১. কেবল অপেক্ষা

ডোলান’স ক্যাডিলাক – স্টিফেন কিং

প্রতিশোধ যত ঠান্ডা হয়, ততই সুস্বাদু হয়ে ওঠে
– একটি স্প্যানিশ প্রবাদ

সূচনা

দীর্ঘ সাত বছর ধরে আমি কেবল অপেক্ষা করছি আর নজর রাখছি। ওকে আসতে দেখেছি, দেখেছি বেরিয়ে যেতে। ডোলান। গায়ে চমৎকার টাক্সিডো স্যুট ও সঙ্গে বাহুলগ্না মেয়ে নিয়ে দামি সব রেস্টুরেন্টে ঢুকতে দেখেছি ওকে দিনের পর দিন। ওসব মেয়ের কাউকে ওর সঙ্গে দু-বার দেখিনি। দু-জন দেহরক্ষী আছে ওর। তারা ওকে সব সময় পেছন থেকে আগলে রাখে।

মানুষটার ধূসর চুল সময়ের সাথে সাথে চমৎকার রুপালি হয়ে উঠতে দেখেছি আমি। এদিকে আমার চুল দিনে দিনে ঝরে গেছে। টাক হয়ে গেছি পুরোপুরি। গাড়িবহর নিয়ে লাস ভেগাস থেকে নিয়মিত ওয়েস্ট কোস্টে আসতে দেখেছি ওকে দেখেছি ফিরে যেতে। পাশের ছোট রাস্তা থেকে ওর চুলের মতোই রুপালি সিডান ডি ভেলিটাকে রুট একাত্তর ধরে সাঁই করে বেরিয়ে যেতে দেখেছি। এমনকি বার কয়েক ওকে হলিউড হিসের বাড়ি থেকে ধূসর ক্যাডিলাকে চড়ে বেরিয়ে যেতেও দেখেছি। আবার, একই গাড়িতে করে ওকে ফিরে আসতে দেখেছি লাস ভেগাসে। যদিও নিয়মিত এসব করার মতো সময় হতো না আমার।

আমি স্কুল শিক্ষক। আর, একজন শিক্ষকের বিত্তশালী সন্ত্রাসীদের মতো চলাচলের স্বাধীনতা নেই। এটাই জীবন যাপনের অর্থনৈতিক বাস্তবতা।

আমি যে ওর উপর নজর রাখছি, এটা অবশ্য সে জানত না। টের পেয়ে যাবে, এ রকম কাছাকাছি কখনো যাইনি আমি। সতর্ক ছিলাম।

লোকটা আমার স্ত্রীকে খুন করেছে, অথবা করিয়েছে। যাই হোক, ঘুরে ফিরে কথাটার মানে আসলে একই। বিস্তারিত জানতে চান? আমার কাছ থেকে জানতে পারবেন না। চাইলে পুরনো পত্র-পত্রিকাগুলো ঘেঁটে দেখতে পারেন। পেয়ে যাবেন।

ওর নাম ছিল এলিজাবেথ। আমরা দুজন একই স্কুলে পড়াতাম। আমি এখনো সেখানেই পড়াই। ও প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পড়াত। ওরা ওকে ভীষণ পছন্দ করত। আমার ধারণা, ওরা সম্ভবত আজো ওকে ভুলে যেতে পারেনি। যদিও এখন ওদের সবাই কৈশোরে পা রেখেছে। আমি ওকে ভালোবাসতাম, এখনো ভালোবাসি। প্রচলিত অর্থে যদিও সুন্দরী ছিল না, কিন্তু মিষ্টি একটা মুখ ছিল ওর। চুপচাপ স্বভাবের হলেও হাসতে জানত। এখনো ওর স্বপ্নে বিভোর থাকি আমি। মনের কোণে ভেসে ওঠে ওর লালচে বাদামি চোখ। আমার জীবনে আর কোনো নারী ছিল না, কোনোদিন আসবেও না আর।

ডোলান একটা জঘন্য অপরাধ করেছিল। আপনাদের এর বেশি জানার প্রয়োজন নেই। দুর্ভাগ্যক্রমে এলিজাবেথও ছিল সেখানে। এটাকে বলে ভুল জায়গায়, ভুল সময়ে থাকা-জঘন্য অপরাধটি দেখে ফেলেছিল সে। পুলিশের কাছে গেলে, ওরা ওকে পাঠিয়ে দেয় এফবিআইয়ের কাছে। এফবিআই ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। ওদের কথায় সে পরে সাক্ষী দিতে রাজি হয়। ওরা কথা দিয়েছিল, ওর নিরাপত্তা দেয়া হবে। হয় তাদেরই কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, আর না হয় ছোট ওরা করে দেখেছিল ডোলানের ক্ষমতাকে। হয়তো দুটোই হয়েছে, কে জানে?

এক রাতে এলিজাবেথ গাড়িতে উঠে বসে স্টার্ট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওটা বিস্ফোরিত হয়। ইগনিশনের সাথে লাগানো ডিনামাইট আমাকে বিপত্নীক করেছিল। উঁহু, আমাকে বিপত্নীক করেছিল ডোলান।

সাক্ষী দেওয়ার জন্য কেউ ছিল না বলে ওকে ছেড়ে দেওয়া হয়। মুক্ত হয়ে সে নিজের দুনিয়ায় ফিরে গেছে, আমি আমারটায়। সে গেছে ভেগাসে তার পেন্টহাউজ অ্যাপার্টমেন্টে, আর আমি ফিরে গেছি নিঝুম শ্মশানতুল্য বাড়িতে। আনন্দমুখর পরিবেশে সান্ধ্য-পোশাক সজ্জিত ললনারা ওকে বরণ করে নিয়েছে। আর, আমাকে গিলে নিয়েছে নিস্তব্ধ নির্জনতা। বছরে চার চারটি ধূসর ক্যাডিলাকে চড়ে ঘুড়ে বেড়িয়েছে ডোলান। আর আমার কপালে জুটেছে জীর্ণ বুইক রিভিয়েরা। ওর চুলের রং ধীরে ধীরে রুপালী হয়ে উঠেছে, আর আমারগুলো পড়ে গেছে।

আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছি।

তবে আমি সতর্ক ছিলাম-দারুণ সতর্ক! আমি জানতাম সে কে, কী করতে পারে। জানতাম, সে যদি দেখে কিংবা অনুভব করতে পারে তার ব্যাপারে আমি কী ভাবছি, তাহলে ছোট্ট পোকার মতো পায়ের তলায় পিষে ফেলবে আমাকে। আমি তাই প্রচণ্ড সতর্ক ছিলাম।

তিন বছর আগের কথা। আমার গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলছিল। তখন একবার ওকে নিরাপদ দূরত্ব থেকে অনুসরণ করে লস অ্যাঞ্জেলেস গিয়েছিলাম। ওখানে সে প্রায়ই যায়। ওর চমৎকার বাড়িটায় রাত কাটায়, পার্টি দেয়। ব্লকের শেষ প্রান্তের এক কোণা থেকে আমি ওর বাড়িতে লোকের আসা যাওয়া দেখেছি। পুলিশের কারগুলো পেট্রোলে আসলে আমাকে নিয়মিত বিরতিতে গা ঢাকা দিতে হতো। স্বস্তা এক হোটেলে উঠেছিলাম। ওখানকার ভাড়াটেরা অসম্ভব জোরে রেডিও ছেড়ে রাখত। রাস্তার উল্টো পাশেই ছিল টপলেস বার। সেখান থেকে নিয়ন আলো জানালা দিয়ে রুমের ভেতরে এসে পড়ত। ঐ রাতগুলোতে ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়তাম। স্বপ্নে দেখতাম এলিজাবেথের লালচে বাদামি চোখ। দেখতাম এসব কিছুই ঘটেনি। আর, কখনো কখনো জেগে উঠে দেখতাম, অশ্রু শুকিয়ে গালে-মুখে লেগে আছে।

আশার সবটুকু প্রায় হারিয়েই ফেলেছিলাম।

মানে, বুঝতেই পারছেন, সে সারাক্ষণই অনেক কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীতে থাকে। যাকে বলে নিচ্ছিদ্র প্রহরা। ঐ দুই ভারি অস্ত্রে সজ্জিত গরিলাকে সাথে না নিয়ে কোথাও যায় না। আর, ওর ক্যাডিলাকও আর্মার প্লেটেড। ছোটখাটো দেশের স্বৈরশাসকেরা যেরকম পছন্দ করে, ওর গাড়ির চাকাগুলোও সেরকম, সেলফ-সিলিং ধরনের।

তারপর, সেই শেষবারে আমি বুঝতে পারলাম, কাজটা কীভাবে করা যেতে পারে। কিন্তু একটা মারাত্মক আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করার আগ পর্যন্ত আমি সেটা দেখতেই পাইনি।

ওকে অনুসরণ করে লাস ভেগাস ফিরে আসছিলাম। সব সময়ই মাঝখানে অন্তত এক মাইলের মতো দূরত্ব বজায় রাখতাম আমি। কখনো কখনো সেটা দুই, এমনকি তিন মাইলের মতোও হতো। আমরা সেবার মরভূমির মধ্যে দিয়ে পূর্ব দিকে যাচ্ছিলাম। কখনো কখনো ওর গাড়িটাকে দিগন্তের এক আলোর ঝলকানির চেয়ে বেশি কিছু বলে মনে হচ্ছিল না। আমার খুব এলিজাবেথের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ভাবছিলাম, চুলে সূর্যের আলো পড়লে ওকে কেমন লাগত।

সেবার অনেকটা পেছনে ছিলাম আমি। সময়টা ছিলো সপ্তাহের মঝামাঝি। ইউএস-৭১ সড়কে তখন গাড়ির খুব একটা ভিড় ছিল না। গাড়ি কম থাকলে অনুসরণ করাটা বেশ বিপদজনক হয়ে উঠে আমার মতো গ্রামার স্কুল শিক্ষকও এটা জানে। পথে কমলা রংয়ের একটা সাইনবোর্ড পেরিয়ে গেলাম। ওতে লেখা :

ঘুরপথ : পাঁচ মাইল

দূরত্ব বাড়ানোর জন্য গতি কমালাম। মরুভূমির ঘুরপথগুলোতে ড্রাইভাররা গাড়ির গতি শামুকের গতিতে নামিয়ে আনতে বাধ্য হয়। ওর ড্রাইভার যখন ধূসর ক্যাডিলাকটাকে বিকল্প কাঁচা রাস্তা দিয়ে ধীরে-সুস্থে ও মাথায় নিয়ে উঠাবে, তখন আমার গাড়িটা ওটার একেবারে পেছনে চলে আসুক, সেটা চাই না।

ঘুরপথ : ৩ মাইল

পরের সাইনবোর্ডটা চোখে পড়ল। নিচে লেখা :

সামনে বিস্ফোরক এলাকা
টু-ওয়ে রেডিও বন্ধ রাখুন

অনেকদিন আগে দেখা একটা সিনেমার কথা মনে পড়ে গেল। মুভিটায় একদল সশস্ত্র ডাকাত একটি বুলেট প্রুফ গাড়িকে রাস্তায় ভুয়া বিকল্পপথ বা ঘুরপথের সাইনবোর্ড লাগিয়ে ফাঁদে ফেলেছিল। ড্রাইভার যখন একবার ফাঁদে পা দিয়ে ফেলে এবং মরুভূমির কোনো পরিত্যাক্ত রাস্তায় গিয়ে উপস্থিত হয় (এমন রাস্তা মরুভূমিতে হাজারটা আছে। শিপ রোড বা ভেড়া চরানোর রাস্তা, খামারের রাস্তা কিংবা পুরনো সরকারী রাস্তা, যেগুলো দিয়ে শেষ পর্যন্ত কোথাও যাওয়া যায় না), দুবৃত্তরা সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলে, গাড়িটার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া নিশ্চিত করে এবং সামনে অবরোধ করে আর্মার্ড-গাড়ি থেকে গার্ড বেরিয়ে আসা পর্যন্ত ঘাপটি মেরে বসে থাকে।

বেরিয়ে আসার পর, গার্ডদের তারা হত্যা করেছিল।

আমার মনে আছে।

ওরা গার্ডদের খুন করেছিল।

ডিটুরের কাছে পৌঁছে, ঘুরে ঢুকে পড়লাম। যেমন ভেবেছিলাম, রাস্তা খুবই খারাপ-কাদা মাটিতে ভর্তি দুই লেনের চাপা রাস্তা খানা-খন্দে ভরা। ঝাঁকুনিতে আমার জীর্ণ বুইক গোঁ গোঁ করে আর্তনাদ করে উঠল। নতুন শক অ্যাবজরবার লাগানো দরকার। কিন্তু শকের মতো এ ধরনের খরচ একজন স্কুল শিক্ষককে সয়ে নিতে হয়। বিপত্মীক, নিঃসন্তান এবং প্রতিশোধের স্বপ্ন ছাড়া আর কোনো শখ আহাদ না থাকলেও, এ রকম খরচ করার মতো সামথ্য থাকে না।

বুইকটা যখন একটু পর পর লাফাচ্ছিল আর নোংরা কাদা পানিতে ডুবে যাচ্ছিল গাড়ির মেঝে, আমার মাথায় চট করে একটা বুদ্ধি খেলে গেল। পরের বার যখন ভোলান ভেগাস থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসর পথে যাত্রা করবে, কিংবা লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে রওনা দেবে ভেগাসের পথে, ডোলানকে অনুসরণ করার বদলে আমি ওকে অতিক্রম করে যাব। তারপর, সামনে কোথাও ওই মুভির মতো ভুয়া বিকল্পপথ সাইন তৈরি করে ওকে ধোঁকা দিয়ে নিয়ে যাব ভেগাসের পুবে। পাহাড় ঘেরা নির্জন কোনো স্থানে। তারপর, মুভির সেই ডাকাতদের মতো সাইনগুলো সরিয়ে ফেলব।

হঠাৎ বাস্তবে ফিরে এলাম আমি। ভোলানের ক্যাডিলাক আমার সামনে-মানে, একদম সামনে-ধুলি ধুসরিত রাস্তার একপাশে থেমে আছে। টায়ারগুলোর একটি, সেলফ-সিলিং হোহাক আর নাই হোক, বসে গেছে। না, শুধু সমান হয়ে বসেই যায়নি। রিমের অর্ধেকটাসহ একেবারে কেটে গেছে। সম্ভবত মাটির উপরে খোঁচা খোঁচা হয়ে বেরিয়ে থাকা পাথরের কোনো টুকরোয় লেগে এ রকম হয়েছে। দুই বডিগার্ডের একজন গাড়ির সামনের দিকে, জ্যাক-ক্রু লাগিয়ে কাজ করছে। শুকর-মুখো দ্বিতীয় বডিগার্ড দরদর করে ঘামছে। তারপরেও, যথেষ্ট সতর্কভাবে ভোলানের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। সদা প্রস্তুত! মানে, বুঝতেই পারছেন, এরা মরুভূমিতেও কোনো দুর্ঘটনা ঘটার সুযোগ দিতে রাজি না।

কালো স্ন্যাকস প্যান্ট ও গলা-খোলা শার্ট গায়ে ভোলান একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। মরুর বাতাসে উড়ছে ওর রুপালী চুল। সিগারেট টানতে টানতে, অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে লোকগুলোর কাজ দেখছিল সে। মনে হচ্ছিল ও যেন ঠিক এখানে নেই। কোনো রেস্তোরাঁ, বলরুম কিংবা কোনো এক ড্রয়িংরুমে হয়তো মনে মনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।

আমার গাড়ির উইন্ডশিল্ডের মধ্যে দিয়ে ওর সঙ্গে একদফা চোখাচোখি হয়ে গেল। যদিও সে আমাকে আগেও একবার দেখেছিল, কিন্তু দেখেই বুঝলাম, একেবারেই চিনতে পারেনি। সাত বছর আগে (তখন অবশ্য আমার মাথায় চুল ছিল!), শুনানির প্রাথমিক পর্যায়ে আমার স্ত্রীর পাশে বসে থাকতে দেখেছিল সে আমাকে। সেই একবারই, তারপরে আমার সঙ্গে ওর আর দেখা হয়নি।

তবু সেই মুহূর্তে ওই ক্যাডিলাকের লোকগুলোর কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার আতঙ্ক নিমিষে হাওয়া হয়ে গেল। সে জায়গা দখল করে নিলো উন্মত্ত ক্রোধ।

মনে হচ্ছিল, পিছিয়ে গিয়ে জানালার কাঁচ নামিয়ে চিৎকার করে উঠি : তোর কতো বড় দুঃসাহস যে, আমাকে ভুলে গেছিস? আমার ব্যাপারে চিন্তা করা পর্যন্ত বাদ দিয়ে দিয়েছিস? কিন্তু ওরকম করাটা হতো ভয়ংকর গাধামী। এটাই বরং ভালো হয়েছে। আমাকে ভুলে গেছে সে। বাদ দিয়েছে চিন্তা করা। তক্তপোষের পেছনে থাকা ইঁদুর হওয়া বরং ভালো। ধীরে ধীরে ঠুকরে ঠিকই পথ করে নেয় সে। চোখের আড়ালে, ছাদের কোণের মাকড়সা হয়ে জাল বোনাও ভালো।

যে লোকটা ক্যাডিলাকের নিচে জ্যাক-ক্রু নিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছিল সে হঠাৎ আমার দিকে হাত নাড়লো। ডোলান একাই যে আমাকে ভুলে গেছে, তা নয়। এরাও ভুলে গেছে। পেছনে ফিরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাত নাড়তে থাকা লোকটার দিকে তাকালাম। আশা করছি, যে কোনো সময় ওর যেন একটা হার্ট অ্যাটাক কিংবা স্ট্রোক হয়। দুটো একসাথে হলে আরো ভালো। না থেমে, সামনে এগিয়েই যাচ্ছিলাম-মাথা দপদপ করছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য দিগন্তে পর্বতগুলোকে দ্বিগুন, এমনকী তিন গুন বড় মনে হতে লাগল।

আমার কাছে যদি একটা বন্দুক থাকত! মনের ভেতরে কথাটা গুমরে উঠছে। এখন খালি যদি একটা বন্দুক থাকত! থাকলে ওর পঁচা, দুর্গন্ধময় জীবনটা তখনই শেষ করে দিতে পারতাম।

কয়েক মাইল পেরিয়ে যাওয়ার পরে অন্য একটা চিন্তা মাথায় খেলে গেল। বন্দুক থাকলে, ওটা শুধু আমার মৃত্যুই নিশ্চিত করত। সেক্ষেত্রে আমি হয়তো রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে দিতাম। বাম্পার-জ্যাক নিয়ে কাজ করতে থাকা যে লোকটা আমাকে দেখে হাত নাড়িয়েছিল, সে তখন আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে, এই নির্জন মরুতে বন্য ক্ষিপ্রতায় গুলি ছুঁড়তে শুরু করত। আমি সর্বোচ্চ কাউকে হয়তো আহতই করতাম। তারপর খুন হয়ে যেতাম। ওরা আমাকে অগভীর কোনো কবরে চুপচাপ মাটি চাপা দিয়ে দিত। ডোলান যখন ওর রুপালি ক্যাডিলাকে সুন্দরি ললনাদের নিয়ে ভেগাস থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসের মধ্যে শোভাযাত্রা করত, মরুভূমির পশুরা তখন ছিঁড়ে খুঁড়ে খেত আমার দেহাবশেষ। হয়তো শীতল চাঁদের আলোয় আমার হাড়গোড় নিয়ে ওদের মাঝে লড়াই বেঁধে যেত। এলিজাবেথের জন্য প্রতিশোধ নেওয়াটা আর হয়ে উঠত না। কিছুই হতো না।

ওর সাথের লোকগুলো প্রশিক্ষিত খুনী। আমার প্রশিক্ষণের দৌড় তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পড়ানোতেই সীমাবদ্ধ।

নিজেকে সতর্ক করলাম। জীবনটা সিনেমা না। ভাবতে ভাবতেই উঠে পড়লাম হাইওয়েতে। কিছুক্ষণের মাঝেই পেরিয়ে এলাম কমলা রংয়ের আরেকটি সাইনবোর্ড : নেভাডা রাজ্যের কন্ট্রাকশন-সাইট এখানেই শেষ। ধন্যবাদ। নিজেকে মনে করিয়ে দিলাম, আবার কখনো যদি বাস্তবতাকে সিনেমার সাথে গুলিয়ে ফেলার ভুল করি, মায়োপিয়া রোগে আক্রান্ত তৃতীয় শ্রেণির এক শিক্ষক হয়ে নিজেকে যদি দিবাস্বপ্নের বাইরেও সিনেমার ‘ডার্টি হ্যারি’ বলে ভাবতে থাকি, তাহলে এই জীবনে আর কোনোদিন প্রতিশোধ নেওয়া হবে না। কখনো না।

কিন্তু এমনিতেও কি কখনো প্রতিশোধ নেওয়া আদৌ সম্ভব হবে? আসলেই?

যে আমি কি না খোলর পরে কখনো কোনো বন্দুক চালাইনি, আর হ্যান্ডগান তো জীবনে ব্যবহারই করিনি; সেই আমার জন্য ভুয়া বিকল্পপথের সাইন লাগিয়ে, পুরনো বুইক গাড়ি থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এসে তিন তিনজনকে গুলি করে শুইয়ে দেওয়ার পুরো পরিকল্পনাটা শুধুই অবাস্তবতা আর রোমাঞ্চে ভরপুর।

এমন দুর্ধর্ষ কাজ একদল দুবৃত্ত ছাড়া আসলে সম্ভব না। যে রোমাঞ্চকর সিনেমা দেখে এতকিছু ভাবছি, সেটাও এই কথাটার দিকেই স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে। সেখানেও আট-নয়জন লোক দুটি ভিন্ন দলে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখছিল ওয়াকিটকি দিয়ে। তার উপরে,আরেকজন আবার ছোট প্লেনে করে হাইওয়ের উপরে নজর রাখছিল। নিশ্চিত হতে চাইছিল, বুলেটপ্রুফ গাড়িটি আদৌ জনসংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, তাদের পূর্ব নির্ধারিত স্থানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কি না।

আমি নিশ্চিত, কোনো এক হোঁকা নিরাইটার নিজস্ব সুইমিংপুলে বসে, একহাতে পিনা-কোলাডা আর অন্যহাতে সদ্য কিনে আনা পেনটেল পেন আর এডগার ওয়ালেস প্লট-হুঁইল নিয়ে সিনেমার এই কাহিনী লিখেছে। সেই লোকেরও এই আইডিয়াকে পূর্ণতা দেওয়ার জন্য একদল লোকের প্রয়োজন হয়েছিল। আর, আমি তো একা একজন মাত্র মানুষ।

এভাবে হবে না। এসব কেবল ক্ষণিকের বিভ্রান্তিকর ভাবনা। বছরের পর বছর ধরে নানা ধরনের যেসব চিন্তা-ভাবনা আমার মাথায় বারবার হানা দিয়ে গেছে, সেরকম। যেমন, একবার ভেবেছিলাম, ডোলানের এয়ার কন্ডিশন সিস্টেমে বিষাক্ত কোনো গ্যাস ছেড়ে দেব, কিংবা ওর লস অ্যাঞ্জেলেসের বাড়িতে বোমা লাগিয়ে দিয়ে আসব। কিংবা, মারাত্মক কোনো মারণাস্ত্র যদি হাত করে নেওয়া যায়-যেমন, বাজুকা-তাহলে, ওটা দিয়ে ওর রুপালি ক্যাডিলাকটাকে পুবে, ভেগাসের দিকে যাওয়ার সময়। কিংবা রুট একাত্তর দিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসের দিকে যাওয়ার সময় আগুনের গোলায় পরিণত করা যেতে পারে।

এসব চিন্তা বাদ দেওয়া বরং ভালো।

কিন্তু যাচ্ছে না।

যে কণ্ঠস্বরটা ভেতর থেকে এলিজাবেথের হয়ে কথা বলে, সেটা অনবরত ফিসফিস করে একটা কথাই বলতে থাকে। ওকে কেটে ফেল। মনিবের নির্দেশে অভিজ্ঞ শিপ-ডগ যেভাবে নির্দিষ্ট কোনো ভেড়াকে পাল থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে, ছিঁড়ে ফালাফালা করে ফেলে, সেভাবে, ওকে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেল। বিকল্পপথের সাইন ব্যবহার করে ওকে ফাঁকা, নির্জন কোথাও নিয়ে গিয়ে খুন কর। ওদের সবাইকে খুন কর।

এসবে কাজ হবে না। আমি যদি অন্য কোনো সত্যকে মেনে নিতে নাও পারি, অন্তত একটা জিনিস আমাকে মানতেই হবে। কেউ যদি ডোলানের মতো এতদিন ধরে দেখে-শুনে বেঁচে থাকতে পারে, আগে থেকে বিপদ আঁচ করার মতো ইন্দ্রিয় তার অবশ্যই আছে। হয়তো এ নিয়ে ওর মাঝে প্যারানয়াও আছে, কে জানে? ডিট্যুরের এই কৌশল ওরা মুহূর্তের মাঝে ধরে ফেলবে।

কিন্তু আজকে তো ধরতে পারেনি।

এলিজাবেথের হয়ে যে কণ্ঠস্বরটা কথা বলে, সে ফিসফিসিয়ে উঠল। সামান্য দ্বিধাও তো করেনি। সুবোধ বালকের মতো ঢুকে গেছে।

কিন্তু আমি জানি-হ্যাঁ, কোনো একভাবে আমি জানতাম! ভোলানের মতো মানুষজন, যাদেরকে মানুষ না বলে বরং নেকড়ে বলা উচিত, বিপদ আসলে তাদের ভেতরের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সতর্কঘন্টা বাজাতে শুরু করে। আমি চাইলে হয়তো রোড ডিপার্টমেন্টের কোনো অফিস থেকে সত্যিকারের বিকল্পপথের সাইনই চুরি করে ঠিকভাবে, জায়গামতো লাগিয়ে দিতে পারব। হয়তোবা কমলা রংয়ের ফুরোসেন্ট রোড-কোন আর স্মাজ-পটগুলোও বসিয়ে দিতে পারব ঠিকঠাক করে। সবই করতে পারব। তারপরেও, সাজানো মঞ্চে পা দেওয়ার সাথে সাথেই ডোলান ওর ওই বুলেট প্রুফ জানালার ভেতর থেকেও নিশ্চিতভাবেই আমার আনাড়িপনার গন্ধ পেয়ে যাবে। চোখ বন্ধ করলেই অনেক দূর থেকে মনের ভেতরে শুনতে পাবে এলিজাবেথের নাম।

যে কণ্ঠস্বরটা এলিজাবেথের হয়ে কথা বলে, ওটা এবারে চুপ মেরে গেল। আমি ভাবলাম, শেষ পর্যন্ত আজকের দিনের মতো ক্ষান্ত দিয়েছে। তারপর, যেই মুহূর্তে মরুর দিগন্তে ভেগাসের কুয়াশাচ্ছন্ন নীলচে আলো দেখা গেল, ওটা আবারো কথা বলে উঠল।

ওকে তাহলে ভুয়া বিকল্পপথের সাইন দিয়ে বোকা বানানোর চেষ্টাই করো না।

কণ্ঠটা ফিসফিসিয়ে উঠল, আসল সাইন দিয়ে বোকা বানাও।

চমকে গিয়ে, বুইকের নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেললাম। থরথর কাঁপতে থাকা দুই পায়ে ব্রেক-পেডাল চেপে ধরে, অনেক কষ্টে গাড়ি থামালাম। বিস্মিত চোখে রিয়ার-ভিউ মিরর দিয়ে অপলক চেয়ে রইলাম নিজের দিকে।

আমার ভেতরের এলিজাবেথের কণ্ঠস্বরটা হাসতে শুরু করল। উন্মত্ত হাসি। কিন্তু কয়েকমুহূর্ত পরে আমিও ওটার সাথে হাসতে শুরু করলাম।

নাইনথ স্ট্রিট হেলথ ক্লাবে পৌঁছালে, অন্যান্য শিক্ষকরা আমাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা শুরু করল। একজন জানতে চাইল, শক্তিশালী কেউ জোর করে ধরে অপমান করার জন্য মুখে বালু ছুঁড়ে দিয়েছে কি না। ওদের কথায় গা করিনি। হেসেছি তাল মিলিয়ে। যতক্ষণ পর্যন্ত ওদের সাথে তাল মিলিয়ে হাসব, ওরা ঘুণাক্ষরেও আমার মতো একজনকে সন্দেহ করবে না। আর হাসব না-ইবা কেন? আমার স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে সাত বছর পেরিয়ে গেছে, তাই না? কফিনে জমে থাকা ধুলোবালির সাথে অল্প কিছু হাড়গোড় ছাড়া ওর তো আর কোনো অস্তিত্ব নেই। তাহলে হাসব না কেন? আমার মতো কেউ হাসা বন্ধ করে দিলেই বরং মানুষ ভাবতে শুরু করবে, কোথাও নিশ্চয়ই কোনো গড়বড় আছে।

প্রতিটা বাক্য যদিও আমার গায়ে অবিরাম শূলের মতো বিঁধেছে, তবু পুরো শরৎ আর শীতকাল জুড়ে আমি ওদের সাথে তাল মিলিয়ে হেসে গেছি। ক্ষুদার্থ ছিলাম, তবু ওদের সাথে তাল মিলিয়ে হেসেছি। মাঝরাতের স্ন্যাকস, বিয়ার কিংবা রাতের খাবারের আগে জিন ও টনিক-সব বাদ দিয়ে দিয়েছিলাম। শুধু প্রচুর চর্বিযুক্ত মাংস আর প্রচুর পরিমাণে সবজি আর সবজি।

ক্রিসমাসের উপহার হিসেবে নিজের জন্য একটা নটিলাস মেশিন কিনে নিয়ে এসেছিলাম।

না। কথাটা পুরোপুরি সত্যি হলো না। আসলে, ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে এলিজাবেথ আমাকে নটিলাস মেশিন কিনিয়েছে।

ইদানীং ডোলানের উপরে নজরদারি করার তেমন সময়ই পাচ্ছি না। ব্যায়াম নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটছে। তলপেটের মেদ কমাচ্ছি। হাত, পা, বুক শক্ত করে গড়ে তুলছি ধীরে ধীরে। মাঝে মাঝে মনে হতো বুঝি আমাকে দিয়ে হবে না। সত্যিকারের দৈহিক ফিটনেস, পেটা শরীর আবার পুনরুদ্ধার করা আমার জন্য অসম্ভব। খাবারের দ্বিতীয় পদ, কয়েক টুকরো কফি কেক, এবং সময় সময় কফিতে ক্রিম না নিয়ে থাকা আমার পক্ষের সম্ভব না। এ রকম দিনগুলোতে আমি ওর প্রিয় কোনো রেস্টুরেন্টের উল্টোপাশে গিয়ে গাড়ি পার্ক করতাম কিংবা গিয়ে ঢুকতাম ওর পছন্দের কোনো ক্লাবে। আর, মনে মনে ওর আসার অপেক্ষা করতাম। কখন সে আসবে, ধূসর ক্যাডিলাক থেকে স্বর্ণকেশী বা লালচুলো কোনো লাস্যময়ীকে বাহুডোরে নিয়ে নেমে আসবে অহংকারী পায়ে। কিংবা ওর দু-বাহুতে হয়তো থাকবে দু-দুজন সুন্দরি। এই সেই লোক, যে আমার এলিজাবেথকে খুন করেছে। গায়ে বিজান’সের ফরমাল শার্ট, হাতে ঝিলিক দিচ্ছে স্বর্ণের। রোলেক্স। ক্লান্ত, নিরুৎসাহিত হয়ে পড়লে আমি ভোলানকে দেখতে যেতাম। মরুর বুকে ছুটে চলা ক্লান্ত পথিক যেমন উন্মত্ত তৃষ্ণায় কুয়ো খুঁজে বেড়ায়, সেভাবেই ওর কাছে ছুটে যেতাম আমি। ওর বিষাক্ত জলে চুমুক দিয়ে চাঙা হয়ে উঠতাম।

ফেব্রুয়ারিতে প্রতিদিন দৌড়াতে শুরু করলাম। অন্য শিক্ষকরা তখন আমার টাক মাথা নিয়ে হাসাহাসি শুরু করল। যত সানব্লকই দেই না কেন, চামড়া উঠে গেলে যে রকম গোলাপী দেখায়, দৌড়ালে আমার টাকটাকে ঠিক সেরকম লাগত। দৌড় শেষে শক্তি একদম ফুরিয়ে যেত। রানের শেষ প্রান্তের মাংসপেশী জমে, খিচুনি উঠে যাওয়ার মতো অবস্থা। দুই পা থরথর করে কাঁপছে, দুইবার প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলার অবস্থা হয়েছে; তারমাঝেও ওদের সাথে তাল মিলিয়ে হেসেছি।

সময় গড়িয়ে গ্রীষ্ম আসল। নেভাডা হাইওয়ে ডিপার্টমেন্টে একটা চাকুরীর আবেদন করলাম আমি। পৌর কর্মসংস্থান অফিস আবেদন পত্রে সম্ভাব্য অনুমোদনের একটি স্ট্যাম্প মেরে, হার্ভে ব্লকার নামে এক জেলা কর্মকর্তার কাছে আমাকে পাঠিয়ে দিল। ব্লকার লম্বাটে গড়নের মানুষ, নেভাডার রোদে পুড়ে প্রায় কালচে হয়ে গেছে। পরনে জিন্স, পায়ে ধুলি ধূসরিত ওয়ার্ক-বুট আর গায়ে একটা নীলচে হাফ-হাতা টি-শার্ট চাপিয়েছে লোকটা। টি-শার্টটা যেন তারস্বরে চিৎকার করছে বলতে চাইছে, ব্যাড অ্যাটিচুডা চামড়ার নিচে গোলাকার, পেটানো লোহার মতো চাক চাক মাংসপেশী স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আমার আবেদন পত্রটা দেখল সে। তারপর, আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল।

‘তুমি নিশ্চয়ই আমার সাথে ফাজলামি করছ! মানে, ফাজলামি ছাড়া আর কী? আমরা এখানে মরুর সূর্য আর গনগনে উত্তাপে কাজ করা নিয়ে কথা বলছি। তুমি এমনিতে করোটা কী? হিসাবরক্ষক হিসবে কাজ করো?

‘তৃতীয় শ্রেণিতে শিক্ষকতা করি।’

‘বাছা,’ বলেই আবারো হেসে ফেলল সে। আমার সামনে থেকে চলে যাও, বুঝলে?

আমার কাছে একটা পকেট ঘড়ি ছিল। আমার দাদার কাছ থেকে হাত বদল হতে হতে আমার কাছে এসেছে। আন্তঃমহাদেশীয় রেলরোডের শেষ অংশটা তৈরির সময় উনিও কাজ করেছিলেন। আমাদের পারিবারিক কাহিনী অনুযায়ী, ঐতিহাসিক গোল্ডেন স্পাইক গাঁথার সময়ও তিনি ওখানে ছিলেন। সেই ঘড়িটা বের করে, ব্লকারের মুখের সামনে চেইন ধরে দোলাতে দোলাতে বললাম, এটা দেখতে পাচ্ছ তো? ছয় থেকে সাতশ ডলারের মতো হবে।

ব্লকার হেসে ফেলল, ‘ঘুষ দিচ্ছ? লোকমুখে শয়তানের সাথে মানুষের চুক্তির কথা অনেক শুনেছি। কিন্তু ঘুষ দিয়ে জাহান্নামে ঢুকতে চায়, এ রকমটা এবারেই প্রথম দেখছি।’ এবারে করুণার চোখে আমার দিকে তাকাল সে। তুমি হয়তো ভাবছ, কোথায় নিজেকে জড়াতে চাইছ, সে সম্পর্কে তোমার ভালো ধারণা আছে। আসলে, তোমার সামান্যতম ধারণাও নেই। জুলাইতে এখানকার তাপমাত্রা একশ সতের ডিগ্রি পর্যন্ত চড়তে দেখেছি আমি। শক্তপোক্ত মানুষজনকেও ভেঙে পড়তে দেখেছি। কেঁদে ভাসিয়ে ফেলেছে, এ রকম অবস্থা। আর তুমি তো কোনোভাবেই শক্ত না রে, ভাই। তোমার গায়ে যে হেলথ ক্লাবের ফাঁপা পেশী ছাড়া আর কিছু নেই, সেটা বোঝার জন্য আমার তো শার্ট খুলে দেখারও দরকার পড়ছে না। এই জিনিস দিয়ে এখানকার এসব ভারি কাজের কিছুই হবে না।

জবাবে বললাম, ‘যেদিন তোমার মনে হবে, আমাকে দিয়ে কাজকর্ম হচ্ছে না, বলে দিও। সোজা চলে যাব। ঘড়িটা রেখে দিতে পারবে। এ নিয়ে আমি কোনো তর্কে যাব না।’

‘তুমি তো দেখি ডাহা মিথ্যুক।’

সোজা ওর চোখে চোখ রাখলাম। কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে চেয়ে রইল সে। তারপর বিস্মিত গলায় বলল, ‘না, তুমি মিথ্যুক নও।

‘না।’

‘টিংকারকে ঘড়িটা রাখতে দেবে তুমি? বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে টাই-ডাই করা, রংচঙে টি-শার্ট পরা বেঢপ মোটা ও কালো এক লোককে দেখাল সে। লোকটা কাছেই একটি বুলডোজারের চালকের কেবিনে বসে ম্যাকডোনাল্ডসের ফুট-পাই খেতে খেতে আমাদের কথা শুনছিল।

‘বিশ্বস্ত তো?’

‘এখন তুমি অযথাই কথা বাড়াচ্ছ।’

‘তাহলে, তুমি আমাকে চলে যেতে বলার আগ পর্যন্ত, কিংবা আমি সেপ্টেম্বরে স্কুলে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত সে এটা রাখতে পারে।’

‘আর আমাকে কী করতে হবে?’

ওর হাতে ধরা আবেদন পত্রটা দেখিয়ে বললাম, ওটায় স্বাক্ষর করে দাও, তাহলেই হবে।

‘তুমি একটা আস্ত পাগল!’

মনের কোণে এলিজাবেথ আর ভোলান উঁকি দিয়ে গেল। কিছু বললাম আর।

‘জঘন্য কাজগুলো দিয়ে শুরু করতে হবে তোমাকে, ব্লকার সতর্ক করার সুরে বলল। ‘বেলচা ভরে ট্রাকের পেছন থেকে পিচযুক্ত পাথর ইত্যাদি নিয়ে গিয়ে রাস্তার খানাখন্দ ভরতে হবে। আমি যে তোমার। চমৎকার ঘড়িটা রেখে দেওয়ার জন্য এ কাজ দিচ্ছি, তা নয়। যদিও রেখে দিতে পারলে খুশিই হবো। সবাইকে আসলে এই দিয়েই সবাই শুরু করতে হয়।

‘ঠিক আছে।‘

‘এইটুকু বুঝলেই হয় আরকি।‘

‘বুঝেছি।‘

ব্লকার জবাব দিল, ‘না, বোঝোনি। কিন্তু বুঝবে।’

লোকটা ঠিকই বলেছিল।

প্রথম দুই সপ্তাহ ধরে আমার শুধু একটা কাজই ছিল-পিচ ও পাথরের মিশ্রণ বেলচা দিয়ে ট্রাকের পেছন থেকে নামিয়ে নিয়ে, আস্তে আস্তে ঠেলে গর্তে ভরতাম এবং ট্রাকের পেছন পেছন মাথা নিচু করে পরবর্তী গর্তের দিকে হেঁটে যেতাম। ট্রাক না থামা পর্যন্ত ওভাবে হাঁটতেই হতো। থেমে গেলেই আবার শুরু হতো রাস্তার গর্ত ভরাটের কাজ। কখনো কখনো স্ট্রিপে কাজ করতাম আমরা। ক্যাসিনোগুলোর জ্যাকপট বেল বেজে ওঠার শব্দ পেতাম। কখনো কখনো মনে হতো, বেলটা বুঝি শুধু আমার মাথার ভেতরেই বাজছে। মাথা তুলে তাকালে দেখতে পেতাম, হার্ভে ব্লকার এক অদ্ভুত করুণার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কাঠফাটা রোদের উত্তাপে ওর মুখ ধিকধিক করছে। মাঝে মাঝে প্লাস্টিক ক্যানভাসে ঢাকা বুলডোজারের চালকের কেবিনে বসা টিঙ্কারের দিকে তাকালে, আমার দাদার সেই ঘড়িটা চেইন ধরে ঝুলাতো সে। সূর্যের আলো পড়ে ঝিলিক দিয়ে উঠত ওটা। চোখ ধাঁধিয়ে দিত।

অজ্ঞান না হয়ে পড়ার সংগ্রামটাই ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। যত যাই হোক, যেভাবেই হোক, জ্ঞান হারানো যাবে না। এভাবেই জুন কেটে গেল। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহও পেরিয়ে গেল কোনোভাবে। তারপর একদিন দুপুরের খাবারের সময় হার্ভে ব্লকার আমার সামনে এসে বসল। কাঁপা হাতে স্যান্ডুইচে কামড় বসালাম। অনেক সময় রাত দশটা পর্যন্তও এই কাঁপুনিটা রয়ে যেত। সব কিছুর পেছনে ছিল ওই তীব্র তাপদাহ। হাতে উপায় ছিল কেবল দুটো। হয় কাঁপতে কাঁপতে টেনে যাওয়া, না-হয় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকা। ডোলানের কথা ভেবে ভেবে, কাঁপতে কাঁপতে কোনোরকমে টেনে যেতাম আমি।

ব্লকার বলল, তুমি এখনো শক্তপোক্ত হতে পারনি।

‘না। কিন্তু লোকে যেমন বলে, আমাকে কী নিয়ে শুরু করতে হয়েছে, আগে তোমার সেটা দেখা উচিত।’

‘আমার প্রায়ই মনে হয়, এক দিন দেখব, তুমি রাস্তায় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে। এখনো হওনি কিন্তু হবে।’

‘না, হবো না।‘

‘হ্যাঁ, হবে। ট্রাকের পেছনে বেলচা নিয়ে পড়ে থাকলে হতেই হবে।’

‘না।’

‘গ্রীষ্মের সবচেয়ে গরমের সময়টা তো এখনো আসেইনি। টিংকার ওটাকে বলে, কুকি-বিস্কুট বেক করার প্রাকৃতিক কড়াই।’

‘এ নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই।’

পকেট থেকে কিছু একটা বের করল সে। আমার দাদার সেই ঘড়িটা আমার কোলের উপর ছুঁড়ে দিয়ে বিরক্ত স্বরে বলল, তোমার এই ফালতু জিনিস তুমিই রাখ। এটা আমি আর চাই না।’

‘তুমি আমার সাথে চুক্তি করেছো।’

‘ওটা বাতিল করে দিচ্ছি।’

‘তুমি যদি এখন আমাকে বরখাস্ত কর আমি তোমার নামে অভিযোগ করব। ওকে মনে করিয়ে দেওয়ার স্বরে বললাম, তুমি কিন্তু আমার আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করেছে।

‘বরখাস্ত করছি না, চোখ সরিয়ে নিল ব্লকার। তোমাকে টিংকারের হাতে ছেড়ে দিচ্ছি ফ্রন্ট-অ্যান্ড লোডার চালানো শেখানোর জন্য।’

কী বলব বুঝতে না পেরে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। আমার তৃতীয় শ্রেণির শান্ত ও মন ভালো করে দেওয়া ক্লাসরুমটাকে আর কখনো এত দূরের মনে হয়নি…এখনো আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না, ব্লকারের মতো একজন সেদিন যা বলেছিল, সেটা সে ভেবেছিল কিভাবে? কিংবা কী মনে করে ওই কথাগুলো আসলেই বুঝিয়েছিল সে? জানি, সে মনে মনে আমার প্রশংসা করেছিল। আবার, আমাকে নিয়ে কিছুটা অবজ্ঞাও ছিল ওর মাঝে। কিন্তু দুটোর একটাও সে কী কারণে অনুভব করেছে বা ওভাবে ভেবেছে, আমি জানি না। এ সময় হঠাৎ এলিজাবেথের কণ্ঠটা বলে উঠল, তোমার তো এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই, প্রিয়। তোমার কাজ ডোলানকে নিয়ে। তুমি বরং ওকে নিয়েই ভাবো।

শেষ পর্যন্ত জানতে চাইলাম, ‘তুমি এটা কেন করতে চাচ্ছ?’

আমার কথা শুনে ফিরে তাকাল সে। দেখলাম, একই সাথে বিস্মিত এবং ক্ষুব্ধ হয়েছে। রাগটাই অবশ্য প্রকট হয়ে বেরিয়ে এলো। সে বলল, ‘তোমার সমস্যা কী, বলতো? তুমি আমাকে ঠিক কী মনে করো?’

‘আমি কিছুই ভাবিনি—’

‘ভেবেছ, ঐ ফালতু ঘড়িটার জন্য তোমাকে খুন করে ফেলব? তাই ভেবেছ তুমি?

‘আমি দুঃখিত।‘

‘হ্যাঁ, সেটাই। তুমি হলে আমার দেখা সবচেয়ে বড় গর্দভ।’

চুপচাপ ঘড়িটা সরিয়ে রাখলাম।

‘তুমি আদৌ শক্তপোক্ত হতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। কিছু মানুষ আর গাছপালা সূর্যের তাপে টিকে থাকতে পারে, কিছু শুকিয়ে মরে যায়। তুমি মরে যাচ্ছ। তুমি জান তুমি মরে যাচ্ছ, তার পরেও ছায়ায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছ না। প্রশ্ন হলো, কেন? কেন এ রকম পাগলামি করছ শুধু শুধু?

‘আছে কিছু কারণ।‘

‘তা তো অবশ্যই আছে। তোমার পথে যে কাঁটা হতে চাইবে, স্রষ্টা তাকে রক্ষা করুক।’

উঠে দাঁড়িয়ে পা বাড়াল সে। এ সময় ব্লকারকে পেরিয়ে এলো টিংকার। দাঁত বের করে হাসতে হাসতে আমার দিকেই আসছে।

‘কী মনে হয়, তুমি ফ্রন্ট-এন্ড লোডার চালানো শিখতে পারবে?’

বললাম, ‘মনে তো হয় পারব।

‘আমারো তাই মনে হয়। ওই মাথা মোটা বুড়োটা তোমাকে কেন যেন পছন্দ করে, কিন্তু প্রকাশ করতে জানে না আরকি।’

‘তাই তো দেখলাম।’

টিংকার হাসল।

গ্রীষ্মের বাকি সময়টুকু আমি ফ্রন্ট-এত লোডার চালিয়ে পার করলাম আমি। সেই শরতে যখন স্কুলে ফিরে এলাম, ততদিনে আমি প্রায় টিংকারের মতোই কালো হয়ে গেছি। অন্য শিক্ষকরাও আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করা বন্ধ করে দিল।

কখনো কখনো ওদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়, আড়চোখে আমাকে দেখত কিন্তু হাসত না।

আছে কিছু কারণ।

এ কথাটাই ওকে বলেছিলাম আমি। আসলে ছিলও। শুধু খেয়ালের বশে তো আর সেই পুরো মৌসুমটা নরকে কাটাইনি। বুঝতেই পারছেন, নিজেকে প্রস্তুত করা দরকার ছিল আমার। কোনো সাধারণ নারী বা পুরুষের কবর খোঁড়ার জন্য এত প্রস্তুতি নেওয়া লাগে না। কিন্তু আমার মনে তো আর সাধারণ কেউ ছিল না।

ওই জঘন্য ক্যাডিলাকটাকে আস্ত পুঁতে ফেলতে চাচ্ছিলাম আমি।

পরের বছরের এপ্রিল নাগাদ স্টেট হাইওয়ে কমিশনের মেইল পাঠানোর তালিকায় আমার নাম উঠে গেল। প্রতিমাসে নেভাডা রোড সাইনস নামে একটি বুলেটিন পেতে শুরু করলাম আমি। ওটার বেশিরভাগ জিনিসই আমি এড়িয়ে যেতাম। সাধারণত হাইওয়ে উন্নয়নের বকেয়া বিল, রাস্তাঘাট সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন যন্ত্রপাতির বেচা-কেনা সংক্রান্ত আলোচনা, বালিয়াড়ি নিয়ন্ত্রণ এবং নতুন ভূমিক্ষয় রোধের কৌশলের মতো ব্যাপারে রাজ্য আইন প্রণয়নকারী সংস্থা কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপসমূহ ইত্যাদি নিয়ে নানা ধরনের প্রতিবেদন থাকত ওতে। আমার আগ্রহ ছিল মূলত ওটার শেষের এক থেকে দুই পাতায়। ক্যালেন্ডার নামের এই অংশটায় কেবল আসছে মাসে বিভিন্ন রাস্তায় যেসব কাজ হবে, ওগুলোর তারিখ ও জায়গার নাম দেওয়া থাকত। বিশেষ করে যেসব জায়গার নাম আর তারিখের সাথে চার অক্ষরের একটি শব্দ-সংক্ষেপ থাকত : আরপিএভি। রাস্তায় নতুন করে পাথর বা ইটের আস্তরণ দেওয়ার কাজ হবে বোঝানোর জন্য এটা ব্যবহৃত হয়। হার্ভে ব্লকারের কর্মী বাহিনীর অংশ হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, এ ধরনের কাজে প্রায়ই বিকল্প পথের ব্যবহার করা হয়। অবশ্যই সব সময় এমনটা হয় না। একান্ত বাধ্য না হলে হাইওয়ে কমিশন রাস্তার একটি অংশ বন্ধ করে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ কখনোই নেয় না। মনে মনে ভাবলাম, আগে-পরে যখনই হোক, ওই চারটা অক্ষরই ভোলানের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করবে। শুধু চারটি অক্ষর, কিন্তু কখনো কখনো ওরা আমার স্বপ্নে এসেও হাজির হতো : আরপিএভি।

এমন না যে, ব্যাপারটা সহজ হবে কিংবা শীঘ্রই ঘটবে। হয়তো বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হবে আমাকে। এর মাঝে অন্য কেউও তাকে শেষ করে দিতে পারে। এ ধরনের বদমাশদের তো কম শত্রু থাকে না। তাদের জীবন এমনিতেই বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়। আর ডোলান তো হারামিদেরও হার মানাবে! তার উপরে, জগতের সবচেয়ে বিরল কাজের মতো চারটি ঘটনাকে এক সুতোয় এসে মিলতে হবে-ডোলানের ভ্রমণ, আমার ছুটি, একটি জাতীয় ছুটির দিন, আর অবশ্যই তিন দিনের উইকেন্ড।

এ জন্য আমাকে হয়তো বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হবে, কিংবা হয়তো কখনোই এ রকম কোনো সুযোগ আসবে না। তবে মাঝে মাঝে এক ধরনের নিশ্চয়তা বোধ হতো আমার। কেমন একটা অনুভূতি, যেন এটা ঘটবেই। আর যখন ঘটবে, আমি সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকব।

শেষ পর্যন্ত আসলেই সেটা ঘটল। সে বছরের গ্রীষ্ম, শরৎ এমন কি পরের বসন্তেও নয়, ঘটল গত বছরের জুন মাসে।

নেভাডা রোড সাইন খুলে দেখি ক্যালেন্ডারে লেখা :

জুলাই ১-জুলাই ২২
ইউএস ৭১ এমআই ৪৪০-৪৭২ (ওয়েস্টবিএনডি) আরপিএভি

হাত কাঁপছিল আমার, পাতা উল্টে আমার ডেস্ক ক্যালেন্ডারের জুলাই। মাসে এসে দেখলাম, জুলাইর ৪ তারিখ আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস সোমবার পড়েছে।

তাহলে এখানে চারটি ঘটনার তিনটি এসে যাচ্ছে। আর এ ধরনের বিস্তৃত জায়গা নিয়ে সড়ক মেরামতের কাজের মধ্যে কোথাও না কোথাও তো নিশ্চিতভাবেই একটি বিকল্প পথও থাকবে।

কিন্তু ডোলান…কী খবর তার? চতুর্থ ঘটনাটির কী অবস্থা?

আমি আগের তিন বছরের কথা মনে করতে পারি। ৪ জুলাইতে সে লস অ্যাঞ্জেলেস গিয়েছিল। লাস ভেগাসের জীবনযাত্রা যে অল্প কিছু সময় স্থবির হয়ে আসে, তার মধ্যে এটি একটি। আরো তিন বারের কথা মনে করতে পারি, যখন সে অন্য কোথাও গিয়েছিল। একবার গিয়েছিল নিউ ইয়কে, একবার মায়ামি, আর একবার উড়ে গিয়েছিলো সুদূর লন্ডনে। চতুর্থ আরেক বারের কথা মনে আছে-সেবার এই সময়টা ভেগাসেই কাটিয়ে দিয়েছিল সে।

যদি সে যায়ও…

আমি কি কোনোভাবে খবরটা বের করতে পারব?

দীর্ঘ সময় ধরে এটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবলাম। কিন্তু দুটো কল্পনা বারবার এক রকম জোর করেই চোখে ভেসে উঠছিল। প্রথমটায় দেখলাম, পেছনে ধুলোর ঝড় রেখে ডোলানের ক্যাডিলাক ইউএস রুট একাত্তর ধরে দ্রুত বেগে লস অ্যাঞ্জেলেসের দিকে ছুটছে। যেতে যেতে পেরিয়ে যাচ্ছে। ‘সামনে বিকল্প পথ’ সাইনটি। যাদের টু-ওয়ে রেডিও আছে, শেষ সাইনটা তাদের সতর্ক করছে রেডিও বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। দেখলাম, ক্যাডিলাকটা পরিত্যাক্ত রাস্তার যন্ত্রপাতি, বুলডোজার, গ্রেডার, ফ্রন্ট-এন্ড লোডার ইত্যাদি পেরিয়ে যাচ্ছে। আসলে, অকেজো হয়ে পড়েছে দেখে ওগুলো ফেলে যাওয়া হয়েছে, এমন না। এখন ছুটি চলছে, উইকেন্ড-তিন দিনের সাপ্তাহিক ছুটি।

দ্বিতীয় দৃশ্যে মানসচোখে দেখতে পেলাম, বাকি সব একই রকম আছে। শুধু বিকল্প পথের সাইনগুলো নেই।

নেই, কারণ ওগুলো আমি সরিয়ে ফেলেছি।

স্কুলে, বছরের শেষ দিনে এসে হঠাৎ বুঝতে পারলাম, ওর যাওয়া আসার খবরটা কিভাবে বের করা যাবে। ঝিমুচ্ছিলাম, আমার মন তখন স্কুল আর ভোলান-দুটো থেকেই মিলিয়ন মাইল দূরে। এর মধ্যেই হঠাৎ লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। দাঁড়াতে গিয়ে আমার ডেস্কের পাশে রাখা একটি ফুলদানি (ওতে কিছু সুন্দর মরু-ফুল ছিল, আমার ছাত্র-ছাত্রিরা ক্লাসের শেষ দিন বলে উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছিল) ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিলাম। পড়ে গিয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল সেটা। ছাত্র-ছাত্রিদের অনেকে তখন ঝিমুচ্ছিল। তারাও চমকে উঠে সোজা হয়ে বসল। আমার মুখভঙ্গির কিছু একটা নিশ্চয়ই ওদের একজনকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। কারণ, টিমোথি ইউরিখ নামের ছোট্ট এক ছেলে হঠাৎ গলা ফাটিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিল। বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করতে হল ওকে।

চাদর, ওকে সান্ত্বনা দিতে দিতে আমি ভাবছিলাম, চাদর, বালিশের কাভার, বিছানা, প্লেট-গ্লাস-চামচ, গালিচা, মেঝে। সবকিছু দেখতে একদম ঠিকঠাক হতে হবে। সবকিছু ঝকঝকে-তকতকে দেখতে চাইবে সে। অবশ্যই চাইবে। ক্যাডিলাকের মতোই, সবকিছু এ রকম পরিপাটি-পরিচ্ছন্ন দেখতে চাওয়াটাও ভোলানের স্বভাবের একটি অংশ।

আমি হাসতে শুরু করলাম। টিমিও আমাকে পাল্টা হাসি উপহার দিল। কিন্তু আমি আসলে টিমির দিকে তাকিয়ে হাসছিলাম না।

এলিজাবেথের সাথে হাসছিলাম!

সে বছর স্কুল শেষ হলো জুনের দশ তারিখে। বারো দিন পরে আমি লস অ্যাঞ্জেলেসের উদ্দেশ্যে উড়াল দিলাম। সেখানে পৌঁছে সবার আগে একটা গাড়ি ভাড়া করলাম। তারপর গিয়ে উঠলাম সেই সস্তা হোটেলটায়। মানে, আগেও বিভিন্ন কাজে আমি এটাতেই উঠেছি। পরবর্তী তিন দিন ধরে, প্রতিদিন একবার করে হলিউড হিলসে গিয়ে ভোলানের বাড়ির উপরে নজর রাখতে শুরু করলাম। সারাক্ষণ নজর রাখার উপায় নেই। সেক্ষেত্রে কেউ না কেউ দেখে ফেলবে। বিনা অনুমতিতে কেউ ঘরে ঢোকে কি না বা অনুসরণ করে কি না, সেটা দেখার জন্য এখানকার ধনীরা লোক ভাড়া করে। কারণ, বেশিরভাগ সময়ই এ ধরনের অনুসরণকারীরা বেশ বিপজ্জনক হয়।

ঠিক আমার মতো।

প্রথমে অস্বাভাবিক কিছুই দেখতে পাইনি। বাড়ির কোথাও কোনো ভাঙাচোরা নেই, আগাছায় ভরে ওঠেনি উঠোন। ক্লোরিন মেশানো পুলের পানি বেশ পরিস্কার দেখাচ্ছে। তবু সবখানে অব্যবহারের একটা ছাপ ও এক ধরনের শূন্যতা জেঁকে বসেছে। জানালার পর্দা টেনে নামানো, গ্রীষ্মের রোদ ভেতরে ঢুকতে পারছে না। সেন্ট্রাল টার্ন-অ্যারাউন্ডে কোনো গাড়ি নেই। একদিন পরপর পনিটেইল করা এক যুবক পুলটা পরিস্কার করে দিয়ে যায়, অথচ ব্যবহার করার কেউ নেই।

আমার ভাবতে লাগলাম, সে বুঝি আসবে না। পুরো পরিকল্পনাটাই ভেস্তে গেল। তার পরেও রয়ে গেলাম। মনের কোণে ক্ষীণ আশা, যদি সে আসে!

জুন মাসের ঊনত্রিশ তারিখের কথা, আমি তখন আরো এক বছরের জন্য নজরদারি, অপেক্ষা এবং ব্যায়ামের কথা ভাবতে শুরু করেছি। গ্রীষ্মে হার্ভে ব্লকারের হয়ে ফ্রন্ট-এন্ড লোডার চালানোর জন্য (যদি সে আমাকে আবার কাজে নেয়) মনে মনে নিজেকে প্রায় প্রস্তুত করে ফেলেছি। সেদিন হঠাৎ একটি নীল রঙের গাড়ি এসে থামল ডোলানের বাড়ির সামনে। ওটার গায়ে লেখা : লস অ্যাঞ্জেলেস সিকিউরিটি সার্ভিসেস। ইউনিফর্ম পরা এক লোক বেরিয়ে এসে চাবি দিয়ে গেইট খুলে দিল। আবার গাড়িতে উঠে ওটাকে ভেতরের এক কোণায় নিয়ে পার্ক করল সে। কয়েক মুহূর্ত পরে ফিরে এসে আবার তালা লাগিয়ে দিল গেইটে।

রুটিনে অন্তত একটা কিছু পরিবর্তন এসেছে। মনে মনে একটুখানি আশা দোলা দিয়ে গেল।

গাড়ি নিয়ে ওখান থেকে চলে এলাম। দুই ঘন্টার মতো এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে আবার ফিরে গেলাম আমি। এবার শেষ দিকে পার্ক করার বদলে ব্লকের একেবারে মাথায় এসে গাড়ি রাখলাম। পনের মিনিট পরে একটি নীল ভ্যান এসে থামল ডোলানের বাড়ির গেইটে। গায়ে লেখা : বিগ জোস ক্লিনিং সার্ভিসেস। হৃৎপিন্ডটা লাফিয়ে উঠল। এসবই রিয়ারভিউ মিরর দিয়ে দেখছিলাম। দুই হাত যে কী প্রচণ্ডভাবে গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলে চেপে বসেছিল, সেটা আমার আজো স্পষ্ট মনে আছে।

ভ্যান থেকে চারজন মহিলা নেমে এলো-দুজন শেতাঙ্গ, একজন কৃষ্ণাঙ্গ। দেখে বুঝলাম, শেষজন মেক্সিকান বংশোদ্ভূত। ওয়েট্রেসদের মতো করে সবাই সাদা পোশাক পরেছে, কিন্তু ওরা আসলে ওয়েট্রেস না, ঘরদোর পরিস্কার করার মানুষ।

তাদের একজন গেইটে কলিংবেল দিলে সিকিউরিটি গার্ড বেরিয়ে এসে তালা খুলে দিল। পাঁচজন মিলে হাসাহাসি করল কিছুক্ষণ। গার্ড লোকটা ওদের একজনকে খোঁচা দিতে চাইলে ধাক্কা দিয়ে হাত সরিয়ে দিল সে। সবাই হাসছে।

ওদের একজন ভ্যানে ফিরে গিয়ে ওটা চালিয়ে ভেতরে নিয়ে এলো। অন্যরা কথা বলতে বলতে পা বাড়াল সেদিকে। গার্ড লোকটা গেইট বন্ধ করে আবার তালা দিয়ে দিল।

দরদরিয়ে মুখ বেয়ে ঘাম পড়ছে। মনে হচ্ছে বুঝি গ্রিজে ভরে গেছে মুখ। হৃৎপিন্ডে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে মুহুর্মুহু।

রিয়ারভিউ মিররে আমার দৃষ্টিসীমা পেরিয়ে গেল ওরা। ঝুঁকি নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশটা একবার দেখে নিলাম।

ভ্যানের পেছনের দরজাটা খুলে যাচ্ছে।

অনেকগুলো পরিস্কার চাদর হাতে বেরিয়ে এলো একজন। আরেকজনের হাতে বেশ কিছু তোয়ালে দেখতে পেলাম। সেই সঙ্গে একজোড়া ভ্যাকুয়াম ক্লিনারও দেখা গেল আরেকজনের হাতে। দল বেঁধে দরজার সামনে পৌঁছুলে, গার্ড ওদের জন্য ভেতরের দরজা খুলে দিল।

গাড়ি চালিয়ে চলে আসলাম আমি। হাত দুটো থরথর করে কাঁপছে। স্টিয়ারিংটাও ঠিক করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না, এমন অবস্থা।

বাড়িটা প্রস্তুত করছে ওরা। ও আসছে! এখানে আসছে!

ডোলান যে বছর-দুই বছরে তার ক্যাডিলাক বদলে ফেলে, তা নয়। যে ধূসর সিডান ডিভেলিটা ডোলান সে বছর জুনের শেষে ব্যবহার করছিল, ওটা প্রায় তিন বছর পুরনো। ওটার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা-সবকিছুর একদম নিখুঁত মাপটুকুও আমি জানতাম। লেখক ও গবেষকের নাম ভাঙিয়ে জিএম কোম্পানির কাছে ওটার হিসাব জানতে চেয়ে বার্তা দিয়েছিলাম আমি। ওরা আমাকে সেই বছরের মডেলটির একটি অপারেটর’স ম্যানুয়াল এবং গাড়ির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের সম্পূর্ণ একটি তালিকা পাঠিয়ে দিয়েছিল। এমনকি ডাক টিকিট লাগানো ঠিকানা সংবলিত যে ফেরত-খামটি আমি সাথে দিয়েছিলাম, সেটাও তারা অব্যবহৃত অবস্থাতেই ফেরত পাঠিয়েছিল। বুঝলাম, মন্দার সময়েও বড় কোম্পানিগুলো যথাযথ শিষ্টাচার ঠিকভাবেই মেনে চলে।

আমার এক বন্ধু লাস ভেগাসের হাইস্কুলে গণিত পড়ায়। ম্যানুয়াল থেকে তিনটি মাপ-ক্যাডিলাকের সবচেয়ে চওড়া জায়গার প্রশস্ততা, সর্বোচ্চ উচ্চতার মাপ, আর লম্বা অংশটার দৈর্ঘ্য-নিয়ে আমি ওর কাছে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম না, আমি নিজেকে এ কাজের জন্য প্রস্তুত করেছি? ওর সবটা কিন্তু শারীরিক প্রস্তুতি ছিল না। আসলে বেশিরভাগ প্রস্তুতিই ছিল এ রকম, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিসসংশ্লিষ্ট প্রস্তুতি।

পুরোপুরি কাল্পনিক একটা সমস্যা হিসেবে ওকে আমার সমস্যাটার কথা জানালাম। বললাম, আমি একটি সায়েন্স-ফিকশন গল্প লেখার চেষ্টা করছি। প্রতিটা জিনিসকে যথাসম্ভব বাস্তবসম্মত রাখতে চাচ্ছি আমি। এমনকি যৌক্তিক কিছু কল্পদৃশ্যও তৈরি করেছিলাম। মনে আছে, নিজের উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখে নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম তখন।

বন্ধু জানতে চেয়েছিল, এলিয়েন স্কাউট ভেহিকলটা কতো জোরে ছুটবে। এই প্রশ্নটা আমি ঠিক আশা করিনি। জিজ্ঞেস করলাম, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় কি না।

‘অবশ্যই।’ ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করল সে, ‘তুই যদি চাস, গল্পে তোর স্কাউট ভেহিকলটা সরাসরি ফাঁদে এসে পড়বে, তাহলে ফাঁদটা একেবারে যথাযথ আকারের হতে হবে। তুই আমাকে যে হিসেব দিয়েছিস, সে অনুযায়ী গাড়িটা সতের বাই পাঁচ ফুটের মতো।

ওর হিসেব যে পুরোপুরি ঠিক হয়নি সেটা বলার জন্য মুখ খুলতেই হাত উঁচিয়ে ধরল।

‘হিসেবের সুবিধার্থে কাছাকাছি একটা মাপ ধরে নিলাম আর কি। এভাবে ধরলে বৃত্তচাপ মাপাটা সহজ হয়ে যায়।’

‘কী?’

‘দ্য আর্ক অব ডিসেন্ট। মানে, যে বৃত্তচাপ ধরে গাড়িটা নিচে পড়তে শুরু করবে,’ বন্ধু বুঝিয়ে দিল। প্রতিশোধপরায়ণ যে কেউ একবার বুঝে ফেললে, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই এই শব্দগুচ্ছের প্রেমে পড়ে যেতে বাধ্য। দ্য আর্ক অব ডিসেন্ট। এর মাঝে একটা অশুভ গন্ধ আছে। আছে নিকষ আঁধারের ছাপ।

আমি ভেবেছিলাম, ক্যাডিলাকের জায়গা হবে, এ রকম একটা গর্ত খুঁড়লেই হলো-ওটা এঁটে যাবে। বন্ধুই আমাকে প্রথম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল ব্যাপারটা। কবর হিসেবে উৎরে যাবার আগে ওটাকে ফাঁদ হিসেবে উৎরে যেতে হবে। তা না-হলে আসল কাজই হবে না।

ও বলে যাচ্ছিল, আকৃতিটা কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যে রকম সরু খাদের কথা আমি ভাবছিলাম, সেটা কাজ না করার সম্ভাবনাই বেশি। ‘স্কাউট-যানটা যদি সরাসরি গর্তের মুখে এসে না পড়ে, তাহলে ওটা হয়তো পুরোপুরি গর্তে ঢুকবেও না। কিছুটা আড়াআড়িভাবে পিছলে গিয়ে যখন থামবে, দেখা যাবে সব কয়টা এলিয়েন দরজা খুলে বেরিয়ে পড়েছে। ওরা বরং তখন তোর নায়ককেই ঠেসে ধরবে।’ এর সমাধানটাও বলে দিল সে। প্রবেশ মুখটা আরো কিছুটা চওড়া করে দিতে হবে। গর্তটাকে হতে হবে চোঙ্গাকৃতির।

তার পর আবার গতি নিয়েও একটা সমস্যা রয়ে গেছে।

ডোলানের ক্যাডিলাকের গতি যদি সেদিন খুব বেশি হয় আর গর্তটা। যদি অনেক ছোট হয়, তাহলে গাড়িটা ওই গর্তটা উড়েই পেরিয়ে যাবে। গর্তের ওমাথায় গিয়ে পেছনের কিছুটা অংশ বা পেছনের চাকা হয়তো সামান্য বাড়ি খাবে। ফলে, গাড়িটা হয়তো উল্টে গিয়ে ছাদের উপরে ভর করে ওপাশে পড়ে থাকবে, কিন্তু গর্তে পড়বে না। আবার ক্যাডিলাকের গতি যদি খুব কম হয়, তাহলে ওটা হয়তো নাকে ভর দিয়ে গর্তে পড়বে। কিন্তু এতে কাজের কাজ কিছুই হবে না। একটা ক্যাডিলাকের পেছনের ট্রাঙ্ক, বাম্পার ও চাকাসহ শেষ দুই ফিট বেরিয়ে থাকলে আপনি ওটাকে কবর দিবেন কিভাবে? একটা মানুষের দুই পা উল্টো হয়ে বেরিয়ে থাকলে আপনি যেমন তাকে কবর দিতে পারবেন না, এখানেও সেই একই জিনিস হবে।

‘তোর স্কাউট ভেহিকল ঠিক কতো জোরে ছুটবে, বল তো?’

দ্রুত হিসেব কষে নিলাম। উন্মুক্ত হাইওয়েতে ডোলানের ড্রাইভার ষাট থেকে পঁয়ষট্টির মধ্যে গাড়ি চালায়। ওই জায়গাটায় সে হয়তো আরেকটু আস্তে চালাবে। ডিট্যুর, মানে বিকল্প পথের সাইনটা হয়তো সরিয়ে নেওয়া যাবে কিন্তু রাস্তা মেরামতের যন্ত্রগুলো কিংবা পুণঃনির্মাণ কাজের সব চিহ্ন তো আর লুকিয়ে ফেলা সম্ভব হবে না।

‘ধর, বিশ রুলের মতো হবে? বিজ্ঞান-কল্পকাহিনীকার হিসেবে বললাম।

‘আরে বাপ, ইংরেজিতে বল।‘

‘পৃথিবীর হিসেবে ঘন্টায় পঞ্চাশ মাইল হবে আর কি।’

‘আহ্-হা। সাথে সাথেই হিসেব কষতে বসে পড়ল। জ্বলজ্বলে চোখে চুপচাপ ওর কাজ দেখতে লাগলাম আমি।

মুহূর্তখানেক পরেই বন্ধু চোখ তুলে তাকাল। ‘তুই বোধ হয় গাড়িটার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা পরিবর্তনের কথা ভেবে দেখতে পারিস, দোস্ত।’

‘এ কথা কেন বলছিস?’

‘স্কাউট ভেহিকলের জন্য সতের বাই পাঁচ ফুট অনেক বড় হয়ে যায়। জিনিসটা তো শালার একদম লিংকন মার্ক ফোরের আকারের হয়ে গেছে! ও হাসছে।

আমিও হেসে ফেললাম। পরে বেশ কিছুক্ষণ হাসাহাসি করেছিলাম এ নিয়ে।

তো, সেদিন ওই মহিলাদেরকে তোয়ালে আর চাদর নিয়ে ওই বাড়িতে ঢুকতে দেখার পর আমি আকাশ পথে ভেগাসে ফিরে এলাম।

বাড়িতে এসে তালা খুলেই সোজা লিভিং রুমে এসে তুলে নিলাম টেলিফোনটা। টের পেলাম, হাত কাঁপছে। নয়টা বছর ধরে জালের ভেতরে ওঁৎ পেতে থাকা মাকড়সা কিংবা কাঠবোর্ডের পেছনের ইঁদুরের মতো আমি শুধু অপেক্ষা করেছি আর নজর রেখেছি। সব সময় চেষ্টা করেছি, ডোলান যেন কোনোভাবেই টের না পায়, এলিজাবেথের স্বামী এখনো তার ব্যাপারে আগ্রহী। সেদিন যখন ভেগাস ফিরে আসার সময় ওর বিকল ক্যাডিলাকের পাশ দিয়ে আসছিলাম, লোকটা আমার দিকে পুরোপুরি ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। ও আমাকে চিনতে না পারায় সেদিন যে উন্মত্ত রাগ উঠে গিয়েছিল, এখন বুঝতে পারছি, ওটা আসলে আমার এতদিনের শ্রমের পুরস্কার ছিল।

কিন্তু এখন আমাকে ঝুঁকি নিতে হবে। কারণ, আমার পক্ষে একই সাথে দুই জায়গায় থাকা সম্ভব না। ভোলান আসছে কী না, সেটা জানা আমার জন্য জরুরি। বুঝতে হবে, কখন বিকল্পপথের সাইনটা সরিয়ে ফেলতে হবে।

প্লেনে করে বাড়ি ফেরার সময় একটা বুদ্ধি বের করেছি। মনে হচ্ছে, কাজ হবে ওতে। হতেই হবে।

লস অ্যাঞ্জেলেস ডিরেক্টরি অ্যাসিসটেন্সে ফোন করে বিগ জো’স ক্লিনিং সার্ভিসের নাম্বার চাইলাম। ওদের কাছে স্থানীয় সব নাম্বার থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নাম্বার পেয়ে গেলাম। ফোন দিলাম ওদেরকে।

বললাম, ‘রেনি’স ক্যাটারিং থেকে আমি বিল বলছি। ১১২১ অ্যাসটার ড্রাইভ হলিউড হিলসে এই শনিবার আমাদের একটি পার্টি আছে। আপনাদের মেয়ে কর্মীদের কেউ কি মি. ডোলানের স্টোভের উপরের কেবিনেটে রাখা পাঞ্চ-বোলটা একটু চেক করে আমাকে জানাতে পারবে? এটুকু কী করে দেওয়া যাবে, ভাই?’

লোকটা একটু অপেক্ষা করতে বলল আমাকে। হোন্ডা করে ধরে রইলাম ফোনটা। অন্তহীন প্রতিটি সেকেন্ড পার হচ্ছে আর আমি আরো বেশি করে নিশ্চিত হচ্ছি, সে আমাকে সন্দেহ করে অন্য লাইনে ফোন কোম্পানিকে কল দিয়ে দিয়েছে।

শেষ পর্যন্ত লোকটা ফোনে ফিরল। হতাশ শোনাল বেচারার কণ্ঠ। খুশি হয়ে গেলাম। ঠিক এটাই চাইছিলাম আমি।

‘শনিবার রাতে?’

‘হ্যাঁ। ওরা যেমনটা চাচ্ছে, আমার কাছে অত বড় পাঞ্চ-বোল আসলে এখন নেই। শহরের ওমাথা থেকে আনাতে হবে। কিন্তু আমি জানতাম, ওনার নিজেরই একটা ছিল। কিন্তু একটু নিশ্চিত হওয়া লাগবে আমাকে।‘

‘ভাই দেখুন, আমার কল-শিটের হিসেবে মি. ডোলানের তো রবিবার বিকেল তিনটার আগে আসার কথা নয়। আমার মেয়েদের কাউকে দিয়ে পাঞ্চ-বোল চেক করে দেখতে আমার কোনো আপত্তি নেই কিন্তু আগে অন্য একটা ব্যাপার একটু নিশ্চিত করে নেওয়া দরকার। মি. ডোলানের সাথে গ্যাঞ্জাম করার তো কোনো উপায় নেই। উনি যদি একদিন আগে চলে আসেন, আমার তাহলে এখনই আরো কয়েকজনকে পাঠাতে হবে ওখানে।‘

‘দাঁড়ান, আমি একটু ডাবল-চেক দিয়ে দেখি।’ রোড টু এভরিহয়্যার নামের তৃতীয় শ্রেণির যে বইটা স্কুলে পড়াই, ওটা পাশেই টেবিলে রাখা ছিল। তুলে নিয়ে ফোনে যেন শোনা যায়, সেভাবে কয়েক পাতা উল্টেপাল্টে

দেখার ভান করলাম। তার পর বললাম, ‘ওহ হো! আমারই ভুল হয়েছে। দেখছি। উনি রবিবার রাতেই পার্টি দেবেন। আমি সত্যিই দুঃখিত। আপনি কি এখন আমার মুখের উপরে

‘সমস্যা নেই, দাঁড়ান। একটু ধরুন, আমি মেয়েদের কাউকে বলি দেখছি–’

‘না, তার আর দরকার নেই। রবিবার সকালে গ্ল্যানডেলের একটা বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে আমার নিজের পাঞ্চ-বোলটাই ফিরবে।’

‘ঠিক আছে। অত দুশ্চিন্তা করবেন না, বুঝলেন?’ লোকটার গলায় স্বস্তি। কিছু সন্দেহ করেছে বলে মনে হলো না। আশা করলাম, এই লোক এ নিয়ে আর দ্বিতীয়বার ভাববে না।

রিসিভার রেখে স্থির হয়ে বসলাম। যথাসম্ভব সতর্কভাবে মাথার মধ্যে পুরো ব্যাপারটার ছক কেটে নিচ্ছি। তিনটায় এলএ’তে পৌঁছানোর জন্য ওকে সকাল দশটার মধ্যে ভেগাস ছাড়তে হবে। তার মানে, এগারোটা পনের থেকে ত্রিশের মধ্যে সে ওই ডিট্যুরের জায়গায় পৌঁছে যাবে। সঙ্গত কারনেই সে সময়টায় রাস্তায় গাড়ি তেমন থাকবে না বললেই চলে।

বুঝলাম, স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে কাজ শুরু করার সময় হয়েছে।

পত্রিকার পাতায় ক্রয় বিক্রয়ের বিজ্ঞাপনগুলো দেখে কিছু ফোন-টোন করলাম। তারপর, আমার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আছে, এমন পাঁচটি ব্যবহত গাড়ি দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। ওগুলোর মধ্যে থেকে একটা ফোর্ড ভ্যান পছন্দ হলো। এলিজাবেথ যে বছর খুন হয় সে বছরই ওটা বাজারে এসেছে। নগদে মূল্য চুকালাম। যখন বেরিয়ে এলাম, আমার সেভিং অ্যাকাউন্টে তখন মাত্র দুইশ সাতান্ন ডলার অবশিষ্ট আছে। এ নিয়ে অবশ্য আমার একটুও দুশ্চিন্তা হয়নি। বাড়ি ফেরার পথে জিনিসপত্র ভাড়া দেওয়ার একটা ডিসকাউন্ট ডিপার্টমেন্ট স্টোর থেকে মাস্টার কার্ড দিয়ে একটি পোর্টেবল এয়ার কম্প্রেসর ভাড়া করলাম।

শুক্রবার বিকেলে সবকিছু ভ্যানে তুলে ফেললাম : গাঁইতি-শাবল, কম্প্রেসর, ডলি, টুলবক্স ও হাইওয়ে ডিপার্টমেন্ট থেকে ধার করা একটি জ্যাকহ্যামার-ওটার মাথায় আবার রাস্তার অ্যাসফ্যাল্ট ভাঙার জন্য তীরের মাথার মতো একটি ধাতু-ফলক লাগানো ছিল। সাথে বর্গাকৃতির বালু রংয়ের একটি ক্যানভাস ও ক্যানভাসের একটি বড় রোলও নিয়ে নিলাম। এই বড় রোলটা আসলে গত গ্রীষ্মে আমার করা একটি বিশেষ প্রজেক্টের অংশ। সেই সাথে নিলাম পাঁচ ফিট লম্বা একুশটি পাতলা কাঠের তক্তা এবং একটি বড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্ট্যাপলার।

মরুভূমির কিনারার শপিং সেন্টারের সামনে থেমে, এক জোড়া লাইসেন্স প্লেট চুরি করে ভ্যানে লাগিয়ে নিলাম আমি।

ভেগাস থেকে ছিয়াত্তর মাইল পশ্চিমে এসে প্রথম কমলা রংয়ের সাইনটা দেখলাম :

সামনে নির্মাণ কাজ চলছে, নিজ দায়িত্বে পার হোন।

আরো এক মাইলের মতো পেরিয়ে এসে সেই সাইনটা দেখতে পেলাম। এই এক সাইনের জন্য আমি…এলিজাবেথের মৃত্যুর পর থেকে অপেক্ষা করে আছি। অবশ্য, এটার কথা আমি তখনো নিশ্চিতভাবে জানতাম না।

সামনে বিকল্পপথ : ৬ মাইল।

আমি যখন পরিস্থিতি যাচাইয়ের জন্য পৌঁছেছি, ততক্ষণে গোধূলি গাঢ় হয়ে অন্ধকার হয়ে আসছে। আগে থেকে পরিকল্পনা করতে পারলে আরেকটু ভালো হতো। তারপরেও বিশেষ সুবিধা হতো বলে মনে হয় না।

ডানে মোড় নেওয়ার পরে, দুটো উঁচু চূড়ার মাঝে বিকল্পপথের সাইন। দেখে মনে হচ্ছে, আগেকার ছোটখাটো বেড়া দেওয়া কোনো রাস্তাকে হাইওয়ে ডিপার্টমেন্ট মসৃণ ও যথাসম্ভব চওড়া করে নিয়ে সাময়িকভাবে ভারি যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করেছে। জ্বলজ্বলে একটি তীর চিহ্ন এই বিকল্প রাস্তাটিকে নির্দেশ করছে। ইস্পাতের তালা দেওয়া বাক্সে রাখা ব্যাটারি থেকে ওটাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।

বিকল্পপথের একদম পরপরই হাইওয়েটা আবার উঁচুতে উঠে গেছে। এখানে দুই সারিতে রোড-কোন বসিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেগুলোর পেছনে (যদি কোনো অসতর্ক ড্রাইভার জ্বলজ্বলে চিহ্নটা মিস করেও যায় এবং রোড-কোনগুলোর উপর দিয়েও না দেখেই গাড়ি চালিয়ে দেয়-কিছু কিছু বোকা ড্রাইভার সম্ভবত দেয়ও) প্রায় বিলবোর্ডের মতো বড় একটি কমলা রঙের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে লেখা :

রাস্তা বন্ধ। বিকল্পপথ ব্যবহার করুন।

তারপরেও বিকল্পপথের সাইন ঝুলানোর কারণটা এখান থেকে দেখা যায় না। আমার জন্য এটা বেশ ভালো হয়েছে। ফাঁদে পা দেওয়ার আগে ডোলান ওটার সামান্য গন্ধও পাক, সেটা আমি চাই না।

দ্রুত কাজ শুরু করে দিলাম। চাই না, কেউ আমাকে এ সময় দেখে ফেলুক। ভ্যান থেকে নেমে কিছু রোড-কোন সরিয়ে ফেলে ভ্যান যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা করে নিলাম। রাস্তা বন্ধ লেখা সাইনটা টেনে ডানে সরিয়ে দৌড় দিলাম ভ্যানের দিকে। ওটাকে ফাঁকা দিয়ে ভেতরে নিয়ে এলাম।

এ সময় একটা গাড়ির এগিয়ে আসার শব্দ ভেসে এলো।

যত দ্রুত সম্ভব, রোড-কোনগুলো রেখে দিলাম আগের জায়গায়। দুটো কোন আমার হাত ফসকে পড়ে গেল, গড়িয়ে গিয়ে পড়ল পাশের পানি নিষ্কাশনের নালায়। হাঁপাতে হাঁপাতে ওগুলোর পিছু দিলাম ছুট। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। এ সময় একটা পাথরের সাথে হোঁচট খেয়ে হাত পা ছড়িয়ে পড়ে গেলাম। তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ালাম। মুখে বালু ঢুকে গেছে। টের পেলাম, এক হাতের তালু থেকে রক্ত ঝরছে। গাড়িটা এখন অনেক কাছে চলে এসেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ওটা বিকল্পপথের আগের উঁচু জায়গাটার উপরে চলে আসবে। হেডলাইটের আলোয় ড্রাইভার হয়তো দেখতে পাবে, জিন্স আর টি-শার্ট পরা কেউ একজন রোড-কোনগুলো সরানোর চেষ্টা করছে। ভ্যানটাও এমন জায়গায় রাখা, যেখানে নেভাডা হাইওয়ে ডিপার্টমেন্টের গাড়ি ছাড়া আর কারো গাড়ি থাকার কথাই না। শেষ কোনটা কোনোভাবে আগের জায়গায় রেখে দৌড়ে সাইনের পিছে চলে এলাম আমি।

এগিয়ে আসা গাড়ির হেডলাইট যখন পুবের উঁচু ঢালে নিজের উজ্জ্বল উপস্থিতি জানান দিল, বার বার মনে হতে লাগল, ওটা হয়তো আসলে নেভাডা স্টেট টুপারের গাড়ি।

সাইনটা আমি আগের জায়গায় না হলেও কাছাকাছিই রেখেছি। দৌড়ে গিয়ে ভ্যানে উঠলাম। সামনের উঁচু জায়গাটা পেরিয়ে ঢালে নেমে এলাম ওটা নিয়ে। পেরিয়ে আসা মাত্রই গাড়িটার হেডলাইট আমার ঠিক পেছনেই ঝিলিক দিয়ে উঠল।

আমার গাড়ির লাইট তো বন্ধ ছিল। ও কি তারপরও আমাকে দেখে ফেলেছে?

মনে হয় না।

সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলাম, বুকের ধড়ফড়ানি কমার অপেক্ষা করছি। শেষ পর্যন্ত গাড়িটা যখন লাফাতে লাফাতে, আওয়াজ করতে করতে বিকল্পপথ পথ দিয়ে বেরিয়ে গেলে বুকটা শান্ত হয়ে এলো।

কাজে হাত দেওয়ার সময় হয়েছে।

উঁচু জায়গাটার পরেই একটা লম্বা, সোজা রাস্তা সমতলভাবে নেমে গেছে। রাস্তাটার দুই-তৃতীয়াংশই নুড়ি পাথর আর কাঁকর বিছানো।

ওরা কি এটা দেখে থেমে যাবে? ঘুরে চলে যাবে? নাকি এই রাস্তা ধরেই সামনে এগোবে? ভাববে, যেহেতু কোনো বিকল্পপথের সাইন নেই, এটা ধরে সামনে যেতে কোনো সমস্যাও নেই।

এখন আর এ নিয়ে ভাবার সময় নেই আমার। অনেক দেরি হয়ে গেছে।

সমতল রাস্তাটার বিশ গজের মতো একটা জায়গা বেছে নিলাম। রাস্তাটা আরো এক মাইলের এক চতুর্থাংশের মতো সামনে এগিয়ে গিয়ে শেষ হয়েছে। রাস্তার এক পাশে ভ্যানটা রেখে পেছনের দরজা খুলে কিছু তক্তা, যন্ত্রপাতি টেনে নামালাম। ভাবলাম, একটু বিশ্রাম নেওয়া যাক। মরুর আকাশের শীতল নক্ষত্রগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, খেলাটায় নেমেই পড়লাম, এলিজাবেথ।

মনে হলো, একটা ঠান্ডা হাত বুঝি আলতো করে ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিল আমার।

কম্প্রেসরটা অনেক শব্দ করে। জ্যাকহ্যামারের অবস্থা তো আরো খারাপ। কিন্তু এটুকু শব্দ এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায়ও নেই আসলে। শুধু আশা করতে পারি, মাঝরাতের আগেই প্রথম পর্যায়টা শেষ করতে পারব। এরচেয়ে বেশি সময় লাগলে এমনিতেও বিপদে পড়ে যাব। কারণ, কম্প্রেসরের জন্য আমার কাছে সীমিত পরিমাণ তেলই আছে।

এ নিয়ে শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করে কোনো লাভ নেই। কে শুনছে অথবা আহাম্মক ভেবে আমাকে গাল দিচ্ছে, ওসব বাদ দিয়ে আমি বরং ভোলানকে নিয়ে, ওর ধূসর সিড্যান ডিভিলেটাকে নিয়েই ভাবি।

আমার গণিতজ্ঞ বন্ধুর হিসেব অনুযায়ী সাদা চক আর মিজারিং টেপ দিয়ে কবরের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ প্রথমে চিহ্নিত করে নিলাম। কাজ শেষ হলে দেখলাম, পাঁচ ফিট চওড়া, চল্লিশ ফিট লম্বা একটি এবড়ো-থেবড়ো আয়তক্ষেত্র অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে। এ মাথা থেকে ওটা ক্রমশ চওড়া হয়েছে। গ্রাফ পেপারে আমার বন্ধুর আঁকা স্কেচটায় ওটা যেমন ফানেলের মতো লেগেছিল, এই আধো অন্ধকারে প্রশস্ত হতে থাকা মুখটাকে আর তেমন লাগছে না। মনে হচ্ছে, আলো-আঁধারের বুকে একটা লম্বা, সোজা উইন্ডপাইপ হাঁ করে আছে।

আয়তক্ষেত্রটার মধ্যে আড়আড়িভাবে দুই ফিট চওড়া করে আরো বিশটা লাইন আঁকলাম। শেষে, মাঝ বরাবর নিচের দিকে একটা লম্বা দাগ টানলাম। এতে করে, দুই ফিট বাই আড়াই ফিটের বেয়াল্লিশটার মতো বর্গ নিয়ে একটি গ্রিড তৈরি হলো। শেষে এসে, তেতাল্লিশতম বর্গটা শাবলের মতো আকৃতি পেয়েছে।

এবারে শার্টের হাতা গুটিয়ে কম্প্রেসর টেনে চালু করে প্রথম বর্গটায় ফিরে গেলাম।

এরচেয়ে দ্রুত কাজ এগোবে বলে আশা করার কোনো অধিকার আমার নেই। কিন্তু আমি সেটাই আশা করেছিলাম। আরো বড় আকারের ভারি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারলে হয়তো আরো দ্রুত করা যেত। কিন্তু ওসব আরো পরে আসবে। প্রথম কাজ হলো, বর্গাকারে কাটা দাগগুলোকে আরো গভীর করে নেওয়া।

মাঝরাত তো মাঝরাত, তিনটার দিকেও কাজ শেষ হলো না। কিন্তু কম্প্রেসরের তেল ফুরিয়ে গেল। এমন যে হতে পারে সেটা আমি আগেই ভেবে রেখেছিলাম। ভ্যানের গ্যাস ট্যাংক থেকে তেল ব্যবহার করার জন্য তাই সাথে করে সাইফন নিয়ে এসেছি। গ্যাস-ক্যাপটা খুলতেই জ্বালানির তীব্র কটু গন্ধে মাথা গুলিয়ে উঠল। কোনোভাবে ক্যাপটা লাগিয়ে দিয়ে, ভ্যানের পেছনে সটান শুয়ে পড়লাম।

আজ আর না। সম্ভবই না আমার পক্ষে। হাতে গ্লাভস পরে থাকার পরেও, তালুতে বড় বড় ফোস্কা পড়ে গেছে। ওগুলোর অনেকগুলো থেকে এখন আবার পানি ঝরছে। সারা শরীর কাঁপছে থরথর করে। মনে হচ্ছে যেন জ্যাকহ্যামারের কাঁপুনিটাই আমার মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। এদিকে হাতের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে উন্মত্ত টিউনিং ফর্ক। ইচ্ছেমতো নড়েই যাচ্ছে, থামছে না। মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে, প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে মাড়িতে। মনে হচ্ছে, মেরুদণ্ডের মধ্যে কেউ বুঝি ভাঙা কাঁচ ভরে দিয়ে গেছে।

এখন পর্যন্ত মোট আটাশটা বৰ্গ কাটতে পেরেছি আমি।

আঠাশটা।

আরো চৌদ্দটা বাকি।

তারপর কেবল আসল কাজ শুরু হবে।

কখনো মনে হয়নি কাজটা অসম্ভব। একা করা যাবে না।

শীতল সেই হাতটা আবারো আদর করে দিল। যেন বলতে চাইছে, পারবে প্রিয়তম, তুমি পারবে।

কানের ভনভনানি অনেকটা কমে এসেছে। খানিক পরে পরে এগিয়ে আসতে থাকা ইঞ্জিনের শব্দ পাচ্ছি…শব্দগুলো একটু পরেই ডানে সরে যাচ্ছে, মিলিয়ে যাচ্ছে রাতের বুকে। হাইওয়ে ডিপার্টমেন্ট এই নির্মাণ এলাকা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য যে ঘুরপথ তৈরি করেছে, সেটাই ব্যবহার করছে ওরা।

আগামীকাল শনিবার…উঁহু, আজকে। আজকেই শনিবার। ভোলান রবিবারে আসবে। হাতে একদমই সময় নেই।

হ্যাঁ, প্রিয়তম।

বিস্ফোরন ওকে টুকরো টুকরো ফেলেছিল।

প্রিয়তম আমার, যা দেখেছে কেবল সেই সত্যিটুকুই জানিয়েছিল পুলিশকে। সত্যি বলায়, সাহসি হওয়ায়, ভয় না পাওয়ার জন্যে ও খন্ড বিখন্ড হয়ে পড়েছিল। আর ডোলান এখনো ক্যাডিলাকে করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাতে চকচকে রোলেক্স পরে বিশ বছরের পুরনো স্কচে চুমুক দিচ্ছে মনের আনন্দে।

ভেবেছিলাম, একটু পরেই আবার কাজে লেগে পড়ব কিন্তু ওভাবেই স্বপ্নহীন, মৃত্যুসম এক ঘুমে তলিয়ে গেলাম আমি।

জেগে দেখি আটটা বেজে গেছে। তেতে উঠেছে সূর্য। কড়া রোদ এসে পড়ছে মুখে। উঠে বসতেই ঝাঁকিয়ে উঠলাম। ব্যথায় টিপ টিপ করতে থাকা হাত পিঠ জুড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে আপনাতেই। কাজ আছে? আরো চৌদ্দ টুকরো অ্যাসফ্যাল্ট কাটতে হবে? হাঁটতেই পারছি না, এমন অবস্থা! তবু হাঁটলাম।

বুড়োদের মতো পা টেনে টেনে, গ্লাভ কম্পার্টমেন্টের কাছে গিয়ে ওটা খুললাম। ঠিক এ ধরনের সকালের জন্যই সাথে করে এক বয়াম অ্যাম্পিরিন ট্যাবলেট নিয়ে এসেছিলাম।

ভেবেছিটা কী আমি নিজেকে? শরীর শক্তপোক্ত হয়ে উঠেছে? আসলেই তাই ভেবেছি?

হাস্যকর!

পানি দিয়ে চারটি অ্যাস্পিরিন গিলে নিলাম। ওগুলো কাজ করার জন্য পনের মিনিটের মতো অপেক্ষা করে। শুকনো ফল এবং পপ-টার্টের উপরে এক রকম ঝাঁপিয়ে পড়লাম। নাস্তা সেরে পড়ে থাকা কম্প্রেসর আর জ্যাকহ্যামারের দিকে নজর দিলাম। মনে হচ্ছিল, কম্প্রেসরের হলদে রং বুঝি সূর্যের আলোয় হিসহিস করছে। যত্ন করে কাটা বর্গাকার অ্যাসফাল্টের টুকরোগুলো ওটার পাশেই পড়ে আছে।

শরীর কোনোভাবেই জ্যাকহ্যামারটা তুলে নিতে চাইছে না। হার্ভে ব্লকারের কথাগুলো মনে পড়ে গেল, তুমি আদৌ কখনো শক্তপোক্ত হতে পারবে বলে মনে হয় না। কিছু মানুষ আর গাছপালা সূর্যের তাপে টিকে থাকতে পারে। কিছু শুকিয়ে যায়, মরে যায়…কেন এ রকম কষ্ট শুধু শুধু নিজের কাঁধে টেনে নিচ্ছ তুমি?

‘টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে ছিল সে,’ তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘ওকে আমি ভালোবাসতাম। আর আমার ভালবাসার মানুষটা ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে ছিল।‘

উৎসাহ দেওয়ার জন্য লোকে যেমন বলে, ‘গো বিয়ারস্!’ কিংবা ‘ছাতু করে দাও শালাকে!’-আমার চিৎকারটা ঠিক সেরকম জুতসই হলো না। কিন্তু এই চিৎকারই কাজ চালিয়ে যাওয়ার শক্তি যোগাচ্ছিল আমাকে। ভ্যানের ট্যাংকের মুখে পাইপ লাগিয়ে ওতে মুখ লাগিয়ে টান দিলাম। ওভাবে সাইফন করতেই কটু স্বাদে মুখ ভরে গেল। খক খক করে একদলা থুতু ফেললাম, জোর করে ভেতরের সব উগরে দেওয়ার ইচ্ছে সংবরণ করছি। এ সময় একবার মনে হলো, দীর্ঘ সাপ্তাহিক ছুটিতে যাওয়ার আগে রাস্তা মেরামতের কর্মীরা যদি ওদের মেশিন থেকে সব ডিজেল ফেলে দিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে কী করব? দ্রুত ঝেটিয়ে বিদেয় করলাম দুশ্চিন্তাটা। নিয়ন্ত্রনের বাইরের কোনো জিনিস নিয়ে অযথা চিন্তা করে লাভ নেই। বি ৫২ বিমান থেকে পিঠে প্যারাসুটের বদলে, হাতে ছাতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লে যেরকম লাগার কথা, নিজেকে আমার বার বার সেরকম কেউ বলে মনে হচ্ছিল।

গ্যাসোলিনের ক্যানটা নিয়ে কম্প্রেসরের ট্যাংকে সবটা ঢেলে দিলাম। এদিকে, ডান হাতের উপর দিয়ে বাম হাত বাঁকা করে কম্প্রেসরের স্টার্টার কর্ডের হ্যাঁন্ডেল ধরতে হলো আমাকে। হ্যাঁন্ডেল ধরে টানার সময় আরো কিছু ফোস্কা গলে গেল। পরে, কম্প্রেসর চালু হওয়ার পরে দেখি হাতের তালু থেকে পুঁজ ঝরছে।

সম্ভব না আমার পক্ষে।

প্লিজ, প্রিয়তম?

জোর করে নিজেকে জ্যাকহ্যামারের দিকে টেনে নিয়ে গেলাম।

প্রথম ঘন্টাটা সবচেয়ে খারাপ গেল। তার পর, একদিকে জ্যাকহ্যামারের একঘেয়ে কম্পন আর রক্তে অ্যাস্পিরিন মিশে গিয়ে মনে হলো পিঠ, হাত, মাথা-সবকিছু বুঝি অসাড় হয়ে গেছে। শেষ অ্যাসফ্যান্টটা যখন কেটে বের করলাম, ততক্ষণে এগারোটা বেজে গেছে। টিঙ্কার আমাকে রাস্তা মেরামতের ভারি যানগুলো জাম্প-স্টার্ট করা শিখিয়েছিল। ওর কতটা মনে আছে, সেটা দেখার সময় এসেছে।

টলতে টলতে ভ্যানে ফিরে গিয়ে, ওটাকে দেড় মাইল চালিয়ে যেখানে মেরামতের কাজ চলছে, সেখানে নিয়ে এলাম। এক পলকেই আমার প্রয়োজনীয় যন্ত্রটা চোখে পড়ে গেল। পেছনে হুক আর সাঁড়াশি লাগানো বড় একটি কেস-জর্ডান বাকেট-লোডার। বর্তমানে এর দাম একশ পঁয়ত্রিশ হাজার ডলার। ব্লকারের জন্য আমি একটা ক্যাটারপিলার চালিয়েছিলাম। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে, এটাও সেরকমই হবে।

আশা করি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *