অধ্যায় ৬
এরপরের দিন যখন রান্নাঘরে প্রবেশ করলাম তখন তিনটা চার বাজছে।
বাবা টেবিলটার পাশে বসে আছেন। আস্তে করে একবার মাথা উঁচু করে আবার নামিয়ে নিলেন। মা’কে নিয়ে ওনার সাথে চিল্লাচিল্লি করার পর থেকে আর দেখা হয়নি আমাদের।
“কি খবর বাবা,” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“এই তো,” আমার দিকে তাকিয়ে বললেন।
“কিছু পেলেন কেসটাতে?” ওভেনে খাবার গরম করতে দিয়ে বললাম।
চশমা খুলে আমার দিকে ঘুরে বসলেন তিনি।
“কেসটা আস্তে আস্তে আরো জটিল হচ্ছে। জেনিফার মেয়েটার একটা ডায়রি আছে যেটাতে সে তার ব্ল্যাকমেইলের শিকার লোকদের ওপর সব তথ্য টুকে রাখত।”
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ, কিন্তু ডায়রির পাতাগুলো সব ছিঁড়ে ক্রাইম-সিনের চারপাশে ছিটিয়ে দেয়া হয়েছিল। গোয়েন্দারা পরবর্তিতে পাতাগুলো ক্রমানুসারে সাজানোর চেষ্টা করলেও আমার মনে হচ্ছে বেশ কয়েক জায়গায় ভুল হয়েছিল তাদের। গত দু-দিন যাবত ওগুলো পড়ে গোছানোর চেষ্টা করেছি। আমি।”
মাথা নেড়ে ওভেন থেকে চিলির বাটিটা বের করে টেবিলে তার পাশে গিয়ে বসলাম।
বাবা গভীর মনোযাগ দিয়ে কাগজগুলো দেখতে লাগলেন। আসলে দেখার ভান করতে লাগলেন বলাটাই ঠিক হবে। তার বারবার পা নাড়ানো দেখেই বুঝতে পারছি, নার্ভাস বোধ করছেন। কার্ড খেলার সময় তার হাতে ভালো চাল থাকলে এমনটাই করেন তিনি।
“বাবা,” আমি বললাম।
তিনি হাত উঠিয়ে আমাকে থামার ইঙ্গিত করে বললেন, “না, আমি আগে বলি,” এরপর লম্বা করে একটা শ্বাস নিলেন, “আমি দুঃখিত, বাক্সগুলোর ব্যাপারে তোমাকে কিছু বলিনি। গত বছর যখন তুমি আমার কাছে তোমার মার ব্যাপারে সবকিছু জানতে চেয়েছিলে তখন তার ব্যাপারে যা যা জানতাম সব বলেছি। অবশ্য ওসব বেশি সাহায্য করতে পারেনি।”
আসলেই বলেছিলেন তিনি। যদিও স্যালি বিনস’ সম্পর্কে তার জানা বেশিরভাগ তথ্যই ছিল বানোয়াট। মা মিথ্যে বলেছিলেন তাকে।
একটাই সত্যি কথা জানতেন তিনি মার ব্যাপারে, তিনি সিআইএ’র হয়ে কাজ করতেন। আমার বয়স যখন দু-বছর তখন ভুলবশত মা’র একটা ভুয়া পাসপোের্ট খুঁজে পান তিনি। এরপরেও বেশি কিছু তাকে জানাননি মা। শুধু এটুকু বলেছিলেন, তিনি সিআইএ’র একজন এজেন্ট। বাবা ধারণা করেছিলেন মা হয়ত গুপ্তচর গোছের কেউ হবেন। অথচ মা ছিলেন তল্কালীন বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা টর্চার বিশেষজ্ঞ।
আমার মনে আছে, তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কিভাবে এসবের সাথে মানিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। কিভাবে এতগুলো মিথ্যে কথা মেনে নিতে পেরেছিলেন। জবাবে তিনি যা বলেছিলেন তা কখনো ভুলব না আমি :
“দেখো বাবা, তোমাকে একটা কথা বলি। তুমি যখন কাউকে মন থেকে ভালোবাসবে তখন এসব জিনিসের সাথে তোমাকে মানিয়ে নিতেই হবে। তোমার মা যতক্ষন আমার সাথে ছিলো, ততক্ষন তো তার পরিচয় ছিলো স্যালি বিনস। আমার আর তোমার প্রতি তার ভালোবাসাটা কিন্তু মিথ্যে ছিলো না। চাকরিক্ষেত্রে প্রয়োজনে যদি তাকে অন্য কোন বেশ ধারন করতে হয়, সেখানে তো আমি আর কিছু বলতে পারি না।”
আবার যখন বর্তমানে ফিরে এলাম তখনও কথা বলে যাচ্ছেন বাবা।
“…বাক্সগুলো দু’মাস আগে খেয়াল করি, সুতরাং তোমাকে জানানো উচিত ছিল। আমি ভেবেছিলাম শুধু কাপড়চোপড় হবে…তোমার সামনে ওগুলো খুললে হয়ত পুরনো স্মৃতির কথা ভেবে শুধু শুধু কষ্ট পাবে।”
“আমি বুঝতে পেরেছি কেন দেখাননি। আমার আসলে আপনার সাথে ওভাবে রাগ দেখানোটা উচিত হয়নি। আমি দুঃখিত।”
“আমিও,” তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বুকের ওপর থেকে পাথর নেমে গেছে। “বাক্সগুলোতে বিশেষ কিছু খুঁজে পেয়েছ নাকি তুমি?”
আমি তাকে খবরের কাগজ আর আর্টিকেলগুলো সম্পর্কে বললাম।
“এমকে আলট্রা,” তিনি বললেন, “আশির দশকে বেশ শোরগোেল হয়েছিল এটা নিয়ে।”
আমি তাকে মার হারানো বছরগুলোর ব্যাপারে আমার ধারণার কথা খুলে বললাম। কিভাবে তার প্রাক্তন স্ত্রী এসবের সাথে জড়িয়ে পড়ে এবং কেন ওয়েন তাকে স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন।
এরচেয়ে বেশি কিছু আর তাকে বললাম না। কারণ প্রতিবার আমি যখন উল্লেখ করি মা আমার সাথে কি করেছেন তখন কিছু সময়ের জন্যে নিজের ঘরে চলে যান তিনি। ব্যাপারটা তার জন্যে খুবই বেদনাদায়ক। আর তাকে ওভাবে কষ্ট পেতে দেখলে আমারো খারাপ লাগে।
টপিক পরিবর্তন করার জন্যে বললাম, “আমাকে এই কেসটা সম্পর্কে বলুন।”
উৎসাহে তার জোড়া লাফিয়ে উঠল।
আমার ফোনের দিকে তাকালাম। তিনটা দশ। আজকে একটু ভালো লাগছে আমার, তাই বললাম, “দশ মিনিট পাবেন।”
ডায়রির কতগুলো পাতা তুলে নিলেন তিনি। ওগুলোর বামদিকে তাকালেই বোঝা যাচ্ছে, উপড়ে ফেলা হয়েছিল ডায়রি থেকে।
.
আজকে মি. ল্যানগন আবার আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছেন।
বদ লোক। ছয় বাচ্চার বাপ না আপনি? আমি যখন খাতা জমা দেব তখন আমার কাঁধ ধরার চেষ্টা করবেন না। আমি চাই না আপনার ঐ লোমশ হাতগুলো আমার পছন্দের নীল সোয়েটারটা ঠুক।
উফ।
মেগান বলল গত বছর ওর সাথেও নাকি একই কাজ করেছিলেন তিনি। ও ভেবেছিল নালিশ করবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত করেনি। আমিও ভাবছি নালিশ করব কিনা।
বলব, প্রিন্সিপাল ডেরি, আপনার উচিত মানবিক বিভাগে নতুন একজন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া। আগেরজন কেবল ছাত্রিদের বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে।
যাই হোক, মেগান গত সপ্তাহে ওর লাইসেন্স পেয়ে গেছে, তাই আজ লাঞ্চ করতে ক্যাম্পাসের বাইরে গেছিলাম ওর গাড়িতে করে। ক্যাফেটেরিয়ার বোরিং খাবারগুলো থেকে অনেক ভালো। সাবওয়ে স্যান্ডউইচ খেয়েছি আমরা। জন ম্যাককানিস আর লুক সার্জেই বসেছিল আমাদের পাশের বুথটার। মেগান বলল লুককে নাকি গত বছর একবার চুমু খেয়েছিল ও। কিন্তু তখন ওদের দুজনের দাঁতেই ব্রেস লাগানো ছিল। জঘন্য, তাই না? লুক ওর ব্রেস খুলে ফেলেছে আর দু-মাসের মধ্যে মেগানও ওরটা খুলে ফেলবে। তখন নাকি আবার চেষ্টা করে দেখবে।
কবে যে আমাকে কেউ চুমু খাবে!
পনের বছর হয়ে গেল আমার আর এখনও কাউকে চুমু খেলাম না। সামার ক্যাম্পের বেনির কথা গোনায় ধরছি না। তখন ক্লাস থ্রিতে পড়তাম আমরা। আমি চাই না ওটা আমার জীবনের প্রথম চুমুর মর্যাদা পাক। ইয়াক!
আমি চাই আমার প্রথম চুমুটা হবে জ্যাসনের সাথে।
কী যে বলি, চতুর্থ বর্ষের কেউ কিনা আমাকে চুমু খাবে? আর ওর তো মার্থা নামে সুন্দরি একটা গার্লফ্রেন্ডও আছে।
স্বপ্ন দেখতে দোষ কোথায়?
.
ফিরতে দেরি হবে, আজকেও। এটাই বলেছে মা। “ববকে বলো তোমাদের ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে গরম করে দিতে।” যেন ঐ বাসি খাবার খেতে খুব ভালো লাগে আমাদের।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী এমন কেসে ব্যস্ত তিনি যে, প্রতিদিন এত রাত করে বাসায় ফিরতে হয় তাকে। “তুমি তো জান সোনামণি, আমি আমার কেসগুলো নিয়ে কারো সাথে কথা বলতে পারি না। নিষেধ আছে।”
হ্যাঁ, জানি। আমার সাথে কোন ব্যাপারেই কথা বলতে পারো না তুমি।
ফুঁ।
বাহ্, মজার তো।
ফুঁ…
শিষ বাজানোর চেষ্টা করছিলাম কিন্তু ডায়রিটাই নিচে পড়ে গেল।
দুঃখিত।
এমন ভাব করছি যেন এই লেখাগুলো কেউ পড়বে!
হ্যাঁ, মার্কাস তোমার উদ্দেশ্যেই কথাগুলো বলছি আমি। এখনই আমার ডায়রি নামিয়ে রাখ। না-হলে পরেরবার ঘুমিয়ে গেলে মাথায় বাড়ি পড়বে তোমার।
হা-হা-হা-হা-হা।
আর কখনোই এটা খুঁজে পাবে না তুমি। লুকোনোর ভালো একটা জায়গা খুঁজে পেয়েছি।
তো যা বলছিলাম, মার কোন একটা সমস্যা হয়েছে।
গত দেড় মাস যাবত প্রতি সপ্তাহে এক বা দু’দিন অনেক রাত করে অফিস থেকে ফিরছেন তিনি।
মানে, এই ব্যাপারটা হয়ত অতটাও অদ্ভুত নয়, সেই সাথে তিনি অদ্ভুত আচরণও করছেন। যা একটু বেশিই অদ্ভুত।
গত শনিবার যখন ফোনটা বেজে উঠল তখন বাইরে থেকে ছুটে এসে ওটা ধরলেন তিনি। এর আগে কখনো তাকে দৌড়াতে দেখিনি আমি। পয়তাল্লিশ বছরের একজন মহিলাকে ওভাবে দৌড়াতে দেখতে অদ্ভুত লাগে। এটা বলতেও চেয়েছিলাম তাকে। কিন্তু অদ্রতা হবে ভেবে বলিনি।
রোববারেও একই ঘটনা।
বব তখন টিভিতে রেডস্কিনসের খেলা দেখায় ব্যস্ত ছিল তাই ওর নজর এড়িয়ে গেছে ব্যাপারটা।
তোমার স্ত্রী এরকম অদ্ভুত আচরণ করছে আর তুমি কিনা খেলা দেখছ! একটু এ্যাকটিক্যাল হও, বব।
ববের কথা থেকে মনে হল, খাবার তৈরি।
কালকের বাসি খাবার।
ইয়াক।
.
মা পরকিয়া করছে!
মেগান আর আমি স্কুলের পরে মলে গেছিলাম। বাল্টিমোেরের মলটাতে। ওর ক্লাসের একটা ছেলে ওকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাবার প্রস্তাব দিয়েছে। সেই উপলক্ষে গ্যাপ নামে একটা দোকান থেকে নতুন সোয়েটার কিনবে ও। বাল্টিমোরের মলটাতে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই ছিল না আমার। কিন্তু গেছিলাম কারণ ওদের ওখানে ‘গ্রেট স্টেক এস্কেপ’ নামে একটা দোকান আছে যেখানকার স্টেকের জন্যে যে কোন কিছু করতে পারি আমি। আর মেগান বলেছিল, আমাকে একটা খাওয়াবে।
(ছেলেটা ওকে নিয়ে একটা রোমান্টিক সিনেমা দেখতে যাবে)
ইয়াক।
আচ্ছা, একটু একটু হিংসা লাগছিল আমার। স্বীকার করছি। আমিও ওরকম একটা ফালতু সিনেমা দেখতে চাই কোন ছেলের সাথে। হবে হয়ত কোনদিন। ও আমাকে স্কুলের ইয়ারবুক থেকে ছেলেটার ছবি দেখিয়েছে। অতও সুন্দর না। কিন্তু সেটা বড় ব্যাপার না। বড় ব্যাপার হচ্ছে অন্যটা।
গ্যাপ থেকে শপিং সেরে যখন বের হচ্ছিলাম আমরা তখন আমার হাতে গুঁতো দিয়ে মেগান বলল, “ওটা তোমার মা না?”
আসলেই মা ছিল ওটা। আরেকটা লোকের সাথে। বাল্টিমোরের এক মলে। একটা ফুডকোর্টে!
আরো ভালোমত দেখার জন্যে কাছাকাছি গেলাম আমরা।
‘গ্রেট স্টেক এস্কেপ’-এ বসে খাচ্ছিল ওরা। শুধু পরকিয়াই না, এখন তার জন্যে আমি আর কখনো ঐ দোকানটায়ও খেতে পারব না।
আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার। লোকটা দেখতে একদম ববের মত। আমি প্রথম পাঁচ সেকেন্ড মনে করেছিলাম ওটা বুঝি ববই। কিন্তু বব কখনো স্যুট পরে না। আর ববের একটু ভুড়ি আছে। এই লোকটা চিকন কিন্তু তার চুল আর চেহারার গড়ন পুরোপুরি ববের মত। তার হাতটা ছিল আমার মা’র পায়ের ওপর!
ওখান থেকে হাত সরা হারামি!
আমার ইচ্ছে হচ্ছিল ছুটে গিয়ে ঘুসি বসিয়ে দেই লোকটার মুখে। কিভাবে পারল মা? বব হয়ত দুনিয়ার সবচেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তি নয়, কিন্তু তার মত ভদ্র আর কেউ নেই। মার সাথে কত ভালো আচরণ করে সবসময়। আমার আর মার্কাস এর সাথেও গত আট বছর ধরে কি সুন্দর মানিয়ে চলেছে। কিভাবে পারল সে ববের সাথে এমন করতে?
এরপর মা ঝুঁকে লোকটাকে চুমু খেল। চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিল। ওনাকে ঘৃণাকে করি আমি। এই মাত্র বাসায় আসল মনে হয়।
বদ মহিলা।
.
বিশ্বাস করবেন না, বদ মহিলাটা, মানে আমার মা কি করেছে।
আমি তাকে বলেছিলাম, কিছু জিনিস কিনতে মলে যেতে হবে আমাকে।
আমাকে গাড়ি চালাতে দিল সে। খুবই ভালো ব্যবহার করল। মনে হয় অপরাধবোধ থেকে অমন করছিল। ববের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্যে অপরাধবোধে ভুগছিল।
ওখানে পৌঁছে পার্কিংলটের একদম পেছনে গাড়ি নিয়ে যাই আমি। সে জিজ্ঞেস করেছিল, কি উদ্দেশ্য আমার। আমি কান্না শুরু করে দিয়েছিলাম। চেষ্টা করেও নিজেকে সামলাতে পারিনি। এত রাগ লাগছিল!
সে আমাকে জিজ্ঞেস করে কোন সমস্যা হয়েছে কিনা? আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়েছি কিনা?
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ, মা। কোন ছেলেকে জীবনে চুমুই খেলাম না আর প্রেগন্যান্ট হয়ে বসে আছি!
আমি বলে দেই, ঐ লোকটার সাথে তাকে দেখে ফেলেছি আমি। দেখে ফেলেছি, গ্রেট স্টেক এস্কেপে বসে দু’জন চুমু খাচ্ছিল।
আর তখন ঐ বদ মহিলা কি করল জানেন? না, ক্ষমা চায়নি। এমনকি বলল ও না, ঐ ব্র্যাড না চাক নামের লোকটার কাছ থেকে দূরে থাকবে। সে বলল আমি যদি কাউকে এ ব্যাপারে না বলি তাহলে মোলতম জন্মদিনে একটা গাড়ি কিনে দেবে আমাকে। একদম নতুন। যেটা চাই আমার। আমি বললাম আমার একটা রেঞ্জ রোভার চাই। সবুজ রঙের। রাজি হয়ে গেলেন তিনি!
এরপর আমি তাকে বলি…থাক, ওটা লিখে ডাইরি নষ্ট করব না আমি।
গাড়ি থেকে নেমে সোজা বাসার পথে হাঁটা ধরি। দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখি বব টিভি দেখছে।
“তোমার স্ত্রী পরকিয়া করছে, বব।”
সব খুলে বলি আমি তাকে। ঐ লোকটার কথা, চুমুর কথা, রেঞ্জ রোভার গাড়ি কিনে দেয়ার প্রস্তাব, সব বলে দেই। শুনে কেঁদেই ফেলে বব। এরপর চলে যায়।
.
দুঃখিত, অনেক দিন লিখতে পারিনি। খুব বাজে দুটো সপ্তাহ গেল। জীবনের সবচেয়ে খারাপ দুটো সপ্তাহ। মেগানদের বাসায় আছি আমি গত এক সপ্তাহ ধরে।
মা আর ববের ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে। বব একটা মোটেলে উঠেছে এখন। মার্কাস মার সাথে থাকছে। ওর ধারণা সব দোষ আমার। আমাকে ঘৃণা করে ও। ওকে কোন দোষ দেই না আমি।
আসলে গাড়িটা নেয়াই উচিত ছিল আমার।
.
বাবা ডায়রি পড়া বন্ধ করে দিলেন। আরেকটু পড়ে শোনালে ভালো হত।
“বেচারা,” বলে উঠি আমি।
আমি জানি না, বাবা ইচ্ছে করেই এই অংশটুকু পড়লেন কিনা, যাতে করে মেয়েটার প্রতি সহানুভূতি জন্মে আমার। আর তার খুনিকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করি তাকে।
তাই যদি হয়, তাহলে তার পরিকল্পনা কাজে দিয়েছে।
মেয়েটার মা’র ওপর আমার মার মতনই রাগ হচ্ছে। তিনি তার মেয়েকে গাড়ি ঘুষ দিতে চেয়েছেন যাতে সে ববকে কিছু না বলে (বব জেনিফারের সত্বাবা। যতদূর বুঝলাম, তাকে খুব ভালোবাসে মেয়েটা)। তার পরকিয়ার কারণে পরিবারটা শুধু ভেঙেই যায়নি, নিজের মেয়ের সাথে সারাজীবনের জন্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছিল। আর মেয়েটার ভাই তাকে ঘৃণা করা শুরু করেছিল এটা ভেবে যে, তার কারণেই সব ঝামেলার সৃষ্টি হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই ব্ল্যাকমেইল করার মত বিপজ্জনক পথে পা বাড়ায় মেগান। যা এক সময় তাকে নিয়ে যায় মৃত্যুর কাছে।
বাবার সাথে কেসটাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে হল। ডায়রির পরবর্তি লেখাগুলোও শুনতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। এরচেয়েও বড় কাজ আছে আমার হাতে।
বাবাকে বললাম কেসটার প্রতি আরো মনোযোগ দিতে এবং কি পেলেন সেটা আমাকে জানাতে। এরপর ল্যাপটপ নিয়ে আমার ঘরে চলে আসলাম।
দুটো নতুন ইমেইল এসেছে।
প্রথমটা পাঠিয়েছে ইনগ্রিড। গত দু’দিন ওদের ওখানে যা যা ঘটেছে সব কিছুর বর্ণনা লেখা ওটাতে। ওর মা এখনও কোমায় আছেন কিন্তু অবস্থার উন্নতি ঘটছে ধীরে ধীরে। ওর বাবা এখনও শান্ত হতে পারছেন না। ইনগ্রিড ওনার ফোনে ক্যান্ডি ক্রাশ গেমটা ইন্সটল করে দেয়ায় ওটা খেলে কিছু সময়ের জন্যে স্ত্রীর অবস্থা ভুলে থাকতে পারছেন। পালা করে ওর মা’র দেখাশোনা করছে ওরা। একজন হাসপাতালে থাকলে আরেকজন বাসায় গিয়ে গোসল সেরে খাবার দাবার নিয়ে আসে। আমাকে ভীষণভাবে মিস করছে আর ওখান থেকে ফিরে একেবারে অ্যাপার্টমেন্টে উঠতে চায় ও। ল্যাসি, মারডক আর বাবার খেয়াল রাখতে বলেছে।
দ্রুত ওর ইমেইলের জবাব লিখে পাঠিয়ে দিলাম। এরপর দ্বিতীয় ইমেইলটা খুললাম।
এএসটি মাইক ল্যাং পাঠিয়েছে এটা।
.
হেনরি,
এটুকুই খুঁজে পেয়েছি আমি। কোন খাটুনি হয়নি, তাই খরচেরও দরকার নেই।
মাইক।
বি: দ্র : তোমার দাদা-দাদির ব্যাপারটাতে দুঃখিত আমি। তা-ও ভ্যালেন্টাইনস ডে’তে!
ইমেইলের সাথে এটাচ করে দেয়া জিপ ফাইলটা খুললাম। চারটা পিডিএফ আছে ওটায়।
প্রথমটা আমার বাবার জন্মসনদ : ডেস মোইনেস, আইওয়া। রিচার্ড জেফরি বিনস। জন্ম : ৮/১/১৯৫০। অভিভাবক : জ্যাক এবং মারগারেট বিনস।
দ্বিতীয়টা খুলে বুঝলাম এটার কথাই ইমেইলে লিখেছে মাইক। আমার দাদা-দাদি মারা যান সড়ক দুর্ঘটনায়। ভ্যালেন্টাইনস ডে’তে ডিনার শেষে বাসায় ফেরার পথে এক মাতাল ট্রাক ড্রাইভার তাদের গাড়ির ওপর তুলে ট্রাক। আমার বাবার বয়স তখন একুশ। আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তিনি। পরের পিডিএফটাতে তাদের মৃত্যু সনদও দিয়ে দিয়েছে। মাইক। ওখানে তারিখ লেখা ২/১৪৭১।
চতুর্থটা আমার জন্মসনদ।
ওটার সাথে আমার আলেক্সান্দ্রিয়ার বাসায় রাখা জন্মসনদটা মিলে যায় : ভার্জিনিয়া। হেনরি গ্রেসন বিনস। ৩/২০/১৯৭৮। অভিভাবক, রিচার্ড এবং স্যালি বিনস।
ওটার নিচের দিকে বাবার সইটাও ঠিক আছে।
একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আমার বাবা আসলেও আমার বাবা।
ধন্যবাদ ঈশ্বর।
.
তিনটা পঁচিশ।
আমার স্টকগুলো দেখলাম। গত দুদিনে প্রায় ষাট হাজার ডলার খুইয়েছি। ওগুলোর ব্যবস্থা করে ল্যাপটপটা নামিয়ে রাখলাম।
প্রায় এক সপ্তাহ কোন ব্যয়াম করিনি। বিছানার নিচ থেকে নাইকি জোড়া বের করে নিলাম। জুতোর ফিতা বাঁধার সময় মনে হল একটা জিনিস দেখতে ভুলে গেছি। বাবার সম্পর্কে জানার পর এতটা স্বস্তি লাগছিল যে গত রাতে পাঠানো মেসেজটার কথা ভুলেই গেছি।
সিডনি ওয়েনকে মেসেজ দিয়েছিলাম আমি।
ফেইসবুকে লগইন করলাম। একটা নতুন মেসেজ এসেছে ওনার কাছ থেকে।
আমার হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল। গত রাতে আমি লিখেছিলাম :
মি. ওয়েন, আমার ধারণা আপনি জানেন আমি কে।
আপনার কাছে কিছু প্রশ্ন ছিল আমার। এটা পাবার পরে আমাকে একটা মেসেজ দেবেন দয়া করে।
ওনার মেসেজটাতে ক্লিক করলাম।
মি. বিনস,
আপনার পরিচয় সম্পর্কে অবগত আমি, আর এটাও জানি, আপনি কোন কন্ডিশনে ভুগছেন। সত্যি কথা বলতে, আমি আসলে অবাকই হয়েছি, আমার সাথে যোগাযোগ করতে এত সময় লাগালেন কেন। আপনার সকল প্রশ্নের উত্তর দেয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করব আমি। তবে বলে রাখছি, ওগুলো শুনতে হয়ত ভালো না-ও লাগতে পারে আপনার।
সিডনি
বড় করে শ্বাস নিয়ে প্রশ্নগুলো লিখতে থাকলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুছে দিলাম সবগুলো। শুধু পাঁচটা শব্দ লিখলাম :
কাল দেখা করতে পারি আমরা?
সেন্ড বাটনে ক্লিক করে জুতোর ফিতা বেঁধে নিলাম। এসময় মারডক ভেতরে ঢুকল। আমি দৌড়ানোর জন্যে তৈরি হতে থাকলেই কিভাবে যেন বুঝে যায় ও। ঘাড় কাত করে আমাকে দেখতে লাগল ও।
“হ্যাঁ, আসতে পারিস তুই।”
খুশিতে লেজ নাড়তে লাগল ব্যাটা। দৌড়ে এসে আমার মুখ চেটে দিল ল্যাসির খোঁজে একবার নজর বোলালাম আশেপাশে। কোথাও দেখলাম ওকে।
তিনটা তেতাল্লিশ নাগাদ আমি আর মারডক বাবার বাসার পাশেই পার্কটার প্রায় অর্ধেক চক্কর দিয়ে ফেললাম। গত সপ্তাহের মত না হলেও গরম খুব একটা কমেনি। পুরো ঘেমে গেছিল আমি। প্রায় নয় বছর পরে এ পথে দৌড়াচ্ছি। নস্টালজিক লাগছে।
মারডকের চেইনটা ছেড়ে দিলাম। মোটামুটি বাধ্য ও এসব ব্যাপারে, ল্যাসির মত নয়। ল্যাসির সবসময়ের চেষ্টা থাকে চেইন ছাড়িয়ে নিয়ে এটা ওটা তাড়া করে বেড়ানো। মাঝে মাঝে আমার হাত থেকে ছুটে গিয়ে সামনে অপেক্ষা করে ও। এরপর আমি কাছাকাছি গেলে আবার দৌড় শুরু করে।
বাবার বাসার সামনের রাস্তায় ঢোকার সময় ফোনটা শব্দ করে উঠল একবার। বের করলাম ওটা।
বাসা থেকে বের হবার আগে ফোনে মেসেঞ্জার অ্যাপটা ইন্সটল করে নিয়েছি। ওটারই নোটিফিকেশন।
বুড়ো মনে হয় এখনও জেগে আছে। ইনগ্রিডের বাবার মত ক্যান্ডি ক্রাশ খেলছে। তার মেসেজটা একদম সাধারণ :
কাল দেখা হচ্ছে।
এরপর একটা ঠিকানা লেখা।
.
বাসায় ঢুকেই বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি কাজটা করবেন কিনা।
“অবশ্যই,” কোন প্রকার দ্বিধা ছাড়াই জবাব দিলেন তিনি।
আমি তাকে ঠিকানা বললে ওটা ফোনে টুকে নিলেন তিনি। বললেন দু টার মত লাগবে পৌঁছুতে।
বাবার বয়স যখন কম ছিল তখন আমাকে কোলে করে নিয়ে গাড়িতে তুলতেন তিনি। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে সাতটা হাড্ডি ভাঙার পর তিনি বুঝতে পেরেছেন, তার একশ ষাট পাউন্ডের ছেলেকে কোলে করে নিয়ে গাড়িতে ওঠানোর দিন শেষ।
তার মানে, আজ রাতে গাড়িতেই ঘুমোতে হবে আমার।
ঘড়ির দিকে তাকালাম। তিনটা পঞ্চান্ন।
দৌড়ে আমার ঘরে গিয়ে এক মিনিটে গোসল করে নিলাম। এরপর একটা টি-শার্ট পরে হুডি আর জিন্স তুলে নিলাম ঘুম থেকে উঠে গায়ে চাপানোর জন্যে।
এক মিনিট বাকি থাকতে গ্যারেজে পৌঁছে গেলাম।
ল্যাসি আমার বাবার গাড়িটার হুডের ওপর বসে আছে। হুডের ওপর যে চকচকে বলটা লাগানো আছে সেটাকে নাড়াচ্ছে বারবার।
হেসে বললাম, “কি করছিস তুই?”
মিয়াও।
“এরকম করলে একটু শান্তি পাস?”
মিয়াও।
“কি?”
মিয়াও।
“গরীব মানুষের খেলার বল এটা? মানে, গরীব বিড়ালের খেলার বল?”
মিয়াও।
“বাসার কাজে আমাকে সাহায্য করলে তোকে হয়ত নতুন একটা বল দিলেও দিতে পারি আমি।”
ওর সাথে কথা বলতে থাকলে সারাদিন পার হয়ে যাবে। কিন্তু আমার হাতে আর কয়েক সেকেন্ড আছে মাত্র। দরজা খুলে প্যাসেঞ্জার সিটটাতে চড়ে বসলাম। ল্যাসি হুড থেকে নেমে লাফ দিয়ে আমার কোলে উঠে গেল।
মিয়াও।
“বাসন মাজার কাজে সাহায্য করবি?”
মিয়াও।
“উঠানের ঘাস কাটতে কিভাবে সাহায্য করবি তুই, শুনি?”
এই সময় বাবা এসে আমার মাথার নিচে একটা বালিশ দিয়ে আমার আর ল্যাসির গায়ে একটা কম্বল চাপিয়ে দিলেন। এরপর ছোট একটা এনার্জি বার আর একগ্লাস পানি খাইয়ে দিলেন। পুরনো দিনগুলোর মত।
“ধন্যবাদ, বাবা,” এই বলে ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
.
অধ্যায় ৭
ভার্জিনিয়ার কালপিপার শহরটা বাবার বাসা থেকে প্রায় সত্তর মাইল দূরে। ঐতিহাসিকদের কাছে এই শহরটার গুরুত্ব অনেক। আমেরিকায় একদম প্রথম দিকে হাতে গোনা যে-কয়টা শহর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার মধ্যে এটি একটি।
আর এ কথাটা আমাকে কে বলেছে তা তো বুঝতেই পারছেন। বাবা। কিছু সময়ের জন্যে অমীমাংসিত কেসের গোয়েন্দা থেকে ঐতিহাসিক বনে গেছিলেন।
বাবাকে বলতে চাইছিলাম শহরের ১৮২৪৭ লোকের মধ্যে কেবল একজনের ইতিহাস জানলেই চলবে আমার। কিন্তু দু-ঘন্টা গাড়ি চালিয়ে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন তিনি, আবার ফিরে যাওয়ার পথে দু-ঘন্টা গাড়ি চালাতে হবে। এটুক ছাড় তো দেয়াই যায়।
মাথা নাড়তে নাড়তে সিটে বসে কাপড় বদলাতে লাগলাম। কাজটা সোজাই, কিন্তু মারডকের কারণে ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। সে এখন আমার মুখ চাটায় ব্যস্ত।
“এই দুই মাস্তানকে সাথে করে নিয়ে আসার কি খুব দরকার ছিল?” বাবার ইতিহাসের লেকচারের মাঝেই জিজ্ঞেস করলাম। তিনি এখন ব্যাখ্যা করছিলেন কেন শহরের নাম ফেয়ারফ্যাক্স থেকে বদলে কালপিপার রাখা হল।
এসময় ল্যাসি হাজির হল মারডকের মাথার ওপর।
মিয়াও।
“আচ্ছা, তুই বড় মাস্তান,” বললাম আমি।
মিয়াও।
“তোর কথা মতই চলে মারডক, বুঝেছি।”
দু-জনকে আবার পেছনের সিটে পাঠিয়ে দিয়ে জিন্সের প্যান্টটা পরে নিলাম।
“ওটাই কি বাসাটা?” জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললাম। একটা বিশাল দোতলা বাড়ি দেখা যাচ্ছে বাইরে।
“হ্যাঁ, ওটাই, মাথা নেড়ে জানালেন তিনি। “আমি একবার চারপাশ দিয়ে হেঁটে দেখেও এসেছি। মেইলবক্সের নম্বর আর আমাকে যে ঠিকানাটা দিয়েছিলে তুমি সেটা মিলে গেছে। গেটের কাছে দুটো ছাগল তো আমাকে ভয় দেখিয়ে প্রায় মেরেই ফেলেছিল।”
বাসাটা বাইরে থেকে একদম ছিমছাম, শান্ত মনে হচ্ছে। ওটার ভেতরে যে মানুষটা বসবাস করছে তার একদম বিপরীত। বেড়ার ভেতর দিয়ে একটা সুন্দর বাগানও দেখা যাচ্ছে বাইরে থেকে।
“আমি কি তোমার সাথে আসব?” বাবা জিজ্ঞেস করলেন।
আসলে তাকে নিয়ে ভেতরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই আমার, আবার না-ও বলতে পারছি না।
“ঐ লোকটা যা বলবে তা আপনার বোধহয় পছন্দ হবে না।”
“ওটা নিয়ে ভেব না,” তিনি শান্ত কিন্তু দৃঢ় স্বরে বললেন, “সময় এসেছে তোমার মা’র আসল পরিচয়টা মেনে নেয়ার।”
“আপনাকে নিয়ে গর্বিত আমি,” তার হাতে আলতো একটা চাপড় মেরে বললাম।
“আরে, এটা তো আমার কথা,” মৃদু হেসে জবাব দিলেন তিনি। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালাম। তিনটা তিন।
“ল্যাসি, মারডক,” আমি ওদের দিকে ঘুরে বললাম, “আমাদের অনুপস্থিতিতে কোন ঝামেলা করবি না।”
ওরা ওদের সবচেয়ে নিরীহ মুখ করে বসে থাকল। যেন ভাঁজা মাছটাও উল্টে খেতে জানে না।
“আর মারডক, তোর ওপর সব দায়িত্ব। দেখবি ছোট মাস্তান যাতে বের না হয় গাড়ি থেকে।”
মিয়াও।
“তখন মিথ্যা বলেছিলাম আমি,” এই বলে তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে বের হয়ে দরজা লাগিয়ে দিলাম।
.
ড্রাইভওয়ে ধরে বাসাটার কাছে পৌঁছুতে দুই মিনিট লাগল। চাঁদের আলোয় সুন্দর দেখাচ্ছে বাড়িটা। তবে বয়সের তুলনায় একটু বেশিই জাঁকজমক দেখে মনে হচ্ছে এক পর্যায়ে হয়ত আবার রিমডেল করা হয়েছে।
বাবা এসময় আমাদের ডানদিকে একটা বার্চ গাছের নিচে দুটো ছায়ার দিকে ইঙ্গিত করল। গভীর রাতে খেতে বের হয়েছে ছাগলদুটো। আমাদের দেখে একবার মাথা উঁচু করে আবার ঘাস খাওয়ায় ফিরে গেল ওরা।
আর যাই হোক, পাহারাদার ছাগল না।
কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে কলিংবেল খোঁজার বৃথা চেষ্টা করলাম। ওরকম কিছু না পেয়ে দরজার বিশাল তামার রিং ধরে আস্তে করে বাড়ি দিলাম তিনবার।
তিরিশ সেকেন্ড কিছুই ঘটল না। এরপর বাবা পাঁচবার নক করলেন জোরে জোরে।
“আশেপাশের পাঁচ মাইলের মধ্যে সবার ঘুম ভেঙে গেছে নিশ্চিত,” আমি বললাম।
“কিছু না পেয়ে ফিরে যাবার জন্যে এতদূর আসিনি আমরা,” কাঁধ ঝাঁকিয়ে নির্লিপ্তভাবে জবাব দিলেন বাবা।
পনের সেকেন্ড পর ভেতর থেকে পদশব্দ ভেসে এল। খয়েরি রঙের নাইটগাউন পরা একজন কষ্ণাঙ্গ মহিলা দরজা খুলে দিলেন।
“শুভ সন্ধ্যা, উজ্জ্বল একটা হাসি দিয়ে বললেন তিনি। “আমি দুঃখিত যে, দরজা খুলতে এত সময় লাগল। এখন আর আগের মত পরিস্কার শুনতে পাই না আমি।”
তাকে দেখে মনে হচ্ছে বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে। চিন্তা করতে লাগলাম তিনি কি মি. ওয়েনের স্ত্রী নাকি কেয়ারটেকার। নাকি দুটোই?
তিনি নিজেই আমার প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিলেন, “আমি ম্যাগি। মি. ওয়েনের টুকটাক কাজে সাহায্য করি।”
সাহায্য বললে কম হয়ে যাবে। কিন্তু এটা ভার্জিনিয়া, এখানকার নিয়মনীতি অন্যরকম।
“মি. ওয়েন আপনাদের জন্যে স্টাডিতে অপেক্ষা করছেন। আমি আপনাদের ওখানে নিয়ে যাচ্ছি।”
বাবা আর আমি তার পেছন পেছন গেলাম।
একটা সরু হলওয়েতে প্রবেশ করলাম। খুব মৃদু আলো জ্বলছে চারপাশে। এতে অন্ধকার যেন আরো বেড়ে গেছে। ফোন বের করে সময় দেখলাম।
তিনটা ছয়।
ভয়েস রেকর্ডার অ্যাপটা বের করে রেকর্ডিং চালু করে আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম ফোনটা।
“আপনাদের কি চা কিংবা অন্য কিছু বানিয়ে দেব?” ম্যাগি জিজ্ঞেস করলেন।
“আমি ঠিক আছি,” বললাম।
“স্কচ হবে আপনাদের এখানে?” বাবা জিজ্ঞেস করলেন।
আমি চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালাম।
একবার কাঁধ ঝাঁকালেন তিনি শুধু।
“অবশ্যই হবে,” ম্যাগি বলল। “বেশ ভালো স্কচ আছে মি. ওয়েনের সংগ্রহে,” এই বলে একটা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি।
আমরা কাছে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। এরপর ফিসফিসিয়ে বললেন, “মি. ওয়েন কথার মাঝখানে অনেক সময় খেই হারিয়ে ফেলেন,” এই বলে মাথার দিকে ইঙ্গিত করলেন আঙুল দিয়ে। “যদি উনি হঠাৎ করে যুদ্ধ সম্পর্কে কথা বলা শুরু করেন, তাহলে দয়া করে এক-দু মিনিট সময় দেবেন ওনাকে। এরপর আপনা আপনিই ঠিক হয়ে যাবেন।”
বাবা আর আমি দু-জনেই মাথা নাড়লাম।
ম্যাগি দরজায় নক করে বললেন, “মি. ওয়েন আপনার অতিথিরা এসে গেছেন।”
ভেতর থেকে একটা অস্ফুট আওয়াজ ভেসে আসলে ম্যাগি দরজার নব ঘুড়িয়ে খুলে ফেলল ওটা। বাবা আর আমি একটা বিশাল স্টাডিতে প্রবেশ করলাম। হলওয়ে থেকেও কম পাওয়ারের আলো জ্বলছে এখানে। চোখ সরু করে টেবিলের ওপাশে বসে থাকা মানুষটাকে দেখতে হল আমার।
মাথা পুরো টাক লোকটার, খালি এখানে ওখানে কয়েক গোছা সাদা চুল। নাক আর কানই ওনার চেহারার প্রায় এক তৃতীয়াংশ জুড়ে আছে। কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে আছে অনেকটা। একটু কুঁজো হয়ে বসে আছেন, মনে হচ্ছে, মাথাটা ঘাড়ের ভেতরে ঢুকে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু এই কম আলোতেও ওনার নীল চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে। যেন একটা কম বয়সি ছেলের মাথা থেকে ওগুলো বের করে মি. ওয়েনের কোটরে বসিয়ে দেয়া হয়েছে।
আশেপাশে বই আর বই। নানা রঙের নানা আকারের বই রাখা আছে। টাল করে। কোন কোন বইয়ের টাওয়ার তো আমার চেয়েও লম্বা। ওগুলোর মাঝে দিয়ে হেঁটে যাবার সময় মনে হচ্ছিল যেকোন সময় মাথার ওপর পড়ে যাবে।
“মি. বিনস,” ভারি স্বরে বললেন ওয়েন, “আর আপনার পাশের ভদ্রলোকটি কে? আপনার বাবা মনে হয়? মি. বিনস সিনিয়র।”
আমাদের মাঝখানে ছয় ফিটের একটা টেবিল।
মাথা নেড়ে সায় জানালাম, এরপর সামনের দিকে ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে দিলাম করমর্দন করার জন্যে।
বাবাও একই কাজ করে বললেন, “রিচার্ড বিনস।”
ওয়েন ওনার দূর্বল হাতটা বাবার সাথে মেলালেন। এরপর বললেন “আমি সিডনি।”
এসময় কমলা রঙের একটা বিড়াল এসে লাফ দিয়ে টেবিলের ওপর উঠে গেল।
“আর এ হচ্ছে পিচেস।”
পিচেস হচ্ছে একটা বিশাল কমলা রঙের ট্যাবি বিড়াল। বিশাল মানে বিশাল। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে বিড়ালদের কুইন লতিফা।
টেবিলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বসে পড়ল বিড়ালটা। গলায় কয়েকটা ভাঁজ পড়ল দেখলাম।
বাবা হাত বাড়িয়ে আদর করে দিলে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ মিয়াও মিয়াও করল। হ “আমি জানি আপনার হাতে সময় সীমিত, একবার মাথা নেড়ে। বললেন সিডনি। “আসল কথা শুরু করা যাক তাহলে।”
ঘড়ির দিকে তাকালাম। তিনটা এগার বাজছে।
আমি আমার প্রথম প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করব এমন সময় ম্যাগি ট্রেতে করে দুই গ্লাস বাদামি রঙের তরল নিয়ে প্রবেশ করল ঘরে। একটা বাবার হাতে দিয়ে অন্যটা মি. ওয়েনের সামনে রেখে দিলেন।
কোন কথা না বলে চলে গেলেন এরপর।
বাবা আর মি. ওয়েন দু-জনেই একবার করে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির শ্বাস ফেললেন। “খুবই ভালো জিনিস, মি. ওয়েন হেসে বললেন। “এগুলোর কথাই মনে পড়বে বেশি।”
কেন যেন মনে হচ্ছে পৃথিবীতে আর খুব বেশি সময় বরাদ্দ নেই মি. ওয়েনের জন্যে। এজন্যেই বোধহয় আমার সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছেন তিনি। বোঝা একটু হলেও কমানোর জন্যে।
“বেশ দামি মনে হচ্ছে,” বাবা জিজ্ঞেস করলেন।
“আসলেই বেশ দামি,” এরপরের দুই মিনিট স্কটল্যান্ডের এক ঐতিহ্যবাহি স্কচ প্রস্তুতকারকের ব্যাপারে গল্প করলেন তিনি।
বাবা আমার দিকে তার গ্লাসটা বাড়িয়ে ধরাতে আমিও এক চুমুক দিলাম। জিনিসটা আসলেও অসাধারণ, কিন্তু আমার কেবলই মনে হতে লাগল, কিভাবে আমার দুই মিনিট নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
“কিন্তু আমরা এখানে স্কচের ব্যাপারে গল্প করতে আসিনি,” ওয়েন আমার দিকে তাকিয়ে বললেন এবার, “শুরু করা যাক।”
“আমার মার সাথে কোথায় দেখা হয়েছিল আপনার?” জিজ্ঞেস করলাম।
বড় করে একটা শ্বাস নিলেন তিনি। “এলেনার সাথে আমার দেখা হয়েছিল যখন ওর বয়স ছিল তেইশ, ক্যাম্প পেরিতে। অনেকে ‘দ্য ফার্ম নামেও চেনে জায়গাটাকে। প্রতি বছর সদ্য নিয়োগপ্রাপ্তদের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাসাবাদের নতুন নতুন ধরণ নিয়ে একটা লেকচার দিতাম আমি।”
“মানে, টর্চারের নতুন নতুন ধরণ,” বললাম তাকে।
“হ্যাঁ, টর্চার।”
“এ সময় আপনি প্রজেক্ট এমকে আট্রার প্রধান ছিলেন?”
“হ্যাঁ। আমার বন্ধু অ্যালেন এ পদে আমাকে নিয়োগ দিয়েছিল সে সময়েরও প্রায় এক যুগ আগে। কিন্তু ১৯৭১ সাল নাগাদ সরকারের চোখে আমাদের অবস্থান অনেকটাই খারাপ হয়ে গেছিল। দু-বছর পরে অফিশিয়ালি প্রোগ্রামটা বন্ধ করে দেয় অ্যালেন।”
“আপনি এমনভাবে প্রোগ্রামটার ব্যাপারে কথা বলছেন যেন ওটা কোন টর্চার এক্সপেরিমেন্ট না, একটা পুণর্বাসন প্রোগ্রাম।”
“আমি জানি আপনারা আমাকে দানব মনে করেন। কিন্তু আপনার সাথে সে ব্যাপারে তর্ক করার মত সময় কিংবা শক্তি কোনটাই নেই আমার। যা প্রয়োজন মনে হয়েছে করেছি আমি।”
কোন প্রকার অপরাধবোধ ছাড়া একদম স্বাভাবিকভাবে কথাগুলো বললেন তিনি। তার কাছে নিরীহ মানুষের ওপর এক্সপেরিমেন্ট করা যুদ্ধের কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া মাত্র। তাদের জীবনের যেন কোন মূল্য নেই।
আমার ইচ্ছে করছিল চিৎকার করে বলি, আমিও ঐ নিরীহ মানুষদের একজন।
তা না করে লম্বা করে দু-বার শ্বাস নিয়ে বললাম, “১৯৭১ সালে ক্যাম্প পেরিতে একটা লেকচার দিচ্ছিলেন আপনি…”
“হ্যাঁ। গত কয়েক বছরের গবেষণায় কি কি পেয়েছি আমরা ওগুলোই বলছিলাম। সেই লেকচারের সময়ই বুঝে যাই, এলেনা অন্যদের চেয়ে আলাদা।”
“কোন দিক দিয়ে?”
“একটা কারণ হিসেবে বলা যায়, আপনার বাবাও আমার সাথে একমত প্রকাশ করবেন আমি নিশ্চিত, আপনার মা খুবই সুন্দরি ছিলেন দেখতে। চোখগুলোও ভীষণ সুন্দর।”
হ্যাঁ, ঐ চোখগুলো। দুঃস্বপ্নে আমাকে তাড়া করে বেড়ায় ওদুটো।
“কিন্তু শুধু তার চেহারা দেখে আমি মুগ্ধ হইনি,” তিনি বলতে লাগলেন, “আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম ওর কথাবার্তায়। লেকচারের শেষ দিকে সে যা বলেছিল তা সারাজীবন মনে থাকবে আমার। আমি যখন বলছিলাম জিজ্ঞাসাবাদের সময় সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে ভয়, তখন এলেনা হাত উঁচু করে বলে, সে আমার সাথে দ্বিমত পোষণ করে। তার মতে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে আশা।”
“আশা?”
“সে বলেছিল, একজন বন্দিকে ভয় দেখিয়ে হয়ত কথা আদায় করা যাবে, কিন্তু তার কাছ থেকে যদি বেঁচে থাকার, তার পরিবারকে দেখার কিংবা প্রচন্ড কষ্ট থেকে উদ্ধার পাবার আশাটুকু কেড়ে নেয়া হয় তাহলে সে সবকিছু নিজে থেকেই বলা শুরু করবে।”
মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শিহরন বয়ে গেল।
বাবার দিকে তাকালাম।
শক্ত হয়ে বসে আছেন তিনি।
আমার তেইশ দিনের দুঃস্বপ্নের কথা ভাবলাম। নদীতীরে পড়ে আছি, কয়েকদিনের অভুক্ত, ওপিকের মৃতদেহ আমার থেকে দশ ফিট দূরে, ল্যাসি ভেসে গেছে নৌকার সাথে, ইনগ্রিড আর বাবার সাথেও দেখা হবার কোন সম্ভাবনা নেই।
অসহায়।
আশাহীন।
সিডনির দিকে তাকিয়ে বললাম, “আর এ সময় আপনি তাকে নিয়োগ দিলেন নতুন একটা প্রোগ্রামে?”
“হ্যাঁ, স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম,” মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বললেন তিনি।
“ঘুম কেন?”
“কারণ মানুষের আচরণের ওপর প্রায় একশ ষাটটা প্রজেক্ট চালানোর পর আমরা খেয়াল করেছিলাম, যেগুলোতে ঘুম নিয়ে কাজ করা হয়েছিল ওগুলোই ছিল সবচেয়ে সফল। আর এটা অনেক আগে থেকেই জানা যে, বন্দিদের যদি ঠিকমত ঘুমোতে না দেয়া হয় তাহলে অসংলগ্ন আচরণ করা শুরু করে তারা। কিন্তু ঘুম বর্ধিতকরণ আর স্বপ্ন দেখা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যে পরীক্ষাগুলো করেছিলাম সেগুলো থেকে ঘুমোতে না দেয়ার চেয়েও ভালো ফলাফল পেয়েছিলাম।”
“স্বপ্ন দেখা নিয়ন্ত্রন বলতে দুঃস্বপ্ন বলতে চাচ্ছেন?”
মাথা নাড়লেন তিনি। এরপরে যেন আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বলে উঠলেন, “কিভাবে সেটা করি আমরা? আসলে বিজ্ঞান থেকে বেশ তফাত আছে উত্তরটার। তবুও সংক্ষেপে আপনাদের বুঝিয়ে বলছি আমি, এই বলে গ্লাসে একটা ছোট চুমুক দিলেন তিনি। “দুঃস্বপ্ন তৈরি করা অনেকটা টর্নেডো তৈরি করার চেষ্টার মত, সেটা সরাসরি সম্ভব নয়। কিন্তু সঠিক পরিবেশ যদি সৃষ্টি করতে পারেন আপনি, যেমন গরম বাতাসের সাথে ঠাণ্ডা বাতাসের সমন্বয় ঘটান, তাহলে একটা টর্নেডো সৃষ্টি হতে পারে। দুঃস্বপ্ন তৈরির ক্ষেত্রেও এই একই কাজ করি আমরা। একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করি মস্তিষ্কে।”
ওয়েন আমার আর বাবার দিকে একবার নজর বুলিয়ে দেখে নিলেন, তার কথাগুলো বুঝতে পারছি কিনা আমরা। দু-জনেই মাথা নাড়লাম।
“তিনটা যৌগ ব্যবহার করি আমরা,” ওয়েন বললেন। “গরম বাতাসের মত আমাদের পদার্থটা কিছু নিউরোট্রান্সমিটারের কাজকে স্তিমিত করে দেয়। যেমন সেরোটোনিন, ডোপামিন। আর কিছু নিউরোট্রান্সমিটারকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উদ্দীপ্ত করে, যেমন মেলাটোনিন।”
মেলাটোনিন কি তা আমার জানা আছে। সতের বছর বয়সে অপারেশন করে আমার পিনিয়াল গ্রন্থি সরিয়ে ফেলা হয়। এই গ্রন্থিটা মস্তিষ্কের মাঝের দিকে অবস্থান করে মেলাটোনিন নিঃসরণ করতে থাকে। আর মেলাটোনিন নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের ঘুমকে। আরো ভালোমত বললে ঘুম আর জেগে থাকার চক্রকে। আমার পিনিয়াল গ্রন্থি স্বাভাবিকের চেয়ে তিনগুণ বড় ছিল আর ধারণা করা হয়েছিল, ওটার কারণেই আমি হেনরি বিনস কন্ডিশনে ভুগছি। কিন্তু ধারণাটা ভুল ছিল।
“দ্বিতীয় যে পদার্থটা ব্যবহার করি আমরা ওটা আমাদের অনুভূতিগুলো নিয়ন্ত্রনের স্থানে প্রভাব ফেলে, যেমন-ভয়, রাগ, ভালোবাসা, হিংসা…”
“আশা,” বাবা বিড়বিড় করে যোগ করে বললেন।
“হ্যাঁ, আশা।”
“আর তৃতীয় যৌগটা কি?” এরপরের প্রশ্নে চলে যেতে চাই আমি। কিন্তু এই বিজ্ঞানের কচকচানির জন্যে পারছি না।
“আহ্, তৃতীয়টা বেশ নামকরা। আমি নিশ্চিত ওটার ব্যাপারে পড়েই এসেছেন আপনি।”
“এলএসডি,” মাথা নেড়ে বললাম।
“ঠিক।”
তারমানে, আমার তেইশ ঘন্টার দুঃস্বপ্নটা এভাবেই তৈরি করা হয়েছিল।
“এরপরের কাজ ভিক্টিমের নিজের মস্তিষ্কই করে দেয়,” ওয়েন বলতে থাকলেন। তাদের স্মৃতি, তাদের ভয়,” আমার দিকে বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন তিনি, এরপর জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার মা আপনার সাথে এমনটাই করেছিলেন?”
মাথা নেড়ে সায় দিলাম। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, গভীর ভাবনায় ডুবে গেছেন। তিনি কি নিজেকে আমার জায়গায় কল্পনা করছেন? বোঝার চেষ্টা করছেন সবকিছু কিভাবে কাজ করল?
“সেটা শুধু কল্পনাই করা সম্ভব আমার পক্ষে,” আস্তে করে বললেন তিনি। যেন কিছুটা হতাশ।
ঠিক এসময়ে বুঝলাম কেন তাকে দানব বলা হয়। আমার জন্যে মোটেও দয়া হচ্ছে না তার। তিনি আসলে কৌতূহলি এ ব্যাপারে। আমাকে তিনি কল্পনা করছেন নল লাগানো অবস্থায় একটা ল্যাবের বিছানায় বন্দি হিসেবে। চারপাশে অনেকগুলো মেশিন।
মনে হল উঠে গিয়ে তার বড় নাকটা জোরে টেবিলের সাথে কে দেই। কিন্তু তা না করে আমার ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালাম।
তিনটা ছাব্বিশ।
দুঃস্বপ্নটার ব্যাপারে আরো জানতে চাই আমি কিন্তু আমার হাতে সময় বড্ড কম। “বলে যান,” আমি বললাম। “আমার মা কেবলই পি কন্ট্রোল প্রোগ্রাম চালু করেছেন…”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ,” তিনি বললেন। এরপর বাবার দিকে নজর দিলেন, “আমাকে ঠিক করে দেবেন যদি ভুল বলি, আপনার সাথে এলেনার দেখা হয়-অবশ্য স্যালি নামে পরিচয় দিত ও তখন…১৯৭৬ সালে।”
বাবা মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ, ঐ বছরের নভেম্বরে একটা কফিশপে ওর সাথে দেখা হয় আমার।”
“তাহলে ততদিনে ওর স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রামে কাজ শুরু করার প্রায় আড়াই বছর হয়ে গেছিল। কিন্তু এমকে আলট্রা বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে এলেনার সাথে স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের ব্যাপারে আমার খুব কমই যোগাযোগ হত।”
“এর পেছনে টাকা ঢালছিল কে?”
“আমি।”
“আপনি?”
“হ্যাঁ। এমকে আট্রার বার্ষিক বাজেট ছিল এক কোটি ডলার, যা আজকের দিনে প্রায় নয় কোটির মতন হবে।”
“ওখান থেকে টাকা সরাচ্ছিলেন আপনি?”
“ঠিক সরাচ্ছিলাম বলব না। জমা করে রাখছিলাম দুঃসময়ের জন্যে।”
“যাতে বন্ধ হয়ে যাবার পরও কাজ চালিয়ে যেতে পারেন?”
“ঠিক।”
“তা, কত টাকা জমিয়েছিলেন আপনি?”
“তিন কোটি।”
তিন কোটি ডলার। তার মানে আজকের দিনে প্রায় সাতাশ কোটি। “ওগুলোর পুরোটাই কি স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের জন্যে বরাদ্দ করেন আপনি?”
“পাগল নাকি? স্লিপ কন্ট্রোল ছাড়াও বেশ কয়েকটা ব্ল্যাক অপস প্রজেক্ট চালু করেছিলাম আমি অবসর গ্রহণের পরে।”
অপেক্ষা করতে লাগলাম, হয়ত এ ব্যাপারে আরো কিছু বলবেন তিনি। কিন্তু বললেন না। “তো, মা’কে কতটা দিয়েছিলেন আপনি?”
“পঞ্চাশ লক্ষ।”
“আর নিজের জন্যে কতটা রেখে দিয়েছিলেন?” আমি ভাবলাম প্রশ্নটা হয়ত এড়িয়ে যাবেন তিনি।
“যথেষ্ট পরিমাণ,” উত্তর দিলেন।
“এই বড় বাড়িটা আর দুটো ছাগল কেনার মত যথেষ্ট পরিমাণ।”
একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠল তার মুখে, “তার মানে মার্শাল আর ল্যাটিমারের সাথে দেখা হয়েছে আপনাদের?”
“হ্যাঁ।”
“ওরা আসলে পাশের একটা খামার থেকে পথ হারিয়ে কয়েক বছর আগে এখানে চলে এসেছে। কিন্তু এখনো যাওয়ার নাম নিচ্ছে না। এটা অবশ্য স্বীকার করতেই হবে, আমার একঘেয়ে জীবনে কিছুটা হলেও আনন্দ নিয়ে এসেছে ওরা।”
ওনার ছাগলদুটো সম্পর্কে কোনই আগ্রহ নেই আমার, “তো, মা এই প্রোগ্রামটা চালাচ্ছে আর আপনি পেছন থেকে টাকা ঢালছেন। এসবের মধ্যে আমি কিভাবে জড়িয়ে গেলাম?”
“আসলে, এলেনার সাথে সরাসরি কখনো কথা বলতাম না আমি। কিন্তু তথ্য আদান প্রদান হত আমাদের মাঝে। একটা চিঠিতে তোমার মা উল্লেখ করেছিল, প্রোগ্রামটা কিছু সময়ের জন্যে ছেড়ে দেবে সে,” এরপর বাবার দিকে মাথা নেড়ে বললেন, “একজনের প্রেমে পড়েছিল…কয়েক মাসের মধ্যে তাকে বিয়ে করার ইচ্ছের কথাও জানায়।”
বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আমরা বিয়ে করি ১৯৭৭ সালের ১৭ই জুন।”
“হ্যাঁ। প্রায় এক বছর তার সাথে কোন যোগাযোগ ছিল না আমাদের। এরপরে একদিন এলেনার কাছ থেকে রিপোর্ট পাই, সে আর তার পার্টনার-ভেতরের খবর বেশি কিছু জানতাম না আমি, পার্টনারের নামও না–নাকি ঘুম বর্ধিতকরণের ব্যাপারে বেশ বড়সড় কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছে। যে পশুগুলোর ওপর পরীক্ষা চালাচ্ছিল তারা, শূকর মনে হয়, ওগুলোকে ঠিক নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। কিছু ট্রায়ালের পর তারা ঐ যৌগটাকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যায় যে, ওটা প্রয়োগের ফলে শূকরগুলোকে তেইশ ঘন্টা ঘুম পাড়িয়ে রাখা সম্ভব হয়।”
আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। “এটা কিন্তু অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগ করে একদম অচেতন রাখা থেকে ভিন্ন। তেইশ ঘন্টার ঘুমের মধ্যে নিয়ন্ত্রিত স্বপ্ন দেখাও চলতে থাকবে। বড় আবিষ্কার কিন্তু এটা ছিল না, বড় আবিষ্কারটা হল শূকরগুলো যখন জেগে উঠত তখন ওগুলো একদম হতাশ, অসংলগ্ন আচরণ করত। যে শূকরগুলোকে ঘুমোতে দেয়া হত না তাদের থেকেও তেইশ ঘন্টা ঘুমের পর জেগে ওঠা শূকরগুলোর অবস্থা বেশি করুণ ছিল। এলেনা প্রস্তাব দেয় সেই যৌগটাকে যদি জিজ্ঞাসাবাদের সময় দুঃস্বপ্ন দেখায় যে তরলটা সেটার সাথে মেশানো যায় তাহলে বন্দিরা তেইশ ঘন্টা একটানা দুঃস্বপ্ন দেখে কাটাবে ঘুমের মধ্যে। এতে অতি অল্প সময়ের মধ্যে তথ্য আদায় করা সম্ভব হবে আমাদের পক্ষে।”
“আসলেই সম্ভব হয়েছিল?”
ওয়েন হাত তুলে থামার নির্দেশ করলেন আমাকে, “একটু বেশিই এগিয়ে যাচ্ছেন আপনি। কেবল কয়েকটা শূকরের পরীক্ষা করেছিলাম আমরা। পরবর্তি ধাপটা হল
“মানুষের ওপর পরীক্ষা,” তার বাক্যটা আমিই শেষ করে দিলাম।
“হ্যাঁ,” তিনি বললেন, “হিউম্যানট্রায়াল।”
“তাহলে এখানেই আমার ভূমিকা? শূকরগুলোর পরে আমার ওপর ঐ যৌগটা প্রয়োগ করলেন মা?”
ওয়েন মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিলেন, “আপনার ধারণা ভুল। এলেনা আমার মত ছিল না, মানে তখন পর্যন্ত। অন্য কোন মানুষের ওপর পরীক্ষা করার কোন ইচ্ছেই ছিল প্রকাশ করেনি সে। একটা বাচ্চার ওপর তো নয়ই। সে পরীক্ষা করেছিল নিজের ওপর।”
অবাক হয়ে বললাম, “কি করেছিল?”
“আপনার মা’ই কম্পাউন্ড-২৩ এর প্রথম হিউম্যান ট্রায়াল,” এই বলে কিছুক্ষণ থেমে কী যেন ভাবলেন তিনি। তারপর যোগ করলেন, “নাকি বলব আপনি এবং আপনার মা।”
চেয়ারে সামনে ঝুঁকে বসলাম।
“এর তিন সপ্তাহ পরে যে চিঠিটা পাই আমি এলেনার কাছ থেকে সেখানে লেখা ছিল কম্পাউন্ড-২৩ এর উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। এক সপ্তাহ যাবত সে দিনে তেইশ ঘন্টা করে ঘুমিয়েছে। মাঝখানে রাত তিনটার সময় শুধু জেগে উঠেছে এক ঘন্টার জন্যে, এরপর আবার ঘুম,” এটুকু বলে বেশ খানিকক্ষণ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলেন তিনি। এরপর শান্তস্বরে বললেন, “চিঠিতে আরো লেখা ছিল, সে নাকি মাত্র একদিন আগে এটা জানতে পেরেছে, সে আট সপ্তাহের গর্ভবতি।”
*
অধ্যায় ৮
কেউ যেন একশ কেজি ওজনের হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি বসাল আমার বুকে।
আমার মা যখন কম্পাউন্ড-২৩ নিজের ওপর পরীক্ষা করেছেন তখন আমি তার পেটে!
চিন্তার ঝড় বইতে লাগল আমার মাথায়। এটা ভেবে স্বস্তি লাগছে, মা ইচ্ছে করে আমার ওপর কোন এক্সপেরিমেন্ট চালাননি। আবার একটা কথা আমি সবসময় ভাবতাম, মা যখন আমার ওপর এক্সপেরিমেন্ট করছেন তখন বাবা কোথায় ছিলেন? এখন বুঝতে পারছি। তিনি জানতেনই না এ ব্যাপারে।
বাবার দিকে তাকালাম। চোখ ভিজে উঠেছে ওনার। তার পায়ে আস্তে করে হাত রাখলাম।
“আপনি এ ব্যাপারে কিছু জানতেন না,” যদিও আমার কথা তার রাগ কিংবা দুঃখ কোনটাই প্রশমিত করতে পারল না।
“কিন্তু পরে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, আমার ঐ কন্ডিশনের জন্যে তিনিই দায়ি, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত,” ওয়েনের উদ্দেশ্যে বললাম। “কারণ ২৩ ঘন্টার দুঃস্বপ্নটা থেকে জেগে ওঠার পর তিনি এরকমই কিছু একটা বলেছিলেন আমাকে।”
“হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছিল ও,” ওয়েন বললেন। “আপনার মা’র পরের চিঠিটা প্রায় দশ মাস পরে এসেছিল। ওখানে বিস্তারিতভাবে আপনার কথা লিখেছিল এলেনা। ওর ধারণা আপনার মস্তিষ্ক গঠনের কোন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কম্পাউন্ড-২৩ নিজের শরীরে প্রয়োগ করেছিল সে। যার কারণে আপনার ঘুম আর জাগরণের চক্র পাল্টে যায়। ফলে ২৩ ঘন্টা ঘুমিয়ে মাত্র এক ঘন্টার জন্যে জেগে ওঠেন আপনি।”
“এটা কি ঠিক করা সম্ভব?” আপনা আপনিই প্রশ্নট বেরিয়ে গেল মুখ থেকে।
“একমাত্র একজন ব্যক্তির কাছেই এর উত্তর আছে।”
আমি মাথা নাড়লাম। “তাকে খুঁজে বের করতে হবে আমাকে।”
এরপরের কয়েক মিনিটে আমি বললাম কিভাবে আমাকে প্লেন থেকে অপহরণ করে নিয়ে গেছিলেন মা আর কি করেছিলেন ঐ তেইশ ঘন্টায়।
“নিজের ছেলেকে টর্চার,” মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন ওয়েন, “যে এলেনাকে চিনতাম আমি তার পক্ষে এমন কাজ করা কখনোই সম্ভব ছিল না। খুব বড় একজন দেশপ্রেমি ছিল সে। যে দেশ তাকে দারিদ্রের হাত থেকে বাঁচিয়ে বড় করে তুলেছে সেই দেশের জন্যে নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও দ্বিধাবোধ করত না এলেনা। সে যা করেছে, যাকে যাকে টর্চার করেছে তার একটাই উদেশ্য ছিল, দেশের জন্যে কিছু করা।”
আমার মা, একজন দেশপ্রেমি?
তবে একথা সত্য যে, তার ছোটবেলা ভালো কাটেনি। যুগোস্লাভিয়ার গৃহযুদ্ধের সময়কালীন সেখান থেকে এ দেশে চলে এসে চাচার কাছে মানুষ হন তিনি। আমেরিকা ই তার সব, এমনই হবার কথা।
একবারের স্বাধীনতা দিবসের কথা মনে আছে। ঐ একটা স্বাধীনতা দিবসেই তাকে পাশে পেয়েছিলাম আমি। আমাকে বাইরে আতশবাজি দেখাতে নিয়ে গেছিলেন আর বলেছিলেন, এটা হচ্ছে বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন।
“আর কিছু না হলেও এ দেশকে খুব ভালোবাসত আপনার মা, বিড়বিড় করে বাবা বললেন পাশ থেকে।
কিছু একটা ঘটেছিল? কি কারণে একজন দেশপ্রেমিক থেকে ওরকম দানবে রূপান্তরিত হলেন তিনি? নাকি ও দুটো সত্ত্বা একই সাথে বিরাজ করত তার মাঝে? আমার উল্টোদিকে বসে থাকা লোকটাও কি দেশপ্রেমিক? দেশের জন্যে নিরীহ লোকদের মেরে ফেলতেও হাত কাঁপেনি তার?
কিন্তু একথা জিজ্ঞেস করার মত পরিস্থিতি নেই এখন। ওটা পরের জন্যে তুলে রেখে পরবর্তি প্রশ্নটা করলাম, “আপনি ঐ সাদা ঘরটার ব্যাপারে কিছু জানেন? ওটার অবস্থান কোথায় হতে পারে এ ব্যাপারে কোন ধারণা আছে?”
“এলেনার সাথে প্রায় এক যুগ ধরে কথা হয় না আমার। শেষবার তার সাথে কথা হয়েছিল ৯/১১-এর ঐ ঘটনার পর। তখন প্রজেক্ট স্যান্ডম্যান নিয়ে ব্যস্ত ছিল ও।”
প্রজেক্ট স্যান্ডম্যান?
তিনি যে ফ্ল্যাশড্রাইভটা খুঁজছেন ওটাতে কি এটার সাথে সম্পর্কিত কিছু আছে?
“প্রজেক্ট স্যান্ডম্যানটা আবার কি?” ওয়েনের মুখটা শক্ত হয়ে গেল। বারবার আশেপাশে দেখতে লাগলেন তিনি।
“তোমরা কারা? প্রেসিডেন্ট রিগ্যান পাঠিয়েছে তোমাদেরকে?”
বাবার দিকে তাকালাম। তিনিও আমার মত বোকা বনে গেছেন।
“কেউ একজন রাশিয়ানদের হাতে সব তথ্য পাচার করে দিচ্ছে। ঐ বিশ্বাসঘাতককে ধরতে হবে আমাদের। না-হলে পাশার ছক পাল্টে যাবে।”
“মি. ওয়েন,” আমি নরম স্বরে বললাম। এটার ব্যাপারেই ম্যাগি সাবধান করে দিয়েছিল আমাদের। লম্বা করে শ্বাস নিন। আমরা আপনার
স্টাডিতে বসে আছি। এটা ২০১৫ সাল।”
“তোমরা কারা? রিগ্যানকে বলবে, হারামিটাকে ধরার জন্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছি আমি।”
“মি. ওয়েন,” বাবা বললেন, “সিডনি!”
ওয়েন কয়েকবার মাথা দোলালেন বিভ্রান্তের মত। তাকে দেখে ক্লান্ত মনে হচ্ছে। যেন এই তিরিশ সেকেন্ডেই তার বয়স বেড়ে গেছে পাঁচ বছর।
“তো যা বলছিলাম। আপনার মার সাথে প্রায় তের বছর যাবত কথা হয় না।”
এমন সময় দরজার পেছন থেকে জোরে একটা শব্দ হওয়ায় পিচেস লাফ দিয়ে উঠল।
“কিসের শব্দ?” চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন ওয়েন। বেশ কষ্ট হল তার কাজটা করতে।
আরেকবার জোরে আওয়াজ হয়ে দরজাটা খুলে গেল।
ম্যাগি ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল, “মি. ওয়েন, আমি জানি না কিভাবে ওরা ভেতরে ঢুকে গেল।”
“কারা?”
“ছাগল দুটো!”
মার্শাল আর লাটিমার।
“সামনের দরজাটা বন্ধ করেছিলাম,” ম্যাগি বললেন জোরে, “এটুকু মনে আছে আমার।”
বাবা আর আমি একে ওপরের দিকে তাকালাম। “শিট, দুজন একই সময়ে বলে উঠলাম। ছাগলের পক্ষে গেট খোলা সম্ভব নয়। কিন্তু মারডকের পক্ষে সম্ভব।
বাবা আর আমি হলওয়েতে বেরিয়ে আসলাম তাড়াতাড়ি।
এসময় কিছু একটা ছুটে ডান পাশের ঘরটাতে ঢুকে গেল।
একটা ছাগল।
এরপর আরেকটা প্রাণীকে দৌড়াতে দেখা গেল। তবে এটা আগেরটার তুলনায় তিনগুণ বড়।
মারডক।
তার পিঠে ঘোড়ায় চড়ার ভঙ্গিতে বসে আছে ল্যাসি। দেখে মনে হচ্ছে ওয়েস্টার্ন সিনেমার কাউবয় ঘোড়া নিয়ে বেরিয়েছে।
ওহ ঈশ্বর।
জোরে কিছু পড়ার শব্দ হল।
বাবা ওদের পেছনে দৌড় লাগালেন। কিন্তু একটু পরেই আবার ঘুরে আমার দিকে দৌড়াতে লাগলেন তিনি।
আমি ডানদিকের বড় লিভিং রুমটাতে ঢুকে গেলাম। একটা ছাগল কাউচের ওপর দাঁড়িয়ে শেষ কুশনটা চাবাচ্ছে।
আমার মনে হয় না খুব শিঘ্রই আর ওয়েন ম্যানশনে আসা হবে।
এসময় জোরে একবার বিড়ালের ডাক শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখি হলওয়ে ধরে পিচেস ছুটে যাচ্ছে। আর ওর দু’ফিট পেছনে ল্যাসি।
“ওকে ছুঁবি না তুই!” চিৎকার করে উঠলাম।
ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনটা পঞ্চাশ বাজছে।
এরপরের পাঁচ মিনিটে পুরো বাসায় ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে লাগল ওরা পাঁচজন মিলে : মারডক, মার্শাল, ল্যাটিমার, ল্যাসি আর পিচেস।
ম্যাগি একটা টেবিলের ওপর ঝাঁটা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তার অবস্থা বিশেষ সুবিধার বলে মনে হচ্ছে না।
“থামান ওদের,” আমাকে দেখে বলে উঠলেন তিনি।
এমন সময় সারাবাড়ি কাঁপানো গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম।
হলওয়েতে এক হাতে লাঠি আরেক হাতে ডাবল ব্যারেল রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং সিডনি ওয়েন। ধোঁয়া উঠছে রাইফেলে নল থেকে।
পিন পতন নীরবতা।
লাটিমার, যেকিনা আবার কাউচের কুশন খাওয়া শুরু করেছিল, মুখ থেকে সেটা ফেলে দিয়ে বুড়ো মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকল ফ্যালফ্যাল করে।
ওয়েন দরজার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “বেরিয়ে যাও সবাই!”
.
“ল্যাসি কোথায়?” বাবার গাড়ির প্যসেঞ্জার সিটের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম।
তিনটা উনষাট বাজছে এখন।
মি. ওয়েনকে ধন্যবাদ দিতে পারিনি আমাদের সময় দেয়ার জন্যে। অবশ্য তাকে দেখে মনে হচ্ছিল না, কথ বলার মুডে আছেন। তারও দোষ নেই আসলে, মারডক আর ছাগলগুলো মিলে তার প্রায় পঞ্চাশ হাজার ডলারের সম্পত্তি ধ্বংস করে ফেলেছে।
ভাগ্যিস দুঃসময়ের জন্যে কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছিলেন তিনি।
“ঐ যে আসছে সে এতক্ষনে,” বাবা ড্রাইভার সিটের পাশ থেকে বললেন। তিনি দরজাটা খুলে ধরলে ল্যাসি এক লাফে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ওর মুখে আর সারা গায়ে আঁচড়ের দাগ থাকলেও খুশির চোটে দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়েছে। সেই সাথে হাঁপাচ্ছে ভীষণ ভাবে।
“আমি জানতাম না, কমলা রঙের বিড়ালও ভালো লাগে তোর,” এটুকু বলে ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
.
ঘুম ভেঙে নিজেকে প্যাসেঞ্জার সিটেই আবিষ্কার করলাম। বোতাম চেপে সিটটা ওপরে ওঠালাম। দু-রাত এমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে শোবার পর সারা শরীরে বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা করছে। হাত পা টানটান করে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলাম। আমার ডান হাতের বাহুতে কী যেন লাগানো আছে। মাথার ওপরের লাইটটা বাম হাতে জ্বালিয়ে ওদিকে নজর দিলাম। একটা আইভি নল। সরু নলটা শেষ হয়েছে পেছনের সিটে রাখা একটা স্যালাইনের ব্যাগে। ওটার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ খালি।
তলপেটের চাপ থেকে বুঝতে পারলাম এটাই প্রথম ব্যাগ না, আরো কয়েকটা ছিল নিশ্চিত।
আমার জীবনের প্রথম বিশ বছর প্রতি রাতে হাতে একটা আইভি নল লাগানো অবস্থায় ঘুমোতে হয়েছে আমাকে। প্রথম দিকে আমি ঘুমন্ত থাকা অবস্থাতেই বাবা নলটা লাগিয়ে দিতেন আমার হাতে। কিন্তু বেশ কয়েকবার ঘুম থেকে উঠে দেখেছি যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে ওটার আশেপাশে। পেশাদার না হবার কারণে শিরা খুঁজে পেতে মাঝে মাঝেই বেগ পেতে হত বাবাকে। তাই ওরকম ক্ষতর সৃষ্টি হত। এরপর থেকে একটা সেমি পারমানেন্ট ক্যাথেটার লাগানোর ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি, যেটা ঘুমোতে যাওয়ার আগে খুব সহজেই নিজে নিজে লাগিয়ে নিতে পারতাম আমি।
তেইশ ঘন্টা যাবত স্যালাইনের নল হাতে লাগিয়ে ঘুমানোর একটা সুবিধা হল জেগে ওঠার পর পানিশূন্যতা অনূভত হয় না আর সজীব মনে হয় নিজেকে।
কিন্তু একটা সমস্যা আছে। বড় সমস্যা। সেটা হল ভেতরে যা ঢোকে তা বেরিয়ে আসার কোন সুযোগ তো থাকতে হবে। তাই জেগে ওঠার পর থেকেই তলপেটে অসহ্য চাপ অনুভব করতাম আমি প্রতিবার।
এই সমস্যার কারণে ধীরে ধীরে স্যালাইন নেয়া কমিয়ে দেই আমি। একসময় পুরোপুরি বন্ধ করে দেই। আমার শরীর দীর্ঘ সময়ের পানি শূন্যতার সাথে মানিয়ে নেয়। আর আমিও একটা আন্দাজ করে নেই, কতটুকু পানি খেলে তেইশঘন্টা বাথরুমে যাওয়া ছাড়াই কাটাতে পারব (ছোট বেলায় ঘুমের মাঝে প্রায়ই বেড শিট পাল্টাতে হত বাবাকে)।
গতকাল মি, ওয়েনের সাথে কথা বলা আর এরপর মারডক আর ল্যাসির পাগলামী নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে, কয়েক বছরের মধ্যে প্রথমবারের মত এক ফোঁটা পানি না খেয়ে ঘুমিয়ে গেছিল। বাবা যদি আমার হাতে আইভি নলটা না লাগিয়ে দিতেন তাহলে প্রায় আটচল্লিশ ঘন্টা কোনপ্রকারের তরল ছাড়াই কাটাতে হত আমাকে (মি, ওয়েনের ওখানে এক চুমুক স্কচ হুইস্কি বাদে)। আর সেরকম হলে আজকের পুরো একঘন্টা আমাকে কাটাতে হত একটু পরপর তরল খাবার খেয়ে।
দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসলাম। জীবনে কখনো বাথরুমে যাওয়াটা এতটা জরুরি মনে হয়নি আমার কাছে। কিন্তু এখন ভেতর পর্যন্ত যাবার সময় নেই। মূত্রথলি ফেটে যাবে মনে হচ্ছে। প্যান্টের চেইন খুলে বাগানের পাশে রাখা ময়লার বাক্সতেই কাজ সেরে নিলাম।
এক মিনিট পরে বাসার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
বাবা রান্নাঘরের টেবিলটায় বসে আছেন। সামনে আবারো একগাদা কাগজপত্র।
“আইভিটার জন্যে ধন্যবাদ বাবা,” আমি বললাম।
তিনি হাসলেন জবাবে। “তুমি ঘুমিয়ে যাবার পরে খেয়াল করে দেখি, তোমার জন্যে যে জুসের বোতল নিয়ে গেছিলাম গাড়িতে করে সেটা ছুঁয়েও দেখোনি। কেমন লাগছে এখন?”
“অনেক ভালো। আসলে আরাম লাগছে বলতে পারেন। এত সময় নিয়ে বাথরুম করিনি অনেকদিন! তবে আপনার ময়লার বাক্সটা পাল্টাতে হবে।”
বাবা জোরে হেসে উঠলেন। “কয় ব্যাগ স্যালাইন লাগিয়েছিলেন আপনি? সাত?”
“মাত্র দুটো।”
“যে জুসের বোতলটা নিয়ে গেছিলেন আমার জন্যে, ওটা আছে এখনও?”
“না, আসার পথে মাস্তান দুটোকে খাইয়ে দিয়েছি।”
“ওরা যে কাণ্ড করেছে, তার পরেও আপনি ওদের খাইয়েছেন?”
জবাবে শুধু কাঁধ ঝাঁকালেন বাবা।
এই সময় ল্যাসি হেলতে দুলতে প্রবেশ করল রান্নাঘরে। এখনও ঘুম লেগে আছে চোখে। দীর্ঘ সময় নিয়ে আড়মোড়া ভাঙল। ওর জীবনে আরেকটা স্বাভাবিক দিনের শুরু মাত্র।
“কিরে?”
আমার দিকে তাকাল ও।
মিয়াও।
“ওভাবে তোর দিকে তাকাচ্ছি মানে? ভুলে গেছিস কাল রাতে কি করেছিস তোরা দুটো মিলে?”
মিয়াও।
“শুধু ‘দুঃখিত’ বললেই হয়ে গেল? তোদের ঐ কাণ্ডের জন্যে দশ মিনিট নষ্ট হয়েছে আমার। সেই দশ মিনিটে আরো কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারতাম আমি মি. ওয়েনকে। এখন আর সেটা কোনদিনই সম্ভব না। কি দরকার ছিল ছাগলদুটোকে তাড়া করার?”
মিয়াও।
“ওহ্, এখন তুই আন্তরিকভাবে দুঃখিত? খুব ভালো লাগলো শুনে, এই বলে নিচু হয়ে মাথায় একটা থাপ্পড় দিলাম ওর।
হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি তিনটা ছয় বাজছে।
বাবাকে বললাম, “একটু দেরি হয়ে গেছে আজকে। আমি কাজ করতে করতে কিছু খাবারের ব্যবস্থা করতে পারবেন?”
সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে ক্যাবিনেট হাতড়াতে লাগলেন তিনি। তিনটা জিনিস খুব ভালোমত রান্না করতে পারেন তিনি, স্প্যাগেটি, গ্রিলড চিজ আর প্যানকেক।
আসলে, ইসাবেল স্যুপ রান্না করে নিয়ে এসেছিল আজকে, বাবা বললেন। “ওটার সাথে আমার বিখ্যাত গ্রিলড চিজ খেতে ভালোই লাগবে।”
ল্যাপটপটা নিয়ে রান্নাঘরের টেবিলটার পাশের সিটে বসে পড়লাম।
ল্যাসি আমার দিকে পিঠ দিয়ে বসে আছে। বোঝা যাচ্ছে, মুখ ফুলিয়ে রেখেছে।
আগে কখনো থাপ্পড় দেইনি ওকে। খারাপই লাগলো আমার।
হেঁটে গিয়ে তুলে নিলাম ওকে। মোচড়ামোচড়ি করতে লাগল সে, কোনমতেই তাকাবে না আমার দিকে।
“তোকে থাপ্পড় মারার জন্যে সরি।”
মিয়াও।
“মোটেও হাতুড়ির বাড়ি বসাইনি।”
মিয়াও।
“বেজবল ব্যাটের বাড়িও ওরকম না,” এই বলে গলার নিচে চুলকে দিলাম একটু, “আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।”
এরপর ওর পেটে কুতকুতি দিতে লাগলাম।
হেসে উঠল ও। মাফ করে দিয়েছে আমাকে। নাকটা চেটে দিল একবার। ল্যাসিকে নামিয়ে দিয়ে বললাম মারডকের সাথে গিয়ে খেলতে। আরো বললাম, কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রিলড চিজ তৈরি করে ফেলবেন বাবা।
ল্যাপটপে বসে প্রথমেই ফেসবুকে লগইন করে দেখলাম সিডনি ওয়েনের কাছ থেকে কোন মেসেজ এসেছে কিনা।
ইনবক্স ফাঁকা।
ওয়েনের বলা একটা কথা মনে পড়ল এ সময় : এলেনার সাথে প্রায় এক যুগ ধরে কথা হয় না আমার। শেষবার তার সাথে কথা হয়েছিল ৯/১১-এর ঐ ঘটনার পর। তখন প্রজেক্ট স্যান্ডম্যান নিয়ে ব্যস্ত ছিল ও।
গুগলে সার্চ দিলাম ‘প্রজেক্ট স্যান্ডম্যান’ লিখে।
কিন্তু প্রজেক্ট স্যান্ডম্যান’-এর জন্যে কোন রেজাল্ট আসল না। তবে ‘স্যান্ডম্যান সম্পর্কে বেশ কয়েকটা রেফারেন্সের লিংক পেলাম।
প্রথমটা হচ্ছে নেইল গেইম্যান নামে এক লেখকের গ্রাফিক নভেল সিরিজ ‘স্যান্ডমান’। আর দ্বিতীয়টা মেটালিকা ব্যান্ডের এন্টার স্যান্ডম্যান গানের ইউটিউব লিংক। তৃতীয় আরেকটা রেজাল্ট দেখলাম উইকিপিডিয়ার একটা পেজ নির্দেশ করছে। ওটাতে ক্লিক করলাম :
স্যাডম্যান হচ্ছে উত্তর ইউরোপিয় ফোক কালচারের একটি কাল্পনিক চরিত্র। তার কাজ হচ্ছে ঘুমন্ত মানুষের চোখের ওপর বাল ছিটিয়ে ভালো স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করা।
স্যান্ডম্যান।
ঘুম।
স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম!
শব্দ করে শ্বাস ফেললাম।
বাবা রান্নাঘর থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হল?”
সব বললাম তাকে।
“ওটা তো আমার কাছ থেকেও জানতে পারতে।”
মাঝে মাঝে এটা ভুলে যাই আমি, বাবা প্রায় ৪০০,০০০ ঘন্টা পেয়েছেন এ পৃথিবী সম্পর্কে জানার জন্যে, যেখানে আমার সম্বল ১৫০০০ ঘন্টা।
“প্রজেক্ট স্যান্ডম্যান নিশ্চয়ই স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের একটি অংশ,” উৎসাহের সাথে বললাম। “আমি বাজি ধরে বলতে পারি তিনি যে ফ্ল্যাশড্রাইভভটা খুঁজছেন ওটাতে এ সংক্রান্ত কিছু আছে।”
“ওই সংক্রান্ত কি থাকতে পারে?”
“সেটা বলতে পারব না। যাদের ওপর এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছে তাদের নাম? কিংবা তাদের মূল পরিচালনা কেন্দ্রের অবস্থান?”
সাদা ঘরটার অবস্থান।
“প্রোগ্রামের পূর্ণ ইতিহাসও থাকতে পারে।”
সেটাই হবে হয়ত!
কিন্তু প্রেসিডেন্ট সুলিভানের সাথে ফ্ল্যাড্রাইভভটার সম্পর্ক কি? আর মা এটাই বা ভাবলেন কেন, তিনি ওটা আমাকে দেবেন?
আরো তথ্য দরকার আমার।
উইকিপিডিয়ার পেজটা পড়তে থাকলাম।
স্যান্ডম্যান চরিত্রটা ১৮৪১ সালে তৈরি করেছিলেন হ্যাঁন্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন। এরপরে এই চরিত্রটাকে বিভিন্ন কমিকবুক, গান কিংবা সিনেমায় ব্যবহার করা হয়েছে।
ইউটিউবের লিংকটায় ঢুকে মেটালিকার গানটা প্লে করলাম।
ভলিউম বাড়ানোর সাথে সাথে বাবাও গাওয়া শুরু করলেন গানটা :
“Say your prayers, little one
Don’t forget, my son
To include everyone
Tuck you in, warm within
Keep you free from sin
Till the Sandman he comes…”
একটা শিহরণ বয়ে গেল মেরুদণ্ডের মাঝ বরাবর।
বন্ধ করে দিলাম গানটা।
“কি হল?” বাবা ঘাড় ঘুরিয়ে জোরে জিজ্ঞেস করলেন। “আমার অনেক ভালো লাগে গানটা। ওটা তোমার-” এটুকু বলে আবার চুলোর দিকে ফিরলেন তিনি। কালো হয়ে গেছে মুখটা।
“গানটা,” বললেন বাবা, “তোমার মার সবচেয়ে পছন্দের গান ছিল।”
.
আরো দশ মিনিট স্যান্ডম্যানের ওপর বিভিন্ন তথ্য পড়লাম ইন্টারনেটে। এর মাঝে বাবা চিজ আর ইসাবেলের টরটিলা অ্যাপ দিয়ে গেলে খেতে খেতে পড়তে লাগলাম।
দুই মাস্তানকেও খাবার দিলেন বাবা। মারডক একেবারে নিজেরটুকু সাবাড় করে ল্যাসির প্লেটের দিকে তাকিয়ে দিল। ল্যাসি এখন তৃপ্তি সহকারে ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে খাবে।
তিনটা পয়ত্রিশের সময় নাইকি জোড়া পরে নিলাম।
এরপরের বিশ মিনিট শক্ত কনক্রিটের ওপর দিয়ে দৌড়াতে লাগলাম আর ভাবতে লাগলাম কিভাবে প্রেসিডেন্ট সুলিভানের কাছে ফ্ল্যাশড্রাইভভটা পৌঁছুতে পারে। যে ফ্ল্যাশড্রাইভটাতে কিনা লুকানো আছে স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রামে অংশ নেয়া প্রতিটা ব্যক্তির নাম, ঠিকানা আর ওটার সাথে জড়িত সবকিছু।
হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল মাথায় : সুলিভান কিভাবে জোগাড় করলেন ওটা? আর যদি পেয়েও থাকেন, তবে সেটা আমাকে দিতে যাবেন কেন? আর মা’রই বা ওটা এত দরকার কেন?
তিনি নিশ্চয়ই এখনও স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের সাথে জড়িত। তিনি কি এই ভয়ে আছেন, ফ্ল্যাশড্রাইভভের তথ্যগুলো ফাঁস হয়ে গেলে তাকে স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে?
মেলাতে পারলাম না কিছু। সুলিভানের অনেকগুলো নীতির একটা হচ্ছে স্বচ্ছতা। সিআইএ’র অবৈধ ব্ল্যাক সাইটগুলো বন্ধ করার জন্যে রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন তিনি। আর সেটা করেছেনও আমার গার্লফ্রেন্ড আর আমার সহায়তায় (অবশ্য আমি পরে জেনেছি পুরো ঘটনা)। প্রথমে ভেবেছিলাম লে’হাইকে মেরেই ফেলেছেন উনি। কিন্তু রেডের কাছে পরে শুনেছি যে প্রাক্তন সিআইএ পরিচালককে এমন কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে যেখান মুক্তি পাওয়ার কোনই সম্ভাবনা নেই। এরকম অবস্থায় সুলিভান যদি সিআইএর আরেকটা গোপন প্রজেক্টের সন্ধান পান, তাহলে সেটার বিরুদ্ধে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নিবেন তিনি, আর মা’র জায়গা হবে জেলে লে হাইয়ের পাশে।
কিন্তু আরো একটা ব্যাপার আছে।
আমি।
এসবের মধ্যে আমার ভূমিকা কোথায়? আমার আর প্রেসিডেন্ট সুলিভানের মধ্যে যে সম্পর্ক সেটাকে হয়ত বন্ধুত্ব বলা যাবে না। কিন্তু আমাদের মধ্যে যে ভালো যোগাযোগ আছে সেটা স্বীকার করতেই হবে। তাই বলে আমাকে ওরকম গুরুত্বপূর্ণ একটা ফ্ল্যাশড্রাইভ দেবেন তিনি? আর তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, মা’র এরকম সন্দেহের পেছনে ভিত্তি কি?
সুলিভান নিজে আমাকে বলেছেন, ওরকম কিছু আমাকে দেননি তিনি।
নাহ, বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছি। কিছুই মিলছে না।
পুরো পার্কটা যখন তিনবার চক্কর দেয়া শেষ করলাম তখন তিনটা পঞ্চান্ন বাজছে। তবে শারীরিকভাবে মোটেও ক্লান্ত লাগছে না আমার। কিন্তু মগজ আর চলতে চাইছে না।
রান্নাঘরে ঢুকে দেখি বাবা নিজের ভাগের গ্রিলড চিজটুকু খাচ্ছেন। বাকি রাতটুকু জেনিফারের কেসটা নিয়ে কাজ করার জন্যে শক্তি যোগাচ্ছেন শরীরে।
“খাবারের জন্যে ধন্যবাদ বাবা, অনেকদিন পরে আপনার হাতের কিছু খেয়ে খুব ভালো লাগল,” ওনার কাঁধে হাত রেখে বললাম, “বেশি ব্যস্ত হয়ে পরেন না কেসটা নিয়ে।”
“ঠিক আছে,” এটুকু বলে থামলেন তিনি, পরে যোগ করলেন “ঘুমানোর আগে দু-গ্লাস পানি খেয়ে নিও।”
ঠিক আগের মত।
*
অধ্যায় ৯
রান্নাঘরে ঢুকে দেখি বাবা টেবিলে ঘুমোচ্ছেন। মাথা একটা হলুদ রঙের নোটপ্যাডের ওপর। তার কাঁধে টোকা দিলে একটু নড়ে উঠলেন। ধরে বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলাম তাকে। মারডক আর ল্যাসি আগে থেকেই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে সেখানে।
আবার রান্নাঘরে ফিরে ফ্রিজ থেকে ভুট্টার সালাদ আর একটা মুদি নিয়ে ল্যাপটপের সামনে বসে গেলাম। তেইশ ঘন্টার ঘুমের পরেও মাথাটা ঘুরছে। বলে মনে হচ্ছে।
ল্যাপটপের স্ক্রিনটা তুলেও আবার নামিয়ে রাখলাম।
হাত বাড়িয়ে বাবার হলুদ রঙের নোটপ্যাডটা তুলে নিলাম কেসটার ব্যাপারে নতুন কিছু খুঁজে পেয়েছেন কিনা দেখার জন্যে। গোটা প্যাড জুড়ে বাবার লেখা, কিন্তু সেগুলোর কোনটারই মর্মোদ্ধার করা সম্ভব না। প্রায় ছয় পাতা ভর্তি নোট, ভেন ডায়াগ্রাম, বুলেট লিস্ট। এরকম দাগটানা নোটপ্যাড ব্যবহার করার মানে কি যখন তিনি ওগুলোর ধার ধারেন না? কিছু নোট ডান মার্জিন অনুসরণ করে লেখা হয়েছে তো অন্যটা উল্টোদিক থেকে শুরু হয়েছে। পুরো বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। শুধু মার্জিনের পাশে ছোট ছোট ঘোড়ার প্রতিকৃতিগুলো বুঝতে পারলাম। বাবার পুরনো অভ্যাস এটা।
নোটপ্যাডটা নামিয়ে রেখে কাছের কাগজপত্রের স্তূপটা টেনে নিলাম। এগুলো অন্তত ক্রমানুসারে গুছিয়ে রেখেছেন উনি। কফির দাগও নেই তেমন একটা।
পাতাগুলো জেনিফারের ডায়রির অংশ।
ওপরের পাতাটা হাতে নিলাম। আট ইঞ্চি লম্বা আর পাঁচ ইঞ্চি চওড়া ওটা। এরকম একটা ডায়রি ছোটবেলায় আমাকে কিনে দিয়েছিলেন বাবা, মনে আছে। (চারবার লেখার পর আর লিখিনি। নিজের চিন্তাগুলো লিখে রাখতে ভালোই লাগত, কিন্তু যখনই লেখার মাঝখানে বিরতি নিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাতাম, খুব অল্প সময় বাকি থাকত আমার হাতে)।
হাতের মুদিটা শেষ করে পড়া শুরু করলাম।
.
বব আমাকে দারুণ একটা ক্যামেরা কিনে দিয়েছে ষোলতম জন্মদিন উপলক্ষে। নাইকন, জুম লেন্সসহ। একটা লাল রঙের কেসও আছে ওটার সাথে। ববের ধারণা আমি এখনও লাল রং পছন্দ করি। কিন্তু তাকে এটা বলতে খারাপ লাগছিল, পছন্দ পাল্টে গেছে আমার। সবুজ রং এখন বেশি ভালো লাগে।
কাল সে বলল আমার ঘরের দেয়ালটা চাইলে লাল রং করাতে পারি।
হ্যাঁ বব, আমি তো একজন সিরিয়াল কিলার!
আমি সবুজ রং করাতে চাই ওটা। গাছের পাতার মত ক্যাটক্যাটে সবুজ, হাল্কা সবুজ। টেনিস বলের মত। দারুণ মানাবে তাহলে।
যাই হোক, পরের সপ্তাহ থেকে আমাকে ঐ বদ মহিলা আর ববের বাসায় ভাগাভাগি করে থাকতে হবে।
বব বলেছে, আমাকে আর মার্কাসকে যে তার বাসায় সপ্তাহে তিনদিন থাকতে দিতে রাজি হয়েছে মা এটাই নাকি অনেক। চাইলে পুরো সময়টা আমাদের নিজের কাছে রাখতে পারতো মা (যেহেতু বব আমাদের সৎ বাবা)।
বলেছি তাহলে কোর্টে আপিল করতাম আমি। আমাদের ভরণপোষণের পুরো দায়িত্ব ববের পাওয়া উচিত। সব দোষ মা’র! তিনি ববের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন পরকিয়া করে।
এটা তার বাথরুমের আয়নায় লিখেও দিয়েছিলাম আমি লিপস্টিক দিয়ে।
হা-হা-হা-হা।
বব বলেছে আমাকে কাজটা করতে (আয়নায় বিশ্বাসঘাতক লিখতে না…বরং মা আর তার মাঝে সময় ভাগাভাগি করে নিতে)। মার্কাসের কথা চিন্তা করে হলেও। শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছি। রবিবার থেকে বুধবার।
মা’র সাথে কেন চারদিন?
মার্কাসের জন্যে হলেও সহ্য করতে হবে তাকে।
মার্কাসের জন্যে হলেও সহ্য করতে হবে তাকে।
মার্কাসের জন্যে হলেও সহ্য করতে হবে তাকে।
আবার ক্যামেরার কথায় ফিরে আসি। এটা আসলেই অসাধারণ। বব আমাকে বিশ রোল ফিল্ম কিনে দিয়েছে যার মধ্যে সাতটা ইতিমধ্যেই শেষ করে ফেলেছি। তিনটা ওয়াশ করতে দিয়ে এসেছি। বব বলেছে আজ অফিস থেকে আসার পথে দেখবে, ওগুলো হয়ে গেছে কিনা।
ওগুলো হাতে পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারছি না। পার্কে একটা মাকড়সার জালের প্রায় তিরিশটা দুর্দান্ত ছবি উঠিয়েছি। শাটার স্পিড আর আলোর দিক নিয়ে পরীক্ষা করছিলাম ছবিগুলো তোলার সময়। প্রতিটা ছবি তুলে নোটপ্যাডে টুকেও নিয়েছি ওটার ক্ষেত্রে কি এক্সপেরিমেন্ট করেছি। তাই ছবিগুলো হাতে পেলে অনেক কিছু শিখতে পারব।
আমার মাথায় আসলেই অনেক বুদ্ধি!
ওহ্, মেগান আর ওর বয়ফ্রেন্ড ডেরিকের পনেরটার মত ছবিও তুলতে হয়েছে আমাকে। মেগান নাকি দু-মাসের অ্যানিভার্সেরি উপলক্ষে ওখান থেকে একটা বাঁধাই করে দেবে ডেরিককে। ঐদিন ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড দ্য টেম্পল অব ডুম নামে একটা সিনেমা দেখবে ওরা।
ঐ ছেলেটার সাথে প্রেম করা শুরু করার পর থেকে আগের চেয়ে সিনেমা দেখার প্রতি আগ্রহ বেড়ে গেছে ওর।
শুক্রবারে যাবে ওরা। মেগান বলেছে চাইলে আমিও ওদের সাথে যেতে পারি কাউকে নিয়ে।
হা-হা।
আমি যাব। কাউকে সাথে নিয়ে! স্বপ্ন!
যদিও সেদিন দেখলাম ব্রায়ান টুম্যান আমার দিকে তাকিয়ে আছে ড্যাব ড্যাব করে।
কিন্তু ও তো আমার থেকে ছোট। বয়সে ছোট কারো সাথে ডেটে যেতে পারি না আমি! ওটা বিরুদ্ধে তো মনে হয় হাইস্কুলে একটা আইনও আছে। (ছাত্রছাত্রিদের তৈরি)!
যাই হোক, আরো ছবি তুলতে যাই এখন।
.
কেউ বিশ্বাসই করবে না। কিন্তু দু-জনকে পরকিয়ারত অবস্থায় দেখে ফেলেছি আজকে।
রবিবারে বব আমাকে মার বাসায়, দুঃখিত, বদ মহিলাটার বাসায় নামিয়ে দিয়ে যায়।
খুব ভালো ব্যবহার তার। আগে থেকেই দুপুরের খাবার তৈরি করে রেখেছিল। আমাদের নিয়ে নাকি অ্যামিউজমেন্ট পার্কেও যাবে।
হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। অ্যামিউজমেন্ট পার্ক।
আমার বয়স ষোল, বারো না। অ্যামিউজমেন্ট পার্কে যাবার বয়স অনেক আগেই পার করে ফেলেছি।
মা বলছিল যেহেতু জন্মদিনের দিন আমার সাথে তার দেখা হয়নি, তাই এটাই আমার জন্মদিনের উপহার।
আমার রেঞ্জ রোভারটার কি হবে? যেটা আমাকে ঘুষ দিতে চেয়েছিলে মুখ বন্ধ রাখার জন্যে?
ঐ প্রস্তাবের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে?
রেঞ্জ রোভার তো দূরে থাক, স্কুলের অন্য মেয়েদের মত সাদা রঙের হোন্ডা সিভিকও জুটবে না আমার কপালে। আর ডিভোর্সের পর থেকে টাকা বাঁচাচ্ছে মা। বলেছে এক বছর পরে ভেবে দেখবে।
যাওয়ার কোন ইচ্ছেই ছিল না আমার। কিন্তু মার্কাস পার্কের কথা শুনেই লাফিয়ে উঠেছিল। আমার প্রতি ওর রাগ কেবলই একটু কমতে শুরু করেছে।
পার্কে গিয়ে আসলেও মজা হয়েছে। তিনঘন্টার জন্যে এটা প্রায় ভুলেই গেছিলাম, মা’কে ঘৃণা করি আমি। মার্কাসও অনেক মজা করেছে। ওকে এতটা খুশি কখনো দেখিনি আগে। বব যদি থাকতো তাহলে আরো ভালো হত।
আমি, মার্কাস আর বব হয়ত আবার একসাথে ওখানে যাব একদিন।
কিন্তু সেই ঘটনা লেখার জন্যে ছুটে এসে ডায়রি নিয়ে বসিনি আমি।
তো, সবকিছু ভালোমতই চলছিল। আমি আর মার্কাস একটা রোলার কোস্টারে চড়ে ঘুরছি এমন সময় ওপর মার দিকে তাকিয়ে দেখি সে তার চেয়ে কম করে হলেও বিশ বছরের ছোট তিনটা ছেলের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে।
আমার বয়সের কাছাকাছি তিনটা ছেলে।
মাথায় রক্ত উঠে যায় আমার।
বাসায় আসার সময় আমি কোন কথা বলছিলাম না দেখে বারবার জিজ্ঞেস করছিল, কিছু হয়েছে কিনা! কিছু হয়নি! শুধু তুমি আমার সমান তিনটা ছেলের সাথে লাইন মারছিলে!
তাকে বলেছিলাম আমাকে ক্যাপিটালের কাছে নামিয়ে দিতে। দু-ঘন্টার মধ্যে বাসায় ফিরে যাব। রাগ কমানোর জন্যে হাঁটাহাঁটি করা দরকার আমার।
আমার সাথে নিকি ছিল অবশ্য। আমার ক্যামেরাটাকে ঐ নামেই ডাকি এখন।
নাইকন=নিকি
ক্যাপিটাল অফিস বিল্ডিংয়ের সামনে খুব সুন্দর একটা ফোয়ারা লাগানো আছে। ওটার ছবি তুলছিলাম।
তখনই তাদের চোখে পড়ে আমার।
ফোয়ারার একদম পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল তারা। লোকটার হাতে বিয়ের আঙটি থাকলেও মহিলার আঙুল ছিল একদম ফাঁকা। তারা হাঁটা শুরু করলে পিছু নেই আমি। হৃৎপিণ্ড মনে হচ্ছিল বুক চিড়ে বেরিয়ে আসবে। রোলারকোস্টারে চড়লেও অমন লাগে না।
তিন ব্লক পরে একটা মোটেলে ঢুকে যায় ওরা। প্রায় আধ-রোল ভর্তি ছবি তুলি আমি এসময়। একজন আরেকজনের ওপর থেকে নজর ফেরাতে পারছিল না দু’জনে। এক ঘণ্টা পর ওখান থেকে বেরিয়ে আসে। তখন বাকি অর্ধেক রোলও শেষ করে ফেলি আমি। স্টুডিওতে দৌড়ে গিয়ে ছবিগুলো ওয়াশ করতে দেই। তিনগুণ খরচ দিতে হয়েছিল।
দু-দিন যাবত একটা কথাই ঘুরেছে মাথায়। ছবিগুলো হাতে পাবার পরে কি করব?
বৃহস্পতিবারের আগে হাতে পাইনি ওগুলো। তাড়াতাড়ি ওয়াশের গুষ্টি কিলাই, যতসব ঠগবাজের দল। ছবিগুলো নিয়ে ববের বাসায় চলে যাই। দারুণ উঠেছিল ছবিগুলো। যে কেউ দেখলে বুঝতে পারবে, ওদের মধ্যে কিছু একটা চলছে। একজন অবিবাহিত আর আরেকজন বিবাহিত।
মেগান আসার পর ওকে দেখাই ছবিগুলো। ওর মুখের অবস্থা যদি দেখতেন!
আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল কি করব ওগুলো দিয়ে। আপনাদের কি ধারণা?
ওদের ব্ল্যাকমেইল করতে চলেছি আমি।
.
পাতাগুলো নিচে নামিয়ে রাখলাম। এরপর কি হয়েছিল কল্পনা করতে কষ্ট হচ্ছে না। পরের দিন লোকটার কাছে গিয়ে ছবিগুলো দেখায় সে। এরপর দুশো ডলার দাবি করে। কোন উচ্চবাচ্য করে এটিএম বুথ থেকে উঠিয়ে ওগুলো দিয়ে দেয় লোকটা।
এরপরের স্তূপটা নিয়ে তিরিশ পাতার মত চোখ বোলালাম। এখানেও অনেকগুলো ডায়রির পাতা আছে। ওগুলোতে বব, মার্কাস, মেগান আর বদ মহিলাটা সম্পর্কে অনেক কিছু লেখা। তবে সবচেয়ে বেশি বর্ণনা আছে। মেয়েটার ব্ল্যাকমেইলের স্বীকার ব্যক্তিদের। কোথাও সরাসরি তাদের আসল নাম ব্যবহার করা হয়নি। বরং রাস্তার নামে তাদের বর্ণনা টুকে রেখেছে। জেনিফার। থার্ড এবং ম্যাস, কে এবং জুনিপার অথবা ফিফথ এবং পেন, সম্ভবত এই জায়গাগুলোতেই তাদের প্রথম দেখে সে কিংবা ছবি তোলে।
এদের মধ্যে একজনই মেরে ফেলেছে মেয়েটাকে।
যে কেউ হতে পারে। ফাস্ট এবং ম্যাকন অথবা আর এবং ম্যাথিস কিংবা লেক্সিংটন এবং রেস, তাদের কেউ।
এদের কেউ একজন হয়ত বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি জেনিফারকে। বিশ্বাস করেনি যে, তাদের স্ত্রীকে আসল ছবিগুলো দেখাবে না মেয়েটা।
কিন্তু কে?
সেটা জানলে তো আর অমীমাংসিত থাকত না কেসটা।
ডায়রির পাতাগুলো নামিয়ে রেখে টেবিলের ওপর থেকে নীল রঙের মোটা একটা বাইন্ডার খাতা তুলে নিলাম। তদন্তের রিপোর্ট।
জেনিফার নিউবারের কেসটা নিয়ে কাজ করেছিলেন, দু’জন হোমিসাইড গোয়েন্দা তাদের নাম হচ্ছে অ্যালবার্ট জনসন এবং ডেভিন কর্নিশ।
রিপোর্টটা একটা টাইপরাইটারে লেখা হয়েছে। বিশ পাতারও বেশি। ক্রাইম সিনের কয়েকটা ছবিও জুড়ে দেয়া আছে। কিন্তু ওগুলো দেখার ইচ্ছে নেই আমার। বাইন্ডারটা খুলে সরাসরি রিপোর্টটা খুঁজে বের করলাম।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি তিনটা সাতাশ বাজছে।
পড়া শুরু করলাম।
.
হোমিসাইড ডিটেক্টিভ জনসন এবং কর্নিশ জেনিফারের সৎ বাবা বব গিলিসের সাথে দেখা করেন ১৯৮৫ সালের ১৩ই জানুয়ারি। উনিই আটচল্লিশ ঘন্টা আগে জেনিফার নিখোঁজ জানিয়ে ফোন করেছিলেন।
ডিটেক্টিভ দু-জন যখন তাকে বলেন যে জেনিফারের মৃতদেহ শহরের পশ্চিম পাশে একটা পার্ক থেকে উদ্ধার করা হয়েছে আর তারা ধারণা করছে যে মেয়েটাকে খুন করা হয়েছে, তখন সেখানেই পড়ে যান বব গিলিস। কর্নিশ তাকে ধরে তোলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ছয় ফিট এক ইঞ্চি উচ্চতার লোকটার ওজন ছিল অনেক, অবশেষে ডিটেক্টিভ দু-জন ধরে দাঁড় করান তাকে।
জনসন, যে কর্নিশের তুলনায় সাত বছরের বড়, এর আগেও প্রায় পঞ্চাটা পরিবারের কাছে প্রিয়জনদের মৃত্যুর খবর নিয়ে গেছেন। সাথে সাথে সন্দেহের তালিকা থেকে বব গিলিসের নাম কেটে দেন তিনি।
লোকটাকে যখন এই প্রশ্নগুলো করা হচ্ছিল তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন তিনিঃ জেনিফারের বন্ধু কে কে? কারো সাথে সম্পর্ক ছিল কিনা মেয়েটার? চেনা কোন শত্রু আছে কিনা?
তার মুখ দিয়ে একমাত্র বোধগম্য যে শব্দটা বের হয়েছিল সেটা হচ্ছে ‘মেগান।‘
মেগান নিউবার হচ্ছে জেনিফারের বেস্ট ফ্রেন্ড এবং চাচাত বোন। দু জনেই থিওডোর রুজভেল্ট হাইস্কুলে ছাত্রি ছিল, মেগান জেনিফারের চেয়ে এক ক্লাস ওপরে পড়ত।
ডিটেক্টিভরা এর পরে যান জেনিফারের মায়ের বাসায়। ওটাও কলম্বিয়া হাইটসেই। ম্যারি নিউবার অবশ্য বব গিলিসের মত ওরকম ভেঙে পড়েননি। কিছুদিনের মধ্যেই ডিভোর্স কার্যকর হয়ে যায় তাদের মধ্যে। ডিটেক্টিভ জনসন ধারণা করেন ঐ মহিলার পক্ষেও তার মেয়েকে খুন করা সম্ভব নয়। যদিও এর পরে বিভিন্ন কেসে এর চেয়েও খারাপ অবস্থার সাক্ষি হয়েছেন তিনি।
ম্যারি নিউবার অকপটে স্বীকার করেন, মেয়ের সাথে তার সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছিল। তাকে পরকিয়ারত অবস্থায় হাতেনাতে ধরে ফেলে সে। আর এজন্যে সম্ভবত তাকে ভীষন ঘৃণাও করত জেনিফার।
এটাকে খুন করার জন্যে যথেষ্ট জোরালো মোটিভ বলে মনে হয়নি ডিটেক্টিভদের কাছে। এই জিজ্ঞাসাবাদের সময় মার্কাস, জেনিফারের ছোট ভাই, বন্ধুদের বাসায় খেলতে গেছিল। ওরকমটা না হলে অস্বস্তিতেই পড়তে হত দুই ডিটেক্টিভকে। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে তারা জানেন, কোন খুনের পর সবচেয়ে বড় ঝড়টা যায় ছোট ভাই-বোনদের ওপর দিয়ে। অনেক সময়ই সত্যটা মেনে নিতে পারে না তারা।
ডিটেক্টিভরা মেগানদের বাসায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে গেলে পুরোটা সময় মেগানের বাবা-মা, রে এবং জোয়ান-তাদের মেয়ের দু-পাশে বসে থাকেন।
তাদেরকেও কিছু প্রশ্ন করেন ডিটেক্টিভরা।
জনসন জিজ্ঞেস করেছিলেন, “মি. রে, আপনি তো ম্যারির প্রথম স্বামী জনের ভাই?”
“জি।”
“তার কি হয়েছিল?”
“জেনিফারের চার বছরের সময় মাছ ধরতে গিয়ে একটা দুর্ঘটনায় মারা যায় সে। তার কথা অতটা মনে পড়ত না মেয়েটার।”
“তিনি একজন ভালো বাবা ছিলেন?”
“যতদূর জানতাম, ভালোই বলা চলে। তখন অবশ্য ওহাইওতে থাকার কারণে ওর সাথে অতটা দেখা সাক্ষাত হত না আমার। আমাদের এখানে চলে আসার অন্যতম একটা কারণ হচ্ছে ম্যারি এবং বাচ্চাদের দেখাশোনা করা।”
“জনের মৃত্যুর ব্যাপারে সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েনি কারো?”
“না, একটা মাছ ধরে তোলার পর ভুলবশত হার্টুনটা তার গলায় বিধে যায়। তীরে পৌঁছার আগেই রক্তক্ষরণে মারা যায় সে।”
কর্নিশ একটু হেসে ওঠে ঘটনাটা শুনে।
জনসন তার পার্টনারের কান্ডজ্ঞানহীনতা ঢাকার জন্যে তাড়াতাড়ি জেনিফারকে প্রশ্ন করা শুরু করেন।
“জেনিফারকে শেষ কখন দেখেছিলে তুমি?”
জবাবে মেগান কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দেয়, জানুয়ারির দশ তারিখ দুপুর সাড়ে তিনটায় শেষবারের মত মেয়েটাকে দেখে সে।
“ওর কি কোন ভালো বন্ধু কিংবা বয়ফ্রেন্ড আছে?”
“না, বেশিরভাগ সময় আমি এবং আমার বয়ফ্রেন্ড ডেরেকের সাথেই থাকতো ও। গত সপ্তাহেও একসাথে পরপর দু-রাত সিনেমা দেখতে গেছিল আমরা।”
“তাই? কি সিনেমা দেখেছিলে তোমরা?”
“শুক্রবারে আমরা দেখি ডিউন আর শনিবার বেভারলি হিলস কপ।”
“এডি মারফি ছিল সিনেমাটাতে, তাই না?”
“হ্যাঁ, ভালোই মজা পেয়েছিলাম আমরা,” জোর করে হেসে উত্তর দিয়েছিল মেয়েটা।
“তোমাদের দুজনের সাথে থাকতে জেনিফার অস্বস্তিবোধ করেনি?” কর্নিশ জিজ্ঞেস করেছিলেন।
“না, একদমই না।”
“আর ডেরিক। ভালো ছেলে ও, নাকি? জেনিফারকে কিছু করার কথা তো তার?”
“না, মোটেও না। কিন্তু আমি জানি এসবের জন্যে কে দায়ি।”
“কে?”
“জেনিফার যাদের ব্ল্যাকমেইল করত, তাদেরই কেউ একজন।” ডিটেক্টিভ দুজন এবং মেগানের বাবা-মা সবার চোখ কপালে উঠে গেছিল কথাটা শোনার পর।
“ব্ল্যাকমেইল?” ডিটেক্টিভদের আগে মেয়েটার বাবাই প্রশ্ন করে বসেন, “কিসের ব্ল্যাকমেইল?”
একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে সবকিছু খুলে বলে মেগান।
.
“ডায়রিটা পড়লেই তো হত,” জোরে বলে উঠলাম, যদিও আমি নিশ্চিত, পরবর্তিতে কোন এক পর্যায়ে তারা পড়েছিলেন সেটা। সম্ভবত পড়ার আগে আঙুলের ছাপ নেয়ার জন্যে পাতাগুলো ল্যাবে পাঠাতে হয়েছিল তাদের। নয়তো জেনিফারের লাশ পাওয়া যাবার অনেক পরে পাতাগুলোর সাথে কেসটার যোগসাজশ খুঁজে পান ডিটেক্টিভরা।
আরো এক ডজন পাতা ওল্টালাম।
তিনটা ছেচল্লিশ বাজছে এখন।
.
দশ মাসের মধ্যে যে পঁচিশজন ব্যক্তিকে ব্ল্যাকমেইল করে জেনিফার, তাদের মধ্যে মাত্র তিনজনকে খুঁজে বের করতে সক্ষম হয় ডিটেক্টিভ জনসন এবং কর্নিশ।
থার্ড এবং এফ।
ফোরটিনথ এবং নিউ হ্যাম্পশায়ার।
আর সেকেন্ড এবং ম্যাস।
এদের খুঁজে পান কারণ তারা যে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে জেনিফারকে দেয় সেগুলো একদম এই নামের রাস্তাতেই অবস্থিত। জেনিফারের ডায়রিতে উল্লেখিত লোকগুলোর শারীরিক বর্ণনার সাথে ব্যাংকের এটিএম বুথের সিকিউরিটি টেপের ভিডিও মিলিয়ে দেখে ভদ্রলোকদের সনাক্ত করেন ডিটেক্টিভরা। ব্যাপারটা অসম্ভব হত যদি তাদের পুরো এক বছরের ভিডিও টেপ দেখতে হত। কিন্তু সৌভাগ্যবশত তিনবারই জেনিফার উল্লেখ করে দিয়েছিল, ঐ সময়ে মেগান আর তার বয়ফ্রেন্ড কোন সিনেমা দেখতে গেছিল।
এতে করে ডিটেক্টিভদের সুবিধা হয় সময়সীমা দশ মাস থেকে দুই সপ্তাহে নামিয়ে আনতে।
আর তিনজন ভদ্রলোকই, জ্যাক নিউবর্ন, চেজ উইঙ্গেলবেরি এবং মন্টেল হারম্যান, স্বীকার করেন, জেনিফার নিউবার তাদের ব্ল্যাকমেইল করেছিল।
জ্যাক নিউবর্ন এবং মন্টেল হারম্যান বলেন, ছবিগুলো দেখিয়ে দুশো পঞ্চাশ ডলার দাবি করার সাথে সাথে জেনিফারকে টাকা দিয়ে দেন তারা। এরপরে তাদের সাথে আর কোন যোগাযোগ করেনি মেয়েটা। চেজ উইঙ্গেলবেরি এটিএম থেকে টাকা বের করেও পরে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, ইচ্ছে করলে আমার স্ত্রীকে গিয়ে এখনই বলতে পারো তুমি। ও জানে আমার স্বভাবের কথা।
নিউবর্ন, একজন বড় ব্যাংকার এবং চার সন্তানের জনক, ব্যাংকের কাজে লন্ডনে ছিলেন জেনিফারের মৃত্যুর সময়।
হারম্যানও সিয়াটলে ছিলেন ব্যবসার কারণে। তাদের কথা মিলিয়ে দেখা হয়েছিল।
উইঙ্গেলবেরির অ্যালিবাই ছিল তার স্ত্রী জেন। যদিও জিজ্ঞাসাবাদের সময় মনে হয়নি, তিনি আগে থেকে কিছু জানতেন স্বামীর পরকিয়ার ব্যাপারে।
জনসন এবং কর্নিশ বুঝতে পেরেছিল মহিলা মিথ্যা কথা বলছেন।
অবশেষে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদের পর মহিলা বলেন, জেনিফারের খুন হবার রাতে বাসায় ফেরেনি তার স্বামী! আসলে দু-দিন যাবত বাসার বাইরে ছিলেন উইঙ্গেলবেরি। আর ঠিক ঐ দুই দিন ধরেই নিখোঁজ ছিল জেনিফার।
বাসায় আসার পর জেন যখন উইঙ্গেলবেরিকে জিজ্ঞেস করে, সে কোথায় ছিল দু-রাত, তখন মিথ্যে কথা বলে লোকটা। বলে যে, বাবা মার ওখানে ছিল। কিন্তু তার মার সাথে জেনের এর আগের রাতেই কথা হয়েছিল ওটমিলের একটা রেসিপির ব্যাপারে।
চেজ উইঙ্গেলবেরিকে কর্মস্থল থেকে ধরে আনা হয়।
বারো ঘন্টা একটানা জিজ্ঞাসাবাদের পর সবকিছু স্বীকার করে সে। বলে, “হ্যাঁ, কুত্তিটাকে খুন করেছি আমি। আমাকে ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টার এক সপ্তাহ পর একদিন রাস্তায় ক্যামেরা হাতে ঘুরতে দেখি তাকে। সাথে। সাথে মুখ চেপে ধরে ট্রাকে নিয়ে তুলি। দু-দিন একটা মোটেলে নিয়ে আটকে রেখে ধর্ষণ করার পর একটা ল্যাম্প দিয়ে মাথায় বাড়ি মেরে পার্কে ফেলে রেখে যাই।”
১৯৮৫ সালের জানুয়ারির ২৭ তারিখে চেজ উইঙ্গেলবেরিকে গ্রেফতার করা হয় জেনিফার নিউবারকে খুনের দায়ে।
দু-দিন পর তার স্ত্রী দুই লক্ষ ডলার সমমূল্যের বন্ডের বিনিময়ে জামিনে ছুটিয়ে আনেন তাকে। সে-রাতে প্রথমে উইঙ্গেলবেরিকে গুলি করেন তিনি। এরপর নিজের মাথায় গুলি চালান।
“এটা কি হল?” বলে রিপোর্টটা টেবিলে নামিয়ে রাখলাম আমি।
এই মহিলা নিজের স্বামীকে জামিনে ছুটিয়ে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলেন, এরপর আত্মহত্যা করেন।
ব্যাপারটা কৌতূহলোদ্দিপক। কিন্তু আমি বিভ্রান্ত বোধ করছি অন্য একটা কারণে।
ইনগ্রিড বলেছিল এটা একটা অমীমাংসিত কেস।
কিন্তু তা নয়!
এটার তো সমাধান হয়ে গেছিল।
তাহলে কেন এটা নিয়ে কাজ করছে সে?
*
অধ্যায় ১০
“ইনগ্রিডকে যখন এয়ারপোর্টে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন সে কি আপনাকে জেনিফারের খুনির গ্রেফতার হবার ব্যাপারে কিছু বলেছিল?”
বাবা বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে ক্যান্ডি ক্রাশ খেলছেন।
তিনটা তিন বাজছে ঘড়িতে।
মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, তা বলেছিল। কিন্তু অনেকেরই ধারণা মিথ্যে স্বীকারোক্তি দিয়েছিল লোকটা। বারো ঘন্টা এক নাগাড়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল তাকে। সহ্য করতে না পেরে হয়ত স্বীকার করে বসেছিল উইঙ্গেলবেরি। তখনকার দিনের প্রযুক্তি তো আর এখনকার মত এত উন্নত ছিল না।”
“কিন্তু লোকটা তো বলেছিল, জেনিফারকে দেখার পর একটা ট্রাকে তুলে মোটেলে নিয়ে ধর্ষণ করে সে দু-দিন ধরে। এরপর মাথায় ল্যাম্প দিয়ে বাড়ি মেরে ফেলে যায় পার্কে। আর সেই আঘাতেই মৃত্যু হয় মেয়েটার।”
“আরেকটা বাইন্ডার খাতা পড়ে দেখনি তুমি, তাই না?”
মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিলাম।
“ওটার মধ্যে সব ফরেনসিক রিপোর্ট আছে। উইঙ্গেলবেরির স্বীকারোক্তির সাথে কিছুই মেলেনি রিপোর্টের। ধর্ষণের কোন আলামত খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর লোকটার গাড়িতেও অপহরণ করে নিয়ে যাবার কোন ক্ল পাওয়া যায়নি। তখনকার দিনে অবশ্য ডিএনএ টেস্টের ব্যবস্থা ছিল না, তবে কোন চুল কিংবা কাপড়ের ছেঁড়া অংশও পাওয়া যায়নি। ঐ এলাকার আশেপাশের মোটেলগুলোতে উইঙ্গেলবেরির ছবি দেখানো হলে কেউ চিনতে পারেনি তাকে, আর ঐ নামে কোন রুমও ভাড়া নেয়া হয়নি।”
আমি মাথা নাড়লাম। তাহলে স্বীকার করল কেন?
কল্পনায় নিজেকে জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে চিন্তা করলাম। বারো ঘন্টা ধরে দু’জন ডিটেক্টিভ একই প্রশ্ন করে যাচ্ছেন বারবার। একদিক দিয়ে চিন্তা করলে, মা আমার সাথে যা করেছেন তার চেয়ে খুব বেশি পার্থক্য নেই ওটার। অবশ্য দু-জন ডিটেটিভ মা’র মত জিজ্ঞাসাবাদের আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করেননি নিশ্চয়ই। তবে তখনকার দিনে থানার বন্দিদের সাথে এখনকার তুলনায় অনেক খারাপ ব্যবহার করা হত। আর সেটা নিয়ে কারো মাথাব্যথাও ছিল না তেমন। কে জানে, হয়ত ক্রমাগত লাথিগুতো আর লাঠির বাড়ি দিতে দিতে কাহিল করে ফেলা হয়েছিল লোকটাকে।
মা যদি আমাকে আরেকবার ঐ তেইশ ঘন্টার দুঃস্বপ্ন দেখতে বাধ্য করতেন তাহলে আমিও ফ্ল্যাশড্রাইভভটার ব্যাপারে সব কিছু স্বীকার করে নিতাম। মিথ্যে হলেও বলতাম-হ্যাঁ, প্রেসিডেন্ট দিয়েছেন ওটা আমাকে। ঐ রাসায়নিকটা শরীরে প্রবেশ করানো থামাতে যে কোন কিছু করতে পারতাম আমি।
চেজ উইঙ্গেলবেরিও হয়ত এমনটাই ভেবেছিল। শুধু নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছিল সে।
“কেসটা নিয়ে কাজ করছেন না কেন?” বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম।
মাথাটা একদিক কাত করলেন জবাবে। এরকমটা আগেও করতে দেখেছি তাকে, কোন শখের প্রতি আগ্রহ উঠে গেলে এই ভঙ্গি করেন তিনি।
“না, মানে ইয়ে…”
“হাল ছেড়ে দিয়েছেন আপনি।”
“তুমিই তো একটু আগে বললে, সমাধান হয়ে গেছে কেসটার।”
“আর আপনিও তো বললেন, লোকটা খুন করেনি জেনিফারকে।”
শব্দ করে একটা লম্বা শ্বাস ছাড়লেন তিনি। গোয়েন্দাগিরির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন বোঝাই যাচ্ছে। এই দু-দিনে হয়ত আবার নতুন কোন কিছু নিয়ে আগ্রহি হয়ে উঠেছেন।
তার ঘরের দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে রান্নাঘরে চলে এলাম।
মেঝেতে মারডক আর ল্যাসি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে গেলেও এখানেই ঠাণ্ডার ওপর শুয়ে পড়েছে ওরা। উপরের ঘরে যাবার চেষ্টাও করেনি।
“কি রে? খুব টায়ার্ড নাকি দু-জনেই?” এই বলে ফ্রিজ থেকে দুটো পপসিকল আইস্ক্রিম বের করে ওদের সামনে রেখে দিলাম।
“কাঠিসুদ্ধ খেয়ে ফেলিস না এবারও,” মারডকের বিশাল মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম।
ও মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে কাঠিসুদ্ধ গিলে ফেলল একেবারে।
এরপর অনেকটা সময় নিয়ে ইনগ্রিডের উদ্দেশ্য একটা ইমেইল লিখলাম। বললাম ওকে কতটা মিস করছি, ওর ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা খুব কঠিন ঠেকছে এখন। বেশি বড় হল না অবশ্য ইমেইলটা, কিন্তু ওটাকেই ঠিকঠাক করতে দশ মিনিট চলে গেল।
তিনটা পনেরতে পাঠিয়ে দিলাম মেইলটা।
ল্যাপটপের ওপর দিয়ে জেনিফারের ডায়রির পাতাগুলোর দিকে তাকালাম। ইচ্ছে করছে এক গ্লাস হুইস্কি নিয়ে মেয়েটার অসাধারণ রসবোধ সম্পন্ন লেখাগুলোতে ডুব দেই। ষোল বছরের একটা মেয়ের চোখ থেকে দেখি দুনিয়াটাকে কিছুক্ষণ।
কিন্তু তা সম্ভব নয়।
চেজ উইঙ্গেলবেরির মিথ্যে স্বীকারোক্তি দেবার ঘটনাটা পড়ার পর থেকে বারবার ঐ সাদা ঘরটার কথা মনে হচ্ছে। ওটা খুঁজে বের করতে হবে আমাকে। মাকে খুঁজে বের করতে হবে। তারও আগে খুঁজে বের করতে হবে ঐ ফ্ল্যাশড্রাইভটা।
কিন্তু কিভাবে?
একটা গোলকধাঁধায় আটকে গেছি আমি এ মুহূর্তে। সিডনি ওয়েনকে ফেসবুকে মেসেজ দিয়ে বলেছি তাকে যে চিঠিগুলো মা পাঠিয়েছিলেন, ওগুলোর কয়েকটা যেন আমাকে পাঠিয়ে দেন। এখন পর্যন্ত কোন রিপ্লাই আসেনি তার কাছ থেকে।
তিনি বোধহয় এখন নতুন কাউচ, কুশন, কার্পেট আর যা যা কিছু নষ্ট করেছে পাঁচ দস্যি মিলে সেগুলো কেনায় ব্যস্ত। আমাকে খুঁজে বের করতে হবে মা কার কার সাথে কাজ করছিলেন। ওয়েন বলেছিলেন, তার কয়েকজন পার্টনার ছিল। তাদের কাউকে খুঁজে বের করতে পারলে হয়ত কোন তথ্য জানা যেতে পারে।
এ সময় সামনের দরজায় কীসের যেন শব্দ হল।
মারডক আর ল্যাসি দু-জনেই লাফিয়ে উঠে দরজার সামনে চলে গেল। মারডক তারস্বরে ঘেউ ঘেউ করছে আর ল্যাসির গলা দিয়ে অদ্ভুত রকম শব্দ করছে।
“চেঁচামেচি বন্ধ কর,” আমি বললাম ওদের উদ্দেশ্যে।
করল না ওরা।
“খবরের কাগজ দিয়ে গেছে, প্রতি সকালেই আওয়াজটা শুনিস তোরা।”
দরজাটা খোলার পর দু-জন ক্ষান্ত দিল।
বাঁচা গেল, কানে তালা লেগে যাবার জোগাড় হয়েছিল।
নিচু হয়ে খবরের কাগজটা তুলে নিলাম। ওয়াশিংটন পোস্টের সংখ্যাটা হাতে নিয়ে ভাবতে লাগলাম আগের চেয়ে কত ছোট হয়ে গেছে। খবরের কাগজের আকার। বাবার সাথে যখন থাকতাম তখন আরো চওড়া ছিল এগুলো। ওটা নিয়ে বাবার ঘরে রেখে দেয়ার জন্যে যাচ্ছি এমন সময় একটা কথা মনে হল হঠাৎ।
খবরের কাগজ!
মা তার বুটের ভেতরেও খবরের কাগজ ঢুকিয়ে রেখেছিলেন।
আর সে দুটো খবরের কাগজও ওয়াশিংটন পোস্টের। ১৯৮০ সালের সংস্করণটায় সিআইএ আর এমকে আলট্রা সম্পর্কে পড়ে এতটা উত্তেজিত হয়ে গেছিলাম যে, ১৯৮৪ সালেরটা ধরেও দেখিনি। যতদূর মনে পড়ে ওটা জানুয়ারি মাসের কোন তারিখের ছিল, আমার মা চলে যাবার এক বছর আগেকার। তার মানে দ্বিতীয় পত্রিকাটাও কোন এক কারণে রেখে দিয়েছিলেন তিনি।
রান্নাঘরে দৌড়ে গিয়ে একটা ফ্ল্যাশলাইট হাতে নিলাম। ল্যাসি আমার পায়ে থাবা দিয়ে গুতোতে লাগল।
মিয়াও।
“আবার বাগানের শেডে যেতে হবে আমাকে।”
মিয়াও।
“হ্যাঁ, এতদিনে হয়ত খরগোশটার ব্রেকআপ হয়ে গেছে ওর বয়েফ্রেন্ডের সাথে,” হেসে বললাম।
মারডককে জিজ্ঞেস করলাম আসতে চায় কিনা। কিন্তু রান্নাঘরের মেঝেতে ততক্ষনে ঘুমিয়ে গেছে সে।
ল্যাসিকে কোলে নিয়ে শেডের দিকে রওনা দিলাম।
.
জানি না কেন ১৯৮৪ সালে ওয়াশিংটন পোস্টটা আবার বুটের মধ্যে ঠেসে রেখেছিলাম আমি।
ওগুলো বের করে শেডের ধুলোময় মেঝেতেই বসে পড়লাম। ল্যাসি আর শেডের খরগোশটা দূরে এক কোণায় আলাপ জুড়ে দিয়েছে কোন এক ব্যাপারে। বোধয়হ তাদের ফেসবুকের রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস নিয়ে।
দু-পায়ের মাঝখানে ফ্ল্যাশলাইটটা রেখে ওটার আলোয় খবরের কাগজটা দেখা শুরু করলাম। এটা ১৯৮৪ সালের জানুয়ারির ৯ তারিখের সংখ্যা। সেদিন ছিল সোমবার। হেডলাইনের জায়গার লেখা, “আবারো হেরেছে রেডস্কিনস।”
আমার বাবা রেডস্কিনসদের খুব বড় ভক্ত, তাহলে কি তিনিই রেখে দিয়েছিলেন কাগজটা? নাকি মা’ও রেডস্কিনসের ভক্ত ছিলেন? মনে আছে, একবার বাবা বলেছিলেন, মা আমেরিকান ফুটবল খেলাটা তেমন একটা পছন্দ করতেন না। ইউরোপিয় বংশোদ্ভুত হওয়াতে ইউরোপিয়ান সকার বেশি ভালো লাগত তার কাছে।
দ্বিতীয় পাতাটা খুললাম। এটাতে একটা আর্টিকেল আছে যার শিরোনাম : ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার।‘ নাইজেরিয়ার দুইশ দুর্নীতিগ্রস্ত মিলিটারি
অফিসারকে গ্রেফতারের ব্যাপারে লেখা আছে নিচে।
আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। আরো কয়েক পাত ওল্টানোর পরেও তেমন কিছু একটা চোখে পড়ল না। হাল ছেড়ে দেব এমন সময়ে বুটের একদম সামনের অংশে দলা পাকিয়ে রাখা একটা পাতা চোখে পড়ল।
বের করে সোজা করলাম ওটাকে।
এখানকার আর্টিকেলটার শিরোনাম : রাশিয়ান ওয়ার ক্যাম্প থেকে পালিয়েছে এক কয়েদি।
সাথে সাথে বুঝে গেলাম, কেন মা রেখে দিয়েছেন খবরের কাগজটা। ওখানে লেখা, ১৯৮১ সালের ১৩ই এপ্রিল এক সিআইএ এজেন্ট নিখোঁজ হয়ে যান সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। মুজাহিদদের তিনি শিখাচ্ছিলেন কিভাবে কার্যকর উপায়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয়। সবাই তাকে মৃত ধরে নিয়েছিল। কিন্তু ১৯৮৪ সালের জানুয়ারির পাঁচ তারিখে তিনি ইরানের আমেরিকান দূতাবাসে হঠাৎ করে উদয় হন। তাকে আসলে রাশিয়ার একটা ওয়ার ক্যাম্পে বন্দি করে রাখা হয়েছিল গত কয়েক বছর ধরে। সিআইএ ঐ এজেন্টের নাম প্রকাশ করেনি। কিন্তু আমি জানি তিনি কে।
আমার মার রিসার্চ পার্টনার।
.
ভেতরে এসে মার ফাইলটা খুললাম।
তারিখগুলো মিলিয়ে দেখলাম, মিলে গেল ওগুলো।
মা আফগানিস্তানে গেছিলেন ১৯৮১ সালের এপ্রিলের ১৫ তারিখে। সিআইএ এজেন্টের নিখোঁজ হবার দু-দিন পরে। ওখানে কয়েক সপ্তাহ কাটানোর পরে মেতে ফিরে আসেন তিনি। এটা কোন কাকতলিয় ঘটনা হতেই পারে না।
মা যেমন হন্ডুরাসের সরকারকে জিজ্ঞাসাবাদ সম্পর্কে প্রশিক্ষন দিতে গেছিলেন, এ লোকটাও আফগান বাহিনীকে জিজ্ঞাসাবাদ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন।
আমার মা প্রথমে আফগানিস্তানে যাননি, কারণ তিন বছরের একটা ছোট ছেলে ছিল তার, তাছাড়া স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের দেখাশোনাও করতে হচ্ছিল। কিন্তু তার পার্টনার নিখোঁজ হবার পরপরই আফগানিস্তানে ছুটে যান তিনি তাকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করার জন্যে। সেই সাথে বন্দি সোভিয়েত সৈন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে।
ল্যাপটপটা খুললাম।
আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এই লোকটাই স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রামে তার পার্টনার ছিলেন। তাকে খুঁজে বের করতে হবে আমাকে। সিআইএ হয়ত তখন ঐ এজেন্টের নাম ওয়াশিংটন পোস্টের কাছে প্রকাশ করেনি কিন্তু পরবর্তি তিরিশ বছরে তার নাম অবশ্যই বের হয়েছে।
গুগলে সার্চ দিলাম : ১৯৮৪ সালে রাশিয়ান/সোভিয়েত ওয়ার ক্যাম্প থেকে পালানো সিআইএ এজেন্ট।
সরাসরি রেজাল্ট এসে গেল কয়েকটা। তার নাম আসলেই জানা গেছে। পরে। সিআইএ এজেন্ট ডেভিড সুলিভান।
প্রেসিডেন্ট কনর সুলিভানের বাবা।
.
আমি এতদিন খুঁজছিলাম, প্রেসিডেন্টের সাথে আমার মার ব্যাপারটার যোগাযোগ কোথায়। পেয়ে গেছি এর উত্তর। স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রামে মা’র পার্টনার হচ্ছে কনর সুলিভানের বাবা।
লম্বা করে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। পাজলের টুকরোগুলো মিলে যেতে শুরু করেছে। ইন্টারনেটে ডেভিড সুলিভানের ব্যাপারে খোঁজ নিতে লাগলাম আমি। স্ক্রিনে বেশ কয়েকটা ছবি ভেসে উঠলে একটাতে ক্লিক করে বড় করলাম। আশা করেছিলাম, তিনিও হয়ত তার ছেলের মতন উঁচা-লম্বা হবেন। কিন্তু সেরকমটা নয়, কনরের লম্বা হওয়ার দিকটা এসেছে তার মা’র তরফ থেকে। তবে তাদের দুজনেরই চোখের রঙই একরকম ধূসরাভ। শুধু তাই নয়, চোয়ালের গঠন এবং চুলের ধরণেও মিল আছে।
তার জীবনবৃত্তান্তে ক্লিক করে পড়তে থাকলাম।
ডেভিড সুলিভানের জন্ম ১৯৩৮ সালে সান ফ্রান্সিসকোতে। ক্যালটেক থেকে রসায়ন বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছিলেন তিনি। সিডনি ওয়েনও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ১৯৫০ সালে সিআইএ’র টেকনিক্যাল সার্ভিসের স্টাফের সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। সিডনি ওয়েনের শুরুটাও এখান থেকেই হয়েছিল।
মি. ওয়েন আমাকে বলেছিলেন, “এর পরে একদিন এলেনার কাছ থেকে রিপোর্ট পাই, সে আর তার পার্টনার-ভেতরের খবর বেশি কিছু জানতাম না আমি, পার্টনারের নামও না-নাকি ঘুম বর্ধিতকরণের ব্যাপারে বেশ বড়সড় কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছে।”
মিথ্যেবাদি।
ডেভিড সুলিভান ১৯৫৯ সালে অ্যাঞ্জেলা নামে এক মহিলাকে বিয়ে করেন। এর তিন বছর পরে জন্ম নেয় তাদের একমাত্র সন্তান।
কনর সুলিভান।
আমেরিকার ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট।
১৯৮০ সালে আফগানিস্তানে মুজাহিদদের জিজ্ঞাসাবাদের কার্যকর পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে যান তিনি। ১৯৮১ সালের ১৩ই এপ্রিল নিখোঁজ হন। এর তিন বছর পরে রাশিয়ার ক্যাম্প থেকে পালাতে সক্ষম হন।
ফিরে আসার পর তাকে বীরের মর্যাদা দেয়া হয় আর তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। ঐ বছরের নভেম্বরে ভার্জিনিয়ার সিনেট নির্বাচনে অংশ নিয়ে একটা পদে জয়ি হন ডেভিড। সেই পদ তিনি ধরে রেখেছিলেন প্রায় দুই যুগ।
২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে ডেভিড সুলিভান এবং তার স্ত্রী সিনেটের এক মিটিঙে অংশ নিতে নিউ ইয়র্কে গেছিলেন। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের নর্থ টাওয়ারের ১০৭ তলায় অবস্থিত একটি রেস্টুরেন্টে তারা যখন সকালের নাস্তা সারছিলেন তখন একটা প্লেন আছড়ে পড়ে ঐ বিল্ডিঙের ওপর। তারাসহ আরো ৬৯ জন সিনেট সদস্য মারা যান ঐ ঘটনায়।
“শিট,” জোরে বলে উঠলাম আমি।
এটা আমি জানতাম না, টুইন টাওয়ারে একটা রেস্টুরেন্টও ছিল। এতগুলো লোক সকালের নাস্তা খেতে ব্যস্ত। মিটিঙের ফাঁকে কফি খাওয়ায় মগ্ন। সবাই মারা গেছিল। আর তাদের মধ্যে ছিলেন কনর সুলিভানের বাবা-মা।
বাবা এ সময় ঢুকলেন রান্নাঘরে।
আমাকে ওরকম উদ্ৰান্ত অবস্থায় দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “ঠিক আছ তুমি?”
“আপনি কি জানতেন, কনর সুলিভানের বাবা-মা ৯/১১-এর ঘটনায় মারা গেছিলেন?”
“অবশ্যই। প্রেসিডেন্ট তখন সিটি কাউন্সিলের প্রধান ছিলেন। আর তার মা-বাবার মৃত্যুর ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে-আসলে কাজে লাগিয়ে বললে খারাপ শোনায়-মা-বাবার ওরকম দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর কারণেই আলোচনার মধ্যমণি হয়ে ওঠেন কনর সুলিভান। এজন্যেই পরের বছরের গভর্নর নির্বাচনে বিরাট সমর্থন পান তিনি, যা তাকে জয়ি হতে অনেকটাই সাহায্য করে,” বললেন বাবা।
“তার জীবনবৃত্তান্ত পড়ার সময় এই কথাটা কিভাবে চোখ এড়িয়ে গেছিল বুঝলাম না।”
জেসি ক্যালোমেটিক্স খুন হবার পরে প্রেসিডেন্ট সুলিভানকে আমার বাসার সামনের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে যেতে দেখে তার সম্পর্কে উইকিপিডিয়ায় খোঁজ নিয়েছিলাম আমি। অবশ্য দু-মিনিটের বেশি নজর বুলাইনি। তার চেহারার সাথে বাইরে দেখা লোকটার চেহারা মেলানোর প্রতিই বেশি আগ্রহ ছিলাম তখন।
বাবা ফ্রিজের দরজা খুলে দুধের বোতলটা বের করে বললেন, “তোমার বলা কথাগুলো নিয়ে ভাবছিলাম আসলে। জেনিফার নিউবারের কেসটার ওপর হাল ছেড়ে দেয়া উচিত হবে না। ওটার শেষ দেখে ছাড়ব আমি।”
“সেটাই ভালো হবে,” যান্ত্রিক ভঙ্গিতে জবাব দিলাম। আমি এখন চিন্তা করছি ডেভিড সুলিভানের মৃত্যু নিয়ে, মা’র ব্যাপারে তার সাথে কথা বলা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।
ল্যাপটপের ঘড়িটার দিকে তাকালাম।
তিনটা ছাপ্পান্ন বাজছে।
এত তাড়াতাড়ি সময় চলে গেল? দরজার কাছ থেকে একটা আওয়াজ ভেসে আসায় ওদিকে তাকালাম। তাড়াহুড়োর কারণে ল্যাসির কথা ভুলেই গেছিলাম আমি। কাঁচের দরজাটা খুলে ওকে ভেতরে নিয়ে আসলাম।
“তাহলে?” জিজ্ঞেস করলাম, “তোর বান্ধবির রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস কি?”
মিয়াও। হেসে উঠলাম জোরে।
ইট’স কমপ্লিকেটেড।