১. নারী-জাগরণ-এর অফিসে

ভূমিকা – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

০১.

নারী-জাগরণ-এর অফিসে আজ প্রবল উত্তেজনা। শ-পাঁচেক মেম্বারের প্রায় সবাই দুপুর একটার মধ্যে চলে এসেছে। আশা করা যাচ্ছে, দুটোর ভেতর বাদবাকিরা এসে পড়বে। কেননা সভাপতি অমিতাদি তিনদিন আগেই বোর্ডে নোটিশ টাঙিয়ে কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন, আজ যার যত জরুরি কাজই থাক, সব ফেলে প্রতিটি মেম্বারকে দুটোর মধ্যে অফিসে হাজির হতে হবে। শুধু টাইপ-করা নোটিশ লাগিয়েই বসে থাকেননি অমিতাদি, প্রতিটি সদস্যকে আলাদা আলাদা করে আসতে বলেছেন। যাদের এ-কদিন অফিসে দেখা যায়নি, তাদের বাড়ি বাড়ি লোক পাঠিয়ে খবর দিয়েছেন।

নারী-জাগরণ মেয়েদের একটি সমিতি। সমাজের সকল স্তরে নারীর মর্যাদা এবং সম্মান রক্ষার জন্য এরা কাজ করে চলেছে। নারী প্রগতি, নারী স্বাধীনতায় এরা বিশ্বাসী। মেয়েদের ওপর যেখানেই অন্যায় বা নির্যাতন চলে সমিতি তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। মেয়েরা পারিবারিক এবং সামাজিক দিক থেকে কোন লেভেলে পড়ে সেই সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করে তোলার দায়িত্ব এরা নিয়েছে।

নারী-জাগরণ-এর মেম্বার প্রধানত মহিলারাই। তবে সমধর্মী কিছু পুরুষ, যারা ভারতবর্ষের মতো পিছিয়ে-থাকা দেশে মেয়েদের হাজার রকম সমস্যা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করে–এই সমিতির সভ্য হয়েছে। এরা সমাজের সকল স্তরে মেয়েদের সমানাধিকার দাবি করে। পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরা একইরকম মর্যাদা নিয়ে চলবে, এটাই তাদের কাম্য।

নারী-জাগরণ-এর অফিসটা দক্ষিণ কলকাতার নিরিবিলি এক রাস্তায়। বড় কম্পাউন্ডওলা একতলা বাড়ি, সামনে অনেকটা খোলামেলা জায়গা জুড়ে সবুজ ঘাস। চারদিকে প্রচুর গাছপালা এবং অসংখ্য পাখি। কলকাতার মতো শহরে যেখানে প্রতিদিন পপুলেশন এক্সপ্লোশান অর্থাৎ জনবিস্ফোরণ ঘটে চলেছে, মানুষ বাড়ছে হু-হুঁ করে, মাথাপিছু যেখানে দশ স্কোয়ার ফিটও বরাদ্দ নেই সেখানে এরকম একটা জায়গার কথা ভাবা যায় না।

অফিসবাড়িটায় সবসুদ্ধ সাতখানা ঘর। দুটো ঘর নিয়ে চমৎকার একখানা লাইব্রেরি। অন্য ঘরগুলোতে নারী-জাগরণ-এর নানা ডিপার্টমেন্ট। এইসব ঘরের দেয়াল জুড়ে উঁচু উঁচু আলমারি। আলমারিগুলো নানারকম এবং ফাইলপত্রে ঠাসা। মেয়েদের নিয়ে সারা ভারতে যেখানে যা যা ঘটনা ঘটে চলেছে, এবং খবরের কাগজে এ-বিষয়ে যেসব রিপোর্ট বেরুচ্ছে। ফাইলগুলোতে তার কাটিং সাজানো রয়েছে। এছাড়া প্রতিটি ঘরেই রয়েছে টেবিল-চেয়ার, টাইপরাইটার ইত্যাদি।

আজ অমিতাদি সবাইকে জরুরি তলব করে যে ডেকে এনেছেন তার কারণ এইরকম। দুদিন আগে বালিগঞ্জের এক দামি, অভিজাত পাড়ায় দাবি অনুযায়ী পণ দিতে না পারায় একটি বধূকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। বধূ-হত্যার প্রতিবাদে আজ দুটোয় নারী-জাগরণ মিছিল বার করবে। সদস্যরা না এলে মিছিল হবে কী করে?

একসঙ্গে এতজন মেম্বার এসে পড়ায় অফিসে জায়গা হয়নি। বেশিরভাগই বাইরের সবুজ জমিতে বসে আছে। মিছিলে নিয়ে যাবার জন্য কয়েকজন পোস্টারে স্লোগান লিখছে। বাকিরা দুদিন আগের বউ-পোড়ানোর ঘটনা নিয়ে তুমুল চেঁচামেচি করেছে। টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরির শেষের দিকে এরকম জঘন্য ঘটনা যে ঘটতে পারে-~এর চাইতে লজ্জার কী হতে পারে! এই কলকাতায়, যেখানে একশো-সোয়াশো বছর আগেই নারীমুক্তির জন্য আন্দোলন হয়েছে, আজ সেখানেই কিনা পুত্রবধূ পোড়ানো হচ্ছে! ভাবা দরকার সোসাইটি সামনের দিকে কতটা এগিয়েছে, নাকি মধ্যযুগের বর্বরতায় ফিরে যাচ্ছে? এর প্রতিকার এখনই করা দরকার, ইত্যাদি।

অফিসের সামনের বড় ঘরটায় গ্লাস-টপ অর্ধবৃত্তাকার একটি টেবলের ওধারে বসে ছিলেন নারী-জাগরণ-এর প্রেসিডেন্ট অমিতাদি-অমিতা সরকার। তিনি মুখে মুখে ডিটেশন দিয়ে যাচ্ছেন।

তাঁর মুখোমুখি টেবিলের ধারে বসে মুখ নীচু করে নোট নিয়ে যাচ্ছে একটি মেয়ে–অদিতি।

এঘরে আরও কয়েকটি তরুণ-তরুণীকেও দেখা যাচ্ছে। তাদের কেউ ফাইল ঠিক করে রাখছে, কেউ খবরের কাগজের কোনো দরকারি রিপোর্ট কাঁচি দিয়ে কাটছে, কেউবা সামনের আলমারি থেকে লাল শালুর ফেস্টুন বার করছে। ফেস্টুনটায় বড় বড় হরফের লেখা আছে-নারী-জাগরণ।

অমিতাদি যে ব্যাপারে ডিকটেশন দিচ্ছেন সেটা হল একটা মেমোরেন্ডাম অর্থাৎ স্মারকলিপি মিছিলটা দক্ষিণ কলকাতা ঘুরে শেষপর্যন্ত রাইটার্স বিল্ডিংসে যাবে। সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে এই স্মারকলিপি দেওয়া হবে।

এবার অমিতাদির দিকে ভালো করে তাকানো যেতে পারে। তার বয়েস পঞ্চান্নছাপ্পান্ন। কাঁচা-পাকা চুল ছেলেদের মতো ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা।

বাঙালি মেয়েদের তুলনায় তাঁকে লম্বাই বলা যায়। হাইট পাঁচ ফিট ছয় কি সাত। গায়ের রং বাদামি, নাক-মুখ কাটা কাটা, ধারালো চিবুক। চোখে ভারী ফ্রেমের চশমা, পুরু লেন্সের ওধারে ঝকঝকে তীক্ষ্ণ চোখ। বাঁ হাতে চওড়া স্টিল ব্যান্ডের চৌকো ইলেকট্রনিকস ঘড়ি ছাড়া সারা শরীরে গয়না-টয়না বলতে কিচ্ছু নেই।

অমিতাদির পরনে পুরুষদের মতো ট্রাউজার্স আর হাতা গোটানো ফুলশার্ট, পায়ে চপ্পল। পুরুষ এবং নারীর কোনোরকম পার্থক্য তিনি মানেন না। এমনকি পোশাকের বেলাতেও না।

তাঁর হাতে এই মুহূর্তে রয়েছে একটি জ্বলন্ত সিগারেট। সামনের অ্যাশট্রেটা পোড়া সিগারেটের টুকরোয় প্রায় বোঝাই।

অমিতাদি চেইন স্মোকার। তাঁর হাতে সিগারেট নেই, এমন দৃশ্য আদৌ চোখে পড়ে না।

তিনি ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতি পড়ান। পুরু চশমা, শার্ট-ট্রাউজার্স, সিগারেট, মাথায় বয়েজ-কাট চুল–সব মিলিয়ে অমিতাদিকে ঘিরে রয়েছে প্রচণ্ড এক ব্যক্তিত্ব।

অমিতাদির জীবনের গ্রাফটি বিচিত্র। সেখানে প্রচুর বাঁক এবং উত্থান-পতন। সতেরো বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। পৈতৃক পদবি সরকার পালটে তিনি হয়েছিলেন অমিতা দত্ত। কিন্তু সেই বিয়েটা তিন বছরের বেশি স্থায়ী হয়নি।

যে ফ্যামিলিতে তিনি বধু হয়ে যান সেটা ছিল বেজায় গোঁড়া, প্রচণ্ড রক্ষণশীল এবং তেমনি তাদের শুচিবাই। উত্তর কলকাতার যেটা তাঁর শ্বশুরবাড়ি সেটা মুঘল হারেমের চাইতেও দুর্ভেদ্য। ছোট ছোট জানলায় একদিকে থাকত তারের জাল, আরেক দিকে মোটা পর্দা। যেদিকে তাকানো যাক, দরজায় জানলায় শুধু পর্দা আর পর্দা।

বাড়ি থেকে এক-পা বেরুবার উপায় ছিল না, এমনকী বাপের বাড়িতেও পুজোয় আর জামাইষষ্ঠীতে এই দুবারের বেশি যেতে দেওয়া হত না। একা স্বামীর সঙ্গে বেরুনোও নিষিদ্ধ। সিনেমা থিয়েটারে যেতে হলে পাহারাদার হিসেবে যেত শাশুড়ি কি খুড়শাশুড়ি কিংবা বিধবা বড় এক ননদ। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা অমিতাদিকে বাড়িঘর এবং আসবারের মতো একটা পারিবারিক সম্পত্তি মনে করতেন। তাঁর আলাদা যে এক অস্তিত্ব আছে, এটা কেউ ভাবতেও চাইতেন না।

তিন বছর সেই দুর্গে আটকে থেকে যখন অমিতাদির দম বন্ধ হয়ে আসছে সেই সময় একদিন মরিয়া হয়ে বাপের বাড়ি পালিয়ে এসেছিলেন। আর কোনোদিন স্বামীর কাছে ফিরে যাননি। আশ্চর্য, স্বামী বা শ্বশুর তাঁর খোঁজখবর করতে একবারও বাবার কাছে আসেননি। শেষপর্যন্ত বাবা ডিভোর্সের জন্য অ্যাপিল করেন। কিন্তু এবারও স্বামী বা শ্বশুরকে কোর্টে দেখা যায়নি। একতরফা মামলা চালিয়ে জিতে যান অমিতাদিরা এবং মসৃণভাবে তাঁর বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে যায়। আসলে স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে আর বিনা অনুমতিতে যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। তাকে ফিরিয়ে নেবার মতো বিন্দুমাত্র আগ্রহবোধ করেননি শ্বশুরবাড়ির লোকেরা।

এরপর অমিতাদির বাবা আবার তাঁর বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি রাজি হননি। প্রথম বিয়ের আগে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন। নতুন করে এই ঝঞ্ঝাটে না গিয়ে তিনি সোজা কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, বাবা চিরকাল থাকবেন না, বাবার কিছু ঘটলে কে তাঁকে আশ্রয় দেবে? কোথায় পাবেন নিরাপত্তা?

পরের মুখাপেক্ষী না-হয়ে বেঁচে থাকতে হলে তাঁর প্রয়োজন সম্মানজনক কোনো চাকরি-বাকরি। কিন্তু সামান্য একজন ম্যাট্রিকুলেটকে কে কাজ দেবে?

চার বছর কলেজে এবং দু-বছর ইউনিভার্সিটিতে মোট ছটা বছর চোখের পলকে যেন কেটে গিয়েছিল। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়েই অমিতাদি কলেজে লেকচারারশিপ পেয়ে যান। সেখানে বছর সাতেক পড়াবার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়ে চলে আসেন। এই সময় তাঁর জীবনে আসে আরেকটি পুরুষ–বিমলেশ।

বিমলেশের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে অমিতাদির বিয়ে হয়নি। স্বামী-স্ত্রীর মতো তাঁরা একসঙ্গে কিছুদিন কাটিয়েছেন কিন্তু সম্পর্কটা একেবারেই স্থায়ী হয়নি। কেন না তখন তিনি জানতেন না বিমলেশ বেজায় অলস এবং প্রচণ্ড মাতাল। পাকস্থলীতে হুইস্কিটা বেশি পরিমাণে ঢুকে গেলে সে ভায়োলেন্ট হয়ে উঠত। তার ওপর একসঙ্গে মাস তিনেক কাটাবার পর সে দুম করে চাকরি ছেড়ে দেয় এবং অমিতাদির কাঁধে চড়ে বসে। তার ধারণা ছিল চিরকাল অমিতাদি তাকে পুষবেন আর মদের পয়সা যোগাবেন। অতিষ্ঠ অমিতাদি একদিন তাকে বাড়ি থেকে বার করে দেন। সেই থেকে পুরুষ সম্পর্কে তাঁর ধারণা আগাগোড়া পালটে যায়। বিশেষ করে বিবাহিত এবং অবিবাহিত দাম্পত্য জীবন সম্বন্ধে তাঁর কোনোরকম মোহ বা আকর্ষণ থাকে না। এ ব্যাপারে তাঁর পুরোপুরি স্বপ্নভঙ্গ ঘটে যায়।

আজকাল অমিতাদি যে অনবরত সিগারেট খান, শার্ট-ট্রাউজার্স পরেন~-এ-সবই এক ধরনের প্রোটেস্ট। নারী জাগরণ-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি পুরুষের প্রভুত্ব, স্বার্থপরতা আর নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে যুদ্ধই ঘোষণা করেছেন বলা যায়।

অমিতাদি প্রেসিডেন্ট হলেও টেবিলের ওধারে বসে যে মেয়েটি (অর্থাৎ অদিতি) ডিকটেশন নিচ্ছে সে-ই এই কাহিনির প্রধান চরিত্র।

অদিতি নারী-জাগরণ-এর একজন অত্যন্ত সক্রিয় কর্মী। তার বয়েস পঁচিশ-ছাব্বিশ। গায়ের রং ডিমের ভেতরকার কুসুমের মতো। টান টান সতেজ চেহারা। লম্বাটে মুখ, নাক সটান কপাল থেকে নেমে এসেছে। উজ্জ্বল চোখ তার, রাজহাঁসের মতো গলা, নিটোল হাতে কোথাও এতটুকু ভাঁজ নেই। দীর্ঘ ঘন চুল এলোমেলোভাবে একটি খোঁপায় আটকানো।

পরনে হালকা রঙের তাঁতের শাড়ি এবং হলুদ ব্লাউজ। অমিতাদির মতোই তার হাতে একটি ঘড়ি ছাড়া আর কোনো গয়না-টয়না নেই। এতেই তাকে অলৌকিক মনে হয়। তার চেহারায় অভিজাত্যের সঙ্গে ব্যক্তিত্ব মিশে আছে।

অদিতি একটা কলেজে ইংরেজি পড়ায়। এমন এক পরিবার থেকে সে এসেছে, যার ইতিহাস রীতিমতো জটিল। কিন্তু সেকথা এখন না, পরে বিস্তৃতভাবে বলতে হবে।

একসময় ডিকটেশন নেওয়া শেষ হয়।

.

অমিতাদি বলেন, কৃষ্ণাকে মেমোরেন্ডামটা টাইপ করতে দাও। খুব তাড়াতাড়ি যেন করে দেয়। দশ মিনিটের ভেতর আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে।

অদিতি একটি মেয়েকে ডেকে স্মারকলিপির খসড়াটা তার হাতে দেয়। সে পাশের ঘরে টাইপ করতে চলে যায়।

অমিতাদি এবার অন্য একটি মেয়েকে বলেন, ইন্দ্রাণী, তুমি বাইরে গিয়ে একটু দেখো তো, ওদের পোস্টার লেখা হয়ে গেছে কিনা।

একটি তেইশ-চব্বিশ বছরের তরুণী ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, এবং কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে খবর দেয় পোস্টার লেখা শেষ করে সবাই অপেক্ষা করছে।

কৃষ্ণার টাইপ হয়ে গিয়েছিল। সে নারী-জাগরণ-এর একটা খাম এবং মেমোরেন্ডমটা নিয়ে এসে অমিতাদির হাতে দেয়। অমিতাদি দ্রুত একবার টাইপ-করা জায়গাটা দেখে, খামে পুরে মুখটা বন্ধ করে দেন। তারপর বলেন, অদিতি, কৃষ্ণা–এবার ওঠা যাক। অনেকটা রাস্তা আমাদের যেতে হবে। একজন গিয়ে দারোয়ানকে বলো, সে যেন অফিস বন্ধ করে দেয়।

নারী-জাগরণ-এর অফিসে একজন দারোয়ান এবং দুটি বেয়ারা রয়েছে। কম্পাউন্ডের পেছনদিকে যে সার্ভেন্টস্ কোয়ার্টাস আছে, তারা সেখানে বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকে।

উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অদিতি বলল, আমি কিন্তু আপনাদের সঙ্গে মিছিলে যাচ্ছি না অমিতাদি।

অমিতাদি রীতিমতো অবাকই হন। বলেন, কেন?

আজ ঢাকুরিয়ার বস্তিতে যাবার প্রোগ্রাম আগে থেকেই কিন্তু ঠিক করা আছে। ওখানে খবরও পাঠানো হয়েছে। বস্তির মেয়েরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে।

আপাতত নারী-জাগরণ-এর একটা বড় কাজ হল, কলকাতার বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে সেখানকার মেয়েদের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে তথ্য যোগাড় করা। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পারিবারিক দিক থেকে তারা কোন লেভেলে পড়ে আছে সে ব্যাপারে পুত্থানাপুঙ্খ খবর সংগ্রহ করে মোটা মোটা ফাইল তৈরি করা হচ্ছে। পরে এদের সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যায় তার জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। বস্তিবাসী মেয়েদের সমস্যা এতই জটিল, বিশাল এবং সুদূরপ্রসারী যে নারী-জাগরণ-এর মতো একটি ছোট প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কিছুই প্রায় করা সম্ভব নয়। এ জন্য সরকারি আর বে-সরকারি সাহায্য একান্ত জরুরি।

নারী-জাগরণ-এর তরফ থেকে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট আর মিনিস্ট্রির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। অমিতাদি, অদিতি এবং আরও কয়েকজন চারটি চেম্বার অফ কর্মাসের প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করেছেন। সব জায়গাতেই ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। সকলেই অসহায় মেয়েদের সম্পর্কে সহানুভূতি জানিয়ে বলেছেন, সঠিক প্রস্তাব পাওয়া গেলে তাঁরা অবশ্যই সাহায্য করবেন।

অমিতাদির মনে পড়ে যায়। তিনি বলেন, বউ পোড়ানোর এই ঘটনাটা নিয়ে এতই ডিসটার্বড় হয়ে ছিলাম যে ঢাকুরিয়ার প্রোগ্রামটার কথা মনে ছিল না। ঠিক আছে, তুমিই যাও। তোমার সঙ্গে আর কে কে যাবে?

ঘরের কোণে একটি ঝকঝকে চেহারার যুবক বই থেকে কিছু নোট করছিল। সে মুখ তুলে বলে, আমি অদিতির সঙ্গে যাব।

অমিতাদি হেসে বললেন, জানি বিকাশ। অদিতি যেখানে যাবে, তুমিও সঙ্গে থাকবে। তাঁর হাসিতে প্রশ্রয় এবং মজা দুই-ই রয়েছে।

বিকাশ বিব্রত মুখে বলে, না, মানে

অমিতাদি এবার জিগ্যেস করলেন, দুজনে তো হবে না। তোমাদের সঙ্গে কৃষ্ণা, রমেন আর এষা যাক। বলেই গলা তুলে ডাকতে লাগলেন, রমেন, এষা, এ ঘরে এসো

পাশের ঘর থেকে রমেন এবং এষা এঘরে চলে আসে। দুজনেরই বয়েস তিরিশের নীচে।

রমেন একটা ব্যাঙ্কে জুনিয়র গ্রেডের অফিসার। গোলগাল ভালোমানুষ চেহারা। এই মুহূর্তে তার পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি।

এষা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে উঁচু ক্লাসে ফিজিক্স পড়ায়। পোশাকের ব্যাপারে সে বেপরোয়া। তার পরনে জিন্স এবং টি-শার্ট, পায়ে পুরুষদের চম্পল। চুলে বয়েজ-কাট। পোশাকে এবং চালচলনে পুরুষদের সঙ্গে কোনোরকম পার্থক্যই সে রাখতে চায় না। দারুণ স্মার্ট আর ঝকঝকে চেহারা। অমিতাদির মতো চেইন স্মোকার না হলেও সিগারেটটা একটু বেশিই খায়। অবশ্য এই মুহূর্তে তার হাতে সিগারেট নেই।

অমিতাদি এষা এবং রমেনকে বললেন, আজ ঢাকুরিয়া বস্তিতে আমাদের একটা প্রোগ্রাম আছে। অদিতি আর বিকাশের সঙ্গে তোমাদের দুজনকে সেখানে যেতে হবে।

দুজনেই জানায়, বস্তিতে যেতে তাদের আপত্তি নেই।

অদিতি এষাকে লক্ষ্য করতে করতে হঠাৎ বলে ওঠে, এষা না গেলেই ভালো হয়।

অমিতাদি ভুরু কুঁচকে জিগ্যেস করলেন, কেন?

অদিতি যা উত্তর দেয় তা এইরকম। তারা যেখানে যাচ্ছে, এষার মতো পুরুষালি পোশাক এবং চুলের ছাট সেখানে একেবারেই খাপ খায় না। বস্তির মেয়েরা এতে একেবারেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে না। শামুকের মতো নিজেদের গুটিয়ে রাখবে। তারা যদি সহজভাবে কাছে এগিয়ে না আসে, তাদের সমস্যার কথা জানা যাবে কী করে?

এষা বিরক্ত হচ্ছিল। সে কিছুটা তীক্ষ্ণ গলায় বলে, ওরা শুধু আমার চুলের কাট আর জিন্স-টিন্স নিয়েই মাথা ঘামাবে? ওদের সম্পর্কে আমার সিম্প্যাথি আর সিনসিয়ারিটির কথা ভাববে না?

অদিতি কোনো কারণেই সহজে উত্তেজিত হয় না। শান্ত মুখে সে বলে, বস্তি নিয়ে আমি বছরখানেক কাজ করছি। ওখানকার মেয়েদের সাইকোলজি খানিকটা বুঝি। এমনভাবে ওখানে যাওয়া উচিত যাতে ওরা মনে করে আমরা ওদেরই লোক। না হলে কাজের কাজ কিছুই হবে না।

এষা ঝাঁঝালো মুখে কিছু বলতে যাচ্ছিল, হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেন অমিতাদি। অদিতি কী বলতে চেয়েছে, বুঝতে অসুবিধে হয়নি তাঁর। বলেন, ঠিক আছে, এষা আমাদের সঙ্গে চলুক। চিফ-মিনিস্টারের হাতে মেমোরান্ডমটা ও-ই দেবে। অদিতি, তুমি যাকে সুটেবল মনে করো, নিয়ে যাও।

.

মিনিট পনেরো পর অমিতাদি বিরাট মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। একেবারে সামনের দিকে লাল শালুর ফেস্টুনের দুই প্রান্ত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে দুজন মাঝবয়সি মহিলা সদস্য।

পাশাপাশি দুটি লাইন করে রাস্তার বাঁ ধার ঘেঁষে মিছিলটা চলছে। অনেকের হাতেই পোস্টার। যেগুলোতে নারী-স্বাধীনতা, নারী-নির্যাতন ইত্যাদি নানা বিষয়ে বড় বড় হরফে অনেক কথা লেখা আছে। দুই লাইনের মাঝখানে অনিমেষ আকাশের দিকে হাত ছুঁড়ে ছুঁড়ে স্লোগান দিতে দিতে যাচ্ছে। কণ্ঠস্বরে নানারকম উত্থান-পতন ঘটিয়ে স্লোগানটা সে চমৎকার দিতে পারে। তার কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে গোটা মিছিলটা গলা মিলিয়ে চিৎকার করে উঠছে।

পণপ্রথা–
বন্ধ করো, বন্ধ করো।
বধু হত্যা—
 চলবে না, চলবে না।
বন্ধু হত্যাকারীদের
শাস্তি চাই, শাস্তি চাই।
নারীর মর্যাদা-
 রক্ষা করুন, রক্ষা করুন।

স্লোগান দিতে দিতে মিছিল গোল পার্কের দিকে এগিয়ে যায়। এদিকে অদিতিও বেরিয়ে পড়েছিল। তার সঙ্গে রয়েছে বিকাশ, রমেন এবং অন্য একটি মেয়ে, বিশাখা। ওরাও ফেস্টুন এবং তিন-চারটে পোস্টার একটা বড় প্যাকেটে করে নিয়ে এসেছে। আর এনেছে নোটবুক, ক্যামেরা, টেপ-রেকর্ডার ইত্যাদি।

নারী-জাগরণ-এর অফিস থেকে ঢাকুরিয়ার বস্তি দু-আড়াই কিলোমিটার দূরে। ওরা খানিকটা বাসে, খানিকটা হেঁটে যখন সেখানে পৌঁছুল, বিকেল হয়ে গেছে।

.

০২.

ঢাকুরিয়ার এই বস্তি প্রায় মাইলখানেক জায়গা জুড়ে। ভাঙাচোরা টালি বা ফুটিফাটা টিনের চালার লাইন এঁকেবেঁকে নানা দিকে গেছে। প্রতিটি চালায় একটি করে ফ্যামিলি থাকে। মুখোমুখি দুই লাইনের মাঝখানে সঁতসেঁতে সরু গলি। সেগুলো একই সঙ্গে পায়ে চলার পথ এবং নর্মা। দু-ধারের ঘরগুলো থেকে থুতু, কফ, মাছের আঁশ, যাবতীয় আবর্জনা ওখানে ছুঁড়ে ফেলা হয়। এখানে-ওখানে বাচ্চাদের প্রাকৃতকর্মের কিছু চিহ্নও আকছার চোখে পড়বে। এখানকার বাতাসে একটা ঘন চাপ-বাঁধা দুর্গন্ধ সারাক্ষণ অনড় হয়ে থাকে।

এখানকার বাসিন্দাদের বেশির ভাগই বাঙালি। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা আর সুন্দরবন থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ভূমিহীন চাষি কাজকর্ম না পেয়ে এই বস্তিতে এসে উঠেছে। কলকাতায় এসে রোজগারের একটা-না-একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে এই ভরসায়। যাদের সামান্য জমিজমা ছিল, ঋণের দায়ে সেসব খুইয়ে তাদের অনেকেই চলে এসেছে। তারা এসেছে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িষা, মধ্যপ্রদেশ আর অন্ধের গরিব হাভাতে কিছু মানুষ। এদের সবারই বিশ্বাস, কলকাতা কাউকে ফেরায় না। কোনো-না-কোনোভাবে পেটের দানার ব্যবস্থা করে দেয়।

এখানকার পুরুষমানুষেরা অনেকেই সাইকেল-রিকশা চালায়, কেউ ঠেলাওলা, কেউ গ্যারেজে বাস-লরির ক্লিনার, কেউ হকার, কেউ চোর, কেউ বে-আইনি চোলাই বানিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে বিক্রি করে। এইভাবে নানারকম উঞ্ছবৃত্তি করে তারা পেট চালায়।

বস্তিটার ডানদিকে ঝকঝকে চওড়া একটা রাস্তার ওপারে পশ্চিমবঙ্গ আবাসন পর্ষদের বিশাল হাউসিং কমপ্লেক্স। সেখানে রয়েছে হাজার দেড়-দুই নানা টাইপের ফ্ল্যাট।

হাউসিং কমপ্লেক্সটার বাঁ-দিকে সাউথ ক্যালকাটার পশ লোকালিটি। ওখানে নিও রিচ বা নতুন বড়লোকদের একটা পাড়া স্বাধীনতার পর গজিয়ে উঠেছে। সেখানে অদ্ভুত অদ্ভুত আর্কিটেচারের দারুণ দারুণ সব বাড়ি। কিছু মানুষের হাতে কী পরিমাণ টাকা জমেছে, এখানে এলে টের পাওয়া যায়। বস্তি এবং বড়লোকদের পাড়ার মাঝখানে বাউন্ডারি লাইন হল সেই ঝকঝকে অ্যাসফাল্টের রাস্তাটা।

বস্তির পুরুষদের একার রোজগারে সংসার চলে না। তাই মেয়েদেরও হাউসিং কমপ্লেক্স আর পশ পাড়ায় কাজে বেরুতে হয়। বস্তিটা মেইড সারভেন্ট সাপ্লাইয়ের প্রকাণ্ড একটা আড়ত।

বস্তিটার ঠিক মুখেই পাশাপাশি দুটো জলের কল এবং একটা ল্যাম্পপোস্ট। বছর তিনেক আগে নির্বাচনের সময় কর্পোরেশন থেকে এখানে রাস্তার আলো এবং জলের ব্যবস্থা করা হয়। এই বস্তিবাসীরা সরকারি খাস জমিতে জবরদখল করে বসে গেছে কিন্তু এদের বেশির ভাগেরই বৈধ রেশনকার্ড এবং ভোট আছে। ভোট পেতে হলে একটু কিছু তো করতেই হয়।

জলের কল এবং ল্যাম্পপোস্টের ধার ঘেঁষে একটা নীচু টালির চালার তলায় চায়ের দোকান। দোকানটার সামনে দু-তিনটে নড়বড়ে বেঞ্চ পাতা। সেখানে আট-দশটা লোক চায়ের গেলাস হাতে নিয়ে বসে আছে।

ভেতরে উঁচু তক্তপোষে মাঝবয়সি পেটানো চেহারার একটি লোককে দেখা যাচ্ছে। তার সামনে ছোট টিনের ক্যাশবাক্স এবং অনেকগুলো কাঁচের বোয়েম সাজানো রয়েছে। সেগুলোতে রয়েছে শস্তা বিস্কুট, লজেন্স, মোয়া, বাদাম, হজমিগুলি ইত্যাদি। বাঁ-পাশে খেলো কাঠের র‍্যাকে রয়েছে গাদা গাদা বিড়ির বান্ডিল, চিড়ে-মুড়ি এবং বাজে বেকারির পাউরুটি।

দোকানটার এক কোণে প্রকাণ্ড উনুন জ্বলছে। সেটার পাশে বসে আছে বয়স্কা একটি মেয়েমানুষ। তার কপালে এবং সিঁথিতে ডগডগে সিঁদুর। তার সামনে একটা সিলভারের বড় পরাতে অনেকগুলো খালি চায়ের গেলাস, ডিশ-টিশ রয়েছে। পাশেই সারি সারি জলের বালতি। একটি কমবয়সি মেয়ে সেখানে এঁটো গেলাস-টেলাস ধুচ্ছে।

মধ্যবয়সি লোকটার নাম যুধিষ্ঠির, এই চায়ের দোকানটা তার। বয়স্কা মেয়েমানুষটি তারই স্ত্রী। গেলাস-টেলাস যে ধুচ্ছে সে তারই মেয়ে।

রাস্তার একটা বাঁক ঘুরে অদিতিরা চায়ের দোকানের সামনে চলে আসে। যুধিষ্ঠির তাদের জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল। তক্তাপোষ থেকে নেমে একরকম দৌড়েই বাইরে বেরিয়ে এল সে। উৎসুক মুখে বলে, এসেছেন দাদাবাবুরা, দিদিমণিরা–আসুন আসুন-বলে নিজেই টানা-হাচড়া করে চায়ের দোকানের একটা বেঞ্চ, একটা পুরোনো চেয়ার এবং উঁচু প্যাকিং বাক্স বার করে আনে, বসুন, বসুন–

এর আগেও বারচারেক এই বস্তিতে মেয়েদের সম্বন্ধে তথ্য যোগাড় করতে এসেছে অদিতিরা। প্রথম দু-বার কাজের কাজ কিছুই হয়নি। হুট করে এসে তারা মেয়েদের ডেকে ডেকে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছিল। এতে সবাই ভয়ানক ঘাবড়ে যায়। অদিতিরা অতিথিদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে এতই সন্দিন্ধ হয়ে ওঠে যে কেউ মুখ খোলেনি। এরা যদি কিছুই না-জানায় এখানে আসার মানে হয় না। যে বিপুল সমস্যার কেন্দ্রে তারা যেতে চায়, এরা কিছু না

দু-বার ফিরে যাবার পর তৃতীয় দিন এসে অদিতিরা যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে ভালো করে আলাপ জমিয়ে নেয়। তারা আগেই খবর পেয়েছিল যুধিষ্ঠির এই বস্তির একজন নেতাগোছের লোক। তার কথা মোটামুটি সবাই মেনে চলে। এখানে তার প্রচণ্ড দাপট।

স্থানীয় কারো সহযোগিতা না পেলে বস্তিতে আসা-যাওয়া সার হবে। অদিতিরা গোপনে যুধিষ্ঠিরকে কিছু টাকা দিয়ে জানিয়েছিল, তাদের সাহায্য করলে আরও প্রাপ্তির আশা আছে। কিছু না পেলে অকারণে পরোপকার করতে কে-ই বা চায়?

কাজেই অদিতিদের ব্যাপারে উৎসাহ বেড়ে গেছে যুধিষ্ঠিরের। অদিতিরা কবে আসবে, আগে থেকেই জানিয়ে যায়। সেদিন বিকেল-হতে-না হতেই সে তাদের জন্য অস্থির হয়ে থাকে।

বলামাত্রই বসে না অদিতিরা। প্রথমে লাল শালুর ফেস্টুন টাঙিয়ে দেয়। পোস্টারগুলোর সঙ্গে কাঠের খুঁটি আটকানো রয়েছে, সেগুলো মাটিতে পুঁতে দেয়। পোস্টারগুলোতে লেখা রয়েছে, নারী নির্যাতন বন্ধ করো, নারীকে সম্মান দিতে হবে, নারীর স্বাধীনতা চাই-ইত্যাদি ইত্যাদি।

যুধিষ্ঠির হইচই বাঁচিয়ে স্ত্রীকে দিয়ে চার কাপ ইস্পেশাল চা বানিয়ে আনে। প্লেটে আটখানা নোনতা বিস্কুট নিয়ে আসে তার মেয়েটা। সসম্ভমে বলে, দাদাবাবু, দিদিমণিরা, কাজ শুরুর আগে একটুস চা খেয়ে ল্যান-

অদিতিরা লক্ষ করেছে, টাকাপয়সা পাওয়ার পর থেকে যুধিষ্ঠিরের খাতিরের মাত্রাটা আচমকা বেড়ে গেছে। চা না খেলে রেহাই নেই। বাজে সময় নষ্ট না করে অদিতিরা চা-বিস্কুট নেয়। খেতে খেতে বলে, যুধিষ্ঠিরদা, দেরি করতে পারব না। আমরা এখনই কাজ শুরু করতে চাই।

যুধিষ্ঠির জানে, এবার তাকে কী করতে হবে। বস্তির মেয়েদের একজন একজন করে নিয়ে আসতে হবে। ঠিক করা আছে, রোজ পঁচিশ-তিরিশজন মেয়ের ইন্টারভিউ টেপ করা হবে এবং ক্যামেরায় তাদের ছবিও ভোলা হবে। যুধিষ্ঠির বলল, ঠিক আছে, আমি পাঁচ মিনিটের ভেতর একজনকে হাজির করে দিচ্ছি। বলে আর দাঁড়ায় না, লম্বা লম্বা পা ফেলে বস্তির মধ্যে ঢুকে যায়।

ভোটারদের লিস্ট দেখে অদিতিরা আগেই জেনে নিয়েছে, এই বস্তিতে সবসুদ্ধ তিন হাজার দুশো বাইশজন অ্যাডাল্ট মেয়েমানুষ রয়েছে। একদিনে তিরিশ-বত্রিশ জনের সঙ্গে কথাবার্তা বললে অন্তত একশো বার তাদের এখানে আসতে হবে।

প্রথম দু-দিন কোনো কাজ হয়নি। তার পরের দুদিনে চল্লিশ জনের ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছে। নতুন জায়গায় শুরু করতে হয়েছে বলে প্রথম প্রথম বেশি মেয়ের সঙ্গে কথা বলা যায়নি। তাদের আড়ষ্টতা এবং সন্দেহ ঘোচাতে বেশ খানিকটা সময় নষ্ট হয়েছে। তবে আজ থেকে সংখ্যাটা বাড়াতেই হবে।

চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। অদিতি বলে, এবার রেডি হয়ে নাও। যুধিষ্ঠিরদা এখনই ফিরে আসবে। বলতে বলতে একমাত্র চেয়ারটায় বসে পড়ে।

চেয়ারের সামনে উঁচু প্যাকিং বক্স। ওটা টেবিলের কাজ করবে। প্যাকিং বক্সের পর নড়বড়ে বেঞ্চটায় ভাগাভাগি করে বাকি তিনজন বসে পড়ে। তারপর ব্যাগ থেকে ক্যামেরা, নোটবুক এবং টেপ রেকর্ডার সাজিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।

অদিতিরা যেখানে বসে আছে সেখান থেকে বিশ-বাইশ ফুট দূরত্বে কর্পোরেশনের কদুটোতে এখন বিকেলের জল এসে গেছে। ওখানে এখন বিরাট লাইন। দেড়শো দুশো পুরুষ এবং মেয়েমানুষ বালতি হাঁড়ি ডেকচি পর পর বসিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য সময় হলে লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে এতক্ষণ তুলকালাম হয়ে যেত কিন্তু এখন কারো জলের দিকে নজর নেই, অপার কৌতূহল এবং বিস্ময় নিয়ে তারা অদিতিদের লক্ষ করছে।

যারা লাইন দেয়নি, এমন কিছু লোকজন একধারে দাঁড়িয়ে অদিতিদের দেখতে দেখতে জটলা করছিল। ফিসফিসিয়ে তারা এভাবে বলাবলি করছে।

একজন বলে, এই দাদাবাবু-দিদিমণিরা দু-চারদিন পর পর কী জন্যি আসছে?

নারী-স্বাধীনতার জন্যে। ওই তো লেখা আছে, নারী নিয্যাতন বন্ধ করো। নারীর মুক্তি চাই। বলে কিছুটা লেখাপড়া জানা একটি লোক আঙুল বাড়িয়ে একটা পোস্টার দেখিয়ে দেয়।

ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বল দিকিন।

ওই যে আমরা ঘরের মেয়েমানুষদের ঠেঙাই, সেটা বোধহয় এরা বন্ধ করতে চায়।

হাই ভগবান, মেয়েমানুষকে না ঠেঙালে কি বশে থাকে? হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে যাবে না?

যা বলেছ। বড়লোকের ছেলেমেয়েদের তো কাজ নেই। মাথায় পোকা নড়ে উঠেছে, অমনি বস্তির মেয়েমানুষদের জন্যে দরদ উথলে উঠেছে।

নেই কাজ তো খই ভাজ।

অদিতিদের ঘিরে এই মুহূর্তে বস্তির শ-খানেক ল্যাংটো-আধাল্যাংটো কাচ্চাবাচ্চা অপার কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদের বয়স তিন থেকে পাঁচের ভেতর। ইন্ডিয়াতে পপুলেশন এক্সপ্লোশান কী ধরনের হয়েছে তার কিঞ্চিৎ নমুনা ঢাকুরিয়ার এই বস্তিতে এলে টের পাওয়া যায়।

যদিও অদিতি চূড়ান্ত আশাবাদী এবং তার মধ্যে একটি অদম্য জেদ রয়েছে তবু চারপাশের এই অস্বস্তিকর পরিবেশে বসে নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে কতটা কী করতে পারবে, ভাবতেই খানিকটা হতাশ বোধ করে। পরক্ষণেই সব নৈরাশ্য ঝেড়ে ফেলে নিজেকে সজীব করে তোলে। এর মধ্যেই তাকে কাজ করতে হবে।

অদিতি বিকাশদের কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই দেখা যায় যুধিষ্ঠির বস্তির ভেতর থেকে একটি অবাঙালি মেয়েমানুষকে সঙ্গে করে তাদের কাছে নিয়ে এসেছে।

যুধিষ্ঠির অদিতিকে বলল, দিদিমণি, লছিমাকে নিয়ে এলাম। এখন একে দিয়েই শুরু করুন। পরে অন্যদের নিয়ে আসছি। অদিতিকে বলার কারণ আছে। কদিন লক্ষ করে যুধিষ্ঠির টের পেয়েছে, এই ছোট টিমটার সে-ই নেত্রী।

অদিতি বেশ সমাদর করেই লছিমাকে বলে, বসুন দিদি, বসুন—

বিকাশরা সরে গিয়ে গিয়ে অনেকটা জায়গা করে দেয়। লছিমা জড়সড় হয়ে বেঞ্চের একধারে অদিতির মুখোমুখি বসে পড়ে।

লছিমার বয়স বোঝার উপায় নেই। তাবে পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশের কম নয়। শক্ত গড়নের চেহারা তার, হাত-পায়ের হাড় মোটা মোটা। গাল খানিকটা ভেঙেছে, হনু দুটো বেশ উঁচু, গায়ের চামড়ায় যৌবনের উজ্জ্বলতা নেই, পেনসিলের অল্প টানের মতো সরু সরু দাগ পড়তে শুরু করেছে। চোখের কোলে হালকা কালির ছোপ। তবু তার মধ্যে লাবণ্যের সামান্য একটু তলানি এখনও অবশিষ্ট রয়েছে।

মুখটি সারল্যে মাখানো। ঘোমটাটা কপালের আধাআধি নেমে এসেছে। দুই ভুরুর মাঝামাঝি এবং হাতের পাতার পিছন দিকে অনেকগুলো উল্কি–তার কোনোটা পদ্ম, কোনোটা শঙ্খ, কোনোটা হরিণ বা পাখি। পরনে বিহার বা উত্তরপ্রদেশের দেহাতী ঢংয়ে রঙিন শাড়ি। হাতে রুপোর কাংলা, আঙুলে চাঁদির আংটি।

যদিও লাজুক, লছিমার চোখেমুখে কৌতুকের একটি হাসি যেন আটকে আছে।

চোখের ইশারায় বিকাশকে টেপ রেকর্ডার চালাতে বলে অদিতি সোজা লছিমার দিকে তাকায়, দিদি, আপনি বাংলা জানেন তো?

লছিমা মৃদু গলায় বলে, জরুর। দশ বরষ কলকাত্তা শহরে কেটে গেল। আর বাংলা বুলি জানব না?

আপনাকে পনেরো-বিশ মিনিট একটু কষ্ট দেব। আমরা কটা কথা জানতে চাই। যদি দয়া করে বলেন

হাঁ হাঁ, পুছ করুন না।

অদিতি জিগ্যেস করে, আপনার নাম?

 লছিমা দুসাধ।

 স্বামীর নাম?

গালের পাশে ঘোমটা টেনে দ্রুত অন্য দিকে মুখ ফেরায় লছিমা। বলে, শরমকি বাত। মরদের নাম কেউ মুখে আনে?

ওধার থেকে যুধিষ্ঠির বলে ওঠে, বদরী দুধ।

এদিকে লছিমার ইন্টারভিউ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের লোকজন অদিতিদের দিকে এগিয়ে এসেছে। লছিমাকে এমন অনেক প্রশ্ন করতে হবে, এত লোকজনের সামনে সেসবের উত্তর দেওয়া প্রায় অসম্ভব। অদিতি যুধিষ্ঠিরকে ডেকে তার কানে নীচু গলায় বলে, এরকম ভিড় হলে তো আমাদের পক্ষে কাজ করাই যাবে না। ওদের চলে যেতে বলুন যুধিষ্ঠিরদা–

আগের দুদিনও লোকজন সরিয়ে দেবার জন্য অনুরোধ করেছে অদিতি। মুহূর্তে যুধিষ্ঠিরের ভেতর থেকে একজন জবরদস্ত নেতা বেরিয়ে আসে। সে ভিড়ের দিকে তাকিয়ে দাপটের গলায় বলে, এই, তোমরা এখানে কী করছ? সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে না-থেকে যে যার কাজে যাও। একদম ঝামেলা করবেন।

লোকগুলো বস্তির দিকে অনেকটা পিছু হটে। তবে একেবারে চলে যায় না। দূর থেকেই অদিতিদের লক্ষ করতে থাকে। খানিকটা অন্তত নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, পঞ্চাশ গজ তফাত থেকে ওরা কেউ তাদের কথা শুনতে পাবে না।

অদিতি এবার যুধিষ্ঠির, বিকাশ এবং রমেনকে চায়ের দোকানে গিয়ে বসতে বলে। কেননা তার প্রশ্নের উত্তরে এমন সব তথ্য লছিমাকে জানাতে হবে যা স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সামনে মুখে আনা যায় না।

ব্যাটারি সেটের টেপ রেকর্ডার চালু করাই ছিল। অদিতি জিগ্যেস করে, আপনার স্বামী কী কাজ করেন?

লছিমা বলে, রিকশা গাড়িয়া চালায়।

 নিজের রিকশা?

নহী দিদিজি। রিকশা কেনার পাইসা কোথায়?

মাসে কীরকম আয় হয়?

মালিককে গাড়িয়ার জন্যে রোজ পাঁচ রুপাইয়া দিতে হয়। সেসব দিয়ে দু থেকে ঢাই শ (আড়াইশো) রুপাইয়া থাকে।

আপনি কিছু করেন?

হাঁ। পাঁপড় বানিয়ে বিক্রি করি।

লাভ কেমন থাকে?

হর মহিনা একশো-দেড়শো। তবে সমসারের সব কাম সেরে সময় তো বেশি পাই না। তা হলে আরও কিছু কামাই হত।

আপনাদের সংসারে কত লোক?

সাত। আমি, আমার মরদ আউর পাঁচ বাচ্চা। আউর বলতে বলতে থেমে যায় লছিমা।

আর কী?

আমার বুডটী সাসও (শাশুড়ি) থাকে আমাদের সঙ্গে।

সবসুদ্ধ আপনারা আটজন। আয় মোটে সাড়ে তিনশো-চারশো টাকা। এতে সংসার চালানো তো মুশকিল।

হাঁ। বহোত মুসিবত-তৎক্ষণাৎ ঘাড় কাত করে সায় দেয় লছিমা।

অদিতি বলে, এত ছেলেপুলে হওয়া ভালো না। তাদের মানুষ করে তোলা কি সোজা কথা!

চোখের কোণ দিয়ে অদিতিকে লক্ষ করতে করতে ঠোঁট কামড়ে হাসতে থাকে লছিমা। ঝপ করে গলার স্বর অনেকটা নীচে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, এ আপনি কী বলছেন দিদিজি! শাদি হয়েছে, মরদের পাশে শুয়ে রাত কাটাচ্ছি। মরদ বুকের ওপর তুলে আমাকে আধি রাত পর্যন্ত আটার মতো ডলছে। আর বাচ্চা হবে না বলে সামনের দিকে অনেকখানি বুকে অদিতির সিঁথি এবং কপাল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে।

তার চাউনির মধ্যে এমন কিছু আছে যাতে অস্বস্তি বোধ করতে থাকে অদিতি। বিব্রতভাবে বলে, কী দেখছেন।

কপালে সিনুর (সিঁদুর) নেই। আপনার শাদি হয়নি–তাই না দিদিজি?

 হ্যাঁ, কেন?

শাদি হলে দেখতেন, আপনার মরদ কীভাবে সুহাগ করত! বলতে বলতে কণ্ঠস্বর আরও নামিয়ে আনে, আর সুহাগ পেলে দেড়-দো সাল পর পর একটা করে বাচ্চা পয়দা করে ফেলতেন। দুনিয়ার এই নিয়ম দিদিজি।

বস্তিবাসী এই মেয়েমানুষটির মুখে কিছুই আটকায় না। কান লাল হয়ে ওঠে অদিতির। নাকমুখ ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে। ওধারে বেঞ্চে বসে ঠোঁটে ঠোঁট টিপে রয়েছে বিশাখা। বোঝা যায়, অবরুদ্ধ হাসির তোড় গলার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। প্রাণপণে সে সেটা আটকে রেখেছে। ফলে তার চোখমুখও লাল হয়ে উঠেছে।

আচমকা বিশাখার দিকে ফিরে লছিমা বলে, দিদিজি, আপনিও রেহাই পাবেন না। বুঝবেন মরদের সুহাগ কাকে বলে!

এরকম অভাবিত আক্রমণে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ে বিশাখা। বিপন্ন মুখে বলে, কী আজেবাজে বলছেন!

আজেবাজে নহী দিদিজি, জিওনের এই হল আসলি বাত। শাদিটা একবার হোক না আপনার, তখন

লছিমাকে থামিয়ে দিয়ে অদিতি বলে, ও-সব আলোচনা থাক। কাজের কথা হোক। একটু আগের বিব্রতভাবটা কাটিয়ে উঠেছে সে। গাম্ভীর্য এবং ব্যক্তিত্ব ফিরে এসেছে তার চোখে-মুখে এবং কণ্ঠস্বরে।

লছিমা সোজা হয়ে বসে, শান্ত চোখে তাকায় অদিতির দিকে। তার চাউনির মধ্যে একটু আগের চটুলতার চিহ্নমাত্র নেই।

অদিতি এবার বলে, একটা কথা জিগ্যেস করব। ঠিক ঠিক জবাব দেবেন—

হাঁ, জরুর।

আপনার সঙ্গে আপনার স্বামীর সম্পর্ক কেমন?

গালের ভেতর জিভটা ঘোরাতে ঘোরাতে লছিমা বলে, নফা আর হবে! দুনিয়ার সব আদমি আর জেনানাদের মধ্যে যেমন হয় আমাদেরও তেমনি।

অদিতি জিগ্যেস করে, আপনার স্বামী আপনাকে ভালোবাসে?

এই একটি প্রশ্নে আবার লছিমার চটুলতা ফিরে আসে। নীচু তারে কণ্ঠস্বরকে বেঁধে রেখে রিন রিন করে সে হেসে ওঠে, এ কী বলছেন দিদিজি, সুহাগই যদি না করবে, পাঁচ-পাঁচটা বাচ্চা পয়দা হল কী করে!

এই খোলা জায়গায়, যেখানে লোকজন থিক থিক করছে, এ-জাতীয় ইন্টারভিউ নেওয়া খুবই অস্বস্তিকর। বিশেষ করে লছিমার মতো মুখ-আলগা হালকা টাইপের মেয়েমানুষদের! অদিতি দ্রুত ভেবে নেয়, ইন্টারভিউগুলো অন্যভাবে নিতে হবে। সে বলে, আপনার স্বামী কখনও খারাপ ব্যবহার করে না?

হে রামচন্দজি, করে আবার না! দুই হাত প্যাকিং বাক্সের ওপর লম্বা করে ছড়িয়ে দিয়ে লছিমা বলে, না করলে এই দাগগুলো কীসের দিদিজি?

লছিমার দুই হাতের উলটো পিঠ থেকে ব্লাউজের হাতা পর্যন্ত খোলা জায়গায় চামড়ার ওপর অগুন্তি কালশিটে পড়ে আছে। কোনো কোনোটা পুরোনো, কিছু কিছু একেবারে তাজা।

অদিতি এবং বিশাখা শিউরে ওঠে। একইসঙ্গে বলে, এভাবে মেরেছে আপনাকে!

বা-রে মারবে না! এখানে এত্তে আদমি দাঁড়িয়ে আছে। নইলে জামাকাপড় খুলে দেখিয়ে দিতাম সারা গায়ে কত দাগ। অনেক জায়গায় চামড়া ফেটে ঘা হয়ে রয়েছে।

এভাবে মারে, আর আপনি কিছু বলেন না!

কী বলব দিদিজি! মরদ সুহাগও করবে, আবার পিটাইও লাগাবে। পিটাই না দিলে আওরতকে কি মুঠির ভেতর রাখা যায়! বলতে বলতে একটু থামে লছিমা। দম নিয়ে পরক্ষণে আবার শুরু করে, আমার মরদটা যখন দারু খেয়ে ঘরে ফেরে তখন কি তার হোশ থাকে। হাতের কাছে যা পায় তা-ই পিটাই করে।

অদিতি লক্ষ করল, লছিমা এক নাগাড়ে এই যে বলে গেল, এতে বিন্দুমাত্র অভিযোগের সুর নেই। স্বামীর হাতে মার খাওয়ার বিবরণ এমন নিস্পৃহ ভঙ্গিতে সে দিয়েছে যাতে মনে হয় এটাই দৈনন্দিন জাগতিক নিয়ম।

অদিতি কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই বস্তির ভেতর থেকে মেয়ে-গলার একটানা তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে আসে। সে এবং বিশাখা চমকে সেদিকে তাকায়।

কিছুক্ষণ পর দেখা যায়, বস্তি থেকে বেরিয়ে একটি মেয়ে উদভ্রান্তের মতো ছুটতে ছুটতে এবং চিৎকার করতে করতে এদিকে আসছে। তার খোলা চুল বাতাসে উড়ছে, পরনে শাড়ি এলোমেলো, আঁচল বুক থেকে খসে মাটিতে লুটোচ্ছে।

অদিতি বুঝতে পারে, এই মেয়েটিরই গলা একটু আগে তাদের কানে ভেসে এসেছিল।

বিমূঢ়ের মতো মেয়েটিকে দেখছিল অদিতি। তার এভাবে ছুটে আসার কারণ কিন্তু একেবারেই বোঝা যাচ্ছে না।

মেয়েটি কোনোদিকে না-কিয়ে সোজা এসে অদিতির সামনে লুটিয়ে পড়ে। তার দুই পা বুকের ভেতর আঁকড়ে ধরে বলে, আমাকে বাঁচান দিদি

মেয়েটির বয়স বাইশ-তেইশ, বিবাহিত। কপালে সিঁদুর লেপটে আছে। মাথা থেকে চুলের ভেতর দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত গড়িয়ে আসছে, হাতে ঘাড়ে এবং কণ্ঠায় চাপ চাপ রক্ত। থুতনির কাছে মাংসের একটা রক্তাক্ত জেলা প্রায় ঝুলছে। তার গায়ে যে এলোপাথাড়ি কোনো ধারালো অস্ত্র-টস্ত্র চালানো হয়েছে, বুঝতে অসুবিধে হয় না। সমানে কেঁদে চলেছে। সে। চোখের জল এবং রক্তে তার মুখ প্রায় মাখামাখি।

ঘটনাটা এতই আকস্মিক এবং অভাবনীয় যে প্রথমটা হকচকিয়ে যায় অদিতি। পরক্ষণেই মেয়েটির সারা গায়ে আঘাতের দগদগে দাগগুলি দেখে শিউরে ওঠে। বিহুলের মতো সে বলে, ওঠো, ওঠো। তোমার এ অবস্থা কী করে হল?

মেয়েটি পা ছাড়ে না। কান্না-ভেজা বিকৃত গলায় বলে, সব বলব, আগে বলুন আমাকে বাঁচাবেন।

এমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতে আগে আর কখনও পড়েনি অদিতি। কোন বিপদ থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করতে হবে, সেটা তার পক্ষে আদৌ সম্ভব কিনা, আগে না-জেনে কথা দেওয়া যায় না। হাত ধরে তাকে পায়ের কাছ থেকে তুলে সামনের বেঞ্চে বসিয়ে দিতে দিতে ব্যস্তভাবে বলে, আগে একজন ডাক্তার দেখানো দরকার। যুধিষ্ঠিরদা, যুধিষ্ঠিরদা বলতে বলতে সে চায়ের দোকানটার দিকে মুখ ফেরায়।

সেখান থেকে যুধিষ্ঠির, রমেন, বিকাশ এবং আরও দু-চারজন বেরিয়ে আসে। জলের কলের ওধারে যে ভিড়টা সিনেমার ফ্রিজ শটের মতো অনড় দাঁড়িয়েছিল, এবার তারা পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে থাকে।

অদিতি যুধিষ্ঠিরকে বলে, যত তাড়াতাড়ি পারেন একজন ডাক্তার ডেকে আনুন যুধিষ্ঠিরদা

নিরাসক্ত ভঙ্গিতে যুধিষ্ঠির জিগ্যেস করে, কেন, ওই চাঁপার জন্যে? বলে আঙুল বাড়িয়ে মেয়েটির ক্ষতবিক্ষত মুখের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দেয়।

হ্যাঁ। দেখছেন না, কী হাল হয়েছে এর

অদিতির উৎকণ্ঠাকে এতটুকু গুরুত্ব দেয় না যুধিষ্ঠির। বলে, এ নিয়ে ভাববেন না দিদিভাই। রোজ বস্তিতে এরকম ঠেঙানোর ঘটনা বিশ-পঞ্চাশটা করে ঘটছে। রাত দশটা পর্যন্ত একদিন এখেনে থাকলে নিজের চোখেই দেখতে পাবেন কতগুলোন মেয়েছেলে জখম হল। ডাক্তার ডেকে কি কূল পাবেন। তা হলে এখেনে হাসপাল বসিয়ে দিতে হয়।

দেখা গেল, চারধারের লোকজনের মধ্যেও কোনোরকম চাঞ্চল্য নেই। বস্তিতে মেয়েমানুষ-পেটানো রোজকার রুটিনের একটা আইটেম। এসব বিচলিত হবার মতো ঘটনাই নয়।

অদিতি বলে, না না, এগুলো কোনো কাজের কথা নয়। এখন ডাক্তারকে খবর দিন।

আপনি পয়লা দিন দেখলেন তো, তাই ঘেবড়ে গেছেন। ডাক্তার ডেকে গুচ্ছের পয়সা লষ্ট করে লাভ নেই। চাঁপা রোজ জখম হচ্ছে, রোজ ঘা শুকিয়ে যাচ্ছে

যুধিষ্ঠিরের অবিচলিত অটল মনোভাব অদিতির স্নায়ুকে ধাক্কা দিয়ে যায়। সে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই মোটা কর্কশ গলায় চেঁচাতে চেঁচাতে বস্তির দিক থেকে মাংসল ঘাড়ে গদানে-ঠাসা মধ্যবয়সি একটা লোক বেরিয়ে আসে। তার রুক্ষ চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। রক্তবর্ণ চোখ, থ্যাবড়া থুতনি, গোল মুখ, মোটা মোটা হাড়ের ফ্রেমে মজবুত শরীর সবকিছুর মধ্যেই রয়েছে মারাত্মক নিষ্ঠুরতা।

লোকটার হাতে রয়েছে একটা ভোঁতা নিরেট কাটারি। তাকে দেখে লোকজন সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে সরে সরে পথ করে দিল। সে ক্রুদ্ধ কর্কশ গলায় পেঁচিয়েই যাচ্ছে, কোথায় গেলি খানকী মাগী, আজ তোর বাপের বিয়ে দেখিয়ে ছাড়ব।

সামনের বেঞ্চ থেকে উঠে দ্রুত অদিতির পাশে গিয়ে দাঁড়ায় চাপা। ভয়ে একেবারে কুঁকড়ে গেছে সে। আড়ষ্ট গলায় বলে, দিদি, ও আমাকে নিঘুঘাত মেরে ফেলবে।

বোঝা গেল, হাতের ওই কাটারিটা দিয়ে কিছুক্ষণ আগে এই লোকটাই নির্দয়ভাবে চাঁপাকে মারধোর করেছে। অদিতি জিগ্যেস করে, লোকটা কে?

ওধার থেকে যুধিষ্ঠির নীচু গলায় জানায়, ও লগা লগেন দাস। হেভি মস্তান দিদিভাই। চাঁপা লগার তিন নম্বর ওয়াইভ।

যদিও যুধিষ্ঠির এই বস্তির একজন মান্যগণ্য নেতাগোছের লোক তবু অদিতি টের পেল নগেনকে যথেষ্টই ভয় পায় সে। আরও জানা গেল, লোকটার তিন-তিনটে স্ত্রী রয়েছে। তবে তিনজনই জীবিত কিনা, বোঝা যাচ্ছে না। থাকলে, ধরে নেওয়া যায়, হিন্দু কোড বিলকে একেবারেই পরোয়া করে না নগেন।

এরকম মারাত্মক একটা ব্যাপার যে ঘটতে পারে, বস্তিতে আসার আগে ভাবতেই পারেনি অদিতি। তার মতো স্মার্ট সাহসী মেয়েও প্রথাটা রীতিমতো ভয় পেয়ে যায়। বিমূঢ়ের মতো নগেনের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।

চারপাশের জনতা সিনেমার ফ্রিজ শটের মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নগেন এলোমলো পা ফেলে এধারে-ওধারে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে আসে। সে ভিড়ের মধ্যে চাঁপাকে খুঁজছে।

এদিকে আতঙ্কে অদিতির পিঠে একেবারে লেপটে গেছে চাঁপা। অদিতি বুঝতে পারে, মেয়েটা ভীষণ কাঁপছে। পেছন থেকে ভয়ার্ত ঝাপসা গলায় চাঁপা বলে, আমাকে বাঁচান দিদি

চাঁপার কথা যেন শুনতেই পায় না অদিতি। তার দুই চোখ নগেনের ওপর স্থির হয়ে আছে।

শেষ পর্যন্ত চাঁপাকে দেখতে পায় নগেন। তার চোখে-মুখে অদ্ভুত এক হিংস্রতা যেন ঝিলিক দিয়ে যায়। লম্বা লম্বা লালচে চুলগুলো এক ঝটকায় পেছন দিকে সরিয়ে অদিতিদের দিকে এগিয়ে আসে সে। বাঁ-হাতে কাটারিটা বাগিয়ে ধরা। ডানহাতের আঙুল নাচাতে নাচাতে বলে, বেরিয়ে আয় মাগী, আভূভি-আভি

হঠাৎ স্বয়ংক্রিয় কোনো নিয়মে অদিতির মাথার ভেতর কিছু একটা ঘটে যায় যেন। নিজের অজান্তেই শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে চিৎকার করে ওঠে, চুপ কর জানোয়ার

এক ধমকেই কিছুটা কাজ হয়। নগেন প্রথমটা হকচকিয়ে যায় এবং প্যাকিং বক্সটার ওধারে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার মুখ থেকে ভক ভক করে গন্ধ বেরিয়ে আসছে। এখনও অনেকটা বেলা রয়েছে, চারদিকে রোদের ছড়াছড়ি। এরই মধ্যে সে কিন্তু প্রচুর পরিমাণে দিশি মদ গিলেছে।

ধাতস্ত হতে খানিকটা সময় লাগে নগেনের। সে চোখ ছোট করে অদিতিকে লক্ষ করতে থাকে। নেশা-টেশা করলেও বুঝতে পারে, বস্তির লোকজনের ওপর যে মেজাজ চালানো যায়, এর কাছে সেটা চলবে না। অদিতিকে কিছু না বলে নগেন চাঁপাকে ডাকতে থাকে, ভালো চাস তো চলে আয় চাঁপা–চাঁপা উত্তর দেয় না, অদিতির শরীরের সঙ্গে নিজেকে প্রায় মিশিয়ে দেয় সে।

অদিতি বুঝতে পারছিল, ভয় পেলে নগেন একেবারে মাথায় চড়ে বসবে। কোনোভাবেই সেটা হতে দেওয়া যায় না। রুক্ষ গলায় সে বলে, চাঁপা এখন যাবে না। তুমি এখান থেকে চলে যাও—

কেউ যে নগেনের মুখের ওপর এভাবে বলতে পারে, বস্তির লোকজনের কাছে তা ছিল অভাবনীয়। তারা একেবারে হাঁ হয়ে যায়।

দাঁতে দাঁত চেপে নগেন ভেংচে ওঠে, অর্ডার দিচ্ছেন নাকি মেমসাহেব?

অদিতি বলে, অর্ডার নয়। কোথাও গিয়ে মাথা ঠান্ডা করে ভদ্রলোকের মতো এসো। তখন কথা হবে।

ভদ্রলোক। বস্তিতে ভদ্দরলোক থাকে বলে শুনেছেন! মাতাল ফোরটোয়েন্টি, খচ্চর হারামি ছাড়া এখানে কেউ থাকে না মেমসাহেব। আমি তাদের ভেতর আবার সব চাইতে ওঁচা মাল। অনেক ভ্যানতাড়া হয়েছে। এবার মাগীটাকে পিঠের কাছ থেকে টেনে বার করে দিন। শালীর চুলের কুঁটি ধরে টেনে নিয়ে যাই।

মেয়েটার কী হাল হয়েছে–দেখছ?

মরে তো যায়নি।

তুমি মানুষ, না কী?

একটু আগে যা বলেছেন তাই জানোয়ার।

মাথার ভেতর রক্ত ফুটতে শুরু করেছিল অদিতির। উত্তেজিত ভঙ্গিতে সে বলে, চাঁপা না তোমার স্ত্রী!

নগেন বলে, সেই জন্যেই তো ঠেঙাতে পারছি। অন্য মেয়েমানুষের গায়ে হাত তুললে ঝামেলা হয়ে যেত। মেলাই ভ্যাজর ভ্যাজর করছেন মেমসাহেব, আমার মাল আমার হাতে তুলে দিন। কেটে পড়ি।

না দেব না।

যুধিষ্ঠির বকের মতো গলা বাড়িয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে, চাঁপাকে দিয়ে দ্যান দিদিমণি। লগেন খুব হারামি লোক–

যুধিষ্ঠিরের কথার জবাব দেয় না অদিতি, স্থির চোখে নগেনের দিকে তাকিয়ে থাকে।

যেন প্রচণ্ড অবাক হয়েছে, এমন একটা ভঙ্গি করে নগেন বলে, আমার বউকে আটকে রাখবেন! এ তো গা-জোয়ারি কারবার হল মেমসাহেব! বলতে বলতে সে এগিয়ে আসে। তার চোখে-মুখে ধীরে ধীরে আগের সেই বেপরোয়া হিংস্রতা ফের ফুটে উঠতে থাকে।

বিপজ্জনক কিছু একটা আঁচ করে রমেন এবং বিকাশ দ্রুত মাঝখানে চলে এসে অদিতিকে আড়াল করে দাঁড়াতে চায়। অদিতি তাদের সরিয়ে দিয়ে তীব্র চাপা গলায় নগেনকে বলে, এক পা-ও আর এগুবে না।

নগেন থমকে যায়। বলে, আমাকে অত ধমকাবেন না মেমসাহেব, আমি আপনার বাবার চাকর লই। ভালো কথায় আমার বউকে ছেড়ে দ্যান।

না।

নগেন বলে, ভদ্দরলোকের বাড়ির মেইয়ে বলে এতক্ষণ খাতির করে কথা কইছি। এরপর কিন্তু ঝামেলা হয়ে যাবে। বলতে বলতে নগেনের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠতে থাকে। কদিন ধরেই খবর পাচ্ছি, আপনারা বস্তির মেয়েমানুষদের খেপিয়ে যাচ্ছেন। আমায় ঘটাননি, তাই কিছু বলিনি। এবার কিন্তু সাপের ল্যাজে পা দিয়ে ফেলেছেন। আপনাকে আমি ছাড়ছি না।

মস্তিষ্কের মধ্যে কোথায় যেন বিস্ফোরণ ঘটে যায় অদিতির। হিতাহিত জ্ঞানশূন্যের মতো সে চিৎকার করে ওঠে, স্কাউলে, এতবড় সাহস তোমার। তোমাকে আমি পুলিশে দেব।

পুলিশের নামে খানিকটা দমে যায়। পরক্ষণেই তেরিয়া হয়ে ওঠে, আমাকে পুলিশের ভয় দেখাবেন না মেমসাহেব। বছরে বিশবার ধরা পড়ি। এক ঘণ্টার বেশি কেউ আমাকে ধরে রাখতে পারেনি। পুলিশ মাকড়াদের আমার বহোতবার দেখা আছে।

অদিতি নগেনের চোখ থেকে চোখ সরায়নি। অত্যন্ত শান্ত গলায় বলে, বছরে যাতে বারো মাস জেলে কাটাতে পারো তার ব্যবস্থা করে দেব।

হইচই উত্তেজনায় নগেনের নেশা অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছিল। অদিতি তার কতটা ক্ষতি করতে পারে ঠিক বুঝতে পারছিল না। সাপের মতো শীতল দৃষ্টিতে অদিতিকে কিছুক্ষণ লক্ষ করে সে, তারপর বলে, আপনার মতলবটা কী?

চাঁপাকে নিয়ে আমি সোজা এখান থেকে থানায় যাব।

যেখানে খুশি নিয়ে যান। শুধু দুটো কথা মন দিয়ে শুনে রাখুন। এক লম্বর লগেন দাসকে এখনও আপনি চেনেননি। দু-লম্বর, এই মাগীকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে। তখন কোন বাপ ওকে বাঁচায় দেখব বলে আর দাঁড়ায় না, ভিড়ের ভেতর দিয়ে বস্তির গোলকধাঁধায় অদৃশ্য হয়ে যায়।

যুধিষ্ঠির পাশ থেকে বলে, কাজটা ভালো হল না দিদিমণি।

বস্তির আরও দু-চারজন বয়স্ক লোক এগিয়ে এসে বলে, দিদিমণি, চাঁপাকে লগেনের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিন। সোয়ামি-ইস্তিরির কারবার। এখন গেলে লগা ঠেঙাবে ঠিকই, আবার মিটমাটও হয়ে যাবে।

একটু দ্বিধান্বিতই হয়ে পড়ে অদিতি। এই বস্তিতে দাম্পত্য জীবনের প্যাটানটা কীরকম, সে-সম্বন্ধে তার পরিষ্কার ধারণা নেই। চাঁপার দিকে ফিরে বলে, তুমি কি ঘরে ফিরে যাবে?

চাঁপা ভয়ে সিঁটিয়ে ছিল। বলে, না না, ওর কাছে আর যাব না। আমাকে পেলে একেবারে খুন করে ফেলবে। আপনি আমাকে বাঁচান দিদি।

এক মুহূর্ত কী ভাবে অদিতি, তারপর বলে, ঠিক আছে, আপাতত আমাদের সঙ্গে চলো। তারপর ভেবে কিছু একটা ঠিক করা যাবে। যুধিষ্ঠিরকে বলে, আজ আর কোনো মহিলাকে ডাকার দরকার নেই। বিকাশ এবং রমেনকে পোস্টারগুলো তুলে ফেস্টুনটা খুলে নিতে বলে। এরপর যুধিষ্ঠিরকে একধারে ডেকে নিয়ে গোটাকয়েক টাকা দেয়।

এটা তার কাজের মজুরি। যুধিষ্ঠির টাকাটা পকেটে পুরতে পুরতে বলে, চাঁপাকে সগে করে না-নিয়ে গেলেই পারতেন দিদিমণি।

এই সৎ পরামর্শটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে এবং বস্তির কয়েকজন কিছুক্ষণ আগেই একবার দিয়েছে। অদিতি হাসে। তারপরেই হঠাৎ কিছু মনে পড়তে সে বলে, চাঁপার ছেলেমেয়ে আছে?

না।

ভালোই হল। বাচ্চাকাচ্চা থাকলে অসুবিধে হত।

গলা অনেকখানি নামিয়ে যুধিষ্ঠির বলে, দিদি, একটা কথা বলব?

অদিতির কপাল সামান্য কুঁচকে যায়। সে জিগ্যেস করে, কী?

এট্টু সাবধানে থাকবেন। লগা কেমন হারামজাদা, নিজের চোখেই দেখলেন। তাছাড়া পাট্টির লিডাররা আছে ওর পেছনে।

পাট্টি মানে পলিটিক্যাল পা.। এতক্ষণে বোঝা যায়, রাজনৈতিক নেতাদের মদতেই নগেদ দাস এমন বেপরোয়া হয়ে উঠতে পেরেছে। অন্যমনস্কর মতো সে বলে, জানা রইল।

এখন কিছুদিন বস্তিতে আসবেন না।

যুধিষ্ঠির তার সত্যিকারের হিতাকাঙ্ক্ষী। বস্তিতে এলে নগেন ঝাট বাধাতে পারে, সেই ভয়ে সে আসতে বারণ করছে। তার মানে, দারিদ্রসীমার নীচে ক্যালকাটা মেটোপলিসের বস্তিবাসী মেয়েদের সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহের যে বিপুল পরিকল্পনা তারা নিয়েছে, সেটা স্থগিত রাখতে হবে। একটু চিন্তা করে অদিতি বলে, দেখা যাক।

কিছুক্ষণ পর দেখা যায়, অদিতিরা চাঁপাকে নিয়ে সামনের গলিটা দিয়ে বড় রাস্তার দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পেছনে বস্তির লোকজন বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।

.

০৩.

আগে আগে হাঁটছে রমেন বিশাখা এবং চাঁপা। তাদের পেছনে অদিতি আর বিকাশ।

বিকাশ নীচু গলায় অদিতিকে বলে, এটা তুমি কী করলে?

দূরমনস্কর মতো হাঁটছিল অদিতি। চমকে উঠে বলে, কোনটা?

চাঁপাকে দেখিয়ে বিকাশ বলে, এই যে মেয়েটাকে নিয়ে এলো বলতে বলতে সে থেমে যায়।

তার ইঙ্গিতটা বুঝতে অসুবিধে হয় না অদিতির। সে বলে, না নিয়ে এলে মেয়েটার অবস্থা কী হত, নিশ্চয়ই তোমাকে বলে দিতে হবে না।

তোমার কি মনে হয়, ওই মাস্তানটা ওকে খুন করে ফেলত! খুনটা এত সোজা ব্যাপার না।

আজকাল ওটাই বোধহয় সবচেয়ে সোজা হয়ে গেছে। নগেন হয়তো একেবারে শেষ করে ফেলত না, তাবে মারাত্মক টরচার করত।

এরকম বউ-পেটানোর ঘটনা রোজ হাজারটা ঘটছে। তুমি সবাইকে বাঁচাতে পারবে?

একজনকেও যদি পারি সেটাই কম নাকি?

চাঁপাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসাটা আদৌ পছন্দ হয়নি বিকাশের। সে কিছুক্ষণ গুম হয়ে থাকে। তারপর বলে, সব ব্যাপারে তুমি নিজেকে বড় বেশি ইনভলভূ করে ফেলো

অদিতি-

চোখের কোণ দিয়ে বিকাশকে লক্ষ করতে করতে ঈষৎ তীক্ষ্ণ গলায় অদিতি বলে, সোশাল ওয়ার্ক করতে নেমেছি অথচ এতটুকু দায়দায়িত্ব নেব না, তাই কখনও হয়?

আমাদের কাজ হল, মেয়েদের সম্বন্ধে ইনফরমেশন জোগাড় করে সেগুলো নানা মিডিয়ার হেল্প নিয়ে দেশের মানুষ আর গভর্নমেন্টকে জানানো। আই মিন, এই সোসাইটিতে মেয়েরা কীভাবে জেনারেশনের পর জেনারেশন কী ভয়ঙ্কর জীবন কাটাচ্ছে, সে সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করা।

তার মানে নিজেদের চামড়া বাঁচিয়ে যেটুকু করা যায়–তাই না?

অদিতির চোখেমুখে এবং কণ্ঠস্বরে চাবুকের মতো এমন কিছু শ্লেষ ছিল যাতে চমকে ওঠে বিকাশ। কিছু বলতে গিয়ে সে থেমে যায়।

খানিকক্ষণ চুপচাপ।

তারপর বিকাশ বলে, মেয়েটাকে তো নিয়ে এলে। এখন ওর কী ব্যবস্থা করবে? কোথায় রাখবে?

অদিতি বলে, নারী জাগরণ-এর অফিসে আগে যাই। অমিতাদির সঙ্গে আলোচনা করে একটা কিছু করতে হবে।

বিকাশ আর কোনো প্রশ্ন করে না। তবে চাঁপার ব্যাপারে সে যে ভীষণ চিন্তাগ্রস্ত এবং বিচলিত, তার চোখমুখ দেখেই তা টের পাওয়া যায়।

.

নারী জাগরণ-এর অফিসে যখন অদিতিরা এসে পৌঁছোয়, সন্ধে নেমে গেছে। রাস্তায় রাস্তায় কর্পোরেশনের তেজি আলোগুলো জ্বলে উঠেছে।

দক্ষিণ কলকাতার এই নিরিবিলি পাড়ায় সন্ধেবেলাতেও লোকজন খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে দু-একটা স্কুটার, অটো রিকশা বা প্রাইভেট কার এখানকার অগাধ শান্তিকে তোলপাড় করে হুস হুস শব্দে বেরিয়ে যাচ্ছে।

নারী-জাগরণ-এর অফিসটা দুপুরের মতো অতটা জমজমাট না হলেও বেশ কিছু মেম্বার এ-ঘরে উত্তেজিতভাবে গলা চড়িয়ে কথা বলছে। অমিতাদিকেও সামনের ঘরে তাঁর নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে বসে থাকতে দেখা গেল।

বোঝা যায়, বধূ হত্যার প্রতিবাদে দুপুরে মিছিল করে নারী-জাগরণ-এর মেম্বাররা যে বেরিয়ে পড়েছিল, নানা রাস্তা ঘুরে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে মেমোরান্ডাম জমা দিয়ে তারা ফিরে এসেছে। এখন সেই বিষয়েই তাদের আলোচনা চলছে।

অদিতি ভেতরের একটা ঘরে চাঁপাকে বসিয়ে সামনের ঘরে এসে অমিতাদির মুখোমুখি বসে পড়ে। বিকাশ, রমেন এবং বিশাখা আগেই থেকে গিয়েছিল। তারা আর ভেতরে যায়নি।

অমিতাদি বললেন, যে মেয়েটিকে ও-ঘরে রেখে এলে সে কে?

অদিতি দ্রুত একবার বিকাশদের দেখে নেয়। বুঝতে পারে, ওরা চাঁপার সম্পর্কে এখনও কেউ কিছু অমিতাদিকে বলেনি। অদিতি সংক্ষেপে চাঁপার ব্যাপারটা বলে, কী পরিস্থিতিতে তাকে এখানে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে জানিয়ে দেয়।

শুনতে শুনতে কপালে ভাঁজ পড়ে অমিতাদির। একটা সিগারেট ধরিয়ে বলেন, তাইতো, এখানে ওকে নিয়ে এলে–

না এলে উপায় ছিল না অমিতাদি। আপনি আমার জায়গায় থাকলে কী করতেন?

ডিফিকাল্ট কোশ্চেন। যাই হোক, এনেই যখন ফেলেছ তখন ওর সম্পর্কে আমাদের একটা দায়িত্ব এসে গেছে। চাঁপাকে নিয়ে কী করবে, কিছু ভেবেছ?

না। আপনি কী করতে বলেন?

একটু চিন্তা করে অমিতাদি বলেন, প্রথমে যেটা সব চাইতে জরুরি তা হল, থানায় ওর সম্পর্কে একটা রেকর্ড করিয়ে রাখা। নইলে পরে ওর স্বামী–মানে হুলিগান টাইপের সেই লোকটা গোলমাল বাঁধাতে পারে।

উত্তর দিতে গিয়ে হঠাৎ কী মনে পড়ে যেতে ব্যস্তভাবে অদিতি বলে, অমিতাদি, আজ আমাকে এখনই বাড়ি যেতে হবে। বাবা বলে দিয়েছিল, সন্ধের আগে আগেই যেন ফিরে যাই। ঘড়ি দেখতে দেখতে বলে, ভীষণ দেরি হয়ে গেছে।

তাহলে আজ বাড়িই যাও। দারোয়ান আর তার বউকে বলে যাচ্ছি, চাঁপা রাত্তিরে এখানে থাকবে। কাল এসেই কিন্তু থানায় চলে যাবে। আশা করি নগেন ওকে যেভাবে মারধোর করেছে, নিজে থেকে আজকেই থানায় যেতে সাহস করবে না।

আমারও তাই মনে হয়।

অদিতি উঠে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বিকাশও উঠে দাঁড়ায়।

অমিতাদি চোখ সরু করে মজার গলায় বলেন, অদিতি যথেষ্টই সাবালিকা-সাফিসিয়েন্টলি অ্যাডাল্ট। ও নিজের সামর্থেই বাড়ি চলে যেতে পারবে। তোমার পৌঁছে না দিলেও চলবে।

ঘরের অন্য সবাই হাসতে থাকে। অদিতির সঙ্গে বিকাশের সম্পর্ক কতটা গভীর, নারী-জাগরণ-এর প্রতিটি মেম্বার তা জানে।

বিব্রত মুখে বিকাশ বলে, না, অদিতির সঙ্গে আমার দরকারি কিছু কথা আছে। তাই তার মুখ লাল হয়ে ওঠে।

অমিতাদি হেসে হেসে খানিকটা প্রশ্রয়ের ঢংয়েই বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোমাকে আনাড়ি প্রেমিকদের মতো অত লজ্জা পেতে হবে না।

অদিতিরা থাকে বালিগঞ্জের পুরোনো পাড়ায়, বিকাশরা ভবানীপুরে।

খানিকটা হাঁটতেই একটা ফাঁকা ট্যাক্সি পেয়ে যায় দুজনে। ঠিক হয় বিকাশ অদিতিকে তাদের বাড়ির কাছে নামিয়ে দিয়ে ভবানীপুরে চলে যাবে।

ট্যাক্সিতে ওঠার পর কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটে। তারপর হঠাৎ বিকাশই শুরু করে, আমি কিন্তু গলফ গ্রিনে একটা ফ্ল্যাট বুক করে ফেলেছি। নেক্সট উইকে পজেশান পেয়ে যাব।

কই, আমাকে আগে কিছু বলেনি তো।

তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।

 কবে বুক করলে?

 দিন কুড়ি আগে।

এত টাকা পেলে কোথায়?

ভবানীপুরে আমাদের বাড়িতে আর জায়গা হচ্ছিল না। আমার অংশটা দাদাকে লিখে দিলাম। দাদা প্রফিডেন্টফান্ড থেকে লোন নিয়ে আমাকে দিল। তাই দিয়েই

বিকাশদের বাড়ির যাবতীয় খবরই অদিতির জানা। সে বলল, ও—

বিকাশ অদিতির দিকে ঘুরে বসে প্রচণ্ড উৎসাহে বলতে থাকে, জানো, ফ্ল্যাটটা দারুণ। থ্রি বেড রুমস, দুটো বাথ, ড্রইং-কাম-ডাইনিং হল, তিনটে ব্যালকনি। সব মিলিয়ে কার্পেট এরিয়া সাড়ে বারোশো স্কোয়ারফিট। তিনটে দিক ভোলা-সাউথ, ইস্ট আর ওয়েস্ট। কবে দেখতে যাবে বলো–

যাব একদিন

একদিন-ট্যাকদিন না, নেক্সট রবিবারই তোমাকে নিয়ে যাব।

একটু চুপ করে থেকে অদিতি বলে, আচ্ছা–ফ্ল্যাটের কথায় সে খুশি হয়েছে কিনা বোঝা যায় না।

অদিতি খুবই চাপা ধরনের। বাইরে থেকে তাকে সমান্যই বোঝা যায়, তার স্বভাবের বেশির ভাগটাই গোপন। বিকাশ বলতে থাকে, ফ্ল্যাটটা কিন্তু খুব ভালো করে সাজাতে হবে।

অদিতি উত্তর দেয় না।

বিকাশের উদ্দীপনা ক্রমশ বাড়তেই থাকে। সে বলে, ইন্টেরিয়র ডেকরেটরদের হাতে ছেড়ে দেব, না নিজেরাই সাজাব?

অতিদি বলে, তুমি যা ভালো বুঝবে।

জানো, অকশনে দুর্দান্ত সব জিনিস-খাট কার্পেট মিক্সি আলমারি শসোফা ক্ৰকারি–খুব শস্তায় পাওয়া যায়। এ সপ্তাহেই তোমাকে অকশন হাউসগুলোতে নিয়ে যাব।

ঠিক আছে।

প্রায় রোজই এই সময়টা ট্রাফিক জ্যাম থাকে। আজ কোথাও বাস মিনিবাস ট্যাক্সি বা প্রাইভেট কার জট পাকিয়ে সবকিছু অচল করে দেয়নি। মসৃণ গতিতে ট্যাক্সিটা পুরোনো বালিগঞ্জে চলে আসে।

বিকাশ বলে, ফ্ল্যাট তো হল। সাজাবার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে কিন্তু আসল কাজটাই এখনও হল না। সেটা ছাড়া এইসব ফ্ল্যাট-ট্যাট একেবারে মিনিংলেস–একটু থেমে গাঢ় গলায় এবার বলে, ভবানীপুরে ভাঙাচোরা বাড়ি, সেখানে অনেক অসুবিধে ছিল কিন্তু এখানে সেসব ব্যাপার নেই। কীরকম সময় আমরা ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিসে যেতে পারব?

শেষের এই কথাটা আগে বেশ কয়েকবার বলেছে বিকাশ। তবে এতটা জোর দিয়ে কখনোই নয়। অদিতির নিজের দিক থেকে এখনও কিছু দ্বিধা আছে, বাড়ির দিক থেকে বেশ খানিকটা বাধাও। কিন্তু সেসব কথা পরে।

অদিতি বলে, আমাকে কিছুদিন ভাববার সময় দাও।

অনেক ভেবেছ। আর সময় পাবে না। ফ্ল্যাটটা সাজানো হয়ে গেলে আমি কিন্তু কোনো কথা শুনব না। বিকাশের গলায় অসহিষ্ণুতা ফুটে বেরোয়।

অদিতি বলে, এত অধৈর্য হলে চলে! ট্যাক্সি তাদের বাড়ির কাছে এসে গিয়েছিল। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে একপলক দেখেই সে ট্যাক্সিওলাকে বলল, সর্দারজি, এখানে একটু থামান।

শিখ ড্রাইভার ব্রেক কষতেই ঘ্যাস্-স্-স্ করে চাকার ঘষ্টানির আওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে ট্যাক্সি থেমে যায়। দরজা খুলে রাস্তায় নামতে নামতে অদিতি বলে, চলি। কাল নারী-জাগরণ-এর অফিসে আসছ তো? চাঁপাকে নিয়ে থানায় যেতে হবে।

বিকাশ বলে, আসব। আমার কথাটা মনে রেখো। একমাসের বেশি সময় কিন্তু দিচ্ছি না।

অদিতি হাসে, উত্তর দেয় না।

ট্যাক্সিটা আর দাঁড়াল না, বিকাশকে নিয়ে চলে গেল।

তারপর কিছুক্ষণ রাস্তার ধারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে অদিতি। একটা কথা ভেবে তার ভীষণ খারাপ লাগে। প্রায় রোজই তাকে বাড়ির গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যায় বিকাশ কিন্তু বিকাশকে সে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে না। কেননা বাড়ির কেউ তাকে একেবারেই পছন্দ করে না। হঠাৎ বিকাশকে তার সঙ্গে আসতে দেখলে বাড়িতে অশান্তি এবং উত্তজেনা এতই বেড়ে যাবে যে অদিতির পক্ষে একটা দিনও এখানে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠবে।

ট্যাক্সিটা অদিতিদের বাড়ি ছাড়িয়ে খানিকটা দূরে এসে থেমেছিল। একসময় অদিতি ঘুরে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *