প্রথম খণ্ড
“I’ll example you with this very:
The sun sa thief, and with his great attraction Robs the vast sea : the moon’s and arrant thief, And her pale fire she snatches from the sun; The sea sa thief, whose liquid surge resolves The moon into salt tears: the earth’s sa thief, That feeds and breeds by a composture stolen From general excrement: each thing sa thief: The laws, your curb and whip, in their rough power Have uncheck’d theft. Love not yourselves : away; Rob one another, There’s more gold: cut throats : All that you meet are thieves:
Dodd’s Beauties of Shakspere.
প্রথম পরিচ্ছেদ – হত্যা—রহস্যপূর্ণ
নগেন্দ্রনাথবাবু নবীন গ্রন্থকার। অল্পদিনের মধ্যে সাহিত্য-ক্ষেত্রে তাঁহার বেশ নাম হইয়াছে—একজন ক্ষমতাশালী ঔপন্যাসিক বলিয়া পাঠকবর্গের নিকটে এক্ষণে তাঁহার প্রতিপত্তি খুব বেশী।
উপন্যাস সাধারণতঃ দুই প্রকার,—Romantic বা অলৌকিক ও Realistic বা প্রাকৃতিক। প্রথমোক্ত উপন্যাসে অনৈসর্গিক ও অতিরঞ্জিত ঘটনাবলীর সমাবেশ করিতে হয়; এবং শেষোক্ত উপন্যাসে যাহা স্বাভাবিক, যাহা সম্ভবপর ও বাস্তব কেবল এইরূপ ঘটনাবলীই লিপিবদ্ধ হইয়া থাকে। আমাদের নগেন্দ্রনাথবাবু শোষোক্ত উপন্যাসের বড় পক্ষপাতী; এবং কল্পনার সাহায্য গ্রহণে একান্ত নারাজ।
তিনি নিজের উপন্যাসের ঘটনাবলীকে স্বাভাবিকতার গণ্ডীর মধ্যে এরূপভাবে আবদ্ধ করিয়া রাখেন যে, সমালোচকের সুতীক্ষ্ণ বিষদন্ত এখানে বিদ্ধ হইবার কোন সুযোগ থাকে না। কল্পনার সাহায্য ব্যতিরেকে স্বাভাবিকতার স্বচ্ছ দর্পণে পাপ ও পুণ্যের নিখুঁত দৃশ্য প্রতিফলিত করাই উচ্চশ্রেণীর ঔপন্যাসিকের কার্য্য, ইহাই শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথবাবুর ধারণা; সেজন্য তিনি প্রাকৃত ঘটনা ও বিবিধ মনুষ্য-চরিত্র দেখিবার জন্য সর্ব্বদা ব্যগ্র।
প্রত্যহ অতি প্রত্যূষে উঠিয়া তিনি লিখিতে আরম্ভ করেন—প্রায় বেলা এগারোটা পর্যন্ত। তাহার পর মধ্যাহ্নে বিশ্রামকালে পুস্তক সংবাদপত্রাদি পাঠ করেন। অপরাহুটা বন্ধুদিগের সহিত : হাস্য- কৌতুকে কাটিয়া যায়। রাত্রিতে বেড়াইতে বাহির হন। রাত্রি বারটা পর্য্যন্ত তাঁহার লৌকিক উপন্যাসের উপাদান সংগ্রহ করিবার জন্য তিনি একাকী নগর-সমুদ্রের মধ্যে ঘুরিয়া বেড়ান। রাত্রিকালে যাহা সংগৃহীত হয়, তাহা অধিকাংশই চিত্তোত্তেজক। ঘটনা-বিন্যাস একাধারে বাস্তব ও চিত্তোত্তেজক হওয়ায় তাঁহার উপন্যাস অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী হইয়া উঠে। আজ তিনি এই উদ্দেশ্যে নৈশভ্রমণে বহির্গত হইয়াছেন।
প্রায় রাত্রি বারটার সময়ে তিনি কলিকাতার বড়বাজারের মধ্যস্থ বাঁশতলা গলির ভিতর দিয়া যাইতেছিলেন। এবং আশে পাশের দোকানদার ও পথিকগণকে বিশেষরূপে পর্যবেক্ষণ করিতেছিলেন।
তখন প্রায় সমস্ত দোকানই বন্ধ হইয়াছে। যে দুই-চারিখানি খোলা ছিল, তাহাও দোকানদারগণ বন্ধ করিতেছিল। পথেও লোক-চলাচল কম হইয়া আসিয়াছিল।
এই সময়ে নগেন্দ্রনাথের দৃষ্টি এক ব্যক্তির উপরে পড়িল। সেই ব্যক্তির বেশভূষায় একটু বিশেষত্ব ছিল বলিয়াই নগেন্দ্রনাথের দৃষ্টি তাহার উপর আকৃষ্ট হইল।
লোকটির বেশ সাধারণ দ্বারবানের ন্যায়। মাথায় একটা বড় পাগড়ি, গায়ে একটা আংরেখা। মুখে খুব বড় ঝাঁকড়া দাড়ি। দাড়িটা ভালো করিয়া দেখিলে পরচুলা বলিয়া বোধ হয়।
লোকটির বয়সও অনেক, ষাট বৎসরের কম নহে। তাহার ভূষা বা আকৃতি যেরূপই হউক, তাহার চলন দেখিলে তাহাকে দ্বারবান বলিয়া বোধ হয় না এবং লোকটি যেরূপভাবে চারিদিকে দৃষ্টি সঞ্চালন করিতেছিল, তাহাতে সহজেই বুঝিতে পারা যায়, যেন শহর তাহার সম্পূর্ণ অপরিচিত। নগেন্দ্রনাথ বুঝিলেন, লোকটা যেন কি অনুসন্ধান করিতেছে।
সে লোকটা একবার কিছুদূর চলিয়া গেল, আবার ফিরিয়া আসিল। একবার যেন নগেন্দ্রনাথকে কি জিজ্ঞাসা করিতে উদ্যত হইল, পরে আবার কি ভাবিয়া তাঁহাকে অতিক্রম করিয়া চলিয়া গেল। লোকটার ভাব দেখিয়া নগেন্দ্রনাথের কেমন সন্দেহ হইল। তিনি সেইখানে দাঁড়াইলেন। ফিরিয়া দেখিলেন, লোকটি হন্ হন্ করিয়া দ্রুতপদে অনেক দূর চলিয়া গেল; আবার কি মনে করিয়া ফিরিয়া ধীরে ধীরে তাঁহার দিকে আসিতে লাগিল।
নগেন্দ্রনাথ তাহার প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন, এবার লোকটি ফিরিয়া আসিয়া নগেন্দ্রনাথের নিকটস্থ হইয়া দাঁড়াইল। তৎপরে ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, “রাণীর গলি কোথায় আপনি জানেন কি?”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “বলিয়া দিলে তুমি কি চিনিয়া যাইতে পারিবে, বোধ হয় না। আমি সেইদিকে যাইতেছি, আমার সঙ্গে আসিলে আমি তোমায় দেখাইয়া দিতে পারি।”
সে ব্যক্তি অতি মৃদু স্বরে বলিল, “আপনাকে ভদ্রলোক দেখিতেছি।”
নগেন্দ্রনাথ হাসিয়া বলিলেন, “আপনার কথায় আপনাকেও তাহাই বোধ হয়।”
সে ব্যক্তি ব্যগ্রভাবে বলিল, “না—না—আমি আপনার সঙ্গে যাইতেছি—চলুন।”
নগেন্দ্রনাথ স্বভাবতই অধিক কথা কহিতে ভালবাসিতেন না। বিশেষতঃ একজন অপরিচিত লোককে বিনা কারণে কোন কথা জিজ্ঞাসা করা কর্ত্তব্য নহে ভাবিয়া তিনি নীরবে চলিলেন। তবে তিনি ইহা বুঝিলেন যে, লোকটি তাঁহাকে বিশ্বাস করে নাই; সে একটু দূরে থাকিয়া তাঁহার অনুসরণ করিতেছে। আরও দেখিলেন, সে তাহার বুকের পকেটটা হাত দিয়া চাপিয়া রহিয়াছে। দেখিয়া নগেন্দ্রনাথ মনে করিলেন, লোকটার পকেটে অনেক টাকার নোট অথবা বিশেষ মূল্যবান্ কোন কাগজপত্র আছে।
তিনি তাহার ভাব ভঙ্গিতে বেশ বুঝিয়া ছিলেন যে, লোকটা দ্বরওয়ান নহে কোন হিন্দুস্থানী ভদ্রলোক, এত রাত্রে এই স্থানে নিশ্চয়ই কোন কারণে ছদ্মবেশে আসিয়াছে। নিশ্চয়ই কোন মলব আছে।
রাণীর গলি যে ভদ্রলোকের পল্লী নহে নগেন্দ্রনাথ তাহা জানিতেন। কলিকাতার কোন স্থানই তাঁহার অবিদিত ছিল না। তিনি মনে মনে স্থির করিলেন “ইহার উপর একটু দৃষ্টি রাখিতে হইবে।” উভয়ে নীরবে চলিলেন, রাণীর গলির মোড়ে আসিয়া নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “এই রাণীর গলি।”
কিন্তু সেই লোকটি কোন কথা না কহিয়া বা গলির ভিতরে না গিয়া দ্রুতপদে অগ্রসর হইল। নগেন্দ্রনাথ একটু বিস্মিতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি গলির ভিতরে যাইবেন না?”
“না, আমার কাজ হয়েছে,” বলিয়া লোকটি অগ্রসর হইল।
একটু দূরে থাকিয়া নগেন্দ্রনাথ তাহার অনুসরণ করিলেন। তাঁহার সন্দেহ এক্ষণে বদ্ধমূল হইল; এবং তাঁহার কৌতূহল চরম সীমায় উঠিল। এই লোকটা কি করে, কোথায় যায়,—তাহা দেখিবার জন্য নগেন্দ্রনাথ বড় ব্যগ্র হইলেন।
সে ব্যক্তি ক্রমে দরমাহাটায় আসিল। সেখানে মোড়ের নিকটে তিনখানা ভাড়াটিয়া গাড়ী দাঁড়াইয়াছিল। নগেন্দ্রনাথ দূর হইতে দেখিলেন, লোকটি একখানা গাড়ীর নিকটে গিয়া দাঁড়াইল। কোম্যানের সহিত কি কথা কহিল, তৎপরে তাহার হাতে কি দিল। কোচম্যান কোবাক্স হইতে নামিয়া ঘোড়ার লাগাম লাগাইতে লাগিল। ইতিমধ্যে সেই লোকটি গাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিল।
ক্ষণপরে কোচম্যান নিজের কাজ সারিয়া গাড়ীতে উঠিয়া ঘোড়ার পিঠে চাবুক লাগাইল। গাড়ী ছুটিল। তখন ছুটিয়া গিয়া নগেন্দ্রনাথ আর একখানা গাড়ীতে উঠিয়া বসিলেন। কোচম্যানকে বলিলেন, “আগের গাড়ীর পিছনে চল্–খুব বখশিস্ পাইবি, যেন নজরের বাহিরে না যায়।”
কোচম্যান বিরক্তভাবে বলিল, “ওসব বুঝি না—ভাড়া আগে।”
নগেন্দ্রনাথ গম্ভীরভাবে বলিলেন, “পুলিসের কাজ—শীঘ্র চল্–বখশিস্ পাইবি।”
পুলিসের নাম শুনিয়া কোচম্যান দ্বিরুক্তি না করিয়া দ্রুতবেগে গাড়ী ছুটাইল। সম্মুখস্থ গাড়ী কিছুতেই নজরের বাহিরে যাইতে দিবেন না ভাবিয়া নগেন্দ্রনাথ গাড়ীর ভিতর হইতে এক-একবার মুখ বাহির করিয়া দেখিতে লাগিলেন।
এই লোকটা কেনই বা রাণীর গলির কথা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া সেই গলিতে না গিয়া গাড়ীতে উঠিল, তিনি তাহার কোনই কারণ স্থির করিতে পারিলেন না। সহসা তাঁহার মনে হইল, “এই লোকটা আমাকে সন্দেহ করিয়াছে, পাছে আমি উহার অনুসরণ করি, এই ভয়ে এ আমার নজর ছাড়া হইবার জন্য গাড়ীতে উঠিয়াছে; নিশ্চয় আবার গাড়ী রাণীর গলির সম্মুখে আসিবে। সে নিশ্চয়ই ভাবিয়াছে যে, আমি এরূপভাবে তাহার অনুসরণ করিব না।”
তিনি দেখিলেন, সেই গাড়ী ক্রমে জোড়াবাগানে আসিয়া পড়িল, ক্রমে বিডন ষ্ট্রীটে—তৎপরে বাঁশতলার গলিতে আসিল। অবশেষে আসিয়া দরমাহাটা ষ্ট্রীটের যেখান হইতে গিয়াছিল, ঠিক সেইখানে আসিয়া দাঁড়াইল।
নগেন্দ্রনাথের গাড়ীও আসিয়া দাঁড়াইল, কোচম্যান নামিয়া আসিয়া বলিল “যেখান থেকে গিয়াছিলাম, সেইখানেই এলাম, আগের সে গাড়ীখানাও এসে দাঁড়িয়েছে।”
নগেন্দ্রনাথ আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া লাফাইয়া গাড়ী হইতে নামিলেন, সত্বর সেই অগ্রবর্ত্তী গাড়ীর নিকট গিয়া তাহার ভিতর দেখিলেন। তাহার কোচম্যান বলিয়া উঠিল, “কি দেখছ, মশাই?”
নগেন্দ্রনাথ ব্যগ্রভাবে বলিয়া উঠিলেন, “যে লোকটা তোমার গাড়ীতে উঠিয়াছিল, সে কোথায় গেল?”
কোচম্যান বিরক্তভাবে বলিল, “তোমার এত খোঁজে দরকার কি?”
নগেন্দ্রনাথের কোচম্যান বলিল, “ওরে কার সঙ্গে তুই অমন করে কথা কচ্ছিস? পুলিসের লোক!”
পুলিসের লোক শুনিয়া সে ভীত হইয়া বলিল, “আমি আপনাকে—আপনাকে—চিতে পারিনি।” নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আচ্ছা পরে চিনতে পারিবি—এখন বল দেখি, তোর গাড়ী পথে কোনখানেও থামে নাই, তবে সে লোক কোথায় গেল?”
সে বলিল, “সে লোক—হুজুর—সে লোক একেবারেই গাড়ীতে উঠে নাই”।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
নগেন্দ্রনাথ অতিশয় আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া বলিলেন, “কিরকম?”
কোচম্যান বলিল, “তিনি—সে লোকটা আমায় এসে বললে একজন বদমাইস্ আমার পেছন নিয়েছে; তোকে এই দুটো টাকা দিচ্ছি, তুই খালি গাড়ীখানা হাঁকিয়ে একদিকে চলে যা—তারপর এখানে ফিরে আসিস্, আমার এখানে একটু কাজ আছে,—তুই ফিরে এলে আমি তোর গাড়ীতে বাড়ি যাব। আরও একটা টাকা তুই পাবি। তখন সে আমার গাড়ীর এক দরজা দিয়ে উঠে আর এক দরজা দিয়ে নেমে নীচে অন্ধকারে লুকিয়েছিল।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তবে সে এখনই আসবে। আমি এইখানেই তাহার অপেক্ষায় থাকিব।”
“অনেক রাত্রি হয়েছে, আমি আর থাকছি না,” বলিয়া সেই কোচম্যান সবেগে ঘোড়াকে চাবুক মারিয়া সবেগে গাড়ী ছুটাইয়া দৃষ্টির বহির্ভূত হইয়া গেল।
তখন নগেন্দ্রনাথ নিজের গাড়ীর কোচম্যানের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “তুই তবে এখানে থাক।” সে উত্তর করিল, “হুজুর হুকুম করিলে থাকতে হবে।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “এইখানে আর একখানা গাড়ী ছিল না?”
সে বলিল, “হাঁ হুজুর। সে বোধহয়, ভাড়া পেয়ে চলে গেছে।”
“সেই লোক গাড়ীর জন্য আবার এখানে আসবে বলেছে—দেখা যাক্ আসে কি না।”
“হুজুর বলেন ত আমি হুজুরের সঙ্গে লন্ঠন ধরে যেতে পারি—গলির ভিতরে তার খোঁজ নিলে হতে পারে।”
নগেন্দ্রনাথ তাহার পরামর্শ মন্দ বলিয়া বিবেচনা করিলেন না। কোচম্যান বলিল, “হুজুর যখন আছেন, তখন গাড়ী কেউ ধরবে না।”
এই বলিয়া সে গাড়ী হইতে একটা লন্ঠন খুলিয়া লইয়া নগেন্দ্ৰনাথের সঙ্গে চলিল। কোচম্যান লন্ঠন ধরিয়া অগ্রে অগ্রে চলিল। তাহার পশ্চাতে নগেন্দ্রনাথ চলিলেন।
রাণীর গলি এত সঙ্কীর্ণ যে, দুই ব্যক্তি পাশাপাশি যাইতে পারে না। তাহাতে ঘোর অন্ধকার, ইহার ভিতর একটীও সরকারী আলো নাই। এটী সাধারণ পথ নহে, গলির ভিতরকার মুখ বন্ধ।
সহসা ‘এটা কি’ বলিয়া কোচম্যান পড়িয়া গেল। নগেন্দ্রনাথ তাড়াতাড়ি তাহার লন্ঠনটা লইয়া দেখিলেন সেখানে এক ব্যক্তি পড়িয়া রহিয়াছে। কোচম্যানও সত্বর উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “এ কে—মাতাল নিশ্চয়।” কিন্তু তখনই লাফাইয়া কয়েকপদ হটিয়া আসিয়া বলিল, “খুন!”
বিস্মিত ও স্তম্ভিত হৃদয়ে নগেন্দ্রনাথ দেখিলেন, তিনি যে ব্যক্তির সন্ধান করিতেছিলেন, সম্মুখে তাহারই রক্তাক্ত মৃতদেহ। কে তাহার বুকে ছোরা মারিয়াছে।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তখন নগেন্দ্রনাথ ও সেই কোচম্যান দ্রুতপদে গলির মুখে আসিয়া, “পাহারাওয়ালা, পাহারাওয়ালা”, বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিলেন, সত্বর দুই দিক হইতে দুইজন পাহারাওয়ালা ছুটিয়া আসিল।
এসকল ব্যাপারে যাহা হয়, তাহাই হইল। একজন লাস এবং নগেন্দ্রনাথ ও কোচম্যানের পাহারায় রহিল। আর একজন থানায় সংবাদ দিতে ছুটিল।
অর্দ্ধ ঘটিকার মধ্যেই ইনস্পেক্টর প্রভৃতি অনেক পুলিস-কৰ্ম্মচারী উপস্থিত হইলেন। লাস লইয়া তাঁহারা থানায় চলিলেন; নগেন্দ্রনাথ ও কোচম্যানকেও থানায় যাইতে বাধ্য হইতে হইল। সেখানে তাহাদের নাম ঠিকানা লইয়া ছাড়িয়া দেওয়া হইল। রাত্রিশেষে নগেন্দ্রনাথ গৃহে ফিরিলেন।
রাত্রির ঘটনায় তাঁহার নিদ্রা হইল না। তিনি ভাবিলেন “যেমন করিয়া হয় কে এই লোকটিকে খুন করিয়াছে তাহা অনুসন্ধান করিব। ইহাতে আমার উপন্যাস লিখিবার পক্ষে সুবিধা হইবে।”
পরদিন সকালে তিনি নিজের বহির্ব্বাটীতে বসিয়া এই বিষয় লইয়াই মনে মনে আলোচনা করিতেছিলেন, এমন সময়ে এক ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত হইলেন।
তাঁহার বয়স প্রায় চল্লিশ বৎসর হইবে। দেখিলেন বোধহয়, শরীরে যথেষ্ট বল আছে; হঠাৎ দেখিলে তাঁহাকে বড় দয়ালু সদাশয় লোক বলিয়া বোধহয়; কিন্তু তাঁহার চক্ষুর দিকে চাহিলে অতি কঠোর ও অতিশয় বুদ্ধিমান চতুর লোক বলিয়া বেশ প্রতীয়মান হয়।
নগেন্দ্রনাথ সন্দিগ্ধভাবে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। তখন নবাগত ব্যক্তি বলিলেন, “রাণীর গলির খুন সম্বন্ধে দুই একটা কথা জিজ্ঞাসা করিবার জন্য আপনার নিকটে আসিয়াছি।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আপনি কি পুলিস হইতে আসিতেছেন?”
তিনি বলিলেন, “হাঁ অধীনের নাম অক্ষয়কুমার—ডিটেটিভ ইনস্পেক্টর। এই খুনের ব্যাপারে অনুসন্ধান করিবার ভার আমার উপর পড়িয়াছে।”
অক্ষয়কুমারের নাম নগেন্দ্রনাথ পূর্ব্বে শুনিয়াছিলেন। ডিটেটিভগিরিতে, তিনি একজন সুদক্ষ লোক বলিয়াই সকলে জানিত। নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “অক্ষয়বাবু, আপনার সঙ্গে পরিচিত হইয়া বড়ই প্রীত হইলাম। আপনার নিকটে আমার একটা অনুরোধ আছে।”
“অনুরোধ কি বলুন? আমি আপনার অনুরোধ রক্ষার জন্য সাধ্যানুসারে চেষ্টা করিব।”
“এই খুনের অনুসন্ধান করিবার জন্য অনুগ্রহ করিয়া আমাকে আপনার সঙ্গে লউন।”
অক্ষয়কুমার চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বিস্মিত ভাব প্রকাশ করিয়া বলিলেন, “কেন?”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আমি দুই-একখানা উপন্যাস লিখিয়াছি—আরও খানকতক লিখিতে ইচ্ছা আছে—ডিটেক্টিভ উপন্যাসও দুই-একখানা লিখিয়াছি; এই খুনের অনুসন্ধানে আপনি যদি আমাকে সঙ্গে রাখেন, তবে আমি আপনার নিকট বিশেষ উপকৃত হই।”
অক্ষয়কুমারবাবু বলিলেন “হাঁ বেশ ত;—তবে একটা কথা আছে।”
নগেন্দ্রনাথ ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “বলুন কি?”
“আমি যাহা বলিব, আপনাকে তাহাই করিতে হইবে। কোনমতে আমার কথার অন্যথাচরণ করিতে পারিবেন না।”
“আপনি যাহা বলিবেন, আমি তাহাই করিব।”
“উত্তম। আসুন,–সেকেণ্ড করুন। আমাদের এগ্রিমেন্ট পাকা হইয়া গেল। আজ হইতে আপনি আমার এ কার্য্যে অংশীদার হইলেন।”
এই বলিয়া অক্ষয়কুমার সজোরে নগেন্দ্রনাথের করমর্দন করিলেন। অক্ষয়কুমার তাঁহার সহিত উপহাস করিতেছেন কি না, এ বিষয়ে নগেন্দ্রনাথের সন্দেহ হইল কিন্তু তিনি সে-বিষয়ে কোন কথা উত্থাপন করিলেন না।
তখন অক্ষয়কুমার প্রাচীরে ঠেস দিয়া ভাল হইয়া বসিলেন। নগেন্দ্ৰনাথ বলিলেন, “এখন এই ছদ্মবেশী লোককে কে খুন করিয়াছে, তাহাই অনুসন্ধান করিয়া বাহির করা আমাদের কাৰ্য্য।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “ঠিক তাহা নহে। যে তাহাকে খুন করিয়াছে, তাহা আমি জানি।”
নগেন্দ্রনাথ সন্দেহ প্রকাশ করিয়া বলিলেন, “তাহা আপনি জানেন?’
“হাঁ, একজন স্ত্রীলোক তাহাকে খুন করিয়াছে।”
“আপনি ইহা নিশ্চিত জানিতে পারিয়াছেন?”
“অবস্থাগত প্রমাণে যতদূর জানা যায়।”
“আপনি কিরূপে জানিলেন? খুনী কি ধরা পড়িয়াছে?”
“ধরিবার বাহিরে গিয়াছে।”
“ধরিবার বাহিরে গিয়াছে?—সে কি?”
“খুনীও খুন হইয়াছে।’
“খুন?”
“হাঁ,—সে-ও খুন হইয়াছে।”
নগেন্দ্রনাথ নিতান্ত বিস্মিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “ওঃ একেবারে ডবল খুন?”
অক্ষয়কুমার নিতান্ত গম্ভীরভাবে বলিলেন, “হাঁ, দ্বরওয়ানের বেশধারী লোকটা সম্ভবতঃ রাত্রি বারটা
হইতে একটার মধ্যে খুন হইয়াছিল। স্ত্রীলোকটি সম্ভবতঃ খুন হইয়াছে, একটা হইতে দুইটার মধ্যে।”
“কোথায় স্ত্রীলোকটিকে পাওয়া গিয়াছে?”
“অধিক দূরে নহে—গঙ্গার ধারের রাস্তার উপর, প্রায় গঙ্গার ধারে।”
“তাহা হইলে বোধ হইতেছে, খুনী লাসটা জলে ফেলিয়া দিবার চেষ্টা পাইয়াছিল?”
“নিশ্চয়ই। কাহারও পায়ের শব্দ শুনিয়া লাস ফেলিয়া পলাইয়া গিয়াছে।”
“কে প্রথম লাস দেখিতে পায়?”
“একটা হিন্দুস্থানী—সে ভোরে গঙ্গাস্নান করিতে গিয়া লাস দেখিতে পাইয়া পুলিসে খবর দেয়। আমিও সংবাদ পাইয়া তখনই লাস দেখিতে যাই।”
“আপনার এত তাড়াতাড়ি যাইবার কি কোন কারণ ছিল?”
“হাঁ—একটু ছিল বই কি? এইটা দেখুন দেখি।” এই বলিয়া অক্ষয়কুমার নগেন্দ্রনাথের হাতে এক টুকরা ছিন্ন বস্ত্র দিলেন। তিনি দেখিলেন, সেটি কোন হিন্দুস্থানী স্ত্রীলোকের সুরঞ্জিত বস্ত্রের কিয়দংশ।
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “এই কাপড়ের টুকরা মৃত দ্বরওয়ানের ডান হাতের মুঠার ভিতরে ছিল। নিশ্চয়ই যখন সে খুন হয়, তখন সে আত্মরক্ষার জন্য তাহার খুনীর কাপড় টানিয়া ধরিয়াছিল, সে ছোরার আঘাতে পড়িয়া গেলে, তখন খুনী কাপড় ছিনাইয়া লইয়া পলাইযা যায়। মৃত ব্যক্তি কাপড়ের কতকাংশ এমনই জোরে ধরিয়াছিল যে সে অংশ তাহার হাতেই রহিয়া যায়, সুতরাং আমি বুঝিলাম যে খুন করিয়াছিল সে স্ত্রীলোক; পুরুষে এরূপ রঙিন শাড়ী পরে না। রঙিন শাড়ী দেখিয়া বুঝিলাম স্ত্রীলোকটি বাঙ্গালী নহে—হিন্দুস্থানী।“
“আপনার অনুমান ঠিক—তবে যে স্ত্রীলোকটি খুন হইয়াছে সেই যে ইহাকে খুন করিয়াছে তাহা আপনি কিরূপে জানিলেন?”
“ক্রমশঃ—ব্যস্ত হইবেন না—স্ত্রীলোক খুন হইয়াছে শুনিয়া আমি তখনই এই কাপড়ের টুকরা লইয়া গঙ্গার দিকে ছুটিলাম। যাহা ভাবিয়াছিলাম তাহাই—সেখানে যে স্ত্রীলোকটি খুন হইয়াছিল, তাহার পরিহিত শাড়ীর একদিক ছেঁড়া। এটা তাহার সহিত জোড়া দিয়া দেখিলাম যে, ঠিক জোড় মিলিয়া গেল। কাজেই এটা স্থির যে, এই স্ত্রীলোকই সেই দ্বরওয়ানের মত লোকটাকে খুন করিয়াছিল।”
“কিন্তু স্ত্রীলোকটিকে খুন করিল কে?”
“এইটি হইতেছে কথা—তাহাই আমাদিগকে এখন অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিতে হইবে। স্ত্রীলোকটির কাপড় বা অন্য কোন চিহ্ন নাই যে, সে কে তাহা সপ্রমাণ হয়। দ্বারওয়ান ও স্ত্রীলোক এ-দু’জনের লাসের এখনও সনাক্ত হয় নাই। ফটোগ্রাফ তোলা হইয়াছে,—শীঘ্রই সনাক্ত হইবে, সন্দেহ নাই।”
“পুরুষটির কাপড়ে কোন চিহ্ন নাই?”
“আছে, এই লোকটি ছদ্মবেশে ছিল, এর গায়ে যে জামা ছিল তাহা সাধারণ দ্বারওয়ানের মত; কিন্তু ঐ জামার নীচে একটা ভাল জামা ছিল, ঐ জামায় ‘বসু এণ্ড কোং’ লেখা আছে। ‘বসু কোম্পানী’ জোড়াসাঁকোর পোষাক বিক্রেতা; তাহাদের নিকট সংবাদ লইলে এই লোকের সন্ধান পাওয়া যাইবে। লোকটির মৃতদেহ দেখিলে স্পষ্টই বোধ হয় যে, তিনি ধনী লোক ছিলেন। সম্ভবতঃ কোন ধনী হিন্দুস্থানী সওদাগর, এই লোকের পরিচয় পাওয়া কঠিন হইবে না, তবে স্ত্রীলোকটির পরিচয় সহজে পাওয়া যাইবে না।”
“স্ত্রীলোকটি কেন এই লোককে খুন করিল, জানিতে পারিলে সে কে জানাও কঠিন হইবে না, সুতরাং বসু কোম্পানীর সূত্র ধরিয়া পুরুষের সন্ধান হইলে স্ত্রীলোকটিরও পরিচয় পাওয়া যাইবে।”
“হাঁ—যদি এই সূত্র ধরে কিছু না হয়, তবে আর একটা সূত্র আছে।”
“সেটা কি?”
“সেটা এই।”
এই বলিয়া অক্ষয়কুমার পকেট হইতে একটী কৃষ্ণপ্রস্তর নির্ম্মিত সিন্দূর রঞ্জিত ছোট শিবলিঙ্গ বাহির করিয়া টেবিলের উপরে রাখিলেন।
নগেন্দ্রনাথের বিস্ময় আরও বাড়িল।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
নগেন্দ্রনাথ সেই শিবলিঙ্গ মূৰ্ত্তিটি হাতে তুলিয়া লইয়া বিশেষরূপে দেখিতে লাগিলেন। ক্ষণপরে বলিলেন, “এটি আপনি কোথায় পাইলেন?”
“একটি পাই নাই—দুটি পাইয়াছি,” বলিয়া অক্ষয়কুমার আর একটি ঠিক সেইরূপ শিবলিঙ্গ নগেন্দ্রনাথের সম্মুখে রাখিলেন।
নগেন্দ্রনাথ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এদুটি আপনি কোথায় পাইলেন?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “একটি মৃতব্যক্তির পার্শ্বে কুড়াইয়া পাইয়াছি, আর একটি সেই মৃত স্ত্রীলোকের আঁচলে বাঁধা ছিল।”
“আশ্চর্য্যের বিষয় সন্দেহ নাই। ইহার অর্থ কি, বুঝিতে পারা যায় না। সম্ভবতঃ এই দুটির বিষয় বিশেষ জানিতে পারিলে কেন এই দুইজন লোক খুন হইয়াছে, তাহা জানিতে পারা যাইবে।”
“আপনি এসম্বন্ধে কিছু জানেন?”
“না, তবে আমার একটি বন্ধু আছেন, তিনি এদেশের দেবদেবী সম্বন্ধে অনেক কথা জানেন, তিনি হয়ত কিছু সংবাদ দিতে পারেন।”
“আপনি একটা কাছে রাখুন তাঁহাকে দেখাইবেন। আমি আপনার সমস্ত কথার উত্তর দিয়াছি, এখন আমি আপনাকে দুই-চারিটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই।”
“স্বচ্ছন্দে।”
“কাল রাত্রিতে প্রথমে আপনি যাহা যাহা দেখিয়াছিলেন, সকল কথা আমায় খুলিয়া বলুন।” নগেন্দ্রনাথ সমস্ত বলিলেন, ডিটেটিভ মহাশয় নীরবে বিশেষ মনোযোগের সহিত সকল শুনিয়া বলিলেন, “লোকটা বুকের পকেটে বরাবর হাত দিয়াছিল?”
“হাঁ।”
“সে একটা পিস্তল—রিভলবার। আমরা যেটা তাহার পকেটে পাইয়াছি; কিন্তু মূল্যবান্ যাহা ছিল তাহা কিছু পাই নাই।”
‘কেমন করিয়া জানিলেন, কোন মূল্যবান্ সামগ্রী তাহার পকেটে ছিল?”
“তাহা না হইলে সে-লোক রিভলবার পকেটে করিয়া বাহির হইত না।”
“হয়ত আত্মরক্ষার জন্যই পিস্তল সঙ্গে রাখিতে পারে।”
“তা হ’তে পারে। কিন্তু সে যে ছদ্মবেশ ধারণ করিয়াছিল তাহাতে তাহার নিকটে যে মূল্যবান্ কিছু আছে, তাহা কেহ ভাবিত না। মৃত ব্যক্তির নিকটে হয় অনেক টাকার নোট বা কোন মূল্যবান্ কাগজ ছিল। ইহাতে আমি যাহা স্থির করিয়াছি, তাহাই আসিতেছে।”
“আপনি কি স্থির করিয়াছেন?”
“এই ভদ্রলোক হিন্দুস্থানী সাজিয়া রাণীর গলিতে রাত বারটার সময়ে আসিয়াছিল। স্ত্রীলোকটির সঙ্গে এত রাতে এই নির্জ্জন স্থানে দেখা ‘করিবার কথা ছিল; পাছে কেহ তাহাকে চিনিতে পারে বলিয়া ছদ্মবেশে আসিয়াছিল। এই লোক, নিজের কাছে টাকাই থাক্ বা মূল্যবান্ কোন কাগজই থাক্ স্ত্রীলোকটিকে দেয়—সে তাহাকে এই শিব ঠাকুরটি দেয়।”
“কেন?”
“কেন? রসীদের মত। স্ত্রীলোকটি যে টাকা—মনে করুন টাকাই পাইল—তাহার প্রমাণস্বরূপ পুরুষটিকে এই সিন্দূরমাখা শিব দেয়। সেই লোক শিবটিকে নিজের পকেটে যেমন রাখিতে যাইবে অমনি স্ত্রীলোকটি টাকা তাহার হস্তগত হওয়ায় তাহার বুকে ছুরি মারে। লোকটির হাত হইতে শিব পড়িয়া যায়—সে তখন স্ত্রীলোকের কাপড় টানিয়া ধরে। কিন্তু স্ত্রীলোক কাপড় টানিয়া লইয়া ছুটিয়া পালায়; সেই টানাটানিতে কতকটা কাপড় সেই মৃত ব্যক্তির হাতের মধ্যে রহিয়া যায়।”
“এ কেবল আপনার ধারণা মাত্র, ইহার কোন প্রমাণ নাই।”
“এখন ধারণা মাত্র, কিন্তু আপনাকে পরে স্বীকার করিতে হইবে যে, আমার ধারণা মিথ্যা নয়।”
“দ্বিতীয় শিবলিঙ্গের বিষয় কি?”
“হাঁ, স্ত্রীলোকটি প্রথম ব্যক্তিকে খুন করিয়া টাকা লইয়া সত্বর গঙ্গার ধারে আসে। সেখানে এক ব্যক্তি তাহার নিকট হইতে টাকা লইবার জন্য অপেক্ষা করিতেছিল। স্ত্রীলোকটি তাহাকে টাকা—মনে করিবেন না যে, আমি স্থির নিশ্চয় হইয়া বলিতেছি যে, টাকাই ইহাদের নিকটে ছিল—সম্ভবতঃ কোন খুব মূল্যবান কাগজ ছিল—যাহাই হউক, স্ত্রীলোকটি ঐ ব্যক্তিকে টাকা দিলে সেও রসীদের মত তাহাকে একটা সিন্দূর মাখা শিব দেয়। সে শিবটি আঁচলে বাঁধিয়া চলিয়া আসিতেছিল, ঠিক এমনই সময়ে ঐ ব্যক্তি তাহার বুকে ছোরা মারে। তৎপরে মৃতদেহ টানিয়া আনিয়া গঙ্গায় ফেলিবার চেষ্টা করিতেছিল; সেই সময়ে কোন লোকের পায়ের শব্দ শুনিয়া পলাইয়া যায়।”
“কিন্তু এই ব্যক্তি এই স্ত্রীলোককে কেন খুন করিল?”
অক্ষয়কুমার কোন উত্তর না দিয়া শিষ দিতে লাগিলেন। ক্ষণপরে চিন্তিতভাবে “এটা জানিতে পারিলেই আমি খুনী ধরিতে পারি, ঐখানেই যত গোল।”
নগেন্দ্রনাথ কোন কথা কহিলেন না। তখন অক্ষয়কুমারবাবু হাসিয়া বলিলেন, “আপনি ডিটেটিভ উপন্যাস লিখেন, এ-ব্যাপারটা কিরকম বুঝিতেছেন?”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “উপন্যাস অপেক্ষাও এ খুনের ব্যাপার রহস্যজনক বলিয়া বোধ হইতেছে।”
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
নগেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন আপনি কি করিবেন, মনস্থ করিয়াছেন?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “প্রথমে আমি বসু কোম্পানীর নিকট সন্ধান লইব। সম্ভবতঃ তাহারা কাহার জন্য এই জামা প্রস্তুত করিয়াছিল, তাহা জানিতে পারিব। তাহা হইলে তাহার বিষয় একটু সন্ধান লইলে তাহাকে কেন খুন করিয়াছে, তাহাও জানিতে পারা যাইবে। খুনীর উদ্দেশ্য জানিতে পারিলে তাহাকে ধরা বড় কঠিন হইবে না। কিন্তু এছাড়াও আর এক সূত্র আছে—ভাড়াটিয়া গাড়ী।”
“কোন্ গাড়ী, যেখানায় আমি উঠেছিলাম? না, যেখানায় উঠিয়া ঐ লোক আমার চোখে ধূলি দিয়াছিল?”
“ও দু’খানার একখানাও নয়। আর একখানা যে গাড়ী ছিল, সেইখানা।”
সেখানার কোচম্যান এমন বিশেষ কি সন্ধান দিতে পারিবে?”
“নগেন্দ্রনাথবাবু, আপনি একজন ভাল উপন্যাস লিখিয়ে হইতে পারেন কিন্তু আপনি ডিটেক্টিভগিরির বিশেষ কিছু জানেন না। ইহা কি সম্ভব নয় যে, আপনাদের দুখানা গাড়ী দাঁড়াইয়া আছে দেখিয়া সেইখানা ভাড়া করিয়া তৎক্ষণাৎ তথা হইতে চলিয়া যাইবে?”
“খুব সম্ভব। কিন্তু সে কি সেই সময়ে আর কোন লোকের সঙ্গে দেখা করিতে সাহস করিবে? তাহা হইলে একজনও ত তাহার চেহারা দেখিয়া রাখিতে পারে?”
“এতটা বুদ্ধি বোধহয়, তাহার সে সময়ে হয় নাই; বিশেষতঃ আমার বিশ্বাস সে-ও ছদ্মবেশে আসিয়াছিল। আরও কারণ—গঙ্গার ধারে আর কোন লোকের সঙ্গে তাহার দেখা করিবার কথা স্থির ছিল। এই খুন করিতেই হয়ত তাহার বিলম্ব হইয়া গিয়াছিল; পাছে সে লোক তাহাকে দেখিতে না পাইয়া চলিয়া যায়, এই ভয়ে সে গাড়ী লইয়াছিল। আরও কারণ আছে, এত রাত্রে স্ত্রীলোক একাকী রাস্তায় গেলে, পাছে পাহারাওয়ালারা ধরে বলিয়া সে গাড়ীতে উঠিয়াছিল। যাহাই হউক, আমি এই গাড়োয়ানকে দুই-একটা কথা জিজ্ঞাসা করিব।
“তাহাকে কোথায় পাইবেন?”
অক্ষয়কুমার হাসিয়া বলিলেন, “এটা কি আপনি বড় শক্ত কাজ মনে করিলেন? আমি এখন উঠিলাম।”
“কখন আপনার সঙ্গে আমার দেখা হইবে?”
অক্ষয়কুমার দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিলেন, “সত্যই কি আপনার একটু ডিটেকটিভগিরি করিবার সখ হইয়াছে?”
নগেন্দ্রনাথ ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “আপনি আমাকে এ-ব্যাপারে সঙ্গে লইতে অস্বীকার করিয়াছেন।”
“ভাল, তবে এক কাজ করুন—আসুন, আমরা দুজনে কাজের একটা বখ্া করিয়া লই।”
“বলুন, কি করিতে হইবে।”
“আপনি এই বসু কোম্পানীর দোকানে গিয়া সন্ধান লউন, আমি গাড়োয়ান প্রভৃতিকে দেখি।”
‘কোথায় আপনার দেখা পাইব?”
“আমি সন্ধ্যার সময়ে আপনার এখানে আসিব। আপনি বাড়ী থাকিবেন।”
“আমি আহারাদির পরই বাহির হইব।”
“আপনার যে বন্ধুর কথা বলিলেন, তাঁহার নিকটে যাইবেন; দেখুন তিনি যদি আপনাকে এই সিন্দুর মাখা দেবতার কিছু সন্ধান দিতে পারেন।”
“নিশ্চয়ই যাইব। একটা শিব আমার কাছে থাকিল।”
“খুব ভাল কথা।”
“কিন্তু আপনি একটা বিষয়ে এখনও স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারেন নাই।”
“এখন আমি কোন বিষয়েই স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারি নাই; তবে আপনি কোনটার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করিতেছেন?”
“স্ত্রীলোকটিকে যে খুন করিয়াছে, সে স্ত্রী না পুরুষ?”
“অন্য অনেক বিষয়েই আমি নিবিড় অন্ধকারের ভিতরে আছি সত্য, কিন্তু এবিষয় আমি স্থির নিশ্চিত হইয়াছি; পরে দেখিবেন, আমার কথা ঠিক কি না।”
“কি হইয়াছেন? যে স্ত্রীলোকটিকে খুন করিয়াছে, সে স্ত্রী না পুরুষ?”
“দুশোবার পুরুষ।”
“আপনি কিরূপে এত কৃতনিশ্চয় হইলেন?”
“নগেন্দ্রনাথবাবু, আপনি উপন্যাস লিখেন, তথাপি এই জিজ্ঞাসা করিতেছেন?”
“কেন?”
কেন? কোন পুরুষের জন্য ভিন্ন কোন স্ত্রীলোক কি কখনও এমন অসমসাহসিকের কাজ করিতে সাহস করে? স্ত্রীলোক ভালবাসায় পড়িয়া সব করিতে পারে—এই স্ত্রীলোক খুন পর্য্যন্ত করিয়াছিল।”
“তবে সে যাহাকে এত ভালবাসিত, সেই তাহাকে এইরূপ নিৰ্দ্দয়ভাবে খুন করিল?”
“জগতে অনেক হয়, অনেক হইতেছে। নগেন্দ্রবাবু, আপনি উপন্যাস লিখিতে বসিয়া পাঠককে মুগ্ধ করিবার জন্য কল্পনার সাহায্যে কত অসম্ভব বিস্ময়জনক ঘটনার অবতরণ করেন, কিন্তু এক একটা সত্য ঘটনা এত বিস্ময়কর যে-আপনার কল্পনা সেখানে কোথায় লাগে?”
তিনি প্রস্থান করিলেন।
নগেন্দ্রনাথ চিন্তিতমনে বসিয়া রহিলেন।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
নগেন্দ্রনাথ এতদিন মনের সুখে কেবল কল্পনারাজ্যে বিচরণ করিতেছিলেন। কল্পনায় উপন্যাস রচিতেছিলেন, কখনও প্রকৃত ঘটনাচক্রে পড়েন নাই। এখন এই খুন রহস্য উদ্ভেদ করিবার জন্য তিনি অতিশয় উৎসাহের সহিত নিযুক্ত হইলেন।
তিনি আহারাদি করিয়াই তাঁহার বন্ধুর সহিত সাক্ষাৎ করিতে চলিলেন। তিনি জানিতেন, তাঁহার বন্ধু এ- সকল বিষয়ে বিশেষ আলোচনা ও চর্চ্চা করিয়াছেন। হিন্দুশাস্ত্র ও হিন্দুর দেবদেবী এবং ভিন্ন ভিন্ন হিন্দু সম্প্রদায় সম্বন্ধে তাঁহার প্রগাঢ় অভিজ্ঞতা।
তিনি বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া সিন্দুররঞ্জিত শিবলিঙ্গ তাঁহার হাতে দিয়া বলিলেন, “দেখ দেখি একবার, এটার কোন অর্থ করিতে পার কি না?”
তিনি শিবটি বহুক্ষণ নাড়া-চাড়া করিয়া চিন্তিতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইহা তুমি পাইলে কিরূপে?”
“সে পরে বলিব। এখন এটা দেখিয়া কিছু বুঝিতে পার?”
“তুমি এটা কিরূপে পাইলে আমি জানি না। তবে এইরূপ সিন্দূরমাখা শিবলিঙ্গের বিষয় আমি এক স্থলে পাঠ করিয়াছি।”
“কি তাহাতে আছে?”
“পাঞ্জাবে একটি ধৰ্ম্ম সম্প্রদায় আছে, ইহারা যদিও শৈব, কিন্তু ইহাদের কার্য্যকলাপ প্রায় শাক্তদিগের মত। ইহাদের সাধন প্রণালী গুপ্ত বিষয়; সম্প্রদায় লোক ভিন্ন ইহাদের বিষয় অপরে কেহই কিছু জানিতে পারে না। ইহাদের সম্প্রদায়ভুক্ত হইলে সেই লোকের নিকটে এইরূপ এক- একটি সিন্দূররঞ্জিত শিবলিঙ্গ থাকে। যাহাদের নিকটে এইরূপ একটি থাকে, তাহাকেই বুঝিতে হইবে যে, সে এই সম্প্রদায়ভুক্ত লোক।”
“ইহাদের বিষয় কি জান?”
“আর বিশেষ কিছু জানি না, ইহাদের শাক্ত কাপালিকের মত কার্য্যকলাপ, আরও পড়িয়াছি যে, ইহাদের মধ্যে কেহ কোন দোষ করিলে ইহারা নাকি প্রাণদণ্ড করে, তখন সেইসকল মৃতদেহের নিকটে সর্ব্বদাই এইরূপে একটি শিবলিঙ্গ থাকে। তাহাতেই জানা যায় যে, সেই লোকটি এই সম্প্রদায়ের কোপে পড়িয়া নিহত হইয়াছে।
“কতকটা এখন বুঝিলাম।”
“কি বুঝিলে? এটা তুমি কোথায় পাইয়াছ?’
“কাল রাত্রে একটি স্ত্রীলোক ও একটি পুরুষ খুন হইয়াছে, তাহাদের দুইজনের নিকটেই এইরূপ শিবলিঙ্গ পাওয়া গিয়াছে।”
“বটে? তবে এরূপ সম্প্রদায় আছে, আমার পূর্ব্ব বিশ্বাস হয় নাই; কেবল ইহাদের বিষয় পড়িয়াছিলাম মাত্র, কখনও এ সম্প্রদায়ের লোক দেখি নাই। খুন কে করিয়াছে, কেহ জানিতে পারিয়াছে?”
“না, সন্ধান হইতেছে?”
তোমার কাছে এ শিবলিঙ্গ আসিল কিরূপে?”
“জানই ত আমি ডিটেকটিভ উপন্যাস লিখিতেছি; এই বিষয়ে আমার বিশেষ উৎসাহ। আমি চেষ্টা করিয়া এ খুনের তদন্ত করিবার জন্য পুলিসের সঙ্গে মিশিয়া পড়িয়াছি।”
“তোমাকে কোনদিন বিপদে পড়িতে হইবে দেখিতেছি।”
নগেন্দ্রনাথ হাসিয়া বলিলেন, “ভয় নাই, সাবধান আছি। এখন চলিলাম, তোমার সময় নষ্ট করিব না।”
তিনি তথা হইতে বহির্গত হইয়া বসু কোম্পানীর দোকানে আসিলেন। দোকানের স্বত্বাধিকারী উপস্থিত ছিলেন। অক্ষয়কুমার তাঁহাকে—যে জামাটি লাসের গায়ে পাইয়াছিলেন—সেই জামাটি দেখাইয়া বলিলেন, “আপনাদের দোকানের নাম এই জামায় লেখা আছে, এ জামাটি কাহার জন্য তৈয়ারী করিয়াছিলেন, বলিতে পারেন?”
স্বত্বাধিকারী কিয়ৎক্ষণ জামাটি দেখিয়া বলিলেন, “এ কথা আপনি কেন জিজ্ঞাসা করিতেছেন?”
“আপনি বলিলে বোধ হয় একজন খুনী ধৃত হইতে পারে।”
‘খুনী’ বলিয়া বিস্মিতভাবে স্বত্বাধিকারী তাঁহার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আপনি কি পুলিসের লোক?”
“কতকটা বটে।”
“আপনি এ জামাটা কোথায় পাইলেন?”
“যাহার গায়ে এ জামাটি ছিল, সে লোক কাল রাত্রে খুন হইয়াছে।”
“খুন হইয়াছে!”
“হাঁ, আপনি এ জামা কাহার জন্য প্রস্তুত করিয়াছিলেন?”
“এ কাপড়ের জামা আমাদের একজন মাত্র খরিদ্দারই ব্যবহার করিতেন, সেজন্য চিনিতে পারিতেছি তবে তিনি নিশ্চয়ই কোন চাকরকে এটা বখ্শিস করিয়াছিলেন; তিনি বড় লোক, তাঁহাকে খুন করিবে কে?”
“তিনি কে?”
“তিনি বড়বাজারের হুজুরীমলবাবু; বড়বাজারে মস্ত গদি আছে। তবে আমরা জানি, তিনি স্ত্রী পরিবার লইয়া এখন চন্দননগরে আছেন। মধ্যে মধ্যে গদিতে আসেন।”
“এতেই আমার কাজ হইবে।”
এই বলিয়া নগেন্দ্ৰনাথ গৃহাভিমুখে ফিরিলেন, তিনি দ্বারের নিকটে আসিলে দেখিলেন, অক্ষয়কুমার সেইদিকে আসিতেছেন। তিনি তাঁহার প্রতীক্ষায় দাঁড়াইলেন।
অক্ষয়কুমার তাঁহার নিকটস্থ হইবার পূর্ব্বেই নগেন্দ্রনাথকে দেখিয়া সহাস্যে বলিয়া উঠিলেন, “নগেন্দ্রনাথ বাবু, খুনী একজন নহে—দুইজন।”
নগেন্দ্রনাথ বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “দুইজন।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “হাঁ, একজন স্ত্রীলোক—আর একজন পুরুষ।”
সপ্তম পরিচ্ছেদ
নগেন্দ্রনাথ বিস্মিতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনাকে এ কথা কে বলিল?”
“গাড়োয়ান—সেই গাড়োয়ান। আমি তাহাকে সন্ধান করিয়া বাহির করিয়াছি।”
“সে কি বলিল?”
“দুখানা গাড়ী চলিয়া গেলে সে একলাই কোন ভাড়া পাইবার প্রত্যাশায় দাঁড়াইয়াছিল। কিছুক্ষণ পরে একটি স্ত্রীলোক ও একটি পুরুষ সেইখানে আসিয়া তাহার গাড়ী হাবড়া ষ্টেশনে যাইবার জন্য ভাড়া করে। সে তাহাদের হাবড়া ষ্টেশনে নামাইয়া দিয়া ফিরিয়া আসে।”
“তাহারা রাণীর গলি হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছিল?’
“হাঁ, অত রাত্রে কে আর আসিবে? লোকটা আন্দাজ সাড়ে বারটার সময়ে খুন হয়, এরা তার পাঁচ মিনিট পরেই আসিয়াছিল।”
“কিন্তু গাড়োয়ান ঘুস খাইয়া মিথ্যাকথাও বলিতে পারে?”
“তাহারা অনর্থক তাহাকে ঘুস দিয়া সন্দেহে পড়িবে কেন? গলির ভিতরে কি হইয়াছে, গাড়োয়ান কিছুই জানিত না, সুতরাং কোন কথাই গাড়োয়ানকে তাহাদের বলিবার আবশ্যক হয় নাই।”
“গাড়োয়ান তাহাদের চেহারা দেখিয়াছিল?”
“ভাল করিয়া দেখে নাই।”
“তাহাদের ভাবভঙ্গিতে তাহারা যে খুব ব্যস্ত সমস্ত বা বিচলিতভাবে ছিল তাহা কি সে লক্ষ্য করিয়াছিল?”
“তাহাকে এ কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। সে বলে স্ত্রীলোকটি অপেক্ষা পুরুষটিই যেন বেশি বিচলিতভাবে ছিল।”
“তাহা হইলে হয়ত সেই পুরুষই খুন করিয়াছে।”
“কে ছোরা চালাইয়াছিল, তাহা এখন জানিবার উপায় নাই, এখন বসু কোম্পানী কি বলে?”
“তারা বলে যে, এ জামা তাহারা বড়বাজারের হুজুরীমলের জন্য প্রস্তুত করিয়াছিল। হুজুরীমলের বড়- বাজারে মস্ত গদি আছে?”
“হুজুরীমল—তিনি খুব বড়লোক, ভারী দান ধ্যান আছে, তাঁহাকে সকলেই চিনে। তিনি খুব সদাশয় লোক বলিয়াই সকলের কাছে পরিচিত।”
“কিন্তু তিনি যদি এতই পুণ্যাত্মা লোক হন, তবে তিনি দ্বরওয়ান সেজে দুই প্রহর রাত্রে এই জঘন্য রাণীর গলিতে আসিবেন কেন?”
“পুণ্যাত্মা লোকের অপঘাত মৃত্যু—এখন বসু কোম্পানী কি বলে তাহাই শোনা যাক্।” নগেন্দ্রনাথ যাহা জানিতে পারিয়াছিলেন, সমস্তই বলিলেন, শুনিয়া অক্ষয়কুমার বলিলেন, “চলুন, একবার তাঁহার গদিতে যাইয়া সন্ধান লওয়া যাক।”
উভয়ে এই খুনের বিষয় নানা আলোচনা করিতে করিতে হুজুরীমলের গদির দ্বারে আসিলেন। হুজুরীমল বড়বাজারের মধ্যে একজন জানিত লোক।”হুজুরীমল গণেশমল” নামীয় গদি সকলেই চিনিত। ইঁহারা দুইজনে একত্রে কারবার করিতেন। উভয়েই বড়লোক বলিয়া বিখ্যাত।
অক্ষয়কুমার ও নগেন্দ্রনাথ একটু বিস্মিত হইয়া দেখিলেন, গদিতে কাজ-কারবার সমভাবে চলিতেছে। একজন অংশীদার, বিশেষতঃ বড় অংশীদারের মৃত্যু হইলে গদির এরূপ ভাব থাকে না। অক্ষয়কুমার বলিলেন, “বোধহয়, ইহারা এখনও হুজুরীমলের কথা শুনিতে পায় নাই অথবা সে লোক মোটেই হুজুরীমল নহে।”
উভয়ে গদিতে প্রবিষ্ট হইলেন। সকলেই তাঁহাদিগের দিকে চাহিতে লাগিল। একজন জিজ্ঞাসা করিল, “আপনারা কি চান?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “আমরা হুজুরীমলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।”
একটি হিন্দুস্থানী যুবক একখানি তক্তপোষের উপর বাক্স পরিবেষ্টিত হইয়া বসিয়াছিলেন। তিনি বলিলেন, “বোধহয়, আপনারা বাবাজী সাহেবের সঙ্গে দেখা করিতে চান। কিন্তু তিনি ত এখানে নাই। তিনি এক সপ্তাহ হইল কাশী গিয়াছেন। হুজুরীমল সাহেবও এখানে নাই, তিনি কাল রাত্রে কাজের জন্য আগ্রায় গিয়াছেন। সেখানেও আমাদের গদি আছে। আমিই এখানকার কাজ-কৰ্ম্ম দেখিতেছি, আপনাদের যাহা বলিবার আছে, আমাকে বলিতে পারেন।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “আপনি নিশ্চিত বলিতে পারেন যে হুজুরীমলবাবু আগ্রায় গিয়াছেন?”
“আমি নিশ্চিত জানি।”
“বোধ হয় না।”
“কেন? আপনি কি জানেন?”
“তিনি কাল রাত্রে খুন হইয়াছেন।”
“খুন হইয়াছেন। আপনি কে।”
“আমি ডিটেক্টিভ ইন্সপেক্টর অক্ষয়।”
যুবকের মুখ শুকাইয়া গেল। যুবক কম্পিতস্বরে কহিলেন, “ডিটেক্টিভ—ডিটেক্টিভ—এখানে কেন?”
এই সময়ে চারিদিক হইতে অনেক লোক আসিয়া সেখানে সমবেত হইল। সকলেই উদ্গ্রীব হইয়া ব্যাপার কি হইয়াছে, শুনিবার জন্য ব্যগ্র হইল। লোকের ভিড় দেখিয়া অক্ষয়কুমার যুবককে বলিলেন, “আপনার সঙ্গে কথা আছে,—আপনি অন্য ঘরে চলুন।”
কম্পিতদেহে বিশুষ্কমুখে যুবক উঠিলেন, অক্ষয়কুমার ও নগেন্দ্রনাথকে পার্শ্বের এক গৃহে লইয়া গেলেন। অন্যান্য সকলকে তথায় আসিতে নিষেধ করিলেন।
অক্ষয়কুমার তাঁহার মুখের দিকে কিয়ৎক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন। তৎপরে বলিলেন, “আপনার নাম কি?”
যুবক শুষ্ককণ্ঠে কম্পিতস্বরে বলিলেন, “আমার—আমার—আমার নাম ললিতাপ্রসাদ।”
ললিতাপ্রসাদ প্রথমে হুজুরীমলের হত্যা সংবাদ পাইয়া যেরূপ বিচলিত হইয়া উঠিয়াছিলেন, এখন আর তাঁহার সে ভাব নাই। আত্মসংযম করিয়াছেন। বলিলেন, “কে তাঁহাকে খুন করিল? সে কি ধরা পড়িয়াছে?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “না তবে একজন স্ত্রীলোক তাঁহাকে খুন করিয়াছে।”
ললিতাপ্রসাদ চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিলেন “স্ত্রীলোক—কোন্ স্ত্রীলোক। অসম্ভব,—আমি মনে-“
তিনি কি বলিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু আত্মসংযম করিলেন। বলিলেন, “সেই স্ত্রীলোক ধরা পড়িয়াছে কি?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “না—তাহাকেও কে খুন করিয়াছে।”
“সেও খুন হইয়াছে! সে কে?”
“তাহা এখনও সনাক্ত হয় নাই। তবে একজন পুরুষ খুন করিয়াছে।”
‘সে ধরা পড়িয়াছে?”
“না, সেজন্যই আপনার নিকট আসিয়াছি।“
“আমার নিকট—আমি কি জানি—আমি এর কিছুই জানি না।”
“কিছু কিছু জানিতে পারেন, হুজুরীমলবাবুর বিষয় আপনি যাহা জানেন, আমাদিগকে বলিলে বোধহয়, আমরা তাঁহার হত্যাকারীকে ধরিতে পারিব।”
“আমি তাহার কি জানি, কিছুই জানি না—তিনি খুব ভাল লোক ছিলেন, কেবল ইহাই জানি।”
“বোধহয়, আপনি জানেন যে, এইসকল ব্যাপার যখনই ঘটে, তখনই ইহার ভিতরে কোন না কোন স্ত্রীলোক থাকেই থাকে।”
“ইহার ভিতরে কোন্ স্ত্রীলোক আছে?”
“তাহারই সন্ধান আমরা করিতেছি।”
“সে কে?”
“এই যে আপনি কাহার কথা বলিতে গিয়া থামিয়া গেলেন।”
“কই—কই–না আমি আবার কি বলিতে যাইব?”
“বেশ—হুজুরীমলের স্ত্রী আছেন?”
“হাঁ, তাঁহার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর মৃত্যু হওয়ায় তিনি তিন-চার বৎসর হইল পঞ্জাবে গিয়া আবার বিবাহ করিয়া আসিয়াছেন।”
পঞ্জাবের নাম শুনিয়া অক্ষয়কুমার নগেন্দ্রনাথ উভয়ই উভয়ের দিকে চাহিলেন।
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “তাঁহার পুত্র কন্যা আছে?”
“না তাঁহার শ্যালীর এক মেয়ে আছেন। তাহাকেই তিনি কন্যারূপে লইয়াছেন।”
“তাঁহার স্ত্রীর বয়স কত?”
“বেশী নহে—ত্রিশ-বত্রিশ হইবে।”
“আর যাহাকে তিনি কন্যারূপে লইয়াছিলেন?”
“পনের বৎসর হইবে।”
“বিবাহ হইয়াছে?”
“না।”
“কেন?”
ললিতাপ্রসাদ এই প্রশ্নে যেন নিতান্ত বিচলিত হইলেন, বলিলেন, “মহাশয় তাহা আমি কিরূপে জানিব? তাঁহার নিজ কারপরদার উমিচাঁদ এই আসিয়াছে। ইহাকে জিজ্ঞাসা করিলে আপনারা হুজুরীমলবাবুর সব কথাই জানিতে পারিবেন।
এই বলিয়া তিনি উঠিয়া যাইতেছিলেন। কিন্তু অক্ষয়কুমার বলিলেন, “যাইবেন না, আপনাকে আমাদের প্রয়োজন আছে।”
তিনি ভীতভাবে বলিলেন “আমাকে।”
“হাঁ আপনাকে। আপনাকে আমাদের সঙ্গে যাইতে হইবে। যিনি খুন হইয়াছেন, তাঁহাকে সনাক্ত করা চাই।”
অষ্টম পরিচ্ছেদ
ললিতাপ্রসাদ বসিলেন, এই সময় সেই প্রকোষ্ঠে একটি যুবক প্রবিষ্ট হইলেন, তাঁহাকে দেখিতে বেশ বলিষ্ঠ ও সুপুরুষ, মুখ দেখিয়া বুদ্ধিমান বলিয়াও বোধ হয়। যুবক অক্ষয়কুমার ও নগেন্দ্রনাথের দিকে চাহিয়া কৌতূহলাক্রান্ত দৃষ্টিতে ললিতাপ্রসাদের দিকে চাহিলেন।
অক্ষয়কুমার জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার নাম কি উমিচাঁদ?”
“হাঁ, আপনারা কি চান?”
“আপনি হুজুরীমলবাবুর কারপরদার?”
“হাঁ।”
“শুনিয়াছেন কি? আপনার মনিব কাল রাত্রে খুন হইয়াছেন?”
উমিচাঁদ অতিশয় আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “খুন হইয়াছেন—সে কি?—তিনি কাল রাত্রে যে আগ্রায় গিয়াছেন।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “না, আগ্রায় যান নাই। তিনি খুন হইয়াছেন।”
“খুন হইয়াছেন!” এই বলিয়া উমিচাঁদ দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া ব্যাকুলভাবে কাঁদিতে লাগিলেন। অক্ষয়কুমার সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাহার আপাদমস্তক বিশেষরূপে লক্ষ্য করিয়া দেখিতেছিলেন। নগেন্দ্ৰনাথ এই লোকটির ভাবভঙ্গিতে তাহাকে সন্দেহ করিবেন কি না, কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না।
কিয়ৎক্ষণ পরে অক্ষয়কুমার আসন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া বলিলেন, “উমিচাঁদবাবু, কাঁদিয়া কোন ফল নাই। যদি আপনার মনিবকে যে খুন করিয়াছে ধরিতে চাহেন, তবে হুজুরীমল সাহেব সম্বন্ধে যাহা কিছু জানেন সকলই আমাদিগকে বলুন।”
উমিচাঁদ চক্ষু মুছিতে মুছিতে মুখ তুলিল। অক্ষয়কুমার জিজ্ঞাসিলেন, “হুজুরীমলবাবুর পরিবারে কে কে আছেন?”
উমিচাঁদ বলিল, “তাঁহার স্ত্রী, তাঁহার স্ত্রীর ভগিনীর এক মেয়ে। ভগিনীর মেয়ে এখানে আসিবার সময় তাঁহার সঙ্গে আর একটি স্ত্রীলোককে লইয়া আসিয়াছিলেন।”
“তিনি কে? বয়স কত?”
“তাঁর মা বাপ কেহ নাই। ছেলেবেলায় বাবুর স্ত্রীর ভগিনী ইঁহাকে মানুষ করেন। বয়স সতের বৎসর হইবে।”
“বাবুর বাড়ীতে বেশী যাওয়া আসা কে কে করেন তাহাই বলুন।”
“বেশীর মধ্যে দুইজন যান। একজন কেবল মাসখানেক পঞ্জাব থেকে কলিকাতায় আসিয়াছেন।”
“তাঁর নাম কি?”
“গুরুগোবিন্দ সিং।”
“আর একজন কে?”
“তাঁর নাম যমুনাদাস।”
“তাঁরা দুইজনে কি করেন?”
“শুনিয়াছি, গুরুগোবিন্দ সিংহের পঞ্জাবে ব্যবসা-বাণিজ্য আছে। যমুনাদাসবাবুর কোথায় একটা দোকান আছে।“
এতক্ষণ নগেন্দ্রনাথ নীরবে বসিয়াছিলেন। এখন বলিলেন, “আমি একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারি?”
উভয়েই তাঁহার দিকে চাহিলেন, অক্ষয়কুমার বলিলেন, “নিশ্চয় কি জিজ্ঞাসা করিবেন, করুন।”
নগেন্দ্রনাথ উমিচাঁদের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “প্রেমের কিছু গোলযোগ ইহার ভিতর আছে কি?”
উমিচাঁদ তাঁহার দিকে বিস্ফারিতনয়নে চাহিয়া বলিল, “আপনি কি বলিতেছেন, বুঝিতে পারিতেছি না।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “আমি বুঝাইয়া দিতেছি। দেখিতেছি, হুজুরীমলবাবুর বাড়ীতে দুটি সুন্দরী যুবতী স্ত্রীলোক অবিবাহিত রহিয়াছেন। আবার দেখিতেছি, দুইজন যুবক হুজুরীমলবাবুর বাড়ীতে যাতায়াত করেন, তাহাই আমার বন্ধু জিজ্ঞাসা করিতেছেন, বলি ইঁহাদের মধ্যে কোন ভালবাসার গোলযোগ নাই ত?”
উমিচাঁদ বলিল, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। তবে যমুনার সঙ্গে বোধহয় গুরুগোবিন্দ সিংহের বিবাহের সম্ভাবনা আছে। সম্ভবতঃ তিনি এই জন্যই কলিকাতায় আসিয়াছেন।”
অক্ষয়কুমার জিজ্ঞাসা করিলেন, “যমুনা কোনটি?”
“যমুনা বাবু সাহেবের শালীঝি?”
“হুজুরীমলবাবুর কোন শত্রু ছিল, এমন মনে হয়?”
“না তিনি এত ভাল লোক ছিলেন, তাঁহার এত দান ধ্যান ছিল যে, এ সংসারে কেহ তাঁহার শত্রু থাকিতে পারে এরূপ বোধ হয় না।”
“হুজুরীমলবাবুর স্ত্রীর চরিত্র কেমন?”
উমিচাঁদ ক্রুদ্ধভাবে অক্ষয়কুমারের দিকে চাহিল। বলিল, “তাঁহার মত ধার্ম্মিকা স্ত্রীলোক দেখি না।”
“হুজুরীমল সপরিবারে এখন চন্দননগরে আছেন কেন?”
“এখানে রোগ শোক বড় বেশী বলিয়া।”
“এখানে তাঁহার বাড়ীতে কে আছেন?”
“এখানে তাঁহার একজন চাকর আছেন।”
“তিনি খুন হইয়াছেন, তবে, তাঁহার খোঁজ করেননি কেন?”
“বাড়ীর লোক জানেন, তিনি আগ্রায় গিয়াছেন।”
“তিনি প্রত্যহই চন্দননগরে ফিরিয়া যাইতেন?”
“না, কোনদিন কাজ মিটাইতে রাত্রি হইয়া পড়িলে এইখানেই থাকিতেন। সেইজন্য তিনি কোনদিন বাড়ী না ফিরিলেও বাড়ীর লোক চিন্তিত হইত না।”
অক্ষয়কুমার এই ব্যক্তির নিকটে বিশেষ কিছুই জানিতে না পারিয়া মনে মনে বিরক্ত হইয়াছিলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “হুজুরীমলবাবু কি বেশী টাকা সঙ্গে লইয়া গিয়াছেন?“
উমিচাঁদ বলিল, “না কেবলমাত্র পঞ্চাশ টাকা লইয়া গিয়াছেন। আগ্রায় পৌঁছিলে তাঁহার টাকার ভাবনা কি?”
অক্ষয়কুমার চিন্তিত মনে বলিলেন, “তা ত নিশ্চয়।”
তিনি বিরক্তভাবে ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া উঠিলেন। তিনি গমনে উদ্যত হইয়াছিলেন, কিন্তু নগেন্দ্রনাথ তাঁহাকে একটু অপেক্ষা করিতে বলিলেন। অক্ষয়কুমার দাঁড়াইলেন।
তখন নগেন্দ্রনাথ পকেট হইতে সেই শিব ঠাকুরটি বাহির করিয়া উমিচাঁদের সম্মুখে ধরিয়া বলিলেন, “এটা কখনও দেখিয়াছেন?”
উমিচাঁদের ভাবে উভয়েই আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। এই শিবলিঙ্গ দেখিবামাত্র উমিচাদের আপাদমস্তক কাঁপিতে লাগিল। কাঁপিতে কাঁপিতে কাঁপিতে সে সংজ্ঞাশূন্যের ন্যায় সেইখানে বসিয়া পড়িল।
নবম পরিচ্ছেদ
পরদিন নগেন্দ্রনাথ অক্ষয়কুমারের সহিত এই খুনের বিষয় আলোচনা করিবার জন্য সম্মিলিত হইলেন। অক্ষয়কুমার বলিলেন, “নগেন্দ্রনাথবাবু, আমার মতের পরিবর্ত্তন হইয়াছে।”
“কোন্ বিষয়ে?”
“আমার এখন মত কোন স্ত্রীলোক হুজুরীমলকে খুন করে নাই।”
“কেন?”
“আমরা গঙ্গার ঘাটে একখানা ছোরা কুড়াইয়া পাইয়াছি। যেখানে স্ত্রীলোকের লাস পাওয়া গিয়াছিল, তাহারই নিকটে পাওয়া গিয়াছে। লোকটা স্ত্রীলোকটিকে খুন করিয়া ছোরাখানা জলে ফেলিয়া দিয়াছিল। ভাটার সময় জল সরিয়া যাওয়ায় ছোরা পাওয়া গিয়াছে।”
“তাহাতে কিরূপে বুঝিলেন যে, স্ত্রীলোকটি হুজুরীমলকে খুন করে নাই?”
“ছোরাখানি পঞ্জাবী, এদেশে এ ছোরার বড় ব্যবহার নাই। যেভাবে এ ছোরা হুজুরীমলের ও এই স্ত্রীলোকের বুকে বসান হইয়াছিল, তাহাতে শরীরে অসীম বল না থাকিলে কেহ তাহা পারে না।”
“সে খুন না করিতে পারে, কিন্তু যখন হুজুরীমল খুন হয় তখন সে নিকটেই ছিল, নতুবা হুজুরীমল তাহার কাপড় ছিঁড়িয়া লইবে কিরূপে?”
“কোচম্যানের কথা শুনিয়া আমার এই কথাই প্রথমে মনে হইয়াছিল, কিন্তু কি উদ্দেশ্যে একজন লোক এরকম ভয়ানক কাজ করিবার জন্য একজন স্ত্রীলোককে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবে? কিসে এ কথা জানা যায়?”
“এখন কি করিবেন, মনে করিতেছেন?”
“এই স্ত্রীলোকটিকে সন্ধান করিয়া বাহির করিতে হইবে।”
“এ পর্য্যন্ত ত তাহার কিছুই হইল না?”
“কতক করিয়াছি, স্ত্রীলোকটির পরনে যে কাপড় ছিল তাহাতে ধোপার একটা দাগ ছিল। কলিকাতা ও চন্দননগরে সমস্ত ধোপার সন্ধান লইয়া যে ধোপা এই কাপড় কাচিত, তাহাকে পাইয়াছি।”
“আপনার খুব বাহাদুরী আছে।”
“আমাদের প্রত্যহই এ কাজ করিতে হয়।“
“ধোপা কি বলিল?”
“কাহার কাপড় তাহা ধোপার নিকটে জানিয়াছি।” নগেন্দ্রনাথ সোৎসাহে বলিলেন, “তবে ত আপনি মৃত স্ত্রীলোকটির নাম জানিয়াছেন?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “ঐ টুকুই গোল–ধোপার কাছে জানিয়াছি, কাপড়খানি হুজুরীমলের স্ত্রীর।”
“বলেন কি, হুজুরীমলের স্ত্রীর, তবে এ স্ত্রীলোক এ কাপড় পাইল কোথা হইতে?”
“তাহাই এখন সন্ধান করিতে হইবে।”
“কিন্তু ললিতাপ্রসাদের ভাবভঙ্গি দেখিয়া তাহার উপরে আমার কিছু সন্দেহ হয়।”
“আরও সন্দেহ হয়, এই গুণবান্ উমিচাদের উপর। সে শিব দেখিয়া অজ্ঞান হইয়াছিল; বলে কি না যে সে এ শিব সর্ব্বদা হুজুরীমলের কাছে দেখিয়াছে। তাহাই ইহা দেখিয়া খুনের কথা মনে পড়ায় অজ্ঞান হইয়াছিল, এ কথা যে সর্ব্বৈব মিথ্যা তাহা বলা নিষ্প্রয়োজন।”
“যেদিক দিয়াই হউক এই শিবঠাকুরটি এই খুনের মূলে আছেন। আপনি গুরুগোবিন্দ সিংহের একবার সন্ধান লউন। দেখিতেছেন না যে, এই খুনের সূত্র সকল রকমে পঞ্জাবের দিকেই যাইতেছে। এই শিবলিঙ্গের সম্প্রদায় পঞ্জাবেই আছে। পঞ্জাবে হুজুরীমল বিবাহ করিয়াছিল। পঞ্জাবী ছোরায় সে খুন হইয়াছে। পঞ্জাবী স্ত্রীলোক হুজুরীমলের স্ত্রী। পঞ্জাবী কাপড় স্ত্রীলোকটির পরা ছিল—আর পঞ্জাবী গুরুগোবিন্দ সিং সম্প্রতি পঞ্জাব হইতে এখানে আসিয়াছে।”
অক্ষয়কুমার চিন্তিতভাবে বলিলেন, “কথা বটে—তবে স্ত্রীলোকটি কেন খুন হইল সেটাও একটা কথা।”
“আপনি হুজুরীমলের স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন না কেন?”
“করিব। আপাততঃ চলুন, প্রথমে একবার হুজুরীমলের চাকরকে নাড়াচাড়া করিয়া দেখা যাক্, সে কিছু না কিছু বলিতে পারে।”
“আপনি যে এ ব্যাপারের কিছু করিয়া উঠিতে পারিবেন বলিয়া আমার ভরসা নাই।” অক্ষয়কুমার হাসিয়া বলিলেন, “দেখিতেছি, আপনি ইহারই মধ্যে এ ব্যাপারে ক্লান্ত ও হতাশ্বাস হইয়া পড়িয়াছেন।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “না আমি হতাশ হই নাই—আমি আপনার সঙ্গ সহজে ছাড়িতেছি না।” অক্ষয়কুমার বলিয়া উঠিলেন, “তবে আসুন, একবার হুজুরীমলের আবাসভূমিটা পর্যবেক্ষণ করা যাক্।”
উভয়ে বড়বাজারের দিকে চলিলেন।
দশম পরিচ্ছেদ
অক্ষয়কুমার নগেন্দ্রনাথকে সঙ্গে লইয়া বড়বাজারে হুজুরীমলের বাড়ীতে উপস্থিত হইলেন। তাঁহারা প্রথমে একজন ভৃত্যের সহিত দেখা করিলেন। অক্ষয়কুমার তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার মনিবের সঙ্গে এখানে শনিবারে কেহ দেখা করিতে আসিয়াছিল?”
“একজন মাত্র আসিয়াছিল।”
“কে সে?”
“সেই পঞ্জাবী, যিনি মাস কত হল এসেছেন।”
“কত রাত্রে এসেছিলেন?”
“বাবু সাহেব এগারটার গাড়ীতে আগ্রা যাবেন, স্থির থাকে, তাই তিনি সেদিন চন্দননগরে না গিয়ে এখানেই আহারাদি করেন।”
“কখন এই পঞ্জাবী লোক দেখা করিতে আসিয়াছিলেন?”
“তখন রাত সাড়ে নয়টা কি দশটা।”
“তিনি কি বলেছিলেন, কিছু শুনেছিলে?”
“না, আমি সেখানে ছিলাম না।”
“আর কেহ এসেছিল?”
“হাঁ, পঞ্জাবীটা চলে গেলে একজন স্ত্রীলোক এসেছিল।”
“সে কে?”
“মাঝে মাঝে এখানে আসে।”
“কখন আসে?”
“অনেক রাত্রে।”
“তুমি তাকে চেন?”
“না, ঘোমটা দিয়ে আসে, কখনও মুখ দেখি নাই।”
“তাকে দেখিলে চিনিতে পার?”
“ঠিক বলতে পারি না তবে তাহার হাতে তিনখানা নীল পাথর বসান একটা চমৎকার আংটা আছে।”
ভৃত্যের নিকটে বিশেষ কিছু আর জানিবার নাই দেখিয়া অক্ষয়কুমার হুজুরীমলের বাড়ী ভালরূপে দেখিয়া, ফিরিয়া তাঁহার গদিতে আসিলেন। তিনি একটি দ্রব্য তথায় পাইলেন, তাহা সত্বর পকেটে লইলেন। তিনি আবার ললিতাপ্রসাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলেন।
তাঁহাকে গোপনে এক গৃহে আনিয়া বলিলেন, “ললিতাপ্রসাদবাবু, কিছু মনে করিবেন না—একটা কথা জিজ্ঞাসা করিব। কর্তব্যের দায়ে আমাদের অনেক সময়ে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিতে হয়।”
ললিতাপ্রসাদ কেবলমাত্র মৃদুস্বরে বলিলেন, “বলুন।”
অক্ষয়কুমার জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনাদের গদির অবস্থা কেমন?”
ললিতাপ্রসাদ কিঞ্চিৎ ক্রোধ প্রকাশ করিয়া বলিলেন, “কেন মহাশয়, এ কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন,
এই বড়বাজারে আমাদের মত কটা সাওকোড় গদি আছে?”
“তা হতে পারে। তবে হুজুরীমল বোম্বে পলাইতেছিলেন কেন?”
“সে কি মহাশয়!”
“হাঁ—এই রকম বোধ হইতেছে, দেখুন দেখি, এ দুখানা।”
এই বলিয়া অক্ষয়কুমার নিজের পকেট হইতে দুইখানা রেলওয়ে টিকিট বাহির করিয়া ললিতাপ্রসাদের হাতে দিয়া বলিলেন, “দেখিতেছেন, এ দুখানা আগ্রার টিকিট নহে—বোম্বের টিকিট।”
ললিতাপ্রসাদ বলিলেন, “আপনি এ টিকিট কোথায় পাইলেন?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “হুজুরীমলবাবুর পকেটের মধ্যেই পাইয়াছি। তিনি সেইদিন সকালবেলা টিকিট দুইখানি কিনিয়াছিলেন। যাইবার সময়ে আর টিকিট কিনিবার হাঙ্গামা রাখেন নাই। ইহাতেই বোঝা যায়, তিনি গোপনে যাইবার মতলব করিয়াছিলেন। তাহার উপর দুইখানা টিকিট সুতরাং একাকী যাইতেছিলেন না—আর একজনের সঙ্গে যাইবার কথা ছিল। সেটি একটি স্ত্রীলোক সম্ভবতঃ, সেই অনেক রাত্রে তাঁহার সঙ্গে দেখা করিত। খুন না হইলে দুইজনে ছদ্মবেশে বোম্বে পলাইতেন। বুঝিলেন, কেন জিজ্ঞাসা করিতেছিলাম, আপনাদের গদির অবস্থা কেমন?”
এই সকল কথায় ললিতাপ্রসাদ বিস্মিত হইয়া স্তম্ভিতভাবে দণ্ডায়মান ছিলেন। কেবলমাত্র বলিলেন, “কেন?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “কারণ মাঠেই পড়িয়া আছে—যদি আপনাদের গদির বা হুজুরীমলবাবুর অবস্থার ভিতরে ভিতরে গোল না ঘটিত, তাহা হইলে তিনি এইরূপভাবে সরিয়া যাইবার চেষ্টা
পাইতেন না। টাকার সহায়তা থাকিলে অনেক কাজ কলিকাতায় বসিয়া করা যাইতে পারে।”
এই সময়ে ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া এক ব্যক্তি সেই গৃহে প্রবিষ্ট হইয়া বলিলেন, “কই—ললিতাপ্রসাদবাবু কই?”
সকলে চমকিত হইয়া ফিরিয়া তাহার দিকে চাহিলেন। দেখিলেন তিনি একজন পঞ্জাবী ভদ্রলোক। তিনি অতি ক্রুদ্ধভাবে বলিলেন, “আমি হুজুরীমলবাবুর নিকটে যে দশ হাজার টাকা রাখিয়াছিলাম, তাহা আপনাদের গদির সিন্দুক হইতে চুরি গিয়াছে?”
একাদশ পরিচ্ছেদ
এই সময়ে উন্মত্তের ন্যায় উমিচাদ তথায় উপস্থিত হইল। তাহার মুখ পাংশুবর্ণ হইয়াছে, তাহার সৰ্ব্বাঙ্গ কাঁপিতেছে। সে ভগ্নকন্ঠে বলিল, “সর্বনাশ হয়েছে।”
সকলেই আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া তাহার দিকে চাহিয়া রহিলেন। তখন পঞ্জাবী ভদ্রলোক বলিলেন, “প্রায় পনের দিন হইল, হুজুরীমলবাবুকে আমি দশ হাজার টাকার নোট রাখিতে দিই। আজ আমার টাকার দরকার হওয়ায় গদিতে আসিয়াছিলাম। গদিতে আসিয়া দেখি এই ব্যাপার।”
অক্ষয়কুমার তাঁহাকে এতক্ষণ বিশেষরূপে লক্ষ্য করিতেছিলেন। তিনি স্পষ্টই বুঝিতে পারিয়াছিলেন, এই ব্যক্তিই গুরুগোবিন্দ সিং, তিনি গম্ভীরভাবে বলিলেন, “গদিতে আসিয়া শুনিলেন, হুজুরীমলবাবু খুন হইয়াছেন?”
পঞ্জাবী ভদ্রলোকটি বিরক্তভাবে বলিলেন, “হাঁ সঙ্গে সঙ্গে আমার টাকাও গিয়াছে।” তৎপরে তিনি ললিতাপ্রসাদের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “আপনি এখন এ গদির কর্ত্তা, আপনি নিশ্চয়ই আমার টাকা ফেরত দিবেন।“
ললিতাপ্রসাদ বলিলেন, “আমি ইহার কিছুই জানি না। আমি বাবুজীকে টেলিগ্রাম করিয়াছি। তিনি আসিলে তাঁহাকে বলিব।” পরে তিনি উমিচাঁদকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “টাকা কিরূপে হারাইল?”
উমিচাঁদ কম্পিতকণ্ঠে বলিল, “ঐ টাকা বাবুর কাছে চন্দননগরেই ছিল। তিনি আগ্রায় যাইতেছেন বলিয়া সেদিন গদিতে লইয়া আসেন। তিনি বাড়ীতে থাকিবেন না বলিয়া গদির সিন্দুকে আমাকে দেখাইয়া দশ খানা হাজার টাকার নোট রাখিয়া দেন। তাহার পর আর তিনি গদিতে আসেন নাই।” গুরুগোবিন্দ সিংহ বলিলেন, “শুনিলেন, আমার টাকা মারা যাইতে পারে না, তিনি মারা গিয়াছেন বটে, তবে উমিচাদবাবু জানেন যে, হুজুরীমলের কাছে আমার টাকা ছিল।”
উমিচাঁদ বলিল, হাঁ, তাঁহার কাছে শুনিয়াছি, এ টাকা পঞ্জাবের কোন সম্প্রদায়ের।” অক্ষয়কুমার বলিয়া উঠিলেন, “ও।” সকলেই তাঁহার দিকে চাহিলেন, গুরুগোবিন্দ সিংহ বলিলেন, “তাঁহার রসিদও আমার কাছে আছে।”
ললিতাপ্রসাদ বলিলেন, “বাবুজী আসুন। হুজুরীমল যথেষ্ট টাকাকড়ি রাখিয়া গিয়াছেন। অবশ্যই আপনার টাকা বুঝিয়া পাইবেন।”
সহসা গুরুগোবিন্দ সিংহকে অক্ষয়কুমার জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়ের এ সম্প্রদায়ের সহিত পঞ্জাবের ধর্ম্ম-সম্প্রদায়ের কি কোন সম্বন্ধ আছে?”
গুরুগোবিন্দ সিং বিস্ফারিত নয়নে অক্ষয়কুমারের দিকে চাহিয়া বিরক্তভাবে বলিলেন, “আমাদের সম্প্রদায়ের সঙ্গে আপনার সম্বন্ধ কি?”
অক্ষয়কুমার মৃদু হাস্য করিয়া বলিলেন, “তা ত নিশ্চয়, আমি ত সিন্দুর মাখা শিব নই।”
এই কথায় গুরুগোবিন্দ চমকিত হইয়া উঠিলেন। অতিশয় বিস্মিতভাবে অক্ষয়কুমারের দিকে চাহিলেন, কিন্তু মুহূৰ্ত্ত মধ্যে আত্মসংযম করিয়া, ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, “আপনার কথা আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।”
তিনি অনন্তর ললিতাপ্রসাদের দিকে ফিরিয়া অতি রুষ্টভাবে বলিলেন, “ললিতাপ্রসাদবাবু, আপনার পিতা ঠাকুর আসিলে তাঁহাকে বলিবেন এই সপ্তাহের মধ্যে আমি টাকা চাই।”
ললিতাপ্রসাদ যুবক মাত্র, গুরুগোবিন্দ সিংহের রূঢ় কথায় ও কথাটা অপমানজনক ভাবিয়া তিনি ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিলেন। বলিলেন, “নতুবা আপনি কি করিবেন?”
গুরুগোবিন্দ অতি গম্ভীরভাবে বলিলেন, “তাহা হইলে আমাদের সম্প্রদায়ের সহিত আপনাদের বোঝা-পড়া হইবে।”
এই বলিয়া মুহূৰ্ত্তমধ্যে গুরুগোবিন্দ সিং গদি হইতে বাহির হইয়া গেলেন। ললিতাপ্রসাদ বিস্মিতভাবে বলিলেন, “ওর সম্প্রদায় আমাদের কি করিবে?”
অক্ষয়কুমার সংক্ষেপে কহিলেন, “খুন।”
ললিতাপ্রসাদ ও উমিচাঁদ উভয়েই শঙ্কিতভাবে বলিলেন, “কাহাকে খুন করিবে?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “কাহাকে খুন করিবে কেমন করিয়া বলিব? তবে যে এই সম্প্রদায়ের কোপে পড়িবে, তাহারই খুন হইবার সমধিক সম্ভাবনা আছে। হুজুরীমলকে এই সম্প্রদায়ই খুন করিয়াছে।”
ললিতাপ্রসাদ নিতান্ত বিস্মিতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “কেন? যেহেতু হুজুরীমল সাহেব এই সম্প্রদায়ের দশ হাজার টাকা লইয়া চম্পট দিতেছিলেন। কে জানে, যে স্ত্রীলোকটিকে লইয়া পলাইতেছিলেন, সে এ সম্প্রদায়ের নহে। সে-ও এই সম্প্রদায়ের কোপে পড়িয়াছিল। সেজন্য উভয়েই খুন হইয়াছে।”
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
উমিচাঁদ অতিশয় ব্যগ্রভাবে বলিল, “এ কখনই হইতে পারে না।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “আমি কেবল অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া একথা বলিতেছি। হুজুরীমল যদি টাকা লইয়া না থাকেন তবে লইল কে? অন্য কেহ চাবি লইয়া তবে সিন্দুক খুলিয়াছিল?”
উমিচাঁদ ক্রুদ্ধ হইয়া বলিল, “তবে কি আপনি মনে করেন, আমি টাকা লইয়াছি?”
“এ কথা আমি বলি নাই।”
“আমি এরূপ মূর্খ নই যে নোট লইব। সমস্তই নম্বরী নোট। সব নোটের নম্বরই গুরুগোবিন্দ সিংহের নিকটে আছে। এ নোট লইলে ভাঙ্গাইবার কোন সম্ভাবনা নাই।”
“আপনার দ্বারা একাজ হয় নাই, তাহা নিশ্চয়। তবে কথা হইতেছে যে, যদি আপনি লইলেন না, হুজুরীমল লইলেন না, তবে লইল কে? কেহ ত চাবি চুরি করে নাই?”
উমিচাঁদ নিজ কোমর হইতে সিন্দুকের চাবি বাহির করিয়া অক্ষয়কুমারকে দেখাইয়া বলিল, “এই চাবী আমার কাছে রহিয়াছে। সর্ব্বদাই থাকে। এ চাবি কাহারও পাইবার সম্ভাবনা নাই।”
“হুজুরীমলের চাবি চুরি যাইতে পারে?”
“না, তিনি সর্বদা চাবি নিজের কাছে রাখিতেন।”
“তাঁহার কাছে কোন চাবি ছিল না।”
উমিচাদ আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া বলিল, “সে চাবি নিশ্চয়ই কেহ লইয়াছিল।” তৎপরে একটু চিন্তিত ভাবে বলিল, “কিন্তু অপর কেহ গদিতে আসিয়া সিন্দুক খুলিলে নিশ্চয়ই ধরা পড়িত। গদিতে সর্বদাই লোক পাহারায় থাকে।”
অক্ষয়কুমার উঠিলেন। বলিলেন, “দেখা যাক্, কতদূর কি হয়।” তিনি ললিতাপ্রসাদ ও উমিচাঁদকে থানায় লাস সনাক্ত করিবার জন্য পাঠাইয়া দিয়া নগেন্দ্রনাথের সহিত হাওড়া স্টেশনের দিকে চলিলেন।
সত্যকথা বলিতে কি, নগেন্দ্রনাথ এ খুনের যে কোনকালে কোনরূপ কিনারা হইবে, এ বিষয়ে হতাশ্বাস হইতেছিলেন। কিন্তু অক্ষয়কুমার হতাশ হন নাই; তিনি নগেন্দ্রনাথের মনের ভাব বুঝিয়া বলিলেন, “ইহারই মধ্যে হাল ছাড়িয়া দিলে চলিবে কেন? আমাদের হতাশ হইবার কারণ নাই। আমরা অনেক বিষয় জানিতে পারিয়াছি।”
“আমি ত মনে করিতেছি, আমরা কিছুই জানিতে পারি নাই।”
“কেন? এই প্রথম—আমরা একটা লাসের পরিচয় পাইয়াছি। জানিয়াছি, তিনি আমাদের বিখ্যাত গদিয়ান হুজুরীমলবাবু—মহাশয় লোক, ধাৰ্ম্মিক ও দানশীল। আরও জানিয়াছি যে, এই সদাশয় ধাৰ্ম্মিক দানশীল ধনী গদিয়ান পরের দশ হাজার টাকা আত্মসাৎ করিয়া একটা স্ত্রীলোকের সঙ্গে বোম্বে পলাইতেছিলেন। আমরা আরও জানিয়াছি যে, এই টাকা পঞ্জাবের এক সম্প্রদায়ের, সেই সম্প্রদায়ের চিহ্ন সিন্দূরমাখা শিব।”
“হাঁ, এ সব প্রমাণ হয়ত—কথা বটে; কিন্তু হুজুরীমল খুন হইয়াছেন ব্যতীত আর কিছুই সপ্রমাণ হয় নাই।”
“ক্রমে সবই সপ্রমাণ হইবে—ভয় নাই। উপস্থিত এখন একবার হুজুরীমলের চন্দননগরের বাড়ীটা দেখা যাক।”
এইরূপ কথা কহিতে কহিতে উভয়ে হাওড়ায় আসিয়া ট্রেনে উঠিলেন।
চন্দননগরে আসিয়া দেখিলেন যে, হুজুরীমল যে বাড়ীতে থাকিতেন, সেটি একটি সুন্দর বাগানবেষ্টিত বড় বাড়ী। অনেক লোকজন দাস দাসী আছে। হুজুরীমল খুনি বড়লোকের ন্যায়ই এখানে বাস করিতেন। অক্ষয়কুমার হুজুরীমলের স্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য জনৈক ভৃত্য দ্বারা বাড়ীর ভিতরে সংবাদ পাঠাইলেন। কিন্তু ভৃত্য ক্ষণপরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “তাঁহার শরীর ভাল নয়—তিনি কাহারও সহিত দেখা করিবেন না।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “…তাঁহার অসুখ হইয়া থাকে—বিরক্ত করিতে চাই না; তাঁহার কোন বাঁদীর সহিত দেখা হইলেই আমাদের কাজ হইবে। বল, আমরা পুলিসের লোক—দেখা করাই চাই।”
ভৃত্য আবার বাটীর ভিতরে চলিয়া গেল। এই সময়ে তাঁহারা উভয়ে দ্বারপথে চাহিয়া দেখিলেন একটি ভদ্রলোক একটি স্ত্রীলোকের সহিত কথা কহিতেছেন। দেখিয়া অক্ষয়কুমার বলিলেন, “বোধহয় ঐটিই যমুনা।”
ঠিক সেই সময়ে কে তাঁহার পশ্চাৎ হইতে বলিল, “আমার নাম যমুনা।”
উভয়ে চমকিত হইয়া ফিরিলেন, দেখিলেন, তাঁহাদের সম্মুখে দাঁড়াইয়া একটি পরম রূপবতী যুবতী, তাহার মুখ ম্লান—বিষণ্ণ। যমুনা অতি বিষণ্ণ স্বরে বলিল, “আপনারা কি চান?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “এ সময়ে আপনাদিগকে বিরক্ত করা আমাদের উচিত ছিল না; কর্তব্যের দায়ে আসিতে হইয়াছে।”
যমুনা কোন কথা না কহিয়া নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল।
অক্ষয়কুমার মৃতা স্ত্রীলোকের পরিধানে যে কাপড়খানি ছিল তাহা বাহির করিয়া বলিলেন, “এ কাপড়খানিতে আপনাদের ধোপার চিহ্ন আছে; এ কাপড়খানি কি চিনিতে পারেন?”
যমুনা কাপড়খানি ভাল করিয়া দেখিয়া বলিল, “হাঁ, এ কাপড়খানি আমার মাসীর ছিল, কিন্তু এ কাপড়খানি একজন দাসীকে তিনি দিয়াছিলেন।”
“সে দাসীর নাম কি?”
“রঙ্গিয়া।”
“বেশ নামটি—এখন সে কোথায় গিয়াছে।”
“সে সাত-আটদিন হইল, দেশে গিয়াছে।”
“ঠিক দেশেই গিয়াছে কি?”
“হাঁ। কেন এ কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন?”
“সে দেশে যায় নাই—সে খুন হইয়াছে।”
“খুন হইয়াছে।” বলিয়া যমুনা শিহরিয়া উঠিল। তাহার ম্লান মুখ আরও ম্লান হইয়া গেল, এবং সে পড়িয়া যাইতেছিল, কিন্তু প্রাচীর ধরিয়া দাঁড়াইল। নিকটে একখানি কোচ ছিল, সে তাহাতে তাড়াতাড়ি বসিয়া পড়িল।
অক্ষয়কুমার মনে মনে হাসিয়া বলিলেন, “তুমি বাপু, ভিতরের অনেক কথাই জান।” কিন্তু ঔপনাসিক নগেন্দ্রনাথ যমুনার নিরুপম রূপলাবণ্যে একেবারে বিমুগ্ধ হইয়া গিয়াছিলেন; তিনি অক্ষয়কুমারের এইরূপ নির্ম্মর্ম ব্যবহারে মনে মনে বিশেষ ক্রুদ্ধ হইলেন। কিন্তু কোন কথা কহিলেন না—নীরবে তাহা সহ্য করিলেন।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
যখন অক্ষয়কুমার দেখিলেন যে, যমুনা কতক প্রকৃতিস্থ হইয়াছে, তখন তিনি বলিলেন, “আপনাকে আরও দুই-একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।”
যমুনা মৃদুস্বরে বলিল, “বলুন।”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “বড়বাজারে রাণীর গলিতে আপনাদের দাসী রঙ্গিয়া হুজুরীমলবাবুর সঙ্গে রাত বারটার সময়ে দেখা করিয়াছিল; সেই সময়ে হুজুরীমল খুন হন।”
যমুনা ব্যগ্রভাবে বলিল, “তবে কি সে তাঁকে খুন করেছে?”
“না—তাহার সঙ্গে আর একজন পুরুষমানুষ ছিল। তাহারা দুইজনে গঙ্গার ধারে যায়; তাহার পর সেখানে রঙ্গিয়াও খুন হয়। তার সঙ্গী নিশ্চয়ই খুন করে নাই; কারণ তাহা হইলে সিন্দূরমাখা শিবের দরকার হইত না।”
যমুনা চমকিত হইল। অক্ষয়কুমারের তীক্ষ্ণদৃষ্টি তাহা দেখিল। তিনি বলিলেন, “এ বিষয়ে আপনি কি জানেন?”
যমুনা কম্পিতস্বরে কহিল, “কি–কি—কি বিষয়ে?”
অক্ষয়কুমার পকেট হইতে তাড়াতাড়ি শিবলিঙ্গটি বাহির করিয়া যমুনার ক্রোড়ে নিক্ষেপ করিয়া কহিলেন, “এই—এই বিষয়ে।”
সহসা কেহ গায়ের উপরে সাপ ফেলিয়া দিলে যেরূপ হয়, যমুনারও ঠিক তাহাই হইল। সে একবার বিস্ফারিতনয়নে অঙ্কস্থিত শিবলিঙ্গের দিকে চাহিল; তখনই সে মূৰ্চ্ছিতা হইল। অক্ষয়কুমার গম্ভীরভাবে কেবলমাত্র বলিলেন, “ওঃ–তুমিও তবে ইহার ভিতরে আছ!”
নগেন্দ্ৰনাথ মহাক্রুদ্ধ হইয়া লাফাইয়া উঠিলেন। এবারে তিনি আর রাগ সাম্লাইতে পারিলেন না। অক্ষয়কুমারকে কঠিনকন্ঠে কহিলেন, “দেখিতেছেন না, ইনি অজ্ঞান হইয়াছেন—এঁর দাসীদের শীঘ্র ডাকুন।”
অক্ষয়কুমার হাসিয়া বলিলেন, “বসুন—অত ব্যস্ত হইতে হইবে না। এইখানে জল আছে, হৃদয়ে ব্যথা পাইয়া থাকেন—মুখে জল দিন।”
নগেন্দ্রনাথ ঔপন্যাসিক—তাঁহার মনটা কোমল; তিনি এরূপ সুন্দরীর এরূপ কষ্টে বড় ব্যথিত হইলেন। তিনি সত্বর জল আনিয়া অতি যত্নে যমুনার মুখে ধীরে ধীরে সিঞ্চন করিতে লাগিলেন।
যমুনা কিয়ৎক্ষণ পরে দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিল। তৎপরে ধীরে ধীরে চক্ষুরুন্মীলন করিল। বোধ হয়, প্রথমে সে কি হইয়াছে স্মরণ করিতে পারিল না—চারিদিকে ব্যাকুলভাবে চাহিতে লাগিল। সহসা তাহার সকল কথা মনে পড়িল; সে কাঁপিতে কাঁপিতে উঠিয়া দাঁড়াইল; এবং গৃহ হইতে বহির্গত হইবার প্রয়াস পাইল; কিন্তু অক্ষয়কুমার তাহার পথরোধ করিয়া সম্মুখে দাঁড়াইলেন। বলিলেন, “আমার সকল কথার জবাব না দিলে আমি যাইতে দিতে পারি না।”
যমুনা সকরুণনেত্রে নগেন্দ্রনাথের দিকে চাহিল। সে দৃষ্টি নগেন্দ্রনাথের হৃদয়ে আঘাত করিল। কিন্তু তিনি কিছুই করিতে পারেন না, নীরবে দাঁড়াইয়া রহিলেন।
তখন যমুনা কাতরকন্ঠে বলিল, “আমার বড় অসুখ করিতেছে।”
এবার নগেন্দ্রনাথ কথা না কহিয়া থাকিতে পারিলেন না—বলিলেন, “অক্ষয়বাবু, দেখিতেছেন না, ইঁহার অসুখ করিয়াছে।”
চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ
অক্ষয়কুমার একবার রুষ্টভাবে নগেন্দ্রনাথের দিকে চাহিয়া মুখ ফিরাইয়া লইলেন। পরে যমুনাকে বলিলেন, “যদি আমার সন্দেহ না ঘুচাইয়া যাইতে চাও, যদি ভয় পাইয়া থাক, তবে যাও।”
যমুনা বিস্মিতভাবে অক্ষয়কুমারের দিকে চাহিয়া বলিল, “আমি ভয় পাইব কেন?” বলিয়া সে ধীরে ধীরে আবার কৌচের উপর বসিল। বসিয়া অতি মৃদুস্বরে বলিল, “বলুন।”
অক্ষয়কুমারের নির্ম্মর্ম ব্যবহারে নগেন্দ্রনাথের ভয়ানক রাগ হইল। তাঁহার ইচ্ছা হইল, একটা মুষ্ট্যাঘাত অক্ষয়কুমারের মস্তকে বসাইয়া দেন, কিন্তু তাহা তিনি করিলেন না। ভাবিলেন, “ডিটেটিভ কাজে যদি এইরূপ নৃশংস হইতে হয়, তাহা হইলে ইহা ভদ্রলোকের কাজ নয়।”
অক্ষয়কুমার কিয়ৎক্ষণ যমুনাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না। তাহাকে প্রকৃতিস্থ হইবার জন্য সময় দিলেন।
যখন তিনি দেখিলেন যে, যমুনা অনেকটা সুস্থ হইতে পারিয়াছে, তখন তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি সিন্দুর-মাখা শিব দেখিয়া মূৰ্চ্ছিত হইলেন কেন?”
যমুনা নতশিরে ধীরে ধীরে বলিল, “ওটা দেখে আমার মেসো মহাশয়ের কথা মনে পড়েছিল, তাই—”
“তাঁর সঙ্গে এর কি সম্বন্ধ আছে?”
“ও রকম একটা তাঁহার কাছে আমি দেখিয়াছিলাম। তিনি আমাকে বলিয়াছিলেন যে, এ একটা ধর্ম্ম-সম্প্রদায়ের চিহ্ন।”
“পঞ্জাবের ধর্ম্মসম্প্রদায়?”
“তা ঠিক জানি না।”
“আপনি ত পঞ্জাব হইতে আসিয়াছেন?”
“কিন্তু সেখানে ইহা দেখি নাই।”
“আপনি এ সম্প্রদায় সম্বন্ধে কিছু জানেন?
“না—কিছুই জানি না।”
“হুজুরীমল এই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন?”
“তা জানি না।”
“যাক্ ও কথা—এখন আপনাদের দাসীর কথাই হউক; এই দাসীর সঙ্গে হুজুরীমলবাবুর কি বড় মেশামিশি ছিল?”
যমুনা বিস্মিতভাবে অক্ষয়কুমারের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, “সে দাসী, তার সঙ্গে মেশামিশি থাকিবে কেন?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “আর কাহারও সঙ্গে ছিল?”
এবার যমুনা ক্রুদ্ধভাবে বলিল, “দাসীদের সকল খবর আমরা জানি না।”
অক্ষয়কুমার একটু অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন, “না—না—তা ত ঠিক। যাক্ সে কথা, গত শনিবার রাত্রে আপনি কি কলিকাতায় হুজুরীমলবাবুর বাড়ীতে গিয়াছিলেন?”
যমুনা বিস্মিত হইয়া বলিল, “আমি—আমি—সেখানে কেন যাইব?”
অক্ষয়কুমার তাহার হাত ভাল করিয়া লক্ষ্য করিয়া দেখিলেন, কিন্তু তাহার আঙ্গুলে কোন আংটী দেখিতে পাইলেন না। তখন তিনি ভাবিলেন, “নিশ্চয়ই এ যায় নাই—অপর কেহ হইবে।”
তিনি কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোন মেয়েমানুষ তাঁহার নিকটে আসিত কি না, তাহা কি আপনি জানেন?”
যমুনা বিরক্তভাবে বলিল, না, আমি জানি না। চাকরেরা জানিলেও জানিতে পারে।” অক্ষয়কুমার সোৎসাহে বলিলেন, “ঠিক কথা, একবার আপনাদের চাকরদের দেখা যাক্।” এই বলিয়া তিনি নগেন্দ্রনাথের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “আপনি এইখানেই বসুন, আমি এখনই আসিতেছি।”
নগেন্দ্রনাথ অক্ষয়কুমারের দুর্ব্যবহারে বিরক্ত হইয়াছিলেন, কোন কথা না কহিয়া বসিয়া রহিলেন। তিনি চিন্তিত মনে বসিয়াছিলেন। সহসা কাহার পদশব্দে তিনি ফিরিলেন। দেখিলেন, একটি ভদ্রলোক একটি স্ত্রীলোকের সহিত সেই কক্ষ মধ্যেই প্রবিষ্ট হইয়াছেন। তিনি যে সেখানে বসিয়া আছেন, তাহা তাঁহারা জানিতেন না। উভয়েই তাঁহাকে দেখিয়া চমকিত হইলেন, এবং তখনই সে কক্ষ পরিত্যাগ করিতে উদ্যত হইলেন। কিন্তু ভদ্রলোকটি তাঁহাকে দেখিয়া বলিয়া উঠিলেন, “নগেন্দ্ৰ না?”
নগেন্দ্রনাথ উঠিয়া দাঁড়াইলেন; বিস্মিতভাবে বলিলেন, “আরে কেও যমুনাদাস!”
তিনি হাসিয়া বলিলেন, “চিনিতে পারিয়াছ, ইহাই আমার সৌভাগ্য।”
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “অনেকদিন তোমাকে দেখি নাই বটে,কিন্তু তোমার চেহারা ঠিক সেইরূপই আছে।”
যমুনাদাস হাসিয়া বলিলেন, “এটি আমার একটা গুণ বলিতে হইবে।”
নগেন্দ্রনাথ পার্শ্ববর্ত্তিনী রমণীকে দেখিতেছেন দেখিয়া যমুনাদাস হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “ইনি হুজুরীমলবাবুর শালীঝির বিশেষ বন্ধু। এই বাড়ীতেই থাকেন, তবে আর বোধহয়, বেশীদিন থাকিতে হইবে না। যমুনাদাস এ রত্ন লইয়া যাইবে।”
রমণী সলজ্জভাবে ভূন্যস্তদৃষ্টিতে দাঁড়াইয়া রহিল। যমুনাদাস বলিলেন, “তুমি এখানে কেন?”
‘একজন ডিটেক্টিভের সঙ্গে এসেছি।”
“ডিটেক্টিভ! হুজুরীমলবাবুর খুনের বিষয়!”
“হাঁ।”
‘এমন ভাল লোককে কে খুন করিল?”
“তাহারই সন্ধান হইতেছে।”
“তুমিও কি ইহার সন্ধানে আছ?”
“হাঁ, অক্ষয়কুমারবাবু অনুগ্রহ করে আমাকে সঙ্গে লইয়াছেন! জান ত, আমি ডিটেটিভ উপন্যাস লিখিবার চেষ্টা করিয়া থাকি। অক্ষয়বাবু একজন খুব নামজাদা ডিটেক্টিভ।”
“বেশ বেশ—খুব ভাল। ভাই, আমাকেও সঙ্গে লও, আমার এসকল বিষয় সন্ধান করিতে বড় ভাল লাগে; বিশেষতঃ হুজুরীমলবাবু আমাকে বড় ভালবাসিতেন
“অক্ষয়বাবুকে বলিব।”
এই সময়ে অক্ষয়কুমার তথায় উপস্থিত হইলেন। কিন্তু ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া উভয়কে লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। সহসা তাঁহার দৃষ্টি রমণীর হাতের দিকে পড়িল। তিনি চমকিত হইলেন।
রমণীর হস্তে সেই আংটী।
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
নগেন্দ্রনাথ ও অক্ষয়কুমার উভয়ে ষ্টেশনে আসিয়া আবার ট্রেনে উঠিলেন। অক্ষয়কুমার কোন কথা কহেন না দেখিয়া নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “যমুনাদাসের সঙ্গে এক সময়ে পড়িয়াছিলাম; অনেকদিন তাঁহার সঙ্গে আর দেখা হয় নাই।”
অক্ষয়কুমার সে কথায় আর কোন কথা কহিলেন না। তখন নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আপনি যমুনাদাসকে কিরূপ দেখলেন?”
অক্ষয়কুমার গম্ভীরভাবে বলিলেন, “ফক্কোড়—এসব লোক দিয়া সংসারের কোন কাজ হইতে পারে না।”
“কিন্তু লোক মন্দ নয়—মন ভাল।”
“যাহারা বেশী বাচাল হয়, তাহারা প্রায়ই এক-একটি প্রকাণ্ড গাধা।”
“হুজুরীমলের সহিত ইহার বিশেষ আত্মীয়তা ছিল; হুজুরীমল খুন হওয়ায় এ বড় প্রাণে আঘাত পাইয়াছে। তাঁহার হত্যাকারীকে ধরিবার জন্য ব্যগ্র হইয়াছে। বলিতেছিল যে, আপনি যদি ইহাকে এই অনুসন্ধানে লয়েন।”
“এ না গঙ্গাকে বিবাহ করিবে?”
“হাঁ, তাতে আপত্তি কি?”
“আছে—এই গঙ্গাই সে রাত্রে হুজুরীমলের সঙ্গে তার বাড়ীতে দেখা করিয়াছিল। মাঝে মাঝে রাত্রে যাইত!”
“আপনি কেমন করিয়া জানিলেন?”
“হুজুরীমলের চাকর বলিয়াছিল, “একটি স্ত্রীলোক মধ্যে মধ্যে রাত্রে হুজুরীমলের সহিত দেখা করিতে যাইত,—তাহার হাতে একটা তিনখানা নীলপাথর বসান আংটী ছিল। এই গঙ্গার হাতে সেই আংটী আছে।”
“গঙ্গার হুজুরীমলের সহিত সাক্ষাৎ করা কি বিশেষ কোন আশ্চর্য্যের বিষয়?”
“তাহা নয়, যদি যমুনা —”
“আপনি যমুনার বিরুদ্ধে কিছু বলিবেন না, সে ইহার কিছুই জানে না।”
অক্ষয়কুমার হাসিয়া বলিলেন, ঔপন্যাসিক—উপন্যাসে সুন্দর মুখ—যাহা হউক, সে কথায় আর কাজ নাই। এখন কথা হইতেছে, রাঙ্গা শিব দেখিয়া সে মূৰ্চ্ছা যায় কেন?
“উমিচাঁদও মূৰ্চ্ছা গিয়াছিল।”
“সেই কথাই বলিতেছি। উমিচাঁদও মূৰ্চ্ছা যাইবার যে কারণ বলিয়াছিল, যমুনাও ঠিক তাহাই বলিল—আশ্চর্য্যের বিষয় সন্দেহ নাই। কাজেই বলিতে হয়, দু’জনের কথাই ঠিক নহে।
“তবে কি আপনি বলিতে চাহেন, যমুনা এই খুন করিয়াছে?”
“অতদূর বলি না। বোধহয়, উমিচাঁদ বা যমুনা খুন সম্বন্ধে জড়িত নহে; তবে ইহাও ঠিক, ইহারা খুন সম্বন্ধে অনেক কথা জানে।”
“এ কথা ঠিক নয়।”
“তাহা হইতে পারে—সে এ সম্বন্ধে সকল কথা জানে না। সে অর্দ্ধেক জানে, আর অর্দ্ধেক উমিচাঁদ জানে।”
“যদি তাহারা জানে, তবে প্রকাশ করিতেছে না কেন?”
“সম্ভবতঃ তাহারা কাহাকে রক্ষা করিবার চেষ্টা করিতেছে।”
“এমন কে আছে যে, তাহারা তাহাকে রক্ষা করিবার চেষ্টা পাইতেছে।”
“অনেকে হইতে পারে। এই মনে করুন, হুজুরীমলের স্ত্রীকে।”
নগেন্দ্রনাথ বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “এ কথা হইতেই পারে না।”
অক্ষয়কুমার মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “অনেক বিষয়ে পারে। এই দেখুন না, দুই কারণে হুজুরীমল খুন হইতে পারে; প্রথম কারণ টাকা—দ্বিতীয় কারণ ঈর্ষা।’
“টাকা সে রাত্রে তাঁহার নিকট ছিল না।”
“কোন মূল্যবান্ কাগজ-পত্রও থাকিতে পারে। যাহা হউক, এজন্য যদি কেহ তাহাকে খুন করিয়া না থাকে, তবে ঈর্ষাবশে খুন করিয়াছে।”
“আপনি কি মনে করেন যে, হুজুরীমলের স্ত্রী দাসীর উপর ঈর্ষা করিয়া স্বামীহত্যা করিয়াছে?”
“দাসীর উপর ছাড়া কি আর কাহার উপরে হইতে পারে না—এই মনে করুন না গঙ্গা।“
“গঙ্গার সঙ্গে যে তাহার কোন সম্বন্ধ ছিল, বোধ হয় না।”
“তবে সে লুকাইয়া রাত্রে তাহার নিকট আসিত কেন? সবই পরে জানা যাইবে। এখন আপনার বন্ধুকে দলে লওয়া যাওয়া যাক। তাহার দ্বারা গঙ্গার বিষয় অনেক জানা যাইবে।”
“সে কখনও তাহা প্রকাশ করিবে না।”
“মহাশয়ের বন্ধুটি যেরূপ বাচাল, তাহাতে তাহার নিকট হইতে কথা বাহির করিতে বিশেষ কষ্ট পাইতে হইবে না।”
নগেন্দ্রনাথ এ কাজটা ভাল বোধ করিলেন না। এইরূপে ভুলাইয়া কাহারও নিকট হইতে কোন গোপনীয় কথা বাহির করিয়া লওয়া বড়ই অন্যায়।
অক্ষয়কুমার তাহার মনের ভাব বুঝিয়া মৃদুহাস্য করিয়া বলিলেন, “নগেন্দ্রনাথবাবু, ডিটেকটিভগিরি করিতে হইলে এত ন্যায়-অন্যায়ের বিবেচনা করিতে গেলে চলে না।”