২. বিস্তৃত ক্ষেতের মধ্যে

অধ্যায় ৬

আশেপাশে বিস্তৃত ক্ষেতের মধ্যে উঁচু একটি ভিটে চাঁদের মলিন আলোতেও উদ্ভাসিত। বড়বড় জানা-অজানা বৃক্ষ যেনো হাতে হাত ধরে চারপাশ ঘিরে প্রাচীর বানিয়ে রেখেছে। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রাচীর ভেদ করে টিমটিমে লালচে আলোর একটি বিন্দু জ্বলছে।

একটা সরু খালের পানিতে যতোটুকু সম্ভব হাত-পা-মুখ ধুতে ধুতে সেই ভিটের দিকে তাকালো ছফা। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আতর। আয়েশ করে সিগারেটে টান দিচ্ছে।

হাত-মুখ ধুয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। শার্টের একপাশে কিছুটা কাদা লেগেছে, ওগুলোর ব্যাপারে আপাতত কিছু করার নেই। পকেট থেকে রুমাল বের করে কিছুটা কাদা মুছে আতর আলীকে সাথে নিয়ে নিঃশব্দে কিছুটা পথ সামনে এগিয়ে গেলো। ভিটার কাছে আসতেই বোঝা গেলো একটা টিনের ঘরের জানালা দিয়ে হারিকেনের আলো দেখা যাচ্ছে।

মাটি কেটে তৈরি করা তিন-চারটা ধাপ পেরিয়ে উঁচ ভিটায় উঠেই হাঁক দিলো আতর, “মাস্টরসাব…ঘুমায় গেছেন নি? ও মাগুরসাব?”।

কয়েক মুহূর্ত পরই দরজা খুলে হাতে হ্যারিকেন নিয়ে বয়স্ক এক লোক বের হয়ে এলেন। “কে? এতো রাতে কে ডাকে?”

ভদ্রলোকের বাচনভঙ্গি স্পষ্ট এবং প্রমিত। ছফা কিছুটা অবাকই হলো। যে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকও প্রমিত-বাঙলায় কথা বলতে পারে। না সেখানে সুন্দরপুরের প্রাইমারি-স্কুলের শিক্ষকের কাছ থেকে এরকমটি সে আশা করে নি।

 “আমি আতর,” নিজের নামটা সুন্দর করেই বললো ইনফর্মার। “ঢাকা থেইকা একজন মেহমান আইছে…”

গায়ে শাল জড়ানো এক বৃদ্ধ; মাথায় কানটুপি; মুখে গোঁফ আর লম্বা। দাড়ি; সবটাই সাদা ধবধবে; অবশ্য চোখে কোনো চশমা নেই।

“আমার সাথে দেখা করতে এসেছে?” বৃদ্ধের চোখেমুখে জিজ্ঞাসা। চোখ কুচকে দেখার চেষ্টা করলেন তিনি।

“আপনের চশমা কই, মাস্টরসাব?”

আতরের প্রশ্নে বৃদ্ধের চোখমুখ আরো কুচকে গেলো। “আর বোলো না, ঢাকা থেকে ফেরার সময় বাসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তখনই ব্যাগটা চুরি হয়ে যায়। চশমাটা ওটার ভেতরেই ছিলো।”

“ক কি?” কৃত্রিম আফসোস আতরের কণ্ঠে। “দ্যাশটা এক্কেবারে চোর বাটপারে ভইরা গ্যাছে।”

কথাটা শোনার পর বৃদ্ধের মুখে প্রচ্ছন্ন বাঁকাহাসি ফুটে উঠলো।

ছফা জানে পুলিশের ইনফর্মারদের কেউই পছন্দ করে না, তবে তাদেরকে ভয় পায়, তাই মুখ ফুটে কেউ কিছু বলার সাহস রাখে না।

চারপাশে তাকালো সে। উঁচু ভিটের উপরে একটি বসতবাড়ি। হালকা কুয়াশায় পৌণে একখান চাঁদের আলোয় শুধু দেখা যাচ্ছে সেই ভিটার চারপাশে বড়-বড় গাছের সমাহার। দুটো ছোটো-ছোটো টিনশেডের ঘর ছাড়া আর কিছু নেই। ঘর দুটোর বিপরীতে, মাঝখানের বিশাল আর পরিস্কার উঠোনের পর বাঁশ-কাঠ দিয়ে বানানো একটি টয়লেট। বাড়ির চারপাশে বড়বড় গাছ ছাড়া ঝোঁপঝাঁড়ও রয়েছে প্রচুর। যেনো সুরক্ষিত প্রাচীর ওগুলো। ঝিঁঝি পোকা ডেকে যাচ্ছে বেশ জোরে জোরে।

মাস্টার ঘরের সামনে উঠানের দিকে যেতে থাকলে আর তার পেছন পেছন মিনতির সুরে কী যেনো বলতে বলতে এগিয়ে গেলো। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলো ছফা, সে বুঝতে পারছে না কী করবে।

“খাড়ায়া আছেন ক্যান? আহেন,” পেছন ফিরে তাড়া দিয়ে বললো ইনফর্মার।

ঘরের সামনে ছাউনি দেয়া বারান্দায় একটা কাঠের বেঞ্চি আর দুটো চেয়ার আছে। দেখে মনে হচ্ছে কমপক্ষে ত্রিশ-চল্লিশ বছরের পুরনো। একটা চেয়ারে বসে পড়লেন মাস্টার, আতর আলী বসলো বেঞ্চিটাতে। ছফা এগিয়ে গিয়ে চুপচাপ অন্য চেয়ারটাতে বসে পড়লো।

 “মাস্টরসাব, উনি ঢাকা থেইকা আইছেন…উনার নাম নুরে ছফা।”

মাস্টারের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে সালাম ঠকলো ছফা।

“এই গ্রামে উনার বিয়ার সম্বন্ধ হইছে, মাইয়ার ব্যাপারে খোঁজ নিবার চাইতাছেন…” আতর সময় নষ্ট না করে তার বানোয়াট কথাবার্তা বলে যেতে লাগলো। “…আমাগো ওসিসাব কইলো আপনের কাছেনিয়া যাইতে…”

নুরে ছফা মনে মনে হাসলো। ইনফর্মারদের এই এক স্বভাব, সব কিছুতে থানা-পুলিশের রেফারেন্স দেবে।

আতরের কথা আমলে না নিয়েই মাস্টার মুখ তুলে তাকালেন ছফার দিকে। তার মুখের অভিব্যক্তি বিভ্রান্তিকর। সেটা দেখে বোঝার উপায় নেই লোকটা কী ভাবছে।

 “এই গ্রামে আপনের মতো শিককিত আর জ্ঞানী মানুষ একজনও নাই। এইখানকার সব মানুষের চৌদ্দগুষ্টির খবর আপনে জানেন। তার চায়াও বড় কথা, আপনে মানুষ ভালা। মিছা কথা-”।

হাত তুলে আতরকে থামিয়ে দিলেন মাস্টার। “পাত্রিটা কে? আমি কি ওকে চিনি? আমার কোনো ছাত্রি?”

আতর কোনো রকম লুকোছাপা না করেই ছফাকে চোখ টিপে মুচকি হাসি দিলো। চশমাহীন মাস্টারের ঝাপসা দৃষ্টির সুবিধা নিলো সে। “না, না। আপনের ছাত্রি না। ঐ যে…হোটেলওয়ালি..মুছকান,” ভুল উচ্চারণে নামটা বললো আতর। “মুছকান জুবুরি।”

ভুরু কুচকে ফেললেন মাস্টার। “উনি পাত্রি!”

সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো সে। ইনফর্মারের ইশারা পেয়ে বললো, “জি…উনিই.”

ছফার দিকে ভালো করে তাকালেন মাস্টার। চোখ দুটো পিটপিট করে দেখার চেষ্টা করছেন। বোঝাই যাচ্ছে চশমা ছাড়া দেখতে পাচ্ছেন না ভালো করে। “ও,” আর কিছু বললেন না সুন্দরপুরের বৃদ্ধ মাস্টার।

 “মাস্টরসাব, ভাইজান ঐ বেটির সমন্ধে কিছু জানবার চায়,” বিগলিত হাসি দিয়ে বললো আতর। “বুঝেনই তো, বিয়া-শাদীর ব্যাপার…”

অসম্ভষ্ট দেখালো মাস্টারকে। “বেটি, মাথারি এইসব শব্দ আমার সামনে বলবে না…ভদ্রমহিলা বলো।”

জিভে কামড় দিয়ে চোখ টিপে বললো ইনফর্মার, “মুককু-সুকু মানুষ…ভুল হইয়া গেছে, মাগুরসাব।”

একান্ত অনিচ্ছায় ছফার দিকে তাকিয়ে বললেন বৃদ্ধ, “আমি তো উনার সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানি না।”

 “ওর ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডটা…” নুরে ছফা বললো। “…মানে আমি জানতে পেরেছি ও এই এলাকার নয়…তাহলে এখানে কিভাবে এলো?”

পিটপিট করে চেয়ে রইলেন বৃদ্ধ। “আপনার সাথে উনার পরিচয় হয়েছে কিভাবে?”

একটু ধন্দে পড়ে গেলো ছফা, তবে সেটা কাটিয়ে উঠতে বেশি সময়ও লাগলো না। “ইয়ে, মানে…ফেসবুকে।”

মাস্টার এবং আতর দু-জনেই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। এই জিনিসের নাম এর আগে তারা কেউ শুনেছে বলে মনে হলো না।

“কি বুক বললেন?”

“ফেসবুক।”

মাস্টার একটু ভেবে নিলেন। “এটা কি পত্রমিতালীর মতো কিছু? আগে চিঠির মাধ্যমে বন্ধুত্ব করার জন্য এক ধরণের চটি বই বের করা হতো…এখন আর ওসব দেখা যায় না।”

ছফা মুচকি হাসলো। পত্রমিতালী সম্পর্কে তার ভালোই ধারণা আছে। ছোটোবেলায় সেও এরকম বন্ধুত্ব করেছে গ্রামে বসে। ঢাকাসহ বড় বড় কয়েকটি শহরে তার কিছু পত্রমিতালী বনধু ছিলো, বলা বাহুল্য, তারা সবাই ছিলো মেয়ে! এ-সময়কার ফেসবুক যে আসলে পত্রমিতালীরই একটি ডিজিটাল সংস্করণ সেটা এর আগে কখনও মনেই হয় নি। প্রথমে ই-মেইল, সেলফোন এসে চিঠি-পত্র হটিয়ে দিলো, তারপর ফেসবুক এসে বিতারিত করলো পত্রমিতালীকে।

“অনেকটা সে-রকমই,” বললো সে।

“ও,” মাস্টার আস্তে করে বললেন। “সেজন্যেই তেমন কিছু জানেন। না।”

কিছু বললো না ছফা।

“ভদ্রমহিলা অলোকনাথ বসুর নাতবৌ,” কথাটা বলেই উদাস হয়ে গেলেন তিনি। যেনো অতীতে ফিরে যাবার চেষ্টা করছেন।

ছফা আর আতর উদগ্রীব শ্রোতা হয়ে বসে রইলো।

“অলোকনাথ বসু ছিলেন সুন্দরপুরের সবচাইতে প্রভাবশালী পরিবারের শেষপ্রজন্ম,” গভীর করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অবশেষে বলতে শুরু করলেন আবার। “কয়েক পুরুষ ধরে তারা জমিদার ছিলেন।”

“অলোকনাথ বসুর নাতবৌ মুশকান জুবেরি হয় কি করে?”

ছফার দিকে তাকালেন মাস্টার। “আপনার প্রশ্নটা একদম সঙ্গত। যেকোনো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ এ প্রশ্ন করবে। এর পেছনে একটা গল্প আছে।”

“কি গল্প?”

“অলোকনাথ বসুর একটাই সন্তান ছিলো, অঞ্জলি বসু। উনি অনেক চেষ্টা করেছেন পুত্রসন্তানের জন্য, দ্বিতীয়বার বিয়েও করেছিলেন কিনতু লাভ হয় নি। ও ঘরে কোনো সন্তানই জন্মায় নি। যাইহোক, মেয়েটা একটু বড় হবার পর পুত্রসন্তানের ইচ্ছে পরিত্যাগ করেন তিনি, মেয়েকে ভালোভাবে লালন-পালন করার দিকেই মনোযোগ দেন।” একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন, “অঞ্জলিকে ঢাকায় পাঠানো হয় পড়াশোনার জন্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় সে, ওখানেই তার সাথে সাঈদ জুবেরির পরিচয় হয়। তারা দুজনেই ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছিলো। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়ার অপরাধে জেলও খেটেছে। অলোকনাথ বসু তার মেয়ের এই সম্পর্কের ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেন নি। তার জন্য ব্যাপারটা ছিলো হৃদয়বিদারক। পুত্রসন্তানের আশা বাদ দিয়ে মেয়েকে ঘিরেই ভবিষ্যৎ বংশধরের স্বপ্ন দেখছিলেন, আর সেই মেয়ে কিনা বিয়ে করতে চায় মুসলিম ছেলেকে…” আবারো থেমে দম নিয়ে নিলেন মাস্টার। “যাইহোক, পিতার অমতে অঞ্জলি বিয়ে করে বসে জুবেরিকে। এটা সম্ভবত ভাষা আন্দোলনের দু-এক বছর পরের ঘটনা। এরপর দীর্ঘদিন মেয়ের সাথে যোগাযোগ রাখেন। নি অলোকনাথ।”

 “তারপর?” ছফা মনে করলো শ্রোতা হিসেবে দুয়েকটা প্রশ্ন না করলে কেমন দেখায়।

 “বিয়ের কয়েক বছর পর ওদের এক পুত্রসন্তান হয়, সেই ছেলেটার বয়স যখন পনেরো কি ষোলো তখন ঢাকাফেরত এক আত্মীয়ের কাছ থেকে অলোকনাথ বসু জানতে পারলেন তার নাতি দেখতে হুবহু তার মতোই হয়েছে। এই খবরটা শোনার পর থেকে উনার মধ্যে বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেলো। সমস্ত রাগ চলে গেলো, বলতে পারেন। তাছাড়া উনারও বয়স হয়েছিলো…স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে কয়েক বছর আগে…নানা রকম অসুখ-বিসুখে পেয়ে বসেছিলো..কখন কি হয় কে জানে। তো, লোকমারফত মেয়ের কাছে। খবর পাঠালেন স্বামী-সন্তান নিয়ে বাড়িতে চলে আসার জন্য।”

মাস্টার থেমে গেলে ছফা দ্বিধায় পড়ে গেলো কিছু বলবে কিনা। “অঞ্জলি কি এসেছিলো?” অবশেষে বলেই ফেললো সে।

মাথা নেড়ে সায় দিলেন মাস্টার। “স্বামী-সন্তান নিয়েই এসেছিলো। অঞ্জলি কিন্তু এমন সময় এলো যখন দেশের অবস্থা মোটেও ভালো ছিলো না।”

“কখন এসেছিলো ওরা?”

“৭০-এর নির্বাচনের পর পর,” বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বৃদ্ধ। “রাজনৈতিক অবস্থা তখন ভালো ছিলো না। অবশ্য ঢাকায় অনেক কিছু হলেও এই সুন্দরপুরে তেমন খারাপ পরিস্থিতি ছিলো না তখনও। প্রায় মাসখানেক এখানে ছিলো বোধহয়, তারপর আবার ঢাকায় ফিরে যায় কিন্তু এরইমধ্যে অলোকনাথ নিজের সমস্ত সম্পত্তির বিরাট একটি অংশ একমাত্র নাতির নামে উইল করে দেন, বাকি সম্পত্তি উনি দেবোত্তর করে দিয়েছিলেন।”

“তার সম্পত্তির পরিমাণ কেমন ছিলো?”

ছফার দিকে এমনভাবে তাকালেন মাস্টার যেনো সে এক যৌতুকলোভী পাত্র, শুধুমাত্র বিরাট সম্পত্তির গন্ধ পেয়ে ছুটে এসেছে এই সুন্দরপুরে! “জমিদার হিসেবে অনেক সম্পত্তির মালিকই ছিলো কিনতু আস্তে আস্তে সেগুলো কমতে শুরু করে। তারপরও নাতির নামে যখন লিখে দিয়ে যান তখনও বেশ ভালো কিছু জায়গা-জমি আর স্বর্ণালঙ্কার ছিলো।”

ছফা চুপ মেরে রইলো।

“শুনেছি স্বর্ণালঙ্করগুলোর সবই নাতিকে দিয়েছিলেন, আর সম্পত্তির বেশিরভাগ৷”

“তারপর উনার নাতি কী করলেন এগুলো পেয়ে?”

“ঐ সময় অলোকনাথ বসুর নাতির বয়স ছিলো খুব কম, মাত্র সাবালক হয়েছে। তাছাড়া উইল করার কয়েক মাসের মধ্যেই স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।” মাস্টার চুপ মেরে গেলেন। এবার দীর্ঘ সময়ের জন্য।

ছফা কিছু বললো না, অপেক্ষায় থাকলো মাস্টারের মুখ খোলার জন্য।

আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সুন্দরপুরের প্রবীণ শিক্ষক। “পঁচিশে মার্চের পর অঞ্জলি তার স্বামী-সন্তান নিয়ে এখানে বাবার কাছে চলে আসে আবার।” একটু কেশে নিলেন বৃদ্ধ। “এপ্রিলের শুরুতে পাকিস্তানি মিলিটারি সুন্দরপুরে আসে..অলোকনাথ, অঞ্জলি, সাঈদ জুবেরিসহ তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করে।”

মাস্টারের চোখেমুখে বিষাদের ছায়া।

 “উনারা ঐ সময় এখানেই ছিলেন? মানে সবাই?”

 “শুধু রাশেদ জুবেরি বাদে।”

 “রাশেদ জুবেরি?”

 “অঞ্জলির ছেলে।”

 “ও তখন কোথায় ছিলো?”

প্রবীণ লোকটি ছফার দিকে তাকালেন। চেহারায় বিষাদের ছায়া। প্রায় অস্ফুটস্বরে বললেন, “আমার এই বাড়িতে!”

“আপনার বাড়িতে?”।

মাথা নেড়ে সায় দিলেন মাস্টার। “হুম। মিলিটারি হামলা চালাবার ঠিক আগে দিয়ে রাশেদ জুবেরি আমার সাথেই ছিলো। আমার কাছে এসেছিলো কিছু বই ধার নিতে। ছেলেটা খুব বই পড়তো। সুন্দরপুরে তো কোনো বইয়ের দোকান ছিলো না তখন…লাইব্রেরিও ছিলো না…অবশ্য এখনও নেই…” চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললেন, “ওর মা অঞ্জলিই বলেছিলো আমার কাছে প্রচুর বই আছে৷ সে জানতো আমি বই-টই পড়ি।”

“আপনার কাছে বই ধার নিতে এসে বেঁচে গেলো রাশেদ জুবেরি?”

“তা বলতে পারেন।”

আর কোনো প্রশ্ন না করে চুপ মেরে গেলো ছফা।

“পাকিস্তানি মিলিটারি সবাইকে খুন করে লাশগুলো জমিদার বাড়ির জোড়-পুকুরে ফেলে দেয়। পরে মিলিটারি জমিদার বাড়িটা দখল করে ওখানে ক্যাম্প বানায়…” মাস্টার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ঐ ক্যাম্পে অনেককে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছিলো,” ভদ্রলোক যেনো উদাস হয়ে গেলেন।

অনেকক্ষণ চুপ থেকে আতর আলী উসখুশ করতে শুরু করলো, কিন্তু তাকেশান্ত থাকার ইশারা করলো ছফা।

 “এখানকার বদরবাহিনীর কিছু মেম্বার আমাদের গ্রামের অনেক হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করে…এরমধ্যে আমার অনেক আত্মীয়ও ছিলো।” মাস্টারের চোখ দুটো কেমন ঘোলা হয়ে গেলো। “আমাকেও করেছিলো..”।

ছফা কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বললো, “রাশেদ জুবেরি, তার কি হলো?”

দীর্ঘশ্বাসের সাথেই বললেন মাস্টার, “যখন জানতে পারলাম মিলিটারি ওর পরিবারের সবাইকে হত্যা করেছে তখন আমি ওকে নিয়ে নিরাপদ কোথাও পালানোর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু তখন পুরো গ্রাম ঘিরে রেখেছিলো মিলিটারি আর তাদের দোসররা। ওরা এই বাড়িতেও হানা দেয়। উপায় না দেখে বড় কবরস্তানে গিয়ে লুকাই আমরা।”

কবরস্তানের কথা শুনে ছফার মনে পড়ে গেলো একটু আগে সে কবরে পড়ে গেছিলো।

“একটা পুরনো কবর…শেয়াল-কুকুর হয়তো গর্ত করে রেখেছিলো…আমরা দু-জন ওটার মধ্যে ছিলাম সারাটা রাত।”

একটু আগে কবরে পতিত হবার ব্যাপারটা মামুলি হয়ে গেলো এ কথা শুনে। “তারপর?”

“পরদিন খুব ভোরে রাশেদকে নিয়ে আমি সুন্দরপুরের বাইরে যাবার চেষ্টা করলে মিলিটারির কাছে ধরা পড়ে যাই।”

“রাশেদ জুবেরি ধরা পড়ে নি?”

মাথা দোলালেন মাস্টার। “না। আমি ধরা পড়লেও ও পালিয়ে যেতে পেরেছিলো।”

“আপনাকে মিলিটারি ধরার পর কি করলো?”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বৃদ্ধ। “কী আর করবে..জমিদার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখলো। মারধোর করলো। শেষে মুসলিম হয়ে গেলাম জীবন বাঁচাবার জন্য…ওরা ছেড়ে দিলো আমাকে।”

ছফা আর কিছু বললো না।

“যুদ্ধের বাকি সময়টা এখানেই ছিলাম। পাঁচ-ওয়াক্ত নামাজ পড়তাম, শান্তি কমিটির মিটিংয়ে হাজির থাকতাম…” আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছফার দিকে তাকালেন। “…সেই হিসেবে আমাকেও রাজাকার বলতে পারেন!”

বিবৃত হবার অভিব্যক্তি লুকানোর চেষ্টা করলো ছফা। “রাশেদ জুবেরির এর কোনো খবর পান নি?”

“না। আমি ভেবেছিলাম ও হয়তো মারা গেছে।”

 “যুদ্ধ শেষে জানলেন মারা যায় নি?”

 “হূম।”

“তারপর?”

“যুদ্ধের পর অলোকনাথের সমস্ত জায়গা-জমি অর্পিতসম্পত্তি হিসেবে নিয়ে নিলো সরকার। বাপ-মা, পরিবার-পরিজন হারিয়ে রাশেদ জুবেরির মানসিক অবস্থা এমন ছিলো যে, সম্পত্তিগুলো ফিরে পাবার কোনো চেষ্টাই করেনি তখন। কয়েক মুহূর্তের সুনসান নীরবতা ভেঙে আবারো বলতে লাগলেন তিনি, “পরে শুনেছি ও এখান থেকে পালিয়ে গিয়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলো। যুদ্ধশেষে ঢাকায়ই থাকতো। বনানীতে ওর বাবার বিরাট একটি বাড়ি ছিলো।”

 “ঐ ছেলেটা কি সম্পত্তিগুলো আর উদ্ধার করার চেষ্টা করে নি?”

“কয়েক বছর পর সম্পত্তিগুলো ফেরত পাবার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু সফল হয় নি।”

“সে কি করতো? মানে কাজের কথা বলছি।”

“শুনেছি ব্যবসা করার চেষ্টা করেছিলো, সুবিধা করতে পারে নি। আসলে বাবার সম্পত্তি আর নানার কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রচুর স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করে ঢাকায় বেশ সচ্ছলভাবেই থাকতো সে। সম্ভবত বাড়ি ভাড়ার টাকায় চলতো। মাঝেমধ্যে এখানে আসতো…কয়েকটা দিন আমার এখানে থেকে আবার ঢাকায় চলে যেতো। একটু বাউণডুলে আর অগোছালো ছিলো। সংসার করার দিকে আগ্রহ ছিলো না। খুব বই পড়তো। নেশার মতো বই নিয়ে পড়ে থাকতো সে,” একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, “৯৪ কি ৯৫’র পর দীর্ঘদিন আর এখানে আসে নি। আমার সাথেও যোগাযোগ হয় নি। অনেকদিন পর শুনতে পেলাম ও অসুখে পড়েছে।”

 “এটা কোন সালের ঘটনা?”

ছফার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকালেন মাস্টার। “২০০৬ সালের দিকে হবে।”

“উনার কি রোগ হয়েছিলো?”

 “ক্যান্সার..প্রোস্টেট ক্যান্সার।”

“উনি কি সুস্থ হতে পেরেছিলেন?”

মাথা দোলালেন বৃদ্ধ। “না।”

“তাহলে মুশকান জুবেরির সাথে

মাস্টার হাত তুলে থামিয়ে দিলেন তাকে। “বলছি। ২০১০ সালের দিকে একটা কাজে ঢাকায় গেছিলাম কয়েকদিনের জন্য, তখন হাসপাতালে গিয়ে ওকে দেখে এসেছিলাম। ভীষণ অসুস্থ ছিলো…দেখাশোনা করার মতো কেউ নেই বলে মাসের পর মাস হাসপাতালেই পড়ে থাকতো।”

|||||||||| “মি. জুবেরি কোন্ হাসপাতালে ছিলেন?” উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলো ছফা।

|||||||||| “অরিয়েন্ট হাসপাতাল।” একটু থেমে ঢোক গিলে নিলেন। “আমি ঢাকা থেকে ফিরে আসার ছয় কি সাত মাস পর মুশান জুবেরি নামের মহিলা এসে হাজির হয় সুন্দরপুরে। নিজেকে রাশেদের স্ত্রী দাবি করে সে।”

মাস্টারকে চুপ থাকতে দেখে ছফা বলে উঠলো, “এ ব্যাপারে কি আপনার মনে কোনো সন্দেহ রয়েছে?”

চোখ পিটপিট করে তাকালেন বৃদ্ধ। “মারাত্মক অসুস্থ, বিছানায় শুয়ে থাকা একজন মানুষ কখন বিয়ে করলো, কিভাবে করলো-এটা ঠিক হিসেবে মেলাতে পারি না। প্রোস্টেট ক্যান্সারের রোগিকে বিয়ে করাটাও বিরল ব্যাপার নয় কি? তাছাড়া যে লোক সুস্থ-সবল অবস্থায় সংসার করার নাম নেয় নি, সে কিনা দুট করে মৃত্যুশয্যায় বিয়ে করে বসলো…স্বীকার করছি, আমি এই বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে সন্দেহ করি এখনও

“উনি যখন এখানে আসেন রাশেদ জুবেরি কি তখনও বেঁচে ছিলেন?”

“না।”

“তাহলে মি. জুবেরি কবে মারা গেছিলেন? আর বিয়েটাই বা করলেন কবে?”

 “ভদ্রমহিলা এখানে আসার দু-একমাস আগে জুবেরি মারা যায়…তাদের বিয়েটা কবে হয়েছিলো সেটা আমি জানি না।”

“মুশকান জুবেরি সম্পত্তিগুলো কিভাবে পেয়ে গেলেন? সম্পত্তিগুলো তো রাশেদ জুবেরি উদ্ধারই করতে পারেন নি।”

ছফার দিকে তাকিয়ে রইলেন মাস্টার। “এসব খবর আমার ভালো করে জানা নেই। লোকজন এ নিয়ে নানান ধরণের গালগল্প করে বেড়ায়। কোটা সত্যি কে জানে,” এরপর আতরের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন তিনি, “আপনার সাথে যে আছে ও-ই বরং এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবে।”

ইনফর্মার বিগলিত হাসি দিয়ে ছফাকে আশ্বস্ত করলো। “মাস্টরসাব, ঠিকই কইছেন…এইটা আমি আপনেরে ডিটেইল কমু নে।”

আতরকে কিছু না বলে মাস্টারের দিকে তাকালো নুরে ছফা। “ঐ মহিলা কি রবীন্দ্রনাথের ভক্ত নাকি?…রেস্টুরেন্টের অমন নাম দিয়েছে যে?”

“উনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভক্ত কিনা সেটা আমি বলতে পারবো না তবে আমার মনে হয় নামটার সাথে ভক্ত হবার না-হবার কোনো সম্পর্ক নেই।”

ছফা আগ্রহী হয়ে উঠলো। “ভক্ত না-হলে এমন নাম রাখার কারণটা কি?”

মাস্টার গভীর করে দম নিয়ে নিলেন। “আগেই বলেছি, মহিলা কেন এমন নাম রেখেছেন সেটা আমি জানি না তবে এমন নামে আমি খুব একটা অবাক হই নি।”

নড়েচড়ে বসলো ছফা।

“সত্যি বলতে কি, রবীন্দ্রনাথ আসলেই এখানে কখনও খেতে আসেননি!”

“উনার আসার কথা ছিলো নাকি?” আগ্রহী হয়ে উঠলো ছফা।

স্থিরচোখে চেয়ে থেকে আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলেন বৃদ্ধ, তারপর গম্ভীরকণ্ঠে বললেন “…ছিলো, কিন্তু উনি আসেন নি।”

“কেন আসেন নি?”

গভীর করে দম নিয়ে নিলেন সুন্দরপুরের বৃদ্ধমাস্টার। “অলোকনাথের বাবা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক মানুষ। তাদের মধ্যে জানাশোনাও ছিলো। এক জমিদারের সাথে আরেক জমিদারের সম্পর্ক থাকাটাই তো স্বাভাবিক।” একটু কেশে নিলেন তিনি। “শুনেছি, অলোকনাথের বাবা। ত্রিলোকনাথ বসু রবীন্দ্রনাথকে সুন্দরপুরে আসার নেমন্ত্রণ করেছিলেন। কবির জন্য বিশাল আয়োজন করেছিলেন তিনি। ঢাকা আর লক্ষৌ থেকে বাবুর্চি এনে রান্না-বান্নাও করেছিলেন হরেকরকম পদের। নিজের বাড়িটাও সাজিয়েছিলেন…আয়োজনে কোনো কমতিই ছিলো না কিন্তু একেবারে শেষমুহূর্তে রবীন্দ্রনাথ দুঃখ প্রকাশ করে জানিয়ে দেন তিনি আসতে পারছেন না।”

“উনি…মানে রবীন্দ্রনাথ কেন আসলেন না? কারণটা কি ছিলো?”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মাস্টার। “এটা ১৯১৮ সালের ঘটনা। যেদিন উনি রওনা দেবেন তার আগের দিন উনার বড়মেয়ে মাধুরিলতা মারা যায়।”

“ও,” আস্তে করে বললো ছফা।

“সম্ভবত মিসেস জুবেরি এই গল্পটা রাশেদের কাছ থেকে শুনে থাকবেন…তাই অমন অদ্ভুত নাম দিয়েছেন।”

মাস্টারকে চুপ মেরে যেতে দেখে ছফা উঠে দাঁড়ালো। তার দেখাদেখি আতরও। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। বলার মতো আর কিছু নেই বৃদ্ধের। “আপনাকে ধন্যবাদ,” বললো সে। “অনেক সময় নষ্ট করলাম আপনার। ভালো থাকবেন। নমস্কার।”

মাথা নেড়ে সায় দিলেন বৃদ্ধ। ছফা আর আতর কয়েক পা এগোতেই পেছন থেকে আস্তে করে কিন্তু দৃঢ়তার সাথে বলে উঠলেন, “আমার কাছে মিথ্যে বলার দরকার ছিলো না।”

চমকে উঠলো তারা দুজন। মাস্টারের ঘোলা দু-চোখ যেনো জ্বলজ্বল করছে। তারা কিছু বলার আগেই বৃদ্ধ বলে উঠলেন আবার :

 “আমি মিথ্যে কথা একদমই পছন্দ করি না।” ছফা কিছু বলতে যাবে অমনি তিনি হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন। “কিছু বলতে হবে না। আপনি কে, কোন উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন সে-সব জানার কোনো আগ্রহ নেই আমার।”

তারপর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লেন তিনি। একটু শব্দ করেই দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। কয়েক মুহূর্ত দরজার কপাটের দিকে ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো ছফা। দরজার পাশে চেয়ারের উপরে রাখা হারিকেনের আলোয় একটা লেখা পড়ার চেষ্টা করলো সে। “উনার নামটা যেনো কি?”

তবে আতর আলী মুখ খোলার আগেই লেখাটা পড়তে পারলো সে।

.

অধ্যায় ৭

রমাকান্তকামার!

অন্ধকারে বিড়বিড় করে উঠলো ছফা।

টাউনে ফিরে যাচ্ছে তারা, তবে শর্টকাট পথ ছেড়ে, কবরস্তানটি এড়িয়ে ঘুরপথে যাচ্ছে এখন।

ছফা জানে রমাকান্ত একটি নাম, যেমন রজনীকান্ত, সজনীকান্ত। কিনতু কামার নিশ্চয় পদবী-টাইটেল। ওটা নামের থেকে আলাদা করেই লেখে সবাই। সম্ভবত মাস্টার নিজের নামটাকে আরেকট বৈশিষ্টপূর্ণ করার জন্য রমাকান্ত আর কামারের মাঝখানে কোনো ফাঁক রাখেন নি। ফলে নামটি উল্টো করে বললে কিংবা লিখলে একই থাকে! এটাও কি এক ধরণের অ্যাম্বিগ্রাম? ছফা নিশ্চিত হতে পারলো না।

মাথা থেকে রমাকান্তকামার বিদায় করে দিয়ে আতর আলীর বয়ানের দিকে মনোযোগ দিলো সে। বিসতৃত ধানক্ষেতের আইল ধরে এগিয়ে যেতে যেতে মুশকান জুবেরির আগমনের গল্পটি বলে যাচ্ছে ইনফর্মার। গল্পটি ছফাকে বেশ আগ্রহী করে তুললো।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পর অলোকনাথ বসুর সম্পত্তিগুলো সরকার অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে নিয়ে নিলেও ওগুলো মূলত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের ভোগ-দখলেই ছিলো। ২০০৮ সালের দিকে মুশকান জুবেরি সম্পত্তিগুলো নিজের অধিকারে নিয়ে নেয় খুব সহজে কারণ রাজনীতিবিদদের জন্য ওই সময়টা ছিলো খুবই কঠিন। তবে ২০০৯ সালে মিলিটারি চলে যাবার পর আস্তে আস্তে রাজনীতিকেরা আবার ফিরতে শুরু করে, তখন ঝামেলা বেঁধে যায়। পুনরায় বেদখল হয়ে যায় কিছু সম্পত্তি। অবশেষে স্থানীয় এমপির সাথে একটা বোঝাঁপড়া করে নেন ভদ্রমহিলা, ফলে কিছু সম্পত্তি ফিরে পান। সেই সম্পত্তির পরিমাণও নেহায়েত কম নয়।

ভদ্রমহিলা এখানে এসেই সরাসরি জমিদার বাড়িতে উঠলেন। সেটা ২০০৮ সালের ঘটনা। অলোকনাথ বসুর বাকি সম্পত্তিগুলোও তিনি নিজের দখলে নিয়ে দেখভাল করতে শুরু করলেন। ব্যাপারটা সুন্দরপুরে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠলেও এ-নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি কেউ, কারণ স্থানীয় এমপি মহিলাকে সব ধরণের সাহায্য করেছেন। এই সাহায্য মোটেও নিঃস্বার্থ ছিলো না, বিনিময়ে বোসবাবুর সম্পত্তির বিরাট একটি অংশ লাভ করেন তিনি। যেসব সম্পত্তি দেবোত্তর করে দিয়েছিলেন সেগুলোর প্রায় সবটা চলে গেছে এমপির পকেটে, বাকি যে সম্পত্তিগুলেী জুবেরির নামে লিখে দিয়েছিলেন সেগুলো পেয়ে যায় ঐ মহিলা।

“খালি জমি না, এহন ঐ বেটিরেও ভোগ-দখল করবার চায় এমপিসাব,” বেশ রসিয়ে রসিয়ে বললো আতর।

তারা এখন বিসতৃর্ণ ক্ষেত পেরিয়ে একটা ডোবার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একটুখানি খামতি নিয়ে আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে জ্বলজ্বলে চাঁদ। প্রায় পূর্ণিমা। জ্যোৎস্নার আলোয় প্লাবিত চারপাশ।

 “উনাকে ভোগ-দখল করতে চায় মানে?” ছফা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।

আতরের বিশ্রী হাসিটা আরো প্রকট হয়ে উঠলো চাঁদের আলোয়। “বুঝলেন না?” তারপর কোনো জবাবের আশা না করেই বলতে লাগলো, “এমপিসাব এহন ঐ বেটিরে শাদী করবার চায়।”

“আপনাদের এমপি কি বিবাহিত না?”

হা-হা-হা করে হাসলো পুলিশের ইনফর্মার। “ঘরে বউ থাকলে কি ব্যাটমানুষ আর বিয়া করবার চাইবো না?”

এ কথার কোনো জবাব দিলো না ছফা।

“হূনেন, আমাগো এমপির বাপ-দাদারা সবতে তিন-চাইরটা কইরা বিয়া করছে..এহন সে যদি বাপ-দাদার ইজ্জত রাখতে চায়, তারে তো কমসে কম দুইটা বিয়া করনই লাগে, নাকি?”

কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে আবার সে বললো, “এমপি যে ঐ মহিলাকে বিয়ে করতে চায় এটা কি এখানকার সবাই জানে?”

“সবাই জানবো কেমনে? এতো ভিতরের খবর তো সবৃতে জানোনের কথা না।”

“ঐ মহিলা কি এই বিয়েতে রাজি হচ্ছে না?” রবীন্দ্রনাথের ভেতরে প্রাইভেট রুম থেকে গম্ভীর মুখে এমপির বের হয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা ভেসে উঠলো ছফার চোখে।

“ঐ বেটি এতো সহজে রাজি হইবো নি…আজব!”

“কেন রাজি হবে না?”

“আরে, ঐ বেটি ভালা কইরাই জানে বাকি জায়গা-জমি খাওনের ধান্দায় এমপিসাব হেরে দুই নম্বর বিবি বানাইবার চাইতাছে।”

“এতো জমির মালিক হবার পরও এমপি আরো চাইছে?”

আতর এমনভাবে তাকালো ছফার দিকে যেনো সে দিন-দুনিয়া সম্পর্কে যথেষ্ট আনাড়ি। “পুলিটিশিয়ানগো খিদা কুনোদিন শেষ হয় না..বুঝলেন। হেরা কব্বরে গেলেও খাই-খাই করে।”

মুচকি হাসলো ছফা। আজব একটা দেশ। সে এখন পর্যন্ত এমন কোনো জায়গায় যায় নি যেখানকার লোকজন রাজনীতিবিদদের পছন্দ করে, তাদের সম্পর্কে ভালো কথা বলে, অথচ যুগ যুগ ধরে এদেরকেই ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়ে যাচ্ছে।

“আমাগো ওসিসাব কি কয় জানেন?”

“কি বলে?”

“ওসিসাব কয়, ঐ বেটি এমপিরে জাদু করছে। নাকে দড়ি লাগায়া ঘুরাইতাছে হেরে। বেটি কুনোদিনও এমপিরে বিয়া করবো না…কিনতু ডাইরেক্ট না-ও করবো না। এইটাই বেটির চালাকি।”

“হুম।” ছফা আর কিছু বললো না। তার মাথায় এখন ঘুরছে অন্য চিন্তা।

ক্ষেত পেরিয়ে একটা বসতবাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় করুণ সুরে মেয়েমানুষের কান্নার শব্দ ভেসে এলো।

“বুঝলেন কিছু?” পেছন ফিরে বললো আতর।

“কি?” ছফা কিছুই বুঝতে পারছে না।

“ফালুর অ্যাডভান্স কব্বর তো এইবারও মিস হইলো না মনে হইতাছে!”

কথাটা বলার সময় ইনফর্মারের মুখে শোকের লেশমাত্র দেখা গেলো না, যেনো খুব মজার কিছু ঘটে গেছে।

আরেকটু এগোতেই এক নারীকণ্ঠের বিলাপ কানে এলো। সুরে সুরে কেঁদে চলেছে সে।

“আমি এহন কেমনে একলা থাকুম…ও তমিজের বাপ! তুমি আমারে রাটি কইরা কেমনে চইলা গেলা!”

হাসিটা জোর করে চেপে রাখলো ছফা। মনে মনে নিজেকে ভর্ৎসনা করলো এজন্যে। কিন্তু সুর করে কাউকে কাঁদতে শুনলে নিজের হাসি চেপে রাখতে পারে না। শৈশব থেকেই এটা হয়ে আসছে। নিকটজন হারিয়ে মানুষজন যখন সুর করে বিলাপ করতে শুরু করে ছফার তখন বড় হাসি পায়। সে জানে এটা নির্মম, অসভ্যতা। পৈশাচিকও বটে।

 “কতো কইতাম, আদারে-পাদারে হাগামুতা কইরো না…হ্ৰনলা না! আমার কথা তুমি হ্ৰনলা না?”

মৃত্যুর মতো করুণ ব্যাপারের সাথে হাগা-মুতার কী সম্পর্ক ভেবে পেলো সে। ভেতরে হাসির দমক আরো বেড়ে গেলো। দ্রুত পা চালিয়ে বিলাপের সুর আর বাণী থেকে নিজেকে দূরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলো কিন্তু আতর আলীর হাটা এখন গদাইলস্করি হয়ে গেছে। সে হাগা-মুতার সাথে মৃত্যুর সংযোগ নিয়ে মাথা ঘামাতে লাগলো।

“তমিজের বাপ এখলাস মিয়া গুয়ের গাড়ায় পইড়া মরছে মনে লয়।”

 ছফা কিছু বললো না।

“..বুইড়া আবার পায়খানায় কাম সারতে ডরায়…খোলা জায়গা না হইলে বেটার হাগা বাইর অয় না। এইটা নিয়া বউ-বাচ্চারা খোটা দিতো,” একমনে বলে যেতে লাগলো আতর।

ছফা বুঝতে পারলো তমিজের বাপের এমন আচরণ করার কারণটা কি। অনেকেই ক্লয়স্ট্রোফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়। আবদ্ধ কোনো জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতে পারে না, দম বন্ধ হয়ে আসে, এক ধরণের ভীতি জেঁকে ধরে। গ্রামের মানুষ এসব জটিল বিষয় বোঝে না। তারা মনে করে এগুলো নিছক কোনো বাতিক।

 “সারাজীবন খোলা জায়গায় আর গাছের নীচে কাম সারতো…অভ্যাস হইয়া গেছিলো আর কি।”

ছফা এই প্রসঙ্গটা পাল্টাতে চাইলো। “আচ্ছা, ঐ মহিলা…মানে মুশকান জুবেরি কি জমিদার বাড়িতে একাই থাকে?”

“না। একটা মাইয়া থাকে লগে।”

“আর কেউ না?” অবাক হলো সে। এরকম গ্রামে বিরাট একটি বাড়িতে দু-দুটো মেয়েমানুষ একা থাকে!

“বোবা ইয়াকুবও থাকে…পোলাটা দারোয়ানের কাম করে।”

“এই তিনজন? আর কেউ না?”

“জমিদার বাড়িতে এরাই থাকে, তয় বাড়ির সীমানার বাইরে চাইরদিকে বোসবাবুর অনেক জায়গাজমি আছে…ওইহানে কিছু লোকজন থাকে।”

“ওরা কারা?”

“এই ধরেন গরুর খামারের লোকজন, মাছ চাষ দেখাশোনা করে যারা..শাক-সবজি…আরো কতো কি যে করে বেটি তার কুনো ঠিক নাই

ছফা বুঝতে পারলো মহিলা জায়গা-জমিগুলোর ভালোমতোই সদ্ব্যবহার করছে।

“বেটির কইলাম সাহস আছে,” বললো আতর। চলতে চলতেই পেছনে ফিরে তাকালো সে। “সাহস না থাকলে এমুন জায়গায় আইসা নাড় গাঁড়বার পারে, কন?”

 “মহিলার সাথে যে মেয়েটা থাকে সে কে? কোনো আত্মীয়?”

“আরে, না। ওই মাইয়াটাও কাম করে…ফয়-ফরমাশ খাটে আর কি।”

একটু চুপ থেকে বললো ছফা, “ঐ জমিদার বাড়িটা কি অনেক বড়?”

“ম্যালা বড়…আগের দিনের জমিদার বিরাট বাড়ি, জোড়া পুকুর…একটা পুরুষগো লাইগা…আরেকটা মাইয়া মানুষের…” মুচকি হাসলো আতর, “বিরাট বাড়ি, বাগান, পুকুর না থাকলে কি জমিদার কওন যায়?” আবারো পেছন ফিরে তাকালো। “বাড়িটা এটু দেখবেন নাকি?”

 “না। আজ থাক কাল যাবো। আজ অনেক রাত হয়ে গেছে।”

“ঐ বাড়ির সামনে দিয়াই কিন্তু যাইতে হইব…ইচ্ছা করলে দুর থেইকা একটু দেইখা নিতে পারেন?”

দ্বিধায় পড়ে গেলো ছফা। “যাওয়ার পথেই পড়বে ওটা?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো আতর। “আমরা তো কবরস্তান দিয়া শর্টকাট না মাইরা ঘুরপথে যাইতাছি..ঐ বাড়ির সামনে দিয়াই কইলাম যাইতে হইবো।”

“ঠিক আছে…তাহলে চলেন।”

পাঁচ মিনিট পর আতর দু-পাশে ঘন ঝোপের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া একটি রাস্তা ধরে এগোতে লাগলো।

“এইখান থেইকা বাড়ির সীমানা শুরু.. শ্যাষ হইছে এক্কেবারে নামায় গিয়া..বিরাট বড় বাড়ি…দৌড়ায়াও শ্যাষ করবার পারবেন না।”

ছফা জানে নীচু ভূমিকে অনেক জায়গায় ‘নামা’ বলে। আতরের পাশপাশি হাটছে সে। দু-হা কিছুই বললো না। চারপাশে তাকিয়ে দেখছে। একটা মোড় নিতেই দেখা গেলো একটু দূরে বিশাল একটি গ্রিলের দরজা। পুরনো আমলে বড়-বড় বাড়িতে এরকম সদর-দরজা দেখা যেতো। তবে গ্রিলের পেছনে পাতলা টিন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। সম্ভবত এটা করেছে। মুশকান জুবেরি। ফলে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ভেতরের কিছু দেখা যায় না এখন।

প্রায় আট-নয় ফিটের মতো উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা মূল বাড়িটা। দেয়ালগুলোর পেছনে বড় বড় গাছ আর ফাঁকে ফাঁকে দেয়াল ডিঙিয়ে বাইরে চলে আসা লম্বা ঝোঁপগুলো যেনো আরো বেশি আড়াল করে দিয়েছে অন্দরমহলটাকে। হঠাৎ মাটির দিকে চোখ যেতেই থমকে দাঁড়ালো সে।

আতরও দাঁড়িয়ে পড়লো। “আর সামনে যাইবেন না?”

ছফা বুঝতে পারলো না কী বলবে। “না…মানে…” তার চোখ এখনও মাটির দিকে।

“কী দেখতাছেন?” আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করলো ইনফর্মার।

 “মহিলার কি গাড়ি আছে?”

 “হ। জমিদারের বৌ..গাড়ি না থাকলে চলে?”

একটু থেমে আবার বললো, “দুইটা গাড়ি আছে…একটা মালপত্তর টানে, আরেকটা বেটি নিজে চালায়। ক্যান, কি হইছে?”

“না। কিছু না।” মুখ তুলে তাকালো ছফা। মেইনগেট থেকে রেললাইনের মতো সমান্তরাল দুটো মেঠোপথ চলে গেছে তাদের পেছন পর্যন্ত। সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই পেছন থেকে একটা শব্দ শুনতে পেলো। ফিরে তাকালো তারা। আবছা অন্ধকারে বোঝা গেলো না কিন্তু কেউ একজন যে তাদের দিকে হেঁটে আসছে সে-ব্যাপারে কোনো সন্দেহ। নেই। যে আসছে তার পদক্ষেপ বেশ ভারি।

আতরের একটা হাত টান দিয়ে পাশের ঝোপের আড়ালে চলে গেলো

“কি হইছে?” চাপাকণ্ঠে বললো বিস্মিত ইনফর্মার।

 “এই লোকটা নিশ্চয় জমিদার বাড়িতে যাচ্ছে।”

 “হ। তো কি হইছে?”

“আমি চাই না সে আমাদের এখানে দেখুক।”

আতর আর কিছু বললো না, চুপ মেরে রইলো।

একটু পরই দেখতে পেলো বলশালী এক যুবক হেলেদুলে আসছে। তাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় যুবকের আবছা অবয়ব দেখতে পেলো তারা।

 “এই পোলা এইখানে কী করতে আইছে!” যুবকের অপসৃয়মান অবয়বের দিকে তাকিয়ে থেকে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠলো আতর।

“ছেলেটা কে?”

“ফালু!”

 “ফালু?” বুঝতে না পেরে বললো ছফা।

“আমাগো কবরস্তানে গোর খুদে।”

অ্যাডভান্স কবর খুরে রাখে যে! “ও এখানে কী করতে এসেছে?” ছফাও যারপরনাই বিস্মিত হলো এবার।

.

অধ্যায়

ঝড় উঠেছে তপ্ত হাওয়ায় হাওয়ায়।
মনকে সুদূর শূন্যে ধাওয়ায়
অবগুণ্ঠন যায় যে উড়ে
 চক্ষে আমার তৃষ্ণা…

গুণগুণ করে গাইতে গাইতে দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দিলো মুশকান।

ঘরটা প্রায় অন্ধকার, তাই আলো জ্বালিয়ে দিলো, সেই আলো বড় টিমে। ঘরের চারপাশে দেয়াল জুড়ে কতোগুলো ক্যাবিনেট। কিছু ক্যাবিনেটের কপাটে কাঁচ লাগানো, ভেতরে কি আছে সবই দেখা যায়, তবে বাকিগুলোর ভেতরের জিনিস দেখার কোনো উপায় নেই। এখানে বড় বড় জারে অদভুত সব জিনিস সংরক্ষিত করা আছে। দেখলে যে কেউ ভাববে এখানে বুঝি প্রাণীদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংরক্ষণ করা হয়।

ঘরের এককোণে চমৎকার একটি কিচেন টেবিল। মার্বেল পাথরের উপরিভাগটা একদম পরিস্কার। কতোগুলো কিচেন নাইফ আর বিভিন্ন ধরণের কিচেন-সরঞ্জাম আছে টেবিলের পাশেই। বড় বড় বেশ কয়েকটি হাড়ি-পাতিল আর পাত্রও দেখা যাচ্ছে। কিচেন টেবিলের কাছেই রয়েছে দুটো। গ্যাস-বনার। একটি আদর্শ রান্নাঘর এটি। বেশ আধুনিকও বটে।

এটাই মুশকানের ল্যাবরেটরি, এখানেই সে খাবার নিয়ে গবেষণা করে। নিত্যনতুন খাবার আর স্বাদ তৈরি করার কারখানা। দিন এবং রাতের অনেকটা সময় এই ল্যাবরেটরিতেই কাটিয়ে দেয় সে। এখানেই সীমিত পরিসরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়। কোনটার সাথে কোটা মেশাবে, কতটুকু মেশাবে, আর কতোক্ষণ ধরে মেশাবে সবই পরীক্ষা করে। ঘরে রান্না করার সব ধরণের সরঞ্জাম থাকলেও একটি পরিচিত জিনিস নেই-প্রেসার কুকার।

মুশকান কখনও প্রেসার কুকার ব্যবহার করে না। প্রেসার কুকারে করা খাবার কখনও মুখেও দেয় না সে। এই জিনিসটা তার সুক্ষম জিভের জন্য বিষ! রান্নার মতো একটি শিল্পকে প্রেসার কুকার সত্যি সত্যি খুব চাপের মধ্যে ফেলে দিয়ে চিড়ে-চ্যাপ্টা করে দেয়। এটা হলো কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানোর মতো ব্যাপার। ফলাফল যা হবার তা-ই। স্বাভাবিক স্বাদ আর পাওয়া যায় না। ওটা হারিয়ে যায় প্রচণ্ড চাপে পড়ে! মুশকান বুঝতে পারে না মানুষ কেন এই জিনিসটা ব্যবহার করে। রান্না করা যদি এতোই ঝামেলার কাজ মনে করে। তাহলে বাইরে থেকে খাবার কিনে এনে খায় না কেন? চটজলদি খাবার উদর ভরতে পারে, কিন্তু মন ভরাতে পারে না। বাজে রান্না আর বাজে স্বাদের খাবার জিভকে ভারি করে তোলে, জিভের সমস্ত সুক্ষমতাকে ধ্বংস করে দেয়। বিভিন্ন স্বাদের পার্থক্য বুঝতে হলে জিভকে নিরন্তর সুরক্ষা করতে হয়। অবশ্য যারা খাবারকে পেট ভরার জিনিস মনে করে তাদের কথা আলাদা। এই জনপদের ইতিহাস হলো অভাব আর দুর্ভিক্ষের ইতিহাস। এখানে পেট ফুলিয়ে খাওয়াই স্বস্তির ব্যাপার।

কিচেন টেবিলসংলগ্ন সিঙ্কে দু-হাত ভালোমতো ধুয়ে নীচু হয়ে কিচেন টেবিলের নীচ থেকে একটা মাঝারি আকারের পাত্র তুলে আনলো। পাত্র ভর্তি মাংস। সেই সকাল থেকে তেতুল মিশিয়ে রেখে দিয়েছে। সে জানে, মাংসের অনেক ভেতরে ঢুকে পড়েছে তেতুলের রস। মাংস নোনতা, তেতুল টকা নোনতা আর টকের মিশ্রণ কতোটা ভালো হয় সেটা দেখার জন্যই এটা করেছে। মাংসগুলো হাত দিয়ে টিপে দেখলো। বেশ নরম হয়ে উঠেছে। নীচ হয়ে আরেকটা ছোটো পাত্র তুলে নিলো এবার। সবুজ রঙের ঘন তরলে ভরা। পুদিনা পাতার ভর্তা এটি। পাত্রটা উপুড় করে সবটা ঢেলে দিলো মাংসের পাত্রে। এবার টেবিলের নীচ থেকে একটা বোতল নিয়ে মুখটা খুলে লাল টকটকে তরল ঢালতে শুরু করলো। প্রায় আধ বোতল ঢেলে দেবার পর রেখে দিলো ওটা। দু-হাত দিয়ে পাত্রের মাংসগুলো দলাই মলাই করলো কিছুক্ষণ। এরপর পাত্রটা তুলে একটা বার্নারের উপর বসিয়ে সুইচ টিপে আগুন জ্বালিয়ে দিলো। অটো ইগনিশান বার্নার, তাই দেয়াশলাইয়ের দরকার পড়ে না। বার্নারের আগুন একেবারে কমিয়ে ঢিমেতালে করে রাখলো। আস্তে আস্তে উত্তাপ পেয়ে মাংসগুলো ধীরে ধীরে রান্না হবে। দ্রুত করলে এর যে-রকম স্বাদ আশা করছে তা কোনোভাবেই পাওয়া যাবে না। পাত্রটার উপর ঢাকনা দিয়ে ঘরের এককোণে চলে গেলো সে।

অসংখ্য জার থেকে একটা অসচ্ছ জার নামিয়ে আনলো মুশকান, রাখলো কিচেন টেবিলের উপর। এই জারের ভেতরে কি আছে বোঝা যাচ্ছে না। জারের মুখটা খুলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। চোখেমুখে স্পষ্ট দ্বিধা। আলতো করে নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরলো সে। অবশেষে সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে জারটা আবার আগের জায়গায় রেখে দিলো।

ক্যাবিনেটে রাখা এক সাইজের অসংখ্য বোতলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো সে। এগুলোই তার আসল সিক্রেট। রেসিপি সিক্রেট রাখাটা প্রায় অসম্ভব। তারপরও কাজটা করা যায়। পুরনো ঢাকার এক বাবুর্চির কাছ থেকে সে শিখেছিলো কিভাবে নিজের হাতের জাদু সংরক্ষণ করা যায়। লোকটা যে স্বাদের মোরগপোলাও রান্না করতো সেটা কেউ নকল করতে পারতো না। এর কারণ সে পোলাও রান্না হবার মাঝখানে বিশেষ কিছু মিশিয়ে দিতো! কি মেশাতে মুশকানকে সে জানিয়েছিলো। খাসির মাথা প্রক্রিয়া করে অল্পকিছু মসল্লার সাহায্যে গরম পানিতে সেদ্ধ করতে করতে এক ধরণের সুপ বানাতো। সাঙ্গোপনে নিজের সাগরেদসহ এবং সবার আলেক্ষ্য সেই সুপ ঢেলে দিতো মোরগপোলাওয়ে। ব্যস, অসাধারণ একটি স্বাদের জন্ম হতো। আইডিয়াটা দারুণ লেগেছিলো মুশকানের। এটাকে সে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে এখন। রবীন্দ্রনাথের রেসিপিগুলোতেও একই কৌশল খাটায় সে।

আয়েশী ভঙ্গিতে বার্নারের কাছে গেলো এবার। পাত্রের ঢাকনা খুলে দেখে নিয়ে চামচ দিয়ে এক টুকরো মাংস মুখে পুরে চেখে দেখলো। ঢাকনাটা আবার পাত্রের উপরে চাপিয়ে দিয়ে বানারের আগুন একদম কমিয়ে দিলো।

ঘরের বাতি নিভিয়ে বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।

*

মানুষজনের পাদ মারার খবরও রাখে যে আতর আলী তার কোনো ধারণাই নেই গোরখোদক ফালু কেন মুশকান জুবেরির বাড়িতে যাচ্ছে।

এই মহিলার সাথে ফালুর সম্পর্কটাই বা কি সেটাও তার অজানা। ছফার কাছে অদ্ভুত ঠেকলো ব্যাপারটা, আর সেটা ইনফর্মারের কাছে একদমই লুকালো না।

 “আপনি এখানকার সব খবর রাখলেও আমার মনে হচ্ছে এই মহিলার ব্যাপারে আপনার জানাশোনা একদমই কম।”

আতর আলী গাল চুলকে নিলো একটু। তার অক্ষমতা নিয়ে কথা বলছে সাংবাদিক। এদিকে আত্মপক্ষ সমর্থন করার মতোও কিছু নেই। কথাটা একদম সত্যি। এই মহিলা সম্পর্কে খুব কমই জানে, কিনতু সে যতোটুকু জানে বাকিরা তাও জানে না। ফিসফাস করে কিছু কথা বলে-দূর থেকে বাঁকাচোখে দেখে জমিদার বাড়ি আর অদভুত রেসটুরেন্টটি-এই তো। এর বেশি কিছু করার কথা তারা চিন্তাও করতে পারে না। লোকাল এমপিকে যে মহিলা আঁচলে বেঁধে রেখেছে তাকে ঘাটানোর সাহস হবে কার?

 “ঐ বেটি এইখানকার না…কইখেকা আইছে তাও কেউ কইবার পারবো না…মানুষের লগে মেশেও না…” নিজের পক্ষে সাফাই গাইলো ইনফর্মার। “…খালি এমপি, ডিসি, এসপির লগে হের খাতির…হেগোরে শাড়ির নীচে রাখে…হের ব্যাপারে নাক গলানোর সাহস এই সুন্দরপুরের কারোর নাই।”

ছফা কিছু না বললো না। তারা এখন জমিদার বাড়ি থেকে একটু দূরে বিরাট একটি বটগাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকে একটা সরু পথ চলে গেছে মেইনরোডের দিকে। এ-পথ দিয়েই মুশকান জুবেরির গাড়ি যাতায়াত করে।

“লোকজন আবার হেরে এটু ডরায়ও।”

 আতরের দিকে তাকালো ছফা। “কেন?”

ইনফর্মার গলাটা নীচে নামিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো, “ঐ বেটি একটা ডাইনি।”

এর আগেও আতরের মুখ থেকে এ কথাটা শুনেছে সে। “আপনি ঐ মহিলাকে ডাইনি কেন বলেন, একটু খুলে বলেন তো?”

 “আপনেরা শহরের মানুষ, আমাগো কথা বিশ্বাস করবেন না। মনে করবেন মুখু মাইনষের গালগপ্প।”

 “না, না। আপনি বলেন। আপনার কথা অবশ্যই বিশ্বাস করবো। আপনি তো অন্য সবার মতো নন।”

মনে হলো কথাটা শুনে আতর খুশি হয়েছে। “তাইলে হূনেন, হাসমত চোরা নামের এক পোলা আছে আমাগো গেরামে…হে অনেকদিন আগে রাইতের বেলায় বেটির বাড়িতে ঢুকছিলো চুরি করবার মতলবে, কিন্তু ঐ বাড়িতে ঢুইকা সে এমন ডরন ডরাইছে…কী আর কমু?”

“সে ভয় পেয়েছিলো কেন?”

“ও দেখছে, বেটি রাইতের বেলায় ডাইনি হইয়া যায়?”

“তাই নাকি?!” বিস্মিত হলো ছফা।

“আমি কইলাম ওর কথা বিশ্বাস করি নাই..” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে, “…পরে বুঝলাম, হাসমত মিছা কয় নাই।”

ইনফর্মারের দিকে তাকালো ছফা। লোকটার চোখমুখ খুবই সিরিয়াস। “আপনি পরে কিভাবে বুঝতে পারলেন এটা?” উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলো সে।

আতর আলী কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বললো, “বেটি এইহানে নাড় গাঁডবার পর থিকাই হের কাম-কাইজ আমার কাছে সুবিধার মনে হইতাছিলো না। একদিন করলাম কি, সাহস কইরা রাইতের বেলায় বেটির বাড়িতে ঢুইকা পড়লাম।”

“কী বলেন? দারোয়ান ছিলো না মেইনগেটে?”

 অশ্লীল হাসি দিলো ইনফর্মার। “বোবা তহন লীলা-খেলায় মশগুল!”

ভুরু কুচকে তাকালো নুরে ছফা। “মানে?”

“ঐ বোবা আর বেটির ফুটফরমাশ খাটে যে মাইয়াটা…ওগোর মইদ্যে একটা লাইন আছে, বুঝলেন?” দু-হাতের তর্জনী আঙটার মতো আর্টকে এক চোখ টিপে বললো সে।

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। বুঝতে পেরেছে সে। “কিন্তু এই খবর আপনি কিভাবে জানলেন? আর ওইদিন ওরা এসব করছে সেটাই বা বুঝতে পারলেন কিভাবে?”

মুচকি হাসি দিয়ে বলতে শুরু করলো আতর, “আমাগো টাউনে তো একটাই ডিপিনচারি..হাফিজ মিয়া চালায়…আমি একদিন রাইতের বেলা বোবারে হাফিজ মিয়ার দোকান থেইকা ফোকনা কিনতে দেখলাম…”

ফোকনা মানে যে কনডম সেটা বুঝতে পারলো ছফা।

 “ আমি তো তাজ্জব…বোবা একটা আবিয়াত্তা পোলা…হে ওইটা দিয়া কী করবো? কার লগে করবো!”

ছফা উদগ্রীব হয়ে রইলো বাকি কথা শোনার জন্য।

“আমি করলাম কি, বোবার পিছন পিছন হাটা দিলাম। বোবায় জমিদার বাড়িতে গিয়া ঢুকলো কিন্তু গেট লাগাইয়া সোজা বাড়ির ভিতরে যে ঢুকছে তো ঢুকছেই, গেটে আহনের আর নাম নাই…”

“আপনি বাইরে থেকে এটা কিভাবে দেখলেন? গেটের গ্রিলগুলো তো প্লেইন-শিট দিয়ে বন্ধ করে দেয়া?”

“আরে, তহন গেটটা লোহার শিকের আছিলো..বাইরে থেইকা সব দেখা যাইতো…পরে বেটি ঢাইকা দিছে।”

“ও।” ছফা আর কিছু বললো না।

“বোবারে গেটে না দেইখা আমি দেয়াল টপকাইয়া ঢুইকা পড়লাম ঐ বাড়িতে।”

“ ছফা প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকালো ইনফর্মারের দিকে। “বলেন কি! তারপর?”

“জানালা দিয়া অনেক ট্রাই করছিলাম কিন্তু কিছু দেখবার পারলাম না। বাত্তি জ্বালানো আছিলো না, সব দরজাও বন্ধ…খালি দোতলার একটা ঘরে বাত্তি জ্বলতাছে…তহন আমি দালানের লগে যে বড় আমগাছটা আছে ঐটার উপরে উইঠা গেলাম…” একটু থামলো সে। “আমি মনে করছিলাম বোবার লগে মনে হয় ঐ বেটির ইটিস-পিটিস আছে।”

ছফা কিছু বললো না। ইনফর্মারের জায়গা সে হলেও এরকমই সন্দেহ করতো।

 “তয় গাছে উঠার পর চমকায়া গেলাম…দেহি ঐ বেটি দোতলার বারিন্দায় বইসা চেয়ারে দোল খাইতাছে আর গান শুনতাছে…হাতে একটা গেলাস…পরথমে বুঝি নাই…পরে ঠাওর কইরা দেখি রক্ত!”

“কি?”

 মাথা নেড়ে সায় দিলো ইনফর্মার। “গেলাসে কইরা রক্ত খাইতাছে!”

“কী বলেন?” ছফা অবিশ্বাসে বলে উঠলো। “রক্ত খাচ্ছে?!”

ঢোক গিললো আতর। “আপনে বিশ্বাস করবেন না, এরপর কি হইলো।”

“কি হলো?”

“বেটি ঘাড় ঘুরাইয়া আমার দিকে তাকাইলো! কেমতে জানি বুইঝা গেছিলো আমি গাছের উপরে থেইকা দেখতাছি।”

“মহিলা আপনাকে দেখে ফেললো?”

 মাথা নেড়ে সায় দিলো ইনফর্মার। “হ।”

“তারপর কি করলো?”

“বেটি কিছুই করলো না…খালি আমার দিকে চায়া রইলো, ডাইনির মতো মিচকা হাইসা মুখ ঘুরায়া চেয়ারে দোল খাইতে খাইতে রক্ত খাইতে লাগলো আবার! যে কিছু হয় নাই!”

 “কী বলেন? আপনাকে দেখেও উনি কিছুই করলেন না? চিৎকার চেঁচামেচি করলেন না?” ছফা অবিশ্বাসে বলে উঠলো। “আজব তো!”

“আরে আজবের কী দেখছেন! আসল কথা তো এহনও কই-ই নাই। আমার জায়গায় অন্য কেউ হইলে গাছ থেইকা পইড়া যাইতো ঐদিন…পাতলা পায়খানা শুরু কইরা দিতো!”

ভুরু কুচকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ছফা।

 “বাপের জন্যেও আমি এমন কিছু দেহি নাই!”

“কী দেখেছিলেন আপনি?”

“ঐ বেটি যহন আমার দিকে তাকাইছে তহন তার চক্ষু দুইটা আগুনের মতো জ্বলতাছিলো! আন্ধারে বিলাই আর শিয়ালের চোখ যিমুন জ্বলে তার চায়াও বেশি! কুনো মানুষের চক্ষু এমন কইরা জ্বলে, ক?”

ইনফর্মারের দিকে অবিশ্বাসে তাকালো ছফা। “মহিলার চোখ দুটো জ্বলছিলো?”

.

ধ্যায় ৯

সুরত আলীর হোটেলে ফিরে জামা-কাপড় না ছেড়েই মোবাইলফোনটা নিয়ে বিছানার উপরে চুপচাপ বসে আছে ছফা। ব্যাটারির চার্জ একদম শেষ। চার্জে দিয়ে জরুরি একটা ফোন করার পর থেকেই এভাবে বসে আছে সে। কিছু অব্যাখ্যাত প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাথায়। তারচেয়েও বড় কথা সীমাহীন এক কৌতূহল তাকে অস্থির করে তুলেছে।

একজন গোরখোদক কেন রাতের বেলায় মুশকান জুবেরির বাড়িতে যাবে? মহিলার সাথে ঐ গোরখোদকের কি সম্পর্ক? আর আতর আলী যে ভয়ানক গল্পটা বললো সেটাই বা কতোটুকু সত্যি? যেখানে শিক্ষিত লোকজনই ভূতপ্রেতের মতো কুসংস্কারে বিশ্বাস করে, অতিপ্রাকৃত গালগল্পে। আস্থা রাখে সেখানে এই গণ্ডগ্রামের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত লোকজন কী দেখে কী বলছে কে জানে! কিন্তু আতরের কথাগুলো তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারছে না। লোকটা নিরীহ কোনো গ্রামবাসী নয়, খুবই ধুরন্ধর আর টাউট টাইপের। পুলিশের সাথে তার নিত্য ওঠা-বসা। এখানকার মাদকব্যবসা থেকে শুরু করে সব ধরণের অপকর্মের সাথে জড়িত। ভয়-ডরও খুব একটা নেই।

একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিত, মুশকান জুবেরি রহস্যময়ী একটি চরিত্র। এ পর্যন্ত তার সম্পর্কে খুব সামান্যই জানতে পেরেছে, তাতেই মনে হচ্ছে মহিলার অনেক গোমড় রয়েছে। আর সেগুলো সুকৌশলে, অত্যন্ত যত্নের সাথে লুকিয়ে রাখে সে। রবীন্দ্রনাথে মহিলা যেভাবে তার দিকে তাকিয়েছিলো সেটা মনে করলো আবার সেই দৃষ্টি মোটেও স্বাভাবিক ছিলো না। চাহনিতে কিছু একটা ছিলো। অব্যক্ত, অব্যাখ্যাত কিছু। যেনো সব কিছু টের পেয়ে গেছে!

তার স্থির বিশ্বাস, মুশকান জুবেরির সমস্ত গোমড় লুকিয়ে আছে দুটো জায়গায়-যেখান থেকে এসেছে আর এই সুন্দরপুরে যেখানে সে থাকে, ঐ জমিদার বাড়িতে। বাড়িটা দূর্গের মতোই। বিশ্বস্ত লোকজন ছাড়া কেউ ঢুকতে পারে না ওখানে। তার ধারণা রবীন্দ্রনাথে তেমন কোনো রহস্য নেই, তবে ওটার অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে হয়তো। প্রতিদিন অসংখ্য লোকজন আসে খাওয়া-দাওয়া করতে-এমন জায়গায় আর যা-ই হোক রহস্য থাকবে না। রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত মহিলার একটি অ্যালিবাই! কিংবা নিছক পাগলামি।

ছফা নিশ্চিত, মুশকান ঢাকা থেকে এসেছে। এর পক্ষে বেশ যুক্তিও আছে তার কাছে। প্রথমত, মি. জুবেরি দীর্ঘদিন ঢাকার একটি হাসপাতালে ছিলেন। অন্তত মহিলার দাবিমতো তাদের বিয়ে হবার সময়কালে। মুশকানের সাথে যদি জুবেরির আদৌ দেখা হয়ে থাকে-রমাকান্তকামারের মতো ছফারও এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে-তাহলে সেটা ঢাকাতেই। হয়েছে। দ্বিতীয়ত, মুশকানের সাথে ক্ষমতাসীন এমপির খুব ভালো সম্পর্ক। আর কে না জানে, ওরকম হোমরাচোমরারা যে যেখানেই থাকুক, তারা ঢাকাতেই পড়ে থাকে। এই দেশটা ঢাকাকেন্দ্রীক। ঐ মহিলা যদি ঢাকা থেকে এসে থাকে তাহলে খুব দ্রুতই অনেক কিছু জানা যাবে।

আরেকটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত, সে এখানে কেন এসেছে, কি করতে এসেছে সেটা ঐ মহিলার পক্ষে জানা অসম্ভব। তার আচরণে এমন বাড়াবাড়ি কিছু ছিলো না যে মহিলা সন্দেহ করবে। এখন পর্যন্ত এক আতর আলী ছাড়া এখানকার কারো সাথে সে মেশেও নি। যার-তার কাছ থেকে মহিলার ব্যাপারে জানতেও চায় নি। এখানে আসার পর থেকে প্রতিটি পদক্ষেপ খুবই সতর্কতার সাথে ফেলেছে। রমাকান্তকামার তার ব্যাপারে মহিলাকে কিছু বলবে সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে মুশকানের সাথে মাস্টারের সম্পর্ক নেই। তারপরও মহিলা কিছু একটা টের পেয়ে গেছে।

স্বজ্ঞা?

নাকি প্রজ্ঞা?

মাথা দোলালো ছফা। এসবের কিছুই না। এটা হলো অপরাধীর সেই চিরায়ত আচরণ-যে ভালো করেই জানে সে কি করেছে। সুতরাং অন্যদের চেয়ে বেশিই সতর্ক থাকবে সে।

একটু আগে ইনফর্মার আতরকে যখন সে বললো হোটেলে ফিরে যাবে তখন লোকটা জানালো কী একটা কাজে তাকে পাশের গ্রামে যেতে হবে। কথাটা শুনে খুশিই হয়েছিলো ছফা। ইনফর্মারকে দুশ’ টাকা ধরিয়ে দিয়ে বিদায় করতে চেয়েছিলো কিন্তু পারে নি। টাকা পেয়ে বিগলিত হয়ে একটা খালি ভ্যান-রিক্সায় তাকে তুলে দিয়ে সে নিজেও উঠে বসে, হোটেলের কাছেই নাকি সে যাবে। ফলে বাধ্য হয়ে তাকে হোটেলে ফিরে আসতে হয়।

হাতঘড়িতে সময় দেখে নিলো। এখনও খুব বেশি সময় পার হয় নি। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে। সুতীব্র কৌতূহল তাকে ঘরে আটকে রাখতে পারলো না। চার্জার থেকে মোবাইলফোনটা খুলে পকেটে ভরে বেরিয়ে গেলো সে।

*

আতর আলী থানায় যায় নি। যাবার কোনো কারণও নেই। তারপরও থানায় যাবার ভান করেছে সাংবাদিককে বুঝিয়ে দেবার জন্য যে, ইনফর্মার হিসেবে এখনও বহাল তবিয়েতে আছে সে। আদতে বেশ কিছুদিন ধরে থানার ত্রি সীমানায়ও যায় না। থানা থেকে কবে যে ডাক পড়বে তার কোনো ঠিক নেই।

কয়েক দিন আগে একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিলো সে। ভুলটা অবশ্য তার একার ছিলো না কিন্তু শাস্তিটা তাকে একাই পোহাতে হচ্ছে। কাক কাকের মাংস খায় না, পুলিশও পুলিশের দোষ খুঁজে পায় নি। পেলেও শাস্তি দেবার বেলায় ভয়ানক কৃপনতা দেখিয়েছে।

সুন্দরপুর থানার এসআই আনোয়ারের সাথে বেশ খাতির তার। দু-জুনে মিলে দীর্ঘদিন ধরেই বাণিজ্য করে আসছিলো। টাউন আর গ্রামের নিরীহ অথচ সচ্ছল পরিবারের সন্তানদের ধরে এনে টাকার বিনিময়ে থানা থেকে ছাড়িয়ে দেবার ধান্দাটা চলছিলো নির্বিঘ্নেই। প্রতিরাতে এসআই আনোয়ার হাজার-হাজার টাকা কামাচ্ছিলো আর তা থেকে সামান্য ভাগ পাচ্ছিলো। আতর। এমনও রাত গেছে, তিন-তিনটি আদম ধরে এনেছে আর সবগুলোই আতরের ইনফর্মেশনে। সে-ই খবর দিয়েছিলো, লুঙ্গি-ব্যবসা করে পুবপাড়ার আলতাফ মিয়া বেশ ভালো টাকা কামাচ্ছে; এখানে সেখানে জায়গা-জমিও কিনছে; তার কলেজ পড়ুয়া ছেলে টুকটাক গাঁজা-ফেন্সিডিলও ধরেছে খারাপ ছেলেপেলের পাল্লায় পড়ে; সুতরাং মুরগি হিসেবে ছেলেটা বেশ ভালো ডিমই দেবে!

কথামতোই এসআই আনোয়ার, যাকে তার স্বভাব-চরিত্রের জন্যে স্বগোত্রীয় পুলিশ আর পরিচিতজনেরা আড়ালে-আবডালে জানোয়ার বলে ভাকে, আলতাফ মিয়ার বখে যাওয়া ছেলেটাকে ধরে আনলো থানায়। কপাল খারাপ, ঐসময় ছেলেটার সাথে নিষিদ্ধ মাদকজাতীয় কিছু ছিলো না। বাড়ি থেকে একটু দূরে, প্রাইমারি স্কুলের মাঠে বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা মারছিলো সে। তাতে অবশ্য সমস্যা হয় নি। কেউ নিষিদ্ধ জিনিস সঙ্গে নিয়ে ঘোরাফেরা করার আগপর্যন্ত তো সে অপেক্ষা করতে পারে না। আইনের হাত অনেক লম্বা, কিন্তু জানোয়ারের হাত শুধু লম্বা নয়, অনেক বেশি নোংরাও। সেই নোংরা হাত যার উপরে পড়বে তার পকেটে গাঁজা, ফেন্সিডিল, ইয়াবা আপনা আপনিই চলে আসবে।

ছেলেটাকে থানায় ধরে এনে একটা ফেন্সিডিল আর কিছু গাঁজার পুরিয়া রিকভারি হিসেবে দেখিয়ে দিলো এসআই। ব্যস, কেস খাড়া। আসামীর কাছ থেকে নিষিদ্ধ মাদক উদ্ধার করা হয়েছে। কমপক্ষে তিন-চার। বছরের জেল তো হবেই। ছেলের বাপের কাছে আতর যখন খবরটা দ্রুত পৌঁছে দিলো তখন বেচারা আলতাফ মিয়ার জান বের হবার জোগার। লুঙ্গি ব্যবসায়ি লুঙ্গির গিট দিতে দিতে উদ্বেগের চোটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে আতরকে সঙ্গে নিয়ে। স্বভাবতই আতরের কাছে চটজলদি সমাধান চাইলো ছেলের বাপ। সেও মহা উৎসাহে বাতলে দিলো সহজ উপায় : ঐ এসআই আনোয়ারকে নগদ এক লাখ টাকা দিয়ে দিলেই কেস ডিসমিস হয়ে যাবে। রাতের মধ্যেই ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসবে, পরিবারের সবার সঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে পারবে তার কাননের একমাত্র নন্দন!

আলতাফ মিয়া একটু গাই-গুই করে রেটটা কমাতে অনুরোধ করে তাকে। সে তো গ্রামেরই ছেলে। তার কি উচিত না একই গ্রামের মানুষকে একটু উপকার করা। সুযোগ বুঝে আতরও দান মেরে দেয়। নগদ পাঁচ হাজার টাকা বাগিয়ে এক লাখকে পঞ্চাশে নামিয়ে আনে। ওদিকে থানায় গিয়ে এসআই আনোয়ারকে বোঝাতে সক্ষম হয় বহুকষ্টে পঞ্চাশে রাজি করিয়েছে, এরচেয়ে বেশি চাইলে ছেলের বাপ বিগড়ে যেতে পারে। পঞ্চাশেই খালাস করে দেয়া উচিত। আনোয়ার জানোয়ারের মতো দৃষ্টি হেনে সন্দেহ করলেও রাজি হয়ে যায়।

যাইহোক, রাত সাড়ে দশটার মধ্যে থানার ভেতরে একরুমে ব্যাপারটা ফয়সালা করতে বসে আলতাফ মিয়া আর এসআই আনোয়ার। আতরও সেখানে উপস্থিত ছিলো, কিন্তু সব ওলট-পালট হয়ে যায় পঞ্চাশ হাজার টাকা লেনদেন করতে গিয়ে। আচমকা সেখানে হাজির হয় স্থানীয় এমপির এক ভাতিজা। ছেলেটা বয়সের চেয়ে বেশি সেয়ানা। এমপি-চাচার পাওয়ারের গরম তাকে অকালে পাকিয়ে ফেলেছে। তারা জানতে পারে, আলতাফ মিয়ার বখে যাওয়া ছেলের জানেদোস্ত এই পাকনা ছেলেটি!

কপাল খারাপ হলে যা হয়, ঐদিন রাতেই কী একটা জরুরি কাজে এমপিসাহেব সুন্দরপুরে চলে এসেছিলো। ক্ষমতাধর চাচাকে কাছে পেয়ে ভাতিজার আধ-কেজির কলিজা বেড়ে সোয়া-কেজি হয়ে যায়। থানায় ঢুকে হাতেনাতে ধরে ফেলে পঞ্চাশ হাজার টাকার লেনদেন। আলতাফ মিয়ার ছেলের তার মতো একজন বন্ধু থাকতে সামান্য এক এসআইকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে ম্যানেজ করতে যাবে কেন? তাহলে আর ক্ষমতাধর এমপির ভাতিজা হয়ে কী লাভ হলো!

তা তো বটেই। আলতাফ মিয়ার হাসি সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায় তখন। যেনো পুচকে এক ত্রাণকর্তা নাজেল হয়েছে তার ছেলেকে উদ্ধার করতে। মুহূর্তে পুরো ঘটনা তালগোল পাকিয়ে গেলো। সুন্দরপুরের ওসি এসব কিছুই জানতো না। সব শুনে সেও ক্ষেপে আগুন। তাকে না জানিয়ে, ভাগ না দিয়ে দিনের পর দিন এসআই না-জানি কতো মুরগি ধরে এনে ‘ডিম খেয়েছে!

পঞ্চাশ হাজার তো গেলোই এমনকি আতরকেও কিছুক্ষণ আগে বাগিয়ে নেয়া পাঁচ হাজার টাকা হাতজোড় করে ফিরিয়ে দিতে হলো। ওসির হাতে তিন-চারটা চরখাপ্পড় আর এমপির ভাতিজার থ্রেট’ ছাড়াও অশ্রাব্য গালিগালাজ উপরি হিসেবে জুটে গেলো তার কপালে।

আতর ভেবেছিলো কয়েকদিনের মধ্যে এসআই আনোয়ার বদলি হয়ে যাবে উচ্চারণ করতে কষ্টকর খাগড়াছড়ি কিংবা রাঙ্গামাটির কোনো অখ্যাত থানায়। কিন্তু তা হয় নি। তবে ঐদিনের পর থেকে আতরের জন্য সুন্দরপুর। থানা কপ্লেক্সে ঢোকাটা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ওসির কাছ থেকে পুনরায় ডাক না পেলে তার পক্ষে থানায় ঢোকা সম্ভব হবে না। এসআই আনোয়ার অবশ্য তাকে আশ্বাস দিয়েছে, কিছুদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে।

সুতরাং থানার কথা বললেও সাংবাদিককে হোটেলে নামিয়েই ভ্যানটা নিয়ে সে সোজা চলে যায় একরামের ডেরায়। দিন দিন তার গাঁজার ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে উঠছে। প্রতিদিন তার কাছ থেকে একশ টাকা আর দুটো গাঁজার স্টিক নজরানা হিসেবে নেয়। সে যে থানায় ঢুকতে পারে না, ওসির কাছে। অপদস্থ হয়েছে এসব কথা যদি একরাম জানতে পারে তাহলে দু-পয়সাও দেবে না। আতরের আশংকা, খুব জলদি থানা থেকে ডাক না পেলে খবরটা চাউর হতে আর বেশি সময় নেবে না। যাইহোক, একরামের ডেরা থেকে বখরা আর দুটো স্টিক নিয়ে রওনা দেয় বড় কবরস্তানের দিকে।

এখন কবরস্তান থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে গাঁজার স্টিকে জোরে জোরে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে সে। এর আগে ফালু পোলাটার দিকে তার নজর খুব একটা পড়ে নি। একজন গোরখোদকের ব্যাপারে নাক গলাতে যাবে কে? মানুষজন কবরস্তান আর গোরখোদক পারতপক্ষে এড়িয়েই চলে। ফালু কি করে, কোথায় যায়, কিভাবে থাকে সে-সব নিয়ে কোনো আজাইরা আর ভাদাইমা লোকও মাথা ঘামাবে না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে পোলাটার দিকে নজর দেয়া দরকার ছিলো। তার অ্যাডভান্স কবর খোদা-খুদির ব্যাপারটা আমলেই নেয় নি এতোদিন। এখন তো দেখতে পাচ্ছে ঐ ডাইনির সাথে তলে তলে তার দারুণ খাতির! নিশ্চয় কোনো ব্যাপার আছে ওদের মধ্যে। আর এটা তাকে জানতেই হবে। সুন্দরপুরে এতোবড় ঘটনা ঘটবে আর আতর কিছু জানতে পারবে না তা তো হয় না।

শেষ কটা টান দিয়ে গাঁজার স্টিকটা মাটিতে ফেলে কবরস্তানের দিকে এগিয়ে গেলো সে। সাবধানে ছোটো ছোটো ঢিবির মতো কবরগুলো এড়িয়ে চলে গেলো ফালুর ঝুপড়ি ঘরের সামনে। কবরস্তানের একমাথায় বড়সড় দুটো কাঁঠাল গাছের পাশে ওটা অবস্থিত। ভেতরে কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। বেড়ার ফাঁকফোকর দিয়ে ঘরের ভেতরে উঁকি মারলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার। দরজাটা ধাক্কা দিতেই দেখলো ওটা ভেতর থেকে বন্ধ করা নেই। বাইরে দরজার কয়ড়ার সাথে ছোটো একটা টিপ-তালা ঝুলছে। নিশ্চিত হলো ফালু ঘরে নেই।

ছোটো-বড় কবরগুলো এড়িয়ে সে চলে গেলে কিছুক্ষণ আগে যেখানে সদ্য খোরা এক কবরে নুরে ছফা নামের সাংবাদিকটি পড়ে গেছিলো। আকাশের চাঁদ দক্ষিণ-পশ্চিমে হেলে পড়লেও বেশ ভালো আলো ছড়াচ্ছে, সেই আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলো দৃশ্যটি।

সদ্য খোরা কবরটি নেই।

.

অধ্যায় ১০

অপূর্ণ চাঁদ দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। রাত এগারোটাই সুন্দরপুরের জন্য গভীর রাত। চারদিক নেমে এসেছে সুনশান নীরবতা, সেইসাথে ভারি হয়ে আসছে কুয়াশার চাদর। চারপাশ ঘোলাটে। ঠাণ্ডা বাতাস হাঁড়ে কাঁপন না ধরালেও গায়ে এসে লাগছে বেশ।

সাইকেলটা থামিয়ে জ্যাকেটের বোতামগুলো লাগিয়ে নিলো ছফা। হোটেল রুম থেকে বের হবার পর পথে কোনো রিক্সা না পেয়ে ম্যানেজারের বাই-সাইকেলটা ধার নিয়েছে। একটা কানটুপিও পরেছে সে। তার কালো জিন্স-প্যান্ট আর মরচেপড়া রঙের গ্যাবাডিনের জ্যাকেট এরকম রাতের জন্য যে নিখুঁত ক্যামোফ্লেজ সৃষ্টি করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিনতু তার কোনো ধারণাই নেই, রাতের এমন সময়েও একটু দূর থেকে একজন মানুষ ঠিকই তাকে দেখে চিনতে পেরেছে।

আজ অনেকদিন পর সাইকেল চালিয়ে মাইলখানেক পথ পাড়ি দিতেই পা দুটো আড়ষ্ট হয়ে গেলো। স্কুল-কলেজের পুরোটা সময়েই সাইকেল চালাতে সে। এমনকি তিন বছর আগে যখন টের পেলো ফিটনেস আর আগের মতো নেই তখন আবারো সাইকেল চালাতে শুরু করে। তবে তার এই স্বাস্থ্য সচেতনতার জোশ ছিলো মাত্র দু-সপ্তাহ। সকালের আরামের ঘুম হারাম করার মতো স্বাস্থ্য-সচেতন মানুষ সে কখনওই ছিলো না।

রবীন্দ্রনাথের সামনে দিয়ে যাবার সময় দেখতে পেলো রেস্তোরাঁটি বন্ধ হয়ে গেছে। জ্বলজ্বলে সাইনে অদভুত নামটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে যাচ্ছে এখনও। ওটা অতিক্রম করে আরেকটু সামনে এগিয়ে আবারো থামলো। সে নিশ্চিত, সামনের ডান দিক দিয়ে যে সরু পথটি চলে গেছে গ্রামের ভেতরে, এটা দিয়েই জমিদার বাড়িতে যাওয়া যাবে। প্যাডেল চালিয়ে সে-পথ ধরেই এগোতে লাগলো। বেশ ধীরে ধীরে প্যাডেল মারছে, সে চাইছে না তেমন কোনো শব্দ হোক কিন্তু কাঁচামাটির পথটি বড় এবড়োখেবড়ো, বার বার সাইকেল ঝাঁকি খাচ্ছে আর আপনা-আপনিই টুং-টাং করে বেজে উঠছে বেল। ডানহাতটা এমনভাবে হ্যাঁন্ডেলের উপর রাখলো যেনো বেলের উপরে আঙুলের স্পর্শ লাগে, এর ফলে ঐ টুং-টাং শব্দটা বন্ধ হয়ে গেলো।

জমিদার বাড়ির অনেকটা দূরে থাকতেই সাইকেল থেকে নেমে পড়লো সে। সাইকেল নিয়েই পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেলো বাকিটা পথ। জমিদার বাড়ির মেইনগেটের কাছে এসে সতর্কভাবে আশেপাশে তাকালো। কেউ নেই। থাকার কথাও নয়। গেটের ভেতরে কারোর কোনো রকম উপস্থিতিও টের যাচ্ছে না। দরজার ওপাশে ঐ বোবা দারোয়ান ঘাপটি মেরে আছে কিনা কে জানে। তাকে আগে নিশ্চিত হতে হবে। মাটি থেকে একটা ঢিল তুলে নিয়ে মেইনগেট লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলো। গ্রিলের দরজায় লেগে টুক করে শব্দ হলেও কারোর সাড়া-শব্দ পাওয়া গেলো না। তারপরও একটু সময় নিয়ে অপেক্ষা করলো সে। আরো বেশি নিশ্চিত হতে হবে। আরেকটা ঢিল ছুঁড়ে মারলেও কোনো সাড়া-শব্দ পেলো না। পরক্ষণেই আপনমনে হেসে ফেললো। বোবা তার ঢিলের শব্দ কি করে শুনবে, সে তো কানেই শোনে না!

একটু ভেবে নিলো সে। ছেলেটা গেটের পেছনে আছে কিনা সেটা খুব সহজেই দেখা যাবে।

এবার মেইনগেটের ডানপাশের সীমানাপ্রাচীর ধরে একটু এগিয়ে গেলো ছফা। দেয়াল টপকানোর মতো ভালো জায়গা দরকার। প্রাচীরের ওপাশে বড় বড় গাছ, কিছু গাছের ডাল-পালা বাইরের দিকে ঝুঁকে আছে। আবছা অন্ধকারেই দেখতে পেলো সীমানাপ্রাচীরটা বেশ পুরনো। জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা খসে পড়ছে। সম্ভবত মূল জমিদার বাড়িটি তৈরি করার সময়েই এটা নির্মাণ করা হয়েছিলো, তবে পাঁচ ফুট উঁচু পুরনো প্রাচীরের উপরে আরো তিন চার ফুটের নতুন দেয়াল তৈরি করা হয়েছে এখন। পুরনো প্রাচীরের পুরুত্ব বিশ ইঞ্চির নীচে হবে না, সে-তুলনায় নতুন দেয়ালের পুরুত্ব। বড়জোর দশ ইঞ্চির মতো।

একটা জায়গায় এসে দেখতে পেলো দেয়ালের উপর দিয়ে নাম-না জানা একটি গাছের ডালপালা ঝুঁকে আছে। সাইকেলটা দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে রেখে আস্তে করে সিটের উপর উঠে দাঁড়ালো সে। দেয়ালের উপর দিয়ে জমিদার বাড়ির ভেতরে তাকিয়ে দেখতে পেলো গেট থেকে মূল বাড়ি পর্যন্ত কাউকে দেখা যাচ্ছে না। দোতলা বাড়িটার সামনের লনের মাঝখানে একটি ফোয়ারা আছে তবে সেটা অকেজো। তারপরও পুরনো

আমলের দোতলা বাড়িটি আভিজাত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুই দিকে বড় বড় চারটা ফ্রেঞ্চজানালা, মাঝখানে তিন-চার ধাপের নক্সা করা সিঁড়িযুক্ত সদর দরজা। দোতলাটি ঠিক নীচের তলার মতোই তবে মাঝখানে একটা ঝুল বারান্দা আছে। সদর দরজার ঠিক উপরে এর অবস্থান। কারুকার্য করা প্রাচীরঘেরা ছাদ। সম্ভবত ভবনটি রেনোভেট করার সময় প্রথমদিকের কিছু সুক্ষম নক্সা আর কারুকাজ হারিয়ে গেছে। পুরো ভবনটি সাদা রঙে রাঙানো। সেই রঙ হলদেটে হয়ে গেছে। জানালাগুলো পুরনো আমলের হলেও সম্ভবত নতুন করে বানানো হয়েছে। কাঠের ফ্রেমগুলো দেখতে নতুন, শত বছরের পুরনো বলে মনে হচ্ছে না।

মূল বাড়ির নীচতলায় বামদিকে এবং দোতলার ডানদিকের একটি ঘরে বাতি জ্বলছে। বাইরের ঘাসের লনটি একেবারে ছিমছাম। কিছু পাতাবাহার গাছ আছে ওখানে। মেইনগেট থেকে ইট বিছানো একটি ড্রাইভওয়ে চলে গেছে মূল বাড়ির সদর-দরজা পর্যন্ত। দরজার উপরে জ্বলছে একটি লালচে বারে বাতি, সেই আলোতে কিছুটা আলোকিত হয়ে উঠেছে লনটি, তবে বিশাল জায়গার তুলনায় তা একেবারেই অপ্রতুল। পুরনো দালানের ডানপাশে টিনের চালার একটি ছোটো ঘর। দেখে মনে হচ্ছে ওটা গাড়ি রাখার কাজে ব্যবহার করা হয়।

কয়েক মুহূর্ত সাইকেলের সিটের উপরে দাঁড়িয়ে থেকে সবকিছু ভালো করে দেখে নিলো ছফা। সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার ঠিক নীচে, ওপাশের দেয়ালজুড়ে কিছু ফুলের গাছ আর পাতাবাহার চলে গেছে ডান দিক দিয়ে। দোতলা বাড়ি পর্যন্ত। তবে ওদিক দিয়ে বাড়ির পেছন দিকে যাবার কোনো রাস্তা নেই। ওখানে একটা ঘর তোলা হয়েছে। ইটের দেয়াল আর টিনের ছাদ। এটা নিঃসন্দেহে অনেক পরে বানানো হয়েছে, সম্ভবত মুশকান জুবেরি আসার পর। ঘরটার পাশেই একটা আমগাছ। আর সম্ভবত এই গাছটায়ই উঠেছিলো। এবার বাডিটার বামদিকে ভালো করে তাকালো। দেখতে পেলো ঘাসের লনের উপর একটা মেঠো পথ। সেটা চলে গেছে বাড়ির বামদিক দিয়ে পেছনে। ছফা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে যতোটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে ওখান দিয়েই বাড়ির পেছন দিকে যাবার রাস্তা। পুরনো দিনের এরকম প্রতাপশালীদের বাড়িতে অন্দরমহলে প্রবেশের জন্যে রাস্তা থাকাটাই স্বাভাবিক। অনেক জমিদার বাড়িতে এটা দেখেছে সে, বিশেষ করে ঘোড়াগাড়ি কিংবা রথ যাতায়াত করতে পারে এমন প্রশস্ত পথ।

এভাবে অনেকক্ষন ধরে বাড়িটা পর্যবেক্ষণ করার পর আস্তে করে ডান পা-টা দেয়ালের উপরে তুলে দিয়ে অনায়াসেই ওটার ওপর উঠে বসতে পারলো। এবার লাফ দেবার পালা। কাজটা তার জন্য সহজ। উপরের দিকে তিন ফুটের মতো দেয়াল নীচের দেয়াল থেকে কম পুরু, ফলে চার-পাঁচ ইঞ্চির একটি ধাপ তৈরি হয়ে গেছে। সেই ধাপে পা রেখে নীচু হয়ে গেলো, শরীরটা ঝুলিয়ে দিলো আস্তে করে, তারপরই ছোট্ট একটা লাফ। কাঁচামাটি আর ঘাসের উপরে পড়তেই সামান্য একটি ভোতা শব্দ হলো কেবল।

উঠে দাঁড়ালো ছফা। পাশের একটি ফুলগাছের আড়ালে চলে গেলো সে। পুরো বাড়িটা সুনশান। দূর থেকে একটা মৃদু শব্দ ভেসে এলেও বুঝতে পারলো না ওটা কিসের। একে তো শব্দটা ক্ষীণ আর ভোতা, তার উপরে ঝিঁঝি পোকার ডাক মিলেমিশে অস্পষ্ট হয়ে গেছে। এখন তাকে বাড়ির পেছনদিকে যেতে হলে দোতলা বাড়িটার সম্মুখভাগের লনের উপর দিয়ে চলে যেতে হবে বামদিকে। এটা হবে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। বাড়ির ভেতর থেকে কেউ দেখে ফেলতে পারে।

দেয়ালের পাশে একটি ফুলগাছের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে রইলো। সে। আতরের কাছ থেকে যতোটুকু জেনেছে, এই বাড়িতে মাত্র তিনজন মানুষ বাস করে। মুশকান জুবেরি ছাড়াও বোবা ইয়াকুব নামের এক দারোয়ান আর কাজের একটি মেয়ে থাকে। সুতরাং সাহস করে লনটা পেরোনোর সিদ্ধান্ত নিলো। একটামাত্র লালচে বাতির আলোয় চতুরটি খুব একটা আলোকিত নয়। প্রথমে এক দৌড়ে ফোয়ারার বেইসের কাছে গিয়ে নীচু হয়ে বসে পড়লো, তারপর সতর্ক দৃষ্টিতে দেখে নিলো বাড়ির সামনে থেকে কেউ দেখছে কিনা। নিশ্চিত হয়ে নিঃশব্দে দৌড়ে গেলো বাড়িটার বামদিকে।

মূল বাড়ির বাম দিকে যে আরেকটা দোতলা ভবন আছে সেটা এইমাত্র আবিষ্কার করলো। এই দোতলাটি খুবই ছোটো। মাত্র দুটো বড়সড় ঘর। বাইরের দিকে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় যাবার ব্যবস্থা আছে। এই ছোটো স্থাপনাটির সাথে মূল ভবনের দুরত্ব হবে বড়জোর পনেরো-বিশ ফিটের মতো। কিন্তু দুটো ভবনে যাতায়াতের জন্য দোতলার উপরে একটি প্যাসেজ রয়েছে; অনেকটা সংযোগ-সেতুর মতো। দুটো ভারি লোহার বিমের উপরে স্থাপন করা হয়েছে এই ঝুলন্ত প্যাসেজটি। ওটার ছাদ টালি দিয়ে ঢাকা, কুড়েঘরের মতো দু-দিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে। সম্ভবত পার্শ্বভবনটি চাকর-বাকরদের কোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মণিবের হুকুম পেয়ে দ্রুত। ছুটে আসার জন্য দোতলার সাথে এর একটি প্যাসেজ দিয়ে সংযোগ করা হয়েছে। এরকম ভবন ছফা আরো দেখেছে। সবই জমিদার আমলের বিত্ত বৈভবের বর্হিপ্রকাশ।

মাথার উপরে প্যাসেজটির দিকে তাকালো সে, তারপর নজর দিলো সামনের দিকে। ইটবিছানো একটি পথ চলে গেছে বাড়ির পেছনে। পা টিপে টিপে সেই পথ ধরে এগিয়ে গেলো। জায়গাটা বেশ অন্ধকার, ফলে তার জন্যে সুবিধাই হলো। কয়েক পা সামনে এগোতেই দেখতে পেলো বামদিকে সার্ভেন্ট কোয়ার্টারটা শেষ হতেই একটা খিলানুক্ত প্রবেশদ্বার। একেবারে ভগ্নপ্রায়। বাড়িটা মেরামত করা হলেও এটার কোনো সংস্কার করা হয় নি। খিলানের কাছে এসে ভেতরে উঁকি দিলো। অন্ধকারেও চোখে পড়লো ছোটোখাটো আঙিনার মতো একটি জায়গা। সেই খোলা জায়গাটির উত্তর পূর্ব দিক জুড়ে ইংরেজি ‘এল’ অক্ষরের মতো করে পাশাপাশি চারটি পাকাঘর। সবগুলোই জীর্ণ, বহুকালের পুরনো।

ছোটো ছোটো ঘরগুলোর উপযোগীতা কি বুঝতে বাকি রইলো না তার। জমিদার বাড়িটা সেই যুগে নির্মাণ করা হয়েছে যখন সবাই বাথরুম-টয়লেট যথাসম্ভব মূল বাড়ি থেকে দুরে রাখতো। তবে সে নিশ্চিত, মুশকান জুবেরি এগুলো আর ব্যবহার করে না। বাড়ির ভেতরে নতুন করে বাথরুম-টয়লেট বানিয়ে নিয়েছে নিশ্চয়। দেখেও মনে হচ্ছে পুরনো শৌচাগারগুলো এখন পরিত্যক্ত।

খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বারটি অতিক্রম করে সামনের দিকে পা বাড়ালো। ইটবিছানো পথটি চলে গেছে সোজাসুজি সামনের দিকে, তবে অন্ধকারে সেটা ঠাওর করতে পারলো না, শুধু বুঝতে পারলো পথটি বহু পুরনো।

বাড়িটা রেনোভেট করার সময় এটার তেমন সংস্কার করা হয় নি। কিছুটা সামনে গিয়েই ইটের পথটি মাটির আস্তরণ আর আগাছায় ঢেকে গেছে। সেই পথের বাম দিক ঘেষে সীমানা প্রাচীর চলে গেছে, প্রাচীর আর পথের মাঝখানের জায়গাটি ঘন ঝোঁপঝাঁড়ে পরিপূর্ণ।

জমিদার বাড়ির সামনের খোলা চত্বর থেকে পেছনের জায়গাটি বেশ বড়। বাড়িটার পেছনদিকে এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত পাকা আঙিনা। মাটি থেকে কমপক্ষে চারফুটের মতো উঁচু হবে ওটা।

দু-দিকের সীমানা প্রাচীরগুলো অসংখ্য বৃক্ষরাজির মধ্য দিয়ে হারিয়ে গেছে। হাসনাহেনা ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করছে জায়গাটা। বাগানে নানান। ধরণের ফুলগাছও আছে। আবছা আবছা অন্ধকারেও কিছু সাদা-ফুল চোখে পড়লো তার। অন্ধকারে ঠাওর করতে পারলো না বাগানের শেষ সীমাটুকু। যেনো গাঢ় অন্ধকার আর গাছপালার ভীড়ে হারিয়ে গেছে।

আতর আলী তাকে বলেছে, বাড়িটার পেছনে বিশাল জলাশয় আছে। সম্ভবত বাগানটা গিয়ে মিশেছে সেই জলাশয়ে। তাহলে জোড়-পুকুরটা কোথায়? সে জানে এই বাড়িতে নারী-পুরুষের জন্য আলাদা দুটো পুকুর আছে। ওটা সম্ভবত খাল আর বাড়ির পেছন দিককার কোনো জায়গার মাঝামাঝিতে অবস্থিত।

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ পেয়ে চমকে উঠলো ছফা। বুঝতে পারলো মূলবাড়ির ভেতর থেকে কেউ বেরিয়ে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে বামদিকের ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে নীচু হয়ে বসে রইলো, দেখতে পেলো, টর্চ হাতে এক নারীমূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে ভবনের পেছন দিকের আঙিনায়। চিনতে পারলো সে।

মুশকান জুবেরি!

ভদ্রমহিলা আঙিনায় এসে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। যেনো বাতাসের গন্ধ নিচ্ছে! সাদা রঙের শাড়ির উপরে লাল টকটকে একটা শাল জড়িয়ে রেখেছে এখন। হাতে একটা টর্চলাইট নিয়ে ধীর পদক্ষেপে আঙিনা থেকে নেমে বাগান পেরিয়ে ঘন গাছপালা আর ঝোঁপঝাঁড়ের ভেতর দিয়ে চলে গেলো সে।

একটু পরই ছফা বেড়িয়ে এলো ঝোপের আড়াল থেকে। এরকম রাতের বেলায় মুশকান জুবেরি টর্চ হাতে কোথায় যাচ্ছে?

সতর্ক পদক্ষেপে কিন্তু অনেকটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো টর্চের আলো অনুসরণ করে এগিয়ে গেলো ছফা। ইট বিছানো পথের উপর পড়ে থাকা শুকনো পাতায় পা পড়তেই মচমচ করে শব্দ হচ্ছে। মুশকান জুবেরি যদি হঠাৎ পেছন ফিরে দেখে তাহলে ধরা পড়ে যাবে, তাই ইট-বিছানো পথ থেকে নেমে গেলো। বেড়ালের মতো সাবধানে পা ফেলে সামনের ছোটো একটা ঝোপের আড়ালে গিয়ে বসে পড়লো সে। একটু থেমে সামনের বড় একটা গাছের আড়ালে চলে গেলো দ্রুত। মুশকান জুবেরি ধীরপায়ে শুকনো পাতা মাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই চোখের সামনে টর্চের আলোটা উধাও হয়ে গেলো। ছফা ধরে নিলো মহিলা সম্ভবত টর্চটা বন্ধ করে দিয়েছে।

থমকে দাঁড়ালো সে। কয়েক মুহূর্ত ভেবে আগের চেয়ে আরো বেশি সতর্ক হয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারের দিকে পা বাড়ালো কিন্তু দশ কদম সামনে এগোতেই দেখতে পেলো পুরনো একটি দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। ঝোঁপ-ঝাঁড় আর গাছপালাগুলো শেষ হয়ে গেছে সেই দেয়ালের খুব কাছে এসে। মাথার উপরে গাছগুলোর ডালপালা মৃদু চাঁদের আলো আটকে দিয়েছে, ফলে জায়গাটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। মুশকান জুবেরি যেনো দেয়াল ভেদ করে হারিয়ে গেছে চোখের নিমেষে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *