশা করেন নাই।
তিনি পুলিস-সংশ্লিষ্ট লোক না হইলে তাঁহার সহিত যমুনার দেখা হইবার আশা ছিল না। তিনি হুজুরীমলের খুন সম্বন্ধে যমুনার সহিত দেখা করিতে চাহেন, এ সংবাদ পাইয়া যমুনা তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিল।
নগেন্দ্রনাথ প্রথমে কি বলিবেন, কিরূপে কথা আরম্ভ করিবেন, কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন। অবশেষে মাথা চুল্কাইতে চুল্কাইতে বলিলেন, “আমি সেই মোকদ্দমার জন্য আসিয়াছি।”
যমুনা মস্তক অবনত করিয়া দাঁড়াইয়াছিল। সে সেইরূপভাবে থাকিয়া মৃদু মধুরস্বরে কহিল, ‘মেসো মহাশয়ের খুনের বিষয়ে কোন সন্ধান পাইলেন?”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আমি খুনের বিষয়ের জন্য এখানে আসি নাই—চুরির জন্য আসিয়াছি।”
“চুরির জন্য?” যমুনা অস্পষ্টস্বরে কহিল।
নগেন্দ্রনাথ দেখিলেন, সহসা তাহার মুখ মলিন হইয়া গেল।
নগেন্দ্রনাথ দেখিয়া বিস্মিত হইলেন। তিনি বলিলেন, “যে দশ হাজার টাকা আপনার মেসো মহাশয়ের সিন্দুক হইতে চুরি গিয়াছিল।”
যমুনা অতি মৃদুস্বরে কহিল, ‘কোন্ টাকা, কি হইয়াছে?”
“গুরুগোবিন্দ সিংহ সে টাকা ফেরৎ পাইয়াছেন।”
“ফেরৎ পাইয়াছেন! “
যমুনা এরূপভাবে এই কথা বলিল যে, বিস্মিত হইয়া নগেন্দ্রনাথ তাহার মুখের দিকে চাহিলেন। যমুনা অস্পষ্টস্বরে কহিল, “না, এ হতে পারে না—নিশ্চয়ই হতে পারে না।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “গুরুগোবিন্দ টাকা পাইয়াছেন।”
যমুনা ব্যগ্রভাবে বলিল, “তবে খুনী ধরা পড়িয়াছে?”
“না—ধরা পড়ে নাই।”
যমুনা অতিশয় বিচলিতভাবে বলিল, “ধরা পড়ে নাই—তবে টাকা ফেরৎ কিরূপে হইল?”
“একজন অজানা লোক গুরুগোবিন্দ সিংহের বাসায় তাঁহার চাকরের নিকটে একখানা পত্র রাখিয়া যায়; সেই পত্রের মধ্যে দশ হাজার টাকার নোট ছিল।”
“তাহা হইলে সেই লোকই খুন করিয়াছিল। সে-ই মেসো মহাশয়ের নিকট হইতে টাকা লইয়াছিল। নিশ্চয়ই সে-ই তাঁহাকে খুন করিয়াছিল। নিশ্চয়ই এ সেই লোক।”
“তাহা কিরূপে হইবে? হুজুরীমলবাবু যখন গদি হইতে যান, তখন উমিচাঁদ টাকা সিন্দুকে বন্ধ করিয়া রাখে। তিনি আর গদিতে ফিরেন নাই, তবে সে রাত্রে তাঁহার সঙ্গে টাকা কিরূপে থাকিবে?” যমুনা নিতান্ত বিচলিত হইল। সে কম্পিতস্বরে অস্পষ্টভাবে বলিল, “তা—ঠিক কথা। আমার ভুল হইয়াছে—”
নগেন্দ্রনাথ স্পষ্ট বুঝিলেন, টাকা সম্বন্ধে যমুনা সকল কথাই জানে, সে কিছুতেই বলিতেছে না। তিনি সেইজন্য বলিলেন, “দেখুন, আপনার কোন কথা গোপন করা উচিত নয়; আপনি সকল কথা না বলিলে একজন নিদোষী লোক জেলে যায়—হয়ত তাহার ফাঁসীও হইবে।”
যমুনার মুখ হইতে কথা সরিল না। সে বংশপত্রের ন্যায় কাঁপিতে লাগিল—তাহার মলিন মুখ আরও মলিন হইয়া গেল। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া যমুনা অন্যদিকে মুখ ফিরাইল।
নগেন্দ্রনাথ কিছুই বুঝিতে না পারিয়া বলিলেন, “আপনি সকল কথা জানা সত্ত্বেও সে কথা প্রকাশ না করায় যদি একজন লোক বিনা দোষে ফাঁসী-কাঠে যায়, তাহা হইলে আপনার এ জীবনে আর শান্তি থাকিবে না।”
যমুনা সভয়ে চারিদিকে চাহিল। তাহার সর্ব্বাঙ্গ কম্পিত হইতে লাগিল। অতি মৃদুস্বরে বলিল, “আমার বলিতে সাহস হয় না।”
নগেন্দ্রনাথ তাহাকে আশ্বস্ত করিবার জন্য বলিলেন, “কে টাকা লইয়াছে, তাহা আমাকে বলুন- কোন ভয় নাই।”
তাঁহার মিষ্ট কথায় বা যেকোন কারণে হউক, যমুনা যেন কতক আশ্বস্ত হইল। ধীরে ধীরে বলিল, “আমি পঞ্জাবের সম্প্রদায়ের ভয়ে বলিতে পারি নাই; শুনিয়াছি, তাহারা খুন করে—
“আপনার কোন ভয় নাই, বলুন।”
“এখন না বলিলে নয়—বিশেষ আপনি ভদ্রলোক—
“আপনি নির্ভয়ে বলুন, কোন ভয় নাই।”
‘কে টাকা লইয়াছে—আমি জানি।”
“কে বলুন।”
যমুনা নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল। তখন নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “কে—উমিচাঁদ?”
যমুনা অস্পষ্টস্বরে বলিল, “না।”
“তবে কে—গুরুগোবিন্দ সিংহ?”
“না—যমুনা।”
“অ্যাঁ—তুমি—তুমি”
“হাঁ, আমি।”
ষোড়শ পরিচ্ছেদ
যমুনার কথা শুনিয়া নগেন্দ্রনাথের মস্তক বিঘূর্ণিত হইল। তিনি যাহাকে মানবীরূপে দেবী মনে করিয়াছিলেন, যাহার অপরূপরূপলাবণ্যে তিনি মুগ্ধ হইয়াছিলেন, নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও যাহার মূৰ্ত্তি সর্ব্বদাই তাঁহার হৃদয়ে উদিত হইতেছিল, প্রকৃতপক্ষে যাহাকে একবার দেখিতে পাইবেন বলিয়াই তিনি আজ চন্দননগরে আসিয়াছিলেন, সে এই খুনের ব্যাপারে জড়িত। সে কেবল খুনী নহে—চোর পর্য্যন্ত। তাঁহার মস্তক বিঘূর্ণিত হইল—তিনি স্তম্ভিতভাবে কিয়ৎক্ষণ ব্যাকুলভাবে যমুনার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
যমুনা তাঁহার মনের ভাব বুঝিল। সে সগৰ্ব্বে মাথা তুলিয়া, গ্রীবা বাঁকাইয়া দাঁড়াইল। তাহার সেই ভাবে, তাহার সৌন্দর্য্য শতগুণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইল। নগেন্দ্রনাথ যমুনার সেই মনোমোহন ভঙ্গীতে আবার মুগ্ধ হইলেন।
যমুনা বলিল, “ভাল করিয়াছি, কি মন্দ করিয়াছি—জানি না। যাহা করিয়াছি, মেসো মহাশয়ের হুকুমে, তাঁহারই জন্য করিয়াছি। কাহাকে এ কথা বলি নাই—তাঁহারই অনুরোধে প্রকাশ করি নাই- কিন্তু এখন প্রকাশ না করিলে নয়, তাহাই বলিতেছি।”
নগেন্দ্রনাথ কেবলমাত্র বলিলেন, “বলুন।” তাহার কি বলিবার আছে, শুনিবার জন্য নগেন্দ্ৰনাথ ব্যগ্র হইয়াছিলেন। সে কি কোন কুকার্য্য করিতে পারে, তাহা তাঁহার মন লইতে ছিল না; এ চিন্তাতেও তাঁহার হৃদয়ে কষ্ট হইতেছিল। তিনি বলিলেন, “বলুন।“
যমুনা বলিল, “মৃত্যুর দিন সকালে মেসো মহাশয় আমাকে ডাকিয়া গোপনে বলিলেন, ‘দেখ যমুনা, তোমায় আমি বড় ভালবাসি; আমি জানি, তুমিও আমাকে বড় ভালবাস, সেইজন্য তোমাকেই বলিতেছি, দেখিয়ো যেন কিছুতেই এ কথা কাহারও নিকটে প্রকাশ করিয়ো না।’ আমি মেসো মহাশয়কে বড় ভালবাসিতাম, আমি তাঁহার নিকটে অঙ্গীকার করিলাম। আমি প্রাণ থাকিতে সে অঙ্গ কার কখনও ভাঙিতাম না; কিন্তু এখন প্রকাশ না করিলে হয়ত একজন নির্দোষী লোক ফাঁসী যায়, তাহাই বলিতেছি। একদিন মেসো মহাশয়ের নিকটে শুনিয়াছিলাম, তিনি যখন পঞ্জাবে মাসীমাকে বিবাহ করিতে যান, তখন এক সম্প্রদায়ের মধ্যে যাইয়া পড়েন।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “সম্প্রদায়ের কথা আমরা শুনিয়াছি, সে সম্প্রদায়ের চিহ্ন সিঁদুর মাখা শিব।”
“হাঁ, যে এই সম্প্রদায়ভুক্ত হয়, সে আর কখনও এ সম্প্রদায় ত্যাগ করিতে পারে না, প্রাণপণে এই সম্প্রদায়কে সাহায্য করিতে সে বাধ্য থাকে—না করিলে তাহার প্রাণদণ্ড হয়, যেকোন উপায়ে এই সম্প্রদায় তাহাকে খুন করে।”
“ইহাও আমরা শুনিয়াছি।”
“মাস কয়েক হইল, গুরুগোবিন্দ সিংহ আসিয়া মেসো মহাশয়কে এই সম্প্রদায়ের দশ হাজার টাকা রাখিতে দেয়। গুরুগোবিন্দ সিংহও এই সম্প্রদায়ের একজন।”
“তাহাও আমরা জানি। সম্প্রদায়ের টাকা যে চুরি গিয়াছিল, তাহা আমরা জানি।“
“মেসো মহাশয়ের খুনের এক সপ্তাহ আগে তিনি তাঁহার বিছানায় একদিন হঠাৎ একটা সিঁদুরমাখা শিব দেখিতে পান।”
“সিঁদুরমাখা শিব!”
“হাঁ, সম্প্রদায় যাহাকে কোন কাজ করিতে হুকুম করে, তাহাকে কোনরূপে একটা সিঁদুর মাখা শিব পাঠাইয়া দেয়। ইহার অর্থ এই যে, যদি সে সম্প্রদায়ের হুকুম না শুনে, তবে তাহাকে সম্প্রদায় খুন করে এবং তাহার কাছে একটা সিঁদুরমাখা শিব রাখিয়া দেয়।”
“এ সবও আমরা শুনিয়াছি।”
“সেই শিবের সঙ্গে মেসো মহাশয় একখানা পত্রও পান। ঐ পত্রে লেখা ছিল;—তোমাকে হুকুম করা যায়, তুমি পত্র পাইবামাত্র বড়বাজারের রাণীর গলিতে শনিবার রাত্রি বারটার সময়ে তোমার নিকটে যে সম্প্রদায়ের দশ হাজার টাকা আছে, তাহা সম্প্রদায়ের অন্যতম সভ্য শান্তপ্রসাদকে দিবে। যেন কোন মতে অন্যথা না হয়—সাবধান! “
“আপনি এ পত্র দেখিয়াছিলেন?”
“হাঁ, মেসো মহাশয় আমাকে দেখাইয়াছিলেন।”
“তাহার পর তিনি কি করিবেন, স্থির করিলেন।”
“তিনি সম্প্রদায়ের হুকুম অমান্য করিতে সাহস করিলেন না। তিনি জানিতেন, “নিশ্চয়ই গোপনে সম্প্রদায় তাঁহাকে খুন করিবে। তিনি টাকা শান্তপ্রসাদকে পৌঁছাইয়া দেওয়াই স্থির করিলেন। অথচ তিনি এ কথা গুরুগোবিন্দ সিংহকে প্রকাশ করিতে সাহস করিলেন না; কারণ তিনি জানিতেন, এ কথা গুরুগোবিন্দ সিংহের নিকটে প্রকাশ করিলেও সম্প্রদায় তাঁহাকে খুন করিবে।”
“এরূপ ভয়ানক সম্প্রদায় ত দেখা যায় না।”
“হাঁ, আমিও সম্প্রদায়ের ভয়ে এতদিন কোন কথা প্রকাশ করিতে সাহস করি নাই। আপনি অতিশয় ভদ্রলোক, তাহাই বলিতেছি।”
যমুনার মুখে নিজের প্রশংসা শুনিয়া নগেন্দ্রনাথ মনে মনে বড় সন্তুষ্ট হইলেন। বলিলেন, “তারপর তিনি কি করিলেন?”
যমুনা বলিল, “এইজন্য তিনি গোপনে টাকা রাত্রি মধ্যে শান্তপ্রসাদকে পৌঁছাইয়া দেওয়া স্থির করিলেন।”
“গুরুগোবিন্দ টাকা চাহিলে কি করিতেন?”
“তিনি সেইদিনই আগ্রায় যাইতেছিলেন। ভাবিয়াছিলেন, গুরুগোবিন্দ শীঘ্র টাকা চাহিবে না, চাহিলেও টাকা চুরি গিয়াছে ভাবিবে, তাঁহাকে সন্দেহ করিবে না। এইজন্য তিনি টাকা লইয়া উমিচাঁদকে গদির সিন্দুকে রাখিতে দেন।”
“তাহা ত আমরা জানি। তিনি উমিচাঁদকে টাকা রাখিতে দিলে সে ললিতাপ্রসাদের সম্মুখে টাকা বন্ধ করিয়া রাখে। পরে তিনি আর গদিতে যান নাই; তিনি টাকা পাইলেন, কোথা হইতে?”
“তাহাই বলিতেছি, মেসো মহাশয় এইসকল কথা আমাকে বলিয়া আমার দুই হাত ধরিয়া বলিলেন, ‘যমুনা, কেবল তুই আমাকে রক্ষা করিতে পারিস্, নতুবা সম্প্রদায়ের হাত হইতে আমার রক্ষার উপায় নাই।”আমি প্রাণ দিয়াও তিনি যাহা বলিবেন তাহা করিব, স্বীকার করিলাম। তখন তিনি বলিলেন, ‘তুই সন্ধ্যার পর গদিতে যাইবি—আমার রেলের টিকিট আমি সেখানে ফেলিয়া আসিব সিন্দুকের ঘরে উমিচাঁদ ছাড়া আর কেহ থাকে না, তাহাকে কোনরকমে অন্যত্র পাঠাইয়া সিন্দুক হইতে টাকা বাহির করিয়া আনিয়া আমায় দিবি।”
“আপনি সিন্দুক খুলিলেন, কিরূপে?”
“সিন্দুকের একটা চাবি উমিচাদের কাছে—আর একটা মেসো মহাশয়ের কাছে থাকিত, তিনি সেই চাবিটা আমাকে দিলেন।”
“আপনি এ কাজ করিতে স্বীকার করিলেন?”
“কি করি, এ অবস্থায় পড়িলে আপনিও করিতেন। আমি এ কাজ না করিলে সম্প্রদায় মেসো মহাশয়কে খুন করে—“
“এই কলিকাতা সহরে খুন করা সহজ নয়।”
“সম্প্রদায়ই ত তাঁহাকে খুন করিয়াছে।”
“কেমন করিয়া জানিলেন?”
“নিশ্চয়ই—তাঁহার মৃতদেহের নিকটে একটা সিঁদুরমাখা শিব পাওয়া গিয়াছে—ঐ শিব সম্প্রদায়ের চিহ্ন।”
“এ বিষয়ে পরে আলোচনা করিব। তাহার পরে আপনি কি করিলেন?”
“আমি তাঁহার কথামত সন্ধ্যার পর গদিতে গিয়াছিলাম। সিন্দুকের ঘরে উমিচাঁদ ছাড়া আর কেহ ছিল না। আমি তাহাকে টিকিটের কথা বলিলাম। সে আমাকে টিকিট দিল। তাহার পর আমি জল খাইতে চাহিলে, সে জল আনিতে ছুটিল। সেই অবসরে আমি সিন্দুক খুলিয়া টাকা বাহির করিয়া লইলাম। উমিচাঁদ ফিরিয়া আসিলে আমি মেসো মহাশয়ের বাড়ীতে গিয়া তাঁহার সঙ্গে দেখা করিলাম। তিনি আমাকে ঘোমটা দিয়া যাইতে বলিয়াছিলেন, আমি সেইরূপেই গিয়াছিলাম; সেজন্য কেহ আমাকে চিনিতে পারে নাই। তাঁহার সঙ্গে দেখা হইলে তিনি আমায় বলেন যে, একটু আগে গুরুগোবিন্দ সিংহ আসিয়াছিল।”
“তিনি গুরুগোবিন্দ সিংহকে কিরূপে ঠাণ্ডা করিবেন, ভাবিয়াছিলেন?”
“তিনি ভাবিয়াছিলেন, এখানে থাকিবেন না, সুতরাং টাকা গিয়াছে শুনিয়া গুরুগোবিন্দ হঠাৎ তাঁহার কিছুই করিতে পারিবে না। সময়ে সম্প্রদায় নিশ্চয়ই টাকার সংবাদ দিবে, তখন তাহার আর কোন ভয় থাকিবে না।”
“হুজুরীমলবাবু খুব সাবধানী লোক ছিলেন, সন্দেহ নাই।”
“সাবধানী হইয়া আর ফল কি? সম্প্রদায়ই শেষ তাঁহাকে খুন করিল।”
“এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।”
“কেন? তবে কে তাঁহাকে খুন করিল? যদি সম্প্রদায় খুন না করিয়া থাকে, তবে তাঁহার নিকটে সিঁদুরমাখা শিব পাওয়া যাইবে কেন?”
“সম্প্রদায় যদি খুন করিবে, তবে সেই খুনের পর টাকা লইয়া সম্প্রদায় আবার গুরুগোবিন্দ সিংহকে ফেরৎ দিবে কেন?”
“আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।”
“আপনি দুখানা রেলের টিকিট উমিচাদের নিকট হইতে আনিয়া মেসো মহাশয়কে দিয়াছিলেন?”
“হাঁ, আপনি এসব কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন?”
“হুজুরীমল দুইখানা টিকিট কিনিয়াছিলেন, তার একখানা গঙ্গার জন্য। তিনি সেই রাত্রে গঙ্গাকে লইয়া বোম্বে পলাইতেছিলেন।”
যমুনা কোন কথা কহিল না। নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল।
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “হুজুরীমল ভাল লোক ছিলেন না। তিনি সম্প্রদায়ের দশ হাজার টাকা আপনার দ্বারা চুরি করাইয়া, নিজের স্ত্রী পরিবার ফেলিয়া একটা কুলটাকে লইয়া পলাইতেছিলেন। তিনি আপনাকে যাহা বলিয়াছেন, তাহা সর্ব্বৈব মিথ্যা।”
যমুনা মৃদুস্বরে বলিল, “তবে কে তাঁহাকে খুন করিল?”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, তাহারই সন্ধান হইতেছে। সম্ভবতঃ হুজুরীমল যে শান্তপ্রসাদের কথা বলিয়াছিলেন, সে কোন গতিকে ভিতরের কথা জানিতে পারিয়া সম্প্রদায়ের টাকাচোর হুজুরীমলকে খুন করিয়াছিল। এরূপ পাষণ্ডের মৃত্যু হইয়াছে, ভালই হইয়াছে।”
যমুনা ব্যাকুলভাবে নগেন্দ্রনাথের দিকে চাহিল। তাহার দুইটি চক্ষু জলে পূর্ণ হইয়া আসিল। সে সত্বর সেখান হইতে উঠিয়া গেল।