০৪.
ছড়ানো কম্পাউন্ডের মাঝখানে অদিতিদের বিশাল তেতলা বাড়ি। লোহার গেটের দুটো পাল্লা অনেক আগেই ভেঙে গিয়েছিল। জায়গাটা হাট করে করে খোলা। গেট পেরিয়ে অদিতি ভেতরে চলে আসে।
এ বাড়িটা ষাট-সত্তর বছর আগে তৈরি করিয়েছিলেন অদিতির ঠাকুরদা শিবপ্রসাদ ব্যানার্জি। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ আমলের একজন নামকরা স্টিভেডর। জাহাজি ব্যবসাতে প্রচুর টাকা করেছিলেন।
গথিক স্ট্রাকচারের এই বাড়িটায় বিরাট বিরাট পিলার, চওড়া চওড়া শ্বেত পাথরের সিঁড়ি। খাঁটি বার্মা টিক আর মেহগনির ওপর কারুকাজ-করা ভারী ভারী আসবাব দিয়ে বাড়ি সাজিয়েছিলেন শিবপ্রসাদ। ড্রেয়িং-টেবিল আর আলমারির গায়ে যেসব লাইফসাইজ আয়না লাগানো ছিল সেগুলো আনানো হয়েছে ইতালি থেকে। দু-হাজার বর্গফিটের প্রকাণ্ড ড্রইংরুমটা ন-ইঞ্চি পুরু কাশ্মীরি কার্পেটে মোড়া থাকত। খাস লন্ডন থেকে জমকালো আটটা ঝাড়লণ্ঠন আনিয়ে সেখানে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন শিবপ্রসাদ।
দুর্দান্ত বিলিতি আর জার্মান গাড়ি ছিল চার-পাঁচটা। চাকর-বাকর শোফার কুক ইত্যাদি নিয়ে ডজনখানেক। বাড়ির পেছনে অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া নীচু সার্ভেন্টস কোয়ার্টাসে তারা থাকত।
এ-সব পুরোনো দিনের ইতিহাস। এখন এগুলো সুখকর অলীক স্মৃতি মাত্র।
অদিতির জন্মের অনেক আগেই তাদের পরিবারের গোল্ডেন পিরিয়ড বা স্বর্ণযুগ শেষ হয়ে গেছে। বিলিতি গাড়ি, ফার্নিচার, শ্যান্ডেলিয়ার, কার্পেট, গন্ডা-গন্ডা চাকর-বাকর–এ সবের কথা সে শুনেছে মা-বাবা পিসিমা কিংবা অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের মুখে।
স্বাধীনতার ঠিক দশ বছর বাদে অদিতির জন্ম। জ্ঞান হবার পর থেকে সে যা দেখে আসছে তা এইরকম।
প্রথমে বাড়িটায় কথাই ধরা যাক। ঠাকুরদার আমলে নাকি তিনটে মালি বছরের পর বছর অক্লান্ত খেটে বাড়ির সামনে এবং পেছনে চমৎকার মরশুমি ফুল আর ফলের বাগান আর সবুজ ঘাসের লন বানিয়েছিল। সে-সবের চিহ্নমাত্র নেই। বিশ-পঁচিশ বছর ধরে বাড়িটাকে ঘিরে শুধু আগাছার জঙ্গল। শ্বেতপাথরের সিঁড়ির কোনোটাই প্রায় অক্ষত নেই। পিলার এবং দেওয়ালগুলোর গা থেকে পলেস্তারা খসে দগদগে ঘায়ের মতো দেখায়। ছাদের কার্নির্স এবং আলসে ভেঙেচুরে বিপজ্জনকভাবে ঝুলছে। দেওয়াল আর ছাদ ফাটিয়ে নানা জায়গায় অশ্বখ গজিয়ে গেছে। ঘুলঘুলিতে বংশপরম্পরায় পায়রা আর চড়ুইয়েরা তাদের সংসার বাড়িয়ে চলেছে। বাড়িভর্তি ইঁদুর আরশোলা এবং ছুঁচোর রাজত্ব।
স্বাধীনতার পর থেকে এ-বাড়িতে আর রং-টং করানো হয়নি। জানলার রঙিন কাঁচ বা খড়খড়ি বলতে কিছু নেই। ভাঙা জায়গাগুলোতে চট বা পুরোনো খবরের কাগজ গুঁজে দেওয়া হয়েছে। মোট কথা, বাড়িটার ধ্বংসের কাজ অনেকটাই এগিয়ে আছে। আর বড়জোর কুড়ি-পঁচিশ বছর, তারপর হুড়মুড় করে হয়তো একদিন ভেঙে পড়বে। চার-পাঁচটা দামি গাড়ির একটাও আর নেই। পুরোনো আসবাব, কার্পেট, শ্যাভেলিয়ার, এ-সব কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে না। সব ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেছে। বর্মা টিকের আসবাবের বদলে ঘরে ঘরে এখন খোলা কাঠের টেবিল-চেয়ার তক্তাপোষ আলমারি ইত্যাদি।
নিজেদের বংশলতা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই অদিতির। শিবপ্রসাদের আগে তাদের পরিবারের সব ইতিহাসই কুয়াশায় ঢাকা। অর্থাৎ আঁক করে বলার মতো তখন কিছুই ছিল না। তাদের বংশে যে ক্ষণস্থায়ী সুখের দিন এসেছিল তা একমাত্র শিবপ্রসাদের জন্যই।
শিবপ্রসাদ মারা গেছেন স্বাধীনতার কয়েকমাস আগে। তারপর আটত্রিশ বছর কাটতে-না-কাটতেই মাত্র দুটো জেনারেশনের মধ্যে বাড়িটার হাল কেন এরকম গেল সেটা বুঝতে হলে অদিতির বাবা এবং দাদাদের জীবনচরিত জানা একান্ত জরুরি। কিন্তু সেসব কথা পরে।
.
গেট দিয়ে ঢুকলেই এবড়ো-খেবড়ো খোয়ার রাস্তা। অদিতির ছেলেবেলায় এই পথটাতে বাদামি রঙের নুড়ি বিছানো থাকত। তারপর কবে যে নুড়িগুলো উধাও হয়ে তার জায়গায় খোয়া ফেলা হয়েছিল, এখন আর মনে পড়ে না।
দু-ধারে আগাছার ঝাড়। পুরোনো দিনের সুখস্মৃতির মতো মাঝে মধ্যে দু-একটা সিলভার পাম এখনও কোনোরকমে টিকে আছে।
কম্পাউন্ডের ভেতর চার-পাঁচটা ল্যাম্পপোস্ট রয়েছে। কিন্তু ইলেকট্রিকের খরচ বাঁচাতে আট-দশ বছর ধরে আলো জ্বালানো হয় না। ফলে এই সন্ধেবেলাতেই চারদিকে ঝুপিসি অন্ধকার। আলোর ছুঁচের মতো সেই অন্ধকারকে ফুড়ে ফুড়ে অগুন্তি জোনাকি উড়ছে। সিলভার পামের মাথা থেকে পাখিদের ডাকাডাকি আর ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজ ভেসে আসছে।
অন্যমনস্কের মতো খোয়া মাড়িয়ে মাড়িয়ে বাড়ির সামনে এসে পড়ে অদিতি। দশটা শ্বেতপাথরের সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলেই বিশাল লাউঞ্জ।
লাউঞ্জ পেরিয়ে বিরাট দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চওড়া প্যাসেজ। সেটার বাঁ-দিকে বিশাল ড্রইংরুম, ডানদিকে ওপরে যাবার সিঁড়ি। দু-ধারে বসার ঘর আর সিঁড়ি রেখে প্যাসেজটা সোজা বাড়ির পেছন দিকে চলে গেছে। সেখানে কিচেন, স্টোর, ডাইনিংরুম। যে দু-একটি কাজের লোক এখনও রয়েছে, তারা ওখানেই থাকে।
প্যাসেজে একটা কম পাওয়ারের টিমটিমে আলো জ্বলছে। সেখানে পা দিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল অদিতি। নিজের অজান্তেই তার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে।
অদিতি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে ড্রইং রুমটা খুব বেশি হলে সাত-আট ফুট দূরে। ঘরের ভেতর দুই দেওয়ালে দুটো জোরালো টিউব লাইট জ্বলছে।
অদিতি দেখতে পায়, বেতের সোফায় তেলচিটে গদির ওপর বসে আছে সিতাংশু সিতাংশু ভৌমিক। তার মুখোমুখি দুই দাদা-বরুণ আর মৃগাঙ্ক। পাশে একটা সোফায় কাত হয়ে আছেন রমাপ্রসাদ। রমাপ্রসাদ ব্যানার্জি অদিতির বাবা।
রমাপ্রসাদের আর্থারাইটিসের কষ্টটা আজ নিশ্চয়ই খুব বেড়েছে, নইলে ওভাবে আড় হয়ে থাকতেন না।
সিতাংশু হাত-টাত নেড়ে ভারিক্কি চালে বাবা আর দাদাদের কী যেন বোঝাচ্ছে।
কেন বাবা বার বার সন্ধের আগে তাকে বাড়ি ফিরতে বলেছিলেন, এতক্ষণে বুঝতে পারে অদিতি। দুপুরে সে যখন বেরোয়, ঘুণাক্ষরেও জানাননি, আজ সিতাংশু আসবে! জানালে সে কিছুতেই ফিরত না।
সিতাংশু যে তার জন্য সেই বিকেল থেকে ঝাড়া দু-তিন ঘণ্টা বসে আছে, এ ব্যাপারে অদিতি পুরোপুরি নিশ্চিত। লোকটার অসীম ধৈর্য।
সিংতাশুকে দেখতে দেখতে অদম্য ক্রোধ অদিতিকে পেয়ে বসে। মাথায় প্রবল রক্তচাপ টের পায় সে। একটি চড় মেরে লোকটাকে বাড়ি থেকে বার করে দেবে কিনা যখন ভাবছে, সেই সময় হঠাৎ রমাপ্রসাদ তাকে দেখতে পান। কাত করা শরীরটা টেনে-হিঁচড়ে খাড়া করতে করতে ব্যস্তভাবে বলেন, বুবু তুই! ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে আয়। অদিতির ডাক নাম বুবু।
অদিতি উত্তর দিতে যাচ্ছিল, আচমকা তার চোখে পড়ে একটু দূরে সিঁড়ির মুখে তাদের কাজের মেয়ে দুর্গা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় তাকে ডাকছে। পায়ে পায়ে সেদিকে এগিয়ে যায় সে।
ড্রইংরুম থেকে রমাপ্রসাদের গলা ভেসে আসে, কী হল রে, কোথায় যাচ্ছিস? এখানে এলি না?
একটু পরে আসছি।
দুর্গার কাছাকাছি আসতেই চাপা গলায় সে বলে, পিসিমা তোমাকে এক্ষুনি একবার ওপরে যেতে বলেছে ছোটদি।
দুর্গার বয়েস সতেরো-আঠারো। কালো সুশ্রী চেহারা। মেয়েটা অদিতির খুবই অনুগত।
অদিতি রীতিমতো অবাকই হল। সে যে এই মুহূর্তে ফিরে আসবে, তেতলার ঘরে শুয়ে শুয়ে পিসিমা কী করে টের পেলেন, কে জানে! জিগ্যেস করল, কেন রে?
দুর্গা বলল, জানি না।
একটু ভেবে অদিতি বলে, তুই পিসিমাকে গিয়ে বল, বাবা দাদারা আর এক ভদ্রলোক আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে ওপরে যাচ্ছি।
সিতাংশুবাবু এসেছে তো?
অদিতি চমকে ওঠে। দুর্গা এমনিতে খুবই চালাক চতুর। তার দুটোর জায়গায় দশটা করে চোখ, দশটা করে কান। তার চোখ-কান এড়িয়ে এ বাড়িতে কিছু হবার উপায় নেই। বোঝা গেল, সিতাংশু যে কিছুদিন ধরে এখানে হানা দিচ্ছে, দুর্গা তা জানে। কোন উদ্দেশ্যে সিতাংশুর যাতায়াত, সেটাও হয়তো তার অজানা নেই।
অদিতি বলে, হ্যাঁ। তুই সিতাংশুবাবুকে চিনলি কী করে?
চোখ দুটো চিকচিকিয়ে ওঠে দুর্গার। ঠোঁট কুঁচকে মজার একটা ভঙ্গি করে বলে, বা রে, চিনব না! তিন মাস ধরে সকাল নেই বিকেল নেই আসছে তো আসছেই। বড়বাবু আর দাদাবাবুদের সঙ্গে বাইরের ঘরে বসে গুজুর-গুজুর কী পরামর্শ যে করে!
এ খবরটা নতুন এবং খানিকটা চাঞ্চল্যকরও। অদিতির ধারণা ছিল তিন-চার বারের বেশি এ বাড়িতে আসেনি সিতাংশু। কিন্তু দুর্গা যা বলছে তাতে মনে হয় নিয়মিতই সে হাজিরা দিচ্ছে।
অদিতি জিগ্যেস করল, আমি যখন থাকি না তখনও আসে?
তখনই তো বেশি আসে গো ছোটদি।
তুই আমাকে বলিসনি তো?
তুমি আমার কাছে জানতে চেয়েছ?
দুর্গার স্বভাবই হল, গায়ে পড়ে কোনো কথা বলে না। সে শুধু দেখে আর শুনে যায়। অদিতি এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করে না।
দুর্গা এবার তাড়া লাগায়, ওপরে চলো ছোটদি। পিসিমা বলে দিয়েছে বড়বাবু, সিতাংশুবাবু আর দাদাবাবুদের কথা কইবার আগে তার সঙ্গে দেখা করতে। খুব দরকার।
আচ্ছা চল।
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে দোতলার বড় বারান্দায় হেমলতাকে দেখতে পায় অদিতি। হেমলতা তার মা। রোগা পাতলা চেহারা। একসময় দুর্দান্ত সুন্দরী ছিলেন। এখন টকটকে রং জ্বলে গেছে। চোখের কোলে কালির ছোপ। মুখটা ভেঙেচুরে কণ্ঠা আর গালের হাড় বেরিয়ে পড়েছে। চুল উঠে উঠে কপালটা চওড়া মাঠের মতো দেখায়। হাতের দিকে তাকালে ফর্সা কোঁচকানো চামড়ার তলায় নীল শিরাগুলো দেখা যায়। শরীরে সারাংশ বলতে বিশেষ কিছু নেই। চারদিকে শুধু ধ্বংসের ছাপ।
হেমলতা একটা আধ-ছেঁড়া মোড়ায় বসে খানিকটা ঝুঁকে কী যেন সেলাই করছিলেন। গোল বাইফোকাল চশমাটা নাকের নীচের দিকে নেমে এসেছে।
পায়ের শব্দে মুখ তুললেন হেমলতা। সিঁড়িতে অদিতিকে দেখতে পেয়ে আবছা গলায় বললেন, এই ফিরলি বুবু? তাঁর কণ্ঠস্বর এর বেশি কখনোই ওঠে না।
অদিতি থেমে যায়। বলে, হ্যাঁ, মা
সিতাংশু এসেছে।
দেখেছি।
তোর বাবা, রাজা আর বাবলু তাকে নিয়ে বাইরের ঘরে বসে ছিল।
রাজা এবং বাবলু বরুণ আর মৃগাঙ্কর বাড়ির ডাক নাম।
অদিতি বলে, ওরা এখনও বসে আছে।
ওদের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে?
না। আগে পিসিমার সঙ্গে দেখা করে আসি।
ভয়ে ভয়ে হেমলতা বলেন, ওদের সঙ্গে কথা বলে এলেই পারতিস।
সেই ছেলেবেলা থেকে অদিতি দেখে আসছে মা সারাক্ষণ শঙ্কিত এবং তটস্থ হয়ে থাকেন। গলা চড়িয়ে তাঁকে কেউ কোনোদিন কথা বলতে শোনেনি। এ বাড়িতে তিনি যে আছেন সেটা প্রায় বোঝাই যায় না। নিজেকে সম্পূর্ণ আড়ালে রেখে নিঃশব্দে ছায়ার মতো চলাফেরা করেন। সবসময় কী একটা অজানা দুর্বোধ্য ভয় তাঁকে তাড়া করে নিয়ে চলেছে।
অত ভেবো না মা। দশ মিনিট পরে ওখানে গেলে এমন কিছু মারাত্মক অপরাধ হয়ে যাবে না।
যা ভালো বুঝিস কর। পরে যেন এ নিয়ে আবার অশান্তি না হয়।
অদিতি বলে, অশান্তি হবেই মা। ভেবে ভেবে তুমি মাথা খারাপ করে ফেললেও ওটা কেউ ঠেকাতে পারবে না। এই বলে সে আর দাঁড়ায় না। দ্রুত সিঁড়ি ভাঙতে-ভাঙতে তেতলার কোণের দিকে একটা ঘরে চলে আসে।
একধারে দেওয়াল ঘেঁষে একটা তক্তাপোষে শুয়ে আছেন মৃণালিনী। ঘরের মাঝখানে একটা টিমটিমে বাল্ব জ্বলছে। এধারে-ওধারে দু-তিনটে পাল্লা-ভাঙা আলমারি। উলটোদিকের অন্য একটা দেওয়ালে গোল আয়না, সেটার তলায় কাঠের তাকে চিরুনি চুলের কাঁটা, একটা খোলা পাউডারের কৌটো, নেইল কাটার, ইত্যাদি। বর্ষার জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে গোটা ঘরটায় কালচে কালচে দাগ ধরে আছে। সিলিং থেকে পলেস্তারা খসে খসে ভেতরকার লোহার ফ্রেম বেরিয়ে পড়েছে।
মৃণালিনীর বয়স পঁয়ষট্টি ছেষট্টি। বাঙালি মেয়েদের তুলনায় তাঁর হাইট রীতিমতো ভালোই-পাঁচ ফিট সাত-আট ইঞ্চির মতো। চওড়া চওড়া হাড়ের ফ্রেমে একসময় দুর্দান্ত স্বাস্থ্য ছিল তাঁর। খুবই সুন্দরী ছিলেন যৌবনে। হেমলতাও অসাধারণ রূপসি। কিন্তু দুজনের রূপ দুই ধরনের। হেমতলার দৈহিক সৌন্দর্যের সঙ্গে মিশে থাকত ভীরুতা। কিন্তু মৃণালিনীকে ঘিরে যা ছিল তা দৃঢ়তা এবং ব্যক্তিত্ব। এমন তেজি মহিলা খুব বেশি দেখেনি অদিতি।
অবশ্য এই পঁয়ষট্টি-ছেষট্টি বছর বয়েসে রূপ এবং স্বাস্থ্যের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। হেমলতার মতোই তাঁর সবকিছু শেষ গেছে। তার ওপর পাঁচ বছর ধরে পক্ষাঘাতে ডানদিকটা পড়ে গেছে। হেমলতা তবু চলে ফিরে বেড়ান, সংসারের টুকিটাকি নানা কাজকর্ম করেন। মৃণালিনীর সে সামর্থ্যটুকুও নেই। আমৃত্যু তাঁকে শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হবে।
মৃণালিনী বললেন, আমার কাছে আয়।
অদিতি এগিয়ে গিয়ে মৃণালিনীর পাশে বসে পড়ে বলে, আমি যে এখন আসব, জানলে কী করে?
দুর্গাকে জানলার কাছে বসিয়ে রেখেছিলাম। তোকে দেখলেই যেন ধরে নিয়ে আসে।
কেন?
তোর বাবা, রাজা, বাবলু আর সেই লোকটা কী যেন নাম?
সিতাংশু ভৌমিক।
হ্যাঁ সিতাংশু। ওদের হাতে পড়ার আগে তোকে অনেক কথা জানাবার আছে।
বলো।
স্বার্থসিদ্ধির জন্যে তোর বাবা আর ভাইরা তোকে সিতাংশুর সঙ্গে বিয়ে দিতে চায়। তবে এটাকে বিয়ে বলে না।
রমাপ্রসাদ, বরুণ আর মৃগাঙ্ক তার বিয়ে যে সিতাংশুর সঙ্গে দিতে চায়, সেটা অনেক আগেই টের পেয়েছে অদিতি। কিন্তু এর সঙ্গে তাদের স্বার্থসিদ্ধির কী সম্পর্ক, বোঝা যাচ্ছে না।
বিমূঢ়ের মতো সে বলে, বিয়ে বলে না!
না।
তাহলে এটা কী?
মৃণালিনীর শরীরের যে অংশটা সুস্থ, সেখানে কোনো অদৃশ্য বৈদ্যুতিক প্রবাহ খেলে যায়। প্রবল উত্তেজনায় সে দিকটা কাঁপতে থাকে। বাঁ হাতটা তুলে তিনি বলেন, তোকে ওরা বেচে দিতে চায়।
এবার হকচকিয়ে যায় অদিতি, মানে।
কিছুই কি তুই টের পাসনি বুবু?
কী টের পাব?
আশ্চর্য, আমি এই বিছানায় শুয়ে শুয়ে সব জানতে পারি আর তোর যে এতবড় সর্বনাশ হতে যাচ্ছে সে খবরটুকুও রাখিস না! বলে একটু থামেন মৃণালিনী। পরক্ষণেই তীব্র গলায় আবার শুরু করেন, তোর বাপ আর দাদারা ওই লোকটার কাছ থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা ধার নিয়েছে। সেসব শোধ করার ক্ষমতা এ জন্মে ওদের হবে না। এদিকে সিতাংশুর নজর পড়েছে তোর ওপর। বিয়ে হলে টাকাটা আর তাকে ফেরত দিতে হবে না।
বাবা আর দাদারা যে এতটা নীচে নেমে গেছে, ভাবতে পারেনি অদিতি। পক্ষাঘাতে-অসাড় মানুষের মতো সে বসে থাকে।
মৃণালিনী বলেন, নারী-জাগরণ নারী-জাগরণ করে তো খাওয়া-দাওয়া ঘুম-বিশ্রাম সব প্রায় ছেড়েছিস, দিন রাত সারা শহর তোলপাড় করে বেড়াচ্ছিস কিন্তু নিজের জাগরণটা কবে হবে?
অদিতি আস্তে আস্তে মৃণালিনীর দিকে তাকায়। তবে কোনো উত্তর দেয় না।
মৃণালিনী সস্নেহে তাঁর বাঁ হাতটি অদিতির কাঁধে রেখে বলেন, ভয় পাস না, আমি তোর পেছনে আছি।
বাবা এবং দাদাদের নীচতা আর গোপন ষড়যন্ত্র অদিতিকে প্রচণ্ড কষ্ট দিচ্ছিল। মৃণালিনী একটু আগে যা বললেন সেই কথাগুলিই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে ভাবছে। নিজের সম্বন্ধে অদিতির ধারণা, নারী স্বাধীনতা এবং মেয়েদের অসংখ্য সমস্যার ব্যাপারে সে একজন ধর্মযোদ্ধা। এই শহরে যেখানেই বধূহত্যা, নারী নির্যাতন বা মেয়েদের ওপর আক্রমণ সেখানেই অদিতি। মেয়েদের সামাজিক মর্যাদা এবং নিরাপত্তার কারণে সে ঊধ্বশ্বাসে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে চলেছে। অথচ তাকেই যে বিক্রি করে দেবার চক্রান্ত চলছে সেই খবরটা পর্যন্ত সে রাখে না। অদিতি নিজে একজন অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত তরুণী, আর্থিক দিক থেকে যথেষ্ট স্বাবলম্বী। একটি কলেজে সে পড়ায়। সামাজিক মর্যাদা এবং প্রতিষ্ঠা বলতে যা বোঝায় সে সবই তার আছে। তার মতো একটি মেয়ের স্বাধীনতা যেখানে বিপন্ন সেখানে তার চেয়ে অনেক নীচের স্তরের অশিক্ষিত এবং আর্থিক দিক থেকে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল মেয়েদের জন্য সে কতটুকু কী করতে পারে? হঠাৎ অদ্ভুত এক নৈরাশ্য চারিদিক থেকে তাকে যেন ঘিরে ধরতে থাকে।
মৃণালিনী আবার বলেন, নিজেকে শক্ত রাখবি বুবু। ওদের কথায় একেবারে রাজি হবি না। আমাদের পরিবারে দুটো দুর্ঘটনা ঘটছে। তৃতীয়বার আর যেন না ঘটে। আমি অন্তত ঘটতে দেব না।
মৃণালিনীর মতো মহিলা এই সামাজিক সিস্টেমে ক্বচিৎ কখনও দেখা যায়। পক্ষাঘাতে একটা দিক পড়ে গেছে, দশ বছর একটানা শয্যাশায়ী হয়ে আছেন কিন্তু এখনও মনের জোর তাঁর অপরিসীম। তাঁর মধ্যে একটি অপরাজেয় দৃঢ়তা আছে, কোনো কারণেই সেটা মাথা নোয়াতে জানে না।
দুটি পারিবারিক দুর্ঘটনার কথা যে মৃণালিনী বলেছেন তার একটি ঘটেছে মৃণালিনীর জীবনে, অন্যটি সুজাতার। সুজাতা অদিতির ছোটদি।
প্রথমে মৃণালিনীর কথাই ধরা যাক। এক সময় দারুণ ছাত্রী ছিলেন মৃণালিনী। সতেরো বছর বয়সে স্কলারশিপ নিয়ে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন। তার পরেই ঠাকুরদা তাঁর বিয়ে দিয়েছিলেন। মৃণালিনী আরও পড়াশোনা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু প্রচুর পয়সা করলেও এ-বাড়ির আবহাওয়ায় বহুকালের প্রাচীন সংস্কার শিকড় গেড়ে ছিল। পনেরো পেরুবার আগেই এই বংশের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। সেদিক থেকে বয়স দুবছর বেশি হয়ে গিয়েছিল মৃণালিনীর। বিয়েটা আটকাবার জন্য প্রচুর কান্নাকাটি করেছেন তিনি, পুরো তিনটে দিন প্রতিবাদ হিসেবে কিছু খাননি। কিন্তু রমাপ্রসাদকে টলানো যায়নি। মেয়ের জন্য পারিবারিক প্রথা তিনি পুরোপুরি ভাঙতে পারেন না।
বিয়ে হয়েছিল উত্তর কলকাতার এক বনেদি অভিজাত পরিবারে। পৃথিবীতে কাম্য বস্তু বলতে তাদের যদি কিছু থাকে তা হল অর্থ। নিজেদের কোনোরকম অভাব ছিল না। গোটাচারেক বাড়ি, তিন-চারটে গাড়ি, ওয়েলার ঘোড়ায় টানা ফিটন ইত্যাদি। তাছাড়া ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিট অজস্র টাকা, নানা কোম্পানিতে আট-দশ লাখ টাকার শেয়ার। তবু তাদের খাই মিটত না। এইসব টাকার বেশিরভাগ এসেছে ছেলেদের বিয়ের যৌতুক হিসেবে। মৃণালিনীর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বিয়েটাকে টাকা বানাবার একটা কৌশল হিসেবে ব্যবহার করত। বেছে বেছে এমন সব বাড়ি থেকে পুত্রবধু যোগাড় করত যাদের প্রচুর অর্থ, বিপুল প্রপার্টি।
মৃণালিনীর বিয়ের সময় তাঁর শ্বশুরেরা যৌতুক এবং নগদ টাকা যা আদায় করার তা তো আদায় করেছিলই, মাসখানেক পর থেকে আরও টাকা আনার জন্য মৃণালিনীর ওপর চাপ দেওয়া শুরু হয়েছিল। প্রথম প্রথম শাশুড়িই তাঁকে টাকার কথা বলত, মৃণালিনী শুনতেন কিন্তু উত্তর দিতেন না। পরে শ্বশুর বলতে শুরু করেছিল। অন্য পুত্রবধূরা যে কত ভালো এবং তাদের বাপেরবাড়ি থেকে কতভাবে কত টাকা নিয়ে এসেছে নাটকীয় ভঙ্গিতে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে বলত, শ্বশুরবাড়িই হচ্ছে মেয়েদের সর্বস্ব এবং সব মেয়েরই কর্তব্য সেখানকার বিষয়-সম্পত্তি আর টাকাপয়সা অনবরত বাড়িয়ে চলা। মৃণালিনীর স্বামীরও এ ব্যাপারে পুরোপুরি সায় ছিল।
মৃণালিনী আগে জানতেন না, পরে শুনেছেন তাঁর শ্বশুরবাড়িতে বধূ হত্যার দু-একটি দৃষ্টান্ত আছে। যে পুত্রবধূরা বাপেরবাড়ি থেকে টাকা আনতে রাজি হয়নি বা এ-ব্যাপারে প্রতিবাদ জানিয়েছে তাদের অকালে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। একেবারে খুনির বংশ। পয়সার জন্য এরা না-পারে এমন কোনো কাজ নেই।
দু-চারবার শোনার পর মৃণালিনী মনস্থির করে ফেলেছিলেন। একদিন শ্বশুরকে বলেছিলেন, আপনি আমাকে নিয়ে বাবার কাছে চলুন।
শ্বশুরের চোখ-মুখ লোভ চকচকিয়ে উঠেছিল। সে তক্ষুনি চুনোট-করা ধাক্কাপড় কাচি ধুতি, গিলে-করা পাঞ্জাবি পরে পায়ে গুঁড়োলা নাগরা লাগিয়ে, মাথায় পরিপাটি টেড়িটি কেটে মৃণালিনীকে নিয়ে ফিটনে উঠেছিলেন।
ওল্ড বালিগঞ্জে নিজেদের বাড়ি এসে শ্বশুরকে ড্রইংরুমে বসিয়ে বাবা, দাদা এবং মাকে ডেকে নিয়ে এসেছিলেন মৃণালিনী। শান্ত গলায় বাবাকে বলেছিলেন, বাবা, থানার
অফিসার-ইন-চার্জকে খবর দাও, এখনই যেন তিনি চলে আসেন।
সবাই হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। শিবপ্রসাদ বিমূঢ়ের মতো বলেছিলেন, থানার অফিসার এসে এখানে কী করবে?
শ্বশুরকে দেখিয়ে মৃণালিনী বলেছিলেন, এই লোকটার নামে আমি একটা ডায়েরি করব।
মা বাবা দাদা, এমনকী মৃণালিনীর শ্বশুর পর্যন্ত আঁতকে উঠেছিল। মা বলেছিলেন, কার সম্বন্ধে কী বলছিস মিনু! তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে!
মাথা আমার ঠিকই আছে মা। তোমরা ভালো করে খোঁজখবর না নিয়ে খুনিদের বাড়িতে আমার বিয়ে দিয়েছিলে।
শিবপ্রসাদ ধমকে উঠেছিলেন, মিনু!
মৃণালিনী বলেছিলেন, আমার সব কথা আগে শুনে নাও। এরা আমার বিয়ের সময় তোমার কাছ থেকে এক লাখ টাকা আদায় করেছিল। এখন আবার পঞ্চাশ হাজার চাইছে। আর সেই টাকাটা নেবার জন্যেই আমাকে নিয়ে এখানে এসেছে। তোমরা যদি না দাও আমার মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারবে না। ঠিক সেই কারণে তিন-চারটি বউকে এরা খুন করেছে।
ভয়ে মৃণালিনীর শ্বশুরের মুখ প্রথমটা একেবারে রক্তশূন্য হয়ে গিয়েছিল। তারপরেই অসহ্য রাগে উঠে দাঁড়িয়েছিল সে। গলায় শির ছিঁড়ে চিৎকার করে উঠেছিল, এই অপমানের কথা আমার মনে থাকবে।
মৃণালিনী বলেছিলেন, মনে থাকাটা খুব দরকার।
শ্বশুর আর দাঁড়ায়নি, দাঁতে দাঁত চেপে বেরিয়ে গিয়েছিল।
শিবপ্রসাদ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন। তারপর বলেছেন, এ তুই কী করলি মিনু! পঞ্চাশ হাজার টাকা নাহয় আমি দিতাম।
কিছুতেই না। এই অন্যায়কে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। আজ পঞ্চাশ হাজার দিয়ে তুমি রেহাই পাবে ভেবেছ! কালই আবার এক লাখ চেয়ে বসবে। ওদের লোভের শেষ নেই।
কিন্তু যে কাণ্ড তুই করলি তাতে শ্বশুরবাড়ির দরজা তো চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল।
আমি সেটাই চাই। ওইরকম পশুদের বাড়ি আমি কখনোই যাব না।
পাগলামি করিস না। আমি তোর শ্বশুরমশাইয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে বরং-~
একেবারে না বাবা। তীব্র গলায় মৃণালিনী বলেছিলেন, একটা ইতর শয়তানের কাছে তুমি হাতজোড় করে গিয়ে দাঁড়াবে, এ আমি ভাবতেই পারি না।
শিবপ্রসাদ একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন, কিন্তু তোর ভবিষ্যৎ?
সেটা আমি ভেবে রেখেছি।
সেদিনই শিবপ্রসাদ এবং রমাপ্রসাদকে সঙ্গে নিয়ে থানায় গিয়ে শ্বশুরবাড়ির নামে একটা ডায়েরি করেছিলেন। পরের দিন থেকে নতুন করে তাঁর পড়াশোনা শুরু হয়েছিল।
শিবপ্রসাদ বেঁচে থাকতে থাকতেই মৃণালিনী এম.এ পাশ করে একটা স্কুলে চাকরি নিয়েছিলেন। এতে খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন শিবপ্রসাদ। মেয়েদের সম্পর্কে এই পরিবারের ধ্যানধারণার সঙ্গে চাকরিটা একেবারেই খাপ খায় না। মেয়েরা পয়সা রোজগারের জন্য বাইরে বেরুবে, এটা ছিল একেবারে অভাবনীয়। ক্ষুব্ধ শিবপ্রসাদ বলেছিলেন, আমি কি তোকে দু-বেলা দুটো খেতে দিতে পারি না?
মৃণালিনী বলেছিলেন, নিশ্চয়ই পারো। তুমি যতদিন আছ ততদিন ঠিক আছে। তারপর?
রমাপ্রসাদ কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, আমার ওপর তোর কি বিশ্বাস নেই মিনু? তাঁর চোখে-মুখে অভিমান এবং কষ্টের ছাপ ফুটে উঠেছে।
মৃণালিনী বলেছেন, কাউকেই আমি অবিশ্বাস করি না দাদা। এম.এ পাশ করে চুপচাপ ঘরে বসে থাকার মানে হয় না। কিছু একটা করা ভালো।
শিবপ্রসাদ কুণ্ঠিত মুখে বলেছিলেন, আমি একটা কথা ভাবছিলাম।
মৃণালিনী জিগ্যেস করেছিলেন, কী কথা?
আবার যদি তোর বিয়ে দিই?
মেয়েদের ব্যাপারে এ বাড়ির লোকেরা বিয়ে ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারত না। সেটাই যেন তাদের পক্ষে ভবিষ্যতের একমাত্র গ্যারান্টি। সেই যে মৃণালিনীর শ্বশুর উত্তেজিত ভঙ্গিতে চলে গিয়েছিল, তার কয়েক দিন বাদেই চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছিল, মৃণালিনীর সঙ্গে তাদের আর কোনো সম্পর্ক নেই, তাঁর কাছে শ্বশুরবাড়ির দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। চিঠিটা পাওয়ার পরই ভঙ্গুর বিবাহিত জীবনের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে মৃণালিনীর হাতে যে শাখা ছিল তা খুলে ফেলেছেন তিনি, সিঁথি থেকে সিঁদুর ঘষে ঘষে মুছে দিয়েছেন। একমাসের দাম্পত্যজীবন এইভাবেই শেষ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। সতেরো বছর বয়সে পুরুষদের সম্পর্কে যে মারাত্মক ধারণাটি তাঁর হয়েছিল তাতে নতুন করে বিয়ের ফাঁদে আর পা দিতে চাননি। মৃণালিনী বলেছেন, যথেষ্ট হয়েছে, আর দরকার নেই।
কিন্তু~~
আমার সম্বন্ধে অত ভেবে ভেবে এই বয়সে কেন শরীর খারাপ করছ? শুধু এ বাড়িতে আমাকে একটু থাকতে দিও। আর কিছু দরকার নেই। আমি তো বাচ্চা মেয়ে নই। কীসে আমার ভালোমন্দ সেটা বুঝি। আমার ভাবনা আমাকেই ভাবতে দাও।
তারপর দশ বছর আগে পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী না-হওয়া পর্যন্ত একটানা স্কুলে পড়িয়ে গেছেন মৃণালিনী। হেড মিস্ট্রেসও হয়েছিলেন।
এর মধ্যে শিবপ্রসাদ এবং তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ মৃণালিনীর মা মারা গেছেন।
দ্বিতীয় ঘটনাটি অদিতির ছোটদি সুজাতাকে নিয়ে। সুজাতার স্বামী এবং শ্বশুর ব্যবসার নাম করে রমাপ্রসাদের কাছে বেশ কিছু টাকা চেয়েছিল কিন্তু তখন এ-বাড়ির অবস্থা পড়ে গেছে। টাকা দেবার ক্ষমতা এদের ছিল না। ফলে সুজাতাকে আর বাপের বাড়ি আসতে দেওয়া হয় না। অদিতিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক একরকম শেষ-ই হয়ে গেছে বলা যায়। তবে মন্দের এটুকুই ভালো, বধূহত্যার তালিকায় তার নামটা অন্তত ওঠেনি।
মৃণালিনীর মতো সুজাতার অতটা সাহস বা দৃঢ়তা ছিল না। শ্বশুরবাড়ি থেকে মাথা উঁচু করে সে বেরিয়ে আসতে পারেনি। শ্বশুর এবং স্বামীর সিদ্ধান্ত সে নিঃশব্দে মাথা পেতে মেনে নিয়েছিল…।
মৃণালিনী এবার বললেন, এই বিয়েতে আমি মত দিলাম বুবু, যদি বুঝতাম সিতাংশু ভালো ছেলে। কিন্তু ওটা পাজির পা ঝাড়া
এতক্ষণ মৃণালিনী এবং সুজাতার অতীত জীবনের কথা ভাবছিল অদিতি। সে চমকে ওঠে।
মৃণালিনী থামেননি, দুশ্চরিত্র, লম্পট। অনেক মেয়ের সর্বনাশ করেছে।
অবাক হয়ে পিসিকে দেখতে থাকে অদিতি। এই মহিলা কি অলৌকিক কোনো ক্ষমতার অধিকারিণী? ঘরে শুয়ে থেকে এত সব খবর পান কী করে? নিজের অজান্তেই অদিতি বলে, তুমি কেমন করে জানলে?
মৃণালিনী বলেন, যখন খবর পেলাম তোর বাবা আর দাদারা সিতাংশুর সঙ্গে তোর বিয়ে দেবার মতলব করেছে তখন চিঠি লিখে টোকনকে ডাকিয়ে এনেছিলাম।
টোকন অদিতির দূর সম্পর্কের খুড়তুতো ভাই। বছর দেড়েক আগে বি.এস সি পাশ করেই নিজের চেষ্টায় একটা বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে অ্যাপ্রেন্টিসশিপ জোগাড় করে ফেলেছে। টোকন দারুণ তুখোড় আর স্মার্ট। অসম্ভব বলে তার কাছে কোনো ব্যাপারই নেই। যে কাজেই তাকে লাগিয়ে দেওয়া যাক, যেভাবেই হোক, সেটি করবেই।
অদিতি এবং মৃণালিনী দরকার হলেই তাকে খবর দেন। পিসি যখন চিঠি দিয়ে ডাকিয়ে এনেছিলেন তখন গোয়েন্দা হিসেবে নিশ্চয়ই সিতাংশুর পেছনে লাগিয়ে দিয়েছেন এবং টোকন অবশ্যই তার সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য সরবরাহ করে গেছে। এসব কাজে টোকনের প্রচণ্ড উৎসাহ।
মৃণালিনী আবার বললেন, বুঝতেই পারছিস কেন টোকনকে চিঠি লিখেছি। ও পরশু জানিয়ে গেছে, সিতাংশু এর আগে দু-বার বিয়ে করে দু-বার ডিভোর্স করেছে। তা ছাড়া দু-একটা রক্ষিতাও নাকি আছে। তা ছাড়া প্রায়ই নতুন নতুন মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করতে পোয়া, গোপালপুর এমনি সব জায়গায় যায়। কন্ট্রাক্টারি করে লাখ লাখ টাকা করেছে–প্রচুর নাকি ব্ল্যাক মানি। পাপের টাকা এইভাবেই খানিকটা ওড়াচ্ছে।
অদিতি বলে, বাবা বড়দা ছোটদা এসব জানে?
জানা তো উচিত।
আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল অদিতি, দুর্গা এসে দরজার সামনে দাঁড়ায়। বলে, ছোটদি, বড়বাবু তোমাকে ডাকছেন। এক্ষুনি নীচে যাও
ঠিক আছে, তুই যা। আমি আসছি। বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় অদিতি। তার মুখ-চোখ দেখে মনে হয়, ভেতরে ভেতরে সিংশুর ব্যাপারে একটা কিছু সিদ্ধান্ত করে ফেলেছে।
দরজার কাছ থেকে চলে যায় দুর্গা। মৃণালিনী বলেন, চললি?
হ্যাঁ।
আমার কথাটা মনে থাকে যেন।
থাকবে।
নীচে নামতে নামতে অদিতি দেখতে পায়, দোতলার বারান্দায় বড় বউদি বন্দনা আর ছোট বউদি মীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। হেমলতাকে এবার আর দেখা যায় না। অদিতির পায়ের শব্দে মুখ ফিরিয়ে তারা থামকে যায়। বোঝা যাচ্ছে, তার সম্পর্কেই দুই বউদি কিছু আলোচনা করছিল।
বড় বউদি বন্দনার বয়স বত্রিশ-তেত্রিশ। ছেলেপুলে হয়নি। খুবই গরিবের ঘরের মেয়ে বন্দনা। বরুণ প্রেম করে তাকে বিয়ে করেছিল। যেমন চতুর তেমনি স্বার্থপর। পারিবারিক ডিপ্লোম্যাসিটা এমনভাবে চালিয়ে যায় যাতে ধরার উপায় নেই। কার সঙ্গে কী ব্যবহার করলে, কার কানে কী লাগালে, কার মন যুগিয়ে চললে স্বার্থটি বজায় থাকে, সে সব সুচারুভাবে করে যায় বন্দনা। তার কাজ এতটাই নিখুঁত যে ধরার উপায় থাকে না।
মীরাও প্রেমের রাস্তাতেই, কিঞ্চিৎ ঘুরপথে এ-বাড়িতে এসে ঢুকেছিল। তবে ছোটদা মৃগাঙ্ক তাকে বিয়ে করে আনেনি। তিন মাসের বাচ্চা পেটে নিয়ে বিয়ের আগেই তার প্রবেশ। প্রথমটা মৃগাঙ্ক মীরার সন্তানের দায়িত্ব স্বীকার করতে চায়নি। এই নিয়ে প্রচুর ঝাট হয়েছে। পরে পাড়ার ছেলে এবং পলিটিক্যাল পার্টিগুলোর চাপে সুড় সুড় করে বিয়ে করেছে। তাদের একটিমাত্র ছেলে–চিকু। সে একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে।
মীরার বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ। তার বাপের বাড়ির অবস্থা বন্দনাদের তুলনায় অনেক ভালো। বন্দনার মতো সে অতটা স্বার্থপর বা ধুরন্ধর নয়। তার মধ্যে কিছুটা উদারতা এবং সারল্য রয়েছে।
দুই বউদি একটিও কথা না বলে অদিতিকে লক্ষ করতে লাগল। অদিতি তাদের দিকে চোখ রেখে আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে।
নীচের ড্রইংরুমে আসতে রমাপ্রসাদ বললেন, এত দেরি করলি! সেই কখন থেকে সিতাংশু বসে আছে। বস।
একটা ছেঁড়া জরাজীর্ণ সোফায় বসতে বসতে অদিতি জিগ্যেস করে, আমার জন্যে?
হ্যাঁ।
সব জেনে-শুনেও অদিতি বলে, কেন?
বিব্রতভাবে রমাপ্রসাদ বলেন, এই তোর সঙ্গে একটু আলাপ করবে। তাই
অদিতি বলে, কার কাছে যেন শুনেছিলাম সিতাংশুবাবু একজন বিরাট বিল্ডার বিরাট কনস্ট্রাকশান বিজনেস আছে ওঁর। কিন্তু সে ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। আমি জানি শেক্সপিয়র, শেলি, কিটস, টেনিসন, সুইনবার্ন, এলিয়ট। এঁদের নিয়ে আলোচনা করলে আমার আপত্তি নেই।
বিপন্ন মুখে রমাপ্রসাদ বলেন, না, মানে
তীক্ষ্ণ চোখে বাবাকে দেখতে দেখতে অদ্ভুত হাসে অদিতি। বলে, বাবা বড়দা ছোটদা, তোমরা ওপরে যাও। সিতাংশুবাবুর সঙ্গে আমিই আলাপ করে নিচ্ছি।
অদিতি যা বলেছে তা প্রায় অভাবনীয়। এর জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। সবাই প্রথমটা হকচকিয়ে গেল। তাপর চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
অদিতি এবার সিতাংশুকে বলে, আপনি চা খেয়েছেন?
সিতাংশু শশব্যস্তে বলে ওঠে, হা হা, নিশ্চয়ই।
আরেকবার দিতে বলব?
আপনি যদি খান তা হলে
ঠিক আছে, খাব।
অদিতি জানে ঘরের বাইরে রমাপ্রসাদ না থাকুন, দুই দাদা নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোথাও রয়েছে। সিতাংশুর সঙ্গে তার কথাবার্তা শোনার জন্য তাদের দম আটকে আছে। গলা তুলে অদিতি বলে, ছোটদা-বড়দা, দুর্গাকে দিয়ে দু-কাপ চা পাঠিয়ে দিও–
বরুণ বা মৃগাঙ্কর সাড়া পাওয়া যায় না। তবে কয়েক মিনিটের ভেতর চা দিয়ে যায় দুর্গা।
একটা কাপ তুলে নিয়ে অদিতি বলে, সারাদিন নানা কাজে অনেক জায়গায় ঘুরতে হয়েছে। আমি ভীষণ টায়ার্ড। আপনিও শুনলাম বেশ কিছুক্ষণ ওয়েট করছেন। বাজে ভণিতা না করে কাজের কথা শুরু করা যাক
সিতাংশু চায়ের কাপ তুলে নিয়েছিল। সে আলতো করে একটা চুমুক দিয়ে উৎসুক চোখে তাকায়।
অদিতি সোজাসুজি সিতাংশুকে লক্ষ করতে করতে বলে, দেখুন কেউ আমাকে স্ট্রেট কিছু বলেনি। তবে মাস দু-তিনেক ধরে খবর পাচ্ছি আপনি রেগুলার আমাদের বাড়ি আসছেন। আমার দাদাদের আপনি বন্ধু, বাবারও বিশেষ পরিচিত। আসাটা স্বাভাবিক। এ ব্যাপারে আমার মাথা ঘামাবার কিছু ছিল না।
কী?
কয়েকদিন হল টের পাচ্ছি, বাবা আর দাদারা চান আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হোক আর সেই উদ্দেশ্য মাথায় রেখে ওঁরা ঠিক করেছিলেন আজ আপনার সঙ্গে আমার ফরম্যাল আলাপের সুযোগ করে দেবেন। ঠিক বলছি তো?
কোনো মেয়ে সরাসরি এ জাতীয় কথা এত অসঙ্কোচে বলতে পারে, সিতাংশুর ধারণা ছিল না। সে প্রথমটা অবাক হয়ে যায়। তারপর দ্বিধান্বিতভাবে বলে, ঠিক
যদি আমার কোথাও ভুল হয় কারেক্ট করে দেবেন।
সিতাংশু উত্তর দেয় না।
অদিতি আবার বলে, আপনি যখন কয়েকঘণ্টা ওয়েট করছেন তখন ধরে নিতে পারি এ বিয়েতে আপনারও সায় রয়েছে।
চোখ নামিয়ে আস্তে আস্তে মুখ হেলিয়ে দেয় সিতাংশু।
অদিতি বলে, যাক, বিয়ের ব্যাপারে আপনার পরিষ্কার মতামতটা যখন জানা গেল তখন আলোচনা করতে সুবিধে হবে।
সিতাংশু এবারও কিছু না-বলে অদিতির দিকে তাকায়।
অদিতি বলে, এবার নিজের সম্বন্ধে আপনাকে কিছু ইনফরমেশন দিই। তাতে আমাকে বুঝতে আপনার পক্ষে সুবিধে হবে।
সিতাংশু স্মার্ট হবার চেষ্টা করে, বেশ তো। ডিসকাশানটা খোলামেলা হওয়াই ভালো। একটু থেমে বলে, সিগারেট খেলে আপনার আপত্তি নেই তো?
নট অ্যাট অল। অদিতি বলতে থাকে, আমি ডিভোর্সি নই, আগে আমার বিয়ে হয়নি। ভার্জিন কুমারী মেয়ে বলতে যা বোঝা যায় আমি তা-ই। তবে
তবে কী?
আপনি হয়তো জানেন আমি একটা কলেজে পড়াই।
জানি।
সেখানে আমার বেশিরভাগ কলিগই পুরুষ। এ ছাড়াও নানা দরকারে বহু পুরুষের সঙ্গে মিশতে হয়। অসংখ্য বয়-ফ্রেন্ড রয়েছে আমার।
এ নিয়ে আমার কোনোরকম শুচিবাই নেই।
ফাইন।
আপনি কি জানেন নারী-জাগরণ নামে আমাদের একটা অরগানাইজেশন আছে?
না। সেটা কী?
নারী-জাগরণ-এর উদ্দেশ্য সংক্ষেপে জানিয়ে অদিতি যা বলে তা এইরকম। পুরুষশাসিত সমাজে মেয়েরা নানা কুসংস্কার এবং শৃঙ্খলে বন্দি হয়ে আছে। এই নারীদের মুক্তির জন্যই তাদের সংগঠন অবিরাম যুদ্ধ করে চলেছে। যেভাবেই হোক মেয়েদের ওপর লাঞ্ছনা এবং অত্যাচার বন্ধ করতেই হবে। যতদিন-না নারীর সম্মান মর্যাদা আর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে নারী-জাগরণ-এর লড়াই চলবেই।
রীতিমতো উৎসাহিত হয়ে ওঠে সিতাংশু। বলে, এ তো বিরাট কাজ। এতে আমার সাপোর্ট আছে।
যদি ডোনেশন নিতে আপনারা রাজি থাকেন, আমি দেব।
ধন্যবাদ। তেমন দরকার হলে নিশ্চয়ই আপনার কাছে নারী-জাগরণ হাত পাতবে।
সিতাংশু অল্প হাসে, তবে উত্তর দেয় না। আগেই একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়েছিল সে, আস্তে আস্তে সেটা টানতে থাকে।
অদিতি থামেনি। সে বলে, নারীমুক্তির জন্য যখন আন্দোলন করছি তখন বুঝতেই পারছেন আমি কী টাইপের মেয়ে। আমার যিনি স্বামী হবেন তাঁকে গ্যারান্টি দিতে হবে, বিয়ের পর আমার স্বাধীনতায় হাত দিতে পারবেন না। আমি কোথায় যাব, কার সঙ্গে মিশব, কখন বাড়ি ফিরব–এসব নিয়ে প্রশ্ন করা চলবে না।
সিতাংশু নড়েচড়ে বসে। অ্যাশট্রেতে সিগারেটের ছাই ঝেড়ে বলে, কিন্তু সংসারের দিকটাও তত মেয়েদের দেখা উচিত।
নিশ্চয়ই। সংসারের ব্যাপারে আমার যেটুকু কর্তব্য তা তো করতেই হবে।
সিতাংশুর মুখ দেখে মনে হয়, অদিতির কথায় খুশি হয়েছে। একটু চুপচাপ।
তারপর কিছুটা ইতস্তত করে সিতাংশু বলে, আমার সামান্য একটা অনুরোধ ছিল।
বলুন।
ব্যবসা করে আমার টাকাপয়সার অভাব নেই। আমার স্ত্রী চাকরি করবেন, এটা ভালো লাগছে না।
চাকরির ব্যাপারটা আগে ঠিক করে নেওয়া যাক। আপনার কত টাকা আছে, আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। তবে ফোর্ড বা রকফেলারের বাড়িতে বিয়ে হলেও চাকরিটা ছাড়তে পারব না। অর্থিক স্বাধীনতা আমার কাছে খুবই ইম্পর্টান্ট। অদিতি না থেমে একটানা বলে যায়, আশা করি চাকরির ব্যাপারটা আপনার কাছে ক্লিয়ার করে দিতে পেরেছি।
সিতাংশুর ধারণা ছিল, এক কথায় চাকরি ছেড়ে দেবে অদিতি।
উত্তর শুনে ভেতরে ভেতরে একটু থমকে যায় সে। আস্তে করে বলে, হ্যাঁ। চাকরি করার যখন এত ইচ্ছে তখন আর কী বলব। ঠিক আছে তা-ই কোরো তুমি। বেশ সচেতনভাবেই, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্যই হয়তো, অদিতিকে তুমি করে বলতে শুরু করে সে।
অদিতি দ্রুত একটি আঙুল তুলে জোরে মাথা নাড়ে, উঁহু উঁহু, এখনও আমরা তুমি বলার স্টেজে আসিনি। আরও কয়েকটা বিষয় আমাদের পরিষ্কার করে নিতে হবে।
সিতাংশু হকচকিয়ে যায়, কী কী বিষয়?
আমার সম্বন্ধে জরুরি ইনফরমেশনগুলো মোটামুটি সবই দিয়েছি মিস্টার ভৌমিক।
কিন্তু বলুন
নিজের সম্বন্ধে আপনি এখনও কিছু জানাননি। বেটার আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের জন্য ওটা আমার জানা দরকার–তাই না?
কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে সিতাংশু। সিগারেটের বাকি অংশটুকু অ্যাশট্রেতে নামিয়ে রেখে বলে, অবশ্যই। আমার সম্বন্ধে কী কী ইনফরমেশন পেলে আপনার সুবিধা হয় বলুন।
দেখুন, আমি ইংরেজিতে ফাস্ট ক্লাস পেয়ে এম. এ পাশ করেছি। একটা কলেজে কাজ করি। প্রথমেই জানতে ইচ্ছে হবে, যিনি আমার স্বামী হবেন তাঁর এডুকেশনাল কোয়ালিফিকেশনটা কী?
নিশ্চয়ই। আমি একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। শিবপুর থেকে পাশ করেছি।
ঠিক আছে। শুনেছি আপনি একজন বিজনেসম্যান। কী ধরনের ব্যবসা করেন?
কনস্ট্রাকশনের। বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট হাউস, হাইরাইজ অফিস বিল্ডিং, সিনেমাহল, ব্রিজ–এইসব তৈরি করে আমার ফার্ম।
এর সঙ্গে ব্ল্যাকমানির সম্পর্ক কতটা?
ভীষণ হকচকিয়ে যায় সিতাংশু। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, অস্বীকার করব না, কিছুটা তো রয়েছেই। ইন্ডিয়াতে এমন কোনো বিজনেস আপনি দেখাতে পারবেন না যার সঙ্গে ব্ল্যাক মানি ইনভলভড় নেই। দিস ইজ আ পার্ট অফ দি গেম। নান ক্যান হেল্প। একটু থেমে জিগ্যেস করে, হঠাৎ ব্ল্যাক মানির কথা জানতে চাইলেন?
বিয়ের পর বাড়িতে সি.বি.আই, আর ইনিকামট্যাক্স রেইড় হতে পারে সেটাই বুঝতে চাইছি।
হেসে হেসে হালকা গলায় সিতাংশু বলে, আজকাল এই রেইডগুলো হল স্টেটাস সিম্বল। এ দিয়ে প্রমাণ হয় ইউ আর সামবডি। তবে–
কী?
আমাদের মতো ছোটখাটো বিজনেসম্যানদের সি.বি.আই-ওয়ালারা কাউন্টই করে না। ভয় নেই, কেউ রেইড করতে আসবে না।
সিতাংশুকে লক্ষ করতে করতে অদিতি বলে, আমি কিছু কিছু ওল্ড ভ্যালুজে বিশ্বাসী। মানুষের, বিশেষ করে প্রিয়জনদের মধ্যে মিনিমাম অনেস্টিটুকু দেখলে আমার আনন্দ হয়।
ব্যস্তভাবে সিতাংশু বলে, আমিও সেন্ট পারসেন্ট অনেস্ট থাকতে চাই। কিন্তু ওই যে একটু আগে বললাম, ব্ল্যাক মানি ছাড়া বিজনেসে একটা স্টেপও ফেলা যায় না। অনেস্টি নিয়ে চললে সাতদিনে আমার কোম্পানি বন্ধ করে দিতে হবে। আর নিট রেজাল্ট হবে এই, চারশো ওয়ার্কার সঙ্গে সঙ্গে বেকার হয়ে যাবে। এই লোকগুলোর ভবিষ্যৎ কী, তারা কী খাবে, কী হবে তাদের ছেলেমেয়ের–এসবও তো মাথায় রাখতে হয়।
কিছুক্ষণ চিন্তা করে অদিতি বলে, অনেস্ট হওয়ার সমস্যাও তা হলে আছে দেখছি।
সিতাংশু বলে, আমাদের সোশিও-ইকনমিক প্যাটার্নটাই এরকম দাঁড়িয়ে গেছে। দু-একজন অনেস্ট হয়ে কী করবে?
ডিজঅনেস্টি যদি চারশোটা ফ্যামিলিকে বাঁচাতে পারে, তা হলে সততা নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলেনা কি বলেন?
সিতাংশু উত্তর দেয় না।
অদিতি বলে, এবার অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। আপনার একজাট বয়স কত?
বিরুদ্ধ পক্ষের উকিলের মতো উলটোপালটা জেরা করে অদিতি তার কাছ থেকে কোন গোপন তথ্য বের করে নিতে চাইছে, বোঝা যাচ্ছে না। সে সতর্ক ভঙ্গিতে জিগ্যেস করে, বয়েস জানতে চাইছেন কেন?
বলুন না—
চল্লিশের কাছাকাছি।
আমাদের দেশের পক্ষে বিয়ের বয়েসটা অনেক আগেই পার হয়ে এসেছেন। পুরোনো কাল হলে বানপ্রস্থর আগে স্টেজে চলে যেতেন। বলতে বলতে সামনের দিকে ঝুঁকে গলার স্বর অনেকটা নামিয়ে দেয়, এতদিন বিয়ে করেননি কেন?
হঠাৎ ভীষণ ঘাবড়ে যায় সিতাংশু। তার মতো একজন সফল স্মার্ট বিজনেসম্যানও উপযুক্ত উত্তরটি খুঁজে পায় না। কোনোরকমে সে বলে, আমি–আমি মানে
অদিতি তার চোখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে ছিল। আস্তে আস্তে বলে, আমি আপনার সম্বন্ধে একটা খবর পেয়েছি। সেটা কতদুর সত্যি, আদৌ সত্যি কিনা, আপনিই শুধু বলতে পারবেন। তিনটে বিয়ের কথাই মৃণালিনী তাকে জানিয়েছেন কিনা, সে মনে করতে পারল না। অবশ্য সিতাংশু তিনটে করুক কি দশটা করুক সংখ্যায় তার কিছু এসে যায় না।
কী খবর?
আপনি আগে তিনবার বিয়ে করেছেন। একবার ডিভোর্স হয়েছে। একবার
অদিতির কথা শেষ হবার আগেই সিতাংশু বলে ওঠে, প্রথম বিয়েটা হয়েছিল নামমাত্র। অ্যাডজাস্টমেন্ট হল না, বছরখানেকের ভেতর আমরা মিউঁচুয়ালি সেপারেশন করে নিই।
আদিতি বলে, আর সেকেন্ড ম্যারেজ? শুনেছি মিস্টিরিয়াস অবস্থায় আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী আগুনে পুড়ে মারা যান। ব্যাপারটা থানা পুলিশ পর্যন্ত নাকি গড়িয়েছিল?
সিতাংশুর কপালে দানা দানা ঘাম জমতে থাকে। রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে সে বলে, কে আপনাকে এসব বাজে খবর দিয়েছে, জানি না। মনে হয়, বিজনেসে আমার যারা শত্রুপক্ষ তারাই এভাবে ক্যারেক্টার অ্যাসাসিনেশন করছে। ইটস আ ডার্টি সোন্ডারিং এগনেস্ট মি। আসলে ঘটনাটা খুবই আনফরচুনেট। একটা গ্যাস সিলিন্ডার বাচঁ করে রমলা, মানে আমার দ্বিতীয় স্ত্রী মারা যায়। এ নিয়ে থানা-পুলিশের ইনভলভমেন্টটা সম্পূর্ণ মিথ্যে। একটানা দম-আটকানো গলায় বলে যায় সে।
অদিতি বলে, আপনার মতো একজন বিশিষ্টি শিক্ষিত ভদ্রলোক যখন বলছেন তখন তা বিশ্বাস করা উচিত। আমিও করলাম। এবার থার্ড ম্যারেজের কী গতি হল বলুন।
অদিতির দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছিল না সিতাংশু। ঘাড় ভেঙে তার মাথা বুকের ওপর ঝুলে পড়েছে যেন। সে বলে, সেটাও আমার পক্ষে খুবই দুর্ভাগ্যজনক। রেখার সঙ্গেও শেষ পর্যন্ত অ্যাডজাস্ট করা গেল না। কোর্ট থেকে আমরা ডিভোর্স নিয়েছি বছর তিনেক আগে।
তৃতীয় বিয়েটার কথা স্রেফ আন্দাজেই বলেছে অদিতি। দেখা গেল, সেটাও লেগে গেছে। কে জানে, আরও ডজনখানেক বিয়ে সিতাংশু করে বসে আছে কিনা। অদিতি অত্যন্ত শান্ত নিস্পৃহ মুখে বলে, আপনি যে কোনো কিছু না লুকিয়ে সব কথা ফ্রাঙ্কলি জানিয়েছেন, সে জন্য অনেক ধন্যবাদ।
গল গল করে ঘামতে ঘামতে এবং সেই ঘাম মুছতে মুছতে সিতাংশু বলে, লুকোবার কী আছে? যা ঘটেছে তা একদিন-না-একদিন জানাজানি হয়ে যাবেই। আমি আর কদিন চাপা দিয়ে রাখতে পারব?
দ্যাট শুড বি দ্যা স্পিরিট। অদিতি বলতে থাকে, আরও কিছু খবর আমার কানে এসেছে। যদিও কোনোরকম রিউমার আমি গ্রাহ্য করি না, তবু ব্যাপারটা আপনার কাছ থেকে শুনলে আপনাকে বুঝতে আমার পক্ষে সুবিধে হয়।
আমার সম্বন্ধে আর কী শুনেছেন? সিতাংশুর চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠতে থাকে।
অদিতি কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলে, সংকোচ হচ্ছে, তবু বলি। শুনেছি, কয়েকটা ফ্ল্যাট কিনে আপনি চার-পাঁচজন রক্ষিতা রেখেছেন।
দ্রুত মাথা তোলে সিতাংশু। তার মুখ থেকে পরতে পরতে রক্ত নেমে গিয়ে একেবারে ফ্যাকাশে দেখায়। ঝাপসা গলায় সে বলে, কারা কারা এসব রটিয়ে বেড়াচ্ছে? দিজ আর অ্যাবসোলুটলি ফলস্।
অদিতি হাসে, আপনার চোখ-মুখ কিন্তু অন্য কথা বলছে মিস্টার ভৌমিক।
কী বলতে চাইছেন আপনি?
যা বলার তা তো বলেই ফেলেছি। তার মধ্যে কোনোরকম অস্পষ্টতা নেই। বিয়ের ব্যাপারে আপনি যেভাবে বললেন, আশা করি রক্ষিতাদের বিষয়েও ঠিক সেইরকম ফ্রাঙ্ক হবেন।
কয়েক সেকেন্ড আগে মুখটা একেবারে রক্তশূন্য হয়ে গিয়েছিল। এবার শরীরের সব রক্ত সেখানে উঠে এসে মুখটাকে ভয়ংকর করে তোলে। সে বলে, কে আপনাকে এ খবর দিয়েছে?
যে-ই দিক, তার নাম বলব না। কথাটা সত্যি কিনা সেটুকুই শুধু জানতে চাইছি।
সিতাংশু উত্তর দেয় না। তার চোয়াল পাথরের মতো শক্ত হয়ে ওঠে।
অদিতি বলে, ভিকটোরিয়ান মরালিটি বলতে যা বোঝায় আমি তা নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাই না। মানুষের বায়োলজিক্যাল প্রয়োজনটা বাস্তব ব্যাপার। নীতি-টীতি দিয়ে সেটা ঠেকিয়ে রাখা যায় না। এনিওয়ে আপনার হয়তো বলতে সংকোচ হচ্ছে। ধরেই নিলাম, এ ব্যাপারে যা শুনেছি, সেটা রিউমার নয়।
মুখের কাঠিন্য বাড়তে থাকে সিতাংশুর। রুক্ষ গলায় সে বলে, সেটা ডেফিনিটলি রিউমার।
আপনি তা হলে ওই ব্যাপারটা অস্বীকার করছেন?
নিশ্চয়ই।
তা হলে এই টপিকটা থাক।
আচ্ছা
বলুন।
আমার সম্বন্ধে সোন্ডারিং-এর খবরই শুধু আপনার কানে এসেছে। একটাও ভালো ইনফরমেশন পাননি?
চমকে ওঠার মতো ভঙ্গি করে অদিতি বলে, পেয়েছি বইকি, অবশ্যই পেয়েছি।
সিতাংশুকে কিছুটা উৎসুক দেখায়, তবে মুখের সেই কঠোরতা কমে না। সে বলে, কী পেয়েছেন?
আপনি অত্যন্ত দয়ালু। আপনার মতো হৃদয়বান মানুষ খুব বেশি দেখা যায় না।
সিতাংশু হকচিকয়ে যায়। একটু আগে যে অদিতি রক্ষিতাদের ব্যাপারে উলটোপালটা প্রশ্ন করে যাচ্ছিল, সে এই মুহূর্তে কোমল গলায় এমন কিছু বলছে যার জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিল না সিতাংশু। মেয়েটাকে একেবারেই বোঝা যাচ্ছে না। এক প্রসঙ্গ থেকে এত দ্রুত অভাবনীয় এমন একদিকে সে সরে যাচ্ছে যে খেই রাখা সম্ভব হচ্ছে না। বিমূঢ়ের মতো সিতাংশু বলে, মানে?
শুনেছি কেউ বিপদে পড়লে আপনি টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করেন।
মুখের সেই কর্কশ কাঠিন্য এখন আর নেই সিতাংশুর। লাজুক হেসে নরম গলায় সে বলে, না না, ওটা এমন কিছু ব্যাপার না। কারও দুঃখের দিনে যদি পাশে গিয়ে না-দাঁড়াই সোসাইটিতে বাস করা কেন? সামাজিক কিছু দায়দায়িত্বও তো থাকা দরকার।
একজাক্টলি সো? অদিতি আস্তে মাথা নেড়ে বলতে থাকে, আচ্ছা মিস্টার ভৌমিক
বলুন।
এখনও পর্যন্ত কত লোককে আপনি সাহায্য করেছেন?
এই মূহুর্তে অত্যন্ত পরিতৃপ্ত এবং খুশি দেখাচ্ছে সিতাংশুকে। অদিতি যে পরোপকারের কারণে তার সম্বন্ধে শ্রদ্ধাশীল সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে। বিপন্ন দুঃস্থ মানুষকে সাহায্য করার খবর তাকে কে দিয়েছে, কে জানে! যে-ই দিয়ে থাক, সিতাংশু তার কাছে কৃতজ্ঞ। যদিও সাহায্যের ব্যাপারটা কতখানি সত্যি, সে-ই সব চেয়ে ভালো জানে। সিতাংশু বুঝতে পারে অদিতি এমন একটি মেয়ে মোটা ব্যাঙ্ক ব্যালান্স, দামি গাড়ি-বাড়ি, বিলাসের উপকরণ বা অঢেল আরাম দিয়ে যার মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া যাবে না। যাকে সে শ্রদ্ধা করতে পারবে তেমন একটি পুরুষকেই শুধু বিয়ে করবে। সিতাংশু মনে মনে ঠিক করে ফেলে তার সম্পর্কে অদিতির যে দুর্বলতাটুকু দেখা দিয়েছে সেটাকে টোকা মেরে মেরে উসকে দেবে।
সিতাংশু বলে, এসব জিগ্যেস করলে খুব লজ্জা পাই। আমার সারপ্লাস কিছু টাকা আছে। লোকের দরকারে দিই। কাকে দিলাম, কেন দিলাম–সেসব মনে করে রাখি না।
অদিতি বলে, তাই তো উচিত। যারা কিছু দিয়েই ঢাক পিটিয়ে প্রচারে নামে তাদের আমি খুব ঘৃণা করি। যাই হোক, আপনি মনে করে না রাখলেও আমি তিনজনের নাম বলে দিতে পারি যাদের আপনি প্রচুর টাকা দিয়েছেন।
সিতাংশু একটু অবাক হয়েই বলে, তারা কারা?
অদিতি বলে, আবার বাবা আর দুই দাদা
সিতাংশু কীসের একটা সংকেত পেয়ে চমকে ওঠে। স্থির চোখে অত্যন্ত সতর্ক ভঙ্গিতে অদিতিকে লক্ষ করতে থাকে।
অদিতি বলে, বাবা আর দাদাদের কত টাকা দিয়েছেন আপনি?
তার কণ্ঠস্বরে একটু আগের কোমলতা নেই, চাপা তীব্রতা বেরিয়ে আসছে সেখান থেকে।
আক্রমণটা এমনই আকস্মিক যে কী উত্তর দেবে, প্রথমটায় বুঝে উঠতে পারে না সিতাংশু। কোনোরকমে বলে, আপনি মানে
চোখ মুখ ক্রমশ ধারালো হয়ে উঠতে থাকে অদিতির। সে বলে, আমার কথার উত্তর দিন। কত টাকা দিয়েছেন? কারেক্ট ফিগারটা আমি জানতে চাই।
অদিতির বলার ধরনে এমন একটা কর্তৃত্ব রয়েছে যা সিতাংশুকে প্রায় মাটিতে নুইয়ে রাখে। সে মিনমিনে গলায় কিছু একটা বলতে চেষ্টা করে, কিন্তু তার একটি বর্ণও বোঝা যায় না।
অদিতি একটু ভেবে বলে, আপনার তো আবার দান-টান করে কিছুই মনে থাকে না। আমি হেল্প করছি। আশা করি মনে পড়ে যাবে। বাবা আর দাদাদের এখনও পর্যন্ত সাড়ে চার। লাখ টাকার মধ্যে দিয়েছেন। তাই না? ভুল হলে কারেক্ট করে দেবেন।
সিতাংশু চুপ করে থাকে।
অদিতি থামেনি, এতগুলো টাকার কী গতি হয়েছে আপনি কি জানেন?
সিতাংশু এবারও উত্তর দেয় না।
অদিতি বলতে থাকে, ডেফিনিটলি আপনি জানেন কিন্তু আমাকে বলতে বোধহয় আটকাচ্ছে। ঠিক আছে, তবু আরেকবার বলা যাক। বাবা শেয়ার মার্কেটের ফাটকাবাজিতে আর দুই দাদা রেস গ্যাম্বলিং উইম্যানজিংয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। আমার ধারণা, এইসব মহৎ উদ্দেশ্যে বাবা দাদারা চাইলে আরও টাকা আপনি দেবেন। কারেক্ট? একটু থেমে পরক্ষণেই আবার সে শুরু করে, মিস্টার ভৌমিক, লোকে দু-পাঁচশো, বড়জোর হাজার দু-হাজার পর্যন্ত দান-টান করে। কিন্তু বিনা স্বার্থে সাড়ে চার লাখ টাকা দিয়ে বসেছে, এমন দানবীরকে চোখে তো দেখিইনি, নামও শুনেনি। আমার ধারণা–
এতক্ষণে সিতাংশুর গলা থেকে একটি মাত্র শব্দ বেরিয়ে আসে, কী?
নিশ্চয়ই স্ট্যাম্পড কাগজে বাবা-দাদাদের দিয়ে সই করিয়ে এই টাকাগুলো আপনি দিয়েছেন। সেখানে কী কী শর্ত আছে, মোটামুটি আন্দাজ করতে পারি।
একটা ঢোক গিলে সিতাংশু বলে, বুঝতেই পারেন, এতগুলো টাকা
ডেফিনিটলি পারি। অদিতি বলতে থাকে, শর্তগুলো কি এইরকম? সাড়ে চার লাখ টাকা ইন্টারেস্ট সুষ্ঠু পার্টিকুলার একটি পিরিয়ডের ভেতর ফেরত দিতে না পারলে, আরও কিছু টাকা দিয়ে এই বাড়িটা আপনি দখল করবেন
মানে আমি তো একজন বিজনেসম্যান। তাই
সিতাংশুর কথা শেষ হবার আগেই হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেয় অদিতি, লেট মি ফিনিশ। প্রথম দিকে হয়তো আপনার ইচ্ছে ছিল, এই বিরাট কম্পাউন্ডওলা বাড়িটার পজেশন নিয়ে পুরোনো বিল্ডিং ভেঙে এখানে হাইরাইজ বিল্ডিং বানিয়ে বেচে দেবেন। তাতে মিনিমাম পঞ্চাশ লাখ টাকা লাভ হবে। আফটার অল, ইউ আর ইন দা কনস্ট্রাকশান বিজনেস। কি, ঠিক বলছি?
সিতাংশু স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। এই মেয়েটির সঙ্গে আগে কখনও আলাপ হয়নি। রমাপ্রসাদ, বরুণ এবং মৃগাঙ্কর সঙ্গে তার যা কথাবার্তা হয়েছে সেটা এতই গোপন যে কারো পক্ষেই তার আঁচ পাওয়া আদৌ সম্ভব নয়। কিন্তু অদিতি টের পেল কী করে? যদি তার নিয়মিত যাতায়াত এবং রমাপ্রসাদের টাকা দেওয়া থেকে এ-সব ধরে নিয়ে থাকে তা হলে বুঝতে হবে অদিতির মতো অসাধারণ বুদ্ধিমতী এই পৃথিবীতে খুব বেশি নেই।
সিতাংশু কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই অদিতি আবার শুরু করে, এবার শুনুন, তার পরের স্টেজটা এরকম হয়েছিল কিনা। হাইরাইজ বিল্ডিয়ের ব্যাপারটা প্ল্যান করতে করতে হঠাৎ আপনার নজর এসে পড়ে আমার ওপর। লোকে আমাকে সুন্দরীই বলে থাকে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় দু-একজন ফিল্ম ডিরেক্টর তাদের ছবিতে হিরোইন করার জন্য আমাদের বাড়ি পর্যন্ত হানা দিয়েছিল। মেয়েদের সম্বন্ধে আপনার উইকনেস আর লোভের তো শেষ নেই। আমাকে দেখেই আগের প্ল্যানটা অ্যাপসেট হয়ে যায়। আপনি বাবা আর দাদাদের নতুন করে প্রোপোজাল দেন। আমার সঙ্গে বিয়ে হলে সাড়ে চার লাখ টাকা ছেড়েও দিতে পারেন।
ভীষণ অস্বস্তি হতে থাকে সিতাংশুর। জিভ দিয়ে শুকনো খসখসে ঠোঁট দুটো চেটে অস্পষ্ট গলায় সে কী বলে, বোঝা যায় না।
অদিতি বলে, কিন্তু মিস্টার ভৌমিক, আপনার একটা পরিকল্পনাও সাকসেসফুল হবে না। প্রথমত, এই বাড়ি আপনি পাচ্ছেন না। যতরকমভাবে সম্ভব আমি বাধা দেব। আর আমার সঙ্গে বিয়ে! বলতে বলতে তার গলায় স্বর কয়েক পর্দা উঁচুতে উঠে যায়! ডিবচ, স্কাউলে, আ গাটার স্রাইপ-তোমার এতবড় সাহস আমাকে বিয়ে করতে চাও! গেট আউট, গেট আউট। আর কোনোদিন যেন তোমাকে এ-বাড়িতে না দেখি—
সিতাংশুর নাক মুখ ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে। শরীরের সমস্ত রক্ত একলাফে মাথায় চড়ে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে, ঠিক আছে কিন্তু কাজটা আপনি ভালো করলেন না–
কতটা খারাপ করেছি আর কতটা করা উচিত ছিল, আমি জানি। নাউ গেট আউট-বলে সোজা দরজার দিকে আঙুল বাড়িয়ে দেয়। জ্বলন্ত চোখে অদিতিকে দেখতে দেখতে উন্মাদের মতো এলোমেলো পা ফেলে বেরিয়ে যায় সিতাংশু।