বিহারী পর্ব

২. তেলের শিশি ভাঙলো বলে খুকুর পরে রাগ করো

‘তেলের শিশি ভাঙলো বলে খুকুর পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো!’
তার বেলা?

সাতচল্লিশের ভারত ভাগ নিয়ে অনেক ভেবেছি। এখনো ভাবি। আমার কাছে কখনো মনে হয়নি, এটা ভাগ হয়েছে। মনে হয় হয়েছে ‘ভাগাভাগি’। কিছু স্বার্থপর মানুষ নিজেদের মতো করে ভাগ করে নিয়েছে দেশটাকে।

এটা নিয়ে হয়তো অনেকেরই মনে অনেক রকম ভাবনা চিন্তা ছিল। যে যার নিজের মতো করে ভাবতেই পারে। তখন যারা পাকিস্তানের জন্মে আনন্দে আত্মহারা হয়েছিল, আমার বিশ্বাস তাদের অনেকেই পরবর্তীকালে আফসোসে চুল ছিঁড়েছেন মাথার।

ভাগ হয়েছে পাঞ্জাব, হয়েছে বাংলা। লাখো মানুষ হয়েছে শরণার্থী। বাপ দাদা চৌদ্দগুষ্টির ভিটে মাটি ফেলে জানের ভয়ে এক কাপড়ে অজানা অচেনা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। বয়েছে রক্তের বন্যা, হয়েছে লুটপাট, সম্পদ হাতিয়ে নেয়া, প্রতারণা, নির্যাতন-যত রকম অনাচার কিছুই বাদ যায়নি। কারণ কী?

দু’দলের নেতারা নিজেরা ক্ষমতার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, এক রকম আপোষ ফর্মুলা করে মানচিত্রে কয়টা দাগ টেনে দু’জনে ক্ষমতায় আরোহণ করে,দেশের মানুষকে, আপামর জনসাধারণকে ফেলেছিলেন অকুল পাথারে।

মানচিত্রে দাগাদাগি নিয়েও বিভ্রান্তির ছিলনা সীমা। মুর্শিদাবাদকে ঘোষণা করা হয় পাকিস্তানের অংশ আর খুলনা হয় হিন্দুস্থান তথা ভারত। তিনদিন পরেই আবার উল্টালো সিদ্ধান্ত। মুর্শিদাবাদ হয়ে গেলো ভারত আর খুলনা পাকিস্তান।

সালু মিঞা অর্থাৎ আমাদের গল্পের রবির বাবা তখন চট্টগ্রাম রেলওয়ের প্রধান কার্যালয় সি.আর.বি. তে (C.R.B) কার্মরত। দেশ ভাগের ঘটনায় আনন্দিত হবেন না দুঃখিত হবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না বিধায় ছুটি নিয়ে দেশে চলে এলেন।

হ্যাঁ, তাঁর দেশ মানে জন্মস্থান হলো পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার জজান গ্রামে।

অনেকটা উদ্ভ্রান্তের মতোই দেশে এলেন। মনের মধ্যে অদ্ভুত সব ভাবনা উড়ে উড়ে আসছে। নিজের ভিটে মাটি সব বিদেশ হয়ে যাবে!

হিন্দু চেনা জানা বন্ধু সব শত্রু হয়ে যাবে এক ভাগাভাগিতে। এ কেমন কথা! এমন স্বাধীনতা কী চেয়েছিল ভারতবাসী?

সালু মিঞা তাঁর ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে কোনো কিছুরই কুল কিনারা খুঁজতে ব্যর্থ হলেন। জজানে ফিরে প্রথমেই ছুটলেন বাবুদের বাড়ি। তাঁদের বাড়ির সামনে বিরাট পুকুরের উল্টো দিকেই বিশাল প্রাসাদ বাবুদের। জমিদার এ অঞ্চলের। জমিদার কেনারাম ঘোষের পুত্র ছোট বাবু কেষ্টধন ঘোষ তাঁর প্রাণের বন্ধু। কেষ্টর সাথে সেই ছোটবেলা থেকে দোস্তি। একসাথে কত দুষ্টুমি, কত খেলা, কত উৎসব করেছেন।

বাবুদের বাড়ির দূর্গাপুজায় খেটেছেন সালু মিঞা। বাবা পীর সাহেব খোন্দকার সাহেবের প্রশ্রয় যে ছিল না তাও নয়। তখন জজানে মহররমে বানানো হতো তাজিয়া। মর্সিয়া গাওয়া হতো। ছোট বাবু কেষ্টধন ওর সঙ্গে সেসবে মেতেছে-সেসব কী থেমে যাবে এক টেবিলে বসে মানচিত্রে দাগ টেনে দেওয়ার কারণে-

ছোটবাবু, বড়বাবু কেউই কোনো বুদ্ধি দিতে পারলো না তাঁকে। সবাই হতবিহ্বল। কী হতে কী হলো।

শ্বশুর নেই, নেই বাবা-বুদ্ধি কোনো মুরব্বিরাই দিতে পারলেন না নিশ্চিত ভাবে। নানান জনে নানান পরামর্শ দেন আবার নিজেরাই বলেন-

‘বাবা তুমি নিজে বুঝ, কী করবে! আমরা কেউ যাচ্ছি না দেশ ছেড়ে।’

সুতরাং সালু মিঞা নিজের বুদ্ধিতেই নিলেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। তাঁর ধারণা দেশ যখন ধর্মের ভিত্তিতে ভাগাভাগি হয়েছে-হিন্দুস্থান-পাকিস্তান-এখানে হয়তো দুই ধর্মের মানুষ একসঙ্গে শান্তিতে বাস করাটা কঠিন হবে। সুতরাং সুযোগ যখন আছে, অফিস থেকেই ‘অপশন’ চেয়েছে-কোন দেশে থাকবে-পাকিস্তানই ভালো-চাকরিটা আছে, পাকা কোয়ার্টার আছে-ভালো না লাগলে ফিরে চলে আসলেই হবে। সবইতো রইলো এখানে।

স্ত্রী সন্তান নিয়ে চট্টগ্রামে যাবেন এটাই হলো তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। কান্নার রোল পড়ল দু’বাড়িতেই। সকল পিছুটান উপেক্ষা করে সালু মিঞা চললেন পূর্ব-পাকিস্তানে নতুন জীবন শুরু করার লক্ষ্যে। কেষ্টধনও চোখের জলে বিদায় জানালো প্রাণের বন্ধু সালু মিঞাকে। ‘আপাতত: এদের বেড়াতে নিয়ে যাই, তারপর দেখা যাবে। বোঝালেন সবাইকে। ‘আমি জানি তোরা বেড়াতেই যাচ্ছিস।’ বলেছিল কেষ্টধন।

সেই বেড়াতে যাওয়াই যে শেষ যাওয়া ছিল, কেউ ভাবতে পারেন নি। তাঁদের ধারণা ছিল ধর্ম নিয়ে দেশভাগ কোনোদিন টিকবে না। আবার সব হয়ে যাবে আগের মতোই। সালু মিঞার বিশ্বাসও তাই ছিল।

ধর্মভিত্তিক দেশভাগ টেকেনি ঠিকই, কিন্তু আগের মতো আর হয় নি সবকিছু।

তবে পাকিস্তানের ভাঙ্গনটা আর দেখে যেতে পারেন নি সালু মিঞা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *