২. ক্যাবে উঠে

ক্যাবে উঠে বসে স্টিক-শিফটের ঠিক উপরে লাগানো ডায়াগ্রামটার দিকে তাকালাম। আমার চালানো ক্যাটারপিরালটার মতোই মনে হলো। দেখে। এক-দুইবার পরীক্ষা করে দেখে নিলাম, ঠিকঠাক চালাতে পারছি কি না। গিয়ারবক্সে কিছু কাঁকর ঢুকেছিল, সেজন্য প্রথমদিকে কিছুটা বাধা পাচ্ছিলাম। চালক লোকটা এর স্যান্ড-ফ্ল্যাপটা নামায়নি। ওর ফোরম্যানও নিশ্চয়ই কোনোদিন চেক করে দেখেনি। ব্লকার হলে দেখত। দীর্ঘ সাপ্তাহিক ছুটি হোক না হোক, ড্রাইভারকে পাঁচ ডলার জরিমানা না করে সে ছাড়ত না।

ওর চোখদুটোর কথা মনে পড়ে গেল। আধা-প্রশংসা, আধা অবজ্ঞা মেশানো ছির তাতে! জানলে আমার এই কাজকর্ম নিয়ে কী ভাবত ব্লকার?

বাদ দাও! নিজেকে মনে করিয়ে দিলাম, হার্ভে ব্লকারকে নিয়ে ভাবার সময় এখন না। এখন এলিজাবেথকে নিয়ে ভাবার সময়। আর, ডোলান-হ্যাঁ, ওকে নিয়েই আসলে বেশি ভাবতে হবে।

ক্যাবের ইস্পাতের ফ্লোরে এক খন্ড চটের মতো বিছানো ছিল, ওটা তুলে চাবির খোঁজে এদিক-ওদিক তাকালাম। স্বাভাবিকভাবেই, কোনো চাবি পেলাম না।

মনের আয়নায় টিংকারে কণ্ঠটা বলে উঠল : আরে বাপ, একটা বাচ্চাও তো এগুলো জাম্প-স্টার্ট করতে পারে। নতুন গাড়িগুলোর তা-ও ইগনিশন লক থাকে, এতে ওসবের বালাও নেই। এদিকে তাকাও, বাপ। চাবি যেখানে লাগায়, ওখানে না। তোমার কাছে চাবিই নেই; ওটা কোথায় লাগায়, সেটা দেখে করবেটা কী তুমি? এদিকে দেখ। নিচে তাকাও। এই যে তারগুলো ঝুলছে, দেখছ?

তাকিয়ে দেখলাম নিচে কিছু তার ঝুলছে। টিংকার যখন দেখিয়ে দিয়েছিল তখন যেমন ঝুলছিল এখনো সে-রকমই লাগল দেখে : লাল, নীল, হলুদ আর সবুজ। সবগুলো তারের এক ইঞ্চি মতো আবরণ ছিলে পকেট থেকে প্যাঁচানো একটা তামার তার বের করলাম।

ওকে, এখন ভালোমতো কথা শোন। কারণ একটু পরে প্রশ্নোত্তর পর্বে তোমাকে এগুলোর জবাব দিতে হতে পারে। বুঝতে পারছ তো? লাল আর সবুজ তারটা পেঁচাবে। ক্রিসমাসের রঙের সাথে মিল আছে না? এটা মনে রাখলেই দেখবে আর ভুলবে না। এইটুকু করলেই ইগনিশনের কাজ হয়ে যাবে।

আমার তারটা দিয়ে কেস-জর্ডানের ইগনিশনের লাল আর সবুজ তারের খোলা জায়গাটা একসঙ্গে পেঁচালাম। সোডা বোতলের মাথায় ফুঁ দিলে যেমন শব্দ হয়, মরু-বাতাস সে-রকম চিকন শব্দে ভরে উঠল। ঘাড় বেয়ে দর দর করে ঘাম নেমে যাচ্ছে, শার্ট ভিজে লেপটে যাচ্ছে শরীরের সাথে।

বাকি রইল নীল আর হলুদ তার। এগুলো আর পেঁচাতে হবে না, শুধু ছোঁয়ালেই হবে। কিন্তু এ সময় ভুলেও তারের খোলা অংশের সাথে হাতের সংযোগ থাকা যাবে না। ওরকম হলে সোজা ভাষায় পটল তুলে হাঁ করে পড়ে থাকবে, বুঝলে? গাড়ি চালু করার কাজটা এই নীল আর হলুদ তার দুটোই করে। ব্যাস! যথেষ্ট আনন্দ করা হয়েছে মনে হলে, টেনে লাল আর সবুজ তার দুটো আলাদা করে দিলেই হবে, বন্ধ হয়ে যাবে ইঞ্জিন। চাবি বন্ধ করার মতোই আর কি।

নীল আর হলুদ তার দুটো একসঙ্গে ছোঁয়াতেই বিশাল এক হলুদ ফুলিঙ্গ লাফিয়ে উঠল। চমকে পেছনে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই ক্যাবের ধাতব পাতের সঙ্গে মাথার পেছনে ধাক্কা খেলাম। সামনে ঝুঁকে তার দুটো একত্র করলাম আবারো। মোটর ঘুরতে শুরু করে, খুক করে কাশি দিয়ে উঠল একবার। ফলে সামনে এগোতে গিয়ে বাকেট-লোডারটা হঠাৎ করেই মুহূর্তখানেকের জন্য থেমে গেল, পরমুহূর্তেই আবারো ছিটকে কিছুটা সামনে বেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ড্যাশবোর্ডের উপরে ছিটকে পড়লাম আমি, মুখের বাম দিকটা বাড়ি খেল টিয়ারিং বারে। আসলে ট্রান্সমিশনটা নিউট্রালে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। ফলস্বরূপ একটা চোখ প্রায় হারাতে বসেছিলাম আরেকটু হলে। মাথার ভেতরে টিংকারের হাসিটা স্পষ্ট ভেসে এলো।

ওটা ঠিক করে, তার দুটো আবারো জুড়ে দিলাম। একবার কাশি দিয়ে মোটরটা এবারে পুরোপুরি ঘুরতে শুরু করল। হুইসেল দেওয়ার মতো শব্দ করে ধপ্ করে এক গাদা নোংরা কালো ধোঁয়া উগরে দিল বাতাসে। মরু বাতাস ওটাকে মুহূর্তের মাঝে উড়িয়ে নিয়ে গেল। মোটরটা একটানা তীক্ষস্বরে আর্তনাদ করেই চলল। নিজেকে বারবার বোঝাতে চাচ্ছিলাম, যন্ত্রটা ময়লা জমে জ্যাম হয়ে গেছে। যে লোক স্যান্ড-ফ্ল্যাপ না নামিয়ে চলে যেতে পারে, আর কী কী যে সে বেমালুম ভুলে গেছে, কে জানে? কিন্তু মনে মনে ক্রমেই আরো বেশি নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছিলাম যে, তারা ডিজেল ফেলে দিয়ে গেছে। মনে মনে ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম আমি।

তারপর, যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়ে লোডারের ফুয়েল ট্যাংকে তেলের পরিমাণ যাচাই করে দেখার জন্য কিছু একটা খুঁজতে শুরু করেছি, সেই মুহূর্তে মোটরটা ষাঁড়ের মতো গর্জন করে জীবন্ত হয়ে উঠল।

তারগুলো ওভাবেই রাখলাম-নীল তারটার খোলা অংশ থেকে ধোঁয়া উঠছিল-সেই সাথে গ্রুটলের খোলা মুখ দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া বেরোতে লাগল। মোটরটা যখন মসৃণভাবে চলতে শুরু করল, ফার্স্ট গিয়ারে দিয়ে গাড়িটাকে ঘুরিয়ে হাইওয়ের পশ্চিম পাশের লেন দিয়ে নিয়ে চললাম চতুর্ভুজাকারে কাটা জায়গাটার দিকে।

ইঞ্জিনের গর্জন আর অগ্নিশিখার মতো তাপদাহে বাকিটা দিন দোজখ যন্ত্রণায় কাটল। কেস-জর্ডানের ড্রাইভার স্যান্ড-ফ্ল্যাপ নামাতে ভুলে গেলেও, রোদের ছাতাটা ঠিকই মনে করে নিয়ে গেছে। পুরনো দেবতারা সম্ভবত মাঝে মাঝে রসিকতা করতে পছন্দ করেন। কোনো কারণ নেই, এমনিতেই। আমার ধারণা, তাদের রসিকতাবোধ খুবই উদ্ভট ধরনের।

বেলা প্রায় দুইটার আগ দিয়ে আমি সব কয়টা অ্যাসফাল্ট টুকরো টুকরো করে কেটে পানি নিষ্কাশনের নালাতে ফেলে দিলাম। সাঁড়াশি দিয়ে কাজ করতে কোনো জটিলতা আর পোহাতে হয়নি। শেষের দিকে পান পাতা আকৃতির টুকরোগুলো ভেঙে দুই টুকরো করে, হাতে টেনে নালায় নিয়ে ফেলেছি। মনে হচ্ছিল, সাঁড়াশি ব্যবহার করলে ওগুলো চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতে পারে।

অ্যাসফাল্টের সবগুলো টুকরো নালায় নামিয়ে দেওয়ার পরে, বাকেট লোডারটা চালিয়ে আবার আগের জায়গাটায় চলে এলাম। এখানেই ওরা রাস্তা মেরামতের সব যন্ত্রপাতি একত্রে রেখে গেছে। তেল প্রায় ফুরিয়ে এসেছে, সাইফনের সময় হয়ে গেছে আবার। ভ্যানের ওখানে থেমে সাইফনটা নিলাম…আর টের পেলাম, মোহাচ্ছন্ন চোখে অপলক পানির বড় জেরিক্যানটার দিকে তাকিয়ে আছি। খনিকের জন্য সাইফনটা ছুঁড়ে ফেলেই দিলাম। হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকলাম গিয়ে ভ্যানের পেছনে। মুখ, ঘাড়, বুকে পানি ঢালতে পারার আনন্দে সব ভুলে চেঁচিয়ে উঠলাম। জানতাম, এখন পানি গিললেই বমি করে দেব। কিন্তু না খেয়ে থাকা আর সম্ভব হচ্ছিল না। তা-ই করলাম, আর যা হওয়ার তাই হলো। হড়হড় করে বমি করে দিলাম। তারপর, মাথাটা একপাশে ঘুরিয়ে কাঁকড়ার মতো হামাগুড়ি দিয়ে যতটা সম্ভব দূরে সরে এলাম।

তার পর আবার ঘুম। যখন ঘুম ভাঙল, ততক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। রাতের আকাশে নতুন চাঁদ উঠছে দেখে দূরে কোথাও হুঙ্কার দিচ্ছে একটি নেকড়ে।

পড়ন্ত বিকেলের আলোয় আমার কাটা জায়গাটা সত্যি সত্যিই কবরের মতো লাগছে-পৌরাণিক কোনো বিশালদেহী রাক্ষসের কবর। গোলিয়াথের হতে পারে। যাই হোক, এখনো আরো অনেক কাজ বাকি।

বিড় বিড় করে অ্যাসফাল্টের বিশাল গর্তটাকে বললাম, আর পারব না।

প্লিজ, এলিজাবেথ আবারো ফিসফিসিয়ে উঠল, প্লিজ…আমার জন্য।

গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট থেকে আরো চারটা অ্যাস্পিরিন বের করে গিলে নিলাম।

‘তোমার জন্য, এলিজাবেথ।’

কেস-জর্ডানটাকে এমনভাবে পার্ক করলাম যেন ওটার ফুয়েল ট্যাংক বুলডোজারের ট্যাংকের কাছাকাছি থাকে। একটা ক্রোবার দিয়ে আড় দিয়ে দুটো ট্যাংকের ক্যাপ খুলে নিলাম। সরকারি ডোজার-চালক হয়তো স্যান্ড ফ্ল্যাপ নামাতে ভুলে যেতে পারে। কিন্তু যেখানে ডিজেলের দাম এখন প্রতি লিটার ১.০৫ ডলার, সেখানে ফুয়েল ট্যাংকের ক্যাপ আটকাতে ভুলে যাওয়া? কখনোই না।

ডোজার থেকে লোডারের ট্যাংকে তেলের প্রবাহ চালু করে দিয়ে অপেক্ষায় রইলাম।

দুশ্চিন্তা না করার চেষ্টা করছি। আকাশের চাঁদটা ধীরে ধীরে আরো উপরে উঠে যাচ্ছে। খানিক বাদে লোডারটা ড্রাইভ করে অ্যাসফ্যাল্টের কাটা জায়গাটায় ফিরে এসে আবার শুরু করলাম খনন।

ফুটন্ত মরু-সূর্যের নিচে জ্যাকহ্যামার চালানোর চেয়ে চালোকে বাকেট-লোডার চালানো অনেক সহজ। কিন্তু কাজের অগ্রগতি ছিল খুবই শ্লথ। গর্তটার তলদেশ যেন ঠিকভাবে ঢালু হয়ে নেমে যায়, এ নিয়ে আমি দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ ছিলাম। ফলে, সাথে করে নিয়ে আসা কারপেন্টার লেভেলটা (এর ভেতরে একটা বুদবুদ থাকে। ওটা মাঝখানে থাকলে বোঝা যায়, তলটা সমান আছে। বুদবুদের নড়াচড়ার মান থেকে পৃষ্ঠতল কতটা বাঁকা, তা বোঝা যায়।) আমাকে ঘন ঘন এডজাস্ট করে নিতে হচ্ছিল। এর মানে হচ্ছে, লোডার বন্ধ করে নেমে এসে ওটার মান দেখে নিয়ে, আবারো উঠে গিয়ে চালকের আসনে বসা। এমনিতে এটা কোনো সমস্যা না। কিন্তু মাঝরাত নাগাদ আমার শরীরের সবগুলো পেশি শক্ত হয়ে গেল। প্রতি নড়াচড়াতেই হাড় আর পেশির ভেতরে চিনচিনে ব্যথা করছে, এমন অবস্থা। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয়েছে পিঠের; মনে হচ্ছিল, বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হয়ে গেছে।

কিন্তু আর সবকিছুর মতোই, এ নিয়েও আমাকে পরে দুশ্চিন্তা করতে হবে।

পাঁচ ফিট গভীর একটা গর্ত যদি বেয়াল্লিশ ফিট লম্বা এবং পাঁচ ফিট চওড়া করে করার প্রয়োজন হয়, জিনিসটা এক কথায় অসম্ভব। বাকেট লোডার থাকুক আর নাই থাকুক, কথা একই। এ রকম অসম্ভব নিয়ে মাততে চাইলে, ওকে বরং মহাশূন্যে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা, কিংবা তাজমহলটা তুলে এনে ওর মাথার উপরে ফেলার কথা ভাবলেই হতো।

এই পুরো জায়গাটায় মাটির পরিমাণ এক হাজার ঘন ফিটের চেয়েও বেশি।

গণিতজ্ঞ সেই বন্ধু আমাকে বলেছিল, ‘গর্তটা অবশ্যই ফানেল আকারের হতে হবে। তাহলে ওটা আপনাতেই তোমার বদ এলিয়েনদের টেনে নেবে। সেজন্য তোমাকে আর্ক অব ডিসেন্টের মতো করে একটা ঢাল বানাতে হবে। ব্যাস!

আরেকটা গ্রাফ পেপারে এঁকে দেখিয়েছিল সে।

‘মানে, তোমার আন্তঃগ্যালাক্টিক বিদ্রোহী বা যাই হোক আর কি, প্রাথমিক অবস্থায় দেখে যে আকার মনে হচ্ছিল, ওদের আসলে এর অর্ধেক পরিমাণ মাটি সরালেই হবে। সেক্ষেত্রে’–খসড়া খাতায় দ্রুত কলম চালাতে চালাতে ও বলেছিল, ‘পাঁচশ পঁচিশ ঘন ফিটের মতো হবে। অত ঝামেলার কিছুই না। একজন মানুষ একাই করতে পারবে।’

এক সময় আমিও তা-ই বিশ্বাস করেছিলাম কিন্তু গরম, ফোস্কা, চরম ক্লান্তি আর পিঠে অনবরত ব্যথা, হিসেবেই ধরিনি। কিংবা মনে ছিল না।

এক মিনিটের জন্য থামো। খুব বেশিক্ষণ আবার থেমে থেকো না কিন্তু! এবারে, গর্তের ঢালটা মেপে নাও।

যতটা খারাপ ভেবেছিলে, ততটা খারাপ তো না, নাকি প্রিয়তম? রাস্তায়ই তো কাজ করছ। মরুর রুক্ষ, ভীষণ শক্ত মাটি নিয়ে তো আর কাজ করতে হচ্ছে না।

দৈর্ঘ্যের গভীরতা যত বাড়ছে, দৈর্ঘ্য বরাবর তত ধীরে ধীরে নড়তে হচ্ছে। লোডার নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে হাত দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। বাকেট মাটি স্পর্শ করার আগ পর্যন্ত প্রচন্ড শক্তিতে ড্রপ-লিভারটাকে সামনে ঠেলে যাও। এবারে, ওটাকে আবার পেছনে নিয়ে আস এবং তীক্ষ্ণ হাইড্রোলিক আর্তনাদের সাথে যে যন্ত্রাংশটা আর্মেচারকে প্রশারিত করে, ওটাকে সামনে ঠেলে দাও। নোংরা কমলা কেসিং থেকে তৈলাক্ত ধাতব পাত যে বেরিয়ে এসে বাকেটকে ধাক্কিয়ে মাটির ভেতরে ঢুকাচ্ছে, সেটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখ। একটু পর পর বাকেটটা নুড়ি-পাথরের টুকরোর সাথে ঘষা খেলে, অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঝিলিক দিয়ে উঠছে। এবারে, বাকেটটাকে তুলে আনন…দুটো অংশ যুক্ত করে প্রায় আয়তাকার রূপ দাও (পিঠের তীব্র ব্যথাটাকে যেভাবে অগ্রাহ্য করছ, ঘাড়ের প্রচণ্ড ব্যথাটাও সেভাবে উপেক্ষা করার চেষ্টা করো) এবং নালায় নিয়ে ফেল। ফলে, ওখানে পড়ে থাকা অ্যাসফাল্টের টুকরোগুলো এতে ঢেকে যাবে।

এত দুশ্চিন্তা করো না, প্রিয়তম। কাজ শেষ হলে, ডোলানকে শেষ করে দেওয়ার পরে, হাতে ব্যান্ডেজ করার অনেক সময় পাবে।

‘মানুষটা ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে ছিল,’ চিৎকার করে উঠলাম। আরো দুইশ পাউন্ড মাটি খুঁড়ে সরিয়ে নেওয়ার জন্য বাকেটটা আবারো আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

ভালো সময় কত দ্রুত উড়ে চলে যায়!

খানিক বাদে খেয়াল করে দেখি, পুব দিগন্তে একটা অস্পষ্ট সরু আলো উঁকি দিচ্ছে। কার্পেন্টার’স লেভেল দিয়ে ঢালের মাপ নেওয়ার জন্য আবারো নামলাম-আসলেই কাজের প্রায় শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। তখন মনে হচ্ছিল, পারব। মাপ নেওয়ার জন্য হাঁটু গেড়ে বসতেই টের পেলাম, পিঠের কিছু একটা যেন ছিঁড়ে গেল। ভোঁতা একটা শব্দ করে ব্যথাটা পিঠ বেয়ে নেমে গেল, ছড়িয়ে পড়ল সবটা জুড়ে।

আর্তনাদ বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে। টের পেলাম, কাঁদছি। গর্তের ঢালু মেঝেতে ধপ করে পড়ে গেলাম। তীব্র যন্ত্রণায় ঠোঁট কামড়ে ধরেছি, চেপে ধরেছি পিঠের নিচের অংশ।

ধীরে ধীরে মরণ যন্ত্রণাটা প্রশমিত হয়ে এলে, পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারলাম।

ব্যাস, মনে মনে ভাবলাম, এইটুকুই। সব শেষ হয়ে গেছে। ভালোই চেষ্টা নিয়েছিলাম। কিন্তু আর সম্ভব না। সব শেষ।

প্লিজ, প্রিয়তম, এলিজাবেথ আবার ফিসফিসিয়ে উঠল-এক সময় যেটা অসম্ভব মনে হতো, তাই হলো। ফিসফিসে স্বরটার উপর মনের ভেতরে চাপা অসন্তোষ দানা বাঁধতে শুরু করল; ওকে মনে হলো প্রচন্ড নির্দয়।

হাল ছেড়ে দিও না, প্লিজ। দোহাই লাগে, কাজ চালিয়ে যাও।

চালিয়ে যাব মানে? হাঁটতে পারব কি না সেটাই জানি না আমি!

আর তো কেবল অল্প একটুই বাকি আছে।

কণ্ঠস্বরটা বিলাপ করে উঠল। যে স্বরটা এতদিন এলিজাবেথের হয়ে কথা বলত, এখন সেটা আর শুধু ওই স্বর হয়ে রইল না। পরিণত হলো স্বয়ং এলিজাবেথে।

অল্প একটুই তো বাকি আছে, সোনা!

চাঁদের বাড়ন্ত আলোয় গর্তটার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে মাথা নাড়লাম। ঠিকই বলেছে ও। বাকেট-লোডারটা শেষ প্রান্তের মাত্র পাঁচ ফিটের মতো দূরে আছে; সর্বোচ্চ সাত ফিটই হবে। কিন্তু এটা হচ্ছে সবচেয়ে গভীর পাঁচ থেকে সাত ফিট; গর্তের সবচেয়ে বেশি কাঁকর এখানটাতেই আছে।

তুমি পারবে, সোনা; আমি জানি তুমি পারবে।

মিষ্টি স্বরে ভোলাতে চাইছে।

এতে আসলে খুব একটা লাভ হয়নি। কিন্তু এখানে আমি এদিকে বাকেট-লোডারের তীব্র কটু গন্ধ ও প্রচণ্ড শব্দের ভেতরে, ধুলো-বালি মেখে একাকার অবস্থায় টন টনে বিক্ষত হাতে একটা গর্তের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, আর ওদিকে ভোলান ওর পেন্টহাউজে আরাম করে ঘুমোচ্ছ-এই ভাবনাটা। মূলত আমাকে কাজ করার প্রেরণা যোগাল। ডোলান নিশ্চয়ই এখন সিল্কের পাজামা পরে স্বর্ণকেশি কাউকে পাশে নিয়ে শুয়ে আছে। মেয়েটার গায়ে টপ। ছাড়া নিশ্চয়ই আর কিছুই নেই।

বিল্ডিংয়ের পার্কিং গ্যারাজে ওর ক্যাডিলাকে নিশ্চয়ই এতক্ষণে মালপত্র সব উঠিয়ে ফেলা হয়েছে। শুধু গ্যাস নেওয়াটা বাকি, তাহলেই ওরা যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে।

‘ঠিক আছে, তাহলে,’ মনে মনে বললাম। আস্তে করে উঠে বসলাম বাকেট-লোডারের সিটে বসেই ইঞ্জিনের গতি বাড়িয়ে দিলাম।

নয়টা পর্যন্ত এক নাগাড়ে কাজ করে একটুখানি ক্ষান্ত দিলাম আমি-আরো কিছু কাজ বাকি আছে, আর আমার সময়ও ফুরিয়ে আসছে। ফাঁদের গর্তটা চল্লিশ ফিটের মতো লম্বা হয়েছে। এতেই কাজ চালিয়ে নিতে হবে।

বাকেট-লোডারটা আগে যেখানে রাখা ছিল, সেখানে নিয়ে গিয়ে পার্ক করে রাখলাম। এটা আবারো লাগবে, তারমানে হচ্ছে, সাইফন করে আরো কিছু তেল ঢুকাতে হবে। কিন্ত এখন এ কাজের জন্য হাতে সময় নেই। শরীর আরো অ্যাস্পিরিন চাচ্ছে, কিন্তু বোতলে আর বেশি নেইও। যে কয়টা আছে, ওগুলো দিনের বাকি সময় আমার লাগবে…লাগবে আগামীকালও। ওহ হ্যাঁ, বলতে ভুলেই গেছি, আগামীকাল সোমবার, গৌরবের জুলাই ফোর্থ।

অ্যাম্পিরিনের পরিবর্তে পনের মিনিট বিশ্রাম নিলাম আমি। অপচয় করার মতো একদমই সময় নেই, কিন্তু বিশ্রাম নিতে একরকম বাধ্য করতে হলো নিজেকে। ভ্যানের ভেতরে চিত হয়ে শুলাম, মাংসপেশীগুলো আক্ষরিক অর্থেই লাফাচ্ছে। শুয়ে শুয়ে ডোলানের কথা ভাবলাম আমি।

সে নিশ্চয়ই এখন একটি ট্রাভেল-অল ব্যাগে শেষ মুহূর্তের গোছগাছ করে নিচ্ছে-পথে চোখ বুলিয়ে নেওয়ার জন্য কিছু কাগজ, একটি টয়লেট কিট, হয়তোবা একটি পেপারব্যাক বই কিংবা এক তাড়া তাস। ধরো, সে এবারে উড়ে গেল? ভেতর থেকে একটা বিষাক্ত গলা ফিসফিসিয়ে উঠল, কোনোভাবেই ভাবনাটাকে তাড়াতে পারছিলাম না। গলা থেকে একটা কাতর স্বর বেরিয়ে এলো। মনে মনে ভাবলাম, সে আগে কখনো এলএতে উড়ে যায়নি-সব সময় ক্যাডিলাকে করেই গেছে। আমার ধারণা, ডোলান আকাশ পথে যেতে পছন্দ করে না। তারপরেও তো গেছে-সুদূর লন্ডনে একবার উড়ে গিয়েছিল সে-এই ভাবনাটা দীর্ঘক্ষণ মনের মধ্যে খচ খচ করতে লাগল।

সাড়ে নটার দিকে ক্যানভাসের রোল, বড় ইন্ডাসট্রিয়াল স্ট্যাপলার আর কাঠের তক্তার গোঁজগুলো বের করে আনলাম। দিনটা মেঘাচ্ছন্ন আর কিছুটা ঠান্ডা-স্রষ্টা মাঝে মাঝে এক-আধটু কৃপা করেন বৈকি! এতক্ষণ, এত কিছুর মাঝে আমার টাক মাথার দুর্দশার দিকে নজর দিতে ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন, মাথায় একটুখানি আঙুল ছোঁয়াতেই মুখ থেকে তীব্র ব্যথায় আর্তনাদ বেরিয়ে এলো। বাইরের প্যাসেঞ্জার মিরর দিয়ে ওখানে তাকালাম। দগদগে, লাল হয়ে আছে তালুটা-উত্তপ্ত আলুবোখারার মতো লাগছে দেখে।

ওদিকে ভেগাসে হয়তো শেষ মুহূর্তের ফোন কলগুলো সেরে নিচ্ছে। ডোলান। ওর ড্রাইভার হয়তো ক্যাডিলাকটাকে সামনের দিকে নিয়ে আসছে। ওর আর আমার মাঝে এখন কেবল পঁচাত্তর মাইলের মতো দূরত্ব। খুব দ্রুতই ওর ক্যাডিলাকটা ঘন্টায় ষাট মাইল বেগে এই দূরত্ব ঘোচাবে। এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পোড়া তালু নিয়ে শোক করার সময় নেই আমার।

তোমার পোড়া টাকও আমার পছন্দ, সোনা।

পাশ থেকে এলিজাবেথের গলা ভেসে এলো।

‘ধন্যবাদ, বেথ,’ বলে কাঠের গোঁজগুলো গর্তের কাছে নিতে শুরু করলাম আমি।

খোঁড়াখুঁড়ির তুলনায় এখানকার কাজটা অনেক সহজ। তাছাড়া, পিঠের অসহ্য যন্ত্রণাটাও একটা স্থির চিনচিনে ব্যথায় পরিণত হয়েছে।

কিন্তু পরে কী হবে?

কৃত্রিম রাগ ঝরে পড়ল স্বরটা থেকে। পরে কী হবে, হুঁ?

পরে এটার যত্ন নিতে হবে আরকি। দেখে মনে হচ্ছিল, ফাঁদটা প্রায় প্রস্তুত হয়েই গেছে। আর, এই মুহূর্তে এটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

কাঠের পাতলা তক্তাগুলো দিয়ে আড়াআড়িভাবে গর্তটাকে ঢেকে দিলাম। তক্তার সামান্য কিছু বাড়তি অংশ গর্তের বাইরে অ্যাসফাল্টের মধ্যে এসে পড়েছে। এভাবেই তক্তা দিয়ে ফাঁদের উপরের স্তরটা তৈরি হলো। রাতের বেলা হলে কাজটা কঠিন হতো। তখন অ্যাসফাল্ট বেশ শক্ত থাকে। এখন, এই মাঝ সকালে জিনিসটা কাদার মতো নরম হয়ে আছে। ট্যাফি চকলেটের মাঝে পেন্সিল খুঁজে দেওয়ার মতো করে সহজেই তক্তাগুলো অ্যাসফাল্টের মধ্যে আটকে দিলাম।

সবগুলো তক্তা দিয়ে ঢেকে দেওয়ার পর গর্তটা চক দিয়ে আঁকা ডায়াগ্রামটার মতোই দেখাতে লাগল। আরকি, মাঝের লাইনগুলো বাদে। এবারে, ভারি ক্যানভাসের রোলটা গর্তের অগভীর প্রান্তে এনে ঠিকভাবে রেখে, বেঁধে রাখা দড়িটা দিলাম খুলে।

তারপর, রুট একাত্তরের বেয়াল্লিশ ফুট রাস্তা রোল থেকে খুলে বিছিয়ে দিলাম।

খুব কাছ থেকে দেখলে জিনিসটাকে নিখুঁত মনে হবে না। মঞ্চের সামনের প্রথম তিন সারি থেকে যেমন মঞ্চ-সজ্জা কখনোই নিখুঁত দেখায় না, সেরকম। কিন্তু কয়েক গজ দূর থেকেও এই জিনিস বোঝা মোটামুটি অসম্ভব। ধূসর-কালো ক্যানভাসটা একদম রুট একাত্তরের মতো।

ক্যানভাসটাকে কাঠের তক্তার সাথে স্ট্যাপল করতে করতে ধীরে ধীরে দৈর্ঘ্য বরাবর এগোচ্ছিলাম। হাত সায় দিচ্ছে না, তবু জোর করে টেনে গেলাম।

ক্যানভাসের কাজ শেষ করে, ভ্যানে ফিরে চালকের আসনে বসে পড়লাম। বসার কারণে মাংসপেশিতে আরেকদফা খিচুনি উঠল। পাত্তা দেওয়ার সময় নেই, ভ্যানটাকে চালিয়ে নিয়ে এলাম রাস্তার উঁচু জায়গাটার উপরে। সেখানে স্বস্তিতে বসে মিনিটখানেক চুপচাপ জিরিয়ে নিলাম। তারপর, বেরিয়ে এসে চোখ রাখলাম রুট একাত্তরের দিকে। নির্দিষ্ট কিছুর দিকে ফোকাস না করে, পুরো জায়গাটা দেখার চেষ্টা করলাম। ডোলানের লোকেরা যখন ওপাশের উঁচু জায়গাটা পেরিয়ে আসবে, তখন ওরা পুরো এলাকার যে দৃশ্যটা দেখবে, সেটাই দেখতে চাইছিলাম আমি। সবকিছু মিলে জিনিসটা কতটা ঠিক বা ভুল হলো, সেটা বুঝতে চাচ্ছিলাম।

যা দেখলাম, এতটা আমি নিজেই আশা করিনি।

দূরে পড়ে থাকা রাস্তা মেরামতের যন্ত্রপাতিগুলোর কারণে খোঁড়াখুঁড়ির ফলে সৃষ্ট মাটির ঢিবিটাকে আর অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। অ্যাসফ্যাক্টের টুকরোগুলো নালাতে প্রায় ডুবেই গেছে। বাতাসের জন্য কিছু টুকরো অবশ্য এখনো দেখা যাচ্ছে, কিন্তু দেখে আগের মেরামত কাজের অবশিষ্টাংশ ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না। ভ্যানে করে নিয়ে আসা কম্প্রেসরটাকে দেখে মনে হচ্ছে হাইওয়ে ডিপার্টমেন্টের যন্ত্র।

আর, এখান থেকে ক্যানভাসের কারিকুরি দেখে একদম নিখুঁত মনে হচ্ছে-যেন রুট একাত্তরকে কেউ কোনোদিন ছুঁয়েও দেখেনি।

শুক্র-শনিবার রাস্তায় প্রচুর গাড়ি ছিল। প্রায় নিরবিচ্ছিন্নভাবে একের পর এক গাড়ি ডিটুরের পথটা ধরে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু আজ সকাল থেকে বলতে গেলে কোনো গাড়িই চলছে না। বেশিরভাগ মানুষই স্বাধীনতা দিবসটা যেখানে কাটাতে চেয়েছে, সেখানে চলে গেছে। কেউ কেউ হয়তো চল্লিশ মাইল দক্ষিণের ইটারস্টেট রোড ধরে যাচ্ছে। আমার জন্য এটা বরং ভালোই হয়েছে।

দৃষ্টি সীমার বাইরে, ঢালের উর্বভাগ পেরিয়ে এসে ভ্যান পার্ক করলাম। তারপর, দশটা পঁয়তাল্লিশ পর্যন্ত ওখানেই উপুড় হয়ে শুয়ে কাটিয়ে দিলাম। একটি মিল্ক-ট্রাক হেলেদুলে বিকল্পপথ ধরে বেরিয়ে গেল। সাথে সাথেই ভ্যান নিয়ে নেমে এলাম। পেছনের দরজাটা খুলে সবগুলো রোড-কোন ভেতরে ছুঁড়ে দিলাম।

জ্বলজ্বলে তীর চিহ্নটা কিছুটা কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল-প্রথমে বুঝতেই পারছিলাম না, নিজেকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট না করে ওটাকে ব্যাটারি-বক্স থেকে বিচ্ছিন্ন করব কীভাবে। তারপরে, প্লগটা দেখতে পেলাম। একটা শক্ত রাবারের ঢাকনা দিয়ে সাইন-কেসের ভেতরে প্রায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে…মজা করে কেউ যেন ইচ্ছে হলেই সাইনটার প্লগ টেনে খুলে রেখে না যায়, সেজন্যই এই সতর্কতা।

টুলবক্সে একটা হাতুড়ি আর বাটাল পেলাম, চার বাড়িতেই ঢাকনাটা ভেঙে টুকরো হয়ে গেল। একটা প্লাস দিয়ে টেনে সরালাম ওটা। তার খুলে দিতেই তীর চিহ্নটা নিভে গেল। ব্যাটারি-বক্সটা নালায় ফেলে, মাটি চাপা দিয়ে দিলাম।

তীর চিহ্নটাকে চারটা ক্রু দিয়ে ইস্পাতের একটা কাঠামোর সাথে লাগিয়ে রাখা হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব খুলে নিলাম স্কুগুলো। এ সময় আরেকটি মোটরের শব্দ ভেসে এলো। কেউ হয়তো আসছে, কিন্তু ডোলানের এখনো আসার সময় হয়নি।

ভেতরের নৈরাশ্যবাদী কণ্ঠটা আবারো জেগে উঠল।

ও যদি উড়ে যায়?

আকাশ পথে যেতে পছন্দ করে না সে।

ধরো, ড্রাইভ করেই গেল, কিন্তু অন্যপথে চলে গেল, তাহলে? যেমন ধরো, ইন্টারস্টেট রোড, আজকে তো অনেকেই ওখান দিয়ে যাচ্ছে…

ও সব সময় রুট একাত্তর দিয়েই যায়।

কিন্তু আজকে যদি–

‘চুপ কর,’ হিসিয়ে উঠলাম আমি। চুপ করো, ড্যাম কোথাকার, একদম চুপ করে থাকো!

ঠিক আছে, সোনা! মাথা ঠান্ডা করো, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।

তীর চিহ্নটা ভ্যানের পেছনে ঠেস দিয়ে রাখতেই, কিছু বা ভেঙে গেল। ধাতব কাঠামোটা ওর দিকে ছুঁড়ে দিতেই ভাঙল আরো কিছু। তীর চিহ্ন আর কোনগুলো তো সরানো হলো, রইল কেবল কমলা রঙের ‘রাস্তা বন্ধ, বিকল্পপথ ব্যবহার করুন’ সাইনটা।

টের পেলাম, একটা গাড়ি আসছে। ডোলান যদি এত আগে চলে আসে, পুরো শ্রমটাই পন্ড হবে। ড্রাইভার সহজেই বিকল্পপথ ধরে বেরিয়ে যাবে, আর আমি উন্মত্ত রাগে এই মরুর বুকে বসে বসে ফুসব।

আসন্ন গাড়িটা একটা শেভ্রোলে।

বুকের ধড়ফড়ানি কমে এলো। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম, বাঁচা গেছে। কিন্তু স্নায়ু শান্ত হয়ে আসার অপেক্ষায় বসে থাকার সময় নেই।

ক্যামোফ্লেজ কেমন হলো, দেখার জন্য যেখানে এসেছিলাম, ভ্যান নিয়ে আবারো ওখানে চলে এলাম। ভ্যানের পেছনে বিশৃঙ্খল পড়ে থাকা জিনিসপত্রের নিচ থেকে হাতড়ে বের করলাম জ্যাক। দাঁত কামড়ে পিঠের ব্যথা চাপার চেষ্টা করতে করতে ভ্যানের পেছনের প্রান্তে জ্যাক লাগালাম, চাকার ভেতরের লাগ-নাটগুলো খুলে নিচ্ছি। ওর লোকেরা আসার সময় এগুলোই দেখবে। এবারে চাকাটা ভ্যানের ভেতরে ছুঁড়ে দিতেই আরো কিছু বাল্ব ভেঙে পড়ল। বাড়তি টায়ার আনিনি। মনে মনে আশা করছি, আর যাই হোক, ওটার যেন কোনো ক্ষতি না হয়।

ভ্যানের সামনে রাখা পুরনো বাইনোকুলারটি নিয়ে বিকল্পপথের দিকে পা বাড়ালাম। ওটা পেরিয়ে এসে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাস্তার পরবর্তী উঁচু ঢালে উঠে এলাম-কোনোরকমে পা টেনে টেনে হাঁটছি।

চূড়ায় উঠে, বাইনোকুলারটা পুবে তাক করলাম।

ফিল্ড অফ ভিশন বা দৃষ্টিসীমা এমনিতে তিন মাইলের মতো। কিন্তু আরো দুই মাইল পূর্বেও ভালোই দেখতে পাচ্ছি। দেখলাম, ছয়টা গাড়ি এগিয়ে আসছে। প্রথমটি একটি বিদেশি গাড়ি, ড্যাটসান কিংবা সুবারু হবে বোধ হয়, এক মাইলেরও কম দূরত্বে আছে। তার পেছনেরটা একটা পিক আপ, এর পরেরটা দেখে মনে হচ্ছে মাস্ট্যাং। বাকিগুলোকে শুধু মরুর আলোক-ঝলকানি মনে হচ্ছে। আসলে, কাঁচ ও রং থেকে প্রতিফলিত হচ্ছে সূর্যালোক।

প্রথম গাড়িটি আরো এগিয়ে এলে বুঝলাম, ওটা সুবারু। বৃদ্ধাঙ্গুলি বের করে ইশারা করলাম, রাইড চাইছি। বুঝতেই পারছিলাম, আমাকে দেখে এদের কেউই রাইড দিতে চাইবে না। এরাও আমাকে হতাশ করেনি। প্রথম গাড়ির ড্রাইভার মহিলাটি দারুণ সেজেগুজে ছিল। আমাকে দেখে মনে হলো যেন বেচারির মুখে কেউ ঘুষি বসিয়ে দিয়েছে। আতঙ্কিত চোখ এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল পাশ কাটিয়ে।

আধা মিনিট পরে পিক-আপের ড্রাইভারের চিৎকার শোনা গেল, ‘আগে গোসল করে এসো, বন্ধু!’

কাছে আসার পরে বুঝলাম, মাস্ট্যাংটা আসলে মাস্ট্যাং না, এসকর্ট। পেছন পেছন এলো একটা প্লেমাউথ। শব্দ শুনে মনে হলো, ভেতরে একদল বাচ্চা বালিশ-লড়াই খেলছে।

কিন্তু ভোলানের কোনো চিহ্নও নেই।

ঘড়ির দিকে তাকালাম, ১১:২৫। ও যদি আসলেই এদিক দিয়ে যায়, তাহলে কিছুক্ষণের মধ্যেই যাবে। এখন যাকে বলে, প্রাইম টাইম চলছে।

ঘড়ির কাঁটা ১১:৪০-এ চলে এসেছে, কিন্তু ওর কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। শুধু পুরনো একটা ফোর্ড আর কালচে, মেঘ-রঙের একটা হার্স চলে গেল।

আসবে না। নিশ্চয়ই ইন্টারস্টেট দিয়ে চলে গেছে। নয়তো উড়ে গেছে।

না, আসবে।

আসবে না। তুমি ভয় পাচ্ছিলে না যে, ও তোমার গন্ধ পেয়ে যাবে? নিশ্চয়ই তা-ই হয়েছে। সেজন্যই ও নিশ্চয়ই যাতায়াতের প্যাটার্ন বদলে ফেলেছে।

আরেকটা আলোর ঝলকানি দেখা গেল দূরে। একটা বড় গাড়ি। ক্যাডিলাকের মতোই মনে হলো, যথেষ্ট বড়।

পেটের উপর শুয়ে, কনুই দিয়ে বালু-কাঁকরের উপরে ভর দিয়ে কাঁধ উঁচু করে চোখে বাইনোকুলার ধরলাম। গাড়িটি একটি উঁচু ঢালের পেছনে হারিয়ে গেল…আবারো আবির্ভূত হলো…ফের বাঁকের পেছনে হারিয়ে গেল…কিছুক্ষণ পরে আবারো বেরিয়ে এলো বাঁক ঘুরে।

ওটা একটা ক্যাডিলাকই, কিন্তু ধূসর না-কালচে সবুজ রঙের।

এরপরের সময়টা আমার জীবনের সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক ত্রিশ সেকেন্ড; ওই ত্রিশটা সেকেন্ডকে মনে হলো বুঝি ত্রিশ বছর। আমার ভেতরের একটা অংশ মুহূর্তের মাঝে সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেল যে, ডোলান ওর পুরনো ক্যাডিলাকটা বদলে নতুন একটা নিয়েছে। সে আগেও এ রকম করেছে, যদিও সবুজ কোনো ক্যাডিলাক কখনো ব্যবহার করেনি ও। আগে না করলে যে এখন করবে না, এ রকম কোনো কথাও তো নেই!

আরেকটা অংশ এর প্রবল বিরোধিতা করতে লাগল। ভেগাস থেকে এলএ-এর মধ্যেকার হাইওয়ে আর বাইওয়েগুলোতে অনেক ক্যাডিলাক দেখা যায়। ক্যাডিলাক হলেই যে ডোলানের হবে, এ রকম ভাবার কোনো কারণই নেই।

ঠিক এ সময় ঘাম পড়ে চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেল। চোখ থেকে বাইনোকুলার নামাতে নামাতে ভাবছি, ওটা দিয়ে আর কাজ নেই। যতক্ষণে আবার চোখে লাগাব, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যাবে।

ইতোমধ্যেই তো অনেক দেরি হয়ে গেছে! নেমে গিয়ে বিকল্পপথের সাইনটা নামিয়ে ফেল! নয়তো ওকে আর ধরতে পারবে না!

এখন সাইনটা লুকালে তোমার ফাঁদে কেবল দুই বুড়ো-বুড়ি ধরা পড়বে। দেখা যাবে, ওরা ছেলে-মেয়েদের দেখতে এবং নাতি-নাতনিদের ডিজনিল্যান্ড নিয়ে যাওয়ার জন্য এল যাচ্ছে।

ওটা সরাও! ক্যাডিলাকে ডোলানই আছে! এটাই তোমার একমাত্র সুযোগ!

ঠিক বলেছ, একমাত্র সুযোগ। তাই ভুল লোককে ফাঁদে ফেলে সুযোগটা নষ্ট করো না।

ওটায় ডোলানই আছে!

না, নেই।

‘থামো,’ দু-হাতে মাথা চেপে ধরে চিৎকার করে উঠলাম। থামো, থামো!

মোটরের শব্দ পাচ্ছি এখন।

ডোলান।

বুড়ো-বুড়ি।

কোনো মহিলা।

বাঘ।

ডোলান।

বুড়ো–

‘এলিজাবেথ, প্লিজ, আমাকে একটু সাহায্য কর!’ কাতরে উঠলাম আমি।

ওই লোক এক জীবনে কখনো কোনো সবুজ ক্যাডিলাক ব্যবহার করেনি। কখনো করবেও না। নিশ্চিত থাক, ওটা ডোলান না।

মাথার ব্যথাটা কেটে গেল। উঠে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রসারিত করে ইশারা করলাম, রাইড চাইছি।

ওটাতে বৃদ্ধ কেউ নেই, নেই ডোলানও। দেখে মনে হলো, বারো জনের মতো কোরাস-গায়িকা ঠাসাঠাসি করে বয়স্ক এক লোকের সাথে বসে আছে। আমার দেখা সবচেয়ে বড় কাউবয় হ্যাট আর কালো ফস্টার গ্রান্ট পরে আছে লোকটা। মেয়েদের একজন আমাকে মুনিং করল (বাঁকা হয়ে নগ্ন পশ্চাদ্ভাগ প্রদর্শন)।

আস্তে করে ভেতরের গুমোট ভাবটা কেটে গেল। বাইনোকুলার চোখে লাগালাম আবারো।

দেখলাম, সে আসছে।

কোনো ভুল নেই। দৃষ্টিসীমার শেষ মাথায়, রাস্তার বাঁক ঘুরে আসছে ক্যাডিলাকটা। আকাশের মতোই ধূসর দেখাচ্ছে ওটাকে। কিন্তু পুব দিকের ঘোলা, ধূসর ভূমির মধ্যে দিয়ে দৃঢ়ভাবে মাথা তুলে এগিয়ে আসছে গাড়িটা।

এটা সে-ই-ডোলান। এতক্ষণ ধরে এত সন্দেহ আর সিদ্ধান্তহীনতাকে এই মুহূর্তে প্রচণ্ড বোকামি মনে হলো। কিন্তু সব সন্দেহ মুহূর্তের মাঝে পালিয়ে গেছে। ওটা যে ডোলান, এটা জানার জন্য ক্যাডিলাকের ভেতরে চোখ রাখার কোনো প্রয়োজনই নেই আমার।

জানি না ও আমার গন্ধ পেয়েছে কি না, কিন্তু আমি ঠিকই ওর গন্ধ পাচ্ছি।

ও যে আসছে, এটা জানতে পেরে পায়ের প্রচণ্ড ব্যথা মুহূর্তে ভুলে গেলাম, ছুটছি।

দৌড়ে গিয়ে বড় বিকল্পপথের সাইনটা ধাক্কিয়ে নালায় নিয়ে ফেললাম। ওটার উপরে বালু রঙের একটা ক্যানভাস দিয়ে দিলাম, তারপর হাতের তালুতে করে বালু নিয়ে গিয়ে ওটা যে পোস্টগুলোতে লাগানো ছিল, তার উপরে ছড়িয়ে দিলাম। নকল রাস্তার মতো এত নিখুঁত না হলেও, মনে হলো এতে কাজ হবে।

এবারে রাস্তার দ্বিতীয় উঁচু চুড়াটার দিকে দৌড় দিলাম। ভ্যানটা ওখানেই রেখে এসেছি। এটা হচ্ছে এই গল্পের আরেকটি দৃশ্য-একটা সাময়িক পরিত্যক্ত গাড়ি পড়ে আছে। আর, গাড়ির মালিক হয় নতুন টায়ার আনতে, না-হয় পুরনোটা ঠিক করাতে কোথাও গেছে।

ক্যাবের ভেতরে ঢুকে টানটান হয়ে আড়াআড়ি শুয়ে পড়লাম, বুক ধকধক করছে। আবারো মনে হলো, সময় দীর্ঘায়িত হয়ে গেছে। চুপচাপ শুয়ে ইঞ্জিনের শব্দের জন্য কান পেতে আছি তো আছিই, কিন্তু শব্দ আর আসে না…আসে না…আসে না।

ওরা নিশ্চয়ই ঘুরে গেছে। কোনো না কোনোভাবে শেষ মুহূর্তে সে তোমার গন্ধ পেয়ে গেছে…কিংবা কোনো কিছু হয়তো বেখাপ্পা লেগেছে ওর কাছে, কিংবা ওর সাথের কারো কাছে…এবং ঘুরে চলে গেছে ওরা।

গাড়ির সিটে শুয়ে আছি, এদিকে পিঠ বেয়ে যন্ত্রণাদায়ক একটা ব্যথার সোত ধীর লয়ে বয়ে যাচ্ছে। চোখের পাতা চেপে বন্ধ করে রেখেছি যেন, এমনটা করলে কোনোভাবে আরো কিছুটা ভালো করে শোনা যাবে।

এটা কি কোনো ইঞ্জিনের শব্দ?

না-বাতাস, এত জোরে প্রবাহিত হচ্ছে যে, সাথে বয়ে আসা বালুর চাদর ভ্যানের গায়ে আছড়ে পড়ছে।

আসছে না। ঘুরে গেছে, নয়তো ফিরেই গেছে।

শুধু বাতাস বইছে।

ঘুরে গেছে, নয়তো ফিরে—

না। ওটা শুধু বাতাস না।

একটা মোটর, শব্দটা বাড়ছে, এবং কয়েক সেকেন্ড পরে একটি গাড়ি-মাত্র একটা গাড়ি-শাঁ করে আমাকে পেরিয়ে গেল।

উঠে বসে স্টিয়ারীং হুইল আঁকড়ে ধরলাম-কিছু একটা ধরতেই হতো আমাকে-আর স্থির দৃষ্টিতে উইন্ডশিল্ড দিয়ে তাকালাম। টের পেলাম, চোখ বড় বড় হয়ে গেছে, কামড় পড়েছে জিভে।

ধূসর ক্যাডিলাকটা উঁচু চূড়াটা পেরিয়ে নিচের দিকে এগোতে লাগল, পঞ্চাশ মাইল কিংবা কিছুটা বেশি বেগে ছুটছে। কোনো ব্রেক লাইট জ্বলে উঠল না। একেবারে শেষ মাথায় গিয়েও ওভাবেই রইল বাতিগুলো। বুঝলাম, ওরা কিছুই দেখতে পায়নি, সামান্যতম আঁচও পায়নি কোনোভাবে।

তারপর যা ঘটল, তা হলো: তাৎক্ষণিকভাবে মনে হলো, ক্যাডিলাকটা যেন রাস্তা দিয়েই চলছে। ইস্যুশনটা এতই ভালো হয়েছে যে, নিজে তৈরি করার পরেও, মুহূর্তের জন্য আমি নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। শুরুতে রুট একাত্তরের উপরে ভোলানের ক্যাডিলাকটার চাকা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল, একটুক্ষণ পরে ওটার কেবল দরজা পর্যন্ত দেখা যেতে লাগল। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো আমার। মনে হলো, জিএম কোম্পানি যদি সাবমেরিন বানাত, ডুবে যাওয়ার সময় ওগুলোকে নিশ্চয়ই ঠিক এ রকমই দেখাত।

ক্যানভাসের নিচের কাঠের তক্তাগুলো গাড়ির চাপে ভেঙে পড়ার শব্দ পাচ্ছিলাম। শব্দ শুনে বুঝলাম, ক্যানভাসটা ছিঁড়ে ফেটে যাচ্ছে।

পুরো ঘটনাটা ঘটতে সময় লাগল মাত্র তিন সেকেন্ড। কিন্তু এই তিন সেকেন্ড সময় আমি সারা জীবন মনে রাখব।

সে সময় মনে হচ্ছিল, ক্যাডিলাকটা বুঝি শুধু ছাদ আর উপরের দুই তিন ইঞ্চি জানালা দৃশ্যমান অবস্থায় ছুটে চলেছে। তারপর একটা প্রচন্ড ধপ আওয়াজের সাথে কাঁচ ভাঙা আর ইস্পাত দুমড়ে যাওয়ার শব্দ হলো। বিপুল পরিমাণ ধুলো ধোঁয়ার মত উঠে গেল আকাশে, ছড়িয়ে পড়ল বাতাসের তোড়ে।

সেই মুহূর্তেই ছুটে যেতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু আগে বিকল্পপথটা ঠিক করতে হবে। আমি চাই না কেউ আমাদের বোঝাঁপড়ার মাঝে বিঘ্ন ঘটাক।

ভ্যান থেকে নেমে, পেছন থেকে টায়ারটা টেনে নামালাম। ওটা হুইলে লাগিয়ে নিয়ে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আঙুল দিয়ে লাগ-নাটগগুলো লাগালাম। পরে আরো শক্ত করে লাগিয়ে নেওয়া যাবে। এখন আমার শুধু ভ্যান নিয়ে বিকল্পপথটা যেখানে রুট একাত্তর থেকে আলাদা হয়ে গেছে, ওখানটায় যাওয়া দরকার। জ্যাক থেকে বাম্পার নামিয়ে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দৌড়ে ভ্যানের ক্যাবে ঢুকলাম।

বাতাস প্রবাহের শব্দ পাচ্ছি।

আর দূরে, রাস্তার আয়তাকার গর্ত থেকে কারো উচ্চ স্বরে ডাকার শব্দ পাচ্ছি…হয়তো চিৎকার করছে, কে জানে?

হাসতে হাসতে আবারো ভ্যানে ঢুকলাম।

দ্রুত রাস্তার ঢালে নেমে এলাম, ভ্যানটা মাতালের মতো সামনে-পিছে। দুলছে। বেরিয়ে এসে পেছনের দরজা খুলে, রোড-কোনগুলো নামিয়ে আগের জায়গায় বসালাম। এগিয়ে আসা গাড়ির শব্দের জন্য কান খাড়া রেখেছি। কিন্তু বাতাস ক্রমেই আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছে। যতক্ষণে কোনো গাড়ির শব্দ পাব, ততক্ষণে ওটা আমার গায়ের উপরে উঠে পড়ার সম্ভাবনা আছে।

নালায় নামতে শুরু করলাম। এ সময় হোঁচট খেয়ে পিছলে গিয়ে পৌঁছালাম একেবারে তলায়। বালু রঙের ক্যানভাস কাপড়টা সরিয়ে, বড় বিকল্পপথের সাইনটা টেনে উপরে তুললাম। আগের জায়গায় বসালাম এটাকেও, তারপর ভ্যানে ফিরে ধাক্কা দিয়ে লাগিয়ে দিলাম পেছনের দরজা। তীর চিহ্নটা পুনঃস্থাপনের কোনো ইচ্ছে আমার নেই।

এবারে, ওটাকে চালিয়ে রাস্তার পরবর্তী উঁচু চূড়ায়, বিকল্পপথ থেকে দৃষ্টিসীমার বাইরে, আমার পুরনো জায়গাটায় এসে থামলাম। নেমে, টায়ার আয়রন ব্যবহার করে পেছনের চাকার লাগ-নাটগুলো আরো শক্ত করে লাগাতে শুরু করলাম। ওদিকে ডাকাডাকি বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু আর্তনাদ-ওটা আগের চেয়ে আরো বেড়েছে।

সময় নিয়ে ভালো করে নাটগুলো লাগিয়ে শেষ করলাম। ওরা ওখান থেকে বেরিয়ে এসে আক্রমণ করবে কিংবা মরুভূমিতে পালিয়ে যাবে, এমন কোনো দুশ্চিন্তা উঁকিও দিচ্ছে না। কারণ, ওরা বেরোতেই পারবে না। ফাঁদটা একদম ঠিকঠাকভাবেই কাজ করেছে। ফলে, ক্যাডিলাকটা এখন গর্তের একদম তলায় চাকায় ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। দুই পাশে চার ইঞ্চিরও কম ফাঁকা জায়গা। ভেতরের তিন জন লোক কোনো মতে ঠেলে ঠুলে সর্বোচ্চ একটা পা-ই বের করতে পারবে, কিন্তু দরজা খুলতে পারবে না। জানালাগুলোও খুলতে পারবে না, কারণ ওরা পাওয়ার-ড্রাইভ করছিল। ফলে, ব্যাটারীর প্লাস্টিক এবং ধাতব অংশ ভেঙে-চুরে গিয়ে ভেতরের এসিড ইঞ্জিনের ভেতরেই কোথাও ছড়িয়ে গেছে।

ড্রাইভার এবং পাশের সিটের মানুষটাও সম্ভবত দুমড়ে মুচড়ে গেছে। কিন্তু সেটা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন না; কারণ, এতসবের মধ্যেও একজনের ঠিকই বেঁচে থাকার কথা। আমি জানি। এও জানি যে, ভোলান সব সময় পেছনের সিটে বসে ভ্রমণ করে এবং ভালো নাগরিকের মতো ঠিকঠাক করে সিট বেল্ট বাঁধে।

সন্তুষ্ট হওয়া পর্যন্ত লাগ-নাটগুলো শক্ত করে লাগালাম, তারপর ভ্যান চালিয়ে ফাঁদের চওড়া, অগভীর প্রান্তের কাছে গিয়ে নামলাম। এই তো, এখানেই পড়ে আছে ভোলানের ক্যাডিলাক।

পুরোপুরি জঞ্জালে পরিণত হয়েছে সামনের দিকটা। ছাদটা দুমড়ে গিয়ে জায়গায় জায়গায় উঁচু হয়ে গেছে। ধাতু, প্লাস্টিক আর পাইপ-ইঞ্জিন কম্পার্টমেন্টে এসব কিছুই তালগোল পাকিয়ে পড়ে আছে, ঢাকা পড়েছে। ধুলোবালি আর কাঁকরের নিচে।

হিস হিস আওয়াজ হচ্ছিল; কোথাও থেকে তরল পদার্থ চুঁইয়ে নামছে নিশ্চয়ই। বাতাসে ভাসছে অ্যান্টিফ্রিজ বা শীতক তরলের অ্যালকোহলের মতো গন্ধ।

উইন্ডশিল্ড নিয়ে আমার কিছুটা চিন্তা হচ্ছিল। ওটা ভেঙে গিয়ে ভেতর থেকে ভোলানকে বেরিয়ে আসার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ জায়গা করে দিতে পারে, এমন একটা সম্ভাবনা ছিল। তবে, অতটা চিন্তাও ছিল না। বলেছিলাম না, স্বৈরশাসকদের নিরাপত্তা দেওয়ার মতো করে এই গাড়ি বানানো হয়েছে? এই কাঁচের এত সহজে ভাঙার কথা না। ভাঙেনি।

আর জায়গা ছোট বলে ক্যাডিলাকের রিয়ার-উইন্ডোর কাঁচ তো আরো শক্ত। ডোন ওটা চাইলেও ভাঙতে পারত না-আমি তাকে যেটুকু সময়

দিয়েছি, এর মধ্যে তো অবশ্যই না। আর, ওইটুকু দূর থেকে কাঁচে গুলি করার সাহসও হবে না ওর। বুলেটপ্রুফ কাঁচে খুব কাছ থেকে গুলি করা আর রাশিয়ান রুলেতে বাজি লাগানো মোটামুটি একই কথা। গুলিটা কাঁচের গায়ে একটা ছোট্ট সাদা ছোপ মতোন তৈরি করে আবার ভেতরেই ফিরে আসবে।

আমি নিশ্চিত, যথেষ্ট সময়-সুযোগ দেওয়া হলে বেরিয়ে আসার একটা উপায় সে বের করতই। কিন্তু ওকে এর কোনোটাই আমি দিচ্ছি না।

লাথি দিয়ে ক্যাডিলাকের ছাদের উপর এক পশলা ধুলো-বালু ছিটিয়ে দিলাম।

ঠিক তখনই একটা গলা ভেসে এলো।

‘আমাদের একটু সাহায্য দরকার, প্লিজ। এখানে আটকে গেছি আমরা।’

ডোলানের গলা। ওকে অক্ষত এবং বেশ শান্ত শোনাল। কিন্তু দৃঢ়ভাবে চেপে রাখা আতঙ্কটা ঠিকই অনুভব করতে পারলাম আমি। ওর দুরাবস্থার জন্য করুনা হচ্ছে। কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি, ক্যাডিলাকের পেছনের সিটে বসে আছে সে। ওর লোকদের একজন আহত, সম্ভবত ইঞ্জিনের ভাঙা অংশ গায়ে বিঁধেছে, আরেকজন হয় মারা গেছে, না-হয় সংজ্ঞাহীন।

ব্যাপারটা কল্পনা করে কেমন একটা আতঙ্ক অনুভব করলাম আমি। এটাকে বলে সিমপ্যাথেটিক ক্লস্ট্রোফোবিয়া। জানালায় ধাক্কা দাও-বাটন চাপ-কিছুই হবে না। দরজা খোলার চেষ্টা কর, পুরোপুরি ভোলার আগেই ভোঁতা শব্দের সাথে মাটিতে আটকে যাবে। খুলবে না।

কল্পনা করা বাদ দিলাম। কেন করব? ও তো নিজেই নিজের এই কবর খুঁড়েছে, তাই না? সজ্ঞানে টিকেট কেটে, মূল্য চুকিয়ে দিয়েছে এখানে আসার জন্য।

‘কে ওখানে?’

‘আমি। তবে তুমি যে সাহায্য খুঁজছ, আমি তা নই, ডোলান।’

লাথি দিয়ে আরেক পশলা বালু-কাঁকর আড়াআড়িভাবে ছিটিয়ে দিলাম ক্যাডিলাকের ছাদে। দ্বিতীয় দফা কাঁকরের শব্দ হতেই শুরু হলো উন্মত্ত চিৎকার।

‘আমার পা! জিম, আমার পা!’

হঠাই সতর্ক শোনাল ডোলানের গলা। বাইরে দাঁড়ানো লোকটা ওর নাম জানে। অর্থাৎ পরিস্থিতিটা ভয়ংকর বিপজ্জনক।

‘জিমি, আমি পায়ের হাড় দেখতে পাচ্ছি!’

‘চুপ কর,’ ডোলান শীতল গলায় বলল। ক্যাডিলাকের পেছনের অংশে নেমে গিয়ে রিয়ার উইন্ডো দিয়ে তাকাতে খুব ইচ্ছে করছিল, কিন্তু বেশি কিছু দেখতে পাব না, জানি। কাঁচের উল্টোপাশে মুখ লাগিয়ে দাঁড়ালেও দেখা যাবে না। কাঁচটা পোলারাইজড। তাছাড়া, আপনাদের তো আগেই বলেছি, ওকে আর দেখতে চাই না আমি। সে দেখতে কেমন, তা আমি জানি। তাহলে আর কী জন্য দেখতে চাইব ওকে? হাতের রোলেক্স আর ডিজাইনার জিনস পরে আছে কি না, সেটা দেখব?

‘কে তুমি, বন্ধু?’ জিজ্ঞেস করল সে।

বললাম, ‘কেউ না। খুব তুচ্ছ একজন মানুষ, যার তোমাকে ওখানে ফেলার খুব ভালো একটা কারণ আছে।

হঠাৎ করেই প্রচণ্ড ভয় চেপে বসল ওর গলায়। বলল, তোমার নাম কি রবিনসন?

মনে হলো, কেউ যেন আমার পাকস্থলীতে সজোরে ঘুষি বসিয়ে দিয়েছে। এতশত আধা বিস্মৃত নাম, অথচ খড়ের গাদায় সুঁই খুঁজতে গিয়ে একেবারে সঠিক নামটাই তুলে নিয়েছে সে। ওকে কি আমি পশু ভেবেছিলাম? কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম পশুদের সহজাত প্রবৃত্তির কথা? এর অর্ধেকটাও যদি জানতাম, যা করেছি, তার সংকল্প করার সাহস আমার কোনোদিন হতো বলে মনে হয় না।

বললাম, ‘নামে কিছু যায়-আসে না। কিন্তু তুমি তো জানো এখন কী ঘটবে, তাই না?

যে লোকটা চিৎকার করছিল, সে আবারো শুরু করল-মুখে গ্যাঁজলা উঠে গেছে নিশ্চিত। ও নিয়েই ষাড়ের মতো চেঁচাচ্ছে।

‘এখান থেকে বের কর আমাকে, জিমি! এখান থেকে বের কর! ঈশ্বরের দোহাই! আমার পা ভেঙে গেছে!’

‘চুপ কর,’ ধমকাল ভোলান। তারপর আমাকে বলল, ‘ওর চিল্কারে তোমার কথা কিছুই শুনতে পাচ্ছি না আমি।’

হাঁটুতে হাত রেখে বাঁকা হয়ে দাঁড়ালাম। বলছিলাম, ‘তুমি তো জানো এখন কী ঘট—’

একেবারে ঠিক সময়ে পিছিয়ে এলাম। চার-চারবার কেশে উঠল একটা রিভলভার। যেখানে ছিলাম, সেখান থেকে প্রচণ্ড শব্দ পাওয়া গেল; গাড়ির

ভেতরে ওদের নিশ্চয়ই কানে তালা লেগে গেছে। চারটা কালো চোখ ফুটলো। ক্যাডিলাকের ছাদে, আর কিছু একটা আমার কপালে বাতাস দিয়ে এক ইঞ্চি পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে গেল।

‘তোমাকে লাগাতে পেরেছি, উজবুক?’ জিজ্ঞেস করল ডোলান।

‘না।’

যে লোকটা চিৎকার করছিল, সে এবারে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। সামনের সিটে বসে আছে, ওর হাত দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। ডুবন্ত মানুষের হাতের মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, দুর্বলভাবে বাড়ি মারছে উইন্ডশিন্ডে। জিমির ওকে অবশ্যই বের করতে হতো। রক্তক্ষরণের সাথে ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা হচ্ছে লোকটার, ব্যথাটা চলে গেছে সহ্য ক্ষমতার বাইরে।

আরেক জোড়া গুলির শব্দ হল। চিৎকার বন্ধ হয়ে গেল সামনের সিটের লোকটার। উইন্ডশিল্ড থেকে খসে পড়ল হাত।

ডোলান ভাবালু গলায় বলল, ‘আর যন্ত্রণা পাবে না ও। আমরাও একে অন্যের কথা শুনতে পাব।’

কিছু বললাম না আমি। হতবুদ্ধি হয়ে গেছি। নিজেকে অসাড় মনে হচ্ছে। এইমাত্র একজন মানুষকে খুন করেছে সে। সব রকম সতর্কতা অবলম্বন করার পরেও, ওর ক্ষমতার দৌড় পুরোপুরি বুঝতে পারিনি আমি, অবমূল্যায়ন করেছি। বেঁচে যে আছি, সেটা আমার সাত জনমের সৌভাগ্য।

‘তোমাকে আমি একটা প্রস্তাব দিতে চাই,’ ডোলান বলল।

নিজেকে জোর করে সংযত রাখলাম।

‘বন্ধু, আছ?’

নিজেকে ধরে রাখতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে আমাকে।

‘এই! গলাটা যেন হোঁচট খেল। তুমি যদি এখনো উপরে থেকে থাক, কথা বল!

‘আমি আছি,’ শেষ পর্যন্ত বললাম। ভাবছিলাম যে, তুমি এরমধ্যেই ছয়বার গুলি করেছে। ভেবেছিলাম, নিজের জন্য হয়তো একটা হলেও বাঁচিয়ে রাখবে। এখন মনে হচ্ছে, ক্লিপে সম্ভবত আটটা গুলি আছে, অথবা রিলোড আছে তোমার কাছে।

এবারে ওর স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার পালা। কিছুক্ষণ পরে আবার জানাতে চাইল,

‘তোমার পরিকল্পনা কী?’

‘তোমার তো ইতোমধ্যেই অনুমান করতে পারার কথা,’ জবাব দিলাম। ‘শেষ ছত্রিশ ঘন্টা ধরে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কবরটা খুঁড়েছি। এখন, এই জঘন্য ক্যাডিলাকের মধ্যেই আমি তোমাকে মাটি চাপা দেব।‘

ওর কণ্ঠস্বরে আতঙ্ক এখনো জেঁকে বসেনি। আমি চাচ্ছিলাম, আতঙ্কটা চেপে বসুক।

‘তুমি কি আগে আমার প্রস্তাবটা শুনতে চাও?’

‘একটু পরে শুনব। তার আগে একটা জিনিস একটু নিয়ে আসতে হবে আমাকে।‘

ভ্যানে ফিরে গিয়ে শাবলটা নিলাম।

ফিয়ে আসার সময় শুনলাম ডাকছে, রবিনসন? রবিনসন? মনে হচ্ছে। কেউ বুঝি লাইন কেটে যাওয়া ফোনে ডেকেই যাচ্ছে।

‘এখানে,’ ওকে বললাম। ‘তুমি বলে যাও, শুনছি। তোমার বলা শেষ হলে আমিও তোমাকে একটা পাল্টা প্রস্তাব দেব।’

এবারে ওর গলা আগের চেয়ে উল্লসিত শোনাল। পাল্টা প্রস্তাব দেওয়ার অর্থ, আমি চুক্তির কথা বলছি। আর চুক্তির কথা বলার মানে, এরমধ্যেই অর্ধেকটা বাইরে চলে এসেছে সে।

‘আমাকে এখান থেকে বের হয়ে যেতে দিলে, তোমাকে এক মিলিয়ন ডলার দিতে রাজি আছি আমি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ–’

এক বেলচা কাঁকর ও বালু ছুঁড়ে দিলাম ক্যাডিলাকের রিয়ার ডেকের উপরে। কিছু নুড়ি-পাথর লাফিয়ে পেছনের ছোট জানালা থেকে গড়িয়ে পড়ল। ট্রাঙ্কের ভেতরেও ঢুকে গেল কিছু।

‘কী করছ তুমি?’ ওর কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে।

‘অলস হাত শুধু শয়তানি করতে চায়,’ জবাব দিলাম। তাই ভাবলাম, শুনতে শুনতে নিজের কাজ চালিয়ে যাই।

আরেক বেলচা বালু তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিলাম।

আগের চেয়ে দ্রুত কথা বলে উঠল ডোলান, গলায় ব্যাকুলতা ঝরছে।

‘এক মিলিয়ন ডলার আর আমি নিজে নিশ্চয়তা দেব যে, কেউ কখনো তোমাকে স্পর্শ করবে না…শুধু আমি বা আমার লোকেরা না, অন্য কেউও তোমাকে কখনো ছুঁতে পারবে না।’

এখন আর হাতে ব্যথা হচ্ছে না। চমৎকারভাবে কাজ করতে পারছি। একের পর এক বেলচা ভরে মাটি ফেলে যাচ্ছি আমি। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বালুতে ঢাকা পড়ল ক্যাডিলাকের পেছনের ডেক। আসলে, মাটি কাটার চেয়ে গর্ত ভরাট করা অনেক সহজ।

থেমে, বেলচায় ভর দিয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। সামনে ঝুঁকে পড়ে বললাম, বলে যাও।

‘দেখ, এটা পাগলামী,’ ওর গলার তীব্র আতঙ্ক এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মানে, এটা পুরোপুরি পাগলামী।

‘তুমি ঠিকই ধরেছ,’ বলে আরো কিছু বালু ছুঁড়ে দিলাম।

আমার মনে হয়, আর যে কারো চেয়ে নিজেকে অনেক বেশি সময় ধরে রেখেছিল সে, স্বাভাবিকভাবে যৌক্তিক কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু রিয়ার উইন্ডোতে বালুর স্তূপ জমে উঠতেই ওর বিচ্যুতি ঘটল, একই কথা বলতে লাগল বারবার, সেই সাথে শুরু করল তোতলামি। একবার প্যাসেঞ্জার ডোরটা যতটা সম্ভব খুলে গেল এবং ধরাম করে বাড়ি খেল গর্তের পাশের দেয়ালে। এক আঙুলে কালো লোম, আর দ্বিতীয় আঙুলে একটা রুবি বসানো আঙটি দেখতে পেলাম আমি। দ্রুত বেলচা ভরে ঝুর ঝুরে মাটি খোলা জায়গাটায় ছুঁড়ে দিলাম। চিৎকার করে, গালাগাল দিয়ে ঝটকা টানে দরজাটা আবার বন্ধ করে দিল সে।

তারপর ভেঙে পড়তে আর বেশি সময় লাগেনি। আমার মনে হয়, ক্রমাগত নেমে আসা বালুর শব্দই ওকে কাবু করে ফেলেছিল। উঁহু, আমি নিশ্চিত।

ক্যাডিলাকের ভেতরে নিশ্চয়ই অনেক জোরে শব্দ হচ্ছিল।

বালু আর নুড়ি পাথরগুলো ছাদের উপর থেকে গড়িয়ে, জানালা বেয়ে নিচে পড়ছিল। শেষ পর্যন্ত ও বুঝতে পেরেছিল সত্যিটা। সুসজ্জিত, আট-সিলিন্ডার বিশিষ্ট ইঞ্জিনের আরামদায়ক এক কফিনের ভেতরে বসে আছে সে।

‘বের কর আমাকে!’ তীক্ষ্ণ স্বরে কেঁদেই ফেলল সে। দয়া কর! আর সহ্য করতে পারছি না আমি। বের কর আমাকে!

জানতে চাইলাম, ‘তুমি কি সেই পাল্টা প্রস্তাবের জন্য প্রস্তুত?

‘হ্যাঁ! হ্যাঁ! হায় ঈশ্বর! হ্যাঁ!’

‘চিৎকার করতে থাক! এটাই পাল্টা প্রস্তাব, আমি এটাই চাই। চেঁচাও, আমার জন্য চেঁচাও। যথেষ্ট জোরে চিৎকার করতে পারলে হয়তো তোমাকে বেরুতে দেব আমি।’

ডোলানের তীক্ষ্ণ, ভীষণ চিঙ্কারে ভরে উঠল চারপাশ।

‘ভালো হয়েছে!’ ওকে বললাম। কিন্তু যথেষ্ট ভালোর ধারে-কাছেও আসেনি এখনো।

আবার খুঁড়তে শুরু করলাম, বেলচার পর বেলচা ভরে মাটি-পাথর ছুঁড়ে দিচ্ছি ক্যাডিলাকের উপরে। কাদা-মাটির দলা উইন্ডশিল্ড দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে, ভরে ফেলছে ওয়াইপারের স্লট।

আবারো চিৎকার দিল সে। এবারেরটা আগের চেয়েও জোরে হয়েছে। ভাবতে চেষ্টা করলাম, একজন মানুষের পক্ষে এত জোরে চিৎকার করা কীভাবে সম্ভব? ওর তো বাকযন্ত্র ফেটে যাওয়ার কথা!

‘খারাপ না!’ বললাম, কাজের গতি দ্বিগুন করে ফেলেছি। পিঠ ব্যথা করলেও আমি হাসছি। তুমি হয়তো শেষ পর্যন্ত মুক্ত হওয়ার মতো জোরে চিৎকার করতে পারবে ডোলান-হয়তো সত্যিই পারবে।’

‘পাঁচ মিলিয়ন। এটাই ছিল ওর বলা শেষ কান্ডজ্ঞান সম্পন্ন কথা।

‘ওতে হবে না, ওকে জানালাম। বেলচার উপরে নুয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছি, ময়লা ঢাকা হাতে মুছে নিচ্ছি কপালের ঘাম। বালু মাটিতে গাড়ির এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত ঢাকা পড়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেন, একটা বড় হাতের মুঠো সাঁড়াশির মতো চেপে ধরেছে ভোলানের ক্যাডিলাক। কিন্তু আট-স্টিকের ডিনামাইট ১৮৬৮ মডেলের শেভ্রোলের ইগনিশনে লাগিয়ে দিলে যে শব্দ হবে, তুমি যদি অতটা জোরে চেঁচাতে পার, কথা দিচ্ছি, তোমাকে বের করে আনব আমি। বিশ্বাস কর!

কথা শুনে চিৎকার করে উঠল সে। আর, আমি বেলচা দিয়ে আরো কিছু বালু ছুঁড়ে দিলাম। বারকয়েক সত্যি সত্যি প্রচন্ড জোরে চিৎকার করল সে। কিন্তু ভেবে দেখলাম, সর্বোচ্চ দুই-স্টিকের ডিনামাইটেই এমন শব্দ হবে, বড়জোর তিন।

ঘড়ি দেখলাম, সবে মাত্র বেলা একটা পেরিয়েছে। আবারো রক্ত ঝরছে হাত থেকে, এবং বেলচার হাতলটা পিচ্ছিল হয়ে গেছে। বাতাসের তোড়ে ভেসে আসা কিছু নোংরা বালু মুখে ঢুকে গেলে, পিছিয়ে এলাম আমি। মরুর দমকা হাওয়া অদ্ভুত অস্বস্তিকর শব্দ তৈরি করে, দীর্ঘ একঘেয়ে শনশন শব্দে বইতেই থাকে। শুনে মনে হবে, কোনো পাজি ভূতের কাজ।

গর্তের দিকে ঝুঁকে ডাক দিলাম, ‘ডোলান?’

কোনো উত্তর নেই।

‘চিৎকার কর, ডোলান।‘

কোনো উত্তর নেই-একটু পরেই একটানা কর্কষ স্বরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ-এর মতো করে একটা গলা চেঁচিয়ে যেতে লাগল।

‘সন্তোষজনক!’

ভ্যানে ফিরে গিয়ে ওটা স্টার্ট করে দেড় মাইল চালিয়ে এসে, যেখানে রাস্তার কাজ চলছিল, সেখানে চলে এলাম। আসার পথে ডব্লিউকেএক্সআর লাস ভেগাস চালু করলাম। আমার ভ্যানের রেডিও একমাত্র এই স্টেশনটাই ধরতে পারে। গায়ক ব্যারি ম্যানিলো বলছিল, ওর লেখা একটা গান সারা পৃথিবী গেয়েছে। ঠিক বিশ্বাস হলো না কথাটা। এরপর শুরু হলো আবহাওয়া-বার্তা। ঝড়ো হাওয়ার পূর্বাভাস দিল-ভেগাস আর ক্যালিফোর্নিয়ার মাঝের প্রধান সড়কগুলোতে কেউ আসলে যেন ভেবেচিন্তে আসে। ডিস্ক জকি জানাল, বালু ঝড়ের জন্য দেখতে মারাত্মক সমস্যা হতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকতে হবে উইন্ড-শিয়ার, মানে, অল্প দূরত্বের মাঝে বায়ু প্রবাহের বেগের ওঠা-নামা নিয়ে। লোকটা কিসের কথা বলছে, সেটা ভালোই বুঝতে পারছিলাম। কারণ, ইতোমধ্যেই ওটা ভ্যানের গায়ে আঁচড় দিতে শুরু করেছে।

আমার বাকেট-লোডারটা এখানেই ছিল; হ্যাঁ, ওটাকে আমি এর মধ্যেই নিজের ভাবতে শুরু করেছি। ব্যারি ম্যানিলোর সুর ভাঁজতে ভাঁজতে ভেতরে ঢুকলাম, এবং নীল আর হলুদ তার দুটোকে আবারো স্পর্শ করালাম। চালু হয়ে গেল লোডারটা। এবার আর গিয়ার নিউট্রালে দিতে ভুল হয়নি। মাথার ভেতর টিংকারের গলা শুনতে পেলাম, খারাপ না। শিখে যাচ্ছে।

হ্যাঁ। সর্বদাই শিখছি।

মিনিট খানেকের জন্য বসলাম আমি, বাকেট-লোডারের ইঞ্জিনের গুড় গুড় শব্দ শুনতে শুনতে ভাবলাম, ডোলান কী করছে। সত্যিকার অর্থেই এটা ওর জন্য এক বিরাট সুযোগ। রিয়ার উইন্ডো ভাঙার চেষ্টা করতে পারে সে, কিংবা উইন্ডশিল্ড। দুটোর উপরেই যদিও কয়েক ফিট করে মাটি ফেলেছি আমি, তারপরেও এটা সম্ভব। নির্ভর করছে এখনও সে কতোটা উদ্যমী আছে, তার উপর। এ নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই আমার। কাজেই, ভেবে লাভও নেই।

বাকেট-লোডারটা গিয়ারে ফেলে, চালিয়ে গর্তের ওখানে নিয়ে এলাম। ওখানে পৌঁছে, গুটি গুটি পায়ে উৎকণ্ঠা নিয়ে এগিয়ে গিয়ে নিচে তাকালাম। ভয় পাচ্ছিলাম যে, ক্যাডিলাকের উপরের মাটির স্তূপের মাঝে মানুষের আকারের ইঁদুরের গর্ত দেখব, যেখান দিয়ে গাড়ির কাঁচ ভেঙে, হামাগুড়ি দিয়ে ভোলান বেরিয়ে গেছে।

কিন্তু এসে দেখি, যেভাবে রেখে গিয়েছিলাম, সব ওভাবেই আছে।

‘ডোলান,’ অনেক আগ্রহ নিয়ে ডাকলাম আমি।

কোনো উত্তর এলো না।

‘ডোলান।‘

কোনো উত্তর নেই।

হয়তো আত্মহত্যা করেছে, ভাবলাম আমি। তিক্ত হতাশায় মন ছেয়ে গেল। কোনোভাবে আত্মহত্যা করেছে, কিংবা ভয়েই মরে গেছে।

‘ডোলান?’

অট্টহাসির একটা সোত মাটির স্তূপ থেকে উঠে এলো; স্পষ্ট, উন্মত্ত, পুরো অট্টহাসি। অনুভব করলাম আমার মাংসপেশী শক্ত হয়ে গেছে। মাথা একদম খারাপ না হয়ে গেলে কেউ এভাবে হাসতে পারে না।

কর্কষ হাসির লেজ ধরে এলো গলা ফাটানো চিৎকার; তারপর আবার হাসি। শেষে একসাথে দুটোই করতে লাগল সে।

ক্ষণিকের জন্য আমিও ওর সাথে সাথে হাসলাম, কিংবা চিত্তার করলাম; মানে, হবে আরকি একটা কিছু।

তারপরে কেস-জর্ডানে ফিরে গিয়ে, ব্লেডটী নামালাম, সত্যিকার অর্থেই কবর দিতে শুরু করেছি।

মাত্র চার মিনিটের মাঝে ক্যাডিলাকের আকারটাও হারিয়ে গেল। পড়ে রইল শুধু মাটি ভরা একটি গর্ত।

এ সময় মনে হলো যেন, কিছু একটা শুনলাম। কিন্তু বাতাস আর লোডারের ইঞ্জিনের পাল্লা দেওয়া ধারাবাহিক গর্জনের মাঝে ওটা কী ছিল, ঠিক বুঝতে পারিনি। হাঁটুতে ভর দিয়ে বাঁকা হলাম আমি; তারপর গর্তের অবশিষ্টাংশে মাথা ঝুলিয়ে দিয়ে সটান শুয়ে পড়লাম।

নিচে; মাটি, বালু আর কাঁকরের নিচে এখনো হাসছে ডোলান। ভেসে আসা শব্দটার কথা আপনি হয়তো কমিক বইতে পড়ে থাকবেন : হি-হি-হি, আহ-হা-হা-হা। সে হয়তো কিছু কথাও বলছে, কে জানে? বাইরে থেকে বলা কঠিন। সব শুনে, হেসে মাথা নাড়লাম।

‘চিৎকার করো,’ ফিসফিসিয়ে উঠলাম আমি। ‘যত ইচ্ছা, চিৎকার কর।’ কিন্তু বিষাক্ত গ্যাসের মতো হাসির দুর্বল শব্দটা মাটির ভেতর থেকে উঠে আসতেই লাগল।

হঠাৎ একটা অন্ধকার ছায়া দেখে আতঙ্কে জমে গেলাম। মনে হলো, ডোলান আমার পেছনে! হ্যাঁ, কোনো একভাবে ডোলান আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে! আর আমি ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই সে আমাকে ধাক্কা দিয়ে গর্তে ফেলে দেবে, এবং…

অনেকটা লাফিয়ে ওঠার মতো পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম, রুক্ষ খসখসে কিছু একটার অস্তিত্ব টের পেলাম আমার বিক্ষত হাতে।

বাতাসে বয়ে আসা বালুর ঝটকা লাগল শরীরে।

কিন্তু আর কিছু নেই।

নোংরা রুমালটা দিয়ে মুখ মুছে নিয়ে, বাকেট-লোডারের ক্যাবে উঠে আবার কাজে মন দিলাম।

অন্ধকার নামার অনেক আগেই ভরে গেল কাটা জায়গাটা। কিন্তু বাতাসে উড়িয়ে নেওয়ার পরেও স্তূপটায় আরো মাটি বাকি রয়ে গেল। কারণ, ক্যাডিলাক গর্তের অনেকটা জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাজটা তাড়াতাড়ি হয়ে গেল…খুব তাড়াতাড়ি।

টের পেলাম, মননে-মস্তিষ্কে ক্লান্তি জেঁকে বসছে। দ্বিধান্বিত এবং আধা বিকারগ্রস্থ আমি তখন লোডারটাকে ভোলানকে যেখানে কবর দেওয়া। হয়েছে, তার উপর দিয়ে সোজা চালিয়ে দিলাম।

ওটাকে আগের জায়গায় নিয়ে এসে পার্ক করে, আমার গায়ের শার্টটা খুলে ক্যাবের সব ধাতব জিনিসগুলো ঘষে ঘষে মুছলাম, হাতের ছাপ মুছে ফেলছি। এই কাজটা ঠিক কেন করলাম, আমি জানি না। কারণ, সারাদিন মিলে চারপাশের আরো হাজারটা জায়গায় নিজের ছাপ রেখে যাচ্ছি আমি। তারপর ঘন, বাদামি-ধূসর, আধো অন্ধকারে ঢাকা ঝড়ো গোধূলীতে ভ্যানে ফিরে এলাম।

ভ্যানের পেছনের দরজাটা খুলে দেখলাম, ভেতরে ভোলান গুটিসুটি মেরে বসে আছে কি না। তারপর, টলোমলো পায়ে পিছিয়ে এসে হাত উপরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে, মুখের সামনে ঢালের মতো করে ধরে, ওর নাম। ধরে চিৎকার করে উঠলাম। মনে হচ্ছিল, হৃৎপিন্ডটা বুঝি বুকের ভেতরে বিস্ফোরিত হবে।

কিন্তু কেউ বেরিয়ে এলো না। দরজাটা কিছুক্ষণ আন্দোলিত হয়ে, দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল বাতাসের ঝাঁপটায়। শেষ পর্যন্ত হামাগুড়ি দিয়ে এগোলাম, হৃৎপিন্ডটা ধড়ফড় করছে, লাফাচ্ছে। অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে ভেতরে তাকালাম আমি। আমার ফেলে যাওয়া জিনিসপত্রের জঞ্জাল ছাড়া আর কিছুই নেই-বা ভাঙা সেই তীর চিহ্ন, জ্যাক আর আমার টুলবক্স।

‘নিজেকে শান্ত করতে হবে তোমাকে,’ নরম গলায় বললাম, ‘নিজেকে সংযত করতে হবে।

এলিজাবেথের গলা শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, সব ঠিক হয়ে যাবে, সোনা…বা এ ধরনের কিছু একটা…কিন্তু বাতাসের শব্দ ছাড়া আর কিছু ভেসে এলো না।

ভ্যানে করে গর্তটার দিকে অর্ধেক পথ এগিয়ে গেলাম আবার। নিজেকে জোর করে ওটুকুই নিতে পারলাম। বোকার মতো হলেও, বারবার শুধু মনে হচ্ছিল, ডোলান ভ্যানের পেছনে ওঁৎ পেতে আছে। বারবার রিয়ার ভিউ মিররের দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল, অন্ধকারের ছায়ায় খুঁজে ফিরছিল ওর অবয়ব।

প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়ে উঠেছে বাতাস, বাতাসের তোড়ে ভ্যানটা স্প্রিংয়ের উপরে রীতিমতো লাফাচ্ছে। শুরু হলো ধুলি ঝড়, এর ভেতর দিয়ে চালিয়ে যেতে যেতে মনে হচ্ছে যেন হেডলাইটের সামনে থেকে ধোঁয়া উঠছে।

শেষ পর্যন্ত রাস্তার এক পাশে ভ্যানটা পার্ক করে বেরিয়ে এলাম। জানতাম, এর মাঝে বাইরে ঘুমানোর চেষ্টা করাও পাগলামি, কিন্তু ভেতরে কোনোভাবেই ঘুমাতে পারতাম না আমি। তাই আমি হামাগুড়ি দিয়ে স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে ভ্যানের তলে ঢুকে গেলাম।

ব্যাগের চেইন লাগিয়ে শুয়ে পড়ার পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

জেগে উঠলাম দুঃস্বপ্ন দেখে। কিন্তু ঘুম ভাঙার পরে তেমন কিছু মনে করতে পারলাম না। শুধু মনে হচ্ছিল, কেউ যেন আমার গলা টিপে ধরেছিল। টের পেলাম, আমাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছে। নাকের উপরে বালু, কানের ভেতরে বালু। বালু এমনকি গলার ভেতরেও ঢুকে গেছে, শ্বাসরোধ করছে।

চিৎকার করে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলাম আমি। প্রথমে মনে হচ্ছিল, স্লিপিং ব্যাগটাই বুঝি দুনিয়া। তারপর দুম করে বাড়ি খেলাম ভ্যানের তলার সঙ্গে। দেখলাম, মরচে ধরা লোহার চলটা খসে পড়ছে।

গড়িয়ে বেরিয়ে এসে দেখি, বাইরে ভোরের আলো ফুটছে। শরীরের ওজন সরে যাওয়া মাত্রই স্লিপিং ব্যাগটা খড়-কুটোর মতো উড়ে গেল। বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠে প্রায় বিশ ফিটের মতো ওটার পিছু ধাওয়া করলাম। তারপর বুঝলাম, শুধু শুধু গাধামী করছি। দৃষ্টিসীমা বিশ গজ কিংবা আরো কমে নেমে এসেছে। এরপরে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। রাস্তার প্রায় পুরোটাই ঢাকা পড়ে গেছে। ভ্যানের দিকে ফিরে দেখলাম, প্রায় ক্ষয়ে গেছে ওটা; পুরনো গাঢ় বাদামি ফটোগ্রাফের মতো দেখাচ্ছে।

দুর্বল পায়ে এগিয়ে গিয়ে, চাবি খুঁজে বের করে ভেতর ঢুকলাম। এখনো থুতুর সাথে বালু বেরিয়ে আসছে, তার উপরে ধরেছে খুশখুশে কাশি। ভ্যান স্টার্ট দিয়ে যে পথে এসেছিলাম, সে পথ ধরেই ফিরে চললাম আবার। আবহাওয়া-বার্তার জন্য অপেক্ষা করার কোনো প্রয়োজন ছিলো না; সবাই রিপোের্ট করতে পারবে এই আবহাওয়ায়। নেভাডার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ মরুঝড় হয়েছে, হচ্ছে। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সব রাস্তাঘাট। নিরুপায় না হলে বাড়ি ছেড়ে বেরুবেন না। নিরুপায় হলেও, যথাসম্ভব বাড়িতেই থাকতে চেষ্টা করুন।

গ্লোরিয়াস জুলাই ফোর্থ। গৌরবের চতুর্থ জুলাই।

ভেতরে থাক। এখন বের হতে চাওয়ার অর্থ, তুমি একটা আস্ত পাগল। বালুতে একেবারে অন্ধ হয়ে যাবে।

এই সুযোগটা আমি নেব। কবরটাকে চিরজীবনের জন্য ঢেকে দেওয়ার এটা একটা সুবর্ণ সুযোগ-আমার সবচেয়ে উন্মত্ত কল্পনাতেও এমন কোনো সুযোগের স্বপ্ন ছিল না। কিন্তু সুযোগটা এখন সামনে চলে এসেছে, এবং আমি এটা নিতে যাচ্ছি।

তিন থেকে চারটা বাড়তি কম্বল সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম। ওর একটা থেকে লম্বা-চওড়া একটা ফালি কেটে বেঁধে নিলাম মাথার চারপাশে। খ্যাপা বেদুইনদের মতো লাগছিল আমাকে। ওভাবেই বেরিয়ে এলাম।

পুরো সকালটা আমি ফেলে আসা অ্যাসফ্যাল্টের টুকরোগুলো নালা। থেকে তুলে এনে গর্তটায় বসানোর কাজে ব্যয় করলাম। একজন মিস্ত্রি যেভাবে দেয়াল তোলে, সেরকম সুবিন্যস্তভাবে কাজটা করার যথাসম্ভব চেষ্টা করলাম আমি। নালা থেকে তুলে বয়ে নিয়ে আসাটা তেমন কঠিন কোনো কাজ ছিলো না। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ববিদরা মাটি খুঁড়ে যেভাবে আর্টিফ্যাক্ট বের করেন, একইভাবে আমাকে প্রত্যেকটি অ্যাসফ্যাল্ট ব্লক মাটি খুঁড়ে বের করতে হচ্ছিল। তার উপরে, বাতাসের সাথে ভেসে আসা বালুর হাত থেকে বাঁচতে এবং বালুঝড়ের তীক্ষ্ণ বিষাক্ত হুল ফোঁটানো থেকে চোখকে বিশ্রাম দিতে প্রতি বিশ মিনিট পরপর আমাকে ভ্যানে ফিরে যেতে হচ্ছিল।

ভোর ছয়টার দিকে পশ্চিমে, গর্তের অগভীর প্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে কাজ শুরু করেছিলাম, আর দুপুর সোয়া বারোটায় শেষ সতের ফুট কিংবা কাছাকাছি পৌঁছালাম। ততক্ষণে বাতাসের বেগ পড়তে শুরু করেছে এবং মাথার উপরে জায়গায় জায়গায় জমাট বাঁধছে নীলচে মেঘ।

নিয়মিত হারে ব্লক বয়ে এনে লাগিয়েই যাচ্ছি। হিসেবমতে, ভোলানের যেখানে থাকার কথা, এখন আমি ঠিক সেখানে এসে পৌঁছেছি। ও কি এতক্ষণে মরে গেছে? একটা ক্যাডিলাক কত ঘনফুট বাতাস ধরে রাখতে পারে? ডোলানের সাথের কেউ যদি শ্বাস না নেয়, তাহলে ঠিক কত দ্রুত ওই জায়গাটা একজন মানুষের জীবন ধারণের অনুপোযোগী হয়ে পড়বে?

হাঁটুতে ভর দিয়ে দাঁড়ালাম। বাতাসে কেস-জর্ডানের ছাপ অনেকেটা ক্ষয়ে গেলেও এখনো পুরোপুরি মুছে যায়নি। এই বিলুপ্তপ্রায় খাঁজ কাটা দাগগুলোর নিচে কোথাও রোলেক্স পরা একজন মানুষ পড়ে আছে।

‘ডোলান,’ আনন্দিত গলায় বললাম, ‘মত পাল্টেছি আমি। ঠিক করেছি। তোমাকে বেরুতে দেব।’

কোনো শব্দই পাওয়া গেল না। এতক্ষণে নিশ্চয়ই মরে গেছে সে। ফিরে গিয়ে আরেক টুকরো অ্যাসফাল্ট নিয়ে এলাম। ওটা বসিয়ে যখন উঠে দাঁড়াতে শুরু করেছি, মুরগীর ডাকের মতো ক্ষীণ একটা হাসির শব্দ মাটির আস্তরণ চুঁইয়ে বেরুতে শুনলাম।

মাথা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে গুটিসুটি মেরে নিচু হলাম আমি-মাথায় চুল থাকলে ওগুলি নিশ্চয়ই এখন আমার মুখের উপ ঝলত। কিছু সময়ের জন্য ওভাবেই রইলাম আমি। শব্দটা ক্ষীণ এবং বেসুমে। শোনাচ্ছে।

শব্দটা যখন থেমে গেল, ফিরে গিয়ে আরেকটা অ্যাসফ্যান্ট নিয়ে এলাম আমি।

এই টুকরোটায় ভাঙা হলুদ রংয়ের একটা লাইন টানা ছিল। হাইফেনের মতো দেখাচ্ছিল ওটাকে। টুকরোটা নিয়ে হাঁটু ভেঙে বসলাম।

‘ঈশ্বরের দোহাই লাগে!’ তীক্ষ্ণ স্বরে কেঁদে উঠল সে। ঈশ্বরের দোহাই লাগে, রবিনসন!

‘হ্যাঁ,’ কথা শুনে হেসে ফেললাম। ‘ঈশ্বরের দোহাই!

অ্যাসফ্যাল্টের টুকরোটা আগেরটার পাশে বসিয়ে দিলাম। মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করলাম আরো কিছু বলছে কি না। কিন্তু আর কিছু শুনতে পেলাম না।

রাত এগারোটার দিকে ভেগাসে, আমার বাসায় ফিরে এলাম। মোল ঘন্টা টানা ঘুমিয়ে উঠলাম আমি। উঠে, কফির জন্য কিচেনে যাওয়ার সময় ভেঙে পড়ে গেলাম, পোকার মতো মোচড়াচ্ছি। পিঠের মাংসপেশী সঙ্কুচিত হয়ে দৈত্যের মতো চেপে ধরেছে আমাকে। কোমরের কাছে, পিঠের বাকা অংশটা এক হাতে চেপে ধরলাম, অন্য হাতটা কামড়ে ধরে আর্তনাদ ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি।

কিছুক্ষণ পর হামাগুড়ি দিয়ে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলাম-দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম একবার, এবং পরিণামে আরেকটা বজ্রাঘাত হলো। ওয়াশস্ট্যান্ড ধরে অনেক কষ্টে নিজেকে কিছুটা টেনে তুলে, মেডিসিন কেবিনেট থেকে দ্বিতীয় বোতল অ্যাম্পিরিন খুঁজে নিলাম।

তিনটা ট্যাবলেট গিলে নিয়ে, বাথটাব ভরতে দিলাম। তারপর, মেঝেতে শুয়ে অপেক্ষা করলাম ভরার জন্য। ভরে গেলে, শরীর কিছুটা মুচড়ে, পায়জামাটা খুলে কোনোরকমে টাবে নেমে গা এলিয়ে দিলাম। পাঁচ ঘন্টার মতো শুয়ে ছিলাম ওখানে, পুরোটা সময় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ছিলাম। যখন উঠলাম, ততক্ষণে আবার হাঁটতে পারছি।

তবে খুব সামান্য।

একজন কাইরোপ্র্যাক্টরের কাছে গেলে ও আমাকে বলল, দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী তরুনাস্থির যে পর্দা থাকে, ওরকম তিনটি পর্দা ছিঁড়ে গেছে, নিচের দিকের কশেরুকাগুলোর মারাত্মক স্থানচ্যুতি হয়েছে। জানতে চাইল, সাকার্স-স্ট্রংম্যানের বিকল্প হিসেবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কি না।

জানালাম, আমার বাগানে খোঁড়াখুঁড়ি করতে গিয়ে এমনটা হয়েছে।

লোকটা আমাকে ক্যানসাস সিটিতে যেতে বলল, অপারেশন করাবে। আমি গেলাম সেখানে। আমাকে অজ্ঞান করার জন্য অ্যানেস্থেশিওলজিস্ট যখন মুখের উপরে রাবার কাপটা রাখল, ভেতরের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসা হিস হিস শব্দের সাথে শুনতে পেলাম, ডোলান হাসছে। ও জানে, মারা যাচ্ছি আমি। রিকভারি রুমটা জলজ-সবুজ টাইলস করা।

শুকনো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি বেঁচে আছি?

নার্স হেসে ফেলল। ‘হ্যাঁ। এক হাতে আমার ভ্রু স্পর্শ করল সে, ওগুলো উঠে প্রায় মাথার কাছে চলে এসেছে। ‘হায় ঈশ্বর, রোদে এমন পোড়া পুড়েছ! ব্যথা করছে, নাকি এখনো ওষুধের ঘোরে আছ?

‘ঘোরে আছি। আমি কি এরমাঝে কোনো প্রলাপ বকেছি?’

‘হ্যাঁ।’

টের পেলাম, সারা শরীর বরফ হয়ে গেছে। হাড়ের মাঝেও কাঁপুনি টের পাচ্ছি। কী বলেছি আমি?

‘বলছিলেন, এখানে বড় অন্ধকার। আমাকে বের কর!’ আবার হেসে ফেলল সে।

‘ওহ!’ বললাম।

ওরা আর কখনো খুঁজে পায়নি ডোলানকে।

সেই ঝড়টা। আকস্মিক ওই ঝড়টাই এই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। পরবর্তীতে ওখানে কী কী ঘটেছে, সে ব্যাপারে আমি মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু খুব কাছ থেকে যাচাই করতে আর যাইনি আমি। কেন, তা তো বুঝতেই পারছেন।

আরএপিভি মনে পড়ে? রিপেভিং, মানে রাস্তায় ইট-পাথরের আবরণ দিচ্ছিল ওরা। রুট একাত্তরের যে অংশটা বিকল্পপথ দিয়ে বন্ধ করা হয়েছিল, ঝড়টা ওটাকে পুরোপুরি বালু চাপা দিয়ে দিয়েছিল। রাস্তার কর্মীরা যখন আবার কাজে যোগ দিয়েছে, তারা তখনই সব বালু সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েনি। কোনো গাড়ি যেহেতু এদিক দিয়ে যাচ্ছে না, তাই চিন্তারও কিছু ছিল না। ফলে ওরা ধীরে ধীরে বালু এবং পুরনো পেভিংটা সরিয়েছে, আবার একই সাথে নতুন ইট-পাথর বসিয়ে দিয়েছে। ডোজার-চালক যদি খেয়াল করেও থাকে যে, চল্লিশ ফিটের মতো বড় একটি অংশের অ্যাসফ্যান্ট তার ব্লেডের সামনে জ্যামিতিক বর্গাকৃতিতে উঠে যাচ্ছে, সে কিছুই বলেনি। হয়তো আধ-মাতাল অবস্থায় ছিল কিংবা প্রিয়তমাকে নিয়ে সন্ধ্যায় ঘুরতে বেরুনোর ইচ্ছে ছিল, কে জানে?

তারপর ডাম্পস্টারে করে নতুন নুড়ি-পাথর এসেছে, সাথে এসেছে স্প্রেডার ও রোলার। এরপর নিশ্চয়ই পেছনে চওড়া স্পেয়ার লাগানো বড় ট্যাংকারটি এসে পৌঁছেছে। সাথে ছিল জুতোর গলন্ত-চামড়ার মতো গরম আলকাতরার গন্ধ। তারপরে যখন নতুন অ্যাসফ্যাল্ট শুকোবে, তখন আসবে লাইন টানার মেশিন। রোদ নিবারক ছাতার নিচে বসে ড্রাইভার লোকটা বারবার পেছন ফিরে নিশ্চিত হতে চাইবে, বিচ্ছিন্ন হলুদ লাইনগুলো ঠিকভাবে সোজা হচ্ছে কি না। কিন্তু জানতে পারবে না, একটা ধূসর ক্যাডিলাকের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে সে। ওটার ভেতরে রয়ে গেছে তিন তিনজন মানুষ। জানবে না, নিচের অন্ধকারে একটা রুবির আঙটি ও স্বর্ণের রোলেক্স পড়ে আছে, যেটা হয়তো আজো সময় গুনে যাচ্ছে।

এই ভারি যানগুলোর কোনো একটির চাপে যে কোনো সাধারণ ক্যাডিলাকের দেবে যাওয়ার কথা। হয়তো কাত হয়ে যেত এক পাশ, ভেঙে পড়ার মচমচে শব্দে সবাই ছুটে আসত, একদল লোক খুঁড়ে দেখত এবং আবিষ্কার করে ফেলত সবকিছু। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই ওটা যতটা না গাড়ি ছিল, তারচেয়ে বেশি ছিল ট্যাংক। সবাইকে দূরে রাখতে ভোলান যথেষ্ট সচেষ্ট ছিল। এই অতিসতর্কতাই এখন ওকে সবার থেকে অনেক দূরে রাখবে।

আগে হোক পরে হোক, ক্যাডিলাকটি একদিন অবশ্যই ভেঙে পড়বে। হয়তো কোনো সেমি (ট্রাক্টর ও ট্রেইলারযুক্ত ট্রাক) পেরিয়ে যাওয়ার সময় ওজনের চাপে ভেঙে যাবে, এবং পশ্চিম পাশের লেন ধরে যাওয়ার সময় পরের গাড়িটি রাস্তায় একটি বড় ভাঙা গর্ত মতোন দেখতে পাবে। এ ব্যাপারে হাইওয়ে ডিপার্টমেন্টকে জানানো হলে, সেখানে তখন আরেকটি আরপিএভি হবে। কিন্তু সেখানে যদি ঠিক কী ঘটেছে, তা দেখার জন্য কোনো হাইওয়ে ডিপার্টমেন্টের কর্মী হাজির না হয়, এবং ট্রাকের ওজনে নিচের ফাঁপা কিছু ভেঙে পড়ল কি না, সেটা পর্যবেক্ষণের চেষ্টা না করে; তাহলে ওরা ধরে নেবে এই মার্শ হোল’ (এ ধরনের গর্তগুলোকে ওরা এ নামেই ডাকে) তৈরি হয়েছে হয় তুষার, নয়তো জমাট লবনের স্তূপ ধ্বসে পড়ার ফলে। কিংবা কোনো মরু-ভূমিকম্পের কারণে। ওটা তারা সেভাবেই মেরামত করে দেবে এবং আবারো সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে।

ডোলান নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ প্রচারিত হলো।

অশ্রুপাতও হলো কিছু।

লাস ভেগাস সানের একজন কলামিস্ট লিখলেন, সে হয়তো কোথাও জিমি হফারের সাথে ডমিনো কিংবা পুল খেলছে।

কে জানে, এটা হয়তো সত্যির কাছা কাছি হতেও পারে!

আর আমি, আমি খুব ভালো আছি। আমার পিঠের অবস্থা এখন অনেকটাই ভালো। ডাক্তার কড়া নির্দেশ দিয়েছেন, কারো সাহায্য ছাড়া ত্রিশ পাউন্ডের চেয়ে ভারি কিছু যেন কোনোভাবেই বহণ না করি। এদিকে, তৃতীয় শ্রেণিতে একদল চমৎকার ছেলে-মেয়ে পেয়েছি এ বছর। প্রয়োজনে ওরা আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করে।

আমার নতুন অ্যাকুরা গাড়িতে করে বেশ কয়েকবার সেই বিস্তৃত লম্বা রাস্তাটা দিয়ে আসা-যাওয়া করেছি। একবার তো ওখানে নেমে গিয়ে (রাস্তা পুরোপুরি ফাঁকা নিশ্চিত হওয়ার পরে) প্রস্রাবও করেছি। কিন্তু কিডনি ভরা থাকলেও, অনেক চেষ্টার পরেও অতটা প্রষাব হয়নি। আর, চলে আসার সময় রিয়ারভিউ মিররে বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল। কোনো এক বিচিত্র কারণে আমার মনে হচ্ছিল, দারুচিনির মতো পোড়া চামড়া, মমির মতো খুলি, বালু ভরা চুল, চোখ আর ঝলমলে রোলেক্স নিয়ে ডোলান বুঝি এখনই পেছনের সিট থেকে বেরিয়ে আসবে।

আসলে, সেবারই আমি শেষ রুট একাত্তরে গিয়েছিলাম। এখন পশ্চিমে যাওয়ার প্রয়োজন হলে আমি ইন্টারস্টেট দিয়ে যাই।

আর এলিজাবেথ? ভোলানের মতো সে-ও নীরব হয়ে গেছে। আর, এতে আমিও পরম স্বস্তি খুঁজে পেয়েছি।

1 Comment
Collapse Comments
দারাশিকো.কম December 29, 2022 at 8:16 am

প্রতিশোধের দীর্ঘ অপেক্ষা আর অবর্ণনীয় পরিশ্রমের অসাধারণ বর্ণনা। খুব ভালো লেগেছে৷ রুট একাত্তর দিয়ে কখনও গেলে ডোলানের কথা ভাববো আমি। ধন্যবাদ অনুবাদক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *